আবারো তন্ন তন্ন করে খুঁজতে আরম্ভ করে দীপ! কিন্তু কোথাও নেই সেই পূর্ণিমা! এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বিষাদ চিত্তে বিছানায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দীপ জগটার মত করেই। কিন্তু আর ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে ঘড়ির কাটাটার দিকে তাকায় সে, আর ক্রমাগত এপাশ ওপাশ করতে থাকে ঘড়ির কাঁটাটার মত করে, একই তাল ও লয়ে! কিন্তু সূর্যের চোখ খোলার সময় যতই এগিয়ে আসতে থাকে, ঘুমের গাড়ি যেন আরো দূরে সরতে থাকে, আর কপালের ভাঁজগুলি বড় হতে থাকে দীপের! আগামীকালই এমন কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপেক্ষা করছে তার জন্য, স্বাভাবিক শরীরেই যার ধকল সহ্য করা কঠিন! ... ...
আমাদের এই নারী উদ্যোক্তা যে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছেই দেনাদার ছিল, তা নয়। ঋণের টাকা দিয়ে তো সে মেশিন কিনল। কিন্তু বড় বড় অর্ডারকে পূরণ করার জন্য যে সে গাদা গাদা কাপড় এনেছিল হোলসেল কাপড় সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে, তাদের দেনা পরিশোধেও ছিল উপুর্যুপুরি আর ধারালো চাপ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইন-সমর্থিত চাপ সামলাতে পারলেও ঐ নারী উদ্যোক্তা সরবারহকারীদের আইন-অসমর্থিত চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়েছিল, যার অবশ্যম্ভাবী ফল নতুন ক্রয় করা সেলাই মেশিনগুলোর অধিকাংশ নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়া কাপড়ের স্টকের সাথে সাথে। এভাবে করোনার করাল গ্রাস সেই সাপ্লাইয়ারদের অস্বাভাবিক মুনাফা এনে দিলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ঋণের কোন টাকাই উদ্ধার করতে পারল না। ফলশ্রুতিতে তারা আইনি পদক্ষেপ শুরু করলে, আমাদের আলোচ্য নারী উদ্যোক্তা মান-সন্মান বাঁচাতে মহাজনদের দ্বারস্থ হল, যারা প্রচলিত সুদের প্রায় চার-পাঁচ গুণ হারে ঋণ দিয়ে থাকে, আর ঋণ আদায়ে তাদের থাকে আলাদা গুন্ডা বাহিনী। ফলে করোনা অস্বাভাবিক মুনাফা এনে দিল টাকার এই আদিম কারবারীদেরও! ... ...
প্রথমে কিছু গগনবিদারি শ্লোগানে গা গরম করে নিয়ে মাইকটা এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল জনপ্রিয় সুরে দল ও নেতার বন্দনাগীতিতে। ইতিমধ্যেই নেতাকর্মীদের ভীড়ে জায়গাটা ভরে গেছে। ওদিকে আরো কিছু মানুষ তাদের জন্য বরাদ্দ কোণাটিতে দাঁড়িয়ে গেছে; অবশ্য নিরাপত্তারক্ষীদের হুংকারে তাদের মাঝেমধ্যে কষ্টকর দিকবদল করতে হচ্ছে! সভার প্রবেশদ্বারটা প্রশস্ত হওয়ায় কোণাগুলি একটু বেশিই বেঁকে গেছে, না হলে সামান্য লম্ফ-ঝম্ফ - এ আর কী এমন কঠিন কাজ! ... ...
‘’কিন্তু সেই দিনটিতে …সেই ভয়ংকর দিনটিতে … সেদিন …সেদিন তো আমাকে, তোকে … দুজনকেই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ওর উপর! কিন্তু ও তো সেদিন …সেদিন …পুরো নিথর….আহারে! আর নড়ার শক্তি ছিল না বাছার আমার! আর কোন শক্তিই অবশিষ্ট ছিল না দেহে ..সব শেষ হয়ে গিয়েছিল…সব …’’ কথা শেষ করতে পারে না পাতলা; হঠাৎ চতুর্দিকে ঘন ধুলোর পর্দা পড়ে যায়, বাতাসের দাপটে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়, তারের উপর বেঁধে রাখা অবয়ব দুটো আর কেউ কাউকে দেখতে পায় না! কিছুক্ষণের মধ্যেই অঝোর ধারায় পড়তে শুরু করবে ভারী অথচ হালকা সব মেঘের দল, যারা লম্বা সময় ধরে ধৈর্য ধারণ করে বসেছিলেন আ-কাশ বিস্তৃত নীলিমার গায়ে হেলান দিয়ে! ... ...
দুইদিন পর রোজিনা আচলের কাপড় ঘঁষতে ঘঁষতে যখন ছেলের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করা শুরু করেছিল, রওশানারা তাকে থামিয়ে দিয়ে কণ্ঠটা চিকুন করে জানতে চেয়েছিলেন, “আগে ক, পোলার কুনো ব্যারাম আছেনি?” এক গাল হেসে দিয়ে রোজিনা মোটা কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিল, “ যেই হারে ব্যায়াম করে, ব্যারাম আইবো কোথ থনে? নিশ্চিন্ত থাহেন ফুবুয়াম্মা, পোলারে একটা কাশ দিতেও হুনে নাই কেউ কহনো। ‘’ ... ...
উনিশশো একাত্তর সনের ৬ই মে, সেই মানিককিশোর সত্তর বছর বয়সে জীবন্ত বলি হলেন বলিহার বাজারের সেই চালাঘরটিতে, যেখানে টিনের চাল বেয়ে নামত সুরের বৃষ্টি, ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজিয়ে দিত চালার তলায় আশ্রয় নেয়া ভাগ্যবান শ্রোতাদের! হয়ত বড় ভালবাসতেন চালাঘরটিকে, সে কারণেই সেই চালাঘরের যূপকাষ্ঠেই অগ্নিস্নান করে সেদিন অমরলোকে পৌঁছে গিয়েছিলেন শহীদ মানিককিশোর, সপ্তাকাশ জুড়ে তখন বেজেই চলছিল কোন ধ্রুপদী রাগ! ... ...
ছবিটি শুরু হয়েছিল কিন্তু বেশ সুন্দর করে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই সময়, ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণের সেই উত্তাপ ভালমতই ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। এরপর ছোট্র রেনুকে যখন গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তাও খুব হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল, বিশ্বাসযোগ্যতার কোন ঘাটতি ছিল না চিত্রগ্রহণ ও অভিনয় শৈলিতে। কিন্তু এরপর যতই এগুতে থাকে ছবিটা, পাঠকের মনে আক্ষেপের কণা সঞ্চিত হতে হতে এমন স্ফীত আকার ধারণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধের সিনে এসে দর্শক মুভিটা থেকে চোখ সরিয়ে নিজের স্মৃতিতে জমা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ভাবতে থাকে। ... ...
জমে উঠেছে এই রেস ভিডিও গেমসের মত। বিচিত্র ব্যাপার, বাসগুলোতে এই কোন লোক নেই, আবার এই লোকে ভর্তি হয়ে গেছে। যেমন, এই মুহূর্তে বাংলামোটরের মোচড়ে যখন দাঁড়িয়ে, তখন কমে গেছে এদের কারো কারো জনবল আশংকাজনক হারে। সিগনালের জ্যাম অস্বাভাবিক দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। পেছনে পড়ে থাকা বাসগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে এই স্থানেই বাস করবে। যখন বাঁয়ের বাসটির ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে ডেকে ডেকে লোক ভরা হচ্ছিল আর এক ফাঁকে হেল্পার নেমে পড়েছিল অদূরে জিহবা বেরিয়ে থাকা ডাস্টবিনটার কোনায়, ঐ মেয়ে দুজনের একজন অগ্নিমূর্তি ধারণ করল, আর নিজেদের বাস ড্রাইভারকেই হুংকার ছাড়ল, “এই ছ্যামড়া, সিগ্নাল দেখলেই কি তোর দাঁড়াইতে মন চায়”, পেছন থেকে উৎসাহ পেয়ে এক যুবক বয়সী বলে উঠে ‘হেল্পার হালায় একটা মাদারচোদ! থামলেই মুত আহে’। ... ...
একটা মচমচে মাছ ভাজার গন্ধ তাতিয়ে দিতে লাগলো দীপকে! পড়ার টেবিলে আর মন বসল না; ‘বাবা নেই’ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ড্রইয়িং রুমের রিমোটটা হাতে তুলে নিল। ব্রেকিং নিউজটা এখন হেডলাইনে কনভার্ট হয়েছে, মানুষ ভেঙে পড়ছে প্রয়াত নায়কের বাড়িতে, একের পর এক সাক্ষাৎকার আসছে, ক্যামেরাম্যান হুমড়ি খেয়ে পড়েছে! ... ...
ফলে মন্নুকে, যার গেঞ্জিতে কাপড়ের চেয়ে ছেঁড়া ছিদ্রের সংখ্যা বেশী, কচি শীর্ণ মুখে বসন্তের ছিট্, সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়, এমনকি নেশাখোর বাপের হাতে নেশার টাকাও তুলে দিতে হয়। খুব চেনা গল্প, এখনো প্রযোজ্য আমাদের সমাজের জন্য, মন্নুর ‘হেই মোড়ে’ সংলাপটা থেকে পাঠক তার পূর্ববঙ্গীয় ভাষার সাথেও একাত্মতা অনুভব করে, গল্পটার এত বছর পরেও। কিন্তু এই চেনা গল্পের মধ্য দিয়েই জ্যোতিরিন্দ্র ঘুরিয়ে আনেন আমাদের অনেক অচেনা শহর, বন্দর, ঘাট। গল্পটির শুরুতেই তার লক্ষণ টের পাওয়া যায়, যখন গল্পের উত্তম পুরুষ মন্নুকে প্রশ্ন করে, “ এত রাতে পালিশ কি রে?”, আর মন্নু উত্তর করে, “আচ্ছা ক’রে করে দেব, একদম আয়না মাফিক”, পাঠক টের পেতে শুরু করে, এক অদেখা আয়নার মুখোমুখি হতে চলেছে সে, সে আয়নায় জীবন ধরা দেবে বহুবিচিত্র রঙে, রূপে, রসে। ... ...