’৭৪-৭৫ সাল থেকে টানা প্রায় ৭-৮ বছর গ্রামে রাত পাহারা দিয়েছি পালা করে। অনেকবার লড়াই হয়েছে ডাকাত দলের সঙ্গে। কুকুরশোল বলে একটা গ্রাম ছিল। একবার সেখানে ডাকাত পড়ল। পুলিশে কাজ করত এক চৌকিদার, থাকত সেখানে। চৌকিদার, তার ছেলে আর গ্রামের লোক লড়াই করে অনেককটা ডাকাতকে ধরে ফেলে। সাত-আটটা ডাকাত মারা যায় ওই দিন। তারপর ডাকাতি প্রায় বন্ধই হয়ে গেল।’ ‘কিন্তু, বলছিলেন যে, গ্রামে বেশিরভাগ লোকই গরিব ছিল। তবে ডাকাতি হত কেন? কী নিতে আসত ডাকাত?’ ‘কী আর নেবে? কারও বাড়িতে হয়তো কিছু চাল ছিল, নিয়ে গেল। মুড়ি, গুড়, কাপড়, তেল সব নিয়ে যেত। লন্ঠন, কুপিও ব্যাগে ভরে নিয়ে গেছে। ডাকাতও তো গরিব। ... ...
“আবার একা একা বাথরুমে গেছ?” জিজ্ঞাসা করে বিনীতা; কোন সাড়া পায় না ভেতর থেকে। ফের জিজ্ঞাসা করে, “দেরি হবে?” তাও কোনও উত্তর নেই। কী ব্যাপার? দরজায় হালকা চাপ দিয়ে বিনীতা বুঝল সেটা ভেতর থেকে বন্ধ নেই; যাক, এই কথাটা অন্তত শুনেছে। আর একটু চাপ দিতে দরজাটা পুরো খুলে গেল। ভেতরে কেউ নেই। বিস্মিত বিনীতা দ্রুত পায়ে ঘরের বাইরে গিয়ে গেস্টরুম, ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন সব ঘুরে দেখে। কোথাও নেই অরুণাভ। কী ভেবে ফের যায় মেয়ের ঘরে, সেখানে রঙিন ঘুমোচ্ছে, আর কেউ নেই। ... ...
‘কারণ, কংগ্রসের তখন দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে। যদ্দিন সরকার ছিল ঠিক ছিল। ভোটে হারার পর কংগ্রসের অনেক ছোটখাট নেতাই সিপিআইএমে চলে গেল। কিন্তু ঝাড়খন্ড পার্টি তখন শক্তিশালী হতে শুরু করেছে আমাদের এলাকায়। নরেন হাঁসদার পেছনে তখন অনেক লোক। আমরা বুঝে গেলাম, সিপিআইএমের সঙ্গে লড়তে পারলে একমাত্র ঝাড়খন্ড পার্টিই পারবে। গ্রামের সব লোক নিয়ে মিটিং হল, ছোটিকে শায়েস্তা করা হবে কিনা জানতে। সবাই হ্যাঁ বলল, গ্রামে ঝাড়খন্ড পার্টির পতাকা তোলা হল।’ ... ...
একদিকে ঝাড়খন্ড পার্টি। তার পেছনে কংগ্রেস। সঙ্গে পুরনো নকশালপন্থীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন। অন্যদিকে, সিপিআইএম। তার সামনে পুলিশ। ছ’য়ের দশকের শেষে যে লড়াই শুরু হয়েছিল জমি রক্ষার এবং দখলের, তাই ১৯৭৭ সালে রাজ্যে সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের কয়েক বছরের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক লড়াইয়ে কনভার্ট করে গেল। প্রথমে জমির লড়াই, তারপর রাজনৈতিক লড়াই, আর এই দুইয়ের যোগফলে শুরু হল হিংসার রাজনীতি। হত্যা-পাল্টা হত্যা। ... ...
একদিন সন্ধ্যায় জামবনিতে ঝাড়খন্ড পার্টির এক কর্মী খুন হলেন। প্রায় মাঝরাতে মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারল পুলিশ। পরদিন সকাল থেকে এই নিয়ে উত্তেজনা পুরো জামবনি, বিনপুরে। সকালে অফিসে কিছু কাজ ছিল। তা শেষ করে দুপুরে মেদিনীপুর শহর থেকে রওনা দিলাম জামবনির উদ্দেশে। রাস্তায় যেতে যেতেই ওয়্যারলেসে খবর পেলাম বুদ্ধ ভকতের গুলি লেগেছে। তাঁকে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হল, পরিস্থিতি আজ হাতের বাইরে চলে যাবে। আগের রাতে ঝাড়খন্ডি খুন। আর তার বদলায় আজ বুদ্ধ ভকত গুলিবিদ্ধ! বুদ্ধদেব ভকত তখন বিনপুরের সিপিআইএম বিধায়ক। ... ...
সেদিনই বিকেলে কিষেণজির নেতৃত্বে মাওবাদীদের সঙ্গে আমাদের প্রথম এনকাউন্টার। বিকেল ৫টা নাগাদ। জঙ্গলে যে ফোর্স লুকিয়ে অপেক্ষা করছে তা কিষেণজি আন্দাজ করতে পারেননি। দূর থেকে মাওয়িস্টদের মুভমেন্ট আন্দাজ করে পুলিশ গুলি চালায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওরাও পালটা গুলি চালায়। কিষেণজিদের বেশ কিছুটা পেছনে মাওবাদীদের আরও একটা দল ছিল। সেটা আমাদের জানা ছিল না। কিষেণজি পেছনের দলটাকে নির্দেশ দেন, পুলিশকে অ্যাটাক করতে। ... ...
সন্ধে ছ’টা-সাড়ে ছ’টা বাজে। অফিসে বসে আছি। মানে, সেই সময়ের স্টার আনন্দ (পরবর্তীকালে এবিপি আনন্দ) অফিসে। হঠাৎ খবর এল, ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি এলাকায় পুলিশের কনভয়ে হামলা চালিয়েছে মাওবাদীরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে খবরের গুরুত্ব বেড়ে গেল এক ধাক্কায়। প্রাথমিকভাবে জানা গেল, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার অজয় নন্দের কনভয়ে হামলা হয়েছে। ... ...
আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না সুচিত্রা মাহাতো এবং মঙ্গল। নেতার নির্দেশ। গুলি ছুঁড়তে, ছুঁড়তেই জঙ্গলের ভেতরে দৌড়লেন সুচিত্রা, সঙ্গে মঙ্গল মাহাতো। আলাদা দিকে দু’জনে। ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার দেখলেনও না কিষেণজি। একটা ম্যাগাজিন শেষ। এ কে ৪৭ রাইফেলে নতুন ম্যাগাজিন ভরলেন তিনি। ফের শুরু করলেন এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে। কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। জওয়ানরা কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে আলাদা আলাদা জায়গায় পজিশন নিয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। ঘিরে ফেলেছেন কিষেণজিকে। একজনের রেঞ্জের মধ্যে চলে এলেন তিনি। ব্যাস...। নিজের এ কে ৪৭ রাইফেলে সেকেন্ড ম্যাগাজিনটা শেষ করতেও পারলেন না। আধা সামরিক বাহিনীর ট্রেনড জওয়ানদের পরপর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শরীরটা। ধুপ করে একটা শব্দ হল শুধু। ... ...
‘স্যার, কিষেণজি ১০-১২ জনের দল নিয়ে কুশবনির জঙ্গলে ঢুকেছে।’ খবরটা এল ঝাড়গ্রামে সিআরপিএফের ১৮৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের অফিসে। এক লাইনের ইনফর্মেশন। সিআরপিএফের এক অফিসারের কাছে ফোনটা এল বিনপুরের একটা গ্রাম থেকে। যিনি টেলিফোনটা করলেন, তিনি তাঁর নাম বললেন না। সিআরপিএফের অফিসারকে শুধু বললেন, ‘স্যার, আমি নিজে দেখেছি। কিষেণজি ১০-১২ জনের একটা দল নিয়ে কুশবনির জঙ্গলে ঢুকেছে।’ ... ...
ইতিহাস ঘেঁটে এই ফিকশন তৈরী। এখানে অনেক মশলা দেওয়ার চেষ্টা করবো। ... ...
অরিন্দম দেখে, মাওবাদী কমান্ডোদের জংলা পোশাক, কালো টুপি পরা এক যুবক কাঁধে এক সেল্ফ লোডেড রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই যুবকই সিংরাই মান্ডি ওরফে জয়ন্ত ওরফে ফড়িং! হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে অরিন্দম। কানে আসতে থাকে রাজ্য পুলিশের ডিজির কথা, ‘তিন রাজ্য মিলে খুন, নাশকতা সহ অন্তত ৫০ টি মামলা রয়েছে সিংরাইয়ের নামে। তাকে গ্রেফতারের জন্য বাংলা এবং ঝাড়খন্ড সরকার মিলিয়ে ৪০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই রাজনীতির ভুল বুঝতে পেরেছে সে। তাই সে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে এসেছে...।’ ... ...
সুবল মান্ডি যখন মা আর ছেলেকে রাস্তায় বসিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে গিয়েছিল, তখন চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখে কী মনে হচ্ছিল দশ-এগারো বছরের ছেলেটার? ভাবার চেষ্টা করে অরিন্দম, ভাবতে পারে না। অরিন্দমের মনে পড়ে অরণ্যের দিনরাত্রি সিনেমার সেই দৃশ্যের কথা, শুভেন্দু বলছে, ‘এই সব জায়গায় এলে মানুষের আয়ু বেড়ে যায়!’ মনে মনে হেসে ওঠে অরিন্দম। মনে হয়, আমরা শহরের লোক, কত কম জানি নিজের রাজ্যটাকে! আদৌ কি জানি? ... ...