এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • রহস্য গল্প : প্রতিচ্ছায়া

    shrabani
    অন্যান্য | ১১ অক্টোবর ২০১১ | ২০৬৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • maximin | 59.93.244.151 | ২২ জানুয়ারি ২০১২ ১৭:০৯495819
  • পড়া হয়নি সার্চ দিয়ে বার করলাম। টইটাকে ওপরে তুললাম পড়ব বলে।
  • শ্রাবণী | 24.99.17.127 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ০৯:৩৯495820
  • নতুন গল্প
    ***********************************************
    দৃশ্যাদৃশ্য
    ---------------------------
    উঠে বসল শ্রীমতী। চারিদিকে কালো অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছেনা তবু সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। হলুদ বাদামী স্টাকো রাঙানো দেওয়াল, আধখোলা ঘুম জড়ানো চোখ। স্বপ্ন দেখেছে, ব্যাপারটা নতুন নয়, প্রায়ই ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে কেন জানি ও উঠে বসে। নতুন ব্যাপার যেটা তা হল এইসব সময়ে বেশীরভাগই জেগে উঠে স্বপ্নটা আর মনে করতে পারেনা। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে সদ্য দেখা স্বপ্নটা সিনেমার ছবির মত জ্বলজ্বল করছে মাথায়। অন্ধকারে বালির রাস্তায় একটা তেজী ঘোড়ার পিঠে সওয়ার সে, দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়েছে। সামনের রাস্তা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, কারণ ঘোড়ার মাথার আলো, গাড়ির হেডলাইটের মত। কিছুটা গিয়ে ঘোড়াটা একটা আওয়াজ করে পড়ে গেল, আলোটা চুরমার হয়ে ভেঙে গিয়ে চারিদিকে গুঁড়ো গুঁড়ো কাঁচ ছড়িয়ে পড়েছে। ও নরম বালিতে পড়েছে, তবু হাতে পায়ে একটা প্রচন্ড ধাতব যন্ত্রণা অনুভব করে আর তখনই দেখে ঘোড়া কোথায়, একটা গাড়ি উল্টে পড়ে আছে! জানালার কাঁচ ভাঙা, লোহার রডজাতীয় কিছু খুলে এসে ওর ওপরে পড়েছে।
    চারিদিকে কত আওয়াজ, লোকের কথা, কলকল শোনা যাচ্ছে, অথচ সে যেখানে বসে সেই জায়গায় কেউ নেই, অন্ধকার। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, পারেনা। চেঁচিয়ে একটু দুরে আলোর লোকজনকে ডাকতে যায় কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। নিরূপায় ভয়ে শরীর অবশ হয়ে আসে আর ঠিক তখনি ঘুম ভেঙে যায়।
    কিছুক্ষণ অন্ধকারে বিছানার ওপর একভাবে থম মেরে বসে থাকার পর, মনে হল গলা শুকিয়ে আসছে। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিতে গিয়ে ডান হাতে একটা প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে, স্বপ্নেও কি এই ব্যথাটাই পেয়েছিল?
    পাশে জয়ন্ত গভীর ঘুমে অচেতন, রোজ শোবার আগে অল্প ডোজের ঘুমের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তার প্রভাব। জল খেয়ে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতটা ম্যাসাজ করতে থাকে আস্তে আস্তে। হাতের ওপর শুয়ে পড়েছিল মনে হয়, ব্যথাটা বেশ জোরালো, একটু অয়েনমেন্ট লাগিয়ে ঘষলে হত,কিন্তু এই মাঝরাতে কে আবার উঠে ওষুধ খুঁজতে যায়!

    যবে থেকে জয়ন্তের অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে, মাঝে মাঝেই অবচেতনে ওর চোখের সামনে ছবি ভেসে ওঠে, একটা গাড়ী এসে হেড অন আর একটা গাড়িকে ধাক্কা মারছে। বিশেষ করে যখন নিজে ড্রাইভ করে তখন। ভাগ্যিস ওকে দুরে কোথাও যেতে হয়না, হাসপাতাল, দোকান বাজার, ছেলের স্কুল ইত্যাদি এই শহরেই,কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই পড়ে সব। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে গেলেও পৌঁছনো যায়। জয়ন্ত যদিও নিজে গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট করেনি, অ্যাক্সিডেন্টের সময় সে গাড়ি চালাচ্ছিলনা এবং কোনো গাড়ির মুখোমুখি ধাক্কারও ঘটনা নয় ব্যাপারটা, তবু শ্রীমতীর কেমন একটা গাড়িতে অস্বস্তি এসে গেছে। অথচ থাকে এমন জায়গায়, এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম একেবারে ভরসাযোগ্য নয়।

    জয়ন্ত একটা ড্রাইভার রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু সপ্তাহে দুই কী তিনদিন একবার বেরোনোর জন্যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে ড্রাইভার পোষা ঠিক মনঃপুত হয়নি ওর, বিশেষ করে এখনের অবস্থায়। এমনিতে অসুবিধে কিছু নেই, শ্রীমতী নিজে গাড়ি মন্দ চালায় না, ছোট গাড়িটা দরকারে সেই চালাতো এতদিন। গাড়ি নিয়ে শহরের বাইরে অবশ্য কোনোদিন যায়নি। এয়ারপোর্ট, স্টেশন বা একটু দুরে কোথাও যেতে হলে জয়ন্ত অফিসের গাড়ি পাঠিয়ে দিত। জয়ন্ত রোজ অফিসে যেত আসতও অফিসের গাড়িতে। আগে পুরনো কোম্পানিতে সে সুবিধে ছিলনা, তখন দুরে যেতে রেন্টাল থেকে গাড়ি নেওয়া হত বা জয়ন্ত সঙ্গে যেত চালিয়ে। বছরখানেক এই নতুন অফিসে আসার পর এধরণের নানা বিলাসিতায় অভ্যস্ত হচ্ছিল ওরা। যখনতখন ড্রাইভার সমেত গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়, রান্না ইত্যাদি নানা কাজের জন্যে তিন মানুষের বাড়িতে চারটে কাজের লোক,এ মল ও বাজার ঘুরে ঘুরে উদ্দাম শপিং!
    এখন সকালে জয়ন্তের জন্যে একজন পুরুষ নার্স অ্যাটেন্ডেন্ট আসে, একটি ছেলে, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, স্নান করানো, ম্যাসাজ করা, ইত্যাদির জন্যে। রান্নার বৌকে অবশ্য ছাড়ায়নি আর সকালের ঝাড়ু মোছা, বাসনের মেয়েটাও আছে। নার্সই যা নেয় তা ওর আগের চারটে কাজের লোকের মাইনের চেয়েও বেশী!
    এখনো তেমন কোনো অসুবিধে নেই, আগের মাসের মত এইমাসেও মাইনের পুরো টাকাটা জয়ন্তের ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে গেছে। চিকিৎসার খরচ সব কম্পানি দিয়েছে, রায়পুর থেকে ব্যবস্থা করে স্পেশ্যাল ফ্লাইটে দিল্লী নিয়ে এসে বড় প্রাইভেট হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করিয়েছে। শ্রীমতীকে শুধু হাসপাতালে যাতায়াত ছাড়া আর কিছু করতে হয়নি, কোনো বিল ও ভালো করে চোখেও দেখেনি, সব একটা মোটা ফাইলে রাখা আছে। কিন্তু কদিন?
    কলকাতা থেকে ওর দিদিরা এসেছিল, এখানে জয়ন্তের কলেজের বন্ধুরা খুব আসাযাওয়া করেছে হসপিটালের দিনগুলোতে। পুরনো কোম্পানি থেকেও দু একজন কলীগ এসেছে। মুখে কেউ না বললেও সবার চোখে ঐ এক প্রশ্ন দেখেছে শ্রীমতী, আর কদিন!
    সে নিজে ভাবনাটাকে সযতনে এড়িয়ে চলে এখনো পর্যন্ত। অফিস থেকে কিছু বলা হয়নি তাকে, সেও জিজ্ঞেস করেনি। আর জয়ন্ত তো নিজের শারীরিক অসুবিধাগুলো নিয়ে এত ব্যস্ত যে সংসার বা অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে চিন্তাভাবনা তার নেই বললেই চলে। ওরকম টগবগে মানুষটা হাঁটতে চলতে পারছেনা। কতগুলো অপারেশনের পরে এখন তাও কোমরে অল্প সাড় এসেছে, বিছানায় উঠে বসছে। কবে সে আবার দাঁড়াতে পারবে, চলতে পারবে সেটাই এখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। শুধু তার কেন, শ্রীমতীর, ছেলে তাতাইয়ের, সবার ঐ এক চিন্তা মাথায়, কবে জয়ন্ত আবার আগের মত উঠে দাঁড়াবে!

    সেদিন রিংকুদির ফোন এসেছিল কলকাতা থেকে। সমরদা, রিংকুদির বর, জয়ন্তের পুরনো কোম্পানির বস, অনেককাল দুজনে একসাথে কাজ করেছে,এখন কলকাতায় একটা কম্পানির হেড অফিসে কর্তা হয়ে বসে আছে। জয়ন্তকে ডেকেছিল ওর কোম্পানিতে, শ্রীমতীর খুব ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় থাকতে পারবে, আত্মীয়স্বজন ছাড়া সমরদাদের মত বন্ধু লোক আছে সেখানে। জয়ন্ত ইন্টারভিউ দিয়ে এসেও শেষে না করে দিল, টাকা খুব বেশী দিচ্ছিলনা। ততদিনে এই কম্পানির অফারটা এসে গিয়েছিল। অবশ্য সমরদাকে বলা হয়েছিল যে তাতাইয়ের ক্লাস নাইন হয়ে গেল, এখন স্কুল বদলালে ওর মানিয়ে নিতে অসুবিধে হতে পারে। শ্রীমতী হতাশ হলেও তাতাইয়ের অজুহাতটা ওর একেবারে অযৌক্তিক মনে হয়নি। ভেবেছিল জয়ন্তকে রাজী করিয়ে ক্লাস টুয়েলভের পরে ছেলেকে কোথাও একটা ভর্তি করে হস্টেলে দিয়ে, ওরা সমরদাদের কাছে কলকাতায় চলে যাবে। এই তিন চার বছরে নিক না জয়ন্ত যত খুশী চুটিয়ে উপায় করে!
    রিংকুদি এতদিনের কাজের সূত্রে কাছের লোক বলেই বোধহয় যে প্রশ্ন নিজের পরিবারের লোকে করতে পারেনি সেই প্রশ্ন সরাসরি করেছিল। "হ্যাঁরে, এত খরচখরচা কোথা থেকে হচ্ছে? অফিস কিছু দিয়েছে? এছাড়া জয়ন্ত তো আপাতত বসে, প্রাইভেট কম্পানি, মাইনে টাইনে বলে কিছু দিচ্ছে না এককালীন ভর্তুকি বাবদ টাকা ঠেকিয়েই শেষ? টাকা পাঠাবো আমরা? দ্যাখ কোনো সংকোচ না করে বল, তোরা তো আমাদের নিজেরই।"
    শ্রীমতী জানে এই প্রশ্ন সবাই তাকে করতে চায় কিন্তু পারেনা। সেও সবাইকে উত্তর দিতে চায়, বলতে চায়, "ওগো এখনো আমাদের সেরকম অবস্থা আসেনি, এখনো সব আগের মতই আছে, এখনি আমার দিকে অমন করুণাভরা চোখে তাকিও না তোমরা।" রিংকুদিকে আশ্বস্ত করে।
    "কী যে বল রিংকুদি, জয়ন্ত কি চিরদিন এমনি থাকবে নাকি! রোজই তো একটু করে ভালো হচ্ছে। হস্পিটালে চেক আপ হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে, সেখান থেকে প্রতিদিন ফিজিওথেরাপিস্ট আসছে, সবাই বলছে দারুন ভালো রেসপন্স। আর ওদের কম্পানি শুধু ভালো বললে কম বলা হয়, এই সমস্ত কিছুর পেমেন্ট ওরাই করছে।"
    শোনার পর রিংকুদি এনিয়ে আর কথা বাড়ায় না। সমরদা কম্পানির ট্যুর নিয়ে এসে জয়ন্তকে হাসপাতালে দেখে গিয়েছিল। পরের মাসে নাকি ট্যুর হতে পারে, হলে রিংকুদিও সঙ্গে আসবে। অপরকে থামিয়ে দেয় কিন্তু ওর নিজের ভাবনার প্রবাহকে রুধবে কেমন করে? মনে সেই প্রশ্ন আসে যার উত্তর ও নিজেও খুঁজে বেড়াচ্ছে, কদিন!

    আধো ঘুমে আধো জাগরণে ভোর হয়ে গেল, এরকম আজকাল মাঝে মাঝেই হয়। জয়ন্ত ঘুমের মধ্যে অল্প নড়ে উঠল। শ্রীমতী আধশোয়া হয়ে ঘুমন্ত জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে, শান্ত অবয়ব। যন্ত্রণা ইত্যাদির পালা হসপিটালেই সেরে এসেছে, মাসখানেক ছিল সেখানে, বাড়ির এদের সেসব তেমন দেখতে হয়নি। ইদানীং শুধু অপেক্ষা, কবে এটা পারবে, কবে ওটা পারবে। প্রথম দিকে বাড়ি আসার পর বাথরুমের ব্যাপারগুলো ঠিক আয়ত্তে ছিলনা, যখন তখন হয়ে যেত। এখনো সমস্যা একেবারে নেই যে তা নয়, তবে সাড় অনেকটা ফিরেছে।
    শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘড়ি না দেখেই শ্রীমতী বলে দিতে পারে এখন প্রায় পাঁচটা বাজে। উঠে পড়ে সে, সাতটায় তাতাইয়ের বাস আসবে, ছেলেকে তুলে দিয়ে রান্নাঘরে যাবে টিফিন বানাতে, তার আগে নিজের জন্যে চা। আগে রোজ জয়ন্তও উঠে পড়ত এই সময়ে ওদের সঙ্গে, চা খেয়ে পাশের পার্কে দৌড়তে যেত। জগিং স্যুট আর জুতোতে যা স্মার্ট আর ফিট দেখাতো ওকে!
  • r | 213.91.201.54 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:০৯495821
  • ও সিকি, লিং কাজ করছে না
  • শ্রাবণী | 24.99.17.127 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:১৪495822
  • *********************
    স্যুটকেস গোছাতে খুব বেশী সময় নেয় না রাই, ভোরের ফ্লাইট। শোবার আগে হাতব্যাগটা একবার ভালো করে চেক করে নেয়, টাকা টিকিট ইত্যাদি। যাচ্ছে যেখানে, জায়গাটা বেশ অজ মফস্বল ধরণের, ক্রেডিট কার্ড চলবেনা অন্য জায়গার মত, তাই বিকেলে অফিস ফেরত এটিএম থেকে টাকা তুলে এনেছিল। এমনিতে দরকার তেমন পড়বেনা, এয়ারপোর্ট থেকে যাতায়াতের গাড়ি ফ্যাক্টরীর অফিস থেকেই আসবে, থাকার ব্যবস্থা গেস্টহাউসে। অবশ্য সে গেস্টহাউসে থাকবেনা, চান্দ্রেয়ীর কাছে, ওদের কোয়ার্টারে থাকবে। তবু এমার্জেন্সীর জন্যে সঙ্গে টাকা রাখা। কাল শুক্রবারে গিয়ে,সোমবার ভোরের ফ্লাইটে ফিরবে। আলোক শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল। রাই পার্সটা বন্ধ করে সামনের টেবিলের ওপর রেখে শুতে গিয়ে বলল,
    -"এই দুদিন টুপাইয়ের ম্যাথস নিয়ে বস একটু, সোমবার ওর ইউনিট টেস্ট"।
    আলোকের মুখটা কিঞ্চিত বেঁকে গেল, মেয়ের সঙ্গে হুটোপাটি খেলা আড্ডা ইত্যাদি ঠিক আছে কিন্তু পড়াতে বসলে দুপক্ষেরই বিরক্তি। টুপাই হাজারটা নালিশ করে, বাবা পড়াতে পারেনা বলে আর বাবার অভিযোগ মেয়ে মন দেয়না।
    -"তা তুমি তো মিটিং শেষ করে শনিবারেই ফিরতে পারতে। টুপাইকে নিজে পড়াতে পারতে তাহলে।"
    রাই জানে আলোক ওর পা টানছে, তবু ছদ্ম রাগ দেখায়,
    -"কেন, আমি দুদিন কোথাও গিয়ে থাকতে পারিনা? তুমি যে হরদম ট্যুরে যাও, তখন তো সব আমি একা সামলাই। কতদিন পরে চান্দ্রেয়ীর সঙ্গে দেখা হবে, একদিন একটু দু বোনে মন খুলে আড্ডা মারব। আমি তো ভাবছি বস কে বলে কোনো কাজ দেখিয়ে সোমবারটাও থেকে যাব।"
    আলোক মুখ টিপে হাসে, ও জানে রাই টুপাইকে রেখে কোথাও যেতে পছন্দ করেনা বলে ট্যুরের কাজ কম নেয় সাধারণত। টিভি বন্ধ করে শুতে যাওয়ার আগে কী মনে হতে আলোক বলে,
    -"একটু সাবধানে যেও। সোমবার সকালের ফ্লাইট ধরার কী দরকার ছিল তোমার, বিকেলে এলেই পারতে। অথবা রবিবার বিকেলে এসে রায়পুরে গেস্ট হাউসে থাকতে পারতে। সকালের ফ্লাইট ধরতে তোমায় রাত থাকতে বেরোতে হবে।"
    রাই মনে মনে অবাক হল, আলোক সাধারণত তার ট্যুর প্রোগ্রাম নিয়ে মাথা ঘামায় না, ঐ যাতায়াতের দিন আর সময় জানলেই হল। প্রথম দিকে তো তাও এয়ারপোর্টে আনতে যেত, আজকাল রাইই সেটা বন্ধ করেছে। তবু তা আসলে আলোকের উৎসাহ নেই দেখেই, জোর করলে কী আর বারণ করত না অপছন্দ করত!
    মনের ভাব না প্রকাশ করে মুখে শুধু বলল,
    -"দুর, একা একা রায়পুর এসে কে আবার রাতে গেস্ট হাউসে থাকবে! সকালের না হলে সেই রাত্তিরের ফ্লাইট, বাড়ি পৌঁছতে বারোটা বেজে যায়, পরদিন অফিস। কেন, সকালের ফ্লাইট খারাপ কী?"
    -"না, খারাপ কিছু নয়, আমিও অনেকবার এরকম করেছি। তবে ইদানীং জয়ন্তের ঘটনাটার পর থেকে একটু অস্বস্তি লাগছে, ঐ একই রাস্তা তো। ট্রাক চলে খুব, আর রাতে ট্রাক ড্রাইভাররা যা চালায়! যাই হোক, তুমি একটু খেয়াল রেখো, ভোর রাতে ড্রাইভাররা ঘুমের ঘোরে উল্টোপাল্টা র‌্যাশ ড্রাইভিং করে, সেরকম করলে গাড়ি থামিয়ে বকুনি দিও। একা থাকবে, সেটাই চিন্তা।"
    রাই কিছু বলে না, আলোক এমনিতে ভীতু টাইপের নয়। জয়ন্ত ওর কলেজের বন্ধু, ওরকম একটা শরীর সচেতন, ব্যায়াম খেলাধুলো করা লোকের এভাবে বিছানায় পড়ে থাকাটা ওদের সবারই খুব খারাপ লাগে। তবে ওটা অ্যাক্সিডেন্ট এবং অ্যাক্সিডেন্ট যে কোনো সময় যে কোনো অবস্থায় যে কারোর হতে পারে। এখন জয়ন্তকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা আশংকা ইত্যাদিতে আলোকের যা মনের অবস্থা তাতে এসব যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই।

    শুয়ে শুয়ে জয়ন্তদের কথা মনে হল। নতুন চাকরীর পরে জয়ন্তরা যেন উড়ছিল, প্রচুর মাইনে, খরচ করে কূল পাচ্ছেনা এমন ভাব। রাইয়ের অবশ্য এসব দিকে নজর করার মত প্রবৃত্তি বা সময় কোনোটাই ছিলনা। তবে মাঝে মাঝে ফোনের তারে ভেসে আসত নানা খবর ও শ্রীমতী ও জয়ন্তের আকাশে ওড়ার নানা কাহিনী ও অভিযোগ!
    আসা যাওয়া তেমন ছিলনা ওদের মধ্যে, দু তিনটে অনুষ্ঠানে দেখা হতে দেখেছে শ্রীমতীর সাজগোজ সব কেমন বদলে যাচ্ছিল, দামী শাড়ি, হীরে প্ল্যাটিনাম, মুখের জেল্লাই অন্যরকম। শ্রীমতীর সঙ্গে ওর আলাদা কিছু বন্ধুত্ব ছিলনা, তবে পছন্দ করত রাই ওকে, খুব মিষ্টি ব্যবহার ছিল, উল্টোপাল্টা গসিপ করতনা।
    আজকাল কেন জানেনা, শ্রীমতী ওকে ফোন করে মাঝে মাঝে। আলোক প্রায়ই যায় জয়ন্তকে দেখতে, আড্ডা মেরে আসে। ওর যাওয়া হয়না, যদিও ওদের বাড়ী খুব একটা দুরে নয়, চার পাঁচ কিলোমিটার হবে। অন্য মহিলারা বলে শ্রীমতী নাকি আজকাল কারোর সাথে তেমন কথাই বলেনা, জয়ন্তের অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে। রাই তাই অবাক হয় যখন শ্রীমতী নিজে ওকে ফোন করে ওর সঙ্গে এটাসেটা কথা বলে, কোনো দরকার ছাড়াই। আজ সন্ধ্যেয়ও করেছিল, বলল ও নাকি খুব গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টের স্বপ্ন দেখছে, প্রায়ই। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এমনটা হতেই পরে যা ঘটেছে তার পরে।
    রাই শ্রীমতীকে বলেনি ও ছত্তিশগড় যাচ্ছে ট্যুরে। ওর নিজেরও আসলে পরিস্কার ধারণা ছিলনা জয়ন্তের অ্যাক্সিডেন্টের জায়গাটা সম্বন্ধে, রায়পুরের কাছে এইটুকুই জানত। এখন আলোকের কথায় বুঝল তাদের বিদ্যুতনগর যাওয়ার রাস্তায়ই হয়েছিল অ্যাক্সিডেন্টটা, কোরবা যাওয়ার পথে!
  • শ্রাবণী | 24.99.73.171 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:১২495823
  • *****************
    লোকদুজনকে বাইরের ঘরে সোফায় বসিয়ে শ্রীমতী ভেতরে দেখতে গেল জয়ন্তের সব সারতে আর কত দেরী। রামনিবাস, নার্স অ্যাটেন্ডেন্ট ছেলেটা বাথরুমের ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। শ্রীমতীকে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল, এসময় ম্যাডাম সচরাচর এঘরে ঢোকেনা। সেদিকে খেয়াল না করে শ্রীমতী জানতে চায়, আর কতক্ষণ লাগবে।
    -"হয়ে এসেছে, আর মিনিট পনের।”
    জয়ন্ত নিজে চান করে, বাথরুমের ভেতর একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে ওকে বসিয়ে দেয় রামনিবাস। দরজার সামনে হুইলচেয়ারটা রাখা। সকালে এইসময় চানটান সব সেরে বারান্দাটায় গিয়ে বসে। রান্নার লোক রান্না করে চলে গেছে, টুকটাক জয়ন্তের স্যুপ, স্ট্যু এগুলো শ্রীমতী নিজে করে, অবশ্য সব জোগাড় করে দিয়ে গেছে মেয়েটা।
    রামনিবাস চলে গেলে দুকাপ চা করে নিয়ে গিয়ে জয়ন্তের সাথে বারান্দায় বসে। দুজনে চা খায়, টুকটাক গল্প হয়, অন্য কথা, অসুখ সংক্রান্ত নয়, বরং যেন সুখের কথার মতই কিছু। কোনোদিন তাতাইয়ের ছোটোবেলার কথা, নানা পুরনো স্মৃতি ঝালানো, বেশ লাগে। রোজ সারাদিনের মধ্যে এই একটা সময় খুব উপভোগ করে সে, অন্যসময় তো শুধু চিন্তা আর চিন্তা।
    আজ নিয়মের গন্ডগোল হবে, হয়ত আজ আর বারান্দায় বসা হবেনা। দুজন এসেছে, তারা জয়ন্তের সঙ্গে কথা বলতে চায়, অফিস থেকেই হবে, ও চেনেনা। শ্রীমতী রামনিবাসকে বলে,জয়ন্তকে তৈরী করে যেন লিভিং রুমে নিয়ে আসে, কারা দেখা করতে এসেছে।
    রান্নাঘরে গিয়ে দুধ বসাল গ্যাসে, কফি বানাবে। এই লোকগুলোকে এর আগে কোনোদিন দেখেনি। আবশ্য নতুন অফিসের কজনকেই বা ও দেখেছে! হাসপাতালে বা বাড়িতে যারা অফিস থেকে এসেছে তাদের দু একজনকে এতদিনে চিনে গেছে। এখন অনেকদিন আর কেউ আসেনা, ডিসচার্জ হয়ে বাড়ি নিয়ে আসার পরে পরে কদিন খুব আসছিল, ইন্সিওরেন্সের নানা কাগজপত্রে ওর সই নিতে।
    সেসময় শ্রীমতীর দিদিরা ছিল, সোমনাথদা সব কাগজপত্র দেখে নিয়েছিল আগে তবে সে সই করেছিল। চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র ফাইল করে ওর হাতে দিয়ে গেছিল। এরপরে অবশ্য তেমন কেউ আর আসেনি। তবে এমনি এমনি আসবেই বা কে, নতুন কম্পানি, সেরকম ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব কোনো কলীগের সাথে এইকদিনে দানা বাঁধেনি জয়ন্তের, সবই অফিশিয়াল সম্পর্ক।
    মালিকদের দুই ভাইয়ের মধ্যে থেকে বড় ভাই অমিত আগরওয়াল হাসপাতালে শ্রীমতীর সঙ্গে দেখা করে দুঃখপ্রকাশ করে সান্ত্বনা জানাতে এসেছিল। ওদের তো আরো ক্ষতি হয়ে গেছে, একই অ্যাক্সিডেন্টে ওদের কাকা চেয়ারম্যান কাম ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ওমপ্রকাশ আগরওয়ালও মারা গেছেন। জয়ন্ত আর ড্রাইভার ছাড়া গাড়িতে ছিল ওমপ্রকাশ আর তার সেক্রেটারী। জয়ন্ত সামনে বসেছিল, ড্রাইভারের পাশে, পেছন থেকে লরি এসে এমনভাবে ধাক্কা মেরেছে যে বাকি তিনজনেই ডেড। জয়ন্তের বেঁচে যাওয়াটা শুধু মিরাক্যল ছাড়া নাকি আর কিছু না, সবাই একথা বার বার বলে গেছে।

    ভাগ্যের ফের ছাড়া আর কী! জয়ন্তের সেদিন ঐ গাড়িতে আসারই কথা নয়। কোরবায় ওদের প্রজেক্টের কাজ চলছে, সি এম ডি গিয়েছিল সাইট ভিজিটে। সেখানে সাইট ইঞ্জিনীয়র ও ভেন্ডরদের সাথে মিটিং করে। দিল্লীর ডিজাইন অফিস থেকে জয়ন্ত আর ওর দুজন কলীগরাও গেছিল সেই মিটিংয়ে। মিটিং শেষে জয়ন্তর সাথীরা সেদিন ওখানে রয়ে যায়, জয়ন্ত পরদিন অফিসে দরকারী কাজ ছিল বলে সেদিন রাতেই রায়পুর রওনা হয় একা, ভোরের ফ্লাইট ধরবে বলে। এ ব্যাপারে খুব পরিস্কার করে জয়ন্তর সঙ্গে শ্রীমতীর কোনোদিন কথা হয়নি, এ প্রসঙ্গ ওরা নিজেদের মধ্যে এখনো তোলেনা কিভাবে কী ঘটেছিল ইত্যাদি। ওকে অফিস থেকে যখন খবর দিয়েছে তখন জয়ন্তকে ওরা রায়পুরের হাসপাতাল থেকে দিল্লী নিয়ে আসার পথে। সোজা হাসপাতালে যেতে বলে দিয়েছিল। ওর তখন কোনো ভাবনা চিন্তা করার মত অবস্থা ছিলনা, কাকে একটা খবর দিয়েছিল, জয়ন্তর কোন বন্ধুকে। মোবাইল হাতড়ে যে নাম্বার প্রথমে পেয়েছিল বোধহয় তাকেই। তারপর জয়ন্তর বন্ধুরা সব এসে পড়েছিল, তারাই ওকে আর তাতাইকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল, আর যা যা করণীয় সব করছিল।

    দু একদিন পরে জয়ন্তর জ্ঞান ফিরলে ও একটু ধাতস্থ হয়। ততদিনে অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে সব আলোচনা থিতিয়ে এসেছে।
    তবু তাতেই যা শুনেছিল তা হল জয়ন্তর গাড়ি খারাপ হয়ে যায় রাস্তায়। ও রাস্তায় অত রাতে তেমন গাড়ি টাড়ি চলেনা, শুধু বড় বড় লরি চলে। জয়ন্ত যা বলেছে তাতে মনে হয় যে ওমপ্রকাশের গাড়িতে ও লিফট নেয়। অন্ধকার রাস্তা ছিল, লরি পেছন থেকে এসে ধাক্কা মেরেছে। সেসবের বিশদ নাকি জয়ন্তর কিছু মনে নেই। গাড়িটা একেবারে চেপ্টে গিয়েছিল। ওভাবে সারারাত পড়ে থাকলে কী হত কে জানে তবে ভাগ্যের জোর বলতে হবে উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি আসছিল, কোলিয়ারীর বড় সাহেবকে নিয়ে, তারা দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে এদের উদ্ধার করে। রায়পুর থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসে।

    রান্নাঘরটা দরজাহীন, খোলা, সেখান থেকে ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে লিভিং রুম দেখা যায় মাঝখানের স্বচ্ছ বাহারে পর্দার এপার থেকে। শ্রীমতী নজর রাখছিল, জয়ন্তকে সেদিকে যেতে দেখে ও কফির ট্রে নিয়ে গেল। স্নান শেভ ইত্যাদির পরে জয়ন্তকে দারুন ফিট লাগছে, মুডও ভালো মনে হয়,হুইলচেয়ারটা এসময়ে বড্ড বেমানান লাগে। আজকাল খুব অল্পেতে রেগে যায় জয়ন্ত, থেকে থেকে মুড বিগড়ে যায়। স্বাভাবিক, এরকম অবস্থায় যে কোনো লোকের হবে, তাই বাড়িতে ওরা খুব সাবধানে থাকে, চেষ্টা করে তার অপছন্দের কাজ না করতে, কথা না বলতে। তবু সবসময় শেষরক্ষা হয়না, তখন শ্রীমতীর খুব অসহায় লাগে, বিশেষ করে যখন বাইরের লোকের ব্যবহারে তাদের সামনে জয়ন্ত বিরক্তি প্রকাশ করে, অধৈর্য্য হয়। কিছু করতে পারেনা,বুঝে ওঠেনা জয়ন্ত কে সামলে অতিথির মান কেমন করে রাখবে! আজ আবার অচেনা লোক, বন্ধুবান্ধব নয়, একবুক আশঙ্কা নিয়ে মুখটাকে হাসি হাসি করে সবাইকে কফি দিল। লোকদুটি তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল, জয়ন্ত তাদের বসতে বলল।
    -"আপনি আমাদের চিনবেন না স্যর, আমরা আগরওয়াল ইন্ডাস্ট্রীজ এর ইন্সিওরেন্স কম্পানির তরফ থেকে আসছি। আমার নাম এ কে দাসানি, আর এ হল আমার কলীগ মনোজ সিং।"
    শ্রীমতী জয়ন্তর পাশের সোফায় বসেছিল, জয়ন্ত কিছু বলার আগেই সে বলে,
    -"কিন্তু ইন্সিওরেন্সের সব কাগজপত্র তো আগেই অফিস থেকে সইটই করিয়ে নিয়ে গেছে।"
    -"না না আমরা মিঃ ঘোষের ব্যাপারে আসিনি। আসলে আমরা লেট ওমপ্রকাশ আগরওয়ালের ব্যাপারে একটু খোঁজখবর করছি। ওনার এগেনস্টে একটা খুব বড় অ্যামাউন্ট ইন্সিওর করা ছিল, তাই একটা রুটিন তদন্ত করতে হচ্ছে। ঐ অ্যাক্সিডেন্টে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি তো স্যর, ওনার থেকেই তাই শুরু করছি। এমনি এভাবে আপনাদের বিরক্ত করার জন্যে আমরা খুব দুঃখিত, প্লীজ আমাদের মাফ করবেন।"
    জয়ন্তর মুখ দেখে মনে হয় না বিরক্ত হয়েছে এখনো পর্যন্ত, শ্রীমতী হাঁফ ছাড়ে। সত্যি তো, ওরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে এত ব্যস্ত যে ভদ্রলোক মারা গেছেন তার কথা কোনোদিন মনেই হয়নি। কে কে ছিল ওনার, ভদ্রলোকের সেক্রেটারীও তো একই সঙ্গে মারা যায়, তারও নিশ্চয়ই পরিবার আছে, তাদের কী অবস্থা কে জানে! এরা জানলেও জানতে পারে, জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কিনা ভাবতে গিয়ে আনমনা শ্রীমতী, বাকীদের কথাবার্তায় বিশেষ কান করেনা।
    -"কী জানতে চান বলুন? আমার কিন্তু আসল ঘটনার সেরকম খুব পরিস্কার স্মৃতি নেই, বুঝতেই পারছেন। তবু যামনে আছে তাতে আপনাদের যদি কিছু সাহায্য হয়।"
    লোকদুটি অত্যন্ত ভদ্র, জয়ন্তর কথা শুনে হাঁ হাঁ করে ওঠে।
    -"না না, আমরা মোটামুটি সব খোঁজখবর করেই আসছি, সবার বয়ান ইত্যাদি জুড়ে ঘটনার ধারা মোটামুটি সাজিয়েছি। আপনি সেটা শুনে যদি কিছু বাদ পড়ছে মনে হয় তা বলে দেন।"
    -"আমি চেষ্টা করব তবে কতটা কী বলতে পারব জানিনা।"
    -"আপনার গাড়িটা বিলাসপুর আর রায়পুরের ঠিক মাঝে এসে খারাপ হয়ে যায়?"
    -"হ্যাঁ, বিলাসপুরে পেট্রল পাম্পে ডিজেল ভরেছিল ড্রাইভার। বেশ কিছুটা চলার পরে একটু কেমন লাগছিল, তারপরে আওয়াজ করে থেমে যায়। অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে যতটুকু চেষ্টা করা যায় ড্রাইভার করছিল বনেট খুলে, কাছাকাছি ঐ রাস্তায় কোনো পেট্রল পাম্পও ছিলনা, রাতের বেলা তেমন গাড়িও চলছিল না, শুধু কতগুলো বড় লরি।
    শেষে এই গাড়িটা রাস্তায় আমাদের গাড়ি দেখে স্লো করে। তখন আমার মাথায় আসে যে যদি লিফট পাই তাহলে আমি রায়পুর চলে যাব এদের সঙ্গে। এরকম একটা রাস্তায় এভাবে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবেনা।"
    -"আপনি এসব যা যা জানিয়েছেন সেসব আমরাও খোঁজ নিয়েছি। আপনার গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা বলেছি। কিভাবে ফিলটার লুজ হয়ে আপনার গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল ড্রেন হয়ে যায় একটু একটু করে, তারপরে যা হয়। আপনি মিঃ আগরওয়ালের গাড়ি করে চলে যাওয়ার পরে ড্রাইভার গাড়ি ওখেনে লক করে একটা লরি ধরে কাছে ওর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রাত কাটায়। পরদিন বিলাসপুরের গ্যারাজ থেকে লোক নিয়ে এসে গাড়ি গ্যারাজে নিয়ে যায়। আপনাকে কি মিঃ আগরওয়াল চিনতেন?"
    -"চিনতেন না সেভাবে, শুধু সেদিনই সকাল থেকে ওনার সঙ্গে মিটিং করেছি। অন্ধকারে বুঝতে পারেননি, আমি ওনাদের চিনতে পেরে নিজের পরিচয় দিই। তখন বোধহয় ওনার মনে পড়ে, দিল্লীর বেশী লোক আমরা ছিলাম না মিটিংয়ে।"
    -"গাড়ীটা যে আপনাদের সি এম ডির সেটা কখন বুঝতে পারলেন?"
    -"গাড়ি দেখে আমার গাড়ির ড্রাইভার দীনেশ চিনতে পেরেছিল ওটা বড় সাহেবের গাড়ি বলে, ঐ থামায় ওদের। আমাকে নিয়ে যে গাড়ি যাচ্ছিল তাও অফিসের গাড়ি ছিল, অবশ্য ছোট গাড়ি।"
    দাসানি এবার চুপ করে যায়, যেন আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা অথবা যা বলতে চায় তা নিয়ে দ্বিধা আছে। জয়ন্তও কিছু বলেনা, এমনিতে সব সহজ সোজা কিন্তু তবু শ্রীমতী কেমন একটা চাপা টেনশন অনুভব করে নিজের ওপর বিরক্ত হয়। সে কি আজকাল প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনুভূতিশীল হয়ে পড়ছে!

    জয়ন্ত এবার একরকম গা ঝাড়া দেয়, ভঙ্গীটা অতিথিদের বিদায়ের ইঙ্গিত দেওয়ার মত। ইন্সিওরেন্স অফিসে কাজ করা লোকেরা পোড় খাওয়া হয়, নানা লোকের সঙ্গে উঠতে বসতে হয় তাদের। জবাবে দাসানিও ঝাঁকুনির ভঙ্গী করল, আসলে অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলল।
    -"মিঃ ঘোষ, এই পুরো ঘটনাটায় একটা ব্যাপার একটু ভাবাচ্ছে আমাকে। ওমপ্রকাশ আগরওয়ালের সঙ্গে যে ব্রিফকেস ছিল সেটাতে তেমন কিছু ছিলনা, শুধু একটা ফাইলে কিছু সাদা কাগজ আর কম্পানীর কয়েকটা ব্রশিওর, ওনার নামে দুটো না খোলা খাম। অবশ্য ওনার কার্ড, প্যাড এসব ছিল। কিন্তু একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থেকে ফিরছেন, এছাড়া মিটিংয়ের আগে কদিন ধরে উনি লোক্যাল একজন লীডার, রায়পুরে কয়লামন্ত্রী ইত্যাদি বড় বড় লোকেদের সঙ্গে দেখা করে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন, অথচ ওর কাছে কোনো কিছু ডকুমেন্ট নেই।"
    জয়ন্তর মুখ দেখে মনে হলনা সে ব্যাপারটায় খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে। আজকাল ও একটু চিন্তাভাবনার বিষয়ে কথাবার্তা হলে কেমন যেন অনদেখা করে অথবা বিষয় পাল্টে দেয়।
    -"আমি অনেক জুনিয়র কর্মচারী ওনার কম্পানিতে, ওনাদের ব্যাপারস্যাপার আমি তেমন কিছু জানিনা। তবে অফিসের দরকারী কাগজপত্র কি উনি নিজের কাছে রাখবেন? হয় ওনার সেক্রেটারীর কাছে থাকবে নয় ওখানে আমাদের সুন্দরনগর ফ্যাক্টরীর বড়কর্তার কাছে।"
    -"ওর সেক্রেটারী নরেশ গুপ্তার কাছে ল্যাপটপের ব্যাগ ছিল আর তাতে ডায়েরী ও টুকটাক কাগজ পত্র। মন্ত্রীর অফিস থেকে আমরা খবর পেয়েছি যে বেশ কিছু কাগজপত্র আগরওয়াল সাহেবকে দেওয়া হয়েছিল মিনিস্টারের কথায়। সেসবের কোনো হদিশ নেই।"
    জয়ন্ত এবার দৃশ্যত বোর, হাই তোলার মত ভাব করে বলল,
    -"আমি ওঁর গাড়িতে লিফট নিয়েছিলাম মাত্র সেও দুর্ভাগ্যবশত। গাড়িতে বসার পর থেকে ওদের সঙ্গে আমার একটিও কথা হয়নি, ওদের নিজেদের মধ্যে কোনো আলোচনা করতেও শুনিনি কোনো ব্যাপারে, সারাদিনের ঝামেলার পরে ওরা ক্লান্ত ছিল, চুপচাপ বিশ্রাম করছিল নির্ঘাত। আপনারা এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন আমি বুঝতে পারছিনা, এসবের সঙ্গে ইন্সিওরেন্সের কী সম্পর্ক কে জানে। তবে আমি কিছু জানিনা।"
    -"আপনি আপনার জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক পেয়েছেন তো? মানে আমরা বুঝতে চাইছি ওখানে অ্যাক্সিডেন্টের পরে আবার চুরিটুরি হয়েছিল কিনা?"
    শ্রীমতী মন দিয়ে শুনছিল সব। অবাক হল, চুরি হলেই বা কী, ওরা তো আগরওয়ালের মৃত্যুর ব্যাপারে শুধু খোঁজ করবে, তার কাগজপত্রের তো আর ইন্সিওরেন্স ছিল না নিশ্চয়ই। জয়ন্ত ওর দিকে তাকালো এবার। ও বুঝতে পেরে বলল,
    -" ওর স্যুটকেস, টাকা পয়সা, ক্রেডিট কার্ড মোবাইল সব বাড়িতে দিয়ে গেছে অফিসের লোক এসে। যিনি রায়পুর থেকে ওকে আনতে গিয়েছিলেন তিনিই বোধহয় নিয়ে এসেছিলেন সব।" আপনাকে কি কেউ আগরওয়াল সাহেবের কাগজপত্রের খোঁজ করতে বলেছে?"
    দাসানি এবার যেন সতর্ক। হাসির মোড়কে বলে,
    -"না না সেরকম কিছু নয়। আসলে ব্যাপারটায় আমার একটু খটকা লাগছিল তাই। আমার ওপর ভার শুধু মৃত্যুটা স্বাভাবিক কিনা তাই দেখার। সেদিকে সন্দেহের কিছু পাইনি তাই এদিক ওদিক করছি, বুঝলেন না, আমারও তো রিপোর্টে দেখাতে হবে যে কতটা কী তথ্যানুসন্ধান করেছি। আপনার ঐ অ্যাক্সিডেন্টের মুহূর্তের কিছু মনে পড়ে না না? মানে লরিটা ঠিক কিভাবে এসে ধাক্কা মেরেছিল?"
    জয়ন্ত এবার উদাস,
    -"নাঃ, আমার ঠিক মনে নেই কিছু। তবে কিছু দেখার তো কথা নয়, শুনেছি লরি পিছন দিক থেকে এসে মেরেছিল, নিশ্‌চয়ই ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়েছিল বা মদ খেয়েছিল। আপনি গাড়িটা দেখেননি?"
    দাসানি এবার উঠে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গীও যে এখনো পর্যন্ত একটাও কথা বলেনি।
    -" হ্যাঁ আমি দেখেছি গাড়িটা, একেবারে চেপ্টে গেছে। আপনি খুব লাকি স্যর, ম্যাডামের পয় আছে। ওরকম অ্যাক্সিডেন্ট থেকে ফিরে এসেছেন। আচ্ছা আমরা আসি, বলার মত কিছু মনে পড়লে আমার কার্ড রইল, একটু ফোন করে দেবেন আমি চলে আসব।"
    শ্রীমতী দরজা বন্ধ করতে করতে জয়ন্ত বারান্দায় পৌঁছে গেছে। এই প্রথমবার দেখল বাইরের অচেনা লোক অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে এত কথা বলে যাবার পরেও জয়ন্তর মেজাজ ঠিকঠাক। এর আগে দেখেছে কেউ এ নিয়ে কথা বললেই বেজার মুখ, মেজাজ সপ্তমে। শুধু ও আর তাতাই নয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এনিয়ে কথা তোলেনা ওরকম করে বলে। শ্রীমতীর খুব ভালো লাগল অনেকদিন পরে একটা অন্যরকম ভালোলাগা!
    নাঃ খুব বেশী বেলা হয়নি, বারান্দার প্রাত্যহিক চায়ের আসর এখনো বসানো যায়!
  • de | 69.185.236.51 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১৫:৫৩495824
  • ভালো লাগছে পড়তে--
  • নেতাই | 131.241.98.225 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১৬:১১495825
  • গুড ঃ)
  • kumu | 132.160.159.184 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ১৭:১৯495827
  • অনবদ্য,আরেকটু তাড়াতাড়ি হোক-
  • sosen | 125.242.163.163 | ০৩ জানুয়ারি ২০১৩ ২২:৪১495829
  • পড়লাম। পড়ছি।
  • piu | 121.93.33.142 | ০৪ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:২৯495830
  • শ্রাবনীদি খুব সুন্দর, অনবদ্য শুরু ।।।।।।আজকের পর্ব-র কখ্ন পাবো ?
  • ranjan roy | 24.97.221.74 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৫৬495831
  • পিউ এর কথা রিপিট করলাম।
  • SG | 134.124.204.10 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৩ ১৫:১৬495832
  • পরের পর্ব টা কি সোমবার হবে?
  • Blank | 69.93.219.49 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৩ ১৮:৫৮495833
  • কই কই?
  • Blank | 180.153.65.102 | ০৭ জানুয়ারি ২০১৩ ১৭:৩৭495834
  • তুলে দিলাম ফের
  • a | 135.16.135.194 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৩:০২495835
  • যা আটকে গেল যে। ও শ্রাবনীদি
  • de | 69.185.236.51 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৩:১৩495836
  • শ্রাবণী বোধায় দিল্লীর ঠান্ডায় কাবু!
  • শ্রাবণী | 127.239.15.101 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:০৬495837
  • দে কী করে জানল!:) সত্যি, কাল রাতে লিখব বলে বসেছিলাম, রুম হীটার, বন্ধ ঘর, বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে..........কিছুতেই হাত দুটো বেশীক্ষণ বাইরে রাখতে পারছিলাম না!
  • kumu | 132.160.159.184 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:১৩495838
  • আরে অত ঠান্ডা নাই,লেখো তাত্তাড়ি।
  • de | 69.185.236.53 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:১৪495841
  • না না একটু ঠান্ডা কমুক তাপ্পর লেখো -- আম্মো বেজায় শীতকাতুরে ঃ))
  • শ্রাবণী | 127.239.15.101 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:১৮495842
  • তাছাড়াও, আমি হপ্তায় একবারই লিখব তার বেশী নয়, এত সময় নেই!
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৭:৫৭495843
  • শ্রাবনী-দি জানি আপনি ব্যস্ত,
    কিন্তু আমার পেট গুর গুর করছে বাকিটা পড়তে না পেলে, তাই একটু হাত চালিয়ে লেখার অনুরোধ :D
  • kumu | 132.160.159.184 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৮:০৩495844
  • হ্যাঁ,আমারো মাথা কটকট,চোখ জ্বলজ্বল,মন উৎসুক-এইসব হচ্চে।
  • Ekak | 24.99.88.124 | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১৮:৩৫495845
  • ঈকি এগোয়না ক্যান ? ইদিকে জয়ন্তর প্রতি সন্দেহে আমি যে বেগ্নে সবুজ হয়ে গেলুম !
  • kumu | 132.160.159.184 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৮:৫২495846
  • ৩ জানুয়ারীতে লাস্ট লিখেছিল।ইদিকে এই হপ্তার তিন্দিন হয়ে গেল।

    জয়ন্তর প্রতি আমারো খুবি সন্দেহ,নামটাই কেমন,এইরকম নামের লোকরা বিশেষ সুবিধের হয় না।
  • শ্রাবণী | 69.94.104.22 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৯:৩৫495847
  • সন্ধ্যে হয় হয়। বিকেলে চা নিয়ে উঠেছিল ছাদে, এমন পরিবেশ যে নামতেই ইচ্ছে করছেনা। চারিদিক শান্ত, আশেপাশে সারি সারি দোতলা কোয়ার্টার কিন্তু কেন যেন মানুষজনের আওয়াজ সেভাবে ভাঙতে পারেনা এই নীরবতার আবেশ । গাড়িও হয়ত চলছে সামনের রাস্তায় দু একটা, এছাড়া একটু দুরে গেটের বাইরে কাঠঘোরা যাওয়ার মেন রোডে ইতস্তত লরি বাসের আসাযাওয়া, তাদের হর্ণ ইত্যাদির শব্দ ছাপিয়ে ওঠে এখানকার সাউন্ড অফ সাইলেন্স।
    চান্দ্রেয়ী বুদ্ধি করে ফ্লাস্ক ভরে চা নিয়ে এসেছে। ওরা এখন দ্বিতীয় কাপ নিয়ে বসেছে। টাউনশিপ ঘিরে দেওয়াল ঘেঁসে সারি দিয়ে বড় বড় গাছ, দুরে পরিস্কার আকাশে মাথা উঁচু করে আছে ফুটকাপাহাড়। দুপুরে হালকা বৃষ্টি হয়ে গিয়ে, আকাশ এখন নীলে নীল। এমন একটা পরিবেশে বেশী কথা বলতে ইচ্ছে করেনা তবু তারই মধ্যে টুকটাক কথা হতে থাকে দুজনের।

    অনেক দিন বাদে দেখা হল চান্দ্রেয়ীদের সঙ্গে। ওর প্যাকেজের কনট্র্যাক্ট ক্লোজিং মিটিং বিদ্যুতনগরে হবে এবং যেতে হবে শুনে রাই বাড়ি এসেই চান্দ্রেয়ী আর পার্থ কে ফোন করেছিল। চান্দ্রেয়ী ওর মাসতুতো বোন, পার্থ একই কম্পানির পুরোনো কলীগ ও অনেকদিনের বন্ধু।
    পার্থর সঙ্গে চান্দ্রেয়ীর বিয়ের সম্বন্ধ ওরাই করেছিল, ও আর আলোক, ভেবেছিল দুই বোন কাছাকাছি থাকবে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই পার্থ বদলি হয়ে যায়, নানান জায়গা ঘুরে ওরা এখন বিদ্যুতনগরে। এমনিতে দেখা সাক্ষাত হয়ইনা, সেই কবে ওদের ছেলে ঋকের অন্নপ্রাশনে কলকাতায় গিয়েছিল, সেও মাসি আর চান্দ্রেয়ীর অনেক অনুরোধে। আর কয়েক বছর আগে শিমলা মানালি যাবার পথে ওরা দুদিন ছিল দিল্লীতে। এছাড়া দুপক্ষের কলকাতা যাওয়া আসার সময় মেলেনা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, নিজেদের অফিস সব মিলিয়ে অনেকবার প্ল্যান প্রোগ্রাম করেও এক জায়গায় হওয়া হয়নি। অবশ্য আলোক কয়েকবার কাজে গেছে পার্থর বিভিন্ন পোস্টিংয়ের জায়গায়, পার্থও দিল্লী এসেছে কাজে বা ট্রেনিংয়ে। শুধু এদের দুইবোনেরই দেখা হয়না।
    রাইয়ের দুরে ট্যুর কম পড়ে, এযাত্রায় বস একবার বলতেই ও রাজী হয়ে যায়। শুরু থেকেই এই প্যাকেজটা ও ডীল করছে, শেষে না থাকলে ভালো দেখায় না। তবে পার্থরা এজায়গায় না থাকলেও ওর উৎসাহ এতটাই হত তা বোধহয় নিজেও হলফ করে বলতে পারেনা!

    আবছা অন্ধকার হয়ে আসে, দুই বোনে গল্পে এতই মগ্ন যে ছাদের আলোটা জ্বালাতে খেয়াল হয়না কারো। খেয়াল যখন হয়, ততখনে ঋক নীচে থেকে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। দোতলা বাড়ির ওপর নীচে আলাদা কোয়ার্টার, দুটো ফ্ল্যাটের প্রবেশপথ সম্পূর্ণ পৃথক, দুটি গেট দুদিকে। শুধু যে ছাতের আলো জ্বালানো হয়নি তাই নয়, সিঁড়িও অন্ধকার। তাই ঋক ভয় পাচ্ছে ওপরে উঠতে এবং নীচে থেকে মাকে ডাকছে। তার সেই ডাক শুনে নীচের তলার বাসিন্দারাও বেরিয়ে এসে গোলযোগ করছে। চান্দ্রেয়ী তাড়াতাড়ি উঠে সব আলো জ্বালিয়ে ছেলেকে সাড়া দেয় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে। রাই চায়ের কাপটাপ গুলো ট্রেতে গোছায়। চান্দ্রেয়ী R্ককে ঘরে ঢুকিয়ে আবার আসে ছাদে, কিন্তু তাল কেটে গেছে আড্ডার। চেয়ার গুলোকে সিঁড়ির ধারে গুছিয়ে রেখে ছাদের দরজা বন্ধ করে ওরা দুজনে দোতলায় নেমে আসে।
    চান্দ্রেয়ী রান্নাঘরে ঢোকে জলখাবার বানাতে। ঋক হাত মুখ ধুয়ে লাফাতে লাফাতে এসে লিভিং রুমের সোফায় মাসির পাশে বসে। খেলার মাঠে কী কী হয়েছে তাই নিয়ে গল্প জুড়ে দেয়। দুটো প্লেটে চাউমিন নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখল চান্দ্রেয়ী, রাই আর ঋকের জন্যে। ছেলে সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে খেতে আরম্ভ করে দিয়েছে, রাই আপত্তি জানায় যদিও তার খিদে পেয়েছে, দুপুরে অফিসের স্পেশ্যাল খাবার তার মুখে সেভাবে রোচেনি তাই খুব কম খেয়েছিল।
    -"পার্থ আসুক, একসাথে খাব।"
    চান্দ্রেয়ীর চোখ ঘড়ির দিকে,
    -"এত দেরী হচ্ছে কেন কে জানে! তুই খেয়ে নে, লাঞ্চে কিছু খাসনি বললি তো। "
    রাই ঘড়ি দেখে, সাড়ে ছটা বাজে, পাঁচটায় ছুটি হয় প্ল্যান্টে। সকালে পার্থই ওকে ছেড়েছিল মিটিংয়ের ওখানে, বলেছিল সন্ধ্যেয় তাড়াতাড়ি ফিরে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেবে। তবে হতেই পারে কোনো জরুরী কাজ এসে গেছে, এখানে অফিসাররা কখনৈ ঘড়ি ধরে ছুটি পায় না। চান্দ্রেয়ীর জোরাজুরিতে খেয়ে নিল, দারুন বানিয়েছে চাউমিনটা।
    খেয়েটেয়ে ঋক পড়তে গেল আর এরা দুজনে মিলে রান্নাঘরে ডিনারের ব্যবস্থায় লাগল, বিরিয়ানীর সব জোগাড় করে দিয়ে গিয়েছিল রান্নার মেয়ে,চান্দ্রেয়ী দমে বসালো। রাই নিজে খুব একটা শৌখীন রান্নার দিকে যায়না, চান্দ্রেয়ী আবার রকমারি রান্না করতে ভালোবাসে, কাল থেকেই কিছু না কিছু বানিয়ে যাচ্ছে বোনের জন্যে।
  • শ্রাবণী | 69.94.104.22 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৯:৫৪495848
  • সাতটা বাজতে এবার ওরা পার্থর জন্যে চিন্তায় পড়ল। ফোনটোনও আসেনি, মোবাইলে একবার কল করল, রিং হয়ে গেল কেউ ওঠালো না। রাইয়ের কথা ভেবে চান্দ্রেয়ী অফিসের ফোনে লাগালো একবার, সেখানেও কেউ তুলল না। রাইয়ের খুব খারাপ লাগছিল, চান্দ্রেয়ীর মুখ চিন্তাক্লিষ্ট, যদিও গল্প করে যাচ্ছিল তবু বারেবারে আনমনা হয়ে পড়ছিল। রাই দেখেশুনে বারান্দায় গেল মোবাইল টা হাতে নিয়ে, বাড়িতে ফোন করবে। টুপাইয়ের সঙ্গে কথা বলা শেষ হয়েছে নীচে পার্থর বাইক এসে থামল। চান্দ্রেয়ী প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে সিঁড়ির আলো জ্বালালো। রাই আর ঋক এসেও দরজায় দাঁড়িয়েছে। পার্থ দাঁত বার করে রাইয়ের উদ্দেশ্যে "সরি সরি রে" করতে করতে ঢুকল।
    -"এত দেরী?"
    -"আরে ফেঁসে গিয়েছিলাম। দাঁড়া চেঞ্জ করে এসে বলছি।"
    দেরী যে মাঝে মাঝে হয়না তা নয়, রাই আছে তবু দেরী করেছে বলেই চান্দ্রেয়ীর আপত্তি। যাইহোক সে গেল রান্নাঘরে চা জলখাবার আনতে। জামাকাপড় ছেড়ে এসে পার্থ জমিয়ে বসল ড্রইং রুমে। চাউমিন খেতে খেতে বলে,
    -"আরে সব ঠিকঠাক, বেরোতে যাচ্ছি, শেষবেলায় খবর এল ওয়াগনে কয়লার মধ্যে একটা লাশ। ব্যস ছুটতে হল। এই এতক্ষণে পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যাওয়ার পর মিশ্রকে সামলাতে বলে চলে এলাম।"
    লাশ শুনে রাই সচকিত। তবে পরক্ষণে চান্দ্রেয়ীর কথা শুনে অবাক, একরকম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে,
    -"তার জন্যে তুমি এতক্ষণ কী করছিলে? পুলিশে খবর দিয়েই চলে আসতে পারতে।"
    রাইয়ের অবাক হওয়া ভাবটা পার্থ বোধহয় টের পায়, সে হেসে বলে,
    -"লাশ শুনেও তুমি এরকম নির্বিকার ভাব করছ দেখে রাই কতবড় হাঁ করেছে দেখেছো?"
    চান্দ্রেয়ী হেসে ফেলে চায়ে চুমুক দিয়ে বোনকে বলে,
    -"তুই আর জানবি কী করে বল, তোদের তো এইসব এলাকায় কাজ করতে হয়না, রাজধানীতে হেড অফিসে বসে থাকিস। কয়লার গাড়িতে এরকম লাশ আসা তো স্বাভাবিক এখানে। আমিও আগে জানতাম না। পার্থ যবে থেকে কোল হ্যানডলিংয়ে বদলি হয়েছে তবে থেকে শুনছি, বছরে দু একটা লাশ নাকি আসবেই।"
    রাই কী বলবে ভেবে পায়না, এরা বলে কী! এরকম তো কখনো শোনেনি আগে কারো কাছে।
    -"কোথা থেকে আসে? কেউ খুন করে লাশ কয়লার গাড়িতে ফেলে দেয়? কয়লার গাড়িতে কেন, এখানে তো চারিদিকে বন পাহাড় নদী, অন্য কোথাও, আরো নির্জনে লুকোতে পারত। কয়লার গাড়িতে ফেললে তো আবিস্কার হয়ে যাবে, জানাজানি হবে। সে নিয়ে হইচই হয়না? পুলিশ পরে কিছু আর জানায়না তোদের?"
    -"ও হো, তুই তো আবার খুনের রহস্য সমাধান না কী যেন করেছিস, আলোক বলছিল। আরে এই সব দিকের পুলিশ কী আর তোদের শহুরে পুলিশ? বেশীরভাগ লাশই শনাক্ত হয়না, কোথাও কেউ খোঁজখবর করেনা। খুন করে কী অ্যাক্সিডেন্টে মরে তাই কেউ জানেনা, পুলিশ কিছুদিন বাদে বেওয়ারিশ লাশ জ্বালিয়ে দেয়। তবে তুই ঠিক প্রশ্ন করেছিস, কয়লার গাড়িতে কেন?
    সাধারণত এই গাড়ি আসে অনেক দুর খনি এলাকা থেকে, এদিকে এত নানা খনি রয়েছে, ঠিক কোথা থেকে আসছে খুঁজে বার করা মুশকিল। অথবা এমনও হতে পারে রাস্তায় কেউ ফেলে দিয়েছে, সস্তায় লাশ পাচার হয়ে গেল। তবে আমাদের এখানে যে থিওরী চালু তা হল খনিতে অনেক অ্যাক্সিডেন্ট হয়, ডেলি ওয়েজদের। এ হল সেই লাশ, ওদিকে আড়াল টাড়াল নেই তাই লাশ লুকোনো একটু মুশকিল, জানাজানি হয়ে যাবে সহজে। এই মজদুরদের ঠিকমত সুরক্ষার সব সামগ্রী পোষাক দেওয়া হয়না, উল্টোপাল্টা কাজ করানো হয় সেফটি নর্ম না মেনে, তাতেই মাঝে মাঝে অ্যাক্সিডেন্ট হয়। এবার জানাজানি হলে হইচই হবে, খনির মালিকদের বাঁশ হবে, খনিতে কাজ করানোর অনেক নিয়মকানুন আছে সেসব না মেনে কাজ করেছে। তারপরে শুধু যে লোকটির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা নয়, মামলা হলে পুলিশ সরকারের ঘরে পয়সা ও নানা হয়রানি। সেসব এড়াতে এরা চুপিচুপি লাশ ওয়াগনে ফেলে দেয়। খোঁজ নিতে গেলে কেউ স্বীকার করেনা, লোকটি তার ওখানে কাজ করেছে। ডেলি লেবার, খাতায় কলমে কিছু থাকেনা ঘুরে ঘুরে সব খনিতে যায় কাজ করতে, তাই প্রমাণও কিছু করা যায়না।"

    রাই অবাক, এত বড় অন্যায় ঘটে যায় এভাবে অলক্ষ্যে আর কেউ কিছু করেনা বলেনা। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হলেও পার্থদের কিছু বলেনা, চুপ করে শুনে যায়।
    -"আরে আজকের সমস্যাটা তো সেইজন্যেই বেশী হল। কয়লা আনলোডিং স্টেশনের একটা লেবার লাশ দেখে চিনতে পরে, তাদের গ্রামের লোক।"
    রাই একটু স্বস্তি পেল, অন্তত একটা লোক কিছুটা বিচার পাবে, নাহলে মনে মনে খুব অশান্তি নিয়ে যেত এযাত্রা, এত ভালো ট্যুর টায় খুঁত থেকে যেত।
    -"তা এখন তোদের গ্রামের পুলিশ কী করবে? লোকটা যেখানে কাজ করত সেখানে খোঁজখবর করবে তো? খনির মালিকরা নিশ্চয়ই পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরের লোক, একখানা ম্যানেজার ট্যানেজার গোছের বলির পাঁঠা জোগাড় করতে হবে। সে যাই হোক এদিককার সব তো আদিবাসী গ্রাম, তুইই তো বলিস এরা বেশ গরীব। লোকটার পরিবার যদি অন্তত কিছু টাকাকড়ি পায়। তোরা মানে আমাদের অফিস থেকে কিছু করবি না?"
    পার্থ হাসিমুখে চুপ করে শুনল রাইয়ের কথা, চান্দ্রেয়ী উঠে গেছে রান্না ঘরে, ঋক পড়ছে নিজের ঘরে।
    -"তোর কেসগুলো কী এরকমই সোজা সাপটা ছিল নাকি রে, গোয়েন্দাসাহিবা? কীরকম সরল সমাধান করে দিলি।"
    রাই হাসিমুখেই ছদ্মরাগ দেখাল,
    -"এই, ভালো হবেনা বলছি। তুইও তোর বন্ধু আর ভায়রাভাইয়ের মত আমার গোয়েন্দাগিরি নিয়ে ইয়ার্কি মারছিস। আরে আমি কী সেই গল্পের বইয়ের গোয়েন্দা নাকি? তবে সমাধান হওয়ার পরে সব কেসই সরল মনে হয়। কিন্তু মজা ছেড়ে বল না, এখানে, তোর আজকের এই ব্যাপারে জটিল কী?"
    পার্থ এবার সিরিয়াস, কপালের রেখাগুলো কোঁচকানো, অন্যমনস্কে ঠান্ডা চায়ের তলানিতেই চুমুক দেয়।
    -"যে লাশ শনাক্ত করেছে, সেই লোকটাকে ইন্সপেকটর আমার সামনেই জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। মৃত লোকটি কোনো খনিতে কাজ করত বলে তার জানা নেই। লোকটার নাম মোতিলাল, হাতরি গ্রামের, আগে কোরবায় কোন ট্রান্সপোর্টারের কাছে কাজ করত। কীসব গোলমাল হয়ে সেই কাজ চলে যায়। কদিন আগে ঠিক বলতে পারেনা ও। তবে বাড়িতে বসেছিল অনেকদিন, মাস কয়েক আগে নাকি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।
    বাড়িতে বাপ ভাইয়েরা আছে, জঙ্গলে কাঠ কাটে কেউ, কেউ ছোটখাটো মজদুরের কাজ করে, অল্প জমিও আছে। আশেপাশে খোঁজখবর করেছিল, পায়নি, মোতিলালের বউ এখন ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকে। ওর গ্রাম এখান থেকে দশ বারো কিলোমিটার হবে। ঐ মজদুরটিকেই পুলিশ বাড়ি পাঠিয়ে দিল মোতিলালের বাড়িতে খবর দিতে আর কাল সকালে ওর বাপ ভাইদের নিয়ে থানায় আসতেও বলে দিল। দেখা যাক কী জানা যায়। হয়ত দেখা গেল কয়লার ওয়াগনের সব লাশই খনি অ্যাক্সিডেন্টের ফল নয়। তবে পুলিশ খুব বেশী কিছু করবেনা, এখানে সেরকম করিৎকর্মা লোকজন কোথায়!"
    -"কয়েকমাস আগে উধাও হয়ে গেছে বললি, তাহলে এতদিন কোথায় ছিল? সেরকম হলে হয়ত ও খনিতেই কাজ করছিল এতদিন।"
    -"হুঁ, তা অবশ্য হতে পারে তবে তাহলে বাড়ির লোকে জানবেনা কেন?"
    -"জানেনা কে বলল, তোর ঐ হাতরি গ্রামের মজদুর লোকটি জানেনা, মৃত লোকটির বাড়ির লোক জানতে পারে, তার স্ত্রী যে বাপের বাড়ি আছে সে জানতে পারে। কিভাবে মারা গেছে মনে হল তোর, পুলিশ কী বলছিল লাশ দেখে?"
    চান্দ্রেয়ী এসে বসেছিল, বিরক্ত হয়ে বলল,
    -"কী টপিক নিয়ে পড়লে তোমরা তখন থেকে, একে এই দেরী করে এলে, অন্য গল্প করো।"
    রাই সম্বিত ফিরে পেল, সত্যি সে আজকাল এধরণের ঘটনা শুনলেই যেন কেমন কৌতূহল চাপতে পারেনা। পার্থ অবশ্য চান্দ্রেয়ীর কথায় কান না করে বলে,
    -"ওরে, এসব গ্রাম তোর শহরের ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, যে পড়শীরা জানবেনা বাড়ির খবর। সবাই সবার সব কথা জানে, সুখে দুখে পাশে থাকে, ঝগড়াঝাঁটি ভাব সবই সমানতালে চলে আর এদের গাঁয়ের পঞ্চ বা গাঁয়ের মাথাদের কথাতেই এরা চলে। এরা বাইরে কাজ করতে আসে ঠিকই, কিছু লোকের পরিবর্তনও যে আসেনি তা নয় তবে গ্রামে এখনো এদের সমাজযাত্রা আমাদের সঙ্গে ঠিক মেলেনা।
    তবে আমি কিছুই শিওর হয়ে বলছিনা। যদি পুলিশে পরে কিছু জানায় আমাদের তবেই জানতে পারব। আমি বা আমাদের অফিসের দায়িত্ব কিছু নেই আর, পুলিশে হ্যান্ডওভার করেই তা শেষ হয়েছে। কেসটেস হলে হয়ত একজন কাউকে যেতে হবে সাক্ষী দিতে সে ল সেল দেখবে। যাক এইসব আলোচনায় একটা কথা মনে হচ্ছে, তুই তোর কিছু অভিজ্ঞতার কথা শোনা না। আলোক একটু বলছিল সেবারে এসে, যেটুকু শুনেছি খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে।"
    এবার চান্দ্রেয়ীও রাজী, সে গল্প শুনবে, সত্যিকারের গোয়েন্দা গল্প। আরেক প্রস্থ কফি এসে গেল, তিনজনে আয়েশ করে বসল। রাই শুরু করার আগে পার্থকে বলল,
    -"আমি একটাই শর্তে তোদের গল্প শোনাব। সেটা হল তুই এই লোকটার মৃত্যু সম্বন্ধে পুলিশ যা খুঁজে বার করবে তা পুলিশের কাছ থেকে জেনে আমাকে জানাবি, সে যতটুকু ইনফর্মেশনই হোক না কেন।"
    পার্থ রাজী হল তবে বেশ খানিকটা ফাজলামি করার পরে। রাই শুরু করল তার গল্প।
    পরদিন রবিবার সকালে ওরা আবার যাবে রতনপুর, মহামায়া মন্দিরে, এদিককার খুব নামকরা মন্দির। রাইয়ের মন্দির দেখার তেমন ইচ্ছে ছিলনা তবে পথে যেতে যেতে দেশটা তো খানিক দেখা যাবে, বন জঙ্গলে ঘেরা সুন্দর রাস্তা, সবাই মিলে ফেরার পথে কোথাও বসে পিকনিক করবে। চান্দ্রেয়ী ভোর ভোর উঠে রান্না করে ফেলবে ঠিক করেছে, ওর উৎসাহই বেশী।
    উঁচু নীচু ঢেউখেলানো পিচের রাস্তা, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম, দেহাতী প্রায় সুনসান বাসস্টপ, এছাড়া রাস্তার দুধারে ঘন জঙ্গল, পাথুরে টিলা, ছবির মত সবকিছু। সুন্দর একটা সকালে ঘন্টা দুয়েক এরকম পথে চলার পরে এসে পৌঁছল ওরা রতনপুরে মহামায়া মন্দিরে। রাইয়ের খুব ভালো লাগল মন্দিরের পরিবেশ। শ্বেত পাথরের মাতৃমূর্তি, সাদা মন্দির গাছপালা ঘেরা, পুকুরে বাঁধানো ঘাট। চান্দ্রেয়ী পুজো দিল, ভীড় ছিলনা একদম যদিও ওরা বলল বারে বা পুজো ইত্যাদির সময় নাকি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। পুরোহিত ওদের সঙ্গে গল্প করল অনেক, বাঙালী দেখে নিজেই ধরে নিল ওরা আদত কলকাতার লোক। "এই মা হচ্ছেন আপনাদের কালীঘাটের মা কালীর বোন"।
    ফেরার পথে রাস্তার ধারে জঙ্গলে ছোট একটা ঝোরার ধারে বসে সঙ্গের ক্যাসারোল ভরে ভরে আনা সুখাদ্য দিয়ে পিকনিক খুব জমে গেল। রাই মনে মনে ঠিক করে নিল এর পরের বারে সপরিবারে আসবে, এমন সুন্দর জায়গা, টুপাইয়ের খুব ভালো লাগবে। দুপুর গড়িয়ে গেল ওদের ফেরার পথ ধরতে ধরতে। কাঠঘোরার ধাবায় চা পকোড়া খেয়ে রওনা হয়ে একটু এগিয়ে কী মনে হতে পার্থ বলল,
    -"এতক্ষণে নিশ্‌চয় মোতিলাল মানে কালকের লোকটার বাড়ির লোকজন থানায় এসে সব যা জানবার জানাজানি হয়ে গেছে। তোদের গাড়িতে বসিয়ে আমি একটু দেখে আসি, ইন্সপেক্টর চোরগোড়ে এমনিতে লোক ভালো, কী জানা গেল শুনে আসি।"
    রাই এতক্ষণ বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছিল কালকের কথা, এখন মনে পড়ে গিয়ে পার্থর ওপর খুশী হল। নাঃ ছেলেটার বেশ দায়িত্বজ্ঞান আছে, তাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে তৎপর দেখা যাচ্ছে। তবে রাইয়ের বোন যে বিশেষ খুশী নয় তা তার মুখের ভাব দেখে বোঝা যায়। বাধা দেয়, "কী দরকার ওসব ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে? তোমার যা করণীয় তা তো করেছ তুমি, আবার কেন?"
    -"আরে, কিছু হবেনা, একটু ঘুরে আসি। তোমরা বস।" পার্থ তর্কে না গিয়ে থানা থেকে একটু তফাতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাল্কা মেজাজে গাড়ি থেকে নেমে থানার দিকে যায়।
  • শ্রাবণী | 69.94.104.22 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ২২:২৪495849
  • *******************
    সকালে আজ অনেকগুলো কাজ ছিল। তাতাইয়ের স্কুলে যেতে হয়েছিল, শনিবার পেরেন্টস টীচার মিটিং ছিল। শ্রীমতীর আজকাল একদম ভালো লাগেনা স্কুলে যেতে, কেমন মনে হয় জোড়া জোড়া চোখের সহানুভূতির দৃষ্টি সবখানে ওর পিছু পিছু ঘুরছে। ক্লাস টীচার ওকে দেখলেই এমন করুণ কাঁদো কাঁদো মুখ করে জয়ন্তর কথা জিজ্ঞেস করে, বিরক্তিকর। তবু নিয়ম, ছেলের পড়াশোনার ব্যাপার, যেতেই হয়। এমনিতে আগেও ও একাই যেত বেশীরভাগ, জয়ন্তর কিছু না কিছু কাজ পড়ে যেত। তবে সে একা যাওয়া আর এখনের একা যাওয়ার মধ্যে অনেক তফাত। রামনিবাস আসতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, রান্নার মেয়েটাকেও থাকতে বলে গেছিল, যদি জয়ন্তর চা টার দরকার হয়। স্কুল থেকে বেরিয়ে সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান, ড্রাইক্লিনারের ওখান হয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গেল।
    গাড়ি পার্ক করে লিফটের দিকে যাবে মিসেস রাওতের সঙ্গে দেখা। সোস্যাইটির মহিলাদের সবার প্রচন্ড কৌতূহল জয়ন্তকে নিয়ে, সে কী অবস্থায় আছে, সারবে কিনা, কতদিনে, এসব নানা প্রশ্ন ঠারেঠোরে। এখানে যখন ফ্ল্যাট কিনেছিল তখন আগের অফিসে ছিল, সবাই মিলে কোঅপারেটিভ করে তৈরী, বাসিন্দারা সব মধ্যবিত্ত। ইদানীং জয়ন্তর একদম পছন্দ হতনা এ জায়গায় থাকা, একটা নামকরা বিল্ডারের সোস্যাইটিতে ডুপ্লে বুক করা হয়েছে, দুটো ইনস্টলমেন্টও দিয়েছে। কদিন আগে বুকিং ক্যানসেল করার কথা বলাতে জয়ন্ত খেপে গিয়ে একাকার। পুরো একদিন কথাই বলল না ওর সাথে।
    কোনোরকমে রাওত গিন্নীর কবল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের দরজার কাছে এসে দেখে সব চুপচাপ। কাজের লোকেদেরও কোনো সাড়াশব্দ নেই। কী মনে করে বেল না বাজিয়ে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল। রান্নাঘর বারান্দা কেউ কোথাও নেই, রান্নার মেয়েটার নাম ধরে ডাকল, সাড়া পেল না। গেল কোথায় সব? হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রেখে একটু ব্যকুল হয়েই ছেলের ঘরে ঢুকল। তাতাইয়ের পড়ার টেবিলের কাছে হুইলচেয়ারটা নিয়ে বসে আছে জয়ন্ত, সামনে ল্যাপটপ খোলা। ও অবাক হল, কতদিন জয়ন্ত কম্পিউটারে হাত দেয়না। আজ দিয়েছে তাও তার অনুপস্থিতিতে!
    বিস্মিত হলেও তা প্রকাশ না করে বলে,
    -"এরা সব গেল কোথায়? রামনিবাস, অঞ্জু?"
    জয়ন্ত ল্যাপটপের স্ক্রীন থেকে মুখ তুলে বলে,
    -" তোমার দেরী হচ্ছিল, রামনিবাসের কোথায় যেন যাওয়ার ছিল তাই আমি ওকে যেতে বলে দিলাম, অঞ্জুকেও।"
    -"ল্যাপটপ নামালো কে আলমারি থেকে?"
    -"রামনিবাস। ওকে বললাম, কানেকশন টানেকশন ওকে বলে দিতে ঐ করে দিয়ে গেল। খালি বসে থাকতে বোর লাগছিল।"
    শ্রীমতী দেখল স্ক্রীনে তাসের গেম। যাক তবু কম্পিউটার খুলল, এখন টিভি দেখা শুরু করলে আরো ভালো হয়। আগে নিউজের পোকা ছিল, বাড়িতে থাকলেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেশবিদেশের খবর শুনবে, এখন খুললে বিরক্ত হয়। ও খুশী হয়ে জামাকাপড় বদলাতে গেল। জয়ন্ত কম্পিউটার বন্ধ করে আস্তে আস্তে হুইলচেয়ার নিয়ে বারান্দায় গেল। তাই দেখে শ্রীমতী চা বসালো।
    -"রামনিবাসরা চলে যেতে তুমি দরজার লক লাগালে?"
    -"হুঁ।"
    -"ডাক্তার তো বলছিলেন আগের দিন এবার ঐ স্ট্যান্ডটা ধরে আস্তে আস্তে একটু চলার চেষ্টা করতে।"
    এবার জয়ন্তকে একটু বিরক্ত দেখালো,
    -"আমি এখনো ঠিকমত উঠে দাঁড়াতে পারছিনা শ্রী, জোর পাই না, আর তুমি চলার কথা বলছ।"
    শ্রীমতী লজ্জা পায়, না বললেই পারত। আস্তে আস্তে সব হবে, সে আজকাল কি খুব অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে।

    দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল একটু। ঘুম থেকে উঠে দেখল জয়ন্ত তার আগেই উঠেছে, তাতাইয়ের সঙ্গে গল্প করছে স্কুলের ক্রিকেট টিম নিয়ে। মনটা হালকা হয়ে গেল, এখানে ওখানে ফোন করল, কলকাতায় দিদিকে, দু একজন পুরনো বন্ধুকে। রাইকেও ফোন করল, ওর বর আলোক ধরেছিল। সন্ধ্যেবেলায় জয়ন্তর সঙ্গে কথা হচ্ছিল,
    -"জানো, রাইকে ফোন করেছিলাম। ও নেই, আলোকদা ধরেছিল, বলল রাই ফিরলে আসবে একদিন তোমার সাথে আড্ডা মারতে।"
    জয়ন্ত শুনছিলনা ঠিক, একটা কাগজ নিয়ে কী সব আঁকিবুঁকি কাটছিল,
    -"জান, রাই বিদ্যুতনগরে গেছে অফিসের কাজে।"
    এবার জয়ন্ত ওর দিকে চাইল। শ্রীমতী আবার প্রমাদ গণে, সকাল থেকে খুশীর চোটে ও আজ একটু ভুলভাল কথা বলে ফেলছে, বিদ্যুতনগর নামটা নেওয়া বোধহয় ঠিক হলনা। জয়ন্ত কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলে,
    -"দাসানিরাও তো ঘুরে এসেছে বলছিল। তা এরপরে ওদের নাহয় রাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিও, গোয়েন্দা মানুষ, ওদের তদন্তে সাহায্য হতে পারে।"
    মজা করেই হয়ত বলা তবু শ্রীমতীর গলাটা ঠিক ভালো লাগল না। ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল।

    রাতে বিছানায় দেখল তাতাই জয়ন্তর মোবাইলটা চার্জ করে এনে বাবাকে দিচ্ছে, এতদিন মোবাইলটা বন্ধ ছিল। তাতাই মাঝে মাঝে চার্জ করে আবার বন্ধ করে দিত।
    ঘুমিয়ে শ্রীমতী স্বপ্ন দেখল, টেলিফোনের আওয়াজ, সেই পুরনো দিনের কালো যন্ত্রের একটানা জোরালো ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে যেতে টুংটাং টুংটাং থেকে গানের সুর মোবাইলের রিংটোন।
  • শ্রাবণী | 69.94.104.22 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ২২:৩১495850
  • ****************************************************
    উঠোনের এক ধারে তার চার বছরের ছেলেটা খেলছে দু তিনটে বাচ্চার সঙ্গে। ঘরের সামনে যে নিম গাছটা আছে তার তলায় একটা মাটির নিকোনো বেদী, সেখানে মঙ্গলার বাপ, শ্বশুর আর গাঁয়ের কয়েকজন বুড়ো বুজুর্গ বসে আছে। কাল সকালে হাতরি থেকে ছোট দেবর সুখলাল গিয়ে খবর দিতে মঙ্গলার বাপ তাদের মা বেটাকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছে। আসার পথে তারা থানা হয়ে এসেছে। সে চুপচাপ দেখেছে তার মরদের লাশ, বাপ হায় হায় করছিল কিন্তু সে একটুও কাঁদেনি। হাতরিতে আসার পর বাড়ির সবাই, গাঁয়ের মেয়েরা তাকে ধরে কাঁদতে গেলে সে চুপ থেকেছে, এখনো তার শুকনো চোখ।

    বিয়ের সময় মোতিলাল কোরবায় কাজ করত, তাই অনেক পণ নিয়েছিল এরা। রুপোর গোট হার, বাজুবন্ধ, ঝুমকো,সোনার নথনি, বাসন, মোটরবাইক চেয়েছিল, বাপ দিতে পারেনি, সাইকেল দিয়েছিল। তাই নিয়ে খুব কথা শোনাত মোতিলাল, মারতও খুব।
    এমনিতে অবশ্য খারাপ ছিলনা, ছেলেকে খুব ভালোবাসত, এই গাঁয়ের হিসেবে বড়মানুষী চাল দেখাতে ভালোবাসত। সেই করেই রোজগারের সব পয়সা বেরিয়ে যেত, ঘরে টিভি এনেছিল, সেকেন্ডহ্যান্ড বাইক কিনেছিল। দারুও খেত খুব, এমনি গাঁয়ে দিশী দারু চলে, সবাই রস খায় কম বেশী এমনে বা উপলক্ষ্যে। মোতিলাল তার শহরের বন্ধুদের সঙ্গে বাবুদের দারু খেত মাঝে মাঝে। তবে তা নিয়ে মঙ্গলার বা বাড়ির কারোর কোনো আপত্তি ছিলনা। মোটের ওপর গ্রামের হিসেবে মোতিলাল একজন ভালো মানুষ ও মঙ্গলার মত মেয়েদের হিসেবে ভালো বর ছিল
    মালিকের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে চাকরীটা যখন চলে গেল প্রথমটায় মুষড়ে পড়লেও এটাসেটা নানা কাজ করে পয়সার কোনোদিন অসুবিধে হয়নি। একটু শহরের দিকে গেলে এসব অলে এখন কাঁচা পয়সা উড়ছে, খাটলে রোজগারের অনেক উপায় আছে। আরেকটা কাজ পাবার কথা চলছিল, এ পর্যন্ত সবই স্বাভাবিক।

    তারপরেই গোলমাল শুরু হল, নাকি শুরু আগেই হয়েছে মঙ্গলা টের পায়নি! কদিন ধরে মোতিলালের ঘরে ফেরার কোনো ঠিকঠিকানা রইল না। মঙ্গলা নিজে কিছু এমন শান্ত সুবোধ ছিলনা, শাশুড়ী ও অন্য বউদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত, তার বর অন্যদের থেকে কাঁচা পয়সা বেশী আনে ঘরে, দেমাকও তার তাই বেশী। বেটাছেলে রোজগেরে হলে বাইরে কতক্ষণ থাকছে না থাকছে তা নিয়ে তাদের সমাজে কেউ অত মাথা ঘামায় না, মঙ্গলাও ঘামায়নি। শুধু মোতিলাল ঘরে যতক্ষণ থাকত কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে থাকত, মারধোর মেজাজও তেমন করছিল না। সে ভেবেছিল তবিয়ত খারাব বোধহয়, তা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বকুনি খায়।

    সেদিন সকাল সকাল রোটি দাল বানাতে বলল, তাই নিয়ে মঙ্গলার ঝগড়া হয়ে গেল শাশুড়ীর সঙ্গে। অন্য সবাই আগের রাতের ভাত খেয়ে বা নিয়ে কাজে যায়, তাই অত সকালে চুলহা ধরেনা ঘরে। মঙ্গলা চুলহা ধরাতে গেলে শাশুড়ী সবার জন্যে রোটি বানাতে বলল, তাই নিয়ে দুজনে লেগে গেল। শেষমেশ মোতিলাল না খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, বলল দোকানে খেয়ে নেবে। সেদিন অবশ্য বলে গিয়েছিল তাকে যে রাতে ফিরবে না, পালি যাচ্ছে দোস্তদের সাথে কী কাজ আছে।
    পরদিন বাড়ির লোকে খোঁজ নিতে মঙ্গলা সবাইকে তাই বলেছিল, পালি গেছে কাজে।
    তিনদিন কাটার পর সে নিজে ও বাড়ির আর সবাই চিন্তায় পড়ল। তারপরে খোঁজখবর নেওয়া শুরু, পালি গিয়েও খুঁজে এল লোকে। যেখানে আগে কাজ করত সেখানে, পুরনো দোস্তদের কাছে, কেউ কিছুই বলতে পারল না। ঘরে তখন নিত্য অশান্তি, মোতিলাল একমাত্র বউ মঙ্গলাকেই বলে গেছে, আর কাউকে কিছু বলেনি। সবাই সন্দেহ করল মঙ্গলা সব জানে, কিছু বলছেনা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কিছু হয়েছে বলে হয়ত মোতি ওকে ছেড়ে অন্য কারুর কাছে চলে গেছে। রোজগেরে ছেলে, বাড়িতে পয়সাকড়ি দিত, মা বাপ ভাইয়েদের খুব লাগছিল। উঠতে বসতে তারা মঙ্গলাকে গঞ্জনা দিতে থাকল।

    মঙ্গলা প্রথম দিকটা হতভম্ব হয়ে চুপ করে সইলেও, দুদিন গেলে সেও কোমর বেঁধে ঝগড়া করল যে বাপ ভাইয়েদের খোরাক জোটাতে গিয়ে সব পয়সা শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখেই তার বর ঘর ছেড়ে চলে গেছে।
    তখন মঙ্গলা এমনটা বিশ্বাসও করেছিল, কারণ মোতিলাল প্রায়ই আলাদা হয়ে কোরবায় গিয়ে থাকার কথা বলত, ছেলে কানহাকে ভালো ইস্কুলে পড়ানোর কথা বলত। মঙ্গলারও সায় ছিল, এই নতুন কাজটা পেলে ওরা গ্রাম ছেড়ে চলে যেত।
    শেষমেশ মঙ্গলা ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। সেখানেও খুব শান্তি নেই, ভাইয়েদের সংসার আছে, তারা বোনকে চিরকাল রাখবেনা, যতদিন মা বাপ আছে ততদিন। বাপের কিছু জমিজায়গা আছে, শ্বশুরবাড়ীর থেকে অবস্থা ভালো।
    মঙ্গলা যে বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করছেনা সেটা সবার খেয়াল হয়েছে, তাই নিয়ে সবাই কানাঘুসো কথাও বলছে তবে সে নিজে তাতে কান দেয় না। তার মনে এখন অন্য চিন্তা।

    সে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে বাপ যেখানে বসে আছে সেদিকে। বাপ একবার তার দিকে তাকাতে সে ইশারায় বাপকে তার কাছে আসতে বলে।
    বুড়োমানুষ আস্তে আস্তে উঠে এসে প্রথমে উঠোনে নাতিকে একহাতে ধরে, সে খেলায় ব্যস্ত, দাদুর হাত ছাড়িয়ে দৌড়য় সাথীদের সঙ্গে। মেয়ের কাছে এলে মঙ্গলা চাপা গলায় বলে,
    -"কী বলছে তোমাকে ওরা?"
    -"সেরকম কিছু না, তোর শ্বশুর খুব ভেঙে পড়েছে, জলজ্যান্ত ছেলেটা।"
    -"ভেঙে পড়ুক, তুমি কিন্তু ওদের কিছু বলবে না। মানুষটাকে মেরে ফেলে এখন কান্না হচ্ছে। আমি এখানে থাকব না, কথা উঠলে আমাদের সব জিনিস নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে। টিভিটাও আমরা নিয়ে যাব, কানহার বাপু কিনেছিল, সব জিনিস কানহার।"
    -"সে নাহয় যাবি, কিন্তু এতো কানহার বাড়ি, এখানে আর ফিরবিনা?"
    -"না, আমরা এখানে থাকব না। তুমি যদি থাকতে না দাও আমি আলাদা থাকব, কাম করে খাব।"
    মেয়ের জ্বলন্ত দৃষ্টি দেখে বাবা আর কথা বাড়ায় না, শুধু বলে
    -"আগে পুলিশ লাশ ছাড়ুক, দাহ হোক, তারপরে এসব কথা হবে নাহয়। আমার এখন কিছুই মাথায় ঢুকছেনা, কে মারল বা কিভাবে মরল মোতি। এই সেদিনও তো তোর সাথে.... "
    মঙ্গলা অজান্তে গলা তুলে ফেলল এবার,
    -"চুপ। একেবারে চুপ কর বাপু, কাউকে কিচ্ছু বলবিনা, খবর্দার কাউকে না। মুখ দিয়ে একটা কথাও যেন বার না হয়।"
    বলেই চারদিকে তাকালো, আশেপাশে কাউকে দেখছেনা, কেউ কিছু শুনে ফেলল নাকি!
    যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাপুকে আর কানহাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবে সে, বুক ভেঙে যাচ্ছে তবু মুখ শক্ত করে বসে রইল।
  • - | 24.99.209.66 | ১০ জানুয়ারি ২০১৩ ১২:২৭495852
  • তারপর?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন