এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ২৪৩৩৫০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • m | 012312.60.900.191 | ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৫১541285
  • Malay Roychoudhury <[email protected]>

    Sat, Dec 8, 11:05 AM

    to bapinmail

    মলয় রায়চৌধুরী

    অবন্তিকার শতনাম
    অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া…

    এক্সট্রা লার্জ মাই বলে ও বলে ওগুলো বাঁট...

    বড়ো-বড়ো মাই বলে কতো গর্ব...

    বড়ো মাই না থাকলে নাকি গরবিনী হওয়া যায় না...

    বাঁদিকেরটা আদর করলেই গোলাপি হয়ে যায়…

    ডানদিকেরটা আদর করলেই হলদেটে রঙ ধরে…

    বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী…

    বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে…

    ডানদিকের বোঁটার নাম ও নিজেই রেখেছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার...

    যে লোকটা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ডিটেকটিভ…

    ডিটেকটিভ বই পড়তে ওর জুড়ি নেই…

    ছুঁলেই কাঁটা দিয়ে ওঠে তাই…

    যোগেন চৌধুরীর আঁকা ঝোলা মাই ওর পছন্দ নয়…

    প্রকাশ কর্মকারের আঁকা কালো কুচকুচে মাই ওর পছন্দ নয়…

    পেইনটিঙের নাম রাখা গেল না…

    যোনির কি নাম রাখবো চিন্তা করছিলুম…

    অবন্তিকা চেঁচিয়ে উঠলো পিকাসো পিকাসো পিকাসো…

    পিকাসোর যোনির কোনো আদল-আদরা নেই…

    কখনও বাদামি চুল কখনও কালো কখনও কিউবিক রহস্য…

    তাহলে ভগাঙ্কুরের…

    ও বলল সেটা আবার কি জিনিস…

    ওর হাত দিয়ে ছুঁইয়ে দিতে বলল অমঅমঅমঅম কি দেয়া যায় বলতো…

    পান্তুয়া চলবে…ধ্যুৎ…রস পানেই পান্তুয়া নাকি আরও কতো রকম মিষ্টি হয়…

    ছানার পায়েস…নারকেল নাড়ু…রসমালাই…নকশি পিঠা…রাজভোগ…লবঙ্গলতিকা…

    হলদিরামে ভালো লবঙ্গলতিকা পাওয়া যায়…

    আমি বললুম যোনির স্বাদ কিছুটা নোনতা…

    ও বলল দুর ছাই আমি নিজে টেস্ট করেছি নাকি যাকগে বাদ দে…

    তোর গুদে দুদিকেই তিল আছে...দারুন...

    জানি...জানি...হেয়ার রিমুভার লাগাবার সময়ে দেখি তো...

    একটার নাম দিই ওগো বধু সুন্দরী...

    অন্য তিলটার নাম দিই বনলতা সেন...

    যখনও স্বপ্নে বনলতে সেনকে দেখি তিলটা দেখতে পাই...

    রাসকেল...বনলতা কেন...আমার তিল দেখলেই তো পারিস...

    না...তোকে দেখলে নাইটফল হয়...তাহলে গুদ ছেড়ে এগোই...

    যোনির চেয়ে গুদ কেমন বিটকেল শুনতে...না রে...

    যেন দুধ ভরা উটের বাঁট...উটের দুধ বেশ ঘন হয়...

    যাকগে এবার এগো দিকিনি...

    হ্যাঁ…এগোই…পাছার কি দুটো নাম হবে…

    ডিসাইড কর…ডিসাইড কর…

    তুই কর আমি তো দেখতে পাচ্ছি না…না না ফের ফের…

    লাবিয়া নোনতা হলেও ওটার নাম দিলুম গোলাপসুন্দরী…

    পারফেক্ট হয়েছে…তাহলে পাছার একটাই নাম দিই…

    নরম নরম কোনো নাম…পাসওয়র্ড…ঠিক…এর নাম দেয়া যাক পাসওয়র্ড…

    ধ্যাৎ…পুরো রোমান্টিক আবহাওয়া ফর্দাফাঁই করে দিচ্ছিস……

    গ্যাস পাস হয় বলে পাসইয়র্ড হতে যাবে কেন…ছিঃ…

    তাহলে এর নাম হোক গরমের ছুটি…

    গরমে বেশ ভাল্লাগে পাউডার মাখিয়ে পাছায় হাত বোলাতে…

    ওক্কে…তারপর…ঘুমোবো কখন…

    বাঁ উরুর নাম দিই ককেশিয়া…ডান উরুর নাম দিই লিথুয়ানিয়া…

    রাশিয়ানদের উরু দারুণ হয় বিশেষ করে শীতকালে যখন ওরা চান করে না…

    ভোদকা খেয়ে ভরভরিয়ে প্রতিটি রোমকুপ দিয়ে গন্ধ ছাড়ে…

    শুয়েছিস নাকি কখনও রাশিয়ান মেয়ের সঙ্গে…

    না কল্পনার যুবতীদের ইচ্ছেমতন হ্যাণ্ডল করা যায়…

    ছাড় ছাড়…এগো…মানে নামতে থাক…

    তাড়াতাড়ি কর নইলে গাধার দুলাত্তি দেবো…

    তা্হলে পায়ের নাম রাখছি জিরাফ…

    বামপন্হী জিরাফ আর দক্ষিণপন্হী জিরাফ…

    এবার ওপরে আয়,,,মুখে…ঠোঁট…ঠোঁটের নাম দিই আফ্রিকান সাফারি…

    আচ্ছা…ঠোঁটের নাম আফ্রিকান সাফারি…

    ব্লোজবে খণ্ড খণ্ড মাংস ছিঁড়ে খাবো…খাস…

    থুতনিতে সেকেন্ড চিন…পিৎজা কোক খাওয়া থামা…

    থুতনির নাম দিই গোলাপজাম…কেন কেন কেন…

    পরে বলব…এখন দুচোখের নামদিই…শতনাম হলো না তো…

    চোখ বোজ চোখ বোজ…

    তোর চোখের তিলের নাম দিলুম অ্যানাকোণ্ডা...

    সেই সাপের জুড়ি নেই...অমন যদি পেতুম...

    জানি...তুই হৃদয় পর্যন্ত পোঁছে দিতিস তোর শৌর্য...

    যাকগে...রাত অনেক হল...একশো নাম তো হল না...

    তুই তো একশোসমগ্র আবার শতনামের কী দরকার…

    ন্যাপকিন কিনিস এক্সট্রা লার্জ মাপের...

    তাহলে আয়…আজ তুই ওপরে না নিচে ?

    s
  • m | 012312.60.900.191 | ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৫৪541286
  • 'দেশ প্রেমের ব্যাপার'
    মলয় রায়চৌধুরী

    মার শালাদের
    মার মার ওটা পালাচ্ছে
    ধর ধর ধর ধর
    তুই ওটাকে ধর
    আমি এগুলোকে সামলাচ্ছি
    পোঁদে লাধি মার চুতিয়াটাকে
    না না বিচিতে মার
    প্যাণ্ট খুলে নে বাঞ্চোৎটার
    ঢুকিয়ে দে ক্যালা না কি তুই
    ঢোকাতে পারছিস না
    মাটিতে ফেলে দে দনাদ্দন
    নাক ফাটিয়ে দে
    তোর তো ঘুষির জোর আছে
    একটাকেও পালাতে দিসনি
    কেস খাওয়ানো দেখাচ্ছিল গাণ্ডুগুলো
    চেনে না আমরা কোন কেউটের
    পেট থেকে বেরিয়েছি
    ন্যাপালা দেখাচ্ছিল রাণ্ডির বাচ্চা
    সব কটাকে ল্যাংটো কর
    বলছি তো কেউ আমাদের
    বালও ওপড়াতে পারবে না
    লাশ ফেলা কাকে বলে দেখাচ্ছি
    মন্ত্রীর বাপ দেখাচ্ছিল
    দেখে যাক যাদের দেখবার
    চল চল
    এদের এখানে পড়ে থাকতে দে
    শীতের শিশিরে ভেজার আনন্দ নিক
    কুত্তির বাচ্চাগুলো
  • m | 012312.60.900.191 | ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৫৭541287
  • প্রথম পর্ব : ষড়যন্ত্র : মারণ
    ( কোরাণ ও গীতা : পুনঃপাঠ )
    মহম্মদ কহিলেন : হে আবুবক্কর ! মদিনা ্‌ইতে এই বিশাল সৈন্যবাহিনী লইয়া যে উদ্দেশ্যে হেথায় আসিয়াছি, তাহা বুঝি আর সফল হইল না । দেখো, সন্মুখসমরে আজ আমারই কোরেশ বংশের বংশজগণ । আর দেখো, উভয় সেনার মধ্যে আমারই পিতৃব্যগণ পিতামহগণ আচার্য্যগণ মাতুলগণ ভাতৃগণ পুত্রগণ পৌত্রগণ মিত্রগণ শ্বশুরগণ সুহৃদগণ অবস্হান করিতেছেন । আমি কাহাকে হত্যা করিব ? হে আবুবক্কর ! যুদ্ধেচ্ছু এই সকল স্বজনদিগকে সন্মুখে অবস্হিত দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ শুষ্ক হইতেছে । ইহা সত্য যে, ৩৬০টি প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়া ইহারা যুগযুগান্ত ধরিয়া আরববাসীগণকে প্রতারিত করিতেছে, আর ওই প্রতীকগুলির সাহায্যে পুরাতন জীবনব্যবস্হায় তাহাদিগকে মোহগ্রস্হ করিয়া রাখিয়াছে, তাহাদের ধনসম্পদ ভোগ করিতেছে । ইহাও সত্য যে, আমি এই বংশেরই এক কনিষ্ঠতম ও অবহেলিত অবক্ষিপ্ত উত্তরাধিকারী, এক দুয়ো-রাজকুমার । তথাপি এক্ষণে ইহাদিগকে সমরাঙ্গনে সন্মুখস্হ দেখিয়া আমার হস্তপদ অবসন্ন হইয়া আসিতেছে ।

    আবুবক্কর কহিলেন : অয় মুহম্মদ ! এই সঙ্কট সময়ে স্বর্গহানিকর অকীর্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্হিত হইল ? এ যুদ্ধ স্বার্থপ্রণোদিত নহে, ইহা জেহাদ, ধর্মযুদ্ধ । হে পরন্তপ ! তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া যুদ্ধার্থে উথ্থিত হও ! জেহাদ অপেক্ষা ইমানদার মোমিনের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছুই নাই । হে ধনঞ্জয় ! এই যুদ্ধ জগৎপিতার নিয়মে স্বয়ং উপস্হিত হইয়াছে । ইহা আমাদের নিমিত্ত জন্নাতের দ্বার উন্মুক্ত করিবে । অতএব যুদ্ধার্থে উথ্থিত হও । অন্যথায় মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশত যুদ্ধে বিরত হইতেছ, দয়াবশত নহে । সুতরাং যাহারা তোমাকে বহু সন্মান করেন, তাহাদিগের নিকট তুমি লঘুতাপ্রাপ্ত হইবে । তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবাচ্য কথা বলিবে । তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কী আছে ? এক হস্তে অধর্মের বিনাশ ও অপর হস্তে ধর্মের প্রতিষ্ঠা নিমিত্ত তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ধর্মভ্রষ্টদিগকে হত্যা করিতে দ্বিধা কিসের ? সুতরাং হে সব্যসাচী, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উথ্থান করো।

    সব্যসাচী কহিলেন : ইহা সত্য যে, ইহারা ধর্মভ্রষ্ট । এই কৌরবগণ আমাদিগের ন্যায় ইক্ষাকু বংশজ হইলেও ইহারা ধর্মের অমর্যাদা করিয়াছে । প্রজাপালন বিষয়ে ইহাদিগের দুঃশাসনের কোনও সীমা নাই । ইহাও সত্য যে, আমরা এই বংশেরই অবহেলিত অবক্ষিপ্ত উত্তরাধিকারী, এই রাজবংশের দুয়ো-রাজকুমার এবং ইহারা আমাদিগকে আশৈশব প্রবঞ্চনা করিয়া আসিতেছে, সাধারণ প্রজাদিগের তো কথাই নাই । সেই হেতু ধর্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থেই ইহাদিগকে ক্ষমতাচ্যুত করা প্রয়োজন । কিন্তু এতৎসত্বেও, স্বজন ও গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কীরূপে প্রাণধারণ করিব, এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত হইয়া চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইতেছি । প্রকৃত ধর্ম কী, এ বিষয়ে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইতেছে । ধর্মপ্রতিষ্ঠার নিমিত্ত এ আমি কাহার হত্যাকারী হইতে চলিয়াছি ? অতএব হে কৃষ্ণ ! যাহাতে শুভ হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বলো !

    শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন : প্রকৃতপক্ষে তুমি কাহারও হত্যাকারী নহ। স্বজন বা গুরুজন যাহাই হউন, যাহারা অন্যায়কারী, প্রজাবৃন্দের প্রতি নির্দয়, অচলায়তন রূপে সমাজের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাঁহারা ধর্মভ্রষ্ট হইয়াছেন । কাল সমুপস্হিত হইলে স্বয়ং শিব ধর্মভ্রষ্টদিগের মহিমাহরণ করিয়া তাহাদিগকে হনন করিয়া রাখেন । এক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছে, তুমি নিমিত্তমাত্র । সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য, স্বজন ও গুরুজনদিগের উপর বাণনিক্ষেপ করিলে কদাচ অধর্ম হয় না। সুতরাং, তুমি নিঃসংশয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও । যাহারা সত্যের নিমিত্ত ধর্মের নিমিত্ত পিতৃব্য ও পিতামহ প্রভৃতি স্বজনগণকে নিকেশ করিতে দ্বিধা করেন না, তাহারাই প্রকৃত ধার্মিক । ইতিহাস তাহার সাক্ষী । অতএব, হে পাশুপতধারী মোমিন ! হে দুয়ো-রাজকুমার ! হে বংশদ্রোহী! তুমি যুদ্ধ করো ।

    Posted by Malay Roychoudhury at 7:37 AM No comments: Email ThisBlogThis!Share to TwitterShare to FacebookShare to Pinterest
    Labels: Anti-Establishment, Kalim Khan, Malay Roychoudhury, Poetic Theory, আভিধানিক, কলিম খান, মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাসমগ্র
    দ্বিতীয় পর্ব : ষড়যন্ত্র : মোহন
    ( দেবীপুরাণ : পুনঃপাঠ )
    ঋষিগণ কহিলেন : হে পণ্ডিতপ্রবর ! যথার্থ পথপ্রদর্শক নেতাই গুরুপদবাচ্য । তাঁহাকে সম্যকরূপে অবগত না-হইয়া তাঁহার অনুসরণ করা উচিত নহে । ইহা জানিয়াও অসুরগণ কী প্রকারে ভুল নেতৃত্বের দ্বারা প্রবঞ্চিত হইলেন, এক্ষণে সে বিষয়ে আমাদিগের কৌতূহল নিবারুণ করুন ।

    বৈশ্যম্পায়ন কহিলেন : বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য উভয়েই ভৃগুর সন্তান হইলেও তাঁহাদের অভিমত ভিন্ন ছিল । সেই কারণে সুরাসুর সংগ্রামে তাঁহারা যথাক্রমে দেবতা ও অসুরগণের পরামর্শদাতারূপে তাহাদের গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন ।

    একদা অসুরগণকে সংযত থাকিতে বলিয়া শুক্রাচার্য্য তপস্যার উদ্দেশ্যে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করিলেন । একথা জানিতে পারিয়া দেবগুরু বৃহস্পতি স্বল্পকাল অতিবাহিত হইলে শুক্রাচার্য্যের রূপ ধারণপূর্বক তথায় উপস্হিত হইলেন । তাঁহাকে সমুপস্হিত দেখিয়া অসুরগণ তাঁহাদিগের গুরুদেব প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন, এইরূপ প্রত্যয় করিল এবং তাঁহাকে পাদ্য অর্ঘ্য দানে যথাবিহিত সন্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁহার উপদেশের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল । অনন্তর শুক্রাচার্য্যরূপী বৃহস্পতি তাহাদিগকে বলিলেন, বৈরিতা কুলক্ষয়ের কারণ । বৈরিতার কারণ বাসনা, অতএব বাসনা পরিত্যাগ করো । বাসনা না থাকিলে কেহই তোমাদিগকে বশীভূত করিতে পারিবে না । অতএব তোমরা বাসনামুক্ত হও, মস্তকমুণ্ডনকরতঃ গৈরিক বস্ত্র ধারণ করিয়া আচারনিষ্ঠ হও । আচারনিষ্ঠগণকে দেবতাও জয় করিতে পারিবে না । গুরুদেবের আদেশ শিরোধার্য করিয়া অসুরগণ তাহাই করিতে লাগিলেন । ইহার ফলে তাহাদিগের হৃদয় হইতে অসূয়াভাব ক্রমে তিরোহিত হইতে লাগিল ।

    ইট্যবসরে, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্য তাঁহার তপস্যা সমাপনান্তে তথায় সমাগত হইলেন । দেবগুরু বৃহস্পতিকে অসুরগণের গুরুপদে অধিষ্ঠিত দেখিয়া তিনি যারপরনাই বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া অসুরগণকে কহিলেন--- এ কাহাকে তোমরা আমার আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছ ? ইনি যে দেবগুরু বৃহস্পতি, তাহা কি তোমরা উপলবদ্ধি করিতে পারো নাই ? তোমাদিগকে বিপথগামী করিবার জন্য আমার অনুপস্হিতির সুযোগ গ্রহণ করিয়া এ প্রবঞ্চক তোমাদিগের সহিত প্রতারণা করিয়াছে । ইনি আমাদিগের ন্যায় স্বর্গদ্রোহী নহেন । তোমাদের নেতার আসন গ্রহণ করিয়া তোমাদের সংগ্রামকে ধ্বংস করাই এই প্রতারকের একমাত্র উদ্দেশ্য ।

    ইহা শুনিয়া শুক্রাচার্য্যরূপী বৃহস্পতি কহিলেন : হে অসুরগণ! অবধান করো ! আমার উপদেশে তোমরা অজেয় হইতে চলিয়াছ দেখিয়া দেবগুরু বৃহস্পতি তোমাদিগকে প্রতারণা করিবার উদ্দেশ্যে এক্ষণে আমার রূপ ধারণ করিয়া তোমাদিগের সন্মুখে উপস্হিত হইয়াছেন । ইনি দেবগুরু বৃহস্পতি । অবিলম্বে ইহার মুখে চুনকালি দিয়া গর্দভের পৃষ্ঠে আরোহন করাইয়া পশ্চাতে হ্ল্লা লাগাইয়া দাও এবং বিতাড়ন করো । অসুরগণ তাহাই করিল ।

    কিয়ৎকাল অতিবাহিত হইলে, অসুরগণ একদিন হৃদয়ঙ্গম করিল, তাহারা প্রবঞ্চিত হইয়াছে । কিন্তু তখন তাহাদিগের আর কিছুই করিবার রহিল না ।

    এইভাবে অসুরগণ ছদ্ম-দেবদ্রোহীকে তাহাদের নেতারূপে বরণ করিয়া মোহগ্রস্ত হইয়াছিল এবং সম্পূর্ণরূপে প্রবঞ্চিত হইয়াছিল ।
    Posted by Malay Roychoudhury at 6:51 AM No comments: Email ThisBlogThis!Share to TwitterShare to FacebookShare to Pinterest
    Labels: Anti-Establishment, Kalim Khan, Malay Roychoudhury, আভিধানিক, কলিম খান, সাহিত্য আলোচক
    তৃতীয় পর্ব : ষড়যন্ত্র : স্তম্ভন
    ( মুক্তধারা : পুনঃপাঠ )
    এক যে ছিল রাজা । তার ছিল দুই রানি, সুয়োরানি আর দুয়োরানি। সুয়োরানি সুখে থাকে রাজপ্রাসাদে আর দুয়োরানি থাকে বনের প্রান্তে, ছোট নদীর ধারে, কুঁড়ে ঘরে। দুয়োরানির ছেলে সেই নদীতে নৌকাবায় । পারানির কড়িতে তাদের দিন কাটে । কিন্তু একদিন তার সাধের নদী শুকিয়ে গেল । কারণ, দেশের রাজ-বিভূতি বাঁধ বেঁধেছেন । কেবল জলধারা নয়, ঈশ্বরের করুণার সকল ধারার সামনেই বাঁধ বেঁধেছেন তাঁরা । লোকে বিস্বাসই করতে পারল না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন, কোনও মানুষ তা বন্ধ করতে পারে । কিন্তু বন্ধ হল, করুণাধারার সব শাখাই ক্রমশ শুকোতে লাগল, আর প্রজাদের জীবন উঠল অতীষ্ঠ হয়ে । এদিকে একদিন দুয়োরানির ছেলে জানতে পারল সে রাজপুত্তুর । সে গেল রাজার কাছে, বললে, রাজপুত্রের অধিকার চাইনে । কেবল ঈশ্বরের করুণাধারার সামনে দেয়া তোমাদের ওই বাঁধগুলো খুলে দাও, এই প্রার্থনা । শুনে সুয়ো-রাজপুত্রেরা অবাক হলো । তারা সেপাই ডাকল, সান্ত্রী ডাকল । ঘাড়ধাক্কা দিয়ে রাজবাড়ি থেকে বার করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো রাস্তায় ।

    ধুলো ঝেড়ে সে উঠে দাঁড়াল । তারপর গেল শিবতরাইয়ের প্রজাদের কাছে । সেখানে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল । সে দেখল, ধনঞ্জয় বৈরাগীর ছদ্মবেশে সুয়োরানির এক ছেলে । আর, তার পেছনে শিবতরাইয়ের মানুষগুলো চলেছে মুক্তধারার বাঁধ ভাঙতে । তখন সেই দুয়ো-রাজকুমার সবাইকে ডেকে বলতে লাগল, ওই বৈরাগী আসল বৈরাগী নয়, ও তো ছদ্মবেশী সুয়ো-রাজকুমার, ও তোমাদের ঠকাবে । এক নদীর মুখেই ওরা বাঁধ বাঁধেনি । সর্বহারার মুখেই ওরা বাঁধ বেঁধেছে । সেগুলি ভাঙতে হলে, তাদের রহস্য জানতে হবে । সেসব আমি জেনে এসেছি । আমার কথা শোনো । কিন্তু দু'চারজন আধপাগলা ছাড়া কেউ তার কথায় কান দিল না ।

    কথাটা গেল মিথ্যে-বৈরাগীর কানে, সে বললে -- ওটা বদ্ধ পাগল । ছন্নছাড়া । খেতে পায়না, হাংরি, তাই মিথ্যে কথা বলে । ওর মুখে চুনকালি মাখিয়ে গর্দভের পিঠে চড়িয়ে পিছনে ভিড়ের হল্লা লাগিয়ে দাও । মজা পেয়ে প্রজারা তাই করলে ।

    এরপর গাধার পিঠে সওয়ার দুয়ো-রাজকুমারের আর কিছুই করার রইলো না । তাই সে কেবল চিৎকার করে । চিৎকারের জন্য চিৎকার । চিৎকারের ভিতরে চিৎকার । চিৎকার করতে করতে একদিন সে বিস্মৃতিলোকে চলে গেলো ।

    তারপর অনেকদিন কেটে গেলে, শিবতরাইয়ের প্রজারা বুঝল তারা ঠকেছে । অতএব, তারা খোঁজ করতে লাগল সেই দুয়ো-রাজকুমারের, যে জানত সব বাঁধের রহস্য । কিন্তু তাকে আর পাওয়া গেল না । তখন যে আধপাগলারা সেসময় তার কথা শুনেছিল মন দিয়ে, তাদেরকে ধরা হলো । বাঁধ ভাঙার রহস্য ওই আধপাগলারা দুয়ো-রাজকুমারের কাছ থেকে জেনে-বুঝে নিয়েছিল কি না, সেটা জানার জন্য । কিন্তু কেউই সেসব কথা ঠিকঠাক বলতে পারল না ।

    রাজপ্রাসাদ থেকেও দুয়ো-রাজকুমারের খোঁজখবর করা হলো । কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না, পাওয়া গেল তার গাধাটাকে । তাকেই নিয়ে এসে ফুলমালা দিয়ে চন্দনের টিপ পরিয়ে রাজসভায় আনা হলো । রাজা সেই গাধাটাকেই শিরোপা দিলেন আর রাজপুরোহিত দিলেন আশীর্বাদ । সবাই বলে উঠল -- সাধু, সাধু !
    Posted by Malay Roychoudhury at 12:16 AM No comments: Email ThisBlogThis!Share to TwitterShare to FacebookShare to Pinterest
    Labels: Anti-Establishment, Kalim Khan, Malay Roychoudhury, Poetic Theory, আভিধানিক, কলিম খান
    Sunday, July 8, 2018
    চতুর্থ পর্ব : ষড়যন্ত্র : বিদ্বেষণ
    ( অভিচারতন্ত্র : পুনঃপাঠ )
    মানুষের উপর মানুষের চড়ে বসাকে বলা হয় 'অভিচরণ' বা 'অভিচার' । আদিকালে সর্বপ্রথম যে-পদ্ধতির সাহায্যে এই কর্মটি করা হতো, তাকে বলা হতো 'শ্যেনযাগাদি' অর্থাৎ অন্য গোষ্ঠীর লোকেদের উপর দলবদ্ধ লুঠতরাজ বা ছিনতাই । তবে সে সবই ছিল সাময়িক । তার সাহায্যে বহুকালের জন্য বা চিরকালের জন্য কারও উপর চেপে বসা যেত না । সেই উদ্দেশ্যে একদিন ভারতবর্ষ আবিষ্কার করে এক অভিনব প্রক্রিয়া ---'মূলনিখনন ও পদধূলিগ্রহণ'। এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে সমাজের স্বাভাবিক জ্ঞানপ্রবাহের উপর বাঁধ বাঁধা হয় ও বৈদিকযুগের সূত্রপাত করা হয় । এটিই পৃথিবীর প্রথম বাঁধ ও আদি বাঁধ । ঈশ্বরের করুণার অন্যান্য ধারাগুলিকে বাঁধ বেঁধে নিয়ন্ত্রণ করার কথা তখনও ভাবা হয়নি ।

    তা সে যাই হোক, সেই 'মূলনিখনন ও পদধূলিগ্রহণ' উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি বলে এখনও আমরা 'বড়ো শত্রুকে উঁচু পিঁড়ি' দিই ; যার সর্বনাশ করা দরকার তার মূর্তি গড়ে পূজা করি ও তার নীতি অমান্য করি এবং এভাবেই আমরা আজও শিব রাম গান্ধী মার্কস রবীন্দ্রনাথের পূজা করি ও তাঁদের নীতি অমান্য করে থাকি।

    দুষমনকে 'পূজা করে মেরে ফেলার' এই বৈদিক নীতির বিপরীতে একসময় তান্ত্রিক নীতিরও জন্ম হয় এই ভারতবর্ষেই । 'নিয়ন্ত্রণসাধন'কে তখন বলা হতিও যন্ত্র, যা দিয়ে অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালানো হতো, ঘাড়ের উপর চেপে বসা ক্ষমতাকে উৎখাত করার চেষ্টা চালানো হতো । তান্ত্রিকেরা শত্রুকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হিসেবে ছয় রকম 'নিয়ন্ত্রণসাধন' বা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন--- মারণ, মোহন, স্তম্ভন ( শত্রুকে স্ট্যাগন্যান্ট করে দেয়া ), বিদ্বেষণ ( ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল ), উচ্চাটন ( স্বদেশভ্রংশন বা শত্রুকে তার কনটেক্সট থেকে উৎখাত করে দেয়া ) ও বশীকরণ । এই যন্ত্রগুলি প্রধানত বাঁধ ভাঙার কাজেই ব্যবহৃত হতো । বৈদিকদের পূজা করে মেরে ফেলার বিপরীতে তান্ত্রিকেরা এই ছয় রকম যন্ত্র ব্যবহার করতেন বলে, বৈদিকপন্হীদের কালচারে এই 'ষড়যন্ত্র' ঘৃণ্য ও নিন্দাজনক হয়ে যায় এবং আধুনিক যুগে পৌঁছে পরিণত হয় 'কন্সপিরেসি'তে, যদিও তান্ত্রিক কালচারে 'ষড়যন্ত্র' যথারীতি প্রশংসাযোগ্য ও গৌরবজনক হয়েই থেকে যায় । অর্থাৎ কিনা, ভারতের তান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুসারে ষড়যন্ত্রের প্রয়োগ অত্যন্ত ভালো কাজ এবং তা আদৌ কন্সপিরেসি নয়।

    তবে নিয়ন্ত্রণসাধনের এই চর্চা এখানেই থেমে থাকেনি । যুগ বহুদূর এগিয়ে চলে এসেছে, যন্ত্রকে করে তোলা হয়েছে 'মোস্ট সফিসটিকেটেড', ক্ষমতা হয়েছে নিরঙ্কুশ । শাসক ও বিদ্রোহীর হাতে ওইসকল যন্ত্রের বিপুল বিকাশ ঘটেছে । বিকাশ ঘটেছে শাসক এবং বিদ্রোহীরও । এখন শাসকের বহু রূপ, বহু সুয়ো ; বিদ্রোহীরও বহু রূপ, বহু দুয়ো । বহু ক্ষেত্রে শাসকই বিদ্রোহীর পোশাক পরে নেয়, কোনও কোনও দুয়ো ভুয়ো-বিদ্রোহী হয়ে সুয়োর দলে ভিড়ে যায় । তাছাড়া, এখন বাঁধের সংখ্যাও প্রচুর, যত ধারা ততো বাঁধ, বাঁধের নিচে বাঁধ, উপরে বাঁধ, সাপোর্টিং বাঁধ, কতো কী ! এমনকি লোকদেখানো মিথ্যে বাঁধও রয়েছে, বিদ্রোহী জনগণের আক্রোশ যার উপর ফেটে পড়ে বেরিয়ে যেতে পারবে, ডায়লুট ও ডাইভার্টেড হয়ে যেতে পারবে, অথচ প্রকৃত বাঁধটা থেকে যাবে অক্ষত ।

    আরও আছে, এখনকার প্রতিটি বাঁধের পাথরপ্রতিমার রূপগুণও ভিন্ন ভিন্ন, পৃথক পৃথক স্পেশালিস্ট বা দক্ষ বিভূতিদের দিয়ে বানানো । এসব বাঁধ ভাঙতে গেলে বিদ্রোহীদেরও ভিন্ন ভিন্ন শাখার স্পেশালিস্ট হতে হয়, দক্ষ হতে হয়, অনেক তপজপ করতে হয় । কেননা এমন ব্যবস্হা করে রাখা হয়েছে যাতে কৃষিবিজ্ঞানী সাংস্কৃতিক বাঁধের রহস্য জানতে না পারেন, জীববিজ্ঞানী রাজনৈতিক বাঁধের রহস্য জানতে না পারেন...ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণ প্রতিটি বাঁধই সেই সেই বিষয়ের প্রতীকের পাথরপ্রতিমা দিয়ে গড়া । তাই, একালে একজন দুয়ো-রাজকুমারে কিছুই হবার নয় । যতোগুলি বাঁধ, বলতে গেলে ততোজন দক্ষ দুয়ো-রাজকুমার লাগে সেগুলি ভাঙবার আয়োজন করতে।

    তাই একালে দুয়ো-রাজকুমারের সংখ্যাও খুব কম নয় । এর ভিতর আবার জালি দুয়ো-রাজকুমার তো রয়েছেই । তার ওপর, কখনও বা কোনও কোনও দক্ষ দুয়ো-রাজকুমারকে রাতারাতি ফুটপাত বদল করতেও দেখা যায় । অবশ্য তার জন্য তাদের ফ্ল্যাট নিতে হয় 'কনখল'-এ । 'কনখল' সেই বিখ্যাত কমপ্লেক্স, যেখানে দাঁড়িয়ে আদি দক্ষ বলেছিল, 'কৌ ন খল অর্থাৎ কে খল নহে ? সব্বাই খল । অতএব আমিও কেন খল হবো না ?' এই বলে, সেও খল হয়ে যায় । সেই জন্য, সেই ভিত্তিভূমির নাম হয়ে যায় 'কনখল' । এলাকার ফুটপাত-বদল-পারদর্শী দক্ষেরা সেই কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিয়ে ঘোষণা করে, 'কে খল নহে ? সব্বাই খল । কেউ কথা রাখেনি । অতএব আমিও কথা রাখব না ।' ---এই বলে তারা সুযোগ পাওয়া মাত্রই সুয়ো-রাজকুমারের দলে ভিড়ে যায় । তাই প্রকৃত বিদ্রোহী দুয়ো-রাজকুমারকে চিনতে পারা এযুগের এক কঠিন সমস্যা ।

    আবার বাঁ৭ ভাঙার ক্ষেত্রেও রয়েছে সমস্যা । পালটা প্রতীকের পাথরপ্রতিমা না বসিয়ে বাঁধের বর্তমান পাথরকে সরানোর কোনও উপায় রাখা হয়নি । আর সেটা করতে গেলেই নতুন প্রতীকের বাঁধ নির্মিত হয়েযায় । ফলে, যে ভাঙতে আসে, দেখা যায়, পাকে চক্রে সে আগের বাঁধ ভেঙে তার স্হানে নতুন আর একটা বাঁধ বেঁধে ফেলেছে নিজের অগোচরেই ।

    এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে, সাম্প্রতিক কালের অধুনান্তিক ( পোস্টমডার্ন ) তান্ত্রিক বিদ্রোহীরা একটি অভিনব পন্হা উদ্ভাবন করেছেন । বাঁধের উৎখাতযোগ্য পাথরপ্রতিমাকে অত্যন্ত স্বল্পায়ু প্রতীক দিয়ে সরিয়ে ফেলা । এ যেন মানববোমা । উদ্দিষ্ট প্রতীকটাকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেও মরে যাবে । এমন জ্ঞানের ব্যবহার, যা পুরোনো জ্ঞানকে মেরে ফেলবে অথচ নতুন 'জ্ঞানের বোঝা' হয়ে দেখা দেবে না ।

    Posted by Malay Roychoudhury at 11:27 PM No comments: Email ThisBlogThis!Share to TwitterShare to FacebookShare to Pinterest
    Labels: Anti-Establishment, Kalim Khan, Malay Roychoudhury, Poetic Theory, আভিধানিক, কলিম খান, সাহিত্য আলোচক
    পঞ্চম পর্ব : যড়যন্ত্র : উচ্চাটন
    ( অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট রিভোল্ট প্রোগ্রামিং : অ্যান আইটি এক্সপ্লোর )
    সবাই জানেন কমপিউটারের দুনিয়ায় উইনডোর নানা ভারশন প্রকাশিত হয়েছে । উইনডো ৯৫, উইনডো ০৭, উইনডো ৯৮ ভারসন ১, উইনডো ৯৮ ভারসন ২, উইনডো মিলেনিয়াম ভারসন ইত্যাদি ইত্যাদি । তবে যেটা অনেকেই নজর করেননি, তা হল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতারও অনেকগুলি ভারসন আমাদের মার্কেটে চালু আছে । প্রতিটি ভারসনের আবার অনেকগুলি করে এডিশন রয়েছে । যার যেটা পছন্দ তিনি সেটা কেনেন, ব্যবহার করেন । ক্রেতার অবগতির জন্য এখানে কয়েকটি ভারসনের একটি করে এডিশন-এর অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল ।
    Posted by Malay Roychoudhury at 6:18 AM No comments: Email ThisBlogThis!Share to TwitterShare to FacebookShare to Pinterest
    Labels: Kalim Khan, Malay Roychoudhury, Poetic Theory, আভিধানিক, কলিম খান, সাহিত্য আলোচক
    ষষ্ঠ পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ভারসন ১
    ( লঞ্চড বাই শিবশম্ভু পাষণ্ড/সনাতন এডিশন )
    ইট ইজ আ প্রিমিটিভ এডিশন অ্যান্ড প্রেজেন্টলি নট অ্যাভেলেবল ইন দ্য মার্কেট।
    Posted by Malay Roychoudhury at 6:09 AM No comments: Email ThisBlogThis!Share to TwitterShare to FacebookShare to Pinterest
    Labels: Kalim Khan, Malay Roychoudhury, Poetic Theory, আভিধানিক, কলিম খান, সাহিত্য আলোচক
    সপ্তম পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ২
    ( লঞ্চড বাই বাল্মীকি/চণ্ডাশোক এডিশন )
    ১) শাসক...ব্রাহ্মণ
    ২) শাসিত...ক্ষত্রিয় বৈশ্য শুদ্র ও অন্যান্য ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়
    ৩) বিরোধের কারণ...সামাজিক মুক্তধারার উপরে নির্মিত বাঁধ
    ৪) বাঁধের কারিগর...কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস ও তাঁর শিষ্যগণ
    ৫) বাঁধ গড়ার উপাদান...সামাজিক প্রতীকের পাথরপ্রতিমা দিয়ে দিয়ে
    ৬) বাঁধ ভাঙার মন্ত্র...পালটা প্রতীকের পাথর দিয়ে দিয়ে
    ৭) সুয়ো-রাজকুমার...রাবণ অ্যাসোশিয়েটস
    ৮) দুয়ো-রাজকুমার...রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম
    ৯) ছদ্ম দুয়ো-রাজকুমার...বিভীষণ
    ১০) বিদ্রোহের নেতা...দাশরথীগণ
    ১১) ছদ্ম বিদ্রোহী নেতা...ঃঃঃঃঃঃঃঃ
    ১২) বিদ্রোহের ( স্লো ) গান...রাম নাম সত্য হ্যায়
    ১৩ ) আধপাগলা...জটায়ু
    ১৪ ) গাধা...হনুমান
  • m | 012312.60.900.191 | ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:০৩541288
  • বিনয় মজুমদার - কবিতার বোধিবৃক্ষ : মলয় রায়চৌধুরী

    ‘জাগতিক সফলতা নয়, শয়নভঙ্গির মতো
    অনাড়ষ্ট সহজবিকাশ সকল মানুষ চায়’

    আমার মনে হয়েছে, গাণিতিক সৌন্দর্য তত্বের ওপর বিনয় মজুমদার গড়ে তুলেছেন তাঁর চারটি সাব-জনার ( sub-genre )-এর কবিতার বনেদ, ‘ফিরে এসো, চাকা’, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’ এবং হাসপাতালে ও শিমুলপুরে দিনযাপনের খতিয়ান ‘শিমুলপুরে লেখা কবিতা’, ‘কবিতা বুঝিনি আমি’, ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ , ‘ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য’ আর ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ । ‘ফিরে এসো, চাকা’ ছিল বাংলা সাহিত্যে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনীয়, এবং পরবর্তী সাব-জনারগুলো প্রতিবার নতুন স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে ।
    যিনি গণিতের সৌন্দর্যে সমর্পিত তিনি নান্দনিক তৃপ্তি পান, গণিতের নির্দিষ্ট রূপকে সুন্দর মনে করে আনন্দ উপভোগ করেন, দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার মাঝেও তিনি হর্ষের মনন-জগতে বসবাস করেন । যাঁরা বিনয় মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাঁরা জানেন যে উত্তর দেবার সময়ে তিনি হঠাৎই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠতেন, এবং শিমুলপুরে থাকাকালীন কয়েকটি গানও রচনা করেছিলেন ।
    ওমর খৈয়াম ও এমিলি ডিকিনসনও গণিতের সৌন্দর্যের বনেদে গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের কাব্য। গণিতের সাথে কবিতা ও সঙ্গীতের, এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের আরাধ্য পুস্তকগুলোর গাণিতিক লেখনবিন্যাসে ( যেমন বাইবেল, কোরান, জেন্দাভেস্তা, গীতা, ত্রপিটক, গুরুগ্রন্হ, তোরা, তালমুদ, কিতাব-ই-আকদাস, অগমসমূহ, কোইজিকি ইত্যাদি ) পার্থক্য খুঁজে পান না গণিত ও কবিতার বিস্ময়ে আক্রান্ত বেশ কয়েকজন গণিতবিদ । কবিতা ও সঙ্গীতের মতো তাঁদের মননে গণিত অনির্বচনীয়, তা ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ক্রিয়ায় বিদ্যমান । গাণিতিক সৌন্দর্যের বিখ্যাত উদাহরণটি হল পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি । বিনয় মজুমদারের সঙ্গে জীবনানন্দের প্রধান তফাত এখানেই । বিনয় দারিদ্র্য, দুঃখ, কষ্ট, অবহেলা, অসুস্হতা, নিঃসঙ্গতা সত্বেও থাকতেন আনন্দের প্রভায় জ্যোতির্ময় ।
    কবিতাকে জীবনের সঙ্গে একাত্ম করেছেন বিনয় মজুমদার । তাঁর কাছে অনেকেই জানতে চাইতেন ‘কবিতা কী?’ বিনয় ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে বলেছেন, “কবিতা কী তা বলা অসম্ভব । কেন ? বলুন তো আপনি কী ? আপনি কি একশো কোটি বছর আগে থেকে পৃথিবীতে আছেন ? আপনি মরলে কি যে-কোনো অবস্হায় হোক প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন ? আপনি যখন আলুডাল খান, এই আলুডাল পাকস্হলীতে গিয়ে হজম হয়ে শেষে প্রাণবন্ত মাংস হয় । তা হলে দেখা যাচ্ছে পাকস্হলীতে জড়বস্তু আলুডাল প্রাণবন্ত হচ্ছে অর্থাৎ পাকস্হলীতে প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে এই তত্বে কি আপনি বিশ্বাস করতে পারেন ? যদি না পারেন তবে আপনার প্রাণ কী ? এইভাবে দেখা যাবে যে আপনি নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা জানেন না । নিজেকেই পুরোপুরি জানেন না আপনি । তা হলে কবিতা কী তাও আপনার জানা অসম্ভব ।”
    ২০০০ সালে প্রকাশিত ডেভলিন কিথ তাঁর ‘ডু ম্যাথেমেটিশিয়ানস হ্যাভ ডিফারেন্ট ব্রেইনস’ গ্রন্হে হাঙ্গরিয় গণিতবিদ পল এরডস -এর এই উদ্ধৃতির মাধ্যমে গণিতের সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক স্পষ্ট করেছেন : Why are numbers beautiful ? It is like asking why is Beethoven’s Ninth Symphony beautiful. If you do not see why, someone can not tell you. If they are not beautiful, nothing is.
    ১৯১৯ সালে বারট্রাণ্ড রাসেল তাঁর ‘দি স্টাডি অফ ম্যাথেম্যাটিক্স’ গ্রন্হে লিখেছিলেন : Mathematics, rightly viewed, possesses not only truth, but supreme beauty — a beauty cold and austere, like that of sculpture ; without appeal to any part of our weaker nature, without the gorgeous trappings of painting or music, yet sublimely pure, and capable of a stern perfection such as only the greatest art can show. The true spirit of delight, the exaltation, the sense of being more than Man, which is the touchstone of the highest excellence, is to be found in mathematics as surely as poetry.
    আইনস্টাইন বলেছিলেন, Pure mathematics is, in its way, the poetry of logical ideas.
    গণিত ও কবিতা উভয়েরই যে ব্যাপারে মিল আছে তা হলো ভাষার মাধ্যমে পরিমাপ ও আঙ্গিকের প্রতি তাদের নিখুঁত হবার প্রচেষ্টা ; মাত্রা বা সংখ্যানিরূপণ ; সমানতা ; ছন্দ ; প্রণালী ; পুনরাবৃত্তি ; অনুক্রম এবং পরিণতি ; পৃষ্ঠার ওপরে আঙ্গিক ও লেআউট, এবং প্রকাশের সংক্ষেপণ, ঘণীভূত করার ইন্দ্রজাল । স্বকীয় মর্মার্থ থেকে পৃথক করার জন্য শব্দ ( সংখ্যা ) ও প্রতীকের একাত্মতাকে একটি স্তরে মান্যতা দিয়ে সংখ্যাবিন্যাস অথবা বাকবিন্যাসের নিরীক্ষা করে গণিত ও কবিতা উভয়ই । জ্ঞান ও বোধ-অভিজ্ঞতার একটি আদর্শ অথচ বিমূর্ত এলাকা গড়ে তোলে উভয়ই, যেখানে সত্য ও মর্মার্থের প্রকৃতি, এবং কেমন করে তাদের সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়, বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্কায়িত করা যেতে পারে, তার অন্বেষন করে । উভয়ই কল্পনা ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । শৈশবে অক্ষর এবং সংখ্যা শেখার উপায় হলো ছন্দের মাধ্যমে মুখস্হ করা । সেই বয়স থেকেই অক্ষর ও নামতা মনে রাখার চেষ্টা করানো হয় একই ভাবে ; তাদের জন্য রচিত কবিতাগুলো গণিত মেনে লেখা হয় যাতে তাদের মনে থাকে । চন্দন ভট্টাচার্যকে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “ছন্দে ও অন্তমিলে লিখলে সে-কবিতা পাঠকের মনে থেকে যায় । কাজেই পাঠকের স্মৃতিতে কবিতা সুমুদ্রিত করার এটাই সেরা পদ্ধতি।”
    বেদের শ্লোকগুলো, যা ছন্দে রচিত, তাতে গণিতের সংযোজন করেছিলেন অপস্তম্ব, বৌধায়ন, মানব, কাত্যায়ন, বরাহ, হিরণ্যকেশিন — ধর্মাচরণের বিষয়গুলো জ্যামিতিক ছক দিয়ে এবং সেগুলো ছন্দের মাধ্যমে উপস্হাপন করেছিলেন । অশ্বমেধ-হোম-যজ্ঞ ইত্যাদির সময়ে সেই জ্যামিতিক ছকগুলো আঁকা হতো । এখনও পুরোহিতরা অনেকে পুজো, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদির সময়ে মাটিতে নকশা আঁকেন, জল দিয়ে, কুশকাঠি দিয়ে, বালির ওপর আঙুল দিয়ে, সিঁদুর দিয়ে । বর্তমান কালখণ্ডে পৌঁছে আমরা শূন্য ও এক-এর বাইনারি কবিতায় পৌঁছেছি । গণিতের ক্ষমতার অংশিদার হলো কবিতা, এই তর্কে যে ভাবকল্প যতো ব্যাপকই হোক না কেন, গণিত ও কবিতা তাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যাপ্রণালী অথবা বাকপ্রণালীতে আঁটিয়ে দিতে পারে — এমনকি বিশাল ব্রহ্মাণ্ডকে্ অত্যন্ত ছোট ফর্মে ভরে ফেলতে পারে ।
    কিংবদন্তি অনুযায়ী ঋষি বৃহস্পতির সাতটি মুখগহ্বর থেকে সাত রকমের ছন্দ নিঃসৃত হয়েছিল, এবং প্রতিটির গণিত-কাঠামো সুস্পষ্ট । সংস্কৃত কাব্যরচনার জন্য গণিত নির্দেশিত ছিল । ছন্দের গণিত বর্ণিত আছে বেদাঙ্গতে, যথা গায়ত্রীঃছন্দ ( ৬ x ৪ ), উশ্নীঃছন্দ ( ৭ x ৪ ), অনুষ্টুভছন্দ ( ৮x ৪ ), বৃহতীঃছন্দ ( ৯x ৪ ), ত্রিষ্টুভছন্দ ( ১১x ৪ ) ইত্যাদি । পিঙ্গলের ‘ছন্দসূত্র’ গ্রন্হে গণিতের সঙ্গে মাত্রা ও শব্দের সম্পর্কনিয়ম আলোচনা করা হয়েছে । ‘নাট্যশাস্ত্র’তে বলা হয়েছে মাত্রার গণিতবর্জিত শব্দ হয় না ; শব্দের গণিতহীন মাত্রা হয় না । ছান্দস বিষয়ে গাণিতিক নিয়মগুলি আলোচিত হয়েছে অগ্নিপূরাণ, নাট্যশাস্ত্র, বৃহৎসংহিতা ও মানসোল্লাস-এ । ‘মহাভারত’-এর ছন্দের গণিত মূলত অনুষ্টুভ ও ত্রিষ্টুভ ।
    ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে বিনয় মজুমদার বটানিকাল গার্ডেনে প্রায়ই যেতেন ; গঙ্গার ধারের দৃশ্যাবলী দেখতেন । পরে যখন শিমুলপুর গ্রামে বসবাস করতে গেলেন তখন আরও কাছ থেকে প্রতিদিন পুকুরের মাছ গাছপালা ফুলফলের জন্ম ও বিকাশ দেখার অফুরন্ত সময় পেতেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে তিনি গণিতের ফিবোনাচ্চি রাশিমালার বিস্ময়কে বকুলফুল এবং বিভিন্ন গাছের শাখা-প্রশাখার প্রসারণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন । এই রাশিমালা আবিষ্কার করেছিলেন ত্রয়োদশ শতকের গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি, যিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির মূল রহস্য তাঁর বর্ণিত রাশিমালা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় । এই রাশিমালা শুরু হয় শূন্যতে এবং সিরিজের পরবর্তী সংখ্যাগুলো প্রতিটি তার পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার যোগফল । সূর্যমুখী ফুলের পাপড়িবিন্যাস, শামুকের খোলের ওপরকার ডোরা, ফুলকপির ছড়িয়ে পড়ার বিন্যাস, মৌমাছির পরিবারতন্ত্র, বিভিন্ন গাছের শাখাবিন্যাস, আনারসের বাইরের বিন্যাস ইত্যাদিতে পাওয়া যাবে প্রকৃতির এই নান্দনিক-গাণিতিক খেলা ।
    গণিতে ‘ফিবোনাচ্চি সিরিজ’ নিয়ে বিনয় এই কবিতাটি লিখেছিলেন :-

    অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিতশাস্ত্র নয়
    লিখিত বিশ্লিষ্টরূপ গণিতের অআকখময়
    হয় না, সে-সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত গণিতশাস্ত্রের
    নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ করেই বিশ্লেষণ
    করা একমাত্র পথ, গণিতশাস্ত্রীয় দর্শনের
    বহির্ভূত অতিরিক্ত দর্শন সম্ভবপর নয় ।
    সেহেতু ঈশ্বরী দ্যাখো গণিতের ইউনিট
    পাউণ্ড সেকেণ্ড ফুট থেমে থাকে চুপে
    এদের নিয়মাবদ্ধ সততা ও অসততা মনতস্ত্বে বর্তমান ইউনিটরূপে
    আলোকিত করে রাখে বিশ্বের ঘটনাবলী চিন্ত্যনীয় বিষয়গুলিকে
    আগামীর দিকে ।

    পোল্যাণ্ডের কবি উইসলাভা সিমবোরস্কা, যিনি ১৯৬৬ সালে কবিতায় গণিত ও জৈবজীবনের রহস্যকে একীভূত করার জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তাঁর ‘পাই’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি পড়লে বোঝা যাবে, যে-কবিরা গণিতকে ভালোবাসেন তাঁদের কবিতা কীভাবে রূপায়িত হয়েছে । আমি ইংরেজি অনুবাদটিই এখানে তুলে দিচ্ছি :-

    The admirable number pi
    three point one four one.
    All the following digits are also initial,
    five nine two because it never ends.
    It can not be comprehended six five three five at a glance,
    eight nine by calculation,
    seven nine or imagination,
    not even three two three eight by wit, that is, by comparison,
    four six to anything else
    two six four three in the world.
    The longest snake on earth calls it quits at about forty feet.
    Likewise, snakes of myth and legend, though they may hold
    out a bit longer.
    The pageant of digits comprising the number pi
    does not stop at the page’s edge.
    It goes on across the table, through the air,
    over a wall, a leaf, a bird’s nest, clouds, straight into the sky,
    through all the bottomless, bloated heavens.
    Oh how brief — a mouse tail, a pigtail — is the tail of the comet !
    How feeble the star’s ray, bent by bumping up against space !
    While here we have two three fifteen three hundred nineteen
    my phone number your shirt size the year
    nineteen hundred and seventy-three the sixth floor
    the number of inhabitants the sixty five cents
    hip measurement two fingers a charade, a code,
    in which we find hail to thee blithe spirit, bird thou never
    were
    alongside ladies and gentlemen, no cause for alarm,
    as well as heaven and earth shall pass away,
    but not the number pi, oh no, nothing doing,
    it keeps right on with its rather remarkable five,
    in uncommonly five eight,
    its far from final seven,
    nudging, always nudging a sluggish eternity
    to continue.
    গণিতের সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা ইউরোপ আমেরিকায় বহুকাল যাবত লেখা হচ্ছে । যেমন মারিয়ান মুর-এর ‘দি আইকোস্যাসফিয়ার’, কার্ল স্যাণ্ডবার্গের ‘অ্যারিথম্যাটিক’, ওয়ালেস স্টিভেন্সের ‘ল্যাণ্ডস্কেপ ফাইভ’, ভ্যাচেল লিন্ডসের ‘ইউক্লিড’ ইত্যাদি ।
    আল মাহমুদ যথার্থই বলেছিলেন, “বিনয় অগোছালো একজন কবি আর আমি খুব গোছানো কবি”, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ধর্মে, যখন কিনা বিনয় মজুমদার ধর্মকে ছোঁয়াচে-রোগের মতো পরিহার করে গণিতের আশ্রয় নিয়েছেন, এবং গণিত যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের মতন বিনয় মজুমদার একজন বেপরোয়া কবি । বিনয়ের এই গাণিতিক কবিতার মতো আল মাহমুদ কোনোদিন রহস্যময় কবিতা লেখেননি, লেখা সম্ভব ছিল না তাঁর শেষ পর্যায়ের মৌলবাদী জীবন পরিসরে । বিনয় মজুমদার লিখিত একটি গণিতাশ্রিত গান :-

    একটি গান
    X = 0
    এবং Y = 0
    বা X = 0 = Y
    বা X = Y
    শূন্য 0 থেকে প্রাণী X ও Y সৃষ্টি হলো
    এভাবে বিশ্ব সৃষ্টি শুরু হয়েছিল ।

    এবং একটি গাণিতিক কবিতা :-
    X, Y ও Z
    দুটো ভ্যারিয়েবল X ও Y
    X ও Y থেকে তৃতীয় একটি ভ্যারিয়েবল বানাতে চাই
    আমরা । তৃতীয় ভ্যারিয়েবল ‘Z’ সহজেই বানানো যায়
    ক্যালকুলাসের দ্বারা ।
    একমাত্র ঐ ক্যালকুলাসের জন্যই ময়ূরীর সন্তান আরেকটি
    ময়ূরীই হয় — ডিম থেকে ময়ূর হয়, তারপরে
    ‘Z’ হয় । Y আর X
    Y ইজ আ ফাংশন অফ X
    ঠিক ডিমটাও হয় সেইরকম । ডিমের ভিতরে
    ‘Y’- ও আছে ‘X’ -ও আছে । সুতরাং ‘Z’ সহজেই
    হয় Y নতুবা X -এর মতন হয়ে । ময়ূরীর ডিম
    তার ভিতরে ময়ূরীও আছে ময়ূরও আছে ।
    সুতরাং ডেরিভেটিভ হয় ময়ূর হবে নয়তো ময়ূরী হবে ।

    বিনয় লিখেছেন, এবং এখানে সত্য কথাটার ওপর আমি জোর দিতে চাই :-

    ক্যালকুলাসের এক সত্য আমি লিপিবদ্ধ করি ।
    যে-কোনো ফাংকশানের এনেথ ডেরিভেটিভে এন
    সমান বিয়োগ এক বসিয়ে দিলেই
    সেই ফাংকশানটির ফার্স্ট ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায় ।

    বিনয় মজুমদারের চিন্তার গাণিতিক ব্যাপ্তি, ১৪১৩ সালে ‘অউম’ পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকার যা বলেছিলেন, তা থেকে স্পষ্ট হবে, “তোমরা মহাগ্রন্হ শুনেছ কি ? পড়েছ কি ? জানো কি ? পৃথিবীর যত বই আছে, সব বই মিলে আসলে একখানি বই । তারই নাম মহাগ্রন্হ । এই মহাগ্রন্হ নিজের প্রয়োজনে বাড়ে । ঠিক আমগাছের মতো বাড়ে মহাগ্রন্হের শাখা-প্রশাখা । মহাগ্রন্হ এখনই বেড়ে যাচ্ছে, এই কলমের মুখ দিয়ে এই মুহূর্তে মহাগ্রন্হ বৃদ্ধি পাচ্ছে । বর্তমান পাঠক যা পড়তে পড়তে টের পাবেন । এবং এই যে পৃথিবীর যেখানে যত লোকই, এখন যারা লিখছে — সবার হাত দিয়েই মহাগ্রন্হ বেড়ে চলেছে । রসায়নশাস্ত্র, উড়োজাহাজ বানাবার বিদ্যা, লোকেদের লেখা চিঠি, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা — এইরূপ অসংখ্য বিষয়ে বর্তমান মুহূর্তে লেখা হচ্ছে, এ সবগুলিই একখানি মহাগ্রন্হের বৃদ্ধিমাত্র । যেমন আমগাছের ডাল একসঙ্গে অনেক গজায় এবং বাড়ে, তেমনি মহাগ্রন্হ একসঙ্গে অনেক গজায় এবং বাড়ে ।

    ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কবিতায় বিনয় এই একই গাণিতিক ব্যাপ্তি লক্ষ্য করেছেন দর্শনে । তিনি বলেছেন :-

    দর্শনের জগতেও নানা পরিবার আছে, অগণন পরিবার আছে
    সে-সকল পরিবারে — আলাদা যে কোনো পরিবারে সবার চেহারা
    চরিত্র ইত্যাদি প্রায় একরকমের হয়, তাই এত পরিবার হয়
    এমন পরিবারের কারো সাথে কথা বলে নিতে গিয়ে যদি তাকে
    পাওয়া নাই যায় তবে সেই পরিবারভূক্ত — একই পরিবারভূক্ত কারো
    অন্য কারো কাছে সেই কথা বলে আসা যায় একই আলোচনা করা যায়;
    তাতে খুব অসুবিধা হয় না, হয়তো বেশি সুবিধাও হয়ে যেতে পারে ।

    ‘লোক’ পত্রিকার জন্য ২০০১ সালে শামীমুল হক শামীম বিনয় মজুমদারের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাতে ছন্দ সম্পর্কে এরকম প্রশ্নোত্তর হয়েছিল :
    প্রশ্ন : আপনি তো পয়ারেই কবিতা লিখলেন সারা জীবন । পয়ারেই কি আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
    বিনয় : এখন আর পয়ারে লিখি না তো । হ্যাঁ, অধিকাংশই, সেই ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৫ পর্যন্ত পয়ারেই লিখে গেছি । একটানা । তবে আমার পয়ারে তফাত আছে, অন্য পয়ারের মতো না । তফাতটা আমি বলছি ; শোনো, এটা হচ্ছে সংস্কৃত পয়ার, ছন্দিত সংস্কৃত ছন্দ আসলে । আর পয়ার ছন্দ বললাম দুটো । কিন্তু কর্কশ ছন্দ ছিল । সেটা মন্দাক্রান্তা ছন্দ । ওই মন্দাক্রান্তা ছন্দটা হচ্ছে মেঘদূতের ছন্দ । ছন্দটাকে ভেঙে আমি এমন বানালাম যে, পয়ার ছন্দটা খুব মিষ্ট হয়ে গেল । পয়ার ছন্দটাকে আমি মিষ্ট বানালাম নানান কাণ্ড করে । ‘আমার ছন্দ’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছি আমি । সম্পাদক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তার পত্রিকায় ছাপিয়েছে ।
    প্রশ্ন : পরে সেটা বই হয়ে বেরিয়েছে ।
    বিনয় : কোন বইতে যেন ?
    প্রশ্ন : ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ ও অন্যান্য’ বইতে ।
    বিনয় : হ্যাঁ, প্রতিভাস থেকে বেরিয়েছে । সেই বইতে ‘আমার ছন্দ’ প্রবন্ধটি আছে । ‘আমার ছন্দ’ প্রবন্ধে পয়ার ছন্দে কীভাবে লিখেছি, পয়ার ছন্দটাকে আমি কীভাবে নিজস্ব পদ্ধতিতে নিয়ে এসেছি সেটা বিশদভাবে লিখেছি, খুবই বিশদভাবে লিখেছি । গাণিতিক ছবি-টবি দিয়ে খুবই সুন্দরভাবে লিখেছি । তারপরে পয়ারটা খুব মিষ্ট ছন্দ হয়ে গেল । এ জন্য পয়ারেই, যেহেতু আমি পয়ারেই ওইরকমের মিষ্ট পয়ার লেখা আবিষ্কার করলাম ; সেই হেতু ঠিক করলাম যে আমি এর পরে শুধু পয়ারেই লিখব, আর কোনও ছন্দে নয় ।
    ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ’ বইটিতে বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “রূপ থেকে অরূপে আসা, আবার অরূপ থেকে রূপে ফিরে যাওয়া, রূপের সহিত অরূপের পারস্পরিক সম্পর্কে — এ সকল বিষয় অত্যন্ত মূল্যবান । গণিতশাস্ত্রেও ঠিক এই । একই ব্যাপার ঘটে । কোনো রূপের নির্যাসরূপে থিওরেম বা ফর্মুলা তৈরি করা হয় । অতঃপর সেই থিওরেম বা ফর্মুলা থেকে যত খুশি রূপ ফিরে পাওয়া যায়, যত খুশি রূপের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় । এই অর্থে –’এই করেছ ভালো,নিঠুর, এই করেছ ভালো…’ কবিতাটি একটি ফর্মুলা — জীবন ফর্মুলা ।”
    বিনয় মজুমদার রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে ফর্মুলা বলায়, অনুমান করা যায়, হয়তো, তিনি নিজের জীবনের ক্ষেত্রেই এই ফর্মুলাটিকে রূপায়িত হতে দেখলেন, যেমনটা রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ নিজেদের জীবনের ক্ষেত্রে দেখেছিলেন ।

    দুই
    উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রিটিশ সরকার, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ তদানীন্তন বর্মায়, বর্তমানে মিয়ানমারে, প্রসারণ ঘটালে, নিজেদের সঙ্গে বহু বঙ্গভাষীকে টেনে নিয়ে যায়, প্রধানত সরকারি চাকরিতে ইংরেজির ব্যবহারে দক্ষ ঔপনিবেশিক শিক্ষায় সড়গড় কেরানি এবং জঙ্গলগুলো থেকে সেগুন ও অন্যান্য কাঠ কেটে সেগুলো রপ্তানির কাজে লাগাবার জন্য, স্বাস্হ্যবান চাষিদের তুলে নিয়ে যায়, যারা কালক্রমে বন্দরশহর রেঙ্গুন বা য়াঙ্গন,এবং প্রাকৃতিক জঙ্গলে ঘেরা মান্দালয়ে বসতি স্হাপন করে । সেসময়ে নিন্মবর্ণের চাষিদের নমঃশুদ্র বলা হতো না, বলা হতো চণ্ডাল, উচ্চবর্ণের বাঙালিরা যাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতো, তাঁরা ছিলেন চতুর্বর্ণের বাইরে একটি অস্পৃশ্য বর্ণ । তখনকার পূর্ববঙ্গে চণ্ডাল বিদ্রোহের চাপে ১৯০১ এর আদমশুমারিতে ব্রিটিশ সরকার চণ্ডাল বর্গের পরিবারদের নমঃশুদ্র হিসাবে চিহ্ণিত করার হুকুম জারি করেছিল । বিনয় মজুমদারের বাবা ব্রিটিশ ভারতের পি ডাবলিউ ডিতে চাকরি করতেন এবং সেই সূত্রে মিয়ানমারে পোস্টেড ছিলেন । বিনয় মজুমদারের বয়স যখন সাড়ে সাত বছর তখন তাঁরা মিয়ানমার ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরতে বাধ্য হন ।
    পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন যে বিনয় মজুমদারের জীবন ও সাহিত্যে অবদান আলোচনা করতে বসে চণ্ডাল ও নমঃশুদ্রের প্রসঙ্গ কেন তুলছি । তার কারণ দুটি । প্রথম হলো এই যে ইরেজরা মিয়ানমারের জঙ্গলের গাছকাটার জন্য এবং ধান চাষের জন্য প্রধানত বাঙালি নমঃশুদ্রদের ও অবাঙালি অন্ত্যজদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক যেভাবে তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফিজি, মরিশাস ও লাতিন আমেরিকায় ভারতীয়দের জোর করে বা ফুসলিয়ে কায়িক শ্রমের জন্য তুলে নিয়ে গিয়েছিল । দ্বিতীয় কারণ হলো বিনয় মজুমদারের কবিতায় তাঁর চণ্ডাল বা নমঃশুদ্র হবার কথা বেশ কয়েকবার এসেছে । সম্ভবত তিনি আঁচ করেছিলেন, যে তাঁর চেয়ে কম প্রতিভাবান উচ্চবর্ণের কবিদের ওপর প্রতিষ্ঠান আলো ফেললেও তাঁকে রেখে দিয়েছে অন্ধকারে । তাঁর অসুস্হতার সংবাদ প্রচারের পরও তাঁর কবিতায় এই প্রসঙ্গটি এনেছেন তিনি, এবং রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি সম্পর্কে দুর্বলতার উৎসও হয়তো তাঁর জন্মসূত্রের এই বোধ, আমার মনে হয়, কেননা সাধনা করার পর নারদ বাল্মীকিকে ঋষি ও ব্রাহ্মণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, যদিও বিনয় বলেছেন যে ‘বাল্মীকি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বলে তাঁর একটি বিতর্কিত বইয়ের নাম ‘বাল্মীকির কবিতা’ ।
    সেই সময়ের মিয়ানমারে নিম্নবর্গের ভারতীয়দের বলা হতো ‘কা-লা’ অথবা ‘কা-লার’, তাদের ত্বক কৃষ্ণবর্ণের বলে। নিজের দেহত্বক সম্পর্কে সেনসিটিভ ছিলেন বিনয়, তিনি লিখেছেন, “সত্যব্রতর বাবাকে আমি দেখেছি/সত্যব্রতর বাবা-ই তখন রাজা/রাজা বলে যে দুধের মতন সাদা গায়ের রঙ তা নয়/প্রায় আমার মতনই গায়ের রঙ।” উল্লেখ্য যে বিনয় মজুমদার সম্পর্কে পশ্চিমবাংলায় যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিম্নবর্গের ।
    বাংলাদেশের একটি পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীম, অমলেন্দু বিশ্বাস, মানসী কীর্তনীয়া এবং মানসী সরকারকে ২০০১ সালে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এই ধরণের প্রশ্নোত্তর হয়েছিল:-
    প্রশ্ন : আপনার পাণ্ডুলিপিখানা এখানে ছাপানোর ব্যবস্হা না করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের মিউজিয়ামে পাঠানোর উদ্দেশ্য কী ? এখানে কি কোনও রহস্য আছে ? কোনও গোপন ব্যাপার না থাকলে খুলে বলুন ।
    বিনয় : মূল উদ্দেশ্য — নমঃশূদ্র । আসল কথা হচ্ছে এটা । নমঃশূদ্র সমাজে তখন কবি বলে কেউ ছিল না । আমি প্রথম নমঃশূদ্র কবি । আমার কবিতা লিখতে বহু কষ্ট করতে হয়েছে । বহু অবহেলা সইতে হয়েছে । আমার বই কেউ ছাপতো না । প্রথম ছাপল মীনাক্ষী দত্ত, তার মানে জ্যোতির্ময় দত্তর বউ অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে — ১৯৬৮ সালে । টাকা দিয়েছে মীনাক্ষী দত্ত নিজে । অথচ ‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রথম ছাপা হয় ১৯৬২ সালে । তারপর, সেই নমঃশূদ্র বলে তো এখনও অবহেলা সইতে হচ্ছে ।
    প্রশ্ন : সেটা কি কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকেও ?
    বিনয় : কবিদের কাছ থেকে, খবরের কাগজের কাছ থেকে, পত্রিকার কাছ থেকে, প্রকাশকের কাছ থেকে, অনুবাদকের কাছ থেকে, সমস্ত । দেখলাম ভেবে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’টাকে বাঁচাতে হয় । আমার নিজের টাকায় তো ছাপা সম্ভব না । এত বড় বই, টাকা পাব কোথায় ? আমার চাকরি তো নেই । সুতরাং পাঠিয়ে দিলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ামে । থাকুক ওদের কাছে । ওদের কাছে থাকলে তবু একটা সান্ত্বনা থাকবে যে — আছে ।
    বিনয় মজুমদারের দুটি রচনা আমার চোখে পড়েছে, হয়তো আরও কয়েক জায়গায় লিখে থাকবেন মনের কথা, অভিমানের কথা, প্রথম কবিতাটিতে উচ্চবর্ণের কবিরা, যাঁরা তাঁকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির মাধ্যমে কোনঠাশা করে দিয়েছিল, তাঁদের তিনি বলছেন নাপিত, যে কবিরা শরীরের চুল কামিয়ে দ্যায় এবং চুগলি করে বেড়ায় । দ্বিতীয় কবিতাটি লেখার সময়ে তাঁর মনে যে মাইকেলের উক্তি বিঁধেছিল, তা প্রকাশ হয়ে পড়ে, নয়তো সাধারণ পাঠকরা মধুসূদনের লাইন তিনটি মনে রাখবেন না ।

    নাপিত বনাম নমঃশুদ্র
    নাপিত উপরে নাকি নমঃশুদ্র সম্প্রদায় উপরে — এ কথা
    যখন আলোচ্য হল তখন কেবলমাত্র এই বললাম
    সাহিত্য দিয়েও নয়, গোপাল ভাঁড়ের গল্প দিয়ে
    নয়, রাজনীতি দিয়ে ভাবো । কতজন মন্ত্রী হয়েছে এ
    নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ে — তাই দিয়ে ভাবো ।
    নাপিতদের কেউ মন্ত্রী হতে পারেনি তো আর
    বহু নমঃশুদ্র মন্ত্রী হয়েছে তো এ যাবৎ গুনে গুনে দ্যাখো ।
    এই রাজনীতি দিয়ে বোঝা যায় নমঃশুদ্র সম্প্রদায় নাপিতের উপরেই ঠিক ।
    ( ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য [ ২০০৭ ] বই থেকে )

    সত্যব্রত ও আমি
    কবি মধুসূদন দত্তের কবিতা :
    ‘চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে ।
    কিন্তু নহি গঞ্জি তেমা, গুরুজন তুমি
    পিতৃতুল্য, ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে…’
    মধুসূদন দত্ত এই কবিতা লেখার শ-খানেক বছর পরে
    মৈমনসিংহের রাজা সত্যব্রত চৌধুরী এবং চণ্ডাল আমি
    এক ঘরের ভিতরে দুই বছর ছিলাম — ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ।
    এইসব আমি ভাবি এবং অবাক হয়ে যাই ।
    সত্যব্রত ব্রেকফাস্ট খায় FIRPO হোটেলে ।
    এবং বর্তমানে ৭২ বছর বয়সে চা খাই তা সিনেমায়
    তুলে নিয়ে গেছে ঢাকার মুসলমানরা । আমি
    FIRPO রেস্তোঁরায় একবারই ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলাম
    সত্যব্রতর সঙ্গে ।
    ( ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য [২০০৭ ] বই থেকে )

    বিনয় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন তখন সত্যব্রত চৌধুরী নামে তাঁর এক সহপাঠী ছিল । সত্যব্রতর বাবা ছিলেম ময়মনসিংহের জমিদার । সত্যব্রতর দাদা শ্রীপতি চৌধুরী ছিলেন সিনেমার হিরো । কবি বিমল চন্দ্র ঘোষ তখন সিনেমার গান লিখতেন । সত্যব্রত চৌধুরী বিনয়কে বিমলচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দ্যান । বিমলচন্দ্র ঘোষ, বিনয় জানিয়েছেন, থাকতেন যদু ভট্টাচার্য লেনে এবং শীত গ্রীষ্ম যাই হোক, লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকতেন । পাশে একটা বিরাট আকারের অ্যাশট্রে । তাতে অজস্র ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের টুকরো । উনি বিনয়কে বলেছিলেন, তোমার কবিতা আমাকে দেখাবে তো । তখন প্রত্যেক রবিবার বিনয় যেতেন বিমলচন্দ্র ঘোষের বাড়ি । বিমলচন্দ্র ঘোষ কয়েকটা কবিতা প্রকাশ করেছিলেন ‘বারোমাস’ পত্রিকায় । বিমলচন্দ্র ঘোষের আগে রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন বিনয় । কবিতার খাতা দিয়ে এসেছিলেন । রমাপদ চৌধুরী তখন ‘ইদানিং’ নামে একটা পত্রিকা বার করতেন । রমাপদ চৌধুরী কয়েকদিন খাতাটা রেখে বিনয়কে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, তুমি লিখে যাও, লিখে যাও ।
    বন্ধু মনোজ বিশ্বাসকে বিনয় মজুমদার একবার বলেছিলেন, “জানিস, মজুমদার পদবিটা নবাব-বাদশার কাছ থেকে পাওয়া যেতো । আমার মনে হয় ওরা যদি বুদ্ধি করে মজুমদার না দিয়ে, মজুতদার দিতো, তাহলে খুব মানানসই হতো — বিনয় মজুতদার । কি রে, মজুতদার দিলে ভালো হতো না ? দেখ না, কতো যন্ত্রণা, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, ব্যথা সব একটা খাঁচার মধ্যে মজুত করে বসে আছি !”
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানিরা মিয়ানমার আক্রমণ করলে আরও বহু বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বিনয় মজুমদারের বাবা বিপিনবিহারি মজুমদার ( বিনয়ের মায়ের নাম বিনোদিনী, ঠাকুরনগরের শিমুলপুর গ্রামে তাঁদের বাড়িটির নাম ‘বিনোদিনী কুঠি’ ) ছয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে ফিরে এসে বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকা ডিভিশনের গোপালগঞ্জ উপজেলার ( সে সময়ের ফরিদপুর জেলা ) বৌলতলিতে তাঁদের আদি নিবাসে বসবাস আরম্ভ করেন । বিনয়ের ঠাকুর্দার নাম নিমচাঁদ । বিনয়ের বাবা মারা গেছেন ৯৩ বছর বয়সে, ১৯৮৪ সালের ৪ঠা জুলাই । তাঁর ছয় মাস আগে মা মারা যান ।
    বেশির ভাগ বাঙালি যুদ্ধের সময়ে মিয়ানমার থেকে পায়ে হেঁটে বর্তমান বাংলাদেশে ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছে ছিলেন । বিপিনবিহারি মজুমদারও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে পৌঁছেছিলেন । বাংলাদেশের উপরোক্ত পত্রিকায় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের বিনয় বলেছিলেন যে, “পাহাড় দিয়ে আমি হেঁটেছি যুদ্ধের সময় । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে আমি নাগা খাসিয়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে ফিরেছি।” অতো দীর্ঘ পথ সাড়ে সাত বছরের বালকের পক্ষে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না । একজন নাগা শ্রমিকের পিঠের ঝুড়িতে বসে বিনয়কে অনেকটা পথ পেরোতে হয়েছিল । তার স্মৃতিতে তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন :-

    একটি নাগার কথা
    একটি নাগার কথা মনে এল কেন যে হঠাৎ।
    চা বাগানে মহিলারা যেমন ঝুড়িটি পরে, ফিতে
    কপালে ঝুলিয়ে নিয়ে, তেমনি একটি ঝুড়ি পরে
    সেই ঝুড়িটির ‘পরে আমাকে বসিয়ে সেই নাগা
    হেঁটে হেঁটে আসছিল উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালে ।
    তার মানে নাগাটির পিঠে ঝুড়ি, ঝুড়ির উপরে আমি বসা,
    ঝুড়িটি তো ঝুলছিল নাগার
    কপাল থেকে ফিতের সাহায্যে তাই মনে পড়ে গেল ।
    এভাবে আমাকে বয়ে আনছিল উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালে ।
    ( শিমুলপুরে লেখা কবিতা – ২০০৫ )
    বিনয়ের ভাই-বোনদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি, তাঁর এক প্রয়াত অগ্রজ অনিল মজুমদার-এর তথ্য ছাড়া, যিনি মধ্যমগ্রামের হৃদয়পুরে বসবাস করতেন, এবং সম্ভবত মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্হতায়, অর্থাৎ স্কিৎসোফ্রেনিয়ায়, আক্রান্ত হন । মেজো ভাই সুনীল কোথায় থাকতেন জানি না। দূর সম্পর্কের অথবা পরিচিত এক দিদি হাবড়ায় থাকতেন, এবং বিনয় মজুমদারের মৃত্যুর পর দিদির ছেলে উত্তম বিশ্বাস বিনয় মজুমদারের রচনাগুলো প্রকাশের দিকে খেয়াল রেখেছেন । পারিবারিক তথ্য প্রয়োজন এই জন্য যে মধ্যবয়সে তাঁদের পরিবারে অন্যান্য সদস্য ও আগের প্রজন্মের সদস্যরা অপ্রকৃতিস্হতা্য ভুগেছিলেন কিনা, কেননা আমার এক কাকা এবং মেজ জ্যাঠা মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্হতায় আক্রান্ত হন, আমার ঠাকুর্দার ছোটো ভাইও মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্হতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ।
    অপ্রকৃতিস্হ বলতে আমি পাগল বলছি না, অসংলগ্ন কথাবার্তা বা আচরণের কথা বলছি, স্কিৎসোফ্রেনিয়ার কথা বলছি । মস্তিষ্কের রোগ আর জিনগত রোগের মধ্যে পার্থক্য আছে । জিনগত রোগ সারাবার জন্য জিন এডিটিং অথবা জিন থেরাপি করতে হয়, যা আমাদের দেশে এখনও এসে পৌঁছোয়নি । তা সম্ভব না হলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে বসবাস থেরাপির কাজ করে । স্কিৎসোফ্রেনিয়া মূলত একটি জিনগত রোগ, এই জিনগত রোগ হোমো স্যাপিয়েনদের দেহে প্রবেশ করেছিল বহুকাল আগে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে,, যখন তাদের সঙ্গে নেয়ানডারথালদের সম্পর্ক ঘটে । বাংলাভাষায়, আমাদের দুর্ভাগ্য যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখলেই তাকে পাগল বা ক্ষ্যাপা বলে চালিয়ে দেয়া হয় । ‘পাগল’ ছাড়া আর কোনো শব্দই নেই ।
    স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বিদেশি কবি ও শিল্পীদের কথা আমরা জানি, যেমন আঁতোয়াঁ আর্তো, কনস্ট্যানটিন বাতিয়ুশনভ, রিচার্ড ব্রটিগান, ভিক্টর হিউগোর মেয়ে আদেলে হিউগো, ফিনল্যাণ্ডের কবি ইউনো কাইলাস, রাশিয়ার ব্যালে নর্তক ভাসলাভ নিজিন্সকি, লর্ড বায়রন, ডিলান টমাস, পাবলো পিকাসো, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গণিতজ্ঞ জন ন্যাশ যাঁর জীবনকাহিনি নিয়ে ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ নামের একটি ফিল্ম হয়েছিল । আর বলা বাহুল্য ভ্যান গগ । মধ্যবয়স থেকে এই বিকলনের কারণে পিকাসো অতিযৌনতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ।
    পশ্চিমবাংলায় ঋত্বিক ঘটক, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, রামকিঙ্কর বেইজ মানসিক বিকলনে আক্রান্ত হয়েছিলেন । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও চিকিৎসা করিয়েছেন লুম্বিনি পার্ক মানসিক চিকিৎসালয়ে । তাঁরা স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন না । তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপার আচরণকে আমরা মনে করি সাধকের স্বাভাবিক দিনানুদৈনিক ব্যাপার, দাহরত শবের মাংসভক্ষণকে কেউই মস্তিষ্কবিকৃতি বলে মনে করেননি । রামপ্রসাদ সেন গঙ্গায় গলা পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন, হিসেবের খাতায় শ্যামাসঙ্গীত লিখতেন, আমরা কখনও ভাবিনি যে তাঁকে ইলেকট্রিক শক দিতে হবে । তার কারণ প্রাগাধুনিক কালখণ্ডে সাধকদের সেই কাজগুলোকে আমরা স্বাভাবিক মনে করতুম । অঘোরী এবং তান্ত্রিকদেরও বঙ্গসমাজে পাগল বলা হতো না । বিনয় মজুমদারকে বার বার পাগল বলা হয়েছে বলে তিনি অপমানিত, আহত ও বিরক্ত বোধ করতেন ।
    বিনয় মজুমদারদের পারিবারিক পদবি ছিল মৃধা, এবং বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় তাঁদের গ্রামের বাড়িকে গ্রামবাসীরা মৃধাবাড়ি নামে চিনতো । ব্রিটিশ পি ডাবলিউ ডিতে চাকরি পাবার সময়ে বিনয়ের বাবা মৃধা পদবি ত্যাগ করে নবাবি আমলে পাওয়া মজুমদার পদবি নিয়েছিলেন । অবিভক্ত বাংলায় ফিরে ১৯৪২ সালে বিনয় মজুমদার গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলির তারাইল পাঠশালায় ভর্তি হন । ১৯৪৪ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হবার পর তাঁকে ভর্তি করা হয় ফরিদপুর হাই ইংলিশ স্কুলে । তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল স্কুলের ম্যাগাজিনে । কিন্তু বৌলতলিতে বেশিদিন বসবাস করা সম্ভব হয়নি । সুরাবর্দির ডায়রেক্ট অ্যাকশান ডের আহ্বানে হিন্দু ও মুসমান সম্প্রদায়ের মাঝে বহুকালের যে সম্পর্ক ছিল তা ভেঙে পড়া আরম্ভ হয়, ক্রমশ বৌলতলিতেও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আরম্ভ হলে অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে ১৯৪৮ সালে বিপিনবিহারী মজুমদারও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে হিন্দু উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন, কলকাতার উপকন্ঠে ঠাকুরনগরের শিমুলতলা গ্রামে চাষের জমিজমা কিনে বসবাস আরম্ভ করেন ।
    ভারতে চলে এসে বিপিনবিহারী মজুমদার বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন । গত বছরে, মানে ২০১৬ সালে, আমরা দেখেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের পরিবারদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল, আর দুর্গাপুজো-কালীপুজোর সময়ে তাঁদের উৎসব ভণ্ডুল করে দিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল । তা সত্ত্বেও সেখানকার নামকরা কবি-লেখকরা সরকারি খুদকুঁড়ো পাবার আশায় মুখ খোলেননি । দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্গের হিন্দু কমিউনিস্ট নেতারা দেশভাগ সমর্থন করেছিলেন । দেশভাগ হতেই সবচেয়ে আগে পালিয়ে আসেন তাঁরা, সেখানকার নিম্নবর্ণ হিন্দুদের দিশেহারা করে দিয়ে, আর পশ্চিমবঙ্গে এসে সাম্যবাদের নামে গদি দখল করে বসেন । নমঃশুদ্র জনগণকে পূর্ব পাকিস্তানে ধরে রাখার জন্য জিন্নাহ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছিলেন । যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের আশ্বাসে বেশির ভাগ নিম্নবর্ণের পরিবার থেকে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে । যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, যিনি নিজেও নমঃশুদ্র ছিলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত করাচিতে বসবাস করে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা সহ্য করতে না পেরে ভারতে পালিয়ে আসেন, এবং লিয়াকত আলি খানকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন ।
    বিনয় মজুমদার জন্মেছিলেন মিয়ানমারের মেকটিলা অঞ্চলের তেডো শহরে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, অর্থাৎ, দেশভাগজনিত সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বৌলতলীর দাঙ্গায় ভিটা ছাড়ার সময়ে তাঁর বয়স ছিল চৌদ্দ বছর । মিয়ানমার ছাড়ার সময়ে তাঁর বয়স ছিল সাড়ে সাত বছর । যুদ্ধ ও দাঙ্গায় আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দেশ থেকে দেশান্তর ও স্হান থেকে স্হানান্তর, এই বিপর্যস্ত জীবন কাটানোর দুঃসহ ঘটনাবলী বিনয় মজুমদারের শৈশব-কৈশোরের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে থাকবে । স্কিৎসোফ্রেনিয়ার দুটি উৎসের কথা বলেছেন মনোবিদরা, পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর প্রভাবে স্কিৎসিফ্রেনিয়া জিনের প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা, এবং বংশপরম্পরায় পাওয়া জিন যা যৌবনে দেখা দেয়। মিয়ানমার থেকে পলায়ন, দেশভাগজনিত দাঙ্গার প্রভাব কিশোর বিনয়ের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল নিঃসন্দেহে, এবং আমার মনে হয়, বংশের জিনগত প্রভাবও ছিল, কেননা বিনয়ের মৃত্যুর আগের দিন তাঁর মধ্যমগ্রাম নিবাসী দাদা অনিলবরণ মজুমদারকে ‘কবিতীর্থ’ সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্য ফোনে মৃত্যুশয্যায় বিনয়ের শারীরিক অবস্হা জানানো সত্বেও তিনি কোনো আগ্রহ দেখাননি ; বরং বিরক্ত বোধ করেন তাঁকে জানাবার জন্য ।

    তিন
    ১৯৮২ সালে সমর তালুকদারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছেন যে, “আমার বাবা ১৯৪৮ সালে এখানে ( শিমুলপুর ) এসে প্রায় এগারো বিঘার মতন জমি কিনে এই ছোট্ট বাড়িটা তেরি করেন । তখন এক বিঘা জমির দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা । এখানে ঠাকুরনগর স্টেশানটি হয়েছে প্রাক্তন এম. পি. ঠাকুরবাবুর প্রচেষ্টায় । লোকও বেড়েছে অনেক । স্টেশনের কল্যাণে এখন জমির দাম কুড়ি হাজার টাকা বিঘা । এই তো, সেদিন বাবা দু’বিঘা জমি বিক্রি করে দিলেন ।”
    ১৯৪৯ সালে তাঁকে, বিনয় মজুমদারকে, কলকাতার মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউটের বউবাজার শাখায় ক্লাস নাইনে ভর্তি করা হয়েছিল। ১৯৫১ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এস সি তে ভর্তি হন । সেই ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পান । এর পর বিনয় মজুমদার শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে স্নাতক হন, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম । ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি । ইঞ্জিনিয়ার হবার পর কিছুকাল চাকরি করেন ইনডিয়ান ইন্সটিউট অফ পাবলিক হেল্হ দপতরে, ইনডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিউটে, অধ্যাপনা করেন ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, এবং ইঞ্জিয়ারের চাকরি করেন দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে ।
    কলকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবের কারণে এবং কবিতা রচনায় একাগ্র হতে চাইছিলেন বলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতা ফিরে আসেন। অবশ্য চাকুরিস্হলে তাঁর সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন না, সেটাও একটা কারণ । মারুফ হোসেনকে ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “১৯৫৭ সালে আমি ছাত্রাবস্হায় কিছু যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলাম । সে সময়ে আমার সহপাঠী ও শিক্ষকেরা যে ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে তা ভোলবার নয় । তারপর চাকরি করলাম সেখানেও সহকর্মীরা আমার সঙ্গে যা ব্যবহার করলেন চাকরি ছেড়ে দিলাম । তখন মনে হল জীবনে একবার মাছের মতো শ্বাস নিতে জলের ওপরে উঠেছিলাম ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে । ইঞ্জিনিয়ারিঙে রেকর্ডস মার্কস পেয়ে ।”
    তারপর থেকে তিনি নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালিত করেছেন, তাঁর কবিতার স্পেকট্রাম বিশাল হয়ে ওঠে, গণিতবিদ রামানুজম এবং সুফি সন্তের চরিত্রের মিশেলে যে ধরণের প্রতিস্ব গড়ে উঠতে পারে, বিনয় পেয়েছিলেন সেরকমই প্রতিস্ব । এই বিশাল পরিধিতে ধরে রাখা জ্ঞান ও কবিত্বের সময়ানুগ বাঁকবদলগুলো তাঁকে বাংলা কবিতার বোধিবৃক্ষ করে তুলেছে । বলা যায় যে জীবনানন্দের পর তিনি বাংলা কবিতার প্রধান বাঁকবদলকারী কবি । বিনয় জীবনানন্দের মতন কবিতার একটি জনারেই আটক থাকেননি । চারটি বিভিন্ন সাব-জনারে ( sub-genre ) কাজ করেছেন, এবং তৃতীয়টি দুঃসাহসিক কাজ, বলা যায় মধ্যবিত্ত ডিসকোর্সকে ফাটিয়ে চৌচির করে দিয়েছেন ‘বাল্মীকির কবিতা’ নামের কাব্যগ্রন্হের সাব-জনারে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ কাব্যগ্রন্হের জনার থেকে বেরিয়ে যেতে চাননি, সারা জীবন তাতেই নিজেকে আটক রেখেছিলেন ।
    বিনয় মজুমদার প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তিনি চাকরি ছেড়ে কবিতা লেখা আরম্ভ করেন বন্ধুদের কথায় — শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, দীপক মজুমদার, শরৎ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের কথায় । অথচ বিনয় যখন ঠাকুরনগরে নিষ্কপর্দক অবস্হায় জীবন কাটাচ্ছেন তখন তাঁর বন্ধুরা প্রতিষ্ঠিত, এবং ইচ্ছা করলেই বিনয়কে দিয়ে কোথাও অর্থকরী লেখালিখির ব্যবস্হা করে দিতে পারতেন । ২০০১ সালে শামীমুল হক শামীমকে বিনয় বলেছিলেন, “চাকরি না করে আমি ছিলামও বটে । ওরা চাঁদা তোলা শুরু করল বটে এবং দিয়েও ছিল বছরখানেক, বছর দেড়েক । তারপরে কিন্তু চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিল । আমি অত্যন্ত, অতিশয় কষ্টে, দিন কাটিয়েছি তারপর । ১৯৬৪ সালের পরে ১৯৭০ সালে আমি আমার বাবার কাছে এখানে চলে আসি । ছয় বছর আমি অত্যন্ত টাকার অভাবে ভুগেছি । টাকার অভাব দেখে বাবা আমাকে ১০০ টাকা করে দিত । আমি প্রতি মাসে পয়লা তারিখে শিমুলপুর এসে টাকা নিয়ে চলে যেতাম কলকাতায় । কলকাতায় ঘর ভাড়া করে ছিলাম।”
    বিনয় মজুমদার সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক কবিদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গী ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সমর তালুকদারের ১৯৮২ সালের এই কটি কথা থেকে টের পাওয়া যায়, যা সমরবাবু বিনয়ের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে লিখেছেন : “কফিহাউসের টেবিলে এক সন্ধ্যায় হঠাৎ হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে বসলেন শ্রীঅমিতাভ দাশগুপ্ত, বসেই চিৎকার করে হাসতে শুরু করে দিলেন, সে হাসি থামতেই চায় না — আমরা যারা টেবিলে ছিলাম ভেবে নিলাম বোধহয় ক্লাবে ( খালাসিটোলায় ) প্রচুর হয়েছে । হাসি থামতে বললেন, ‘তোমরা শালারা একেবারেই অপদার্থ। কলকাতায় কী ঘটছে কিছুরই খবর রাখো না ।’ সত্তরের দশক — বড়-বড় চোখ করে ওঁর দিকে চেয়ে থাকলুম দুরুদুরু বুকে — এবার কে গেল ? কোন শ্রেণিশত্রু ! অমিতাভ বললেন, ‘বিনয়দা এ-যাত্রা বেঁচে গেলেন — গোবরা মানসিক হাসপাতালে আছেন — স্নানটা অন্তত করছেন নিয়মিত — খাওয়া দাওয়াও মন্দ করছেন না । বেশিরভাগ একা-একাই থাকেন, আর কী সব নাকি বিড়বিড় করে বলেই চলেন অনবরত । শুনেছি পাশের ঘরে এসে জুটেছিলেন ঋত্বিক ঘটক । বাংলা মদের সাপলাইয়ের কোনও অভাব ছিল না । এ যেন একটা এক্সকারশান । ওখানেই ঋত্বিক শেষ করেছেন তাঁর ‘জ্বালা’ নাটক, অভিনয়ও হয়ে গেছে ওই গোবরাতেই — প্রধান ভূমিকায় বিনয় মজুমদার ।”
    পরে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, “আমি সাম্প্রতিক কালের এক কবির সম্পর্কে আস্হা রাখি, যিনি কবিতার জন্য যথার্থ জন্মেছেন । আমার মনে হয় এ-কালে বাংলাদেশে এতোবড় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কবি আর জন্মাননি । তিনি হলেন বিনয় মজুমদার।” প্রৌঢ় বয়সে বিনয়ের স্মৃতি থেকে ঋত্বিক ঘটক মুছে গিয়েছিলেন ; বিনয় বলেছিলেন, ঋত্বিকের সম্পর্কে তাঁর কিছুই মনে নেই ।
    আমরা যারা সেই সময়ের অমিতাভ দাশগুপ্তকে খালাসিটোলায় মাতাল অবস্হায় উল্টোপাল্টা আচরণ করতে দেখেছি, বলতুম যে উনি হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিলিপি । সেই সময়ে কলকাতায় মধ্যবিত্ত কমিউনিস্টদের বাংলা মদ অর্থাৎ শ্রমজীবিদের পানীয় খেয়ে বিশেষ বুদ্ধিজীবি প্রমাণ করার চল ছিল । তাছাড়া বুদ্ধদেব বসু বাঙালি লেখকদের বদলেয়ার, হেনরি মিলার, অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখের জীবন ও কাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর অনেকেই এই বিদেশি কবি-লেখকদের জীবনকে আত্মস্হ করার প্রয়াস করেছিলেন সেসময়ে, মদের জমঘট এবং যৌনপল্লীতে সমবেত হইচইয়ের মাধ্যমে ।
    বস্তুত বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো,চাকা’ ছিল বাংলা কবিতার জগতে, আগেই বলিছি, ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ; ওই কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলোর পাশে পঞ্চাশ দশকের কবিদের কাজগুলো জোলো হয়ে যাচ্ছিল, একমাত্র শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ ছাড়া । শক্তির ছন্দময় অথচ দুর্বোধ্য কবিতার তুলনায় বিনয়ের কবিতা তরুণ কবিদের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল, তার কারণ তাঁর কবিতার ক্ল্যারিটি এবং অসাধারণ রূপকল্প । ফলে বিনয়ের বিরোধিদের সংখ্যা এবং ক্ষতিকারক লবি বেড়ে উঠতে সময় লাগেনি । বিনয়ের কবিতার উচ্ছ্বসিত বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্ময় দত্ত ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখার পর বিরোধিরা আরও বেশি বিনয়-নিন্দা আরম্ভ করে দিয়েছিল । ‘দি স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্র সেসময়ে বর্তমানকালের আনন্দবাজারের চেয়ে বেশি নজরকাড়া প্ল্যাটফর্ম ছিল । সমসাময়িকদের কার্যকলাপে বিনয়ের ক্রুদ্ধ ও অপমানিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, বিভিন্ন টেবিলে গিয়ে তিনি গালমন্দ করতেন । একদিন তিনি কফিহাউসের এক বেয়ারার মাথায় লাঠি মারার দরুন বেয়ারাদের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হন আর কুড়ি দিনের জেল-হাজতবাস করতে হয় । সেসময়ে গুজব ছিল যে তাঁর সমসাময়িক কয়েকজন কবি তাঁকে উসকেছিলেন।
    কলকাতার বিরক্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বিনয় মজুমদার ১৯৬৬ সালে পায়ে হেঁটে বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান, ফরিদপুরের নিজেদের গ্রাম তারাইলে, তখন তাঁর বত্রিশ বছর বয়স । গ্রামে গিয়ে আত্মীয় আর পরিচিত লোকজন পেয়ে গেলেন । সেখানকার যুবকেরা দিব্বি তাঁর আদর আপ্যায়ন করল । ভোরবেলা একজনকে ইংরেজি পড়াতেন, দুপুরবেলায় শেখাতেন অঙ্ক। আর রাত্রিবেলা চার-পাঁচজনকে পড়াতেন — ক খ গ ঘ থেকে শুরু করে ক্লাস নাইনের পড়া পর্যন্ত । বাকি সময়টা আড্ডা মেরে বেড়াতেন । থাকা খাওয়া আর সিগারেটের বিনিময়ে । কলকাতা ছেড়ে সেখানে বেশিদিন থাকতে ভালো লাগলো না । একদিন স্হানীয় থানায় গিয়ে জানালেন যে তিনি অনধিকার প্রবেশকারী ভারতীয় নাগরিক, বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন, তাঁকে যেন ভারতে ফিরে যেতে বলা না হয়, যদি দরকার হয়, তিনি মুসলমান হয়ে যেতে রাজি, তিনি মুসলমান হয়েই তাঁর গ্রামে থাকবেন যেখানে তাঁর বাবা-মা জন্মেছিলেন, তাঁকে যেন ভারতে পাঠানো না হয় ।
    বিনয় জানিয়েছেন, “ঢাকা থেকে গোয়েন্দা এলো । আমাকে বলল, কবিতা লেখেন নাকি ? কাগজ দিচ্ছি, লিখুন দেখি কী কবিতা লেখেন । ফোটো তুললো আমার । সামনে, দুই পাশে, চুল দাড়িসহ, চুলদাড়ি কামিয়ে ইত্যাদি নানাভাবে ফোটোতোলা হল।” বিচারাধীন আসামি হিসাবে ছ’মাস জুডিশিয়াল কাস্টডিতে থাকার পর তাঁকে বেকসুর মুক্তি দেয়া হয় । সেই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বিনয় বলেছেন, “আমাদের হাজতের চেয়ে ওদের হাজত অনেক ভালো । লোকগুলো ভদ্র, খাওয়াদাওয়া ভালো । সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো কী জানো, যত্ন করে বেশ কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিলে, সঙ্গে দু’পাশে দু’জন এসকর্ট, যারা আমাকে সীমান্ত অব্দি পৌঁছে দিয়েছিল ।”
    শামীমুল হক শামীম বিনয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “হঠাৎ মুসলমান হবার আকাঙ্খা জাগল কেন ?” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “তখন এত কষ্টের ভিতরে চলছিল অবস্হা হিন্দুদের নির্যাতনে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাওয়ার যোগাড় । তখন আমি পালিয়ে চলে গেলাম ফরিদপুর । বাল্যকালের বন্ধবান্ধবদের সঙ্গে দেখা । আমি বললাম মুসলমান হব । আমাকে তোমরা তোমাদের ধর্মে নিয়ে নাও । তারপর তারা বহু ভেবে বলল — তোমাকে আমরা মুসলমান করব না, তুমি হিন্দুই থাক । তোমাকে আমরা মুসলমান করতে রাজি নই ।”
    পরে, ১৯৯৮ সালে ধর্ম নিয়ে বিনয় মজুমদার এই কবিতাটি লেখেন ( ‘কবিতা বুঝিনি আমি’ কাব্যগ্রন্হের অন্তর্ভূক্ত ।

    এই এক
    এই এক গুপ্ত রোগ পৃথিবীর সবার হয়েছে ।
    যদিও গোপন খুব, তবুও সংবাদপত্রে মাঝে-মাঝে ছাপে —
    এসব রোগের কথা নিক্তি অনুসারে
    ছাপা হয়ে যায় দেখি । আড়াই হাজার বছর
    আগের ডাক্তার বুদ্ধ কিছু কিছু ওষুধ বলেছে–
    সে-সব ওষুধে কিন্তু মায়ামৃত সুফল ফলেনি ।
    আরেক ডাক্তার ছিল হজরত মোহম্মদ, তার
    কথামতো ওঠে বসে রোগীগণ, তবু
    রোগ তো সারে না, আরো বেড়ে যায়, দেখি
    সীমান্তেও গুলিগোলা অল্প স্বল্প বিনিময় হয় ।

    বিনয় মজুমদারের নিজের কলমেই পড়া যাক কবিতার বিশ্বে তাঁর প্রবেশের কথা : “কৈশোর থেকেই আমি কবিতা লিখতে শুরু করি । প্রথম কবিতা যখন লিখি তখন আমার বয়স তেরো বছর । নানা কারণে সেই ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে । কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিল এই : এক পালোয়ান বাজি ধরে একটি চলন্ত মোটরগাড়িকে টেনে পেছিয়ে নিয়ে এলো । এর পরেও আমি মাঝে-মাঝে কবিতা লিখতাম । কিন্তু ষোলো-সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত কী লিখেছিলাম, কবিতাগুলির দশা কী হয়েছিল কিছুই এখন আর মনে নেই । তখন কলকাতার স্কুলে পড়ি । মাস্টারমশাইরা ঘোষণা করলেন যে স্কুলের একটা ম্যাগাজিন বেরোবে । ছাত্রদের কাছে লেখা চাইলেন । আমি একটা কবিতা লিখে ফেললাম ; তার একটা পংক্তি এখনও মনে আছে — ‘ভিজে ভারি হলো বেপথু যুথীর পুষ্পসার’ । মাস্টারমশাইয়ের হাতে নিয়ে দিলাম । তিনি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন । কিন্তু কী জানি কেন, শেষ পর্যন্ত সে ম্যাগাজিন আর বেরোলো না । এর পরবর্তী সময়কার কবিতা লেখার ব্যাপার একটু বিশদ ভাবেই আমার মনে আছে । স্কুল ছেড়ে কলেজে এসে ভর্তি হলাম এবং আমার কবিতা লেখার পরিমাণও কিছু বাড়লো । আমার একটি খাতা ছিল । ডবল ক্রাউন সাইজের চামড়ায় বাঁধানো, কাগজের রঙ ইঁটের রঙের মতো । খাতাটি খুব মোটা । আমার সব লেখাই এই খাতায় লিখতাম । স্কুলে কবিতা লিখতাম কচিৎ-কদাচিৎ । কিন্তু কলেজে উঠে নিয়মিত লিখতে শুরু করি । লিখতাম বেশ গোপনে-গোপনে, যাতে কেউ টের না পায় । কারণ আমি কবিতা লিখি — একথা কেউ বললে খুব লজ্জা হতো আমার । কলেজের হোস্টেলে থাকতাম । ফলে অন্যান্য আবাসিকরা শীঘ্রই জেনে ফেললো যে আমি কবিতা লিখি । আমার ঘরে দুটি সিট ছিল । আমার রুমমেটই বোধহয় ফাঁস করে দিয়েছিল খবরটা । আমাদের রান্নাঘরের দেওয়ালে একটা নোটিসবোর্ড টাঙানো ছিল । হোস্টেল কর্তৃপক্ষের নোটিসগুলি ঐ বোর্ডে আঠা দিয়ে সেঁটে লাগানো হতো । কিছু দিনের ভেতরেই ঐ নোটিশবোর্ডে আমার লেখা কবিতাও সেঁটে দিতে লাগলাম — সবগুলিরই বিষয়বস্তু হোস্টলের খাবার দাবার সম্বন্ধে ছাত্রদের অভিযোগ । সবই হোস্টেলের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট সম্পর্কে লেখা ব্যঙ্গ কবিতা । পড়ে ছাত্ররা কিংবা সুপারিনটেনডেন্ট যে প্রশংসা করতো তা নয় । ডালে কেন ডাল প্রায় থাকেই না, কেবল জল, মাংস কেন ঘন ঘন খেতে দেওয়া হয় না — এই সবই ছিল নোটিশবোর্ডে সাঁটা কবিতার বিষয়বস্তু । কলেজে একটা দেওয়াল পত্রিকাও ছিল । খুব সুন্দর হাতের লেখায় শোভিত হয়ে পত্রিকাটি নিয়মিত বেরোতো । আমার লেখা কবিতা কিন্তু কখনও এ-দেওয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি । সেই সময় আমার সব কবিতায় মিল থাকতো । মিলগুলি অনায়াসে মন থেকে বেরিয়ে আসতো । তার জন্য একটুও ভাবতে হতো না । কবিতা যখন লিখতাম তখন মনে হতো আগে থাকতে মুখস্হ করা কবিতা লিখে যাচ্ছি, এতো দ্রুত গতিতে লিখতে পারতাম । এক পয়ার ভিন্ন অন্য সব ছন্দেই লিখতাম । কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র, প্রায় সবই কাল্পনিক । দু’একটা বিষয়বস্তু অবশ্য আমার এখনও মনে আছে — চিল্কা হ্রদের ধারে এক সঙ্গিনীসহ বসে বসে চারিপাশে নিসর্গকে দেখছি বা এক সঙ্গিনীসহ মোটরগাড়িতে করে খুব দ্রুত বেগে চলেছি, মনে হচ্ছে গাড়িটা পৃথিবীর এক উপগ্রহ বিশেষ বা ট্রেনে করে দৈনিক লক্ষ লক্ষ কেরানি কী ভাবে চাকুরি করতে কলকাতায় আসে ইত্যাদি ইত্যাদি । সেই সময়ে লেখা কবিতাগুলো খুব দীর্ঘ হতো । ছোটো কবিতা আমি প্রায় লিখতে পারতাম না । এবার একটু আগের কথা লিখে নিই । আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, মনে হচ্ছে, তখনই সিগনেট বুক শপ নামক দোকানটি সবে খুললো । তখন দোকানের মালিক দিলীপবাবু নিজেই দোকানে বসে বই বিক্রি করতেন । কী করে যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো ঠিক মনে নেই । আমি তখন দৈনিকই ঐ দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম । বোধ হয় বই কিনতে গিয়েই আলাপটা হয়ে থাকবে । আমি প্রায় দৈনিক একখানা করে কবিতার বই তাঁর কাছ থেকে কিনতাম । রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাছা বাছা কবিদের বই অনেক কিনে ফেললাম, পড়েও ফেললাম সব । অথচ কোনো কারণে সেই বইগুলি মনে বিশেষ সাড়া জাগাতো না । বয়স কম বলেই হয়তো অমন হতো । যাই হোক, ইংরেজি ক্লাসিকাল কবিদের বই আমি প্রায়শই লাইব্রেরি থেকে এনে পড়তাম । সেই বয়সে তাদের কবিতা আমার ততো ভালো লাগতো না । আবার মনে হচ্ছে বয়স কম বলে অমন হতো — একথা বোধহয় ঠিক লিখিনি । কারন তখন রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুলির মধ্যে আমার ভালো লেগেছিল ‘প্রান্তিক’ নামক ছোটো বইখানি । এখনও আমার ঐ বইখানি সবচেয়ে ভালো লাগে । বয়স বাড়ার ফলে আমার সে অল্প বয়সের ভালো লাগা পাল্টায়নি । যা হোক আমি নিজে কী লিখতাম সেইটেই এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু । বিষয়বস্তু লিখেই মনে পড়লো কবিতা লেখার অন্যতম প্রধান ব্যাপার হচ্ছে একটি ভালো বিষয়বস্তু মনে আসা । তখনকার বিষয়বস্তু ছিল অধিকাংশ কাল্পনিক একথা আগেই লিখেছি । শহরের দৃশ্যাবলী — পথ ঘাট মাঠ বাড়ি — এসকল আমার কবিতার বিষয়বস্তুতে আসতো না । মাঝে-মাঝে গ্রামে আসতাম । গ্রামের দৃশ্যাবলীও আমার বিষয়বস্তু হতো না । অর্থাৎ কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি সেই বয়সেই লিখতে পারতাম না । এতোদিন পরে এখন কিছু কিছু লিখতে পারি । এ প্রসঙ্গে পরে আবার আসবো । ইতিমধ্যে কলেজ পালটে অন্য এক কলেজে চলে যেতে হলো । সেখানে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করতে হতো । সেখানে কলেজের পড়াশুনায় এতো বেশি সময় দিতে হতো যে অন্য কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করার সময় পাওয়া যেতো না । ফলে বছর দুয়েক আমার কবিতা লেখা বন্ধ থাকলো । গঙ্গার ধারে কলেজ, পাশেই বোটানিক গার্ডেন । নদীর পাড়ে বিরাট কাঠগোলা । আন্দামান থেকে জলপথে নিয়ে আসা বিশাল বিশাল সব কাঠের গুঁড়িতে নদীর পাড় ঢাকা। সেখান থেকে গঙ্গার দৃশ্য অপূর্ব । কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি তখনও লিখতে শিখিনি । ফলে সেই কলেজে থাকাটা আমার কাব্যচর্চার ভিতরে বিশেষ স্হান পায়নি । সেই কলেজে ছিলাম চার বছর ছাত্রাবাসে । তার প্রথম দু’বছর কবিতা লেখার সময়ই পাইনি । শেষ দু’বছর কিছু কিছু সময় পেতাম এবং মাঝে মাঝে লিখতাম । কাপড়ে বাঁধানো রয়াল সাইজের একটা প্রকাণ্ড ডায়েরি আমি যোগাড় করেছিলাম। মিল দিতে বিশেষ বেগ পেতে হতো না । মিল যেন আপনিই এসে যেতো । এই কলেজে আসার পর আমি পয়ারে লেখার চেষ্টা করতাম । কিন্তু দুঃখের বিষয় নির্ভুল পয়ার আমি একবারও লিখতে পারতাম না। কোথায় ভুল হচ্ছে সেটি স্পষ্ট টের পেতাম । কিন্তু সে ভুল শোধরাবার উপায় খুঁজে পেতাম না । তখন থেকে শুরু করে চার বছর লেগেছিল আমার পয়ার লেখা শিখতে । এবং ১৯৬০ সালের শুরুতে আমি পয়ার লেখার নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করি । তারপর পয়ার ভিন্ন অন্য কোনো ছন্দে লিখিইনি । এখন পয়ারই আমার প্রিয়তম ছন্দ । শুধু পয়ারেই লিখি । নানা কারণে এখন আমার মনে হয় কেউ নিখুঁত পয়ার লিখতে পারলেই তাকে কবি বলে স্বীকার করা যায়, স্বীকার করা উচিত । যাই হোক, সেই বয়সের কথায় ফিরে যাই। আমাদের কলেজ থেকে ছাত্রদের সম্পাদনায় একটা বার্ষিক সাহিত্য সংকলন বেরোতো । তাতে আমার লেখা কবিতা চেয়ে নিতো । গোটা কয়েক কবিতা ছেপেছিল । এই কলেজে পাঠকালে লেখা কবিতায় কাটাকুটি আবির্ভূত হয় । আগে কাটাকুটি করার বিশেষ দরকার হতো না । এবার দরকার হতে লাগলো । কবিতায় অলঙ্কার বলতে আগে দিতাম শুধু উপমা । এবার কবিতায় উপমার সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকও ব্যবহার করতে লাগলাম । সে সময়কার কবিতার খাতাগুলি আমি সব হারিয়ে ফেলেছি । আমার যতোদূর মনে পড়ে ঐ কলেজে চার বছরব্যাপী পড়ার সময়ে আমি গোটা পঞ্চাশ কবিতা লিখেছিলাম । শুধু যে সময়াভাব এর জন্য দায়ী তা নয় । কাব্যিক বিষয়বস্তুর অভাবও এর জন্য দায়ী । অনেক পরে আমি যে কোনো বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করি । অনেক পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বইয়ের এক সমালোচনায় লিখেছিলো, আমি যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে পারি, এমনকি ‘গু-গোবর’ নিয়েও আমি সার্থক কবিতা লিখতে পারি । কিন্তু তখনও অবস্হা অমন হয়নি । সেই কলেজে পাঠকালে ভাবলাম কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক, আর কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক নয় । এখন আমার মনে হয়, ব্যাপারটা তেমন নয় । সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক এবং যার দৃষ্টিতে এই কাব্যিকতা ধরা পড়ে, তিনিই কবি । এমনকি চিন্তা করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যে পদ্ধতিতে ভাবলে কাব্যিকতা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় । বিষয়বস্তুর মধ্যে কাব্যিকতা লুকিয়ে থাকে, তাকে বের করার জন্য চিন্তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে । এসব কথা আমি টের পাই, বুঝতে পারি, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের গোড়া থেকে । তার আগে জানতাম না । যাই হোক, ১৯৫৭-ও শেষ হলো, আমার কলেজে পড়াও শেষ হলো । পঠদ্দশা শেষ হয়ে গেল । কলেজের ছাত্রাবাস ত্যাগ করে আমি শেষ অবধি কলকাতায় চলে এলাম । এই সময় কুশল মিত্র নামে এক কবির সঙ্গে আমার আলাপ হয় । তার কবিতার বই তখন সবে বেরিয়েছে । যেদিন বেরোলো সেদিন তিনি বললেন, চলুন মিষ্টির দোকানে, আপনাকে মিষ্টি খাওয়াই । এই বইয়ের প্রকাশক দেবকুমার বসুর সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন । অধুনালুপ্ত ‘গ্রন্হজগৎ’ দোকানটি ছিল দেবকুমার বসুর । আমি মাঝে মাঝে দেবকুমার বসুর দোকানে গিয়ে বসে থাকতাম । আমি স্হির করলাম আমারও একখানি বই প্রকাশ করা দরকার । কলকাতায় তখন নিজেকে একেবারে নবাগতর মতন মনে হতে লাগলো । কফির আসরে, আড্ডাখানাগুলিতে, আমি যেতাম আমার অফিস ছুটি হলে পর । দেখতাম আলোচনার বিষয় সর্বত্রই সাহিত্য এবং রাজনীতি । অথচ বাংলা সাহিত্যের খবর আমি তখন রাখতাম না । রাখার সুযোগই হয়নি ইতিপূর্বে । ফলে আলোচনায় যোগদান করা আমার হতো না । চুপচাপ বসে শুনতাম কে কী বলে । তারপর ভাবলাম আর কিছু না হোক লোকজনের সঙ্গে মেশার জন্যই তখনকার কাব্যসাহিত্য কিছু পড়া ভালো । ফলে কিছু পড়াশুনা শুরু করলাম । এই সময় ‘দিগদর্শন’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আমার জানাশোনা হয় । তিনি আমার কাছ থেকে কিছু অনুবাদ চেয়ে নিয়ে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করলেন । আনুবাদগুলি কবিতার নয়, গদ্যের । এই সময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয় । ওঁরা তখন কবিরূপে অল্পপরিচিত । মোহিতবাবু তখন এম. এ. পড়তেন । আমি তখন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনায় মোটামুটি যোগদান করতে শিখছি । আমার কোনো কবিতা আমি কোনো পত্রিকায় পাঠাতাম না । আপন মনে লিখে খাতাতেই রেখে দিতাম । দেবকুমার বসু আমার কবিতার বই প্রকাশ করতে রাজি হলেন । আমি তখন আমার পুরোনো কবিতার খাতা ফের পড়তে লাগলাম । পড়ে মনে হলো, গোটা পঞ্চাশ কবিতার মধ্যে কবিতাপদবাচ্য বলা যায় গোটা পাঁচেককে । মনটা খুব দমে গেলো । তখন নতুন কিছু কবিতা লিখতে গেলাম । সব পয়ারে । বাছাই ইত্যাদি করে অতো ছোটো একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করা যায় বলে দেখা গেল । দেবকুমারবাবু অতি সজ্জন । তিনি বললেন, চলুন দেবুদার কাছে, মলাট আঁকিয়ে নিয়ে আসি । চললাম তাঁর সাথে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, বেলেঘাটায় । কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে তিনি একটা ছবি এঁকে দিলেন । অতি সুন্দর হলো দেখতে । বই ছাপা হয়ে বেরোলো । মোট ষাট পাউন্ড অ্যান্টিক কাগজে ছাপা । জানাশোনা লোকেদের কয়েকজনকে দিলাম পড়তে । কিন্তু কেউ আমার কবিতা সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য শুরু করলো না, প্রশংসাও করলো না । দেবকুমারবাবু নিশ্চয়ই সাময়িক পত্রিকায় দিয়েছিলেন । কেউ ভালো করে রিভিউ করলো না । সব চুপচাপ, যেন আমার বই প্রকাশিত হয়নি । এ-বইয়ের নাম ‘নক্ষত্রের আলোয়’ । দেবকুমার বাবুর মাধ্যমে আমার বহু তরুণ কবির সঙ্গে আলাপ হয় । তাঁরাও আমার বই সম্পর্কে কোনো আলোচনা করতেন না । তবে এটা ঠিক যে লক্ষ্য করে পড়ে দেখতাম অন্যান্য তরুণ কবির লেখা থেকে আমার কবিতা ভিন্ন প্রকারের, একই রকম নয় । আমার কবিতা বেশ পুরোনো ধাঁচের, সেগুলিকে ঠিক আধুনিক কবিতা বলা চলে না । এই সময় কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে আমার আলাপ হয় । কী করে হয়েছিল এখন আর তা মনে নেই । মোট কথা মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময়ে তাঁর বাড়িতে যেতাম । কোনো কোনো দিন কবিতার খাতা নিয়ে যেতাম । তিনি খাতা পড়ার জন্য রেখে দিতেন । তৎকালে ‘সাহিত্যপত্র’ নামে একটি পত্রিকা বেরোতো বিষ্ণুবাবুর তত্বাবধানে । ঐ ‘সাহিত্যপত্রে’ আমার একটি কি দুটি কবিতা তিনি ছেপে দিয়েছিলেন । ‘নক্ষত্রের আলোয়’ বইখানা পাঠক-সমালোচক মহলে সমাদৃত না হওয়ায় আমি খুব ভাবিত হয়ে পড়লাম । অন্যান্য তরুণ কবির ঢঙে লেখা তো আর চাইলেই হয়ে ওঠে না । ফলে এরূপ চিন্তা আমি করতাম না । কলকাতার কোনো লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যোগাযোগ তো দূরের কথা, জানাশোনাই ছিল না । আমার বয়স তখন তেইশ-চব্বিশ । ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ । এসময়ে লেখা আমার কবিতা বর্জন করে মন খুব বিষময় । এই ভেবে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ চলে গেলো । ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দটি চাকুরি না করে শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম । এই সময় প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পাঠ করি । ধীরে ধীরে আমার মনে কবিতা রচনার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আবির্ভূত হয় । এই ১৯৫৯ সালে আমায় বেশ কিছু অনুবাদ করতে হয় । পাইকপাড়া থেকে ‘বক্তব্য’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো । সম্পাদক ছিলেন বিমান সিংহ । আমি থাকতাম গ্রামে ; আমার গ্রামের ঠিকানায় তিনি প্রায়ই চিঠি দিতেন অনুবাদ কবিতা প্রার্থনা করে । আমি অনুবাদ করে পাঠাতাম এটা ঠিক । কিন্তু তিনি আমার নিজের লেখা কবিতা কেন চান না — এ ক্ষোভ আমার মনে মনে থাকতো । কিছু বিরক্তও বোধ করতাম । আমি যে কবিতা লিখি সে কথা সম্পাদক জানতেন, ‘নক্ষত্রের আলোয়’ তিনি পড়েছিলেন । তবু কখনো আমার নিজের লেখা কবিতা চাইতেন না । এরপর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের একেবারে গোড়ার দিকে আমি স্হির করলাম সর্বান্তঃকরণে কবিতাই লিখি । চাকুরি আপাতত থাক । গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম । সকালে জাগরণ থেকে শয়ন পর্যন্ত সারাক্ষণ কবিতাই ভাবতাম । আশেপাশে শহরের যে দৃশ্যাবলী দেখতাম তার কোনো কিছু কাব্যিক মনে হলে তখনি নোটবুকে টুকে রাখতাম । ছোটো আকারের কবিতার নোটবই সর্বদাই প্যাণ্টের পকেটে রাখতাম । সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত । এদের ভেতরে সূত্রগুলি পৃথক নয়, একই সূত্র তিনের ভেতর বিদ্যমান । এই সার সত্য সম্বল করে ভেবে দেখলাম জড়ের জীবনে যা সত্য , মানুষের জীবনেও তা-ই সত্য, উদ্ভিদের জীবনে যা সত্য মানুষের জীবনেও তা-ই সত্য । অতএব জড় ও উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি । এবং তাদের জীবনের ঘটনাকে মানুষের জীবনের ঘটনা বলেই চালাতে লাগলাম । এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পথযাত্রা, আমার নিজস্বতা । এইভাবে সৃষ্টি হলো ‘গায়ত্রীকে’, ‘ফিরে এসো, চাকা’ ।”

    ঠিক কী যে বিনয়কে উদ্বেলিত করেছিল, ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে অসাধারণ প্রেমের কবিতাগুলো লিখতে, তা রহস্যই থেকে গেছে । শিবপুরের ছাত্রজীবন থেকে কলকাতায় ফিরে, কফিহাউসে যাতায়াত করে, প্রেসিডেন্সির করিডরগুলোয় ঘুরে, গায়ত্রী চক্রবর্তী নামের সেই কিশোরীটির স্মৃতিই কী ? স্মৃতির গোপন ঘায়ের রক্ত আবার যদি না বেরোতো তাহলে এই তিন বছরের কবিতাগুলো লেখা সম্ভব হতো না বলেই মনে হয় । এমনও হয়েছে যে একই দিনে তিনি দু’তিনটি কবিতা লিখেছেন ; রাতে তাঁর ঘুম হয় না, যৌবনের স্বাভাবিক কুসুম-কুসুম জ্বরে তপ্ত হয়ে ওঠেন, যার দরুন রস এসে চাপ দিতে থাকে, ছন্দিত ঘর্ষণে উত্তেজনা চরমে ওঠে, তারপর রসপাত হলে শান্তি হয় । বিনয়ের সঙ্গে জীবনানন্দের এখানে পার্থক্য এই যে, জীবনানন্দ ‘যোনি’ শব্দটি বহুবার প্রয়োগ করলেও, ব্রাহ্মধর্মের বেড়াজাল তাঁকে যুবকের যৌন উত্তেজনার যন্ত্রণা সম্পর্কে এরকম খোলাখুলি লিখতে দিতো না ।

    ২২ জুন ১৯৬২ তারিখে বিনয় মজুমদার এই কবিতাটি লিখেছিলেন :-

    যাক তবে জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয় ।
    সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই ।
    শুধু তার যন্ত্রণায় ডুবে থাক হৃদয় শরীর ।
    তার তরণির মতো দীর্ঘচোখে ছিল সাগরের
    গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ বাতাস ।
    কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
    দীর্ঘস্হায়ী তার চিন্তা — প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া
    ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা ।
    যাক সব জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয় ।

    ২৯ জুন ১৯৬২ তারিখে লিখেছিলেন এই কবিতাটি

    তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুন্ঠিত শিশুকে
    করাঘাত করে-করে ঘুম পাড়াবার সাধ করে
    আড়ালে যেও না ; আমি এতদিনে চিনেছি কেবল
    অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি ; ক্ষিপ্র হাত দুটি…
    ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা-একা ব্যর্থ বারিপাত ।
    কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে না কি ? সার্থক চক্রের
    আশায় শেষের পংক্তি ভেবে-ভেবে নিদ্রা চলে গেছে।
    কেবল কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে ।
    তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধুর ঈর্ষিত
    স্হান চায়, মালিকায় গাঁথা হয়ে ঘ্রাণ দিতে চায় ।
    কবিতা সমাপ্ত হতে দাও নারী, ক্রমে…ক্রমাগত
    ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ, উত্তেজনা শীর্ষ লাভ করে
    আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে ।
    আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ করে ।

    চার
    বিনয় মজুমদার স্বীকার করেছেন যে তিনি কাল্পনিক বিষয় নিয়ে লেখেন না, তাঁর বিষয়বস্তু বাস্তবজগত থেকে সংগ্রহ করা । সুতরাং অনুমান করা যেতেই পারে যে ‘গায়ত্রী’ বাস্তব জগতেরই কেউ একজন ; বনলতা সেন, নীরা বা সুপর্ণার মতো কাল্পনিক নন । এখানে উল্লেখ্য যে জীবনানন্দ দাশ এবং ভাস্কর চক্রবর্তী স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক মধ্যবিত্তের মতন দাম্পত্য সম্পর্কে গড়ে তুলতে পারেননি, যেকারণে তাঁরা কাল্পনিক প্রেমিকা তৈরি করে নিয়েছিলেন । ‘গায়ত্রীকে, বা ‘ফিরে এসো, চাকার’ পরে বিনয় মজুমদারের বড়ো কাজ ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ । এই বইটি সম্পর্কেও তাঁর কলমেই পড়ি তিনি কী বলছেন:
    “এ পর্যন্ত আমি কোনোদিন নিসর্গমূলক কবিতা লিখিনি । অধিকাংশই ঘটনার বিবৃতি লিখেছি । অতঃপর আমায় কলকাতার শহরতলিতে থাকতে হয়, যাকে প্রায় গ্রাম বলা যায় । চারিদিকে নানা গাছপালা লতাপাতা ছিলো, ছোট বড়ো পুকুর ছিল । ভাবলাম প্রকৃতির বর্ণনা লেখা যাক । এক মাসের ভেতর খুব দীর্ঘ ছয়টি কবিতা লিখলাম । হিসাব করে দেখলাম, বই আকারে ছাপলে এই ছয়টি কবিতা ৪৮ পৃষ্ঠার বেশি জায়গা নেবে । ফলে আর বেশি লিখলাম না । বইয়ের নাম দিলাম ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ এবং কবিতাগুলির কোনো নাম না দিয়ে সংখ্যাচিহ্ণ দিয়ে চিহ্ণিত করলাম — ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং ৬ । একবার ভাবলাম কায়দা করে ছ’টি কবিতাকে জোড়া লাগিয়ে একটা কবিতা করি, ৪৮ পৃষ্ঠার লম্বা একটা কবিতা । কিন্তু এতো দীর্ঘ কবিতা পত্রিকায় ছাপা অসম্ভব হবে ভেবে শেষ পর্যন্ত আলাদা আলাদা ছ’টি কবিতাই রাখলাম । এর প্রথম কবিতাটি ছাপতে নিলেন ‘অনুভব’ পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ ভৌমিক, দ্বিতীয় কবিতাটি নিলেন ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, তৃতীয় কবিতাটির কী হয়েছিল তা গোপন রাখতে চাই, চতুর্থ ও পঞ্চম কবিতা দুটি ছাপতে নিলেন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ষষ্ঠ কবিতাটি ছাপতে নিলেন ‘দৈনিক কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বিমল রায়চৌধুরী । সকলেই যথা সময়ে ছেপে বার করলেন । পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইখানা আমি ছেপে বের করব, কবিতার সঙ্গে ইলাসট্রেশন দেবো । অমিতাভ দাশগুপ্ত বললো, তোর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র সমালোচনা লিখব, বই হয়ে বেরোবার আগেই । কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেলো তাদের কথা প্রশংসাবাক্য মাত্র। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র তৃতীয় কবিতাটি ছাপা হয়েছে জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকায় — ১৯৭০ সালে । এই একই প্রকার কবিতা আমি আরো লিখে যেতে পারতাম । কিন্তু পড়তে একঘেয়ে হয়ে যাবে ভেবে লিখিনি । এর পরে আমার কবিতা লেখার গতি খুব মন্দ হয়ে আসে ।”
    একজন কবি যদি আখের গোছাবার ধান্দায় থাকতেন তাহলে তিনি পরের পর ‘ফিরে এসো, চাকা’র মতোই কবিতা লিখে যেতেন, যা বিনয়ের পক্ষে সেই সময়ে সহজও ছিল, কেননা তিনি অমন কবিতা লেখার পদ্ধতি ও ছন্দ রপ্ত করে ফেলেছিলেন । কিন্তু সেই পথ ছেড়ে বিনয় লিখলেন আদিরসাত্মক কবিতা । র‌্যাবেলের ‘গার্গাঁতুয়া পাঁতাগ্রুয়েল’ আলোচনাকালে বাখতিন বলেছেন, লেখক যদি বেপরোয়া না হন তাহলে তাঁর পক্ষে কার্নিভালেস্ক রচনা সম্ভব নয় । বিনয় প্রচলিত গণ্ডি কেটে বেরিয়ে গেলেন এবং লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, তারপর ‘বাল্মীকির কবিতায়’ ভুট্টা সিরিজ ও ডালাসারির কবিতাগুচ্ছ, এবং হাসপাতাল ও গ্রামজীবনের দিনপঞ্জিমূলক কবিতা , অর্থাৎ বিদ্যায়তনিক সাহিত্যের ক্যাননের তিনি ধার ধারলেন না, বলা যায় সপাটে চড় কষালেন সাহিত্যিক মূল্যবোধের মালিকদের গালে । গণ্ডিকেটে বেরোনোর সঙ্গে বিনয়ের স্কিৎসোফ্রেনিয়ার সম্পর্ক খোঁজা ভুল হবে কেননা র‌্যাবেল-এর এবং ডন কিয়োটের লেখক সেরভানথেসের স্কিৎসোফ্রেনিয়া ছিল না।
    নিজের জীবনকে কবিতার জগতে এমনভাবে নিয়ে গেলেন বিনয় যে আর সবাইকে শুনিয়ে বলার দরকার হলো না যে শুধু কবিতার জন্য তিনি অমরত্বের তোয়াক্কা করেননি, এবং সত্যই তাই, তিনি কারোর তোয়াক্কা করেননি, আর এই ধরণের কবিতাও তাঁকে লিখে যেতে হয়নি যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘শুধু কবিতার জন্য’ রচনায় লিখলেন :-

    শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম শুধু কবিতার
    জন্য কিছে খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধ্যাবেলা
    ভূবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
    অপলক মুখশ্রীর শান্তি এক ঝলক ;
    শুধু কবিতার জন্য নারী, শুধু
    কবিতার জন্য এত রক্তপাত মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
    শুধু কবিতার জন্য, আজো দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকতে লোভ হয় ।
    মানুষের মতো ক্ষোভময়, শুধু কবিতার
    জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি ।

    বিনয় মজুমদার যখন ২০০৩ সালে বাঙ্গুর সাইকিয়াট্রি ইন্সটিউটে চিকিৎসাধীন তখন তাঁর প্রয়াত মা ও বাবার সম্পর্কে মনকেমনকে কেন্দ্র করে দুটি কবিতা লিখেছিলেন, পড়লে টের পাওয়া যাবে তাঁর চিন্তাধারা কোন পথে চালিত হচ্ছিল সেসময়ে :

    মায়ের
    মায়ের ইনসোফেগাস ক্যানসার হয়েছিল
    কোনো কিছু গিলে খেতে পারত না, জল
    খেতে পারত না ।
    পীযুষ ডাক্তার
    গ্লুকোজ ইনজেকশান দিত দুই হাতে ।
    তাতে আর কী বা হয়, না খেয়ে পনেরোদিন থেকে
    মা-ও মারা গেল ।
    মরবার আগে একবার
    আমার বাবাকে মা তো কুকুর বলেছে ।
    মরবার আগে মা আমার
    বাড়ির চাকরটির পা-ও ধরেছিল ।
    এর নাম মৃত্যু মহাশয় ।

    নিজের মাকে নিয়ে এই ধরণের কবিতা বিনয়ের আগে আমরা আর কোনো কবিকে লিখতে দেখিনি । সকলেই মাকে নিয়ে যেসব কবিতা এযাবৎ লিখেছেন সেগুলো নাটুকে ও কৃত্রিম বলে মনে হয় । এবার পড়া যাক বাবাকে নিয়ে লেখা কবিতা :

    যখন আমার বাবা
    যখন আমার বাবা খুব বুড়ো হয়েছিল
    বয়স তিরানব্বই বৎসর হয়েছিল তখন তো বাবা
    বিছানায় বসতেই পারত না, শুয়েই থাকত ।
    বুড়ো হলে এই হয়, আমারো তো হবে ।
    বড় ভগ্নীপতি এসে হাবড়ায় নিয়ে
    বাবার পেটটি কেটে এনেছিল, পরে
    একটানা এগারোটি দিনব্যাপী রক্ত পড়েছিল
    কাটা পেট থেকে ।
    তারপরে বাবা মারা গেল ।
    বাবার তো আত্মা নেই পূনর্জন্ম নেই ।
    বাবাকে পোড়ালে পরে বাবার ছাই তো আছে, এই
    ছাই ভাবে পৃথিবীর মাটির সহিত ।

    বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বের জন্য বিনয় মজুমদার জার্মানিতে গণিত অধ্যাপকের চাকরি পেয়েও জাননি । ১৯৯৮ সালে ‘অধরা মাধুরী’ পত্রিকার জন্য বোধিসত্ব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছিলেন, “ বার্লিনে নেমন্তন্ন করেছিল আলেকজান্ডার ডি ভার্স্ট বলে একজন ভদ্রলোক । তিনি ছিলেন গণিতের অধ্যাপক । আমি তাঁকে দরখাস্ত দিই, আমি চাকরি করতে চাই জার্মানিতে । আমি তাঁকে আমার গণিতের গোটা কয়েক খাতা পাঠিয়েছিলাম । সেইগুলি পড়ে উনি আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন । বললেন, তুমি এসো, আমাদের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক কষাবে । তোমাকে মাইনে দেয়া হবে ইউ. এস. এ.’র স্কেলে । তখন আমি বাবাকে বললাম, আমাকে দেখছি জার্মানিতে ডেকেছে ! অঙ্ক কষাতে হবে এম. এস. সি ক্লাসে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে । বাবা বললেন, দ্যাখ, আমরা বুড়ো হয়ে গেছি । আমার বয়স আশি-পঁচাশি বছর । তোর মায়ের বয়সও ওইরকম । আমাদের বাড়িতে দেখাশুনা করার মতো কেউ নেই । তুই-ও একা আছিস। তুই আর যাসনে কোথাও । আমাদের দেখাশোনা কর । সুতরাং আমি আর জার্মানিতে যেতে পারিনি।”
    দার্শনিক-তাত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, যাঁকে নিয়ে’ গায়ত্রীকে’ ( পরিবর্তিত নাম’ ‘ঈশ্বরীকে’ এবং আরেকবার পরিবর্তিত নাম ‘ফিরে এসো, চাকা ) বইয়ের কবিতাগুলো বিনয় মজুমদার লিখেছেন , এবং বিনয় নিজেও তা প্রথম দিকে স্বীকার করেছিলেন, এবং জীবনের মধ্যভাগে তা স্বীকার-অস্বীকারের দোনামনায় ভোগা আরম্ভ করেন, তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন ১৯৫৯ সালে ।
    গায়ত্রী চক্রবর্তীর বাবার বাড়িতে বিনয় গিয়েছেন কয়েকবার তা তিনি ২০০১ সালে ‘লোক’ পত্রিকার সম্পাদক শামীমুল হক শামীম-এর কাছে স্বীকার করেছেন, এবং কিশোরী গায়ত্রীর প্রতি তিনি টান অনুভব করতে থাকেন, সেই টান তিনি আজীবন বয়েছেন, একতরফা প্রেমের টান, নিজের মনের কথা উচ্চবর্ণের ধনী পরিবারের স্মার্ট কনভেন্টে-পড়া ইংরেজি-বলিয়ে কিশোরীটিকে বলে উঠতে পারেননি । তাঁর অবস্হান থেকে তা বলা বিপজ্জনক ছিল ।
    শামীমুল হক শামীম প্রশ্ন করেছিলেন, “ফিরে এসো, চাকা’ যাঁকে উৎসর্গ করেছেন সেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?”
    বিনয় মজুমদার উত্তরে বলেছিলেন, আমি যখন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ছিলাম তখন গায়ত্রীর বাবা ছিলেন সুপারিনটেনডেন্ট, জনার্দন চক্রবর্তী, দাদার নাম প্রসূন চক্রবর্তী । তখন ওর বয়স বারো । তখন থেকে দেখেছি । পুরোহিতের মেয়ে তো । বেশি কথাবার্তা হয়নি । আলাপ-আলোচনা হতো — কবিতা নিয়ে। ‘কবিতা লিখেছি কবে, দুজনে চকিত চেতনায়’ — এবার বুঝলে তো ! তারপর ভালো ছাত্রী হওয়ার ফলে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ২৩ বছর বয়সে আমেরিকায় চলে গেল। আমি তিনটি বই তাকে উৎসর্গ করেছি।”
    গায়ত্রী স্মার্ট তন্বী ছিলেন, আকর্ষনীয়া, প্রতিভাময়ী, কিন্তু সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তাঁর যৌবনের ছবি দেখে তা মনে হয় না । মিষ্টি মেয়ে বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন তিনি । কিন্তু তরুণ বিনয়ের অস্তিত্বে তিনি প্রগাঢ় ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন, “কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে” কবিতাটি পড়লে তার আঁচ পাওয়া যায় :

    কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে ।
    কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
    উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ দিকচক্রবাল ।
    সময়ে ভেবেছিলাম সন্মিলিত চায়ের ভাবনা,
    বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু ।
    দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়,
    তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত ।
    অথবা করেছ ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে ।
    জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
    পুনরায় কেশোদ্গম হবে না ; বিমর্ষ ভাবনায়
    রাত্রির মাছির মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা–
    হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে ।
    মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
    প্রস্রাব করার মতো অস্হানে বেদনা ঝরে যাবে ।

    পাঁচ

    অরুণেশ ঘোষ ‘গায়ত্রীকে’ বা ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের প্রতি বিনয়ের আকর্ষণ স্বীকার করেননি । অরুণেশ লিখেছিলেন, “এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিনয় পাগল হয়ে গেছে আর সেই উন্মত্ত অবস্হার মধ্যে লেখা হয়েছে ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতাগুচ্ছ । আরও গুজব ছিল, এমন একটি অভিজাত, উঁচু বংশীয় আর সুন্দরী মেয়েকে সে দূর থেকে ভালবাসত — সে ঘূনাক্ষরেও নাকি ধারণা করতে পারেনি, কোনো উন্মাদপ্রায় কবি তাকে ভালবেসে লিখে ফেলেছে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতাবলি । এই গুজবের রেশ এখনও রয়ে গেছে।”
    আসলে গায়ত্রী সম্পর্কে ক্রাশ এবং স্কিৎসোফ্রেনিয়া যে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার তা ধরতে পারেননি অরুণেশ । বোধিবৃক্ষের তলায় গৌতমবুদ্ধ উলঙ্গ হয়ে বসেছিলেন আমৃত্যু, কিন্তু তার জন্য তাঁকে তাঁর শিষ্যরা পাগল তকমা দেননি । একজন ভিখারিনিকে নিজের কাপড় খুলে দিয়ে উলঙ্গ হেঁটেছিলেন শিষ্যদের সঙ্গে, তার জন্য তাঁকে পাগল বলা হয়নি । সম্প্রতি হরিয়ানা বিধানসভায় জনৈক উলঙ্গ দিগম্বর জৈন সন্ন্যাসী বক্তৃতা দিয়েছিলেন ; তাঁকে কেউ পাগল বলেননি। মহাবীরও উলঙ্গ বসে সাধনা করেছিলেন, শিষ্যদের বাণী শুনিয়েছেন, তার জন্য কেউ তাঁকে সমাজবহির্ভূত উন্মাদ মনে করেনি । কবিদের বোধিপ্রাপ্তির পথে যাত্রাকে তাহলে কেন পাগলামি ইত্যাদি বলা হবে ! এই বিপর্যয় এনেছে আধুনিকতাবাদী শিক্ষা, ইউরোপের সংস্কৃতি । ব্রিটিশরা আসার আগে ভারতবর্ষে পাগলাগারদ বলে কিছু ছিল না।
    গণিতের অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র ঘোষও মনে করেন যে গায়ত্রী চক্রবর্তীকে নিয়ে অহেতুক মিথ সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে। ‘গায়ত্রীকে’ নামকরণ তিনি সম্পৃক্ত করেছেন হিন্দু ধর্মের গায়ত্রীমন্ত্রের সঙ্গে, যে মন্ত্রটি দ্বারা উপনয়নের সময়ে সদ্যব্রাহ্মণকে দীক্ষিত করা হয় । তিনি ‘সৃষ্টিসন্ধান’ ওয়েব-পত্রিকায় লিখেছেন যে, “বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হটি বিভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে । ১৯৬১ সালে চোদ্দটি কবিতা নিয়ে বিনয়ের ‘গায়ত্রীকে’ নামের কবিতার বই প্রকাশিত হয় । চোদ্দর সঙ্গে আরও তেষট্টিটি কবিতা যোগ করে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ফিরে এসো.চাকা’ কাব্যগ্রন্হ। ‘ফিরে এসো, চাকা’ নাম পালটিয়ে একই কবিতাগুচ্ছ নিয়ে ১৯৬৪ সালে নতুন নামে প্রকাশিত হয় ‘আমার ঈশ্বরীকে’ । নামকরণের কারণেই গায়ত্রী চক্রবর্তী-চাকা-ঈশ্বরী সম্পৃক্ত হয়ে এক মিথের জন্ম দিয়েছিল এবং গাণিতিক চেতনার কবির বিশ্লেষণাত্মক ছন্দময় কাব্যপ্রবাহকে ‘হতাশাজনিত মস্তিষ্কবিকৃতি’, ‘ব্যর্থ প্রেমিকের পাগলের প্রলাপ’ প্রভৃতি উক্তি দ্বারা অভিহিত করে কবি বিনয় মজুমদারের কাব্যভাবনার মূলকে সৃষ্টির আড়ালে রাখার সচেতন বা হেঁয়ালি প্রয়াস দেখা যায় । অনেক সময়ে মিথ যেন সত্য মনে হয়:
    ‘কী রহস্য যেন সর্বদা আমাকে ঘিরে রাখে’
    ‘রহস্য’ কবিতার এই পংক্তিটি যেন কবি বিনয় মজুমদারের নিজের জীবনযাপন, কাব্যকৃতি, প্রেম-বাসনা, বিষাদ-আনন্দের অনুরণন । তাঁর কবিতায় জননপ্রক্রিয়া, পদার্থবিদ্যা, বীজগণিত, কফিহাউস, পড়শি রঞ্জিত, পীযুষ ডাক্তার, কৃত্তিবাস, হাংরি আন্দোলন, বাবলা গাছ, লাঙল, হারাধন, বুচি, জীবনানন্দ, বাবা, মা, মানসিক হাসপাতাল, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, মঘা তারা, রেবতী, কৃত্তিকা, ছন্দভাবনা, সমাজভাবনা, সরস্বতীপুজো, সব একাকার হয়ে গেছে । সেখানে কোনো কাব্যের নামকরণ বা কাব্যভাবনাকে বিশেষ কৌণিক বিন্দু থেকে মূল্যায়ন করলে মিথ আরও মিথের জন্ম দেবে । বিনয় রহস্য উন্মোচনে তাই বড়ো বেশি সাবধানী হওয়া বোধহয় শ্রেয় :
    ‘তাকাই সামনে সোজাসুজি
    ব্যাকুল আশায় তাকে খুঁজি’
    যিনি ব্যাকুল আশায় তাঁকে খোঁজার প্রয়াস চালিয়েছেন সম্ভবত সেই বিনয় মজুমদারকে খুঁজতে দুচোখ ধারালো করা প্রয়োজন এবং এ-কাজে কোনো মিথর শিকার না হয়ে মনে রাখা দরকার : সংযম কবিদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এক দুরূহ তপস্যার মতো । কেননা বিনয় মজুমদারের কথায় :
    ‘নিষ্পেষণে ক্রমে-ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে
    হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত’
    এ তো বিনয়ই শিখিয়েছেন । তাই মিথ নয়, যুক্তসমীকরণে বিনয়-প্রতিভার সন্ধান চালানো ভালো :

    যে কোনো গণিতসূত্র নিয়ে তার পরবর্তীদের
    বাঁপাশে আনার পরে সে সমীকরণে
    সমান চিহ্ণের পরে — ডানপাশে শূন্য হয়ে যায় ।
    এইভাবে কতিপয় যত খুশি সূত্র নিয়ে এগুলির বামপার্শ্বগুলি
    গুণ করে শুধুমাত্র একটি সমীকরণ সহজেই পাই
    এবং ডানপার্শ্বে শূন্য শূন্যের সমান
    সদ্য উল্লিখিত এই একটি সমীকরণ জ্যামিতিতে রূপায়িত হলে
    অনেক পৃথকরূপ পৃথক পৃথক চিত্র পাওয়া যায় সর্বদাই পাই ।
    মূল সমীকরণের — আলাদা আলাদা সব সমীকরণের
    আলাদা সকল চিত্র একীভূত সমীকরণের
    জ্যামিতিক রূপায়ণে তার মানে পাওয়া যায় অনেক সূত্রকে
    একীভূত করা যায় কেবল একটিমাত্র করে ফেলা যায় ।
    তাতে আমাদের কিছু লাভ হয় এখানে আমার বৌ রাধা
    এই লিখে রাখা ভালো সবার অবগতির জন্যই নিশ্চয় ।

    নারায়ণচন্দ্র ঘোষ আরও বলেছেন যে, “প্রকল্পিত সমীকরণের পদ্ধতি অজানা থাকলে রাধার একীভূত সত্তার প্রসঙ্গ সহজবোধ্য হয় না । অজানা থেকে যায় রূপময়তার পরিসরে আলাদা হয়ে যাওয়া, আলাদা থাকা, বহুময়তা আর সমন্বয়, সমাবিষ্ট, একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাসূত্র — ভেদ ও অভেদের গমনপথ, পারস্পারিকতার রহস্য । বিনয়কে বুঝতে হলে, বিনয়ী হয়ে বলা ভালো, গাণিতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়া জরুরি ; অন্যথায় মিথ মিথের জন্ম দেবে ; বিনয় কেবলমাত্র অবিনশ্বর প্রেম কাহিনীর প্রতীক হয়ে থাকবেন। মিথপ্রেমীদের পথ তখন মহাশূন্যের কোটরে দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হবে । গণিতবিদ নারায়ণবাবু তাই পৌরাণিক মিথে টেনে নিয়ে গেছেন বিনয়ের ‘চাকা’কে । তিনি বলেছেন সুদর্শন চক্রের আবহমণ্ডলে ভারতবাসী তথা বাঙালির অবস্হান । কত না মিথ সুদর্শনচক্রকে উপলক্ষ্য করে । অশোকচক্র, সেও কি কম কথা । উপনিষদে বর্ণিত সত্যচক্র হলো একটি ত্রিমুখী সিংহের পায়ের নিচে একটি ছোটো চক্র আর মাথার উপরে আরেকটি বড়ো চক্র । এর অর্থ হলো পশু শক্তি সত্যকে দমন করতে চাইলে সত্য আরও বড়ো আকার নিয়ে পশু শক্তির উর্ধ্বে নিজের স্হান করে নেয় ।”
    বলা বাহুল্য, নারায়ণবাবুর এই যুক্তি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি । বিনয়ের কবিতায় পুরোহিততন্ত্র ও ব্রা্‌হ্মণ্যবাদের প্রতি খোঁচা বেশ কয়েকটি কবিতায় ও সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায় ।
    কবি জুবিন ঘোষ ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার ২০১৬ সালের একুশে জানুয়ারি সংখ্যায় বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্হটি সম্পর্কে আলোচনাকালে নারায়ণ ঘোষের বক্তব্যকে আরও প্রসারিত করেছেন গায়ত্রীমন্ত্র ও ষটচক্রের প্রেক্ষিতে । তিনি বলেছেন যে, গায়ত্রী শুধুমাত্র একটা মন্ত্র নয়, এটা হিন্দুদের একটা পরম সাধিত স্তব । যার সুর অমর । ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্হে ‘ভক্ত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ থাকুর লিখেছেন, “একদিকে ভূলোক, অন্তরীক্ষ, জ্যোতিষ্কলোক, আর একদিকে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, আমাদের চেতনা — এই দুইকেই যদি এক শক্তি বিকীর্ণ করছে, তার এই শক্তি বিশ্বের মধ্যে এবং আপনার বুদ্ধির মধ্যে ধ্যান করে উপলব্ধি করবার মন্ত্র হচ্ছে গায়ত্রী ।” বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতার শেষ কয়েক পংক্তির মধ্যে বলেছেন, “আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন/সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।” সেখানে এক অমরতার চিহ্ণ পাই সকল আকাশে বিচরণ করার শক্তির মধ্যেই । গায়ত্রী স্তবের সুর যা ‘জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে’ আসে হিন্দুদের কাছে । এই অমরতা যা মন্ত্রের সুরেই সম্ভব । স্বর না থাকলেও সুর থেকে যায় অনাদিকাল, পুনরাবিষ্কার হয় তার । সেই গায়ত্রী শব্দোচ্চারণের সুরেই বিনয় বলেছেন, “লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।” এখন বেদ মন্ত্রের আলোকে দেখা যাক ‘ধী’ কী ! সূর্যের কল্যাণতম তাপ মানবের ব্যক্তিচৈতন্যের উপরে বেগ সৃষ্টি করে জ্ঞান, আত্মা বা ‘ধী’ এর পরিস্ফূটন ঘটায়। এই ‘ধী’, যা মানুষের আত্মশক্তিকে তেজপূর্ণ করে, সূর্যের অমৃতজ্যোতির সঙ্গে সাযুজ্যতা দিয়ে থাকে। ‘ধী’ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের ২/৪০/৬ ঋক বলছে, ‘ধিয় পূষা জিম্বতু বিশ্বামিত্রো রয়ি সোমা রয়িপতির্দাধতু।’ মানে হলো, সব জীবনের ধ্যানে, মননে, চিন্তনে রয়েছেন পূষা, তিনিই ‘ধী’ যা সবার ধ্যানচৈতন্যের স্ফূরণ করে, সোমলতাকে ‘ধী’ রসবন্ত করে । গায়ত্রী স্তবেও বলছে ‘ধিযো নঃ প্রচোদয়াৎ’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই ধ্যানকে উপলব্ধি করতে হয়, আবিষ্কার করতে হয়, তাই তো ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় বিনয় লেখেন, ‘দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।’ গায়ত্রীমন্ত্র একবার মনস্হ করে হয় না, তাকে ধীরে ধীরে ১০ থেকে ১০৮ বার করতে হয় । বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় লেখেন, ‘নিমেষেই/গলধঃকরণ তাকে না করে ক্রমশ রস নিয়ে/তৃপ্ত হই’ — এই ধীর স্বাদ গ্রহণের চমৎকার অবস্হায় প্রকৃত সাধক বিনয় মজুমদার ‘পরাবর ব্রহ্ম’ দর্শন করেন । দর্শনের শেষে যা আসে তা দেব দর্শনের মতো মিলিয়ে যায়, শরীর সাকার হয় না, চিত্ররূপ থেকে যায় মনে, ‘প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্হায়ী হাসি নিয়ে তুমি/চলে যাবে ; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি’ ( ভালোবাসা দিতে পারি — ১৮.৫.৬২ ) । এই ভাবে স্তব বা বেদমন্ত্রে গায়ত্রী জীবন্ত মানুষী হয়ে ওঠেন । ঠিক যেমন গায়ত্রীমন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে এক অপূর্ব আলোর পরিস্ফূরণ, স্রোতের তরঙ্গশীর্ষে রয়েছে উত্তরণের সাংকেতিক লিপি । লক্ষ-কোটি মুহূর্তের প্রবাহে যিনি নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে এই শক্তিকে আত্মস্হ করেন, তিনিই যোগী । ‘ধী’ অর্থাৎ বোধ আমাদের রক্ষা করছে । বোধের পূজারী হলেন বিনয় মজুমদার । তিনি বারবার গায়ত্রীর মূল রসকে সেই স্তরের ব্যাখ্যায় অন্তস্হিত মর্মে পদার্পণ করেছেন । ‘ধী’ ও গায়ত্রীকে মিশিয়ে দিয়েছেন কাব্যের আধ্যাত্মিকতায় ।
    জুবিন ঘোষ আরও বলেছেন, এবং যা বলেছেন, খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে বিনয়ের ‘বাল্মীকির কবিতার’ ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য, যদিও জুবিন ঘোষ ‘বাল্মীকির কবিতা’র পপসঙ্গ তোলেননি এখানে । জুবিন বলেছেন, “ফিরে এসো, চাকা’ তো সভ্যতার প্রধান চক্র, যার মাধ্যমে মানবসভ্যতা গড়িয়ে এগিয়েছে, আর চক্র মানেই ‘ষটচক্র’ । সেখানে দেখব রয়েছে : ১) মূলাধারচক্র; ২) সাধিষ্ঠচক্র ; ৩) মণিপুরচক্র ; ৪) অনাহতচক্র ; ৫) বিশুদ্ধিচক্র ও ৬) আজ্ঞাচক্র । এই চক্রের পুনঃসাধনার কথাই বলেছেন কবি বিনয় মজুমদার। এতো সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক গভীরতার দিকে এগিয়েছে বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’, যাকে বলতে পারি ফিরে এসো চক্র — সভ্যতার সাবলীল গতিসমূহ মানবদেহের সাবলীল সাধনাসমূহ । মূলাধারচক্র সাধনায় মানুষের বাসনা সিদ্ধ হয় — সে মুক্তি লাভ করে । বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’-এ বলছেন, ‘কাকে বলে নির্বিকার পাখি/অথবা ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়/উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে/…/আমি মুগ্ধ ; উড়ে গেছ ; ফিরে এসো চাকা । এই মুগ্ধ উড়ে যাবার মধ্যে মুক্তির স্বাদ । মুগ্ধতার অর্থ বাসনা পরিতৃপ্তির ফল । এই মুগ্ধ উড়াল আমরা বার বার পাই ‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রথম কবিতাতেই, ‘একটি উজ্বল মাছ, যা ১৯৬০ সালের ৮ই মার্চ লেখায় আশ্রিত — ‘একটি উজ্বল মাছ একবার উঠে/দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেল/ এই স্মিত দৃশ্য দেখে বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হল ফল/…/বিপন্ন মরাল ওড়ে অবিরাম পলায়ন করে ।’ আবার ‘কাগজ কলম নিয়ে’ ( ১৪/১০/১৯৬০) বিনয় লিখছেন, ‘তবু কী আশ্চর্য দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে/তার সেই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়।’ এই ওড়াটাই হলো মুক্তির আর্কিটাইপ, উড়ে যেতে চাইছে সব ছিন্ন করে, মুক্তি পেতে চাইছে বাসনা তৃপ্ত করে, যা মূলাধারচক্র সাধনার মূল রস , যা আবার ফিরে এসেছে ‘মুকুরে প্রতিফলিত’ ( ২৬/৮/১৯৬০) কবিতায়, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’ এভাবেই ঈচ্ছিক মুক্তির পথে বার বার তাঁর কলম লিখে চলেছে মূলাধারচক্রের সার কথা। মণিপুরচক্র বলছে যে, এই সাধনার ফলে সাধক অন্যের শরীরেও প্রবেশ করতে পারেন, যেভাবে ‘আমার আশ্চর্য ফুল যেন চকোলেট এক বস্তুস্হিত অবস্হান থেকে অন্য বস্তুস্হিত অবস্হানে চলে যাচ্ছেন কবি । স্বচ্ছ জলে মিশে যাওয়াটাই মণিপুরচক্র । প্রায় প্রত্যেক কবিতায় এই বৌদ্ধিক সাধকের মিশে যাওয়াটাই অনুভব করতে হয় । একটা চিত্র বার বার অন্য চিত্রের সঙ্গে, অন্য আর্কিটাইপের সঙ্গেমিশে যাচ্ছে । বিশুদ্ধিচক্রে পরমযোগী হবার সাধনা বার বার তাঁর কাব্যে এসেছে, যেমন ‘কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে’ । এমন তো একজন প্রকৃত ঋষিই পারেন, পরম সাধকেই তো তিনি উত্তীর্ণ ।”
    জুবিন ঘোষ বাসনা পরিতৃপ্তির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আমরা বিনয়ের ভুট্টা সিরিজ কবিতাতেও পাই। সেই কবিতাগুলোয় একটি আশ্চর্য ফুল রূপান্তরিত হয়েছেন একজন রক্তমাংসের ফুলে । হিন্দু তন্ত্রসাধকদের মতো বিনয়ও আশ্রয় নিয়েছেন রক্তমাংসের অভিজ্ঞতায় । বিনয় তাঁর জাগতিক অভিজ্ঞতাকে অসম্পূর্ণ রাখতে চাননি, যা তিরিশের মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল । ভুট্টা সিরিজের কবিকে আমরা হিন্দু তন্ত্রসাধকদের অন্বেষণের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যাঁরা তনুমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতেন । দেবীর আধারে নির্বাচিত সঙ্গিনীর সঙ্গে যৌন একাত্মের মাধ্যমে জরা, ব্যাধি, বার্ধক্য, মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতেন ; মৃত্যুঞ্জয়ী ও ভয়জয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করতেন । হিন্দু ও বৌদ্ধিক তান্ত্রিকদের যৌন একাত্মতা ছিল দেহ ও মনের পরস্পরের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক বুনন, পুরুষের সঙ্গে নারীর, মানবের সঙ্গে দৈবের । বিনয় মজুমদার রক্তমাংসের ঈশ্বরীকে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর রাধায় । সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য বিনয় মজুমদার স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চেয়েছেন, বোধিপ্রাপ্ত, এবং চেয়েছেন শেষতম শান্তি, যাতে মন থেকে যাবতীয় নোংরা বিদায় নিয়ে তাঁকে বামাক্ষ্যাপার স্তরের বোধিতে উন্নীত করতে পারে ।
    অরুণেশ ঘোষ, জুবিন ঘোষ ও নারায়ণচন্দ্র ঘোষ, এবং তাঁদের মতো আরও অনেকে বিনয়ের কবিতায় গায়ত্রী চক্রবর্তীর অস্তিত্ব নস্যাৎ করতে চাইলেন কেন বোঝা কঠিন । বিনয়ের ইনটারমিডিয়েট পড়ার সময়ে আরও ছাত্রী ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে । গায়ত্রীর নামটিই কেন তাঁর কাব্যগ্রন্হের নামকরণে এলো ? পুরাণের নানা রকমের চক্র বিনয়কে ‘ফিরে এসো, চাকা, অথবা ‘গায়ত্রীকে’ অথবা ‘আমার ঈশ্বরীকে’ নামকরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এরকম ভাবতে খটকা লাগে । বিনয় যদি ব্রাহ্মণ পরিবারের বা উচ্চবর্ণের সন্তান হতেন তাহলে না হয় কিছু যুক্তি দেয়া যেতে পারত ।
    তরুণ বয়সে কোনো কিশোরীর প্রতি ক্রাশ যদি হয়েই থাকে এবং তা যদি মনের গভীরে বাসা বেঁধে তরুণটিকে সেই কিশোরীকে নিজের কবিতায় তুলে আনতে প্ররোচিত করে থাকে, সেটাই তো বরং স্বাভাবিক মনে হয় । তবে বিনয় নিজেই বলে গেছেন যে লিখিত কবিতার ভেতরে যা লুকিয়ে থাকে এবং পরবর্তীকালে তাকে পাঠ করলে যদি নতুন কিছু পাওয়া যায় তাহলে তা কবিতাটির অন্তর্গত ‘অতিচেতনা’ ; এই অতিচেতনা এবং অতিসত্য গণিতে থাকে, যে কারণে একই গণিততন্ত্র পরবর্তীকালে আরেকজন গণিতবিদের জন্য অন্য পথের দিশারী হয়ে ওঠে । তাই নারায়ণবাবু ও জুবিনবাবুর যুক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা উচিত হবে না, তাঁরা বিনয়-কথিত ‘অতিচেতনা’ আবিষ্কার করেছেন তাঁর কবিতায় ।
    ১৯৮২ সালে ‘কোনো গোপনতা নেই’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে “বাস্তব কবিতা বলে কিছু হয়কি?” প্রশ্নের উত্তরে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “পুরোটাই — কবিতার প্রত্যেক শব্দ, প্রত্যেক বাক্য, বাস্তব জগত, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া।” ১৯৬৬ সালে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে তিনি লিখেছেন যে একেবারে কাল্পনিক ভাবনা হলো চিন্তাশূন্য শূন্যস্হান, তার মানে মৃত :-

    সব মিলে একটিই বিশাল জীবন তবে ভূবক্ষে রয়েছে
    আপাত দৃষ্টিতে দেখা যে-কোনো তথাকথিত একটি ব্যক্তিকে
    বিশাল সমগ্র থেকে আলাদা করে নিলে হঠাৎ —
    যদি কোনোদিন নিতে কোনোভাবে পারা যায় তবেই হঠাৎ
    দেখা যাবে ব্যক্তিটির চিন্তা বলে কিছু নেই, মন তার শুধু
    চিন্তাশূন্য শূন্যস্হান — একেবারে কাল্পনিক, তার মানে মৃত

    অর্থাৎ পুরাণের কোনো মিথ থেকে তিনি চাকা ও গায়ত্রীকে এনেছেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন । সুমন গুণও বলেছেন, “বিনয়ের ভাষ্য আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্তিগত; নিজেকে কেন্দ্র করেই তাঁর বিস্তার ।
    ওই সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “আচ্ছা, কবিতা কি এমন হতে পারে না — ধরো, খাতা কলম নিয়ে রেল লাইনের ধারে গিয়ে বসলাম, যা দেখি ঠিক তাই লিখি — না দেখা একটা শব্দও যেন না থাকে — যেমন ধরো —
    সামনেই ধানক্ষেত দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ে আছে
    ধানক্ষেতটির ওই পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে
    উত্তরের দিক থেকে ঠিক দক্ষিণের দিকে — তাই দেখি…।

    ‘গায়ত্রীকে’, ‘ফিরে এসো, চাকা, ‘ঈশ্বরীকে’ কাব্যগ্রন্হটির অসাধারণ প্রেমের কবিতাগুলোও বাস্তবজগতের, এবং এখানেই জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতার সঙ্গে বিনয় মজুমদারের পার্থক্য । ১৯৮২ সালের উপরোক্ত সাক্ষাৎকারটিতে বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে ?” উত্তরে বিনয় মজুমদার, একজন প্রেমিক যেভাবে নিজের গোপন প্রেমের কথা বলে, বলেছিলেন, “আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে তিনচার দিনের আলাপ — প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপরে কোথায় চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।”
    পরে অজয় নাগ জিগ্যেস করেছিলেন, “বিনয়দা, চক্র মানে কী ?” উত্তরে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “চাকা, যা গড়িয়ে গিয়ে চলে আসে, যেখান থেকে শুরু করেছিল ; যে চাকা চালায় সে চক্রবর্তী, আমি সেই চক্রবর্তীকে ফিরে আসতে বলেছি, গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই একটা আস্ত চাকা বানিয়ে দিয়েছি ।” ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে মারুফ হোসেন জিগ্যেস করেছিলেন, “গায়ত্রী চক্রবর্তী সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই ।” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “যিনি আমার গুরুদেব ছিলেন, বাংলা ভাষা পড়াতেন আমাকে প্রেসিডেন্সি কলেজে, সেই জনার্দন চক্রবর্তীর মেয়ে হলো গায়ত্রী চক্রবর্তী । ইডেন হিন্দু হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্টও ছিলেন । আমি ওই হোস্টেলে থেকেছি দুই বছর । গায়ত্রীর বয়স তখন কত হবে ? ১০-১১-১২ বছর । আমার তখন হবে ধরো ১৬-১৭-১৮ বছর । তখন আমি ওকে দেখেছি ।”
    ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতাটি সম্পর্কে মাসুদুল হক বিনয় মজুমদারের মনোভঙ্গ বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, “ব্যাপারটি এভাবে উপলব্ধি করা যায় । পুকুরের তলদেশে একটি নারীমৎস্য দুঃখ নিয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে । হঠাৎ একটি পুরুষ মৎস্য কোনো এক আনন্দের স্পর্শ দিল । সে-সুখে নারীমৎস্যটি জলমাধ্যম থেকে বায়ুমাধ্যমে উড়াল দেয় । কিন্তু সে আনন্দের উড়াল ক্ষণিকের, কেননা সে অনিবার্যভাবেই আবারও দুঃখের স্রোতে মিশে যাবে । কিন্তু মাঝখানে প্রকৃতির ঐক্যের কারণে, আপেক্ষিত তত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, এই উড়াল দৃশ্য একটি ফল দেখে নিয়ে দার্শনিক বেদনাতে আপক্ক রক্তিম হয়ে ওঠে । নিউটনের সেই আপেলের ভূপৃষ্ঠে পতিত হবার যে ঘটনা তা দুঃখবাদের কেন্দ্রগামী বিন্দু । যাকে তিনি অভিকর্ষীয় ত্বরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন এই বস্তুবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে । কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে দুঃখবাদের এক অনন্ত সমীকরণ । সেই সমীকরণই ঘটান বিনয় মজুমদার, তাঁর ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতায় গণিতের সমীকরণ দিয়ে । বিনয় তো নিজের সম্পর্কে বলেছেন, মূলত আমি গণিতবিদ, আমার অধিকাংশ সময় কাটে গণিত চিন্তায় ; আর কবিতা, মানুষ যেরকম কাজের অবসরে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান তৈরি করে, তেমনি ।”
    মাসুদুল হক কিন্তু বিনয় মজুমদারের দুঃখের উৎসসূত্রটি জানাননি ।
    বিনয়ের চোখে গায়ত্রী নামের যুবতীটি সুন্দরী, তিনি একজন গর্বোদ্ধত স্মার্ট ইংরেজিতে-কথা-বলিয়ে কনভেন্টে-পড়া যুবতী সন্দেহ নেই, তবে ফিল্মস্টার বা মডেলদের মুখশ্রীর সৌন্দর্যের দাবিদার তাঁকে বলা যায় না । তাঁর সৌন্দর্য সবাইকে ছাপিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হবার, এবং পরবর্তীকালে দেরিদার অনুবাদকের ও সাবঅলটার্ন দর্শনের মুখপাত্রীর। গায়ত্রীর চলে যাওয়াটাও ফিরে এলো ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হে, এবং যে ছবিগুলো কবিতায় বিনয় মজুমদার নিয়ে এলেন, তা বাস্তব জগতের, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা নয়, অবলোকিত বাস্তব :

    বেশ কিছু কাল হল চলে গেছ, প্লাবনের মতো
    একবার এসো ফের ; চতুর্দিকে সরস পাতার
    মাঝে থাকা শিরীষের বিশুদ্ধ ফলের মতো আমি
    জীবন যাপন করি ; কদাচিৎ কখনো পুরোনো
    দেওয়ালে তাকালে বহু বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো
    মানুষীর আকৃতির মতো তুমি দেখা দিয়েছিলে ।
    পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কুজনের মতো
    তোমাকে বেসেছি ভালো ; তুমি পুনরায় চলে গেছ ।

    বিনয় মজুমদারের কাব্যসমগ্রের সম্পাদক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্যসমগ্রের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন, ‘গায়ত্রীকে’ কবিতাপুস্তিকাটির নামকরণ প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার তাঁকে লিখেছিলেন, গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তো এবং ১৯৬০ কি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে বি.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করেছিল । সে-ই আমার কবিতা বুঝতে পারবে ভেবে তাকেই উদ্দেশ্য করে ‘গায়ত্রীকে’ বইখানি লেখা । সেই হেতু বইয়ের নাম ‘গায়ত্রীকে’ রেখেছিলাম ।

    ছয়
    জীবনানন্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর যদি উল্লেখ করি তবে দেখা যাবে যে তা সম্পূর্ণ কবিকল্পিত, তা অবলোকিত বাস্তব নয়, যা আমরা বিনয় মজুমদারে পাই । তাছাড়া জীবনানন্দ বলছেন ‘থাকে শুধু অন্ধকার’ যা সারাজীবন দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করার পরও বিনয় মজুমদারকে বলতে শোনা যায় না । ‘পুনর্বসু’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে ( ১৯৮৭ ) বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি এরকম থাকেন কী করে ? রহস্যটা কী ? সর্বদাই এমন আনন্দে ?” জবাবে বিনয় বলেছিলেন, “আমি সারাক্ষণ আনন্দে থাকি এটা সত্য কথা । তার জন্য আগে থাকতে ব্যবস্হা করে রাখতে হয় ।” পক্ষান্তরে জীবনানন্দ লিখেছিলেন :-

    হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
    সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
    অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
    সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে
    আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
    আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন

    চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
    মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; অতিদূর সমুদ্রের পর
    হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
    সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
    তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
    পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন ।

    সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
    সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
    পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
    তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;
    সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী — ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন ;
    থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন ।

    পাশাপাশি পড়ে দেখা যাক বিনয় মজুমদারের অবলোকিত বাস্তবের কবিতা, বিশেষ করে যেগুলো জনপ্রিয় । বিনয় প্রয়োগ করছেন যা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত, যা যুক্তিপূর্ণ, এমন ছবি :

    একটি উজ্জ্বল মাছ
    একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
    দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
    পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
    বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল ।
    বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
    যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
    রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
    স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;
    সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায় তবু
    এমন সময়ে তুমি হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি… তুমি…
    কিংবা দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্হ বৃক্ষেরা
    পৃথিবীর পল্লবিত ব্যপ্ত বনস্হলী
    দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে
    তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
    চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা ।

    আর যদি নাই আসো
    আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচরী
    বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো নাই মেশো,
    সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে
    নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
    তোমার অভাব বুঝি, কে জানে হয়তো অবশেষে
    বিগলিত হতে পারো ; আশ্চর্য দর্শন বহু আছে
    নিজের চুলের মুগ্ধ ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
    হয়তো পাইনি আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
    অস্ফূট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
    গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে

    জীবনানন্দ দাশ-এর ‘রাত্রি’ ( সাতটি তারার তিমির ) কবিতাটি এবার পড়ে দেখি । দেখবো যে জীবনানন্দ কলকাতা শহরকে পর্যবেক্ষণ করে কবিতাটি লিখেছেন ; বিনয় মজুমদারের অবলোকন পদ্ধতির ( act of observing, viewing, noticing from personal experience ) সঙ্গে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ( act of seeing or looking at and act of ruminating historical events ) পার্থক্য আছে । বিনয় নিজের কবিতার খাতায় মার্জিনে যে নোটগুলো নিতেন, ‘ফিরে এসো, চাকা’ লেখার সময়ে, সেগুলো প্রধানত ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবনে পাওয়া অভিজ্ঞতাগুলো, যখন কিনা জীবনানন্দ অন্য খাতায় নোট নিয়ে রাখতেন বাক্যের, শব্দবন্ধের, চিত্রকল্পের, যেগুলোর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের তুলনায় বাইরের জগতের বিষয়বস্তু বা ঘটনা এবং পৃথিবীর লুপ্ত সভ্যতাগুলোর স্মৃতিচারণ বেশি । জীবনানন্দের ‘পর্যবেক্ষণ’ আর বিনয়ের ‘অবলোকন’ এর সূক্ষ্ম তফাত । ‘রাত্রি’ কবিতাটি :

    হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল ;
    অথবা সে হাইড্র্যাণ্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসে ।
    এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে ;
    একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে

    অস্হির পেট্রল ঝেড়ে — সতত সতর্ক থেকে তবু
    কেউ যেন ভয়াবহভাবে প’ড়ে গেছে জলে ।
    তিনটি রিকশ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাস ল্যাম্পে
    মায়াবীর মতো জাদুবলে ।

    আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে — হঠকারিতায়
    মাইল মাইল পথ থেঁটে — দেয়ালের পাশে
    দাঁড়ালাম বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে — টেরিটিবাজারে ;
    চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে ।

    মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে ।
    কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ
    ডাইনামোর গুঞ্জনের সঙ্গে মিশে গিয়ে
    ধনুকের ছিলা রাখে টান ।

    টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পৃথিবীকে ।
    টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা ।
    শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে ।
    রাজ্য জয় করে গেছে অমর আত্তিলা ।

    নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে
    গান গায় আধো জেগে ইহুদী রমণী ;
    পিতৃলোক হেসে ভাবে , কাকে বলে গান —
    আর কাকে সোনা, তেল, কাগজের খনি ।

    ফিরিঙ্গি যুবক কটি চলে যায় ছিমছাম ।
    থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে ;
    হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার করে
    বুড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে ।

    নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
    লিবিয়ার জঙ্গলের মতো ।
    তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব — অতিবৈতনিক
    বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত ।

    শার্ল বদল্যারের মতন জীবনানন্দও একজন পথচর ছিলেন, নিশাচরও, এবং তাঁর ‘পথ হাঁটা’ কবিতাটি পড়লে তা স্পষ্ট হবে :

    কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে
    অনেক হেঁটেছি আমি, অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস সব ঠিক চলে
    তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে
    সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে ।
    কেউ ভুল করেনাকো — ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
    চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে ।
    একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব ;
    তখন অনেক রাত — তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
    নির্জনে ঘিরেছে এসে ; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
    আর দেখেছি কি ? এক রাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা ?
    চোখ নিচে নেমে যায় — চুরুট নীরবে জ্বলে — বাতাসে অনেক ধুলো খড় ;
    চোখ বুজে একপাশে সরে যাই — গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
    উড়ে গেছে ; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতরে
    কেন যেন ; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর ।

    বিনয় মজুমদার পথচর ছিলেন না, নিশাচর তো নয়ই । মাঝবয়সে আসঙ্গ-উন্মুখ বিনয় যৌনপল্লীতে ( যাকে তিনি বলেছেন তাঁর ‘বৃন্দাবন’ ) হয়তো রাধার কাছেও, তিনি যেতেন ‘বিশাল দুপুরবেলায়’, ‘প্রকাশ্য দিনের বেলা’ । ‘বাল্মীকির কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে, তার মানে তখন তাঁর বয়স ৪২ । তার আগে ১৯৬৬ সালে তিনি লিখেছেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ নামে আদিরসাত্মক কবিতাটি, তখন তাঁর বয়স ৩২, যে বয়সে পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবি সোনাগাছি যাওয়া আরম্ভ করেন । আমি তাঁদের সেই পাড়ায় দেখেছি বলে জানি । আমার হাংরি মামলার উকিলের বাড়ি ছিল ঠিক অবিনাশ কবিরাজ লেনের উল্টোদিকে, এবং উকিলের জানালা দিয়ে সবই দেখা যেতো ।
    কল্পনা নয়, বাস্তব জীবন থেকেই বিনয় তুলে এনেছেন তাঁর কবিতা ও গল্পের রসদ । ঠাকুরনগরের শিমুলপুরের গ্রামে চায়ের ঠেকে আড্ডা দিতে দিতে যা চোখে পড়ত, সেগুলোই উঠে আসত বিনয় মজুমদারের কবিতায় এবং গদ্যকাহিনিতে । এই পর্বে বিনয় তাঁর দিনপঞ্জীর কাব্যায়ন করতেন : “দিনপঞ্জী লিখে লিখে এতোটা বয়স হলো/দিনপঞ্জী মানুষের নিকটতম লেখা।” যৌনপল্লীতে রাধার কাছে দিনের বেলায় যাবার স্বীকৃতি রয়েছে তাঁর ‘চাঁদের গুহার দিকে’ কবিতায়:-

    চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, মেঝের উপরে
    দাঁড়িয়ে রয়েছে চাঁদ, প্রকাশ্য দিনের বেলা, স্পষ্ট দেখা যায়
    চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, ঘাসগুলো ছোটো করে ছাঁটা ।
    ঘাসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় গুহার উপরকার ভাঁজ ।
    গুহার লুকোনো মুখ থেকে শুরু হয়ে সেই ভাঁজটি এসেছে
    বাহিরে পেটের দিকে । চাঁদ হেঁটে এসে যেই বিছানার উপরে দাঁড়াল
    অমনি চাঁদকে বলি, ‘তেল লাগাবে না আজ’, শুনে চাঁদ বলে
    ‘মাখব নিশ্চয়, তবে একটু অপেক্ষা কর’ বলে সে অয়েলক্লথ নিয়ে
    পেতে দিল বিছানায়, বালিশের কিছু নিচে, তারপর হেঁটে এসে চলে গেল
    নিকটে তাকের দিকে, একটি বোতল থেকে বাম হাতে তেল নিয়ে এল
    এসে তেল মাখা হাতে ভুট্টাটি চেপে ধরে ।
    যখন ধরল তার আগেই ভুট্টাটি খাড়া হয়ে গিয়েছিল ।
    চাঁদ আমি দুজনেই মেঝেতে দাঁড়ানো মুখোমুখি
    এক হাতে ঘসে ঘসে ভুট্টার উপরে চাঁদ তেল মেখে দিল ।

    বিনয়ের দৃষ্টিপথে ব্যবিলন, বিম্বিসার, অশোক, মালয় সাগর, আত্তিলা, বিদিশা, শ্রাবস্তী, দারুচিনি দ্বীপ, লিবিয়ার জঙ্গল ইত্যাদি পড়ে না । বিনয়ের কাছে গ্রামের তুচ্ছ জিনিস আর সামান্য চাষি বা দোকানিও গুরুত্বপূর্ণ, তিনি সকলের নাম জানেন, চেনেন। বিনয় লিখেছেন : “সকলকিছুর মানে আছে, মানে থাকে, মানে নেই এরকম কিছু/স্বাভাবিক প্রকৃতিতে কখনো সম্ভব নয়, সৃষ্টি হলে মানে হয়ে যায়।” ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’ বইটিতে তাঁর গ্রামের মানুষজনদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সূত্র পাই । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চম্পাহাটি গ্রামে জমিজমা কিনে বেশ কয়েক বছর ছিলেন, অথচ তাঁর গল্পগুলোয় সেই আন্তরিকতা পাওয়া যায় না যা বিনয়ের ছোটগল্পের চরিত্রদের সঙ্গে বিনয়ের কথাবার্তায় পাওয়া যায় । শ্যামল একটি সাহিত্যিক দূরত্ব গড়ে চরিত্রগুলোকে উপস্হাপন করেছেন ।
    জীবনানন্দ সম্পর্কে বিনয় মজুমদারের শ্রদ্ধা ১৯৯৯ সালে মারুফ হোসেনের সঙ্গে এই প্রশ্নোত্তরে ফুটে ওঠে :
    প্রশ্ন : আপনার মতে বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি ?
    বিনয় : জীবনানন্দের ‘সমারূঢ়’ অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা । ( বিনয় আবৃত্তি করেন )
    বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা
    বলিলাম ম্লান হেসে ; ছায়াপিণ্ড দিল না উত্তর ;
    বুঝিলাম সে তো কবি নয় — সে যে আরূঢ় ভণিতা;
    পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ‘পর
    বসে আছে সিংহাসনে — কবি নয় — অজর, অক্ষর
    অধ্যাপক ; দাঁত নেই — চোখে তার অক্ষম পিচুটি ;
    বেতন হাজার টাকা মাসে — আর হাজার দেড়েক
    পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি ;
    যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
    চেয়েছিল — হাঙরের ঢউয়ে খেয়েছিল লুটোপুটি ।
    প্রশ্ন : হাঙর মানে ?
    বিনয় : হাঙর মানে মনস্তত্ববিদগণ, হাঙর মানে ডাক্তারগণ, হাঙর মানে পুলিশগণ, হাঙর মানে মন্ত্রীগণ, হাঙর মানে পুরোহিতগণ । এই হাঙরদের পাল্লায় পড়ে প্রাণ বেরিয়ে যাবার যোগাড় । বহু কবি মারা গিয়েছেন এদের দুর্ব্যবহারের জন্য । ভেবে দ্যাখো আমরা পাঁচ দশকে যারা কবিতা লিখতাম তাদের মধ্যে বর্তমানে কজন টিকে আছে ? জনা দশেক । তাও নয় । হাঙরেরা দিয়েছে বাকিগুলোকে শেষ করে । ফলে ভয়ে ভয়ে লেখা বন্ধ করে দিয়েছি । এখন একটু জ্বলাতন কম আছে । তবে মরে গেলেই মুক্তি পাব। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে/আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ভাসে ভাসে ।
    এখানে মনে করিয়ে দিই যে বিনয় যাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়েছেন, বা যারা তাঁকে অসীমের দিকে যাত্রায় বাধা দিয়েছেন, তাদের বলছেন হাঙর, মনস্তত্ববিদরা, ডাক্তাররা, পুলিশরা, এমনকি গায়ত্রীর পরিবার যে পুরোহিতের পরিবার ছিল, সেই পরিবারকেও । সময় ও বয়সের সঙ্গে কিশোরী গায়ত্রী ক্রমশ আবছা হয়ে বিনয়ের কাছে হয়ে উঠেছেন বিমূর্ত ঈশ্বরী ।
    ২০০৩ সালে প্রৌঢ়া গায়ত্রী চক্রবর্তীকে নিয়ে এই কবিতাটি লিখেছিলেন বিনয় মজুমদার, কবিতাটি থেকে অনুমান হয় যে সেই কিশোরী গায়ত্রী যে তাঁকে আকর্ষণ করেছিল, সে তার স্মৃতিতে আর নেই, চাকা আর ফেরেনি :

    আমরা দুজনে মিলে
    আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
    তোমার গায়ের রঙ এখনও আগের মতো, তবে
    তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছ ।
    তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি ।
    আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেটেছি এখন
    তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করা ছাটা,
    ছবিতে দেখেছি আমি, দৈনিক পত্রিকাতেই ; যখন দুজনে
    যুবতী ও যুবক ছিলাম
    তখন কী জানতাম বুড়ো হয়ে যাব ?
    আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে ।
    আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
    তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
    চিঠি লিখব না ।
    আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায় ।
    ( হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ )
    ২০১৩ সালে কলকাতায় যে লিটেরারি ফেস্টিভাল হয়েছিল, সেখানে বাংলা কবিতা আলোচনাকালে বিনয়ের কবিতাকে গায়ত্রী চিহ্ণিত করেছিলেন ‘জ্ঞানতত্ত্বের মহাকাব্য’ এবং ‘এপিসটেমলোজিকাল এপিক’ হিসাবে । গায়ত্রী পরবর্তীকালে লিখেছিলেন ‘ক্যান দি সাবলটার্ন স্পিক’ ; আমি বলব এর উত্তর তো বিনয় মজুমদার, যিনি সাবলটার্ন বর্ণের বলে কবিতা রচনা সত্ত্বেও জীবদ্দশায় সেরকম গুরুত্ব পাননি, যেমন পেয়েছেন তাঁর সমসাময়িক উচ্চবর্ণের কবিরা ।
    বিনয় যে বহুবার মানসিক চিকিৎসালয়ে ছিলেন এবং তাঁকে অনেকে পাগল মনে করে, তা তাঁর চেতনায় ক্ষতের মতন থেকে গিয়েছিল । অন্যের অস্বাভাবিক আচরণকে কেন পাগলামি বলে হবে না তা তিনি লক্ষ্য করেছেন এবং লিখেছেন । ‘কয়েকটি কবিতা’র পাঁচ সংখ্যক কবিতায় কলকাতা কফি হাউসে দুটি যুবতীর অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে এই রচনাটি লিখেছিলেন বিনয় :

    আমাদের কফি হাউসে
    অন্তত দেড়শো জন লোকের সামনে বসে
    একজন যুবতী একজন যুবকের হাতে হাত বোলায়
    আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনায় — ‘তুমি কেমন করে
    গান করো হে গুণী…’
    যুবতীটি সবার সামনেই যুবকটির হাতে বহুক্ষণ যাবৎ
    হাত বোলায় আর বোলায় আর বলে —’আপনি আমার
    দাদার মতো।’
    এবং যুবতীর বোন আরেক যুবতী কফি হাউসের
    টেবিলের নীচে যুবকটির পা দুই পা দিয়ে
    জড়িয়ে ধরে সবার সামনেই, কফি
    হাউস ভর্তি লোকের সামনেই । এ করে প্রত্যহ ।
    অর্থাৎ পাঠকগণ আমার মতে সব মেয়েই একটি
    ‘মানসিক হাসপাতাল’
    ( ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য, জানুয়ারি ২০০৭ )

    সাত
    ‘ফিরে এসো, চাকা, বইটির অসাধারণ কবিতাগুলো সত্বেও বিনয় মজুমদারকে সেই ধরণের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল না, যেমন শক্তি-সুনীল শক্তি-সুনীল ধুয়ো তুলে একটা প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্মে তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল । স্বাভাবিক যে নিজের মধ্যে পুষে রাখা অপরত্ববোধ বা আদারনেস বিনয় মজুমদারের মানসিকতায় প্রগাঢ় প্রভাব ফেলে থাকবে । আশ্চর্য যে ওই সময়ের কবিদের তরুণ বয়সের অজস্র ফোটো পাওয়া যায় অথচ বিনয়ের তরুণ বয়সের ফোটো দুষ্প্রাপ্য । বিনয় মজুমদারের প্রায় সমস্ত ফোটোই এমন যে যাঁরা ফোটোগুলো তুলেছেন তাঁরাও প্রমাণ করতে চাইছেন যে বিনয় একজন “অপর’’– উস্কোখুস্কো চুলের বিনয়, লন্ঠন হাতে চলেছেন বিনয়, মাথায় মাফলার জড়িয়ে বিনয়, হাতে বালতি ঝোলানো বিনয়, খালি গায়ে বেঞ্চে বসে বিনয়, ইত্যাদি । আর্যনীল মুখোপাধ্যায় এমনকি লিখেছেন যে বিনয় ছিলেন ‘একসেনট্রিক’ ; আমি বলব বিনয় ছিলেন ‘একলেকটিক’ । বিনয় তো সাহিত্য সভায় কবিতা পাঠও করতেন অথচ সেই সময়ের বিনয়ের ফোটো পাওয়া যায় না কেন ? শক্তি-সুনীল-শরৎ এমনকি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ফোটোও পাওয়া যায়, কিন্তু গায়ত্রীর প্রেমিক যুবক বিনয়ের ফোটো বিরল । অপর করে দেয়া বা ‘আদারিং’ শব্দটি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সৃষ্ট ।
    সবচেয়ে বিস্ময়কর, বিনয় মজুমদারের সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোনো লোভ ছিল না, যেমনটা ছিল তাঁর দশকের অধিকাংশ কবি-লেখকের, এবং পরের প্রতিটি দশকের কবি-লেখকদের মধ্যে । পুরস্কার, সম্বর্ধনা, রেডিও-টেভিতে রঙিন জামা পরে হাত-পা নাড়াতে দেখা যায়নি তাঁকে । আনন্দবাজার আর দেশ পত্রিকার করিডরে কোনোকালেই ঘুরঘুর করতে যাননি । কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁকে কোনঠাশা করে দেবার প্রয়াস চলছে । তিনি অনুমান করেছিলেন যে তাঁর পাণ্ডুলিপি সেইভাবে সংরক্ষিত হবে না যেভাবে খ্যাতনামা কবিদের পাণ্ডলিপি সংরক্ষণ করা হয় । “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি যাতে সংরক্ষণ করা হয় তাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও ওয়েস্ট বেঙ্গল আর্কাইভকে অনুরোধ করেছিলেন । তারা প্রত্যাখ্যান করলে পাঠিয়ে দেন ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে । পঁচিশ বছর পর একটা চিঠি লিখে বিনয় মজুমদার জানতে পারেন যে পাণ্ডুলিপিটি সেখানে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে ।
    গণিত নিয়ে তাঁর গবেষণা সম্পর্কে ১৯৭২ সালে দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে দেয়া সাক্ষাৎকালে বিনয় মজুমদার জানিয়েছিলেন, “১৯৬৩ সালের কিছু চিন্তাকে আমি ভাবলাম মৌলিক আবিষ্কার এবং সেগুলোকে আমি লিখে ফেললাম । লিখে ফেলে প্রথমে আমি ম্যাকমিলান কোম্পানিকে দিয়ে বললাম যে, ভাই দ্যাখ তো তোমরা ছেপে দিতে পারো কিনা পুস্তকাকারে । তবে শেষ পর্যন্ত ছাপা হয়নি, তার কারণ আমি যা শুনেছিলাম, তা হল যে ওদের অধিকাংশই পাঠ্যপুস্তক ছাপার দিকে নজর । একদম একেবারে যা কিনা মৌলিক আবিষ্কার, যা কোথাও পাঠ্য নেই, সেটা ছাপতে ওদের অসুবিধা হয়, বিক্রির ব্যাপার রয়েছে, বিক্রি হয় না । যাই হোক পরে সেই ম্যানাসক্রিপ্ট, ১৯৬৩ সালের ব্যাপার বলছি, ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে ব্রিটিশ মিউজিয়াম আমার কাছ থেকে অ্যাকসেপ্ট করল । আমি পাঠিয়েছিলাম, ওরা বলল, হ্যাঁ, আমরা আপনার পাণ্ডুলিপিখানাকে যত্নের সঙ্গে প্রিজার্ভ করছি, আমাদের মিউজিয়ামে রেখে দিচ্ছি । আমি নিশ্চিন্ত হলাম । সেই পাণ্ডুলিপিখানাকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রিজার্ভ করে রেখেছে । এর মাস কয়েক পর আমি লিখলাম যে
    আমার কাছে তো কোনও কপি নেই ভাই, আমার একটা কপি দরকার । ওরা তখন পুরো ম্যানাসক্রিপ্টকে, ধরো একশো পৃষ্ঠা হবে, সেটাকে ওরা পুরো ফোটোকপি করে, ওই একশো পৃষ্ঠা আমাকে পাঠিয়ে দিলো । আমি সেই ফোটোকপিগুলোকে ভালো করে ভাঁজ করে বাঁধালাম, সুন্দর চামড়া দিয়ে বাঁধিয়ে আমাদের ন্যাশানাল লাইব্রেরি, ভারত সরকারের লাইব্রেরি, ওখানে জমা দিয়ে দিলাম । সে হচ্ছে তোমার ধরো ১৯৬৫ সালের গোড়ার দিকের কথা । আমার পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যে কপি রয়েছে, সেই কপির ভেতরে বারংবার ব্রিটিশ মিউজিয়ামের স্ট্যাম্প মারা রয়েছে । ওই স্ট্যাম্প দেখে ন্যাশানাল লাইব্রেরি ওটা অ্যাকসেপ্ট করল । আমার তারণা ওই পাণ্ডুলিপিখানা এক মৌলিক আবিষ্কার, গণিতের মৌলিক আবিষ্কার । Interpolation Series and Geometrical Analysis and United Analysis Roots of Calculus.” তবে ? যিনি এইভাবে নিজের রচনাবলী নিয়ে চিন্তা করতে পারেন তাঁকে কলকাতার সাহিত্যিকরা ‘পাগল’ হিসেবে দেগে দিল কেন ?
    ১৯৭২ সালে ‘গল্পকবিতা’ পত্রিকায় গণিত ও কবিতা নিয়ে দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেয়া বিনয়ের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল । বিনয় তখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন, এবং তার কারণ তিনি জানিয়েছিলেন যে গণিত তাঁর মস্তিষ্ক দখল করে আছে । প্রশ্নোত্তরের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু পড়লে বিনয়ের সেই সময়কার ভাবনাচিন্তা কোন পথে প্রবাহিত হচ্ছিল তা স্পষ্ট হবে ।
    প্রশ্ন : কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে যে জীবিত খুব কম জনই আপনার মতো কবিতার এতো ভেতরে যেতে পেরেছেন । আপনি খুব সার্থক এবং সাবলীলভাবে, বলা যেতে পারে, কবিতার অতো ভিতরে গিয়েও কেন কবিতা ছেড়ে দিলেন এটা হচ্ছে প্রশ্ন । আর কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত আপনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন যে এই এই কারণে, এই এই অসুবিধে হচ্ছে আমার কবিতা লেখার জন্য — যার ফলে আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দেব । আমরা সেই ভেতরের কারণটা জানতে চাইছি ।
    বিনয় : ভেতরের ?
    প্রশ্ন : ভেতরের কারণ বলতে আপনার মনের ভেতরে যে কারণটা ছিল, যেটা আপনাকে কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে প্রণোদিত করেছে । এই আর কি !
    বিনয় : কিছুদিন আগে তুমি আমাকে লিখেছিলে যে ‘আমার ঈশ্বরীকে’ বইয়ের পিছনে গণিত গ্রন্হের বিজ্ঞাপন দেখেছ তুমি । শুধু ‘আমার ঈশ্বরীকে’ কেন, অনেকগুলো বইয়ের ভিতরে বিজ্ঞাপন আছে । ‘আমার ঈশ্বরী’ বইয়ের বিজ্ঞাপনও আছে । ‘ঈশ্বরীর’ বলে আমার একটা বই আছে, তার ভিতরেও বিজ্ঞাপন আছে। ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’ বলে আরেকখানা বই আছে, তার ভিতরেও গণিতগ্রন্হের বিজ্ঞাপন রয়েছে । এমনকি এক ফর্মার একটি ছোটো পুস্তিকা বেরিয়েছিল ‘অধিকন্তু’, সেই ‘অধিকন্তু’র ভিতরেও আমার লেখা গণিত গ্রন্হের বিজ্ঞাপন রয়েছে । এই গণিতের জন্য আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।
    প্রশ্ন : কিন্তু গণিত এবং কবিতা কি পাশাপাশি চালানো যেত না ? আপনি চেষ্টা করলে পারতেন । সকলের পক্ষে সম্ভব না হলেও । এবং গণিত ও কবিতার মধ্যে কোথাও মিলও তো আছে । হায়ার ম্যাথমেটিকসের কথা আমি বলছি, আমি যতদূর শুনেছি অবশ্য।
    বিনয় : কথাটা অবশ্য সত্য । গণিত জিনিসটা ইচ্ছা করলে আত্মস্হ করা যায় না, আবার ইচ্ছা করলে এড়ানোও যায় না । মাথার ভিতরে যখন চিন্তা আসে, গণিত বিষয়ক চিন্তা, তখন তাকে ফেলবার উপায় থাকে না । চিন্তাগুলো বার বার আসতে থাকে । গণিতের নানা সূত্র, গণিতের নানা দর্শন, গণিতের নানা প্রকৃতি মাথার ভিতরে আসতে থাকে, সেটাকে ইচ্ছা করলে বন্ধ করা যায় না । কত সময় মাসের পর মাস মাঝে-মাঝে মাঝে-মাঝেই আসতে থাকে । এইভাবে গণিত একজনের চিন্তাকে, এবং আমার চিন্তাকে আত্মসাৎ করে নিয়ে বসে আছে । আমি এই যে বাড়িতে বসে থাকি, কখনও ঘুরে বেড়াই, যখনই একটু-একটু একা থাকি, অন্য মনে, তখনই দেখা যায় মাথায় গণিতের বিষয়ে চিন্তা আসছে । এই ভাবে আসা শুরু করেছে এমন নয়, বহু-বহু অনেক বছর আগে থেকেই, ১৯৫৬-৫৭ সাল থেকেই বলা যেতে পারে । তারপর প্রায়ই আসে মাঝে-মাঝে, আর আসতে-আসতে যখন কোনও চিন্তাকে মনে হয়, গণিত বিষয়ক চিন্তাকে মনে হয়, যে এটা লিখে রাখা উচিত, কাজে লাগতে পারে, আমার কিংবা অপরের যদি কাজে লাগে, তখন তাকে লিখেও রাখতে হয় । এইভাবে গণিতের চিন্তা আমার সমস্ত চিন্তার ভিতরে একটা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে আছে দীর্ঘকাল থেকে ।
    প্রশ্ন : গণিতের বিষয় নিয়ে নতুন করে আপনি ভাবতে শুরু করেছেন আবার তাহলে !
    বিনয় : না, কবিতা আমি লিখতাম, এটা ঠিক, কিন্তু সেটা আমার গণিত চিন্তার ফাঁকে-ফাঁকে, এবং তুমি আমার কবিতাগুলো পড়লে দেখতে পাবে যে অধিকাংশই গাণিতিক কবিতা ।
    প্রশ্ন : হ্যাঁ, সেটা আমি লক্ষ্য করেছি ।
    বিনয় : এটা তুমি লক্ষ্য করেছ, ভালো করেছ । বইগুলি এখনও সব পাণ্ডুলিপি আকারে পড়ে আছে । গণিতের কোনও গ্রন্হ আমার ছাপা হয়নি, সমস্ত গ্রন্হই পাণ্ডুলিপি আকারে পড়ে আছে । এখন এই বর্তমানে আমায় তো সারাক্ষণ গণিত ভেবেই কাটাতে হয় । না ভেবে উপায় থাকে না, মাথায় এসে উদিত হয়, যাকে বলে আবির্ভূত হয় । সারাক্ষণ । অন্য কোনও চিন্তা করতেই পারি না । এই চিন্তার উপরে, এই চিন্তার আসা যাওয়ার উপরে, আমার নিজের কোনও হাত নেই । নিজের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই । মাথায় আসতে থাকে সারাবেলা, ফলে কবিতা লেখার কথা ভাবতেই পারি না, কবিতা আর মাথায় এখন আসেই না । তুমি নিজে কবি, কবিতার আবির্ভাব কী করে হয় নিজের মনে বুঝতেই পারো । নিশ্চয়ই টের পাও কবিতা কী করে আবির্ভূত হয় । সে ইচ্ছে করলে যে কবিতা আবির্ভূত হল সেরকমও নয়, আবার ইচ্ছে করে কবিতা এড়িয়ে গেলে সেরকমও নয় । কবিতার যখন আসার সময় তখন এসে যায় । গণিতও সেরকম, যখন আসার সময় তখন এসে যায় । আমার মাথায় এখন শুধু গণিতই আসছে, অন্য কিছু চিন্তা করার অবকাশ থাকছে না ।”
    ‘গ্রন্হি’ পত্রিকার জন্য ১৪১২ বঙ্গাব্দের সাক্ষাৎকারে চন্দন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিনয় মজুমদারের বিজ্ঞানভাবনা নিয়ে যে কথাবার্তা হয়েছিল, তা পড়লে বিনয়ের একটি সামগ্রিক ছবি তৈরি হয় :-
    প্রশ্ন : একজন কবিতা পাঠক হিসেবে যখন কবি বিনয় মজুমদারের মহত্ব বা uniqueness-এর কারণ খুঁজতে বসি, তখন মনে হয় বৈজ্ঞানিক মনন, বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতি আর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে কাব্যরসে আগাগোড়া ডুবিয়ে হাজির করার অভূতপূর্ব গুণটিই আপনার কাব্য-সার্থকতার জন্য এক নম্বর কৃতিত্ব দাবি করতে পারে । ‘ফিরে এসো, চাকা’র খুব জনপ্রিয় কয়েকটি লাইন তুলে নিচ্ছি উদাহরণ হিসেবে । ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’– এই লাইনের শিরদাঁড়া একটি বৈজ্ঞানিক সাধারণ জ্ঞান বা যুক্তিসিদ্ধ পর্যবেক্ষণ ছাড়া আর কিছু তো নয় । অথচ লাইনটি একটি শ্রেষ্ঠ পংক্তি হয়ে উঠল কীভাবে ? ‘প্রকৃত’ শব্দের প্রয়োগের জন্য । ‘প্রকৃত’ শব্দটি কাব্যগুণের দ্যোতক হিসেবে কাজ করছে এখানে । একই ভাবে, ‘একটি উজ্বল মাছ…পুনরায় ডুবে গেল’, এই দীর্ঘ বিখ্যাত কবিতার লাইন মূলত বিধৃত করেছে ক্লাস নাইনের ফিজিক্স জ্ঞানকে, একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিশিয়ে । আমরা সবাই পড়েছি জলের রঙ নেই । গভীর জলের মধ্যে যখন আলোকরশ্মি প্রবেশ করে, তখন রশ্মিগুচ্ছ বর্ণালীতে বিশ্লিষ্ট হয় । বর্ণালির সাতটি রঙের সাতটি বিভিন্ন চ্যুতিকোণ আছে । জলের গভীরতার ওপর নির্ভর করে কোনও নির্দিষ্ট রঙের চ্যুতি আমাদের চোখের অবস্হানের সঙ্গে মিলে-মিশে যায় । ফলে জলকে আমরা সেই রঙেই রঙিন দেখি। আপনি দৃশ্যত সুনীল না লিখে দৃশ্যত সবুজ বা দৃশ্যত তমস — যেখানে সব রঙ শোষিত — লিখতে পারতেন। কিন্তু লাইনটায় কবিতা সৃষ্টি হল ‘প্রকৃত প্রস্তাবে’ শব্দবন্ধের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে । বিজ্ঞানভাবনার হাড়কাঠামোর ওপর সৌন্দর্যের মাংসত্বক বসিয়ে দিলো সে । এইরকম নানা উদাহরণ আছে । যেমন মশা উড়ে গেলে তার এই উড়ে যাওয়া ‘ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়ে থাকে’ সেই বিষয়টা । এখন কথা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক মননকে এভাবে বাংলা কবিতায় তো কেউ আনেননি ?
    বিনয় : তোমাদের এই কথাটা ভুল । প্রাচীনকালেও কবিরা বিজ্ঞানভাবনা থেকে কাব্যের আঙ্গিক সৃষ্টি করে নিয়েছেন । আমি যে খুব নতুন কিছু করছি তা নয় । যেমন ধরো কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব কাব্য’ । একটি দৃশ্যে যখন হরপার্বতীর বিয়ে হচ্ছে, সেখানে কালিদাস লিখলেন, পৃথিবীর চারদিকে যেমন আলো আর অন্ধকার ক্রমাগত ফিরে-ফিরে আসে, তেমনি শিব আর উমা আগুনের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছেন । এটা তো বিজ্ঞানই । অথবা, এই সংস্কৃত শ্লোকটি লক্ষ্য করো — ‘হংসের্যথা ক্ষীরম অম্বু মধ্যাত’। মানে হল, হাঁস যেমন অম্বু অর্থাৎ জলের ভেতর থেকে ক্ষীর বেছে নেয় । তো, এটাও তো সেই তোমার ভাষায় যুক্তিসিদ্ধ বা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণকে কাব্যে প্রকাশ করা । তাই নয় কি ? আমিও লিখেছি ‘ব্রোঞ্জের জাহাজ আছে যেগুলি চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় না । এরূপ জাহাজে বৈজ্ঞানিক সামুদ্রিক গবেষণা করে।’ এই কবিতাটি ‘গায়ত্রী’ কাব্যগ্রন্হে আছে । ‘ফিরে এসো, চাকা’তে নেওয়া হয়নি ।
    প্রশ্ন : বেশ । কিন্তু পরের দিকের কাব্যগ্রন্হে আর একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেল । বিজ্ঞান বা অঙ্কের কোনো কনসেপ্টকে আপনি মানবজীবনের কোনও ঘটনার মতো উল্লেখ করেছেন কবিতায় । বা বহু জায়গায় অঙ্কের সূত্র দিয়ে মানুষের জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন । বিজ্ঞান ও অঙ্কের সূত্রেরা এভাবে রক্তমাংসে জীবিত হয়ে উঠছে ।
    বিনয় : মনুষ্যীকরণ । মনুষ্যীকরণ । আর কিছুই না । সেই সময়ে বিজ্ঞানের বেশ কিছু বই অনুবাদ করতে হয়েছিল আমাকে । বইগুলো মন দিয়ে পড়ে দেখলাম, বৈজ্ঞানিক সত্যদের মানুষের জীবনের সঙ্গে মেলানো যায় । এবং এটা কবিতা লেখার এক নতুন পদ্ধতি হতে পারে ।
    প্রশ্ন : সীমা, অসীম, কল্পনা, ব্যোম, রেখা ইত্যাদি জ্যামিতিক ধারণাগুলিকে আপনি মানব বা মানবীচরিত্র দিতে লাগলেন কবিতায় । জ্যামিতির ওপরও আপনার অসম্ভব টান লক্ষ্য করি ।
    বিনয় : ঠিক তাই । আচ্ছা আমি হচ্ছি ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র । একটা কথা আছে, ড্রইং ইজ দি ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ইঞ্জিনিয়ার্স । আমি যদি একটি ড্রইং এঁকে পাঠিয়ে দিই তবে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তেই একজন ইঞ্জিনিয়ার সেটি দেখে বুঝতে পারবে আমি কী বলতে চেয়েছি । নানা রকম ভাবনা মনে আসে । ধরো ম্যাক্সিমা-মিনিমা বিষয়টা । একটা কার্ভড লাইনের পয়েন্ট অফ ইনফ্লেকশান-এ কার্ভটাকে ডিফারেনশিয়েট করলে পাচ্ছ একটা পজিটিভ ম্যাক্সিমা, তাকে আবার ডিফারেনশিয়েট করলে আসবে নেগেটিভ স্ট্রেট লাইন, তাকে ফের ডিফারেনশিয়েশানের ফল হলো নেগেটিভ মিনিমা বা ইনফিনিটি…অর্থাৎ অসীম । সুতরাং কার্ভটির পয়েন্ট অফ ইনফ্লেকশান-এ কী ঘটছে, তার একটা ডায়াগ্রাম এঁকে আমি একখানা জেরক্স করে রেখেছি ।
    প্রশ্ন : আপনার আরেকটি চূড়ান্ত রহস্যময় কবিতা হলো ‘সমান সমগ্র সীমাহীন’-এর ছয় নম্বর লেখাটি: ‘একটি বিড়ি ধরিয়ে সেই পোড়া দেশলাই/কাঠি দিয়ে আমি/টেবিলে লিখেছিলাম অসীম এক নং যোগ অসীম দুই নং যোগ অসীম তিন নং যোগ ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা…’ এবং তারপর লেখা যখন সমাপ্তিকে ছুঁতে চাইছে সেই সময়ে ‘পেলাম অসীম সিংহ/পেলাম অসীম বালা, অসীম মজুমদার/পেলাম অসীম রায় ভাইরে/অসীম’ । আমরা জানি ইনফিনিটি অবিভাজ্য । তো এই অসীমকে ভাগ করা বা বিভিন্ন অসীমের ধারণা করা কীভাবে সম্ভব ?
    বিনয় : কতকগুলো চিন্তা আমার মাথায় অনেকদিন ধরেই ঘুরপাক খায়, এটি তার অন্যতম । ধরা যাক, আমাদের এই ঠাকুরনগরে এক বিঘে বর্গ ক্ষেত্রাকার জমি আছে, অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে এক বিঘে, প্রস্হেও এক বিঘে । এবার যদি মাটির ওপর ওই জমির অংশটুকু কল্পনা করি, তবে তা আকাশ ছাড়িয়ে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাবে । একইভাবে জমিটির মাটির নীচেও নেমে যেতে অসীম পর্যন্ত ছড়িয়েছে । কাজেই এক বিঘে বর্গক্ষেত্রের এক টুকরো অসীম পাওয়া গেল ।
    প্রশ্ন : কিন্তু বর্গক্ষেত্র তো দৈর্ঘ্য আর প্রস্হের গুণফল । তার অস্তিত্বের ধারণা শুধুমাত্র টু-ডাইমেনশানাল । সেটি আকাশে বা পাতালে প্রসারিত হওয়ার উপায় কোথায় ?
    বিনয় : বেশ, তাতে না হয় আমি আরেকটি মাত্রা জুড়ে দিলাম । সুতরাং তাকে ত্রিমাত্রিক কল্পনা করতে আর অসুবিধা নেই । এইভাবে, ধরো, ওই এক বিঘে বর্গক্ষেত্রের পাশে আর এক টুকরো এক বিঘের বর্গক্ষেত্র, তার পাশে আরও একটা, এইভাবে টুকরো টুকরো অসীমকে পেয়ে যাচ্ছি । এই অংশগুলির কোনওটির নাম দেয়া যায় অসীম বালা, কেউ অসীম রায়, কেউ অসীম মজুমদার ইত্যাদি । আবার এই সব আলাদা অসীমের যোগফল এক পূর্ণ অসীমও কিন্তু রয়েছে । সে যেন এক ঈশ্বর, এই ব্রহ্মাণ্ডের রাজা । সম্পূর্ণ অসীম যেন এই ছোট-ছোট অসীমের সাহায্যে আমাদের বিশ্বকে শাসন করে চলেছে ।
    ২০০০ সালে ভালোবাসা নিয়ে রোমন্হন করেছিলেন বিনয় মজুমদার, এবং আরেকবার ভেবেছিলেন মানসিক শান্তির কথা এই কবিতাটিতে :-

    একমাত্র ভালোবাসা
    ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসা ভরে দিতে পারে মনে
    শান্তি এনে দিতে
    কেবল নারীর প্রতি পুরুষের কিংবা কোনো পুরুষের প্রতি
    কোনো নারীর প্রণয় ভালোবাসা ।
    — এ তো আছে থাকবেই, তদুপরি প্রতিটি বিশেষ্য পদকেই
    ভালোবাসা হল সেই ভালোবাসা যাতে মনে
    শান্তি এনে দেয়
    আর এই শান্তি কী বা আমাদের প্রয়োজন ?
    মনে যদি শান্তি থাকে তবে আর কোনো কিছু
    চাওয়ার থাকে না ।
    যদি বা চাওয়ার থাকে তা এরূপ যাতে মনে
    শান্তি ঠিক আগের মতন থেকে যায়
    আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার তালিকাগুলি এইভাবে
    আমরাই তৈরি করে থাকি ।
    ( কবিতা বুঝিনি আমি — জানুয়ারি ২০০১ )

    আট

    যে লোকটির নিজের সম্পর্কে এই ইতিহাসবোধ আছে তাঁকে কেমন করে ‘পাগল’ বলা হয় ? এ যেন উস্কো-খুস্কো চুলের জন্য আইনস্টাইনকে পাগল বলার মতন । বস্তুত বিনয় মজুমদারের মানসিক চিকিৎসালয়ের প্রেসক্রিপশানগুলো কোনো গ্রন্হের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ।
    বিনয় মজুমদারের রাজনৈতিক মতামত নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে, বিশেষ করে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত “আমি এক কমিউনিস্ট এই কথা উচ্চারিত হোক/দিকে-দিকে পৃথিবীতে’, কবিতাটি লেখার পর । ‘কবিতা বুঝিনি আমি’ কাব্যগ্রন্হে তাঁর এই কবিতাটিও বিতর্ককে উসকে দিয়েছে :-

    দেশে সাম্যবাদ এলে
    দেশে সাম্যবাদ এলে সকল মন্দির
    ডিনামাইটের দ্বারা ভেঙে ফেলা হবে
    আর যদি কেউ তার বিবাহের কালে
    পুরোহিত ডেকে আনে মন্ত্র পড়াবার
    নিমিত্ত তাহলে তাকে যাবৎ জীবন
    কারাদণ্ড দেওয়া হবে যথা ভগবান
    নামক ব্যক্তিকে দাহ করা দরকার
    হয়ে পড়ে একদিন অথবা যেমতি
    অন্ধকারে বজ্রপাত প্রয়োজন হয় ।
    মাঝে-মাঝে মন ক্রমে মহীর মানুষ
    অসভ্য অসভ্যতর হয়েই চলেছে
    এইভাবে মুহূর্তেই ভাবি মানুষের
    গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে — এ চিন্তা আমার
    সান্ত্বনা আনত না মনে, আমি তো ভ্রান্ত না ।

    কিন্তু ১৯৮২ সালে ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকার দেয়া সাক্ষাৎকারে সমর তালুকদার যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “শুনেছি সেই সময়ে ( ১৯৫১-১৯৫২ ) তুমি মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিতই হওনি শুধু — ‘ডাস ক্যাপিটাল’-টাও নাকি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ে ফেলেছিলে ?” জবাবে বিনয় বলেন, “সে সময়টা বড়ো অদ্ভুত সময় ছিল । মার্কসবাদ সম্পর্কে লেখাপড়া, মার্কসবাদ নিয়ে আলোচনা একটা ফ্যাশানের মতোই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল — বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে । Serious commitment of sincere conviction কতটা ছিল তা বুঝতেই পারি আজ ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের চেহারা দেখেই । চীনের পার্টি আর আমাদের পার্টির জন্ম প্রায় একই সময়ে — ওরা কোথায় আর আমরা কোথায় ! কী করেই বা হবে ? — ভাবা যায় কমিউনিস্ট পার্টির ( ভারতের ) ইতিহাস লেখা হচ্ছে বুর্জোয়া সরকারের জেলে বসে — ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ! একে এক ধরণের অর্ডারি লেখা বলা যায় নাকি ? আমি নিজে ন্যাশানাল বুক এজেন্সিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রুফ দেখে দিয়েছি।”
    সমর তালুকদার বিনয়কে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে তো কমিউনিস্টরা শাসন চালাচ্ছেন এখন ?” উত্তর বিনয় বলেন, “ধ্যূৎ, এরা আবার কমিউনিস্ট নাকি !” লক্ষ্যনীয় যে বিনয় মজুমদার কথাটা বলছেন ১৯৮২ সালে, এবং তখনই তিনি আঁচ করে ফেলেছিলেন নেতাদের অধঃপতন, অথচ বহু কবি-লেখক সেসময়ে আর তারপরও বহুকাল বামপন্হীদের লোভী লেজুড় আর স্যাঙাত হয়ে সেঁটে ছিলেন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে তো মৃত্যুর কয়েক বছর আগেও দেখা গেছে বইমেলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পেছন-পেছন ঘুরছেন । স্বাভাবিক যে বিনয়ের মতন এই ধরণের খোলাখুলি কথাবার্তা বললে কার্ড হোল্ডারদেরও পার্টিতে পাত্তা দেয়া হতো না ।
    ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য মারুফ হোসেনের সঙ্গে বিনয়ে যে প্রশ্নোত্তর হয়েছিল তা থেকে তাঁর সামাজিক অবস্হানের আঁচ পাওয়া যায় ।
    প্রশ্ন : ষাট-সত্তরের উত্তাল সময় । খাদ্য আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সময়কে নিয়ে কবিতা লিখে চলেছেন একের পর এক, সহযাত্রী মণিভূষণ ভট্টাচার্য, সমীর রায় প্রমুখ । আর আপনি ১৯৬৬ সালে লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ । প্রকাশ হল ১৯৭৪-এ । এটা কি সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয় ?
    বিনয় : আমি লিখেছি আমাকে নিয়ে, অন্য কাউকে নিয়ে কবিতা লিখিনি । সবই আমার দিনপঞ্জি । দিনপঞ্জি লিখে লিখে এতটা বয়স হলো/দিনপঞ্জি মানুষের নিকটতম লেখা । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ হল আমার একাকীত্ব নিয়ে ।
    প্রশ্ন : ওই সময় আপনার জীবনে কোনও প্রভাব ফেলেনি ?
    বিনয় : না, একদম না । আমি তখন থাকতাম কলকাতা -২৮, মানে দমদম ক্যাণ্টনমেন্টে দিদির বাড়ি । আসলে পঞ্চাশের কবিরা প্রায় সবাই আত্মজীবনীমূলক কবিতা লিখেছে । শুধুমাত্র নিজেদের নিয়ে লেখা । এটা একটা ট্রেণ্ড বলা যেতে পারে । কেননা এর আগে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বিষয়ে কবিতা লিখেছেন । জীবনানন্দ লিখেছেন, নজরুল লিখেছেন । পঞ্চাশের পরেও বিভিন্ন কবিরা লিখেছেন । কিন্তু পঞ্চাশের প্রায় সবাই নিজেদের নিয়ে লিখেছে ।
    প্রশ্ন : এর কারণ কী বলে মনে করেন আপনি ?
    বিনয় : তার আবার কারণ কী ! তখন দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে । সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কবি বলে আমাদের কবিতায় আনন্দের কথা ছিল । স্ফূর্তিও ছিল প্রচুর ।
    ২০০১ সালে ‘লোক’ পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীম-এর সঙ্গে প্রায় একই বিষয়ে বিনয়ের সঙ্গে এই কথাবার্তা হয়েছিল :-
    প্রশ্ন : আপনি যখন লেখালিখি শুরু করেন তখনকার কলকাতার আর্থ-সামাজিক অবস্হা সম্পর্কে জানতে চাই ।
    বিনয় : আর্থ-সামাজিক অবস্হা কী হবে ? সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে । প্রচুর উদ্বাস্তু এসে হাজির হয়েছে । কলকাতায় তাদের থাকতে দেওয়ার জায়গা হচ্ছে না । বাড়িঘর নেই, বেকার, চাকরি নেই, কী চাকরি দেবে ? চাল-ডালের অভাব । এখন একেক বিঘে জমিতে ধান হয় ২৫ মন, তখন হতো ৮ মন । খাবার নেই । পুরো বীভৎস অবস্হা তখন । ১৯৫৩ সালে অনেক হাতে-পায়ে ধরে নেহরু আমেরিকা থেকে গম আনায় । দেশ ভাগ হয়েছে ১৯৪৭-এ । সারা বছর না খেয়ে, শুটকি মেরে, চাকরি নেই, বাকরি নেই, থাকার জায়গা নেই — এ অবস্হায় থেকে ৬ বছর পর আমেরিকা দয়া করে গম পাঠাল । সেই গম খেয়ে-খেয়ে মানুষের দিন চলে । কিন্তু দেশ তো স্বাধীন । ৫০-এর কবিরা সেই স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক পরবর্তী সময়কার কবিরা, স্বাধীন যে বছর হল সেই বছর বেশ কিছু কবিতা লিখেছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাই । কবিতাগুলো খুব আনন্দদায়ক হয়েছিল কিংবা আনন্দ-স্ফূর্তির কবিতা হয়েছিল ।
    প্রশ্ন : তার মানে কম বয়সে লেখার ফলে আনন্দদায়ক হয়েছিল ?
    বিনয় : না, স্বাধীনতা পাওয়ার ফলে ।
    ‘ পুনর্বসু’ পত্রিকার জন্য দেয়া ১৯৮৭ এর সাক্ষাৎকারে, রণজিৎ দাশ জানতে চেয়েছিলেন, “শেষ লেখাটায় আপনি বলেছেন, যে আমি এক কমিউনিস্ট, এই কথা উচ্চারিত হোক ?” জবাবে বিনয় বলেন, “হ্যাঁ, যখন আমি লিখেছিলাম, তখন আমার মনে হল যে এইটা হওয়াই ভালো বুঝলে, ‘পরিচয়’ পত্রিকা… ’পরিচয়’ পত্রিকা, আমার কাছে একটা কবিতা চাইল । কমিউনিস্টদের কাগজ, বুঝেছ ? তখন ভেবে চিন্তে দেখলাম, লিখে দেব । কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য আমি ছয়মাস ছিলাম । এত খাটতে হয়, এত দৌড়োদৌড়ি ছুটোছুটি, যে আর আমার দ্বারা হল না, ছেড়ে দিলাম । হ্যাঁ, রাত্তির সেই এগারোটা পর্যন্ত বক্তৃতা, বুঝতে পারছ ?”
    এখানে পরিষ্কার যে বিনয় মজুমদার সেই সময়ের চালু ধুয়ো “গরিব হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো, কমপিউটার না শেখা ভালো, অবরোধ করা ভালো, কারখানা লাটে উঠিয়ে দেয়া ভালো” ইত্যাদি ভাঁওতার খপ্পরে পড়েননি ।
    কেবল বামপন্হীদের সমালোচনায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি বিনয় মজুমদার । অগ্রজ আর সমসময়ের কবিদের সম্পর্কেও নিজের মনের কথা বলেছেন, রাখঢাক করেননি । ১৯৯৮ সালে ‘অধরা মাধুরী’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকারে বোধিসত্ব রায় বিনয়ের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, “বাংলা আধুনিক কবিতা কি পাশ্চাত্যের অনুসারী ?” উত্তরে বিনয় বলেন, “না তো ! ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট আমলে যত বাঙালি কবি ছিল সবাই ইংরেজির অধ্যাপক । ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট এদের ছাড়া কাউকে কবি হতে দেয়নি । জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণুদে, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী এঁরা ইংরেজির অধ্যাপক । ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ইচ্ছানুসারে এই সব কবির কাজই ছিল ইউরোপিয়ান কবিতা নকল করা।”
    ২০০১ সালে ‘লোক’ পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেন, “শক্তি খুব ভালো কবিতা লিখত কিন্তু শেষ বয়সে মাথাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল । সুনীল যে কী লেখে তা আমি জানি না । মন্তব্য না করাই ভালো ।” ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য মারুফ হোসেনের প্রশ্ন, “আপনার সমসাময়িক কবিদের কবিতা আপনার কেমন লাগে?” এর উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “এদের কবিতা আমার খুব বেশি ভালো লাগে বলি না । উৎপলকুমার বসুর কবিতা ভালো লাগত । ‘গোলাপ তোমাকে আমি ঈর্ষা করি/কত না সহজে তুমি তার মত্ত কেশে ঢুকে যাও ।” উৎপল বসুর এটুকু কবিতাই মনে আছে । অমিতাভ দাশগুপ্তর কবিতা একখানাও মনে নেই ।”
    ১৯৮২ সালে ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সে ধরনের কবিতা লিখছেন কোথায় — ওনাকে এখন বরঞ্চ ঔপন্যাসিক বলাই ভালো । নীরেন চক্রবর্তীর অনেক আগের লেখা মন্দ নয় — এখন উনি লেখা বন্ধ করে দিলেই ঠিক কাজ হবে বলে মনে হয় । শঙ্খ ঘোষ মাঝে মাঝে ভালো লেখেন ।” প্রতিষ্ঠানে যাঁরা ছড়ি ঘোরান তাঁদের সম্পর্কে এই ধরণের সাক্ষাৎকার দেবার পর যে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার পাওয়া এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পাওয়া কঠিন তা আমরা বহুকাল হলো জেনে গেছি ।
    জীবনের শেষ দিকে বিভিন্ন পুরস্কার পাবার আগে বিনয় মজুমদারকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার দেয়া হয়েছিল, দশ হাজার টাকা, প্রধানত তাঁর আর্থিক অবস্হার কারণে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পুরস্কারের টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বিনয়কে পুরস্কারটি দেবার জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করে অনুষ্ঠান করা হয়েছিল । বিনয় মজুমদার বসে ছিলেন একটি চেয়ারে । একের পর এক বক্তা সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে, বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে বক্তৃতা দিতে থাকেন । ঘণ্টাখানেক পর বিরক্ত হয়ে বিনয় মঞ্চ থেকে নেমে নিজের ঘরে ফিরে যান । কিন্তু তারপরও বক্তৃতা থামেনি । কলকাতা থেকে যাঁরা বক্তৃতা দেবার জন্য গ্রামে পৌঁছেছিলেন, সবায়ের কোটা শেষ হবার পর অনুষ্ঠান ফুরোয় । চা-সিঙাড়া-সিগারেট পর্ব শেষে তাঁরা বিনয়ের ঘরে গিয়ে দেখেন যে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন ।
    মৃত্যুর এক বছর আগে তাঁকে অকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ওই বছরেই, তাও সেই পুরস্কারটি তাঁকে ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছিল জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে ! রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়ে বিনয় বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার একজন ডাক্তার আর একজন ইঞ্জিনিয়ারকে সাহিত্যের স্বীকৃতি দিলো । রবীন্দ্র পুরস্কার তাঁর আগে দেয়া হয়েছিল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অমিতাভ দাশগুপ্ত এবং সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে । আনন্দ পুরস্কার তাঁকে দেয়া হয়নি, যে পুরস্কার পেলে তাঁর দৈনন্দিন খরচের সুরাহা হতো, অথচ ওই পুরস্কার দুবার করে দেয়া হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তসলিমা নাসরিন ও জয় গোস্বামীকে । অকাদেমি পুরস্কার নিতে তিনি যাননি, তাঁর ঠাকুরনগরের বাড়িতে এসে দিয়ে যান দিব্যেন্দু পালিত, উপস্হিত ছিলেন অমিয় দেব ।
    বিনয় মজুমদার কয়েকবার আত্মহত্যার প্রয়াস করেছিলেন বলে শোনা যায় । ঠিক কোন কারণে তিনি নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন, সে-বিষয়ে কোনো সাক্ষাৎকার অথবা নিকটজনের বিবৃতি পড়িনি । পুলিশও হস্তক্ষেপ করেছিল কিনা জানি না । তবে স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় জিন জাগ্রত হয়ে উঠলে সেই সময়টায় আত্মহত্যা করার রোখ মাথায় চেপে বসে ।
    জয় গোস্বামী, যিনি বিনয়ের কবিতার পাণ্ডুলিপি দেখেছেন, এবং টেলিফিল্মে বিনয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তিনি ‘আকস্মিকের খেলা’ ( ২০০২) গ্রন্হে বলেছেন যে বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি যেন কাফকার ডায়েরি । পাণ্ডুলিপির মার্জিনে আছে স্বপ্নের অনুবর্তীতা, দ্রুত-নেয়া নোট, সংক্ষিপ্ত লিখন — তাঁর মনে হয়েছে তিনি যেন কবির পাশেই রয়েছেন, যেমন যেমন কবি তাঁর লাইনগুলোকে আদল-আদরা দিচ্ছেন ।
    জয় গোস্বামী এই সূত্রে উল্লেখ করেছেন বার্গম্যানের ‘থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি’ ফিল্মটির, যা মোটামুটি ‘ফিরে এসো, চাকা’ রচনার সমসাময়িক । ফিল্মটিতে একজন নারী দেয়ালের ফাটলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন, যা নারীটিকে এক ঐন্দ্রজালিক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে সবাই আলোচনা করছে এবং অপেক্ষা করছে, লোকগুলোর মুখশ্রী উজ্বল, যে কোনো মুহূর্তে ঈশ্বরের দেখা পাবার জন্য । একজন কবি যদি ভিন্নভাবে আসপাশের বস্তু ও ঘটনাবলীর দিকে তাকান, এবং সাধারণ মানুষ যেটুকু সচরাচর দেখতে পায়, তার চেয়েও বেশি কিছু দেখতে পান কবি, তাহলে তাকে মানসিক রোগগ্রস্ত তকমা দিয়ে দেয়া হয়, ‘থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি’ ফিল্মের নারীটির মতো ।
    গ্রামের পথে বাজারে বিনয় মজুমদার স্হানীয় একটি দোকানের দিকে তাকিয়ে যখন অবলোকন করেন, তা শার্ল বদল্যারের ফ্ল্যনেয়ার থেকে ভিন্ন । তিনি দোকানটি, দোকানে রাখা জিনিসপত্র, দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং সম্পর্কটির বিস্তার ঘটিয়ে বিশাল সৃষ্টিজগতের সঙ্গে সম্বন্ধস্হাপন করেন । সাধারণ গ্রামীণ দোকানটির সম্পর্ক রয়েছে স্হানীয় খেতের চাষিটির সঙ্গে, পৃথিবীর অভিকর্ষের সঙ্গে, অক্লান্ত সূর্যের সঙ্গে, দেবী সরস্বতীর সঙ্গে । ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’ ( ১৯৯৮ ) গ্রন্হে শিমুলপুরে তাঁর দিনযাপনের চিন্তাকর্ষক খতিয়ান মেলে ।

    নয়
    একজন কবির সঙ্গে জনসাধারণ কেমনতর আচরণ করেন তা আমরা কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে দেখেছি ; তাঁর জন্মদিন এলে তাঁকে বিয়ের বরের মতন কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করা হতো । অথচ কবি কিছুই বুঝতে পারছেন না । ভ্রাতৃতুল্য ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুরতা হলো সম্পর্কের একটি প্রাগৈতিহাসিক আচারানুষ্ঠান । কবিরা এই সামাজিক শোষণপদ্ধতি থেকে পরিত্রাণ পান না, বিশেষ করে তাঁকে যদি মনে করা হয় মস্তিষ্কবিকৃত একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি । জন্মদিন পালন এই আচারানুষ্ঠানে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুরতা ও অবমাননার উৎসব, যাতে অংশগ্রহণ করে লোকটিকে হেনস্হা করা হয়, এবং প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে মানুষটিকে সমভোগতান্ত্রিক বারোয়ারি পীঠস্হানে বসিয়ে হাস্যকর করে তোলা হয় । প্রতিভাবান মানুষকে নিষ্ঠুরতার অস্ত্র প্রয়োগ করে রোমান্টিসাইজ করার এটি একটি ভয়ঙ্কর খেলা । বিনয় এটি বুঝতে পেরেছিলেন, আর সে কথা তাঁর ‘কয়েকটি কবিতা’র ছয় সংখ্যক কবিতায় লিখেছেন :

    আমার জন্মদিন পালন করত আগে
    কয়েক বছর আগে ।
    আহ্বায়ক ছিল অমলেন্দু বিশ্বাস নৌকা পত্রিকার সম্পাদক ।
    দৈনিক ‘আজকাল’ পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হতো–
    ‘১৭ই সেপ্টেম্বর কবি বিনয় মজুমদারের
    জন্মদিন পালন করা হবে, আপনারা দল বেঁধে আসুন
    শিমুলপুরের কবির বাড়িতে ।’
    অনেকেই আসত । এসে কবিতাপাঠ গানবাজনা
    ইত্যাদি করত । এই অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়াও হতো ।
    কয়েক অতিথি আমার প্রতি সদয় ছিল না–
    আমাকে কতবার মানসিক হাসপাতালে
    নেওয়া হয়েছিল সেই কথা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে
    আলোচনা করত । তাতে আমি মনে খুব ব্যথা পেতাম ।
    ফলে আমি আমার জন্মদিন আর পালন করতে দিই না ।
    আমার জন্মদিন পালন বন্ধ হয়ে গেছে ।

    কবিতাটি থেকে স্পষ্ট যে, আয়োজকগণ এবং যাঁরা কলকাতা থেকে গিয়ে শিমুলপুরে জড়ো হতেন, তাঁরা গোপনে একজন প্রতিভাবান স্কিৎসোফ্রেনিয়া রোগির রোগটিকেই উৎসবে বদলে দিয়ে নিজেরা আনন্দ করতে চাইতেন । কবিকে মনে করিয়ে দিতেন যে তিনি কতোবার মানসিক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছিলেন, যেন মানসিক চিকিৎসালয়ে থাকা একজন দ্রষ্টা কবির বৈশিষ্ট্য । তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া হতো যে তাঁর অসুস্হ জীবনের আরেকটি বছর হাতছাড়া হয়ে গেল । নিজের জন্মদিনে জড়ো হওয়া লোকগুলো সম্পর্কে যিনি এরকম কবিতা লিখতে পারেন, তাঁকে কি মানসিক অসুস্হ বলা যায় !
    ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ ( ২০০৩ ) কাব্যগ্রন্হের ভূমিকায় বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “কবিতীর্থ প্রকাশিত ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ গ্রন্হের প্রায় সব কবিতাই হাসপাতালে থাকাকালে লিখেছি । একটা কথা আমি দিনে তিনচার বার বলি — সবই সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা । এবারেও তাই লিখি । আমাকে হাসপাতালে পুরে সৃষ্টিকর্তা কী পরীক্ষা করলেন কে জানে ! কী দুরূহ পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে এবং পাঠকপাঠিকাগণের কাছে । পরীক্ষায় পাশ করেছি বোঝা যায় ।”
    “কবিতা লেখা আমি মাঝে-মাঝে ছেড়ে দিই । তখন এমন-এমন কাণ্ড ঘটে যাতে ফের লিখতে বাধ্য হই । এই বইখানাও তেমনি জোর করে লেখানো । কবিতা না লিখে বছর চারেক ছিলাম । তারপর আমাকে হাসপাতালে পুরে কাগজ এবং কলম দিয়ে আমাকে বলা হল — ‘কবিতা লিখলে ছাড়া হবে নচেৎ নয়।’ তার ফলে আমি লিখেছি ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ বইখানা ।”
    স্কিৎসোফ্রেনিয়ার নিরাময় হিসাবে হয়তো মানসিক চিকিৎসকরা তাঁকে কবিতা লিখতে বলতেন ।
    রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালির নিষ্ঠুরতা বিষয়ে বিনয় একটি কবিতা লিখেছেন, শিরোনাম ‘কিছু কিছু কবির’ । এই কবিতাটিতে বিনয় মজুমদার দেখিয়েছেন যে মৃত্যুপথযাত্রী রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে যতো বেশি পারা যায় কবির প্রত্যাদেশ ছেঁকে বের করে আনার চেষ্টা করেছিল সমবেত জনগণ । রবীন্দ্রনাথের সেই মুহূর্তের কাঁপা কাঁপা কন্ঠের কবিতাকে দ্রষ্টার দিব্যদৃষ্টি করে তোলার চেষ্টা হয়েছিল, যাকে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘বাণী’ । একজন কবি, যিনি মানবজীবনের অস্হিরতা সম্পর্কে চিরকাল চিন্তা করে গিয়েছেন, তাঁকে মৃত্যুশয্যায় একটি স্বয়ংক্রিয় দিব্যদৃষ্টির যন্ত্রে পালটে ফেলার চেষ্টা হলো । এখনকার দিন হলে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হতো, টিভি সাংবাদিকরা ক্যামেরা মাইক নিয়ে পৌঁছে যেতো আর জানতে চাইতো তিনি কেমন ফিল করছেন ! । বিনয়ের ক্ষেত্রেও, “মানসিক হাসপাতাল থেকে ফেরা” কিংবা “মানসিক হাসপাতালে প্রতিভাবান কবি বিনয়” নাম দিয়ে মোবাইলে তোলা হয়ে থাকবে হয়তো ।

    কিছু কিছু কবির সঙ্গে বাঙালিগণ
    খুব নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন ; এবং মনে হয়
    ভবিষ্যতেও করবেন । যেমন রবীন্দ্রনাথ যখন মৃত্যুশয্যায়
    হাত নাড়তে পারছিলেন না
    তখনো বাঙালিগণ দাবি করলেন যে
    রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে একটি কবিতা বলুন
    সেই কবিতা কাগজে লিখে নেবেন অন্য একজন ।
    অগত্যা রবীন্দ্রনাথ কবিতা বললেন এবং
    তা লিখে নিলেন একজন শ্রোতা ।
    এই হলো রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা ।

    দাদা সমীর রায়চৌধুরী ‘অপর’ তত্ত্বটি বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে পুরাণ থেকে ‘সংজ্ঞা’ নিরুপণ আলোচনা করেছিলেন। উনি বলেছিলেন, মার্কণ্ডেয় পুরাণে সংজ্ঞা বিশ্বকর্মার মেয়ে আর সূর্যের স্ত্রী । সংজ্ঞাকে নিয়ে যে আখ্যান তা থেকে জানা যায় কখন তিনি চোখ বোজেন, আর কখনই বা চপলভাবে দৃষ্টিপাত করেন, আবার কখনও চোখ মেলে পরম মিলনে প্রস্ফূট হয়ে ওঠেন । এই অবলোকন বদলের ওপর নির্ভর করে কখন তিনি সংযমনকারী যমকে প্রসব করবেন, আর কখনই বা প্রসব করবেন চঞ্চলাস্বভাবা নদী যমুনাকে, আবার কখন জন্ম দেবেন যুগলদেবতা অশ্বিনীকুমারদের । অশ্বিনীকুমার যম নন, তবে যমজ, সৌন্দর্যের অধিকারী আর নিরাময়ে পারদর্শী — স্বর্গবৈদ্য ; বিশ্বচরাচরের মহাপারিবারিক আসঙ্গযুক্ত দ্বিপাক্ষিক শঙ্খিলতার মহাপরিপূরকতা বজায় রাখা যাঁর ধর্ম । চোখ মেলে সংজ্ঞা আরও প্রসব করেন রেবন্ত, যিনি সর্বদা সংঘর্ষে, প্রতিবাদে উদ্যত । যিনি পূর্বের ক্লেদ অপসারণ করে নবীনতাকে প্রশ্রয় দেন । এই আখ্যান বিনয় মজুমদারকে সংজ্ঞায়িত করে, অবলোকন ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি জগতসংসারের বিশাল স্পেকট্রামকে পাঠকের সামনে মেলে ধরেন ।
    ‘আজকের পত্রিকা’র ১১ই ডিসেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় বীরেন মুখার্জি লিখেছেন যে বিনয় মজুমদার একজন ইনট্রোভার্ট বা আত্মমুখিনতার রূপদক্ষ শিল্পী — অপ্রাপ্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ, স্বগতোক্তি কিংবা আত্মকথন যা শান্তরস-সিক্ত তা রয়েছে তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’ পর্যায়ের কবিতায় — তীব্র ব্যঞ্জনাধর্মী ও গভীর অর্থবোধক, তাঁর কবিতার সুর তন্ময় ব্যক্তিগত কিংবা মন্ময় বস্তুগত ; তাঁর কাব্যবোধ তাঁর প্রেমিক সত্তাকে প্রজ্ঞাবান করার পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতায় জারিত । তবে বীরেন মুখার্জি মনে করেন যে বিনয় মজুমদারের ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ ও ‘বাল্মীকির কবিতা’ পাঠে তাঁকে ‘কামোন্মাদ’ বলে মনে হয় । তিনি বলেছেন, জৈবিক মিথুন-সত্তায় আক্রান্ত বিনয় না পাওয়ার তীব্রতর বেদনা শব্দমাধুর্যে উপস্হাপন করলেও, তা অত্যন্ত নিচুস্বরে, যেমন :-

    কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে, ক্রমাগত
    ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখো, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
    আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে ।
    আড়ালে যেও না যেন ঘুম পাড়াবার সাধ করে ।

    বিনয় মজুমদারকে নানা ধরণের উন্মাদের তকমা দেয়া হয়েছে দেখে বীরেন মুখার্জি সম্ভবত ‘কামোন্মাদ’ তকমাটি ধরিয়ে দিলেন । ‘কামোন্মাদ’ ! এরকম ভয়ঙ্কর আরোপ আর হয় না, যেন বিনয় একজন গ্রিক দেবতা স্যাটারিয়াসিস । বিনয় নিজেই বলেছেন যে তিনি ‘ইরোটিক’ কবিতা লিখতে চান, কেননা ইরোটিক কবিতা লেখার যে চল ইংরেজরা আসার আগে ছিল তা শেষ হয়ে গেছে । কথাটা সত্যি । শ্রীরামপুরের পাদরি আর ম্যকলে সাহেবের ভিকটোরিয় শিক্ষাপদ্ধতির দরুণ প্রাগাধুনিক বাংলার ধারা থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেওয়াকে মধ্যবিত্ত বাঙালি গৌরবের ব্যাপার মনে করেছে বহুকাল, তার ওপর ব্রাহ্মধর্মের হাস্যকর রক্ষণশীলতা মিশে সেই ধারাকে সম্পূর্ণ তামাদি করে দিয়েছে ।
    ইংরেজি ভাষার কবি নন বলে ওভিদ, কাতুল্লুস, সেক্সটাস প্রোপার্টিয়াস, পেত্রার্ক, পিয়ের লোয়ুস, গ্রেগোরিও দে মাত্তোস, হিল্ডা হিলর্স্ট, গ্লাউকো মাটোসো, ভিনি করেয়া, ম্যানুয়েল মারিয়া প্রমুখ বাদ গেছেন আমাদের বিদ্যায়তনিক জগত থেকে । ইংরেজিতেও কবিরা লিখেছেন, যেমন চার্লস সুইনবার্ন ( লাভ অ্যাণ্ড স্লিপ ), রবার্ট হেরিক ( আপঅন জুলিয়াজ ক্লোদস ), ই ই কামিংস ( মে আই ফিল সেড হি ), ডাবলিউ এইচ অডেন ( দি প্ল্যাটনিক ব্লো ), জন ডান ( টু হিজ মিসট্রেস গোইং টু বেড ), এমিলি ডিকিনসন ( কাম স্লোলি ইডেন ), ওয়াল্ট হুইটম্যান ( আই সিং দি বডি ইলেকট্রিক ), হার্ট ক্রেন ( ভয়েজেস ) ইত্যাদি । ইংরেজরা সবচেয়ে বড়ো যে ক্ষতি করে গেছে, তা হলো আমাদের সনাতন রসশাস্ত্রকে লোপাট করে দিয়ে নিজেদের ভাষার অলঙ্কার বাংলা ভাষায় চাপিয়ে দেয়া ।
    বাংলা সাহিত্যে ইরটিক কবিতা লেখার ঐতিহ্য ছিল । জেমস লঙ-এর কুযুক্তির দরুন বটতলা সাহিত্য বিলুপ্ত হতে সময় লাগেনি । চর্যাপদ, কালিদাসের মেঘদূত, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান, দৌলত কাজীর সতীময়না লোরচন্দ্রানী, সপ্তদশ শতকের শুকুর মামুদের গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস ইত্যাদি । বহু আলোচক বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’র পর আর তাঁর কাব্য বিশ্লেষণে এগোন না, তাঁদের মধ্যমেধা-মধ্যবিত্ত মননে চোট লাগে । নৈসর্গিক বর্ণনার মাধ্যমে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে যে যৌনতা আছে তা হয়তো বহু পাঠক ধরতে পারেন না, কিন্তু ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্হের ভুট্টা সিরিজে ও ডালাসারির কবিতায় গিয়ে তাঁদের মধ্যবিত্ত চেতনা আক্রান্ত হয় । ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্হের পরেও বিনয়ের কবিতার বই বেরিয়েছে, ছোটো গল্পের বই বেরিয়েছে, সেগুলো নিয়ে আগ্রহ দেখা যায় না তাঁদের !
    কবিতা লিখে আনন্দের কথা বলেছেন বিনয়, তা যেমন কবিতাই হোক, তাঁর ‘কবিতালেখা’ নিবন্ধে, “তুমি কষ্ট পাচ্ছো সেই কষ্টের কথা লিখে তুমি আনন্দ পেতে পারো । সৃষ্টির ব্যাপারে এই আনন্দটা তিন স্তরে বিভক্ত । লেখার আগে একটা জিনিস ভাবতে হচ্ছে, তখনকার আনন্দ একরকম ; যখন লিখছি তখন আরেকরকম, আর লেখার শেষে আরেকরকমের আনন্দ । আনন্দ না থাকলে শিল্পসৃষ্টি হয় না ।” তারপর যোগ করেছেন, “ময়ূর পেখম তুলে নাচে — আমরা দেবতারা মন খুলে কবিতা লিখি । ময়ূরের নাচের মতনই কবিতা লেখা ব্যাপারটা ।”

    দশ
    বিনয়ের ঈশ্বরীতে ফিরি । উচ্চাকাঙ্খী গায়ত্রী আমেরিকায় গিয়ে ১৯৬০ সালে ট্যালবট স্পিভাককে বিয়ে করেন, এবং কিছুকাল পরেই তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । আমার মনে হয় আমেরিকায় পাকাপাকি বসবাসের জন্য ট্যালবট স্পিভাককে বিয়ে করেছিলেন গায়ত্রী, আর ছাড়াছাড়ির পরেও তিনি নিজের নাম থেকে স্পিভাক পদবি বাদ দেননি। আমেরিকায় গিয়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর এবং তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচ ডি করেন । স্নাতক স্তরে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন । বিনয় মজুমদার গায়ত্রীর প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে থাকবেন, কেননা হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের বাড়িতে আত্মগর্বী গায়ত্রীকে তিনি দেখে থাকবেন কয়েক ঝলক মাত্র । পরবর্তীকালে গায়ত্রীর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি তাঁকে বিনয়ের কবিতার কেন্দ্রে এনে থাকবে । ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইটির খ্যাতির পরেও গায়ত্রী বহুকাল জানতেন না যে বিনয় মজুমদার নামে প্রতিভাবান অথচ উচ্চাকাঙ্খাহীন, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া এক ইঞ্জিনিয়ার যুবক তাঁকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছেন। গায়ত্রী কেবল কলকাতার খ্যাতনামা উচ্চ পরিবারের মেয়ে নন, তাঁর দাদুর বাবা ছিলেন রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসক, গায়ত্রীর বাবা সারদা দেবীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন — কলকাতার বুর্জোয়া পরিবার বলতে যা বোঝায় । বিনয় তাই এঁদের বলেছেন পুরোহিত পরিবার ।
    ষাটের দশকে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমিও জানতুম না যে ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইয়ের চাকা হলো গায়ত্রী চক্রবর্তী নামের একজন বিদুষী । বিনয় মজুমদার দুই বছরের জন্য হাংরি আন্দোলনে ছিলেন । সেই সময়ে তিনি একটার পর একটা চারমিনার সিগারেট খেয়ে তর্জনীকে নিকোটিনের রঙে মুড়ে ফেলে ছিলেন । উনি আমায় বলেছিলেন, “তুমি শক্তিকে নেতা করেছো আর শক্তি আমাকে নেতা করেছে।”
    ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকায় মারুফ হোসেনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছেন, মলয় “হাংরি সাক্ষাৎকারমালা” নামে একটা বই প্রকাশ করেছে । ওতে আমাকে বা শক্তিকে প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়নি।” এই বক্তব্য থেকে মনে হয় যে হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি বিনয় চেয়েছিলেন, এবং তাঁকে প্রতিষ্ঠাতার আসনে বসাইনি বলে আহত বোধ করেছিলেন । উনি স্পষ্ট বললে, ওনাকে প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি দিলে, বরং পরবর্তীকালে হাংরি আন্দোলন নিয়ে সুনীল-শক্তি-সন্দীপন যে সাংস্কৃতিক রাজনীতি আরম্ভ করেছিলেন তা ঘটত না ।
    সেই সময়ে কলকাতায় হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, তাতে বিনয় মজুমদারও প্রভাবিত হয়ে থাকবেন । ২২ জুন ১৯৬৪ তারিখে দেবী রায় আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, তাতে এই কথাগুলো ছিল, “তুমি-আমি নাকি কলকাতায় অ্যারেস্ট হয়ে গেছি, চতুর্দিকে গুজব । কয়েকজন চেনা হেফচেনার সঙ্গে দেখা হলে অবাক চোখে তাকাচ্ছে । ভাবখানা এই : কবে ছাড়া পেলে ? আমার তো এখন একতারা নিয়ে বাউল হয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে কলকাতায় । সবাই তালে আছে ‘বাঘে ছুঁইয়ে দেওয়ার’, পর্নোগ্রাফি প্রমাণ করে । সুবিমলকে মেসে কে একজন বলেছে, ‘দেখব কী করে হাংরি বুলেটিন বের হয় ।” সেপ্টেম্বর ১৯৬৪-এ আমরা সত্যিই গ্রেপ্তার হই আর আমার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা আরম্ভ হয় ।
    সেই সময়ের এলিট বঙ্গসমাজ যে কতোটা চটেছিলেন, হাংরি আন্দোলনের ওপর, তা অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর ৩১ অক্টোবর ১৯৬৪-এর এই চিঠি থেকে অনুমান করা যায়:-
    Dear Mr. Ginsberg,
    I am amazed to get your pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with the Communist characterization of the Congress for Cultural Freedom as a fraud and a bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate did not, however, surprise me ; for I never thought the Congress for Cultural Freedom had any charge of escaping your contempt for everything ‘bourgeois’ or ‘respectable’.
    If any known Indian writer or intellectual come under police repression for their literary and intellectual work, I am sure the Indian Committee for Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful promptings from you. I am glad to tell you that no repressions of that kind has taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self-advertising leaflets and printed letters abusing distinguished persons in filthy and obscene language ( I hope you agree that the word ‘fuck’ is obscene and ‘bastard’ filthy, at least in the sentence ‘Fuck the bastards of the Gangshalik School of Poetry’; they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avantgarde exhibition ! You may think it your duty to promote in the name of cultural freedom such adolescent pranks in Calcutta from halfway round the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.
    It was of course foolish of the Police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now ) thus giving the publicity and some public sympathy — publicity is precisely what they want to gain through their pranks.
    I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of of American Beatnik poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language — a language of which you to choose to remain totally ignorant.
    With all good wishes in spite of your grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.
    Yours Sincerely
    Abu Sayeed Ayyub
    অ্যালেন গিন্সবার্গকে এই চিঠিটা লেখার সময়েও আবু সয়ীদ আইয়ুব আমাদের গ্রেপ্তার হওয়া ও মকদ্দমা সম্পর্কে কোনো খবর রাখেননি । আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কোমরে দড়ি বেঁধে আর হাতে হাতকড়া পরিয়ে, তা উনি জানতেন না । উনি যখন চিঠিটা লিখছেন তখন কেউই মকদ্দমা থেকে ছাড়া পায়নি ; তারা ছাড়া পেয়েছিল ১৯৬৫ সালের মে মাসে । আইয়ুব সাহেব জানতেন না যে আমার বিরুদ্ধে মামলা আরম্ভ হয়েছে য পঁয়ত্রিশ মাস চলেছিল । শঙ্খ ঘোষ যখন ১৯৭১ সালে ‘শব্দ আর সত্য’ প্রবন্ধটি লেখেন, তখন তিনিও খবর রাখেননি যে ইতিমধ্যে নিম্ন আদালতে আমার জেল-জরিমানার দণ্ডাদেশ হয়ে গেছে, বা হয়তো জেনেও চেপে গিয়েছিলেন, আর প্রবন্ধতে কেবল লিখে দিয়েছেন ‘কয়েকজন যুবককে একদিন হাজতবাস করতে হয়েছিল’ । শঙ্খ ঘোষের এই বইটি বিভিন্ন কলেজে বাংলা ভাষার সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত, এবং ছাত্রদের কাছে ভুল বার্তা চল্লিশ বছর যাবত চলেই চলেছে; নতুন সংস্করণেও তিনি সঠিক তথ্য দেবার প্রয়োজন মনে করেননি ।
    যাই হোক, পরে হাংরি বুলেটিন থেকে নেতা ব্যাপারটা আমি বাদ দিয়ে দিই । বিনয়ের কবিতা কয়েকটা বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । সেসময়ে বিনয় মজুমদারের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা লক্ষ্য করিনি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক রাজনীতিতে বিরক্ত হয়ে বিনয় মজুমদার আন্দোলন ত্যাগ করেন, কিন্তু আন্দোলন ছাড়ার সময়ে শক্তি আর সন্দীপনকে গালমন্দ করে একটা বুলেটিন নিজেই ছাপিয়েছিলেন, বিলি করতে দিয়েছিলেন আমাদের । বিনয়ের কবিতার নতুনত্বের কারণে ওনার খ্যাতি তরুণ মহলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, যা সহ্য করতে পারছিলেন না পঞ্চাশ দশকের কবি আর লেখকরা। আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলুম বলে হয়তো বিনয়ের কিছু ভীতিও জন্মেছিল হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে।
    শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নির্মল মৈত্র এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে উল্লেখ করে তাঁর লেখা বুলেটিনটি তুলে দিচ্ছি এখানে । স্বাভাবিক যে এই বুলেটিনটির পর তাঁর সময়ের কবি-সাহিত্যিকরা, যাঁরা তাঁকে আর্থিক সাহায্য করার কথা বলেছিলেন, সেই সাহায্য বন্ধ করার জন্যে তদবির আরম্ভ করেন আর শেষাবধি বন্ধও করে দেন।
    ১) শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনিপুণ নপুংসকরূপ আশা করি এযাবৎ পাঠকপাঠিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি ; সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে অবস্হাকে বেশ মজাদার করেছেন ; পদলেহী কুকুরের নিয়োগকারিণী চালচুলোহীন এক নারীর আত্মার নির্দেশনা অনুসারে উক্ত কবি নিজেকে মহিলা মনে করে কবিতা লেখেন ; আর কথপোকথনকালে দেখি মহিলার অভিনয় করায় শ্রীমানটির কোনো ভাবলেশ উপস্হিত হয় না ; অথচ ক্রমে-ক্রমে আমার দাসীত্ব দিয়ে সেই বেয়াদপ আত্মাটিকে শায়েস্তা করেছি আর অঙ্কশাস্ত্রে শ্রীমতি এখন মতামত জ্ঞাপনের মতন স্হূলতা দেখাবার বিপদের ঝুঁকি নিতে সক্ষম হবে কি ? কবিটির জন্ম কি কুকুর আর গাধার সঙ্গমজাত ফল ।
    ২) স্হাপত্যবিদ্যায় ফেল মেরে-মেরে এক ছাগছানা বীর্যজাত নির্মল মৈত্রেয় জীবিকায় হাস্যকর ভিক্ষাবৃত্তি ঝুলে আছে । তবে ভয় নেই, যতক্ষাণ তার কচি পায়ু আছে, দালালী রয়েছে ।
    ৩) সন্দীপন, হে শ্রীমান, দাস-অনুদাস শব্দটি শুনেছিলাম কবে যে ঠিক মনে নেই । তবে এটা নিশ্চিতই কবুল করতে হবে — দাসী-অনুদাস বলে কোনো শব্দ এ যাবৎ আমি তো শুনিনি । ফলে যথাযথরূপে তোমার অবস্হা প্রকাশের স্বচ্ছতা, বৎস, ভবিষ্যতে ভেবে দেখা যাবে ।
    ৪) দল পাকাবার আগে, পরেও তাদের, রেকটাম বীট করে দিয়েছি বলেই, এইসব কেঁচোবৃন্দ বীটনিক নাম নিয়েছিল ।
    ১০.৬.১৯৬৪
    রচয়িতা ও প্রকাশক
    বিনয় মজুমদার
    ৬৯, মীর্জাপুর স্ট্রিট, কলকাতা – ৯

    কফিহাউসে বেয়ারার মাথায় লাঠি মারার দরুন পুলিশ হাজতে থাকার সময়ে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে পুলিশ দুর্ব্যবহার করে থাকবে, হয়তো থানার লকআপে তাঁর আচরণেও স্কিৎসোফ্রেনিয়া রোগির ব্যাখ্যাহীন আস্ফালন নিচু স্তরের পুলিশকর্মীদের বিরক্ত ও ভীত করে থাকবে । আর হাংরি আন্দোলনে আমাদের গ্রেপ্তারি-মামলা ইত্যাদি নিয়ে কলকাতার সাহিত্যজগত তখন বেশ উত্তপ্ত । বিনয়ের ওপর হাজতে পুলিশ সত্যই খারাপ ব্যবহার করে থাকবে, যে কারণে বিনয়ের বাঁ কান আর বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । সঞ্জয় চক্রবর্তীকে দেয়া ১৯৯৩ সালে ‘যোগসূত্র’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছেন যে, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর চোখ কান সবই ভালো ছিল। কিন্তু কলকাতাতেই পরে লোকে ধরে বাঁ-চোখ আর বাঁ-কান নষ্ট করে দিয়েছিল । সম্ভবত বারবার ইলেকট্রিক শক দেবার ফলে অবস্হা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল । সঞ্জয় চক্রবর্তীকে বিনয় বলেছিলেন যে উনি চারবার জেল খেটেছেন । দ্বিতীয়বার জেলে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে । অন্য দুইবারের তথ্য আমি যোগাড় করতে পারিনি । ১৯৭২ সাল থেকে যে সাক্ষাৎকারগুলো বিনয় মজুমদার দিয়েছেন, তাঁর উত্তরগুলো থেকে মনে হয় যে তিনি ঠিকমতন শুনতে পারছেন না, এবং মাঝে-মাঝে তাঁর উত্তর অস্ফূট হয়ে যাচ্ছে । পরে তাঁর ডান কানের ব্যথা বেড়ে গিয়ে শ্রবণশক্তি কমে যায়, যা উনি এই কবিতাটিতে লিখেছেন :-

    চোদ্দই অগাস্ট আজ
    চোদ্দই অগাস্ট আজ দু-হাজার দুই সাল । কানে
    তীব্র ব্যথা, ফলে
    সব কাজ বন্ধ আছে, অতি কষ্টে কবিতাটি লিখছি এখন ।
    ডান কানে তীব্র ব্যথা, এবং ডাক্তার
    ওষুধ দিয়েছে কিন্তু ব্যথা তো সারেনি ।
    কানের শ্রবণশক্তি কিছুটা কমেছে ।
    যদি কেউ কথা বলে তাকে বলি ‘চিৎকার করো’।
    যদি চিৎকার করে তাহলে শুনতে পাই, না হলে শুনি না ।
    ( হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ – ২০০৩ )
    ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকারে মারুফ হোসেন বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করেছিলেন, “হাংরি জেনারেশন সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই”। জবাবে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘ফিরে এসো, চাকা’ সমালোচনা করতে গিয়ে সম্প্রতি পত্রিকায় প্রথম লিখল ‘খুতকাতর সম্প্রদায়’ । বলল আমি নাকি হাংরি জেনারেশনের প্রতিষ্ঠাতা । এরপর হাংরি জেনারেশন পত্রিকা বেরোলো ‘ক্ষুধার্ত’ । হাংরি জেনারেশনের বুলেটিন । সেই পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম কবিতাটিই ছিল আমার । ‘খেতে দেবে অন্ধকারে সকলের এই অভিলাষ’ । আমার পরে শক্তির কবিতা । তারপরে মলয় রায়চৌধুরী প্রমুখের কবিতা । এরপর আমি শক্তিকে লিখলাম, না আমি প্রতিষ্ঠাতা নই । হাংরি জেনারেশন যখন শুরু হয়, যখন পত্রিকা বেরোয় তখন আমি দুর্গাপুরে চাকরি করি । ফলে আমার পক্ষে কোনো আন্দোলন শুরু করা সম্ভব নয় । সুতরাং আমি নই, শক্তি চট্টোপাধ্যায় হল হাংরি জেনারেশনের প্রতিষ্ঠাতা । পরে শক্তি হাংরি থেকে বিচ্যুত হল, আমিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম । ফলে মলয় রায়চৌধুরী হাংরি প্রতিষ্ঠা করেছে বলে দাবি করে । কথাটা মোটামুটি সত্য কথাই । শেষ পর্যন্ত ও-ই যখন হাংরি জেনারেশন চালাচ্ছে তখন ওকেই প্রতিষ্ঠাতা বলা কর্তব্য বলে আমার মনে হয় । এটা উচিত ।”
    প্রথম সংখ্যায় নয় । বিনয়ের কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল দশ নম্বর বুলেটিন থেকে । তার আগের বুলেটিনগুলো আমি পাটনা থেকে ইংরেজিতে ছাপাতুম । দেবী রায় কলকাতায় ছাপানো আরম্ভ করলে বাংলায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে । আর “ক্ষুধার্ত” হলো সুভাষ ঘোষ-শৈলেশ্বর ঘোষ-বাসুদেব দাশগুপ্তদের সত্তর দশকের পত্রিকা, হাংরি বুলেটিন নয় । মামলায় রাজসাক্ষী হবার দরুন ওরা হাংরি শব্দটা তখন ব্যবহার করতে ভয় পেতো, তাই “ক্ষুধার্ত” বের করতো । আমি “হাংরি কিংবদন্তি” বইটা লেখার পরে ওদের টনক নড়ে । শঙ্খ ঘোষের বদান্যতায় হাংরি আন্দোলনের বিকৃত ইতিহাস ও আমাকে গালাগালসহ দে’জ থেকে “ক্ষুধার্ত” সংকলনগুলো হাংরি জেনারেশনের নামে প্রকাশিত হয়েছে । বলা বাহুল্য যে তাতে বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই, আলো মিত্র এবং আমার কোনো রচনা নেই । অর্থাৎ যাঁরা আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তাঁদের লেখাই নেই ।
    শক্তি আর সন্দীপনও একই সময়ে হাংরি আন্দোলন ছাড়েন, প্রধানত আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওসকানিতে; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেছিলেন যে তাঁর ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠী ভেঙে দেবার ষড়যন্ত্র হিসাবে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা হয়েছে, আর সেকথা তিনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন । বস্তুত সেসময়ে তিনি এতোই হিংসুটে মনোভাবের হয়ে গিয়েছিলেন যে তারপর আমার কাছ থেকে কখনও কবিতা চাননি, দাদাকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে মলয় কবিতা লিখতে জানে না, যদিও তার আগেই উনি ‘কৃত্তিবাস প্রকাশনী’ থেকে আমার ‘শয়তানের মুখ’ কাব্যগ্রণ্হ প্রকাশ করেছিলেন, ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় আমার যে কবিতা প্রকাশ করেছিলেন সেগুলো ‘কৃত্তিবাস সংকলন’ গ্রন্হে অন্তর্ভুক্ত করেছেন । তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ও আমাকে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় কবিতা লিখতে বলেছিলেন । আমি ‘নীরার জন্য প্রেমের কবিতা’ লিখেছিলুম যা প্রকাশ করতে চাননি তাঁর সহসম্পাদকরা । এই কবিতাটা আমার ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’ কাব্যগ্রন্হে আছে ।
    সেই সময়ে কফি হাউসের বেয়ারার মাথায় লাঠি মারার দরুন বিনয় মজুমদারকে পুলিস আটক করেছিল, কুড়ি দিন জেল-হাজতে কাটাতে হয়েছিল। আরেকটা মারামারির দরুণ মাতালদের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেশ আহত হয়েছিলেন, তাঁর চোখ-মুখে রক্তের কালশিটে পড়ে গিয়েছিল । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় দাদাকে লেখা একটা চিঠিতে এই ব্যাপারগুলো বেশ রসিয়ে লিখেছিলেন । মারামারির একটা পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন ; সুবিমল বসাককে কফিহাউসের সামনে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর অনুজ কবিরা ঘিরে ধরেছিলেন মারার জন্য কিন্তু সুবিমলের হিন্দি গালাগালের হুঙ্কারে সবাই পালিয়েছিল ।

    এগারো
    স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হবার বয়স হল ষোলো থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে । তা মূলত জিনগত রোগ হলেও, জন্মের আগে গর্ভে ভ্রুণের দুর্বলতার জন্য, সামাজিক চাপে মস্তিষ্কে ডোপামাইন ও গ্লুটামেটের রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য, ভাইরাসের আক্রমণে জিনে প্রভাবের জন্যে ঘটতে পারে । চিকিৎসা হয় প্রধানত অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধের দ্বারা, বন্ধুবৎসল পরিবেশের দ্বারা, পরিবারে আদরযত্নের দ্বারা ।
    ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলো লেখা হয়ে যাবার পর বিনয় মজুমদার প্রথমবার স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে অনুমান করা যায় । প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় তিনি স্বাভাবিক ছিলেন এবং ইডেন হোস্টেলের মাঠে ফুটবল খেলতেন ; ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ছাত্র ইউনিয়ানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন । সুতরাং ছাত্রাবস্হায় তিনি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হননি । তাহলে কি গায়ত্রীকে নিয়ে কবিতা রচনার প্রচণ্ড চাপ গড়ে উঠেছিল বিনয়ের ওপর ? সমর তালুকদার ১৯৮২ সালে কবিতীর্থ পত্রিকায় লিখেছিলেন, তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি যখন বিনয় মজুমদারকে দেখেছিলেন তখন “বিনয়ের মাথায় ঝাঁকড়া অগোছালো চুল, মুখভর্তি দাড়ি, জামাকাপড়ে মালিন্যের করুণতম ছাপ, গায়ে দুর্গন্ধ, আঙুলে বড় বড় নখভর্তি ময়লা । আর ছিল সমস্ত শরীর, স্নায়ু-গ্ল্যাণ্ডভর্তি রাগ । সবাইকে ভেংচাচ্ছেন — কাউকে খামচে দিচ্ছেন নিজের খেয়ালখুশিমতো । অশ্লীল ভাষায় থুতু ছিটিয়ে চলেছেন টেবিলে টেবিলে।”
    আমি কিন্তু হাংরি আন্দোলনের শুরুতে বিনয়ের ওই রূপ দেখিনি । কোন ঘটনার চাপ তাঁর ভারসাম্যকে দুলিয়ে দিয়েছিল তা জানি না, কবিতা লেখার চাপ ছাড়া । হিন্দি লেখক ও ‘জ্ঞানোদয়’ পত্রিকার সম্পাদক শরদ দেওড়া এই সময়ের বিনয় মজুমদারকে নিয়ে “কলেজ স্ট্রিট কা নয়া মসিহা” নামে একটা বই লিখেছিলেন । অন্যান্য সমসাময়িক কবিদের তুলনায় বিনয় যে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন তা অবাঙালি লেখক শরদ দেওড়ার সাহিত্যিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন থেকে স্পষ্ট হয় ।
    স্কিৎসোফ্রেনিয়ার জন্য একজন লোক কবি বা আঁকিয়ে হন, নাকি তিনি কবি বা আঁকিয়ে বলে স্কিৎসোফ্রেনিয়ার জিন জাগ্রত হয়ে ওঠে, এই প্রশ্নের কোনো উত্তর মনোবিদরা খুঁজে পাননি আজও । কোনো কোনো পুরাতাত্বিক মনে করেন যে গুহার দেয়ালে হোমো এরেকটারদের আঁকা যে ছবিগুলো দেখা যায় তা হয়তো স্কিৎসোফ্রেনিয়ার জিন দেহে ছিল এমন মানুষদের আঁকা । অধিকাংশ বিখ্যাত লেখক-কবি-আঁকিয়ের চরিত্রে সমাজের বাইরে বসবাস করার এবং সীমালঙ্ঘনের আগ্রহ দেখা গেছে । কবিতার ও ছবিআঁকার শৈলী সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে আর পরিবর্তনের সেই উথ্থান-পতনের সঙ্গে নিজের কাজকে সামাল দেবার প্রয়াস করতে হয়, এই ব্যাপার যেমন দেখি পাবলো পিকাসো এবং পল গঁগার ক্ষেত্রে, তেমনই দেখা গেছে বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে । এর দরুণ আলোচকদের প্রশংসা অথবা কটূ সমালোচনা জোটে কবি-লেখক-আঁকিয়ের । তাঁদের ভাবতে বাধ্য করে যে সাহিত্য বা ছবি আঁকা তাঁদের সারা জীবন হয়তো চাকুরিহীন থাকতে বাধ্য করবে, এই ভাবনা বিনয় মজুমদারে পাই আমরা । এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, তিনি বিয়ে করেননি কেন ? উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, তাঁর কোনো চাকরি নেই, বাঁধা আয় নেই, তাই ।
    স্কিৎসোফ্রেনিয়া রোগের উপসর্গ হল অজীর্ণ, যা লোকটিকে সারা জীবন বইতে হয়, অনেক সময়ে পেট খারাপের দরুন যেখানে-সেখানে মলত্যাগ হয়ে যায় ; তারপর অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধের ক্রিয়ায় অজীর্ণ স্হায়ী হয়ে যায় ; ফলে ফ্যানাভাত খেতে হয় বা আলুসিদ্ধ খেতে হয় । বিনয় মজুমদার শেষ বয়সে তাঁর অজীর্ণ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন, তাতে “মুগ্ধ মলত্যাগ” অভিব্যক্তিটি অসাধারণ :-

    আর গাইব না
    অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর গান গাই না তো ।
    যেখানে সেখানে মুগ্ধ মলত্যাগ শেষ হয়ে গেছে ।

    বর্তমানে বসে আছি আমার চৌকির উপরে ।
    পরনে একটি লুঙ্গি, গায়ে এক গেঞ্জি আছে ।
    ঢেকুর বেরোচ্ছে বটে, তবে এ ঢেকুর ধোঁয়া ঢেকুর নয় ।
    কোনো গন্ধ নেই এ ঢেকুরে ; আমি একা একা আছি ঘরের ভিতরে ।
    আমার বাড়ির সব আলো জ্বালা আছে ।
    তদুপরি হারিকেন লন্ঠনটি জ্বালা আছে টেবিলের উপরে ।
    অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর গান গাই না তো, আর গাইব না ।

    আধুনিকতাবাদের সবচেয়ে গোলমেলে ব্যাপার হলো যে বৃহত্তর সমাজ তাঁদের সম্পর্কে একটি নেগেটিভ ধারণা গড়ে তোলে, যেন নিউরোটিক এবং মনস্তাত্বিক বিপর্যয় কবিতা রচনা বা ছবি আঁকার জরুরি উপাদান । বঙ্গসমাজে আমরা দেখেছি যে প্রাগাধুনিক কালে এই ধরণের মানুষ সমাজের বাইরে বেরিয়ে অঘোরী-তান্ত্রিক-সন্ন্যাসী-সুফি-দরবেশ-ফকির-আউল-বাউলের জীবন বেছে নিতেন । সুফি সন্তরা যেভাবে নৃত্য করেন তাকে সালাফিস্টরা বলেন পাগলামি, তার কারণ সবাইকে সালাফিস্ট ভাবধারায় পিটিয়ে সমরূপী করার তত্ত্বকে অস্বীকার করেন সুফিরা ; এ এক ধরণের সাম্রাজ্যবাদি প্রয়াস, তত্বের উপনিবেশের জেলখানায় ঢুকিয়ে বন্দি করে রাখার চেষ্টা । পাকিস্তানে সুফি সন্তদের সমাধিগুলোকে সালাফিস্টরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে, তার দরুণ সমবেত তীর্থযাত্রীরাও মারা যাচ্ছেন । বুল্লে শাহের মতন সন্তের গান নিষিদ্ধ করে দিয়েছে সালাফিস্টরা । বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রেও , বহু আলোচক তাঁকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হের সাব-জনারেই আটক রাখতে ভালোবাসেন , অথচ তিনি আরও তিনটি সাব-জনারের কবিতা লিখে গেছেন ।
    আজকাল দেখি অনেকেই, এমনকি দরবারি তাঁবেদাররাও, উপদেশ দেন যে হাংরি হলে কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয় ! আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলুম বলে গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে উঁচু পদে চাকরি করেছি বলে আমাকে আক্রমণ করা হয়, যেন গরিব সেজে ঘুরে বেড়ানো উচিত ছিল । হাংরি আন্দোলনের সময়ে বিনয় মজুমদার যদি ভুট্টা সিরিজের কবিতা লিখতেন তাহলে সরকার সংবাদপত্র বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরা তাঁর কি গতি করতেন তা সহজেই অনুমেয় । গোর্কি সদনের অনুষ্ঠান থেকে ‘বাল্মীকির কবিতা’র কবিতা পাঠ করার জন্য বিনয় মজুমদারকে অশ্লীল কবি ছাপ্পা দিয়ে বিতাড়ন করা হয়েছিল । ১৯৭৭ সালে প্রকাশক ‘বিশ্ববাণী’র কাছে লালবাজার থেকে নির্দেশ গিয়েছিল যাতে বইটি বিক্রি করা না হয় । পুলিশকর্তারা তো নিজে থেকেই নির্ণয় নেন না ; কোনো সাহিত্যিক খোচর তাঁদের কাছে বইটির কথা রসিয়ে-রসিয়ে বলে থাকবে, একটি কপি প্রেস সেকশানে জমা দিয়ে, একথা আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, হাংরি মামলায় ‘উপদ্রুত’ নামের পত্রিকার সম্পাদক পবিত্র বল্লভ পুলিশের খোচরের কাজ করতেন, এবং আমাদের যাবতীয় প্রকাশনা নিয়মিত পৌঁছে দিতেন লাল বাজারের প্রেস সেকশানে, তার বিভাগীয় প্রধান ডেপুটি কমিশনার ছিলেন আবার কবি তারাপদ রায়ের মেসোমশায় । এই খোচরটিকেই সৃজিত মুখার্জি তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ ফিল্মে তুলে ধরেছিলেন ।
    আধুনিকতাবাদের ফলে কবি বা ছবি আঁকিয়ের আর্থিক অবস্হা খারাপ হয়ে উঠলে সাধারণ সমাজ এবং রাজনীতিকরা কবি বা ছবি আঁকিয়ের চরিত্রের নেগেটিভ দিকগুলোকে গুরুত্ব দেন । বিনয় মজুমদারকে আর্থিক সাহায্যের সময়ে এই তর্ক তুলেছিলেন অনেকে । ইউরোপে নেগেটিভ ছাঁচে ফেলে মার্কা-মারা করে দেবার ইতিহাস বেশ প্রাচীন । আধুনিতাবাদের প্রভাবে আমরাও সেই ছাঁচটা নেগেটিভ বলে চিহ্ণিত করতে শিখেছি । এই ইউরোপীয় মানদণ্ডের ফলে সাহিত্য এবং ছবি আঁকার যে সৃজনশীল প্রক্রিয়া তার অর্থপূর্ণ বিশ্লেষণ হয় না । সৃজনশীল সাহিত্যিক ও ছবি আঁকিয়ে বা নৃত্যশিল্পীর ওপর ব্যাপারটা ভয়ংকর চাপের কাজ করে । এই প্রসঙ্গে আমরা আধুনিকতার বাইরে বসবাসকারী রামকিঙ্কর বেইজের প্রসঙ্গ তুলতে পারি । সামাজিক মানদণ্ডের বাইরে বসবাসকারি লালন সাঁই, তুকারাম, কবীর, রবিদাস-এর প্রসঙ্গ তুলতে পারি, যাঁদের এখন বলা হয় সন্ত ।
    কবি, লেখক, ছবি আঁকিয়ে যা করেন তার প্ররোচনার উৎস কোথায় ? যাঁরা টাকা রোজগারের জন্য করেন তাঁদের কথা আমি বলছি না । এই প্রশ্নটা আলোচকদের, দার্শনিকদের, মনোবিদদের, চিকিৎসকদের বহুকাল ধরে ভাবাচ্ছে । নতুন প্রজন্মে নতুনতর তত্ত্ব উপস্হাপন করা হয়েছে । সৃজনশীল প্রক্রিয়ার যুক্তিহীনতাকে নিদারুণ অবজ্ঞা করে প্ল্যাটো বলেছিলেন যে “কবিরা সঠিক চেতনার মানুষ নন, তাঁরা সৃজনদেবীর নিশিডাকে যুক্তির জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ।”
    ১৪১৩ বঙ্গাব্দে ‘অউম’ পত্রিকার জন্য জয় মুখোপাধ্যায় ও সন্মোহন চট্টোপাধ্যায়ের নেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এরকম প্রশ্নোত্তর হয়েছিল :-
    প্রশ্ন : ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’য় আক্রান্ত হয়ে স্বদেশ নির্বাচনের দায়িত্ব একদিন যে সাম্রাজ্যবাদ আপনাকে দিয়েছিল, আজ এই অন্ধকার ও প্রায় অজ্ঞাত পৃথিবীর মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে আপনার কি মনে হয় না যে বস্তুত সেই সাম্রাজ্যবাদই আসলে কোনও দিন ছিল আপনার বাস্তুচেতনা ?
    বিনয় : কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন — “তুমি মা কল্পতরু/আমরা সব পোষা গোরু।” বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন লোকে বলেছিল, ‘একটি এঁড়ে বাছুর জন্মেছে।’ প্লেটো বলেছিলেন — তাঁর রিপাবলিকে কোনো কবি রাখা হবে না । এই মত এখনও এই পশ্চিমবঙ্গে ছাপা হয় ( ব্যঞ্জনবর্ণ পত্রিকা ) । আর কবিরা নিজেদের ঢাক নিজেরাই শুধু পেটায় । তবে ওই প্লেটোই যখন জন্মেছিল, তখন মন্ত্র পড়া হয়েছিল কবিতায়, ওই প্লেটোর অন্নপ্রাশনের সময় যে মন্ত্র পড়া হয়েছিল. সেই মন্ত্র কবিতা, ওই প্লেটোর বিয়ের সময় যে মন্ত্র পড়া হয়েছিল, সেই মন্ত্র কবিতা, ওই প্লেটোর শ্রাদ্ধের সময় যে মন্ত্র পড়া হয়েছিল, তা-ও কবিতা, এমনকি জীবিত অবস্হায় প্রত্যেক রবিবারে ওই প্লেটো গির্জায় যে প্রার্থনা করত, তাও কবিতা — এর পরে আর কী বলা যায় ।’
    বিনয় মজুমদার প্ল্যাটোকে একজন খ্রিস্টধর্মী অনুমান করে কথাগুলো বললেও, জয় মুখোপাধ্যায় ও সন্মোহন চট্টোপাধ্যায়ের তথাকথিত জোলো বামপন্হী ভাবধারাকে যুৎসইভাবে উপড়ে দিতে পেরেছিলেন । বিনয় মজুমদার ধর্মে আস্হা রাখেননি কিন্তু ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামের কোনো ক্ষমতাকে বিশ্বাস করেছেন, যা তাঁর এই কবিতায় পাই আমরা :-

    ২০ আগস্ট ১৯৯৮
    তিন চোখ, চার হাত — এইসব দেবদেবীদের
    মূর্তি দেখে যেতে হবে চিরকাল ? কী করে টের
    পেয়েছিল হিন্দুগণ — এরা সব আছে ?
    ধীরে ধীরে যেতে হয় হিন্দুদের পঞ্জিকার কাছে ।
    পঞ্জিকায় ছবি ছাপা — দশভূজা, আরো কতোজন ।
    এদের এড়িয়ে দেখি বেঁচে থাকে খ্রিস্টানের মন ।
    এই বিশ্বে দীর্ঘকাল টিকে থাকে যা যা
    তা তা সত্য ; তাহলে দেবতাদের রাজা
    ইন্দ্র আর সরস্বতী, লক্ষ্মী এরা আছে
    তবুও আমার মনে সন্দেহ থেকেই যায়, বলি কার কাছে
    সেহেতু কখনো কারো পুজাই করিনি ।
    তবু সৃষ্টিকর্তা আছে যার কাছে আমি আজো ঋণী ।
    আমার বাঁহাত আছে এটা যত সত্য বলে মানি
    সৃষ্টিকর্তা আছে এটা তত সত্য বলে আমি জানি ।
    ( শিমুলপুরে লেখা কবিতা — ২০০৫ )
    বিনয় মজুমদারের সমসাময়িক কবিরা, এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের কবিরাও, এই ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নগুলো নিয়ে নিজেদের ভাবনাচিন্তা উপস্হাপন করেননি । তাঁরা কেবল আঙ্গিক আর বিষয়বস্তুর ভেতরে নিজেদের চিন্তাকে সীমিত রেখেছেন ।
    ফ্রেডরিক নিৎশে বলেছিলেন যে “মানসিক অসুস্হ না হলে কবি বা শিল্পী হওয়া যায় না ; অস্বাভাবিকতা থেকে সৃজনশীলতার সৃষ্টি হয় ।” আবার ফ্রেডরিক নিৎশেই বলেছেন যে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটেছে মানুষের চরিত্রে সৃজনশীলতার অস্বাভাবিকতা থেকে। খ্রিস্টধর্মের প্রসার সম্পর্কে একই কথা বলেছিলেন টমাস অ্যাকুইনা । গভীরভাবে ভেবে দেখলে ধর্ম ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক ; সেকারণেই ধর্মের মতন অব্যাখ্যেয় চিন্তার দরুণ মানুষ পরস্পরের সঙ্গে লড়ে মরে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের ‘লোক’ পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “ধর্ম জিনিসটা বড় গোলমেলে। আমি ওই সাতে পাঁচে নেই । ধর্মীয় কারণে জীবনানন্দের চেয়ে নজরুল এদেশে উপেক্ষিত হচ্ছে এবং ঠিক একই কারণে নজরুলকে তোমরা জাতীয় কবি করেছ।” ওই সাক্ষাৎকারে বিনয় আরও বলেছেন, “গান্ধী বলেছেন ‘ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম সব কো সন্মতি দে ভগবান’ । এই কথা বলাতে গান্ধীকে গুলি করে মেরে ফেলল । ধর্মভিত্তিক একটা বিভাজন হয়ে গেছে । ধর্মের চেয়ে বরং মৃত্যু নিয়ে লেখা সাহিত্যিকদের স্মরণীয় করে রাখে। জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার’, ‘আট বছর আগে একদিন’ কী অদ্ভুত কবিতা !”
    সবাই কবিতা লেখেন না, ছবি আঁকেন না, কৈশোরে আর তরুণ বয়সে আরম্ভ করে ছেড়ে দেন, কিন্তু অনেকে ছাড়তে পারেন না, খ্যাতি বা টাকাকড়ির জন্য নয়, তাঁরা ছাড়তে পারেন না কেননা, তাঁরা আটক পড়েন কোনও এক অস্বাভাবিক মননঘুর্ণিতে, তাঁরা তাড়িত হন সাইকোপ্যাথিক সাহসের কোনো এক মানসিক চাঞ্চল্যের নিশ্চয়তায়, যা কিনা সৃজনশীল ব্যক্তিমানুষের চরিত্রের সৎ উপাদান, এবং সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ক্রিয়াবৈগুণ্যে সম্পর্কিত । ‘ট্রেণ্ডস ইন কগনিটিভ সায়েন্সেস’ পত্রিকার জুলাই ২০১৫ সংখ্যায় ‘থিংকিং টু মাচ : সেল্ফ জেনারেটেড থট অ্যাজ দি ইনজিন অফ নিউরটিসিজম’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যে স্বতঃচিন্তা সৃজনশীল কাজে সাহায্য করে বটে কিন্তু তা ব্যক্তিবিশেষের দুঃখেরও কারণ হয়ে ওঠে । বিনয় মজুমদার একটি লেখায় বলেছেন যে দুঃখের কবিতা লিখে কবি আনন্দ পান । ‘নেচার নিউরোসায়েন্স’ পত্রিকার জুন ২০১৫ সংখ্যায় বলা হয়েছে যে, স্কিৎসোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার ব্যক্তিএককের ভেতরে ঘুমিয়ে-থাকা বংশগত জিনটি সহজাত সৃজনীপ্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে, এবং এই জিনগুলো সাধারণ মানুষের থেকে ভিন্ন ।
    কে জেমিসন তাঁর ‘টাচড উইথ ফায়ার : ম্যানিক ডিপ্রেসিভ ইলনেস অ্যাণ্ড দি আর্টিস্টিক টেমপেরামেন্ট’ ( ১৯৯৬ ) বইতে বলেছেন যে কবি ও ছবি আঁকিয়েদের সৃজনশীলতার সঙ্গে তাঁদের মুডের বিশৃঙ্খলা এবং শৈল্পিক বাতিকজনিত মনোভঙ্গের সরাসরি যোগাযোগ আছে । তাঁদের শৈল্পিক ক্ষমতা যতো হ্রাস পেতে থাকে তাঁদের অবদমিত বিষণ্ণতাবোধ ও যৌনতায় বিফলতা ততো বেশি তাঁদের মেজাজকে বিধ্বস্ত করতে থাকে । স্টিফেন ডায়ামণ্ডস ‘অ্যাঙ্গার ম্যাডনেস অ্যাণ্ড দি ডায়ামনিক : দি সাইকোলজিকাল জেনেসিস অফ ভায়োলেন্স, ইভিল অ্যান্ড ক্রিয়েটিভিটি’ ( ১৯৯৯ ) গ্রন্হে বলেছেন যে, সৃজনশীলতার সঙ্গে ক্রোধ, ক্ষিপ্তাবস্হা, আকস্মিক উদ্দীপনা, উগ্রতা, মন্দচিন্তা, অশ্লীল ভাবনা ও অসংলগ্ন আচরণের সম্পর্ক আছে, এবং তা কবিতায়-ছবি আঁকায় বা আচরণে ফুটে ওঠে ; বহুক্ষেত্রে শিল্পী তাঁর পুরোনো গড়ে তোলা ইমেজের বাইরে বেরিয়ে যাবার প্রয়াস করেন ।
    বিনয় মজুমদারের কবিতাগুলো সম্পর্কে কেউ-কেউ সেরকম কথাই বলে থাকেন । অথচ বিনয় মজুমদার ইনসেন বা ম্যাড ছিলেন না, তিনি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় ভুগতেন । স্কিৎসোফ্রেনিয়া যদি জিনগত রোগ হয়, তাহলে কেন তাঁকে ‘পাগল’ তকমা দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো ? প্রায় তিরিশ বার তাঁকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে ; আটবার ভর্তি করা হয়েছে মানসিক চিকিৎসালয়ে, যেখানে স্কিৎসোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন না । যাঁরা চিকিৎসা করতেন তাঁরা হয় এম.বি.বি.এস অথবা মনোবিদ ।
    সুমন গুণ, ছন্দবিদ অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছেন, বাঙালির সহজাত আলস্যপ্রবণতার একটি জনপ্রিয় প্রকাশ হলো জীবনানন্দের কবিতায় ছড়ানো অক্ষরবৃত্ত ছন্দ । এই ছন্দই বিনয় মজুমদারেরও পছন্দ । তাঁর প্রতিটি কবিতা পয়ারে লেখা । সুমন গুণ বলেছেন, এই প্রাকরণিক সখ্য তাঁদের সংঘবদ্ধ করেছে । এই দুজন কবির ঘরানার মধ্যে একটি বৈষয়িক সম্বন্ধও আছে । তাঁরা দুজনেই কবিতায় এক স্মিত দার্শনিকতার প্রশ্রয় দিয়েছেন । জীবনানন্দের দর্শন ভেতরে জড়িয়ে রাখে সময়ের ইতিহাসের ঘোর । আর বিনয়ের কবিতা ঘটনার, বিজ্ঞানের, গণিতশাস্ত্রের উদাহরণ পাওয়া যায় । রবীন্দ্রনাথের পরে সময় ও সমাচার নিয়ে এমন অক্ষুন্ন মনস্কতা অন্য কোনো কবির লেখায় বিশেষ পাওয়া যায় না । জীবনানন্দ ও বিনয় কোনও ঘটনার বিবরণ দিয়ে থেমে যান না, সেই ঘটনা বা প্রসঙ্গের একটি সাধারণ নির্ণয়ও রচনা করেন । সুমন গুণও ‘ফিরে এসো,চাকা’ কাব্যগ্রণ্হের পর সম্ভবত আর এগোননি ।
    বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে বলেছেন, “গোবরডাঙায় সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার একবার আলোচনা হয়েছিল । সন্দীপ এবং আমি একমত হলাম যে গত আড়াই হাজার বছরে যত বই লিখেছে ভারতীয়গণ, তার একটা মোটামুটি হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে দুইজন অমর কবি আছেন । এক শতাব্দীতে সারা ভারতে মাত্র দু’জন । এই হিসেবটাই সত্য । সুতরাং হে বাঙালিগণ, কবি জীবনানন্দের কী দশা হবে আগামী ২০০০ বছর পরে কে বলতে পারে ? কিন্তু জীবনানন্দ খুব খারাপ কবিতা লেখেননি । জীবন যোগ আনন্দ — একসঙ্গে মিলে জীবনানন্দ । তা সত্বেও জীবনানন্দ একটিও আনন্দের কথা লিখতে পারেননি । সব বেদনার কবিতা লিখেছেন ।”
    ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে বিনয় আরও লিখেছেন, “আমি কৈশোরে দাড়ি গোঁফ গজাবার আগে, প্রায় প্রত্যহ দিলীপ গুপ্ত মশাইয়ের সিগনেট বুকশপে যেতাম। দিলীপবাবু আমাকে একটানা আবৃত্তি করে শোনাতেন, তৎকালীন তরুণ কবিদের কবিতা — জীবনানন্দ, সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ আরো নানাজনের কবিতার বাছা-বাছা অংশগুলি । আমি হাঁ করে শুনতাম । ফলে সপ্তাহে অন্তত একখানা এদের রচিত বই খানিকটা প্রেমে পড়েই কিনে ফেলতাম । জীবনের আনন্দের, মানে জীবনানন্দের কোনো কবিতার বই তখন কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় কেনার জন্য পাওয়া যেতো না । সুতরাং দিলীপ গুপ্ত মশাই জীবনানন্দের বাড়িতে গিয়ে একখানি ‘ধূসর পাণ্দুলিপি’ এনে আমাকে দিয়েছিলেন । যতখানি ব্যথাভারাতুর মন হলে জীবনানন্দের ব্যথাভারাতুর কবিতাগুলি ভালো লাগে, ততদূর ব্যথাভারাতুর মন আমার তখনো হয়নি । তবুও আমার কবিতাগুলির প্রতি কেমন যেন মায়া জন্মেছিল । ধূসর শালপাতায় জড়িয়ে যেমন মাংস বিক্রি করে, তেমনি দু-খানি ধূসর মলাটের মধ্যে কবির হৃৎপিণ্ড জড়িয়ে আমার হাতে দেওয়া হয়েছিল ।”
    মামুদ সীমান্ত, যিনি ভারতে এসে শিমুলপুর গ্রামে গিয়ে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, জোগিরার ১৮ অক্টোবর ২০১২ সংখ্যায় লিখেছেন, “যে দৃষ্টি দিয়ে বিনয়কে মানসিক অসুস্হ বিবেচনা করে থাকি, মূলত সেটাই বিনয়ের কাব্যভাষা । লক্ষ্য করার বিষয়, বিনয়কে আমাদের এই অপ্রকৃতিস্হ বোধ-বিবেচনার ফলে বিনয়ের কোনো কবিতায় ব্যঙ্গ-রসাত্মক উপমাটি আমাদের কাছে অন্য মানে তৈরি করে । জৈবনিক দীক্ষায় তিনি কি অন্যমনে শেষমেষ কবিতাকেই ধিকৃত করেছিলেন সমর্পণের দায়ে ? বিনয়ের এইরূপ ভাষা-প্রক্রিয়ায় খেলা করার বিষয়টি বাংলা কবিতার সমঝদার পাঠকশ্রেণিকে নিশ্চয়ই আন্দোলিত করে । বিষয়-বৈচিত্র্যে বিনয়ের কাব্যভাষায় যথেচ্ছ চমক আছে । বিনয় সেই অবতারপ্রাপ্ত হয়েই জন্মেছেন । কিন্তু সমকালের বিকৃত বিবেচনাই তাঁর সে অবস্হানকে ক্ষুন্ন করেছে । বৈচিত্র্যের বদলে হয়ে উঠেছেন মরুবৃক্ষের ন্যায় বিপন্ন, বৈভবহীন, ছিন্ন-মণিষা । ভুল আলোচনার শিকার হয়ে পীড়িত হয়েছেন তিনি। তাঁর কাব্যভাষা মহাকালের খণ্ডিত কম্পনরূপে সাক্ষরিত হয়ে থাকলো আমাদের কাছে ।”
    মামুদ সীমান্ত আরও লিখেছেন, “বিনয় তাঁর কাব্যে অবস্হান করেন উত্তমপুরুষে । এই উত্তমপুরুষটি এককেন্দ্রিক, অন্য অর্থে বহুধাবিভক্তও বটে । কবিতার অন্তর্গত সেই উত্তমপ্রকৃতিটিরই প্রকাশনা ঘটিয়েছেন নির্দ্বিধ, কোথাও ফাঁকি দেননি । এটি তাঁর একটি সেনশেশানাল ফেজ । অথচ তাতে বিনয়ের কোনো খেদ নেই । কেননা বিনয় সেদিকে ফিরেও তাকান না বা তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেন না । তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’, যাকে বলা হচ্ছে যৌনতার ভাষনির্মাণ, সেই কবিতাগুলোকেই আমার বহুল অর্থে লিখিত বলে মনে হয় । প্রশ্ন উদ্রেক হয় যে কবিতাগুলো পাঠের শুরুতেই পাঠক যৌনতা বিষয়ক আচ্ছন্নতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন । এক্ষেত্রে যৌনতার সূত্র ধরে বাংলা কবিতায় উপমা ও বিবৃতির গাণিতিক ব্যাখ্যাটিকেই তিনি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন ।. কবিতাগুলোর মূল্যায়ন বিষয়ে অধিকাংশ পাঠকের নিম্নরুচির উপমাবিচার বাদ দিলে, কবিতাগুলো সর্বাধিক কাব্যশৃঙ্গারে উন্নীত । ভারতীয় উপমহাদেশে কামশৃঙ্গারের বিশ্লেষিত উপস্হাপনায় যেরূপ চিত্র সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত, বিনয়ের কবিতা মোটেও তা থেকে পিছিয়ে থাকে না । ‘আমার ভুট্টায় তেল’ জাতীয় কবিতায় রূপকার্থে ব্যবহৃত এমন সব শব্দ পাওয়া যায় যাকে বহু পাঠক, প্রাবন্ধিক, আলোচক এ যাবত কবিতাগুলিকে যৌনতার অপব্যাখ্যা দিয়ে কবিতার মূল টার্ম ভেঙে বিনয়কে কাণ্ডজ্ঞানহীন দোষী সাব্যস্ত করেছেন, যা একজন উচ্চমার্গীয় কবি-লেখকের ক্ষেত্রে কোনো কালেই প্রাপ্য ছিল না । কবিতাগুলি পাঠশেষে, সর্বাগ্রে আমি এটাই মনে করি, বিনয় মজুমদার এই কাব্যগুলোতেই ভাষার গূঢ়তাত্বিক কারিগরি করেছেন।”
    তিনটি কবিতা পাঠ করে দেখা যাক :-

    বসার পরে
    বসা শেষ হয়ে গেলে দেখা যায় ভুট্টা অতি সামান্যই নরম হয়েছে ।
    নদী সোজা উঠে পড়ে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি গ্লাসের বাহিরে
    রস লেগে আছে কিনা, নদী তার হাত দিয়ে আমার ভুট্টাটা
    তখন — বসার শেষে কখনো ধরে না, ভুট্টা রসে ভেজা থাকে ।
    আমি কিন্তু হাত দিই, ঘাসের উপরে হাত বোলাতেই থাকি,
    ঘাস টেনে টেনে দেখি, ঘাসের উপরে হাত বোলাতেই থাকি,
    ঘাস টেনে টেনে দেখি, অনেক অশ্লীল কথা অনায়াসে বলি ।
    নদীর গ্লাসের দৃশ্য — গ্লাসের বাহিরটিকে প্রাণভরে দেখি
    ( গ্লাসের ভিতরে দেখি বসার সময়ে শুধু ) বসা শেষ হলে
    গ্লাস খুলে দেখতে সে এখনো দেয়নি, আমি বহির্ভাগ দেখি ।
    হঠাৎ বেলের দিকে চোখ পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই ।
    বেল দুটি এ বয়সে অল্প পরিমাণ ঝুলে পড়েছে, সে দুটি
    মনোমুগ্ধকর তবু চোখ ফের নেমে যায় নিচের গ্লাসের দিকে, সেই
    গ্লাসের উপরিভাগ বসার সময়ে যতো চওড়া দেখেছি
    এখন ততটা নয়, সরু হয়ে পড়েছে তা ঘাসগুলি ঘন হয়ে পড়েছে এখন ।

    যৌবন কাহিনী
    এখন ফুলকে খাই প্রায়শই কলকাতা গিয়ে ।
    কয়েক বছর ধরে খাওয়া হলো, ছেলেও হয়েছে ।
    আরো ছেলে মেয়ে চাই — এই কথা ফুলকে বলেছি,
    খাওয়ার সময়ে আমি ধাক্কা দিতে দিতে এই কথাই বলেছি ।
    ফুল তাতে রাজি আছে, এই ভাবে দুজনের জীবন চলেছে ।
    ফুলের ঘরের পাশে আরো বহু ঘর আছে, প্রতিটি ঘরেই
    নদী আছে, তারা সব আমার খাওয়ায় খুব সহযোগীতাই
    করে থাকে সর্বদাই, ফুল যেই বলে ‘আজ একবার বসি’
    অমনি সে নদীদের একজন জল এনে দেয় ।
    আমরা খাওয়ার পরে সেই জলে কলা গুহা ধুই ।
    আমি গেলে মাঝে মাঝে তাদের ভিতরে কেউ জিজ্ঞাসাও করে
    ‘আজ তুমি বসবে কি’ এইসব পরস্পর খাওয়ার সহযোগীতা করে
    সেখানে — আমার ফুল যেখানে রয়েছে সেই বাড়িটিতে
    নদী আছে, প্রতিবার খাওয়ার পরেই ভাবি তারা সব দেবী ।

    তিন ঘণ্টা পরে
    একবার বসা হলে কমপক্ষে সারাদিন তার
    আমেজ শরীরে থাকে, ভুট্টা থাকে কাৎ হয়ে পড়ে
    সহজে দাঁড়ায় না সে ; মাঝে মাঝে ভুট্টাকে ফুটিয়ে
    ময়লা ও লেগে থাকা রস তুলে আনি
    হাতের আঙুল দিয়ে এবং সে ময়লা ও রসের সুঘ্রাণ
    নাক দিয়ে শুঁকি খুব ভালো লাগে ; প্রথম প্রথম
    বসার পরেই আমি ভুট্টা ধুয়ে ফেলতাম — চাঁদ জল দিয়ে
    গুহা ধুয়ে ফেলবার পরেই আমার ভুট্টা ধুয়ে দিতো জল ঢেলে ঢেলে ।
    অবশ্য কয়েকবার নিজেও ধুয়েছি আমি নিজে জল ঢেলে ।
    তারপর ভাবলাম ভুট্টাতে গুহার রস লেগে থাকা ভালো ।
    তাতে বেশি সুখ পাবো, রস শুঁকে আনন্দও পাবো ।
    সেহেতু এখন আর ধুই না এবং আমি মাঝে মাঝে ভুট্টাকে ফুটিয়ে
    ময়লা ও লেগে থাকা রস তুলে এনে তাই শুঁকি ।
    ভালো লাগে, তার হেতু এই রস চাঁদের গুহার ।

    সমর তালুকদার বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করেছিলেন, “নারী সংসর্গের অভাব বোধ কর না ?” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “এটা ব্যক্তিগত — এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কোনো আলোচনা করব না।”

    বারো

    ‘শব্দের শিশির’ গ্রন্হপ্রণেতা কবি ও প্রাবন্ধিক জয়িতা চক্রবর্তী বলেছেন যে, “প্রত্যেক সৃষ্টিশীল কাজেই প্রাথমিক উথ্থান কবিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয় ; তাঁর সেরা সৃষ্টিগুলি একে-একে শেষ হতে থাকে । অধোগতি হয়েছে একথা শুনতে হয় তাঁকে । ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ, যাঁর সেরা সৃষ্টিগুলি পরিণত ও শেষ পর্বে পাওয়া যায় । শিল্পী কখনও নিঃশেষিত হন না । পঞ্চাশের দশকের কবি বিনয় মজুমদার যতো জনপ্রিয় ততোটাই নিন্দিত । আমি মনে করি ‘ভালো কবিতা’ বা ‘মন্দ কবিতা’ বলে কিছু হয় না । বিনয় মজুমদারের প্রথম পর্বের কবিতাগুলিতে রোমান্টিসিজম ছিল, যা বাঙালি পাঠকের চির পছন্দের । শেষ পর্বের লেখাগুলো সময়ের চেয়ে এগিয়ে । কবিতা যেখানে জীবনের অপ্রিয় সত্য, জৈব সত্য ও জীবনের বাহ্যিক অর্থহীনতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে । অনেক কবির মতে বিনয় মজুমদারের সেসব কবিতা অপাঠ্য, বিকৃতরুচির পরিচায়ক । আমি জোর দিয়ে বলছি, তারা বদ্ধ জলাশয় । এমনকি ভুট্টা সিরিজের কবিতার বই পুলিশ অব্দি গড়ায় । স্টল থেকে তুলে নেওয়া হয় তাঁর বই । বাঙালির যৌনতা সম্পর্কে ছুঁৎমার্গ কাটবে না ; তাঁরা ঘোমটার আড়ালে খেমটা নাচ পছন্দ করেন । বিনয় মজুমদারের কবিতায় আছে কাব্যগুণ, আছে জীবনবোধ । তাই শেষজীবনে অসুস্হ শরীরে লেখা কবিতাগুলি অত্যন্ত উপভোগ্য ও উত্তরআধুনিক কবিতাধারায় সৃষ্ট ; একজন সাহসী লেখকের মননশীলতার পরিচয়।”

    এই প্রসঙ্গে পুনরাধুনিক কবিতার প্রবক্তা ও কবি অনুপম মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “এই ভুট্টাপর্বের কবিতাগুলোর জন্য তাঁকে কম গালমন্দ খেতে হয়নি । অনেকেই তাঁকে সিরিয়াসলি নিতে চাইলেন না আর এই কবিতাগুলো লেখার পরে । কিন্তু বিনয় ভুট্টা পর্বের কবিতাগুলোয় সম্ভবত সেটাই করলেন, যেটা পিকাসো তাঁর অন্তিমপর্বের এচিংগুলোয় করেছিলেন । নিজের জৈবিক এবং প্রায় হাস্যকর ও অসহায় কামপ্রবৃত্তিকে তুলে আনলেন চোখের সামনে । তিনি ‘লিঙ্গ’ লিখলেন না, এমনকি তার দেশজ প্রতিশব্দটিও লিখলেন না, তিনি লিখছেন ভুট্টা। এটা শব্দের প্রতিস্হাপন । এই খেলাই আমি আজকাল নিজের কবিতায় খেলি । আমি তাঁর স্হানে থাকলে ‘লিঙ্গ’ কেটে ‘ভুট্টা’ লিখতাম, কিন্তু কাটা শব্দটিও পাশে রেখে দিতাম । বিনয় ‘রমণী’ লিখলেন না, তার বদলে ‘চাঁদ’ লিখলেন । ‘যোনি’ লিখলেন না, তার বদলে ‘গুহা’ লিখলেন । ‘সঙ্গম’ লিখলেন না, তার বদলে ‘নাচ’ লিখলেন । বললেন, মেয়েদের নিয়মিত নাচা উচিত । বেশ্যাগৃহে গিয়ে সঙ্গমকে ‘বসা’ লিখলেন । কোনো মেয়ের নাম দিলেন ‘ঔদার্য’, এবং মনে মনে তার সঙ্গে রমণ করে কবিতা লিখলেন । যোনিপ্রদেশকে বললেন মায়াসভ্যতা । বীর্যের ফোঁটাকে বললেন চন্দন । কিন্তু যখন তাঁর কবিতার নাম হলো ‘আমার ভুট্টায় তেল’, স্পষ্টই বোঝা গেল তিনি কী লিখছেন — একজন দেহপসারিণী নিজের যোনিতে নেওয়ার আগে একজন পুরুষের লিঙ্গে তেল মাখাচ্ছেন । যেমন গাছের তলায় রাখা লম্বাটে পাথর দেখলে মানুষ প্রণাম করে, কারণ তার মাধায় শিবলিঙ্গ উদ্ভাসিত হয়, যেমন আলুর শুঁড় দেখেই তাকে বস্তা থেকে সরিয়ে কুলুঙ্গিতে রাখা হয়, গণেশ হিসাবে । কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত কবি এভাবে সরাসরি কামবিষয়ক কবিতা লিখবেন এটা অনেকেই মানতে পারেননি, আজও পারেন না । তাঁরা আজও ‘ফিরে এসো, চাকা’, অথবা খুব বেশি হলে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’কেই বিনয় মজুমদার মনে করেন এবং স্বস্তিতে থাকেন, মধ্য ও শেষ পর্বের বিনয়কে উন্মাদ আখ্যা দিয়ে।” ( ২০১৬ )
    অনুপম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য লক্ষনীয় । অনুপম বলছেন না যে বিনয় তাঁর এই কবিতাগুলোয় ‘উপমা’ প্রয়োগ করেছেন । বিনয় মজুমদার শব্দের ‘প্রতিস্হাপন’ ঘটালেন । এখানেই জীবনানন্দের সঙ্গে বিনয়ের পার্থক্য । জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় ‘মতো’ ‘যেন’ ইত্যাদি প্রয়োগ করে গেছেন, যা বিনয় ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ থেকে তাঁর পরের কবিতায় আর করেননি, ‘বাল্মীকির কবিতা’য় তো করেনইনি । উপমা বাদ দেবার দরুণ বিনয় প্রকৃতির সঙ্গে পরমাপ্রকৃতির অভেদকে সনাক্ত করছেন । কিন্তু জীবনানন্দ যে ক্রমে উপমা থেকে সরে গিয়ে প্রতীকে এবং প্রতীক থেকে বস্তু-সম্পর্কে চলে যেতে লাগলেন, তা বিনয় ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে । বিনয়ের এই পর্বের কবিতায় শব্দের প্রতিস্হাপনের কথা অর্ঘ্য দত্ত বকসীও বলেছেন তাঁর “প্ল্যানচেটে যৌনসমীক্ষায় বিনয় মজুমদার” আলোচনা পুস্তিকায়, তিনি এদের বলেছেন প্রতীক : চাঁদ, নদী, ফুল, গুহা,হ্রদ ( যোনি ), ঘাস ( যোনিরোম ), লেবু, বেল ( স্তন ), ভুট্টা, কলা, চন্দনকাঠ ( লিঙ্গ ) ।
    এই প্রতিস্হাপন বাংলা কবিতায় নতুন নয় । চণ্ডিদাস-এর ৮৭৯ পদ পাঠ করা যাক :

    সহজ সহজ সবাই কহয়ে
    সহজে জানিবে কে ।
    তিমির অন্ধকার যে হইয়াছে পার
    সহজে জেনেছে সে ।।
    চান্দের কাছে অবলা আছে
    সেই সে পিরীতি সার ।
    বিষে অমৃততে মিলন একত্রে
    কে বুঝিবে মরম তার
    বাহিরে তাহার একটি দুয়ার
    ভিতরে তিনটি আছে ।
    চতুর হইয়া দুইকে ছাড়িয়া
    থাকিব একের কাছে ।।
    যেন আম্রফল অতি সে রসাল
    বাহিরে কুশী ছাল কষা ।
    ইহার আস্বাদন বুঝে যেই জন
    করহ তাহার আশা ।।

    নিজের কবিতার কৃৎকৌশলের সঙ্গে বিনয় মজুমদার প্রথম থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত সচেতন ছিলেন ; কবিতার সৃজন এবং বর্জনীয় উপাদান সম্পর্কে অতিসতর্ক থাকতেন । সেকারণে দেখা যায় যে আলোচনাকালে তিনি আধুনিক পেইনটিঙ থেকে ব্রাশ স্ট্রোকের বিলয় এবং মেটাফর থেকে কবিতার মুক্তির কথা বলেছেন, যাতে জীবনের রহস্যময়তাকে সম্পূর্ণ উদ্ঘাটন করা না হয়, এবং সেই সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার ও পারলৌকিকতার ফাঁদে না পড়তে হয় ।
    প্রণব সরকার বলেছেন, “বিনয় একালের কামসূত্র বা ভুট্টা সিরিজের কবিতা বা ‘বাল্মীকির কবিতা’র ভিতরে রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সঙ্গে, যা আমাদের কাছে সরাসরি অশ্লীল কোনো ভাব প্রকাশ করে না । বরঞ্চ প্রাপ্তবয়স্কদের মনস্ক করে ।”
    উপরোক্ত বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে প্রবীর ভৌমিক বলেছেন, “যে সৌন্দর্যময় নারীচেতনার তান্ত্রিক পূজারী বিনয়, তিনিও অপরিচ্ছন্ন, বিকৃত, বমন উদ্রেককারী এই লাইনগুলো লেখেন, ‘গুহায় বোজানো মুখ চেপে ধরে ঠেলা দিই/সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি/ভুট্টাটি সহজভাবে ঢুকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা শুরু করি ।’ এ বিনয়কে মানায় না । বিনয়ের এই কবিতাগুলোকে মহিমান্বিত করে ছোট করবার একটা অপচেষ্টা চলছে । আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।”
    রনজিৎ দাশ একটি যুক্তি দেবার প্রয়াস করেছেন । তিনি বলেছেন, “আর দশজন আধুনিকের মতো বিনয়ও হেঁটেছেন বদল্যার নির্দেশিত এই স্বপ্নসম্ভব পথেই, কিন্তু পৌঁছেছেন এক ভিন্ন গন্তব্যে।”
    প্রশ্ন হলো, ‘ফিরে এসো, চাকা’ লিখে বিনয় তো বাংলা কবিতার ইতিহাসে জীবনানন্দের পর নিজস্ব স্হান করেই নিয়েছিলেন । তাহলে তিনি ‘অঘ্রাণের অনূভূতিমালা’ আর ‘বাল্মীকির কবিতা’ এবং তার পরবর্তী সাব-জনারের কবিতাগুলো লেখার উদ্যোগ নিলেন কেন ! এগুলো লেখার জন্য তো তিনি টাকা পাননি, বরং পুরস্কারের লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে ছিটকে গিয়েছিলেন । বদল্যারের জীবনকাহিনির প্রভাবে পঞ্চাশের কবিরা কলকাতার যৌনপল্লি যাওয়া আরম্ভ করেন ঠিকই, বিনয়ও, আমার অনুমান, তাঁদের কিছু পর থেকে তাঁর নারীহীন যৌনজীবনের প্রয়োজন মেটাতে যাওয়া আরম্ভ করেছিলেন বটে, কিন্তু কবিতা লিখে তার প্রমাণ দিতে যাবেন কেন ?
    আমার মনে হয় যে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে-তুলে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা এবং তাঁর গুণমুগ্ধরা , একই খোঁচা বার বার দিয়ে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিলেন। তা থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি হয়ে উঠেছিল, এবং তার প্রথম ধাপ হিসাবে তিনি লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’. যেটিকে তিনি বললেন “নারীভূমিকা বর্জিত আদিরসাত্মক কবিতা”– ঈশ্বরী অথবা গায়ত্রীর ভূমিকা আড়াল করার এটি প্রথম পদক্ষেপ । বিনয় লিখলেন :-

    এইখানে পাহাড়ের ভাঁজ বলা যেতে পারে, বাঁক বলা যেতে পারে, অথবা
    দু-দুটি পাহাড় এসে মিলে গেছে যদি বলা হয় তবে একেবারে
    হুবহু বর্ণনা হয় ; …মিশেছে প্রায় সরলকোণের খুব কাছাকাছি এক স্হুলকোণে

    ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ থেকে প্রাসঙ্গিক লাইন তুলে তুলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বকসী তাঁর ‘বিনয় মজুমদার ও অঘ্রাণের অনুভূতি– বিশাল দুপুরবেলার যৌনসমীক্ষা’ বিশ্লেষণে ( ২০১৪ ) । অর্ঘ্য বলেছেন, “অনেকটা উল্টোনো বিস্ময়বোধক চিহ্ণের মতো লাগে এই যোনি । বিস্ময়বোধক, তাই হয়তো উল্টোনো, ডিসপ্লেসড । দেহের সর্বাপেক্ষা গোপন স্হানে যোনির অবস্হান। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তি গোপনতায় । চাঁদের গুহার দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকেন কবি । কবি বলছেন, প্রাণলোকে ( অনুভূতিমণ্ডলে ) প্রবেশাধিকার দিয়ে তৎলোকে বিক্ষোভ সৃষ্টি করে তৃপ্তিদান করানোর বাসনা এবং গোপনতার অনুভূতির সঙ্গে যোনির সরাসরি সম্পর্ক । যোনি varies directly as প্রাণলোকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার বাসনা — গোপনতা । তাই পাহাড়ের জীবনেও গোপনভাবে প্রবেশ করে কবি বর্ণনা করেছেন এই জোড় ও মধ্যবর্তী গোপন গোপন ক্রীড়ার স্হান — বানিয়েছেন প্রাকৃতিক যোনি — প্রকৃত কবিতার মতো ! প্রকৃত সারসের মতো !”
    এক কোণে, পাহাড়ের কোণের ফাঁকেই হল আমার বাড়িটি, ঠিক কোণে
    পাহাড়ের ঢালু গায়ে চুড়ার কিছুটা নীচে ঢালু কোণে বাড়িটি ঢোকানো
    লম্বালম্বিভাবে পাহাড়ের ভিতরে অনেক দূর খুব বেশি সুন্দর উপায়ে

    অর্ঘ্য বলেছেন, “স্তন বা চূড়ার নীচে যৌনস্হান যা ঢালু অংশে স্হাপিত সেখানে যোনিমুখ থেকে ভিতরে ‘ঢোকানো’ দীর্ঘ যোনিগহ্বর ও তাতে নিত্য অবস্হানরত অনুপ্রবেশিত শিবলিঙ্গ, সদারমণরত নিত্য পূজা।”

    বারান্দাটি শুধু এই পাহাড়ের পাথরের গা থেকে বেরিয়ে ঝুলে আছে
    সামান্যই বেরিয়েছে, পাতলা লতার গাছে বারান্দাটি চারপাশে ঘেরা

    অর্ঘ্য মনে করেন, “বাড়ি যদি লিঙ্গ হয়, বারান্দা তবে স্বভাবতই বাইরে ‘ঝুলে’ থাকা চারপাশের যৌনরোমসহ অন্ডকোষ । বিনয় অন্যত্র ঘাসের কথা বলেছেন যা প্রকৃতপক্ষে যোনিরোম।”
    দ্বিতীয় পদক্ষেপ হল ‘বাল্মিকীর কবিতা’ — যা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ও গুণমুগ্ধ স্তাবকদের থেকে গায়ত্রীকে সম্পূর্ণ আড়াল করার জন্য যথেষ্ট ছিল ।
    ‘বাল্মীকির কবিতা’ নিয়ে বিনয়ের মনে দোনামনা ছিল বলে মনে হয় । ‘গ্রন্হি’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে ১৪১২ বৈশাখে চন্দন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিনয়ের এরকম কথাবার্তা হয়েছিল :-
    প্রশ্ন : এখনকার বাংলা কবিতায় মেয়েরা যৌন আকাঙ্খামূলক লেখাগুলো বেশ খোলামেলা ভাবেই লিখছেন । প্রতিষ্ঠিত কবিরা স্বাগতও জানাচ্ছেন এই পরিবর্তন কে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রন্হির বর্তমান সংখ্যাতেই তসলিমা লিখেছেন একটি গদ্য, নাম ‘নারী শরীর’ । আপনিও যৌন অভিজ্ঞতার কথা সরাসরি দু’একটি প্রতীকের আড়ালে লিখেছিলেন ভুট্টা সিরিজের কবিতায় । একটা ছোট কবিতার বইও সম্ভবত হয়েছে কবিতাগুলি জড়ো করে । পরে আপনি তাদের disown করেন । আজ এই মুহূর্তে কি পাল্টাবেন মতামত ? এই ধরণের কবিতার স্হায়ীমূল্য কি আছে ?
    বিনয় : ( মৃদুস্বরে বলে যান ) না, কোনও বই নেই তো । আমার জানা নেই এমন কোনও বইয়ের কথা । এগুলো উল্লেখযোগ্য লেখা নয় ( অস্বীকারের ভঙ্গীতে হাত নাড়েন ) । তবে মহিলা কবিরাই চিরকাল ভালো কবিতা লিখে এসেছেন । যেমন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে ।’ কিংবা ওই লেখাটা, ‘ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়…।’ আর স্হায়ী মূল্যের কথা বলছ ? দ্যাখো, প্রথমে যখন লিখতে শুরু করি তখন লক্ষ্য ছিল পাঠককে জ্ঞান দান, তার বুদ্ধি বাড়ানো, কবিতাগুলিকে তার মনে রাখানোর চেষ্টা, তার সঙ্গে যেন আমার কথাও মনে পড়ে, সেদিকে নজর রাখা ইত্যাদি । কবিতা কীভাবে হয়, কীভাবে সার্থক, আমিও জানি না । হয়ে যায়, এই পর্যন্ত।’
    ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় ১৯৮২ সালে প্রকাশিত সমর তালুকদারের ঠাকুরনগর স্টেশানে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময়ে কথাবার্তার মাঝে বিনয় মজুমদার সমরবাবুকে জিগ্যেস করেছিলেন, “১৯৭৭ সালে বিশ্ববাণী থেকে প্রকাশিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ বইটি তিনি পড়েছেন কিনা।” ১৯৯৩ সালে কথাপ্রসঙ্গে ‘যোগসূত্র’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে অজয় নাগকে বিনয় বলেছিলেন, “আদিরসাত্মক কবিতাগুলি নিয়ে একটা বই বেরোয় তার নাম দিই ‘বাল্মীকির কবিতা’ ; কেন যে লিখেছিলাম মনে নেই এখন ।”
    বিনয়ের কবিতাকে প্রতি-রোমান্টিসিজমের প্রসারণ থেকে, যা কিনা পুনরুদ্ধারের অতীত এক নিগূঢ় পন্হা, এবং যা কিনা অবিরাম রোমান্টিক-নিউরোটিককে , আর আমাদের জীবনযাপনের আধুনিকতাবাদী ব্যাজস্তুতিকে, পর্যদুস্ত করে, তা থেকে বের করে আনা দরকার । বিনয়ের কবিতা আক্রান্ত হয়েছে সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে, বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে, যার পাল্লায় এক সময়ে জীবনানন্দকে পড়তে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকেও পড়তে হয়েছিল । এখানে বিনয়ের এই কবিতাটি প্রাসঙ্গিক :

    হাসপাতালে
    এজরা হাসপাতালে যখন ছিলাম
    তখন পাগল বলে ডাকত আমাকে
    রাত্রিবেলা অন্ধকারে দেখতাম আমাকে খাওয়ার
    নিমিত্ত রামদা হাতে আসত পরমেশ ও
    উমা দাশগুপ্ত, দেখে আমি
    বলতাম দরজায় লেখা আছে আমি আছি পাগলা গারদে
    আমি তো পাগল আর পাগলের মাংস খেলে
    তোরাও পাগল হয়ে যাবি
    প্রতিদিন রাত্রিবেলা এ কাণ্ড ঘটতো ।
    তখন আমাকে আর কেটে কেটে খেতে আসত না ।

    প্রত্যেকেই অস্তিত্বের পাগলাগারদে জীবন কাটান । সেটা হলো অক্ষমতার অস্তিত্ব । তা এই জন্য নয় যে আমরা মানসিকভাবে যুক্তিহীন প্রাণী, বরং মানুষকে মেরে ফেলে তার মাংস খাওয়াকে অসম্ভব মনে করা যায় না । আমরা সবাই কিনারায় দাঁড়িয়ে কাঁপছি । মানুষ মেরে তার মাংস খাবার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যাবে না । সেই দিন আগত । প্রতিটি বাঁকে আমরা আমাদের সহযাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর, এবং তা মেরে ফেলে মাংস খাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয় । পাগলাগারদের পাহারাদার অভিভাবকদের ভূমিকা সেটাই । সুযোগ পেলেই মানুষ তার সহযাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর হবার যারপরনাই প্রয়াস করে । পাগলাগারদের বিশেষ অভিভাবক হবার সংজ্ঞা সেইটাই । আমরা নিজেদের কেটে টুকরো করছি, আমাদের অস্হিরতা আমাদের তা করতে প্ররোচিত করছে, যাতে আমরা সমাজে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে পারি ।
    কলকাতা শহরের হাসপাতালগুলোয় রোগীদের ক্রুদ্ধ আত্মীয়দের আক্রমণাত্মক আচরণ দেখলেই তা টের পাওয়া যাবে । স্কিৎসোফ্রেনিয়ার চিকিৎসক আমাদের দেশে বিরল ; যে চিকিৎসকরা আছেন তাঁরা ম্যাডনেস ও ইনস্যানিটির ডাক্তার, যে কারণে সোভিয়েত দেশ ভেঙে পড়লে নিমু ভৌমিক তা সহ্য করতে না পেরে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং উন্মাদ হয়ে যান, তাঁকে বাঁচানো যায়নি, তিনি জার্মান কবি ফ্রেডরিক হ্বেল্ডারলিনের মতন ‘হাইপোকনডিয়াইসিস’ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন । সোভিয়েত দেশে নিমু ভৌমিক সারা জীবন সুস্হ ছিলেন। বাংলা ভাষায় ‘হাইপোকনডিয়াইসিস’-এর বাংলাও পাগল হয়ে যাওয়া, কেননা হাইপোকনডিয়াইসিসের বাংলা প্রতিশব্দ নেই ।
    মালটিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, প্যারানয়া, সাইকোসিস, ডিপ্রেশনজনিত অসংলগ্নতা, উদ্বেগের অসংলগ্নতা, ট্রমাজনিত আচরণ, ফোবিয়া, হ্যালুসিনেশনবোধ, ডেলিউজান, অ্যানেরোক্সিয়া নার্ভোসা, বুলিমিয়া নার্ভোসা সোমাটোফর্ম, স্মৃতিবিলোপ, সবই বঙ্গসমাজে পাগলামির নাম দিয়ে চালানো হয় । স্কিৎসোফ্রেনয়াও তিন রকমের হয় : অ্যাক্টিভ, ক্যাটাটনিক এবং ডিসঅর্গানিজড — শরীরে রাসায়নিক ও হরমোনের ভারসাম্যের তারতম্য দিয়ে নির্ধারিত হয় । সবগুলোকেই বলা হয় মস্তিষ্কবিকৃতি বা পাগল হয়ে যাওয়া ! লুম্বিনী পার্কের চিকিৎসকরাও শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি করেননি ।
    বাংলা ভাষায় শব্দসংখ্যা এতোই কম যে এই বিষয়ে ১৪১৩ বঙ্গাব্দে ‘অউম’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদার জয় মুখোপাধ্যায় ও সন্মোহন চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, “ শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন যে, একটি কবিতায় একস্হানে একটিমাত্র শব্দ বসার কথা । জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে ১,২০,০০০ শব্দ আছে । সেই শব্দের ভিতর থেকে একটিমাত্র শব্দ এনে বসাতে হবে । এই খুঁজে বের করা কবির বিষয় । এটা শিবরামের হলেও সমান চিন্ত্যনীয় । কারণ আগেই বলেছি যে ধেনুর সঙ্গে বেণু, গেনু, পেনু এইসব শব্দ অভিধান থেকে বেছে বের করার সময় সৃষ্টিকর্তার মাতব্বরির খপ্পরে পড়তে হয় ।” বস্তুত সৃষ্টিকর্তার মাতব্বরির খপ্পর থেকে বেরোবার জন্যই কবিরা একটি শব্দের জায়গায় আরেকটি শব্দ প্রতিস্হাপন করেন, যা বিনয় মজুমদার করলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ ও ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্হে । উল্লেখ্য যে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি শব্দের ডিজিটাইজেশনের পর জানিয়েছে যে তাতে শব্দসংখ্যা ১০,২২,০০০ ; অর্থাৎ আমাদের ভাষার দশগুণ । ইংরেজির চেয়ে তুর্কি ও জার্মান ভাষায় শব্দের সংখ্যা বেশি । শেক্সপিয়ার বহু শব্দ তৈরি করে দিয়ে গেছেন । জীবনানন্দের মতন বিনয় মজুমদারও বেশ কয়েকটি শব্দ তৈরি করেছেন। আটের দশক থেকে কবিরা শব্দ তৈরি করছেন, কলকাতার সাধারণ মানুষও সমবেত শব্দ তৈরি করেন । কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি কমিটি না থাকায় শব্দ সংগ্রহ করে অভিধানে ঢোকানো হয় না ।
    বিনয় মজুমদারের কোন ধরণের স্কিৎসোফ্রেনিয়া হয়েছিল তা তাঁর হাসপাতালের কাগজ দেখে গবেষকরা বের করবেন কখনও, আশা করি । তাঁর অসংলগ্নতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসফল আশপাশের মানুষেরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিতেন মানসিক চিকিৎসালয়ে । এই প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গের পাগলাগারদ সমূহের পরিদর্শক আমি । আমার সরকারি চাকরিই তাই । যা বেতন পাই তাতে মোটামুটি সংসার চলে যায় — একার সংসার।” ১৯৯৩ সালে সঞ্জয় চক্রবর্তীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে যখন ছিলেন, “তখন কেউই বড়ি-ফড়ি কিছু খাওয়াতেও এলো না । ইনজেকশানও দিতে এলো না । তোফা ছিলাম । আর ভারতবর্ষে আমাকে সাতবার পাগলাগারদে পোরা হয়েছে । অনেকেই তো পাগলাগারদে ছিলেন । তাঁদের জীবনীতে তা লেখা হয় না । আর আমার জীবনী লিখতে গেলে প্রথম বাক্যই লেখে — গোবরা মানসিক হাসপাতালে ছিলেন । পাগলাগারদে আর কে কে ছিলেন শুনবে ? লুম্বিনী পার্কে ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক । এঁদের জীবনী যখন লেখে তখন তো একথা এভাবে লেখে না যে এঁরা পাগলা গারদে ছিলেন । অথচ আমার ক্ষেত্রে প্রথমেই ওই কথা — মানসিক হাসপাতালে ছিলেন ।”
    আমাদের মানসিক অবস্হা দিয়ে আমাদের প্রকৃতিস্হতা সংজ্ঞায়িত হয় না । হয় আমাদের বেঁচে থাকার উপরিতল দিয়ে – বিনয়ের উপরোক্ত কবিতার ক্ষেত্রে ‘মাংসভক্ষণ’ নিষ্ঠুরতাকে গোপন করে রেখেছে, মানুষের নিষ্ঠুরতা, প্রতিপদে সামনের শত্রুকে খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র । এই নিষ্ঠুরতা যেন সহ্য হয়ে-যাওয়া নৈতিকতা । প্রতি রাতেই যে তা ঘটে তা বিনয়’ বাল্মীকির কবিতা’য় আমাদের দেখিয়েছেন । মানুষের মাংসভক্ষণ হয়ে ওঠে মানুষের অন্তরাত্মার ভক্ষণ । এই কবিতাটি পড়ে দেখা যাক :

    মাংস খাওয়া
    আমি যদি মুরগির মাংস খাই
    তাতে মুরগির উপকার হয় ।

    জীবিত অবস্হায় ছিল তুচ্ছ মুরগি
    তার মাংসে খুব উন্নত স্তরের কিছু ছিল ।

    প্রবাদ বাক্য হচ্ছে মাংসে মাংস বৃদ্ধি ।

    তার মানে যখন মুরগির মাংস খেলাম
    তখন সে মুরগির মাংস আমার শরীরের
    মাংস হয়ে গেল ।

    তার মানে সবই বুঝতে পারি
    আমার শরীরের মাংস মুরগির
    মাংসের চেয়ে উন্নত স্তরের কিছু ।

    এতে দেখা যাচ্ছে মুরগির উপকার হয়ে গেল ।

    তেরো

    বিনয় মজুমদারের অসুস্হতাকে তরুণ কবি-লেখকরা অনেকেই রোমান্টিসাইজ করার প্রয়াস করেছেন — তা একজন মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ছেলেখেলা । কলকাতায় বসবাস করে দূরত্ব বজায় রেখে বিনয়ের অসুস্হতার নান্দনিকতা গড়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁরা, যেন তাঁরা বিনয়ের কবিতার উদ্ধারকারী। কবি কিন্তু তাঁর পারক্যবোধকে সযত্নে আগলে রাখতেন, এবং অতিথি গুণমুগ্ধদের ভাবপ্রবণ আচরণকে প্রকৃতি-পৃথিবীর অত্যন্ত জটিল ব্যাখ্যার মাধ্যমে সীমায়িত করে দিতেন । বিনয়ের চরিত্রে ছিল অদম্য বলিষ্ঠতা। তাই তিনি নিজে যে ধরণের কবিতা ও গদ্য লিখবেন বলে মনস্হ করতেন, তাই লিখতেন । তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ পড়লে বোঝা যায় তিনি ভাবনাকে কোন পথে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন । কবিতায় দিনপঞ্জির অনুপ্রবেশ ঘটনোর মাধ্যমে তিনি নিজের জীবনচর্যা রেকর্ড করেছেন এবং এগিয়ে গেছেন, যেমনটা দিনপঞ্জি লেখকেরা করে থাকেন, আগের দিনের ঘটনাকে পেছনে ফেলে আসেন । কবিতা লেখা হয় ভাষার মাধ্যমে, এবং ভাষা চিরকাল সময়বন্দী, পরবর্তীকালে গিয়ে তা আটকে যায়, যেমন চর্যপদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, সময়ের দ্বারা তা সীমায়িত । প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন কাল্ট ফিগার, আর নিজের দুরাবস্হাকে উপস্হাপন করে সেই প্রতিষ্ঠানকে হাস্যকর ও অপ্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন করে দিয়েছেন । কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ব্যথা তিনি তাঁর কবিতাকেই অবিরাম জানিয়ে গেছেন, ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইয়ের কবিতাগুলোর সময় থেকে । তাঁর একটি কবিতার শিরোনাম ‘আমরা সর্বাঙ্গ দিয়ে ভাবি’ — তাঁকে যারা পাগল তকমা দিয়েছিল তাদের এটা সরাসরি আক্রমণ, কেননা তিনি কেবল মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবছেন না, সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে ভাবছেন ।

    আমরা সর্বাঙ্গ দিয়ে ভাবি

    আই গ্রাফটিং করা হয়
    তার মানে একজনের চোখ
    কেটে তুলে নিয়ে অন্য একজনের
    চোখের জায়গায় জোড়া লাগিয়ে
    দেওয়া হয় ।

    প্রথম ব্যক্তির চোখ উপড়ে
    নেওয়া হল । জোড়া লাগিয়ে
    দ্বিতীয় ব্যক্তির শরীরে ।

    এই উপড়ে নেওয়া এবং জোড়া
    লাগানো, এই করতে সময় লাগল
    ধরা যাক পাঁচ মিনিট । এই পাঁচ মিনিট যাবৎ
    চোখ জীবিত ছিল ।


    একজনের শরীরের রক্ত বার করে নিয়ে
    বোতলে পুরে রাখা হয় এবং কয়েক
    দিন পরে এই বোতলের থেকে অন্য
    একজনের শরীরে ঢুকিয়ে
    দেওয়া হয় এর থেকে বোঝা যায়
    বোতলে পোরা অবস্হায় রক্ত জীবিত
    ছিল, রক্তের প্রাণ ছিল, রক্ত ভাবছিল ।
    কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তির শরীরে ঢুকে
    রক্ত স্বাভাবিক হয়ে গেল ।


    ‘খ’-এ যা লিখেছি ( বোতলে যখন রক্ত ছিল তখন রক্তের প্রাণ
    ছিল ) তাহলে মুরগি যখন কাটা অবস্হায় পড়েছিল ( ‘ক’ দেখো )
    তখন মুরগির মাংসের প্রাণ ছিল, ভাবছিল সুতরাং একজন মানুষ
    মুরগির মাংস খেলে পাকস্হলির ভিতরের মুরগির মাংস জীবিত,
    ভাবছিল পরে এই মুরগির মাংস মানুষের শরীরে মাংস হয়ে
    গেল । এই নতুন দ্বিতীয় অবস্হায় মুরগির উপকার হল ।

    অদ্রীশ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিচরণে লিখেছেন, “আমি যখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র, তখন বিনয় মজুমদারকে ঠাকুরনগর থেকে মেডিকাল কলেজে এজরা ওয়ার্ডে ভর্তি করে নিয়মিত কলেজ থেকে এসে দেখাশোনা আর গল্প করার ভার দেন তৎকালীন দুই উচ্চপদস্হ আমলা তারাপদ রায় ও কালিকৃষ্ণ গুহ । সেই সময় থেকে বিনয় মজুমদার ওনার বিখ্যাত খবরের কাগজের সংবাদই কবিতায় ঢোকান । আর ছিল ডায়েরি বা দৈনন্দিনকে কবিতায় ঢোকানোর পর্ব। এই পদ্ধতির ব্যবহার নিজের চোখে দেখা । অনেক কবিতা আজও সংগ্রহে আছে । কিন্তু বিনয় মজুমদার যে মহাপয়ারের জন্য বিখ্যাত, সেই কবিতাগুলো, ‘ফিরে এসো, চাকা’ নিয়ে শৈবাল মিত্র একটা চমৎকার টেলিফিল্ম বানান যা অনালোচিত থেকে গেছে বাঙালি জীবনে । এই সেই একমাত্র টেলিফিল্ম যেখানে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে সেরিব্রাল ডিরেক্টারের মতো করে তুলে এনেছেন । কিন্তু বিনয় মজুমদারের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে আমি ওঁর লেখা দুষ্প্রাপ্য কাব্যগ্রন্হ ‘বাল্মীকির কবিতা’ বিষয়ে আলোচনা তুলি । দেখি, উনি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, এড়িয়ে যাচ্ছেন । বললেন, কোথায় শুনলাম এই নাম । আসলে ‘বাল্মিকীর কবিতা’র কথা বলেন সন্দীপ দত্ত । তখন আমি কপি সংগ্রহ করি বইটার প্রকাশকের ঘর থেকে । কিন্তু দেখি সন্দীপ দত্ত কথিত সেটা একটা খণ্ডিত সংস্করণ ; মানে, সব কবিতা নেই। ব্রজগোপাল মণ্ডল ছিলেন প্রকাশক । তারপর বিনয় মজুমদার বলেন ‘এটা হলো বিনয় মজুমদারের একমাত্র ইরোটিক কবিতার বই বা বাংলা ভাষায় একমাত্র ইরোটিক কবিতা । ভারতীয় কামসূত্র বা দেশীয় আকাঙ্খাকে তত্ত্ব হিসাবে ব্যবহার করা ও ব্যক্তিজীবনকে মিশিয়ে কবিতার ইরোটিকা তৈরি করা ।’ কেউ জানতো না । প্রকাশক ছাপতে রাজি হয়নি । খণ্ড ছেপেছে । আমি সন্দীপ দত্তের কাছে কিছু পূর্ণসংস্করণের খোঁজ পাই । কপি মেলে না । তখন বিনয় মজুমদার ঠাকুরনগর থেকে কপি এনে দেন । পড়ে আমি অবাক হই যে কেন এমন একটা কবিতার ইরোটিকা বাঙালি পড়তে পারবে না । এটা নিয়ে লিখি ও পুনর্মুদ্রণের দাবি করি । এই দাবি বিনয় মজুমদার সমর্থন করে ইনটারভিউ দেন সুবীর ঘোষকে । তারপর দেজ থেকে ‘বাল্মীকির কবিতা’র পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ বের হয় । ওই ‘বাল্মিকীর কবিতা’র সূত্রেই আমি ওঁর বউ ও ছেলের খোঁজ পাই । তাদের নাম রাধা ও কেলো । একদিন সোনাগাছিতে গিয়ে তাদের আবিষ্কার করি আর সেলুলয়েডে ইনটারভিউ তুলে আনি।”
    অদ্রীশ বিশ্বাস যদি সংবাদপত্র থেকে গড়া বিনয়ের কবিতাগুলো প্রকাশ করেন তাহলে আমরা বিনয়-চরিত্রের আরেকটা ডাইমেনশনের সঙ্গে পরিচিত হবো, বিনয়ের কবিতার আরেকটি সাব-জনারের কথা জানতে পারবো ।
    এই সূত্রে সন্দীপ দত্ত জানিয়েছেন যে, “১৯৭৫ সালে এক সাহিত্য সন্মেলনে বিনয় মজুমদার ‘বাল্মীকির কবিতা’ বই থেকে কবিতা পড়া শুরু করা মাত্র ভদ্রলোকদের উঠে যেতে দেখেছিলাম।”
    পরে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে একটি টেলিফিল্ম হয়ছিল যাতে বিনয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জয় গোস্বামী । বিনয় ফিল্মটা প্রতিবেশীর টিভিতে দেখেছিলেন । এই বিষয়ে চন্দন ভট্টাচার্য তাঁকে প্রশ্ন করলে প্রথমে তিনি নিরুত্তর থাকেন, পরে বলেন, “এক-দু ঘণ্টার সিনেমায় কি গোটা জীবন ধরা যায়!”
    বিনয় মজুমদারের বউ রাধা আর ছেলে কেলোকে নিয়ে লেখা কবিতাটি একটি গাণিতিক প্রতর্কে মোড়া :

    ভারতীয় গণিত
    ক্যালকুলাসের এক সত্য আমি লিপিবদ্ধ করি ।
    যে কোনো ফাংকশানের এনেথ ডেরিভেটিভে এন
    সমান বিয়োগ এক বসিয়ে দিলেই
    সেই ফাংকশানটির ফার্স্ট ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায়–
    এনেথ ডেরিভেটিভে এন
    সমান বিয়োগ দুই বসিয়ে দিলেই
    সেই ফাংকশানটির থার্ড ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায়–
    এই ভাবে সহজেই যে কোনো অর্থাৎ
    দশম বা শততম অথবা সহস্রতম ইন্টিগ্রেশনের
    ফল অতি সহজেই পাই ।
    এই কবিতায় লেখা পদ্ধতির আবিষ্কর্তা আমি
    বিনয় মজুমদার । আমার পত্নীর নাম রাধা
    আর
    আমার পুত্রের নাম কেলো ।

    বিনয়েরর স্মৃতিশক্তি বার্ধক্যেও প্রখর ছিল, সাক্ষাৎকারগুলোয় তিনি অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠতেন । ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হের প্রকাশক উৎপল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন যে এই গ্রন্হের জীবনানন্দ বিষয়ক নিবন্ধগুলো জীবনানন্দের বই ছাড়াই, কেবল স্মৃতি থেকে লিখেছিলেন বিনয় মজুমদার। বইটিতে ‘ধূসর জীবনানন্দ’ শিরোনামে তাঁর এই কবিতাটি আছে :-

    ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
    কতিপয় ছিল শুধু বলেছিল, ‘এই জন্মদিন’ ।
    এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
    দর্শনে বিফল ব’লে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান ।
    সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
    দেখে-দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
    একদিন সচেতন হরীতকী ফলের মতন
    ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেলো ।
    এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
    পূঞ্জীভূত বাষ্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত ;
    বৃষ্টির নিমিত্ত ছিলো, এখনো রয়েছে, চিরকাল
    রয়ে যাবে ; সঙ্গোপন লিপ্সাময়ী, কল্পিত প্রেমিকা–
    তোমার কবিতা, কাব্য, সংশয়ে-সন্দেহে দুলে-দুলে
    তুমি নিজে ঝরে গেছো, হরীতকী ফলের মতোন ।

    নিজেকে বিনয় মজুমদার কখনও কবিতার শহিদ বলে মনে করেননি, কেননা সাহিত্যকে জীবিকা বা ধনোপার্জনের সঙ্গে একাসনে বসাননি তিনি, তাঁর সমসাময়িক কবিদের মতন। ‘কবিতার শহিদ’ তকমাটা শক্তি চট্টোপাধ্যায় চাপিয়েছিলেন বিনয়ের ওপর । প্রাপ্তির জন্য লালসা ছিল না তাঁর, কিংবা জাগতিক ধনদৌলতের জন্য দুঃখ। অনুষ্টুপ পত্রিকায় ২০১৩ সালে সুমন গুণ ঠিকই লিখেছিলেন যে “জীবনানন্দের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত এই রকম সয়ম্ভর কবি আর কেউ নেই।” এক সময়ে বিনয় ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লণ্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে । সেই বিনয়ই শিমুলপুরে বসবাসের সময় থেকে পাণ্ডুলিপি এবং লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কবিতা সংরক্ষণ করা আর জরুরি মনে করতেন না ।
    বিনয় এক স্বতন্ত্র সত্বার কবি, তাঁর সময়ের সবচেয়ে বৈচিত্রময় কবি তিনি, বিচিত্রপথগামী তাঁর ভাবনা । আঙ্গিকগত বিন্যাস, শব্দ, ছন্দ, চিত্রকল্পের মিশ্রণে তাঁর কাব্যচেতনা অভিনব । ‘আধুনিক কবিতার হালচাল’ প্রবন্ধে বিনয় বলেছেন, “কালোত্তীর্ণ নয়, কালোপযোগী লেখাই অমর।” সহিদুল হক ২০১৭-এর বাংলা কবিতা পোর্টালে লিখেছেন, “বিনয় মজুমদার তাঁর বহু কবিতায় তথাকথিত অশ্লীলতাকে এক আশ্চর্য সুন্দর শৈল্পিকরূপ দান করেছেন ।” বিনয় মজুমদার অত্যন্ত সচেতন মানুষ ছিলেন, নয়তো তাঁর কথা শোনার জন্য তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তরুণ কবিরা জড়ো হতেন না, এবং তা প্রায় প্রতিদিন ।, কেবল তাঁর লেখার ব্যাপারেই নয়, তাঁর পার্সোনা নিয়ে সাহিত্যিকরা যে ছবি গড়ে তুলতে চাইছেন তা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন তিনি তা এই কবিতাটি থেকে পরিষ্কার হবে, তাঁর জীবনের শেষ পর্বে লেখা :-

    মনস্তত্ত্ববিদদের কীর্তি
    ভাস্কর চক্রবর্তী পাগলা গারদে ছিল
    কিন্তু পাগলা গারদ বলে না, বলে এটা মানসিক হাসপাতাল ।
    ভাস্কর চক্রবর্তীর বাবাকে মনস্তত্ত্ববিদগণ বলেছে আপনার
    ছেলে আপনার চাইতে বেশি খ্যাতিমান
    এই কথা বলাবলি করছে অন্যান্য কবি ও কবিবন্ধুগণ
    ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেও একথা বলেছে ।
    এটা ভাস্কর চক্রবর্তীর মনোরোগ
    এই মনোরোগ আমরা সারিয়ে দিতে পারি
    কিভাবে সারাতে পারি ?
    ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই লিখবে যে আমার বাবা
    আমার চাইতে বেশী বিখ্যাত লোক
    আমাকে পশ্চিমবঙ্গে কেউ চিনল না বাবাকে চেনে
    এই কথা ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই লিখবে
    এই রকম মনোরোগীর চিকিৎসা আমরা বহু
    করেছি । সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক এদের
    আমরা চিকিৎসা করেছি ।

    হে জনসাধারণ এই যে ভাস্কর চক্রবর্তী
    ভাবে যে ভাস্কর চক্রবর্তী জনসাধারণের চাইতে
    উঁচু দরের বাঙালি একজন ।
    আমরা এই ভাস্কর চক্রবর্তীর মনোরোগ চিকিৎসা
    করতে পারি । চিকিৎসা করতে পারলে ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই
    বলবে যে আমি জনসাধারণের সমান মানে
    কেরানির সমান, স্কুল মাস্টারের সমান । চাষার
    সমান ।
    তোমরা শুধু অনুমতি দাও ভাস্কর চক্রবর্তীর
    চিকিৎসার জন্য তাহলে আমরা ভাস্কর চক্রবর্তীকে
    তোমাদের সমান অর্থাৎ কেরানি, চাষী, স্কুল মাস্টার
    রিকশাওয়ালার সমান । একথা ভাস্কর চক্রবর্তী
    নিজেই বলবে আমাদের এখানে চিকিৎসা করার
    পর ।

    বাঃ ভাস্কর চক্রবর্তীর বাবা অনুমতি দিয়েছেন
    জনসাধারণ অনুমতি দিয়েছেন । এইবার তাহলে
    হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করি ।
    এই রকমের পাগলাগারদে ডাক্তাররাও আছে
    যেমন রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস এম. বি. বি. এস. পাশ
    করা ডাক্তার সে আছে মেডিকাল কলেজের পাগলা
    গারদে । এইরকম ভাবে পুলিশও আছে পাগলা গারদে ।
    ( তার মানে মানসিক হাসপাতালে ) ।
    মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করা হচ্ছে
    পুলিশ অনন্ত দেবরায়কে অর্থাৎ এরা হচ্ছে বিশেষ
    বিশেষ উদাহরণ ।
    পুলিশ, এম.বি.বি.এস. পাশ করা ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ
    বিশ্বাস । এর পরে কবি বাদ দিলাম । অন্যান্য
    যারা পাগলা গারদে ছিল এবং আছে ডাক্তার রবীন্দ্র
    নাথ বিশ্বাস, পুলিশ অনন্ত দেবরায়

    কিন্তু এই রকমের দু’একজন ডাক্তার পুলিশ
    এদের সঙ্গে পাগলা গারদে আছে শত শত জনসাধারণ
    হাজার হাজার জনসাধারণ এবং

    ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস নিজেই বলল যে
    তার নিজের হয়েছে ক্রনিক শিজোফ্রেনিয়া
    এই অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস
    কে সারাজীবন ঔষধ খেতে হবে এবং আনুসঙ্গিক
    চিকিৎসা করাতে হবে ।

    এ তো হল একজন ডাক্তার, একজন কবি, একজন পুলিশ
    এদের ভাগ্য আর অন্যান্য যাদের এই ভাগ্য হয়েছে
    তারা হলেন হাজার হাজার জনসাধারণ ।

    ডি. জ্যাবলো হার্শম্যান এবং জুলিয়েন লিয়েব ( ১৯৯৮ ) তাঁদের ‘ম্যানিক ডিপ্রেশান অ্যাণ্ড ক্রিয়েটিভিটি’ গবেষণাপত্রে বলেছেন যে সৃজনশীল শিল্পীরা ম্যানিক ডিপ্রেশানকে নিজের জীবনে ও কাজে সদর্থক উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারেন । পল গঁগা যখন দেখলেন তিনি ফ্রান্সে বসে আঁকতে পারছেন না তখন ইউরোপের সমাজকে পরিত্যাগ করার জন্য তাহিতি দ্বীপে বসবাস করতে চলে গিয়েছিলেন । ম্যানিক ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউটন , বিটোফেন এবং চার্লস ডিকেন্সও । মনোভঙ্গের বাঁধন কেটে বেরোবার জন্য ডিকেন্স লিখেছিলেন ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ ।
    লুডউইগ এম অ্যারনল্ড ‘দি প্রাইস অফ গ্রেটনেস : রিজলভিং দি ক্রিয়েটিভিটি অ্যাণ্ড ম্যাডনেস কনট্রোভার্সি’ ( ১৯৯৫ ) গ্রন্হটি ১০০০ বিখ্যাত মানুষের জীবনকাহিনি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন। তিনি তর্ক দিয়েছেন যে যাঁদের চেতনার স্তর সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা, স্কিৎসিফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া, সংবেদনের অতিরেক, যৌন অক্ষমতা, যাঁরা নিঃসঙ্গতা পছন্দ করেন, তাঁদের মুক্তির পথ হলো সৃজনশীল শিল্প, তাঁদের ক্ষেত্রে তা নিরাময়ের কাজ করে । বিনয় মজুমদারকে কেউ কেউ বলেছেন পাগল ; কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে তিনি রুশভাষা শিখে ছয়টি বই অনুবাদ করলেন, একুশটি কাব্যগ্রন্হ লিখলেন, ছয়টি গদ্যের বই, গণিতের বই লিখলেন কেমন করে ? এখনও তাঁর বহু রচনা অগ্রন্হিত রয়েছে ।
    দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী, সম্প্রতি বিজেপির ছাত্র সঙ্গঠন যাঁকে আক্রমণ করে পাঁজরের হাড় ভেঙে দিয়েছে, তাঁর ‘দি অপুলেন্স অফ এক্সিসটেন্স : এসেজ অন ইসথেটিক্স অ্যাণ্ড পলিটিক্স’ ( জানুয়ারি ২০১৭ ) বক্তৃতামালায় বিনয় মজুমদার সম্পর্কে এই কথাই বলেছেন যে, “বিনয়ের কবিতা আলোচনাকালে চিরকাল তাঁর একাকীত্বপ্রিয়তা এবং নিউরটিক প্রলক্ষণকে তাঁর কবিতার মূল্যায়নের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে ; এর চেয়ে বেশি নাটুকে ও বিরক্তিকর ভাবপ্রবণতা আর হতে পারে না । বিনয়ের কবিতার বিশুদ্ধ প্রাণচাঞ্চল্য মূল্যায়নের পথে এটি পরিত্যাজ্য বাধা । বিনয় ছিলেন পরমোৎকর্ষ-সন্ধানী এবং সতর্ক কবিতাশিল্পী ।”
    প্রশান্ত চক্রবর্তী আরও বলেছেন, এবং এই প্রসঙ্গে ওপরে আলোচিত সংজ্ঞার অবলোকনের প্রসঙ্গ এসে পড়ে, কবিজীবনের শেষ পর্বে বিনয় মজুমদার কবিতাকে জার্নাল লেখার মতো করে তোলেন । তিনি নিজের চারিপাশের বস্তুগুলো এবং ঘটনাগুলোর দিকে গভীর ভাবে তাকাতেন এবং সেগুলি রেকর্ড করতেন । তার ফলে একদিকে আমরা যেমন একজন ঘটনাপঞ্জীর দ্রষ্টাকে পাই, তেমনিই আরেকদিকে পাই কলকাতার বাইরে চলতে থাকা সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো । পংক্তিগুলো জার্নাল রচনার অসাধারণ অভিব্যক্তি, তাতে কোনোরকম কৃত্রিম কবিত্ব করা হয়নি, তার চেয়েও বেশি কিছু উপস্হাপন করা হয়েছে যা বুনিয়াদি : স্রেফ বেঁচে থাকা । রেকর্ড করার অর্থ হল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বস্তুদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসন্ধান ।
    বিনয়ের লেখার প্রথম কালখণ্ড ছিল মূলত ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ । এই সময়টাতেই পঞ্চাশের কবিদের অনেকে সোনাগাছি-হাড়কাটা-খিদিরপুর যাওয়া আরম্ভ করেন, প্রধানত বুদ্ধদেব বসুর বদল্যার সম্পর্কিত বইটি প্রকাশিত হবার পর । বিনয় মজুমদার একা সোনাগাছি এলাকায় যেতেন বলে অনুমান করি, তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’ থেকে সেরকমই মনে হয় ; যৌনকর্মীর ঘরের যে বর্ণনা তাঁর কবিতায় পাই তা কেউ যৌনকর্মীর ঘরে না গেলে বলতে পারবেন না । অদ্রীশ বিশ্বাসের স্মৃতিচারণা থেকেও তেমনটাই আঁচ করা যায় । নিয়মিত গ্রাহক সোনাগাছিতে ‘বাবু’ অভিধা পান ; বিনয় হয়তো কিছুকালের জন্য রাধার ‘বাবু’ প্রেমিক ছিলেন । রাধা নামে এক যৌনকর্মী আর তার ছেলের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা বলে গেছেন বিনয়। অদ্রীশ বিশ্বাস জানিয়েছেন যে তিনি যৌনপল্লীতে গিয়ে রাধা আর কেলোর ফিল্ম তুলে এনেছিলেন । সেগুলো প্রকাশিত হলে পাঠকের অনুসন্ধিৎসা মেটে । ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো পড়লে বিশ্বাস করা যায় যে তিনি নিয়মিত নারীসঙ্গ করতেন কোনো এক সময়ে । হয়তো লেখালিখি তাঁকে এই সময়টায় ছেড়ে গিয়েছিল বলে তিনি রাধায় আশ্রয় নিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনের গল্পলেখক বাসুদেব দাশগুপ্ত যখন আর লিখতে পারছিলেন না তখন তিনি ‘বেবি’ নামে এক যৌনকর্মীর ‘বাবু’ হয়ে ওঠেন । হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরী জানিয়েছেন যে বাসুদেব দাশগুপ্ত সে-সময়ে ভায়াগ্রার সন্ধান করতেন ।
    “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” কাব্যগ্রন্হে ‘বিশাল দুপুরবেলা’ শিরোনামে একটি কবিতা আছে । যাঁরা দুপুরবেলায় সোনাগাছি নিয়মিত যান তাঁরা জানেন যে এই সময়টাতেই অনেকক্ষণের জন্য নিজের কাছে পাওয়া যায় প্রেমিকা-যৌনকর্মীকে । সময়টা বিশাল, দুজনে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার খদ্দের না আসা পর্যন্ত অঢেল সময় । যিনি ‘বাবু’ তিনিও নিজের জীবনের দুপুরবেলাতেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন, অমন সম্পর্কে, বাসুদেব দাশগুপ্তের মতন । বাসুদেব দাশগুপ্ত অমন দুপুরবেলা কাটিয়ে সন্ধ্যার সময়ে আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বাড়িতে এসে চিৎপটাঙ হয়ে শুয়ে পড়তেন, নেশা কেটে গেলে অশোকনগরে বাড়ি ফিরতেন ।
    আশি ও নব্বুই দশকে বিনয় মজুমদার অসুস্হ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে দেখাশোনা করতো কলকাতা শহরতলীর ঠাকুরনগরের শিমুলপুরের একটি পরিবার । অনেকে এই আশ্রয়কে তুলনা করেছেন মানসিক রোগাক্রান্ত পরিবার-পরিত্যক্ত কবি ফ্রেডরিক হ্বেলডার্লিনের সঙ্গে, যাঁকে অমনই একটি গরিব মুচি পরিবার আশ্রয় দিয়েছিল । কেমন ছিল বিনয় মজুমদারের সে সময়ের জীবন ? এই কয়েকটা লাইন পড়লে কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে, কেবল কার্বোহাইড্রেট খেয়ে দিনের পর দিন চালিয়েছেন বিনয় মজুমদার, জীবনানন্দের পর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি । সে সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেন্সে বসে খাচ্ছেন মুর্গির ললিপপ দিয়ে স্কচ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় খাচ্ছেন স্ত্রীর রান্না করা উপাদেয় স্বাস্হকর খাদ্য । বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা দেবার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিজের ক্যাম্পাসে আহ্বান করে নিয়ে গিয়েছিলেন, প্রধানত শক্তি-সুনীল ব্র্যাণ্ডটাকে ব্যবহার করার জন্য , বিনয়কে নিমন্ত্রণ জানাতে তাঁরা হয়তো ভয় পেয়েছিলেন । শিমুলপুরে পাকাপাকি থাকতে গিয়ে বিনয়ের দৈনিক জীবন কেমন কাটছিল তা উনি বিয়াল্লিশ মাত্রার মহাপয়ারে লিখে রেখে গেছেন :

    এইমাত্র পান্তাভাত
    এইমাত্র পান্তাভাত খেলাম অর্থাৎ আমি হাত ধুতে গেছলাম
    অবশ্য খাবার পরে এঁটোথালা ধুই আমি নিজে
    ভোরে ধুই দুপুরেও ধুই শুধু রাত্রিবেলা ধুই সে এঁটো থালা
    ভোরবেলা রাত্তিরের এঁটোথালা হাতে নিয়ে যাই
    বুচির বাড়ির কাছে, এঁটো থালা দিয়ে আসি তার হাতে, বুচি নিজে
    ধুয়ে দেয় রাত্তিরের এঁটো থালাখানি ।
    সেই ধোয়া থালাটিতে বুচি নিজে খাদ্য দেয় আমার ভোরের খাদ্য
    গতকাল দিয়েছিল বেগুনসিদ্ধ ও ভাত আর
    আজ দিল তো পান্তাভাত ; ভোরে বেশিদিন দ্যায় আলুসিদ্ধ আর ভাত
    মনে হয় আগামীকাল দেবে আলুসিদ্ধ ভাত।
    আজ আমি এঁটো থালা কলঘরে ধুয়ে এনে রেখেছি তো টেবিলের
    উপরেই, এই ধোয়া থালাটিতে ভাত দেবে বুচি ।
    ( ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ কাব্যগ্রন্হ — ২০০৬ )
    অসুস্হতার পরে তাঁর কবিতা রচনার আরেকটি পর্ব শুরু হয়, প্রধানত লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের চাহিদা মেটাতে, যে কবিতাগুলিতে বিনয় তাঁর সামনেকার বস্তুজগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং বস্তুগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে চলেছেন ।
    ‘মনে থাকা’ শিরোনামে একটি কবিতায় বিনয় জানিয়েছেন যে, যে-কবিতার মানে বোঝা যায় না তাও ওনার মনে থাকে । তাঁর স্মৃতিশক্তি শেষ বয়সেও ছিল প্রখর । বিনয়ের মনে থাকলেও দুর্বোধ্য কবিতা আমার মনে থাকে না । বিনয় তিনটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন :

    অমিয় চক্রবর্তী :
    “খড়মাঠ কথা কয়, অজানা খোটানি
    ঘনমেঘ চলে ছায়াটানি
    নয় নীল শূন্য ত্রিশূল
    টুকরো পাহাড়”

    বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় :
    “সাদা বা কালো ক্ষণপাথর
    এ কোন আলো হৃদয়ে বা
    অথবা নীচে নীল সাগর
    পাহাড়ে নাচে হৃদয়ে বা
    বুড়োর এ মন কবরে যায়
    যখের ধন গভীরে চায়
    হৃদয়ে তবু প্রেম নাচায়
    পাহাড়ে বা হৃদয়ে”

    মৃদুল দাশগুপ্ত
    “কয়েক মুহূর্তকাল থামো —
    আমি তাকে বলি
    থেমে অশ্ম মন্ত্র ও মেশিন”

    চোদ্দ

    ‘গ্রন্হি’ পত্রিকার জন্য চন্দন ভট্টাচার্যকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ( মে, ২০০৫ ) বিনয় মজুমদার কবিতা-বিশেষের মনে রাখা নিয়ে ছন্দ ও অন্ত্যমিলকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন :
    চন্দন : আপনি কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ছন্দ ও অন্ত্যমিলে লিখলে সে কবিতা পাঠকের মনে থেকে যায়। কাজেই পাঠকের স্মৃতিতে কবিতাকে সুমুদ্রিত করার এটাই সেরা পদ্ধতি । এখনও কি তাই মনে করেন কবি ? তবে কি গদ্যে লেখা কবিতাগুলি মানুষ বিস্মৃত হবে কালে কালে ?
    বিনয় : আজও তাই মনে হয় ।
    চন্দন : কিন্তু ধরুন, লাতিন আমেরিকার বা ইউরোপেও তো শুধু গদ্য কবিতার ছড়াছড়ি । মিটার নামক শব্দটা ওরা হয়তো ভুলেই গেছে । শুধু কিছু গানের কথা ছাড়া —
    বিনয় : গানও আজ কবিতা হয়ে গেছে । আমিও তো গদ্য কবিতা লিখেছি, প্রথম কবিতাটির নাম ছিল “আমার প্রথম গদ্যকবিতা”, বেরিয়েছিল ‘রোপণ’ পত্রিকায় । আমার ধারণা লোকে গদ্য কবিতা পংক্তির পর পংক্তি এভাবে মনে রাখে না । মনে রাখে শুধু কবিতাটির বিষয়বস্তুকে ।
    চন্দন ভট্টাচার্য প্রশ্ন করতে পারতেন যে তাঁর ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো কি তাহলে বিষয়বস্তুকে মনে রাখার জন্য ।
    বিনয় মজুমদারের কিন্তু প্রতিটি কবিতাই বোঝা যায় । ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইয়ের কবিতাগুলো তো বটেই, স্কিৎসোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করে ফিরে এসে লেখা যে কবিতাগুলোর জন্য তিনি অনেকের দ্বারা আজকাল নিন্দিত হন, সেই কবিতাগুলোও । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইতে ছয়টি দীর্ঘ কবিতা আছে । বিনয় মজুমদার বলেছেন যে কবিতাগুলি যদিও নারীভূমিকাবর্জিত, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যাকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন কবিতাগুলো আদিরসাত্মক । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে বিনয় মজুমদার ‘অতিচেতনা’ ও ‘অতিসত্য’. নামে দুটি ভাবকল্পের সূত্রপাত ঘটালেন ।
    ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে বিনয় লিখেছিলেন

    আমার সচেতনতা যেন অতিচেতনার সমপরিমাণ হয়ে যায়
    উভয় চেতনা যেন সমান কুশলী হয় সমান সক্ষম হয়ে যায়
    দুই চেতনার মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্হাটি যেন খুব স্বচ্ছলতা পায়

    বিনয় সচেতনতা ও অতিচেতনায় পার্থক্য করেছেন । সচেতনা কবির প্রতিস্বের, যিনি কবিতাটি অথবা গল্প-উপন্যাস লিখছেন, তাঁর। কিন্তু অতিচেতনা ও অতিসত্য পাঠবস্তুতে লুকিয়ে থাকে । কিছুকাল পরে পড়লে কবি অথবা পাঠক টের পান যে তাঁর সচেতনতায় ছিল না এমন জিনিসও রয়েছে পাঠবস্তুতে ; আবার বহুকাল পরে পড়লে আরও নতুন উদ্ভাস পাবেন তিনি, যা প্রথমবার বা দ্বিতীয়বার পড়ে পাননি । অর্থাৎ পাঠবস্তুটি নিজের উপরিতলের নীচে অতিচেতনার ও অতিসত্যের বহুবিধ স্তর সঙ্গোপনে রেখে দেয় । বিনয়ের অতিচেতনা ও অতিসত্য তাঁর ব্যক্তিপ্রতিস্বের নয়, তা পাঠবস্তুটির ।
    ১৯৮৭ সালে ‘পুনর্বসু’ পত্রিকার জন্য রণজিৎ দাশের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিনয়ের অতিচেতনা ও অতিসত্য বিষয়ে এরকম প্রশ্নোত্তর হয়েছিল :
    প্রশ্ন : কথা হচ্ছে যে, আমি একটা কথা মনে করি, সেটা হচ্ছে যে আমি মনে করি, আমার সঙ্গে তখন একমত হয়েছিলেন আপনি — যে কোনও অভিজ্ঞতাই একজন কবির লেখার বিষয় নয় ! মানে যে কোনও অভিজ্ঞতা, হঠাৎ একটা অভিজ্ঞতা হল, এটাই আমার লেখার বিষয় হয়ে উঠতে পারে না । মানে যতক্ষণ না সেই অভিজ্ঞতাটা আমার মধ্যে জারিত হচ্ছে । জারিত হতে হতে এমন একটা পয়েন্টে এসে পৌঁছোল, যখন সেটা, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা বা একটা সাধারণ উপলব্ধির স্তরে থাকে না — মানে সেটা একটা, কী বলব, অভিজ্ঞা বা আদ্যাজ্ঞানের অবস্হায় চলে যায় । তখনই একটা, সেই অবস্হা থেকে যখন একটি লোক লেখে, তখন সেটাই চূড়ান্ত কবিতা হয়ে উঠতে পারে, সম্ভাবনা থাকে । তো আপনি কি এটা মনে করেন ? কেননা আপনার কবিতা পড়ে তো — তাই মনে হয়েছে, কেননা চার বছর অতিক্রম করবার পরে–
    বিনয় : কবিতায় অবচেতন মন বলে একটা জিনিস আছে, শুনেছ ? সেটা কিছু-কিছু লোকের কবিতায় খুব থাকে । তুমি নিজের কবিতা রেখে দাও, ছাপা কবিতা…চার…পাঁচ, আস্তে আস্তে তোমার নিজের কবিতার মানেই তোমার কাছে কিন্তু ধীরে-ধীরে উন্মোচিত হতে থাকবে, মনে হবে যেন, এই মানেটাও, রয়ে গেছে কবিতার মধ্যে, খেয়াল, খেয়াল না করে লিখে ফেলেছ, বুঝতে পারলে, এই যে জিনিসটা এটাকে তোমার অবচেতনাই বল, অতিচেতনা, আমি ‘অতিচেতনা’ বলে একটা শব্দ সৃষ্টি করেছি, আলট্রা ভায়োলেট রে ।
    প্রশ্ন : এটা অনেক ভালো শব্দ, অনেক ভালো শব্দ ।
    বিনয় : অতিচেতনা ।
    প্রশ্ন : খুব ভালো, কাজে লাগবে ।
    বিনয় : আমি প্রথম ব্যবহার করেছি, ‘অতিচেতনা’ শব্দটা আগে ছিল না ।
    প্রশ্ন : আপনি তো ‘অতিসত্য’ বলেও একটা সাংঘাতিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, এক জায়গায় আছে —অতিসত্য ।
    বিনয় : আচ্ছা, কনসাস মাইণ্ড, অ্যাঁ ?
    প্রশ্ন : অতিসত্য । অতিসত্য, আপনার লেখায় এক জায়গায় আছে । –’শুধু সত্য আমি’, ‘বাকিসব অতিসত্য, শুধু সত্য আমি’।
    বিনয় : অতিসত্যটা তখন….
    প্রশ্ন : আপনি ‘অতিসত্য’ ব্যবহার করেছেন । মানে, সমাসবদ্ধভাবে । তাহলে ‘আমার’ সঙ্গে চারিদিকের তফাত একটা আছে ?
    বিনয় : অ্যাঁ ?
    প্রশ্ন : আমার সঙ্গে ।
    বিনয় : তুমি যা লিখে রেখেছ, রেখে দাও, ছাপা হোক, বই হোক, দশ, পনেরো, কুড়ি বছর পরে নিজেই টের পাবে ভিতরে-ভিতরে একটা গভীরতম অনুভূতিও রয়ে গেছে, নিজেও ভালো করে লক্ষ্য করতে পারোনি লেখার সময় ! বুঝতে পারছ ! লেখার সময়ে তুমি নিজেও ভালো করে লক্ষ্য করনি, তোমার অজ্ঞাত, তোমার নিজেরই অজ্ঞাতসারে এমন কিছু হয়ে গেছে । তাকে আমি নাম দিলুম অতিসত্য, সেটা একদম অতিচেতন মন । সাবকনসাস, কনসাস, এদুটো ছিল, আলট্রাকনসাস বলে, আলট্রা কনসাস, আলট্রাকনসাস, নাম দিলুম ‘অতিচেতনা’ ।
    প্রশ্ন : আচ্ছা এটা কি সব লেখা সম্পর্কেই মনে হয়, না কিছু-কিছু লেখা সম্পর্কে মনে হয় ?
    বিনয় : তুমি নিজে মনে-মনে ভাব ।
    বিনয় মজুমদারের দেয়া সাক্ষাৎকারগুলো অন্যান্য কবিদের সাক্ষাৎকারের থেকে একেবারে আলাদা। বিনয় সাক্ষাৎকারের মাঝেই নিজের কবিতা, জীবনানন্দের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আচমকা আবৃত্তি করে সাক্ষাৎকার যাঁরা নিচ্ছেন আর নিজের মাঝে একটি অভিকরসম্পর্ক গড়ে তোলেন, দূরত্বকে মুছে ফেলেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর নিজের দেয়া সাক্ষাৎকার সম্পর্কে একবার বলেছিলেন যে তা হল Gesture towards a history of vanishing present এবং the interview is an enabling violation that allows the interviwee subject to produce a narrative of the self through a responsive encounter with the OTHER, as well as produce an ethics of accountable transformation. The interviewee not only articulates strategic essentialism but performs it. এই বক্তব্য বিনয় মজুমদারের দেয়া সাক্ষাৎকারগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোয্য। অন্যান্য লোকেদের যদি জিগ্যেস করা হয় ,কেমন আছেন, তাঁরা উত্তর দ্যান ‘চলছে’ । বিনয় কিন্তু জানান যে তিনি আনন্দে আছেন ।
    সত্তর দশকের কবি বারীন ঘোষাল ‘অতিচেতনা’ নামে একটি কাব্যিক ভাবকল্পের কথা বলেছেন যা বিনয় মজুমদারের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । বারীন ঘোষাল ব্যক্তিএককটির প্রতিস্বের অতিচেতনার কথা বলেছেন, সে কারণে বারীনবাবুর ‘অতিচেতনা’ কবিতার ভাবকল্পে সমর্পিত কবিদের আঙ্গিকে প্রতিফলিত হয়, এমনটাই তাঁরা মনে করেন, এবং সেই আঙ্গিকের প্রতি নজর দিলে স্তেফান মালার্মের বিখ্যাত কবিতা “এ রোল অফ দি ডাইস উইল নেভার অ্যাবলিশ চান্স’-এর প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে । মালার্মে বলেছিলেন বস্তুজগতের সত্য স্বপ্রকাশিত হয় কবির অতিচেতনার ( সুপারকনসাশনেস ) দ্বারা । দি নিউ ইয়র্কার পত্রিকা এপ্রিল ২০১৬ সংখ্যায় বলেছে যে স্তেফান মালার্মে হলেন ‘প্রফেট অফ মডার্নিজম’ । বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ কিন্তু বলেছেন যে অতিচেতনা ( সুপার-কনসাশনেস ) সম্ভব হয় মাদক সেবনের মাধ্যমে এবং সেই অবস্হায় সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য যে বিনয় মজুমদারের অতিচেতনা থেকে এনাদের অতিচেতনা সম্পর্ণ আলাদা ।
    ‘নিশিকড়’ প্রবন্ধে বারীন ঘোষাল লিখেছেন, “চেতনা শব্দটা একটু গোলমেলে । অনেকে একে বিবেক, চৈতন্য ইত্যাদির সাথে গুলিয়ে ফেলেন । মানুষের মনে যখন একটা বদ্ধমূল ধারণা হয় যা অন্ধ সেটাকেই তার চেতনা মনে করে । একই বিষয়ে অনেক চেতনা, আবার অনেকানেক বিষয়ে বহুবিধ চেতনা তার হতে পারে। অনেক সময়েই চেতনাগুলোর মধ্যে সংঘাত হয় তাদের আপাতবিশৃঙ্খলার জন্য, কার্য ও কারণের মধ্যে সম্পর্কহীনতার জন্য, মিথ্যা বিশ্বাসের জন্য, এবং ভাষা ও শব্দের প্রতীকভাষ্যের জন্য । চেতনাগুলির মধ্যে যদি শৃঙ্খলা সম্ভব হয় তবে তার মানসিকতাও সমৃদ্ধ হয় । আবার দেখুন, মানুষের শরীরে বস্তুগত শূন্যতা ৭০%, যা তার প্রতিটি পরমাণুর কোয়ার্কের সমষ্টিগত অন্ধকার । এই অন্ধকারও সচল, তার ডাইমেনশান আছে, আলোয় আসতে চায় । এটা তার প্রগতির লক্ষণ, প্রকৃতির শিক্ষা । চেতনাদলের অপার বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানুষের পরিবেশ-সঞ্জাত যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্যাটার্নটি সম্ভাবিত হয় তা-ই তার অতিচেতনা ।” প্রশ্ন হলো বারীনবাবুর ‘নতুন কবিতা’ আন্দোলনের সকলেরই ব্যক্তি-প্রতিস্বে যা ঘটে তা কি অন্য মানুষদের থেকে আলাদা ?
    অতিচেতনা সম্পর্কে ‘অষ্টাবক্র গীতা’য় বলা হয়েছে যে, “তুমি তখন পৃথিবী নও, জল নও, আগুন নও, বায়ু নও, আকাশ নও তখন স্বাধীনতাবোধের জন্য নিজের আত্মনকে অতিচেতন বলে মনে করো এবং ওই স্হিতিতে সাক্ষী থাকো পঞ্চভুতের ।”
    একটি থেকে আরেকটি সাব-জনারে বিনয় স্বচ্ছন্দে চলে গেছেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলো এবং তার পরে লেখা কবিতাগুলো আঙ্গিক ছন্দ ও ভৌতজগতের নৈসর্গিক বিস্তার ‘ফিরে এসো, চাকা’ থেকে সম্পূর্ণ সরে গেল । প্রশ্ন ওঠে, তা কি এইজন্য যে আলোচকরা তাঁর কবিতাকে বার বার জীবনানন্দের সঙ্গে তুলনা করছিলেন । বিনয় বলেছেন জীবনানন্দের কবিতা অত্যন্ত জটিল, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু চেষ্টা করেছিলেন জীবনানন্দের ঢঙে লিখতে । কিন্তু তিনি নিজে যে প্রভাবিত নন, এবং মৌলিকতা যাতে কবিতা রচনা করার সময়ে আসে শেষ পর্বের এই কবিতাটিতে বয়ান করে গেছেন :

    কলমটি পড়ে আছে টেবিলের কোণে
    হাত দিয়ে কলমটি ধরি…
    এইভাবে আমি কবিতা রচনা করি
    যাতে মৌলিকতা কবিতায় আসে
    কারো কাব্য অনুসরণের চেষ্টা তো করিনি আমি
    যা-যা ঘটে যা-যা করি তাই লিখি মাঝে -মাঝে ।

    পনেরো

    মাদুলি পত্রিকার বিনয় মজুমদার সংখ্যায় ( ২০১০ ) শিমুল সালাহউদ্দিন “‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ আবিষ্কার” প্রসঙ্গে লিখেছেন যে ঢাকার এক সাহিত্য আসরে একজন আবৃত্তিকার এই কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন, এবং খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন কবির নাম বিনয় মজুমদার :-

    বিড়িতো ফুরালো প্রায় । দুটি বিড়ি আছে
    শালপাতা দিয়ে এই বিড়ি বানায় । এপর্যন্ত লিখে
    মনে এলো রেললাইনের পাশে লম্বা এক শালবন
    বানিয়েছে । শালপাতাগুলির সেই শাদা শাদা ফুল ।
    গন্ধ আছে নাকি এই শালফুলে, ঘ্রাণ যদি না থাকে
    এই শালফুলে তবে শালফুল অঘ্রাণ
    এবং এই শালফুলের মানে শালফুলের মনের অনুভূতি
    ধরা আছে আমাদের পৃথিবীর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালায়”

    শিমুল সালাহউদ্দিন লিখেছেন, “পড়িতে বসিলাম ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ । জীবন্ত সব ডালপালা সমেত যেন অন্ধকারে একটি মৃত গাছ আমার জানালায় নড়িয়া উঠিল । মৃত গাছ তথাপি প্রসারণশিল তার ডালপালা । জীবন্ত । নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে কথা কই্ছে যেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র সেই ঘোর বাধ্য করিল বিনয়ে আসক্ত হইতে, বিনয়কে ভয় পাইতে, বিনয় নিয়া পড়াশুনা চিন্তা করিতে । দেখিলাম বিনয় পণ্ডিতরা বিবৃতি করেছেন বিনয় মানসিক অসুস্হতার কারণে কলকাতা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রহিয়াছিলেন । দীর্ঘ সময় । কিন্তু সেই সময়ে লিখিত এক পংক্তির দুইশত একটি কবিতার ভিতর দিয়া খেয়া-নাও পাড়ি দিতে দিতে এ অধমের কখনও মনে হয় নাই সেই মেদুর কবিতাপংক্তিসমূহের কোনো একটাও পাগলপ্রলাপ । বিনয়ের এ কবিতাগুলো যেন ভিন্নতর দর্শনের আয়না, জন্মশেকড় হইয়া দেখা দিলো আমার কাছে । কল্পনা, তাঁহার পরিচিত দৃশ্যকল্প জগতে কল্পনার স্হান বিনয়ের এ কবিতাগুলোতে নাই । যেন বা জীবনের প্রতি অনাসক্ত এক দ্রষ্টা বিপরীত আয়নায় দেখিতেছেন জগতকে । কবিতার সবকটি লাইন জুড়িয়াই রহিয়াছে অনন্য সব বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং অনুধাবন । কেবল কবিতা কেন, বিনয় গদ্য সাহিত্যও সাজান পরতে-পরতে, তাকে তাকে, থাকে থাকে, গণিত প্রভাবিত দার্শনিকতায় । প্রতিভা ও মেধার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানি না আমি । কোনো লেখক বা কবিকে আমাদিগের জগতে চরিয়া খাওয়া তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানরা যে সকল অভিধায় ভূষিত করিয়া থাকেন, তা-ও করা যায় কিনা এ-লইয়া রহিয়াছে পক্ষে-বিপক্ষে প্রভূত বিতর্ক । তবে বিনয়ের কবিতা, তামাকে ডুবিয়া গিয়া যেমন, তেমনি বিনয়ের শত্রু ধরিয়া নিয়াও নিঃসন্দেহে বলা যায়, কোনো গণিতে, কোনো ভূগোলেই কোনো কবি-লেখক-সৃষ্টিশীল সত্ত্বাকে আটক করিয়া রাখা যায় না । দৃশ্যত এমনই এক অতিবাস্তব-অধিবাস্তব অনুধাবনের মাঝখানে নির্লিপ্ত দাঁড়াইয়া সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন একের পর এক । হইয়া উঠিয়াছেন রাজা । ঘোর আর প্রবণতার । আর শব্দ, ব্যঞ্জনা, উপমায় উপমিত করিয়াছেন কবিতার ঘরগেরস্হালি, শিথান-পৈঠা-উঠান । নিজস্ব ডায়েরির মতো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আঙ্গিকের কাব্যে হইয়া উঠিয়াছেন দৃশ্য আর বলিবার মতোন নিরাসক্ত, নির্মেদ, সাবলীল, বহমান, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ষোলোঘুটির ঘরের প্রবাদপুরুষ।”
    ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কবিতাটির তৃতীয় পর্ব কিছুটা পড়ে দেখা যাক, যে পর্বটি এক সম্পাদক ছাপবেন বলে নিয়ে অশ্লীলতার ভয়ে ছাপতে চাননি, কেননা তখনও হাংরি মামলা হাইকোর্টে চলছে আর বিনয় মজুমদার বছর দুয়েকের জন্য হাংরি আন্দোলনে ছিলেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ রচনার পরে ‘বাল্মীকির কবিতা’কে স্বাভাবিক ও অনায়াস অগ্রগতি বলে চিহ্ণিত করা যায়, যে পথে হাঁটার সাহস আর কোনো কবি এতাবৎ দেখাতে পারেননি ।
    বহু পরে, জ্যোতির্ময় দত্ত ওনার ‘কলকাতা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন তৃতীয় পর্বটি :-

    সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে, ফোটে শীতাতুর রাতে
    যদিও বছর ভর, আষাঢ়ে-আশ্বিনে, চৈত্রে বকুলের নাম শোনা যায়,
    শুনি বকুলের খ্যাতি, বকুলের প্রিয়তার সকল কাহিনী
    তবু খুব অন্তরঙ্গ মহলেই শুধুমাত্র আলোচিত হয়
    তার ঢাকাঢাকি করে এ-সব নরম আর গোপন বিষয় ;
    অচেনা মহলে প্রায় কখনোই বকুলের নাম বা কাহিনী
    তোলে না, শরমবোধে চেপে যায় যেন কেউ বকুল দ্যাখেনি ;
    তবে — তবু আমি জানি সকলেই এ-সকল মনে মনে ভাবে
    বড়ো বেশি করে মনে মনে ভেবে থাকে সারাটা জীবন
    ভেবে বেশ ভালো লাগে বকুল ফুলের রূপ এবং সুরভি ।
    আমাদের সব চিন্তা অদৃশ্য বাস্তব হয়ে পাশে চারিধারে
    রূপায়িত হতে থাকে, হয়ে যায়, অবয়বসহ হয়ে যায়,
    চলচ্চিত্রাকারে হয়, চিন্তাগুলি অবিকল এমন বাস্তব
    বলেই হয়তো এতো ভালো লাগে বকুলের বিষয়ে ভাবনা ।
    বকুলের আকারের বিষয়ে ভাবনা তবু বেশি ভালো লাগে
    ঘ্রাণ ও রঙের চেয়ে অন্যান্য গুণের চেয়ে ফুলের আকার
    চিরকাল সকলেরই অনেক অনেক বেশি ভালো লেগে থাকে–
    মাঝখানে বড়ো এক ছিদ্রপথ, ছিদ্রপথ ঘিরে
    অনেক পাপড়ি আছে, এলোমেলো সরু সরু পাপড়ি ছড়ানো ;
    এই চেহারাটি আমি স্বভাবত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি
    এ-সকল পাপড়িকে অতিশয় সাবধানে নাড়াচাড়া করি,
    এখন এই তো এই বকুলবাগানে একা অঘ্রাণের রাতে
    নাড়াচাড়া করে দেখি, অতি সাবধানে টানি, ধীরে-ধীরে টানি
    যাতে এ-সকল দল ছিঁড়ে বা উঠে না যায় ; কী রকম লাগে,
    মনে হয়, মনে পড়ে এতো বড়ো বাগানের শরীরের থেকে
    শুধুমাত্র ভালো-ভালো, মূল্যবান জিনিসকে বেছে-বেছে নিয়ে
    যে-রকম চর্চা হয়, সৌন্দর্যচর্চার রীতি চিরকাল আছে
    তার বিপরীতভাবে গদ্যময়তার থেকে বাদ দিয়ে দিয়ে
    সারহীন অঙ্গগুলি সরিয়ে-সরিয়ে রেখে ডালপালা পাতা
    একে-একে বাদ দিতে-দিতে শেষে যখন এমন
    আর বাদ দিতে গেলে মূল কথা বাদ যায় যার তখন থেকেই
    দেখা যায় জোছনায় ফুল ফুটে আছে, এই বকুল ফুটেছে,
    দেখা যায় একা-একা অঘ্রাণের জোছনায় আমি ও বকুল,
    বকুলের ফাঁকটির চারধারে সরু-সরু পাপড়ি ছড়ানো
    অতি সোজা সাদা কথা যেন অবশিষ্টরূপে পড়ে আছে তবু–
    তবু এ তো ডাল নয়, তবু এ তো পাতা নয়, এ হলো বকুল ।

    ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র ছয়টি কবিতাই বেশ দীর্ঘ, এবং একই কথা শুনতে শুনতে পাঠক আগ্রহ যাতে হারিয়ে না ফেলেন, এবং পাঠকের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, তাই বিনয় মজুমদার ‘এলিমিনেশান পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে মাঝে-মাঝে কবিতার মাঝখানে বাঁকবদল ঘটিয়ে দিয়েছেন । এই এলিমিনেশন পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর একটি প্রবন্ধ আছে যা আমরা পরে আলোচনা করব । যেমন ওপরের ওই লাইনটির পরে একটি ভাঙন তৈরি করে তিনি আরম্ভ করছেন এইভাবে :

    শতকরা একেবারে একশতভাগ খাঁটি দর্শনের নাম
    সংজ্ঞা অনুসারে ধর্ম, মনে হয় চারপাশে মহাকাশময়
    অনাদি সময় থেকে, গণিতেরই মতো বহু কবিতা রয়েছে
    চুপচাপ পড়ে আছে কোনোদিন একে-একে আবিষ্কৃত হয়
    কোনো অঘ্রাণের রাতে বকুলবাগানে খুব মৃদু জোছনায়
    সুডৌল পাতার ফাঁকে গহ্বরের মতো কিংবা ছিদ্রের মতোন ।

    এর পরে বাঁকবদল করে কবিতাটিকে অন্যদিকে চালিত করলেন বিনয়, বা বলা যায়, যারা এতক্ষণ আঁচ করতে পাচ্ছিলেন না বকুলফুল প্রকৃতপক্ষে ঠিক কোন জিনিশ, তাঁদের নিয়ে গেলেন পথ দেখিয়ে :

    ছবি আঁকবার কালে কোনো যুবতীর ছবি আঁকার সময়ে
    তার সব প্রত্যঙ্গকে হাজির রাখাই হলো বেশি দরকারি–
    সবচেয়ে দরকারি, কোনো অঙ্গ কোনোক্রমে বাদ চলে গেলে
    অন্যান্য অঙ্গগুলি যতো ভালো আঁকিই না কেন এই ছবি দেখে
    ভয় করে, সকলেরই অতিশয় ভয়াবহ বলে মনে হয় ।
    তাই সব প্রত্যঙ্গকে হাজির রাখাই হলো বেশি দরকারি–
    দরকারি বকুলের কুঁড়িগুলি শাদা-শাদা গোল-গোল কুঁড়ি–
    এই কথা বকুলের কাছে আমি চোখ বুজে বলে ফেললাম,
    বলি, ও বকুল, তুমি বোঝো না কি কুঁড়িগুলি খুব বেশি ছোট,
    আরো ঢের বড়ো-বড়ো নরম-নরম হবার কথা না ?
    এ-সকল কুঁড়ি নেড়ে টিপে-টিপে সুখ পেয়ে — পাবার পরে না ?
    শুনে ফুল হেসে ফ্যালে, মৃদু-মৃদু হেসে ফ্যালে, কথা সে বলে না ।
    হেসে ফেললেই এই ঠোঁট দুটি এতো বেশি ফাঁক হয়ে যায়
    গোলটুকু এতো বেশি ফাঁক হয়ে যায় কেন বকুল-বকুল,
    হাসিকান্না যাই হোক গোল ঠিক এক মাপে থাকার কথা না —
    এই কথা আমি বলি, একটু বিস্মিত হয়ে বলে ফেলি আমি ।

    এলিমিনেশান পদ্ধতি প্রয়োগ সম্পর্কে বিনয় মজুমদার আলোচনা করেছেন তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে । তিনি লিখেছেন, “যে-কোনো রচনা সম্পূর্ণ বিবরণ-সংবলিত হওয়ার কথা । কিন্তু তা থেকে কোনো অংশ ( স্তবক ইত্যাদি ) কিংবা বাক্য সুপরিকল্পিতভাবে বাদ দিলে, এই বাদ দেওয়ার ব্যাপারটিকে বলি ‘এলিমিনেশান’, যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘পুজারিনি’ কবিতাটির শেষ স্তবক এবং ঠিক তার আগের স্তবক — এই দুইয়ের মাঝখানে ঘটনার বিবরণ মহাকবি স্বেচ্ছায় সুপরিকল্পিত ভাবে বাদ দিয়েছেন :-

    এমন সময়ে হেরিলা চমকি প্রাসাদে প্রহরী যত
    রাজার বিজন কানন-মাঝারে
    স্তূপপদমূলে গহন আঁধারে
    জ্বলিতেছে কেন যেন সারে সারে প্রদীপমালার মতো ।
    মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক তখনি ছুটিয়া আসি
    শুধালো, “কে তুই ওরে দুর্মতি,
    মরিবার তরে করিস আরতি।”
    মধুর কন্ঠে শুনিল, শ্রীমতী, আমি বুদ্ধের দাসী”

    সেদিন শুভ্র পাষাণফলকে পড়িল রক্তলিখা ।
    সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে
    প্রাসাদকাননে নীরবে নিভৃতে
    স্তূপপদমূলে নিভিল চকিতে শেষ আরতির শিখা ।।’

    শেষ স্তবকের ঠিক আগের স্তবকে কবি লিখেছেন যে প্রাসাদের প্রহরীরা দেখতে পেলো রাজার বিজন কাননে স্তূপপদমূলে প্রদীপমালা জ্বলছে । তার পরেই শেষ স্তবক — শেষ স্তবকে শুধু লিখেছেন যে সেদিন শুভ্র পাষাণফলক রক্তচিহ্ণিত হল এবং শেষ আরতির শিখা চকিতে নিভে গেল । এতে রচনা অধিকতর হৃদয়গ্রাহী হয়েছে, বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে । অনুরূপভাবে কোনো রচনার কোনো বাক্য বা বাক্যাংশ বাদ দেওয়ার উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করছি বর্তমান প্রবন্ধের রচয়িওতারই একটি কবিতা । ‘আমার ঈশ্বরীকে’ গ্রন্হের তৃতীয় সংস্করণে ছিল, ‘যে গেছে সে চলে গেছে, দেশলাইয়ের বিস্ফোরণ হয়ে/বারুদ ফুরায় যেন, অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/আপন অন্তরলোকে’, ইত্যাদি । পরে ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’র সংস্করণে পরিমার্জনার পর লিখি : ‘যে গেছে সে চলে গেছে, অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/আপন অন্তরলোকে’ ইত্যাদি । এতে কবিতাটি অধিকতর হৃদয়গ্রাহী হয়েছে বলে আমার ধারণা । চিত্রশিল্পীদেরও এই ধরণের এলিমিনেশান ব্যবহার করা ভিন্ন গত্যন্তর নেই । পিকাসোর চিত্রে ( একটি উদাহরণ ‘মা ও ছেলে’ ), মাতিসের চিত্রে ( একটি উদাহরণ সেই দীর্ঘ গ্রীবা বিশিষ্ট তরুণী মহিলা ), দেখা যায় বিশদরূপে আঁকতে গেলে যত রেখা ব্যবহার করতে হয়, তত রেখা তাঁরা ব্যবহার করেননি, বহু রেখাই বাদ দিয়ে দিয়েছেন । দিয়েছেন সংক্ষেপে কাজ সারার জন্য, শ্রীমণ্ডিত করার জন্য । এলিমিনেশানের ফল রহস্যময়তা ও দুর্বোধ্যতা । জীবনানন্দের নিজেরই রচনায় এলিমিনেশানের একটি সুন্দর উদাহরণ মনে পড়ল : ‘বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।/ও প্রাসাদে কারা থাকে ? কেউ নেই — সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে/নড়িতেছে-জ্বলিতেছে -মায়াবীর মতো যাদুবলে’ ইত্যাদি । এখানে এই আগুন কি কোনো আলেয়ার, নাকি ওই প্রাসাদ থেকে আসা আলোর প্রতিফলন, না কি অন্য কোনো স্হান থেকে আসা আলোর প্রতিফলনও হতে পারে । কবি সে কথাটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন, যেন বিষয়টি অত্যন্ত গোপন কথা । ফলে কবিতাটির এস্হানটি রহস্যময় হয়ে উঠেছে, পাঠক উপরিউক্ত সম্ভাবনাগুলির কোনটি হতে পারে ভাবতে শুরু করেন ; পথ চলতে-চলতে রহস্যের ঘ্রাণ পেয়ে থেমে পড়ার মতো, থেমে পড়ে চতুস্পার্শ্ব একটু খতিয়ে দেখার মতো । এর ফলে সেই খতিয়ে দেখা স্হানটি পথিকের মনে গেঁথে যায়, গেঁথে যায় অনুরূপভাবে কবিতাটির পংক্তিগুলিও । ফলে দেখা যাচ্ছে এলিমিনেশান কবিদের মস্ত সহায়, প্রায়শই ভরসা । এলিমিনেশানের ফলে রহস্যময়তা বাড়ে, দুর্বোধ্যতা বাড়ে– মাঝে-মাঝে কবিতার অর্থ ‘কোনোদিন বোঝা যাবে না’ অবস্হায়ও এসে দাঁড়ায় । কিন্তু কবির চরম উদ্দেশ্য পাঠককে ভালো লাগানো, বোঝানো নয়।”
    বিনয় মজুমদার ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে লিখেছেন যে জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় সৌন্দর্যতত্বের কয়েকটি ব্যাপার অনুপস্হিত ; প্রবন্ধটি ১৯৬৬ সালে লেখা ।

    অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ
    যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা ;
    যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই — প্রীতি নেই —
    করুণার আলোড়ন নেই
    পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড় ।

    যাদের গভীর আস্হা আছে আজো মানুষের প্রতি
    এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
    মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
    শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় ।

    “এতে ‘এলিমিনেশান নেই । আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে চ্যুতি নেই” । বিনয় বলেছেন, “অঙ্কিত চিত্র যেমন আলোকচিত্র নয়, কবিতাও তেমনি সাংবাদিকতাময় মাধ্যম নয় । অর্থাৎ চিত্রশিল্পীকে ভেবে-চিন্তে সুপরিকল্পিত ভাবে আলোকচিত্র হতে চ্যুত হতে হয় — তার উদ্দেশ্য দর্শককে অধিক পরিমাণে ভালো লাগানো। তেমনি কবিকেও ভেবেচিন্তে সুপরিকল্পিতভাবে সংবাদসুলভ রচনা থেকে চ্যুত হতে হয় । ফলে জন্ম হয়েছে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রের, অ্যবসট্র্যাক্ট চিত্রের । ফলে জন্ম হয়েছে অ্যাবসট্র্যাক্ট চিত্রের সমধর্মী আধুনিক কবিতার। আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে চ্যুতির একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত জীবনানন্দে — ‘ঘাসের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবুজ বাতাস/অথবা সবুজ বুঝি ঘাস ? /অথবা নদীর নাম মনে করে নিতে গেলে চারিদিকে প্রতিভাত হয়ে ওঠে নদী’, ইত্যাদি । এখানে কবি স্বেচ্ছায় আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে অত্যন্ত বেশি সরিয়ে নিয়ে এসেছেন রচনাকে এবং রচনাও আশ্চর্য হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে ।”
    কবিতাটির বিশ্লেষণে বিনয় মজুমদার বলেছেন, “মূল বিষয়বস্তু যা কবিকে ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় উক্ত বা ব্যক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছিল, সেই মূল বিষয়বস্তুটি নেই । অর্থাৎ সাক্ষপ্রমাণহীন অবস্হায় রয়েছে কবিতাটির বক্তব্যবিষয় । এগুলো কবিতাটির এডিটিং-এর অঙ্গ । কিন্তু এই কবিতাটিতে আছে: ১) আবিষ্কার । যে-কোনো নতুন আবিষ্কার চমকপ্রদ এবং মনকে সেহেতু নিজের দিকে আকৃষ্ট করে । ২) উপমার বদলে সাবস্টিটিউশান আছে । প্রকৃতপক্ষে মূলে সাংবাদিকসূলভ কতকগুলি বাক্য কবির লেখার ছিল ; সেই বাক্যগুলির সাবস্টিটিউটরূপে কতকগুলি বাক্য কবি লিখেছেন, মূল বাক্যগুলি একদম না লিখে । মূল বিষয়বাহী বাক্যের সাবস্টিটিউটরূপে কবি অ্যানালজাস বিষয়বাহী বাক্য লিখলেন, এবং তা করতে উপমা, উপমার থেকে প্রতীক তাঁকে সাহায্য করল । ৩) বারংবার পঠনেচ্ছা-উদ্রেকের ব্যবস্হা আছে । অন্যতম প্রকৃত চিন্তনীয় বিষয় এই যে কবিতার অদ্ভূত সংসৃজন, এতে বিবৃত দার্শনিক আবিষ্কার, এর অন্তর্নিহিত এবং অনুল্লেখিত বেদনা, কবিতায় সৃষ্ট বিষণ্ণ পরিবেশ, মন্হর গতি ইত্যাদি সব মিলিয়ে পাঠককে কবি দ্বিতীয়বার পাঠে বাধ্য করতে সমর্থ হয়েছেন । এবং প্রথমে, দ্বিতীয়বার পাঠের পরে তৃতীয়বার পাঠের আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে — কারণ পাঠক নিজে তখন পাঠক থেকে কবি হতে থাকেন, চিন্তায় পড়ে, বাধ্য হয়ে । রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেকে অত্যন্ত তুচ্ছ ( রবীন্দ্রনাথের তুলনায় ) মনে করতে বাধ্য, আর জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করতে বাধ্য, যার ফলে পাঠকের পঠনেচ্ছা বাড়তেই থাকে । ৪) সহজে মুখস্হ করে রাখার ব্যবস্হা আছে । বারংবার পড়তে পড়তে যাতে কবিতাটি স্মৃতিস্হ হয়ে যায় সেদিকে কবি দৃষ্টি রেখেছেন । ৫) গভীরতা আছে । অর্থাৎ পাঠকের চিন্তার খোরাক প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান । ৬) সংযম আছে । সংযম কবিদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এক দুরূহ তপস্যার মতো । যে-সব ব্যাপার লক্ষ্য করে কবি এই ‘সিদ্ধান্ততে’ পৌঁছেছেন, সেসব ব্যাপার অনুল্লেখিত, অলিখিত । ‘সিদ্ধান্তটিই’ কবিতা । ৭ ) বহুমাত্রিক চরিত্র আছে । বহুমাত্রিক শব্দটি আমি মাল্টিডাইমেনশানাল অর্থে ব্যবহার করছি । মাত্রা বা ডাইমেনশন মানে স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু একটিমাত্র বিষয় ধরছি — যেমন প্রেম, জীবনদর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি ।”
    ১৯৬৬ সালে লেখা উপরোক্ত বিশ্লেষণের মূল বিন্দুগুলো এই জন্যই উপস্হাপন করলুম যে বিনয় সেই সময়েই লিখছিলেন ছয় পর্বে দীর্ঘ তাঁর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’। ১৯৯৯ সালে মারুফ হোসেনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা; কবিতাটি তিনি লিখেছেন তাঁর একাকীত্ব নিয়ে। আশা করি আলোচকরা বিনয়ের এই কবিতাটি এবং পরবর্তীকালে রচিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ পড়ার সময়ে খেয়াল রাখবেন যে বিনয় তাঁর কবিতার ক্রাফটে কেমন ধরণের বৈশিষ্ট্য বুনে দ্যান । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র বকুল ফুল তার ছিদ্রপথ এবং ফাঁক আর পাপড়িদের নিয়ে আরো সুস্পষ্টভাবে ফিরে এসেছে ‘বাল্মীকির কবিতা’য় । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যটিকে বিনয় মজুমদার বলেছেন সেটি হলো ‘ধর্মগ্রন্হ’ ; এই ধর্ম তাঁর ব্যক্তিগত ধর্ম, কেননা একটা আগেই পড়েছি যে ধর্ম থেকে বিনয় সাত হাত দূরে । অর্ঘ দত্ত বকসী তাঁর ‘বিনয় মজুমদার ও অঘ্রাণের অনুভূতি — বিশাল দুপুরবেলার যৌনসমীক্ষা’ নিবন্ধে বলেছেন যে “জীবন থেকে, গণিত থেকে, আত্মসমীক্ষা থেকে পাওয়া যাবতীয় দর্শনের মহাবিস্ফোরণ আছে এই কবিতাগ্রন্হে” ।
    বিনয় মজুমদার যখন সীমান্ত পেরিয়ে পুর্ব পাকিস্তানে নিজের গ্রামে গিয়ে কিছুকাল ছিলেন, তখন তাঁর আচরণে গ্রামবাসীরা কোনো অস্বাভাবিকতা পাননি । বিনয় যখন শিমুলপুর গ্রামে পাকাপাকি বসবাস আরম্ভ করলেন তখনও তাঁর আচরণ থেকে অস্বাভাবিকতা বিদায় নিয়েছিল । তার কারণ পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে এবং শিমুলপুরে তিনি ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর কৌম-প্রতিস্ব, হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতির সবুজ ভূখণ্ডের অঙ্গাঙ্গী । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বিনয়ের সেই কৌম-প্রতিস্বকে উন্মুক্ত করেছে, কোনো রাখঢাককে তোয়াক্কা করেনি।
    ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বেরিয়ে কলকাতা মহানগরের জটিল ও সর্পিল পথসমষ্টির বিভ্রান্তিকর রাস্তা, পথ, গলির এবং সেখানকার মানুষদের ভুলভুলাইয়ায় তাঁর কৌম-প্রতিস্ব আবছা হয়ে উঠছিল ক্রমশ । তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই হয়তো তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের ছেড়ে আসা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন । কলকাতা মহানগরে তিনি আক্রান্ত হচ্ছিলেন পারস্পরিক দূরত্বের অসম্বদ্ধতায়, অপসৃতির বোধে । শিমুলপুরে পৌঁছে তিনি স্রষ্টাকে খুঁজে পেলেন, যা একযোগে তাঁর ভেতরে এবং বাইরে বিদ্যমান । ‘অউম’ পত্রিকার জন্য দেয়া সাক্ষাৎকারে ১৪১৩ বঙ্গাব্দে তিনি বললেন, “শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর — এই অনাদি একের থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এ বিশ্বের সবকিছু । অত্রি তারা আমাকে বলেছিল, শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর । আমারও তাই মত । বেঁচে থাকতে হলে এই একটি বাক্যাংশই মনে রাখতে হবে । আর কোনও মন্ত্র নেই ।” ‘ফিরে এসো, চাকা, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’ ও পরের দিনপঞ্জিমূলক সাব-জনারের কাব্যগ্রন্হগুলোতে আমরা বিনয়ের এই বার্তাটিকেই প্রতিটি পংক্তিতে প্রবহমান দেখি ।

    ষোলো
    বিনয় মজুমদার কয়টি নাটক লিখেছিলেন জানি না । ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে একটি নাটক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে লেখা । নাটকটির নাম ‘আপনারা হাসুন’ । বইটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, যে বছর উনি মারা যান । তার মানে আর কোনো নাটক সম্ভবত উনি লেখেননি ।
    রচনাটিকে আমি নাটক বলছি কেননা বিনয় মজুমদার একটি মঞ্চ কল্পনা করেছেন । আসল যে ব্যাপারটি তিনি ঘটিয়েছেন তা হল মঞ্চের মাঝখানে নাটকের প্রমটারকে একটি চেয়ারে বসিয়ে রেখেছেন, যার হাতে একটি গ্রন্হ, যখন কিনা প্রমটার উইংসের আড়ালে থাকেন এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যাতে সংলাপ ভুলে না যান তাই আড়াল থেকে সংলাপ প্রমট করেন, দর্শকরা তাঁকে কখনও দেখতে পান না । ওই চেয়ারটি ছাড়া মঞ্চে আর কোনো আসবাব নেই । শাড়ি-ব্লাউজ পরা নামহীন তিনজন সুন্দরী নারী আছেন মঞ্চে যাদের কোনো সংলাপ নেই । বিনয় হয়তো বলতে চেয়েছেন, নারীদের প্রমট করার প্রয়োজন হয় না এবং তাঁরা অযথা সংলাপ খরচ না করে ঘটনাবলীর প্রতি নজর রাখেন । প্রমটারও নামহীন ।
    তিনজন পুরুষ আছেন মঞ্চে, এবং তারা প্রমটার যে সংলাপ বলে তার পুনরুক্তি করে । প্রমটার মাঝে-মাঝে সেই চরিত্রগুলোর নাম নিয়ে আদেশ করে, অমুক এবার তুমি বলো, অথবা তমুক এবার তুমি বলো, ইত্যাদি । পুরুষ চরিত্রগুলোর নাম হলো :
    ১ ) পিঙ্গুহুয়া : পাজামা পরা অভিনেতার বাংলা নাম কাহালি ।
    ২ ) টিরিনচাগা : প্যান্ট পরা অভিনেতার বাংলা নাম বুদ্ধ ।
    ৩ ) গেঞ্জি পরা অভিনেতার বাংলা নাম দীপক ।
    চরিত্রগুলোর নামকরণে গণিতের খেলা আছে কিনা তা ডিকোড করা দুরূহ । বিনয় মজুমদার মূলত একজন কবি ও গণিতজ্ঞ, তাই নাটকটির বাস্তবতাকে পাশে সরিয়ে তাকে মেটাফর হিসাবে ব্যাখ্যা করার প্রলোভন হয় । সংলাপগুলোতেও রহস্য বুনেছেন বিনয় কিন্তু তার মাধ্যমে চরিত্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না । ফলে মঞ্চটাকে মনে হয় সমাজের একটি সামগ্রিক মানসিক স্হিতি। চরিত্রগুলো মঞ্চের কারাগারে আটক , তারা প্রমটারের সংলাপ আউড়িয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য । তারা নিজের মনের কথা বলার স্বাধীনতা পায়নি । অতএব মঞ্চটি অথবা এই জগতসংসারটিকে একটি আবদ্ধ জায়গায় আটক থাকার গারদ বলে অনুমান করা যায় । কিন্তু প্রমটার লোকটি তার কাজের মাধ্যমে চরিত্রগুলোকে নিয়ে একটি ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে অসমর্থ ।
    নাটকটির সংলাপের পুনরুক্তির পর পুনরক্তি থেকে আঁচ করা যায় যে, বিনয় মজুমদার একটি বাধ্যবাধকতার ও সীমাবদ্ধতার দমবন্ধকর পরিসরকে আগাম অনুমান করতে পেরেছিলেন, যাকে নিয়ন্ত্রণ করছে অন্ধকার ও ক্ষতিকর ক্ষমতাগুলো । সেই নিমিত্তবাদকে গড়ে তুলেছে একটি নিষ্ঠুরতা যার মুখোমুখি হতে মানবসমাজ বাধ্য । এখানে উল্লেখ্য যে বিনয় মজুমদার যখন এই নাটকটি লেখেন তখন বামপন্হী ভাবধারায় প্রভাবিত গ্রুপ থিয়েটারগুলোর রমরমা চলছে । তাছাড়া বিনয়ের নিবন্ধগুলোয় ‘নবান্ন’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘উলুখাগড়া’ ইত্যাদি নাটকের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না । সাক্ষাৎকার গ্রহনকারীরাও তাঁকে নাটক বা গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে প্রশ্ন করেননি । হয়তো তাঁরা জানতেন না যে বিনয় ১৯৯৫ সালে একটি নাটকও লিখেছেন ।
    বিনয় তাঁর নাটকটির মাধ্যমে সে-সময়ের নাটক-সংস্কৃতিকে তুলোধনা করেছেন । গ্রুপ থেয়েটার তখন ক্রমশ জীবাশ্ম হয়ে উঠছিল, জীবনের বুনিয়াদি প্রশ্নাবলী থেকে সরে গিয়ে র‌্যালি ও র‌্যালায় মজে যাচ্ছিল, দারিদ্র্যকে গৌরবান্বিত করা আরম্ভ করেছিল, যাকে বলা যায় এক ধরণের বামপন্হী এলিটিজম, নানা জারগণের ধুমধাড়াক্কা । থিয়েটার ক্রমশ হয়ে পড়ছিল লিখিত নাটকের চাকর । বিনয় তাই প্রমটারটিকে নিয়ে এলেন চাকরের ভূমিকায় যে আবার একই সঙ্গে প্রভূত্ব করে । প্রমটার খোলাখুলি দেখিয়ে দিচ্ছে যে যেগুলোকে নাটকের মাস্টারপিস মনে করা হয়, গ্রুপ থিয়েটারের সেই সব ভাষাপ্রবৃত্তির কোনো স্হান আর বাঙালিসমাজে নেই । তারা বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অক্ষম । তারা কেবল ব্যক্তি-বিশেষেরর মামুলি সমস্যাকে মানসিক সমস্যা বলে উপস্হাপন করতে চেয়েছে ।
    মানসিক সমস্যা বলতে যে ঠিক কী বোঝায় তা বিনয় মজুমদারের চেয়ে ভালো আর কেউ জানতেন না বাংলা সাহিত্যের জগতে ।

    ১৯৯৮ সালে বিনয় মজুমদারের চল্লিশটি ন্যারেটিভ’ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’ । ছোটগল্পের সংজ্ঞা অনুযায়ী এগুলো ছোটোগল্প নয়, কোনো গদ্যেই সেই হুইপক্র্যাক এনডিং এবং ব্যক্তি-এককের সমস্যা নেই । ন্যারেটিভগুলো শিমুলপুরে বিভিন্ন গ্রামবাসীর সঙ্গে বিনয়ের কথোপকথন, বিনয়ের দিনপঞ্জিমূলক কবিতাগুলো গদ্যে রূপান্তরিত । এগুলোকে বলা যায় ‘গল্পহীন গল্প’ । বাংলা ভাষায় গল্পহীন গল্প বিনয়ই সম্ভবত প্রথম লিখেছেন ।
    বড়ো ও ছোটো আইডিয়াগুলোকে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে উপস্হাপন করেছেন বিনয় ; ঠাকুরনগরের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন সেই আইডিয়াগুলোকে । চল্লিশটি গদ্যকে যদি ঘটনা অনুযায়ী জুড়ে একটি দীর্ঘ গদ্য তৈরি করা হয়, তাহলে বিনয়ের সেই সময়ের জীবনযাপন ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে একটি ন্যারেটিভ গড়ে উঠবে ; সেগুলোকে বলা যায় গল্প সম্পর্কে গল্প । গদ্যগুলো দিয়ে ন্যারেটিভের নদী তৈরি করেছেন বিনয়, প্রতিটি গদ্য পৃথকভাবে তার শাখানদী । আর প্রতিটি শাখানদী তার সংলাপপ্রবাহে লুকিয়ে রেখেছে একটি বার্তা । গদ্যগুলো জুড়ে একটা দীর্ঘ পাঠবস্তু তৈরি করলেও তা মেটাফিকশান হবে না ।
    গদ্যগুলো গতানুগতিক গল্পের মতন ফরমুলাচালিত নয় । ফরমুলানির্ভর গল্প ক্রমশ একটি সমস্যা উপস্হাপন করে এবং শেষে গিয়ে তার সমাধান ঘটে । বিনয়, যিনি একজন গণিতবিদ, তিনি প্রতিটি গদ্যে ওই ফরমুলাতেই অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে দিলেন । ফরমুলা-নির্ভর গল্প রচিত হয় বাজারের কথা ভেবে এবং সেটি একটি মার্কেটেবল প্রডাক্ট — বাস্তব হোক বা কাল্পনিক । চিরাচরিত কাহিনি-প্রণালীকে চ্যালেঞ্জ করলেন প্রণালীহিনতার দ্বারা ।
    প্রথানুগত গল্পের মতন কোনো বাঁধাধরা আরম্ভ ঘটান না, সংলাপ দিয়ে আরম্ভ করেন, এবং পাঠককে তিনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তা পাঠক সেই সংলাপগুলোকে অনুসরন করার পর টের পায় ; বহুক্ষেত্রে তিনি পাঠককে কোথাও নিয়ে গিয়ে মাঝপথে ছেড়ে দেন, যাতে বাকি পথটা পাঠক নিজেই নির্ণয় নিয়ে এগোতে পারে । তাতে কিন্তু ফরমুলা গল্পের নাটক জোড়েন না বিনয় । সংলাপের আঙ্গিকটি অনেক সময়ে এমনভাবে উপস্হাপিত হয় যে বোঝা যায় বিনয় নিজেই বিরুদ্ধ-যুক্তি-প্রদর্শক কিংবা মূল প্রতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন, যাতে যাঁর সঙ্গে বিনয় কথা বলছেন তাঁকে ছোটো করা না হয় । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যাকে বলতেন ‘না-গল্প’, বিনয়ের ন্যারেটিভগুলো তা নয়, অর্ক দত্ত বকসী যাকে বলছেন ‘প্রগল্প’, তাও নয়, এবং অর্ক চট্টোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘গল্পনা’ তাও নয় । বিনয়ের গল্পগুলোর উপসংহার এবং ক্যাথারসিস ঘটে কাহিনিটি ফুরিয়ে যাবার পর অন্য কোথাও ।
    ঠাকুরনগরের একজন বা কয়েকজনের সঙ্গে কোনো একটি বিষয়ে আলোচনা আরম্ভ করেন বিনয়, এবং তা বিনয় নামেই করেন । সেই আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে যুক্তি, শ্লেষ, বিদ্রূপ, ব্যাজস্তুতি, হাস্যরস, বৈজ্ঞানিক-তর্ক, সরল গণিত, ব্যঙ্গ, আমোদ, ঠাট্টা, কৌতুক, গভীর জ্ঞান, প্ররোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রোতার মনে শেষ পর্যন্ত প্রত্যয় উৎপাদন করেন তিনি। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে সমাজের বিরুদ্ধে আক্রমণ আছে, এবং সেগুলো এমনভাবে উপস্হাপন করেছেন তিনি যেন ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক । কোনো-কোনো প্রতর্ক তাঁর কবিতাতেও আছে । প্রায় প্রতিদিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিতর্কিত বিষয়ের আলোচনা করে বিনয় মজুমদার, যাঁকে গ্রামের মানুষ জানে একজন বিখ্যাত কবি হিসাবে, পারস্পরিক হায়ারারকি ভেঙে ফেলেছেন।
    ‘মনা আজ এসেছিল আমার কাছে…’ গল্পটিতে তিনি মনে নামের ছেলেটিকে বলছেন, “দ্যাখো, আমিই চাঁদ নিয়ে কবিতা লিখেছি, ‘চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকি…’, যা তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা”র লাইন, এবং কথা প্রসঙ্গে পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁর কাছে বইটির গুরুত্ব আছে । গল্পটিতে তিনি গণিতবিদ ও ইঞ্জিয়ার লেওনার্দো দা ভিঞ্চির সঙ্গে নিজের তুলনা করেছেন, লেওনার্দোর মতন তাঁরও অবিবাহিত থাকার প্রসঙ্গে এনেছেন, ‘মোনালিসা’ আঁকার কথা তুলেছেন, বলেছেন যে লেওনার্দোর মতন তিনিও ছবি এঁকেছেন সাহিত্যচর্চা করেছেন, কিন্তু একবারও গায়ত্রী প্রসঙ্গ আসেনি ।
    ‘পরোপকারী’ গল্পে বিনয় হোটেল মালিক মিত্র মশায়কে বোঝাচ্ছেন যে তিনি মুর্গির মাংস, পাঁঠার মাংস খাওয়াচ্ছেন খদ্দেরদের । মানুষেরা পাঁঠা পোষে, খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে, তারপর তাকে কেটে খায় । কারণ মানুষ পাঁঠার চেয়ে অনেক উঁচুস্তরের জীব । তিনি প্রস্তাব দেন যে মিত্র মশায় সেই তর্কে যদি মানুষের মাংস কেটে খদ্দেরদের খাওয়ান তাহলে একজন মানুষের মাংস খেয়ে আরেকজন মানুষ দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হবে । মিত্র মশায় বলেন বুঝেছি । বিনয় জানান যে কলকাতায় তিনি নিজের চোখে দেখেছেন যে মানুষের মাংস খাচ্ছে মানুষ, একবার নয়, অনেকবার ।
    ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ নামের পাঠবস্তুটিতে খাদ্যবস্তু থেকে মানুষের দেহে মাংস তৈরি হবার কথা আরেকবার এসেছে । মিষ্টি বিক্রেতা মুকুন্দ বণিকের সঙ্গে বিনয়ের কথাবার্তা হয় । মুকুন্দ বণিক প্রতিদিন মানুষকে মিষ্টি বিক্রি করে তাদের দেহে মাংস তৈরি করে দিচ্ছেন । তেমনই চাষিরাও মানুষের দেহে মাংস তৈরি করে । বিনয়ও বছরে আড়াই হাজার ডাব বেচে অন্তত আড়াইটে ডাবের সমান রক্ত তৈরি করে দেন মানুষের শরীরে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিছুই করেন না, কেবল মুখে-মুখে গল্প মেরে বেড়ান । মুকুন্দ বণিককে বিনয় জানান যে সেই জন্যই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে অনেক উপরে । মুকুন্দ বণিক তর্কে বিশ্বাস করেন এবং বলেন যে যত মন্ত্রী আছে, বিধানসভায় সদস্য আছে, রাজ্যপাল তাঁরা মুকুন্দ বণিকের নীচেই । এই একই বিষয় ফিরে এসেছে ‘আমার চাষিভাইরা’ গদ্যে, যখন বিনয় দ্যাখেন যে রেলস্টেশনে মাইক বসিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে স্হানীয় নেতা গোবিন্দ দেব । বিনয় মজুমদার সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন দেখে তাঁকেও বক্তৃতা দিতে বলা হয়, চাষিদের ধানের দাম, পাটের দাম বাড়ানোর জন্য । বিনয় একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন এবং জানান যে চাষিদের ফসল খেয়েই মানুষের দেহে বছর-বছর রক্তমাংস হয়, চাষিরা ভালো-লোক খারাপ-লোকের পার্থক্য করেন না, তাঁদের ফসল সকলেই খায়, সেকারণে ধানের আর পাটের দাম বাড়ানো জরুরি ।
    শেষ গদ্যটিতে যুগপৎ অনেককে ঠোনা মরেছেন বিনয় মজুমদার । গদ্যটির শিরোনাম ‘সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ’ । গদ্যটিতে বিনয় একজন সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর নির্দেশেই নানা ঘটনা ঘটে । ভারতের লোকে স্বাধীনতা চাইছে এবং ষষ্ঠ জর্জ পরামর্শ চাইছেন মেরির কাছে । উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল নেহরু, করমচন্দ গান্ধিকে এক এক করে পেশ করা হলো সম্রাটের সামনে। তাঁরা তিনজনেই জানালেন এ হলো বিনয়দার লীলাখেলা, স্বাধীনতা দিতে হবেই । মনস্ত্বত্ববিদরা সম্রাটকে জানালো যে এই ভারতীয়দের পরীক্ষা করে জানা গেছে যে তারা মনোরোগী । সম্রাটের অমাত্য নিলসন জানতে চাইল, এদের চিকিৎসা কোথায় করা হবে, লণ্ডনে না অন্যত্র ? সম্রাট আদেশ দিলেন, এই তিন যুবকের মনোরোগের চিকিৎসা করা হোক ভারতে — কলকাতায় মেডিকাল কলেজের এজরা ওয়ার্ডে ।
    বিনয় মজুমদারের ‘ছোটোগল্প’ নামের এই পাঠবস্তুগুলোকে বিদ্যায়তনিক ডিসকোর্সের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছে অথচ মর্মার্থ ও সংলাপের এরকম বুননশৈলী আর কারো গদ্যে দেখা যায় না । সাধারণ মানুষ ও তাদের সংলাপ ব্যবহার করে বিনয় নির্মাণ করেছেন একটি দার্শনিক ভঙ্গী অথবা অভিগমন । গ্রামে জীবনযাপনের দরুন তিনি জানেন যে মানুষের জীবনে ভাষা একটি প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তা একজনের সঙ্গে আরেকজনের সহজ যোগাযোগের মাধ্যম, তা বাস্তবতাকে পালটে দিতে পারে, অভিজ্ঞতাকে আদল দিতে পারে । সংলাপ তখনই নিজস্ব হয়ে ওঠে যখন বক্তার মস্তিষ্কে সেই সংলাপের উদ্দেশ্য গাঁধা হয়ে যায় । সাধারণ মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলার সময়ে বিনয় খেয়াল রেখেছেন যে গাম্ভীর্যের ভেতরে লুকোনো হাসাহাসি বুদ্ধির খেলাকে পরস্পরের মধ্যে জীবন্ত করে তোলে ।

    [ রচনাকাল জানুয়ারি – মার্চ ২০১৭ ]
  • m | 012312.60.90023.249 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৩৮541289
  • আরেকবার ক্ষুধিত পাষাণ -- রবীন্দ্রনাথের প্যাশটিশ
    মলয় রায়চৌধুরী
    আমি এবং আমার আত্মীয় বিদেশ ভ্রমণ সারিয়া দিল্লি বিমানবন্দর হইতে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময়ে দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জে সহযাত্রীটির সহিত পরিচয় হয় ; তিনি লণ্ডনে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে বক্তৃতা দিয়া স্বদেশে ফিরিতেছিলেন । তাঁহার বেশভূষা শ্মশ্রুকেশ দেখিয়া প্রথমটা তাঁহাকে পশ্চিমদেশীয় মুসলমান বলিয়া ভ্রম হইয়াছিল । তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া আরো ধাঁধা লাগিয়া যায় । আলোকচিত্র বিষয়ে তো অবশ্যই, এতদ্ব্যতীত পৃথিবীর সকল বিষয়েই এমন করিয়া আলাপ করিতে লাগিলেন, যেন তাঁহার সহিত প্রথমে পরামর্শ করিয়া বিশ্ববিধাতা সকল কাজ করিয়া থাকেন । বিশ্বসংসারের ভিতরে ভিতরে যে এমন সকল অশ্রুতপূর্ব নিগূঢ় ঘটনা ঘটিতেছিল, রুশিয়ানরা যে এতোদূর অগ্রসর হইবার পরও আত্মধ্বংসের পথে চলিয়া গিয়াছে, চিনারা চেয়ারম্যান মাওয়ের বিশাল তৈলচিত্র টাঙাইয়া সাম্যবাদের পুঁজিবাদী পরীক্ষায় সফল হইয়াছে, পেটরল লইয়া আমেরিকানদের যে এমন সকল গোপন মতলব আছে, দেশীয় রাজনৈতিক নেতাদের অধঃপতন এবং বপুর স্ফীতি সীমা অতিক্রম করিয়াছে, গণতন্ত্র যে এমন খিচুড়ি পাকিয়া উঠিয়াছে, টাকার এভারেস্টে না উঠিলে নির্বাচনের শৃঙ্গ জয় অসম্ভব, এ সমস্ত কিছুই না জানিয়া আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হইয়া ছিলাম ।
    বাবুটি প্রকৃত কৃষ্ণবর্ণ, তাই বলিয়া তাঁহার গায়ে ভ্রমর বসিলে যে দেখা যাইবে না, অথবা কালি মাখিলে জল মাখিয়াছেন বোধ হইবে, কিংবা জল মাখিলে কালি মাখিয়াছেন বোধ হইবে, এমন নহে । যেরূপ কৃষ্ণবর্ণ আপনার ঘরে থাকিলে শ্যামবর্ণ বলি, পরের ঘরে হইলে পাতুরে কালো বলি, বাবুটির ত্বক সেইরূপ কৃষ্ণবর্ণ । তাঁহার চক্ষুদুটি এরূপ যেন সদাসর্বদা অগ্নিস্ফূলিঙ্গ নির্গত হইতেছে । দারপরিগ্রহে জ্ঞানোপার্জনের বিঘ্ন ঘটে আশঙ্কায় নিতান্ত নিরুৎসাহে অদ্যাবধি বাবুটি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নাই, বসতবাটী হইতে দূরে রাজস্হানি মারোয়াড়ি অধ্যুষিত আকাশচুম্বী অট্টালিকায় একটি দুই কামরার আবাস ভাড়া লইয়া কম বয়সী যুবতীর সহিত একত্রে বসবাস করিতেছেন, সে তথ্য স্বয়ং স্বীকার যাইলেন ।
    আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ আমাদের নবপরিচিত আলাপিটি ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন : There happen more things in haven and earth. Horatio, than are reported in your newspapers. আমরা বহুকাল ইউরোপ আমেরিকায় সময় অতিবাহিত করিয়া স্বগৃহে ফিরিতেছি, সুতরাং আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ লোকটির রকমসকম দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম । লোকটা সামান্য উপলক্ষে কখনো বিজ্ঞান বলে, কখনো বেদের ব্যাখ্যা করে, কখনো ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায় স্লোগানের বোমাবাজদিগের বহুরূপীস্বভাবের গল্প বলে, পাকিস্তানের দাবি করিয়া যে উচ্চবর্ণ বাঙালিরা নিম্নবর্গদিগকে ফেলিয়া পূর্ববঙ্গ হইতে ভারতে পলাইয়া আসিয়াছিল এবং সিংহাসনে বসিয়া পরমানন্দে আখের গোছাইয়া লইয়াছে তাহাদের গোপন কাহিনি শোনায় , আবার কখনো কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও উত্তরাধুনিকতা আওড়াইতে থাকে । বিজ্ঞান, বেদ, মার্কসবাদী পুঁজিবাদ, জাতিপ্রথা-নির্ভর গান্ধিবাদ এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সে আমাদের কোনোরূপ অধিকার না থাকাতে, তাঁহার প্রতি আমাদের ভক্তি উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল।
    আমার সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে, আমাদের এই আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ সহযাত্রীর সহিত কোনো-এক রকমের অলৌকিক ব্যাপারের কিছু একটা যোগ আছে -- কোনো-একটা অপূর্ব চৌম্বকত্ব অথবা দৈবশক্তি, অথবা সূক্ষ্ম শরীর, অথবা ঐ ভাবের একটা-কিছু । তিনি এই অসামান্য মানুষটির সমস্ত সামান্য কথাও ভক্তিবিহ্বল মুগ্ধভাবে শুনিতেছিলেন এবং গোপনে নোট করিয়া লইতেছিলেন । আমার ভাবে বোধ হইল, অসামান্য ব্যক্তিটিও গোপনে তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং কিছু খুশি হইয়াছিলেন ।
    আমার সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির কার্যকলাপ স্বচক্ষে দেখিয়া ভূমিসংস্কারক নেতা বিনয় চৌধুরী একদা বলিয়াছিলেন যে বঙ্গদেশের গণতন্ত্র বাই দি ঠিকেদার ফর দি ঠিকেদার অফ দি ঠিকেদার হইয়া গিয়াছে । আত্মীয়টি সিন্ডিকেট নামক একটি যুবক-সমবায় স্হাপন করিয়া প্রচুর কাঁচা টাকা একত্র করিয়াছিলেন এবং বিদেশভ্রমণের সাধ মিটাইবার ও বিখ্যাত মণীষীদের সাক্ষাৎ পাইবার জন্য রক্তপিপাসু জোঁকের ন্যায় আমার সঙ্গ লইয়াছিলেন । বিদেশে আমরা আলবার্ট আইনস্টাইন, রমাঁ রোলাঁ, এইচ জি ওয়েলস, ডাবলিউ বি ইয়েটস, এজরা পাউণ্ড, রবার্ট ব্রুজেস, আরনেস্ট রাইস, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, আগা খাঁ, রেজা শাহ পহলভি, হেনরি বার্গসঁ, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, বেনিতো মুসোলিনি প্রমুখের সহিত দেশ ও দশের কল্যাণের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সারিয়ে ফিরিতেছিলাম ।
    সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির প্রপিতামহ অভিবক্ত বঙ্গের স্বনামধন্য মানুষ ছিলেন, সেই সময়ের বঙ্গে, বর্তমানে যাহা ভারতীয় বঙ্গ ও বাংলাদেশ নামে দুইটি পৃথক দেশ, উভয় অংশেই তাঁহার প্রভূত জমিদারি জমিজমা ছিল এবং আফিম ও নীল চাষ হইত । চিনদেশে আফিম রপ্তানি করিয়া এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গগণকে নিয়মিত রৌপ্যমুদ্রা উপঢৌকন দিয়া কলিকাতায় একখানি বৃহৎ পারিবারিক অট্টালিকা নির্মাণ করিয়াছিলেন । কথিত আছে যে বিলাতে তাঁহার আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং তথায় তাঁহাকে সমাধিস্হ করা হইয়াছিল, যদ্যপি তাঁহার বঙ্গদেশীয় হৃৎপিণ্ডখানি কর্তিত করিয়া স্বদেশে আনিয়া ধর্মমতে কলিকাতায় অন্ত্যষ্টি করা হইয়াছিল । কিন্তু আত্মীয়টির পিতামহ খ্রিস্টধর্মাবলম্বীগণের ধর্মাচরণ ও ধর্মগ্রন্হে আকৃষ্ট হইয়া তদৃশ একটি ধর্মস্হাপনের প্রয়াসে আত্মনিযুক্ত হইবার ফলে প্রপিতামহের ব্যবসায় এবং জমিদারির চাষবাস এতোই অবহেলিত হয় যে ক্রমে তাঁহাদের সন্তান-সন্ততি ধর্ম ও বিদ্যাশিক্ষায় আগ্রহান্বিত হইয়া প্রপিতামহের ব্যবসায়কে অতল জলরাশিতে নিমজ্জিত করিয়া দেন । পরবর্তী প্রজন্মের বংশধরগণ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই যে ঐশ্বর্যের নিজের কোনো লজ্জাবোধ নাই । যাহাই হউক, সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টি তাহা বুঝিতে পারিয়াছেন এবং উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ধনবৈভবের পূজারীরূপে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছেন ।
    আমি যখনই বিদেশযাত্রা করি, অথবা স্বদেশেও কোথাও ভ্রমণে যাইলে সঙ্গী লইয়া যাইতে পছন্দ করি, এই জন্য যে তাঁহারা পরবর্তীকালে আমাকে লইয়া স্মৃতিকথা লিখিয়া কিঞ্চিদধিক রোজগারপাতি করিবেন, এবং তাঁহাদের স্মৃতিকথার উপর নির্ভর করিয়া অধ্যাপকবৃন্দ আমাকে লইয়া ইচ্ছামতো গল্প ফাঁদিতে পারিবেন ও ছাত্রছাত্রীদিগকে পিএইচ ডি পাইতে পথনির্দেশ করিতে পারিবেন । একই কারণে আমি গুণগ্রাহী তরুণ-তরুণী এবং আত্মীয়-অনাত্মীয় পরিচিত-অল্পপরিচিত ব্যক্তিগণকে নিয়মিত চিঠি লিখিয়া থাকি, যাহাতে তাঁহারা আমার মৃত্যুর পর চিঠিগুলি ভাঙাইয়া খাইতে পারেন, আমার আলোকে কিঞ্চিদধিক অন্ধকারের বাহিরে আসিবার সুযোগ লইতে পারেন, আমার জীবনের দুঃখজনক ঘটনাবলী ফেনাইয়া কেচ্ছা লিখিয়া কোটিপতি হইতে পারেন ।
    লণ্ডনের হিথরো বিমানবন্দর হইতে আসিয়া আমাদের বিমানটি দিল্লিতে নামাইয়া দিল, আমরা দমদমগামী বিমানের অপেক্ষায় লাউঞ্জে সমবেত হইলাম। তখন রাত্রি সাড়ে দশটা । কলকাতায় সার্বিক ধর্মঘট অথবা ব্রিগেড সমাবেশ জাতীয় একটা-কী ব্যাঘাত হওয়াতে বিমান অনেক বিলম্বে আসিবে শুনিলাম । আমি সন্ধ্যার পান-ভোজন সারিয়া ইতিমধ্যে মখমলশোভিত সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমাইব স্হির করিয়াছি, এমন সময়ে আলোকচিত্র-বিশেষজ্ঞ অসামান্য ব্যক্তিটি নিম্নলিখিত গল্প ফাঁদিয়া বসিলেন । যৎসামান্য সিঙ্গল মল্ট পান সত্ত্বেও সে রাত্রে আমার আর ঘুম হইল না :---

    ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার পক্ষ হইতে বিদেশে কয়েকটি অভিশপ্ত প্রাসাদ ও গৃহাদির গোপন কাহিনি ও আলোকচিত্রের কর্মটি সুসম্পন্ন করিবার পর পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ভারতের শরিফাবাদে অবস্হিত অভিশপ্ত অট্টালিকাটির আলোকচিত্র তুলিয়া একটি নিবন্ধ লিখিবার প্রস্তাব দিলে আমি তৎক্ষণাত রাজি হইয়া গিয়াছিলাম । আলোকচিত্র হইল আমার মাদকীয় আধ্যাত্মিকতা ।
    তখন দেশ অরাজক । ইংরাজ শাসক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন । ইংরাজ শাসকের পর যাহারা গদিনশীন হইল তাহারা দেশকে ছারখার করিয়া দিবার খেলায় মত্ত হইয়া গেল । যাহারা গদিনশীন হইবার প্রয়াস করিতেছিল, তাহাদের অত্যাচারে বরেন্দ্রভূমি ডুবিয়া যাইতেছিল । অনেকেই কেবল খাইতে পায় না তা নয়, গৃহে পর্যন্ত বাস করিতে পারে না । যাহাদের খাইবার নাই তাহারা পরের কাড়িয়া খায় । কাজেই গ্রামে গ্রামে দলে দলে চোর-ডাকাত । কাহার সাধ্য শাসন করে । পারস্পরিক হত্যা, গ্রাম হইতে বিতাড়ন, জলচল বন্ধ, পাকা ফসল ও খামারে অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদির মাধ্যমে শাসক ও বিরোধী সম্প্রদায় জনগণকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস করিতেছিল ।
    অভিশপ্ত প্রবন্ধশৃঙ্খলা লিখিবার নিমিত্ত প্রথমে গিয়াছিলাম ক্যাম্বোডিয়াস্হিত তুয়োল স্লাঙ গণহত্যা প্রদর্শশালায় । এই গৃহটি তৎকালীন একাধিপতি পল পটের গুপ্তচরগণ, যে নাগরিকদিগকে সন্দেহ করিত তাহাদের তুলিয়া আনিয়া যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দিয়া হত্যা করিত । চিকিৎসক অধ্যাপক শিক্ষক প্রযুক্তিবিদ বিজ্ঞানী প্রমুখ ব্যক্তিগণকে চাষবাসে নিযুক্ত করিয়াছিলেন পল পট, এবং তাঁহার বশংবদগণ সন্মানীয় ব্যক্তিগণকে খেতে-খামারে অকর্মণ্যতার জন্য চাবুক দ্বারা পিটাইত, বন্দুকের গুঁতা দিয়ে অষ্টপ্রহর খাটাইত, যে কারণে তাঁহারা প্রায় সবাই মৃত্যু বরণ করেন । প্রদর্শশালায় বর্তমানে সতেরো হাজারেরও বেশি নিহত মানুষের চিৎকার শুনিতে পাওয়া যায় ; পল পট যে কতো লক্ষ মানুষকে যাতনা দিয়া হত্যা করিয়াছিল তাহার হিসাব মেলে নাই, কিন্তু সেই নিহত মানুষগুলির ছায়াশরীর এখনও যাতনাদানকারীদিগের বংশধরদের পিছু ধাওয়া করে । আমি আমার শব্দধারকযন্ত্রে চিৎকারের কিয়দংশ ধরিয়া রাখিয়াছি, লিখিবার সময়ে ক্রন্দনাশ্রুর অনুনয়-বিনয় শুনিলে বাক্যাদি স্বাবলীলতায় কলমের সূচ্যাগ্রে চলিয়া আসে । বিস্ময়ের ব্যাপার হইল যে বামপন্হীগণ তিরিশ বৎসরেরও বেশি পশ্চিমবঙ্গে পলপটিয় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করিলেও অদ্যাপি কেহই পল পট সম্পর্কে কোনো কথা বলা সমিচীন মনে করেন নাই, তাহাঁদের মৌনতা একটি হুডিনি রহস্য ।
    স্কটল্যাণ্ডের এডিনবরায় মেরি কিংস ক্লোজ নামে একটি অভিশপ্ত অঞ্চলের আলোকচিত্র লইবার নির্দেশ পাইয়া কয়েক দিন কাটাইবার পর এক পক্ককেশ বৃদ্ধা ও একটি কম বয়সি মেয়ের ছায়াশরীরের অস্তিত্ব জানিতে পারি ; ভ্রমণকারীগণও অনেকে তাহাদের উপস্হিতি, পদধ্বনি ও হাসাহাসি শুনিতে পায় । আপনারা ইউনাইটেড কিংডম ভ্রমণে যাইলে অবশ্যই মেরি কিংস ক্লোজ দেখিয়া আসিবেন । সন্ধ্যার পর পর্যটকগণের প্রবেশ নিষেধ । দুর্ভাগ্য যে আমার আলোকচিত্রগুলিতে সেই বৃদ্ধা ও তাহার নাতনির মৃত্যুপরবর্তী ছায়াশরীরের কোনও আভাস ভাসিয়া উঠে নাই । আমার যন্ত্রে তাঁহাদের কন্ঠস্বরও ধরিয়া রাখিতে পারি নাই ।
    আমাদিগের দেশে রাজস্হান রাজ্যের আলওয়ারে ভাঙ্গার দুর্গে অবশ্যই যাইবেন । কথিত আছে যে জনৈক স্বাস্হ্যবান তন্ত্রসাধনাকারী যুবক প্রাসাদনিবাসিনী এক সুন্দরী রাজকন্যার প্রেমে আক্রান্ত হইয়া জাদুটোনার মাধ্যমে যুবতীটিকে বশীভূত করিবার প্রয়াসে বিফল হইবার পর আত্মহত্যা করিয়া লয় এবং মৃত্যুশয্যায় অভিশাপ দিয়া যায় যে দুর্গস্হিত সকলেই কয়েক দিবসের ভিতর উন্মাদ হইয়া যাইবে । কেহ উন্মাদ হইয়াছিল কিনা তাহার কোনো প্রমাণ নাই, তথাপি সন্ধ্যার পর দুর্গটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করিয়া দেয়া হইয়াছে । বহু ভ্রমণার্থী মস্তিষ্কবিকারে আক্রান্ত হইয়াছেন । সন্ধ্যার পর দুর্গটিতে উন্মাদ অপচ্ছায়াদের চিৎকার এবং তান্ত্রিকের অট্টহাস্য শোনা যায় । এক্ষেত্রে আমার আলোকচিত্রে যদিও প্রমাণ পাই নাই, কন্ঠস্বর ধরিয়া রাখার যন্ত্রে উন্মাদ মানুষের চিৎকার ও তান্ত্রিকের অট্টহাস্য ধরা পড়িয়াছিল । ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের সম্পাদক মহাশয় বলিয়াছিলেন যন্ত্রটি বহু পুরাতন বলিয়া অমন আওয়াজ হইতেছে, বিজ্ঞানীগণ শুনিলে বিশ্বাস যাইবেন না।
    তাহার পর গিয়াছিলাম সিংগাপুরের পুরাতন চাঙ্গি চিকিৎসালয় ভবনে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানি সৈন্যগণ ভবনটিতে শত্রুসেনাগণকে অকথ্য যন্ত্রণা দিত এবং দেহগুলি এলাইয়া পড়িলে হত্যা করিত । বহু ভারতীয় সৈন্যকে তাহারা যাতনা দিয়া হত্যা করিয়াছে । পর্যটকগণ যন্ত্রণাকাতর মানুষের ক্রন্দন শুনিতে পান, মৃতদেহ ছুঁড়িয়া ফেলিবার শব্দ শুনিতে পান, ভারতীয় সৈন্যগণের হিন্দুস্তানি ভাষায় ক্রন্দন শুনিতে পাওয়া যায়, জাপানি সেনার বুটজুতার পদশব্দ শোনা যায় । আমিও শুনিয়াছি কিন্তু আলোকচিত্রগুলিতে সেই ক্রন্দন ও মৃতদেহ ফেলিয়া দিবার আভাস ধরিতে পারি নাই ।
    মেক্সিকোয় জোচিমিলকো নামে একটি স্হানের জনহীন দ্বীপে গিয়াছিলাম । দ্বীপটি এতোই অভিশপ্ত যে জলযানগুলি ভ্রমণকারীদের লইয়া দ্বিপ্রহরেই ফিরিয়া চলিয়া আসে । তথায় একদিন যে সময়ে মেঘপূঞ্জ স্বর্ণমালাবৎ পশ্চিম গগনে বিরাজ করিতেছিল, তৎসময়ে একটি বালিকা তাহার ডলপুতুল সামলাইতে গিয়া জলমগ্ন হইয়া মারা যায় । বালিকাটির আত্মার শান্তির জন্য জনৈক ব্যক্তি প্রচুর ডলপুতুল লইয়া গিয়া দ্বীপটিতে রাখিয়া আসিত । একদিন সেই ব্যক্তিটি সেই একই স্হানে জলে ডুবিয়া মারা যায় যেস্হানে বালিকাটি জলমগ্ন হইয়া অপঘাতে মারা গিয়াছিল । দিবাদ্বিপ্রহরেও বালিকার খিলখিল হাসি শুনিতে পাওয়া যায়। দ্বীপের যত্রতত্র রক্ষিত ডলপুতুলগুলি পর্যটকদিগের পানে তাকাইয়া থাকে এবং বহু ভ্রমণার্থী সেই দৃষ্টি এবং খিলখিল হাসি হইতে সারা জীবনেও মুক্তি পায় নাই । সৌভাগ্যবশত আমাকে কোনও ডলপুতুল বশীকরণ করিতে পারে নাই ।
    এক্ষণে একটি অভিশপ্ত অরণ্যের কথা বলিব । ঘন অরণ্যটি জাপানের আকিগাহারায় স্হিত । বহু জাপানি যুবক-যুবতী এমনকী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগণও সেই জঙ্গলে গিয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন । অরণ্যে প্রবেশ করিবার পর তাঁহাদিগকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই । আজও অনেক হতাশ্বাস মানুষ চুপি-চুপি অরণ্যটিতে প্রবেশ করিয়া হারাইয়া যান, এবং আত্মীয়গণ অনুমান করেন যে তাঁহারা আত্মহত্যা করিয়া লইয়াছেন । অরন্যটির ভিতর দিবাবসানে বহু মানুষের হাহাকার ও বক্ষ-চাপড়ানি শুনিতে পাওয়া যায় । কর্তৃপক্ষের নির্দেশ আছে যে ভ্রমণের জন্য অরন্যটিতে প্রবেশ করিলে পথে পথে সীতার অলঙ্কারের ন্যায় চিহ্ণাদি রাখিয়া যেন অগ্রসর হন । অত্যন্ত ঘন জঙ্গল, আমি স্হানীয় এক অরণ্যপ্রদর্শক লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিলাম, সবুজের বিভিন্নপ্রকার পার্থক্যসমাবেশে আলোকচিত্রগুলি চমৎকার ফুটিয়া উঠিয়াছিল, এবং একাধিক বৃক্ষের শাখা হইতে যেন গলায় রজ্জু বাঁধিয়া মানুষ ঝুলিয়া আছে এমত ইশারা চাক্ষুষ করিয়াছিলাম ।
    এইবার স্বদেশের একটি অট্টালিকার ঘটনা বলিব । ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিক নির্দেশ দিয়াছিল যে এবার যেন ভারতের শরিফাবাদের বহুল প্রচারিত অবহেলিত ও অতিঅভিশপ্ত খণ্ডহরটির আলোকচিত্রসহ ছায়াশরীরগণের চিৎকার ও ক্রন্দন ও তথ্যাদি সংগ্রহ করিয়া পাঠাই । অর্ধশতকাধিক পূর্বে যে উগ্রক্ষত্রিয় পরিবার খণ্ডহরটিতে বাস করিতেন, তাঁহাদের পরিবারের জনৈক জীবিত সদস্য একজন তত্ত্ববধায়ক নিযুক্ত করিয়াছেন যিনি তাঁহাদের ভগ্নপ্রায় নিবাসটিতে দিবাবসান পর্যন্ত থাকেন । শরিফাবাদ নিবাসী আমার শ্যালক, অর্থাৎ মৃত স্ত্রীর বৃদ্ধ ভ্রাতা, অভিশপ্ত অট্টালিকাটির বিষয়ে তথ্যাদি দিবার পর আমি সেই অট্টালিকাটিকে কেন্দ্র করিয়া আলোকচিত্রের কর্ম আরম্ভ এবং তথ্যাদি সংগ্রহ করা মনস্হ করি। শ্রীমতী ঝুমা চট্টোপাধ্যায় নামক এক প্রথিতযশা লেখিকা-আলোকচিত্রী অভিশপ্ত অট্টালিকাটির কাহিনি ও আলোকচিত্র সংগ্রহ করিয়া আমাকে এতদ্বিষয়ে সম্যক অবহিত করিয়াছিলেন, আমি তাঁহার অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ ।
    শরিফাবাদস্হ খণ্ডহরের অভিশপ্ত দ্বিতল অট্টালিকাটির কেয়ারটেকার অর্থাৎ তত্ববধায়ক মহাশয়ের সহিত আমার শ্যালকের বহুদিনের পরিচয় ছিল । সহৃদয় তত্ববধায়ক মহাশয় আমাকে সেই অট্টালিকারই একটি অব্যবহৃত পরিত্যক্ত ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া খাট-বিছানা পাতিয়া, মশারির ব্যবস্হা করিয়া, টেবিল-চেয়ার আনিয়া দিয়া থাকিবার ব্যবস্হা করিয়া দিলেন । প্রথম দর্শনেই স্পষ্ট হইয়া গিয়াছিল যে আমার পূর্বে ঘরটি কেহ বহুকাল ব্যবহার করে নাই, অর্ধশতাধিক কাল চুনকাম হয় নাই । একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকা যে অভিশপ্ত তাহা আলোকচিত্রে ধরিয়া রাখিবার জন্য তথায় দুই-তিন দিন রাত্রিবাস প্রয়োজন, মনে করিয়াছিলাম, যেমন নামিবিয়ার জীবজন্তুর আলোকচিত্র লইবার সময়ে জঙ্গলের ভিতরেই তাঁবু খাটাইয়া রাত্রিবাস প্রয়োজন ছিল।
    যে সময়ে শরিফাবাদের দ্বিতল অট্টালিকাটি অভিশপ্ত হয় নাই, সেসময়ে বিজলি ব্যবস্হা ছিল, যত্রতত্র বিজলির তার ভাঙা টিউবলাইট ঝুলিতে দেখিয়া অনুমান করিলাম, এখন তত্ববধায়ক মহাশয় কেরোসিন লন্ঠন এবং মোমবাতি জ্বালাইয়া সন্ধ্যাপর্যন্ত এই গৃহে থাকেন । সন্ধ্যা হইলে নিজ বাসভবনে চলিয়া যান ।
    প্রথম দিবসেই মাথার উপরে শব্দতরঙ্গে আকাশমণ্ডল ভাসাইয়া পাপিয়া ডাকিয়া গেল । অনুমান করিলাম শুভলগ্নেই অট্টালিকাটিতে প্রবেশ করিয়াছি ।
    তৎকালে জায়গাটি বড়ো রমণীয় ছিল । নির্জন পাহাড়ের নিচে বড়ো-বড়ো বনের ভিতর দিয়া দক্ষিণ-পশ্চিমে দ্বারকেশ্বর ও দামোদর নদী দুটি, পূর্বপ্রান্ত ভাগিরতী ও উত্তরে অজয় নদী উপলমুখরিত পথে নিপুণা নর্তকীর মতো পদে পদে বাঁকিয়া বাঁকিয়া দ্রুত নৃত্যে চলিয়া গিয়াছে । ঠিক সেই নদীর ধারেই পাথরবাঁধানো বহুসোপানময় অত্যুচ্চ ঘাটের উপর একটি প্রাচীন স্হাপত্যের অট্টালিকা শৈলপদমূলে একাকী দাঁড়াইয়া আছে -- নিকটে কোথাও লোকালয় নাই । খণ্ডহরের তত্ত্ববধায়ক মহাশয় বলিয়াছিলেন দ্বিতল অট্টালিকাটিতে একদা একটি উগ্রক্ষত্রিয় জমিদার পরিবার থাকিত, তাঁহাদের প্রচুর জমিজমা খেত-খামার ছিল । বাড়িটি অভিশপ্ত হইবার পূর্বে জমিদারের খেতগুলি ও ফসলের আড়ত এই স্হান হইতে কিয়ৎক্রোশ দূরে ছিল । সে সময়ে এই অঞ্চলে জোতদারেগণ সংখ্যায় শতাধিক, তখনও জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় নাই ।
    তত্তববধায়ক মহাশয়ের কাছে শুনিয়াছিলাম, তৎকালে যাহারা শরিফাবাদের প্রাচীন নিবাসী ছিলেন না, অন্যত্র হইতে আসিয়া তথায় ঘর বাঁধিবার প্রয়াস করিতেছেন, বিশেষ করিয়া দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান হইতে আশ্রয়প্রার্থীর দল, তাঁহারা কলহাস্যমুখর পরিবারের সেই দ্বিতল অট্টালিকা, যাহার মধ্যস্হলে একটি সুন্দর উদ্যান ছিল, তাহা দেখিয়া হিংসায় ও বিদ্বেষে জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিতেন এবং মনে-মনে ষড় করিতেন যে কখনও সুযোগ পাইলে প্রাসাদটিকে আক্রমণ করিয়া বিদ্ধস্ত করিয়া দিবেন, ভূস্বামীর বৈভব প্রদর্শনের গর্বের জন্য নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে উগ্রক্ষত্রিয় গৃহনিবাসীদের উচিত শিক্ষা দিবেন । এই সংবাদ আমি পরবর্তীকালে অট্টালিকার তত্ত্ববধায়কের নিকট পাইয়াছিলাম, তৎসত্ত্বেও এই গৃহের নিবাসীগণের প্রতিই যে কেন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শীগণ বিদ্বিষ্ট হইয়াছিলেন তাহা তিনি ব্যাখ্যা করিতে পারেন নাই, আরও বহু ধনী জোতদারগৃহ তো শরিফাবাদে ছিল। সে যাহাই হউক, ভগ্নপ্রায় অট্টালিকাটি আলোকচিত্র লইবার উপযুক্ত ছিল ; এই প্রকার আরও অভিশপ্ত পরিবার ও গৃহাদি অন্যত্র খুঁজিয়া পাইব কিনা নিশ্চিত ছিলাম না । রাজনৈতিক মতাদর্শীগণ প্রকৃতই তাঁহাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন কিনা, তদ্বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল এবং পরবর্তীকালে তাঁহাদের কার্যকলাপ, চরিত্রদূষণ, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা ও লোভ দেখিয়া আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হইয়াছে, তাঁহারা বহুলাংশে মতাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়া লোভের আবর্তে নামিয়া ভিন্নমতাদর্শীগণের অনুচররূপে দাসখৎ লিখিয়া দিয়াছেন । ইহা মানবসমাজের উত্তর-সত্যের যুগ, নাগরিকগণ ক্রীড়নক মাত্র ।
    ####
    ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রশাসনের সহিত জমিদার জোতদার তালুকদারদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্হায় তাঁহারা ভূসম্পত্তির নিরঙ্কুশ অধিকারী হন ; স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্হায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বের জমিদারিস্বত্বও তাঁহারা লাভ করেন।
    সেই সময়ের এক উগ্রক্ষত্রিয় জমিদার মহাশয় এই দ্বিতল অট্টালিকাটি নির্মাণ করাইয়াছিলেন । তখন স্নানশালার ফোয়ারার মুখ হইতে গোলাপগন্ধি জলধারা উৎক্ষিপ্ত হইতে থাকিত এবং সেই শীকরশীতল নিভৃত গৃহের মধ্যে মর্মরখচিত স্নিগ্ধ শিলাসনে বসিয়া, কোমল নগ্ন পদপল্লব জলাশয়ের নির্মল জলরাশির মধ্যে প্রসারিত করিয়া, তরুণী বাঙালি রমণীগণ চুলে জবাকুসম তেল মাখিয়া, স্নানের পূর্বে দীর্ঘ কুঞ্চিত কৃষ্ণকেশ মুক্ত করিয়া দিয়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত অথবা অতুলপ্রসাদী গান করিতেন । খণ্ডহরটিতে আজও সেই গানের আবছা রেশ ক্বচিৎ-কখনও বাতাসে ভাসিয়ে বেড়ায় ।
    লাহোরে শাহজাদা সেলিমের প্রেমিকা আনারকলিকে যেভাবে সম্রাট আকবরের নির্দেশে ইষ্টক গাঁথিয়া জীবন্ত সমাধিস্হ করা হইয়াছিল, সেই পদ্ধতিতেই এই অভিশপ্ত অট্টালিকাটির সদর দরজার সন্মুখভাগ ইষ্টক গাঁথিয়া বন্ধ করিয়া দেয়া হইয়াছে, গৃহস্হিত উদ্যানটির চতুর্দিকে অবিন্যস্ত অনিয়ন্ত্রিত ঝোপঝাড়, নামহীন লতা সুযোগ পাইয়া সরিসৃপের ন্যায় আঁকিয়া-বাঁকিয়া অন্দরে-কন্দরে প্রবেশ করিয়াছে, দ্বিতলের সিঁড়ি বাহিয়া উপরের ঘরগুলিতে নিজস্ব নৃত্যছন্দে হস্তপদ মেলিয়া দিয়াছে ।
    এখন আর সে ফোয়ারা খেলে না, সে গান নাই, সাদা পাথরের উপর শুভ্র চরণের সুন্দর আঘাত পড়ে না --- এখন ইহা আমাদের মতো নির্জনবাসপীড়িত সদাভ্রাম্যমান পেশাদার আলোকচিত্রীর অতিবৃহৎ এবং অতিশুন্য সাময়িক বাসস্হান । কিন্তু তত্ত্ববধায়ক এবং আমার শ্যালক উভয়েই আমাকে এই অট্টালিকার একটি পরিত্যক্ত বিজলিহীন ঘরে বাস করিতে বার বার নিষেধ করিয়াছিলেন ; বলিয়াছিলেন, “ইচ্ছা হয় দিনের বেলা থাকিবেন, কিন্তু কখনো এখানে রাত্রিযাপন করিবেন না ; স্পেনের ইনকুইজিশনের কাহিনি শুনিয়াছেন তো, ভিন্নবিশ্বাসী স্ত্রী-পুরুষকে জীবন্ত দগ্ধ করা হইত ? এই অট্টালিকায় দিন নাই রাত্রি নাই সেই অতিনিষ্ঠুর লুন্ঠন-অভিলাষী অগ্নিসংযোগকারীদের উল্লসিত কন্ঠস্বর ধোঁয়ার ন্যায় জাগিয়া উঠে, ছায়াশরীরেরা লুন্ঠনকারীর ন্যায় আমোদনৃত্য করে, আপনি বারুদের গন্ধ পাইলে অবাক হইবার কিছু নাই ।”
    আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম । তত্তবধায়ক বলিলেন, তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকিবেন, কিন্তু রাত্রে এখানে থাকিবেন না, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিবেন । আমি বলিলাম, “তথাস্তু” । এই অভিশপ্ত খণ্ডহরের এমন রহস্য ও কিম্বদন্তি ছিল যে, রাত্রে দলীয় মাস্তানগণও এখানে আসিয়া গঞ্জিকা সেবনের আড্ডা দিতে সাহস করিত না , এবং পুলিশও জেল পলাতক কয়েদির অনুসন্ধানে এ-মুখো হইত না। সন্মুখের দ্বার ইষ্টক গাঁথিয়া বন্ধ করিয়া কর্তৃপক্ষ সম্রাট আকবরের ন্যায়ই এই গৃহের জীবনালোক নির্বাপিত করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন বলিয়া অনুমান করি । একদা এই অট্টালিকা উৎফুল্লকমলজালশোভিত, বিহঙ্গমাক, স্বচ্ছ বারিবিশিষ্ট শান্তিনিকেতন ছিল, তাহা অনুমান করিতেও কষ্ট হয় ।
    প্রথম প্রথম গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া লতাগুল্মে আচ্ছন্ন এই পরিত্যক্ত ভগ্নপ্রায় অবহেলিত অট্টালিকার বিজনতা আমার বুকের উপর যেন একটা ভয়ংকর ভারের মতো চাপিয়া থাকিত, সূর্যোদয় এবং দ্বিপ্রহরে খণ্ডহরটির বিবিধ স্হানের আলোকচিত্র তুলিয়া আমি যতটা পারিতাম দ্বিপ্রহরের ভোজনের পর বাহিরে থাকিয়া, শরিফাবাদের অন্যান্য স্হানের আলোকচিত্র তুলিয়া ঘরে ফিরিয়া এক পাঁইট মদ্য সেবন করিয়া শ্রান্তদেহে নিদ্রা দিতাম এবং রাত্রিকালের অপেক্ষা করিতাম ।
    দ্বিতল অট্টলিকাটি বন্যলতার ঠাসবুনোটে বসবাসের অযোগ্য হইয়া গিয়াছে, দেয়াল ও গৃহের মাটিতে গুলঞ্চ, পাটেঙ্গা, কালকাসুন্দা, বিছুটি, শেয়ালকাঁটা, ভাটফুল, আলকুশি ইত্যাদি বিস্তার করিয়াছে নিজেদের স্বেচ্ছাচারী গণতন্ত্র । নিবিড় বন নহে, স্হানে স্হানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ মণ্ডলাকারে কোনো কোনো ভূমিখণ্ড ব্যাপিয়াছে । উদ্যান হইতে উইপোকাগণ তাহাদের রানিমার নির্দেশে সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে, দেয়ালে এবং সিঁড়িতে তাহাদের স্বেদ-লালার উত্তরাধুনিক অঙ্কনমালা ।
    আলোকচিত্রের ফিল্ম স্হানীয় বিপণীতে রসায়নে মুদ্রণ করিতে দিলে দোকানিটিও আশ্চর্য হইত কিন্তু ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের একটি সংখ্যা তাহাকে দিবার পর একটি পৃষ্ঠায় আমার হাস্যময় মুখ মুদ্রিত দেখিয়া আমাকে সে শ্রদ্ধাপূর্বক সাহায্য করিতে আত্মনিবেদিত হইয়াছিল ।
    একদিন না যাইতেই অবহেলিত ভগ্নপ্রায় অট্টলিকাটির এক অপূর্ব নেশা আমাকে ক্রমশ মোহাবিষ্ট করিয়া ধরিতে লাগিল। আমার সে অবস্হা বর্ণনা করাও কঠিন এবং সেকথা লোককে বিশ্বাস করানোও শক্ত । সমস্ত অট্টালিকা একটা সামুদ্রিক অক্টোপাসের ন্যায় আমাকে তাহার আলিঙ্গনের বেগুনি ফুৎকারে ও তীব্র মোচড়ে জঠরোস্হ মোহরসে অল্পে অল্পে যেন নেশাগ্রস্ত করিতে লাগিল ।
    বোধহয় এ অভিশপ্ত বাড়িতে পদার্পণমাত্রেই, পরিত্যক্ত ঘরটির খাটে বিছানা পাতিবার ও মশারি টাঙাইবার পর এ প্রক্রিয়ার আরম্ভ হইয়াছিল -- কিন্তু আমি যেদিন সচেতনভাবে প্রথম ইহার সূত্রপাত অনুভব করি, সেদিনকার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে ।
    তখন গ্রীষ্মকালের কারণে উর্ধাঙ্গের পোশাক খুলিয়া বৈকালিক বাতাসের অপেক্ষা করিতেছিলাম । সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আমি সেই নদীতীরে ঘাটের নিম্নতলে একটা আরাম কেদারা লইয়া বসিয়াছি । দামোদর নদী শীর্ণ হইয়া আসিয়াছে ; ওপারে অনেকখানি বালুতট অপরাহ্ণের আভায় রঙিন হইয়া উঠিয়াছে, এপারে ঘাটের সোপানমূলে স্বচ্ছ অগভীর জলের তলে নুড়িগুলি ঝিক ঝিক করিতেছে । সেদিন কোথাও বাতাস ছিল না । দ্বিতল অট্টালিকাটির খণ্ডহরের ঝোপঝাড় হইতে বনতুলসী পুদিনা কালকাসুন্দা গুলঞ্চ ভাটফুল আলকুশি ও বন্যঘাসের একটা ঘন বনগন্ধ উঠিয়া স্হির আকাশকে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল ।
    আকাশে শাদা মেঘ রৌদ্রতপ্ত হইয়া ছুটিতেছে, তাহার নিচে কৃষ্ণবিন্দুবৎ পাখি উড়িতেছে, নারিকেল গাছে চিল বসিয়া, রাজমিস্ত্রির মতো চারিদিক দেখিতেছে, কাহার কিসে ছোঁ মারিবে । বক ছোটোলোক, কাদা ঘাঁটিয়া বেড়াইতেছে । ডাহুক রসিক লোক, ডুব মারিতেছে । আর আর পাখি হালকা লোক, কেবল উড়িয়া বেড়াইতেছে। হাটুরিয়া নৌকা হটর হটর করিয়া যাইতেছে -- আপনার প্রয়োজনে । খেয়া নৌকা গজেন্দ্রগমনে যাইতেছে -- পরের প্রয়োজনে । বোঝাই নৌকা যাইতেছে না -- তাহাদের প্রভূর প্রয়োজন মাত্র ।
    দিনমণি অস্তাচলগামী, সূর্য যখন দিগন্তের অন্তরালে অবতীর্ণ হইল, তৎক্ষণাৎ দিবসের নাট্যশালায় একটা দীর্ঘ ছায়াযবনিকা পড়িয়া গেল --- এখানে সূর্যাস্তের সময় আলোআঁধারির সম্মিলন অধিকক্ষণ স্হায়ী হয় না । সাইকেল সঞ্চালন করিয়া অথবা সাইকেল-রিকশ ভাড়া করিয়া একবার অঞ্চলটির পথে-পথে বেড়াইয়া আসিব মনে করিয়া উঠিব-উঠিব করিতেছি, কালধর্মে নিশারম্ভেই প্রবল ঝটিকাবৃষ্টি আরম্ভ হইয়া গেল, মস্তকোপরি বৃষ্টির ইলিশগুঁড়ি ধারাপাত হইতেছিল, নিশার সেই ঘোরতর অন্ধকারে দিগম্ত যখন স্হিত হইতেছে, এমন সময়ে সিঁড়িতে একাধিক পায়ের শব্দ ও বহু মানুষের আক্রমণাত্মক “মারো, মেরে ফ্যাল শালাদের, বড়ো বাড় বাড়িয়েছে, জমিজমার মালিক বইল্যা ধরাকে সরা জ্ঞান করতাসে, ধড় থিকা মাথা উড়ায়ে দে, চোখ খুবলাইয়া নে, আগুন ধরাইয়া দে” ইত্যাদি সমবেত কন্ঠস্বরের চিৎকার শুনিতে পাইলাম । আক্রান্ত পুরুষের অস্ফূট আতর্নাদ কর্ণে প্রবেশ করিল, যেনবা কাহারও প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া গেল । পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম, কেহ নাই । মনের চাঞ্চল্যহেতু একই স্হানে বসিয়া থাকিতে পারিলাম না ।
    ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মনে করিয়া পুনরায় ফিরিয়া বসিতেই, একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল --- যেন বিদ্বেষ ও ঈর্ষায় আক্রান্ত অনেকে মিলিয়া ছুটাছুটি করিয়া তিন-চারিজনকে ধরিবার নিমিত্ত নামিয়ে আসিতেছে । ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরূপ বিস্ময় মিশ্রিত হইয়া আমার সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল । যদিও আমার সন্মুখে কোনো মূর্তি ছিল না তথাপি স্পষ্ট প্রত্যক্ষবৎ মনে হইল যে, এই গ্রীষ্মের সায়হ্ণে ভয়ে কন্ঠাগতপ্রাণ তিন-চারিটি রক্তাক্ত পুরুষ দামোদরের জলের মধ্যে লুকাইতে নামিয়াছে । জলের তলায় লুকাইয়া তাহারা যেন বিভিন্ন তরঙ্গবিন্যাসে কাঁদিয়া কন্ঠরুদ্ধ আর্তচিৎকার করিতেছিল । এমনই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গিয়াছিলাম যে খেয়াল করি নাই বৃষ্টিতে ঈষৎ ভিজিতেছি ।
    যদিও সেই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ প্রায়ান্ধকারে, নদীতীরে, নির্জন অট্টালিকায় কোথাও কিছুমাত্র শব্দ ছিল না, তথাপি আমি যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম বর্ষাকালের পর্বতের পাথর নামিবার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া ভয়ার্ত ও রক্তাক্ত পুরুষ তিন-চারিটির সন্ধানে আমার পার্শ্ব দিয়া মশাল বহনকারীরা তীর-ধনুক টাঙ্গি দা কাটারি লাঠি কুড়াল পেটরলের ও অ্যাসিডের জেরিক্যান লইয়া দৌড়াইতে দৌড়াইতে চলিয়া গেল, তাহাদের পশ্চাতে উৎসাহ দিবার নিমিত্ত খোল করতাল মৃদঙ্গ ডুগডুগি ঢোলক খঞ্জনি বাদকের দল । আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না । তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেইরূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য । মনে হইল বৃষ্টিও তাহাদের ভয়ে আতঙ্কিত হইয়া মেঘগুলিকে মাথার উপরের আকাশ হইতে নদীর ওই পারে লইয়া চলিয়া গেল ।
    নদী পূর্ববৎ স্হির ছিল, কিন্তু আমার নিকট স্পষ্ট বোধ হইল, স্বচ্ছতোয়ার অগভীর স্রোত অনেকগুলি বলয়শিঞ্জিত বাহুবিক্ষেপে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে ; জনৈক দলপতির নির্দেশে সমবেত যুবকগণ হাসিয়া হাসিয়া অগ্নিসংযোগের জন্য তীরগুলিকে কেরোসিন তেলে চুবাইয়া এই অট্টালিকার দিকে ছুঁড়িয়া মারিতেছে, এবং স্লোগানকারীগনের উৎসাহদানে উগ্রক্ষত্রিয়-গৃহমুখী যুবকগণ হোমারের মহাকাব্যে বর্ণিত গ্রিক সৈন্যগণের ন্যায় ট্রয়ের মানুষদের ধ্বংস করিতে উদ্যত হইয়াছে, কিন্তু তাহাদের পোশাক গ্রিক সৈন্যগণের ন্যায় নহে, তাহারা এতদ্দেশীয় পোশাক শার্টপ্যান্ট, লুঙ্গি, গামছা পরিয়া, হস্তে তীর-ধনুক দা কাটারি টাঙ্গি লাঠি কুড়াল মশাল জেরিক্যান লইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল । আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে দলপতিগণ মতাদর্শের উত্তরাধিকারী হইয়া জন্মায়, মানবসন্তান রূপে নহে ।
    যদ্যপি কে যে ইহাদের দলপতি তাহা সম্যক বুঝিয়া ফেলা দুষ্কর, কেননা যেখানে সবই কাঁটাবন, সেখানে পুষ্পচয়ন দুঃসাধ্য, তথাপি হইহইকারীদিগকে যে নির্দেশ দিতেছিল, সেই দলপতি কহিল, এতকাল শৃগাল কুক্কুরের মাংস ভক্ষণ করিয়াছি, ক্ষুধায় প্রাণ যায়, আজ নরমাংস খাইব । এই বলিয়া প্রেতবৎ ছায়াসকল অন্ধকারে খলখল হাস্য করিয়া হাততালি দিয়া নৃত্য করিতে লাগিল । চক্ষে চশমা পরিহিত দলপতির বাম হস্তে একটি ক্ষৌরকর্মের পেটিকা ঝুলিতে ছিল, মনে হইল তাহা একটি পুস্তক, বৈদ্যগণের সমাজ-চিকিৎসার বিদেশি গ্রন্হ । বৈদ্যগণের উৎসের সন্ধান মনুস্মৃতিতে নাই । উহারা বর্ণসংকর বলিয়া অনুমান করি, এবং সেহেতু জারজ ও প্রত্যেকের প্রতি বিদ্বিষ্ট । সম্ভবত, দুর্ভাগ্যবশত উগ্রক্ষত্রিয় পরিবারটি বৈদ্য দলপতির ঈর্ষার কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল । দলপতি মহাশয় এই জগৎ পবিত্র করিবার জন্য কোন কালসময়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহার পিতামাতাই বলিতে পারিবে, ইতিহাস তাহা লিখে নাই, ইতিহাস এইরূপ বদমায়েশদের লইয়া অনেকপ্রকার বদমাইশি করিয়া থাকে ।
    ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে লিখিয়া গিয়াছেন, “অবস্হাবিশেষে মনুষ্য হিংস্র জন্তু মাত্র।” ছায়াশরীরগণ অট্টালিকাটিতে আয়োজিত অন্নপ্রাশনের শিশুটিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিলে ঋষির বাণীর অমোঘ সত্যতা উপলব্ধি করিলাম ।
    আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল, আতঙ্কে ললাটে স্বেদস্রুতি হইতে লাগিল; সে উত্তেজনা উদ্বেগের কি উৎকন্ঠার কি কৌতূহলের, ঠিক বলিতে পারি না । বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছুই ছিল না ; মনে হইল ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে ; কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকার ঝিল্লিরব শোনা যায় । মনে হইল, পঞ্চাশ বৎসরের অধিক কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে আপন মাদকে দুলিতেছে --- ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করি --- সেখানে বৃহৎ সালিশি-সভা বসিয়াছে, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না । সন্দেহ হইল যে এই বায়বীয় অপচ্ছায়াগুলির উপস্হিতির জন্যই হয়তো অট্টালিকাটিকে অভিশপ্ত তকমা দেয়া হইয়াছে ।
    হঠাৎ গুমোট ভাঙিয়া হু হু করিয়া একটি বাতাস দিল --- দামোদরের স্হির জলতল দেখিতে দেখিতে অপ্সরীর কেশদামের মতো কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, এবং সন্ধ্যাছায়াচ্ছন্ন সমস্ত বনভূমি এক মুহূর্তে একসঙ্গে মর্মরধ্বনি করিয়া যেন দুঃস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিল । স্বপ্নই বলো আর সত্যই বলো, অর্ধশতাধিক বৎসরের অতীত ক্ষেত্র হইতে প্রতিফলিত হইয়া আমার সম্মুখে যে-এক অদৃশ্য মরীচিকা অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা চকিতের মধ্যে অন্তর্হিত হইল । যে আক্রমণকারীগণ আমার দেহের উপর দিয়া শরীরহীন দ্রুতপদে শব্দহীন উচ্চ ক্রোধে ছুটিয়া আসিয়াছিল, তাহারা অট্টলিকাটিতে তীর ও মশাল সংযোগে অগ্নিকাণ্ড ঘটাইয়া দিল । বাতাসে যেমন করিয়া গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যায়, বসন্তের এক নিঃশ্বাসে তাহারা তেমনি করিয়া উড়িয়া অদৃশ্য হইয়া গেল । অগ্নিকাণ্ডের তাপের পরিবর্তে আমার ত্বকে শীতস্বেদের বিন্দু ফুটিয়া উঠিতে লাগিল ।
    তখন আমার বড়ো আশঙ্কা হইল যে, হঠাৎ বুঝি নির্জন পাইয়া ঠাকুমার ঝুলির রাজকন্যা, রাজপুত্র, রাক্ষস ও দানবগণ আমার স্কন্ধে আসিয়া ভর করিলেন ; আমি বেচারা নানাবিধ আলোকচিত্র তুলিয়া ব্যাখ্যা ও বিক্রয় করিয়া খাই, ঠাকুমার ঝুলির ঠাকুমাটি ঝুলি হইতে রাক্ষস-খোক্কোস ছাড়িয়া দিয়া এইবার বুঝি আমার মুণ্ডপাত করিতে আসিলেন । ভাবিলাম, ভালো করিয়া আহার করিতে হইবে ; শূন্য উদরেই সকল প্রকার দূরারোগ্য ব্যধি আসিয়া চাপিয়া ধরে । অট্টালিকার তত্ত্ববধায়ক মহাশয়কে ডাকিয়া বলিলাম স্বগৃহে যাইবার পূর্বে প্রচুর ঘৃতপক্ক মসলা-সুগন্ধি রীতিমত মোগলাই খানা স্হানীয় খ্যাতনামা রেস্তরাঁ হইতে আনাইয়া দিতে ।
    তত্ববধায়ক মহাশয় বিদায় লইলে, পথের দিকের গবাক্ষের কপাট খুলিয়া দেখিলাম, সন্মুখের পথ দিয়া যাইবার কালে এক পথচারী, দেখিতে অনেকটা হিন্দু পুরোহিতের ন্যায়, ব্রা্হ্মণ হইবেন বলিয়া মনে হইল, অতি দীর্ঘাকায় পুরুষ, শরীর শুস্ক, আয়ত মুখমণ্ডলে শ্বেতশ্মশ্রু বিরাজিত, ললাট ও বিরলকেশ তালুদেশে অল্পমাত্র বিভূতিশোভা, ব্রাহ্মণের কান্তি গম্ভীর ও কটাক্ষ কঠিন, আমাকে এই অভিশপ্ত অট্টালিকায় দেখিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, “তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” অনুমান করিলাম, বৃদ্ধ পুরোহিত হয়তো পাগল হইয়া গিয়াছেন, অথবা গলায় শালগ্রামশিলা ঝুলাইয়া হাঁটিবার সময়ে অমন চিৎকার করিয়া থাকেন । তৎসত্তবেও তিনি কলেজফেরত জিনস ও টপ পরিহিতা যুবতীগণের প্রতি অলক্ষ্যে চাহিয়া লইতেছেন ।
    রাত্রিশেষে ঘোরতর কুজ্ঝটিকা দিগন্ত ব্যাপ্ত করিয়াছিল, দিনমণি দিগন্তে উদিত হইলে, প্রাতঃকালে সমস্ত ব্যাপারটি পরম হাস্যজনক বলিয়া বোধ হইল । অদ্য আবহাওয়া মনোরম ছিল, প্রদোষকালে যৎসামান্য ঝটিকাবৃষ্টি হইয়া গিয়াছে । আনন্দ মনে শহরের বড়ো কোম্পানির আধিকারিকের মতো শার্ট ও গ্যালিসদেয়া প্যাণ্ট পরিয়া, সাইকেল সঞ্চালন করিয়া, দ্রুতবেগে আপন দৈনন্দিন কার্যে, অর্থাৎ পোস্টাপিসে গিয়া আলোকচিত্রগুলি অনুমোদনের নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম, প্রবন্ধটির খসড়া লিখিবার জন্য একপ্রস্হ ফুলস্কেপ কাগজ কিনিলাম । সেই দিন প্রবন্ধটি আরম্ভ করিবার জন্য অট্টালিকায় নিজ ঘরে ফিরিয়া একাগ্রচিত্তে লিখিবার কথা । কিন্তু সন্ধ্যা হইতে না হইতেই আমাকে দ্বিতল ভগ্নপ্রায় অট্টালিকাটির রহস্য চুম্বকের ন্যায় টানিতে লাগিল । কে টানিতে লাগিল বলিতে পারি না ; কিন্তু মনে হইল, আর বিলম্ব করা উচিত হয় না । মনে হইল, অট্টালিকাটিতে কোনো পূজা অথবা শিশুর নামকরণের অনুষ্ঠান আরম্ভ হইতেছে, ধুপ-ধুনা চন্দন ও ফুলমালাদির সুগন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে । সেই সন্ধ্যাধূসর তরুচ্ছায়াঘন নির্জন পথ সাইকেল সঞ্চালনের শব্দে সচকিত করিয়া অন্ধকার ভগ্নপ্রায় অবহেলিত নির্জন নিস্তব্ধ অট্টালিকাতে গিয়া উত্তীর্ণ হইলাম ।
    সিঁড়ির উপরে সম্মুখের ঘরটিতে মনে হইল দুটি ভাই-বোন গৃহশিক্ষকের নিকট পড়াশুনা করিতেছে, গৃহশিক্ষকের তিরস্কার ও কিশোর কিশোরীর কথাবার্তা কানে আসিতেছিল । সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া দেখিলাম কেহই নাই, ঘরটিতে টিকটিকি , গিরগিটি , চামচিকা ও উইপোকাগণ আশ্রয় লইয়াছে, বন্য লতাও সুযোগ পাইয়া সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া প্রবেশ করিয়াছে । যেন শুনিলাম কিশোর কন্ঠ যাতনায় চিৎকার করিয়া উঠিল, “মাথা ফাটিয়ে দিলো ওরা আমার মাথা ফাটিয়ে দিলো” । সিঁড়ি দিয়া কয়েকজনের দ্রুত নামিবার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না । সম্ভবত নিজের পদশব্দকেই ভয়ে অন্যের পদশব্দ বলিয়া ভ্রম করিতেছি । তথাপি কয়েকজনের উচ্চকিত কন্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম, “এই, মাস্টারটা পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাচ্ছে, ধর ধর, পালাতে দিসনি।” শীতের সময়ে নতুন লেপ তৈয়ারির জন্য ধুনিরি লেপের উপর ছড়ি পেটাইয়া খোলের তুলাকে সর্বত্র ছড়াইয়া দেয়, সেই প্রকার শব্দ এবং আর্তচিৎকার, “মরে গেলুম মরে গেলুম মেরে ফেললে মেরে ফেললে”, কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতে লাগিল । অথচ কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলাম না ; অভিশপ্ত অট্টালিকাটি যেন আমাকেই অভিশপ্ত করিয়া তুলিতেছে এমত প্রতীয়মান হইল ।
    বিস্তীর্ণ দালান ও তাহার পার্শ্ববর্তী ঘরগুলি বিশাল ছাদ ধরিয়া রাখিয়াছে । এই প্রকাণ্ড দালান ও তৎপার্শ্ববর্তী ঘরগুলি যেন আপনার বিপুল শূন্যতাভারে অহর্নিশ নিজস্ব আতঙ্কে ছম ছম করিতে থাকে । সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে তখনও লন্ঠন জ্বালানো হয় নাই । দরজা ঠেলিয়া আমি একতলার একটি ঘরের কপাট ঠেলিয়া যেমন প্রবেশ করিলাম অমনি মনে হইল ঘরের মধ্যে যেন ভারি একটা বিপ্লব বাঁধিয়া গেল -- যেন হঠাৎ সভা ভঙ্গ করিয়া চারিদিকের দরজা জানালা ঘর পথ বারান্দা দিয়া কে কোন দিকে পলাইল তাহার ঠিকানা নাই । আমি কোথাও কিছু না দেখিতে পাইয়া অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম । শরীর এক প্রকার আবেশে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল । যেন বহুদিবসের লুপ্তাবশিষ্ট বিড়ি-সিগারেট ও নস্যের গন্ধ আমার নাসার মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল । আমি সেই দীপহীন জনহীন প্রকাণ্ড ঘরের প্রাচীন ইষ্টকপ্রণালীর মাঝখানে দাঁড়াইয়া শুনিতে পাইলাম --- ঝর্ঝর শব্দে দুইটি পাশাপাশি চৌবাচ্চায় কেহ স্নান করিতেছে । মনে হইল ট্রানজিসটারে সঙ্গীত বাজিতেছে, কী সুর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছি না, কোথাও বা গৃহিনীগণের স্বর্ণভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও বা কিশোরীর নূপুরের নিক্বণ, কখনোবা পুজার ঘণ্টাধ্বনি বাজিবার শব্দ, অনতিদূরে সানাইয়ে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের স্ফটিকদোলকগুলির ঠুন ঠুন ধ্বনি,বারান্দা হইতে খাঁচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা পাখির ডাক আমার চতুর্দিকে একটা প্রেতলোকের রাগিণী সৃষ্টি করিতে লাগিল ।
    আমার এমন একটা মোহ উপস্হিত হইল, মনে হইল, এই অস্পৃশ্য অগম্য অবাস্তব ব্যাপারই জগতে একমাত্র সত্য, আর সমস্তই মিথ্যা মরীচিকা । আমি যে আমি --- অর্থাৎ আমি যে শ্রীযুক্ত মলয় রায়চৌধুরী, শ্রীযুক্তরঞ্জিত রায়চৌধুরীর কনিষ্ঠপুত্র, আলোকচিত্র তুলিয়া জগতে কিঞ্চিদধিক সুনাম অর্জন করিয়াছি, আমি যে শার্ট-প্যাণ্ট ও বুটজুতা পরিয়া কাঁধে একাধিক ক্যামেরা ঝোলাইয়া আলোকচিত্র লইয়া থাকি, লেন্সের ভিতর দিয়া দৃশ্যাবলীকে অনুপুঙ্খ যাচাই করি, এ-সমস্তই আমার কাছে এমন অদ্ভুত হাস্যকর অমূলক মিথ্যা কথা বলিয়া বোধ হইল যে, আমি সেই বিশাল অন্ধকার ভগ্নপ্রায় অট্টালিকার বন্য ঝোপঝাড়ের মাঝখানে দাঁড়াইয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলাম ।
    নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তন করিয়া গবাক্ষের কপাট খুলিয়া দেখিলাম, সেই বৃদ্ধ পুরোহিত, লাল শালুতে মোড়া শালিগ্রামশিলা তাঁহার বুকে ঝুলিতেছে, এই ভগ্নপ্রায় অট্টালিকা ছাড়িয়া আমি চলিয়া যাই নাই দেখিয়া সম্ভবত অবাক হইলেন, এবং পূর্বেকার তুলনায় আরও তারস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “ তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য ।” তাঁহার শ্লেষপূর্ণ ঘোষণা আমাকে সত্যই গৃহটি সম্পর্কে আরও আগ্রহান্বিত করিয়া তুলিল। আমার ভ্রুকুঞ্চন ও প্রশ্নময় চাহনি দেখিয়া পুরোহিতটি আমার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া কহিলেন, “অবস্হাবিশেষে মনুষ্য হিংস্র জন্তু মাত্র, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ।” বুঝিলাম যে তিনি বহুবিধ দেবী-দেবতার সেবক, আমার পক্ষে তাঁহার বক্তব্যের নিহিতার্থে প্রবেশ সম্ভব নহে ।
    তখনই মোমের আলো নিভিয়া গেল এবং কিয়ৎক্ষণ পর তত্ত্ববধায়ক মহাশয় প্রজ্বলিত কেরোসিন ল্যাম্প হস্তে ঝুলাইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং টেবিলের উপর রাখিয়া চুপচাপ চলিয়া গেলেন । তিনি আমাকে পাগল মনে করিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার স্মরণ হইল যে, আমি শ্রীযুক্ত রঞ্জিত রায়চৌধুরীর কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত মলয় রায়চৌধুরী, একজন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ; ইহাও মনে করিলাম যে, জগতের ভিতরে অথবা বাহিরে কোথাও অমূর্ত ফোয়ারা নিত্যকাল উৎসারিত ও অদৃশ্য অঙ্গুলির আঘাতে কোনো মায়া সেতারের অনন্ত রাগিনী ধ্বনিত হইতেছে কি না তাহা আমাদের মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবিবর জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিনয় মজুমদার বলিতে পারেন, কিন্তু এ-কথা নিশ্চয় সত্য যে, আমি দেশ-বিদেশের আলোকচিত্র বিক্রয় করিয়া এবং তদ্বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিয়া জীবন নির্বাহ করিয়া থাকি । তখন আবার আমার পূর্বক্ষণের অদ্ভুত মোহ স্মরণ করিয়া কেরোসিন-প্রদীপ্ত ক্যাম্পটেবলের কাছে খবরের কাগজ লইয়া আনন্দসংবাদ-এর দায়িত্ব হইতে রুপালিচুল মালিকের আকস্মিক পদত্যাগের খবরটি পড়িয়া সকৌতুকে হাসিতে লাগিলাম ।
    সংবাদপত্র পড়িয়া এবং মোগলাই খানা খাইয়া আলো নিবাইয়া দিয়া এই ভগ্নপ্রায় গৃহের পুরাতন খাটে বিছানায় গিয়া শয়ন করিলাম, পুরাতন খাটটির দুর্বল স্বাস্হ্যও এমন ভুতগ্রস্ত যে পাশ ফিরিলে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠে । আমার সম্মুখবর্তী খোলা জানালার ভিতর দিয়া উর্ধ্বদেশের একটি অত্যুজ্বল নক্ষত্র সহস্র কোটি যোজন দূর আকাশ হইতে এই অতিতুচ্ছ ক্যাম্পখাটের উপর শ্রীযুক্ত আলোকচিত্রীকে একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছিল, ইহাতে আমি বিস্ময় ও কৌতুক অনুভব করিতে করিতে এবং চিন্তা করিতে করিতে কতক্ষণ যে তন্দ্রাভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলাম বলিতে পারি না । মশকগণের সঙ্গীত ও অত্যাচার হইতে আত্মরক্ষার জন্য মশারি খাটাইয়া কতক্ষণ ঘুমাইয়া ছিলাম তাহাও জানি না । সহসা এক সময় শিহরিয়া জাগিয়া উঠিলাম ; ঘরে যে কোনো শব্দ হইয়াছিল তাহা নহে, কোনও যে লোক প্রবেশ করিয়াছিল তাহাও দেখিতে পাইলাম না । আকাশে অনিমেষ নক্ষত্রটি অস্তমিত হইয়াছে এবং কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণচন্দ্রালোক অনধিকারসংকুচিত ম্লানভাবে আমার বাতায়নপথে প্রবেশ করিয়াছে । যখন নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছে তখন রজনী গভীর ।
    কোনো লোককেই দেখিলাম না । তবু যেন আমার স্পষ্ট মনে হইল, জরিপাড় ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি পরিহিত একজন পুরুষমানুষ মশারির একপাশ তুলিয়া আমাকে আস্তে আস্তে ঠেলিতেছে, তাহার পাঞ্জাবির সোনার বোতাম অন্ধকারে জ্বলজ্বল করিতেছে । আমি জাগিয়া উঠিতেই সে কোনো কথা না বলিয়া কেবল যেন তর্জনীর ইঙ্গিতে অতি সাবধানে তাহার অনুসরণ করিতে আদেশ করিল । তাহার দুইটি চোখে যেন সদ্য অ্যাসিড ঢালিয়া উপড়াইয়া তোলা হইয়াছে, এবং দরদর করিয়া রক্ত গড়াইতেছে । তাহাকে দেখিয়া আমি কি যে করণীয় তাহা নির্ণয় করিতে পারিলাম না, ভয়ে-ভয়ে তবু তাহার পিছু লইলাম । কাহারা এই ব্যক্তির চোখ উপড়াইয়া লইয়াছে, এবং তৎসত্ত্বেও সে কীরুপে আমাকে পথনির্দেশ করিতেছে তাহা জিজ্ঞাসা করিবার মতো আত্মপ্রত্যয় হইল না।
    আমি অত্যন্ত চুপিচুপি উঠিলাম । যদিও সেই ভগ্নকক্ষপ্রকোষ্ঠময় প্রকাণ্ড শূন্যতাময়, নিদ্রিত ধ্বনি এবং সজাগ প্রতিধ্বনিময় দ্বিতল অট্টালিকায় আমি ছাড়া আর জনপ্রাণীও ছিল না, তথাপি পদে-পদে ভয় হইতে লাগিল, পাছে আরও কেহ জাগিয়া উঠে । অট্টালিকার একতলার দালানের দুই পাশের অধিকাংশ ঘরের কপাট রুদ্ধ এবং সে-সকল বন্ধ ঘরে আমি কখনো রাত্রিবেলায় প্রবেশ করি নাই , আমার সাহসে কুলায় নাই। উঁকি দিয়া দেখিলাম একটি ঘরে, যাহার দ্বার রুদ্ধ করা হয় নাই, অথবা দিনের বেলায় রুদ্ধ দেখিয়াছিলাম, সেই ঘরে পূজার উপাচার সাজানো হইয়াছে, অন্নপ্রাশনের নিমিত্ত আসন পাতা হইয়াছে এবং একজন পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করিতেছে । পুরোহিতটির শ্মশ্রু নাই, তবু মনে হইল পথে চিৎকারকারী পুরোহিতটির সহিত এনার মুখাবয়াবের যথেষ্ট মিল রহিয়াছে ।
    চোখ ওপড়ানো ব্যক্তিটি যেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল সেটি একটি উঠান, সেখানে নিমন্ত্রিত অতিথিগণকে খাওয়াইবার জন্য ভিয়েন বসানো হইয়াছে, থালায় থালায় অন্ন ব্যঞ্জন প্রভৃতি সাজানো, দেখিলাম হইহই করিয়া পঞ্চাশ-ষাটজন মানুষ, যাহাদের সহিত উৎসাহদানকারী খোল করতাল মৃদঙ্গ ডুগডুগি ঢোলক খঞ্জনিবাদকেরা ছিল, টাঙ্গি কাটারি দা শড়কি লাঠি অ্যাসিডের বোতল মশাল ইত্যাদি লইয়া দুইজন যুবকের পিছু ধাওয়া করিতেছে, তাহাদের একজন পাশের বাড়িতে পলাইবার প্রয়াস করিতে সেখান হইতে টানিয়া আনিয়া, দুইজন যুবককেই মাটিতে ফেলিয়া চাপিয়া ধরিল, এবং আমার সন্মুখেই দুইজনের গলায় কোপ মারিয়া ধড় হইতে মাথা পৃথক করিয়া দিল । স্পষ্ট অনুভব করিলাম আমার দেহে তাহাদের রক্ত ছিটকাইয়া আসিয়া লাগিল, মনে হইল বমন করিয়া ফেলিব । উঠানে আজানো থালা হইতে ভাত তুলিয়া সদ্যমৃত যুবকদিগের রক্ত তাহাতে মাখিয়া এক প্রৌঢ়াকে জোর করিয়া খাওয়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল আক্রমণকারীগণ । মহিলাটি যে বিধবা, তাঁহার পরিধেয় হইতে বুঝিতে পারিলাম, তিনি উন্মাদিনীর ন্যায় চিৎকার করিতেছিলেন, নিজেকে ছাড়াইয়া যুবকদ্বয়ের নিকটে যাইবার প্রয়াস করিতেছিলেন ; তাঁহার ঐ রুপ আচরণে তাঁহাকে যুবকদ্বয়ের মাতা বলিয়াই মনে হইল । একটি কিশোরী সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে বলিতে লাগিল, “এতো রক্ত কেন ? এতো রক্ত কেন ? এতো রক্ত কেন?”
    ঘর্মাক্ত কলেবরে খাটের উপর উঠিয়া বসিয়া বুঝিতে পারিলাম দুঃস্বপ্ন দেখিতেছিলাম, অথবা হয়তো ইহাই এই গৃহকে অভিশপ্ত করিয়া তুলিবার বিস্মৃত ঘটনাবলী, যাহা সেই অচেনা পুরোহিত, লাল শালুতে মোড়া শালিগ্রাম শিলা বুকে ঝুলাইয়া, সতর্ক করিয়া দুইবার বলিয়া গিয়াছেন “তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” পুরোহিত মহাশয় ঘটনাবলীর কথা না জানিলে কেনই বা বার বার বলিবেন, “সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” গবাক্ষ খোলা ছিল এবং বৃষ্টির ছাট আমার দেহের উপর পড়িবার ফলে আমি তাহাকে রক্তের ঝাপটা মনে করিয়াছিলাম । বৃষ্টিধারা ও ঝটিকার প্রবেশ রোধার্থ গবাক্ষের কপাট দুটি যোজিত করিলাম। আকাশে বারিধারার ভৈরব কল্লোল উথ্থিত হইয়াছে । নিজের অজ্ঞতায় নিজেই হাসিয়া উঠিলাম । প্রায়ান্ধকারে দেখিলাম বাদলা বাতাস ঘরে প্রবেশ করিয়া আমার আলোকচিত্রগুলিকে টেবিলের উপর হইতে উড়াইয়া মেঝেতে ফেলিয়া দিয়াছে । সেগুলি তুলিয়া একত্রিত করিয়া টেবিলের উপর ক্যামেরা চাপা দিয়া রাখিলাম । বৃষ্টির ছাটে কয়েকটি আলোকচিত্র ভিজিয়া গিয়াছিল।
    প্রদোষকালে ঝটিকাবৃষ্টি নিবারণ হইয়া গিয়াছিল ।
    জানি না স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন একত্রে কেমন করিয়া মস্তিষ্কে ক্রীড়া করে, কেমন করিয়াই বা বুঝিব তাহারা সত্য নহে, তাহারা অবাস্তব । রক্তমাংসের মনুষ্যই কি কেবল সত্যের অধিষ্ঠাতা ? দুঃস্বপ্নের অপচ্ছায়ারা নহে ? দুঃস্বপ্নকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা পাগলের যুক্তির ন্যা্য় সন্দেহজনক । ঘুমাইলে সুখস্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন মস্তিষ্কে আশ্রয় লইবে । সেকারণে মনুষ্য কি ঘুমাইবে না ? অনুমান করিলাম অন্ধকার অশান্ত ঘৃণায় নিমজ্জিত অভিশপ্ত খণ্ডহরটিই আমাকে দুঃস্বপ্নের চরিত্রগুলির সহিত সমঝোতা করিতে শিখাইতেছে, যেনবা অট্টালিকাটির গোপন কাহিনি মেলিয়া ধরিবার প্রয়াস করিতেছে। দুঃস্বপ্ন যেন একখানি আতঙ্কের কবিতা, যাহার প্রভাব সারা জীবন অন্তরজগতে সুপ্ত থাকিবে, এবং ক্বচিৎকখনও তাহার বিস্ফোরণের সুযোগ খুঁজিবে, যেমন আজ আপনাদের সন্মুখে মেলিয়া ধরিতেছি, নতুবা সদ্য পরিচিত দুইজন সহযাত্রীর নিকট কেনই বা অকস্মাৎ অভিজ্ঞতাখানি বাখান করিবার ধৃষ্টতা করিব ।
    সকালে, কুজ্ঝটিকার অন্ধকাররাশি হইতে দিঙমণ্ডল বিমুক্ত হইলে তত্ববধায়ক মহাশয়ের সশঙ্কচিত্ত আহ্বানে ঘুম ভাঙিবার পর রাত্রের দুঃস্বপ্নের ঘটনাবলী তাঁহাকে শোনাইলে, বারেক কথাবার্তা স্হগিত করিয়া তিনি ভয়কাতর কন্ঠস্বরে কহিলেন, “অদ্যই আপনার উচিত এই অট্টালিকা ছাড়িয়া কোনো হোটেলে রাত্রিবাস করিতে চলিয়া যাওয়া, নতুবা শ্বেতশ্মশ্রু পুরোহিতটির মতো আপনারও মস্তিষ্কবিকৃতির সম্ভাবনা আছে ।”
    পৃথিবীর এতো দেশ ভ্রমণ করিয়াছি, বহু অভিশপ্ত স্হানের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছি, দুর্গম স্হানে রাত্রিবাস করিয়াছি, সিংহের গর্জন শুনিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছি, ইত্যাদি গল্প তত্ববধায়ক মহাশয়কে শোনাইবার পর তিনি কহিলেন, ‘যা ভালো বোঝেন তাই করুন, তবে অন্যত্র রাত্রিবাসই মঙ্গলকর’ । তাঁহাকে আমার মনের কথা বলিলাম না যে, এই গৃহের আলোকচিত্রাদির প্রতি আগ্রহ আমাকে রাত্রিবেলায় এক ভিন্ন জগতে লইয়া যায় এবং আমি সেই বর্ণনাতীত অদৃশ্য মনুষ্যগুলির নিয়তির প্রতি মাদকসেবকের ন্যায় আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছি ।
    তত্ববধায়ক মহাশয় চলিয়া যাইবার পর টেবিল হইতে কল্যের আলোকচিত্রগুলি তুলিয়া প্রবন্ধের জন্য নির্বাচন করিব মনস্হ করিয়া এক এক করিয়া যাচাই করিতেছি, দেখিলাম তিনটি আলোকচিত্র কল্য দিনের বেলায় যেমন দেখিয়াছিলাম, তেমন নাই, আবছা হইয়া গিয়াছে । মনে হইল উঠানের কোণের লতাপাতাকীর্ণ প্রায়ান্ধকারের ছবিগুলিতে ধোঁয়ার ন্যায় দুটি যুবকের রক্তাক্ত ধড় দেখা যাইতেছে, তাহাদের উপর টাঙ্গি কুড়াল ইত্যাদি স্বয়ং বর্ষিত হইতেছে, কেহই সেগুলি ধরিয়া নাই, যুবক দুইটির দেহে যেন পেটরল ঢালিয়া জ্বালাইয়া দেয়া হইয়াছে। হয়তো কল্য আলোকচিত্রগুলি ঠিকমতো অনুধাবন করি নাই, আরেকবার আলোকচিত্রের বিপণীতে গিয়া মুদ্রণের জন্য দিতে হইবে ।
    পুনরায় মুদ্রণের জন্য আলোকচিত্রের বিপণীতে দিলে দোকানি যুবকটি কহিল, মুদ্রণ তো নিয়মমতোই করিয়াছিলাম, আপনি নিজেও তা যাচাই করিয়া লইয়াছিলেন, তথাপি এইরূপ বিকৃতি কেন ঘটিল জানি না । ওই গৃহ অভিশপ্ত, হয়তো প্রকৃত ঘটনা আপনার আলোকচিত্রে প্রেতের ন্যায় প্রবেশ করিয়া গিয়াছে, প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কেহই ওয়াকিবহাল নহেন । এইরূপ অভিজ্ঞতা ইহার পূর্বে এক সাংবাদিকের হইয়াছিল, সে আতঙ্কে উৎকন্ঠায় বাধ্য হইয়া সংবাদপত্রের চাকুরি ত্যাগ করিয়া টিভিতে কুতর্ক-সঞ্চালকের কর্ম করিতেছে, আয়ও ভালো হইতেছে । দোকানিকে বলিলাম, উচিত কথাই বলিয়াছ, চক্ষে ঠুলি বাঁধিয়া হস্তিকে বর্ণনা করা কঠিন, একমাত্র হস্তিই জানে তাহার চারটি পা, একটি শুঁড় এবং দুইটি দীর্ঘ দন্ত রহিয়াছে । দেখি, যদি সম্পূর্ণ হস্তিটির আলোকচিত্র তুলিতে পারি ।
    আলোকচিত্রগুলিতে গোলমাল ঘটিতে দেখিয়া আমি নূতন যে লেন্স ইউরোপ হইতে আনিয়াছিলাম তাহা ক্যামেরায় পরাইয়া একের পর এক বহু আলোকচিত্র লইলাম । ইষ্টক দ্বারা সদর হইতে প্রবেশ নিষিদ্ধ হইলেও পাঁচিলের ভাঙনের ভিতর দিয়া প্রবেশ করিয়া প্রতিটি ঘরের অন্ধকারের ও আলোর খেলার, সিঁড়ির ও সিঁড়ির উপরের ঘরের, দুটি পাশাপাশি চৌবাচ্চার, একটি জলকূপের এবং উঠানময় যে আগাছা সবুজ-হলুদ পত্রাবলী মেলিয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে, প্রতিটি বস্তুর আলোকচিত্র লইয়া নিশ্চিত হইবার প্রয়াস করিলাম যাহাতে পুনরায় গোলমাল হইবার অবকাশ আর না থাকে ।
    আলোকচিত্রের বিপণীতে গিয়া মুদ্রণের জন্য নির্দেশ দিয়া আসিলাম ।
    তত্ববধায়ক মহাশয় টিফিন ক্যারিয়ারে আমার সন্ধ্যার খাবার একটি কিশোরের হাতে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন । সে অবাক দৃষ্টি মেলিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আপনি এই ঘরে থাকেন ?’ আমি মস্তক নাড়াইয়া হ্যাঁ বলিবার পর কিশোরটি অভিভাবকের ন্যায় বলিল, ‘এখানে থাকিবেন না, এই গৃহে একাধিক ভুত-প্রেত আছে, পুরোহিত মহাশয়কে দেখিয়াছেন তো ? পাগলের ন্যায় “তফাত যাও তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য” চিৎকার করিতে করিতে পদযাত্রা করেন, উনি অন্নপ্রাশনের দিন ছিলেন, সবকিছু নিজ চক্ষে দর্শন করিয়া পাগল হইয়া গিয়াছেন । আপনিও এই গৃহে থাকিলে পাগল হইয়া যাইবেন ।’
    বালকটিকে মাথায় হাত বুলাইয়া একটি মুদ্রা দিয়া কহিলাম, ‘আমি যৎসামান্য পাগলই, আর পাগল হইবার সম্ভাবনা নাই ।’ সে আমার প্রতি কৌতূহলমিশ্রিত দৃষ্টি মেলিয়া পিছন ফিরিয়া বার বার আমাকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে দ্রুত পলাইয়া গেল, যেন আমিও এই খণ্ডহরের অপচ্ছায়া-সমাবেশের সদস্য ।
    জল পান করিয়া পুনরায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম । মনে হইল চতুর্দিক হইতে অট্টালিকাটি লক্ষ্য করিয়া ইষ্টকবৃষ্টি হইতেছে । ইষ্টকবৃষ্টির পাশাপাশি আগুনের মশাল ও তীরে আগুন ধরাইয়া গৃহটির ভিতর নিক্ষেপ করা হইতে লাগিল । উঠিয়া বসিলাম এবং পুনরায় দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত হইবার কারণে লজ্জিত হইলাম । কী আর করিব, স্বপ্নই হউক অথবা দুঃস্বপ্ন, তাহাদের উপর তো কোনো নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে, তাহারা যুক্তি তর্কের তোয়াক্কা করে না, যেনবা নানা প্রকার ব্যথা-যন্ত্রণার আমোদ-আহ্লাদে অভিষিক্ত করিবার জন্যই চুপিসাড়ে মস্তিষ্কে আশ্রয় লইয়াছে।
    সুটকেস হইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত গ্রন্হ লইয়া কেরোসিনের আলোয় তাঁহার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি পড়িতে পড়িতে ঘুম পাইতে লাগিল । গ্রন্হটি বিছানার শিয়রে রাখিয়া দিলাম ।
    নিশ্চিন্ত হইবার নিমিত্ত ঘুমের একটি ট্যাবলেট খাইয়া শুইয়া পড়িলাম । বেলায় উঠিলেও চলিবে । বহু আলোকচিত্র ক্যামেরাবন্দি করিয়াছি ।

    বেশ ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, মনে হইল কে একজন আমার কানের কাছে মুখ নামাইয়া আনিয়া নাম ধরিয়া ডাকিতেছে, সে পুরুষ না নারী অনুমান করিতে অক্ষম রহিলাম । আমি জাগিয়া উঠিতেই সে কোনো কথা না বলিয়া অতি সাবধানে তাহার অনুসরণ করিতে আদেশ দিল । আমি অত্যন্ত চুপি চুপি উঠিলাম । যদিও সেই অট্টালিকার প্রকাণ্ডশূন্যতাময়তায়, নিদ্রিতধ্বনি এবং এবং সজাগ প্রতিধ্বনিময় ভগ্নপ্রায় বাড়িটিতে আমি ছাড়া আর জনপ্রাণীও ছিল না, তথাপি পদে পদে ভয় হইতে লাগিল, পাছে কোনো মৃত মনুষ্য প্রাণ পাইয়া উঠিয়া দাঁড়ায়, আক্রমণকারীগণ টাঙ্গি তীর-ধনুক লাঠি দা কুড়াল প্রজ্বলিত মশাল লইয়া আমার দিকে ছুটিয়া আসে ।
    সে রাত্রে নিঃশব্দপদবিক্ষেপে সংযতনিঃশ্বাসে সেই অদৃশ্য আহ্বানছায়াকে অনুসরণ করিয়া আমি যে কোথা দিয়া কোথায় যাইতেছিলাম, আজ তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারি না । কত সংকীর্ণ অন্ধকার পথ, কত দীর্ঘ বারান্দা, কত গম্ভীর নিস্তব্ধ সুবৃহৎ সভাগৃহ, কত রুদ্ধবায়ু ক্ষুদ্র গোপন কক্ষ পার হইয়া যাইতে লাগিলাম তাহার ঠিকানা নেই ।
    আমার অদৃশ্য মায়ার ছায়াটিকে যদিও চক্ষে দেখিতে পাই নাই, তথাপি তাহার মূর্তি আমার মনের অগোচর ছিল না । আমার মনে হইল, আরব্য উপন্যাসের একাধিক সহস্র রজনীর একটি রজনী আজ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসলোক হইতে উড়িয়া আসিয়াছে । আমি যেন অন্ধকার নিশীথে মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণস্হ রাজা দশরথের সুপ্তিময় অযোধ্যার রাম-লক্ষ্মণ-সীতাহীন নির্বাপিতদীপ সংকীর্ণ পথে সংকটসংকুল পঞ্চবটীর বনবাসে যাত্রা করিয়াছি ।
    অবশেষে আমার মায়াপথিক একটি ঘননীল পর্দার সম্মুখে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া যেন নিম্নে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল । নিম্নে কিছুই ছিল না, কিন্তু ভয়ে আমার বক্ষের রক্ত স্তম্ভিত হইয়া গেল । আমি অনুভব করিলাম, সেই পর্দার সম্মুখে ভূমিতলে সাতজন উলঙ্গ খোজা কোলের উপর খোলা ভোজালি ও চাপাতি লইয়া দুই পা ছড়াইয়া দিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে, স্বপ্নে যে জনগণ গৃহটিতে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করিতেছিল, সেই ভিড়ে ইহাদেরও দেখিয়াছিলাম । বহুদেশ ঘুরিয়াছি কিন্তু ইতোপূর্বে খোজা দেখি নাই, জানি না সম্রাট অথবা শাসক একজন পুরুষকে কেমন করিয়া খোজা করিয়া তোলেন, তাহা কি খাসি করিবার পদ্ধতিতেই করা হইয়া থাকে !
    মায়াপথিক লঘুগতিতে একজনের দুই পা ডিঙাইয়া পর্দার এক প্রান্তদেশ তুলিয়া ধরিল ।
    ভিতর হইতে একটি ঘরের কিয়দংশ দেখা গেল । তক্তের উপরে কে বসিয়া আছে দেখা গেল না --- কেবল রক্তপাড় ধুতির নিম্নভাগে কালো পামশু-পরা দুইটি পা ফুটরেস্টের উপর অলসভাবে স্হাপিত রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম । মেজের একপার্শ্বে একটি বরফ-উপচানো মদিরার কাচপাত্রে শ্যাম্পেনের বোতল অতিথির জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে । ঘরের ভিতর হইতে অত্যন্ত পুরাতন নথিসমূহ ও কাগজপত্রের ধুলাধুসরিত গন্ধ আসিয়া আমাকে বিহ্বল করিয়া দিল । দেখিলাম সন্মুখবর্তী একটি বিশাল ঘরে সারি-সারি টেবিলের উপর নথিপত্রের পর্বত এবং টেবিলে মাথা রাখিয়া যুবক-যুবতীরা ঘুমাইতেছে ।
    আমি কম্পিত বক্ষে লুঙ্গি পরিহিত জনৈক খোজার প্রসারিত পদদ্বয় যেমন লঙ্ঘন করিতে গেলাম, অমনি সে চমকিয়া জাগিয়া উঠিল --- তাহার কোলের উপর হইতে লোহার চাপাতি পাথরের মেজেয় শব্দ করিয়া পড়িয়া গেল । খোজাটির মুখ দেখিয়া মনে হইল আমার কোনো একটি আলোকচিত্রে ইহার মুখ আবছা ফুটিয়া উঠিয়াছিল এবং আমি তাহাকে আলোকচিত্র মুদ্রণের ভুল অনুমান করিয়াছিলাম । চাপাতি পড়িবার শব্দে অন্যান্য খোজাগণ ও যে যুবক-যুবতীগণ টেবিলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতে ছিল তাহারা সকলেই সুপ্তাবস্হা হইতে ফিরিয়া আসিল। সেই বিশাল ঘরখানি হইতে গোলাপি রঙের একাধিক শূকর, যেগুলিকে চিনদেশে দেখিয়াছিলাম এবং কাষ্ঠের আগুনের ধোঁয়ায় সিদ্ধ মাংস রসনা তৃপ্ত করিয়াছিল, তাহারা দল বাঁধিয়া একের পিছনে আরেক ওয়িংক ওয়িংক ওয়িংক চিৎকার করিতে করিতে পলাইতে লাগিল ।
    সহসা একটা বিকট চিৎকার শুনিয়া চমকিয়া দেখিলাম, আমার সেই ক্যাম্পখাটের উপরে ঘর্মাক্ত কলেবরে বসিয়া আছি, ভোরের আলোয় কৃষ্ণপক্ষের খণ্ডচাঁদ জাগরণক্লিষ্ট রোগির মতো পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেছে -- এবং আমাদের পাগলা পুরোহিত গলায় লাল রঙের শালুতে শালিগ্রাম শিলা বাঁধিয়া প্রাত্যহিক প্রথা অনুসারে প্রত্যুষের জনশূন্য পথে “তফাত যাও তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য” বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে চলিয়াছে
    এই রূপে আমার আরব্য উপন্যাসের এক রাত্রি অকস্মাৎ শেষ হইল --- কিন্তু এখনো এক সহস্র রজনী বাকি আছে ।
    আমার দিনের সহিত রাত্রের ভারি একটা বিরোধ বাধিয়া গেল । দিনের বেলায় শ্রান্তক্লান্তদেহে আলোকচিত্রগুলি সাজাইয়া প্রবন্ধটির খসড়া লিখিবার প্রয়াসে নাজেহাল হইতাম, শূন্যস্বপ্নময়ী মায়াবিনী রাত্রিকে অভিসম্পাত করিতে থাকিতাম, আবার সন্ধ্যার পরে আমার দিনের বেলাকার কর্মবদ্ধ অস্তিত্বকে অত্যন্ত তুচ্ছ মিথ্যা এবং হাস্যকর বলিয়া বোধ হইত ।
    সন্ধ্যার পরে আমি একটা মাদকের ধুম্রময় জালের মধ্যে মৎস্যের ন্যায় বিহ্বলভাবে জড়াইয়া পড়িতাম । অর্ধশতাধিক বৎসর পূর্বেকার কোনো-এক অলিখিত ইতিহসের অন্তর্গত আর-একজন অপূর্ব ব্যক্তি হইয়া উঠিতাম, তখন আর শার্ট এবং গ্যালিসবাঁধা প্যাণ্টালুন আমাকে মানাইত না । শীতল কুয়োর জলে স্নান সারিয়া. লুঙ্গি পরিয়া, দেহে সুগন্ধি পাউডার মাখিয়া, যেন রাত্রে কোনো এক অপূর্ব ঘটনাসম্মিলনের জন্য পরমাগ্রহে প্রস্তুত হইয়া থাকিতাম ।
    তাহার পর অন্ধকার যতই ঘনীভূত হইত ততই কী-যে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিতে থাকিত তাহা আমি বর্ণনা করিতে পারি না । ঠিক যেন একটা চমৎকার গল্পের কতকগুলি ছিন্ন অংশ বসন্তের আকস্মিক বাতাসে এই খণ্ডহরপ্রতিম অট্টালিকার বিচিত্র ঘরগুলির মধ্যে উড়িয়া বেড়াইত । খানিকটা দূর পর্যন্ত যাওয়া যাইত তাহার পরে আর শেষ দেখা যাইত না । আমিও সেই ঘূর্ণমান বিচ্ছিন্ন অংশগুলির অনুসরণ করিয়া সমস্ত রাত্রি ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম, যেগুলির কপাট দিনের বেলায় বন্ধ থাকিত ।
    এই খণ্ডস্বপ্নের আবর্তের মধ্যে -- এই ক্বচিৎ ধুপ-ধুনার গন্ধ, ক্বচিৎ অগ্নিময় তীর বর্ষণ ও অগ্নিকাণ্ডের শব্দ, ক্বচিৎ বন্যলতাপাতামিশ্র বায়ুর হিল্লোলের মধ্যে একাধিক ধাবমান খোজার আক্রমণাত্মক চিৎকার ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎশিখার মতো চকিতে দেখিতে পাইতাম । তাহাদেরই রক্তবর্ণ পোশাক এবং হস্তে অস্ত্রশস্ত্র লইয়া উগ্রক্ষত্রিয় অট্টালিকাটিকে চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া ফেলিয়া “মেরে ফ্যাল, কেটে ফ্যাল, আগুন লাগিয়ে দে, চোখ উপড়ে নে, পিটিয়ে থেঁতো করে দে” ইত্যাদি আক্রোশের উক্তিতে অন্ধকার মথিত হইয়া উঠিত ।
    নৃশংস ঘটনাবলী আমাকে পাগল করিয়া দিয়াছিল । আমি প্রতি রাত্রে নিদ্রার রসাতলরাজ্যে স্বপ্নের জটিলপথসংকুল অট্টালিকাটির মধ্যে গলিতে গলিতে কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইয়াছি ।
    এক- এক দিন সন্ধ্যার সময় আয়নার দুই দিকে দুই মোমবাতি জ্বালাইয়া যত্নপূর্বক সাজ করিতেছি এমন সময় হঠাৎ দেখিতে পাইতাম, আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের পার্শ্বে ক্ষণিকের জন্য অস্ত্রধারী খোজাগণের ছায়া আসিয়া পড়িল, তাহাদের পশ্চাতে একদল ছায়াশরীর ডুগডুগি খোল-করতাল ঢোলক ভেঁপু ইত্যাদি বাজাইতেছে --- পলকের মধ্যে চাপাতি তুলিয়া আমার গর্দান লইবার জন্য তাহারা প্রস্তুত হইল এবং আমি তাহাদের প্রতিরোধ করিবার প্রয়াস করিতেই তাহারা চিন দেশের গোলাপি শূকরে পরিবর্তিত হইয়া বাতাসে মিলাইয়া গেল, হাজার হইলেও তাহারা অতীতের সম্রাট অথবা শাসকের খোজাবাহিনী, বর্তমানযুগের মনুষ্যের সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধ করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব নহে।
    একদিন অপরাহ্ণে আমি তত্ববধায়ক মহাশয়ের সাইকেল লইয়া বাহির হইব সংকল্প করিলাম --- কে আমাকে নিষেধ করিতে লাগিল জানি না -- কিন্তু সেদিন নিষেধ মানিলাম না । একটা কাষ্ঠদণ্ডে আমার শার্ট, গ্যালিসদেয়া ফুলপ্যাণ্ট দুলিতেছিল, পাড়িয়া লইয়া পরিবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময় দামোদর নদীর বালি এবং নিকটবর্তী অঞ্চলের শুষ্ক পল্লবরাশির ধ্বজা তুলিয়া হঠাৎ একটা প্রবল ঘূর্ণাবাতাস আমার সেই শার্ট এবং গ্যালিস দেয়া ফুলপ্যাণ্ট ঘুরাইতে ঘুরাইতে লইয়া চলিল এবং একটা অত্যন্ত গম্ভীর আর্তনাদ সেই হাওয়ার সঙ্গে ঘুরিতে ঘুরিতে আতঙ্কের সমস্ত পর্দায় পর্দায় আঘাত করিতে করিতে উচ্চ হইতে উচ্চতর সপ্তকে উঠিয়া সূর্যাস্তলোকের কাছে গিয়া মিলাইয়া গেল ।
    সেদিন আর সাইকেল সঞ্চালন করিয়া শরিফাবাদের পথে ভ্রমণে যাওয়া হইল না এবং তাহার পরদিন হইতে সেই শার্ট এবং গ্যালিসদেয়া ফুলপ্যাণ্ট পরা একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছি ।
    আবার সেইদিন অর্ধরাত্রে বিছানার মধ্যে উঠিয়া বসিয়া শুনিতে পাইলাম কাহারা যেন গুমরিয়া গুমরিয়া, বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে --- যেন আমার খাটের নীচে, মেঝের নীচে এই খণ্ডহরের সিমেন্টভিত্তির তলবর্তী একটা আর্দ্র অন্ধকার উদ্যানের ভিতর হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতেছে, ‘তুমি আমাদের সত্য ঘটনাবলী পৃথিবীর জনগণের সন্মুখে স্পষ্টভাবে তুলিয়া ধরো --- কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া, তুমি আমাদিগকে রাজনীতির পঙ্কিল আবর্ত হইতে তুলিয়া, বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া তোমাদের সূর্যালোকিত বিশ্বের দরবারে আমাদিগকে লইয়া যাও । আমরা বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়িয়া আছি।’

    আমি কে ! আমি কেমন করিয়া উদ্ধার করিব ! আমি এই ঘূর্ণমান পরিবর্তমান স্বপপ্নপ্রবাহের মধ্য হইতে কোন মজ্জমান বিস্মৃত মনুষ্যদিগকে তীরে টানিয়া তুলিব । তোমরা কবে ছিলে, কোথায় ছিলে হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা কোন অগ্নিকুণ্ডের ভিতর নিক্ষিপ্ত হইবার পর ভস্মে রূপান্তরিত হইয়াছিলে ? তোমরা কোন মাতার কোলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে । তোমাদিগকে কোন বেদুইন দস্যু, বনলতা হইতে পুষ্পকোরকের মতো মাতৃক্রোড় হইতে ছিন্ন করিয়া, জগতসংসার হইতে নিশ্চিহ্ণ করিয়া দিয়াছে ?
    সেখানে সে কী ইতিহাস । সেই খোজাবাহিনীর চিৎকার, বাদ্যকরদিগের শ্রুতিকটূ বাজনা, এবং শাসকের সুবর্ণমদিরার মধ্যে মধ্যে ছুরির ঝলক, বিষের জ্বালা, চাপাতির উপর্যুপরি আঘাত, অন্তহীন গোলাপি শূকরদের সারি । কী অসীম বিস্মৃতি, কী অনন্ত কারাগার । শাসক বাদশার রক্তপাড় ধুতি ও পামশুর কাছে লুটাইতেছে তোমাদিগের ইতিহাস; বাহিরের দ্বারের কাছে যমদূতের প্রতিনিধিগণ ভোল পালটাইয়া দেবদূতের মতো সাজ করিয়া, খোলা ভোজালি ও চাপাতি হাতে দাঁড়াইয়া । তাহার পরে সেই রক্তকলুষিত ঈর্ষাফেনিল ষড়যন্ত্রসংকুল ভীষণোজ্বল ঐশ্বর্যপ্রবাহে ভাসমান হইয়া, তোমরা কোন নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে অবতীর্ণ অথবা কোন নিষ্ঠুরতর মহিমাতটে উৎক্ষিপ্ত হইয়াছিলে !
    এমন সময়ে, দেখিতে পাইলাম, সেই পাগলা পুরোহিত, গলায় লাল শালুতে শালিগ্রাম শিলা বাঁধিয়া বুকের মাঝে ঝোলাইয়া, চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “তফাত যাও, তফাত যাও , সব সত্য সব সত্য সব সত্য।” চাহিয়া দেখিলাম, সকাল হইয়াছে ; তত্ববধায়ক মহাশয় ডাকের চিঠিপত্র লইয়া আমার হাতে দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ কিরূপ ভোজন প্রস্তুত করিতে হইবে ।
    আমি কহিলাম, না, আর এ অট্টালিকার খণ্ডহরে থাকা হয় না ।
    সেই দিনই আমার জিনিসপত্র তুলিয়া হোটেলে গিয়া উঠিলাম, বৃদ্ধ শ্যালকের গৃহে আশ্রয় লইলে ইয়ার্কি করিত । হোটেলের রিসেপশানিস্ট যুবতীটি আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিল । আমি তাহার হাসিতে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর না করিয়া লিফ্টে চাপিয়া নির্দিষ্ট ঘরে চলিয়া গেলাম ।
    যত বিকাল হইয়া আসিতে লাগিল ততই অন্যমনস্ক হইতে লাগিলাম -- মনে হইতে লাগিল, এখনই কোথায় যাইবার আছে --- আলোকচিত্রের কাজটা নিতান্ত অনাবশ্যক মনে হইল, ইন্টারন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের দায়িত্বও আমার কাছে বেশি-কিছু বোধ হইল না --- যাহা-কিছু বর্তমান, যাহা-কিছু আমার চারিদিকে চলিতেছে ফিরিতেছে খাটিতেছে খাইতেছে সমস্তই আমার কাছে অত্যন্ত দীন অর্থহীন অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল ।
    আমি লিফ্ট দিয়া নামিয়া একটি রিকশ ভাড়া করিয়া রিকশঅলাকে কোনো নির্দেশ ব্যতিরেকে সিটে বসিলাম । দেখিলাম, রিকশঅলা ঠিক গোধূলিমুহূর্তে আপনিই সেই ভগ্নপ্রায় খণ্ডহরের ইষ্টকদ্বারা বন্ধ দ্বারের কাছে গিয়া থামিল । ভাড়া মেটাইয়া দ্রুতপদে নিজের পূর্বের ঘরে প্রবেশ করিলাম।
    আজ সমস্ত নিস্তব্ধ । অন্ধকার ঘরগুলি যেন রাগ করিয়া মুখ ভার করিয়া আছে । অনুতাপে আমার হৃদয় উদবেলিত হইয়া উঠিতে লাগিল, কিন্তু কাহাকে জানাইব, কাহার নিকট মার্জনা চাহিব খুঁজিয়া পাইলাম না । আমি শূন্য মনে অন্ধকার ঘরে অবহেলিত উদ্যানের লতাপাতার জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম । ইচ্ছা করিতে লাগিল এককখানা সঙ্গীতযন্ত্র হাতে লইয়া অদৃশ্য ছায়াশরীরদের উদ্দেশ করিয়া গান গাহি ; বলি, ‘হে প্রেতাত্মাগণ, যে আলোকচিত্রী তোমাদের কাহিনি উদ্ঘাটন করিতে না পারিয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, সে তোমাদিগের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার জন্য আসিয়াছে । এবার তাহাকে মার্জনা করো, তাহার দুই পক্ষ দগ্ধ করিয়া দাও, তাহাকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলো।’
    হঠাৎ উপর হইতে আমার কপালে দুই ফোঁটা অশ্রুজল পড়িল । সেদিন শরিফাবাদের সন্ধ্যাকাশে ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছিল । দামোদরের মসীবর্ণ জল একটি ভীষণ প্রতীক্ষায় স্হির হইয়াছিল । জলস্হল আকাশ সহসা শিহরিয়া উঠিল ; এবং অকস্মাৎ একটা বিদ্যদ্দন্তবিকশিত ঝড় শৃঙ্খলছিন্ন উন্মাদের মতো শরিফাবাদের ভিতর দিয়া আর্ত চিৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল । খণ্ডহরের শূন্য ঘরগুলো সমস্ত ভগ্নদ্বার আছড়াইয়া তীব্র বেদনায় হু হু করিয়া কাঁদিতে লাগিল ।
    আজ এখানে আলো জ্বালাইবার কেহ ছিল না । সেই মেঘাচ্ছন্ন অমাবস্যার রাত্রে খণ্ডহরের ভিতরকার নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে আমি স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিলাম -- তিনচারিজন মানুষ উঠানে উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে এবং একজন প্রৌঢ়া দুই দৃঢ়বদ্ধমুষ্টিতে আপনার আলুলায়িত কেশজাল টানিয়া ছিঁড়িতেছে, তাহার গৌরবর্ণ ললাট দিয়া রক্ত ফাটিয়া পড়িতেছে, কখনো সে শুষ্ক তীব্র অট্টহাস্যে হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিতেছে, কখনো ফুলিয়া ফুলিয়া ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে । মুক্ত বাতায়ন দিয়া বাতাস গর্জন করিয়া আসিতেছে এবং মুষলধারে বৃষ্টি আসিয়া তাহার সর্বাঙ্গ অভিষিক্ত করিয়া দিতেছে ।
    সমস্ত রাত্রি ঝড়ও থামে না, ক্রন্দনও থামে না । আমি নিষ্ফল পরিতাপে গৃহের অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম । কেহ কোথাও নাই ; কাহাকে সান্ত্বনা করিব । এই প্রচণ্ড অভিমান কাহার । এই অশান্ত আক্ষেপ কোথা হইতে উথ্থিত হইতেছে ।
    শুনিতে পাইলাম, পুরোহিত চিৎকার করিয়া উঠিল, “তফাত যাও, তফাত যাও । সব সত্য সব সত্য সব সত্য ।”
    দেখিলাম ভোর হইয়াছে এবং পুরোহিত মহাশয় এই দুর্যোগের দিনেও গলায় লাল শালুতে শালিগ্রাম শিলা ঝোলাইয়া যথানিয়মে খণ্ডহরের সন্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার অভ্যস্ত চিৎকার করিতেছেন । হঠাৎ আমার মনে হইল, হয়তো ওই পুরোহিতও আমার মতো এক সময় এই প্রাসাদে বাস করিয়াছিলেন, এখন পাগল হইয়া বাহির হইয়াও এই খণ্ডহরের বিস্মৃত ইতিহাসের মায়াজালে আকৃষ্ট হইয়া প্রত্যহ প্রত্যুষে স্মৃতি জাগরিত করিতে আসেন ।
    আমি তৎক্ষণাৎ সেই বৃষ্টিতে পুরোহিতের নিকট ছুটিয়া গিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পণ্ডিত মহাশয় , কোন ঘটনাকে আপনি প্রতিদিন সত্য বলিয়া ঘোষণা করিয়া চলিয়া যান ?”
    তিনি আমার কথায় কোনো উত্তর না করিয়া আমাকে ঠিলিয়া ফেলিয়া অজগরের কবলের চতুর্দিকে ঘুর্ণমান মোহাবিষ্ট পক্ষীর ন্যায় চিৎকার করিতে লাগিলেন । যেন প্রাণপণে নিজেকে সতর্ক করিবার জন্য বারংবার বলিতে লাগিললেন, “তফাত যাও, তফাত যাও, সব সত্য সব সত্য সব সত্য ।”
    আমি সেই ঝড়জলের মধ্যে পাগলের মতো শ্যালকের গৃহে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহার অর্থ কী আমায় খুলিয়া বলো।”
    শ্যালক যাহা কহিল তাহার মর্মার্থ এই : একসময় শরিফাবাদের ঐ অট্টালিকায় ফুলে-ফলে ভরা উগ্রক্ষত্রিয়দের বৈভবশালী পরিবার বাস করিত । তাহাদের আত্মগর্বী বৈভব ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি দেখিয়া বহু মানুষ বিদ্বেষ ও হিংসায় আলোড়িত হইত --- সেই সকল চিত্তদাহে, সেই সকল ক্রোধোন্মত্ত জনগণের ঈর্ষায় এই অট্টালিকার প্রত্যেক নোনালাগা ইষ্টক ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত হইয়া আছে, সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে বিস্মরিত স্মৃতিতে মুড়িয়া ফেলিতে চায় । যাহারা ঘটনার দিন ওই খণ্ডহরে ছিল , তাহাদের মধ্যে কেবল পুরোহিত মহাশয় পাগল হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছেন, এ পর্যন্ত আর কেহ তাহার গ্রাস এড়াইতে পারে নাই । রাত্রির পর রাত্রি, শীতল উদাসীনতায় আচ্ছন্ন গৃহনিবাসীগণ পাতালের ভুতগ্রস্ত দ্বারগুলি খুলিয়া, তাহাদের অপূরণীয় শোকে আক্রান্ত চক্ষু হইতে অগ্নির অশ্রুবর্ষণ করে, প্রতিশোধস্পৃহার উন্মাদ নৃত্যে অবর্ণনীয় অপচ্ছায়াদের সহিত রহস্যময় বার্তালাপ করে, অপরাধীগণ নিজদিগের আত্মায় কলঙ্ক ও শিরায় বরফপ্রবাহ লইয়া অচেনা ভয়ে মুখহীন দেহ লইয়া পলাইয়া বেড়ায় ।
    আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার বিস্মৃতির কি কোনো পথ নাই ।”
    শ্যালক কহিল, “একটিমাত্র উপায় আছে, তাহা অত্যন্ত দুরূহ । তাহা তোমাকে বলিতেছি --- কিন্তু তৎপূর্বে এতদ্দেশের জনৈক রক্তপাড় সম্রাটের পুরাতন ইতিহাস বলা আবশ্যক । তাঁহার স্কন্ধের উপর মস্তক ছিল না বলিয়া কিংবদন্তি প্রচলিত । তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া রাত্রিবেলায় কঙ্কালেরা নৃত্য করিত এবং উর্দ্ধমুখ শৃগালেরা অমাবস্যার অন্ধকারে ক্রন্দন করিত । তেমন আশ্চর্য এবং তেমন সন্দেহজনক ও শাসন ব্যবস্হায় সম্পূর্ণ উদাসীন মনুষ্যের আয়েশি জীবনের ঘটনা সংসারে আর কখনো কোথাও ঘটে নাই । ইতিহাসে তাঁহাকে একপ্রকার ভ্যামপায়ার হিসাবে চিহ্ণিত করা হইয়াছে”

    এমন সময়ে বিমানবন্দরে ঘোষণা হইল দমদমগামী বিমান আসিতেছে , যাত্রীগণ সিকিউরিটি চেক করাইয়া লউন । এত শীঘ্র ? একজন চিনা বৃদ্ধ ইলেকট্রনিক বোর্ডে বিমানের গন্তব্য ও সময় পড়িবার চেষ্টা করিতেছিল, আমার সহযাত্রী বন্ধুটিকে দেখিয়াই ‘নি হাও’ বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল এবং জড়াইয়া ধরিল । আমরা সিকিউরিটি চেকের জন্য নির্দিষ্ট দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলাম । কৃষ্ণত্বক বাবুটি যে কে, খবর পাইলাম না, গল্পেরও শেষ শোনা হইল না । নিজের নাম বলিতেছিল মলয় রায়চৌধুরী, যেন তিনি জাদুকর পি সি সরকার, জগতসংসারে মানব মাত্রেই নামটির সহিত পরিচিত ।
    আমি বলিলাম, লোকটা আমাদিগকে বোকার মতো দেখিয়া কৌতুক করিয়া ঠকাইয়া গেল, গল্পটা আগাগোড়া বানানো ।
    এই তর্কের উপলক্ষে আমার সমাজবাদী ঠিকেদার আত্মীয়টির সহিত আমার জন্মের মতো বিচ্ছেদ ঘটিয়া গিয়াছে । ক্বচিৎ-কখনও সংবাদপত্রে তাঁহার সম্পর্কে পড়িয়া জানিতে পারি সরকারি ঠিকেদারির মাধ্যমে প্রভূত সম্পত্তি করিয়াছেন, শহরের পেজ থ্রি সুন্দরীগণের কোমরবেষ্টিত হস্তে ছিটকাপড়ের জামা পরিহিত তাঁহার হাস্যময় মুখ দেখা যায় ।
  • m | 012312.60.8923.236 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:১০541290
  • অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর গদ্য বুঝে ওঠার চেষ্টা
    মলয় রায়চৌধুরী
    পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন অর্ঘ্য, দাঁড়ান গুনে বলছি কতোগুলো গদ্য আছে বইটায়, হ্যাঁ, সাতটা, তবে মাসখানেকের বেশি নানা সময়ে পড়েছি বলে জানি না, একআধটা হারিয়ে ফেললুম কি না ।
    পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে প্রথম যে ভাবনাটা মাথায় এলো, তাহলো এই যে কতো বছর বয়সে লেখকীয় ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বক্সী ?
    কোনো কিছু পড়ায় আমার বদভ্যাস হল যে অবান্তর চিন্তায় হারিয়ে যাই, ফলে আবার ফিরে আসতে হয় যেখান থেকে শুরু করেছিলুম সেখানে ; এই করে অর্ঘ্যর গদ্যগুলো পড়ে উঠতে বেশ সময় লেগে গেল । সাতাত্তর বছর বয়সে ডাইগ্রেশন স্বাভাবিক, নয়কি ?
    এই বয়সে সাহিত্য আলোচনা করতে আমি বড়োই অনাগ্রহী ।
    লরেন্স স্টার্ন অবশ্য বলে গেছেন যে ‘পড়তে বসে হারিয়ে যাওয়া হলো সূর্যের আলো, জীবন, বই পড়ার আত্মা’। সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে যে গদ্যটা পড়ছিলুম, দুপুরে অন্য একটা গদ্যে আটকে যাই ; পরের দিন আবার আরেকটা অন্য গদ্য।
    পাণ্ডুলিপি পড়ে বইয়ের সামনে দিকে দুচারপাতা লিখতে বলেছেন অর্ঘ্য আর ওনার বন্ধু মৃগাঙ্কশেখর ।
    প্রস্তাবটা পেয়ে ভাবছিলুম যে আমার মতন একজন কমব্যাট্যান্টকে কেন ! আমাকে যা ক্রুদ্ধ করে, প্যাশনেট করে তোলে, অসংযত করে তোলে, বিরক্ত করে, মানুষের যা অপছন্দ করি, তা কি অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর ক্ষেত্রেও একই ? তিনিও কি আমার মতন সমাজের হাতে বিধ্বস্তদের পক্ষে ভাবতে বসে ডিসটার্বড ? মানে খুঁজে বেড়ান যা কিছু অতর্কিত, তাইতে ? পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতন অর্থহীন শব্দবন্ধের বদলে ইনোভেটিভ শব্দটা ব্যবহার করতে চান ?
    প্রথম পাঠে মনে হলো, অর্ঘ্য সম্ভবত স্বীকার করেন যে লেখকীয় কাজ যদি সত্য হতে হয়, তাহলে তাকে মানব-মনের গভীর, অন্ধকার, অসুস্হ, হেজে-যাওয়া, বিরক্তিকর কোনগুলোতে জোর-জবরদস্তি ঢুকে পড়তে হবে, কেবল ইনোভেশান দিয়ে সামলানো যাবে না। তারপর তো পাঠকের দায়িত্ব সেই কাজে অজস্র রাস্তা খুঁজে পাওয়া ।
    কিন্তু আমি অনেক বইকে কেবল ফিকশান বলে মনে করি, যেমন সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের বই, এতো ভালো উপন্যাস কম লেখকই লিখেছেন । আমি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি সবই ফিকশান বলে মনে করি, ইতিহাস বলে মনে করি না ; যেমন মঙ্গলকাব্যের কাহিনিগুলো । তাই কোন চরিত্র কেন অমন আচরণ করলো, তার দায়-দায়িত্ব পাঠকের বলে মনে করি, লেখকের নয় ।
    পুতুল নাচের ইতিকথায় শশির এরেকটাইল ডিসফাংশান ছিল কিনা তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে যাননি, তার কারণ ওটা একটা ফিকশান । যে যেমন চায় ব্যাখ্যা করবে ।
    একটি সাহিত্যকর্মকে তার নিজের গুণে দাঁড়াতে হয়, যেমন রামায়ণ মহাভারত দাঁড়িয়ে আছে , কৃতিত্বটা বাল্মীকির ও ব্যাসদেব নামের লেখকদের । বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে আমি ভেতরে ঢুকে দেখে এসেছি, অযোধ্যায় বহুবার গেছি চাকুরিসূত্রে । আমার কখনও বিশ্বাস হয়নি যে রামায়ণ কাহিনির রামের ওটা জন্মস্হান আর জন্মশহর । কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর গেছি । সবই গল্প । বরং কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে-থাকা মহেঞ্জোদারোর কিশোরীটি আসল, এখনও কিশোরীরা অমন ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে ।
    রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে অর্ঘ্যর আগ্রহ এবং মহাকাব্যগুলির চরিত্রদের নিয়ে তিনি খেলেছেন নিজের মতন করে, সেঁদিয়ে গেছেন ভেতরে ভেতরে ।
    আমি ভাবি যে রামায়ণ-এর গল্পটা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, আশেপাশে কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ল, আর ছড়িয়ে পড়ার সময়ে মূল রামায়ণ থেকে সরে গিয়ে যে-যার নিজের মতো করে গল্পটা তৈরি করে ফেলল, চরিত্রদের ওলোট-পালোট করে ফেলল । এই একই ব্যাপার মহাভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি কেন ? ব্যাসদেবরা মহাভারতে যেমন যে-যার নিজেদের লেখা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, তা কেন সম্ভব হয়নি রামায়ণের বেলায় ? শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধাকেই বা কারা জুড়ে দিয়েছিল, মহাভারতে তো নেই !
    বাঙালিদের বাড়িতেও দেখি গোপাল, নাড়ুগোপাল, দোলগোবিন্দ, রাধাগোবিন্দ, রাধাকেষ্ট ইত্যাদি । তা বাঙালিরা রাধাকে কবে আর কোথা থেকে পেলো ? বঙ্গদেশে আমদানি-করা উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণরা এনেছিল কি নিজেদের পুঁটলিতে বেঁধে ? ব্রাহ্মণরা বঙ্গদেশে আসার আগে এখানকার দেবী-দেবতা এবং মিথগুলো কেন হারিয়ে গেল ! বৌদ্ধধর্মের দেবী-দেবতারাই বা চিরকালের জন্য কেন লোপাট হয়ে গেল !
    ন্যারেটিভে সোমরস প্রসঙ্গ এলে বেশ হতো, কেননা ওটা যে ঠিক কী জিনিস আমি আজও জেনে উঠতে পারিনি ।
    সরি, আবার ডাইগ্রেশন ঘটিয়ে ফেলছি ।
    সে যাক, পুতুল নাচের ইতিকথা নিজের গুণে দাঁড়িয়ে আছে ।
    একজন লেখক স্রেফ তার সৃজনকর্মের গাদ । রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ লেখকদের মতন তাঁদের আড়ালে চলে যাওয়া উচিত ।
    এর আগে কয়েকটা বইয়ের মুখবন্ধ বা ইনট্রো, ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের, যা-ই বলুন, লিখেছি বটে, কিন্তু ন্যারেটিভ নিয়ে এরকম নিজের সঙ্গে নিজে বার্তা-বিনিময়ের একাধিক কন্ঠস্বরের নিরীক্ষা, মেইনস্ট্রিমের বাইরে বেরিয়ে, ফাঁকা জায়গায় শ্বাস নেবার ইনোভেশানের লেখা নিয়ে লিখিনি ।
    বলা যেতে পারে, অর্ঘ্য আমাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন ।
    পড়তে গিয়ে আমি কোন গদ্যের পর কোন গদ্য, তাও বিছানায় শুয়ে, আরামচেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের টেবিলে ঠ্যাঙ তুলে, আর ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ার সময়ে গোলমাল করে ফেলেছি । অবশ্য জানি, অর্ঘ্যর তাতে খুব-একটা কিছু আসে যায় না । ছাপাতে দেবার আগে সাজিয়ে নেবেন ।
    অর্ঘ্য তাঁর প্রোটোফিকশানগুলোকে বলেছেন প্রগল্প । মনে হয় প্রথানুগত গল্প বলার কায়দাকে তিনি কনটেম্পচুয়াস মনে করেন । স্বাভাবিক । বালজাক বলেছিলেন যে, ফিকশান লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তনরত মূল্যবোধের ভয়াবহ প্রকোপ ফাঁস করে দেয়া । বালজাকের সময় থেকেই নয়, মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিষ্ঠুরতা আবিষ্কার করেছে, সভ্যতার প্রসারে তা কাজে লাগিয়েছে । তা সত্ত্বেও ভাবুক ও সাহিত্যিকরা আশা করেন যে মানুষ মানবতাবাদী হবে, সাম্যবাদী হবে, কল্যাণকামী হবে, যুক্তিতে বিশ্বাস করবে, ইত্যাদি । এদিকে দেখতে দেখতে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থব্যবস্হার রক্ষিতা বা জিগোলো ।
    অর্ঘ্য ইচ্ছানুযায়ী ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, চিন্তার স্রোত বজায় রাখার কারণে, আমিও লিখতে বসে মগজে ইংরেজি শব্দ এসে গেলে তা-ই করবো ।
    অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যে বিদেশি লেখদের কথা মনে এলো, তাঁরা উলিয়াম বারোজ, ইশমায়েল রিড, টেরি সাদার্ন, কার্ট ভনেগাট, রিচার্ড ব্রটিগান, টমাস পিনচন নয়, কেননা এঁরা একরৈখিকতা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যেতে পারেননি, এঁরা নির্ভর করেছেন প্রচলিত ন্যারেটিভের ডিভাইসের ওপর ; ফিকশান ও গদ্যের প্রথাকে ভেঙে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াসের বদলে ফিকশানের ফিকশানালিটিকে মান্যতা দিয়েছেন ।
    অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যাঁদের কথা মাথায় এলো তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য মেরি গেইটস্কিল, কেথি অ্যাকার, গ্যারি ইনডিয়ানা, কারেন ফিনলে, ডেনিস কুপার, ডেভিড ওজনারোইজ প্রমুখ ।
    হয়তো অর্ঘ্যের অবচেতনায় জাঁ জেনে, লুই ফার্দিনান্দ সেলিনে, জর্জ বাতাই, মরিস ব্লাশোঁ প্রমুখের রচনা পাঠের রেশ থেকে গেছে । এঁদের গদ্য ভিশনারি ও কাব্যিক মোডের । অর্ঘ্য নিজেই স্বীকার করেছেন ঋত্বিক ঘটক থেকে পাওয়া তাঁর প্রোটোফিকশানের উপাদান প্রাপ্তির ।
    হাংরি আন্দোলনের গদ্যকার সুভাষ ঘোষ ও সুবিমল বসাকের কথাও উল্লেখ করতে চাইবো, তুলনা নয়। তবে প্রথানুগত ন্যারেটিভ টেকনিকের কারণে বাসুদেব দাশগুপ্তের গদ্যের তুলনা করবো না । একই কারণে উল্লেখ করতে চাই না সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ফিকশান এবং শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের । শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররা মুক্ত সূচনা দিয়ে আরম্ভ করলেও তাঁরা একরেখিকতা ও বদ্ধ সমাপ্তির বাঁধন থেকে বেরোতে পারেননি, তাঁদের চরিত্ররা কেলাসিত রয়ে গেছে ।
    উল্লেখ করতে চাইবো রবীন্দ্র গুহ, অজিত রায়, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সৌগত বালী প্রমুখের ইনোভেটিভ গদ্য ।
    সুবিমল মিশ্রকেও উল্লেখ করতে চাইবো, তাঁর টাইপোগ্রাফিকাল ইমেজখেলা ও অক্ষরকোলাজ বাদ দিয়ে। সুবিমল মিশ্রের একজন শিষ্য, স্বপনরঞ্জন হালদারের একটা বই আমি আলোচনা করেছিলুম, কিন্তু সেই সময়ের কমিউনিস্টদের রোগ থেকে বেরোতে পারেননি উনি, মুখ ফুটে বলতে পারেননি রক্তচোষার দিগ্বিজয়, উল্টে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের গুরুঘণ্টাল পিঁজরাপোল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর অপমানজনক সমালোচনা করেছিলেন ।
    ইনোভেটিভ গদ্যের এই এক বিপদ, কে যে কোথা থেকে ঢুকে পড়বে আর জিনিয়াসগিরির দাবি করবে স্পষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে ।
    যাঁদের নাম উল্লেখ করলুম, তাঁরা সকলেই, অর্ঘ্যের মতন, জানতেন যে সাহিত্যের রিসেপশানের মণ্ডপে ঢোকার মুখে তাঁদের পড়তে হবে বাউন্সারদের পাল্লায় । কারণ এনারা ফিকশানের সংজ্ঞা ও মূল্যবোধের মালিকানা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চেয়েছেন ।
    আগের প্রজন্মের ওই লেখকদের লেখনজগতকে সরিয়ে এগোবার রাস্তা বের করতে হয়েছে অর্ঘ্যকে । শব্দ মুচড়ে গড়া ভাষা এবং আইডিয়া ও চিন্তা দিয়ে গড়া ভাষার যে গভীর পার্থক্য আছে তা নিজের গদ্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অর্ঘ্য ।
    এক বাসুদেব দাশগুপ্তকে ছাড়া, মেইনস্ট্রিম বাংলা সাহিত্য অন্যান্যদের নিয়ে চিন্তা করেনি, তার কারণ অবিরাম বদলাতে থাকা সংস্কৃতির, ভাষাসংস্কৃতির প্রতি, আলোচকরা খেয়াল নিয়োজিত করেননি।
    অর্ঘ্যর হাতে পড়ে প্রতিটি অবজেক্ট মর্মার্থে ভরপুর হয়ে উঠেছে, কিন্তু অবজেক্টের মর্মার্থ প্রতিটি পাঠকের কাছে একই বার্তা পৌঁছে দেবে, তা আশা করা যায় না, কেননা অর্ঘ্যের মতামত তাতে কুঁদেকুঁদে ব্যক্তিগত গোপনতাসহ রাখা আছে, সবায়ের অভিজ্ঞতার বনেদ তো একই নয় ।
    অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে কোনো বিশেষ জনারে চিহ্ণিত করা যাচ্ছে না বলে আমি বলেছি প্রোটো-ফিকশান ; গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে অর্ঘ্য একজন Neo-gnostic, গোপন জ্ঞানের ভাঁড়াররক্ষক।
    শিরদাঁড়ার শীতল সিরসিরানিকে নিজের গদ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন অর্ঘ্য । সম্ভবত যখনই এই সিরসিরানি তাঁর অস্তিত্বে ঘটে তখন তিনি বাক্যগুলোয় যাতে তা থাকে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছোয়, তার প্রয়াস করেন । পড়ার সময়ে পাঠক টের পান ঠিক কী ধরণের শীতলতার টর্চার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে, চরিত্রগুলোকে রাস্তা থেকে, চায়ের ঠেক থেকে, গ্রন্হ থেকে, স্মৃতি থেকে, পুরাণ থেকে, তুলে আনার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, কিংবা হয়তো কল্পনায় তৈরি করে নিতে হচ্ছে, ন্যারেটিভের জটিলতার সূক্ষ্ম তারতম্যকে বাছাই করতে হচ্ছে, কেননা মুহূর্তবিশেষের প্রয়োজনীয়তার দিকে খেয়াল দিতে হচ্ছে অর্ঘ্যর ন্যারেটিভকে ।
    কতো কতো ফিকশান পৃথিবী জুড়ে লেখা হয়ে চলেছে । তাদের লেখক-নির্মিত চরিত্ররা কি পৃথিবীর অদৃশ্য জনসংখ্যার একটা সমান্তরাল খাড়া করছে না ? পরের প্রজন্মের লেখকরা ওই অদৃশ্য জনসমুদায়ের সঙ্গে মিশে তাদের একজন হবার প্রয়াস করেন এবং সেই অদৃশ্য জগত থেকে বেরিয়ে এসে দৃশ্যমান জগতে নিজেই গড়ে তোলেন অদৃশ্য চরিত্রদের, পাঠকদের সামনে ছেড়ে দেন তাদের ।
    গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে যে আমরা জগতসংসারকে আর আধিবিদ্যক এবং মিসটিকাল পাটাতনে ফেলে বিচার না করলেও, ব্যাপারটা হলো যে ভারতীয় মিথগুলো আমাদের জাগিয়ে তোলার অপেক্ষায় থাকে, যাতে আমরা তা খোলা চোখেই দেখতে পারি । দুর্ভাগ্য যে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক- সংস্কৃতিকে ঘেরাও করে নিয়েছে কিৎশ -- যেন একেবারে হোস্টেজ সিচুয়েশান ।
    অর্ঘ্যকে সংলাপ আবিষ্কার করতে হয়েছে, যাতে যে অভিজ্ঞতা তাঁর ঘটছে, তার সঙ্গে সংলাপগুলো খাপ খেয়ে যায় । আমরা তো সদাসর্বদা শব্দের মাধ্যমে চিন্তা করি না ; আমাদের ভেতরের গভীরতম এলাকাকে পুরোপুরি ধরতে সক্ষম হয় না কথাবার্তা । শব্দদের নিজস্ব সত্য ও সত্তা থাকে, এবং তা বেরিয়ে পড়ে তার আওয়াজের বা স্ফোটনের সূত্রে । ফলে বস্তু-বিশেষের সঙ্গে শব্দেরা হুবহু মিলে যেতে অস্বস্তি বোধ করে । বিভাবসু, কবি, এই কারণে শব্দগুলোকে ধ্বনিভিত্তিক করে নিয়ে লেখেন ।
    শব্দগুলোর নিজের নিজের ক্ষুধা থাকে এবং তারা তা-ই খেতে চায় যার অভিজ্ঞতা লেখকের হয়েছে। সমস্যা হল যে পাঠক-বিশেষের সেই একই অভিজ্ঞতা না-ও থাকতে পারে । ভিন্ন কিছু গড়ে তোলার জন্য ভাষাকে প্রয়োগ করতে অর্ঘ্য বাধ্য হন, কেননা জীবন আর ভাষা একই ব্যাপার নয় । বস্তুত পরাবাস্তব তখনই কাজ করে যখন তা বাস্তব থেকে চাগিয়ে উঠছে ।
    যা বলা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে, তা এক ব্যাপার, কিন্তু যা বলা হচ্ছে না, বা লেখা হচ্ছে না, তাও উপস্হিত থাকছে অর্ঘ্যর গদ্যে । যা লেখা হয়নি অথচ তা লিখিত পাঠবস্তুর সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা লেখক অনুভব করতে পারেন এবং তাঁর লেখাটা এমনই হওয়া দরকার যে পাঠকও ওই ভাসতে থাকা মর্মার্থের সঙ্গে নিজেকে মিশ-খাওয়াতে পারবে ।
    অর্ঘ্যর বাক্যগুলো এলিপটিকাল, অনেকসময়ে ছোটো-ছোটো স্ফোটন জুড়ে-জুড়ে তৈরি, বাস্তব জগতকে অবিরাম স্ক্যানিং করার জন্য, যে বাস্তব জগত অর্ঘ্যর বয়সি যুবকের কাছে সতত পরিবর্তিত ও উপস্হাপিত হয় মেটাবলিজমের ও হরমোনের, প্রধানত প্রজেস্টেরনের, মাধ্যমে ।
    গদ্যের মাঝে আচমকা উদয় হন অর্ঘ্য। মেইনস্ট্রিম আলোচনায় শৈলীটা মনে হতে পারে সাধারণ্যের শৌখিন শোভনতাকে আক্রমণের পরিবর্তে এক ধরণের অমার্জিত মর্ষকামী বিকৃতি । ওই সাহিত্যিক প্রেজুডিসকেই তো বিধ্বস্ত করতে চাইছেন অর্ঘ্য, গদ্যের নান্দনিক স্ট্র্যাটেজির বর্শাফলক দিয়ে ।
    বেশ আনন্দের সঙ্গে স্যাটায়ার প্রয়োগ করেছেন অর্ঘ্য । স্যাটায়ার ব্যাপারটা একই সঙ্গে নীতিমূলক আর রাজনৈতিক । বলা চলে লেখকের বুনো ক্রোধের তরোয়াল লুকোবার খোপ । স্যাটায়ার হলো বাঁশের তৈরি ‘হস্তশিল্পের’ চোঁচ, যা ফুটে গেলে সময়মতো বের করে না দিলে বিষিয়ে কেলেঙ্কারি ঘটাতে পারে ।
    অর্ঘ্য ওনার গদ্যে নিজের প্রতিস্বে ব্যক্তিএককের ইউনিকনেস যেমন দিয়েছেন, তেমনই ওই ইউনিকনেসকে গুলিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন । পাঠককে ধৈর্য ধরে এগোতে হবে । গ্রিক দেবতা জানুসের যেমন দুটো মুখ ছিল, মুক্ত সূচনার ও মুক্ত সমাপ্তির, যে দেবতার কোনো পুরোহিত ছিল না, অর্ঘ্যর গদ্যকে তেমনই দুই দিক থেকে বুঝতে হবে ।
    অর্ঘ্যকে প্ররোচিত করে আইডিয়া ও চিন্তা, এবং তাঁর অ্যাড্রেনালিনের উৎস ওনার আইডিয়া-বিশেষ, এক-একটি আইডিয়া উদয় হয় আর তা থেকে কথন-প্রক্রিয়া ধার নিয়ে এগোতে থাকেন । আইডিয়ার ফিকশান, যদিও অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে ফিকশনের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা ভুল হবে, অবহেলিত থেকে গেছে, যেমন অতীন্দ্রীয় পাঠকের গদ্যগুলোর ক্ষেত্রে ।
    অর্ঘ্যর উদ্ভাবনা আনফেটার্ড, হয়তো বাক্যগঠনে আকস্মিকতা তাঁর অজানিতেও ঘটে গেছে, প্রতিরূপ উপস্হাপনে অবসেসিভ, বারবার বলেছেন একই কথা বা ঘটনা, তাঁর কনসেপচুয়ালাইজেশান নির্বাধ ।
    সাহিত্যিক ইনোভেশান বিকল্পকে দৃষ্টিগোচর এবং কল্পনাসাধ্য করে তোলে, আর এই সমস্ত বিকল্পের মধ্যে থেকেই ভবিষ্যতের বনেদ গড়ে ওঠে, লেখালিখির সম্পূর্ণ নতুন পাটাতন, যা কালক্রমে মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে চুয়ে পড়ে । ইনোভেশানকে বলা যায় সাহিত্যিক রদবদলের ও পুনরুদ্ধারের ইনজিন ; সাহিত্য নিজেই নিজেকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরাবিষ্কার করে ।
    ইনোভেশান হলো জড়তাহীন, লৌকিকতাবর্জিত, রীতিনীতি অস্বীকারকারী, কাটিং-এজ সাহিত্য, যাতে থাকে অভিঘাতের লক্ষ্য, অপমানকরার উদ্দেশ্য, আইকনোক্লাজম ও জটিলতার মারপ্যাঁচ ।
    অর্ঘ্য লক্ষ্য স্হির করেছেন নিপুণ বাক-প্রতিবেদন আবিষ্কারে, আসঙ্গময় কন্ঠস্বরে, এবং প্রয়োগ করেছেন তাঁর দৃষ্টিপ্রতিভা, পথ কেটে বের করেছেন ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতর দিয়ে, এবং স্ট্রোব লাইটের ঝলকানির সাহায্যে এগিয়ে গেছেন, জীবন প্রকৃতপক্ষে কী তার রহস্য অনুসন্ধানে, লিঙ্গোথ্থান হয় না এমন যৌন-প্রসঙ্গ এনেছেন, চুরো-করা বাক্যাংশের দুমড়ে ফেলা ছবি উপস্হাপনের সাহায্যে । পাঠকদের ধাঁধিয়ে দিতে পেছপা নন অর্ঘ্য ।
    নিৎশে বলেছিলেন ‘অশুদ্ধ চিন্তা”র কথা । তাঁর মতে, জীবনের বাস্তব ঘটনাবলীর সঙ্গে যখন বিমূর্ততা মিশে যায় তখন ‘অশুদ্ধ চিন্তা’ প্রশ্রয় পায়, পেয়ে বসে মানুষের ওপর, দুটোকে ছাড়িয়ে তারপর আলাদা করা যায় না । অর্ঘ্য বহু ক্ষেত্রে বিমূর্তের সঙ্গে বাস্তব জীবনের ঘটনাবলীকে উস্হাপন করেছেন ।
    অর্ঘ্য মনুস্মৃতির প্রসঙ্গ এনেছেন কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতির প্রসঙ্গে তোলেননি, যখন কিনা কাব্যিক আঙ্গিকে রচিত যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে সাহিত্যিক কাজ বলা যায়, এবং যা মনুস্মৃতির পরবর্তীকালে লেখা । ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের পরিকল্পনা চরিতার্থ করার জন্য, প্রথম জনগণনার সময়ে ব্রাহ্মণদের সাহায্য নিয়ে মনুস্মৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছিল, অথচ ততোটা গুরুত্ব দেয়নি যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে। প্রথম সেনসাসের চতুবর্ণকে প্রতিষ্ঠা করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র থেকে হিন্দু বাঙালি সমাজ আর বেরোতে পারেনি ; ব্রাহ্মণরা বাঙালি ক্ষত্রিয়দেরও শুদ্রে বর্গীকরণ করে দিয়েছিল, যে কারণে পিছড়াবর্গের কোটা নিয়ে মারাঠা, জাঠ, গুজ্জর, প্যাটেলদের মতন বর্গ বঙ্গসমাজে নেই ।
    যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতি তিনটি খণ্ডে রচিত, আচারকাণ্ড ( রীতিপ্রথা ), ব্যবহারকাণ্ড ( বিচার ব্যবস্হা ) এবং প্রায়শ্চিত্ত কাণ্ড ( অপরাধের শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত ) ।
    যাজ্ঞবল্ক্যের বক্তব্য ছিল যে মানুষের রয়েছে তেজোময়তা বা কর্মশক্তির উদ্বৃত্ত, যার একটা হিল্লে প্রতিটি ব্যক্তিএকককে করতে হয় । সেই উদ্বৃত্তই হলো জীবন । উদ্বৃত্ত বাদ দিয়ে জীবন সম্ভব নয় । একটি জনসমাজের মানুষ সমবেত উদ্বৃত্ত দিয়ে যা করে, তার দ্বারা সংস্কৃতিটির তো বটেই, মনেরও, আদল-আদরা নির্ধারিত হয় । এই দিকটি অর্ঘ্য নিয়েছেন, যদিও যাজ্ঞবল্ক্যের উল্লেখ তিনি করেননি ।
    অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো, বিশেষ করে একরৈখিক একেশ্বরবাদীদের মতো, সনাতন ভারতীয় চিন্তায় দেবতারা প্রথমে আসেননি । এসেছিলেন প্রজাপতি, এবং তিনি যে কে তা মিথই রয়ে গেছে । প্রজাপতির পর এসেছিলেন ঋষিরা । তারপরে দেবতারা । অতএব লেখক যখন মিথের জগতে প্রবেশ করছেন তখন বেশ ঝুঁকি নিয়েই তা করছেন, এবং মানুষ নিজের ভেতরে মিথের মাধ্যমে পুলক সৃষ্টি করে।
    মিথের রহস্যে , সেই বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ করেন লেখক, কেননা ওই এলাকাটি অজানা । লেখক যা-ই করুন না কেন, তিনি একটি উপকথার জগতে ঢুকে পড়েন, এবং উপকথার সংজ্ঞানুযায়ী, তা মানুষের চেতনায় পুলক গড়ে তোলে ।
    মিথ কখনও একটি গল্পে ফুরোয় না । মিথ আনন্দ আনে এবং আনন্দ হলো এক বিস্ময়কর অসুখ । এই কারণেই দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে কেন্দ্র করে এতো অপমানজনক গল্প সংস্কৃতভাষীরা লিখে গেছেন যে মনে হয় বেচারা রাজা না হলেই পারতো ।
    সে যাক, এবার অর্ঘ্যের গদ্যের কিছু-কিছু অংশ পড়া যাক :

    নিম্নবর্গের খিস্তিমাত - চায়ের দোকানের Salanguage
    ব্লেড বা কাঁচির নাগাল পাবার আগেই যাবতীয় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের ঋতবানস্বামী গুম মেরে বসে বসে নাকি পোঁদ উল্টে মটকা মেরে ধূমকেতুর মতোন “পাশের বাড়ির বৌদিকে ন্যাপা চুদে” নামক দেশী পর্ন দেখতে থাকে অথচ স্ফূতি পায় না যাহার নিকট মেয়ে দুই প্রকার, এক যারা চুষে দেবে, আর যারা চোষে না -- এই একমাত্র criteria তার কাছে মেয়ে বিষয়ক, নারীগুণ, --- একেও এক ব্যতিক্রমী নিম্নবর্গীয় চেতনা বলি, আক্ষরিক অর্থেই উন্নতবর্গে নিম্ন শ্রেণীর চেতনা ব্যতিক্রম, বিরল প্রাণী ঋতবান -- ঋত+বান -- এই সেই “ঋত”, ঋগ্বেদের, যাহা হইতে বরুণাদি দেবতা সৃষ্টি, যাহার অনুকরণ করেন পরমদেব ইন্দ্র, যাহাই প্রকৃতিস্বরূপ, যাহার মাধ্যমে গাভী, অন্ন প্রাপ্ত হয় ও যজ্ঞ যাহার অনুগামী, অনুগামী সকল দেবতা, ঋত -- যাহার উর্দ্ধে, যাহা অপেক্ষা কেহ নাই, সকলেই ঋতবান -- সেই অর্থেই যৌনতা আমাদের এ বালকে ও সকল বালকেই প্রায়, বিশেষত বাজার ঋত অর্থে ইহাই উপাসনা করে ।
    ---লাইক ব্রিটনি বিচ, ইটস জোডি বিচ…
    ---tell one more time and i will be off…
    ---ইটস জোডি জোডি জোডি বিচবিচারি
    ---ok, it’s over, bye, see u…
    হাসতে হাসতে যে সম্পর্ক শেষ করি সে এক ব্রিটেনের অজ পাড়াগাঁর নিম্নবর্গ কিশোরী, যে কিনা সদ্য রিহ্যাব-ফেরত ও লিভটুগেদারি । প্রেমটা অফুরন্ত হাসি আর ইয়ার্কির মধ্যে দিয়ে ভাঙল, i’m suffering from too much happiness…
    আমি বিলেতি নিম্নবর্গ, গরিব মানুষ চিনলাম, যারা তাদের মাতৃভাষা ইংরেজির বানান লেখে ধ্বনিভিত্তিক, আমাদের ডিকশনারীও প্রপার স্পেলিং নয়, যারা ব্যবহারকে অসোংখো চলতি ইংরেজি, যা কেবোল মাতৃভাষাতে কথা বলার সময়ি ব্যাবহার করা যায়, খোদ ব্রিটিশের মাত্রিভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উপলব্ধি করি ধ্বনিভিত্তিক বানানেই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ, ইহাই প্রোতিষ্ঠান বিরোধিতার ভাষা এখন, ভবিষ্যতে ইহাই নিওম হইবে…
    এবং আমি যখন একটি লেখার শেষ স্তরগুলি edit করে যোগ করি তখন এ ভেবেই করি অ্যাখন অব্দি যাবতীয় চিন্তা ম্যাচিওরিটি অভিজ্ঞতা এতে সর্বোৎকৃষ্টরূপে একত্র ও লিপিবদ্ধ থাক । এই লেখাই যদি শেষ লেখা হয় তবে কোনো খেদ যেন না থাকে । চলছে এরকমই, চলুক, কারণ কখন যে মাথা বিগড়োয় কিচ্ছু বলা যায় না…

    সন্ধ্যেবেলা সেদিন এক হিজড়ের দল এল তারকের দোকানে ।
    তারা বলিল --- আসবি ?
    প্রবল আমোদ হইল তারকের । সে নিজ বাম হস্তের কনিষ্ঠাটি দেখাইল । মধ্যমাটি দেখানোর বদলে । ইহাও সাংকেতিক অর্থে তোদের গুদও নেই পুরুষ মানুষের মতো বাঁড়াও নেই । আছে এক প্রতিবন্ধী বাঁড়া । না চোদা যায়, না চোদন দেওয়ার ক্ষমতা আছে ।
    তবুও তারা রাগিল না । তারকের দোকান হইতে চা কিনিয়া আমাকে ও তারককে চায়ের ভাগ দিল । আমার যথারীতি আপত্তিতে বলিল --- পি লে, পেয়ার বড়েগা ! তারক মাইতে হাত বুলাইল, তাহারা হাসিল, চলিয়া গ্যালো, তারক গান ধরিল, মহাতৃপ্তিতে, যৌনসঙ্গীত…
    সে নিম্ন, তাহা অপেক্ষা নিম্ন পাইয়া সে তো আহ্লাদিবেই । এই তো পিরামিড, সমাজের শ্রেণী পিরামিড, কেউ তোমার জ্বালায় মরে, তুমি কারো জ্বালায় মরো ।

    কিশোরের নীতা ও নামস্তোত্র
    কিশোর + নবনীতা
    Kishore + Nabanita
    কি Share + Na ব
    Ki শোর + ন Ba

    যে বয়সে মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়, তখনো কিশোর মেয়ে দেখে নাই । মেয়ে চেনে নাই । তখন অবধি মা, দিদা, মাসী, জেঠী, দিদি ছাড়া মহিলা কি বোঝে নাই কিশোর ।

    যে বয়সে মেয়েরা ঝাড়ি মারা কি বুঝে ফেলে, সে বয়সে কিশোর মেয়ে বানান লিখিত ‘মে’ । গৃহশিক্ষকের চপেটাঘাত, ভর্ৎসনা ও ভ্রম সংশোধন শিখিল প্রকৃত মেয়ে বানান -- মেয়ে দিবস হয়ে ওঠে সেই জিয়ানস্টাল ! তবুও তখনো মেয়ে কি বস্তু -- মেয়ে নাম কেন, কেন উহাদের মেয়ে বলে শেখে নাই ।
    ---মা, যাদের লম্বা চুল তারাই কি মেয়ে ?
    ---মেয়ে কি তুই শুধু লম্বা চুল দিয়েই চিনিস ?

    কাহাদের মেয়ে কয়, কাহারা মেয়ে, কারাই বা ছেলে -- ইহা পৃথক করিতে শিখে নাই যখন, তখন মেয়েরা শিখে গেছে ঝাড়ি মারা কাকে বলে । যখন তাহার ক্লাসমেটরা প্রাথমিক শিশুযৌনতা -- শিশু যৌনঘটনা কিছু কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে চুপি চুপি -- অথচ দ্যাখো মেয়ে কাকে বলে কেহই শেখায় নাই -- শেখায় নাই জাতীয় গ্রন্হ কি টেক্সটবুক তাহাকে উহা শেখায় নাই বলে কিশোরের কাছে যদ্যবধি মেয়ে না আসিল -- মা, দিদা, মাসী,জেঠী ব্যতিরেকে যখন সে মেয়ে দেখিল সে তখনও বোঝে নাই কাহাকে মেয়ে কয়, কি করে মেয়ে দিয়ে, কি ভাবে করে তা জানা তো প্রশ্নাতীত ।
    কিশোর অন কিশোর
    Kishore on Kishore
    নব অন নব
    Naba on Naba
    কিshore অN Kiশোর
    Niবস Oন নিBs

    যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি ।
    নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি ।।

    কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে আশ্চর্যান্বিত হই, ১০৮টি নাম মাহাত্মের তৎকালীন যুগানুযায়ী তা কর্ম পরিচায়ক । অর্থাৎ যে জীবনে মহৎ যে কাজগুলি করেছে ও তার চারিত্রিক গুণাবলী অনুযায়ী পরবর্তীকালে নামগুলি “আরোপিত” হয় । এগুলি বর্তমানের মতো জন্মকালীন নাম নয় । যথা মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ । দুটিই পরবর্তীকালে । তার কীর্তির পরিচায়ক বিশেষণ । এ পর্যন্ত ভীষণ সাধারণ । কিন্তু কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে চমকিত হয়ে যাই । ১০৮ জন ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠী ১০৮ রকম নাম দিচ্ছে । যা নাম দিচ্ছে তা সবই কৃষ্ণের attribute, গুণ, বৈশিষ্ট্য, সুতরাং উহারা নাম বিশেষণ । এতো গেল । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, যে যে কৃষ্ণকে যা যা নাম দিচ্ছেন, তাঁর নিজের বৈশিষ্ট্যও তাইই । কৃষ্ণ যে mirror maze ; এতে যেরকম সে কৃষ্ণের মধ্যে তাই দেখছে । নিজেকেই দেখছে, নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছে। নাম--নামী--নামকারী অভেদ হয়ে যাচ্ছে । উদাহরণ দেয়া যাক ।
    যুধিষ্ঠির নিজে রাজা ও তার কাছে যাদব রাজনৈতিক শক্তির গুরুত্বই সর্বপ্রধান । তাই যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর ।
    বিদুর মহামন্ত্রী হলেও কুরুক্ষেত্রের পরান্নভোজী দাসীসন্তান । তাই বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গাল ঈশ্বর ।
    নারদ ভক্তশ্রেষ্ঠ । নারদ রাখিল নাম ভক্ত প্রাণধন ।
    অহল্যা যদিও রামায়ণের যুগের চরিত্র, তবু অহল্যার পাষাণ শাপমুক্তি celebrate হচ্ছে এই বলে যে অহল্যা রাখিল নাম পাযাণ-উদ্ধার ।
    প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহমুরারী।
    এই নাম সাহিত্যে এমন অসংখ্য রেফারেন্স পাওয়া যাবে যা কৃষ্ণযুগের বহু আগের চরিত্রের উল্লেখে পূর্ণ, বৈদিক যুগের, এমনকি দেবতাদেরও জননী আদি দেবী অদিতি থেকে বহু পরবর্তীকালের, মহাভারতের বহু বহু পরবর্তীযুগের চরিত্রদের উল্লেখ বর্তমান । এ লেখা তাই ইতিহাস চর্চার এক মহৎ উপাদান, manifold, অত্যন্ত অর্বাচীন যুগের এক রচনা এক অতি উত্তম গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে ।
    যা বলছিলাম, যার যা বৈশিষ্ট্য তাই কৃষ্ণ বৈশিষ্ট্য ।
    অত্রিমুনি হলেন বিশেষ একটি নক্ষত্র অত্রি যা সপ্তর্ষিমন্ডলের অন্তর্গত, অর্থাৎ আকাশ সম্বন্ধীয় । অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর ।
    রুদ্রগণও ঋগ্বেদে আকাশের দেবতা ও পসুত্ব, উগ্রতা, শত্রুবিনাশকারী, ভয় উৎপাদক, ধ্বংসকারী ইত্যাদি গুণসম্পন্ন দেবতা যার সব বৈশিষ্ট্য পরে মআদেব আরোপিত । রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল ।
    এ জাতীয় বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে ঈশ্বর আমি স্বরূপ । আমিত্বের শ্রেষ্ঠত্বই ঈশ্বরত্ব ও আমার গুণলক্ষণ, বৈশিষ্ট্য, আমার মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গী, আমার যা মত ততই ঈশ্বর । কিশোরের নীতা পপেম নবনীতাই ঈশ্বরী । তার নামার্থ বদলে যায়, আসলে নীতাতেই অষ্টোত্তর শতনাম অর্পিত হতে গেলে কিশোর নিজেকে ১০৮ ভাগে, বৈশিষ্ট্যে, মতে, পরিস্হিতিতে সময়ে বাস্তবচাহিদায় বিভক্ত করে । করে নাম-নামী-নামকারী অভেদ হয় । কিশোর কৃষ্ণ হয়ে ওঠে । কারণ যার যা শ্রেষ্ঠ গুণ তা বিভূতিযোগে ঈশ্বরপ্রতিম হয়ে ওঠে ।

    কর্ণ-কৌরব সংবাদ --- অবতার সংস্করণ --- হোমো ফ্লেবার্ড --- একটি বাজে প্রগল্প
    ---কৌরব, আমি ও আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল ফুল, বড় সেন্সেটিভ । বড় স্পর্শকাতর, অস্বাভাবিক কম রোধযুক্ত, ঘণ্টায় যেমন বাধ্যত ৬০টি একক, তেমনি বাধ্যত ওর নিত্য সেবা । না দিলে বড় সাফোকেশন হয়, বড্ড তার ছোঁয়াছুঁয়ি বাই, বড্ড তার খালি ক্ষরণ করা চাই...। এবং জলের বোতল, কল, টিপট ইত্যাদি যা যা থেকে লিঙ্গসদৃশ ক্ষরণ হয়, তা নারী ব্যবহার করছে দেখলে আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল বড্দ সেন্সেটিভ হয়ে যায় । যথা যথা নেত্র পড়ে তথা তথা লিঙ্গ স্ফূরে, তথা তথাই কৌরব as a পুরুষোত্তম স্ফূরে স্ফূরে ওঠে…
    মাঝে মাঝে লিঙ্গ অণ্ড চেপে জঙ্ঘার ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে নারীযৌনাঙ্গ সুলভ এক ফিল আনি মুখ্যবিন্দুদেশে । সেখানে হাত বোলাই যেন যোনি নিয়েই খেলছি । পুরুষের আর কি আছে -- তার খেলার সঙ্গী তো ওই এক, সাত রাজার ধোন এক লিঙ্গ । স্বমিথুন করি । করে বীর্য উরুতে ফেলি । দেখি তার মুক্তাসম শ্বেতত্ব -- হোয়াইটনিং ফিলোজফি । পারদ, জল, বীর্যে ষড়বলের এক বল ( সারফেস টেনশন ) ধর্মতা দেখি । বীর্যকে দেখতে থাকলে -- কি ভাবে সে ঘনত্ব হারিয়ে তরল হয়ে ওঠে ক্রমশ যত ঠাণ্ডা হতে থাকে -- ধর্মের বিপরীত এই নিয়মে টেনশন কমে, রিলিজেই রিলিজড হয়ে কিছি বাস্তবোপযোগী উপদেশ দিয়ে যায়, বীর্য বেরিয়ে এসে দর্শন দিলে সিদ্ধাবস্হাই বলা হোক তাকে । আমি ভর পেট ভাত খেতে পাই বা পাই না, এই দেহামৃত ঘৃত আমি জানোয়ার শাস্ত্রানুযায়ী প্রেইজ করি । বীর্যময় বিবিধ প্রোডাক্ট ( স্পার্মস্যুপ কি স্পার্ম ডিও বা স্পার্ম ফ্লেবার্ড কন্ডোম । মার্কেটে লঞ্চ করা যায় কি না সে সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে থাকি।

    কর্ণ আপন মনে প্রশ্ন করে --- কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    কর্ণই উত্তর করে --- আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।

    ও রাত জাগানিয়া, তোমায় গান শোনাবো…

    সেলফ হিপনোটিক স্বমিথুন যেন ন্যায়া কুছ করনে কো মিলা । স্বমিথুন পুরুষভাবনা ধীরে ধীরে যা বোঝা যায় চলে আসবে কর্ণে, পুরুষের Porn আর ভালগার লাগবে না স্বমিথুন করে । বক্ষাকাশ, জঙ্গলশরীর, উদরসাগরে প্রাকৃতিক ধাতুবৃষ্টি কাদা কাদা করে দিলে আদিম আদিম ব্যঞ্জন হয় । তবে স্নানাগারে যাই । মৃতেঞ্জোদারোর স্নানাগার মনে হয় কাজের পর এই উঠে যাওয়ার প্রবল প্রযত্ন । ক্রমশঃ চুল ভেজে, বালী হয় ; গ্রীবায় জল আসে, সুগ্রিব হয় ; কন্ঠায় আসে, নীলকন্ঠ হয় ; হনুতে হনুমান হয় ; বক্ষ ভেজে -- সাহারায় হড়কায় স্নেহ ; উদর ভেজে, আদ্যা হয় ; নাভি সীতা হয় ; জঙ্ঘা জঙ্ঘুমুনি, পুরুষের নিতম্ব সৌন্দর্য নিয়ে একটা উপন্যাস হয়ে যাক --- শরীর বেয়ে নদী বেয়ে যায়, নাড়ির টানে এ-শরীর সদাশিব হয় । পুরুষ স্নান করে সঙ্গমোত্তর ।

    না, মিখায়েল বাখতিনের কারনিভালের প্রসঙ্গ তোলার জন্য অর্ঘ্যর পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দিইনি ; বাখতিন থেকে আজকের সমাজে, সব দেশের সমাজেই, যা প্রাসঙ্গিক, তা হলো শরীরের ফাটলগুলোর আহ্লাদ । আজকের দিনে ফিকশানের ন্যারেটিভ আঙ্গিকগুলো আগেকার-কালের উপন্যাসের একটি চরম ও আত্মসচেতন, আত্মসচেতন কথাটায় লক্ষ্য রাখুন, রূপ, নানা রূপের মধ্যে একটি রূপ ।
    অর্ঘ্য নিজের পছন্দের রূপ বেছে নিয়েছেন প্রতিটি গদ্যে । অর্ঘ্যের গদ্যগুলো, প্রতিটি গদ্য, নিজের আঙ্গিককেই সমালোচনা করতে করতে এগিয়েছে, ডিসকোর্সের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ককে যাচাই করতে করতে এগিয়েছে । আসলে সমস্ত আর্ট ফর্মই, ফিকশানের তো বটেই, সে তাকে প্রগল্প বলা হোক বা অন্য নাম দেয়া হোক, স্বয়ংসমালোচনায় আবিষ্ট । ওপরে যে উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছি তা সেই অবসেশনকে পরখ করার উদ্দেশে ।
    অর্ঘ্য কী করছেন ? তিনি আর্ট ও বাস্তবের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সরাসরি সন্দেহ করছেন, পাঠককে ফাঁসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর নিজেরই নান্দনিক আত্মপরিচয়ে । এর ফলে তাঁর গদ্যগুলো সাহিত্য ও জীবনের সীমায় আত্মসচেতনতা নিয়ে উপস্হিত থাকছে, আর তার মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে লেখক-সহযোগী পাঠকের সূক্ষ্ম পার্থক্য গড়ে তুলছেন ।
    অর্ঘ্যের গদ্যের আঙ্গিক এবং বিষয় ( কেন্দ্রহীন বিষয় ) দুটিই একযোগে যুক্তিতর্ক-নির্ভরতা, প্রচলিত রীতি ও আধিপত্যের কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছে, বা বলা চলে, অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ঘটিয়ে এগিয়েছে। বাখতিন কিন্তু ব্যক্তিকে ততো গুরুত্ব দেননি যতোটা অর্ঘ্য দিচ্ছেন তাঁর গদ্যগুলোয় । আমরা পাই ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্ট, ইয়ার্কি, বিভ্রান্তি, বোকামির উল্টো টাঙানো, প্রায় অভাবনীয় একখানা জগত ।
    অর্ঘ্যর অন্তর্ঘাত অনেক সময়ে তথাকথিত উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার আদল-আদরা পায় । এমনকি পাঠককে চমকে দেবার, বিহ্বল করে দেবার জন্য তিনি বর্তমান কালখণ্ডের যে সমস্ত যৌন আচরণ যুবক-যুবতীরা পছন্দ করেন, মূলত সন্তানোৎপাদন এড়াবার জন্য, সমকাম, বীর্য নিয়ে খেলা, যোনির বাইরে বীর্য ফেলা বা ওনানিজম, মুখমেহন ইত্যাদিকে সন্দর্ভে তুলে এনেছেন । সবকিছুই স্পার্মফ্লেভার্ড হোক ।
    সন্তানোৎপাদনের বাইরে যৌনতার কথা বাংলা সাহিত্য এতোকাল এড়িয়ে গেছে, যে কোনো কারণেই হোক । অথচ সন্তানোৎপাদনের ভীতির কারণে যৌনতার মজা নষ্ট হয়ে যায় । সন্তানোৎপাদনের ভীতিকে যদি জলাঞ্জলি দেয়া যায়, যা আমরা অর্ঘ্যর গদ্যতে পাই, তাহলে যৌনতা হয়ে ওঠে আহ্লাদের, আনন্দের, সুখের, বিজয়প্রাপ্তির, জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপার, নারী ও পুরুষ উভয়েরই ।
  • | 012312.60.8923.236 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:১১541291
  • যখন ফালগুনী রায়ের সঙ্গে আকাশে উড়তুম
    মলয় রায়চৌধুরী

    যখনই ফালগুনী পাটনায় এসেছে, বলেছে, চলুন আকাশভ্রমণে যাওয়া যাক ।
    নীল তুলোয় গড়া আকাশ আমাদের দখলে, আমরা দুজনে ডানা মেলে যথেচ্ছ উড়তুম, পালকের রঙ আর মাপ ইচ্ছানুযায়ী বদলে নিতে পারতুম, উড়তে-উড়তে বা ওড়ার আগে ।
    পুনপুন নদীর ওই পারে, গণ্ডক নদী যেখানে বাঁক নিয়ে গঙ্গায় ঢুঁ মেরেছে, তার ওপরের আকাশে, শোনের বালিয়াড়ির ওপরের সোনালি আকাশে, কোইলওয়ারের ওপরের নীইইইইইল আকাশে, উড়েছি, উড়েছি, উড়েছি, এনতার, অপরিসীম টলারেন্স লেভেল গড়ে উঠল আকাশে গিয়ে ।
    ডানা, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা, যখন যে পাখির চাই, সেই পাখিদের কাছ থেকে পেয়ে যেতুম । সেই পাখির আকার পেয়ে যেতুম, আর দুজনে উড়তুম পাশাপাশি, কথা বলতে-বলতে বা ঠোঁট বুজে ।
    চাকরি থেকে সাসপেন্ড, মানে অফিসে যাবার বালাই নেই, ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সাজা হয়ে গেছে, হাইকোর্টে রিভিশান পিটিশান করেছি, কবে ডেট উঠবে তার ঠিক নেই । হাইকোর্টের উকিল পেয়েছি সদ্য ইংল্যাণ্ড-ফেরত কিরণশঙ্কর রায়ের সহযোগীতায়, উনি যার আন্ডারে জুনিয়ার, সেই মৃগেন সেন, ক্রিমিনাল লইয়ার, লড়বেন মামলাটা, আরও চারজন অ্যাসিস্ট্যান্টের সাহায্যে ; বলেছেন, চিন্তা নেই ।
    সুবিমল বসাক যোগাযোগ রেখেছে ওনাদের সঙ্গে, ডেট উঠলে জানাবে ।
    চিন্তা যখন নেই, তখন আকাশেই উড়ি । চিন্তা কেবল টাকার ।
    ফালগুনী পাটনায় ওর দিদির বাড়িতে, যাঁর প্রতিবেশী ফালগুনীর প্রেমিকার স্বামী ।
    ফালগুনী সকাল-সকাল পৌঁছে গেছে আমাদের বাড়ি, দরিয়াপুরে । ইমলিতলা পাড়া ছেড়ে দরিয়াপুরে চলে এসেছি ; হিপি-হিপিনীরা নেপালে যাবার পথে দরিয়াপুরে হল্ট করে স্টিমারে বা নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে হিচহাইক করে চলে যায় কাঠমাণ্ডু ।
    ফালগুনী কাঠমাণ্ডু যেতে চায় না, পাটনায় দিদির বাড়ি আসার উদ্দেশ্য তো প্রেমিকার সঙ্গে চাউনি বিনিময়, যদি সুযোগ পাওয়া যায় ।
    চাউনি বিনিময় হয়ে গেলে, সেদিন আকাশে ওড়ার অফুরন্ত নীল, সারসদের পাশাপাশি, সাগর-ঈগলদের সঙ্গে, বেগুনি কালেমের ফিকে বেগুনি-নীল পালক আর গোলাপি ঠ্যাঙের, কালো চকচকে ফিঙের, শাদা-গোবকের ঝাঁকের, ভুবনচিলের সঙ্গে শীতের ফিনফিনে দুপুরের ওড়াউড়ি ।
    আকাশে ওড়ার অনেকরকম সরকারি হাওয়াইজাহাজ ছিল তখন, বোর্ডিং পাসও বেশ সস্তা, দু-আনা পুরিয়া, চার-আনা পুরিয়া, আট-আনা পুরিয়া, পৌয়া বাটলি আট আনা, ছটাক বাটলি চার আনা, সোমরস খুচরা দু আনা, ঠররা খুচরা চার আনা, লমনি তাড়ি পাতার দোনায় এক-আনা, মাটির ভাঁড়ে চার আনা ।
    হিপি-হিপিনিদের দেয়া লাইসারজিক অ্যাসিডে ভিজিয়ে শোকানো ব্লটিং পেপারের এক ঘন ইঞ্চের টুকরো আর পিসিপি বা অ্যাঞ্জেল ডাস্টের গুঁড়ো ফ্রি, পেইনটার করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাইয়ের সৌজন্যে, স্টকে অবশ্য বেশি নেই ।
    একাধদিন ফালগুনী বলত, আজকে কাঁদতে-কাঁদতে উড়ব, ভুবনচিলেরা কাঁদে, চলুন চিলেদের পাশাপাশি উড়ি ; আপনি খেয়াল রাখবেন যাতে চোখের জল মাটিতে ঝরে না পড়ে, যেখানে পড়বে সেখানে হয়তো দৈত্যরা জন্ম নেবে, সে দৈত্যরা ধোঁয়ায় গড়া, আমি চাইনা ওই ধোঁয়া লোহানিপুর পাড়ায় দিদি-জামাইবাবুর বাড়ির দিকে ভেসে যাক ; আমার ভিতর এক কুকুর কেঁদে চলে অবিরাম ।
    আমি ওকে বলি, আমিও চাই না হে, তোমার জামাইবাবু সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে আমার ওপর চটা । ওনার ক্লাসে সিটে বসে হিসি করেছিল কানাইলাল সাহা, আর উনি ভাবলেন কাজটা আমার, কেননা উনি যখন রিকশায় চাপছিলেন তখন আমি হেসে ফেলেছিলুম । উনি এতো মোটা যে রিকশঅলা বলেছিল, হুজুর আপনার ওজন তো দুজনের, আপনি একজনের ভাড়ায় কি করে যেতে চাইছেন ! রিকশয় চাপার আগে উনি প্রতিবার হুড ঝাঁকিয়ে পরখ করে নিতেন বইতে পারবে কি না ।
    ফালগুনী বললে, জানি, যেদিন থেকে শুনেছেন আপনি আমার বন্ধু , সেদিন থেকেই উনি আমাকে সাবধান করেছেন যে আপনি আমাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবেন, দিদিকেও বলেছেন যাতে আপনার সঙ্গে না মিশি । আপনার গ্রেপ্তারির খবরটা ইনডিয়ান এক্সপ্রেস বেশ নোংরাভাবে প্রকাশ করেছিল ।
    তোমার দিদি আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলে গেছেন যে আমি তোমাকে নষ্ট করে দিচ্ছি ।
    ফালগুনী বললে, ওনাদের তো পাখিদের সঙ্গে আকাশে ওড়ার, নদীর তলায় হাঙর, তিমি, সিলমাছ, ইলিশঝাঁকের সঙ্গে সাঁতার কাটার, মাটির নিচে ঢুকে ডাকিনি-প্রেতিনিদের সঙ্গে আগুনের হল্কার ভেতরে নাচবার অভিজ্ঞতা নেই, তাই ।


    আজকে গুলফি ঘাটের শ্মশানে গিয়ে ওড়া যাক, হাথুয়া মার্কেটের পানের দোকান থেকে দুখিলি গিলোরি পান কিনে খেতে-খেতে বললে ফালগুনী । তালশাঁসের মতন পানের ভেতরে ভাঙের মশলা ভরা, একটু সময় লাগে উড়তে, যতক্ষণে আমাদের ডানা আকাশ পাবে ততক্ষণে গান্ধি ময়দানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবো শ্মশানে ।
    তীরে বালি জমে-জমে গঙ্গা নদীর সঙ্গে শ্মশানও এগিয়ে চলেছে ; যাদের শব পুড়ছে তাদের দাদু-দিদা যেখানে পুড়েছিল, সেখানে ঘাস গজিয়েছে । শবদাহ চলছে দূরে । ভালই, আমাদের জন্য বসার জায়গা, শবাযাত্রীদের সঙ্গে, তারা একে-একে ন্যাড়া হচ্ছে, আর আমরা একটু-একটু করে উড়ছি, যেন লম্বাগলা বগিবক, ক্ষনিকেই ডানা মেলব দুজনে ।
    ফালগুনী বললে, ওই দেখুন, সময় ; আঘাত লুকিয়ে রাখাও শিল্প, বুঝেছেন ।
    বললুম হ্যাঁ, সময়কে দেখছি ।
    শবকে শোয়াবার আগে তার দেহ থেকে আঙটি ইত্যাদি খুলে নিচ্ছিল শ্মশানডোম । শবের ছেলে বললে, বাবার হাতের ঘড়িটা থাকতে দাও, ওটা ওনার প্রিয় রোলেক্স ঘড়ি, উনি বলেছিলেন যে মারা গেলে যেন ঘড়িটা খোলা না হয় ।
    সময়কে দেখলুম, পুড়ছে ।
    ফালগুনী বললে, নীল আকাশে পৌঁচেছেন কি ?
    নাহ, এখনও মাটির কাছাকাছিই উড়ছি, চড়ুই-শালিখদের মতন ।
    তাহলে চলুন, ওই সাধুদের জমায়েতটায়, ছিলিম ফুঁকছে ।
    দুজনে বসলুম গিয়ে, কিছুই বলতে হল না, ছিলিম এগিয়ে দেয়া হল আমাদের দিকে; সাধুরা কাপড় ভিজিয়ে ছিলিমে মুড়ে ফোঁকে না, আমি রুমাল বের করে মুড়ে নিলুম ।
    দুজনেই দু-ফুঁক করে মারলুম । ফিরে গিয়ে বসলুম আগের জায়গায় । হাতঘড়ি পুড়তে আরম্ভ করেছে শবের সঙ্গে ।
    পোড়া ঘড়িটা আমাকে কনফিডেন্স দিচ্ছে, মড়াটাকে ধন্যবাদ ; একটু থেমে, ফালগুনী বললে, সবই আছে, আমার জন্য নয় ।
    তুমি তার মানে ওড়া আরম্ভ করে দিয়েছ ! দাঁড়াও ওই আইসক্রিমের ঠেলা থেকে দুটো কাঠিবরফ কিনে আনি ।
    হ্যাঁ, আনুন, আমারও গলা শুকিয়ে গেছে, কাশতে চাই না, কাশতে ভয় করে, আমাদের পরিবারে কাশি ব্যাপারটা নিষিদ্ধ ।
    নিয়েলুম দুটো আইসক্রিম । চুষতে চুষতে মনে হচ্ছে সবকিছু নতুন, ন্যাড়ালোকগুলোর মাথা ঘিরে রুপোলি জ্যোতি, শবের আগুনে কমলা আর সবুজ রঙের পরিরা নাচছে, গঙ্গা আর নেই, সবুজের পর সবুজ ।
    ফালগুনী বললে, ভাঙের সঙ্গে পানের ভেতরে অন্যকিছুও ছিল, বুঝলেন, ওইপারের গাছগুলোও দেখতে পাচ্ছি, গাছেদের লালরঙের পাতাগুলো দেখতে পাচ্ছি, আগে এরকম গাছ দেখিনি, নৌকো দেখছেন, মাঝিদের গান শুনতে পাচ্ছেন, সালারা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে বোধহয় ।
    কোন গান ?
    আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত জানেন ? ওই গানটা, কেন যামিনী না যেতে জাগালে না ।
    জানি, চলো ওই দিকে, জলে গিয়ে বসি, এখানে বুড়ো শবযাত্রীরাও কাঁদতে আরম্ভ করেছে, বুড়োরা এরকম ভেউ-ভেউ করে কাঁদছে, আগে দেখিনি ।
    চলুন, ফিরতে ফিরতে শুকিয়ে যাবে , সব কান্নাই শুকিয়ে যায়।
    নদীর কিনারায় গিয়ে বসি দুজনে, জলের খুদে ঢেউ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । স্টিমার গেলে তখন ঢেউগুলো জোর পাবে ।
    আমি শুরু করি, গলা ছেড়ে, বেসুরো হলেও কিছু এসে যায় না, জানি, শ্রোতা বলতে গঙ্গা নদী আর ফালগুনী রায় । আমার স্কুলের বন্ধু বারীন গুপ্ত আর সুবর্ণ উপাধ্যায় থাকলে তিনজনে মিলে গাইতুম, বারীন গুপ্ত তাড়ির হাঁড়িতে তবলা বাজাত গাইতে গাইতে ।

    কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে
    শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথের মাঝে
    আলোকপরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া
    কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে

    বললুম, ব্যাস এইটুকুই মনে আছে ।
    ফালগুনী বলল, ওই কটা লাইনই গাইতে থাকুন ।
    আরেকবার গাইবার পর দেখলুম ফালগুনীর চোখে জল । কয়েক ফোঁটা পড়ল নদীর ঢেউয়ে । স্মৃতির টর্চারের কাছে পুলিশের থার্ড ডিগ্রিও পালকের সুড়সুড়ি । কিংবা হয়তো ওই বৃদ্ধদের কান্নার শোক নিজেও নিণে নিয়েছে কিছুটা ।
    এই শ্মশানে আমার বড়োজ্যাঠার মুখাগ্নি করেছিলুম ; তখন পুরুতমশায় সতীশ ঘোষাল বলেছিলেন, শ্মশানে এলে একধরণের বৈরাগ্য হয় ।
    দুজনে চুপচাপ বসে রইলুম সন্ধ্যা পর্যন্ত । আমরা সেই স্হিতিতে, যাকে হিপি-হিপিনীরা বলে ‘স্টোনড’ ।
    ফেরার সময়ে, রূপক সিনেমার কাছে ঘুগনি খেলুম । ফালগুনী বললে, আমি কিন্তু ইনসেন নই, কেবল অযাচিত ঘটনার সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলছি । আর আপনি যেচে লাৎ খাচ্ছেন ।
    বললুম, আমার টলারেন্স লেভেল এখন অমেয় ।


    আরেক দিন ফালগুনী । সেই একই পোশাকে, ঝোলা কোট আর ধুতি, দুটোই নোংরা, কখনও কাচা হয় না, দেখলেই বোঝা যায়, কোটটা ওর বাবা বা কাকার কারোর, বা তারও আগের, ওদের জমিদারির অবশেষের চিহ্ণ । মাঝখানে সিঁথিকাটা, কাঁধ পর্যন্ত চুল, স্নান করা হয়ে ওঠেনি বেশ কয়েকদিন, নখ বড় হয়ে উঠেছে । ওর আঙুলগুলো চিত্রকরদের মতন । পায়ে চটি ।
    আমার ঘরে গিয়ে বসবে চলো । ঘরে বসে ওড়ার সুবিধা হল অযথা হাঁটতে হয় না, বাইরে বেরোলে দুপুরের রোদে ডানার পালক শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে যায় ।
    ধোঁয়ার গন্ধে আপনার মা জেনে ফেলবেন, বলবেন না তো কিছু ?
    ফুঁকব না, গিলব । তাছাড়া হিপি-হিপিনীরা আমাদের বাড়িকে হলটিং স্টেশান করে মা আর বাবাকে কবি-আঁকিয়েদের জগতের সঙ্গে সম্যক পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, ছোটোলোক পাড়ায় বসবাস করার এই সুবিধা ।
    কী আছে ?
    অ্যাঞ্জেল ডাস্ট । করুণা-অনিল নেপাল থেকে ফেরার সময়ে একটু দিয়ে গিয়েছিল, বেশ মজার, নিজেকে হারিয়ে না ফেলেও ওড়া যায় । জলে গুলে খেয়ে নিলেই হল । ঘণ্টাখানেক পরে উড়তে থাকো ।
    অরেঞ্জজুসের সঙ্গে অ্যাঞ্জেল ডাস্ট বা পিসিপি গুলে খেলুম দুজনে ; অতিথিকে অরেঞ্জজুস খাওয়ানো যেতেই পারে ।
    ফালগুনী বললে রেকর্ড প্লেয়ারটা লাগান, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয় ।
    মোৎসার্ট ছিল, লাগিয়ে দিলুম ।প্রথম-প্রথম মোৎসার্ট শুনে বুঝতে পারতুম না, রেকর্ডের লেবেল দেখে বুঝতুম । বারবার শুনে আইডিয়া হয়ে গেছে ।
    সোফায় রুপোলি মেঘের ওপর শুয়ে ফালগুনী বলল, আমিই সঙ্গীত হয়ে গেছি, সঙ্গীত শুনছি না, সঙ্গীত হয়ে গেছি, দেখুন গায়ে হাত দিয়ে, মিউজিকের ফ্রিকোয়েন্সি অনুভব করবেন । সবকিছু বেশ ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে কল্পনাশক্তি আঙুলের ডগায় চলে এসেছে, জলের ফোঁটা টেবিলের ওপর পড়েছে, দেখুন, দেখতে পাচ্ছেন, প্রিজমের মতো দেখাচ্ছে, প্রিজমের সাতরঙা লাইট ছড়িয়ে পড়ছে, মোৎসার্ট বললেন তো ? মোৎসার্টকে বুঝতে পারছি, অনেকদিন পর রিল্যাক্সড ফিল করছি, সবায়ের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কেউ তো আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না ।
    তুমি ওড়া আরম্ভ করে দিয়েছ ; উড়তে থাকো, মেঘের ওপর দিয়ে ওড়ো, বেশি কথা বোলো না, আরও ওপরে ওঠার পর কথা বোলো।
    কথা বলতে ভালো লাগছে, বারান্দার দরোজা দিয়ে দেখুন, আকাশের রঙ, বেগুনি হয়ে গেছে । সত্যিই কি বেগুনি ?
    বেগুনি রঙটা মোৎসার্টের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি, অবাস্তব নয় ।
    ধ্বনি শুনছি না কিন্তু, কেবল প্রতিধ্বনি শুনছি, কান পেতে শুনুন, রাস্তার লোকজন আর যানবাহন চলারও প্রতিধ্বনি শুনছি আয়নার দিকে তাকান, আয়নার দিকে তাকান, টান দিচ্ছে, আয়নাটাই আমাকে টান দিচ্ছে । রাস্তায় তাকান, রাস্তায় তাকান, রিকশটা ভাসছে, রিকশঅলা কই, ট্রাকটাও উড়তে উড়তে চলে গেল ।
    তুমি বললে, তুমিই সঙ্গীত হয়ে গেছ, নেশা করলে কি তুমি তোমার কবিতা হয়ে যাও ?
    সোফায় সটান মেঘের ওপর শুয়ে ফালগুনী বললে, এক্ষুনি বলতে পারব না, নেশা ছেড়ে গেলে বলতে পারব । এখন আমি ওই পিঁপড়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারি, পিঁপড়েটা আমার কথা ঠিক বুঝতে পারবে ।
    দুপুরে মাংস-ভাত খাবার পর ফালগুনীকে আরেকবার প্রশ্নটা করলুম ।
    ফালগুনী বলল, জিজ্ঞাসা করেছিলেন নাকি ? তখনই বলতে পারতাম, এখন পারব না, এখন কবিতা নিয়ে ভাবতে চাই না ; বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে চাই । কেমন একটা চাপ-দেয়া পীড়া ছিল যখন এসেছিলাম, কানে অস্পষ্ট কোলাহল ছিল, অ্যাঞ্জেল ডাস্টে পীড়া লাঘব হল মনে হয় । বাকি যেটুকু আছে, নিজে খাবেন না, আরেকদিন বসব । রিকশা ভাড়াটা প্লিজ দিয়ে দিন ।


    আজকে কনভেন্ট স্কুলের মোড়ের দোকান থেকে চরস কিনে খাওয়া যাক, কী বল ? ফালগুনীকে বললুম ।
    খাবার কথা বলছেন কেন ? ফুঁকলে বেশি আনন্দ হবে ।
    আনন্দের জন্য ফোঁকো ?
    দৈনিক ব্যানালিটি থেকে বেরিয়ে শান্তি পাই ! আমি কি বোদলেয়ার নাকি যে কবিতা লেখার জন্য নেশা করব !
    বোদলেয়ার, থিওফেল গতিয়ে আর ওনাদের আগে ডি কুইনসি, এই নেশাগুলোর কথা কিন্তু বলেছেন সৃজনশীল হয়ে ওঠার জন্য ।
    ধ্যুৎ । বোদলেয়ার হ্যাশিস, আফিম আর মারিহুয়ানার তুলনায় ওয়াইনকে গুরুত্ব দিয়েছেন ওনার আর্টিফিশিয়াল প্যারাডাইস বইতে ।
    তার কারণ হল রোমান্টিকরা প্রাচ্যের নেশাকে মনে করত জংলিদের সংস্কৃতি । তাইতো দেখা যায় এমিল জোলার বইতে মদ খাওয়া আর বৈভবের তোল্লাই ; উল্টো দিকে আমাদের দেশে ওনাদের ঢঙে মদ খাওয়াটা অধঃপতনের লক্ষণ । আসলে উপনিবেশবাদ ওইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের আর ওনাদের সংস্কৃতিতে। বোদলেয়ার আফিম আর হ্যাশিশের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন ; আফিমের ব্যবসা ইউরোপই চালু করেছিল, ভারতে আফিম চাষ করে চিনে রপ্তানি করত । আফিম বিক্রির টাকায় তৈরি হয়েছিল রোমান্টিক যুগের বনেদ । বোদলেয়ারও আফিম খেতেন সিফিলিসের যন্ত্রণা উপশমের জন্য ; অথচ পরে গিয়ে আর্টিফিশিয়াল প্যারাডাইস লিখলেন প্রচ্ছন্নভাবে ওয়াইনের গুণগান করে ।
    ফালগুনী বললে, আমি কবিতা লেখার জন্য নেশা করি না, নেশা করি দৈনন্দিন ব্যানালিটি থেকে বেরোনোর জন্য, আপনি যদি আমাদের বাড়ির সদস্য হতেন তাহলে বুঝতে পারতেন, কলকাতায় সময় কাটানোটাও ব্যানাল হয়ে দাঁড়িয়েছে । মেঝে থেকে মার্বেলপাথর তুলে বিক্রি করে দিচ্ছে কেউ-কেউ । প্রেম নেই, প্রেমে না-থাকার ব্যাখ্যাহীনতা আছে ।
    তুমি তো তোমার বাড়ির বিষয়ে বলো না কিছু, জিগ্যেস করতেও কুন্ঠিত হই, তোমার দাদা তুষারের সঙ্গে মারামারি করেছিলে শুনেছি ।
    আমি করিনি, তুষারই দাদাগিরি ফলিয়ে মেরেছিল আমাকে ; হাংরি আন্দোলনে যোগ দেয়া ও পছন্দ করেনি, বলছিলো এই আন্দোলনের ভবিষ্যত নেই, তার ওপর মামলা-মোকদ্দমা ।
    তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো, তাই হয়তো । আমার দাদা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক তো বন্ধুত্বের ।
    আপনি বুঝবেন না, আপনাদের কথা আলাদা । আপনাকে বলেছিলাম চাইবাসায় নিয়ে চলুন, নিয়ে গেলেন না, শালপাতায় হাড়িয়া খাওয়া হল না, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, হাড়িয়া আর মহুয়ার কথা, টাটকা গরম-গরম মহুয়া । উনিও কবিতা লেখার জন্য নেশা করতেন না, নেশাগ্রস্ত থাকতে ওনার ভালো লাগত।
    ভাবলুম বলি যে তোমার মতনই প্রেমে চোট খেয়েছেন শক্তিদা, কিন্তু বললুম না । তার বদলে বললুম, যাকগে, চলো, দোকান খোলাই রয়েছে, ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাত ঢোকাতে হবে । শিক্ষিত চেহারা দেখলে গাঁজা-চরসের দোকানের ভিড়টা আপনা থেকে জায়গা করে দ্যায়, মদের দোকানে কিন্তু করে না । বোদলেয়ার যে কেন মদের পক্ষে আর গাঁজা-চরসের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন তা এই ব্যাপারটা থেকে স্পষ্ট হয় । আমার সেজমামার শশুরের গনোরিয়া ছিল, উনি ব্যথা উপশমের জন্য আফিম খেতেন । শশুরের জন্য কিনে নিয়ে যেতেন সেজমামা, তখনকার দিনে সরকারি দোকানে যৌনরোগের জন্য চাই বললে, আফিম সহজেই কিনতে পাওয়া যেত ।
    এনাদের থেকে, এই ভিড়ের মানুষদের থেকে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই মলয়, দেখতে কি আমি একই রকম নই, চুল আঁচড়াইনি কতদিন, দাড়িও বেড়ে চলেছে, স্নান করা হয়ে ওঠেনি বেশ কয়েক দিন ; আপনি তবু ডেইলি স্নান করেন, কিন্তু দাড়ি বাড়িয়ে চলেছেন, পোশাকেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, এই একটা কর্ডুরয় ফুলপ্যান্ট আছে ?
    এটা নোংরা হয় না, কাচাকাচি করতে হয়না । একটাকার কয়েনটা ওদের কোমরের মাঝখান দিয়ে জানলার ভেতরে ঢুকিয়ে বলো দো পুরিয়া চাটনি ।
    মূর্খকুৎসিতদরিদ্র মানুষ-মানুষীর মিছিলে আমি ভেসে চলে ভুলে যাই সে সময়ে আমি বেটাছেলে না মেয়েছেলে ।
    ঠিকই বলেছ তুমি, এই ভিড়ে ঢুকে বোঝা গেল যে বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, করবিয়ের, লাফোর্গ, আঁতোয়া আর্তোর উদ্দেশ্যময় নেশা করা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আমাদের উদ্দেশ্যহীনতা এই মূর্খ কুৎসিত দরিদ্র লোকগুলোর সঙ্গেই তুলনীয় ; তুমি এলে আমি নেশা করি, করুণা-অনিল এলে নেশা করি, রাজকমল চৌধুরী এলে করি, ফণীশ্বরনাথ রেণু বাড়িতে ডাকলে গিয়ে নেশা করি । নিজে একা-একা গাঁজা-চরসের নেশা করি না ।
    একদিন নিয়ে চলুন না ফণীশ্বরনাথ রেণুর বাড়িতে ।
    হাজিপুরের একজন বিডিও ডেকেছে আমাদের, রাজকমল, রেণুও যাবেন, তুমিও চোলো সঙ্গে, স্টিমারে করে ওপারে, পাকা কলার কাঁদি ঝোলা বাগানে সাহিত্যসভার আয়োজন করেছে বিডিও ।
    যাবো । বোর হয়ে গেছি এখানে । সুভাষরা পত্রিকা বের করবে বলছে । কবিতা লিখে রেখেছি কিন্তু এখনও চায়নি আমার কাছ থেকে । কেউই আমার কবিতা প্রকাশ করতে চায় না ।
    সুবিমল বসাকের কাছে দিয়ে রাখো কয়েকটা । সুভাষ পত্রিকা বের করছে চিঠিতে জানিয়েছে ত্রিদিব । আমি, দেবী, সুবিমল, ত্রিদিব বাদ যাচ্ছি । দ্যাখো তোমাকে ইনক্লুড করে কি না ।
    সুবিমলবাবুকে দিয়েছি ; বললেন বুলেটিন বেরোনো অনিশ্চিত ।
    হ্যাঁ, আমার মাইনে এখনও আটকে আছে, উকিলের কাছেও বকেয়া রেখেছি ।


    ফালগুনী বললে, গিলে তো নিলাম, ইউফরিয়া আরম্ভ হল না তো ! ফুঁকলে বরং এতক্ষণে শুরু হয়ে যেত । চলুন সবজিবাগের সামনের জাহাজঘাটায় গিয়ে বসা যাক, স্টিমার যাতায়াত দেখব চাতালটায় বসে । এখানে আন্টাঘাটে সবজিঅলাদের বড্ডো কিচাইন । এটা অ্যাফ্রোডিজিয়াক নয়তো ? বোদলেয়ার নাকি অ্যাফ্রোডিজিয়াক হিসাবে গিলতেন ।
    কম বয়স থেকে বেশ্যালয়ে ঢুঁ মারতেন, তারপর জাঁ দুভালকে সামলানো, দরকার পড়ত হয়ত অ্যাফ্রোডিজিয়াক হিসাবে ।
    হাঃ হাঃ, পা দুটো ক্রমশ মাখনের তৈরি মনে হচ্ছে, মাতালের মতন হাঁটছি না তো ? আপনিও লিকুইড হয়ে উঠছেন । চেয়ে দেখুন, চেয়ে দেখুন, ছায়ার খাপে-খাপে শরীর বসছে না ।
    এক্ষুণি উড়ো না, আরেকটু সামলে চলো, এই রাস্তাটার দু-পাশে ভিকিরি । গিন্সবার্গ যখন এসেছিল, এই ভিকিরিগুলোর ফোটো তুলে নিয়ে গেছে ।
    বিট-ফিটদের কথা বাদ দিন, শালারা প্রচুর টাকা কামাচ্ছে কবিতার বই বেচে, পৃথিবী ঘুরছে ; ওনাদের কবিতা ততো ফিল করতে পারি না । আমার ব্যক্তিগত-সত্য কি বিট কবিদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব ? আমার সত্যাবস্হা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, আমি তা নিজে অনুভব করতে পারি, অবিরাম তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে । এক ঘণ্টার বেশি হয়ে গেল এখনও জাহাজঘাটায় পৌঁছোলাম না তো ।
    ঘড়ি তো পরে আসিনি, দাঁড়াও এই লোকটাকে জিগ্যেস করি । ভাইসাব কিতনা বজা হ্যায় ?
    ইগারা বজকে পঁয়তিস মিনট ।
    কেবল পাঁচ মিনিট হয়েছে, মনে হচ্ছিল একঘণ্টা ; কারো ঘড়িতে কটা বেজেছে জেনে কীই বা হবে । সময় জিনিসটা আনরিলায়বল । সেদিন দেখলেন পুড়তে, পুড়েই চলেছে । আপনি আমার হাতটা থরে থাকুন, হাওয়া যা দিচ্ছে, উড়ে না যাই , নাকি পৃথিবী অভিকর্ষহীন হয়ে গেল ।
    তুমি পৃথিবীকে অভিকর্ষহীন করে ফেলেছ । ইউফোরিয়া চাইছিলে !
    ব্যাপারটা কী বলুন তো ? টেম্পল অফ ইনফিনিটি খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে । এটাই হ্যালুসিনেশান বুঝেছেন, স্বপ্ন থেকে আলাদা ।
    তোমার তো দেখছি কনশাসনেস দিব্বি রয়েছে । চলো ওখানটায় বসা যাক, স্টিমারযাত্রীদের ভিড় কম ওই জায়গাটায় । লোকগুলোর এতো চেঁচামেচির কী আছে বুঝিনা ।
    হ্যাঁ, আমার কোনো কিছুতেই আর তেমন নেশা হয় না । খালাসিটোলাতে গিয়েও মাতাল হইনি কোনোদিন। আপনার কি এরকম হয়েছে যে কবিতার লাইন চলে আসছে মনের মধ্যে অথচ লিখতে ইচ্ছা করছে না ।
    আমি মনে রাখতে পারি না, যদি কাগজ কলম কাছাকাছি থাকে তাহলে লিখে রাখার চেষ্টা করি ।
    জলে উড়ছি, জলে উড়ছি, মানুষগুলো মাছের মতন সাঁতার কেটে স্টিমারে উঠছে, দেখুন দেখুন । আবার কাশি পাচ্ছে, লেমোনেড খাওয়ান না, হাফ-হাফ ।
    দাঁড়াও, কেশো না, আনছি লেমোনেড, খসখসের গন্ধ থাকে সবুজ লেমোনেডে, কাশি কমাবে তোমার ।
    সুধীন দত্ত বেঁচে থাকলে ওনার বাড়ি যেতাম একবার, শুনেছি এক্কেবারে সাহেব মানুষ ছিলেন, মদ খাবার কেতা ছিল । পাতা ফুঁকে যেতাম কবিতা শোনাতে , ওনার প্রতিক্রিয়া এনজয় করতাম ।
    গলা ধাক্কা খেতে, ওনার অর্ডারলিকে ডেকে বলতেন, থ্রো হিম আউট । আমি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবনে গিয়েছিলুম । নাম শুনেই মুখের ওপর দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । প্রথমটা খারাপ লেগেছিল, তারপর পথে নেমে এই ভেবে আনন্দ হল যে আমার দুর্নাম ওনার কাছে আগেই পৌঁছে গেছে ।
    মানুষ কেন মানুষকে অপছন্দ করে বলুন তো ? আমি তো কাউকে অপছন্দ করি না । সময় যেখানে পুড়ে নষ্ট হয়ে চলেছে, সেখানে কাউকে আঘাত দেবার কোনো মানে হয় না । এই যে সকলের সঙ্গে থাকি, থাকাটুকুই সার । আমাদের নাম নিউজপেপারের নোংরা পৃষ্ঠায় ছাপা হয়, তবু স্বর্গে যাবো, দেখে নেবেন ।


    সোফার ওপর মেঘে শুয়ে যাকে বলে ‘স্টোনড’ সেই তুরীয় অবস্হায় ফালগুনী, এলএসডিতে ভিজিয়ে শোকানো এক ঘন ইঞ্চের ব্লটিং চিবিয়ে ।
    আমি খাইনি ; ফালগুনীকে লক্ষ্য রাখার জন্য । দুজনে তুরীয় অবস্হায় থাকলে মা এসে দেখবেন আর বিরক্তি প্রকাশ করবেন । ফালগুনীর দিদি অলরেডি এসে কথা শুনিয়ে গেছেন ।
    ওর দিকে তাকিয়ে ভাবি, কিসে আক্রান্ত ফালগুনী ? রবীন্দ্রনাথের বৌঠান, জীবনানন্দ দাশের লাবণ্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শীলা--- ফালগুনী কি সেভাবেই আক্রান্ত ? ওনারা কবিতায় নিয়ে গেছেন আত্মস্হিতিকে ; ফালগুনী সেইভাবে কবিতায় নিয়ে যেতে চাইছে না, অত্যন্ত গোপন রাখতে চাইছে, শেয়ার করতে চাইছে না আমার সঙ্গে, এমনকী নিজের কবিতার সঙ্গেও ! কেন ? কী বলব ওর আত্মস্হিতিকে ? দৌর্মনস্য ? লুগিয়াউব্রিয়াসনেস ? গোপন ঐকান্তিকতা ? অতৃপ্তি ? উদ্দেশ্যহীনতা ?
    গ্রিক ভাবুকরা মনে করতেন পিত্ত কালো হতে থাকলে দৌর্মনস্য দেখা দেয়, আর তা যদি সারতে বহুদিন লেগে যায় তাহলে বুঝতে হবে কোনো অপদেবতা ভর করেছে । ফালগুনীকে কথাটা বলেছিলুম একদিন । ও বললে, আমি তো চাই ডাকিনী-পিশাচিনী ভর করুক, ক্যাথারসিসের অদৃষ্ট করে তো আসিনি ।
    জ্যোতিষীরা মনে করেন শনির প্রকোপে পিত্তদোষ হয়, এবং তার দরুন দৌর্মনস্য । ফালগুনী বলেছিল একবার, ওর নাকি এখন শনির সাড়ে-সাতি চলছে, যা পারা যায় এই সাড়ে-সাতি পিরিয়ডেই লিখে ফেলতে হবে । অথচ লেখালিখি তো তেমন করছে না । ওয়েটিং ফর গোডোর মতন সদাসর্বদা যেন অপেক্ষা করে আছে, কিসের অপেক্ষা তার অনুসন্ধান করে চলেছে, প্রত্যাদেশের, অনুপ্রাণনার ।
    শুয়ে-থাকা ফালগুনীকে দেখে সুফি সন্তদের কথা মনে এলো । আরবরা ‘হুজুন’ বা ‘হুজ্ন’ বলে একটা শব্দ প্রয়োগ করে, নিজের ভেতরে নিজে প্রবেশ করে যাওয়া ব্যাখ্যা করার জন্য । ইরানের দার্শনিক-ডাক্তার বলেছিলেন ‘হুজ্ন’ হল এমনই এক স্হিতি যখন প্রেমিকার নাম শুনলেই ব্যর্থ প্রেমিকের নাড়ি-স্পন্দন তীব্র হয়ে ওঠে । আমি ফালগুনীর প্রেমিকার নাম জানতুম, কিন্তু এই নিরীক্ষা করে দেখিনি কখনও, কেননা জানতুম না ঠিক কী ধরণের ইনট্রিগ ওকে ছেঁকে ধরেছিল যে এই ক্যাটাসট্রফিক পরিস্হিতিতে ফালগুনী পৌঁছেচে । রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠভূমি জানি, অথচ নিকটবন্ধুর ব্যাপারই জানা হয়ে উঠল না । দাঁতে ঈশ্বরকে প্রেমিক কল্পনা করে বলেছিলেন যে, একজন মানুষ যদি হৃদয় দিয়ে, মন দিয়ে, আত্মা দিয়ে ঈশ্বরে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পিত না হয়, তা হলে সেই লোকটি এমনই এক গোপনতায় আক্রান্ত হয় যা সে কাউকে বলতে পারে না, সে একাই ওই ভার বইতে বাধ্য হয় ।
    জার্মান লেখক জিন পল ‘ওয়েলৎশমের্তস’ অভিধাটি কবি-লেখকদের এই বিশ্ববীক্ষার প্রেক্ষিতে তৈরি করেছিলেন : “বাস্তব জগতটি মনের জগতকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না” । পাশ্চাত্য সাহিত্যে এই আত্মস্হিতি নিয়ে যাঁরা কাজ করে গেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন চার্লস অগাস্টিন, সাঁৎ ব্যভ, শাতুব্রিয়ঁ, আলফ্রেদ দি ভিনি, আলেকজান্ডার পুশকিন, মিখাইল লেরমেনতোভ, ন্যাথানিয়েল হথর্ন, হার্মান হেস, হাইনরিখ হাইনে প্রমুখ ।
    বাংলা সাহিত্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৩৮ - ১৯০৩ ) এই ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ‘চিন্তা-তরঙ্গিনী’ নামে একটি কাব্য লিখেছিলেন ; বাহুল্য বলা যে তখনকার সমালোচকরা ‘চিন্তা-তরঙ্গিণী’ কাব্যের আধুনিকতাকে উপলব্ধি করতে পারেননি । অক্ষয়চন্দ্র সরকার লিখেছিলেন, ‘হেমবাবু কালস্রোতের যেভাগে প্রথম দেখা দেন, সেই ভাগ অতি বিষম ; কালস্রোত তখন কেবলই ভাঙ্গিতে ছিল ; ভাঙ্গিব বলিয়াই ভাঙ্গিতে ছিল, গড়িব বলিয়া ভাঙ্গিতেছিল । হেমবাবুর জন্মসময়ে কোনও কিছু ভাঙ্গিতে পারিলেই কৃতবিদ্য আপনাকে গৌরবান্বিত মনে করিতেন । সমাজ ভাঙ্গিতে হইবে, ধর্ম ভাঙ্গিতে হইবে । এমনকী, অনাচারে অত্যাচারে স্বাস্হ্য ভঙ্গ করিয়া, অকালে কালগ্রাসে ডুবিতে থাকাও যেন সেই সময়ে গৌরবের বিষয় বলিয়া ধারণা হইত । আর এখন হেমবাবুর মৃত্যু সময়ে বোধ হয়, যেন সিকস্তির পর একটু পয়স্তি হইতেছে।’
    পড়ে মনে হবে অক্ষয়চন্দ্র সরকার যেন ফালগুনী রায়ের সমালোচকদের নকল করছেন ।
    আত্মস্হিতির এই অবস্হাটি বৌদ্ধধর্মে বহুকাল আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, যখন বুদ্ধ ‘দুঃখসত্য’-এর কথা বলেছিলেন, যে-সত্যটি চারটি সত্যের অন্যতম । বৌদ্ধধর্মে অবস্হাটি আশাবাদ বা নিরাশাবাদের নয়, তা বাস্তববাদের ।


    তুমি স্বর্গে চলে গেছো ফালগুনী, ১৯৮১ সালের মে মাসে, সাড়ে তিন দশক আগে ।
    তোমাকে বলেছিলুম গোলঘরের ভেতরে গিয়ে তোমার কবিতাপাঠ শুনব, তোমার কন্ঠস্বর একুশবার প্রতিধ্বনিত হবে, তা আর শোনা হল না, যেদিন আমরা গোলঘরে গিয়েছিলুম সেদিন বন্ধ ছিল, তাই একশো চুয়াল্লিশটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তোমার কবিতা শুনেছিলুম, সম্পূর্ণ নয়, অর্ধেক, কেননা তুমি কাশতে আরম্ভ করেছিলে, আমরা সঙ্গে করে জল বা পিপারমেন্ট লজেন্স নিয়ে যাইনি ।
    তোমাকে বলেছিলুম চাইবাসায় রোরো নদী আর লুপুংগুটু ঝর্ণা দেখাতে, শালপাতায় হাড়িয়া আর মাটির ভাঁড়ে মহুয়া খাওয়াতে নিয়ে যাব ; তা আর হতে পারেনি ।
    এই বাংলা আর দুই বাংলার বহু সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপাধভায়, শান্তনু দাশ যেমন তোমাকে বাদ দিয়েছেন, তেমনই মণীন্দ্র গুপ্ত । অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তোমাকে বাদ দিয়েছেন ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’ আর ‘ষাটের দশকের কবিতা’ সন্দর্ভে । প্রদ্যোত সেনগুপ্ত তাঁর ‘অন্য দিগন্ত : ষাটের কবিতা’ রচনাটিতে । আশিস সান্যাল তাঁর ‘ষাটের কবিতা’ গ্রন্হে । আরও বহু গ্রন্হে, যার হদিশ রাখিনি আমি, কী-ই বা হবে বলো ।
    তোমার ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসান’, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রথম প্রকাশ করার পর বারবার ছাপা হয়ে চলেছে । অলোক গোস্বামী, শুভঙ্কর দাশ, আলোক সরকার, মনফকিরা, সমীর রায়চৌধুরী পুনর্মুদ্রণ করেছেন, তোমার অপ্রকাশিত কবিতা যেগুলো সুবিমল বসাকের কাছে ছিল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ।
    বইটি ছাপা হবার পরই ফুরিয়ে যাচ্ছে ।
    দুই বাংলায় তোমার পাঠকসংখ্যা অগুণিত ; তোমার সময়ে ইনটারনেট ছিল না । এখন ইনটারনেটে তোমার কবিতা খুঁজলেই পাওয়া যায়, সম্পূর্ণ বইটির কবিতা পাওয়া যায়, তোমার সম্পর্কে প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাওয়া যায় ।
    তোমাকে আবার পাঠকদের সামনে আনছেন ‘চন্দ্রগহণ’ পত্রিকা ।
    জানি, সুফিসন্তদের মতো তুমি আগ্রহহীন ।
  • | 012312.60.8923.236 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:১৫541292
  • স্বপনরঞ্জন হালদার : অখ্যাত লেখকের অবহেলিত বই
    মলয় রায়চৌধুরী
    নন্দীগ্রাম
    পথে-পথে কৃষিমুণ্ড পথে-পথে আমাদের পরিত্যক্ত লাশ
    এইমাত্র শেষ হল আমাদের প্রতিরোধ, স্বপ্নতিতাস ।
    লালঝাণ্ডা কমরেড, বাবা ছিল তেভাগার চাষি
    কাস্তে হাতুড়ি তারা --- পরিসর পরিজন মাসি
    সকলেই দেখেছিল : ফেটে গেছে তলপেট, গাভী
    আমিও কি কমরেড ? সেই কথা সারাদিন ভাবি
    পথে-পথে কৃষিমুণ্ড, শকুনেরা মাংস খায় চিরে
    পরিত্যক্ত আমরা পড়ে থাকি চুপচাপ মার্ক্সবাদী নীড়ে
    মার্ক্সবাদ মার্ক্সবাদ, কাটা হাতে লাল ঝাণ্ডা তুলে
    মাঝরাতে আমরাও চাষিদের কান দিই মুলে
    ( জহর সেনমজুমদার )

    স্বপনরঞ্জন হালদারের নাম আমি প্রথম শুনলুম ‘উল্টো দূরবীন’ পত্রিকার সূত্রে, যখন পত্রিকাটির পক্ষ থেকে আমার একটি সাক্ষাৎকার তিনি নিতে চাইলেন । ‘উল্টো দূরবীন’ পত্রিকাটির সঙ্গেও সেই প্রথম পরিচয় । তাই, ওনার লেখা একটি বই, মানে এমন একজন যাঁর লেখা আমি বুড়ো বয়সে প্রথম পড়তে বসলুম, জানতে পারলুম যে উনিও ষাট পেরিয়েছেন, এইটি তাঁর একমাত্র বই, তাই একজন অখ্যাত লেখকের বেপরোয়া কাজ নিয়ে লেখার ইচ্ছে হল ।
    প্রথমেই বলে নেয়া যাক যে কেবল গ্লসি পত্রিকা ও রঙবেরঙ মলাটে মোড়া গল্পের বইয়ের সাধারণ পাঠকরাই নয়, বহু লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর পাঠকদেরও এই বইটির গদ্যপাঠ মনে হবে জ্বালাতনমূলক, হুঁচটবহুল, বিরক্তিকর এবং অস্বস্তিকর । বইটি পড়ার জন্য চাই ধৈর্য ।
    ২০০১ থেকে ২০১০ এর মাঝে লেখা, গদ্যগুলো এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি । বইটির নাম ‘প্রকাশ্য দিবালোকে পাকা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ফটাফট কাপড়চোপড় খুলে ফেলছিল যে যুবতী পাগলিটা’, দেখার পর, কয়েকদিন ভেবেছি যে স্বপনরঞ্জন হালদার তাঁর বইটির নামে ‘ফটাফট’ শব্দটা যোগ করলেন কেন ? ‘ফটাফট’ শব্দটিতে যে ধ্বনি, তা কি ছবিটিতে হেরফের ঘটাচ্ছে ? বইটির গদ্যগুলোকে উপস্হাপনের ব্যাখ্যায় কি ‘ফটাফট’ জরুরি ছিল ? তারপর ‘পাগলিটা’ শব্দ কেন প্রয়োগ করলেন ? একজন বাঙালি যুবতী মাঝরাস্তায় দিনদুপুরে স্বতঃপ্রবৃত্ত উলঙ্গ হলে কি তার সঙ্গে কাপড়চোপড় খুলে ফেলতে থাকা একজন ‘পাগলির’ পার্থক্য আছে ? আর যদি তা থাকে তাহলে বইটির গদ্যের নির্মাণে কি প্রক্রিয়াটি বর্তমান বঙ্গসমাজ সম্পর্কে বিশেষ বার্তা দিতে চাইছে ? ‘প্রকাশ্য দিবালোকে’ শব্দবন্ধ থেকে অনুমান করি যে খবরের কাগজের চালু-সংবাদীয় রিডার-ফ্রেন্ডলি দিনানুদৈনিককে কটুতায় মুড়তে চেয়েছেন স্বপনরঞ্জন, নয়তো দিবালোকে বা দিনের বেলায় লিখতেন বলেই মনে হয় ।
    মানসিক অসুস্হ না হলে একজন যুবতী কেনই বা সকলের চোখের সামনে জামাকাপড় খুলে ফেলবেন, তা দিনদুপুরে হোক বা রাতের বেলাকার রাস্তায় । এখানে ‘পাকা’ শব্দটাও ভেবে দেখার ; কেন স্বপনরঞ্জন হালদার ‘পাকা’ শব্দটা রাখলেন । যে-কোনো রাস্তাই তো হতে পারত । অনুমান করি যে তিনি শহরের কথা বলছেন, বা শহুরে ঘটনার কথা বলছেন, যে অঞ্চলে ক্ষমতাপ্রতাপের আস্ফালন প্রদর্শিত হয় । মেট্রপলিটান কেন্দ্রের কথা । পাকা রাস্তা এখন পশ্চিমবাংলার মাঝ দিয়ে নানা জায়গায় গিয়েছে ; সেগুলো অনেকাংশে ফাঁকা । ফাঁকা রাস্তায় একজন উন্মাদিনী উলঙ্গ হতে চাইলে ‘প্রকাশ্য দিবালোকে’ শব্দবন্ধটা ওনার গদ্যের লক্ষ্যস্হলকে চিহ্ণিত করবে না । তাই, প্রকাশ্য দিবালোকে শুনলে শহরের ব্যস্ত কোনো রাজপথ বলেই মনে করতে হবে, অনুমান করি । দিনদুপুরে একজন যুবতী রাস্তায় দাঁড়িয়ে উলঙ্গ হতে চাইছে, বর্তমান বঙ্গসমাজের এরকম একটি ছবিই তাহলে স্বপনরঞ্জনের গদ্যকল্পনায় বাসা বেঁধে আছে । এরকম মনে হবার কারন, তিনি জানিয়েছেন বইটির
    রচনাকাল হল তাঁর ‘স্বপ্নভঙ্গের শেষ অধ্যায়’, অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০১০ । লক্ষ্য করবার যে তিনি বলছেন স্বপ্নভঙ্গের শেষ অধ্যায় ; তার মানে বেশ আগে থেকেই তাঁর স্বপ্নভঙ্গ ঘটতে আরম্ভ করেছিল । কবে থেকে, জানতে পারলে একজন লেখকের হেরে যাবার সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের উৎস অনুধাবন করা যেতে পারত । অ্যাংস্টও সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের বনেদ গড়তে পারে তাহলে ।
    গদ্যগুলোকে তিনি বলেছেন ‘কথন’ ; ‘গল্প’ হিসাবে চিহ্ণিত করেননি, যদিও ইংরেজিতে গদ্যগুলোকে বলা হয়েছে ‘স্টোরি’। গল্প বা স্টোরি বলতে সাধারণত যা বোঝায়, এই বইয়ের গদ্যগুলো তা নয় । আমার মনে হয়েছে, স্বপনরঞ্জন হালদার একজন লেখক নন, তিনি একজন পাঠক, এই বইটিও তাঁর গড়া স্বপাঠবস্তু । বহু গ্রন্হ ও দিনানুদৈনিক সংবাদপত্রের পাঠকরূপে তাঁর মস্তিষ্কে বিভিন্ন ঘটনার মৌমাছিদের প্রতিনিয়ত উড়ালের স্মৃতিগুঞ্জনের দুঃখ, কষ্ট, যাতনা, পরাজয়বোধ, গ্লানি, ক্ষোভ, ক্রোধ, কান্না, হতাশা, বিশ্বাসঘাতকতা, কৃতঘ্নতা, ইত্যাদির চাক । চাকটি তিনি নিজেই ভাঙছেন আর হুলের বিষ সহ্য করছেন ; তাঁর স্বীকৃতি অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে । অন্যান্য লেখকরা মুখোশ আর বোরখাজাল পরে থাকেন বলে তাঁদের অমন হুলের বিষ পোয়াতে হয় না, বা হলেও, তা জানাতে চান না সবাইকে, আখের গোলমালের ভয়ে ।
    তবে স্বপনরঞ্জন হালদার কি টের পাননি যে বিষটা ২০০১ সাল নয়, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই তাঁর এবং তাঁর স্বপ্নজগতের বহু নাগরিকের ব্যক্তিক ও কৌম অস্তিত্বে সঞ্চারিত হচ্ছিল ! আমরা তো দেখেছি জঙ্গিপাড়ায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করে আঁজলাভরে রক্ত পান করা হয়েছে, হাওড়ার কান্দুয়ায় পাথরে হাত রেখে হাতের পাঞ্জা কেটে নে্য়া হয়েছে, যাদবপুরে থেঁতলে মেরে ফেলা হয়েছে বৃদ্ধাকে, বর্ধমানের দেওয়ানদিঘিতে আটজনকে বেদম পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, সতেরোজন সন্ন্যাসীকে দিনদুপুরে গায়ে পেট্রল ঢেলে পোড়ানো হয়েছে, বানতলায় ঘিরে মেরে ফেলা হয়েছে মহিলাকে, কুড়ি বছরের নাজিমা খাতুনকে উলঙ্গ করে পিটিয়ে ঘোরানো হয়েছে শ্যাওড়াফুলিতে, আওয়ামি লিগ নেত্রীকে পারাপারি ধর্ষণ করা হয়েছে হাওড়ার রেলের যাত্রীনিবাসে । আরও কত অমন নারকীয় ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই ।
    বইটিতে স্বপনরঞ্জনের নিবাসস্হান দেয়া আছে গাঁড়াপোতা, উত্তর চব্বিশ পরগণা । ‘উল্টো দূরবীন’ পত্রিকাটি তিনি এবং অমিত চক্রবর্তী দু’জনে সম্পাদনা করেন । অমিত চক্রবর্তী থাকেন কলকাতার বাগুইআটিতে ; অমিতবাবুর বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হয় পত্রিকাটি । গাঁড়াপোতা অঞ্চলিটিতে আমি কখনও যাইনি, তাই জানি না যে সেখানে ‘পাকা রাস্তা’ বলতে ঠিক কী ধরনের পথ বোঝায় । এও জানি না যে গাঁড়াপোতায় বসবাসের আগে তিনি কলকাতা মহানগরে থাকতেন কি না, গাঁড়াপোতা ছাড়া পশ্চিমবাংলার অন্যত্র বসবাস করেছেন কি না, পশ্চিমবাংলার বাইরের ভারতবর্ষের অন্যত্র বসবাসের পার্সপেক্টিভ আছে কি না। গদ্যগুলো পড়ার সময় আমি চাকুরিসূত্রে গ্রামগঞ্জ চষে-বেড়ানো আমার দেখা পশ্চিমবঙ্গকে স্বপনরঞ্জনের গড়া বিভিন্ন ছবি-বক্তব্যের মাধ্যমে দেখতে ও বুঝতে চেয়েছি ।
    গদ্যের সূচি বা তালিকা, যাকে তিনি বলছেন ‘কথন-ক্রম’, তা দেয়া আছে বইটির একেবারে শেষে, যা থেকে জানতে পারি যে এগারটি গদ্য তিনি লিখেছেন তাঁর স্বপ্নভঙ্গের দশকে, মানে ২০০১ থেকে ২০১০র মাঝে। পাঠক গদ্যগুলো পড়ে নিয়ে কথন-ক্রমে পৌঁছোবেন । প্রথম গদ্যটির শিরোনাম ‘আসলে এটি সুবিমল মিশ্র নামক জনৈক আত্মঘাতী জঙ্গি লেখকের বৃত্তান্ত হয়ে উঠতে পারত।’ এই গদ্যটিতে স্বপনরঞ্জন স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন যে তিনি সুবিমল মিশ্রের একজন গুণগ্রাহী একনিষ্ঠ পাঠক । গদ্যটি সুবিমল মিশ্রকে তাঁর ট্রিবিউট ; বইটি উৎসর্গও করেছেন সুবিমল মিশ্রকে । আর সত্যিই, বইটি সুবিমল মিশ্রের ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ গ্রন্হটির কাজকে নকল করার প্রয়াস করা হয়েছে ।
    বইটির শেষে, ‘কথন-ক্রম’ তালিকার আগের পাতায়, বড় মাপের পাতাজোড়া অক্ষরে এই ঘোষণাটি রেখেছেন স্বপনরঞ্জন হালদার : “জানি, হয়তো, গড়ে উঠল না কিছুই -- তবু, অন্যদিক, উল্টোদিক থেকে শাবলটা, হ্যাঁ, ততটা মজবুত নয়, অবভিয়াসলি, পল্লবগ্রাহিতার জংজর্জর, তথাপি, সেটা কি সামর্থ অনুযায়ী আনাড়ির মতোই ঢুকিয়ে দেওয়া গেল পুরনো গাঁথনির ভেতর --- ইট খসানোর চেষ্টায়….ঝরে পড়ল কি অন্তত
    এক মুঠো জীর্ণ চুনবালি ?” আমি বলব, পড়ল না, কেননা এই বইটি সেই সময়ে প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল যখন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে চলছিল রাজনৈতিক রক্তচোষাদের দিগ্বিজয় ।
    ডাকের মোড়ক খুলে, বইটি উল্টে-পাল্টে, প্রথম প্রতিক্রিয়ায় আমার মনে হয়েছিল যে স্বপনরঞ্জন হালদার সুবিমল মিশ্র দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত । কিন্তু পরের দশটি গদ্য পড়তে-পড়তে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি এবং সুবিমল মিশ্র দুই বিপরীত চিন্তন-মেরুর নিবাসী । সুবিমল মিশ্রের লেখা আক্রমণাত্মক, যখন কিনা স্বপনরঞ্জন হালদারের লেখা একজন বিধ্বস্ত আক্রান্তের মনন জগতকে মেলে ধরে ; তিনি নিজেই বলেছেন তাঁর গদ্যগুলো স্বপ্নভঙ্গের, অর্থাৎ হেরে যাবার । সুবিমল মিশ্র, যতদূর জানি, হেরে গেছেন বলে স্বীকার করেন না, পশ্চিমবাংলায় বামপন্হীদের দ্বারা চর্চিত জুরাসিক বাগানের পত্তন, পচন এবং পতন সত্ত্বেও । সুতরাং স্বপনরঞ্জন হালদারের পরাজয়ের গদ্যবৃত্তান্তের দায় তাঁর নিজেরই, সুবিমল মিশ্রের নয় । সুবিমল মিশ্রকে আত্মঘাতী চিহ্নিত করার মাধ্যমে স্বপনরঞ্জন নিজেকেই মেলে ধরছেন, কেননা সুবিমল মিশ্রকে আত্মঘাতী মনে করাটা সুবিমল মিশ্রের লেখাপত্র সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা গড়ে তোলে । অবশ্য সুবিমল মিশ্রও এখন কিছুটা মেলোড ডাউন । সুবিমলবাবুর বই হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে, টেহেলকাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, ইউটিউবে নিজের সম্পর্কে ফিল্ম আপলোড করতে দিয়েছেন, গাঙচিল প্রকাশনী থেকে বই বের করার অনুমতি দিয়েছেন ।
    পাঁচের দশকের আমেরিকায় জেরক্স কোম্পানি তাঁদের মেশিনটি যখন বাজারে ছাড়েন, তখন সেদেশে একটি লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ ঘটে । জেরক্স-করা এই লিটল ম্যাগাজিনগুলো যাঁরা প্রকাশ করতেন তাঁরা অনেকে পরবর্তীকালে ‘বিট আন্দোলনকারী’ হিসাবে চিহ্ণিত হন । সাহিত্য-বাজারের বাইরের লেখক ও ছবি-আঁকিয়েরা কাগজের ওপর যথেচ্ছ কাজ করার স্বাধীনতা পেয়ে যান । যেমন হরফ-মাপের হেরফের, হরফ সাজানো, ছবির সঙ্গে লেখা, ফাঁকা রেখে দেয়া পৃষ্ঠা, পত্রিকার সামনে দিক ও পিছন দিক থেকে পাঠের জন্য দু’রকম প্রচ্ছদ এবং একই পত্রিকার দুটি নামকরণ, ইংরেজি গদ্যের ভিতরে গ্রিক অথবা লাতিন হরফে লেখা বাক্য, ইত্যাদি । যেহেতু এই পত্রিকাগুলো ছিল বাজারের বাইরে, তাই, মধ্যবিত্ত বাঙালিসমাজে যাকে বলা হয় স্ল্যাং, গালাগালি, অশ্লীল অভিব্যক্তি বা যৌনশব্দ, তা প্রচুর ব্যবহার করা হতো, এবং নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের ছবিও থাকত । উল্লেখযোগ্য পত্রিকাগুলো হল সিটিলাইটস জার্নাল, গেরিলা, স্যানফ্রানসিসকো আর্থকোয়েক, এল কর্নো এমপ্লুমাদো, ক্ল্যাক্টোভিডসেডস্টিন, কুলচুর, এভারগ্রিন রিভিউ, দি ভিলেজ ভয়েস, বার্নিং ওয়াটার, ইনটারগ্যালাকটিক, সলটেড ফেদার্স, এজরা, ড্যাম ইউ, ফাক ইউ, মাই ওন ম্যাগ, ভিনসেন্ট, প্যানিক, র‌্যামপার্টস, ইকো, আইকনোল্যাট্রে, ইমেজো, হোয়্যার, ওয়র্ক ইত্যাদি । আমেরিকায় অবশ্য রাষ্ট্রপতিরাও ফাক, শিট, আসহোল, সান অব এ বিচ ধরনের অভিব্যক্তি আইজেনহাওয়ারের সময় থেকেই প্রয়োগ করে আসছেন ।
    বিট আন্দোলনকারীদের আবির্ভাবের পূর্বে, নিউ ইয়র্কে ‘হার্লেম রেনেসঁস’-এর আফ্রোমার্কিন কবি-লেখক-ছবি আঁকিয়েরাও কেউ-কেউ এই টেকনিকগুলোর প্রয়োগ করেছেন, লিথোতে বা নিজেদের ঘেটোর ছাপাখানায় ছেপে প্রকাশ করা বই ও পত্রিকায় । তারও আগে ফ্রান্সের ডাডা আন্দোলনকারীরা প্রয়োগ করেছেন কয়েকটি টেকনিক। সুবিমল মিশ্র যেমন করেছেন, তেমনভাবে স্বপনরঞ্জন হালদারও তাঁর বইটিতে ন্যারেটিভকে বিঘ্নিত-করার এই টেকনিকগুলোর বেশ কয়েকটি প্রয়োগ করেছেন, বিশেষ করে হরফের মাপ, হরফ সাজানো, ভেঙে-ফেলা ইংরেজি বাক্য প্রয়োগ, ফাঁকা রেখে-দেয়া পৃষ্ঠা, সংবাদপত্রের দৃষ্টি আকর্ষণকারী বক্সের মতন বর্ডার-দেয়া টুকরো গদ্য ইত্যাদি । তবে ডাডা এবং বিটরা যে কাঁচিকাটা গদ্যশৈলীর প্রচলন করেন, যাকে এখন বলা হয় ‘ব্রায়ান জিসিন টেকনিক’, যা সুবিমল মিশ্র প্রয়োগ করেছেন, তা প্রয়োগ করেননি স্বপনরঞ্জন । ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হবার পর, স্বাভাবিক কারণে, বিট আন্দোলন ফুরিয়ে যায় এবং আমেরিকা-ইউরোপে অমনতর লিটল ম্যাগাজিন যুগের অবসান ঘটে । প্রকৃতঅর্থে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ আর ইউরোপ আমেরিকায় প্রকাশিত হয় না । পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারাও ভিজুয়াল থেকে সরে গেছে গদ্যশরীরে ।
    ডাডাবাদীরা, পরাবাস্তববাদীরা, বিট আন্দোলনকারীরা বলে গেছেন যে বাস্তববাদী লেখকরা মানুষের অবচেতনের আড়ালে লুকোনো তুমূল বিশৃঙ্খলাকে তুলে ধরতে পারেননি ; তাঁরা তাই অন্য উপায় খুঁজে বের করতে বাধ্য হলেন । বাধ্য হলেন ভাষাকাঠামোয় নতুনত্ব আনতে ; নতুন কোড, নতুন দ্যোতক, নতুনরূপক
    উদ্ভাবন করতে হল তাঁদের । যেহেতু শব্দ আর রূপকল্প নিজেই ধাবমান, অনিশ্চিত এবং বিশৃঙ্খল, কবি-লেখকরা উদ্ভাবন করতে চাইলেন মুহূর্ত-বিশেষের ছাপকে ধরে ফেলবার মতন বাকজগত গঠনের শৈলী । চাইলেন অভিঘাত সৃষ্টি করতে, ধাক্কা দিতে, উদ্দীপ্ত করতে, ঝাঁকুনি দিতে । মন্তাজ ও ব্রিকোলাজ ছিল ওই শৈলীগুলোর অন্যতম । একাধিক সময় ও পরিসরকে তাঁরা একটিমাত্র জমিতে বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । বিধ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন একরৈখিকতাকে, কেননা খ্রিস্টধর্মের সময়ানুক্রমী প্রগতিতত্ব থেকে জন্ম নিয়েছিল রৈখিক কাহিনির বিন্যাস । তাঁরা বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন জনচিত্তরঞ্জন থেকে । এই প্রবণতাকে ডেভিড হার্ভে বলেছিলেন ‘সৃজনশীল বিনাশ।’ ডাডাবাদীরা, পরাবাস্তববাদীরা, বিট আন্দোলনকারীরা সনাতন নন্দনতত্বকে বিসর্জন দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের বাজার তাঁদের পৌঁছে দিয়েছিল এক বিপরীত নানন্দনিকতায় । তাঁদের স্বঘোষিত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ও পাতিবুর্জোয়া শিল্পবোধের বিরোধিতা বাজারের খপ্পরে পড়ে ‘ব্র্যাণ্ড নেম’ হয়ে গেল । উইলিয়াম বেনিয়ানিন একে বলেছেন ‘জ্যোতির্ময় শিল্প।’
    যখন ডাডাবাদীরা এবং পরাবাস্তববাদীরা সাহিত্যের মাঠে নামেন তখন যান্ত্রিক মুদ্রণ এবং ফোটোগ্রাফি পালটে ফেলছিল সাহিত্যিক আর ছবি-আঁকিয়ের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকা । তাঁরা টের পাচ্ছিলেন যে চেতনার ভেতরে রয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা ; ব্যক্তিএকক যত ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে তত বেশি ওই বিশৃঙ্খলার খপ্পরে পড়ে । প্রশ্ন হল যে কেন স্বপনরঞ্জন হালদার, যাঁর মগজের বাস্তব জগতটি, বইটি পড়ে সেরকমটাই মনে হয়, মিডিয়া-প্ররোচিত, গ্রন্হ-তাড়িত, রাজনৈতিক-আড্ডা-প্রসূত, সেইসব টেকনিককে সাহিত্যে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন যেগুলো ইউরোপের লেখক ও চিত্রকররা বহুকাল আগে তাঁদের বইতে ও ক্যানভাসে করে গেছেন, ডাডাবাদীরা করেছেন, পরাবাস্তববাদীরা করেছেন, বিট আন্দোলনকারীরা করেছেন, হার্লেম রেনেসঁসের লেখকরা করে গেছেন । আমার অনুমান, যে সমাজটিতে তাঁর বসবাস, তথ্যবিস্ফোরণের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সেই সমাজটির নানাত্ববাদী বিশৃঙ্খলার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন গদক্রীড়ায় নিজের নির্নয়কে পরখ করতে চেয়েছেন স্বপনরঞ্জন হালদার, যার দরুণ অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়ও, শ্লেষ-বিদ্রূপ-ব্যাজস্তুতি, খোঁচা, খুনসুটি, ঠাট্টা, ইয়ার্কি, মজা, চিমটি ইত্যাদির ক্ষুর দিয়ে চিরে ফালা-ফালা করে পাঠকের সামনে তুলে ধরা যায়। সন্দর্ভগুলো, গদ্যগুলোকে যদি তা-ই বলি, ওই শ্লেষ-বিদ্রূপ-ব্যাজস্তুতির অনুবর্তনের মাধ্যমে যাতে ক্রমাগত পাঠককে পাকে-পাকে জড়িয়ে ধরতে পারে, তার প্রয়াস করেছেন । স্বপনরঞ্জন হালদার ভুলতে দিতে চান না, যে, পাঠক যদিও একটা বানানো ঘটনাক্রম পড়বে, সে পশ্চিমবাংলার বাস্তব এবং লেখকের দ্বারা বানানো ঘটনার সম্পর্ককে সচেতনভাবে যাচাই করতে বাধ্য হবে । অবশ্য এই নির্মাণ-পক্রিয়ার আরেকটা দিকও আছে, আর তা হল গদ্যক্রীড়ার আড়ালে মর্মার্থ ও অনুযায়ীতার হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা । আসলে চতুর্দিকের বিশৃঙ্খলার মাঝে, যে বিশৃঙ্খলা ক্রমশ অনতিক্রম্য হয়ে দেখা দিচ্ছে, অমন ধ্বংসের মাঝে ওই বিশৃঙ্খলাকে দখল করে তারই খেলার চালগুলোকে রপ্ত করতে চেয়েছেন লেখক ; মিডিয়া-চালিত, তদ্বারা নির্মিত ও প্রোৎসাহিত বাস্তবকেই তুচ্ছতাচ্ছ্যল্যে হেয় করেছেন, তাঁর স্বপ্নভঙ্গের বদলা নেবার অভিপ্রায়ে, হেরে যাবার অসুস্হতার নিরাময় হিসাবে।
    গতানুগতিক ন্যারেটিভে ভঙ্গুরতা এবং অতিপ্রাতিস্বিকতাকে মনে করা হতো যে তা ব্যক্তিলেখকের আস্তিত্বিক অমূর্তাবস্হার বয়ান , কিংবা ফ্রয়েডিয় অন্তর্দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ, যার সমাধান করতেই হবে ; এবং সেই সমাধানসূত্রটি লেখক তাঁর রচনায় জানাবেন । গতানুগতিক ন্যারেটিভে একাধিক বিষয় এবং জনারের মিশ্রণকে মনে করা হতো সাহিত্য হিসাবে গদ্যকর্মটির পক্ষে ক্ষতিকর । এমনকী তা করলে লেখনকর্মটিকে সাহিত্য হিসাবে স্বীকার করা যাবে না । কিন্তু স্বপনরঞ্জন হালদার যা করেছেন তা চেষ্টাকৃতভাবেই করেছেন, বেরিয়ে যেতে চেয়েছেন প্রথাগত সাহিত্যের বিদ্যায়তনিক চৌহদ্দি থেকে । গোছানো সমাপ্তি থেকে রচনাগুলোকে মুক্তি দিয়ে লেখকের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন । লেখক, পাঠবস্তু ও পাঠকের মাঝে যে গূঢ় চুক্তি, যে চুক্তির সাহায্যে একজন লেখক ব্র্যাণ্ড-নেম গড়ে তোলেন এবং পাঠকের বাজারে প্রবেশ করেন, তাতে অন্তর্ঘাত ঘটাতে চেয়েছেন । লেখক নিজেই গদ্যের ন্যারেটরের জীবনে ঢুকে পড়ছেন এবং ভাঙচুর চালাচ্ছেন, সৃষ্ট চরিত্রকে
    আক্রমণ করছেন । ফলে রচনার স্ট্র্যাটেজিটিই হয়ে উঠেছে ন্যারেটিভ ।
    সারোগেট পদ্ধতি, যাকে ইনটারটেক্সচুয়ালিটিও বলা হয়, সেই কৌশলটি প্রয়োগ করে, স্বপনরঞ্জন হালদার পূর্বতন সাহিত্যিক কাজগুলোর ওপর তাঁর নির্ভরতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন ; বিতর্ক তুলছেন সমাজ ও সাহিত্যের মাঝে গড়ে ওঠা সম্পর্ক নিয়ে । পাঠককে তিনি ভুলতে দিতে চাইছেন না যে তাঁর গদ্যগুলো নিছক গালগল্প নয় । এই মেটাফিকশান পদ্ধতির সাহায্যে তিনি নিজের উপস্হিতি জানান দিচ্ছেন, সন্দর্ভের অনুক্রমে উথাল-পাথাল ঘটাচ্ছেন ; গদ্যকে লাফিয়ে যেতে দিচ্ছেন পরিসর থেকে পরিসরে, সময় থেকে সময়ে, কমেডি থেকে আতঙ্কে, যাতে জঘন্য, মজাদার, পোলেমিকাল ও বিক্ষুব্ধ আত্মজ্ঞানের বর্ণনাকারী হিসাবে তিনি ব্যক্তিগত আবেগের যতটুকু-সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন ; ঘটনাবিশেষের সঙ্গে খাপ খায় না এমন সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসিক প্রসঙ্গের অবতারণা করতে পারেন । রৈখিকতাকে চুরমার করছেন গদ্যপ্রবাহে ও পৃষ্ঠায় সাজানো দৃষ্টিগোচর কমপোজিশানে । ফলে গদ্যের সঙ্গে একযোগে পাঠকও ডিসওরিয়েন্ট হয়ে চলেছে । সম্ভবত লেখকের ধারণা যে সাহিত্যের গতানুগতিক গদ্যপদ্ধতি প্রয়োগ করে পশ্চিমবাংলার বর্তমান কৌম-বিশৃঙ্খলার ভয়াবহতাকে পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যাবে না, তা হয়ে যাবে মেট্রপলিটান বাজারের একটি ক্রয়যোগ্য প্রডাক্ট, যেগুলো প্রতিদিনের ‘ব্যবহার করো আর ফেলে দাও’ বস্তুর মতন কিলো দরে কাগজের মণ্ড তৈরির কারখানায় গিয়ে নবজন্ম নিয়ে থাকে ।
    তবে ব্যক্তিগত আবেগ থেকে, নিজের অ্যাড্রেনালিনের স্ফূরণচমকের দরুণ, তনি, স্বপনরঞ্জন হালদার, প্রতিটি গদ্যে, নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি, বা অবচেতনায় চাননি । মনে হয় যেন একদা-প্রিয় নিজের তাত্ত্বিক বিশ্বাসই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে । ফলত আস্তিত্বিক স্হিতিটি তাঁর সামনে যে স্বপনরঞ্জনকে মেলে ধরছে তিনি ভঙ্গুর, অনিশ্চিত, সন্দেহত্রস্ত, অসম্বদ্ধ, অসংলগ্ন, শিথিল, সঙ্গতিহীন, আসঞ্জনহীন, বোধাতীত, নিষ্পত্তিহীন, অস্হির, বেমানান, বেখাপ্পা, এবং এই স্ববৈচিত্রগুলো ছাপ ফেলছে তাঁর গদ্যশরীরের কেন্দ্রহীনতায়, প্যারডিতে, আয়রনিতে, অক্রমিকতায়, খেয়ালে, বৈসাদৃশ্যে । তিনি সম্ভবত টের পাচ্ছেন যে এতাবৎকাল লালিত বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির প্রতিস্ব কী ভাবে জ্ঞানের মাপকাঠি দিয়ে বিশ্লেষণ করা কঠিন হয়ে চলেছে, কেনই বা চেতনা হারিয়ে ফেলছে প্রতিস্বটি, কোন কারণে যুক্তির আলো ফেলা যাচ্ছে না আচার-আচরণে । নিজেরই রচনার ট্র্যাজিক নাটকের তিনি নায়ক, যার শোকে তিনি মূহ্যমান । কিন্তু শোক যে ঘটছে তার স্বীকৃতিই স্বপনরঞ্জনের বিলাপের, আর্তনাদের প্রাপ্তিফসল । তিনি ঘটনাগুলোর ছবি তো সাজাচ্ছেন, কিন্তু কেন ঘটছে এই জিজ্ঞাসাটি রাখছেন না । এই প্রসঙ্গে কাফকা সম্পর্কে ডেভিড ফসটার ওয়ালেস-এর এই বক্তব্যটি মনে পড়ে : “ জীবনের মর্মার্থ অনুসন্ধানের শেষহীন, শাস্তিমূলক, প্রতিরোধী প্রয়াসের প্রক্রিয়াটিই জীবনের মর্মার্থ ; নিজেকে অন্বেষণের জন্য একজন মানুষ সারাজীবন যে প্রচেষ্টা চালায় শেষ পর্যন্ত ওই প্রচেষ্টাকেই তার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।”
    প্রথম গদ্যটির শিরোনাম ও বিষয়বস্তু আগেই জানিয়েছি । অন্য গদ্যগুলোর শিরোনাম পড়লে স্বপনরঞ্জন হালদারের চিন্তায় যে তোলপাড়, তা ধরা পড়বে : ২ ) কমরেড অজামিল তলাপাত্রের দিনক্ষণ এখন যেভাবে ; ৩) ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা ; ৩ ) অ্যাম্বুলেন্স সংক্রামক ব্যাধির জন্য নহে ; ৪ ) যে নকসি কাঁথাটির বুননে প্রতি বর্গ বিঘতে ছুঁচ ও আঙুলটুপি বদলানো হয়েছিল ; ৫ ) একটি গ্রামীণ পরচর্চাকেন্দ্রে অগ্ন্যুৎপাত ও শিলাবৃষ্টিজনিত ক্ষয়ক্ষতি, যতটুকু যা জানা গেছে ; ৬ ) ও হুজুর-- ; ৭ ) ঝুমকা গিরা রে/ বেরেলি কা বাজার মে ; ৮ ) দীনময়ী, সিমন দ্য বভ্যোয়া ও পবিত্রর বউ ; ৯ ) ইনট্রোডাকশান টু অ্যান অটোবায়োগ্রাফি; ১০ ) বিলিভ মি, যাহা বলিব সত্য বলিব । এই কথনগুলো সংক্ষেপে এক-এক করে দেখা যাক ।
    ‘কমরেড অজামিল তলাপাত্রের দিনক্ষণ এখন যেভাবে’ রচনাটিতে ‘কমরেড’, ‘অজামিল’ এবং ‘তলাপাত্র’ শব্দগুলো লক্ষ্যনীয় । প্রফুল্ল চক্রবর্তী তাঁর ‘দি মার্জিনাল মেন’ গ্রন্হে স্বাধীনতার পর লুম্পেন প্রলেতারিয়েত মাস্তানদের উদ্ভব, ও তারা কীভাবে রাজনীতিকদের ক্রীড়নক হয়ে উঠল আর রাজনীতির খেলা বুঝে তাতে
    ক্রমশ ঢুকে পড়তে লাগল, তা বিশ্লেষণ করে গেছেন । এই কথনের অজামিল তলাপাত্র, বিড়ি-বাঁধিয়ে মা আর কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান বাবার সন্তান, সেইসব লুম্পেনদের ক্লোন । ক্লাস নাইনে ফেল করার পর সে বাসের ক্লিনার, কন্ডাক্টার, ইউনিয়ন, সিটু, সিপিএম, পঞ্চায়েত ইত্যাদির বোমা-বন্দুক ও সেক্স-সন্ত্রাসের সিঁড়ি বেয়ে এদল-সেদল করে নিচেতলা থেকে রাজনীতির ওপরতলায় ওঠে । লেখকের আপত্তি সম্ভবত এই জন্য যে একজন ‘কমরেড’ কেন অমন হবে ! সে তলাকার পাত্র মাত্র, এবং তার সঙ্গে স্বপ্নের কৌমসমাজের সম্পর্ক একটি গোঁজামিল । প্রশ্ন হল যে একজন মানুষ যদি সমাজের একেবারে নিচেতলায় জন্মায় তাহলে কেনই বা সে যেন-তেন-প্রকারেণ ওপরতলায় উঠবে না ? ওপরতলায় যাদের নিবাস তারা তো ভোটপালোয়ানদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের আত্মীয় স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টিদের পাইয়ে দেবার ধান্দায় ‘কমরেড’ সেজে তিরিশ বছর বসে ছিলেন। অজামিল তলাপাত্র যদি কমরেডি যোগাড়-যন্তর চালিয়ে তাই করে থাকে তাহলে তার দোষটা কোথায় ? তাকে বা তাদের মতো লোকেদের তো পরিকল্পিতভাবে ওপরে টেনে তোলার ব্যবস্হা ছিল না, নেই । তাছাড়া, নিচে থেকে যেসব অজামিল তলাপাত্ররা, তাদের অসামাজিক কাজের জোরে, ঠেলে ওপরে উঠছে, তাদের মধ্যে থেকে একটাও ‘দাউদ ইব্রাহিম’, ‘ছোটা শাকিল’ তৈরি হল না কেন !
    এই কথনের সূত্রে স্বপনরঞ্জন হালদার তাঁর কমরেডি দীর্ঘশ্বাস এই ভাবে ফেলেছেন : “ব্যক্তিস্বার্থই বানায় এক-একটা পুততুণ্ড কিংবা অমুক কিংবা তমুক কিংবা তলাপাত্র । আংকেল মদনের দলবলের কাঁধে শ্মশানে গেলেন পদাতিক কবি । তিনি কাকে যেন বলেছিলেন, চারু মজুমদারই শেষ কমিউনিস্ট । তিনি ধরে ফেলেছিলেন নিজের মূর্খামি । তাই, কবি বলেই, স্বহস্তে লিখেছেন --- সুভাষ মূর্খোপাধ্যায় ।” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ওপর স্বপনরঞ্জনের ক্রোধ সুভাষবাবু বামপন্হা ছেড়ে তৃণমূলে ঝুঁকেছিলেন বলে । অথচ তার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যাঁরা কংগ্রেসি ছিলেন, তাঁরা বামপন্হীরা মসনদ দখল করতেই রাতারাতি যে বামপন্হী হয়ে গেলেন, তা স্বপনবাবুর কলম এড়িয়ে গেল ।
    তারপর, পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পালাবদলের আগে, তিনি লিখেছেন : “বিপ্লব হবে না । ক্ষমতা ছাড়া যাবে না । চাই ভোট । যেন তেন প্রকারেণ জয় । মানুষ কাকে ভোট দেবে ? কে চাইবে ভোট ? ছিটগ্রস্ত মহিলার হাতে রাজ্যভার তুলে দেওয়া কোনও সুস্হ মানুষের অভিপ্রায় হতে পারে না।” সমগ্র ভারতের পার্সপেক্টিভ থাকলে বিপ্লব হওয়ার কথা ভাবতেন কি স্বপনরঞ্জন হালদার ? নেপাল থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত জঙ্গল করিডরে যে বিপ্লবীরা মুক্তভূমি গড়েছেন, তা ওই জঙ্গলেই থেকে যাবে । ষাটের দশকে কলকাতার রাজপথে যা ঘটছিল এবং সেইসব ঘটনার মই বেয়ে যে বামপন্হীরা ক্ষমতায় এলেন তাঁরা তো অনেক কিছুই করতে পারতেন, অথচ করলেন না । কেবল অজামিল তলাপাত্র, পুততুণ্ড এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখকে দোষ দেয়া কেন ? স্বপনরঞ্জন হালদার তাঁর গদ্যের স্বনির্মিত ডিসওরিয়েন্টেশানের মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা থেকে যেমন নিষ্কৃতি ও আস্তিত্বিক অসুস্হতা থেকে নিরাময় চাইছেন, তেমনই সুভাষ মুখোপাধ্যায় চেয়েছিলেন গাঁটকাটা-জোচ্চোরদের সঙ্গ বর্জন করার মাধ্যমে । এই প্রসঙ্গে জানাই যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ( ইনি অতুল্য ঘোষের পত্রিকা ‘জনসেবক’-এর বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন ; অতুল্য ঘোষের সুপারিশপত্র নিয়ে বিগ বস হাউসে ঢোকেন ), শক্তি চট্টোপাধ্যায় ( এনার ‘সীমান্ত প্রস্তাব’ কবিতার একটি লাইন হল ‘জ্যোতি বসুকেই দাও বেন্টিক স্ট্রিটের চর্মমালা ), সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ( এনার ‘কম্যুনিস্ট পার্টি’ শীর্ষক গদ্যের লাইন হল ‘ এ দেশের কম্যুনিস্টরা যখন বেঁচে থাকতে চাইছে থাকুক না তারাও বেঁচে, তাতে কার কী ক্ষতি’ ) , এনারা সবাই ষাটের দশকে ছিলেন ঘোর কম্যুনিস্ট-বিরোধী ; কিন্তু বামপন্হীরা গদিতে বসতেই এনারা ভোল পাল্টে ল্যাংবোটে রূপান্তরিত হলেন । আমার অনুমান, বেঁচে থাকলে এনারা মসনদের নতুন ক্ষমতাধিকারীদের ল্যাংবোট হতেন । সিপিএম-এর ওয়েবসাইটে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু সম্পর্কিত সংবাদের এই অংশটি স্বপনরঞ্জন হালদারের নজরে পড়েনি বলেই মনে হয় : “হোয়াইল রিকলিং দি মেমরিজ অব দি পাস্ট ইন সিক্সটিজ স্টুডেন্টস মুভমেন্ট ডেজ লেফ্ট ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বাসু সেড দ্যাট উই ওয়্যার ডিপলি অ্যাট্র্যাক্টেড টু সুনীলদা’জ কৃত্তিবাস ডিউরিং দোজ টারবুলেন্ট ডেজ । বাসু অলসো অ্যাডেড দ্যাট কৃত্তিবাস রিমেইনড এ স্টলওয়ার্ট পাবলিকেশান অ্যামাং দোজ বিইং পাবলিশড ফ্রম কফিহাউস, ফর হুইচ দি এনটায়ার ক্রেডিট শুড গো টু সুনীলদা । হি ইনট্রোডিউসড দি টেল অফ হাংরি জেনারেশান ইন আওয়ার কানট্রি অ্যাজ ইফ উই ওয়্যার মেড অ্যাট পার উইথ বিটলস অফ ইউরোপ ।” ওপরতলায় যদি জ্ঞানের বহর এমনতর
    হয়, তাহলে নিচেতলার মানুষদের সম্পর্কে তাঁরা যে কেমনতর খোঁজখবর রাখেন তা সহজেই অনুমেয় । এবং এই কৌমপরিসরে স্বপনরঞ্জন হালদারের স্বপ্নভঙ্গ না হবার কারণ নেই ।
    ওপরতলা থেকে গোঁজামিল ফুটোপাত্রদের চাপিয়ে দিলে নিচে থেকে ওপরে ওঠার সব রাস্তাই বন্ধ । তা সে ওই সরকার হোক বা এই সরকার ।
    সোভিয়েত কাঠামো লাটে ওঠার পর জানা গিয়েছিল যে সবাইকে পিটিয়ে সমান করার একরৈখিক প্রগতির তত্বটি সমগ্র কাঠামোটিকে ভেতর থেকে কুরে-কুরে খেয়ে ফেলেছিল, অথচ হুদো-হুদো ফেলোট্র্যাভেলার বাঙালি বুদ্ধিজীবী বারবার সেখানে গিয়ে কুটোটিও টের পাননি, যখন কিনা সোভিয়েত খোরপোষে অনেকের সংসার চলত, পত্রিকা চলত, প্রকাশনা চলত, বইয়ের দোকান চলত, এমনকি তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বিয়ের পর হানিমুন করতে যেত সেখানে । পাননি কেননা তাঁদের ব্যক্তিকস্তরে নৈতিক অধঃপতন ঘটে গিয়েছিল তার আগে থাকতে । তাঁদের জীবনে ব্যক্তিপ্রতিস্বের নৈতিকতা রাষ্টটির সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছিল--- রুণু গুহনিয়োগীর একের পর এক পদোন্নতি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । স্বপনরঞ্জন হালদারের মতনই, পোস্টমার্কসিস্ট ভাবুক ও অ্যাক্টিভিস্টরা এখন একেবারে দিশেহারা ও শতধা । বস্তুত শতধা হয়ে তাঁরা নিজেরাই প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন বহুরৈখিকতার, বহুত্বের, অনির্ণেয়তার, কালক্রমের অনিশ্চয়তার----স্বপনরঞ্জন হালদারের এই বইটিই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । পরিচয় আর দৈনিক কালান্তরের মতন বহু পত্রিকার অন্তর্জলী যাত্রা ঘটে গেল ।
    ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা’ রচনাটি শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই উক্তিটি দিয়ে : “বহুমত প্রকাশের অধিকার যদি না থাকে তাহলে বার্লিন প্রাচীরও ভেঙে পড়তে বাধ্য ।” যখন বলেছিলেন, তখন প্রাক্তন হননি বলে মনে হয় । স্বপনরঞ্জন হালদারের এই গদ্যটি, বলাবাহুল্য, ওপরে বর্ণিত বিভিন্ন গদ্য-কৌশলের সাহায্যে তাঁর নিজেরই যুগ্মজবৈপরীত্য বা বাইনারি-অপোজিটের মাঝের টানাপড়েনজনিত অবস্হানকে স্পষ্ট করে তুলতে চায়, যেমন তিনি বলছেন টক্করের কথা, টিপিকাল মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট বনাম প্রকৃত বামপন্হা, শরৎ চাটুজ্যে বনাম মানিক বাঁড়ুজ্যে, শক্তি কাপুর বনাম ওম পুরি, স্বপন সাহা বনাম ঋট্বিক ঘটক, রুশ চ্যানেলের পর্ণোগ্রাফিক ছবি বনাম রুশ ছবি ‘টরাস’, রবীন্দ্রভবনে মদের দোকানের লাইসেনসিং লটারি বনাম একদা জ্যোতি বসুর উক্তি, “যে রাজ্যে সরকার অর্থের জন্য আফিম, মদ এইসব বিক্রি করে বিক্রি-কর বাবদ সাধারণ মানুষের উপর বোঝা চাপায়, সেই রাজ্যের ভবিষ্যৎ বড় অন্ধকার”, ইহুদি জেমাইমার মুসলমান স্বামী ইমরান খান বনাম খ্রিস্টান হিউ গ্রান্ট, আমলাশোলে কৈলাশ মুড়ার অনাহারী সত্য বনাম সিপিএম নেতৃত্বের পেট-ভরে ঢেঁকুরতোলা সত্য, ইত্যাদি । তিনি তাঁর রোষ কেন্দ্রীভূত করেছেন মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদে । অথচ সত্য, বিচারবোধ ও রুচির সর্বজনীন অনুশাসন গড়তে গিয়ে ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করে দিয়েছে ‘প্রকৃত’ নামক ভাবকল্পটি । কী করছে ভাবকল্পে চোবানো লোকটা ? যুগ্মবৈপরীত্যকে অবস্হা বুঝে ব্যবস্হায় পরখ করছে । যেন ইতিবাচক দিকটিতে থাকে ‘প্রকৃত’ বামপন্হী । তাই ভালো/খারাপ, সুন্দর/কুৎসিত, জ্ঞানী/মূর্খ, ন্যায়/অন্যায়, সংস্কৃতি/প্রকৃতি, সাদা/কালো, মন/দেহ, নতুন/পুরানো, বন্ধু/শত্রু ইত্যাদির একটি দিকে ‘প্রকৃত’ বামপন্হী । অজামিল তলাপাত্ররা ( এই গদ্যে তার নাম পান্নালাল মজুমদার ) কেন শক্তি কাপুর, স্বপন সাহা, শরৎ চাটুজ্যে, মদ-খাওয়া, পর্নোগ্রাফিক ফিল্ম দেখার দিকে থাকবে না ? বিভাজনটি তো নকল । বাঙালিরা বহুকাল সরকারি চাকরি ‘ভালো’ আর ব্যাবসা করা ‘খারাপ’ মনে করত, যার দরুন সরকারি চাকরিতে তারা রূপান্তরিত হয়েছে অলস গাধায় এবং ব্যাবসায় অপাঙক্তেয় । পান্নালাল মজুমদাররা, তাদের অসততার জোরে, কেন ধিরুভাই আমবানি হতে পারেনি, পারে না ?
    উপরোক্ত পৃষ্ঠপটে সুকঠিন সনাতন ‘আদর্শ মূল্যবোধগুলো’ খেলো হয়ে গেছে । আফশোষ করা ছাড়া স্বপনরঞ্জন হালদারের অন্য কোনো নিদান নেই । অজামিল তলাপাত্র আর পান্নালাল মজুমদারকে কেনই বা মনে করা হবে সমাজবিরোধী ! তারা তো ‘প্রকৃত’ রাজনৈতিক ভাবুকদের বানানো সমরূপী মানুষ, মানব গড়ার কারখানায় তিরিশ বছর ধরে তৈরি । তাদের সাংস্কৃতিক বিবিধতা মুছে গেছে । নৈতিক ডিসকোর্সকে সরিয়ে
    বঙ্গসমাজ সে জায়গায় বসিয়েছে অবজেকটিভ, আন্তর্স্হানিক ও নৈর্ব্যক্তিক সত্যের ডিসকোর্স । ব্যাপারগুলোয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সিপিএম না তৃণমূল না কংগ্রেস না বিজেপি, সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর হয়ে গেছে । বস্তুত নৈতিক নিয়মাবলী প্রণয়নের কাজটা বর্তেছে গিয়ে একটি অধিব্যক্তিক বা সুপ্রাইনডিভিজুয়াল স্তরে । এথিকাল অথরিটি ব্যাপারটাই হয়ে গেছে তামাদি । পশ্চিমবাংলার মানুষ পৌঁছে গেছে এমন একটা পর্যায়ে যাকে বলা যায় ‘উত্তরআদর্শবাদী’, এবং স্বপনরঞ্জন হালদারও দাঁড়িয়ে আছেন সেই ব্লেডের ধারের ওপর ।
    ‘অ্যাম্বুল্যান্স সংক্রামক ব্যাধির জন্য নহে’ রচনাটির শিরোনাম থেকেই ব্যঙ্গের খোঁচা সুস্পষ্ট ; পশ্চিমবঙ্গের মরাল ও এথিকাল ব্যাধিটি আজ সংক্রামক, এবং যে বাহনটির কাজ রোগিকে নিরাময়ের জন্য মসনদের শুশ্রুষার আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া, সেই রাষ্ট্র-বাহনটিই ঘোষণা করছে যে সে অমন রোগিদের পৌঁছে দিতে অপারগ । পশ্চিমবঙ্গের মতন অ্যাম্বুল্যান্স সেবা ভারতের আর কোনো রাজ্যে নেই, কেননা পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাব অ্যাম্বুল্যান্স কোনো-না-কোনো ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত । ক্লাবগুলো বিশেষ উদ্দেশ্যে পত্তন করেছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, দলের নেটওয়ার্কিঙের সুবিধার জন্য, প্রতিটি মোহোল্লা কমিটির নিয়ন্ত্রণে একটি ক্লাব, এবং ক্লাবের পরিষেবামূলক ছবির জন্য অ্যাম্বুল্যান্স । ক্লাব-সদস্যদের খোরপোষের দায়িত্ব ছিল মোহোল্লা নামক ঘাঁটিকর্তাদের জিম্মায়। ক্রমে সেবার পরিবর্তে এই ক্লাবগুলোই হয়ে উঠল ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের আঁতুড়ঘর । ক্লাবের ছেলেমেয়েদের রক্তে ঢুকে গেল সংক্রামক ব্যাধির বিষ । ক্রমশ সেগুলো চলে যেতে লাগল অজামিল তলাপাত্রদের কব্জায়, এবং বলাবাহুল্য, অজামিল তলাপাত্ররা, স্বপনরঞ্জন হালদার তা আগাম আঁচও করেছেন, যেদিকে মসনদ সেদিকে গিয়ে ভেড়ে, লাল হলে লালে, সবুজ হলে সবুজে । সরকারে বদল ঘটতেই বহু ডিগবাজি-বিশারাদ বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও ছবি-আঁকিয়ে, ব্যাঙ-লাফ মেরে গিয়ে পড়েছেন নতুন মসনদে । পুরস্কারপ্রাপকদের তালিকাও পালটে গেছে রাতারাতি ।
    আগে পুলিশের নিজস্ব ইনফরমার থাকত, প্রধানত ছিঁচকে চোর বা পকেটমাররা সে-কাজ করত । রাজনীতির তৈরি মাকড়জালে ক্লাবগুলো পয়দা করল নতুন ইনফরমার, যারা নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, এবং সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে তাদের বিশেষ সময় লাগল না । পুজোর চাঁদার বদলে দেখা দিল তোলা আদায় । তোলা আদায় করা টাকায় প্রতিটি পুজোয় বাজতে লাগল হিন্দি ফিল্মের গান, এমনকি পাঞ্জাবি গান । ক্লাবদের আয়োজিত জলসায় গান গাইতে আমন্ত্রিত হন ডুপলিকেট কিশোরকুমার, ডুপলিকেট লতা মঙ্গেশকর বা যে হিন্দি গান তখন বাজার মাত করে রেখেছে । ক্লাবের প্রশ্রয়ে প্রতিটি রিকশা স্ট্যাণ্ডে শনিমন্দির, যা ভারতের অন্য কোনো রিকশা স্ট্যাণ্ডে পাওয়া যাবে না । সংক্রমণটা দুর্বৃত্তায়নের ; কলকাতায় মিছিলের দরকার পড়লে জড়ো করা হয় এদের । পার্টি নির্বিশেষে বিভিন্ন মিছিল ও র‌্যালিগুলোয় দেখা যায় পতাকাগুলোকে বহন করা হচ্ছে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর ঢঙে ; পতাকাগুলোর আকারও থার্ড রাইখ বা স্তালিনিস্ত । এই সংক্রমণ চলে গেছে গ্রামস্তর পর্যন্ত । হাজার-হাজার অ্যাম্বুল্যান্স, কিন্তু তারা বিশেষ রোগীদের রোগ সারাতে নিয়ে যাবে না। আর বাছাই-করা রোগীকে নিয়ে যাবার মতন সরকারি হাসপাতাল নেই , তাই তাদের নিয়ে যেতে হবে কোনো রাজনৈতিক সমাজকর্তার নার্সিং হোমে । সরকারি স্হাস্হ্যকেন্দ্রগুলো নিজেরাই তো অসুস্হ ।
    ‘অ্যাম্বুল্যান্স সংক্রামক ব্যাধির জন্য নহে’ রচনাটিতে অজামিল তলাপাত্র বা পান্নালাল মজুমদার জাতীয় কৌমপ্রতীক নেই । গদ্যটি যুক্তিভাঙনের এবং ছবিলাফের একটি ম্যাশ-আপ ; বিভিন্ন ঘটনার, জ্ঞানের, বক্তব্যের, সংবাদের, সংলাপের ও পাঠরেচনের-- তাতে এসেছে রামকৃষ্ণ, বঙ্কিমচন্দ্র, জুনমালিয়া, এষা দেওল, বিল ক্লিন্টন-জেনিফার, অমিতাভ বচ্চন, স্যামুয়েল জনসন, গণেশের দুধপান, মহাদেবের ষাঁড়ের দুধপান, শ্বশুরের বধু-ধর্ষণ, শিশু-রক্ষাকারী পথকুকুর, মহাকাশযান, ফিনেগান্স ওয়েক, টেলিফিল্ম পিকুর ডায়েরি প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের লেখা খোকাদের জন্য সায়েন্স ফ্যান্টাসি ইত্যাদি । এবং অশ্লীলতা । অশ্লীলতা প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষের কাছায় টান দিয়েছেন স্বপনরঞ্জন হালদার, তাঁকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-কথিত ‘আমাদের বিবেক’ লেবেলটির ঠোনা মেরে । বিবেক কেন লাইন পালটালেন, সম্ভবত সে-প্রশ্নই স্বপরঞ্জনের চিন্তায় ঘূণপোকা হয়ে সেঁদিয়েছে । এক-একটি
    প্যারাতে ঘটনা থেকে ঘটনায় চলে যেতে পেরেছেন লেখক , বলা যায় অনায়াসে ।
    ‘যে নকসি কাঁথাটির বুননে প্রতি বর্গ বিঘতে ছুঁচ ও আঙুলটুপি বদলানো হয়েছিল’ রচনাটিতে স্বপনরঞ্জন হালদার প্রয়োগ করেছেন সাহিত্যিক সংকরায়ণ : সমসাময়িক ইতিহাসের চরিত্রে চাপিয়েছেন অসেতুসম্ভব ঘটনাবলী, হিন্দি গান গাইতে গাইতে দৌড়ে ফাঁসির মঞ্চে উঠে যাওয়া ধনঞ্জয়ের সঙ্গে অতিবাম রাজনীতি, জ্যোতির্ময়ীর মধুচক্রের সঙ্গে ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ ফিল্মে সেন্সরের কেটে নেয়া সঙ্গমকালীন মুখাবয়ব, সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে অধীর চৌধুরী, ‘অপসংস্কৃতির’ বিরুদ্ধে বামপন্হী সংগ্রামের সঙ্গে লিঙ্গোথ্থানের আয়ুবর্ধক পাউডারের বিজ্ঞাপন, এবং সিন্ধুসভ্যতার ‘অবক্ষয়’ সম্পর্কে ডি ডি কোশাম্বীর বক্তব্যের হোর্ডিং । কবিতার লাইন ব্যবহার করে তিনটি ভাঁজে কথাগুলো চারিয়ে দিয়েছেন স্বপনরঞ্জন হালদার । ভাঁজের মধ্যেকার কাজে গাঁথুনি দেয়া হয়েছে ডেরিভেটিভ বা আহরিত গদ্যের, যেখানে তিনি ফ্লাক্সাস-পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন-- একই সঙ্গে উইট এবং বালখিল্য, যা পুরোপুরি একটি অ্যান্টি-আর্ট হস্তক্ষেপ হিসাবে ইউরোপে প্রথম প্রয়োগ করেছেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা । এই পদ্ধতিকে রেডিমেড ম্যাডনেসও বলা হয়েছে, কেননা যে সমাজব্যবস্হা চলে গেছে ভোগবাদী বাজারের দখলে, পুঁজিবাদের প্রাথমিক স্তরে যাবার আগেই, সেখানে ম্যাডনেসকে অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করা ছাড়া উপায় নেই । সুতরাং যে যুবতী পাকা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘ফটাফট’ কাপড়চোপড় খুলে ফেলছিল সে আদপে এই বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যবস্হাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল তার সর্বস্বহীনতা প্রদর্শন করে । স্বপনরঞ্জন হালদার স্পষ্ট করে দিতে চাইছেন যে কোন নকশি কাঁথা তিনি চেয়েছিলেন আর কোন নকশি কাঁথা তিনি শেষ পর্যন্ত পেলেন যেটি বুনতে আঙুলটুপি পরা সত্ত্বেও ক্ষত থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না ।
    পরের গদ্যে, যার শিরোনাম ‘একটি গ্রামীণ পরচর্চা কেন্দ্রে অগ্ন্যুৎপাত ও শিলাবৃষ্টিজনিত ক্ষয়ক্ষতি, যতটুকু যা জানা গেছে’ স্বপনরঞ্জন হালদার প্রয়োগ করেছেন অ্যাবসার্ডিস্ট কনট্রাস্ট : অস্তিত্বের সহজাত মর্মার্থ-জিজ্ঞাসা ও তার উদ্দেশ্যসন্ধান, এবং তাতে অবধারিতভাবে বিফল হবার আগাম আশঙ্কা । গদ্যটি যেখানে শুরু হয়, সেখানেই শেষ হয়, অর্থাৎ একজন মানুষের জখম অবস্হায় পড়ে থাকা এবং তাকে ভবঘুরে মনে করে জনগণের অবহেলা । তার মাঝে একের পর এক ভাবনা, ভাবকল্প, ঘটনা, যৌনইশারা ও তাঁর মগজের অবধারিত কাঠপিঁপড়ে বিজেপি-সিপিএম-তৃণমূল এটসেটরার রাজনৈতিক চিন্তার স্লাইড সাদা-কালো ম্যাজিক লণ্ঠনে দেখাতে থাকেন স্বপনরঞ্জন হালদার, যাদের মধ্যে আপাতসম্পর্ক বলতে ওই অ্যাবসার্ডিস্ট কনট্রাস্টের কুটিল-কৌতুক। অবশ্য প্রতিটি গদ্যেই, গদ্যশরীর আর তার শিরোনামের মাঝে ওই কুটিল-কৌতুক বজায় রেখেছেন স্বপনরঞ্জন হালদার ; কয়েকটিতে শিরোনামের তলায় নামকরা লোকেদের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন সেই মেজাজে ।
    ‘ও হুজুর--’ গদ্যে মনের সুখে ব্রিকোলাজ প্রয়োগ করেছেন স্বপনরঞ্জন হালদার, পেইনটিঙে বা কাটাজোড়া ছবিতে যেভাবে কোলাজ ব্যবহার করা হয় । নতুন ছাপাপ্রযুক্তির জন্য তাঁর সুবিধা হয়েছে, যা ডাডাবাদীদের এবং বিটদের নাগালে ছিল না । এই গদ্যেও রয়েছে প্রথাগত সংস্কারজনিত যৌনসম্পর্কের সীমালঙ্ঘন, যা ইপ্সিতা নামের একজন বাঙালি বউ করছে, কিন্তু ডায়না স্পেনসরকে করতে হয়নি যখন ডায়না ‘রিলেশানশিপ’ গড়ে তুলেছে একের পর এক দশ জনের সঙ্গে, যাদের নামের তালিকা দিয়েছেন স্বপনরঞ্জন, ডায়নাদের দেশে অমন সীমারেখা বহুকাল তামাদি হয়ে গেছে বলে । পরের প্যারায় আবার বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে চুলের মুঠি ধরে মেয়েকে শাস্তি দিয়ে মা জানতে পারেন যে তার শিক্ষক তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক পাতিয়েছে । এভাবেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যে গদ্যের ব্যাঙনাচন খেলিয়েছেন স্বপনরঞ্জন হালদার । পরের পৃষ্ঠায় চিরকুটের চিপ্পিমারা গদ্যটুকরো, সংবাদপত্র থেকে, শ্লীলতাহানি, মানববোমা, ধর্ষণ, মন্দিরে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ক । কিশোর নায়ক আদিত্যর সঙ্গে মনীষা কৈরালার ফিল্মের সংলাপ । আর, বহু বহু বহু বহু রচনায় যেমন শশী-কুসুমের বাইনারি-অপোজিট সম্পর্কের কথাটি উল্লেখ করা হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়ানে, মানিকবাবুর জ্ঞানপরিসরের যৎসামান্য দখল নেবার আশায়, স্বপনরঞ্জন হালদারও করেছেন ।
    আমার মনে হয়েছে, আমাদের, অর্থাৎ আমার ও স্বপনরঞ্জন হালদারের যৌন-জীবনের সময়ে, যৌনসম্পর্কের যে সামাজিক সীমাগুলো ছিল, তার চৌহদ্দি অনেক বেড়ে গেছে, বিশেষ করে ভারতের মেট্রপলিসগুলোয়, এবং স্বপনরঞ্জন হালদার সেগুলোর সঙ্গে নৈতিকতার তাল রাখতে পারেননি । ‘নাইট-আফটার’ গর্ভনিরোধক পিল এবং প্রযুক্তির দ্রুতি তোলপাড় ঘটিয়ে দিয়েছে যুবক-যুবতীদের যৌনসম্পর্কে, প্রেমিক-প্রেমিকার সংজ্ঞায়, ভারতের আদালতে লিভ-ইন সম্পর্কের স্বীকৃতিতে । তাঁর গদ্যের ছককাটা দাবার ঘরগুলোয় যখন যেমন ইচ্ছে বোড়ে, ঘোড়া, উট, হাতিদের চালনা করার সময়ে লেখক ওই পরিবর্তনের আভাস দিতে পারেননি । ব্যক্তিক্রিয়ায় এককত্বের উদ্ভবের হদিশ দিতে পারেননি । আসলে, সতত নির্মীয়মান প্রতিস্বের বিশাল কালপ্রবাহ থেকে এক খাপচা তুলে নিয়ে কি বলা যায় যে ওটিই আমার স্বপ্ন ছিল ? একজন মানুষের অজস্র মানসিক অবস্হানের ফাঁকে-ফাঁকে ‘সুস্পষ্ট’ জলবিভাজক থাকে নাকি ? টুকরো তুলে-তুলে যদি জীবনের অতীত কালপ্রবাহে নজর দিই, তাহলে নিজেরই বহু চাহিদা নিজের কাছে স্ট্রেঞ্জ ঠেকবে । স্বপনরঞ্জন তাঁর গদ্যকে চালিয়ে নিয়ে গেছেন এই স্ট্রেঞ্জনেসের উড়ন্ত বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে । ফলে একনিষ্ঠ পাঠক ছাড়া অন্যেরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলবেন তাঁর সনাতনী সংস্কারে কিঞ্চিদধিক আচ্ছন্ন চিন্তাভাবনা এবং চরম পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ।
    ‘ঝুমকা গিরা রে / বেরেলি কা বাজার মে...’ রচনাটি শুরু হয়েছে রামকৃষ্ণ কথিত একটি অ্যানেকডোট দিয়ে । আমার মনে হয় হিন্দি গানটায় ওই লাইনটা ছিল ; ‘বরইলি কে বাজার মেঁ’ । এই গদ্যের ধারাটিকে কী বলব ? সাবিত্রী-মদনের সম্পর্কের সূত্র ধরে গল্পের মতো আরম্ভ হয়ে ক্রমশ অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে যেভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন লেখক, একে বলা যেতে পারে পরাবাস্তব কৌতুক । গদ্যের অস্বাভাবিক পরিমিতিবোধে সুচিন্তিত অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে লেখক গড়ে তুলতে চেয়েছেন এমন সমস্ত আচরণ ও পরিণাম যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিহীন, উদ্ভট পরস্পরবিরোধিতায় মোড়া, আকস্মিক, এবং, বাংলা প্রতিশব্দ মনে আসছে না বলে ইংরেজিতাই বলি, Non-Sequitur. গল্পের রেল-লাইন ধরে একটু এগিয়েই ঘটনার কামরা গুলো আলাদা হয়ে যেতে থাকে, অন্য ঘটনার কামরায় জুড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে আগেকার রেল-লাইনের কামরার সঙ্গে । পরাবাস্তব কৌতুক এই জন্য বলছি যে স্ট্রিম অব কনশাসনেস বলতে যে প্রবাহ বোঝায় তা একনাগাড় চিন্তার একই লাইন বরাবর এগিয়ে যাবার কথা । স্বপনরঞ্জন হালদার দুম করে সেই প্রবাহে ভিন্ন চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছেন । ফলে গদ্যটির চিন্তাধারায় ঘটছে অরাজকতা, যে অরাজকতা, সামাজিক-রাষ্ট্রিক-নৈতিক অরাজকতা ও অপ্রতিসাম্য, তাঁর ব্যক্তিগত স্বপ্নভঙ্গের কারণগুলোর অন্যতম ।
    একই প্যারায়, সাবিত্রী-মদনের গল্প শুরু হয়ে তারের ওপর দিয়ে হাঁটতে-থাকা জাঙিয়ে-কাঁচুলি যুবতী ; তা থেকে দুম করে স্বাধীনোত্তর কংগ্রেসি ‘অপশাসন’ থেকে অজয় মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, জোতদার, খাস জমি, লাল ঝাণ্ডা, মেহনতি মানুষের লড়াই ; সেখান থেকে আন্দামান-নিকোবরের সরে যাওয়া, এবং ফিরে সাবিত্রী-মদন । এর পরের প্যারায় চলে আসে লেখকের স্বপ্নভঙ্গের খতিয়ান : হকারদের ফুটপাত, বস্তি উচ্ছেদ, শহর-শহরতলিতে শপিং মল, রেড স্যালুটু টু বেনি স্যান্টোসা, পুঁজিপতির হাতে গ্রেট ইস্টার্ন, বিমান বন্দরের বেসরকারীকরণ, আন্দোলন ইত্যাদি ।
    পরের প্যারায় চিন্তাগদ্যের ট্রেন ফেরে সাবিত্রী-মদনের রেললাইনে, জাঙিয়া-কাঁচুলি যুবতীতে, এবং আবার দুম করে স্বপ্নভঙ্গের রেললাইনে, শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের শিল্পস্হাপন বিষয়ক অবামপন্হীয় বক্তৃতায় । এখানে স্তালিনের উক্তিতে, ইংরেজিতে দিয়েছেন লেখক, জানি না ভুলটা ইচ্ছাকৃত না ছাপার ভুল, Live শব্দটা Leave ছাপা হয়েছে । যাই হোক, দুম করে গদ্যের চিন্তার রেললাইন পালটে চলে যায় ‘ব্যণ্ডিট কুইন’ ফিল্মে বিক্রম মাল্লা আর ফুলন দেবীর সঙ্গম দৃশ্যে । শেখর কাপুর এবং লেখক একযোগে এখানেই ‘কাট’ ঘোষণা করেছেন এবং লেখকের চিন্তার রেলগাড়িটি বাফারে ধাক্কা মেরে থেমেছে । যে ভাবনা নিয়ে ডিসকোর্সটি এগোয়, সেখানে ফেরে না । স্বপনরঞ্জন হয়তো বলতে চেয়েছেন, যে ডিসকোর্সের পত্তন বামপন্হী সরকার করেছিল, সেখান থেকে বহু দূরে, অন্য ভাবনায় চলে গেল তারা , রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে গেল ভবঘুরে, তার কুশীলবদের মগজ ভরে
    গেল ধোঁয়ায় ।
    ‘দীনময়ী, সিমন দ্য বভ্যোয়া ও পবিত্রর বউ’ গদ্যটি নারী-পুরুষ ‘রিলেশানশিপ’ নিয়ে । বাংলায় বোধহয় একে সম্বন্ধ-পাতিয়ে-থাকা বলা যায় । জাঁ পল সার্ত্রে-সিমন দ্য বভ্যোয়া, দীনময়ী-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং পবিত্র সূত্রধর-পবিত্রর বউ জুটিদের সম্পর্কের জটিলতাকে অনুধাবন ও উপস্হাপন করতে চেয়েছেন লেখক তাঁর নিজস্ব গদ্যশৈলীতে । এই গদ্যে অন্ধকার চৌকাঠে ঠোক্কোর খাবার জিগস-হেঁয়ালি তেমন নেই । জাঁ পল সার্ত্রে যেমন অন্য নারীদের সঙ্গে সঙ্গমসম্পর্ক পাতাতেন, তেমনই সিমন দ্য বভ্যোয়া পাতাতেন অন্য পুরুষদের সঙ্গে ; অথচ দুজনে দুজনের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে নিজেদের মধ্যে তাঁদের পরস্পরের দেহ-মনের স্হায়ী সম্পর্কটি তার দরুন যেন বিঘ্নিত না হয় । পরস্পরের কাছে লুকিয়ে সম্পর্ক পাতানোর ‘চিটিং’, যা সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে ঘটে থাকে, তার আত্ম-কলুষ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন তাঁরা । ভারতের মেট্রপলিসগুলোয়, বিশেষ করে মুম্বাই বাঙ্গালোর দিল্লিতে, যৌনসম্পর্ককে আরেকটি স্তরে নিয়ে গেছেন বৈভবশালীরা--- সমবেত যৌনতার উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে দম্পতিদের কাছে স্বীকৃত যে যুগ্ম-দোসররা নির্বাচিত রাতে আরেকজন বা আরও অনেকের সঙ্গে দেহসম্পর্কের আনন্দ উপভোগ করবে ; তাতে পরস্পরের কাছে যদিও লুকোছাপার ব্যাপার নেই, পুলিশ-প্রশাসনের আড়ালেই করতে হয় । বিত্তশালী বর্গে বিয়ে এড়িয়ে ‘রিলেশানশিপ’ গড়ে ‘লিভ ইন’ থাকার রেওয়াজ বাড়ছে । স্বপনরঞ্জন হালদার বলেছেন, “‘শান্তি’ ও ‘তৃপ্তির’ মধ্যে যে অমোচনীয় বৈরিতা, দ্বন্দ্ব, যার বিপরীতে দ্ব্যর্থকতায় লুকিয়ে রাখা অস্তিত্বের প্রকট অহমিকা, সমূহ সংঘটনের অন্তরঙ্গ, এক অন্ধ মৎস্যজীবীর আমিষ অন্বেষণ । অনির্বাণ তুমূল অস্হিরতায় ‘শান্তি’ বস্তুত বয়ে আনে আরও মদ ও মাৎসর্য -- উত্তুঙ্গতার হাতছানি , নেশা ।” আমার মনে হয়, ‘শান্তি’-’তৃপ্তির’ দ্বন্দ্ব শুধু নয়, বিপদের আকর্ষণ থেকে ব্যক্তিএকক নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে না, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়তে চায় । তাই মেট্রোপলিসগুলোয় আমদানি হয় অঢেল ‘পার্টি ড্রাগ’, আর বৈভবশালীদের শহরতলীর খামারবাড়িগুলোয় রেভ পার্টির রমরমা । লর্ড কর্নওয়ালিসের হাতে গড়া জমিদারদের সান্ধ্যকালীন বাগানবাড়ি আর বউবাজারের কথা মনে পড়িয়ে দ্যায়।
    পবিত্র সূত্রধর কাজ করে দুবাইতে, প্রচুর টাকা পাঠায় বউকে, সে-টাকায় বউ ধনী হয়ে ওঠে এবং নিজের দেহের খোরাক মেটায় নাড়ু মল্লিকের সঙ্গে । পবিত্র সূত্রধর আর তার বউকে লুকিয়ে সেই কাজ করতে হয় যা সার্ত্রে এবং সিমন লুকিয়ে করেননি । তার কারণ পবিত্র সূত্রধরের শ্রেণি ও শিক্ষা সার্ত্রের সমকক্ষ নয়, সংস্কৃতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন । পবিত্র সূত্রধর, তার বউ আর নাড়ু মল্লিকের সম্পর্কের মাঝে যে অবিশ্বাসের বনেদ তা বঙ্গসংস্কৃতির তৈরি সনাতন সম্পর্কজালে আটক । নিম্নবিত্ত থেকে ওপরের দিকে উঠে গেলে তারা বিবাহবিচ্ছেদের আশ্রয় নিতে পারত, যেমন আকছার ঘটছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দম্পতিদের মধ্যে ।
    লেখক প্রসঙ্গ টেনেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং তাঁর স্ত্রী দীনময়ীর । নিজের বিপুল কর্মযজ্ঞের পাহাড়ে বসে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর স্ত্রী দীনময়ীকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন ; তাঁর মনে পড়ে বিয়ের ৪২ বছর পর । উপেক্ষিতা দীনময়ীকে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনীকাররাও কোনো গুরুত্ব দেননি, যদিও রামায়ণ আলোচনার সময়ে লক্ষ্মণের স্ত্রীর একাকীত্ব ও উপেক্ষা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে । স্বপনরঞ্জন হালদার বক্স আইটেম হিসাবে একটি বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট দিয়েছেন, ‘জিনেই লুকিয়ে যৌন রহস্য’ ; মস্তিষ্কে ডোপামিন রাসায়নিকের ক্ষরণ দ্বারা একজনের যৌনতা পরিচালিত হয় । তবে কি বিদ্যাসাগরের মস্তিষ্কে অমন ক্ষরণ একেবারেই হতো না ? লেখক কোনো উত্তর দেননি। বিদ্যাসাগরের গবেষকরাও ভয়ে বিষয়টি আলোচনা করেননি কখনও । গদ্যটির শেষে তাই একটি ফাঁকা পৃষ্ঠা রেখে দিয়েছেন স্বপনরঞ্জন হালদার ।
    ‘ইন্ট্রোডাকশন টু অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ রচনাটিতে স্বপনরঞ্জন হালদার আবার ফিরে গেছেন তাঁর সারোগেট বা ইনটারটেক্সচুয়াল গদ্যশৈলীতে । জানি না ‘পল্লবগ্রাহী’ টুকরোগুলোর ভেতর দিয়ে তিনি নিজের জীবনস্মৃতির দিকে, ভাবনাচিন্তার পাটাতনে, পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন কি না । কোন অংশটা কার
    রচনা থেকে তোলা তা আমার স্মৃতির, পড়াশোনারও, বাইরে । এই রচনাটির বিশ্লেষণ হিসাবেই আমি মুখবন্ধরূপে জহর সেনমজুমদারের ‘নন্দীগ্রাম’ কবিতাটা তুলে দিয়েছি । স্বপনরঞ্জন হালদার তুলে দিয়েছেন ঋত্বিক ঘটকের কথা : “ গল্পের যুগ শেষ হয়ে গেছে, এখন এসেছে বক্তব্যের যুগ।” তারপর পাসোলিনির : The real marxist must not be a good marxist. His function is to put orthodoxy and codified certainties into crisis. His duty is to break the rules. গদ্যের নিয়মাবলী প্রতিটি রচনাতেই ভেঙেছেন স্বপনরঞ্জন হালদার । কিন্তু গুড মার্ক্সিস্ট যে হতে পারেননি, হওয়া সম্ভব নয়, তাও ওই ভাঙচুরের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে জানান দিয়ে গেছেন । যাদের গুড মার্ক্সিস্ট ভেবেছিলেন, তারাই তাঁকে ক্ষমাহীন পরাজয়বোধের খাদে ঠেলে ফেলে দিয়েছে ।
    রচনাটিতে কন্ঠস্বরগুলোর মাঝের প্রতর্ককে পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন লেখক , যার দরুণ কোনো একটি টেক্সট কেন্দ্রীয়তা দাবি করার মতো থাকছে না, এমনকি স্বপনরঞ্জন লেখকের ভূমিকা থেকেই সরে গিয়ে বহুস্বরিক এবং সংকরায়িত বাকক্ষেত্রে আছড়ে পড়ে এই ঘোষণা ধার নিচ্ছেন : Art is not a pleasant trip, it is a mill that grinds. প্রশ্ন হল, ‘আর্ট’ নামে কোনো ব্যাপার আর আছে কি, এই ব্যবহার-করো-ফেলে-দাও কালখণ্ডে ? ‘ব্র্যাণ্ড নেম’ প্রয়োগ করে টাকা কামাবার কালখণ্ডে ?
    স্বপনরঞ্জন হালদারের তৈরি পাঠবস্তুর বাস্তবের সঙ্গে বহির্জগতের বাস্তবের মিশেল ঘটিয়ে লেখক দেখাতে চেয়েছেন যে এই দুটি পরস্পরের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তাদের ছাড়ান যাবে না , তাদের পরস্পরের সীমাগুলো অপরিহার্যভাবে ঘোলাটে, এবং দুরূহভাবে কৌশলী । প্রতি প্যারায় ও তার ফাঁকফোকরে, স্বপনরঞ্জন হালদার পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাইছেন যে বর্তমানে সে এমন একটি রচনা পড়ছে যা আরেকজন মানুষ খেটেখুটে গড়ে তুলেছে -- আর এই সম্পর্কটি টেক্সটের সঙ্গে পাঠকের, পাঠকের সঙ্গে লেখকের, পাঠকের সঙ্গে পাঠকের, এবং তা তুলনামূলকভাবে গদ্যে বর্ণিত ঘটনাবলী ও চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের চেয়ে গভীর ও আন্তরিক, তা পাঠক যেন ভুলে না যান । ঘটনা বলতে-বলতে চটজলদি আরকটি ফ্যাঁকড়ার দিকে এগোন স্বপনরঞ্জন হালদার, চলে যান ভিন্ন প্রসঙ্গে, যাতে পাঠক তার পাঠকত্বের ভূমিকা ভুলে না যায়, যাতে সে ভুলে না যায় যে লেখাটা স্বপনরঞ্জন হালদারের মগজ থেকে বেরিয়েছে । এই প্রক্রিয়ায় স্বপনরঞ্জন হালদার দুটি সতত সক্রিয় আত্মচেতনার জন্ম দিতে চেয়েছেন : পাঠক টের পাচ্ছে যে সে আসলে পাঠক, আর বইয়ের গদ্য বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে তা নির্মিত ঘটনাবলীর সমাহার ।
    শেষ গদ্য ‘বিলিভ মি, যাহা বলিব সত্য বলিব’ । এই গদ্যে স্বপনরঞ্জন তাঁর সবকটি কৌশল তারিয়ে-তারিয়ে ফুরিয়ে ফেলতে চেয়েছেন । এখানে পৌঁছে স্বপনরঞ্জন অস্বীকারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন অন্যান্যদের কন্ঠস্বর, চেষ্টা করেছেন অবিনির্মাণের সাহায্যে নির্মাণ করতে । ডাডাবাদীরা আর পরাবাস্তববাদীরা যেমন আহরণ করেছিলেন ইউরোপের উপনিবেশগুলোর সংস্কৃতি থেকে, স্বপনরঞ্জন আহরণ করতে চেয়েছেন ডাডাবাদীদের থেকে, বিট আন্দোলনকারীদের থেকে, বাংলা সাহিত্যের যে বইগুলো পড়ার পর তাঁর মগজে এই গদ্যটি লেখার সময়ে রেশ রয়ে গেছে সেই হেলাফেলা থেকে--- উদ্দেশ্য, তাঁর গদ্যশৈলীর জন্য উপাদান সংগ্রহ, যে উপাদানগুলোকে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের মুখোমুখি দাঁড় করালে প্রতিস্পর্ধী ও বেমানান দেখাবে । তিনি নিজের গদ্যের মধ্যে ঠিক সেইভাবে আনন্দবিহ্বল, যেভাবে নর্তক তার নাচের সময়ে হয়ে ওঠে ; দর্শকদের আনন্দের চেয়ে নর্তকের নিজে নাচবার আনন্দ, নাচবার সময়ে সারা শরীর জুড়ে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপভোগের খেলা হিসাবে তার অস্তিত্ব ছেয়ে ফেলে, অনেকটা সেরকম ।
    গদ্যটিতে আচমকা নিজের খোলস ছেড়ে একআধবার বেরিয়ে তাঁর কটু আলোচকদের দিকে ছোরাছুরি চালিয়ে দিয়েছেন স্বপনরঞ্জন হালদার । চতুষ্পার্শের সন্নিহিত ইন্দ্রিয়গোচর জগত থেকে তথ্য, প্রভাব ও ঘটনার টুকরোটাকরা নির্বাচন করে বাস্তব সম্পর্কে যে ব্যক্তিগত ধারণা তিনি গড়ে তুলেছেন, তাকে ঘিরে যে যাপনযাত্রা, অন্যান্যদের মতামতের ঘূর্ণির ভেতরে যাতায়াত করে যে দৈনন্দিন , যেগুলো মোটামুটিভাবে সেই
    লোকগুলোরই অভিজ্ঞতাপ্রসূত, এবং যেগুলোকে সেই লোকগুলো মনে করেছে সত্য, তাদের যাচাই করেছেন স্বপনরঞ্জন হালদার, চটে উঠেছেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন তাদের সত্যতা সম্পর্কে । নানাবিধ অবস্হা উপস্হাপন করে তাদের অসংখ্য মর্মাথের সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি সত্য ব্যাপারটির এড়িয়ে যাবার ক্ষমতাকে নিয়ে খেলা চালিয়ে গেছেন । এ যেন যে প্রশ্নের উত্তর হয় না তাকে সমাধানের প্রয়াস । সে সমস্যার কোনো নাম নেই । ফলে অবসন্ন লেখক আটকে পড়েছেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় দুঃখের ভুলভুলাইয়ায় । তাঁর গদ্যকে সেকারণে বলতে হয় Endless defferal. নিজের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে-দিতে স্বপনরঞ্জন হালদার লিখে গেছেন তাঁর পরাজয়বোধের আত্মজীবনী ।
    ( রচনাকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৪ )
  • m | 012312.60.6723.6 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:১৫541293
  • কবি শম্ভু রক্ষিত : হাংরি আন্দোলন থেকে মহাপৃথিবী
    মলয় রায়চৌধুরী
    ‘তিতীর্ষু’ পত্রিকার শম্ভু রক্ষিত সংখ্যায় ( ২০১৭ ) শম্ভু রক্ষিত ‘আমি স্বাধীন’ শিরোনামে লেখাটি শুরু করেছেন ‘আমি স্বাধীন । আমি হাংরি।’ ঘোষণার মাধ্যমে । ওই প্রবন্ধেই তিনি বলেছেন, ‘মলয় রায়চৌধুরীদের সাথে পরিচয় হওয়ার ফলে হাংরি জেনারেশনের সাথে আমিও জড়িয়েছিলাম ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এর পরেও বাংলা সাহিত্যে অনেকে আন্দোলনের কথা বলে থাকেন ; কিন্তু আমার মতে হাংরি-র পর বাংলা সাহিত্যে সেই অর্থে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলন হয়নি ।’ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি চতুর্দশ লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০১২ স্মারক পত্রিকায় প্রকাশিত স্বরূপ মন্ডলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কবিতা লেখার প্রেরণা প্রথম পাই মলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকে । ওঁর সাথে কফিহাউসে আলাপ । মলয় রায়চৌধুরী ও উৎপলকুমার বসু এই দু’জনের কাছেই আমি কবিতা লেখা শিখি।’
    হ্যাঁ, শম্ভু রক্ষিতকে আমিই হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য উসকে ছিলুম । ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৩-৬৪ নাগাদ, সবে কবিতা লেখা আরম্ভ করেছেন, উৎসাহ দেবার মতন বন্ধুর প্রয়োজন, থাকেন মামার বাড়িতে, হাওড়ার কদমতলায় । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ওনার আগ্রহ প্রথম থেকেই এমন ছিল যে উনি নিজেই একটা হাংরি পত্রিকা প্রকাশ করার ইচ্ছের কথা জানান । আমরা সেসময়ে আন্দোলনের পক্ষ থেকে এক পাতার লিফলেট প্রকাশ করতুম, বড়োজোর এক ফর্মার বুলেটিন । শম্ভু ওনার সম্পাদনা আর প্রকাশনায় হাওড়ার বাড়ি থেকে বের করলেন ‘ব্লুজ’ নামে একটি পত্রিকা । কতোগুলো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল মনে নেই, তবে শম্ভুর মধ্যে ভাষার প্রতিষ্ঠান ভাঙার যে হলকা ছিল তা পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ধরা পড়েছিল । সেই সংখ্যায় উৎপলকুমার বসুর একটা ছোটো গদ্যও ছিল ভাষার প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলার ডাক দিয়ে ।
    মামারবাড়িতে তাঁর নিজস্ব একটি ঘর ছিল । শম্ভুর আশা ছিল যে তিনি বাড়ির একটা অংশ, অন্তত তাঁর ওই প্রিয় ঘরটা, পাবেন । কিন্তু দিদিমা মারা যাবার পর তাঁর মামারা তাঁকে ওই বাড়ি থেকে উৎখাত করেন, ( শম্ভুর কথায়, সিপিএম-এর ক্যাডারদের সাহায্যে ) আর তাই নিয়ে বেশ কিছুকাল মামলা করেছিলেন শম্ভু, যদিও শেষ পর্যন্ত মামলায় হেরে গিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরে যান ।
    শম্ভু রক্ষিতের আদিবাড়ি মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামে, যেখান থেকে তিনি ‘মহাপৃথিবী’ নামের প্রায় নিয়মিত একটি পত্রিকা গত ছেচল্লিশ বছর যাবত সম্পাদনা ও প্রকাশ করে চলেছেন । কবিরাও ওনার ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশনা থেকে নিজেদের কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করে গর্ববোধ করেছেন । তাঁর জন্ম মামার বাড়িতে, ১৯৪৮ সালের ১৬ই আগস্ট । কিন্তু শৈশব কেটেছে বিরিঞ্চিবেড়িয়ায় ; পড়াশোনা হাওড়ার বাড়ি থেকে । তাঁর বাবা নন্দলাল রক্ষিত সিন্দুকের ব্যবসা আর চাষবাস করতেন ; স্বাভাবিক যে আধুনিকতার ধাক্কায় এই ধরণের ব্যবসা ক্রমশ ব্র্যাণ্ডেড লোহার আলমারি আর অ্যালুমিনিয়ামের ট্রাঙ্কের কাছে জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো । ফলে চাষাবাদ করেই তাঁকে সংসার চালাতে হতো । শম্ভুর মায়ের নাম রাধারানি দেবী ।
    শম্ভু রক্ষিত যে হাংরি আন্দোলনে ছিলেন, জানি না কতোজন জানেন ব্যাপারটা । যাঁরা পরে আদালতে মুচলেকা দিয়ে হইচই করলেন আন্দোলনটা নিয়ে, তাঁরা শম্ভুকে পাত্তা দিলেন না, অথচ প্রথম থেকেই শম্ভু রক্ষিত একেবারে নতুন ধরণের কবিতা লেখা আরম্ভ করেছিলেন । কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকরা “হাংরি জেনারেশন” নামে যে-সমস্ত সংকলন প্রকাশ করেছেন তাতে উল্টো-পাল্টা অনেকের লেখাপত্র আছে, এমনকি হাংরি আন্দোলনের সময়ে জন্মাননি যাঁরা, তাঁদের লেখাও সংকলিত হয়েছে, কিন্তু শম্ভু রক্ষিতের লেখা সেগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শম্ভু রক্ষিতেরও তাতে বিশেষ কিছু আসে-যায় না ।
    ‘তিতীর্ষু’ পত্রিকায় অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী ‘হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পটভূমি : শম্ভু রক্ষিত’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনের ‘অষ্টম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪তে এবং অশ্লীলতার দায়ে সংখ্যাটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয় । এই মামলায় অল্পসল্প হাজতবাস ছাড়া শেষ পর্যন্ত বিশেষ শাস্তি কারোরই হয়নি । বাংলার কবিরা একযোগে কবিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।’ সুমিতা চক্রবর্তী যে ভুল বক্তব্য রেখেছেন হুবহু সেই একই বক্তব্য দেখা যায় আধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের ‘শব্দ ও সত্য’ প্রবন্ধে : ওনারা দুজনেই জানেন না যে এই মামলা ৩৫ মাস চলেছিল আর ব্যাংকশাল কোর্টে আমার দুশো টাকা জরিমানা ( সেই সময়ে সর্বোচ্চ ) অনাদায়ে একমাস কারাদণ্ডের সাজা হয়েছিল । বলা বাহুল্য যে কবিরা একযোগে আমাদের পাশে দাঁড়াননি, শঙ্খ ঘোষও ছিলেন না আমাদের পাশে । সুমিতা চক্রবর্তী যে হাংরি বৈশিষ্ট্যগুলো শম্ভুর কবিতায় চিহ্ণিত করেছেন তা স্বীকার্য । আরেকটা কথা, ওই সংখ্যাটা মোটেই অষ্টম সংখ্যা নয় ; তার আগে শতাধিক বুলেটিন বেরিয়েছিল, বহু বুলেটিন স্টেনসিল করে, যাতে সুবিমল বসাকের আঁকা ড্রইং থাকতো ; বহু পোস্টার বুলেটিনও বের করেছিলেন অনিল করঞ্জাই এবং করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ।
    অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে ‘নতুন কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় ( এপ্রিল - জুন ২০১৭ ) ‘এক কৃত্তিবাসীর আত্মকথা’ স্মৃতিচারণে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় যে কথাগুলো লিখেছেন, তা, আমার মনে হয় লেখা জরুরি ছিল। শরৎ লিখেছেন, ‘শঙ্খ ঘোষ মহাশয় কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণ করলেন । কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত থেকে তিনি একটি পুরস্কার নিতে অসন্মত হন, কারণ তিনি ছিলেন হিন্দুবাদী, বিজেপি পার্টির নেতা । শঙ্খ ঘোষ যে সিপিএম-সিপিআই দলের সমর্থক, এ-কথা আমরা আগেই জানতাম, কিন্তু একথা জানতাম না প্রধানমন্ত্রীর পদ পেলেও পার্টির দুর্গন্ধ মোছে না।’
    হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে শম্ভু পত্রিকার নাম ‘ব্লুজ’ ( Blues ) কেন রেখেছিলেন আমার ঠিক মনে নেই, কয়টা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, তাও মনে নেই। আমরা তখন গাঁজা-আফিম-চরস-এলএসডি খেলেও শম্ভু খেতেন না সেই সময়ে, মানে আমরা দলবেঁধে বেরোবার সময়ে শম্ভুকে সঙ্গে পাইনি । কাঠমাণ্ডুতে আর খালাসিটোলাতেও তাঁকে সেই সময়ে দেখিনি কোনো দিন । বয়স কম হবার দরুন বেশ ইনোসেন্ট চেহারা ছিল শম্ভু রক্ষিতের । তখন শম্ভু হাওড়ার ঠাকুরদত্ত লেনে থাকতেন । হাংরি বুলেটিন ৯৯ নম্বরের প্রচ্ছদে হাংরি আন্দোলনকারীদের মুখগুলোর ফোটো সাজিয়ে একটা কোলাজ তৈরি করেছিলুম, তাতে আছে শম্ভুর ইনোসেন্ট মুখখানা ।
    শম্ভুর কবিতা কয়েকটা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । প্রকাশিত বুলেটিনগুলো নিজেদের সংগ্রহে রাখিনি বলে অধিকাংশই হারিয়ে গেছে । সম্প্রতি হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো এসেছিলেন, যিনি হাংরি আন্দোলন নিয়ে পিএইচডি করছেন, তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলুম বিদেশের বিভিন্ন আরকাইভে হাংরি বুলেটিনগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে, এমনকি তিনি মুখোশ আর বিয়ের কার্ডও দেখেছেন কার্ল ওয়েসনারের আরকাইভে । প্রথম যে কবিতা শম্ভু লিখেছিলেন তার শিরোনাম ছিল ‘আমি বাঁচতে চাই’ ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমি “জেব্রা” পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলুম, তার দ্বিতীয় সংখ্যায় শম্ভুর যে কবিতাটা প্রকাশিত হয়েছিল তার শিরোনাম ছিল “আমি স্বেচ্ছাচারী”, তাতে শম্ভু বলছেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছেনি-শাবল চান, এবং তিনি হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে বাঘের মতন লাফিয়ে পড়বেন --- শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “আমি স্বেচ্ছাচারী” কবিতার অনেকদিন আগেই লিখেছিলেন শম্ভু। কবিতাটা এখানে দিলুম, লক্ষনীয় যে সেই সময়ের একরৈখিক কবিতার অনুশাসনকে শম্ভু ষাটের দশকে শুরুতেই অস্বীকার করেছিলেন :

    আমি স্বেচ্ছাচারী
    এইসব নারকেল পাতার চিরুনিরা, পেছন ফিরলে, এরাও ভয় দেখায় ।
    কিছুই, এক মিনিট, কিছুই জানি না, সাম্যবাদী পার্লামেন্টে জনশ্রুতি সম্পর্কে বা ।
    চণ্ডাল কুকুরদের আর্তনাদ আমাকে ঘিরে-- এবং আমাকে আলবৎ জানতে হবে, আলবৎ আমাকে
    ডুবতে দিতে হবে, যেতে দিতে হবে যেখানে যেতে চাই না, পায়চারি করতে দিতে হবে ।
    আমার গলা পরিষ্কার -- আমি স্বেচ্ছাচারী - কাঁচের ফেনার মধ্যে চুল -- স্পষ্ট করে কথা বলতে দিতে হবে
    আর কথাবার্তায় তেমন যদি না জমাতে পারি সেরেফ
    পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো -- সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ।
    ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে । ঘামের জল ধুয়ে -- শুদ্ধভাবে আমি সেলাম আলয়কুম জানিয়ে
    পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো ১ থেকে ২ থেকে ৩, ৪, ৫ গাছের পাতার মতো । রিরংসায় ।
    মাটিতে অব্যর্থ ফাঁদ পেতে রেখে । রাস্তায় । ব্রিজের ফ্ল্যাটে । ট্রেনে,
    যে কোনো কিশোরীর দেহে । শেষ রাতে -- পৃথিবীর মানচিত্র এঁকে, কেবল স্হলভাগের
    হু হু করে জেটপ্লেনে আমি যেতে চাই যেখানে যাবো না, এর ভেতর দিয়ে
    ওর ভেতর দিয়ে -- আর । হুম । একধরনের ছেনি-শাবল আমার চাই--
    যা কিছুটা অন্যরকম, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের নয় -- ঠিক
    খেলার মাঠে স্টার্টারের পিস্তলের মতো -- রেডি -- আমি বাঘের মতন লাফিয়ে পড়ব । খবরদার ।

    তারপর ১৯৬৪ সালে আমার মামলা-মকদ্দমা আরম্ভ হল, পঁয়ত্রিশ মাস চলল, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী হল আমার বিরুদ্ধে । পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হিসাবে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে চিঠি অ্যালেন গিন্সবার্গকে লিখেছিলেন তাতে উনি জানিয়েছিলেন যে পুলিশ সবসুদ্ধ ছাব্বিশজন কবি-লেখককে জেরা করেছিল লালবাজারে ডেকে । ‘নতুন কৃত্তিবাস’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন যে যাদের ডাকা হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই মুচলেকা দিয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুচলেকার বদলে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় একটা সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, যাকে মুচলেকাই বলা চলে, তখন কেস সাব জুডিস ।
    শম্ভু রক্ষিত আর বিনয় মজুমদারকে লালবাজারে ডেকে জেরা করা হয়েছিল কিনা জানি না । কিন্তু মামলার জন্য শম্ভু রক্ষিতের ‘ব্লুজ’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় । তার বেশ কিছুকাল পরে উনি প্রকাশ করা আরম্ভ করেন ‘মহাপৃথিবী’ নামের পত্রিকা । বিনয় মজুমদার আর শম্ভু রক্ষিত দুজনেই কবিতা লেখা ছাড়া সারাজীবনে আর কিছু করেননি । আর এনারা দুজনে কবিতা লিখে জানাননি যে শুধু কবিতার জন্যই তাঁরা বেঁচে আছেন, যেমনটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে গেছেন । যাই হোক, শম্ভু রক্ষিত আর বিনয় মজুমদার মুচলেকা দেননি এবং পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হননি । আমার অনেক সময়ে মনে হতো যে হাংরি আন্দোলনে ছিলেন বলেই প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারগুলো শম্ভু রক্ষিতকে দেয়া হয়নি এবং বিনয় মজুমদারকে মৃত্যুশয্যায় দেয়া হয়েছিল । তাছাড়া আত্মসন্মানের দরুণ এনারা দুজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্তাবকদের দলে ঢোকেননি । অথচ কবিদের মধ্যে এঁদের দুজনের আর্থিক অবস্হা সবচেয়ে দয়নীয় বলা চলে, পুরস্কারের টাকা এনাদের কাজে লাগতো ।
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় মুচলেকা দিয়েছিলেন আর পুলিশের পক্ষে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছিলেন । তিনি বলেছেন যে তিনিই প্রতিষ্ঠানবিরোধি, অথচ প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারের জন্য দুবেলা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে বনসে থাকতেন । তাঁর অযুহাত ১৯৮৬ সালে সুমিতাভ ঘোষালের ‘গদ্য-পদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় লিখে জানিয়েছিলেন ; লেখাটা তুলে দিচ্ছি এখানে, অনেকে পড়েননি বলেই মনে হয় :

    “সে-সময়ে আমাদের কেউই পাত্তা দিত না তা যারা হাংরি আন্দোলন শুরু করে সেই মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী আমাকে জানান যে আমার লেখা ওদের ভালো লেগেছে, ওরা যে ধরণের লেখা ছাপাতে চায়, তা নাকি আমার লেখায় ওরা দেখতে পেয়েছে, তাই আমার লেখা ওরা ছাপতে চায় । ওদের কাছে পাত্তা পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছিলুম।
    হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সসময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম -- একটা ছেলে, তাত ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁটটা খেতে শুরু করে । এই ভাবে সে একটু-একটু করে পুরো শাড়িটাই খেয়ে ফ্যালে । তাতে তার বেশ ভালোই লাগে । তখন সে ছাত্রীকেই খেতে শুরু করে । একটু টক টক লাগে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো ছাত্রিকেই সে খেয়ে ফ্যালে । এ বভাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এরপর থেকে সে অনেককিছুই খেতে শুরু করে। যেমন জানালা, চেয়ার,ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রীকে সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে যায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দ্যায় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দ্যায় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশ্যে ভাসিয়েছিল তা জানা যায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে । পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটার শেষ । এই গল্পটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটাই মূল কথা ।
    আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ -- আমার ভালো লেগেছিল এবং তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা-টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
    তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
    প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ্ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার ‘বিজনের রক্তমাংস’ গল্পটি বেরনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।
    আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্যের দৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
    আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বললো যে একেইতো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।”

    ইন্দিরা গান্ধির চাপানো এমারজেন্সির সময়ে জেলে পোরা হয়েছিল শম্ভু রক্ষিতকে । প্রেসিডেন্সি জেলে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে থাকার সময়ে ২ ডিসেম্বর ১৯৭৬ তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন, শিরোনাম ‘রাজনীতি’ :

    চ্যান্টার -- অশ্ব আর গ্রহদের নিয়ে আমি এখন আর পালিয়ে বেড়াই না
    নির্দোষদের বন্দি করার নীতি ধ্বংস করে আমি আমার খনন শুরু করি
    এবং বস্তুতঃ এমন একটা বক্তব্য উচ্চকন্ঠে তুলে ধরতে চেষ্টা করি
    ঐন্দ্রজালিক উদোম ন্যাংটো সব বিশ্লেষণকে যা আগেই এড়িয়ে যায়
    আমি চিন্তানায়কদের দিকে ককনও তাকাইনি, এখনও তাকাচ্ছে না
    তবে জেলের টাইপরা সুপারকে কয়েকবার বলেছি :
    আপনাদের শ্রুতিঘোড়াটি একমাত্র ‘সর্বশক্তিমান’ নয়, আপনিও !
    বন্দিনিবাসেও দু-দশদিন অন্তর তাই আমার চামড়া ভাঁজ করে শুকিয়ে ফেলা হয়
    ভোঁ… ভোঁ… ও অশান্ত অঞ্চল গান শব্দে ‘পাগলি’ বেজে ওঠে…

    কারাবাস সম্পর্কে শম্ভু বলেছেন :

    দেখুন জেল খুব ভালো জায়গা । এই জেলখানাতে খুব সহজে
    যাওয়া যায় না । আপনার টাকাপয়সা থাকলে আপনি
    পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবেন, কিন্তু আপনি ইচ্ছেমতো
    জেলখানায় জেতে পারবেন না । আমার তো জেলখানা খুব
    ভালো লেগেছে । আমার মনে হয় প্রত্যেক কবি যদি
    একবার করে জেলখানায় ঘুরে আসতে পারতেন তো খুব
    ভালো হত ।

    বিনয় মজুমদার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সীমান্ত পেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে । সেখানে তাঁকে তিন মাসের জন্য জেলে পোরা হয়েছিল । শম্ভু রক্ষিত আর জ্যোতির্ময় দত্ত আট মাস জেলে ছিলেন । স্পেশাল ব্রাঞ্চের যে পুলিশ অফিসার তাঁদের ওপর দৈহিক অত্যাচার করেছিল তার নাম তারাপদ, যে কমিশন ব্যাপারটি অনুসন্ধান করেছিল, তার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে ।
    অক্ষয়কুমার রমনলাল দেশাই সম্পাদিত “ভায়োলেশান অফ ডেমোক্র্যাটিক রাইটস” এর তৃতীয় খণ্ডে লেখা হয়েছে যে ১৯৭৬ সালে পুলিশ শম্ভু রক্ষিত, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং প্রশান্ত বসুর ওপর হাজতে অকথ্য অত্যাচার করেছিল, তারপর বিনা বিচারে তাঁদের আটমাস আটক রাখা হয়েছিল । গ্রেপ্তার করার সময়ে তাঁদের বাসস্হানের সমস্ত জিনিস পুলিশবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে লণ্ডভণ্ড করেছিল । জ্যোতির্ময় দত্তের বাড়ি শম্ভু রক্ষিতের হাওড়ার ফ্ল্যাটের তুলনায় অভিজাত ছিল । জ্যোতির্ময় দত্তের মেয়ে সেই সময়ে পুলিশের আচরণের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়ে শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছিল, তার হদিশ মেলে, কেননা গরিবের ওপর অত্যাচার করে পুলিশ যারপরনাই উল্লসিত হয় । শম্ভু রক্ষিতের তখনকার পোশাক যেমন ছিল, এখনও তেমনই জীর্ণ ও মলিন, পায়ে রবারের চটি ।
    এমারজেন্সি উঠে যাবার পর নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধি হেরে গেলে প্রশাসন ও পুলিশের বাড়াবাড়ি অনুসন্ধানের জন্য কমিশন বসানো হয়। অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দেবার জন্য সরকার যে কমিশন নিয়োগ করেছিল, তার রিপোর্টে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যে-পুলিশকর্মীদের বেআইনি কাজ সম্পর্কে রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হোক । শাস্তি দেবার ভার এসে পড়ে ১৯৭৭ সালে গদিতে-বসা বামপন্হী সরকারের ওপর, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, বরং তারাপদ আর রুণু গূহনিয়োগীকে উঁচু পদে প্রোমোশানের জন্যে সুপারিশ করেন । সেই তখন থেকেই বামপন্হীদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কালখণ্ড আরম্ভ হয় ।
    শম্ভুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হলো আশির দশকের শেষ দিকে, কফিহাউসে । আমি সেসময়ে লখনউতে থাকতুম । আমি কলকাতায় গিয়েছিলুম উত্তম দাশ-এর মহাদিগন্ত প্রকাশনী থেকে আমার কবিতার বই ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ প্রকাশ উপলক্ষ্যে । দেখলুম শম্ভু রক্ষিতের চেহারায় দরকচা পড়ে গেছে, মুখ থেকে বাংলা মদের গন্ধ, সেই ইনোসেন্ট চাকচিক্য আর নেই, চোয়াল দুমড়ে গেছে । শম্ভু আমার ঠিকানা নিলেন আর মাঝে-মধ্যে ‘মহাদিগন্ত’ পাঠাতেন, দুটি কাব্যগ্রন্হ পাঠিয়েছিলেন, “প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না” আর “পাঠক অক্ষরগুলি” । আমি কয়েকবার লিখেছি ওনার পত্রিকায়, যতোদূর মনে পড়ে । দেখে বুঝতে পারলুম যে হাওড়ানিবাসী “ব্লুজ” পত্রিকার সম্পাদক সেই কচি গালফোলা শম্ভু রক্ষিতকে আমি ভুলে গেছি ।
    ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ কাব্যগ্রন্হটি পড়ে বুদ্ধদেব বসু শম্ভু রক্ষিতকে লিখেছিলেন, “বইটি পড়ে আমি অভিভূত হয়েছি”। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “সত্তরের আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান ও সম্ভাবনাময়” কবি শম্ভু রক্ষিত । শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, “তাঁর কবিতা সমকালের পাঠকরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও, আগামী দিনের পাঠকরা সঠিক মূল্যায়ন করবে।” ব্যাস, এই পর্যন্তই । যাঁরা অকাদেমি, বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, সংস্কৃতি দপতরের কর্ণধার, বড়ো কাগজের কবিতা-সম্পাদক, তাঁরা শম্ভু রক্ষিতকে নিজেদের পরিমণ্ডলের বাইরে অস্পৃশ্য করে রেখে দিলেন । পাওয়া আর পাইয়ে দেবার যে সাংস্কৃতিক নোংরামি বামপন্হীদের রাজত্বের সময় থেকে আরম্ভ হলো, শম্ভু রক্ষিত স্বেচ্ছায় সেই নোংরামির বাইরে রাখলেন নিজেকে, যাতে তাঁর কবিজীবন দূষিত না হয়ে যায় । এতাবৎ তাঁর আটটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে । কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের মধ্যে কেবল অধীর বিশ্বাসের গাঙচিল প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল “শম্ভু রক্ষিতের কবিতাগুচ্ছ”।
    আমার সঙ্গে শম্ভু রক্ষিতের আবার দেখা হলো দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুটিয়ারির বাড়িতে, তখনও পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়নি । আমি হুইস্কির একটা বড়ো বোতল নিয়ে গিয়েছিলুম । আমার “অ” বইটা উৎসর্গ করেছিলুম দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, সেটা দিতে গিয়েছিলুম, আর বইটা সেলিব্রেট করার জন্য হুইস্কি। আমার কোনো বইয়েরই ঘটা করে কোনো মঞ্চে লেকচারবাজিসহ উদ্ঘাটন বা মোড়ক মোচন হয় না । অনুমান করি শম্ভুর বইয়েরও তেমন আনুষ্ঠানিক হইচই হয় না । যাই হোক কিছুক্ষণ পরে শম্ভু রক্ষিত এলেন, দেবীপ্রসাদের কাছ থেকে কবিতা নেবার জন্য আর ওনাকে ‘মহাদিগন্ত’ দেবার জন্য, হাতে একগোছা প্রুফ-- দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার । আমাকে অবশ্য দিলেন না, কবিতাও চাইলেন না । কাঁচাপাকা কয়েক দিনের দাড়ি, মাথার সামনে দিকে টাক পড়ে গেছে, চোখের কোল বসে গেছে, হনু আর কন্ঠা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, রোগাটে হয়ে গেছেন ।
    শম্ভু রক্ষিত চলে যাচ্ছিলেন, আমি বললুম, কিছুক্ষণ থাকো, মদের বোতলটা ঝোলা থেকে বের করলুম । শম্ভুর মুখে ঔজ্বল্য ফুটে উঠলো । মদ খাওয়া আরম্ভ হলো । আমি নিজেকে জানি যে কতোটা মদ আমি খেতে পারবো অথচ মাতাল হবো না । তারপর আমি খাই না, কেননা বাড়িতে একা মদ খেয়ে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে ; সাধারণত আমি একা বসে মদ খেতে ভালোবাসি, আর সিঙ্গল মল্ট ছাড়া খাই না ।
    শম্ভু গেলাসের পর গেলাস খেয়ে চললেন ; মাতাল হয়ে গেলেন । দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন শম্ভুকে টালিগঞ্জ মেট্রোয় পৌঁছে দিতে । মদ খেতে-খেতে শম্ভু বললেন যে, প্রেসে বসে উনি নিজেই হরফ সাজাবার কাজটা করেন । এখন কমপিউটার এসে যাবার পর তিনি কী করে ছাপান, বা পত্রিকা বেরোয় কিনা জানি না ।
    রিকশায় বসে টলছিলেন শম্ভু । বললেন, ওনার কোনো অসুবিধা হয় না, অন্যের, যারা মুখ থেকে গন্ধ পায়, তাদের অসুবিধা হয় । পথে শম্ভু রক্ষিত প্রস্তাব দিলেন একদিন ওনার বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামে মহাপৃথিবীতে যেতে, এক কাঠা জমিতে গাঁজার চাষ আরম্ভ করেছেন, ফোঁকা যাবে । আমার যাওয়া হয়নি। শম্ভুর কাঁধের ঝোলায় প্রচুর প্রুফের কাগজ দেখে মনে হচ্ছিল যে অন্যান্য কবিরাও শম্ভুকে দিয়ে প্রুফ দেখার কাজটা করিয়ে নেন, কেননা প্রুফ দেখতে-দেখতে শম্ভু এক্সপার্ট হয়ে গেছেন । আর সেকারণেই ওনার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে।
    ভূমেন্দ্র গুহ, আমার দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের পর যিনি আমার চিকিৎসা করেছিলেন, তিনি গিয়েছিলেন হলদিয়ার সুতাহাটার প্রত্যন্ত গ্রাম বিরিঞ্চিবেড়িয়ায় শম্ভুর বাড়িতে, বেশ খানিকটা হাঁটা পথ । বলেছিলেন যে ঢুকেই দেখা যায় দেয়ালে বড়ো-বড়ো করে লেখা রয়েছে মহাপৃথিবী । ভাঙাচোরা চালা । নিজেই কোদাল চালিয়ে চাষবাস করেন ; মনে হয় নিত্যদিনের প্রয়োজন চাষ থেকে, আর পত্রিকা-বই বিক্রি করে কিছুটা মেটে । ছেলের নাম কীর্তিকর, সে এক কারখানায় চুক্তিভিত্তিক কাজ করে ; মেয়ে দিওতিমা । তাঁর একমাত্র টেবিল ফ্যানটি চোরে তুলে নিয়ে চলে গেছে ।
    ভূমেন্দ্র গুহের কাছেই শুনেছিলুম যে শম্ভুর শরীর অত্যন্ত খারাপ এবং রোগ সারাবার টাকাকড়ি না থাকায় ভূমেন্দ্র গুহর উদ্যোগে কলকাতার একচল্লিশজন খ্যাতনামা পেইনটাররা, পরিতোষ সেন, যোগেন চৌধুরী, রবিন মন্ডল, তপন মিত্র এবং বুদ্ধিজীবি কালীকৃষ্ণ গুহ, সন্দীপ রায় প্রমুখ শম্ভু রক্ষিতের সাহায্যার্থে একটি প্রদর্শনী করেছিলেন, আর পেইনটিং বিক্রির টাকা শম্ভুকে দেয়া হয়েছিল । সে যাত্রা শম্ভু সেরে ওঠেন ।
    এখন শম্ভু রক্ষিতের স্বাস্হ্য আরও খারাপ হয়ে গেছে, চোখে ঠিকমতন দেখতে পান না, একটি চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হয়, হাঁটাহাঁটি করতে, পায়ে ও বুকে ব্যথা ধরে । ফলে আগের মতো আর নিয়মিত কবিতা লিখতে পারেন না । পুলিশের অত্যাচারে ভেঙে-পড়া স্বাস্হ্য ফিরে পায়নি বলেই মনে হয় ।
    আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই । দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় বসে শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে মনে হচ্ছিল যে, উনি নিজের গড়ে তোলা কবিতার জগতে একা বসবাস করেন । সেখানে কাউকে ঢুকতে দেন না । তাঁর লিখে যাওয়াই প্রধান কাজ । কেউ পড়লো কি পড়লো না, কোথাও আলোচনা হলো কি হলো না, তাঁকে কবিতা পড়তে কোথাও ডাকা হোক বা না হোক, তাতে শম্ভুর কিচ্ছু যায় আসে না । কলকাতার দু’তিন দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠকদের যে দীর্ঘ তালিকা আমন্তনপত্রে ছাপানো হয়, তাতে ওনার নাম কচ্বিৎ কখনও দেখেছি । সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাহিত্য অকাদেমির উদ্যোগে আগস্ট ২০১৬ সালে যে কবিসন্মেলন হলো তাতে শম্ভু রক্ষিতকে কবিতা পড়ার জন্য ডাকা হয়েছিল । হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরীকেও ডাকা হয়েছিল । মূলত অধ্যাপক সুতপা সেনগুপ্তের উদ্যোগে । শম্ভুর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে উনি কেবল মুচকি হাসি দিয়ে তার উত্তর দেন । সম্ভবত মনে করেন. “এ শালারা আমার কবিতা কী বুঝবে।”
    সাহিত্য জগতের দিকে যে তিনি একেবারেই হাত বাড়িয়ে দেন না, তা বোধহয় বলা যাবে না, কেননা ২০০৮ সালে তিনি বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে ‘মহাপৃথিবী’র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন । তিনি আমেরিকা নিবাসী বাংলাদেশের সাহিত্যানুরাগীদের দেয়া “শব্দগুচ্ছ” পুরস্কার পেয়েছিলেন । তাঁর কবিতা ইংরেজি ও হিন্দিতে অনুদিত হয়েছে ।
    আসলে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের সামন্তবাদী ভুলভুলাইয়ার বাইরে সম্পূর্ণ বেপরোয়া না হলে নিজের যা ইচ্ছে লেখা যায় না, যা আমরা দেখেছি উইলিয়াম ব্লেক, আর্তুর র‌্যাঁবো, মালার্মের প্রথাবহির্ভূত কবিতার ক্ষেত্রে । শম্ভুর কবিতা পড়ে টের পাওয়া যায় যে তিনি কারোর তোয়াক্কা করেন না, যেমন ইচ্ছে হয় তেমনভাবেই লেখেন। আমি প্রতিষ্ঠান শব্দটা প্রয়োগ করলুম না । প্রতিষ্ঠান ভাবকল্পটা এমন ঘেঁটে গেছে যে বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতির সামন্তবাদী দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যায় না ।
    যাঁরা আমাদের সংবিধান লিখেছিলেন তাঁরা কেউই অনুমান করতে পারেননি যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সামন্তবাদ ওই সংবিধানেই ঘুমিয়ে আছে, আর সময়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে । ক্ষমতাবানদের জুতো সাফ করবে বা জুতোর ফিতে বেঁধে দেবে আমলারা, সরকারি চাকুরেকে চটিপেটা করে ফলাও করে সেকথা বলে বেড়াবেন সাংসদ । হাজার-হাজার গরিবের টাকা মেরে লোপাট করে দেয়া হবে, আর জেলফেরত রাজনৈতিক আসামীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে, জেল থেকে বেরিয়ে দু-আঙুল তুলে ভিক্টরি সাইন দেখাবে, বুড়ো-বুড়িরা তাঁদের থেকে কম বয়সী নেতা-নেত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবেন । উত্তর-ঔপনিবেশিক সামন্তবাদের পচাইতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি যে ভাবে পচেছে, দিকে-দিকে গজিয়ে উঠেছে গ্যাঙলর্ডরা আর তাদের জিহুজুরিরা । আত্মসন্মানবোধসম্পন্ন শম্ভু রক্ষিতের পক্ষে, তাঁর অর্থনৈতিক দারিদ্র্য সত্ত্বেও, কোনো গ্যাঙের সদস্যতা নেয়া অসম্ভব ছিল ।
    শম্ভুর একটি লেখা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন করে গজিয়ে ওঠে তা এক রহস্য । কবিতা বিশেষটি আরম্ভ করে শম্ভু ক্রমশ ভঙ্গুর ডিকশনের মাধ্যমে তাঁর গঠনবিন্যাসের ল্যাবিরিন্হে নিয়ে যান । ছবি পুরো গড়ে ওঠার আগেই অন্য ছবিতে চলে যান । ষাট, সত্তর, আশি, নব্বুই দশকের কবিতার যে ধারা তার সঙ্গে শম্ভুর কবিতার মিল নেই । তিনি নিজের বাক্য-সাজানোর কৌশল গড়ে ফেলেছেন এবং তা থেকে কখনও সরে যাননি, আশে-পাশে নানারকমের আন্দোলন ও শৈলী-নিরীক্ষা সত্তেও। মনে হয়, এই বুঝি একটা ন্যারেটিভ গড়ে উঠলো, কিন্তু পরের পংক্তিতেই বাঁকবদল নিয়ে ভিন্ন দিকে চলে যান, ছিঁড়ে যায় ন্যারেটিভ ।
    তাঁর “প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না” কাব্যগ্রন্হ থেকে ২৭ সংখ্যক কবিতাটা পড়া যাক :

    হৃদরোগের সন্ধান নিয়ে ঢুকে পড়ো । সরবরাহকারী নির্মাণযন্ত্র
    পৃথিবীর মেঘময় আতঙ্ক শেষপর্যন্ত আধার হিসেবে ।
    উর্ধ্বময় সর্বনাশ ভেবে স্নায়ুতন্ত্রের কাজ । সুরক্ষিত জল
    দহনক্রিয়া মাথার ধমনী ছিঁড়ে যাও, বোতল, বায়ুর কাঠিন্য অনুশীলন শরীর
    অরণ্যসমগ্র, পাখিদের শ্রবণশক্তি, আঙুর সমস্যা সহজ নয়
    উজ্বল মাথার পর্যবেক্ষণ ভেঙে অবসাদগ্রস্ত উচ্চগ্রামের অংশে
    প্রমাণিত হই ; অন্ধ দৈবজ্ঞ, সৌরশক্তি, প্রশান্তি যেন আওয়াজ বিক্রি
    টিন-ভর্তি কুয়াশা নিয়ে মানুষ-জীবজন্তুর মাথা হয়ে হাতজোড় করি
    বসো গৌরবসূর্য, অদ্ভুত ভুত-প্রেত বিশ্বাস সে-বিষয়ে সচেতন
    পৃথিবীর মেঘ, শিস, দৃষ্টিনির্ভর আস্বাদনের ফসল-রহস্যের মিশ্রণ চেতনা
    অতুল ঘনরাশি ও উরসুলার কিয়দংশের লাল রং লেগে আছে দুর্যোগমথিত
    এলাকায় ; তোমার কোনো অলৌকিক পরিক্রমা নেই । শুধু ফুলবাগিচার
    ও জলবায়ু কুয়াশার অংশ লক্ষনীয়, সাড়া দাও, রূপকের মতো বিবরণ, দৈববাণী
    সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়ে যায় ; শরীরের ভিতর বেশি, নিশ্চিত প্রমাণ এই
    গবেষণাশক্তি, কেন না, এখানে এই উক্তি সত্যি স্বর্ণসূর্য হয় -- আবিষ্কার
    রং তুলি বিপদের হুঁশিয়ারি রূপকর্ম হয় ও যেন আদানপ্রদান
    তোমার সহানুভূতিশীল হৃদয়টি আমার চাই

    শম্ভু রক্ষিতের কবিতার সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক কবিদের তুলনা আমি গাজর বা আলু আর আদার তফাত দিয়ে বোঝাতে চাইব, যাতে পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হয় । গাজর উপড়ে তোলার আগেই আমরা জানি গাজরের আদল-আদরা রঙরূপ কেমন । আলুর ক্ষেত্রেও তাই, আলাদা আলাদা প্রায়-গোল আলু বেরোবে । কিন্তু আদা গাছ ওপড়াবার সময়ে কেউই বলতে পারেন না যে কেমনতর চেহারা নিয়ে আদা মাটি থেকে বেরোবে, তার আদল-আদরা কেমনধারা হবে । শম্ভুর সমসাময়িক কবিদের কবিতা গাজর আর আলুর মতন, কবির নাম দেখেই বলে দেয়া যায় যে লেখাটা লম্বা বা গোল কেমন হবে । আদার ক্ষেত্রে বলা যায় না । আদা কেমনভাবে মাটির তলায় এঁকে-বেঁকে শুয়ে আছে তা ওপড়াবার আগে বলা যায় না । শম্ভু রক্ষিতের নাম দেখে কবিতাটার আদল-আদরা কেমন হবে বলা সম্ভব নয় । কবিতাটা পড়েই কেবল তা বোঝা যাবে । মাটির তলায় আদা যে প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তার নাম রাইজোম ; অর্থাৎ শম্ভু রক্ষিতের কবিতাগুলো রাইজোম্যাটিক ।
    গাজর হলো রৈখিক, আদা কিন্তু রৈখিক নয় । তেমনই শম্ভু রক্ষিতের কবিতা বহুরৈখিক । আলু স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর্ট ফর আর্টস সেকের মতন আলু ফর আলুজ সেক । তাকে আদার মতন ভেঙে ফেলা যায় না । আসলে মানুষ তো জলে ঘেরা দ্বীপ নয়, তেমনই শম্ভুর কবিতাও ভাষায় ঘেরা দ্বীপ নয়, তাঁর পাঠবস্তু ছড়িয়ে পড়ে । শম্ভুর সমসাময়িক কবিদের কবিতা আমাদের স্মৃতিকোষে ঢুকে পরিচিত ইশারা পেয়ে যায় । শম্ভুর ক্ষেত্রে তাঁর কবিতার বহুমাত্রিকতার কারণে আমাদের স্মৃতিকোষে পরিচিত ইশারা খুঁজে পায় না । কবিতাটি কেমনভাবে এগিয়ে চলেছে তা যদি পাঠক নিখুঁতভাবে অনুসরণ না করেন, তাহলে তিনি পথ গুলিয়ে ফেলতে পারেন, কিংবা পূর্বেকার কোনো ইশারার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে পারেন ।
    শম্ভুর কবিতাটি শুরুতেই বলছে “হৃদরোগের সন্ধান নিয়ে ঢুকে পড়ো।” তারপরেই লাফিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য একটি প্রসঙ্গে যা আগের বাক্যটির সঙ্গে সংযুক্ত হতেও পারে বা নাও পারে, “সরবরাহ নির্মাণকারীযন্ত্র পৃথিবীর মেঘময় আতঙ্ক শেষপর্যন্ত আধার হিসাবে।” পাঠককে নির্ণয় নিতে হবে যে তিনি নিজের না কবির, কার হৃদরোগের সন্ধান নিয়ে ঢুকবেন, এবং কোথায় ঢুকবেন, হাসপাতালের আইসিইউতে, অপারেশান থিয়েটারে, নাকি কবিতাটির ভুলভুলাইয়ায়, যা আতঙ্কের আধারকে কোনও একটি দিকে চালিত করে চলেছে । যে ‘ভাইব’ কবি গড়ে তুলছেন, তা কার আত্মসচেতনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে, তা অনুধাবন করতে হবে ।
    শম্ভুর সমসাময়িক অধিকাংশ কবিই মিনিম্যালিস্ট, তাঁরা শব্দ গুণে-গুণে, সংক্ষেপে কবিতার থিমকে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে চান । যদি বিশেষ ছন্দের আঙ্গিকে লিখতে হয়, যেমন সনেট, তাহলে সেই আঙ্গিকেই আঁটিয়ে দিতে হবে । শম্ভু ওই ঔপনিবেশিক মানদণ্ডকে মান্যতা দিচ্ছেন না । তিনি একজন ম্যাক্সিম্যালিস্ট কবি, নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ থাকতে রাজি নন, পাঠবস্তুটিকে তিনি ছড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা দেন, মাঝপথে হঠাৎ ডাইভার্সান নিয়ে অন্যান্য থিমের সন্ধানে এগিয়ে যান । একদিকে তিনি “উজ্বল মাথার পর্যবেক্ষণ ভেঙে অবসাদগ্রস্ত উচ্চগ্রামের অংশ প্রমাণিত” হন, আবার আরেকদিকে “টিন ভর্তি কুয়াশা নিয়ে মানুষ জীবজন্তুর মাথা হয়ে হাতজোড়” করেন । তাঁর এই অবসাদ যেমন ভাস্কর চক্রবর্তীর মধ্যবিত্ত শহরজীবনের অবসাদ নয়, তেমনই হাতজোড়টা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রভু নষ্ট হয়ে যাই-এর মতন নয় ।
    বিনয় মজুমদার ‘ফিরে এসো, চাকা’ কবিতার বইয়ের কবিতাগুলো লিখেছিলেন মিনিম্যালিজম প্রয়োগ করে । পরে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ লিখলেন ম্যাক্সিম্যালিজম প্রয়োগ করে । জীবনানন্দ দাশ ‘ঘাস’ লিখলেন মিনিম্যালিজম প্রয়োগ করে ; ‘আট বছর আগের একদিন’ লিখলেন ম্যাক্সিম্যালিজম প্রয়োগ করে । পক্ষান্তরে শম্ভু রক্ষিত তাঁর প্রতিটি কবিতাতেই ম্যাক্সিম্যালিজম প্রয়োগ করেছেন । ঠিক কোন কৌশলে আপাতবিচ্ছিন্ন ভাবধারা ও ছবিবাক্যকে একের পর এক বসাতে থাকেন তা তাঁর পাণ্ডুলিপি দেখে হয়তো বলা যেতে পারে ।
    শম্ভু তাঁর কবিতায় আরেকটি কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা হল ফ্র্যাগমেন্টেশান বা ভঙ্গুরতা বা ছবির খন্ড একত্রীকরণ । একটি বাক্যের সঙ্গে পরের বাক্যের সরাসরি জৈবিক যোগাযোগ অনেক সময়ে থাকে না । এই ভঙ্গুরতা আলোকপ্রাপ্তির কারণে ব্যক্তি-প্রতিস্বের দুঃখ কষ্ট গ্লানি ক্ষোভ ক্রোধের ভঙ্গুরতা নয়, যা আমরা তথাকথিত বিষাদগ্রস্ত কবিদের লেখায় অহরহ পড়ি। শম্ভুর কবিতার ভঙ্গুরতা উঠে এসেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডের সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক ভঙ্গুরতা থেকে, পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগোত্তর ভঙ্গুরতা থেকে, জনগণের ক্ষুদ্ধ দারিদ্রিক চাপ থেকে, নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীনের বাকহারা অসংলগ্নতা থেকে, লুকিয়ে রাখা আর্তনাদ থেকে, পরিবর্তনের চক্রনাভি থেকে, চাষির জীবনের ছত্রখান অবস্হা থেকে ।
    শম্ভু, যিনি নিজেই এককালে চাষবাস করতেন, কোদাল চালিয়ে মাটি কোপাতেন,, কলকাতা কফিহাউসে আড্ডা মারতে যেতেন, মদের আড্ডায় গিয়ে বাংলা মদ খেতেন, চাকরি-বাকরি করলেন না, পত্রিকার জন্য প্রেসে গিয়ে নিজেই হরফ সাজাতেন, বিরিঞ্চিবেড়িয়ার ভাঙা চালাঘরে থাকতেন, তাঁর কবিতায় শহুরে কবিদের লোকদেখানো বিষাদের বাজার নেই । বৈশিষ্টটা তাঁর এই কবিতাটি পড়ার সময়ে পাওয়া যাবে :

    মুক্তিবাদ
    যারা আমাকে ডিগডিগে
    আমার রুহকে যুদ্ধের হিরো
    আমার ঈশ্বরকে অনিষ্টজনক
    আমার কবিতাকে
    চাকচিক্যময় আভিজাত্য বা বিক্ষিপ্ত প্রলাপ মনে করে

    আহ ভাইরে
    তারা বাণিজ্যের অযথার্থ ক্ষমতা দিয়ে
    তাদের নাক কান মুখ দখল করে
    এই শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের
    অস্তিত্ব রক্ষা করুক

    যারা বালি ফুঁড়ে
    আমাকে বাল্যপাঠ শেখাচ্ছে
    আহ ভাইরে
    তারা মেকি সুন্দরের মিথ্যে সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে
    অন্তত একটা ছোটোখাটো দেবদূতের সন্ধান করুক

    অকেজো জ্যুকবক্সে স্হির ডিস্ক
    জীবনের আর ভাঙা ইঁটের
    অশুভ যুদ্ধপরায়ণ যন্ত্রণায় আন্তর্জাতিক কোরাস
    আহ ভাইরে

    কবরখানা আর সুড়ঙ্গের মধ্যে গুঞ্জন-করা
    আস্তাবলের ধূর্ত পিটপিটে মায়া
    মধ্যে মধ্যে ফ্যাঁকড়া
    আহ ভাইরে

    কাঁধে অগ্নিবর্ণের ক্যামেরা
    হাতে অ্যান্টিএয়ারক্র্যাফ্ট ট্রানজিসটার
    অন্য সম্রাটের দায় যাতে মেটে
    মাংস ভেদ করে সচল ফ্রেস্কোর মতো
    এই সব রেডিও-টিভি-অ্যাকটিভ যুবশক্তি
    মুক্তিবাদ এবং জাঁকজমক খুঁড়ে নৈশ-স্তব্ধতা
    আহ ভাইরে

    উপরোক্ত কবিতায় যে বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয় তা হল আয়রনি বা শ্লেষ বা ব্যাজস্তুতি বা বিদ্রূপ । শম্ভু রক্ষিতের প্রায় প্রতিটি কবিতায় লুকিয়ে রাখা থাকে আয়রনি, কিন্তু তা নিছক বক্রোক্তি নয় । তা ফরাসি কবি-নাট্যকার আতোঁয়া আর্তোর মতন সিরিয়াস অবস্হার অসম্ভাব্যতা ও তীব্রতাকে সামনে তুলে ধরার খেলা । প্রাকঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে ক্লাসিসিজম, রিয়্যালিজম ও রোমান্টিসিজম সব কয়টিই বাইরের জগতটিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল ; ঔপনিবেশিকতার শেষ দিকে কবিরা নিজেদের ভেতরে প্রবেশ করলেন, আধুনিক জীবনযাত্রার বিভিন্ন প্রসঙ্গকে নিয়ে এলেন নিজেদের কবিতায়, অভিজাত বাঙালির তিরিশের দশক থেকে চালাক-চতুর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত । যে কবিতাটির জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার”, তাও ছিল একটি কনফেশানাল কবিতা, এবং জজ সাহেব সেই কথাই তাঁর রায়ে গুরুত্ব দিয়ে সাজা দিয়েছিলেন আমায় । ওপরে শম্ভু রক্ষিতের ‘মুক্তিবাদ’ নামের যে কবিতাটি দিয়েছি তাতে তিনি সমসাময়িক সামন্তবাদী কবিদের আক্রমণ করছেন না, স্রেফ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন, তাদের নিয়ে ঠাট্টা করছেন, তারা যে কতো হাস্যকর তা বার বার ‘আহ ভাইরে’ বলে-বলে তাদের বিব্রত করছেন ।
    ওই সময়ে কনফেশানাল কবিতা লেখার চল আরম্ভ হল, যা আমরা বিনয় মজুমদার, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখের কবিতায় পেলুম । এনাদের কবিতা এমনভাবে বাজার দখল করে ফেলেছিল যে কারোর কারোর কবিতার লাইন টিশার্টেও দেখা যেতে লাগল, অনেকটা চে গ্বেভারার মুখের বাণিজ্যকরণের মতন, যে প্রতীকটির বার্তা ভারতীয় ক্রনি ক্যাপিটালিজমের দৌরাত্ম্যে ফালতু হয়ে গেছে । অনেকের কবিতা স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ঢুকে গেল । এমনকি পরীক্ষার প্রশ্নেও আসতে লাগলো, যার অর্থ কবিতা-বিশেষের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে, নয়তো ছাত্র-ছাত্রী গোল্লা পাবে। মাঝরাতের বেপাড়া-জাগানো কবিরা বাড়িতে কোলবালিশ জড়িয়ে শোবার কবিতা লেখা আরম্ভ করলেন ।
    রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপরোক্ত দুটি টিলার মাঝে জলবিভাজক । হাংরি ও শ্রুতি আন্দোলনে, এবং শম্ভু রক্ষিতের পরের কবিরা যেমন অলোক বিশ্বাস, প্রণব পাল, ধীমান ভট্টাচার্য, বারীণ ঘোষাল, দেবযানী বসু, অনুপম মুখোপাধ্যায় প্রমুখ , দেখালেন, ভাষা কেমনভাবে নিজের সৃষ্টিক্ষমতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, তারই ভেতরে গোপনে রাখা নানা কৃৎকৌশলের মাধ্যমে, বিভিন্ন আঙ্গিকহীন পাঠবস্তু নির্মাণের মাধ্যমে ।
    জীবনানন্দের সময় থেকেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির কবিতা, যা আমরা শম্ভু রক্ষিতের প্রতিটি কবিতার ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করি । শম্ভুর কবিতা যে-কোনো পংক্তি থেকে পড়া আরম্ভ করা যায়, শেষ থেকে শুরুর দিকে পড়া যায়, শিরোনাম না হলেও চলে । শম্ভুর কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, যা আমরা জীবনানন্দের বহু কবিতার ক্ষেত্রে পাই, কবিতার শিরোনাম তার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করে না । বস্তুত শম্ভুর কবিতায় তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের কবিদের যেমন থাকতো, তেমন বিষয়কেন্দ্র থাকে না, ফলে কবিতার নামকরণে কবি নিজেকে একজন টাইটেল হোল্ডার হিসাবে উপস্হাপন করেন না ।
    তাঁর আগের কবিদের লেখা পড়ে শম্ভু রক্ষিতের মনে হয়েছে যে তাঁদের কবিতা বড়ো বেশি আস্রবণশীল হয়ে গেছে, কিংবা হাড়ের মতন অত্যন্ত শক্ত হয়ে গেছে, যে ধরণের কবিতা বার-বার পেছন ফিরে তাকাতে ভালোবাসে, এবং যা বড্ডো নিয়ন্ত্রিত, তাদের গড়ে ওঠার স্বাধীনতা দেয়া হয়নি, তাদের টেনে আটকে রাখা হয়েছে । শম্ভুর মনে হয়ে থাকবে যে রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় নিষ্ঠাকে সরিয়ে সেই জায়গায় বসানো হয়েছে কবিতা/কৃত্তিবাস/শতভিষার গোঁড়ামি । শম্ভু রক্ষিত বাধ্য হলেন ভাষার, ছবির, বিন্যাসের, বাক্যগঠনের, পংক্তিনির্মাণের আইকনোক্লাস্ট হিসাবে আবির্ভূত হতে । নিজেকে আলাদা করে নিতে । অগ্রজ কবিদের জৈবিক আঙ্গিক এবং সঙ্গতির প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের আত্মসমর্পণকে প্রত্যখ্যান করতে বাধ্য হলেন শম্ভু রক্ষিত । সেই জন্যই আরো পাঠবস্তুকে ভঙ্গুরতা দিয়ে মন্তাজ বা কোলাজ তৈরি করতে থাকলেন কবিতার পর কবিতা । কবিতাকে আদল-আদরা দেবার প্রচলিত মেটাফর এবং অন্যান্য আলঙ্কারিক গূঢ়োক্তিকে এড়িয়ে যাওয়া জরুরি মনে করলেন শম্ভু রক্ষিত ।
    অনেকে শম্ভুর আভাঁগার্দ টেকনিক বুঝে উঠতে পারেন না, অথচ তাঁরা একই ধরণের টেকনিক প্রয়োগে তৈরি আভাঁ গার্দ চিত্রপরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনি, রবের্তো রোসেলিনি, লুই বুনুয়েল, সের্গেই আইজেনস্টিন, ড্যামিয়েন পেটিগ্রিউ, এমির কুস্তেরিকা, ওজেচিয়েহ হাস, মার্কো ফেরেরি, জাঁ লুক গোদার, আব্বাস, কিয়ারোস্তামি, জাফর পনাহি, আলাঁ রোব-গ্রিয়ে, রাইনের ওয়ের্নার ফাসবিন্দার, আনদ্রেই তারকোভস্কি, অ্যাণ্ডি ওয়ারহল প্রমুখের ফিল্ম দেখার জন্যে ভিড় করেন !
    “শব্দগুচ্ছ” আন্তর্জাতিক ওয়েব-পত্রিকায় প্রকাশিত শম্ভু রক্ষিতের ‘গাঁয়ের চাষাভুষোরা আবার’ কবিতাটা এবার পড়ে দেখা যাক:

    গাঁয়ের চাষাভুষোরা আবার
    প্রত্যেকটি পৃথ্বীর নিচে একটি করে পাহাড় গড় রয়েছে
    এবং কবিতা কি ? গাঁয়ের চাষাভুষোরা জানে না,
    তাদের যে যা বোঝায় আর কি !

    তাদের সবল স্পর্ধার শক্তি এবং গুটিয়ে থাকা ফুসফুস
    তাদের ছোট ধাইমার দূরবিন দিয়ে দেখা সৌজন্য
    যা বলা যায় তাই করে ।

    মহার্ঘ ঝুনঝুনি-নাড়া বৃক্ষের উপবাসী চোখ, শহরের সন্মুখভাগ
    অতোটা বড়ো নয়
    প্রকৃতির আঁচলপাতা কুশল
    মিথুনজননীর স্পর্ধা
    তাদের বাহুর ওপর দৌড়ে এসে উঠতে পারে---
    ভিলাই সঙ্গীত, খেলনাপাতি করাত, চোঙা রেকর্ড, ফোনোগ্রাফ
    এবার কি এদের সহযোগ করা যেতে পারে ?
    ঘুটেগেড়িয়ার ওই ধাতু তৈরি হতে যে উপকরণ লাগে
    সে সমস্তই এদের আত্মীয়বর্গের জানা হয়েছে
    বাস্তবিক কাছেই বারুদ-ফাঁপা লোহার গোলার মধ্যে
    এদের আত্মীয়বর্গ ব্রক্ষা গৃধ্নু ছুরি নিয়ে মহাযজ্ঞ সারছে ।

    আর যাদের উদাসীনতা আজ দু’হাজার বর্গমাইলের খাদ্যসম্ভারের ওপরে
    যাদের দাদামহাশয় কিংবা বড়োদাদা তাদের টিপ্পনীকার ও প্রযোজক
    বা যারা ক্ষেপণাস্ত্রের পাথর তারামণ্ডলের কাছ থেকে
    এনেছে বলে দাবি করছে
    মজা, তাদের যৌবন পড়ে গেছে ।
    মজা, গাঁয়ের চাষাভুষোরা আবার কবিতার মধ্যে
    একটা প্রাকৃত জানোয়ার কুড়িয়ে পেয়েছে
    মজা, তারা শহরের মঞ্জিলে এসে পড়লো ।

    এই কবিতাটি পড়ে সন্দেহ হয় যে কখনও কলকাতা মহানগরে শম্ভু রক্ষিতকে কোনো কবি বা কবির দল চাষাভুষো হিসাবে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন এবং শম্ভুর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন, হয়তো বলেছিলেন চাষাভুষোরা আবার কবিতার কী বুঝবে ! আমরা আবার এসে পড়ি সামন্তবাদী সাহিত্যিক মূল্যবোধের ধ্বজাধারীদের আখাড়ায় । এই সামন্তবাদী ধ্বজাধারীদের শোষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বহু নিম্নবর্গের বাঙালি পালিয়েছিল মরিশাস, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপূঞ্জ, লাতিন আমেরিকা আর ফিজিতে । শম্ভু রক্ষিতের এই কবিতাটি পড়লে আমরা আরেকবার চার্লি চ্যাপলিনের সেই কথাটা মনের ভেতরে গেঁজিয়ে নিতে পারি যে, দূর থেকে যাকে মনে হয় সুন্দর একটি কমেডি, কাছে গেলে টের পাই যে তা মূলত ট্র্যাজিক ।
    যাঁরা কলকাতা মহানগরের নিবাসী তাঁরা জানেন না গ্রামের কালবৈশাখি সেখানকার কৌমজীবনে কেমন প্রভাব ফেলে, তাঁরা জানেন না মাঝরাতে ঘুর্ণিবাত্যার লেজের ঝাপট একটা চালাবাড়ির ওপর কেমন অত্যাচার করে, বৃষ্টির দাপটে চাষের ক্ষেতে কতোটা লোকসান ঘটায়, প্রচণ্ড গরমে ভাঙা চালাবাড়িতে একজন কবি কেমনভাবে তার দিন আর রাত কাটায়, অন্ধকার রাতে একজন কবি মাইলের পর মাইল হেঁটে কেমন করে বাড়ি ফেরে আর রাত জেগে কবিতা লেখে । ফলে শম্ভু রক্ষিত কলকাতা মহানগরের কবিদের রচনায় প্রাকৃত জানোয়ার আবিষ্কার করেন । কবিতার সামন্তবাদ গ্রামে নেই, আছে মহানগরে । বস্তুত কবিতার জগতে দেখা দিয়েছে ক্ষমতার দুর্ভিক্ষ, বাতাসে ঝুলতে থাকা ডিজেলগুঁড়োর মতন নোংরামি । যারা ক্ষুদকুঁড়ো পায় না তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য মারামারি করে, তা জানেন শম্ভু, এবং উনি নিজেকে সেই পৃথিবী থেকে দূরে রেখেছেন । শম্ভু জানেন কলকাতা মহানগরের কবিদের “মহার্ঘ ঝুনঝুনি-নাড়া উপবাসী চোখ”, তাঁদের মাথার ওপরে লাল সরকারি আলো জ্বেলে সভা সমিতিতে কবিতা পড়তে যান, “দাদামহাশয় বা বড়োদাদা তাদের টিপ্পনীকার ও প্রযোজক”।
    আগের কবিতাগুলোর মতন এই কবিতাটিতেও শম্ভু রক্ষিত পূর্বজদের সাহিত্যিক মানদণ্ডকে ডিক্যাননাইজ করেছেন, প্যারডির দ্বারা সুত্রগুলোয় অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছেন, সাংস্কৃতিক দমনপ্রক্রিয়ার প্রতিরোধ করছেন, প্রসঙ্গের আবরণ খুলে দিচ্ছেন, বলতে চাইছেন যে মর্মার্থ অমীমাংসিত, মানুষের অবস্হা পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য করছেন, বিশেষ করে যারা মহানগরের অধিবাসী নয়, শেষতম বা পছন্দযোগ্য ব্যাখ্যার সুযোগ দিচ্ছেন না ।
    উল্লেখ্য যে বিদ্যায়তনিক চাপ সবসময়েই এই তর্ককে সমর্থন করেছে যে ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে সমসাময়িক বা শম্ভু রক্ষিতের সময়কার কবিতার অনবছিন্নতা বজায় আছে । আসলে বিদ্যায়তনিক ইনডাসট্রি একটি ভানের ভাঁড়ার । এই ইনডাসট্রি যতোই মৌলিকতা এবং প্রামাণিক সত্যের বাগাড়ম্বর করুক, লেখক মাত্রেই জানেন যে তাকে, অর্থাৎ সাহিত্যিক মানদণ্ডকে চ্যালেঞ্জ ছাড়া উপায় নেই। যে কবি মুক্ত আঙ্গিকে লেখেন তিনি নিজের লেখালিখির প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গড়ে ওঠেন, তাঁর কবিতা তাঁর ভাবনাকে লেখার সময়ে অনুসরণ করতে থাকে, তিনি কখনই একটা বদ্ধ আঙ্গিকে নিজেকে বেঁধে ফেলতে চাইবেন না, বিশেষ করে যে কবি দীর্ঘকাল জেল খেটে বেরিয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানুষদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন । এই একই কারণে, জেল খাটার পর বিনয় মজুমদার যে কবিতাগুলো লেখা আরম্ভ করেন তা ‘ফিরে এসো, চাকা’ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । তাঁদের কাছে আগের তৈরি পথে চলা সম্ভব নয়, তা তাঁদের লেখালিখির বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাঁদের মনে হয় তা অসৎ, তা সৃজনশীলতার পথের কাঁটা ।
    লেখাটা শেষ করছি শম্ভু রক্ষিতের একটা পুরোনো কবিতা দিয়ে, যে কবিতাকে হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি, ফালগুনী রায়ের ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’, ত্রিদিব মিত্রের ‘হত্যাকাণ্ড’, সুবিমল বসাকের ‘হাবিজাবি, প্রদী্প চৌধুরীর ‘চর্মরোগ’ আর আমার ‘জখম’ কবিতার সঙ্গে একই হাংরি-চেতনায় রাখা যায়, শিরোনাম ‘মৈত্রীভাবনা’ :

    আমার সমঘন মগজটি আবার মদিরা ও যবনীগ্রহণ করে
    চাষআবাদ, মৎস্যধরা, পলুপোষার কাজে জমায়েত হয়েছে
    আমার ভয় লগুড়গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে উড়ে যাবার উপায়
    উপকরণ সম্পর্কে বিদেশি বণিক দেশপতির কাছে ভক্তিভাব যোগাচ্ছে
    আমার শাসিত দেহটি নিচ্ছে এই অংবিঅং ববম ববম মালকোষের তালিম
    আমার অনুবর্তীগণ অধরারুন কুন্দবদন ছোকরাবেশী যুবকের সুরত নিয়েছে
    আমার পুরোনো অধভাঙা খেলনা আমার কোষের ভেতরে এসে অদৃশ্য
    ফলে আমার কিছু কোষ এখনও অক্ষত, কিছু অতিশয় হতে চলেছে
    আমার ক্ষোভ : আমি আজও গাঁদাফুলের মালা গলায় পরে মাঙ্গলিক গান গাইতে পারিনি
    ( কোষকারীর দেশে তাই আমার চলচিত্ত লোককবিতা নিক্কণ পায়নি )
    আমি মদহিভাষী আমি ক্ষুদে প্রফুল্ল আমার বাড়ি
    নবদ্বীপে বুনো রামনাথের ভিটের ওপর
    আমার মিশরকুমারী শহরে ছুটে বেড়াচ্ছে
    হর্ষ ! আমার কাছে একটি কালো বাউথাস
    একজন সন্ত পিটার আবলার্ড
    অত্যন্ত হ্র-স্বীকৃতভাবে, একেবারে কোনঠাসা অবস্হায় অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে
    আমি উলো বীরনগরের ঢিবিতে ভবেশ্বরীর মমতায় সাজিয়ে রেখে বিব্রত
    আমি পরমোৎসবের কার্পেটে শয়পত্রী ফুল এখনও ছড়াইনি
    রামাই, সেতাই, নেলাই আমি নয়, ধুমসা ও মাদল সংগতে
    ভেসে সরবরাহ করতে চাই ভবিষ্যপুরাণ
    বীরহাম্বীরের সঙ্গে মানতের হাতিঘোড়াও আমি গড়তে চাই
    হ্যাঁচ্ছো ! আমার গলার কোনো কোক-তেওহার ফুলের মালা নেই
    কিন্তু মালার বদলে আছে এক বিত্রস্ত থলি

    এমারজেন্সির সময়ে তাঁরা যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, জ্যোতির্ময় দত্ত একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলেন স্ত্রী মীনাক্ষীর কাছে, শম্ভু রক্ষিতের হাতে । পুলিশের নাকের ওপর দিয়ে শম্ভু জ্যোতির্ময় দত্তের গলফ ক্লাবের বাড়িতে গিয়ে সেই চিঠি দিয়ে এসেছিলেন । মীনাক্ষী আঁৎকে উঠে বলেছিলেন, ‘সেকী, তুমি এখানে কেন?’ শম্ভু বলেছিলেন, ‘দুর, পুলিশ আমায় জিগ্যেস করলে বলব, আমি ধোপা, বউদির কাপড় নিতে এসেছি । আমায় একটা নোংরা বোঁচকা দিয়ে দেবেন।’
  • m | 012312.60.8923.63 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:১৮541295
  • উনিশতম অশ্বরোহী: কাজী নজরুল ইসলামের সম্পূর্ণ আলাদা বিশ্লেষণ
    মলয় রায়চৌধুরী
    বেগম সুফিয়া কামাল, আব্বাসউদ্দীন আহমদ প্রমুখ অনেকে নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্ধে তাঁদের বিশেষ আচরণটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘কদমবুছি’ নামক শব্দটির দ্বারা । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপকগণ কর্তৃক সংকলিত ও সংশোধিত ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ গ্রন্হে শব্দটি নেই । অর্থৎ অভিধানে অভিধা নেই ।এই বহু ব্যবহৃত ও প্রচারিত বইটির উপদেষ্টাবৃন্দের মধ্যে আবদুল ওদুদ, আবুল হাসনাৎ, মুহম্মদ আবদুল হাই, ও সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম আছে । অর্থাৎ অভিধানটি কেবল পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু উচ্চবর্গ-উচ্চবর্ণ ভাষাবিদ ও সাহিত্য অনুরাগীদের তত্বাবধানে বিরচিত, এমন মনে করার কারণ নেই । ঢাকায় প্রকাশিত যে বাংলা অভিধানগুলো কলকাতায় বিক্রি হয়, তাতেও শব্দটি নেই । কিন্তু এই একটিমাত্র উদাহরণের দ্বারা প্রতিপাদিত হয় যে ভাষা, তা সে বাংলা, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি যা-ই হোক না কেন, একটি ঐকিক প্রণালী নয় । একবর্গীয় অভিব্যক্তি-বিন্যাস নয় । ভাষাকে যদি কাঠামিবদ্ধ ঐকিক নিয়মের অন্তর্গত মনে করা হয়, এবং সেই ভাষাপ্রণালীটিকে সাংস্কৃতিক স্ফূরণের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে একটি এজমালি সংস্কৃতি, অথবা একটি প্রভাবশালী, এমনকী আধিপত্যবাদী, ভাবতত্বের চাগিয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যার দরুন সমাজটির অন্তর্গত সাংস্কৃতিক জটিলতার যৌগিক প্রক্রিয়াটি আমাদের অনুসন্ধানের আড়ালে থেকে যেতে পারে । বলনকেতা এবং লিখিত ভাষার কার্যসম্পাদন সর্বদা সংঘটিত হয় একটি কালখণ্ডের বিশেষ সামাজিক অবস্হায়, আলোচ্য সমাজটির সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ।

    একটি ভাষা বহুবিধ ছোট-ছোট প্রণালী বা ডিসকোর্সের সংমিশ্রণে গঠিত । যেমন লেটোর গান, সনেট, অভিভাষণ, চিঠি, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, মর্সিয়া, কীর্তন, গালাগাল, আবৃত্তি, কোরাস, গজল, গল্প, প্রতিবেদন, বকবক, আঞ্চলিক বাচন, অমার্জিত কথাবার্তা, প্রেমালাপ, বকুনি, অফিস-নোট ইত্যাদি । ব্যবহৃত শব্দাবলি এবং অভিব্যক্তির নিহিতার্থ, সন্দর্ভ অনুযায়ী পালটায়, প্রয়োগকারীর সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্হানের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে তাদের অর্থবোধকতার সম্পর্ক । শব্দাবলির বা অভিব্যক্তিসমূহের নির্গলিতার্থ ভাষা-বিশেষটির দরুণ রূপায়িত হয় না, তা হয় ডিসকোর্স-বিশেষটিতে অন্তর্ভুক্তির কারণে । শ্রেণি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বর্গ, জাতপাত, ধর্ম ইত্যাদির অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বলনকেতার জন্ম হয়, এবং তা ভাবাত্মক স্হিতিগুলোর পরস্পর-বিরোধিতার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত । অতএব, সমাজটির সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতার জাল ছেয়ে ফেলতে পারে অভিব্যক্তির স্ফূরণ ও তার মধ্যেকার আধিপত্য বা দুর্বলতাকে, মানে বা নিহিতার্থ নামের পুরো ব্যাপারটাকে, আর অভিধান প্রণেতাদের । আমরা জানি, একই অভিব্যক্তির ট্রেড ইউনিয়ন মঞ্চে একরকম মানে হয়, আবার আমলাদের সভায় আরেকরকম মানে হয় । অভিব্যক্তি চেপে যাওয়াটাও এক ধাঁচের অভিব্যক্তি । পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের বহু অভিধানে, সজ্ঞানে অথবা অজান্তে, বহু অভিব্যক্তি চেপে যাওয়া হয়েছে, এবং তা সচেতনভাবে বা অবচেতনায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত । সমাজের অন্যান্য বর্গের মতন, সাহিত্যের আলোচক ও ইতিহাসকার, ভাষার ক্ষমতা ও দক্ষতাকে প্রয়োগ করেন । যাঁরা সাহিত্য পড়েন এবং আলোচনা করেন, তাঁরা কেউই সাংস্কৃতিক-মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নন । কোনও লোকের পক্ষে অমন নিরপেক্ষ হয়ে সাহিত্যের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় । সংস্কৃতি বলতে জীবনের সবকিছু বোঝায়, সমস্ত ব্যাপার, এমনকী ডাক্তারির মতন নিরপেক্ষ জ্ঞানের এলাকাও ।

    অভিব্যক্তির সাহায্যে সমাজের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো রূপায়িত হয়, আর তাকে দাঁড় করিয়ে রাখে মূর্ত বা বিমূর্ত সমসাময়িক জ্ঞান, বিশেষ করে সেই সব জ্ঞানাধিকারীদের কার্যকলাপ, যাঁরা এই জ্ঞানকে একচেটিয়া করে রাখতে চান । বিশেষ একটি জ্ঞানের সাহায্যে যে-ব্যাপারটিকে পঞ্চাশ বছর আগে আমরা বলতুম পাগল হয়ে যাওয়া, এখন তাকে বলি মানসিক অসুস্হতা । সমাজে অন্যত্র তাকে বলা হয় ভুতে পাওয়া । মানসিক অসুস্হতাও যে অনেক ধরণের হয়, তা আমরা আজ জানতে পেরেছি । একশো বছর আগে সুন্দরী বলতে যে দেহকাঠামো ও মুখাবয়ব অনুমোদিত ছিল, এখনকার সুন্দরীর সংজ্ঞা তা থেকে একেবারে আলাদা । তখনও, এবং এখনও, সংজ্ঞা তৈরি করা হয়েছে জ্ঞান প্রয়োগ করে । জ্ঞানের প্রয়োগে সাহিত্যের মান বা অনুশাসন বা মানদণ্ড বা ক্যানন বানানো হয় । অমন নানা জ্ঞান নানা বিষয়ে স্ফূরিত হতে থাকে সমাজের ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে, মসনদটির মূল্যবোধ থেকে । জ্ঞান ব্যাপারটি হল সমাজিক নিয়ন্ত্রণের ফর্ম । জ্ঞান থেকে ক্ষমতার উৎসারণ ঘটে । যেমন-যেমন নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভব হয়, তেমন-তেমন বিকশিত হয় ক্ষমতার নবীন আদরা । কোনটা উৎকৃষ্ট বা কোনটা নিকৃষ্ট, কাকে স্বাভাবিক বলা হবে আর কাকে অস্বাভাবিক, কী হলে ভালো আর কী হলে খারাপ, নির্ধারিত হয় ক্ষমতাকাঠামোর চরিত্রের দ্বারা । কেননা ক্ষমতা দেয় বিচার করার অধিকার, এবং সেহেতু শাস্তি দেবার বা উপেক্ষা করার যোগ্যতা । প্রাচীনকালে সাহিত্যিক-ভাবুক-দার্শনিকদের শারীরিক শাস্তি দেবার চল ছিল । ক্রমশ শাস্তিকে করে তোলা হয়েছে মানসিক । বহু কবি লেখক আঁকিয়ে আজও সমাজ থেকে একঘরে বা স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হন ক্ষমতাকেন্দ্রে আঘাত হানার কারণে, এমনকী তাঁদের গুমখুন করে লোপাট করে দেয়া হয়, কিংবা খুন করে খুনিরা লুকিয়ে পড়ে । অভিধান থেকে নির্বাচিত ও চিহ্ণিত অভিব্যক্তিসমূহকে বাদ দিয়ে যেমন একদল মানুষকে শাস্তি দিতে পারে সমাজ, তেমনি একজন সাহিত্যিককে শাস্তি দিতে পারে তাকে ম্লেচ্ছ, নেড়ে, কাফের, মালাউন, ক্ষ্যাপা, আধপাগল বদনাম দিয়ে । অথবা সাংস্কৃতিক চত্বর থেকে তার অপসারণ ঘটিয়ে, বা তাকে হীনম্মন্য চিহ্ণিত করে । কিংবা এরকম রটনাও বাজারে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে, যে অমুক লোকটি ছোটোলোকদের জন্য লেখেন, নোংরা লেখেন, মাগিবাজ ছিলেন, মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান, গলায় গানের মাধুর্য নেই, মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন ইত্যাদি । ক্ষমতার অবয়ব ব্যতিরেকে কুৎসার প্রসার ঘটে না । কুৎসা সর্বদা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ।

    প্রশ্ন হল, এই যে ক্ষমতা তা আসে কোথা থেকে ? যে গোষ্ঠী শাসন করে, তারাই ক্ষমতার উৎসসূত্র । ক্ষমতা দখলের জন্য ভোটাভুটির নামে কতো খুনোখুনি হয় তা আমরা প্রতিটি নির্বাচনে দেখি । যারা ক্ষমতা দখল করে তারাই শাসক । শাসকের মূল্যবোধ চেপে বসে সমাজের সর্বত্র । বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাকাডেমি-প্রশাসন-রাজকোষ তাদের মূল্যবোধকে এবং মূল্যবোধপ্রসূত অনুশাসনকে, মানদণ্ডকে, ক্যাননকে, মাপকাঠিকে, নানন্দনিকতাকে প্রতিষ্ঠা দান করে । এই ক্ষমতাকেন্দ্রটিই প্রতিষ্ঠান । রাজকোষ যাদের, উৎপাদনক্রিয়ার মালিকানা এবং ভোগের সুযোগ তাদের । সমঝোতার বুদ্ধিবৃত্তি আকৃষ্ট হয় সেইদিকেই । কিন্তু শাসকবর্গের মধ্যে নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাদের আধিপত্য প্রয়োগ করে ক্ষমতাকেন্দ্রটি নিজেদের দখলে রাখতে চায়, যার ফলে বিকল্পের সম্ভাবনা দেখা দেয় । বিকল্পগুলোর অবিরাম টানাপোড়েন চলতে থাকে । সাংস্কৃতিক বিকল্পের যাতে উদ্ভব না হয়, বা হলেও তাকে দাবিয়ে দেয়া যায়, তাই রাষ্ট্রকাঠামো নিজেকে নাৎসি, ফ্যাসিবাদী, সাম্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী, বৌদ্ধ বা ইসলামি, অথবা যে-কোনও ভিত্তিবাদী দর্শন ঘোষণা করতে পারে, এবং করেও, যেমন সাম্প্রতিক কালের চীন। পাকিস্তানের কথাও বলা চলে, যেদেশে শিয়া, বোহরা, আহমদিয়া, ফকির, সুফি ইত্যাদিকে ধ্বংস করার প্রয়াস চলে, যদিও তারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী । এইসব ক্ষেত্রে মূল্যবোধটির মাল-মশলা আগে থাকতে তৈরি পাওয়া যায় । নৈতিক এবং বৌদ্ধিক উৎকর্ষের প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন উপায়ে করার চেষ্টা করে শাসকগোষ্ঠী, বা আধিপত্যের কর্তৃত্বধারী ব্যক্তিগণ । উৎকর্ষের সংজ্ঞা তাদেরই বানানো । সংজ্ঞাটির বাইরের ব্যক্তিকে তখন বাধ্যহয়ে বিরোধী ভাবধর্ম ও শৈলী থেকে সূত্র আহরণ করতে হয় । এর দরুণ সংস্কৃতি বিশেষটির চেহারায় ফুটে ওঠে বহুত্বের আভাস, আর ক্ষমতায় চোট লাগার ভয়ে, সে-সমস্ত বিরোধিতাকে নাকচ করার প্রয়াস হয় ।

    আইডিওলজি ব্যাপারটা তো কোনও বিমূর্ত, ওপর থেকে চাপানো প্রত্যয়ের বিন্যাস নয় । আর আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুমানসমূহ এবং ভাবনা ও অভ্যাস কেবল অন্যের দ্বারা কলকাঠি নাড়ার ফলাফল নয় । কিংবা তা প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ নয়, যে, যখন ইচ্ছে থামিয়ে দেয়া চলে বা গুটিয়ে নেওয়া যায় । তা যদি হতো তাহলে সংস্কৃতিকে যেদিকে যেমন ইচ্ছে চালনা করা যেতো । ইরানের শাহ শত চেষ্টা করেও নিজের ইচ্ছেমতন চেহারা দিতে পারেননি সেদেশের সংস্কৃতিকে । আবার খোমেইনিও সফল হননি । সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত চাপের দরুন পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল । সোভিয়েত দেশও ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল এবং টুকরোগুলো নিজের সংস্কৃতিতে ফিরে গেল । যোগোস্লাভিয়া ছিৎরে গেল । অথচ চাপিয়ে দেয়া নান্দনিকতার রেশ থেকে সংস্কৃতিটির বিশুদ্ধ মুক্তি বেশ কঠিন, বলা যায় অসম্ভব -- পদাবলী বা মঙ্গলকাব্যে আর ফেরা যায় না । পক্ষান্তরে, তৃণমূল স্তরে প্রতিরোধগুলো যতদিন টিকে থাকে ততদিন সংঘর্ষ চালিয়ে যায় ।

    নিচুতলাটিকে তাঁবেদারির কাছে আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটি হল হিগেমনি । এই হিগেমনি শব্দটি কিছু বিদ্যায়তনিক মহলে উচ্চারিত হয় ‘হেজিমনি’, কেননা আমেরিকানরা বলে হেজিমনি, আর বর্তমান দুনিয়া জুড়ে আধিপত্য তো আমেরিকার । শব্দার্থ যার মুলুক তার । অবশ্য প্রান্তিক ইংরেজিভাষী দেশগুলো যে পপতিরোধ তুলেছে, তা থেকে উদ্ভূত হয়েছে গ্লোবাল ইংলিশ, যে ইংরেজির মালিকানা কারোর একচেটিয়া নয় । হিগেমনি একটা লাগাতার সংঘর্ষের প্রক্রিয়া যা চলতেই থাকে । চলতেই থাকবে । যারা ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে, তারা অধস্তন, তারা নিচুতলার, তারা নিম্নবর্গের । নিচুতলা মানেই দারিদ্র্য নয় । সংখ্যাগরিষ্ঠের তুলনায় সংখ্যালঘু থাকবে নিচুতলায়, বাংলাদেশে হিন্দুরা আর ভারতে মুসলমানরা নিচুতলার, উঁচু জাতের তুলনায় দলিতরা থাকবে নিচুতলায়, শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়ানের সামনে বিরোধিদলের ট্রেড ইউনিয়ান হতে পারে নিচুতলার, পুলিশ প্রশাসনের আশ্রিত গুণ্ডা-মাস্তানের তুলনায় স্বনির্ভর গুণ্ডা-মাস্তান হতে পারে নিচুতলার । ব্রাহ্মসমাজের মূল্যবোধ যদি সমাজটিতে ছেয়ে থাকে তবে ব্রাহ্ম কবি হবেন উঁচুতলার, বামপন্হী শাসকের রাজত্বে বামপন্হী লেখক-কবিরা উঁচুতলার এবং শাসকের পুরস্কারগুলো তাঁদেরই প্রাপ্য । সমাজটি উর্দুভাষীর কিংবা হিন্দিভাষীর নিয়ন্ত্রণে থাকলে তাদের ভাবুকরা অন্য ভাষাভাষীর তুলনায় হবে ওপরতলার । একটি সমাজব্যবস্হায় যেমন-যেমন ব্যতিহার্য অনুমোদনের আচরণ গড়ে ওঠে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জন্মায় অর্থবোধকতা এবং মূল্যমানের বিন্যাস । ফলে এককালের ভালো পরবর্তীকালে তেমনকিছু আহামরি মনে হয় না । ও যে মানে আর মূল্যায়ন, সেটাই কিন্তু সমাজের বেশির ভাগ লোকের কাছে বাস্তবতা । ক্ষমতাকেন্দ্রটি যদি ঘোষণা করে শতফুল বিকশিত হোক, তাহলে তার বাইরে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ হবে যে একরকম ফুলের নাম বুঝি শতফুল ।

    ক্ষমতাকাঠামো সম্পর্কে প্রাগুক্ত বক্তব্যের সমর্থনে একটি ছোট উদাহরণ দেয়া যাক । ইকবাল ও নজরুল দুজনেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী । ইকবাল প্রদত্ত ভাবকল্প থেকে পাকিস্তান তত্বের জন্ম । তিনি কবি অথচ সাম্প্রদায়িক । তিনি রুটমার্চের গান লেখেননি । অথচ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে তাঁর লেখা গান ( সারে জহাঁ সে অচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা ) নেওয়া হয়েছে । সেতারবাদক রবিশঙ্কর তাতে সুর দিয়ে কুচকাওয়াজের উপযোগী করে তুলেছেন । নজরুলের বহু গান আছে রুটমার্চের, এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে তা উৎসাহ-উদ্দীপনার জন্য ব্যবহৃত । নজরুল পাকিস্তান চাননি । ধর্মান্তরিত অন্ত্যজ হিন্দু পরিবার তাঁর অতীত নয় । তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার তুমুল বিরোধী । ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে তাঁর গান নেওয়া হয়নি ( বাংলাদেশে নেওয়া হয়েছে কিনা জানি না ) । পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর কোনও গানের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে তোলেননি । সম্ভবত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কর্তারা তাঁর নামই শোনেননি । ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-উত্তর ক্ষমতাকাঠামোটিতে সুভাষচন্দ্র বসুর হাত থাকলে, ব্যাপারটা হয়তো অমন হতো না । ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরেই, যে নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নীতিমূল্য দিল্লির মসনদ থেকে স্ফূরিত হয়েছিল, তাতে সুভাষচন্দ্র বসু ও কাজী নজরুল ইসলাম, উভয়েই পর্যবসিত হয়েছিলেন নিচুতলায় । তাছাড়া বাংলা, যে ভাষাটিতে গান লিখেছিলেন নজরুল, সেটি ভারতের মসনদ দখলকারীদের ভাষা নয় । দেশভাগের পর পূর্বপাকিস্তানের, অর্থাৎ বাঙালিদের, মসনদের ভাষা বেশ কিছুকাল ছিল উর্দু । হিগেমনিটির বিরুদ্ধে তাঁদের সংশস্ত্র সংগ্রাম করে মসনদে বাংলা ভাষাকে বসাতে হয়েছে ।

    ভারতবর্ষে, শিক্ষিত বাঙালি বালক-বালিকারা, ‘সারে জহাঁসে অচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা’ গানটির সঙ্গে যতোটা পরিচিত, ততোটা নন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’-এর সঙ্গে, যদিও প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টিতে ভাষা, শব্দবিন্যাস ও ধ্বনিক্রীড়ার আধিক্য নজরুলকে প্রথম থেকেই বিতর্কিত করেছিল, কেননা তাঁর অহং-পাত্রটিকে সংজ্ঞায়িত করা তাঁর নিজের পক্ষেও ( বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার ও লেটোর দলের ঢোলক-বাজিয়ের শৃঙ্খলায় গঠিত ) কঠিন ছিল । জীবনযাপনের উচ্ছৃঙ্খলতার ভারসাম্য গড়ে তুলতে ঢোলবাদক ও কুচকাওয়াজকারীর শৃঙ্খলাবোধ কাজ করে থাকবে যা পরবর্তীকালে গানের বিমূর্ত নান্দনিকতায় হয়ে গিয়ে থাকবে জটিল । রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে তাঁর ফোটোগুলো আচার্য-সুলভ পোজ দিয়ে তোলাচ্ছিলেন, সেসময়ে নজরুল কমনীয় কবি-কবি পোজ দিচ্ছিলেন, এই জন্যে যে, বঙ্গসমাজে ঢোলবাদক ও হাবিলদার নিচুতলার । বস্তুত নিচুতলার তকমা দিয়ে সমগ্র বেঙ্গল রেজিমেন্টকেই ভেঙে ফেলা হয়েছিল, যদিও অন্যান্য রাজ্যের নামে রয়েছে বিভিন্ন রেজিমেন্ট ।

    বঙ্গীয় রেনেসাঁসের দরুন কবো ও গায়কের তুলনায় একজন সাধারণ মানুষকে নিকৃষ্ট মনে করার চল আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । তদানীন্তন সাহিত্য আলোচকদের নজরুল-বিরোধী উপপাদ্য ছিল যে, তাঁর পদ্যের ধ্বনিক্রীড়াটি শহুরে বাঙালি অভিজাত সমাজকে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিব্রত করে । লক্ষণীয় যে তদানীন্তন কলকাতাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ক্ষমতাকেন্দ্রটি অভিজাতবর্গের কুক্ষিগত থাকার দরুন, বাঙালির কোনও নিজস্ব নাচ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি, যেভাবে অন্যান্য ভাষাভাষীদের ভাঙড়া, বিহু, লাওনি, কুচিপুড়ি, কথ্থক, ওড়িসি, কথাকলি, গরবা, ডাণ্ডিয়া ইত্যাদি নাচগুলো, সেই ভাষাভাষী নারী-পুরুষকে শ্রেণি নির্বিশেষে দৈহিক বিভাস দিয়েছে । বাঙালি সমাজের ছৌ, সাঁওতাল এবং রায়বেঁশে উপেক্ষিত থেকেছে খালি গায়ে ছোটলোকদের নাচ হিসাবে, এবং দেশভাগের পর এই তিনটি নাচকে পর্যটক আকর্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয় ।

    নাচ ব্যাপারটি ধ্বনিক্রীড়াকে শরীরের মাধ্যমে রূপায়িত করে । বাঙালি জমিদারবাবুরা নাচের জন্য বঙ্গসংস্কৃতির আওতার বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে নর্তকীদের আমদানি করে ধ্বনিক্রীড়ার আশ মেটাতেন । এখনও নৃত্য বঙ্গসমাজে তুলনামূলকভাবে অপাঙক্তেয়, শরীরকে ধ্বনিক্রীড়ার কাছে সোপর্দ করতে হবে বলে । নৃত্যানুষ্ঠান নামের ব্যাপারগুলো ঘটে শহরের মঞ্চে, মধ্যবিত্তের খোরাকের জন্য । পুরুষের নাচ তো আজও প্রায় নিষিদ্ধ বলা চলে । নাচের গুরুত্ব না থাকায়, উচ্চবিত্তের অধিকাংশ বাঙালির শরীর মেদবহুল এবং শরীরের ফর্ম বীভৎস । উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরুতে নাটকে নারীচরিত্রে অভিনয়ের জন্য সমাজ বাধ্য হয়ে মঞ্চে এনেছিল বারবনিতাদের । বস্তুত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলোকে নিচুতলার হাত থেকে কেড়ে নেয়ার পরই সেগুলোকে শিল্পের খেতাব দেয়া আরম্ভ হয় । কারণ ওই হিগেমনি । শিল্প নামক তথাকথিত ব্যাপারটির মালিকানা উচ্চবর্গের, কেননা কাকে শিল্প নামে অভিহিত করা হবে তার একচেটিয়া জ্ঞান তো তাদের । এই জ্ঞান এনেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা । উপনিবেশগুলোয় শিল্প নামের ভাবকল্প তারাই জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

    কাজী নজরুল ইসলামের কাজকে শিল্প নামে অভিহিত করা হবে কিনা, তা তাঁর আবির্ভাব থেকেই তর্কের প্রসঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছিল, এবং সে সংশয় আজও মধ্যবিত্ত-নিয়ন্ত্রিত বিদ্যায়তনিক মহলে বজায় আছে, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হীদের সাড়ে তিন দশকের মৌরসিপাট্টা সত্বেও যায়নি । যদিও ইতোমধ্যে সমাজ তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় নাপিত, ছুতোর, দর্জি, স্যাকরা, পেইনটারের দোকানে দোকানে আর্ট বা শিল্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে । তাঁরা বাধ্য হয়েছেন আর্ট বা শিল্পের ভাবকল্পকে এভাবে আক্রমণ করতে, কেননা বাজারচালু মূল্যবোধ অনুযায়ী শিল্প হল ওপরতলার কিন্তু লোকসংস্কৃতি নিচুতলার । আসলে বাঙালির মূল সংস্কৃতির নামে গত দেড়-দুশো বছরে যা চালানো হয়েছে, তা হল শিক্ষিত ও হাফলিটারেট মধ্যবিত্তের কাজ-কারবার, যা সমগ্র বাঙালিসমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র । কাজ-কারবারটি গড়ে উঠেছে আধুনিকতার তাগিদ, জাতয়তাবাদ আর ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে । নজরুলের ক্ষেত্রে বক্তব্যটির প্রাসঙ্গিকতা আমরা পরে আলোচনা করব ।

    ১৯২৭ সালে ইব্রাহিম খাঁকে লেখা চিঠিতে নজরুল এই সংশয়টির মোকাবিলা করেছিলেন এইভাবে, প্রাতিস্বিক স্তরে : “আমি আর্টের সুনিশ্চিত সংজ্ঞা জানিনে, জানলেও মানিনে । এই সৃষ্টি করলে আর্টের মহিমা অক্ষুন্ন থাকে, এই সৃষ্টি করলে আর্ট ঠুঁটো হয়ে পড়ে, এমনিতরো কতকগুলি বাঁধা নিয়মের বলগা কষে-কষে আর্টের চরম সুন্দর নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ হলো -- একথা মানতে আর্টিস্টের হয়তো কষ্টই হয়, পরান হাঁপিয়ে ওঠে । জানি, ক্লাসিকের কেশো রুগিরা এতে উঠবেন হাড়ে-হাড়ে চটে, তাঁদের কলম হয়ে উঠবে বাঁশ । এর মধ্যে হয়েও উঠেছে তাই । তবু আজ একথা জোর গলায় বলতে হবে নবীনপন্হীদের । এই সমালোচকদের নিষেধের বেড়া যাঁরাই ডিঙিয়েছেন, তাঁদেরই এঁদের গোদা পায়ের লাথি খেতে হয়েছে, প্রথম শ্রেণি হতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে নেমে যেতে হয়েছে । ….আমার হয়েছে সাপের ছোঁচো গেলা অবস্হা । ‘সর্বহারা’ লিখলে বলে কাব্য হল না, ‘দোলনচাঁোপা’, ‘ছায়ানট’ লিখলে বলে ও হল ন্যাকামি ! ও নিরর্থক শব্দঝংকার দিয়ে লাভ হবে কী ? ও না শিখলে কার কী ক্ষতি হত ?”

    নজরুলের ক্ষোভ থেকে টের পাওয়া যায়, বহুকাল সাম্যবাদী নেতা মুজফফর আহমেদের সংস্পর্শে থাকলেও, ‘কবি’, ‘আর্টিস্ট’ ইত্যাদি নতুন গড়ে ওঠা এবং সাম্রাজ্যবাদ-উদ্ভূত তকমার আগ্রহ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি তিনি । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আরও নানা তকমা এনেছিল যা সনাতন ভারতীয় অথবা ইসলামি চিন্তায় ছিল না, যেমন ‘প্রতিভা’, ‘মাস্টারপিস’ ইত্যাদি ।

    দুই
    মানবেতিহাস প্রকৃতপক্ষে লাগাতার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বহুমুখী ইতিহাস । তা সিংহাসনে রাজা-রানি বদলের গল্প নয় । ইতিহাসকে রাজা-রানি বদলের গল্পতে সীমিত রাখলে তা কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রের ছত্রপতিদের কেচ্ছা নিয়ে মেতে থাকে । অবহেলিত থেকে যায় বিস্তীর্ণ ভুগোলের জনমানব । ঔপনিবেশিকতা আসার আগে বাঙালির বিশাল ভূগোলের অজস্র ঘটনা-এলাকা ছিল, এবং সেসব স্হানের নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার নাট্যস্ফূরণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ । গৌড়, রাঢ়, বঙ্গ, বরেন্দ্র, পুণ্ড্রবর্ধন ইত্যাদি এলাকার সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতি একে আরেকের থেকে পৃথক ছিল বলে অনুমান করা যায় ; স্হাপত্য ও হাতের কাজ থেকে তেমনটাই মনে হয় । জনসমাজের প্রতিটি বর্গের জীবনকাহিনি ছিল আলাদা । শিক্ষাকেন্দ্রগুলো, যেমন ভাসুবিহার, জগদ্দল বিহার, বিক্রমপুরী বিহার, পণ্ডিত বিহার, কণকস্তূপ বিহার, দেবীকোট বিহার, সোমপুর বিহার ছিল বাঙালির ভূগোলের নানা এলাকার স্হানিক বৈভিন্ন্যে ছড়িয়ে । ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে বিপুল ও গভীর রদবদল সূচিত হয় । সাংস্কৃতিক নকশা এবং সামাজিক কাঠামোটিকে ছিৎরে দেবার মাধ্যমে বহিরাগত সমাজটি তার কর্তৃত্ব কায়েম রাখে । কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য সমাজের সাংস্কৃতিক নকশা পালটানো যায় না । পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, বিকাশ, পরিব্যপ্তি ও সংঘর্ষ দেখা যায় তা সাম্রাজ্যবাদী কত্তাত্তির কারণে । পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবদী অধিপতি-সমাজটি ফেরত যাবার পর উপনিবেশের মননবিশ্বে নিজের এমন সমস্ত ছাপ ছেড়ে যায় যা আর কখনও সম্পূর্ণ মুছে ফেলা যাবে না । অথচ কর্তার সংস্কৃতি থেকে যায় উৎকৃষ্ট চেহারায়, এবং বাঙালির আদি ও সনাতন সংস্কৃতি নিকৃষ্ট চেহারায় । ক্ষমতার চরিত্রই অমন । এর কোনো স্বকীয় নান্দনিক যুক্তি নেই। ফলে মর্সিয়ার চেয়ে এলেজি হয়ে ওঠে উৎকৃষ্ট, যাত্রাপালার চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রতীয়মান হয় প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে, লেটোর গানের চেয়ে রক অ্যান রোলকে, পয়ারের চেয়ে স্প্রিং রিদমকে, অগুরুর চেয়ে ইন্টিমেটকে, এবং নিদারুণ গ্রীষ্মেও জুতোমোজা পরে চাকরি করতে যায় লোকে, লোডশেডিং আক্রান্ত দপতরে ।

    ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গ্রেকোরোমান অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বটি যেহেতু প্রজ্ঞাকে কৌম-নিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষ্ণ মনে করত, সেহেতু সমাজের সুফলকে আত্মসাৎ করে সৃজন-কর্মকে ব্যক্তি মালিকানাধীন মেধাজাত পণ্যে পর্যবসিত করা হয়েছে । লোকসংস্কৃতির কাজগুলো তো সৃষ্টিকারী ব্যক্তি-মালিকের নয় । তা স্বতঃস্ফূর্ত যৌথতার অভিব্যক্তি । অথচ ব্যক্তিপ্রজ্ঞার কাজ না হলে সে-কাজের মৌলিক হবার সম্ভাবনা নেই । ‘মৌলিক’ নামের ভাবকল্পটিও ইউরোপের । অধিপতির অনুমোদন ছাড়া কোনও কাজ ‘মৌলিক’ তকমা পায় না, কেননা মানদণ্ড, অনুশাসন, ক্যানন তৈরি করার অধিকার কেবল কর্তার, মসনদের । উপনিবেশগুলোর স্হানিক সংস্কৃতির ওপর ইউরোপ থেকে আমদানি-করা সংস্কৃতি চাপানোর ফলেই চাটগাঁর বাঙাল, পাকিস্তানের বালুচ, আমেরিকার নাভাহো, অস্ট্রেলিয়ার মাওরি, আফ্রিকার জুলু, চিলির উপজাতি সবাই একইরকম লিরিক, এলেজি, সনেট, তের্জারিমা, ভিলানেল লিখে আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন ।

    পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, ফরাসি উপনিবেশবাদীরা যখন বাংলা ভূখণ্ডে এসে ভিড়েছিল, তখন তাদের উদ্দেশ্য কেবল রোজগার করা আর আর স্বদেশে লভ্যাংশ পাঠানোয় সীমাবদ্ধ ছিল না । তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত যে, তারা আদিম কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশের লোকগুলোকে ( ফ্রেডরিক হেগেল যাদের মনে করতেন ‘বর্বর’ ) সুসভ্য এবং সংস্কৃতিবান করতে এসেছে । তাই তাদের নিজেদের বিশ্বাস, ধর্ম, আচার-আচরণ, রুচি তারা সুপরিকল্পিতভাবে , এবং শুরুতে অসহ্য জোরজুলুমসহ, চাপিয়ে দিয়েছিল শাসিত সমাজটির ওপর । শাসক যাকে সমর্থন করেছে তাকে উৎকৃষ্ট বলে গ্রহণ করেছে উপনিবেশের লোকেরা । তাদের ভাষায় তারা যে সমস্ত ব্যাপারকে ভালো বলে মনে করেছে, সে সমস্ত তারা চারিয়ে দিয়েছে শাসিতের ভাষায় । বস্তুত ব্রিটিশরা এসে গদিতে জমিয়ে বসার কিছুকাল পরেই আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্র লোপাট হয়ে যায় । সাম্রাজ্যবাদের জাহাজ সুতানুটি-গোবিন্দপুরে নোঙর না ফেললে, স্বদেশের নিজস্ব অনুশাসন ও অলঙ্কারশাস্ত্র প্রয়োগ করে উপনিবেশের লোকেরা নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরণের মূল্যবোধ নির্ধারণ বহুলাংশে বজায় রাখতে পারত । কিন্তু নবাগত ইউরোপীয় হস্তক্ষেপে তাদের চাপিয়ে দেয়া কাজগুলো হয়ে গেল ‘সংস্কৃতি’ এবং ভূমিপুত্রদের নিজস্ব কাজগুলো হয়ে গেল ‘কৃষ্টি’ । তাদের সরবরাহ করা নান্দনিকতার নকল করলে তা হল ‘আর্ট’, কিন্তু বাঙালির ভূমিজ নান্দনিকতা রূপায়িত হলে তাকে বলা হল ‘ক্র্যাফ্ট’ । কেননা সংস্কৃতি এবং আর্টের তুলনায় কৃষ্টো ও ক্র্যাফ্ট নিকৃষ্ট । ইংরেজরা যেহেতু সমাজের মানদণ্ড নির্ধারণের মালিক, এবং আর্ট ও সংস্কৃতি উৎপাদনের নেতৃত্বটি তাদের, অতএব বাঙালি সমাজের যে অংশটি তাদের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত, সেই অংশের লোকগুলোর কাজই আর্ট ও কালচার দাবি করার যোগ্যতা পেল । আর ইংরেজদের সংস্কৃতির কাছাকাছি থাকার জন্য জরুরি হল কলকাতায় থাকা, এবং সামর্থ থাকলে বিলেতে গিয়ে থাকা, অন্তত কিছুদিনের জন্যে । বাইরে যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সেখানের বাঙালিদের কাজগুলো হয়ে গেল অপাঙক্তেয় । আর্থিক মানদণ্ডের পরিবর্তে, সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে নির্ধারণ করা হল কারা ছোটলোক, নির্ধারণ হল ভদ্র ও অভদ্র, সভ্য ও অসভ্য, সুরুচি ও কুরুচি, বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধ, সংস্কৃতিবান ও ‘আনকালচার্ড’-এর সীমা ।

    ঔপনিবেশিক আমলের গোড়াপত্তন থেকেই, বাঙালির সংস্কৃতিতে, পাশ্চাত্য নান্দনিকতার জ্ঞান ব্যতীত, স্বীকৃতি পাওয়া, উনিশ শতকে ও বিশ শতকের প্রথম দিকে প্রায়-অসম্ভব তো ছিলই, এখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে গেছে । স্বদেশি নন্দন-অনুশাসনের কাঠামো গ্রহণ করলেও, তাতে পাশ্চাত্য নান্দনিকতার মিশেল ছাড়া কোনও কাজকে ‘আর্ট’ হিসাবে মেনে নেয়া যাবে না । আসলে সাম্রাজ্যবাদ হল ভূমিপুত্রের স্মৃতিবিপর্যয় । ভূমিপুত্রের ইতিহাসকে বেমালুম লোপাট করে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল ইউরোপীয় মননবিশ্বটি । জেমস লঙ ভারতচচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’কে বলেছিলেন ইতে ও অশোভন, এবং বাঙালির উচিত চসার-মিলটন পড়া । দেড়শো বছর যাবত তাইই করছে বাঙালি, এবং ভারতচন্দ্রকে ভুলে গেছে । প্রচলিত পাঁচালিগুলোকে জেমস লঙ বলেছিলেন নোংরা, লালসা উদ্রেককারী, মোটাদাগের কাজ । তারপর থেকেই অভিজাত বাঙালির পারিবারিক ধর্মকর্ম থেকে বিদেয় করা হল পাঁচালিগুলোকে । আজ সেগুলো নিম্নবর্গের নগণ্য পরিবারে কোনও রকমে টিকে আছে । বাঙালি বিদ্ব্যজ্জনদের মাথার ওপরে চেপে বসে গেছে ভিকটোরীয় আমলের ঔপনিবেশিক হাউসকোট ।

    ইংরেজরা আসার আগে, ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাবে, বাঙালির জীবনে সনাতন ভারতীয় সভ্যতা একটি নবতর দার্শনিক আধেয় গ্রহণ করেছিল, যার দরুন উন্মেষ ঘটে একটি লৌকিক বাঙালি সংস্কৃতির । সারা বাংলা জুড়ে, গড়ে ওঠে স্হানিক ছোট-ছোট ইতিহাস, যা, অভিজাত মুসলমান সমাজের বাইরে জন্ম দিয়েছিল ধর্ম, আচার-আচরণ, সাহিত্য, সঙ্গীতের তৃণমূল কৌমসংস্কৃতি । তুর্কি, আফগান, মোগল, ইরানি, বাগদাদিরা সেই অর্থে কোনও ব্যক্তি-প্রজ্ঞাবাদী মননবিশ্ব আনেনি, যেমনটা এনেছিল ইউরোপীয়রা । তাঁদের ব্যক্তিনির্মাণ প্রকল্পটি ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনির্ভর । কাজী নজরুল ইসলামের উন্মেষ ঘটেছিল এই খাঁটি বাঙালি কৌমদর্শনের পৃষ্ঠভূমিতে। সম্ভবত তিনিই তার শেষ প্রতিভূ । ওই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাইরে নজরুলের মূল্যায়ন যে কেবল ভুল, তাইই নয়, তা অসম্ভব । ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে এই ধরণের ভূমিজ মনীষার উদ্ভব বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে সমাজচিন্তনের প্রকাশরূপে : থিরু ভাল্লুভার, মীরাবাই, তুকারাম, কবিরদাস, লালন প্রমুখ ।

    ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহনরূপে ইংরেজি, এবং ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, বাঙালির জীবনে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড সংস্কৃতির সুযোগ তৈরি করে দিতে পেরেছিল, যা তার লৌকিক সংস্কৃতি থেকে মধ্য ও উচ্চবর্গকে ক্রমশ বিছিন্ন-বিযুক্ত করে দিলে । ইয়ং বেঙ্গল এবং অন্যান্য সম্প্রদায় আবির্ভূত হলেন, বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রধানত নিম্নবর্গের, সংস্কৃতির বিপরীতে । ইংরেজদের সংস্কৃতিকে মান্যতা দেয়া এবং গ্রহণ করে নেয়াটা শিক্ষিত ও সবর্ণ বাঙালির বৈধতা পেল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ‘অনুকরণ’ নামের প্রবন্ধে । ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “পশ্চিম আজ খুলিয়াছে দ্বার/সেথা হতে সবে আনে উপহার/দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে -- এই ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে” । এই বিরাট মিলনযজ্ঞের উচ্চবর্গের হোতারা খেয়াল করলেন না যে, কলকাতা সাংস্কৃতিক ক্ষমতাকেন্দ্রের বাইরে অজস্র ছোট ছোট লৌকিক সংস্কৃতির গ্রামীণ ও নিম্নবর্গ মানবনদী ইতোমধ্যে শুকিয়ে যাচ্ছে । তাদের সজীবতা ও উৎকর্ষের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে পড়েনি কারোর । ক্রমাগত অবহেলিত থাকার পর তা কালক্রমে তামাদি হয়ে গেল । বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির আদি সংস্কৃতিটি নিকৃষ্টতার তকমায় ভূষিত হল । ইউরোপের অনুকারকরাই ছিলেন বঙ্গসংস্কৃতির নিয়ন্তা । অনেকে নিজের নামপদবিরও ইংরেজিকরণ করে ফেলেছিলেন । ইসলামের একেশ্বরবাদের চাপ ছিল না অভিজাত হিন্দু সমাজে, যদিও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের চাপ ছিল অবহেলিত নিম্নবর্গের ওপর । কিন্তু ইউরোপীয়দের প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজের প্রয়োজন অনুভূত হল, আইনের ঘোষণার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হল যে ব্রাহ্মরা হিন্দু নয় । পরিস্হিতি এমন দাঁড়াল যে ইউরোপীয়দের নকল করা কাজগুলোকে বলা হতে লাগল ‘ভালো’, এবং বাঙালির সনাতন কাজগুলোকে বলা হতে লাগল ‘খারাপ’ । এরকম পরিমণ্ডল সত্ত্বেও, ইংরেজি কবিতার কোলাবোরেটর হিসাবে নতুন উরনের যে বাংলা কবিতার উন্মেষ ঘটছিল, নেটিভ লোকসত্তার কারণে সেই দলে ভিড়তে পারেননি কাজী নজরুল ইসলাম । বহিরাগত রাজা কন্ঠস্বরের ফর্মের পরিবর্তে নিজের চারপাশের সাধারণ জনগণের কন্ঠস্বরের ফর্ম তাঁর শ্রেয় মনে হয়েছিল ।

    ইউরোপের সংস্কৃতিতে অমন জলবিভাজক দেখা দেয়নি, যার দরুন একেবারে গেঁয়ো কিশোর জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবোর মতন মনীষার আবির্ভাব ও স্বীকৃতি ঘটেছিল । খ্রিস্টধর্মের তৃণমূল স্তর থেকে উদ্ভব ও আগমন ঘটেছে, মৌলবাদিতা বর্জিত, উল্লেখযোগ্য কবি ও চিত্রকরের, যখন কিনা নিজেরই ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্যে গৌরব অনুসন্ধান করেছে বাঙালি, অথবা আহ্লাদিত হয়েছে মৌলবাদে আত্মসমর্পণ করে । মুৎসুদ্দি, বেনিয়ান, গ্রাম-ছাড়া ভূস্বামী, উচ্চবর্গের দোআঁশলা মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে উঠেছিল বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির মানদণ্ড, অনুশাসন, ক্যানন -- যা বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল হিন্দু কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহেবি প্রশ্রয়ে । কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন এই পরিমণ্ডলের বাইরে তৃণমূল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির লৌকিক জগৎ থেকে, এবং সেহেতু উচ্চবর্গের মানদণ্ডে থেকে গেলেন বিতর্কিত ও প্রান্তিক । ইয়ং বেঙ্গলের ঔরসপ্রসূত কাব্যভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর খাঁটি ভূমিজ বাঙালিত্ব স্বাভাবিকভাবে সন্দেহজনক ছিল । সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ততোদিনে সায়েবি অনুপ্রবেশ পুরোদমে ঘটেছে । বিলিতি পুঁজিবাদের প্রথম শিকার ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি । ইতিহাসের সনাতন ধারাগুলোকে প্রবাহিত রাখতে চেয়েছিলেন নজরুল, তাই তিনি পদে-পদে আক্রান্ত হয়েছেন, নতুন আমদানি-করা আর্টের পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা, ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধিদের দ্বারা, নব্যহিন্দু কর্তাদের দ্বারা, শহুরে সাহিত্যিকদের দ্বারা । নজরুলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূল সাংস্কৃতিক চরিত্রস্বভাবকে পরিত্যাগ করে মেট্রপলিটান সংস্কৃতিতে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না । একই কারণে মেট্রপলিটান সংস্কৃতিতে পালিত আলোচকরা নজরুলের কাজগুলো সম্পর্কে বিব্রত বোধ করেন । দ্বন্দ্বজটিল নজরুলকে বর্গীয়করণ করা তাঁদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে গিয়েছিল, এবং এখনও বিদ্যায়তনিক আলোচনাচক্রে তাঁকে ইউরোপীয় ক্যানন প্রয়োগ করে যাচাই করার প্রয়াস হয় । তাঁরা ভুলে যান যে তাঁদের নিজেদের প্রতিস্বটি ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্ব দ্বারা নির্মিত, সে তাঁরা যতোই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কাঁধে চাদর ফেলে বাঙালি সাজার ভড়ং করুন ।

    ইউরোপীয় রেনেসাঁসের তিনশো বছর পর সেখানে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল মেট্রপলিসের বা বিশ্বনগরীর যুগ, যেখানে মিশ খেলো পেশাদারদের পেশার সঙ্গে দ্রষ্টাদের দৃষ্টি, তার সঙ্গে রাজনীতিকের রাজনীতি, এবং উদ্ভব হল জগৎসংসার বিষয়ে সুশৃঙ্খল বৌদ্ধিক নিরিখ, যা যুক্তিপ্রতর্কের ধাপ দিয়ে গড়া । সত্যের পরম ও সর্বজনীন মানদণ্ডের সমারোহ প্রতিফলিত হল রাষ্ট্রের বিধানে, বর্গীকরণ প্রক্রিয়ায়, তথ্য সঞ্চয়ে, পৃথগীকরণে, সংজ্ঞা তৈরিতে, সংস্হাপন প্রণালীতে । সত্য ও ক্ষমতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য হয়ে দেখা দিল মেট্রপলিসে । সেখানে মতবিরোধ মানেই যেন অসত্য । এই ব্যাপারটা হাংরি আন্দোলনের সময়ে ঘটতে দেখেছি । মতবিরোধিতা মানেই হাংরি আন্দোলনকে অনেকে অসত্য সাব্যস্ত করতে চেয়েছিল । মতবিরোধিতা যেহেতু ক্ষমতার বিরোধিতা, তাই মেট্রপলিসে তা হেয়, কেননা ক্ষমতার ধারকদের মতে তা বিশৃঙ্খলর জন্ম দেয়, অনিশ্চয়তার প্রসার ঘটায় । যা অনিশ্চিত তা বর্গীকরণের অযোগ্য, তা অন্যরকম । যারা অন্যরকম তারা পশ্চাদপদ । মেট্রপলিসের কাজ হল এদের তুলে এনে সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন করে তোলা । তা না করা গেলে তাদের সমাজের বাইরে রেখে দিতে হবে। যারা অন্যরকম এবং খাপ খায় না, তাদের মাড়িয়ে এগিয়ে যাবে মেট্রপলিস । এগোবার পথে সনাতন আদর্শ ও সংস্কারকে সরিয়ে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করবে মেট্রপলিসের নতুন আদর্শ ও সংস্কার । ইংরেজরা চারটি মেট্রপলিস প্রতিষ্ঠা করেছিল ভারতীয় উপনিবেশে, যার অন্যতম হল কলকাতা । এই মেট্রপলিসের মূল্যবোধের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলেন না কাজী নজরুল ইসলাম । মেট্রপলিটান নিরিখে তিনি চিহ্ণিত হলেন ‘বহিরাগত’ ও ‘অন্যরকম’ হিসাবে ।

    ইংরেজদের মেট্রপলিটান প্রভাবে, ‘কবি’র সংজ্ঞাটি, একটি সাংস্কৃতিক ফাটলের সৃষ্টি করেছিল । তাদের আগমনের আগেকার কবিদের এবং আগেকার কবিত্ব বহনকারী কবিদের একঘরে করে ফেলা হয়েছিল । কবি-র নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী আড়াআড়ি-খাড়াখাড়ি বিভাজিত হয়ে যান বাঙালি কবিরা, এবং এই নতুন সংজ্ঞাটিও ইউরোপীয় ঢঙে ‘ভালো’ কবি, ‘খারাপ’ কবি, বড়ো মাপের কবি, ছোট মাপের কবি ইত্যাদি বিভাজনে সাহায্য করেছে । বাংলা পাঠকৃতি ইউরোপীয় মানদণ্ডে যতো নিখুঁত তা ততো ‘ভালো’, তার রচয়িতা ততো ‘বড়ো মাপের’। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মুচিরাম গুড়’ থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ পর্যন্ত দেখা যায় কলকাতা মেট্রপলিসে এক নতুন ধরনের বাঙালির উদ্ভব হয়েছে, যাদের সঙ্গে তৃণমূল বাঙালির বিশেষ মিল নেই । কাজী নজরুল ইসলাম পড়ে যান সেই বিভাজনের জাঁতায় । সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকায়তের সঙ্গে মুষ্টিমেয় মেট্রপলিটানের ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’ অসম্ভব ছিল । অথচ নজরুল পদক্ষেপ করলেন সেই অসম্ভব সংঘর্ষময় এলাকাটিতে । একদিকে বহুত্বময় যৌগিক সংস্কৃতির দ্বারা রূপায়িত তৃণমূল চেতনা, আরেকদিকে সংস্কৃতির আদল-আদরা পালটাবার মসনদি চেতনা । মেট্রপলিটান বাবুরা যখন ইংরেজের শাসন থেকে মুক্তির যুক্তিতর্কে ব্যস্ত, সে সময়ে নজরুল তাঁর কাজগুলোকেই চালিত করেছেন মসনদের বিরুদ্ধে । ইংরেজদের শাসনের ও শোষণের বিরোধিতায় বঙ্গসমাজে একদিকে ছিল তৃণমূল জাতীয়তাবাদ এবং অপরদিকে রক্ষণশীল ইংরেজি-শিক্ষিত ভদ্রলোকের জাতীয়তাবাদ । নজরুলের কৌমসত্তা তাঁকে প্রথমটির বাইরে যেতে দেয়নি। মেট্রপলিসের বাবুকবিদের কোনও হেনস্হা হয় না, কিন্তু কবিতা লেখার দায়ে নজরুলের এক বছর জেল হয় । নজরুলকে দৃষ্টান্তস্বরূপ বিধ্বস্ত করা দরকার ছিল, ইংরেজদের আনা সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক মানদণ্ডকে বঙ্গজীবনে গভীরভাবে চারিয়ে দেবার জন্য ।

    লোগোসেন্ট্রিক ইংরেজদের কাছে শব্দের নিহিতর্থের খেলার তুলনায় তার ধ্বনির খেলাটি ছিল নিকৃষ্ট, অথচ ক্রিয়াভিত্তিক বাংলা শব্দ তার ধ্বনিকে প্রাথমিক ব্যাখ্যায় প্রয়োগ করে । বাবুকবিরা ধাক্কা খেলেই আশ্রয় নিয়েছেন কবিতায় । কাজী নজরুলল ইসলাম আশ্রয় নিয়েছেন জীবনে । বাবুকবিরা কবিতায় দেখিয়েছেন পারক্য, অস্তিত্বের ফাটল, ব্যক্তিপ্রতিস্বের কাতরতা, আত্মার ক্ষত । এই বোধগুলো কৌমনিরপেক্ষ । নজরুল যৌথতার ভূমিজ বোধ ( অনেকে একে বলেন গ্রাম্য, অর্থাৎ খারাপ ! ) দ্বারা সেগুলোর আস্তরণ গড়েছেন তাঁর পদ্যে, তাঁর গানে । সংঘর্ষের দামামা বাজিয়ে তিনি আড়াল করেছেন তাঁর অন্তরজগতের সন্ত্রাস । তাঁর রচনায় পাওয়া যাবে মরুভূমির বাবকল্পের স্বাধীনতা । র‌্যাঁবোর মতন লৌকিক সক্রিয় আনন্দ । শরীরের নিজস্ব যাপনবোধ । রাজনৈতিক কবিতা ও গানকে যে-সময়ে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যাচ্ছিলেন নজরুল, বাঙালির রাজনীতিতে সে-সময়ে যে-ঘটনাগুলো ঘটছিল তা ছিল নজরুলের কীর্তির পক্ষে ক্ষতিকর, কেননা সেসব ঘটনা বাঙালির জীবনবোধকে পরবর্তীকালে পালটে দিয়েছিল, এবং সমগ্র সমাজকে ফেলে দিয়েছিল আতান্তরে । ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ও গান্ধির মতান্তর । ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু । ১৯৩২ সালে কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড । ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস কর্তৃক ফজলুল হকের দলকে প্রত্যাখ্যান । ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে গান্ধির পরাজয় এবং সুভাষের কংগ্রেস ত্যাগ । সে বছরই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের বাংলা ভাগের আন্দোলন । তারপর তো উন্মাদ হয়ে গেলেন নজরুল, নির্বাক হয়ে গেলেন, জগতসংসারের প্রতি সাড়াহীন।

    দেশভাগের অব্যবহিত পরের সময়প্রবাহ, পশ্চিমবঙ্গে, নজরুলের প্রতিষ্ঠার অনুকূল ছিল না । প্রথমত, শরৎ বসুকে সরিয়ে মসনদ দখল করেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এবং ব্রাহ্ম বিধানচন্দ্র রায় । দ্বিতীয়ত, পূর্ববঙ্গ থেকে হু হু করে পশ্চিমবঙ্গগামী উদ্বাস্তুদের দুঃখদুর্দশা এক বিমূর্ত মুসলমান-ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল সর্বস্তরের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে, এবং পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক মানদণ্ডটি এঁদেরই অভিজাত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায় । মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ক্রমশ দখল করে নেন উদ্বাস্তু নেতারা । স্বভাবতই রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, শিক্ষপর্যদ, অ্যাকাডেমি প্রভৃতির চুড়োয় বসিয়ে দেয়া হয় একদা-উদ্বাস্তু উচ্চবর্গীয় কর্তাব্যক্তিদের । উল্লেখ্য যে পূর্ববঙ্গে থাকার সময়ে এই উচ্চবর্গীয় হিন্দু কম্যুনিস্ট নেতারা দেশভাগ সমর্থন করেছিলেন আর দেশভাগ হতেই সবচেয়ে আগে তাঁরাই পালিয়ে আসেন, নিম্নবর্গের মানুষদের অবহেলা করে । কলকাতায় নতুন একটি রাজনৈতিক স্লোগান আসর জমিয়ে বসে । তা হল : গরিব হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, শোষিত হওয়া ভালো । এর দরুন একটা সময়ে নজরুলের চেয়ে বড়ো করে তুলে ধরা হয় সুকান্ত ভট্টাচার্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখকে । নজরুল থেকে যান কেবল প্রতীকি উপস্হিতি নিয়ে । নজরুলের প্রতি এই কৌম-উপেক্ষা, নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে বাধ্য করে থাকবে উন্মাদ, নির্বাক, বৃদ্ধ কবিকে সে দেশে নিয়ে গিয়ে সন্মান ও প্রতিষ্ঠা দিতে । দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে কাজী নজরুল ইসলাম রূপান্তরিত হন সেখানকার এসট্যাবলিশমেন্টের, এমনকী আবছাভাবে ধার্মিক প্রাতিষ্ঠানিকতার, সাংস্কৃতিক প্রতিভূরূপে । মসনদ-বিরোধী কথকের এ এক ভয়াবহ প্রতীকবদল । বাংলাদেশের এসট্যাবলিশমেন্টের সৌভাগ্য যে নজরুল কোনো কিছুর প্রতি সাড়া দেবার অবস্হায় ছিলেন না

    উভয় বাংলায়, দেশভাগের পর, মূল্যবোধের বীভৎস ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে, নজরুলের ভূমিজ ইতিবাচক কবিতার অ্যাড্রেনালিন প্রায় অসহ্য হয়ে ওঠে ব্যক্তিপ্রজ্ঞাবাদী মধ্যবিত্ত পাঠকের অবচেতনায় । বস্তুত স্বদেশী আন্দোলনের যাবতীয় দ্যোতকগুলোকে নিজেদের স্মৃতিতে স্হান দিতে ভয় পেতে লাগলেন নাগরিকরা । স্বাধীনতার পর, দুই বাংলাতেই, কবিতা আবৃত্তির জগতে পেশাদার আবৃত্তিকারদের মধ্যে গলা-কাঁপানো নম্র ব্রা্‌হ্ম ঢঙটি জাঁকিয়ে বসে, যার দরুন নজরুলের উদাত্ত ওজস্বী বজ্রনির্ঘোষ কবিত্ব প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কন্ঠস্বরের রেওয়াজ অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল । কিংবা চলে যায় ছেঁদো পার্টিবাজদের এক্তিয়ারে । নজরুল সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন স্কুলের বালক-বালিকাদের মঞ্চে । অথচ ভারতবর্ষে প্রতিবেশী পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষ বাধলে বা শহরে দাঙ্গা লাগলে, এসট্যাবলিশমেন্ট ঝেড়ে-পুঁছে বের করে নজরুলের পদ্য ও গান । কন্ঠস্বরের শব্দাঙ্ক বাঙালির ক্ষুদ্র রাজনীতির ফলে এতই নোংরা হয়ে গেছে যে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে নজরুলের কবিতা আবৃত্তির শব্দাঙ্ককে সেই কলুষ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে, তা আর আদপে নজরুলি থাকে না । দুই বাংলার বর্তমান ন্যায়নৈতিক পরিমণ্ডলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, নজরুলের স্বয়ম্ভূ তৃণমূল কাব্যভাবনার নিজস্ব মানদণ্ডটি, সাংস্কৃতিক নান্দনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ অস্বস্তিকর ।

    তিন
    তাঁর কবিতা ও গানের রচয়িতা-অহংটি আদপে কে এবং কী, এই দার্শনিক সংকটটি নজরুলের সময়কাল থেকে হয়ে উঠেছে জটিলতর । মোহিতলাল মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ বিদ্বজ্জনেরা কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যপ্রতিষ্ঠার মূল্যায়ন সম্পর্কে দোনামনা করেছেন, একটা কিন্তু-কিন্তু ভাব দেখিয়েছেন । মূল কারণটি হল, বাংলা ভাষাসাহিত্য তখন ইউরোপীয় আধুনিকতায় আক্রান্ত হয়েছে । পরিশীলিত শিল্পবোধের ধুয়ো তুলে, যা ছিল পপধানত হেলেনিক ( হেগেল ভাবতেন যে শিল্প বলতে যা বোঝায় তা কেবল প্রাচীন গ্রিসেই জন্মেছে), বাদ দেয়া হয়েছে আদি ভূমিজ বাঙালির ডিসকোর্স, যে বাঙালিদের ইংরেজরা নেটিভ হিসাবে চি্‌হ্ণিত করেছিল। সে-সময়ে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজানো আরম্ভ করেছিল আধুনিকতার কাড়া-নাকাড়া, যেন ইউরোপীয় আধুনিকতাই সত্য, বাদবাকি সব মিথ্যা । অমন একটা ধারনার রমরমায় নজরুলকে যে কোথায় খাপ খাওয়ানো হবে, তা একটি জ্ঞানতাত্বিক সমস্যা হয়ে উঠেছিল বাঙালি সাহিত্য আলোচকদের কাছে, কেননা তাঁকে প্রাগাধুনিক বা আধুনিক কোনো বর্গীকরণেই ফেলা যাচ্ছিল না । কল্লোলের নীল নকশা নজরুল অগ্রাহ্য করেছিলেন, আবার সেই সময়ের প্রথাবাহিত কবিতা ও গানের ঐতিহ্যকেও করেছিলেন অস্বীকার । তিনি জানতেন যে তিনি একজন দ্রোহী, কিন্তু সেই দ্রোহটিকে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চালিত করেননি, যেমনটা ইউরোপে সাহিত্য ও ছবি আঁকার নানা আন্দোলনে ঘটতে দেখা গেছে । দ্রোহ ব্যাপারটাই তাঁর চেতনায় একটা ‘ঘোর’ তৈরি করেছিল, আর সেই আত্মসত্তাটিতে মগ্ন থাকার উৎসারণ ঘটেছে বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা, ধূমকেতু, লাল সালাম, সর্বহারা ইত্যাদি দ্যোতকে । দ্যোতকগুলো আধুনিক হওয়া সত্বেও তাঁর চিত্তবৃত্তিতে যেহেতু লোকরঞ্জনের ক্ষমতা ও দক্ষতা ছিল, সেগুলো পড়ে গেছে উচ্চবর্গের সংস্কৃতি ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির টানাপোড়েনের ফাঁদে ।

    বঙ্গসংস্কৃতিতে পপুলার কালচারের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার আরম্ভ হয় বিশ শতকের ছয়ের দশক থেকে । কবিতার গ্রামোফোন রেকর্ড, কবিতার অডিও ক্যাসেট, মঞ্চসফল কাব্যপাঠ, পেশাদার আবৃত্তিকার, কবিতাপাঠের সঙ্গে সঙ্গীতযন্ত্র ইত্যাদি লোকরঞ্জনী প্রক্রিয়ার সুদূরপপসারী সূত্রপাত ঘটে । পপুলার কালচার বলতে আমি বোঝাতে চাইছি এমন সাংস্কৃতিক পরিস্হিতি ও পরিবেশ যখন খবরের কাগজের মালিক, রেডিও ও টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তা, টিভি টাইকুন ও প্রযোজক, গ্রন্হ প্রকাশক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক, রেকর্ড ও ক্যাসেট কোম্পানি, আর্টগ্যালারি, বাণিজ্যিক পত্রিকার স্বত্বাধিকারী, স্টুডিও মালিক, সঙ্গীতযন্ত্র প্রযুক্তিবিদ, গণমাধ্যম ব্যবস্হাপক, মিছিলে ভিড় সাপলাইকারী প্রমুখ লোকজন সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন । এই পপেক্ষিতে বোঝা যায় কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সময়ের অনেক আগে আবির্ভূত হয়েছিলেন । পপুলার কালচারের পৃষ্ঠপটে, কবিতায় ছন্দের বদলে ধ্বনিক্রীড়ার প্রবর্তন একটি অত্যাধুনিক নিরীক্ষা । এ এক অভূতপূর্ব নিরীক্ষা যা একাধারে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডটির সর্বসন্মতিক্রমের বিরোধিতা করে, আবার সেই সঙ্গে তার মধ্যে রয়েছে লোকরঞ্জনের প্রাণশক্তি । জ্ঞান, রাজনীতি, নান্দনিকতা ও নৈতিকতার বহুত্বকে এইভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ।

    খ্রিস্টধর্মের বাহকরূপে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ যখন এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় পৌঁছেছিল, তখন অষ্টাদশ শতকে পাওয়া তাদের নতুন দার্শনিক উদ্দীপনাকে তারা চারিয়ে দিতে চেয়েছিল তথাকথিত আবিষ্কৃত ভূখণ্ডের জনসাধারণের জীবনে । ইউরোপ তার কৌশল ও সামরিক ক্ষমতার গরিমায় নিজেকে মনে করেছিল, আজও করে, আলোকপ্রাপ্ত প্রগতির দূত । বাদবাকি পৃথিবীকে নিজের মতন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল । নিজের সমান নয়, বলাবাহুল্য । কিন্তু তাদের সবাইকে পিটিয়ে একইরকম করতে চেয়েছিল । চেয়েছিল সর্বজনীন করে তুলতে । ইতিহাসকে, সময়কে, তারা মনে করেছিল একমুখী আর একরৈখিক । আধুনিকতাকে ভিত্তিকরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বঙ্গসমাজে যে প্রাতিষ্ঠানিক বোধের প্রবর্তন ঘটায়, তার প্রক্রিয়া ও প্রভাবে আমজনতার সাহিত্য সঙ্গীত সংস্কৃতির বাইরে গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টধর্ম-প্রভাবিত রাজধানির বন্দনাকারী মুষ্টিমেয় উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির একটি কেন্দ্রাতিগ আধিপত্যবাদী একমুখী একরৈখিক দোভাষীর খাস সাহিত্য সঙ্গীত সংস্কৃতি । বঙ্গসমাজের অজস্র রূপকে তা ঢালাই করতে চেয়েছিল এবং তাতে সফলও হয়েছিল, একরূপতায় বা সমরূপতায় । অনেক স্বরকে পালটাতে চেয়েছিল একক স্বরে এবং তাতে সফল হয়েছিল । নজরুল গ্রাম ও পাড়ার নানাধর্মী নেটিভ নান্দনিকতাকে বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন শাসকর কেন্দ্রাভিগ নান্দনিকতার বিরুদ্ধবাদী স্ফূরণে, ইতিহাসের সর্বজনীনতার বিরুদ্ধে, ভাষার উচ্চবর্ণ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, মানবেতিহাসকে একটিমাত্র আখ্যানের অন্তর্গত মনে করার বিরুদ্ধে, বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক সত্তার ধারনার বিরুদ্ধে । এই কারণেই, মোহিতলাল মজুমদার যখন তাঁকেশেলি, কিটস, টেনিসন, ওয়র্ডসওয়র্থের কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেন, তখন নজরুল ওই ব্রিটিশ কবিদের কাজকে অসহ্য মনে করে প্রত্যাখ্যান করেন । ইউরোপের সরবরাহ করা আলোকপ্রাপ্তির দর্শনটিকে সর্বজনীন নৈতিক ও বৌদ্ধিক প্রগতির প্রতিভূ বলে মেনে নিতে পারেননি কাজী নজরুল ইসলাম । তাই বলে নজরুল দেহাতি নন বা স্কিৎসোফ্রেনিকও নন ।

    ত্রয়োদশ শতকে বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহর থেকে এসেছিলেন নজরুলের পূর্বপুরুষ মহম্মদ ইসলাম। ঘরসংসার মা-বাপ ফেছনে ফেলে অজানার উদ্দেশ্যে এই বেরিয়ে পড়ার আরবিক ইন্দ্রিয়চেনতা ও নারীসৌন্দর্যে স্তম্ভিত হওয়ার ( যে জন্য আবায়া পরার প্রথা ) সংবেদন নজরুলকে কৈশোর থেকে আটপৌরে বাঙালিদের থেকে আলাদা করেছিল । ওল্ড টেস্টামেন্টের চরিত্রদের সঙ্গে তাঁর রক্তসম্পর্ক ছিল । গৌরবর্ণ মজবুত চওড়া হাড়ের নজরুল, ময়লা চেহারার পাঁচফিটের রোগাটে বাঙালিদের মধ্যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেয়েছেন কবিজনোচিত নম্রতার খোলোশ দিয়ে । তাঁর ্রবিক ইন্দ্রিয়চেনা তাঁকে যোদ্ধা হতে প্ররোচিত করেছে এবং সেকারণে তিনি গর্ববোধ করেছেন হাবিলদার পদের আখ্যায় । যা তদানীন্তন সাহিত্যজগতে ছিল অকল্পনীয় । আমরা ফরাসি কবি গীয়ম অ্যাপোলোনিয়ারের কথা জানি, যিনি সাহিত্যিক মহলে সামরিক পোশাকে ঘুরে বেড়াতেন । ঘরকুনো কলকাতাবাসী কবিমহলে নজরুলের প্রাগুক্ত বাড়িহীনতাকে বোহেমিয়ান বলে ভুল করা হয়েছে । কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বাঙালি ছিলেন না, সেকারণে তাঁর বোধে হীনম্মন্যতা কাজ করেনি কখনও ।

    বাঙালিবাড়ির আদ্দামড়া খোকারা মায়ের আঁচল ছেড়ে অন্যত্র যেতে চান না । কিন্তু আমরা আজও দেখি বাড়িঘর ছেড়ে ইরাক-ইরান-লিবিয়ার যুবকেরা মতাদর্শের লড়াই লড়তে চলে যাচ্ছে আলজেরিয়া সুদান সিরিয়া ইরাক আফগানিস্তান লেবানন চেচনিয়া বসনিয়ায় । এ এক আত্মআবিষ্কারের কৌম-প্রক্রিয়া যা বস্তুজগতের লাভ-লোকসান দিয়ে পরিমাপ করা যায় না । অথচ একদা-ধর্মান্তরিত পরিবারের বাঙালি যুবকেরা নিজের দেশের মানুষের মাথায় বোমা ফাটাতে ব্যস্ত । নিজের তৃণমূল বোধের জন্য নজরুল আর্থিক দৈন্যে বিপর্যস্ত হয়েছেন বারংবার, গুছিয়ে বসার ব্যাপারটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি । তাঁর কবিত্ব-প্রতিস্বের দুর্বার প্রাণস্রোত, একই সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকের কবিতা ও গান লেখার অনর্গল ক্ষমতা, সামনের সমস্তকিছু জয় করে যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবার আকাঙ্খা, তাঁর অশ্বারোহী পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া । এই কারণেই তাঁর সমকালীন বাঙালি কবিরা ব্রিটিশ রোমান্টিসিজমের ভাষা-জটিলতায় আচ্ছন্ন হলেও, নজরুল এড়িয়ে গেছেন সেই জগৎটিকে । পয়গম্বর হজরত মহম্মদের বিরোদ্ধে বিদ্রোহকারী খালেদ সম্পর্কে ১৯২৬ সালে একটি কবিতা লেখেন নজরুল । পরবর্তীকালে হজরত মহম্মদের সেনাপতি হয়ে খালেদ রোমক শাসকদের কবজা থেকে উদ্ধার করেছিলেন পবিত্র মক্কা নগরীকে । আরবিক ইন্দ্রিয়চেতনা সঞ্জাত প্রতিস্বকে নজরুলও, খালেদের মতন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিপুত্রের সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধারের কাজে লাগাতে চেয়েছেন । তাকে মুক্ত করতে চেয়েছেন ইউরোপীয় মননবিশ্বের কোড লোগো প্রতীক চি্হ্ণ দ্যোতক রূপক ইত্যাদির জেলখানা থেকে । তাঁর সারা কাব্যদুনিয়ায় পাওয়া যাবে বিলম্বিত ও দ্রুতলয়ের অশ্বখুরধ্বনি, যা বাবু-মিয়াঁ বাঙালিকে বিব্রত করে । অমন অন্ত্যজ ভাবদুনিয়ায় ঢুকতে অপ্রস্তুত বোধ করেন অভিজাত বাঙালি । তাঁর প্রতিবাদের মুহুর্মুহু আধিপত্যবাদবিরোধী আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয় তাঁর কাব্যভাষার সন্ত্রাসে । মোলায়েম প্যানপেনে ন্যাকান্যাকা অভিব্যক্তির হিনম্মন্যতা থেকে তিনি ছিনিয়ে বের করতে চেয়েছেন কবিতাকে, কবিত্বকে । আরবি রূপকল্প ও শব্দাবলীর অন্তর্ঘাতই কেবল নয়, তলে-তলে কাজ করেছে বিকল্প মূল্যবোধ সৃষ্টির অভিঘাত, যে-অভিঘাতের সূত্র ছিল মারফতি ও মুরশিদা, নৌরচকা ও গজল, নিকউবানা ও ভাটিয়ালি, লাউনি ও ঝুমুর, সারি ও রামপ্রসাদী, তোড়ী ও কীর্তন । সাহিত্য সংস্কৃতির ইউরোপীয় মানদণ্ডটি তিনি ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন ঔপনিবেশিক কালখণ্ডেই, যখন কিনা এই স্ট্র্যাটেজি বিভিন্ন দেশে উৎসারিত হতে দেখা গেল উত্তরঔপনিবেশিক আমলের সাহিত্য সংস্কৃতিতে ।

    নজরুল তাঁর গানের স্বরলিপির কপিরাইটের ধার ধারেননি । তিনি চেয়েছেন মীরাবাই, রহিম, লালন, রামপ্রসাদের মতন তৃণমূলে নিজেকে চারিয়ে দিতে, যাতে যে গাইবে তারই যেন হয়ে ওঠে তাঁর গান । যাতে তাঁর গানকে কেন্দ্র করে কোনও আধিপত্যবাদী শাসন-কাঠামো না জন্মায়, যাতে না তা অভিজাত নিয়ন্ত্রকদের স্বার্থান্ধ বিধিবিন্যাসের কবজায় স্হবিরতা লাভ করে, যাতে না তা স্হিতাবস্হার আরোপিত অভ্যাস গড়ে তোলে, যাতে না তা মুষ্টিমেয়র সুবিধাভোগের চক্রব্যূহ বানিয়ে, যা গাইতে চায় তাকে ঘিরে ধরে বোবা করে দেয় । বাজার না হলে আধুনিকতার পপকল্প সম্পূর্ণ হয় না, অথচ প্রভূত জনপ্রিয়তা সত্বেও বাজারকে উপেক্ষা করেছেন নজরুল । তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি তাঁকে আপনা থেকেই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মডেলটির বিরোধী করেছিল ।

    আধুনিকতাবাদের সঙ্গে নজরুলের সংঘাত কেবল আরব ইন্দ্রিয়চেতনার জন্য নয় । ঔপনিবেশিকতাকে সহ্য করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ মুসলমান সমাজ, অভিজাত ও মধ্যবিত্ত তো বটেই, হিন্দু নিম্নবর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত মানুষও, আধুনিকতাকে সরাসরি গ্রহণ করতে চাননি । নজরুল কর্তৃক আধুনিকতাবাদ প্রত্যাখ্যানের উৎসসূত্র হল বহু জনমানস-সম্ভূত সাংস্কৃতিক ভূমিপুত্র হিসাবে অন্ত্যজ ও প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব । তাঁর আগে ও পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বঙ্গসমাজের একটি ক্ষুদ্র বর্গ-বিশেষের কন্ঠস্বর নিয়ে এসেছিলেন । তা হয় এলিটের নয় পাতিবুর্জোয়ার বা নিচুতলার । তা পূর্ববঙ্গের বা পশ্চিমবঙ্গের । তা ব্রাহ্ম বা হিন্দু বা মুসলমানের । এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যের নিদারুণ চাপ যে কোনও সুস্হ মানুষকে উন্মাদ করে দিতে পারে ।অধচ নজরুলের জনপ্রিয়তার ভিত্তি ছিল এই ভয়ঙ্কর ভারসাম্য, যাকে তিনি ব্যক্তিগত স্তরে সামলাবার চেষ্টা করেছেন অযথা অট্টহাস্যের দ্বারা, দিলখোলা কথাবার্তার দ্বারা, জীবনযাপনের নোঙরহীনতার দ্বারা, গানের সর্বভূক ব্যাপকতার দ্বারা । নজরুলের কীর্তিকে বিচার করতে হলে আলোচককে কেবল প্রান্তিকের প্রতিনিধিত্ব করলেই চলবে না, তাঁকে হতে হবে বহুত্ববাদী যৌগিক সংস্কৃতির ভূমিপুত্র । প্রান্তিক ও অন্ত্যজ বাঙালির জ্ঞানতাত্বিক অবয়বটির উপলব্ধি থাকা তাঁর প্রয়োজন । দেশভাগের পর দুই বাংলার গ্রামীন কমিউনগুলোর কাঠামো ভেঙে পড়ায় সেই ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে । জনৈক মুসলমান যুবক শ্যামাসঙ্গীত গাইছেন ও সুর দিয়ে তাকে রামপ্রসাদের গানের চেয়ে জনপ্রিয় করে তুলছেন, আজকের ঐক্যবুকনির যুগে, পদ্মা-গঙ্গা ড্রামাবাজির দিনকালে, সংহতি-বক্তিমে ঝাড়ার দিনে, স্রেফ ভয়াবহ । বাংলাদেশে তো আরও বিপজ্জনক । বাজারের খোরাকের ব্যাপার না হলে, তা যদি কবির নির্মল ব্যক্তিপ্রতিস্বের উৎসার হয়, তাহলে বর্তমান কালখণ্ডে সমাজ তা অনুমোদন করবে বলে মনে হয় না । নজরুল যে তাঁর সমসাময়িক কবি ও সঙ্গীতকারদের ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তা ওই প্রাণস্পন্দিত ভারসাম্য সৃষ্টির ক্ষমতার দরুণ । তাঁর নির্মাণপ্রকল্পের তাৎক্ষণিক অভাবনীয় সফলতার মধ্যেই ছিল ভবিষ্যতে উপেক্ষিত হবার বীজ । রবীন্দ্রনাথের কর্মকাণ্ড দেখেও তিনি শিখতে পারেননি ।

    সমগ্রের পৃষ্ঠপোষক নজরুল বাদ দিতে চাননি কোনও কিছু, এবং সেকারণেই সমর্থন করেননি কবি ইকবালের রাজনীতিকে । একথা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “সভাকবি হতে হলে এসট্যাবলিশমেন্টের কাছে মাথা নোয়াতে হয়, নজরুল কখনও নোয়াননি” । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজে পরবর্তীকালে বেমালুম এসট্যাবলিশমেন্টে সেঁদিয়ে গেলেও, নজরুল কিন্তু রফা করেননি । ভারতীয় এসট্যাবলিশমেন্টের কাছে তাই ইকবাল ও গালিবের তুলনায় উপেক্ষিত ছিলেন, এবং থেকে গেছেন । ভারতবর্ষে, বহুকাল পর্যন্ত, শিক্ষা দপতরটির নিয়ন্ত্রণ ছিল মৌলানা আবুল কালাম আজাদের হাতে । কেবল জিন্নার পাকিস্তানে নয়, ভারতবর্ষেও মুসলমান বাঙালির সাহিত্যসঙ্গীতকে মুসলমান উর্দুভাষীর কীর্তির চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করেছে এসট্যাবলিশমেন্ট । বাঙালি মুসলমান ছিল নিম্নবর্গের, অর্থাৎ মেট্রপলিটান ক্ষমতাজোটের বাইরের লোক । প্রাগাধুনিক আমলে, মোগল এসট্যাবলিশমেন্টে, এবং তার ভাঙনের সময়েও, অভিজাত মুসলমান সমাজের ভাষা ছিল ফারসি-আরবি-উর্দু। ওই ভাষাভাষি সাহিত্যিক কোড অমান্য করা ছিল গর্হিত, কেননা আধিপত্যের আহ্লাদের মুসলমানি উৎসসূত্র ছিল সেই ডিসকোর্স । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের উর্দুভাষীরা বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে চোখা-চোখা গালমন্দ উপহার দিয়েছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তাদেরই নব্বুই হাজার সেনা ল্যাজগুটিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচে । নজরুল তা অমান্য করেছিলেন, এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেকারণেই মৃত নজরুলের দাবিদার হয়ে ওঠে । প্যান ইসলামিক সমাজে বাঙালি মুসলমান অবশ্য এখনও প্রায় প্রান্তিক । আর নজরুল যে সেই মঞ্চে রবাহুত, তা না বললেও চলে । ব্যাপারটা বিস্ময়কর এইজন্যে যে, মসনদের পপাগাধুনিকতা এবং আধুনিকতাকে একযোগে প্রতিরোধ করে একেবারে নিজস্ব আধার ও আধেয় গড়েছিলেন তিনি । মনে রাখা দরকার যে বঙ্কিম যেমন ইংরেজিতে ‘রাজমোহনস ওয়াইফ’ এবং মাইকেল যেমন ইংরেজিতে ‘ক্যাপটিভ লেডি’ লিখে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেরকম নজরুল শুরু করেছিলেন আরবি-ফারসি-উর্দু নগমা-শায়রি দিয়ে । আধুনিকতার দ্যোতকগুলোর চাপে তাঁর সময়কার বাংলা কবিতা যদিও ইউরোপীয় আদলটি গ্রহণ করেছিল, তিনি কিন্তু প্রাচীন ও নবীনের মাঝে নেটিভ যোগসূত্রটির একচ্ছত্র মালিকানা বজায় রাখলেন । কিন্তু খ্রিস্টধর্মের তল্পিবাহকরূপে আধুনিকতাবাদ আসার আগেও বাংলা কাব্য ছিল প্রধানত অ্যাপোলনীয় । প্রথমে মাইকেল মধুসূদন এবং পরে নজরুল ইসলাম প্রবর্তন করেছিলেন ডায়োনিসীয় মেজাজের । ডায়োনিসীয় মেজাজটা বাঙালি পাঠকের কাছে বেশ অস্বস্তিকর । নজরুলের কবিতায় ভাষার নৃত্যভঙ্গিমা বাঙালি বাবু ও মিয়াঁ সমাজের মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায় । বস্তুত মনস্তাত্বিকদের উচিত বিশ্লেষণ করে দেখা যে, ‘দে গোরুর গা ধুইয়ে’ সংলাপটি কোনও ব্যক্তিগত ইশারা বহন করছে কি না । বাক্যটিকে অর্থহীন কথার কথা মনে করা ভুল ।

    প্রাগাধুনিক সমাজটি যখন আধুনিকতার ভান করেছে, তার ঘুর্ণিতে পড়তে হয়েছে নজরুলকে । একাধিকবার মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের দরুন আচমকা সম্পর্ক ছিন্ন করে মেনে নিলেন রহস্যময় চিরবিচ্ছেদ । সিয়ারশোল স্কুল থেকে উৎখাত হলেন, কেননা প্রাগাধুনিক প্রকৃতিবাদী প্রধানশিক্ষক গিয়ে তাঁর জায়গায় এলেন আধুনিক সংস্কৃতিবাদী প্রধানশিক্ষক । রেলের খ্রিস্টান গার্ডের খোঁড়া সৎ-মেয়েটিকে তার আশ্রয়স্হলে পৌঁছে দেবার বদান্যতা দেখাতে গিয়ে কৈশোরেই কুড়োলেন ইলোপ করার বদনাম । প্রণয়িনীর চুলের কাঁটা পকেটে নিয়ে যোগ দিলেন সৈন্যবাইনীতে । ফিরে এসে, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাদুড়বাগানের মেসে দিনকতক থাকার পরের উৎখাত হলেন হিন্দু আবাসিকদের হল্লায় । ডেরা বাঁধলেন কাগজের অফিসে । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিচে থেকেই ‘গুরুজি গুরুজি’ বলে হাঁক পাড়লেন । মোহিতলাল মজুমদারের বিরুদ্ধে চাপালেন চাপান উতোর । তাঁর ক্রুদ্ধ রচনার দরুন ‘নবযুগ’ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হল । দেওঘরে যাঁর বাসায় আশ্রয় পেলেন, সেখানে স্বামী-স্ত্রী নয় এমন যুবক-যুবতীকে রাতভর থাকতে দিয়ে উৎখাত হলেন । দৌলতপুর গিয়ে অতিদ্রুত সৈয়দ আসাব খানের প্রেমে পড়লেন এবং কাবিনামার শর্ত মনঃপূত না হওয়ায় বিয়ের আসর থেকে উঠে চলে গেলেন । ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করলেন, এবং তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি বাজেয়াপ্ত হল । ‘ধূমকেতু’ প্রকাশের দায়ে কুমিল্লা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এনে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল । মেদিনীপুরে তাঁর গান ও কবিতা আবৃত্তিতে মুগ্ধ একটি হিন্দু যুবতী নিজের গলার সোনার হার খুলে নজরুলকে পরাবার পর পারিবারিক ও সামাজিক ধিক্কার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করে নিল । ঢাকার রানু সোমের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য আঁচ করে তাঁকে প্রহার করেন সমাজের কর্তাবাবারা । তেইশ বছরের নজরুল আহলে-কেতাব মতে বিয়ে করলেন ষোলো বছরের প্রমীলা সেনগুপ্তকে । নলিনাক্ষ সান্যালের বিয়েতে মুসলমান বরযাত্রী হওয়ার দরুন বিতাড়িত হলেন বিয়েবাড়ি থেকে । হিন্দু মেয়ে বিয়ে করায় কলকাতার কোথাও বাড়ি ভাড়া না পেয়ে শেষে থাকতে বাধ্য হলেন হুগলির মুসলমান গেটো মোগলপুরায় । তারপর সেখানেও টিকতে না পেরে বাসা নিলেন কৃষ্ণনগরে, এবং এমন দারিদ্রে আক্রান্ত হলেন যে বন্ধুবান্ধবদের ‘নজরুল সাহায্য রজনী’ অনুষ্ঠান করে চটজলদি টাকা তুলতে হল । উত্তরোত্তর হিন্দু দেবী দেবতার প্রসঙ্গ তাঁর গান ও কাব্যে বৃদ্ধি পাওয়ায়, বিরাগভাজন হলেন মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল বর্গের । ‘মোহম্মদি’ পত্রিকা তাঁকে ‘কাফের’ আখ্যায় ভূষিত করল । গণিতে স্নাতকোত্তর যুবতী ফজিলতুন্নেসার প্রতি আকৃষ্ট ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে টের পেলেন যে কবিতা ও গানের জনপ্রিয়তার বাইরে একটি আত্মাভিমানের জগৎ আছে যেখানে তাঁর স্বীকৃতি সম্ভব নয় । অকস্মাৎ একদিন, তাও বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানে, তাঁর উচ্চারণ ক্ষমতা তিরোহিত হল, এবং বাকহীন হয়ে গেলেন বাকি সারাটা জীবন । তাঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল । তাঁর শাশুড়ি একদিন কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন । ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’ দুশো টাকা মাসোহারার ব্যবস্হা করেছিল, কিন্তু জনৈক ঈর্ষান্বিত কবি কলকাঠি নাড়িয়ে তা বন্ধ করে দিলেন । তাঁর স্ত্রী আক্রান্ত হলেন পক্ষাঘাতে । জীবনের শেষ কয়েকদিন মৌন সম্রাটের মতন ঢাকায় কাটালেন নজরুল । নজরুলের পপতিষ্ঠার জন্য তা ভালোই হল । পশ্চিমবঙ্গে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে-ওঠা সংস্হার সংগঠকরা যে-যার আখের গুছিয়ে কেটে পড়লেন , এবং সংস্হাটি লাটে উঠে গেল । তাঁর রচনাসমগ্রের ফাইল লোপাট হয়ে গেল সরকারি দপতর থেকে । একুশ শতকের পোস্টমডার্ন দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, প্রাগুক্ত ঘটনাবলীকে একটি ভয়াবহ ত্রাসিত রূপকথা মনে হয়, অধিবাস্তব মনে হয় । কিন্তু প্রাগাধুনিকতা ও আধুনিকতার বঙ্গীয় সাঁড়াশিতে আটক নজরুল ভুগেছেন ওই অনৈক্য, ওই অনিশ্চয়তা, ওই হাহাকার, ওই আক্রমণ, ওই অনপনেয় জীবন ।

    চার
    রবীন্দ্রনাথ ১৩০৫ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘গ্রামসাহিত্য’ নিবন্ধে এই কটা কথা লিখেছিলেন : “গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত ্‌ইয়া থাকে ; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্হানীয় । তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য, সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না । সাহিত্যের যে অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাকাটার উপরে দাঁড়াইয়া আছে । এইরূপ নিম্নসাহিত্য এবং উচ্চসাহিত্যের মধ্যে বরাবর ভিতরকার একটি যোগ আছে । যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুলফল ডালপালার সঙ্গে মাটির নিচেকার শিকড়গুলোর তুলনা হয় না -- তবু তত্ববিদদের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সম্বন্ধ কিছুতেই ঘুচিবার নহে ।” প্রাগুক্ত নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছিলেন, “নিচের সহিত উপরের এই যে যোগ, পপাচীন বঙ্গসাহিত্য আলোচনা করিলে ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় । ‘অন্নদামঙ্গল’ ও ‘কবিকঙ্কণ’-এর কবি যদিচ তাঁহারা উভয়ে রাজসভা-ধনীসভার কবি, যদিচ তাঁহারা উভয়ে পণ্ডিত, সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিশারদ, তথাপি দেশীয় প্রচলিত সাহিত্যকে বেশিদূর ছাড়াইয়া যাইতে পারেন নাই ।”

    নিম্নসাহিত্য ও উচ্চসাহিত্যের খুঁটি দুটিতে বাঁধা বঙ্গসংস্কৃতির অশ্বটিকে মুক্ত করে দিলেন নজরুল, ছুটিয়ে দিলেন তাকে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝেকার বঙ্গীয় মননের টালমাটাল কালখণ্ডে, এবং আঘাত হানলেন যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোর ভিত্তিবাদী ও খণ্ডবাদী বনেদে । একেবারে ভণ্ডুল করে দিতে চাইলেন তাদের : আর্য ও অনার্য, উচ্চ ও নিম্ন, হিন্দু ও মুসলমান, ভূমিপুত্র ও বহিরাগত, মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র, সাকার ও নিরাকার, কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক, জ্ঞান ও কর্ম, মন ও দেহ, দেবতা ও রাক্ষস, শহর ও গ্রাম, বেদ ও নির্বেদ, ফরসা ও কালো, ঈশ্বর ও অনীশ্বর, মস্তিষ্ক ও হৃদয়, শ্রীকৃষ্ণ ও ইন্দ্র, শুভ ও অশুভ, উর্বশী ও অর্জুন, মূর্ত ও বিমূর্ত, ভদ্রলোক ও ছোটলোক ইত্যাদি । এ-প্রসঙ্গে আনন্দবেদনার অভিজ্ঞান ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সেই নিগূঢ় ও ওজস্বী বৈপরীত্যগুলোকে স্মরণ করা যায়, যা একদা ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য মানদণ্ড প্রয়োগ করে বিচ্যুতি ঠাওরেছেন এলিট আলোচকের দল, যাঁদের সঙ্গে সুফি গায়ক-কবি বুল্লে শাহের রচনার ( বুল্লা কি জানা ম্যায় কৌন ) পরিচয় নেই :

    আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘুর্ণি
    আমি পথ সন্মুখে যাহা পাই তাহা চূর্ণি
    আমি চিরদুরন্ত দুর্মদ
    আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়
    আমি শ্মশান,
    আমি আবাসন, নিশাবসান ।

    এরই বিপরীতে, একই পাঠকৃতিতে তিনি লিখেছিলেন :
    আমি বন্ধনহারা । কুমারীর বেণী
    তন্বী নয়নে বহ্ণি,
    আমি ষোড়শীর হৃদি সরসিজ প্রেম
    উদ্দাম, আমি ধন্যি ।

    চিন্তা ও অসামঞ্জস্যকে যেভাবে তাঁর পদ্যে ও গানে বার বার এনেছেন নজরুল, আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, ঠাণ্ডামাথায় পুনঃচিন্তিত স্মৃতি কালক্রমে তার আদল পালটায়, চরিত্রহীন হয়ে যায় । তাঁর অধিকাংশ পাঠকৃতি সেহেতু দ্রুত, স্বতঃস্ফূর্ত ভৌতবৃত্তীয়, সংবাহক । ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বে প্রতিপালিত বাঙালি ভাবুকদের একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত । নয়তো তাঁরা কীভাবেই বা এই ঘটনাগুলো মিলিয়েছেন : জেমস স্টুয়ার্ট মিল-এর উদারনীতি এবং তাঁর ভারতবর্ষের ইতিহাস, ম্যাকলের হুইগিশ উদারনীতি নিজেরদেশে বসে এবং উপনিবেশে রেসিজম, ইউরোপীয়দের নিজেদের জন্য ‘মুক্তি-ভাতৃত্ব-স্বাধীনতা’-র স্লোগান আবার একই সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস রাখা, একদিকে আলোকপ্রাপ্তি তত্বের রমরমা আর তার বিপরীতে নারীকে ভোটাধিকার না দেবার প্রয়াস । একইভাবে প্রশ্ন ওঠে যে, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সাহিত্যিকদের রচনাতে ইসলামের মিথ ব্যবহৃত হয়নি কেন ! হয় না কেন ? তাহলে তাঁদের চেতনাকে তো আত্মসর্বস্ব এবং খণ্ডিত আখ্যা দেওয়াই উপযুক্ত । আসলে ‘মসনদের মূল্যবোধ তার নিজস্ব মালিন্য গড়ে তোলে’। যেমন পরবর্তীকালে তসলিমা নসরিনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ও তাদের বিতাড়ন বিষয়ক বই ‘লজ্জা’-কে কেন্দ্র করে।

    প্রাগুক্ত মালিকানার দরুন অনেক আলোচক নজরুলে আলোচনা এড়িয়ে যান । তাঁদের ভয় হয়, নজরুলের আলোচনা করলে বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁরা নিজেরাই বেকায়দায় পড়বেন, তাঁদের হয়তো সাহিত্যসমাজে জবাবদিহি করতে হবে, অধ্যাপকদের কাছে কারণ দর্শাতে হবে । আসলে নজরুলের সংবরণহীনতা, সংহতিহীনতা, সংশ্লেষহীনতার সামনে পড়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান তাঁরা, কেননা তাঁদের হাতে গুঁজে দেওয়া মাপকাঠিতি জগা কৈবর্ত, বিশা ভূঞিমাল এমনকি শিবনাথ শাস্ত্রীও নয় । তা দিশি কেরি সাহেবদের মারফত পাওয়া স্যামুয়েল জনসন প্রমুখের মাপকাঠি । তিরিশের দশকের পাঁচজন কবি, যাঁরা বাংলা কবিতায় আধুনিক আদরা-আদল-কাঠামোর অনুপ্রবেশ ঘটান, তাঁরা সবাই ছিলেন ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক । অর্থাৎ সাদা-কলার সংস্কৃতির তাঁরা ছিলেন অন্তরঙ্গজন । বাঙালি চাষা ক্ষেতমজুর ঢুলি মোয়াজ্জিন সেপাই কাজি বাবুর্চি খানসামা এমাম ইত্যাদি প্রান্তিক মানুষের কালচেতনা ও অভিব্যক্তি-বিন্যাস যে কলেজ অধ্যাপকদের থেকে আলাদা হবে না, তা নজরুলের আলোচকরা ঠাহর করতে পারেননি, পারেন না । ওপরতলার বিদ্যায়তনিক ঠাটটিকে যেহেতু নিচুতলার হেলাফেলার বিশ্ববীক্ষা দিয়ে চুরমার করেছিলেন তিনি, সেহেতু ওপরতলার তথাকথিত শিক্ষিত সংস্কৃতিবান রুচিসম্পন্ন এলিটের আঁতে ঘা লেগেছিল, আজও লাগে । নজরুলের পাঠকৃতিতে আওয়াজ অর্থকে ছাপিয়ে যায় । অর্থ অনেক সময়ে বোধাতীত হতে পারে, কিন্তু আওয়াজের ঘোরের মধ্যে বোধকে পড়তেই হয় । নিহিতার্থ বা মানের মালিকানা থাকে ওপরতলার কবজায় । আওয়াজ নিচুতলায় । রস ওপর থেকেই টানা যায় । সেখানেই নান্দনিকতার কারখানা । ফলে যত দিন যাচ্ছে আর যাবে, দেয়ালে টাঙনো তাঁর ছবির সংখ্যাবৃদ্ধি হলেও, তাঁর বহু পাঠকৃতি বিদ্যায়তনিক ও বৌদ্ধিক মহলে হয়ে উঠবে এগজটিক ।

    লক্ষণীয় যে, কাজী নজরুল ইসলামের সমকক্ষ জনপ্রিয় কবি, উভয় বাংলাতেই, আবিভূত হননি । আবৃত্তিকার-কবিদের পারফরমেন্স আরম্ভ হয়েছে তাঁর বহু পরে । পারিবারিক সংস্কৃতিতে ইউরোপীয় দ্যোতকগুলি অনুপ্রবেশ করতে পারেনি বলে, পশ্চিমবঙ্গে তিন, চার ও পাঁচের দশকে মুসলমান সমাজ থেকে বাঙালি কবি নেই । তারপর যাঁরা এলেন, কবিরুল ইসলাম, সামসুল হক, শামসের আনোয়ার প্রমুখ, মসনদের পপাতিষ্ঠানিক জ্যোতির্মণ্ডলের বাইরের অন্ধকারে, রয়ে গেলেন আগন্তুক ও প্রান্তিক । উপেক্ষিত ও অবহেলিত শামসের আনোয়ার বেছে নিলেন আত্মনিধনের পথ । সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর হিন্দু সমাজটি এমন এক বিমূর্ত মূল্যবোধের চাপ সৃষ্টি করে যে, সেই প্রক্রিয়ায় মুসলমান কবি রয়ে যান প্রান্তে, সাহিত্যশাসকদের ক্ষমতাকেন্দ্রটির ছত্রছায়ার বাইরে । কবি নজরুল ইসলামের, পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, ক্রমাবলুপ্তির ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ওই প্রক্রিয়ায় ।

    মক্তব, মদ্রাসা, দার-উল-উলুমে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকের পক্ষে আর বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে কবি হওয়া এবং স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব নয় । বাংলাদেশে কি সম্ভব ? আমার মনে হয় সম্ভব নয় । বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে অবস্হা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় ‘লানত গলায় গোলাম ওরা সালাম করে জুলুমবাজে/ধর্মধ্বজা উড়ায় দাড়ি গলিজ মুখে কোরান ভাঁজে’ পড়েন পঠক তখন তিনি মানে বইয়ের খোঁজ করেন । একই ব্যাপার ঘটে যখন ‘চিরনির্ভর’ কবিতায় শোনা যায় ‘ইস্রাফিলের বজ্রবিষাণ বেজে ছিল বারবার’, কিংবা ‘চোর ডাকাত’ কবিতায় ‘জগৎ হয়েছে জিন্দানখানা প্রহরী যত ডাকাত’ । এমন অজস্র আছে । পেশাদার আবৃত্তিকাররা নজরুলের গুটিকয় অতিজনপ্রিয় কবিতাই মঞ্চে-মঞ্চে পড়ে বেড়ান । পশ্চিমবঙ্গের ভাষাজগৎটিতে দেশভাগের পর যে বৌদ্ধিক ও সেম্যানটিক পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটে চলেছে, নজরুলের বহু প্রতীক রূপকল্প শব্দবন্ধ অভিধা সেই প্রেক্ষিতে হয়ে উঠেছে অপরিচিত । পক্ষান্তরে তাঁর গান, বিশেষ করে শ্যামাসঙ্গীত, টিকে আছে তৃণমূল স্তরে । নজরুলের অভিব্যক্তি বুঝতে না পারলেও, বাঙালি যুবক-যুবতীরা, নর্তক-নর্তকীরা বলিউডের সালমান খান বা শাহরুখ খানের উর্দু সংলাপ দিব্বি বোঝেন ও নিজেদের বাক্যালাপে ব্যবহার করেন।

    নজরুলের বিদ্যায়তনিক ও সমাজতাত্বিক গ্রহণ বর্জন ব্যাখ্যা করা যায় সম্ভবত পোস্টস্টাকচারাল অর্থাৎ উত্তরকাঠামোবাদী বা উত্তরগঠনবাদী ভাষাতত্বের দ্বারা । ধারণাটি জানায় যে, মানবসত্তাকে কোনও সর্বজনীন নিয়ম-পদ্ধতি প্রয়োগ করে টের পাওয়া যায় না, যা আধুনিকতাবাদ করতে চেয়েছিল নানারকম গ্র্যাণ্ডন্যারেটিভ
    (মহাআখ্যান, মহাসন্দর্ভ, মহাগল্প ) দ্বারা । বলা হল যে, গল্পটি অনুযায়ী, ইউরোপ একটি তুলাদণ্ড তৈরি করেছে এবং এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য-সংস্কৃতি জীবনধারাকে তাইতে ওজন করে ফতোয়া দিতে চেয়েছে । ওজন করার পর তাদের মাপে যে বা যা বা যেগুলোকে মনে হয়েছে ইউরোপের, সেই বুড়ি ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একটা একমুখী একরেখ ইতিহাসের নৈতিকতা ও বৈধতা তারা অনুমোদন করেছে । এমনিতেই, একটিমাত্র সংস্কৃতি নামে কিছুই ছিল না উপনিবেশগুলোয় । তার ওপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দাপটে তা হয়ে গেছে যৌগিক, দোআঁশলা, মিশ্রিত, বহুমুখী, বহুরেখ, বহুস্বর ।

    সাম্রাজ্যবাদী শাসনকেন্দ্রটি, আধুনিকতাবাদের মাধ্যমে তৈরি করেছিল একটি জেলখানা, যা আজও বজায় আছে উপনিবেশগুলোয়, এবং ভয়ংকর রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় । এমন জেলখানা, যেখানে, সমস্ত আত্মপরিচয়কে খোপে-খোপে আবদ্ধ করা হয়েছে । কাজী নজরুল ইসলামকে তেমন কোনো খোপে ফেলতে না পারায় দেখা দিয়েছে সমস্যা, কেননা একদিকে আরব ইন্দ্রিয়চেতনার সাহায্যে ও ইসলামের গরিমা আশ্রয় করে তিনি আধুনিকতাবাদকে প্রতিরোধ করেছেন, আরেকদিকে রাঢ় বাংলার সহজ চিত্তবৃত্তি প্রয়োগ করে বহু প্রচলিত ও পপতিষ্ঠিত সীমাগুলোকে অভাবিত তাড়নায় লঙ্ঘন করে গেলেন । অথচ দ্রোহীর অহংটিকে সংজ্ঞায়িত করলেন না । দ্রোহী নজরুল তাঁর প্রান্তিক স্হিতি বজায় রেখেছেন সাম্রাজ্যবাদী শাসনকেন্দ্রটির বিরুদ্ধে আঘাত ঘটিয়ে । আর সাবঅলটার্ন উপসংস্কৃতির সঙ্গে প্রগাঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন ‘শ্মশানকালীর নাম শুনেরে, শ্যামা মায়ের ভেলায় চড়ে, আল্লা রসুল জপের গুণে, বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ’ ইত্যাদি অজস্র লোকায়ত গানের মাধ্যমে ।

    নজরুলের পাঠকৃতি অনুধাবনকালে উত্তরকাঠামোবাদের এই বক্তব্যটিও প্রযোয্য যে, শব্দাবলী বা অভিধাসমূহের নিহিতার্থের উৎস হল আধিপত্যবাদী ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্কের লাগাতার টানাপোড়েন । এই টানাপোড়েনে শব্দ তামাদি হয়ে যায়, কিংবা তার নিহিতার্থ পালটে যায় । যে-বিবাহ বাসর থেকে বরের পোশাক ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি, সেই বিয়ের কনেকে নিয়ে লেখা ‘হিংসাতুর’ শিরোনামটি ওই প্রগাঢ় প্রেমের কবিতাটি এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য । নজরুলের আলোচনা ডায়াক্রনিক নিরিখের পরিবর্তে সিংক্রনিক নিরিখ অনুসারী হলে তাঁকে এবং তাঁর রচনাকে বুঝতে সুবিধে হবে । সিংক্রনিক নিরিখটি পাঠকৃতিটিকে সংস্কৃতি-বিশেষটির জটিলতার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করে । নজরুলের পাঠকৃতিগুলো অনেকানেক সাংস্কৃতিক, নৈতিক, ধার্মিক, নান্দনিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক উপাদানে নির্মিত । তাতে পাওয়া যায় জ্ঞানতাত্বিক ও ভাবাত্মক রেশারেশির অনর্গল দোটানা, মেলবন্ধন, বহুধ্বনিময়তা ।

    ভাষার বাইরের নার তার ভেতরের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা করা যায় না । শব্দ ও বাক্যের মানে বাইরের বস্তুজগতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থেকেই কেবল গড়ে ওঠে না, পাশাপাশি অন্যান্য শব্দ ও অভিব্যক্তির কারণেও শব্দের নিহিতার্থ তৈরি হয় । চিন্তা ও কর্মে প্রোথিত থাকে ভাষা । নজরুলেরও তা-ই ছিল । ছিল তাঁর স্বজন ও পরিচিতের । শব্দার্থ উদ্ভূত হয় সামাজিক প্রসঙ্গভূমিতে । শব্দ ও চিন্তা, শব্দ ও কাজ, শব্দ ও বস্তু, এদের মধ্যে নিহিতার্থের অপরিবর্তনীয় সম্পর্ক যে থাকে না, তা অভিধান খুললেই টের পাওয়া যায় । শব্দ ও অভিব্যক্তি মাত্রেরই থাকে অপার মানে-সম্ভাবনা । অধিপতিরা এই সম্ভাবনাকে খাটান । যে আলোচকরা কাজী নজরুল ইসলামকে নাকচ করে দিতেন, এখনও নাকচ করে দিতে চান, তাঁরাও খাটান এই সম্ভাবনা ।

    বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতারা খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে আধুনিকতাবাদী ঐতিহাসিকতার নকশা প্রয়োগ করে যে গল্পটি লেখার চেষ্টা করেন, তাতে বিভিন্ন কালখণ্ডের একই পথ-বরাবর, তাঁদের নিজেদের পোঁতা মাইল-পাথরের বুড়ি ছুঁয়ে, এগিয়ে যান । সে-পথ, যাদের এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’, এবং রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘উচ্চবর্গ’, তাঁদের চেনাজানা । আশপাশ থেকে যে আরও নানা পথ নানা দিকে চলে যাচ্ছে, যায়, তা তাঁরা খেয়াল রাখেন না, কেননা সেসব পথ, প্রথমত তাঁদের পরিচিত নয়, দ্বিতীয়ত তাঁদের নিরিখ-নকশায় খাপ খায় না, এবং তৃতীয়ত তাঁদের স্বীকৃতি পায় না । সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদ থেকে বিভিন্ন দিকে এগিয়ে গেছে অজস্র সাংস্কৃতিক কাজের মাধ্যমে । ইতিহাস তো অতীত । রেখা টানতে হলে অগুনতি জাতি, গোষ্ঠী, বর্গ, শ্রেণি, ধর্ম, সম্প্রদায়, অঞ্চল, মতাদর্শ সবকিছুর জন্যে বিভিন্ন দিকে টানতে হয় । পেঁপের বীজ থেকে অজস্র পেঁপের বীজ আর তার প্রতিটি থেকে আরও অজস্রের মতন হবে রেখাগুলো । একটিমাত্র তত্ববিশ্বের ধারণাটি ভুল ও তা মানবজাতির পক্ষে ক্ষতিকর । বাঙালি বলতে কেবল কলকাতা-ঢাকার শহরাঞ্চলের অতিশক্ষিত বর্গটিকে বোঝায় না । বলাবাহুল্য যে প্রথমে হিন্দু পরে খ্রিস্টধর্মী মাইকেল, ব্রাহ্ম জমিদার সন্তান রবীন্দ্রনাথ এবং নিম্নবর্গীয় যোদ্ধা মুসলমান ও পরে সর্বসম্্রদায়ি নজরুল ইসলাম একই পথের মাইল-পাথর নন।

    [ রচনাকাল : ১৯৯৬, পরবর্তীকালে, কবিতীর্থ প্রকাশিত ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্হে পরিমার্জিত ]
    রচনাটি লেখার জন্য নজরুলের জীবনী ও গানের বই দিয়ে সাহায্য করেছিলেন কলিম খান ও জাহিরুল হাসান।
    প্রথম প্রকাশিত ঢাকার ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’য় ২০০০ সালে ।
  • m | 012312.60.8923.63 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:১২541296
  • যখন করুণানিধানের সঙ্গে গাঁজা-আফিম-চরসের গুলি ফুঁকতুম
    মলয় রায়চৌধুরী
    করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ছিল হাংরি আন্দোলনের হেনরি মিলার, লেখালিখি বজায় রাখলে ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’-এর আদলে নিজের জীবন নিয়ে একখানা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতো । হেনরি মিলারের মতনই সকাল থেকে উঠে খাবার যোগাড়ের চেষ্টা, কারোর কাঁধে চেপে পরিবারের জন্যে কিছু টাকা যোগাড় করে স্ত্রীকে কিছুকালের জন্যে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে লোপাট হওয়া, বাড়ি মানে একটা মন্দির চত্তর যা কখনও কোনো জমিদারের ছিল আর দেখাশোনার অভাবে করুণার জিম্মায় এসে পড়ে, কোনো যুবতী রাজি হলেই তার সঙ্গে শোয়া, ষাটের দশকের শুরু থেকে বেনারসে হিপিনীদের আস্তানা গাড়তে সাহায্য করা, হিপি-হিপিনীদের জন্যে মাদকের ব্যবস্হা করা, তাদের সঙ্গে শোয়া, মাদকের নেশা করা, ছবি আঁকা, কতো কি যে করেছে করুণা, এমনকি নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে বেনারস ছেড়ে পালিয়েছে । হেনরি মিলারের মতনই নানা গালমন্দ ও নিজেই আবিষ্কার করেছিল, প্রয়োগও করতো কথায় কথায় ।
    করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল ষাটের দশকে, কাঞ্চনকুমার মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে । তারপর সত্তরের দশকে কাঞ্চন যখন নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তখন করুণানিধান আর অনিল করঞ্জাইও যোগ দিয়েছিল, ফলে ওদের বেনারস ছেড়ে রাতারাতি পালাতে হয় ।
    কাঞ্চনকে ওদের বিশাল বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে বেনারস ছাড়তে হয়েছিল । কাঞ্চনের নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হবার কারণে কাঞ্চনের ভাইকে কলকাতা পুলিশের চাকরি ছাড়তে হয়েছিল । বেনারসে গেলে সাধারণত কাঞ্চনদের গ্যারাজের ওপরের ঘরটা ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের জন্য ।
    ব্যাংকশাল কোর্টে আমার মামলার সময়ে কাঞ্চন কলকাতায় এলে ওর পুলিশ ভাইয়ের কোয়ার্টারে রাত কাটিয়েছি অনেকসময়ে, কোয়ার্টারটা ছিল ভবানী ভবনের পেছনে ।
    নকশাল আন্দোলনের কারণে পুলিশ ওদের বেনারসের ছবি আঁকার স্টুডিও লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, ওদের আঁকা পেইনটিঙগুলো নষ্ট করে দিয়েছিল । অনিল এক মার্কিন যুবতীর সঙ্গে পালালো প্রথমে দিল্লি, তারপর দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন ; কাঞ্চনও আমেরিকায় ওর কোনো আত্মীয়ের কাছে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়েছিল ।
    করুণানিধান পাটনায় পালিয়ে এসেছিল আর দাড়ি গোঁফ ভুরু কামিয়ে নাম পালটে সতীশ হয়ে গিয়েছিল। দাদা সমীর রায়চৌধুরী ওকে পাটনায় রঙিন মাছ আর অ্যাকোয়েরিয়ামের দোকান খুলে দিলে করুণা বেনারস থেকে স্ত্রী আর ছেলেকে পাটনায় ডেকে নিয়েছিল । দিব্বি সংসার করেছিল সতীশ নামের আড়ালে, পাটনায় সবাই ওকে সতীশবাবু বলে ডাকতো ।
    নকশাল আন্দোলনের খুনোখুনি শেষ হলে অনিল আমেরিকা থেকে দিল্লিতে ফিরে এসেছিল, মার্কিন স্ত্রীকে না জানিয়ে, জাস্ট বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্লেনে চেপে সোজা কেটে পড়েছিল । অনিলের ডাকে করুণাও পাটনা থেকে সপরিবারে দিল্লি চলে গিয়েছিল । মাছের দোকানটা তখন চালানো আরম্ভ করে দাদার এক শালা, সেও মারা গেছে ।
    কাঞ্চন অবশ্য কলকাতায় থেকে গেল বেনারসের বাড়ি বেচে, নকশাল আন্দোলন ছাড়েনি, একটা পত্রিকাও প্রকাশ করতো, পরে সম্ভবত মাওবাদে আকৃষ্ট হয়েছিল ।
    করুণা আর অনিলের জীবনের কিছু ঘটনা আমি ব্যবহার করেছি আমার “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে । করুণার সঙ্গে পরিচয়ের আগে আমি গাঁজা আর চরস আলাদা ফুঁকেছি, আফিম চেটেছি আলাদা কিন্তু তিনটে মিলিয়ে গুলি বানিয়ে পাইপে ফোঁকার ব্যাপারটা করুণার আবিষ্কার, আর ওর এই আবিষ্কারে ও হিপিদের গুরুস্হানীয় হয়ে গিয়েছিল ।
    প্রথমবার যখন অমন গুলি ফুঁকেছিলুম তখন এই কনককশানের নেশা সম্পর্কে তেমন আইডিয়া ছিল না, কড়া টান দিয়ে চিৎপটাঙ অজ্ঞান হয়ে বেনারসের রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলুম । এল এস ডি ক্যাপসুলও পেয়েছিলুম করুণার দৌলতে, হিপিদের আনা, অনেকসময়ে কাস্টমসকে এড়াবার জন্যে হিপিরা লাইসারজিক অ্যাসিডে ব্লটিং পেপার ভিজিয়ে তারপর শুকিয়ে নিয়ে আসতো ।
    গাঁজা, ভাঙ, চরস, আফিম এগুলোর নেশা করে নেশাগ্রস্ত অবস্হায় লেখালিখি করা যায়, মনের ভেতরে সেই সময়ে যা ঘটছে তা ধরে রাখা যায় । কিন্তু এল এস ডি খেয়ে মনের ভেতর কি ঘটছে তা নেশাগ্রস্ত অবস্হায় লেখা যায় না ; বলা চলে যে নিজের দেহের সঙ্গে কল্পনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কল্পনা অসম্ভব হয়ে ওঠে একথা সত্যি, কিন্তু পরে সমস্তকিছু আর মনে থাকে না, আবছা মনে থাকে । আমার মনে হয় রাসায়নিক মাদকের এটাই গোলমেলে অবদান যা কাজে লাগে না ।
    বেশিরভাগ হিপি তাদের বাবা-মায়ের প্ররোচনায় হিপি হয়ে গিয়েছিল যাতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে না হয় । আমেরিকা থেকে উড়ে অ্যামস্টারডম, তারপর সেখান থেকে হিচহাইক করে গ্রিস তুর্কি ইরাক ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তান হয়ে ভারতবর্ষের বেনারসে । হিচহাইক করার এই পথের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘হিপি ট্রেইল’ । ওদের বাবা-মায়ের পাঠানো ডলার নিয়মিত আসতো অ্যামেরিকান এক্সপ্রেসের মাধ্যমে । এখন তো হিচহাইকের পুরো রাস্তাটাই নানারকমের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ।
    অ্যালেন গিন্সবার্গ বেনারসে থাকার সময়ে করুণাদের স্টুডিওর পাড়া বাঙালিটোলাতে ছিল । অ্যালেনের খবর আমেরিকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এড়াতে হিপি হয়ে যাওয়া যুবক-যুবতীরা বেনারসে এসে ঘাঁটি গাড়ত ; ততোদিনে বিটনিক আন্দোলন ফুরিয়ে গেছে, বিটনিকদের অনেকে যেমন জ্যাক কেরুয়াক, উইলিয়াম বারোজ, ডায়ানা ডি প্রিমা বিটনিক তকমায় বিরক্ত হচ্ছিলেন ; হিপিদের উদ্ভবে তাঁরা বিটনিক তকমা থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পেলেন ।
    যে হেপিরা বেনারসে আসতো করুণা ছিল তাদের গাইড, সব ব্যাপারেই, মণিকর্ণিকা ঘাটে নিয়ে যাওয়া থেকে ভজনসভায় আর বিশেষ করে মাদক সংগ্রহ করার ব্যাপারে, আর হিপিনীদের সঙ্গে শোবার । গর্ভনিরোধক বড়ি ওই সময়েই আবিষ্কার হয়েছিল, আর ফেমিনিজমও তখনই দেখা দিয়েছিল । বহু হিপিনী বডিস পরতেন না। বেনারস তখন বিজেপির ঘাটি হয়ে ওঠেনি ।
    তখনকার দিনে সত্যমেব জয়তে ছাপমারা গাঁজা-আফিম-চরসের পুরিয়া সরকারি দোকানে পাওয়া যেতো ; খালাসিটোলার পাশেও একটা দোকান ছিল ; আমেরিকার চাপে আশির দশকে বন্ধ হয়ে যায় । অথচ এখন আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে গাঁজা বা মারিহুয়ানা ফোঁকায় আইনের বাধা তুলে নেয়া হচ্ছে ।
    বেনারসে যে হিপিরা আসতো তারা নেপালে যাবার পথে পাটনায় আমাদের বাড়িটাকে হলটিং স্টেশন করে দিন কয়েক থেকে তারপর কাঠমাণ্ডু রওনা হতো, গঙ্গা পেরিয়ে শোনপুরে গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে রকসওল তারপর রিকশায় বসে বর্ডার পেরিয়ে বাসে করে নদীর ধার দিয়ে কাঠমাণ্ডু । হিপিদের এই আসা-যাওয়ার সঙ্গে আমার মা মানিয়ে নিয়েছিলেন, যদিও তাঁর ভীতি ছিল যে আমি কোনো হিপিনীকে আঁকড়ে দেশ থেকে কেটে না পড়ি ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমরা যে দল বেঁধে নেপালে গিয়েছিলুম তার উদ্যোগ নিয়েছিল করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ও আগেই একজন হিপিকে নিয়ে কাঠমাণ্ডু চলে গিয়েছিল, তারপর সেখান থেকে এই চিঠিটা লিখে আমাদের ডাক দিয়েছিল, আমরা লোভ সামলাতে না পেরে ছুটেছিলুম কাঠমাণ্ডু ; মনে আছে কাঞ্চন বাসে বমি করতে করতে গিয়েছিল আর একজন অচেনা নেপালি বউ ওকে শাদা গুঁড়ো কিছু খাইয়ে-খাইয়ে সামলেছিল।
    কাঠমাণ্ডু
    ১১ এপ্রিল ১৯৬৬
    মলয়, হুররেরেরে
    এই ঠিকানায় চিঠি দাও বা প্রভাতীর চিঠি এলে সেই চিঠিকে রিডাইরেক্ট না করে আর একটা খামের মধ্যে পুরে নতুন ভারতীয় স্ট্যাম্প লাগিয়ে পাঠাও ।
    কী করে আসতে হবে চার্ট পাঠালাম ।
    সমীরকে চিঠি দিয়েছি । অনিলকেও ।
    কাল থেকে বেরিয়ে পড়ব বার্তা নিয়ে ।
    এখানে সেই যে বালিশের নিচে মুড়ি দিয়ে র‌্যাঁবো পড়ে, সেই ঘি ( গাই )-এর সঙ্গে দেখা -- ওর ওখানেই উপস্হিত ।
    দারুণ ব্যাপার ।
    তাড়াতাড়ি এসো ।
    লুণ্ড হয়ে থাকা যাক কিছুদিন ।
    অফুরন্ত চরস আর মেয়েছেলে ।
    আন্ডারগ্রাউণ্ড আর ওভারগ্রাউন্ড মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন ছেলে আর মেয়ে -- একেবারে গিজগিজ করছে । শিগগির এসো, আমি হাংরি হ্যাপেনিং করার তালে আছি । পরে মোটা খাম পাঠাচ্ছি ।
    করুণানিধান মুখোপাধ্যায়
    করুণার চিঠিতে পরের মোটা খামের যে উল্লেখ রয়েছে তাতে করে আফগানি চরস পাঠিয়েছিল । করুণা চাকরিবাকরি কিছুই করতো না, হিপিরা বেনারসে আসার আগে ও হিন্দি পত্রিকা আর বইয়ের মলাট এঁকে রোজগার করতো, তাও সেগুলো পাইয়ে দিতো অনিল করঞ্জাই ।
    করুণার আরেকটা চিঠি :-
    প্রিয় মলয়,
    হঠাৎ আফগানি মাল কিছুটা পেয়ে গেলাম বেশ খানিকটা । বিলি করা শুরু করেছি, তোমায় পাঠালাম, চাপ দিলেই গুঁড়ো, সিগারেট পাইপ ছিলিম যাতে খুশি খেতে পারো । মালের প্রাপ্তি সংবাদ দিও ।
    হঠাৎ আমার এক অ্যালসেশিয়ান বন্ধুর সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলাম । সুবিমলের আস্তানায় ছিলাম । সুবিমল, সুভাষ, ফালগুনী, শম্ভু রক্ষিত, ত্রিদিব, আলো আর দেবীও পীড়াপীড়ি করে জুটেছিল খালাসিটোলায় । মাতাল অবস্হায় জেনারেশনের সবাই গড়াগড়ি দিয়েছিল, দেবী ছাড়া ।
    আজকার ভীষণ একটা যা-তা, বিশ্রী, দারুণ গালাগালি দিয়ে নিজের নোংরামিগুলো বমি করতে ইচ্ছে করছে । লেখাটা সেই নিয়ে চলছে । আমি অনিল একটা পত্রিকা বের করার তালে আছি, তোমার কানে পৌঁছে থাকবে । ভালোবাসা---
    করুণা
    ( তারিখ মনে নেই )
    পেইনটার হিসেবে অনিল তখন থেকেই নামডাক করে ফেলেছিল, পরে ১৯৭২ সালে অনিল ললিতকলা অ্যাকাডেমির পুরস্কারও পেয়েছিল, কিন্তু নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগের ইতিহাসের জন্য অন্য পেইনটাররা ওকে এড়িয়ে যেতো ।
    হিপিরা বেনারসে আসার পর করুণা ওদের গাইড আর ভারতীয় মাদকের ঘোঁতঘাঁতের খবর দিয়ে ভালোই উপার্জন করতো । হিপিনীদের সঙ্গেও বেশ জমে যেতো ওর সম্পর্ক । ওর স্ত্রী প্রভাতী কোনো আপত্তি করতেন না, সম্ভবত এই জন্যে যে প্রভাতীকে করুণাই আশ্রয় দিয়ে বিয়ে করেছিল আর সেকারণে করুণা বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমি প্রথমবার যখন বেনারসে যাই তখন করুণা বাড়ি ছেড়ে একজন হিপিনীর সঙ্গে বেনারসের গঙ্গার চরে কুটির বানিয়ে দুজনে উলঙ্গ অ্যাডাম আর ইভ হয়ে জীবন কাটাচ্ছিল, ওদের দুজনের উলঙ্গ ফোটো তোলাতেও আপত্তি ছিল না । বস্তুত ওদের দুজনকে উলঙ্গ অবস্হায় দেখে আমিই বিব্রত বোধ করছিলুম । করুণা মাঝে-মধ্যে সকালের দিকে বাড়ি গিয়ে প্রভাতীকে খরচ দিয়ে আসতো ।
    নেপালে আমরা ছিলুম ঘর ভাড়া করে, বিছানা ছিল খড়ের, তার ওপর চাদর পাতা, মাসে মাথাপ্রতি এক টাকা । বিশাল একটা চালাঘরের প্রাসাদে, পাকানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হতো । আমি বহুবার নেশা করে ফেরার পর ঘর গুলিয়ে ফেলেছি । একবার ওপরে উঠে নিচে নেমে কয়েকবার ওঠা-নামা করার পর একটা ঘর থেকে মেয়েলি হাতের হ্যাঁচকা টানে সেই ঘরের মহিলাটির ঘাড়ে পড়ে টের পাই যে সেটা শুঁড়িখানা আর বেশ্যালয় দুটোই একসঙ্গে। বউটি বলেছিল, “রোজ দেখি দরোজা পর্যন্ত এসে ফিরে যাও।” যে মদ ওই শুঁড়িখানায় বিক্রি হতো তার নাম রাকসি, কাঁচা মোষের মাংস চটকে রাকসির সঙ্গে খাওয়া হতো । নেপালের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাই “খেউড়” নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করার তোড়জোড় করেছিল কিন্তু তা ভেস্তে যায় সুভাষ-শৈলেশ্বরদের “আমরা উদ্বাস্তু -আমরা আলাদা” গ্রুপবাজির জন্য । পরে করুণা ‘সানপাকু’ নামে একটা পত্রিকা বের করবে ভেবেছিল, তাও ভেস্তে যায়, খেয়োখেয়ির কারণে ।
    অনেকে দেখি হাংরি আন্দোলন বিষয়ে লেখালিখির সময়ে সুভাষ-শৈলেশ্বরের সঙ্গে আমার আর ত্রিদিব মিত্রের ঝগড়াকেই গুরুত্ব দেন, আমাদের লেখালিখি নিয়ে আলোচনা করেন না । এই অশিক্ষিত ইডিয়টগুলো জানে না যে দুই বন্ধু কার্লোস ফুয়েন্তেস আর ওক্তাভিও পাজের ঝগড়া সারাজীবনে মেটেনি, নরম্যান মেইলার ঘুষি মেরে ছিলেন গোর ভিডালকে, সালমান রুশডি আর জন আপডাইকের ঝগড়া সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় জায়গা করেছিল, হেনরি জেমস আর এইচ জি ওয়েলসের ঝগড়া তো কিংবদন্তি, জোসেফ কনর‌্যাডের সঙ্গে ডি এইচ লরেন্সের জোর বিবাদ হয়েছিল, জন কিটসের সঙ্গে লর্ড বায়রনের হয়েছিল, চার্লস ডিকেন্স আর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসনের বিবাদ হয়েছিল, ঝগড়ার সময়ে মারিও ভারগাস য়োসা নাকে ঘুষি মেরেছিলেন গ্যাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেজের। কিন্তু এনাদের লেখালিখি বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা কেউই তাঁদের পরস্পরের ঝগড়াঝাটিকে গুরুত্ব দেন না ।
    আঁদ্রে ব্রেতঁ কতোজনকে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেগুলো তো আলোচিত হয় না, যা আলোচিত হয় তা হল সুররিয়ালিস্টদের আঁকা আর লেখালিখি । অ্যালেকজান্ডার পুশকিন সতেরোবার ডুয়েল লড়েছিলেন এবং ডুয়েল লড়তে গিয়েই মারা যান, কিন্তু এগুলো পাঠকরা আলোচনা করেন না, তাঁরা পুশকিনের কবিতা আলোচনা করেন । মার্ক টোয়েন এক সংবাদপত্র সম্পাদকের সঙ্গে পিস্তলের ডুয়েল লড়তে গিয়েছিলেন সম্পাদক মশায় তাঁর বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বলে, কিন্তু মার্ক টোয়েন আলোচনার সময়ে তাঁর এই ডুয়েলের কথা আলোচিত হয় না, আলোচিত হয় “দি অ্যাডভেঞ্চারস অফ টম সোয়্যার” কিংবা “অ্যাডভেঞ্চারস অফ হাকলবেরি ফিন” ।
    করুণা আর অনিল ওদের পত্রিকা ছাপানোর কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে ওদের আঁকা স্কেচ ছিল । সুবিমল বসাকও স্কেচ এঁকে দিয়েছিল । সুভাষ-শৈলেশ্বরের দলবাজির কারণে সব ভেস্তে যায় । তারপর করুণা-অনিলের আস্তানায় নকশাল আন্দোলনের সময়ে যখন পুলিশের রেইড হল তখন সব ছত্রাখান হয়ে যায় । আমি অনিলের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়েট রেনোল্ডসকে জিগ্যেস করেছিলুম যে ওদের সেই সময়ের কাগজপত্র ছবি ইত্যাদি কিছু আছে কিনা ; জুলিয়েট এখন দিল্লিতে থাকেন, ফেসবুকে অনিলের আঁকা পেইনটিঙের একটা কমিউনিটি পেজ খুলেছেন । উনি জানিয়েছিলেন যে কিছুই নেই, পুলিশ সবই নষ্ট করে দিয়েছিল । জুলিয়েট এসেছিলেন আয়ারল্যাণ্ড থেকে, ভারতীয় শিল্পকলা বিষয়ে গবেষণার জন্য ।
    করুণা “সানপাকু” নামে নিজের জীবন থেকে টুকরো-টাকরা নিয়ে ফিকশান লেখা আরম্ভ করেছিল, তার প্রথম পাতা কেবল আছে কেননা তা কোনো হাংরি বুলেটিন বা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । করুণার লেখার হাত সম্পর্কে ওর এই গদ্যটা পড়লে ধারণা করা যাবে :-
    জন্মমৃত্যু সম্পর্কে
    আজ ভোর ৬.৪৫ মি. আমার একমাত্র ছেলে আরক মারা গেলো । ব্রংকোনিমোনিয়া ।
    আমি ওকে একা নিয়ে চলে গেলাম নদীর ওপারে বালিয়াড়িতে ।
    বসে বসে অনেক কিছু ভাবলাম । তারপর ওর গায়ের সঙ্গে ভারি পাথর বেঁধে মাঝগঙ্গায় ফেলে দিলাম । পাথর খুঁজতে প্রায় দুঘণ্টা লেগে গেলো ।
    বাড়ি ফিরে এসেছি । আমার বৌ ভীষণ কাঁদছে । মানুষের সেন্টিমেন্ট নষ্ট করার মতো আমার কাছে কিছুই নেই ।
    আজ দুপুরে অফুরন্ত সময় ছিল ।
    আমার জন্ম কাশীতে । বাবা তখন আই এন এতে নেতাজির গ্রুপে । তারপর পঁচিশ বচর যখন, বাবা আমায় নিয়ে যান রেংগুনে ।
    আই এন এ ছেড়ে দিয়ে বাবা পুলিশে চাকরি নেন । রেংগুনে একনাগাড় প্রায় ১০ বছর ।
    তারপর সাইরেন, ব্ল্যাকআউট,
    সংবাদপত্রের হেডলাইন, হাসপাতাল । জাহাজে চেপে বর্মা থেকে সোজা খিদিরপুর ।
    খিদিরপুর থেকে আবার কাশী ।
    জানতে পারলাম বাবা কোনো বার্মিজ মেয়েকে বিয়ে করেছেন । সেই থেকে
    সমাজের বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে
    লড়াই ।
    লেখাপড়া হলো না । ক্লাস টেনে পৌঁছে বাবার বাবার টাকা বন্ধ হয়ে গেল ।
    তখন থেকেই আমি নেমে গেলাম ।
    হেল্প ! হেল্প !! হেল্প !!!
    ছোটোবেলায় আঁকার ঝোঁক ছিল । ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিলাম । ছবি আঁকতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে গেল ।
    কাশীতে একটা ঘর ভাড়া করে নিজের স্টুডিও করলাম ।
    ছবি দেখে লোকে পাগল বলতে লাগল । বাড়ির লোকে মা বোন সকলেই পাগল বলে বাড়ি থেকে বের করে দিলো ।
    আমি বাড়ির বড়ো ছেলে ।
    ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে একজন কায়স্হ মেয়েকে বিয়ে করলাম ।
    অব্রাহ্মণ বলে বাড়িতে ঢুকতে পাই না ।
    কেই নেই । কেউ নেই ।
  • | 012312.60.90034.197 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৫২541297
  • হাংরি আন্দোলন ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়
    মলয় রায়চৌধুরী
    দাদা সমীর রায়চোধুরী, তাঁর বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি চাইবাসায় দাদার নিমডি পাহাড়টিলার চালাবাড়িতে দু’বছরের বেশি ছিলেন, আমি, এবং আমার বন্ধু দেবী রায়, আমরা চারজন ১৯৬১ সালের নভেম্বরে, পাটনায় আমাদের বাড়িতে বসে কয়েকদিনের আলোচনার পর নির্ণয় নিই যে আমরা উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের প্রেক্ষিতে “হাংরি আন্দোলন” নামে একটা আন্দোলন আরম্ভ করব, যার রূপরেখা আমি আগেই ছকে রেখেছিলুম, তা অন্য তিনজনকে বোঝাই, এবং তাঁরা রাজি হন । “হাংরি” শব্দটা আমি পেয়েছিলুম জিওফ্রে চসারের কবিতার লাইন In Sowre Hungry Tyme থেকে এবং তাত্ত্বিক বনেদ গড়েছিলুম ইতিহাসের দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের The Decline Of The West বই থেকে । উপস্হিত তিনজনই তা অনুমোদন করেন । ঠিক হয় যে প্রতি সপ্তাহে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হবে, আর তা কলকাতার কফিহাউস, কলেজ, সংবাদপত্র দপতর ইত্যাদিতে ফ্রি বিলি করা হবে, তার খরচ আমি আর দাদা দেবো ।
    কলকাতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাদের চেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন বলে তাঁকে নেতৃত্ব নিতে বলা হয়, এবং তিনি তৎক্ষণাত রাজি হন । হাওড়ায় দেবী রায় যে বস্তিবাড়িতে থাকতেন, তাকেই প্রকাশকের ঠিকানা হিসাবে ঘোষণা করা ঠিক হয়, কেননা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোনো নির্দিষ্ট আস্তানা ছিল না, কলকাতার উল্টোডাঙার যে বস্তিতে উনি থাকতেন সেখানে কেউ যাক তা চাইতেন না, এবং তিনি দাদার শ্যালিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের গভীর প্রেমে পড়েছিলেন বলে, অধিকাংশ সময়ে চাইবাসাতেই থাকতে চাইতেন ; দাদা লম্বা ট্যুরে গেলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মধুটোলায় নিজের শশুরবাড়িতে অতিথি হিসাবে রেখে যেতেন । একবার দাদা চাকুরিসূত্রে সামুদ্রিক জাহাজে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন, বেশ কয়েক মাসের জন্য, তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার শশুরবাড়িতে এতোদিন ছিলেন যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর খোঁজে এসে অবাক হয়ে বলেন, “তুই এখানে ইস্টিশান পুঁতে ফেলেছিস ?” তাঁর প্রেমিকা কলেজে পড়তে গেলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ফিরে আসার রাস্তায় কোনো গাছতলায় দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ অপেক্ষা করতেন ।
    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্হ “হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য” এই প্রেমের ফসল । তার আগে তিনি ঔপন্যাসিক হবার কথা ভাবছিলেন, উপন্যাস লিখে টাকা রোজগারের আশায় ; “কুয়োতলা” ( রচনাকাল ১৯৫৬-৫৭; প্রকাশিত ১৯৬১ সালে ) নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপু চরিত্রের সঙ্গে তাঁর নিজের মিল ও প্রকৃতির বর্ণনায় তাঁর নিজের বহড়ু গ্রামের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে । তারপরেও তিনি “কুয়োতলা” গ্রন্হের নায়ক নিরুপমকে নিয়ে একাধিক উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু “কুয়োতলা”র পর্যায়ের লিখতে পারেননি একটিও, ততদিনে তাঁর সৃজনশীল একাগ্রতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে কবিতায়, এবং একের পর এক অসাধারণ কবিতা লিখে গেছেন ।
    শক্তি চট্টোপাধ্যায় মদ খেতে ভালোবাসতেন ; চাইবাসার মধুটোলায়, মধ্যবিত্ত বাড়ির তরুণীর সঙ্গে প্রেম করার সময়েও তাঁর অভ্যাস ছাড়তে পারেননি, তাঁদের বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকার সময়েও মহুয়ার মদ আর আদিবাসী হাটের হাড়িয়া খেয়ে ফিরেছেন । মাতাল বলতে যা বোঝায়, তা উনি হতেন বলে মনে হয় না আমার, পোশাকে মদ ছিটিয়ে মাতালের অভিনয়ও করতে দেখেছি ওনাকে ।
    ১৯৬৩ সালে উনি যে হাংরি আন্দোলন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন, তার দুটি কারণের একটি হল, প্রেমিকাকে বিয়ে করতে না পারা, এবং সেই ব্যাপারে দাদা সমীর রায়চৌধুরী আর আমার হাত ছিল বলে ওনার ঘোর সন্দেহ । নিজের প্রেম নিয়ে লেখা “কিন্নর কিন্নরী” ( ১লা বৈশাখ ১৩৮৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ) উপন্যাসে, যে বইতে তিনি নিরুপম-এর বদলে পার্থ নাম দিয়েছেন নায়ককে, তাতে হদিশ দিয়েছেন অন্যের ষড়যন্ত্রের । অনেকে প্রশ্ন তোলেন যে প্রেমিকাকে না পাওয়ার জন্য হাংরি আন্দোলনের বিরোধীতা, আর আমার বিরুদ্ধে মামলায় পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হলেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ? আমার বক্তব্য হল যে ষাঠ বছর আগের যুবক-যুবতীরা প্রেমে ব্যর্থ হলে অমনধারাই আচরণ করতেন, এখনকার যুবক-যুবতীদের পক্ষে যা বুঝে-ওঠা সম্ভব নয় ।
    চাইবাসা থেকে কলকাতায় ফিরে তিনি রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে চারটি ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি লিখেছিলেন : “অম্বা ও দেবব্রত”, “রামচন্দ্র ও শর্বরী”, “সোম ও তারা” এবং “অর্জুন ও উত্তরা” । হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে সাহিত্যে ধরে রাখার জন্য ১৩৮১ বঙ্গাব্দে তিনি “হৃদয়পুর” নামে একটি উপন্যাস লেখেন, যার নায়ক নিরুপম বাড়ি থেকে রাজপথে বেরিয়ে সামনে যা দেখে, মানুষসুদ্দু লাল মোটরগাড়ি, বাসের কাচ, জুতোর দোকান থেকে জুতো, বিশাল নমুনা-কলম, বিশাল নমুনা-ফুটবল, চারফুট লম্বা মদের বোতল, তা-ই খেতে থাকে ।
    প্রেমিকাকে না পেয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি যদি বেকার না হতেন, এবং সাহিত্যিক হিসাবে খ্যাত হতেন, তাহলে সমীর রায়চোধুরীর শশুর তাঁকে জামাই হিসাবে স্বীকৃতি দিতেন । ১৯৬৩ সালেই তিনি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় দপতরে চাকরির আহ্বান পেলেন, শর্ত ছিল যে তাঁকে হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করতে হবে । তিনি যে হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেছেন তা প্রমাণের জন্য এক সন্ধ্যায় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সামনে কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে, যে দলে সেই পত্রিকার সাংবাদিকও ছিলেন, ঘিরে ধরলেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার সুবিমল বসাককে । সে এক কেলেঙ্কারি দৃশ্য, মাতালের কুখ্যাতিকে ভাঙিয়ে নেবার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কীই বা হতে পারে । সেসময়ে সুবিমল বসাকের চেহারা ছিল কুস্তিগিরের, তাই তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, পারস্পরিক হুমকি ছাড়া ।
    ১৯৬২ সাল জুড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলন নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহান্বিত ছিলেন, এটি যে একটি জলবিভাজক আন্দোলন হিসাবে দেখা দিয়েছে, তাও মেনে নিয়েছিলেন, অশোক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “সম্প্রতি” পত্রিকায় হাংরি আন্দোলন নিয়ে একটা ছোটো লেখাও লিখেছিলেন, আমার ব্যাখ্যা করা অসওয়াল্ড স্পেংলারের বক্তব্যকে সম্প্রসারিত করে, অর্থাৎ “সভ্যতা ও সংস্কৃতি হল জৈব প্রক্রিয়া, কোন দিকে তার বাঁকবদল ঘটবে তা আগে থাকতে বলা যায় না ; একটি সংস্কৃতির অবসান সেই পর্যায়ে আরম্ভ হয়, যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে সংস্কৃতিটি নির্বিচারে যা পায় তা-ই খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। হেগেলের এই তর্কটি ভুল যে ইতিহাস যুক্তিসংগতভাবে একটি রেখা বরাবর এগোয়।”
    “কৃত্তিবাস” গোষ্ঠীর যে কবি-লেখকরা হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার প্রমুখ, তাঁরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ডাকেই যোগ দিয়েছিলেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেসময়ে শেয়ালদার কাছে একটা কোচিং ক্লাস চালাতেন, সেখানে পড়াতেন বাসুদেব দাশগুপ্ত, তিনিও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ডাকে হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ , প্রায় প্রতিটি বুলেটিনে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতো । অন্যান্য যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা এসেছিলেন সুবিমল বসাক ও দেবী রায়ের ডাকে ।
    আমার লেখা প্রথম ইংরেজি বুলেটিনে আনন্দ বাগচী ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার সমালোচনা ছিল, যা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পছন্দ হয়নি ; তিনি উষ্মা প্রকাশ করায় বুলেটিনটি দ্বিতীয়বার প্রকাশ করা হয়, বিতর্কিত প্যারাটি বাদ দিয়ে । রাজনৈতিক ইশতাহারে ( ১৫ নং ) একটা ঘোষণা সম্পর্কেও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন উনি, এই তর্কবিন্দুটি নিয়ে কবি কৃষ্ণ ধর পর-পর দু’দিন প্রধান সম্পাদকীয় লিখেছিলেন “যুগান্তর” সংবাদপত্রে । ঘোষণাটি ছিল এরকম : “বেশ্যার মৃতদেহ এবং গর্দভের লেজের মাঝামাঝি কোথাও সেই স্হানটি দেখিয়ে দেয়া হবে, যেটা বর্তমান সময়ে একজন রাজনীতিকের।” বুলেটিনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর প্রতি আক্রমণ আমরা যতো বাড়িয়ে তুলেছি, উনি ততো অস্বস্তি বোধ করেছেন ।
    ১৯৬৪ সালে আমাকে ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে আমেরিকার আইওয়া পোয়েট্রি ওয়র্কশপ থেকে লেখা চিঠিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরোপ করেছিলেন যে “কৃত্তিবাস” গোষ্ঠীকে ভেঙে দেবার জন্যই আমরা ষড়যন্ত্র করে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেছি ; অমন চিঠি সম্ভবত শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও লিখে থাকবেন। বলা বাহুল্য যে “কৃত্তিবাস”কে আমরা ঔপনিবেশিক সাহিত্যতন্ত্রের একটি পত্রিকাগোষ্ঠী বলে মনে করতুম, আন্দোলন নয় বা ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কাউন্টার ডিসকোর্স নয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে হাংরি বুলেটিনে আমিই প্রকাশ করেছি, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অ্যালেন গিন্সবার্গকে বুঝিয়েছিলেন যে আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে ইংরেজি কবিতা লিখিয়ে তাঁর প্রতিভাকে খর্ব করছি । “কৃত্তিবাস” একটি পত্রিকা, এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরও তা প্রকাশিত হয়ে চলেছে ।
    ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে এগারোজন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে ১২০বি এবং ২৯২ ইনডিয়ান পিনাল কোডের ধারায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোয়, তাঁরা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, এবং আমি । কিন্তু গ্রেপ্তার হই আমি, দেবী, শৈলেশ্বর, সুভাষ, প্রদীপ আর দাদা । উৎপল গ্রেপ্তার হননি, কিন্তু যোগমায়া দেবী কলেজে তাঁর অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন । প্রদীপ চৌধুরী বিশ্বভারতী থেকে রাস্টিকেট হন । আমাকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে বাড়ি থেকে থানা আর থানা থেকে আদালতে সাতজন চোর-ডাকাতের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ।
    লক্ষণীয় যে এফ আই আর-এ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম ছিল না । কিন্তু হাংরি আন্দোলন থেকে নিজের দূরত্ব প্রমাণ করার জন্য তিনি যেচে লালবাজারে গিয়ে পুলিশের কাছে আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন, এবং ব্যাংকশাল কোর্টে হাংরি মামলায় আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন । আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিয়ে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষও, কিন্তু তাঁরা তা করেছিলেন মামলা থেকে অব্যহতি পাবার জন্য । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের তো তেমন পরিস্হিতি ছিল না । দাদা সমীর রায়চৌধুরী মনে করেন যে, ব্যর্থ প্রেমের প্রতিশোধ ছাড়াও, হাংরি আন্দোলনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণকারী হয়ে থাকার প্রতি তাঁর দৃষ্টিকোণ বদলে দিয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাবোধ, সংবাদপত্রে চাকরির শর্ত, কলকাতায় পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক, এবং প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতির চাপ । ব্যাংকশাল কোর্টের জজসাহেব আমাকে একমাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন পুলিশ পক্ষের সাক্ষী আর রাজসাক্ষীদের দেয়া সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে ।
    শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হয়েছেন জানার পর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তৎক্ষণাত আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে রাজি হন ; তার আগে তিনি সাক্ষ্য দেবেন না বলেছিলেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চেকমেট !
  • m | 012312.60.90034.197 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:৪৯541298
  • প্রবন্ধ : ঈশ্বরচন্দ্রের পাকিস্তানিফিকেশান
    মলয় রায়চৌধুরী
    যখন কলকাতায় নাকতলায় থাকতুম তখন ঢাকা থেকে মাঝে-মাঝে ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার’ সম্পাদক মীজানুর রহমান, কলকাতা শহরে এলে, অবশ্যই আমার তিন তলার ফ্ল্যাটে আসতেন, আশি বছর বয়সে, পুরোনো-কেতা বাড়ির তিন তলায়, সস্ত্রীক, ঊঁচু-উঁচু সিঁড়ি ভেঙে ।
    মীজানুর সাহেব নিয়মিত আমার লেখা প্রকাশ করতেন ওনার পত্রিকায়, ছোটো ভাইয়ের মতন ভালোবেসে ফেলেছিলেন আমাকে । আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ ওনার পত্রিকাতেই ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল । শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওনাকে শামসুর রাহমানের মাধ্যমে ‘হাংরি কিংবদন্তি’র ধারাবাহিক প্রকাশনাটা বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন ; উনি বন্ধ তো করেনইনি, উলটে শক্তি আর সুনীলের কার্টুন ছেপেছিলেন। মীজানুর রহমান ওনাদের ইশারায় ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে একটা উপন্যাস দিতে বলেন, এবং আমার ‘নামগন্ধ’ ওনার পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । উনি ‘নামগন্ধ’ বই হিসাবেও বের করেছিলেন, অত্যন্ত উন্নতমানের কাগজ, প্রচ্ছদ এবং ছাপা, কলকাতা বইমেলায় যতোগুলো কপি পাঠিয়েছিলেন সবই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ।
    মীজানুর রহমানের পরিচিত এক যুবক, যিনি ‘বিদ্যাসাগর সোসায়টি অব বাংলাদেশ’ -এর পরিচালক ছিলেন, নাম এক্ষুনি মনে পড়ছে না, তিনি নাকতলার বাড়িতে আসতেন, মীজানুর সাহেবের পত্রিকা নিয়ে এবং ওনার সোসায়টি কী কাজ করছে তা জানাবার জন্য, সঙ্গে ফোটো অ্যালবামও নিয়ে আসতেন, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ওনার সোসায়টির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ফোটো । উনি সিপিএম নেতাদের সঙ্গেও দেখা করতেন আলিমুদ্দিনে গিয়ে, যাতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন তাঁর সোসায়টিকে আর্থিক এবং সাংগঠিনিক সাহায্য করতে ।
    একবার এসে তিনি জানালেন যে তাঁকে ‘ইণ্ডিয়ার এজেন্ট’ এবং ‘হিন্দুদের দালাল’ বলা হচ্ছে, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তিনি কাজ করছেন বলে, তাঁকে মারধরের হুমকিও দেয়া হয়েছে । তার কিছুকাল পর, তিনি আমার ফ্ল্যাটে আসা বন্ধ করে দেবার পর অনুমান করতে পারলুম যে তিনি নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছেন, কেননা ইতিমধ্যে হুমায়ুন আজাদ পাকিস্তানপন্হীদের রামদা আর কাটারির ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মারা যান । একের পর এক প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্লগার যখন খুন হতে থাকলেন, তখন নিশ্চিত হলুম যে ‘বিদ্যাসাগর সোসায়টি অব বাংলাদেশ’-এর নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়া অনিবার্য ।
    মীজানুর রহমান যখন শেষবার আমার নাকতলার ফ্ল্যাটে আসেন তখন জানতে পারি যে পাকিস্তানপন্হী বাংলাদেশিদের হুমকির কারণে ‘বিদ্যাসাগর সোসায়টি অব বাংলাদেশ’ সংগঠনটি তুলে দেয়া হয়েছে । অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের পাকিস্তানিফিকেশান সম্পূর্ণ । পিএইচডি এম-ফিল ছাত্ররা পাকিস্তানপন্হীদের ভয়ে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আর গবেষণা করতে চান না । কে-ই বা বেঘোরে পপাণ দিতে চায় ।
    মীজানুর রহমান বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৯৭ সালে, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার, এপ্রিল-জুন মাসে । সেই সংখ্যায় গবেষক মোহম্মদ আবদুল হাই লিখেছিলেন যে, “পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী বিদ্যাসাগরকে চিহ্ণিত করেছিল ‘ব্রিটিশপোষ্য’ বাংলা ভাষাকে ‘সংস্কৃতায়ন’ করার প্রধান পুরোধা হিসাবে । তিনি লিখেছিলেন যে, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর আমাদের আলোচনা-সমালোচনায় নতুন কোনো মাত্রালাভ করেননি । লেখক গবেষক শিক্ষার্থিদেরও বিদ্যাসগরকে নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই । বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বিগত ছাব্বিশ বছরে এম-ফিল পি-এইচডি পর্যায়ে যতোগুলি গবেষণামূলক কাজ হয়েছে তাতে বিদ্যাসাগর স্হান লাভ করেননি । ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র, সাহিত্য সংকলন, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী ইত্যাদি কাঙ্খিত ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না । তিনি আরও বলেছেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে, ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বিদ্যাসাগর কদাচিৎ স্হান লাভ করেছেন । বাংলাদেশর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেনি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়, সংকলন কর্তারা বিদ্যাসাগরকে স্বাধীনতা-পূর্বকালের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে সক্ষম হননি ।”
    এক কথায় বলতে গেলে বিদ্যাসাগর আর পড়ানো হয় না বাংলাদেশে, তাঁর কাজ নিয়ে গবেষণাও হয় না, তাঁকে স্মরণ করা হয় না, পাকিস্তানি আমলের চেয়েও বেশি বিদ্যাসাগর-বিরোধী হয়ে গেছে বাংলাদেশের এসট্যাবলিশমেন্ট, প্রধানত রাজনৈতিক মৌলবাদীদের চাপে, যখন কিনা একুশে ফেব্রুয়ারির লড়াইটা বিদ্যাসাগরের গড়ে দেয়া বাংলা ভাষার লড়াই ছিল, সেই ভাষার লড়াইটা ছিল বাঙালির নবজাগরণের প্রসার, যে নবজাগরণের হোতাদের অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । বস্তুত বিদ্যাসাগরের অবদান ছাড়া একুশে ফ্রেব্রুয়ারি সম্ভব হতো কিনা বিতর্কের বিষয় ।
    স্কুল ও কলেজপাঠ্য পুরোনো বইগুলোয় তাঁর রচনা অন্তর্ভুক্ত হলেও, সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হন না ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । বাংলাদেশে সম্প্রতি আরও লেখক-কবিদের বাদ দেয়ার কাজ চলছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনা বাদ দিয়ে পাঠ্যপুস্তকে মৌলবাদী চিন্তাধারা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে । এর প্রতিবাদে হাইকোর্টে জনস্বার্থ রিট দায়ের করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন ও পাঠ্যপুস্তক বিশেষজ্ঞ মমতাজ জাহান । সেই আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট রুল জারি করে জানতে চেয়েছে কেন এই পরিবর্তন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না । রিটের পক্ষের আইনজীবিরা জানিয়েছেন, কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কিছু প্রখ্যাত লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে । সেই তালিকায় বাদ পড়েছেন খোদ লালন শাহ, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এস ওয়াজেদ আলি, উপেন্দ্রকিশোর, সঞ্জীবচন্দ্র প্রমুখ ।
    বিদ্যাসাগর আগে থাকতেই বাদ গিয়েছিলেন ।
    পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বাদ দেবার একটা যুক্তি আছে । তা হলো ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তানে এবং তারপর স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে বহু প্রবন্ধকার, ঔপন্যাসিক ও কবি আবির্ভূত হয়েছেন । স্কুল ও কলেজে তাঁদের কবিতা ও গদ্য অন্তর্ভুক্ত করার একটা চাপ তৈরি হয়ে থাকবে । তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কয়েকজনের লেখা সরিয়ে ফেলতে হবে । কিন্তু তা করতে গিয়ে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক হেফাজতে ইসলামের দাবির কাছে বাংলাদেশি এসট্যাবলিশমেন্ট আত্মসমর্পণ কেন করবে সেটা বুঝে ওঠা তেমন কিছু কঠিন নয় । ভারতে আসামে ২০১৭ সাল থেকে স্কুলগুলোয় রবীন্দ্রজয়ন্তীর ছুটি তুলে দেয়া হয়েছে । উত্তরপ্রদেশে স্কুল ও কলেজে ইংরেজি সিলেবাসে ব্রিটেনের কবিদের বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে ।
    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং সেই সময়ের অন্যান্য হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি আলোচকদের অভিযোগ যে তাঁরা বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন করে দিয়েছেন এবং তা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের মুক্তি প্রয়োজন ; সেই মুক্তির জন্য বাংলা ভাষাকে আরব তুর্কি ফারসি শব্দ দিয়ে ঐশ্বর্যময় করে তুলতে হবে, এমনকি ক্রমে অক্ষরগুলোকেও নাস্তালিক স্ক্রিপ্টে লেখার আয়োজন করতে হবে। পাকিস্তান যদি সমগ্র দেশে ভারতীয় মোহাজিরদের ভাষা উর্দুকে চাপিয়ে দিতে পারে, নাস্তালিক উর্দু স্ক্রিপ্টকে পেশোয়ার ও বালুচিস্তানেও গ্রহণযোগ্য করে ফেলতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ পারবে না কেন , মনে করেন হেফাজতে ইসলামির আশরাফ নেতারা ।
    ভারতের মতোই, বাংলদেশের সমাজে একটি বিভাজন ঘটে চলেছে মৌলবাদী ও উদারপন্হী লেখক-রাজনেতা-সুশীল সমাজের সদস্যদের মাঝে । সউদি আরব বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য করছে প্রতিটি গ্রামে একটি করে মসজিদ এবং তৎসংলগ্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য । সরকারের ধারণা যে সেগুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং সরকার তাদের প্রভাবিত করতে পারবে । আসলে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা চান যে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে বাংলাদেশ সম্পর্ণ মুক্ত হয়ে যাক, এই ভাবে তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যে ভারতীয় জওয়ানরা প্রাণ দিয়েছিল, কলকাতা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের যে ব্যবস্হা করেছিল, ১৯৭১ সালে খানসেনাদের অত্যাচারে এই পারে পালিয়ে-আসা লক্ষ-লক্ষ মানুষ যশোর রোডের দুই পারে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দুবেলার খাবার পেয়েছিল, তার স্মৃতি এবং ঋণভার থেকে নিজেদের ছাড়িয়ে আনা যাবে। পশ্চিমবাংলার ভাষা থেকে বেরিয়ে যাবার অহরহ প্রয়াস করে চলেছেন সেই গোষ্ঠীর মানুষ ; বিদ্যাসাগরকে বাংলাদেশের কৌমস্মৃতি থেকে মুছে ফেলা তাই জরুরি ।
    পাকিস্তানি আমলে, পাকিস্তানি বলতে উর্দুভাষীদের কথা বলছি না, পাকিস্তানপন্হী বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এবং প্রশসনিক কর্তাদের কথা বলছি, যাঁরা বাংলাভাষী বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্মের কারণে বেশ কূপিত ছিলেন, এবং পাকিস্তানের প্রতি সমর্পিত ছিলেন, তাঁরা ‘ইণ্ডিয়া’ নামের ভূখণ্ডের অনেককে ঘৃণার চোখে দেখতেন, অর্থাৎ ঈর্ষা করতেন, তাঁরা বিদ্যাসগরের কাজকর্মে খুঁত আবিষ্কার করা আরম্ভ করেন । তাঁদের অভিযোগগুলো আমি নিজের জীবনযাপন দিয়ে ভালো করে অনুধাবন করতে পারি, তার কারণ আমার শৈশব কেটেছে একটি অন্ত্যজ বিহারি ও অত্যন্ত গরিব শিয়া মুসলমান পাড়ায়, ইমলিতলায় ।
    বস্তুত ইমলিতলা পাড়ায় থাকার সময়ে আমি জানতুমই না যে শিয়া আর সুন্নি নামে মুসলমানদের বিভাজন আছে, তাদের মসজিদ আলাদা, নামাজ পড়াতেও যৎসামান্য পার্থক্য আছে । মহরমের সময়ে আঘাতে নিজেদের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করেন শিয়ারা, যা সুন্নিরা ভালো চোখে দেখেন না । আমার অনুমান বাংলাদেশে শিয়া মুসলমান একেবারেই নেই। বলা হয় যে সুফিদের প্রভাবে অন্ত্যজ হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ; এখন সেই সুফিদের স্মৃতি বাংলাদেশে মুছে ফেলার প্রয়াস চলছে, আর পাকিস্তানে তাদের মাজারগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে । ললন সাঁইকে বাংলাদেশে আর শ্রদ্ধা করা হয় না । হাছন রাজা এই পারে যতো শ্রদ্ধেয়, বাংলাদেশে ততোটা নন ।
    আমি মুসলমান পাড়ায় বসবাস করে, মুসলমান প্রতিবেশির বাড়িতে অহরহ যাওয়া-আসার মাধ্যমে যে জীবনধারা সম্পূর্ণ জানতে পারিনি, তা কেমন করেই বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জানবেন, যিনি মুসলমানদের সমাজে বসবাস করেননি, কেবল বীরসিংহ গ্রামের মুসলমান চাষিদের দেখে থাকবেন । পাঁচ বছর বয়সে তিনি পাঠশালায় ভর্তি হন, এবং আমি নিশ্চিত যে তাঁর কোনো মুসলমান সহপাঠী ছিল না । তাঁর সময়ে কলকাতায় যে বৈভবশালী মুসলমানরা থাকতেন তাঁরা প্রায় সকলেই উর্দুভাষী ।
    বিদ্যাসাগর শিয়া-সুন্নি বিভাজনের কথা কি জানতেন ? পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর আমরা আহমেদিয়া, মোমিন ইত্যাদি মুসলমানের কথা জানতে পারছি । শৈশবে আমি শিয়াদের মসজিদে লুকোতুম লুকোচুরি খেলার সময়ে, ইমাম সাহেব আপত্তি করতেন না । আমি নিঃসন্দেহ যে বিদ্যাসগর কখনও কোনো মসজিদে প্রবেশ করেননি । এখনকার বহু হিন্দু যুবকও প্রবেশ করেননি বলেই অনুমান করি ।
    কৈশোরে ইমলিতলা পাড়া ছেড়ে দরিয়াপুর পাড়ায় বাবা-মা আর দাদার সঙ্গে থাকতে চলে যাই, বাবা নতুন বাড়ি তৈরি করার পর ; পাড়াটা আরও গরিব সুন্নি মুসলমানদের । এই পাড়ায় মুসলমান প্রতিবেশিদের সঙ্গে পরিচয় হলেও কেউ বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিতেন না ; মসজিদের ভেতরে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না, মসজিদের ভেতরে যদি উঁকি মারতুম দেখার জন্য যে ইমলিতলার মসজিদের সঙ্গে এর ভেতরটা আলাদা কিনা, তাহলে কেউ একজন বেরিয়ে এসে ধমকানি দিয়ে বলতো, ‘কি রে জুতো চুরি করতে এসেছিস?’ বুঝলুম যে, সব মুসলমানরা একইরকম নয় । বিদ্যাসাগরের পক্ষে এই ব্যাপারটা জানা কি সম্ভব ছিল ? দরিয়াপুর পাড়ার এক মুসলমান চুড়িঅলার কাছ থেকে আমার মা মুর্গির মাংস রাঁধতে শিখেছিলেন, তাকে আমাদের রান্নাঘরেও ঢুকতে দেয়া হয়েছিল, কারণ ইমলিতলায় মুর্গি আর মুর্গির ডিম খাওয়া বারণ ছিল ।
    লখনউতে যখন চাকুরিসূত্রে পোস্টিং হলো তখন বাংলোবাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত আবদুল করিম নামে এক অবিবাহিত সহকর্মী অফিসারের বাড়িতে ছিলুম প্রায় মাসতিনেক ; সে অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মাম জেলার সুন্নি চাষি পরিবারের, বিশাল আমবাগান আছে ওদের, যদিও ওদের বংশে আবদুল করিমই প্রথম শিক্ষিত প্রজন্ম । ধর্মের ব্যাপারে করিম বেশ গোঁড়া ছিল, রান্নার আগে পাঁঠার মাংস ঘণ্টাখানেক জলে ভিজিয়ে রাখতো, যাতে সব রক্ত বেরিয়ে যায়, মুর্গি আস্ত ছাড়িয়ে উনুনের ওপর ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে রক্ত শুকিয়ে নিতো । ওর বিয়ে হলো হায়দ্রাবাদের শিক্ষিত ধনী পরিবারের মেয়ের সঙ্গে যে, মেয়েটি করিমের এই ধরণের গোঁড়ামিতে বিরক্ত হতো এবং কালক্রমে সেসব পাট চুকিয়ে ফেললো । বিদ্যাসাগর কি এই ধরণের মুসলমান পরিবারে থেকেছেন ? থাকলে তাঁর জাত চলে যেতো । আমিও ব্রাহ্মণ পরিবারের, কিন্তু আমার জাত আছে না গেছে তা নিয়ে আমার বাবা-মাও চিন্তা করতেন না । অর্থাৎ দেড়-দুশো বছরে সবকিছু পালটে গেছে ।
    করিমের বিয়েতে গায়েহলুদের মতন কোনো অনুষ্ঠান হয়নি, ইমলিতলায় কুলসুম আপাদের বাড়িতে কারোর বিয়েতে গায়েহলুদ অনুষ্ঠান হয়নি, যা আমি নাকতলায় এসে প্রথম দেখলুম বাংলা ভাষার গল্প লেখক মুর্শিদ এ. এম-এর মেয়ের বিয়েতে । বুঝলুম যে মুসলমানদের মাঝেও জন্ম-বিয়ে-মৃত্যু নিয়ে আচার-বিচারের পার্থক্য আছে । বিদ্যাসাগর কি জানতেন যে মুসমানদের কোথাও গায়েহলুদ হয় আর কোথাও হয় না ?
    এতক্ষণ যাবত আমি এই কথাগুলো এই জন্যে বললুম যে কোনো সমাজ সম্প্রদায় এবং সেই সমাজ সম্প্রদায়ের চরিত্র ও আচার-আচরণ সম্পর্কে লিখতে হলে তাদের সম্পর্কে জানাটা জরুরি । বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজ সম্প্রদায় আর তাদের শাস্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতেন কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্হ কোরান, হাদিস এবং শরিয়া সম্পর্কে বিশেষ জানতেন না বলেই মনে হয় । কলকাতায় আমি এই বইগুলোর বাংলা অনুবাদ সংগ্রহ করেছিলুম, কিন্তু সে অনুবাদের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি, এতো বাজে অনুবাদ ছিল ; এখনই যদি এই অবস্হা, তাহলে বিদ্যাসাগরের সময়ে কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয় ।
    আমার গল্প-উপন্যাসে যে মুসলমান চরিত্রদের এনেছি, সেগুলো আমার পরিচিত পারিপার্শ্বিক থেকে সংগ্রহ করা । বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগে মুসলমানের উল্লেখ নেই বলে বাংলাদেশে কেউ-কেউ বিদ্যাসগরকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেগে দিয়েছেন । “মূলধারা” ২৩ আগস্ট ২০১৬ সংখ্যায় এস এম রেজাউল করিম আক্ষেপ করেছেন, “১৮৫৫ থেকে পরের একশো বছর বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়াই বাংলা ভাষার শিশু শিক্ষা শুরু হইছে । এই শিশুরা কী শিখলো ? রাম ওইটা করে, সুরেন্দ্র সেইটা করে, গোপাল সুবোধ ছেলে, যাদব মায়ের আদেশ মানে ; করিম তো ছিল না । ফলে রাস্তায় যেই করিমের সাথে দেখা হইলো, সেই করিম উটকো ।”
    আমি এবং আমার দাদা ও জাঠতুতো-খুড়তুতো বোনেরা সকলেই শৈশবে বিদ্যাসগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগ দিয়েই পড়াশুনা শুরু করেছি । আমাদের সকলেরই মুসলমান ছেলে-মেয়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল, কিন্তু কাউকে রাস্তায় দেখে কখনও উটকো মনে হয়নি । বস্তুত বিদ্যাসাগরকে সাম্প্রদায়িক প্রতিপন্ন করে এবং তাঁকে বাংলাদেশের বৌদ্ধিক জগত থেকে নির্বাসন দেবার জন্য জনাব এস. এম. রেজাউল করিম তাঁর অভিজ্ঞতা-জগতের বাইরে গিয়ে তত্ব ফেঁদেছেন, এই ব্যাপারটাকেই আমি বলছি বিদ্যাসাগরের পাকিস্তানিফিকেশান ।
    এখানে উল্লেখ করি যে আমার জাঠতুতো দিদির ছোটো মেয়ে এক মুসলমান যুবককে বিয়ে করেছে, সংসার পেতেছে, এবং সেও শৈশবে ‘বর্ণপরিচয়’ পড়েছিল, কই যুবকটিকে তার উটকো মনে হয়নি তো । বস্তুত যে মনোবীজের দরুণ স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ১৮৭৫ সালে আধুনিক শিক্ষার জন্য ‘মোহামেডান অ্যাংলো অরিয়েন্টাল কলেজ’ স্হাপন করেছিলেন, যা পরে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি হলো, অবিভক্ত বঙ্গদেশে সেরকম কলেজ স্হাপনা হলো না কেন, মানে একজন মুসলমান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্ভব হলো না কেন, যখন কিনা ধনী মুসলমান বঙ্গদেশে বেশ কয়েকজন ছিলেন ! বলা বাহুল্য যে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ ছিল না, বাঙালি মুসলমানদের আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ তাঁদের ছিল না ।
    এনটিভি অনলাইনের ২০১৬ সালের ২৯ জুলাই সংখ্যায় আলী নইম লিখেছেন, “১৯৯১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু শতবর্ষে হায়াৎ মামুদ লিখেছিলেন, ‘কি দুঃখ কি লজ্জা যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু শতবার্ষিকীর দিনটি প্রায় অলক্ষ্যে এসে চলে গেল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গসাহিত্যের অধ্যাপক কেন্দ্রিক একটি সারস্বত গোষ্ঠীর ঘরোয়া আলোচনাসভা এবং একটি দৈনিক ‘সংবাদ’-এর মেয়েদের পাতায় ও ড. আনিসুজ্জমানের একটি রচনাতে ছাড়া তাঁকে আর কেউ আর কোথাও স্মরণ করেছেন বলে আমার জানা নেই ।” আলী নইম কটাক্ষ করেছেন, “হায়াৎ মামুদ এখনও বেঁচে আছেন । আজ তিনি কী লিখবেন জানি না ।” এই যে শেষের বাক্যটা, “আজ তিনি কী লিখবেন জানি না”, স্পষ্ট করে তোলে যে ঈশ্বরচন্দ্রের এমন পাকিস্তানিফিকেশন ঘটে গেছে বাংলাদেশের বৌদ্ধিক জগতে যে, মৌলবাদীরা চেপে বসেছে বিদ্বজ্জনদের ওপরে, সুশীল সমাজের বৌদ্ধিক শক্তির অবসান ঘটেছে ।
    একজন ভাবুক ও লেখককে তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করা জরুরি । ইস্ট ইনডিয়া কোমপানির কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকার এদেশের দায়িত্ব নিজেদের হাতে নেবার পরে জানতে পারে যে তখনও বঙ্গদেশে ১৬০০ সংস্কৃত টোল রয়েছে । সুতরাং বাল্য বিবাহ বন্ধ, সতীদাহ বন্ধ থেকে বিধবা বিবাহ চালু করার সমর্থনে প্রতিটি সমাজ সংস্কারের কাজে তাঁকে সংস্কৃত শাস্ত্র থেকে সমর্থন সংগ্রহ করতে হয়েছে । সেই সময়ের সমাজকর্তাদের নিজের দিকে টানার জন্য অন্য কোনো উপায় ছিল না । বাঙালির নবজাগরণের হোতা হিসাবে বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন যাকে রেনেসাঁস বলা হয়, সেই বঙ্গসমাজ ছিল বাঙালি হিন্দুর উচ্চবর্ণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ।
    বিদ্যাসাগর কেন মুসলমান সমাজে বাল্যবিবাহ বন্ধ, বহুবিবাহ বন্ধ করার কথা ভাবলেন না, এরকম কুতর্ক যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের অন্তত এটুকু মনে রাখা উচিত যে ইসলামি শাস্ত্রাদির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের গভীর পরিচয় ছিল না । তাছাড়া হিন্দু সমাজে পরিবর্তন আনতেই তাঁর প্রচুর সময় লাগছিল এবং কুলীন ব্রাহ্মণদের কোপের মুখে পড়তে হচ্ছিল, সেই অবস্হায় তিনি আগ বাড়িয়ে মুসলমান সমাজের সংস্কারের কথা ভাববেন, এরকম চিন্তাই মূর্খতা ।
    এই অভিযোগও করা হয় যে সংস্কৃত কলেজের কারিকুলাম বিদ্যাসাগর সংস্কৃত বই দিয়ে ভরে দিয়েছিলেন ; তখন পর্যন্ত তো বাংলায় বই লেখা সেভাবে আরম্ভই হয়নি, তো বাংলা বই কোথা থেকে পেতেন ! আরেকটা অভিযোগ হলো যে সংস্কৃত কলেজে হিন্দুদের সব বর্ণের ছাত্র ভর্তি হতে পারতো না । সংস্কৃত কলেজে পারতো না ঠিকই, তার পঞ্চাশ বছর পরও রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা সংস্হায় বর্ণপ্রথা প্রথম দিকে বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন । তবে বিদ্যাসাগর হিন্দু কলেজে সব বর্ণের ছাত্রের ভর্তি হবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন ।
    বিদ্যাসাগরের হিন্দুত্ব নিয়েও আক্রমণাত্মক লেখালিখি নজরে পড়ে বাংলাদেশের কোনো-কোনো সাইটে, এমনকি কম বয়সে তাঁর টাক পড়ে যাওয়া সত্বেও তাঁরা দাবি করেন যে বিদ্যাসাগর টিকি রাখতেন । বিদ্যাসাগর আস্তিক ছিলেন না নাস্তিক, ঈশ্বরে বা দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করতেন কিনা, অজ্ঞাবাদী ছিলেন কিনা, সেই তর্ক এখনও ফুরোয়নি । ড. আহমদ শরিফ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ইন্দ্রমিত্র মনে করেন যে বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন ।
    কর্মজীবনের প্রথম দিকেই বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের এবং কলকাতার হিন্দু উচ্চবর্ণের নেতাদের থেকে দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছিলেন, কেননা তাঁর মনে হয়েছিল যে ব্রাহ্মসমাজের নেতারা বেশ গোঁড়া, এবং হিন্দুনেতারা অনমনীয়, যাদের সঙ্গে একসাথে কাজ করা কঠিন । তাই সামাজিক পরিবর্তনের কাজ তিনি শিক্ষার প্রসার ও আইনের মাধ্যমে করতে চাইলেন । তাছাড়া নিজের ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মাচরণ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সংযতবাক ছিলেন, কাউকে স্পষ্টভাবে কিছুই বলতেন না । বিধবা বিবাহ, সতীপ্রথা নির্মূল, বাল্যবিবাহ বন্ধ, নারীর শিক্ষা, অব্রাহ্মণদের শিক্ষিত করে তোলা ইত্যাদির জন্য যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন তা উচ্চবর্ণের এসট্যাবলিশমেন্টের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছিল, সেক্ষেত্রে ধর্ম সম্পর্কে নিজের মনের কথা চাউর করা ছিল বিপজ্জনক ।
    অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় “বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ছিলেন” রচনায় বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের বাকসংযমকে দায়ি করেছেন, এই নির্ণয়ে পৌঁছোতে যে তিনি নাস্তিক ছিলেন, না আস্তিক না অজ্ঞাবাদী । কুলীন ব্রাহ্মণরা সেসময়ে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছিল যে তিনি গোপনে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস করেন । কুলীন ব্রাহ্মণ এসট্যাবলিশমেন্ট তাঁর সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্ণয়ে পৌঁছোতে পারতো না কেননা তিনি উপবীত পরতেন এবং বাংলায় চিঠি লেখার সময়ে সেকালের প্রথা অনুযায়ী চিঠির ওপরে ঈশ্বর চিহ্ণ দিতেন বা দুর্গাশরণং লিখতেন । অর্থাৎ এই ব্রাহ্মণসমাজের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বিদ্যাসগর নিজের তীর আর তুণীর তৈরি করে ফেলেছিলেন । সেই সময়ের সামাজিক আবহে একজন লোক একা যে লড়াইটা লড়ছেন তার জন্য বাইরে তাঁকে এই ধরণের পাঁচিল তুলে ফেলতে হয়েছিল ।
    অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে সুনির্দিষ্ট নির্ণয়ে পৌঁছোবার মতো তথ্য প্রায় নেই, যাও বা আছে সেগুলো হয় ভাসাভাসা নয় পরস্পরবিরোধী । তিনি লিখেছেন যে যদিও বঙ্কিমের হিন্দু পুনরুথ্থান, ব্রাহ্মসমাজের তিন গোষ্ঠীর ধর্মমত অথবা খ্রিস্টধর্ম কোনোটিই বিদ্যাসাগরকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, একথা স্বীকার করতে হবে যে বিদ্যাসাগর ধর্মপ্রচারের বিরোধী ছিলেন, খ্রিস্টধর্মী যাযকদের উপদেশাবলীরও বিরোধী ছিলেন তিনি, কিন্তু ঠাহর করা দুষ্কর যে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতেন কিনা । রামকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যখন বলেছিলেন যে কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁর ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটবে তখন বিদ্যাসাগর কেবল মৃদু হেসেছিলেন, কোনো উত্তর দেননি । রামকৃষ্ণই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় করতে গিয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর যাননি।
    প্রাথমিকের শিক্ষার্থিদের জন্য বিদ্যাসাগর যখন ‘বোধোদয়, লিখলেন, যেমনটা ইংল্যাণ্ডে ছিল ‘চেম্বার্স রুডিমেন্টস অফ নলেজ’, সেই বইতে বিদ্যাসগর ধর্ম নিয়ে কোনো পর্ব রাখেননি । পরবর্তীকালে গুণগ্রাহী, বন্ধু এবং আলোচকদের অনুরোধে তিনি বলেন যে ঈশ্বর ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’, যার সঙ্গে ইসলামি ভাবনার মিল আছে, তাঁদের আরাধ্য ঈশ্বরকেও তা-ই বলা যায়, যিনি নিরাকার। বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামি গোষ্ঠী এই বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেননি, তাঁরা বিদ্যাসাগরকে বাংলাদেশে পাকিস্তানিফাই করতে বদ্ধপরিকর ।
    বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মোহনদাস করমচন্দ গান্ধি লিখেছেন, He was a Hindu and a Brahmin too. But to him, Brahmin and Sudra, Hindu and Muslim were all alike. Himself he led a very simple life. His dress consisted of a coarse dhoti, a shawl of similar kind to cover his body, and slippers. In that dress he used to call on Governors, and in the same dress he greeted the poor. He was really a fakir, a sannyasi or a yogi. বিদ্যাসাগরকে তাঁর জন্মসূত্র অনুযায়ী হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ উল্লেখ করলেও, গান্ধি বলেননি যে বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন না আস্তিক । তার কারণ গান্ধি জানতেন যে বিদ্যাসাগর কোনো মন্দিরে যেতেন না, বিগ্রহের আরাধনা করতেন না ; সেসময়ের কুলীন ব্রাহ্মণদের ইষ্টদেবতা বা পারিবারিক দেবতার মতো তাঁর কোনো আরাধ্য বিগ্রহ ছিল না । তাছাড়া তিনি সাংখ্য ও বেদান্তকেও স্বীকৃতি দেননি ।
    রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ রচনায় লিখেছিলেন , “বিদ্যাসাগরের চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ, যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে -- করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গয়াছিলেন, আমি যদি অদ্য তাঁহার সেই গুণকীর্তন করিতে বিরত হই তবে আমার কর্তব্য একেবারেই অসম্পন্ন থাকিয়া যায়।” রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে বিদ্যাসাগর কোনো বিশেষ সম্প্রদায়, অর্থাৎ কেবল হিন্দুদের জন্যই কাজ করেননি, তিনি সবায়ের জন্য আত্মনিয়োজিত ছিলেন ।
    বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামি গোষ্ঠীর রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত কথাগুলো পছন্দ হবে না জানি, কেননা তাঁরা রবীন্দ্রনাথেরও পাকিস্তানিফিকেশান করতে চাইছেন, তাঁরা দাবি করছেন যে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলা হোক । আমরা অপেক্ষায় আছি সেই দিনটির, বাংলাদেশের মৌলবাদী না উদারবাদী, দুই পক্ষের কারা জেতেন দেখার জন্য ।
    [ রচনাকাল : এপ্রিল - মে, ২০১৭ ]
  • m | 012312.60.7812.131 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:১০541299
  • যখন বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে হাঙরের ঢেউয়ে সাঁতার কাটতুম
    মলয় রায়চৌধুরী
    হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় বছরে, ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে, পরিচয় হয়েছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে, আর তখন থেকেই আমাদের হাঙরের ঢেউয়ে সাঁতার কাটা ।
    বাসুদেব দাশগুপ্ত তখন ‘রন্ধনশালা নামের ফিকশনটা লিখছে ।
    ওহ সে কতো সমুদ্র, কতো নদ-নদী, কতো ঝিলপুকুর ।
    কতো হাঙর চলে গেছে আমাদের পাশ দিয়ে, দেঁতো হাসি হেসে, কিংবা ল্যাজের আছাড় মেরে জলকে ঘোলাটে ফেনায় ফাঁপিয়ে, হাঁ-মুখ খুলে গোঁতা মেরেছে কুচো মাছের ঝাঁকে ।
    ক্রান্তীয় নাতিশীতোষ্ণ উষ্ণ পত্রিকায় আর খোলা সাগরের সেই স্পিনার হাঙরেরা, গায়ে চাককাটা বুশশার্ট, ছুঁচোলো মুখ, কালচে নিউজপ্রিন্ট নাড়িয়ে ভাসতে ভাসতে গেছে আড়চোখে ।
    ক্যারিবীয় প্রবাল হাঙর, আঙুলে গোমেদ আর প্রবালের আঙটি কিন্তু মার্কসবাদী, রঙবদলু অক্টোপাস খেতে ভালোবাসে, অতলান্তিকে সাঁতরেছে আমাদের পাশ কাটিয়ে, শিকারি চোখের পিটপিটে চাউনি মেলে ।
    কাঁধে ঝোলা পিগমি হাঙর, বড়ো হাঙরদের চেলা, দেখেই ফিসফিসিয়ে পালিয়েছে কফিহাউসের ভিন্ন ভিড়েল টেবিলে । তিমি হাঙর, বেঘো হাঙর, লিটল সিল মাছ দেখলেই, পেংগুইন দেখলেই ছুটেছে পেছনে, তুলে আছাড় মারার ধান্ধায়, তারপর আমাদের দেখে কেটে পড়েছে অন্য ঢেউফেনায় ।
    কতো যে দাঁত বদলাতে দেখেছি সেসব হাঙরদের, সারা জীবনে তিরিশ হাজার দাঁত ওঠে আর পড়ে যায় ওনাদের, মানে জীবনভর ওনারা একবার শিশু , আর একবার বুড়ো , এই ভাবেই চালিয়ে দেন ওনাদের দেঁতো বিদ্যায়তনিক আর সাংবাদিক অভিজ্ঞতার ওঠানামা ।
    আমরা তবুও সাঁতরেছি নীল জলে; কাউকে ভয় দেখাইনি, তবুও হাঙরেরা আমাদের ভয় পেয়েছে । সেপাই বরকন্দাজ খোচর লেলিয়েছে । টেকো খোচর, পিঠে কুঁজ খোচর ।
    কতো দিন পেছন ফিরে দেখেছি, ফলো করছে । ভেবেছি, আমাদের ফলো করার কি দরকার ! কোনো তরুণী ফলো করলে না হয় কথা ছিল । কিন্তু টেকো কুঁজো কিংবা রোগা কেলো ভেড়া ! তারা যে পুলিশের ইনফরমার, জেনেছি, কয়েক বছর পর ।
    কখনও পাশ দিয়ে কিলবিলিয়ে গেছে কালচে-পেছল অ্যানাকোণ্ডা ।
    আর রুপোলি আঁশের মাছেরা ? বোয়াল, চিতল, মাগুরেরা ? তারা তিড়িক নাচন নেচেছে । তারপর প্রতিষ্ঠানের বঁড়শিতে গেঁথা কেঁচো কামড়ে ধরতে গিয়ে এইপাশ ওইপাশ । পড়েছে গিয়ে মেছো বাজারের দরাদরিতে । গলা কাটা, রক্ত বেরোচ্ছে, পটকা ফেটে বেরিয়ে গেছে বক্তিমেবায়ুর তেলপোঁটা ।
    ঠোঁটে লিপ্সটিক মাখা পারশে, তোপসে, বাটা ।
    আর বিদ্যায়তনিক শুঁটকি । রোদে থুথ্থুরে লাঠি হাতে গলির ভেতর দিয়ে যেতে দেখেছি শুঁটকি মাছবুড়োদের।
    ব্ল্যাক সি, ইয়েলো সি, হোয়াইট সি, রেড সি ।
    কালো প্রেস, হলুদ প্রেস, শাদা প্রেস, লাল প্রেস -- হাঙরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ।


    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোচিং ক্লাসের টিচার বাসুদেব দাশগুপ্ত, শক্তিদার চেলা, কোচিং ক্লাসে সব বিষয়ই পড়ায় ।
    উনি বললেন, একে নিয়ে নাও, পাণ্ডুলিপি দেখিয়েছে, গদ্যের হাত খুব ভালো । ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’ পড়েছো তো ? ও এর আগে যে লেখাটা লিখেছে, ‘চোরাবালি’ নামের গদ্য, সেটা অবশ্য এক্সপেরিমেন্টাল নয় ।
    ‘রন্ধনশালা’ নামে একটা গল্প লিখছি । একটা উপন্যাসও প্রায় শেষ করে এনেছি, নাম দিয়েছি, ‘উৎপাত’ । শক্তিদাকে বলল বাসুদেব । আচরণে যৎসামান্য বিব্রতভাব ।
    কঙ্কাবতী আমার স্নাতকস্তরের বাংলা কোর্সে ছিল ; তাছাড়া ত্রৈলোক্যনাথ আমার ঠাকুমার জাঠতুতো ভাই, ওনার সুপারিশে বড়োজ্যাঠা পাটনা মিউজিয়ামে কিপার অফ পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার হয়েছিলেন । পরে, বাসুদেবের ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের ফিকশান পড়ে বুঝেছি যে ত্রৈলোক্যনাথের সঙ্গে বাসুদেবের বেশ পার্থক্য আছে । ত্রৈলোক্যনাথ ইরর‌্যাশানাল হলেও ধাপেধাপে যুক্তিগেঁথে ফিকশানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন । বাসুদেব এগিয়েছে ন্যারেটিভের সময়ের অনুক্রম ভেঙে-ভেঙে, এক ঘটনা থেকে হঠাৎ আরেক ঘটনায় লাফিয়েছে । বাসুদেবের ন্যারেটিভ স্ট্রেটেজির সঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথের ন্যারেটিভ স্ট্র্যাটেজির মিল নেই ।
    বাসুদেব, তুমি হারাধন ধাড়াকে গদ্যটা দিয়ে দিও, উনিই কলকাতায় ছাপাবার ব্যবস্হা করেন । বললুম আমি, যুবকটিকে ।
    নববর্ষের অনাবিল আনন্দ
    মিস ক্যালকাটার উপস্হিতিতে ২০ জন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর নৃত্য, অর্কেষ্ট্রা, বাংলা ও হিন্দী চিত্রের গান, গজল ও
    ফিরপোর পুরো ক্যাবারে ।
    আরও একটা ব্যাপার, বললেন মিসেস কফ । এখেনে নিউ ইয়র্কের মতো বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় না।
    ওখানে জানালা খুললে বিজ্ঞাপনের আলো, টেলিভিশানে বিজ্ঞাপনের ছবি, রেডিওয় বিজ্ঞাপনের চিৎকার, কোথায়
    যাই বুঝতে পারি না । এখানে বিজ্ঞাপন এখনও তেড়ে এসে মাথায় উঠে বসেনি । ইচ্ছে করলে নিরিবিলি শান্তিতে
    গার্হস্হ জীবন যাপন করতে পারে একজন বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্যের বাইরে ।
    শাড়ি পরা মিসেস কফের কোলে দৌড়ে এসে বসল তার ফুটফুটে ছেলে আর মিসেস কফের ছোট্ট চিৎকার, এই
    যাঃ ।
    কী হল ?
    শাড়ি খুলে গেল !
    ঘুটঘুটে অন্ধকার । আমরা কোথায় চলেছি ?
    স্টিকস নদী পার হওয়ার সময় নিশ্চিন্ত করে কেউ বলতে পারে না কোথায় যাচ্ছি….
    -- ঐ যে ডেসমণ্ড । ওই তোমার শত্রু ।
    --কোথায় ?
    -- এটা ছেড়ে দাও । শান্ত হও ডেসমণ্ড । পৃথিবীতে তোমার কে শত্রু আছে ?
    -- আমি জানি না স্যার । কিন্তু তলোয়ারটা ছোঁবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অজেয় মনে হল, আর সবাইকে শত্রু বলে
    মনে হতে লাগল ।
    --এটা অশুভ….। এখান থেকে পালাতে হবে ।

    দিয়ে দেব । তুমিই ছাপাবার খরচ দাও ? চাকরি করো ? আমার এখনও চাকরি জুটল না । টিউশানি করে চালাচ্ছি ।
    আমার মুখ থেকে আর্কটিক সাগরের গন্ধ বেরোচ্ছিল বোধহয় ।
    বললুম, ওয়েলকাম টু দি হাংরিয়ালিস্ট প্যানথেয়ন ।
    আমার দিকে ইশারা করে শক্তিদা বললেন, আরে ও তো কোটিকোটি টাকার নোট পোড়াবার চাকরি করে ।
    নোট পোড়াবার চাকরি ? অবাক বাসুদেব । অমন চাকরি হয় নাকি ?
    হ্যাঁ, বস্তা-বস্তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পচা গলা তেলচিটে নোংরা নোট, যেগুলো আর চলবেনা, সেগুলো জ্বালানো হয়, ইনসিনেটারে । নাকে রুমাল বেঁধে, কেননা তা থেকে মড়াপোড়ার গন্ধ বেরোয় ।
    বাসুদেব মোটা কাচের চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ কুঁচকে জানতে চাইল, তোমার ইয়ার অফ বার্থ কতো ?
    ব্যাঙ্কনোট পোড়ানোর সঙ্গে জন্মসালের কি করার আছে বুঝতে পারলুম না. বললুম, ১৯৩৯ সাল ।
    হেঃ হেঃ, বলল বাসুদেব, আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়ো, আমি জন্মেছি ১৯৩৮ সালে । তা তুমি হারাধন ধাড়া লোকটাকে পেলে কোথায় ? দেখতে কেমন ভদ্রলোককে ?
    বললুম, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দৌরাত্ম্যে এতদিন তো ব্রাহ্মণ, কায়স্হ, বদ্যিরাই সাহিত্যে রাজত্ব করল, ইউরোপ থেকে আনা মানদণ্ডে লেখালিখি করে । তাই ধাড়া পদবি দেখে একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের বাড়িতে মিট করতে বলে ওনাকে পেয়েছি । তবে উনি পদবি পালটে ফেলার কথা ভাবছেন ; ওনার মতে, অমন পদবী দেখে কেউই লেখা ছাপতে চায় না ।
    সেকথা ঠিক । তা কোথায় থাকেন উনি ?
    হাওড়ার একটা বস্তিতে ।
    আচ্ছা, আন্দোলনের অফিস তাহলে বস্তিতে ?
    অফিস-টফিস বলে কিছু নেই । কলকাতায় একজন কাউকে তো দরকার যে কোঅর্ডিনেট করবে । আমাদের আন্দোলন কারোর বাপের সম্পত্তি নয়, কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, পলিট ব্যুরো, সম্পাদকের দপতার জাতীয় ব্যাপার নেই ; তুমিও নিজের লেখা নিজেই ছাপাতে পারো, হাংরি জেনারেশনের ডাক তুলে ।
    ছাপাবার পয়সা কোথায় ! বাংলায় বিএ স্নাতক হয়ে চাকরিই জুটলো না এখনও ।
    বাংলা পড়ে চাকরি জোটা কঠিন । গ্র্যাজুয়েশানের পর পোস্টগ্র্যাজুয়েশান করছ না ?
    খরচ দেবে কে ? স্নাতক হয়েছি এই তো যথেষ্ট । স্কুলটিচারি যদি পাই তাহলে বি এডটা দেবো ।
    শক্তিদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো আমার চেয়ে বেশি ডুবজলে চলে গেছো দেখছি ; সকালবেলাতেই টেনে এসেছ ?
    পিসেমশায়ের বাড়ি উঠেছি ; সেন্টুদাকে তো জানেনই, বললে, চল, রাধাবল্লভী, আলুর দম আর তাড়ি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করা যাক । বিহারিদের ঠেক আছে সোনাগাছির লাগোয়া, সকালবেলায় তাড়ি বিক্রি করে ।
    সোনাগাছিও যাও নাকি ? জানতে চাইল বাসুদেব ।
    এখনও যাইনি ।
    যদি যাও তাহলে জানিও । নোট পোড়াবার চাকরি করছ, কিছু নোট না হয় ওই পাড়ায় পোড়ালে।
    ঠিক আছে ; সেন্টুদাকে সঙ্গে নিতে হবে, নয়তো উল্টোপাল্টা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোব আর টাকা খসিয়ে নেবে ।
    মলয়, ওকে এত তাড়াতাড়ি তোমাদের খোট্টা লাইনে নিয়ে যেও না, আগে লেখালিখিটা পাকুক , শক্তিদার উপদেশ ।
    জিগ্যেস করি বাসুদেবকে, ওর মুখে অসহায়তার পাতলা প্রলেপ দেখে, তুমি কি প্রেম করে ব্যর্থ হয়েছ ?
    বাসুদেব, কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল, হেঃ হেঃ ।
    এরপর লক্ষ করেছি, প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে হলে বাসুদেবের মুখ থেকে কেবল হেঃ হেঃ ।
    সেন্টুদাকে চেনেন শক্তিদা, সমুদ্র দুজনেই এক চুমুকে ফুরিয়ে ফেলতে পারেন । পিসেমশায়ের বড়ো ছেলে । সেন্টুদা আর পিসেমশায় দুজনেই বাংলা সমুদ্র ভালোবাসেন, বিদেশি সমুদ্রে আগ্রহ নেই । ওঁদের দুজনেরই দাঁত কালো হয়ে এসেছে । সন্ধ্যাবেলায় একই সময়ে দুজনকে দেখা যায় খালাসিটোলায় ।
    শক্তিদার সঙ্গে সাঁতার কাটা মানে পুরো পুকুর উনি শুষে নেবেন, নদী হলে নদী, সাগর হলে পুরো সাগরই চোঁ-চোঁ করে । ওনাকে সাগরে ভাসাতে হলে বেস্ট ছিল ওনার উল্টোডাঙার বস্তির ঘরে এক বোতল সমুদ্র নিয়ে পৌঁছোনো, নীল সমুদ্র নয়, আবসাঁথ তো আর আমাদের পুকুরে-নদীতে-সাগরে মেলে না । জলের রঙের সমুদ্র কিংবা চায়ের লিকারের রঙের । ওনার কোনো বাছবিচার নেই ।
    চাইবাসায় দেখেছি ওনার কাজকম্মো । প্রেমিকাকে ফেলে পালিয়ে এসেছিলেন কেন, তা তখন, ১৯৬১-৬২ সালে জানতুম না, পরে জানলুম, ব্যর্থ প্রেমের বদলাটা আমার ওপর নিয়েছিলেন, আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে ।
    বাসুদেবের মোটা কাচের চশমা, বাদামি ফ্রেম, ফিকে নীল জলকাচা বুশশার্ট, ধূসর রঙের প্যাণ্ট, চটি । হেঃ হেঃ হাসি । করমর্দন করে বুঝলুম হাত ঘামে, নরম । হেঃ হেঃ হাসির আড়ালে কেমন যেন যন্ত্রণার রেশ ।
    বললে, তুমি তো পাটনায় থাকো, কলকাতায় হ্যাঙ্গাম বাধিয়েছ কী করে ?
    বললুম, হারাধন ধাড়া আছেন কলকাতায় । কফিহাউসে, প্রেসিডেন্সিতে, সংবাদপত্র অফিসে প্রথম তিনটে বুলেটিন বিলি করেছে, ফলে হইচই ।
    বললে, হারাধন ধাড়া, ওই যিনি হাওড়ায় থাকেন ? পরিচয় হয়নি এখনও ।
    শক্তিদা বললেন, আমি পরিচয় করিয়ে দেব’খন । আজকেই সন্ধ্যাবেলা কফি হাউসে লেখা কালেক্ট করতে আসবে অরূপরতন বসুর থেকে । সন্দীপন হারাধনের বাড়ি গিয়ে লেখা দিয়ে এসেছে ।
    পাটনার ঠিকানা দিয়ে বললুম, তোমার কয়েকটা ফোটো পাঠিয়ে দিও, সকলের ফোটো কালেক্ট করছি, কোলাঝ বানাবো, পোস্টার হবে আর সেটা ছোটো করে বুলেটিনেও যাবে ।
    বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষের ফোটো দিয়ে দুটো পৃথক কোলাঝ করেছিলুম । সকলের ফোটো মিলিয়ে একটা কোলাঝ করেছিলুম, যেটা নিরানব্বুই নম্বর বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । তা অবশ্য বেশ পরে । সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে, ‘এষণা’ পত্রিকায় প্রকাশিত শৈলেশ্বর ঘোষের ‘তিন বিধবা’ কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে আমি ১৯৬৩-এর ডিসেম্বরে পাটনায় একটি প্রেসে বুলেটিনে ছাপাই ; তাছাড়া ওর আর মাত্র একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল হাংরি বুলেটিনে । সুভাষেরও একটামাত্র লেখাই বুলেটিনে বেরিয়েছিল, সেই যে সংখ্যাটা নিয়ে মোকদ্দমা হয়েছিল । বাসুদেবের লেখা ১৯৬২ থেকে বুলেটিনে ছাপা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ।
    বাসুদেবকে বললুম, ঠিকানা তো দেয়াই রইল, পাটনায় চলে এসো, হিপিরা কাঠমাণ্ডু যাবার পথে আমাদের বাড়িটাকে হলটিং স্টেশান করে, একদিন থেকে, পরের দিন পাড়ি মারে । ফেরার সময়ে একদিন থেকে, বেনারস পাড়ি মারে। বেনারসে অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আছে ।
    বাসুদেব আসেনি কখনও ; দাদাও বলেছিল, চাইবাসায় যেতে, যায়নি ।
    পরে, দাদা বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি থাকা আরম্ভ করলে বাসুদেব প্রায়ই দুপুরবেলায় বেহেড মাতাল হয়ে দাদার বাড়িতে এসে চিৎপটাঙ হয়ে খাটে শুয়ে পড়ত । একা । নেশা কেটে গেলে চলে যেত ।
    শেষদিকে কি বন্ধুহীন হয়ে গিয়েছিল ? অবনী ধরের মতে হ্যাঁ, একা থাকতে ভালো লাগত এদান্তি ।


    পথে বেরিয়ে বাসুদেব বলল, ওরা রিফিউজি ফ্যামিলি, ছয় ভাই এক বোন, তারপর চুপ করে গেল ।
    ছয় ভাই, এক বোন, আজকালকার দিনে, শুনে, পরিবারটাকে স্ট্রেঞ্জ মনে হয়েছিল । বৈভবশালী ছিল তাহলে, জমিজমা, প্রতিপত্তি ওপার বাংলায় ।
    আমি আবার জানতে চাইলুম, প্রেম করে লাৎ খেয়েছ নাকি ?
    আরেকদিন বলব, অত্যন্ত জটিল সম্পর্কে ফেঁসে গেছি । হঠাৎ মুখ নিচু করে বলল, শালা আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে ।
    আত্মহত্যা ? আর ইউ ম্যাড ? আমিও তো প্রথম প্রেমে প্রেমিকার লাৎ খেয়েছি, কিন্তু কখনও হেরে গেছি বলে ভাবিনি, হেরে যাবার বোধ আমার মধ্যে নেই ।
    তুমি তো বিহারি খোট্টা, শক্তিদার কাছে তোমার আর তোমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর অনেক গল্প শুনেছি, চাইবাসার, পাটনার, মহুয়া, হাড়িয়া, সোমরস, ঠররা, তাড়ি, গাঁজা, চরস, ভাঙ, আরও কতো কি ! যাকগে পরে শুনবো একদিন । এখন বড্ডো খিদে পেয়েছে । চলো না, কোনো পাইস হোটেলে, ভাত খেয়ে নেয়া যাক । খরচটা তুমিই দেবে ।
    এখনকার, মানে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ের ছেলে-মেয়েরা, গাঁজা, চরস, ভাঙ বলতে লজ্জা পায় । গাঁজাকে বলে পাতা বা মারিহুয়ানা । চরসকে বলে হ্যাশ । অথচ ফোঁকেনি এমন ছাত্র-ছাত্রী মিলবে না । তখনকার দিনে এগুলো সরকারি দোকানে বিক্রি হতো, পুরিয়ায় সত্যমেব সিংহের ছাপ মারা ।
    শ্যামবাজারের মোড়ের পাইস হোটেলে, যেখানে দাদা কলেজে পড়ার সময়ে খেতুম, মুড়ি ঘন্ট, ডাল, ভাত আর লেবু । আমি বেশি খেতে পারলুম না, তাড়ি আর রাধাবল্লভী তখনও হজম হয়নি ।
    কফি হাউসে যাবে নাকি ?
    বললুম, নাঃ, পিসেমশায়ের বাড়িতেই যাই, ভাত আর তাড়ির মিশেলে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে । তুমি কোথায় যাবে ?
    দাদার বাড়ি । বালিগঞ্জে ।
    পরের বার কলকাতায় এসে বাসুদেবের মুখেই শুনেছিলুম, ওর দাদার বাড়িতে থাকার সময়েই এক নিকটাত্মীয়ার প্রেমে পড়েছিল বাসুদেব । সেই প্রেমিকা ওর মাসির মেয়ে নয়, যেমনটা বিভিন্ন পত্রিকার গালগল্পে লেখা হয়ে থাকে। সেই মেয়েটি ছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের Neice. আমি Niece লিখছি, পরিচয় গোপন রাখার জন্য ।
    চুমু পর্যন্ত খায়নি তখনও পর্যন্ত । সব সময় ধরা পড়ে যাবার ভয় । দুজনে একসঙ্গে ইডেন গার্ডেনস, গঙ্গার পাড়, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর গল্পও সম্পাদকদের বানানো, সম্ভবত বাসুদেবের গেলানো গুলগল্প । আমি ওর প্রেমের ঘটনাটা জানি, কেননা আমার সামনে কেঁদেছিল বাসুদেব । ওর প্রায় প্রতিটি কাহিনীতে দেখা যায় ওর প্রেমিকাকে, একটি বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়ে, ‘রতনপুর’ কাহিনির চুমকি আর রুমকি, ‘বমনরহস্য’-এর হৈমন্তী উল্লেখ্য ।
    পরিকল্পনা করেছিল ছাতা আড়াল করে দুজনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে একদিন ঘনিষ্ঠ হবে । প্রেমিকার ভীতির জন্য তা সম্ভব হয়নি ।
    শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলঘর ভাড়া নিয়েছিল একদিনের জন্য । কিন্তু প্রস্তাবেই কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল ওর প্রেমিকার, তেড়ে জ্বর এসে গিয়েছিল । তাই ফাঁকা হোটেলঘর ফাঁকাই থেকে গিয়েছিল অন্ধকারে।
    ব্যর্থ প্রেমিক বাসুদেব আমার চেয়েও বেশি মদ খাওয়া আরম্ভ করে দিয়েছিল । আমি কলকাতায় গেলে প্রতি সন্ধ্যার ঠেক হয়ে গেল খালাসিটোলা । নয়তো সুভাষ ঘোষের সঙ্গে ; তখনও পর্যন্ত সুভাষের সঙ্গে সাহিত্যিক রেশারেশি আরম্ভ হয়নি ওর । আরম্ভ হল সুভাষের ‘আমার চাবি’ গদ্যটা বেরোবার পর ; যদিও তার কোনো কারণ ছিল না, কেননা দুজনের গদ্যের জনার ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ।
    মদের প্রভাব বাসুদেবের গালে আর দেহে পড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । ছিপছিপে ভাবটা হারিয়ে ফেলছিল।
    সুভাষের চরিত্রে সমবয়সী গদ্যলেখকদের হিংসে করার গোপন একটা দিক ছিল ।
    আমার ‘ডুবজলে যেটুইকু প্রশ্বাস’ পড়ে সৈয়দ মুজতফা সিরাজ একটা চিঠি দিলে, দাদা সেটা ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকায় ছাপিয়েছিল ।
    সুভাষের চন্দননগরের বাড়িতে ১৯৯৬ নাগাদ দেখা করতে গেলে, প্রথমেই আক্রমণ করে বসল সিরাজকে । ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসকে টিটকিরি মারা আরম্ভ করলে টের পেলুম কেন সিরাজ সম্পর্কে অকথা-কুকথা বলছে ।
    বাসুদেব আর সুভাষের তাত্বিক ঝগড়াটা ওদের কাহিনি-বিশ্লেষণে নিয়ে যায়নি ওরা, বা পশ্চিমবঙ্গের সমাজব্যবস্হার ক্রম-অবনমন নিয়ে এগোয়নি তর্কটা, যেমনটা আমরা দেখি ওক্তাভিও পাজ আর কার্লোস ফুয়েন্তেসের পারস্পরিক বিতর্কে ; চার্লস ডিকেন্স আর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যানডারসনের পারস্পরিক সমালোচনায়, গোর ভিডাল আর নরম্যান মেইলারের, সলমান রুশডি আর জন আপডাইকের, হেনরি জেমস আর এইচ জি ওয়েলসের, জোসেফ কনরাড আর ডি এইচ লরেন্সের, রবের্তো বোলানো আর গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের মাঝে । কিংবা পিকাসোর আঁকার স্টাইল নিয়ে মাতিসের ।
    বামপন্থার দুটি ভিন্ন পাটাতনে দাঁড়িয়ে দুজনের কাছে কাঙ্খিত ছিল যে বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘খেলাধূলা’ উপন্যাস নিয়ে সুভাষ ঘোষ তার বক্তব্য রাখবে আর সুভাষ ঘোষের ‘সাবিত্রীবালা’ কিংবা ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’ নিয়ে রাখবে বাসুদেব দাশগুপ্ত--- পরস্পরের রাজনৈতিক চিন্তার বৈভিন্ন্যের প্রেক্ষিতে ।
    আজিজুল হক সম্পর্কে যখন বক্তব্য রাখতে পারে বাসুদেব তখন হাংরি আন্দোলনের দুই গল্প-উপন্যাস লেখক সুভাষ ঘোষ আর সুবিমল বসাক সম্পর্কে লেখা প্রয়োজন মনে করল না কেন ? এমনকি যখন ‘ক্ষুধার্ত’ সম্পাদনা করল, তখনও সুবিমল বসাককে বাদ দিল । আমি এই ব্যাপারটাকে হালকা করে দেখতে চাই না, এই বাদ দেবার প্রক্রিয়াটি ইউরোপ থেকে আমদানি করা আধুনিকতাবাদী বিদ্বেষমূলক চারিত্র্য । এটা তিরিশের দশকের লেখক-কবিরা আরম্ভ করেছিলেন ।
    আমার তো মনে হয় বাসুদেবের চরিত্রে গোপন ঈর্ষা কাজ করত, দরবারি প্রতিষ্ঠানের নেকনজর পাওয়া সত্ত্বেও, যা সিপিএম কার্ড হোল্ডার সুভাষ ঘোষ পায়নি, আর প্রতিটি রাজনৈতিকপন্হার সমালোচক সুবিমল বসাক একেবারেই পায়নি । সুবিমল বসাককে শেষে আলোচনার কেন্দ্রে আনার প্রয়াস করলেন নিম্নবর্গ ও দলিত বাঙালি লেখকগোষ্ঠী-সংস্হা ।
    বাঙালি লেখকরা এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে একটা ভাই-ভাই ক্লাবের মতন সাহিত্যের আলোচনা করেন । শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মনে করেন মানুষেরা এসেছে ভিন্ন গ্রহ থেকে, অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য, অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনও শীর্ষেন্দুর সাহিত্যে এইগুলির প্রভাব নিয়ে ওনার সাহিত্য আলোচনার সময়ে লেখেননি, যখন কিনা সুনীল ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা ভাবনাচিন্তার মানুষ । একই বক্তব্য খাটে শীর্ষেন্দুর ক্ষেত্রেও । এইটেই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিষ ।
    বাসুদেবের গোরু আর শুয়োরের মাংস খাবার সঙ্কোচ ছিল না । সুভাষ কখনও গোরুর আর শুয়োরের মাংস খেতে চাইত না, বলত আমার ধার্মিক ইনহিবিশান কাজ করে, বমি করে ফেলব । সিপিএম-এর কার্ডহোল্ডারের এই ধার্মিক ইনহিবিশান বেশ কনট্রাডিকটরি মনে হয়েছিল । ব্যক্তি-এককের কনট্রাডিকশান অবশ্য থাকবেই ।


    অশোকনগরে উদ্বাস্তুদের জন্য নির্দিষ্ট ফ্ল্যাট পেয়ে প্রেমিকার শহর থেকে দূরে থাকার সুযোগ তৈরি হল বাসুদেবের, এবং মেয়েটিকে ক্রমশ ভুলে যাবার । আমি কেবল দুবার গেছি বাসুদেবের অশোকনগরের বাড়িতে। দ্বিতীয়বার আমায় দেখে বিব্রত বোধ করেছিল বাসুদেব, কেননা তখন হাংরি আন্দোলন মোকদ্দমা পুরোদমে চলছে আমার বিরুদ্ধে । পুলিশের কাছে জমা দেয়া মুচলেকাগুলো হাতে পেয়ে গেছি ।
    অশোকনগরের মার্কসবাদে ওই এলাকার জীবন যাপনের প্রভাব ছিল, আর বাসুদেব তাকে আত্তীকরণ করে নিয়েছিল । বস্তুত প্রমোদ দাশগুপ্তের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি শহর ও গ্রামকে পার্টি নেটওয়র্কের অন্তর্গত করার প্রয়াস হয়েছিল ; ছোটো শহরগুলোর যুবকদের পক্ষে ওই ফাঁদের বাইরে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করা তখনকার দিনে অত্যন্ত কঠিন ছিল । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনে জেতার প্রধান কারণ ছিল প্রমোদ দাশগুপ্তের দমবন্ধকরা নেটওয়ার্কিঙের প্রভাব, যে নেটওয়র্কিঙের কারণে মুসলমানরা নিজেদের অবহেলিত মনে করেছিল ।
    বর্তমানে তৃণমূল দলটি ওই নেটওয়র্কটিকেই রেডিমেড পেয়ে গেছে এবং তা আমরা ছোটো শহরগুলোয় চাক্ষুষ করছি । বাসুদেবের পক্ষে অশোকনগরের জাল আর সুভাষের পক্ষে চন্দননগরের জাল এড়ানো কঠিন ছিল । যে কবি-লেখকরা কলকাতায় থাকেন তাঁরা এই জালটিকে এড়িয়ে নিজস্ব ভাবনাচিন্তা আর রাজনৈতিক লেখালিখি ও সমাজ-বিশ্লেষণ করতে পারেন । মফসসলে ব্যাপারটা তখন বিপজ্জনক ছিল; এখন হয়তো আরও বিপজ্জনক । জানতে ইচ্ছে করে সুভাষ যদি অশোকনগরে থাকত আর বাসুদেব যদি চন্দননগরে, তাহলে ওদের মননজগতটা কেমনধারা হতো ।
    সুভাষের চন্দননগরের মার্কসবাদ ছিল পার্টি প্রভাবান্বিত, প্রাতিষ্ঠানিক দরবারি রাজনীতির বামপন্হা ।
    পরে বামপন্হী সরকার তখতে বসলে দুজনের মধ্যে বিদেশী তাত্ত্বিকদের মার্কসবাদের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ নিয়ে তুমূল মনোমালিন্য শুরু হয়েছিল । বাসুদেব একদল শিষ্য যোগাড় করে ফেলেছিল আর সুভাষ ঘোষ আরেকদল । অথচ তা বাসুদেব সম্পাদিত বা সুভাষ ঘোষ সম্পাদিত ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকায় প্রতিফলিত হয়নি, কখনও হয়নি ।
    কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগ হয়ে গেলে সুভাষ ঘোষ সিপিএম-এর কার্ড হোল্ডার হয়ে গেল । জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হলে, সুভাষ ঘোষ নিজের বাড়িতে জ্যোতিবাবুর ফোটো টাঙিয়ে রাখত, সিপিএম-এর ঝাণ্ডা উড়তো দোরগোড়ায় । সিপিএমের মিছিলে যোগ দিয়ে স্লোগান দিত ।
    বাসুদেব আকর্ষিত হল উগ্র বামপন্হার দিকে, অ্যাকটিভিস্ট হিসাবে নয়, ভাবুক হিসাবে । ওর অশোকনগরের বাড়িতে জ্যোতি বসুর ফোটো ঝুলতে দেখিনি । বালক-বালিকাদের মাঝে ইনটারন্যাশানাল গাইত । সুভাষ ঘোষ গান গাইতে বিব্রত বোধ করত ।
    হাংরি আন্দোলনে করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, যে আমাদের পোস্টার ড্রইং ইত্যাদি এঁকে দিত, সে বেশ গলা ছেড়ে গান গাইত, বিশেষ করে হিন্দি । করুণানিধান মুখোপাধ্যায় একবার ফালগুনী রায়ের পোরট্রেট এঁকে খালাসিটোলায় পেছনের দিকে টাঙিয়েছিল, যেখানে তখনকার দিনে শ্রমিক আন্দোলনের পোস্টার মারা হতো । পেইনটিঙটা দুতিন দিন পরেই হাপিশ হয়ে গিয়েছিল ।
    বাসুদেব হিন্দি ফিল্ম দেখতে ভালোবাসত আর হিন্দি সিনেমার গানও গাইত গলা ছেড়ে । নায়িকাদের স্তন দেহ ইত্যাদি নিয়ে খোশমেজাজ আলোচনা করত, বিশেষত নার্গিস আর মধুবালার । প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র এদের কখনও গান গাইতে শুনিনি । অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য হবার পর সুবো আচার্য হয়তো আশ্রমিকদের নির্দিষ্ট গান গায় ; আমি অবশ্য শুনিনি কখনও ।
    আমার মনে হয়, বাসুদেব আর সুভাষের মার্কসবাদ নিয়ে কচকচিটা ছিল আড়াল । ওই আড়ালের পেছনে দুজনে দুজনের গদ্য নিয়ে ঈর্ষার লড়াই লড়ত । নয়তো, মাও জে ডং, চীন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে ১৯৭৮ সালের ‘দন্দশূক’ পত্রিকায় বিতর্কের আর তো কোনো কারণ দেখি না ; সে সময়ের পশ্চিম বাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রেক্ষিতে ওই সমস্ত তত্ব ছিল জ্ঞান ফলাবার অহেতুক বালখিল্য । পশ্চিমবাংলা ক্রমশ যে গাড্ডায় গিয়ে পড়ল, তার আভাস নেই ওদের তর্কবিতর্কে ।
    তখন পশ্চিমবাংলা থেকে কল-কারাখানা পালাতে আরম্ভ করেছে অন্যান্য রাজ্যে, অথচ তার কারণ বিশ্লেষিত হল না বা প্রতিফলিত হল না ওদের লেখায় । তারপর যখন স্কুলে মিডডে মিল খাওয়াবার ব্যবস্হা হল, তখন আড়ালে যে উঁচু জাত-নিচু জাতের বিভাজন দিব্বি বজায় রয়েছে, তাও নজরে পড়ল না ওদের !
    একদিকে দুজনে মানবতাবাদী তক্কাতক্কি চালাচ্ছে, আরেক দিকে ‘ক্ষুধার্ত খবর’ আর ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকা থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছে ত্রিদিব মিত্র, দেবী রায়, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই আর সুবিমল বসাককে । চরিত্রের দৈন্য ছাড়া কী বলব একে ?
    আমাকে বাদ দেবার ব্যাপারটা ব্যাখ্যাযোগ্য, কেননা আমার জন্যই বাকি দশ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোয় ; ওদের নতুন চাকরি নিয়ে টানাটানির ভয় ছিল । অবিরাম বাদ দিতে থাকার দরুন ত্রিদিব মিত্রও লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিল । ত্রিদিব ‘উন্মার্গ’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করত ; তাতে লেখা দিতে অস্বীকার করল বাসুদেব, সুভাষ, শৈলেশ্বর । বেশ আহত আর অপমানিত বোধ করেছিল ত্রিদিব । পত্রিকাটা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল ওদের অসহযোগীতায় । বাসুদেবকে আমি যতটা বুঝেছিলুম, মানে সেই সময়, এই রকম আচরণ কাঙ্খিত ছিল না। পরে তো ওরা দেজ থেকে প্রকাশিত সংকলনে শঙ্খ ঘোষকেও হাংরি বলে চালিয়ে দিলে !
    সারা ভারত সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে কেবল পশ্চিম বাংলার একটি বিশেষ শহরের, চন্দননগর আর অশোকনগর, ভাবনাচিন্তা-নির্ভর বিতর্ক, যাতে পরস্পরের গদ্য বিশ্লেষণ হচ্ছে না, সময়-কাগজ-টাকা নষ্ট ছাড়া আর কিই বা বলা যায় তাকে ।
    ১৯৭০ সালে বাসুদেবের বিয়ের সময় সুভাষ ঘোষ আর ফালগুনী রায় বিয়ের মণ্ডপে এতো বেশি মাতলামি করছিল যে বাসুদেব ওদের দুজনকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল । কোনো কথা শুনছিল না সুভাষ । ফালগুনীও সুভাষের পাল্লায় পড়ে অপমানিত হয়েছিল । এই তথ্য অবনী ধরের কাছে পাওয়া ।
    ফালগুনীকে অপদস্হ করে অনুতপ্ত বাসুদেব ফালগুনীর কবিতাগুলো নিয়ে ১৯৭৩ সালে প্রকাশ করেছিল এক ফর্মার ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’ ।
    অবনী ধরের কাছে শুনেছিলুম, শৈলেশ্বর ঘোষের স্ত্রীর পরিবারের যুবতী ইন্দিরা কুণ্ডুকে বিয়ে করেছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত । ইন্দিরা কুণ্ডুর সঙ্গে বাসুদেবের বন্ধুত্ব শৈলেশ্বর ঘোষের সূত্রেই হয়েছিল ।
    সুভাষ ঘোষ আর ফালগুনী রায় গোলমাল করতে পারে অনুমান করে ওদের সম্ভবত নিমন্ত্রণ করা হয়নি ; তাই ওরা বিয়ের মণ্ডপে উদয় হয়ে মাতলামির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিল ।
    আমি, দাদা, সুবিমল বসাক, দেবী রায়, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই, আর ত্রিদিব মিত্রও বাসুদেব দাশগুপ্তের বিয়ের নিমন্ত্রণ পাইনি । প্রদীপ চৌধুরী আর সুবো আচার্য নিমন্ত্রণ পেয়েছিল কিনা জানি না । অবশ্য সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষও ওদের বিয়েতে জানায়নি ; শৈলেশ্বর বিয়ের পর দাদাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল ।
    বাসুদেবের প্রথম প্রেমের জটিলতা সম্পর্কে জানতুম বলে, আর মোকদ্দমার দরুন সম্পর্ক বিগড়ে গিয়েছিল বলে হয়তো বলেনি আমাকে ।


    বাসুদেবের প্রথম প্রেমোত্তর বিষণ্ণতা কেটেছিল ডেভিড গারসিয়া নামে একজন বিদেশির হোটেলঘরের স্নানঘরে উলঙ্গ হুল্লোড়ের পর । ডেভিড এসেছিল গ্রিস থেকে । আগেই ও আমাকে লিখে জানিয়েছিল যে কলকাতায় আসছে আর কোন হোটেলে উঠবে ।
    আমি সবাইকে জানিয়ে দিলুম । তারপর একদিন সবাই মিলে ডেভিডের হোটেলঘরে পৌঁছে চরস ফোঁকার পর যৌথ স্নানের ইচ্ছে হল । ঝটপট পোশাক খুলে ফেলল বাসুদেব, সুবিমল, সুভাষ, শৈলেশ্বর । আমিও। স্নানঘরটা বেশ বড়ো ছিল ।
    পরস্পরকে হোটেলের দামি সাবান মাখিয়ে স্নানের হুল্লোড়ের মাঝে বাসুদেব বলেছিল, যাক, আমার লিঙ্গ সুভাষের চেয়ে ছোটো নয় ।
    সুভাষের দেয়া উত্তরটা মনে আছে, ‘আমি এখনও ভার্জিন, বুঝলে, এখনও ফুল খোলেনি ; একবার খুলে যাক, তারপর সবাইকে দেখাবো’ ।
    ডেভিড বললে, ও একজন বাঙালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে চায় । অথচ কেবল এক সপ্তাহ থাকবে, তারপর যাবে দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বাড়ি দুমকায় ।
    এতো তাড়াতাড়ি তো আর প্রেমিকা পাওয়া যাবে না । আমরা প্রস্তাব দিলুম, সোনাগাছি যাওয়া যাক ।
    অবিনাশ কবিরাজ লেনে পৌঁছোতেই, সন্ধ্যা তখন সবে নামছে, পিম্পরা পেছনে লেগে গেল । একজন সাহেবের সঙ্গে এতোগুলো ভারতীয় দেখে পিম্পগুলোও মন্তব্য আরম্ভ করল আমাদের উদ্দেশ্য করে, সায়েবকে ফতুর করার জন্য আমরা ওকে এপাড়ায় ধরে এনেছি ।
    পিপ্মগুলোর টিটকিরি এড়াতে সামনে বাঁদিকে যে তিনতলা বাড়িটা ছিল, তার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলুম আমরা। দোতলায় উঠে দশ স্কোয়ার ফুট মতো বারান্দার তিন দিকে একাধিক দরোজায় দাঁড়িয়ে নানা বয়সের সুন্দরীরা।
    মাসি সামনে পানের ডাবর রেখে সুপুরি কাটছিল, পান সাজছিল ।
    মাসিকে বলা হল যে ইনি বিদেশ থেকে এসেছেন, বাঙালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে, কম বয়সী হলে ভালো হয়, যাকে প্রেমিকা-প্রেমিকা মনে হবে । মাসি একটা দরোজার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে বছর কুড়ির এক তন্বীকে দেখে পছন্দ হল ডেভিডের । গোলাপি অরগ্যাণ্ডির শাড়ি, কেবল বডিস পরে, খাঁজ দেখা যাচ্ছে, যদিও মেয়েটির খাঁজ তখনও ভালো করে গড়ে ওঠেনি । কম বয়সের বলে অন্যান্য যৌনকর্মীদের মতন কুৎসিত ভাবে সাজতে হয়নি মেয়েটিকে ।
    মেয়েটি আমাদের এতজনকে দেখে বলল, সবাইই নাকি, একসঙ্গে একের পর এক পারব না ; পনেরো মিনিট করে হাঁপ ছাড়ার সময় দিতে হবে ।
    সুভাষ বোঝালো যে, সবাই নয়, কেবল এই সায়েব, কোনো সায়েবের সঙ্গে ইয়ে করেছ কখনও ?
    ডেভিডের দাড়িতে হাত বুলিয়ে মেয়েটি বললে, না গো করিনি, তবে সায়েব বলে দাম কম হবে না, বলে দিচ্ছি ।
    বাসুদেব বলল, শুধু সায়েব হলেও আমাদের একটু নষ্টামি করতে দিতে হবে ।
    ফষ্টিনষ্টির নামে সবাই যদি এখানে সেখানে হাত দাও আর চুমু খাও, তাহলে দাম ডবল পড়বে কিন্তু ।
    আমি বললুম, ঠিক আছে, চলবে ।
    মাসিকে ডেকে মেয়েটি জানিয়ে দিল যে সবাই প্রথমে একটু ফস্টিনষ্টি করবে, তারপর সায়েবের সঙ্গে কাজ হবে । মাসি বললে ঠিক আছে, ডবল খরচ লাগবে, সায়েবরা তো বিদেশি টাকাও দেয় ।
    আমি বললুম, চলবে । জানি বাদবাকি সকলেই মহাকিপটে কিংবা চাকরি নেই ।
    সেইদিনের জন্য মেয়েটির নাম রাখা হয়েছিল বেবি । ওদের নাম প্রতিদিন বদলায় । মনে আছে । বেবি বলল, মদ আনাও, খেয়ে নিই আগে, মেজাজকে বাগে আনি ।
    ‘আমিও খেয়ে নিই’ বলে বাসুদেব বেবিকে জড়িয়ে ওর ঠোঁটে চকাচক-চকাচক কয়েকটা চুমু খেল । বাসুদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল যে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়ার গ্লানি আর কুন্ঠাকে কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছে ।
    বাংলা মদ এলে, সকলে তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল ; বেবিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল কেউ-কেউ । ডেভিড বলল, বাংলা মদ অনেকটা ক্যারিবিয়ান হোমমেড রাম-এর মতন স্বাদ ।
    ডেভিডকে ঘরে রেখে আমরা বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম আর এঘর-সেঘর থেকে ডাক শুনতে লাগলুম । চারিদিকে তাকিয়ে বিভিন্ন বাড়ির নারীদের দেখা গেল কে কেমন বিদকুটে সেজে আছে ।
    ডেভিড প্রায় আধঘণ্টা পরে বাটারফ্লাই স্ট্রোক সাঁতার কেটে বেরিয়ে এলো । বলল, সাচ এ স্মল কান্ট, অ্যাণ্ড দ্য বুবস আর সো স্মল ইউ ক্যাননট হোল্ড ইন ইওর পাম ; আই লাভড হার, টকড টু হার ইন ইংলিশ অ্যান্ড শি ওয়াজ ভেরি মাচ অ্যাটেনটিভ ।
    বুকে আঁচল চাপা দিয়ে বেবি দরোজায় এসে বললে, আরেকজন এসো, ডবল দাম দেবে যখন । দুই ঘোষভাইয়ের মধ্যে একজন ঢুকে গেল তড়িঘড়ি । দশ মিনিটেই বেরিয়ে এলো, হয়তো ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতার দিতে গিয়ে ডুবে যাবার আশঙ্কায় ।
    অবিনাশ কবিরাজ লেন থেকে বেরিয়ে আমরা সাঁতার দিলুম হিন্দি ‘জ্ঞানোদয়’ পত্রিকার সম্পাদক-লেখক শরদ দেওড়ার আড্ডায় । কাছাকাছি স্টুডিওয় গিয়ে আমাদের সবায়ের একটা গ্রুপ ফোটো তোলানো হল শরদের ইচ্ছায় ।
    ডেভিডকে নিয়ে আমি রওনা দিলুম দুমকা, দাদার আস্তানায়, মহুয়া, হাড়িয়ার জগতে ।


    শক্তিদা ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে দলবল নিয়ে সুবিমল বসাককে মারধর করার জন্য কফি হাউসের সামনে ঘিরে ধরেছিলেন । সুবিমলের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের যারা ছিল পালালো সবাই । বাসুদেব দাশগুপ্তও পালালো। সুবিমলের খোট্টা চিৎকারে শক্তিদার দলবলও ছত্রভঙ্গ ।
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থেকে ফিরেছিলেন । আমেরিকা থেকে শক্তি, সন্দীপন, উৎপল প্রমুখকে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলন ছেড়ে দেবার । তার প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল তাঁর ইয়ারদোস্তদের মাঝে । ওনার চিঠি প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হয়েছে, তা থেকে জানা গেছে যে উনি আশঙ্কা করেছিলেন ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীকে ভেঙে দেবার জন্যই হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা হয়েছে ।
    একদিন সন্ধ্যায়, আমিই খরচ করব জানিয়ে, বাসুদেব দাশগুপ্তকে ওর মুখের কোলাঝটা দেখাবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলুম খালাসিটোলায় ।
    ওর দুটো মুখের ওপর বসানো জাপানে আণবিক বোমার দরুণ জন্মানো এক বিকৃত শিশুর দেহ, যার মুখ বলতে প্রায় কিছুই নেই ।
    কোলাঝের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ কাঁদতে আরম্ভ করে দিল বাসুদেব ।
    বলল, তুমি আমার অবস্হার যথার্থ ব্যাখ্যা করেছ । এই যে আমার কপালের ওপর এক বিকৃত শিশুর লিঙ্গ এসে পড়েছে, এটাই আমার বর্তমান অস্তিত্ব, হয়তো এটাই আমার বেঁচে থাকার ব্যাখ্যা ।
    কি বলব বুঝতে পারলুম না । কেন কান্না, তাও জিগ্যেস করতে পারলুম না । ভাঙা প্রেম হয়তো খোঁচা হয়ে লুকিয়ে আছে । ভাবলুম, কাঁদছে, কেঁদে নিক, জমে থাকা কান্না বেরিয়ে যাক । সে সময়ে খালাসিটোলায় অনেককেই কাঁদতে দেখা যেত, তাই ওই পরিবেশে বাসুদেবের আচরণে কোনো ব্যাখ্যাহীনতা ছিল না ।
    বাসুদেবের সঙ্গে যেটুকু মিশেছি, ওকে মনে হয়েছে ভিতু প্রকৃতির । একাধিক বন্ধুবান্ধব সঙ্গে থাকলে ওকে সাহসী মনে হতো । একা থাকলে ভালনারেবল ফিল করতো ।
    হাংরি আন্দোলনের মুখোশ পাঠানোর ব্যাপারটা ওর পছন্দ হয়নি । সব সময় বলত, কিছু যদি হয়, যদি সরকার স্টেপ নেয়, ইত্যাদি । সুবিমল বসাকের আঁকা ড্রইংগুলো সম্পর্কেও বাসুদেবের ইনহিবিশান ছিল, বলত ওগুলো নোংরা হয়ে যাচ্ছে না কি । বিভিন্ন ট্যাবলয়েডের সংবাদে বা আমাদের কার্টুন কোনো কাগজে বেরোলে বলত, কাজগুলো বোধহয় উচিত হচ্ছে না । আসলে বাসুদেবের ভীতির কারণ যে পবিত্র বল্লভ নামে এক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক, যে পুলিশের কফিহাউস-ইনফমফার ছিল, তা আমরা তখন জানতে পারিনি ।
    সুভাষকে নিয়ে করা কোলাঝটা সুভাষের পছন্দ হল না । আমরা দুজনে অলিমপিয়ায় । সুভাষ বলল, বাসুদেবের প্রতি তোমার পারশিয়ালিটি রয়েছে, ওই কোলাঝটা আমার হবার কথা, আমি কপালে বিকৃত শিশুর লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছি ।
    সুভাষের সমস্যা ছিল যে বাসুদেবের ১৯৬২ সালে ‘রন্ধনশালা’, ১৯৬৪ সালে ‘রতনপুর’ প্রকাশিত হয়ে গেছে আর কফিহাউসে আলোচ্য হয়ে উঠেছে ; তখনও পর্যন্ত সুভাষের ‘আমার চাবি’ গদ্যটা বেরোয়নি ।
    সুভাষের আরেকটা অভিযোগ ছিল । যখন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কার্যক্রম চালাচ্ছে হাংরি আন্দোলনকারীরা তখন বাসুদেব দাশগুপ্ত চুপচাপ নিজের একটি কাহিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় জমা দিয়ে এসেছিল । পরবর্তীকালে যখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘এখন আমার কোনো অসুখ নেই’ উপন্যাস ওই একই বিগহাউস পত্রিকায় প্রকাশিত হল, তখন প্রথম অভিযোগের আঙুল তুলেছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত ।


    ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে আমাদের এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোল, সমীর রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত আর আমি, ১২০ ( বি ) আর ২৯২ ধারায়, দাদার জন্য একটা আলাদা ধারা, ২৯৪ যোগ হয়েছিল । কিন্তু সবাইকে গ্রেপ্তার করা হল না ।
    আমি, দাদা, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ গ্রেপ্তার হয়েছি শুনে, অনেকেই কলকাতা ছেড়ে যে যার গ্রামে চলে গিয়েছিল । রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তো ভয়ে সাহিত্যই ছেড়ে দিলে । সুবো আচার্যকে প্রদীপ চৌধুরী সঙ্গে চলে গিয়েছিল ত্রিপুরায় ওর বাড়িতে । সেখান থেকে প্রদীপকে গ্রেপ্তার করে এনেছিল কলকাতা পুলিশ, সুবো তখন আরও ভেতরে কোনো গ্রামে চলে গিয়েছিল ।
    কলকাতা ছেড়ে যারা চলে গিয়েছিল তারা ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ২রা নভেম্বর ১৯৬৪-এর ফোটোতে নেই । ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের রিপোর্টার লুই কার কলকাতায় এসে জ্যোতির্ময় দত্তর কাছে আমাদের খোঁজ করে । আমি আর দাদা সবাইকে সংবাদ পাঠাই যাতে সাক্ষাৎকারের জন্য গ্র্যান্ড হোটেলে উপস্হিত হয় ।
    মামলাটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে, ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার দায়ে । বাদবাকি সকলের ওপর থেকে আরোপ তুলে নিয়েছিল পুলিশ ।
    শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ হাংরি আন্দোলনের বিরোধীতা করে, মুচলেকা লিখে, আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে রাজি হওয়ায় ওদের বিরুদ্ধে চার্জ তুলে নেয়া হয়েছিল । আমার একমাসের কারাদণ্ডের আদেশ ওদের সাক্ষ্যের কারণেই হয়েছিল ।
    বাসুদেব দাশগুপ্তকে জেরার জন্য পুলিশ লালবাজারে ডেকে পাঠায়নি, তাই বাসুদেবকে কোনো এজাহার দিতে হয়নি । বাসুদেবকে তলব না করার প্রধান কারণ অবশ্য ছিল পবিত্র বল্লভ নামে লালবাজার পুলিশের প্রেস সেকশানের একজন খোচর, যে ‘উপদ্রুত’ নামে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করত, আর তারই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ ।
    পবিত্র বল্লভ যে একজন খোচর, কফিহাউসে লেখকদের ওপর নজর রাখে, লালবাজারের প্রেস সেকশানে লিটল ম্যাগাজিন জমা দেয়, তা জানতে পেরেছিলুম লালবাজারে ঘোরাঘুরি করে ; আমার মামলায় পবিত্র বল্লভ ছিল পুলিশের পক্ষে ভুয়ো সাক্ষী ।
    বাসুদেব কখনও পবিত্র বল্লভ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেনি । পবিত্র বল্লভ সম্পর্কে জানাজানির পরে বাসুদেব আমার আর দাদার কাছ থেকে সেসময়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল ।
    ১৯৬৫ সালের ৩ মে আমাকে চার্জশিট দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হতেই, সবাই কেটে পড়েছিল, মায় বাসুদেব দাশগুপ্ত । সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র আর পরে ফালগুনী রায় ছাড়া কেউই আদালতের ত্রিসীমানায় আসত না । আমার মোকদ্দমা চলেছিল পঁয়ত্রিশ মাস । বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষের মাও জে ডং, সাংস্কৃতিক বিপ্লব আর চিন-কিউবার মানবতাবাদী বিতর্ক তখন হাওয়া । কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, কিন্তু বাসুদেব কখনও বলেনি যে মামলার ডেট না থাকলে ওর অশোকনগরের বাসায় গিয়ে থাকি । থাকতে বাধ্য হতুম সুবিমলের জ্যাঠার স্যাকরার দোকানঘরে, আর টয়লেট ব্যবহার করতুম শেয়ালদার টয়লেটে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা দূরপাল্লার ট্রেনে ।
    তখন থেকে হাঙরের ঢেউয়ে একাই সাঁতার কাটা রপ্ত করে ফেললুম ।


    ফিকশান লেখকরা দুটি উপায়ে সাধারণত তাঁদের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যান । প্রথম উপায়ে তাঁরা চরিত্রগুলোকে সুস্পষ্ট ভাবে ছকে নেন, তাদের দেখতে কেমন, আচরণ কিরকম হবে, তাদের জীবনের ঘটনাবলী, এবং সর্বোপরি কাহিনির প্লট আগেই নিশ্চিত করে প্রারূপ তৈরি করে রাখেন । আরেকটি উপায় হল একটি আইদিয়াবিন্দু থেকে লেখকের কল্পনাশক্তি তাঁর কলমকে যেমন-যেমন এগিয়ে নিয়ে যায়, লেখক সেই প্রবাহের সঙ্গে চলেন । বাসুদেব দাশগুপ্তের রন্ধনশালা সিরিজের ফিকশানগুলো দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় লেখা ।
    সৌষ্ঠবের অবশ্যম্ভাবী প্রত্যয় নিয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত তার ফিকশানে গড়ে তুলেছে এক বিশেষ জগত যেখানে ক্রিয়া করে চলেছে অবিশ্বাস্য বাস্তব । ফিকশান বলছি, কেননা ছোটোগল্পের যে সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে আমরা পেয়েছি, তার আওতায় পড়ে না বাসুদেবের রন্ধনশালা সিরিজের গদ্য । জাগতিক চরিত্রের চৌহদ্দিতে বাসুদেব প্রদর্শন করেছে তার প্রভাববিস্তারী দক্ষতা, যে জগতে জীবন অতিবাহিত হয় কল্পনার সীমাহীনতার দ্বারা, যেখানে মৃতরা মরে না, যেখানে ইনোসেন্স সবসময় নিষ্পাপ, যেখানে যাপনপ্রক্রিয়ার জটিলতাগুলো আদপে জটিল নয় ।
    ইউরোপের সংজ্ঞাকে অস্বীকার করায় কাজ করেছে উত্তরঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ববোধ, যে দ্বন্দ্ববোধের মাধ্যমে বাসুদেব বিদেশী আর স্বদেশী অথবা সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক দুই কাহিনিবিন্যাসের সংঘর্ষজনিত বাস্তবকে আয়ত্ত করতে চেয়েছে । যদিও ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের ফিকশনগুলোয় ‘আমি’ বলে চলেছে ঘটনাগুলো, কিন্তু তা মেটাফিকশান হিসাবে নয় । হিন্দু পুরাণের অপ্রত্যাশিত ও অসম্ভাব্য ঘটনাবলীর সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। বাসুদেব প্রয়োগ করেছে উত্তরঔপনিবেশিক ফিকশন স্ট্র্যাটেজি, যার দ্বারা ইউরোপের ন্যাচারালিজম ও রিয়্যালিজমকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে ।
    প্রতীকি বলা উচিত নয় হয়তো, কিন্তু যে ঘটনাগুলো তিনি ঘটিয়ে চলেন, তাতে গুরুত্ব পায় প্রেমের প্রয়োজনীয়তা । তার ফিকশানের পৃথিবীকে সে নিজেই আবিষ্কার করেছে । অথচ ন্যারেটিভের শেকলগুলো বারবার ভেঙে ফেলেছে । কল্পনাশক্তিকে বাসুদেব ব্যবহার করেছে বাস্তবকে সমৃদ্ধ করার জন্য, তাকে এড়িয়ে যাবার জন্য নয় । বাসুদেবের অবাস্তবতার গভীর শিকড় রয়েছে বাস্তবে, কেননা তা বাস্তব থেকেই উদ্ভূত, আর রোশনি ফ্যালে অপ্রত্যাশিত ঘটনার সৌন্দর্যে ।
    মার্কেজের অথবা রুশডির ম্যাজিক রিয়ালিজমের সঙ্গে রন্ধনশালা সিরিজের ফিকশানগুলোর কল্পনাকে তুলনা করা যাবে না বলেই মনে হয় । মার্কেজ ও রুশডি স্বদেশের ইতিহাসের ঘটনাবলীর ওপরে গড়ে তুলেছেন তাঁদের ফিকশানগুলো, চরিত্রগুলো সেই ইতিহাস থেকে বাছাই করে তোলা । বাসুদেব রন্ধনশালা সিরিজের ফিকশানে ভারতের বা কলকাতার বা বাঙালির ইতিহাসকে আশ্রয় করেনি । কিন্তু মার্কেজের বা চার্লস ডিকেন্সের মজাদার অতিশয়োক্তিকে প্রয়োগ করেছে বাসুদেব । হয়তো মাশাদো দি আসিস, হোর্হে লুই বোর্হেস, হুয়ান রালফোর কল্পনাপ্রয়োগের সঙ্গে তুলনা করা যায় বাসুদেবের ফিকশানের দ্রুত জায়মান ঘটনাগুলোকে ।
    শহরের মাঝেই গ্রাম গড়ে তুলেছে বাসুদেব, কফিহাউসের মধ্যেই বিশাল গ্রাম, তবু তা আর্বান ফিকশান নয়। কল্পনার উড়ালের জন্য তার শেকড় অভিজ্ঞতায় সঞ্চয় করা বাস্তবে পোঁতা । শহর আর গ্রামের দ্বন্দ্ব । ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ফিকশানও আর্বান নয়, আবার তা গ্রামীণও নয় । বাসুদেবের বাস্তবতাকে বিশেষ চারিত্র দেয় আধাশহুরে সংবেদন, অলৌকিক রয়েছে সর্বত্র এবং তা রয়েছে প্রাত্যহিকতায় ।
    বামপন্হী হিসাবে বাসুদেব স্বপ্ন দেখতো, নিভৃত কুহকে আশ্রিত সেই সব স্বপ্ন, স্বপ্নের গভীরের সত্য, যা গড়ে তুলেছে একযোগে একাধিক সময় পরিসর, অতীত-বর্তমান একে আরেকের ভেতরে প্রবেশ করে যায়, ঘটতে থাকে আনন্দের ডিলিরিয়াস মুহূর্তপূঞ্জ ।
    পরবর্তীকালে, রাজনৈতিক বোধোদয়ে ক্রমে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল ।
    বাসুদেব ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের জন্য একটি পৃথক জনার তৈরি করে ফেলতে পেরেছিল, যা ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়, এবং সুররিয়ালিজমও নয় । প্যারাগ্রাফের ভেতরেই সংলাপ চলতে থাকে; একজনের সংলাপের সঙ্গে আরেকজনের সংলাপের যোগসূত্র থাকে না । প্যারাগ্রাফের মানদণ্ড অস্বীকার করে, প্যারাগ্রাফ যেখানে বদলানো দরকার সেখানে পরের প্যারায় না গিয়ে অবিরম চলতে থাকে । এক প্যারা থেকে ফিকশন পরের প্যারায় কেন গেলো, তার গোপন ইশারা আছে বটে কিন্তু তা ম্যাজিক রিয়্যালিজম ও পরাবাস্তববাদ কিংবা ঠাকুমার ঝুলির মতন ফেবুলিস্ট ফিকশানের শেকলগুলোকে মান্যতা দেয় না । শেকল জুড়ে দিতে থাকে ‘আমি’ নামের এক ব্যক্তিএকক, যার বর্ণনা কোথাও নেই ; কেবল জানা যায় যে সে চশমা পরে ।


    ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের ফিকশানে বহু চরিত্র উদয় হয় আর মিলিয়ে যায় ; ডিটেইল বাস্তব বন্দোবস্তের ভেতরে ঢুকে পড়ে এমন অবাস্তবপ্রতিম ঘটনাবলী যা সহজে বিশ্বাসযোগ্য নয় । বাস্তব ও দৈনন্দিনের পরিবেশে স্বাভাবিকত্ব পেয়ে যায় প্রকৃতির নিয়ম বহিভূত অতিপ্রাকৃত ছমছমে উপাদানসমূহ ।
    আমি বাসুদেবের ফিকশনকে পরাবাস্তব বলছিনা কেননা বাসুদেবের গদ্যের ফোকাস রয়েছে বস্তু বা মেটেরিয়াল অবজেক্টের ওপর এবং পৃথিবীতে যে সমস্ত জিনিসপত্র ও মানুষজন রয়েছে তার ওপর, যখন কিনা পরাবাস্তবে কাঙ্খিত হল বৌদ্ধিকতা, স্বতঃলিখন, ও অবচেতনের বাস্তব ।
    ত্রিস্তান জারা চেয়েছিলেন, প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি বিশ্ববীক্ষার অধিকারী করতে যার ভিত্তিতে সে ডিঙোতে পারবে ভণ্ডামি ও নীতিসীমার প্রাকার-পরিখা, এবং পৌঁছোতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে । আঁদ্রে ব্রেতঁ বলেছিলেন, প্রকৃত সত্য বিরাজ করে ব্যক্তিএককের অবচেতনে ; পরাবাস্তববাদীর উদ্দেশ্য হল তার স্বতঃলিখনের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে আবিষ্কার করা । বাসুদেবের গদ্যকে আমি স্বতঃলেখন বলব না । উল্লেখ্য যে বাসুদেব, তখন উনি মার্কসবাদী, বলেছিলেন. “আমার ক্ষুধা ছিল মানুষের সার্বিক মুক্তির ক্ষুধা ।” এই একই বক্তব্য রেখেছেন সুবো আচার্য, অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য হবার পরে, তাঁর গুরুদেবের ধর্মবোধের ভিত্তিতে ।
    বাসুদেবের ফিকশনগুলো বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি বা ফ্যানটাসি-গল্প নয় ; অর্থাৎ বাসুদেব এসকেপিস্ট ফিকশান লেখেননি ; সিরিয়াস ফিকশান লিখেছেন । বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি বা ফ্যানটাসি-গল্পও সিরিয়াস ফিকশান হতে পারে । সিরিয়াস ফিকশানের কাজ হল পাঠককে ন্যারেটিভের বিশ্ববীক্ষায় বিজড়িত করে নেয়া এবং সত্যের অনুসন্ধানে সাহায্য করা । বাসুদেব সিরিয়াস ফিকশানের একটি নিজস্ব জনার গড়ে তুলেছেন, যে ন্যারেটিভে সময় লিনিয়র নয়, কার্যকারণ-সম্বন্ধ তাঁরই আবিষ্কৃত, এবং দৈনন্দিন ও অপ্রকৃতে তফাত নেই । পরে বাসুদেব যখন মার্কসবাদী তত্বের আওতায় নিজেকে আটক করলেন তখন আর ‘রন্ধনশালা’ সিরিজের মতন ফিকশন তিনি লিখতে পারলেন না, তার কারণ তখন তাঁর বিশ্ববীক্ষা পালটে গিয়ে হয়ে গেছে বস্তুগত, অভিজ্ঞতাজাত এবং দৃষ্টবাদী ।
    শেষ পর্যন্ত লেখালিখি তাঁকে ছেড়ে চলে গেল ।
    [ রচনাকাল : জুন ২০১৫ ]
  • m | 012312.60.7812.131 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:২৫541300
  • The Beat and the Hungry generation: When losing became hip.

    By Goirick Brahmachari & Abhimanyu Kumar
    When Cafe Dissensus asked us to edit a special issue on the Beats and the Hungryalists, we were very unsure about the kind of response we might receive. But, during the next few months, we received a stream of submissions and solicited works from writers, photographers, poets, artists, Beatniks, Hungry generation enthusiasts and academic researchers alike. It was indeed an enriching experience to go through the pieces, to learn about the new areas that have remained unexplored, to acquaint ourselves with some critical questions that require attention within the scope of the Beat and the Hungryalist literature, and to trace the mutual connections and differences between the two schools, their triumphs and follies.
    For this special issue on the Beat and the Hungry Generation, in his superb essay, “Spring and Oblivion”, Indran Amirthanayagam revisits Allen Ginsberg’s Howl and Other Poems through his personal memory of the poet (who was close friends with his father), their interactions, the copy of the book gifted to his father by Allen and Ginsberg’s readings that Indran had attended.
    Poet and Beat researcher, Marc Olmsted’s essay investigates Ginsberg’s source and commitment towards Tibetan Buddhism and tries to find how he balanced it with his political views/socialism.
    While Marc Goldin (writer and Beat researcher) traces Burroughs and his pals, their days of haze and hallucinations all the way up to Tangier – its magic and influence on their writing, Uttaran Das Gupta’s “Performing the hobo in Jack Kerouac’s On the Road” questions if Kerouac was indeed a hobo and investigates if playing the hobo itself was an art of some sort, scrutinising it through theories of theatre. Titas De Sarkar does a fine critical survey of Hungryalist Manifestoes. Priyabrata Das’s survey of socio-economic, political and cultural condition of Bengal in the 1940s is a fine prelude to the Hungry Generation.
    Art critic (and wife of famous Hungryalist painter, Anil Karanjai), Juliet Reynolds’ essay is a comparative study of Art in Hungry Generation and Beat generation, its importance in both these schools (that were predominantly seen as a movement of poets/writers), and how the artists and the writers of both these generations inspired each other. Reynolds’ piece makes an interesting observation on how the image of a young girl became the symbol of inspiration for the Hungry Generation (artists in particular).
    In her fascinating essay on the women Beats, poet Pamela Twining (Partner of Beat poet, Andy Clausen) tells us how these women Beats have been over-shadowed by their male counterparts, yet, many of them have inspired a new generation of American girls to grow up differently. It also tells us about their rebelliousness, sexuality, and their contribution towards the feminist consciousness in the 1960s.
    Nandini Dhar’s strong feminist critic of Hungry Generation writers and their writing also brings in some necessary and interesting questions to the fore, though we have certain reservations about some of her readings of the Hungry poets.
    We also have a beautiful piece by Brinda Bose, who looks at the two decades of collaborations between Bob Dylan and Allen Ginsberg through poetry, music and films. Sagorika Singha’s review essay analyzes two Beatnik films, Rob Epstein and Jeffrey Friedman’s Howl and Walter Salles’ On the Road.
    Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury writes a first-hand account of her visit to the Roychoudhury residence in Kolkata, where she meets and converses with Samir Roychoudhury about Allen Ginsberg and the Hungryalist Movement.
    Tanmoy Bhattacharjee interviews Subimal Basak, who talks about his life and times. We also reprint The Sunflower Collective’s Interview with Malay Roychoudhury, the founder of the Hungry Generation and Juliet Reynolds, art critic and wife of the famous Hungryalist painter, Anil Karanjai.
    In this issue, we are delighted to include a wonderful photo-essay by well-known photographer, Sally Davies, who documents the East village, places in and around the apartment, where Allen Ginsberg lived until early 1980s. Matthew Bialer’s photo-essay makes time liquid and walks through the Fifth Avenue to remind us of the poem, ‘My Sad Self’ by Allen Gingsberg. Ishan Marvel and Akash Sangma take us through a Baul sojourn, one that inspired the Beats and The Hungryalists alike.
    Anuj Gupta, Yatin Dawra and Dhairya Gupta have an audio-visual montage that juxtaposes social commentary with electronica, while paying homage to the work of Beats, especially Ginsberg’s poetry.
    And finally some beat inspired poetry by Avner Pariat, Ishan Marvel, and Nellie Edwards to take a pause from the road and smoke a long one.
    We would like to point out here that as much as we would have liked to cover other Beats and Hungry Generation writers, due to the nature of submissions and some other reasons, it did not materialise. However, having said that, we believe we have covered some new areas that might give the Beatniks and the Hungry Generation enthusiasts some food for thought. Our other intension was to create a dialogue between the aficionados and researchers of the two schools of literature and art that we dig.
    While editing the issue, we realised that the reception of Hungry poetics is a more complex phenomenon. Their politics of non-conformation, their furious questioning of morality through obscenity (much like the Beats), may not always be comprehended, if seen through the lens of black and white.
    We hope you will enjoy reading!
    Guest-Editors:
    Abhimanyu Kumar is a journalist. His poems and fiction have appeared in several journals. He co-edits The Sunflower Collective.
    Goirick Brahmachari works as a consultant in a research organisation in New Delhi. His first collection of poems, For the love of Pork, was published from Les Editions du Zaporogue, Denmark in January, 2016. He co-edits The Sunflower Collective.
    ***
  • m | 012312.60.7812.131 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:২৭541301
  • জুলিয়েট রেনোল্ডস : ছবি আঁকা, হাংরিয়ালিজম ও বিট আন্দোলন
    দুটি আন্দোলনেই, কবি ও লেখকদের সংখ্যাধিক্যের কারণে, বেশ কম লোককেই পাওয়া যাবে যিনি তর্ক জুড়বেন যে বিট আন্দোলন এবং হাংরি আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ছিল সাহিত্যের আন্দোলন । দুটি আন্দোলনই ডাডাবাদীদের সঙ্গে তাঁদের তুলনাকে আকৃষ্ট করলেও, কেউই এই দুটিকে শিল্পের আন্দোলন বলতে চাইবেন না, যা কিনা ডাডা আন্দোলনকে বলা হয়, তাঁদের গোষ্ঠীতে সাহিত্যিকরা থাকলেও ।
    কিন্তু বিট এবং হাংরিয়ালিস্টদের ইতিহাস ও উত্তরাধিকারকে যদি খুটিয়ে দেখা হয় তাহলে সন্দেহ থাকে না যে যেমনটা আলোচকরা মনে করেন তার চেয়ে অনেকাংশে বেশি ছিল শিল্পীদের অবদান এই দুটি আন্দোলনে। বিট আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিশ্লেষণেই তা সত্য বলে প্রমাণিত হয় । তাঁদের আন্দোলনে শিল্পের যে স্হির-নিবদ্ধ সন্দর্ভ প্রধম থেকে ছিল তা কখনও থামেনি । অবশ্য মনে রাখতে হবে যে বিটদের সম্পর্কে তথ্যাদি ভালোভাবে নথি করা হয়েছে, যা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে হয়নি, ব্যাপারটা প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের ফাটলের অবদান । বিট আন্দোলন কাউন্টার কালচার হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে উদয় হয়েছিল, যখন কিনা হাংরি আন্দোলন তার কায়া পেয়েছিল দরিদ্র, অবিকশিত একটি দেশে, তাও তারা সীমিত ছিল একটি রাজ্যে বা এলাকায় । তাছাড়াও, হাংরি আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিকভাবে এমন করে দাবিয়ে দেয়া হয়েছিল যা বিটনিকদের ক্ষেত্রে একেবারেই ঘটেনি । গিন্সবার্গ, ফেরলিংঘেট্টি, কোরসো, বারোজ এবং বাকি সবাই তাঁদের কুখ্যাতিকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, তাঁরা তা না চাইলেও পেরেছিলেন । এর ফলে তাঁদের আন্দোলন বহুকাল টিকে থাকতে পেরেছিল এবং লতায় পাতায় বেড়ে উঠতে পেরেছিল, জনমানসে কাল্ট হিসাবে স্হান করে নিতে পেরেছিল ।
    অপরপক্ষে, ১৯৬১ সালে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী ও দেবী রায় যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তা কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারি লাঠিচালনা ও নিজেদের মধ্যে অবনিবনার কারণে স্তিমিত হয়ে যায়, অবনিবনার কারণ ছিল সরকারের লোকেদের দ্বারা আন্দোলনকারীদের হয়রানি ও নাকাল করার চাপ । অশ্লীলতার আরোপে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা ও পরে মলয়ের জেলজরিমানা ছিল হাংরি আন্দোলন ভেঙে ফেলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পনা । তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে নির্মম পুলিশি হানা দিয়ে বৌদ্ধিক ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, বই, পাণ্ডুলিপি এবং চিঠিপত্র ।
    হাংরি আন্দোলনের শিল্পীদের ক্ষেত্রে, বেনারসে, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় এবং সহযোগী শিল্পীদের ‘ডেভিলস ওয়র্কশপ’ নামে স্টুডিও তছনছ করে দিয়েছিল পুলিশ, নষ্ট করে দিয়েছিল তাঁদের আঁকা পেইইনটিঙ, আন্দোলনের নথিপত্র, যা পরে আর ফেরত পাওয়া যায়নি । সৌভাগ্যবশত অনিল করঞ্জাইয়ের কিছু কাজ, হাংরি আন্দোলনের লাগোয়া সময়ের, সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল এবং তাঁর সংগ্রহের দুর্মূল্য সম্পদ হিসাবে সংরক্ষণ করা গেছে, যেগুলোয় পাওয়া যাবে হাংরি আন্দোলনের আইডিয়া এবং উদ্বেগ । এগুলো থেকে হাংরি আন্দোলনকে আরও গভীর ভাবে বোঝা যায় । এটা বলা ক্লিশে হবে না যে শব্দাবলীর তুলনায় উদ্দেশ্যকে ছবি আরও স্পষ্ট করে মেলে ধরতে পারে। অনিল করঞ্জাই ( ১৯৪০ - ২০০১ ) ছিলেন হাংরি আন্দোলনের প্রতি সমর্পিত একমাত্র শিল্পী । একই ধরণের বিট চিত্রশিল্পী ছিলেন রবার্ট লাভাইন ( ১৯২৮ - ২০১৪ )। অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছেন যে বিট আন্দোলনের জন্ম দেয়ায় রবার্টের বেশ বড়ো অবদান আছে । রবার্টের সান ফ্রানসিসকোর বিশাল বাড়িতে বোহামিয়ান, পোশাকহীন, বুনো তরুণ-তরুণী বিট আন্দোলনকারীরা সবাই মিলে বিট আন্দোলনকে চরিত্র দিয়েছিলেন । বিট আন্দোলনের গ্রাফিক্স আর পোস্টার এঁকে দিতেন রবার্ট। অনিল এবং করুণাও হাংরি আন্দোলনে একই কাজ করতেন ।
    গিন্সবার্গ এবং রবার্ট নিজেদের মধ্যে নান্দনিক ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন । তাঁরা দুজনেই আণবিক কাখণ্ডে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত যুবসমাজের চেতনায় প্রতিফলিত অবক্ষয় ও মৃত্যুবোধকে নিজেদের কাজে প্রতিফলিত করতে চাইতেন, রবার্ট লাভাইনের কথায়, “স্হায়ীত্বের মিথ্যা” সম্পর্কে তিনি গিন্সবার্গের থেকে জেনেছিলেন । যে জগতের ভবিষ্যৎ নেই সেখানে স্হায়ী শিল্পকর্মের ধারণা তাঁকে অবশ করে দিয়েছিল, যা থেকে তাঁর মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ছিল যদি না তিনি বিটনিকদের সংস্পর্শে আসতেন । ‘পাগল, ল্যাংটো কবি’ হিসাবে লোকে গিন্সবার্গকে জানতো, এবং রবার্টকে গিন্সবার্গ বলেছিলেন ‘মহান উলঙ্গ শিল্পী’, দুজনেই সহকর্মী ও বন্ধুদের চরিত্র তুলে ধরেছিলেন নিজের নিজের কাজে, প্রথমজন জ্বলন্ত ‘হাউল’ কবিতায় এবং দ্বিতীয়জন তাঁর রেখা ও রঙে । তাঁর আঁকা যুবক গিন্সবার্গের অয়েলপেইন্ট ব্যাপারটাকে বিশদ করে তুলেছে ।
    বিটদের তুলনায় অনিল করঞ্জাই পোরট্রেট আঁকা বেশ দেরিতে আরম্ভ করেন । স্টাইলের দিক থেকেই আর্টিস্ট দুজন ভিন্ন, কিন্তু তাঁদের আঁকা বেশ কিছু পোরট্রেটে পাওয়া যাবে ব্যক্তিবিষয়ের কোমলতা । এটা অনিলের ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে করুণার বাচ্চা মেয়ের চারকোল স্কেচে, যে বাচ্চাটাকে অনিল জন্মের সময় থেকেই জানতো, আর হাংরি আন্দোলনকারীদের ম্যাসকট হয়ে উঠেছিল ।
    রবার্ট লাভাইন, প্রেমে গিন্সবার্গের প্রতিদ্বন্দ্বী, পিটার অরলভস্কির যে বিরাট পেইনটিঙ এঁকেছিলেন, সেইটিই ছিল গিন্সবার্গের সবচেয়ে প্রিয় ছবি । উলঙ্গ, সুন্নৎ না-করা লিঙ্গ যৌনচুলে ঢাকা, ছবিটা যৌনতা উত্তেজক হলেও দুঃখি আর বিষণ্ণ । গিন্সবার্গ লিখেছেন যে তিনি পিটার অরলভস্কির সঙ্গে পরিচয়ের আগে ছবিটা যখন দেখেছিলেন তখন ‘চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমে বিদ্যুৎপৃষ্ট বোধ করেছিলেন।’ সেই সময়কার মানদণ্ড অনুযায়ী গিন্সবার্গ এবং লাভাইন দুজনেই ছিলেন পর্নোগ্রাফার । কিন্তু কবির তুলনায় শিল্পী বেঁচে গিয়েছিলেন আদালতের হয়রানি থেকে, বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কেননা সত্তর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সামনাসামনি নগ্নতা এবং সমকামকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করা হতো । রবার্ট লাভাইনের মতো অনিল করঞ্জাইও নগ্নিকা এঁকেছিলেন এবং আদালতের চোখরাঙানি পোহাতে হয়নি । কিন্তু অনিলের ‘ক্লাউডস ইন দি মুনলাইট ( ১৯৭০ ) রোমা্টিক ক্যানভাসে বিট পেইনটারের তুলনায় অনিলকে ভিশানারি বলে মনে হয় ।
    প্রখ্যাত কবি এবং ‘সিটি লাইটস’-এর প্রতিষ্ঠাতা লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, যাঁকে ‘হাউল’ প্রকাশ করার জন্য অশ্লীলতার আরোপের মুখে পড়তে হয়েছিল এবং যিনি হাংরি আন্দোলনকারীদের মামলার সময়ে হাংরিয়ালিস্টদের রচনা প্রকাশ করেছিলেন, নিজেও শিল্পী ছিলেন । ফেরলিংঘেট্টির এক্সপ্রেশানিস্ট দৃশ্যাবলী, প্রথম দিকে বিমূর্ত, পরে ফিগারেটিভ এবং প্রায়ই সরাসরি রাজনৈতিক -- দর্শকদের নাড়া দেয় এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসাবে তাঁর গুরুত্ব বৃদ্ধি করে ।
    ‘নেকেড লাঞ্চ’ গ্রন্হের লেখক উইলিয়াম বারোজ, যাঁকে আইনের ফাঁদে পড়তে হয়েছিল, বিট জেনারেশনের একজন নামকরা সদস্য, তিনিও ছিলেন ভিশুয়াল আর্টিস্ট । কিন্তু বারোজের পেইনটিঙ এবং ভাস্কর্য প্রকৃতপক্ষে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী । তিনি অনেক সময়ে নিজের মনের গভীরতাকে তুলে ধরার জন্য চোখ বন্ধ করে আঁকতেন, যাগুলো হতো উন্মাদগ্রস্ত, কেবল কড়া মাদক সেবনের এবং অযাচারী যৌনতার ফলেই নয়। বেশ কিছু ক্যানভাসে বুলেটের ছ্যাঁদা আছে, তাঁর দর্শকদের জানাবার জন্য যে উইলিয়াম টেলের মতন গুলি চালাতে গেলে তিনি নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিলেন, স্ত্রীর মাথাকে খেলার বল মনে করে । বারোজকে বলা হতো ‘পাঙ্ক’-এর পিতা, পরে ‘পপ শিল্পের পিতা’ অ্যাণ্ডি ওয়ারহল-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন এবং দুজনে একত্র হলে আমোদ করতেন । অ্যাণ্ডি ওয়ারহল বন্দুকের ব্যাপার ভালোই জানতেন, যদিও তিনি ছিলেন আক্রান্ত, আক্রমণকারী নন । ‘দি ফ্যাক্টরি’ নামে খ্যাত ওয়ারহলের নিউ ইয়র্কের স্টুডিওতে বারোজ প্রায়ই যেতেন ।
    প্রথম দিকে বিটদের বিমূর্ত এক্সপ্রেসানিস্ট পেইনটারদের সঙ্গে একাসনে বসানো হয়েছিল, যদিও বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটাররা তাঁদের জীবনযাত্রায় বিটদের অচিরাচরিত ব্যক্তিগত জীবনের মতন ভবঘুরে ছিলেন না । তাঁরাও মিডিয়াকে ও দর্শকদের তাঁদের কাজের মাধ্যমে চমকে দেবার প্রয়াস করতেন । তাঁরাও, একইভাবে, প্রথানুগত আঁকার রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতেন । তার জন্য তাঁরা বিশাল বিশাল ক্যানভাসে দ্রুত তরল স্ট্রোক দিতেন ; একে তাঁরা বলতেন ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’, আর এই ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’ ছিল হাংরিয়ালিজমের মননবিন্দু । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটিঙকে এখন নৈরাজ্যবাদী মনে হতে পারে, যা বিট এবং হাংরি আন্দোলনের রচনাপদ্ধতিতে একই ধরনের ছিল বলা যেতে পারে, কিন্তু হাংরি পেইনটারদের শিল্পকলা ছিল সুচিন্তিত, তাঁদের কেঅস ছিল পরিকল্পিত ।
    একজন শিল্পী উন্মাদের মতন অনিয়ন্ত্রিত আবেগে এঁকে চলেছেন ব্যাপারটা নিছক ক্লিশে, এবং কম সংখ্যক শিল্পীই অনিল করঞ্জাইয়ের মতন এই ব্যাপারটায় জোর দিয়েছেন । নিওফাইট হিসাবেও, অস্হির তেজোময়তা ও পরিপূর্ণ জোশে অনিল করঞ্জাই এঁকেছেন প্ররিশ্রমান্তিক সুচিন্তিত ক্যানভাস । হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থাকার কারণে, যাঁদের মধ্যে তাঁর বয়স ছিল সবচেয়ে কম, এই বৈশিষ্ট্যগুলো গুরুত্ব পেয়েছে । যে একমাত্র শিল্পী তাঁকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন ডাচ শিল্পী হিয়েরোনিমাস বশ ( ১৪৫০ - ১৫১৬ ) । বশের গ্রটেস্ক বিদ্রুপাত্মক চিত্রকল্প অনিল করঞ্জাইকে অনুপ্রাণিত করত, যে সময়ে অনিল শ্রেণিবিভাজিত এবং শোষিত সমাজের একক ভিশন নিজের পেইনটিঙে গড়ে নেবার প্রয়াস করছিলেন । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিজম সম্পর্কে অনিল বহু পরে জেনেছেন ।
    সবচেয়ে কুখ্যাত বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট জ্যাকসন পোলক -- ‘ফোঁটাগড়ানো জ্যাক’ --- একজন ‘অ্যাকশান পেইনটার’, ক্যালিফর্নিয়ার ‘দি আমেরিকান মিউজিয়াম অভ বিট আর্ট’’-এ বহু শিল্পীর সঙ্গে স্হান পেয়েছেন । চরম ডাডাবাদী মার্সেল দুশঁও পেয়েছ, যিনি, বিটনিকরা জন্মাবার আগেই ‘অ্যান্টি-আর্ট’ শব্দবন্ধটির উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং সেকারণে বিটদের আদর্শ । কিন্তু শোনা যায় যে পঞ্চাশের দশকে যখন অ্যালেন গিন্সবার্গ ও গ্রেগরি কোরসো প্যারিসে দুশঁর সঙ্গে দেখা করেন, দুজনে নেশায় এমন আচ্ছন্ন ছিলেন যে গিন্সবার্গ দুশঁর হাঁটুতে চুমুখান, আর কোরসো নিজের টাই কেটে ফ্যালেন । বয়স্ক দুশঁর তা পছন্দ হয়নি । বিটদের সেসময়ের আচরণ এমনই স্বার্থপরভাবে অসংযত ছিল যে তাঁরা অনেককে চটিয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন, এমনকি জাঁ জেনেকেও, যাঁর আদবকায়দা মোটেই ভালো ছিল না ।
    বেনারসে বসবাসের সময়ে অনিল করঞ্জাই ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মাঝে ছবি আঁকার বিষয় নিয়ে কোনো অর্থবহ আলোচনা হয়েছিল বলে মনে হয় না । মার্কিন লোকটির আগ্রহ ছিল উচ্চতর ব্যাপারে প্রতি, অর্থাৎ সাধু, শ্মশানঘাট, মন্ত্র, গাঁজা ইত্যাদি । হিন্দি ভাষার বৌদ্ধ কবি নাগার্জুনের সঙ্গে অনিল ও করুণা অ্যালেন গিন্সবার্গকে হারমোনিয়ামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পাশাপাশি গিন্সবার্গ ও অরলভস্কিকে ছিলিম টানার কায়দা শিখিয়ে ছিলেন, যা প্রায় ধর্মাচরণের ব্যাপার এবং মোটেই সহজ নয় । এ ছাড়া হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকায় গিন্সবার্গ বিশেষ আগ্রহ দেখাননি । অনিলের খারাপ লাগেনি কেননা তাঁর বয়স তখন কম ছিল, আনন্দ পেয়েছিলেন ইংরেজিতে কথা বলার সুযোগ পেয়ে, যা ভাষায় অনিল তখন অত সড়গড় ছিলেন না । অনিল আর করুণা দুজনেই খ্যাতিপ্রাপ্ত মার্কিন সাহেবকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না, কিন্তু পরবর্তীকালে গিন্সবার্গের আমেরিকা কবিতার পঙক্তি চেঁচিয়ে অনিল বলতেন, “আমেরিকা তোমার ডিমগুলো কবে ভারতে পাঠাবে?”
    সন্দেহ নেই যে গিন্সবার্গ রেসিস্ট ছিলেন না, অন্তত সচেতনতার স্তরে । কিন্তু তাঁর মধ্যে সাদা চামড়ার মানুষের ঔদ্ধত্য ছিল, যা অন্যান্য বিটদের মধ্যেও ছিল । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন হওয়া সতবেও একটা স্তরে তা ছিল অত্যন্ত এলিটিস্ট । যেমন বারোজ, স্ত্রীকে খুন করার পরেও ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন, কেননা তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছিলেন এবং তাঁর পরিবার ছিল বৈভবশালী । গিন্সবার্গ ততোটা ধনী পরিবারের না হলেও বেশ কমবয়সেই সুপারস্টার হয়েগিয়েছিলেন । তিনি ভারতে এসে যতোই গরিব সেজে থাকুন, তা তাঁকে তাঁর মঞ্চ থেকে নামাতে পারেনি, তা ছাড়া ভারতে তিনি চামচাগিরির সুখও পেয়ে থাকবেন ।
    সম্ভবত হাংরি আন্দোলনকারীরাই একমাত্র তাঁর সঙ্গে সমানে-সমানে আইডিয়া আদান-প্রদান করেছিলেন এবং তাঁর কবিতায় ও ভাবনাচিন্তায় হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রভাব স্বীকার না করাটা তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করে না ।
    গিন্সবার্গ, যিনি ভারতের ধর্মে পরোক্ষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়, হাংরি আন্দোলনকারীদের ধর্ম সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তাকে গ্রহণ করতে পারেননি । হাংরি আন্দোলনকারীরা ঈশ্বরকে বিসর্জন দিয়েছিলেন আর যে কোনো ধরণের উপাসনা-অর্চনা সম্পর্কিত বিশ্বাসকে সমসাময়িক ভাষায় নিন্দা করেছেন । অনিলের শৈশব বেনারসে কাটার দরুন তিনি ছোটোবেলা থেকেই ধর্মে বিশ্বাস করতেন না ; তিনি মন্দিরের বয়স্কদের বারো বছর বয়স থেকেই চ্যালেঞ্জ করতেন, আর তাদের তর্কে হারিয়ে দিতেন হিন্দুধর্মের জ্ঞানের সাহায্যে । বিজ্ঞাননির্ভর মানসিকতা নিয়ে অনিল সারাজীবন আস্তিক ছিলেন । প্রথম দিকের বৌদ্ধধর্ম তাঁকে আকৃষ্ট করলেও অনিল তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সমালোচনা করতেন, আর শেষ জীবনে অ্যালেন গিন্সবার্গ এই ধর্মে ধর্মান্তরিত হন । অবশ্য বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে বিট কবিদের যুদ্ধবিরোধী রাজনীতির মিল ছিল, যেমনটা ছিল হাংরি আন্দোলনের অন্যান্য সদস্যদের ।
    হাংরি আন্দোলনকারীদের রাজনীতির কথা যদি বলতে হয়, শেকড়পোঁতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবাই যেমন তীব্র আক্রমণ চালাতো তাকে অনিল করঞ্জাই সমর্থন করতেন, কিন্তু তাদের অ্যানার্কিজমকে মেনে নিতে পারেননি অনিল । হাংরি আন্দোলনকারীদের বক্তব্য যে মানবাস্তিত্ব হল রাজনীতিরও আগের এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোকে বর্জন করা দরকার, তাও মানতে পারেননি অনিল । অনিল কিছু দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার আগেই বেরিয়ে আসেন । তা সত্বেও অতিবামের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল । হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার পরে তিনি নকশাল দলে যোগ দিয়েছিলেন, এই কথাটা সত্য নয় ।
    এ কথা সত্য যে বেনারস ও কাঠমাণ্ডুতে হাংরি আন্দোলনকারীরা যৌথ যৌনতার অর্গিতে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন, কিন্তু তা বিটদের যৌনজীবনের হইচইয়ের সামনে অত্যন্ত হালকা । অনিল এবং করুণা হিপি আর বিদেশি সাধক-সাধিকাদের সঙ্গে বেনারসে আন্তর্জাতিক কমিউনে বসবাস করেছিলেন, এমনকি করুণা ছিলেন সেই কমিউনের ম্যানেজার ও মুখ্যরাঁধুনি । চেতনার বিস্তারের জন্য তাঁরা এলএসডি, ম্যাজিক মাশরুম ইত্যাদি মাদক নিয়ে পাঁচিল ঘেরা জায়গায় নীরক্ষা করতেন । অনিলের চেতনায় এর প্রগাঢ় প্রভাব পড়েছিল কেননা অনিল দায়িত্বহীনভাবে মাদক সেবন করতেন না, পজিটিভ থাকার প্রয়াস করতেন, পেইনটার হিসাবে ভিশানের বিস্তার ছিল তাঁর কাম্য । ‘ড্রাগ অ্যাবিউজ’ বলতে যা বোঝায় তার খপ্পরে তিনি পড়েননি ।
    হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের পেইনটিঙ ইচ্ছে করে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, এটাও বাড়িয়ে-চাড়িয়ে তৈরি করা গালগল্প, ১৯৬৭ সালে কাঠমাণ্ডুর বিখ্যাত একটি গ্যালারিতে প্রদর্শনীর শেষে এই সমস্ত ব্যাপার ঘটেছিল বলে প্রচার করা হয় । লেখকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যাতে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল । করুণা তার যাবতীয় পেইনটিঙ পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলেছিলেন । অনিল করঞ্জাই একপাশে দাঁড়িয়ে মজা উপভোগ করেছিলেন । অমন শিল্পবিরোধী কাজ তাঁর মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি । অনিলের আইকনোক্লাজম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের ।
    হাংরি আন্দোলনকারীদের মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর কিছুটা অমিল থাকলেও, হাংরির নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে দিয়েছিলেন অনিল । ষাটের দশকে বেনারসের কমিউনে টানা বাহান্ন ঘণ্টায় আঁকা তাঁর ‘দি কমপিটিশন’ পেইনটিঙে তা প্রতিফলিত হয়েছে, কাজটা একটা বটগাছকে নিয়ে, যাকে তিনি উপস্হাপন করেছিলেন কেঅস এবং সময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের মেটাফর হিসাবে । এই পেইনটিঙে হাংরি আন্দোলনকারিদের উদ্দেশ্য যেমন ফুটে উঠেছে তেমনই বিটদের উদ্দেশ্য ; প্রকৃতিপৃথিবীর সঙ্গে মানুষের একাত্মতা, যে পৃথিবীতে অশ্লীলতা বলে কিছু হয় না এবং মানুষের ইনোসেন্স পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ।
    হাংরি আন্দোলনের পরের দশকগুলোয় অনিল করঞ্জাইয়ের অঙ্কনজগতে পরিবর্তন ও পূর্নতাপ্রাপ্তি ঘটলেও, হাংরি আন্দোলনের সময়কার অভিজ্ঞতা তাঁর চেতনায় থেকে গিয়েছিল । তাঁর আইডিয়াগুলো হয়তো বিভিন্ন সূত্র থেকে আহরিত, কিন্তু হাংরি আন্দোলনের লক্ষ্য তাঁর দৃষ্টির বাইরে ককনও যায়নি । তাঁর আঁকা পরবর্তীকালের ছবিগুলো অনেকাংশে ক্লাসিকাল, বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ । তাঁর ল্যাণ্ডস্কেপগুলো দেখলে প্রথমদিকের পরাবাস্তব চিত্রকল্পের বিরোধাভাসমূলক মনে হবে, যা তাঁর দর্শকদের বিভ্রান্ত করে । কিন্তু একথা নিশ্চয় বলা যেতে পারে যে প্ররোচনাদায়ক অলঙ্কারপূর্ণ চিত্রকল্প থেকে তিনি দূরে সরে গেলেও, ছবির ভিত্তিতে পরিবর্তন ঘটেনি । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনিল করঞ্জাইয়ের ছবিতে পাওয়া যাবে মানবাস্তিত্বের নাট্য যা প্রকৃতি নিজের মুড ও আঙ্গিকের মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছে । আর হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতার সঙ্গে তা খাপ খায় ।
    বিনয় মজুমদার তাঁর ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতায় চিত্রকল্পর আত্মাকে ধরে রেখেছেন, যখন তিনি বলেন:
    পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্হলী
    দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে
    তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
    চিরকাল থেকে ভাবে মিলাইবে শ্বাসরোধী কথা ।
    অনিল করঞ্জাইয়ের জীবনেও মিলনের এই স্বপ্ন বার বার ফিরে এসেছে তাঁর আঁকা ছবিগুলোয় । ১৯৬৯ সালে আঁকা ‘দি ড্রিমার’ নামের পেইনটিঙে অনিল স্পষ্ট করে তুলেছেন সৃষ্টিকর্মীর একাকীত্ব : সেই ‘ড্রিমার’ হাংরি আন্দোলনের সংঘর্ষময় এলএসডি মাদকে মুখিয়ে রয়েছে ; অনিলের আরেকটি ওয়াটার কালারে মলয় রায়চৌধুরীর ঘোষণা এসেছে ছবির থিম হয়ে । মলয় বলেছিলেন, “আমি মনে করি প্রথম কবি ছিলেন সেই জিনজাসথ্রপাস প্রাণী যিনি লক্ষ লক্ষ বছর আগে মাটি থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে তাকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন।” পরের দিকে অনিলের একা কবি ও দার্শনিকরা, পাথরে খোদাই করা, প্রকৃতির শৌর্যমণ্ডিত, তাদের অস্ত্র কেবল তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা । এই ছবিগুলো মহান আর্টিস্টের মতন করে আঁকা । হাংরি আন্দোলন-এ অনিলের মতন এমন একজন ছবি আঁকিয়ে ছিলেন যিনি মৌলিক ।
  • m | 012312.60.7812.131 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৩০541302
  • যখন কবি প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে শ্যাম্পেনের বোতলে বাঙলা খেতুম
    মলয় রায়চৌধুরী
    হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরীর কথা মনে পড়লেই শ্যামপেনের কথা মনে পড়ে । সঠিক উচ্চারণ শ্যামপেন না শপ্যাঁ ? প্রদীপ ভালো বলতে পারবে । ইউরোপে প্রায়ই ঢুঁ মারতো যৌবনে, বিশেষ করে প্যারিসে, বিশেষ করে ফরাসি ভাষায় লেখা বা অনুবাদ করা ওর কবিতা পাঠের জন্য বা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ফরাসি ভাষায় বক্তৃতার জন্য, বুদ্ধিজীবি সমাবেশে, রেডিওয়, টিভিতে । বদল্যার, র‌্যাঁবো, ভেরলেন, গীয়ম অ্যাপলিনেয়ারদের জমঘটের স্মৃতি-পরিসরে, পরাবাস্তববাদী আর ডাডাবাদীদের বিচরণ ক্ষেত্রের হাওয়ায় শ্বাস নিয়েছে, বেড়িয়েছে মঁপার্নাস, ল্যাটিন কোয়ার্টার আর প্যারিসের বিখ্যাত যৌনকর্মীদের প্রেম বিলোনোর প্রায়ান্ধকার সুগন্ধের অলিগলিতে, ওর চেয়ে প্রতিটি যৌনকর্মীই দীর্ঘাঙ্গী, আর হেনরি মিলারের ট্রপিক অফ ক্যানসারের পৃষ্ঠা থেকে নেমে আসা সুন্দরীরা, বদল্যারের কৃষ্ণাঙ্গী ভেনাসেরা, যাদের সঙ্গে ওর দহরমমহরম প্রদীপ চৌধুরীর আত্মজীবনী প্রকাশিত হলে হয়তো জানতে পারব কোনোদিন ।
    প্রদীপের কথা মনে এলেই মনে পড়ে শ্যামপেনের কথা । না এ শ্যামপেন ফরাসিদেশের বিখ্যাত শ্যামপেন এলাকার স্পার্কলিং ওয়াইন নয়, ফ্রান্সের শপাঁ এলাকার নয়, যে মদ তৈরির আছে নানান নিয়মকায়দা, কালো পিনো নয়ের আর কালো পিনো মেয়ঁর থেকে যা তৈরি হয়, যে মদ সতেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের রাজারাজড়াদের প্রিয় পানীয় ছিল, খ্রিস্টধর্মী মঠের মঙ্করা দায়িত্ব নিয়ে তৈরি করাতেন, খ্রিস্টধর্মী ভিক্ষুণিদের পা-দিয়ে থেঁতো-করা আঙুর থেকে, যে বুদবুদময় মদ যাযকরা আবিষ্কার করেছিলেন ১৫৩১ সালে, আকস্মিকভাবে, আর যার বোতল ফেটে ছিপি লাফিয়ে ওঠায় তাঁরা আনন্দে হাততালি দিয়ে মদটির ডাকনাম রেখেছিলেন ‘শয়তানের পানীয়’, তখন কিছুটা মিষ্টি হতো, তারপর তাঁরা শিখলেন বোতলে ছিপি কতোটা ভেতরে থাকবে, তৃতীয়াংশ ডুবে থাকবে বিশেষভাবে তৈরি বোতলের পানীয়তে, আর যা খাওয়া হবে শ্যামপেন ফ্লুট নামের গেলাসে । প্রদীপের সঙ্গে যেদিন স্মিরনফ ভোদকার বোতল কিনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলুম -- শক্তি চট্টোপাধ্যায় দুপুরে খেতে ডেকেছিলেন --- ওনার স্ত্রী মীনাক্ষী ওই শ্যামপেন ফ্লুটে খেয়েছিলেন ভোদকা, সেটিই ওনার মদ খাবার গ্লাস জানিয়ে ।
    ষাটের দশকের অনলপ্রবাহের পর প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে বহুকাল পরে, নব্বুই দশকে যখন আবার দেখা হল, প্রদীপ ডেকেছিল আমাদের, দাদাকে আর আমাকে সপরিবারে ওর রিজেন্ট পার্কের ফ্ল্যাটে,খানা-পিনার জন্য, পিনা বিশেষ করে, শ্যামপেন খাওয়াবে । বোতলটা শ্যামপেনের হলেও, তাতে ছিল বিশুদ্ধ খালসিটোলার বাঙলা, সেটাই হুল্লোড় করে খেলুম সবাই মিলে, প্রদীপকে জানতে না দিয়ে যে আমার মেয়ে-জামাই যতোবার বিদেশ থেকে আসে, চার বোতল করে মদ নিয়ে আসে, শ্যামপেন, সিঙ্গল মল্ট, স্কচ, আবসাঁথ, ভেরমথ, কনিয়াক, রাশিয়ান ভোদকা--- যা ওদের নিয়ে আসতে বলি--- কাঙারুর সসেজও । প্রদীপের বিল্ডিঙে ওর ভাইরাও থাকে দোতলা-তিনতলায়, ওর বাবার জমিতে বিল্ডারের তোলা ফ্ল্যাটে। তারাও জড়ো হয়েছিল হুল্লোড়ে, মনে হল প্রদীপের হাংরি আন্দোলনের সময়ের হলকায় ওরাও ছিল, সেই জেল-জরিমানা-রাজসাক্ষী-মুচলেকার দিনগুলোয় । প্রদীপের স্ত্রী গৌরী তখনও মারা যাননি ।
    প্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালে, কুমিল্লায় । এখন ওর বয়স তিয়াত্তর বছর । দেশভাগের পর ওরা ত্রিপুরায় চলে যায়, তা সত্ত্বেও প্রদীপের জিভে এখনও কুমিল্লার উচ্চারণের রেশ রয়ে গেছে । স্কুলে পড়েছে পার্বত্য ত্রিপুরায় । স্কুলে পড়ার শেষে প্রদীপের বাবা ওকে শান্তিনিকেতনের বিদ্যাভবনে ভর্তি করে দিয়ে যান, হোস্টেলে থাকার ব্যবস্হা করে । ওর প্রথম কবিতা ১৯৬১ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । প্রদীপ ১৯৬২ সালেই হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে, দেবী রায়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর, যখন কিনা শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ যোগ দিয়েছিল ১৯৬৩ সালে, দেবী রায়ের ডাকে ।
    শান্তিনিকেতনে থাকাকালে ‘স্বকাল’ নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা আরম্ভ করেছিল প্রদীপ । বিদ্যাভবনের ছাত্রী ঈশিতা ঠাকুরের প্রতি ইনফ্যাচুয়েশানে আক্রান্ত প্রদীপ নিজের কবিতায় যুবতীটির নাম উল্লেখ করে ; মেয়েটির তা পছন্দ হয়নি এবং বিদ্যাভবন কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করে । তাঁরা প্রদীপকে সতর্ক করে দ্যান কিন্তু ইনফ্যাচুয়েশানে আক্রান্ত প্রদীপের পক্ষে মেয়েটিকে ভোলা সম্ভব হচ্ছিল না । মেয়েটিকে আবার উল্লেখ করে নিজের কবিতায় । এখনকার মেয়েরা হয়তো দলবেঁধে যুবকটিকে গোটাকতক চড় মেরে বা হুমকি দিয়ে ছেড়ে দিত, কিন্তু এই ঘটনা পঞ্চাশ বছরের আগেকার তরুণীদের নিয়ে । সেই বিতর্কিত কবিতাগুলো প্রদীপ আমাকে পড়ায়নি ; ওই সংখ্যায় আমার কবিতা বা গদ্য ছিল না ।
    বিদ্যাভবন কর্তৃপক্ষ প্রদীপ চৌধুরীকে রাস্টিকেট করে দিলেন । প্রদীপকে বলা যায় হাংরি আন্দোলনের প্রথম ক্যাজুয়ালটি । বিহিষ্কারপত্রটা তুলে দিচ্ছি এখানে :

    নং. আই.ডি.পি/VII-১০/৬৩-১০ তারিখ ১৮ জুলাই ১৯৬৩
    শ্রীপ্রদীপ চৌধুরী
    আপনাকে সতর্ক করে দেওয়া সত্তেও এই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ থেকে আপনি বিরত হননি। কর্তৃপক্ষের নির্ণয় অনুযায়ী এই পরিসরে ছাত্র হিসাবে আপনার উপস্হতি কোনোমতেই কাম্য নয় । অতএব আজ দ্বিপ্রহরের পূর্বেই আপনাকে ছাত্রাবাস ত্যাগ করার আদেশ দেওয়া হচ্ছে এবং জানানো হচ্ছে যে যতো সত্বর সম্ভব আপনি আপনার ট্রান্সফার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নিন ও সমস্ত বকেয়া চুকিয়ে দিন ।
    কালিদাস ভট্টাচার্য পি.সি দাশগুপ্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
    অধ্যক্ষ বিদ্যাভবন প্রোকটর বিভাগীয় প্রধান
    শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী ইংরেজি

    বহিষ্কার সংক্রান্ত যে-চিঠি বিদ্যাভবন কর্তৃপক্ষ প্রদীপ চৌধুরীর বাবাকে লেখেন :
    নং. সি.এস.এস VII-I/৬৩/৭৯ তারিখ ১৮ জুলাই ১৯৬৩
    শ্রীপ্রমোদরঞ্জন চৌধুরী
    প্রিয় মহাশয়
    শ্রীমান প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর ।
    কয়েক মাস পূর্বে ‘স্বকাল’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় সে জনাকয় ছাত্রীর নামোল্লেখ করে একটি অর্ধ-অশ্লীল কবিতা লেখে । প্রচ্ছদে জানানো হয় যে পত্রিকাটি বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন হতে প্রকাশিত । তাকে ডেকে সতর্ক করে দিয়ে জানানো হয় যে ভবিষ্যতে যেন কোনো সংখ্যায় বিশ্বভারতীর নাম না থাকে এবং অশ্লীল কবিতা বা রচনা প্রকাশিত না হয়, অন্যথা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে ।
    পরবর্তী সংখ্যায় কেবল যে বিশ্বভারতীর নাম ছিল তা নয়, সঙ্গে অত্যন্ত অশ্লীল একটি কবিতে দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই, যা একজন ছাত্রের কাছ থেকে আশা করা যায় না, যদি তার রুচি অত্যন্ত নোংরা না হয় । অতএব বিশ্বভারতীর ছাত্র হিসাবে তার উপস্হিতি সম্ভব নয় এমন একটি নির্ণয় নেওয়া হয় এবং তাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বলা হয় । আদেশের একটি কপি পাঠানো হল ।
    শ্রীমান প্রদীপ চলে যাবার পর অ্যাকাউন্টস অফিসার জানিয়েছে যে ৪৫৫ টাকার বিশাল অঙ্ক সে বাকি রেখে গেছে।
    কালিদাস ভট্টাচার্য
    অধ্যক্ষ বিদ্যাভবন
    শান্তিনিকেতন

    বিশ্বভারতী থেকে রাস্টিকেট হবার পর বুদ্ধদেব বসু, নরেশ গুহ, দীপক মজুমদারের সৌজন্যে প্রদীপ কলকাতায় এসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ক্যাজুয়াল স্টুডেন্ট হিসাবে ভর্তি হয়, থাকতো পান্হনিবাস হোটেলে । যাদবপুর থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর এবং ফরাসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি পায় ।
    যে বুলেটিনটির জন্য মামলা দায়ের হয়েছিল, সেটি প্রদীপই ছাপিয়েছিল, কিন্তু শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষের মতন মুচলেকা দেয়নি এবং রাজসাক্ষী হয়নি প্রদীপ চৌধুরী । বুলেটিন ছাপাবার টাকা দেবী রায়কে আমি পাঠিয়ে দিয়েছিলুম, সুবিমল বসাক লেখা সংগ্রহ করেছিল আর তা কোনো প্রেসে ছাপাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পঞ্চাশ দশকের দাদারা সেসময়ে প্রেসে গিয়ে ভয় দেখাবার কারণে কোনো প্রেস ছাপতে রাজি হয়নি ।
    শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয়, অর্থাৎ ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, ওরা সেই দিনেই মুচলেকা লিখে দিয়েছিল, জানিয়েছিল যে হাংরি আন্দোলনে ওরা বিশ্বাস করে না, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ওদের কোনো সংশ্রব নেই । প্রদীপকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আনে এফ আর দায়ের হবার ছয় মাস পর, ত্রিপুরা থেকে, ৩১ মার্চ ১৯৬৫ তারিখে । প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে সুবো আচার্যও ছিল ত্রিপুরায় প্রদীপের বাড়িতে; প্রদীপকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে এসেছে দেখে সুবো সেই দিনই আরও ভেতরের একটি গ্রামে গিয়ে লুকিয়েছিল । একা আমার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হবার পর সুবো আচার্য ওর বিষ্ণুপুরের বাড়িতে ফিরেছিল । শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষের মুচলেকার কথা জেনেও প্রদীপ যে স্টেটমেন্ট লালবাজারে দিয়েছিল তা এই :
    My name is Pradip Choudhuri. I am appearing for M.A. ( English ) examination from Jadavpur University, this year as a casual student. I came in contact with the publication known as Hungry Generation sometime in 1962, while I was a student of Visva Bharati University. I had contributed one of my poems titled “বাবা আমার বর্বরতা” in the said booklet. I also sent a poem entitled “সাময়িকতা” To Debi Roy taking him as editor of the magazine as was published in the previous issue of the Hungry Generation. Later on while the paper was running high controversy among public, I enquired from Shakti Chattopadhyay about the motto of Hungry Generation who was one of the editors. From the very beginning my outlook was philosophical. Hungry Generation I considered an aesthetic movement and accordingly I even placed it to the Philosophical Congress of Shantinikatan. About the booklet in question I have only to confess that on someday in April 1963 Saileswar Ghose came to Panthanivas where I used to reside and they told me that another booklet was going to be published under the patronage of Malay Roychoudhury, Subo Acharjee and others who contributed in the booklet in question. I myself also felt some interest as one of my poem was going to be published. Saileswar and Subhas who were trying to publish the said booklet even before my coming to Calcutta but in vain. They told me whether I could solve the matter. Accordingly I introduced them to Dhananjoy Samanta of Mahendra Press at 58 Kailash Bose Street whom I knew earlier as I published a booklet entitled “স্বকাল” from them. Dhananjay Samanta agreed on our proposal of printing 300 copies entitled Hungry Generation, a Bengali booklet and duly received the manuscript copy from us with advance payment. I saw the proof along with Saileswar and Subhas at the press. I cannot say who actually gave the cost of printing for those booklet. It is a fact that I took delivery of those books from the press and kept at Panthanivas Hotel where I used to reside. In the evening of the date of delivery Saileswar and Subhas came to my hotel and we took some copies and went to Coffee House where we distributed free of cost few copies to the members present over there. I sent a copy to Samir Roychoudhury at his Chaibasa address forthwith. I left Calcutta in July 1964. I know the handwriting of Malay Roychoudhury.
    ত্রিপুরায় ৩১ মার্চ ১৯৬৫ গ্রেপ্তার হয়ে প্রদীপ চৌধুরী ৭ এপ্রিল ১৯৬৫ আমাকে এই চিঠিটা লিখেছিল, ও জানতো না যে তখন কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, আদালতে মামলা চলার দরুন দুবেলা খাবার মতন যথেষ্ট রেস্ত বাঁচে না, একই পোশাক পরে দিনের পর দিন চালাচ্ছি, হাগতে যাই শেয়ালদার দূর পাল্লার ট্রেনে, নিয়মিত স্নান করা হয়ে ওঠেনা, বেশির ভাগ দিন থাকি সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানে, বৈঠকখানাপাড়ায় ।
    প্রিয় মলয়,
    এর মধ্যে তোমাকে চিঠি, সুভাষকে চিঠি এবং টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি, তোমার ঠিকানা সম্পর্কে আমি শিওর নই, তাই আর কিছু করতে পারলাম না । ট্রাঙ্ক কল করার ইচ্ছে ছিল ।
    কলকাতার পুলিশ আমাকে ৩১ মার্চ ১৯৬৫ ত্রিপুরায় এসে গ্রেপ্তার করেছে ; কিন্তু আজ আর সেই প্রাথমিক উচ্ছ্বাস একদম নেই, জুজুর ভয়ও নেই । কবিতার বুকের ওপর চেপে বসলে সম্ভবত এইটেই ভবিতব্য । তুমি হাজতে বসে যা আমাকে লিখেছিলে -- আমি তার সিগনিফিক্যান্স আগে যেমন, এখন তার চেয়ে অনেক স্বাভাবিক, তাই অনেক ভয়ংকর করে ভাবতে পারছি ।
    অনেকদিন এমন নিঃসঙ্গতা ও ভয় এবং অনুশোচনায় কাটিয়েছি যে, কী দারুণ উৎকন্ঠার ভিতর আমি প্রদীপ চৌধুরীর যাবতীয় আবরণ খুলে, লাথি মেরে নষ্ট করে, একজন কবন্ধ লেখকে পরিণত হয়েছি । আমাকে না দেখলে, আমার মুখোমুখি না হলে, তুমি বুঝতে পারবে না । অসম্ভব দুঃখ পেয়েছি যেদিন শৈলেশ্বরদের ঠিকানা থেকে আমার বই ফেরত এসেছিল ( ওরা রিফিউজ করেছিল ) --- হ্যাঁ তখন থেকে আমার অসহায় দুঃখকে চাবুকের মতোই আমি নিজের শরীরে ব্যবহার করে আসছি ।
    এনি হাউ, আমি ১২ এপ্রিল দুপুর ১২-১২.৫০-এর মধ্যে দমদম বিমানঘাঁটিতে পৌঁছব । কলকাতা পৌঁছে ব্যক্তিগতভাবে আমার একমাত্র সান্ত্বনা থাকবে বিমানঘাঁটিতে পৌঁছেই যদি তোমাকে ও অন্যান্য সবাইকে দেখতে পাই । তারপর এয়ার-অফিসের গাড়িতে না এসে একসঙ্গে ট্যাক্সিতে করে ফেরা যাবে কলকাতায় ।
    ১৪ এপ্রিল কোর্টে সারেণ্ডার করার দিন । এর মধ্যে জামিনের সব ব্যবস্হা করে রেখো । আজ আর কিছু লিখি না--- লিখলে কেবল অনুশোচনা ও বর্বর সহানুভূতিই আমাকে কাটবে । ভালোবাসা জানাই । তোমার
    প্রদীপ চৌধুরী
    ৭ এপ্রিল ১৯৬৫
    ৩রা মে ১৯৬৫ আমাকে চার্জশিট দিয়ে বাকি সবাইকে রেহাই দিয়ে দিলে সবাই যে যার আস্তানায় ফিরে যায়, প্রদীপ চৌধুরী ত্রিপুরায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত অশোকনগরে । সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র ছাড়া কেউই আর কোর্টে আসতো না, আমার লেখা ছাপতেও ভয় পেতো ওরা। বাসুদেব-সুভাষ-শৈলেশ্বর “ক্ষুধার্ত”, ক্ষুধার্ত খবর” ইত্যাদি প্রকাশ করলেও তা থেকে “যারা উদ্বাস্তু নয়” তাদের বাদ দিয়ে দ্যায় ওরা, কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশানাল গাইতে-গাইতে । ব্যাংকশাল কোর্টে যে আমার এক মাসের সাজা হয়ে গেছে, হাইকোর্টে আমার শুনানি যে তখনও শেষ হয়নি তা প্রদীপ চৌধুরী জানতো না । বোঝা যায় প্রদীপের এই চিঠিটা থেকে :
    India Hotel
    প্রিয় মলয়, Surya Sen Street, Kolkata -9
    কলকাতা এসেই ভীষণ অর্থকষ্টে পড়ে গেছি । সঙ্গে বউও রয়েছে । তুমি আমার চিঠি পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কমপক্ষে ২০০ টাকা ধারদেনা করে হলেও পাঠিয়ে দাও । টাকাটা আমার ১ জুনের মধ্যে দরকার । DONT FAIL TO WIRE RUPEES TWO HUNDRED AT ONCE.
    এটাকে কোনো শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে দিও না ।
    বিয়ে করে আমি এতই crippled হয়ে পড়েছি যে কারোর সঙ্গেই ঠিকমতো সময় কাটাতে পারছি না । আমি তোমার T.M.O.-র অপেক্ষা করব । অসম্ভব risk-এর মধ্যে আছি ।
    ২৭ মে ১৯৬৭ প্রদীপ

    কলকাতা হাইকোর্টের রায়, ব্যাংকশাল কোর্টের দণ্ডাদেশ নাকচ করে বেরোয় ২৬ জুলাই ১৯৬৭ । তারপর থেকে আমার সঙ্গে প্রায় সকলের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় । বস্তুত মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হয়েছিল বলে সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে বহুকাল ঘৃনা পুষে রেখেছিলুম । ১৯৯৫ সালে যখন কলকাতায় ডেপুটি জেনেরাল ম্যানেজার হয়ে ফিরলুম, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জ ঘোরার, চাষি তাঁতি জেলে ক্ষেতমজুর উপজাতিদের সমস্যা বোঝার জন্যে ট্যুর করার প্রচুর সুযোগ পেতুম, আমার স্ত্রীকেও নিয়ে যেতুম সঙ্গে । ফিরে এসে সকলের সঙ্গে আবার দেখা করার ইচ্ছে হল, কে কেমন আছে, কী করছে জানার জন্য । প্রদীপ আমার নাকতলার ফ্ল্যাটের কাছেই থাকত, রিজেন্ট পার্কে । দাদা “হাওয়া৪৯” পত্রিকা বের করা আরম্ভ করলে প্রদীপকে নিয়ে আমি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলুম । দুর্ভাগ্যবশত প্রদীপ তখনও শৈলেশ্বরদের নিশিডাকে আক্রান্ত ছিল আর আমার প্রবন্ধটা অনুমোদন করাতে নিয়ে গিয়েছিল । প্রদীপকে ভালোমন্দ শোনানো হয়ে থাকবে । সঙ্গে দেবার জন্যে প্রদীপ নিজের একটা ফোটো এনে দিল যেটি প্রবন্ধলেখককে পা দেখাচ্ছে । আমি সেই ফোটোসুদ্দুই ছাপিয়ে দিয়েছিলুম প্রবন্ধটা । এখন প্রদীপ মনে করে ওকে নিয়ে লেখা সেইটিই সবচেয়ে উচ্চমানের বিশ্লেষণ ।
    শৈলেশ্বর ঘোষের বাড়ি কোথায় জানতুম না বলে প্রদীপকে অনুরোধ করলুম যে একদিন ও সঙ্গে চলুক । যেদিন যাবার সেদিন গড়িয়া বাস স্ট্যাণ্ডে দুঘণ্টা অপেক্ষা করেও প্রদীপের দেখা পেলুম না । প্রদীপ সেদিন শৈলেশ্বর ঘোষকে আগাম জানিয়ে দিতে গিয়েছিল যে আমি দেখা করতে যাচ্ছি । পরের দিন প্রদীপের সঙ্গে গেলুম শৈলেশ্বর ঘোষের বাড়ি । বেশ ভালো লাগলো, ছোট্টো বাংলো টাইপ বাড়ি । গল্প হল খানিকক্ষণ । কিন্তু বুঝতে পারলুম না এরকম বাড়িতে থেকেও বইয়ের আর পত্রিকার মলাটে দারিদ্র্যকে তুলে ধরা হয় কেন । কলকাতায় অনেক মধ্যবিত্ত কবি-লেখককে দেখেছি ভালো মাইনেপত্র পায়, ভালো খাওয়া-দাওয়া করে, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে গরিব সেজে থাকে বা নিজেকে গরিব দেখাবার চেষ্টা করে । সেই “সর্বহারা হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো, কমপিউটার না শেখা ভালো, কলকারখানা বন্ধ করিয়ে দেয়া ভালো” দর্শন থেকে বেরোতে পারেননি এনারা । প্রদীপ চৌধুরী নিজে অবশ্য ভালোভাবেই থাকে, শ্যামপেন-কনিয়াক খায়, বিদেশে যায়, ত্রিভাষিক পত্রিকা প্রকাশ করে, বিদেশি কবিরা অতিথি হয়ে আসেন ওর বাড়িতে, ছেলে-বৌমা-নাতনিকে নিয়ে বেড়াতে যায়। এখন “স্বকাল” পত্রিকার নাম রেখেছে “স্বকাল ফুঃ”। হাংরি আন্দোলনে অপদস্হ হবার কারণেই হয়তো, প্রদীপ বহুকাল কলকাতার কবি-লেখকদের সঙ্গে মিশত না, এখন কিছুকাল হল মেলামেশা আরম্ভ করেছে, বিক্রির জন্য ধ্যানবিন্দুতে কাব্যগ্রন্হ দিচ্ছে ।
    ত্রিপুরায় হাংরি আন্দোলনকে প্রসারিত করার চেষ্টা করেছিল প্রদীপ, সেলিম মুস্তফা, অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, অরূপ দত্ত, রত্নময় দে প্রমুখকে একত্র করে, কিন্তু অরুণ বণিকের নৃশংস হত্যার পর তা থিতিয়ে যায় । অলোক গোস্বামী “কনসেনট্রেশন ক্যাম্প” আর রাজা সরকার “ধৃতরাষ্ট” পত্রিকার মাধ্যমে যে ভাবে উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে পেরেছিল, তা ত্রিপুরায় সম্ভব হয়নি ।
    সমসাময়িক অনেক কবিকে সমালোচকরা বলেছেন নিঃসঙ্গ একাকী অসামাজিক অবসাদগ্রস্ত । অথচ প্রায় প্রতিটি সংকলনে এবং দুর্গোৎসব অমনিবাসে তাঁদের পাওয়া যাবে ! সেসব অন্তর্ভুক্তির জন্যে যে তৎপরতা এবং নেটওয়র্কিং প্রয়োজন, তাতে কিভাবেই বা, কেউ নিঃসঙ্গ একাকী অবসাদগ্রস্ত থাকেন ? প্রদীপ চৌধুরীকে ১৯৬৩ সালে দেখার পর, পরে নব্বুই দশকে তার সঙ্গে ওঠাবসা মেলামেশায়, তার বাড়ি যাতায়াত করে, এসব কথা মাথায় এসেছিল । “স্বকাল ফুঃ” নামে যে ত্রিভাষিক পত্রিকা ( বাংলা, ফরাসি, ইরেজি ) সম্পাদনা করে প্রদীপ, তার সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নন কলকাতার পাঠক । সন্দীপ দত্তের গবেষণাগারে গিয়ে গবেষকরা পত্রিকাটির প্রয়োজনীয় কপি খুঁজে পান না । বাঙালি পাঠকের কাছে যদি না পৌঁছোয় তাহলে ঠিক কি জন্যই বা লেখা ! সাড়ে পাঁচ দশকে মাত্র কয়েকটি বই বেরিয়েছে প্রদীপ চৌধুরীর, যার অধিকাংশই চটি : “অন্যান্য তৎপরতা ও আমি” ( ১৯৬৪ ), “চর্মরোগ” ( ১৯৬৫ ), “৬৪ ভুতের খেয়া” ( ১৯৭১ ) এবং “কালো গর্ত” ( ১৯৮৩ ), “রাত্রি”, “মত্ততা ও তারপর” এবং “কবিতাধর্ম” ; এছাড়া ফরাসি ভাষায় এবং ইংরেজিতে আছে কয়েকটি গ্রন্হ । ফলে, আপাতভাবে, তাকে সাইকোপ্যাথিক মনে হতে পারে । ট্র্যাংকুইলাইজার ও বারবিটুরেট নিতো বলে, মাদক সেবন করত বলে, তার চরিত্রে এবং কবিতার ও গদ্যের উপরিতলে অসঙ্গতি অস্হিরতা অসংলগ্নতা অনিশ্চয়তা এবং ঠাণ্ডা চাঞ্চল্য থাকে। “স্বকাল” পত্রিকার ৭৯ নম্বর সংখ্যায় হাংরি আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করেছিল প্রদীপ ।
    প্রদীপের কাছে একবার জানতে চেয়েছিলুম যে কেন সে কলকাতার কবিদের সঙ্গে মিশ খেতে পারে না, যখন কিনা সে ইউরোপীয় কবিদের সঙ্গে কাফে-পাব-কবিতাআড্ডায় সহজে মেলামেশা করে ? বাঙালির বর্তমান সমাজে তার কি সততা নষ্ট হবার আশঙ্কা ? প্রদীপ চৌধুরী বলেছিল ও নিশ্চিত নয় । প্রদীপ বলেছিল, ওর তাবৎ ব্যাপার ইন্সটিংকটিভ, এমনকি কবিতা লেখে আর্জ থেকে । ডাডাবাদ ও পরাবাস্তববাদকে ছাপিয়ে যে বিকার ওর কবিতায় থাকে, তা অস্তিত্বকে কদর করার নান্দনিকতা, কেননা জ্ঞানপ্রাপ্তি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যে-কোনো জ্ঞান । বিলুপ্তির উদ্বেগ থাকে প্রত্যেকেরই, এবং উপেক্ষার ব্যবহার কমিয়ে আনা কঠিন । প্রদীপের কবিতায় তাই নান্দনিকতার নয়ছয়, শিল্পের ভূক্ষয় । তাছাড়া শান্তিনিকেতনে ঈশিতা ঠাকুর, যাদবপুরে ইলিনা রায় আর ত্রিপুরায় গৌরীর সঙ্গে ওর সম্পর্কগুলো ভাঙচুর করেছে প্রদীপকে । গৌরীকে ও বিয়ে করেছিল কিন্তু কলকাতায় এসে মারা যান গৌরী ।
    ষাট দশকের আগের কবিদের রচনার সঙ্গে যদি প্রদীপ চৌধুরীর কবিতা তুলনা করি তাহলে দেখবো যে হাংরি আন্দোলনের শুরুতেই প্রদীপ জীবন থেকে সরাসরি যুক্তিহীন ও অসম্ভাব্য অসঙ্গতিমূলক ছকভাঙা শব্দবিন্যাস টেনে নামিয়েছিল । যে-সময়ে কাব্যগ্রন্হের নাম রাখা হচ্ছিল “যৌবন বাউল”, “একা এবং কয়েকজন”, “হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য”, “দিনগুলি রাতগুলি”, “উতল নির্জন”, “সহজ সুন্দরী”, সে সময়ে প্রদীপের যে তুমুল বদল ঘটে প্যারাডাইমে ও চেতনায়, তা ধরা পড়ে “চর্মরোগ” বা “৬৪ভুতের খেয়া” নামকরণ থেকে । প্রচ্ছদগুলোও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন । আধুনিক কবিতা বলতে যে নান্দনিক ব্যাখ্যাযোগ্যতা স্বীকৃত ছিল, তাকে প্রথম থেকেই একেবারে এলোমেলো করে দিয়েছে প্রদীপ, প্রবেশ ঘটিয়েছে যুক্তিভাঙনের, মুক্তসূচনার, মুক্তসমাপ্তির । প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছে তাড়না এবং মুর্চ্ছাপ্রবণতাকে । মনে রাখা দরকার যে জীবনানন্দ ছাড়া পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত কবিতাকে সিকোয়েনসিং ও লজিক থেকে মুক্তি দেননি কবিরা । ওর কবিতায় রয়ে গেছে ত্রিপুরার জামাতিয়া রিয়াং ককবরক জনজীবনের চাপা দুর্জ্ঞেয় প্রভাব, জীবনের এলাহি ও ক্রুর অরডিয়ালের প্রতিচ্ছায়া, ত্রিপুরার বিদীর্ণ উপজাতি সংস্কৃতি এবং সেই ভূখণ্ডে বহিরাগত বঙ্গসংস্কৃতির দ্বিমুখী চাপের মাঝে বহুত্ববাদী জিজ্ঞাসাবোধ।
    তাবৎ ফর্ম থেকে মুক্ত কবিতার সূচনা করতে চেয়েছিল প্রদীপ ।
    কবিতা লেখার জন্য প্রদীপ চৌধুরী ভালো চাকরি-বাকরির দিকে গেল না, একটা প্রাইভেট ছোটো ইশকুলে মাস্টারি করে কাটিয়ে দিল সারা জীবন । বাবার জমিতে ফ্ল্যাটের সুবিধা না থাকলে ওই চাকরি করে প্রদীপের সংসার চালানো কঠিন হতো ; ওর স্ত্রী গৌরী সরকারি চাকরি করতেন ত্রিপুরায়, তাঁকেও চাকরি ছাড়িয়ে কলকাতায় নিয়ে চলে এসেছিল । জীবনের পুরো ব্যাপারটা নিয়ে প্রদীপের যে কারবার, নিজেকে কলকাতার কবিদের থেকে আলাদা করে রাখার চেষ্টা, সবাইকে এড়িয়ে যাবার ঝোঁক, নিজের কলকাতার বাড়িতে ঘরকুনো অথচ বিদেশে হরফনমওলা, তার বাংলা কবিতার বই কেউ পড়ছে কিনা, সে ব্যাপারে আগ্রহের অভাব, পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিনে ওর বইয়ের রিভিউ বা আলোচনা সম্পর্কে স্পৃহাহীনতা, সব মিলিয়ে একজন জটিল প্রদীপ চৌধুরীর ছবি গড়ে ওঠে ; যন্ত্রণার অভীষ্টে হয়তো কোনো গোপন আনন্দ আছে । কলকাতায় প্রদীপের নিকটবন্ধু, ও হয়তো উপদেষ্টা, ছিল কেবল শৈলেশ্বর ঘোষ ।
    লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির “সিটি লাইটস জার্নাল”, ডিক বাকেনের “সল্টেড ফেদার্স”, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ডের “ইনডিয়ান পোয়েমস” এবং বিট আন্দোলনের সময়ে বহু পত্রিকায় হাংরি আন্দোলনের কবি-লেখকরা যাতে অন্তর্ভুক্ত হন আমি সে চেষ্টা করতুম বলে আমেরিকা-ইউরোপে হাংরিদের লেখাপত্র পৌঁছোতে পেরেছিল । প্রদীপ বহুবার গেছে বিদেশে, বহু পত্রপত্রিকায় ইংরেজি আর ফরাসি ভাষায় লিখেছে, কিন্তু কখনও চেষ্টা করেনি যে ওর লেখার পাশাপাশি অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের অনুবাদকরা লেখাও প্রকাশিত হোক ।
    এক অভ্যন্তরীণ নকশায় সম্পর্কিত, প্রদীপের কবিতা, এলোমেলোভাব সত্বেও, স্বয়ংসম্পূর্ণ ; মনে হয় সচেতনভাবে নিরীক্ষা করে না । সামান্য টেনশনে ওর মেটাবলিজম বিঘ্নিত হয় । এই সংবেদন থেকে একাধিক ইন্দ্রিয়চেতনার অর্গল ভেঙে বেরোয় প্রদীপের শব্দ আর রূপকল্প, শৃঙ্খলাবর্জিত, ছিন্নভিন্ন, বিস্রস্ত, কিন্তু তা অটোমেটিক রাইটিং নয়, কেবল অবচেতন নির্ভর নয় । স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনিসংঘাত মডুলেশানের প্রয়োগ নিয়ে, পাঠকের কথা মনে রেখে, নিরীক্ষা করেনি প্রদীপ । উপজাতিদের স্বরগ্রাম আবার স্মরণ করতে হয় । মোটামুটিভাবে রবীন্দ্রনাথের মডুলেশান থেকে বাংলা কবিতা যে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারেনি তা কবিতাপাঠের আসরগুলোতে গেলে টের পাওয়া যায় । সেনেট হলে জীবনানন্দ যখন নিজের কবিতা পড়েছিলেন, অনেকেই ভেবেছিলেন উপস্হিত অন্যান্য কবিদের মতো তিনিও রবীন্দ্রনাথের মডুলেশান দেবেন । ক্ষমার অযোগ্য এই ধারণা । প্রত্যেক কবিরই নিজের ফোনেটিকাল কাঠামোয় গড়ে ওঠে তাঁর কবিতা । একজন কবির থেকে আরেকজন কবির ফোনেটিক কাঠামো আলাদা হওয়া জরুরি নয়তো প্রভাব রয়ে যাবার প্রশ্ন ওঠে । কবিতার ইশারা ছন্দ শব্দ যা-ই হোক না কেন, তা যদি রাবীন্দ্রিক পাঠের ও আবৃত্তির ফ্রেম থেকে বেরোতে না পারে, তাহলে তাকে সত্যিই সমসাময়িক বা রবীন্দ্রোত্তর বলা হবে কিনা তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে । প্রদীপের ফোনেটিকাল কাঠামো এবং ওর কবিতার মডুলেশান-যোগ্যতা একেবারে আলাদা, ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই তা টের পাওয়া যায় ।
    আমি এখানে এজিটপ্রপের ফোনেটিকসের কথা পাড়ছি না । বস্তুত প্রদীপের যাপনপ্রক্রিয়া এবং কবিতার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, দায়বদ্ধতা, সমাজমনস্কতা ইত্যাদি ইশ্যুগুলো ক্লিশে মনে হয় । হাংরি আন্দোলনের সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত দরবারি বামপন্হার আশ্রয় নিয়েছিল, যখন কিনা পশ্চিমবঙ্গে সেসময়ে চলছে রক্তচোষার দিগ্বিজয় । প্রদীপ চৌধুরী অমন প্রাতিষ্ঠানিকদরবারের আশ্রয় নেয়া দরকার মনে করেনি । প্রদীপের চোরাগোপ্তা নাস্তিক্যবোধ সামগ্রিক । তাঁর কবিতায় মৌনতা যেমন নেই, তেমনই নেই চিৎকার, যা হাংরি আন্দোলনের কবি ত্রিদিব মিত্রের “হত্যাকাণ্ড” কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । প্রদীপের কবিতায় আছে গোঙানি ; যন্ত্রণাশীর্ষেও যেখানে শেষতম সহ্যশক্তি অটুট থাকে । কবি তার ক্রাইমের জায়গায়, অর্থাৎ কবিতায়, ফেরত যেতে বাধ্য হয় । নিজস্ব ধাঁধা-লোকসানে আটক জেরিক্যান প্রস্তুতকারকদের, মড়ার মাচান বিক্রেতাদের, কবর খুঁড়িয়েদের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থব্যবস্হায়, প্রদীপ চৌধুরী জানে যে তার জায়গা কোথাও নেই । আর ওর কোনো ডুপ্লিকেটও সম্ভব নয় ।
    রুদ্ধতা বদ্ধতা বন্দীত্ব ভবিষ্যতহীনতা ধূসর বিবর্ণ শূন্যগর্ভ নেতি ইত্যাদি ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছে প্রদীপ, কেননা তারুণ্য থেকেই অনির্বাণ যৌনতা আছে তার অস্তিত্বের কেন্দ্রে। সমর সেন থেকে ভাস্কর চক্রবর্তী পর্যন্ত, এমনকি হাল আমলের তরুণতম কবিদের কয়েকজনের ক্ষেত্রেও, নিজেকে হেয় করার নাগরিক কবিত্বে যে বিচ্ছিন্নতাবোধের আধুনিকতায় উত্তরণ, প্রদীপ চৌধুরী তা থেকে চিরকাল দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছে । অবশ্য ফরাসিদেশের এখনকার কোন-কোন কবিদের সঙ্গে ও মিশেছে, বর্তমান ফরাসি কবিতার রেশ প্রদীপ চৌধুরীর কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে কিনা, তা আমি বলতে পারব না ।
    প্রদীপকে জানতে পারবো এ-কথা মনে রাখলে যে প্রাইমেট মাত্রেই স্বমেহনের হকদার, কেননা তা তাকে কীট বা পাখি বা সরিসৃপ বা জানোয়ার থেকে পৃথক ও গৌরবান্বিত করে । মানব ইথসের মূল হল যৌনতা । মাদক নেয়াটাও মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে । উপজাতি মানুষের কাছে মাদক স্বাভাবিক, তা তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ । যৌনতা ভাষার সীমাকে ভাঙে । ভাষা না জেনেও যৌন সম্পর্ক সম্ভব এবং কাম্য । তাতে সংলাপবর্জিত বার্তাবিনিময় ঘটে --- কবিতার ভরকেন্দ্রের ইশারার সঙ্গে যা তুলনীয় ।
    বিশ্বভারতী ছাড়ার সময়ে কেঁদেছিল প্রদীপ । প্রদীপের ধারণা ছিল যে, যেহেতু ও একজন কবি, রবীন্দ্রনাথের সম্পত্তির ওপর ওর অধিকার আছে । প্রদীপের কবিতা থেকে অতিষ্ঠতা তাই যেতে চায় না । তার মানসদুনিয়ায় প্রকৃতিস্হতা আর অপ্রকৃতিস্হতার ডিকটমি নেই ; পাঠককে ঘিরে ফেলতে হবে ছবি-শব্দের জলস্তম্ভে । যে-কালে বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে সংক্ষিপ্ত এবং মেদহীন, প্রদীপ মনে করে যে কবিতাকে হতে হবে ভারবোজ, অতিকথনের লতায় জড়িয়ে নিতে হবে পাঠককে, বোধের ধারাপ্রবাহকে চিন্তা দিয়ে আখছার টুকরো করে ফেলতে হবে, কেননা প্রদীপের মতে কবিতা লেখার অছিলা হয় না, সেকারণে একের পর এক হাইপার রিয়াল কবিতা আসতে থাকে ওর কবিতায় । প্রদীপের কবিতা তাই গাটারাল ও লাবিয়াল মিশ্রিত। প্রচুর ঝুঁকি নিতে হয়েছে সেকারণে । ফ্রেমের পর ফ্রেমে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে চকিত বর্তমানকে । ও চারিয়ে দিচ্ছে অতিরেক, চারিয়ে দিচ্ছে ভারবোজ অতিকথন, চারিয়ে দিচ্ছে ধাতুকীটের শয়তানি ।
    [ রচনাকাল : এপ্রিল ২০১৬ ]
  • m | 012312.60.7812.131 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৩৪541303
  • যখন হাংরি আন্দোলনে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পেণ্ডুলাম ছিলেন
    মলয় রায়চৌধুরী
    প্রথমে পড়ুন দেবশিস মজুমদারকে দেয়া সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই সাক্ষাৎকার-চুটকি, তারপর আরও কিছু সন্দীপনীয় মাল-মশলার সঙ্গে পরিচয় করাবো ।

    ‘কৃত্তিবাস’-এর সূত্রেই শক্তির সঙ্গে আলাপ এবং শক্তির সূত্র ধরেই ‘হাংরি জেনারেশনে’র সঙ্গে যোগাযোগ। হাংরির প্রতি এই আকর্ষণের কারণটা কী ছিল?
    প্রথম কথা, আমি হাংরি জেনারেশনের লেখক নই। যদিও বুলেটিনে হয়তো একবার ২/৪ লাইন লিখেছি কিনা মনে নেই। তাতে হাংরি বলে কিছু ছিল না। যেমন, হাংরি জেনারেশন বলে যদি কোনো আন্দোলন হয়ে থাকে তাতে যোগদান করার কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে মলয়রা যাদের ‘হাংরি’ লেখক বলে মনে করেছিল তাদের মধ্যে অবশ্যই আমি একজন। জীবনানন্দ দাশও একজন। সমীর আর শক্তির প্রতি আমার বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রেই যেটুকু। কিন্তু সব খবর রাখতামও না। একবার একটা আড্ডায় আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তাহলে কিছু মুখোশ কিনে বিভিন্ন লোককে পাঠানো যাক। ওপর থেকে নিচে সমস্ত স্তরের লোককেই। সে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ই হোক আর সাগরময় ঘোষই হোক। ঠিক হল মুখোশে লেখা থাকবে – ‘মুখোশ খুলে ফেলুন।‘ দ্যাট ওয়াজ মাই আইডিয়া। আর আমার আইডিয়া বলে সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে গিয়ে মুখোশগুলো কিনতে হল। এই রকম সব ঘটনা আর কি। তারপর ওরা যখন অ্যারেস্ট হল তখন আমি বিয়ে করেছি, ৬৪ সালের কথা। সত্যিকথা বলতে কি রীণারা খুবই অভিজাত পরিবারের মেয়ে। এই যেমন ধরো ওর দাদা পাঁচটা আংটি পরে। যারা উত্তর কলকাতায় থাকে। চামড়া রক্তাভ। তা যাইহোক, বিয়ে করে দমদমে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি, এমন সময় একদিন লালবাজার থেকে ডেকে পাঠালেন। আমার কিন্তু সাহস বলতে যা বোঝায়, তা হল ভীরুর সাহস। আমাদের দলে সাহসী বললে বলতে হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। এবং বারবার যে ওর দিকে আকর্ষিত হই তা ওই সাহসের কাছে। আর বাকি সব ভীতুর দল। তখন তো সুনীল এখানে নেই – আইওয়াতে। এদিকে এখানে এরা সব আন্দোলন করেই খালাস। লিখতে যে হবে সে ধান্দা তো নেই। লেখক বলতে যা তা ওই আমি, শক্তি আর উৎপল। আর একজনের কথা বলতে হয়, তাকে হাংরি জেনারেশনই বল আর যাই বল, সে হচ্ছে বাসুদেব দাশগুপ্ত।

    সত্যিই, আজও ‘রন্ধনশালা’র গল্পগুলো পড়লে অভিভূত হই।
    ওই রকম বই ওই সময় ওই একটাই। তা, বাসুদেব তো লিখলো না। আসলে লেখাটাই হচ্ছে প্রকৃত বিপ্লব করা আর সেটাই করে যেতে হয়। যাই হোক, হাংরি জেনারেশনের একটা সংখ্যা বেরিয়ে গেল পাটনা থেকে যাতে খুবই অশ্লীল লেখাটেখা ছিল। সেই পত্রিকার প্রিন্টার অ্যাণ্ড পাবলিশার হিসাবে ছিল আমার নাম।

    আপনি জানতেন না?
    উইদাউট মাই নলেজ – টোটালি। সেইজন্য লালবাজারে গিয়ে আমি বলেছিলাম যে, এই সংখ্যাটা আমি ছাপিনি বা প্রকাশ করিনি। কিন্তু সাক্ষী দেওয়ার সময় মলয়কে সম্পূর্ণভাবে ডিফেণ্ড করি। বলি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইরকম এক্সপেরিমেন্ট হয়েই থাকে। আজ যা অশ্লীল, পরে তাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হয়ে দাঁড়ায়। পরে কোনো একটা লেখায় বোধ হয় এই বিষয়টা স্বীকার করেছে সমীর রায়চৌধুরী। তবে সমীর শক্তির বিষয়ে যেটা বলেছে সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। যদি সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটে থাকে তবে তা দুঃখজনক। শক্তি যদি বলে থাকে বিষয়টা সত্যিই অশ্লীল তা হলে যা দাঁড়াচ্ছে সেটা খুব খারাপ।

    পড়লেন তো ? কোনো বুলেটিনেই ওনার নাম পাবলিশার হিসেবে ছিল না, তা সে পাটনা থেকে হোক বা মঙ্গল গ্রহ থেকে । এবার পড়ুন হারাধন ধাড়া অর্থাৎ দেবী রায়কে লেখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠিখানা :

    প্রিয় দেবী,
    পর-পর দুসপ্তাহ এলেন না, কোনো চিঠিপত্রও নেই, দোষ একটিমাত্র করেছি । এতোদিনের বন্ধুত্বে একটি, আপনাকে লেখা দিইনি । এজন্যে যদি কিছু মনে করে থাকেন, আমার কিছু করার নেই । উৎপল আপনার ওখানে গিয়েছিল ? প্রিয় উৎপল অনেকদিন দেখা হয়নি । রয়েড স্ট্রিটে উঠে গেছেন ? আমি সুনীলের একটা চিঠি পেয়েছি । আমি খুব ভালো নেই । একদিন যদি চলে আসেন ভাল হয় --- আপনি তো শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না । আপনি চলে এলেই পারেন । বীটদের একটা পত্রিকা Now ডাকে পেয়েছি । প্রেরক C.Plymell একজন কবি । 1537 N. TO Peka/Wichita/Kansas/USA. একটা উত্তর দিন । ভাই শক্তি, 'দেশে' কলাম ছাপানো ব্যাপারে তৈরি plan কী successful হল, অন্যান্য planগুলো, শংকর, বরেন, সুভাষ মুখো থেকে শুরু করে নরেশ গুহ স্টিল সুনীল, বুদ্ধদেব, নীরেনবাবু ইত্যাদি মিলিয়ে, ও বিধু, রবীন দত্ত, সামসের সমেত ও অধুনা সংকর কী যেন ( ছাড়পত্র সম্পাদক ) প্লাস শরৎ, ভাস্কর, প্রণব প্রভৃতি নিয়ে যে বিরাট জাল ফেলেছিস, সেটা এবার তোল । আমরা আর কতো সময় দাঁড়িয়ে থাকব ? তারপরেও অপেক্ষা করতে হবে । আমেরিকাগামী প্লেনে দমদমে see off করতে পারলে তবে আমাদের ছুটি । প্রিয় সুনীল, আপনার চিঠি পেয়েছি । আমার bedroom-এ উঁকি মারছেন কেন ? আমার সমূহ বিপদ --- এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে, আমার দ্বারা বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না এখন আমার কী করা উচিত, এখন এই প্রথম আমাকে অপরের উপদেশমতো চলতে হবে । প্রিয় দীপেন, তোমার কী হল ? কোথায় থাক ? তুমি যেন আমার সব অপরাধের শাস্তি আমি ভোগ করছি । প্রিয় উৎপল, আপনি ছাড়া কারো সম্পর্কে এখন বন্ধুত্বের বোধ নেই । সুনীলের জন্য আছে, কিন্তু তা বোধহয় সে আমেরিকায় আছে বলে ।
    শ্যামবাজার থেকে টু-বি ধরেছি, দোতলা, মাঝে-মাঝে বাসস্টপগুলির সুযোগ নিয়ে লিখছি । একদিন আসুন ।
    আপনাদের সন্দীপন ।

    এই চিঠিটা সন্দীপন হাংরি বুলেটিন বা হাংরি আন্দোলনের পত্রিকায় প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন । চিঠিটা পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চটে-মটে সন্দীপনকে এই চিঠি দিয়েছিলেন, আয়ওয়া, আমেরিকা থেকে :

    15 June 1964
    313 South Capital
    Iowa City, Iowa, USA
    সন্দীপন, নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসেছি, প্রচণ্ড হাওয়া, সঙ্গে ৫ ডজন বিয়ার ক্যান, পাশে সাঁতারের পোশাক পরা একটা ধলা মেয়ে, মাঝে মাঝে তার পাছায় টোকা মারছি পায়ের আঙুল দিয়ে, এ দৃশ্য কেমন ? অবিকল এই দৃশ্যের মাঝে আমি শুয়ে আছি । চিঠি লিখছি। কিন্তু আমি এ দৃশ্যের মধ্যে নেই । হাতের তালু গোল করে খুব ছোটো করে, চোখের কাছে আনছি -- সব কিছু দূরে চলে যাচ্ছে । মেয়ের মুখও । খিদে নেই । তেষ্টা নেই । তবু বিয়ার খাচ্ছি । কারণ, এখানে বসে খাওয়া বেআইনি বলে, ঘরের মধ্যে খুব গরম, থাকতে পারিনি। ঘাসের ওপর গড়িয়ে এলাম। একটা দূরন্ত খরগোশকে ধরার জন্য পাঁচবার ছুটে গিয়েছিলাম ।
    কী ভালো লেগেছিল আপনার চিঠি পেয়ে । বিশেষত লাল পেনসিলের অক্ষর । যেন দুটো চিঠি পেলুম । গল্পটা আপনার ভালো লাগবে না জানতুম । গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই । সত্যি নেই । কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না । কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে কাছে আর কেউ পোঁছতে পারেনি । আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না । লিখবো না । কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য । আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না । তবু কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না । লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেতা ছাপার সম্ভাবনা নেই । আমার কবিতার জন্য আপনাকে ভয় করি না, কবিতা লেখার ক্ষমতার ওপর আমার বেশি আস্হা নেই, আপনি যেরকম কবিতা ভালোবাসেন, অথবা যাই হোক --- আমি সেরকম কখনও লিখব না । আমি কবিতা লিখি গদ্যের মতো, ওরকমই লিখে যাবো । ও সম্বন্ধে আমার কোনো দ্বিধা নেই । শক্তি অসাধারণ সুন্দর বহু লাইন লিখেছে । আমার চেয়ে অনেক বড়, আমি ওকে শ্রদ্ধা করি । কিন্তু শক্তির কবিতা মুণ্ডহীন, আমি ওরকম লিখতে পারব না, চাই না, কারণ আমি ওরকম ভাবে বেঁচে নেই । বরং উৎপলের কবিতা আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করছে । কিন্তু এখানে এই শুয়ে থাকা, গাছের ছায়া মুখে পড়ছে --- তখন মনে হয় কোথাও কিছু নেই, না কবিতা, না হৃদয় ।
    প্রিয় সন্দীপন, দু-দিন পর আজ সকালে আবার আপনার চিঠি পেলুম । কি সব লিখেছেন কিছুই বুঝতে পারলুম না । কেউ আমাকে কিছু লেখেনি । শরৎ ও তারাপদ কফিহাউসে কি সব গণ্ডোগোলের কথা ভাসা-ভাসা লিখেছে । সবাই ভেবেছে অন্য কেউ বুঝি আমাকে বিস্তৃত করে লিখেছে । কিন্তু আপনার চিঠি অত্যন্ত অস্বস্তিজনক । তিনবার পড়লুম, অস্বস্তি লাগছে । বিছানা থেকে উঠে কলের কাছে গেলুম, ফিরে এলুম টেবিলে, আবার রান্নাঘরে, ভালো লাগছে না, কেন আমাকে এরকম চিঠ লিখলেন । আমি তো শুয়েছিলুম । আমি তো বিছানায় রোদ ও আলস্য নিয়ে খেলা করছিলুম । কেন আমাকে এমনভাবে তুললেন !
    সন্দীপন, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি, প্রায় বছরতিনেক । তার বদলে আপনি কুচোকাচা গদ্য ছাপিয়ে চলেছেন এখানে সেখানে । সেই স্বভাবই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় হাংরির হাঙ্গামায় । আমি বারণ করেছিলুম । আপনি কখনও আমাকে বিশ্বাস করেননি । ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন । আমি শক্তিকে কখনও বারন করিনি, কারণ আর যত গুণই থাক --- শক্তি লোভী । শেষ পর্যন্ত উৎপলও ওই কারণে যায় । কিন্তু আমি জানতুম আপনি লোভী নন । আপনার সঙ্গে বহুদিন এক বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি । সেই জন্য আমি জানতুম । আমি আমার লোভের কথা জানতুম । সেই জন্যই বুঝেছিলুম আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয় । আমার ওতে কখনও লোভ হয়নি, হয়েছিল অস্বস্তি থেকে ঘৃণা । ইংরেজিতে রচনা ছাপিয়ে ইওরোপ আমেরিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার বিষম বদ রুচি মনে হয়েছিল আগেই, এখানে এসে আরও বদ্ধমূল হয়েছি । হাংরির গ্যাঁড়াকলের প্রতি আরও ক্রুদ্ধ হয়েছি । অপরের কৌতূহল এবং করুণার পাত্র হতে আপনার ইচ্ছে করে ? হাংরি এখানে যে দু'একজন পেয়েছে, তাদের কাছে তাই । আমি এতদিন দেশে রইলুম --- অনেক সুযোগ এবং আহ্বান পেয়েছিলুম, কোথাও তবু একটি লাইনও ইংরেজি পদ্য ছাপাইনি । ছাপালে কিছু টাকা পেতুম, তবু না । কারণ সবাইকে বলেছি, আমি বাংলা ভাষার কবি, আমি শুধু বাংলাতেই লিখি, যে ভাষাব কথা বলে ৭ কোটি লোক --- ফরাসি ও ইতালির চেয়ে বেশি । এবং ফরাসি ও ইতালির চেয়ে কম উন্নত ভাষা নয় । আমার কাজ কবিতালেখা, নিজের কবিতা অনুবাদ করা নব, ও কাজ অন্যের । তোমাদের দরকার হলে বাংলা শিখে অনুবাদ করে নাও । এই ধরনের সূক্ষ্ম পিঠ চাপড়ানির ভাব লক্ষ্য করেই আমি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্হের কাজ, যেজন্য আমি এখানে এসেছিলুম, এক লাইনও করিনি ।
    হাংরির এই ইংরেজি মতলোব ছাড়া, বাংলা দিকটা আরও খারাপ । ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই । শর্টকাটে খ্যাতি বা অখ্যাতি পাবার চেষ্টা --- অপরকে গালাগাল বা খোঁচা দিয়ে । আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন --- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে, আপনি নিশ্চই মনে-মনে বিশ্বাস করেন না । আমি চলে আসার পরও আপনি হাংরির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন --- হিন্দি কাগজের জন্য আপনি কি একটা লিখেছিলেন --- তাতেও হাংরির জয়গান । ভাবতে খুব অবাক লাগে --- আপনার মতো অ্যাব্সট্র্যাক্ট লেখক কী করে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছবি ছাপাটাও উল্লেখের মনে করে । এগুলোই হাংরির গোঁজামিল । এই জন্যেই এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক থাকাতে বারবার দুঃখ পেয়েছি, দুঃখ থেকে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা । একটা জিনিশ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি কখনও প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিনি, ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করিনি । পারতুম । করিনি, তার কারণ, ওটা আপনাদের শখের ব্যাপার, এই ভেবে, এবং আপনারা আপনারা ওটাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছিলেন কৃত্তিবাস বা সুনীলের প্রতিপক্ষ হিসেবে । সে হিসেবে ওটাকে ভেঙে দেওয়া আংমার পক্ষে নীচতা হতো খুবই । বিশ্বাস করুব, আমার কোনো ক্ষতির কথা ভেবে নয়, আপনার অপকারের কথা ভেবেই আমি আপনার ওতে থাকার বিরোধী ছিলুম । এটা হয়তো খুব সেন্টিমেন্টাল শোনালো, যেন কোনো ট্রিক, কিন্তু ও-ই ছিল আমার সত্যিকারের অভিপ্রায় ।
    এবারে নতুন করে কী ঘটলো বুঝতে পারলুম না । যে ছাপা জিনিসটার কথা লিখেছেন, সেটা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতুম । এবং এটা খুবই গোলমেলে --- যে চিঠি আপনি চারজন বন্ধুকে এক সঙ্গে লিখেচেন, যেটা চারজনকে একসঙ্গে পাঠানো যায় না, সেতা হারাধন ধাড়াকে পাঠালেন কী জন্য, বুঝতে পারলুম না । কিংবা আমার বোঝারই বা কী দরকার ? আচ্ছা মুশকিল তো, আমাকে ওসব বোঝার জন্য কে মাথার দিব্যি দিয়েছে এই আষাড় মাসের সন্ধ্যাবেলা ? আমি কলকাতায় ফিরে শান্তভাবে ঘুমোবো, আলতো পায়ে গুরবো --- আমার কোনো সাহিত্য আন্দোলনের দরকার নেই । মলয় আমার চিঠি কেন ছাপিয়েছে ? আমার গোপন কিছু নেই--- বিষ্ণু দেকে আমি অশিক্ষিত বলেছি আগেও, কৃত্তিবাসের পাতায় ব্যক্তিগত রাগে, কারণ উনি ওঁর সংকলনে আমার কবিতা আদ্দেক কেটে বাদ দিয়েছেন বলে । কিন্তু মলয়ের সেটা ছাপানোর কি মতলব ? যে প্রসঙ্গে লিখেচিলুম সেটা ছাপিয়েছে তো ? আমি ওকে লিখেছি সম্প্রতি, 'সামনে-পেছনে বাদ দিয়ে , ডট ডট মেরে চালাকির জন্য আমার চিঠি যদি ছ আপাও, তাহলে এবার ফিরে গিয়ে কান ধরে দুই থাপ্পড় মারব।' আপনার চিঠি সম্বন্ধেও তাই । আপনার চিঠি ওরা ছাপিয়েছে, সেটাই খারাপ --- যা লিখেছেন তা নয় । বেশ করেছেন লিখেছেন --- আমি না পড়েই বলছি । ওটা আপনার শক্তির আর আমার ঘরোয়া ব্যাপার --- আর কার কি তাতে ? আপনার যা খুশি বলার অধিকার আছে ।
    কিন্তু ওসব থাক সন্দীপন । আপনাকে কেউ মারবে না । কার অমন স্পর্ধা আছে ? যদি আপনি জায়গা দেন, আমি সব সময় আপনার পাশে আছি । অনেকে আছে । আপনার সঙ্গে কত ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে --- কিন্তু এই দীর্ঘদিন নিরালায় ভেবে দেখলুম, আপনাকে বাদ দিয়ে আমাদের চলে না । এক হিসেবে আপনি আমার অপরাংশ, আপনার চরিত্রের অসংলগ্নতা, ভুল এবং জোচ্চুরি -- সব কিছু আমার প্রিয় । যেন আমার না পাওয়া জীবন । লেখক হিসেবে, 'প্রতিভাবান' এই শব্দটা যদি ব্যবহার করতে হয় --- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া --- শুধু আপনার সম্বন্ধেই আমি ওকথা ভাবি । আপনার ঐ সুখের সূক্ষ্ঞ শরীর কেউ ছোঁবে না --- কলকাতা শহরে এমন কেউ নেই । না নেই । আপনি নরম ভাবে শুয়ে থাকুন রীনার পাশে, আপনি ওঁকে মঙ্গল গ্রহের গল্প বলুন ।
    আমি কলকাতায় পৌঁছোবো --- ১৮ আগস্ট । নানা কারণে এখানে এক মাস দেরি হয়ে গেল । দেরি হয়ে গেল আমারই বোকামিতে খানিকটা । জুনের মাঝামাঝি বা আস্টের প্রথমে প্যারিসে একটা থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কয়েকদিনের জন্য । আমি জুন মাসটা নষ্ট করেছি --- সুতরাং আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা না করে উপায় নেই । এই ঠিকানায় আছি জুলাই-এর বারো তারিখ পর্যন্ত অন্ততঃ, তারপর নিউইয়র্ক ও ইংল্যান্ড । এখানে থেকে এম. এ. পড়তে পারি আমি --- আপনার মনে এরকম ধারনা এল কি করে ? আমি কি সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়েছি ? কৃত্তিবাসে আপনার লেখা নিয়ে প্রচুর গণ্ডোগোল করেছি --- তবু, এবার কৃত্তিবাসে আপনার লেখা না দেখে মন খারাপ লাগলো । এখান থেকে কোনো জিনিস নিয়ে যাওয়ার হুকুম আছে আপনার কাছ থেকে ?
    ভালোবাসা ।
    সুনীল

    এবার পড়ুন দেবী রায়কে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি । চিঠিতে উনি প্রস্তাব দিচ্ছেন যে হাংরি আন্দোলনের একটা সিমবল তৈরি করা হোক আর বুলেটিনগুলোর পাঁচ পয়সা দাম রাখা হোক।

    মির্জাপুর, ৫ অক্টোবর ১৯৬৩
    প্রিয় হারাধনবাবু
    হাংগরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম । প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট — এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব । প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন । ছাপালে সবকটি একসঙ্গে ছাপাতে হবে — নইলে খাপছাড়া লাগবে । ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে, দরকার পড়লে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন ।
    ‘অমৃত’তে আমার বইয়ের যে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল, দেখেছেন ? নইলে পাবলিশারের কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যস্হা করেন তো খুশী হই । ওই বিজ্ঞাপনটাই দেশে বেরোবার কথা আছে — যদি বেরোয় তার প্রুফটা কাইন্ডলি দেখে দেবেন । আনন্দবাজারে লেখকদের লেখকদের কোনো বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি ? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন ।
    সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব । আরো একমাস থাকবো বা ততোধিক । সহজে যাব না । শরীর ভালো । ছোটোগল্পে আবার লেখা দিতে পারলাম না, সম্ভব হলে ক্ষমা করবেন ।
    আগামি সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাবো । তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর, — এই ঠিকানায় দেবেন । ‘আক্রমন’ বানান কী ? ‘ন’ না ‘ণ’ ?
    লেখাটা প্রকাশ হবার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে । অনেক বাদ দিয়ে, খুব নরম করে, সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই ।
    হাংগরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, তার কী হল ? ৫ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন।
    কমাগুলো ভেবেচিন্তে দিয়েছি, ওইগুলোই আসল জিনিস যেন থাকে ।
    শেষের তারিখটা যেখানে আছে, ওখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন ।
    ‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো ?
    সুনীলবাবুকে ( হাজরা ) প্রীতি জানাচ্ছি ।
    ইতি
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

    বুঝতে পারছেন তো যে পেণ্ডুলাম দোল খেতে শুরু করেছে । ১৯৬৪ সালে হাংরি মামলা আরম্ভ হতে লালবাজার থেকে যখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডাক পড়ল, তখন উনি আমার বিরুদ্ধে পুলিসের সাক্ষী হতে রাজি হয়ে গেলেন আর ১৫ই মার্চ ১৯৬৫ তারিখে এই জবানবন্দি দিলেন, মানে পেণ্ডুলাম দোল খেয়ে গ্যালিলেওকে পর্যন্ত ঘাবড়ে দিয়ে থাকবে:
    I am graduate of Calcutta University and employed as an Assistant Inspector, Calcutta Corporation. I am also a writer and used to visit the College Street Coffee House where young writers of Calcutta generally assembled in the evening. Samir Roychoudhury is a personal friend of mine. I came to know the sponsors of Hungry Generation, namely Shakti Chatterjee, Malay Roychoudhury and others. Although I am not directly connected with the Hungry Generation but I was interested in the literary movement. Some of the manifesto of the Hungry Generation contain advertisement of my literary works. In one of the publication my name was cited as the publisher. This was done with a motive to exploit my reputation as a writer but since my prior consent was not taken I took exception. The present publication in question also came to my notice. As a poet myself I do not approve either the theme or the language of the poem of Malay Roychoudhury captioned I have severed all connections with Hungry Generation. I had correspondence with Malay Roychoudhury who often sought my advise in literary matters.
    Sandipan Chattopadhyay
    15 March 1965
    আমি যখন হাইকোর্টে কেস জিতে গেলুম, তখন পেণ্ডুলাম মাঝখানে এসে ঝুলে থাকার কথা বলল, ৩০ জুলাই ১৯৬৭ তারিখের এই পোস্টকার্ডখানায় :
    প্রিয় মলয়,
    হাইকোর্টের রায় পড়ে তোমাকে মনে-মনে তৎক্ষণাৎ কনগ্র্যাচুলেট করেছি । একটা মামলা হওয়া দরকার ছিল, কাউকে না কাউকে এরকম মামলার আসামী হতেই হত । সীমাবদ্ধ হওয়া সত্বেও এর ফলাফল আধুনিক সত্য সাহিত্যের পক্ষে যথেষ্ট ভালো হবে, মনে হয় ।
    কৃতিত্ব সবটাই তোমার একার, তবু লেখক নামের যোগ্য সকলেই একে পুরস্কার বলে মনে করবে ও ভাগ করে নিতে চাইবে । ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরস্কৃত হওয়ার আনন্দ পেয়েছি ।
    প্রীতিসহ
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

    আবার ১৯৮৬ সালে সুমিতাভ ঘোষালের ‘গদ্যপদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় পেণ্ডুলাম আরেক দিকে যেতে চাইলো।

    “সে সময়ে আমাদের কেউই পাত্তা দিত না । তা যারা হাংরি আন্দোলন শুরু করে, সেই মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী আমাকে জানান যে আমার লেখা ওদের ভালো লেগেছে, ওরা যে ধরণের লেখা ছাপাতে চায় তা নাকি আমার লেখায় ওরা দেখতে পেয়েছে, তাই আমার লেখা ওরা ছাপাতে চায় । ওদের কাছে পাত্তা পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছিলুম ।
    হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সেসময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম -- একটা ছেলে, তার ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁটটা খেতে শুরু করে । এইভাবে সে একটু একটু করে পুরো শাড়িটা খেয়ে ফ্যালে । এ ব্যাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এর পর থেকে সে অনেক কিছুই খেতে শুরু করে । যেমন জানালা, চেয়ার, ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রীকে সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে চায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দেয় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দ্যায় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশে ভাসিয়েছিল তা জানা যায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে । পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটা শেষ । এই গল্পটা আমাকে সেসময়ে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটাই মূল কথা ।
    আমি হারি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ -- আমার ভালো লেগেছিল, এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
    তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
    প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার 'বিজনের রক্তমাংস' গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।
    আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
    আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই, আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বলল, যে একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।”

    গ্যালিলেও আগেই পেণ্ডুলামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে গেছেন, আমার নতুন কিছু বলার নেই ।
  • m | 012312.60.4523.168 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:০৯541304
  • যখন রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে চীনা পাড়ায় ঢুঁ মারতম
    মলয় রায়চৌধুরী

    ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত, সন্তোষ রায় সম্পাদিত ‘জলজ’ পত্রিকার নভেম্বর ২০১২ সংখ্যায় হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর বিখ্যাত ( আলোচকদের মতে কুখ্যাত ) ‘মুক্তিপ্রসঙ্গ’ কবিতার বিশ্বজিত সেনকৃত বাংলা অনুবাদ পড়ার পর রাজকমল সম্পর্কে অনেক কথা মনে পড়ছিল । ‘মুক্তিপ্রসঙ্গ’ একটি দীর্ঘ কবিতা । হাংরি আন্দোলনের সময়ে রাজকমল কলকাতায় ছিল আর ওর সান্নিধ্যে কলকাতার অন্ধকার জগতটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, কেননা সেসময়ে ওই জগতটির নিচুতলার বেশির ভাগ কুশীলব ছিল বিহারি, অনেকে রাজকমলের জেলার । তখনকার কলকাতায় চিনে পাড়ায় চিনেদের জন্যে যে বিশেষ চিনা রমণীদের রেড লাইট এলাকা আছে তা রাজকমলের দরুন জানতে পেরেছিলুম ।
    রাজকমলের গ্রাম মাহিশিতে একটা মন্দিরের কথা বলত ও, যেখানে মোষ বলি হত আর গ্রামের সবাই সেই মোষের রান্নার ভোগ খেত । আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল মোষের মাংস খেতে । আমি অবশ্য তার আগেই নেপালে কচিলা খেয়েছিলুম, গমের মদ সহযোগে । রাজকমলের মতে, ওই মন্দিরের তারা মূর্তির মাথায় ফুল রাখলে ফুলটা যদি না পড়ে তাহলে মনোকামনা পূর্ণ হয় । রাজকমল, আমার সামনেই কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, প্রতিবারই ফুল পড়ে গিয়েছিল । ফুল রাখছিল ওর দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাইঝিকে প্রণয় নিবেদন করে সফল হবার আশায় ।
    রাজকমলের বাবার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করেছিলেন । রাজকমলের বিমাতা ছিলেন রাজকমলের চেয়ে ছোট । বাড়িতে অবস্হা ঘোরালো হয়ে উঠছে অনুমান করে রাজকমলের বাবা রাজকমলকে সৌরঠ সভার গণবিবাহের মাঠে নিয়ে গিয়ে শশীকান্তা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন , আর রাজকমলকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন আমাদের কলেজের হোস্টেলে । বিয়ের চার বছর পর রাজকমল সাবিত্রী শর্মা নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করে, প্রথম বউ যদিও তখন বাড়িতে । সাবিত্রীর সঙ্গে বিয়ে এক বছরের বেশি টেকেনি, তার ভাইঝির প্রতি রাজকমলের টানের কারণে ।
    দ্বিতীয় স্ত্রী সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কলকাতায় চলে এসেছিল রাজকমল । তখন আমি হাংরি মকদ্দমার দরুন কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করছি । আমার ফ্যা-ফ্যা বৃত্তির সঙ্গে যোগ দিল রাজকমল । ও ছিল ফালগুনী রায়ের মতন । গাঁজা আর চরসের নেশা ওকে ধরে ফেলল । ফলে শরীর বেশ খারাপ হওয়া আরম্ভ হতে ফিরে গেল পাটনায় ।
    আমি হাইকোর্টে মকদ্দমা জিতে পাটনায় গিয়ে দেখি রাজকমল হাসপাতালে ভর্তি । ওর জন্যে পাটনা হাসপাতালের রাজেন্দ্র ওয়ার্ডে একটা আলাদা ঘর বরাদ্দ হয়েছিল । প্রতি সন্ধ্যায় তরুণ সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো । টের পাওয়া যাচ্ছিল ওর শরীরের অবনতি হয়ে চলেছে । ও বলত সার্জেন বলেছে অপারেশান টেবিলে পেট চেরার পর পুরো হাসপাতাল গাঁজার ধোঁয়ায় ভরে যাবে ।
    একদিন সবাই চলে যাবার পর রাজকমল আমায় বলল, পরের দিন সকালে আমি যেন ওকে এক প্যাকেট কনডোম দিয়ে যাই । বলল, একটি নার্স রাজি হয়েছে । একটু পরে একজন মালায়ালি নার্স এসে ওর মাথায় যখন হাত বোলানো আরম্ভ করল, রাজকমল বলল, এই যে এই মেয়েটিই রাজি হয়েছে । মেয়েটি আমার দিকে চেয়ে হাসল , জানাল যে, আপনি কাল সকালে দিয়ে যাবেন এক প্যাকেট কনডোম ।
    পরের দিন সকালে গিয়ে দেখি ঘর ফাঁকা । খোঁজ নিয়ে জানতে পারলুম যে রাতেই মারা গেছে রাজকমল । ওর মরদেহ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ওর প্রথম স্ত্রীর কাছে ।
  • m | 012312.60.89.19 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৩৯541306
  • অদ্রীশ বিশ্বাসের আত্মহত্যা
    মলয় রায়চৌধুরী
    হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    যখন আকাশের ইস্পাতে গিঁট বাঁধছিলে
    দেখে নিচ্ছিলে গিঁট শক্ত হলো কিনা
    পায়ের শিরাগুলো তাদের কুয়োর দড়ি দিয়ে রক্ত তো পাঠাচ্ছিল
    তোমার হৃৎপিণ্ডের দিকে, ভালভ খুলে এবং বন্ধ করে
    ওই দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম শুনে তাড়া পড়ে গিয়েছিল
    তোমার শরীর জুড়ে, অথচ তুমি বরফের তৈরি মাথায়
    জানি না কবে কোন দিন কখন নির্ণয় নিয়ে ফেলেছিলে
    আকাশের হুক থেকে ঝুলে পড়ে, ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করে নেবে
    শেষ প্রশ্বাসের সঙ্গে শেষ বীর্য ফোঁটা ঝরেও ঝরবে না
    কিছুটা হদিশ কি পাইনিকো ? পেয়ে তো ছিলুম--
    বলেও ছিলুম, এ কী করছো অদ্রীশ তুমি, উত্তর দিলে না
    নারীও পুরুষের মতো জড়িয়ে ধরতে পারে, ধরে, জানাই ছিল না
    আমি তো জানোই, নারীদেরই জড়িয়ে ধরেছি চিরকাল
    পুরুষকে জড়িয়ে ধরার কথা ভাবলেই বিরক্তি ধরে, বমি পায়
    মনে হয় রাস্তাছাপ রাজনীতি শরীরে আশ্রয় নিতে এলো
    এও বলেছিলে তুমি, চিরকাল মুক্তযৌনতার পক্ষে
    রজনীশ-আশ্রমের যৌনতার খেলা সমর্থন করো, সম্পর্কের ব্যাগাটেলি
    তোমার যৌনজীবনের কথা জানতে চাইলে তবে লজ্জা পেয়েছিলে কেন
    ইউরোপে গিয়ে বিদেশিনী প্রেম করেছিলে কিনা, রোমান হলিডে,
    জুলিয়েট, জাঁ দুভাল, তার কোনো উত্তর দাওনি তো
    তোমাকে বুঝতে পারা ক্রমশ জটিলতর করে দিয়ে তুমি
    ফেলে গেলে বুদ্ধদেব বসুর উপহার দেয়া মিমিকে ১৯৬৫ সালে
    লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি সম্পাদিত সিটি লাইটস জার্নালের দ্বিতীয় খণ্ডটি
    যাতে হাংরিদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ডের
    বিদ্যায়তনিক ভূমিকাটিসহ, ফুটপাথ থেকে কেনার সময়ে
    হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    তোমার কাছেই জানলুম, জীবনানন্দের মেয়ে মঞ্জুশ্রীর চাকরি গিয়েছিল
    সাউথ পয়েন্ট থেকে, মধুসূদন সান্যালের সাথে প্রেমের কারণে
    বলেছিলে তুমি, যে বিদ্রোহী সে তো সমাজবিহীন, তার কেউ নেই
    তার অদ্রীশ আছে, মলয়ের প্রথম সাক্ষাৎকার তুমি নিয়েছিলে
    যখন কেউই পাত্তা দিতে চায়নি আমাকে, আমার প্রবন্ধগ্রন্হের
    ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলে, জানি না কখন কবে প্রৌঢ় হয়ে গেলে
    সংবাদপত্রে পড়লুম, যখন আকাশের খুঁটি থেকে ঝুলছিলে, ঘরে ছিল
    আলো, নাকি অন্ধকার ঘরে তুমি শ্লেষ হাসি ঠোঁটে নিয়ে
    এনজয় করেছো প্রিয় একাকীত্ব ; তখনও কি নিজেকে নিজে নিঃশব্দে
    বলছিলে : এই বাংলায় দুইটি জিনিস আর ফিরবে না কোনোদিন :
    সুভাষচন্দ্র বসু আর সিপিএম । মার্কস বা লানিন নয়, স্তালিনও নয়
    মাও বা ফিদেল কাস্ত্রো নয়, কেবল সিপিএম ক্যাডারিত হাড়গিলে লোকেদের
    ঘেন্না করে গেছো, তুমি তো প্যারিস রোম ফ্লোরেন্স ভেনিস ব্রিটেনে গিয়েছিলে
    তবু তারা রাস্তায় তোমাকে ফেলে রায়গঞ্জে থেঁতো করেছিল
    যাদবপুরের চারতলা বাড়ি থেকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে
    ইলেকট্রিক শক দিয়েছিল, অথচ তুমি তো নিজেই বিনয় মজুমদারকে
    হাসপাতালে দেখাশোনার ভার নিয়েছিলে, বিনয় মজুমদারের বউ রাধা
    আর ছেলে কেলোকে সোনাগাছি গিয়ে খুঁজে-খুঁজে ছবি তুলে এনেছিলে
    অর্ঘ্য দত্তবক্সির বইয়ের মলাটেতে দেখেছি তাদের, সত্যি বলতে কি
    কয় দিন কয় রাত ঝুলেছো নিজের ঘরে, তারপর পিস হেভেনের শীতাতপে নয়
    কাটাপুকুর মর্গে তিন দিন পড়েছিলে, বুক চিরে ব্যবচ্ছেদ হয়েছিল ?
    ডাক্তারেরা পেয়েছিল কিছু ? জমাট বেঁধে যাওয়া দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    জানি না । শুনিনিকো । দেহেতে পোশাক ছিল ? কোন পোশাক ?
    লাশকাটা ঘরে ? চোখ আর বন্ধ করোনিকো, সম্ভবই ছিল না
    সবুজ প্লাস্টিকে মোড়া, ফুল নেই, রজনীগন্ধার রিদ নেই
    সাজুগুজু সুন্দরীরা এসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নিকো তোমার মরদেহ ঘিরে
    কেওড়াতলায় উল্টো বন্দুক করে প্রতিষ্ঠানের সেলামি পাওনি তা জানি
    নন্দন চত্বরে প্রতিষ্ঠানের মোসাহেবদের মতো শোয়ানো হয়নি দেহ
    তোমার প্রিয় সন্দীপন ঘুরতো তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পিছনে পিছনে
    জিগ্যেস করোনি তাঁকে সিপিএম কেন তোমাকে টার্গেট করেছিল !
    আশে পাশে আরও কয়েকজনের শব ছিল, ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    দাদা নকশাল বলে শ্রীরামপুরের বাড়িতে হামলা করেছিল, তোমার কথায়
    সেই লোকগুলো যারা বাংলার রেনেসাঁকে ধ্বংস করে গড়িয়ার মোড়ে নেচেছিল
    বটতলা ফিরিয়ে আনলে তুমি গবেষণা করে, ভিক্টোরিয় বিদেশিরা যাকে
    অশ্লীল ছাপ দিয়ে আদিগঙ্গার পাঁকে ছুঁড়ে ফেলেছিল
    আর কমলকুমারের রেডবুক, ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত প্রথম বাঙালি মহিলার
    লেখা উপন্যাস ‘মনোত্তমা’ খুঁজে পেয়েছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরির তাকে অযত্নে রাখা
    তখন হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    যেমন প্রথমবার প্রেসিডেন্সির প্রথম বছরে ঝালমুড়ি খেতে খেতে
    প্রিন্সেপ ঘাটে, ভিক্টোরিয়ায়, ক্যানিঙের ট্রেনে, গঙ্গার খেয়া নিয়ে এপার-ওপার
    মা ‘লীলাবতী’কে নিয়ে বই লিখে হয়তো ভেবেছিলে পৃথিবীতে কাজ সাঙ্গ হলো
    জানবো কেমন করে বলো, এই তো সেদিন ১৯৬৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর
    জন্মেছিলে তুমি, মৃত্যুর দিনটাকে আকাশের খুূঁটিকে বলে চলে গেলে
    কেবল এটুকু জানি ২০১৭ সালে ১৬ই জুন কেওড়াতলার শ্মশানে প্রাঙ্গনে
    ডেডবডি ক্যারিয়ার সার্ভিস গাড়িতে গোপনে শুয়ে গন্তব্যে চলে গেলে
    পাখিরা কোথায় গিয়ে মারা যায় জানতে চেয়েছেন অরুন্ধতী রায়
    তিমিমাছ বুড়ো হয় মারা যায়, রুই ও কাৎলা বুড়ো হয়ে মারা যায়
    মারা গেলে তাদের গল্পগুলো জলের তলায় চাপা পড়ে থাকে--
    কতো কাজ বাকি রয়ে গেল, সেসব প্রজেক্টের কেউই কিচ্ছু জানে না
    যাকিছু বহুদিন সযত্নে সংগ্রহ করেছিলে সবই ফালতু মনে হলো
    যা জরুরি মনে হলো তা ওই এক ঝটকায় দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    বন্ধ করে, নিঃশব্দে অট্টহাসি হেসে, আত্মনিধন করে ফেলা…
  • m | 012312.60.89.19 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৪০541307
  • অসীম অধিকারী - নব্বুই দশকের কবি
    যাঁকে তাঁর সঙ্গিনী পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন
    মলয় রায়চৌধুরী

    অসীম অধিকারীকে, যতদূর মনে আছে, একবারই দেখেছি, যখন উনি কলকাতায় আমার নাকতলার ফ্ল্যাটে এসেছিললেন। অসীমকে দেখে, আর ওঁর জীবনের দুর্ঘটনার বর্ণনা শুনে, আমার স্ত্রী শলিলা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল, নাকতলার বাড়িতে বেডরুমে গিয়ে একলা ফোঁপানি সামলে নিয়ে, আমাকে ভেতরে ডেকে জিগ্যেস করেছিল, ‘এরকমও হয়?’’
    প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন, অসীম আর অসীমের কমবয়সী সঙ্গী, যার নাম আমি ভুলে গেছি, দুজনেই ভিজে জবজবে হয়ে পৌঁছেছিল আমাদের ফ্ল্যাটে ; আমাদের বিল্ডিঙের সামনে একটু বৃষ্টিতেই হাঁটুজল জমে যেতো, আর সেদিন তো অবিরাম বৃষ্টি, থামবার কোনো লক্ষণ নেই, এরকম বিতিকিচ্ছিরি । কাহিল স্বাস্হ্যের কারণে অসীম সেসময়ে একজন সঙ্গী ছাড়া বাইরে বেরোতেন না ।
    শলিলার নির্দেশে অসীম শার্ট খুলে, আমার একটা শার্ট পরতে বাধ্য হল, আর তখন অসীমের দেহ যে আঘাত সহ্য করেছিল, দগদগে ক্ষতের রেশ তরতাজা, আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল আমাদের কাছে । যাঁরা সেসময়ের অসীমকে দেখেছেন, তাঁরা জানবেন কেমন ছিল ওর বাকরুদ্ধকরা বহিরঙ্গ । এককথায় বলতে হলে, অসীমকে দেখে শলিলা বলেছিল, উনি তো একেবারে মমির মতন আগাপাশতলা শাদা ক্রেপ-কাপড়ে মোড়া, মাথা-কপাল সবই কাপড়ে ঢাকা, ওগুলোও তো ভিজে জবজবে হয়ে গেছে । কিন্তু মমির পোশাক খোলা সম্ভব ছিল না অসীমের পক্ষে, কেননা , নিজের অবিশ্বাস্য জ্বলন্ত ট্রমাকে একাকীত্ব দিয়ে সামলাতে চেয়েছেন উনি, অন্যের সামনে অবারিত করতে চাননি দেহের অবস্হা, বুঝতে দিতে চাননি ওঁর দগ্ধ ও আত্মদগ্ধ অভিকর্ষ । ওঁর শার্ট ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে নেবার পরই ফিরে যেতে দেয়া হয়েছিল । ওঁর ওই আগাপাশতলা মোড়া মমির পোশাকও বিশেষভাবে সেলাই করাতে হয়েছিল হয়ত, সেসব প্রশ্ন তোলার মতন সাহস হয়নি আমাদের দুজনের ।
    অসীমের দুর্ঘটনাটি ছিল পুড়ে যাবার ; গ্যাস খুলে রেখে দেয়া হয়েছিল, আর সারা রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই দানবী গ্যাস ; অন্যমনস্ক অসীম উনোন ধরাতেই হয়ে ওঠেন আগুনের জ্বলন্ত গোলা । একজন জীবন্ত মানুষের দেহ দাউ-দাউ করে জ্বলছে, এই দৃশ্য কল্পনা করতে হলে আতঙ্কে সিঁটিয়ে যেতে হয় । উদ্দেশ্যপ্রণদিত ছিল কি ? সঠিক জানি না । সঙ্গিনী উধাও হয়ে যান, আর ফেরেননি ; হাসপাতালে, যেখানে অসীম বেশ কয়েকমাস চিকিৎসার জন্য ভর্তি ছিলেন, একের পর এক শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতির তলায় মুখ বুজে চুপচাপ শুয়ে চোটশূন্যতার জগতে ঝিমিয়ে সেঁদিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই হাসপাতেলেও তিনি কখনও অসীমের সঙ্গে দেখা করতে যাননি, শুনেছি । তিনি সেই যে উধাও হলেন, তারপর তাঁর সঙ্গে অসীমের দেখা আদালতে ।
    অজস্রবার অপারেশান টেবিলে, তীব্র আলোর তলায়, শুতে হয়েছে অসীমকে, লড়তে হয়েছে সম্ভাব্য মৃত্যুর সঙ্গে । ধারদেনা করে অজস্র টাকা খরচ করতে হয়েছে সুস্হ হয়ে ওঠার জন্য । আমরা জানতে চাইনি অসীমের বাড়িতে আর কে-কে আছেন, বাবা-মা ভাই-বোন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সাহস হয়নি । মনে হয়েছে, হয়তো ওঁর কোনো গোপন জখম খুঁচিয়ে ফেলব অজান্তে । যে ট্রমা উনি লুকিয়ে রাখছেন তা অবিশ্বাস্য । যখন উনি বহুক্ষণ একা কোথাও বসে থাকেন, আড়ালে, তখন কি ওর ফুঁপিয়ে ওঠার ইচ্ছা হয় ? জানি না ।
    যেটুকু জেনেছি তা ওঁর ‘হালকা নীল টেবল ল্যাম্প’ কাব্যগ্রন্হের পেছনের প্রচ্ছদে অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর এই লেখা থেকে : “অসীম অধিকারীর জন্ম ২৮ আগস্ট ১৯৭৫-এ যাদবপুরে । বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা জায়গায় । দেশ দেখেছেন মানুষ দেখেছেন ছেলেবেলা থেকেই । কবিতার জন্য সংগ্রহ এইসব অসীমকে পাকাপাকিভাবে নিবিষ্ট করে ১৯৯৬ সাল থেকে । অসীমের কবিতা বর্ণময় । নাগরিক । কিন্তু নগরের মৃতপ্রায় আবেগ ও মনুষ্যত্বকে পাশ কাটিয়ে তাঁর যাত্রা একেবারেই ভিন্নরকম । তিনি জীবনকে ধরতে চেয়েছেন তাঁর তপ্ত মুঠোয়, প্রবল ভালোবাসার শব্দসমারোহে । ফলে তাঁর কবিতা মুহূর্তে পাঠককে অধিকার করে নেয়, চূড়ান্ত অভিভূত করে । চিত্রকল্প ও ভাষা বিস্ময়কর । এই সময়ের কবিতা অনেকটাই স্তিমিত, অনেকটাই নিরক্ত । অসীমের কবিতা এই দুইকে অস্বীকার করে এবং সেকারণে বাংলা কবিতায় অসীমের জন্য তৈরি হয়েছে স্হায়ী একটা জায়গা।”
    বাহুল্য বলা যে অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর প্রমাণপত্রের বক্তব্যের সঙ্গে অসীম অধিকারীর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গির মিল নেই, আমি কেবল অসীমের ব্যাকগ্রাউন্ডটুকু জানাবার জন্য এটা তুলে দিয়েছি । কলেজ স্ট্রিট থেকে যেসব “এই বাংলা”, “দুই বাংলা”, “এই দশক”,”সেই দশক”,”প্রেমের কবিতা”, “মাকে নিয়ে কবিতা”, “বাবাকে নিয়ে কবিতা”, “প্রতিবাদের কবিতা”, “কলরবের কবিতা” ইত্যাদি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে তার কতগুলোয় অসীম অধিকারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা নব্বুই দশকের কবিতার পাঠকরা ভালো করে জানেন ।
    নব্বুই দশকের একজন কবির দেহ আগুনের গোলায় রূপান্তরিত, সেই অগ্ন্যুদ্গীরক হলকার ইনকিউবেটারে, তাঁর ইন্দ্রিয়ের প্রতিবর্তীক্রিয়া আক্রান্ত, তিনি কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না, এই অসহ্য দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসীমের কবিতা পড়ার সময় ; অসীম নিজেও স্হায়ী ট্রমার সেই ভয়াবহ ও মর্মান্তিক পীড়নের অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি চেয়েও বেরোতে পারেন না, ওঁর ‘আগুন কোথায়’ কবিতাটি পড়লে স্পষ্ট হবে :

    সেসব কথা ইতিহাস আজ
    কিছুই সেসব পড়ে না মনে
    পড়ল মনে কেন যে আজ
    বুকের মধ্যে জ্বালা ধরে

    এই যে জ্বালা জুড়াব কিসে
    শস্যধান ক্ষেতখামারে
    আগুন কোথায় জ্বালব আমি
    পথ ভুলেছি অন্ধকারে

    অসীম অধিকারী ‘সেসব জ্বালা’-র নিদারুণ পীড়া, মানসিক যন্ত্রণা, অ্যাংস্ট থেকে, আত্মরক্ষা করছে প্রকৃতির প্রগলভতাকে আশ্রয় করে ; উনি যে ঠিক কে তা খুঁজতে ওঁর ভয় নেই, তা যতই না কেন আত্মআতঙ্কের কারণ হোক । কবিতাটিতে ‘জ্বালা’ আর জ্বালব’ এবং ‘সেসব’ শব্দগুলোর প্রয়োগ লক্ষ্যনীয় । ওঁর ফেসবুকের পাতায় দেখেছি এমন একটি শিমুল ফুলের ফোটো পোস্ট করেছেন যেটি পাতাহীন গাছের গুঁড়িতে একা ফুটে আছে । ওঁর ট্রমা ভুলে যাবার আর মনে পড়ে যাওয়ার ডিলেকটিকে আক্রান্ত ; রক্তপাত দেখা যায় না ।
    ঘরানাহীনতা ও গোষ্ঠীমুক্তির কারণে, মনে হয়, নিদারুণ আত্মসচেতন গতির সঙ্গে গিয়ার-পালটানো কবিতা-লিখিয়েদের ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ কোনো ‘স্কুল’-এর সদস্যতার অবস্হান নিতে পারেননি অসীম, যদিও ‘মেইনস্ট্রিম’ আর ‘আভাঁ গার্দ’ যুদ্ধের সীমানার প্রয়োজনীয়তা নব্বুই দশকের আগে আশির দশক থেকেই তামাদি হয়ে গিয়েছিল ; কবিরা ধ্বনিব্যঞ্জনা, আঙ্গিক, ছবিগঠন আর ডিকশানের নিজস্ব কৌশলে মন দেয়া আরম্ভ করেছিলেন । তার কারণ অপসৃয়মান আত্মতার বোধকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেবার উদ্দেশ্যে টেকনিক ও ডিভাইসের অপ্রচলিত বিস্তারের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন প্রায় সকলেই ।
    কবিতা রচয়িতাদের কোনো ক্যাননকে আর মান্যতা দেবার দরকার পড়ে না । মোটামুটিভাবে কবিতার মান পরিমাপের একটি ভাসাভাসা সাবকালচার গড়ে উঠেছে আশির দশক থেকে যা বিদ্যায়তনিক ক্যাননকেন্দ্রিক নয়। আমি অবশ্য নিজেকে সাংস্কৃতিক অথরিটি দাবি করছি না । কবিতার মান পরিমাপের একটিমাত্র মাপকাঠি আর নেই, যে মাপকাঠিগুলো আছে তাও মনে হয় বাতাসের তৈরি । অস্বীকার করা যাবে না যে বহু কবির ক্ষেত্রে কবিতা বেশ এনিগম্যাটিক পাঠবস্তুতে রূপান্তরিত । প্রশ্ন হল মর্মার্থের ক্ষণিক বিদ্যুচ্চমকে পৌঁছোবার ট্রিগারটি কী বা কী-কী । অমন বিদ্যুচ্চমকে তো ডিকশান, বাগধারা, ছবি আর আঙ্গিক বেয়েই পৌঁছোতে হবে । সাহিত্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কবিতায়, পরম্পরাগতভাবে আঙ্গিকই ছিল পাঠবস্তুর জি-স্পট । অসীমের ক্ষেত্রে, কবিতা রচনার জন্য কাজ করে ট্রমার ‘ট্রিগার’ যা উল্লেখ করেছি ওপরে ।
    যখন নাকতলায় ছিলুম তখন অসীম ওঁর ‘ঘৃণায় বেঁকে যাচ্ছে তর্জনী’ কবিতার বইটা দিয়েছিলেন আমায় । পরে মুম্বাইতে পাঠিয়েছেন ‘হালকা নীল ট্যাবল ল্যাম্প’ কাব্যগ্রন্হ’ । এই বইটির পর ওঁর আরেকটি কবিতার বই বেরিয়েছে, ‘ঈশ্বর আজ দু পেগ নিন’ । আমার আর শলিলার দেখে ভালো লেগেছে যে অসীম আবার বিয়ে করেছেন, ছেলে হয়েছে, যার নাম রেখেছেন যিশু, মমির পোশাক খুলে ফেলে আগাপাশতলা-ঢাকা প্রতিদিনের পোশাকে ফিরেছেন পরচুলা পরতে হয়েছে পুড়ে-যাওয়া করোটি ঢাকার জন্য । স্কুলে পড়াচ্ছেন, স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে আনন্দ করছেন, মোটর সাইকেল চালাচ্ছেন, আর সবচেয়ে যেটা বাহবাযোগ্য, তা হল এত উথালপাথালের মাঝেও অসীম সাহিত্যের একাগ্রতায় স্হির রেখেছেন নিজেকে, ভেঙে পড়েননি । ওনার ‘নেশা’ কবিতাটা পড়া যাক :
    রাত হলেই নেশা ছোটে
    টাট্টু ঘোড়ার মতো
    আমাদের জুয়ার বোর্ড দ্রৌপদীহীন
    নিজে নিজের সাথে খেলি
    হো হো হাসি হাসি, তামাশা করি

    সাহিত্যে ফিরে, অসীম বিষাদ, ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা ইত্যাদিতে, আচমকা আক্রান্ত হয়েছেন বটে, কিন্তু সংবেদনগুলোকে একাকীত্বের বর্ম দিয়ে প্রতিহত করেছে,, ভেসে যাননি তাদের ষড়যন্ত্রে, অসহায় হবার প্রদর্শনী করেননি, যা অসীমের চেয়ে কমবয়সী কবিরা, যাঁরা মাঝে-সাঝে প্রতিবাদের কবিতা লেখেন, তাঁদের কবিতায় করে চলেছেন । আর আলোচকরা, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান করুণ অবস্হা সত্ত্বেও, ব্যক্তিযুবকের বিষাদ, হতাশা, দুঃখ, গ্লানি, অসহায়তার প্রদর্শনীকে তোল্লাই দিয়ে চলেছেন । পশ্চিমবঙ্গের অবস্হাকে অসীম বলেছেন নরক ; বর্তমানে যা নিঃসন্দেহে পলিটিকালি ইনকারেক্ট স্টেটমেন্ট । সত্তর দশকের পর অসীম অধিকারীর মতন এমন বেপরোয়া সাহিত্যিক নজরে পড়েনি । বর্তমান পশ্চিমবাংলায় সকলেই যে যার আখের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত ।
    পক্ষান্তরে, অসীমের চরিত্রে, দুর্ঘটনাটির কারণে, গোপন-ক্রোধ পোষা আছে, একাধবার টেলিফোনে ওঁর কথায়-কন্ঠস্বরে, কিংবা ইন্টারনেটে ওঁর করা মন্তব্যে, বুঝতে পেরেছি । ক্রোধের কারণটি সাহিত্যজনিত নয় বলেই মনে হয়েছে আমার ; কারণটির উৎস সম্ভবত সেই যুবতীর উপেক্ষা, অবহেলা এবং তার নির্দয় ও নিষ্ঠুর কার্যকলাপ সম্পর্কে সন্দেহ । আর, দুর্ঘটনার পর, নিকটকবিদের সঙ্গে, দূরত্ব । এমনও হয়েছে, বয়স্ক কবিদের বাড়ি থেকে অপমান করে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে অসীম অধিকারীকে । অসীম লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে কেউ কারো নয় এই সত্যিটা বুঝতে কেটে গেল ৩৯ বছর।’ কিন্তু পরক্ষণেই ঘোষণা করেছেন, ‘আই অ্যাম এ পার্ট অফ দিস ইউনিভার্স।’ কবিতায় কবির ‘মৃত্যুচেতনার’ কথা আখচার শুনতে পাই ; অসীম অধিকারীর চেতনাকে ট্রমা ছাড়া কোন অভিধা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করব?
    অসীম অধিকারীর ‘অপারেশান’ কবিতাটা পড়ে ওপরের কথাগুলো মনে এলো । কবিতাটার উপরিতলে যা বলা হচ্ছে, সাবটেক্সট গোচরে আনে প্রকৃত বার্তা, যার কাব্যিক ফ্লুয়োরেসেন্স প্রচণ্ড মনধাঁধানো । অ্যানাসথেসিয়ার তীব্রতা আর ছুরি কাঁচির মাঝে ওর ‘উতরোল উতরোল’ অভিব্যক্তি, জাস্ট ডেডলি ; যাঁরা অপারেশান টেবিলে শুয়ে ক্রমশ সুগন্ধিত যন্ত্রণাহীনতায় ঢলে পড়ার দুর্ভোগ সহ্য করেছেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন এই অভিব্যক্তিটির ওজন ; আর সেই সময়ের নিদারুণ একাকীত্ব, টেবিলের ওপর শুয়ে, ধবধবে ঝাঁঝালো আলোয় যখন নিজেকে খোঁজার মুহূর্ত, তার আগে বন্ড সই করে দিয়েছেন অসীম, যে, অপারেশান টেবিলের ওপর শল্যচিকিৎসায় ওঁর মৃত্যু হলে হাসপাতাল আর চিকিৎসকরা দায়ি নয় । বেঁচে ফিরে আসা আর মারা যাওয়ার মাঝে একা, নিঃসঙ্গ । অমন একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা সত্ত্বেও পরাজয়বোধে জারিত হচ্ছেন না অসীম। তারপর যখন জ্ঞান ফেরে, যন্ত্রণা ফেরে তার স্নায়বিক আক্রোশ নিয়ে, অসীম বলছেন, ‘প্রকৃতি তোমাকে আলিঙ্গন করি’ :-

    মেয়েটি বললে, তোর অপারেশান
    সিগারেট খাচ্ছিস, ফুর্তি করছিস
    হো হো হাসি হাসি নাবালিকা
    একটি অপারেশানের জন্য
    কতটা মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন
    আঠারোবার অস্ত্রোপচারের পর
    আমি জেনে গেছি
    ফালতু সেন্টিমেন্টের দাম নাই
    কতবার তুই পেয়েছিস অ্যানাসথেসিয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ
    উতরোল উতরোল
    ছুরি-কাঁচির ঝন ঝন
    অ্যাপ্রন-পরা মানুষেরা কতটা নৃশংস হতে পারে
    আমি জানি সবুজ গাছেদের সাথে বন্ধুতা
    হা হা হাসি হাসি
    যন্ত্রণায় লীন হয়ে
    তীব্র আলোয় নিজেকে খুঁজি নিজের ভেতর
    একটি অপারেশানের জন্য
    প্রকৃতি তোমাকে আলিঙ্গন করি
    মেয়েটি জানে না
    সৌখিনতার বশে স্মার্ট সাজে--

    সেই মুহূর্তটিকে কি বলব, যখন নব্বুই দশকের একজন কবিকে ঘিরে থাকা তার শ্বাসের বাতাস আচমকা তাকে নাপাম বোমার মতন জাপটে বিস্ফোরণ ঘটায় ? লেলিহান আগুনশিখার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়াবার আপ্রাণ প্রয়াস করে চলেছেন একজন তরুণ কবি ? যাঁকে প্রেমিকারূপে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তাঁর বিষাক্ত আগুনে আপাদমস্তক পুড়ে ? হয়ত তা এপিফ্যানি । বাংলা ভাষার আর কোনোও কবিকে কখনও ওই ভয়ংকর অপ্রেম, আতঙ্ক, অবিশ্বাসের এপিফ্যানির মুখোমুখি হতে হয়নি । যাকে জড়িয়ে চুমু খেয়েছেন কখনও, আলিঙ্গন করেছেন সপ্রেম আদরে, তাঁর দেয়া ক্ষতের দগদগে অন্তর্দাহ ও বহিরঙ্গের গোলাপি হয়ে-ওঠা স্মৃতি সারাজীবন বইতে হবে অসীমকে, তাঁর ত্বকে তো বটেই, কবিতার শরীরেও । হয়তো তাই, অসীমের কবিতার লাইনগুলোয় দেখি ব্যাখ্যার গোপন পরম্পরাপন্নতা, আঙ্গিককে মুক্ত করে ফেলার প্রয়াস । অবস্হানপন্ন ছবি আর প্রতিদিনের বাগধারা প্রয়োগ করে গড়ে তুলছেন নিজস্ব প্যাস্টোরাল পরাবাস্তব জগত। । তাঁর কাজ ব্যকরণ ভাঙার জটিল মারপ্যাঁচের নয়, বরং তা উপলব্ধির প্রতিদানমূলক কাঠামো, যেটা নিজেই নিজেকে পরতে-পরতে মেলে ধরতে চেয়েছে । সেকারণে কাব্যগ্রন্হের নাম ‘ঈশ্বর আজ দু’পেগ নিন’ । কোন ঈশ্বর ? ট্রমার ঈশ্বর !
    আঙ্গিক আর সারবস্তুর মাঝে জটিল খেলায় আর পাওয়া যাবে না কোনো পাঠবস্তুর কবিতা হয়ে ওঠার সূত্র ; তা কারোর কারোর কবিতায় কাজ করেছে আশির দশকের আগে পর্যন্ত । অবশ্য আশির দশকেও কেউ-কেউ কবিতাকে চরিতার্থ করে তোলার শৈলী হিসেবে উপাদান দুটির উদ্ভাবনী-বৈশিষ্ট্যকে স্বকার্যে লাগিয়েছেন । সেগুলো ম্যানসার্ড পংক্তি দিয়ে গড়া হয়েছে, ঠিক যেমন ম্যানসার্ড ছাদে ওঠার জন্য নিচের সিঁড়িগুলো দুরারোহ হয় । অসীম তা ব্যবহার করেছেন আভাসিক ছন্দের মাধ্যমে, বা গদ্যে, ওঁর বাচনিক প্যাটার্নিং, ধ্বনিসাদৃশ্য, বাকচাঞ্চল্য, অনুপ্রাস, কিংবা বারংবার একটি শব্দ বা তার সঙ্গে ধ্বনিগত মিল আছে এমন শব্দ । এইভাবে কবিতা রচিত হলে তা সামাজিক ‘কন্সট্রাক্ট’ হয়ে দেখা দেয়, মনগড়া ব্যক্তিক কন্সট্রাক্টরূপে নয় । ওঁর আভাসিক ছন্দে থাকছে সন্মোহিনী সংবেদনের বৈশিষ্ট্য । যে মানুষ আগুনশিখার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তাঁর পক্ষে জয় গোস্বামী, শ্রীজাত বা মন্দাক্রান্তা সেন প্রমুখের মতো নিখুঁত ছন্দে কবিতা লেখা সম্ভব নয় বলেই মনে হয় । প্রতিটি কবিতায় অসীমকে নতুনভাবে বাস্তবজগতে প্রবেশ করতে হচ্ছে ; ধ্বনি আর অনুভূতির নবীকরণ করতে হচ্ছে ।
    অসীম অধিকারী শৈলী আর ভাষা নিয়ে নিরীক্ষা করলেও, কবিতাগুলোকে ভেঙে ফেললে পাওয়া যাবে ওঁর প্রিয় থিম, যা একাকীত্বের, নিঃসঙ্গতার, ট্রমা লুকিয়ে রাখার । ফেসবুকে দেখেছি অসীম অধিকারীর অধিকাংশ ফোটো কোথাও একা বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার, স্টেশানের ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে, পার্কের বেদিতে, চায়ের ঠেকে, জনহীন রাস্তার বেঞ্চে, গাছের তলায় । ফোটোগুলো অন্যের তোলা, ঠিকই, কিন্তু পাঠক-দর্শকের সামনে অসীম অধিকারী উপস্হাপন করছেন তার বিপজ্জনক নিঃসঙ্গতাকে । ওঁর যে কবিতাগুলোর উৎস বিশ্বাসঘাতকতার এবং মৃত্যুবোধের অপরিমেয় যন্ত্রণার, তাতে আছে বিচ্ছিন্নতাবোধ, সংযোগচ্যুতি, ছিন্নসম্পর্ক, স্বাতন্ত্র্য, পৃথগন্ন ব্যক্তিএকক ; তা বোদলেয়ারীয় আন্যুই নয়, পারক্যবোধ নয় । বস্তুত সমাজের সঙ্গেও যে ওঁর খটমটি লেগে থাকে তা রাজনৈতিক-ডিগবাজি-খাওয়া জনৈক কবির মর্ফড ফোটো ওঁর টাইমলাইনে দেখে বলা চলে, যে কবিকে উনি একসময়ে শ্রদ্ধা করেছেন তাঁর অমন পেন্ডুলাম রাজনৈতিক লোভের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি অসীম অধিকারী । উনি প্রতিদিনই পশ্চিমবঙ্গে নিজের চোখে দেখছেন কবি-লেখক-চিত্রকরদের বীক্ষাবদলের চরিত্রহীনতা, টাকার লোভ, অধঃপতন, পুরস্কারকামী মোসাহেবি ।
    একাকীত্ব আর তার অনুবোধ হল ব্যক্তিএককের বিমূর্ত সংবেদন । অসীমের কবিতায় অন্যান্য ছবিগুলো মূর্ত থাকলেও এই একটি বিমূর্ত অনুভূতি প্রায়ই উঁকি মারে, নানা চেহারায় উঁকি মারে, যার দরুন অনেকসময়ে মনে হয় কবির মুড কৃষ্ণাভ, রহস্যময়, গুপ্ত, দুর্বোধ্য, অজানা, অচেনা, গুমোগন্ধময়, অভিশপ্ত । অথচ তাকেই, ওই মুডকেই, উৎসবের চেহারা দিতে চেয়েছেন অসীম । তার কারণ ট্রমা তো সাক্ষাৎ ও নিজেই ।
  • m | 012312.60.89.19 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৪২541308
  • ঋতবীণার রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
    মলয় রায়চৌধুরী
    ঋতবীণা’ ( ২০১৪ ) বইটি নব্বুই দশকের কবি রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, যখন ‘বাক’ ব্লগজিনে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল তখন টুকরো-টাকরা পড়েছিলুম । ধারাবাহিক ব্যাপারটা সয় না বলে পড়া ছেড়ে দিই, তার কারণ, হয়ত বয়সের কারণে, আমার মগজ যুক্তিযুক্ত বোধগম্যতায় কাজ করে না ; আর ‘ঋতবীণা’ বইটা হাতে পেয়ে বুঝতে পারলুম যে, সাহিত্য যেহেতু নামতা বা লগটেবল নয়, অমনভাবে না পড়ে ঠিক কাজই করেছিলুম । রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় এবং শমিত রায় পরিকল্পিত প্রচ্ছদের ছবিটিও, যাতে সম্পূর্ণ ও আর অর্ধদেহ পোশাকহীন ম্যানেকুইনদের মুখোশ পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা রয়েছে, ইঙ্গিতবহ । এমনও হতে পারে, তাঁরা, ম্যানেক্যুইনরা, যাঁদের লিঙ্গ আর যোনি নেই, নিজেরাই দাঁড়িয়ে বা হাঁটুগেড়ে রয়েছেন ।
    ভারতের কপিরাইট আইন অনুযায়ী একটা বইতে ইংরেজিতে লেখকের নাম আর জনার, মানে কবিতা, উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, নাকি কী বিষয়ে তা লেখা থাকা দরকার, যাতে রেজিস্ট্রারের দপতর আর চারটে সর্বভারতীয় লাইব্রেরি যেখানে বইটি পাঠানো অতিআবশ্যক, সেখানকার কর্মীরা, স্বাভাবিকই তাঁরা অবাঙালি, বইটা নথিবদ্ধ করে নিতে পারেন ।
    রাজর্ষির ‘ঋতবীণা’ বইটাকে কোনো পরিচিত বিদ্যায়তনিক জনারের অন্তর্গত করা যাবে বলে মনে হয় না, তাই হয়ত উনি এবং কবি-প্রকাশক রোহন কুদ্দুস আইনি বাধ্যবাধকতাগুলো বাদ দিয়েছেন । ‘ঋতবীণা’র গদ্য-টেকনিক যে ভাবে পাঠককে তার অলিগলি দিয়ে টেনে নিয়ে যায়, সহজ বোধগম্যতাকে জলাঞ্জলি দেবার প্রথম ধাপ জনারের বর্গীকরণ না করা ; প্রাথমিক স্বীকৃতি যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা কোনোরকম প্রশ্ন না তুলে ব্যক্তিএকককে হোমো সেপিয়েন মেনে নিই বটে , কিন্তু সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিএককটি যে বেশ খানিকটা হোমো ডেমোনস, ও সেহেতু দ্যুতিময়, ওই বিজ্ঞানের লজিকাল জয়ঢাকের কারণেই স্পষ্ট হয়ে গেছে ; মানুষ আসলে জন্তুজানোয়ারের মতন প্রকৃতি-নির্দেশিত র‌্যাশানাল প্রাণী নয়, সে ব্যাখ্যার অতীত, সেই যখন থেকে সে গুহার দেয়ালে এঁকেছে, অ্যাজটেক মন্দিরে মানুষের কাটা মুণ্ডু নিয়ে নেচেছে, কলকাতার রাস্তায় ছেচল্লিশের দাঙ্গায় একে-আরেকজনকে কচুকাটা করাছে, সোভিয়েত দেশকে টুসকি বাজিয়ে লাটে উঠিয়ে দিয়েছে, বা অতিসম্প্রতি বিধর্মী ও আধাবিধর্মী পরিবারের নারী-কিশোরীদের ধর্ষণের জন্য দখল করে কালাশনিকভ হাতে বিজয়ের কালো ধ্বজা উড়িয়েছে, স্কুলে ঢুকে একশো তিরিশটি বাচ্চাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, অত্যন্ত গরিব মানুষদের ফুসলিয়ে তাদের সঞ্চয়কে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছে ‘দরিদ্রসেবী’ ধনীগোষ্ঠী । যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যার অতীত না হলে মানুষ কেনই বা কন্ঠস্বরকে উঁচু-নিচু করে কথা বলবে আর তাকে বলতে চাইবে গান ? হাত-পা-দেহের ‘যুক্তিহীন’ ভঙ্গীকে বলবে নৃত্য ? কেনই বা মগজের ভেতরের কল্পনাকে কাগজে বা কমপিউটারে নামিয়ে তাকে বলতে চাইবে সাহিত্য ? আর এই ধরণের কাজগুলো করে সে গর্ববোধও করবে ! স্ট্রেঞ্জ !

    দুই

    প্রশ্ন উঠতে পারে উপরোক্ত ব্যাপারগুলো কি মানবসমাজে অ্যাবারেশান ? না মানব সভ্যতায় চলে আসছে ব্যাপারগুলো আর চলতেই থাকবে ? যুক্তিযুক্ত বোধগম্যতার প্রশ্নটা এইজন্য তুললুম যে বাংলা প্রথানুগত সাহিত্য বা বাণিজ্য সাহিত্য, যাকে সাধারণত বলা হয় বাস্তববাদী, ইরর‌্যাশানাল গদ্যকাঠামোকে আশ্রয় করে ন্যারেটিভ গড়তে ভয় পায়, অথচ আমাদের মগজে চিন্তাপ্রক্রিয়া নামতার ধাঁচে পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে নামে না । রাজর্ষির বইয়ের পাঠবস্তুকে নিরীক্ষামূক ঘোষণা করার জন্য আমি পটভূমিটা তৈরি করছি না ; তাঁর পাঠবস্তুটির গঠন নিরীক্ষামূলক নয়, তা ইনোভেটিভ । বলছি না যে গদ্যের ন্যারেটর নির্ভরযোগ্য নন ; সৃজনশীল ন্যারেটিভে অসচারচর ঘটনা ঘটতেই পারে । রাজর্ষির সাহিত্যিক টেকনিক বা ডিভাইস সম্পর্কে বলছি, ন্যারেটিভের সাহিত্যিক উপাদান সম্পর্কে নয় । বইটিকে আত্মপ্রবন্ধ, খামচানো স্মৃতি, গদ্যকবিতা, কাব্যোপন্যাস, স্মৃতিবিচরণ, ঠিক কী বলা উচিত, তা পাঠক পড়ে নির্ণয় নেবেন । পাঠবস্তুটি এক্কেবারে কাহিনিহীন নয় । কাহিনির গদ্যকার হলেন কবি রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়, যিনি লিখে চলেছেন আর পাঠক হিসেবে আমি পড়ে চলেছি । তাঁর পেছু-পেছু ঘটনাগুলোকে অনুসরণ করছি । পাঠবস্তুটি কবি-লেখকের জীবনের কিছু-কিছু ঘটনা ও তাদের ঘিরে একত্রিত চরিত্রদের প্রতিস্ব-চমকের মাঝে উঁকি দিয়ে এগিয়েছে, আর পাঠককে যেমন হঠাৎ মাঝপথে ধরে নিয়ে খেলাচ্ছিল, তেমনই মাঝপথে আচমকা তাকে ছেড়ে দিয়ে, অন্য ঘটনায় খেলাতে নিয়ে গেছে । আলোচকের চিন্তা-পরিসরে সাংস্কৃতিক প্রডাক্ট হিসাবে কবি রাজর্ষির পাঠবস্তু একটা ক্রাইসিস তৈরি করে ফ্যালে । এই বইটা সম্পর্কে আমি তাই যখন যেমনটা মনে আসছে, কমপিউটারে লিখে রাখার চেষ্টা করছি । সমালোচনার ধার ধারছি না ।

    তিন

    কাহিনি গড়ার বিবেচনার ধারণাটি ওই কাহিনির পরিসরের স্হানাঙ্ককে পূণঃচিহ্ণিত করার একটি নিমিত্ত বলে মনে করা যায় । তা পাঠবস্তুর সারমর্মতে পাওয়া যাবে না, তার আঙ্গিকেও নয়, পাওয়া যাবে সারমর্মকে আয়ত্ত করার আনুষ্ঠানিক অর্জনে ; তার মানে প্রক্রিয়াটি থেকে তাকে ছাড়ানো যায় না -- লেখার প্রক্রিয়া এবং পড়ার প্রক্রিয়া । যেকোনো সিরিয়াস পাঠবস্তুর বিবেচনাভিত্তি মস্তিষ্কের কাজের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে ; তা বিমূর্ত নয় বটে কিন্তু তা সর্বব্যাপী, আর তার মর্মার্থকে বুঝে ওঠার মাধ্যমে মনে রাখতে হয় যে পাঠের মাধ্যমেই পাঠবস্তুটি গড়ে ওঠে-- তার সমগ্রতা ও সমাপ্তি স্রেফ আনুমানিক ।
    ঋতবীণার রাজর্ষির কাহিনির বোধগম্যতা, তাহলে, ততটা ব্যাখ্যা নয়, যতটা প্রতিবেদন । আলোচক একজন পাঠক হিসাবে রচনাটি পাঠ করেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতাকে প্রতিবেদনরূপে উপস্হাপন করেন । আমি অন্তত সেটাই করার চেষ্টা করছি, কেননা আজকাল আমার ধৈর্য বড্ডো কম । পাঠ-প্রতিক্রয়ার বিবেচনায় খেয়াল রাখতে হচ্ছে যে প্রতিক্রিয়াটি বহুমাত্রিক ; পাঠকও, লেখকের মতোই, নিজের সংবেদ, নান্দনিকবোধ এবং একাগ্র চিন্তার নিবেশ করছেন রচনাটিতে ; তাঁকে মনে রাখতে হচ্ছে যে মগজের কারখানায় ঘটনাবলীকে নকল করার প্রক্রিয়াকে অতিক্রম করে, যে কাহিনি গড়ে উঠছে তা ওই সাহিত্যিক সৃজনকর্মে অংশগ্রহণ । নয়তো ঠাকুমা-দিদিমারা কাহিনি নির্মাতা হিসাবে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক স্বীকৃতি পেতেন ।
    ব্যাপারটা প্রতিনিধিত্বমূলক মডেল গড়া নয়, ব্যাপারটা ডিসকার্সিভ । এই সৃজনশীলতা পাঠবস্তুটিকে স্বায়ত্তের তত্ব থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করছে । বাস্তববাদী আর সৃজনশীল দুই-ই কাহিনি, কিন্তু সৃজনশীল পাঠবস্তু পাঠকের একাগ্রতা দাবি করে, পাঠক তাতে নিজের ক্ষমতা আর ইচ্ছানুযায়ী, সংবেদ ও নান্দনিক বোধ নিবেশ করে । বাস্তববাদী ও সৃজনশীল কাহিনীর পার্থক্য তাদের উদ্দেশ্যে । অধিকাংশ বাস্তববাদী সাহিত্য এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘টাইম পাস’ । সৃজনশীল রচনা কেবল আঙ্গিক নিয়ে চিন্তিত নয়, যেমনটা ছিল ইউরোপের আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে বা আমাদের শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনকারীদের রচনায় । একথা সত্য যে বাস্তববাদী বা বাণিজ্যিক সাহিত্যে আঙ্গিকের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় না ; তা নিয়ে চিন্তা করার সময় বড়ো একটা পান না অমন লেখকরা । বাস্তববাদী বা বাণিজ্যিক লেখনকর্ম খেলো হয়ে যাবার কারণ হল তা কেবল বিষয়বস্তুতেই গুরুত্ব দিয়েছে, বা বলা যায় যে বেশ কিছু চরিত্র একত্রিত করে তাদের জীবনের ঘটনাবলী বয়ান করে গেছে । কিন্তু বিষয়বস্তুই সাহিত্য নয় , নয়তো সংবাদপত্রে প্রতিদিন প্রচুর বিষয়বস্তু পাওয়া যায় । সৃজনশীল কাহিনির একটি আঙ্গিক দরকার, বিষয়বস্তুকে একটি আদরায় ফেলা দরকার। ইনোভেটিভ রচনা-প্রক্রিয়া সাহিত্যের পুরো সম্ভাবনাকে ব্যবহার করতে চায় ।

    চার

    পড়তে বসে ভাবছিলুম, এই বইটা কি উপন্যাস ? এর গদ্য বেশ লিরিকাল, কবিতার লাইনও চলে আসছে টুক-টাক, ফাঁক-ফোকরে । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’ উপন্যাস রিভিউ করার সময়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “নিজের চরিত্রের ওপর দিয়ে একজন কবির মানসভ্রমণ এই উপন্যাস । একদিকে শক্তি স্বগতোক্তি, স্বীকারোক্তিতে বিভোর, আরেক দিকে শক্তি সঙ্গিনীর প্রতি ভালোবাসায় ভেসে যাচ্ছে । আর কিছু শব্দের শক্তি-প্রয়োগ উপন্যাসের ব্যকরণে জায়গা পাওয়ার মতো । এই শব্দ আর কেউ ব্যবহার করলে উপন্যাসে তা মানাত না । যেমন পশ্চাদ্ধাবন, দুরূহ, সদর্থে, ব্যাপক, বৃথা, পদার্পণ, প্রাসঙ্গিক, উষ্ণ, স্হগিত, মূলোচ্ছেদ, বার্তা, যথাসর্বস্ব, এমতাবস্হা, নাট্য ।” রাজর্ষির বইটির ক্ষেত্রেও উক্তিটা প্রাসঙ্গিক মনে হলো । রাজর্ষিও প্রয়োগ করেছেন এই ধরণের শব্দাবলী, যেমন, মস্তিষ্কপ্রসূত, জীবনভাষ্য, আনুপূর্বিক, পুনর্জন্মপ্রাপ্তি, প্রতিসন্ত্রাস, প্রতীতি, অন্তর্ভুক্তিগত, প্রতিশোধপ্রিয়, দৃশ্যময়তা, অহৈতুকি, প্রত্যন্তর, পাখিশাবক, অভিজ্ঞতালবদ্ধ, অনন্বয়, উৎস্রোত, মঞ্চচ্যুত, অননিবার্য ইত্যাদি । বাহান্ন পাতার মধ্যে রাজর্ষি প্রায় প্রতিটি জনারকে আনতে চেষ্টা করেছেন বলে মনে হল, এমনকি নাট্যরসও ।
    পাঠক পাওয়া সহজ হবে না বা পাঠকসংখ্যা কমে যেতে পারে জেনেও কেন একজন কবি-লেখক এই ধরণের কমপোজিশান পছন্দ করেন, প্রশ্ন উঠতে পারে । এর উত্তর খুঁজতে হবে পশ্চিমবাংলার সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপটে । ইংরেজি ভাষায় প্রথম যে ইনোভেটিভ কাঠামোর বইটি রচিত হয়েছিল তা লরেন্স স্টার্ন-এর লেখা ‘দি লাইফ অ্যাণ্ড ওপিনিয়নস অফ ট্রিস্ট্রাম শ্যাণ্ডি, জেন্টলম্যান’ ( ১৭৫৮ ) এবং ফরাসি ভাষায় দেনিস দিদেরো রচিত ‘জাক দি ফ্যাটালিস্ট অ্যাণ্ড হিজ মাস্টার’ ( ১৭৬৫-১৭৮০ ), যে সময়ে ইউরোপে ইনডাস্ট্রিয়াল রিভলিউশানের ( ১৭৬০ - ১৮২০ ) কারণে সামাজিক ও ব্যক্তি-জীবনে উথালপাথাল ঘটে চলেছে এবং নির্মিত হচ্ছে ব্যক্তি-এককের প্রতিস্ব-পরিচয় । দ্বিতীয় বইটিতে প্রথম বইটির বহু উপাদান গ্রহণ করা হয়েছিল এবং বইটি প্রশংসা করেছিলেন গ্যোটে, শিলার, শ্লেগেল ও স্তাঁদাল । প্রথম বইটিতে একটি চরিত্রের মৃত্যু হলে লরেন্স স্টার্ন একটি পৃষ্ঠাকে সম্পূর্ণ কালো করে দিয়েছিলেন পাঠককে শোকে শামিল করে নিয়েছিলেন । বাংলা সাহিত্যে শাস্ত্রবিরোধীদের আবির্ভাব হয়েছিল দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকারি প্রচেষ্টায় হেভি ইনডাস্ট্রিজে পুঁজি নিবেশের দরুণ নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির যখন উদ্ভব হল ।
    রাজর্ষির বইটি, এবং আরও কয়েকজন তরুণের বইও, সৃজনশীল গদ্য কাঠামোকে গ্রহণ করা আরম্ভ করল যখন ভারতে উদারিকরণের দরুণ দেখা দিল ক্রোনি ক্যাপিটালিজম আর মধ্যবিত্তদের জন্য একটা সাহিত্য-টিভি বাজার তৈরি হল । সম্প্রতি মফসসলের এক যুবক বুকে পিঠে পোস্টার টাঙিয়ে দাবি করেছেন যে ওই সমস্ত সাহিত্য-টিভিকে নিষিদ্ধ কিরা হোক, কেননা ওগুলোর কাহিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারদের প্রভাবিত করে অসান্তি ঘটাচ্ছে । অমন বাজারে রাজর্ষি ও তরুণ গদ্যকাররা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না । বুক ভরে শ্বাস নেবার জন্য তাঁদের নিজস্ব ন্যারেটিভের আকাশ-বাতাস গড়ায় একাগ্র হতে হল ।
    এখানে বলে নিই যে আমি জেমস জয়েস, মার্সেল প্রুস্ত, স্যামুয়েল বেকেট, আতোঁয়া আর্তো, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, সালমান রুশডি প্রমুখের সঙ্গে তুলনায় যাচ্ছি না । তার কারণ, আগেই বলেছি, রাজর্ষির ঋতবীণা একটি সাংস্কৃতিক প্রডাক্ট, বাঙালির সংস্কৃতির ।

    পাঁচ

    কেন প্রথাগত ফরমুলা-লেখনকর্মের বাইরে বেরিয়ে টেকনিকের নবায়ন ? রাজর্ষির টেকনিকে রয়েছে মুছে ফেলার আর রদ করার, ভেঙে টুকরো করার আর থামবার, খেলার আর অস্হিরতার সংযুক্তিকরণ -- যে প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে লেখক মর্মার্থকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন অনির্ণেয়তার স্তরে, যা শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের গল্পকারদের থেকে তাঁর শৈলীগত দূরত্ব গড়ে তোলে । হোলিস্টিক কাহিনির পাঠবস্তুতে যে স্বতঃস্বীকৃত অকল্পনা থাকে তা লেখককে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে পারে না । রাজর্ষির পাঠবস্তু স্বীকার করে নিয়েছে যে বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক’ সিস্টেম’ আক্রান্ত হয়েছে অসঙ্গতিতে, আসঞ্জনহীনতায়, পরিধি খসে ঝরে পড়ছে ; অতএব কাহিনির নিজস্ব একটি উৎসব পালন করতে হবে এবং তার জন্য নিজস্ব ন্যারেটিভ-কাঠামো প্রয়োজন । প্রথানুগত কাহিনিগুলোকে বলা চলে এসকেপিস্ট ; তাদের কাজ হল পাঠককে ফুসলিয়ে ভুলোমনের ঘুমঘোরে নিয়ে যাওয়া ।
    প্রথাবহির্ভূত ন্যারেটিভ পাঠককে প্রায়ই বিচলিত করে, তাকে অস্বাচ্ছন্দ্য বা অস্বস্তিতে ফ্যালে, কেননা তা স্বীকৃত বিদ্যায়তনিক ও বাণিজ্যিক নিয়মকে ভেঙে ফেলে নতুন আইডিয়ার জন্ম দেয় । জগতকে যে পরিচিত কাঠামোর সাহায্যে পাঠক ভেবেছিলেন বোধগম্য তার বদলে বিকল্প বোধগম্যতায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করে পাঠবস্তুটি এবং পাঠককে মুক্তির আহ্বান জানায় । বাস্তববাদী বা বাংলা বাণিজ্যিক কাহিনিকে পরীক্ষার খাতায় টিক দেবার বাক্সগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায় ; কি-কি তাতে থাকতে হবে, সম্পাদক টিক দিয়ে স্বীকৃতি দেন-- চরিত্রচিত্রণ, থিম, প্লট, রৈখিকতা, মর্মন্তুদ বা করুণাউদ্রেককারী ঘটনা ইত্যাদি । ওই স্কুলের বাইরের লেখকরা প্রথমেই টিক দেবার কাগজটি ছিঁড়ে ফেলে দেবেন ; তিনি যেন বিদেশে গেছেন যেখানকার পথঘাট তাঁর পরিচিত নয়, অথচ সে দেশের বিষয়ে শুনেছেন অনেক কিছু । প্রতিকীভাবে, রাজর্ষির চরিত্রটি গিয়েছে বাংলাদেশে, যেখানকার গল্প সে তার মায়ের কাছে শুনেছে, যে চরিত্রদের সাথে পরিচিত হচ্ছে, তাদের কথাও সে মায়ের কাছে শুনেছিল ।
    কাহিনির তুরুপের ইশারা হল বইয়ের শেষদিকে বাংলাদেশে যাবার পথের একটি ঘটনা । সে দেশে যাবার পথে চরিত্রটির সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে মিরিয়ম নামে এক তরুণী সহযাত্রিণীর , যিনি মাইজপাড়া কী ভাবে যেতে হয় তা অন্য আরেকজনের কাছে জেনে নিয়ে, জিগ্যেস করছেন, ‘পারবেন তো যেতে’ । ঋতবীণার পাঠক, কাহিনির শেষে রাজর্ষির কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছোলেন কিনা, তা আছে প্রশ্নটিতে ।

    ছয়
    কি করার প্রয়াস করা হয়েছে বইটায় ? প্রথাগত, ট্রাডিশানাল, মেইনস্ট্রিম, কমার্শিয়াল সাহিত্যের কর্তৃত্বকর ক্যাননকে র‌্যাডিকালি যাচাই করতে চেয়েছেন ঋতবীণার রাজর্ষি ; তার চরিত্রচিত্রণের সঙ্গতিকে, ঘটনাবলীর যুক্তিপূর্ণ অনুক্রমকে, বিশ্বাসযোগ্য আচরণকে, পরিচিত অবস্হাকে, তৈরি বিন্যাসকে, দৃষ্টিভঙ্গীকে, কমন সেন্সকে করতে চেয়েছেন যাচাই । ঋতবীণার রাজর্ষির সঙ্গিনী দিল্লির রাজপথে অটোতে কুইকি সেক্স করে নিয়েছে ; অটোঅলাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পুরি খেয়ে আসতে বলে ।
    ‘গার্ল’ নামে জামাইকা কিনকেইড-এর লেখা পড়েছিলুম, মনে আছে, তাতে প্লটের প্রয়োগ, প্রতিস্বের বিকাশ, সংলাপ, লেখক-দৃষ্টি, সেটিং, আঙ্গিকের উপাদান ইত্যাদিকে কোনো গুরুত্ব দেননি তিনি । কাহিনি যেন সংলাপনির্ভর মনে হয়, যেমনটা প্রথম পাঠে ঋতবীণা ; তারপর ঋতবীণার রাজর্ষির চরিত্ররা এক একবার উঁকি দিয়ে চরিত্রের ঝলকানি দেখিয়ে উবে যায় । সেসব চরিত্র ঋতবীণার রাজর্ষির মাধ্যমে ফিলটার হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয় । সেই হিসেবে ঋতবীণাকে বলা যেতে পারে, একই সঙ্গে অ্যান্টি-রিয়্যালিস্টিক এবং অ্যান্টি-মাইমেটিক ; ঋতবীণার রাজর্ষি স্বচ্ছতা গড়ে উঠতে দিচ্ছেন না । বইটিতে ঋতবীণার রাজর্ষি বলছেন যে তা মেটান্যারেটিভ নয় । ঠিকই, ঋতবীণা মেটান্যারেটিভ নয় । দশ কাঁচির ঋতবীণা বইটা পড়তে বসে রাজর্ষিকে উত্তর-সমসাময়িক কবি বলে আঁচ করতে পারি । কিন্তু এই কাঁচি ব্রায়ন জিসিন-উইলিয়াম বারোজের নয়; গদ্যবিন্যাসকে কাটার কাঁচি নয় । ঘটনাবিন্যাসকে কাটার কাঁচি । প্রথানুগত সাহিত্যের মাইমেটিক ক্লান্তির কথা পাঠবস্তুটি জানে বলেই মনে হল ।

    সাত

    ঋতবীণার রাজর্ষি পাঠককে সাহিত্যপাঠের রুটিন থেকে বের করে ভিন্নভাবে চিন্তা করার এলাকায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন ; আর, মনে হয়, বাস্তবের ব্যাখ্যা পাঠক যেমনতর করে আসায় অভ্যস্ত তাকে সেই অভ্যাস থেকে বের করে আনতে চেয়েছেন । ট্রাডিশানাল কাহিনি সাধারণত একটি প্লটকে ঘিরে পাক খায় ; সেই প্লট পাঠকের সামনে একটা বা কয়েকটা সমস্যা খাড়া করে তাদের সমাধানে শেষ হয় । রাজর্ষি সেই ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারকে ভেঙে ফেলেছেন ; প্লটের আইডিয়াকেই আক্রমণ করেছেন । জীবনের আকর্ষণ তো প্লটের ওপর নির্ভর করে না ; কোনো কিছু ঘটার জন্য জরুরি নয় যে তাকে একটি সমস্যা হতে হবে, হাত-ছাড়া অবস্হা হতে হবে, পাত্র-পাত্রীদের জীবনের ঘটনা নিয়ে কান্নাকাটি করতে হবে । বরং ঋতবীণার রাজর্ষি উপস্হাপন করেন তারিয়ে উপভোগ করার মতন অ্যাবসার্ডিটি, চমকের উপাদান । তিনি কাহিনি নির্মাণের ভান করছেন না । কাইনেটিক ছবির মাধ্যমে বাক্য থেকে বাক্যে তুলে আনছেন ঘটমান আর ঘটে-যাওয়া মুহূর্ত ; তাদের একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র ঋতবীণার রাজর্ষি ।
    আগেই বলেছি যে ঋতবীণা মেটা ন্যারেটিভ নয় ; লেখক আগে থেকেই একজন কবি, তিনি কবি ‘হয়ে ওঠার’ প্রয়াস করছেন না । তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “কবির বিনির্মিত লব্ধজ্ঞানই কবিতার উপকরণ ? আর এটাই ‘কবিতার নতুন ?”
    বলছেন, “কবির অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পুননির্মাণ একমাত্র কবিতাতেই হয়, যখন কবি অখণ্ড চেতনায় রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জ গুণগুলি কবিতায় ব্যবহৃত শব্দে আরোপ করেন ।….কবিতা তার বাহ্য রূপ অরূপকে ধ্বংস করে অভিরূপের দিকে যায় । এটা কবিতার আকাঙ্খা আর কবিই পারেন যে কোনও একটা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একমাত্র তাঁর কবিতাতেই অনন্ত রচনা করতে, এটা কবির ।”
  • m | 012312.60.89.19 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৪৪541309
  • কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’
    মলয় রায়চৌধুরী
    বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, আয়ওয়া পোয়েট্রি ওয়র্কশপ থেকে সদ্য ঘুরে-আসা, ইউরোপীয় সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক, ‘জনসেবক’ সংবাদপত্রের সাহিত্য বিভাগের প্রাক্তন সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম “আত্মপ্রকাশ” কেন রেখেছিলেন, তা এক রহস্য হয়ে থেকে গেছে সুনীলের বন্ধুর ভাই ও ‘আত্মপ্রকাশ’-এর নগণ্য চরিত্র পরিতোষের কাছে । যখন উপন্যাসটি ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য লেখেন, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়স ছিল একত্রিশ বছর । বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে, আমার সামনে রয়েছে বইটির ষষ্ঠদশ মুদ্রণ, ২০১৭ সালে প্রকাশিত। অর্থাৎ বইটি বেশ জনপ্রিয় ।
    ‘আত্মপ্রকাশ’ নাম হলেও, উপন্যাসটি কিন্তু ‘কিউনৎসেলরোমান’ নয়, যে অর্থে পঁচিশ বছর বয়সে লেখা জেমস জয়েসের উপন্যাস ‘পোরট্রেট অফ দি আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াং ম্যান’, পঁচিশ বছর বয়সে লেখা টমাস মানের ‘টোনিও ক্রোগার’, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে লেখা রাইনের মারিয়া রিলকের ‘দি নোটবুকস’, আটত্রিশ বছর বয়সে লেখা স্যামুয়েল বাটলারের ‘দি ওয়ে অফ অল ফ্লেশ’ কিংবা ছেচল্লিশ বছর বয়সে লেখা গ্যেটের ‘উইলহেল্ম মিয়েস্টার্স অ্যাপ্রেন্টিসশিপ’, যে বইগুলোর বিষয়বস্তু একজন লেখক বা কবির আত্মপ্রকাশ সংক্রান্ত, অর্থাৎ বইগুলো কিউনৎসেলরোমান সাব-জনারের ( মূল জনার বিলডুংসরোমান ) অন্তর্গত । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বইগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলেই মনে করে পরিতোষ ।
    আত্মপ্রকাশ উপন্যাসের ভাষাবিন্যাস ও কাঠামো সম্পর্কে ভেবেছে পরিতোষ ; তার মনে পড়েছে যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাস লিখেছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়সে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালি’ পাঁচ বছর সময় নিয়ে লিখেছিলেন, কিন্তু আরম্ভ করেছিলেন উনত্রিশ বছর বয়সে । ভাষার কাজ যে অত্যন্ত জরুরি এবং বাংলা সাহিত্যকে উচ্চতর মানে নিয়ে যেতে হবে, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসগুলো থেকে স্পষ্ট । ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে এই উপন্যাসগুলোর ভাষা-নির্মাণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণে ছিল না, তা বিশ্বাস করে না পরিতোষ ।
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’র পাণ্ডুলিপি পড়েছিল পরিতোষ, পাণ্ডুলিপিতে মাঝে-মাঝে জায়গা ছাড়া ছিল এবং সে-বিষয়ে প্রশ্ন করলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিতোষকে বলেছিলেন, ‘এখানে ভাষার খেলা দেখাবো’ । তিনি ‘কুয়োতলা’ লিখছিলেন ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে, যখন তাঁর বয়স তেইশ বছর, উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে । নিজের কবিতাকে তিনি যেমন ‘পদ্য’ বলতেন, তেমনই উপন্যাসকে বলতেন গদ্য । ‘কুয়োতলা’ তাঁর আত্মজীবনী, এবং এই বই থেকে পরের পর একাধিক উপন্যাসে নিরুপম অর্থাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই । ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসের গদ্যবিন্যাসই কেবল নয়, বিভিন্ন চরিত্রচিত্রণ, ও উপন্যাসের কাঠামোয় প্রতিফলিত হয় তাঁর সাহিত্যনির্মাণের জন্য পরিশ্রম, একাগ্রতা ও সততা । পরিতোষ জানে যে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসের ভাষানির্মাণের পরিশ্রমের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেক বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যাঁর সঙ্গে পরিতোষের ভালো পরিচয় ছিল, ১৯৬১ সালে আঠাশ বছর বয়সে ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ গল্প লিখে সাড়া ফ্যালেন, প্রধানত তাঁর লিখনভাষার কারণে । তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি একটি নিজস্ব ভাষাশৈলী আয়ত্ব করেছিলেন এবং তা আজও অননুকরণীয় হয়ে আছে ; নিজস্ব গদ্যবিন্যাস নির্মাণের জন্য প্রায় তিন বছর অবিরাম পরিশ্রম করেছিলেন তিনি । তাঁর নাম না থাকলেও বোঝা যায় রচনাটি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ।
    কয়েকজন বিদেশি ঔপন্যাসিকের প্রথম বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিল পরিতোষ, যেমন গুন্টার গ্রাসের ‘দি টিন ড্রাম’, মার্গারেট মিচেলের ‘গন উইথ দি উইণ্ড’, চার্লস ডিকেন্সের ‘দি পিকউইক পেপার্স’, জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যাণ্ড সেনসিবিলিটি’, এই জি ওয়েল্সের ‘দি টাইম মেশিন’, জে ডি স্যালিঞ্জারের ‘দি ক্যাচার ইন দি রাই’, কুর্ট ভনেগাটের ‘প্লেয়ার পিয়ানো’, সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’, উমের্তো একোর ‘দি নেম অফ রোজ’, খালেদ হুসেইনির ‘দি কাইট রানার’, জোসেফ হেলারের ‘ক্যাচ-২২’ ইত্যাদি । তাই পরিতোষ, যে কিনা তার দাদার বন্ধু সুনীল গাঙ্গুলির সঙ্গে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পরিচিত ছিল, আশা করেছিল যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস নিশ্চয়ই ওই পর্যায়ের হবে । হয়নি বলে খারাপ লেগেছিল পরিতোষের ।
    আমেরিকার আয়ওয়া পোয়েট্রি ওয়র্কশপের জন্য সেখানে থাকাকালীন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি চিঠিতে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই । সত্যি নেই । কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না । কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে-কাছে আর কেউ পৌঁছোতে পারেনি । আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না । লিখব না । কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য । আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না । তবু কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না, লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেটা ছাপার সম্ভাবনা নেই।”ওই চিঠিতে তিনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে আরও লিখেছিলেন, “লেখক হিসেবে, ‘প্রতিভাবান’ এই শব্দটা যদি ব্যবহার করতে হয় -- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া -- শুধু আপনার সম্বন্ধেই আমি ও কথা ভাবি।”
    পরিতোষের মনে হয়েছে, এ কেমনধারা যুক্তি, টাকার জন্য যেমন-তেমন একটা উপন্যাস খাড়া করার চেষ্টা ! টাকার অভাব শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আরও বেশি ছিল, তিনি উল্টোডাঙার একটা বস্তিতে থাকতেন, কিন্তু নিজের কবিতা ও উপন্যাসের প্রতি তাঁর ভালাবাসাবোধকে টাকার ক্ষয়রোগ থেকে দূরে রেখেছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদি টাকার জন্য ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখেও থাকেন, তিনি কিছুটা সময় সাগরময় ঘোষের কাছে চেয়ে নিতে পারতেন যাতে উপন্যাসটি সত্যিই তাঁর ‘আত্মপ্রকাশ’ হয়ে ওঠে ; টাকার প্রয়োজনের কথা সাগরময় ঘোষকে বললে তিনি উপন্যাসের জন্য অগ্রিমের ব্যবস্হা করে দিতেন বলেই মনে হয় ।
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা উপরোক্ত চিঠিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের ও সন্দীপনের সাহিত্যিক লোভ সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন, “আমি জানতুম, আপনি লোভী নন । আপনার সঙ্গে বহুদিন বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি । সেই জন্য আমি জানতুম । আমি আমার লোভের কথা জানতুম । সেই জন্যেই বুঝেছিলুম, আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয় ।” দেশ পত্রিকার পাতায় তাঁর উপন্যাস প্রকাশের লোভে তিনি যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এই বিষয়ে সুনীল গাঙ্গুলির বন্ধুর ছোটো ভাই পরিতোষের কোনো সন্দেহ নেই ।
    পরিতোষ জানে যে সাগরময় ঘোষের প্রস্তাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লোভ জেগে ওঠে, আর তিনি বেশ তাড়াতাড়ি একটা উপন্যাস নামিয়ে ফ্যালেন । তাড়াতাড়ি উপন্যাস নামিয়ে ফেলার এই কর্মপ্রক্রিয়ায় তিনি সারাজীবনের জন্য নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন, যে-কারণে তাঁর সঙ্গে বহুপ্রসু ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদের তুলনা করা হয়, গদ্যশিল্পী ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের তুলনা করা হয় না । এখানে ‘নির্বাস’ উপন্যাসের শুরুতে অমিয়ভূষণ মজুমদার যে মতামতটা প্রসঙ্গক্রমে দিয়েছেন তা উল্লেখ্য ; তিনি লিখেছেন, “চেতনায় অন্য কারো জীবনের ছায়া যদি মুহূর্তের জন্যও পড়ে তবে সে বাইরের বিষয় থেকে নিষ্কৃতি পাবার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে ছায়াটাকে বিশ্লেষণ করে দেখা, তা নিয়ে আলোচনা করা, অন্য কথায় গল্পটা বলে ফেলা।” ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গল্পটা বলে ফেলার বদলে ‘বয় মিটস গার্ল’ ধরণের এনটারটেনার ও জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দি রোড’ উপন্যাসে বন্ধুবান্ধবদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটানো নিয়ে লেখার দোটানায় ভুগেছেন ; ছায়াগুলো বিশ্লেষণের প্রয়াস করেননি । ফলে তা মিলস বুনও যেমন হয়নি, তেমন কেরুয়াকও হয়নি ।
    উল্লখ্য যে আমেরিকায় থাকাকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরিতোষকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “বালজাকের মতো আমি আমার ভোকাবুলারি তৈরি করে নিয়েছি কবিতা ও গদ্যে।” ‘আত্মপ্রকাশ’ পাঠান্তে পরিতোষের সন্দেহ জেগেছে যে তিনি অমন ভোকাবুলারি তৈরি করে প্রয়োগ করার কথা সত্যিই তাঁর প্রথম উপন্যাসটি রচনার সময়ে মনে রেখেছিলেন কিনা । বালজাক চেয়ারে বসে লিখতেন না, দাঁড়িয়ে একটি উঁচু ডেস্কে লিখতেন এবং ঘরে পায়চারি করার সময়ে আলমারিতে রাখা বই ঘাঁটতে তাঁর অসুবিধা হতো না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতন তাঁরও মুখ গোল এবং চেহারা ছিল গোলগাল । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক রচনা লিখে গেছেন বসে থাকা অবস্হায় । লাগাতার বসে থাকলে প্রস্টেট এবং প্রস্টেটের ক্যানসারের সম্ভাবনা দেখা দেয় । যাঁরা বসে লেখেন, তাঁরা তাই উঠে একটু পায়চারি করে নেন মাঝে-মধ্যে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তা করতেন না বলেই মনে হয় ।
    অনরে দ্য বালজাককে বাস্তববাদী সাহিত্যের জনক বলে মনে করা হয় । একশোটি উপন্যাসে, নেপোলিয়ানের পতনের পর জনগণের বাস্তব জীবনযাত্রা ধরে রেখেছেন বালজাক । তিনিও টাকা রোজগারের জন্য সতেরো-আঠারো ঘণ্টা লিখতেন । এই দিক থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বালজাকের মিল আছে ; সুনীলও শতাধিক উপন্যাস লিখেছেন । ক্রমশ উচ্চবর্গ সমাজের অন্তর্গত হবার দরুন সুনীল পরবর্তীকালের উপন্যাসে সেই সমাজের চরিত্রদের আনার প্রয়াস করেছেন । বালজাকের মতনই তাঁরও মনে হয়ে থাকবে অমরত্বের জন্য তাঁর পাঠবস্তুগুলো ধারে না কাটলেও ভারে তো কাটবে ।
    ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে প্রধান চরিত্রের নাম সুনীল গাঙ্গুলি, কিন্তু উপন্যাসের সুনীল গাঙ্গুলির বন্ধুরা সকলেই ফিকটিশাস বন্ধু ( শেখর, তাপস, অবিনাশ, পরীক্ষীৎ, সুবিমল, অরুণ, নুরুল প্রমুখ । একমাত্র পরিতোষ চরিত্রটি বাস্তব, তাই শুরুতেই চরিত্রটিকে আক্রমণ করেছেন ), তাঁর ফিকশান রচনার জন্য গড়ে নেয়া বন্ধু, চরিত্রচিত্রণের জন্য তাদের সম্পর্কে বিশেষ চিন্তা করেননি লেখক, তারা কেউই শক্তি, সন্দীপন, সমীর, শরৎ, তারাপদ, শংকর, দীপক, উৎপল, পার্বতী মুখার্জি নয় ।
    লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার পর নিজের বন্ধুদের নিয়ে আসেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসে, কেননা ততোদিনে তিনি টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে ফিকটিশাস বন্ধুদের কাউকেই তিনি ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে দাঁড় করাতে পারেননি, তারা সকলেই ভাসা-ভাসা । বস্তুত ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসই তাঁর সত্যকার ‘আত্মআবিষ্কার’ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তায় গালমন্দ প্রয়োগ করতেন না, কিন্তু তাঁর বন্ধুরা, বিশেষ করে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বাঞ্চোৎ ও বাইনচোৎ শব্দটি প্রয়োগ করতেন, দীপক মজুমদারও কথাবার্তায় গালমন্দ প্রয়োগ করতেন, অথচ ‘আত্মপ্রকাশ’ আর ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসগুলোয় বন্ধুরা তা নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ করেন না ; করলে অবশ্য ব্রাহ্মবাড়ির মানুষ সত্যজিৎ রায় উপন্যাসটি নিয়ে ফিল্ম করতেন না । অগোছালো জীবনযাত্রার চিত্রণ করলেও, চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ-কাঠামো ভেঙে বেরোতে পারেনি । ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসে দেখা যায়, যে চরিত্রটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আদলে তৈরি, সে যুবতীদের সামনে খালি গায়ে স্নান করতে লজ্জা পায়, অথচ ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে সে বেশ্যালয়ে যেতো !
    তাঁর জীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ গ্রন্হে ‘আত্মপ্রকাশ’ সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “সাবলীল ও যথেচ্ছভাবে অনেকখানি লেখার পর হঠাৎ আমার মনে হল, এ যা লিখে যাচ্ছি, গল্পের মাথামুণ্ডু নেই, এ কী সত্যি পাঠযোগ্য ? নাকি নিতান্তই ভাবালুতা ? অথবা সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায় গর্ভস্রাব ?” তিনি আরও লিখেছেন, “দেশ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশের সময়ে আমি লজ্জায় ও আতঙ্কে কিছুদিন লুকিয়েছিলুম কলকাতার বাইরে । উপন্যাসটার জন্য নিন্দা ও প্রশংসা দুইই জুটেছিল । তবে, নিন্দা, বিরূপ সমালোচনা, এবং কটুক্তিই বেশি । পাঠক যদি বলেন এসব এলোমেলো গদ্যপ্রবাহের কী মানে হয় ।”
    ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে তিনি যে সিরিয়াস ছিলেন না, তা ‘অর্ধেক জীবন’ বইয়ের এই কথাগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, “জোর করে ঢুকিয়ে দিলুম একটা উপকাহিনি । পূর্ববঙ্গের এক অভিনেত্রীর ঘটনাটি অন্যের মুখে শোনা, আমার নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস নয় বলেই বেশ কৃত্রিম, এবং আত্মপ্রকাশ উপন্যাসের সেই অংশটিই সবচেয়ে দুর্বল।” প্রশ্ন হল, একত্রিশ বছর বয়সে তো তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল, কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের কেন্দ্র করেই কতো ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িয়েছিলেন, আমেরিকার কয়েকটি শহর, লণ্ডন ও ফ্রান্স ঘুরেছিলেন, এক বিদেশিনীর সঙ্গে প্রণয়সম্পর্ক গড়েছিলেন, অথচ উপন্যাস লেখার সময়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে সুনীল গাঙ্গুলি নামের চরিত্রটিকে শেখর, তাপস, অবিনাশ, পরীক্ষীৎ, সুবিমল, অরুণ, নুরুল প্রমুখ চরিত্রদের সঙ্গে ঘটনাহীন সংলাপে জুড়তে-জুড়তে উপন্যাসটিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়াস করলেন ।
    উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটির লেখক, ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে স্পষ্ট হয়, নিজেই সন্দেহে ভুগছিলেন যখন, তখন সন্দেহ নিরসনের পর ঠাণ্ডা মাথায় বইটা লেখা উচিত ছিল না কি ? ‘অর্ধেক জীবন’-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “সুনীল নাম দিয়ে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে এটা আমার জীবনের ঘটনা । কিন্তু আত্মজীবনী নয়।” জীবনের ঘটনায় দেশভাগে চার বছরের বাচ্চা তার বাবা-মা দিদির সঙ্গে বহরমপুরে চলে আসে, যুবাবস্হায় বাবার সঙ্গে মনোমালিন্যে ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ কলকাতায় চলে যায় ।
    এই ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ নিজে বা তাঁর বাড়ির কেউই, অথবা বহরমপুরের রিফিউজি পরিবারের যুবতীটি, তাঁরা কেউই পূর্ববঙ্গের বুলিতে কথা বলে না ; পূর্ববঙ্গের বুলি সর্বত্র এক নয় । সুনীল গাঙ্গুলি নামের ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ আর তার পরিবার বিমূর্ত রয়ে গেল, পূর্ব পাকিস্তানের কোন গ্রাম বা শহর থেকে তারা এসেছিল তা টের পাওয়া গেল না। ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে উত্তর কলকাতা নিবাসী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, এবং একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা মেট্রপলিসের কৈশোর-যৌবনের জীবনযাপনের সঙ্গে । সম্ভবত ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ ভাবকল্পটি ব্যবহৃত হয়েছে গর্ববোধের উৎস হিসাবে, কেননা যে-সময়ে তিনি ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখেছিলেন সেই সময়ে গরিব-হওয়া-ভালো, উদ্বাস্তু-হওয়া-ভালো, সর্বহারা-হওয়া-ভালো ইত্যাদি প্রয়োগ করা হচ্ছিল কলকাতা কসমোপলিসের বিপরীতে নবতম মূল্যবোধরূপে খাড়া করার জন্য । সুনীল গাঙ্গুলি নামের চরিত্রটিতে দেশভাগের ট্রমা কেন ছাপ ফেলেনি সে প্রশ্ন ওঠে ।
    উপন্যাসটিতে লেখক নিজেকে এবং বন্ধুদের উপস্হাপন করতে চেয়েছেন ছন্নছাড়া জীবন, খেদ, যৌনতা, বেশ্যাগমন, হতাশা, সামাজিক সীমালঙ্ঘন, টাকাকড়ির অভাব এবং তা সত্বেও জুয়াখেলার প্রতি আসক্তি, ব্যর্থ প্রেমের ঘেরাটোপে আবদ্ধ জীবনের আঙ্গিকহীন কাহিনির মাধ্যমে । কিন্তু আগে থাকতে ভেবে লিখতে নামেননি বলে কাহিনি বা প্লট গড়ে ওঠেনি । ব্যাস, মধ্যবিত্ত যুবকের উদ্দেশ্যহীন দিনযাপন ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করা হয়েছে । উপন্যাসের তিনটি নারী চরিত্র হলো যমুনা, সরস্বতী এবং মনীষা, যাদের ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করেননি লেখক ; তিনি যেভাবে উপস্হাপন করেছেন, যমুনা হলো দেবী, মনীষা ছলনাময়ী, সরস্বতীর চরিত্র ঘোলাটে । বস্তুত দেবী ব্যাপারটি যে ঠিক কী, তা ১৯৬৬ সালেও ব্যাখ্যা যোগ্য ছিল না, আর এখন তো হাস্যকর ; কোনো তরুণীকে ছলনাময়ীর তকমা দেয়াটা বিশ শতকে আরও গোলমেলে নয় কি ?
    সবশেষে বেশ্যা বীণার বোন নুরজাহান বেগমের উপকাহিনি ঢুকিয়ে দিলেন ফিল আপ দি ব্ল্যাংক করার জন্য, যার কোনো আগাপেছু নেই, অথচ তাকে দিয়েই ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাস আচমকা শেষ হয়েছে । বীণার ঘরের বর্ণনা পড়লে মনে হয়ে লেখক একটি বাঙালি বেশ্যার ঘর খুঁটিয়ে দেখেননি, যা আমরা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনায় পাই ।
    পরিতোষের ধারণা, সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের সমাদর পেয়েছে ‘আত্মপ্রকাশ’ , নয়তো পঞ্চাশ বছর যাবত বার-বার মুদ্রণ হতো না ।
  • m | 012312.60.89.19 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৯:৪৬541310
  • প্রবন্ধ : চাইবাসা ও কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেম
    মলয় রায়চৌধুরী
    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কিন্নর কিন্নরী’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, ঘটনাগুলো ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালের, চাইবাসায় টানা যতদিন ছিলেন, সেসময়ের । তাঁর ‘কুয়োতলা’ উপন্যাস, যা তাঁর শৈশবের কাহিনি, সে উপন্যাসে তিনি নিজের নাম দিয়েছিলেন নিরুপম ; পরে নিজের জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে যে আখ্যানগুলো লিখলেন, প্রতিটি উপন্যাসে তিনি নিরুপম । ‘কিন্নর কিন্নরী’, যা তাঁর প্রথম প্রেম, কবি হয়ে ওঠা এবং কবিবন্ধুদের নিয়ে, এই আখ্যানে তিনি নিরুপম নামটা বাদ দিয়ে নিজেকে বললেন পার্থ।
    উপন্যাসটিতে সুনীল, সন্দীপন, দীপক, উৎপল আছেন, এবং আছেন সমীর রায়চৌধুরী আর আছে চাইবাসা, লুপুংগুটু ঝর্ণা, রোরো নদী, হেসাডির অরণ্য, মধুটোলা, সেনটোলা । উপন্যাসটিতে সমীর রায়চৌধুরীর অদ্ভুত প্রেম নিয়ে একটি সাবপ্লট আছে । কাকে কি নাম শক্তি দিয়েছেন তা যাঁরা চাইবাসার ঘটনাবলী জানেন তাঁরাই বলতে পারতেন । বইটি শক্তি উৎসর্গ করেছিলেন শান্তি লাহিড়ি আর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী খুকুকে ; শক্তির প্রেমিকার সবচেয়ে ছোটো বোন খুকু, যাঁকে শক্তি নাম দিয়েছেন বিন্তি । প্রেমিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের নাম দিয়েছেন নয়ন, সবচেয়ে বড়ো বোন মন্টি , যার বিয়ে হয়ে গেছে, তার নাম দিয়েছেন চয়ন, অবিবাহিত বোনেদের নাম দিয়েছেন ময়ন, ইন্তি, বিন্তি, ভাই সন্তুর নাম শানু । সমীরের নাম শম্ভু, সুনীলের নাম হিরণ্ময়, সন্দীপনের নাম সনাতন, দীপকের নাম শর্বরী । পার্থ নামের মতোই, প্রতিটি নামই গোপন বার্তাবহ ।

    ষোলো পর্বের ‘কিন্নর কিন্নরী’র অষ্টম পর্বে চাইবাসায় মধুটোলার ছোটোঘরে শক্তি তাঁর প্রেমিকা নয়নকে নিজের লেখা কবিতা শোনাচ্ছেন, সেই সূত্রে লিখেছেন :
    চোখ খুললো নয়ন । গভীর কালো চোখে তার খুশি উপচে পড়ছে । এত সামান্যে খুশি হয় নয়ন ? ওর বিপদ অনেক ।
    বাষ্পাকুল চোখ দুটি তুলে বলে, ‘আর একটা বলবে ? এই শেষ । আর বলতে বলবো না ।’
    ‘কেন ? আর বলবে না কেন ?’ সপ্রশ্ন পার্থ ।
    ‘তোমারও তো কষ্ট হয়, যেমন হচ্ছে আমার ! হয় না ?’
    ‘হয় নয়ন, হয় -- কষ্ট মেশানো সুখও হয় আবার । কিন্তু থাক, এতো কথা এখনই, তোমায় না বললেও হবে ।’
    ‘কবিতাটির কোনো নাম দিইনি এখনও, নামটা তুমি দিয়ে নিও নয়ন । পারবে না ?’
    পার্থ আর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে আবৃত্তি শুরু করে :
    যাবার সময় বোলো কেমন করে
    এমন হলো, পালিয়ে যেতে চাও ?
    পেতেও পারো পথের পাশের নুড়ি
    আমার কাছে ছিল না মুখপুড়ি
    ভালোবাসার কম্পমান ফুল ।
    তোমায় দেবো ? বাগান দ্যাখো ফাঁকা
    তোমায় নিয়ে যাবো রোরোর ধার
    তোমায় দেখে সবার অন্ধকার
    মুছতে গেল সময়, আমার সময় ।

    ফিরে আবার আসবো না ককখনো
    তোমার কাছে ভুলতে পরাজয় ।
    সবাই বলতো, ইচ্ছেমতন এসো
    অমুক মাসে, বছরে দশবার ।
    তুমি আমায় বললে, এসো নাকো
    জীবনভর কাজের ক্ষতি করে ।
    ‘মিথ্যুক, মিথ্যুক । আমি এমন কথা কবে তোমায় বলেছি ? ছাই তোমার কবিতা -- বিচ্ছিরি --- ককখনো সত্যি নয় । ছিঃ’ --- নয়ন রাগে অভিমানে আকুল হয়ে পার্থর বুকের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে । ‘তুমি আমায় ভাবো কী ?’
    ‘আমার কেবলি ভয় করে, নয়ন, যদি এমন হয় ! তুমি আমায় ভুল বুঝো না, এমন হতেও তো পারে ?’

    তৃতীয় পর্বে শম্ভুর চাইবাসার বাসায় পৌঁছোনো আর থেকে-যাওয়া নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন :
    পাকা বিহারী গেরস্হালির ছোঁয়াচ শম্ভুরা আবাল্য পেতে অভ্যস্ত । ওরা প্রবাসী বাঙালি । খাস বাড়ি কলকাতায় হলেও বাপ-পিতেমো ব্যবসাসূত্রে পাটনায় দীর্ঘদিন ছিলেন । সেখানে ওদের নিজেদের বাড়ি, নিজেদের ব্যবসা ।
    শম্ভু চিরকালই লেখাপড়া সাহিত্যশিল্পের অনুরক্ত । ট্রেনিং নিতে চলে গেলো সুদূর জাপানে একদিন । বাড়িতে আগে থেকে কিছুই জানায়নি । যখন জেনেছে তখন বাড়ি থেকে বাধা দিলেও শম্ভুকে ফেরানো শক্ত । তাই অকারণ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি কেউ । বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে ঐ অল্প বয়সেই সে বিহার সরকারের বেশ উচ্চ কর্মচারী একজন । অবিবাহিত, রুচিবান, ভালো মনের বন্ধুবৎসল ছেলে । তাই ওর ওপর অত্যাচার অনেক সময়ে মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ।
    পার্থ অল্প পরিচয় সত্বেও, শম্ভুর হৃদয়ের কাছাকাছি মানুষজনদের অন্যতম । যখনই কলকাতায় ছোটে কাজে-কর্মে ছুটিছাটায় -- খুঁজে পেতে পার্থর সঙ্গে দেখা করেছে । তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে । পার্থ যথারীতি গেছে এড়িয়ে । বলেছে অনেক কাজ । অমুক মাসে নিশ্চয় যাবো । তারপর সেই পার্থ হঠাৎ এলো শম্ভুর কাছে । এলো আর কিছুতে তাকে ছেড়ে যেতে পারল না । দীর্ঘ দিন পার্থ তার কাছে ছিলো, একেবারে আপনার মতো হয়ে হয়ে ছিলো, তারপর হঠাৎ আবার একদিন পালালো । শুধু শম্ভুর থেকেই পালালো নয় । শম্ভুর যাবতীয় সংস্রব থেকে ছুটি নোলো । মিলিয়ে গেল -- কলকাতার জনসমুদ্রে । কিন্তু তা একেবারেই গল্প শেষের গল্প । আজকের কথা নয় ।

    নবম পর্বে নয়ন সম্পর্কে শম্ভুর উক্তি নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন :
    শম্ভুর যেখানে বাসা সে-অঞ্চলটির নাম নিমডি । চাইবাসা শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে, পূর্বাঞ্চলে । বাড়িটার নামও অদ্ভুত । পুরানা ভাট্টি । আগে এখানে ছিল এক ভাটিখানা । ভাটিখানা উঠে যাবার পর সরকার থেকে এটা নিয়ে নিয়েছে ।
    বাড়িটা একটা উঁচু টিলার মাথায় । খাপড়ার চাল । গা-গতর পাথরের । দরজা-জানলা সবগুলো দশাসই, তাদের গা-ভর্তি মুঠোর মতন বলটু মারা । খিল যেন ছোটোখাটো শালবল্লী ।
    জায়গাটা নির্জন । শহর বন্দরের শেষে এমন নির্জন একঘরে জায়গায় ভাটিখানাই সম্ভব । মানুষের পক্ষে বাস করা একটু শক্ত ।
    কিন্তু শম্ভু ওই বাড়িরই একটা অংশ বসবাসের জন্যে পেয়েছিল । বাকি অংশে থাকতেন আবগারি ইন্সপেক্টর । তাঁর অফিসও এখানে ।
    এক চাকর, শম্ভু এ আবগারি দুজনেরই খাবার তৈরি করে দিতো । ফাইফরমাস খাটতো । কোন অসুবিধে ছিল না । আজকাল শম্ভু অধিকাংশ দিনই চয়নদের বাড়িতে রাতে খায় । খেতে হয়, না খেলে ওঁরা ছাড়েন না । রাগ করেন । পার্থ যখন এলো তখন শম্ভু বাড়িতে খাওয়াই স্হির করে ফেলল। কেননা দুজনে মিলে কারুর বাড়ি খাওয়া খুবই দৃষ্টিকটু । সকালের দিকে হাতে হাতে উভয়ে তৈরি করে নিতো খাবার । সেই খাবারই থাকতো রাতের জন্যে । অসুবিধে হবার কথা নয় ।
    তাতেও ওঁরা রাগ করেন । একেকদিন রাতে শম্ভু-পার্থর নিজের হাতে তৈরি খাদ্য পড়ে-পড়ে পচতে থাকে। ওদের ওখানে চর্বাচূষ্য খেয়ে শম্ভু উদগার তোলে । আর শুধোয়, ‘কী রে কেমন বুঝছিস ?’
    ‘কীসের আবার বোঝাবুঝি ?’ পার্থ শম্ভুর প্রশ্নের বাঁকা ভাব সিধে করে দ্যায় ।
    তবু ছাড়ে না শম্ভু, ‘না, তাই বলছিলুম আর কি ।’
    নিশ্চিন্তে গা ছেড়ে দ্যায় বিছানায় শম্ভু । ‘তা কি পড়াচ্ছিস নয়নকে ? এরকম বিনি পয়সার মাস্টারি আগে করেছিস নাকি কখনো ?’
    ‘না’, পার্থ রাগ করে । শম্ভুর এভাবে কথা বলা তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না ।
    চলে আসার সময়কার নয়নের স্পষ্ট ও ফিসফাস কানে বাজে, ‘কালকে আসবেন তো ? ঠিক ?’
    পার্থ মাথা নাড়ে ।
    শম্ভু বলে, ‘কী রে পাগল-ফাগল হয়ে গেলি নাকি শেষ পর্যন্ত ? ওভাবে একা-একা মাথা নাড়ছিস কেন ? এ্যাঁ ?’
    পার্থ এবার বাস্তবিক ফেটে পড়ে । আর সহ্য হয় না । শম্ভুর চিপটেনের একটা সীমা থাকা উচিত নিঃসন্দেহে ।
    ‘তাই বলে একা-একা ছাড়া দুজনে কীভাবে মাথা নাড়ে -- আমার জানা নেই শম্ভু । তুই হয়তো জানতে পারিস । তা দেখিয়ে দে কেমন করে নাড়তে । দেখে শিখি ।’
    ‘বাব্বাঃ তুই দেখি রেগেই টং । একটু রহস্য করছিলুম -- তাতে তুই যেমন চ্যাটাং চ্যাটাং বোল ছাড়ছিস, আজ উড়েই যাবো বোধ হচ্ছে । হয়েছে কি ? নয়নের বুঝি লক্ষ্মীপুজো ছিল আজ ? বেশিক্ষণ পড়াশুনো হয়নি, তাই...’
    ‘রাখ শম্ভু।’ পার্থ কী বলবে বুঝতে না পেরে হেসেই ফেললো ।
    ‘এই তো, উঃ, কীরকম রামগরুড় হয়ে উঠেছিলি না ? যদি আরশি থাকতো মুখের কাছে -- তা বল দিকি কতোদূর এগুলি, একটু শুনি ।
    ‘তুই মহা ইয়ে...’ বলতে পারে না পার্থ । লজ্জায় অধোবদন হয় ।
    ‘আচ্ছা । তাহলে অনেকখানিই পচ ধরেছে ।’ শম্ভু উঠে বসে আর তখনি মন্ত্রোচ্চারণের মতো পার্থ বলে, ‘হ্যাঁরে, ও আমার কাছে অনেককিছু আশা করে ।’

    প্রথম পর্বে নয়ন কখন কলেজ থেকে ফিরবে তার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষারত পার্থ সম্পর্কে হিরণ্ময়ের ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ) উক্তি বর্ণনা করেছেন শক্তি:
    ‘তুই ছোঁড়া কী রে ? ঐভাবে ক্যাংলার মতো একটা মেয়েছেলের জন্যে বসে থাকিস হাপিত্যেশ করে । দিন নেই রাত নেই --- একি তোর বাপের পোঁতা ইস্টিশান পেলি নাকি ?’

    দশম পর্বের শুরু এইভাবে, এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রগাঢ় প্রণয়ের এবং অজস্র কবিতা রচনার সূত্রপাত ; তাছাড়া শম্ভু সম্পর্কে চয়নের দুর্বলতার কথা :
    শম্ভুকে ট্যুরে যেতেই হলো । বহুভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলো । পারল না ।
    যাবার আগে পার্থকে নয়নদের বাড়ি রেখে গেলো । বলল, ‘ভালোভাবে থাকিস । গাছের ডালে চড়িয়ে রেখে গেলাম । দেখিস অন্তত যে গাছের ডালে বসলি সেই ডালটাই মহান কবির মতো কেটে ফেলিস না।’
    ‘মানে ?’ পার্থ শম্ভুর রহস্যালাপ বুঝেও না বোঝার ভান করে ।
    মানে যে কী -- শম্ভু বলার সময় পায় না । ইন্তিবিন্তিরা হৈ হৈ করে এসে পড়ে ওদের কাছাকাছি । ইন্তিবিন্তিরা নয়নের ছোটোখাটো বোনের দল । ছোটো মানে নিতান্ত ছোটো নয়, ক্লাসের উঁচুর দিকে পড়ে । ইন্তি সবচেয়ে ওপরের ক্লাসে, বিন্তি আর এক ক্লাস নিচুতে ।
    ‘সর্বনাশ, দুই বন্ধু আবার কী যুক্তি করছে রে ?’ ইন্তি বলে বিন্তিকে ।
    ‘কী যুক্তি, কী যুক্তি’ -- বলে বিন্তি যেন নাচে-ভাসা, ওদের গায়ের কাছে সরে আসে । কান পেতে শোনার ভান করে । শম্ভুদা তো স্পিকটি নট । পার্থদা, বলুন না, কী গোপন আলোচনা হচ্ছিলো ? নিশ্চই আমাদের নিয়ে, তাই না রে ইন্তি ?’
    আমাদের নিয়ে তো বটেই । তারপর পার্থদা ! এখন তো আপনি আমাদের, শম্ভুদা টোটালি ফালতু । ধরুন আমরা ওঁকে চিনি না, কী বলুন ?’
    পার্থ মাথা নাড়ে, ‘বেশতো বেশতো । তা ধরা যায় ।’
    চয়ন এসে বলে, ‘শানু এলে পার্থবাবু তুমি ওর সঙ্গে গিয়ে তোমার টুকিটাকি জিনিসপত্র এনে নেবে শম্ভুর ওখান থেকে ।’
    তারপর অত্যন্ত সহজ করে জিজ্ঞেস করে, ‘ট্যুরে কোনদিকে যাবে শম্ভু এবার ?’
    ‘জৈতগড়, আর সেখান থেকে ময়ূরভঞ্জের দুচারটে ব্লক ।’
    ‘ফিরবে ?’
    ‘দেখি । সাতদিনের প্রোগ্রাম -- আগে শেষ করতে পারলে, আগেই ফিরবো ।’
    ‘গরম জামা-কাপড় সঙ্গে নিও ।’
    ‘বাঃ, তা নেবো না কেন ? আমি কি আর নতুন ট্যুরে বেরুচ্ছি ?’
    ‘নতুন আমি বলছি না তো, তবে তুমি যেরকম উসোভুলো ।’
    ‘আমি ? তাহলে পার্থকে যে কী বলবে ?’
    ‘উনি কবি মানুষ, ওঁর ভুল তো স্বাভাবিক ।’
    ‘বাঃ, এরই মধ্যে পক্ষপাত শুরু হয়ে গেলো ? দ্যাখ পার্থ, কেমন ভাগ্যবান ব্যাটা তুই -- দুদিনের জন্যে এসে আমার জায়গাটা দখল করে নিলি ?’
    পার্থ কিছু বলে না । ইন্তিবিন্তির সঙ্গে ঘরের ভেতর দিকে চলে যায় । এখন ওদের একটু সময় দেওয়া উচিত ।
    ময়ন নামটা হয় না । ময়না থেকে ভেঙে গায়ের জোরে ওরা ওদের নামধারার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে । চয়ন ময়ন নয়ন ! তারপর আর মিলরাখা পায়নি বলেই ইন্তি বিন্তি শানু ।
    চয়ন নয়ন ওদের নামের সঙ্গে ময়নকে মিলিয়েছে বটে, কিন্তু ময়ন মেলেনি । সে ওদের স্বভাবের ঠিক বিপরীত ধাতুতে গড়া । অন্তরালবাসিনী । ওদের মায়ের হাতে ধরা । বড়ো একটা মজলিসে আসে না । সময় পায় না ? তাও হতে পারে । আর সময় করে নিতেও চায় না । ও ভেতরে থাকে, ভেতর থেকেই ওদের ওপর মানসিক নজর রাখে । কার কখন কী দরকার ময়নের নখদর্পণে । গোটা সংসারের হাল ধরে আছে সে । মা তো রুগ্নাই । উনি ময়নের কাছে বসে থাকেন । ময়ন বলেছে, তোমায় কিছু করতে হবে না । তুমি শুধু কাছ থেকে বলে দিও ।
    তবুও মা এটা-ওটা টেনে নিয়ে করতে চান । ময়ন রাগ করে ।
    মা বলেন, ‘যা না তুই ওদের সঙ্গে একটু গল্প-টল্প করে আয় । দেখা করে আয় শম্ভুর সঙ্গে । ও তো আবার ট্যুরে যাচ্ছে আজ ।’
    ‘দিদিরা তো আছেই, আমার অনেক কাজ ।’

    এগারোতম পর্বে নয়নের সঙ্গে পার্থর প্রেমের কথা এইভাবে বলেছেন শক্তি :
    কলেজে যাবার আগে নয়ন একবার পিছন ফিরে তাকায় । তারপর চোখের ইশারায় বলে, ভালো হয়ে থেকো ।
    তাই পার্থ ভালো হয়ে থাকে । একেকদিন নিজের সর্বনাশ করতে ইচ্ছা হয় । একেকদিন তাই বাইরে বেরিয়ে রোদে পুড়ে শরীর জখম করে নিয়ে আসে । চলে যায় নয়নের বাস যে পথ ধরে গেছে সেই পথে -- কোর্ট কাছারি বেড় দিয়ে গোশালার সেই পিচ-মসৃণ রাস্তায় । ওইদিকেই অপার চাইবাসা । নয়নের হলুদ কলেজ এতোদূর থেকেই দেখা যায় ।
    কেন যে এই বোকামিটুকু করে ? সর্বক্ষণ নয়নের কাছাকাছি থেকেও এই যে অল্প সময়ের আড়াল --- এতেই পার্থ পাগলের মতন হয়ে যায় । নাকি এ-সমস্তই তার লোকদেখানো বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতা । যেতে-যেতে প্রায়ই মনে হয়, আশপাশের পথচারীদের ডেকে বলবে, শোনো, নয়ন, যাকে আমি ভালোবাসি -- সে এই পথ ধরে গেছে বলেই আমি তার পিছু-পিছু পথ স্পর্শ করতে বেরিয়ে পড়েছি । আমার এ-পাগলামির নাম প্রেম । তোমরা একে প্রেমের উদাহরণও বলতে পারো ।
    নয়নেরই ছোট্ট পড়ার ঘরটায় পার্থর বিছানা । এক কোণে বসে পড়তো নয়ন আর পার্থ চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকতো । চীনালন্ঠনের আলোয় গরবিনীর মুখ লাল ।
    ‘কী দ্যাখো অমন করে ?’
    ‘তোমায় -- তোমাকে দেখি ।’
    ‘আমি আবার দেখার জিনিস নাকি কিছু ?’
    ‘তেমন নয়, তবে--’
    ‘সর্বদাই তো দ্যাখো, দেখে-দেখে এতোদিনে মুখস্হ হয়ে যাবার কথা ।’

    প্রথম পর্বে শক্তি চট্টোপাধ্যায় শম্ভু আর চয়ন-এর জটিল সম্পর্কের কথা লিখছেন :
    ‘হ্যাঁরে নয়ন, তোর হয়েছে কি ? সর্বাদাই কী যেন ভাবিস । চুপচাপ, গম্ভীর । কই এমন তো ছিলি না তুই।’
    ‘কী আবার নতুন পেলে আমার মধ্যে’, পালটা প্রশ্ন করে নয়ন ।
    চয়ন হাসে । ‘তোর তো সবটাই নতুন রে আজকাল।’
    ‘তাই বুঝি’, হেসে পাশ কাটায় ।
    না, এভাবে চলবে না, চলতে পারে না । সে ধরা পড়ে যাচ্ছে । বিশেষ ভাবে দিদির চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাচ্ছে না । দিদি নয়নের আদ্যোপান্ত জানে । আচ্ছা, জানেই যদি তবে অকারণ এটা-ওটা শুধোয় কেন ? আসলে বোধহয় ও কথাবার্তায় সহজ হাওয়া চায় । নয়নকে ভালোবাসে বলেই নয়নের মনের ভাব ভাগ করে নিতে চায়। আশ্চর্য, দিদি ওকে মুখ ফুটে কিছু বলছে না কেন ? দিদিকেও কেমন অদ্ভুত মনে হয় । মনে হয় দিদিও ধীর ও ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে । সে-ও নয়নকে কিছু জানাতে চায় আপন অন্তর্বেদনার কথা । নয়ন বুঝতে পারে, দিদি এক অন্যায় আর অপ্রতিরোধ্য আবর্তে জড়িয়ে যাচ্ছে । ভুল, অত্যন্ত ভুল । নয়ন কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না । সাবধান করবে দিদিকে ? তাতে কি বাস্তবিক কোনো লাভ হবে ? দিদি কি নিজেই যথেষ্ট সাবধান নয় ? তবে ? তবে ছেলেপুলে নিয়ে এখুনি রাউরকেলায় জ্যোতিদার কাছে যাওয়া উচিত । নয়নই চিঠি লিখবে জ্যোতিদাকে । তাড়াতাড়ি করুন, স্ত্রীপুত্রকে এভাবে ফেলে রাখবেন না আর । ভালোমানুষ জ্যোতিদার মুখটা মনে পড়ে নয়নের । দিদি কেমন করে ওঁকে ঠকাচ্ছে ভেবে শিউরে ওঠে সে । বাবাও টের পাচ্ছেন । অস্হির হয়ে ওঠেন তিনিও । এখনই বৈঠকখানা ঘরের দিকে তাকালে দেখা যাবে টেবিল আলোয় তাঁর মুখ অভিমানে জ্বলছে । ঠিক বিস্ফোরণের আগের অবস্হা । দিদি অন্ধ তাই টের পাচ্ছে না । নয়ন কিন্তু বুঝতে পারে যে সর্বনাশের আর বেশি দেরি নেই ।
    নয়ন চোখ মুদে স্তব্ধ । অকস্মাৎ বিচিত্র কোলাহলে চোখ মেলে দ্যাখে, ‘তুমি ? সত্যি তুমি ? এত দেরি করলে যে !’

    দ্বিত্বীয় পর্বে চয়ন-শম্ভু সম্পর্কের জট এই ভাবে খুলেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় :
    প্রথম দিন ওর দিদি চয়নের সঙ্গে দেখা । তিরিশের সামান্য ওপরে বয়স, স্বাস্হ্যোজ্বল চেহারা, হাস্যময় চোখ, তাছাড়া গলার স্বর মায়ায় ভরা । দেখা মাত্রই ভালো লেগে গেল পার্থর । তাছাড়া উনি বললেন যে পার্থর কবিতা পড়েছেন । ভালো লাগে । সব আধুনিক কবিদের মতন দুর্বোধ্য নয় । সুতরাং, পার্থরও ভালো লাগে ।
    পার্থ অবশ্য মুখে বলে, ‘আমার কবিতা ? ওঃ শম্ভু দিয়েছে বুঝি আপনাকে ? ছিঃ ছিঃ সে তো ছোটোবেলায় লেখা --- লেখা না বলে বরং তামাশা বলাই ভালো ।’
    চয়ন মৃদু হাসেন । বলেন, আপনারা দেখছি সবাই এক । নামেই তুলকালাম আধুনিক -- আসলে সেই ম্যাদামারা ভিতু বাঙালি -- কবিতা লেখেন তাতে এত কিন্তু-কিন্তু করেন কেন পার্থবাবু ?’
    শম্ভু অন্যমনস্ক । একটা চাপা অস্বস্তি তার মুখচোখ ছেয়ে ফেলেছে । তখন বে-আব্রু অবস্হার হাল ধরতে তড়োঘড়ি বলে ওঠে, ‘আচ্ছা মুশকিল, বন্ধুকে আনলাম কোথায় চা-টা খাওয়ানো হবে, না । একি কাণ্ড, হ্যাঁ ? ভেবেছিল বেচারা কটা দিন এখানে থাকবে, তা এমন করলে...’
    চয়ন অপ্রস্তুত হন । ‘সত্যিই তো, কী অন্যায়, কিছু মনে করবেন না পার্থবাবু, থাকবেন বৈকি, নিশ্চয় থাকবেন...তখন বুঝবেন আমি কিন্তু মানুষ খারাপ নই । আপনার বন্ধুকে...’
    পার্থ তাঁর মুখের কথা লুফে নিয়ে বলে, ‘শম্ভুর কথা বলছেন ? ও তো আপনার নামগান করছে বলতে পারেন ।’
    মহিলা আরক্ত হন । পার্থর নজর এড়ায় না । সে কিন্তু তার কথার ওজন সম্পর্কে একেবারেই অবহিত না। দোষক্ষালনের জন্যে সত্বর বলে, ‘মাপ করবেন, যদি ভুল করে আপনাকে আঘাত করে থাকি তো ; আমি কিন্তু কিছু ভেবে বলিনি । এমনি হঠাৎ । ও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে’, বলেই চমকে ওঠে । এ কী কাণ্ড করছে সে পর পর ? তার কি মাথা খারাপ ? না হেসাডির অরণ্য, পরিবেশের বিধিবহির্ভূত অকপট, তাকে এহেন মুক্ত আর অসামাজিক কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে । ছিঃ ছিঃ !
    তাই শুধরে নেবার জন্য শেষমেশ বলে বসে, ‘আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না কিন্তু, আমি সামাজিক কথাবার্তার বিশেষ একটা ধার ধারি নে । মুখে-মনে এক বলি । আমি বলতে চাই শম্ভু আপনাকে...’
    ‘অশেষ শ্রদ্ধা করে -- এই --তো ? সে তো জানিই ! আপনাকে আর ওর হয়ে সাউখুড়ি গাইতে হবে না । আপনি একটু বসুন ভাই, আমি এক্ষুনি আসছি । শোনো শম্ভু ।’
    পার্থ একাকী বসে নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকলো । শম্ভু গেলো বাইরে, সম্ভবত দোকানেই গিয়ে থাকবে ।
    চয়ন এসে বসলেন, ‘তারপর কী ভাবছিলে পার্থবাবু ? তোমাকে তুমিই বলি । তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোটো । তর্ক কোরো না, যা বলছি মেনে নাও।’
    ‘নিলাম, মেনে নিলাম । শুধু বলুন, আপনি কিছু মনে করেননি তো ? আমি এখনো পর্যন্ত ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে শিখলুম না । আপনি যদি কিছু মনে করে থাকেন তো---’
    ‘যদি করেই থাকি । তবে তোমার কি ক্ষতিবৃদ্ধি পার্থবাবু ? তুমিই বলো, মনে করা আমার উচিত কিনা।’
    ‘করতে পারেন । আমার সত্যিই কিছু বলার নেই । আমার মাথাটা---’
    ‘তোমার মাথাটা খারাপ নয় তেমন, তবে কি জানো ভাই, এক বিবাহিতা মহিলার নামগান যদি তাঁর অতিবড়ো ভক্তেও করে, ব্যাপারটা সত্যি হলে, নিছক ইয়ার্কির খাতিরেও বলা যায় না । আমি শম্ভুকে ভালোবাসি।’
    এমন স্পষ্ট আর সদম্ভ উক্তি পার্থ জীবনে শোনেনি । বই-এ পড়েছে ক্বচিৎ-কখনো । রক্তমাংসের সাধারণ এক গৃহস্হবধু স্বল্পশিক্ষিত মনের মধ্যে, স্বামী ছাড়াও আরেকজনের জন্যে সযত্নে সিংহাসন পেতে রেখেছেন । পার্থর মহিলাকে প্রণাম করতে ইচ্ছা হয়েছিলো । ভাগ্যিস, এমন খেলো একটা কাজ সে তড়িঘড়ি করে বসেনি । সন্মান প্রদর্শনের বদলে ব্যাপারটা এমন কুৎসিত হয়ে দাঁড়াতো ।
    চয়ন বললেন, ‘পার্থবাবু আমার নাটক করার ইচ্ছে নেই, নতুবা গল্পে যেমন হয় আমি ছেলেমেয়ে স্বামী বিসর্জন দিয়ে শম্ভুর হাত ধরে বলতাম, চলো শম্ভু এবার নতুন রকমের জীবনে ঢুকি । এমন ঘটনা কি আর হয় না? আখছার হচ্ছে আজকাল । তবে আমি বলবো, এ সবই হচ্ছে মোহ থেকে -- ভালোবাসা থেকে নয় । আমি আমার স্বামী জ্যোতিকে অসম্ভব ভালোবাসি । তাঁর ছেলেমেয়েকেও । তিনিও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না, আমি জানি ।’
    ‘শম্ভুর কথা --’
    ‘হ্যাঁ, এও তিনি জানেন । তাঁকে আমিই বলেছি । তিনিও শম্ভুকে ভালোবাসেন খুব । তিনি কারিগরি কাজের মোটা মানুষ, ভেবেছেন হয়তো স্ত্রীর মধ্যে যে সূক্ষ্ম আবেগ-অনুভূতিগুলো রয়েছে সেগুলোর সাহচর্য দিতে যদি কেউ এগিয়ে আসে, কেউ যদি স্ত্রীর মানসিক সহায় হয়, তাতে আপত্তির কী আছে ? এর ফলেই না উভয়ত স্বাস্হ্য বজায় থাকবে । তাঁর কোনো আপত্তি নেই আমাদের এই আলাপচারিতায়, সহযোগে । তিনিও, এখানে এলে আমাদের মধ্যে বসে থাকেন ।’
    ‘ভারি অদ্ভুত তো ? আশ্চর্য !’
    ‘অদ্ভুত কিছুই নয় পার্থবাবু, এ হলো সাদামাটা বাঁচার বিলিব্যবস্হা । নয়ন কিন্তু আমার এ-ব্যাখ্যা মানে না...’

    পঞ্চম পর্বে সনাতন ( সন্দীপন ) সম্পর্কে হেসাডির জঙ্গলের ঘটনা লিখছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় :
    সনাতন যে কাণ্ড করেছিলো তা সত্যিই অলৌকিক । অলৌকিক মানে, মানুষের অসাধ্য । এক কথায় বলতে হয়, সনাতন লেমসার মাকে তার অস্তমান যৌবন-স্মৃতির একটি টুকরো উপহার দেয় ।
    বারান্দায় বসে পার্থ লক্ষ্য করছিল সবই । শুধু এক শ্বাসরোধী আতঙ্কে কোনো কথা বলেনি । বাধাও দেয়নি । কথা বললে কী হতো বলা যায় না । হয়তো কিছুই হতো না । কারণ সনাতন জানতো পার্থ টের পাচ্ছে…
    নানা প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত পার্থ, সনাতন কখন এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি । হঠাৎ চমকে ওঠে, ‘এতো কী ভাবছিস পার্থ ?’
    পার্থ কিছু উত্তর করে না । মুখ নিচু করে বসে থাকে ।
    সনাতন বলে, জানি তুই কী ভাবছিস । কিন্তু ঘেন্নার কাজ আমি কখনো করিনি তুই জানিস । তাছাড়া, এক্ষেত্রে অহল্যার মতো এক পাষাণ প্রতিমাকে স্পর্শ করলুম । আমার পূণ্যই হলো । ঐ অশিক্ষিতা স্ত্রীলোক কি কথা বললো জানিস । তুমি তোমার বন্ধুর কাছে ছোটো হয়ে গেলে না তো ? আমার বড়ো উপকার করলে তুমি ---জেনানা লোকের এ যে কতো বড়ো উপকার --- সে তুমি বুঝবে না ।
    সনাতনই একটানা স্বপ্নে, ফিসফিসিয়ে বলে গেলো লেমসার মায়ের অতীত ।
    ওর স্বামীও ছিলো এমন চৌকিদার । সেসময়ে ওরা বুঝি থাকতো চাইবাসার সদর শহরে । বাংলোয় লোকজনের ভিড় লেগে থাকতো সদাসর্বদাই । ওর স্বামী, স্ত্রীর যৌবনের উপাসক একেবারেই ছিলো না । অহোরাত্র নেশায় চুর হয়ে থাকতো । সেই নেশার ঘোরে স্ত্রীকে তুলে দিয়ে আসতো বাংলোর ঘরে । প্রথম প্রথম অভিমান হতো ওর । হোক না আদিবাসী … তাই বলে কি রেণ্ডির মতন এর তার সঙ্গে শুতে হবে ।
    সুতরাং ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত দুই পৃথক নেশাতে গিয়েই দাঁড়ালো । স্ত্রীর এক, স্বামীর অন্য । ….
    ম্লান হাসে পার্থ । সেই হাসি দেখে সনাতন আরো উত্তপ্ত হয়ে পড়ে ।
    ‘নিজেকে আর কতো ভুল বোঝাবি সনাতন ? তোর শরীর তোর ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে । যতই ব্যাপারটা অন্যভাবে নিস, আমি বলবো--’
    কথাটা পার্থ শেষ করতে পারলো না, সনাতন মুষ্টি একত্র করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর ।

    ( চতুর্থ পর্বে সনাতনের চাকরি সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছেন শক্তি : “ও মাসের প্রথম দিকটায় দু-এক দিনের জন্য অপিস যায় । তখন মাইনে পাবার সময় কিনা । কাজ করে কর্পোরেশানে । ঘুষের সুযোগ আছে বলে ওর সহকর্মীরাই হামলে পড়ে সনাতনের কাজটুকু করে । সনাতনের ঘুষ নিতে নীতিতে বাধে না, ও নিশ্চিত জানে ঘুষঘাস নিতে গেলেই কাজের দায়িত্ব এড়াতে পারবে না । তার বদলে ঘুষের খাতা সহকর্মীদের হাতে তুলে ও মাসমাইনে নিয়েই বিষম তৃপ্ত । )

    তেরো আর চোদ্দো পর্বে শম্ভু ময়নকে বিয়ে করল ; চয়ন সে বিয়েতে উপস্হিত থাকতে চায়নি । শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন :
    নয়ন বলছে পার্থকে, ‘তারপর আবার কী ? হ্যাঁ-হ্যাঁ একটা সুখবর আছে । তোমাকে শম্ভুদা নিশ্চয় জানাবে । ময়ন, মানে মেজদি আর শম্ভুদার বিয়ে যে গো !’
    ‘অ্যাঁ ? সত্যি বলছো ?’
    ‘সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি । কার্ড পাঠাচ্ছি তোমার নামে । এই আসছে হপ্তায় পাবে । আর দিদিটা জানো কি কেলেঙ্কারি করেছে ? ও তো একদম রাউরকেল্লা চলে গেছে, আবার লিখেছে ঐ সময়ে আসতে পারবে না । কী যেন একটা ঝঞ্ঝাটের কথাও লিখেছে বাপু । তা তুমি আসছ তো ? এই ? আমার অনেক বন্ধুকে বলেছি...তারা তোমাকে দেখতে চায় । কি অসভ্য দ্যাখো ।’
    …..
    শম্ভুর বিয়ের চিঠি এসেছে । খুব আশ্চর্য, সে ময়নকে উদ্ধার করতে চলেছে । এই বাড়িতে সে নিজেকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করতে চায় । ভালো কথা । পার্থর কাছে এ-চিঠির একদিন প্রচণ্ড মূল্য ছিল । আজ এর দাম কানাকড়িও না । সে নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছে ।
    শম্ভু লিখেছে, ময়নের প্রতি পার্থর যে মনোভাব সে কারুর অজানা নয় । না এলে ময়ন ভীষণ দুঃখ পাবে ।
    ইনিয়ে বিনিয়ে শম্ভু লেখে বেশ । মাছের খবরদারি না করে যদি উপন্যাস-টুপন্যাস লিখতো তাহলে বাজারে কাটতো ভালো । কিন্তু বাপু, পার্থর কাছে আজ আর কিছু কাটবে না । পার্থ অনেক সাবধান হয়ে গেছে আজ । কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারবে না ।

    শেষ পর্যন্ত কেন তাহলে বিচ্ছেদ ? শক্তি ইঙ্গিত দিয়েছেন, শম্ভু আর ময়নের ভূমিকার :
    শম্ভু আর ময়ন দুজনেই মুকুট নামে একজনের কথা পার্থকে বলেছেন । তার মাধ্যমে চিড় ধরিয়েছেন পার্থ আর নয়নের সম্পর্কের মাঝে । পার্থর সেসময়ে চালচুলো ছিল না, চাকরি করতেন না, মদ খেতেন, এই সব কারণেই হয়ত শেষ পর্যন্ত নয়নের বাবা-মা সম্পর্কের অনুমোদন দেননি । প্রকৃত কী ঘটেছিল তা স্পষ্ট করে জানায়নি পার্থ, নয়নকেই হয়তো তাহলে দায়ি করতে হতো ।
    ঘটনা হল যে স্নাতকোত্তর পড়াবার অজুহাতে নয়নকে পার্থর সংস্পর্শ থেকে দূরে পাটনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল শম্ভুদের বাড়িতে ।
    পার্থ আর কোনোদিন চাইবাসা ফেরেনি ।
  • m | 012312.60.7834.182 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৫৩541311
  • 'যুগান্তর' সংবাদপত্রে হাংরি আন্দোলন নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয়
    কলকাতা, ১৯ জুলাই ১৯৬৪
    হাংরি আন্দোলন মামলা রুজু হবার আগে ।
    দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় লেখা প্রধান সম্পাদকীয় ।
    শিরোনাম : 'আর মিছিলের শহর নয়'

    "বাংলাদেশে দলাদলিতে দীর্ণ বিশ্বাসহীন রাজনীতি আজ নিজের মস্তক চর্বণ করিতে ব্যস্ত । এই আবহাওয়ার জন্যই কি সমাজে এক ধরণের নিরাশাবাদ জন্মলাভ করিতেছে, যার চেহারা ড্রেনপাইপ মস্তানি, যার আওয়াজ রাস্তার রোমিওদের শিস এবং সাহিত্যের 'ক্ষুৎকাতরতার' মধ্যে ভয়াবহভাবে প্রকাশ পাইতেছে ? কাজেই ইহা আশ্চর্য নয়, এই সব বিকৃতির উপাসকরা যারা 'হাংরি জেনারেশন' নাম ধারণ করিয়াছে, তারা পরম শ্রদ্ধাহীন অবজ্ঞায় 'গণিকার মৃতদেহ ও গর্দভের লেজের মাঝে কোথাও' রাজনীতিকদের স্হান নির্দেশ করিতে চাহিতেছে । কলিকাতার ক্ষুধার্ত ছেলেরা এই ধিক্কার দিতেছে এবং আত্মধিক্কারের মধ্যে বন্দী হইতেছে, ইহা কি বন্ধ্যা রাজনীতিকদের প্রায়শ্চিত্ত অথবা অসুস্হ সমাজের অভিশাপ ?"
  • m | 012312.60.7834.182 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:০৫541312
  • দার্শনিক-সাহিত্যিক, কবি সমীর রায়চৌধুরী
    মলয় রায়চৌধুরী

    প্রাচীন ও নবীনের প্রান্তসীমা ধ’রে
    গভীরে প্রবেশ তাঁর ; মধ্যমণি যাঁকে
    বিহঙ্গদৃষ্টিতে মেনে, রন্ধন স্বপাকে
    প্রস্তুতির বেশি কিছু ব্যর্থতার জ্বরে
    বিপন্ন যে কতবার ! কিন্তু এতে সুখ
    গোপন করিনি, জানে শ্বেত পারাবত ;
    উদ্ডীন, তথাপি খুঁজে অগ্রদানী ক্ষত
    নিরস্ত হয়েছে । তুমি প্রতিমার মুখ
    সম্যক আয়ত্ত করে এই নষ্টপ্রায়
    সময়ের ঊর্ধ্বে উঠে রাবণসম্মতি
    অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত করেছো বান্ধব--
    ঋষির পাণ্ডিত্যে তাই শিশুর সভায়
    মানায় তোমাকে, তুমি স্পর্শগন্ধশ্রুতি
    স্বয়ং স্বতঃসিদ্ধ -- ক্ষান্ত হলে জনরব ।
    ( শঙ্করনাথ চক্রবর্তী, ‘সমীর রায়চৌধুরী’ )

    সমীর রায়চৌধুরী একজন দার্শনিক-সাহিত্যিক ; কেবল ভাবুক বা কবি বা গল্পকার বা প্রাবন্ধিক বললে ওনাকে বোঝানো যায় না । ইউরোপে যেমন ছিলেন স্তেফান মালার্মে, উমবের্তো একো, এজরা পাউণ্ড, জাঁ পল সার্ত্রে, আতোয়াঁ আর্তো, আলবেয়ার কামু, মিলান কুন্দেরা, টি এস এলিয়ট, অলডাস হাক্সলি, জাঁ জাক রুশো, ফিয়োডোর ডস্টয়েভস্কি প্রমুখ, যাঁদের লেখায় আমরা তাঁদের বিশ্ববীক্ষা পাই । বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকের পর থেকে আমরা কেবল প্রাবন্ধিক বা গল্পকার বা কবি বা ঔপন্যাসিক পেয়েছি বলে সমীর রায়চৌধুরীর কাজকে বুঝে ওঠা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি -- তাঁরা সমাজকে বুঝতে চেয়েছেন কেবল বাংলা ভাষাসাহিত্যের জ্ঞানের মাধ্যমে । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার যে বিশেষ সংখ্যা ওনার কাজ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাতেও দেখা গেছে কেউ-কেউ, অন্ধের হাতি দেখার মতন, কেবল একটি ডাইমেনশানকেই তুলে ধরেছেন, হয় তাঁর গল্প বা কবিতা বা শব্দভাবনা ; হাংরি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে লিখতে দেখলুম না কাউকে, সম্ভবত হাংরি আন্দোলন ব্যাপারটাই এমন । দাদা, তাঁর গভীর পড়াশুনা আর ব্যাপক অভিজ্ঞতার দরুণ, ছিলেন মাল্টিডিসিপ্লিনেরিয়ান ।
    অলোক গোস্বামী দাদার ছোটোগল্পের বই “খুল যা সিমসিম” আলোচনায় ( বোধ, মার্চ, ২০০৯ ) একটি ঘটনার কথা বলেছেন, “কফিহাউস থেকে বেরুনোর পথে এক প্রথিতযশা সাহিত্যিক বলেছিলেন, সমীর রায়চৌধুরী পড়েছি । তবে কী যে লেখেন, গল্পের আকারে প্রবন্ধ না প্রবন্ধের আকারে গল্প, বুঝতে পারিনি।” উমবের্তো একোর “দি নেম অফ দি রোজ” সম্পর্কে কয়েকজন আলোচক, বুঝতে না পেরে, এরকম কথাই বলেছিলেন ; এজরা পাউণ্ডের কবিতা সম্পর্কে এখনও এমনতর মন্তব্য ইনটারনেটে পাওয়া যায় । দাদা তাঁর ছোটোগল্পে অন্ধকারকে, জ্যামিতিকে, ভারসাম্যকে, সন্ত্রাসকে, ভয়কে কেন্দ্রচরিত্র দিয়েছেন, যখন কিনা বঙ্কিমচন্দ্রের পর থেকে গল্প লেখা হয়ে আসছে ব্যক্তিএকককে নিয়ে । দাদা তাঁর অন্তর্ঘাতী, ক্যাননভঙ্গকারী, সৃজনশীল রচনাগুলোয় যা ধরার প্রয়াস করেছিলেন তা হল “মানবেতিহসের প্রেক্ষিতে এই মুহূর্তের সংঘর্ষময় নবাঞ্চল”। তাঁর ইতিহাসবোধ কেবল সময়কেন্দ্রিক ছিল না । তাঁর পাঠবস্তুর শরীরেই জ্ঞানের বিকাশে অভিজ্ঞতার ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন, রৈখিক সময়ের একটিমাত্র ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বস্তুত ‘সময়বোধ’-এ বিপ্লব আনতে চেয়েছেন, এবং চল্লিশ বছরের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংঘর্ষময় জায়গাটাকে ভরে তুলতে চেয়েছেন নবাঞ্চলের ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা দিয়ে, অভেদের সন্ধান দিয়ে ।
    ১৯৬৩ সালে, হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ‘জলছবি’ নামে, তা শেষ হয়েছে স্বমেহনের অবিকল বাৎসায়নি বর্ণনা দিয়ে, যা বহু পাঠক ধরতে পারেননি, সম্ভবত অতো আগে তেমন পাঠক গড়ে ওঠেনি :
    “উরুসন্ধিতে সাবান বোলাতেই বুক ফুঁড়ে অসংখ্য বুলবুলি উঠে যায় ।
    দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ায় । ক্ষিপ্ত মুঠোয় নির্মমভাবে সাপ ধরে ফেলে ।
    শিরাউপশিরা ধমনিতে উষ্ণরক্ত টগবগ করে ওঠে । অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া
    ছোটে সীমান্তের দিকে । একত্রিত অনিমেষ দ্রুত নিক্ষেপে শরীর ফুঁড়ে
    ছিটকে বাইরে বেরোয় । একটা স্তব্ধ মুহূর্ত । বার্তা পৌঁছোয় ।”
    যে ধরণের প্রশ্নাবলী সাধারণত বিতর্কমূলক দর্শনে আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়, তা দাদা তাঁর কবিতা ও ছোটোগল্পে বুনে দিয়েছেন । দাদার কবিতা ও ছোটোগল্প কেউ-কেউ বুঝে উঠতে পারেননি তার কারণ বঙ্গসমাজের বর্তমান কালখণ্ডে অজ্ঞানতা ও শিক্ষাহীনতা হয়ে উঠেছে গর্ববোধের ব্যাপার । বাঙালির সমাজে পাড়ায় পাড়ায় কোমসোমোলদের চূড়ায় একজন করে ইলিয়া এরেনবুর্গ দিব্বি তাদের সাংস্কৃতিক মধ্যস্হতার পণ্ডিতিয়ানা চালিয়ে রাজত্ব করছিল, যখন দাদা হাংরি আন্দোলনের পরে, নব্বুই দশকের গোড়ায়, পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরলেন। দাদা বুঝতে পারলেন যে এই কলকাতা, এই পশ্চিমবাংলা, তাঁর সিটি কলেজে পড়ার সময়কার, পাণিহাটিতে থাকার সময়কার, উত্তরপাড়ার বসতবাড়ির খণ্ডহরে থাকার সময়কার বাস্তবতার শহর ও রাজ্য নয়, এই বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন । যে সমস্ত পত্রিকা সে সময়ে প্রকাশিত হচ্ছিল, সেগুলো তাঁর মনের মতো ছিল না, বেশিরভাগ পত্রিকা ছিল, আছে এখনও, বিশেষ-বিশেষ বৌদ্ধিক কমপার্টমেন্টে কিংবা গোষ্ঠীতে বিভাজিত ।
    কলকাতায় ফিরে দাদা “হাওয়া৪৯” নামে একটি সাহিত্যিক-দার্শনিক পত্রিকা প্রকাশের তোড়জোড় করলেন, বন্ধুদের বাড়ি-বাড়ি গেলেন, কিন্তু কেউই আগ্রহ দেখালেন না । কোন বন্ধু ? যে বন্ধুর প্রথম কাব্যগ্রন্হ তিনি নিজের টাকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ; যে বন্ধু তাঁর চাইবাসার নিমডি টিলার বাসায় টানা আড়াই বছর ছিলেন, মানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ; যে বন্ধু মদ খাবার পরের দিন সকালে খাঁটি দুধ খেতে চান বলে দাদা তার জন্য বাড়ির সামনে দুধ দোয়াতেন, মানে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ; যে বন্ধু তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে বিনা ভাড়ায় বছর খানেক থেকে উপন্যাস লিখে অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন, মানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় । দাদার প্রস্তাব শুনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, “হাঃ হাঃ, সমীর চিরকাল নতুন-নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে, ও কলেজের সময় থেকেই অমন।” বার্ধক্যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শরীর যখন ভেঙে পড়েছে, তখন ভূমেন্দ্র গুহকে বলেছিলেন, “সবাই আমার কাছে আসে, শুধু সমীরটাই আসে না, ও কি পুরস্কার চায় না !”
    বয়স্ক বন্ধুদের বাড়ি না গেলেও চলতো । দাদা লক্ষ করেননি যে তাঁর অবর্তমানে কলকাতায় ও পশ্চিমবঙ্গের জেলা সদরগুলোয় নতুন প্রজন্মের কবি ও লেখকরা দেখা দিয়েছেন, যাঁদের ভাবনাচিন্তা প্রায় দাদার সমান্তরাল, যাঁরা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক প্রথানুগত চলতি-আড্ডার গুমোট নয়, ভাষাসাহিত্যের ক্যানন অস্বীকার করতে চাইছেন, যাঁদের পাঠবস্তু ট্র্যান্সগ্রেসিভ এবং অন্তর্ঘাতী । ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে দাদা প্রকাশ করলেন “হাওয়া৪৯” পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ।
    ১৯৪৯ সালে, যে-বছর দাদা ম্যাট্রিক পাশ করলেন, আমার বয়স ছিল দশ, আমাকে একটা ফিল্ম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, দাদা পাটনার এলফিনস্টোন সিনেমা হলের মর্নিং শোতে ফিল্মটা আগেও কয়েকবার দেখেছিলেন, আর ভালো লেগেছিল বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, ফিল্মটার নাম ‘দি উইজার্ড অফ অজ’, নায়িকা জুডি গার্ল্যাণ্ড, পরবর্তীকালে এই ফিল্মটার ডিভিডি কিনে আমি আমার স্কুলপড়ুয়া ছেলে আর মেয়েকে প্রায়ই দেখাতুম । ১৯৯০ সালে, অবসর নিয়ে যখন দাদা কলকাতায় ফিরলেন, তখন বলেছিলেন, গল্প রচনার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক ক্রমশ ভেঙে পড়ছে, আর ‘দি উইজার্ড অফ অজ’ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, সমাজের ভেতরের সংঘর্ষে ব্যক্তিজীবনের ব্যাখ্যার অতীত দুর্ঘটনাগুলো ওই ফিল্মের জাদুবাস্তব চরিত্রদের মতন হয়ে চলেছে । বস্তুত, তরুণ আর অতিতরুণদের কাছে, কলকাতায় এসে, দাদা দেখা দিলেন সাহিত্যের নবাঞ্চলের উইজার্ড হিসাবে । ২২শে জুন ২০১৬ তাঁর মৃত্যুর পরে ২৪ জুন তেইশটি পত্রিকা একত্রিত হয়ে কলকাতার অবনীন্দ্র সভাঘরে যে স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন, তা থেকেই তাঁর উইজার্ডরির জাদুবাস্তব খেলার সঙ্গে পরিচিত হই ।
    ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনেও দাদা ছিলেন উইজার্ডের ভূমিকায়, কেবল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের আন্দোলনের প্রতি প্রত্যয় উৎপাদনের জন্যই নয়, অনেক সময়ে বুলেটিন ছাপার খরচ দেবার জন্যও নয়, কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে মননভূমি আগে থেকেই গড়ে তোলা দরকার সে-বিষয়ে পরামর্শের জন্যও । এখন সকলেই জানেন যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আইওয়া থেকে চিঠি লিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখকে হাংরি আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য প্ররোচিত করছিলেন, কিন্তু দাদাকে তিনি তেমন কোনো চিঠি লিখছিলেন না । ওনারা শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু দাদা হাংরি আন্দোলনে ম্যাটাডরের মতন লাল চাদর নিয়ে ষেঁড়ো লেখকদের থামাচ্ছিলেন । অবশ্য বিবিসি থেকে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ডোমিনিক বার্নের একটি রেডিও প্রোগ্রামের জন্য অসুস্হ শরীরে উৎপলকুমার বসু সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি একজন হাংরি আন্দোলনকারী, তার মাস কয়েক পরেই উৎপলকুমার বসু মারা যান ।
    ওনারা তিনজনেই যখন আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হলেন তখন দাদা বলেছিলেন, “অবাক হবার কিছুই নেই”। শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ যখন ছাড়া পাবার জন্য হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার মুচলেকা লিখে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, তখনও দাদা বলেছিলেন, “ওরা সারাজীবন এই পরাজয়বোধ বয়ে বেড়াবে আর লেখালিখি করবে সেই ক্ষয়রোগের সমর্থনে।” একেবারে অব্যর্থ বলেছিলেন দাদা । দাদার বিরুদ্ধে একটা বাড়তি পেনাল কোডের সেকশান চাপানো হয়েছিল, তরুণদের বিপথগামী করার । চাইবাসার মতন ছোটো জায়গায় দাদার গ্রেপতারি বেশ অপমানজনক ছিল নিশ্চয়ই, দাদার শশুর একজন মোক্তার ছিলেন বলে, আর জেলা শাসক দাদার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে, তাঁকে লকআপে ঢোকানো হয়নি।
    এখানে একটা ঘটনা বলে নিই, নয়তো লিখতে বসে ভুলে যেতে পারি । বড়োজ্যাঠা-মেজজ্যাঠার পরপর মেয়ে হবার দরুণ ঠাকুমা, বংশধরের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন । দাদাকে ঠাকুমা তাই খুব ভালোবাসতেন। হাংরি আন্দোলনে দাদা গ্রেপ্তার হয়েছেন শুনে ঠাকুমার সেইদিনই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আর মারা যান । ঠাকুমার মৃত্যুর কারণে হাংরি আন্দোলনের সময়ে বাবা আর জেঠা-কাকারা জেঠিমা-কাকিমারা সবাই উত্তরপাড়ায় একত্রিত হয়েছিলেন । বড়োজ্যাঠা ন্যাড়ামাথায় গিয়েছিলেন আমাদের মকদ্দমার প্রথম দিনে, আর কোনো ভাই ন্যাড়া হননি ।
    ঠাকুমা, যাঁর নাম ছিল অপূর্বময়ী, আর ঠাকুর্দা যাঁর নাম ছিল লক্ষ্মীনারায়ণ, ওনাদের ছয় ছেলে প্রমোদ, সুশীল, রঞ্জিত, অনিল, সুনীল, বিশ্বনাথ আর এক মেয়ে কমলা । বাবা ছিলেন তৃতীয়, রঞ্জিত, লাহোরে জন্মেছিলেন বলে মহারাজা রঞ্জিত সিংহের নামে ওনার নামকরণ । একান্নবর্তী পরিবারটিকে মোটামুটি একা বইতেন বাবা । নিম্নবিত্ত বলতে যা বোঝায়, তাই । থাকতুমও আমরা পাটনার অতিদরিদ্র পাড়ায় । দাদার শেষ কাব্যগ্রন্হের নাম “অপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয়”। উত্তরপাড়ার বসতবাড়ি খণ্ডহর হবার আগে, নকাকা-নকাকিমার সবে বিয়ে হয়েছে, তখন ওনারা সাবর্ণ ভিলার দুটো বিশাল ঘরে “অপূর্বময়ী বিদ্যালয়” নামে বাচ্চাদের একটা স্কুল খুলেছিলেন ; স্কুলটা উঠে যায় ওনাদের দুজনের মধ্যে অবনিবনার কারণে, তখনকার দিনে তো কথায়-কথায় ডিভোর্স ব্যাপারটা ছিল না ।
    দাদার প্রধান অবদান দুটি শতকের সাহিত্যিক-নান্দনিক বৈভিন্নকে দুই হাত দিয়ে টেনে নিজের বুকের কাছে এনে একটা সেতু গড়ে ফেলা, এবং সেকারণেই দাদা আগ্রহী করতে পেরেছিলেন আগের শতকের প্রভাত চৌধুরী, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের পাশাপাশি পরের শতকের অনুপম মুখোপাধ্যায়, তুষ্টি ভট্টাচার্য প্রমুখকে, অথচ দাদা কোনো সংবাদপত্র বা পাবলিশারের পেটোয়া লেখক ছিলেন না ; ওপরে শঙ্করনাথ চক্রবর্তীর কবিতাটা পড়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে । দাদার এই ধরণের বক্তব্য যে, “শব্দের ভেতরে শব্দেরা পাশ ফিরে থাকে”, “একটি বাক্যের ভেতরে লুকিয়ে থাকে একাধিক বাক্য”, “গল্পেরা আমার মাধ্যমে জন্মায়, কলম থেকে নয়”, “তুমি নিজের পারিবারিক ইতিহাসের ভেতরে যেমন জন্মাও, তেমনই স্বদেশের ইতিহাসের ভেতরে” ইত্যাদি কথাগুলো তাঁর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ।
    অভিজ্ঞতা জমেছে শৈশবে পাটনা শহরে অন্ত্যজপাড়া ইমলিতলায় থাকার সময় থেকেই । তাঁর সময়ের আর কোনো বাঙালি সাহিত্যিক কি এমনতর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন, তাঁদের শৈশবে ! ছোটোবেলায় দাদার একটা চোখ ট্যারা ছিল, ট্যারা চোখ সোজা করার জন্য ডাক্তার দেখাবার মতন টাকাকড়ি বাবার ছিল না কেননা ওনাকে কুড়িজনের একান্নবর্তী পরিবার চালানো ছাড়াও উত্তরপাড়ায় ঠাকুমার খরচ আর বসতবাড়ির ট্যাক্স পাঠাতে হতো ; বাবার দোকানে আড্ডা মারতে আসতেন এক বৃদ্ধ, যিনি ছিলেন বিখ্যাত চোখের ডাক্তার দুকখন রামের ( জগজীবন রামের বাবা ) কমপাউণ্ডার, তিনি আরেকজন বালকের ট্যারা চোখ সোজা করার প্রেসক্রিপশানের নকল এনে দিলে বাবা দাদার চশমা করিয়ে দিয়েছিলেন, গান্ধিছাপ গোল চশমা, ডাঁটিটা স্প্রিঙের ; দাদার ট্যারা চোখ বছর দুয়েকে সোজা হয়ে গেল কিন্তু বাঁ-চোখটা সারাজীবনের মতন খারাপ হয়ে গেল ।
    ইমলিতলা ছিল অন্ত্যজ বিহারি আর অত্যন্ত গরিব শিয়া মুসলমানদের পাড়া ; এই পাড়ায় চোর-পুলিস খেলার সময়ে যেকোনো বাড়ির ভেতরে ঢোকা যেতো, কেউই বারণ করতো না, মসজিদের ভেতরে মাদুরের আড়ালে লুকোনো যেতো, যদিও বড়োজ্যাঠামশায় তা পছন্দ করতেন না। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যে কানা গলি ছিল তার শেষে একটা বস্তি ছিল, বস্তিতে গাঁজা গাছের ঝোপ, ওই গাছের ফুল শুকিয়ে বউ-মরদরা ফুঁকতো, দাদার গাঁজা ফোঁকার হাতেখড়ি সেখানেই হয়ে গিয়েছিল, আমার আর মেজদারও । দাদার কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বন্ধুরা গাঁজা ফুঁকতেন বলে মনে হয় না । দাদা আমাদের সঙ্গে নেপালে গেলে, হাংরি আন্দোলনের সময়ে, হিপিদের জমায়েতে, গাঁজা হ্যাশিশ আর এল এস ডি নিয়েছিলেন, মোষের কাঁচা মাংসের পদ চাল-গমের মদ রাকসির সঙ্গে খেয়েছিলেন । নেপালের সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় দাদার ছবি ছাপা হয়েছিল । পরে দাদা নেপালি কবিলেখক আর হাংরি আন্দোলনকারীদের একটা যৌথ সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন, যার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন অনিল করঞ্জাই ।
    কানা গলির শেষের বস্তিতে শুয়োর মেরে খাওয়া হতো, তাড়ি সহযোগে । সন্ধ্যাবেলায় গনগনে লোহা ঢুকিয়ে গর্তে ফেলা শুয়োর মারার আর্তনাদ পেলে দাদা পরের দিন বলতেন, চল শুয়োরের মাংস খাব তাড়ি দিয়ে, রান্নাঘর থেকে এলাচ নিয়ে নে, ফিরে এসে ফিটকিরি দিয়ে দাঁত মেজে নিস । সেই সব গরিব পরিবারের পুরুষ সদস্যরা চুরি-ডাকাতি-পকেটমারি করে সংসার চালাতো, তাদের কাউকে গ্রেপতার করার জন্যে পাড়ায় পুলিশ ঢুকলে দাদা বলতেন চল চল ছাদে চল ; ছাদে গিয়ে দেখতুম সন্দেহজনকরা গোলটালির ওপর দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে পেছনের আমবাগানে । পাড়ায় দাদার সমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে একজনের বাবা পকেটমার ছিল, সেই বন্ধুও বাপের কাছে পকেট মারা শিখছিল, দাদা তাকে বদ্রি পাটিকমার বলে ডাকতেন । দাদা বাড়িতে এসে বলেছিলেন, বদ্রির কুঁড়েঘরে ইশকুলের মতন ব্যাপার, এ-পাড়ার আর অন্য পাড়ার অনেক ছোঁড়া শিখছে, দুআঙুলে পার্স তোলা, আধখানা ব্লেডে কাটা, এইসব ।
    আমাদের বাড়িতে খাঁচাকলে ইঁদুর পড়লে বস্তির দুসাধদের দেয়া হতো, পুড়িয়ে খাবার জন্য । দাদা, মেজদা আমি শৈশবে ইঁদুরপোড়া চেখেছি । যদি জাঁতিকলে ইঁদুর পড়তো তাহলে দাদা ছাদে গিয়ে কিংবা মাঠে গিয়ে, ইঁদুরের ল্যাজ ধরে “চিল কা বাচ্চা চিলোড়িয়া” বলে ঘোরাতেন আর আকাশে চিলেরা পাক খেতে আরম্ভ করলে ছুঁড়ে দিতেন, একটা চিল ঠিকই ইঁদুরটাকে ধরে নিয়ে পালাতো । পরে আমি আর মেজদাও এই খেলা খেলেছি ।
    ইমলিতলায় গুলি, টেনিসবলের ফুটবল, ড্যাঙগুলি, লাট্টুখেলায় দাদা ছিলেন ওস্তাদ, সাইকেলের টায়ারকে কাঠি মেরে মেরে গোলা রোডের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবার প্রতিযোগীতায় দাদা জিততেন প্রতিবার । কিন্তু কাঁইবিচি মানে পাকা তেঁতুলের বিচি আর কলকে ফুলের বিচি যাকে পাড়ায় বলা হতো কানায়েল, সেগুলো গর্তে ফেলার আর টিপ করে মারার খেলায় মেজদা জিততো । টেনিসবল নর্দমায় পড়ে গেলে গুয়ের ভেতর থেকে কাঠি দিয়ে বের করে আনতে হতো, আর বাড়ির কেউ দেখে ফেললে, সন্ধ্যায়, শীতকাল হলেও, চান করে গায়ে গঙ্গাজল ছেটাতে হতো । কম বয়সে পৈতে হয়ে গিয়েছিল বলে বকুনিটা বেশি করে খেতে হতো দাদাকে । বড়দি-ছোড়দির বিয়ে হয়ে যাবার পর সন্ধ্যার সময়ে গামছা পরে চৌকাঠগুলোয় গঙ্গাজল ছেটাবার আর শাঁখ বাজাবার কাজ ছিল দাদার ।
    বাবা তাই দাদাকে একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন । দাদা পাড়ায় ফুটবল টিম গড়ে অন্য পাড়ার টিমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতার আয়োজন করতেন । শিল্ডটা দাদা নিজে তৈরি করতেন, পিচবোর্ডকে শিল্ডের মতন কেটে তার ওপর ব্রুকবণ্ডের রাঙতা মুড়ে আর লাল রঙের রিবন সেঁটে । মাঠে খেলতে গেলে, এখন তার নাম গান্ধি ময়দান, একদিকের গোলপোস্ট হতো দাদার দুপাটি জুতো দিয়ে, অন্য দিকেরটা বিরজু নামে দাদার এক পাড়াতুতো খোঁড়া বন্ধুর, তার মা ছাতু বিক্রি করতেন । দাদা ফেরার সময় জুতো পরে আসতে ভুলে যেতেন আর পুজো পর্যন্ত বিনা জুতোয় থাকতেন, স্কুলও যেতে হতো খালি পায়ে, কেননা বাবা সকলের জুতো বছরে ওই একবারই কিনে দিতেন, মহালয়ার আগে । খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া এড়াতে দাদা একজন জজের জুড়িগাড়িতে, পেছন দিকে যেখানে আর্দালি দাঁড়ায়, সেখানে বসে চলে যেতেন, জজ সায়েবকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময়ে আর্দালির দাঁড়াবার জায়গা তো ফাঁকা থাকতো ।
    ইমলিতলায় শাসনের ভার ছিল বড়োজ্যাঠার ওপর । ওনার খাটের তলায় শরকাঠির গোছা ছিল তা থেকে একটা টেনে বের করে হাতের চেটোয় মারতেন, শরকাঠি অবশ্য দুতিনবারেই ভেঙে যেতো । বড়োজ্যাঠা দাদার নাম ধরে হাঁক পাড়লেই দাদা আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ মেরে হুলাসবাবুদের বাড়ির ছাদে গিয়ে ওনাদের চারটে সিঁড়ির কোনো একটা দিয়ে নেমে পালাতেন, ফিরতেন বড়োজ্যাঠা অফিস চলে গেলে কিংবা ভুলে গেলে । দুটো বাড়ির মাঝের গলি ছিল অন্তত চার ফিট । হুলাসবাবু তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ নিয়ে একটা খেলা খেলতেন যা দাদার পছন্দ ছিল ; কুরুশকাঠির মতন একটা লোহার কাঠি যাকে ‘শ্রীরামশলাকা’ বলা হতো, সেটা কোনো একটা খোপে চোখ বুজে রাখা ; যেখানে-যেখানে রাখা হতো সেই অক্ষরগুলোর সাহায্যে কোনো দোহা চিহ্ণিত করে ব্যাখ্যা করে হুলাসবাবু ভবিষ্যত বলতেন । এই খেলা নিয়ে “টিনিদির হাত” নামে দাদার একটা গল্প আছে ‘খুল যা সিমসিম’ গল্পগ্রন্হে ।
    স্কুলের শেষ ধাপ পর্যন্ত, অর্থাৎ ম্যাট্রিকুলেশান অব্দি, দাদার পড়ার টেবিল বলতে ছিল একটা বড়ো মাপের প্যাকিংবাক্স, বাবার ফোটোগ্রাফির দোকান থেকে আনা, তার ওপর মায়ের পুরোনো শাড়ি পাতা । দাদাকে মেঝেয় বসে পড়তে হতো, রাতে লন্ঠনের আলোয় । লন্ঠনের কাচের ভুষো দাদাকে পরিষ্কার করতে হতো । কাচ ভেঙে গেলে দাদা বাতি জ্বেলে রসুন দিয়ে জুড়ে নিতেন যতো দিন চলে । মা ছিলেন রান্নাঘরের ইনচার্জ, সুতরাং মায়ের আদেশে দাদাকে কয়লা ভাঙতে হতো, বাতিল প্যাকিংবাক্সের কাঠ টুকরো করতে হতো উনোনের জন্য, অনেকসময়ে সকালে পোড়া কয়লা বের করে উনোন সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে হতো । পোড়া কয়লার সাদা অংশ আলাদা করে রেখে দিতে হতো যাতে তার সঙ্গে ফটকিরির গুঁড়ো মিশিয়ে বাবা বাড়ির সকলের জন্য দাঁতের মাজন তৈরি করে দিতে পারেন ।
    মেজজ্যাঠা জামের ভিনিগারের ব্যাবসা আরম্ভ করার তোড়জোড় করে ছিলেন, যদিও চলেনি । আড়াই-তিন ফিটের এনামেলের গামলা জামে ভরে দাদাকে তার ওপর লেফ্ট-রাইট করতে বলতেন, পরে আমিও করেছি । লেফ্ট-রাইট করার সময়ে দাদা একটা গান গাইতেন, “তুফান মেল, ইসকে পইয়ে জোর সে চলতে, অওর অপনা রাস্তা তয় করতে, সবহি ইসসে কাম নিকালে, বচ্চে সমঝে খেল, তুফান মেল”, কাননবালার গান সম্ভবত, স্মৃতি থেকে লিখছি ।
    সন্ধ্যাবেলা পড়াশুনার শেষে বড়োজেঠিমা আমাদের গল্প বলতেন, ঠাকুমার ঝুলি, পঞ্চতন্ত্র, ইশপের ফেবল, আরব্য রজনীর খিচুড়ি বানিয়ে ওনার নিজস্ব গল্প । আমরা জাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনরা লন্ঠন ঘিরে ওনার গল্প শুনতুম । শুনতে-শুনতে দাদা লন্ঠন নিভিয়ে দিতেন, বলতেন, “আলো জ্বললে গল্পটা দেখতে পাবো না”। দাদার গল্পে যে ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তব তার উৎস বড়োজেঠিমার অবিশ্বাস্য গল্পগুলো । দাদার গল্পগুলোয় জাদুবাস্তবতার আরেকটা কারণ হলো, যেকারণে দাদা তাঁর পত্রিকার নাম রেখেছিলেন “হাওয়া-৪৯” বা ঊনপঞ্চাশ বায়ু, তা হল এই যে পাটনা কলেজিয়েট স্কুল, যে স্কুলে দাদা পড়তেন, তা এক সময়ে ছিল পাগলাগারদ, সেই বিলডিং ভেঙে স্কুলের বিলডিঙ তৈরি হয়, পরে পাগলাগারদ রাঁচিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় । স্কুলের ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে পাগলদের সম্পর্কে নানা আজগুবি কুহকের গল্প ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে আদান-প্রদান করতো, চোর-পুলিশ লুকোচুরির বদলে পাগল আর সুস্হমগজের খেলা খেলতো । অবসরের পর বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি থাকার সময়ে দাদা এক মুসলমান চাবিঅলা, ঠেলাগাড়ির সবজিঅলা আর নাপিতের সঙ্গে বাড়ির বারান্দায় খোশগল্প করতেন আর তাদের কাছ থেকে যে জাদুবাস্তব জগতের আভাস পেতেন তা তাঁর গল্পে কাজে লাগতো। “তোমাদের বাড়ির রোদ”, এই অভিব্যক্তি দাদা পেয়েছিলেন তাঁর বাংলাদেশি কাজের-বউয়ের কাছ থেকে, যে রোদ, দাদার মনে হয়েছিল, একযোগে স্হাবর ও অস্হাবর সম্পত্তি । তেমনই বাড়ির নিজস্ব অন্ধকার, যা পাওয়া যাবে দাদার ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পে ।
    দাদার আরেকটি স্মৃতি ছিল পাণিহাটির রাঙাদিদুকে কেন্দ্র করে, যিনি কম বয়সে বিধবা হয়ে যাবার দরুন সংসারছাড়া হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে সবাই নেড়ি পাগলি বলতো, তিনি দাদাকে ভালোবাসতেন আর কোলে বসিয়ে নানারকম আজগুবি গল্প শোনাতেন । মামার বাড়ির ব্যানার্জি পাড়া রোডে যখন যার বাড়িতে ইচ্ছে খেতেন রাঙাদিদু, দাওয়ায় শুতেন, মাথা গোলমাল হলেও সমাদৃত ছিলেন, পাড়ায় পাড়ায় সারাদিন টোটো করে বেড়াতেন । উনি ছিলেন দাদামশায়ের কোনো ভাইয়ের স্ত্রী । নাপিত দেখলেই বেলতেন, ‘এই হারু, আমার মাথাটা ন্যাড়া করে দে দিকিনি’ ।
    দাদার কাছে একটা খেলা শিখেছিলুম যা আমি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” স্মৃতিকথায় লিখেছি । একটা নীল মাছিকে মেরে, সুতোর একদিকে বেঁধে দাদা ছুঁড়ে দিতো গোপাল হালুইকরের জিলিপির পাহাড়ের ওপরে, সেই পাহাড়ে ভিমরুলের ঝাঁক । একটা ভিমরুল মাছিটাকে কামড়ে ধরে মিষ্টির বদলে ননভেজ খাওয়াই পছন্দ করতো, মুখ থেকে ছাড়তে চাইতো না, পেট না ভরা পর্যন্ত । দাদা অন্য প্রান্তটা ধরে ঘুড়ির মতন ওড়াতে-ওড়াতে ইমলিতলার এগলি-সেগলি দৌড় মারতেন, পেছনে পাড়ার ছেলেরা ।
    গোলা রোড দিয়ে শব গেলে শববাহকরা ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ বলতে বলতে যেতো, যা শোনা যেতো ইমলিতলার বাড়ি থেকে । মৃতের আত্মীয় শবের সামনে হাঁটতে-হাঁটতে খইয়ের সঙ্গে তামার পয়সা ছেটাতো । শববাহকদের কন্ঠস্বর শুনতে পেলে দাদা বলতেন, “চল চল পয়সা লুটবো” । আমি আর মেজদা দাদার পেছন -পেছন দৌড়োতুম, আর পয়সা কুড়োতে-কুড়োতে ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ ধ্বনি তুলতুম । দাদা পয়সা জমিয়ে আলুকাবলি খেতেন বা সিনেমা দেখতেন, একেবারে সামনের শ্রেণির, যাকে তখন বলা হতো ছওআনিয়া, বা তখনকার চব্বিশ পয়সা। সিনেমা দেখা আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল, বড়োজ্যাঠা আর ঠাকুমা পছন্দ করতেন না, সিনেমাকে বলতেন লোচ্চাদের তামাসবিনি । বয়স্করা লক্ষ্য রাখতেন যে তিনটে থেকে ছ’টা টানা তিন ঘণ্টা ছোটোরা কেউ বাড়িতে অনুপস্হিত থাকছে কিনা । দাদা একটা উপায় বের করেছিলেন ; একদিন প্রথমার্ধ উনি দেখে গেটপাসটা আমায় দিতেন দ্বিতীয়ার্ধ দেখার জন্য, পরের দিন আমি প্রধমার্ধ দেখতুম আর দাদা দ্বিতীয়ার্ধ । মরনিং শো দেখতে গেলে বাড়িতে কেউ টের পেতেন না । অমন একটা মরনিং শোতে দাদা আমাকে ‘উইজার্ড অফ অজ’ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন ।
    দাদার জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটিতে, মায়ের মামার বাড়িতে, ব্যানার্জি পাড়া রোডে, এখন রাস্তাটার অন্য কোনো নাম হয়েছে ; দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কম বয়সে মারা যাওয়ায় দিদিমা ছেলে মেয়েদের নিয়ে বড়ো ভাই অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় পান । মায়ের বাপের বাড়ি, যার নাম “নিলামবাটি”, তা ছিল অনাদিনাথের বাড়ির উল্টোদিকে । পাণিহাটিতে দাদার নাম রাখা হয়েছিল বাসুদেব, সেখানে সকলে বাসু নামেই চেনে দাদাকে, মা-ও দাদাকে বাসু নামে ডাকতেন । পাটনায় আসার পর, জাঠতুতো দিদিরা দাদাকে মিনু বলে আদর করা আরম্ভ করেন, দাদা মীনরাশির জাতক বলে । সমীর নাম রাখা হয়েছিল জন্মছকে ‘স’ উঠেছিল বলে । জাঠতুতো দিদিদের বিয়ে হয়ে গেলে ওনাদের বাড়িতে ভাইফোঁটা করতে যেতুম দুজনে, মেজদা যেতো না। ইমলিতলার বাড়িতে ভাইফোঁটা হতো তার আগের দিন, প্রতিপদে, সাবর্ণ চৌধুরীদের পারিবারিক সংস্কার রক্ষার খাতিরে ।
    ইমলিতলায় দাদার জিভে বাংলা আর পাটনাইয়া হিন্দির খিচুড়ি তৈরি হচ্ছিল বলে দাদাকে ভর্তি করা হয় বাঙালি পরিবার পরিচালিত মহাকালী পাঠশালায় । দাদার জন্ম যদিও ১৭ আগস্ট, কিন্তু ভর্তির সময়ে পুরুত মশায় সতীশ ঘোষালের উপদেশে দাদার জন্ম তারিখ পাল্টে করে দেয়া হয়েছিল ১লা নভেম্বর, ১৯৩৩ । ইমলিতলার বাড়িতে জন্মদিন পালনের কোনো ব্যাপার ছিল না ; দাদার জন্মদিন পালনের কোনো ঘটনা দরিয়াপুরে চলে যাবার পরও ঘটেনি । জন্মদিন যে উৎসব হিসেবে পালন করা হয় সেই সাস্কৃতিক স্তরে ছিল না আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ।
    মহাকালী পাঠশালায় পড়া শেষ করলে দাদাকে ভর্তি করা হয় পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে । এই স্কুলে দাদা পাটনার খ্যাতনামা বাঙালি পরিবারের ছেলেদের পান, যেমন বিমানবিহারী মজুমদার, গোপাল হালদারের ভাই রঙিন হালদার, প্রভাতী পত্রিকার সম্পাদক মানিক ভট্টাচার্য, জহর রায়ের বাবা সতু রায়, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত প্রমুখ । দাদার আগ্রহে একটা নাটকের দল গড়ে ওঠে, আর বন্ধুরা মিলে বড়দির শশুরের বিশাল জমিদারবাড়ির দালানে নাটক অনুষ্ঠান করতেন । দাদার পাটনার বন্ধুরা কিন্তু আমাদের ইমলিতলার বাড়িতে আসতেন না, ছোটোলোকদের পাড়া বলে।
    ম্যাট্রিকুলেশানের পর দাদাকে কলকাতায় পড়তে পাঠাবার নির্ণয় নেন বাবা-মা, তার কারণ আমার মেজদা ( যাকে বড়োজেঠা এক বেশ্যার কাছ থেকে দেড়শো টাকায় কিনেছিলেন ) নিজের জন্মের কথা কোনো সূত্রে জানার পর, যাকে বলে “খারাপ হয়ে যাওয়া” তাই হয়ে যাচ্ছিল, বাংলায় কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মায়ের মামার বাড়িতে । মামারা দাদাকে সিটি কলেজে আই এস সি পড়ার জন্য ভর্তি করে দেন । মামার বাড়িতে ছোটোমামা ছিলেন মার্কসবাদে আকৃষ্ট, প্রচুর বই ছিল ওনার সংগ্রহে, নিজের সংগ্রহের শতাধিক বই দাদাকে দিয়ে দিয়েছিলেন । তাছাড়া ওই বাড়িতে বৈঠকখানায় ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের একটি গ্রন্হাগার ছিল, পুরোনো আমলের পত্রিকা ছিল, দেয়ালে টাঙানো ছিল উনিশ শতকের মনীষীদের ছবি, সেই ঘরে সন্ধ্যাবেলায় পাণিহাটির বয়স্করা একত্রিত হতেন দার্শনিক তর্কাতর্কির জন্য ।
    মামার বাড়ির শিক্ষা আর পারিবারিক সংস্কৃতি দাদার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পেরেছিল । দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কারকারী স্যার রোনাল্ড রসের সহগবেষক, গ্রেট ব্রিটেনের সপ্তম এডোয়ার্ডের স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন । পাণিহাটির কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন দাদামশায় । তাঁর নামে পাণিহাটিতে একটি রাস্তা আছে । ব্যাঙ্কে তাঁর ফোটো ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত টাঙানো ছিল, পাণিহাটির মিলিউ পালটে যাবার পর ছবিটি ফেলে দেয়া হয়েছে । তাঁর সঙ্গে আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর পরিচয় ছিল, এবং সেই সূত্রেই মা-বাবার বিয়ে । মায়ের নাম অমিতা। দাদা আর আমি দুই ভাই, নিজেদের কোনো বোন নেই।
    মায়ের মামার বাড়ির শৃঙ্খলা দাদার ইমলিতলা চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না । তাছাড়া সেসময়ে ইলেকট্রিক ট্রেন আরম্ভ হয়নি, প্যাসেঞ্জার ট্রেনে শেয়ালদায় আসা-যাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় ছিল না । শেয়ালদা স্টেশানও হাওড়া স্টেশানের তুলনায় পুর্বপাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুতে ছিল ছয়লাপ, প্রতিদিন যাদের দুরবস্হা দেখতে-দেখতে দাদার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল । তাছাড়া ঠাকুমার পছন্দ ছিল না যে দাদা পাণিহাটিতে মায়ের মামার বাড়িতে থাকুন । দাদা চলে এলেন উত্তরপাড়ায় ঠাকুমার বারো ঘর চার সিঁড়ির খণ্ডহর সাবর্ণ ভিলায়, বেছে নিলেন চিলেকোঠার ঘর, ঠাকুমাকে এড়িয়ে এই ঘরে সিগারেট ফোঁকা যেত। পাণিহাটিতে রাতে বাড়ি ফিরতেই হতো, তার কারণ মামারা কলকাতায় চাকরি করতে যেতেন আর ফিরতেন, তা যতো রাতই হোক, ট্রেন পাইনি বলে ওজর দেবার সুযোগ ছিল না । ঠাকুমা একা থাকতেন, তাই রাতে কলকাতায় থেকে গেলে তাঁকে যা হোক কোনো গল্প শুনিয়ে দিতে পারতেন দাদা । উত্তরপাড়ার বাড়িতে আদ্যিকালের একটা পেল্লাই বিছানা দাদাকে বরাদ্দ করেছিলেন ঠাকুমা, যার পায়াগুলো ছিল বাঘের পায়ের মতন ।
    উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে প্রতিবেশী অমিত মৈত্র নামে একজনের সঙ্গে দাদা “লেখা’ নামে একটা পত্রিকা আরম্ভ করেন । সিটি কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একজনের কবিতা প্রশংসনীয় মনে হওয়ায় দাদা আর্টস বিভাগে গিয়ে সেই ছাত্রটির সঙ্গে পরিচয় করেন । ছাত্রটির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । দাদার সঙ্গে এই সময়ে পরিচয় হলো আনন্দ বাগচি, দীপক মজুমদার, শংকর চট্টোপাধ্যায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, শিবশম্ভু পাল, ফণীভূষণ আচার্য প্রমুখের , যাঁরা প্রায়ই ছুটির দিনে দাদার চিলেকোঠায় আড্ডা মারতে আসতেন । এনারা কেউ না কেউ দাদার জন্যে খাবার আনতেন ছুটির দিনে । কলেজের দিনে দাদা কলকাতার পাইস হোটেলে খেতেন, সাধারণত কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের পাইস হোটেলে বা শ্যামবাজারের পাইস হোটেলে । “কৃত্তিবাস” পত্রিকা আমি প্রথম দেখি দীপক মজুমদারের হাতে, শ্যামবাজারের পাইস হোটেল থেকে খেয়ে দাদা আর আমি বেরিয়েছি, ওনার সঙ্গে দেখা। দাদা ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দ্যান প্রখ্যাত কবি আর সম্পাদক হিসেবে ।
    ইমলিতলার পরিবেশ থেকে মুক্ত করার জন্য দাদাকে সিটি কলেজে পড়তে পাঠানো হলেও পিসতুতো ভাই সেন্টু ওরফে অজয় হালদার দাদাকে কলকাতার সেই পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করাতে কার্পণ্য করলেন না । পিসেমশায় থাকতেন আহিরিটোলার শরিকি বাড়িতে, নিয়মিত সোনাগাছি যেতেন আর ধেনো মদ খেতেন। সেন্টুদার সঙ্গে পরিচয় ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের, সম্ভবত কোনো মদের জমঘটে তাঁদের প্রথম আলাপ । দাদার সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় হলো । দাদার চিলেকোঠার ঘরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন আর দীপক মজুমদার গাইতেন হিন্দি ফিলমের গান । সেন্টুদা আর দীপক মজুমদারের তর্কাতর্কি হতো হিন্দি ফিলমের রেহানা, কুলদীপ নায়ার, সুরাইয়া, মধুবালার যৌনতা নিয়ে । একবার তর্কে হেরে যেতে যেতে সেন্টুদা হঠাৎ দীপক মজুমদারকে বলে ওঠেন “তুমি রেহানার ওখানে হাত দিয়ে দেখেছো নাকি !”
    ও, হ্যাঁ, দাদার সম্পর্কে আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল, ভুলে যাবার আগে লিখে ফেলি । বেনারসে কাঞ্চনকুমার মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে যোগ দিলে ওর বন্ধু হাংরি আন্দোলনের ছবি-আঁকিয়ে অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়েছিল । এই ঘটনাটা নেপাল থেকে আমরা ফেরার পর । নেপাল থেকে অনিল আর করুণা একটা করে ‘রেড বুক’ কিনেছিল, আমিও কিনেছিলুম । সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিল বলে ওরা দুজনে চিনে তৈরি লাল টকটকে মাও সে তুঙ কোট কিনেছিল । আমি আর দাদা কিনিনি, আমার রঙচঙে পোশাকের অ্যালার্জি আছে, আর বিহারের জাতপাতে আক্রান্ত মার্কসবাদ দেখে দাদা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল । বেনারসে অনিলের বাঙালিটোলার স্টুডিওতে কিংবা কাঞ্চনের বাড়ির গ্যারাজের ওপরের ঘরে বেনারসের নকশালদের জমায়েত হতো । বেনারসের বাঙালিটোলার পেইনটারদের সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গ আর পিটার অরলভস্কির পরিচয় হয়েছিল ।
    একদিন একজন সাংবাদিকের কাছে ওরা জানতে পারলো যে অনিলের স্টুডিওয় পুলিসের রেইড হতে পারে আর হয়তো ওদের গ্রেপ্তার করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে । কলকাতায় নিয়ে যাওয়া মানেই মাঝপথে কোতল । অনিল দিল্লি পাড়ি মারলো আর আমেরিকান বন্ধুনির সঙ্গে পালালো আমেরিকা, কাঞ্চনও আমেরিকা চলে গেল । করুণার বউ-ছেলে ছিল, ও এসে আমাদের পাটনার বাড়িতে লুকোলো । দাদার পরামর্শে করুণা চুল-দাড়ি কামিয়ে প্রায় ন্যাড়া হয়ে ধুতি-গেঞ্জিতে বিহারি সীতেশবাবু হয়ে গেল, আর দাদা করুণার জন্য একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দিলেন । মাসখানেক বাদে বউ-ছেলেকে পাটনায় ডেকে পাঠালো করুণা । বছর দুয়েক পরে অনিল দিল্লি ফিরলে করুণাও চলে গেল দিল্লি ; কাঞ্চন ফিরল কলকাতায় । নকশাল আন্দোলনের দরুণ বেনারসের বিশাল বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয় কাঞ্চনকে । অনিল আশির দশকে আইরিশ শিল্পসমালোচক জুলিয়েট রেনোল্ডসকে বিয়ে করেছিল । জুলিয়েট পরে অনিলের স্টুডিওতে গিয়েছিলেন, ওর লেখাপত্র আর পেইনটিঙ রেইডের সময় নষ্ট করে দিয়েছিল পুলিস, কিছুই উদ্ধার করা যায়নি ।
    ওফ হো, আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল, এই সুযোগে বলে নিই । ১৯৬৮ সালে আমি অফিসের কাজে গিয়েছিলুম নাগপুর, সেখানে নভেম্বরের শেষে পরিচয় হল সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে । কয়েকদিন পরে ওকে বললুম, আপনাকে বিয়ে করার জন্য আপনাদের বাড়িতে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে । সলিলা বলেছিল, বড়ো মামার সঙ্গে । ওদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলুম সলিলা রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় ছিল, ড্রইংরুমে শিল্ড আর নানা মাপের কাপ । বিয়েতে ওর মত আছে দেখে দাদাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলুম আর বউদিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলুম । পাটনায় বাবাকেও টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলুম । দাদা প্রথম ট্রেনেই চলে এলেন নাগপুর, সেসময়ে নাগপুরের প্লেন চালু হয়নি, হলেও দাদাকে চাইবাসা থেকে জামশেদপুর হয়ে কলকাতা গিয়ে নাগপুর পৌঁছোতে হতো । দাদা চক্রধরপুর থেকে সোজা পৌঁছে গিয়েছিলেন নাগপুর । সলিলার বড়োমামার সঙ্গে কথা বলে ফিরে গিয়েছিলেন । বিয়েও ঠিক হয়ে গেল ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৬৮ । দাদা তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন আর বউদি, মেয়ে হনি আর দাদার শাশুড়িকে নিয়ে চলে এলেন । বাবা-মা এলেন না কেন, তখন টের পাইনি । ভেবেছিলুম প্রেমিক হিসাবে আমার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে ওনারা রুষ্ট বলে হয়তো আসেননি । বউদিও তড়িঘড়ি চলে এসেছিলেন একই কারণে, আমার প্রেমিকত্বর সিরিজ শেষ করার জন্য । বিয়ের পর পাটনায় যাবার বদলে দাদা টিকিট কাটলো চক্রধরপুরের । চক্রধরপুর থেকে গাড়িতে চাইবাসা । চাইবাসায় গ্যাঁদাফুলে গ্যাঁদাশয্যা, খাটও এমন যে ক্যাঁচোর-ম্যাচোর আওয়াজ হয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেম করার অভিজ্ঞতা ছিল খাটখানার । কয়েক দিন পরে পাটনা গেলুম। গিয়ে জানতে পারলুম যে মেজ জ্যাঠামশায় মারা গেছেন আর ওনার অশৌচ চলছে । অশৌচের মধ্যেই বিয়ে করে ফিরলুম আর যেদিন লোক খাওয়ানো সেইদিনই বউভাত হলো । দাদা সব চেপে গিয়েছিলেন যাতে বিয়েটা বানচাল হয়ে না যায় । মা সেন্টুদার হাতে একটা চিরকুট পাঠিয়ে দাদাকে লিখেছিলেন, “সিঁদুর পরিয়ে আনলেই হবে।” মানে, মাও চাইছিলেন যাতে বিয়েটা ফসকে না যায় ।
    উত্তরপাড়ায় ফিরি । দাদা বি এস সি পাশ করে জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছিলেন । বাবা ডেকে পাঠালেন পাটনায় । বাবার দোকানে আড্ডা মারতে আসতেন বিহার সরকারের মৎস্য দপতরের বিভাগীয় প্রধান মিস্টার ভর্মা । তিনি বাবাকে বলেছিলেন দাদাকে যদি ফিশারিজ ইন্সপেক্টরের চাকরিতে ভর্তি করতে চান তাহলে ডেকে পাঠাতে । দাদা পাটনায় ফিরলে চাকরিটা পেয়ে গেলেন । তাঁর নিয়োগে একটাই অসুবিধে ছিল যে তিনি বাঁচোখে দেখতে পেতেন না । মিস্টার ভর্মার সহৃদতায় ডাক্তারি পরীক্ষার সময়ে ডাক্তারই বলে দিয়েছিল কেমন করে চোখের চেকআপটা করাতে হবে । চাকরি পাবার পর দাদার পোস্টিং হল বিভিন্ন জেলা সদরে মিষ্টিজলের মাছ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের জন্য । তারপর বিহার সরকার পাঠিয়ে দিল কোচিতে, সামুদ্রিক মাছ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের জন্য ; এই সময়ে দাদা মাছ ধরার জাহাজে বেশ কিছুকাল আরব সাগরে কাটিয়েছিলেন ।
    ফেরার পর দাদার পোস্টিঙ হল চাইবাসায় । দাদার বন্ধু বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ভাগলপুরে দাদার সঙ্গে একই মেসে থাকতেন, তাঁর বিয়ে হল চাইবাসায় মধুটোলা নিবাসী সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেজ মেয়ে ডলির সঙ্গে । দাদা চাইবাসাতেই চাকরি করেন জেনে মধুটোলা বাড়ির সদস্যরা বললেন, সময় কাটাবার জন্য মাঝে-মাঝে আসতে । দাদা কবিতা আর গল্প লেখেন, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত জেনে ওই বাড়ির বড়ো মেয়ে মন্টি, যাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তিনি দাদার প্রতি আকর্ষিত হন । দাদা আর মন্টি নির্ণয় নেন যে দুজনে যেমন আছেন তেমনই থাকবেন, পরিবার ভেঙে বেরোবার প্রয়োজন নেই । এই ঘটনাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “কিন্নর কিন্নরী” উপন্যাসে বিস্তারিত লিখেছেন, সেখানে দাদার নাম শম্ভু আর শক্তির নাম পার্থ ।
    উত্তরপাড়ার চিলেকোঠায় দাদার যে বন্ধুরা আড্ডা মারতে যেতেন, তাঁরা এবার চাইবাসায় দাদার নিমডির কুঁড়েঘরে আড্ডা মারতে যাওয়া আরম্ভ করলেন, প্রধানত হাটে সবুজ শালপাতায় করে হাড়িয়া খাওয়া, মহুয়ার মদ খাওয়া, যা তাঁরা সকলেই প্রথমবার চাইবাসায় খেলেন, আর আসেপাশের জঙ্গলে-ঝর্ণায় ঘুরে বেড়ানো । দাদার বাড়িতে কবি-লেখকরা প্রায়ই আসেন জানতে পেরে মধুটোলার বাড়িতেও তাঁরা খাবার আমন্ত্রণ পেতেন । দাদা নিমডি টিলার ওপরে একটা চালাঘরে একা থাকতেন বলে একাকীত্ব কাটাবার জন্য কলকাতা থেকে বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে থাকার জন্য ডেকে আনলেন । শক্তি তখন “কুয়োতলা” উপন্যাস লিখছিলেন । দাদা অফিসের কাজে বাইরে গেলে শক্তিকে মধুটোলার বাড়িতে অতিথি হিসাবে রেখে যেতেন । শক্তিকে মাসের পর মাস কলকাতায় অনুপস্হিত পেয়ে একবার সুনীল আর সন্দীপন চাইবাসায় গিয়ে দ্যাখেন নিমডির চালায় দাদা নেই, ট্যুরে গেছেন, ওনারা দুজনে মধুটোলায় গিয়ে শক্তিকে দেখে অবাক, দুজনের কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘কী রে, তুই এখানে ইস্টিশন পুঁতে ফেলেছিস !’
    কৃত্তিবাস পত্রিকার ২৫ তম সংকলনে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ‘চাইবাসা চাইবাসা’ নামে একটা ছোটো গদ্য লিখেছিলেন, বেশ ইনটারেসটিং, তুলে দিচ্ছি এখানে । “বিশ্বস্তসূত্রে এই উড়োখবর আমরা পাই যে শক্তি চাইবাসার সেন্ট্রাল জেলে রয়েছে, তছরুপের কথাই আমি শুনি । এটা শুনে, তখন আমরা ছেলেমানুষ ছিলুম বলে, আমার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের খুব মনোকষ্ট হয় । আমি ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তির দুই বন্ধু, আমরা সেদিন রাত্রেই, সম্বলপুর প্যাসেঞ্জার ধরি । এটা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ । আমি নিই হাওড়ার চেনা দোকান থেকে তিনটে খালি সোডার বোতল, চাইবাসায় এক্সচেঞ্জ করার কথা ভেবে, এটা সুনীলও যুক্তিযুক্ত মনে করেছিল । সুনীল একটা ক্যাপস্টানের টিন নিয়েছিল, যা গরাদের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে ডোরাকাটা শক্তির হাতে ওর দেবার ইচ্ছে ছিল । টিনটা আমরা ট্রেনে খুলিনি । মাইরি ।”
    “চাইবাসায় গিয়ে এবারও সমীরকে পেলুম না, ট্যুরে । কিন্তু শক্তি ? পরদিন জেলে গিয়ে খবর নিলেই হবে এরকম ভেবে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে টিনটা ও ওপরে তিনটে সোডার বোতল রেখে, ডাকবাংলো ছেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম নদীর দিকে, চাইবাসার শ্মশানের দিকে শীতের রাত্তিরে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলুম গান গাইতে গাইতে । মধুটোলার কাছে ফটাস করে একটা বাড়ির দরোজা খুলে গেল, ‘এতো রাত্তিরে চাইবাসায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় কে রে’, বলতে বলতে শক্তি বেরিয়ে এলো । এখানে হঠাৎই মনে পড়ল, এই মধুটোলার রাস্তাতেই, ‘সাইকেল কি সাঁতার কেউ কখনো ভোলে ভাই’, বলে তড়াক করে সাইকেলে লাফিয়ে উঠে ঐ বাড়ির পাঁচ বোন ও তিন বন্ধুর সামনে সুনীল উলটে দড়াম করে রাস্তায় পড়ে যায় । যাই হোক সেদিন রাতে, নভেলে-পড়া যায় এমন মধ্যবিত্ত প্রবাসী বাঙালির লাল টালির বাড়ির মধ্যে বসে আমরা দুজনে আধ ঘণ্টার মধ্যে বুঝতে পারি যে শক্তি জেলে নেই । ক্যাপ্সটেনের টিন খুলতে আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে যাই । ঐ বাড়ির দুটি মেয়ে সমীরের ও শক্তির বান্ধবী ( একজন পরে সমীরের স্ত্রী ) এটা বুঝতে আমাদের দু’দিন সময় লেগে যায় । এটা বুঝে, মধুটোলায় ওরা সান্ধ্য চা-পান করতে গেলে আমি ও সুনীল তখন সোডার বোতলগুলি ( তখন ভর্তি ) একের পর এক জ্বলন্ত হ্যারিকেন লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারি । সমীরের লেপ তোশক ও মশারিতে আগুন লেগে যায় । আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে রো-রো নদীর ওপারে গিয়ে আমাদের জীবনের প্রথম আদিবাসী রমণীর কাছে জীবনের প্রথম মহুয়া খাই । তার শারীরিক সৌন্দর্য ছিল ।”
    “চাইবাসা থেকে ফিরেই আমি মায়ের কাছে কাশীতে চলে গেলুম । সম্ভবত ঐ একই ট্রেনে, ডুন এক্সপ্রেসে, সুনীলের চিঠিটাও আমার সঙ্গে যায়, কারণ হিসেবমতো ১৪/১/৬০ তারিখে আমি সেবার কাশী পৌঁছেছিলুম । যাই হোক, ঐ চাইবাসা পরে আমাদের তিনজনের লেখাতেই বেশ একটা ভূমিকা নিয়েছিল বলতে হবে । আমি সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী নামে গল্প লিখি, সুনীল যুবক যুবতীরা ও অন্যান্য । শক্তির লেখার এক অংশে চাইবাসা হাহাকারের মতো ছড়িয়ে রয়েছে।”
    “চাইবাসা থেকে অদূরে পাহাড়ের ওপর হেসাডির ডাকবাংলোয় বড়ো প্যাঁচে পড়েই কবি তথা লেখক হিসেবে আমাদের ডি এফ ও শ্রীকমলাকান্ত উপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল । প্রমাণস্বরূপ শক্তি ওঁর সামনে একটা ছোটো কবিতা রচনা করে, যার মধ্যে ‘ছুটে কে তুলিলে শালবন বাহুবন্ধন চারিধারে’ এরকম একটা লাইন ছিল । বস্তুত ছোটো ও বড়ো দলে চাইবাসায় আমাদের একাধিকবার যেতে হয়েছিল । শক্তি বারংবার গেছে । চাইবাসায় যাওয়ার জের আমাদের পরবর্তী জীবনেও বেশ কয়েক বছর ধরে চলে । ওখানে না গেলে আমরা হয়তো এরকম হতুম না । কী হতুম ? রাজা হতুম, আবার কী । রাজা হতুম কথার কথা । এতটা প্যাঁচে পড়তুম না ।”
    শক্তি মধুটোলার বাড়ির মেয়ে শীলার প্রেমে পড়েন এবং তাকে শোনাবার জন্য অজস্র কবিতা লেখা আরম্ভ করেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বাড়ির কিশোর সন্তুর চরিত্রটিকে নিজের কাহিনিতে ভূমিকা দিলেন, যে কাহিনিগুলোয় তিনি নিজেই কাকাবাবু । সুনীল চাইবাসাকে কেন্দ্র করে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে লিখলেন “অরণ্যের দিনরাত্রি”, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখলেন “জঙ্গলের দিনরাত্রি”, শক্তিও শীলার সঙ্গে প্রেম এবং চাইবাসা-হেসাডি-বেতলায় কাটানো অভিজ্ঞতা এনেছেন ‘‘কিন্নর কিন্নরী” উপন্যাসে।
    চাইবাসার স্মৃতি নিয়ে দাদাকে একটা চিঠি ১৯৬৮ সালে লিখেছিলেন সন্দীপন, নসট্যালজিক, বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার অনুশোচনারও যেন আভাস একচিলতে ।

    ১৬/৯ বরানগর
    ৭১ কাশীনাথ দত্ত রোড, দোতলা
    কলকাতা - ৩৬
    প্রিয় সমীর,
    অনেকদিন আগেই ঠিকানা লিখে ফেলেছিলুম, আমার মেয়ে জুলেখা টিকিটটা ছিঁড়ে নিয়েছিল । অর্থাৎ আমার মেয়ে বেঁচে আছে । ক’দিন আগে গিয়েছিলুম সুনীলের কাছে -- মদ্যপানজাত মারামারির ফলে প্রহৃত ও গুরুতর আহত হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে জেনে যাই, সন্ধের দিকে রিক্সা করে একটি ও.টি. পাঁইট এনে দুজনে খেলুম, তোমাকে নিয়ে কথা বলছি দেখলুম । সুনীল তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে বলল ও তোমার ঠিকানা আমি চেয়ে নিলুম । স্বাতী দিল্লিতে ।
    তোমাদের একটি ছেলে হয়েছে শুনলুম । তুমি অনেকদিন কলকাতা আসোনি । চাইবাসার কথা মনে পড়লে তোমার কথা মনে পড়ে । তুমি সৎ-ব্যবহার করেছিলে যা মনে পড়ে । রো-রো নদীর ধারে বসে শ্মশানে গল্প মনে পড়ে । নিমডির বাড়ির উঠোনে তেল মেখে হাঁড়িয়া-খাওয়া মনে পড়ে । বেলাদের বাড়ি মনে পড়ে । মধুটোলা, বাজারের দোকানে চা ও সিঙাড়া -- কানপুরে অস্ট্রেলিয়া হেরে গেছে তোমাদের খবর দিলুম -- হেসাডিতে এসে তুমি এক রাত্তির কাটিয়ে গিয়ে আমাদের ঋণমুক্ত করে গেলে -- এসব ও অন্যান্য মনে পড়ে।
    চাইবাসা আমার মনে ইমপ্রেশান রেখে গেছে যা মোছার নয় -- তখন সরল ও ছেলেমানুষ ছিলুম । আজো তাই আছি । চাইবাসা ও তোমাকে একসঙ্গে মনে পড়ে ।
    ভেবে দ্যাখো, এ-রকম হওয়া সম্ভব, এ-রকম মনে পড়া । বয়স ৩৫ হল, আজো ৩০-দিকে গড়াচ্ছি -- ২৫এর দিকে । আমার হাংরি জেনারেশান-ফেশান মনে পড়ে না । তোমাকে ও চাইবাসাকে আজও মনে পড়ে ।
    তুমি অ্যাকসেপ্ট করো বা না করো আমার বাস্তবিক কিছু এসে যায় না । কাফে খালি হয়ে গেলেই আমার মাথাও খালি হয়ে যায় না ।
    শুভেচ্ছাসহ
    সন্দীপন
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই চিঠির পাশাপাশি দেবী রায়কে হাংরি বুলেটিনে ছাপার জন্য পাণ্ডুলিপি পাঠাবার সময়ে ৯ জানুয়ারি ১৯৬৩ তারিখে যে চিঠি উনি লিখেছিলেন তা পড়লে পাঠক বেশি আনন্দ পাবেন বলে মনে হয় :-
    প্রিয় হারাধনবাবু,
    হাংগরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম । প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট -- এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব । প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন ।
    ছাপলে সবকটি এক সঙ্গে ছাপতে হবে --- নইলে খাপছাড়া লাগবে । ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে। দরকার করলে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন ।
    অমৃত-তে আমার বইয়ের যে-বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে, দেখেছেন ! নইলে পাবলিশার-এর কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যবস্হা করেন তো খুশী হই । ওই বিজ্ঞাপনটা দেশে বেরোবার কথা আছে -- যদি বেরোয়, তার প্রুফটা কাইণ্ডলি দেখে নেবেন । আনন্দবাজারে কোনো লেখকদের বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি ? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন ।
    সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব । আরো এক মাস থাকবো না ততদিন । সহজে যাব না । শরীর ভালো । ‘ছোটোগল্পে’ আবার লেখা দিতে পারলাম না , সম্ভব হলে, ক্ষমা করবেন ।

    পুনশ্চ : লেখাটা প্রকাশ করার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে । অনেক বাদ দিয়ে খুব নরম করে সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই ।
    *) হাংগরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, কী হল ! পাঁচ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন ।
    **) কমাগুলো ভেবে চিন্তে দিয়েছি, ওইগুলো আসল জিনিস, যেন থাকে ।
    ***) শেষের তারিখটা যেখানে আছে, সেখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন ।
    ****) ‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো ?
    ****) আগামী সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাব । তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর --- এই ঠিকানায় দেবেন । ‘আক্রমন’ বানানে কী ‘ন’ না ‘ণ’?
    ভালোবাসা নিন । সুনীলবাবুকে ( হাজরা ) প্রীতি জানাচ্ছি।
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

    ১৯৬২ সালে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও পিটার অরলভস্কিও গিয়েছিলেন চাইবাসায় দাদার নিমডির কুঁড়েঘরে, ছিলেন দিনকয়েক । ওনারা গিয়েছিলেন চাইবাসায় উপজাতিদের তৈরি হাড়িয়া আর মহুয়া মদের কথা শুনে । দাদা ওনাদের তালশাঁস আর জাম খাইয়েছিলেন । ওনারা ওগুলোকেই ভেবেছিলেন মাদক । জাম খেয়ে জিভ বেগুনি হয়ে গিয়েছিল বলে আশঙ্কিত ছিলেন । পরে সন্ধ্যায় ওনাদের নিয়ে হাটে গিয়ে হাড়িয়া খাওয়ান দাদা আর দাদার ড্রাইভার গুলাব সিংকে দিয়ে সদ্য চোলাইকরা গরম-গরম মহুয়ার মদ আনিয়ে খাওয়ান । গিন্সবার্গ পাটনায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন এপ্রিল ১৯৬৩ সালে ।
    ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষের স্ত্রী ডেবোরা বেকার অ্যালেন গিন্সবার্গের ভারতে থাকা নিয়ে একটা বই লিখেছেন “দি ব্লু হ্যাণ্ড” নামে ; সেই বইতে তিনি হাংরি আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন অথচ তিনি কোনো হাংরি আন্দোলনকারীর সঙ্গে দেখা করেননি, তাঁর বইতে তিনি ব্লার্বে লিখেছেন যে বাংলা জানেন অথচ ইনডেক্স দেখলেই টের পাওয়া যায় যে বাংলার একটিও বই-পত্রিকা-বুলেটিন তিনি পড়েননি, তিনি কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গুলগল্প লিখেছেন । বলাবাহুল্য যে হাংরি আন্দোলনকে বিদেশি পাঠকের কাছে ফালতু প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন । গিন্সবার্গের সঙ্গে যে হাংরি আন্দোলনকারীদের পরিচয় হয়েছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বা তাদের উল্লেখ করেননি । সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে হাংরি আন্দোলনের পৃথক সংগ্রহ দেখারও আগ্রহ হয়নি ডেবোরা বেকারের । দাদা সেসময়ে কলকাতাতেই ছিলেন, দেখা করেননি কেন তা এক রহস্য । অথচ ইতালির গবেষক ড্যানিয়েলা লিমোনেলা কলকাতায় এসে দাদার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন । বিবিসির ডোমিনিক বার্নও দাদার সাক্ষাৎকার নিয়ে গিয়ে প্রচার করেছেন । ডোমিনিককে দাদা বলেছিলেন “আমি এক হাজার বছর বাঁচবো”।
    দাদা মধুটোলার বাড়ির সেজ মেয়ে বেলাকে বিয়ে করেন । বরযাত্রী হিসাবে কলকাতা থেকে এসেছিলেন উত্তরপাড়ার চিলেকোঠার কবি-বন্ধুরা । বিয়ের পর দাদা নিমডি টিলার চালাঘর ছেড়ে রোরো নদীর ধারে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলেন । সেই বাড়িতে সন্তোষকুমার ঘোষ এবং আরও অনেকে গিয়েছিলেন । কলকাতার কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এক্সকারশানে যাবার আগে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন আর দাদা তাদের থাকার ব্যবস্হা করতেন । হাড়িয়া আর মহুয়ার মদের কথা শুনে অচেনা তরুণ কবি-লেখকরাও পৌঁছে যেতেন ।
    একদিন পাটনায় আমি অফিস যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলুম, বাবা ডেকে পাঠিয়ে বললেন, মিনু একটা মেয়েকে বিয়ে করবে বলছে, তুই দেখেছিস ? আমি মধুটোলার বাড়িতে বারকয়েক গেলেও কাউকে তেমন লক্ষ্য করিনি ; মা মধুটোলার বাড়ি গিয়েছিলেন, বললেন যে উনি মেয়েটিকে দেখেছেন, ভালো সেলাই-ফোঁড়াই, রান্নাবান্নার কাজ জানে । দাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা-মা’র সামনে, আমাকে বললেন, চারপাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে নে । বরযাত্রীদের জন্য সেনটোলায় একটা বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্হা হয়েছিল। বিয়ের পর দাদার বন্ধুদের আমরা জিপে করে জামশেদপুর স্টেশান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলুম, তখনও ওনারা সিল্কের পাঞ্জাবি আর জমকালো ধুতিতে ।
    হাংরি আন্দোলনে সবাইকে জেরা করেছিল ইন্সপেক্টার অনিল ব্যানার্জি, নকশাল আন্দোলনের সময়ে যাঁর বেশ নামডাক হয়েছিল, কিন্তু দাদাকে আর আমাকে জেরা করে একটা ইনভেসটিগেটিং বোর্ড । পুলিশ কমিশনার পি সি সেনের ঘরে কমিশনার ছাড়াও উপস্হিত ছিলেন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার দেবী রায়, যাঁর ধারণা ছিল হারাধন ধাড়া তাঁকে অপমান করার জন্যই দেবী রায় ছদ্মনাম নিয়েছেন, আর ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লিগাল রিমেমব্রানসার, চব্বিশ পরগণার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিসট্রেট, স্বরাষ্ট্র দপতরের আধিকারিক, ফোর্ট উইলিয়ামের মিলিটারি অফিসার । বোঝা যাচ্ছিল যে আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে বিশেষ করে অভিযোগ এনেছেন কলকাতার তদানীন্তন এলিটরা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য আবু সয়ীদ আইয়ুব, সন্তোষকুমার ঘোষ এবং সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র মালিক । স্বরাষ্ট্র দপতরের আধিকারিক বোধহয় জানতেন না যে হাংরি বুলেটিন বেরোয় ফালি কাগজে, তাই জিগ্যেস করেছিলেন, “আন্দোলন চালাবার জন্য কোথা থেকে টাকা পান?” ফালি কাগজ কিনতে আর ছাপাতে পঞ্চাশ টাকা লাগে শুনে পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন “আপনারা সাহিত্য করছেন না দাঁতের মাজন বিক্রি করছেন ।”
    হাংরি আন্দোলনে বন্ধুদের গোলমেলে ভূমিকার পর দাদা তাঁদের সঙ্গে সাহিত্যিক যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছিলেন । তাঁর লেখালিখির প্রথম পর্ব বলতে গেলে মামলার পর শেষ হয়ে যায় । পড়াশুনায় একাগ্র হন, পাটনা থেকে ইংরেজি বইপত্র নিয়ে যেতেন । বন্ধুরা কিন্তু কলকাতা থেকে পালাবার জন্য দাদার পোস্টিঙের জায়গাগুলোয় যেতেন, মজফফরপুর, দ্বারভাঙ্গা, ধানবাদ, দুমকা, ডালটনগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় । আমি ডেভিড গারসিয়া নামে একজন হিপি ও সুবো আচার্য আর সুবিমল বসাককে দুমকায় নিয়ে গিয়েছিলুম । দুমকার বিশাল বিহারি টাইপ বাড়িতে পায়খানা ছিল বেশ দূরে, আর পোশাক খুলে টাঁঙাতে হতো সামনের একটা কাঁঠাল গাছের ঝুলন্ত এঁচোড়ে, পায়খানায় দরোজা ছিল না, গাছটা আড়ালের কাজ করতো । তরুণরা যাতে তাঁর বাসায় দলবেঁধে যায়, দাদা একবার বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। তাঁর লেখালিখির দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হয় অবসরের পর কলকাতায় নিজের বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে পাকাপাকি থাকতে এসে, যখন ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করলেন ।
    “কালিমাটি “ পত্রিকার ( ৯৩ নং ) জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে দাদাকে প্রশ্ন করেছিলুম, “তোমার কলেজজীবনের সময় থেকে দীপক মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, বিমল রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ পাটনা, উত্তরপাড়া, চাইবাসা, ধানবাদ, ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, মজফফরপুর, দুমকা ডালটনগঞ্জ ইত্যাদি বাসায় নিয়মিত যেতেন । তাঁদের স্মৃতিচারণামূলক লেখায় তোমার উপস্হিতির অভাব দেখা যায় । তা কি তুমি দীর্ঘ দিন বাইরে ছিলে বলে ? নাকি হাংরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলে বলে ? অথবা তোমার ট্রাইবাল ইন্সটিংক্ট নেই বলে ?”
    উত্তরে দাদা বলেছিলেন, “স্মৃতিচারণায় না থাকা স্বাভাবিক, কেননা অনেক তথ্য ও সত্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে, নানা ধরণের পার্থিব ভীতি তাঁদের মনে কাজ করে, হিসেব করে লেখেন, বাদ দেওয়াকেই সহজ উপায় বলে মনে করেন । আবার হয়তো দীর্ঘ দিন বাইরে থেকেছি, কলকাতার কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারিনি । হাংরি আন্দোলন বা অধুনান্তিক চিন্তাভাবনা বা কোনো নতুন ধারণা আধুনিকতামনস্ক বন্ধুদের কাছে একটি বিশাল অন্তরায় । তাছাড়া, তাঁরা অনুগামী গড়ে তুলতে অধিক মনোযোগী । তাঁদের বেশিরভাগকে আবিষ্কারকের ভূমিকায় দেখি না, সংযোজনমনস্ক নয় ।”
    লেখক-কবির কাজ সম্পর্কে দাদা বলেছিলেন, “চিন্তার মাধ্যমে ভাব ও ভাষার সামঞ্জস্য গড়া, প্রকাশময়তার সম্প্রসারণ ও ব্যাপ্তি ঘটানো, যার ফলে পূর্ব অবস্হান থেকে ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়ে নবাঞ্চলের সংযোজন করে নতুন প্রজন্মের ভাষা হয়ে উঠবে, সম্প্রসারণ মানেই তো অতিক্রম, আর কবি ও লেখকের প্রধান দায়বদ্ধতা ভাষার প্রতি, কেননা ভাষাকে উত্তরোত্তর সমাজের আরও যোগ্য করে তোলা । ভাষা বদলে গেলে সামাজিক প্রক্রিয়া স্বতঃপ্রভাবিত হয় । উনিশ শতকে যেভাবে প্রভাবিত হতো আজ আর সেভাবে সম্ভব নয় । বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখেরা নিজেদের লেখালিখির মাধ্যমে আইনকানুনকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, আজ যেমন অরুন্ধতী রায়কে দেখা যায় মেধা পাটকরের সঙ্গে আন্দোলন করছেন, নর্মদা বাঁধের উচ্চতা হ্রাস এবং সংলগ্ন জনবসতিগুলোর পুনর্বাসন সম্পর্কে, তাঁদের আন্দোলনের ফলে সমাজ রাষ্ট্র প্রভাবিত হয়েছে, আন্দোলন অনেকটা সফলতা পেয়েছে । মুশকিল এই যে, আজ রাষ্ট্র স্বয়ং প্রতিবাদীর ভূমিকা নেয় । যার ফলে কবি-লেখকের প্রতিবাদী ভূমিকাকে হজম করে নেয় বা বানচাল রাখে । ইনটারনেট আর ব্লগ ব্যবহার আজ অন্যতম উপায়, এবং কবি-লেখকরা আজ ঠিক তাই করছেন । আরেকটা কথা, বাংলা ভাষা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা, প্রত্যেক শব্দের একাধিক অর্থ । কেননা, ব্যক্তি, দাম্পত্য, সমূহ সবই সেই অর্থময়তার পরিসরে অন্তর্ভুক্ত, যেকারণে শব্দগুলির অর্থময়তার বীজমন্ত্রে যথেচ্ছ সম্প্রসারণের খোলা-সম্ভাবনা । মনুষ্যসমাজ বা মানবপ্রজাতি টিকে আছে তার চিন্তাচেতনার ও ভাষার উত্তরোত্তর সম্প্রসারণের মাধ্যমে ।”
    দাদার লেখায় পরিসরের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছিলেন অরবিন্দ প্রধান তাঁর “পরিসরের ভিন্ন মন্তাজ : সমীর রায়চৌধুরীর ছোটোগল্প” ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) প্রবন্ধে । পরিসরের গুরুত্বের কারণেই হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা দেখা দিয়েছিল । দাদা দেখিয়ে ছিলেন যে এটি একটি দার্শনিক প্রতর্ক । কৃত্তিবাস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কতৃক ইতিহাসকে একরৈখিক অনুমান করার জন্য গলদটা গড়ে উঠেছিল । ভুলটা ঘটেছিল স্পেস বা ভাবনা পরিসরকে গুরুত্বহীন মনে করে, টাইম বা ঘটনার অনুক্রমকে অতিগুরুত্বপূর্ণ মনে করার ফলে । সময়কে একটিমাত্র রেখা বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন তাঁর ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যান্য দিকে চলে গেছে, বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যালে । ফলে জসীমউদ্দিন বাদ যান, নজরুল বাদ যান । মাইলফলক কেবল একটা রাস্তাতেই থাকে না । সব রাস্তাতেই থাকে । তাবৎ মাইলফলক বরাবর একটা রেখা টানা যায় না । শ্রীরামপুরের প্রটেস্ট্যান্ট ইংরেজরা একটিমাত্র রেখা বরাবর লাইনগুলোকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিল, যার ফলে বহু মাইলফলক বাদ যেতো । দাদা এটা প্রমাণ করার জন্য প্রথমে ইংরেজিতে সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেন “পোস্টমডার্ন বাংলা পোয়েট্রি” ও “পোস্টমডার্ন বাংলা শর্ট স্টোরিজ” এবং হিন্দিতে সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেন “অধুনান্তিক বাংলা কবিতা”, যে সংকলনগুলোয় সেই মাইলফলকগুলোকে তিনি পুঁতলেন যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক একরৈখিক পথের বাইরের ।
    দাদার কাছ থেকে আমরা জানলুম যে ‘কৃত্তিবাস’ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ডিসকোর্সটি ঔপনিবেশিক নন্দনবাস্তবতা বা কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়ালিটি দ্বারা তাড়িত বলে তা টাইম কেন্দ্রিক । কিন্তু হাংরি আন্দোলনের ডিসকোর্সটি স্পেস বা স্হান বা পরিসরলব্ধ, কেননা তা উত্তরঔপনিবেশিক টানাপোড়েন উপজাত । ‘কৃত্তিবাস’ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কাউন্টার ডিসকোর্সরূপে উদ্ভূত হয়েছিল উত্তরঔপনিবেশিক পরিসরের হাংরি আন্দোলন, যে আন্দোলনটি আরম্ভ করার প্রধান উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন দাদা । ইউরোপীয় ভাবনার ধারকবাহক হিসাবে যে নতুন ধরণের দার্শনিকতা জন্মেছিল, তাঁরা নিজেরা ছিলেন স্হানিক বা ভূমিক পরিসর থেকে উৎপাটিত ; এই যে পরিসরহীনতা, এটা একরৈখিক দর্শনে জরুরি ছিল । দাদা বললেন ,হাংরি আন্দোলনের আনা পরিবর্তন-প্রয়াস হল চিন্তাতন্ত্রের, সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র থেকে পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার । ইংরেজরা আসার আগে প্রাকঔপনিবেশিক ভাবনা-পরিসরটি ছিল বিশেষ-বিশেষ মনন-প্রবৃত্তির এলাকা । দাদার বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিচলিত হয়েছিলেন, এবং তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় লেখা ১৯৬৬ সালের তাঁর এই সম্পাদকীয়তে, তখনও হাংরি মকদ্দমা আদালতে চলছে এবং কেস সাবজুডিস :
    “অনেকেই প্রশ্ন করছেন বলে আমরা লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য হলুম যে হাংরি জেনারেশান নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলনের সঙ্গে কৃত্তিবাস সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্কিত । ঐ প্রকার কোনো আন্দোলনে আমরা বিশ্বাস করি না । কৃত্তিবাসের নামও যুক্ত করতে চাইনি কখনো । ‘হাংরি’ নামে অভিহিত কোনো-কোনো কবি কৃত্তিবাসে লেখেন, বা ভবিষ্যতে অনেকে লিখবেন, কিন্তু অন্যান্য কবিদের মতোই ব্যক্তিগতভাবে, কোনো দলের মুখপাত্র হিসেবে নয় । সংঘবদ্ধ সাহিত্যে আমরা আস্হাশীল নই । পরন্তু বাংলাদেশের যেকোনো কবির প্রতিই কৃত্তিবাসের আহ্বান । হাংরি জেনারেশানের আন্দোলন ভালো কি খারাপ আমরা জানি না । ঐ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বা পরিনাম সম্পর্কে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই । এ-পর্যন্ত ওদের প্রচারিত লিফলেটগুলিতে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি চোখে পড়েনি । নতুনত্ব প্রয়াসী সাধারণ রচনা । কিছু-কিছু হাস্যকর বালক ব্যবহারও দেখা গেছে । এছাড়া সাহিত্য-সম্পর্কহীন কয়েকটি ক্রিয়াকলাপ বিরক্তি উৎপাদন করে । পিজিন ইংরেজিতে সাহিত্য করার লোভ উনিশশো ষাট সালের পরও বাংলাদেশের একদল যুবক দেখাবেন --- আমাদের কাছে তা কল্পনাতীত ছিল। তবে ঐ আন্দোলন যদি কোনোদিন কোনো নতুন সাহিত্যরূপ দেখাতে পারে -- আমরা অবশ্যই খুশো হবো ।”
    মনে রাখা দরকার যে হাংরি আন্দোলনে দাদাও চাইবাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, আর এই মামলা চলাকালীন সম্পাদকীয়টি লিখছেন দাদার সেই বন্ধু যাঁর “একা এবং কয়েকজন” কাব্যগ্রন্হটি দাদা নিজের টাকায় “সাহিত্য প্রকাশক” নামে একটা সংস্হা খুলে ছাপিয়েছিলেন । সুনীল কেন এই সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন, দাদা গ্রেপ্তার হওয়া সত্বেও তা এখন কিছুটা আঁচ করা যায় । দৈনিক পত্রিকায় চাকুরি ও লেখা প্রকাশ ছাড়াও, মনে হয়, পুলিশের চাপ ছিল । শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় “নতুন কৃত্তিবাস” পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লিখেছেন যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন। আমার চার্জশিটের সঙ্গে সেই মুচলেকাগুলোর কপি পুলিশ দেয়নি বলে ঠিক জানি না, পুলিশ আমায় কেবল শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষের মুচলেকার কপি দিয়েছিল, সম্ভবত তারা মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিল বলে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অ্যালেন গিন্সবার্গকে লিখেছিলেন যে মোট ছাব্বিশজনকে পুলিশ জেরা করেছিল, অর্থাৎ হাংরি বুলেটিনে যাদের নাম ছিল তাদের তো জেরা করা হয়েই ছিল, দাদার সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব ছিল তাদেরও জেরা করা হয়েছিল, এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও । উৎপলকুমার বসুকে লেকচারারের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলে অ্যালেন গিন্সবার্গের সৌজন্যে তিনি লণ্ডনে একটি স্কুলে পড়াবার চাকরি পান ।
    ২ অক্টোবর ২০১৫ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত, আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠি দুটি থেকে ব্যাপারটা কিছুটা স্পষ্ট হবে :
    প্রথম চিঠি:-
    ৭০৪ ইস্ট ফিফথ স্ট্রিট, অ্যাপট ৫এ, নিউ ইয়র্ক
    অক্টোবর ৬, ১৯৬৪
    প্রিয় আবু সয়ীদ,
    আপনার কাছে পাঠানো আমার চিঠিটি নিতান্তই বোকার মতো উদ্ধত এবং বুদ্ধিহীন হয়ে গিয়েছে এবং আমি দুঃখিত যে, সেটি আপনাকে রীতিমতো ক্ষুব্ধ করেছে । আমার লেখায় যে বিরক্তিকর অসম্মান প্রদর্শন এবং ধৃষ্টতা ফুটে উঠেছে তার জন্য আমার চুপ করে থাকাই শোভন, যেমন আপনার কী করা উচিত নয়, এসব ব্যাপারে অযথা নাক গলিয়েছিলাম, হয়তো লেখার গুণগত মান না বুঝেই । এবং এক অগ্রজকে বকাঝকা করা । আমি ক্ষমাপ্রার্থী, সেই সঙ্গে অজুহাত হিসাবে এটাও জুড়ে দিই যে, আমি অত্যন্ত দ্রুত লিখছিলাম -- একই বিষয়ে, একই দুপুরে অনেকগুলো চিঠি --- এবং অবস্হাটি আমি যেমনটা বুঝতে পারছি, আপনি যেমন ভাবছেন, অল্পববসী লেখকদের কাছে সেটি আর-একটু বেশি আশঙ্কাজনক । সম্ভবত আমার লেখার পর, এতদিনে অবস্হাটি অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে । কিন্তু আমি মলয়, এমনকি সুনীল গাঙ্গুলি এবং উৎপল বসুর ( শেষোক্ত দুই ব্যক্তির মনে হয় বিচক্ষণতা বেশি ) চিঠি থেকে যা বুঝতে পারছি, মলয় মানুষ হিসাবে আমার পছন্দের এবং ওর ইংরেজিদুরস্ত ম্যানিফেস্টোর প্রাণোচ্ছলতা আমার সত্যিই ভালো লাগে --- আমার মতে যেকোনো ভারতীয় ইংরেজি গদ্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত । যদিও আমি এটা বুঝেছি যে ছেলেটি অনভিজ্ঞ, আবেগপ্রবণ এবং ওঁর ম্যানিফেস্টোগুলির ছেলেমানুষি, কিংবা বলা ভাল, সারল্যের মধ্যেই তার আবেদন
    ( আসলে ব্যাপারটি নিছকই পছন্দ, রুচি বা ধারণার ওপর নির্ভরশীল, এবং নিশ্চিতভাবেই এমনতর সাহিত্যসংক্রান্ত ঘটনা নয় যার মীমাংসা করতে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে ); পুলিশের কাণ্ডকারখানা এমনই যে কেবল মলয়ই নন, তাঁর ভাই সমীর ( তরুণ দার্শনিক ) দেবী রায় এবং আরও দুই যুবক, যাঁদের সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি, শৈলেশ্বর এবং সুভাষ ঘোষ, এঁরা প্রত্যেকেই গ্রেপতার হয়েছিলেন । তারপর জামিনে ছাড়া পান । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিসের তদন্ত, উৎপলের বয়ান অনুযায়ী, “যাঁদের গ্রেপতার করা হয়েছিল তাঁদের এর মধ্যেই চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং দোষ প্রমাণিত হলে সেটি তাঁরা খোয়াতেও পারেন ।” আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে এই “অশ্লীল সাহিত্যের ষড়যন্ত্র” ব্যাপারটায় ইন্ধন যুগিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, জনতা ও অন্যান্য বাংলা সংবাদপত্রগুলি । পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের আদালতের নির্দেশমতে ‘লেডি চ্যাটার্লি’ অশ্লীল আখ্যা পাওয়ায়, আমার সংগ্রহে রাখা টাইমস অফ ইনডিয়ার একটি খবরে জানানো হয়েছে, ‘অনেক বাঙালি কবি ও ঔপন্যাসিকের রচনার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনতে বহু মানুষ এগিয়ে এসেছে।’ বসু লিখেছেন, ‘একটি চাকরি খোয়ালে আর-একটি জোটানো অসম্ভব।’ গ্রেপতার হওয়া পাঁচজনকে আটক রাখা হয়েছিল প্রায় দু’দিন । উৎপল বসুকে আটক করে পাঁচ ঘণ্টা জেরা করে পুলিশ । আমি বুঝতে পারছি, সুনীলকেও পুলিশ জেরা করেছে । যতদূর জানি, পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে কিনা, সেটি এখনও স্হির করা হয়নি এবং সেই সিদ্ধান্ত অনেকখানি নির্ভর করবে এই তরুণ লেখকরা অগ্রজ এবং প্রতিষ্ঠিত লেখক, কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম) এর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সমর্থন পাবেন কিনা, তার ওপর । আমি অবশ্য প্রত্যেকের কাছেই শুনেছি, কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এ-ব্যাপারে একেবারেই মুখ খোলেনি । এই লেখকদের রচনার গুণগত মান কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, আপনার চিঠি থেকে যা প্রকাশিত হয়, তার চেয়ে আদত পরিস্হিতিটি কিন্তু আরও অনেক ভয়াবহ । ভারতে পুলিশি তদন্তের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার -- তার অন্তহীনতা ও কাফকিয়ান নির্মমতা -- যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তাতে ব্যাপারটিকে আপনার মতো হালকা চালে আমি কিছুতেই দেখতে পারছি না । আপনার হয়তো মনে আছে, বেনারসে মাসের পর মাস আমায় লোক অনুসরণ করেছে, পুলিশ এসেছে, মার্কসবাদীরা হুমকি দিয়েছে, দশ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ো নোটিস এসেছে, অশ্লীল সাহিত্য বিলি করা ও তরুণদের নষ্ট করার ভিত্তিহীন অভিযোগে । দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বন্ধুদের মধ্যস্হতায় এবং ভারতীয় কনস্যুলেট থেকে নিউ ইয়র্কে পাঠানো চিঠির সাহায্যে সব সামাল দেয়া গিয়েছিল । সাহিত্যক্ষেত্রেও একবার এহেন সাংঘাতিক আইনি ব্যবস্হা চালু হয়ে যাওয়ার পরও তা দ্রুত খারিজ হয়ে যাবে, এমন আত্মবিশ্বাস আমার নেই, বিশেষ করে যেখানে তরুণ অরাজনৈতিক অনভিজ্ঞ উৎসাহীরা জড়িয়ে । ‘Fuck the Bastards of Gangshalik School of Poetry’ -র মতো একটি বাক্য নিয়ে অশ্লীলতা সম্পর্কে আপনার যা বিশ্লেষণ, তার সঙ্গে আমি একেবারে সহমত নই । এটা যে কোন ‘স্কুল’ তা আমি জানিও না । কিন্তু প্যারিস কিংবা কলকাতার কাফেতে, ত্রিস্তঁ জারার পুরোনো ম্যানিফেস্টোতে এটাই চলতি সাহিত্যভাষা -- মুখের ভাষা এবং প্রকাশিত লেখাতেও । সাহিত্যে এই কায়দা, এই আবেগ, বুদ্ধিদীপ্ত হালকা বদমায়েসি, বিশ শতকের ‘গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দাও’ চিৎকারের মতোই । আমি সত্যিই তেমন শকড হইনি, যখন ওনারা বলেছিলেন, জনসমক্ষে একজন মহিলা তাঁর স্তন অনাবৃত করে দিক । আপনার সত্যিই ব্যাপারটি আপত্তিকর মনে হয় ? বড়োজোর এটা আইনবিরুদ্ধ, এই পর্যন্ত । অনেকের কাছেই শুনেছি, গতবছর এডিনবরা ফেস্টিভালের উজ্জ্বলতম মুহূর্তটি ছিল ব্যালকনিতে এক সম্পূর্ণ নগ্ন মহিলার উপস্হিতি -- আমি অবশ্যই ব্যাপারটা সমর্থন করি। তবে আমি নিজে বিশ্বের অপরপ্রান্ত থেকে এটি ‘প্রোমোট’ করতে আসিনি । আর আমার এটাও মনে হয় না যে, এই ধরণের ডাডামার্কা কাজকর্মের নেপথ্যের গভীরতম প্রেরণাটি কেবলমাত্র সস্তা আত্মপ্রচার । সেকারণেই আমার মনে হয়, এঁদের প্রতি আপনি সত্যিই অবিচার করছেন, এঁদের সাহিত্যকৃতিকে আপনি যতোই নিচু নজরে দেখুন না কেন । কারণ সাহিত্যগত মান নিয়ে নানাবিধ মতামত থাকবেই । মলয়, সুনীল বা বসুকে ফারলিংঘেট্টি চেনেনও না, কিন্তু ‘সিটি লাইটস জার্নাল’-এ ওনাদের অনুবাদ প্রকাশ করছেন । এশিয়া সোসায়টির শ্রীমতী বনি ক্রাউন টেক্সট যোগাড় করে দিয়েছেন । যতো অনুবাদ তিনি সংগ্রহ করেছেন, এই লেখাগুলিও তাঁর কাছে ততটাই কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে । এখানে KULCHUR পত্রিকাটিও -- আভাঁগার্দ কাগজ হিসেবে যার বেশ নামডাক -- তাতে আলোচ্য তিনটি ম্যানিফেস্টো ( গদ্য, পদ্য এবং রাজনীতি বিষয়ক ) চলতি বছরের গোড়ায় পুনর্মুদ্রণ করেছিল । এব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনও প্রয়োজন হয়নি ।
    “অনুবাদ পড়ে আমি এটুকু অন্তত বুঝেছি, মলয় এবং অন্যান্য কবিদের, যাঁদের গ্রেপতার কিংবা জেরা করা হয়েছে, তাঁদের কবিতা এবং ম্যানিফেস্টো যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক । সুতরাং অন্য গোলার্ধের বাসিন্দা হয়েও এবং সাহিত্যের সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতা স্বীকার করেও, আমি কবি এবং সমালোচক হিসেবে ( যেহেতু আমি এখানে কেরুয়াক, বারোজ, আর্তো, এবং মার্কিন কবিদের বিভিন্ন ধারার অপ্রকাশিত লেখার সম্পাদক এবং এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছি ) আমার মতামত প্রকাশ করবই, আমার নিজের বিশ্বাসে স্হির থাকার জন্য, এবং আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এঁদের কাজে আধুনিক জীবনের নানা চিহ্ণ সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । এঁরা জিনিয়াস বা অসাধারণ, এমন দাবি না করেও বলা যায়, সমাজব্যবস্হার প্রতি তাঁদের যে মনস্তত্বগত অনাস্হা, সেটি তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন স্পষ্ট ও মৌলিক ভাষায় । অন্যদিকে, এঁদের সমসাময়িক এবং অগ্রজরা এখনই ধ্রুপদী ভক্তিভাব বা সামাজিক ‘উন্নত’ ভাবনা, মার্কসবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কেই অধিক আগ্রহী । আমার মনে হয় না এই লেখকদের ‘বিটনিক’ আখ্যা দেওয়া উচিত, বিট-অনুকারকও নয়, কারণ শব্দটাই অত্যন্ত কাগুজে বাঁধাধরা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি মার্কিন ধারণা অনুযায়ী ‘বিটনিক’দের সঙ্গেও এটি খাপ খায় না ।
    “আর কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) সম্পর্কে আমার কিছু ভীতি আছে, যেমন ১) সংস্হাটি সম্ভবত মার্কিন সরকারের সঙ্গে যুক্ত ফাউণ্ডেশান ফাণ্ডগুলির সাহায্য পায় ; ২) আয়রন কার্টেন অন্তর্গত শাসনব্যবস্হার চেয়ে পশ্চিমী দুনিয়ার দমননীতির বিপজ্জনক দিকগুলি সম্পর্কে এরা কম সতর্ক । আমেরিকায় সারা বছর ধরে নাট্যশিল্প, বই, চলচ্চিত্র, কবিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে আইনি যুদ্ধ চলে, যার ফলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আভাঁগার্দ চিন্তাভাবনা প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছে । মার্কিন কমিটির মাথা মিস্টার এ. রাইখম্যান-এর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম । তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকায় কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এর কোনো অস্তিত্বই নেই, নিতান্তই কঙ্কালটুকু পড়ে আছে । আর এই বছর আমায় নিউ ইয়র্ক থেকে জন হান্টের যোগাযোগ করতে হয় প্যারিসের অলিম্পয়া প্রেসকে বাঁচানোর জন্য । গাফিলতি কিন্তু আছেই । আপনি যতখানি মঞ্জুর করবেন, তার চেয়ে আমার সমালোচনা খানিক বেশিই হয়ে গেল । বেশ -- নিষ্পাপ বিবেক --- অ্যালেন ।
    “পুনশ্চ: আপনি সত্যিই একথা জোর দিয়ে বলছেন যে ম্যানিফেস্টোকে সাহিত্য বলা যাবে না এবং সেকারণেই ঘটনাটি সাহিত্যে দমননীতির উদাহরণ নয় ? সত্যি ???????????????
    “আমি প্যারিসে অফিস এবং মিস্টার কারনিক দুজায়গাতেই চিঠি লিখব । আপনার নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, রাশিয়ানরা ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো, ভজনেসেন্সকিদের তৃতীয় শ্রেণির শিল্পী হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিল, যাদের কোনো সরকারি গুরুত্ব পাওয়ার প্রয়োজন নেই । এবং মার্কিন পুলিস এজেন্সিগুলির কাছ থেকে এই একই কথা আমাদের সম্পর্কেও শুনেছি ।”

    দ্বিতীয় চিঠি:-
    ৭০৪ ইস্ট ফিফথ স্ট্রিট, এন ওয়াই সি-৯, অ্যাপ্ট-৫এ
    ১৩ অক্টোবর ১৯৬৪
    প্রিয় আবু সয়ীদ,
    “জঘন্য ! আপনার বাগাড়ম্বর আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে, মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, ‘আমার কোনও পদমর্যাদা নেই’, এসব কথার মানে কী? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড রয়েছে । কমিটির ভারতীয় এক্সিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে, ভারতে কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কেও আপনি ওয়াকিবহাল । চিনের ভারত আক্রমণের সময় আমি কলকাতায় একটি বড়সড় সমাবেশে উপস্হিত ছিলাম, সেখানে আপনার সহসম্পাদক মিস্টার ( অম্লান ) দত্ত সাংস্কৃতিক বর্বরতা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন। যা হোক, মিস্টার বি. ভি. কার্নিককে আমি চিঠি লিখেছিলাম, যদিও আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতা কমিটির কোনও সদস্য বা কমিটির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিরই কাজটি করা দরকার ছিল । আর বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি ‘আপত্তিকর উপাদান’-এর কথা । মহাশয়, আপনি ও পুলিশই সেগুলিকে আপত্তিকর বলছেন । সেগুলি নিছক আপত্তিকর তকমা পাওয়া উপাদান মাত্র, প্রকৃত আপত্তিকর নয় । পরের দিকে যে বলেছেন ‘প্রশ্নাতীত আপত্তিকর’, তাও নয় । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি, তাই তা এতোটুকুও ‘প্রশ্নাতীত’ নয় । আসলে পুরোটাই হলো রুচি, মতামত ইত্যাদির ব্যাপার । পুলিশ তাদের নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । আমার মতে এটি কালচারাল ফ্রিডাম বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতারই বিষয় । আশা করছি, এ-বিষয়ে ইন্ডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম, বিশেষ করে সেটির কলকাতা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা-ও একমত হবেন । আমার আরও অদ্ভুত লাগে জেনে যে, এক্ষেত্রে কারওকে সাহায্য করা মানে নবীন লেখকদের বলা, তাদের মতাদর্শ থেকে পিছু হটতে, নিজেদের অবস্হান পালটাতে, ইত্যাদি । ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো প্রমুখের ক্ষেত্রে যেরকম করা হয়েছিল, সেরকমই একেবারে । এমনকী, তারা যে ‘ফালতু’ লেখক, সেটাও । আমি আপনাকে ফের রাগাতে চাই না । আপনি ক্ষুব্ধ হন এমনকিছু বলছি না । কিন্তু একটি কথা বলতেই হবে যে, বর্তমান ইশ্যু নিয়ে আমার-আপনার চিঠি আদান-প্রদান আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে ওই নবীন রুশ কবিরা কেন আপত্তিকর বা ‘ফালতু’, তা নিয়ে আমার সঙ্গে রুশ আমলাদের কথোপকথন । ‘দায়িত্বহীন, ‘নিম্ন মানের লেখা’, ‘নিম্ন রুচি’। ব্রডস্কির মামলার সময়ে, আপনার মনে থাকতে পারে, বিচারক প্রায় সারাক্ষণ ব্রডস্কিকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক কবে আপনার মর্ম স্বীকার করেছে।’ বেচারা মলয় --- যদি ও একজন নিম্ন মানের লেখকও হয় --- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সম্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।
    “ওরা সকলেই সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন, জ্যোতি ( দত্ত ) যদি একথায় আপনার সহমত হয়, তাহলে ও আপনার আত্মগরিমা তুষ্ট করার জন্য সাধুতার ভান করেছে । দলের সবাই, ছাব্বিশজন যাদের জেরা করা হয়, সুনীল উৎপল বসু, সন্দীপন, তারাপদ তো আছেই, এরা ছাড়া অন্য যারা গ্রেপতার হয় সেই সব মধ্যমানের লেখকরা -- যদিও মলয়ের নির্যাতনের প্রতি প্রতিষ্ঠানের সপসপে মনোভাব দেখে মলয়ের অনভিজ্ঞতার প্রতি আমার মমত্ব জাগছে -- এরা সবাই ফালতু এরকম দাবি করা আপনার পক্ষে বা জ্যোতির পক্ষে অসম্ভব । কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ও হাংরি আন্দোলনের সদস্যদের -- এই মামলায় যারা সকলেই পুলিশের দ্বারা হেনস্হা হয়েছে --- সমর্থন করেন, এমন কোনও বাঙালি লেখক বা সমালোচককে যদি আপনি না চেনেন, তাহলে আপনার মতামত সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে । নিজেকে একদম আলাদা রেখেও বুদ্ধদেব বসু তাদের গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন বিষ্ণু দে ও সমর সেন । আমি শুধু মলয় নয়, সমস্ত সদস্যদের কথা বলছি ।
    “এর পাশাপাশি আপনার আর একটি বিরক্তিকর বক্তব্যে আমি স্তম্ভিত, যে পশ্চিমের দমননীতির বিরুদ্ধেও কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম)কে একইরকম ভূমিকা নিতে হবে । আপনি বলেছেন, ‘আমি পর্তুগাল, স্পেন ও পাকিস্তানের কথা ভাবছিলাম’। এখনও পর্যন্ত আমার শোনা আপনার বক্তব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর এটি । লরেন্স, ফ্যানিহিল, জেনে, বারোজ, মিলার, আপনাদের কামসূত্র, কোনারকের আলোকচিত্র -- এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে ধারাবাহিকভাবে, বহুল-প্রচারিত আইনি মামলা চলছে, শায়েস্তা করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া ফ্রান্সে একাধিক সংবাদপত্র ও আলজেরিয় যুদ্ধবিষয়ক বই দমননীতির কোপে পড়েছে, পড়ছে । রাজনৈতিক কারণেই এই দমন । এমনকী কংগ্রেসও ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এর কয়েকটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যদিও তা নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবেই । কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) সম্ভবত আয়রন কার্টেন দমননীতির বিরুদ্ধেই সরব হতে পছন্দ করে, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধে নয় --- আমার এ ধারণা আরও বেশি করে দৃঢ় হচ্ছে, বিশেষ করে আপনার প্রতিক্রিয়ার ধরণ-ধারণ দেখে । এই বিগত এক বছরেই নিউ ইয়র্ক শহরে চলচ্চিত্র, বই সম্পর্কে পুলিশি ধরপাকড় তো হয়েইছে, এমনকী কমেডিয়ানরাও ( লেনি ব্রুস-এর ঘটনা ) বাদ যাননি । আমার মনে হয়, আপনার এ-সম্পর্কে যতোটা জানা দরকার ততটা আপনি জানেন না । ভদ্রভাষায় বললে তাই দাঁড়ায় আরকী । যেমন, আপনি কি জানেন যে, ইংরেজি ভাষায় যে প্রকাশক ডুরেল, মিলার, বারোজ, নবোকভ, টেরি সাদার্ন, দ্য সাদে ও প্রাচ্য প্রণয়গাথা প্রকাশ করেছিল, সেই অলিম্পিয়া প্রেস ফরাসি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ? এ ব্যাপারে ফরাসি কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) কিছু করতে তেমন উৎসাহী ছিল, তা নয় । অলিম্পিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক আন্তর্জাতিক কেচ্ছায় পরিণত হওয়ায় একটু নড়েচড়ে বসে তারা একটি পিটিশন চালু করেছে । নিশ্চয়ই এটা জানেন যে, ভারতে লেডি চ্যাটার্লিজ নিষিদ্ধ ? ভারতীয় কমিটি কি এ বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে ? হাংরিরা তো হালের ।
    “যা হোক, এসবই তত্ত্বকথা, আমার ক্ষোভ উগরে দেওয়া -- মতের বিনিময় -- ঈশ্বরের দোহাই, মাথা গরম করবেন না --- মলয় ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের অভিযোগ মনে হয় এখনও রুজুই আছে --- মলয় লিখেছে যে ২৮ ডিসেম্বর বিচার শুরু হবে --- এই অদ্ভুত পরিস্হিতি থেকে মুক্ত হওয়ার মতো প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকে কোনও সহায়তাই পাওয়া যায়নি এখনও অবধি --- ও বলেছে, বোধহয় ওর কথাগুলো সত্যিই, যে, ‘আমাদের গ্রেপতার হওয়ার ফলে কবি ও লেখকরা এতোটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, তারা প্রায় সকলেই তাদের লেখার ধরনটাই পালটে ফেলেছে ।’ অবশ্য ও যে লেখক দলকে চেনে, তাদের কথাই বলছে, ‘প্রতিষ্ঠিত’ বয়স্কদের কথা নয় । ও জানিয়েছে কংগ্রেসকে ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পায়নি ও । আপনিও এড়িয়ে গেছেন । আর ‘আমাদের গ্রেপতার হওয়ার পর আমাদের কোনো ম্যাগাজিন বা বুলেটিন আমরা ছাপাতেই পারছি না ।’ পুলিশের ভীতি । উৎপল বসু আজ একটা চিঠিতে লিখেছে, ‘ভীষণ বাজে খবর । আজ আমার কলেজ কর্তৃপক্ষ ( যেখানে আমি জিওলজি পড়াই ) আমায় পদত্যাগ করতে বলল । আমার কোনো যুক্তিই ওরা শুনতে নারাজ । আমার তো একরকম সর্বনাশ হয়ে গেল । ওরা টাইম পত্রিকা খুলে দেখিয়ে বললে, এই তো আপনার ছবি ও বক্তব্য । আপনার মতো কোনো লোক আমাদের এখানে থাকুন, এ আমরা চাই না...আমার চিঠিপত্র পুলিস ইনটারসেপ্ট করছে । আপনি আমার শেষ চিঠিটা পেয়েছেন ?...ইত্যাদি।’ এ একেবারে অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে প্রাথমিকভাবে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশি শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে ।এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ, দায়িত্ববান কোনও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্কৃতি সম্ভব নয় । বোধহয় ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডমের প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতায় কংগ্রেসের ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) দপতরে এ-বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে চিঠিতে অন্তত আপনাকে কথাগুলি সোজাসুজি বলছি । এই মুহূর্তে আপনার-আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয়।--- অনুগত, অ্যালেন গিন্সবার্গ ।
    “পুনশ্চ : আমার বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী । পিটার ( অরলভস্কি ) ও আমি গত এক মাস হারভার্ডে বক্ততৃতাদানে ব্যস্ত ছিলাম । আমি মাত্র কয়েকদিন আগেই কেমব্রিজ থেকে ফিরেছি ।
    দাদাকে সম্ভবত জ্যোতির্ময় দত্ত বলেছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করতে । আমরা দুজনে দেখা করেছিলুম । কিন্তু আইয়ুব সাহেব এ-ব্যাপারে মুখ খোলেননি, এমন ভাব করেছিলেন যেন দুটো ভিখারি ওনার ড্রইংরুমে ঢুকে পড়েছে । দাদাও জানতো না, আমিও জানতুম না যে গিন্সবার্গ আর আইয়ুব সাহেবের মধ্যে আমাদের কেস নিয়ে কথাবার্তা চলছে । ব্যাপারটা আমরা জানতে পারি পরে যখন দাদাকে আর আমাকে কলকাতায় র‌্যাডিকাল হিউম্যানিস্টের দপতরে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামের ভারতীয় সচিব এ. বি. শাহ দেখা করতে বলেন । এ. বি. শাহ পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে জেনেছিলেন যে কলকাতার এলিটবর্গের কারা আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকেছেন । এ. বি. শাহ বললেন, তিনি কিছু করতে পারবেন না । এলিটবর্গের কলকাঠি ছাড়া তো জানার কথা নয় যে উৎপলকুমার বসু কোথায় অধ্যাপনা করেন, এবং তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত ।
    অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠির জবাবে আবু সয়ীদ আইয়ুব ৩১ অক্টোবর ১৯৬৪ এই চিঠিটি লেখেন । চিঠিটির কপি পরে গিন্সবার্গই আমাদের পাঠিয়েছিলেন, জানাবার জন্য যে আইয়ুব সাহেব কতোটা ক্রুদ্ধ :-
    Pearl Road
    Calcutta
    31 October, 1964
    Dear Mr Ginsberg,
    I am amazed to get your pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with communist characterization of the Congress for Cultural Freedom as a fraud and a bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate, did not, however surprise me ; for I never thought the Congress had any charge of escaping your contempt for everything ‘bourgeoisie’ or ‘respectable’.
    If any known litteratur or intellectual had come under police repression for their literary or intellectual work, I am sure the Indian Committee for Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful promptings from you. I am glad to tell you that no repressions of that kind has taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile work to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self-advertising leaflets and printed letters abusing distinguished persons in filthy language ( I hope you agree that the word ‘fuck’ is obscene and ‘bastard’ filthy at least in the sentence ‘Fuck the Bastards of the Gangshalik School of Poetry’; they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avantgarde exhibition ! You may think your duty to promote in the name of cultural freedom such adolescent pranks in Calcutta from halfway round the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.
    It was of course foolish of the police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now) thus giving the publicity and some public sympathy --- publicity is precisely what they want to gain through their pranks.
    I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of American Beatnik poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language --- a language of which you chose to remain totally ignorant.
    With all good wishes in spite of your grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.
    Yours sincerely
    Abu Sayeed Ayyub

    আইয়ুব সাহেব যখন এই চিঠিটা লিখছেন তখন পর্যন্ত চার্জ শিট দেয়া বাকি আছে, প্রদীপ চৌধুরীকে ত্রিপুরা থেকে গ্রেপতার করে কলকাতায় আনা বাকি আছে । আইয়ুব সাহেব দাদার “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি” কাব্যগ্রন্হ তখনও পড়েননি, উৎপলের কবিতাও পড়েননি, তা তিনি স্বীকার করেছিলেন আমাদের কাছে । তিনি জানতেনই না যে উৎপলের চাকরি চলে গেছে, জানতেন না যে দাদাকে চাইবাসায় গ্রেপতার করা হয়েছিল, আর তখনও পর্যন্ত সাসপেন্ড রয়েছেন । কারা তাঁকে খবর যোগাচ্ছিল জানি না । যারা যোগাচ্ছিল তারাই আমাদের বুলেটিন, পত্রিকা ইত্যাদি কলকাতায় ছাপাতে দিচ্ছিল না । দাদার এক বন্ধু, অদ্রীশ বর্ধনের দাদা, নতুন প্রেস খুলেছিলেন বহরমপুরে, সিগনাস প্রিন্টিং নামে, দাদা সেখানে ছাপার ব্যবস্হা করে দেন তাঁকে বলে ।
    অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং আবু সয়ীদ আইয়ুবের চিঠিগুলো পড়লেন তো ? এবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটি চিঠি পড়ুন, একটি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা, হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে, তাতে দাদার কোনো উল্লেখ নেই, অন্য চিঠিটা এক বছর পরে দাদাকে লেখা, যাতে লিখছেন যে মলয় কবিতা লিখতে জানে না, বোঝাই যায় যে পরের দশকগুলোর কবিতায় আসন্ন বাঁকবদলের হদিশ পাননি, এমনকী তরুণীরাও যে বাঁকবদলের অন্যতম কারণ হবেন, তা আশা করেননি, নকশাল আন্দোলনের আগাম আঁচ করতে পারেননি । পরের প্রজন্মের কবিদের সম্পর্কে তাঁর হিংসে তিনি লুকোননি, বোধহয় ভেবে দেখেননি যে চিঠিগুলো কখনও প্রকাশিত হলে ছবিটার ফ্রেমে ঘুণ ধরে যেতে পারে, কিংবা হয়তো ভেবেছিলেন যে বহুল প্রচারিত পত্রিকার গদিতে বসে সময়কে রৈখিকতার বাইরে যাবার তত্বকে হাপিশ করে দিতে পারবেন ।
    15 June 1964
    313 South Capital
    Iowa City
    USA
    সন্দীপন,
    নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসেছি, প্রচণ্ড হাওয়া, সঙ্গে ৫ ডজন বিয়ার ক্যান, পাশে সাঁতারের পোশাক পরা একটা ধলা মেয়ে, মাঝে মাঝে তার পাছায় টোকা মারছি পায়ের আঙুল দিয়ে, এ দৃশ্য কেমন ? অবিকল এই দৃশ্যের মাঝে আমি শুয়ে আছি । চিঠি লিখছি । কিন্তু আমি এ দৃশ্যের মধ্যে নেই । হাতের তালু গোল করে খুব ছোটো করে, চোখের কাছে আনছি --- সবকিছু দূরে চলে যাচ্ছে । মেয়ের মুখও । খিদে নেই । তেষ্টা নেই । তবু বিয়ার খাচ্ছি । কারণ, এখানে বসে খাওয়া বেআইনি বলে, ঘরের মধ্যে খুব গরম । থাকতে পারিনি । ঘাসের ওপর গড়িয়ে গেলাম । একটা দূরন্ত খরগোশকে ধরার জন্য পাঁচবার ছুটে গিয়েছিলাম ।
    কী ভালো লেগেছিল আপনার চিঠি পেয়ে । বিশেষত লাল পেনসিলের অক্ষর । যেন দুটো চিঠি পেলুম । গল্পটা আপনার ভালো লাগবে না জানতুম । গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই । সত্যি নেই । কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না । কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে কাছে আর কেউ পৌঁছোতে পারেনি । আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না । লিখবো না । কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য । আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না । তবু, কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না, লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেটা ছাপার সম্ভাবনা নেই । আমার কবিতার জন্য আপনাকে ভয় করি না, কবিতার লেখার ক্ষমতার ওপর আমার বেশি আস্হা নেই, আপনি যেরকম কবিতা ভালোবাসেন, অথবা যাই হোক --- আমি সেরকম কখনও লিখব না । আমি কবিতা লিখি গদ্যের মতো, ওরকমই লিখে যাবো । ও সম্বন্ধে আমার কোনো দ্বিধা নেই । শক্তি অসাধারণ সুন্দর বহু লাইন লিখেছে । আমার চেয়ে অনেক বড়ো, আমি ওকে শ্রদ্ধা করি । কিন্তু শক্তির কবিতা মুণ্ডহীন, আমি ওরকম লিখতে পারবো না, চাই না, কারণ আমি ওরকমভাবে বেঁচে নেই । বরং উৎপলের কবিতা আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করেছে । কিন্তু এখানে এই শুয়ে থাকা, গাছের ছায়া মুখে পড়ছে --- তখন মনে হয় কোথাও কিছু নেই, না কবিতা, না হৃদয় ।
    প্রিয় সন্দীপন, দু’দিন পর আজ সকালে আবার আপনার চিঠি পেলুম । কি সব লিখেছেন কিছুই বুঝতে পারলুম না । কেউ আমাকে কিছু লেখেনি । শরৎ ও তারাপদ কফিহাউসে কি সব গণ্ডোগোলের কথা ভাসা ভাসা লিখেছে । সবাই ভেবেছে অন্য কেউ বুঝি আমাকে বিস্তৃত করে লিখেছে । কিন্তু আপনার চিঠি অত্যন্ত অস্বস্তিজনক । তিনবার পড়লুম, অস্বস্তি লাগছে। বিছানা থেকে উঠে কলের কাছে গেলুম, ফিরে এলুম টেবিলে, আবার রান্নাঘরে, ভালো লাগছে না, কেন আমাকে এরকম চিঠি লিখলেন ? আমি তো শুয়েছিলুম । আমি তো বিছানায় রোদ ও আলস্য নিয়ে খেলা করছিলুম । কেন আমাকে এমনভাবে তুললেন ?
    সন্দীপন, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি, প্রায় বছর তিনেক । তার বদলে আপনি কুচোকাচা গদ্য ছাপিয়ে চলেছেন এখানে সেখানে । সেই স্বভাবই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় হাংরির হাঙ্গামায় । আমি বারণ করেছিলুম । আপনি কখনও আমাকে বিশ্বাস করেননি । ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন । আমি শক্তিকে কখনও বারণ করিনি, কারণ আর যতো গুণই থাক, শক্তি লোভী । শেষ পর্যন্ত উৎপলও ওই কারণে যায় । কিন্তু আমি জানতুম আপনি লোভী নন । আপনার সঙ্গে বহুদিন এক বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি । সেই জন্য আমি জানতুম । সেইজন্যই বুঝেছিলুম আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয় । আমার ওতে কখনও লোভ হয়নি, হয়েছিল অস্বস্তি থেকে ঘৃণা । ইংরেজিতে রচনা ছাপিয়ে ইওরোপ আমেরিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার বিষম বদরুচি মনে হয়েছিল আগেই, এখানে এসে আরও বদ্ধমূল হয়েছি । হাংরির গ্যাঁড়াকলের প্রতি আরও ক্রুদ্ধ হয়েছি । অপরের কৌতূহল এবং করুণার পাত্র হতে আপনার ইচ্ছে করে ? হাংরি এখানে যে দুএকজন পেয়েছে, তাদের কাছে তাই । আমি এতোদিন দেশে রইলুম --- অনেক সুযোগ এবং আহ্বান পেয়েছিলুম, কোথাও তবু একটি লাইনও ইংরেজি পদ্য ছাপাইনি । ছাপালে কিছু টাকা পেতুম, তবু না । কারণ সবাইকে বলেছি, আমি বাংলা ভাষার কবি, আমি শুধু বাংলাতেই লিখি, যে ভাষায় কথা বলে সাত কোটি লোক -- ফরাসি ও ইতালির চেয়ে বেশি । এবং ফরাসি ও ইতালির চেয়ে কম উন্নত ভাষা নয় । আমার কাজ কবিতা লেখা, নিজের কবিতা অনুবাদ করা নয়, ও কাজ অন্যের । তোমার দরকার হলে বাংলা শিখে অনুবাদ করে নাও। এই ধরণের সূক্ষ্ম পিঠচাপড়ানির ভাব লক্ষ্য করেই আমি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদগ্রন্হের কাজ, যে জন্য আমি এখানে এসেছিলুম, এক লাইনও করিনি ।
    হাংরির এই ইংরেজির মতলব ছাড়া, বাংলা দিকটা আরও খারাপ । ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই । শর্টকাটে খ্যাতি বা অখ্যাতি পাবার চেষ্টা --- অপরকে গালাগাল বা খোঁচা দিয়ে । আপনি মলয়কে এতো পছন্দ করছেন --- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে, আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে বিশ্বাস করেন না । আমি চলে আসার পরও আপনি হাংরির পৃষ্ঠপোষকতা করছেন --- হিন্দি কাগজের জন্য আপনি কি একটা লিখেছিলেন --- তাতেও হাংরির জয়গান । ভাবতে খুব অবাক লাগে --- আপনার মতো অ্যাবস্ট্র্যাক্ট লেখক কি করে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছবি ছাপাটাও উল্লেখের ব্যাপার মনে করেন । এগুলোই হাংরির গোঁজামিল । এই জন্যই এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক থাকাতে বারবার দুঃখ পেয়েছি, দুঃখ থেকে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা । একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি হাংরির কখনও প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিনি, ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করিনি । পারতুম । করিনি, তার কারণ, ওটা আপনাদের শখের ব্যাপার, এই ভেবে, এবং আপনারা ওটাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন কৃত্তিবাস বা সুনীলের প্রতিপক্ষ হিসেবে । সে হিসেবে ওটাকে ভেঙে দেওয়া আমার পক্ষে নীচতা হতো । খুবই । বিশ্বাস করুন, আমার কোনো ক্ষতির কথা ভেবে নয়, আপনার অপকারের কথা ভেবেই আমি আপনার ওতে থাকার বিরোধী ছিলুম । এটা হয়তো খুব সেন্টিমেন্টাল শোনালো, যেন কোনো ট্রিক, কিন্তু ও-ই ছিল আমার সত্যিকারের অভিপ্রায় ।
    এবারে নতুন করে কি ঘটলো বুঝতে পারলুম না । যে-ছাপা জিনিসটার কথা লিখেছেন সেটা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতুম । এবং এটা খুবই গোলমেলে --- যে চিঠি আপনি চারজন বন্ধুকে একসঙ্গে লিখেছেন, যেটা চারজনকে এক সঙ্গে পাঠানো যায় না, সেটা হারাধন ধাড়াকে পাঠালেন কি জন্য, বুঝতে পারলুম না । কিংবা আমার বোঝারই বা কি দরকার ? আচ্ছা মুশকিল তো, আমাকে ওসব বোঝার জন্য কে মাথার দিব্বি দিয়েছে এই আষাঢ় মাসের সন্ধ্যাবেলা ? আমি কলকাতায় ফিরে শান্ত ভাবে ঘুমোবো, আলতো পায়ে ঘুরবো --- আমার কোনো সাহিত্য আন্দোলনের দরকার নেই । মলয় আমার চিঠি কেন ছাপিয়েছে ? আমার গোপন কিছু নেই --- বিষ্ণু দেকে আমি অশিক্ষিত বলেছি আগেও, কৃত্তিবাসের পাতায় ব্যক্তিগত রাগে, কারণ উনি ওঁর সংকলনে আমার কবিতা আদ্দেক কেটে বাদ দিয়েছেন বলে । কিন্তু মলয়ের সেটা ছাপানোর কি মতলব ? যে প্রসঙ্গে লিখেছিলুম সেটা ছাপিয়েছে তো ? আমি ওকে লিখেছি সম্প্রতি. ‘সামনে পেছনে বাদ দিয়ে, ডট ডট মেরে চালাকির জন্য আমার চিঠি যদি ছাপাও, তাহলে এবার ফিরে গিয়ে কান ধরে দুই থাপ্পড় মারব’। আপনার চিঠি সম্বন্ধেও তাই । আপনার চিঠি ওরা ছাপিয়েছে সেটাই খারাপ(*) --- যা লিখেছেন, তা নয় । বেশ করেছেন লিখেছেন --- আমি না পড়েই বলছি । ওটা আপনার, শক্তির বা আমার ঘরোয়া ব্যাপার --- আর কার কি তাতে? আপনার যা খুশি বলার অধিকার আছে ।
    কিন্তু ওসব থাক সন্দীপন । আপনাকে কেউ মারবে না । কার অমন স্পর্ধা আছে ? যদি আপনি জায়গা দেন, আমি সব সময় আপনার পাশে আছি । অনেকে আছে । আপনার সঙ্গে কতো ঝগড়াঝাটি হয়েছে --- কিন্তু এই দীর্ঘদিন নিরালায় ভেবে দেখলুম, আপনাকে বাদ দিয়ে আমাদের চলে না । এক হিসেবে আপনি আমার অপরাংশ, আপনার চরিত্রের অসংলগ্নতা, ভুল এবং জোচ্চুরি --- সব কিছু আমার প্রিয় । যেন আমার না-পাওয়া জীবন । লেখক হিসেবে, ‘প্রতিভাবান’ এই শব্দটি যদি ব্যবহার করতে হয় --- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া --- শুধু আপনার সম্পর্কেই আমি একথা ভাবি । আপনার ঐ সুখের সূক্ষ্ম শরীর কেউ ছোঁবে না --- কলকাতা শহরে এমন কেউ নেই । না নেই । আপনি নরম ভাবে শুয়ে থাকুন রীনার পাশে, আপনি ওঁকে মঙ্গল গ্রহের গল্প বলুন ।
    আমি কলকাতায় পৌঁছোবো ১৮ই আগস্ট । নানা কারণে এখানে এক মাস দেরি হয়ে গেল । দেরি হয়ে গেল আমারই বোকামিতে খানিকটা । জুনের মাঝামাঝি বা আগস্টের প্রথমে প্যারিসে একটা থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কয়েক দিনের জন্য । আমি জুন মাসটা নষ্ট করেছি --- সুতরাং আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই । এই ঠিকানায় আছি জুলাইয়ের বারো তারিখ পর্যন্ত অন্তত, তারপর নিউ ইয়র্ক ও ইংল্যাণ্ড। এখানে থেকে এম এ পড়তে পারি আমি --- আপনার মনে এরকম ধারণা এলো কি করে ? আমি কি সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়েছি ? কৃত্তিবাসে আপনার লেখা নিয়ে প্রচুর গণ্ডোগোল করেছি --- তবু, এবার কৃত্তিবাসে আপনার লেখা না দেখে মন খারাপ লাগলো । এখান থেকে কোনো জিনিস নিয়ে যাবার হুকুম আছে আপনার কাছ থেকে ?
    ভালোবাসা
    সুনীল
    (*) এটি চিঠি নয় । দেবী রায়কে লেখা -- হারাধন ধাড়াকে নয় --- নানা রঙিন পেনসিলে লেখা হাংরি বুলেটিনের জন্য গদ্য । বুলেটিনে এই গদ্যটি প্রকাশিত হয়েছিল । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবিরাম উপন্যাস লেখা আরম্ভ করলে আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাস প্রকাশ অসম্ভব করে দিয়েছিলেন । সেকারণে সন্দীপন আজকাল পত্রিকায় যোগ দেন । দাদাও কৃত্তিবাস পত্রিকায় লেখা পাঠানো বন্ধ করে দেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য দাদার কাছ থেকে কবিতা দাদার পোস্টিঙের জায়গায় গিয়ে নিয়ে আসতেন, তখন দাদার কবিতার ধারা কৃত্তিবাসের ধারা থেকে পালটে গেছে । এবার দাদাকে লেখা চিঠিটা পড়ুন :-
    ৩২/২, যুগীপাড়া রোড, দমদম
    কলকাতা - ২৮
    ৯ নভেম্বর ১৯৬৫
    সমীর,
    মলয়ের ৫ তারিখের মামলার বিস্তৃত বিবরণ নিশ্চয়ই ওদের চিঠিতে জানতে পারবি, বা জেনে গেছিস । সে সম্পর্কে আর লিখলুম না ।
    দুটি ব্যাপার দেখে কিছুটা অবাক ও আহত হয়েছি । তুই এবং মলয় ইত্যাদি ধরেই নিয়েছিলি আমি মলয়ের স্বপক্ষে সাক্ষী দেবো না --- বরং অন্যান্যদের বারণ করব, কোনোরকম সাহায্য করবো না । তোর অনুরোধ ছিল ‘শেষ অনুরোধ’ --- যেন আমি প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় বা চতুর্থ অনুরোধ আগে প্রত্যাক্ষ্যান করেছি । মলয়ও কয়েকদিন আগে সকালে আমার বাড়িতে এসে বললো, ওর ধারণা আমি চারিদিক থেকে ওর সঙ্গে শত্রুতা করছি এবং অপরকে ওর সঙ্গে সহযোগীতা করতে বারণ করছি !
    অপর পক্ষে, মামলার রিপোর্ট কাগজে বেরুবার পর --- কফি হাউসের কিছু অচেনা যুবা, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসে । আমি নাকি খুবই মহৎ ব্যক্তি --- হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে কখনও যুক্ত না থেকেও এবং কখনও পছব্দ না করেও যে ওদের স্বপক্ষে সাক্ষী দিয়েছি --- সেটা নাকি আমার পক্ষে পরম উদারতার পরিচয় ।
    ওদের ওই নকল উদারতার বোঝা, এবং তোদের অন্যান্য অবিশ্বাস --- দুটোই আমার পক্ষে হাস্যকর মনে হল । মানুষ কি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে ভুলে গেছে ? আমার ব্যবহার আগাগোড়া যা স্বাভাবিক তাই । আমার স্ট্যাণ্ড আমি আগেই পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছি । আমি হাংরি জেনারেশন পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে ) । আমি ওদের কিছু-কিছু পাজি ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি । মলয়ের দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না --- আমার রুচি অনুযায়ী এই ধারণা । অপরপক্ষে লেখার জন্য কোনো লেখককেই পুলিশের ধরার এক্তিয়ার নেই --- একথা আমি বহুবার মুখে এবং কৃত্তিবাসে লিখে জানিয়েছি । পুলিশের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো লেখকের স্বপক্ষে ( সে লেখকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যা-ই হোক না ) দাঁড়ানো আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ বলেই মনে করি । কারুর লেখা আমি অপছন্দ করি বলেই তার শত্রুতা করবো, কিংবা অন্য কারুকে নিবৃত্ত করবো তাকে সাহায্য করতে -- এরকম নীচতা কি আমার ব্যবহারে বা লেখায় কখনো প্রকাশ পেয়েছে ? এসব ছেলেমানুষী চিন্তা দেখলে -- মাঝে মাঝে রাগের বদলে হাসিও পায় ।
    যাই হোক, আদালতের সাক্ষ্যতে আমি দুটি কথা বলেছি । মলয়ের লেখার মধ্যে অশ্লীলতা কিছুই নেই --- এবং ওর লেখাটা আমার ভালোই লেগেছে । ধর্ম সাক্ষী করে আমি দ্বিতীয় কথাটা মিথ্যে বলেছি । কারণ, কয়েকদিন আগে মলয় যখন আসে --- তখন আমি বলেছিলুম যে ওর লেখা আমি পছন্দ করি না । কিন্তু শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্নটি জেনারাল, এবং সেই জেনারাল প্রশ্নে আমি অশ্লীলতা বলে কিছুই মানি না । সুতরাং সেই হিসেবে মলয়ের লেখাও যে বিন্দুমাত্র অশ্লীল নয়, তা আমি সাক্ষীর পক্ষে উঠে স্পষ্ট ভাবে বলতে রাজি আছি । তখন মলয় আমাকে অনুরোধ করে, আমি যদি ওকে সাহায্য করতে চাই, তবে জজসাহেবের সামনে ওর কবিতা খারাপ লাগে এটাও যেন না বলি । আদালত তো আর সমালোচনার জায়গা নয় । বরং ওর কবিতা ভালো লাগে বললেই নাকি মলয়ের পক্ষে সুবিধে হবে ।
    সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়।(*) পড়ে আমার গা রি-রি করে । এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি --- আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না--- এসব কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না । মলয়ের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই । মলয় যদি আমার ছোটো ভাই হতো, আমি ওকে কবিতা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম । যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে । এর কারণ আমার কোনো মহত্ব নয় --- আমার সাধারণ, স্বাভাবিক সীমাবদ্ধ জীবন । যে কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি --- সেই কারণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি । যাই হোক, সেদিন আদালতে দাঁড়িয়ে মনে হল, হাকিম এবং পুলিশপক্ষ এ মামলা ডিসমিস করে দিতে পারলে বাঁচে । কিন্তু মলয়ের প্রগলভ উকিল মামলা বহুদিন ধরে টেনে নাম কিনতে চায় ।
    ডিসেম্বর ৮-৯ তারিখে পাটনায় আমেরিকান সাহিত্যের ওপর একটা সিমপোজিয়াম হবে । আমি তাতে যোগদান করার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছি । ঐ সময়ে পাটনা যাবো । আশা করি ভালো আছিস ।
    সুনীল ।
    (*) কবিতাটির নাম ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কবিতাটি প্রথমবার পড়েন । তার আগে তিনি কবিতাটি পড়েননি ।
    ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘কৃত্তিবাস’ দ্বিতীয় সংকলনের সম্পাদকীয় লেখার সময়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের প্রতি ঈর্ষাজনিত ক্ষতের কথা ভুলতে পারেননি । তিনি লিখেছিলেন, “অ্যালেন গিনসবার্গের প্রভাবেই কিনা জানি না, এই সময় কৃত্তিবাস লেখক গোষ্ঠীরই একটি অংশ হাংরি জেনারেশন নামে একটি আন্দোলন শুরু করে । প্রায় একই লেখক গোষ্ঠী হলেও, কৃত্তিবাস পত্রিকা ঘোষিতভাবে হাংরিদের সঙ্গে সম্পর্ক-বিযুক্ত থাকে, আমি নিজেও কখনো হাংরিদের দলে যোগ দিইনি । দু’এক বছরের জন্য হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের সোরগোল কৃত্তিবাসের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল হয়েছিল এবং তা একদিকে টাইম ম্যাগাজিন অন্যদিকে আদালত পর্যন্ত গড়ায় । আমি হাংরিদের থেকে সব সময়ে দূরে দূরে রইলেও অশ্লীলতার অভিযোগে যখন শ্রীযুক্ত মলয় রায়চৌধুরীর বিচার হয়, তখন আমি তার পক্ষ সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম ।”
    হাংরি আন্দোলনের দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় কারোর সঙ্গে গিন্সবার্গের দেখা হয়নি । দাদার সঙ্গে হয়েছিল ১৯৬২ সালে আর আমার সঙ্গে ১৯৬৩ সালে । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে । বস্তুত কৃত্তিবাস গোষ্ঠীই গিন্সবার্গের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং তাঁদের অনেকেরই কবিতায় সেকারণে এই সময় বাঁকবদল ঘটেছিল, যখন কিনা তাঁরা কবিতা লিখছিলেন পঞ্চাশ দশক থেকে । গিন্সবার্গের তোলা ফোটোও তাঁরা কৃত্তিবাস পত্রিকার কভারে ছেপেছেন । কোনো হাংরি বুলেটিনে গিন্সবার্গের অস্তিত্ব নেই ।
    ‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকার হাংরি সংখ্যার জন্য নাসের হোসেন দাদাকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন, “হাংরি আন্দোলন চলাকালীন নানাধরণের ঘটনা ঘটেছে । এমনকি পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটেছে । এই ঘটনার প্রভাবে মেইনস্ট্রিমের কিছু-কিছু ভূমিকা সম্পর্কে কিছু কি বলবেন ?”
    দাদা তার এই উত্তর দিয়েছিলেন, “দেখ, আমার প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে সুনীল বাইরে থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ভাঙন ধরাতে সচেষ্ট ছিলেন । শক্তিকে নেতা করা হয়েছিল বলে সুনীল অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিলেন । আর প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষ মহাশয় ভেতর থেকে ভাঙন ধরাতে চেষ্টা করেছিলেন এবং অনেকটা সফল হয়েছিলেন । এগুলি যে কেউ গবেষণা করলেই টের পাবেন ।”
    দাদার জন্য তাই জরুরি ছিল কলকাতায় এসে “হাওয়া-৪৯” পত্রিকার মাধ্যমে নিজের দর্শনকে প্রতিরোধ হিসাবে এসট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতরূপে তুলে ধরা । এক সাক্ষাৎকারে ( চন্দ্রগ্রহণ, হাংরি সংখ্যা ) নাসের হোসেন দাদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “হাংরি জেনারেশন থেকে আপনি অধুনান্তিক অবস্হানপন্নতায় গেলেন কীভাবে ? আমার ধারণা এ-দুটোর দূরত্ব বিস্তর।”
    উত্তরে দাদা বলেছিলেন, “আধুনিকতা বা ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে উত্তরঔপনিবেশিক অধুনান্তিকতায় যাত্রাপথ চিহ্ণিত করা তোমার পক্ষেও সহজ । দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও, স্বাধীনোত্তর চেতনা তারিখের কাঁটায় সায় দিয়ে বদলে যায় না । হাংরি আন্দোলন স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ঘটেছিল ষাটের দশকে । এবং ক্রমশ ভেদের সনাক্তকরণ থেকে অভেদের সন্ধানে যাত্রার মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে প্যারাডিম শিফট বা বাঁকবদলের অনিবার্যতা । ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে বেরিয়ে আসার পরিস্হিতি । হাংরি আন্দোলন সবার আগে এই পরিস্হিতি অনুধাবন করতে পেরেছিল ; এবং আন্দোলনের অপরিহার্যতাকে উপলব্ধি করেছিল । কেননা এই ধরণের পরিবর্তন আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব । যার ফলে পরবর্তীকালে পর পর একাধিক আন্দোলন ঘটতে থেকেছে । স্বাধীনোত্তর পর্বে ঘটলেও, সেই আন্দোলনগুলির কাঠামো ছিল ঔপনিবেশিক আধুনিকতায় আক্রান্ত । আমরা এ-কথা বুঝতে পেরেছিলাম যে আগের কাঠামো থেকে যেভাবেই হোক বেরিয়ে পড়তে হবে । এবং সাহিত্যের প্রথম শর্ত আগের ভাষাকাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ভাষার পরিমণ্ডল গড়ে তোলা । আমরা প্রত্যেকেই কবিতা-গল্প ইত্যাদিতে ভাষার পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট থেকেছি । যেমন মলয় তাঁর কবিতার নাম দিলেন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, শৈলেশ্বর ঘোষ দিলেন ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’, প্রদীপ চৌধুরী নাম রাখলেন ‘চর্মরোগ’, বাসুদেব দাশগুপ্ত তাঁর গল্পগ্রন্হের নাম রাখলেন ‘রন্ধনশালা’, সুবিমল বসাক তাঁর উপন্যাসের নাম রাখলেন ‘ছাতামাথা’, আমি আমার গল্পের নাম দিলাম ‘স্মৃতির হুলিয়া প্রতুলের মা অমলেট অবধি’, ‘জলছবি’, ‘অতিক্রম’, কাব্যগ্রন্হের নাম রাখলাম ‘জানোয়ার’ । প্রত্যেকের ভাষা, উপস্হাপনা, প্রয়োগ সম্পূর্ণ পৃথক । এগুলো ঠিক রাতারাতি ঘটেনি । বিষয়গুলোকে নিয়ে আমি ও মলয় দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করেছি, আলোচনা হয়েছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের ( হারাধন ধাড়া ) সঙ্গে । দেবী রায়ের কবিতা প্রথম থেকেই গঠন ও মেজাজ-মর্জিতে অভিনব । আমাদের পূর্বে যাঁরা লেখালিখি করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না । ফালগুনী রায় তাঁর বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’ । হাংরি আন্দোলনের মধ্যেই এবং ষাট দশকের অধিকাংশ আন্দোলনের মধ্যেই অধুনান্তিকতার বীজ অন্তর্নিহিত ছিল । কেননা যে পরিবর্তন ঘটছিল তা সময়কেন্দ্রিক প্রশ্নময়তা থেকে পরিসরভিত্তিক অবস্হানপন্নতার দিকে তার চেতনার অভিমুখ ক্রমশ রচনা করছিল । এই প্রসেসটা এমন ছিল যে সেখানে প্রাধান্য ছিল গড়ে তোলার চেয়ে উঠে আসার দিকে গুরুত্ব দেওয়ার স্বতশ্চল তাগিদ । হাংরি আন্দোলনের কোনো হেড অফিস/হাই কমাণ্ড/পলিটব্যুরো বা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ছিল না । ঠিক যেমন অধুনান্তিকতার কোনো কেন্দ্র থাকে না, অধুনান্তিক লেখালিখির চরিত্র একটি বিকেন্দ্রিক উপস্হাপনা । ফলে ষাট দশকের অন্যান্য সাহিত্য আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল না, অধুনান্তিক বীজ সেখানে নিহিত ছিল । হাংরি আন্দোলন থেকে অধুনান্তিকতায় পৌঁছে যাওয়া যেজন্য খুব স্বাভাবিক । হাংরি আন্দোলন ছিল সর্বাত্মক আন্দোলন । সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি জীবনচর্যার সবদিকেই এই আন্দোলন মনোযোগ দিয়েছিল । “হাওয়া ৪৯” পত্রিকার সংখ্যাগুলিতে বিষয়গুলির ক্রমান্বয়কে যদি লক্ষ্য করো, তাহলে দেখতে পাবে, সমস্ত দিকেই ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের গভীর অভিনিবেশ । ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কাগজে-কলমে মুক্তি পাওয়ার পর হাতেনাতে সেই মুক্তি প্রতিষ্ঠার দায় প্রবলভাবে অস্হির রাখে সমাজচিত্তকে । সঙ্গে থেকে যায় ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া খেসারতগুলো । মাথাচাড়া দেয় আত্মবিচ্ছেদগ্রস্ত সত্তার নিজস্ব ভৌমতার অনিবার্যতা । অধুনান্তিকতা সেই সময়ে আমাদের পরিকল্পনায় ছিল না, যদিও তার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল আমাদের ডিসকোর্সে । পরিবর্তনই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য । অধুনান্তিকতা উঠে এসেছে বোধের সমস্তরকম স্বতঃস্ফূর্ততা থেকে । কোনো পরিকল্পনা থেকে উঠে আসেনি। আধুনিকতা বা মডার্নিজমের থেকে বেরিয়ে এসে তুমি যে জায়গাটায় পৌঁছোলে বা পৌঁছোচ্ছ, তার একটা নামকরণ দরকার এবং সেই ভিন্ন পরিসরটির নামকরণ করেছেন আলোচকরা । অধুনান্তিকতা একটি পরিসর ; অনেকে তাকে আন্দোলন ভেবে ভুল করেন ।”
    ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ প্রবন্ধে ‘অধুনান্তিক’ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন বহুভাষাবিদ প্রবাল দাশগুপ্ত ।
    তাঁর “উত্তরাধুনিক প্রবন্ধ সংগ্রহ” গ্রন্হে দাদা একটা তালিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন, স্পষ্ট করার জন্য যে আধুনিকতার সঙ্গে অধুনান্তিকতার পার্থক্য কোথায়, তুলে দিচ্ছি এখানে :
    আধুনিক অধুনান্তিক
    যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, যুক্তিবিপন্ন, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে
    সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কের মতো যুক্তি মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা,
    ধাপে-ধাপে এগোয়, কবিতার আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু
    আদি-মধ্য-অন্ত এই ভাবগুলো হওয়া আর শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না
    বজায় থাকে, একরৈখিক দেওয়া, ছেতরানো, ক্রমান্বয়হীন, আবেগ
    ক্রমঅগ্রসর, কেন্দ্রাভিগ, যুক্তির যুক্তির দ্বৈরাজ্য কেন্দ্রাভিগ, যুক্তি ও
    দিকে কবিতার অভিমুখ, আঁটো আবেগের দ্বৈরাজ্যের দিকে কবিতার অভিমুখ,
    সাঁটো, স্বয়ংসম্পূর্ণ । এলোমেলো দেখায় ।

    বদ্ধ সূচনা, বদ্ধ আঙ্গিক, বদ্ধ মুক্ত সূচনা, মুক্ত আঙ্গিক, মুক্ত সমাপ্তি ।
    সমাপ্তি ।

    ডিসটোপিয়া । হেটারোটোপিয়া ।

    সুনিশ্চিত মানে, পরিমেয়তা ও মানের নিশ্চয়তা এড়িয়ে যাওয়া, অফুরন্ত
    মিতকথনের প্রতি গুরুত্ব, কবির মানে, যা ইচ্ছে তা মনে করে নিতে পারেন
    ঠিক করে দেয়া মানে, স্হাবর । পাঠক, মানের ধারণার প্রসার, প্রচলিত মত
    অস্বীকার ।
    তলে-তলে মানে, বাইরে মুখোশ। যা আছে তা-ই, লুকোনোর কিছু নেই,
    স্বচ্ছতার বাধ্যবাধকতা ভিতর-বাহির
    আলাদা নয় ।

    ‘আমি’ পাঠবস্তুর কেন্দ্রে, ‘আমি’র একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব,
    নির্মাণ, একক আমি, পূর্ব ক্যানন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ক্যানন
    নির্ধারিত মানদণ্ড, ক্যানন দাঁড় ভেঙে দেওয়া, সীমা আবছা, সীমায় ভাঙন,
    করানো, সীমা স্পষ্ট, আত্মপ্রসঙ্গই মিশ্রতা, লিমিন্যালিটি, সংকরায়ন,
    মূল প্রসঙ্গ, শুদ্ধতা, ‘আমি’র সংকরত্ব ।
    পেডিগ্রি ( কুলুজি )।

    একক মালিকানা, স্পষ্ট মালিকানা, মালিকানার রুবরিক, মালিকানার বহুত্ব,
    শেকড় -- গোপন গভীরে, কবিই মালিকানা বিপন্ন, মালিকানা বিসর্জন,
    টাইটেল হোলডার । পাঠকই টাইটেল হোলডার, শেকড়
    ছড়িয়ে পড়ে, রাইজোম্যাটিক ।

    একরৈখিক, লিনিয়ার, লিনিয়রিটি, প্লুরালিজম, বিদিশাগ্রস্ত বহুস্বরের আশ্রয়,
    দিশাগ্রস্ত, একক গলার জোর, কবি দিগ্বিদিকে গতিময়, ভাবুক, জগৎ
    ধ্বনি মিল দেন, প্রগতি । আয়োজনের মেলবন্ধন উসকে দেন,
    অ্যাক্টিভিস্ট ।

    কবি একজন বিশেষজ্ঞ । কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত
    বৈশিষ্ট্য ।

    শ্রেষ্ঠত্ব, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবি, বিবেচন-প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা
    একজনকে তুলে ধরা, হিরো, গুরু সরিয়ে দেয়া, কবির বদলে সংকলনের
    কবির গুণগান, একসময়ে একজন গুরুত্ব, কবিতার প্রধান পাঠকৃতি বিচার্য,
    বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ডনেম তৈরি, বিশেষজ্ঞ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা, শ্রেষ্ঠত্ববোধক
    সেন্সেলাইজেশান, আইকন । ফাঁস করে দেয়া, সার্বিক চিন্তা-চেতনা,
    জেনেরালাইজেশান ।

    কথা খেলাপ, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, শব্দার্থকে কথা চালিয়ে যাওয়া, কথার শেষ নেই,
    সীমাবদ্ধ রাখা, কবিতার জন্য কবির শ্বব্দার্থের ঝুঁকি, কবিতাকে আত্মমনস্কতা
    আত্মধ্বংস, কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন । থেকে মুক্তি ।

    বাদ দেবার প্রবণতা, এলিমিনেশন, জোটবাঁধা, যোগসূত্র খোঁজা, শব্দজোট,
    ঝকঝকে, ছাড়া-ছাড়া স্পষ্ট শব্দ । অর্থ-জোট, বাক্যজোট, উগ্র মতকেও
    পরিসর দেয়া ।

    একটিমাত্র মতাদর্শ, ইজম, তন্ত্র বহুমতাদর্শের পরিসর, ভেঙে-ভেঙে
    অনুযায়ী চলবে, হাইকমাণ্ড, টুকরো ইজমের সমাজ অনুযায়ী
    পলিটব্যুরো-নির্দেশিত । প্রতিনিয়ত রদবদল, ক্রমাগত
    পরিবর্তন, ভঙ্গুরতা, জীবন থেকে
    উঠে-আসা ধারণা ।

    নিটোল কবিতা, শক্তিমত্তার পরিচয়, এলোমেলো কবিতা, বহুরঙা, শক্তি
    গুরুগম্ভীর, কবিতার নির্দিষ্ট মডেল জাহির করা মুশকিল, হালকা মেজাজ,
    যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি, নির্দিষ্টতার বাইরে, অপরিমেয় নাগাল ।
    অনুভবের গভীরতার খোঁজ ।

    কবিকে প্রকৃতির বাইরে সাংস্কৃতিক জীব সব মানুষই প্রকৃতির অংশ,
    মনে করা, নিসর্গবন্দনা । ইকোফ্রেণ্ডলি কবি ।

    প্রতীকের প্রাধান্য, প্রতীকের প্রতীক এড়িয়ে যাওয়া, ভেঙে দেয়া,
    চমৎকারিত্ব, প্রতীকের আহামরি, যা বলার সরাসরি বলা ।
    ঘুরিয়ে বলা ।

    স্হিতাবস্হার কদর, পরিবর্তন শ্লথ। পরিবর্তনের তল্লাশি, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ
    স্বীকৃত ।

    নাক-উঁচু সংস্কৃতি, প্রান্তিককে অশোভন সাংস্কৃতিক বিভাজন বিলোপ, অভেদের
    মনে করা, শ্লীল ও অশ্লীল ভেদাভেদ, সন্ধান, একলেকটিক, বাস্তব-অতিবাস্তব-
    ব্যবধান তৈরি করা, ভেদের শনাক্তকরণ । অধিবাস্তবের ব্যবধান বিলোপ ।

    ‘বড়ো কবি’ বলে দেবে কাকে কবিতা যেমন ইচ্ছে হয়ে ওঠা কবিতা, বহুপ্রকার
    বলে, ভালো কবিতা ও খারাপ কবিতা, প্রবণতা গ্রাহ্য, কবি বেপরোয়া ।
    বাইনারি বৈপরীত্য, উতরে যাওয়া
    কবিতা, কবিতা হবে সমরূপী ।

    খণ্ডবাদী, রিডাকশানিজম, কমপ্লেকসিটি, জটিলতা, অনবচ্ছিন্নতার
    অবিচ্ছিন্নবোধ । দিকে ।

    কেন্দ্রিকতায় উদ্ভূত, গ্র্যাণ্ডন্যারেটিভ । প্রান্তিকতায় উদ্ভূত, মাইক্রোন্যারেটিভ।

    পরমসত্য, অকাট্যসত্য, ধ্রুবসত্য । সাময়িক প্রত্যয়, তত্বের বহুবিধ
    অনুশীলন ।

    কবিতা বিষয়কেন্দ্রিক, কবিতা কবিতা ফ্লাক্স থেকে জাত, কেন্দ্রিয়
    দর্শন নির্ভর । বিষয়ের অনুপস্হিতি ।

    কবিতার শিরোনামের গুরুত্ব, কবিতার শিরোনাম গুরুত্বহীন,
    শিরোনামের সঙ্গে কবিতার দার্শনিক না থাকলেও চলে, প্রান্তিক শব্দ, পথচলতি
    বা ভাবগত সম্পর্ক, হিরো, গুরু, অভিব্যক্তি ।
    প্রতিভা, মাস্টারপিস, ক্ষমতার মসনদ
    তৈরি, শব্দে মহিমাযোগ, মৌলিকতার
    হামবড়াই ।

    একটিমাত্র বার্তার বাহক । একসঙ্গে বহুকন্ঠস্বর ও বহুবার্তা,
    এমনকী বার্তাবর্জন ।

    কবিতার লক্ষ্য অব্যর্থ, কবির কবিতার লক্ষ্য বহুত্ববাদী ।
    ব্যক্তিসত্তার বিবেচন ।

    আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা । আধিপত্যের বিরোধিতা ।

    ‘আমি’ যা বলব সেটাই কবিতা, ‘তুমি’ যা বলবে সেটাও কবিতা,
    এককেন্দ্রিকতা, বৃক্ষশাখার মতন বহুকেন্দ্রিক বা কেন্দ্রহীন পাঠবস্তুর
    ইন্টারলিংকড । অজস্র উপাদান, সংজ্ঞার সীমা
    ছাপিয়ে যায়, ঘাসের মতন ইন্টারলকড,
    রাইজোম্যাটিক ।

    ওপরের তালিকাটা থেকে স্পষ্ট হয় যে দাদার গল্প লেখার দ্বিতীয় পর্বে অধুনান্তিক জাদুবাস্তবতা এসেছে তাঁর বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি ও পাঠ থেকে সংগ্রহ করা চিন্তাভাবনার হাত ধরে । বন্ধুদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে দাদা লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রায় দেড় দশক । প্রথম পর্বের গল্পগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলোর ভাষায় ও কাঠামোয় পার্থক্য আছে । একইভাবে তাঁর প্রথম পর্বের কবিতা ( ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি, জানোয়ার, আমার ভিয়েৎনাম ) থেকে তাঁর দ্বিতীয় পর্বের কবিতা ( মাংসের কস্তুরীকল্প, পোস্টমডার্ন কবিতাগুচ্ছ, বিদুরের খড়ম, নির্বাচিত কবিতা, আপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয় ) সম্পূর্ণ পালটে গিয়েছে । ছোটোগল্পের যে সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে এসেছিল, অর্থাৎ একটি হুইপক্র্যাক এনডিং থাকতে হবে এবং ব্যক্তিএককের কাহিনি হবে, তা দাদার গল্প লেখার প্রথম পর্বেও ছিল না।
    রবীন্দ্র গুহ তাঁর ‘সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের ভূবন : গাণিতিক বহুকৌণিকতা ও উপভোগের প্রতিক্রিয়া’ প্রবন্ধে ( কবিতা ক্যাম্পাস, নং ৭১, জানুয়ারি-জুন ২০১১ ) বলেছেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ছোটো গল্পের প্রধান ধারক ভাষা ও আঙ্গিক । পৃথিবী জুড়ে যা কিছু লেখালিখি হচ্ছে তার মূল শক্তি বিষয় নয়, দায়বদ্ধতা নয়, আসল হচ্ছে কাঠামোটি । শাখা-প্রশাখা বিনোদনের উপকরণ সমৃদ্ধ হলেই গল্পটি উপভোগ্য হবে এমন নয় । ভাষার গুণে এবং সুঠাম কাঠামোর জন্য অনেক তুচ্ছ বিষয়ও ভাবনার স্তরে বিস্তর অতিরিক্ত ভাবনা ফুটিয়ে তোলে । যেমন আছে ‘মেথিশাকের গন্ধ’তে, ‘শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’-এ এবং ‘আলজাজিরা’তে । ‘মেথিশাকের গন্ধ’তে ডিটেইলিং নেই, আছে অতি সহজবোধ্য সংকেতময়তা । অন্ধকার তুলকালাম আড্ডা জমায় । ছায়ার পিছনে বিনম্র ছায়া । আড়ালে গোছানো কথাবার্তা । নির্জনতার মোড়ক উন্মোচিত হয় এইভাবে :-

    ‘অন্ধকারে জুজুবুড়ি, রাক্ষস, খোক্কোস, শাঁকচুন্নি, একানড়েরা থাকে -- মা’র কথা না শুনলে খপ করে খেয়ে নেয়-- তারপর মা যখন মামার বাড়ি পাণিহাটিতে নিয়ে যেতেন-- রাঙাদিদু কাছে টেনে সবাইকে রাক্ষস খোক্কোস জয় করার রূপকথা শোনাতেন --- আমরা নিজেরাই কেউ রাজপুত্র সেজে জয়ের খেলা খেলতাম-- খেলতে খেলতে ভয় কেটে গেল --- রাঙাদিদু স্বামীর ঘর করার আগেই বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে বিধবা হয়ে গিয়েছিলেন -- ছোটোছোটো কদমছাঁট চুল -- ফর্সা রঙ -- রোগা হাত-পা --- পরনে থানকাপড় -- সবাই বলত নেড়ি পাগলি--- আমাদের রাগ দুঃখ বাড়ত --- সেই রাঙাদিদু হঠাৎ মারা গেলেন --- পরের বার পাণিহাটিতে গিয়ে আর দেখা হল না --- মা বললেন --- অন্ধকারের দেশে চলে গেছেন --- সেই প্রথম অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়জনের বাস তৈরি হল --- তারপর এক-এক করে মা বাবা ছোড়দি মেজোজেঠা নকাকা বন্ধুবান্ধব কতো প্রিয়জন সেই অন্ধকারে চলে গেল----’ ( মেথিশাকের গন্ধ )

    ‘মেথিশাকের গল্প’তে অন্ধকারই প্রধান চরিত্র । অলোক গোস্বামী ‘খুল যা সিম সিম’ প্রবন্ধে ( বোধ, মার্চ ২০০৯ ) বলেছেন, “গল্পটিতে সমীর এই অন্ধকারকে, তার বহুমাত্রিকতা এবং ব্যক্তিত্ব সমেত তুলে ধরেছেন । পড়তে পড়তে বুঝি অন্ধকারকে ভয় পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ জড়িয়ে আছে অস্তিত্ব-চেতনার সঙ্গে । যে অভিজ্ঞানগুলো মারফৎ কোনো ব্যক্তি নিজেকে সনাক্ত করে অন্ধকার নিমিষে সেসব অভিজ্ঞান হাপিস করে দিতে পারে । মুছে দিতে পারে পরিচিত ভূগোল । কেড়ে নিতে পারে সভাসামগ্রী । অর্থহীন করে দিতে পারে কোড অফ কম্যুনিকেশন, তছনছ করে দিতে পারে পারস্পরিক সম্পর্কক্ষেত্র ।
    “অন্ধকারের স্বরূপসন্ধান যেহেতু সভ্যতার কাম্য নয়, তাই শেফালির মারফত সমাজ বহুবচনে বিধিসম্মত সতর্কবার্তা পাঠায়, ‘যে যেখানে আছ সেখানেই থাকো -- মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে আসছি…’।
    “কিন্তু অন্ধকারই তো পারে মনকে প্রশ্রয় দিতে, কল্পনাকে বিস্তৃত করতে । সেজন্যই সৃষ্টির আধার অন্ধকার । ভুলি কেমনে বাল্মীকির আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম তমসা, যা সমীরের ভাষ্যে, ‘কবিতার জন্ম হয়েছিল এই নদীতীরে, আরও সহজ করে বলা যায়, মানুষ নামের প্রাণীর কবিত্বের জন্ম কবিতার জন্ম এই তমসাতীরে । যে কবিত্ব এই প্রজাতির চালিকাশক্তি ।
    “হতেই পারে অন্ধকার মৃত্যুর নিজস্ব এলাকা । তার জন্য সেই স্হান ভয়ঙ্কর হবে কেন ? মৃতের তালিকায় প্রিয়জনও তো থাকেন ।

    ‘এখন আমার নিজেরই অন্ধকারের দেশে চলে যেতে তত দ্বিধা নেই...সেখানে বাঁধন আছে...শক্তি আছে...রাঙাদিদু মা বাবা ছোড়দি সবাই তো সেখানেই...অন্ধকার এখন প্রিয়জনের সংসার…’

    “আলোকে অন্ধকারের সাপেক্ষে রেখে সমীর বলেন,

    ‘শীতের সকালের দিকে যেমন ব্রেকফাস্টের সময় ডাইনিং টেবিলের ডানকোনে একচিলতে চেনাজানা এ-বাড়ির নিজস্ব রোদ আসে । একটু মনোযোগ দিলেই দেখা যাচ্ছে এই অন্ধকারও সমান চেনাজানা । চলতে ফিরতে, সঙ্গ নিতে কোনো অসুবিধে নেই । এই অন্ধকার নিজস্ব বিষয়-সম্পদের বাইরে নয় ।”

    আরেকটি গল্পে অন্ধকারকে কেন্দ্রচরিত্র দিয়েছেন দাদা, ‘কালো রঙের কাজ : আঁধারের অবিনির্মাণ’। অন্ধকার সম্পর্কে দাদার গল্প দুটি আলোচনা কালে বিজ্ঞানের অধ্যাপক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সমীর রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : কয়েকটি বিজ্ঞানময় অবলোকন’ প্রবন্ধে ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) বলেছেন, “বিজ্ঞানে, অন্ধকার স্হানিক বা অস্হানিক দুইই হতে পারে ( আলো কেবল স্হানিক ) যে অন্ধকারের বিন্দুগুলি পরস্পরের সংযুক্ত নয়, সেই অন্ধকার স্হানিক । অস্হানিকে অন্ধকারের এক বিন্দু নড়ে-চড়ে উঠলে, অন্য এক বিন্দুতেও টান ধরে । কথক ও তাঁর স্ত্রী শেফালির মধ্যে সেই অস্হানিক অন্ধকার সেখানে যোগাযোগসূত্রটি হল রান্নাঘরে নির্মীয়মান মেথিশাকের গন্ধ।”
    নীলাঞ্জন লিখেছেন, ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পে লেখক শুরুতেই অন্ধকারের পরিসরে নিজের জড়ো করা সত্ত্বার ( Acccumulating self ) বর্ণনা দিয়েছেন :-

    ‘অনেকদিন পর আবার হঠাৎ লোডশেডিং । যাকিছু আমার বলার মতো বিষয় সম্পদ জড়ো করেছি, সব আড়াল হয়ে গেল। টেবিল চেয়ার বেডরুম টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন শেফালি ঘরদোর বুকসেল্ফ সিলিংফ্যান কবিতার খাতা পাশবই, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এ-বাড়ির যাকিছু দৃষ্টোগোচর, এই মুহূর্তে নিজের নিজের অবস্হান থেকে সেই উপস্হিতি এই অন্ধকারে নিভে গেছে । যে অবস্হানগুলো নিজেদের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে এই মহাবিশ্বে আমার জলজ্যান্ত থেকে যাওয়া।

    নীলাঞ্জন তারপর লিখেছেন, এর পরেই দেখি অন্ধকারের সঙ্গে আত্মীয়তা গঠনের চেষ্টা । অবশ্য তা হতেই পারে । ‘আমি আছি; এই বোধ যদি আলো হয়, তবে ‘আমি নেই’ এই বোধ অন্ধকার । দুই বোধই পাশাপাশি থাকে । কবির কাছে অন্ধকার এক গাঢ় তন্ময়তা ডেকে আনে । হয়তো বা তখনই উদ্ভাসিত হয় তৃতীয় নেত্র। দুই চর্মচক্ষুর কাজ ফুরোলেই, তৃতীয় নেত্র নড়েচড়ে ওঠে । লেখক মনে করিয়ে দিচ্ছেন তমসা নদীর কথা । তমসা সামান্য পাল্টালে তামস, যার মানে অন্ধকার । আবার তামস উল্টে দিলেই ‘সমতা’ । অন্ধকারে সবাই সমান । সেই মনের ওপর ভর করেই লেখক এগোন । চেয়ার ছেড়ে উঠে, হাতের স্পর্শে অন্ধকারকে চিনে চিনে, অন্ধকারের ভিতর কতো অলিগলি, লেন বাইলেন টেবিলের দুইপাশ দিয়ে বেরিয়েছে । অন্ধকারে ভিতর ফাটলের সন্ধান পাচ্ছেন লেখক । আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরকার অন্ধকার । দুই স্নায়ুকোষের মধ্যবর্তী ফাটল, সেও এক অন্ধকার, বিজ্ঞানীরা যাকে বলেছেন Synaptic Cleft.
    অভিজ্ঞতা ছেনে দাদা পেয়েছেন স্বপ্ন-কল্পনা-বাস্তবের অন্তরালে কুহকী বাস্তবতার ইন্দ্রজাল, যেখানে ব্যক্তিক সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তব তার সত্যগুলোকে চিনে নিতে পারে, কয়েকটি গল্প সেই সময়ে লেখা যখন পশ্চিমবঙ্গে চলছে রক্তচোষার দিগ্বিজয়, যার দরুণ রাজনৈতিক সামাজিক সমালোচনা মুড়ে ফেলতে হয়েছে জাদুবাস্তবে, দ্বৈততার সংমিশ্রিত আদরায়। বাস্তব সমাজকেই দাদা গুরুত্ব দিয়েছেন, আর দ্বিতীয় পর্বে লেখা তাঁর গল্পগুলোয় বাস্তবের ভাঁজে খুলে দিয়েছেন প্যাণ্ডোরার বাক্স । প্রচলিত কৃৎকৌশল বাদ দিয়ে দাদা তাঁর গল্পগুলোয় এমন এক আবহ সৃষ্টি করেন যা আপাত-অস্বাভাবিক, পার্থিব ও অপার্থিব এবং সময় ও পরিসরকে মিশিয়ে গড়ে তোলেন এক তৃতীয় স্হিতি, দুঃখ-কষ্ট-ভয়ের পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন আনন্দময় পরিবেশের আকস্মিকতা । ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ গল্পে আরবি ভাষায় ছিল ‘ইফতাহ ইয়া সিমসিম’, দাদা তাই গল্পগ্রন্হের নাম রাখলেন ‘খুল যা সিমসিম’, ‘চিচিং ফাঁক’ নয়, কেননা ‘চিচিং ফাঁক’ শব্দবন্ধটির মধ্যে বিশাল পাথরের দরোজা খোলার ধ্বনিসাম্য নেই, গুহা সামান্য ফাঁক করে আলিবাবা আর চল্লিশটা চোর তাতে ঢুকতো না । নৃসিংহমুরারি দে তাঁর প্রবন্ধ ‘মূল সূত্রটাই যে অণোরণীয়ান’ ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) প্রশ্ন তুলেছিলেন হিন্দি নামকরণ কেন । বস্তুত সিমসিম শব্দটি হিন্দি নয়, আরবি। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ বাংলায় গল্পটি লেখার সময়ে ইংরেজি ‘ওপন সিসেম’কে ‘চিচিং ফাঁক’ করে দিয়েছিলেন ।
    দাদার লেখায় জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ সম্পর্কে সর্বপ্রথম লিখেছিলেন রবীন্দ্র গুহ ( কবিতা ক্যাম্পাস, নং ৭১, জানুয়ারি জুন ২০১১ ) তাঁর প্রবন্ধ “সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের ভূবন : গাণিতিক বহুকৌণিকতা ও উপভোগের প্রতিক্রিয়া” প্রবন্ধে । রবীন্দ্র গুহর প্রবন্ধটি থেকে প্রাসঙ্গিক আংশটি তুলে দিই আপনাদের কাছে:-
    “সহজ কথাটা সরাসরি বলাই ভালো, সৎ-সাহিত্যের দরোজাটা বাংলা সাহিত্যে খুলে দিয়েছে সমীর রায়চৌধুরীর পয়লা নম্বর গল্পবিশ্ব ‘খুল যা সিমসিম’। যাকে নিঃসঙ্কোচে বলা যায় রুবিক পৃথিবীর একটা মাল্টিক্রোম হাতছানি, অথবা আলো এখন বক্ররেখায় যায় । সমীরের ডায়াসপোরিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পাই সোজাসাপটা সরলতা, অনুভূতির অসনাক্ত বিন্দুসকল ও কালের পরিবর্তনশীলতা । আরও পাই অজস্র কিংবদন্তি, রূপনির্মিতি, ক্ষেত্রজ জাদুবাস্তবতা ।
    “আমরা যারা গদ্যের হিয়ায়, বাকশস্যে অফুরন্ত ইঙ্গিতময়তা প্রত্যাশা করি, শব্দের সম্পর্কায়ন ও দেহপুষ্টিতে যুগপৎ গুরুত্ব দিই, তাদের কাছে সমীর রায়চৌধুরী নামটির একটি একসেপশানাল গ্রামার আছে । সে শুধু সীমা ডিঙোয় না, ক্রিয়েটিভ প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত মোচড়ায় না, তার আনতাবড়ি অন্ধকারেরও একটা শৈলীগত অর্থ আছে । যা আপাত-অচ্ছুত মনে হলেও আদৌ অচ্ছুত নয় । সে এক আশ্চর্য জাদুসৌন্দর্যের ইশারা, যেখানে অন্ধকার ততোটা অন্ধকার নয়, শূন্যতা ততো গভীর শূন্য নয় । সমীরের কাছে অন্ধকারও একটা সম্পদ, শূন্যতাও মধুময়, শব্দ ও ধ্বনিময় । ‘বহুজাতিক ভুতের গল্পের খসড়া’ একটি খসড়ামাত্র নয়, বিশ্বায়নের হাজার বাস্তব মজার মধ্যে একটি অতিবাস্তব মজা । সমীরের লেখায় এই ঐতিহাসিক ধরতাইটা সত্য, অ্যাবসলিউট সত্য । জীবনে কতো দ্বন্দ্ব সংঘাত দুর্যোগ, কতো জ্যোৎস্না মেঘ কুয়াশা । অন্ধকারের ফাটল দিয়ে সব দেখতে পায় সমীর ---উত্তরঔপনিবেশিক অন্ধকারের অংশীদার সমীর বনাম কার্তিক । কার্তিককে ভুতের গল্প লিখতে হবে । এর আগে ছোটোদের ভুতের গল্প লিখেছে অনেকগুলো । সে লক্ষ্য করেছে পাঠক আগের থেকে অনেক বেশি ভুতপ্রুফ, সহজে ভয় পায় না । তাই সে এনেছিল উপাদান-বিভোর রেডিমিক্স । কিন্তু তাতে যে শর্টহ্যাণ্ডের সংক্ষিপ্ত ছোঁয়া, সেখান থেকে ভুতের গল্প বানানো বেশ দুষ্কর, সেসব বাকমালা পড়তে পড়তে প্রায়শই অন্যকিছু দেখতে পায় । যেমন সে দেখতে পেল :-

    ‘অনির্বাণের কথাই হয়তো ঠিক । লাইফ সেভিং ড্রাগ এদেশে ওই গন্ধমাদন । আস্ত পর্বত । পর্বে পর্বে গল্পের ভাঁজ । বহুজাতিকে হনুমানের ঝামেলা নেই, সবাই সমান হন্যমান । যেখানে ভাঙা কার্নিশ কথা বলে কবির সঙ্গে । চৈত্রের দুপুরে কুয়োর গভীরে শুয়ে থাকে নির্জনতা ।’

    বোধোদয়ের দোকান থেকে কার্তিক সেল্ফমেডের প্যাকেট নিয়ে আসে । এটা আশ্চর্য একটা প্যাকেট, প্যাকেটের মধ্যেই প্যাকেট, তার মধ্যে প্যাকেট, তার মধ্যে, তার মধ্যে । আরও ছোটো । আরও । কেবলই অনুমেয়র দিকে আরও ভুতভাবনের বহুব্রী ।

    ‘বড়ো প্যাকেট খুলতে না খুলতেই বেড়ে যাচ্ছে হতে-হবের ঝোঁক । আশশ্যাওড়ার মৌলিক গন্ধ । ছায়ারা খেলছে আনি বানি জানি না । সব কিছুই চাইছে হতে পারলে হয় । গড়ে উঠছে কুহককুহেলি । খসে পড়ছে নোনা ইঁট । এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত অবধি পোড়াবাড়ির ইতিহাসের আত্মবিলয়ের আতর । ভেসে উঠছে ভৌগলিক।’

    ‘রেডিমিক্সের প্যাকেট খুলতেই ছড়িয়ে পড়ছে আবছা, ক্রমশ আঁধারের তিথিমাপ বাড়ছে । কার্তিক খুঁজে দেখে মলিন না আবডাল । নক্ষত্র নিভিয়ে আসছে জোনাকি, দমকা হাওয়ায় ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুঃখু । জেগে উঠছে পোড়ো বাড়ির একদা । অনুসন্ধানী প্যাঁচা সন্ত্রস্ত চামচিকে আর ইঁদুরের বাসাবদলের চিরনির্মাণ ভেসে উঠছে ইহভৌতিক ছাপিয়ে । সন্দিগ্ধ খোঁড়া হয়ে হাঁটছে ।’
    ‘সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে আমতা-আমতা দোটানা । সিলিঙে ঠেকছে হতভম্ব, মাটিতে গড়াচ্ছে খটকা, বুজকুড়ি কাটছে তাজ্জব, অস্হির হয়ে উঠছে খামোকা, উঁকি মারছে তালগোল । জানলার কাছে ঝুলতে শুরু করেছে কাঁচুমাচু’

    গল্পটি শেষ হয়েছে একটি অবিশ্বাস্য জাদুবাস্তব-অধুনান্তিক আবহে--

    ‘চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে হাড়গিলে নিশুতির হামা । বাড়ছে ভুতুড়ে পুঁজির রমরমা । পরস্পরের জায়গা বদল করছে খুঁটিনাটি আর খুঁতখুঁত । কার্তিক ভেবে দেখছে এবার কি সে ভীতির মধ্যে যাবে না ভয়ের অন্তরায় হয়ে উঠবে । প্যাকেট থেকে বেরোনো ক্রমউপদ্রবী আবছায়ায় সে একা । এই মুহূর্তে ছায়া-প্রচ্ছায়া দিশেহারা । জানলায় ঝুলছে কাঁচুমাচু । হতভম্ব ঠেকছে সিলিঙে । ছড়িয়ে পড়ছে অনুপস্হিতির অনুপ্রবেশ । এলোমেলো হয়ে পড়ছে চিন্তাজনিত । মাটিতে গড়াচ্ছে খটকা । বুজকুড়ি কাটছে তাজ্জব ।’

    “স্বাধীনতার পরও ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হাতে অবাধ মৃগয়া ক্ষেত । তাবড় তাবড় ভারতীয় বণিকরা ভিন্নদেশীয় বন্ধুদের মদতে চমকদার সাবান, তেল, কেশকালা, দাঁতের মাজন তৈরি করছে । এইসব সামগ্রীর গুণ বিচারের জন্য কোনও কোনও বাণিজ্য সংস্হা দশ মিলিয়ন টাকা খরচ করছে বিজ্ঞাপন বাবদ । এদের সমবেত আক্রমণের ফলে আমজনতা পিতৃনাম ভুলতে বসেছে । ক্রেতারা বিগবাজারে বলিপ্রদত্ত । আজও কেউ বুঝলেন না ভোগবাদ একটি রোগ ।
    “সে কলকাতাই হোক বা মুম্বাই বা শহর দিল্লি, মোড়ে মোড়ে বিশাল হোর্ডিং । বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন । কোলগেট, পণ্ডস, পেপসোডেন্ট -বিড়লা-টাটা-রিলায়েন্স-বাজাজ-হিন্দুজা-মহিন্দ্রা । কাগজে টিভিতে কতোরকম নখরা । গাজোয়ারি নয়, সব বুদ্ধির খেলা । এই বিজ্ঞাপনের খরচ তুলতে, কতো রকমের প্যাঁচ -- কতোরকম ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’ ---’ওঁ হ্রী হ্রী শ্রী ওঁ লক্ষ্মীবাসুদেবায় নমঃ।” ক্রেতাকে বিব্রত না করে বাজার দখল করতে হবে । সে গল্প শোনায় পিনাকী । গল্পের নায়ক সুব্রত । কোম্পানির মাল্টিন্যাশানাল, কোম্পানিতে অনেক কবি-লেখক-ডকু ফিল্মমেকার একাধিক । সবাইকে টপকে অ্যাসাইনমেন্টটা পায় সুব্রত । অফিস থেকে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে পুরীতে এসে হোটেলে ওঠে । সে খায় দায় আর লক্ষ্য করে কে কেমনভাবে টুথপেস্ট ব্যবহার করে । মুখশ্রীতে কেমন মহিমা খেলা করে । ব্রাশের ডিজাইন দ্যাখে, টিউবের প্যাকিং । ফেনা, গল্প, স্বাদ, মেজাজ । ব্রাশের আকার ছন্দ দ্যাখে । গাদা ব্রাশ-টুথপেস্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করে । এভাবেই সে পেয়ে যায় সূত্র । কেল্লা ফতে ---

    ‘স্রেফ টুথপেস্টের টিউবের মুখটা এক মিলিমিটার বাড়িয়ে দিতে হবে । গোপন থাকবে এই কৌশল । দাম মাত্র দুটাকা কমিয়ে একটা ঝুটো মিতব্যয়িতার গিমিক ধরে রাখা হবে বাজারে । অধবা গোড়ার দিকে সঙ্গে একটা গিফট বা কুড়ি পার্সেন্ট এক্সট্রা পেস্টের ভড়ং । মনোযোগের কেন্দ্র সরিয়ে দিতে । তাহলেই ফর্টি পার্সেন্ট অতিরিক্ত টুথপেস্ট ড্রেনআউট হয়ে যাবে । কেননা টিউবের মুখের ডায়ামিটার আগের চেয়ে বেড়ে গেছে । স্রেফ এক মিলিমিটার ।’ ( শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বচন )

    “কালখণ্ডের চমৎকার কৌতুক হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের বাজারায়ন তথা বিশ্বপুঁজিবাদ । একথা বোধহয় বাংলা সাহিত্যে আধিপত্যবাদীরা বুঝে ওঠার আগেই বুঝে ফেলেছিলেন কতিপয় গোত্রচিহ্ণহারা দ্রোহপুরুষ, যাদের মধ্যে অন্যতম সমীর রায়চৌধুরী । শৈলী বা প্রকরণ মেনে সমীর কখনও গল্প লেখেননি । তাঁর পাঠকাঠামোয় কারো প্রভাব নেই । একেবারেই ভিন্ন এবং তাৎপর্যপূর্ণ । স্তন্যপায়িনীর পৃথিবীতে চলতে চলতে আবার সেই জাদুবাস্তবতা --- আছে আর নেই ।
    “ভূখণ্ডের ক্ষয়, নিসর্গের ক্ষয়, এর মধ্যে জাদুবাস্তবতা খুব বাড়তি মনে হলেও ময়লা নয় । বিষয়টি আমাদের সাহিত্যে নতুন মনে হলেও বিশ্বসাহিত্যে নতুন নয় --
    The term magic realism, originally applied in 1920 to a school of painters, is used to describe the prose fiction of Jorge Luis Borges in Argentina, as well as the work of writers such as Gabriel Garcia Marquez in Colombia, Isabel Allende in Chile, Gunter Grass in Germany, and Joh Fowels in England. These writers interweave, in ever shifting pattern, a sharply etched realism in representing ordinary events and descriptive details together with fantastic and dreamlike elements, as well as with materials derived from myth and fairy tales ( A Glossary of Literary Terms, M.H.Abrams)
    “আমাদের জীবনে বাস্তবতা একাধিক । যেমন নিত্যবাস্তবতা, অদ্ভুত বাস্তবতা, রূঢ় বাস্তবতা, দিব্য বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা । দুঃখ এবং সৌন্দর্যে ভরা এইরকম লাগামছাড়া বাস্তবতার জীব আমরা নাটকের কুশীলব, চিকিৎসক, সমাজসেবিকা, মিথ্যাবাদী, কবি, ভিখিরি, যোদ্ধা । সবার জীবনযাপনে পদ্ধতির পার্থক্য আছে । এই পার্থক্যের ব্যাপারে যিনি যতোটা সচেতন তিনি ততোটাই সার্থক বস্তুবাদী । সমীরের চোখ সরাসরি নিত্যসুন্দরের দিকে থাকলেও, মার্কেস এবং গুন্টার গ্রাসের মতো জাদু-ভেল্কি-মন্ত্র-তন্ত্র বাদ যায়নি । বিশ্বায়নের মজা বাদ যায়নি । যেভাবে কল্লোল যুগের লেখকরা নতুন ঘরানার সাহিত্য গড়ে তুলেছিলেন, নির্মাণ করেছিলেন নতুন ভাষার, তেমনি সমীর আনলেন কল্লোল পরবর্তী অধুনান্তিক টাইমস স্টাইল, প্রকৌশল । গদ্যভাবনার গুণমাহাত্ম্য ভিন্নমাত্রা পেল । বিজ্ঞজনেরা ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে তার পাঠবস্তুর মাপজোক করল, পরিসর পরিস্হিতি এবং মুক্ত সূচনা, মুক্ত সমাপ্তির লক্ষণ খুঁজল, বিবাদ সৃষ্টি করতে পারল না ।
    “সময়ের ক্ষয়, আতঙ্ক, সন্ত্রাস, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বাতাবরণ মানেই উত্তরআধুনিক, একথা সমর্থন করেন না সমীর । তার চেনা-অচেনা শব্দসকল, সাবঅলটার্ন কথাবিশ্ব অধুনান্তিক বিশ্বায়নের সারবস্তু । সমীরের পাঠবস্তু ন্যারেটিভ নয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফর্মবর্জিত । তার রচনায় অদ্ভুত ভাষাবুলি ঝুড়িঝুড়ি, যেমন---

    দিলফাড়, ঠাওর-ঠিকানা, মিল্লত, উড়ানমনস্ক, বুজরুকি, আলিশান, কাঁটোকা হার, দিল-জ্বালানি, হিট-রহস্য, দীর্ঘ জুম ফোকাস, ফিলিম, তুক মেলানো, বেপর্দা, কাঁইয়া, স্তনের ডৌল, জৈবতাপ, মনমর্জি, লালফুটকি, চিৎপুতুল, ঢালাউপুর ( ‘খুল যা সিম সিম’ গল্পগ্রন্হ থেকে )

    ‘গোলগল্প থেকে গালগল্প : একটি অর্বাচীন ডায়ালগ’ প্রবন্ধে ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’ বিশ্লেষণকালে শাশ্বত সিকদার বলেছেন :-
    “সমীরের লেখায় আমরা স্পষ্টত যা পাচ্ছি তা হল স্মৃতি আর কল্পনার দোলাচল । কোথাও বোঝার সঙ্জ উপায় নেই, কোনটা রিয়েল লাইফ ফিকশনের অংশ, কোনটা বাজিয়ে তোলা । সদ্য নোবেলপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক কোয়েটজির ‘এলিজাবেথ কোস্টেল্লো’ উপন্যাসেও আশ্চর্যভাবে বাস্তব ও মনগড়া চরিত্ররা মিলেমিশে থাকে । এর পরে, সমীর পাঠবস্তুর বাইরে থেকে সবজান্তা চালে বানোয়াট গল্প ফাঁদছেন না । পা ফেলছেন না নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে । তিনি নিজে অংশগ্রহণ করছেন রচনার অন্তবর্তী ব্যবসাবিষয়ক প্রতিবেদনে । অনেকের স্বরের সাথে চালাচ্ছেন ইনটারাপ্টেড ডিসকোর্স । নিজের বৈচিত্র্যময় ডায়াস্পোরিক অভিজ্ঞতার লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলে তিনি বার করে চলেছেন একটার পর একটা রসদ ।
    “আমাদের মনে হয়েছে, সমীরের সব গল্পই আসলে, একভাবে, তাঁর অলিখিত আত্মজীবনীর টুকরো অংশ । পাণিহাটীর শৈশব আর কর্মসূত্রে বিহার-ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের দ্বৈত ডায়াস্পোরিক অভিঘাত সমীরের জীবনকে অনবদ্য সব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছে । সমীরের ভূগোল হয়েছে আশয়, তাই তাঁর ইতিহাসও হয়েছে সীমাহীন । আর তাই তাঁর গল্পে হাঁটাহাঁটি পা ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন পরিসরের ভূগোল, ইতিহাস, প্রান্তিক মানুষজনের ঘামের টাটকা গন্ধ । অবলোকন প্রতিভার জাদুতে বর্ণিত এইসব ঘটনাগুলোর চারপাশের অদ্যাবধি আলো-না-ফেলা অঞ্চলগুলো এসেছে প্রকাশ্যে । সমীর তাকে হিরের মতন শব্দের আলো ফেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা তরতরিকায় দেখেছেন ।”
    দাদার গল্পের পাশাপাশি যে বিদেশি লেখকদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁরা হলেন টমাস বার্নহার্ড, পিটার হাণ্ডকে, জন ফাউলস, অ্যাঞ্জেলা কার্টার, জন বানভিল, মিশেল টোরনিয়ার, গিয়ানা ব্রাশচি, ইউলেম ব্রাকমান, লুইস ফেরন প্রমুখ --- যাঁদের গদ্য একযোগে জাদুবাস্তব ও উত্তরাধুনিক । পরাবাস্তবের প্রভাবের কথা বলব না, কেননা দাদা পাণ্ডুলিপিতে যথেষ্ট কাটাকুটি করতেন এবং স্বগতলিখন লিখতেন না, লেখার আগে কাহিনিটি নিয়ে প্রচুর চিন্তা করতেন, বিভিন্ন রেফারেন্স বই ঘাঁটতেন । “হাওয়া ৪৯”-এর যে বিশেষ সংখ্যাগুলো প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিটির বনেদে একটি গল্প বা কবিতাগুচ্ছ প্রসঙ্গক্রমে এসেছে দাদার চিন্তায়, যেমন জটিলতা, সংকরায়ন, অপর, অধুনান্তিকতা, উত্তরঔপনিবেশিকা, ইকোফেমিনিজম, সীমা, ভারতত্ব, ডায়াসপোরা ইত্যাদি। বস্তুত ম্যাজিক রিয়্যালিজম অভিধা এতো বেশি প্রয়োগ হয়েছে, বিদেশে তো বটেই, এদেশেও, যে এসকেপিস্ট ফিকশানকেও অনেকে জাদুবাস্তবের পর্যায়ে ফেলছেন, ফলে বিনোদনের জন্য বা বাজারকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে অবজেকটিভ মেইনস্ট্রিম ফিকশান লেখা হচ্ছে. তাদেরও জাদুবাস্তব বলে চালানো হচ্ছে ।
    জাদুবাস্তব এসকেপিস্ট ফিকশান নয়, বিনোদনের জন্য নয়, বাজার ধরার জন্য নয় । এই ফিকশান আমাদের জগতকে চিহ্ণিত করে এবং তাতে আমাদের অবস্হানকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় ; সত্যগুলোর বার্তা পাঠায় অথবা তাদের অন্বেষণ করে । জাদুবাস্তব অত্যন্ত সিরিয়াস ফিকশান এবং তাতে গদ্যবিন্যাসের কাজ জরুরি । লেখক চেষ্টা করেন একটি বাক্যের মধ্যেই অতীত-বর্তমান ভবিষ্যতকে উপস্হাপন করতে । প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক বাস্তব থেকে এই বাস্তব পৃথক । জাদুবাস্তব ফিকশান চিন্তার পরীক্ষানিরীক্ষা নয়, দূরকল্পনামূলক নয়, তার বিশ্ববীক্ষা অবজেকটিভ মেইনস্ট্রিমের বাইরে ।
    ‘সিগারেটের তিরোভাব’ গল্পটি নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন (কালিমাটি নং ৯৩), আমি প্রসঙ্গিক অংশগুলো তুলে দিচ্ছি :-
    “এই গল্পে রয়েছে কথক ও তাঁর দৌইত্রী পিংকির মধ্যে স্নেহমধুর ভাবের আদানপ্রদান ও পিংকির দাদানের ( ঠাকুরদা ) মৃত্যু নিয়ে জেগে ওঠা সামাজিক পারলৌকিক সংস্কারবাহিত কিছি চিত্র । এই গল্পে সিগারেট দেহের বিকল্প হিসাবে দেখা দিয়েছে । দাদান অবিনাশবাবু ছিলেন চেন-স্মোকার । তাঁর মৃত্যু যেন সিগারেটের তিরোভাব । তাঁর সহসা মৃত্যুতে বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল, শোকের ছায়া নেমে এল। পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের কাজ এগোতে লাগল। পিংকির মনে নানান প্রশ্ন । দাদুকে তার উত্তর যোগাতে হয় । পরদিন সন্ধ্যাবেলায় পুরোহিত এলেন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ব্যবস্হার জন্য । কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখে বিধান দিলেন ---’ত্রিদোষ ঘটেছে । দানদক্ষিণা বেশি লাগবে । ষোড়শদান । আত্মাদেবতার তুষ্টি । বিশদভাবে অনুষ্ঠান প্রয়োজন।’
    “এক দৃষ্টিতে দেখলে ( আধুনিকতাবাদী ) এসব হল পুরোহিত অং-বং-চং । অবসলিট শাস্ত্রে এসব পাওয়া যায় । পরলোক অস্তিত্বহীন । কিন্তু তৃতীয় তরঙ্গের পোস্টমডার্ন বিজ্ঞান জানাচ্ছে, এগুলো ওরকম হুশ করে কালো কাকের মতো উড়িয়ে দিলে চলবে না, বরং এর ভিতরেও ফেলতে হবে সন্ধানী সার্চলাইট । মৃত্যু নিয়ে ভাবনার শিখা উসকে দিয়েছেন কাহিনিকার সমীর রায়চৌধুরী । লিখছেন:-

    ‘কিছুকাল আগে মরে যাওয়া ভাবলে কষ্ট পেতাম । যত দিন যাচ্ছে মৃত্যু নিয়ে ভাবনা পাল্টাচ্ছে । বাবা মা ন-কাকিমা ছোড়দি কিছু প্রিয় বন্ধুবান্ধব আর এই দাদান মারা যাওয়ার পর, মৃত্যুর এলাকাকে ফাঁকা লাগে না । একা বলে মনে হয় না । মনে হয় মৃত্যুও বসবাসের যোগ্য ।’

    “এককালে মৃত্যুর এলাকাকে ‘অমুত্র’ বলা হতো । আমি শব্দটির মধ্যে রস পাচ্ছি তাই একে ফিরিয়ে আনতে চাইছি :

    ‘পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে... ন এব ‘ইহ, ন ‘অমুত্র’ ( হে পাত্র, বৈদিক কর্মত্যাগ করা সত্বেও যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি ইহলোকেও পতিত হয় না, পরলোকেও নিকৃষ্ট শরীর প্রাপ্ত হয় না ) [ গীতা, ধ্যানযোগ ৬.৪০ ]

    “পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যান বলতেন, পদার্থবিদ্যার সমস্ত সমীকরণকে একটি মহাসমীকরণের মধ্যে পুরে ফেলা যায় । সেই মহাসমীকরণ হল Unworldliness = 0, সংক্ষেপে U = 0 এখন এই Unworldliness এর বাংলা করছি ‘অমুত্র’ । এই সমীকরণের অর্থ পদার্থবিদ্যার সবকিছুই ইহসর্বস্ব ( Worldly) ; ইহলোকের বাইরে কিছুই নেই ; কিন্তু এই দৃষ্টিতে অধিবিদ্যার ( Metaphysics ) সম্ভাবনাকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে । তৃতীয় তরঙ্গের পোস্টমডার্ন বিজ্ঞান কিন্তু তা চাইবে না । সে বলবে -- ‘অমুত্র’ আছে । আছে তার নির্দিষ্ট গঠন । মৃত্যুর পর সেখানে যাওয়া যেতেই পারে । একে বলি প্রেতলোকের অসমীকরণ। গল্পকার সমীর রায়চৌধুরী আন্দাজ করেছেন এই অসমীকরণের অন্ধকারে দৃষ্টি চালিয়ে--

    ‘যারা মারা যায় তারা বোধহয় স্বজনের মৃত্যুর দ্বিধা সংগোপনে চুরি করে নিয়ে যায় । প্রেতলোকে আর খারাপ লাগে না।
    এদিকে পুরুতঠাকুর বলেছেন, বৈতরণী, চতুর্ধাশান্তি, ষোড়সদান, ভোজ্যউৎসর্গ --- শ্রাদ্ধানুকল্প -- মনোময় কোশ --- সে অনেক ব্যাপার ।’

    “মনোময় কোশের পর হল বিজ্ঞানময় কোশ, যেখানে তৃপ্ত আত্মার বাস, যেখানে ‘ইহ’ (This) এবং ‘অমুত্র ( That ) -- দুই পৃথক নয়, দুই জুড়ে সন্ধি হয়ে রচিত হয়েছে ‘ইহমুত্র’ যা স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় শব্দ ছিল । এই ইহমুত্রই গোটা জগৎ । মনোময় কোশে এদের দুই খণ্ডকে আলাদাভাবে দেখা হয় । আলাদাভাবে দেখা হলেও এদের মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় না, কোয়ান্টাম দর্শন এখানে কাজে লাগে । পিণ্ডদান কিংবা ভোজ্য উৎসর্গের পদ যেন এক একটি Wave-packet । সেই পদগুলি, এক্ষেত্রে, গল্পকার জানাচ্ছেন, স্হির হল…

    ‘হিঙের কচুরি, বেগুনি, মোচার ঘণ্ট, কইমাছের ঝালদে, দই ইলিশ, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, এবং চা-সিগারেট’

    “সিগারেট তাহলে পুরুপুরি তিরোহিত হচ্ছে না, চলছে মৃতকের সহানুকল্পে --- অমুত্রের দিকে । তবু শ্রাদ্ধদিবসের দিনে অবিনাশবাবুর প্রিয় ব্র্যাণ্ডের সিগারেট প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেল না, কিনেও আনা হল না, ভোজ্য উৎসর্গের থালায় একটি পদ রিক্ত থেকে গেল
    “এই না পাওয়া নিয়ে সমীর রায়চৌধুরীর গল্পে দ্বিতীয় এপিসোড । স্কুলে পিংকির জামার মধ্যে শুঁয়োপোকার প্রবেশ, শুঁয়ো ফোটানো ও পিংকির জ্বর, শুঁয়োপোকা বন্ধন ও প্রজাপতি মুক্তির প্রাণময় উপস্হিতি। সেই বন্ধন ও মুক্তি ক্রমশ ‘ইহ’ ও ‘অমুত্রে’ও ।
    “ স্কুলে গিয়েছিল পিংকি, তার গায়ে শুঁয়োপোকা উঠেছে, গায়ে ফুটিয়ে দিয়েছে শুঁয়ো । পিংকির বেশ জ্বর । ডাক্তারবাবু এসেছেন। সন্না দিয়ে শুঁয়ো তোলা হয়েছে, মলম লাগানো হল । দাদুকে দেখে পিংকির তোড়ে কান্না-- ‘শুঁয়োপোকা কেন স্কুলে গিয়েছিল ?’ জন্মদিনে পিংকিকে দাদু উপহার দিয়েছিলেন লতাপাতা আঁকা সবুজ জামা । সেইটি পরেই কি স্কুলে গিয়েছিল পিংকি ? উত্তর এখানে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ যাই হোক না কেন --- অন্তরালে দেখি সম-অভিযোজনের দোলা, পিংকি ও শুঁয়োপোকা একই বিন্দুতে পৌঁছোচ্ছে ।
    “কথক, পিংকির দাদু, পিংকির কান্না থামানোর জন্য তার ডলপুতুল ন্যান্সির খোঁজ করেন । সেই পুতুল পাওয়া যায়, জুতোর বাক্সের ভিতরে উল্টোনো অবস্হায়, এবং কী আশ্চর্য, সেই পুতুলের বুকের নিচে -- সেই আত্মার তৃপ্তিকর রিক্ত পদ --- সিগারেটের প্যাকেট । লোভনীয় সিগারেট, তবু কথক, পিংকির দাদু সেই প্যাকেট খোলেন না শেষ পর্যন্ত -- যেখানকার বস্তু সেখানেই ফিরে যাক । ওঁ নমো ।”
    দ্বিতীয় পর্বের ফিকশনে দাদার ন্যারেটিভ কেতা হয়ে উঠেছিল সহজাতভাবে অন্তর্ঘাতী, পরাভবী এবং তাতে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার প্রতি খোঁচাগুলো মজার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যেমন, ওষুধের জন্য আমাদের দেশ সেই গন্ধমাদন পর্বেই রয়ে গেছে আর বিদেশ থেকে আনছে নানা ধরণের ক্যারদানি । একই ন্যারেটিভ কন্ঠস্বর প্রয়োগ করে তিনি বাস্তব এবং জাদুর মাঝে পর্যয়ানুবৃত্তি ঘটিয়েছেন, কিন্তু দুটির মাঝের পালাবদলকে এমনভাবে ন্যারেটিভে বুনে দিয়েছেন যে বোঝার উপায় নেই কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব। ফলে বাস্তব আর ইন্দ্রজালের বাইরে একটা তৃতীয় জঁর তৈরি করতে পেরেছেন, যেকারণে পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট তত্ত্বের মাধ্যমে বলা চলে যে তাঁর ন্যারেটিভের একাধিক ব্যাখ্যা হতে পারে । পর্যায়ানুবৃত্তির কারণে একটিমাত্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কন্ঠস্বরকে প্রতিরোধ করে পাঠবস্তুগুলো । তাঁর ন্যারেটিভের কেতাটি সীমাগুলোকে অনুসন্ধানের পর লঙ্ঘন করে, সে সীমা রাজনৈতিক হোক বা ভৌগলিক হোক বা তাত্ত্বিক হোক বা বস্তুবর্গীয় হোক । সীমাগুলোকে ভেঙে তিনি উত্তরঔপনিবেশিক ভারতের সমাজ, গণতন্ত্র, ধর্মদ্বেষ, সন্ত্রাস, জাতিপ্রথা, দারিদ্র, দলীয় রাজনীতি, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ইত্যাদির সত্যগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন । পাঠকের মনে সন্দেহ চাগিয়ে তোলেন যে বাস্তবের বৈশিষ্ট্য যদি চূড়ান্ত না হয় তাহলে সত্য সম্পর্কে যাবতীয় অনুমানই ঝুঁকিআক্রান্ত। ক্ষমতা থেকে যাদের বঞ্চিত করা হয়েছে সেই ‘অপরদের’ বাকজগতকে প্রয়োগ করতে হয়েছে তাঁকে । ঔপনিবেশিক ও উত্তরঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রকরা, এদেশে হোক বা বিদেশে, ‘অপর’ সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রেখে যে অবাস্তবতা সৃষ্টি করেছে, জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে তিনি তা উপস্হাপন করেছেন তাঁর ফিকশানগুলোয়।
    ১৯৯৯ সালে লেখা “খননকার্য” গল্পে কথকের মাসিমার শাবল হারিয়ে দিয়েছেন কোনো কবিবন্ধু কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে । শাবল দিয়ে একজন কবি কেঁচো খুড়ছেন, কেন, তাঁর কেঁচো কেন দরকার, কথক সেকথা পরে জানিয়েছেন যে খোঁড়াখুঁড়ি কবিদের কাজ, অর্থাৎ এক ধরণের কবি কেঁচোর সন্ধান করে পুরস্কৃত হন । কথক কবিবন্ধু সম্পর্কে তাঁর খোঁচাটি লুকোননি, স্ত্রীকে বলছেন :

    ‘তা বড়ো বড়ো নামকরা কবিবন্ধু থাকলে ওসব একটুআধটু হবে, দাড়িওয়ালা ভক্তিপ্রসাদকে তো বহুবার দেখেছ, একটু বেশি মদ খেতে ভালোবাসে, একবার বাড়ি এলে সহজে যেতে চায় না, সাহিত্য অকাদেমি আনন্দ পুরস্কার, অনেক সব প্রাইজ পেয়েছে, তুমি তো আগে দেখেছ, আর ওই ঝাঁকড়াচুল জ্ঞানপীঠ পেয়েছেন পদ্যলেখার সবচেয়ে বড়ো প্রাইজ, খুব অসাধারণ সব লোক, একটু আধটু হুঁশ কম থাকে, কবি হলে ওসব হয়, অতশত তুমি বুঝবে না, পদ্য লিখলে বুঝতে, ব্যাপারই আলাদা । ওরা সব একধরনের অমর মানুষ ।’

    মাসিমার লোহার শাবলের বদলে ভালো স্টেনলেস স্টিলের শাবল কিনে এনে দেবার পর মাসিমা জানান যে পুরোনো শাবলটা ওঁর শশুরমশায়ের, ওঁর স্মৃতির, বাড়ি তৈরির সময়ের অনেক গল্প আছে পুরোনো শাবলে, নতুন শাবল তা যত ভালোই হোক মাসিমার চাই না, পুরোনো শাবলের সঙ্গে তাঁর জীবনের গল্পও হারিয়ে গেল । অর্থাৎ অন্যের পারিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে কবিরা আগ্রহী নন, তাঁরা কেবল পদ্য লিখে প্রাইজ পেতে চান এবং ‘একধরনের অমর মানুষ’ হতে চান ।
    ১৯৯৩ সালে লেখা “টিনিদির হাত” গল্পে দাদা শৈশবের হুলাসচাচার ‘রামচরিতমানস’-এর প্রশ্নাবলীর খেলাকে এনেছেন এবং ন্যারেটিভে সংযোজন করেছেন বিভিন্ন মাত্রা, প্রেমের, হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, ছোটোলোক-ভদ্রলোক বিভাজন এবং ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসের গুরুত্ব, যা ঔপনিবেশিক চাপ সত্ত্বেও নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে টিকেছিল । হুলাসচাচার ‘রমাচরিতমানস’ খেলায় একটি শলাকা দিয়ে বইতে নির্দেশ করলে হুলাসচাচা নির্দিষ্ট চৌপাই ব্যাখা করে ভবিষ্যত বলে দেন । বালক কথকের প্রতিটি ইচ্ছে পূরণ হয়েছে শুনে তার বন্ধ সুলেমানও খেলতে আসে, মনস্কামনা পূর্ণ হয় কিন্তু তার গাছে চাকা-চাকা ঘা দেখা দেয় । কথকের হিন্দু পরিবার মনে করে গোরুর মাংস খাবার কারণে হয়েছে ; সুলেমান মনে করা হিন্দুর গ্রন্হের খেলা খেলার জন্য হয়েছে । কথকের বাবা ঘায়ের ওষুধ দেন যা কথক ভুলিয়ে খাওয়ায় সুলেমানকে, খুদাবক্স ডাক্তারও ওষুধ দেন, আনোয়ারের দোকানে গিয়ে গোরুর মাংস খায় সুলেমান, টিনিদি আদর করে হাত বুলিয়ে দেন সুলেমানের মাথায় । সুলেমানের অসুখ সেরে যায় । বালক কথকের মনে সন্দেহ জেগে ওঠে যে এইগুলোর মধ্যে ঠিক কোন কারণে সেরে গেল সুলেমানের অসুখ ।
    “টিনিদির হাত” গল্পটিতে জাদুবাস্তবতা হল ‘রামচরিতমানস’ এর রামশলাকা খেলা আর হুলাসচাচার ভবিষ্যৎবাণী প্রত্যেকের ক্ষেত্রে অব্যর্থ হওয়া । গল্পটির মাধ্যমে দাদা দৈব ঘটনাকে বাস্তবের রূপ দিয়েছেন, প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে উদ্ভাবনাকে গুলিয়ে দিয়েছেন, যার দরুন চাপ সৃষ্টি করেছেন বাস্তব সম্পর্কিত ধারনায় । ইউরোপের আনা বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর ‘আলোকপ্রাপ্তির’ আঠারো শতকী প্রভূত্ববাদী সংস্কৃতির চাপকে আক্রমণ করেছেন সনাতন ভারতীয় সাংস্কৃতিক আচরণের মাধ্যমে । আলোকপ্রাপ্তির ঔপনিবেশিক চাপ অনুগত করতে চেয়েছিল কেবলমাত্র বিজ্ঞান ও যুক্তির দ্বারা, যখন কিনা সাধারণ ভারতীয়রা যেযার সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের নিজস্ব সত্যকে বাতিল করতে চায়নি । ‘অপর’-এর দৃষ্টিতে দেখলে, যেটা দাদা তুলে ধরতে চেয়েছেন এই গল্পে, যুক্তিহীনতাও জীবনের বহু ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে, এবং বাখতিনের বক্তব্য ধার নিয়ে বলা যায় এক্ষেত্রে দেখা দেয় হেটেরোগ্লসিয়া বা বহু পরস্পরবিরোধী কন্ঠস্বর, ভারতের চিন্তাভাবনার সাস্কৃতিক বহুত্ব, নানাধর্মিতা, পারস্পরিক বৈভিন্ন্যকে ফিকশনটি আলোকিত করে ।
    হাংরি আন্দোলনের আগে এবং হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার যে তিনটি কাব্যগ্রন্হ বেরিয়েছিল, সেগুলো নিয়ে দাদাকে একটা বই বের করতে বলেছিলুম, কিন্তু বইগুলো উনি নিজের কাছে রাখেননি, কারোর কাছ থেকে সংগ্রহ করতেও পারেননি । বইগুলো হল “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি”, “জানোয়ার” এবং “আমার ভিয়েৎনাম”। আমি কৃত্তিবাস সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে দাদার কয়েকটা কবিতা তুলে দিচ্ছি যা থেকে স্পষ্ট হবে যে কৃত্তিবাসের লিরিকাল ধারা থেকে কীভাবে উনি ধাপে-ধাপে বেরিয়ে গেলেন ।
    “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি” পর্বের কবিতা ( দাদার মেয়ের নাম হণি, সেই সময়ের কবিতা ) কৃত্তিবাস পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল :

    হণির ভিতর দিয়ে দেখা যায়
    জাহান্নমে যাক গ্রহনক্ষত্রসমূহ ভেঙে পৃথিবীও যাক জাহান্নমে
    লাথি মেরে সব ভেঙে চুরমার করে দিলে, কাল আমি সহাস্যবদনে
    হাততালি দিয়ে মঞ্চে কোনোরূপ গ্লানিহীন নুরেমবার্গের আদালতে
    তুড়ি মেরে কাঠগড়া মুঠোয় গুঁড়িয়ে তোমাদেরও পারতাম ভেলকি সুবিস্তারে ।
    সৌরমণ্ডলের পথে তছনছ পৃথিবীর অন্ধকার ফেরি আবর্তন
    কোনোরূপ রেখাপাত সম্ভব ছিল না গ্রন্হে হৃদয়ে মেধায়,
    আমার শরীর ঘিরে ইহুদির হিন্দু শিখ মুসলিমের আততায়ী আদর্শের
    ঘৃণ্য রক্তপাত--
    আমাকেও জয়োল্লাস দিয়েছিল মূত্রপাতে পোষা রাজনীতি ।
    তোমাদের আস্ফালনে বিনয়ী মুখোশ ঘিরে আমার হণির জন্মদিন
    আমারই মুখোশ ধরে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে আর্ত চিৎকারে--
    ধান উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ এখন পেয়েছি শুঁকে কৃষকের উর্বর শরীরে
    কুমারী মহিলাদের উজ্জ্বল মসৃণ দেহে বহুবার হাত রেখে উত্তরনিশীথে
    পরাগ চমকে ওঠে, স্পর্শ করে নারীর সমগ্র দেহ জুড়ে
    আশ্রয় ছড়ানো আছে প্রীত এক ধরণের মিহি রুখু বালি ।
    ক্রমে এই সমস্তই নাভির ভিতরে আনে রুদ্ধ আলোড়ন,
    জেগে ওঠে মৃগনাভি, চেয়ারে টেবিলে গ্রন্হে অম্লান মাঠের ভিতরে
    ধু-ধু রিক্ত প্রান্তরের দিকে শাবক প্রসব করে রঙিন প্রপাত,
    চারিদিকে ফলপ্রসূ হয়ে গেছে রাশিরাশি প্রতিহারি ধান---
    #
    মনে হয় বহুক্ষণ মাঠে মাঠে গড়াগড়ি দিয়ে বিছানায় উঠে আসে নারী
    ক্ষুধার্ত শিকড়গুলি ঢুকে যায় নীড় আস্বাদনে,
    তখনই উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ জাগে, কৃষকের উর্বর শরীরে
    প্লুত আবছা আঁধারে তাই বারবার মনে হয় পৃথিবীর সহজ সুদিন
    ফিরে এলো সুধাশান্তি
    আমার হণির জন্য তোমাদের কাছে আমি ঋনী চিরদিন ।

    এই কবিতাগুলো কৃত্তিবাস পত্রিকার কুড়ি নং সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল :-
    ব্যক্তিগত ন্যাপথালিন
    বাক্স খুললেই ভবঘুরে সুখ
    ন্যাপথলিন তীব্র ন্যাপথলিন
    ন্যাপথলিনের গন্ধে সংসার উন্মুখ

    নিজস্ব ডেটল
    ছুটে আসে হাসপাতাল অতিউগ্র তরল শেফালি
    বুকে রাখা কোতোয়াল ভেদ করে তীব্র অশ্রুপাত
    স্পর্শ করে লুকানো ডুমুর ।
    হনির মুখশ্রীছবি আমাদের আবহাওয়া রিপোর্ট
    আমাদের বুঁদ জলবায়ু
    জারি রাখি উচ্ছন্ন মেয়াদ মৃত্যু বেহুঁশ টম্যাটো ।
    ক্রমশ হারিয়ে যায় আমার একান্তপ্রিয়
    টম্যাটোর লাল
    ছুটে আসে হাসপাতাল, অতিউগ্র তরল শেফালি
    ছুটে আসে তিন লক্ষ উন্মাদ কুকুর
    নধর পালংশাক রেগে ওঠে হঠাৎ খুরপি লাগে বুকে--
    মনে হয় বেশ আছি ছেলেপুলে নিয়ে সুখে ।

    মৃতমন্ত্রীবিষয়ক নিধি
    আমিও শকুন হয়ে দেখতে চাই না আর নানাবিধ মড়া
    টক মিষ্টি ঝাল
    ওরা সব ছিল কাল
    আজ উঠে গেছে ঝাঁজ
    হঠাৎ পথের মোড়ে পুলিশের পক্ষে ওই মৃত বৃদ্ধ রেখে
    কিসের সুরাহা হবে ট্যাক্সিঅলা জানে
    এই অবসরে আমি চলে যেতে চাই কোনো আবছা আকাশে
    ঠুকরে দেখতে চাই টাটকা বিনোবা কতখানি ভেপসে উঠেছে ভেতরে

    ঝ্যান্ত মানুষ ঠুকরে
    দ্যাখা যায় গোপনীয় লাশ
    দ্যাখা যায় বাগানের লুকানো পলাশ
    এসোনা ঠুকরে দেখি তোমার প্রতিভা ।

    হাংরি আন্দোলনের সময়ে প্রকাশিত হয় দাদার কাব্যগ্রন্হ “জানোয়ার”, টের পাওয়া যায় কেন তিনি কৃত্তিবাসের কোটর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কৃত্তিবাসের লিরিকাল জগত থেকে উত্তরঔপনিবেশিক বাস্তবতায় আক্রান্ত হয়েছিল তার সংবেদ, তা “রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক এই কবিতাটিতে স্পষ্ট :-
    ১.
    ঈশ্বরকে চিনে নেওয়ার জন্য আর আমার বেলপাতার দরকার নেই
    কবিতাকে চিনে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন নেই ‘মতো’ আর ‘যেন’র
    জন্মভূমি স্বদেশ মাতৃভূমি চিনে নেওয়ার জন্য
    দেশবাসীর এখন মানচিত্রের প্রয়োজন
    সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য চিনে নেওয়ার জন্য
    সমাজের দরকার পোশাক-পরিচ্ছদ
    নির্ধারিত উর্দি ভাগাভাগি করে গা্য়ে চড়িয়ে মানুষ
    অভিনেতা পুলিশ শুশ্রুষাকারী উকিল বিচারক আর নেতা হয়ে উঠছে
    আমি কলতলায় ন্যাংটো স্নান করে দেখে নিচ্ছি আমার গোপন পবিত্রতা
    শান্তি আর শৃঙ্খলার জন্য মানুষকে হত্যা করা প্রয়োজন
    স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জন্য কাঁদুনে গ্যাসের দরকার
    আদর্শ আর ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন যুদ্ধ আর শান্তির শর্তাবলী
    যে-কোনো ধারণার চেয়ে মানুষ আজ খাটো হয়ে পড়ছে
    ২.
    শিল্প ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    দেশ ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    ধর্ম ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    ভাষা ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    সৌন্দর্য ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    সংস্কৃতি ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    ঐতিহ্য ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    বিশ্বপৃথিবী ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যুর পরেও তার সোনার বাংলা ভাগ হয়ে গেছে
    সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যুর পরেও তারই গান গেয়ে
    একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে খুন করছে
    ৩.
    কংগ্রেস আর মুস্লিম লিগের ক্ষমতার চেয়ে
    ধর্মান্ধ রাজনীতির বিশাল দাপটের চেয়ে
    রবীন্দ্রনাথের ক্ষমতা অনেক অনেক কম
    নজরুলকে মাসোহারা দিয়ে বিধানসভা চক্ষুলজ্জা ঢাকছে
    দশ হাজার শান্তিনিকেতন খুলে রেখে পৃথিবীকে শান্ত রাখা সম্ভব নয়
    দশ কোটি শান্তিনিকেতন খুলে রাখলেও
    রাজনীতির হিংস্র বর্বরতা থামানো অসম্ভব
    পঁচিশে বৈশাখ থেকে বাইশে শ্রাবণ অব্দি ছুটে গিয়ে দেখেছি
    পৃথিবীর কিছুই সুরাহা হয়নি
    মানুষকে ভালো করে তোলা আমার সাধ্যাতীত
    বহুদূর পথ হেঁটে গিয়ে আমি পুনরায় ফিরে যাচ্ছি
    আমারই অশ্লীল নিভৃত কোটরে ।

    “জানোয়ার” এর পর প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্হ “আমার ভিয়েৎনাম” । এখানে যে কবিতাটি তুলে দিচ্ছি, “পালামৌ -- ১৯৬৬”, তা “আমার ভিয়েৎনাম” পর্বের। কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য দাদা লেখা পাঠাচ্ছেন না দেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দাদার কর্মস্হল ডালটনগঞ্জে গিয়েছিলেন কবিতা আনার জন্য । দাদা কবিতা লিখে দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিপে করে দেহরি অন শোন স্টেশানে ছেড়ে দিয়ে আসেন । দাদা ইচ্ছাকৃতভাবে হাংরি আন্দোলনকারীরা সেসময়ে যে ধরণের কবিতা লিখছিলেন, যা ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আমার আর সুবিমল বসাকের কবিতা পড়লে স্পষ্ট হবে, সেই ফর্মেই সামাজিক-রাজনৈতিক কবিতাটি দিয়েছিলেন ।

    পালামৌ -- ১৯৬৬
    পাঁচ হাজার কেঁচোর সঙ্গে মাটি খুঁড়ে ভেবেছিলাম
    ঘুম ভেঙে উঠে দেখব সবুজ বিশাল ভারতবর্ষ
    হঠাৎ সঞ্জীবচন্দ্র ডেকে উঠবেন সমীর পালামৌ সমীর
    অথচ ভোটবাক্স নিয়ে আমি খুঁজে বেড়ালাম ভারতবর্ষের ভালোবাসা
    আমার গোপন তকমার লোভে কৃষকের লাঙল থেকে
    খুঁটে তুললাম প্রভূত ন্যাপথলিন
    কেননা পৃথিবীর সবচেয়ে নগ্ন আর মজবুত স্ত্রীলোকের নাম ভিয়েৎনাম
    এখন স্রেফ পাঁচ বস্তা চাল কিনে রেখে
    আমি দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব সেরে নিচ্ছি
    কয়েকটা ব্যাপারে কেবল মহিলার আধিপত্য সহ্য হচ্ছে না
    আত্তিলার রক্তেও ছিল না একশো ভাগ নিরেট পৌরুষ
    বুঝতে পারছি না কেন আমার গর্ভধারণের ইচ্ছে হয়
    কেন আমার মসৃণ বুকে হাত রেখে মাঝরাতে হঠাৎ ককিয়ে উঠেছি
    আমারই যৌনতার মধ্যে খুঁজে দেখেছি নিজস্ব গোলাবাড়ি একান্ত বীজধান
    আমারই বীর্য থেকে স্রেফ আমারই শরীরে প্রসব চেয়েছি আমি
    অথচ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাবে মহিলাকে দিয়ে এলাম প্রেম আর কোকাকোলা
    ঠিক এই কারণেই কোথায় কতখানি সমীর পরখ করতে
    এক মহিলা থেকে ঘুরে বেড়ালাম অন্য শরীরের আনাচে কানাচে
    আমার বাঁ-চোখ থেকে খুঁটে তুললাম তিনশো জোনাকির হঠাৎ জ্বলে ওঠা
    গোলাপের চতুর্দিকে নিয়ন্ত্রিত কীটের উদ্বেগ অভিযান লক্ষ্য করে
    আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার বিবেকের তলপেট
    নিজের তৈরি বাস্তবিকতার সঙ্গে
    পৃথিবীর বাস্তবিকতা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে
    আমি টের পেলাম আমার ব্যক্তিগত ছাপাখানা
    কেননা প্রত্যেকবার একটা চৌরাস্তার কাছ-বরাবর এসে
    আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাচ্ছি
    বাম আর দক্ষিণ কমিউনিস্টদের খেল কসরৎ ঈর্ষা দেখতে
    মার্কসের জরায়ু থেকে বের করে আনছি তিন লক্ষ সমীর
    ভোরে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে কামরাজ পাতিল যেমন চোখে পড়া মাত্র
    আমার মুখ তেতো হয়ে উঠছে
    স্বপ্নের প্রথম শর্ত
    মনে করো জেগে আছো তুমি
    শব্দ আর শব্দ বিনিময়ে কবিতার ধর্ম হয়ে ওঠে
    শপথের চেয়ে ঘৃণ্য কোনো পাপ নেই
    প্রতিটি গলির মোড়ে অন্য এক প্রতিজ্ঞায় রুখে
    এখন সাপের খেলা
    ভ্রূ-আঁকা পেন্সিলে আমি মহিলার চোখের পাতায় লিখছি অশ্লীলতা, নার্সারি রাইম ।

    কলকাতার বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি আসার পর প্রায় দেড় দশক পর দাদা যখন লেখালিখি এবং ‘হাওয়া ৪৯’ পত্রিকার সম্পাদনা আরম্ভ করলেন তখন তাঁর কবিতাভাবনায় এবং কবিতা রচনায় বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে । তার প্রধান কারণ সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের সমাজের রাজনীতির সংস্কৃতির যে নতুন রূপের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, তার সঙ্গে তাঁর কলেজ জীবনের অভিজ্ঞতার দুস্তর ফারাক অনুধাবন করতে পারলেন, প্রত্যক্ষ্য করতে পারলেন নবোদ্ভূত কেয়সকে, দেখলেন তার কেন্দ্রটি নিশ্চিহ্ণ । ফলত তাঁর কবিতায় কোনো ডমিন্যান্ট শৈলীর প্রভাব পড়ল না, কেননা কবিতার ক্র্যাফ্টকেই তুলে আনলেন কবিতার শরীরে ; তিনি ছবির সঙ্গে ন্যারেটিভকে এবং দার্শনিক বিবেচনা, প্রতিবর্তী ক্রিয়া, মুক্ত-সমাপ্ত পরস্পরবিরোধিতা, বুদ্ধিগত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, একই সঙ্গে একাধিক ঘটনা, দৃষ্টিভঙ্গীর পর্যায়ান্বন, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তর, অসঙ্গতি, অপ্রত্যাশিত বাঁক, অর্থান্তর সৃষ্টিকারী ও আপাতবিচ্ছিন্ন চিন্তাপ্রবাহ মিশিয়ে দিতে লাগলেন । অনেক কবিতায় শৈলীটিকে ভঙ্গুর করে ফেলে তাকে ডায়েরির রূপ দিলেন । তাঁর কবিতাভাবনা পশ্চিমবঙ্গের তরুণদের মাঝে জলবিভাজকের কাজ করল ; একদিকে পরম্পরাবাদীরা এবং অন্যদিকে তাঁরা, যাঁরা কবিতার ক্র্যাফ্টকে কবিতারচনার প্রধান আগ্রহ করে তুললেন । কবিতায় “বিষয়”-এর মৃত্যু ঘোষণা করলেন, বললেন যে শিরোনাম হল কবিতার ‘রুবরিক’, তা কবিতাবিশেষের টাইটেল হোলডার নয় । প্রাগাধুনিক-প্রাকঔপনিবেশিক কবিতার মতন পরিসর তাঁর কবিতায় হয়ে উঠল শব্দমূল ও ধাতুকাঠামো সংক্রান্ত আগ্রহ । পাশাপাশি, যেমন তাঁর ছোটোগল্পে, তেমনই কবিতায় উঠে এলো বহুজাতিকতা ও ক্রনি পুঁজিবাদের দরুণ প্রভাবিত মানুষের অবদমন. মনোভঙ্গ, বিষণ্ণতা ; ব্যক্তিএককের বেদখল হয়ে যাওয়া চেতনা, পরিবেশ ও সংসার ।
    “জীবনানন্দ : সূর্য ও তপতী” প্রবন্ধে দাদা লিখেছিলেন, “কবিতার লক্ষ্য অনুভূতিদেশ । অনুভূতির গভীরে আছে আদি স্বাগতম । আছে সর্বভূতেষু জাগরণস্পৃহা । অহং ব্রহ্মাস্মি চেতনার অপেক্ষমাণ বুদবুদ । কবি সে আসঙ্গ-যুক্ততার কাতরতাকে উসকে দেন । শব্দ যোজনার সেই কালিক চেতনাকে অতিক্রমণ কবির লক্ষ্য । ঈষৎ অনন্যসাধারণ উত্তরসমাজকে ত্বরান্বিত ত্বরান্বিত ও আরো বেগবান করে তোলার তিনি চেতনার অভিমুখের মশালবাহক । সমাজ যত বেশি একলষেঁড়ে হয়ে পড়ে, একলপ্ততার প্রয়োজন তত বাড়ে । বহুরৈখিকতা, ময়ূরপঙ্খী বর্ণময়তা সেখান থেকে মুক্তি দেয় ।”

    তাঁর শেষ পর্বের কয়েকটি কবিতা এখানে তুলে দিই ।
    এই কবিতা দাঁড়াতে চায় না
    কিছু কিছু শব্দের সকাল হয়ে আসছে
    কিছু কিছু শব্দের রিপেয়ারিং চাই দরকার জোড়া লাগানো
    কার সঙ্গে কিসের জোড়া সে-কথা পেয়ারিং শব্দের মধ্যেই আছে
    প্রয়োজন প্যার মহব্বত পিরিত পেয়ার
    পুরুষ প্রকৃতির তত্ত্বকথা না শোনালেও চলবে

    ছন্দ
    প্রত্যেক শব্দের মধ্যে কিছু শব্দ পাশ ফিরে থাকে
    প্রত্যেক শব্দের মধ্যে কিছু অক্ষর থেকে যায় স্বল্প উচ্চারণে
    কিছু উপসর্গ প্রত্যেক ধাতুর সম্পর্কে থেকে যায় অর্থবিহীন
    বুঝ আর অবুঝের মধ্যে বোঝাপড়া রাখে কার্যসাধিকা
    নীলুদের সংসারে ছোটমাসি মুখ বুজে কাজ করে যায়---
    জটিলতার কাছে সোপর্দ রয়েছে
    গতির অরৈখিক নকশা
    অংশ-প্রীতি, ঘুম
    যেভাবে বিশৃঙ্খলা ছন্দের মুখোশ ।

    নিজস্ব রোদের জন্য
    নতুন বাড়িটিতে যেদিন প্রথম বিকেলের রোদ এসে
    জীবনের খোঁজ নিয়েছিল সেদিন থেকেই এবাড়ির নিজস্ব রোদ
    নিজস্ব হাওয়া বাতাস নিজস্ব মেঘলার জন্ম
    সবকিছু যা একান্তই এবাড়ির
    যেভাবে কিছু রোদ কিছু বৃষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকা সংসার পাতে

    যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় মহাভাষ্য থেকে
    যেভাবে ব্যক্তিগত রোদের কাতরতা নিয়ে একসময়
    পশ্চিমের বারান্দায় অতসীলতাকে বাঁক নিতে দেখেছিলাম
    দেখেছিলাম রোদের জন্য ঠাকুমার হাপিত্যেশ
    এখনও মনে পড়ে যায় দ্বারভাঙ্গায় আমাদের ডাইনিং টেবিলে
    চা পানের সঙ্গী এক চিলতে রোদ্দুর
    স্কুলের ছুটির ঘণ্টার সঙ্গে চলে যাওয়া রোদের অন্য এক সম্পর্ক ছিল
    যেমন কিছি কিছু ছায়ার সঙ্গে আমাদের নিভৃতের যোগাযোগ

    যেভাবে কিছু রোদ কিছু ছায়া ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে জমা পড়ে
    যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় মহাভাষ্য থেকে ।

    আয়নাঘর
    ঘুম ভেঙে আয়নায় দেখি বাবার তিনকাল পেরোনো মুখ
    রাতে খুলে রাখা দাঁতের ডিবে খুঁজছে...
    ইসেবগোল খেয়ে ঘুমিয়ে ওঠা লোকটার শুকনো গলায় তেষ্টা…
    কোঁচকানো গালে ছ-দিনের দাড়ি, ভুরুর বাড়ন্ত চুল চোখ ঢাকছে…
    ফিটকিরির গুঁড়ো দিয়ে ঢিমেতাল মাড়ি শেষ যত্নে ধুয়ে নিচ্ছে…
    সাদা পাথায় তিনটে কালো চুল দেখে নির্বিকার ফোগলা শূন্য হাসছে…
    খুলে রাখা নাক কান চোখ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁর দলিলে নেই

    বর্ণমালার ক্ষয়িষ্ণু অমৃতকণা ড্যাখে পরস্পর বর্ণগুলি মৌলকণা
    করোগেটেড কপালের বলিরেখায় কেওসের চিহ্ণ…
    ক’দিন বাদেই আসবে ডেটল না-রাখা টিনের কাঁচি চিরুনি…
    ইমলিতলার ভ্যানওয়ালা লটারি পাওয়ার গল্প শুনিয়ে যাবে…
    এমনই অনেক অনুভব ভব হয়ে উঠছে আয়নায় দেখা মুখের ভাঁজে…

    পেছন ফিরে দেখি চিরযৌবন আর কবিতার খাতা নিয়ে সমীর--
    শেফালির সঙ্গে বকখালিতে আজ ডেটিং
    পরস্পরের ভূপ্রকৃতি বাস্তুতন্ত্র গিরিখাত আগ্নেয়মুখ চিনে নিতে এখনও বাকি…
    কবিতার খাতা শেষ পাতায় লিখে রাখা ইজা

    আয়নাঘরে পেছনের আয়নায় বাবা পিতামহের মুখ দেখছে…
    প্রপিতামহ দেখছে প্রপৌত্রের মুখ
    পাঁচ রাউণ্ডের শেষে শেষ ডিফেন্সে আমি গোলপোস্টে একা
    নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে বিপক্ষের কর্ণার কিকের মুখোমুখি
    গোলার সামনে দুই জার্সি জটলায় পজিশন নিচ্ছে
    হেড-বেহেডে মাথার ওপর বল ঘুরছে ফিরছে
    পক্ষ বিপক্ষ বুঝে উঠতে হিমসিম খাচ্ছি

    ভয় এবার যদি পেনাক্টিকিকের হুইসল বাজে
    আয়নাঘরের মাঠে…

    [ রচনাকাল : জুলাই ২০১৬ ]
  • | 012312.60.7834.182 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:১১541313
  • সোনালী মিত্রের যোনিজ কবিতা
    মলয় রায়চৌধুরী
    একদিন সোনালী মিত্রের একটা কবিতা হঠাৎই নজরে পড়েছিল ; পড়ে মনে হয়েছিল আমাকে আক্রমণ করে লেখা, কিন্তু না, কবিতার শেষের দিকে গিয়ে মনে হয়েছিল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক’ ছুতার কবিতার শুভা চরিত্রটিতে প্রতিস্থাপনের গোপনেচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে । কেবল তা কিন্তু নয় ; তাঁর কাজটি একজন নারীর যৌনতাবোধকে সেন্সর করার বিরুদ্ধে স্বাবলম্বী ক্ষমতা হিসাবে উপস্থাপিত ; সোনালী মিত্র কবিতাটির মাধ্যমে তাঁর নিজের দেহের কর্তৃত্ব দাবি করছেন, নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, নিজের জ্যোতির্ময়তা, যা পুরুষদের আকর্ষণ করে । বস্তুত শুভার স্থান দখলের ইচ্ছা বহু তরুণীই ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু সেগুলোর থেকে সোনালী মিত্র ভিন্ন ।
    সোনালী মিত্রের কবিতাটা এই রকম:
    হাংরি
    আরো একবার যদি প্রবল বর্ষায় ভেসে যায় দ্বীপ
    আরো একবার যদি প্রচণ্ড বিদ্যুতে কেঁপে ওঠে বুক ( সম্পূর্ণ কবিতা ... পৃষ্ঠায় )
    কবিতাটি পড়ার পর ওনার কবিতাগুলো, অনুসরণ বলব না, বস্তুত ওনাকে স্টকিং করা আরম্ভ করলুম, যেভাবে একজন সুন্দরী যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার পেছন-পেছন উন্মাদের মতন ছায়া হয়ে বেড়ায় একজন পুরুষ । পড়তে-পড়তে মনে হলো, এনার কবিতা যেভাবে গড়ে উঠছে, একে তো সমসাময়িক মহিলা কবিদের, বিশেষ করে মল্লিকা সেনগুপ্তের ফেমিনিস্ট কবিতা, কৃষ্ণা বসুর পিতৃতন্ত্রবিরোধী কবিতা, যশোধরা রায়চৌধুরীর সংসার ও গার্হস্থ্যজীবনের কবিতা, বলা যাবে না ।
    সোনালী মিত্রের কবিতার লিরিকাল কণ্ঠস্বর এবং সেই লিরিসিজমের ভেতরে বুনে দেয়া ইরটিক ন্যারেটিভ একেবারে অন্যরকম । আমি তাঁর কবিতাকে তাই বলেছি ‘যোনিজ কবিতা’ । দেহে যোনি থাকার দরুন একটি মেয়ের কৈশোর থেকে অস্তিত্বে যে বহুবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হতে থাকে তাদের প্রকাশ করার একটি পথ তিনি কবিতার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন । পথটা দ্রোহের, র‌্যাডিকাল, সমসাময়িক কবিতার প্রতিষ্ঠানের বা নির্ধারিত ক্যাননের বিরুদ্ধে দ্রোহ । সোনালী মিত্র বেপরোয়া, তাঁর চেতনা যোনিজ ।
    শুভাকে কেন্দ্র করে সোনালী মিত্রের আরেকটি যোনিজ আক্রমণ :
    বিস্ফোরণ ও শুভা
    ক্রমশ ঊর্ধ্ব সত্তরের প্রেমে ডুবে যাচ্ছে বসন্তবর্ষীয় আয়ু,
    সারসার দিয়ে রক্তকীট ...বাস্তুতন্ত্রের বিষাক্ত ফণা ধেয়ে গেল
    গঠনপোক্ত মধ্যে তিরিশের দিকে , তাদেরও
    হারিয়ে দিতে পারে বুকে লাট খেয়ে যাওয়া
    তোমার সাদা চুলের ঘোড়া । ( সম্পূর্ণ কবিতা ... পৃষ্ঠায় )
    তাঁর কবিতাগুলোর জন্য সোনালী মিত্র নিজস্ব এক আঙ্গিক গড়ে নিয়েছেন । সনাতন ভারতীয় ভাবনাকে যদি আশ্রয় করি তাহলে আঙ্গিকমুক্তিকে বলতে হয় ‘নির্গুণ’, আর আঙ্গিকবদ্ধতাকে বলতে হয় ‘সগুণ’ । সোনালী মিত্র দেবী-দেবতায় বিশ্বাসী, তাঁর পুজোর ঘরে আছেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তি, অর্থাৎ তিনি ঘোরতর আস্তিক । হিন্দুদের ধর্মচিন্তায় ‘নির্গুণ’ হলো যৌনতাহীন, বিবাহহীন ও সন্তানোৎপাদনের অনুপযুক্ত । ‘সগুণ’ হলে তা স্বয়ম্ভূ অথবা যোনিজ । গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে তাঁর দেহে দুটি গর্ভপথ আছে, একটি যোনি এবং অপরটি আত্মা ; এই বক্তব্যটি একটি টেনশনের ভারসাম্য । এই একই টেনশনের ভারসাম্য গড়ে তোলার প্রয়াস করেন সোনালী মিত্র । সুতরাং ‘নির্গুণ’ বড়ো না ‘সগুণ’ বড়ো এরকম তর্ক তোলা যায় না তাঁর কবিতার ক্ষেত্রে । ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতে’ আমরা এই টেনশনের ভারসাম্য প্রত্যক্ষ করি । ‘মহাভারতকে’ যেমন যৌনতাহীন কল্পনা করা অসম্ভব, তেমনই সোনালী মিত্রের এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। নারীকে সোনালী মিত্র পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উপস্হাপনের পরিবর্তে, যা ফেমিনিস্টরা সচরাচর করে থাকেন, তিনি কাছে টেনে নিয়ে মৈত্রীবন্ধনে আটক করতে চেয়েছেন ।
    যৌনতাকে যাঁরা কবিতায় আনতে কুণ্ঠিত বোধ করেন, তাঁদের আদি শঙ্করাচার্য সম্পর্কে প্রচলিত গল্পটা মনে করিয়ে দিই। শঙ্করাচার্য ছিলেন চিরকুমার । মণ্ডণ মিশ্রের স্ত্রী উভয় ভারতী তাঁর সঙ্গে তর্কে শঙ্করাচার্যকে বলেন যে তাঁর জ্ঞান খণ্ডিত, কেননা যৌনতার আনন্দ সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা নেই । শঙ্করাচার্য তাই কাশ্মীরের মৃত মহারাজা অমরুর দেহে প্রবেশ করেন এবং মহারাজাকে জীবিত করে তুলে যৌনতার আনন্দ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে বাধ্য হন ।
    কবি সোনালী মিত্র জানেন যে নারীর অনুভূতি ও সংবেদনকে অপব্যবহার করা হয়, বিকৃত করা হয় । তাই তিনি ইরটিসিজমকে নারীর ক্ষমতায়ন হিসাবে প্রয়োগ করেছেন তাঁর কবিতায়, যা বাংলা কবিতায় প্রান্তিক ক্যাননের স্থানও পায়নি এতকাল । নারীর দৃষ্টি-প্রতিভা দিয়ে দেখেছেন প্রেম এবং সৃষ্টিকে, যে নারী একজন ব্রতী, সৎ ও দুঃসাহসী ।
    পাঠক, কবি সোনালী মিত্রের সুস্পষ্ট ইরটিক কণ্ঠস্বরের গভীরে যে চোট জখম রয়েছে, যে সুরক্ষাহীনতার বোধ রয়েছে, তার অন্তস্থ আত্মিক, মানসিক ও দৈহিক পীড়ার সঙ্গে পরিচিত হন । তাঁর আত্মসন্দেহ ও আত্মআবিষ্কারের অভিজ্ঞতার অংশভাক হয়ে ওঠেন ।
    নাইটফল অথবা সমুদ্রযাত্রা
    তখন রাতগুলো পরী ভালবাসায় ভরপুর
    হরিদার চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় ফেলে আশা
    মিঠু বউদি আর ঝিলিক সেনের ঝিকিরমিকির দুই চাঁদ
    রাতে নাড়িয়ে দিলে গো । ঘুম , ঘুম আসে না
    অস্থির , বুকের ভিতরের হ্যাংলা কুকুরটা বনেদী নয়
    ঠিক , ঠিক যেন ভাদ্রের মত অবস্থানে
    আর কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠু না ঝিলিক সেনের বুকে
    বুঝলাম না ...... ( সম্পূর্ণ অংশ --- পৃষ্ঠায় )
    উল্লেখ্য যে সোনালী মিত্র দিল্লির মতো একটি বদনাম কসমোপলিসে বিচরণ করেন, সেই শহরের বেয়াড়া ভিড় ও জাঠ খাপসংস্কৃতিতে প্রতিপালিত এঁড়ে পুরুষদের যমঘটের প্রতিদিনই মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে । ছেলের পড়াশুনার খেয়াল রাখতে হয় । সংসার সামলাতে হয় । এই কাজগুলোর পাশাপাশি তিনি কবিতা লিখে চলেছেন। কলকাতার মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে প্রতিদিনকার মেলামেশা, তর্ক, আলোচনা, নিয়মিত কবিতাপাঠ ও আড্ডার সুযোগ নেই সেখানে । পশ্চিমবাংলার কবিতা পত্রিকাগুলোও পৌঁছোয় না, যাতে তিনি সমসাময়িক কবিতার ট্রেণ্ড টের পেতে পারেন । তা সত্তেও তিনি নিজস্ব একটি ধারা গড়ে তুলতে পেরেছেন । কীভাবে তিনি নারীযৌনতার বিস্তার ঘটিয়েছেন তা চ্যালেঞ্জের মতো ছুঁড়ে-দেয়া, অরিণ দেবকে উদ্দেশ্য করে রচিত(কবিতার নাম-অশ্লীল কবিতা) কবিতাটিতে স্পষ্ট, কোনো রাখঢাক নেই । কবিতার লাইনগুলো তাঁর প্ল্যাসেন্টার আহ্লাদযন্ত্রণাকে বয়ে নিয়ে যায় ।
    হিন্দু পৌরাণিক অতিকথার সূত্রে সোনালী মিত্র একযোগে অভিন্নতা, সংহতি, ঐক্য এবং নিপীড়িতের বোধকে একই পাটাতনে উপস্থাপন করেছেন, যেমন তাঁর ‘রাধাতত্ত্ব’ কবিতায় । সেই সঙ্গে বৃত্তটির পরিধি বিস্তার ঘটান ইতিহাস ও পুরাণের মিশেল দিয়ে । উপস্থাপিত হয় নারীর আত্মজ্ঞান । তাঁর কবি-পারসোনার ইরটিক স্পষ্টভাষণ ও দেহের উৎসববোধ গোঁড়া সমালোচকদের বিব্রত করতে পারে । আমি বলব সেটাই সোনালী মিত্রের লক্ষ্য ।
    রাধা তত্ত্ব
    তারাখচিত ধাবা । ধুধু বিশলাখি চাকামাতম । আহাঃ প্রান্তিকট্রাক -
    ট্রাক-ট্রাক , আহাঃ পরীযোনিধাবা , চোদ্দআনাগরম ।
    ফার্মালিনব্রাহ্মণরাত । হুডখোলা প্রান্তরে উলঙ্গবন্দর । আসে ত্যাজ্যযোনি ( সম্পূর্ণ অংশ ... পৃষ্ঠায় )
    কবি সোনালী মিত্রের কবিতাগুলো আক্রমণাত্মকভাবে ননকনফরমিস্ট ও মৌলিক । তাঁর সমসাময়িক কোনও কবিকে এতোটা র‌্যাডিকাল বলা যায় না ; রক্তাক্ত আঘাতের মতন তাঁর কবিতার পরতে-পরতে রয়েছে স্পর্শকাতরতা, চামড়া উঠে গিয়ে ভেতর থেকে মাংস বেরিয়ে এসেছে এমন অব্যক্ত শব্দপ্রকাশ । তাঁর কবিতার গুরুত্ব হলো র‌্যাডিকালিজম, যৌনতা ও যোনিজ চেতনার স্পষ্ট উচ্চারণ । আমার ধারণা তাঁর কবিতা কোনো কমার্শিয়াল পত্রিকার সম্পাদক অনুমোদন করবেন না, হয়তো রক্ষণশীল লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক যাঁরা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস” কালখণ্ডে ধ্বসে পড়েছেন, তাঁরা তাঁদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের কারণে অনুমোদন করতে পারবেন না । তাঁর কবিতার ইরটিক ন্যারেটিভ চালু-জনসমাজে প্রচলিত নারীযৌনতার সংজ্ঞার বিস্তার ঘটায় । এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হেটেরোসেক্সুয়াল ন্যারেটিভ নকশা, যা বিভিন্ন নারীর অভিজ্ঞতার স্বাতন্ত্র্যকে দার্শনিক প্রতিরূপে প্রবর্তনের প্রয়াস করে ।
    নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও সোনালী মিত্রের কাহিনিজগত গড়ে উঠতে দেখি ; তিনি অন্যান্য কবিদের কবিতা পছন্দ হয়েছে ঘোষণা করে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দেবার একটি প্রক্রিয়া রপ্ত করেছেন, সম্ভবত তাঁর নিজের র‌্যাডিকাল জগতের প্রতি সেই কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ; সেই তরুণী কবিদের কবিতায় কিন্তু নারীদেহের বাকপ্রতিমার মোজেইক থাকে না যার মাধ্যমে নারী তাঁর দেহকে ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োগ করতে পারেন এবং তাকে নারীর বহুবিধ পলকাটা অস্তিত্বের উৎসব-সমিধ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন । এটি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, কবিতার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, যে ক্ষমতার উৎস তার দেহ । এই অভিজ্ঞতা তিনি সংগ্রহ করেন যাপনের মাধ্যমে, যেগুলো পুরুষ কবিদের দ্বারা অবহেলিত, যা পুরুষতান্ত্রিক গদ্য-পদ্যে জায়গা পায় না । এটা কিন্তু ফেমিনিজম নয়, এটা নিজের শরীরের উৎসব, দেহের কারণেই কবি একাধারে স্ত্রী, জননী, কন্যা, শাশুড়ি, সংসারের কেন্দ্রস্হানীয়া । ‘মাতৃতন্ত্র’ শিরোনামের এই কবিতাটি উল্লেখ্য :
    মাতৃতন্ত্র
    মাকে দাহ করে ফিরলাম ।
    অদ্ভুত !আত্মাহীন মুখে কোন বিষাদের চিহ্ন থাকেনা
    অথচ খাঁ খাঁ বিছানা-বালিশে কষ্টের গন্ধ এখনো প্রকট।
    আমাদের দুইবোনের যুবতী দুপুর ঝুঁকে আছে মাতৃসভ্যতার দিকে
    মায়ের বুকের অমৃতকলসী মুখে অবাঞ্ছিত কীটের নষ্ট খিদের মাতন।( সম্পূর্ণ অংশ ... পৃষ্ঠায় )
    সোনালী মিত্রের কবিতার ন্যারেটিভ একজন শক্তিশালী মহিলা-প্রট্যাগনিস্টকে তুলে ধরে, যাঁর আত্মআবিষ্কারের যাত্রা একইসঙ্গে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এবং পিতৃতান্ত্রিক এসট্যাবলিশমেন্টকে পাত্তা দিতে অস্বীকার করে, যদিও সেই ঘেরাটোপের মধ্যে বসবাস করে তাঁকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয় । তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয় একটি নারীকেন্দ্রিক কবি-পারসোনা, যার ভূমিকা বহুবিধ, পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্হাকে বিভিন্ন স্তরে আক্রমণ চালায় । তিনি বলতে চান যে একজন নারীকে একটি ডাইমেনশানে আবদ্ধ করা ভুল, তার ডাইমেনশান অনেকগুলো এবং তারা উৎসবকল্প ।
    কবিতা রচনার মাধ্যমে নিজের দেহের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন সোনালী মিত্র, শরীরের মালিকানা নিজের আয়ত্বে নেন, যা তিনি জানেন, পুরুষদের এসট্যাবলিশমেন্ট সহজে দিতে চায় না । লেখনপ্রক্রিয়া তাঁকে কণ্ঠস্বর দেয় ।
    কয়েকজন যুবতীকে নিয়ে আমি একটা ‘জেমস বণ্ড সিরিজের কবিতা’ লিখেছিলুম । কবিতাগুলো আমার ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত । সোনালী মিত্র’র জন্যও একটি প্রেমের কবিতা লিখে তাঁর যোনিজ উৎসবে অংশ নেবার প্রয়াস করেছিলুম ।
    পুরাণের সংস্কৃত গন্ধ থেকে নেমে এসে তুইই শিখিয়েছিলিস
    কবির লেখকের গণ্ডারের চামড়াখানা খুলে রাস্তার ভিড়েতে মিশে যেতে
    তার আগে নিজেকে বড় উন্নাসিক সুপারম্যান ভেবে
    হাতঘড়ির কলকবজায় ঝড়ের মেটাফরগুলো চালুনিতে চেলে
    ভেবেছি পিস্তল পাশে নেই বলে আত্মহত্যা করিনি এখনও
    দিল্লির নিম্নচাপে চোখ এঁকে ফিরিয়েছিলিস শব্দ-ভিজুয়াল
    তরোয়ালে আইনি ঝলকে লিপ্সটিকে ছাপা অটোগ্রাফ দিয়ে বলেছিলি
    প্রতিটি বিপ্লবের দাম হয়, বদলের বাজারও তো বসে
    জুলিয়াস সিজারের গম্ভীর শেক্ষপিয়ারি সাহিত্যের গমগমা ছেড়ে
    সাধারণ মানুষের মতো ক্যাবলা চাউনি মেলি তোর কথা মেনে
    বুড়ো বলে সক্রেটিস সাজবার সত্যিই দরকার ছিল নাকি
    গ্রিসের গাধার ওপরে বসে আথেন্স বা কলকাতার পচাগ্যাঞ্জামে
    ধুতি পরে ? কাঁধে উত্তরীয় ? সাহিত্য সভায় ? নাকের বক্তিমে ঝেড়ে !
    ভুলে যায় লোকে । মজার এ মরে যাওয়া । গন ফট । খাল্লাস ।
    সোনালী প্রেমিকা ! তুইই বুঝিয়েছিলিস : হুদো-হুদো বই লিখে
    বিদ্বানের নাকফোলা সাজপোশাক খুলে দেখাও তো দিকি
    কালো জিভ কালো শ্লেষ্মা কালো বীর্য কালো হাততালি
    উলঙ্গ নাচো তো দেখি তাণ্ডবের আঙ্গিকবর্জিত তালে-তালে
    চুমুর পুনঃচুমু পুনঃপুনঃচুমু দিল্লির নিম্নচাপ মেঘে
    এই দ্যাখ গণ্ডারের শিব-সত্য-সুন্দরের চামড়া ফেলে দিয়ে
    কেমন পেয়েছি নখে সোনালীর চুলের জীবাশ্ম
    'স্পর্ধাকাল' সোনালী মিত্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ । নিজের লেখার কাছে সৎ থেকে যে -কজন কবি ইদানিং কালে কবিতা লিখছেন সোনালী মিত্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম । মনের কোনও অবস্থান যেমন শাশ্বত হয় না , তেমন মনের কোনও অবস্থানই অচ্ছুৎ নয় । কিন্তু সাধারণ মানুষেরা অন্যের কাছে নিজেকে সৎ প্রমাণ করার জন্য মনের গোপন কথা চেপে যায় , সোনালী মিত্রের কবিতায় যেন ভেতরের সেই গোপন কথা বেরিয়ে এসেছে । শুধু বেরিয়ে আসেনি , পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে । ভীতু সৈনিক কোনদিন যুদ্ধে জয়ী হয় না , জয় চিরকাল সাহসীদের জন্য । সোনালী মিত্রের কবিতা সাহসী সৈনিক , তেজী ঘোড়া । সোনালী মিত্র যেন বাংলা কবিতার মিথ ভাঙতে এসেছেন , যেন শব্দকে শাসন করতে এসেছেন । নাহ্‌ , পূর্বসূরির বা বর্তমানের কোনও কবির কবিতা অনুসরণ নয় , বরং নিজেকে নিজে অনুসরণ করে গিয়েছেন 'স্পর্ধাকাল' জুড়ে । যারা সমসাময়িক কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন , তারা যদি সোনালী মিত্রের কবিতা না পড়ে থাকেন , বলব পড়ুন । পড়তে হবে এই কারণে যে , আপনি না পড়লে সোনালী মিত্র এগিয়ে যাবেন আর আপনি পুরাতন হয়ে যাবেন । কলকাতা পুস্তকমেলায় সোনালী মিত্রের 'স্পর্ধাকাল' শুধু প্রকাশই পাচ্ছে না , বাংলা কবিতাজগত পাচ্ছে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র । আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে 'স্পর্ধাকাল' শুধুমাত্র কবিতাবীজ নয় , একটা বোধিবৃক্ষ । তাই পুস্তকমেলায় পাঠক গেলে একবার স্পর্ধাকাল হাতে নিয়ে দেখুন , আশা রাখি সোনালী মিত্র ব্যর্থতা দেবে না পাঠককে ।
    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    কবিতা
    ১-
    মডেল
    শাড়িরগিঁট খুলতে খুলতে তিনি বললেন - ভয় করছে তোর ?
    তোর তো এই প্রথমবার !যদিও আমারও এই প্রথম।
    ঘরের ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা তার লেখা বইগুলো ফিক্‌ করে হেসে উঠলো
    বুঝলাম- ডাহাঝুট বলছে লোকটা।
    শিরশিরে ভালোলাগার পরশ ,মহব্বতে ছুটখাট মানিয়ে যায় এসব।
    সাদালোমশ বুকে লেপটে থাকা চামউকুনের মতো বিলি কেটে বললাম-
    না না ভয় আর কি !আপনি বিশিষ্ট শিল্পী ,তায় শ্লেষ্মারযাত্রী
    তার হাঁ-মুখে সিঙ্গেল মল্ট , দু আঙুলের ফাঁকে গলন্ত 555
    বগলে বুড়োঘামের গন্ধ।এসব নাকে নিয়ে ,
    তার দৃষ্টির সামনে খানিক ভিক্টোরিয়ার পরীমডেলে দাঁড়িয়ে বললাম-
    দেখুন তো এই পজিশনে সুবিধে হবে কি আপনার?
    কপাল থেকে রুপালি চুল সরিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে
    আলতো করে পর্বতচুড়ায় হাত রাখলেন পাড়াতুতো হুলোর মতো
    মিহিন লালওড়না পর্বতজোড়ার মধ্যেখানে ফেলে বললেন -
    এইবার ভীষণ নিসর্গ নিসর্গ লাগছে না ?
    দেখছি একটা বাচ্চাসাইজের ছিপ জলের ওপরে
    দাঁড়াচ্ছেই না , অথচ মাছেরচার রয়েছে যথেষ্ট !
    ডট পেনের সাথে খাতার সঙ্গম ঘটিয়ে তিনি বললেন-
    শুধু দেখেই যেতে হবে তোর অপরূপ রূপ ! বল কি আর করতে পারি তোকে
    শোকেসে সাজিয়ে শব্দ সাজানো ছাড়া!
    শোন,সিন্ধুসভ্যতার ক্লিভেজ ব্যাপারটা সামনে আনতে চাইনা কিন্তু,
    থাক কিছুটা অবস্ট্রাট ,কি বল!
    দর্শক তোকে মিস্ট্রিয়াস ভাবুক...
    মনে মনে হাসলাম,জানতে চাইলাম,আপনার আগের মডেলরা
    অনেক বেশি সুন্দরী ছিলেন,তাদের ছেড়ে আমায় নিয়ে মাতলেন কেন?
    বললেন তিনি,তারা ছিল ন্যুডকবিতার মডেল
    তোর মতো গ্রিক মিথলজি ছুঁড়ে কেউ আগুনে পুড়িয়ে এভাবে মারতে
    চায়নি আমায়।

    ০২
    রাজকুমার
    ------------
    এই প্রথমবার ঢেকে নিয়েছি হলুদপাতায় যৌবন
    এই প্রথমবার হেঁটে যাচ্ছি আগুন অভিমুখে
    এই প্রথমবার খই ছড়িয়ে দিচ্ছে আত্মজ
    এই প্রথমবার সিঁদুর - রক্ত - আগুন ফ্যাকাসে
    #
    আগুন উস্কে দিচ্ছে , লেলিহান সম্পর্ক মেপে নিচ্ছে তির্যক
    সম্পর্ক গিলে খাচ্ছে হবিষ্যি
    এই প্রথমবার দেওয়ালে টাঙানো প্রতিকৃতি যথেষ্ট ধুলোয় ।
    আর এই প্রথমবার তুমি অন্য বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ভাবছ
    একটা শরীরই যথেষ্ট অতীত ভুলবার ।
    #
    এই প্রথমবার নির্দ্বিধায় হেঁটে যাচ্ছি বৈঁচিফুলের দেশে
    এই প্রথমবার ভীষণভাবে বেঁচে উঠলাম ফুলের মধ্যে
    স্বপ্ন আসলে রক্ত বর্জিত এক রাজকুমার।

    ০৩
    চটি
    -----
    মন্দিরে যেতে ভালো লাগে
    সুযোগ পেলেই যাই – মন্দিরে।
    মন্দিরের নীচে খোলা নানা মাপের সুদৃশ্য-বিসদৃশ চটিগুলো সন্তসুলভ
    এদের সামনে ধ্যানস্থ হয়ে দেখি নানা রূপে নরনারায়ণ ...
    চটি গলিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন গরম পিচে দিকে
    দুর্ভিক্ষের সাথে সংকীর্তন সাধুসঙ্গ
    কেউ কেউ
    এসি গাড়ির হাওয়ায় জুতোর ময়লাটুকু ঝেরে
    পৃথিবী এবং মধ্যবর্তী ছায়ায় কাচ তুলে দিচ্ছেন প্রাগৈতিহাসিক।
    ...প্রকৃতই তারা ঈশ্বর!
    #
    মন্দির দ্বারের বাটি হাতের ভিখারীগুলোকে পাপিষ্ঠ মনে হয়
    মনে হয় অসুখ ভর্তি ফুসফুস রোজ বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
    ফিতে ছেঁড়া চপ্পলে শুনেছেন ঈশ্বর থাকে কোনদিনও?
    #
    গড় হয়ে প্রণাম করি,খোলা চপ্পলের পাশে ঈশ্বর দর্শনে
    ফেলে যাওয়া রাবারের জুতোকে অনেকটা নরম এবং শান্ত মনে হয়
    জাত খোয়ানো প্রসাদ ও চানজলের মত
    জাহান্নামের চটিজোড়ায়
    খুঁজি আতিপাতি করে খুঁজতে থাকি নিজের পায়ের মাপের ঈশ্বর !

    ৪-
    চৈতন্যযাপন
    অবদমিত রাত্রি মাতন।পূর্ণ চন্দ্র গৌর আঙ্গ।গৌরের অঙ্গ।দাও হে সঙ্গ।
    সঙ্গ পয়অঙ্গ ভজ।অঙ্গ ভেজে।ক্ষ্যাপা আর তো পাবি না না না ...
    ছেড়ে দিলে সোনার গৌর ...
    ভাঙ দুয়ার।যোনি দ্বার।ঈশ্বর প্রেম।প্রেমিক আমার প্রেম না জান!
    প্রেমিক আমার নরনারায়ণ, কোটি চন্দ্রেশ্বর।প্রেম না জান!
    বলি,নাচ হে নিমাই।নাচ তো দেখি?
    ধা গিরি গিরি ধা গিরি গিরি ধা ধা ধা।
    নাচ তো দেখি!
    ও হে কানাই গলছে আমার আকন্দের আঠা!
    এক দেহে বিলীন দেবোত্তম,হে মাধব- জাত রাখি না কূল রাখি শ্যাম?
    বৈষ্ণব রাই রসকলি ত্বকে।রস কমলীনী।কৃষ্ণ মাখ,চৈতন্য আন চেতনা প্রহর।
    অচৈতন্য কালো দেহে সাধ দেহতত্ত্ব,বাজাও খোল, বাজাও ব্রজের বুলি
    তুমুল বাজাও বৈষ্ণবীর ঝুলি।
    আমার সোনার অঙ্গ পুড়ে সঙ্গ...
    খাও ক্ষীরনদ খাও নীরনদ।রজ:স্বলা খাও শ্রী হরির দ্যুতি।
    বীজের ভার -বীর্যের ভার এ দেহ ছোঁবে না।
    এস গাঁথি মালা হে পরম ঈশ্বর,এক হাতে মাই অন্য হাতে নিমাই।
    খাও রে প্রেম- সাধন সঙ্গ,পরম ব্রহ্ম- সাধন অঙ্গ
    বলি,ছেড়ে দিলে সোনার গৌর ...ক্ষ্যপা ছেড়ে দিলে প্রাণের গৌর
    আর তো পাবে না না না...যেতে দেবো না।



    মর্জিমাফিক
    এই যে শ্রীমান , মাফ করে দিলাম , তাকিয়ে থেকো
    এই যে শ্রীমান , সাতখুনের অনুমতি দিলাম , সাধু সেজো।
    #
    তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই , একটু আগে এলে সন্তান উপহার দিতাম
    বর্তমানে আমি অচ্ছুৎকন্যা , বিষরক্তের দিব্যদেহে বন্ধ্যা
    তবে উপেক্ষা পাবে না , কথা দিলাম
    এসেই যখন পড়েছ যেতে দেবো না , থাকো মোমের-সিংহাসনে।
    সৈনিকের মত থাকো , অস্ত্র উঁচিয়ে ঢুকে যাও , চিচিংফাঁক
    ঢুকে যাও , ভেতরে মণিমুক্তা , ভেতরে নিযুত সম্পদগড়
    এই গুহাগৃহে তোমার পিতা এসেছিলেন , তাঁরও পিতা এসেছিলেন
    তাঁরও পিতা... কার্যত তোমার অপরিচিত নয় , কার্যত
    আমি তোমার মায়ের মত প্রাচীনা , ঠাকুমার মত , তাঁর মায়ের মত
    একদম লজ্জা করো না , দোহাই , ভেতরে লুকোনো কোনও সৈনিক নেই
    তুমিই সর্বাধিনায়ক , তুমিই শক্তিমান।
    কোষের এই বুধীরগড় এবার তোমার , সোজা হয়ে বস , ভয় পেয়ো না
    ওই দেখো অলৌকিক সুড়ঙ্গ , নিচে নেমে যাও , যাও
    দেখো , মেষপালক আছেন , অর্জুন সারথি আছেন , আছেন
    রিকশাচালক , পুরোহিত , অফিসযাত্রী , আরও আরও ...
    দেখো , সুড়ঙ্গের মধ্যে এত অন্ধকার
    দেখো , লক্ষবছরের ডুয়েল যোদ্ধারা
    তোমার আগে এসেছেন , তোমার সঙ্গে এসেছেন , তোমার পরে আসবেন
    আর আমি , আর আমি এক সামান্য নারী
    উপোস পাঠাবো না ফেরত , শ্রীমান খাদে পুততেই হবে মোমেরগাছ
    #
    দাঁড়াও , দাঁড়াও , যেয়ো না , মাতৃসভ্যতায় ক্ষুধার্ত থাকা ভাল নয়
    এইটুকু দিতে পারি , তুমি না নিলে জোর করে নেবেন অন্য কেউ আবার...


    অমৃত চুষি
    খিদে পেলে দাদুর ফিরে আসে যুবকবেলা
    ছানিপড়া চোখে কচি কচি বসন্ত ফুল তার মুখের সামনে
    ধরেন--- আমার কৃষ্ণপ্রিয়া ঠাম্মা।
    দাঁতহীন মুখে দাদু জাবর কাটেন।
    পৃথিবীর সফল মূহূর্তগুলো মানুষ জমিয়ে রাখে চোখে
    তা বুঝি রোমন্থনের জন্যেই?
    শীতের দিকে পিঠ ফিরে বসে শুকতে দেন গ্রাজুয়েশনের ডিগ্রি ,
    কাগজ মিলের মাইনে,নব বধূর ফুলের মতো যোনি,সন্তানের
    অভাবী মুখ,এবং জীবন যুদ্ধ যুদ্ধ এবং যুদ্ধ।
    #
    আমি এবছর ষোলো
    হু হু হাওয়ার সাথে সাইকেলের প্যাডেল ছোটাই
    আমি -লুকিয়ে চুরিয়ে সিগারেটে তামাম গোঁফের রেখায়,
    আমি-বন্ধুনীর নিটোল বুকের দিকে অতৃপ্ত পাড়ার হুলো...
    ঠাম্মা বলেন,ঠিক তুই দাদুর যৌবনবেলা
    যমক্ষেত্রে শুয়েও অমৃত চুষে বুঝিয়ে দেন দাদু,
    পুনর্জন্ম নিচ্ছেন দৌহিত্রের সবুজ বুকে।



    পদ্মাবতী
    চারপ্রহরের জন্য হয়েছি পদ্মাবতী
    সাপে কাটা দেহ নিয়ে আলপথে হাঁটতে হাঁটতে
    রূপশালী ধান ভরছি মড়াই, গমরঙা ইতিহাসে
    তুসের আগুনে জ্বলতে থাকা যাবতীয় সাপের খোলস ছেড়ে
    এসো আদি অনন্ত জয়দেব , বীজ রোপণ কর
    প্রেমের মহিমায়
    লুটিয়ে যাক উত্তরীয় , কৃষ্ণ সখির কাঁচুলিতে বুক রেখে
    ভুলের মাশুল দিয়েছে ইতিহাস ,ভুলের ভিতরে যত সর্বনাশ
    আর একবার ভুল কর কবি জয়দেব
    ব্রহ্মজ্ঞানে খেয়ে ফেল নারীর দ্রাক্ষা রসের ভাঁড়
    তোমার আস্ত পদাবলী গিলে ঢেকুর তুলে ভুলে যাও গীত
    আমার উদরে বেড়ে উঠুক প্রেমের সহস্রকীট ।
    প্রহর শেষে তৃতীয় দুয়ার উন্মুক্ত , এসো সখা , কবি আমার
    সাহিত্য ঘরে নতুন 'গীত গোবিন্দম ' ঠিক তোমারই মতন।
    চারপ্রহরের পদ্মাবতী নাম হোক সকল নারীর...


    "অ্যাসিড "
    আমার এগারোতম প্রেমিকের চোখে সালফিউরিক অ্যাসিড দেখেছিলাম। স্মিতহাস্যে সে আমার দশ নম্বর উলম্ব কাঁটাটা তুলতে তুলতে আলতো করে পায়ের পাতায় ছুঁয়ে দিয়ে বলেছিল, - এত ওজন নিয়ে ঘোরা ফেরা করো না হে...... তলিয়ে যাবে অতলে।অহংকারে আমার ভরে ওঠা ডাল পালা । আবেগ আর ওজন কি সমকেন্দ্রিক?কেন্দ্রবিন্দুটা কি কোন আধারকে কেন্দ্র করে ,এক বিশেষ ভর নাকি ভার!আবেগের রসায়নকে বহুবার টেস্টটিউবে ফেলে কাটাছেঁড়া করে দেখেছি নিটফল বিগজিরো।ইলেভেনের ফিজিক্স খাতায় আশুতোষ স্যারের নাম লিখতাম ,মনে মনে জুড়ে দিতাম নিজস্ব ভালো লাগার কিছু সোনালীডানা।আইনস্টাইনের মত মুখ করে ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে যখন দ্রবণ আর দ্রাবকের টানাপোড়েন বোঝাতেন ,আমি হাঁ করে চেয়ে থাকতাম তার ঢেউ খেলানো চুলের স্ট্যাটিস্টিকের দিকে ,শার্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া মার্বেল গুলির দিকে।মনে হত ভর ও ভারের বিশ্লেষণ বুঝি গুলিয়ে যাচ্ছে কিছু সংখ্যাতত্ত্বের বায়ুচাপের ওঠানামার মত বিন্দু বিন্দু ঘামে। মায়ের নিকানো উঠান থেকে খালপাড়ের কুরচি গাছ পর্যন্ত উড়ে যাচ্ছে ভৌতবিজ্ঞানের পাতা ,উড়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত দ্রবণ -দ্রাবক। আমার আগামী প্রেমিক তুমি কি বুঝতে পারছ বিস্ফোরণ আমার শিরায়- উপশিরায়।ভালবাসতে হলে আরো আরো সালফিউরিক করে তোল একান্ত সমীকরণ সময়। আমাদের উত্তাপের নাম দেব "অ্যাসিড "বিস্ফোরণ।আর একবার বুনসন বার্নার বুকে নিয়ে এস রীতিমত ভৌতবিজ্ঞান হয়ে উঠি।


    নাগকেশর

    কাল সারারাত দরজায় কড়া নেড়ে ফিরে গেছে
    নাগকেশরের ফুল তুলে এনে দিত যে ছেলেটি
    নীলবিকালে শ্যাওলা দীঘির ঝিল থেকে
    আমার আদুরে বেণীতে পরিয়ে দিয়ে বলত--
    টিউলিপ ফুল পরীরা দেখতে ঠিক তোর মত হয় ...
    কদমডাঙার মাঠের জলফড়িঙের ডানা থেকে
    সূর্যরঙ চুরি করে আমার ডালিম ঠোঁটে গুঁজে
    বলেছিল - পৃথিবীর সব রঙের কারখানা ঠোঁটে।
    #
    অথচ গুহ্যদেশ ভেদ করে পতন ডেকেছে আয়
    গুহাদেশের সাপ ডেকেছে যেখানে বৃষ্টিতে সাপেরা সর্পিণী সঙ্গমে
    গুহা ভাস্কর্য দেখিয়ে দিয়েছে তার শিল্পী স্বত্বা
    আর আমার আঁচল খুলতে খুলতে বলেছিল --
    সমস্ত শিল্প সৃষ্টি হয়ে চোখে ,
    বৃষ্টিবাদল বুকেই থাকে , দে ভিজিয়ে দে রে ।
    #
    এইসব ডাক উপেক্ষা করে বুঝেছি
    শিল্পের গায়ে শালীনতা শব্দ ঝুটা মুক্তো
    সৌন্দর্য আছে , নির্ভরযোগ্যতা তেমনটি সুগঠিত নয় ।

    ১০

    অশ্লীল কবিতা
    চেনা হাফডজন পুরুষের কোলাজে তুমি ঠিক পড় না ।
    বাবুগিরির চোদ্দআনা সিনেমাটিক রঙিনজলের মেহেফিলে
    ডিগবাজি খাওয়া চোখে তুলে নিচ্ছে
    আমার যন্ত্রমুগ্ধযৌন ১৪ মেগাপিক্সেল 'অ্যাপেল ' ।
    নিম্নে ধাবমান শুক্রকীটের আক্রোশ নিয়েই কি শুধু ভাববে
    আমার অদ্বিতীয় পুরুষবাজ ? তবে কি
    মরফিন-ঘুমে তলিয়ে থাকা ভুঁইফোড় অতিরঞ্জিত সময়ে
    বিষাক্ত জেলিফিশের চেয়ে রমণীর শুঁড় আনন্দদায়ক ?
    আমিও জেলিফিশ খাওয়া কুমিরদাঁত শান দিয়ে
    ডাকব অরিণ , এসো , এসো পেতে রেখেছি
    পুরুষের অন্তিমশয্যা , জো জমিনে ফলিয়ে নাও ফসলমাঠ
    আর নারীশরীরী সমুদ্রসৌকর্য নিয়ে সৃষ্টি করো সাহিত্য ।
    পুরুষের জ্বলন্ত সিগারের ওপর চিত শুয়ে আছি
    পটাশিয়াম সাইনায়েড নেই নারী গুহা- গহ্বরে
    স্তনে , যোনিতে বাজছে পিয়ানো রিডের গিমিক
    ত্রিশলক্ষ কীট পাঠিয়ে দাও তোমাদের সভ্যতা পালিত ক্ষেতে
    আমিও ভ্যানিসিং ম্যাথডের অঙ্ক জানি
    কীটদের নিহত ভবিষ্যৎ রেখেছি জন্মনিরোধক পিলে ।
    #
    অরিণ , পৃথিবীতে একচক্ষু মাকড়শা জাল বুনে যাচ্ছে
    নারীর স্তনের দিকে আদিমমত্ত কামনায়
    একটা গোটা 'জন ওয়াকর '- মুখে ঢেলে এগিয়ে আসছে
    যোনি-রক্তখোর মহাজোঁক ,
    র‍্যাটেল স্নেকের বিষাক্ত ধ্বনি নিয়ে
    দু'ই ঠ্যাঙের ফাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিশ্বশান্তির পতাকা
    প্যালেস্টাইনের হাভাতে শিশুরা গর্ভ থেকে চিৎকার করছে-
    মা , আমাকে পৃথিবীতে এনো না
    আমাকে জরায়ুর মধ্যেই হত্যা করতে পারতে মহাসৃষ্টি !
    শুধু যুদ্ধ করো নারী শরীরের অভয়ারণ্যে
    নিহত বর্তমান নিয়েই নারীর অন্তিম সুর-শয্যা ?
    আমার জীবন্ত শরীরে শবপোকায় অবৈধ রেণুসম্ভোগে
    স্যাঙাত থেমো না , মিনিটে ১২০ হার্টবিট তোল বুকে
    ৩৬০ ডিগ্রি নারী-গুহার দিকে একপাল ঘেও কুকুর লেলিয়ে
    ধ্বজভঙ্গ জানে না কোন হাতে মাই , কোন হাতে থাকে নিমাই
    আমিও আমার শরীর একান্নপীঠ তীর্থ করার জন্য
    ব্লাউজহীন নীলসৌন্দর্যের দিকে রাখবো না আর শেষশ্বাস !
    আমাকে গ্রহণ করতে কষ্ট হয় তোমার প্রেম ?
    গলার কাছে জমে আছে অমিতব্যয়ী শ্বাসকষ্ট
    ইনসুলিন নির্ভর জলসোহাগের সঙ্গমে পাঁচ'টা ঠোঁট
    পাঁচ'টা নামাজী বা পাঁচ'টা পুরোহিত বা পাঁচ'টা বিশপ
    যখন ধীরে ধীরে এঁকে দিচ্ছিল লিঙ্গকলার মধ্যে মৃতলক্ষ্মীর মুখ
    তখন বাতাসের বেগ যথারীতি স্বাভাবিক ...
    বৈদিক যজ্ঞ থেকে উঠে এসেছি আমি , নারী
    চন্দ্রের ঘরে ষোলআনা অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে শিল্পের সমাধান , নারী
    অথচ তোমরা , তোমরা ধর্ষিতা শব্দ আনলে , গণধর্ষণ আনলে
    আর শিল্প সাহিত্যে ফুটিয়ে তুললে ধর্ষণশিল্প !
    সাইজ ৩৪ ক্যাপের খোলে গণনাতীত মনু-পুরুষের লালা
    লালা শেষে হস্তমৈথুনঅঙ্গে ক্যাথিডার মালা পরে
    হাসপাতালের চির-নীরোগ নবোদয় !
    ২০১৫ সালকে প্রেমের স্মরণীয় মাইলফলক বানাতে চাও ?
    চাও কি আত্মহত্যা করি ?
    মা , পঞ্চাশ অধিবর্ষ ঘুমিয়ে রয়েছে , পঞ্চাশ অধিবর্ষ পাটক্ষেতে শুয়ে
    ঘুমন্ত শিরদাঁড়ার উপর দিয়ে খেলে গেছে ফসল
    হাজার-লক্ষ যুগসন্ধিক্ষণের শিশুরা কলরোলে হারিয়ে গেছে
    এক্স- ওয়াই ফ্যাক্টরে
    তোমার আগের প্রেমিকারা কোথায় এখন জেনেছ কি ?
    হাজার - হাজার বেদ- উপনিষদ শ্লোক জুড়ে সুস্থতা
    হাজার - হাজার তীর্থংকর বর্ণমালা
    যা শুনিয়ে গেছে জীবতত্ত্বে
    সেসব অস্বীকার করে 'এ'- ছাপ ময়দামাখা নরমের দিকে ছুটবে ?
    স্থবিরতা , শারীরিক নয় বলি যদি মানসিক ?
    মা বলেছিলেন তুলসীগাছ পুতে দিও উঠোনের কোণে
    তুলসী নারী পবিত্রতা
    তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাতে - জ্বালাতে
    অসতী তুলসী হয়ে গেলাম মা , হাজারজোড়া
    গনবুট পিষে দেয় দু'শো ছয়'টা মেয়েহাড়ের কঙ্কাল
    তখন তোমরা কোথায় থাক পুরুষ ? কোথায় ছিলে অরিণ
    কোন বিশল্যকরণী নিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রেম ? কোন লৌকিক শিল্প
    আমার ভাঙা বুকের কাছে হয়েছিল অর্জুন সারথি ?
    প্রেম ক্রমশ বাজার দরের চেয়েও ভয়ানক সস্তা হয়ে যাচ্ছে
    রজঃস্বলা পৃথিবীর স্তন ,যোনি ,নাভি ,উরু .জঙ্ঘা ,
    শিল্প সাহিত্য ললিতকলায় ধর্ষণ শিল্পে হয়ে এলে
    আমি , হ্যাঁ আমি হাজার ধর্ষিতা নারীর প্রতিনিধি
    হয়ে অশ্লীল ও এডাল্ট কবিতায় বারবার বলবে
    ধর্ষণের চেয়ে কোন এডাল্ট শব্দ নেই
    ধর্ষণের চেয়ে অশ্লীল কোন শব্দ নেই অভিধানে ।
    সানগ্লাস চোখে যারা পৃথিবীর শিল্পের কারবারি , যারা
    নারীর উরুজঙ্ঘা, ঠোঁটের উপপাদ্যে নিজের অব্যক্ত কাম
    ফুটিয়ে তোলেন তথাকথিত শিল্প সাধনায়
    তাদের সুখের জন্য সোনালী মিত্র দায়ী নয় ।
    নারীর পায়ের ওপর কোমর , কোমরের ওপর স্তন , আর
    সবার ওপর একটা মাথা আছে এই সত্যর সামনে
    দ্বিধাহীন বলি- পৃথিবীর সমস্ত নারীঘাতী চোখ অশ্লীল

    ১১-

    হাংরি
    আরো একবার যদি প্রবল বর্ষায় ভেসে যায় দ্বীপ
    আরো একবার যদি প্রচণ্ড বিদ্যুৎএ কেঁপে ওঠে বুক
    তোমার মধ্যসত্তরের বায়োস্কোপ পিছিয়ে গেছে পাঁচটি দশক
    বলিরেখা মুছে গেছে , চুলের রঙ অভুক্তনিগ্রো
    সটান শরীরে সভ্যদেশে লিখছ- "ছোটলোকের কবিতা"
    মনোহর আইচ চেহারায় শুভাকে নিচ্ছ তোমার হাংরি বুকে
    শুভা তীব্রতম হচ্ছে , ঐ -তো শুভাকে নিয়ে লড়াই করছে
    ক'টি কালো পোশাকের আইন
    কালো পোশাক ঠিক করে দিচ্ছেন , কবি অশ্লীল , কবি ইতর
    কখন , কীভাবে অজান্তে যদি শুভা হয়ে উঠি এই একুশ শতকে
    ছিনিয়ে নিই শুভার রাজমুকুট ? যদি বলিঃ-
    কবি , নারীর গ্রীবার ওপরে মাথা , মাথায় দু'টো চোখ
    কঙ্কালযোনি একটা কবিতায় এগিয়ে যেতে পারে
    আত্মাপুড়িয়ে 'যোনিকেশরে' মন্থিত হতে পারে অমৃতযোগ
    কবি, পাঁচ দশক আগে আমি জান্মালে ? পাঁচদশক আগে
    আমাকে পুড়িয়ে দিতে - দিতে একবার ও ভাবতে না
    নারী দুষ্প্রাপ্য সোনালীসেডনা ?
    নদীর বুক ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে , ক্রমশ নৌকা ছোট
    পূর্নাঙ্গ জীবন মিলিয়ে যেতে যেতে সূর্য দেখছে সামনে অন্ধকার
    পথ অন্ধকার , অন্ধকারে একটা হাতই যথেষ্ট , কবি
    একটা হাতই যথেষ্ট, হাত ধরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে

    ১২-
    নাবিধ্বসা

    সেই লোকটির সাথে রোজ দেখা হয়
    সব্জি বিক্রির ফাঁকে ক্রেতা গৃহিণীর সুডৌল নরম হাত ছুঁয়ে
    পুড়ে যায় যার সবুজ পাজামার গোপনতা।
    তার লালাসিক্ত চিত্তবৈকল্যের দিকে একযোগে
    গ্রাস করত শয়তান এবং সন্ন্যাস সন্তাপ।
    সেই শূককীট উন্মাদ লোকটিকে দেখতাম,
    চাষযোগ্য মাটি পেলেই,
    নাভিকুন্ড আঁকছেন তার নিরক্ষর সব্জীশালায়,
    নিখুঁত দাঁড়িপাল্লায় ফুটে উঠছে একে একে
    নধর আপেল,মধুবনি সরোবর, ত্রিভুজ মাপের যজ্ঞভূমি।
    দেখতাম,
    অববাহিকার শেষ বিন্দুটিতে বসিয়ে দিচ্ছেন কৃষ্ণ সারসের
    অভুক্ত দুটি চোখ
    #
    সেই লোকটা ভোরবেলা ছুটে যান সব্জি বাজারে
    যার ঝুড়িসুদ্ধ আলুতে লেগে থাকে নাবিধ্বসা গন্ধ
    যারা সফলভাবে সব্জির শরীর খেতে অক্ষম তারা সস্তা শব্দের
    নির্যাস খেয়ে বাঁচেন।
    বেপাড়ার ফেলে দেওয়া নিরোধকের মত দুঃখী মুখে
    গলা চড়িয়ে হাঁকেন "বৌদি ফল কিন্তু সস্তা,সব্জির সাথে এককাঁদি ফ্রী” ।

    ১৩-
    জলাতঙ্ক
    _______________________
    তিনপ্রহরের বিলের ধারে দেখেছিলাম
    সাপ গিলে খাচ্ছে সাপের সন্তান
    গিলে খাচ্ছে সন্তানের মৃতনাভী শোক
    ভুলে যাচ্ছে মা সাপের ডিমের জগত , ভুলে যাচ্ছে
    প্রসববেদনা রক্তাক্ত জরায়ুর জল
    এ কেমন জলাশয় ! যেখানে একে অপরের শরীর
    চাটতে চাটতে নখাঘাতে দাঁতের রোমহর্ষে
    নীলাভ স্তনে ধর্মযাজকের ক্রুসেড সেনার স্বাক্ষর?
    সেখানে জন্মানো শিশুরা বিশুদ্ধ আর্যরক্ত কিনা পরীক্ষা
    দিতে দিতে বুলেটের সামনে পুরো প্যালেস্টাইন!
    #
    আমাদের জন্ম হয়েছিল লিঙ্গের উদ্বেগে একথা
    বিশ্বাস করতে বাধ্য হলে পিতার মধ্যে গৌরাঙ্গ নেই।
    মায়ের দু পায়ের ফাঁকে ধর্মের বীজ বুনে দিলেন যে পিতা
    তার কুলীনতা আর ধর্ম ভালোবাসার অন্তরালে
    যারা রয়েছেন তাদের যদি শ্রেণীশত্রু বানিয়ে দাও
    তাহলে আমিও ভাই এর বুকে ভাই এর ছুরি।
    কোন লুব্রিকেন্ট সন্ধ্যায় নারীর যোনিতে পুরুষ লিঙ্গ
    চাপিয়ে দেওয়া এই সময়টাকে মান্যতা দিয়ে বলব
    হত্যা তুমি জায়েজ …
    #
    গির্জার ঘণ্টা নাড়িয়ে রক্তের দিকে হেঁটে যাওয়া অন্ধকার
    তোমাকে শাবাশ
    মসজিদের দিকে নামাজী মাথা রেখে তলোয়ারে শান দেওয়া
    মস্তিষ্ক তোমাকে শাবাশ
    মন্দিরের আরতি প্রদীপের শিখায় হাত ছুঁইয়ে গানফাইটের
    চেতনা পুরুষ , তোমাকে শাবাশ।।
    #
    ক্রমে ক্রমে দুষ্প্রাপ্য প্রজাতিরে দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি
    সন্তান গিলে ঢেকুর তুলে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকি......

    ১৪-

    নিটোল প্রেমের কবিতা

    আমাদের নতুন ফ্ল্যাটের দক্ষিণ খোলা ঘরে
    একটা মেহগিনি কাঠের পালঙ্ক শুইয়ে রেখ
    জানলায় ঝোলাব তোমার ঠোঁটের রঙের পর্দা।
    ব্যালকনিতে মানিপ্ল্যান্টের টব থাকবে ভালবাসা
    লতায় পাতায় গ্রীলের ফাঁক বেয়ে নেমে যাবে
    আমাদের হূদয় যেখেনে থাকে।খুব সাধ জান -
    সিঁড়ির পাশে যোগেন চৌধুরী চুঁইয়ে পড়বে
    টুকরো সম্ভাবনার চিলতে আভিজাত্য ...
    স্টাডি রুম টা হবে ঠিক তোমারই মত
    রবি ঠাকুরের যুবক বয়সের ছবি দেয়ালে ঝুলবে
    নিয়ন লাইট শেডে ...আবার ,
    মেঘ করবে যখন তখন হঠাৎ নামা বিষ্টি তে
    বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজে যাবে আরশী টানা জানলা
    ঘনিষ্ঠ কোন মুহুর্ত...
    শুধু ছাদ টা হবে ঠিক আমার মত
    আপেল গাছের সবুজ লালে মিশে
    কিছু ছোট্ট ছোট্ট পাখির মিষ্টি সুরে
    ঘুরে আসব সবুজ দ্বীপের চরে।
    কপালের টিপের মত একটা আকাশ কিন্তু রাখব
    তুমি আবার না করো না যেন
    সন্ধ্যে বেলা মিউজিক সিস্টেমে বাজবে কোন
    দেশোয়ালি গজল ,হেলিয়ে পড়া সোফায় মাথা রেখে
    তোমার বুকের তারা খসা দেখব।

    ১৫-
    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে

    গর্ভ নিরোধক পিল খেয়ে ঢেকুর তুলে
    স্বর্গীয় রাত গুলো যখন হিমাঙ্ক ভাঙে শরীরের
    আর পুরুষ-জাহাজ ভাস্কো - দ্যা -গামা কলম্বাসের ভূমি
    আবিষ্কারের আনন্দে নোঙর ফেলে অন্ধকারে !

    তখন আমি
    নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে বেহায়া সাতাশ-যৌবন
    স্বপ্নের -ঘোরে ভিজিয়ে নিই শিউলি-সকাল
    আর প্রভাতের মাটি ভেজা শিশির রঙে নীলকণ্ঠ পাখি
    এসে বসে চোখের ডালে ;
    তার পালক থেকে ঝরে-পড়ে ঝর্ণা মুগ্ধতা
    তার ডানায় থাকে আকাশের আমন্ত্রণ
    #
    হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়
    দেখি শরীর জড়িয়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন-পুরুষ
    আমাকে জড়িয়ে রয়েছে শতাব্দী-প্রাচীন পুরুষাঙ্গ !
    #
    এসো নীলকণ্ঠ পাখি ,
    আমি শরীরের আবেদন ছড়িয়ে যাব রাত্রির কাছে
    প্রভাতী আলোতে দিও উজ্জ্বল ডানায় একবার ...

    ১৬-

    বর্ষামঙ্গল

    এমন পাগলের মতো ভালোবাসতে আছে বলো !
    ভালোবাসতে গেলে দু একটা বর্ষাদুপুরকে আগুনের স্পর্শ দিতে হয়
    খোলা জানলার বৃষ্টিছাঁটে , চিবুক ছোঁয়া গুঁড়োগুঁড়ো জলরেণু ...
    বলিষ্ঠ বাহুঘেরে ভিজতে দাও মেঘনগরীকে।
    জান না ,প্রকৃত ভালোবাসারা ভাষাহীন হতে চায়!
    বন্যা আসতে পারে ,অতি বর্ষণের সঙ্কেত মেঘে!
    ঘরে চাল-ডাল তুলে রাখার মতো মাতোয়ারা হোক প্রেম
    কলারভেলা ভাসিও ,দু'জনে লগি ঠেলে দেখে আসবো সেই
    কদমগাছের চূড়া আর কবুতরদের সংসার- অক্ষত আছে কিনা!
    এরাই তো শিখিয়েছিল, এ-ওর পালকে ঠোঁট ঘষে মাখে সঞ্জীবনীপ্রেম সুধা
    এস শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বুকে ধরি, লোকে বেহায়া বলতে পারে !
    বলুক; সিগারেট নি:শেষে তোমার কবিতায় বইবে যমুনার নীল উপমা
    আমার চন্দ্রাবলী চাঁদে মাথুরজনিত বিলাপে জেগে থাকুক ব্যক্তিগত বর্ষামঙ্গল।

    ১৭-
    বিবাহবহির্ভূত

    তার সাথে বৈবাহিক কোন সম্পর্ক নেই আমার,
    অতএব স্বামী বলা যায়না তাকে।
    জৈবনিক ক্রিয়ায় সংযুক্ত নই বলে পরকীয়া ও নয় ...
    প্রাক্তন প্রেমিক!
    বর্তমান প্রেম জোটা না পর্যন্ত তার নামের আগে
    প্রাক্তন বসানো যায় কি!
    অথচ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলেই
    কি করে যে কেটে গেল এতগুলো কবিতা বছর!
    টেরই এযাবৎ পাইনি।
    #
    যৌনতায় তিনি আছেন?
    না না সে তো কামনাসঙ্গীও নন।
    আমি জানি তিনি নন আমার সিঁদুরের সমকক্ষ,আমি এটা জানি
    কারণ আমার জানাটা সকলের জানার চেয়ে বেশি জরুরি।
    শ্রেষ্ঠ সিংহাসনে তাকে মান্যতা দিতে গেলে ভেঙে পড়ে
    সমাজের পুরাতন ভাবাবেগ। তবে সে আমার অভ্যাসগত নিত্যদিনের অন্ন।
    #
    ব্যক্তিগত পুরুষ ভাবতে পারি?
    তাই বা কি করে হয়!
    প্রাগৈতিহাসিক দেওয়াল জুড়ে সে ছড়িয়ে রাখেন অক্ষরজনিত ব্যথা ,
    কিছু পোষা ময়ূরীর পেখম পাবেন বলে।
    #
    সে আমার লৌকিক নন,অলৌকিক ও নন
    পারলৌকিকক্রিয়ায় আমার সাদাথান পড়ার দায় নেই কোন
    তার নামের হবিষ্যি আমার ছেলের সরায় ফুটবে না কখনই।
    অথচ ,
    চেলিতে মোড়ানো রূপশালী ধানের বীজে রাখি তাকে
    বিনাবাক্যব্যয়ে তার নারীখোর হাত ধরে অধঃপতনে ডুবে যাই।
    ঘর ও নয় পরও তো নয়,সে আমার বিবাহবর্হির্ভূত।

    ১৮-
    ফিতে

    তখন শ্যামাপূজার মেলায় নিশ্চিন্দিপুর মাঠে
    খুব ধুমধাম বাজি পোড়ান হত ,
    ভায়ের হাত ধরে জংলা খালপাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম
    কত্ত রংবেরঙের চুড়ি ফিতে দোকানে ঝুলছে
    আর মাঞ্জা দেওয়া সুন্দর যুবাপুরুষরা কিনে দিতেন
    তাদের প্রিয় কেউকে সেসব , বাড়ি এসে
    মায়ের কাছে বায়না ধরতাম , আমার অমন ফিতেই চাই ।
    মা হাড়ির নীচে মাটি লেপতে -লেপতে বলত , - আগে বড় হতে হবে
    তারপর না ফিতে! ফিতে বাঁধতে চুল লাগে ।
    আমি এখন কুলুঙ্গি পেরিয়ে আড়ায় রাখা কুলের আচার পর্যন্ত ছুঁতে পারি
    মা ,আমি আর কত বড় হব !কবে ফিতে দেবে ?
    মিত্তিরদের ছাদে অনেক ফিতে ঝোলে।
    কুলের বিচি থেকে তালশাঁসের জমানায় পড়লাম ,
    মা কবে বুঝবে তুমি ! সময় যে যায় ...
    সেবার খুব বর্ষা হল , মাঠঘাট তাথৈ তাথৈ
    সেবার ঘোষদের জোড়া দীঘিতে খুব বাড়ল ব্যাঙের ডাক
    কোনো-এক আটপৌরে রঙিন কাপড়ের ফিতে আমার গলায়
    মা অন্ধকারে মৃদু কুপির আলোতে আবিষ্কার করল বোধহয় !
    মা আমার আর কোন ফিতের অভাব নেই ...
    গলা থেকে পা পর্যন্ত ঝুলছে অদ্ভুত সব রঙিন ফিতে

    ১৯- মৃত ঈশ্বর
    ______________________________
    আর খানিক পথ বাকি , বাকিপথ পেরলেই
    গণিকার রূপ , যে রোজ -রোজ খুন করে দু'চারটে ঈশ্বর ।
    ভয় পেও না ধৈর্য রাখো , তার ভরাট স্তনের দিক মাথা রাখো ,
    তার ঘামের স্নানে বেহেস্তের শুদ্ধতা , মুখের দিকে
    তাকিও না , হুইপ দাও , বল , খোল দ্বার !
    জব্বর মূর্খ ক'জনেরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে
    তুমি তো তেমন নয় ! ওর কপাল তিলে লেখা আছে
    বিকৃত সভ্যতার ভেঙে যাওয়া মন্দির
    ওর গালের টোল দেখে ভুলে যাও
    ঘরের সন্তান হেসে উঠলে অবিকল অবিকল অমন টোল
    যে ঠোঁটে স্বর্গ বসিয়েছ সেখানে দেখো বসে আছে
    শহুরে গঞ্জের সমস্ত ঈশ্বর
    তুমি তো এমন বোকামো করো না ! তুমি বরং ওর নাভির
    গভীরতা মাপ , দেখবে কেমন জন্ম নিচ্ছে কামের ঈশ্বর...........
    #
    এত সিঁড়ি ভেঙে তুমি কি এমন দেবতার জন্ম দেখতে চেয়েছিলে?

    ২০- মৌ রঞ্জন
    হে আপলক ,ক্ষান্ত হও
    অনির্বাণ দৃষ্টিপাশে বিদ্ধ করনা ঐশ্বর্য সনাতন গৌরব
    তাবৎ আগুন - রূপ শুধুই বিভ্রম নেশাগ্রস্ত ;তিষ্ঠ কিয়ৎকাল।
    বনমালীপ্রেম, মৌ রঞ্জন শিখিপাখা;হে মাধব
    রমনীর পায়ের কাছে রেখো না ফুলেল উত্তাপ
    বরং সুপ্রসন্ন হও মোহনী মোহন , গুণগ্রাহীতায় অমরাবতী ভাব।
    পুড়ে যেতে দিও না নিরক্ষর হিরন্ময় শৃঙ্খল
    যে সুচারুকাম জননী গুহার দিকে
    জিইয়ে রেখো গাভীর জাবরধর্মে।
    শুদ্ধ হোক সুশীল হে অকৃতজ্ঞ সময়
    যদি বলি ,
    লোলুপগ্রাসের মুখরায় জেনো ভালবাসা হারায়
    দুইহাতে জড়িয়ে ধর রমণীয় নাভিকুন্ড,উন্নত স্তনজোয়ার
    অমৃতসিন্ধু ভাব ,একবার মাতৃকাম্য ভাব।
    মহাপ্রলয়ের আগে যেখানে ব্যথা নেই,ক্ষত নেই
    কূল হারাবার ব্যাভিচার নেই পৃথিবী জন্মখেতে।
    শতেক অক্ষয়লিঙ্গ সেখানে ডুবে গিয়ে ভেসে জন্মায়
    ব্রহ্মজ্ঞানী অমৃতস্য পুত্র:
    ২১-
    অরণ্যভূত

    মায়ের পা জড়িয়ে ধরে দাদা বলেছিলো,'ফিরে আসবো একদিন'
    আমরা সকলেই জানতাম, দাদা আর ফিরবে না।
    শাল,মহুয়ার পাতা ভেদ করে ধূসর রঙের চাদরে মুড়িয়ে
    দাদার শরীর মিশে যেতে দেখেছিলাম একলা অরণ্যে।
    #
    ঠাকুমা বিড়বিড় করে মাকে বলেছিল,ভূতে ধরেছে ওকে
    জঙ্গলভূত গিলে খেলো তোর ভাতার , এবার জোয়ান ছেলে।
    মা শক্ত বলিরেখায় ঠিক সেনা-জোয়ানদের
    মায়ের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে;বিমূঢ় অথচ দৃঢ়,ক্লান্ত অথচ বলিষ্ঠ।
    আমরা দেখছি,
    উঠোনের কোণে বাবার সাইকেলের সাথে দাদার মোটরসাইকেলও
    শান্ত হয়ে রোদবৃষ্টি মাখছে
    আর বাইকের সামনে লেখা "মায়ের আশীর্বাদ" ক্রমশ: মুছে মুছে
    যাচ্ছে অতর্কিত ঝড়ে।
    ভারী বুটের আওয়াজে-সাইরেনের শব্দে-বুলেটের গন্ধে
    মা আমায় বুকের মধ্যে চেপে ধরতো
    ততোধিক জোরে আমিও আঁকড়ে ধরতাম মাকে।
    #
    কথা রেখেছিল দাদা
    একদিন কাক-জাগা ভোরে কারা যেন দলা পাকানো ছিন্নভিন্ন
    শরীরটাকে ফেলে গিয়েছিল আমাদের গোয়াল ঘরের পাশে
    যেন বাঘে খাওয়া দাদা।
    চোখে ওর নিশ্চিত বিদ্রোহ লেগে আছে
    তখনো দাদার হাতে বারুদের পরত
    বারুদ ছুঁয়ে দিতেই ভূতে পাওয়া মানুষ আমি
    গিলে নিচ্ছে মা'গো
    ক্রমশ: গিলে নিচ্ছে আমায় জঙ্গলভূতের ক্ষুধার্ত কৃষ্ণবিবর।

    ২২-
    বিজ্ঞাপনের পুরুষ

    বিজ্ঞাপনে প্রথম দেখেছিলাম তোমায়
    হলুদ আলোয় প্রেমচাতক খিদে মসৃণ হয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল
    রোমহীন বুকের হোর্ডিং ঘেঁষে ।
    কৌপিন জেদী মিশাইল যুদ্ধরত উন্মাদনায়
    পুরুষাকারকে উজাগর করে ছড়িয়ে দিচ্ছিলে চূড়ান্ত
    আভিজাত্য নাকি অহঙ্কার?
    দুরাত ঘুমাতে পারিনি আমিও,আকাশের উপর দাঁড়িয়ে
    তোমার আকাশ ছুঁতে চাওয়া ভঙ্গিমা দুডানা মেলে দিয়ে
    এত কামনীয় তুমি!এত ঐশ্বর্য কোথায় রাখ পুরুষ!
    যেন গ্রিক কারুকলা,যেন বিশ্বকর্মা শ্রেষ্ঠ সৃষ্ট এগিয়ে আসছে
    ঝুম চাষের নেশায়

    শীতকালীন গমবোনা রোদ্দুরে এস প্রেমিক হয়ে উঠি
    তোমার ড্রয়ার জাঙ্গিয়া রঙিন বিজ্ঞাপনে
    যদি ধরে নিতে পারি বাস্তববর্জিত তুমি নও

    ২৩-
    ভুল সময়ের মেয়ে

    ভুল নক্ষত্রে জন্মেছি বলে ছোড়'দা যখন-তখন
    শরীরে আরশোলা ছেড়ে দিত কবিরাজি বড়ির ফিকিরে

    #
    আলসে থেকে গড়িয়ে নামা বিকালের রোদ রসস্বাদ
    জিভ দিয়ে চেখে নিতে নিতে বুঝেছি
    বোধিসত্ত্ব থাকে মেয়ের চোখে আর পায়েস থাকে
    মেয়ের বুকে ...
    ভুল সময়ে জন্ম নাকি অশ্বিনী নক্ষত্রের অবস্থান ভুল !
    অনুভবের সঙ্গমরত গ্রন্থি আলাদা করতে গেলে দেখেছি.....
    মায়ের শুকনো বুকের হলদে কষে আমাদের ছয় ভাইবোনের
    লিকলিকে ঠোঁট , ভাতের পাতে ঠাণ্ডা ফ্যান , কমলিশাকের
    ঝোল গিলতে গিলতে , মা সাক্ষাৎ দেবী অন্নপূর্ণা !
    সময়ের ওজন নিতে নিতে দেখেছিলাম
    চুপসে যাওয়া মুকুল এর মত বড়দি ,আমার ফুলবেলায়
    মেজদা জিরাফ ও মাছরাঙা ঢুকিয়ে দিয়েছিল অন্তর্বাসে
    বলেছিল: বড় হলে সব অবস্থান মানিয়ে নিতে হয় ।
    #
    মাঝরাতে খিদে পেলে বিস্কুটের কৌটো হাতড়াই
    মনে হয় পুরুষ তালগাছ গিলে ফেলি , যদি পেটেভাতে
    মনে হয় গাছসহ পৃথিবী খেয়ে ফেলি , যদি পেটেভাতে
    মা বোঝে , আমার শরীরে মায়েরই বিষ
    মা , আমি তো আজন্ম ঘোড়া বিষের অ্যান্টি ভেনম

    ২৪-
    প্রযত্নে ঈশ্বর
    সূর্যডোবা পৃথিবীটা বাবা কাত হয়ে শুয়ে রোজ দেখেন । মাথার কাছে বুকশেলফে লাবণ্যর ক্লান্তি ছুঁয়ে ঘুমিয়ে থাকে শেষের কবিতা'র অমিত । ফিনাইলের গন্ধ , ধুলোবালি , ঝুলপড়া সিলিং টপকে ওরা দুজন আর বাবার হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনা।ক্যাথিডার নল পাক খেয়ে মাধবীলতার মত নেমে গেছে খাটের নীচে। বাবা বাগান ভালবাসতেন।মাধবীলতা পাতা ঝরিয়ে দিলে বাবা বুঝতে পারেন ক্ষয়ে যাচ্ছে তাঁর বাগান ।
    #
    'কর্কটরাশিতে কর্কট। বুঝলি '! বাবা মজা করে বলতেন।আমরা মজা করে বলতাম, সাঁড়াশি রাশি । বাবার যকৃৎ-এ কর্কটরাশি তিনবছর আসন পেতেছে ।ডাক্তার ফিরিয়ে দেবার আগে বাবা খুব মাংস খেতে চাইতেন , বুঝতেন না তাঁর একটু একটু মাংস খাচ্ছে শ্রীকর্কট । জ্যোতিষ শাস্ত্রে ভক্তি তেমন আগে দেখিনি , অথচ এখন মাঝেমাঝে মাসীমা কানের কাছে গীতার শ্লোক আউড়ে যান , বাবার চোখের কোণে সামান্য ভেজা ভাব লক্ষ্য করি ।জানতাম তার চোখের আয়ু কমে আসছে ক্ষীণশ্বাসের সাথে।
    #
    বাবা ঈশ্বর মানতেন না। ল্যবরোটারিতে বসে নিজে জন্ম দিতেন ঈশ্বরের । এখন মনে মনে নিজের তৈরি ঈশ্বরের স্মরণ করেন , তাঁরা সাহায্য করেন কিনা বুঝতে পারি না । স্যালাইন নির্ভর শ্বাসের গতির দিকে তাকিয়ে থাকি , জলের স্যালাইনের বুদবুদ পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাস ।
    #
    হাতঘড়িটা নিয়ে এসেছি আমি ।চশমাটা নিয়েছে ভাই।মায়ের জন্য পড়ে রইলো রঙহীন ঘুড়ি । শুধু দেরাজের চাবিটা উধাও। কারা যেন পতনের দিকেতাকিয়ে থাকেন পার্থিব গোছানোর জন্য । পৃথিবীতে সমস্ত কিছুই সমান চলছে । শুধু শিল্পী এসেছেন একজন , লেটার বক্সে আমাদের নামের প্রযত্নে বাবার নামে ঈশ্বর চিহ্ন লেখা হচ্ছে।

    ২৫-
    ব্যক্তিগত কুকুর

    আমার বাড়িতে কোনও বিলিতিকুকুর নেই
    যায় গলা জড়িয়ে ছবি তোলা যায়
    নাকে নাক ঠেকিয়ে আদরমুদ্রা লেন্সবন্দী করে
    টেবিলের ফটোফ্রেমকে সমৃদ্ধি দেওয়া যায় ।
    আমার বাড়িতে বিলিতি কুকুর নেই
    আধকিলো মাংস কিনে এনে উপাদেয় রান্নায়
    লুলু,লুসি,চিকি নামে ডেকে মেলে ধরা যায় তুমুল আভিজাত্য,
    আত্মীয়ের পাতে হাড় কখানি রেখে।

    কি করব বলুন!
    আমার বাড়িতে বিলিতিকুকুর নেই
    যে টিউশনি পড়তে আসা ছাত্রদের বলবো- তাকে ভাই বলে ডাকতে
    আর জিভের সাথে জিভ লাগিয়ে আদর মাখতে মাখাতে বলবো
    কেঁদো না সোনা,কেঁদো না, এই তো মা এসে গেছে

    আমার বাড়িতে সত্যি সত্যি কোন উচ্চ-মধ্য-নিম্ন জাতেরই
    বিদেশী কুকুরের জলাতঙ্ক নেই ,
    তার সাদা-লাল লোম নেই ইতিউতি ছড়িয়ে
    মোটা লেজের মারকাটারি ঐশ্বর্য নেই বাথরুম থেকে বেডরুমে
    সারমেয় আর আমার ব্যক্তিগত বিছানাও নেই
    অভাব পূরণের প্রয়াস নেই দেখে প্রতিবেশীরাও হাসেন।
    নিজের গলায় বকলেস পরে ঘুরতে ঘুরতে
    নাসিকা আবিষ্কার করে পেছনে দেশি ঘেউঘেউ
    তাই আমি স্বামীর সাথে ছবি তুলে সিরিয়ার শিশুদের ট্যাগ করি
    ওঁদের গলার অস্পষ্ট বকলেসটা ধরে আছেন কোন সুন্দরীঈশ্বরী!

    ২৬-
    ওম
    এস গোটা মন্দারমনি চেটে খাই দুজনে ...
    শীত শীত বালুচর, সোনালী-ওম মেখে শুকতে দিই
    দুমাথা অসম অবৈধচুল।
    ঘুমন্ত সমুদ্র পুরুষালী বুকে চুমু খেয়ে
    বিলিয়ে দেবেনা প্রিয়া চুপিচুপি ভালোলাগা!
    ঝাউয়ের আড়ালে চাঁদে গচ্ছিত থাক উষ্ণতা ছোঁয়াছুয়ি
    আহা চুকচুক প্রেম,মন মন নয় মাংসে মাংস গলে
    শিরশিরে মাখামাখি,
    আহা আরো ঘন হয়ে আসা শ্বাসে
    এস উত্তাল হয়ে উঠি ,আসন্ন ঝড় হয়ে বিয়ারের ছিপির গায়ে!
    মুঠোফোন অফ রাখ প্লিজ,
    জানু মনু সোওওনা বেবি, স্বামী সন্তান মিউট সুইসে থাক
    ভোর রাত্রেই ফিরে যাবে সুখ,সংসার সন্ধানী প্রিয়চোখ
    ধূনোর গন্ধে দেবী দেবী সেই তুমি।
    তার আগেই এস কুড়িয়ে তুলি বালির গভীরে স্বর্ণখনি
    প্রিয় কবিনী আমি কালিদাস খোলা বুক দাও,বিনিময় হোক কবিতার চাষ
    এস এস প্রিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে শাদা শাদা ফ্যানায়
    ঢেউয়ে ঢেউ মেখে দোজখ আগুনে উচ্ছন্নে যাই অবহেলায়।

    ২৭-
    আত্মহত্যার পরে...

    সেই ছেলেটিকে দেখলাম রেল লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে
    পেছন থেকে দানবের মতো আসছে ক্যাপিটাল-মেল
    সে ঝাঁপাবে কি ঝাঁপাবে না ভেবে চোখ বন্ধ করে
    কী ভাবছে ? এই মুহূর্তে ?
    মায়ের হাতের মরিচমাখা আলু !পঙ্গু বাবার প্রস্রাবের কৌটো!
    অবিবাহিতা দিদির বরফমাছের মতো দৃষ্টি !
    ছেলেটির হাতের ফাইল থেকে উড়ছে বীমা কোম্পানির কাগজ
    কোম্পানির ভরাডুবি এখন তার শরীরে , ডুবন্ত জাহাজ
    কালোমুখ , কালোমাথার ছেলেটি থেঁতলে যাওয়া গলা
    ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখছি , সম্মান কীভাবে মৃত্যুর চেয়ে বড় হয়ে ওঠে!
    #
    ফের দেখা হল পাটক্ষেতে তার সাথে
    মুখের গ্যাঁজলায় ফলিডলের পোকামারা বিজ্ঞাপন
    মিডিয়ার লেন্সের ঝলকানি , রূপবতী রিপোর্টারের দরদী কান্না ;
    দেখুন সরকারের উদাসীনতা
    দেখুন ফসলের দাম না পেয়ে আত্মঘাতী পাটচাষী ।
    তার স্ত্রীর শুকনো ফুটিফাটা কান্নার পাশে বসে দেখলাম
    সংসারের দায় ভার থেকে পালিয়ে যাওয়া পুরুষ
    শিরদাঁড়া ভাঙা মানুষের জীবন শ্বাসের চেয়ে অনিশ্চিত!
    #
    আরও খানিকটা এগিয়ে
    দেখলাম সিলিংয়ে ঝুলছে লাফিংবুদ্ধ ,
    কানের কাছে কান নিয়ে ফিসফিস করে জানতে চাইলাম
    -কেন করলে ? হাওয়া দিল , পকেট থেকে পড়ল লিফলেট
    বাবার এল আই সি ভেঙ্গে এসেছিল ডাক্তার হতে
    হোস্টেলের রাগিং
    ছেলেটির ঝুলন্ত পা দুটো হাওয়ায় অল্প অল্প নড়ছে
    তার মায়ের হাহাকার বুকে তুলে নিয়ে কারা যেন চিৎকার করে বলছে,
    দেখ দেখ জীবনযুদ্ধে সাহসিকতার আকাল!
    #
    শেষবার দেখা হল ওর সাথে,
    মর্গের হুহু হাওয়ায় সাদা চাদর উড়ে যাচ্ছে
    বরফের মধ্যে বরফ হওয়ার আগে
    অ্যাসিড-পোড়া গলায় কি যেন বলতে চাইলো
    তার মুখের কাছে কান পেতেও ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
    ডোমের ছুটোছুটি , ডাক্তারের হাঁকডাকের আওয়াজ আসছে
    অগত্যা বেরিয়ে আসতেই হয় , ওমা বেরবো কী
    দেখি , আমার সারা গায়ে অজস্র উল্কি , উল্কির সঙ্কেত বুঝতে
    না পেরে বাইরে বেরিয়ে এলাম , মর্গের বাইরে সেই ভিখারির
    সঙ্গে দেখা হল , যাকে আগে কোনোদিন দেখিনি ,
    ওমা , কী অবাক ! ভিখারি ডেকে বলল - করেছ কি ? গায়ে তো
    এমন খিদের ছবি এঁকেছ , ঠিক দেখো অবিকল পৃথিবীর মতো...

    ২৮-
    পটুয়া

    জেগে ওঠো মৃন্ময়ী। আত্মাস্থিত হও।
    প্রতিষ্ঠিত প্রাণ,খণ্ডিত দৈবরূপে।
    রূপদর্শী নাভির গভীরে নেশাজাত মধুফুল !
    আর এক পোঁচ মাটি। অহম -দাম্ভিকা-সৌন্দর্য রূপিণী।
    মৃত্তিকাশ্বরী।সুউচ্চ চূড়া।বৃন্তে অমৃতরেণু। দৃষ্টিসুখ।
    চক্ষুর সৃষ্টিসুখ!
    আহ !এস ঘাম-জলে।খসে যাক পাপড়ি-ঈশ্বরীমাটি।
    ওম শ্রমণা, প্রিয়তমাষু।পয়যোনি সম্ভূতা।
    আমি ডুব ডুব সাঁতার।আমি জন্মদাতা-আমি জন্মপিতা।
    কাপড়ে জড়াবার আগে মাত্র একটিবার...অপরূপ নোনাজল।
    কুমোরটুলির স্বাদ, অধোবদনা দেবী ঠোঁটে মেখে নাও।
    জোয়ারের স্রোত।তোমাতেই জায়া-প্রিয়া-ভার্যা।
    এস মৃন্ময়ী,যুবকক্ষীর নদে -আবক্ষ অবগাহনে।
    বল,দেবী আমার
    এক পটুয়া জীবন কি যথার্থ নয় মাটি ভালোবাসার?

    ২৯-
    বসন্তব্যধি

    কাউকে বলা হয়নি ,
    আমার স্বর্গীয়পাপ এবং দুরারোগ্য বসন্তব্যধির কথা
    কাউকে বলা হয়নি ,
    প্রতিটি বৃক্ষের কোটরে থাকে ভালোবাসার স্পর্ধা
    বাকলে থাকে ভাঙনের রুদালি
    #
    কৃষ্ণগহ্ববরের অতলে প্রসিদ্ধ ঠোঁট ডুবিয়ে দেখেছি
    নোনাস্বাদ নেই , জলীয়গন্ধ নেই , এমনকি ঘামের অনুতাপ নেই
    চোখের বোধিসত্ত্বে নির্মাণ কিংবা নির্বাণ নেই
    শুধু প্রাণীজ হাড়ে বিষ প্রবাহের হুতাশন
    #
    অস্বস্তিকর সংখ্যাতত্ত্ব জুড়ে বসে আছি ঘড়ির কাঁটায়
    অদক্ষ আগুনে বারবার ঝলসে যাচ্ছে দেহ , পোড়া রূপ নিয়ে
    কোনভাবেই ছুঁয়ে দেওয়া যায় শিল্পসম্ভার ?
    #
    কাউকে বলা হয়নি , রূপহীন মগজে কেমিক্যাল বন্ধন
    ছুঁয়ে যাবে , ছুঁয়ে যাবার-- সন্তান জন্মের আগে দেহ বারংবার?

    ৩০-
    কবি ০১

    আরো সরে আসছি কি তোমার দিকে দেবোত্তম ?
    ম্যানহোলের নীচে জমা টুপটাপ জলজ অন্ধকারে
    বিকলাঙ্গ শোক নেই , মিথেন আর মিথেন!
    তোমার মিথেন ছুঁয়ে দিব্য বেঁচে আছি।
    কুড়িয়ে তুলছি ফোটা শিউলি সকাল গার্হস্থ্য করপুটে
    গ্যাসীয় অবয়বের সকাল কেটে গিয়ে হেরিটেজ
    রাতে ভেজা সপসপ অন্তর্বাস ওঝা-সাপের মত
    লেলিয়ে দিয়ে কি খেলায় নেমেছ তুমি ?
    রোদ সরে যায় দ্বিতীয় রোদের দিকে
    এ যাবত অন্ধকার নামে অন্ধকারের মধ্যে
    পৃথিবী তার শোকের ছবি খুলে বসে শোকের ঘরে।
    #
    এমন কেন হয় দেবোত্তম ?
    #
    ভালোবাসলে কি রাত্রি যুবক হয়ে যায়?

    ৩১-
    সমকামী

    নিতার দুধফর্সা গালে কালোতিল নদীজোয়ার
    এই ভাসান কেউ দেয়নি , ভেসে যাওয়া ভেলা দেয়নি পুরুষমারীচ
    গায়ের বুদবুদ গন্ধ অফিসটাইমের লেজার খাতা পর্যন্ত ছুঁয়ে।
    ওয়াশরুমে সাবান ও জলের প্রবণতায় ভিজে সপসপ অন্তর্বাসে
    কাঁঠালরসের অন্তর্যামী মুছে যাচ্ছে বিতর্কিত
    রাত গভীর হলে হাত ঠোঁট দীর্ঘ জিব্রাগ্রীবা মুখ তুলে ঘাসের দিকে
    নিতার চুলের মত নিষ্ঠুর আকাঙ্ক্ষা ,
    নিতার বুক পাহাড়ে সৃষ্টিছাড়া আফিমখেত
    নিতার চুমুতে ঈশ্বর জন্মান আর মৃতসন্তান বীজ কষ্টহীন গর্ভাশয়ে
    ধর্ম আর বিধর্মীর মতো ঈশ্বর হন্তারক যারা উৎসাহী ,
    যারা সমাজের চোখে ধুলোবালি পায়ে পায়ে ঘোরে
    এবার বিজ্ঞাপন পাবেন আনন্দবাজারে , চলে এসো
    নাম-রুমেলা আহমেদ , সাকিন - ১৭০/A মেটিয়াবুরুজ

    ৩২-
    চিন্তন

    একটা ব্যর্থতার পাশে অনেকগুলো শূন্য বসালে- প্রেম হয়
    অনেকগুলো ব্যর্থপ্রেমের সামনে আয়না ধরলে - রোগ হয়
    অনেকগুলো রোগের সামনে ওষুধ ধরলে- টাকা হয়
    অনেকগুলো টাকা শীতবিছানায় ধরলে - উষ্ণ হয় কিনা পাঠক জানেন।
    #
    ফুল নিয়ে কথা হবে না এবং মথ নিয়েও না
    আশা এবং নিরাশা নিয়ে দর্শন হতে পারে , কবি চাইলে
    শব্দ নিয়ে অনেক কিছু তোমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ফিরে এসেছি
    বলে - তৃষ্ণা এবং বীজতলা নিয়ে কথা শুনিয়ে যাবেন - বাউল
    #
    দুঃখজনক ঘটনা তুলে খবরপাঠিকা - কাঁদতেই পারেন
    আমি একটা শূন্যের আগে আর একটা শূন্য বসিয়ে বললাম - দুই
    রাতের মধ্যে রাত ঢুকিয়ে বললাম- কতকাল ঘুমিয়ে রয়েছি দলঘাসে
    ঘুমের ভেতরে তোমায় জড়িয়ে ধরেছিলাম - তুমি বলতেই পারো
    মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা ...

    ৩৩-
    সোনাবৌঠান

    তারপরে রবিবারগুলো হারিয়ে গেলো ,
    তখন আমাদের রবিবারগুলো ছিল সোনাবৌঠানের মতো পাঁচমিশালি
    বড়লোক স্বামী , সোনাবৌঠানের ছিটেল ঘুঙুরসৌন্দর্যের
    মতো চঞ্চল ছিল আমাদের 'রকবাজ' মুহূর্তরা ।
    অন্য দিনগুলো সফল মৈথুন পরের ঝিঁঝিঁর মতো ঝিমিয়ে থাকত ।
    রবিবার এলে আমরা সকলে সামনের ছাদে শাড়ি মেলতে আসা
    বৌঠানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম , ঈশ্বর কেন সকল সফলতা
    বোঠানের সিনার দিকে দিয়েছে ভেবে এ- ওর সিগারেট কাউন্টার
    টেনে নিতাম নিঃশেষ !
    দেখতাম সোনাবৌঠান আলতা পায়ে স্লিভলেস ব্লাউজে
    উদ্দাম ও উদ্ধত আঁচল নেমে আসা বুকের রঙ্গোলী ছড়িয়ে দিচ্ছে
    শেষসন্ধ্যার নির্মম রাস্তায়
    যেমন বটি ছাই মাছের গন্ধের দিকে উন্মাদ হুলো একশত বছর ।
    আমাদের হালত ছিল বাসুকিনাগের ফণার বিষের আধার নিয়ে
    প্রকৃত আঁধারের দ্বারে স্খলনের বীর্যদৈন্যতা
    #
    তখন আমাদের নদী ছিল নৌকা ছিল না ভেসে যাওয়া
    তখন আমরা নৌকোখোলে লুকোনো শিখিনি যান্ত্রিক
    তখন আমাদের রবিবার ছিল যুবককলা
    তখন আমাদের ব্যক্তিগত রবিবারের নামটি ছিল সোনাবৌঠান

    ৩৪-
    পাগল
    শ্যামনগরের প্রেমিকার বহু ব্যবহৃত থুথু ঠোঁটে
    হামলে চুমু খেতে খেতে ওপাড়ার গৌরাঙ্গ
    বলেছিল - 'তোকেই চাই রে মাইরি জীবনে'
    হেসে গড়িয়েই পড়েছিল মেয়েটি , যেন বাঁধ ভাঙা নদী
    #
    গৌরাঙ্গ এখন দিন-রাত চৌরাস্তায় ট্র্যাফিক সামলায়
    চাকা ও মানুষের পদার্পণে
    মানুষ যত এগিয়ে এসেছে শরীরের দিকে
    প্রকৃত প্রেম সরে গেছে ট্র্যাফিকের দিকে...........

    ৩৫-
    তিল

    চিবুকের পাশের কালো তিলটিকে ঘিরে
    যাবতীয় গোলযোগ ,
    বান্ধবীরা হেসে বলত- রোম্যান্টিক বিউটিস্পট ,
    ছোটদি কাজল পেন্সিল নিয়ে তিল ছুঁয়ে নিত দেখে
    খুড়িমা হেসেই লুটোপুটি ।

    তুমি যখন ওই তিল নিয়ে মোহিত হয়ে - তিলের অছিলায়
    হাত রাখতে তিললীলায়
    বন্ধুমহলে ছড়িয়ে যেত অহেতুক উত্তেজনা ।

    এক সন্ধ্যেয় হায়নার চোখে তিলটা চকচকে--
    উজ্জ্বল খাদ্যভাণ্ডার মাকে দেখলাম প্রথমবার ,
    টিসুপেপার দিয়ে চেষ্টা করছে পাগলের মতো আমার চিবুক
    ঘষে তিলের সব গল্প মুছে দিতে

    ৩৬-
    মধ্যরাত্রির লন্ঠন
    ***************
    মাঝ-রাত্রিরে লন্ঠনের আলোয় ঘুমন্ত মুখ দেখি
    অনাবিল এক দেবশিশু , নিষ্পাপ , হত্যার চিহ্ন নেই
    ওই ঘুমন্ত শরীরে যে ঘুমিয়ে আছে থাক , নখহীন
    ঘুমের অবকাশে দাঁত নেই , পেশীতে অসুর নেই
    মেদে যৌন গন্ধ নেই
    খোলা তলোয়ারে কোন লোভীরক্ত লেগে নেই
    ঘুমিয়ে রয়েছে , নিষ্পাপ , নিষ্পাপ
    ঘুমের মধ্যে কালক্ষয় নেই , ঘুমের মধ্যে বিপন্নতা নেই
    আজ ঘুমিয়ে থাক , আজ থাকো দেবশিশু
    কেননা সুসময় এর জন্যই সময় আগামীর দিকে হাঁটে
    কেননা যেকোনো খোলা বুক পেলেই এস-ট্রে তে পিষে যাবে আগুন
    কেননা অন্ধকারেই ঝলসে উঠবে আবার মীরজাফরের বর্ম
    হে প্রিয়তম শরীর, গত মধ্যরাতের লন্ঠন কি তোমার মনে আছে?

    ৩৭-
    মরণফগ

    প্রত্যেকটা প্রেমিক চোখ আসলে এক একটা
    আটলান্টিক মহাসাগরীয় মরণফগ
    প্রেমিকেরর বুকের মধ্যে নারী 'মায়া সভ্যতা'র মিথ
    তার তুরুপের অঙ্গ আসলে কাদাজলের জোঁক
    যখন নরমবল উঁচিয়ে থাকে উপোষী 'কালুরায় ' দেবতার দিকে
    তখন নরমবল আসলে থলথলে মাটির জেলি কুমোরের হাতে
    আসলে , পুরুষের কাঁধে নয় , উরুতে জন্ম নেয় নারী
    পুরুষের চওড়া উন্মুক্ত বুক হাসিমারা অভয়ারণ্য
    নাভিকুণ্ড প্রেমের উষ্ণপ্রস্রবণ
    নারীকে ওম দাও , চোখে সে অন্নপূর্ণা, চোখে সে লক্ষ্মী
    নারী তখন চীনের প্রাচীর , তখন
    প্রত্যেকটা পুং আসলেই গ্রীক সূর্যদেবতা
    একালের পুংলিঙ্গকে 'হোক কলরবের ' মতো লাগে
    প্রতিটি শিডিউল আসলে গঞ্জিকা অন্ধকার
    'জাগতে রহ' নেপালি চৌকিদারের মতো সময়টুকু জেগে থাকে
    মানুষের জন্মের জন্য যতটুকু পুরুষের জাগা দরকার ...
    রবিনহুড বুক বিছিয়ে দাও প্রেমিক , নইলে ওয়াই কীট নিয়ে
    বেদে তাঁবুতে খেলে যেতে যাবে যেকোনো মদনকুমার।

    ৩৮-
    আত্মহত্যা #১২

    সেই মানুষটাকে আত্মহত্যার কথা বলি,
    বলি - অলৌকিক সুড়ঙ্গে একাকী নি:স্ব হতে ভালো লাগে না
    কোন ধাতুক্রিয়ায় মরতে ভালো লাগে না,ভোগের মহাকুম্ভে বাঁচতে ভালো লাগে না
    প্রেমিকের স্নানদৃশ্যের পুনর্জন্ম ভালো লাগে না,
    আমায় কেউ একটু ধুতরাবীজের সর্বনাশ দিয়ে যাও
    খেয়ে অঙ্গার দাহ্যে অমরত্ব ঘোষণা করি
    #
    জলের হুঙ্কারে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখেছি
    বর্ষণের মারণটানে উজাড় হতে দেখেছি কত পলাশের বন
    তাকে বারবার বলি- সম্পর্কে ছিদ্র রাখা ভালো নয়
    চোখঅদৃশ্য ছিদ্র দিয়েই লখিন্দরের মহাকাল।
    #
    শিকারের বিজ্ঞান শিকারির হাতছাড়া হয়ে কখনও নিজেই শিকার
    বলা যায় না তাকে - আত্মহত্যা প্রবণ বর্ণমালা ভুগছে অনাবৃষ্টির শোকে
    বলা যায় না - নিজস্ব শব্দরা বিশ্বাসহীনতায় ফুলশয্যার বাসি চাদর
    কাকে বলব , সোনার মোড়কে নিলাম উঠেছে ব্যক্তিগত অপূর্ণতা।

    ৩৯-
    বেশরম

    প্রথমবার তোমার হুকে হাত রাখতেই কুঁকড়ে গিয়েছিলে লজ্জায়
    প্রবল উত্তেজনায় ডান হাতে খামচে ধরেছিলে বেডকভার
    আর বাঁ হাতের সুদৃশ্য ধারালো নখগুলো অযান্ত্রিক
    শীৎকারে গেঁথে গিয়েছিল আমার রোমশ পিঠে।
    মুহূর্তের রাজা আমি। তত দ্বিগুণ আকর্ষণ উত্সাহে হুকের
    নিষিদ্ধ অন্ধকারে ঠোঁট চালিয়ে বুঝেছিলাম লক্ষ্মীতত্ত্ব থাকে
    লজ্জাশীল আঁচলে। পৃথিবীর অমৃতভান্ড থাকে,প্রেয়সীর মধুবুকে।
    দ্বিতীয়,তৃতীয়,চতুর্থ বারেও তোমার নাজুক শরম গলে গলে
    ভিজিয়ে দিয়েছিল আমার প্রাকৃতিক গোপনতা।
    অলৌকিক দেবীত্বে তুমি প্রেয়সী নিশিজান।
    আশ্চর্য!
    শেষবার অসম্ভব তুখোড় তুমি,দক্ষ হাতে ছিনিয়ে নিয়েছিলে
    প্রেমিক খিদের আকাল।
    ওগো মহাদেবী, তোমার পারদর্শী মুখরেখায় ছিল বেপরোয়া উষ্ণতা!
    দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললাম,মেয়েদের এত উদ্ধত হতে নেই,
    শেখায় নি তোমার মা?
    তুমি ক্লিভেজ খুলে দেখিয়েছিলে ঈশ্বরীর মুখবিবর
    উফ কি প্রচণ্ড ভয়ঙ্কর বধ্যভূমি !
    সেই প্রথমবার তোমায় ভীষণ সস্তা মনে হল
    অথবা মনে হয়েছিলো পূর্ণআগুন;জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে পারে
    যাবতীয় পৌরুষত্বের উদ্রেক!

    ৪০-
    রোদ্দুর ...তোমাকে
    প্রিয় রোদ্দুর ,আমার আর কোন কষ্ট নেই দেখ
    নবান্নের বুকে মাথা রেখে ফসল কাটা মাঠ ছুঁয়ে আছি
    সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়া বিষে নীলকণ্ঠের ডানায়
    অন্ধকারের দিকে পিঠ ,মুঠোয় সূর্য ধরে যন্ত্রণাটা অনেক কম।
    পৃথিবীর একটি অংশ ছুঁয়ে আছি অলকানন্দার ঢেউয়ে
    আর কোন ব্যথা নেই , প্রিয় তোমার বিজয় মুকুটে ঝরে পড়ে ঘাম
    পান করি নি:শব্দে...
    #
    পদ্ম গোখরোর গ্রীবা জড়িয়ে আছি ,শাল বনের মহুল তীব্র নেশায়
    আদিবাসী রাতে সাপের মাংস পোড়া গন্ধে ঝিম ধরে গেছে শরীর।
    কষ্ট টা আর নেই ছুঁয়ে দেখ...
    যে বার মেঘ করে ভীষণ ঝড় উঠল
    যে বার তোমার ডাকের অপেক্ষায় থেকে বজ্রপাতে বধির হল কান ,
    আমি অশ্লেষা নক্ষত্র হয়ে জেগেছিলাম আগামীর শেষ রাতে
    তাই কষ্ট টা আর নেই প্রিয়তম...
    কষ্টের কোন জাত নেই ,ক্ষয় নেই ,বিশেষ কোন অবয়ব ও নেই
    শুধু সময়ের দিকে জন্ম লিখে রাখে সময়ের দিকের মৃত্যু
    প্রিয় রোদ্দুর কষ্ট টা আর নেই।

    ৪১-
    শৃঙ্গারসিদ্ধ

    চৌষট্টিকলা শৃঙ্গারসিদ্ধ উচ্ছন্নে যাওয়া রমণীর মতো
    ব্যক্তিগত বাক্যরাও তন্বী হবে একদিন
    বৃক্ষেরশাখায় ঈশ্বর এসে লিখিয়ে নেবেন
    আমাদের গাছমাতৃক শূন্যতা ।
    বর্ণমালার মতো চোখে জেগে থাকা প্রাগৈতিহাসিক নদী'রা
    আত্মহত্যাপ্রবণ ভূমির গায়ে এঁকে দেবে ভ্রষ্টসঙ্গমের চিহ্ন
    #
    একদিন , ফুলশয্যায় শুকিয়ে যাওয়া নিঃস্ব ফুলেরা
    আমার প্রেমিকের কথা নয় , উচ্ছন্নে যাওয়া রাতের কথা নয়
    প্রভাতফেরী করা অভাবী সূর্যের গায়ে ছুঁড়ে দেবে
    তামাম পুঞ্জিভূত ক্ষোভ
    #
    অহরহ যাদের থেকে ধার করা অনুভব নিয়ে
    শব্দে নাড়াচাড়া করি , তারাই কেড়ে নেবে অধিকার ,
    হয়তো বা বলবে , কাঁদতে হলে নিজের হৃদয়ে কাঁদো
    কবিতার শব্দ আর কতখানি গভীরে ঢুকতে পেরেছে ?

    ৪২-
    এক্সক্লুসিভ

    পাঠক আমাকে বলেছিল,
    এবার আপনি কবি হতে পারেন
    অপূর্ব অক্ষরবিন্যাস বিপ্লব এনে শাসন করুন কড়া অনুশাসন
    নিন আগুন বেঁধে, আগুন মহড়ায়
    দিন ,দিন জ্বালিয়ে সমাজ অবক্ষয়।
    #
    পাঠক আমাকে বলেছিল,
    পুরুষবিদ্বেষী- নারীবাদী ইত্যাদি শব্দ একটা তকমা,
    মঞ্চে উঠুন -গর্জে উঠুক স্লোগান
    হন্তারক হাত গুঁড়িয়ে দিন শ্লেষ শব্দবাণে
    একে একে ছুঁড়ে ফেলুন ন্যাকা ন্যাকা তত্ত্বকথা
    শব্দকে যথেচ্ছ ভাবে নগ্ন করে তুলুন।
    #
    পাঠক আমায় বলেছিল,
    শিল্পীত হয়েছে সময়,পাঁচিল টপকে পালিয়ে যান,পালান পালান এবার
    এবার অন্তত অব্যাহতি দিন বাচালতা...
    ওই ছুটে আসা ইঞ্জিনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন নেশারু পায়ে
    অথবা ,অথবা কয়েকপাতা স্লিপিং পিলে অবসাদগ্রস্ত কবি
    পোষ্টমর্টেমে জানতে চাই, আপনার নরম বৃন্তে... প্রিয় -অপ্রিয় পুরুষ ঠোঁট
    ছুঁয়ে ছিল কতজন! সঙ্গীমানুষটি বিচ্ছেদ দিয়েছিলো !
    সঙ্গম শৃঙ্গারে অতৃপ্তিজনিত খিদে!
    মধ্যরাতের শকুন টেনে হিঁচড়ে খুবলে না খেলে এমন লেখা যায় কি!
    মরুন মরুন মরুন কবি,কবি মিছিলে দু মিনিটের নীরবতা পালন দেখি।

    ৪৩-
    আবিষ্কার
    এক সময় গাভীনীর প্রসব দেখার কৌতুহল ছিলো খুউব ।আমরা লুকিয়ে গোয়াল ঘরের পিছনে দাঁড়ালেই মা নীল আঁধারে ঢেকে দিতেন কাঙ্খিত সেসব দৃশ্য।তখন আবিষ্কারের নেশাটা ছিলো প্রবল,পিঠে নেমে আসা বেদম প্রহারের চেয়েও।তখন দুলে দুলে কলম্বাসের আবিষ্কার মুখস্থ করি।সদ্য জন্মানো বাছুরের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখার উচ্ছ্বাস মোহিত করে রাখতো আমাদের চারবেলা।
    দেখতাম বড়দিকে খানিকটা মায়ের মতো মুখ করে ঘুরতে।ইচ্ছে থাকলেও খেলতে যেতো না,গাছে চড়ে পেয়ারা খেতো না।মা বলতেন,সেয়ানা মেয়েদের ওসব করতে নেই।তখনো অবশ্য "সেয়ানা মেয়ে" আমার অনাবিষ্কৃত অধ্যায়।আমি টের পেতাম গাভীনীর চোখের সৌন্দর্য আমার মায়ের চোখ,বড় দিদির চোখ ছুঁয়ে নেমে আসছে আমার চোখে।সে ঝড়ের রাতে মাকে আতঙ্কিত হতে দেখলাম।লন্ঠনের মৃদু আলো ছড়িয়ে গেলো গোয়াল ঘরে।হঠাৎ আলোয় আরো বেশি অন্ধকারে ডুবে গেলো চরাচর।অদ্ভুত এক দৃশ্য নাকি কল্প!আমার ছোট্ট নরম চোখে ভয়ার্ত অনুরণন।গাভীনী তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।মা এবং গাভীনীর অসহায় দুটিমুখ ।পিছনের পা দুটো পেঁচিয়ে ধরে বিশালাকায় এক দাঁড়াস গাভীনীর স্তনের বোঁটায় জিভ লাগিয়ে শুয়ে।মা ধীরে ধীরে বুঝিয়েছিলেন দুধেজনিত আকাল।বুঝিয়েছিলেন আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধের জরুরি বিজ্ঞাপন ।
    রুগ্ন গাভীনীর পাশে পড়ে থাকে আমাদের বিলাপ।গাভীনীর টানা টানা চোখ ঠিক মায়ের চোখ,ঠিক দিদির চোখ।ভাবতাম ,আশ্চর্য ওদের শিংএর ধার কোথায়!দাদা বলতো বড় অবলা জীব।খুঁটি এবং দড়ির মধ্যে দীর্ঘ হতে থাকেন মা এবং বড় দিদি।ঘুমের মধ্যে বাড়ন্ত সেই দৃশ্য বিশাল সর্প হাঁ-মুখ।উঠে আসছে পায়ের পাতায়,হাঁটুর উপর,বুকের দিকে ...যেন নড়ে উঠছে আমার গলায় বাঁধা সুদৃশ্য দড়ি ও ঘন্টার শব্দ,টং টং টং টং টং টং ...

    ৪৪-
    তবু প্রেম দিলে না প্রাণে!
    তোমার প্রেমিকা হবো বলে
    যুবতীসূর্যের আকারের টিপ লাগাই আমার পাললিক কপাল চূড়ায়
    উন্নত বুক,পিঠ,নিতম্বে ছড়িয়ে রাখি মাতাল নরম সুঘ্রাণ
    তোমার উষ্ণতা পেতে চেয়ে,মধুঠোঁটে গচ্ছিত থাকে সুচতুর বর্ণমালা।
    #
    কেবল তোমার প্রেমিকা হবো বলেই
    শিকারী প্রবণতা আড়াল করি কস্তুরি হরিণীর ছালে
    আর খোঁপায় জুই ফুলের মালা জরিয়ে,তীব্র রোদ্দুর মাথায় করে
    প্রতিবাদী হই,বিরুদ্ধে ;ধর্ম -সমাজ- শৃঙ্খলের ভন্ড উচ্ছ্বাস।
    তোমার প্রেম পাব বলে
    মাতন জুড়ে আমি বৃন্দাবনী রাই,উত্তাল যৌবনে প্রেয়সী রাস রাধাকাল
    #
    কেবল তোমার জন্যেই,
    বাজি রেখে দেবীত্বের সংজ্ঞা,চোখের সনেটে মোহের কাজল গাঢ় ...
    আশ্চর্য! কাজল গভীর কালোয় চন্দ্রাহত তুমি?
    কলঙ্ক ভেবে আহুতি দাও প্রেমে, কৃষ্ণদ্বাদশীর আকাল!

    ৪৫-

    লড়াই
    হাত ধরে টানতে টানতে সকলের অলক্ষ্যে ঘরে
    ছিটকিনি তুলে দেওয়ালের সাথে ঠেসে ধরে পিসতুতো
    দাদা বলেছিল -চল ধর্মান্তরী হই
    #
    মা সকলের আড়ালে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ রাঙিয়ে
    ফিসফিস করে বলেছিল - রক্তের সম্পর্ক মনে রেখ
    ফরিদাদের মত আমরা নই ...
    #
    নার্সিংহোমে আমার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে
    নি:সন্তান দম্পতিটি, সদ্যজাত সন্তান কোলে নিয়ে বলেছিলেন -
    তুমি তো ওষুধ , ওষুধের কী জাতধর্ম
    #
    নার্সিংহোমের একান্ত কেবিনে ওড়নায় মুখ লুকিয়ে,
    সন্তানের ভবিষ্যৎ মায়ের হাত দুটো ধরে বলেছিলাম -
    বিশ্বাস করুন,
    আমার শিরদাঁড়ায় বিন্দুমাত্র সাহস নেই সোজা হয়ে লড়বার।

    ৪৬-
    সমাধান
    আশ্চর্য! একটাকা,দুটাকা যেখানে যা কুড়িয়ে পাচ্ছেন
    জমিয়ে রাখছেন বাবা ধুতির কোঁচড়ে ।
    জানতে চাইলে বলছেন-
    চিতার কাঠ সঞ্চয়ও জরুরী বেঁচে থাকার রসদের চেয়ে ।
    অথচ সঞ্চয়ের পাহাড়ে কতগুলি শূন্য লাগে আগুনে পুড়তে
    জানেন না পিতৃধর্ম,
    তিনি জানেন না কলুর তেলও যথেষ্ট নয়
    নিজেকে পোড়ানোর...
    #
    বাবা এখন আর সংখ্যা চিনতে পারেন না ,
    পরমহংস বাবার চোখে , আঙ্গুলে বিবেকানন্দ
    ব্যাংকের চেকবই হাতের সামনে হাজির করলে
    বাবা মাটি হয়ে যান
    আমরা বুঝতে পারি , আমাদের জন্য ফসলহীন বাবার মাটি।
    #
    নবান্নের পরে দিদি চলে গেলো , মা তো সেই অনেক আগে ...
    আমি আর বাবা খাতা নিয়ে বসি
    বাবার ক্ষুদ্র সংগ্রহ ছড়িয়ে রাখি মেঝেতে, বাবা বিড়বিড় করে গোনেন
    একে বিয়ে , দুইয়ে নাতি , তিনে পুড়ছে শরীর
    পাঁচে তোর চতুর্দশী ।
    ইদানীং বাবার মাথার ভুল হচ্ছে ভেবে আমি গোনা শুরু করি
    দশে - দশদিকে শকুন , নয়ে - নব্বই শেয়াল
    আটে আষ্টধাতুর আঙটি মানুষ
    সাতে , অভুক্ত কাঁঠাল রসে চামড়া ছিঁড়ছে খিদের জিন
    #
    পুজোর পর দাদা
    চলে আসার সময় পাঁচশ'র নোট ধরাতেই
    তার চোখ ও জলের বুনিয়াদে দেখতে পেলেন ভবিষ্যৎ
    কোঁচড়ে বেঁধে বল্লেন -সদগতি জন্মে বাঁধা থাকলো হবিষ্যি সমাধান।

    ৪৭-
    মেধাবী আগুন

    যখন তোমাকে ছুঁতে চাইলাম
    ওমনি ছুড়ে দিলে প্রাচীন মেধাবী আগুন
    শহরের সহস্রাব্দ কাঠ নিয়ে যেই না তোমাকে আবার ছুঁতে চাইলাম
    ওমনি ভস্মে পরিনত হোল শরীরের জতুগৃহ !
    যেবার তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ঘুমিয়ে গেল বংশানুক্রমিক নদী !
    ওমনি তুমি শবসাধনায় জিতে নিলে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল
    আর কেমন অবলীলায় ঈশ্বর হয়ে উঠলে
    আমি ও যগডুমুরের ভূমিকায় , আহূতি নাও দেব আমার !
    #
    ফিরে এসো প্রেমিক ----
    ডাকের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে সাত- সাতটা মহাসমুদ্র
    তুমি জন্মান্তরবাদের অমরত্বের দিকে রেখে যাচ্ছ যোনিকঙ্কাল
    আমি তখন ইহজন্মের খাল কেটে কুমীর ডাকছি

    ৪৮-

    মানচিত্র
    --------
    আমি আকাশ দেখতে চাইলাম
    আপনি মানচিত্র বিশেষজ্ঞের মত বৈষম্য ছুঁড়ে দিলেন মহামান্য!
    দু'হাতে শতাব্দী ঘেঁটে দেওয়াল তুলে দিলেন প্রজ্ঞার ।
    মাথার মধ্যে আভিজাত্য মস্তিষ্কে আপনার বংশানুক্রমিক অহংকার
    #
    সারা শরীরে আমার আদিমফুলের গন্ধ ,যৌবন মৌতাতে
    সাপকে রাখি ফাঁসুড়ে বিনের ঊর্ধ্বে , হরিণের মাংস
    পোড়া ধোঁয়ায় ক্ষুধার্ত ঈশ্বরী তখন প্রান্তিক হয়ে ওঠেন।
    স্তন ভারে নম্র নীলকণ্ঠের পালক পোড়ার গল্প , সূর্যপোড়া ছাইয়ে
    আমার বিষবৃক্ষের চাষ।
    #
    আমাদের খিদে ,গোপন কথা,প্রিয়র বুকে আদর ঘষার
    গন্তব্যসীমা এক,এমন কি সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া পর্যন্ত এক।
    অথচ আপনার ঐশ্বর্য দেবত্ব ছুঁয়ে গেল , প্রতিকৃতি লেখেন
    পাতালপুরীর গায়ে ,অহ: দেবী ..." করালবদনাং ঘোরাংমুক্তকেশীং
    চতুর্ভূজাম্। কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্।"

    ৪৯-

    নাইটফল অথবা সমুদ্রযাত্রা
    তখন রাতগুলো পরী ভালবাসায় ভরপুর
    হরিদার চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় ফেলে আশা
    মিঠু বউদি আর ঝিলিক সেনের ঝিকিরমিকির দুই চাঁদ
    রাতে নাড়িয়ে দিলে গো । ঘুম , ঘুম আসে না
    অস্থির , বুকের ভিতরের হ্যাংলা কুকুরটা বনেদী নয়
    ঠিক , ঠিক যেন ভাদ্রের মত অবস্থানে
    আর কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠু না ঝিলিক সেনের বুকে
    বুঝলাম না ......
    আর নাভি খাচ্ছে , আর কোমর ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে দাঁতে
    দরদর ঘামে ভিজে উঠছে গা
    থামবে না , এ-খাওয়া থামবে না
    সমস্ত বেডকভার ড্রেনডাইট চটচটে , আহা মায়াবী আঠা
    ক্রমশ কুকুরের গা মোচড়ানো শিথিল হয়ে ওঠে
    ঘুম , ঘুম , ঘুম
    সকালে ভুলে যায় আস্ত একটা কুকুর নিয়ে আমার রাতের সংসার
    কেননা তখন আমাদের রাত্রির বুক অবিবাহিতকলা
    কেননা তখন পায়জামার অন্ধকারে হাজার ওয়াট
    তখন আমাদের নিজস্ব রাতের নাম ছিল -
    'নাইটফল মেমরি'।

    ৫০-
    রাধা তত্ত্ব
    তারাখচিত ধাবা । ধুধু বিশলাখি চাকামাতম । আহাঃ প্রান্তিকট্রাক -
    ট্রাক-ট্রাক , আহাঃ পরীযোনিধাবা , চোদ্দআনাগরম ।
    ফার্মালিনব্রাহ্মণরাত । হুডখোলা প্রান্তরে উলঙ্গবন্দর । আসে ত্যাজ্যযোনি
    বাবু , রাতের অভাব জানি । জানু- জানু-জানুউ । কাতুকাতুমাখা দেহাতিট্রাক , রাতটম্বুর,শ্বাসটম্বুর , শ্বাসটম্বুর , 'খুলে দাও প্রিয়া খুলে দাও বাহুডোর' ।
    হে , সার্ফসফেদদ্রবণ , হে আকন্দক্ষয় , শাদা , মিহিনদুধশাদা , সাধি , সাধ্যাতীত নাও । পেছনে ট্রাকআলো , মেঘআলো , চিন্তিত একবিন্দু ।
    কড়কর , কড়কড়ে , ঘামমাখা টাকা একশো কুড়ি ।
    চিন্তিতসরণ , স্মরণ , শরম , সতীসাধ্বী পয়মুখতদেহ , ওগো রাখালিরাধা
    ওগো , সখিমোর লিঙ্গসাধা ।
    কেন ফোটাফোটা গোলাপজল । জালভৈরব । ক্ষয়জয় , জয়ক্ষয়
    দুঃখট্রাক পরিপাট নিখাত নিখাত ।
    জ্বলতব্য বুকপাথর , প্রথমসোহাগ শালি মাসিমণি মেয়ে । তারপর , তারপর
    অনেকটা ধনঞ্জয় । কৃষ্ণবিবর , নিকুচি করেছি মাগি , শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজয় ।
    মাটিরাস্তা , পিচরাস্তা । রাতরাস্তা । যৌনমেদুর ।
    মাগি , এ-সস্তারাতে , শালা ফাঁকা ধাবায় , তারাদের যৌনকেলী
    এসো ছল , খল , মল , জল , ও অপ্সরা
    এসো , বিবিধ
    নলে ঝরে শেষসভ্যতার বীর্য

    ৫১
    আগুনমুখো

    একটা শব্দকে কল্পনা করা যাক , এমন শব্দ
    যার মধ্যে জীবিকা- আহার-বাসস্থান চমৎকার মানিয়ে যাবে !
    কিন্তু শর্ত একটাঃ শব্দের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম রাখবেন না
    শব্দের মধ্যে রাষ্ট্র রাখুন উহ্য
    আপাতনিরীহ এই শব্দটা খুঁজতে থাকুন
    আপাতত মধুবৃন্তে ঠোঁট লাগিয়ে খুঁজতে থাকুন
    এটাও বৃহৎ কাজ ,বরং রাজ্যের নাম পরিবর্তন নিয়ে ভাবুন
    #
    যদি সহ্যের ঊর্ধ্বে মনে হয় এসব খোঁজাখুঁজি , তবে
    গা থেকে বাড়তি ওজন ঝরিয়ে বরং ধর্ম নিয়ে ভাবা যাক-
    বিষয়টা এমন, বনভোজনের উৎসবে মাতাল চলেছে
    গাড়িতে মুরগি বাঁধা , গাড়িতে আগুন বাঁধা
    গাড়ি সুদ্ধ পুড়িয়ে খেতে পারেন কিংবা না পারে্ন
    তাছাড়া , একটা কবিতা লিখে বলতে পারেন ,
    আপনি সৎ ,আপনি বিনয়ের অবতার।
    #
    এছাড়া আপনি কী করতে পারেন , বলুন , বলুন শুনি -
    আগুন ছাড়া আপনি কী খেতে পারেন , বলুন শুনি?

    ৫২-
    হৃদয়খেকো
    আমি সেই সুপ্রাচীন সম্রাজ্ঞী,
    আমার সৌখিন অহম ডালপালা আধুনান্তিক মনগ্রাসী
    যার আদিগন্ত রাজ্যপাটের এক নগণ্য প্রজা মাত্র তুমি।
    এইমাত্র সম্রাটের মুখাগ্নি করে দাঁড়ালাম অজস্র সঙ্গমের চিহ্ন বুকে নিয়ে,
    পুরাতন প্রেমিকের সমাধির ঠিক পাশটিতে...
    কথা ছিল আমার আগামী প্রেমিক এখানেই বীজ বুনে যাবে আসন্ন।
    #
    আমি সেই অভিজাত রাজকুমারী
    যার মোহগ্রস্ত যৌবন-তামাম পুংপতঙ্গকে গিলে খেয়ে ঢেকুর তোলে অতৃপ্তির
    নারীর কোমরের নীচে ফুল বিছানো নরকের তোরণ,
    প্রকৃতির পায়ের নীচে অভিলাষ মৈথুন মোক্ষ!
    তুমি এক অচ্ছুৎ প্রেমিক চাষি,সুচারু শব্দের কারবারী
    দূর থেকে গোলাপ ছুঁড়ে দেওয়া সম্ভ্রান্ত লাস্যকে ভাবলে স্বর্গ!
    #
    হে বোকাপুরুষ
    প্রেম ভেবে কবিতার জমিনে বুনলে ফলন্ত রবিশস্য !
    ঠিক চিনেছো , আমিই সেই ক্ষুধার্ত সাপিনী
    শীতের ওম মেখে উষ্ণ রাখি পুরুষঘাতি বিষ
    প্রেম খাই,কাম খাই,খাই সম্পর্কের অন্তষ্টিক্রিয়া...
    কবিতার শেষ পাতায় শিরোনামে লেখা হয়েছিল যাকে
    রূপবতী হৃদয়খেকো রানী...
    ৫৩-
    ছুরি

    বহুদিন শুয়ে আছি মনখারাপের পাশে
    অসুস্থ সময়ের মৎস্যগন্ধা বালুচরে
    খুলে রেখেছি শ্রেষ্ঠার উষ্ণীষ,নগরচারিনী যৌবন,
    ঘুমবো ভেবে আলগা করেছি বাঘিনীর চোখ নিশ্ছিদ্র ফাঁদ,
    গুটিয়ে নিয়েছি প্রাগৈতিহাসিক লুকানো ছুরি।
    এখন শিরায় স্খলিত বিচিত্র আঁশটে গন্ধ
    থাবার নীচের স্মৃতিরা ছোবলে অনড়,নখের কোটরে ময়লা জমে
    জমে মারণ স্পষ্ট চিহ্ন
    কস্তূরীমৃগের নাভি পোড়া ধোঁয়ায় রোমকূপ জুড়ে আদিম খিদের মাতন।

    বহুদিন শুয়ে আছি মনখারাপের পাশে
    শীতকালীন অবসরে উড়ে যাব নীলদীঘির চরে
    ছলনায় কুড়িয়ে নেবো নুড়ির কাঁকড়ের প্রবহমান প্রবাহ
    পেতে চাই নিশ্চিত ঘুমের অন্ধকার অভ্যাস...
    ৫৪-
    কাঙ্ক্ষিত

    ভালবাসতে জানলে সামনের মূর্তি
    তেল রঙ মাখা কুমোরটুলির প্রতিমা
    না হলেও চলে ! তখন
    প্রতিটি নারী মুখেই ফুটে ওঠে অলৌকিক দেবীর সাক্ষর
    আর নারীর চোখে নগণ্য জংলী ও প্রকৃত পুরুষ হয়ে ওঠে
    আর তখন প্রত্যাশিত পুরুষ বুকে রূপালী নক্ষত্র বিছিয়ে দিতে দিতে
    কাঙ্ক্ষিত দেব কুমার !
    ভালবাসতে শেখ ,ভালবাসায় থাকলে চিরিয়াঘরে প্রিয়ার নগ্ন রূপে
    ওড়না জড়িয়ে দেওয়া হায় , সিঁথিতে ভরিয়ে দেওয়া যায়
    রঙের রূপটানে ,
    মাটির সঙ্গে পায়ের সম্পর্ক থাকলে প্রতিটি পুরুষ চোখে
    নারী হয়ে ওঠে পরিণত চাষের ভূমি
    তখন যা -কিছু ফসল ফলিয়ে নেওয়া যায় ...
    ভালবাসতে পারলে
    চোখের মণিতে একাধিক স্বর্গ-দ্বার খোলে, ভালবাসায় সমর্পণ শেখ
    ভালবাসাকে ঈশ্বরের পাশে রাখ দেখবে অমরাবতী নেমে এসেছে
    ভাঙা টিনের চালে ঘন বর্ষায়

    55-
    ধন্যবাদ তোমাকে
    তুমি আমাকে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচালে!
    তুমি আমাকে উচ্চরক্তচাপ এবং নার্সিংহোমের তিতকুটে গন্ধ থেকে বাঁচালে!
    এবার বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা জলে শরীর ধুয়ে ফুলুরি দিয়ে মুড়ি মেখে খাবো।
    আমি সমাজবিদ্যা পড়ানো সাধারণ মাষ্টার
    এসব যুদ্ধটুদ্ধর হ্যাপা সামলানোর শিরদাঁড়া কোথায়!
    এসব তুমি চার হাতপায়ে স্যালাইনের ছুঁচ গুঁজেও বুঝেছিলে?
    #
    কাকেদের পিন্ড খাওয়ানো ছাড়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর কোন কাজ থাকেনা।
    শ্মশান বান্ধবরাও গলির মুখ পর্যন্ত সান্ত্বনা ছড়িয়ে ফিরে গ্যাছে যে যার ঘরে।
    ফেরার পথে বাবুর দোকান থেকে ক'প্যাকেট চন্দন গন্ধের ধূপ
    কিনে আনবো
    তুমি তো চন্দন ভালবাসো!
    তোমার বিছানার পাশটিতে রোজ ধূপের সঙ্গে পুড়বো
    কাল থেকে আর মর্নিং ওয়াক যাওয়া নেই!
    এখন থেকে রাতে বিরিয়ানি সহযোগে তিন পেগ লার্জ ভোদকা খাব।
    সকালে ঘুম ভেঙে মশারি না খুল্লেও চলে যাবে
    সন্ধ্যেবেলায় আর অকারণে সিরিয়াল টিরিয়ালের ঝকমারি নেই
    অল টাইম টিভিতে চালাবে নিউজ আর বাসি খেলা
    #
    এই বেশ ভাল হল বুঝলে!
    সমস্যা হচ্ছে একটাই,চশমা কখন যে ফাঁকি দিয়ে
    বারবার লুকিয়ে পড়ছে কলেজ প্রেমিকার মতো!
    আমি যেন তার মরুভূমির চাতক।
    ডায়বেটিস,সুগার,ব্লাডপ্রেসারের ওষুধগুলোও আঁখমিচোলি
    এটুকুই যা ...
    বাকিসবই তো ঠিক!
    শুধু আমার বুকের ভিতর বেদম যন্ত্রণা ঠেলে উঠলে
    চাঁপাগাছের নি:স্বতা থেকে আমার শরীর পর্যন্ত একটা
    অলৌকিক ছায়াকে ব্যাধিগ্রস্থ হতে দেখি।

    ৫৬-
    না -কবিতা
    হে অনন্ত পথ,
    আসন্নের উপাসনায় পুড়িয়ে দিয়েছি পূর্বজ দেবতার মুখ,
    আমাদের সম্ভোগ ফুলরেণু, সিংহীখোদিত সহস্র ভ্রুণসহ
    গান্ধারী মাটিরকলস,ধন্বন্তরির মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রপূত জল।
    যাবতীয় পুড়িয়ে দিয়ে যথার্থ আততায়ী ।
    এখন প্রজ্ঞায় তাবৎ মৃতপ্রায় বেদেনীর ঠোঁট উপছানো ফ্যানা
    মনিষীপুরুষের বাঁধারমনীর ঋতুন্যাকড়া পোড়ানো ধোঁয়ায়
    গার্হস্থ্য জুড়ে চন্ডালের পদচিহ্ন।
    আমার সুপ্রাচীন চানঘরে শরীরশ্রম কলঙ্কঅক্ষর।
    পথের দুধারে মহামারির ভিড়,দু -একটা জন্মবীজে
    বালিহাঁসের সঙ্গম ক্লান্তচিহ্ন।
    গতজন্মে বর্ণমালায় যারা জাতিস্মর ছিল।
    মূর্খপ্রায় আমি।না-কবিতা আর সুবর্ণশূকরের তফাৎ ঘোচাতে পারি?
    অনন্ত শাব্দিক খিদেয় কিশমিশ থেকে চেটে তুলে নিচ্ছি আঙুরের
    বেদনানুভব ...পর্যাপ্ত তিরস্কারে।

    ৫৭
    মৃত্যুবিন্দু
    *******
    সময়ের দগ্ধঘাসে শরীর ঢাকা ছিল বুঝতে পারিনি ,
    জলজমাটির ওমে আত্মহনন লুকানো ছিলো বুঝতে পারিনি ।
    আলো জমতেই সর্ষেক্ষেতে ঘাসফড়িঙের পাশে এসে বসলাম...
    কোথাও কি জন্ম নিল ফসলফোটার কাল?
    #
    তুমি ডেকেছিলে ,তাই আত্মহননের গল্প লেখা হল ।
    অমাবস্যার অফুরন্ত ভবিষ্যৎ পড়ে থাকে ভেজা বালিশে
    মাছের চোখের মতো সকাল জ্বলে রইল চোখে
    চোখ ও মানচিত্রে তবুও নদীর হাহাকার
    #
    খুব খিদে পায়
    খিদের পরে থেকেই শুরু শূন্যর রাজত্ব
    জলতল ছুঁয়ে পিপাসা তৃষ্ণা হরিণের মতো ছুটে যায় মৃত্যুর দিকে
    মৃত্যু ও তৃষ্ণার মধ্যেই অবস্থান নেয় ঈশ্বর
    তক্ষুনি বুঝতে পারি সব তৃষ্ণার উৎস তুমি

    ৫৮-
    শুধুমাত্র প্রবাসী

    চলে আসার পরে প্রথম চিঠিতে লিখেছিলে -
    "একা থাকতে বড্ড কষ্ট হয়,ফিরে এস তুমি"
    দ্বিতীয় চিঠিতে বেশকিছু দীর্ঘশ্বাস পাঠিয়েছিলে যত্ন করে
    পরের ষোলটি চিঠিতে কোন শব্দ ছিলো না, না বর্ণমালা
    ভাঙার ব্যার্থ প্রয়াস।শুধু কান্নার শুকনো দাগ লেগে থাকতো
    গোলাপী কাগজের অভ্যাসে ।
    তখন আমিই একচ্ছত্র সম্রাট
    চিঠি লেখার সময় পাইনা বিশেষ ...
    দু বছরে প্রথম চিঠি লিখলাম -আমি ফিরছি তাড়াতাড়ি
    তুমি জানালে একটিমাত্র বাক্য -"বেশ ভালো আছি"
    এই প্রথমবার নিজেকে নি:স্ব মনে হল,
    অবহেলার থেকে অবহেলিত যখন।

    ৫৯-
    শূন্য

    ইদানিং মৃত্যুর পর আর জন্ম নিতে ইচ্ছে করে না
    জন্ম মানেই একটা অজানা হারেম থেকে
    লোকায়ত অদৃশ্য রাজা- বাদশার হারেম ! জন্ম নিলেই
    সেই তো ঘোড়া , সেই তো হাতি, দাঁতে শান দেওয়া জন্তু জানোয়ার !
    সেই তো হাজার ওয়াট মৌলবাদী লোলুপ থাবা
    এর আগে কিছু নেই , পরে চিতাকাঠ
    ছাই , ধোঁয়া , কার্বন
    যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ
    অনর্গল শ্বাসে মিথেন।
    নদী ভেসে যাওয়া অসময়ের বৃষ্টি
    শূন্য রানওয়ে
    কয়েক কয়েক কয়েক কোটি হায়না দৌড়ে যায়
    শূন্য মানুষের দিকে
    শূন্যর দিকে...

    ৬০-
    সভ্যতা আবিষ্কার
    ***************
    অবশেষে ভূমধ্যসাগরে
    ওরা নোঙর ফেলল , আউসশীষ আর সূর্যের আড়াল নিয়ে
    জাহাজ ভিরলো নব্য বন্দরে।
    পিলপিল করে নেমে এলো অসংখ্য দক্ষ কারিগর
    ঢেলে দিলো ঘড়া ঘড়া সঞ্জীবনী সুধা ,
    কেউ বলল , এবার ফসল হবে অনেক
    কেউ ছুটে গিয়ে আয়না ধরে বসল
    কেউ বলল , প্রকৃতই মানুষের মত
    নদী পাড়ের মেয়ের গায়ে মেঠোফুলের গন্ধ
    মাটিরাঙা মেয়ের হাতের কাছে মাটি
    সজোরে মেয়ে ঘুরিয়ে দেয় চাকা ...
    বন্ বন্ বন্
    শীর্ণ হাতের ছোঁয়া গরিষ্ঠ রূপ নেয়।
    মেয়ের হাতে সূর্য ,
    মেয়ের পেটে খিদে
    মেয়ের চোখে বিদ্যুৎ
    মেয়ের নাম কৃষ্টি
    ওরা অবাক হয়ে দেখলো মেয়ের বুকে অলঙ্ঘনীয় পিয়াসমধু
    আঁচলভরা সনাতন গর্ব
    ওরা এক ঝটকায় কাপড় টেনে নিল
    গর্ভে ভরে দিল কিছু সোনালী বীজপত্র
    ভ্রুণের নাম দিল সভ্যতা
    কয়েক মহাকাল পর ...
    সভ্যতা এখন পরিপূর্ণ নারী
    ওর শরীরে এস আরেক কোন জাহাজ
    হোক রহস্য কলম্বাস আবিষ্কার ...

    ৬১-
    উৎসর্গপত্র
    রূপবতী নদীরচরের কথা মনে আছে ?
    সেই ষাঁড়াষাঁড়ি বানের বছর , সাল আটাত্তর
    তারপর শুধু লবণ আর লবণ
    #
    তুমি বলেছিলে - জীবাশ্ম মধ্যে শুধু পলি না, লবণও থাকে ।
    আমি দেখলাম কঙ্কালসার বৃক্ষমাতার কোটরে ক্লান্ত পাখিদের অনন্ত রুদালি,
    তাদের আমি কি উপেক্ষা করতে পারি?
    উৎসর্গপত্রে লিখে রেখে যাই কদমফুলের দেশ
    লিখে যাই জলজ অহংকারে জলফড়িং এর স্বচ্ছডানায় রঙের কারখানা
    আর জলবিভাজিকার পৌরাণিক সঙ্গম চিহ্নের দিকে তাকিয়ে
    ছেড়ে যাই শ্বাস-বিশ্বাস
    তোমার চোখের মহিমাকে অভিভাবকের আসনে বসিয়ে
    মান্যতা দিতে চাইলাম , চাইলেও চাওয়ারা পাওয়া হয় না
    #
    বিদূষক সময়কে বলি তফাৎ হট ...
    আমি দেখলাম রূপবতী নদী-উর্বরা হয়ে উঠেছে শ্রাবণমেঘের মত
    কৃষিজমিতে বীজধান বুনছে ম্লেচ্ছ সময়
    ভাঙা মাটির হাঁড়ি,পোড়া উনুন তার রূপের পাশে বইতে বইতে
    কৃষাণীবধূর ঘামজল খেয়ে নিচ্ছে জগতের রূপকার।

    ৬২-
    বিস্ফোরণ ও শুভা
    ক্রমশ উর্দ্ধ সত্তরের প্রেমে ডুবে যাচ্ছে বসন্তবর্ষীয় আয়ু,
    সারসার দিয়ে রক্তকীট ...বাস্তুতন্ত্রের বিষাক্তফণা ধেয়ে গেল
    গঠনপোক্ত মধ্যে তিরিশের দিকে , তাদেরও
    হারিয়ে দিতে পারে বুকে লাটখেয়ে যাওয়া
    তোমার সাদা চুলের ঘোড়া ।
    ছুটছে,ছুটছে ছত্রপতি শিবাজি চত্বর পেরিয়ে মহানভারত দরজায়
    উড়িয়ে দিচ্ছে সবুজ পতাকার স্নেহ।
    পতাকার দন্ডে আত্মমৈথুনরত সাহিত্যচেতনা।
    থ্রিজি নেটওয়ার্কেও কেন গিলে নিতে পারছি না সমগ্র তুমিকে !
    পিচ্ছিলজাত পরমান্নে ফসকে যাওয়ার খেলা।
    উফ ! আর পারছি না কেন ! জ্বলে যাচ্ছে সৃষ্টিশীল তুরুপ?
    কেন ডুবে যাচ্ছি তোমার মধ্যে ?
    তোমার থেকে তোমার আগুন জ্বলানো বীর্যক্ষয়ী শব্দের শরীরে ?
    সেখানে আউসের শীষে সোনালী শিল্পের ক্ষণজন্ম
    তেমন ভাবে জরুরী কি ?
    সেখানে আমাদের মত সহস্র তামাটে চামড়ার ছড়াছড়ি
    যারা চিচিং ফাঁক মেলে ধরে সিঁধিয়ে নিয়েছিল ছয় ফুট
    আট ইঞ্চির আত্মঘাতী ধাতব সমীকরণ ...
    দশেরার রাবণ মারতে মারতে আমিও পুরুষ বিরোধী
    হয়ে উঠছি সময় ?
    আমিও সেঁটে নিচ্ছি তকমা ! নারীবাদী হলে
    কতটুকু লাভ চেটেপুটে নেওয়া যায় ক্যালকুলেশনে বইয়ে দিচ্ছি
    ফেসিয়ালে লোমতোলা মোম ত্বক !
    আমার শিরায়-প্রতিশিরায় একশ ছিনেজোঁক বাসা
    বাঁধবে বলে নি,
    আমার জঙ্ঘার মধ্যবিত্ত গুহায় ঘোলা রসে তোমার নাম নিয়ে
    প্যান্টি ভিজিয়ে যাবে এমনও ঘটে নি প্রিয় পুরুষ।
    তবুও তোমার প্রেমে পড়া যায় !
    গত এককুড়ি রমনীর মত
    বুকের ওড়না সরিয়ে বলতেই পারি আমিই বা কম কিসে !
    যারা তোমার শীতঘুম ভাঙনের অহরহ নায়িকা, চোখ তুলে
    দেখ নব্বই মিলিয়ন উষ্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি শূন্যদশকের
    খাতা জুড়ে। একশ শ্বাপদ হামলে পড়েছে নারীর
    রসালো খাদ্যের দিকে। সন্ধ্যারতি থেকে ভোরের নামাজ
    তক ছুঁড়ে দিচ্ছে মুঠোমুঠো উপঢৌকন উপাচারে ।
    আমি ওদের পাত্তা দিই না...
    তোমার কথা ভেবে,বালিসে চুমু খেতে খেতে এটা তো জানি
    কাগজের গায়ে উষ্ণতা দিতে সক্ষম বলেই আমার আগে ও পিছের
    রাধাবিন্দুর একচ্ছত্র সম্রাট তুমি ।
    অগ্রজ 'শুভা' মহলক্ষ্মী হলে তুমি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মে
    তেভাগার নারায়ণ,
    রূপের পরে কয়েকটা শূন্য বসালেই জলন্ত সূর্যের তাপ ক্রমশ হ্রাস।
    তখন কাকে আগ্রাধিকার দিয়ে বলবে প্রিয়
    তোর শ্রীমুখ ঐশ্বর্যের উপর অন্নপূর্ণা !
    ঐশ্বর্যের উপর নিটোল ফিগার এঞ্জেলিনা তথাস্ত ঠোঁটের আগমন !
    না মশাই কেবল রূপের মহিমা নই...
    সন্ন্যাসী এবং শরীরখোড় ঈশ্বর এলেও তরতর করে
    লিখে যেতে পারি বিশ্বাসঘাতিনী শব্দ ।
    তোমার মত একচাদরের নীচে নারী ও শিল্পকে সঙ্গমরত করে
    বলতে পারি নারী ও শিল্পের মত বিশ্বাসঘাতিনী আর কিছু নেই।
    প্রেমিকার চোখের দিকে চোখ রেখে জেগে ওঠা পুরুষাঙ্গের মত
    অস্থির কলমের দিব্যি - ঘাড়ের নীচে কামড়ে ধরে থাকা ক্ষুধার্ত
    বাঘিনীরদল
    তোমার শিরদাঁড়া ভাঙা জন্তুটাকেও নাড়িয়ে চাড়িয়ে
    তারাও বলতে পারে-
    যৌবন থেকে শিল্প পযর্ন্ত গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়াও একটা আর্ট,
    যৌনতা থেকে কবিতা পর্যন্ত সৃষ্টিকে সফলতা দেওয়াও একটা আর্ট ।
    শুধু সেখানেই তুমি-আমি কি সফল! 'ওরা' বলে,
    নষ্ট শব্দের কচকচি ঘাঁটার চেয়ে
    তোমার আর্থ্রাইটিস ভোগা অঙুল ঢের বেশি ভাল।
    যাদের জড়িয়ে বলতে পারি,
    যে শিশুদের জন্ম দিয়ে গেল বাতক্ষয়িত আঙুল
    তারা তোমার বীর্যের চেয়েও দামী ।
    শ্লেষ্মা কষ্টে হৃৎপিন্ডে জাগা বুকে শেষ বারের মত ভরে নাও
    বিশুদ্ধ অক্সিজেন আর একবার তোমার নীচে
    আরাম গ্রহণকারিনী নারীটিকে ভেবে ছড়িয়ে দাও বীর্য
    ৩০০০০০০ শিশু উড়ে যাক গ্রিক মিথোলজির দিকে
    সাবর্ণ লাম্পট্য আমপ্লিফিয়ার ছিঁড়েখুঁড়ে
    নারীর পরম মমতার দিকে বেঁচে থাক মাইলের পর মাইল
    নায়িকা ও পুরুষের পুনমিলনের পরে সৃষ্টি ইতিহাস।
  • Jayeeta | 012312.60.2334.207 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৩৩541314
  • জয়িতা ভট্টাচার্য নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    জয়িতা: কবিতা না গদ্য-- গদ্যের ক্ষেত্রে প্রবন্ধ না গল্প-উপন্যাস ---তুমি নিজে কোনটা লিখতে বেশি পছন্দ করো।
    মলয়: আমার নিজের তেমন কোনো প্রেফারেন্স নেই । নির্ভর করে মগজের ভেতরে একটা বিশেষ সময়ে কি ঘটছে । প্রবন্ধ লিখি মূলত সম্পাদকদের অনুরোধে । এখন আর প্রবন্ধ লিখতে ভালো লাগে না, প্রাবন্ধিকের সংখ্যা কম বলে সম্পাদকরা প্রবন্ধ চান, এমনকি সম্পাদক নিজে কোনো বিষয় বেছে নিয়ে লিখতে বলেন। তা কি পারা যায় ? এখন তেমন পড়াশোনা করতে বা সমাজ নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে না । ফিকশান লিখি, কোনো একটা ব্যাপার স্ট্রাইক করলে লিখতে থাকি, কেউ চাইলে দিই । কবিতা তো অ্যাডিকশান, যখন নেশাটা পেয়ে বসে তখন না লিখে নিস্তার নেই । সেগুলোও ইমেলের বডিতে লিখে রাখি, কেউ চাইলে পাঠাই । ইন ফ্যাক্ট যে চায় তাকেই পাঠাই, কোনো বাদ বিচার করি না । কবিতার খাতা বলে আমার কোনো ব্যাপার নেই, ২০০৫ সালের পর থেকে, আরথ্রাইটিসের কারণে । আরথ্রাইটিসের কারণে লেখালিখির বাইরে চলে যাচ্ছিলুম, সে কষ্ট তুই বুঝতে পারবি না । মগজের ভেতরে লেখা ঘুর্ণি হয়ে পাক খাচ্ছে অথচ কিছুই লিখতে পারছি না । তারপর মেয়ের উৎসাহে কমপিউটার শিখলুম, বাংলা টাইপ করতে শিখলুম, ডান হাতের মধ্যমাটা কম আক্রান্ত, সেটাই টাইপ করতে ব্যবহার করি । ছেলে এই কমপিউটারটা দিয়ে গেছে, ছুটিতে এলে পরিষ্কার করে দিয়ে যায় ।
    জয়িতা : তোমার বিভিন্ন উপন্যাস পড়লে দেখা যায় প্রতিটির ন্যারেটিভ টেকনিক ও আঙ্গিক এ ভিন্নতা । ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস থেকে জলাঞ্জলি, নামগন্ধ, ঔরস, প্রাকার পরিখা, সবগুলো একই চরিত্রদের নিয়ে এগিয়েছে, একটাই উপন্যাস বলা যায় তাদের, কিন্তু তুমি প্রতিটির ফর্ম আর টেকনিকে বদল করতে থেকেছো । কেন ? তারপর, অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা উপন্যাসে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন টেকনিক প্রয়োগ করলে, তিন রকমের বাংলা ভাষার খেলা দেখালে। ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে বেশ কয়েকটা ছোটোগল্প আর নিজের রোজনামচার অংশ ঢুকিয়ে দিয়েছ । এই বিষয়ে কিছু বলো । এটা কি সচেতন প্রয়াস?
    মলয় : হ্যাঁ । পাঁচটা মিলিয়ে একটা অতোবড়ো উপন্যাস তো কেউ ছাপতো না, তাই আলাদা-আলাদা করে লিখেছিলুম । ‘ডুবজলে’ উপন্যাসটা সহকর্মীদের নিয়ে লেখা, ক্রমে জানতে পেরেছিলুম যে কয়েকজন গোপন মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট । পাঁচটা আলাদা উপন্যাস লিখতে পেরে একদিক থেকে ভালোই হলো, সব কয়টায় নতুনত্ব আনতে চেষ্টা করেছি । ব্যাপারটা মগজে এলে বেশ কিছুকাল ভাবি আঙ্গিক নিয়ে, উপস্হাপন নিয়ে, তারপর লেখা আরম্ভ করি । অনেক সময়ে লিখতে লিখতে আপনা থেকেই একটা আঙ্গিক গড়ে ওঠে, যেমন ‘নখদন্ত’ বা ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ । ‘নখদন্ত’ বইটার জন্য চটকল আর পাটচাষ নিয়ে প্রচুর তথ্য যোগাড় করেছিলুম । তেমনিই ‘নামগন্ধ’ লেখার সময়ে আলুচাষি আর কোল্ড স্টোরেজের তথ্য সংগ্রহ করেছিলুম । এই বইদুটোয় বেশ কিছু চরিত্র চোখে দেখা । অভিজ্ঞতার বাইরেও লিখেছি, যেমন .জঙ্গলরোমিও’, একদল ক্রিমিনালের বিস্টিয়ালিটি নিয়ে । টানা একটামাত্র বাক্যে ফিকশান লিখেছি ‘নরমাংসখোরদের হালনাগাদ’, এটাও জাস্ট ইম্যাজিনেটিভ । ‘হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা’ রবীন্দ্রনাথের দাদুর দেহ ইংল্যাণ্ডের কবর থেকে তুলে হৃৎপিণ্ডে কেটে কলকাতায় নিয়ে আসার কাহিনি, রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের বাবারও সমালোচনা করেছি ফিকশানটায় । রবীন্দ্রনাথের দাদু যদি আরও দশ বছর বাঁচতেন তাহলে পশ্চিমবাংলার ইনডাস্ট্রি উন্নত হতো ।
    জয়িতা : পোষ্টকলোনিয়াল বা কমনওয়েল্থ লিটেরেচারের ক্ষেত্রে সলমন রুশডিকে আদর্শ পোস্টমডার্ন নভেলিস্ট বলে কি তুমি মনে করো ?
    মলয়: রুশডি একজন ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট ঔপন্যাসিক । আমেরিকার আলোচকরা ম্যাজিক রিয়্যালিজমকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায় না, কেননা টেকনিকটা তাদের দেশে গড়ে ওঠেনি, তাই ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট লেখকদেরও পোস্টমডার্ন বলে চালাবার চেষ্টা করে । পোস্টমডার্ন উপন্যাসের কিছু সূক্ষ্ম উপাদান থাকলেও রুশডির ফিকশানকে পোস্টমডার্ন তকমা দেয়া উচিত হবে না । গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে পোস্টমডার্ন বললে স্প্যানিশ আলোচকরা বুল ফাইটের ষাঁড় লেলিয়ে দেবে ।
    জয়িতা : তোমার গদ্যে প্রথাগত প্রেম আসেনা । নেই স্টিরিওটাইপ প্রটাগনিস্ট । সেটা কি সচেতন ভাবে পরিহার করেছো স্বকীয়তা আনতে? ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস উপন্যাসে মানসী বর্মণ, শেফালি, জুলি-জুডি ; নামগন্ধ উপন্যাসে খুশিরানি মণ্ডল, অরূপ তোমার এঁটোকাঁটায় কেকা বউদি, ঔরস-এ ইতু, এরা একজন আরেকজনের থেকে পৃথক এবং কেউই স্টিরিওটাইপ নয় । এমনকি উপন্যাসের শেষে চমক দিয়েছ যে খুশিরানি মণ্ডলকে পূর্ববঙ্গ থেকে তুলে আনা হয়েছিল, সে প্রকৃতপক্ষে জনৈক মিনহাজুদ্দিন খানের নাতনি । আত্মপরিচয় নিয়েও খেলেছো খুশিরানি মণ্ডলের ক্ষেত্রে, সে নিজের উৎস না জেনেই লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে, ব্রত রাখে, চালপড়ায় বিশ্বাস করে ।মলয়রচনার আঙ্গিক সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত জানতে চাইবো ।
    মলয় : তার কারণ আমি প্রথাগত প্রেম করিনি । বয়সে আমার চেয়ে বড়ো নারীরা আমার জীবনে প্রথমে প্রবেশ করেছিলেন । তাই হয়তো যুবকের চেয়ে যুবতীর বয়স বেশি হয়ে যায়। নারী চরিত্রগুলোয় আবছাভাবে কুলসুম আপ আর নমিতা চক্রবর্তীর উপস্হিতি রয়ে যায় । হাংরি আন্দোলনের সময়ে যে যথেচ্ছ জীবন কাটিয়েছি, তার ছাপও নারী চরিত্রদের ওপর রয়ে গেছে । খুশিরানি মণ্ডলের মাধ্যমে দেখিয়েছি যে নিজের আইডেনটিটি ব্যাপারটা কতো ইডিয়টিক । এখনকার ভারতীয় সমাজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, আইডেনটিটি পলিটিক্সের দরুন সমাজ ভেঙে পড়ছে, প্রতিনিয়ত লাঠালাঠি হচ্ছে, দলিতদের পেটানো হচ্ছে । গোরুর মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে কতো লোকের জীবিকা নষ্ট করা হয়েছে । আইডেনটিটি পলিটিক্স থেকে আমরা পৌঁছে গেছি জিঙ্গোইজমে । আমার বিয়ের কথা বলি ; আমি সলিলাকে বিয়ে করেছি তিন-চার দিনের আলাপের মধ্যেই, দুজনে দুজনকে হঠাৎই ভালো লেগে গিয়েছিল।
    জয়িতা: ডুবজলে উপন্যাসে টেবিলের ওপরে রাখা মানসী বর্মণের পাম্প দিয়ে বের করা দুধ অতনু চক্রবর্তী টুক করে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিয়েছিল । এটা কেন ?
    মলয় : অতনুর মা সম্প্রতি মারা গিয়েছিলেন, সে কয়েকমাস মিজোরামে জুলি-জুডি নামে দুই সৎবোনের সঙ্গে যৌনজীবন কাটিয়ে পাটনায় ফিরে মানসিক গুমোটের মধ্যে আটক হয়ে গিয়েছিল। দুধটা দেখে আপনা থেকেই মায়ের অনুপস্হিতি তার মনে কাজ করে ওঠে । পরে ঔরস আর প্রাকার পরিখা উপন্যাস দুটোয় মানসী বর্মণ আর অতনু চক্রবর্তীর জটিল যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ওরা তখন ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী জমায়েতে যোগ দিয়েছে ।
    জয়িতা: বাংলা সাহিত্যে বিশ্বায়নের প্রভাব কতটা প্রতিফলিত বলে তোমার মনে হয় ? বিশ্বায়নের রেশ ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় তোমার ?
    মলয় : এখনকার ব্যাপারটা বলতে পারব না । আমি আর বিশেষ পড়াশুনার সময় পাই না । বুড়ো-বুড়ি মিলে সংসার চালাতে হয় বলে সময়ের বড্ডো অভাব, ঝাড়-পোঁছ, কুটনো কোটা, রান্নায় হেল্প ইত্যাদি । বিশ্বায়নের পর যে সব বাংলা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে তার কিছুই পড়িনি, বিশ্বায়ন তো বলতে গেলে ব্রেক্সিট আর ট্রাম্পের গুটিয়ে ফেলার রাজনীতির দরুন উবে যেতে বসেছে, কেবল চীনই আগ্রহী ওদের মালপত্তর বিক্রির জন্য, আমাদের দেশের বাজার প্রায় কবজা করে ফেলেছে চীন । তবে ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্য তো ইউরোপের অবদান । বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেছিলেন ইউরোপীয় ফর্মে । মাইকেল অমিত্রাক্ষর আরম্ভ করেছিলেন ইউরোপের ফর্মে । তিরিশের কবিরা কবিতা লেখা আরম্ভ করেছিলেন ইউরোপের ফর্মে, এমনকি জীবনানন্দের কবিতায় ইয়েটস, বিষ্ণু দের কবিতায় এলিয়টের উপস্হিতি খুঁজে পান বিদ্যায়তনিক আলোচকরা । ব্রিটিশরা আসার আগে আমাদের সাহিত্যধারা একেবারে আলাদা ছিল । প্রতীক, রূপক, চিত্রকল্প, মেটাফর ইত্যাদি ভাবকল্পগুলো তো ইউরোপের অবদান । আধুনিক সঙ্গীত সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই, কিন্তু অনেকে রবীন্দ্রনাথের গানে ইউরোপের প্রভাব পান, এমনকি হুবহু গানের সুরের নকল ।
    জয়িতা: শূন্যদশকের কবি সাহিত্যিকদের কাছেও পুনরাধুনিক ,উত্তরাধুনিক বা আধুনান্তিক সাহিত্য সম্পর্কে ধোঁয়াশা। এর কারণ কি বলে মনে হয় ? বাংলা সাহিত্য সামগ্রিকভাবে আজকের বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে কতটা সমান্তরাল ?
    মলয়: ধোঁয়াশা হলেও তাদের লেখায় ছাপ পাওয়া যাবে । আর সকলেরই মগজে ধোঁয়া ঢুকে আছে বলা যাবে না । অনেকে যথেষ্ট শিক্ষিত । আবার অনেকের আগ্রহ নেই, তারা নিজের মতো করে লিখতে চায় । পুনরাধুনিক, উত্তরাধুনিক, অধুনান্তিক, স্ট্রাকচারালিজম, পোস্টস্টাকচারালিম, ফেমিনিজম সম্পর্কে না জেনেও দিব্বি লেখালিখি করা যায় । কবিতা সিংহ তো ফেমিনিজমের তত্ব না পড়েও ফেমিনিস্ট কবিতা লিখে গেছেন । বাংলায় এখন যে ধরনের মিল দেয়া কবিতা লেখা হয়, ইউরোপে আর তেমন কবিতা লেখা হয় না, ওদের কবিতায় ছবির ভাঙন অনেক বেশি আর দ্রুত । প্যারিস রিভিউ আর পোয়েট্রি পড়লে দেখা যায় যে অনেকে সহজ ভাষায় কবিতা লিখছেন, জটিলতা বর্জন করে, যখন কিনা বাংলায় বহু তরুণ কবিতাকে জটিল করে তুলছেন ।
    জয়িতা : একটু ব্যক্তিগত প্রশ্নে আসি । ছোটোলোকের ছোটোবেলা ও ছোটোলোকের যুববেলায় নিজের বড়ো হয়ে ওঠার কথা লিখেছো ।হাংরি আন্দোলনের সময়কার ঘটনাগুলো আমরা জানি । কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়ে মলয় রায়চৌধুরী বেশ কিছুকাল অপ্রকাশিত । এই সময়টার কথা বলো । সত্যি কি লেখোনি না লিখেছ তা অপ্রকাশে ।এই ট্রান্সিশনাল সময়টার কথা বলো।
    মলয়: লিখেছি তো, সবই লিখেছি । ‘আখর’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় লিখেছি “ছোটোলোকের জীবন” শিরোনামে । ওটা প্রতিভাস থেকে “ছোটোলোকের সারাবেলা” নামে প্রকাশিত হবার কথা ।
    জয়িতা : ব্যক্তি মলয় ও লেখক মলয়ের মধ্যে ফারাক কতটা? তুমি নিজেকে কিভাবে
    দ্যাখো ।
    মলয় : কোনো তফাত আছে বলে মনে হয় না । আমিও যেকোনো লোকের মতন বাজার যাই, দরাদরি করি, যৌবনে মেছুনির সঙ্গে ফ্লার্ট করতুম, এখন সন্ধ্যাবেলা সিঙ্গল মল্ট খাই । হাংরি আন্দোলনের সময়ে গাঁজা চরস আফিম এলএসডি বাংলা খেতুম, এখন আর খাই না । বাড়িতে যে পোশাক পরে থাকি সেটাই অতিথিদের সামনেও পরে থাকি, মহিলারা এলেও । কথা বলার ধাঁচেও কোনো তফাত নেই, যদিও বেশ কিছু সাহিত্যিককে দেখেছি কেমন ক্যালাটাইপের গলায় কথা বলতে । তারা সব বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র বা ছাত্রদের ছাত্র ।
    জয়িতা: তোমার সমসাময়িক কোনো সাহিত্যিকের কথা বলো যাঁর সঠিক মূল্যায়ন কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য গোষ্ঠি করতে পারেনি যথাযথ ।
    মলয়: মূল্যায়নই হয় না, তো আবার সঠিক মূল্যায়ন । এতো বেশি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীবাজি হয় যে বেশির ভাগ প্রতিভাবান লেখক-কবির মূল্যায়ন হয় না, বিশেষ করে যারা গদ্য নিয়ে কাজ করছে তারা অবহেলিত থেকে যায় । পুরস্কারগুলো নিয়ে টানাটানি হয় । সিপিএমের লোকেদের বাংলা অকাদেমি থেকে বিদেয় করে দেয়া হলো ওই একই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কারণে, তাঁরাও জ্ঞানী-গুণী ছিলেন ।
    জয়িতা:জীবনের ইমনকল্যাণে এসে তোমার চেতনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে ? জীবন দর্শনের ক্ষেত্রে বলছি ।
    মলয়: এখন আমার একাকীত্ব ভালো লাগে, বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না, আমার স্ত্রীও বেশি কথা বলা পছন্দ করে না । আমরা কোনো অনুষ্ঠানে যাই না । খাবার নেমন্তন্ন এড়িয়ে যাই, শরীরের কারণে । এখানে মুম্বাইতে আত্মীয় বলতে আমার এক মামাতো ভায়রাভাই, যার বয়স আমার চেয়ে ছয় বছর বেশি । কিন্তু এও মনে হয় যে মরার পর শ্মশানে নিয়ে যাবার লোক জোটানো বেশ কঠিন হবে । বেস্ট হবে দেহ দান করে দেয়া । সেটা মরার পর বডির অবস্হা কেমন থাকে তার ওপর নির্ভর করে । আমার স্ত্রীর আপত্তি নেই । স্ত্রী আগে মারা গেলে আমারও আপত্তি নেই ।
    জয়িতা: তোমার জীবন ও সাহিত্যচর্চার ওপর দেশে বিদেশে গবেষণা হয়। সে সম্পর্কে কলকাতার পাঠক মহল জানতে চায় ।
    মলয়: বছর দশেক আগে থেকে আরম্ভ হয়েছে । প্রথম পিএইচডি করেছিলেন বিষ্ণুচন্দ্র দে আর এমফিল করেছিলেন স্বাতী ব্যানার্জি । আমেরিকা থেকে মারিনা রেজা এসে হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করে গেছেন, এখন গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করছেন ড্যানিয়েলা লিমোনেলা, রূপসা নামে একটি মেয়ে এমফিল করছে, প্রবোধচন্দ্র দে এম ফিল করছেন । এনারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে জানি । অনেকে যোগাযোগ না করেই, সন্দীপ দত্তর লাইব্রেরি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে করেছেন, যেমন সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য । উদয়শঙ্কর বর্মা পিএইচডি করেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি । সুতরাং কে কোথায় গবেষণা করছেন বলা কঠিন ।
    জয়িতা: সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা নিয়ে নানা কাজ করেছো ।কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে কাজ করবার ইচ্ছে আছে ?
    মলয়: আপাতত একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি । বাউল যুবক যুবতী জুটিকে নিয়ে, যারা তারুণ্যে একজন নকশাল আর একজন কংশাল ছিল । কিন্তু তাদের ঘিরে যে চরিত্ররা থাকবে সেই লোকগুলোকে গড়ে তুলতে পারছি না । এতেও যুবতীর বয়স যুবকের চেয়ে বেশি। পরস্পরকে মা-বাবা বলে ডাকে । সরসিজ বসু অনুরোধ করেছেন একটা গদ্য তৈরি করতে বর্তমান ভারতের জাতীয়তা, দেশপ্রেম, দাঙ্গা, গরুর মাংস খাওয়া, নিম্নবর্গের মানুষকে কোনঠাসা করার চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে । জানি না ব্যাপারটা মগজে কেলাসিত করতে পারব কিনা ।
    জয়িতা :তোমাকে প্রাচীন স্পার্টান বীরের মতো মনে হয় ।এই যে নানা ঘাত প্রতিঘাত নিন্দে মন্দ সব কিছুকে অবজ্ঞাভরে কেবল কাজ করে যাওয়া ,এই জীবনিশক্তির মূলমন্ত্র কি। অনুপ্রেরণাদাতা বা দাত্রী কে ?
    মলয় : হলিউড-বলিউডের ফিল্ম দেখে বলছিস বোধহয়, সিলভিস্টার স্ট্যালোনের র‌্যামবো, সালমান খানের চুলবুল পাণ্ডে, নাকি ? কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পরে সাতজন ক্রিমিনালের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার পর, বন্ধুরা আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াবার পর, নিন্দে-মন্দ গায়ে লাগে না, লিখেও তো কতো লোকে গালমন্দ করে, বিশেষ করে রাজসাক্ষীদের ছেড়ে যাওয়া অ্যাণ্ডা-বাচ্চারা । ওতে আমার কিসসু হয় না । যখন লেখা আরম্ভ করেছিলুম তখন কুলসুম আপা, নমিতা চক্রবর্তী, বাড়ির চাকর শিউনন্নি, বাবার দোকানের কাজের লোক রামখেলাওন সিং ডাবর ছিল, শেষের দুজন রামচরিতমানস আর রহিম কবির দাদু থেকে কোটেশান ঝেড়ে আমাদের বকুনি দিতো , ব্যাপারগুলো ছোটোলোকের ছোতোবেলায় লিখেছি । আমার লেখালিখি নিয়ে আমার স্ত্রী আর ছেলের কোনো আগ্রহ নেই ; মেয়ের আছে, কিন্তু তার হাতে সময় একেবারে নেই । বস্তুত অনু্প্রেরণা বলে সত্যিই কি কিছু হয় ? আমার তো মনে হয় আমি নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা।
    জয়িতা : তোমার বর্তমান যাপন সম্পর্কে তোমার অনুরাগী পাঠকসমাজকে কিছু জানাও।
    মলয়: আমি প্রথমে উঠি, স্ত্রী দেরিতে কেননা ওর রাতে ঘুম হয় না । ফ্রি হ্যাণ্ড এক্সারসাইজ করি । এক গেলাস গরমজল খাই যাতে পেট পরিষ্কার হয় । ব্রেকফাস্ট বানাই, ওটস । তারপর ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ বসে টাইমস অফ ইনডিয়া পড়ি । আমার পাড়ায় বাংলা সংবাদপত্র পাওয়া যায় না, এটা গুজরাটি ফাটকাবাজদের এলাকা, একটা ফাইনানশিয়াল টাইমস কিনে দশজন মিলে শেয়ারের ওঠানামা পড়ে । আমি কখনও শেয়ার-ফেয়ার কিনিনি, তাই কোনো উৎসাহ পাই না ওনাদের সঙ্গে গ্যাঁজাতে । হকারকে বললে চারদিনের বাংলা কাগজ তাড়া করে একদিন দিয়ে যায়। ব্যায়ামের পর চা বানাই গ্রিন টি । ততক্ষণে স্ত্রী উঠে ওটস ভাগাভাগি করে আর আপেল বা কিউই বা যে ফল হোক কাটে । আমি খেয়ে নিই । স্ত্রী এগারোটায় ব্রেকফাস্ট করে । তারপর বাজার যাই । মাছ-মাংস কেনার থাকলে ফোন করে দিলে দিয়ে যায় । ফিরে এসে এগারোটা নাগাদ কমপিউটারে বসি আর ভাবি । ফেসবুক খুলে জিমেল খুলে চোখ বুলিয়ে নিই । তারপর বই আর পত্রিকা পড়ি । একটায় স্নান, খাওয়া ঘুম । তিনটের সময়ে উঠে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখি, ইউরোপের, ভারতের থাকলে ভারতের । সাড়ে চারটের সময়ে বিবিসি । ছয়টা থেকে আটটা কমপিউটারে লেখালিখি আর সিঙ্গল মল্ট খাওয়া । তারপর রুটি তরকারি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা আর সেই ফাঁকে লেখার সম্পর্কে চিন্তাভাবনা, কেননা ঘুম আসতে দেরি হয় । ফোন বন্ধ করে দিই, যাতে কেউ ঘুমের দফারফা না করে ।
    জয়িতা :আজকাল কবিতাকে দশক হিসেবে ক্যাটিগোরাইজ করা হচ্ছে ; জেলা ও বিষয় ভিত্তিক ক্যাটিগোরাইজ করা হচ্ছে । কতটা প্রাসঙ্গিক বলে তোমার মনে হয় ?
    মলয়: এটা এই সময়ের ব্যাপার । সময় আপনা থেকে ঝরিয়ে দেবে যারা প্রাসঙ্গিক নয়, তাদের । প্রতিটি জেলায় কবিদের সংখ্যা তো কম নয় । হয়তো অমন সংকলন বেরোলে জানা যাবে তাদের ওপর জেলা-বিশেষের কথ্যভাষা আর ভূপ্রকৃতির প্রভাব পড়েছে কিনা । আমি নিজে তো জানি না আমি কোন জেলার । পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত এসেছিলেন যশোর থেকে কলকাতায়, তাঁর বংশধররা বেহালা-বড়িশায় ঘাটি গাড়েন । একজন শরিক ১৭০৩ সালে নদীর এপারে উত্তরপাড়ায় চলে আসেন, আমি তাঁর বংশধর । উত্তরপাড়ার জমিদার বাড়ি ভেঙে আবাসন হয়েছে, আমি আমার শেয়ার বেচে দিয়েছি । তারপর ছিলুম নাকতলায় । নাকতলার ফ্ল্যাট বেচে চলে এসেছি মুম্বাই । যে বাসা আমি একবার ছেড়েছি, সেখানে আর দ্বিতীয়বার ফিরে যাইনি । আমি একই ঘরে, একই বাড়িতে, একই পাড়ায়, একই শহরে সারাজীবন কাটাইনি ।
    জয়িতা :অনুকবিতা সাহিত্যপত্র গুলির নতুন আবিষ্কার । তোমার কি মতামত ? কবিতাকে কি সম্পাদক শব্দসীমায় বেঁধে দিতে পারে? কবি অসহায় বোধ করে অনেক সময়ই ।
    মলয় : এটা কবির সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে ঘটছে, অনেককে জায়গা দেয়া যায় অনুকবিতা পত্রিকায় । যে কবি অসহায় বোধ করে তার তো লেখাই উচিত নয় অমন সংকলনে । তবে চীনা আর জাপানি কবিতার প্রভাবে এজরা পাউন্ড ‘ইমেজিজম’ নামে অনুকবিতার আন্দোলন করেছিলেন । In a Station of the Metro নামে ওনার একটা দুই লাইনের কবিতা আছে, যাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুকবিতার মান্যতা দেয়া হয়েছে, কবিতাটা শোন :
    The apparition of these faces in the crowd ;
    Petals on a wet, black bough.
    জয়িতা : তোমার আন্তর্জাতিক যোগসুত্র বিশ্ব পরিচিতি সম্পর্কে বলো ।এখানকার পাঠকদের জানা দরকার। কোন বিদেশী সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপিত হয়ে মুগ্ধ হয়েছো ? কার বন্ধুত্ব নিবিড় হয়েছে । এখন বিদেশে তোমার রচনা নিয়ে বাংলা প্রেমী বিদেশী ছাত্রছাত্রীরা কতটা সচেতন ?
    মলয় : হাংরি আন্দোলনের সময়ে হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, ডিক বাকেন, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, মার্গারেট র‌্যানডাল, ডেইজি অ্যালান, ক্যারল বার্জ, ডায়না ডি প্রিমা, কার্ল ওয়েসনার প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত ছিলুম । অ্যারেস্ট করার সময়ে পুলিস ওনাদের চিঠিপত্রের ফাইল নিয়ে চলে গিয়েছিল, আর ফেরত পাইনি । এখন মাঝে-মাঝে প্রিন্ট বা মিডিয়ার সাংবাদিকরা যোগাযোগ করেন, সাক্ষাৎকার নিয়ে যান । স্কটল্যাণ্ডের একটা সংবাদপত্রের পক্ষে নিকি সোবরাইটি নামে এক তরুণী সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন । বিবিসির পক্ষ থেকে দুবার, একবার জো হুইলার আর আরেকবার ডোমিনিক বার্ন সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছেন । ড্যানিয়েলা লিমোনেলার কথা আগেই বলেছি, যাঁকে আমার স্ত্রীও ভালোবেসে ফেলেছে, ড্যানিয়েলা বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান বলতে পারে, হাত দিয়ে ভাত খায় আমাদের বাড়ি এলে । আমি আর নিজে থেকে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করি না ।
  • m | 012312.60.2334.207 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৩৬541315
  • মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ :
    অধ্যাপক শীতল চৌধুরীর বিশ্লেষণ
    দেশে-দেশে যখনই স্রষ্টার কলম নিয়ে নতুন পথের পধিক হতে চেয়েছেন যে সব কবিরা, তখনই অগ্নিসর্মা হয়ে বাধাস্বরূপ দাঁড়িয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছুঁৎমার্গীরা । বহু কবিকূলকে এজন্য ব্যঙ্গবিদ্রূপ হজম করতে হয়েছে, সময়ে সময়ে এজন্য দণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে । কঠিন জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে । ফরাসি দেশের আধুনিক কবিদের পুরোধা বোদলেয়ারের নাম বিশেষভাবে করা যায় । ছুঁৎমার্গীদের কাছে তিনি জীবিতাবস্‌আয় ছিলেন অচ্ছুৎ । ‘হাংরি জেনারেশন’-এর পপধান পুরোহিত তাঁর সময়কালে যে নতুন সাহিত্যপথের পথিক হয়ে ছুঁৎমার্গীদের কোপে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক । এজন্য স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীকে শ্রীঘরেও অতিথি হতে হয়েছে ।
    কবি চসারের In the sowre hungry tyme পংক্তিটি থেকে ‘হাংরি’ শব্দটি তুলে নিয়ে ১৯৬১ সালের নভেম্বরে নতুন বাংলা কবিতা আন্দোলনের পুরোহিত মলয় রায়চৌধুরী যে পত্রিকা প্রকাশ করেন, তার নাম রাখা হয় ‘হাংরি জেনারেশন’ । ‘হাংগরি’ বা ‘হাংরি’ যাই বলিনা কেন -- এই শব্দের আড়ালে প্রচ্চন্ন রয়েছে যে অর্থটি তা হলো ‘ক্ষুধা’ । এ ক্ষুধা যে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক, এবং চিরাচরিত বস্তাপচা মূল্যবোধকে ভাঙার, তা বলা বোধ করি অনুচিত হবে না ।
    রোমান্টিসিজমের ছাঁচে বন্দি চিরাচরিত ভাবলোক থেকে আত্মানুসন্ধানে বেরিয়ে এসে মলয়বাবু বাংলা কবিতাকে অস্তিত্ব-সংকট মুক্তি দিয়ে এক নতুন আত্মদীপের সন্ধানে মুখর করতে চেয়েছেন । কবিতাকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন যৌনতা, জান্তব ক্ষুধা বা জৈবতার মধ্যে ; এক জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি । প্রচণ্ড জান্তব ক্ষুধাকে সঙ্গী করে তিনি চেয়েছেন বাংলা কবিতার দিকবদল ও অন্তরাত্মার মুক্তি । ‘হাংরি জেনারেশন’-এর মূলমন্ত্র এটিই । মলয়বাবুর প্রথম বাংলা বুলেটিনের তাত্ত্বিক ভাষ্যেই তা পরিষ্কার ।
    “ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচনা হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমুহুর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে ‘সচেতনভাবে বিহ্বল’ হলেই কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । শখ করে, ভেবে ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন আর কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহিনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে ।”
    অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির সামর্থ্যে তিনি কবিতাকে স্হাপন করতে চেয়েছেন বস্তুগত জীবন ও আত্মিক জীবনের পারস্পরিক মেলবন্ধনে । একারণেই কিনা জানি না মলয়বাবু বহু-বিতর্কিত তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিতে অস্তিত্বের সংকটকে বড়ো করে দেখিয়েছেন । কবিতাটির শুরুতেই তিনি যখন সোচ্চারে একথা বলেন ---

    ওঃ মরে যাবো মরে যাবো মরতে যাবো
    আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
    আমি কী কোর্বো কোথায় যাবো ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
    সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবো শুভা
    শুভা আমাকে তোমার তরমুজ আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও
    চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
    শমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
    আমি আর পার্ছি না, অজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে

    আমরা এখানে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি কবি মলয়ের অন্তরের অস্তিত্বের সংকট কি ভয়ানকভাবে চেপে বসেছে, তাই তিনি চামড়া জ্বলার মধ্যে দিয়ে তাঁর যন্ত্রণার কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন, তেমনি সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবার কথাও প্রেমিকা শুভাকে বলছেন । তবু অস্তিত্বের সংকট থেকে পালিয়ে যাওয়া তো জীবনের ধর্ম হতে পারে না --- তাই পরক্ষণে তিনি শুভার ‘তরমুজ আঙরাখার’ ভেতরে চলে যাবার আকাঙ্খা করছেন । এ আকাঙ্খার মধ্যে রয়েছে কবি মলয়ের এক দিকে যেমন অস্তিত্বের সংকট থেকে ক্ষণিক মুক্তি, তেমনি যন্ত্রণা-জ্বালা থেকে ক্ষণিক মুক্তিও । যে যন্ত্রণা-জ্বালা অভুক্ত হৃদয়ের, শরীর ও মনের ।
    একটা কথা মনে রাখতে হবে । পঞ্চাশের থেকে সাহিত্যে একটা বন্ধ্যা যুগ তৈরি হয়েছে । একথা বলার কারণ পঞ্চাশের কবিদের সৃষ্টি-নির্মাণে পূর্বজদের রোমান্টিসিজমে গড়া সাহিত্যধারাই চর্বিতচর্বণ হয়েছে । চল্লিশের বা তিরিশের কবিদের মতন তেমন কোনো সাহিত্য পটপরিবর্তনের স্বাক্ষর তাঁরা রাখতে পারেননি । এমনকি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরের ছত্রছায়ায় লালিত পরবর্তী-সময়ের ভেঙে পড়া মূল্যবোধের যন্ত্রণা-জ্বালা বুকে নিয়ে যে সব চল্লিশের কবিরা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের বাণী নির্মাণের চেতনায় লিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মত ও পথের চর্বিতচর্বণ বাহকরূপেই পঞ্চাশের কবিরা কাটিয়ে দিয়েছেন পরবর্তী সময়কে কবিমানসের অনুশীলনে । বোধ ও মেধাচর্চায় আর নতুন কোনো আলোকিত জীবনমন্হনের হদিশ দিতে পারেননি । সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর সভ্যতা ক্রমশ অন্তঃসারশূন্য হয়ে, মানুষকে ও তার ভাবনা ও চেতনাকে, এক নৈরাজ্যের বাসিন্দায় পর্যবসিত করে, ক্রমশ অস্তিত্ব-সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে, এসত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে কবি মলয় রায়চৌধুরী ‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সাহিত্যনির্মাতদের বুকে যেমন আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন, তেমনি চেয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারা থেকে সাহিত্যের মুক্তি, শিল্পের মুক্তি । অনায়াসে কবি মলয় একথা বলেন ---

    আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
    প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
    শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফূলিঙ্গ

    যৌনতায় ডুবে যাওয়া নয়, কেবল যুগযন্ত্রণার অসুস্হতায় আচ্ছন্ন থাকাই কবি মলয়ের কাম্য নয় । তিনি চান জীবন যাপনের সত্য প্রকাশের মধ্যে দিয়ে প্রেমে-অপ্রেমে-বিদ্রোহে ওলোটপালোট করে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক ক্ষুধায় জীবনের এক পূর্ণতা, এমনকি শিল্পেরও । পরবর্তী কটি পংক্তিতেই যার আভাস আমরা পাই কবি মলয়ের তির্যক কথায় ---

    মা তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন
    তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম
    কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না
    একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
    ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতোদিন
    কবিতার আদিত্যবর্ণা মুত্রাশয়ে
    সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা
    ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
    শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমার ক্ষুধায়

    আসলে অনুপযুক্ত পৃথিবীর ধ্বস্ত সময়ের ফাঁস ছিন্ন করে কবি মলয় দাঁড়াতে চান প্রকৃত সত্যসন্দর্শন শিল্পের কাছে । তাই তাঁর অকপটে বলতে বাধে না --- “ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতোদিন” । আবার পরক্ষণে তিনি যখন বলেন, কবিতার আদিত্যবর্ণা মুত্রাশয়ে/এসব কি হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ/সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা” --- তখন বুঝতে বাকি থাকে না শিল্পের চর্বিতচর্বন সূতিকাগারে তিনি আবদ্ধ থাকতে চান না, তিনি চান গতানুগতিক বিশুদ্ধ শিল্পের নামে ধর্ষিত শিল্পভাবনার জগৎটিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে । “ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব”, এই পংক্তির মধ্য দিয়ে কবিতা রচনাকারদের শিল্পের নামে বাহারি ‘সম্মেলন’ নামক ভণ্ডামির প্রতি তাঁর তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ একই সঙ্গে ব্যক্ত হয় । নারীই যুগে-যুগে যেহেতু কবিদের কাছে কবিতার প্রতিমূর্তিরূপে উদভাসিত হয়েছে, কবিকে সমৃদ্ধ করেছে, সেহেতু কবি মলয় রায়চৌধুরীও শুভাকে চেয়েছেন শিল্পের জন্য । “হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমার ক্ষুধায়”, একথা বলার মধ্য দিয়ে শিল্পের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে । এ-কথা বলার কারণ, কবিতাকে তিনি নারীর মতনই সম্ভোগ করতে চান নিজস্ব আত্মদর্পণে । কোনো গতানুগতিক ধারার অনুসরণে নয় । শিল্প গড়ে উঠুক কবির মননসমৃদ্ধ ব্যক্তিক আত্মদর্পণের নিজস্ব নিয়মে, সময়কালের প্রেক্ষিতে, আত্মশ্লাঘা ও আত্মজিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে ।
    কবি মলয়ের ইংরেজি বা বিদেশি ভাষানবীশ কবিওয়ালাদের প্রতি ব্যাঙ্গোক্তিও দেখি এ-কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে । যারা নিজস্ব অন্তরাত্মার দিকে না তাকিয়ে পরদেশীয় ভাবনার অবগাহনে শিল্পের মুগ্ধতার চমৎকারিত্বে সদাই মশগুল । বিশেষত শহর কলকাতার শিক্ষিত কবিকূলেদের যা একান্ত ধর্মরূপে প্রতিভাত । আর এজন্যই কবি মলয়ের কন্ঠে এক অসহায়তাবোধ জেগে উঠেছে, সঙ্গে-সঙ্গে এক ধিক্কার ও ব্যঙ্গও তাই তিনি অকপটে বলতে দ্বিধা করেননি ---

    কলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
    কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছি না
    আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
    আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
    আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
    প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
    অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
    শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার

    কবি মলয়ের অস্তিত্বময় সংকট ও আত্মদর্পণের বিস্ময়প্রসূত আত্মজিজ্ঞাসার একটি সার্থক সত্যসুন্দরের দলিল হল এই ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি । একথা বলার কারণ মলয়ের আত্মধিক্কারের মধ্য দিয়ে নতুন পথ খোঁজার আত্যন্তিক ইচ্ছের ব্যাপারটি কবিতাটির মধ্যে বারবার ব্যক্ত হয়েছে, কখনো সরাসরি ভদ্র-প্রতিবাদীর মোড়কে, কখনো শ্।ইলতার মাত্রা ছাড়ানোর অভিব্যক্তিতে । শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানোর অভিব্যক্তি যেমন ---

    অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
    যোনিকেশরে কাঁচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা

    একটা কথা এখানে বলা বোধ করি উচিত হবে, এই শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানো অভিব্যক্তি কিন্তু কখনো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে না । কবিতাকে নারীদেহ রূপে দেখাটাই সাধারণত সৎ কবির ধর্ম । বৈষ্ণব সাহিত্যেও প্রেমের অভিব্যক্তির চরম প্রকাশে বার বার উঠে এসেছে নারীদেহের সুধামন্হন ও সৌন্দর্যের বর্ণনায় । যোনিই যেহেতু সন্তানের জন্মদ্বার --- সেহেতু যোনির সুস্হতা চাওয়ার মধ্য দিয়ে কবি মলয়ের সার্থক কবিতা নির্মাণের ভাবটিই এখানে ব্যক্ত হয়েছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি । সময়ে সময়ে ধর্ষণ শব্দটি দেখি তাঁর কবিতায় ফিরে এসেছে । ধর্ষণ শব্দটিকে ধ্বস্ত বা নষ্ট অর্থে ধরতে হবে । যা চর্বিতচর্বনে বহুব্যবহৃত তাকেই সম্ভবত তিনি ‘ধর্ষণ’ অর্থের দ্যোতনায় চিহ্ণিত করতে চেয়েছেন ।
    ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিকে শল্যচিকিৎসকের মতন যদি প্রথম থেকে শেষাবধি কাটাছেঁড়া করা যায় --- তাহলে যে সত্য চালচিত্রটি ধরা পড়ে তা হলো এক নবীন কবির আত্মবীক্ষণের ও আত্মমন্হনের এক সুগভীর প্রশ্ন-বিহ্বলের সুতীব্র আর্তনাদ, এবং এক অসহায় অস্তিত্বের তীব্র সংকটের ।
    শিল্পকেই একমাত্র জীবনযন্ত্রণার নিস্তার ও মুক্তি বলে মনে করেছেন বলেই তাঁর কবি-অন্তরে দ্বান্দ্বিকতা দেখা দিয়েছে । কবি মলয় একারণে যেমন বলতে বাধ্য হয়েছেন --- ‘ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন’, আবার বলতে বাধেনি --- ‘আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই’ । কৃত্রিম ভাবনালোক ত্যাগ করে মলয় চান সত্য সন্দর্শনের প্রকৃত জীবনযন্ত্রণার অক্ষরের পিনবিদ্ধ রক্তঘামে-ভেজা রক্ত-মাংসজনিত সাবলীল ভাবনালোক । কবিতা তাঁর কাছে ঈশ্বরী না হয়ে, হয়ে উঠুক সময়কালের দর্পণে জীবনযন্ত্রণায় পোড়া সত্যকারের মানবী । তাই দেখি শুভাকে তিনি শিল্পের মানবীসত্ত্বার প্রতীকীব্যঞ্জনায় আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, তাকে বারবার রমণে ও মননে । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির সারসত্য এইটাই । কবিতাকে তিনি তাঁর চূড়ান্ত অসহায়বোধ থেকে শেষ পর্যন্ত গভীর তৃঢ়্ণায় নিশ্চিন্ত বোধের জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান । কল্পনার রঞ্জিত বিলাসে তিনি যে গা ভাসাতে ইচ্ছুক নয়, তা স্পষ্ট করেছেন বিশেষত মাতৃগর্ভে ফিরে যাবার পর ফের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে জীবনের আস্বাদকে লেহন করার মধ্যে দিয়ে । শুভা কেউ নয়, কবি মলয়ের জীবন-আস্বাদনের প্রতিভূ --- শিল্পের মানবী বা আধার । মলয়বাবু শিল্পরূপী কবিতাকে টেনে আনতে চেয়েছেন প্রকৃত জীবনের কাছে, প্রকৃত বাস্তবের সত্যসন্দর্শনে ।
    এ আলোচনার সমাপ্তিকালে কটি কথা বলা বোধ করি উচিত হবে, ‘হাংরি জেনারেশন’এর পুরোহিত কবি মলয় রায়চৌধুরী প্রকৃত কালসত্যের সন্দর্শনটি মেলে ধরেছিলেন তাঁর সুবলিষ্ঠ লেখার মাধ্যমে বলেই, বাংলা কবিতায় আজ শ্লীল-অশ্লীলের কাল্পনিক বা সমাজবিদদের চাপানো কতকগুলি ধারনার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে বাংলা সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে যে সাবালকত্বের দুয়ার খুঁজে পেয়েছে, তা সত্তর দশকের কবিকূলের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায় । বিশেষ করে সত্তর দশকে প্রখ্যাত কবি জয় গোস্বামীকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বমহিমায় ‘দশচক্র’ কবিতাটির কথা বলা যেতে পারে । জয়ের এ উচ্চারণ---

    স্বয়ং মা সরস্বতী বীণা ও পুস্তক ফেলে দু-হাত দিয়ে পথ আটকে
    দাঁড়ালেন আমার রাস্তায়
    পরনে কিচ্ছুটি নেই, একদম ন্যাংটো শুধু আঙুলে নেলপালিশ
    সরু সরু নখসুদ্দু আঙুল
    ঢুকিয়ে দিলেন চোখে, মরে গেলাম মরে গেলাম, মরতে মরতে কী দেখলাম
    বলব কী ভুতুম আমি কী বলব তোমায়
    দেখতে দেখতে আমি স্বয়ং ভগবান হয়ে যাচ্ছি মাকে ডাকছি বাপকে ডাকছি
    চোদ্দগুষ্টিকে ডাকছি আয় আয় আয়
    বাপকে মেয়ের সামনে ছেলেকে মায়ের সামনে মেরে শুইয়ে দিচ্ছি কেটে ।

    জয়ের এ-উচ্চারণে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাব পাওয়া যায় না কি ? হাংরি জেনারেশন আন্দোলন যে বৃথা যায়নি, তা টের পাই সত্তর দশকের বহু কবিদের বেশ কিছু রচনাতেই । সত্তর দশকের কবিদের গতানুগতিক বৃত্তভাঙার মন্ত্রবীজটি যে হাংরি জেনারেশনের কাছ থেকেই এসেছে তা বোধকরি মনে কোনো দ্বিধা না রেখেই বলা যায় । কবি মলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পুরোহিত বা পুরোধা হিসাবে সার্থকতা এখানেই । তিনি পপকৃত কবিতার বিবর্তনের স্রোতটি খুব অনায়াসভাবে পৌঁছে দিতে পেরেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের বোধে-মননে ও হৃদয়ে । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ যথার্থই একটি সার্থক কবিতা । কি উপমা প্রয়োগে, কি শব্দচয়নে, কবি মলয়ের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় । বিশেষ করে ‘নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা’ ও ‘কাঁচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা’ উপমা দুটি নজর কাড়ে । ‘তরমুজ আঙরাখার’,’ আঁচ মেরে’, ‘ক্লিটোরিসের’, ‘লাবিয়া ম্যাজোরার’, ‘হিপ্নটিক’, ‘যৌনপরচুলায়’, এসব শব্দ যেমন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কবিতাটিকে অর্থবহ করে তুলেছে, তেমনি রসঘনভাবে একটা বিশ্বাসের ভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । সর্ব অর্থেই একটি তারিফযোগ্য কবিতা এটি, এবং হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রকৃত মন্ত্রবীজ হয়ে উঠেছে এই কবিতা । কবিতাটির যথার্থ মূল্য এখানেই ।
    -------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    Published in ‘Swapna’ literary periodical, ( 2008 ) Edited by Dr. Bishnu Chandra Dey, Nabin Chandra College, Assam University, India.
  • | 012312.60.2334.207 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:১৪541317
  • প্রবন্ধ: স্ল্যাঙালঙ্কার
    মলয় রায়চৌধুরী
    কিছুকাল আগে উত্তর ভারতে একটা হিন্দি গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘ভাগ ভাগ ডিকে বোস’, কিন্তু উর্দু-হিন্দিভাষী পাড়া ছাড়া পশ্চিমবাংলায় অন্যত্র তত পাত্তা পায়নি, তার কারণ গানটিতে যে গালাগাল লুকোনো আছে তা, এ-বং ও-বং দুই বঙেই, অপ্রচলিত । গানটা দ্রুত গাওয়া হয়েছিল, এইজন্য যে তাহলে বাক্যটা এরকম শোনাবে, ‘ভাগ ভোঁসড়িকে ভাগ’। ইনটারনেট সার্চ করে দেখলুম যে বাংলাদেশিরা যে-যার নিজের সাইটে সেদেশে প্রচলিত গালাগাল ( কেউ-কেউ তাকে ভুল করে লিখেছেন ‘স্ল্যাং’ ) অন্তর্ভুক্ত করলেও তাতে ‘ভোঁসড়ি’ শব্দটা নেই, যদিও ‘চুত’ শব্দটা আছে, ‘চুতিয়া’ নেই । তাছাড়া বাংলাদেশি গালাগালগুলোর অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে ও শহরে ঘোরাঘুরির সময়ে শুনিনি, দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু এলাকাতেও শুনিনি । অন্ত্যজ বিহারি ও কাঙাল মুসলমানদের ইমলিতলা পাড়ায় শৈশব কেটেছিল আমার, সেখানে যে হিন্দি গালাগাল প্রয়োগ হতো, সেগুলোর বেশ কয়েকটা অবশ্য পশ্চিমবাংলায় শুনেছি ; নাকতলাতে ছ’বছর কাটিয়ে টের পেয়েছি যে বাঙালি পাড়াতেও হিন্দির যৌন-গালমন্দই প্রয়োগ করেন ছেলে-ছোকরারা ।
    গালাগাল ( swear words ) বা খিস্তি ( abusive words ) আর স্ল্যাঙের তফাত আছে । গালাগাল কাউকে অবমাননা কিংবা মানসিক আঘাত করার উদ্দেশে প্রয়োগ করা হয় । কেউ যখন গালাগালটি কারোর উদ্দেশে প্রয়োগ না কোরে, নিজের কথাবার্তায় বিশেষ ঝোঁকের জন্য ব্যবহার করেন, তখন অভিব্যক্তিটি ‘খিস্তি’ হয়ে ওঠে । কাউকে ‘খিস্তি করলে’ তখন তা গালাগাল । ‘স্ল্যাং’ শব্দটি ইংরেজি অভিধানে প্রবেশ করেছিল ১৭৫৬ সালে, ব্রিটেনে ইনডাস্ট্রিয়াল রিভলিউশানের সময়ে, যখন অজস্র শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে উঠতে লাগল নতুন শহুরে এলাকা, আর শ্রমিকরা, তাঁদের পারস্পরিক আদানপ্রদানের বুলিতে, নিজের-নিজের এলাকা থেকে নিয়ে এলেন সমাজের নিচুতলার শব্দভাঁড়ার । ইনডাস্ট্রিয়াল রিভলিউশান যেমন পুঁজিপতি-শ্রমিকের বিভাজন সৃষ্টি করল, তেমনই সৃষ্টি করেছিল বাকজগতের বিভাজন । ১৭৫৬ সালে অভিধানে অন্তর্ভুক্তির সময়ে ‘স্ল্যাং’-এর মানে দেয়া হয়েছিল ‘ভোকাবুলারি অব লো অর ডিসরিপিউটেবল পিপল।’ কেবল নিচুতলার নয়, তাদের কুখ্যাতি বা বদনামকে চিহ্ণিত করবার জন্য অভিব্যক্তিটা লক্ষ্য করার ব্যাপার ।
    ভাষাতাত্ত্বিক বেথনি ডুমাস এবং জোনাথান লাইটার তাঁদের ‘ইজ স্ল্যাং এ ওয়র্ড ফর লিংগুইস্টস’ গ্রন্হে লিখেছেন যে স্ল্যাং হল একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আইডেনটিটি গড়ার ‘ইনসাইডার স্পিচ’ ,এবং সমাজের উঁচুতলার দায়িত্বশীল লোকেদের ডিসকোর্সে তা ট্যাবু । ১৭৫৬ সালে, খ্রিস্টধর্মের রমরমার দিনে, ট্যাবুর অর্থ ছিল ‘অপবিত্র’। বেথনি ও জোনাথান যখন বইটি লিখছেন ( ১৯৭৮ ) তখন ট্যাবু মানে যে কাজ বা কথা নিষিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় । কিন্তু কেনই বা নিচুতলার মানুষ বা বদনাম মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের বুলিতে স্ল্যাং প্রয়োগ করে ? তারা, সচেতনভাবে, বা অবচেতনার প্ররোচনায়, তা প্রয়োগ করে শিষ্ট ভাষায় অন্তর্ঘাত ঘটাবার জন্য, সমাজের প্রতিষ্ঠিত ভাষাকে আক্রমণ করার মাধ্যমে উঁচুতলাকে বিধ্বস্ত করার উদ্দেশে । ডুমাস ও লাইটার লিখেছেন যে স্ল্যাং শব্দগুলোকে জারগনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে ।
    স্ল্যাং ব্যবহারের মাধ্যমে গোষ্ঠীবিশেষরা তাদের ‘ইনডেক্সিক্যালিটি’ গড়ে তোলে, যে কারণে একটি গোষ্ঠীর ব্যবহৃত স্ল্যাং আরেকটি গোষ্ঠীর কাছে দুর্বোধ্য হতে পারে । ওপরে বর্ণিত ‘ভোঁসড়ি’ অভিব্যক্তিটির মতন । যে দেশগুলোয় ইংরেজিভাষীদের বসবাস, যেমন ব্রিটেন, কানাডা, আমেরিকা, অসট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইত্যাদি, একদেশের স্ল্যাং অন্যদেশের বুলিতে ঢোকার সুযোগ সমান্তরালভাবে পায় না । জুলিয়া কোলম্যান তাঁর ‘লাইফ অফ এ স্ল্যাং’ ( ১৯৯৬ ) বইতে লিখেছেন যে সাধারণত একটা স্ল্যাং সে দেশের বুলিতে যদি দশ বছর টিকে যায় তাহলে তা ক্রমশ শিষ্টভাষায় ঢুকে পড়ে, এবং বিদ্যায়তনিক স্তরে গৃহীত হয় । গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং যদি শিষ্টভাষায় প্রবেশ করে তাহলে তাদের ধার ভোঁতা হয়ে যেতে থাকে । মার্কিন সাহিত্যিক নরম্যান মেইলার ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত সৈন্যবাহিনীতে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দ্য নেকেড অ্যান্ড দ্য ডেড’ উপন্যাসে ‘ফাক ইউ’, ‘মাদারফাকার’ ইত্যাদি শব্দগুলো লেখার সাহস যোগাতে পারেননি বলে ‘ফাগ ইউ’, মাদারফাগার’ ইত্যাদি লিখে চালিয়েছিলেন, কেননা তখনও মার্কিনসমাজের প্রতিটি স্তরে শব্দটা প্রবেশ করেনি । তিনি একজন সাহিত্যিক হয়ে অমন হেরো কাজ করেছিলেন বলে সমালোচকরা সেসময়ে তাঁকে তুলোধনা করেছিলেন । ১৯৫৮ সালে বইটির গল্প নিয়ে তৈরি ফিল্মে অবশ্য চরিত্ররা ‘ফাক’ শব্দটিই উচ্চারণ করেছিল । আসলে ততদিনে বিট আন্দোলন ও হার্লেম রেনেসঁসের কবি-লেখকরা তাঁদের লিটল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং দিয়ে ছেয়ে ফ্যালেন ; খোলাখুলি যৌন ড্রইংও প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা । তাঁরা উৎসাহিত হয়েছিলেন মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এর এই কথাগুলো থেকে : ‘স্ল্যাং ইজ দ্য স্টার্ট অব ফ্যানসি, ইম্যাজিনেশান অ্যান্ড হিউমার, ব্রিদিং ইনটু ইটস নসট্রিলস দি ব্রেথ অব লাইফ’ ( কালেক্টেড প্রোজ, ১৮৯২ ) ।
    সম্প্রতি সিদ্ধার্থ মালহোত্রা ও পরিণিতি চোপড়া অভিনীত ‘হাসি তো ফাসি’ নামের হিন্দি ফিল্মটির প্রচারে বলা হয়েছিল যে তা ‘কাকিং ফ্রেজি’ ফিল্ম । শব্দটি ‘ফাকিং ক্রেজি’, যা ব্যবহার করলে আমাদের দেশের সেনসর বোর্ড কর্তারা নির্ঘাত হাতে কাঁচি তুলে নিতেন । বাজারে পোশাকের একটি ব্র্যাণ্ড এসেছে, Fcuk নামে । অর্থাৎ মধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণে যে পপুলার জোগান-চাহিদার ক্ষেত্র, সেখানে মার্কিন গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং প্রবেশ করে গেছে, বাজারের মাধ্যমে । মার্কিনদেশে ওগুলো সমাজের নিচুতলা থেকে ওপরে গিয়েছিল । সেদেশে এখন রাষ্ট্রপতি, সেনেটর, আমলা, পুলিশের লোক, সকলেই নির্দ্বিধায় ফাক, আসহোল, সান অব এ বিচ ইত্যাদি প্রয়োগ করেন । কিছুকাল আগে তাঁদের মহিলা কূটনীতিক ইউরোপিয় ইউনিয়ানের প্রতিনিধিকে ‘ফাকিং ইউরোপিয়ানস’ বলায় বেশ জলঘোলা-গোঁসাগোঁসি হয়েছিল । আমাদের দেশে নেহেরু-বিধান রায়ের সময়ের রাজনীতিকদের যে বিলাতে-শিক্ষিত উৎসভূমি ছিল, এখনকার রাজনীতিকদের উৎসভূমি তা থেকে ক্রমশ সমাজের নিম্নবর্গের দিকে চলে গেছে ; সমাজ হয়ে গেছে আরবানাইজড, বহু এলাকা থেকে জনগণ হয়ে গেছে উৎপাটিত, গণমাধ্যমের অকল্পনীয় প্রসার ঘটেছে । বিহার-উত্তরপ্রদেশ-হরিয়াণা-রাজস্হানের এখনকার, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে, প্রায় সব রাজনীতিকের মুখে ‘ভ্যায়েনচো’ শব্দটা তাঁদের আড্ডায় প্রতিনিয়ত শোনা যায় ।
    মাইকেল অ্যাডামস তাঁর ‘স্ল্যাংস - দি পিপলস পোয়েট্রি’ ( ২০০৯ ) গ্রন্হে লিখেছেন যে স্ল্যাং হল প্রতিদিনকার কথাবাত্রার কবিতা, জনগণের কবিতা, এবং ভাষাকে শিল্পের শিখরে তুলে নিয়ে যাবার উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্য স্ল্যাংকে অভিবাদন জানানো উচিত ; স্ল্যাং হল মূলস্রোতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের হাতিয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাধারীদের বিস্হাপিত করার সাধিত্র । বিশেষ-বিশেষ স্ল্যাং-অভিব্যক্তি, যারা সেগুলো ব্যবহার করে না বা করতে লজ্জা পায়, তাদের হেনস্হা করার জন্য, জ্বালাতন করার জন্যই ওই স্ল্যাংগুলোকে উদ্ভাবন করা হয় । স্ল্যাং মানেই যে তা যৌন অভিব্যক্তি থেকে পয়দা হয়েছে, এমন নয়, বলেছেন মাইকেল অ্যাডামস ; যৌন অভিব্যক্তিগুলো প্রয়োগ হয় মর্মার্থে ‘শক’ দেবার ক্ষমতার জন্য ; সেই শব্দগুলো সেক্সিস্ট নয়, বরং অপরপক্ষের পিতৃতান্ত্রিক কৌমপ্রতাপকে খর্ব করার বোমাবারুদ ।
    যাদের মগজ থেকে ওই অভিব্যক্তিগুলো তৈরি হয় তাদের প্রশংসা করা উচিত, লিখেছেন অ্যাডামস, কেননা তারা আমাদের দেখায় যে ভাষাবিশেষে সাংস্কৃতিক সংঘাতের জন্য খেলা করার কেমন ফাঁকা এলাকা পড়ে আছে, মানুষের সহজাত উদ্ভাবনীশক্তির কথা সমাজকে প্রতিনিয়ত জানাতে থাকে, ভাষার ভেতর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে স্ল্যাংগুলো চোখ মেরে দিয়ে চলে যায়, এবং ভাষায় উদ্ভাবনার ক্ষেত্রটি মূলত কবিদের । কবিরা যেমন সাহিত্যিক কৌশল ব্যবহার করেন, তেমনই স্ল্যাং ব্যবহারকারীরা স্ল্যাঙের মধ্যে দিয়ে উপস্হাপন করে রূপক, উপমা, অনুপ্রাস, পরাবৃত্ত, ধ্বনিক্রীড়া, লক্ষণালঙ্কার, সিনেকড্যকি, ইত্যাদি । সমাজের উঁচু স্তরে জারগন তৈরি হয়, কিন্তু গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং সাধারণত জন্মায় সমাজের সাবকালচারে ; অভিব্যক্তিগুলো যতদিন অভিধানের বাইরে থাকে ততদিন তা কাউন্টার ডিসকোর্সের কাজ করে । যেহেতু কাউন্টার ডিসকোর্স, সেহেতু সংস্কৃতির অভিমানে লালিত প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে তাকে মনে করা হয় অশ্লীল ।
    কনি এলবি তাঁর ‘স্ল্যাং অ্যান্ড সোশিয়েবিলিটি ; ইন-গ্রুপ ল্যাংগুয়েজেস অ্যামাং কলেজ স্টুডেন্টস’ ( ১৯৯৬ ) গ্রন্হে লিখেছেন যে শোষিত যেমন শাসক বিরোধীতার জন্য গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং উদ্ভাবন করে, তেমনই যুবক-যুবতীরা তাঁদের পারস্পরিক আদানপ্রদান এবং গোষ্ঠী আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য নিজেদের সময়কে চিহ্ণিতকারী ‘ইশারাশব্দ’ গড়ে তোলেন যা ক্রমে তাঁদের প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্ল্যাং-এর আদল পায় । যুবক-যুবতীদের কাছে স্ল্যাং-বিশেষের মর্মার্থ তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, কীভাবে প্রয়োগ করা হল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ শব্দমাধ্যমটি নিজেই হয়ে দাঁড়ায় ‘বার্তাবিশেষ’। বার্তাটির অন্তর্গত যে সাবটেক্সটটি পাওয়া যায়, তা হল যে বক্তা ও শ্রোতা একটি গোষ্ঠী বা দলের বা শ্রেণির সদস্য ।
    হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমরা আকছার গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং প্রয়োগ করতুম, বিশেষ করে হ্যাণ্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, সুবিমল বসাক যেগুলো ওর দপতরে স্টেনসিল করতো সেই বুলেটিনগুলোয়, ত্রিদিব মিত্রের ‘উন্মার্গ’ এবং ‘ওয়েস্ট পেপার’ পত্রিকায় । সে সময়ে, ষাটের দশকের শুরুতে, কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক কর্তাব্যক্তিরা বেজায় চটেছিলেন একটি বিয়ের কার্ডে ছাপানো এই বাক্যটির জন্য : ‘ফাক দি বাস্টার্ডস অব গাঙশালিক স্কুল অব পোয়েট্রি’, তার কারণ সংস্কৃতি-অভিমানী স্তরটিতে তখনও ‘ফাক’ এবং ‘বাস্টার্ড’ গৃহীত হয়নি ; এবং তখনকার কোনো-কোনো প্রবীণ বুদ্ধিজীবী এই ভেবে অপমান বোধ করেছিলেন যে তাঁদের বটানিকাল পোয়েট্রিকেই বলা হচ্ছে ‘গাঙশালিক স্কুল অব পোয়েট্রি’ । এখন কোনো কবি বা লেখক এই কথাগুলো লিখলে তা ফালতু মনে হবে, কেননা সমাজে ঢুকে গিয়ে ওই স্ল্যাং ও গালাগালি তাদের আক্রমণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে ।
    হাংরি আন্দোলনের আগে প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণের জন্য, ক্ষমতাগর্বী সাহিত্যিক-সম্পাদক-অধ্যাপকদের ছড়ি ঘোরাবার মৌরসিপাট্টাকে হেনস্হা করার জন্য, সাহিত্যের শিষ্টভাষাতে অন্তর্ঘাত ঘটাবার জন্য, মেইনস্ট্রিমের ডিসকোর্সকে ফুটো করার জন্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃজনশীল লেখালিখিতে গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং ব্যবহার করার সাহস কেউই দেখাতে পারেননি । এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোর্সটি উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায়, নিম্নবর্গের প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সটি লোপাট হয়ে গিয়েছিল । হাংরি আন্দোলনে আমি তফশিলিপাড়া ইমলিতলা থেকে, সুবিমল বসাক পাটনার দরিদ্রপাড়া দুরুক্ষি গলি থেকে, দেবী রায় হাওড়ার স্লাম থেকে, সুভাষ ঘোষ বালুরঘাটের উদ্বাস্তু কলোনি থেকে এসেছিলুম । অর্থাৎ মূল সংস্কৃতিতে আমরা ছিলুম ‘আউটসাইডার’ । স্বাভাবিক যে তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই । তারপর তো অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট, লালবাজার, লকআপ, হাতকড়া, আদালত, সাক্ষীসাবুদ, জেলজরিমানা ইত্যাদি ।
    সেসময়ে, ষাটের দশকে, হাংরিদের প্রয়োগ-করা বাঞ্চোৎ, বোকাচোদা, বাল, পোঁদ, গু, মুখে মুতি, পুটকি মারি, বাঁড়া, নরক কিচাইন, শুয়োরের পোলা, মাদারচোদ, খানকিবোঁটা, মাল, গুদ, পাদ, লেড়িয়ে গেছি, মাই, খোকোনপোঁদা, এমসিবিসি, ফাটবুকনি, ঢপকুমার, ফাকাফাকি, পেছন মারি, লাইনমারুয়া, পোঁদ ধুইয়ে, লুণ্ড হয়ে থাকব, থুতুচাটন, চুষকি , রস-কচলা, পেঁয়াজি, নাঙলা, হাত-মারলে রস পড়ে না, ছেমড়ি, গালফুলো-গোবিন্দ ইত্যাদি অভিব্যক্তির ভেতরে পোরা থাকত নাস্তানাবুদ করার ক্ষমতা । বলাবাহুল্য সেগুলো ছিল যৌবনের ‘কোর এলিমেন্ট’ ।
    হাংরি আন্দোলনের পরের প্রজন্মগুলোয় গালাগাল, খিস্তি, স্ল্যাং নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে লেখালিখিতে ; পড়তে আক্রমণাত্মক লাগলেও, সেগুলো স্রেফ নব্যালঙ্কার হিসাবে উপস্হাপিত হচ্ছে , যাঁদের আক্রান্ত হবার কথা তাঁরা অপমানিত বোধ করার বদলে সেগুলো বিদ্যায়তনিক আহ্লাদে সীমিত রাখছেন । যেমন এই কটা লাইন হাংরি আন্দোলনের সময়ে কোনো আন্দোলনকারী লিখলে লালবাজারের প্রেস সেকশানের যে ইনফরমাররা কফিহাউসে ঘোরাঘুরি করে তারা নিয়ে গিয়ে নালিশখাতায় নথি করে রাখত, প্রতিষ্ঠানের বিগবসরা টেলিফোন টেপাটিপি করে প্রশাসনকে জানাতেন বঙ্গসমাজ কতটা উচ্ছন্নে চলে যাচ্ছে । কিন্তু তা হবার মতন মনন-পরিসর উবে গেছে, সমাজটাই পুরোপুরি পাল্টে গেছে । বস্তুত বর্তমান কালখণ্ডে সরাসরি গালমন্দ করলে তবেই প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে, কর্তাবাবা-বিবিরা চটতে পারে । মন্দাক্রান্তা সেনের কবিতার এই লাইন কটা তুলে দিয়ে লেখাটা এখানেই শেষ করি, সত্যি কথাই বলেছেন মন্দাক্রান্তা সেন :
    ‘প্রতিষ্ঠানের বুক থেকে দুধ টানছ
    প্রতিষ্ঠানের বুকেই আঘাত হানছ
    বিপ্লবী কবি বলেছে তোমাকে পাবলিক
    আসলে তো তুমি আগাপাশতলা, বানচোদ’

    আহা, বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ অলঙ্কার সৃষ্টি করে গেছে হাংরি আন্দোলনকারীরা, এবং তা হল ‘স্ল্যাঙালঙ্কার’ ।
    ( রচনাকাল : মার্চ ২০১৪ )
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন