এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ৪৭

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৮ মে ২০২৪ | ৩৫৪ বার পঠিত
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ৪৭
    নবযুগের দপ্তরে


    গিরিবালা দেবী আর প্রমীলা দুজনেই বললেন, নজরুলের সঙ্গে অরবিন্দর সূক্ষ্মদেহে দেখা হবার কথা নজরুল আগেও অনেকবার বলেছে। শুধু তাঁদেরই নয়, বলেছে আরও অনেককেই। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। তাতে কিছুই আসে-যায়নি নজরুলের, তবে এবারের মতো এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েনি আগে।

    এবার এতটাই অসুস্থ নজরুল যে অফিসে যেতে পারল না বেশ কয়েকদিন। এদিকে কলকাতার য়্যুনিভার্সিটি থেকে ইন্টারমীডিয়েট পরীক্ষায় বাংলার পরীক্ষক নির্বাচিত করে তার কাছে একরাশ উত্তরপত্র আর পরীক্ষকের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী পাঠিয়ে দিয়েছে য়্যুনিভার্সিটি। নবযুগে নজরুলের সহকারী কালীপদ গুহ ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরীক্ষকের কাজ করেছে আগে। সে-ই উত্তরপত্র পরীক্ষায় নজরুলকে সাহায্য করতে শুরু করল। ফজলুল হক সাহেব নজরুলকে জানিয়েছেন, শরীর যতদিন সম্পূর্ণ ভালো না হয় ততদিন তার অফিসে আসার প্রয়োজন নেই। অমলেন্দু বা কালীপদদের ডাকিয়ে এনে বাড়িতে বসেই পত্রিকা সম্পাদনার কাজও চালিয়ে যেতে পারে সে। এই সুযোগে কালীপদ থাকতেই শুরু করল নজরুলের বাড়িতে, এখন নজরুলের যে অবস্থা তাতে ঘড়ি-ধরে কাজ করা তো সম্ভব নয় তার পক্ষে। চব্বিশ-ঘন্টায় যখনই কাজের মূড আসবে তখনই কাজ! সেই সময় কালীপদ সঙ্গে না-থাকলে কি চলবে?

    জানতে পেরে আপত্তি করেননি হকসাহেব, লীগ-হক মন্ত্রীসভা ভেঙে যাবার পর নজরুলের প্রয়োজন অনেকটাই বোধ হয় এখন কমে গেছে তাঁর কাছে। আসল কথা এই যে, যতই নবযুগের সম্পাদকীয়তে লীগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের ব্যাপারে হক সাহেবের সমর্থনে নজরুল মুসলিম লীগের সমালোচনা করে থাকুক, ওই মুসলিম লীগেরই তরুণ কর্মীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার জন্যেই মূলত হক সাহেবের তাকে প্রয়োজন হয়েছিল। অফিসে বসে এক দঙ্গল ছাত্র-লীগের কর্মীদের সঙ্গে তার আড্ডা এখন আর তেমন পছন্দও হচ্ছে না হক সাহেবের। শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা এখন তো চলছে ভালোই। কাজি না-থাকলেও এখন দিব্যি চলবে নবযুগ। আর, এমনকি নবযুগ না-থাকলেও এখন দিব্যি চলবে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার!

    কিন্তু তবুও, এমন অসুস্থতার সময় কোন একটা বিকল্প ব্যবস্থা না-করে নজরুলকে নবযুগ থেকে সরিয়ে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না হক সাহেব। একটা সুযোগ এসে গেল। সেই সময় অল ইণ্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর-জেনারাল ছিলেন আহ্‌মদ শাহ্‌বুখারী, নজরুলের প্রতিভার পরম ভক্ত তিনি। যুদ্ধের সময় সরকারি প্রচারের স্বার্থে সং পাবলিসিটি অর্গানাইজেশন নামের একটা সংগঠন তৈরির উদ্যোগ চলছিল তখন। স্বাভাবিক ভাবেই আহ্‌মদ শাহ্‌বুখারী সাহেবের মতামত মূল্যবান ছিল এ-ব্যাপারে। হক সাহেবও বুখারী সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন। লোক-সঙ্গীতের কাজ; নজরুলকে নেওয়া হবে গীতিকার-সুরকার-পরিচালক হিসেবে, আর তাঁর সহকারী হবেন আব্বাসউদ্দীন। চাকরিটা কেন্দ্রীয় সরকারের, কিন্তু কলকাতার অফিস রাইটার্স বিল্ডিঙে। কাজটা পাওয়া এতটাই পাকা যে সরকারি দপ্তরের নানা লোকজন বাড়িতে এসে অসুস্থ কবিকে দিয়ে অনেকগুলো ফর্ম পূরণ করিয়েও নিয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে রাইটার্সে অফিসেও গেল নজরুল; নিজে অফিসে বসে সারাদিন ধরে উশখুশ করল সে, কারো সঙ্গে একটাও কথা পর্যন্ত বলল না। প্রথম দিনের কাজই হল শেষ দিনের কাজ!

    কিন্তু এমনটা করল কেন নজরুল? তাহলে কি সরকারি পয়সায় সরকারের প্রচারের চাকরি তার পছন্দের নয়? যুদ্ধ চলছে, দখলদার ব্রিটিশ সরকার ভারতের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, সেই সরকারের অপকর্মের গুণপণা প্রচারের চাকরি? যে যুদ্ধ চলছে এখন, সে কি ভারতবাসীর যুদ্ধ? নজরুলের মনে পড়ে যায় সে একবার প্রচারমূলক একটা গান রচনা করে, তাতে সুরসংযোগ করে, শিল্পীদের শিখিয়ে-পড়িয়ে সেই গান রেডিওতে প্রচার করিয়েছিল। একেবারেই শিল্পকর্ম হয়ে ওঠেনি
    সে-গান। সে জানতও তা। বন্ধুবান্ধব-পরিচিতদের মধ্যে হাসাহাসিও হয়েছিল সেই গান নিয়ে। নজরুল পাত্তা দেয়নি সেই সমালোচনাকে। ও জানত, শিল্পী হিসেবে ওর যে প্রতিষ্ঠা, হয়তো তারই ওজনে – শিল্প হিসেবে যতই নিম্নমানের হোক – এই গান গাওয়ার উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত বুঝবে রেডিওর শ্রোতারা। ম্যালেরিয়া-পোষক কচুরিপানার বিরুদ্ধে এই গানের প্রচার একেবারেই উদ্বিগ্ন করেনি তাকে :

           ধ্বংস করো এই কচুরিপানা
    এরা   লতা নয় পরদেশি অসুর-ছানা।।
           ইহাদের সবংশে করো করো নাশ
           এদের দগ্ধ করে করো ছাইপাঁশ
    এরা   জীবনের দুশমন গলার ফাঁস
    এরা   দৈত্যের দাঁত রাক্ষসের ডানা।।
    এরা   ম্যালেরিয়া আনে আনে অভাব নরক
    এরা   অমঙ্গলের দূত ভীষণ মড়ক
    এরা   একে একে গ্রাস করে নদী ও নালা
    যত   বিল ঝিল মাঠঘাট ডোবা ও খানা।।

    বন্ধুদের ঠাট্টার জবাবে তখন নজরুল বলেছে, আমার এই গান যদি কোন-একটা গ্রামের একটা মানুষকেও কচুরিপানার হাত থেকে তার গ্রামকে মুক্ত করার চেষ্টাতে এমনকি একটুও উদ্বুদ্ধ করে তাহলে আমি শ'য়ে শ'য়ে এরকম গান গাইতে রাজি আছি।

    আর, শেষ পর্যন্ত বাস্তব পৃথিবীর আক্কেলও ফিরল নজরুলের; অফিসে না-গিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে চলবে না। নজরুলের প্রয়োজন হয়তো প্রাথমিকভাবে ফুরিয়েইছে হক-সাহেবের; তাই সাময়িক ছুটি নয়, ভদ্রভাবে বোধ হয় তাকে তাড়াবারই মতলব করছেন তিনি। তাই কারো সঙ্গে কিছু আলোচনা না-করে হঠাৎই পরের দিন নজরুল দুপুর বেলা হাজির অফিসে। সাধারণত এই সময় রাইটার্সে থাকেন হক সাহেব, নজরুলকে দেখে বললেন, আরে কাজি যে, আছ কেমন? আপিসে আইলে ক্যান, ঘরে মন লাগে না?

    ঘর কেন, দেশেই তো মন লাগে না এখন, বলে নজরুল, রেডিও খুললেই এখন কেমন যেন সুভাষবাবুর গলা শুনছি বলে মনে হয়। কিন্তু তিনি তো ঘরের বাইরে, দেশের বাইরে। তবুও রেডিও খুললেই এখন তাঁরই কথা মনে পড়ে, মনে হয় যাই চলে এক ছুটে তাঁর কাছে।

    তা করে, তা করাডাই তো স্বাভাবিক, বলেন হক সাহেব, আমার এই বুরা-হারেও যে করে না তা কইতে পারি না। আর তোমরা তো প্রায় সমবয়েসীই হব, কে বড়? তুমি, না হ্যায়?

    উনিই বোধ হয় একটু বড়, নজরুল বলে, আমার জন্ম আঠেরশো নিরানব্বই-এর মে মাসে, আর সুভাষবাবুর বোধ হয় সাতানব্বই-এর জানুয়ারি।

    তাই কই, যে কষ্টডা হ্যায় করল, আর যে বীরত্ব আর বুদ্ধিডা দেখাইল এলগিন রোডের বাড়ি থেইক্যা পুলিশের চক্ষে ধুলা দিয়া দ্যাশের পর দ্যাশ পার হইয়া! কও, এক্কেরে বার্লিন! আরও কয়েকখান সুভাষের প্রয়োজন ছিল আমাগো এই দ্যাশের। তা, আজ আসছ যখন নিজের ডেস্কে গিয়া কাম কর, আমিও যাই রাইটার্সে।

    হক সাহেব বেরিয়ে যাবার পর নিজের সম্পাদকীয় দপ্তরে যায় নজরুল, সেখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে বসে কাজ করছিল অখিল নিয়োগী আর দেবনারায়ণ গুপ্ত। কাজিদার অফিসে আসার কোন খবর ছিল না তাদের কাছে, হঠাৎ কাজিদাকে দেখবে আশাও করেনি তারা, অশেষ কৌতূহল নিয়ে কাজিদার পেছন পেছন তার নির্দিষ্ট ঘরে ঢোকে ওরাও।
    বসতে বসতে কাজি বলে, তারপর, কী খবর, হালচাল কেমন দেখছ?

    দেবনারায়ণ বলে, কী আর দেখব কাজিদা, এখন তো এই-যুদ্ধ-লাগল এই-যুদ্ধ-লাগল ভাব চারদিকে। একদল রিফিউজি আসছে বার্মা-মালয় থেকে কলকাতায় রোজ, আর তার ঠিক উল্টোটা হচ্ছে কলকাতার লোকদের; দলে দলে এখান থেকে পালাচ্ছে লোকে। চারধারে ট্রেঞ্চ, রাস্তাঘাটের সব ল্যাম্পপোস্টে কালো ঠোঙা, টিমটিম-করা আলোয় শহরটাকে কেমন যেন ভুতুড়ে লাগে! আমরাও অফিসে এসে কত তাড়াতাড়ি পালাব সেই চিন্তাই করি শুধু। কেউ মুখে তেমন কিছু না-বললেও সবাইকেই মনে হয় আতঙ্কগ্রস্ত। আপনিও তো অফিসে এলেন না কতদিন, মাঝে মাঝে কালীপদদা কিছু এডিটোরিয়াল নিয়ে এসে প্রেসে দিয়েই চলে যায়, শুনি, আপনিই লিখে দিয়েছেন। সব মিলে, আমরা ভালো নেই কেউ।

    হুঁ, খবরের কাগজের অফিসে যদি আড্ডাই না বসে নিয়মিত, হেসে বলে কাজি, তাহলে আর অফিস কিসের! যাই হোক, আমি তো শেষ অফিসে এসেছিলুম সেই ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে, সুভাষবাবুর জার্মানী থেকে প্রথম রেডিও-বক্তৃতার পর বড় জোর আরও সপ্তাখানেক। তার পর থেকে তো বাড়িতেই বসে আছি। এক মাস হতে চলল প্রায়, এখন তো খবর পাই এতদিনে বার্মায় শুধু নয়, সাউদ-ঈস্ট এশিয়ায় কতো শহরই যে জাপানীদের হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে তার হিসেব ঠিকঠাক জানেনা বোধ হয় কেউই। এই-যে রোজ রোজ কলকাতায় রিফিউজিদের এত আগমনের ঘটা, সে তো আর এমনি-এমনি নয়। ব্রিটিশের হয়ে এত যে ভারতীয় লড়াই করছিল এতদিন, এখন যত ভারতীয় যুদ্ধে মরছে আর বন্দী হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যুদ্ধটা আমাদের দেশের ভেতরেই ঢুকে পড়ছে হুড়মুড় করে।

    আপনি তা-ই ভাবছেন কাজিদা, এবার কথা বলে অখিল, কিন্তু আমি তো একজনের কাছে শুনলাম যে এই যুদ্ধে সুভাষবাবুর বাংলাকেই উৎসর্গ করে দেবার মতলব সাহেবদের।

    বাংলাকেই উৎসর্গ? তার মানে? উৎসর্গ মানে কী? বাংলা মানেই সুভাষবাবুর বাংলা, এতে তো কোন তক্কো নেই, কিন্তু উৎসর্গ কথাটার মানে কী হল?

    মানেটা সহজ, বলে অখিল, এই উনিশশো বেয়াল্লিশে জাপানীরা যে অঞ্চলে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে নাস্তানাবুদ করছে ওদের, সেখান থেকে পালাবে যারা তারা আর আসবে কোথায়? বাংলা ছাড়া? পরাক্রমী জাপান যদি ওদের মারতে মারতে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এগোতে এগোতে ওরা আর আসবে কোথায়? বাংলাতেই শেষ পর্যন্ত, তাই না? তাহলে এখন যদি বাংলা ছেড়ে আরও পশ্চিমে পিছিয়ে যায় আমাদের প্রভু ব্রিটিশ সরকার উইদ ব্যাগ অ্যাণ্ড ব্যাগেজ, বীরবিক্রমে পশ্চাদ্ধাবনই করে যদি, তাদের তাহলে গন্তব্যস্থল তো বাংলা থেকে আরও পশ্চিমেই হবে, তাই না? তার মানে কী হল? ইংরেজের পক্ষে? বাংলাকে জাপানের হাতে উৎসর্গ করে দিয়ে বাকি ভারতে রাজত্ব চালানো, তাই না? বাকি ভারতে তো আর সুভাষবাবু নেই, নেই তাঁর চেলারাও। অতএব শান্তি, পরম শান্তি!

    নজরুল বলে, তা যা বলেছ। এই সুভাষবাবুর মতো মানুষ কী ভুলে যে এই ভীতু কর্তাভজাদের বাংলায় জন্ম নিলেন তারই কোন কিনারা পাই না। সুভাষবাবুকে কংগ্রেস-ছাড়া করবার পর অ্যাড-হক কংগ্রেস আর সুভাষপন্থী কংগ্রেসের নানা বচসা মারামারি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে যখন বড় বড় কাগজে অনেক লেখালিখি চলছে, সেই সময় হঠাৎ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে ওই যে বেলঘরিয়া না সোদপুরে কী যে এক আশ্রম আছে, সেই আশ্রম থেকে গান্ধীর এক চেলা রবীন্দ্রনাথকে সুভাষবাবুর সমর্থক ধরে নিয়ে এমন কদর্য ভাষায় এক চিঠি লিখলেন যে পড়ে আমরা সবাই হতবাক। গুরুদেব অবিশ্যি এই চিঠিকে কোনই গুরুত্ব দিলেন না! তাই মাঝে মাঝে ভাবি অকৃতজ্ঞ বাঙালিজ ডু নট ডিসার্ভ আ রিয়েল হীরো লাইক সুভাষ!

    খানিকটা উত্তেজিতই হয়ে পড়ে নজরুল এই সব আলোচনায়। এর কিছুদিন পরেই ষোলই এপ্রিলের নবযুগে সম্পাদকীয় স্তম্ভের ঠিক নীচে প্রকাশিত হল তার প্রবন্ধ, বাঙালির বাংলা। প্রবন্ধের প্রথম লাইনই “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে – “বাঙালির বাঙলা” সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।”

    সেইদিনই অফিসে এসে নজরুল সকালবেলার কাগজে তার নিজের সদ্যপ্রকাশিত প্রবন্ধটাই পড়ছে, এমন সময় হাতে সেই দিনেরই রোল-করা কাগজখানা নিয়ে সোজা তার ঘরে ঢুকলেন হক সাহেব, তারপর নিজস্ব ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন, কী কর, নিজের লেহাডাই পড় নাকি?

    চেয়ারে বসতে বসতেই হক সাহেব বোঝালেন নজরুলের এই প্রবন্ধখানা তিনি মন দিয়েই পড়েছেন, এবং এইরকম তৎসমশব্দবহুল রচনাটা পড়ে প্রথমেই তাঁর মনে যে প্রশ্নটি এসেছে তা হল – অন্তত তা-ই তিনি বললেন – ও কাজি নজরুল, তুমি আবার ব্রাহ্মণ হইলে কবে? বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের লাগসই প্রয়োগের জন্যে যে বিশেষভাবে পরিচিত সেই নজরুলের এই দীর্ঘ প্রবন্ধে একবার মাত্র পানি, আজান একবার, এবং আল্লাহ্‌-র উল্লেখও ওই একটিইবার! তা ছাড়া পুরোটাই, যাকে বলা চলে বঙ্কিমী বাংলা খানিকটা আধুনিক বেশে! তা-ও, আল্লাহ্‌-র নাম এসেছে ধর্মবোধ প্রসঙ্গে ভগবানের নামের সঙ্গে একসঙ্গে, এবং আজানের কথা বলা হয়েছে যে বাক্যে সেই বাক্যটি হল – হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খঘন্টার ধ্বনি! হস্তধৃত কাগজখানা টেবিলে মেলে ধরেন হক সাহেব এবং নজরুল লক্ষ করে, মুদ্রিত রচনাটি রক্তিমনিম্নরেখায় প্রায় সম্পূর্ণ রঞ্জিত! দুয়েকটি বাক্য বেশ জোর গলায় নাটকীয় ভঙ্গিতে হকসাহেব পড়েনও, যেমন, “এই হিমালয়ের গভীর হৃদয়-গুহার অনন্ত স্নেহধারা বাংলার শত শত নদ-নদীরূপে আমাদের মাঠে ঘাটে ঝরে পড়েছে”, অথবা “যাদের মাথায় নিত্য স্নিগ্ধ মেঘ ছায়া হয়ে সঞ্চরণ করে ফিরে, ঐশী আশীর্বাদ অজস্র বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ে, শ্যামায়মান অরণ্য যাকে দেয় স্নিগ্ধ-শান্তশ্রী, বজ্রের বিদ্যুৎ দেখে যারা নেচে ওঠে, – হায় তারা এই অপমান, এই দাসত্ব, বিদেশী দস্যুদের এই উপদ্রব, নির্যাতনকে কি করে সহ্য করে?” – পড়েই উচ্চকিত হো হো হাসিতে ছোট ঘরখানা ভরিয়ে তোলেন হক সাহেব, এ কি মুসলমানের লেখা হল, এতো শ্রীমৎ নজরুলানন্দ সাহিত্যসরস্বতীর রচনা!

    হাসে নজরুল, বলে, বাংলা ভাষার লেখককে তো একই সঙ্গে সাহিত্যসরস্বতী আর ডক্টর শহীদুল্লা হতে হয়। আর তার সঙ্গে ইংরিজি ফরাসী ওলন্দাজী ছাড়াও একটু-আধটু বৌদ্ধ দোহা – তা ছাড়াও আরও কতো রকমের যে মিশেল দিতে পারলে তবে দাঁড়ায় আমাদের বাংলা ভাষা! এ তো আমাদের কবির ভাষায় দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে। কিছু একটা লিখি যখন এই ভাষায়, তখন তো আর মাপ করে – এতটুকু যখন সংস্কৃত এসেছে, অতটুকু তাহলে আরবী বা ফারসি আসুক – এই ভেবে তো সাহিত্য করা চলে না। বাংলা ভাষা বাংলাই, তার চলনে তো সারা পৃথিবীর সুর। আর তারই মধ্যে তার নিজস্বতাও। লিখি যখন, তখন অবিশ্যি এত কিছু ভেবে লিখতে বসি না। যা স্বাভাবিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত আসে কলমের ডগায় তা-ই লিখি।

    তোমার কলমের ডগায় যা আসে, লেখক তুমি লেখ তা-ই – এ কথা তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আমরা যারা লেখক নই, সেই আমরা যে কথা বলি সেও তো ওই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই; এই কথাটা ক'জন বোঝে বলতো। যে মুসলিম লীগ পার্টিটাই তৈরি হল বাংলায়, আজ তার ওয়র্কিং কমিটিতে একটা বাঙালিকেও রাখা গেল না, এভাবে কি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে?

    আমরা তো তখনই প্রতিবাদ করেছিলুম আমাদের নবযুগে, বলে নজরুল, মনে আছে আপনার?

    মনে তো আছেই, হক সাহেব বলেন, তোমার সেই তিন লাইনের হেডলাইনখানা, বড় বড় হরফে পাঁচের পৃষ্ঠায়, বাঙালি মুসলমানের অবমাননা/ মিঃ হকের পরিবর্তে/ অবাঙালি মিঃ ইস্‌পাহানি লীগ ওয়র্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত – মনে নাই আবার? অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের খবর ছেপেছিলে তুমি, ভাষা ঠিক মনে নাই, তবে খানিকটা এইরকম: নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি মিঃ জিন্নাহ্‌ ঘোষণা করিয়াছেন, তিনি মিঃ ফজলুল হকের নাম কাটিয়া তাঁর স্থলে কলিকাতা হইতে মিঃ এইচ ইস্‌পাহানিকে লীগ ওয়র্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত করিয়া বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি নিয়োগ করিয়াছেন। কী, ঠিক বললাম? আর এই একজনকে বিয়োগ আর অন্য একজনের নিয়োগের ফলটাও, যতদূর আমার মনে পড়ছে, ওই লেখাতেই ব্যাখ্যা করেছিলে তুমি। মুখে না-বললেও মনে মনে হক সাহেব ভাবেন, নজরুলকে ছাড়া চলবে না। জিন্নাহ্‌-র মনোভাবটা সাধারণ বাঙালি মুসলমানকে বোঝাতে পারবে এক নজরুলের কলমই।

    কোন কথা না বলে কিছুক্ষণ নজরুলের দিকে তাকিয়ে থাকেন হক সাহেব। তার পর বলতে থাকেন, সেই সময় কলকাতার কর্পোরেশনেও ওই একই ইস্‌পাহানি নির্বাচিত হয়েছিল ডেপুটি মেয়র। তুমি লিখেছিলে, ইস্‌পাহানির বদলে কোন বাঙালি মুসলমানকে দাঁড় করালে সেই বাঙালি মুসলমানটি কিন্তু ডেপুটি নয়, পুরোপুরি মেয়রই হতে পারত। আমি বুঝি না কাজি, বলেই চলেন হক সাহেব, কেন যে এরা মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালির ভাগাভাগিটা কমাবার চেষ্টা না-করে আরও বাড়িয়েই চলছে। একে তো ক্যাবিনেটে শ্যামাপ্রসাদ, আমাদের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ, আছেই। গতবছর শুধু ঢাকা নয়, পুব বাংলার আরও কয়েকটা জেলায় গিয়ে সেন্‌সাসে মাথা গলিয়ে সে যে দাঙ্গার অবস্থা তৈরি করে এল, তাতেও সাবধান হলাম না আমরা মুসলমানরা। এখন যদি আমরাও চালে ভুল করে বাঙালি মুসলমানদের পিছিয়ে রাখি, সেটা কি এই বাংলার পক্ষে ভালো হবে? নাকি মুসলমান-প্রধান বাংলার মন্দ হলে সারা ভারতের মুসলমানদের পক্ষে সেটাই ভালো?

    আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন হক সাহেব, নজরুল বলে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনটা শেষ পর্যন্ত না
    হিন্দু-মুসলমানের লড়াই হয়ে দাঁড়ায়, আর সাহেবরা তারই সুযোগ নিয়ে দেশটাকে লুটপাট করে। এখন তো শুনতে পাই জাপানীদের কাছে সব জায়গায় হেরে গিয়ে বাংলাকে নাকি জাপানের হাতে ছেড়ে দিয়ে দেশটাকে অ্যাবান্‌ডন করে চলে যাবে ইংরেজ।

    কও কী, বাংলারে অ্যাবান্‌ডন! আরে না না! আসলে এই বেঙ্গল প্রভিন্সডা অগো কাছে গরম আণ্ডা; কামড়ানোও যায় না, ওগরানোও হেই একই জ্বালা। হেই কার্জনের আমল থেইক্যা শুরু। স্বদেশী আন্দোলন, আর তারপর বোমা-পিস্তলে আজ ফাঁসি তো পরের দিন আন্দামান! নিজে যাই নাই, তবে শুনছি অগো সেল্যুলার জেল-এর সব সেলই রিজার্ভ্‌ড্‌ ফর বেঙ্গলীজ। নো এন্ট্রী ফর ইণ্ডিয়ান্‌স্‌ ফ্রম আদার প্রভিন্সেস! কিন্তু তবুও, প্রভিন্সটা তো সোনার খনি, কইলকাতা শহরখানা সেকেণ্ড সিটি অব দি এম্পায়ার! কী আর করে কও। অ্যাবান্‌ডনের কোন কথাই নাই, ইংরাজের লোভ! ওরা ছাইরবে কইলকাতা!

    আসলে, বলতে থাকেন হক সাহেব, জাপানীরা টাইট তো দিসেই অগো। সিঙ্গাপুরের টাইটটা বড়ই চোট দিল। এই মার্চেই তো, জাপান বার্মা ইনভেড করার আগেই অগো পিটটানের প্ল্যান সারা। কয়, উইদ্‌ড্রয়াল। রেঙ্গুনে পৌঁছাইয়াই জাপান দ্যাহে রেঙ্গুন ফাঁকা, তহন এট্টু-আধটু বম্বিং কইরল কি না-ই কইরল, ও তেমন কিছু বড় কথা নয়। আর ব্রিটিশ বাহিনী? নিজগো খান দুই-চার অফিসার আর এক পাল ভারতীয় সেনা লইয়া ব্রিটিশ বাহিনী পেট্রল-খনিতে আগুন লাগাইতে লাগাইতে রাস্তাঘাটে-জলাশয়ে বিষ মিশাইতে মিশাইতে, ধান-চালের দফা শ্যাষ কইর‍্যা যঃ পলায়তি সঃ জীবতি! আসামে, নানা ট্রাইবাল এরিয়ায়, আর আমাগো বেঙ্গলে!

    তবে হ, ক্ষতি করছে আমাগো উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে। ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল-চট্টগ্রাম-নোয়াখালি। আর তা-ই বা কই ক্যান, পুরা পুব-বাংলাই ধর। কয়, ডিনায়াল। ধান-চালের বাজারে আর কিছু নাই। দশ-বারো লক্ষ মণ চাল অলরেডি কলেক্টেড। অ্যাতো কলেকশন ক্যান? সব মিলিটারির খাদ্য – ভবিষ্যতের, বুঝ? তুমি কও অ্যাবান্‌ডনিং বেঙ্গল। অ্যাবান্‌ডনিং বাই হু? এই লোভী ইংরেজরা? হঃ!

    এক দিকে ডিনায়াল, চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে তারপর হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসে বলেন হক সাহেব, আর অন্য দিকে যাকে বলে স্কর্চড আর্থ পলিসি, পোড়ামাটি নীতি। জাপানীরা যদি ফিরে আক্রমণ করতে চায়ও আবার, তাহলে আসবে কোন্‌ রাস্তায়? সব শেষ, পেট্রলের খনিতে আগুন লাগানো হয়েই গেছে, যানবাহনের তেল পাবে না। পুব বাংলায় জলপথে আসবে? স্টীমার-জাহাজেও তেল লাগে। দাঁড়-বাওয়া নৌকো? পাবে না। আমি প্রভিন্সের প্রধানমন্ত্রী। আমার কথা শোন। শুধু বাখরগঞ্জেই বার হাজার নৌকো পোড়ানো হয়ে গেছে এর মধ্যে, আরও হবে। যা ছিল, সাইকেল ঠেলাগাড়ি সব শেষ। এই যে কলকাতায় রোজ এত রিফিউজি দেখ, এত ভিখিরি বাড়ছে, এরা কারা? সব ওই পুব বাংলার মানুষ, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। কারো কোন আয়ের রাস্তা থাকবে না, এখনই নাই। কাদের আশ্রয়ে আর সহযোগিতায় থাকবে জাপানী শত্রু? অথবা ওদের বিবরণে, পঞ্চম বাহিনী?

    তোমাকে একটা কথা বলি, কাজি। আমাদের এই প্রোগেসিভ পার্টির দিন তো শেষ হতে চলল। বেয়াল্লিশেই আবার ইলেকশন। আমাদের প্রসপেক্ট ভালো নয়। মাঝে যতগুলো বাই-ইলেকশন হল সবকটাতে হেরেছি আমরা। বাঙালি মুসলমান এখন থরোলি মিসগাইডেড। কাজেই তোমার-আমার অনেক কাজ। নতুন উদ্যমে নামতে হবে ময়দানে। কিন্তু ইদানিং লক্ষ করছি তোমার যেন সবসময়ই মন খারাপ। কী যে কারণ আমি জানিনা। এই ইলেকশনে তোমার একটা বড় দায়িত্ব আছে।

    প্রায় ফিসফিস করে বলেন হক সাহেব, বঙ্গীয় মুসলমানের কিলার ইনস্টিঙ্কটা একটু নাড়াচাড়া দিতে লাগব, বাড়াইতে হব। আমার ওই একডাই চিন্তা, একডাই ভয়। বাঙালি মুসলমান ঠকেই যাব বোধ হয়। এখন চাই, তোমার ওই ওজস্বী ভাষা। তা নইলে, এবার যদি ঠকে, কয়েক জেনারেশন যাব হেই ভুল শোধরাইতে।

    হঠাৎ-আবার-জেগে-ওঠা এক লাইনের বরিশাইল্যা ডাইলেক্টের থেকে ফের সর্বমান্য বাংলায় ফিরে আসেন হক সাহেব। রেডিওতে মাঝে-মাঝেই হারামণি নামে একটা গানের প্রোগ্রাম তুমি কর। তুমি জান কিনা আমি জানিনা তোমার এই প্রোগ্রামটার আমি কিন্তু একজন ভক্ত। আর, আমি ভক্ত হলে অন্ধ ভক্ত যে হই না তাও তুমি জান। আগে থেকে খেয়াল থাকে যেদিনই, একটু অবসর পেলে সেদিনই তোমার এই প্রোগ্রামটা আমি শুনি। যখন শুনি, মন দিয়ে শুনি। তোমার গানের কথাগুলাও মনে রাখি। ইদানিং কিন্তু বেশ কিছুদিন হল এই প্রোগ্রামটা আর হচ্ছে না। শুরু কর না কেন আবার? ওই যে হারিয়ে-যাওয়া কোন রাগ নতুন করে উদ্ধার করে তার নাম দেওয়া, আর সেই নামটাই ওই রাগে তোমার
    নতুন-লেখা কোন গানের একটা কলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে রাগটা চিনিয়ে দেওয়া; ধর, ওই যে মীনাক্ষী নাম দিয়েছ নতুন-করে উদ্ধার করা যে রাগটার, সেই রাগে তোমার লেখা-গানের প্রথম কলিই হল, কী জানি, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে – চপল আঁখির ভাষায় হে মীনাক্ষী কয়ে যাও – আর এসব নিয়ে সেদিনের প্রোগ্রামে যখন আলোচনায় মেতে গেলে তুমি আর তোমাদের রেডিওর ওই ভদ্রলোক – বোধ হয় সুরেশ চক্রবর্তী নাম – তাই না?– আহা! গানটা গাইয়েছিলে কাকে দিয়ে? বিজনবালা ঘোষ, ঠিক? ভারি জমে গিয়েছিল।

    আমি তাই একটা উপদেশ তোমাকে দিই কাজি। নবযুগের অফিসে আসাটা তোমার ইচ্ছাধীন, যেদিন মন কয় একবার অফিসে যাই, আসবে। কবিতা-টবিতা লেখা, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় যখন যা ইচ্ছে হবে, সব লেখ। কিন্তু রেডিওতে নিয়মিত আবার যাওয়াটা আর একবার চালু কর তো দেখি। ক্রিয়েটিভ কাজ করবে, দেখবে, মন তোমার ভালো হয়ে গেছে। তুমি তো বেসিকালি ক্রিয়েটিভ কাজেরই মানুষ, শুধুই খবরের কাগজে লিখলে কি তোমার মন ভালো থাকে? আর, মন ভালো না-হলে আবার লড়াই করবে কী করে, কাজি? সুভাষ তিন বছর আগেই বলেছিল এই যুদ্ধের ডামাডোলে চারদিকের চাপে বিধ্বস্ত ইংরেজকে ঠিক ঠিক চাপ দিতে পারলে স্বাধীনতার আর দেরি নাই। কংগ্রেস তখন বুঝল না, কিন্তু আজ গান্ধী তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পারছেন। সকলের কাছে সোজাসুজি তা স্বীকার করবার সাহস তাঁর নাই, কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের কাগজেও সেই কথাই তিনি বারবার বলছেন। ব্রিটিশকে বলছেন তোমরা আজই আমাদের দেশ ছেড়ে পালাও নিজের দেশে, আমাদের দেশ আমাদের ফিরিয়ে দাও, তারপর তোমাদের যুদ্ধে কতটা কী করা যায় আমরা দেখব। তার আগে নয়। জওহরলাল-আজাদ-প্যাটেল সব বুঝেও বুঝছে না। জওহরলালের বন্ধু ক্রিপসকেও গান্ধী ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। দেখ, আমার মন বলে, স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নাই। বাঙালি মুসলমানকে যদি বাঁচাতে চাও, আর নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নাই।

    কথাগুলো শেষ করে হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান হক সাহেব। বলেন, তাহলে এই কথাই রইল কাজি, আমার অনেক কাজ আছে, এখন আমি যাই। যে চেয়ারে তিনি বসেছিলেন, তার ঠিক পেছনেই এই ঘরে ঢোকবার দরজাটা। হাট করে খোলা সেটা। কাজি বুঝতে পারে হন হন করে হক সাহেব বেরিয়ে গেলেন। খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে এতক্ষণ বাইরের ঘরটা থেকে কোন শব্দ আসছিল না, দরজাটা যে এতক্ষণ খোলা ছিল তা-ই বোঝা যাচ্ছিল না। এবার মৃদু গুঞ্জন শুনতে পায় কাজি। অর্থাৎ, হক সাহেবের সঙ্গে কাজির কথোপকথন এতক্ষণ ধরে এই-ঘরের-সঙ্গে-লাগোয়া-ঘরে বসে যারা শুনছিল – সম্ভবত মন দিয়েই শুনছিল যারা – তাদের মন্তব্য এখন শোনা যাচ্ছে। এটাই হক সাহেবের স্টাইল। খুব গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বার্তা সহজে ছড়িয়ে দেবার জন্যে মীটিং ডাকবার প্রয়োজন হয় না তাঁর। এবং ছড়িয়ে দেবার দায়িত্বও তাঁকে নিতে হয় না!

    নজরুল উঠে দাঁড়ায়। বাইরে বসে আছে চার-পাঁচ জন। তাদের একজনকে সে বলে, গত তিন-চার মাসের গান্ধীজির হরিজন পত্রিকাগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা কোরো তো।

    বেরিয়ে যায় নজরুল।




    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৮ মে ২০২৪ | ৩৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অভিজিৎ চক্রবর্তী। | 103.240.99.176 | ২১ মে ২০২৪ ১০:৪২532059
  • খুব ই অগ্রহায়ণ সহকারে পড়লাম। উপভোগ করছি তথ্য সহযোগে লেখার বাধুঁনি। পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় থাকলাম। লেখককে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। 
  • অভিজিৎ চক্রবর্তী। | 103.240.99.176 | ২১ মে ২০২৪ ১০:৪৪532060
  • ভূলবশতঃ অগ্রহায়ণ না হয়ে আগ্ৰহ হবে। 
  • &/ | 107.77.237.129 | ২৩ মে ২০২৪ ০২:২৯532209
  • শুরু থেকেই পড়ছি , ভালো লাগছে। পরে বই হয়ে বেরোলে সংগ্রহ করার সাগ্রহ ইচ্ছে রইল। 
  • kk | 172.56.32.178 | ২৩ মে ২০২৪ ০২:৫৯532210
  • 'সীমানা' প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে না এবারের বইমেলায়?
  • &/ | 151.141.85.8 | ২৩ মে ২০২৪ ২১:৫১532249
  • ধারাবাহিকটা এখনও চলছে কিনা! তাই ভাবলাম হয়তো পরে সবটা একসঙ্গে বই হয়ে বেরোবে। প্রথম খন্ড বেরিয়েছে সেটা এখন খেয়াল করলাম। আগেও নির্ঘাৎ দেখেছিলাম, কিন্তু স্মৃতিতে সেভড হয় নি,পাশ দিয়ে চলে গেছে। আগে আমি ভাবতাম কুমার সিদ্ধার্থের ব্যাপারটা কী? প্রাসাদেই থাকুন আর জাঁকজমকেই থাকুন, জরা ব্যাধি মৃত্যু দেখতে পাবেন না এ আবার কেমন কথা? বুড়ো বুড়ি কি আর প্রাসাদে ছিল না? জ্বর সর্দি কাশি এইসব অসুখবিসুখও কি দেখেন নি? নিজেরও কি ছোটোবেলা জ্বর টর হয় নি? আর মারা যায় নি কেউ আশেপাশে, সেও তো হতে পারে না। পর পর তিনদিন রথে চড়ে বেরোলেন আর জরা, ব্যাধি, মৃত্যু দেখলেন? চতুর্থদিনে দেখলেন সিদ্ধযোগী? ব্যাপারটা কী? এখন একটু একটু বুঝতে পারি এমনি দেখা আর 'সত্যি করে দেখা' অনেক পৃথক। আগে সবই দেখেছেন, ডাইনে বাঁয়ে দিয়ে বয়ে চলে যেতে দিয়েছেন, ওসব মনে ঠাঁই দেন নি। মনে যেদিন ঠাঁই দিলেন, সেদিনই...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন