এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ঘাসফুলের দরজা 

    Rimel Sarker লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ মে ২০২৪ | ১৮৫ বার পঠিত


  • ছোট বেলায় যখন বাবার কাছে চিঠি আসতো, সিদ্ধার্থের মনে হতো যেনো এক মেঘপিয়ন এক দিস্তা কাগজ জুড়ে লিখে পাঠিয়েছে “কেমন আছো, সিদ্ধার্থ?”। ওর এমন মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, ওকে কেউ কখনো জিজ্ঞেসই করে নি ও কেমন আছে কিংবা ও আছে তো? আসলে ওর উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি কখনোই কাউকে ভাবায় নি। জন্মের পর বাবা কে দেখেছে শুধু বড় বড় ফিল্ম বানাতে, টেলিভিশনে বুদ্ধিজীবিদের মতন বোধের বাণী শুনাতে, অথচ বাড়ি এলে কীভাবে সেই বোধের বাণী কর্পুরের মতন নিদারুণ ভাবে মিলিয়ে যায়, তাও দেখেছে ও। জন্মের পর ৬ বছর মাতৃস্নেহে লালিত, পালিত সিদ্ধার্থ খেলা শেষে ফিরে এসে দেখেছে রক্তাক্ত মায়ের মরদেহ। আজো ওর আবছা আবছা সেই স্মৃতি মনে পড়ে। বিকেলের পড়ন্ত রোদে, সহসা খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে দেখে, মায়ের দেহ নগ্ন, তখনো বুঝে উঠতে পারে নি যে, এক হায়েনা ছিড়ে খেয়েছে তার মাতৃদেহ। এটুকু বয়সে কী কোনো ছেলে বা মেয়ে বুঝবে এসব? সারা মেঝে তে রক্ত, মায়ের মাথা, বুক, যোনী থেকে রক্ত অনবরত পড়েই যাচ্ছে, কিছু বুঝে উঠতেই পারছে কী হলো, কীভাবে হলো। ছোট্ট ছেলে টা তার বাবা কে ডাকতে ডাকতে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে, বাবা এলেন, দরজা আটকালেন আর বললেন ঈশ্বরের সাথে বাবার যুদ্ধতে বাবা হেরে গিয়েছেন, তাই হেরে যাওয়ার ফলস্বরূপ ঈশ্বর নাকি কেড়ে নিয়েছেন মা কে। বোকা সিদ্ধার্থ জানেও না ঈশ্বর ঘুমিয়ে আছেন, ঘুমকাতুরে ঈশ্বর কিছু জানেন না, তিনি জানেন না কিসের যুদ্ধ, জানেন না তিনি। 

    সিদ্ধার্থের আজো মনে পড়ে, মায়ের ঘরের জানালা দিয়ে সোনালী সূর্য কেমন আলো দিচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো যেনো মায়ের মৃতদেহ থিয়েটারের স্পটলাইটের নিচে, আর রক্ত গুলো সূর্যের কান্না। জানালার দিকে তাকাতেই সিদ্ধার্থ একটা বাচ্চা মেয়ের অবয়ব দেখতে পেয়েছিল মিত্রদের বাড়িতে। মিত্রদের বাড়ির একটা ঘর আর ওর মায়ের ঘর একদম মুখোমুখি। সিদ্ধার্থ মেয়েটির পরিচয় জানার জন্য আকুল হয়ে বসেছিলো সেদিন, মনে প্রশ্ন জমে আছে; ও কি সব দেখেছে? কী হয়েছিলো আমার মায়ের সাথে? সিদ্ধার্থের বাবা বলেছিলো মা নাকি অনন্ত কালের রথে চড়ে বিদেয় নিয়েছেন, আর বলে গিয়েছেন ও ঘরে যেনো কেউ না ঢোকে। সিদ্ধার্থে বাবা লাশ সমেত সেই ঘর তালা বন্ধ করে দেন। আশ্চর্যের বিষয়, লাশ পঁচে গিয়ে তো দুর্গন্ধ বের হবার কথা, কিন্তু দুর্গন্ধ কখনোই বের হয় নি, বরং সিদ্ধার্থ পেয়েছে হাসনা হেনা এর সুবাস। কত শত চিঠি আসতো, আর সিদ্ধার্থ ভাবতো ওর মা চিঠি পাঠিয়েছে, কিংবা কেউ ওর কথা জিজ্ঞেস করে লিখেছে। মা এর মৃত্যুর পর  সিদ্ধার্থ ভয়ানকভাবে একা, নিরপরাধ ঈশ্বরকে শত্রু ভেবে বড় হয়ে ওঠে। বাবা মানুষটা ওর খোঁজ না নিলেও সিদ্ধার্থ খুব ভালোবাসতো বাবাকে। আস্তে আস্তে এমন একাকিত্বকে বন্ধু করে বেড়ে ওঠা সিদ্ধার্থ চলে যায় কলকাতায় দর্শন নিয়ে পড়তে।  ছোট বেলায় একবার সেনেকার “অন দ্যা শর্টনেস অফ লাইফ” পড়েছিলো, সেই থেকে দর্শন কে বড়ো ভালোবাসে। ম্যনিফেস্টোও পড়া হয়েছিলো তার। আসলে সিদ্ধার্থ বড়ো অদ্ভুত, একই সাথে মলয় ও শঙ্খকে ভালোবেসেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন ওর এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটির নাম সিদ্ধা, কেমন যেনো মিল দুজনের নামে। পুরুষের স্বভাব, তার চোখ যদি একবার কোনো নারীকে নিস্পলকভাবে একাধারে দেখতেই থাকে, হৃদয় দূর্বল হয়ে যায় তার অজান্তেই। সিদ্ধার্থও এর ব্যতিক্রম নয়, সিদ্ধাকে ও প্রথম দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী তে, মেয়েটা ওর প্রিয় সেই ছোটবেলায় পড়া বইটিই খুঁজছিলো কিন্তু পাচ্ছিলো না। সিদ্ধার্থ মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আর জিজ্ঞেস করলো তুমি কি সেনেকার সেই বইটা খুঁজছো? কোন বইটা? সিদ্ধা পালটা প্রশ্ন করলো। অন দ্যা শর্টনেস অফ লাইফ? সিদ্ধার্থের এই প্রশ্নে অবাক হয়ে গেলো সিদ্ধা, আর মনে মনে ভাবতে লাগ্লো,সিদ্ধার্থ কীভাবে বুঝতে পারলো ও এই বইটিই খুঁজছে। সিদ্ধার্থ আবার বললো, আমি যেভাবেই বুঝতে পারি, এই নাও বইটি, এটা আমার মা আমায় দিয়েছিলো, আমার শেষ জন্মদিনে।  সিদ্ধা বইটি নেয়, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না, কারণ প্রশ্ন করেই বা কী লাভ? এই লাইব্রেরীতে দুই চাতক পাখির প্রশ্ন আর উত্তর পর্বে কী পৃথিবী কান দিচ্ছে? না দিচ্ছে না, সময় এমনিতেই তার পেটের মধ্যে আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে, তাই সময় কে নষ্ট করে কী লাভ? নষ্ট করার প্রতিশোধে সময় যদি আরো দ্রুত পেটের মধ্যে গ্রাস করে নেয়? যদি গলিয়ে ফেলে পেটে থাকা হাইড্রোকলিক এসিডে? তবে সব প্রশ্ন-উত্তর যদি সময় নষ্ট হতো পৃথিবীতে প্রেম বলে হয়তো কিছু হতো না। একটা মৃদু হাসি দিয়ে “ধন্যবাদ আপনাকে” বলে মৃদু মন্দ বাতাসের মতন বয়ে গেলো সিদ্ধা, সিদ্ধার্থের থেকে দূরে। তবে সিদ্ধার্থ বুঝেছিলো ও প্রেমে পড়েছে সিদ্ধার। নইলে মায়ের দেয়া প্রথম ও শেষ স্মৃতি, বইটি দিয়ে দিতে পারতো না। সিদ্ধাও কেমন, বইটি কবে ফিরিয়ে দেবে, বা সিদ্ধার্থের কবে প্রয়োজন একটি বার জিজ্ঞেসও করলো না। সিদ্ধার্থ তো বলল যে বইটা ওর শেষ জন্মদিনে পাওয়া। সিদ্ধা একবারও প্রয়োজন বোধ করল না সিদ্ধার্থকে জিজ্ঞেস করার, যে ওর জন্মদিন কবে ছিল? সিদ্ধার্থ ওর মা বেঁচে থাকাকালীন শেষ জন্মদিনকেই জীবনের শেষ জন্মদিন হিসেবে ধরে নেয়। ওর জন্ম ও মৃত্যুর খেলা, ওর মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ। যে মাকে সিদ্ধার্থের এমন ভয়াবহ আত্মমৃতের মতন মনে পড়ে, সেই মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতিটুকু কী অবলীলায় বিলিয়ে দিলো সিদ্ধার কাছে! এই কি তবে প্রেম? না কি শুধুই মোহ? মোহ বোধ হয় নয়। মোহ হলে বই দিতো না, সেই তো ছোট বেলা থেকে বইকে বন্ধু হিসেবে ভেবে বড় হয়েছে। আর এই পৃথিবীতে চিরচিরায়ত ভাবে দেখা গিয়েছে প্রেমের ফলে বন্ধুও হারিয়ে যায়, প্রেমিকা হয়ে ওঠে সব থেকে বড় বন্ধু। সিন্ধু নদীকে বড় ভালোবাসে সিদ্ধার্থ, সিদ্ধাকে দেখার পরেই ওর মনে হয়েছিলো সিদ্ধা আর ও সিন্ধু নদীর পাড়ে বসে আছে, গান গাইছে; ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে। সিদ্ধার্থ খুব ভালো গান গাইতো, সিদ্ধাও খুব ভালো গান গায় তবে রবি বাবুর গান একটু বেশিই ভালো লাগে ওর গলায়। এই ভ্রম থেকে সিদ্ধার্থ বেড়িয়ে আসে অপভ্রংশের মতন, ইতি টানে সমস্ত অমনিবাসের। সিদ্ধার সাথে ওর পরের দিন গঙ্গার পাড়ে দেখা হয়, মরা শুয়োরের পঁচা গন্ধ, কি এক বিভৎস পরিবেশ। সিদ্ধার্থ একটু বেশিই অবাক হয়ে যায় আর ভাবে  সিদ্ধা এখানে কী করছে? এই মরা গঙ্গার ধারে ওর মতন মলিনা, শুভ্র,সুন্দর যৌবন রসে পরিপূর্ণ এক নারী তো এই পরিবেশের সাথে মানায় না। এই স্থান যে শুধুই বিপ্লবীদের, যে মরা গঙ্গায় ভেসে যায় লাশ, পঁচা গন্ধ সেখানে তো এই ঈশ্বরীর থাকা সাজে না। সিদ্ধার্থ সিদ্ধাকে গিয়ে বলে, কী মনে পড়ে আমায়? সিদ্ধা জবাবে বলে, “আপনার কথাই ভাবছিলাম”। সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে বলে, “কী! তাই নাকি?!” সিদ্ধা বলে, “কেনো? কাল তো খুব মন পড়তে পারলেন আজ পারলেন না যে?” সিদ্ধার্থ কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলে “কাল একটু ঘোরে ছিলাম”। সিদ্ধা আর জিজ্ঞেস করে না কীসের ঘোর। বেচারা সিদ্ধার্থ ভাবে, “এ জীবনে যা কিছু চেয়েছি সেই কলহে ভীত ঘুমকাতুরে ঘুমন্ত ঈশ্বর তা কাড়িয়ে নিয়েছেন তার নামের বড়াত দিয়ে, সিদ্ধাকেও কি কেড়ে নেবেন তিনি?” ঠিক সেই মূহুর্তেই সিদ্ধা বলে , “চলুন, আজ আমি আর আপনি একসাথে মাতাল হবো, কলেজ স্ট্রীট এ একটা গোপন বার আছে শুনেছি, যাবেন নাকি?” । সিদ্ধার্থ  এই আকস্মিক প্রস্তাবে একটু অবাক হয়, আর ভাবে “ভালো করে চেনা জানাই হলো না, আর একসাথে মাতাল হবো? আমি তো ওর প্রতি এমনিই মাতাল, ও কি সেটা জানে না?”। বোকা সিদ্ধার্থ  জানেও না অবয়ব কী এবং তার স্মৃতিশক্তি সিদ্ধার থেকে কত দূর্বল, সিদ্ধা যে তাকে কাল প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছিলো, তাই আর কোনো প্রশ্ন করে নি , সেটা সিদ্ধার্থ এখনো ধরতে পারে নি। বারে দুজনে উন্মাদের মতন মদ্যপান করে, সিদ্ধা হুশ এ থাকলেও সিদ্ধার্থের বাঁধ ভেঙে যায়। সিদ্ধার্থ কে সিদ্ধা ওর ফ্ল্যাটে পৌছে দিতে আসে। কিন্তু দুজনেই আজ মাতাল, হৃদয়ের ভেঙেছে বাঁধ, সিদ্ধার্থ সিদ্ধাকে টেনে নিয়ে চুমু তে লিপ্ত হয়ে পড়ে। দুজনে আজ দেহের সকল জরা জীর্ণতা কে সময়ের বালুর নিচে চাপা দিয়ে মিলিত হয়। সিদ্ধা আর সিদ্ধার্থ, দুজনেরই প্রথম বৈপরীত্য এর ছোয়া পাওয়া। পুরো রাত ভরে সিদ্ধার্থ চলে যেতে থাকলো সিদ্ধার তরমুজ আঙরাখার ভেতরে, মাথায় মলয়ের কবিতার লাইন :
                        “সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর০0
                        আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
                          আর আমি পার্ছি না অজস্র কাচ
                                    ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে”
    শুভ্র সকালে, সিদ্ধার্থ অনুভব করে তার কপালের উপর ঝুলছে সিদ্ধার সাদা শুভ্র স্তন, স্তনে মাঝে একটা নীল রঙের লকেট। পৃথিবীর কোনো প্রেমই এমন কাব্যিক যৌনতা দিয়ে শুরু হয় কিনা সিদ্ধার্থ তা জানে না। তবে তার প্রেম এভাবেই শুরু হয়েছে, কালের বরপুত্র হবার ফসল হয়তোবা। ছোট বেলা থেকে ঘুণপোকার সিংহাসনে বসে, উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করা ছেলেটা যখণ হাবিজাবি নিয়ে ভাবতে ভাবতে উন্মাদ হয়ে যায়, অন্তর টনিকেও কাজ হয় না, তখন সে যেতে চায় সাজানো বাগানের পরের স্টপেযে, আর সেই স্টপেজ হয়েই ধরা দেয় সিদ্ধা। একাকিত্ব কে সাথী করে বড় হয়ে ওঠা সিদ্ধার্থ এবার সিদ্ধাকে সাথী করে নেয়। সিদ্ধার্থ একা হলেও নিস্বঙ্গ ছিলো না, ওকে স্বঙ্গ দিতো বিড়ালের চোখ, লক্ষ্মী প্যাঁচার চাহনি,  শিশিরের জলে ভেজা চালতা ফুলের সুবাস। তবে এবার সেই সাথে সঙ্গ দিচ্ছে হাসনা হেনা হয়ে আসা সিদ্ধা।  মধুর প্রেম এভাবে গড়াতে থাকে, ঠিক বছর খানেকের মাথায় সিদ্ধার্থ সিদ্ধাকে কোনো একটি শোভাযাত্রায় দেখে এক অপরিচিত ছেলের হাত ধরে নাচতে, খুব অভিমান হয় সিদ্ধার্থের, ছোট বেলা থেকে কিছু না পেয়ে আসা মানুষটা যখন কাউকে আকড়ে ধরে বট গাছের শেকড়ের মতনই হয়তো আঁকড়ে ধরে। সেই আঁকড়ে ধরার ফল যে কী ভয়াবহ অভিমানের জন্ম দেয় সিদ্ধার্থ তা ভালো বুঝেছে এবার। সিদ্ধার ওপর অভিমান হয় নি ওর, আক্রোশ ও ক্ষোভ হয়েছে ঈশ্বরের প্রতি। এবার ক্ষীপ্ত হয়ে গিয়ে সিদ্ধার্থ এক চিঠি লেখে ঈশ্বরের কাছে,
    “ অন্তরীক্ষ ভেদ করে দেখি, দেখবার বদলে শুনতে পাই সহস্র ঘোর বিভিষীকা। যতদূর শুনি, শুনতে পাই প্রভুর যবনিকা। কেন? কেন এই বৈপরীত্য? আমি কি তোমার আঁতে খুব ঘা দিয়ে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি? অমনিবাসের ইতি টেনে পাপের ক্যাফেতে বসে কালো গায়িকার ব্লুজ শুনতে তোমার কী খুব ভালো লাগে ঈশ্বর? তুমি কি কামাচ্ছন ওই কালো গায়িকার প্রতি? একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে শব্দ কে জমা রাখবো, বাকশক্তিও কি জমা রাখা প্রয়োজন নয়? নইলে তোমার বিরুদ্ধে বার বার বলে উঠছি যে! সহস্র বৈদূর্যমণি ভেদ করে দূরে-দূরে  এণ্ড্রোমেডো আর মিল্কিওয়ের চুম্বন দেখবে তুমি। আর সেই মৃত্যুজ্বালায় শত শত ঘাস্ফুল না ফড়িং হয়ে যায়! ব্যবিলিয়নের মতন আমি গুড়িয়ে দেবো তোমার প্রতি আমার নৈবেদ্যের থালা। তোমার যাকে দেখলে যৌনাকাঙ্খা বেড়ে যায়, সমুদ্রের বোন সেই কালোগায়িকা। কালো গায়িকার দেহের গন্ধে তুমি কেমন মোহাচ্ছন্ন, নইলে ওতো গুলো প্রাণ ঝড়ে গেলো তুমি কিছুই করতে পারলে না। ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দোষে ভুগছো। কেমন করে সেই এক জোড়া চোখ তাকিয়ে রইলো,অথচ তুমি ক্ষমাশীল হতে পারলে না ! ওহ তুমি তো শুধু জানো তোমার দোহাই দিয়ে কতগুলো প্রাণ কাড়িয়ে নিতে। বিশ্বাস করো মনে হচ্ছে ছুড়ি বেছানো কোনো বাগানে আমি উদ্ভ্রান্তের মতন শুয়ে আছি, শয্যাশায়ী। ঈশ্বর তুমি বড় নির্দয়, অবশ্য ঘুমিয়ে থাকা কোনো কিছুর হৃদয় কাজ করে না, নইলে যে পাখিকে ভালোবেসে ফেলে দিয়েছিলাম সকল জীর্ণতাকে আজ তারই উদ্দেশ্যে মহাশুন্যের দিকে তাকিয়ে বলতে হলো, ‘ পাখি, তোমায় ছাড়া কেমন করে কাটলো আমার বেলা, নিশীথ নিঝুম, কোথাও কেউ নেই, আমার মনে আপন কোণে হৃদয় বীণায় কী বিষাদ কণ্ঠস্বর বাজে, এর থেকেও বেদনা বিধুর নিদারুণ সুন্দর কিছু হতে পারে? বিট রুটের পাখি তুমি যে এত তাড়াতাড়ি ইউক্যালিপ্টাস এর চুড়োয় উঠে যাবে কেই বা জানতো? তোমার কথা যে আমি পিষে ফেলতাম না, পুষে রাখতাম…’ ঈশ্বর কি সুন্দর একটা অভিশাপ আমায় দিলে আবার, অবশ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠে আর কীই বা করতে পারো তুমি! তোমার পোদে যদি একশো খানা লাথি মারতে পারতাম মনে বড় শান্তি পেতাম। তুমি ঘুম থেকে আর উঠো না, তুমি জেগে থাকলেই আরেক চাতক তার চাতক পাখিকে হারাবে, ঝড়ে যাবে কোনো বিপ্লবীর প্রাণ, পুঁজিবাদি পিতা তার সন্তান কে শেখাবে কীভাবে প্রেমের কারেন্সী চুমু থেকে মুদ্রাতে রুপান্তর করা যায়, কীভাবে নিজ চামড়ায় ত্বকের বিপরীতে মুদ্রাকে বসাতে হয়, তুমি শক্ত করে  বন্ধ করো নিজেকে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে।” 

    এই চিঠি লেখার পর সিদ্ধার্থ সিদ্ধার থেকে অনেক দূরে চলে আসে। ১ মাস পর সিদ্ধা যায় সিদ্ধার্থের কাছে, ক্ষমা চায় তার এই ঠকবাজির জন্যে। ছোটবেলা থেকে একাকিত্ব কে আপন করে বেড়ে ওঠেছে সিদ্ধার্থ, কিন্তু সিদ্ধার অনুপস্থিতি ওকে যে ভয়াবহভাবে একলা করে দেবে ও সেটা বোঝে নি। না বুঝোক, ক্ষমাও করেনি। তবে সিদ্ধা যাওয়ার আগে কিছু সত্য উন্মচন করে যায়, আসলে সিদ্ধাই সেই অবয়ব যা সিদ্ধার্থ দেখেছিলো মাতৃ মৃত্যু কালে। সিদ্ধা আজ বলে গেল্‌ তার বাবা তার মাকে হিংস্র নেকড়ের মতন ধর্ষণ করে কামড়ে কামড়ে খেয়েছে,কিন্তু কেনো খাবে, নিজ স্ত্রীকে? আসলে ওর বাবা আদিম কালের নেকড়ে, নেকড়ের ছেলে হিসেবে ও জন্মেছে ফড়িং হয়ে, ওর মায়ের মতন। সিদ্ধার্থ চোখ বন্ধ করতেই সেই বিভিষিকাময় দৃশ্য ওর চোখের সামনে ভেসে আসে। সিদ্ধা কাঁদছে আর বলছে তোমায় খুব মনে পড়বে, আমায় একটি বার ক্ষমা করো না?! সিদ্ধার্থ জোসেফ স্ট্যালিন। তবে সিদ্ধার প্রস্থান কালে  ও একটি কথা বলে, “কখনো যদি আমায় মনে পড়ে, ঘাস্ফুলের দরজায় ঠক ঠক করো, যদি সত্যি ভালোবাসো সাড়া দেবো”

    সিদ্ধা আর কথা বাড়ায় নি, ভাবতে ভাবতে চলে যায়, আর কথা বাড়িয়েই বা কী লাভ? পৃথিবী কি কান দিচ্ছে? সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়তে থাকে সিদ্ধার। লাভ নেই, সময় প্রেম কে গ্রাস করে নিয়েছে। সিদ্ধার্থ এবার ফিরে যায় তার সেই বাড়িতে, বাবা কে দেখে এতো ঘৃণা হয় ওর, ঈশ্বরকেও এত ঘৃণা করে নি ও। ও ঠিক করে এবার মা আর ওর তরফ থেকে বাবাকে চিঠি পাঠাবে ডাকবাক্সে, সেই চিঠি বাবার কাছে পৌছেও যায়, আর সেই চিঠি পড়ে আত্মহত্যা করে ওর বাবা, চিঠিতে কী লেখা ছিলো তা সিদ্ধার্থ না জানিয়েছে কাউকে, না ওর বাবা। বাবার আত্মহত্যার পর, সিদ্ধার্থ ওর মায়ের ঘরের তালা ভাঙে, ভেতরে ঢুকে দেখে সেই রক্ত কে জল হিসেবে ব্যবহার করে মায়ের হাড়োর উপরে গজিয়ে উঠেছে ঘাস্ফুল, জানালার ধারে নীলকণ্ঠ, পায়ের কাছে হাসনা হেনা। সিদ্ধার্থ ঠিক করে নিজেকেও বন্দি করে ফেলবে ঘাস্ফুলের ঘরে, সিদ্ধার মনে বড় রকমের ঝড় বইছে, মনে হচ্ছে সিদ্ধার্থ ওর থেকে খুব খুব দূরে মহাকালের রথে চড়ে অন্তরীক্ষ ভেদ করে চলে যাচ্ছে, সিদ্ধা পাগলের মতন দৌড়ে ছুটে চলে যায় সিদ্ধার্থের বাড়ি, ততক্ষণে খুব দেরী হয়ে গিয়েছে। সিদ্ধার্থ নিজেকে বন্ধ করে নিয়েছে ওর মায়ের ঘরে। সিদ্ধা সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজে, কিন্তু কোথাও সিদ্ধার্থ নেই, সবশেষে মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়, দেখে তালা নেই দরজায়, ভেতর থেকে বন্ধ। সিদ্ধার্থের কথাটা ওর মনে পড়ে,  “কখনো যদি আমায় মনে পড়ে, ঘাস্ফুলের দরজায় ঠক ঠক করো, যদি সত্যি ভালোবাসো সাড়া দেবো”

    সিদ্ধা দেখে ঘড়ের দরজা দিয়ে ঘাস্ফুল বের হয়ে আছে, ও ঠক ঠক করে কিন্তু কোনো সাড়া আসে না, সিদ্ধার্থকে আর দেখেনি পৃথিবী, কেঁদেছে অনেক।
    এতকিছুর পরও ওঁ পৃথিবীকে দেখছে সেই ঘর থেকে মায়ের কোলে শুয়ে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শান্ত দাস | 103.66.176.11 | ০৩ মে ২০২৪ ১৯:১৮531357
  • গল্পটা একটু দুর্বোধ্য।
  • dc | 2402:e280:2141:1e8:5050:3aba:5dda:de76 | ০৩ মে ২০২৪ ১৯:১৮531358
  • দারুন ভালো লাগলো। 
  • r2h | 192.139.20.199 | ০৩ মে ২০২৪ ১৯:১৯531359
  • ছবিটা কী সুন্দর!
  • পাখি | 103.60.175.44 | ০৩ মে ২০২৪ ২১:২২531365
  • গল্পটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেছি! গল্পকার সার্থক। তার জন্য ভালোবাসা <3 ​​
  • kk | 172.58.241.244 | ০৩ মে ২০২৪ ২২:১০531368
  • ছবিটা আমারও খুব সুন্দর লাগলো। গল্পটা পুরো কবিতা। কতগুলো মাইনর টাইপো আছে, সেগুলো সামান্য চোখে লাগছে। ঠিক করে নেওয়া যায় কি? অবশ্যই এটা নিটপিকিং করা হলো। তবু আর কী।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন