এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    pi
    বইপত্তর | ২৪ মার্চ ২০১২ | ২৩৮৩৬৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 012312.60.2334.207 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:১৬541318
  • প্রবন্ধ :স্বমেহনের দর্শন
    মলয় রায়চৌধুরী

    কামস্তদগ্রে সমবর্ততাধি মনসো রেতঃ পরথমং যদাসীত ।
    সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন হর্দি পরতীষ্যাকবয়ো মনীষা ।।
    ঋগ্বেদ, দশম সুক্ত

    To intervene in this personal, secret activity, which masturbation was, does not represent something neutral for parents. It is not only a matter of power or authority, or ethics ; it is also a pleasure.
    ( Michel Foucault, Politics, philosophy, culture : interviews and other writings, 1977-1984 ). 1990.

    এতটা বয়স হোলো তবু লোভ কুন্ঠিত হোলো না ।
    লুন্ঠিত বীর্যের ফেনা চেয়ে চেয়ে দেখি ।

    এত যে প্রলোভ তবু সাহস অর্জিত হোলো না ।
    স্খলিত স্পর্ধার আঠা টিপে টিপে দেখি ।
    আত্মরতি, সুকুমার চৌধুরী

    স্বমেহনের কি দর্শন হতে পারে ? কেননা দর্শন তো প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ, এটি জ্ঞানের একটি ধারা যা, আমরা কি ভাবে বেঁচে থাকি আর থাকব, তা নিয়ে আলোচনা করতে চায় । দর্শনের জন্য কাম্য প্রজ্ঞায় তাই সম্ভবত প্রয়োজন ব্যক্তিএককের অর্ন্তদৃষ্টি, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী আর বিচার-বিশ্লেষণের সামঞ্জস্য । কিন্তু আমরা কি ভাবে বেঁচে থাকি আর থাকব, তা তো দেশ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি, রাষ্ট্র, ধর্ম ইত্যাদিতে একই হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে । সেক্ষেত্রে স্বমেহনের দর্শন কেমন করেই বা সম্ভব ! তাছাড়া, কৌমপ্রজ্ঞা কি সম্ভব ? এমন একটি মানবজোট যার প্রতিটি ব্যক্তিএকক সদস্য একই প্রজ্ঞার উৎস ? আর স্বমেহন তো যৌনতা । যৌনতা কি ব্যক্তিএককের নিজস্ব প্রায়ভেট এলাকা নয় ? তার ভেতরে কেন কৌমপ্রজ্ঞাকে নাক গলাতে দেয়া হবে, যদি কৌমপ্রজ্ঞা বলে কিছু হয় ? কৌমপ্রজ্ঞা হিসাবে যদি ধর্মগুলোর কথা চিন্তা করা হয় তাহলে দেখি একটি ধর্ম নানা ফ্যাঁকড়ায় বিভাজিত, এমনকি সেসব ফ্যাঁকড়া গুলো এতই পরস্পর বিরোধী যে খুনোখুনি করতেও পেছপা নয়। কৌমপ্রজ্ঞা হিসাবে যদি রাজনৈতিক মতবাদকে নিই, যেমন মার্কসবাদ, তাতেও নানা রকমের ফ্যাঁকড়া-বিভাজন। শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ফ্যাঁকড়ার শীর্ষে থাকেন একজন বলিয়ে-কইয়ে গাজোয়ার, অর্থাৎ ব্যক্তি-একক, যিনি নিজের মতামতকে সমূহ ব্যক্তিএককদের ওপর অন্তত কিছুকালের জন্য চাপিয়ে দিতে সফল হন । তাহলে ? দেখা যাক যাচাই করে ।
    সুরজিৎ সেন তাঁর ‘শহর সংস্করণ’ উপন্যাসে যে প্যারাগ্রাফটি লিখেছেন, সেটা আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি : “লেখক আখতারুজ্জমান ইলিয়াসশহর নামে একটা লিটল ম্যাগাজিনে যা লিখেছেন তা প্রণিধানযোগ্য । উনি লিখেছিলেন, “আমি মাস্টারবেশন বা স্বমেহনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিই, কারণ এর মধ্যে আমি সোসাইটিকে দেখি । যে লোকটা মাস্টারবেশন করছে সে চূড়ান্ত নিঃসঙ্গ ও ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ। এই বিকারগ্রস্ততা সমাজের প্রোডাক্ট । কেননা সেক্স ব্যাপারে সঙ্গীই প্রধান । যে লোক মাস্টারবেট করে, ধরে নিতে হবে তার সঙ্গী নেই । থাকলেও সে তার যৌনতার পূর্ণ তৃপ্তি ঘটাতে অক্ষম । ফলত তাকে মাস্টারবেট করতে হচ্ছে । সমাজে ইউজুয়াল সেক্সের সুযোগ নেই, কেননা তা মুক্ত নয়, এমনকি স্বাস্হ্যকর বা সুস্হও নয় । সিক সোসাইটিতে লোকে মাস্টারবেট করে। বহু বিবাহিত পুরুষকেও করতে হয় ( প্রসঙ্গত, লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে স্বীকার করেছেন, যে, তিনি মাস্টারবেট করে সঙ্গমের চেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছেন । এটা আমাদের সমাজের সম্ভবত ৯০ শতাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে সত্য । কিন্তু স্বীকার করার মতো কালেজা নেই ) । এটা আসে গভীর নিঃসঙ্গতা থেকে । অসুস্হ সমাজেই মানুষের এ দুরবস্হা হয় । আমেরিকানরাও মাস্টারবেট করে এবং গর্বাচভকেও সেটা করতে হয়, কারণ সেও এক সিক সোসাইটির হোতা । মাস্টারবেশন আর নিঃসঙ্গতার ব্যাপারে আমার মিলান কুন্দেরার লাইফ ইজ এলসহোয়্যার বইটির কথা মনে পড়ছে । ওখানে একটা চ্যাপ্টার আছে ‘পোয়েট মাস্টারবেট’ নামে । সত্যি, এ এক ভয়াবহ ব্যাপার । এই নিঃসঙ্গতা, আমি মনে করি এটা একটা ইউনির্ভার্সাল প্র্যাকটিস । আমরা সবাই আনহেলদি ওয়ার্ল্ডে আছি । এটা একটা টোটাল লিবার্টির ব্যাপার, আমাদেরকে সেই কনসেপ্ট তৈরি করতে হবে, যেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা অন্য কোনো সোস্যালিস্ট কালচার তৈরি করতে পারেনি । আমি যে সমাজের কথা ভাবি, সেখানে সেক্স ব্যাপারে কোনো সংস্কার বা বেড়া থাকবে না । আমি চাই পূর্ণ স্বাধীনতা । না হলে ফ্রিডমকে লিমিটেড করে রাখা হয় । আর যে ফ্রিডাম সীমাবদ্ধ, তা কি আদৌ ফ্রিডম ?
    “যদি কোনো ফ্রিডমের কথা বলি তাহলে অ্যাবসলিউট ফ্রিডমের কথাই বলা উচিত । কেননা মানুষের যৌনতা নিছক বায়োলজিকাল ব্যাপার নয়, কালচারাল ব্যাপারও বটে । আরও সরাসরি বললে বলতে হয়, এর মধ্যে একটা সৃষ্টিশীলতার অনুভূতিও রয়েছে । স্পষ্ট না হলেও অত্যন্ত গভীরে সেটা আছে । দৈহিক সুখের সঙ্গে সৃষ্টির আনন্দ যখন যুক্ত হয়, তখন সেটাই সর্বোচ্চ আনন্দ । এখন নানা উপায় আছে যা ব্যবহার করলে নরনারী সঙ্গম করতে পারে অথচ তাদের সন্তান হবে না । কিন্তু এতে কি দৈহিক তৃপ্তির দিক থেকে আগের মতো আনন্দ পাওয়া যায় ? যখনই একজন কনডোম ব্যবহার করে, তার সৃষ্টিশীল অনুভূতিটা অর্ধেক মার খেয়ে যায়, ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এই যে, মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিজের অপার সম্ভাবনাময় প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে শুধু ।”
    আখতারুজ্জমান ইলিয়াস সাহেবের কয়েকটা শব্দের বিশেষ ঝোঁক রয়েছে । যেমন, ‘নিঃসঙ্গ’, ‘ব্যাধিগ্রস্ত’, ‘বিকারগ্রস্ততা’, ‘যৌনতার পূর্ণ তৃপ্তি’, ‘সিক সোসায়টি’, ‘অসুস্হ সমাজ’, ‘ভয়াবহ ব্যাপার’, ‘আনহেলদি ওয়ার্ল্ড’, ‘টোটাল লিবার্টি’, ‘অ্যাবসলিউট ফ্রিডম’, ‘সৃষ্টিশীল অনুভূতি’, ‘প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ’ ইত্যাদি । উনি আমেরিকানদের আর গর্বাচভের উল্লেখ করেছেন, অথচ পশ্চিমবঙ্গীয় ও বাংলাদেশী কোনো নেতার বা কবি-লেখকের নাম উল্লেখ করেননি । উনি নিজেও স্বমেহন করতেন কিনা অথবা কখনও করেননি, তা হয়তো অন্যত্র লিখেছেন, আমার চোখে পড়েনি । ওনার লেখাটা কবেকার তা জানি না । ওনার বক্তব্যের সঙ্গে আঠারো শতকের দার্শনিক জাঁ জাক রুশোর বক্তব্যের মিল আছে, যা রুশো ‘এমিলে’ ( ১৭৬২ ) এবং ‘কনফেসানস’ ( ১৭৮২-১৭৮৯) বইতে করেছিলেন । রুশো লিখেছিলেন যে, স্বমেহন হল নিজের মনকে ধর্ষণ, স্বমেহনের উৎস হল সমাজের দূষিত পরিবেশ ও প্রভাব, যে মানুষেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজ জটিলতাহীন জীবন যাপন করে, তারা স্বমেহনের মতন অস্বাভাবিক জঘন্য কাজ কখনই করবে না ।
    পশ্চিমবাংলায় বহুকাল আগে থেকেই কবি-লেখকরা যে নিজেদের স্বমেহন নিয়ে লিখছেন তা ওপরে সুকুমার চৌধুরীর ২০০৩ সালে লেখা কবিতাটি থেকেই স্পষ্ট । শূন্য ও তার পরের দশকের তরুণীদের কবিতা বা গদ্যতেও স্বমেহন আর মুখমেহন প্রসঙ্গ পাওয়া যাবে ।
    আমরা যারা খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকে লেখা, ফিকে হয়ে আসা মনুস্মৃতির ঘেরাটোপে শৈশব কাটিয়েছি, যৌবন শুরু করেছি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে লেখা বাৎসায়ন পড়ে, বয়স্কদের বাণী শুনেছি ব্যক্তিজীবনের চারটি লক্ষ্য ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ নিয়ে, ইলিয়াস সাহেবের ঝোঁক আমল করতে বসে সবই গুলিয়ে ফেলছি । স্বমেহন কেমন করে করতে হবে তার নির্দেশ বাৎসায়ন দিয়ে গেছেন; সিংহের বিক্রমে । বাৎসায়নের সময়ে, দ্বিতীয় শতকের সনাতন ভারতীয়রা কি ‘নিঃসঙ্গ’, ব্যাধিগ্রস্ত’, বিকারগ্রস্ত’ ছিল ? তারা কি ‘সিক সোসায়টি’, ‘আনহেলদি ওয়র্ল্ড’, ‘অসুস্হ সমাজ’-এর সদস্য ছিল ? তারা কি ‘প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ’ করা আরম্ভ করেছিল ? আমার তো তা মনে হয় না । যৌন সম্পর্ক নিয়ে পুরাণগুলোয় যে সমস্ত কর্মকাণ্ড আছে, তা থেকে মনে হয় সে সময়ে যথেষ্ট যৌন স্বাধীনতা ছিল ।
    ভারত, গ্রিস, মিশর, চিন ইত্যাদি ভূখন্ডগুলোর প্রাচীন অতিকথা ও পুরাণকাহিনিতে কেন স্বমেহনকে অনৈতিক মনে করা হতো না ? সেসময়ের মানুষরা কি প্রাজ্ঞ ছিলেন না ? উপনিবেশবাদের কাঁধে চেপে আধুনিকতা আসার পর গোষ্ঠীপতিদের আওতায় নৈতিকতা নির্ণয়ের ক্ষমতা কু্ক্ষিগত হবার ফলে, তার মানে, নতুন মানদণ্ড গড়ে উঠল যৌনতার, বিশেষ করে স্বমেহনের, বিভিন্ন উপনিবেশের সমাজগুলোয় !
    প্রাচীন মিশরের দেবতা আপসু স্বমেহন করে আকাশে ছায়াপথ সৃষ্টি করেছিলেন । এটা নিছক একটা গল্প ; কিন্তু এই গল্পের মাধ্যমে, যেহেতু দেবতারা স্বমেহন করেন, স্বাভাবিক যে ফ্যারাওদের প্রজারাও ইচ্ছে করলে স্বমেহন করতে পারত । গ্রিক দেবতা হারমেস নিজের ছেলে পানকে তার প্রেমিকাকে কল্পনা করে স্বমেহন করতে শিখিয়েছিলেন, কেননা পানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল একো নামের সুন্দরী নিমফ । এরকম কাহিনিতে দৈবিক অনুমতি দেয়া হচ্ছে না কি, যে, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক তার প্রেমিকাকে কল্পনা করে স্বমেহন করতে পারবে ? সারা ডেনিং তাঁর ‘দি মাইথলজি অফ সেক্স’ ( ১৯৯৬ ) গ্রন্হে জানিয়েছেন যে প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ায়, এখনকার দক্ষিণ ইরাকে, স্বমেহনকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল, মনে করা হতো যে একা বা দুজনে পরস্পরের স্বমেহনে সাহায্য করলে বীর্যশক্তির বৃদ্ধি ঘটে, আর তা পৌরুষের জন্য জরুরি । এই একই কথা এখনকার সেস্কপার্টরাও বলেন ।
    দেবী-দেবতার জগত থেকে বেরিয়ে আথেন্সের তৎকালীন বাস্তব জগতে এলে দেখি, খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ‘দার্শনিক’ ডায়োজেনেস সকলের সামনে স্বমেহন করতেন; তাঁর বক্তব্য ছিল মানুষের কোনো কাজকে লজ্জাকর মনে করার কারণ নেই, এবং স্বমেহন কোনো লজ্জার ব্যাপার নয় । খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে রোম সাম্রাজ্যের গ্রিক শল্যচিকিৎসক অ্যালিয়াস গালেনাস তাঁর রোগীদের স্বমেহন করার পরামর্শ দিতেন ; তিনি মনে করতেন যে দেহে বীর্যের আধিক্য থেকে নানা রোগ দেখা দিতে পারে । সেসময়ের গ্রিসে ও রোমে ধনীরা স্বহস্তে কাজটি করতেন না, তার জন্য তাঁরা চাকর অথবা ক্রিতদাস রাখতেন, কেননা নিজের হাতে করাটা দারিদ্র্যের লক্ষণ মনে করা হতো।
    আথেন্সের নারীরা স্বমেহন করতেন ‘অলিসবোস’ বা ‘বাউবন’ নামে একটি বস্তুর দ্বারা যা অনেকটা এখনকার ডিলডোর মতন। ডিলডো ভারতের বাজারে নিষিদ্ধ বলে যাঁরা ইউরোপ-আমেরিকা-ব্যাংকক যান তাঁরা কিনে আনেন । ‘অলিসবোস’ জিনিসটা হতো নরম চামড়ায় তৈরি । গ্রিস ও রোমে স্বমেহনকে মনে করা হতো সমাজের ‘সেফটি-ভালভ’ ।
    দশম থেকে দ্বাদশ শতকে নির্মিত খাজুরাহোর মন্দিরে, যা রাজপুত চাণ্ডেলা রাজারা হিন্দু আর জৈন সম্প্রদায়ের ধার্মিক আচার-ব্যবহারের জন্য তৈরি করিয়েছিলেন, আঠারো শতকেও শিবরাত্রিতে পুজো হতো, সেখানে পুরুষ আর নারীর স্বমেহনের মূর্তি আছে । অর্থাৎ সনাতন ভারতে স্বমেহনকে উপরোক্ত নৈতিক দৃষ্টিতে ‘খারাপ’ জীবন দর্শনের তকমা দেয়া হয়নি । সংস্কৃত সাহিত্যে জায়গাটির নাম ছিল জিহোতি আর জেজাহোতি । অধিকাংশ মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসক কুতুবুদ্দিন আইবক আর সিকন্দর লোদির সময়ে। মন্দিরগুলো থাকলে আমরা আরও লিবারেটেড ও সৃষ্টিশীল ভাস্কর আর স্হপতিদের সুস্হ ও বিস্ময়কর কাজের সঙ্গে পরিচিত হতুম । এই বিদেশি শাসকরা ধ্বংস করতে চেয়েছেন, কেননা তাঁদের সাম্প্রদায়িক জীবন দর্শনের বিরোধী ছিল মূর্তিগুলোয় দর্শানো ক্রিয়া ; তাছাড়া তাঁরা ছিলেন মূর্তি-নির্মাণ ধারণার বিরোধী ; এর সাম্প্রতিক নমুনা তালিবানের দ্বারা আফগানিস্তানে বুদ্ধমুর্তি ধ্বংস, ইরাকে আইসিস বাহিনীর দ্বারা তাবৎ প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস । খাজুরাহো ধ্বংসের আগে কুড়ি বর্গ কিলোমিটারে পঁচাশিটি মন্দির ছিল । ধ্বংসের পরে বেঁচেছে ছয় বর্গ কিলোমিটারে কুড়িটি মন্দির, তার কারণ এই মন্দিরগুলো জঙ্গলের আড়ালে ছিল ।
    কেবল ভারতেই নয়, যতকাল মানুষ প্রকৃতিকে পূজ্য মনে করেছে ততোকাল স্বমেহনকে ‘খারাপ’, ‘অসুস্হ’, ‘ব্যাধিগ্রস্ত’, ‘নিঃসঙ্গ’ জীবনদর্শন-প্রসূত মনে করেনি , তার কারণ তখনও ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ব্যক্তিএককের জন্ম হয়নি । মালটায় চতুর্থ শতকের স্বমেহনরতা নারীমূর্তি পাওয়া গেছে । প্রাচীন মিশরে বিশ্বাস করা হতো যে দেবতা অতুম-এর স্বমেহনের ফলে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, নীল নদের জোয়ার-ভাটাও তাঁর স্বমেহনের কারণে ঘটে। ফ্যারাওরা প্রতি বছর নীল নদে স্বমেহনের উৎসব পালন করতেন ।
    সনাতন ভারতীয় চিন্তা-চেতনায় তাহলে কবে থেকে এই ধারণা সেঁদোলো যে স্বমেহন ‘খারাপ’, ‘অসুস্হ’, ‘ব্যাধিগ্রস্ত’, ‘নৈতিক অধঃপতন’ ‘স্বাস্হের পক্ষে ক্ষতিকর’, ‘নিঃসঙ্গ’, জীবন দর্শন-প্রসূত ? আমি মনে করি, এই ভাবনা এসেছে বিদেশী শাসকদের মূল্যবোধের সঙ্গে । অথচ বাইবেলে স্বমেহন সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা নেই । বাইবেলের বুক অফ জেনেসিস এর ৩৮তম পর্বে যা আছে, এবং যেটি স্বমেহনবিরোধী দর্শনের উৎসসূত্র, তা হল ‘এর’ এবং ‘ওনান’ নামের দুই ভাইয়ের কাহিনি ।
    য়াহওয়েহ বা জেহোভা বা ঈশ্বর প্রথমে এরকে হত্যা করেন, কেননা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করেছিল এর , সে সন্তান চাইত না, এর মনে করত সন্তান হলে তার সুন্দরী স্ত্রী তামার-এর রূপ নষ্ট হবে যাবে ; তার মনোভাবকে জেহোভা ক্ষতিকর এবং দুর্নীতিপরায়ণ আখ্যা দেন ,আর তাকে মেরে ফ্যালেন । এর যখন মারা গেল তখন তাদের বাবা জুডা ওনানকে আদেশ দিলেন যে “লেভিরেট সম্পর্কপ্রথা”( ছোটো বা বড়ো ভাইয়ের বিধবাকে বিয়ে করা বা তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করা ) অনুযায়ী ওনান তামার-এর সঙ্গে সঙ্গম করে সন্তানের জন্ম দিক । এর যখন মারা গেল তখন স্বাভাবিকভাবে সম্পত্তির অধিকারী হবার দাবিদার ছিল ওনান । ওনান তাই তামার-এর গর্ভে সন্তান চায়নি, তার ঔরসে সন্তান জন্মালেও সে সন্তান পেতো এর-এর উত্তরাধিকার । বাবার আদেশ অনুযায়ী ওনান প্রতিরাতে সঙ্গম করত কিন্তু তামার-এর যোনিতে বীর্য পড়ার আগেই তা বাইরে পৃথিবীর মাটিতে ঝরিয়ে নষ্ট করে ফেলত । বীর্য নষ্ট করার কারণে জেহোভা তাকেও হত্যা করেন । এই গল্প থেকেই ইহুদি আর খৃষ্টধর্মী যাজকরা প্রচার আরম্ভ করেন যে বীর্যকে পৃথিবীর মাটিতে ঝরিয়ে দেয়া একটি গর্হিত কাজ, ঈশ্বর তাতে কূপিত হন; বীর্যের একমাত্র কাজ হল সন্তান উৎপাদন । পৃথিবীর মাটিতে ওনান স্বমেহন করে ধাতুরস ঝরায়নি, কিন্তু ইহুদি আর খৃষ্টধর্মী প্রচারকরা যুক্তিটিকে টেনে নিয়ে গেলেন স্বমেহন বিরোধিতায় । ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারী আব্রাহামিক ধর্মগুলো যৌনতার দর্শন নির্মাণে এই গল্পটির আশ্রয় নিয়েছে । আমেরিকায় সপ্তদশ শতকে ওনানের গল্পটির এতই প্রভাব ছিল যে গোঁড়া খ্রিস্টধর্মী গ্রাম কনেকটিকাটের নিউ হেভেনে স্বমেহনকারীকে ফাঁসি দেয়া হতো । ওনানের গল্পটি আশ্রয় করে খ্রিস্টধর্মী যাজকরা স্বমেহনের বিরোধিতা করলেও, ইহুদিরা আর মুসলমানরা টেস্টামেন্টের কাহিনিকে মান্যতা দিয়ে পুরুষদের সুন্নৎ করান, যাতে মেসমা নামের মোম না জমে যায় চামড়ার তলায়, এবং ওই মেসমার কারণে নারীদের ইউরিনারি ট্র্যাক্টে রোগ না হয়, কিন্তু খ্রিস্টান যাজকরা এই প্রথাটিকে সর্বসন্মত স্বীকৃতি দেননি ।
    ইহুদি আর খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকরা ‘ওনানিজম’ নামক একটি ‘পাপ’ এর কথা প্রচার করতে লাগলেন । ওনানিজম, অর্থাৎ বীর্যকে সন্তান উৎপাদন ছাড়া অন্য কাজে প্রয়োগ করা । নারীর যোনিতেই কেবল বীর্য ফেলতে হবে ; সেকারণে গোঁড়া ইহুদি আর ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা কনডোম ব্যবহারকে মনে করেন ওনানিজম, পায়ুসঙ্গম আর পশুসঙ্গমও তাই । সমকাম বিরোধিতার উৎসও হল ওনানিজম ।
    অষ্টাদশ শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে যখন দলে-দলে যুবক শ্রমিকরা শিল্পাঞ্চলগুলোয় জড়ো হতে লাগলেন, তাঁদের জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠল, অনেকে, যাঁরা বেশ্যালয়ে যাবার মতো রোজগার করতেন না, তাঁরা স্বমেহনের আশ্রয় নিতেন । শিল্পাঞ্চলগুলোয় গিয়ে পাদ্রিরা স্বমেহনকে ওনানিজম নামক পাপের তকমা দিয়ে যুবক শ্রমিকদের উপদেশ দিতেন আর তাদের বোঝাতেন তারা যেন নিজেদের ধাতুরসকে পৃথিবীর মাটিতে না ঝরায় । ওনানিজমের ভয়ের কারণে শিল্পাঞ্চলগুলোয় বেশ্যালয় গজিয়ে ওঠে, এবং তার বিরোধিতা সেসময়ের পাদ্রিরা করতেন না, কেননা বেশ্যাদের কাছে গেলে ধাতুরসকে বাইরে ফেলা হবে না । শিল্পাঞ্চলগুলোয় গজিয়ে উঠতে থাকে শ্রমিকদের জন্য বাজার, আর এই বাজারে স্বমেহনকে ওনানিজমের ছাপ্পা মেরে চিকিৎসকরা স্বাস্হ্যের অবনতির ভয় দেখিয়ে বাড়িতে তৈরি শিশির ওষুধ, ওষুধের বড়ি, ওষুধের পাউডার ইত্যাদি বিক্রির বাজার খুলে বসেন ।
    ওনানিজমের ভয় দেখিয়ে প্রথম যিনি ১৭১৬ সালে লণ্ডন থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন তিনি ঈশ্বরতাত্বিক পাদ্রি বালথাজার বেকার । তাঁর বইটির নাম ছিল, ‘ওনানিয়া, দি হিনিয়াস সিন অফ সেল্ফ পলিউসান অ্যাণ্ড অল ইটস ফ্রাইটফুল কনসিকোয়েনসেস, ইন বোথ সেক্সেস কনসিডার্ড, উইথ স্পিরিচুয়াল অ্যাণ্ড ফিজিকাল অ্যাডভাইস টু দোজ হু হ্যাভ অলরেডি ইনজুয়র্ড দেমসেল্ভস বাই দিস অ্যাবোমিনেবল প্র্যাকটিস’ । বালথাজার চিকিৎসক ছিলেন না, কিন্তু ওষুধপত্র বিক্রি করতেন । তাঁর পুস্তিকাটি গুরুত্ব দিয়েছিল স্বমেহন করার ফলে সংগ্রহ করা পাপ আর নিজের আত্মাকে নোংরা করে তোলার কারণে অধঃপতন, আর তা থেকে মুক্তির উপায় । পুস্তিকাটি স্বীকৃতি দিচ্ছে যে পুরুষ এবং নারী উভয়েই স্বমেহন করতেন ।
    অাত্মিক অধঃপতনের দরুণ, বালথাজার লিখেছিলেন যে স্বমেহনের কারণে এই অসুখগুলো হয় : পাকস্হলির গোলমাল, পাচনশক্তির অভাব, ক্ষুধামান্দ্য, দাঁড়কাকের মতন রাক্ষুসে খিদে, বমির ভাব, মৃগিরোগ, খসখসে গলা, নপুংসকতা, পিঠ ব্যথা, ক্ষীন দৃষ্টি শক্তি, কালা হবার সম্ভাবনা, মুখময় ব্রণ, ফ্যাকাশে ত্বক, বৌদ্ধিক ক্ষমতাহ্রাস, স্মৃতিহীনতা, মূর্খতা, এবং আত্মহত্যার ইচ্ছা । বইটির সঙ্গে কয়েকজন যুবকের দেয়া চিঠিও ছিল, স্বমেহনের ফলে তাদের অসুখের ফিরিস্তি দিয়ে । এই সমস্ত শারীরিক আর মানসিক অধঃপতন থেকে বাঁচার জন্য তিনি বিক্রি করতেন দশ শিলিঙে শক্তি ফিরে পাবার এক বোতল ওষুধ আর বারো শিলিঙে এক প্যাকেট পাউডার । পুস্তিকাটির ষাটটি সংস্করণ হয়েছিল এবং ইউরোপের প্রায় প্রতিটি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল । স্বমেহন করলে ওষুধের মাধ্যমে শারীরিক আর মানসিক অধঃপতন থেকে যে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, প্রটেস্ট্যান্ট ব্রিটেনে পুস্তিকাটি প্রকারান্তরে সেকথাই প্রচার করেছিল । কিন্তু ক্যাথলিক ইউরোপে পুস্তিকাটি ওনানিজমের ভীতি সঞ্চার করতে সফল হয়েছিল ।
    ভারতে এবং অন্যান্য উপনিবেশে ইভানজেলিস্টরা কাঁধে করে ওনানিজমকে নিয়ে গিয়ে সেখানকার জনসমুদায়ের ওপর প্রচার ও আইনের মাধ্যমে চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন । ইউরোপের দেশগুলো প্রতিটি উপনিবেশের মানুষদের ‘উন্নত’ করে তোলার জন্য তাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, এবং সফলও হয়েছিল জনসমূদায়ের বৃহদাংশকে, বহু দেশে সবাইকে, ধর্মান্তরিত করতে। ফলে, উপনিবেশগুলোর নিজস্ব যৌনদর্শনের ওপর ক্রমশ মোটা চাদরের পরত পড়ে গেল, আর সে জায়গায় জমে বসল সাম্রাজ্যবাদীদের যৌনদর্শন । ইউরোপে খৃস্টধর্মীদের নিজেদের মধ্যে রেফর্মেশান, রিভাইভালিজম, রেসটোরেশানিজম আন্দোলনের কারণে নৈতিক গোঁড়ামি এই তিন-চারশ বছর যাবত সমাজকে আঁকড়ে ব্যক্তিএকককে নীতিজালের ভেতরে বেঁধে ফেলতে পেরেছিল ।
    জিন স্ট্রেনজার্স এবং অ্যানে ভ্যান নেক তাঁদের ‘ম্যাস্টারবেশান : দি হিসট্রি অফ এ গ্রেট টেরর’ ( ২০০১ ) বইতে জানিয়েছেন যে, ১৭৪৩-৪৫ সালে রবার্ট জেমস নামে একজন চিকিৎসক তাঁর ‘এ মেডিকাল ডিকশানারি’তে লিখলেন যে, স্বমেহন হল এমন একটি জঘন্য অসুখ যা সারে না, এবং এটি একটি এমনই পাপ, যার ফলাফল অকল্পনীয় । বালথাজার তবুও মেকি ওষুধের মাধ্যমে সারাবার ব্যবস্হাপত্র করেছিলেন । রবার্ট জেমস, যেহেতু চিকিৎসক, তার পথও বন্ধ করে দিলেন ।
    ইউরোপে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে সফল হয় সুইডিশ চিকিৎসক স্যামুয়েল আগুস্তে তিসো’র বই ‘লে ওনানিজমো’; বইটিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে ধাতুরস হল শরীরের ‘অত্যাবশ্যক তেল’ আর ‘জীবনরস’ । তিনি তাঁর কাল্পনিক রোগীদের ইতিহাস একত্র করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে স্বমেহনের ফলে তাদের দেহ থেকে অত্যাবশ্যক তেল আর জীবনরস বেরিয়ে যাবার দরুণ তাদের স্মৃতিক্ষয় হয়ে গেছে, স্নায়ুবিপর্যয় ঘটেছে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে এবং তাদের স্বাস্হ্য সংকটাপন্ন ।
    ১৮৭০ সালে খ্রিস্টধর্মী সংস্হা সেভেন্হ ডে অ্যাডভেনটিস্ট পাবলিশিং অ্যাসোসিয়েশান একটি বই প্রকাশ করেছিল, এলেন জি হোয়াইট সম্পাদিত, ‘এ সলেমন অ্যাপিল রিলেটিভ টু সলিটারি ভাইস অ্যান্ড দি একসেসেস অফ দি ম্যারেজ রিলেশানস’ নামে । তাতে সাবধান করে দেয়া হল নারী আর পুরুষ উভয়কেই, যাদের বয়স পনেরো বছরের বেশি, তারা যদি স্বমেহন করে এবং যোনি ছাড়া অন্যত্র ধাতুরস ফ্যালে, তাহলে এই প্রকৃতিবিরোধিতার জন্য প্রকৃতিই তাদের শাস্তি দেবে । পুরুষদের ফুসফুস, বৃক্ক, যকৃত রোগাক্রান্ত হবে আর ক্যানসারাস টিউমার দেখা দেবে । নারীদের ক্যাটারাহ, ড্রপসি, পিঠ আর কোমর ব্যথা এবং ক্যানসারাস টিউমার হবে ।
    ‘আলোকপ্রাপ্তি কাকে বলে’ ( ১৭৮৪ ) এবং ‘মেটাফিজিকস অফ মরালস’ ( ১৭৯৭ ) রচনার লেখক-দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট স্বমেহন বিষয়ক একটি দার্শনিক বক্তব্য রেখেছিলেন । তিনি বলেছিলেন স্বমেহন হল এমন এক অস্বাভাবিক কাজ যা একজনের নিজের চিন্তাভাবনার গোড়ায় কুড়ুল মারে, নিজের প্রতি দায়িত্বকে অস্বীকার করে এবং কাজটি অনৈতিক । তবে তিনি একথাও বললেন যে, অমন অস্বাভাবিক কাজের একটি যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয় ; শেষ পর্যন্ত কাজটি এই জন্য অনৈতিক যে ব্যক্তিএকক তার নিজের প্রতিস্বকে বিসর্জন দিয়ে স্রেফ নিজের জান্তব তাড়নাকে চরিতার্থ করে । আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছিল আলোকপ্রাপ্তির ভাবনাচিন্তা থেকে, যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে নিয়ে গেল বিশ্বযুদ্ধের আত্মধ্বংসে । ইউরোপের প্রতিটি দেশের নেতারা ভাবতে লাগলেন তাঁরাই সবার চেয়ে বেশি উন্নত ও সভ্য ।
    উনিশ শতকের ব্রিটেনে এবং তার উপনিবেশগুলোয় ভিকটোরিয় নৈতিকতার প্রসার ঘটানো হয় । ছেলেদের ট্রাউজার এমনভাবে সেলাই করানো হতো যাতে তারা পকেটে হাত ঢুকিয়ে লিঙ্গ নিয়ে খেলতে না পারে; স্কুলের ছাত্রদের বসার জন্য সিট এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে তারা পায়ের ওপরে পা দিয়ে না বসতে পারে । মেয়েদের ঘোড়ায় চাপা এবং সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ ছিল, কেননা তার ফলে যে ধরণের গোপন আনন্দ হয় তা স্বমেহনের সমতুল্য । ছেলে বা মেয়ে কেউ যদি স্বমেহন করা অবস্হায় ধরা পড়ে যেত তাহলে মনে করা হতো যে তার ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে ; ইচ্ছাশক্তিকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের বিস্বাদ নিরামিষ খাবার দেয়া হতো । ভিকটোরিয় আমলের ডাক্তাররা মনে করতেন যে স্বমেহন থেকে মুক্ত করার উপায় হল ইলেকট্রিক শক দেয়া । তাতেও যদি রোগি নিজের অভ্যাস বদলাতে অক্ষম হতো তাহলে চেস্টিটি বেল্ট পরানো হতো । ছেলেদের চেস্টিটি বেল্ট ছিল চামড়ার খোলে লিঙ্গকে ঢেকে রাখার বেল্ট, যার ফুটো দিয়ে কেবল প্রস্রাব করা যেতো । মেয়েদের ক্ষেত্রে যোনিকে সম্পূর্ণ ঢেকে কেবল প্রস্রাব করার ফুটো রাখা হতো । চেস্টিটি বেল্টের চাবি থাকত বাবা-মায়ের কাছে । গরিব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পরানো হতো লম্বাহাতা জামা, যার হাতাগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা সেলাই করে দেয়া হতো যাতে হাত ব্যবহার করা না যায় । শাস্তি হিসাবে শিশ্নের ওপরের চামড়াকে ছ্যাঁকা দেবার প্রথাও ছিল । ভিকটোরিয় যুগে ব্রিটেন আর আমেরিকায় শৈশবে ছেলেদের সুন্নৎ করে দেবার প্রথা বহুকাল চালু ছিল । পরবর্তীকালে তা এই যুক্তিতে বন্ধ হয় যে অমন শল্যচিকিৎসার জন্য শিশুরা অনুমতি দিতে পারে না, এবং বড়ো হয়ে তারা এর প্রতিবাদ করলে বাবা-মাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে ।
    মেয়েরা যাতে স্বমেহন না করতে পারে, এবং বিয়ের আগে তারা যাতে পবিত্র থাকে, আফ্রিকার সাতাশটি দেশে, ইয়েমেন, ইরাকি কুর্দিস্তান, মধ্যপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়, এবং ডায়াসপোরা মুসলমানদের সমাজে শৈশবে ক্লিটোরিসের দৃশ্যমান অংশটুকু কেটে বাদ দেবার প্রথা এখনও আছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কাজটি করেন অভিজ্ঞ মহিলারা, কাটা হয় ব্লেড দিয়ে ।
    ইসলামে “যিনা” বা ব্যভিচারের বিরুদ্ধে আদেশ আছে, কিন্তু, যতটা তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, স্বমেহনের বিরুদ্ধে শরিয়তে সরাসরি নির্দেশিকা নেই । কিন্তু পরবর্তীকালে সৌদি আরবের ধর্মব্যাখ্যাতারা জানিয়েছেন যে স্বমেহনও যিনার পর্যায়ে পড়ে । সম্ভবত সরাসরি নির্দেশিকা থাকলে আখতারুজ্জমান তার উল্লেখ করতেন এবং ব্যভিচারকারীদের জন্য নির্ধারিত শাস্তির উল্লেখ করতেন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, আমেরিকান আর রাশিয়ানদের পাশাপাশি স্বদেশের কয়েকজনের নামও উল্লেখ করতেন । ব্রায়ান হুইটেকার তাঁর প্রবন্ধ ‘সেমিনাল কোয়েশ্চেন’, দি গার্জিয়ান-এ ২০০৬ সালে প্রকাশিত, জানিয়েছেন যে, ১৯৯০ সালে সৌদি আরবের প্রধান মুফতি আবদ আল-আজিজ বিন বাজ ইসলামের অবস্হানটি স্পষ্ট করে দেন ; তিনি বলেন যে স্বমেহন করলে পাচনশক্তির গোলমাল হয়, অণ্ডকোষ ফুলে যায়, শিরদাঁড়ার ক্ষতি হয়, দৈহিক কাঁপুনির রোগ হয়, মস্তিষ্কের গ্রন্হি দুর্বল হয়ে যায় এবং মানুষ উন্মাদ হয়ে যেতে পারে । তাই এই কাজটি থেকে পুরুষ ও নারী উভয়েরই বিরত থাকা উচিত । বিন বাজ যিনার উল্লেখ করেননি ।
    সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে যে আইসিস নামের সুন্নি যোদ্ধাদলের সদস্যরা ইরাক ও সিরিয়ায় ব্যাভিচারের ব্যাখ্যাকে সীমিত করে ফেলেছে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ; তারা শিয়া এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নারীদের যৌনক্রীতদাসী হিসাবে ব্যবহার করছে । সংবাদপত্র আর বৈদ্যুতিন মাধ্যম থেকে জানা গেছে ,নাইজেরিয়াতেও বোকো হারাম যোদ্ধাদল কর্তৃক যুবতীদের স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাবার ঘটনা, যাদের যৌনক্রীতদাসী হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে । এখানে যে ব্যাপারটি প্রাসঙ্গিক, তা হল যুদ্ধ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ( ১৯১৪-১৯১৮ ) দরুণ ইউরোপীয় সমাজে যাবতীয় নৈতিকতার মানদণ্ড ভেঙে পড়েছিল এবং তাকে ফেরত প্রতিষ্ঠা দেবার আগেই আরম্ভ হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ( ১৯৩৯-১৯৪৫), যে যুদ্ধে মানবসমাজের সমস্ত নীতিবোধের জলাঞ্জলি ঘটে যায় ; আনবিক বোমার বিস্ফোরণের মাধ্যমে নস্যাৎ হয়ে যায় এতাবৎ দার্শনিকদের ‘ভালো, ‘উন্নত’,’সভ্য’, ‘মানবিকতা’ ‘ব্যক্তি চরিত্র’, ‘নৈতিক চরিত্র’ ‘ন্যায়পরায়ণতা’, ‘সততা’, ‘কর্তব্যপালন’, ‘দায়িত্ব’ ‘ভালোমন্দ বিচার’ ‘বিশ্বাস’, ‘হিতসাধন’, ‘মানুষের মঙ্গল’, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়ক বক্তব্যগুলো । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও যে আঞ্চলিক যুদ্ধগুলো হয়েছে, তাতেও দেখা গেছে শত্রুপক্ষের নারীদের আয়ত্ব করে ধর্ষণ করাটা সৈন্যদের প্রধান লক্ষ্যগুলোর অন্যতম । ভিয়েৎনাম যুদ্ধে নাপাম বোমায় জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে সেদেশের সাধারণ মানুষকে । বস্তুত লক্ষ-লক্ষ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে, তারপর এই জ্ঞান দেয়া যে স্বমেহন অনৈতিক, ব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তির কাজ, অসুস্হ বিকার, ইত্যাদি বুকনিকে মনে হয় মূর্খতার চরম এবং তা নিছক দার্শনিক জোচ্চুরি । সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানে দেড়শো স্কুলের বাচ্চাকে অকারণে হত্যা করেছে তালিবানের আদর্শে বিশ্বাসীরা । কেনিয়াতে সোমালিয়ার আল শবাব গোষ্ঠী খ্রিস্টধর্মী ছাত্রছাত্রীদের পৃথক করে প্রায় দেড়শজনকে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছে ।
    বিশ্বযুদ্ধের ফলে মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ডে বিপুল পরিবর্তনের মাধ্যমে আক্রান্ত দেশগুলোয় যৌনবিপ্লব ঘটে যায় । বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রসমীক্ষা করে দেখা গেছে যে প্রতিটি সমাজের একটি বড়ো অংশ, পুরুষ ও নারী উভয়েই, স্বমেহন করে। আমেরিকায় কিনসে রিপোর্টে তার প্রমাণ মেলে । জাপানে বিয়ে করা ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠে বাসস্হানের সমস্যার কারণে । তাই সঙ্গমের জন্য সিনথেটিক জিনিসের ফোলানো নারী উদ্ভাবন করতে হয় । তাছাড়া, বৌদ্ধধর্মে কেবল ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা ছাড়া আর কারোর জন্য স্বমেহন নিষিদ্ধ নয় । এক্ষেত্রে তাদের অবস্হান হিন্দুদের মতোই, ব্রহ্মচর্যের পরবর্তী স্তরে সে স্বাধীন যৌনতার অধিকারী ।
    শুক্রকীট নিয়মিত ধাতুরসের সঙ্গে বেরিয়ে না গেলে মৃত শুক্রের সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে । পুরুষের ক্ষেত্রে স্বমেহনে ধাতুরস বেরিয়ে গেলেই কাজটি সেই সময়ের জন্য সমাধা হয়ে যায় । নারীর ক্ষেত্রে অরগ্যাজমের চাহিদা থাকে বারংবারের ; সেকারণে সঙ্গমের আগে বা পরেও তাদের স্বমেহনের প্রয়োজন হয় । নারীবাদী আন্দোলনের প্রবক্তাদের কাছে এই প্রসঙ্গটিও উল্লেখ্য ছিল যে পুরুষেরা নারীর চাহিদার কথা জানে না; তারা নিজেদের কাজ সমাধা করেই মনে করে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হয়ে গেল ।
    ষাটের দশকে ইউরোপ-আমেরিকায় যে যৌনবিপ্লব ঘটে, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে প্রায় প্রতিটি দেশে । তার আগে পরাবাস্তববাদীরা মানুষের দেহকে ক্যানভাস হিসাবে ব্যবহার করে ছবি আঁকা আরম্ভ করেছিল ।কাউন্টার কালচার বা প্রতিসংস্কৃতির প্রবক্তারা নিজের দেহকে আবিষ্কারের কথা বলেন; সমাজের নৈতিক বন্ধন এবং আইনের সীমা থেকে নিজের ব্যক্তিপ্রতিস্বকে স্বাধীন করে তোলার কথা বলেন । তাঁদের বক্তব্যের উৎস ছিল দ্রোহের এই বোধ যে নিজস্ব ইরটিসিজম হল একটি উৎসব, এবং এই উৎসব অন্যের মানদণ্ড দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে না । ব্যক্তির ইরটিক যাপন হল স্বাভাবিক জীবনের অঙ্গ । তাকে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না । গণমাধ্যম আর ইনটারনেট আসার পর প্রভাব আরও গভীর হয়ে উঠতে পেরেছে । তারপর যখন সঙ্গমান্তিক পিল আবিষ্কার হল তখন অবিবাহিত নারী-পুরুষের সঙ্গমের অসুবিধাগুলো আর রইল না ।
    যাদের বাচ্চা হবার সম্ভাবনা নেই, তাদের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্বমেহনকে জরুরি করে তুলেছে, শুক্রকীট বিক্রির জন্য । নারীরাও তাঁদের ডিম বিক্রি করার সুযোগ পেলেন । একদা যারা স্বমেহনের বিরোধী ছিল, তারাও বাচ্চা পাবার জন্য স্বমেহনকৃত শুক্রকীটের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হলেন । স্বমেহনের দর্শন পুরো এক পাক খেয়ে প্রাচীন ভারত, গ্রিস, মিশর আর রোমের প্রজ্ঞায় ফেরত চলে এসেছে ।
  • m | 012312.60.2334.207 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:১৫541319
  • The Hungryalists – an excerpt

    Smart Work vs Hard Work: An Excerpt from The Ultimate Memory Handbook for Students

    The Hungryalists, by Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury is the never-before-told true story of the Hungry Generation (or ‘the Hungryalists’)-a group of barnstorming, anti-establishment poets, writers and artists in Bengal in the 1960s. Braving social boycott, ridicule and arrests, the Hungryalists changed the literary landscape of Bengal (and many South Asian countries) forever. Along the way, they also influenced iconic poets, such as Allen Ginsberg, who struck up a lifelong friendship with the Hungryalists.

    Here is an excerpt of the introduction of the book.

    The sixties were a turbulent period throughout the world. People subverted the morality, politics and economics of the day publicly and privately. Through it all, poetry gave vent to much of this angst and restlessness.

    Counterculture has a penchant for the eccentric. The Beats and the Hungryalists, for instance, were bands of rebel poets and advocates of a poetry of chaos. After years of obscurity, Allen Ginsberg finally took his place in the limelight. Thousands of miles away, another Bengali poet broke all the rules.

    Dissatisfied with society, the Beats and the Hungryalists alienated themselves from the mainstream and their movements became underground, thereby challenging the poetics of the day. These poets/writers rejected standards of literature, introduced new societal norms, shunned mercenaries of culture, and even spawned a new drug subculture. By the time they were done, the world recognized them as the most politically trenchant, culturally influential and innovative artists, whose lives spanned an extraordinary frame, thus changing the larger picture for many. These poets were eccentric, contingent rebels, and these movements were not alternative lifestyles, but life itself.

    These two movements were connected by the fringe elements interwoven with counterculture, moving towards a contrary punk aesthetic with improvised nonchalance. The Beats and the Hungryalists were co-travellers in their own ways, but they weren’t exactly bothered about influencing each other. Some of the Beats, through their world travels, landed in India, leading to a terrific intermingling that would have a lasting impact on both sets of poets. This, then, is the story of the fantastic journeys of writers and poets, distinct in their bold subculture, just as their poetry was. Rarely have poetry movements around the world impacted generations of writers, intellectuals and thinkers in the way these two movements have. In that sense, it is also the narrative of an entire generation.

    In this story of parallels, Ginsberg and Malay Roy Choudhury are simultaneous leaders–speakers for the bands of different. The journey of these movements begins with them and takes the form of visions. Sex, drugs and language are co-travellers in this selfexploration. Ginsberg reflected all that he experienced during his many travels in his poetry. And Calcutta, where most of this story is set, played a major role in his life and changed him as a person and a poet. Sunil Ganguly, Shakti Chatterjee—iconic figures in Bangla literature—share the plot and take this story forward.

    But while the story begins at poetry it doesn’t necessarily end there. Like always, it is the stories in between that make the subplot richer and grittier. This, then, is a narration of love and lovers, intrigue and politics, sex and drugs, state censorship, arrests and travels. It is set in a time when wars, immigration, homelessness and poverty framed the human imagination.

    The book is arranged chronologically as well as geographically. However, there has been no attempt at mapping every little nook and corner visited by these poets. Trying to include every little town and city would be an overwhelmingly impossible task and not necessarily rewarding, because the range of travel, especially for the Beats, in India and through Asia, was encyclopaedic. Locations have thus been selected based on their relevance to this narration and their significance in the artists’ works.

    According to the format of narrative non-fiction, some poetic licence has been taken with the romantic angle in Malay’s life (with due permission from him) and the names of his love interests have been changed to protect the privacy of the women in question. In the end, all personal relations lie cold and exhausted and, as Ginsberg said, ‘I’ll be on impersonal curiosity hence flying around the world hoping for not.’ Perhaps the story of poetry found and lost is the only personal journey that survives in the end, everything else becomes a myth.
  • m | 012312.60.6734.100 | ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৪৫541320
  • বেস্টিয়ালিটি বা মানুষের পশুরতি
    মলয় রায়চৌধুরী
    আমার ‘রাহুকেতু’ নিরুপন্যাসে একটি ঘটনা আছে । রাহু বা রাহুল সিংহ হিমালয়ের তরাইতে নেপাল সীমান্তের গ্রামগুলোয় অফিসের কাজে গিয়ে বাঁশে চারপা বাঁধা চিৎ করে শোয়ানো মৃত এক বাঘিনীর গোলাপি যোনি আর মাইকুঁড়ির দিকে তাকিয়ে অপ্রতিরোধ্য চাঞ্চল্যে আক্রান্ত হয়েছিল ; রাহুল সিংহের অন্তরজগতের বাঘ তার দেহকে একটু-একটু করে জাগিয়ে তোলার পর, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে, রাহুল সিংহের সহকারি ভেটেরিনারি অফিসার বাঘিনীর দেহে পারফিউম ছিটিয়ে দিতে, রাহুল সিংহ অনেকটা রাম টেনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে শুয়ে পড়েছিল বাঘিনীর বুকের ওপরে । রাহুল সিংহের এই পশুপ্রণয়ের ইংরেজি শব্দ ‘জুফিলিয়া’ ( zoophilia ) ; এবং পশুরতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘বেস্টিয়ালিটি’ ( Bestiality ) ।
    হয়তো উপরোক্ত শব্দগুলোর সংস্কৃত বা পালি প্রতিশব্দ আছে, কেননা খাজুরাহোর ( দশম শতাব্দী ) লক্ষ্মণ মন্দিরের গায়ে ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গমরত এক যুবকের একটি ভাস্কর্য আছে যাকে ঘিরে রেখেছেন উঁচু-বুক উঁচু-পাছা চাণ্ডেলা যুবতীরা । ঋষি বিভণ্ডক একটি হরিনীর সঙ্গে সঙ্গম করে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির জন্ম দিয়েছিলেন । কর্ণাটকের শিমোগা জেলার বাল্লিগাভির কেদারেশ্বর মন্দিরের দেয়ালে জনৈকা নারীর পশুরতি খোদাই করা আছে ; মন্দিরটি একাদশ শতকে চালুক্য রাজত্বের সময়ে তৈরি । জাহাঙ্গির ও শাহ জাহানের সময়ে আঁকা বেশ কিছু মিনিয়েচার পেইনটিঙে দেখা যায় হারেমের নারীরা নানা রকমের পশুর সঙ্গে সঙ্গম করছেন; খোজা পরিবৃত প্রাসাদে হয়ত তা অস্বাভাবিক ছিল না, কেননা, উইলিয়াম ডালরিমপলের লেখা বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনী থেকে জানা যায় যে, উইলিয়াম হডসনের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা যখন দুর্গ আক্রমণ করে তখন সম্রাটের হারেম থেকে অজস্র মহিলা পালাতে আরম্ভ করেন । দিল্লিশ্বরেরা নিজেরাও জানতেন না তাঁদের হারেমে কতজন উপেক্ষিতা নারী আছে । যোগাড় করে এনে প্রথম রাতে কুমারীত্ব দখল হয়ে গেলে তাঁরা হারেমের তরুণীদের ভুলে যেতেন হয়ত ।
    দুটি গ্রিক অভিধা ‘জোলোন’ অর্থাৎ পশু এবং ‘ফিলিয়া’ অর্থাৎ প্রেম শব্দের সন্ধি হল জুফিলিয়া ; ফিলিয়া অভিব্যক্তিটি ‘ফোবিয়া’র বিপরীত। জুফিলিয়া শব্দটির উৎপত্তি প্যারাফিলিয়া ( Paraphilia ) থেকে ; প্যারাফিলিয়া হল একটি স্পিসিসের সঙ্গে আরেক স্পিসিসের সঙ্গম, যেমন আমরা দেখেছি সিংহের সঙ্গে বাঘের, জেব্রার সঙ্গে ঘোড়া বা গাধার, ছাগলের সঙ্গে ভেড়ার সঙ্গমে জন্মানো প্রাণী। জুফিলিয়া হল মানুষ আর পশুর প্রণয় ; সাম্প্রতিককালে পশুর সঙ্গে মানুষের যৌনসম্পর্ককে বলা হয়েছে ‘বেস্টিয়ালিটি’। অধিকাংশ দেশে মানুষ-মানুষীর পশুরতি নিষিদ্ধ হলেও ব্রাজিল, ক্যামবোডিয়া, ফিনল্যান্ড, নামিবিয়া, ফিলিপিনস, রোমানিয়া এবং থাইল্যান্ডে তা এখনও আইনত নিষিদ্ধ নয়, আদালতে প্রতিটি মামলা পৃথকভাবে বিচার হয় । যে দেশগুলোয় নিষিদ্ধ সেখানে আইনপ্রণেতারা আন্তর্প্রাণী যৌনসম্পর্ককে ধার্মিকভাবে অনৈতিক এবং ক্রিয়াটিকে প্রকৃতিবিরোধী ও পশুনিগ্রহ বলে মনে করেন । ১৮৮৬ পর্যন্ত ক্রিয়াটিকে প্যারাফিলিয়া হিসাবে চিহ্ণিত করা হত ।
    ১৮৮৬ সালে জার্মান মনোবিদ তাঁর ‘সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিস’ গ্রন্হে মানুষ-পশু প্রণয়সম্পর্ককে চিহ্ণিত করার জন্য ‘জুফিলিয়া’ শব্দটি তৈরি করেন । অনেকে পশুদের চাবকে বা কষ্ট দিয়ে মর্ষকামী যৌন আনন্দ পান-- সেই কাজটিকে ১৯৯০ সালে আর্নেস্ট বনেমান ‘জুস্যাডিজম’ ( Zoosadism ) হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন । পশুদের চামড়া এবং লোম থেকে যাঁরা যৌন আনন্দ পান তাঁদের কাজকেও জুফিলিয়া বলা আরম্ভ হলে পশুর সঙ্গে মানুষের যৌনসম্পর্ককে গ্যাস্টন ডুবয়-ডেসাউল তাঁর ‘বেস্টিয়ালিটি: অ্যান হিসটরিকাল, মেডিকাল, লিগাল অ্যান্ড লিটেরারি স্টাডি’ ( ২০০৩ ) গ্রন্হে বলেছেন ‘বেস্টিয়ালিটি’; আমেরিকায় বিভিন্ন রাজ্যের আইনে বেস্টিয়ালিটি, জুফিলিয়া ও জুস্যাডিজমের পার্থক্য করা হয়েছে । ভারতে পশু-মানুষ যৌনসম্পর্কের জন্য আইনের পৃথক ধারা নেই ; ভিক্টোরীয় ভাবধারায় প্রতিপালিত ম্যাকলে সায়েব যে ধারাটি সমকামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করে গেছেন, অর্থাৎ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা, সেটিকেই বেস্টিয়ালিটির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।
    পর্তুগালের চোয়া ভ্যালিতে পশুরতির প্রমাণ গুহার দেয়ালে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আঁকা চিত্র থেকে পাওয়া যায় । ইতালির কামোনিকা ভ্যালিতে গুহার দেয়ালে যে পশুরতির চিত্র পাওয়া গেছে তা খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০-এর সময়কার; সম্ভবত সেই সময় নাগাদ কুকুর, ছাগল, ভেড়া, গোরু, হরিণ ইত্যাদি প্রাণীরা গৃহপালিত জীব হয়ে ওঠে । প্রাচীন গ্রীক দেবীদেবতাদের নিয়ে তৈরি কাহিনীগুলোয় মানবাকৃতির দেবী আর দেবতারা পশুর সঙ্গে সঙ্গম করেছেন, যেমন ষাঁড়ের সঙ্গে ইউরোপা, ঈগলের সঙ্গে গ্যানিমিড, রাজহাঁসের সঙ্গে লেডা, মাদি-ছাগলের সঙ্গে স্যাটির ইত্যাদি, এরকম কাহিনির সঙ্গে আমরা পরিচিত । স্যাটিরিয়াসিস এমন একটি যৌনতাড়না, যার দরুন রোগি আত্মসংবরণ করতে পারে না এবং বহু নারীর সঙ্গে ক্রমাগত সঙ্গম করে বেড়ায়, যে রোগে গল্ফ খেলোয়াড় টাইগার উডস আক্রান্ত হয়েছিলেন ।
    পঞ্চম শতকে হেরোডোটাস এবং পিনডার লিখে গেছেন যে তাঁদের সময়ে মিশরীয় নারীরা ‘পবিত্র’ রামছাগল পুষতেন, সঙ্গম করার জন্য; সেসব প্রাণীদের তা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হতো । আবার একই সময়ে গ্রিকদের সম্পর্কে প্লুটার্ক লিখে গেছেন যে গ্রীক পুরুষরা মাদি-ছাগল, ঘোটকী, মাদি-শুয়োর পুষতেন, সঙ্গম করার জন্য । অনুমান করা যায় যে, ওই সমাজগুলোয় সেসময়ে এই ধরনের যৌনসম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল না । ইউরোপে ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম প্রবেশের পরে তা নিষিদ্ধ হয় । ইহুদি ধর্মগ্রন্হে পশুরতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে মানুষ এবং প্রাণিটিকে মৃত্যুদণ্ড দেবার কথা বলা আছে ; ইহুদিদের প্রাচীন আচারসংহিতা ‘তালমুদ’-এ বলা হয়েছে যে কোনো যুবতীকে যেন কোনো পুং ভেড়া বা গৃহপালিত পুংজীবের সঙ্গে একা না রাখা হয়। নিষেধাজ্ঞা থেকে আঁচ করা যায় যে তাদের সমাজে পশুরতির প্রচলন ছিল ।
    ফ্রান্সে ১৪৬৮ সালে বাছুর এবং মাদিছাগলের সঙ্গে সঙ্গম করার অভিযোগে জাঁ বেইসিকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর পর তার দেহকে পোড়ানো হয়েছিল । ১৫৩৯ সালে মাদিকুকুরের সঙ্গে সঙ্গম করা অভিযোগে গিয়ম গারিঙকে বেদম পেটানো হয়েছিল, তারপর তাকে আর তার কুকুরকে একসঙ্গে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল । ১৬০১ সালে ক্লদাঁ দ্য কুলাম নামে একটি ষোলো বছরের মেয়ে কুকুরের সঙ্গে সঙ্গম করার সময়ে ধরা পড়ে ; তাকে এবং তার কুকুরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেহগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয় । এই ধরনের সাজা সত্ত্বেও, ইউরোপে উইচক্র্যাফ্ট বা ডাকিনিবিদ্যা শেখার জন্য গোপনে পশুরতির প্রচলন ছিল ; তারা ধরা পড়লেও তাদের কল্পিত ক্ষমতার ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে প্রতিবেশিরা ভয় পেত । জার্মান চিত্রকর ফ্রানৎস ভন বেয়ার্স ( ১৮৬৬ - ১৯২৪ ) পশুরতির বেশ কিছু ড্রইং ও পেইনটিং এঁকে গেছেন, যার মধ্যে বিখ্যত ড্রইং হল একজন তরুণীর যোনিতে জিভ দিয়ে মুখমেহন করছে একটি হরিণ । পনের শতকের ইরানের কয়েকটি বইতে নারীর সঙ্গে পশুর সঙ্গমের ছবি পাওয়া গেছে ।
    আমেরিকা আবিষ্কারের পর ১৬০০ সাল থেকে ইউরোপিয়রা সে ভূখণ্ডে ভাগ্যান্বেষণের জন্য যাওয়া আরম্ভ করেন; ভাগ্যান্বেষীদের মধ্যে আধিক্য ছিল পুরুষদের । নারীর অভাবে এবং পুরুষে-পুরুষে বন্ধুত্ব জরুরি হয়ে উঠলে পাশাপাশি সমকামও দেখা দেয় । এফ ডাবলু ভোগেট তাঁর ‘সেক্স লাইফ অফ আমেরিকান ইনডিয়ানস’ ( ১৯৬১ ) গ্রন্হে বলেছেন যে, কোনো কোনো রেড ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীতে ( আরিজোনার হোপি উপজাতি এবং কানাডার ইনুইট উপজাতি ) পশুরতি অনুমোদিত থাকায়, ভাগ্যান্বেষী তরুণ ইউরোপীয়দের মধ্যে পশুরতি, বিশেষ করে গরু এবং ঘোটকির সঙ্গে সঙ্গম গ্রহণযোগ্য আচরণ হিসাবে স্বীকৃতি পায় । আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাসীদের চালান করে আনার পরও তাদের কাছে তুলনামূলকভাবে পশুরতি কাম্য ছিল, কেননা আফ্রিকা থেকে আনা কালো মানুষদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ককে প্রথমদিকের যাযকরা শাস্তিযোগ্য মনে করতেন, কৃষ্ণাঙ্গদের তখনও মনে করা হতো মানবেতর প্রাণী । ধর্মের স্তরে তা অনুমোদন না করলেও, শ্বেতাঙ্গিনীর সংখ্যা কম হবার কারণে সমকাম ও পশুরতি বৃদ্ধি পেতে থাকলে, কালো তরুণীদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের কথা জানতে পারলেও, তেমন গুরুত্ব দেয়া হতো না । ক্রমে ইউরোপ থেকে নারীরা আসা আরম্ভ করলে যাযকরা, বিশেষ করে দক্ষিণের রাজ্যগুলোয়, বিধিনিষেধ লাগু করেন, যা গৃহযুদ্ধের সময় পর্যন্ত প্রচলিত ছিল ।
    হিন্দুদের ‘ভাগবত পুরাণ’ অনুযায়ী গোরুর সঙ্গে সঙ্গম করলে নরক প্রাপ্তির কথা বলা আছে বটে, কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক সম্পর্কে কোনো বার্তা নেই । প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে, খ্রিস্টপূর্ব ১২৫ থেকে ৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অপরাধীদের, পুরুষ ও নারী দুইই, শাস্তি দেবার জন্য, জনসাধারণের উপস্হিতিতে, কলোসিয়ামে ও সার্কাস ম্যাক্সিমাসে, তাদের উলঙ্গ করে তাদের ওপর ধর্ষণে প্রশিক্ষিত পশু ছেড়ে দেয়া হতো ; অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী ।
    টম রিগান তাঁর ‘অ্যানিমাল রাইটস: হিউমান রঙস’ ( ২০০৩ ) গ্রন্হে বলেছেন যে, ইউরোপে ‘আলোকপ্রাপ্তি’র পর পশুরতিকে অনৈতিক ঘোষণা করা হলেও বর্তমানে যে যুক্তিটি প্রধান তা হল যে দৈহিক সম্পর্কের জন্য পরস্পরের যে অনুমতি থাকা দরকার তা একটি মাদি-পশু পুরুষ মানুষকে দিতে পারে না যে ভাবে সে নিজের প্রজাতির প্রাণীকে দিতে পারে । পুরুষমানুষ যখন একটি পশুর সঙ্গে সঙ্গম করে তখন সে যা করে তা হল ধর্ষণ । নারীরা যখন পশুরতি করে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে পশুটির অনুমোদন থাকে, কেননা পশুটিকে তা করার জন্য প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়, বা পশুটি অনোন্যপায় হয়ে নিজের যৌনতার প্রয়োজন মেটায় । মাইকেল রবার্টস তাঁর ‘দি আনজাস্টিফায়েড প্রহিবিশান এগেইনস্ট বেস্টিয়ালিটি’ ( ২০০৯ ) রচনায় বলেছেন যে, যাঁরা পশুরতির পক্ষপাতী, তাঁদের বক্তব্য হল যে, পশুদের বীর্য সংগ্রহে মানুষ নিজের সুবিধার্থে গাজোয়ারি করে, পশুর মাংস খাবার জন্য তাদের সুখাদ্য খাইয়ে চর্বিদার করা হয়, গোরু বা ছাগলকে গর্ভসঞ্চার করাবার জন্য তাদের যখন ষাঁড় বা রামছাগলের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন মানুষ নিজের ইচ্ছানুযায়ী নিয়ে যায়, গবেষণাগারে কাটাছেঁড়া করার সময়ে তাদের অনুমতি নেয়া হয় না, ইত্যাদি; পক্ষান্তরে যারা পশুরতি করে তারা পশুটিকে গোপনে নিজের প্রেমিক বা প্রেমিকার মতো যত্ন করে, ভালোবাসে । এম জেকব অ্যাপেল তাঁর ‘থ্রি রিজনস সোসায়টি শুড নট রাশ টু কনডেম বেস্টিয়ালিটি’ ( ২০০৯ ) রচনায় যুক্তি দিয়েছেন যে মানুষেরা পশুদের বন্দী করে রাখে, চেন বেঁধে রাখে, তাদের অনুমতি ব্যতিরেকে যখন কিনা মানুষের সঙ্গে অমন ব্যবহার করা যায় না ; পশুর সঙ্গে রতিসম্পর্ক গড়ে তুললে তাকে চেন বেঁধে বা বন্দী করে রাখার প্রয়োজন হয় না ।
    টি. জন অ্যালেকজান্ডার তাঁর ‘ক্যাথারিন দ্য গ্রেট : লাইফ অ্যান্ড লিজেন্ড’ ( ১৯৮৯ ) গ্রন্হে লিখেছেন যে রুশ দেশের অষ্টাদশ শতকের সম্রাজ্ঞীর বাইশজন সঙ্গমকারী সঙ্গী ছিল, এবং তাঁর সময়ে গুজব প্রচলিত ছিল যে তিনি এতই কামাসক্ত ছিলেন যে পুরুষ সঙ্গীরা তাঁকে তৃপ্তি দিতে অক্ষম হলে পশুদের ব্যবহার করতেন । তাঁর মৃত্যও পশুর সঙ্গে সঙ্গম করতে গিয়ে ঘটে বলে বহুকাল জনগণের মাঝে গালগল্প প্রচলিত ছিল । সেকারণে জনগণ তাঁকে বলত রুশ দেশের ‘মেসালিনা’ । রোম সাম্রাজ্যের খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকের সম্রাট ক্লদিয়াসের স্ত্রী ছিলেন মেসালিনা ; তাঁর যৌনতাড়না সম্পর্কে প্রচলিত গল্পগুলোর অন্যতম হল তিনি প্রতিরাতে রোমের বেশ্যালয়ে গিয়ে খদ্দেরদের সঙ্গে অবিরাম একের পর এক সঙ্গম করতেন, এবং তাতেও তৃপ্তি না পেলে রাজপ্রাসাদের প্রশিক্ষিত পশুদের ব্যবহার করতেন । ‘হিসটরিয়া নাতুরালিয়া’ ( খ্রিস্টপূর্ব ৮০ ) গ্রন্হে প্লিনি লিখে গেছেন যে এক রাতে জনৈকা যৌনকর্মীর সঙ্গে প্রতিযোগীতায় ২৫ জন পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করে মেসালিনা বিজয়ী হন । স্বামীকে সরিয়ে নিজেই সিংহাসনে বসার ষড়যন্ত্র করে ধরা পড়ার পর তাঁর স্বামীর হুকুমে তাঁকে মৃত্যু দণ্ড দেয়া হয় ।
    স্বমেহনের জন্য ইউরোপ আমেরিকার বাজারে যে বস্তুগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে এমন আকৃতির জিনিশও আছে যেগুলো কুকর, ষাঁড়, রামছাগল ইত্যাদির লিঙ্গের মতো বা কুক্কুরি, মাদিছাগল, হরিণী, বাছুরের যোনির আকারের । ভারতের বাজারে এগুলোর বিক্রি নিষিদ্ধ । যাঁরা বিদেশে যান, লুকিয়ে কিনে আনেন বা ইনটারনেটের মাধ্যমে কেনেন । ইনটারনেটে পশুরতিকারীদের জমায়েত আছে, যেমন আছে অন্যান্য যৌন আগ্রহের মানুষদের গোপন জমায়েত ।
  • m | 012312.60.6734.100 | ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:৫৫541321
  • মলয় রায়চৌধুরী
    হিন্দি সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণুর সঙ্গে তাড়িসন্ধ্যা
    পাটনায়, চল্লিশ দশকের ইমলিতলায়, এখন ভাবি, ‘খারাপ’ আচরণ ব্যাপারটা , এখন যেসমস্ত আচরণকে বলা হবে সীমালঙ্ঘণ, তা সম্ভবত ছিল না । আমাদের বাড়ির সামনের রকে আমার শৈশবের বন্ধু কপিলের দাদু একটি খিস্তি শেখাবার স্কুল চালাতেন ; তাঁর কাছে শিশুদের রেখে মায়েরা যে-যার কাজে ব্যস্ত থাকার সময়ে কপিলের দাদু, যাকে আমরা বলতুম রামচন্দর, কোনো পথচারীর দিকে নির্দেশ করে একটি শিশুকে বলতেন, ‘এই তুই ওকে অমুক গালাগালটা দে’ । শিশুর কন্ঠ থেকে বেরোত এমন সমস্ত খিস্তি যা শুনলে বর্তমান কালখণ্ডে মারামারি-খুনোখুনি আরম্ভ হয়ে যাবে । নিজে তাড়ি খেতে-খেতে শিশুদেরও খাইয়ে দিতেন এক-আধ ঢোঁক ।
    ওই পাড়ায় কারা কারা চুরি পকেটমারি ছিনতাইবাজি ইত্যাদি করে জীবন চালাত তা ইমলিতলার সকলেই জানত । স্বাভাবিক যে পাড়ার তাড়িখোররা তাড়িও চুরি করে এনে খেত । ছেলে-ছোকরারা খবর আনতো যে কোথায় কোন কোন গাছে তাড়ির হাঁড়ি বাঁধা হয়েছে । ব্যাস , ভোর রাতে বেরিয়ে পড়ত একদল লোক । পাড়ায় পৌঁছে যেত বেশ কয়েকটা তাড়ির হাঁড়ি । সকালে নামিয়ে আনা বলে কিছুক্ষণ রেখে দেয়া হতো যাতে রোদের গরমে গেঁজিয়ে ওঠে ।
    আমার তাড়ি পানের হাতেখড়ি ওই ইমলিতলা পাড়াতেই, শৈশবে । কিন্তু আমাদের তাড়ি খাওয়াবার জন্য বড়োজ্যাঠা বকুনি দিতেন, আমাকে নয়, যারা তাড়ি খাইয়েছে তাদের । তবে তাড়ি খাওয়াকে খারাপ চরিত্র-লক্ষণ মনে করা হতো না, কেননা আমাদের বাড়িতেও, বিহারি সংস্কৃতির প্রভাবে বোধহয়, বলা হতো যে তাড়ি স্বাস্হ্যের পক্ষে উপকারী ; ভোর রাতের তাড়ি খেলে মোটা হওয়া যায় । গেঁজিয়ে-ওঠা তাড়ির গন্ধ আমার ভালো লাগত না ; নাক টিপে খেতে হতো । তাড়ি খাবার জমায়েত দেখলে তাই এড়িয়ে যেতুম, যদিও পেছন থেকে ডাক পড়ত, টিটকিরিও মারত বয়স্কদের অনেকে ।
    হিন্দি সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণুর সঙ্গে বসে নানা রকমের নেশা করেছি । ওনার গ্রামের বাড়ি ছিল নেপালের সীমান্তে । বিহারি তরুণ কবি-লেখকরা ওনার বাড়িতে একত্রিত হলে কখনো-সখনো গাঁজা খাওয়া হতো ; গাঁজার শৌখিন ছিলিম ছিল রেণুজীর । তবে উনি ভালোবাসতেন রাম খেতে, নিট রাম । আমি দরিয়াপুরের বাড়িতে যাবার পর উনি বাড়ির কাছে এসে আমার নাম ধরে হাঁক পাড়তেন । রিকশায় উঠে আমরা যেতুম একটা বারে; সেটা ছিল ‘সেন্ট্রাল হোটেল’ নামের পোড়োবাড়িতে । আরও অনেকে এসে পৌঁছোত । রাম খাওয়া হতো । রামও আমার প্রিয় নয় । আমি কম খেতুম ।
    একবার উনি ওনার রাজেন্দ্রনগরের ফ্ল্যাটে সাহিত্যিক আড্ডার ব্যবস্হা করেছিলেন, হিন্দি সাহিত্যিকরা যাকে বলতেন ‘গোষ্ঠী’ । এখন এই জমায়েতগুলোকে কী বলা হয় জানি না । গোষ্ঠী জমজমাট হয়ে উঠলে ট্রেতে সাজানো কাটগ্লাসের পাত্রে চলে এলো পানীয় । ফিকে কমলা রঙের, ছোটো এলাচের গুঁড়ো ভাসছে তার ওপর । অপরিচিত গন্ধ । ভোর রাতের তাড়ি ফ্রিজে রেখে তার সঙ্গে মেশানো হয়েছে জাফরানের জল আর ওপর থেকে ছোটোএলাচ !
    বলাবাহুল্য যে প্রত্যেকের কবিতাপাঠের পর ‘ওয়াহ’ ‘ওয়াহ’ ধ্বনি উঠছিল । ষাটের দশকের পর উঠে গেছে এই ধরণের কবিতাপাঠের আসর।
  • m | 012312.60.2334.199 | ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:২১541322
  • The common thread between the Beats and the Hungryalists
    Rima Bhattacharya
    PhD Research Scholar
    Department of Humanities and Social Science
    Indian Institute of Technology, Kharagpur
    The history of American poetry since World War II represents a contest between a formalist approach towards the experimental impulse of modernism and an anti-formalist revolt that affirms the presence of open forms. Postmodern poetry or avant-garde poetry has always posed oppositional challenges to the cultural establishments of a society. Modern and late modern experimental writers have repeatedly suggested that technically disruptive work is scientific, objective and presentational–the very opposite of representational and rhetorical writing. This was followed by the uprising of a new group of poets known as The Language poets. They were an avant-garde group in United States that emerged in the late 1960s and early 1970s. Its immediate postmodern precursors were the New American poets, a cluster which includes the New York School, the Objectivist poets, the Black Mountain School, the Beat poets, and the San Francisco Renaissance. Language poetry can be defined as the work of an associated network of writers who share in the main a number of questions about the relation between language and the politics of cultural production.
    By the time Allen Ginsberg was reading out his poem “Howl” for the 6 Poets at the 6 Gallery Reading, San Francisco, 1955, poetry has become a tangible social force, moving and unifying its auditors, releasing the energies of the audience through spoken, even shouted verse. Young poets did then engage in an enthusiastic, free-spirited celebration of poetry. The audience participated, shouted and joyfully applauded at times. Ginsberg’s poem is a howl against everything in our mechanistic civilization which kills the true spirit of life. It uncovers the nerves of suffering and spiritual struggle. However, its positive force and energy come from a redemptive and eternal quality of love, although it meticulously catalogues the evils of our time, from physical depravation to madness. Nearly all of Ginsberg’s poems which were based on so-called beat themes–allegiance to spontaneity, rejection of artificial forms, commitment to physicality, pursuit of the non-mimetic, are excellent examples of Language Poetry. All these poems generated a poetics of their own along with their own academically respectable theorists William Carlos Williams and Charles Olson (Merrill 16).
    It is extremely interesting to trace the geographical expansion of this trend of writing Language Poetry which has influenced the broader spectrum of literature world-wide. With the first reading of Howl in 1955, Ginsberg explodes on the page with a driving challenge of language, perception, and the development of a new American vocabulary, similar to that of Walt Whitman. Ginsberg's greatest contribution as a poet was the development of a new poetics. Upon the release of the poem as a part of his 1956 collection of poetry titled Howl and Other Poems, Lawrence Ferlinghetti and the bookstore's manager, Shigeyoshi Murao, were charged with disseminating obscene literature, and both were arrested. Only a few years later, in a completely different part of the world, in India, a similar incident took place. On September 2, 1964, arrest warrants were issued against eleven young alienated young poets of Bengal who called themselves The Hungryalists. The group included Malay Roychoudhury, Saileswar Ghosh, Subhas Ghose and Pradip Choudhuri, who had been arrested and charged with conspiring to produce and distribute an obscene book in violation of Section 292 of the Indian Penal Code. The book was an anthology of their writings, in which Stark Electric Jesus was Malay Roychoudhury’s contribution. Later that summer charges were dropped against five of them, but the prosecution of Malay Roychoudhury continued. On 28 December 1965 he was found guilty by a Calcutta court and sentenced to a fine of 200 rupees or one month’s imprisonment. The poem was banned. The court case went on for years. News of the persecution appeared in the November 4, 1964, issue of Time magazine, which brought the Hungryalist movement worldwide coverage. Poets like Octavio Paz and Ernesto Cardenal, and Beat poets like Allen Ginsberg visited Roychoudhury1.
    Soon after Independence, poetry in most of the Indian languages went through a turbulent phrase at approximately the same time. As a result of this various “regional” poetic movements were launched; these were often simply called new poetry (for instance, naikabita in Hindi and nayakavya in Marathi). The major context of nineteenth and twentieth century Indian poetry cannot be grasped if one does not take into consideration the vast gamut or network of Indian and foreign literatures surrounding it. It is almost undeniable that “foreign influences” have played a crucial role in the emergence of Indian post-modern poetry. English literature has been an obvious influence, and it has permeated all the Indian language traditions since the nineteenth century. American Beat poetry of the 1950s and 1960s, especially the poetry of Allen Ginsberg also had a widespread effect, on the Indian literary scenario, drawing strong and favorable responses from all over the subcontinent. During the postcolonial decades, the Indian literary world saw the advent of powerful new writers from formerly suppressed or marginal social groups and communities. In the 1960s and especially in the 1970s, poets from lower middle class and lower class backgrounds began challenging the canons of middle-class and upper- caste literary establishments in languages like Telugu, Kannada, Tamil, Malayalam, Bengali, Marathi and Hindi. Among the poetic movements that emerged from this wider phenomenon were the Digambara (“naked poetry”) movement in Andhra Pradesh, the controversial and short-lived Hungry Generation movement in Bengal and the Marxist- Leninist (Naxalite) movement of revolutionary writing in different parts of the country (Dharwadker 220)
    For a diversified nation like India it is impossible to maintain a tidy clarity and present a singularly unified poetic attitude to the world. No other country in the world can offer greater extremes or variety in the total experiences which shape poets. The poetic vision of the Hungry Generation erupted in Bengal and rapidly spread to such cities like New Delhi, Bombay and Allahabad. This kind of poetry was dangerous and revolutionary like the Beat poetry, and did seek to clean the society by violence and destruction. This was the poetry of the disaffected, the alienated, the outraged, and the dying. It was a kind of poetry which alarmed and disgusted the bourgeois, for it laid bare their sickened state more clearly than they wished to hear, and exposed the hypocrisy of their decency2. In an interview with Subhankar Das, the editor of Graffiti, Kolkata Roychoudhury states that “the Hungryalist movement has changed the course of Bengali literature once for all. We definitely created a rupture in terms of time, discourse, experience, narrative diction and breath span of poetic lines” (See “Conversing with Malay”). One of the reactions of good citizens had been to accuse the hungryalist poets of hysteria and obscenity, which is reminiscent of the first line of Ginsberg’s poem “Howl”: “I saw the best minds of my generation destroyed by madness, starving hysterical naked,/ Dragging themselves through the negro streets at dawn looking for an angry fix” (Collected Poems 126). The long and painful persecution of Malay Roychoudhury, ended in his conviction on 28th December 1965 on charges of obscenity. This is an indication of the disturbance that the poets had created in an apparently well-wrought society comprising mainly of corrupted and hypocritical people.
    During his India trip, Bengal introduced Ginsberg to a group of anti-establishment writers like himself and the other beatniks. This group include people like Shakti Chattopadhyay, Malay Roy Choudhury, Samir Roychoudhury, Subimal Basak, Debi Roy (HaradhonDhara), Utpalkumar Basu, Binoy Majumdar, Sandipan Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Roy and last but not the least Falguni Roy, who is considered to be responsible for heralding the postmodern era in Bengal. Falguni Roy’s book Nashto Atmar Television (The Television of Ruined Subjectivity), published on 15th August 1973 was supposed to signify the end of modernity in Bangla poetry and thereby herald post-modernity. Falguni Roy completely rejected collectively proclaimed rules and canons and wrote poems which veered toward open, playful, disjunctive, displaced, hybridized, immanent, fragmentary, selfless Bangla indigenous forms. His poems too are strikingly different wherein lines, stanzas, voice-grids are interlocked as against the interlinking form of pre-Hungry Generation Bengali poetry.
    In his prose and poems Falguni Roy made constant efforts to dismantle modern poetry's beliefs in unity, hierarchy, identity, foundations, subjectivity and representations, while celebrating counter-principles of difference and multiplicity in everyday life3. It is possible to draw a comparison between the poetry of Ginsberg and Roy on the account of the tremendous fatigue and hopelessness expressed by their poems. Allen Ginsberg’s collection of early poems The Empty Mirror begins with a poetic statement of the profoundest uselessness and hopelessness:
    I feel as if I am at a dead
    end and so I am finished.

    are true but I never escape
    the feeling of being closed in
    and the sordidness of self,
    the futility of all that I
    have seen and done and said. (Collected Poems 71)
    One would encounter the same feeling of hopelessness and despair in Falguni Roy’s poem “Personal Neon”:
    I am devoid of genius
    that is why I can touch my nose with my tongue
    and prove that I am really a genius
    Sometimes while walking in front of
    Manik Bandyopadhyay's house I brood
    about the street on which he once walked
    I am also on the same road, but worthless, Falguni Ray4
    The poem expresses neither exultation, nor the certitude of life that provides the human soul with a sense of comfort, but the mood of a spirit that has long been besieged by doubts regarding one’s own abilities and has experienced a face-to-face encounter with the sense of despair. In both of the poems one would find echoes of existential complaints. It is also important to note that both the poems make use of similar spontaneous language and emotions. One would find that Ginsberg’s poetry usually depends upon the existentialist formula: existence precedes essence. While he is writing, he claims to be living or existing through the experience. Thought about that experience (i.e. essence) would reduce the immediacy of the experience itself. Hungryalist manifestoes contain several points to second Ginsberg’s methods. In fact in more than one way Falguni Roy can be considered to be one out of the group of outcast seekers suffering persecution, madness, suicide and among whom Ginsberg includes himself, in his poem “Howl”. The Moloch, which in Ginsberg’s Howl is a representative of social ills, equally oppresses Falguni’s life, although he belongs to a different culture and country.
    At that time, Kolkata, then called Calcutta, was undergoing change at a fast pace. Partition had unleashed a catastrophic inflow of displaced people, which was gradually changing the social fabric of border towns as well as the city of Calcutta. Migration began before Partition and continued into the 1960s and beyond. By late 1959 there were processions of hungry migrants; many died or were killed. Malay Roychoudhury’s poem Wolf Dynasty (translated by the poet from the bengali version Nekrayr Bangsho) depicts this sour time of putrefaction:
    They pressed a pistol on my temple, yelled:
    Why have you basterd turned up again
    We'll slap hungry lips with scarlet fangs
    tongue will lick the sunbeam from your nails
    and stop the tinsel Jatayu's hinged-wing strain.
    Oilsoot penury in me lees whatever is stark
    designs in secret teak trees behind screen of bark (Malay Roy Choudhury Poems 80)
    The poem in its spirit and use of language is reminiscent of Ginsberg’s poem “America” and a later collection of poems named “The Fall of America”. “America” is a poem, as spontaneous as “Wolf Dynasty”. It is also comic, tedious, honest and yet highly incisive. The poem is an attempt to catch the mood of a particular attitude towards the United States without the interference of logic or rationality. However through all the turmoil, gibberish, and illogicality of the poem, a broad-based attack, which rational discourse can only hint at, is launched against American values. The seemingly hopeless illogicality of the poem, which is also a characteristic of “Wolf Dynasty”, acts as a mirror for the hopeless condition of the Nation it reflects. First and foremost Whitman’s exuberant optimism towards America turns into disillusionment in the voice of the poet: “America I’ve given you all and now I’m nothing” (Collected Poems 146). This admission is followed later in the poem by an appeal to America to shake off its hypocrisy and be equal to Whitman’s challenge: “America when will you be angelic? / When will you take off your clothes?”(Collected Poems 146). The real impact of the protest in this poem is conveyed structurally. The total bewilderment and confusion that one feels in reading the poem reflects the American dilemma Ginsberg attempts to mirror.
    One key concern of the language poets all over the world has been to point out the manner in which traditional poetic genres and forms tend to naively reflect establishmental and institutional values of societies. These writers consciously identify poetry as conditioned by the ideological limitations and power of the written word in traditional cultures. For all these reasons, language poets are considered to be radical revisionists of existing poetic forms. They tend to reject traditional forms, lyricism, narrative, subjectivity, and naively representational writing. They have also accepted that language is constructed by relations of power, and that it cannot naively access either transcendence or the natural world, or unproblematically represent the way the world "actually is." Therefore Ginsberg writes in Wichita Vortex Sutra:
    The war is language,
    Language abused
    For Advertisement,
    Language used
    Like magic for power on the planet (Collected Poems 401)
    The Fall of America shows Ginsberg moving closer to Kerouac’s conception of the writer as memoirist. Much of the book is drawn from journal transcription, or composed directly on the tape recorder as Ginsberg traveled about the country by car, plane, and train. This is Ginsberg’s most despairing and least affirming book, haunted by a constant sense of doom. The basis of The Fall of America is the violence of Vietnam during the 1960s as reflected in an inner violence of America. The destruction of foreign war is complemented by the devastation of America’s own natural environment. Ginsberg’s poems are based on the Buddhist notion of karma that promises that any present action will affect future incarnations, or the biblical maxim on sowing and reaping. Instead of the ecstatic resources of drugs or mysticism, the only relief Ginsberg projects in this poem is an apocalypse of self-destruction.
    On the other hand if one can take a look at India, specially at Bengal, then one would discover that during the period of 1959- 60, the Post-partition Bangla polity was definitely a time of turbulence. The society was filled with angry young men. Indifferent politicians and not concerned intellectuals governed the sphere of influence. A post-Partition turmoil had overtaken West Bengal. It was during this time Roychoudhury had started the movement with his elder brother, Samir Roychoudhury, and two other poets, Shakti Chattopadhyay and Debi Ray. The word Hungryalism was coined by the Hungryalists from English poet Geofrey Chaucer’s line In the Sowre Hungry Tyme. The Hungryalists felt that the post-colonial dream of a new, ecstatic, resurgent India had turned sour due to the licensed existence of a corrupt bureaucracy-politician nexus and the country was hurtling towards a nightmare after partition of the Bengali time and space5. Such an atmosphere which is comparable to the atmosphere described by Ginsberg in The Fall of America, was responsible for the production of Malay Roychoudhury’s poem “Shame on you Calcutta”:
    Stay and live with your eunuchs
    You are their nurse who piss in bed in winter rain
    Lift their legs and change wet pants
    Write great words on walls to be urinated by pimps
    I don’t want to meddle in your affairs now.
    Lips will turn sour if I kiss you after death.
    (Malay Roy Choudhury Poems 60)
    Both the Beats as well as the Hungryalists believed in spontaneity and acceptance of reality. They were both trying to reintegrate humans with the natural world and thereby to establish a world of “natural humanity”, instead of an “artificial ideal” and for this it was necessary to accept both the holy and evil side of one’s own nature and surroundings. Samir Roy Choudhury, like his younger brother Malay, criticizes as well as accepts the bad side of his city, Calcutta in his poem “So” (translated by the poet from the bengali version “To”) :
    Oh Sir, nobody uses the Jadavpur subway for road crossing
    during night aristocrat lunatics sleep thereat
    a passenger queried- is the taxi-meter OK?
    I delivered a counter- is the country OK?
    In front of Tollygunj Metro both flyover and subway are being constructed
    that does not mean pedestrians will not come under wheels
    how will then media-fedia dailies-failies run6
    During his Indian sojourn, Allen Ginsberg struck great friendship with Malay and his older brother Samir Roy Choudhury and lived in their Patna house for several months. These were the formative years of the Hungryalist Movement. While Allen cast a certain Beat influence on the Roychoudhury brothers, they too, were instrumental in creating profound cultural influence on Ginsberg. Allen Ginsberg's Indian Journal bears ample proof of that although he fails to mention the Roychoudhury brothers in the book. Touched by the raw and fiery poetry of the Hungryalist poets, Ginsberg brought back to America in 1962-63 translations of a whole bunch of Bengali Hungryalist poets which Lawrence Ferlinghetti published later in a special issue of the City Lights Journal. According to Alden the beat generation and the last World War as a whole did not leave the Indian writer untouched. He by that time has developed a new attitude and has matured a lot. The poets of Bengal gradually started moving away from the Romanticism and elegance of the poetry of the early 1900’s, landing up in a new individualized space. Poets started experimenting with new forms, drawing inspiration from Apollinaire, Rimbaud and Baudelaire. It was believed that this kind of “new poetry” took recourse to ugliness and led to the destruction of the human soul in contrast to the previous task of poetry that persisted in the pursuit of “beauty” (See Alden 398).
    Ginsberg’s famous poem Kaddish dedicated to his mother, written quite a few years before his trip to India, shows an obsession with the idea of death. For various reasons it had seemed to Ginsberg at that point of time, that the best thing to do was to drop dead or not to be afraid of death but go into death. He began to believe that God was death, and if he wanted to attain God, he had to die: “Nameless, One faced, Forever beyond me, beginningless, endless, Father in death” (Collected Poems 212). The “Hymmnn” which follows Kaddish, ends with the words “Blessed be Death on us all” (Collected Poems 225) and this once again reinforces Kaddish’s consolation for the dead. For Ginsberg, death was a release from the miseries of an unfeeling time and world. One can find a similar obsession with death in Malay Roychoudhury’s poem “Stark Electric Jesus” which begins with the line: “Oh I’ll die I’ll die I’ll die” and again in the same poem, where the poet writes:
    I do not know whether I am going to die
    Squandering was roaring within heart’s exhaustive impatience
    I’ll disrupt and destroy
    I’ll split all in to pieces for the sake of Art
    There isn’t any other way out for Poetry except suicide.
    (Malay Roy Choudhury Poems 68)
    Ginsberg’s Kaddish is the personal diary of a son’s witness to his mother’s acute sufferings under the accumulations of life that ultimately result in death. It is also an “autobiographical” narrative because the real history presented is not that of Naomi Ginsberg but the history of her son finding himself in reliving his memory. Ginsberg calls on his Origin, and exploits his recollection of Naomi’s anguish to help him understand the nature of his own:
    O glorious muse that bore me from the womb, gave
    Suck first mystic life and taught me talk and music,
    From whose pained head I first took Vision –

    What mad hallucinations of the damned that drive me out of my
    Own skull to seek Eternity till I find Peace for Thee,
    O Poetry – and for all humankind call on the Origin. (Collected Poems 223)
    In Kaddish the poet expresses a strong desire to return to and fuse with his mother in death. For Ginsberg separation from his mother was never independent but always an absolute, sterile and frustrating isolation. The separation was so radical that it could not be resolved by mere verbal or emotional communication and therefore Ginsberg longs to be delivered from this agonizing isolation by a kind of self-annihilating fusion with the mother. From this point of view, one can understand his incestuous desires, as expressing his wish to get inside his mother and see things as she does:
    One time I thought she was trying to make me come lay her-
    Flirting to herself at sink –

    Seemed perhaps a good idea to try – know the Monster of the Beginning Womb –
    Perhaps – that way. Would she care? She needs a lover. (Collected Poems 219)
    One would find the same desire to merge with the Origin in Malay Roychoudhury poem “Stark Electric Jesus”:
    Let me sleep for the last time on a bed soft as the skin of Shubha’s bosom
    I remember now the sharp – edged radiance of the moment I was born
    I want to see my own death before passing away
    The world had nothing to do with Malay Roychoudhury
    Shubha let me sleep for a few moments in your violent silvery uterus

    Let me create myself in your womb with my own sperm.
    (Malay Roy Choudhury Poems 68)
    Shakti Chattopadhay’s poem Yarasandha vibrates with the same spirit and the poet makes an appeal to his mother to take him back. His unique voice spoke to the urban youth of post-World War II generation. His distinct style, like his friend Ginsberg was filled with a sense of deep angst: Why did you bring me in?
    Take me back
    The face cold as dark
    The sad eyes poor as dry lake
    Let your mother take you back

    Why did you labor
    On the crunched bed of straw
    To usher me in? (Poems of a Rebel 8)
    The appeal of Naomi’s cryptic advice at the end of the poem, “The key is in the window, the key is in the sunlight at the window” undoubtedly bears an unwitting resemblance to Shakti Chattopadhay’s poem The Key (translated by the poet from the Bengali version Chabi), in which Shakti Chattopadhay gives a similar kind of advice to his dear friend Malay Roychoudhury:
    Till this day here lies with me
    Lost long ago, your dearest key
    You open still that chest of yours? (Shakti Chattopadhay Poems 27)
    Interestingly, Ginsberg’s masterpiece “Howl” and Malay Roychoudhury’s poem “Wound” (translated by the poet from the bengali version Jakham), bear a striking resemblance. In “Howl”, the first part of the poem attempts to create the impression of a kind of nightmare world in which people representing “the best minds of my generation”, in the author’s view, are wandering like damned souls in hell. This is done through a kind of series of what one might call surrealistic images, a kind of state of hallucinations. Roychoudhudy dwells on the same hellish atmosphere at the beginning of his poem “Wound”:
    Awning ablaze with toxic fire above me
    I lie watching the winged blue of this crawling sky
    Putting down the crushing anger of my suffering
    I crossexam my nocturn doubts
    Pushing a gramophone needle over the lines of my palm
    I scan the prophecy. (Malay Roy Choudhury Poems 81)
    The mood of the poem “Howl” changes in the second section and becomes an indictment of those elements that are destructive of the best qualities of human nature and of the best minds. “What sphinx of cement and aluminium,” it begins, “based upon their skulls and ate up their brains and imagination?”. “Moloch! Solitude! Filth! Ugliness!”, he answers, and thus begins to list the soulless, materialistic, sexless mechanized elements of Moloch whose presence leads to destruction and war (Collected Poems 131). In Roychoudhury’s poem “Wound”, however, the poet himself becomes the representative of the decadent society he depicts. Ginsberg’s mental Moloch takes the shape of ravens at times for Roychoudhury as one finds him describing his state in his poem “Wound”:
    16 dvn ravens whirl around my torso for 25 years
    My bones reel clutching my raw wounds
    My peeled fleshblood
    Flaying my skin I uncover arrogant frescos of my trap
    Ageless sabotage inside the body (Malay Roy Choudhury Poems 81)
    At other times it takes the shape of hounds that haunt him:
    2000 hounds released from out of my skull
    Haunting me for 25 years (Malay Roy Choudhury Poems 82)
    At the end of the poem Roychoudhury even mentions a list of atrocities which he imagines himself to have committed but the atrocities seem to reflect a common attitude of the generation he represents:
    I had lifted a 5- paise coin from a blind beggar’s palm
    I had looted benevolent money of hearse- corpses (Malay Roy Choudhury Poems 83)
    Ginsberg’s famous and revolutionary poem “Howl” was initially a highly censored poem. Both Ginsberg’s and Roychoudhury’s poems reflect a common sentiment which is clearly stated in the latter’s poem “Wounds”: I may be censored I can not be disregarded (Malay Roy Choudhury Poems 83)
    Although both Ginsberg and Roychoudhury were considered to be rebels by their society, both of them at some of time, did realize their limitation as human beings and felt like succumbing to their cruel fate. Thus one finds that at one point of time Roychoudhury is almost ready to give up and accept all tortures. Thus he writes in his poem Humanology (translated by the poet from the bengali version Monushyatantra):
    I am ready to be mugged O deadly bat come
    Tear off my clothes, bomb the walls of my home,
    Press trigger on my temple and beat up in jail
    Push me off a running train, intern and trial. (Malay Roy Choudhury Poems 31)
    Ginsberg’s humanology is the same as that of Roychoudhury as one finds him reflecting the same sentiments in his poem “The End” where he too is ready to accept death:
    I sit in the mind of the oak and hide in the rose, I know if any wake up, none but my death,
    Come to me bodies, come to me prophecies, come all foreboding, come spirits and visions,
    I receive all, I’ll die of cancer, I enter the coffin forever, I close my eyes, I disappear.
    (Collected Poems 259)
    In the “Author’s Preface, Reader’s Manual” to Collected Poems: 1947 – 1980, Allen Ginsberg provides an insight to the manner in which his poems were composed: “First thought, best thought. Spontaneous insight - the sequence of thought- forms passing naturally through ordinary mind – was always motif and method of these compositions” (Collected Poems xx). The technique adopted by both the Beats and the Hungryalists was that of the confessional, where the confessor willingly gives priority to the catharsis of thought and feeling over the structure that the catharsis itself is to discover. As early as his first contact with William Carlos Williams, Ginsberg began experimenting with ways to restore speech to the language of poetry. William in turn, while advising Ginsberg was anticipating Olson’s third dogma of “Projective Verse” that “One Perception must immediately and directly lead to a further perception” (Merrill 19).
    Like all American tourists, Gary Snyder, Allen Ginsberg and Peter Orlovsky had landed at Bombay (now Mumbai) port in formal Western attire. They visited North and North-East Indian tourist spots and hill-stations with their coat, trousers, tie, shirt, shoes, and socks on. Once they arrived at Calcutta (now Kolkata), their metamorphoses began. They threw away their Western dress and clothed themselves in home-attire of the Hungryalists of the time, viz., handloom kurta-pyjama and rubber chappal footwear, with a cotton sling bag hanging on the shoulder. They allowed their hair and beard to grow like some of the Hungryalists (See Tridib Mitra and Alo Mitra). Allen Ginsberg, the poet of Howl and Kaddish, after his interaction with the painters and poets of the Hungryalist movement, could never remain the same person. Ginsberg’s biographers and critics, most of whom are American, are almost ignorant of Indian complexities and have never taken into account the contributory factors that impacted the poet to such an extent that his post India poems changed structurally, semantically. Poems written by Ginsberg after his India visit are composed in the breath-span of mantras, pranayamas as well as Bangla poetry of 1960s, all of which remained beyond Euro-American academic comprehension. Ginsberg’s chanting and singing of mantras were pregnant with values inculcated in a historical faith-penumbra of the people he lived with in India. Thus in “Wichita Vortex Sutra”, one finds Ginsberg invoking “Harekrishna as preserver of human planet”, challenging all other powers usurping state consciousness and thus delivering the sacred formula bringing peace:
    I lift my voice aloud,
    Make Mantra of American language now,
    Pronounce the words beginning my own millennium,
    ‘I here declare the End of the War!’ (Collected Poems 407)
    The central implication of the poem seems to be clear. The poet tries to find out whether the ‘mantra’ of the American language can in some vigorous and magical way put an end to the slaughter in Vietnam (Hyde 293). This particular poem embodies an experience of contemporary American language and also focuses on the cultural irresponsibility of language which in turn establishes the kinship of “Wichita Vortex Sutra” to Carlos William’s and Charles Olson’s lamentation of the separation of language from reality. One can find a similar use of mantric language at the end of the poem “What would you do if you lost it?” where he calls upon the prominent Indian divine figures, to bid them a final goodbye, but which also makes one feel that he was aware of and affected by their existence:
    Bom Bom! Shivaye! Ram Nam Satyahey! Om Ganipatti, Om Saraswati Hrih Sowha! Ardinarishvara Radha Harekrishna faretheewell forevermore! (Collected Poems 594)
    One finds similar use of language in Ginsberg’s other poems like “On Illness” in which the poet calls upon his dead mother and fuses the Hindu chant of OM with the word MOM, bestowing on the mother, a divine quality to cure, as it is only the mother figure who can provide the best respite from illness:
    Om Saraswati Hrih Sowha
    MOM
    Mom Mom Mom Mom Mom Mom Mom (Collected Poems 603)
    Whether be it Benaras, Kolkata, Tarapith, Chaibasa or Patna, Ginsberg invariably visited the burning ghats (where the dead are consigned to flames), accompanied by one or several members of the Hungryalist movement. The experience was so earthshaking for him (quite a normal one for any Hindu) that he could, for the first time in his life, understand the difference between the occidental quest for immortality and the oriental quest for eternity. His biographers and critics, who are either Jew or Christian, have never taken into epistemic consideration the dedication page of Ginsberg’s Indian Journals (See Indian Journals 3). Ginsberg, however, could comprehend that the Hungryalists had dispensed with the colonial compartmentalization such as Good/Evil, God/Devil etc binary opposites. The Hungry Generation poets explained to him that each of the triumvirate Brahma, Vishnu and Maheshwara embody traits which exist in nature itself and nature was never monocentric7. This idea has been articulated by Ginsberg to several of his interviewers. Allen Ginsberg was in awe with the depth of tolerance and resiliency of Indian masses. On his way back from India to USA in the Kyoto-Tokyo Express he had realized that in order to attain the depth of consciousness that he was seeking, he had to cut himself off from the Blake vision and renounce it. While expressing this realization he was actually revealing the impact of the Hungry Generation on him. He was talking about a new awareness gained, which sought cosmic consciousness not in visions but in contact with what was going on around him.
    One cannot help but notice the similarity in the spontaneous use of language by both Allen Ginsberg and the “wandering minstrels” or “bauls” of West Bengal, those who like Ginsberg rebelled against the generalizing and the discursive use of language and constructed their songs likewise in order to restore the other function of language i.e, “speech”. Close to the end of his nine-month stay in Calcutta, the American Beat poet Allen Ginsberg—accompanied by his partner, Peter Orlovsky, the Bengali poet Shakti Chatterjee, and their would-be spiritual guru, Asoke Fakir—had travelled to Siuri, home to a large clan of Bauls, the troubadour poet-singers of the Bengal countryside. After visiting Tarapith they had arrived at a little hamlet outside Siuri. There Ginsberg found the aged, legendary Baul master Nabani Das Baul living in a small mud hut, bedridden and unable to sing. When Nabani spoke to Ginsberg from his sick bed, reciting with difficulty the songs he had once sung so lustily, Ginsberg scribbled Asoke’s roughly translated words dutifully in his notebook. He spent a week with the Baul family. From Nabani’s wife he learnt to eat with his hands, from Nabani he learnt to play the single-stringed ektara and four-stringed tanpura, the instrument that provides a background drone to Indian classical music. He was also schooled in the chanting of the mantra “Om Namah Shivaya.”. In an interview with Suranjan Ganguly, Ginsberg mentions Asoke fakir being “both a fool and at the same time a devotional man” and states that he was a person who almost instantly understood the motive behind their visit to India (Ganguly 26). Ginsberg hoped to find, in Baul spiritual teachings and songs, a new wellspring for his own poetic work. Bauls were distinguished from the usual run of men by flouting social convention, avoiding temples and mosques and any denotation of caste. Song and dance were their only form of worship and their bodies their only temple. Ginsberg carried a harmonium from Benaras when he returned to USA, and introduced the custom of extempore poetry composition, and singing, while playing on the harmonium. When he was in Benaras , Anil Karanjai and Karunanidhan Mukhopadhyay, the Hungryalist painters, and Hindi poet Nagarjuna (a Buddhist), had introduced him to this musical instrument, which is played on by devotees when they sing poems composed by Tulasidasa, Kabirdasa, Meera Bai, Tukaram, Krittibas, Ramprasad Sen and other saint poets. Ginsberg had found the same tradition at the Vaishnava, Shaivaite and Ramakrishna ashrama temples in Mayapur, Nabadwip, Puri, Chaibasa, Patna, Gaya, and Kolkata. He translated the word baul as “madcap”8.
    Ginsberg’s realization that if a poem was not composed on the tongue, it would become an essay was an insight he received from the stories of oral poets of 19thcentury Kolkata. Ginsberg came to know about people like Bhola Moira, Anthony Firingi, Ram Basu, Jagneshwar Das, Gonjla Guin, Nityananda Boiragi, Nilmoni Thakur, Nrisingha Rai, Bhabani Banik, Krishnakanta Chamar, Raghunath Das, Haru Thakur, and many others from Asoke Fakir, whose Champahati hutment used to be frequented by the Hungryalists. Like the Hungryalists and the Bauls of Bengal, Language poets all over the world emphasized the use of metonymy ,synecdoche in their compositions, which, even when employed in everyday speech, created a different texture. The result was often alien and difficult to understand at first glance, which is what Language poetry intends: for the reader to participate in creating the meaning of the poem.
    It is quite easy to guess the reason behind Ginsberg’s fondness and appreciation of Baul songs and poetry. For many years, Ginsberg had convinced himself that poetry held the key to mystical experience and spiritual awakening. As a young college student in New York City, he had had a spontaneous and beatific vision of God while reading the poems of William Blake in his Harlem tenement in 1948. After this visionary experience, he was probably heading toward a path of self- destruction. His India trip, his conversation with numerous sadhus, Hungryalist poets, Bauls, and finally his commitment to Buddhism made him realize that the Divinity for which he had been searching within external sources, actually resides within his own body. The Baul songs, which Ginsberg came across in Bengal were stuffed with enigmas and codes and summed up the similar Baul philosophy of Dehattaya (Truth in the Body), which is most probably the central theme of Baulism9. Bauls' body-centric philosophy can also be connected to the thoughts of the transcendentalist Emerson, and also to the thoughts of Tagore who talks about the Supreme Being, expressed through the physical existence of a human being. In order to understand the body-centric Baul songs, conscious efforts should be made to decode the songs, filled with language riddles, using imagery from daily life-activities, such as fishing, farming, sailing, trade and even robbery, foreclosure, and litigation as spiritual metaphors. Therefore one can easily arrive at the conclusion that it is the common philosophy of viewing the body as the microcosm of the universe, which is responsible for bringing two geographically diversified groups together (The Beats on one hand, and the Hungryalists and Bauls on the other) and unifying them for a common cause.
  • m | 012312.60.2334.199 | ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:১৪541323
  • জয়িতা ভট্টাচার্যের ‘হয়ে ওঠা’ : মলয় রায়চৌধুরী
    পুরুষ কবি ও লেখকদের 'হয়ে ওঠা' নিয়ে নানা আলোচনা পড়ার সুযোগ হয়েছে, কোন পুরুষ লেখক বা কবির গ্রন্হে তাঁর হয়ে ওঠা বর্ণিত হয়েছে তা পড়েছি ইংরেজিতে, কেননা তাঁরা ইউরোপিয় সাহিত্যিক, এবং এই 'হয়ে ওঠা' ব্যাপারটির তত্ব তাঁদেরই গড়া । সাহিত্যিক নিজেই যদি লেখেন তাহলে তা বিলডুংসরোমান ( Bildungsroman )-এর সাবাজনার কুন্সটলরোমান ( Kunstlerroman ) অথবা 'শিল্পীর নিজস্ব ন্যারেটিভ' হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছে । অন্যের লেখা হলে তা বিলডুংসরোমান । জয়িতা ভট্টাচার্যর এই গ্রন্হের ন্যারেটিভ ওই দ্বিতীয় বর্গে পড়ে, যদিও তা কেবল 'হয়ে ওঠা'য় সীমাবদ্ধ নয় । কিন্তু, এখানে একটা কিন্তু আছে, তা এই যে জয়িতা বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে, ইউরোপিয় পরিবারে প্রতিপালিত মেমযুবতী নন । তাঁর 'হয়ে ওঠা'র সঙ্গে এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিঙের 'অরোরা লেই', মারিয়া বেনেডিটা বোরম্যানের 'লেসবিয়া', প্যাট্রিসিয়া হাই স্মিথের 'দি প্রাইস অফ সল্ট', অ্যালিস মুনরোর 'লাইভস অফ গার্লস অ্যাণ্ড উওমেন', মার্গারেট লরেন্সের 'দি ডিভাইনার্স', মার্গারেট অ্যাটউডের 'ক্যাটস আই', জেনিফার ডোনেলির 'এ নর্দার্ন লাইট' বইগুলোর তুলনা করা ভুল হবে । তার কারণ তাঁরা লড়েছেন মূলত সমাজের চাপিয়ে দেয়া সেই মূল্যবোধের সঙ্গে যা নারীর পক্ষে অস্বস্তিকর এবং একজন মহিলা কবি-লেখককে লেখার স্বাধীনতা বা বেঁচে থাকার স্বাধীনতা তেমনভাবে দেয় না, 'শিল্পীর স্বাধীনতা'র দেয় না, যা একজন পুরুষকে দেয় ।

    পক্ষান্তরে, জয়িতা ভট্টাচার্যকে প্রথম থেকেই লড়তে হয়েছে দশভূজার মতন, বা হয়তো আরও বেশি হাতে, এবং তিনি পা-ও চালিয়ে থাকতে পারেন । বইটি পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন যে তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি । সাহিত্যের জগতে জয়িতার প্রবেশ, কৈশোর-তারুণ্যের বাধানিষেধের বিরুদ্ধে, ব্যক্তিগত এক কনটেমপ্লেশান, নিজের অন্তর্জগতের অভিপ্রায়, আবেগ ও আকুল কামনার সঙ্গে পরিচিত হবার উদ্দেশ্যে ।
    ভারতীয় উপমহাদেশে, পরিবারে কন্যাসন্তান কেউ সাধারণত চান না, আর প্রথম সন্তান কন্যা হলে পাড়া-পড়শিরাও যেচে বাড়ি এসে হাহুতাশ বিলিয়ে যান । জয়িতার পরিবারে সবায়ের আশা ছিল ছেলে হবে । হল না । জয়িতার যখন ভাই হল, তখন তাঁদের চাহিদা পূরণ হলো । কিন্তু ছেলে হবার দরুন জয়িতার আদরযত্নের খেয়াল রাখার প্রয়োজন মনে করলেন না তাঁরা । পরিবারে যে একটা স্পেস বা পরিসরের প্রয়োজন হয়, মেয়েদের বিশেষ করে, তাকে গুরুত্ব দিতে চান না ভারতীয় উপমহাদেশের বয়স্ক আত্মীয়-স্বজনরা । আমার মনে হয়, যাঁরা লেখালিখি করেন না, তাঁদের মস্তিষ্কে একটি স্ট্রিম অফ কনশাসনেস বইতে থাকে, নানা খাতে বইতে থাকে । জয়িতাকে তো কেউ প্রশ্রয় দেননি লেখালিখির, তবু তাঁর মনে হয়েছে যে মগজের ভেতরে যে চেতনার ধারা বহমান তাকে প্রকাশ করা প্রয়োজন । কবিতার নীল বিষ গলায় ধরে রাখা আরম্ভ করলেন ।

    তিনি স্কুলে ভর্তি হলেন, কৈশোরে পৌঁছে টের পেলেন যে অযাচিত রোমিওদের মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে, এই ধরণের অভিজ্ঞতা সচরাচর কিশোরদের হয় না । মেয়েদের কৈশোর পেরোবার পর বাড়িরে বাইরে একটা ভিন্ন জগত গড়ে উঠতে থাকে, আর যেমন-যেমন কিশোরীটি যৌবনের দিকে এগোন, তাঁর সমস্যা বাড়ে । বাড়ির বয়স্ক মহিলারা, কিশোরীকে বলেন না যে তার বয়স হয়েছে, একদিন যোনি থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে, এবং তা প্রতিমাসে হবে, তাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বাঁধতে হবে । কৈশোরে প্রথম রক্তের অভিজ্ঞতা এবং পিরিয়ডজনিত শারীরিক কষ্ট তার জীবনে একটি জলবিভাজক । এখনকার কিশোরীদের, টিভির বিজ্ঞাপন ও বন্ধুদের অভিজ্ঞতার দরুন, ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার সুযোগ হয়, যা জয়িতার সময়ে ছিল না ।

    স্বাভাবিকভাবে মন ও দেহ প্রেমের ডাক জাগায়, মস্তিষ্ক ডাক দেয় কবিতার দিকে, সামাজিক বিপ্লবের দিকে । জয়িতা কবিতা লেখা আরম্ভ করেন ; তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে । তিনি 'পার্টি করা' আরম্ভ করেন । তিনি প্রেমে পড়েন । প্রেমে পড়লে যেমন হয়, জয়িতা প্রেমিককে বিশ্বাস করে বিয়ে করার পর জানতে পারেন যে স্বামী কোনো চাকরি-বাকরি করেন না, তাঁর বিদ্যায়তনিক শিক্ষা নেই, অর্থাৎ চাকরির বাজারে তিনি অচল । শশুরবাড়ি গিয়ে, অতএব, সংসার সামলাবার আর্থিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে হলো জয়িতাকে । বাড়ির বিরক্তিকর ভাড়াটে তোলার দায়ও তাঁর ওপর বর্তালো, বহু পুরোনো বাড়ি সারাবার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তালো ।

    ভাগ্যক্রমেই বলতে হবে, তিনি একটি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পান । তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠেন। তাঁরও প্রথম সন্তান একটি মেয়ে, যার দরুন মা ও মেয়েকে একই সঙ্গে খোঁটা খেতে হয় । প্রথম দিকে শিশুকে কোলে নিয়ে চাকরি করতে যেতেন । পরে তাকে বাড়িতে রেখে আসতেন ;বুকে বাড়তি দুধ হবার ফলে প্রতিদিন টয়লেটে গিয়ে দুধ গেলে ফেলে দিতে হতো, এবং শিশুটির জন্য লুকিয়ে কেঁদে নিতে হতো । এইটুকু সময়ের মধ্যে কতোকিছু হয়ে উঠলেন তিনি-- কবি, প্রেমিকা, স্ত্রী, রাঁধুনি, শিক্ষিকা, মা, বউমা, সংসারের আর্থিক মেরুদণ্ড, ভাড়াটেদের নিয়ন্ত্রক !

    মনের ভেতরের প্রবাহ তো থামে না, তা অভিজ্ঞতার প্রহারের সঙ্গে ঢেউয়ের আছাড় মেরে এগিয়ে নিয়ে যায় পরবর্তী সংঘাতের দিকে । জয়িতার শশুর আক্রান্ত হলেন ব্রেন টিউমারে এবং শাশুড়ি আক্রান্ত হলেন ক্যানসারে, এবং জয়িতার সেবার দায়িত্ব বাড়ল । সংসারের চাপে তাঁর লেখালিখি ছেড়ে গেল, কফিহাউসে যাওয়া, কবিদের সঙ্গে সময় কাটানো, নতুন কবিতা কেমন লেখা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করা বন্ধ হয়ে গেল । 'পার্টি করা' থেকে তিনি নিজেই বেরিয়ে এলেন যখন চোখের সামনে দেখলেন যে তথাকথিত নেতারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন, সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই করছেন না । জয়িতার ঘরের দেওয়ালে ধুলোর আড়ালে ঝুলে রইলেন চে গ্বেভারা । যাপন ও প্রেম সম্পর্কে মোহমুক্তি তাঁকে বার-বার টেনে নিয়ে গেছে লেখালিখির দিকে, যার জন্য তাঁর পক্ষে সময় বের নেয়া ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে । একজন লেখিকা ও মানবী হিসাবে নিজেকে আবিষ্কারের প্রয়াসে খুঁজে পাবার প্রয়াস করতে হয়েছে আত্মপ্রকাশের নিয়মনিষ্ঠ প্রণালী । জয়িতার এই ন্যারেটিভে তিনি অবজেকটিভ লেখিকা হিসাবে তাঁর নৈতিক লড়াইকে প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন, নিজেকে প্রশ্ন করেছেন তাঁর নির্ণয়গুলো সম্পর্কে, কেননা তাঁর অন্তরজগতের বিক্ষোভ, চাঞ্চল্য, কলরোলগুলোই পরিচালিত করেছে তাঁর ন্যারেটিভকে। যেন মনে হয় ন্যারেটিভের প্রট্যাগনিস্ট এমন স্হিতিতে রয়েছেন যা তাঁকে গণ্ডির বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না । জয়িতার এখনকার কবিতা পড়লেও একজন নারীর এই অনুপ্রাণন পাওয়া যাবে । আবার লেখালিখির জগতে প্রবেশ করে ডাঁটিয়াল ও প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষ র‌্যাম্বো-সম্পাদকদের হুমকি সামলাতে হয় জয়িতাকে, যাঁরা, জয়িতার কবিতা বা গদ্য তাঁদের পত্রিকায় প্রকাশ করার পর বলেন, "যা, পাতিরাম থেকে কিনে নে"।

    ওপরে যে বিদেশিনি লেখিকাদের প্রসঙ্গ তুলেছি, তাঁদের কয়েকজনের মতন জয়িতার জীবনেও শৈশব থেকেই লেখন-প্রক্রিয়ার দিগন্তকে বাঙালি গেরস্তবাড়ির নিয়মনীতি দিয়ে একটা ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলার সীমারেখা গড়ে দিয়েছিল, আশেপাশের লোকজনরাও সেই রেখাকে স্হায়ি করার প্রয়াস যে করেননি তা বলা যাবে না । এই বাঁধনকে জয়িতা অস্বীকার করেছেন উইল পাওয়ারের মাধ্যমে, এই উইল পাওয়ার প্রকৃতপক্ষে আরেকটি পরিসরে স্হান তৈরি করার কৌশল, নিজের উৎসভূমি থেকে বেশ দূরে, যেখানে নিজের স্বপ্ন এবং কাঙ্খিত বৃত্তিকে সাফল্য প্রদান করা যায় । এই গ্রন্হের ন্যারেটিভ সেই সাফল্যের খতিয়ান ।
  • Ajit | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:০৪541324
  • অজিত রায়
    মলয় রায়চৌধুরীর ট্রিলজি-- ডুবজলে, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ
    মলয় রায়চোধুরীকে বাঙালি পাঠক এখন অনেক ভাবে চেনে। ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ, নতুন কবিতাধারার প্রবর্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক; মায়, দু-একটি কাঁপা হাতের স্কেচও আমরা দেখেছি। এই ভার্সাটাইল কাজকর্ম নিয়ে, তিনি একজন পোস্টমডার্ন ভাবুক। জীবনের যা কিছু ---- বাঁচা, বেঁচে থাকা, ভাষা সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান অর্থনীতি রাজনীতি, ভূগোল ইতিহাস সাহিত্য ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাগত আনাগোনা। অথচ তিনি নিজেকে কোন বিশেষ অভিধায় চিহ্নিত করতে নারাজ। কেননা তিনি মনে করেন নিজেকে বা অপরকে অভিধায়িত করার যেসব শব্দাবলি চারপাশে সাজানো আছে, এখনো, সবই ব্রিটিশ মাস্টারদের ফেলে-যাওয়া বইপত্র, অভিধান আর আধুনিকতাবাদীদের বুকনি থেকে নেওয়া। অথচ মলয় বিশ্বাস করেন শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি তাতে সেরকম মডারনিস্ট স্পেশালাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সার-বীজ সব পচে-হেজে নষ্ট হয়ে গেছে। 'আধুনিকতা' ব্যাপারটাই এখন 'একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর'। বলেছেন তিনি, এতদিন, 'আধুনিকতা ভালো, নৈতিক, নান্দনিক, প্রগতিশীল, উন্নত, কাম্য, কল্যাণময় এমনতর ভাঁওতায় ভুলিয়ে রাখা হচ্ছিল বাংলা ভাষাকে।' এহেন সময়ে একজন সমাজ ও সময় সচেতন লেখক যা করতে পারেন, তা হলো, বিগ্রহ ভাঙার কাজ। মলয় রায়চোধুরীর বেশির ভাগ রচনায় হাতুড়ির সেই চিহ্ন আমরা দেখেছি। কোন ধর্মভীরুতা বা প্রলোভন তাঁকে এই ভাঙার কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, না বিদ্যায়তনিক মাস্তানদের ঘাতক-ছুরি। বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ও এঁদো চিন্তাভাবনা ও তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে দিতে চেয়ে মলয়ের লেখার জগতে প্রবেশ। আজীবন অর্জিত নিজের ভোগান্তি, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে তিনি যা-কিছু প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-উদ্ভূত, মেরে লটলট ধ্বসিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। একজন কালচেতন, সদাজাগ্রত লেখক প্রতিষ্ঠানের সামনে কী ভীষণ প্রব্লেম্যাটিক হয়ে উঠতে পারেন, তার জলজ্যান্ত মিশাল মলয় রায়চোধুরী।

    নিজেকে ‘কালচারাল বাস্টার্ড’ বলেছেন মলয়। নিজেকে বলেছেন, বাঙলার মূল সংস্কৃতিতে আউটসাইডার। তাঁর বিভিন্ন রচনা,গল্প ও উপন্যাসে আমরা তাঁর সেই জারজ উপাদানের সুসম্বদ্ধ রূপটি গড়েও নিতে পারি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাহীন, হতাশাখোর, তথাকথিত শিক্ষিত হায়ারক্লাস বুদ্ধিজীবীরা মলয়ের পশ্চিমবঙ্গ-হামলার মনসুবাটা ধরতে পারেননি। আমি নিজে তথা-অর্থে 'বহিরাগত' হওয়ার দরুন স্থূল ও সূক্ষ্ম দু-নিরীখেই অনুধাবন করেছি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর মূল স্বরূপ বিশ্লেষণে মলয় কিন্তু আগাগোড়াই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ, যার তন্নতন্ন প্রতিফলন তাঁর লেখাজোখায় দুরনিরীক্ষ্য নয়। বাঙালির ভিড় থেকে, হরির লুঠ থেকে, বাঁধাধরা বঙ্গ-কালচার থেকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালি সংস্কারের সর্বোচ্চ পীঠ বলে কথিত কলকাতা থেকে ২৬০ কিমি দূরে পড়ে আছি বলেই আমার কাছে ইঁদুরের প্রতিটি লাফ আর চাল জলবৎ ধরা পড়ে। তথাকথিত 'প্রবাস'-যাপনের সুবিধে এটাই যে, নিজের সঙ্গে অন্যের সাদৃশ্য ও পার্থক্য হবহু ধরে ফেলা যায়। দেখতে পাই দ্বৈরাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই বিশ্বচরাচর, তার প্রতিটি নড়ন ও চড়ন। মলয় রায়চোধুরী আজন্ম মূল বঙ্গ-সংস্কারের বাইরে বাস করে এই একই মাইক্রো-দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ও বাদ-বাংলার সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন যে-বঙ্গসংস্কৃতিকে নিয়ে বাঙালির এত আত্মম্ভরিতা, গুমর আর বারফট্টাই ----- সেই বিশুদ্ধ বঙ্গসংস্কৃতির হদিশ পৃথিবীতে আজ কোথাও নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে নানা জাতি ও সংস্কারের,বিশেষত মুসলিম ও ইংরেজ বেনিয়ার শাসনে, সর্বোপরি ভৌগোলিক কাটছাঁট, দেশভাগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক স্পৃহার খপ্পরে পড়ে বাঙালি নিজের সর্বস্ব আজ খুইয়ে ফেলেছে। এমনকী, বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিও আজ মিথ মাত্র। ভারতবর্ষীয় বাঙালির কোন সংস্কৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই; সময়ের চাপে সব উচ্ছন্নে গেছে। জন্ম নিয়েছে এক জগাখিচুড়ি কালচার। ছত্রখান সংস্কৃতি। বাঙালির পোশাক পাল্টেছে বহুদিন হল,বহু খোঁপা আর সিঁথি এখন বিদেশিনী হয়ে গেছে, এমনসব হেয়ারডু যা বাঙালি কস্মিনকালে ভাবেনি। পুরুষেরা তামুক দোক্তা বিড়ি গড়গড়া ছেড়ে সিগারেট বিয়ার ব্রাউনসুগারে মজেছে। যে-ফুটবলে বাঙালির নিজস্ব দাপ ছিল তা এখন আকখা ওয়ার্ল্ড খেলছে, বাঙালি লোকাল ট্রেনে আর রকে বসে খেলছে তিন-পাত্তি, টোয়েন্টি নাইন। বাঙালি টুসু ভাদু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুলে পাঞ্জাবি পপে মাজা দোলাচ্ছে। পড়াশোনা চাকরি ব্যবসা থেকে ক্ৰমে উৎখাত হতে হতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো, রকে বসে বুকনি ঝাড়া, পরস্পর পেছনে লাগা, লেংগি মারা, মিথ্যে বলা, হীনমন্যতা, চা চপ ঝালমুড়ি, লোকনিন্দা, ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসে, কথায় কথায় মাথাগরম আর খিস্তিবাজি। পাশাপাশি শনি-শেতলার পুজো, তৃণমূল-সিপিএম, আর দুগ্গাপুজোয় চাঁদা আর হুল্লোড়বাজি।

    তো, এইখান থেকে আমাদের পাঠ শুরু হয় মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দা-ফাঁস উপন্যাস "নামগন্ধে"র। মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।

    উপন্যাস শুরু হচ্ছে একটা সন্ত্রাস দিয়ে, মলয়ের এটা অমোঘ টেকনিক, ----- পাঠকের সামনে সন্ত্রাস ঘটিয়ে, তাকে তার মধ্যে হিঁচড়ে ঢুকিয়ে সন্ত্রস্ত করে, সন্ত্রাসের বিভীষিকা মেলে ধরা। বঙ্গ-কালচারের বর্তমান হাল বোঝাতে মলয় হাওড়া জেলার ভোটবাগানের লোহার কাবাড়িখানা, নদিয়া জেলার কালীগঞ্জের কাঁসা-পেতলের ভাংরি, বিভিন্ন জেলার আলুর কোল্ড-স্টোরেজ মন্তাজ করে ফুটিয়ে বঙ্গভূবন একাকার করে ফেলেছেন। 'মুসলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমাদের কালে হয়েচে পার্টিদার, আজগালকার জমিদার'। নমঃশূদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সনে, যুবক ভবেশকাকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিল কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে। পুরনো বাড়ির পাড়ায় ইউনাইটেড রিহ্যাবিলিটেশন কাউনসিলের 'আগুন-খেকো নেতা' ছিল ভবেশকাকা, যিনি বিধান রায় ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেন। তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাঁচে কংগ্রেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিলেন। দেশভাগের খেলাপে নারাবাজি করেছিলেন, 'হাতে পেলে জহোরলাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে'।। সেই ভবেশ মণ্ডল আজ মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোহতাজ হিমঘরের অংশীদার। যিশুর / লেখকের মন্তব্য : 'আজকাল গ্রামগুলোর সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাকাদের হাতে।' আর 'চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায়।'
    মলয় নিজেকে গদ্যকার সাব্যস্ত করতে আদৌ গল্প-উপন্যাসে আসেন নি। তবু, গোড়া থেকেই যেটা সচেতনভাবে করেছেন, গল্প-বানানোর প্রথাগত টেকনিক ও সিদ্ধ নিয়মগুলোকে বানচাল করে বাংলার চলে-আসা মূল সাহিত্যধারাকে একেবারে অস্বীকার করার চেষ্টা। ভাষার ক্ষেত্রেও মিথ, দুয়ো শব্দকলাপ ও পড়িয়ে-নেওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম ইস্তেমাল। এবং বিষয় পুরোপুরি অধীত, সংপৃক্ত, যেন রিচার্ডস ওয়ার্ক পড়ছি। যেমন, 'ডুবজলে', 'জলাঞ্জলি' আর 'নামগন্ধ' ---- এই ট্রিলজিতে মলয় এক-গোছের চাকরির জিগির এনেছেন, সেটা হল, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি করা, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যেন, 'অর্থনীতির স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম। অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর প্রাপক স্নাতক।' অন্যদিকে, আজন্ম শহরবাসী মলয় কীভাবে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে পরিব্যাপ্ত রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি আর কালচার জরিপ করেছেন তা 'নামগন্ধে' পড়ে থ মেরে যায় পাঠক। 'এই ভেবে যে কী করে পারেন! রীতিমত 'আলু-সমাজ-নাম'গুলোর গন্ধতালাশ। প্রান্ত গন্ধ।' কাহিনী বা নাটক সেখানে ন্যূন, আগেই বলেছি, বরং তা ঘনিয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখা দিলে মলয় তা নিরাসক্ত ও নির্মোহ মনে ভেঙে দিয়েছেন। অন্বেষণের মেধা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাতায়-পাতায়, বিশেষত উপন্যাসের শেষ দিকটা মার্ভেলাস। খোদ মলয়ের জীবন যেমন, উপন্যাসও তেমনি ----- জীবনেরই, অথচ প্রথানুগতের বাইরে। জীবনেরই ছোট ছোট খণ্ড, জীবনের সমাহার যেন, সম্পূরক। যেমন একযুগ পর ভবেশকাকার।বোন খুশিদিকে দেখে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছে যিশু। 'পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু।' ভোগদৃশ্যটা অবিস্মরণীয় ----- 'প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলায়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত। সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে। খুশিদির জৈব-প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয়। থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা।'

    আর, যেজন্য এই উপন্যাসের জিগির। মলয়ের লক্ষ্য গপ্পো বলা নয়, উপন্যাস গড়া নয় ---- ভাষা নির্মাণ। যেন, বাংলা গদ্যকে সশক্ত বনেদ পাইয়ে দিতেই তুখোড় কবিতাবাজ মলয় গদ্যের বাদাড়ে এসেছেন। গদ্য, যা বাঙালির যতিচিহ্ন। সমস্ত আবেগময়তাকে জোর ধাক্কা মেরে, থুয়ে রেখে, বাংলা গদ্যভাষাকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে মলয় মরিয়া। অন্তত নামগন্ধ বাবদ আমার স্বতোচ্ছ্বাস মারহাবা।
  • ajit | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:০৭541325
  • মলয় রায়চৌধুরী, তাঁর সাহিত্য, হাংরি আন্দোলন ও বন্ধুরা ( ১৯৯৯ ) "সাক্ষাৎকার" গ্রন্হের ভূমিকা লিখেছেন অজিত রায়

    সামান্য অভুয়িষ্ট ক্ষুধিত প্রজন্মের কবি ও কবিতা নিয়ে একটা আচাভুয়া লেখা লিখেছিলুম বছর পনেরো আগে, এক মফসসলি কাগজে । সেই শুরু । সেদিনের সেই সব্রীঢ় আত্মপ্রতর্ক থেকে প্ররোচিত হই হাংরি সিসৃক্ষার কলিন অধ্যয়নে । আর পরপর পরিচিত হতে থাকি মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, ফালগুনী রায়, সুবো আচার্য, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় প্রমুখ হাংরি আন্দোলনের প্রতিভূ এবং তাঁদের সজ্ঞাননা-সম্ভূতির সঙ্গে ।

    এঁদের মধ্যে, আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা আর বাংলা আভাঁগার্দ সাহিত্যের প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে আলাদা কথা আছে । আলাদা, কেননা, আমার মনে হয়েছে, মলয়ই প্রথম, যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত এঁদো চিন্তাভাবনা আর তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে চেয়ে লেখালিখির জগতে এসেছিলেন । মলয় এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বঙ্গসংস্কৃতির কোনো শিসই গজাবার নয় । জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় সেখানে । বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে অতিবাহিত শৈশব । টায়ার ছোটোবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যুষিত দরিয়াপুর মোহল্লায় । সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বলা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা । সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী কসরতের সাক্ষী, স্পেংলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টি-দোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালিখির মঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই আছে ।

    বাংলা সাহিত্যের, বিশেষত কবিতায় চলে আসা ন্যাকাচিত্ত পিলপিলে গীতিধর্মিতার প্রতি প্রচণ্ড বিরক্তি, ক্ষোভ আর প্রত্যাখ্যানসহ নতুন একটা কিছু করার ছটফটানি তিনি যখন সবে টের পাচ্ছেন, তখন তিনি পাটনা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির পড়ুয়া এবং মার্কসবাদ ও কবিতায় গভীরভাবে আক্রান্ত । তিরিশের পর চল্লিশ দশক থেকেতাঁর কাছে সমস্ত বাংলা কবিতাই যেন জোলো ঠেকছে । পঞ্চাশও নিজের ল্যাসল্যসানি সমেত কুণ্ডলী মেরে বসতে চাইছে । মলয় দেখলেন কবিতাকে আর এভাবে চলতে দেয়া ঠিক হবে না । বদল চাই । ফেরাফিরি চাই, তরমিম চাই । স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে আন্দোলন চাই । মলয়ের মাথায় গড়ে উঠল আন্দোলনের জিগির । আচমকা একদিন ইংরেজি পদ্যের বাবা জিওফ্রে চসারের এক টুকরো "ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম"এর মধ্যে খুঁজে পেলেন 'সমকালের অবধারিত সংজ্ঞা' । অসওয়াল্ড স্পেংলারের প্রাগুক্ত তত্বে আরোপ করলেন চসার কথিত সেই হাংরি ভাবনার দ্যোতনা । নিজের প্রজন্মের নাম দিলেন 'হাংরি' ।

    প্রাথমিক পর্যায়ে মলয় পেয়েছিলেন দু'জনকে । হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে । পঞ্চাশের কবি হিসাবে শক্তি তখনই প্রতিষ্ঠিত । মলয়ের চিন্তাভাবনায় উৎসাহিত হয়ে শক্তি পাটনা থেকে ফিরে 'ছোটোগল্প' পত্রিকায় লিখলেন "ক্ষুৎকাতর আক্রমণ", আর বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমালোচনা করতে গিয়ে সম্প্রতি কাগজে লিখলেন "হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব"। এ-দুটিই ছিল মলয়ের পরিকল্পনার প্রাথমিক ভাষ্য । পরে কেউ-কেউ, এবং শক্তি নিজে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা হিসাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামটি চালাতে চেয়েছিলেন । সে ভিন্ন কথা । ১৯৬১ সালের নভেম্বর নাগাদ 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের কাগজের ইস্তাহারটি প্রকাশ পায়, তাতে বার্জাস টাইপে ছাপা হয়েছিল 'স্রষ্টা : মলয় রায়চৌধুরী, নেতা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক : দেবী রায়' । আত্মার অশ্রুত ছটফটানিসহ যে মূলবার্তা মলয় এই ইস্তাহার মারফত প্রচার করতে চেয়েছিলেন, তা হল : "কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয়, অতিপ্রজ অন্ধ বল্মীক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রাগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবী বিরোধিতার নয়, তা মানসিক, দৈহিক এবং শারীরিক । এ-ক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা । কারণ কবিতা ব্যতীত কি আছে আর জীবনে !...কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মোহমুক্তির প্রতি ভয়ঙ্কর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খাঁচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । ...ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পূর্ণরূপে আরণ্যকতার বর্বরতার মধ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এখন শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেকসে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে 'সচেতনভাবে বিহ্বল' হলেই, এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব ।...শখ করে, ভেবে ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনি পারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে।"

    বাংলা কবিতাকে চরিত্রহীনা হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাবার এ ছিল এক অভিনব আয়োজন ।এই আনকা নওল মতধারা থেকেই হাংরি আন্দোলনের পথচলা শুরু। যা পরবর্তী দিনে খাড়া করে বাংলার শক্তমুঠো প্রতিভাবান শর্করীবাজদের এক দীর্ঘ রিসালা । মলয়ের একক ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে গোষ্ঠীচেতনায় । ভবিষ্যত কর্মসূচি ঠিক করে নেবার জন্য দরকার হয় নির্নায়ন নিয়মাবলীর । সেই তাগিদে মলয় তৈরি করেন একটি চোদ্দদফা ইশতাহার, যা থেকে ফুটে ওঠে আন্দোলনের নিখাঁজ রূপরেখা এবং উদ্দেশ্য, কী আর কীভাবে লিখব-র উত্তর । পূর্ণাবস্হায় ইগোর ক্ষমাবর্জিত প্রকাশ, খাস লহমায় বিস্ফরিত আত্মার ইঙ্গিত পুরোপুরি শব্দবন্ধে ও প্রকাশভঙ্গীতে । ঐতিহ্য ও গতানুগতের প্রতিবাদ । এবং তার ভাস্বরতা প্রাত্যহিক জবানে । বাঁধাধরা মূল্যবোধের খেলাপে জেহাদ । ধর্ম অহিফেন, রাজনীতি বন্ধ্যা । মূলধন শুধু কবিতা । সেই কবিতাই হাংরিদের হাতিয়ার হল । সশস্ত্র হাংরিরা ছড়িয়ে পড়লেন চারিদিকে । রাস্তায় ঘাটে দোকানে বাজারে অফিসে দেওয়ালে পোস্টারে ...সর্বত্র হাংরি হাংরি হাংরি । প্রথম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ।

    হাংরি কোনও 'ইজম' ছিল না । ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া । তবে স্ফীত অর্থে আন্দোলন কথাটা অনেকের পছন্দ । বলতে পারি একটা ঘটনা, বাংলা সাহিত্যে সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি । বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল একটা ঢেউ, উঠে, আছড়ে পড়েছিল ইজি গোইং সাহিত্যের প্যালপিলে ল্যাসলিসে মসৃণ চত্বরে । সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলাসাহিত্যের লিরিকফুলের সাজানো বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনও অব্দি একমাত্র বৈপ্লবিক সমীহা । পাশল অর্থে একে "আন্দোলন" বলা হচ্ছে, সেহেতু তা শুরু হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, গোষ্ঠী আর প্রস্তুতি নিয়ে । যার লিখিত ম্যানিফেস্টো ছিল। এবং যার অনেক ইশ্যু, সেই ডামাডোল প্রধান ষাট দশকে বাঙালি কবি-গদ্যকারদের এমনকি পঞ্চাশ দশকের কবিদের একাংশকেও তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছিল -- যার দরুণ সুদীর্ঘ কাতার । প্রবল ঘুর্ণাবর্ত্ম ।

    এটা ঠিক যে ঐ সময়ে মলয় ও তাঁর সহযাত্রীদের কজন মিলে এমন কয়েকটি কাণ্ড করেছিলেন, যার সঙ্গে আন্দোলনের ঘোষিত উদ্দেশ্যের কোনও রকম সরোকার ছিল না, এবং যার দরুণ গঙ্গাজলি সাহিত্যের কোল-আলো-করা কবি-লেখকরা আন্দোলনের ওপরই দারুণ খচে যান । কিন্তু বলা বেশি, বাড়িতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ভুয়ো খবর দিয়ে জনৈক বাজারি লেখকের অফিসে ফোন, বিভিন্ন পশুপাখি ভাঁড় আর শ্বাপদ-শয়তানের মুখোশ কিনে প্রাতিষ্ঠানিক নোকরদের নামে পাঠানো, পাবলিক ল্যাভাটরিগুলোর দেওয়ালে উদ্ভট পোস্টার সাঁটা বা বাঙালি কবিদের বংশপঞ্জি প্রচার -- এসবে নয়, প্রতিষ্ঠানের লোকেরা ভয় পেয়েছিলেন হাংরিদের যা ছিল আসল হাতিয়ার : অনুশাসন থেকে মুক্ত ছোটোলোকি শব্দের ব্যবহার আর নিচুতলার মনোভাবের ছোঁচালো সীবনীটিকে। আর সেটাই ছিল আন্দোলনের পজিটিভ দিক ।

    আসলে হাংরিরা যে ভাষায় ও চেতনায় গদ্য-পদ্য নিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল আমাদের এতোদিনকার বুর্জোয়া সংস্কারের বাইরে । আন্দোলনের মেজর কবি-লেখকরা প্রায় প্রত্যেকেই এসেছিলেন বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, সেই স্তরের যাবতীয় শিক্ষা-সংস্কার নিয়ে । শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, সমীর, সুবো, মলয়, ত্রিদিব, দেবী, ফালগুনী, অবনী, অরনি, রবিউল, বাসব,বাসুদেব, সুবিমল, সুভাষ, প্রদীপ, শৈলেশ্বর প্রমুখের সবার সম্পর্কেই এ তথ্য লাগসই । সুতরাং তাঁদের আত্মার ঘোর আততি, স্বদন্দ্বের সিনথেসিস থেকে গদ্য ও কবিতাকে রূঢ় কর্কশ ছালে সজ্জিত করা । জীবনকে প্রায় চিনিয়ে দেয়া, স্বাধীনতার তলানিটুকু পর্যন্ত উজাড় করে স্মাৎ করা, দৈনন্দিন হাড় পুঁজ রক্ত কফ উচাটন ফন্দিহীন ভাবে গদ্য ও কবিতায় আনা দগদগে আত্মবোধ ও অহং, মগজকে সম্বল করে সৃজন -- এসবের কোনো কিছুর মধ্যেই কোনও সিউডোপনা, পাঁয়তাড়া, বারফট্টাই বা কারাসাজি ছিল না । বাংলা সাহিত্যে এই জিনিস আলবৎ নতুন । আমাদের বুর্জোয়া সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীত । আসলে বাংলা গদ্য ও কবিতাকে তার কৃত্রিমতার খোলস ছাড়িয়ে একটা পরাদর্শী আর শক্ত সবল বনেদ পাইয়ে দেবার জন্যে হাংরিদের এ ছিল এক ভয়ঙ্কর আয়োজন ।

    ভয়ঙ্কর হলেও সাহিত্যের তাতে ক্ষতি হয়নি । কেননা অতি ভদ্র আর ঝুঁকিহীন মন্তব্যে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরাও প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে, বাংলা কবিতা নিয়ে উত্তর-রবীন্দ্রকালে নিরীক্ষার ব্যাপারটা হাংরিরা প্রথম চালু করেন । আর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাহিত্যের ক্ষতি হয় না । বরং তন্বিষ্ঠ গবেষণা একদিন বলবে, এতে করে কয়েক ধাপ হঠাৎ দুম করে এগিয়ে গিয়েছিল বাংলা কবিতা । পরবর্তীকালের বাংলা কবিতায় এর সুফল দুর্লক্ষ্য নয় । বিশেষত সত্তর-আশির সময় থেকে কবিতাক্ষেত্রে একটা মৃদু প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে । কবিদের একটা গণ্য অংশ অন্তত লিরিকাল ধাঁচ ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, হাংরির তত্বভাবনা অনেকের লেখায় পরোক্ষভাবে কাজ করেছে এটা কম কথা নয় । বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ত্বকে পচন ও পয়মালের ঘা দগদগ করছে যখন, সেই মুহূর্তে একদল তেজি, রাগি আর প্রতিভাবান যুবক নিজেদেরকে উচ্ছন্নে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ভেজানো কপাটে দিতে পেরেছিলেন একটা জোর দস্তক, এটা ঊন বা অবম তথ্য নয়। যে কারণে জন্মকালেই হাংরি আন্দোলনকে ধ্বংস করার চক্রান্ত, দুষ্প্রচার, অতর্কিত হামলা, পুলিশি হুজ্জত, কোর্ট কেস, মুচলেকা লেখানো, চাকরি থেকে বরখাস্ত, ট্রান্সফার ইত্যাদি স-অব ঘটেছে একাদিক্রমে এবং পরপর ।

    এসবের দরুণ এবং আরও কিছু পরোক্ষ ও পপত্যক্ষ কারণে এই আন্দোলনের নখদন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের শরীরে পিরেনিয়্যেল আঁচড় কেটে অচিরেই ধাবাড় মেরে যায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫কেই বলা যায় হাংরি আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর আর ঘটনাবহুল অস্তিত্বকাল । কিন্তু অন্যদিকে জেব্রা, উপদ্রুত, ক্ষুধার্ত, ফুঃ, উন্মার্গ, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বী, ওয়েস্ট পেপার, স্বকাল, ব্লুজ, জিরাফ প্রভৃতি কাগজকে ঘিরে পাশাপাশি শম্ভু রক্ষিত, আলো মিত্র, দেবী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায়, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, তপন দাশ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, অশোক চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর দে, বিকাশ সরকার, মলয় মজুমদার, জীবতোষ দাশ, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অরুণেশ ঘোষ প্রমুখেরা গড়ে তুলেছিলেন হাংরি সিসৃক্ষার আরেকটি চক্র । এবং আন্দোলনের উত্তেজনা থম মেরে গেলেও, তারপরেও সেই সব সেরকশ আর গেঁতো মৌমাছি , ক্ষুধার্ত, প্রতিদ্বন্দ্বী, সকাল, ফুঃ, চিহ্ণ, জিরাফ, আর্তনাদ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি রেফ্লুয়েন্ট চাককে আঁকড়ে কিছুকাল শর্করাবাজি চালিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু আসর আর জমেনি ।

    আসলে সাহিত্যের আন্দোলন মাত্রেই হ্রস্বজীবি । হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া সমস্ত কবি-লেখকদের কথা যদি ধরি, সকলে কোনো নির্দিষ্ট সমাজ-স্তর থেকে আসেননি । তাঁদের মধ্যে নান্দনিক দৃষ্টিবৈভিন্ন্য ছিল, যা আন্দোলনের শেষাশেশি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল । এ-বাদে ব্যক্তিজীবনের উচ্ছৃঙ্খল বিষাদ, উপরতস্পৃহা, আর নিরাশাও চাগাড় দিয়ে উঠেছিল । এ-কথা অনস্বীকার্য যে তত্ববিশ্বের দিক থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন, কিন্তু তবু কবিতার জন্ম ফ্রম এ স্ট্রং পার্সোনাল নিড, র‌্যাদার দ্যান ফ্রম এনি থরো আনডারস্ট্যানডিং অফ অ্যান আইডিওলজি --- ফ্রয়েডিয় মতবাদের গুরুত্ব ও প্রভাব কম হয়ে যায় না । ছেষট্টির গোড়া থেকেই শরিকরা বয়স-অভিজ্ঞতা-চিন্তা মোতাবেক নিজের-নিজের বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক রাস্তা বেছে নিতে শুরু করেছিলেন । প্রকৃত সাংস্কৃতিক নিউক্লিয়াসের অভাবে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে । তারপর আন্দোলন সম্পর্কে ভাবি-প্রজন্মের মনে দুরোধিগম্যতা, খটমটি, ভ্রান্তব্যাখ্যার যথেষ্ট সুযোগ জিইয়ে রেখে আন্দোলনের প্রভাব ডবলমার্চ করে ফিরে গেল ভাটায় । আন্দোলন পুরোপুরি বানচাল হয়ে গেলে কেউ কেউ তিন সত্যি কেটে সাইড নিয়ে নিলেন, প্রচল ধারায় লেখনীপাত শুরু করলেন, কেউ-কেউ মার্কসবাদী রাজনীতির ঝাণ্ডাতলে গিয়ে সাময়িক স্বস্তি লাভ করলেন, কেউ-বা আশ্রয় নিলেন ধর্মের, আবার কেউ-বা লেখালিখি ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে, সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে চলে গেলেন অজ্ঞাতবাসে । চিরতরে হারিয়ে গেলেন কেউ-কেউ । কিংবা যোগ দিলেন অ্যাকাডেমি ও মিডিয়ার তাঁবুতলে ।

    পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেল তারপর । পঁয়ত্রিশ বছর । নিছক কম সময় নয় । এ নিছক ঘড়ির কাঁটার টিক-টিক সরে যাওয়ার বা ক্যালেণ্ডারের তারিখ বদল নয় । অনেক বদল ঘটে গেছে এই সময়ে । এর আগে অব্দি কোথাও না কোথাও, কোনোখানে, একটা স্হৈর্য, স্হিতিবোধ, বিশ্বাসের বলয়ে জীবনকে সংবৃত করে রেখেছিল, চতিস্পার্শস্হ মসৃণ জীবনযাত্রায় জীবনমোহরের একটা স্হির অলিকল্পিত উপলব্ধি সৃজনশীল মানুষের মনে সদা জায়মান থেকেছে । কিন্তু এখন, তরবারীর সুমসৃণ যখন ফালি-ফালি করে কেটে ফেলছে আমাদের জোড়াতালি অস্তিত্ব, হঠাৎ-হঠাৎ টের পাচ্ছি সমুখে সমূহ অস্হিরতা, এখন এই অস্হির দজ্জাল সময়ে সুস্হতার মাঝে বিধ্বংসী ভালোবাসা আর বিপন্ন মগজজাত ক্ষিপ্ত চেতনা নিয়ে 'লড়াই' জেতার উপকিঞ্চিৎ লজিকটুকুও বেমালুম হাপিস । এ-সময়ে হিটলার হয়ে দুনিয়াটাকে দাপানো সহজ যদি-বা, কিন্তু নিছক কলমী বিদ্রোহ করে কিছু গড়তে পারার সম্ভাবনা বুঝি আর নেই । যাকে নিয়ে আমার চিন্তা, যার মুখ একটু-একটু করে সোজা রাখতে চাওয়া -- তার জন্য, আমাদের অভিজ্ঞতা বাৎলে দিচ্ছে, বাস্তিল থেকে শুরু করে গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা কোনো কিছুতেই প্রাসাদশীর্ষ থেকে বদল সম্ভব নয় । এবং যা বিপ্লব, মত-সাপেক্ষে তা প্রতিবিপ্লব । যুদ্ধ কবেই হেজে গেছে, এখন খড়গের শানানো ধারে খয়েরি পোঁচড়, গিলোটিনে আলপনা বিলাসিতা । 'প্রতিবাদ' শব্দটাকে অভিধান থেকে লোপাট করে দেবার দিন আজ । আশার পাছায় ঘাঘরা বেঁধে কোঠায় ছেড়ে দেবার দিন ।

    তো ? এরকম সময়ে, এই প্রেক্ষিতে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, তার পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার একান্ত অভীপ্সায় দুর্বিনীত আসর যিনি করেছিলেন, বিশ-তিরিশ বছর বাদে লেখালিখির জগতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলেও, তাঁর কাছে প্রধান সমস্যাটা কী খাড়া হতে পারে ?এমনিতে পঞ্চাশের কবি-লেখকরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নিজেদের চরিত্র মোতাবেক লিখে আসছিলেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এতোলবেতোল জীবন শুরু হয়ে যায় আর তিনি ছদ্মনামে 'রূপচাঁদ পক্ষী' হয়ে যান, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একটা নির্দিষ্ট গদ্য রেওয়াজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীতে থিতু হন । বিদেশ থেকে ফিরে উৎপলকুমার বসুও কাব্যচর্চার নবাঞ্চল অব্যাহত রাখেন । ষাটের কবি-লেখক হিসেবে পরিচিত অশোক চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরনি বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, ফালগুনী রায়, শম্ভু রক্ষিত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখের লেখালিখি থেমে থাকেনি এবং দেখা গেছে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সিরিয়াসনেসের দরুন এঁদের কেউ-কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ফর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীতে একজন আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যজনের থেকে । অর্জন করেছেন চারিত্র্য, আর বাংলা সাহিত্যে এনেছেন ভিন্নতর আধার-আধেয় !

    মলয় রায়চৌধুরীর কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা । এবং আপাত-জটিল । বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্হান হিসেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের তলায় সেভাবে লাগেনি, যেখানে, অনেকে মানতে না চাইলেও, অনেক ধুলো । কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে । কলকাতা মলয় রায়চৌধুরীকে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল । কলকাতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের লোক নও । তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা । তোমার কলমে ছোটোলোক রক্ত । তোমার টেক্সট আলাদা । আলাদা থিসরাস । তফাত হটো তুমি । এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে । ভয়ে কোনও সম্পাদক তার কাছে আর লেখা চান না । বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে আসে ক্রমশ, এবং যারা মুচলেকা দিয়েছিল তারা সবাই স্লিপ করে যায় । লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে । এই বীভৎস যন্ত্রণা, একাকীত্ববোধ, অপমান একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে । এই যন্ত্রণা, অপমানই মলয় রায়চৌধুরীকে লেখালিখি থেকে নির্বাসন-ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে । ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন । সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন । আর নিজেকে ক্রমশ অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফ্যালেন । প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা -- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে ।

    আত্মবিবাসনের সেই বিবিক্ত দিনে, ১৯৬৮-এর ডিসেম্বরে রাজ্য-স্তরের হকি খেলোয়াড় শলিলা মুখার্জির সঙ্গে উদ্বাহর সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে । জীবনের মতো ভেলকি জানে কে আর ! সে বারে-বারে মানুষকে ষাঁড়ের গোবর করে । চটকায় । ঘুঁটে বানিয়ে শুকোতে দেয় । আবার, পেড়েও আনে । জীবন লিখেওছে এমন ফিচেল কেলিকিন, যে কবিতা বোঝে না । মন বোঝে না । আদর্শ বোঝে না । আলোপিছল প্রতিষ্ঠানের মসৃণ করিডোর দিয়ে হাঁটিয়ে সটান তুলে দেয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্তৃত্বের সুনিপুণ এলিভেটরে । অর্থাৎ 'একদা আপোষহীন' এবং পরে 'অঙশভাক' এই ঐতিহাসিক গল্পের পুনরাবৃত্তি মলয়ের জীবনে ঘটাল সেই নর্মদ । এই ট্র্যাজেডির জন্যে আমরা ইতিহাস আর সময়কে বাদ দিয়ে বরাবর ব্যক্তিকে দায়ি করি, তাকে ব্যক্তির ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্ণিত করে সৌমনস্য উপভোগ করি, সে আমাদের প্রবলেম ।

    কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অনৈতিহাসিক তত্ব । এ-খবর সত্যি যে বিবাহোত্তর প্রবাসে বিভিন্ন শহরে কিছুদিনের জন্য এলিট সংসারি হয়ে উঠেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । সৃজন, সাহিত্য, বইপড়া, বাংলা ভাষা ইত্যাদি থেকে আরও দূরে সরে থাকবার মতো সরঞ্জাম তখন মজুত । মৎসরী বন্ধুরা হয়তো এই জেনে কিঞ্চিৎ আরামও উপভোগ করছিলেন যে গার্হস্হ দায়িত্ব নির্বাহ করা ছাড়া মলয় "আর কিছুই করছেন না"। কিন্তু তাঁদের গুড়ে বালি নিক্ষেপ করে আশির দশকের গোড়ার দিকে আবার লেখালিখির জগতে তুমুল বেগে ফিরে এলেন মলয় রায়চৌধুরী ।

    প্রত্যাবর্তিত মলয় রায়চৌধুরীর মধ্যে অনেক মাল, অনেক মউজ । মানে, দারুণ একটা রায়বেঁশে, হই হল্লা, তারপর নর্তকের আর কোমর-টোমর রইলো না, মলয়ের কেসটা সেরকম নয় । তিনি যে হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, বেশ কিছু জ্যামিতিক পারফরমেন্স দেখিয়েছিলেন । বিশ বছর বাদেও দেখছি, সেই কোরিওগ্রাফিটা থেকে গেছে । দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, গুঁতো দেবার তালেই ছিলেন যেন । আর গুঁতোবার আগে যেমন মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অগ্নিবাহন, তেমনি করে হয়তো-বা আবার করে অঙ্গহার দেখাবেন বলে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন মলয় । কিংবা লেখা ছাপানো বন্ধ রেখে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি টিকে আছেন, না উবে গেছেন ।

    মলয় রায়চৌধুরী যে আবার নতুন করে লেখালিখি শুরু করেন, উনিশশো আশি-বিরাশি নাগাদ, তার পেছনে প্রাথমিক প্ররোচনা ছিল সত্তর দশকের বিশিষ্ট কবি, গদ্যকার ও 'কৌরব' পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তীর । কমল নাগাদে তাগাদা দিয়ে মলয়ের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন এক গোছা মন্ময় পদ্য । আজকের এই ফিরে আসা হই-চইহীন নিরুত্তেজ উদ্দাস্ত-যমিত শান্ত অবাস্হ নিরুদ্বেগ ঠাণ্ডামাথা মলয় রায়চৌধুরীর মধ্যে সেদিনের সেই উত্তপ্ত অস্হির আন্দোলিত প্রবহস্রোতের মাঝে অবগাহনরত মলয় রায়চৌধুরীকে খুঁজতে যাওয়া গোঁয়ার্তুমি মাত্র । তবে, বুকের মধ্যে ঢেউয়ের সেই দাপানিটা আর নেই বটে, কিন্তু পানখ সাপের ফণাটা এখনও উদ্যত ( উল্লেখ্য, মলয় রায়চৌধুরীর ডাকনাম 'ফণা' ) । সেই কর্কশ আর গতলজ্জ ভাষা, নিলাজ শব্দাক্রমণের ফলাটা এখনও তেমনি পিশুন । আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে বেড়ে-ওঠার অদম্য উৎসাহ, জেদ আর সামর্থ । যেন পুরোনো দখলতি হাসিল করতেই তাঁর ফিরে আসা ।

    তবে গড়ে-ওঠা পর্বে, খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ কালখণ্ডে লেখা কবিতার প্রথম সংকলনটি বেরিয়েছিল ১৯৬৩ সালে 'কৃত্তিবাস প্রকাশনী' থেকে, 'শয়তানের মুখ' নামে ( প্রচ্ছদ মেকসিকোর জনৈক চিত্রকর )। হাংরি আন্দোলনের বাইপ্রডাক্ট 'জেব্রা' পত্রিকা থেকে ১৯৬৫-এ বেরিয়েছিল দুটি দীর্ঘ কবিতা - "অমীমাংসিত শুভা" আর "জখম" । "জেব্রা" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল মলয়ের অ্যাবসার্ড নাটক 'ইল্লত', যাকে পরবর্তীকালে বলা হয়েছে 'পোস্টমডার্ন' -- নাটকটি 'বহুরূপী' পত্রিকার কুমার রায় এবং 'গন্ধর্ব' পত্রিকার নৃপেন সাহা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিলেন, দুর্বোধ্য হিসাবে । পরে কবিতীর্থ প্রকাশনী হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর তিনটি 'হাংরি' নাটক 'নাটকসমগ্র' নামে প্রকাশ করেছে।

    মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম দিককার সমস্ত লেখা আমার পড়া হয়নি, বিশেষ করে ১৯৬২ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত মলয়ের 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' এবং 'বিংশ শতাব্দী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত 'ইতিহাসের দর্শন'। যেটুকু পড়েছি, তাতে সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়েছি 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ। হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের আগস্ট ১৯৬৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল কবিতাটি, যা মলয়ের জীবনে, এবং তাঁর হাংরি বন্ধুদের জীবনেও, বয়ে এনেছিল প্রচণ্ড তুফান । আদালতে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ আমি খুঁজে পাই এক তরতাজা যুবকের আর্তি, অসহায়তা, যন্ত্রণা, আমর্ষ আর ক্লেদ । বাংলা কবিতার জমিতে গড়া প্রচলিত সংস্কারের গাঁথুনির ভিত নড়বড়ে করে দিয়ে জীবনচর্চার গূঢ় সত্য প্রকাশ করে বলেই কবিতাটি একই সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পর্যায়ের কবিতা চর্চা আর হাংরি আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেষ্ঠ মুখবন্ধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত । এ ছিল মলয়ের চেতন-অবচেতনের এক উজ্জ্বল প্রতিফলন ।

    স্বীকার করা ভালো, মলয়ের সেইসময়কার বেশিরভাগ কবিতা পড়লে মনে হয় তাঁর স্বঘোষিত 'অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে' যে লেখা বের হয়, তেমন-কিছু তিনি নামাতে পেরেছেন খুব কম । তাঁর বেশির ভাগ কবিতাকে মনে হয়েছে বানানো । শব্দ শরব্যতার দিকে তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক । একেকটা শব্দকে কোথায় কীভাবে কতোটা ফাঁক দিয়ে বসালে চমক খাবে পাঠক, যেন এই প্রবণতা থেকেই এক-একটি কবিতা তাঁর । এটা ঘটেছে, কেননা আদপে তিনি কবিতা গড়েন, বানান, তৈরি করেন । এবং যথেষ্ট সচেতন থেকে তাঁর নিজের কথায় 'একটা আইডিয়া কিছুদিন ধরে আমার মাথায় ঘোঁট পাকায় । কিছুটা ঘোরের মতো সেটা কাগজে নামাই । তারপর ঘষেমেজে কবিতাটা লিখি'। আসলে মলয় আগাগোড়া সুররিয়ালিজমকে বাহন করেছেন, অবচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির কথা ভেবেছেন ঠিকই, কিন্তু সচেতনভাবে । তাঁর কথা হলো -- "সচেতনভাবে বিহ্বল হয়েই কবিতা লেখা সম্ভব"। অর্থাৎ মেধা-মননের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে কবিতা । যে-জন্যে তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্হের নাম 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'চিৎকার সমগ্র', 'যা লাগবে বলবেন'।

    মলয় রায়চৌধুরী তাঁর নানা গদ্যে, সাক্ষাৎকারে, একটা কথা বেশ গুরুত্ব আর জোর দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, হাংরি আন্দোলন বা হাংরি লেখালিখি আগাগোড়া সাবভারসিভ ছিল ( তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল ), সুররিয়ালিজম বাদে তাতে অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব ছিল না । কিন্তু গোড়ার দিককার তাঁর নিজের কিছু-কিছু কবিতায় বাহ্যিক প্রভাব সম্পর্কে অনেকে সন্দিহান । কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ তাঁর 'অমীমাংসিত শুভা' ও 'জখম' পর্যায়ের নির্মাণগুলিতে দেখেছেন বিট কবিদের উচ্চকিত প্রভাব । মলয় এই আরোপের বিরুদ্ধতা করেছেন । আমি সেই বিতর্কের মধ্যে যেতে চাইছি না । শুধু বলব, প্রভাব জিনিসটা কি সত্যিই নক্কারজনক ? শুনেছি, অল আর্ট ইজ মাইমোসিস । আর কবির সৃষ্টি-প্রভায় 'প্রভাব' শব্দটি সবিশেষ অর্থবহ । সামান্য 'ইনফ্লুয়েন্স' শব্দে তা নিরূপেয় নয় । প্রভাব অর্থে 'প্রকৃষ্ট ভাব', তা পূর্বতনের হলেও ভিন্নতর কবিকল্পনায় নতুন করে 'হয়ে ওঠে' । আর হাংরি কবি-লেখকরা তো ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে কবিতা বানাননি, বানিয়েছেন কলম-কাগজ দিয়েই । প্রশ্ন হল, কবিতায় মলয় কতোখানি উতরেছিলেন ? আমি তাঁর প্রথম পর্বের যে কয়েকটা কবিতা পড়েছি, চার-পাঁচটি বাদে, এখনকার কবিতার তুলনায় জোলো ঠেকেছে। 'শয়তানের মুখ' আমার কাছে নেই । ঐ বইটার সুনাম কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না । নিজের পাঠের সঙ্গে অন্যান্যদের বিশ্লেষণ মিলিয়ে বুঝেছি, মলয়ের সেই সময়কার অনেক রচনাই রুগ্ন । কবর-চিহ্ণে মুদ্রিত । দারুন চমকে দেবার মতো কবিতা তিনি লিখেছিলেন খুব কম ।

    বরং তাঁর দ্বিতীয় পর্বের মেটামরফসিস আমাদের আকর্ষণ করে, কিছু-কিছু সংগঠন দারুন অভিভূত করে । এই পর্যায়ে আমরা পাচ্ছি মহাদিগন্ত প্রকাশিত 'কবিতা সংকলন' ( ১৯৮৬ ), 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' ( ১৯৮৭ ) , 'হাততালি' ( ১৯৯১ ), গ্রাফিত্তি প্রকাশিত 'মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা' (১৯৯৪), কবিতা পাক্ষিক থেকে প্রকাশিত 'চিৎকার সমগ্র' ( ১৯৯৫ ), কবিতীর্থ প্রকাশনীর 'ছত্রখান' ( ১৯৯৫ ), আর কৌরব প্রকাশনীর 'যা লাগবে বলবেন' ( ১৯৯৬ )। এ ছাড়া স্বরচিত কবিতার দুটি ইংরেজি অনুবাদ যথাক্রমে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর অনুবাদ 'স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস ( ১৯৬৮ ) ও রাইটার্স ওয়ার্কশপ থেকে 'সেলেকটেড পোয়েমস' ( ১৯৮৯ ) । এই পর্বে অনুবাদ করেছেন অ্যালেন গিন্সবার্গের 'হাউল' ( ১৯৯৪ ) ও 'ক্যাডিশ' ( ১৯৯৫ ), ব্লাইজি সঁদরার 'ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপপেস' ( ১৯৯৭ ), উইলিয়াম ব্লেকের 'ম্যারেজ অফ হেভেন অ্যাণ্ড হেল' ( ১৯৯৮ ), ত্রিস্তান জারার 'ডাডা কবিতাগুচ্ছ' ও 'ম্যানিফেস্টো' ( ১৯৯৬ ), জাঁ ককতো'র 'ক্রুসিফিকেশান' ( ১৯৯৬ ), পল গঁগার 'আত্মজীবনী' (১৯৯৯), 'শার্ল বদল্যার' ( ১৯৯৮), 'জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো' ( ১৯৯৯ ), 'অ্যালেন গিন্সবার্গ', সালভাদর দালির 'আমার গুপ্তকথা' । 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলি বুলেটিন আকারে প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল, কবিতা থাকতো মলয়ের এবং তার সঙ্গে ড্রইং থাকতো প্রকাশ কর্মকারের ।

    মলয় জানিয়েছেন, কবিতা তাঁর প্রাইমারি কনসার্ন । কবিতার মধ্যেই যাকিছু দেখা ও দেখানো । ছয়ের দশকের মলয়ের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন আটের-নয়ের দশকের পুনরাগত মলয় রায়চৌধুরী । এ-পর্যন্ত ( ১৯৯৯ )যা লিখেছেন, সংখ্যাগত দিক থেকে -- বয়স, অভিজ্ঞতা ও পড়াশুনার তুলনায় অনেক কম । তথাচ পূর্বাপরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা সীমারেখা এখনি গড়ে তুলতে পেরেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের সার্থক সব কবিতার পাশে তাঁর এ-যাবৎ লেখা কবিতার একটা গণ্য অংশ অন্তত সম-বা পৃথক -মর্যাদায় গৌরবের আসন দাবি করতে পারে -- এ-মন্তব্য খুব ভেবে-চিন্তে রাখা যায় । আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধান জানাচ্ছে, কী কবিতায় কী গদ্যে পুনরুথ্থিত মলয় খুব ধীরে-ধীরে একটা জায়গা বানিয়ে নিচ্ছেন । এবং, তিনি অপ্রতিরোধ্য ।

    বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হতে পারে না, মলয় রায়চৌধুরী সেখানে একটা মিশাল খাড়া করলেন । প্রচণ্ড স্প্যানিশ ভাবনার উদ্যত ছোবল দেখি তাঁর কবিতায় । তাঁর শব্দ খোঁজার কায়দা, শব্দ বানাবার টেকনিক, পংক্তিবিন্যাস, চিত্রকল্প-নির্মাণ ইত্যাদি পূর্বাপর কোনও কবির সঙ্গে খাপ খায় না। স্বচরিত্রে বিশিষ্ট তাঁর কবিতা । বিশেষত শব্দ দিয়েই কবিতা লেখেন তিনি, আর শব্দচয়নে তাঁর মুঠোর জোর এখন প্রায় সব মহলেই স্বীকৃত । এক-একটি শব্দ নিয়ে তাঁর দারুণ ভাবনা । পক্ষান্তরে ভাবনা বা ভাবনাসমূহের পারস্পরিক মারামারি ঢুসোঢুসি ছেঁড়াছিঁড়ি ধস্তাধস্তি থেকে বেরিয়ে আসে তাঁর শব্দ । তারপর সেই শব্দ তুলে এনে খুব ভেবেচিন্তে রয়েসয়ে তার সঙ্গিশব্দদের পাশে বসান তিনি । প্রচল ধারায় ভাষার জ্যামুক্ত তীব্র গতি বলতে যা বোঝায়, তা আনার কোনো প্রচেষ্টাই তাঁর থাকে না, হয়তো বা অপারগ ; কিন্তু একটা অন্য ধরণের স্পিড ( 'অ' গ্রন্হে তিনি বলেছেন যে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' হল স্পিডের কবিতা ), স্মার্টনেস থাকেই, যা আমাদের তাঁর কবিতা পড়িয়ে নিতে বাধ্য করে । আসলে, ঐ যে বললুম, তাঁর নতুন ও আনকা শব্দ, শব্দসংগঠন, পংক্তিনির্মাণ তথা চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলার কুশলতা তাজ্জব করে দেবার মতো । 'নতুন' ও 'পৃথক' বলছি তা এই কারণেও যে তিনি এ-যাবৎকাল লিখে আসছেন প্রবল অন্তর্চেতনার কবিতা, প্রচলন ধাঁচ ও লিরিকাল ব্যঞ্জনা বর্জন করে, এবং সচেতনভাবে । তাঁর সব কারবার সচেতনতা ও মেধা নিয়ে । কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনাচিন্তার কথা বহু দিন ধরে লিখে আসছেন মলয় রায়চৌধুরী । সেগুলো ততোটা নয়, কবিতাই তাকে করে তুলেছে বিশিষ্ট । আসলে কবিতা যা, সে নিজেই স্বক্ষেত্রে এক অপ্রতিবিধেয় শক্তি । কথাটা ভাবালুতায় আবিষ্ট ঠেকলে অন্য ভাবে বলা যায়, অহরহ একজাই অনিবার উথ্থান ও পতন, গহণ ও বর্জনের মধ্যে দিয়ে শশ্বৎ সে আরও শাক্তিশালিনী হয়ে ওঠে । পিতৃত্বের জন্য বীর্যবন্ত করে তোলে কবিকে । কবির রুচি, ইনার-কালচার, শিক্ষা, মেধা, আকাঙ্খা ও স্বপ্নের শন্নিপাত ঘটলে কবিতাই কবিকে করে তোলে প্রাতিস্বিক, নিজস্বতাময়, অনন্য । মলয়ের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, সেটা তাইই । মলয়ের প্রধান হাতিয়ার শব্দ, আর বুদ্ধি ও মেধার সহযোগে তার ব্যবহারের কুশলতাই তাঁর কবিতাকে উতরে দেয় । তথাকথিত লিরিকাল কবিদের প্যানপ্যানানির সঙ্গে তাঁর লড়াই এইখান থেকে, কিংবা জেহাদ বলুন । আজকের ঐ বয়স্ক কবিরা যাঁরা এখনও চিনিতে চিনিই ঢেলে যাচ্ছেন এবং ঢেলে যাবেন, মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁদের ফারাকটা এইখানে যে, মলয়ের এতবার ম্রক্ষণ-যুতিতে নেই, চিনির সঙ্গে একটু কৃষ্ণসীস বা সীসাঞ্জন মেশানোর দিকেই তাঁর অবসক্তি । এ-ভাবে, প্রথা ভেঙেই, আজ তিনি ক্রমশ-প্রতিষ্ঠান ।

    আরেকটি কথা মলয়ের কবিতা সম্পর্কে বলার আছে । সেটি হলো, তাঁর কবিতার বিষয়, বা ইমেজ বলুন আপাতত । জেনে বা না-জেনে, চেতোমান মলয় বলেছেন, কবিতায় তিনি ছুরি-চাকু চালানো রপ্ত করেছেন চার দশক ধরে। তাঁর কবিতার সেলাখানায় আছে বিবিধ তবক কারবাইন, মাস্কেট, তোপ, কর্নি, মর্টার, মলোটভ ককটেল, করপাল, বৃক্ষাদন, কুকরি, পর্শ্বধ, বাইস, ধারাবিষ আর চিয়ার-বরশার চিত্রকল্প । আর এইসব চিত্রকল্পের ধারাবাহিক অনুশীলনে তাঁকে সাহায্য করে তাঁর আশৈশব-আহরিত ইমলিতলা পাড়ার প্রায় হাজার খানেক অসৎ কুচেল অভাগা দুর্বাহৃত শব্দাবলী আর বাক্যবিন্যাস । বর্তমানের প্রতিফলনের দরুন সন্ত্রাসের ইমেজ, যা নিছক জান্তব বা যৌন নয়, এ একা মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাতেই মেলে । যার ফলে কবির নাম না পড়েও তাঁর কবিতার স্ট্রাকচার আলাদা ও সহজ ভাবে শনাক্ত করা যায় ।

    মলয় বলেছেন কবিতাই তাঁর প্রাইমারি কনসার্ন । কিন্তু নিছক কবিতা বানাতে তাঁর জন্ম নয় । বরং বাংলা গদ্যকে তাঁর অনেক কিছু দেবার আছে, দিয়েছেন, দিচ্ছেন । এই যে বিশ বছর বিরাম, তাঁর নির্জনবাস, এর ফলে তাঁর নিজের পক্ষে যেমন, বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেল । মলয়ের গদ্যে যাঁরা সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন, অন্তত তাঁদের কাছে এটা অতিশয়োক্তি বলে মনে হবে না ।

    বাংলা গদ্য নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিজস্ব ভাবনা আছে । বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা গদ্যের তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি । বরং বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূচনাকালে আমাদের জন্য যে গদ্যভাষা ধার্য করা হয়েছিল, এতো বছর ধরে ঐ গদ্যকেই মডেল হিসাবে সামনে রেখে আমরা রেওয়াজ করে আসছি । গদ্য, যা বাঙালির অভিন্ন জাতি-চিহ্ণ, তাকে উন্নত করার জন্য নিরীক্ষার কোনও আয়োজনই ব্যাপকভাবে সেরে রাখিনি আমরা । সাধু থেকে চলিত ভাষায় আসতেই আমাদের অনেকটা সময় গেছে । এখনও আমরা তৎসম শব্দের মোট বইছি আর তথাকথিত ইতরশ্রেণির শব্দগুলোকে নিজেদের অভিধানে ঢুকতে না দিয়ে বাংলা সবেধন দেড় লক্ষ নলাপচা শব্দ নিয়েই শব্দঘোঁট পাকিয়ে চলেছি । মলয় দেখেছেন, বাংলা ভাষায় শব্দ ব্যবহার, বাক্যগঠন, ক্রিয়াপদের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দারুন অবকাশ আছে । তার কিছু একটা করে দেখিয়েছেন কমলকুমার মজুমদার, কমল চক্রবর্তী, নবারুণ ভট্টাচার্য, সুবিমল বসাক এবং আরও দু'একজন নবীন লেখক। কিন্তু ব্যাপক স্তরে সেথা হচ্ছে না । নিচুতলার ভাষা ও শব্দাবলীকে মূলধারার সাহিত্যে অভিষেক ঘটাতে হবে । শুধু ভাষা ও শব্দকাঠামোকেই নয়, নিচুতলার সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ঢঙ, আচার-আচরণ, খাওয়া-পরা, আনন্দ-দুঃখ সবই তুলে আনতে হবে । সাহিত্যের স্বার্থেই সেই ব্রাত্য করে রাখা শব্দ, ভাষা, সংস্কৃতিকে সাহিত্যে স্হান দিতে হবে, এবং তা সরাসরি । তাতে ফাঁকি রাখা চলবে না ।

    বাংলা গদ্যে শৈলী, শব্দ ও ভাষার ব্যাপারে মলয়ের আকাঙ্খিত এই ভাবনার রূপকার মলয় স্বয়ং নন । তবে তিনি মনে করেন, আধুনিক বিশ্বের জন্যে একটা যুৎসই গদ্য আমাদের পেতে হবে । হয়তো তার জন্য প্রস্তুতিও সারা । দলবেঁধে মঞ্চে নামা হবে, না, যে-যার নিজের মতন করে ডেভলপ করতে করতে সেটা আনবেন তার ঠিক নেই । বুর্জোয়া শব্দভাঁড়ারকে সাবাড় করে একেবারে অব্যবহৃত নতুন শব্দের সাঁজোয়া নিয়ে তাঁর পক্ষে সম্ভব যিনি ঐ বুর্জোয়া শব্দপালকদের সমান বা তার চেয়ে বেশি প্রতিভাবান অথচ নিম্নবর্ণের বা নিম্নবর্গের ও বিত্তহীন শ্রেণির । জানোয়ারকে খতম করতে জানোয়ার হতে হয়। একমাত্র সেই নিচুতলার গাড়োয়ানই পারবেন শব্দের চাপকানি দিয়ে বুর্জোয়া গদ্যের পিলপিলে ছালটাকে উখড়ে বাংলা গদ্যে নতুন দ্যুতি ফিরিয়ে আনতে।

    ১৯৬২ সালে 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' নামে মলয়ের যে প্রবন্ধ-পুস্তিকাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেছিলেন, বা ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত 'আমার জেনারেশনের কাব্যদর্শন বা মৃত্যুমেধী শাস্ত্র' নামে জেব্রা প্রকাশনীর বইটিও, পড়ার সুযোগ আমার হয়নি । তবে ওদুটিতে গদ্যের কি কাজ ছিল তা অনুমান করতে পারি । কেননা সেই একই সময়কালে হাংরি দর্শন সংক্রান্ত মশক খানেক ইস্তাহারেই তিনি আধুনিক মনস্ক পাঠক-লেখকদের একটা অংশকে সেদিন আতপ্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, এ-সংবাদ আমরা শুনেছি । পরে সেই ম্যানিফেস্টোগুলোকে 'ইস্তাহার সংকলন' নাম দিয়ে মহাদিগন্ত প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায়, ১৯৮৫ সনে, যা আমি পড়েছি ।

    পুনরুথ্থিত মলয় প্রধানত দু'ধরণের গদ্য চর্চা করে যাচ্ছেন । একটা খুবই সাদামাটা, ঝরঝরে, গতিশীল, আর মেদ বর্জিত । আন্দোলনের সময়ে লেখা বিভিন্ন ইস্তাহার, প্রবন্ধ, পরবর্তী বা আটের দশকের শেষ থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা হাংরি বিষয়ক আলোচনা, স্মৃতিচারণ, সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ, ঢাকার মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় প্রথমে ধারাবাহিক প্রকাশিত এবং পরে ১৯৯৪ সালে হাওয়া উনপঞ্চাশ থেকে প্রকাশিত 'হাংরি কিংবদন্তি' গ্রন্হ, হাওয়া৪৯ থেকে প্রকাশিত 'পোস্টমডার্নিজম' ( ১৯৯৫ ), এবং প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'পরাবাস্তববাদ' ( ১৯৯৭ ), কবিতা পাক্ষিক থেকে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত 'আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা', গ্রন্হগুলিতে বাহন হয়েছে এই আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গদ্য । অন্যদিকে আর একটি গদ্য আছে মলয় রায়চৌধুরীর, যা এখনও নিরীক্ষার পর্যায়ে, যাতে অনিবার নতুন আর আপাত-জটিল শব্দের তোড়, তাকে আশ্রয় করি মলয় তাঁর এখনকার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলি লিখছেন । দারুণ মডার্ন প্রোজ । দারুন-দারুন সব অ্যাঙ্গেল, যে-মুহূর্তে ক্লিক করেন, মলয় আমাদের কাছে এ-সময়ের একজন মেজর গদ্যকার হিসেবে ফুটে ওঠেন । কিন্তু ঐ, শর্ট ডিস্টান্স রানার । বেশিক্ষণ দৌড়োতে পারেন না । হেলে পড়েন । এক একটা প্যারাগ্রাফের দারুন স্পিড, কিন্তু প্যারা ফুরিয়ে যেতেই দম ফুরিয়ে আসে । আবার নতুন করে প্যারা শুরু করতে দমও নিতে হয় নতুন করে । এ-যেন ঠিক হার্ডল রেস । এটা অনুশীলনহীনতার কুফল। দেড়-দু দশকের গ্যাপ তো কম কথা নয় । সেই জন্যেই বলছিলুম, এই বিশ বছরের গ্যাপে মলয়ের খানিকটা ক্ষতিই হয়ে গেছে ।

    কবিতার মতো গদ্যেও মলয় খুব শব্দ-সচেতন । কোনও-কোনও ক্ষেত্রে যেন অতিরিক্ত সচেতন । প্রায় প্রত্যেকটা শব্দেই অনেক বেশি করে কলেজা-রক্ত ঢেলে ফেললে যা হয়, নুনের পরিমাণ অনেক সময়ে লাগসই হয় না । দেখেশুনে ভাবা যেতে পারে, মলয়ের নিজস্ব একটা ঢালাই ঘর আছে । সেখানে শব্দের কিউপোলা। এক-একটা অভাগা অস্পৃশ্য দুর্ব্যবহৃত জংধরা মরচেলাগা লৌহমল বা কিট্ট নিয়ে পাঁচমিশালি গহনা বানান তিনি । হিট ট্রিটমেন্ট । কিন্তু মলয়ের, ঐ যে বললুম, সবচেয়ে বড়ো মুশকিল, এক-একটা এলিমেন্ট নিয়ে বডডো বেশি ভাবেন । হরেক কিসিমের রসায়ন, রূঢ় পদার্থ আর গ্যাস দিয়ে মূল ধাতুর খোল নলচে পালটে দেন । আবার সচেতন হয়ে উঠলেই টেম্পো খুইয়ে ফ্যালেন । দারুন মেদহীন গতিশীল গদ্যের তিনি প্রাকৃত-ভাণ্ডার । কিন্ত যেইমাত্র সচেতন হয়ে ওঠেন যে তিনি গল্প লিখছেন, সেইমাত্র একরাশ আগুন হলকা তাঁর হাত দিয়ে চাঁদির চন্দোত্তরি করে দেয় । ফলত স্ক্র্যাপ আয়রন আর স্টেনলেস হয় না । ক্র্যাক করে যায় । তিনি ভালোভাবেই জানেন, ধরো তক্তা মারো পেরেক গোছের লেখক তিনি নন । তবু মারা তিনি থামাতে পারেন না । যার ফলে পেরেকের পর পেরেক ভোঁতা হয়ে হয়ে বেঁকে-বেঁকে যায় । এর ফলে কী হয়, কোনও কোনও অনুচ্ছেদ খুব দারুন লাগলেও খুব কনট্রাইভ, আর গদ্য বানানোর দাগগুলো চোখে পড়ে যায় । এটাকে মলয়ের গদ্যের দুর্বলতা বলুন বা বৈশিষ্ট্য ।

    এই অবক্ষ্যমান গদ্যেই মলয়ের 'দাফন শিল্প' পড়ি ১৯৮৪ সালে, এবং পত্রিকায়, যা পরে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্রহ 'ভেন্নগল্প'-এর ( দিবারাত্রির কাব্য প্রকাশনী, ১৯৯৬ ) অন্যতম ভূমিকা হিসাবে পুনর্মুদ্রিত হয় । আবার সেই একই গদ্যে, সামান্য আলগা-ভাবে তাঁর প্রথম নভেলেট 'ঘোঘ' পড়ি ১৯৯২ সালে, এবং সেই গদ্যের উত্তরণ দেখি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এ ( ১৯৯১-১৯৯৩-তে লেখা এবং হাওয়া৪৯ প্রকাশনী কর্তৃক ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ) । একালের রক্তকরবীতে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস 'জলাঞ্জলি'ও ( ১৯৯৬ ) এই গদ্যে লেখা । 'ভেন্নগল্প' গ্রন্হে প্রকাশিত এক ডজন ছোটগল্প আর শেষোক্ত দুটি উপন্যাস পড়ে বুঝেছি, তাত্বিক মলয় রায়চৌধুরী আর লেখক মলয়ের মধ্যে একটা দারুণ প্রত্যাসত্তি রয়েছে । কিছু সর্ব-অস্তিত্বময় বর্তিষ্ণু চরিত্রকে ঘিরে লেখকের নিজস্ব চাকরিজীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা, নানা অর্ন্তদেশীয় চেতনা আর আচার-আচরণের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার এক-একটি ছবি ফুটে উঠেছে এইসব গল্প-উপন্যাসে । পাতি কলকাতার কাগজগুলোতে, বিশেষত 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর উচ্চকিত প্রশংসা পড়ে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বাঙালি পাঠকরা তাদের প্রোরড়মান ফেজ কাটিয়ে উঠেছে । আসলে আলোচক-পাঠকদের একটা গ্রুপ যে আক্রান্ত হয়েছেন, তার মূলে বাংলা সাহিত্যের অনেক অচ্ছুৎ-অব্যবহৃত শব্দ আর ছবি একটা বিল্টি কেটে পাঠানো হল এই প্রথম । সতীনাথ ভাদুড়িম প্রফুল্ল রায়, সুবিমল বসাককে মনে রেখেও বলা যায়, আবহমান বাংলা আখ্যান-সাহিত্যের ট্রাডিশানে যা আগে কখনও এভাবে খাপ খায়নি । মোটামুটি সবই এসেছে হিন্দি বলয় থেকে । খাস করে বিহারের দেশোয়ালি আর সড়কছাপ জংমরচে লাগা শব্দগুলোকে সামান্য ঝেড়ে-ঝুড়ে তোলা হয়েছে এই ফিকশানে । ঐ ষাট-সত্তর দশক থেকেই বিহারি বঙ্গকৃষ্টি দারুন-দারুন ঝাপট মেরে বাংলা সাহিত্যের ঘাটে এসে লাগতে আরম্ভ করেছে । একটা সফল ঝাপটা লাগল 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' উপন্যাসে। বিহারের আর্থ-সমাজ সংস্কৃতি-রাজনীতির এমন ভিতর-বার গুলিয়ে ফেলা ফিকশান আর কোথাওটি পাননি কলকাতার আলোচক-পাঠকরা । আর তাতেই তাঁরা দারুন অমায়িক হোসটেস হয়ে পড়েছেন 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর। কিন্তু, এটা মলয়ও জানেন, রানওয়ে মাত্র -- উড়ান দেখব পরবর্তী ফেজে । মলয়ই দিতে পারেন সেটা । ঢাকায় 'মীজানুর রহমানের ত্রেমাসিক পত্রিকা;য় ধারাবাহিক প্রকাশিত ও গ্রন্হাকারে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত 'ডুবজলে'-র তৃতীয় পর্ব 'নামগন্ধ' উপন্যাসটি এখনও আসেনি কলকাতায় । 'ডুবজলে' পাঁচটি পর্বে সমাপ্য-- 'নামগন্ধ'র পর 'ঔরস' এবং 'প্রাকার-পরিখা' ।

    মলয় রায়চৌধুরী বহুপ্রজ লেখক নন -- এমন ঘোষণা এখন নির্ণিমিত্ত মাত্র । খুব লিখছেন, বেশি লিখছেন । সূর্যের আলোটা কিঞ্চিৎ স্কিম করে আস্তে-আস্তে উঠে আসছে যেন । শব্দে শব্দাক্কার হয়ে সাজছে কবিতা, গদ্য । তাতে কী হচ্ছে, কতোটা, তা সময় বলবে । তাঁর সাফ কথা : "ন্যাটা হাতে যুঝে যাবো, জমিন ছাড়বো না"।

    একটি ঘটনা, তা সামান্য বা অসামান্য যাই হোক না কেন, অনেক সময়ে সেই ঘটনার সাথে যুক্ত কোনও ব্যক্তিকে বিখ্যাত বা কুখ্যাত করে তোলে, যাঁর সম্পর্কে বহু সুনৃত তথ্য অনাবিষ্কৃত থেকে যায় । হাংরি আন্দোলন তেমনিই এক ঘটনা যার প্রধানতম অনুষঙ্গ হিসেবে অনিবার্য ভাবে চলে আসে মলয় রায়চৌধুরীর প্রসঙ্গ, এবং যাঁকে ঘিরে রহস্য, বিভ্রান্তি, দুষ্প্রচার, অপপ্রচারের অন্ত নেই । এটা ঘটেছে, যেহেতু ১৯৬৭-এর পরবর্তী দেড়-দুই দশকে নিজের বা নিজের প্রজন্মের অন্য কারও সম্পর্কে কোথাও কিচ্ছু লেখেননি মলয় । অথচ এই কালখণ্ডে মলয় ও হাংরি আন্দোলন নামের ঘটনা দুটি পাঁচকানে বাখান হয়ে-হয়ে এমন এক প্রবহ্ণিকার স্তরে পৌঁছে যায় যেখানে ভুল বোঝাবুঝির বিস্তর সুযোগ । আসলে আন্দোলন থিতিয়ে আসার বছর কয়েক পর থেকেই অভিবাদ-অভিশংসার এই নতুন খেলাটি শুরু হয়েছিল । লেখন জগতের একটা বিশেষ সেক্টর মেতে উঠেছিল এই খেলায় । সাহিত্যের ইতিহাসে হাংরি আন্দোলনের অবদান ব্যাপারটিকে অবজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেবার জোর কোশিশ চলেছিল । যার ফলে এই সময়সীমায় হাংরি আন্দোলনকারীদের নিয়ে গালগল্প দেদার হয়েছে, কিন্তু সিরিয়াস, নিরপেক্ষ ও অ্যাকাডেমিক গবেষণা একটিও হয়নি।

    কেন হয়নি, তার জন্যে আমাদের আলোচক-গবেষকদের অসংবিদানকে দোষার্পণ করা সহজ, কিন্তু কেন এই অজ্ঞানতা তাও ভেবে দেখা দরকার। আমি এ-উত্তর দেব না যে ভারতবর্ষের বুকে সংঘটিততাবৎ সাহিত্যান্দোলনের মধ্যে একমাত্র হাংরি আন্দোলনের আকর্ষণ আলোচকদের কাছে এতো প্রবল হয়েছে, তার মূলে তথাকথিত অশ্লীল কবিতা বা ইশতাহার বিলির দায়ে ফুটপাতে থান ইঁট, লোহার রড সহযোগ হাংরিদের ওপর যুথবদ্ধ হামলা, পুলিশি হুজ্জত, কোর্ট কেস, জেল-জরিমানা এই সব অ্যাঙ্কর স্টোরির উপযোগী উপাদান । আসলে হাংরি আন্দোলন ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যধারাকে জমি পাইয়ে দেবার তাগিদে এদেশের বুকে প্রথম ও একমাত্র সামাজিক মুভমেন্ট । তার দুর্নিবার গতি সেই সময় বাংলা ও ভারতবর্ষের পাঠকদের হতচকিত করে তুলেছিল। প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কর্তারা তাকে ভয় পেয়েছিলেন, যেহেতু সাধারণ পাঠকের মনে হাংরি দর্শনের প্রতিষ্ঠা ঘটলে তাদের নিজেদের ভাবমুখে চড়ানো তাপ্পি-পুলটিশ মারা মুখোশটা উখড়ে যাবার সাধ্বস ছিল । যে-কারণে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকে ধ্বংস করার বিরাট চক্রান্ত হয়েছিল । মিডিয়া হাউসগুলো হাংরি আন্দোলনকে এমনভাবে প্রচার করেছিল, যে সাধারণ পাঠক এটাকে নিছক হাংরি আন্দোলনকারীদের বিভীষকাময় দাপটের বহিঃপ্রকাশ বলেই ধরে নিয়েছিলেন । পুলিশি কার্যকলাপ, মামলা-মুচলেকা, জেল-জরিমানা ইত্যাদিকেও ঐ খাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা হয়েছিল । পাঠকদের সামনে আন্দোলনের স্বরূপ ছিল অস্পষ্ট এবং বেশিরভাগ পাঠকই মনে করতে শুরু করেছিলেন যে এটা আসলে প্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিজীবী-বিরোধী হাঙ্গামা যার মূল লক্ষ্য অবাঞ্ছিত লেখকদের সাহিত্যক্ষেত্র থেকে বিতাড়ন আর ক্ষমতা দখল । আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে, ১৯৬৬-৬৭ সালে, হাংরি আন্দোলনকারীদের পারস্পরিক কাদাহোলি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, অন্য কবিদের সম্পর্কে ব্যাসোহ মন্তব্য এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকেই এই কার্যক্রম প্রকারান্তরে সমালোচিত ও নিন্দিত হওয়ায়, পাঠকদের সংশয় আরও বহু পরিমাণে বেড়ে যায় এবং তা তাঁদের মনের মধ্যে ঘর করে যায় । পাশাপাশি সাহিত্যের ছাত্র ও গবেষকরা, যাঁরা হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখালিখি করেছেন, তাঁরাও থেকেছেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত ।

    এমতাবস্হায় নতুন করে হাংর-বিপ্লবের তাৎপর্য বিশ্লেষণ ও হাংরি-সাহিত্যের মূল্যায়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনের কথা অস্বীকার করা যায় না । এই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের কয়েকটি উপায় আমাদের জানা আছে । তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী হলো, সমস্ত হাংরি রচনাবলী খুঁজে পেতে পড়া,, এক একটা লেখা ধরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা । এটা কিন্তু বুড়োদের দ্বারা আর সম্ভব নয় । যেহেতু তাঁরা আগেকার সব সেন্টো পড়ে ফেলেছেন এবং কনফিউজড । তাঁরা এটা করতে বসলে কনফিউজানের ঐ ফিতে দিকদারি করবে । এ-কাজ একমাত্র নতুন প্রজন্মের পাঠক গবেষকই করতে পারবেন । সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নতুন প্রজন্মের অন্বেষকরাই ভরসা ।

    হাংরি আন্দোলন ও হাংরি লেখালিখির প্রধান সুরটি অবিকৃতভাবে খুঁজে পেতে হলে আমরা আরেকটি তরিকা অবলম্বন করতে পারি, সেটা হলো সাক্ষাৎকার চর্চা । আশার কথা যে হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস অনেক দূর অতীতে মিলিয়ে যায়নি এবং অনেকেই জীবিত । যেখানে সমীক্ষার জমঘট, সর্বোপরি বৃদ্ধ পাঠক ও গবেষকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিমজ্জিত -- সেখানে আন্দোলনের এক সময়কার শরিক, বষীয়ান লেখক-কবিদের সামনে ক্যাসেট-টেপ রেকর্ডার অন করে বসলে অন্বেষকের কাজ অনেকটা আসান হয়ে যায় । তাছাড়া সাহিত্য-বিচারের আধুনিক পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সাক্ষাৎকার-চর্চার স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে । গভীর অধ্যয়ন, অকপট নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কোনও লেখকের লেখালিখি ভাবনাচিন্তা, কাজকর্ম, সমস্যা, আদর্শ, স্বপ্ন, জীবন, অপারগতা, আকাঙ্খা ইত্যাদি ব্যাপারে স্বয়ং লেখকের কাছ থেকে বিবরণ সংগ্রহের শ্রমসাধ্য কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে সেই বিচার-বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নের দাম আরও বেড়ে যায় ।

    মলয় রায়চৌধুরী আবার নতুন করে লেখালিখি শুরু করার পর তাঁর কাছ থেকে আদায় করা ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে বর্তমান গ্রন্হটি পরিকল্পিত । বাংলাভাষায় কথাবার্তার মাধ্যমে একটি সাহিত্য আন্দোলনকে বোঝবার চেষ্টা এই প্রথম । হাংরি বিষয়ে মলয় রায়চৌধুরীর কথাবার্তা স্বভাবতই একটা দলিল । কিন্তু যেভাবে এগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে দলিলের একঘেয়েমি নেই । কেননা বইটির কথা ভেবে একটা প্যাটার্ন মোতাবেক সাক্ষাৎকারগুলো নেয়া হয়নি । বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী, বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভিন্ন অভিসন্ধি থেকে এগুলো গ্রহণ করেছেন । পক্ষান্তরে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা নানা মত ও পথের অপেশাদার অন্বেষকের নিজস্ব জিজ্ঞাসায় মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি দর্শনের প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধায় ও মমত্বে গড়ে ওঠা এই সাক্ষাৎকার সংগ্রহের মধ্যে হাংরি আন্দোলন ও বাংলা আভাঁগার্দ সাহিত্যের এই বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে তাঁর যাবতীয় প্রকর্ষ ও অপকর্ষসহ এই প্রথম পৌঁছে দেয়া হলো সাহিত্য গবেষকদের ব্যবচ্ছেদ-টেবিলে ।

    লেখালিখি থেকে অজ্ঞাতবাসের পর সংসারধর্ম ব্যতিরেকে 'আর কিছু না করেও' হবতো-বা নিজেরই অজ্ঞাতে এক নতুন অজ্ঞাতপূর্ব পরিবেশ ও পটভূমিতে মলয় রচিত হচ্ছিলেন এই বিশ বছর ধরে । ফিরে আসার পর তাঁর লেখাত দীধিতি আমাদের অনুমানকে সপ্রমাণ করে । ছয়ের দশকের 'নিছক বুলেটিন-লেখক আর তিরিশটি কবিতার স্রষ্টা' আটের দশকে ফিরে এসে লেখকতায় দুর্দান্ত যৌবন ফিরে পান । কিন্তু এটা একরকম ভাবে সত্য, যে নিছক কবিতা বা গল্প লিখতেই তাঁর প্রত্যাবর্তন নয় । আবার কবি বলেই যে তাঁর মধ্যে কবি-কবি ভাব রয়েছে , তাও নয় । তাঁর কাছে কবিতা হলো 'আগুনের ভেতর থেকে ঝলসানো বাহুর সিগনালিঙ', এবং তিনি কবিতা শুরু করেন একটা পিক-আপ থেকে । বাসরঘরে কেলিকুঞ্চিকা পরিবৃত জামাইবাবু কবিটি তিনি নন । দারুণ বদখত, আদাড়ে, কট্টর, আর মুখফোড় এই মসীদানব । তিনি একাধারে কবি, গদ্যকার ও বক্তা । তাঁর লেখায় ও কথায় নিজের ব্যাপারে যেমন অনেক কনফেশন আছে, কোনও রাখঢাক বা পুশিদা কারসাজি নেই, তেমনি অন্যের অশালীন কুৎসিত ঘৃণ্য অসূয়াবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিপ্রহার হানতেও এখন আর তিনি দ্বিধাগ্রস্ত নন । একসময় মৎসরী কলকাতার কুইসলিং বন্ধুরা অপক্রোশভাবে যে মন্তব্যটি করেছিলেন, কিছু লেখার বদলে হইচই আর হাঙ্গামার দিকেই তাঁর ঝোঁক আর চটজলদি খ্যাত পাবার লক্ষ্য, এবং তাঁর সেন্টিমেন্ট ও অপমানবোধের তোয়াক্কা না করে পর-পর দেগে গিয়েছিএন কুম্ভিলকবৃত্তি, মিথ্যাভাষণ, আত্মস্তুতি, নোংরামি আর কোরকাপের আরোপ -- সেই সব কিতবের মাথা স্লাউচ করে দিতেই যেন পুনরুথ্থিত মলয়ের প্রখ্যাপন -- "অতটা খাতির নেই যে তোমরা কশাবে এই গালে থাপ্পড় আর আমু টুক করে অন্য গাল তোমাদের হাতে ছেড়ে দেব !"

    ঐ চাকু চালাবার কয়েকটা ক্যারদানি বক্ষ্যমান সাক্ষাৎকারগুলিতে মিলবে । এক-একটা তাক কতরকমভাবে করা যায়, তার নমুনাও । আসলে তিনি ফিরে এসেছেন মনের ভেতরে পুষে রাখা সেই আকাঙ্খাজ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে নিয়ে । অনেক অপ্রিয় সুনৃত কথাও তিনি অকপটে লিখে আর বলে যাচ্ছেন । এবং কোনও তাগবাগ নেই, বারফট্টাই নেই । যদিবা কোনও কোনও মন্তব্যে তাঁকে ভীষণ অহংভাবাপন্ন ঠেকে, এবং কিছু-কিছু কথা প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা থেকে বলার দরুণ এবং তদনুযায়ী শব্দ ব্যবহারে অনেককে খুশি নাও করতে পারেন । কিন্তু যাঁরা তাঁর লেখালিখির গতের সঙ্গে পরিচিত, যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁদেরকে নতুন করে বলার কিছু নেই যে তঁর কথা ও কথনভঙ্গী তাঁর নিজের মতোই নিজস্বতাময় -- রাগি ও জেদি । লেখার মধ্যে মলয় রায়চৌধুরী নিয়ত প্রচেষ্ট থাকেন যাতে প্রতিস্পর্ধী বুর্জোয়া নিউক্লয়াসকে কামান দাগা যায়। কথার মধ্যেও সেই মারমুখি প্রবণতা । কোথাও সাংবাদিক সুলভ তীর্যক, কোথাও স্লোগানধর্মী, কোথাও চিত্রল, বক্র ও বিধ্বংসী অথচ আশ্চর্যরূপে গঠনমূলক । এটা হতে পেরেছে যেহেতু আদপে তিনি ভাষাজ্ঞানী । চিন্তাবিদ লেখক ও প্রভাবশালী বক্তা । শব্দ ব্যবহারে দারুন সচেতন । খাসা ভাষা, অকপট বর্ণনা আর সরস উপমা তাঁর রাগ-ধরানো কথাবার্তাকেও সুখপাঠ্য করে তোলে । এই সাক্ষাৎকারমালায় আমরা সেই রাগি মুখফোড় খোলামেলা তত্বজ্ঞানী, শব্দজ্ঞানী, ব্রাত্য-কথককে খুঁজে পাচ্ছি ।

    মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকারমালার সম্পাদনার কাজ কিছুটা আকস্মিকভাবে হাতে পেয়েছিলুম । পূর্বপ্রস্তুতি প্রায় ছিলই না, মনে-মনে পরিকল্পনাও করিনি । তবে বিগত পনেরো বছরে হাংরি সিসৃক্ষা নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি করে আসছিলুম, তাতে এ যেন একটা কাজ করার গুরুত্বের কথা একেবারেই ভাবিনি তা নয় । আসলে আমি নিজেই একটা দীর্ঘ কথোপকথন চাইছিলুম এই আশ্চর্য বিতর্কিত ব্রাত্য ভাবধারার লেখকের সঙ্গে । মলয়ের সাম্প্রতিকতম গদ্যগুলি পড়ে একটা সবিমুগ্ধ শ্রদ্ধাই যেন তোড় ভাঙতে চাইছিল । দারুণ অন্য ধরণের কিছু, কিংবা একটা স্বল্পায়তন উপন্যাস লেখার কথাও ভেবেছি তাঁকে নিয়ে । মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে লেখা যে কি প্রচণ্ড আত্যয়িক, তার আভাস আমি পেয়েছি । তবু নিজেকে নিরাসক্ত রাখতে পারছিলুম না । সেই মতো চিঠি চালাচালিও করেছিলুম মলয়ের সঙ্গে, তাঁর পুরোনো লেখাপত্তর, মলয় সম্পর্কে অন্যদের লেখা ঢুঁঢ়ে ঢুঁঢ়ে পড়া শুরু করেছিলুম, ক্রমে ক্রমে পরিকল্পনার একটা ভিজুয়াল সার্কলও গড়ে উঠছিল যখন, ঠিক তখনই, এক অচিরস্হায়ী ডামাডোলের মাঝে, হাতে এসে যায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি । তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারকে আমি এই গ্রন্হে অন্তর্ভুক্ত করিনি, কেননা সেগুলো প্রশ্নোত্তরের আকারে প্রকাশিত হয়নি । সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পায়েল সিংহ ( ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইনডিয়া : ১৫,৫.১৯৮৮ ) ; সোমা চট্টোপাধ্যায় ( ফ্রি প্রেস জার্নাল : ১৩.১.১৯৯১ ); এবং নওল ঘিয়ারা ( মিডডে : ১৪.৪.১৯৯১ ) । এঁদের প্রশ্নাবলী হাংরি আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না ।

    যে কথা আগেই বলেছি, এই সাক্ষাৎকারগুলি গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন অন্বেষখ, তাঁদের স্বকীয় ধারণা, নিজস্ব ভাবনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে । সাক্ষাৎকারগুলিকে নির্দিষ্ট রীতি-পদ্ধতি ও উদ্দেশয় অনুযায়ী পরিচালনা করতে না-পারার দরুণ বা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না-থাকার অসুবিধার ফলে, যে এলোমেলো ব্যাপারটি প্রায় অনিবার্য ছিল তাকে ডেক্সওয়র্কের মাধ্যমে, নির্বাচন ও গ্রন্হনার কাজ স্বতন্ত্রভাবে করার কথা গোড়ার দিকে মনে হয়েছিল । কিন্তু এ নিয়ে ডেলিবারেটলি নিজের সঙ্গে তর্ক করে দেখেছি, এই অসুবিধেকেই একটা মহৎ সুবিধায় পাল্টানো যেতে পারে যাতে ব্যাপারটা আরও রুচিকর আর যুক্তিগ্রাহ্য হয় । সাক্ষাৎকারগুলো পড়ে বুঝেছি, কয়েকটি সাক্ষাৎকার লিখিতভাবে নেয়া, এবং সেক্ষেত্রে স্বয়ং মলয় জবাবগুলি লিখে দিয়েছেন । মানে, এখানেও মলয়ের সেই মেদরিক্ত গতিশীল ভাষাটাকে পাচ্ছি । আবার যাঁরা মাউথপিস বা নোথখাতা ব্যবহার করেছেন, মলয়কে সামনে বসিয়ে অনর্গল কথা বলিয়ে আর লিখে গেছেন, তাঁরাও যে শুধু মলয়ের কথাগুলিকে হুবহু লিখে গেছেন, তা নয় । বরং প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন ও সেগুলির জবাবের মাঝখানে যে অন্তর্নিহিত কথাবার্তা, সেগুলিকেই সজীব করে ফুটিয়ে তুলেছেন । ফলত যেসব বিষয় গুরুগম্ভীর ছিল, সেগুলিও লেখায় অনবদ্য হয়ে উঠেছে ।

    একদিকে মলয়ের সুস্পষ্ট চাঁচাছোলা সাবলীল কথাবার্তা, তার ওপর স্বচ্ছন্দ গতিতে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ -- তাকে লেখার আকারে ধরে রাখা অধিকতর অধিকতর বিচিত্র হয়েছে । অন্যদিকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা, যাঁরা নিজের ভাষা মিশিয়ে মলয়ের কথাগুলি লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো জড়তা বা আড়ষ্টভাব নেই বললেই চলে । সাধারণত সাক্ষাৎকার যেভাবে নেয়া হয়, অত্যন্ত মামুলি ঢঙে, তার মধ্যে উৎসাহ বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না । কিন্তু এখানে খুব গূঢ় আর কঠিন বিষয়ও স্বচ্ছন্দ ভারমুক্তভাবে বলা ও লেখা হয়েছে । যেসব কথা মলয় রায়চৌধুরী এই সাক্ষাৎকারগুলিতে বলেছেন, সেগুলি আগেও নিজের স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও প্রবন্ধসমূহে লিখেছেন । কিন্তু তবে, যাঁরা তাঁর মৌলিক রচনাগুলির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা কোনও-না-কোনও ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারগুলি পড়ে লাভবান হতে পারেন -- কেননা মলয়ের কথাবার্তা তাঁর লেখালিখির প্রতিনিধিত্বই শুধু করে না, তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বাদ দেয় । তাঁর আগেকার লেখালিখি আর এইসব সাক্ষাৎকার পাশাপাশি রাখলেও বোঝা যায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে তাঁর ভাষা ও মানস কীভাবে কতোদূর বদলেছে । দোষে-গুণে ভরা একটা মানুষকে ধরবার চেষ্টা করা হয়েছে এইসব সাক্ষাৎকারে । সর্বোপরি বক্তার বলবার মুন্সিয়ানায়, লেখকদের লিপিকুশলতার গুণে এগুলি মামুলি সাক্ষাৎকারের বিবরণমাত্র না হয়ে, এক-একটি বিচিত্র তথ্যবহুল আখ্যায়িকার রূপ নিয়েছে ।

    একথা বলা যাবে না যে সব কয়টা সাক্ষাৎকারই উত্তীর্ণ হয়েছে বা নূনতম মান বজায় রাখতে পেরেছে । অমুক সাক্ষাৎকারটি যে গভীরতা পেয়েছে, তার সঙ্গে তমুক পত্রিকাগোষ্ঠীর কথোপকথন নিশ্চয়ই সমান্তরাল নয় । আবার একই প্রশ্ন একই প্রসঙ্গ বার-বার ঘুরে ফিরে এসেছে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে, সেগুলিকে কেটে-ছেঁটে লাগসই ভাবে ছাপানো যেত । কিন্তু একটি লাইনও বাদ না দিয়ে সমস্ত সাক্ষাৎকার হুবহু আসতে দিয়েছি প্রথমত আগে অন্যত্র ছেপে গেছে বলে, আর সবচেয়ে বড়ো কথা, আমি কোনও চালুনি ব্যবহারের পক্ষপাতি নই। আমার বিশ্বাস পূর্ব-প্রকাশিত কোনও রচনার ওপর সম্পাদনার নিয়ম বেশিদূর অবধাবিত হলে, রচনা ও রচকের মর্যাদাহানি হয় । সেরকম অমার্যনীয় মাস্টারিতে আমি যাইনি । খড়কুটোকে ধানের শিষের সঙ্গে আসতে দিয়েছি । তাছাড়া বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব মলয় রায়চৌধুরী স্বয়ং লিখে দিয়েছেন বলে সেব সাক্ষাৎকারের মধ্যে ভাষাগত, শৈলীগত ও পদ্ধতিগত একরূপতাও প্রকারান্তরে এসে গেছে, এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একটি নিবদ্ধ স্তবকের মতো পরস্পর অন্বিষ্ট হয়ে উঠেছে । এদের পারস্পরিক ঘনতার সম্ভাবনা আঁচ করে কোনও যোগ বিয়োগের প্রয়োজন আমি অনুভব করিনি । পুরোপুরি যুক্তির ওপর নির্ভর করে রচনাগুলিকে পর-পর সাজিয়েছি মাত্র । সুতরাং এই গ্রন্হে যদি কিছু কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে, তার জন্যে আমার নয়, অন্বেষকদের অবদানই স্বীকার্য । ধন্যবাদার্হ লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার সন্দীপ দত্ত, যিনি রচনাগুলি সংগ্রহ করে দিয়েছেন ।

    পরিশেষে জরুরি যে-কথা, এবং সম্পাদক হিসেবে যে-কথা বলার দায় আমার ওপরই বর্তায়, তা হলো, সাক্ষাৎকারগুলি যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লোক, এবং এ-কথা অনস্বীকার্য যে বাঙালি জাতির যদি কোনও জাতীয় চরিত্র টিকে থাকে তবে ইদানিং তা বোধ করি ছোট কাগজের মাধ্যমে প্রকাশ পায় । মতান্তরে, লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে ঘিরে যে ইন্টেলিজেনশিয়া, তা-ই আজ বাঙালির যা-কিছু । সুতরাং বড়ো মিডিয়া হাউসগুলো হাংরি আন্দোলন ব্যাপারটাকে যখন খুব করে দাবানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, হাংরি আন্দোলনের শরিকরা পারস্পরিক কাদাহোলি করে ভুল বোঝাবুঝির বিস্তর সুযোগ করে দিচ্ছেন, তখন লিটল ম্যাগাজিনগুলি গোরস্হান খুঁড়ে হাংরি আন্দোলনকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবাভাবি শুরু করবে, এতে আর আশ্চর্য কী ! মলয় রায়চৌধুরীর পুনরাগমনের পর এই ভাবাভাবিটা হঠাৎ রাতারাতি বিরাট আকার নিয়ে ফেলেছে । বিশেষত আটের দশকের প্রথম পাঁচ-সাত বছরে হাংরি লেখালিখির আলোচনা-পর্যালোচনার স্রোতে লিটল ম্যাগাজিনগুলির পরিমণ্ডল কিছুটা উচ্ছ্বসিত ছিল । উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আসার পর ইদানিং হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনার মান উৎকর্ষ ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, হাংরি লেখকদের প্রতি মনোযোগ বাড়ছে । এটা শুভ লক্ষণ । এই সাক্ষাৎকারগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়েও একটা কথা আমার বার বার মনে হয়েছে, তা হলো, আধুনিক আর কম বয়সী পাঠক-গবেষকরা ব্যাপারটাকে ক্রমাগত আরও গুরুত্ব দিতে শিখছেন ।

    কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী মানে এখন আর নিছক হাংরি আন্দোলন, হাংরি বুলেটন নয়। অথচ মলয়ের সঙ্গে কথা বলতে বসেও দেখা গেছে আজকের দিনেযখন তাঁর 'কবিতা সংকলন', 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'হাততালি', 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস', 'পোস্টমডার্নিজম', 'ভেন্নগল্প' 'জলাঞ্জলি', জীবনানন্দ ও নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত, বেশির ভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মূলত দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চেয়েছেন । এক, হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল বা হাংরি আন্দোলন শুরু হলো কী ভাবে ; আর, দুই, সাহিত্যের ইতিহাসে হাংরি আন্দোলনের স্হান কোথায় বা কতো উর্ধে । প্রশ্নদুটি এতোবার এতোভাবে তাঁকে করা হয়েছে, আর এতো ভেঙে-ভেঙে জবাব দিয়েছেন মলয় আগেও বহুবার, যে এখন আর এসব প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না । প্রশ্নকর্তারা তো কেউ মলয় বা হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আগে থেকে কিছু না-জেনে বা না-পড়ে আসেননি । ধরে নেয়া যেতেই পারে যে আন্দোলনের বিদ্রোহাত্মক চেহারা, বড়ো প্রাতিষ্ঠানিক আঁতেলদের ভয় পেয়ে যাওয়া, পুলিশী পীড়ন, মারপিট, কোর্ট-কেস, জেল-জরিমানা এসব কোনও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে প্রাথমিক পর্বে উদ্দীপিত করেছে, এবং তাঁরা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, বা প্রশ্নাবলী পাঠিয়েছেন প্রায়-হঠাৎ ভাবনা, উদ্দীপনা আর প্রশ্রয়েই । নির্দিষ্ট কোনো বিশ্লেষণ জানার আগ্রহে নয় । যার ফলে অনেকের প্রশ্ন আর মলয়ের জবাব একঘেয়েমি এনেছে । অথচ উদ্যোগ যদি আরও একটু ভাবনাচিন্তা করে নেয়া হতো, তবে তাঁরাই হয়তো ক্রমশ গড়ে তুলতে পারতেন যুগপৎ হাংরি সাহিত্য আর মলয়-সাহিত্যের আলোচনার এক নতুন সম্ভাবনা ও সার্থকতা ।

    এ-কথা ঠিক যে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবমূর্তির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে হাংরি আন্দোলনের ইমেজ । বেশিরভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মলয়কে ঘিরে প্রশ্নের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, পক্ষান্তরে তাঁর হাংরি ইমেজটাকেই গ্লোরিফাই করার জন্য যেন । মানুষ মলয়কে, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে বেড়ে ওঠা নানান অভিজ্ঞতার আকর মলয়কে, নিজেকে সাংস্কতিক দোআঁশলা বলে পরিচিহ্ণিত করতে চাইছেন যিনি সেই মলয়কে, কবি ও গদ্যকার মলয়কে, ভাষাজ্ঞানী মলয়কে, তাত্বিক মলয়কে তাঁরা যেন খুঁজে পেতেই চাননি । আবার হাংরি প্রসঙ্গেও কিছু-কিছু প্রশ্ন এমনভাবে করা হয়েছে, তার জবাব অদীক্ষিত ও নতুন পাঠকের সামনে চিন্তাশীল কবি, বলিষ্ঠ গদ্যকার, বিরল তত্বজ্ঞানী মলয়ের আসল মানসিক গঠনটাই ধেবড়ে দিতে পারে । আবার মলয় যে ভালো বিশ্লেষক, দারুণ সমালোচক, তাঁর কাছ থেকে অন্যান্য হাংরি লেখকদের ভাষা, রচনাশৈলী, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সম্পর্কে বিশেষ কোনও আলোচনাই চাওয়া হয়নি । আবার মলয় সম্পর্কেই যে সবকথা জানা হয়েছে, তাও নয় । ভুলে গেলে চলবে না যে মলয় বার-বার এ-কথা বলে চলেছেন যে তিনি এখন শুধু মলয় রায়চৌধুরী হিসেবেই পরিচিত হতে চান, 'হাংরি' বা 'একদা হাংরি' হিসেবে নয় । তাঁর কবিতার বই আর গল্প-উপন্যাসের বইগুলি প্রকাশ হয়ে যাবার পরে যাঁরা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তাঁদের অন্তত মলয়ের কবিতার প্রাতিস্বিক ধারা, গদ্যের ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ ছিল । এ-ছাড়া পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে বিরাট আলোচনা আদায় করা যেত। তিনি যে জায়গায় জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন, চাকরি করছেন, সারা ভারত ঘুরে-ঘুরে বেড়িয়েছেন, যার ফলে কলকাতার পাতি লেখকদের সঙ্গে তাঁর যে বৈশিষ্ট্যগত তফাৎ গোড়া থেকেই ঘটেছে, সেসব নিয়েও দারুণ আলোচনার স্কোপ ছিল ।

    আরেকটি দিক থেকে মলয় রায়চৌধুরীর ওপর আলোকপাত করা দরকার । সেটা হলো তাঁর মনস্তত্বের উৎসসন্ধানের দিক । যেহেতু লেখকের মানসিকতা এক নিত্যসচল ও পরিবর্তমান জিনিস, এবং অক্ষর তাঁর বাহন, তাই কোনও একটি মানসিক অবস্হান থেকে কোনও কিছু লেখাকে লেখকের সব বলা যায় না । সাহিত্যসৃজনের ভেতর স্রষ্টার রচনার শক্তি, জ্ঞান, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির রূপ, কল্পনা ও চিন্তাশক্তি, বিচারবোধ ও অনুভূতি বিশেষ ভূমিকা নেয় । এসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয় জীবনের প্রতি কোনও এক ধরণের দৃষ্টি আরোপ করার ক্ষমতাও। আবার এ-কথাও ঠিক যে লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতি, আবেগদ্বন্দ্ব, কনফিউজন, মানসিক আকাঙ্খা প্রভৃতি সব সৃষ্টিমূলক অবদানের মূলেই কোনও না কোনও ভাবে কার্যকরী । আসলে, নিছক বস্তুনির্ভর পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টিমূলক রচনা বোধহয় সম্ভব নয় । এই সাক্ষাৎকারসমূহে মলয় রায়চৌধুরীর বুদ্ধি, পড়াশোনা, বিচারশক্তি ও দ্বন্দ্বের ক্রিয়াশীলতার রূপ ততোটা ফুটে ওঠেনি। অধচ এইসব ফুটে উঠলে সাক্ষাৎকারগুলি তখন নিছক তথ্য ও উপাদান সংগ্রহের পদ্ধতি হিসাবে গণ্য হতো না । অনেক কিছুই তখন তত্বের পর্যায়ে চলে আসতো । অনেক জরুরি প্রশ্নই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা করতে পারেননি । মলয় রায়চৌধুরীকে ঘিরে প্রশ্নের পাহাড় রচনা করার অবকাশ তাই থেকে গেল। ১ বৈশাখ ১৪০৬
  • m | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:১০541326
  • মলয় রায়চৌধুরী
    ভোররাতে শেক্সপিয়ার

    ‘পাড়া’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? মহানগরগুলোয় ‘পাড়া’ জিনিশটা ক্রমশ লোপাট হয়ে চলেছে। বা, বলা যায়, মহানগরের অনুন্নত এলাকাগুলোয় টিকে থাকছে আধখ্যাঁচড়া ‘পাড়া’। কলকাতার কেন্দ্র থেকে পাড়া চলে গেছে শহরের পরিধিতে; কসমোপলিসের পরিধি মানেই তো প্রান্তিক। ভুল বললুম, কলকাতায় দলতন্ত্রের দাপটে, তা সে যে দলই রাজত্ব করুক, ‘পাড়া’র অস্তিত্ব অবলুপ্ত। আগের দল পাড়ার নতুন নামকরণ করেছিল মহল্ল¬া’, কেন তা জানি না। কিন্তু সেই মহল্ল¬ায় অংশভাগ ছিলেন কেবল দলের হবুগবুরা। শহরতলি বা গ্রামেও, পশ্চিমবঙ্গে ‘পাড়া’ সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণার আওতায় চলে গেছে। হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় বসতবাড়িতে যখন থাকতুম, ছোটোবেলায়, পাড়া ছিল জীবন্ত জীবনপ্রক্রিয়া। তারপর তো নাকতলায় যে রাস্তায় থাকতুম তার নাম ‘লেটারবক্সপাড়া’ হলেও, দুই দলের জগঝ¤পতে অঞ্চলটি থেকে পাড়া উবে গিয়ে যে সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। কিংবা, হয়তো, পর¯পরের পরিচিত কয়েকজন মানুষ-মানুষী মহানগরের এক জায়গায় উদ্দেশ্যহীন জড়ো হলে একটা তাৎক্ষণিক পাড়া গড়ে ওঠে ।

    আমি এখন মুম্বাইয়ের শহরতলিতে থাকি। এই অঞ্চলে যাঁরা থাকেন তাঁদের পর¯পরের সঙ্গে পরিচয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যখন পাটনার ইমলিতলা পাড়ায় থাকতুম তখন ওই পাড়ার সবাই সবাইকে চিনতুম; আমরা ছোটোবেলায় চোর-পুলিশ খেলার সময়ে যে কোনো বাড়ির যে কোনো ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে পারতুম। এমনকি পাড়ার শিয়া মসজিদে গিয়ে লুকোলেও, নামাজের সময় ছাড়া, নিষেধ করতেন না ইমামসাহেব। মসজিদের সামনে নাজিম-কুলসুম আপাদের বাড়িতেও যে কোনো ঘরে লুকোনো যেত। ইমলিতলা থেকে ‘পাড়া’ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ধর্মীয় ভেদাভেদ আর জাতিপ্রথার রাজনীতিকরণের কারণে। ‘পাড়া’ উবে যাবার সঙ্গে ছোটোদের বহু খেলাও, মহানগরে, লোপাট হয়ে গেছে। চোর-পুলিশ, গুলি, লাট্টু ইত্যাদি আর বোধহয় খেলা হয় না। ‘পাড়া’ জিনিশটার আরেকটা অবদান ছিলÑ গোপন প্রেম। কসমোপলিসগুলোয়, কিশোর-কিশোরী আর তরুণ-তরুণীদের, প্রৌঢ়রাও বাদ যান না, কাজ-কারবার দেখে আঁচ করতে পারি যে প্রেমও তার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে ফেলেছে ।

    আমাদের বিল্ডিঙের তিনদিকে রাস্তা, যার একটি ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে, একটি সার্ভিস রোড আর অপরটি খ্যাত সাঁই-টেমপল স্ট্রিট। হাইওয়ে কখনও ঘুমোয় না; রাতে বরং আওয়াজের রকমফের পায়ে হাইওয়ে উড়তে থাকে নানা বেগবতী আলোগুলোকে ধাওয়া করে। মন্দিরের রাস্তাটা ঘুমোতে বাধ্য হয় কেন-না গাড়ি পার্ক করে চারিদিকের আবাসিকরা চলাচলের অযোগ্য করে দেন মাঝরাতের পর। সার্ভিস রোডটা, যার দুধারে দোকানপাট, আধা-মল, স্কুল, পলিটেকনিক-কলেজ, ফুটপাথ জুড়ে ফল, সবজি আর নানা টুকিটাকি, রাত্রিবালা ঘুমোয় না, ঝিমোয়— যেকোনো সময়ে অটো বা ট্যাক্সি পাওয়া যায়, রাতদুপুরেও, কেননা এই রাস্তাটা সকাল থেকে তার রূপ বদলাতে থাকে। বহু আকাশমুখো আবাসন এই সার্ভিস রোডে আর তার ফ্যাঁকড়াগুলোয়। বেশ কয়েকটা নার্সিংহোম থাকায় রাতের দিকে অ্যামবুলেন্সের হুটার ঘুমন্ত বুড়োদের হুশিয়ারি দিতে দিতে চলে যায়। ভোরের দিকে বিটকেল নামের চকচকে মোটরগাড়িতে চেপে শুটিং সেরে ফেরেন টিভি-সুন্দরীরা, যাঁরা না ঘুমিয়েও কি করে যে রূপ ধরে রাখেন জানতে ইচ্ছা করে।

    সার্ভিস রোডের দুধারে, অন্ধকার থাকতে, ভোরবেলা থেকে, কোচিংক্লাসের জন্য কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা জড়ো হতে থাকে, বিভিন্ন বিল্ডিঙের ওপরতলার কোচিং ইনস্টিটিউটে ঢোকার আগে, ছোটো ছোটো পাড়া গড়ে ওঠে। এই সমস্ত কোচিং ক্লাসেও সহজে স্থান পাওয়া যায় না, তার ওপর কোচিং ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ের জন্য ফিজ প্রতিমাসে আমার পেনশনের কয়েকগুণ। বেশ কয়েকটির বিষয়-অনুযায়ী বাৎসরিক চার্জ; একলক্ষ টাকার কাছাকাছি বা বেশি। সকলেরই ৯৫% এর চেয়ে বেশি মার্কস চাই। আগের বছর যারা মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে বিভিন্ন বিষয়ে ৯৯% মার্কস পেয়েছিল বা যারা ক্যাট আইআইটি জেইইতে সফল হয়েছে তাদের মুখের ছবি দিয়ে বিরাট-বিরাট ব্যানার টাঙিয়েছে বিভিন্ন কোচিং ক্লাস, সেসব ব্যানারের মাপ এলাকার খুচরো রাজনৈতিক নেতাদের মুখের ব্যানারের চেয়ে বড়।
    এই প্রায়ান্ধকার ভোরেও কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কাউকে দেখি না যে সে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে, পিঠে বইখাতার রাকস্যাক ঝুলিয়ে। সকলেই হাল আমলের রঙচঙে পোশাকে। যারা ৯৯% পেতে চায় বা নিজের পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে চায়, তারা কেউই যে আনস্মার্ট নয় তাও হয়তো কোচিংক্লাসেই শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে, জীবনযুদ্ধে লড়াইটা যে অবস্থায় পৌঁছেছে, পার্সোনালিটি তৈরি করার কাজও চলছে পাশাপাশি। পাশ দিয়ে যাবার সময়ে ভেসে আসে পারফিউম। মানুষ যত ধনী হয় ততই তার দেহের গন্ধ নকল হতে থাকে। অবশ্য এক-আধজন যুবতীর হরমোন এতই কড়া যে বৈভবশালী পরিবারের হওয়া সত্ত্বেও পারফিউম দিয়ে তা চাপা পড়ে না। এই সময়ের, ভোররাতের, বাসট্রেনেও যথেষ্ট ভিড় হয়, সেই গাদাগাদি সামলে ফুরফুরে চেহারায় সুগন্ধ বয়ে নিজেদের হাজির করা সহজ নয় নিশ্চয়ই। আমি তো আর বাসট্রেনে চাপতে পারিনা, তা সারাদিনে যে সময়েই হোক। মোটরসাইকেলেও আসতে দেখেছি ছাত্রদের, পেছনে গার্লফ্রেন্ডকে বসিয়ে, যদিও যারা কিশোর চেহারার তাদের তা চালাবার লাইসেন্স আছে কিনা সন্দেহ। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল পাখা মেলে দেয় হাইওয়ের ওপর।

    অন্য শহরের কথা জানি না। নতুন এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের এত কাছ থেকে অবজার্ভ করার সুযোগ অন্য শহরগুলোয় ছিল না। আমার স্কুলে পড়ার শেষপর্বে, কোএডুকেশান থাকলেও, সহপাঠিনীদের সঙ্গে তেমন হৃদ্যতা সম্ভব ছিল না; তারা সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল; বয়স্ক সহপাঠীদের দিকেই ছিল তাদের টান। মুম্বাইতে অধিকাংশ স্কুলে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছোলে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড জুটি তৈরি হতে থাকে। সবচেয়ে সুন্দরীরা সৌম্যকান্তি ছেলেদের বয়ফ্রেন্ড হয়ে ওঠে। যে মেয়েটির চটক নেই তার ভাগ্যে বয়ফ্রেন্ডটিও তেমন জোটে। কোচিং ক্লাস শুরু হবার আগে মোটরসাইকেলের সিটে বা দোকানের বন্ধ শোকেসের সামনের চাতালে জুটিতে বসে গ্যাঁজায় যারা তাদের দেখে এরকম আন্দাজ করে নিয়েছি। পড়াশোনায় সকলেই নিশ্চয়ই ভালো নয়তো কোচিং ক্লাসেও সিট পাওয়া কঠিন। ভোরবেলা থেকেই জেরক্সের দোকানে ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত দেখে ধারণাটা আরও দৃঢ় হয়।

    ইংরেজি পড়ার, শেখার ও বলার ক্লাসের পর্ব ফুরোলে অন্যান্য বিষয় ও ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং ক্লাস শুরু হয়। কোচিং ক্লাস শেষ হবার পর দলে-দলে শিশুদের দেখা মেলে স্কুলের পথে। মায়েরা টানতে-টানতে বা অটো বা গাড়িতে করে নিয়ে চলেছেন। তারই ফাঁকে কাঁধে নানা আকারের ব্যাগ ঝুলিয়ে অফিসযাত্রী আর যাত্রিণী । তারপর বেরোন বিভিন্ন বয়সের মহিলা ও পুরুষ, বাজারে কেনাকাটা করার জন্য। এই মহানগরে লোকে সব সময়ই কিছু না কিছু কিনছে! কোনো দোকান দুপুরে বন্ধ হয় না। রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। দোকানপাট বন্ধ হবার পর সার্ভিস রোডের ওপর এলাকার বিয়ার বার জ্বলে ওঠে রঙিন আলোয়, জড়ো হতে থাকে কত রকমের গাড়ি, রাস্তার দুই ধারে। রাত তিনটে পর্যন্ত ওই ঝিলমিলে আলোগুলো দেখতে পাই আমার ছয় তলার জানলা দিয়ে। মৌমাছির চোখের মতন হয়তো হয়ে ওঠে গাড়ির দিকে এগোতে থাকা মাতালদের চোখ, কারোর কারোর কাঁধে সঙ্গিনীর মাথা। জানলা দিয়ে দেখেছি বিভিন্ন বিল্ডিঙে রাত তিনটের সময়েও লোকে টিভিতে দেখছেন কোনো প্রোগ্রাম বা হয়তো ব্লু ফিল্ম। মদ খাবার জন্য, তা সে বাড়িতে বসে হোক বা বারে, আবগারি দপতরের প্রমাণপত্র প্রয়োজন হয় মুম্বাইতে। মদের দোকানে কিনতে গেলে বা বারে মদ খেতে গেলে যথাযথ চার্জ নিয়ে তারা নিজেরাই দিয়ে দেয় প্রমানপত্রখানা। মাঝে শখের কেক প্রস্তুতকারিণী এক মহিলা বাড়িতে বেশ কয়েকটা বোতল রেখেছিলেন বলে পুলিশের খপ্পরে পড়েন! আমি কেবল সিঙ্গল মল্ট খাই যা ছেলে বা মেয়ে এনে দেয় বিদেশ থেকে— প্রমাণপত্র ছাড়াই খাই। প্রতিদিন মদ খাবার প্রমাণপত্র নিতে হলে ডাক্তারের লেখা চিঠি চাই ।

    সার্ভিস রোডের ধারে বৃদ্ধদের জন্য ঝকঝকে-তকতকে একটা আড্ডা মারার ঘর তৈরি করে দিয়েছে মুম্বাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন— ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়ে যাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাঁরা এখানে বসে জিরিয়ে নেন, স্ত্রী বা ছেলের বউয়ের বারণ-করা সিগারেটটি ফুঁকে নেন। অবশ্য এই ঘরে বসে কোচিং ক্লাসের কচি খুকিদের দেখার আর তাদের কথাবার্তা শোনার আনন্দটাও পেয়ে যান সেই ফাঁকে। নতুন প্রজন্মের খোকা-খুকুদের কথাবার্তা শোনেন মুচকি মুখে। গ্যাপ যে কতগুলো জেনারেশানের তা কপালের ভাঁজের সংখ্যা দিয়ে টের পাওয়া যায়। এলাকাটা গুজরাতিতে ওপচানো; ফলে বুড়োরা, ভেতরে ভেতরে যাই হোন, মুখে সংরক্ষণশীল। অধিকাংশ গুজরাতিরা ব্যবসাদারি করেন, আর সে কারণে ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকা পড়েন, যে পত্রিকাটিতে গত বছর আমার সম্পর্কে বড়সড় ফোটো দিয়ে একটা সাক্ষাৎকার-নির্ভর প্রবন্ধ লিখেছিলেন নয়নিমা বসু। সেই থেকে কয়েকজন জানেন যে আমি কবিতা লিখি।

    আমার সকালের হাঁটাহাঁট শেষে, দুধের প্যাকেট আনতে গিয়ে যেদিন দেখি বুথটা তখনও খোলে নি, আমিও অবসর সময়টা খুকিদর্শন আর ছেলেমেয়েদের কথাবার্তা শোনায় খরচ করি। অত্যন্ত বোল্ড প্রজন্ম, সন্দেহ নেই। নিজেদের মধ্যে এরা প্রায় সবাই ইংরেজিতে বা মুম্বাইয়া হিন্দিতে কথা বলে। অধিকাংশ সময় ইংরেজিতেই, যেহেতু শিট, ফাক, কান্ট, আসহোল, সাকার, হুকার, ফাক ইউ ইত্যাদি শব্দ মাতৃভাষায় বললে যেমন কাঁচা শোনায়, ইংরেজিতে বললে নোংরা শোনায় না। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় চেতলা বাজারের ওপর ওনার ফ্ল্যাট থেকে প্রতিদিন সকালে নেমে আসতেন বাজার থেকে চরিত্র আর চরিত্রানুযায়ী সংলাপ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে, কেননা বার্ধক্যে পৌঁছে কম বয়সের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ ফরম্যাল হয়ে ওঠে।

    ইংরেজি ক্লাসের একটি সৌম্যদর্শন তরুণ, যাকে দেখে অনুমান হয় যে সে বোধহয় কোনো তরুণীকে গার্লফ্রেন্ড করতে চায়নি বা সে এতই সোফিসটিকেটেড যে কোনো তরুণী তার বন্ধুনী হবার সাহস যোগাড় করতে পারে নি, প্রায়ই ইংরেজি সংলাপ আওড়ায়। তরুণ-তরুণীরা তার সংলাপ বলার ধরনে আকৃষ্ট হয়ে তাকে ঘিরে থাকে। হয়তো মুম্বাইয়ের কোনো নাটকদলে অভিনয় করে— বহু নাটকদল আছে সোবোতে বা সাউথ বম্বেতে যারা নিয়মিত ইংরেজি নাটক করে। একদিন যখন তরুণটি একটা দীর্ঘ সংলাপ শোনাচ্ছিল সমবেত তরুণ-তরুণীদের, পাশের বিল্ডিঙের দোতলার কোচিং ক্লাসের ইংরেজির অধ্যাপক আমার পাশে এসে বসলেন। ইনিও পারফিউম মেখে বেশ সেজেগুজে আসেন, প্রতিদিন প্রেস-করা ফুলশার্ট আর ট্রাউজারে, নিজে স্কোডা অকটাভিও ড্রাইভ করে। ফিসফিস করে বললেন, শুনুন শুনুন, ছেলেটি যে কবিতাটা আবৃত্তি করছে, সেটা ভালো করে শুনুন। শোনবার চেষ্টা করলুম কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলুম না।
    অধ্যাপক মশায় ডাকলেন তরুণটিকে। জানতে পারলুম ছেলেটির নাম মন্দার। মন্দারের সঙ্গে তার বন্ধুবান্ধবরাও এলো পেছন-পেছন। অধ্যাপক মন্দারকে আমার পরিচয় দিয়ে বললেন যে ইনিও কবিতা লেখেন। তুমি যে কবিতাটা সবাইকে এতক্ষণ শোনাচ্ছিলে সেটি ইনিও শুনতে চাইছেন। ছেলেটি কুণ্ঠিত। আমি বললুম, লজ্জার কী আছে, শোনাও না, তোমার সহপাঠীদের তো শোনাচ্ছিলে, বেশ মনোমুগ্ধকর তোমার কন্ঠস্বর। মন্দার নাটুকে আবৃত্তি আরম্ভ করল, অনেকটা উৎপল দত্তের স্টাইলে। শুনলুম। সমবেত গুজরাতিরা হাততালি দিলেন। তরুণটি ও তার সহপাঠীরা চলে গেলে অধ্যাপক বললেন, ফিসফিস করেই বললেন, জানেন কি যে এটি শেকসপিয়ারের একটি বিখ্যাত সনেট।

    নিজেকে নিজে চুপচাপ শোনালুম বিখ্যাত? শেকসপিয়ারের ১৫৪টি সনেটই তো বিখ্যাত। ১ থেকে ১২৬ পর্যন্ত সনেটগুলো একজন পুরুষকে উদ্দেশ্য করে রচিত, যার সঙ্গে কবির অন্তরঙ্গ রোমান্টিক স¤পর্ক। তাঁর সনেটগুলো শেকসপিয়ার উৎসর্গ করেছিলেন ডাবল্যু এইচ নামে রহস্যে মোড়া কোনো একজনকে, যিনি, সমালোচকদের মতে, পেমব্রোকের আর্ল উইলিয়াম হারবার্ট। অবশিষ্ট ১২৭ থেকে ১৫৪ পর্যন্ত সনেটগুলো একজন কৃষ্ণাঙ্গী নারী, যিনি ‘ডার্ক লেডি’ নামে খ্যাত, এবং যিনি নাকি ব্যভিচারিণী ও কুচুটে, তাঁকে নিয়ে লেখা। শেকসপিয়ারের সনেট শক্তি চট্টোপাধ্যায় বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, ওনার নিজস্ব ডিকশানে। ইনটারমিডিয়েটে, অর্থাৎ এখনকার যা উচ্চমাধ্যমিক, কোর্সে শেকসপিয়ারের ১৮ নম্বর সনেটটি পাঠ্য ছিল। আমাদের ইংরেজির অধ্যাপক ড. দাশগুপ্ত, যিনি আমার হাতে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা দেখে আমায় ওনার প্রিয় ছাত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন, ১৮ নম্বর সনেটটি পড়াবার সময় বলেছিলেন, ‘শেকসপিয়ারের সনেট আগুপিছু ক্রিটিকাল অ্যাসেসমেন্ট করতে হয়’। ওই আগু-পিছু ইশারাখানা উনি নিজেই পরে খোলোসা করেছিলেন।

    মন্দারের অধ্যাপক মশায়কে আমি বললুম, মনে হচ্ছে সনেটটা আপনার বেশ প্রিয়, শোনান না, শুনি, একটু রয়েসয়ে শোনান যাতে বুঝতে পারি। উনি শোনালেন,

    A woman’s face with Nature’s own hand painted
    Hast thou, the master-mistress of my passion;
    A woman’s gentle heart, but not acquainted
    With shifting change, as is false women’s fashion;
    An eye more bright than theirs, less false in rolling,
    Gliding the object whereupon it gazeth;
    A man in hue, all ‘hues’ in his controlling,
    Much steals men’s eyes and women’s souls amazeth.
    And for a woman wert thou first created.
    Till Nature, as she wrought thee defeated
    By adding one thing to my purpose nothing.
    But since she pricked thee out for women’s pleasure,
    Mine by thy love and thy love’s use their treasure.

    ১৯৫৬ এর পর শেকসপিয়ারের সনেট শুনলুম পর-পর দুজনের কণ্ঠে। ১৯৫৬ সালের পরেও শুনেছি, কাঠমান্ডুতে, ১৯৬৬ সালে, চরসের নেশায় চুর ট্রেশাম গ্রেগ নামে এক হিপির কণ্ঠে। মন্দার শোনালো ভোরের আলো ফোটার সময়। গ্রেগ শুনিয়েছিল মাঝরাতে, খড়ের ওপর পাতা চাদরের বিছানায় শুয়ে— রিচার্ড বার্টনের ঢঙে।

    অধ্যাপক মশায়, ওনার ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে ফেরত এলেন, বললেন, এটা শেকসপিয়ারের কুড়ি নম্বর সনেট; ‘মাস্টার-মিস্ট্রেস’ শব্দটা শুনলেন তো? মাস্টার-মিস্ট্রেস মানে পুরুষ রক্ষিতা। এই কবিতাটি শেকশপিয়ার কোনো নারীকে নিয়ে লেখেননি, লিখেছেন পুরুষ প্রেমিকের উদ্দেশে। শেকসপিয়ার বলছেন, তোমার হৃদয় একজন নারীর মতো কোমল, অথচ তুমি নারীদের মতো আনচান করো না; তাদের চেয়েও তোমার চোখদুটি অত্যুজ্জ্বল ও সৎ, যে বস্তুর দিকে তাকাও তাকেও তুমি তোমার দৃষ্টি দিয়ে আলোকময় করে তোলো।

    কিছুক্ষণ থেমে, বোধহয় ভাবলেন আমি ওনার কথাটা ঠিকমতো নিতে পারব কিনা, বললেন, জানেন তো, শেকসপিয়ার উভকামী ছিলেন আর এই কবিতাটিসহ অনেকগুলো সনেট তার প্রমাণ। আমি ওনার মুখের দিকে খুঁটিয়ে তাকালুম, তারপর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সৌম্যকান্তি মন্দারের দিকে তাকিয়ে দেখলুম। ওহ, মন্দারের চোখের আলোয় উনি আলোকিত; কামানো দাড়িতে দামি লোশন মেখে আরও বেশি আলোকিত দেখাচ্ছিল ওনাকে।

    উভকামীরা, বিশেষ করে যারা কচি তরুণদের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করে, মনে হয় সত্তর বছর পেরিয়েও সক্রিয় যৌনতা দিব্বি বজায় রাখতে পারে।
    ——————————————————–
  • Rafiq Ul Islam | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:১১541328
  • রফিক উল ইসলাম
    মলয় রায়চৌধুরীর ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ : এক অন্তর্মুখী পাঠকের ভাবনা

    প্রাককথন

    নিয়ত এই কবিতাযাপনের ভেতর হঠাৎ কিছু কুশলী কলম

    নাড়িয়ে দিয়ে যায় আমাদের । নিত্য থেকে অনিত্যে

    পৌঁছোনোর সেই যাত্রাপথ তখন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে ।

    কবিতার ভাব, ভাষা, চিত্রক্লপ অথবা প্রকরণ সবটুকুই

    সময় বাহিত । এবং সময়শাসিতও বটে । এর ভেতরেই

    কিছু-কিছু ঘুরে দাঁড়ানো, মিছিল থেকে দূরে সরে আপন

    সত্ত্বায় ঝলমল করে ওঠে। নতুন-কবিতা-পড়তে-আসা

    আমরা, দশ সহস্রাধিক পংক্তি নিয়ে যখন অতলের খেলায়,

    হঠাৎ কিছু-কিছু কাব্য আড়ালে ডেকে নিয়ে যায় । সেই

    অপরূপ আমাদের মোহিত করে রাখে বহুকাল, এমনকি

    হলেও হতে পারে সারাটা জীবন। নিরন্তর কুড়োনো এবং

    হাত ফসকে গলে যাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে কোনো-কোনো

    মণিরত্নরাজি সারাজীবনের সঙ্গী হবে, এমন প্রশ্নে নির্বাক

    হয়ে যাই।

    বহুকাল পূর্বে পঠিত 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' এমনই

    ডেকে নিয়েছিল আড়ালে, নির্বাক করে তুলেছিল ।

    কবিতায় তরুণকাল পেরিয়ে আমরা তখন যুবক হব-হব ।

    হঠাৎ কেউ হাত রাখলেন পিঠে, আর অমোঘ সেই ডাক,

    গম্ভীর অথচ আন্তরিক, তিরের ফলার মতন শাণিত,

    ব্যতিক্রমী এবং স্পষ্ট । ফেরার কোনো উপায়ই রইলো
    না।

    এমনই কবি মলয় রায়চৌধুরী।তখনও পর্যন্ত কিছু-কিছু

    কবিতা পড়েছি তাঁর । সেই প্রথম কাব্য পড়ব । আর

    পড়তে গিয়েই সমূল কেঁপে ওঠার পালা । পড়তে-পড়তে

    চতুর্দিকে ধ্বসে পড়ার পালা। স্মৃতিবাহিত সে-সব

    অভিজ্ঞতা স্পষ্ট মনে এল, আজ আবার নতুন করে

    কাব্যগ্রন্থটি পড়তে গিয়ে । মনে হল, সেসব কবিতার

    নির্মাণ বুকের ভেতর যে সুরম্য বিনির্মাণ গড়ে তুলেছিল,

    সবটুকু মুছে যায়নি আজও । যায়নি বলেই বুঝি কবিতা

    এমন সদাজাগ্রত প্রহরীর মতন আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে

    চলেছে; কবিতা থেকে কবিতা এবং কবিতায় ।

    কবির আত্মপরিচয়

    পৃথিবীর প্রথম পাপের স্পন্দন ঘিরে আমাদের

    আত্মপরিচয়। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে তৃণ থেকে সাগরে,

    সাগর থেকে গ্রহ-গ্রহান্তরে । এই যে ইঁট কাঠ লতা তন্তু আর

    দৃশ্য-অদৃশ্য সকল প্রাণী এবং জড়জগৎ সবখানেতেই

    আমাদের আত্মপরিচয় পোষিত হয়ে আছে। কোনও এক

    মহাপ্রাণ থেকে ছিটকে এসে নিজেকে টুকরো-টুকরো করে

    ছড়িয়ে দেওয়া, আর সেই ছড়ানো 'আমি'-কে সাধ্যমতন

    কুড়িয়ে আবার মহাপ্রাণে ফিরে যাওয়া--- এইই আমাদের

    নিয়তি। একজন কবির নিয়তিও বটে। পূর্ণ থেকে ভগ্নাংশে,

    আবার ভগ্নাংশ থেকে পূর্ণে---কোন মহাচালক যে আমাদের

    এমন বিচলিত করে, তার হিসেব পাই না। এর ভেতরেই

    নিজেদের অস্তিত্ব ঘিরে লড়াই। আর প্রাণে-প্রাণে, পথে-পথে

    অস্ফুট গান গেয়ে যাওয়া । যদি কোথাও তা কোনো দিন

    লিপিবদ্ধ হয়ে যায় । যদি কোথাও সেই সাধকের আত্মলিপি

    গ্রথিত হয়ে যায়।
    কবি মলয় রায়চৌধুরী কেমন ভেবেছেন তাঁর আত্মপরিচয়

    নিয়ে? খুঁড়ে-খুঁড়ে দেখি। ছিঁড়েকুটে দেখি। অল্প আয়াসেই যা

    খুঁজে পাই, তা দেখার পর এতখানি বিস্মিত হব, স্তম্ভিত হব,

    স্বপ্নেও তা কি ভেবেছি কোনও দিন?

    আলোচনা নিষ্প্রয়োজন । কবিকে উদ্ধৃত করি:

    আমি ভূকম্পনযন্ত্র হাণবিক যুদ্ধ দেখব বলে বেঁচে আছি
    নীল গর্দভের লিঙ্গ মানবের শুক্রজাত কাফ্রি খচ্চর
    (মনুষ্যতন্ত্র পৃ ৩৯)

    অথবা

    কীটনাশকের ঝাঁঝে মজে-থাকা ফড়িঙের রুগ্ন দুপুরে
    ভূজ্ঞানসম্পন্ন কেঁচো উঠে আয়
    চাকুর লাবণ্য আমি আরেকবার এ-তল্লাটে দেখাতে এসেছি।
    ( প্রস্তুতি পৃ ১২ )

    অথবা

    মরার জন্যে যারা জন্মায় আমি সেই ধর্মবংশ
    বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বার-বার ঝুলি না ফাঁসিতে ।
    ( আরেকবার উহুরু পৃ ২৩ )

    সময়, হে অশ্বারোহী

    একজন কবি কীভাবে লেখেন বিস্তৃত এই কালপ্রবাহ ও তাঁর

    সময়কালকে ? দুরন্ত অশ্বারোহীর মতন যে যে সময়

    আমাদের চতুশ্পার্শে তুফান তুলে চলেছে, তার কতটুকুই বা

    গ্রহণ করা যায় । মর্মে-মর্মে যেধ্বনি জাগরিত, সময়ই তার

    আদি এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রক । এই নিয়ন্ত্রণের ভিতরই কবির

    চোখ মেলে দেখা । এই ধারাবাহিক গণ্ডি কি পুরোপুরি

    ডিঙিয়ে যাওয়া যায় ? অঅতীত আর বর্তমানের, বর্তমান

    আর ভবিষ্যতের সূচকরেখায় দাঁড়িয়ে কবি আন্দোলিত

    হন, ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন, উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন । এই

    উজ্জীবনের সামান্য আঁচড় ধরা পড়ে তাঁর কাব্যে, এবং

    অবশ্যই তাঁর জীবনধারায় ।তখনই কাব্য ও কবিজীবন

    সমার্থক হয়ে ওঠে। প্রকৃত কবির কাছে তাই কাব্য আর

    জীবনচারণের আদর্শগত সব পার্থক্য মুছে যায়। কাব্য

    থেকেই কবির প্রকৃত মুখ আমরা খুঁজে নিতে পারি। কাব্য

    থেকে কবির সমকালকেও খুঁজে নিতে পারি, যা এই বিস্তৃত

    কালপ্রবাহে একাকার হয়ে গেছে। এমনকি বিশিষ্ট কোনো

    উন্মত্ত সময়, যা ইতিহাস হয়ে আছে, স্মরণীয় হয়ে আছে,

    সেসবও কি ধরা পড়ে না কবির কলমে ? সর্বত্রই আড়ি

    পেতে দেখি। যেমন পুলিশ আড়ি পেতেছিল সব চিঠিপত্রের

    ওপর; আর চতুর্দিকে শুধুই হাতকড়া! আমরা কি ভুলে

    গেছি সেই সব দিনগুলোর কথা ? কবিও ভোলেননি। তাঁর

    সময়কালের সঙ্গে-সঙ্গে তাই উঠে এসেছে আড়িপাতা আর

    হাতকড়ার গল্প; রোমশ সারেঙের গল্পও:

    'পুলিশে নজর রাখে এখনও চিঠি খুলে পড়ে
    ওপরঅলাহে---হাতকড়া পরে আর কতদিন যাবে
    উবু হয়ে আছি চার হাতেপায়ে ঝাঁপিয়ে ধরব টুঁটি দাঁতে'
    (ধ্রুপদী জোচ্চোর, পৃ ২২)
    অথবা

    'ভোর রাতে দরজায় গ্রেপ্তারের টোকা পড়ে
    একটা কয়েদি মারা গেছে তার স্হান নিতে হবে'
    ( অস্তিত্ব পৃ ৪০ )

    অথবা

    'নৌকোর গোলুই থেকে ছুরি হাতে জ্যোৎস্নায়
    বুকের ওপরে বসবে লুঙিপরা রোমশ সারেঙ
    নাসারন্ধ্র থেকে বন্দুকের ধোঁয়া
    "বল শালা শকুন্তলার আঙটি কোন মাছে আছে ?"...'
    (লালসেলাম হায় পৃ ৪৪)

    প্রেম লিপ্সা ক্রোধ ইত্যকার প্রবাহ

    সবখানেতেই প্রেম আমাদের । সবখানেতেই লিপ্সা ।

    ঘাসবীজ থেকে মথের ডানা, চোরাগলি থেকে সুন্দরীর

    নাভি। কলম কোথাও সুস্হির থাকে না । ক্রমাগত লিপ্সা

    থেকে বিরহ, বিরহ থেকে নতুনতর লিপ্সায় আমাদের

    জড়িয়ে পড়তে থাকা। এ যেন চিরকালের খেলা। কবি

    সুব্রত রুদ্র লিখেছিলেন: 'সবুজ ঠোঁটের ভেতর থেকে দাঁত

    বের করে আমাকে কামড়ে দিল গাছটা।' এমনও হতে পারে

    কবির লিপ্সার রঙ ! ভাবলে শিউরে উঠতে হয় । কবি

    মলয় রায়চৌধুরীও ব্যতিক্রমী নন। তাঁর সোচ্চার উচ্চারণ

    স্পষ্ট, এবং অবগুন্ঠিত নয় । প্রেম ও লিপ্সার ভিতর, মায়া

    ও সৌন্দর্যের ভিতর একটি রাগি-চেতনা সর্বদাই তাঁর

    কবিতায় মিলেমিশে আছে। সবখানেতেই এক রাগি যুবকের

    উপস্হিতি আমরা সহজেই টের পাই। কোনও

    আন্দোলনকারী হিসাবে নন, একজন শুদ্ধ কবি হিসাবেই

    সেই রাগি যুবকের প্রেম, লিপ্সা অথবা রাগের ধরন খুঁজে

    নিতে চাইছি। তাঁকে ঘিরে যে সময়ের আবর্তন, যে অসম্ভব

    ধূর্ত আর প্রতারক জীবনযাত্রার আবর্তন, সেই আবর্তনের

    ভিতর 'নারী' কেমনভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তাঁর কবিতায় ?

    যে-কোনো লিপ্সার ভিতরই একটি শুদ্ধ নারীচেতনা

    অদৃশ্যভাবে কাজ করে যায় । তাও স্মরণ রাখতে হবে

    আমাদের। উন্নত প্রেম কোনো প্রতিবন্ধকতা মানে না । এই

    প্রতিবন্ধকতাহীন, আড়ালহীন প্রেম কী ভাবে শিল্পের কাছে

    আত্মসমর্পণ করে, তা তো দেখে নিতে হবে আমাদের :

    'সঙ্গমের আগে মাদি পিপীলিকা ডানা খুলে রেখে দেবে পাশে'
    ( প্রস্তুতি পৃ ১২ )

    এ পঙক্তি পড়ার পর মনে হল, প্রেম-পরিণয়কে মাটির

    সাথে, রূঢ় বাস্তবের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে তুলতে চেয়েছেন

    কবি । মনের দৃঢ়তা তো আছেই তাঁর । শুধু ইচ্ছে হলেই

    হল, সামান্য ইশারার:

    'কতদিন ইচ্ছে হব সামান্য ইশারা করে আমার দলের লোকেদের
    তোমাকে রাস্তা থেকে জোর করে তুলে নিতে বলি।'
    (বাজারিনী পৃ ৩১ )

    কিন্তু তাঁর লিপ্সার কাছে এসে থমকে দাঁড়াই। শিউরে উঠি :

    'ভিজে শায়া শাড়ি ভেতরের আঁটো জামা
    দপ শব্দে জ্বলে ওঠো আগুনের জিভ
    চেটে নিক যোনির রেশম দুই মাই
    লেলিহান কষ্টে নাভি ঝলসে উঠুক'
    ( কাঠামোতত্ব পৃ ৩৫ )

    এ তো গেল প্রেমের কথা, লিপ্সার কথা । এবার সেই রাগি

    যুবকটিকে খুঁজব। যার কোমরে সঙ্গোপনে বাঁধা আছে

    পিস্তল; ক্ষুর বা ভোজালি চুপচাপ । আর কাঁধে ঝোলানো

    ব্যাগে থরে থরে বোমা সাজানো আছে।এমন যুবককে সঙ্গে

    নিয়ে সতত সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। যে-কোনো সময়েই লণ্ডভণ্ড

    হয়ে যেতে পারে সবকিছু। কেন এত রাগ, অভিমান তাঁর ?

    এই সুষমামণ্ডিত পৃথিবীর কোনো অপরূপই কি পারে না

    তাঁকে শান্ত রাখতে ? বিস্মিত হতে হয়। যে-জীবন পলাশের

    ডালে রঙ ছিটিয়ে দেয়, ঝাউশাখাকে আন্দোলিত করে

    তোলে, সে-জীবনের প্রতি কোনও টানই কি নেই তার!

    আর এই যে সম্পর্কের বাতাবরণ, যাকে ঘিরে আমরা

    প্রস্ফুটিত হতে থাকি, আন্দোলিত হতে থাকি, শিহরিত হতে

    থাকি, তা কি কোনোই ছাপ ফেলে না ওই রাগি যুবকটির

    মর্মে ! খুবই সঙ্গোপনে ভাবি, 'ধানের বুকের দুধে হাত রেখে'

    ভাবি । 'কলাপাতা কি করে খুলে যায় দেখবো সারারাত

    ধরে' পড়তে পড়তে ভাবি। কবি মলয় রায়চৌধুরী কী

    ভাবছেন আপাদমস্তক ক্রোধ নিয়ে ? ওই রাগি যুবকটি,

    যার কোমরে গোঁজা পিস্তল আর কাঁধের ব্যাগে থরে থরে

    বোমা, কেন তাঁর কবিতায় সেই ছায়ামুখ ফিরে-ফিরে

    আসে! নাকি এই আপাতধ্বংস আর প্রলয়ের আড়ালে

    কোনও গূঢ় নবপল্লবের ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি?

    'নেকড়ে বালিকার কাছে দীক্ষা নিয়ে দুর্গন্ধ মেখেছি টাকরায়
    দুচোখে লঙ্কার গুঁড়ো ছুঁড়ে মারো
    মুখাগ্নি করার কালে দেখব না কার থ্যাঁতা মড়া
    তপ্ত সাঁড়াশি দিয়ে ছিঁড়ে নাও ধাতুকোষ বংশলোপ হোক'
    ( নেকড়ে বংশ পৃ ৪৫ )

    অথবা

    ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে মশাল হাতে এগিয়ে চলেছি আমি
    ঘাঁটি-পতনের দিকে
    দুপাশে শহর জ্বলছে
    কাঁধে শিবলিঙ্গ নিয়ে ল্যাংটো মোহন্ত ছুটছে
    ( পালটা মানুষ পৃ ২০ )

    বাড়িদখলের কথা

    'দখল করছি না আপাতত কেননা এখনও অনেক বাড়ি

    বাকি'--- এরকম পংক্তি থেকেই একজন কবির সামগ্রিক

    শিল্পসত্ত্বা আমাদের কাছে ইঙ্গিতপূর্ণ হয়ে ওঠে। দখল করা

    এবং তা অনায়াসে পরিত্যাগ করা অন্য দিগন্তে এগিয়ে

    যাওয়ার মধ্যে যে-দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আর অপূর্ণতার তৃষ্ণা

    খুঁজে পাই, তা একজন প্রকৃত কবিরই ক্ষরণজাত। এর

    সঙ্গেই যুক্ত আছে লড়বার মন। আত্মতৃপ্তি যে-কোনো

    কবিরই মৃত্যুর কারণ। সুখের কথা, এ-কবি অন্তত সেই

    শ্রেণীভূক্ত নন। নিরন্তে অতৃপ্তি তাঁকে পীড়ন করে চলেছে ।

    ফলে অনেক দূর এগিয়ে আছেন তিনি। যা-কিছু মুঠোর

    ভিতর, অধিকারলব্ধ, সে-সব ছুঁড়ে ফেলে নতুনতর খেলায়

    মেতে উঠতে চান তিনি। ফলে তাঁর সৃষ্টি ব্যতিক্রমী হয়ে

    উঠতে চায়। সদাজাগ্রত মননের সাথে ক্রোধ মিশিয়ে

    যে-বজ্রকন্ঠ অর্জন করেছেন তিনি, একদিন এসবও

    পরিত্যাগ করে নতুন বর্ণমালায় ধ্বনিত হয়ে উঠবেন।

    সুরম্য এক অলীক প্রাসাদের খোঁজে আমাদের যাবতীয়

    গৃহহীনতা । আবার তা হয়তো খুঁজে পেয়েও দু-হাতে ঠেলে

    সরিয়ে নবতর প্রাসাদের অন্বেষণ--- এভাবেই চলতে থাকা

    সারাটা জীবন। এক জীবনে ঠিক কতগুলো প্রসাদ দখল

    করা যায়? কতগুলোই বা পরিত্যাগ করে ডিঙিয়ে যাওয়া

    যায় ? উত্তর মেলে না কোথাও। যেমন আমি ভেবেছিলুম,

    'ঠিক কতগুলো খড়খড়ি থাকে জীবনে! কতগুলো খোলা

    যায়!' কোনও প্রসাদে বন্দি হলেই কবির মৃত্যু--- এমন

    ধারণা কি চিরকালের সত্য হয়ে উঠবে ! যদি তাই হয়,

    এমন মৃত্যু ইপ্সিত নয় কখনও। তাই এই কবির

    'বাড়িদখলের' দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকি। একদিন

    স্বেচ্ছায় এ-বাড়িও পরিত্যাগ করবেন তিনি, নতুন বাড়ি

    দখলের লক্ষ্যে। আমরা তাঁর লক্ষ্যের সাথে নিজেদের লক্ষ্য

    জুড়ে গেঁথে দিই:

    'দরোজায় লাথি মেরে বেহায়া চিৎকার তুলছি মাঝরাত্তিরে
    যারই বাড়ি হোক এটা খুলতে হবেই নাতো ভেঙে ঢুকে যাবো
    সামলাও নিজস্ব স্ত্রীলোক-বাঁদি সোনাদানা ইষ্টদেবতা
    ফেরেবের কাগজপত্তর নথি আজ থেকে এ-বাসা আমার
    ভোর হলে রাস্তায় সমস্ত আসবাব ছুঁড়ে ফেলে দেবো
    শষ্যের গ্রীষ্মবর্ষা পাপোষের নারিকেলসারি-ছায়া পোশাকের মেঘলা দুপুর
    গয়নার ভালোবাসা বাসনের দিনান্তের ক্ষিদে
    সদর দরোজা দিয়ে ধাক্কা মেরে বের করে দোবো
    দখল করছি না আপাতত কেননা এখনও অনেক বাড়ি বাকি'
    ( বাড়িদখল পৃ ১৩ )

    ( হাওয়া৪৯ পত্রিকার মলয় রায়চৌধুরী সংখ্যা, বৈশাখ ১৪০৮, থেকে পুনঃপ্রকাশিত )
  • শহর | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:১৪541329
  • মলয় রায়চৌধুরী
    নষ্টালজিহ্বা
    হাঁ, তো রউয়াকে কা খবর বা অজিতবাবু ? সব ঠিকঠাক চলত রহল নু ? অপনা কে কা কহিঁ, উমর হো গইল, মনওয়া মেঁ কুছো জমত নহিঁ, একদম চিনি লইকিকে চুচি নিয়র দিখত নাহিঁ, সমঝলুঁ না ? তব আপ কহল রহলুঁ কি য়াদ করকে কুছো লিখল যায়, কোচিস করল যায়, দেখৌ ।

    এখন সত্তর পার বলেছে অজিত রায় লিখুন দিকিনি একখানা গৎ
    কামিনা টাইপ আপনার যৌবনের লীলেখেলা যা-যা মনে আসে ঝেড়ে দিন !
    আররে অজিত ভায়া যৌবন কবে যে এসে কুঁচকিতে দুলাৎথি মেরেছিল
    গোঁফের পাতলা রেখা গজানোর আগেপিছে নাকি যেদিন বন্ধুরা বলেছিল
    আবে সালে মুঠ নহিঁ মারেগা তো পতা হ্যায় কিতনা গনদা ইককঠা হোগা
    তেরা চমগাদড় মেঁ, তু সালে কাটুয়া হ্যায় তো নহিঁ কি খুললা সাফ-সুফ
    হোতা রহে ? নাকি সেই দিন যেদিন ছাত্ররা মিলে নেহেরুকে পচধরা ডিম
    ছুঁড়ে মারবার ফলে পুলিশ চালিয়েছিল গুলি, দীনানাথ পাণ্ডে মারা গেল--
    মুঠ মারা শিখলুম ক্লাস টেনে সেটা কি যৌবন নাকি রুবিকন লাইনের
    শেষ বা ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ উনিশশো বাহান্ন বছরে ব্রাহ্ম ইশকুলে

    এই দশটা লাইন লেখার পর আর কিছুই লেখার নেই । শৈশব নিয়ে লিখে ফেলেছি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বইতে, তার পরের পর্ব লিখেছি ‘ছোটোলোকের যুববেলা’ বইতে আর শেষ পর্ব লিখেছি ‘ছোটোলোকের জীবন’ নামের দীর্ঘ আত্মঘটনায় ।
    অজিতবাবু, আপ কবসে মুঠ মারনা শুরু কিয়ে ? বিছৌনা গন্দা করনে কে বাদ, কি পহিলে ?
    মামলার ঝকমারি নিয়ে লিখেছি ‘হাংরি কিংবদন্তী’’ আর ‘প্রতিভাস’ থেকে প্রকাশিত, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হাংরি সাহিত্য আন্দোলন’ বইতে ।
    কবে প্রথম এক কিশোরীকে তার পান্তাভাত-খাওয়া ঠোঁটে চুমু খেয়েছিলুম, তার চুলের নারকেল তেলের গন্ধ, তার পুটপুটিয়া বোতাম খুলে বুকের পরাগে হাত দিয়েছিলুম, কুঁড়িতে মুখ দিয়েছিলুম, লাবিয়া ম্যাজোরায় তর্জনী রেখে ফোরপ্লে করে অরগ্যাজম এনেছিলুম, সবই তো লিখে ফেলেছি । হ্যাঁ, তারিখ-ফারিখ মনে নেই বটে। তবে, আঙুলটা মুখে পুরে স্বাদ নিয়েছিলুম, সেকথা এতাবৎ চেপে গেছি ।
    তো রায়বাবু, অব কা বাকি রহল, বোলুঁ ? সব লিখ দেলি এন্নে-ওন্নে ।
    অজিতবাবু বলার পর থেকে সেটাই ভাবছি বেশ কিছুকাল যাবত । কী বলা হয়নি !
    ও, হ্যাঁ, যাকে প্রথম চুমু খেয়ে তার প্রথম ফোরপ্লে করে অরগ্যাজম এনেছিলুম, সে পরে বলেছিল যে ওই আঙুলের কারণে তার মাসিক গোলমাল হয়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ রোগ ধরেছিল, আর সেইজন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হতো, গাইনাক দেখাতে হয়, ভাগ্যিস বরব্যাটা গাইনাককে জিগ্যেস করেনি ।
    মুখে আঙুল পুরে যে স্বাদ পেয়েছিলুম সেই স্বাদ আবার ফিরে এসেছিল, এক বাঘিনীর দেহঘাঁটার সূত্রে । পাহাড়ি হিন্দু গ্রামবাসীরা বাঘের মাংস খায়, সেই প্রথমবার দেখলুম । সেই ঘটনাটা নিয়ে অজিতের “শহর” পত্রিকায় একটা গল্প লিখেছিলুম, “দুধসন্দর্ভ” নামে, সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে, যাকে বলে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে, আমার “অপ্রকাশিত ছোটগল্প” বইতে আছে, শাশ্বত সিকদার প্রকাশ করেছিল । সেই গল্পতে, যেহেতু তাকে গল্পের শেষ প্যাঁচ দেবার ছিল, তাই আরেকটু তথ্য চেপে গিয়েছিলুম, যা পরে লিখেছি “বাঘিনীর জন্য প্রেমের কবিতা”য়, আর পরের দিন একজন পাহাড়ি বাঘের মাংস রেঁধে এনেছিল, আমাদের জন্য, আমি এক টুকরো খেয়েছিলুম, ছিবড়ে টাইপ, ঘোড়ার মাংসের মতন অনেকটা, কিন্তু লোকে যে বলে বেড়ায় বাঘের মাংসে দুর্গন্ধ থাকে, রান্নাকরা মাংসে তা পাইনি । গন্ধ পেয়েছি কাঙারুর সসেজে, ছেলে এনে দিয়েছিল অসট্রেলিয়া থেকে । তার চেয়ে ইউরোপে বাছুরের আর গোলাপি শুয়োরের মাংসের যে মিটবল বিক্রি হয়, স্পঞ্জের মতন, মুখে দিলেই গলে যায় । এবার বাঘিনী প্রেমিকাকে নিয়ে যে কবিতাটা লিখেছিলুম :-

    বাঁশে চার-থাবা বাঁধা বাঘিনীর ঘুষঘুষে বুকে
    উপুড় শুয়ে পড়ি পূর্ণিমার শিশির-ভেজা রাতে
    আমার উলঙ্গ ঘ্যামা স্খলিত সত্তা মুড়ে
    বাঘিনীর মাইয়ের বোঁটা মুখে কান্না পেয়ে গেল
    দুধহীন চুষি আর বেঁহেড ফোঁপাতে থাকি
    ক্রমে লিঙ্গ জেগে ওঠে কান্না বন্ধ হয়
    বাঘিনীর যোনিতে মুখ রেখে বলি, ভালোবাসি তোকে
    অবন্তিকা, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি

    হ্যাঁ, বাঘিনীর যোনিতে আঙুল দিয়েছিলুম, আর সেই আঙুল মুখে পুরেছিলুম । আর স্বাদ ? হুবহু আমার কিশোরী প্রেমিকার যোনিরসের মতন, তার নাম বলা যাবে না, বুড়ি হয়ে এখনও শিক্ষকতা করে যাচ্ছে। তাকে নিয়ে অনুপম মুখোপাধ্যায়ের বাক-এ একটা কবিতা লিখেছি । সব প্রাণীর যোনির স্বাদ কেন নোনতা, অনেকটা বিকেলে নামানো তাড়ির মতন ।
    অজিতবাবু, আপ কভি উংলি ডালকে রস চকখে হ্যাঁয় কি নহিঁ ? কহিয়ে ? মজা আয়া থা না ? কইসন নমকিন নমকিন, আঁয় ?
    তাড়ির কথায় মনে পড়ল, আমার জিগরি দোস্ত, এখন অক্কা পেয়ে নির্ঘাৎ পারগেটোরিওতে, এরিক পেজ, বলতো তাড়ি হলো ঈশ্বরের বীর্য, দ্যাখো, তাড়ি কেবল লিঙ্গের মতন গাছেই হয়, তালগাছে, মানে তাড়লিঙ্গ, খেজুর গাছে, কিন্তু নারকেল গাছে হয় না, কেননা নারকেল গাছ নিজের ইচ্ছে মতন বেঁকেও উঠে যেতে পারে । বাঙালিরা পাকা তালের আঁটি মাটিতে পুঁতে ফোঁপল খায়, কিন্তু মালায়ালিরা ওই আঁটিকে পচিয়ে দেশি মদ বানায়, আহা, এক ভাঁড় চুমুক দিলেই বোদলেয়ারের জাঁ দুভালের কোলে গিয়ে তুমি আছড়ে পড়বে, শুনতে পাবে ফরাসি ভাষায় তার কালচেত্বক খিলখিল ।
    তবে সবচেয়ে কড়ক তাড়ি খেয়েছিলুম আরেক ধরণের তাড়লিঙ্গ গাছের, তার নাম সালফি, গাছগুলো দেখতে প্রায় খেজুর গাছের মতন, কিন্তু পাতা সরু-সরু । আমার আর আমার সহকারি অফিসার উমা মহেশ্বর রাও-এর গাইড বলেছিল, এই মদে এতো নেশা হয় যে লোকে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ।
    জায়গাটা দান্তেওড়ার অবুঝমাড় জঙ্গল, সেখানে পরিষ্কার জল সহজে পাওয়া যায় না, তার বদলে সালফি খেয়ে লোকে চালায়, নয়তো পাহাড়ি চিলতে নদীর বর্ষাকালের জল । আমরা বোতলে জল ভরে নিয়ে গিয়েছিলুম । এই বোতলে জল নিয়ে যাবার আরও খানিক ঘটনা আছে, পরে মনে পড়লে, বলব ।
    অবুঝমাড় এখন মাওওয়াদিদের ইলাকা-এ-লাল । সেখানে আরেকটা বস্তুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যাকে বন দপতরের অফিসার বলেছিল রেড ভেলভেট মাইট বা ট্রমবিডাইডা পোকা, লাল টকটকে, অবুঝমাড়ের গোঁড়-মাড়িয়ারা বলে বিয়ার বহোতি, শুকিয়ে খায় তারা, শহরের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে । পুরুষ আর নারী, দুইই পোকাগুলো খায় ইনডিয়ান ভায়াগ্রা হিসেবে। পোকাগুলো পিষে অবুঝমাড়িয়ারা তেল বানায়, বাতে মালিশ করার জন্য, নারায়ণপুর শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রিও করে । একটু সালফি খেয়েছিলুম ফেরবার দিন, জলের বোতলে ভরে এনেছিলুম, গেস্টহাউসে খেয়েছিলুম কেয়ারটেকারের রাঁধা মুর্গির মাংস দিয়ে । আর বিয়ার বহোতি পোকা এনে অফিসে বিলি করেছিলুম । অবুঝমাড়ের অভিজ্ঞতা আমি আমার “ঔরস” উপন্যাসে ঢুকিয়েছি, এখনও প্রকাশক পাইনি বই করে বের করার ।
    এখন আর আমি বাংলামদ, তাড়ি, ফেনি, ফলচোলাই করা দেশি মদ খেতে পারি না, লিভারে ঝিংকে ওঠে । সবচেয়ে ভালো লাগে আবসাঁথ, যা র‌্যাঁবো-ভেরলেন-বোদলেয়ার খেতেন, নিট খেতে হয়, সবুজ রঙের, মৌরি থেকে তৈরি, জল বা সোডা মেশানো যায় না, মেশালেই তাড়ির মতন সাদাটে হয়ে যায়, মজা কিরকিরা করে দেয় । আর খাই সিঙ্গল মল্ট । এগুলোও ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে, জামাই যখন বিদেশ থেকে আসে তখন ডিউটি ফ্রি থেকে কিনে আনে । মদ আমি একা খেতে ভালোবাসি । এমনিতেই আমি একা থাকতে ভালোবাসি ।
    অজিতবাবু, আপকো কৌন মাল অচ্ছা লগত হ্যায়, ঠররা কি বিলয়তি ? ঠররা না ? হম জানত রহি, হেঃ হেঃ ।
    একটু আগে যে কথা হচ্ছিল, মরা বাঘিনীর, রিগর মরটিস হয়ে যাবার ফলে লিঙ্গ প্রবেশ করানো যায়নি, তবে ছড়ে গিয়েছিল, তার আগে আমার কখনও ছড়েনি, লুব্রিক্যাণ্ট ব্যবহার করতুম বলে । ট্যুরে তো আর সঙ্গে লুব্রিক্যাণ্ট নিয়ে ঘোরা যায় না, তাও আবার হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে । ছড়ে যাবার কথায় বিনয় মজুমদারের এই কবিতাটা মনে পড়ে গেল, অসাধারণ কবিতা :-

    যাক তবে জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা, হৃদয় ।
    সব শান্তি দূরে যাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই ।
    শুধু তার যন্ত্রণায় ডুবে থাক হৃদয় শরীর ।
    তার তরণির মতো দীর্ঘ চোখে ছিল সাগরের
    গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ বাতাস ।

    কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
    দীর্ঘস্হায়ী তার চিন্তা -- প্রথম মিলনকালে ছড়া
    ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা ।
    যাক সব জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা, হৃদয় ।

    বিনয় মজুমদার হাংরি আন্দোলনে প্রথম দিকে ছিলেন, তারপর শক্তি-সন্দীপনের সাহিত্যিক রাজনীতিতে বিরক্ত হয়ে আন্দোলন ত্যাগ করেন । ১৯৯৯ সালে বিনয় এক সাক্ষাৎকারে মারুফ হোসেনকে যা বলেছিলেন, তা পড়ে মনে হলো যে ওনাকে হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ঘোষণা করা উচিত ছিল । উনি সরাসরি যদি আমাকে বলতেন তাহলে আমি বুলেটিনে ওনার নামই “ফাউণ্ডার” হিসাবে ছেপে দিতুম, তাহলে সুনীল-শক্তি-সন্দীপনের কলকাঠি পোয়াতে হতো না । শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষীও হয়তো হতো না । শঙ্খ ঘোষও হামবড়াই করে “শব্দ আর সত্য” নামের গুরুঘণ্টাল লিখতেন না ।
    ইনকা নাম সুনে হ্যাঁয় অজিতবাবু ? ই সনকা ঘোস ? আররে কা বতাই ।
    “শব্দ আর সত্য” শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন ১৯৭১ সালে, মাইন্ড ইট রজনীকান্ত, ১৯৭১ সালে, প্রবন্ধটা শুরু করেছেন এই ভাবে, “কবিতালেখার অপরাধে এই শহরের কয়েকজন যুবককে যে একদিন হাজতবাস করতে হয়েছিল, এটা আজ ইতিহাসের বিষয়।” উনি এই লাইনটা লেখার আগে পঁয়ত্রিশ মাস যাবত আদালতে আমার মামলা চলেছিল, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের জজ জেলজরিমানার আদেশ দিয়েছিলেন । সেসব পুরো চেপে গেছেন উনি, কেন জানি না । আমি সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদের পুরস্কারে লাথি মেরে ফেরত দিয়েছি, তাও ২০১৪ সালে উনি জানতেন না ; প্রণব চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করে কপি চেয়েছিলেন, বিশ্বাস হচ্ছিল না বলে । প্রবন্ধে উনি লিখেছেন, “মলয় রায়চৌধুরীর যে উত্তেজনা বা আগ্রহ ফুটে উঠেছিল তার কোনো সঙ্গত কারণ দেখতে পাই না।”
    সমঝেঁ কি নহিঁ অজিতবাবু ? ই হ্যাঁয় কলকতিয়া বনাইল-খোখোয়া ।
    বুঝলে অজিত, আমি সেই সময়ে আদলতে চক্কর কাটছি, পকেটে পয়সা নেই, কলকাতায় মাথা গোঁজার জায়গা নেই, উকিলের চেম্বারে বসে থাকছি, হাইকোর্টের উকিল খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর উনি আরামে নিজের ঘরে বসে দিব্বি হেঁকে ডেকে কিল মেরে উপদেশ ঝেড়ে দিলেন ।
    যে অধ্যাপক নিজের জীবনে কখনও রাস্তায়, মাঠে বা নদীর ধারে বসে হাগেননি, তাঁর পক্ষে জীবন আর সমাজকে বোঝা কঠিন ।
    হ্যায় কি নহিঁ অজিতবাবু ? অব আপ কহিয়েগা কি নহিঁ হ্যায় তো লোগ হগতে হ্যাঁয় কহাঁ সে !
    “ফিরে এসো, চাকা” বইটার জন্য বিনয়ের খ্যাতি কলকাতার হিন্দি সাহিত্যিকদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছিল । জ্ঞানোদয় পত্রিকার সম্পাদক বিনয়কে নায়ক করে সেই সময়ে একটা বই লিখেছিলেন, “কলেজ স্ট্রিট কা নয়া মসীহা” নামে । শরদ দেওড়ার চাকরি ছিল খবরের কাগজ পড়ার । বালিগঞ্জের মারোয়াড়ি কলোনিতে গিয়ে জৈন পরিবার, বিরলা পরিবার, খেতান পরিবারের বুড়িদের খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো পড়ে শোনানো । তারপর ফিরে এসে বড়োবাজারে ওর দাদার গদ্দির ব্যবসা চালানো, প্রধানত ফাটকাবাজির ব্যবসা। আমি শরদ দেওড়ার বড়োবাজারের মেঝেয় পাতা মোটা গদিতে শুয়ে অনেক রাত কাটিয়েছি, মামলার সময়ে, তবে সকালে উঠে হাগবার সমস্যা হতো, কেননা কলকাতার বাইরে থেকে যে মারোয়াড়িরা ব্যবসার কাজে আসতো তারাও অনেকে ওই গদিতে শুয়ে রাত কাতাতো ।
    বিনয় মজুমদার আন্দোলন ছাড়ার সময়ে শক্তি-সন্দীপনের বিরুদ্ধে একটা বুলেটিন ছাপিয়ে ছিলেন আর বিলি করতে দিয়েছিলেন আমাদের । মজার বুলেটিন :-
    ১) শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনিপুণ নপুংসকরূপ আশা করি এ-যাবৎ পাঠক-পাঠিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি ; সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে অবস্হাকে বেশ মজাদার করেছেন ; পদলেহী কুক্কুরের নিয়োগকারিনী চালচুলোহীন এক নারীর আত্মার নির্দেশনা অনুসারে উক্ত কবি নিজেকে মহিলা মনে করে কবিতা লেখেন ; আর কথপোকথনকালে দেখি মহিলার অভিনয় করায় শ্রীমানটির কোনো ভাবলেশ উপস্হিত হয় না ; অথচ ক্রমে-ক্রমে আমার দাসীত্ব নিয়ে সেই বেয়াদপ আত্মাটিকে শায়েস্তা করেছি আর অঙ্কশাস্ত্রে শ্রীমতি এখন মতামত জ্ঞাপনের মতন স্হুলতা দেখাবার বিপদের ঝুঁকি নিতে সক্ষম হবে কি -- কবিটির জন্ম কি কুকুর আর গাধার সঙ্গমজাত ফল ?
    ২ ) স্হাপত্যবিদ্যায় ফেল মেরে-মেরে এক ছাগলের বীর্যজাত নির্মল মৈত্রেয় জীবিকায় হাস্যকর ভিক্ষাবৃত্তি ঝুলে আছে ; তবে ভয় নেই, যতক্ষণ তার কচি পায়ু আছে, দালালী রয়েছে ।
    ৩) সন্দীপন, হে শ্রীমান, দাস-অনুদাস শব্দটি শুনেছিলাম কবে যে ঠিক মনে নেই । তবে এটা নিশ্চিতই কবুল করতে হবে আজ -- দাসী-অনুদাস বলে কোনো শব্দ এ-যাবৎ আমি তো শুনিনি । ফলে যথাযথরূপে তোমার অবস্হা প্রকাশের ভাষার স্বচ্ছতা, বৎস, ভবিষ্যতে ভেবে দেখা যাবে ।
    ৪ ) দল পাকাবার আগে, পরেও তাদের, রেকটাম বীট করে দিয়েছি বলেই, এইসব কেঁচোবৃন্দ বীটনিক নাম নিয়েছিল ।
    ১০. ৬. ১৯৬৪
    রচয়িতা ও প্রকাশক
    বিনয় মজুমদার
    ৬৯, মির্জাপুর স্ট্রিট, কলকাতা - ৯
    এর পরেই বিনয় মজুমদারের স্কিৎসোফ্রেনিয়ার আক্রমণ হয় । হঠাৎই । কফিহাউসে ঢুকলেন, মাথায় ঝাঁকড়া অগোছালো চুল, দেখলেই টের পাওয়া যায় যে স্নান করা ছেড়ে দিয়েছেন, গায়ে দুর্গন্ধ, মুখভর্তি দাড়ি, জামাকাপড় বেশ নোংরা, আঙুলের নখ কাটেননি বেশ কিছুকাল, নখের ভেতর নোংরা, রেগে আছেন উপস্হিত সবায়ের ওপর, গালাগাল দিচ্ছেন, টেবিলে-টেবিলে থুতু ছেটাচ্ছেন । একদিন একটা লাঠি এনে এক বেয়ারার মাথায় আঘাত করলেন । বেয়ারারা ধরে নিয়ে গেল থানায় । কুড়ি দিন জেলহাজতে থাকার পর ছাড়া পেলেন। ছাড়া পাবার কিছুকাল পর বিনা পাসপোর্ট ভিসায় সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলেন পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের ফেলে-আসা গ্রামে ।
    জানতে হ্যাঁয় অজিতবাবু, ই বিনয় হ্যাঁয় না, ই চারবার জেল যা চুকে হ্যাঁয় ।
    হম জানতে হ্যাঁয়, অজিতবাবু, আপকো একবার মাফিয়া লোগন পিট-পিটকে কচুম্বর বনা দিহিস রহলা !
    বিনয়কে গোবরা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো । সে খবর আবার কফিহাউসে রসিয়ে-রসিয়ে বেওড়া-কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত, যাঁকে আমরা বলতুম, কবিতায় আর মাতলামিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ডুপলিকেট, এইভাবে টেবিলে-টেবিলে বলে বেড়ালেন, “তোমরা শালারা একেবারেই অপদার্থ । কলকাতায় কী সব ঘটছে কিছুরই খবর রাখো না । বিনয়দা এ-যাত্রা বেঁচে গেলেন । গোবরা মানসিক হাসপাতালে আছেন । স্নানটা অন্তত করছেন নিয়মিত । খাওয়া-দাওয়াও মন্দ করছেন না । বেশির ভাগ একা-একাই থাকেন, আর কী সব নাকি বিড়বিড় করে বলে চলেন অনবরত ।”
    মনে পড়ে গেল, “পরিচয়” পত্রিকায় রিভিউ করার জন্য আমার প্রথম উপন্যাস “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” দিয়েছিলুম অমিতাভ দাশগুপ্তকে । উনি বললেন চলো চা খাওয়া যাক । নিয়ে গেলাম দপতরের পাশের প্রায়-ফাঁকা চায়ের ঠেকে । উনি হাতে নিয়ে বললেন, “দেবেশ রায়ের কাছে বইটার কথা শুনেছি” । উনি বইটার প্রকাশক ইত্যাদি দেখতে লাগলেন, বললেন, হ্যাঁ, আমি নিজেই রিভিউ করব । আমি চলে এলাম । মিনিট কুড়ি পরে সন্দেহ হওয়ায়, ফিরে গিয়ে দেখি, বইটা বসার জায়গায় ফেলে দিয়ে চলে গেছেন । একেবারে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বসানো ।
    গৌতম সেনগুপ্ত, এখন শুনেছি পাবলিকেশান খুলেছে, নাকতলায় থাকতে সুরজিৎ সেনের সঙ্গে আসতো আমার ফ্ল্যাটে আড্ডা মারতে আর সলিলার হাতের রান্না খেতে । কড়াইশুঁটির সঙ্গে রশুন-তেজপাতা-লবঙ্গ-এলাচ পেষা তরকারি ওর ভালো লাগা্য়, নিজের বউয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিল ডিবে করে । গৌতম সেনগুপ্ত বলেছিল, দেবেশ রায় “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” রিভিউ করবেন বলেছেন । কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, দেবেশ রায় করেননি। গৌতমও তারপর আর আসতো না, সুরজিৎ কেবল একা আসতো । ওরা দুজনে আমার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, “হাওয়া৪৯” পত্রিকার এপ্রিল ২০০১ সংখ্যার জন্য ।
    বিনয় মজুমদার পরে “বাল্মীকির কবিতা” লিখলেন, যা হাংরি আন্দোলনের বুলেটিনে প্রকাশিত হলে দারুণ ব্যাপার ঘটত, কলকাতাকে একদম কমরিয়া হিলেলা চুতড়ওয়া ডোলেলা করে দেয়া যেতো । আপশোষ হয় যে আমি কেন এরকম লিখে উঠতে পারিনি । একটা কবিতা দিচ্ছি :

    চাঁদের গুহার দিকে নির্ণিমেষে চেয়ে থাকি, মেঝের উপরে
    দাঁড়িয়ে রয়েছে চাঁদ, প্রকাশ্য দিনের বেলা, স্পষ্ট দেখা যায়
    চাঁদের গুহার দিকে, নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, ঘাসগুলো ছোট করে ছাঁটা ।
    ঘাসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় গুহার উপরকার ভাঁজ ।
    গুহার লুকোনো মুখ থেকে শুরু হয়ে সেই ভাঁজটি এসেছে
    বাহিরে পেটের দিকে । চাঁদ হেঁটে এসে যেই বিছানার উপরে দাঁড়াল
    অমনি চাঁদকে বলি, ‘তেল লাগাবে না আজ’, শুনে চাঁদ বলে,
    ‘মাখব নিশ্চয়, তবে একটু অপেক্ষা কর’, বলে সে অয়েলক্লথ নিয়ে
    পেতে দিল বিছানায়, বালিশের কিছু নীচে, তারপর হেঁটে এসে চলে গেল
    নিকটে তাকের দিকে, একটি বোতল থেকে বাম হাতে তেল নিয়ে এল
    এসে তেল-মাখা হাতে ভুট্টাটি চেপে ধরে ।
    যখন ধরল তার আগেই ভুট্টাটি খাড়া হয়ে গিয়েছিল ।
    চাঁদ আমি দুজনেই মেঝেতে দাঁড়ানো মুখোমুখি
    এক হাতে ঘসে-ঘসে ভুট্টার ওপরে চাঁদ তেল মেখে দিল ।

    কৃত্তিবাসের কবিদের যেতে দেখেছি, অবিনাশ কবিরাজ লেনে, পার্বতী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে, কেননা হাংরি মামলার সময়ে ( ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ ) আমার উকিলের চেম্বার ছিল গলিটার ঠিক উল্টো দিকে, আর কারা কারা ঢুকছে তা উকিলের জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যেতো । বিনয় এই পাড়াকে বলেছেন বৃন্দাবন, যার কাছে যেতেন তার নাম রাধা । বিনয়কে যেতে আমি দেখিনি ; উনি বেশ পরে যেতেন বলে মনে হয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও কখনও দেখিনি কৃত্তিবাসের দলে ।
    কবিতাটায় তেল মাখার প্রসঙ্গটা বুঝতে পারলুম না । যাঁকে তিনি বলছেন বৃন্দাবন, সে পাড়ায় তো গুহায় এতোবার যাওয়া-আসা হয় যে তাকে অবারিতই বলা যায় । এতোই অবারিত যে হাংরি আন্দোলনকারীরা যখন বৃন্দাবনে যেতো তখন পারাপারি করে কাজ ফুরিয়ে ফেলতে বিশেষ সময় লাগতো না ; সময় যা লাগতো তা হলো ফস্টিনষ্টি করার, আর সকলেই কাজের চেয়ে ফস্টিনষ্টি করাতেই বেশি আগ্রহ দেখাতো । বেবি, মীরা, দীপ্তির ঘরে । একবার তো সুভাষ ঘোষ মীরার ঘরে ঢুকেই তিন মিনিটে বেরিয়ে এসেছিল । “বাঘের বাচ্চা” পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠি থেকে জানা যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত বেবি নামের চলনসই তরুণীর বাবু হয়ে বছরের পর বছর কাটিয়েছে, অবসর নেবার পরও, দুপুরে বৃন্দাবন থেকে চলে আসতো দাদার বাঁশদ্রোণীর বাড়ি, এতোই মাতাল যে সোফায় চিৎপটাঙ, খোঁয়ারি কাটলে ফিরে যেতো অশোকনগরে ; অনেকসময়ে অবনী ধরকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনে যেতো, দুপুর বেলা । চিঠিগুলো থেকে জানা যায় শৈলেশ্বর ঘোষ যেতো মীরার কাছে, ফর্সা থলথলে ড্যাবড্যাবে চোখ যুবতী, সম্ভবত স্ত্রী মারা যাবার পর বাসুদেব দাশগুপ্তের অনুসরণকারী হয়ে গিয়েছিল ।
    বৃন্দাবনের গোপীদের ব্যাপারে এক্সপার্ট ছিল করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ওর কোনো বাছবিচার ছিল না। হিপিনির গালে পটাক করে চুমু খেতে পারতো প্রথম পরিচয়েই । এক হিপিনির সঙ্গে বাঁশ-খড়ের কুটির তৈরি করে গঙ্গার ওপারে বালিয়াড়িতে অ্যাডাম-ইভের মতন উলঙ্গ সংসার পেতেছিল কিছুকাল, ওর স্ত্রীকে মাঝে-মধ্যে হিপিনির দেয়া ডলার দিয়ে আসতো । নেপালে একজন আমেরিকান-আফ্রিকানকে ফাঁসিয়ে তার সঙ্গেও শোবার বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল । কাঠমাণ্ডুতে মাঙনায় চরস ফোঁকার জন্য মন্দিরে সন্ধ্যায় বুড়োদের যে জমায়েত হয়, তাতে গিয়ে বসে পড়ত আর কয়েকটান দিয়ে নিতো, ওর দেখাদেখি আমরাও ক্রমশ লজ্জা-কুন্ঠা বিসর্জন দিতে শিখে গিয়েছিলুম । গর্দা বা গুঁড়ো গাঁজা ( পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসতো হিপিরা ), চরস আর আফিমের গুলি পাকিয়ে পাইপে বা ছিলিমে ভরে ফোঁকা আবিষ্কার করেছিল করুণা, সুপারস্ট্রং নেশার জন্য মস্তানা গোলি ।
    জীবনকে সাবভার্ট করার মাস্টার ছিল বলতে হবে ।
    অজিতবাবু, আপ বৃন্দাবনমে তিরথ করনে কে লিয়ে গয়েঁ থে কি নহিঁ ?
    চাকরিতে যোগ দিয়ে জুটেছিল ব্যাংকনোট পোড়াবার কাজ, পচা-গলা নোটের পাহাড় পুড়িয়ে নষ্ট করার কাজ, এখন অবশ্য সেই প্রথা উঠে গিয়ে শ্রেডিং করে নষ্ট করা হয়, পাল্প থেকে পিচবোর্ড ইত্যাদি তৈরি হয় । ওই চাকরি থেকে আমি প্রথম সুযোগেই পালাই, যোগ দিই গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের কাজে । সেই কাজে যে হাগবার কতো অসুবিধা তার অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি । সেসময়ে বিহার উত্তরপ্রদেশ রাজস্হান হরিয়ানা পাঞ্জাব মধ্যপ্রদেশের গ্রামে ধনীদের বাড়িতেও পায়খানা নামের ব্যাপার ছিল না । সকালে উঠে মাঠে যাও । প্রথম দিকে, ওই যে লজ্জা-কুন্ঠা, কাজ করতো ; পরে অভ্যাস হয়ে গেল । ট্যুরের জন্য আমি একটা এনামেলের মাগ কিনে নিয়েছিলুম, তখনও প্লাসটিকের মাগ বেরোয়নি । আর নিতুম জলের বোতল। তবুও পেট খারাপ হতো । পেট খারাপের জন্য সঙ্গে ওষুধ রাখতুম, তা সত্বেও পাতলা পায়খানা থেকে নিষ্কৃতি পেতুম না। তার ওপর যান বাহনের সে কী অসুবিধা, ওফ, নদীর ধার দিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছিই, হাতে ব্যথা ধরে গেলে মাথার ওপর ভারি ব্রিফকেস চাপিয়ে । উটের পিঠে, হাতির পিঠে, ঘোড়ার পিঠে চেপেও যেতে হয়েছে । রাজস্হানের একটা গ্রামের মোড়ল একবার পাল্কির ব্যবস্হা করেছিল, স্যাঁতসেতে গন্ধ, বসেই আমি আর আমার সহকারী আধিকারিক টের পাচ্ছিলুম যে বহুকাল ব্যবহার হয়নি । সামন্তবাদী জীবনযাপন বলতে ওইটুকুই অভিজ্ঞতা ।
    হাগাহাগির কথা বলতে গিয়ে আরও দুটো ঘটনা মনে পড়ে গেল ।
    হনিমুন করতে যাচ্ছিলুম শিমলা, তখন সেখানে তুষারপাত আরম্ভ হয়েছিল বলে । যাচ্ছি শুনে অফিসের সহকর্মী সুশীলকুমার বললো ও-ও যাবে বউকে নিয়ে । যাবার পথে ওর গ্রাম রোপড়ে দুদিন হল্ট । ওর গ্রামে গিয়ে জানা গেল যে ওদের বাড়িতে পায়খানা নেই । নববধু সলিলা কী করবে ! বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে ভোররাতে ওকেও যেতে হলো আখের খেতের আড়ালে । আমার কোনো সমস্যা ছিল না, গেলুম মাঠে হাগতে সুশীলের সঙ্গে। কলেজে এন সি সিতে যখন ছিলুম, তখন ক্যাম্পে দল বেঁধে গোল হয়ে বসে হাগতুম আর গল্প করতুম, পাদের প্রতিযোগীতা করতুম ।
    আরেকটা ঘটনা হল নাকতলার ফ্ল্যাটে থাকার সময়ে । গ্যারেজটা ভাড়া নিয়ে ফিয়াট গাড়ি রাখতুম । একদিন গাড়ি বের করতে গিয়ে দেখি পুরো গ্যারেজে গোড়ালি পর্যন্ত গু ভাসছে, গাড়ির চাকা গুয়ে । বিলডিঙের পেছনে গিয়ে জানতে পারলুম ফ্ল্যাটগুলোর পায়খানার পাইপ বন্ধ হয়ে গেছে, একতলার ভাড়াটেদের কচি মেয়েগুলোর ফেলা স্যানিটারি ন্যাপকিনে । বাঁশদ্রোণীর কাছে যে কাজের লোকরা ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে বসে থাকে, তাদের বলতে, বলল, ওসব কাজ ওরা করে না । করপোরেশানের দপতরে খোঁজ নিতে, তারা বলল যে নদর্মা আর রাস্তা পরিষ্কার করার কর্মীরা করপোরেশানে নয়, পার্টি অফিসে থাকে । পার্টি অফিসে গেলুম, সাফাইকর্মীরা বলল, বাড়ির ভেতরকার ডিউটি ওদের নয় ।
    অগত্যা দুটো লম্বা ক্লিনার কিনলুম, রাবার লাগানো, পাইপ কিনলুম বেশ অনেকটা । সলিলা শায়া ব্লাউজ পরে আর আমি গামছা পরে গ্যারেজ থেকে গু ঠেলে-ঠেলে নর্দমায় নিয়ে গেলুম, ওপর থেকে পাইপ ঝুলিয়ে জল এনে আমি আর সলিলা ঝেঁটিয়ে-ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করলুম ।
    সবচেয়ে প্রথম যা করলুম তা হলো গাড়িটা বেচে দেয়া । প্রথম যে কিনতে এসেছিল, তাকেই বেচে দিলুম ।
    কিছুদিন পরে ফ্ল্যাটটাও বেচে দিলুম, জাস্ট পাঁচ লাখ টাকায় । খাবার জলের প্রচণ্ড অসুবিধা হচ্ছিল । কোনো ভারি তিন তলায় জল আনতে রাজি ছিল না । মিনারাল ওয়াটারের কুড়ি কেজি কনটেইনার কয়েকদিন তুলে আর পারলো না দোকানদার ছেলেটা । জল ভরতে দেড় লিটারের বোতলে রাস্তার টিউকল থেকে জল ভরতে হতো, থলেতে করে তিন তলায় তুলতে হতো । কয়েকদিন তুলেই হালত খাস্তা ।
    ফ্ল্যাটটা যখন বেচলুম, দাদাকে বলেছিলুম, ওপরতলাটা আমাকে ভাড়া দাও । বউদি বললেম, না, তা হবে না, তোমরা কোথাও একতলা ভাড়া করে থাকগে যাও ।
    দাদা বললেন, তোরা থাকলে পরে প্রবলেম হবে ।
    আসলে দাদার ছেলেরা পাটনার বাড়ি থেকে আমার-সলিলার আর আমার ছেলে-মেয়ের যাবতীয় আসবাবপত্র, বইসংগ্রহ, স্কুলের পুরস্কার, গ্যাজেট, ফোটো ইত্যাদি বেচে দিয়েছিল বা ফেলে দিয়েছিল । বাসন-কোসন আর ফার্নিচার ফ্রিজ ইত্যাদি বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে নিয়ে চলে এসেছিল । দাদা হয়তো ভাবলেন যে আমরা ওপরতলায় ভাড়া নিয়ে আর উঠতে চাইব না ।
    ব্যাস চলে এলুম মুম্বাই ।
    সমঝেঁ না অজিতবাবু ? অব বুঢঢা-বুঢঢিকা হালত অ্যায়সা হো গয়া হ্যায় কি য্যাদা দুর চলতে হ্যাঁয় তো হাঁফনে লগতে হ্যাঁয় । মেহরারু কা হালত অওর খরাব, হড্ডিকে জোড়-জোড় মেঁ দর্দ, ডাক্টার কা কহনা হ্যায় কি দাওয়াই খাতে রহিয়ে অওর অ্যায়সা হি জিন্দগি চলাতে রহিয়ে ।
  • উত্তম | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:১৬541330
  • উত্তম দাশ : মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন
    "শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত।" মলয় রায়চৌধুরী

    প্রচণ্ড অবিশ্বাস, ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান, এই ত্রিবিধ নৈরাজ্যে ষাটের দশকের শুরুতে আত্মার একটা ছটফটানি মলয় রায়চৌধুরী যখন সবে টের পাচ্ছেন তখন তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র । জীবনের মুখোমুখো দাঁড়াবার বয়েস । নিজেকে চিনে নেবার, অস্তিত্বের স্বরূপ আবিষ্কারের সময় । ততদিনে চিনে নেবার অবকাশ হয়েছে স্বদেশকে, সমাজ তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো খুলে ধরেছে সামনে । স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে চোদ্দ বছর আগে । দেশবিভাগ, শেকড়হীন মানুষের বিলি ব্যবস্হা, দেশপ্রেম ততদিনে মুনাফা তুলছে । পরিবারের গঠন পালটাচ্ছে; শহর-গ্রাম ব্যবধান বাড়ছে, নীতিবোধ ভাঙছে, বিশ্বাসের তলানি এ-প্রজন্ম চোখে দেখার ফুরসৎ পায়নি । বাংলাকবিতায় রবীন্দ্রবিরোধিতা রাজণেতিক মুনাফার জন্য মাত্র প্রয়োজন, ত্রিশ-চল্লিশের কবিতা গতানুগতিক হচ্ছে নির্জীব কবিদের হাতে । পঞ্চাশ সবে জা্ছে । নিজস্ব ভূমি আবিষ্কার হয়নি ।

    এমন একটি টালামাটাল সময়ে আমরেকান কবি গিনসবার্গ পাটনায় মলয়ের বাড়ি । দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সুবাদেই এই যোগাযোগ । সমীর নিজে কবি, পঞ্চাশের কবিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ । বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে তখন মলয়ের পরিচয় নিবিড় নয় । এই সময়ে হঠাৎ ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের In The Sowre Hungry Time পঙক্তিটি তাঁকে ঘিরে থরল । এখান থেকে তুলে নিলেন 'হাংরি' শব্দটি । অসওয়াল্ড স্পেংলারের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় বিষয়ক কনসেপ্টে খুঁজে পেলেন হাংরি শব্দের দার্শনিক ভিত্তি । এরই প্রেক্ষিতে গিন্সবার্গ আকর্ষণ করলেন বৈদ্যুতিক । শুধু কবিতা নয়, জীবনযাত্রাও । উত্তাল উদ্দাম শেকড়হীন নোঙেছেঁড়া । মলয়ের জীবন চর্চায় ঈশ্বর নেই ( গিনসবার্গের ছিল বুদ্ধে ), ব্যক্তিসত্ত্বার বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু কবিতায় জীবনের বিশ্বস্ত অনুবাদ আছে, ছলনাহীন, স্পষ্ট । জীবন আর কবিতা দুটো সমান্তরাল বাহু নয় । একই বাহু । ফলত জীবন ও কবিতা সেখানে সমার্থক । আকৃষ্ট হতেই পারেন মলয় । এই সময়ের প্রতিক্রিয়া দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে জানালেন তিনি । শক্তিও তখন পাটনায় । শক্তি উৎসাহিত হলেন । উৎসাহ দিলেন । কিন্তু শক্তি কলকাতায় ফিরেই 'সম্প্রতি' পত্রিকায় লিখলেন 'ক্ষুৎ-কাতর আক্রমণ' । বাংলায় লেখা মলয়ের পরিকল্পনার প্রথম ভাষ্য । দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নেতৃত্বে অভিষিক্ত করে ১৯৬১ সালের নভেম্বরে প্রথমে ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলেন মলয় একটি ইস্তাহার । ১৯৬২ সালের এপ্রিলে বাংলায় বের করলেন একটি ইস্তাহার, 'হাংগরি জেনারেশন' । তিনকলমে ডবলক্রাউন ১/৮ প্ররষ্ঠায় ছাপা বুলেটিন । বার্জাস টাইপে ছাপা হলো -- স্রষ্টা : মলয় রায়চৌধুরী । নেতৃত্ব : শক্তি চট্টোপাধ্যায় । সম্পাদনা : দেবী রায় । এক পৃষ্ঠার বুলেটিন, বাঁধা পত্রিকার ডিমাই ১/৮ সাইজে পরিবর্তনের পথে নামের বানানের বিবর্তন হলো 'হাংরি জেনারেশন' ।ততদিনে অবশ্য দলবল বেড়েছে । কিন্তু হাংরি জেনারেশনের প্রথম বুলেটিনটি গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে যাঁরা হাংরি আন্দোলনের শরিক হয়েছিলেন, ধরে নিতে হবে এই বুলেটিনের বয়ানে তাঁদের সায় ছিল । অন্তত তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন একটা আন্দোলনকে, হাংরি জেনারেশন নামের আন্দোলনকে ।

    মলয়ের লেখা প্রথম বুলেটিনের সঙ্গে মৌল কোনো বিরোধ তাঁদের আদর্শগত কারণে ছিল না, থাকলে একদল তরুণ নিশ্চয় এভাবে সংগঠিত হতে পারতেন না ল আমি ভুলিনি, একটা আন্দোলন যৌথ চিন্তার ফসল । পরবর্তীকালে হাংরি আন্দোলনে এই যৌথ চিন্তার রূপ দেখব । কিন্তু প্রাথমিক স্তরে একজন তাত্বিকের আনুগত্য মেনে নেয়াই সঙ্গত । তাত্বিক মলয় প্রথম বুলেটিনে লিখেছেন :

    "কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন এমনভাবে আবির্ভূত যে, জীবনের কোনো অর্থ বের করার প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রাগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃধিবীবিরোধিতার নয়, তা মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক । এক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা, কারণ কবিতা ব্যতীত আর কি আছে জীবনে ! মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয় ।

    কবিতা থাকা সত্ত্বেও, অসহ্য মানবজীবনের সমস্ত প্রকার অসম্বদ্ধতা । অন্তরজগতের নিষ্কুন্ঠ বিদ্রোহে, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তিতে, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হয় কবিতা -- উঃ, তবু মানবজীবন কেন এমন নিষ্প্রভ, হয়তো, কবিতা এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁদের অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্ব এই সংকটের নিয়ন্ত্রক।

    কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মোহমুক্তির প্রতি ভয়ংকর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খাঁচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । এমন কি, প্রত্যাখ্যাত পৃথিবী থেকে পরিত্রাণের পথরূপেও কবিতার ব্যবহার এখন হাস্যকর। ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পূর্ণরূপে আরণ্যকতার বর্বরতার মধ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । সমস্তপ্রকার নিষিদ্ধতার মধ্যে তাই পাওয়া যাবে অন্তরজগতের গুপ্তধন । কেবল, কেবল কবিতা থাকবে আত্মায় ।

    ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অর্গাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । যেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে 'সচেতনভাবে বিহ্বল' হলেই এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে ।"

    হাংরি জেনারেশনের বিরুদ্ধে প্রচলিত যে অভিযোগ যৌনতা এবং জান্তব ক্ষুধা বা জৈবতার, তার ইঙ্গিতমাত্র নেই মলয়ের বুলেটিনে । যদিও জীবনের সামগ্রিক ক্ষুধাকে তিনি বলেছেন -- 'মানসিক, দৈহিক এবং শারীরিক ।' তবু তাঁর বিশ্লেষণ যেখানে এসে থেমেছে সেখানে এ-ক্ষুধা আত্মিক । অন্তরাত্মা ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির সামর্থ্যে কবিতা আসলে বস্তুগত জীবন ও আত্মিক জীবনের মেল বন্ধন । কবিতা যেখানে জীবনের একমাত্র আশ্রয় সেখানে কবিতা ও জীবন একার্থক, অথচ জীবনের সংকট কবিতা ও জীবনকে ভিন্নভাবে দেখে । কবিতা বানিয়েদের মলয় দেখেছেন ক্ষমাহীন, কবিতা তাঁর কাছে অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্ত, সুতরাং 'সচেতনভাবে বিহ্বল' হলেই কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । অরগ্যাজমের মতো বলতে, যে জৈববৃত্তি বোঝায় তা কখনোই উদ্দীপনাহীন ও স্বতঃস্ফূর্ত নয় । বৈজ্ঞানিক সত্যে উপমাটি ব্যর্থ । এখানে আমাদের মেনে নিতে হবে কবিতার স্বতঃস্ফূর্তি, মলয়ের ধারণা মতো । অনেকটা রোমান্টিক কবিদের স্পন্টেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস, অবশ্যই রোমান্টিকদের মতো আবেগে আত্মসমর্পণ নয়, কল্পজগৎ তেরি নয়, সচেতন বিহ্বল অবস্হাই মলয়ের ধারণায় কবিতা সৃষ্টির শর্ত, 'অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি' না থাকলে তাকে মলয় কবিতা বলতে রাজি নন । নিঃসন্দেহে অভিনব । বিশেষত বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তি । কিন্তু এই অভিনব মতবাদ থেকেই হাংরি আন্দোলনের শুরু ।
  • মলয় | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:১৯541331
  • এখনও পিঠ ব্যথা করে
    মলয় রায়চৌধুরী
    ইমলিতলা পাড়ায়, পাটনা শহরের মহাদলিতদের পাড়া, যেখানে ছোটবেলা কেটেছে, চোর-পুলিশ খেলার সময়ে যে কোনো বাড়ির যে কোনো ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকার অবাধ অনুমতি ছিল, দড়ির খাটের তলায়, আলকাতরা-লাগানো দরোজার পেছনে, উঠোনের জংলি-গাঁজার ঝোপে, কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতেন না। আমাদের বাড়ি ছাড়া সব কয়টাই ছিল খড়ের চালের, আর আমাদের বাড়ির বাঁদিকের গলিটা ছিল কানাগলি, পাঁক আর সকালের গুয়ে ওপচানো। আমার সমবয়সীরা, যাদের সঙ্গে খেলতুম, তারা সকলেই এই সমস্ত চালাবাড়ির ছেলে-মেয়ে।
    একদিন বিকেলে খেলার সময়ে কালুটুয়াদের বাড়িতে লুকোবার জন্য একটা ঘরে ঢুকে দেখি কালুটুয়ার চাচি দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ঢুকে গেলুম খাটের তলায়। চাচির শোয়ার দরুন খাটটা একটু নেমে এসেছিল বলে সুবিধাই হলো, সহজে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, দেখতেই পাবে না আমাকে অন্ধকার ঘরে, তার ওপর দড়ির খাটের তলায়।
    আমার খোঁজে কেউ এলো না বটে, ঢুকলেন কালুটুয়ার হোঁৎকা বিশালবপু চাচা, দরোজা বন্ধ করে দিলেন। ভাবলুম, ভালোই হলো, এই ঘরে আর কেউ খোঁজ করতে পারবে না আমার। চাচা শুয়ে পড়লেন খাটে। বুঝতে পারলুম, উনি লুঙ্গি খুলে মেঝেয় ফেলে দিলেন আর খাটে শুয়ে পড়লেন।
    একটু পরেই খাটের ওপর চাচা-চাচির মুখ দিয়ে নানা আওয়াজ বেরোতে শুনলুম। বুঝতে পারলুম না কী করছেন ওনারা। খাটের খসখসে দড়ি মাঝে-মাঝে আমার পিঠে এসে ঠেকছিল। একবার অনেক জোরে দড়ির ধাক্কা এসে লাগল পিঠের ওপর, প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্হা। কান্না চেপে চুপচাপ পড়ে রইলুম, চাচা-চাচির ঘর থেকে বেরোবার অপেক্ষায়। অন্তত শেকল খুললেই খাটের তলা থেকে বেরিয়ে পালাবো। পিঠে অসহ্য ব্যথা আরম্ভ হয়েছে, বাড়ি গিয়ে চুন-হলুদ লাগিয়ে দিতে বলতে হবে জেঠিমাকে। জিগ্যেস করলে বলব পড়ে গিসলুম।
    চাচাকে খাট থেকে নামতে দেখলুম, মেঝে থেকে লুঙ্গি তুলে পরে নিলেন। শেকল খুলে বেরিয়ে যেতে, চাচিও খাট থেকে নামলেন, হদিশ পেলুম না উনি কেন ব্লাউজ খুলে ছিলেন, চাচা-চাচি কীই বা করছিলেন জানি না। চাচি যখন শাড়ি সামলে ব্লাউজ পরতে ব্যস্ত, আমি খাটের তলা থেকে কাতরিয়ে বেরোলুম, এক পলক ওনার দিকে চাইতে, মাই দেখিয়ে বললেন, কি রে খাবি না? ছোটবেলায় তো খেতিস! শৈশবে আমার মায়ের বুকে দুধ হতো না বলে ছোড়দি পাড়ার নার্সিং মাদারদের বাড়ি আমাকে নিয়ে গিয়ে দুধ খাইয়ে আনতেন। চাচির দুধও খেয়ে থাকবো।
    আমি কথার উত্তর না দিয়ে বাইরে পোঁ-পাঁ।

    বুড়ো বয়সে ব্যথাটা ফিরে-ফিরে আসে। ডাক্তারকে বলতে পারি না ছোটবেলায় কী ভাবে চোট লেগেছিল। চাচির ব্লাউজ খোলা তামাটে ঢাউস মাই এখনও চোখে ভাসে। ব্যথা যায় না।
  • Pranab | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২২541332
  • প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় : হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী

    ছয়ের দশক । নেহেরুর দ্বিতীয় যোজনা অনেকটা সরে গেছে বোম্বাই মডেলের দিকে । ঔপনিবেশিক খেসারত দিতে ভারত-চিন যুদ্ধ । ভারত পাকিস্তন যুদ্ধ । স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখি, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, উত্তরঔপনিবেশিক ভারতে তা সেই সেময় দিশা হারিয়েছে । বাংলা সাহিত্যে তখন মূল ধারা দুটি । একটি বুদ্ধদেব বসু, আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, কবিতা সিংহ, শতভিষা নামক পত্রিকাসহ খ্যাতির মধ্যগগনে । অন্য ধারাটি বামপন্হী সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ, রাম বসু প্রমুখরা । এই সময়কালে সাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভাব হলো হাংরি আন্দোলনকারীদের । যা খাপ খোলা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, নেতৃত্ব দিলেন মলয় রায়চৌধুরী নামের একুশ বছরের যুবক । কলকাতা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাবুরা ইস্তাহার দেখেছে ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলনে, রাজনৈতিক দলে । তা বলে সাহিত্য আন্দোলনে ইস্তাহার বিলি করে ! ভাবগতিক দেখে নড়ে চড়ে বসলেন প্রাতিষ্ঠানিক কবি-সাহিত্যিকের দল । প্রতিটি বিষয়ের ওপর হাংরি আন্দোলনকরীদের আলাদা আলাদা ইস্তাহার ছিল । সাহিত্য বিষয়ক প্রথম ইস্তাহারটি লেখা হয় ইংরেজিতে, প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে । কারণ সেটির রচয়িতা মলয় রায়চৌধুরী পাটনার বাসিন্দা, সেখানে কোনো বাংলা প্রেস নেই । পরে ১৯৬২ সালের এপ্রিলে বাংলায় ইস্তাহার প্রকাশিত হয় । ক্রিয়েটর মালয় রায়চৌধুরী, লিডার উল্টোডাঙা বস্তিতে সেই সময়ে বাস করা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক ও সম্পাদক হাওড়ার এক বস্তিবাসী হারাধন ধাড়া ( দেবী রায় ) । কী ছিল সেই ইস্তাহারে ?

    সেই ইস্তাহার ছিল এই রকম : মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র পরাজিত । কবিতাই এখন একামাত্র আশ্রয় । এখন প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন অনর্থ বের করা । চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা থেকে জন্ম নেবে কবিতা । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার চালাকি এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবল ল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানানোর কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের স্বতঃস্ফূর্তিতে । অন্তরজগতের নিষ্কুন্ঠ বিদ্রোহ, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তি, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হবে কবিতা । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক বা ধ্বনি পারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতন অনুন্মেষিনী হয়ে যেতে পারে ।

    সাহিত্যে ছড়িয়ে পড়ল হাংরি আন্দোলন । একে একে এসে যোগ দিলেন বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, বাসিদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, রবিউল, শম্ভু রক্ষিত, তপন দাশ, এবং আরও অনেকে । তখনকার প্রচলিত রীতি মানেননি হাংরিরা, তাঁদের কোনো সম্পাদকীয় দপতর বা হেড কোয়ার্টার ছিল না। যে যার মতো করে ফালি কাগজে বুলেটিন বার করত, খরচ দিতেন মলয় এবং সমীর । পত্রিকাগুলোর নামও ছিল একেবারে ভিন্ন, স্বকাল, ফুঃ, চিহ্ণ, জেব্রা, জিরাফ, প্রতিদ্বন্দ্বী, উন্মার্গ, ওয়েস্ট পেপার, ধৃতরাষ্ট্র, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি । প্রকাশিত বুলেটিনগুলি কফি হাউসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংবাদপত্র দপতরে, কলেজে হাতে হাতে বিলি করা হতো ।

    হাংরি আন্দোলন বহিরাগত এমন তকমা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখকরা দল বাঁধতে লাগলেন ভিতরে ভিতরে । শক্তি চট্টোপধ্যায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে ‘সীমান্ত পপস্তাব’ কবিতায় লিখলেন :
    “কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছেনা
    যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে ? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে
    তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন?”

    আগুনের মতো সব লেখা বেরিয়ে আসছে । নতুন ভাষা, নতুন আঙ্গিক, ঝরঝরে গদ্য, তথাকথিত অশ্লীল ও যৌনশব্দের মিশেল, একবার পড়লে আর একটা পড়তে ইচ্ছা হবে । গ্রন্হ প্রকাশিত হতে লাগল আন্দোলনকারীদের । শৈলেশ্বর ঘোষের ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’, সুভাষ ঘোষের ‘আমার চাবি’, ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’, ফালগুনী রায় লিখলেন ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’, বাসুদেব দাশগুপ্ত লিখলেন, ‘রন্ধনশালা’, সুবিমল বসাক লিখলেন ‘ছাতামাথা’, মলয় রায়চৌধুরী লিখলেন ‘শয়তানের মুখ’, ত্রিদিব মিত্র লিখলেন ‘হত্যাকাণ্ড’, প্রদীপ চৌধুরী লিখলেন ‘চৌষট্টি ভুতের খেয়া’, আরও অনেকের লেখা বই ।

    আঁকার জগতে প্রসারিত হল হাংরি ভাবধারা । যোগ দিলেন অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । মাত্র সাতাশ বছর বয়সে অনিল করঞ্জাই দিল্লির ললিতকলা অ্যাকাডেমির পুরস্কার পেয়েছিলেন।

    কলকাতায় আন্দোলনের ধারা ঝড় তুলেছে । বিভিন্ন জীবজন্তু, জোকার, রাক্ষস, দেবতার মুখোশ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি, কবি, লেখক, সাংবাদিক, সরকারি আধিকারিকদের পাঠিয়ে বল হলো ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ । পত্রিকার দপতরে বাচ্চাদের চটির বাক্স পাঠিয়ে বলা হলো রিভিউ করতে । নিমতলা শ্মশানঘাট, মাইকেলের কবর, খালাসিটোলা-মদের আড্ডায় কবিতা উৎসব করলেন তাঁরা, হাওড়া স্টেশনে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়লেন ত্রিদিব মিত্র ও মলয় রায়চৌধুরী । মাইকেল এবং জীবনানন্দ ছাড়া অন্য কোনও কাব্যপ্রতিভাকে স্বীকার করতেন না তাঁরা । রবীন্দ্রনাথকে তাঁর গানের জন্য শ্রদ্ধা করতেন । রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন বাসুদেব দাশগুপ্ত ও মলয় রায়চৌধুরী ।

    হাংরি আন্দোলনের সংবাদ বিদেশেও পৌঁছালো । আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে ফোটোসহ হাংরি আন্দোলনকারীদের সংবাদ প্রকাশিত হবার পর ভারতের অন্যান্য ভাষায় ছড়িয়ে পড়ল । ১৯৬৩ সালে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে পাটনায় গিয়ে দেখা করলেন বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ । বেনারসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের। কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক লেখকরা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি অ্যাকশান নেবার জন্য । ১৯৬৪ সালে পুলিশ তাঁদের ওপর অ্যাকশান নেয়া আরম্ভ করলে, আমেরিকা থেকে অ্যালেন গিন্সবার্গ হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম এর কর্তাব্যক্তি আবু সয়ীদ আইয়ুবকে ১৯৬৪ সালের ৬ই অক্টোবর চিঠি লেখেন :-
    “আপনার বাগাড়ম্বর আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলছে । মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন ? ‘আমার কোনো পদমর্যাদা নেই’, এসব কথার মানে কি ? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড আছে । ভারতীয় কমিটির এগজিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে । বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি আপত্তিকর উপাদানের কথা । মশায়, আপনি এবং পুলিশই একমাত্র লেখাগুলি আপত্তিকর বলছেন । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি । পুলিশ নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । ” ( দেশ, অক্টোবর, ২০১৫ )

    আবু সয়ীদ আইয়ুব অ্যালেন গিন্সবার্গকে জবাবে বলেন, “আই ডু নট অ্যাগ্রি উইথ ইউ দ্যাট ইট ইজ দি পপাইম টাস্ক অব দি কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম টু টেক আপ দিস কজ অব দিস ইমম্যাচিয়র ইমিটেটরস অব আমেরিকান পোয়েট্রি।”

    আবু সয়ীদ আইয়ুবের উষ্মার কারণ ছিল । মলয় রায়চৌধুরী সেসময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কবি-লেখকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “ফাক দি বাস্টার্ডস অব গাঙশালিক স্কুল অব পোয়েট্রি”। কথাগুলি একটি বিয়ের কার্ডে ছাপিয়ে সাহিত্যিকদের পাঠানো হয়েছিল ।মলয়ের দেওয়া অভিধা আইয়ুব সাহেবকে আঘাত করে থাকবে ।

    বিরোধের কারণ হল, ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত একটি হাংরি বুলেটিনে মলয় রায়চৌধুরীর লেখা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ( Stark Electric Jesus ) কবিতাটি, যার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে । এছাড়াও ওই কবিতায় প্রচলিত কাব্যভাষার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ ছিল । কবিতাটি এখানে দেয়া হল:

    ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
    আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
    আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
    সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
    শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতর চলে যেতে দাও
    চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
    সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
    আর আমি পার্ছি না, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
    আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
    প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
    শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
    মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
    তাহলে আমি দুকোটি আলোকবষহ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম
    কিন্তু কিছুই ভলো লাগছে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না
    একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
    ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
    কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে
    এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
    সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
    ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
    শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
    দিতেই হবে শুভাকে
    ওঃ মলয়
    কোল্কাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
    কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কী কোর্বো বুঝতে পার্ছি না
    আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
    আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
    আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
    প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
    অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
    শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
    অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
    যোনোকেশরে কাঁচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্হতা
    আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
    আমি বুঝতে পার্ছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
    আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
    আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে
    শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
    জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
    আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
    তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
    তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
    আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
    আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
    সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
    আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
    শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
    ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
    শুভা, ওঃ শুভা
    তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
    পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
    যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
    ১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
    তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
    পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
    হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
    আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
    মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
    তুল্কালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়
    সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
    শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব
    কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
    শুভা
    আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও
    দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
    বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
    কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?
    কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি ?
    কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায় ?
    অথচ আমার নীচে চিত আধবোজা অবস্হায়
    আরামগ্রহণকারিণী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার
    এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
    আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
    এখন আমার হি২স্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
    মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
    আমি মরে যাব
    ওঃ এসমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
    আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
    পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
    ৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
    ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
    এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
    হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
    ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
    কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার আপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি

    তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকরা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষুধার্ত ভাষা সম্পর্কে আতঙ্কিত হচ্ছিলেন । প্রচারের সব আলো তখন হাংরি আন্দোলনের দিকে । সরকার বিব্রত হচ্ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের বৌদ্ধিক আক্রমণে । একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ( পবিত্র বল্লভ ), কয়েকজন কবি এবং পুলিশের ইনফরমাররা গোপনে তথ্য, বুলেটিন, পত্রিকা, হাংরিদের ঠিকানা ইত্যাদি যোগাড় করতে লাগল, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশান নেবার জন্য । পরিশেষে ছাব্বিশজন কবিকে লালবাজারে ডেকে জেরা করা হল । ওয়ারেন্ট ইশ্যু করা হল এগারোজনের বিরুদ্ধে । বুলেটিনের প্রকাশক হিসাবে সমীর রায়চৌধুরী গ্রেপ্তার হলেন চাইবাসা থেকে । তিনি সেখানে ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ফিশারিজ অফিসার । কলকাতার পুলিশ পাটনায় গিয়ে মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করল । গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ইন্সপেক্টররা রিকশায় বসলেন এবং মলয়কে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতের মতন রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে বহু লেখাপত্র নষ্ট করে দেওয়া হল। ফাইল, বইপত্র, টাইপরাইটার ইত্যাদি বগলদাবা করে কলকাতায় নিয়ে গেল লালবাজার পুলিশ, যা আর পরে ফিরে পাননি হাংরি আন্দোলনকারীরা। শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ গ্রেপ্তার হল কলকাতায় । তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আগরতলা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলো প্রদীপ চৌধুরীকে । দেবী রায়কে বর্ধমানে পোস্টাফিসের দপতর থেকে গ্রেপ্তার করে আনা হল । সুবো আচার্য আগরতলা থেকে এক উপজাতি গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলেন, পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি । সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষকে দিয়ে মলয় ও হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় । মলয়ের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু — এনারা মলয়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন । শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ মলয়ের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে ছাড়া পান । ১৯৬৫ সালে নিম্ন আদালতে ( ব্যাংকশাল কোর্ট ) মলয়ের দণ্ডাদেশ হয় । মলয় এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ।

    কলকাতায় যখন হাংরি আন্দোলন নিয়ে তোলপাড় চলছে , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন মার্কিন সরকারের টাকায় গেছেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার কর্মশালায় যোগ দিতে । ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা সামলাচ্ছেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় । স্বাভাবিকভাবেই সুনীল বেশ উদ্বিগ্ন । তাঁর অবর্তমানে কলকাতা দখল করে নিচ্ছে একদল তরুণ, এবং তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না ; বন্ধুদের চিঠি পেয়ে তাঁর উদ্বেগ বাড়ছে । ১৯৬৪ সালের ১০ই জুন একটি চিঠিতে সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে লিখলেন, “কলকাতা শহরটা আমার, ফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব । দু’একজন বন্ধুবান্দব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি । এখনও সে ক্ষমতা রাখি । লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি । যতো খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না ।” আসলে সুনীলও প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের মতো হাংরি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা ও বিস্তার নিয়ে শঙ্কিত হচ্ছিলেন । আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিনে হাংরি আন্দোনকারীদের রচনা তাঁর চোখের সামনেই প্রকাশিত হচ্ছিল । উক্ত চিঠিতে সেই উদ্বেগের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ।

    কলকাতা হাইকোর্টে মলয়ের মামলাটি ওঠে বিচারক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে ।মলয়ের হয়ে মামলাটি হাইকোর্টে লড়েছিলেন ব্যারস্টার মৃগেন সেন ও তাঁর চারজন সহকারী । মৃগেন সেনের কাছে মলয়কে নিয়ে গিয়েছিলেন সদ্য লণ্ডন থেকে ফেরা ব্যারিস্টার, জ্যোতির্ময় দত্তের বন্ধু, করুণাশঙ্কর রায় ।

    ব্যাংকশাল কোর্টে মলয়ের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ‘উপদ্রুত’ পত্রিকার সম্পাদক পবিত্র বল্লভ । এর পর লালবাজারের জাল সাক্ষী দিয়ে গেলেন এক অফিসার যিনি মলয় রায়চৌধুরীকে পাটনা থেকে গ্রেপ্তার করে এনেছিলেন । এরপর শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি প্রথম হাংরি ইস্তাহারে লিডার ছিলেন । এছাড়াও মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, অন্য দুই হাংরি শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ । তারপর মলয়ের পক্ষের সাক্ষীরা । প্রথমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারককে জানালেন কবিতাটি অবসিন নয়, ভালগারও নয়, কবিতাটিতে নামমাত্র অশ্লীলতা আছে বলে তিনি মনে করেন না । একে একে সাক্ষ্য দিলেন তরুণ সান্যাল, কবি বুদ্ধদেব বসুর জামাতা জ্যোতির্ময় দত্ত, কবি অজিত দত্ত’র মার্কিন-প্রবাসী পুত্র সত্রাজিৎ দত্ত । মলয়ের পক্ষে এতোজনের সাক্ষ্য সত্ত্বেও বিচারক অমলকুমার মিত্র মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারীদের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন।
    কলকাতা হাইকোর্ট মলয়কে ১৯৬৭ এর জাজমেন্টে বেকসুর খালাস করে দেন । মলয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগকে নাকচ করে দেন বিচারক । এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় ভালো রকমের সাড়া ফেললো । টাইম ম্যাগাজিন লিখলো, ‘ক্যালকাটাজ হাংরি জেনারেশন ইজ এ গ্রোইং ব্যাণ্ড অব ইয়ং বেঙ্গলি টাইগার্স উইথ টাইগার্স ইন দেয়ার ট্যাঙ্কস’।
    মলয়ের ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হল ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে, ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ নামে যা হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড অনুবাদ করেছিলেন । কবিতাটি এবং তাঁর কোর্ট কেসের সংবাদ তার আগে প্রকাশিত হয়েছিল লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি সম্পাদিত ‘সিটি লাইটস জার্নাল’ পত্রিকায় । এই সিটি লাইটস থেকেই প্রকাশিত হতো বিট আন্দোলনের কবি ও লেখকদের বই ।

    ১৯৬৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ব্লিৎস পত্রিকায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী হাংরি আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হল । তাতে বলা হল, “পুলিশ ন্যাব ক্যালকাটা বিটনিকস । ইরটিক লাইভস অ্যাণ্ড লাভস অব হাংরি জেনারেশন।”

    আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময়ে আনন্দবাজার, যুগান্তর, সাপ্তাহিক জনতা নামের সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত হাংরি আন্দোলনের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হতো । দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগান্তর, আনন্দবাজর পত্রিকায় মলয় ও দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ে জনতা পত্রিকার প্রথম পাতায় একবার মলয়ের আকটি কার্টুন প্রকাশিত হল । উপরে শিরোনাম “কল্লোল যুগের প্রৌঢ় কবিও কি হাংরি?” কার্টুনের তলায় বুদ্ধদেব বসুর সাম্প্রতিক একটি লেখা থেকে কয়েক লাইন । উদ্ধৃত অংশটি লেখার কিছুদিন আগেই বুদ্ধদেব বসু আমেরিকা গিয়েছিলেন । লেখাটিতে বুদ্ধদেব বসুর এরকম লাইন ছিল, “শিথিল শাড়ি, সোনালী শরীর গলে যায় ধীরে, স্তনের বোঁটা, চোখের মতো কাঁপছে । টার পাই তার স্তন দুটি উঁচু হয়ে আমাকে দেখছে । বলি, থামো, যেও না, ময়লা জিনের প্যান্টালুন থেকে বেরিয়ে আসবে তলোয়ার, জ্বলবে আমার আগুন তোমার জোয়ারে । জবাবে সে মাথার তলা থেকে বালিশ ফেলে দেয়, দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় শাড়ি, তার উদর পালের মতো এগিয়ে আসে । এখনও তবু আমি লুব্ধ । হাড়ে হাড়ে অমর কাম ক্ষমাহীন।”

    এই লেখাটি প্রমাণ করে যে কেবল যৌন শব্দপ্রয়োগের জন্যই মলয় রায়চৌধুরী আক্রান্ত হননি । তাহলে বুদ্ধদেব বসুও হতেন । আসল কারণ ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । প্রতিষ্ঠান চায়, ব্যক্তিএকক চিরকাল সরকার ও ক্ষমতাবান প্রাতিষ্ঠানিকদের পদানত থাকবে । এটাই সত্য । মলয়ের অসহ্য উপস্হিতি, সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্তাদের বিব্রত করছিল । তাই সকলকে ছেড়ে দিলেও মলয় রায়চৌধুরীকে মামলার মুখোমুখি হতে হয় । হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি বেঁধে তাঁকে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । হাংরি আন্দোলন মামলা চলাকালীন বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন মলয়, তাঁর কবিতা ভবনের বাড়িতে গিয়ে । বুদ্ধদেব বসু দেখা করতে চাননি ; মলয় পরিচয় দিতেই দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ।

    এখন দেখা যাক মলয় রায়চৌধুরী মানুষটা কেমন । কিসের জোরে হাংরি আন্দোলনের মতো এতো বড়ো উথালপাথাল ঘটিয়ে দিতে পারলেন, তার জন্ম দিলেন, তাকে লালন করলেন, অংশগ্রহণকারীদের একত্রিত করে প্রকৃত নেতৃত্ব দিলেন । বাংলা কবিতার খোলনলচে পালটে দিয়ে জেল খাটলেন কবিতা লেখার জন্য । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রাতিষ্ঠানিক লেখককে ভয় পাইয়ে দিলেন । মলয় রায়চৌধুরী, যিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন, সাহিত্যের আধুনিকতাবাদ একটি ‘ধ্রুপদী জোচ্চোর’ ।

    মলয় ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন পাটনা শহরের ইমলিতলা নামের এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত পাড়ায়, যেখানে ডোম, মেথর, দুসাধ, চামার, কুমোর, দরিদ্রতম মুসলমান পরিবারের বসবাস ।

    মলয়ের শৈশব কেটেছে প্রত্যহ সন্ধ্যায় শূকরের মৃত্যুকালীন আর্ত-চিৎকার শুনে । পাড়ার গরিব অন্ত্যজরা শুকরের মাংস খেতো । শূকরকে মারার জন্য প্রাণীটাকে একটা গর্তে ফেলে দিয়ে তার দেহে গনগনে লোহার শিক বিঁধে দিত, আর তার মৃত্যকালীন চিৎকারে ভারি হয়ে উঠত মহল্লার বাতাস । কম বয়সি বাচ্চাদের মুখে ফিরত “পুরি কচৌড়ি তেল মে, জিন্না বেটা জেল মে।”

    মলয় প্রাথমিক শিক্ষা পান পাটনা শহরের মিশনারি স্কুলে । মিশনারি স্কুলের চার্চের ফাদার হিলম্যান মলয়ের বাবার ফোটোর দোকানের ক্রেতা ছিলেন ; তাঁরই সহযোগিতায় মলয় ভর্তি হন, এবং তাঁর ফিসও মুকুব করে দেয়া হয়েছিল । তারপর ক্লাস সিক্স থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে । পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে অর্থনীতিতে সান্মানিক স্নাতক হন, দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন । ১৯৬০ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হন, এবং পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন । পাশ করা মাত্র তিনি ভাগলপুর ও শিলঙে অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবা-মা তাঁদের একা ছেড়ে যেতে বারন করেন । মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী ডিস্ট্রিক্ট ফিশারিজ অফিসার হিসাবে বিহারের বিভিন্ন জেলা সদরে চাকরি করতেন । বাবা-মাকে দেখার আর কেউ ছিল না । মলয়রা দুই ভাই, কোনও বোন নেই ।

    পাটনার অতিদরিদ্র ইমলিতলা পাড়ায় বসবাস করলেও, মলয়ের একটি উজ্জ্বল পারিবারিক অতীত আছে । বড়িশা-বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী বংশের সপ্তম প্রজন্ম মলয় । বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী, মা অমিতা রায়চৌধুরী । মলয়ের বাবা ও দাদুর কোনো বিদ্যায়তনিক শিক্ষা চিল না । দাদু ফারসি, আরবি, উর্দু লিখতে পড়তে পারতেন, কিন্তু ইংরেজি জানতেন না । সেই অর্থে মলয় এবং দাদা সমীরই স্কুল-কলেজে শিক্ষিত প্রথম প্রজন্ম । মলয়ের বাবার ঠাকুর্দা সাবর্ণ চৌধুরী পরিবার থেকে বিতাড়িত হন মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাল্য বিধবাকে বিবাহের কারণে । মলয়ের বাবার পাটনায় ফোটোগ্রাফির দোকান ছিল, ব্যবসাটি পত্তন করেছিলেন মলয়ের ঠাকুর্দা, সেসময়ে তা ছিল ভ্রাম্যমান ফোটোর ব্যবসা । ঠাকুর্দা বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে গিয়ে অভিজাত পরিবারের সদস্যদের ফোটো তুলে তা থেকে পেইনটিঙ আঁকতেন । মলয়ের জেঠামশায় প্রমোদ ছিলেন পাটনা মিউজিয়ামের ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার’।

    সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর কাছ থেকেই ১৬৯৮ সালে মাত্র তেরোশো টাকায় জোব চার্নকসুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা নামের তিনটি গ্রামের ইজারা নিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন করেন । নবাবের নির্দেশে তাঁরা ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষ নেবার কারণে সাবর্ণ চৌধুরীরা অন্যান্য অভিজাত পরিবারের তুলনায় ব্রিটিশদের দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, এবং তাঁরা ক্রমশ ছত্রভঙ্গ হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েন ।

    বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করার সময় থেকেই মলয় মার্কসবাদ ও ইতিহাসের দর্শন নিয়ে পড়াশুনা ও লেখালিখি করছিলেন । ‘ইতিহাসের দর্শন’ শিরোনামে তিনি ‘বিংশ শতাব্দী’ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক রচনা লিখেছিলেন । দাদার বন্ধু কবি দীপক মজুমদারের পরামর্শেই তিনি ইতিহাসের পরিবর্তে ইতিহাসের দর্শনে আগ্রহী হন । ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কিত বইগুলি পড়ার সময়ে মলয় ইতিহাসকার অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট’ বইটির সঙ্গে পরিচিত হন । ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় পেয়েছিলেন ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে । অসওয়াল্ড স্পেংলারের বই এবং জিওফ্রে চসারের কবিতার লাইন মলয়কে হাংরি আন্দোলনের তাত্বিক ভিত গড়তে সাহায্য করেছিল ।

    স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা লিনিয়র নয়, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবিক প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশ কোন দিকে কার বাঁকবদল ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে থাকে ; তার নিত্য নতুন স্ফূরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয়, যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই ‘আত্মসাৎ’ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন।

    মলয় রায়চৌধুরীর মনে হয়েছিল, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ঙ্কর অবসাদের মুখে পড়েছে । কলকাতা থেকে পাণিহাটি যাবার সময়ে ( তাঁর দাদা সমীর পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থেকে কলকাতার সিটি কলেজে যাতায়াত করতেন ) মলয় ও সমীর উদ্বাস্তুদের অসহায় জীবন প্রত্যক্ষ করতেন প্রতিদিন, কলকাতার পথে দেখতেন বুভুক্ষুদের প্রতিবাদ মিছিল । ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ প্রকাশ করার জন্য তাঁদের দুজনের মনে হয়েছিল হাংরি আন্দোলন জরুরি । মলয় মনে করতেন, তাঁরা না করলেও অন্যেরা এই ধরণের আন্দোলন করত, প্রতিষ্ঠানকে নাস্তানাবুদ করত ।
    মলয়ের প্রথম বই প্রবন্ধের, ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’, ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । হাংরি আন্দোলনের সময়ে একটি কপি দেবী রায়ের কাছে রেখে বাকি কপি পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল । মলয় পরে বলেছিলেন, ওই পুড়িয়ে দেয়াটা ছিল একটা পলিটিকাল ব্লাণ্ডার । শোনা যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওপর ক্ষেপে গিয়ে শক্তির উল্টোডাঙা বস্তিবাড়ির সামনে বইগুলো জড়ো করে জ্বালিয়েছিলেন মলয় । তাঁর দ্বিতীয় বইটি ছিল কবিতার ; বইয়ের নাম শয়তানের মুখ, ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয় কবি অথবা লেখক নেই যাঁর গ্রন্হ শক্তি এবং সুনীল দুজনেই প্রকাশ করেছিলেন ।

    মলয়ের গ্রন্হাবলী ও সাহিত্যচর্চাকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায় । যার প্রথম পর্ব ছিল হাংরি আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া পর্যন্ত । অর্থাৎ ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল । এই সময়পর্বে তিনি ‘জেব্রা’ নামের একটি পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশ করেন এবং শতাধিক হাংরি বুলেটিন প্রকাশের জন্য আর্থিক সাহায্য করেন । হাংরিদের পত্রিকার কভারের ব্লকও তিনি পাটনা থেকে করিয়ে এনে দিতেন । মলয়ের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিজীবীরা পেরে উঠতেন না তার কারন মলয়ের গভীর পড়াশুনা ।

    ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকায় মলয় সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন :-
    “মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম । তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও পোলেমিক্সের সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা। তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেনিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে — আক্রান্ত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি । গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা-যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতির’ ঘরে তাঁর লালন-পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ, বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মআজাগতিক সচেতনতা,মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতে খড়ি হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে?’ বলা বাহুল্য তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছিলেন ‘পলিটির’ কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব — মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন।”
    প্রথম পর্বের পর প্রচণ্ড অভিমান, ঘৃণা ও বিরক্তিতে মলয় তাঁর সমস্ত বইপত্র বিলিয়ে দিয়ে প্রথমে লখনউ ও পরে মুম্বাই চলে যান । রিজার্ভ ব্যাঙ্কে নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে তিনি অ্যাগরিকালচারাল রিফাইনান্স ও ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে যোগ দেন, এবং তখন থেকেই তিনি চাকুরিসূত্রে ভারতের গ্রামেগঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, কুমোর, চামার, ঝুড়ি প্রস্তুতকারী, খেতমজুর, ছুতোর প্রমুখ সমাজের তলার দিকের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হন যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধে । এআরডিসি থেকে তিনি চলে যান নাবার্ডের মুম্বাই হেড অফিসে এবং ১৯৯৭ সালে অবসর নেন কলকাতা দপতরের ডেপুটি জেনারাল ম্যানেজার হিসাবে, পশ্চিমবঙ্গে সম্পর্কে প্রভূত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর ।

    দ্বিতীয় পর্বের আত্মপ্রকাশ আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে । মহদিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক উত্তম দাশ তাঁর লখনউয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে কবিতা সংকলন ও ইস্তাহারগুলির সংকলন প্রকাশে উৎসাহিত করেন । দুই পর্ব মিলিয়ে, এই রচনা লেখার সময় পর্যন্ত মলয়ের কাব্যগ্রন্হ চৌদ্দটি, উপন্যাস চৌদ্দটি, ছোটোগল্প সংকলন দুটি, নাটকের বই একটি, অগ্রন্হিত কাব্যনাটক তিনটি, প্রবন্ধ সংকলন সতেরোটি, স্মৃতিকথা দুটি, অনুবাদগ্রন্হ সাতটি, সাক্ষাৎকারগ্রন্হ চারটি — সব মিলিয়ে সত্তরটির মতো ।

    সাতাত্তর বছর বয়সে এসে কমপিউটারে এক আঙুলে টাইপ করে লেখেন । এখনও সচল মস্তিষ্ক । চিকিৎসা বিভ্রাটে আর্থ্রাইটিসে সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে কাজ করে চলেছেন । তরুন কবি ও লেখকদের বইয়ের ভূমিকা লিখে দিচ্ছেন । যৌবনের শুকনো নেশা, ক্যানাবিস, হ্যাশিস, মেস্কালিন, এলএসডি, আফিম, খালাসিটোলার বাংলা, পাটনার ঠররা, নেপালের ঠমেলে মোষের কাঁচা মাংস হরিণের মাংসের আচার আর গমের মদ ইত্যাদি থাবা বসিয়েছে স্বাস্হ্যের ওপর ।

    মলয়ের যাবতীয় লেখালিখি সবই লিটল ম্যাগাজিনে । এপার বাংলা, বাংলাদেশে এবং যেখানে বাংলা ভাষার কাগজ প্রকাশিত হয় তার প্রায় সব কাগজেই মলয় কোনো না কোনো সময় লিখেছেন । প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাগজে মলয় কখনও একলাইনও লেখেননি । মলয় সম্ভবত একমাত্র লেখক যিনি তাঁর বইতে ঘোষণা করতেন যে তাঁর বইয়ের কারোর কোনো কপিরাইট নেই । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় স্হির অবিচল মলয় ২০০৩ সালে ফিরিয়ে দিয়েছেন অকাদেমি সাহিত্য সন্মান । যদিও তাঁর এক সময়ের হাংরি বন্ধ শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, সুবিমল মাথা পেতে সরকারিপুরস্কার নিয়েছেন । মলয়ের লেখালিখির ওপর পিএইচডি করেছেন আসাম বিশ্ববিদ্যলয়ের কুমার বিষ্ণু দে এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদয়শঙ্কর বর্মা । এম ফিল করেছেন অনেকে, এখনও কয়েকজন করছেন । তাঁর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা নিয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক শুভশ্রী দাশ ।গবেষণা করেছেন মার্কিন ছাত্রী মারিনা রেজা ।

    ‘মধ্যরাত্রি’ পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ সমিদুল ইসলাম একটি সাক্ষাৎকার মলয় রায়চৌধুরীকে প্রশ্ন করেছিলেন, “মলয়বাবু, আপনি কখনও নিশ্চয়ই ভেবে দেখেছেন, আপনি কী ? আপনি কে?”
    জবাবে মলয় জানিয়েছিলেন, “আজিজুল হক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মলয় রায়চৌধুরী মানব সমাজের পেরিফেরির জীব, সোজা বাংলায় আমি একজন কালচারাল বা্টার্ড।”
    ( ‘নতুনপথ এই সময়’ পত্রিকার ১৪২৪ শরৎ সংখ্যায় প্রকাশিত )
  • Biswajit | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৪541333
  • বিশ্বজিত সেন
    মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা

    বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা ভাবাভাবি করেন, তাঁদের কিছু মজার প্রবণতা আছে। তাঁরা কবিতাকে গদ্য থেকে একেবারে আলাদা করে দেখেন, ও সেই দেখা চিরস্হায়ি করতে নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রপেরও আয়োজন রয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেরই নাম--- কবিপ্রণাম । রবীন্দ্রনাথকে মূলত দেখা হয় কবি হিসাবে। গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ তেমন গুরুত্বপূর্ণ লোক নন। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলব, গল্পলেখক রবীন্দ্রনাথই আমার কাছে সর্বাধিক গ্রাহ্য । যদিও রবীন্দ্রনাথের গল্প লেখার দর্শন আমার কাছে একেবারেই গ্রহণীয় নয়, তবু 'কবি' রবীন্দ্রনাথের চেয়ে, এই লোকটি আমার চোখে ঢের বাস্তব।

    কবিতাকে আলাদা করে দেখা, তাকে সুউচ্চ বেদিতে বসিয়ে রাখা, অহরহ গুজগুজ-ফিসফিস, আরে আজও যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে বাংলা সাহিত্যে ও মধ্যবিত্ত জনজীবনে । এ নিয়ে চিন্তা করেছি, আজও মাঝে-মাঝে করি। এ ভাবনার উৎস কোথায়?কিছুটা কি "ভারতীয় অতীত"- এর ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত--- সবই কবিতায় । কবিকে রহস্যময় মানুষ মনে করা হত, যিনি নিজের চিন্তা-ভাবনাকে ছন্দবদ্ধ করতে সক্ষম। মনে করা হত স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর কাছে বার্তা পাঠিয়ে থাকেন। ভগবানের স্পেশাল মেসেঞ্জার তিনি, 'নট টু বি টেকন লাইটলি'। তার বহু পরে, 'ভক্তি' যুগে ভারতীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবিকে সাধক বানিয়ে কুলুঙ্গিতে লাল শালু মুড়ে রেখে দেওয়া হল।কবীর, দাদু, নানক, সুরদাস, রহিম, জয়দেব, চণ্ডীদাস । তুলসীদাসকে 'গোঁসাই' বানিয়ে তাঁরও একই হাল করা হল।'রামচরিতমানস'কে ধর্মগ্রন্হ মনে করে গদগদ আপামর হিন্দিভাষী জনসাধারণ। তার দোহায় দোহায় শব্দের যে অদ্ভুত খেলা, ভাষাকে কাদার মতো ব্যবহার করে তা থেকে বিচিত্র নানা মূর্তি গড়ে তোলা, সেদিকে দুচারজন ক্রিটিক ছাড়া কারো নজরই যায়নি প্রায়। হিন্দি সাহিত্য ঐশ্বরিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে কবে একাজে হাত দেবে জানি না । আজকে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, এ-কাজ করার সময় এসে গেছে ।

    ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চল কিন্তু কবিকে অনেক সহজভাবে নিয়েছিল। কথক ও কবিয়াল ছিলেন, কবিগান ছিল। যাত্রার, পালার আসর ছিল, চণ্ডীতলা ছিল। অবশ্যই কবিকে স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ লোক মনে করা হত; তবে সাউক বা অবতার, বা ভগবান নয় । কবির লড়াইতে তো কবিতা তৈরি হত সর্বসমক্ষে, মুখে-মুখে। আর হারজিতও ছিল। কাজেই রহস্যের সেখানে কোনো ভূমিকাই ছিল না । কবি স্পেশাল টেকনিকে দক্ষ বলে তাঁদের আদর-আপ্যায়নও হত, তবে তাঁকে একটি বেদিতে বসিয়ে তাঁর মুখের ওপর স্পটলাইট জ্বেলে রাখা ? নাঃ ! ইংরাজপূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে তা করা হত না।

    ইংরাজরা আসার পর বাংলা সাহিত্যে কবিতার রহস্যের আমদানি হয় । নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে ইংরাজদের কিছু ছিল না। যাকে তারা নিজের সংস্কৃতি বলত, তার খুঁটিগুলো সবই ছিল গ্রিস, রোম থেকে ধার করা। গ্রিসে 'বার্ড' বা ভ্রাম্যমান কবিদের নিয়ে রহস্য গড়ার অভ্যাস প্রচলিত ছিল। ভক্তি যুগের আদলেই প্রায় বলা যায়, তাঁদের 'ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা', ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী, ইত্যাদি মনে করা হত। হোমারের স্হান গ্রিক মানসে প্রায় ঋষির জায়গাতেই ছিল, দাড়ি-টাড়ি সমেত। শেকসপিয়রও আরও কয়েকশো বছর আগে জন্মালে ঐ জায়গাতেই পৌঁছে যেতেন। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি পরে জন্মানোর দরুন বিশ্বসাহিত্য একটি নিদারুণ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

    রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, সাহিত্যিক জীবনের পরবর্তীপর্বে, কবিতার বিশেষত্বের জায়গা থেকে অনেকটা সরে এসেছিলেন। যাকে সাহিত্যের বিশেষজ্ঞরা 'গদ্য কবিতা' বলেন, তা তাঁর এই বোধের সাক্ষ্য দেয়। তাঁর কিছু গদ্য কবিতা গল্পকেন্দ্রিক। সাহিত্যকর্ম ইশাবে অনেক উঁচু দরের কাজ সেগুলো। মোদ্দা ব্যাপার হল, আজ পাড়াব-পাড়ায় 'কবি প্রণাম' সত্ত্বেও সাহিত্যের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির মাঝখানের দেওয়াল ধ্বসিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁকে বাঙালি এত বেশি 'কবি' বানিয়ে ফেলেছিল যে হাত খুলে এই কাজটি করা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। তবে কাজের মধ্য দিয়ে ঠারে-ঠারে যতটা পেরেছেন, করেছেন। বিশেষ করে ছবি আঁকার মাধ্যমে।

    কবিতাকে বা কবিকর্মকে ঘিরে একটা রহস্য সৃষ্টি করে রাখলে কবিতা কখনই সামাজিক পরিস্হিতির দলিল হয়ে উঠতে পারে না। কবিতার মিস্টিসিজমের প্রথম অসুবিধে এটা। কবিতা যদি সামাজিক পরিস্হিতির দলিল না হয়, তবে তাকে ড্রইংরুম সাজানোর ডলপুতুল বা অশ্রুমোছার রুমাল হয়ে থাকতে হয় কেবল।সেটা অবশ্য অনেকেরই মনঃপূত, বিশেষ করে যাঁরা 'সমাজ-টমাজ'কে দশ হাত দূরে রাখতে চান। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও লড়াই আছে, পক্ষ-প্রতিপক্ষ আছে। একটি পক্ষের বিশেষ দর্শন এটাই। কবিতার গায়ে গরম হাওয়ার ঝাপটা যেন না লাগে।

    কবিতার মিস্টিসিজমের দ্বিতীয় অসুবিধে ভাষার স্তরে। ভাষা তো একটি নদী বিশেষ। একূল-ওকূল দুকূলই সে ভাসায়। তাকে সিমিলি, মেটাফর, ছন্দবৃত্ত, মাত্রা, পয়ার ইত্যাদির গণ্ডীর মধ্যে সর্বদা বেঁধে রাখা যায় না। কবিতার নিয়মানুবর্তিতা থেকেই কবিতার মিস্টিসিজমের জন্ম। এই নিয়মানুবর্তিতার দরুনই, একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজন অনুভূত হয়, যে কবিতা 'লিখতে পারে'। যে 'পারে না', তাকে দূর করো, দাঁড় করিয়ে রাখো দরজার বাইরে। তার ভাষাটিও ব্রাত্য।

    তাই, কবিতার স্বার্থেই, কবিতার রহস্যময়তাকে ভাঙা অত্যন্ত প্রয়োজন।

    বাংলা সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠক সম্প্রতি নড়ে-চড়ে বসেছেন। ষাটের দশকে, যে একটি তুমুল ওলোট-পালোট ঘটে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে--- সেদিকে নজর গেছে তাঁদের। দেরিতে হলেও, এটাই কাম্য ছিল।'হাংরি আন্দোলন' নিয়ে ইতিপূর্বে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোছের কথাবার্তা হয়েছে। 'হাংরি আন্দোলনকারীদের' গভীর মননশীল পঠন-পাঠন ছিল, যাকে বলা যায় ওভারভিউ। হাংরির পরেও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন এসেছে, তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঝাঁকুনি হিসাবে হাংরিই ছিল "প্রথম"। বাংলা সাহিত্যের অবস্হা, হাংরি আন্দোলনের আগে ছিল অকালবৃদ্ধ আফিংখোরের মতো। রবীন্দ্র ঐতিহ্য পুঁটুলি বেঁধে কোলে নিয়ে বসে ঝিমোনো আর মাঝে-মাঝে চটকা ভেঙে, "অ্যাই, গোল কোরো না বলচি, পড়াশুনো করো, পড়াশুনো..."। অথচ দেশে-বিদেশে তখন ঘটছে যুগান্তকারী ঘটনা । 'গ্রানমা' জাহাজে চড়ে বিপ্লব করতে আসা কয়েকজন যুবক হঠাৎ জয়ী হয়েছেন। ওয়াশিংটন থেকে মাত্র নব্বই মাইল দূরে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহের পতাকা। ওদিকে ঠাসবুনোট সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্রমে ঠোঙা বানাবার কাগজ বই আর কিছু নয়। স্হিতাবস্হাকামী বাণিজ্যিক সংবাদপত্র গোষ্ঠীর প্রচণ্ড একমাত্রিক দাপট বাংলা সাহিত্যে। তার দোরগোড়ায় মাথা না ঠুকলে কেউ মানুষই হবে না, সাহিত্যিক হওয়া তো দূরে রইল।

    এইরকম সময়ে বাংলা সাহিত্যের 'পীঠস্হান' কলকাতা থেকে দূরে, পাটনা শহরে, যেখানে ঐশ্লামিক ধর্মশাস্ত্র পড়তে গিয়েছিলেন রামমোহন রায়, আর বেশ কয়েক বছর চাকরি করে গেছেন দীনবন্ধু মিত্র, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি অপরিচিত গরিব পরিবারের যুবক মলয় রায়চৌধুরী আই আন্দোলনটির ছক কষেন। দাদা সমীর রায়চৌধুরী কলকাতায় সিটি কলেজে পড়েন, সেই সুবাদে যুবা বাঙালি লেখক-কবিদের সাথে আলাপ-পরিচয় । দেশ-দুনিয়ে জুড়ে উথালপাথাল সত্ত্বেও কলকাতা, ব্রিটিশের প্রিয় 'কালকুত্তা' তখনও শীতল। বামপন্হী দলগুলোর বিরুদ্ধে গান্ধীবাবার কংগ্রেস প্রতিপালিত গোপাল পাঁঠা, ইনু মিত্তিরদের দাপাদাপি; কলকাতা শীতল। কবিতা ভবন (!) থেকে 'কবিতা' বেরোয় । বুদ্ধদেব বসুর পরিশীলিত আঙুল কবি বাছাই করে, ফতোয়া দেয়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই উপস্হিতি। এককালে...'না না অমন বলবেন না । সুকান্তও কবি। ছন্দ বোঝে। এই দেখুন আমি দেখাচ্ছি --- পতা/কায় পতা/কায় ফেরমিল/আনবে ফেব্রু/য়ারি। দেখলেন ?

    অট্টহাসি উদ্রেক করা সেই সময়। সমীর রায়চৌধুরীর 'পাটনাই' হওয়ার দরুন কলকাতার যুবক কবিদের পাটনায় আনাগোনা। এঁদের মধ্যে অন্যতম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যাঁর বিষয়ে বাসব দাশগুপ্তকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মলয় বলেছেন, "শক্তির কবিতা সম্পূর্ণ নিজস্ব ও অসাধারণ। কেননা তিনি পাঁড় অশিক্ষিত, কোনো লেখাপড়া করেন না, এবং দর্শন, ইতিহাস, সমাজবোধ এসব ছিটেফোঁটা তাঁর মধ্যে নেই। নিজের খাঁটি বোধ থেকে তিনি লেখেন, তখন তাঁকে জীবনানন্দের পরের প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন মনে হয়।" মনে রাখা প্রয়োজন, এই সাক্ষাৎকারটি যখন দিচ্ছেন মলয়, তখনও হাংরি আন্দোলনের স্মৃতি, তজ্জনিত তিক্ততা, সব কিছু মলয়ের মস্তিষ্ককোষে উপস্হিত। কিছুই ক্ষমা করেননি। অথচ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে মলয়ের চোখা, টান-টান মূল্যায়ন। ব্যক্তিগত তিক্ততা সেখানে ছায়া ফেলেনি।

    হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনাপর্বে এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মলয় সঙ্গে পেয়েছিলেন, আর পেয়েছিলেন দেবী রায় ( হারাধন ধাড়া) কে। পাটনার সুবিমল বসাক এসে যোগ দেন কিছুকাল পরে।একটি সাহিত্য আন্দোলন, যা বাংলা সাহিত্যের হাল-হকিকত পালটে দিয়েছিল, কত সামান্যভাবে শুরু হয়েছিল, ভাবলে অবাক লাগে। প্রেস পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই মিষ্টির দোকানের বাকসো যে জব প্রেস ছাপতো, সেখানেই ছাপতে হয় হাংরি বুলেটিন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে মলয় তখন লোয়ার গ্রেড কেরানির চাকরিতে, কত মাইনে পেতেন জানা নেই, তবে প্রায় সম্পূণফ মাইনেটাই মনে হয় হাংরি বুলেটিনের পেছনে ঢালতে হত। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম কাগজ বেরোনোর আরম্ভটা এইরকম। 'শতভিষা' পত্রিকার তুলনায় 'কৃত্তিবাস' ও নিজেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজই বলত, তবে হাংরি বুলেটিনের সাথে তার ছিল মৌলিক প্রভেদ। 'কৃত্তিবাস' ছিল সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্খীদের কাগজ। তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে সুরে সুর মিলিয়ে। প্রতিষ্ঠান কখন যশ, প্রতিপত্তি, বৈভব, টাকাকড়ি, সামাজিক সুবিধার কাজে লেগে যায়, বলা তো যায় না। হাংরি বুলেটিনের উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধ। আপসের জন্যে সেখানে কোনও জায়গাজমি রাখা হয়নি।

    অনেকের মতে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি গিমিকের আশ্রয় নিয়েছিলেন রাতারাতি খ্যাত হবার জন্য, যেমন শাদা দিস্তা কাকজ, জুতোর বাকসো ইত্যাদি রিভিউএর জন্য পাঠানো, টপলেস প্রদর্শনীর আয়োজন ( টপলেসের অর্থ যে মুন্ড বা মস্তিষ্কবিহীনও হয়, এই বোধটুকু কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের হয়নি), জীবজন্তু-জোকারের মুখোশ বিলি ইত্যাদি। 'হাংরি কিংবদন্তি'তে মলয় উদ্ধৃত করেছেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের যে মন্তব্য, তা এ-প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে।কিন্তু মলয় বা তাঁর সঙ্গীরা কি জানতেন না যে প্রতিষ্ঠান ও প্রসাশন কতদূর হিংস্র হতে পারে? এ জানা সত্ত্বেও একজন চাকুরিজীবী ( মলয় ) নিজেকে এই ঝুঁকির সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন কেন ? শুধুই প্রচারের জন্য? না কি কিছু মূল্যবোধের ব্যাপারও ছিল ? মলয় তাঁর 'সাক্ষাৎকারমালা'র এক জায়গায় বলেছেন, 'ষাট দশকের সুস্হতা স্বাভাবিক ছিল না।' এই অস্বাভাবিক সুস্হতাকে ভালোমতো একটা ঝাঁকুনি দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তার জন্য দুহাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি পরে চোর-ডাকাতের সঙ্গে সার বেঁধে পাটনা শহরের রাস্তায় অতিপরিচিতজনের মাঝে হাঁটা, চাকুরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, পঁয়ত্রিশ মাস প্রতি সপ্তাহে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো--- সবই। প্রচার পাওয়ার জন্য যদি এত করতে হয়, তাহলে তো মুশকিল। এর চেয়ে সহজ রাস্তা তো কতই ছিল। বিশেষত, 'কৃত্তিবাস' গোষ্ঠীতে তাঁর দাদার বন্ধুরাই যখন সর্বেসর্বা। সমসাময়িক অন্যান্যদের মতন একটু মিঠে ব্যবহার রাখলেই আর দেখতে হচ্ছিল না। আর, 'কৃত্তিবাস'ও তেমন-তেন বৈশিষ্টহীন ও লুপ্ত হবার পথে এগিয়েছে। সাহিত্য আন্দোলন সম্পর্কে 'কৃত্তিবাসীয়'দের সততার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে ?

    বলা যেতে পারে যে 'কৃত্তিবাস' যদি সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে না টিকে থাকে তবে 'হাংরি বুলেটিন'ও তো টেকেনি। হ্যাঁ, হাংরি বুলেটিন উঠে গিয়েছিল মামলা-মকদ্দমার দরুন, অন্তর্কলহের দরুন। কিন্তু হাংরিদের ঝগড়াঝাঁটি ছিল খোলাখুলি, তাতে মধ্যবিত্তের চাপ-চাপ ঢাক-ঢাক ছিল না। মামলা-মকদ্দমার ভয়ে কেউ রাজসাক্ষী হয়েছিলেন ( সুভাষ ঘোষ,শৈলেশ্বর ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ ), কেউ ভেবড়ে গিয়ে কলকাতার বাইরে কেটে পড়েছিলেন ( প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখ )। সেগুলোকে দেখার কোনও অর্থ হয় না।'হাংরি বুলেটিন' বন্ধ হবার পর অগনণ পেশিবহুল বাহু এগিয়ে এসেছে আন্দোলনের পতাকা তুলে নিতে।জেব্রা, উন্মার্গ, ফুঃ, স্বকাল, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ওয়েস্ট পেপার, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দী ইত্যাদি পত্রিকাও হাংরি বুলেটিনই। মলয় কোনোদিন বলেননি যে হাংরি আন্দোলনের কপিরাইট একমাত্র তাঁর। হ্যাঁ, আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও দার্শনিক প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে, যা তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পাঠকদের সামনে রেখেছেন।এই অধিকার থেকে তো আর তাঁকে বঞ্চিত করা যায় না। মলয়ের পরবর্তীকালীনরা হাংরি মতাদর্শকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।এটিও একটি আন্দোলনের প্রাণশক্তির প্রমাণ। মলয়, হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর, পড়ালেখার নিজস্ব পৃথিবী গড়ে তুলেছেন, মন দিয়ে এবং চুটিয়ে বিভিন্ন শহরে চাকরি করেছেন, সংসার করেছেন, ভারতীয় জনজীবনকে দেখেছেন, জীবন থেকে শিখেছেন। আজ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধের যে হতচকিত-করা ফসল তিনি আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তা সম্ভব হতে পেরেছে এরই দরুন। বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আঙুলে চাবির রিং ঘোরাননি মলয়। এর জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। অন্তত একটি আকাশ এমন রয়েছে, যাকে ঢেকে ফেলতে পারেনি কালো মেঘ।

    মলয়কে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির দরুন মামলায় পড়তে হয়। কবিতাটি বর্তমানে বহুল প্রচারিত, তাই তাকে আর সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। তবে এই কবিতাটিকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এর পেছনে কোনো অসূয়া কাজ করছিল না, একটি কৌতুকপ্রদ মাইন্ডসেট-এর দিকে ইঙ্গিত করে। এই মাইন্ডসেটটি তদানীন্তন বুদ্ধিজীবী বাঙালির, যিনি পুজোর ছুটিতে সস্ত্রীক খাজোরাহো দেখতে যান। তাহলে মলয়ের কবিতা কেন গ্রহণীয় নয় ? মজা কেবল এই জায়গাটুকুতে নয়, অন্যত্রও আছে। "আমরা যখন অসভ্য ছিলুম তখন ওইগুলো বানিয়েছি। এখন আমরা সভ্য, এখন তো আর এসব চলতে দেওয়া যায় না ।" এও মানলাম, কিন্তু মাই ডিয়ার, ব্যাপারটা যে আদপে তা নয় একেবারেই। ব্যাপার আগাগোড়া অন্যরকম। যৌন রূপকল্প, দ্যোতক ও বিম্ব কেবল ব্যবহার করেছেন মলয়, সেগুলির মাধ্যমে নিজের কথা বলেছেন। এও চলবে না ? তাহলে শিবলিঙ্গ তুলে দিন, গৌরীপট্ট নাকচ করুন, অম্বুবাচী ব্যান করুন। কামাখ্যা মন্দিরে মা-কামাখ্যার মাসিক যেন আর না হয়। কি বলেন ? যাঁরা "অশ্লীল অশ্লীল" চিল্লিয়েছিলেন, তাঁরা সম্ভবত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর এই লাইনগুলো নজর করে দেখেননি--
    ১.
    জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
    আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
    তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে কিছুকাল ঘুমোতে দাও শুভা
    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
    ২.
    হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
    আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
    মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
    তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহ্যতায়
    সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
    শিল্পর জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো
    কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই...
    ৩.
    এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
    আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
    এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
    মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
    আমি মরে যাব...
    ৪.
    ৩০০০০০ লক্ষ শিশি উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
    ঝাঁকেঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
    এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
    হিপ্নটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
    ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
    কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি

    এই পঙক্তিগুলো একটু মন দিয়ে পড়লে বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পক্ষে বোঝা দুষ্কর ছিল না যে নিছক যৌনতা নয়, আরো গূঢ় কোনো বোধের দ্যোতনা এই পঙক্তিগুলোয় রয়েছে।'সাত বছর আগের একদিন' কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছিলেন, "অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে। লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই..."। এই পঙক্তিগুলোকে উদ্ধৃত করে জীবনানন্দকে শবসাধক সাব্যস্ত করা অবশ্যই উচিত হবে না, অথবা ঘোর অঘোরপন্হী। তেমনই হাস্যকর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ যৌনতার বহিঃপ্রকাশ খোঁজা। আসলে মলয়ের বিরুদ্ধে যখন ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার মকদ্দমা দায়ের করা হয়, তখন ষাটের দশকের 'অস্বাভাবিক সুস্হতা' রাজত্ব করছে পুরোদমে।'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে প্রবোধকুমার সান্যালের 'দেবতাত্মা হিমালয়' আর মেট্রো সিনেমার ফুটে রিফিউজি যুবতীদের শরীর নিয়ে চলছে অবাধ বাণিজ্য! পায়ের চটি ঘষটাচ্ছে রিফিউজি যুবক, 'মাই ওন সিসটার স্যার, ভেরি সুইট, ওনলি সিক্সটিন'। অথচ বাঙালি পাঠক 'কত অজানারে'র বারবেল সাহেব আর 'সখী সংবাদ' এর মিষ্টিদিদি, নতুন দিদি, এদের নিয়েই মুগ্ধ। সমাজ কোথাও নেই; সমাজের জ্ধবলাপোড়া, আর্তি, চিৎকার এগুলোও কোথাও নেই। বামপন্হীরা 'পরিচয়' পত্রিকা চালাচ্ছেন, তাতেও এন্ট্রি পারমিট নিয়ে ঢুকতে হয়। এইরকম এক সময়ে 'হাংরি বুলেটিন' এর দরকার ছিল, প্রয়োজন ছিল 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এর। মূল্যবোধ ভেঙে খানখান হওয়ার যে হরর, শিল্পপ্রতীক জোলো হয়ে যাওয়ার যে শক, তাকে যথার্থ ফুটিয়ে তুতে গেলে এই কবিতাই তো লিখতে হবে। মলয় তাই করেছিলেন।

    অবশ্য বিপদ চেনার ব্যাপারে প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। কেই বা পড়ে তখন 'হাংরি বুলেটিন', কটা লোক ? পাটনার দুই যুবক, একজন হাওড়ার, একজন বিষ্ণুপুরের, একজন শান্তিনিকেতনের, এদের বুলেটিন বেরোয়। তার জন্যও আবার এই প্রেস, ওই প্রেসের হাতে-পায়ে ধরাধরি। তাহলে? এমন কী ক্ষমতাসম্পন্ন এরা, যে ক্ষেপে উঠল গোটা কলকাতার বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন ? মলয়ের বিরুদ্ধে কেবল মামলাই নয়, তাঁকে ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে অপমান করা হল চরম, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন এই জাতীয় প্রবণতা মাথা তোলার হিম্মত না করে ।

    বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন যে সমাজকে বুঝতেন না তা নয়, ভালোমতোই বুঝতেন। তাঁরাও জানতেন যে, যে-বদমায়েশি তাঁরা শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতির সর্বত্র বিছিয়ে রেখেছেন, তা মানুষের জন্য নয় । তবে শ্রেণী স্বার্থে এর প্রয়োজন তাঁদের ছিল। যেমন ইংরেজরা, আই.সি.এস.কে লৌহ কাঠামো হিসাবে গড়ে তুলতে ছেয়েছিল, তেমনই উত্তর-স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় পুঁজিবাদ, আমলাতন্ত্র ও তার মিডিয়া-খানসামাদের লক্ষ ছিল একটি জড়, নির্বোধ, সংবেদনহীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তোলা। তাদের রুচি, জীবনযাপন, মূল্যবোধ, সব কিছু হবে ছাঁচে ঢালা, সিনথেটিক। তারা হাসবে, কাঁদবে, গাইবে, সঙ্গম করবে একটি বিশিষ্ট কায়দায়। 'হাংরি প্রজন্ম'এর হুড়মুড় করে এসে পড়ায় এই গোটা গেমপ্ল্যানটি ধ্বসে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মলয় এবং অন্যান্যদের ওপর আক্রমণ সেই কারণেই।

    প্রজাপতি-আঁকা বিয়ের কার্ডে হাংরি প্রজন্ম ধ্বনি তুলেছিল, "গাঙশালিক কাব্যস্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো"। এই ধ্বনিটিতে অন্তর্নিহিত ছিল তদানীন্তন কাব্যধারার প্রতি বিবমিষা।

    প্রকৃতি, নিসর্গ এই ব্যাপারগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বাংলা কবিতার কলোনোয়াল রোগবিশেষ। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ ছিল একটা কমপালশান, যেমন লেখালিখি ছিল তাঁর কমপালশান। সেজন্য তাঁর লেখায় প্রকৃতি, নিসর্গ বিশেষভাবে উপস্হিত--- কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে। আঁকার সময়ে তিনি এগুলো বর্জন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে, বাংলা কাব্যধারায় এই ব্যাপারগুলো প্রয়োজনীয় অনুপান হয়ে ওঠে। এবং অনুপানেরও অধিক, অভ্যাস।জীবনানন্দ লেখেন 'রূপসী বাংলা'। তাতেও নিসর্গ ছিল; তবে সেই নিসর্গ, প্রকৃতির প্রতিটি কমপোনেন্ট আবহমানের বাঙালিজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিল।মানুষের সাথে সম্পর্কবিহীন ছিল না সেই নিসর্গ, সেই প্রকৃতি।সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "একদা আষাঢ়ে এসেছি এখানে, মিলের ধোঁয়ায় পড়ল মনে; কালবৈশাখী নামবে যে কবে আমাদের হাত-মেলানো গানে"। এখানে মানুষের সংগ্রামকে আঁকা হয়েছে প্রাকৃতিক ঘটনার রং-তুলিতে। কিন্তু বাংলা ভাষার সেইসব কবিরা (গাঙশালিক কাব্যস্কুল) সৃষ্টি করছিলেন মনুষ্যবিহীন নিসর্গ, মানুষকে মাইনাস-করা প্রকৃতি। এ ছিল একজাতীয় পলায়নবাদ। শংকরের 'কত অজানারে' যেমন বাঙালি যুবকের বেকারত্ব থেকে পলায়ন করতে চেয়ে বারবেল সাহেবের মহানতায় বুঁদ হয়ে থাকা, বিমল মিত্রের মিষ্টি দিদি, নতুন বৌদি, ছোট বৌঠান যেমন নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক ফেস করতে না চাওয়ার যুক্তি, তেমনই 'গাঙশালিক কাব্যস্কুল' ছিল মানুষের দুঃখ, শোক, রোগ, ঘা-পাঁচড়া এগুলোকে দেখতে না চেয়ে স্টুডিওর পর্দায় আঁকা চাঁদ, তারা, নদী, ফুলে বিভোর হয়ে থাকা। ঠিক তখনই মানুষের জীবনধারণ কতদূর দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল, তা দেখতে পাওয়া যায় ঋত্বিক ঘটকের ফিলমগুলোতে। সেই দৈন্য, দুর্দশা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের প্রতিফলন এই কবিতাগুলোতে কোথাও ছিল না। কেন ? কেননা, তা করার অসুবিধে ছিল। তা করতে গেলে দীর্ঘ একটা লাফ দিতে হত, বিশেষ করে ভাষার ক্ষেত্রে।ঋত্বিক যেমন 'মেঘে ঢাকা তারা' বা 'কোমল গান্ধার' -এ গোটা ইডিয়মটিকেই ভেঙেচুরে ফেলেছিলেন, তেমনই ষাটের দশকের বঙ্গসমাজ ও মানুষেকে তুলে আনতে গেলে বাংলা কবিতার গোটা ইডিয়মটিকেই ভাঙতে হত। খানিকটা শ্রেণী পরিপ্রেক্ষিত আর কিছুটা গাড্ডায় পড়ে যাওয়ার ভয়, উভয়ে মিলে এ-কাজ করতে দেয়নি বাংলা ভাষার কবিদের। অতএব চাঁদ, তারা, নদী, ফুল, মৌমাছি…

    আরেকটি প্রশ্নও ছিল। কবি কি কেবল কবিতাই লিখবেন, না সামাজিক ভাষ্যকারও হবেন ? রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন, সামাজিক ভাষ্যকারও ছিলেন। জীবনানন্দও তাই ( জীবনানন্দকে নিবীঢ়ভাবে পড়লে এই ব্যাপারটি ধরা পড়ে) । কিন্তু উত্তরোত্তর সামাজিক ভাষ্যের ব্যাপারটি বাংলা কবিতা থেকে উঠে যেতে থাকে। "কবিতা কবিতাই। সামাজিক ভাষ্যটাষ্য আবার কী?" এ-জাতীয় একটী প্রবণতা বাংলা কবিতাকে পেয়ে বসতে থাকে। একে ক্রমাগত হাওয়া দিতে থাকে স্বার্থান্ধ বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান।
    খুব স্বাভাবিকভাবেই নভেম্বর ১৯৬১-এর প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি প্রজন্ম এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ছিল। সেই দিন থেকে আজ অব্দি মলয়, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি কোনোদিনই হাতছাড়া করেননি। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'এ যেমন সামাজিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে তাঁর তীব্র বিবমিষা, তামনই আজও। তাঁর হালের একটি কবিতা নেওয়া যেতে পারে, 'যা লাগবে বলবেন' সংকলন থেকে । কবিতাটির নাম 'ক্ষুধার্ত মেয়ে':

    আমার আসক্তি নেই কোনো
    চলে যা যেখানে যাবি
    যার সঙ্গে শুতে চাস যা
    আমি একা থাকতে চাই
    ক্ষুধার্ত বা পেটুক মহিলা
    যে ঘোরে সবার হাতে
    খড়কুটোময় সংসারে
    তার কোনো প্রয়োজন নেই।'

    কবিতাটিতে জড়িয়ে আছে একটা ঈষৎ বোহেমিয়ান বাচনভঙ্গী। পড়লে মনে হবে কেউ একজন লিখছেন তাঁর শয্যাসঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে। এটি কিন্তু কবিতার প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে কবিতা ও সমাজ সম্পর্কে মলয়ের দার্শনিক বোধ সন্নিহিত। শয্যাসঙ্গিনী মহিলাটি আসলে কবিতাই। অথচ সবার হাতে ঘোরার প্রবণতা তার, সে হাত স্মাগলারের হোক বা বিপ্লবীর।কবিতার লয়ালটি সন্দিগ্ধ। ওদিকে সংসার অনিত্য, অতএব তার প্রয়োজন কিসের?

    'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতায় যে-কথা বলার জন্য মলয়কে অনেক বেশি জায়গা ব্যবহার করতে হয়েছে, 'যা লাগবে বলবেন' গ্রন্হে সেই কথাই তিনি বলেছেন অনেক সংক্ষিপ্ত পরিসরে। 'হাংরি আন্দোলন' থেকে সরে এসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্সপেক্টিং অফিসার হিসেবে ভারতের গ্রামে-গঞ্জে শহরে শহরে ঘোরা, তারপর এ.আর.ডি.সি. ও নাবার্ডের গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের উচ্চপদে। যদিও মলয় তাঁর এই পরিবর্তিত জীবনশৈলী নিয়ে 'হাংরি কিংবদন্তি' গ্রন্হের শেষে মশকরাও করেছেন, "ছাই-এর জায়গায় আসে টুথপেস্ট, কয়লার উনুনের বদলে গ্যাস, সর্ষের তেলের বদলে সূর্যমুখী, শার্ট-প্যান্টের বদলে সাফারি, মাদুরের স্হানে বিছানা, ঢাবার বদলে রেস্তরাঁ, দিশির জায়গায় স্কচ, কলেজস্ট্রিট ও বইপাড়ার বদলে বাংলার গ্রামশহর।" কিন্তু তবু জীবনের এই অধ্যায়টিও যে কবি হিসেবে মলয়কে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই।
    'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ বাঁধন-ছেঁড়া রাগ ছিল মলয়ের কবিতার পরিচিত চিহ্ণ। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে জীবনের বহু কিছু দেখে-শুনে মলয়ের কন্ঠস্বর তেতো, অম্লকষায়, আর তার সাথে এসে জুটেছে আয়রনির অধুনান্তিক পরিহাসও। তবু তা মলয়ের কবিতাকে সর্বজনগ্রাহ্যও করে তোলে বটে।'যা লাগবে বলবেন'-এর আরও একটি কবিতাকে নেওয়া যেতে পারে, যেমন 'দ্রোহ':

    এ-নৌকো ময়ূরপঙ্খী
    তীর্থযাত্রী
    ব্যাঁটরা থেকে যাবে হরিদ্বের
    এই গাধা যেদিকে দুচোখ যায় যায়
    যাযাবর
    ঘাট বা আঘাটা যেখানে যেমন বোঝে
    ঘুরতে চাই গর্দভের পিঠে
    মাথায় কাগুজে টুপি মুখে চুনকালি
    পেছনে ভিড়ের হল্লা ।

    ব্যাস! কবিতা এইটুকুই। অথচ বাঙালি সমাজের যে একটি বিশেষ প্রবণতা, কবিকে বেদিতে বসিয়ে রাখার, তাকে কত সার্থক ভাবে ভাঙঅ হয়েছে এখানে। পাটনার অন্ত্যজ মহল্লাগুলোতে হোলির দুতিন দিন আগে থেকে চোখে-পড়া একটি সুপরিচিত দৃশ্যকে ব্যবহার করেছেন মলয়, প্রশ্নাতীত দক্ষতাসহ। তার সাথে মিশিয়েছেন তীর্থযাত্রার জন্য বাঙালি হিন্দুর চিরাচরিত আতুরতাটিকে, যাতে পোস্টমডার্ন পরিহাস আরও তীব্র হয় । আর... হাংরি মামলার সময়ে তাঁকে যে-সামাজিক অবমাননা সইতে হয়েছে, তাও উঠে এসেছে। মাত্র কয়েকটি পঙক্তির মধ্যে কত প্রসঙ্গ যে এসেছে, অথচ বলার ভঙ্গিটি এত সহজ যে ভাবাই যায় না ।

    এই সংগ্রহের আরেকটি কবিতা 'যে পার্টি চাইছেন সে পার্টিই পাবেন'।
    বিশ্বাস এক দুর্ঘটনা
    বুকপকেটে শ্রেণী
    প্রতিরোধী থাকেন জেলে
    কাজু-ফলের ফেনি
    বরং ভালো
    ভুল অঙ্কের ডানা।
    ...মোড়ল দলের পাড়ার কেউ বা
    আওড়ায় বেঘোরে
    ছাদ ঢালায়ের সমরবাদ্য
    কর্তাবাবার জানা
    মেলাবেন তিনি অন্তরীক্ষে
    মোক্ষ একখানা ।

    কবিতার শেষ দুটি পঙক্তিতে অমিয় চক্রবর্তীর 'মেলাবেন তিনি মেলাবেন', এই শান্ত, স্হিত, প্রায় ব্রাহ্ম, উত্তর-রাবীন্দ্রিক বিশ্বাসের আদলটি একেবারে বিপরীত অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পার্টি আমলাতন্ত্রের যে প্রবল দাপত, যার দরুণ তেলে-জলে মিশ খেয়ে একেবারেই একাকার, পুতুল নাচের সুতোর শেষ প্রান্তটি ব্যক্তিবিশেষের হাতে, সেটিতে যেমন-যেমন টান পড়ছে, কাঠের পুতুলগুলো তেমন-তেমনই নাচছে; এই গোটা পরিবেশটি উঠে এসেছে কয়েকটি মাত্র পঙক্তির মাধ্যমে। মলয় বুঝিয়েছেন, যা বোঝাতে গেলে অন্তত কয়েকশো পাতার বই দরকার। আর? বিরোধীপক্ষ বলতে কিছু নেই আর। যারা বিরোধ করছে, তারাও বস্তুত নিজের-নিজের ছাদই ঢালাই করছে। সেই ছাদ ঢালাই-এর বাজনাকে মানুষ মনে করছে সমরবাদ্য।

    এত সূক্ষ্ম যাঁর ভাষার পরিমিতিবোধ, তিনি কিন্তু 'চিৎকারসমগ্র' গ্রন্হে এসে আবার অন্যরকম হয়ে যান। দড়ি ঢিলে দেন একটু, যাতে তাঁর সংবাদবাহক ঘুরতে পারে জায়গা-বেজায়গায়। 'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতাটির অংশ পড়া যেতে পারে এই প্রসঙ্গে:

    হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া সেই প্রৌঢ় নদী
    নাচছে দুর্গাবোঙার ফরসা কোমর জড়িয়ে
    শহর-পুরুতের গামছা কাঁধে
    তাককা হুরে
    আরে হুরে তাককা হুরে

    বোঙা আদিবাসী দেবতা-অপদেবতার সর্বনাম। দুর্গা বাঙালির আবহমানের দুর্গতিনাশিনী। তারই কোমর জড়িয়ে নাচছে হাজত থেকে ছাড়ান-পাওয়া প্রৌঢ় নদী, কাঁধে শহর-পুরুষের গামছা। তাককা হুরে, আরে হুরে তাককা হুরে, শহুরে মাস্তানদের উল্লাসধ্বনি।

    ভাঙনের ছায়াগাছ। এই ভাঙনকে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না, অথচ সে তার কাজ করে চলেছে। ভাঙন বস্তুত একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। এর দরুন সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে মজাদার মিলমিশ। বুর্জোয়ার বক্তব্য আশ্রয় করে লুমপেনের ভাষাকে।লুমপেন অ্যাডপ্ট করে বুর্জোয়ার চালচলন। এর সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে ওর উঠোনে। ওর 'রোনাধোনা'য় শোনা যায় এর অনুরণন।

    চিৎকার করতে-করতে পড়ছে জলপ্রপাত চুলে
    ঢাউসপেট পোয়াতি অফিস-বারান্দায় আইল হাতে
    থ্যাতলানো ট্যাক্সিচালক হাওড়া স্টেশানে
    যেখানে সাপের ফণা জমা রাখতে হয়

    শহর বিষদাঁত খুলে নেয় প্রত্যেকের। ছোবলানো তো চলবেই না, ফোঁস করাও নয়। অফিস বারান্দায় ফাইল হাতে গর্ভিনী। কী প্রসব করতে চলেছে সে ? তারই মধ্যে ঝরে যেতে থাকা কেশপাশের চিৎকার। আলুলায়িত কেশপাশ বাঙালির আবহমানের সৌন্দর্য-মিথের অংশ।

    মেঝেময় ছড়িয়ে-থাকা গোঙানির টুকরো তুলে
    তারা বদলায়নি তবু আদল পালটেছে
    হে নাইলন দড়ি বাড়িতে এখন কেউ নেই
    কিন্তু বাইরে হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর

    কবিতাটি পড়তে-পড়তে বহু পুরোনো টার্কিশ ফিলম 'কংকারার্স অফ দি গোলডেন সিটি'র কথা মনে পড়ে। নিষ্পাপ একটি গ্রাম্য পরিবার শহরে এসে সব কিছু ধিরে-ধিরে হারাল। তার মেয়েরা হয়ে গেল বেশ্যা, পুরুষেরা অপরাধি। হাজার দুর্গন্ধে ভাগ-করা শহর--- গোল্ডেন সিটি। সোনার শহর। নারকেল দড়ির বদলে নাইলন দড়ি, সভ্যতার অগ্রগতি। বাড়িতে কেউ নেই , শূন্যতা অপরিসীম।

    কবিতাটির শেষ স্তবকে এসে মলয় দুর্বার ছুট লাগান--- এমন ছুট যে কবিতা ব্যাপারটাই দুমড়ে-মুচড়ে যায়।

    কচি বালক-পাছার নধরমাংস দেবদূত
    মাখনমাখা ব্রয়লার যার শেষ খদ্দের
    চলে গেছে তিন বছর তার ব্লাউজে সেফটিপিনগাঁথা হৃদয়
    স্লুইস দরজা খুলে আলোর নারীশরীর
    যে জীবন বুকের সামনে উঁচিয়ে অচেনা পিস্তল
    তখনই সিঁড়িতে সাদা ছড়ির আওয়াজ তুলে
    গামছায় মুখ ঢেকঢ গাঁও বালিকার কান্না
    কেঁপে উঠেছে শিশুর গায়ে হাত ঠেকলে

    ভাঙন যখন সব কিছুকেই ভাঙছে, তখন কবিতাকেও সে ভাঙবে। ভাঙতে-ভাঙতে কবিতাও মুক্ত হয়ে যাবে। তখনই বোধহয় বিদ্যুৎ ঝলকের মত এক অন্য কবিতার সৃষ্টিমুহূর্ত।'ভাঙনের ছায়াগাছ' কবিতায় আমরা সেই প্রক্রিয়াটি দেখতে পাচ্ছি, চাক্ষুষ।মলয় রায়চৌধুরী থেকে বোধ হয় এক নতুন কবিকুলের সৃষ্টি হল, যাঁরা কেবল কবি নন, আপোষহীন সামাজিক ভাষ্যকারও বটে। "ঘুম-ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত" এর ব্যকরণ ভেঙে চুরমার, পর্বত শিখরে সূর্যোদয়ের মতো শোনা যাচ্ছে সেই নতুন কবিতার বজ্রনির্ঘোষ।
    'হাংরি সাক্ষাৎকারমালা'য় মলয় বলছেন বিবেকানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে, "যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন কবিতা ও গদ্যের চাকুতে একনাগাড় পালিশ দেওয়া দরকার।" হাংরি আন্দোলন ফুরোবার পর মলয় কেবল প্রথাগত জীবন যাপনই করেননি, একনাগাড়ে অনুশীলনও করেছেন। এই অনুশীলন ও পঠন-পাঠন ছিল একলব্য সদৃশ, অথচ সামনে ছিল না দ্রোণের মূর্তি।মলয়ের সাধনা এরকমই। তার ফলে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' ও তাঁর আজকের কবিতার মধ্যে গড়ে উঠেছে লক্ষণীয় দূরত্ব। 'লক্ষণীয়' বললাম, কারণ মলয়ের 'হাততালি' কবিতাটিতে এমনই কিছু পরীক্ষা ও নিরীক্ষা জ্বলজ্বল করছে। রেলওয়ে ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন ট্রেনের আলো-আঁধারি কামরাগুলো ঝটিতি চোখের সামনে দিয়ে বহুমাত্রিক অর্থময়তায় সরে-সরে যেতে থাকে, তেমনই এই কবিতার অজস্র ছবি, চিত্রকল্প, ইশারা এরা দ্রুত ছুটে চলেছে:

    তারপর পলিতকেশ কাশফুলে
    পইপই বারনের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে
    দগদগে রোদে
    চন্দন রক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে
    অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প
    কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব
    হাহ
    রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে
    হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি
    চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা

    'হাততালি' প্রাথমিক স্তরে উল্লাসের বহিপ্রকাশ। প্রশ্ন উঠছে, সমাজ যখন পচছে-গলছে, তখন কবি এত উল্লসিত কেন ? কিসের এ-উল্লাস ? কেন উল্লাস ? বিশৃঙ্খলার মহোল্লাস ?

    যা অচল, যা জড়, তাকে একদিন না একদিন ভেঙে জেতেই হবে। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন নতুন কিছু গড়ে উঠবে না, উঠতে পারে না। মানুষের ভাবনাচিন্তা কার্যকলাপের ইতিহাসে এই উল্লাস অন্যত্রও দেখা গেছে। তন্ত্রসাধনার যে দিকগুলো, বামাচারের যে চালচলনগুলোকে 'বিকৃতি' বলে মনে করা হয়েছে, বস্তুত তা ছিল বর্ণাশ্রমপন্থী ছুঁৎমার্গপ্রবণ সনাতন হিন্দুধর্মের গড়া বিভিন্ন আগড় ভেঙে ফেলার উল্লাস। ভিন্ন 'অন্ত্যজ' বা অস্পৃশ্য জাতির নারীদের সাধনসঙ্গিনী করা, এই উল্লসিত বিদ্রোহের একটি দিক। নালান্দা জেলার কিংবদন্তি অনুযায়ী বৌদ্ধতন্ত্রের ভিক্ষু 'পদ্মসম্ভব' একজন অন্ত্যজ নারীকে নিয়ে ইলোপ করেছিলেন, ও দীর্ঘকাল নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে উধাও ছিলেন।দাহসংস্কারকে নানা কর্মকাণ্ডে মুড়ে সনাতন হিন্দুরা চেয়েছিলেন, মানুষ যেন অতীতকে খুঁটিয়ে না দেখে। শবসাধনা ও অঘোরপন্থা ছিল পরোক্ষে এর বিরুদ্ধচারণ। অতীতকে বিশ্লেষণ করা ও তার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, এই ছিল নানা তান্ত্রিক আচারের পেছনের অস্ফুট উত্তেজনা ও মহোল্লাস । মলয়ের 'হাততালি' কবিতার শিরোনাম ও ও প্রথম স্তবক এই আশ্চর্য নানার্থময় উল্লাসে মুখর। পুশতুভাষী দুর্যোধনের পৌরাণিক প্রাসঙ্গিকতাও আছে। একেবারে আলটপকা নয় এই অভিব্যক্তি। গান্ধার, কান্দাহার, পুরুষপুর, পেশাওয়ার, ভারত-পুরাণের এই অতিদীর্ঘ ছায়াবৃত যাত্রাপথের দূরত্ব নির্দেশকারী সংকেতগুলো মলয় ব্যবহার করেছেন স্হপতির নিপুণতায়, ইউক্লিডের নির্দেশ অমান্য করে। চন্দনরক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে। হিন্দুর পূজাসামগ্রী রক্তচন্দন। তাকে উল্টে চন্দনরক্ত। রক্ষীদের পোশাক পাথরের। অজর অনড় সনাতনী অতীত ভারত দেশের। অতীতকে না হয় মুছে ফেলা গেল, কিন্তু তারপর ?
    "অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প/কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব/হাহ"। যে নতুন পৃথিবী তৈরি হয়েছে তা নারকীয়। অতীতের বিকল্প গড়ে তোলার নামে কেবল নরকই তৈরি হয়েছে, অন্য কিছু নয়।
    আধুনিকতার লাফঝাঁপ আজ হাস্যকর।

    আধুনিকতার হাতে গড়া সামাজিক প্রতিবাদের নানা যোগাড়যন্ত্র প্রতিবাদকে ব্যহতই করেছে, আর কিছু করেনি।"হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেনি হাততালি", তথাপি "চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা।" কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা কোনটি, তবে আমি কিন্তু বলব না, 'পরমাণু বোমা আবিষ্কার'। বলব না 'ঔপনিবেশিকতা'। বলব না কলম্বাস অথবা ভাস্কো ডা গামার জন্ম। আমার উত্তর "মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা মার্কসবাদ ও জুডিও ক্রিশ্চিয়ানিটির সমার্থক হয়ে যাওয়া।" মার্কস একেবারে চাক্ষুষ দেখে ছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদের উদয়। সেই দেখা ছিল নিখুঁত। তাঁর অভুতপূর্ব মেধা খুঁজে পেয়েছিল সেই উদয়ের কারণগুলোকে। কিন্তু এক জীবনে তাঁকে করতে হয়েছিল বিপুল পরিমাণ কাজ।করাল দারিদ্রের সাথে প্রতিনিয়ত যুঝে, একমাত্র বন্ধো ও সহযোদ্ধা এঙ্গেলসের সাহায্যে, তাঁকে সমাজবাদী দর্শন, অর্থনীতি ও সমাজত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করতে হয়েছিল। তাই ইউরোপীয় সমাজের বাইরে বড় একটা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি তাঁর দৃষ্টি। তবু ভারতবর্ষকে বোঝবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন, উল্লেখ করেছিলেন 'এশিয়াটিক মোড অফ প্রডাকশানে' এর কথা। যদি এই মোডকে বোঝাবার সময় তাঁর হাতে থাকত, তবে হয়ত, হয়ত কেন, অবশ্যই, পরবর্তীকালীন যান্ত্রিকতা থেকে মার্কসবাদের মুক্ত থাকার সম্ভাবনা হত অনেক বেশি প্রবল।তা না হবার দরুন, পরে জুডিওক্রিশ্চান নিয়তির সাথে মার্কসবাদও জড়িয়ে পড়ে। যেমন খ্রিস্টধর্ম দরিদ্র ইহুদি ক্রীতদাসের ধর্ম হিসাবে যাত্রা শুরু করে, পরে রোমক সম্রাটদের ধর্ম হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনিই, মার্কসবাদ, কাউটস্কি প্রমুখ সুবিধাবাদীর হাতে পড়ে অচিরেই ইউরোপীয় পুঁজিতন্ত্রের সেবাদাসের কাজে লেগে যায়।

    মার্কসবাদের সামাজিক বিকাশের নিয়মটিকে তার দ্বান্দ্বিক অন্তর্বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমনই একটি যান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পরিণত করা হয়েছিল যে, বলা হল, "ধাপে-ধাপে এগিয়ে পুঁজিবাদই সমাজবাদ (!) হয়ে উঠবে"--- এই হয়ে ওঠে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগোলুর ধারণা।লেনিন, রোজা লুক্সেমবুর্গ প্রমুখেরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে সৃষ্টিশীল মার্কসবাদের গোড়াপত্তন না করলে, পরে মার্কসবাদকে পুঁজিবাদের দর্শন থেকে আলাদা করে আর চেনাই যেত না। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লেনিন ছিলেন অধুনান্তিক রাজনীতিবিদ, যিনি আধুনিকতার প্রবক্তা কাউটস্কির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কাউটস্কি প্রমুখরা মার্কসবাদকে অক্ষরসর্বস্ব করে তুলেছিলেন।কিন্তু যান্ত্রিকতা বোধহয় মানুষের একটি স্বাভিক ঝোঁক। পরে লেনিন-শিষ্যরাই আবার যান্ত্রিক হয়ে ওঠেন; রুশ মডেলটিকে ব্যবহার করতে থাকেন যত্রতত্র সর্বত্র। ভারতের মার্কসবাদীরাই হয়ে ওঠেন সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিক।

    'ইতিহাস' ভদ্রলোকটি নানাবিধ পরিহাসে যে ভালোরকম সিদ্ধহস্ত, তাতে আর সন্দেহ নেই। মলয়ের 'হাততালি' কবিতার ( এটি একটি দীর্ঘকবিতা ) দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় পঙক্তিতে আছে, "যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছেন লালশালু নৌকার হাততালি।" পরিস্হিতি বারবার ওলোটপালোট করে দিচ্ছে মার্কসবাদীদের কষা ছক। এর ঠিক আগের পঙক্তিতে আছে, "একথোকা অন্ধকারে জোর করে দেখানো স্বপ্নে...।" মার্কসবাদীরা ভবিষ্যতের একটি মনমোহক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আপামর জনসাধারণকে। সেই ছবি বাস্তবসম্মত ছিল না। তাই ছক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হতপ্রভ মার্কসবাদী ভাবুক শিবির। "না খেতে পাওয়া হলুদ শীতে/গরম আলকাতরায় ফোটা ফরসা রজনীগন্ধা।" ওদিকে শোষণও অব্যাহত। তারই হাড়ে-মাংসে তৈরি হচ্ছে নবতম 'নন্দনতত্ত্ব'। "কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি।" অতীতের দুঃসহ চাপ আর বারবার সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার... "জ্বরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তাঁর পশুপশম নাভিতে।" এরপর গুটিয়ে-রাখা একটি প্রাচীন, কীটদষ্ট মানচিত্র খোলার মতো একখানা গোটা উপমহাদেশ মলয় খুলে ধরেন আমাদের চোখের সামনে। সেই উপমহাদেশকে নষ্ট করেছে সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদ। তাদের রূপক দ্যোতক প্রতীকগুলো বর্শাফলকের মতো বিদ্ধ হয়ে আছে উপমহাদেশটির হৃদয়ে।

    "ব্যাবিলনের শাদা নরকহুরি/উত্রমুখো নকশিমেঘের ওষুধবড়ি গিলিয়েছে/রেড়িপ্রদীপে ঝুঁকে ঘুরঘুরে শুঁটিপোকা/
    এলোচুলে ঢাকা রাজকন্যার মুকুট থেকে গানের টুকরো/
    পায়ে রক্তমাখা রাজহাঁস/যখন-তখন চেয়েছে বাড়িফেরত সৈন্যের বসন্তকাল/সাজিয়েছে খেলাচ্ছলে মারা চরমযুবার মা-বাপের সবুজকাঁথা ধানক্ষেত/তুঁতেরঙা কুয়াশা এগিয়েছে সিংহচামড়া শিকারীর গোপন ঘাসপথে/বিবাহযোগ্য ঘুড়সওয়ার হাততালি/হেই হো"। এই নষ্ট প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে দানা বাঁধেনি, বাঁধতে পারেনি যথার্থ বিদ্রোহ, যদিচ দেখতে বিদ্রোহের মতন, এমন অনেক কিছুই ঘটেছে।"আগুন যখন ধোঁয়া থেকে আলাদা হচ্ছে/যেটুকু সময়ে/আলজিভ/দুই হৃৎস্পন্দনের মাঝে তেতো হয়ে ওঠে/জলপথে এসে আক্রমণ করেছে জ্বরবিদ্রোহী/গাছে-গাছে ঝড়কালীন পলাশের লাল সক্যতা/ঠিক যেন চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎহীন/শেষ হাওয়ায়/পটকা ফাটিয়েছে রাংতাপাড় মেঘ/যেন এক্ষুনি এসে পড়ল বলে হাততালি।" একটি নষ্ট প্রক্রিয়া, তার বিরুদ্ধে 'গড়ে ওঠা' বিপ্লবী আন্দোলনের দেউলেপনা, সবকিছু মিলে বিচিত্র এক পরিস্হিতি। বিপ্লবী আন্দোলনের সেই সততা নেই যে নিজের দেউলেপনা স্বীকার করে নেবে।"কবরে পাওয়া গেছে ভাত খাবার কাঁসি/অত্যাচারিতের কাতরানিতে পড়েছে হাড়ের খিলান/কেউ সুখি নয়/কেমন আছো জানতে চাইলে বলেছে /ভালো/পাকের পর পাক কাঁটাতার কোমর থেকে খুলে দিয়েছে"।

    ভারতবর্ষে বিহারসদৃশ যে কয়টি আভ্যন্তরীণ উপনিবেশ আছে, সেখানে অবস্হা আরও ভয়াবহ।এই আভ্যন্তরীন উপনিবেশগুলোকে নিয়ে বিপ্লবীদের ভড়ংএরও শেষ নেই।"ওদিকে হাততালিবাদক/ভগ্নস্বাস্হ্য আকাশে/পাখিদের গান শুধরে দিতে চেয়েছে/তারা দপদপে অন্ধকারে/
    বালিশ-জড়ানো বর্ষায়/পালামৌ জেহানাবাদ রোহুতাসে কাদাপেছল মাগুরের আঁশটে হাঁপানি/শামুক থুতনি বুড়ির চোখের পাতায় ধূসর সোরাগন্ধক।"

    সবকিছুর শেষে, সমস্তকিছুর পরিণামে খিদে। খেতে চাইছে মানুষ আর নিরন্তর খাদ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাকেই। আর তার এই খাদ্য হয়ে যাওয়াকে নানা অং বং চং দিয়ে মহিমা মন্ডিত করা হচ্ছে। মলয় এই বিচিত্র প্রক্রিয়াকে প্রস্ফূট করতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন রূপকল্প, যাতে এই পরিস্হিতির দ্বৈততা যথার্থ ব্যাখ্যাত হয়। যে ক্ষুধার্ত, সে-ই খাদ্য। "এদিকপানে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ছোকরা সূর্যমুখী/ গরম তেলে লাল দুহাত উড়িয়ে স্বাস্হ্যবতী কাঁকড়া/ভাতের হাঁড়িতে নেচেছে সফেদ-মসলিন নরম অপ্সরা/তখন অন্ধকারে কেঁদে নিয়ে আলোয় হেসেছে হাততালি/হাসপাতালের বিছানায় লোহার শেকলে বাঁধা শুনেছে/ টেবিল ঘড়িতে সারারাত গ্রেপ্তারের ঠক ঠক ঠক ঠক।"

    আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাঁরা ঔৎসুক্য রাখেন, তাঁদের অবশ্য পঠনীয় একটি বই "দি নিউ ক্লাস", লেখক মিলোভান জিলাস। জিলাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আবশ্যক।মিলোভান জিলাস, তদানীন্তন যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্হানীয় নেতাদের একজন, স্ট্যালিন ও টিটোর অন্তরঙ্গ, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের 'কমিনফর্ম' পর্যায়ের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যতা ত্যাগ করেন ও এই বইটি ও আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই লেখেন, যেমন "কনভারসেশানস উইথ স্ট্যালিন" লেখেন। "দি নিউ ক্লাস" লেখার অপরাধে টিটো জিলাসকে সশ্রম কারাদন্ডে দম্ডিত করেন। দি নিউ ক্লাস বইটিতে জিলাস সমাজবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে একেবারে নতুন একটি অবদান রাখেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, মিনস অফ প্রোডাকশানের মালিকানা স্বত্ব কাগজে-কলমে না থাকলেও সমাজতন্ত্রী দেশগুলোতে একটি নিউ ক্লাস বা নতুন শ্রেণির উদয় হয়েছে, যারা উদ্বৃত্ত বা সারপ্লাস সংগ্রহ করতে সক্ষম। এই শ্রেণীটি ক্রমশ নিজেদের হাতে প্রভূত অর্থ ও ক্ষমতা কেন্দ্রিত করেছে, এবং পার্টি, শাসনতন্ত্র, সমস্তকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। জিলাসকে সেই যুগে সাম্রাজ্যবাদীর দালাল উত্যাদি আখ্যায় বদনাম করা হয়েছিল। তিনি কারাবাস করেন, এবং ধিরে-ধিরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পরে যখন সোভিয়েট দেশ ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ধ্বস নামে, এক কালীন পার্টি আমলারাই সি.পি.এস.ইউ.কে ভোগে দিয়ে দেন, এবং রাতারাতি বিশাল-বিশাল কল-কারখানার মালিকের চেয়ারে জাঁকিয়ে বসেন, তখন আবার জিলাসকে খোঁজা আরম্ভ করেন যথার্থ মার্কসবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গে বহুকাল বহুবছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার ফলে আমলাতন্ত্রের যে অভ্যুদয় ঘটেছে, তাকে যথাযথ বুঝতে যাঁরা চান, তাঁরা এই বইটির সাহাজ্য নিতে পারেন।

    'কৌণপের লুচিমাংস' কাব্যগ্রন্হের ভূমিকায় মলয় বলেছেন, "বর্তমান কালখন্ডের বঙ্গসমাজটি অধিবাস্তব। আমি চেষ্টা করেছি তাকে উপস্হাপনের। সেকারণে কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো। আমার প্রতিভা দ্বারা কবিতাগুলোর সৃজন হয়েছে মনে করা ভুল।আমিই বরং সৃজিত হয়েছি কবিতাগুলোর দ্বারা। ভাষাসমাজের দ্বারা।"মলয়ের এই বক্তব্যটি কবিত্বের ধারণাটিকেই পালটে দেয় মূল থেকে। গলায় গাঁদাফুলের মালা, স্কুল-শিশুদের উদ্দেশ্যা নরম গলা, 'নারীত্বের' প্রতি সম্ভ্রমশীল, চোখ ঢুলুঢুলু, ভুলো মন, জীবন সম্বন্ধে উদাসীন--- স্বল্পকথায় একটি প্রবল নন্দনতাত্ত্বিক তালগোলের যে চিত্রটি চোখে ভেসে ওঠে 'কবি' শব্দটি উচ্চারণ করতেই, তা থেকে মলয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন কিছুটা জোর করেই হয়ত। মলয় বলছেন, 'কোথাও-কোথাও পঙক্তি এবং ছবিকে মনে হতে পারে জটপাকানো'। এও বলছেন, একটি অধিবাস্তব সমাজকে উথ্থাপন করতে গিয়েই হয়ত এই জটিলতার সৃষ্টি। কৌনপ একজন পৌরাণিক রাক্ষস, যে কুনপ অর্থাৎ শব খেয়ে বেঁচে থাকে। 'কৌনপের লুচিমাংস' রাজনৈতিক কবিতার সংগ্রহ। সর্বসাকুল্যে বত্রিশটি কবিতা আছে সংকলনে। কবিতাগুলির প্রত্যেকটিই একটি করে হাহাকার। আজকের পশ্চিমবঙ্গ, তার সমাজ, তার সংস্কৃতি, তার পচন, সবকিছু নিয়ে হাহাকার; যদিও ওই একই ভূমিকায় মলয় বলেছেন, 'এই গ্রন্হের পাঠবস্তু আসলে বাঙালির পচনের হোলিখেলা'। কিন্তু মলয়ের কষ্ট ও বেদনা প্রতিটি কবিতায় প্রস্ফূট। তার আঙ্গিকটি যদিও উল্লাসের, হোলিখেলার। ব্যাপারটা কিছুটা চার্লি চ্যাপলিনের ফিলমের মত বলা যায়।অধুনান্তিক। 'রাঁঢ়বাজারে শততম প্রেমিকের আবির্ভাব হল/ অথচ ফুলের টবে মাটি নেই শেকড়ে-শেকড়ে ছয়লাপ সংসার'। রাঁঢ়বাজার শব্দটি প্রণিধানযোগ্য।

    মলয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পরিস্হিতিকে 'রাজনীতিবিদ বনাম জনতা' এভাবে নিচ্ছেন না কিন্তু। আগেও বলেছি, সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি মলয় কখনই হাতছাড়া করেননি। সেই ভূমিকাটিই তাঁকে উৎসাহিত করেছে পশ্চিমবঙ্গের কলোনিয়াল অতীতকে খুঁটিয়ে দেখতে। তাঁর লেখা বহু গল্পে ও প্রবন্ধে এই দেখা খুব স্পষ্ট। মলয়ের অধুনান্তিক ধ্যান-ধারণার উৎপত্তিও বস্তুত এখান থেকেই। উপনিবেশবাদ পশ্চিমবঙ্গের মনোজগৎকে ভালো রকম ধামসে দিয়েছে বহু আগেই। তার ফলে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ফলাও রাঁঢ়বাজার, যেখানে কেবল প্রেমিক যায় আর আসে। বর্তমান কালখণ্ডের ক্যাডাররা সেই রাঁঢ়বাজারের শতশত প্রেমিক। ফুলের টবে মাটি নেই, অথচ শেকড় সেঁদিয়ে গেছে ভেতরে, প্রায় অতল পর্যন্ত।অনন্ত পর্যন্ত নানা কায়েমিস্বার্থ চারিয়ে দিয়েছে শেকড়।

    সামাজিক ভাষ্যকারের ভূমিকাটি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়ার দরুনই মলয় খুঁটিয়ে দেখেন গলদ কোথায় ছিল আর আছে। কমিউনিস্ট-বিরোধীরা যেমন গোটা ব্যাপারটিকেই "আরে ও শালারা অমনধারাই" বলে সেরে নেন, মলয় কিন্তু তা করেননি। তিনি খু#টিয়ে দেখেন, জানতে এবং জানাতে চান।তার ফলে তাঁর চোখে ধরা পড়ে বহু বিচ্যুতি, যেগুলো হয়ত অনেকেই দেখেও দেখেননি। 'কাউন্টার ডিসকোর্স' কবিতায় মলয় বলছেন, "খাটের দুপাশ দিয়ে আলাদা বয়ে যাচ্ছিল মজুরের নদী কৃষকের নদী। যে কড়াকড়িতে সারাদিনে সূর্য শুধু একবারই ওঠে আর মিলিয়ে যায়।"

    অক্টোবর বিপ্লবের সময় সহসা আবিষ্কৃত হয় যে বলশেভিক পার্টির হাতে কৃষক শ্রেণির জন্য কোনো আলাদা প্রোগ্রাম বা কর্মসূচী নেই। অথচ বিপ্লবের কর্মকান্ডে কৃষক শ্রেণির সহযোগীতা অপরিহার্য। লেনিন দ্বিধাহীনভাবে এস.আর. (শ্পেশাল রিভলিউশানারি)-দের প্রোগ্রামটিকেই সরকারের তরফ থেকে অ্যাডপ্ট করে নেন। কয়েকটি পার্টির যে যুক্তফ্রণ্ট অক্টোবর বিপ্লব ঘটাতে চলেছিল, তাদের মধ্যে এস.আর. দলটিও ছিল, তাই এই কাজটি কারো অবিপ্লবী মনে হয়নি। নিজের পার্টির ত্রুটি মেনে নেওয়া, স্বীকার করা, পরিমার্জনা করার ব্যাপারে লেনিন তো, প্রায় বলা চলে তুলনাহীনই ছিলেন। আজকের ভারতবর্ষের, আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, আজকের নানা রঙের বামনেতাদের মাইন্ডসেট কি একটুও এরকম? পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ওলোটপালোট ঘটাতে গেলে যে-দুটি শ্রেণীর হাত মেলানো প্রয়োজন, তারা দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা অবস্হানে।শ্রমিক ও কৃষকের উঠোন একেবারেই ভিন্ন। আবার মজুরদের বমধ্যেও পি.এস.ইউ.এর মজুর আর আনঅর্গানাইজড সেক্টরের মজুরের আলাদা হাঁড়ি। কৃষকদের মধ্যেও এই জাতীয় নানা ভাগাভাগি। অথচ এ নিয়ে 'মার্কাসবাদী' তাত্ত্বিকদের মাথাব্যথা আছে , ঔপচারিক বুকচাপড়ানো ছাড়া , এমন তো মনে হয় না। তাহলে রদবদলটা ঘটবে কীভাবে ?

    রদবদলের আশা করাটাও কী উচিত ? যখন বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ এক হিমশীতল রুটিন মাত্র , তার রন্ধ্রে-রন্ধে বাসা বেঁধেছে নানা সাইজের ঘুঘু , পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগামী দর্শনটি এক অকিচিঞ্চিৎকর উপচারে পর্যবসিত, তখন সত্যিই কি কোনো আশা কোথাও রয়েছে যে একদিন সব কিছু বদলাবে ? "শেষ ট্রেনের নাম তত্ত্ববিশ্ব" কবিতায় বলছেন মলয়, "আর ভাটার দুলুনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক ক্লান্ত স্টিমলঞ্চ/হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া হাড়গুলো দাঁতনদেঁতো প্যাংলার দুর্ভাবনায়/ডেরা ডেলে চুলখোলা বারান্দায় চোখ বুজে দেখবে এক তিন ঠেঙে বেড়াল/শ্যাল-চাদর মুড়ি দেয়ে/প্রতিধ্বনি নকল করতে ওস্তাদ তলপেট-ফোলা বোল্ডার/পিঁপড়ের খনি-টানেলে জড়ো করেছে টুসকি নির্দেশে/নামিয়ে-আনা তত্ত্ববিশ্ব।" তবু মানুষের আশা...। ধন্য আশা কুহকিনী। এখনও সে আশা রাখে রেলিতে যায়, ব্রিগেড জমায়েতে যায়। এখনও পার্টিদাদার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যে তার আশা-হতাশার কথা দাদা শুনবেন। এখনও...। "খোঁড়া বরের টোপর" কবিতায় মলয় বলছেন, "দূরে শোনা যাচ্ছে/ নারকেল-পাতায় উড়ন্ত ঘোড়ার খুরধ্বনি/ বর আসছে বর আসছে বর আসছে একঠেঙে/ কাছিম-টেকো মাথায় ফর্দাফাঁই লালটোপর।"

    "কৌনপের লুচিমাংস" সংগ্রহে এসে মলয়ের কবিতায় আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ঘটেছে বলে আমার ধারণা। এই কথাটি মলয় নিজেও স্বীকার করেছেন সংগ্রহের ভূমিকায়, "বাঁকবদলের জন্যেই তো নতুন কাব্যগ্রন্হ, নইলে একঘেয়ে একের পর একের কোনো মানেই হয় না।" মলয়ের ভাষা আশ্চর্য দ্যুতিমান হয়ে উঠেছে এই সংগ্রহে এসে। "ভূমিপুত্রের জন্মস্হান বদলের দরখাস্ত" কবিতাটিতে মলয় বলছেন, "দাদু, কেন্দ্র কই, সেই গর্মাগরম ষাঁড়িত জান্তব সিংহাসন ?/এ তো দেখছি গ্যাংগ্রিনের শাশ্বত নালি ঘা!" দুটি মাত্র পঙক্তি। তার মধ্যেই বিধৃত একটি সমাজের গোটা ইতিহাস, তার অতীত, তার বর্তমান, আর বোধকরি তার ভবিষ্যতও। কি আশ্চর্য দক্ষতায় মলয় দেখিয়ে দেন সবকিছু; মাত্র দুটি পঙক্তিতে কত কথাই যে বলেন। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের আজকের হাল-হকিকত বোঝাতে...."এই একপশলা সন্ধ্যায় ট্রানজিসটারে লকাপ লোচ্চার লিট্যানি শুনতে/গুটিপোকার সবুজ দেহতরঙ্গের তুলতুলে গানে গাছের কোটরে/সঙ্গীত খুঁজছে কাঠঠোকরা তার নিলাম-ডাকা মেশিন ঠোঁটে/পিটিয়ে-মারা শেষ শেয়াল পঞ্চায়েতকে উন্নীত করেছে জেলাসদরে/ড্যাশবোর্ডে থ্যাঁতামাথা কুষ্ঠ-সাম্রাজ্যের সোনাজল ভোটার/ঠায় বসে আছেন কাদা-কুঁজোর কায়দায় ঘুরন্ত চাকে।"( ফ্রান্তস ফ্যানঁ ) । অথবা..."আমি যে কিনা কুহকঠুঁটো মেয়েদের মাঝে ছিলুম ট্রিগারলিঙ্গ যুবা/খড়খেতের সোঁদা-সোনালি চামচমকানো মকাইগুঁফো চাষার ছেলে/একটা চুল টানতেই বেরিয়ে পড়েছে রক্তপচা আঁতের ঝুরি/জ্ঞাতিদের মুখে পাঁঠার গলায় নেমে আসা খাঁড়ায় আঁকা চোখের কান্না/ দেখছি আর ভাবছি কি মজা শবশকটে আগে চড়িনি কক্ষুনো" (রূপসী বাংলার ভাতার )

    অথবা..."আমি কিন্তু কুঁড়ে টাইপের বিকেলবেলায় যখন বেহেড/পাকস্হলি নিয়ে ফিরছি/ভুল সময়ে আগত শীতে বদন-বেচুনিদের চৌরঙ্গি স্যামপেলের ডেরায়/ম্যাপ খুলে দেখাবে, হ্যাঁ, ওই যে ওই তো ইউজারফ্রেন্ডলি বসন্তঋতু/ চিলের পেছন-পেছন উড়ে ব্লো-আপ হিরোর গায়ে/হাত ছুঁইয়ে ভিককে চাইছে/আমি কিন্তু অতীতকে নতুন করে গড়ে ফেলেছি জলফোঁটায় বেঁধে-বেঁধে/প্রকৃতি কি আর ভাবছেন জানত না লাশ গোঁজড়াতে একসেট অমাবস্যা চাই/তাই তো জলের ক্যাঁদরায় খুকি-পোনাদের ভাসিয়ে নিয়ে/চলল জোয়ার-বুড়ো" (ক্যাটাক্রিসিস)।

    প্রথম-যৌবনে কবিতা লেখার জন্য লাঞ্ছিত ও নিন্দিত, পরে বহু বছর নৈঃশব্দের অতলে, আর আজ বাংলা কবিতার মধ্যগগনে সূর্যের মত ভাস্বর মলয় রায়চৌধুরী এখন পরিণত বয়স্ক। আয়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই মানুষের; শোনা যায় মলয়ের শরীরও খুব একটা সুস্হ নয়।বাংলা ভাষার যে অপরিমেয় সম্ভাবনা আছে, তার ঠাহর মলয়ের মত আর কারো হয়ত নেই। বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ নতুন এক আয়তন, তাকে আজকের পৃথিবীর যোগ্য করে তুলেছেন।মলয়ের কবিতা নিয়ে কথাবার্তার এক নতুন পর্ব আরম্ভ হবে বলে প্রতীক্ষা করছি আমরা। সেই কবে কৃত্তিবাস ওঝা দ্বিধাজড়িত হাতে লেখা আরম্ভ করেছিলেন, "গোলকে বৈকুন্ঠপুরী সবার উপর।/ লক্ষ্মীসহ তথায় আছেন গদাধর।/তথায় অদ্ভু বৃক্ষ দেখিতে সুচারু।/যাহা চাই তাহা পাই নাম কল্পতরু।। দিবানিশি তথা চন্দ্র-সূর্যের প্রকাশ।/তার তলে আছে দিব্য বিচিত্র আবাস।।/নেতপাট সিঙহাসন উপরেতে তুলি।/বীরাসনে বসিয়ে আছেন বনমালী।।/মনে মনে প্রভুর হইল অভিলাষ।/এক অংশ চারি অংশ হইতে প্রকাশ।।" তেলের প্রদীপের আলোয় সামনের দিকে নুইয়ে পড়ে তিনি লিখেছিলেন। বাইরে চরাচরব্যাপী অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হয়ত বা জ্বলছিল-নিভছিল গুটিকয় জোনাকি। অশ্বথ্থের নিষের অমান্য করে হঠাৎ-হঠাৎ হাওয়া বইছিল। অসংখ্য কান প্রতীক্ষা করছিল বাংলা কবিতার জন্মের প্রথম কান্নাটি শুনবে বলে। খাগের কলমের খসখস শব্দ উঠছিল তুলোট কাগজে। তারপর দীর্ঘপথ। কত রাজত্ব, সাম্রাজ্যবাদের উথ্থানপতন। ধুলোয় গড়াগড়ি কত মুকুট, রাজদণ্ড। রক্তাপ্লুত, কাঁটা-বেঁধা পায়ে কেবল হেঁটেছে বাংলা কবিতা। হেঁটেছে, হেঁটেছে আর হেঁটেছে। এখনও চোখ খুললে সেই মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে, যাঁরা সেই শিশুটিকে বয়স্ক করে তুলতে অসহ্য দুঃখ স্বীকার করেছেন। সকল পার্থিব সুখ-সুবিধা তুচ্ছে করেছেন তাঁরা, নিজের জীবন, যৌবন, মান-সম্মান, সব কিছু ব্যয় করেছেন বাংলা কবিতার জন্য। যেদিন মলয় কবিতা লেখার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিনই, সবার অলক্ষ্যে, এই মানুষদের একজন হয়েগিয়েছিলেন তিনি। ভুল করেছিল বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন। বাংলা কবিতার জন্য সর্বস্বপণ যোদ্ধাকে অট সহজে পরাভূত করা যায় না। জয় মলয়েরই হয়েছিল। সেই জয় আজ প্রতিধ্বনিত মলয়ের প্রতিটি কবিতায়।

    ----------------------------------------------------------------------------------
    বিশ্বজিত সেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি বহু অংশে বিভাজিত হবার পর ও তাদের সদস্যদের নৈতিক পতনে আশাহত শ্রীসেন পার্টি ত্যাগ করেন।কিন্তু তিনি আজও নিজেকে একজন মার্কসবাদী ভাবুক বলে মনে করেন।তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্হ, গল্পগ্রন্হ ও প্রবন্ধের বই আছে।
  • Shital | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৬541334
  • শীতল চৌধুরী : 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতার বিশ্লেষণ
    দেশে-দেশে যখনই স্রষ্টার কলম নিয়ে নতুন পথের পথিক হতে চেয়েছেন যে সব কবিরা, তখনই অগ্নিশর্মা হয়ে বাধাস্বরূপ দাঁড়িয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছুঁৎ-মার্গীরা । বহু কবিকুলকে এ-জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হজম করতে হয়েছে; সময়ে-সময়ে আ-জন্য দণ্ডভোগও করতে হয়েছে । কঠিন জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে ।

    ফরাসিদেশের আধুনিক কবিদের পুরোধা বোদলেয়ারের নাম বিশেষভাবে করা যায় । ছুঁৎ-মার্গীদের কাছে তিনি জীবিতাবস্হায় ছিলেন অচ্ছুৎ । হাংরি জেনারেশনের প্রধান পুরোহিত তাঁর সময়কালে যে নতুন সাহিত্য পথের পথিক হয়ে ছুঁৎ-মার্গীদের কোপে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক লএজন্য স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীকে শ্রীঘরেও অতিথি হতে হয়েছে । কবি চসারের In the sowre hungry tyme পংক্তিটি থেকে হাংরি শব্দটি তুলে নিয়ে ১৯৬১-এর নভেমবরে নতুন বাংলা কবিতা আন্দোলনের পুরোহিত মলয় রায়চোধুরী যে পত্রিকা প্রকাশ করেন তার নাম রাখা হয় হাংরি জেনারেশন । এই শব্দের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে যে অর্থটি তা হলো ক্ষুধা ।

    এ-ক্ষুধা যে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক, এবং চিরাচরিত বস্তাপচা মূল্যবোধকে ভাঙার, তা বোধকরি বলা অনুচিত হবে না । রোমান্টিসিজমের ছাঁচে বন্দী চিরাচরিত ভাবলোক থেকে আত্মানুসন্ধানে বেরিয়ে এসে মলয়বাবু বাংলা কবিতাকে অস্তিত্ব-সংকট থেকে মুক্তি দিয়ে এক নতুন আত্মদীপের সন্ধানে মুখর করতে চেয়েছেন । কবিতাকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন যৌনতা, জান্তব ক্ষুধা ও জৈবতার মধ্যে এক জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি । প্রচণ্ড জান্তব ক্ষুধাকে সঙ্গী করে তিনি চেয়েছেন বাংলা কবিতার দিকবদল ও অন্তরাত্মার মুক্তি । হাংরি জেনারেশন-এর মূল মন্ত্র এটাই ।

    মলয়বাবুর প্রথম বুলেটিনের তাত্ত্বিক ভাঢ়েই তা পরিঢ়্কার: "ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিবে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেকসে কলম ডুবিয়ে কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমূউর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে সচেতনভাবে বিহ্বল হলেই কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত ।

    শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে আর কোনোদিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যম্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধানিবৃত্তির শক্তি না থাকলে , কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিনী হয়ে যেতে পারে । " অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির সামর্থে তিনি কবিতাকে স্হাপন করতে চেয়েছেন বস্তুগত জীবন ও আত্মিক জীবনের পারস্পরিক মেলবন্ধনে । এ-কারনেই কিনা জানি না, মলয়বাবু তাঁর বহু বিতর্কিত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটিতে অস্তিত্বের সংকটকে বড়ো করে দেখিয়েছেন । কবিতাটির শুরুতেই তিনি যখন সোচ্চারে এ-কথা বলেন--- "ওঃ মরে যাবো মরে যাবো মরে যাবো আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে আমি কী কোর্বো কোথায় যাবৌ ওঃ কিছুই ভালো লাগছে না সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবো শুভা শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায় সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর আমি পার্ছি না, আজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে" আমরা এখানে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি কবি মলয়ের আন্তরের আস্তিত্বের সংকট কি ভয়ানকভাবে চেপে বসেছে, তাই তিনি চামড়া জ্বলার মধ্যে দিয়ে তাঁর যন্ত্রণার কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন, তেমনি সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবার কথাও প্রেমিকা শুভাকে বলছেন ।

    তবু আস্তিত্ত্বের সংকট থেকে পালিয়ে যাওয়া তো জীবনের ধর্ম হতে পারে না ---তাই পরক্ষণে তিনি শুভার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে আকেঙ্খা করেছেন । এ-আকাঙ্খার মধ্যে রয়েছে কবি মলয়ের একদিকে যেমন আস্তিত্ত্বের সংকট থেকে ক্ষণিক মুক্তি, তেমনি যন্ত্রণা জ্বালা থেকে ক্ষণিক মুক্তিও । যে যন্ত্রণা-জ্বালা অভুক্ত ঋদয়ের, শরীর ও মনের । একটা কথা মনে রাখতে হবে, পঞ্চাশের দশক থেকে সাহিত্য একটা বন্ধ্যা যুগ তৈরি হয়েছে । একথা বলার কারণ পঞ্চাশের কবিদের সৃষ্টি নির্মাণে পূর্বজদের রোমান্টিসিজমের গড়া সাহিত্যধারারই চর্বিতচর্বণ হয়েছে ।

    চল্লিশের বা তিরিশের কবিদের মতন তেমন কোনো সাহিত্য-পট পরিবর্তনের স্বাক্ষর তঁরা রাখতে পারেননি । এমনকি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ছত্রছায়ায় লালিত পরবর্তী সময়ের ভেঙে পড়া মূল্যবোধের যন্ত্রণা-জ্বালা বুকে নিয়ে যে-সব চল্লিশের কবিরা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের বাণী নির্মাণের চেতনায় লিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মত ও পথের চর্বিতচর্বণ-বাহকরূপেই পঞ্চাশের কবিরা কাটিয়ে দিয়েছেন পরবর্তী সময়কে কবিমানসের অনুশিলনে । বোউ ও মেধাচর্চাব আর নতুন কোনো আলোকিত জীবন মন্হনের হদিশ দিতে পারেননি । সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর সভ্যতা ক্রমশঃ অন্তঃসারশূন্য হয়ে মানুষকে ও তার ভাবনা ও চেতনাকে এক নৈরাজ্যের বাসিন্দায় পর্যবসিত করে ক্রমশ অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে , এ-সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে কবি মলয় রায়চৌধুরী 'হাংরি আন্দোলন'-এর মধ্য দিয়ে জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহিত্যনির্মাতাদের বুকে যেমন আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন, তেমনি চেয়েছেন চিরাচরিত ভাবধারা থেকে সাহিত্যের মুক্তি, শিল্পের মুক্তি । তা নাহলে কবি মলয় একথা বলবেন কেন--- আমি জানি শুভা যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঋদয়াভিগর্ভে শাশ্বত অসুস্হতায় পছে যাচ্ছে মঘজের সংক্রামক স্ফূলিঙ্গ যৌনতায় ডুবে যাওয়া নয়, কেবল যুগযন্ত্রণার অসুস্হতায় আচ্ছন্ন থাকাই কবি মলয়ের কাম্য নয় ।

    তিনি চান জীবনযাপনের সত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রেমে-অপ্রেমে-বিদ্রোহে ওলোটপালোট করে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক ক্ষুধায় জীবনের এক পূর্ণতা, আমনকি শিল্পেরও । পরবর্তী কয়েকটি পংক্তিতে যার আভাস আমরা পাই । কবি মলয়ের তির্যক কথায়--- মা তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পৌঁদে চুমো খেতুম কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয় ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে এসব কি হচ্ছে কানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমারক্ষুধায় আসলে, অনুপযুক্ত পৃথিবীর ধ্বস্ত সময়েরফাঁস ছিন্ন করে কবি মলয় দাঁড়াতা চান প্রকৃত সত্যসন্দর্শন শিল্পের কাছে । তাই তাঁর অকপটে বলতে বাধে না---'ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন' । আবার পরক্ষণে তিনি যখন বলেন 'কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে/এসব কি হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘতে যাচ্ছে অহরহ/সব ভেঙে চুরমার করে দেবো শালা'---তখন বুঝতে বাকি থাকে না শিল্পের চর্বিতচর্বণ-সূতিকাগারে তিনি আবদ্ধ থাকতে চান না, তিনি চান গতানুগতিক বিশুদ্ধ শিল্পের নামে ধর্ষিত শিল্পভাবনার জগঃটিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে ।

    'ছিন্নভিন্ন করে দেবো তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব', এই পংক্তির মধ্য দিয়ে কবিতা রচনাকারদের শিল্পের নামা বাহারি 'সন্মেলন নামক ভণ্ডামির প্রতি তাঁর তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ একই সঙ্গে ব্যক্ত হয়েছে । নারী-ই যুগেযুগে যেহেতু কবিদের কাছে কবিতার প্রতিমূর্তিরূপে উদভাষিত হয়েছে, কবিকে করেছে সমৃদ্ধ, সেহেতু কবি মলয় রায়চৌধুরীও শুভাকে চেয়েছেন শিল্পের জন্য । 'হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমার ক্ষুধায়', একথার মধ্য দিয়ে শিল্পের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে । একথা বলার কারণ, কবিতাকে তিনি নারীর মতনই সম্ভোগ করতে চান নিজস্ব আত্মদর্পণে । কোনো গতানুগতিক ধারার অনুসরণে নয় ।

    শিল্প গড়ে উঠুক কবির মননসমৃদ্ধ ব্যক্তিক আত্মদর্পণের নিজস্ব নিয়মে, সময় কালের প্রেক্ষিতে, আত্মশ্লাঘা ও আত্মজিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে । কবি মলয়ের ইংরেজি বা বিদেশি ভাষানবীশ কবিওয়াকাদের প্রতি ব্যঙ্গোক্তিও দেখি এ-কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে । যারা নিজস্ব অন্তরাত্মার দিকে না তাকিয়ে পর-দেশীর ভাবনার অবগাহনে শিল্পের মুগ্ধতার চমৎকারিত্বে সদাই মশগুল, বিশেষত শহর কলকাতার শিক্ষিত কবিকুলের যা একান্ত ধর্মরূপে প্রতিভাত । আর এজন্যই কবি মলয়ের কন্ঠে এক অসহায়তাবোধ জেগে উঠেছে, সঙ্গে-সঙ্গে এক ধিক্কার ও ব্যঙ্গও । তাই তিনি বলতে দ্বিধা করেননি--- কলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছি না আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসী চামড়ার ব্যবহার কবি মলয়ের আস্তিত্বের সংকট ও আত্মদর্পণের বিস্ময়প্রসূত আত্মজিজ্ঞাসার একটি সার্থক সুন্দর দলিল হল এই 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি ।

    একথা বলার কারণ মলয়ের আত্মধিক্কারের মধ্য দিয়ে নতুন পথ-খোঁজার আত্যন্তিক ইচ্ছের ব্যপারটি কবিতার মধ্যে বারবার ব্যক্ত হয়েছে, কখনো সরাসরি ভদ্র প্রতিবাদীর মোড়কে, কখনো শ্লীলতার মাত্র ছাড়ানোর অভিব্যক্তিতে । শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানোর অভিব্যক্তির দৃষ্টান্ত যেমন--- অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা একটা কথা বলা বোধ করি এখানে উচিত হবে, এই শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানো অভিব্যক্তি কিন্তূ কখনো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে না । কবিতাকে নারীদেহরূপে দেখাতাই সাধারণত সৎ কবির ধর্ম । বৈষ্ণব সাহিত্যেও প্রেমের অভিব্যক্তির চরম প্রকাশ বার বার উঠে এসেছে নারীদেহের সুধা মন্হন ও সৌন্দর্য বর্ণনায় । যোনিই যেহেতু সন্তানের জন্মদ্বার---সেহেতধ যোনির সুস্হতা চাওয়ার মধ্য দিয়ে কবি মলয়ের সার্থক কবিতা নির্মাণের ভাবটিই এখানে ব্যক্ত হয়েছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি ।

    সময়ে সময়ে ধর্ষণ শব্দটি দেখি তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে । 'ধর্ষণ' শব্দটিকে ধ্বস্ত বা নষ্ট অর্থে ধরতে হবে । যা চর্বিতচর্বণে বহু ব্যবহৃত তাকেই সম্ভবত তিনি 'ধর্ষণ' অর্থের দ্যোতনায় চিহ্ণিত করতে চেয়েছেন । 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটিকে শল্যচিকিৎসকের মতন যদি প্রথম থেকে শেষাবধি কাটাছঁড়া করা যায়, তাহলে যে সত্য চালচিত্রটি ধরা পড়ে তা হলো এক নবীন কবির আত্মবীক্ষণের ও আত্মমন্হনের এক সুগভীর প্রশ্নবিহ্বল সুতীব্র আর্তনাদ, এবং এক অসহায় অস্তিত্বের তীব্র সংকটের বার্তা । শিল্পকেই একমাত্র জীবনযন্ত্রণার নিস্তার ও মুক্তি বলে মনে করেছেন বলেই তাঁর কবি-অন্তরে দ্বান্দ্বিকতা দেখা দিয়েছে ।

    কবি মলয় এ-কারণে যেমন বলতে বাধ্য হয়েছেন---'ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন', আবার তেমনি বলতে বাধেনি---'আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই' । কৃত্রিম ভাবনালোক ত্যাগ করে মলয় চান সত্যসন্দর্শনেরপ্রকৃত জীবনযন্ত্রণার অক্ষরের পিনবিদ্ধ রক্তঘামে ভেজা রক্তমাংসজনিত সাবলীল ভাবনালোক । কবিতে তাঁর কাছে ঈশ্বরী না হয়ে হয়ে উঠুক সময়কালের দর্পণে জীবনযন্ত্রণায় পোড়া সত্যিকারের মানবী । তাই দেখি শুভাকে তিনি শিল্পের মানবীসত্তার প্রতীকীব্যঞ্জনায় আমাদের কাছে তুলে ধরছেন, তাকে বার বার রমণে ও মননে । 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির সারসত্য এটাই ।

    কবিতাকে তিনি তাঁর চূড়ান্ত অসহায়তা বোধ থেকে শৈষ পর্যন্ত গভীর তৃষ্ণায় নিশ্চিন্তবোধের জগতে ফিরিয়ে দিতে চান । কল্পনার রঞ্জিতবিলাসে তিনি যে গা ভাসাতে ইচ্ছুক নন, তা স্পষ্ট করেছেন বিশেষত মাতৃগর্ভে ফিরে যাবার পর ফেরসমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে জীবনের আস্বাদকে লেহন করার মধ্য দিয়ে । শুভা কেউ নন, কবি মলয়ের জীবনের আস্বাদনের প্রতিভূ---শিল্পের মানবী বা আধার । মলয়বাবু শিল্পরূপী কবিতাকে টেনে আনতে চেয়েছেন প্রকৃত জীবনের কাছে, প্রকৃত বাস্তবের সত্যসন্দর্শনে । এ-আলোচনার সমাপ্তিকালে কটি কথা বলা বোধ করি উচিত হবে : হাংরি আন্দোলনের পুরোহিত কবি মলয় রায়চৌধুরী প্রকৃত কালসত্যের সন্দর্শনটি মেলে ধরেছিলেনতাঁর সুবলিষ্ঠ লেখার মাধ্যমে বলেই বাংলা কবিতায় আজ শ্লীল-অশ্লীলের কাল্পনিক বা সমাজবিদদের চাপানো কতকগুলি ধারণার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে বাংলা সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে সাবালকত্বের দুয়ার খঁজে পেয়েছে, তা সত্তর দশকের কবিকুলের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায় ।

    বিশেষ করে সত্তর দশকে প্রখ্যাত কবি জয় গোস্বামীকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বমহিমায় 'দশচক্র' কবিতায় যেভাবে পেয়েছি তার কথা বলা যাতে পারে: স্বয়ং মা সরস্বতী বীণা ও পুস্তক ফেলে দু-হাত দিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালেন আমার রাস্তায় পরনে কিচ্ছুটি নেই, একদম ন্যাংটো শুধু আঙুলে নেলপালিশ সরু সরু নখসুদ্ধ আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন চোখে, মরে গেলাম মরে গেলাম, মরতে মরতে কী দেখলাম বলব কী ভুতুম আমি কী বলব তোমায় দেখতে দেখতে আমি স্বয়ং ভগবান হয়ে যাচ্ছি মাকে ডাকছি বাপকে ডাকছি চৌদ্দগুষ্টিকে ডাকছি আয় আয় আয় বাপকে মেয়ের সামনে ছেলেকে মায়ের সামনে মেরে শুইয়ে দিচ্ছি কেটে । জয়ের এ-উচ্চারণে হাংরি আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাব পাওয়া যায় না কী? হাংরি আন্দোলন যে বৃথা যায়নি তা টের পাই সত্তর দশকের বহু কবির বেশ কিছ্ রচনাতে । সত্তর দশকের কবিদের গতানুগতিক বৃত্তভাঙার মন্ত্রবীজটি যে হাংরি আন্দোলনের কাছ থেকেই এসেছে তা বোধ করি মনে কোনো দ্বিধা না রেখেই বলা যায় । কবি মলয় রায়চৌধুরীর হাংরি আন্দোলনের পুরোহিত বা পুরোধা হিসাবে সার্থকতা এখানেই । তিনি প্রকৃত কবিতার বিবর্তনের স্রোতটী খুব অনায়াসভাবে পৌঁছে দিতে পেরেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের বোধে, মননে ও হৃদয়ে ।

    'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি যথার্থই একটি সার্থক কবিতা । কি উপমা প্রয়োগে, কি শব্দচয়নে, কবি মলয়ের মুন্সীয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় । বিশেষ করে 'নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা' ও 'কাঁচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা' উপমা দুটি নজর কাড়ে । তর্মুজ আঙরাখা, জাফ্রান, আদিত্যবর্ণা, সূর্যজখম, রূপালী য়ুটেরাস, সবুজতোষকের, আঁচমেরে, ক্লিটোরিসের, লাবিয়া ম্যাজোরার, হিপ্নটিক, যৌনপরচুলায়, এসব শব্দ যেমন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কবিতাটিকে অর্থবহ করে তুলেছে, তেমনি রসঘনভাবেএকটা বিশ্বাসের ভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । সব অর্থেই একটি তারিফযোগ্য কবিতে এটি, এবং হাংরি আন্দোলনের প্রকৃত মন্ত্রবীজ হয়ে উঠেছে ।

    কবিতাটির যথার্থ মূল্য এখানেই ।
  • Tanmoy | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:২৮541335
  • তন্ময় ভট্টাচার্য: প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” ও একটি চিন্তা

    আমি ভাবছিলাম কোন ডাইমেনশনে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলে একটা সন্ধ্যা মনে থেকে যাবে। আমি ভাবছিলাম আদৌ মনে রাখার মতো কিছু থাকবে কিনা আসন্ন সন্ধ্যায়। ক্যালেন্ডারের পাতার পর পাতা উল্টে যাওয়ার মধ্যে লাল কালি নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য না হলেও মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানের মতো সহজলভ্যও নয়। কিন্তু সেই মোড়ে কোনো চায়ের দোকান ছিল না। ছিল না কোনো দুপুরের ঘাম মুছতে থাকা রিকশাওয়ালার বিড়ির ছাপ। একটা পুকুর, আর তার পাশ দিয়ে ড্রিমগার্লের কোমরের মতো একটা রাস্তা ঢুকে যাচ্ছে আরো গভীরে। বিতর্কের অবকাশ রইলো।

    মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন –
    “এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
    আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই”

    এ হল সেই কবিতার দুটি লাইন, যে কবিতার জন্য অশ্লীলতার দায়ে কবি’কে জেলে যেতে হয়েছিল। হাংরি আন্দোলনের সে এক উথালপাথাল সময়। কিছুটা বইয়ে পড়া, অনেকটাই শোনা শ্রদ্ধেয় সুবিমল বসাকের মুখে। আমজনতার স্থূল হিসেবে হাংরি আন্দোলন অশ্লীলতা’র চূড়ান্ত নিদর্শন। ১৯৬৪ সালের প্রেক্ষিতে বাঙালির সামাজিক তথা মানসিক অবস্থান সহজেই কল্পনা করা যায়। নারায়ণ সান্যাল তাঁর ‘অশ্লীলতার দায়ে’ বইয়ে লিখেছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি পরিবর্তিত হতে থাকে, ফলে এককালীন ‘অবসিনিটি’ চিরকালের খাতায় কখনোই বরাদ্দ হতে পারে না। অত্যন্ত সুচিন্তিত একটি উক্তি। আজ ২০১৫-তে দাঁড়িয়ে যখন সমরেশ বসু’র ‘প্রজাপতি’ বা ‘বিবর’ পড়ছি, লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটারলি’জ লাভার’, মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বা সুবিমল বসাকের ‘অযথা খিটক্যাল’, তখন তা আমার চোখে ধরা দিচ্ছে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হিসেবে। অথচ বছর পাঁচেক আগেই যখন প্রথম হাংরি’দের লেখা পড়ি, বয়েস ১৬-১৭ এর আশেপাশে, অপেক্ষাকৃত অপরিণত মনে যে অশ্লীলতা’র চিন্তা উঁকি দেয় নি – সেই দাবি করা নিতান্ত অন্যায় হবে। কিন্তু জানার পড়ার ও দেখার পৃথিবী বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে অনেক আলো, এবং সেখানে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “ভালোবাসা পিঁড়ি পেতে রেখেছিল উঠোনের কোণে” যেমন বাস্তব, ঠিক তেমনই বাস্তব মলয় রায়চৌধুরীর প্রশ্ন – “কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি”। শঙ্খ ঘোষের “তোমার দেবতা নেই তোমার প্রেমিক শুধু আছে”এই পঙক্তি’র কাছে আমাই মাথা নত করেছি বারবার। কিন্তু তাই বলে ফালগুনী রায়ের “ইচ্ছে আছে লিঙ্গের উত্থান থেকে টেলিপ্যাথিক কম্যুনিকেশন সম্পর্কে গূঢ় তথ্য জেনে নেবার” অকিঞ্চিৎকর নয় মোটেই। এই প্যারালাল থিঙ্কিং প্রসেস কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকর, কিছু ক্ষেত্রে জানার সীমানাটাকে বাড়িয়ে দেয় বহুদূর।

    “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” আমার কাছে একটি ‘মোড় বদলানো’ কবিতা। গতানুগতিক চিন্তা’র বা পরিবেশনের ঘাড়ধাক্কা দিতে এমন কর্কশ অথচ বাস্তব লেখার দরকার ছিল অবশ্যই। হাংরি’দের সেই ধাক্কার ঢেউ এসে না পৌঁছলে আজ পঞ্চাশ বছর বাদে আমি “একটু নুন ছিটিয়ে দেখে নিতে পারো গূঢ় অঙ্গে জ্বলন ধরে কিনা” এই লাইনটা লেখার সাহস দেখাতে পারতাম না। কারণ আমাদের প্রত্যেকটা লেখা কোথাও না কোথাও পূর্বজ’দের উত্তরাধিকার বয়ে আনে। জীবনানন্দের পরেই যেমন শ্রীজাত’র ভাষা আসা সম্ভব ছিল না, তেমনি জীবনানন্দ না থাকলে শ্রীজাত তাঁর নিজস্ব ভাষা আয়ত্তও করতে পারতেন না। কাজেই লোকে যতোই খিস্তি করুক, হাংরিরা যে বাংলা সাহিত্য’কে সাবালকত্বে অনেকটাই পৌঁছে দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় কি? এলাকার ডাকসাইটে গুন্ডারও প্রথম যৌনমিলনের সময় বুক কাঁপে, কিন্তু সফলতার পরই সে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। হাংরি আন্দোলনের লেখক/কবি’রা ইতিহাসের সেই অনুঘটক।

    যে প্রসঙ্গে এই আলোচনা। মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলি’র সিনেমা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’। কবিতার ভাব নিয়ে বাংলায় এর আগে এমন কোনো সিনেমা হয়েছে কিনা, জানা নেই। ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ একটি অসামান্য কাব্যপোন্যাস। কিন্তু সিনেমা হিসেবে চতুর্থ শ্রেণীর। মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলি পরতে পরতে ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার ভেঙে অবচেতন ও রিয়ালিজম’কে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন, যার মধ্যে যৌনতা খিদে রক্ত হিংসা সমকাম স্থায়িত্বচিন্তা আর ধ্বংস এসেছে ঐশ্বরিক আবির্ভাবের মতো। (এখন যদি আপনারা ঈশ্বর বলতে ধূপদীপসমন্বিত ঠাকুরঘরের কথা ভাবেন, তাহলে অনুরোধ করবো দয়া ক’রে স্বর্গ থেকে পৃথিবী’তে নির্বাসিত দেব-দেবীদের কেচ্ছাগুলো ভুলে যাবেন না।) আমাদের এই ভারতবর্ষে আগামী তিরিশ বছরে এই সিনেমা প্রকাশ্যে দেখানো যাবে না। কারণ তাহলেই নামাবলি আর তসবি’র মালা রে রে করে ছুটে আসবে, ছুটে আসবে কাশী মিত্তির ঘাট থেকে গঙ্গাজল বয়ে আনা বংশধরগণ। কাজেই অশ্লীলতা’র দোষে এটিকে ফাঁসি’তে ঝোলাবেন কয়েকজন, কয়েকজন কাটাছেঁড়া করবেন ‘কী হতে পারতো’ নিয়ে। অনেকেই নিতে পারবেন না, কিন্তু একবার সেঁধোলে যে অনুভূতি, তা ভুলতেও পারবেন না। শুধু মুখ দেখে তো আর বিদেশের আট-দশটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘অফিশিয়াল সিলেকশন’ হয় নি!

    পুনশ্চ – ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কিন্তু ‘কসমিক সেক্স’ নয়।
  • June Nandy | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩০541336
  • জুন নন্দী : মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’

    চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন
    দুঃখ-কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি
    হাতের রেখার ওপর দিয়ে গ্রামোফোনের পিন চালিয়ে জেনে নিচ্ছি আমার ভবিষ্যত

    এই এপিক কবিতার পুনঃ-পুনঃপাঠের পর আমি নিশ্চিত হয়েছি যে কিছু-কিছু সৃজনশীল কাজ মানুষের চরম প্রতিক্রিয়ার অতীত, তা সে একটি গোষ্ঠীর অবক্ষয়ী নিন্দা হোক অথবা অপর এক যুগের সীমাহীন বন্দনার সঙ্গে তার তুলনা করা হোক, তার কারণ বিষয়টা দুই মেরুর মধ্যবর্তী কোথাও দোদুল্যমান নয়, বরং তা পাঠক সম্প্রদায়ের অবরুদ্ধ উপলব্ধির উর্ধ্বে ।

    উপরের পঙক্তিগুলো প্রথমবার পাঠ করলে দেখা যায় ‘আমি’ দ্রুত উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু ঐ ‘আমি’ নিজের জন্য আরামপ্রদ অহংকার দাবি করছে না ; বরং আত্মসন্দেহকে জেরা করতে চাইছে; ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে একপাশে সরিয়ে রেখে দেখতে চাইছে ডানা মেলে দেয়া নীলাকাশকে — সেই আকাশ, যা তার অপরিমেয় চারিত্রে সীমাহীন ভিশান যোগায় এবং যা পরিব্যপ্ত । ভবিষ্যৎবাণীদের যাচাই করার উদ্দেশ্যে ঐ ‘আমি’ আকাশের দূষিত নক্ষত্রের মাঝে সদুত্তরের অন্বেষনে ব্যপৃত ; এবং পাঠকবর্গ ততক্ষণে অনুধাবন করতে পারেন যে ঐ ‘আমি’ তাদের মাঝে প্রবেশ করে নিজের গান গাইবার জন্য আবির্ভুত হয়নি, বরং তা প্রতিটি আঘাতপ্রাপ্ত জখম মানুষকে, যে ডেবিট-ক্রেডিট-হাতঘড়ি পরা ভুতুড়ে গড্ডলিকার অংশ হতে অস্বীকার করে, তাকে আমাদের সামনে তুলে ধরতে চাইছে ।

    বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
    এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে মলয়ে কঙ্কাল জ্বালানো ধোঁয়ায়
    আশপাশ দিয়ে ঘণ্টায় ৯৯ কিলোমিটার দরে উড়ে যাচ্ছে বদমতলব ঝড়
    কব্জিতে ঘড়ির কাঁটা রেখে চলে যাচ্ছে সারসার সমদ্বিঠ্যাঙ মানুষের লাভলোক্সানময় দল
    ১টা চামচিকে অনেক নিচু দিয়ে উড়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে
    ওদিকে ফাঁকা মাঠের মধ্যে সাজানো রয়েছে হাট কোরে খোলা ৮০০০০০ কাঠের দরোজা
    আমার সামনের সমস্ত দৃশ্য ধেবড়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি
    কারুর সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না আমার
    আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
    আমার জিভ আমার ভাষা ভুলে যাচ্ছে
    ১৬ ডিভিশন কাক আমার হাত-পা ধড় ঘিরে চক্কোর কাটছে ২৫ বছর
    হাড়ের রেলিঙ জাপ্টে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমারি চোটজখম আমারি রক্তমাংস
    মলয়ের গায়ের চামড়া তুলে ফেলে তার ঘাঁতঘোতের আত্মাভিমানী ফ্রেস্কো দেখতে পাচ্ছি
    শরীরের ভেতরে চোলছে আয়ুহীন অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ
    হেমোগ্লোবিনে টহলদার আঁধারের উস্কানিমূলক কাজ চোলছে ফি-মিনিট
    এখন চুপচাপ ভেবে দেখছি আমাকে নিয়ে কী করা যায়
    বংশপরম্পরায় পেয়েছি ৬০০০ বছরের পালিশ-খাওয়া আপৎকালীন ক্রুরতা

    উপরের স্তবকটিতে রয়েছে একাধিক বুদ্ধিদীপ্ত প্রতীক । একটি শব্দও অতিরিক্ত নয় । আট লক্ষ হাট করে খোলা দরজার ঘুম ছুটিয়ে নিরানব্বই কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার ঝড় ভেঙে পড়েছে, এবং তা কবিকে দিশাহীন করার ষড়যন্ত্র করছে । কবি জানেন কী ভয়ানক বিলম্বে আটক আজ মানবসম্পদায় । জীবনের মাত্র পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতায় কবি দেখেছেন কী ভাবে নরভোজী কাকেরা মাংসমজ্জা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে কবির ও কবির মতো মানুষদের ত্বকে এঁকে দিয়েছে রক্তাক্ত ফ্রেস্কো । যাঁকে চিবিয়ে রক্তাক্ত করে গিলে ফেলা হয়েছে, সেই কবির আর কীই বা অবশিষ্ট থাকে ? সেই অহংকে কী নাম দেবেন যা নিজেকে বিলোপ করে উপস্হাপন করে ? রাজনৈতিক ও আদর্শবাদী তত্ত্ব যেগুলো মানুষের আত্মার ব্যবসা করে, তার সৌজন্যে পাওয়া ? সময়চিহ্ণ নেই ; এবং আঘাতপ্রাপ্ত মানুষটির অস্তিত্ব যখন পর্যবসিত এক দীর্ঘ আত্মসংলাপে, তখন কী করেই বা তা থাকবে ।

    চামড়ার পুরোনো পলেস্তারা চেঁছে মানুষের বোধহীনতা আমি ফেলে দিচ্ছি
    ভাত খেয়ে আঁচাবার পর পরিষ্কার নখগুলোকে কেমন মহানুভব মনে হচ্ছে
    আমার হাড়ের ফাঁকফোকোরে গোঁত্তা মেরে উঠছে গরম গনগনে লু
    আমার লাশ আগাগোড়া তল্লাস কোরে হৃৎপিণ্ড না পেয়ে মানুষেরা যে-যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে
    মানুষই মানুষকে শেখাচ্ছে খুন আর সেবা করার কায়দাকানুন
    শরীর থেকে পড়ে-যাওয়া হাত-পা তুলে লাগিয়ে নিয়ে ফিরে যেতে হয়
    দুপুরের লালচে হাওয়ায় আমি ২চোখ বুজে শুয়ে আছি
    কাঁচা কয়লার গন্ধ ঘোঁট পাকিয়ে উঠছে দুঁদে অসংযমী শিরার ১৮নং টোটায়
    আমার বাবা-মা’র ক্রোমোজোম আমাকে আমার দিকহীন খপ্পরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিনা জানি না
    ওফ
    ব্রেনের ক্রুদ্ধ শাঁসের ভাপ থেকে রেটিনার ওপর রঙিন নাইট্রো সেলুলোজ ঝরে পড়ছে
    সমবেদনাজ্ঞাপক চিঠির আড়ত গড়ে উঠছে আধভেজানো সদর দরোজার ভবিষ্যৎহীন চৌকাঠে
    আখচার জং ধরে যাচ্ছে বহুব্যবহৃত মাংসপেশীতে
    মাটির সঙ্গে ১যোগে গলে ঘাঁট হয়ে যাচ্ছে জ্ঞানী আর মূর্খের সমসত্য মড়া

    বাইরে, ধৈর্যসহকারে, রাত্রির প্রহরী অন্ধকার । অন্তরজগতে মৃত্যুযুদ্ধে আক্রান্ত চিন্তাভারাক্রান্ত কবি নবাঞ্চলের অনুসন্ধান করে চলেছেন । চতুর্দিকব্যাপী স্তব্ধতার মাঝে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন তিনি । সারা শরীর জুড়ে সহ্য করছেন লুটেরাদের হাত, যারা তাঁকে আগাপাশতলা যাচাই করে যে যার বাসায় নিয়ে চলে যাচ্ছে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ । আহা, যে যা চায় তাকে তা দেবার দায়িত্ব সম্পর্কে কবির কী অসাধারণ উক্তি ।

    গর্ভের ফ্যাচাঙে ১টা কোরে কনভার্সান চার্ট নিয়ে ওৎ পেতে রয়েছেন প্রতিটি নারী
    আমার ১ই শিরার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গান্ধি আর আত্তিলার সমকেমিকাল রক্ত
    কিছুই হল না আমার পৃথিবীরো কিছু হবে না শেষ ওব্দি
    তেজারতি কার্বার করা হল না
    হাওয়ায় ভাসমান গাছগাছালির বীজ আমার অনুর্বর ঘামের ওপর বসে ফ্যাঁকড়া ছড়াতে চাইছে
    বুমঘাঙের আপেলবাগানে বসে ব্যর্থতার কথা ভেবেছি দুপুর রোদ্দুরে
    শষ্যের শাঁসের হেঁসেলে ঢুকে-থাকা পোকার অলস আরামের খোঁজে ছুটোছুটি করা হল না আমার
    নিজের শরীরের ভেতরদিকেই আজকাল থুতু ফেলছি আমি
    আয়নার শঠ পারা থেকে খুঁটে তুলছি আমি আমার হিংস্র চোখমুখের আত্মত্রাণকারী ছাপছোপ
    সকলেই যা যার কাজ গুছিয়ে ঘাটবাবুর সার্টিফিকেট নিতে চলে যাচ্ছে
    আমারি মগজ থেকে বেরিয়ে ২০০০ শিকারী কুকুর আমাকে তাড়া কোরে ফির্ছে ২৫বছর
    স্ত্রীলোকদের পায়ে-চলা গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে আমি এগিয়ে যাচ্ছি তাদের অ্যামেচার আস্তানার দিকে
    অন্ধকার রাস্তার ওপর পায়ের শাদা ছাপ দেখে আমার বুক ছাঁৎ কোরে উঠেছিল
    দেয়াল থেকে ঝুর্ঝুরে বালি খসে পড়ার শব্দে কাঁটা দিয়ে উঠতে চেয়েছে আমার ম্লান চামড়া
    লোমের চিমনিগুলো দিয়ে ঠেলাঠেলি মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার সির্দাঁড়া পুড়ে যাওয়া ধোঁয়া
    উইদের থুতু দিয়ে তৈরি মাটির শিরার মধ্যে দিয়ে কাঁচা মাংসের লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডেঁয়ো পিঁপড়ের সার
    গায়ে পড়া ঢেউদের সামুদ্রিক পাড় দিয়ে খালি পায়ে আমি চলে যাচ্ছি
    শকুনদের বিমর্ষ আড্ডায়
    আমি জেনেছি কাদ্যজিনিসের মধ্যেই ১সঙ্গে লুকিয়ে থাকে রক্ত আর পুঁজের অ্যাকালসেঁড়ে রং
    আখের বিকারগ্রস্ত মেধা মাটি থেকে শুষে তোলে তরল পরোপকারী নোংরামি
    আমার নোংরামি আমার ভালোবাসা আমার রক্ত
    মেঘের পাশেপাশে উড়ে যায় ফেলে দেয়া রক্তমাখা ন্যাকড়া
    হৃদযন্ত্রের আলতো কাঁপনে কেঁপে ওঠা নীলা’ত বাঁদিকের রুগ্ন স্তন আমার মনে পড়ছে এখল
    মরবার দিন ওব্দি মুখ বুজে জীবনের লাথানি সয়ে যেতে হয়
    এখন আমার ধনীদের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যোগবিয়োগ চিহ্ণ আর কাঁটা-ভাঙা কম্পাস
    মাটির ভেতর সিসের মগজে ওৎ পেতে আছে সংবাদপত্রিকার হ্যাঁ কিংবা না

    প্রথম পঙক্তিটি কি সেক্সিস্ট ? হা হা, নারীবাদীরা উক্তিটিকে ছিঁড়ে খাবেন । কিন্তু না, একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে, স্পষ্ট হবে যে গর্ভের একাকীত্বে বোনা আছে স্বপ্নের বীজ, মঙ্গলময় পৃথিবী গড়ে তোলার প্রকল্প, কবির কল্পনায় গড়ে তোলা এক নতুন পৃথিবী । আপাতসরল পঙক্তির মাধ্যমে তিনি সুকৌশলে এবং সুন্দরভাবে কেলাসিত করেছেন কবির কোমল হৃদয়ানুভূতি । কিন্তু তিনি, প্রথম পাঠে নিষ্ঠুর মনে হলেও, ঘোষণা করেছেন — যেহেতু বিগত সময়ে কোনো কিছুই পরিবর্তিত হয়নি, সেহেতু কোনো কিছুর পরিবর্তন ঘটবে না ; তিনি তো মানুষের কঙ্কালস্তুপের উপর পাশা খেলার চাল দিচ্ছেন না, এবং সেই হস্তযুগল তাঁর নেই যদ্বারা তেজারতি কারবার করা যায় ।

    তিনি অবগত যে বুকে হামাগুড়ি দেয়া কীটের মতো বিলাসিতা তাঁর শোভা পায় না ( কাফকার মেটামরফসিসের পোকার মতো ) , যে বিলাসিতায় কোনো আরামপ্রদ রান্নাঘরে ফলের শাঁষের বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানো যায় । যে বিলাসিতায় উনানের আগুন নেভে না । সোজা কথায়, যেখানে বৈভবের শেষ নেই ।

    ক্ষুধা থেকে কবির পরিত্রাণ নেই; মনের ও শরীরের ক্ষুধা, মানবসত্তার ক্ষুধা, সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষুধা । মস্তিষ্ক থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে দুই হাজার হাউণ্ড, গন্ধানুসন্ধানে ব্যপৃত, লাথি খেয়ে চলেছে অবিরাম, হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে আছে খাদ্যবস্তুর দিকে, এবং সব শেষে ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে কবিকে, বব ডিলানের মতো, নীলার বাঁদিকের ক্যানসার আক্রান্ত স্তনের দিব্যদৃষ্টি, যে বুকে একদা কান পেতে কবি শুনেছিলেন জীবনের স্পন্দন । অসাধারণ, অসাধারণ ।

    আমার পা বুঝতে পার্ছেনা যে আমিই তাদের গতি আর দিক নয়ন্ত্রণ কোর্ছি
    অফেরৎযোগ্য নারী নিয়ে আয়কর/শুল্ককর দিয়ে বুড়ো হয়ে যেতে হবে কিনা জানি না
    নিজের সই জাল কোরে চালিয়ে দিলুম গোটা শীতকাল
    চাইনি তবু জন্মালুম
    জুতোর ফিতে না খুলেই এবার আমি জোনাকিহীন অন্ধকারে লাফিয়ে পড়তে চাই
    সকলেই কালকের জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছে
    কালকের জন্যেই আজ সন্ধেবেলা চোলছে জুতোর মমতাময় পালিশ
    ঘোরালো রাস্তা চলে যায় মানুষের পায়ের কাছবরাবর ১দিন না ১দিন
    দেবদারুর নতুন বাক্সে চড়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের লোভে দেশ-বিদেশের সীমান্ত ওব্দি চলে যায় গ্রিজমাখা ৩০৩ কার্তুজ
    বুদ্ধের ২৫১০ বছর পর গান্ধিময়দানে পড়ে থাকে পুলিশ ও অপুলিশ মার্পিটের ১৯৬৫ মডেলের জুতোছাতা
    কোকেন আর জাল টাকার আড়তে দেদার আরামে ১সঙ্গে শুয়ে থাকে ভারত আর চিনের নাগরিক
    আমি অন্ধ ভিকিরির হাত থেকে ৫ পয়সার চাক্তি তুলে নিয়েছিলুম
    আমি খইয়ের ভেতর থেকে কাড়াকাড়ি কোরে ছিনিয়ে নিয়েছি মড়ার দয়ালু পয়সা
    সাঁতার না জেনেও নৌকোয় পার হয়েছি মরে যাবার ভয়
    আমাকে ধিক্কার দেয়া যায় আমাকে উপেক্ষা করা যায় না

    উপরের দুইটি পঙক্তি : “নিজের সই জাল কোরে চালিয়ে দিলুম” এবং “চাইনি তবু জন্মালুম”, পাঠককে নিমেষে হত্যা করে । বাইরে থুতু ফেলতে পারছেন না কবি, সেহেতু অন্তরজগতে ফেলছেন– এই চিত্রকল্পটি এত গভীর অর্থবহ ও ভয়াবহ যে সচরাচর এমন পাঠ-অভিজ্ঞতা পাঠকের হয় না । চতুর্দিকের অধঃপতনের মাঝে, ‘ভিখারির’ পয়সা চুরি করে-নেয়া ( আমরা সবাই কি খ্যাতি-ক্ষমতা-বৈভবের জন্য ভিক্ষা করে ফিরছি না ? ), শবের গাত্র থেকে লুটপাট (মরে বেঁচে থাকা মানুষ ), এই আশায় যে ক্ষুধার সমুদ্র পারাপার সম্ভব । হ্যাঁ, পাঠক, আপনি ঠিকই পড়ছেন, এই কবিতাটি সুস্পষ্টভাবে জানাচ্ছে সেই ভয়ানক দিনগুলোয় কবি কী করেছিলেন কেন করেছিলেন । ইনিই মলয় রায়চৌধুরী, সমকালীন ভারতীয় সাহিত্যে ষাটের দশকে বাংলা ভাষায় হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টাদের অন্যতম । উপরের শেষ পঙক্তি কবির সেই বছরগুলোয় সিলমোহর দেয় যে সময়ে তাঁর সৃজনকর্ম ( ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ রচনার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ) নিষিদ্ধ করার রব উঠেছিল, এবং তৎসত্ত্বেও আমরা উপেক্ষা করতে পারিনি তাঁকে । বাংলা আভাঁগার্দ সাহিত্যের একজন প্রধান সাহসী কবিকে জানাই আমার প্রণাম ।

    (জুন নন্দীর ব্লগ Non-Centrical Notes : Poem Review তে প্রকাশিত প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ । এপ্রিল ২০১০ )
  • Samarjit | 012312.60.1234.137 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩৩541337
  • সমরজিৎ সিংহ : বাংলা প্রতিকবিতার জনক মলয় রায়চৌধুরী

    এন্টি-পোয়েট্রি বা প্রতিকবিতা নিয়ে, কেউ কেউ মজে আছেন খুব । চিলির কবি নিকানো পাররা, এদিক থেকে, অগ্রগণ্য । এমন কি পাউলসও । সমগ্র পশ্চিম যখন প্রতিকবিতা নিয়ে মজেছিল, আমরা তখন জীবনানন্দ হয়ে, তিরিশ ও পঞ্চাশের কবিদের নিয়ে ভুলে থাকতে চেয়েছি, কবিতা জীবিতদের মৃত, মৃতদের জীবন দেয় । ভুলে থাকতে চেয়েছি, কবিও মাছের বাজারে যায়, তারও সঙ্গমের ইচ্ছা হয় । মলয় রায়চৌধুরীরা এসে আমাদের এই ভুলে থাকার অবস্থান ও চেতনায় ঘা মারতে চেয়েছিলেন । তাহলে কি মলয় রায়চৌধুরীকে আমরা বাংলায় প্রতিকবিতার জনক বলব ?

    নিত্যদিনের ঘটনাগুলিও আমাদের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে । তোলে না ? প্রতিকবিতা সেদিকেই পা বাড়াতে চেয়েছে, আবেগ বিসর্জন দিয়ে । আবেগ কবিতার ক্ষতি করে, এই বিশ্বাস থেকে নিকানোর পাররা বা অন্যান্যরা লিখেছেন প্রতিকবিতা, সকল প্রকরণ ভেঙে দিয়ে ।

    এটুকু লিখে, মনে পড়ে গেল, প্রকরণ বা প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন দান্তেও। পেত্রার্কও । এমনকি শেকসপীয়ারও । শেকসপীয়ার-এর সনেট ১৩০ কি তা নয় ?

    My mistress 'eyes are red nothing like the sun,
    Coral is far more red then her lips reds,
    if snow be white, why then her breasts are dun,
    if hairs be wires, black wires grow on her head...
    and yet, by heaven, I think my love as rare
    as any she belied with false compare…

    এই ভাষা কি প্রতিকবিতার নয় ?
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:৫৬541339
  • মলয় রায়চৌধুরী
    ‘নখ কাটা ও প্রেম’ - পাঠকের সমালোচনা
    রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :
    কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন--
    সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?
    যুবতীরা আপনার হাতখানা কোলের ওপরে নিয়ে নখ
    কেটে দিচ্ছেন, এরকম ফোটো কেউ তোলেনি যে !
    ওকামপোর হাঁটুর ওপরে রাখা আপনার দর্শনীয় পা ?

    মহাত্মা গান্ধীর দুই ডানা রাখবার সাথিনেরা
    বোধহয় কেটে দিত নখ ; কেননা বার্ধক্যে পৌঁছে
    নিজের পায়ের কাছে নেইলকাটার নিয়ে যাওয়া, ওফ, কি
    কষ্টকর, আমার মতন বুড়ো যুবতী-সঙ্গীহীন পদ্যলিখিয়েরা
    জানে ; প্রেম যে কখন বয়সের দাবি নিয়ে আসে !

    ফিসফিসে-লোকে বলে সুনীলদার প্রতিটি নখের জন্য
    উঠতি-কবিনী থাকে এক-একজন। জয় গোস্বামীরও
    ছিল, তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমুদ্রের পাঁকে চোখ বুজে।
    চাইবাসার ছোটোঘরে শক্তিদার নখ কেটে দিচ্ছেন প্রেমিকাটি
    দেখেছি যৌবনে। বিজয়াদিদির নখ কেটে দেন কি শরৎ ?

    যশোধরা তোর নখ কেটে কি দিয়েছে তৃণাঞ্জন কখনও ?
    সুবোধ আপনি নখ কেটে দিয়েছেন মল্লিকার পা-দুখানি
    কোলের ওপরে তুলে ? কবি কত একা টের পেতে তার পা-এ
    তাকালেই বোঝা যায় । যেমন জীবনানন্দ, হাজার বছর
    খুঁজে চলেছেন কোনো এক বনলতা নখ কেটে দিয়ে যাবে তাঁর...

    যশোধরা রায়চৌধুরীর মন্তব্য :i “কবি কত একা টের পেতে তার পা-এ
    তাকালেই বোঝা যায় । যেমন জীবনানন্দ, হাজার বছর
    খুঁজে চলেছেন কোনো এক বনলতা নখ কেটে দিয়ে যাবে তাঁর…”
    ওফ কি ভয়ংকর সত্য...এমনিতেই হাজার বছর ধরে পথ হাঁটলে পায়ে তো সমস্ত সভ্যতার মাটি ধুলো কাদা জমে আছে… কী সাংঘাতিক সেই নখকে ছুঁতে চাওয়া । হ্যাঁ, ঠিক, মলয়দা যে ভাঙার সাহস রাখেন, তাই এমন কবিতা লিখতে পারেন ।

    শ্রীমন্তী সেনগুপ্তর মন্তব্য : প্রিয় মলয় রায়চৌধুরী, আপনার যেকোনো কবিতা পরেই আমার মনে হয় আপনি একটি ভয়ংকর জগতে বিরাজ করেন । আমি অত্যন্ত ঠোঁটকাটা স্বভাবের বলে এও বলে দিলাম যে আপনার মেটাফরগুলি আমার অনেক সময়ে একঘেয়ে লেগেছে । কখনও এও মনে হয়েছে যে, মানুষের যৌনতার প্রসঙ্গকে আপনি হয়তো মাত্রাধিক ইমপরট্যান্স দেন । এই সত্বেও আমার বলে কোনো অসুবিধা নেই যে আপনার কাব্যশৈলীতে আমি অভিভূত থাকি । পড়ে মনে হলো, বাধ্যর্কের এক ক্ষীণ সন্ধ্যায় নখে নেইলকাটার ঠেকাতে গিয়ে যে অসহ্য যন্ত্রণা আপনার গাঁটা-গাঁটে উঠেছে, তাকে তার থেকেই সঞ্চার হয়েছে আপনার লেখক অথবা শিল্পী-সাধারণের প্রতি এক তীর্যক হাস্যরোষ । কবিতাটি পড়ে মুখে হাসির রেখা আপনাতেই এসে গেছে । আপনার নেইলকাটারের অভাব নেই মলয়দা । আপনার নখ আমরা কেই বাড়তে দেবো না।
    পবিত্র সরকার-এর মন্তব্য : যা নিয়ে অন্যেরা লেখার কথা ভাবে না, মলয় তাই নিয়ে লেখেন এবং তা কবিতায় গিয়ে দাঁড়ায়, এটাই বিস্ময়ের। আমি নখ কাটা ব্যাপারে অত্যন্ত নার্ভাস বোধ করি, তাই মেয়েদের হাতে নেইল ক্লিপার তুলে দিতে চাই না। রবীন্দ্রনাথ গান্ধিজি যা করে পার পেয়েছেন আমার সে মুরোদ নেই।

    তুষার গায়েন-এর মন্তব্য : মলয়দা, কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হলাম। প্রায় ওজনহীন শব্দগুলোর ভেতরে এক আশ্চর্য তড়িৎপ্রবাহ – সংবেদনার গ্রন্থিগুলো কেমন যেন চিন চিন করে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের পা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কোলে – শুকনো কাঠে তৈরী এক দারুণ সুরেলা বীনা যেন সাধিকার উষ্ণতা সন্ধানে ... প্রেম বয়সের দাবী নিয়ে আসে, সত্যি, আবার তা যে কখনো কখনো অতিক্রম করে যায়, আপনার কবিতা তার প্রমান। আপনার উদারতা মুগ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি যাদের নাম চলে আসে কবিতায়, তাদের অনেকেই তো সৃজনশীলতা ও জ্ঞানগম্যিতে আপনার থেকে ঊন জেনেও আপনি অবলীলায় তাদের নাম নিচ্ছেন, সেটা এইকালে আর ক’জনই বা পারে!

    সঞ্জীব নিয়োগীর মন্তব্য : ‘নখ’ সব্দটির ব্যঞ্জনা ‘পরিপাটি’ সামাজিক ব্যবস্থার বিপরীতে অবস্থান করে। শব্দটির মতলব কোনো না কোনো ভাবে ‘বিস্টিয়ালিটি’ কে উসকে দেয়। এবার, সে-সবের থেকে একজাতীয় কাব্যিক প্রশমন কবিদের পার্টনারগণ দিতে পারেন বলে মলয় রায়চৌধুরী হয়তো মনে করতে চেয়েছেন। এই মনে করার মধ্যে নারী-পুরুষের শারীর-বিদ্যার সহজপাঠ-টি প্রচ্ছন্ন। যা, ভেতর-টান। ভাবনা হিসেবে অসামান্য। কিন্তু কবিতা হিসেবে, রচনাটিকে, পাঠক আমি, মলয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোডাক্ট কেটাগোরিতে ফেলব।

    স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মন্তব্য : অসাধারণ । এই কবিতাটি ভালোবাসা আর শরীরী প্রতিবিম্বর টুকরো টুকরো ছবি এঁকে পরে তাদের একসাথে জুড়েছে । কী অপূর্ব এর দেহশৈলী । রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করে এখনকার কবিরা নখসূত্রে জুড়ে গেলেন । এ লেখার তুলনা হয় না । বোধহয় কেবল মলয়দাই এমন পারেন !

    কাজল চক্রবর্তীর মন্তব্য : কিসের মধ্যে কী ? পান্তাভাতে ঘি ! এই সব বাংলা কবিতা ! মরে যাই, মরে যাই ।

    অগ্নিদীপ মুখোপাধ্যায়-এর মন্তব্য : অ্যাসটাউণ্ডিং ! এই ধরণের লাইনের সঙ্গে কেবল উডি অ্যালেন প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারেন । “কেননা বার্ধক্যে পৌঁছে নিজের পায়ের কাছে নেইলকাটার নিয়ে যাওয়া, ওফ , কি কষ্টকর !”

    অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য : অসম্ভব ধারালো । কি চমৎকার আয়রনিক উইট । কিন্তু তার মধ্যেও সেরা লাইনগুলো যেন আয়রনি ছাপিয়ে ওঠে । যেমন, “প্রেম যে কখন বয়সের দাবি নিয়ে আসে ! কবি কতো একা টের পেতে তার পা-এ তাকালেও বোঝা যায় ।” আয়রনির ভেতরে একটা চাপা প্যাথস দাগ কেটে গেল।

    রেজওয়ান তানিম-এর মন্তব্য : অদ্ভুত সুন্দর। প্রেমের কবিতাতেও মলয়দা ঈর্ষনীয়। কত সামান্য বিষয়কে উপজীব্য করে এই কবিতাটি। ভাবতেই অবাক লাগে। আমারো মনে হয় মলয়দার প্রেমের কবিতার সঙ্কলন আমাদের পাওনা। আশা করছি অচিরেই পাব ।

    সোমেন রায়-এর মন্তব্য : কবিরা সাধারণত কবিদের নিয়ে লেখেন না। লিখলেও তার স্তব, স্তুতি অথবা স্থাপত্য নিয়েই লেখেন বড়জোর। কিন্তু কবিও মানুষ, তারও ক্লেদ-বমি-ইচ্ছা-অনিচ্ছা-প্রেম-হিংসা আছে। এইভাবে রক্তমাংসের প্রেমের সন্ধান করতে পারতেন সন্দীপন, এখন পারেন মলয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে তৃণাঞ্জন অবধি এক বিশাল ইতিহাসকে তিনি এক ছাঁকনির নিচে এনে রাখলেন। অনবদ্য মলয় ।

    সাকিরা জুঁই-এর মন্তব্য : বারবার প্রেমে পড়ি প্রতিভার , হে মুগ্ধতার যাদুকর !

    বিজয় ঘোষ-এর মন্তব্য : বিষয়টাই অভিনব। কত সাধারণ একটা প্রশ্ন অথচ আমরা তো ভেবে দেখিনি।
    Mousumi Roy-এর মন্তব্য : Malay Roychoudhury(dada),the poem tells the story the poet cannot tell; a terrible thought went through your mind.Thought of the century.In spite of the slings and arrows of outrageous envy, malice and academic pomposity.But I have a feeling that we are yet to understand the poet as a whole.He seems to be known only on the fragments of his genius.

    শঙ্করী মুখার্জির মন্তব্য : অসাধারণ ! অসাধারণ ! অসাধারণ! এমন দর্শন যে শুধু কোনো কবিরই থাকতে পারে ছোট্টো অনালোচিত বিষয় যে এতো হৃদয়গ্রাহী কবিতা হতে পারে, ভাবা যায় না ।

    নীতা বিশ্বাস-এর মন্তব্য : শুধু নখের্‌ই জন্যে, মলয়দা ? আমি তো আছি, পা দুখানি তুলে নেবো, কেটে দেবো নখ সযত্নে, প্রণামও সেরে নেবো, যদিও সুন্দরী আমি নই, আপনার চেতনার রঙে সুন্দর হতে পারি যদি, কবিতার সৌজন্যে ।

    শান্তনু সান্যাল-এর মন্তব্য :l কবিতা টি দারুণ, অবশ্যই আমি ব্যক্তিগত ব্যাপারে খুব একটা উতসাহিত নয়, কিন্তু কবিতাটির মধ্যে এক সুন্দর প্রবাহ রয়েছে, সেটা মন কেড়েছে, অপূর্ব রচনা, অজস্র ধন্যবাদ মলয় রায়চৌধুরী ।

    কিশলয় ঠাকুর-এর মন্তব্য : লেখাটি অসাধারণ... বাংলা কবিতার কয়েকটা দশকের সমন্বয়। ভাবছি শক্তি,সুনীল,জয় সুবোধ এদের পর আবার জীবনানন্দের নাম ফিরে এল... একটু ব্যতিক্রমী। অসাধারণ। কোনও সন্দেহ নেই ।

    জয়ন্ত চক্রবর্তীর মন্তব্য : ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন ।'মলয় রায়চৌধুরী' নামটি মুছে ছাপোষা কোনো নাম যেমন - হরিগোপাল রায় নামটি লেখা থাকত কবিতাটির লেখক হিসেবে তখন এত শত সম্মোধন অসাধারণ কবিতা কবিত্ব কবি।কবিরত্ন কাবিতধিরাজ ...... জুটত কি ? মলয় দা আমার দৃহ বিশ্বাস তুমি জানো আমি কি বলতে চাইছি . কোনো এক সৎ শ্বাশত জায়গা থেকে প্রতিষ্ঠিত গতনুগতিক সিস্টেম ভাঙ্গতে চেয়ে আজ তোমাকেও আমরা এস্টাব্লিশমেন্ট এর চড়া একপেশে গন্ধ উপহার দিয়ে চলেছি আমাদের তোমার কলমের শব্দ চয়ন স্বতস্ফুর্ত আঙ্গিক স্যাটারে আর দরকার নেই । শুধু 'মলয় রায়চৌধুরী' নামটাকে দরকার বড়ই দরকার । এটাই কি, এটাকে কি বলে "সীড অফ ডেথ" ! জানি না ।
    উনি কি তবে ভাঙ্গনের কবি !? উনি কোনকিছুই ভাঙ্গেন নি গড়েছেন . আর সঙ্গে জুগিয়েছেন সাহস। তোমায় ছাড়াই বাঁচবো আমি যেমন বাঁচে মাতৃহারা ;গিরগিটি টা কিলবিলিয়ে যেমন বাঁচে গাছের চারা । সরি টু সে, উনি গড়তে জানেন; নইলে এই ভাঙনের হুজুগে বহু নব্য কবি ওনাকে, ওনাদেরকে, অন্ধের মতো অনুরসরণ করতে গিয়ে অচিরেই তার কবিত্ব হারিয়ে এখন যাত্রার স্ক্রিপ্ট লেখেন ।

    শাকিলা তুবার মন্তব্য : এমন করে তো ভাবিনি কখনো! ধন্য আপনি কবি শুধুমাত্র নখকে কেন্দ্র করে বিশাল এক চত্ত্বর প্রদক্ষিণ করে গেলেন--দেখিয়ে দিলেন আমাদেরকেও অন্য এক জগত। আপনি চিরদিনই আমার প্রিয় কবি তালিকায় আছেন, ছিলেন। অনেক শুভ কামনা থাকল।

    দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মন্তব্য : খুবই গভীর দার্শনিক প্রশ্ন । আলোড়িত করল খুব ।

    সিদ্ধার্থ মজুমদার-এর মন্তব্য : একটি ‘বুড়োটে’ কবিতা যে কি সাংঘাতিক ঝকঝকে স্মার্ট অথচ সরল-মননশীল আর রসালো ও রোমান্টিক হয়ে উঠতে পারে, তা এই অনন্যসাধারণ কবিতাটি পড়ে জানলাম । এরকম ঠাট্টা-ইয়ার্কির রসায়ন-মিশ্রিত । অসাধারণ লাগলো ।

    হিন্দোল ভট্টাচার্যর মন্তব্য : " কবি কত একা টের পেতে তার পা-এ তাকালেই বোঝা যায় । " এই লাইনটি অসামান্য ।

    রেহানা আখতার-এর মন্তব্য : আহা! কি অসাধারন প্রাণবন্ত বাস্তবানুভব ! কথার অনুপম-ময়তা হ্নদয় ছুঁলো !

    পার্থ ঘোষ-এর মন্তব্য : কী অদ্ভুত সুন্দর ভাবনা! সামান্য নখকাটাও অসাধারণ হয়ে উঠেছে ।
  • Daniela Cappelo | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:০১541340
  • Daniela Cappelo : Strategies for Translating Obscenity: Medical Language and Sanitization in Malay Rāychoudhury’s Poetry

    Obscenity and Taboo Language
    Cultures vary widely in the treatment and reception of speech related to sex and bodily
    activities; while some cultures may perceive language related to sex as dirty and offensive, other social and cultural contexts may in fact not regard the same as a taboo (Allen and Burridge 2006). Working on modern Bengali poetry and specifically dealing with ‘poetics of obscenity’ has forced me to question my position as a translator with regard to the cultural, social and ethical limits – as well as freedoms – that I, consciously or unconsciously, avail myself of in my research. In particular, I was faced with the challenge of finding ways to negotiate between the multiple meanings of the text and my personal experience and understanding of those. For instance, how does a foreign translator of a South Asian language respond to ‘obscene’ phrases which are not a taboo in her own culture? Or else, how do I, an Italian scholar translating into English for a German academic audience, distinguish between different layers and understandings of a translated ‘obscene’ word, and reproduce its ambivalences and problematics? To show how possible an ‘impossible translation’ can be, I will here address some of the problematics that I face in translating ‘obscene’ words and phrases in the poem ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ (1964) and its English translation (‘Stark Electric Jesus’, 1967) by the Hungryalist poet and writer Malay Rāychaudhurī.

    In particular, the verses that will be examined relate to the description of a woman’s sexual organs, rape, masturbation, and bodily ‘effluvia’,1 such as sperm and menstrual blood. In my attempt at re-translation, I have first identified the ambivalent purpose behind the texts: the poet’s ironical use of a Bengali ‘medical’ lexicon achieves a ‘sanitized’ description of the sexual organs and sexual activity while aiming at provoking the ‘bourgeois’ readership and subverting normalized views on sexuality. Yet the scientific high-status language of both the Bengali poem and its English translation, pregnant with terms of Latin derivation, betrays the poet’s attempt at ‘cleaning’ the translation of its most controversial aspects in order to avert the risks
    of obscenity charges. The dualities and ambivalences of ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and its English counterpart make the process of re-translation all the more significant to the translator who wants to unravel the multiple stages, layers, and meanings of a literary text. My concern here is to engage with the ‘possibilities’ of negotiation between the textual strategies (irony, sanitization, subversion, and self-censorship) and the material and economic reasons behind the production of such texts. Before addressing the problems of translation, the main methodological question that I am constantly faced with is: what do we mean by ‘obscenity’? Which textual strategies and interpretative practices operate within an ‘obscene’ poem? The boundaries between the concepts of erotic, bawdy, obscene and pornographic have always been fuzzy and mobile, moving back and forth according to gender, class, taste and times.2 Any attempt to define this category has inevitably ended up in essentialistic views of obscenity and resulted in determining ‘obscene’ an intrinsic quality of a speech, a writing, a performance. However, there has been wide research from different disciplines, from legal, cultural and literary studies, that has wanted to re-examine the concept of obscenity as it was
    formulated in a specific historical situation by a particular social group in power. These reexaminations have contributed to releasing the concept of obscenity from moral, legal and ethical essentialisms, acknowledging the multiplicity of its meanings and applications in different social and cultural locations.3 The concept of the obscene (aślīl) in nineteenth century Bengal, for instance, was informed by the differentiation that was being shaped between elite and popular culture, high and low registers, where the latter was obscured and suppressed from the life of the bhadralok, the Bengali gentry (Banerjee 1197). Obscene acts or materials generally denote something that is offensive to common morality and to the public sense of decency, predominantly referring to the domain of sexuality (‘Obscenity’, Encyclopaedia Britannica). Breaking down the concept of obscenity into smaller units can help in identifying the main characteristics that define a behaviour, a speech, or a text, as obscene. Taboo, for instance, is a key concept to the understanding of the ‘obscene’: it originally denoted a ‘prohibition’, more likely a food, an object, or a behaviour that was perceived as ‘polluting’, harmful and offensive, to a certain community. Taboo and taboo language has been the subject of much scholarship from anthropology and social linguistics which has found the main interpretation of taboo as ‘the matter out of place’, that is contaminating and therefore dangerous for the social order of the community (Douglas 1966). Yet taboo language, in its most contemporary and colloquial acceptation, is more than ritual prohibition and avoidance: it is “a breach of etiquette” consisting of ‘dirty words’ that a speaker normally avoids in a standard public context. These words
    “have the power to titillate” and along with taboo language are “the most emotionally evocative of all language expression” (Allan and Burridge 42). The process of translating Bengali aślīl poetry into English has shown resistance to traditional practices of translation formulated in the field of Translation Studies, such as fluency, accuracy, and Lawrence Venuti’s much debated ‘foreignization’ of a text and ‘visibility’ of the translator (Venuti 2008). To cope with these problematic aspects of the translation process, I have taken free inspiration from Anjali Nerlekar’s study on the poet Arun Kolatkar (2016), the bilingual poet in the Marathi and English languages, where she observes that the concept of translation needs to be questioned because of the “slippery nature of the translational practices”, especially when these take place in multilingual contexts. Practices of self-translation and transcreation have in fact contributed to interrogating the authority and authenticity of original texts (Nerlekar 208). In the same way as Kolatkar’s translation of his own poetry collection Jejuri resists simplified readings – which identify one version as the original and the other as a derivative version – the ‘mobile’ nature of the two translations of the Hungryalist poem is established by reason of its multiple editings and re-translations.

    The Poet and the Poems:
    ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and ‘Stark Electric Jesus’ Malay Rāychaudhurī is today acknowledged as one of the early creators of the Hungry Generation movement in 1961, along with his brother Samir, Shakti Chattopadhyay and Debi Roy.4 Inspired by the American beatniks and affiliated to the global neo-avant-gardes, the anti-establishment group of wild guys published manifestos and little magazines, experimented with language, brought their subjectivity and sexuality into poetry and challenged the cultural and political establishment of Calcutta with irony and provocation. Born in Patna in 1939, Malay lived his childhood and late adolescence in a poor suburb of the city known as Imlitalā. In his childhood memoirs, Malay gives great importance to the years spent in this neighbourhood surrounded by Shia Muslims, Dalits and low-caste Hindus. He turns to the memories and stories of these subaltern people in Patna to retrace the cultural and social hunger for a ‘realer’ literature, as promoted in a late manifesto, which has later become a mark of Hungryalist writing (Rāychoudhurī n.d.).

    Both the English and Bengali versions of the poem ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and ‘Stark Electric Jesus’ have become icons of Hungryalist writings, especially after Malay’s infamous sentence for obscenity. The poem originally appeared in Bengali in 1964 as part of the Hungry bulletin that was seized by the police and used as the main object for the obscenity accusations against the Hungry writers. After the poem was banned as obscene, Malay and his fellows, Debi Roy, Subimal Basak, Saileswar Ghosh and Pradip Chaudhuri started an intense correspondence with American editors and poets, such as Howard McCord, Karl Weissner, Lawrence Ferlinghetti and Allen Ginsberg, in order to ask for financial support for the trial. In response to that, the international avant-garde community started a circle of literary exchange with the Hungryalists, collected and edited a selection of their writings and compendia of contemporary Indian poetry that were eventually published in special issues of American journals and little magazines such as Salted Feathers, Intrepid and City Lights.

    From the mid-sixties, Malay and his ‘Stark Electric Jesus’ had become well-known names associated with the Indian avant-garde movement and with issues related to obscenity and freedom of speech. The English version of the poem was originally published by Tribal Press and edited by Howard McCord, professor of English literature at Bowling Green State University and avant-garde writer himself, in three editions in 1965 and 1966 with an afterword by the editor. City Lights Journal #3 also published the poem with a longer version of the afterword under the title “Note on the Hungry Generation” (Ferlinghetti 159-60). ‘Stark Electric Jesus’, self-translated by Malay for the first Tribal Press edition, appears again in a 1967 issue of the American journal Salted Feathers edited by DickBakken. In this issue, fully dedicated to poetry, essays and letters from Hungryalist writers, it is mentioned that Dick Bakken wrote to poets and scholars of Bengali in the United States, at that time Edward C. Dimock and Jyotirmoy Datta, to assist him in the translation project (Bakken n.p.). The politics of translation endorsed by the editor of Salted Feathers aimed at keeping the original translations of the Bengali authors, unless otherwise noted, and changing some spelling, diction and syntax to make them ‘less awkward’ (Bakken n.p). Malay offered to translate his poetry as well as some of his friends’, who were “not well to do with English”, and leaves the work of re-editing to Dick Bakken.5 The English version of the poem is then edited at least twice by McCord and Bakken to produce a text that appeals to a different audience - readers of avant-garde literature in Europe and the United States. The distribution of Malay’s English poem to these American journals of avantgarde poetry finds the main reason in the search for financial support during the obscenity trial. The ‘material’ reason of financial necessity behind the translation of the Bengali poem locates this text at the juncture of commercial publishing and experimental writing. Prompted by the need for a critical re-interpretation of the poem, I will here lay out some methodological principles that have guided my new English translation of ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ (from now on PBC), informed by a consciousness of the economic reasons and ethical choices that stood behind Malay’s ‘Stark Electric Jesus’ (from now on SEJ). In the extracts from the English poem that will follow in this paper, I suggest a slightly different rendering of the verses here discussed, especially those concerning the representation of the female body and male masturbation.

    Translating Shubha’s Sexual Body
    Issues surrounding the poet’s unfulfilled sexual desires, his inability to love, scenes of rape and masturbation have made this poem a divisive icon of the unabashed and grotesque, yet ultimately misogynist and irreducibly bourgeois, ‘hunger’ of these poets. Through the hallucinatory monologue of Malay to his imaginary muse Shubha, an allegoric representation of woman, the poem describes the oedipal and sexual frustrations of the poet. The documents of the Hungryalists’ trial show that the charges for obscenity were corroborated by Section 292 of the Indian Penal Code, which stated that “the accused was found to be in possession of the impugned publication. So one of the ingredients of Sec 292 IPC namely, of circulation, distribution, making and possessing [of obscene material] are present.” Although the Magistrate acknowledges that the IPC does not define the word ‘obscene’, and that a piece of art or literature may not be judged only on the basis of vulgarity, he finally decides to sentence Malay’s poem because it deals with sex and nudity in a way that “transgresses public decency and morality.”6 Interestingly, the Magistrate then delves into a detailed description of the ‘moral transgressions’ of the poem:

    In bizarre style it starts with restless impatience of sensuous man for a
    woman obsessed with uncontrollable urge for sexual intercourse followed
    by a description of the vagina, uterus, clitoris, seminal fluid, and other parts
    of the female body and organ, boasting of the man’s innate impulse and
    conscious skill as to how to enjoy a woman, blaspheming God and
    profaning parents accusing them of homosexuality and masturbation,
    debasing all that is noble and beautiful in human love and relationship.
    (Decision by Presidency Magistrate, 1965)

    According to the Magistrate’s interpretation, the offensive passages of the poem were the ones describing female pleasure and uncontainable sexual desire, parental homosexuality and masturbation.The controversial content of the poem was identified in the idea of a woman’s sexual ‘urge’ and in sexual activity as non-procreative or as performed for the sake of pure pleasure. Malay’s banned poem is still the object of critique from Bengali literary critics, academics and an ordinary readership who have especially criticized the lack of substantial literary quality in his poetry. Apart from that, there exists also a feminist critique of Hungryalism as a male-centered poetics where “female sexual agency is vilified” and where women are described only as ‘sexual bodies’ (Dhar).7 The ambivalent status of Hungryalism in Bengali literary history seems to mirror the ambiguous role that the representation of sexuality and the related terminology plays in Malay’s poetry. In the controversial passages of the Bengali poem, for instance, transliterated English words are juxtaposed to a scientific Bengali terminology to describe Shubha’s sexual and reproductive organs and other bodily activities such as male ejaculation and urination. Kumar Bishnu De, in his research on Malay’s poetry, admits that the meaning of the words ‘clitoris’ and ‘labia majora’ became clear only after he read the sequence of Bengali words that visually depicted a vagina (De 210).8 The incorporation of these English words into the Bengali text helps mitigate the scandalous content and attenuate the visual power that the ‘obscene’ words depicting the female sex organs may have on the Reader.

    The following verses show how the juxtaposition between the English-Latin words (i.e. uterus, clitoris, labia majora) and the Sanskritized Bengali words (i.e. garbha (womb), ṛtusrāb (seasonal bloodstream), śukra (sperm) and satīcchad (hymen)) operates in the poem as ‘sanitizer’ of the ‘sexual body’, ultimately deprived of its sensual component and transformed into a biological body, where sexual intercourse and masturbation occur exclusively as mechanical activities:

    Shubha, let me sleep for a few moments in your violent silvery uterus
    Give me peace, Shubha, let me have peace
    Let my sin-driven skeleton be washed anew in your seasonal bloodstream [ṛtusrāb]
    Let me create myself in your womb with my own sperm [śukra]
    […]
    Let me see the earth through your cellophane hymen [sāticchad]
    […]
    I remember the letter of that final decision in 1956
    The surroundings of your clitoris were being embellished with coon9 at that time
    […]
    Let me enter in the immemorial incontinence of your labia majora
    Into the absurdity of woeless effort
    In the golden chlorophyll of the drunken heart (Bakken 1967)10

    Both the Bengali words (ṛtusrāb; ātmamaithuna; śleṣmā) and their English translation (i.e. seasonal bloodstream; self-coition; ovum-flux) show a conscious selection by the author of a scientific vocabulary of the Bengali language and a correspondent English translation of the medical terminology related to the sexual body. In some of the passages illustrated above, Malay directly uses the transliterated English word to denote the female sexual organs (i.e. labia majora; uterus; clitoris) for lack of a Bengali equivalent, or so the poet himself explained during an interview I carried out at his home in Mumbai (personal interview, November 26, 2017). Yet the proliferation of a Bengali ‘sexual’ terminology, already established from the late nineteenth century through an expanding market of medical publications (Mukharji 86), shows that Malay’s use of the English words was actually prompted by the need for a certain degree of secrecy with regard to the more contentious aspects of the poem. It is in fact quite common in ordinary Bengali language, and especially in the technical and more problematic context of sexual activity, to use English words as substitutes for a Bengali that would more easily ‘offend’ middle-class morality. If the poet was at that point already aware of the risk of a trial and sentence for obscenity, he knew how provocative and transgressive his writings could become in media and popular perception. The use of the English equivalents in the Bengali poem then shows the poet’s attempts at suppressing the straightforwardly outrageous quality of the Bengali by replacing it with a more ‘delicate’ English word to attenuate the scandalous content.

    Medical Language and Sanitization
    The second half of the nineteenth century saw the explosion of medical publishing in vernacular languages, including Bengali medical dictionaries, books on sexology and encyclopedias of sexual knowledge, which acted as sites of ‘vernacularization’ that provided vernacular alternatives to English technical terms (Mukharji 86-7). These publications illustrate the creation of a vocabulary of anatomic and physiological terms of the Bengali language, shaped from an already established English medical lexicon, encouraged by the international reception of modern ‘western’ books on the study of sexuality. For instance, the description of the male and female reproductive organs (strī-jananendriya) already had a quite well-established Bengali vocabulary by the late 1930s, when Hasanat’s Yauna Bigyān and Basu’s Yauna-Biśbakoṣ were published (Hasanat 1936; Basu 1938-1946). In the latter, ‘clitoris’ is in fact translated into bhogāṅkur and ‘labia majora’ into bhogādhar guru (lit. bhog = vagina; adhar = lip) (Basu 187).

    Malay plays with the Bengali medical lexicon related to sexual organs and activities (i.e.
    yonivartma (urethra); ātmamaithuna (self-coition); rajah/ṛtusrāb (menstruation); śleṣmā (mucus, phlegm)) to convey a biological description of the body.11 The effects generated by such scientific treatment of the language are ones of ironic ‘inversion’ of the obscene images related to sex: on the one hand, non-procreative sex acquires dignity of literary treatment, while on the other, the high status of the constructed, artificial scientific vocabulary is ironically downplayed through the sexual context.

    Abul Hasanat’s Sacitra Youna Bigyān (Illustrated Book of Sexual Science) presents a good example of a modern book of sexology dealing with multiple aspects of sexuality, including illustrated descriptions of conception, the formation of the embryo, and birth, as well as a detailed analysis of younabodh, the sexual perception. 12 In the first volume, Hasanat describes the anatomy and physiology of sex (youna-indriyasamuha) with illustrations of the male and female sex organs (Hasanat 93-99) and the process of menstruation (ṛtusrāb), a word “originated from the latin ‘mensis’ meaning ‘monthly.’ Since it takes place every month, it is called monthly (māsik) in different languages” (Hasanat 102). Abul Hasanat wrote books on this subject until the 1950s and his works remained highly popular through the sixties. The occurrence of words for the organs, such as linga, yoni, jorāyu, garbha, śukra, aṇḍakoṣ, mūtrāśay, yonipath, satīcchad, and their functions, such as prasrāb (urination) and ṛtusrāb (menstruation), provide evidence for the selection of medical words in the Bengali poem.

    In my own translation, I substitute seasonal bloodstream and ovum-flux with menstruation, self-coition with masturbation and phlegm with mucus, as it appears from the following verses:

    Why wasn’t I lost in my mother’s urethra?
    Why wasn’t I shaken away in my father’s urine after he masturbates?
    Why wasn’t I mixed with mucus in the menstruation?13
    As compared to Malay’s English translation:
    Why wasn’t I lost in my mother’s urethra?
    Why wasn’t I driven away in my father’s urine after his self-coition?
    Why wasn’t I mixed in the ovum-flux or in the phlegm?

    My choice of replacing the more sterile, scientific terms that describe masturbation and menstruation was informed by the need for greater readability and a more direct reception of the ‘defiling’ activities on behalf of the readers, while still retaining the scientific touch of the Latin etymology. If Malay’s self-coition, phlegm, and seasonal bloodstream aim at reproducing masturbation, menstruation and reproduction purely as mechanical processes of the biological body in the ‘anatomic’ lexicon, they also lay out different possibilities of interpreting the reasons behind their use. The semantic potential of the English self-coition and seasonal bloodstream, for example, and the possibilities of playing with the construction and meaning of these words, allow the retention of the ‘clinical’ structure of the poem and a mechanical description of the body. At the same time, the choice of ‘high’ words here serves two functions: on the one hand, they elevate to a lyrical subject what the middle-class readership interprets as low, repulsive and scandalous; on the other, they ironically ‘minimize’ the technical scientific language by applying it to the low semantic sphere of sex and other bodily activities. By replacing self-coition with the verb masturbate, I have tried to make the reading more fluent and the ‘obscene’ content more easily graspable, as well as to reproduce the ironical touch that was inevitably lost in the ‘surgical’ English translation. Yet Malay’s ‘sanitization’ of the original poem is only one among other valuable hypotheses that explain the textual tactics and language strategies behind this text. The representation of Shubha’s body and of the male semen through a subversive use of Bengali medical terminology is not only a mark of purification of the text already banned for obscenity. The hyper-pedantic constructions of the English translation (i.e. self-coition; ovum-flux; seasonal bloodstream), as well as the juxtaposition with the higher status of the Latin derived English words, appear as anti-hegemonic practices of translation and language construction that give the dignity of literary matter to the bawdy topic of sexuality. One more practice of subverting the rules of accuracy and faithfulness in translation appears in another instance of the poem, where Malay translates the Bengali dharṣaṇ into the English ‘copulation’, as in the following verses:

    I’d have gone two billion light years and kissed God’s ass
    But nothing pleases me nothing sounds well
    I feel nauseated with more than a single kiss
    I've forgotten women during copulation and returned to Muse
    Into the sun-colored bladder
    I do not know what these happenings are but they are occuring within me
    […]
    My power of recollection is withering away
    Let me ascend alone toward death
    I haven’t had to learn copulation and dying (Bakken 1967)14

    If we look into the Sanskrit etymology of the word dharṣaṇ, we encounter no explicit ‘sexual’ connotation, but the nouns ‘assault, outrage, offence, violation, seduction’, ‘overpowering’ and ‘copulation’ (Monier Williams 513). For a modern definition of the word, the Samsad Bengali-English Dictionary (2000 edition) translates dharṣaṇ also as ‘rape’ (537). On the other hand, according to the Samsad Bāṁlā Abhidhān (1964 edition), the monolingual dictionary of the Bengali language, the noun lacks the connotation of sexual abuse, signifying more generally an act of oppression or submission (416). However, among the multiple entries under dharṣaṇ (i.e. pīṛhan, atyācār, balātkār, daman, parājit-karaṇ), the synonym balātkār in particular involves the idea of oppression, control and submission “especially against women” (biśeṣatah nārīr prati) (Biswas 416). I could not come across any critical engagement with the alleged ‘dishonest’ translation until I came across Nandini Dhar’s ‘feminist critique’ of Hungryalist poetry, where she acknowledges the Hungryalist movement as a “profound failure of the Bengali radical imagination” (Dhar n.p.). Here she proposes a gender-based critique by pointing out to the fundamental ‘vilification’ of the female sexual agency in Malay’s poetry, turned into a site of male sexual violation. In a new critical reading, Dhar remarks how Malay has mistranslated the passages of the poem that centered on Shubha’s body. In Dhar’s view, the alleged mistranslations of dharṣaṇ as ‘copulation’, and of uṭhiye neowā as ‘elevate’ (whereas she claims the real meaning to be ‘abduction’) legitimize rape and sexual violence.

    My suspicions regarding Malay’s translation grew during a reading session with Bengali-speaking colleagues and students at the Südasien-Institut in Heidelberg, as they remained quite perplexed at the ‘unfair’ translator. My puzzlement at the ‘mysterious’ translation initially led me to argue that if Malay had replaced ‘copulation’ with another English equivalent involving a violent act of oppression and submission he could have found a way to escape the mistranslation. Since SEJ was edited and corrected by the American editors, native speakers of English who were most likely not aware of the original Bengali version, we could assume that Malay was fully conscious of the ‘corrupt’ translation he was proposing to avant-garde readers in the United States. Yet in order to clarify Malay’s choice of translation, I turned to him in a private communication where he claimed that “the word ‘rape’ has been in use now only. When I wrote, people talked either of intercourse or of copulation. For me at that time ‘dharshan’ was same as intercourse or copulation. I did not mean rape while using the word ‘dharshan’”.15 How do I engage with the changing semantics of one specific word in translation? Was the poet enacting a strategy of self-censorship, purging the text of its most objectionable contents to make it less problematic to the American readership (where Shubha would not be the object of violent sexual abuse, but the consenting partner in intercourse)? Or is the ‘misunderstanding’ by Nandini Dhar caused by the enhanced sexual and violent connotation that has been assigned to the word in more recent times? Dharṣaṇ today has become a highly controversial term in the social and political landscapes of South Asia, especially after the Delhi Gang Rape in 2012 has projected the discourse on rape and violence against women to the foreground of national interest. Taking the word out of the original poetic context here helps retracing the semantic history and evolution of the word and establishing a trajectory of social, cultural and literal meaning that could not be transmitted to the reader through the mere act of translating. The recasting of dharṣaṇ and its history into the subversive semiotics of the poem, which aims at representing the act of sexual intercourse as a possibility of emancipation from middle-class oppressive morality, also on behalf of the ‘sexual body’ of the Muse Shubha, contributes to returning meaning and dignity to what Dhar has criticized as a ‘mysterious’ translation that ‘legitimizes rape and sexual violence through repetitive articulations of male pain and alienation’ (Dhar n.p.). The rough, unabashed ‘bodily’ language of Malay, a mark of the Hungryalist aesthetics signalling the disintegration of a masculinity that oscillates between the traditional models of the Indian patriarchate and the ‘Western’-oriented revolution of love and sexual relationships, is often embodied in Malay’s highly conservative and misogynist aesthetics. Yet in the internal logic of the poem, where dharṣaṇ is viewed as an imaginary act of social subversion, it can be argued that the word had a more nuanced connotation that did not necessarily entail sexual aggression or abuse in the years when Malay was writing and translating his poem.

    What, in this case, shall a more ethically and politically correct translation in the first place account for? The task of the translator in this case lies in the sensibility and ability to ensure the same thoroughness and contextualization for both options of translation (i.e. copulation, rape). Although my translation here ‘betrays’ the intentions of the author, who had personally dissociated the word dharṣaṇ from a context of sexual violation, it performs a conscious transgression of traditional norms and practices of translation such as accuracy and faithfulness. My personal approach was here to exploit the potential of the original word, with all the multiple shades of meaning implied in the Sanskrit and Bengali etymology, by suggesting in my own re-translation the more contemporary political signification of dharṣaṇ in PBC, in order to ‘dislocate’ the poem and operate a semantic transfer to a modern readership’s perception.

    Then I would kiss the ass of God for billions of light years
    But nothing pleases me, nothing pleases me
    If I gave more than one kiss my body would be nauseated
    How many times have I forgot women after rape and came back to Art
    In the solar bladder of poetry
    What’s going on I don’t know, yet it happens inside me
    […]
    My power of recollection is fading away
    Let me walk alone towards death
    I didn’t have to learn about rape and death

    Translating Masturbation
    The abundance of descriptions of male masturbation in Hungry poetry has turned it into a true literary topos of Hungryalism. The grotesque and pictorial character of masturbation, a leitmotif of avantgarde arts, performances and literature across the world, plays a relevant role also in Hungryalist poetry: the non-reproductive nature of ‘solitary’ and pleasurable sex becomes one way to express the social and psychological conflicts of the young Bengali male with the dominant bourgeois morality and middle-class social regulations of post-independence Bengal. Masturbation and ejaculation were signs of pathological abnormality in colonial Bengal that affected Bengali middle-class narratives of the body and sexuality. The ‘weakness of the semen’ (dhātu dourbālya), associated with impotency and involuntary discharges, substantiated the anxieties of Bengali effeminacy and racial inferiority (Mukharji 247). Following Foucault’s engagement with the repression of ‘peripheric’ sexualities and the obsession with their classification in the Victorian period (Foucault 1990), scholarship on the cultural significations of masturbation in colonial India has showed that loss of semen was mainly associated with sickness, sexual perversion and anxieties of masculinity (cf. Pande 2010; Alter 2011; Mukharji 2011). In the late nineteenth century, Bengali men, burdened with the stereotypes of degeneration and perversion, developed a paranoia over squandered sperm resulting in an ambivalence towards women that verged on misogyny (Pande 172). Bengali periodicals on public health treated the subject of masturbation, especially when this activity takes place during puberty and adolescence, as a serious health issue since it makes the boy’s “semen watery and weak” (śukradhātu taral o nisteja) (Basu 228). In accordance with the state of brahmacharya, male Hindu celibacy, masturbation was interpreted in terms of physical strength more than a moral vice: the preservation of semen represented in fact an act of self-control and self-development while waste of semen signified a loss of virility (Alter 287). According to Hindu physiology at large and to Indian traditional medicines, ejaculation was therefore equated to a loss of masculine strength and waste of essential energy. However, Srivastava has remarked how the notion of ‘semen anxiety’, combined with a general ethic of self-control, had come to take on the appearance of an irrevocable truth of Indian masculinity(Srivastava 3).16
    In Hungryalist poetry, non-reproductive sexual activity is ambivalently represented as a
    liberating act that denounces and subverts the regulation of social bonds and relationships, as well as a state of frustrated uneasiness with one’s own unconventional position towards matters of sexuality and sociality. As powerfully illustrated by Falguni Roy, a cult figure of the Hungry Generation, in his poem ‘Byāktigata Bichāna’ (A Private Bed), the act of masturbating becomes part of normal daily life when it concerns the ideal ‘family man’:

    Not only Radha – even the prostitute menstruates
    The father of three children – the ideal man of family planning
    Masturbates from childhood – doesn’t he? 17 (my translation)

    The acts of masturbating and ejaculating, as suggested in this passage, do not only relate to colonial discourses and to traditional medicine that pathologized sex and semen loss. Through masturbation, here the Hungry poet wants to subvert the post-colonial predicament of the Indian father, ‘ideal man of family planning’, with all the creepy associations with vasectomy and mass sterilization programs carried on under Indira Gandhi’s rule, and express the wish for liberation from imposed disciplined regulations of the body. At the same time, these poets’ relationship with the body remains ambiguous and unavoidably torn between society and personal experience, between the ongoing sexual revolution of the West and the ostensible cultural immobility of Bengali middle-class society. In Malay and other Hungryalist poets like Falguni Roy, preoccupations with masculinity and virility take shape through the description of male semen during sexual intercourse, masturbation and fetus production (Miśra 2015). The obscene character of these representations, however, is not determined by the ‘fear’ of prudish descriptions of sexual intercourse or discourses on sexuality at large; rather, they are informed by the insecure and precarious conditions of modern masculinity. The act of masturbation thus reproduces the conflicts, ambivalences and anxieties of a changing concept of the modern male middle-class Bengali individual.

    We have already encountered the word ātmamaithuna in PBC, which is transcreated in SEJ as self-coition, a neologism crafted by the poet to reproduce ironically and scientifically a ‘copulation with oneself.’ Although ātmamaithun seems to be the most common word in Bengali language that refers to ‘masturbation’, along with hastamaithun, there are other equivalents to define both male and female masturbation, such as svamehan, svakām, hastamaithun and svayaṁrati, as appears from a fully detailed Wikipedia page in Bengali dedicated to this subject.18 The medical periodical Chikitsā Sammilanī, a magazine of health and medical science instructing families on modern concerns surrounding sexuality and sexual relations in late colonial Bengal, also uses the word hastamaithun for the ‘evil’ practice of masturbation among male children and adolescents (Basu 227). Abul Hasanat’s Sacitra Youna Bigyān dedicates a section to ‘auto-eroticism’ (svayaṁmaithuna) and ‘masturbation’ (hastamaithuna), and includes these phenomena in the section ‘The Multiple Manifestations of the Sexual Perception’ (younabodher bibhinnamukhī prakāś) (Hasanat 200-1). Although the word ‘masturbation’ linguistically speaking is an ‘orthophemism’ that does not constitute an offense,19 the trespassing from the medical space into the public domain of literature and poetry makes its interpretation more problematic, to the point that it becomes one of the triggers of the obscenity charges, as it is pointed out by the Magistrate of the obscenity trial (Decision by Presidency Magistrate, 1965). In the following verses of SEJ, the contentious topic of masturbation and the cultural significations of male semen are addressed with the Bengali words śukra and bīrya:

    Let me create myself in your womb with my own sperm [śukra]
    Would I have been like this if I had different parents?
    Was Malay alias me possible from an absolutely different sperm? [śukra]
    Would I have been Malay in the womb of other women of my father?20
    […]
    I will die
    Oh what are these happenings within me
    I am failing to fetch out my hand and my palm
    From the dried sperms [bīrya] on trousers spreading wings
    3000000 children gliding towards the district of Shubha’s bosom
    Millions of needles are now running from my blood into Poetry
    Now the smuggling of my obstinate leg is trying to plunge
    Into the death-killer sex-wig entangled in the hypnotic kingdom of words
    (Bakken 1967)21

    The English ‘sperm/s’ for both words in SEJ does not distinguish between the meanings of the two Bengali words śukra and bīrya, two equivalents of the English ‘sperm’, ‘semen.’ The Samsad Bāṁlā Abhidhān considers both terms, śukra and bīrya, as synonyms, although there is a qualitative difference between the two that classifies śukra as noun only, and bīrya also as attribute (i.e. as in the adjectival construction bīryavān or bīryaśālī, ‘endowed with vigour’). The Sanskrit definition of vīrya associates it with ‘manliness, valour, strength, power, energy’, and only in the third entry with ‘manly vigour, virility, semen virile’ (Monier-Williams 1006); the modern Bengali usage assigns to bīrya the characteristics of valour, courage and heroism, which are by definition qualities that pertain to a male hero, a bīr (Biswas 756). As also Kakar observes, vīrya is “a word that stands for both sexual energy and semen. Virya, in fact, is identical with the essence of maleness: it can either move downward in sexual intercourse, where it is emitted in its gross physical form as semen, or it can move upward through the spinal chord and into the brain, in its subtle form known as ojas” (Kakar 118-9).Hasanat’s sexology book, in the section describing the male sex organs, abounds with compounds having śukra- as first noun for organs related to the production of semen (i.e. śukrakoś; śukravahī nala) (93). ‘Spermatozoa’ here translate as śukrakīṭ and are described as follows: “The man’s spermatozoa give life to the woman’s eggs. The spermatozoa are immerged in the liquid part of theman’s semen (puruśer śukrer aṁgśe bhāsiyā beṛhāy)” (86). The recurrence of śukra in such texts, as compared to the absent bīrya, suggests the scientific connotation of the former.

    In Malay’s poem, bīrya stands as the concrete physical appearance of the spermatic liquid, while śukra represents the neutral, scientific term that refers to the smaller units of the latter, the spermatozoa, as shown above in Habunat’s sexology book. Drawing a distinction between the two words becomes a significant operation in the translation of Malay’s medical language: if śukra is an orthophemism, a neutral term with neither positive nor negative connotation, bīrya has attributive quality and is intentionally juxtaposed to the latter to suggest a metaphorical reference to the poet’s troubled masculinity, expressed through the culminating gesture of the poet who compares the activity of masturbation to poetry-making. Also the recurrence of the words bīrya and bīj rather than śukra in Falguni Roy’s poetry is used in a significantly different context where the ‘liquid flow of sperms’ is the material substance through which heredity traits are transmitted: “In the liquid flow of sperms inside autoeroticism there is a skeleton of 206 bones and fleshy nerves sticking to the skeleton in the liquid semen the semen of memories of thought-carrying sound” (Miśra 29). The abstract matter denoted by the word śukra is substantiated in bīrya, significantly originating from the same root of bīj, the seed, through the bodily materialization of the spermatozoa during ejaculation. Hence in my retranslation I suggest preserving the ‘material’ differentiation denoted by the Bengali words by translating śukra as the English ‘semen’ and bīrya as ‘sperm’, following the Oxford Learner’s Dictionaries of the English Language that define ‘semen’ as “the whitish liquid containing sperm” (‘Semen’, Oxford Learners Dictionary). Exploiting the Latin etymology of semen, I aimed at highlighting the medical representation of male semen.

    Give me birth again from your womb with my own semen
    Would I have been like this even if I had different parents?
    Would I have become Malay alias me from a completely different semen?
    Would there be Malay if my father had impregnated another woman?

    The orthophemistic or neutral connotation of the words ātmamaithuna, śukra and bīrya, shows that Malay pursued an ambivalent strategy of sanitization of the text through the medical lexicon that resulted in an ironical ‘inversion’ where the ‘dirty’ sexual matter is elevated to lyrical subject of poetry, while the high status of the scientific language is minimized through the transgressive descriptions of masturbation and bodily fluids. Masturbation is not only painted as a mechanical act, but it stands also as the ultimate condition of the alienated male poet, the ultimately bourgeois man of modernity, inexorably caged in a modernity that mechanizes sexuality and disintegrates relationships between the sexes.

    Concluding Remarks
    In this paper, I have tried to clarify the linguistic terminology related to the description of sexual organs and masturbation, and to identify the textual strategies for sanitizing the ‘sexual body’ in selected passages of Malay Rāychoudhurī’s banned poem ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and his English self-translation ‘Stark Electric Jesus’. First, the use of a medical terminology for describing the ‘sexual body’ in Bengali (i.e. yoni, jorāyu, mūtrāśay, śukra, yonivartma, satīcchad, ātmamaithun, rajahsrāb, śleṣmā) and in the English translation (i.e. uterus, bladder, semen, urethra, hymen, selfcoition, seasonal bloodstream, ovum-flux, phlegm) functions as a strategy of ‘sanitization’ of the language related to the contentious topic of the text. The incorporation of transliterated English words into the Bengali poem (i.e. lābiyā myājorā, yuṭerās, kliṭoris) allows the poet to attenuate the ‘bawdy’ and ‘obscene’ perception of what the Bengali middle-class interprets as indecent and offensive. The hyper-literal, artificial constructions of the English translation (i.e. self-coition, seasonal bloodstream) aim at representing the body as a machine, in its purely biological functions. Secondly, as illustrated by the discussion surrounding the translation of the word dharṣaṇ, the hyper-technical lexicon of medical sciences could be seen as a moderate practice of self-censorship that ‘obscures’ the most controversial aspects treated in the poem as a tactic to defend himself against further institutional censorship. Yet the poet’s subversive use of the medical lexicon allows for a double effect of subversion of the textual components: on the one hand, the high status of the scientific language is brought down to earth by applying it to the semantic sphere of sex, a subject considered unsuitable for
    the ‘respectable’ sphere of poetry. On the other, the socially reproachable topics of masturbation and un-reproductive sexual activity gain dignity of literary and lyrical subject by being dealt with a scientific terminology that dislocates the repulsive sexual matter to the ‘extra-ordinary’ discourse of poetry-making.

    In the duality of Malay’s poem, located between irony, sanitization, literary subversion, and self-censorship, dwells the ‘radical’ operations of the translator and the problematic process of retranslation. The pragmatic choices of my re-translation and re-reading of ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ reflect the need to propose a new text that identifies and reproduces the strategies already foregrounded in the source-texts. The multiple textual strategies already identified in the ‘original’ poem shall not be neglected by the translator who wants to produce an ethically and politically correct translation. The conclusions that I want to share in this paper are based on my experience of translating so-called ‘obscene’ modern poetry in Bengali; they show that translation remains a ‘tentative process’, neither impossible nor fully possible, that can change according to the tasks and intentions of the translator, who becomes a ‘visible’ agency, to follow Venuti’s main argument, of a newly produced independent text. As translators, especially of writings of living authors, we have to engage with the ‘life’ and mobility of that text, confront the textual strategies and the material and economic conditions behind the production of the piece of writing. Finally, what I draw from the ‘tentative process’ of translation of Hungryalist poetry is: that one way to process a ‘radical translation’ is to elaborate a personal and contextual practice of the latter by going to the ‘roots’, that is, to the textual, economical and material reasons of semantically problematic texts such as ‘obscene’ poetry.

    Notes
    1 I am borrowing this evocative phrase from Allen and Burridge, which offers a perspective on ‘the human psyche’ in its relation with ‘tabooed language’ (2), who associate “bodily effluvia like ear-wax, menstrual blood, piss, semen, shit, snot, spit, sweat and vomit” with “dirt, rotting organic material” (41).
    2 See, for example, Gladfelder’s overview of the debates on the cultural significance of erotic, obscene, and pornographic writing from the eighteenth century (Gladfelder 2013). Here he lists the criteria that scholars have used to distinguish among the concepts of ‘pornographic, obscene, erotic, bawdy, lewd, and indecent’, such as authorial intention, content, tone, mode of representation, reader and political or censorial response. For instance, an ‘obscene’writing is defined as ‘a description whose effect is shocking or disgusting [reader response]’,while ‘bawdy’ denotes ‘the humorous treatment of sex [content and tone]’ (Gladfelder 5).
    3 For works that focus on India, see for example Deana Heath’s exploration of the British biopolitical project of regulation of the obscene in Britain and its relocalization in the colonies (Heath 2010); Anindita Ghosh’s analysis of the popular prints of Baṭtalā market in colonial Bengal (Ghosh 2006), and Charu Gupta’s study on the emergence of discourses on gender and sexuality in colonial Hindi pamphlets (Gupta 2001).
    4 There has been a long controversy on the issue of the ‘founder’ (sraṣṭābitarka) in Bengali criticism on the Hungry Generation (Sen 13-6). Meetings and interviews with some old Hungryalists and other contemporary poets have proved the existence of multiple narratives on the history of the movement. I have noticed a clear negative stance against Malay Rāychoudhurī on behalf of some Bengali academics and critics, as well as of some poets and translators who associated with the movement in the past. On the other hand, Malay has been the gigantic omnipresence of Hungryalism compared to others participants of the rebellious group, who celebrated himself as a ‘great poet’ (mahākabi) and as the only founder of the movement (Sen 13). The eminent Bengali critic Jyotirmoy Datta, for instance, claims that
    Malay has been “quite as generous to himself and his brother as he is niggardly to others”, alleging Bengali criticism and writing to be “dead, mummified, goofy, but when he comes to himself his language rises to lyric heights” (Bakken 1967).
    5 “I’ll have to translate all the matters. Because my friends are not well to do with English. I, myself, can somehow cook in English, as you find in this letter. So you’d have to edit the matter properly. You give all sorts of matter in it. You can include my poem” (Letter from Malay Raychoudhuri to Dick Bakken, 18.4.66).
    6 Decision by Presidency Magistrate, Bankshal Court, Calcutta, concerning Malay
    Roychoudhuri’s Poem “Prachanda Baidyutik Chutar”, Case No. Cr/579 of 1965 (Courtesy of Stanford University Libraries, Dept. of Special Collections, Ginsberg Papers).
    7 The phrase ‘sexual body’ is used in Nandini Dhar’s article to criticize the misogynist stance of much Hungryalist poetry, where women are represented as “nothing but bodies on which desire is projected” (Dhar).
    8 “Barāṅga, bīrya, mūtrāśay, satīcchad, yuterās, ṛtusrāb, yonivartma, śukra, yonikeśar, poṁd, prasrāb, ityādi”. He later on explains his embarrassment in reading out the poem or reciting it in public because at a first reading those words had sounded ‘obscene’ (aślīl) to him (De 211).
    9 According to the digital Oxford Living Dictionaries of English, the word has two definitions: the first one is a shortened version of ‘raccoon’ (the North American Procyon), while the second is an offensive way to address a black person. Considering that the original Bengali poem has bhālluker chāl (lit. bear fur), I assume that the English translation ‘coon’ must be a metonymic use of the word that, by extension, must here signify the pubic hair. Yet one fundamental question remains unanswered: why did the Bengali poet and the American editor use such a problematic word, at least for a virtual American readership of the Sixties, such as the slang ‘coon’? In the limited space of this paper it suffices to take this example as a further evidence of the multiple –and unexpected!– manners of subverting the original meaning of a
    given text.
    10 Unless stated otherwise, all quotations of the English poem ‘Stark Electric Jesus’ in this paper are taken from the issue of the journal Salted Feathers dedicated to Hungryalism and Indian experimental writings (Bakken 1967).
    11 In a private conversation, Malay confirmed his selective choice of the words that illustrate the sexual body from a Bengali medical handbook until then unknown to him (Private Facebook conversation with Malay Rāychoudhurī, April 17, 2018).
    12 I am deeply grateful to Projit Bihari Mukharji who has shared with me his findings and considerations on Abul Hasanat’s Sacitra Yauna Bigyān. In a private conversation via email, Projit Bihari Mukharji kindly informed me that Abul Hasanat was a police officer who turned to sexology partly under the influence of Girindrasekhar Bose (who corresponded with Freud and presided over one of the most popular literary addas in the 1920s/30s). Hasanat began writing on sexology in the late 1930s, and wrote several books on the subject until the early 1950s, which remained highly popular through the 60s. One of Hasanat's stated missions was to create a scientific vocabulary for speaking of sex in his mothertongue, viz. Bengali. Hasanat's mentor, Girin Bose, was the elder brother of Rajsekhar Bose (aka Parasuram, the litterateur) who purportedly presided over a Calcutta University committee to create a scientific vocabulary in Bengali (private mail conversation, April 17, 2018).
    13 The italicized words are my own rephrasing of Malay’s English translation.
    14 “tāhole āmi dukoṭi ālokbarṣa iśbarer poṁde cumu khetum/ kintu kichui bhālo lāge nā āmār kichui bhālo lāgche nā/ ekādhik cumo khele āmār gā guloy/ dharṣaṇkāle nārīke bhule giye śilpe phire esechi katadin/ kabitār ādityabarṇā mūtrāśaye/ esab kī hocche jāni nā tabu buker madhye ghoṭe jāchhe aharaha […]/ āmār smṛtiśakti naṣṭa hoye jācche/ āmāke mṛtyur dike jete dāo ekā/ āmāke dharṣaṇ o more jāowā śikhe nite hoyeni” (Rāychoudhurī 187).
    15 Private Facebook conversation, April 17, 2018.
    16 He further argues that the obsession of India-related scholarship for semen anxiety has overshadowed the multiple, little ‘social topographies’ that could constitute a fuller picture of Indian sexualities, a word that the sociologist declines in plural (Srivastava 4).
    17 “śudhui rādhikā noy - gāṇikāo ṛtumatī hoy/ tin santāner pitā – paribār parikalpanār
    ādarśapuruṣ/ kaiśore kare thāke ātmamaithun – kare nā ki” (Mishra 19).
    18 “Svamehan” (n.d.). In Wikipedia. Retrieved January 23, 2018, from
    https://bn.wikipedia.org/wiki/স্বমেহন
    19 As pointed out by Allen and Burridge (29), masturbation is an orthophemism, a neutral term with neither positive nor derogatory connotations.
    20 “āmāke tomār garbhe āmāri śukra theke janma nite dāo/ āmār bābā-mā anya holeo ki erakam hotum?/ sampūrna bhinna ek śukra theke malay orphe āmi hote pārtum?
    (Rāychoudhurī 188)
    21 “oh e samasta kī ghaṭche āmār madhye/ āmi āmār hāt hāter ceṭo khuṁje pācchi nā/
    pāyjāmār śukiye jāoyā bīrya theke ḍānā melche/ 300000 śiśu uṛhe jācche śubhār
    stanamaṇḍalīr dike/ jhāṁke jhāṁke chuṁc chuṭe jācche rakta theke kabitāy/ ekhan āmār jedi ṭhāṅger corācālān seṁdote cāiche/ hipnoṭik śabdarājya theke phāṁsāno mṛtyubhedī jounaparculāy” (Rāychoudhurī 189).
  • Dhurjai and others | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:০৩541341
  • Dhurjati Chanda, Bapi Chakraborty, Subhankar Das and Alexander Jorgensen in conversation with Malay Roychoudhury
    Dhurjati Chanda, Editor, Ebang, Kolkata

    Malay Roychoudhury ( Photo by Sandip Kumar )
    Dhurjati: Some critics are of the opinion that you are one of the main architect of Bengali fictional prose ; of the same exalted class as that of Satinath Bhaduri, Kamal Kumar Majumdar, Subimal Basak and Subimal Misra. However, you are the exceptional torchbearer in this regard. What is your opinion ?

    Malay: See, compared to European languages, Bengali prose is quite recent. Mathi Likhito Susamachar ( Gospels of St Mathew ) was published in 1800. Sixty five years after that, Bankimchandra Chattopadhyay‘s novel Durgeshnandini was published. Third stage in prose arrived in 1914 when Pramatha Choudhury started publishing the periodical Sabujpatra ; that would mean a three year old kid. Compared to this the Jews Had their Old Testament in ancient times. The Apology of Socretes by Plato, Poetics by Aristotle, and Confessions by Saint Augustine appeared in 3rd century BC. Six hundred years before Pramatha Choudhury, Decameron was written by Boccaccio. The Praise of Folly was written by Desiderius Erasmus ; Castiglione had written The Book of the Courier. Think of Rabelais who wrote Gargatuan Pantagruel four hundred years before Rabindranath Tagore was born ; Autobiographical Prose was written by Benvenuto Cellini, Don Quixote was written by Miguel De Cervantes. How many names of European prose writers do you want me to refer to ? Pascal in 17th century, Voltaire and Rousseau in 18th. Obviously the appearance of Edgar Allan Poe, Nathaniel Hawthorne, Herman Melville, Balzac, Flaubert, Turgenev, Dostoevsky, Tolstoy, Chekov, Henry James in 19th century was a foregone conclusion. The prose writers who came after them in Europe revolutionized sentence structures, construction of words, diction, expressive inventions. To name a few : James Joyce, Andre Gide, Thomas Mann, Frantz Kafka, Marcel Proust, D.H.Lawrence, Jean Paul Sartre, Albert Camus and William Falkner. The labour and love invested by Borges, Gabriel Garcia Marquez, Salman Rushdie in their prose is evident if you leaf through just a few pages of their books. Can you imagine as to which height the language and expressive medium has reached in their society as a result of their contributions ? Compare the rich prose used for conveying news by reporters of CNN and BBC with our Doordarshan, Ananda (ABP), ETV, Akash, Chobbish Ghanta, Kolkata TV etc. Right from the war zone or accident site the extempore prose the Westerners are using is far more developed than even the written news of our Broadcasters. Read the pages of TIME, Newsweek and London newspapers alongside Ananda Bazar Patrika, Ganashakti of Kolkata. Compare the lectures of illiterate President George Bush with our erudite Chief Minister Buddhadeb Bhattacharya ; you will find even in prose Bush is wealthy. It is the writer who has to take up the job of nurturing Bengali prose. The foremost duty of a Bengali fiction writer is to develop the language and make it rich. Well crafted stories may be narrated by any grandmother. The question is not of converting language into Arts. The issue is of loving your mother tongue, local and geographical, and respecting it.

    Dhurjati: Concurrently, you have had to talk about writers’ honesty on several occasions. In the present Indian context, West Bengal in particular, don’t you think ‘morality’ or ‘de-morality’ are just hollow words ?

    Malay: The word honesty is so all pervasive in gambit, that virtue, morality, ethics, commitment etc—- every value system come within its purview. Actually, for the weak-kneed bengali, it is very difficult to disregard the values of life emanating out of the power structure of society. I had analyzed the present society of West Bengal in 2001 issue of Khanan magazine of Nagpur ; the essay is titled Postmodern Times and the Fall of Bengalies. It was to be included in the Little Magazine Digest, but the editor of the Digest Mr Jyotirmoy Das panicked and rejected it. You may go through the essay in Khanan. I do not know how we are going to get out of the hell that the people of West Bengali have got themselves trapped in post colonial logjam. The putrefaction is much deeper than immorality and dishonesty. Most of the poets, writers, critics— not only in the case of servants of media, but in Little Magazine world as well, lack self-confidence and self-respect, and are chicken-hearted , greedy and brazen faced. They don’t love the place called West Bengal. Sunil Gangopadhyay, wants the name of West Bengal changed to Bangla, but would not like the name of East Bengal Football Club changed to Football Club of Bengalies.

    Dhurjati: “You can’t carry your flag of honesty to places where millions of Rupees are spent on fireworks by individuals in one single night during Diwali festival, lecherous lasses collect gold biscuits in day-night performance.” You had, in an interview to Arunesh Ghosh, said these words. The word ‘honesty’ is very relevant here. To a postmodern thinker, does honesty of the day entail death of modernity ?

    Malay: Are you attacking Arunesh Ghosh ? In that case he has to answer this question. It is true, he is simultaneously writing in DESH, associating himself with Marxist Communist Party in power, trying to prove himself a participant in the Hungryalist movement, has declared himself to be an anti-establishment writer, etc. Don’t you think such a character signals the end of modernity ? Arunesh Ghosh is a present day Bengali, a member of the dreaded School Teacher Gang of the ruling party. However, his brandishment is visibly palpable at the micro level. Of late he has been found to have opposed the present power brokers of West Bengal. His modernist ideals might have withered away, but what about the dead end where the philosophy of idealism itself has reached ? LTTE, Jaish-e-Mohammad, ULFA, HUJI, Al Qaida, NLFT, LET, Hizbul Mujahideen etc are all fluttering some sort of flags of idealism to kill human beings. Modernity died at that juncture. And thus the relevance of local narratives. hordes of border-crossing ungrateful Bengalies have destroyed the ‘local’ society and culture of North West Bengal by grinding it under the steamroller of the grand narrative. Arunesh Ghosh is obviously pained and guilt stricken as he is one of those border-crossing Bengalies who have decimated the Coch, Mech and Rajbanshi people.
    In reply to second part of your question, I’d like to say that one may be a modern person ; but just because the structure of his writings is postmodern, you need not label him as postmodern. Local narratives may term him as Dalit, Subaltern, Green Peacenik, Environmentalist, Feminist, Anti Global etc., or he may be part of any other micro level protest ; here their honesty is unchallangeable. It is mainly because of their honest intent that so many Public Interest Litigations are being filed in various High Courts and Supreme Court.

    Dhurjati: What is the explanation of morality and moralization in the Uttaradhunika or Adhunantika perspective ?

    Malay: These days I prefer to use the word Postmodern in place of Uttaradhunika or Adhunantika. Linguist Dr Prabal Dasgupta had coined the synonym Adhunantika in the Indian perspective ; that is because some pro-establishment poets such as Anjan Sen, Amitava Gupta etc. had launched a poetry movement named Uttaradhunika. The idea of literary movements itself is a relic of modernism. As was Hungryalist movement. All literary movements have been conceived on the assumption of the Grand Narrative of Time and human civilization as linear. In modernist prescription one could predict the march of history. Which means the structure of present and future are known beforehand. One may conceive of theories. Postmodernity is an open-ended space. It can not predict the future. However, it analyzes the present and identifies the features. It surpasses the author to examine his texts. If you deconstruct their discourse, you will be able to make out as to why these people turned out in to great frauds who took refuge in the Grand Narrative. People who once bragged about social commitment, today we have come to know that they had forcibly occupied other people’s lands, which they are selling now to promoters-builders. Through their Grand Narrative traps they catch voters. This is whu postmodernists are giving importance to local narratives. Postmodern ethics is : “Small is Better than Big”. Microforms or microlevel systems, disciplines, relations, face negligible erosions, if confronted. That is why they are better than macroform systems. Macrolevel moralities were imposed by Stalin, Pol Pot, Hitler, Pinochet, Franco, Idi Amin, Yahya Khan, etc.

    Dhurjati: If ‘Establishment’ is a modernist epithet, what is the postmodern or Adhunantika flip side?

    Malay: No, no. A word can not be modernist or postmodernist, that way. The idea within an epithet can be confronted from modernist or postmodernist view. Modernists, I am talking of West Bengal, who are embeded in governmental Grand Narrative, have been labeling Ananda Bazar Patrika corporate house as Establishment. Whichever government is installed at the Centre in Delhi, they call it Step Mother Establishment. That is an epistemic fraud. Ganashakti newspaper and the local government secretariat are limbs of the same power structure. The Bengali Marxists do not have faith in the governmental Grand Narrative though ! In the postmodernist perspective when you talk of local narratives, all suzernities are ‘Establishment’. Patriarchy is establishment to Feminists. For Subaltern writers the State Award Committees lorded over by upper caste writers are establishment. Some son of the soil of West Bengal, ie., the original inhabitants, unlike East Pakistani refugees, had told me last year that the Bangla and Sahitya Academies have been captured by those erstwhile refugees who have converted them into Hindu East Bengali Establishment. Muslim writers consider these Award Committees as Hindu Establishment.

    Dhurjati: I consider your poetry collection Shoytaner Mukh ( Face of The Devil ), wherein some of the poems were stamped CANCELLED, as postmodern or Adhunantika. Would you yourself call it modern ?

    Malay: Oh ! I find you remember it. The day the book was released, it created much turmoil at the Kolkata Coffee House ! Publisher Sunil Gangopadhyay had gone to Iowa, USA to learn how to write poems., and the Krittibas group was headed by stop-gap leader Saratkumar Mukhopadhyay. I do not have a copy of the book. I am unable to recall the poems which were branded CANCELLED. The rubber stamp was used at that time to cancel gilt-edged bonds. I guess it may be explained this way : “the pages which were marked CANCELLED could be construed postmodern in the sense that their beginning and exit points got a visual structure of being wide-open.” Anyway, it has become one of watershed legend of the Hungryalist movement. The event was an iconoclastic venture which in retrospect now appears to be one of the ultimate triumph of modernism, that artistic game in which life was put at stake and the rules of which required such brazen acts of impudence to be legitimized by manifestoes.

    Dhurjati: Today the market culture is the superordinate ruler ; consumerism is victorious. What is the postmodern explanation ?

    Malay: This exactly is the condition which people are terming as end of modernism, or the Postmodern Condition in India. In such a situation the market is the superordinate discourse to which corporate media literature of potboiler writers is relativised, and in which it finds meaning and justification. Just as dot-pens and injection syringes have now become disposable, so are poetry books, novels, films, compact discs, DVDs, songs, paintings, etc. In today’s West Bengal, there is an intensification of awareness of incoherence, along with the decline in the need for order. It reveals an equivocality about the meanings and relations of things, matched by willingness to live with uncertainty to tolerate the contemporary West Bengali world seen as random and multiple and even incongruent.

    Dhurjati: A creative person’s life long struggle is not for amassing money or wealth. It is rather a desire for recognition which spurs him. How far is it applicable to you ?

    Malay: Who told you only poets and writers are creative persons ? Doctors, farmers, labourers, engineers, hawkers, shopkeepers, cooks, train drivers, miners, pilots are all creative persons. Otherwise the Homo Sapiens who once emerged from Africa would not have danced on the surface of moon. The human being in a collective is very complex. He keeps on breaking barriers and enhancing frontiers. That is how we got high yielding Taichung paddy, Operation Flood, Borlaug’s wheat, cloning, heart transplant, Save Narmada River Movement etc. I am similar to such collective humans. Paradigm shift takes place because of the work of ‘thinking’ of some people. As a result his work or thought comes down to everybody’s notice and benefit.
    ( Translated from Bengali by Indrajit Bhattacharya )
    Dhurjati Chanda

    Malay Roychoudhoudhury
    January 5, 2013 – 6:19 am Categories: Hungry Generation, Hungryalist Movement, Indian Literature | Comments (1) Tagged Bengali prose, Fiction, Tagore |
    Bapi Chakrabarty, Editor, Durer Kheya, Kanpur

    Malay Roychoudhury

    Bapi: You are considered to be a part of the Hungryalist movement. Is it proper ? Because, during the Hungry Generation movement in the 1960s, only two thin poetry collections of yours were published ; ie., Shoytaner Mukh published by Sunil Gangopadhyay and Jakham published by Subimal Basak. However, your literary fame started some 20 years the Hungryalist movement withered away, when your poetry collection Medhar Batanukul Ghungur and your novel Dubjaley Jetuku Proshwas were published. That has been the learned observation of academic readers. Have you ever made a self-assessment regarding this aspect ?

    Malay: Critics did identify me that way about 30-40 years earlier ; that is because the Hungryalist movement was started by me. Now that a number of titles of mine have been published, I presume I am not branded that way anymore. This aspect has not at all been raised by Dr Tapodhir Bhattacharya, Satyajit Bandopadhyay, Udayan Ghosh, Barin Ghoshal, Ajit Ray, Zahirul Hassan, Samir Sengupta and others who have discussed my fictions and poems in2001 in the collection of articles edited by Murshid A.M. Since you reside far away from Kolkata, you appear to live in that past glory. I would prefer that whatever I have written be discussed in a panorama. I don’t want evaluation of my identity.

    Bapi: I think your personality has got mixed up with your Hungryalist image, and as a result the creative genius of poet and prose architect Malay Roychoudhury has been submerged beneath it. In the Hungry Sakkhatkarmala interview collection of yours edited by Ajit Ray, all the fifteen interviewers have repeated the same boring questions about the Hungry Generation movement. Ahabkal magazine edited by Ratan Biswas, which was published during 2002 Kolkata Book Fair, exclusively on your work, has glorified your Hungryalist image. How would you react to it ?

    Malay: Modernist critics, as an easier way to enter a text, used to concentrate on the author’s person. And they were elated if they could catch hold of an image. It is just a colonial remnant; an analytical tool imposed by Europe. In traditional Indian literature, the authors were never given importance. Nobody has any idea of the identity and image of Krittibas Ojha and Bharatchandra. British imperialism had imported community-neutral image of the individual. After the Britishers departed, modernity has started disappearing in our postcolonial life. The critics who are still suffering from European canons of modernity are the persons who concentrate their focus on the writer rather than what he has written. The canon of hoisting the image was placed at the centre-stage of epistemic world of European imperialism. Nevertheless, some critics do claim that I have started surpassing my writings. I do not have any role in it.

    Bapi: Your birth, childhood, youth, education etc everything have happened in Patna. Your childhood was spent in the Imlitala slum of Bakharganj. Comparison of your origin is impossible with the middle class non-resident writers such as Bibhutibhushan, Sharadindu, Bonoful, Satinath and Subodh Ghosh. With that sort of background how did you emerge as one of the foremost writer of Bengali literature ?

    Malay: Other writers write for money, fame, honour, domination, awards etc. My literary activity has been an effort of an Outsider who endeavours to enter into West Bengali culture, in view of the fact that I belong to the family of one of the original inhabitants of Kolkata city, ie., the Sabarna Roychoudhurys. Ahabkal magazine has published my ancestral tree since 9th century. I do not think any other Bengali writer has had to bear such burden of being associated with his own culture. Apart from this, my education at Catholic Christian and Brahmo Samaj schools has been inspirational for me.

    Bapi: Are movements necessary for literature ?

    Malay: Hungryalism has been the only worthwhile movement in Bengali literature. Obviously, there must have been socio-political reasons. Sociologists would be in a better position to explain as to why it erupted. In the post-colonial period, no other movement is possible. The reason is the speed of consumerist society. Thus the question of necessity of literary movements in future is absurd in West Bengal.

    Bapi: Such a movement in Bengali literature was not launched either from Kolkata or any place in West Bengali. It started from outside Bengal ; from Bihar.

    Malay: That is because of the desire for entering West Bengali culture ; a desire to dredge the filth out of its cultural river, and recreate the streaming flow ; to kick the butts of vulgar refugee-esque literary guardians. The residents of West Bengal of that time, ie., 1960s, were not even aware of their self-imposed lethargy, inactivity, inertia, disease. Since I was born and brought up outside of West Bengal, things were quite clear to me
    .
    Bapi: You have termed yourself a Cultural Bastard. Kindly explain it.

    Malay: Go through the two explanations which Bishwajit Sen and Ajit Ray gave on the subject. Bengalies who live outside West Bengal, gradually get transformed into cultural bastards. The same has happened with me. Bishwajit and Ajit have discussed the social, political and literary dimensions of the issue. But I have presented the matter in a wider perspective. In our Roychoudhury family, Mughal and Pathan cultures intruded during my ancestor Panchanan, who was a military commander in Humayun and Akbar’s cavalry. Panchanan’s grandson Jia, who became known as the famous sage Kamadeva Brahmachari, tried to combine the values of Vaishnava and Shakta sects, by worshiping Shyama Rai and Kali at family level. His son Lakshmikanta, when he was advisor to Maharaja Pratapaditya, was imbibed in Portugese culture. I have studied in Catholic school and Brahmo school. The childhood locality of Imlitala had homes of low caste families, at that time called Untouchables. The locality of adolescence was crowded with conservative destitute Sunni Muslims. If one has to deconstruct my text he will have to go through these layers.

    Bapi: What is your opinion about today’s Bengali literature ? Is it really unthinkabe to launch a literary movement any more ?

    Malay: Other than my own writings I am not bothered about anything else these days. Not only in literature, no movement is possible in any other field. In other areas some pressure may be created, such as in Save Narmada River or Tribal Rights. However, the consumerist media impact in case of market literature is so all-pervasive that no movement can change the speed in life and living.
    ( Translated from Bengali by Indrajit Bhattacharya )

    Bapi Chakrabarty ( on left )
    January 2, 2013 – 5:32 am Categories: Hungry Generation, Hungryalist Movement, Indian Literature | Post a comment Tagged Bengali Poetry, Diaspora |
    Subhankar Das, Editor, Graffiti, Kolkata

    Malay Roychoudhury
    This may be beginning of a conversation between me and poet Malay Roychoudhury who was prosecuted for the publication of his poem “Stark Electric Jesus” in 1964. This poem was originally written in Bengali titled “prachanda Boidyutik Chhutar” which was subsequently translated in English with the help of Prof Howard McCord and Carl Weissner. The poem defied the forms of Bengali lyric poetry ( sonnet, villanel, minnesang, pastourelle, canzone, stew etc as well as Bengali metres ( matrabritto, aksharbritto etc ) retaining , however, its content vehicle, expressing subjective personal feelings. Malay Roychoudhury, a Bengali poet, has been a central figure in the Hungry Generation’s attack on the Indian Cultural Establishment in the early 1960s, now living a life of a recluse in Mumbai. I was in Mumbai for a few days but could not meet him as he was not doing well and my visit coincided with his visit with the Doctor. So I mailed a few questions to him and this is what he had to say.
    Subhankar: The Hungry Generation literary movement was launched by you in November 1961 with the publication of a manifesto on poetry in English from Patna, where you were residing at that point of time and nobody could believe that a Bihar-based Bengali can have any say about Bengali literature. During the course of the movement you got arrested, lost your job, dragged around town by the Police with a rope on your waist. How far is it true ? Do you still feel the relevance of the movement still exists ? If not, why ?

    Malay: Everything is recorded in the trial papers which may be retrieved from the records of Bankshal Court, Kolkata. The case number etc are also available in various publications. Why don’t you make a little effort and spend a few silver to get certified copies of these papers to enable yourself to get enlightened about the facts. The Hungryalist movement has changed the course of Bengali literature once for all. We definitely created a rupture in terms of time, discourse, experience, narrative diction and breath-span of poetic lines. The lecturer of Assam University who is writing his dissertation for a Doctorate on the subject, gleefully informed that Bengali academicians are even today scared to utter the word Hungryalism. Well, I guess that speaks a lot.

    Subhankar: I need a little more explanation on the word Behari — the causes behind the rejection etc., lost your job, dragged around town by the police with manila rope on your waist— do yo still remember that day ? I need the story of that day. Can you elaborate a little— rupture in terms of time, discourse, experience, narrative diction and breath-span of poetic lines.

    Malay: I don’t want to recall those days ; it gives me pain in my present loneliness. I want to forgive everybody. There is a rupture, in Bengali we call it Bidar. Look around you and you will get the answer. Manila ropes were not there in our time. Ropes were made of coconut husks. I don’t think you will fathom the diasporic plurality of a Behari Bengali, or a cultural bastard.

    Subhankar: Keeping in mind the Hungryalist movement made big difference in the attitude of Bangla literary scene, don’t you think any kind of movement finally aspires for a kind of regimentation, closed groups where the freedom of the authors needs to be sacrificed to keep the movement going ? Please share your experience.

    Malay: Arrey yaar, don’t think in terms of your knowledge of the movements in Western literature. Hungryalist movement did not have a centre of power, high command or polit bureau. Any one and everyone were free to join the movement just by declaring himself that he was a Hungryalist. In fact some of the later Hungryalists are not known to me even today ! Participants were free to publish their own broadsides, pamphlets, booklets, magazines etc. The movement was not confined to Kolkata only. As you have just said, I was from Patna, Subimal Basak was from Patna as well. Pradip Choudhuri was from Tripura. Subo Acharya was from Bishnupur. Anil Karanjai was from Benaras. The little Magazine Library & Research Centre at Kolkata is having an archive, you may like to check out.

    Subhankar: What initiated you to leave the literary hub Kolkata to live a life of a recluse in Mumba?

    Malay: I sold off my Kolkata flat, gifted entire collection of books, gramophone records, discs, cassettes etc to friends and readers and donated all furniture in my neighbourhood. I felt very sad about Kolkata. As you know, once upon a time Kolkata belonged to our clan. I found it just leaching. Not that I wanted to come to Mumbai. I would have preferred to go anywhere. I came to Mumbai because I have a one-room flat in this city.

    Subhankar: Why you found Kolkata is now just leaching and nothing more ?

    Malay: I just stopped myself from uttering the expression The City of Lechers. I had experienced the city some sixty years back ; it was completely different . Ask anyone of my age , anyone who is not a part of the present power nexus.

    Subhankar: Do you still feel like an Outsider after all these 49 years ?

    Malay: Oh, yes. I am The Outsider.
    ( Copyright Subhankar Das )

    Subhankar Das
    November 2, 2012 – 2:34 pm Categories: Hungry Generation, Hungryalist Movement, Indian Literature | Post a comment Tagged Bengali Poetry, Poetry |
    Alexander Jorgensen ( Part 1 of Interview )

    Malay Roychoudhury
    Known for his candour, sense of purpose and ability to transcend the banal with ferocity, Malay Roychoudhury, founding member of the Hungryalist Movement remains a seminal figure in the formulation of 21st century poetry. Personally associated with such literary figures as Allen Ginsberg and Octavio Paz, Roychoudhury has authored 40 works including poetry, novels, drama, social criticism and translations. First published in 1964, his poem “Stark Electric Jesus” incited enormous controversy, leading to both public and private persecution and ostracisation. Due to the ensuing scandal, Roychoudhury refused to write again, only returning to his craft after his mother’s death in 1983. Now an active and vital contributor to the international arts community, Roychoudhury is gracious in his time with visitors and willing to engage in discussions on creativity and politics. Working out of Kolkata, India, Roychoudhury relates his remarkable life and career with both frankness and levity.
    Alex: In what ways were you successful in “undoing the done for world” and start afresh from chaos?

    Malay: Success is a strange word as far as arts and literature are concerned. Are the cave paintings, Aztec sculptures, pyramid engravings successful ? We do not know their views. The Hungry Generation movement was definitely successful in undoing the colonial canons.

    Alex: If you could name a few artists who inspired you, who would they be ?

    Malay: I would name two illiterate persons : Shivnandan Kahar, a man who knew Ramayana, the epic written by poet Tulasidas, by heart ; and Ramkhilawan Singh Dabar, who could recite couplets from the works of poet saints Kabir, Rahim and Dadu. They were our family servants at Patna. They quoted from these poets in order to reprimand us during our childhood.

    Alex: In one sentence, what would you like to say to those who might argue that Hungry Generation poets were, well, reckless ?

    Malay: They have not read us, otherwise they would have known that the human brain is Divine. our books are published by small presses , and the reader generally has to contact us for a copy of any publication.

    Alex: We have many examples of individuals who have had a difficult time “balancing” the requirements of family and art. How important has “family” been to you as an artist ?

    Malay: very important. Without a supportive family a writer can not have structured peaceful schedule.

    Alex: If you were to die tomorrow, would be happy with the contribution to the arts and the world that you have made ?

    Malay: Happiness emanates from the process of involvement in writing. I don’t think that a writer is much bothered about immortality, especially a Hindu, who burn their dead, and do not have the culture of writing epitaphs.

    Alex: Any regrets ?

    Malay: Yes. I should have inculcated the habit of maintaining daily diary right from the school days. My experiences are extensive and varied. Unfortunately I am unable to recall the important incidents which impacted me.

    Alex: What type of things do you find yourself working on these days ?

    Malay: An M Phil student, Swati Banerjee, was preparing her thesis on comparative study of my poetry and Ginsberg’s. I had to search out material for her. for the present, Prof Bishnu Chandra Dey of Assam University, who is preparing his Ph D thesis on the Hungryalist movement, is seeking my help in locating references. This has kept me busy for sometime.

    Alex: Where do you go for inspiration ?

    Malay: Inspiration comes from within a writer. It is an up-wailing precess in your psyche.

    Alex: In terms of expression, the saying “what needs to be said” and how that might be articulated, what do you think about the use of multimedia and technology in the arts nowadays ?

    Malay: They have vastly widened our sense of wonder. One now has unlimited spark-ways to venture into the unknown.

    Alex: To someone looking to learn more about the Hungry Generation movement, where would you recommend they start ?

    Malay: Not much is readily available in English. My Selected Poems were published twenty years back. During the sixties several little magazines in the UK and US brought out special Hungry Generation issues. Those magazines may be traced from archives of the editors maintained in Universities. If Black Robert Journal is interested I would make available xerox of a couple of informative essays.

    Alexander Jorgensen

    ( Copyright Alexander Jorgensen. Reprinted from Black Robert Journal, 1999 issue )
    October 26, 2012 – 1:33 pm Categories: Hungry Generation, Hungryalist Movement, Indian Literature | Comments (1) Tagged Bengali Poetry, Poetry |
    Alexander Jorgensen ( Part 2 of Interview )

    Malay Roychoudhury’s interview by Nayanima Basu
    Founding member and central figure of the Hungryalist movement, a literary torrent predicated on the subversion of India’s cultural establishment, Malay Roychoudhury is the author of more than 50 books, a Bengali poet, novelist, dramatist, essayist, translator, and social critic, he remains a seminal figure in the understanding of 21st century poetry. His association have included such literary giants as Allen Ginsberg and Octavio Paz.
    Roychoudhury’s experimental work entitled “Prachanda Baidyutik Chhutar” ( “Stark Electric Jesus” ) , a deeply personal and confessional poem penned in 1963 and first published in 1964, created enormous controversy with its publication. It led to both public and private condemnation of its author and, due to the ensuing scandal, which included his prosecution and ostracization at the hands of peers, Roychoudhury refused to write again. It was not until 1983, following the death of his mother, that he would return to his writing.
    First introduced to Malay Roychoudhury on a visit to Kolkata in 2007, I have found his discussions and correspondenses to be vibrant, thoughtful, frank, and often filled with levity. Uniquely engaging, he has offered opinions on everything from contemporary visual poetry ( vispo ) to politics. “An interview with Malay Roychoudhury : Part One”, appears at http://www.blackrobertjournal.blogspot.com )

    Alex: You have said that Hungryalists were not “reckless”. Would you admit, however, that some members would later become self-serving ? My question relates to the idea that we become less idealistic as we grow older. Is idealism important ? How does it fit into your life ?

    Malay: I am not sure whether the 19th Century concepts of “self” , “ego” and “idealism” retain their original definitions in our 21st Century world. How do you explain these concepts in the perspective of what is being called Islamic Terrorist Human Bomb ? He definitely has what we presume to be “self”, “ego” and surely “idealism!” Otherwise why should he come to India to kill Hindu, Cristian, Jew, Sikh, Jain, Buddhist infidels ? Marx, Sartre, Freud and even Darwin would have experienced a vertigo of ontological nightmares if confronted with the present world scenario . “Idealism”, thus, is a term applicable to situations in time and space. I remain idealistic in the original Hungryalist sense of being honest . Idealism does not wane with age ; it gets continuously redefined . It definitely becomes difficult to remain a social being in West Bengal with Humanitarian Honesty as an ideal.
    The Hungryalists were not self-serving, since they wrote very little during the movement, and published lesser, as nobody liked to publish them. But after name and fame , a few Hungryalists did become self-serving, whom I avoid, and who obviously despise me. The problem is that when the discourse is narrowed down to ART , ego becomes relevant. The superordinate discourse is the market today, and ego functions as a conveyance.

    Alex: While in Kolkata, I witnessed what I interpreted at the time to be “poetry guilds;” my feeling was that these communities were involved in the construction of an “intentional poetry of political allegiance,” with attention paid to a particular style of writing. Would you say this is true ? if so, then would this be a byproduct of the Hungryalist Movement ? What are your thoughts ?

    Malay: No. Groupism evolved in mid-1950s with Krittibas and Shatabhisha poetry magazines, which claimed and behaved in a fashion as if only they had the power of definition, distinction and evaluation of literary discourses. Krittibas ultimately got inducted into the business house called Ananda Bazar Patrika ( leftists dub it as “Establishment”). The Hungryalists were treated as untouchables by these groups, though Hungryalism as a movement was in a continuous flux, somewhat like the Surrealists. Hungryalists made attempts to wrest that power and dismantle Groupism. What you call Guilds ( may be we can call them poetry cartels ) evolved in Kolkata ( not throughout West Bengal ) after the Naxalite political upheaval. Naxalites had to form secret hitmen groups. Nowadays , poetry Guilds are formed around a couple of poets who can afford to publish a regular poetry magazine. These are magazine oriented groups, and do not have an agenda. I guess most of these poets come from refugee families of erstwhile East Pakistan who wanted to legitimize themselves by re-rooting in West Bengal through a periodical based literary group. They should not be taken seriously.

    Alex: Was Tagore the worst thing to ever happen to Bengali poetry ? To Poetry ?

    Malay: Rabindranath Tagore‘s ( the Shakespeare of Bengali literature ) poems are now confined to academia. Academicians use him as a ladder in the cultural circuit of West Bengal, which unfortunately lacks in “Icons.” As a Bengali cultural icon, he can not be wished away. It is not his poems, but his songs which works as an impediment, the result of which has meant that Bengali music in post-independent India has failed to catch up with the world ( only now we have a singer poet in Kabir Suman ). His songs are being sung even in funerals ! Nevertheless, written Bengali diction had emerged out of the Tagore family. You can’t blame them. Had the British started their Empire from Dhaka in Bangladesh, the Bengali literary diction would have been different. Authors in Bangladesh, such as Bratya Raisu, Jewel Mazhar and Ebadur Rahman, write in their diction ; literary diction in Bangladesh is therefore changing. I would like to mention that one of the Hungryalists, Subimal Basak had written his novel CHHATAMATHA in this diction in 1965, for which he was castigated by academicians. Today, in West Bengal, Tagore is just a show piece to be flaunted, especially by middle class gentry. His Shantiniketan has been ruined by the Leftists.

    Alex: Tell us about your typical day. Now, I hear you are currently putting together a daily diary. How often do you meet visiting writers and artists ? How do your wife and son assist you with your many appointments ?

    Malay: I get up early, quite early, and spend a couple of hours on the Internet, as no charges are levied till 8AM. Do some yoga thereafter as advised by the physiotherapist. Have a frugal breakfast of oatmeal with vegetables while browsing through two Bengali and English newspapers. Till 1PM, I read a magazine or a book, while taking notes in my brain. I simultaneously read several books and magazines ( that is why I refrain from reviewing books ). I dislike visitors till 3PM. From 3 to 4PM, I do some freehand exercises and sit at the PC to attend to my blogs ; nowadays I concentrate on Bengali sites where I interact with young readers. As often as possible, I avoid visitors ; I have found that most of the visitors are not well-read ( the Leftist government abolished English teaching in schools in 1980s ), and it is a sheer waste of time. It is also irritating, a few obstinate readers insist on visiting me, though I do not know why. They come from remote places and I can’t drive them away like poet Buddhadeva Basu who had shut his doors the moment I uttered my name. I was born in 1939 and at this age I love to be left alone in my silence. Due to my bad health, my wife quite often intervenes ( so that I do not lapse into bronchial bouts of coughing ) if the visitor wants me to go on talking. Visitors are entertained upto 7PM, when I sit with my drinks and start brooding about the next day’s blog ( where I write the drafts and block public visibility till finalization ). My son is very busy now with an Australian firm. Since attending to my blogs, I don’t write daily diary, and have destroyed whatever I had written earlier .

    Alex: What words of advice might you offer if asked to serve in the role of a mentor ?

    Malay: No. No. I don’t want the role of a mentor bestowed on me. Each person should introspect and chalk out his own path.

    Alex: How important have your exchanges with other writers been ? What did you gain from Allen Ginsberg ? What did Ginsberg gain from his time spent with you ? In terms of cross-cultural challenges, did you find that there were any present during this period of mutual exchange ?

    Malay: Yes. That was the case till 1980s when I interacted with any or all writers. I gained a lot from the visiting authors, as varied as from Daisy Aldan to Dhumil to Kamal Chakraborty. The most important has been the visit of Professor Howard McCord of Washington State University ( later Bowling Green ) , who published my controversial poem Stark Electric Jesus with an introduction in a booklet form, and made me known in North and South America and Europe during the 1960s. It is thanks to him that this poem gets reprinted almost every year ( I do not have any copyright of any text of mine ; they are owned by my readers ). He sent me books written by US and European authors about whom I had only heard.
    Allen Ginsberg visited me at a time when I was dithering in non-religious atheism. He reinforced my pagan heritage of worshiping water, light, fire, air and other gods of nature. I can’t claim that I contributed to his thinking, though, perhaps in changing the notion that there can not be only one God ; there has to be innumerable gods for innumerable human spreads out in order to be eclectic, tolerant and resilient. Three fishes with one head, which he used as his logo, was pointed out by me from Emperor Akbar’s grave floor — the Emperor who himself wrote a religious treatise to unite all the religions of India.
    Ginsberg used to talk to my mother in sign language. My father was terribly angry with him as Ginsberg was interested in taking photographs of beggars, lepers, mutilated, half-naked poor Indians. After I saw his Indian Journals, I was very much upset to see those photographs highlighted.
    I spent a few months with non-literary hippies in Varanasi, Patna and Nepal. That was quite an experience with women and drugs. Hippies were fascinated that Allen Ginsberg had visited me.

    Alex: Tell me about the technology you employ in sharing your work and ideas with others ? I know you have a blog ?

    Malay: Other than using the desktop PC for net surfing, writing blogs and visiting network sites, I don’t have access to any other technology. No blackberry, IPod, IPhone or other gadgets. I wish I was young and used the gadgets that keep on coming. In case of the desktop PC, I am also a novice. I have to request my son to lend a helping hand to sort out things when I find myself stuck. But the internet really places my work far and wide ; people pick up my work and spread it among themselves. In most cases, I come to know after quite sometime, even a year. It is a pleasant feeling
    .
    Alex: If you could walk a mile in whatever circumstance, where where would you choose to do it ? What would be your last meal ?

    Malay: I would go to the bank of river Ganges, at the place where I had kissed my Nepali classmate Bhuvanmohini Rana. My first and memorable kiss. I do not know where she is now. Must have become old or might have died ; she was two years older than me. I would sit at the same spot at the same time of autumn evening to revisit her tenderness.
    My last meal will be a hot chicken tanduri and a few pegs of single malt.
    ( Copyright Alexander Jorgensen. Reprinted from the Chekoslovak-based GRASP magazine, May 2010 issue )

    Alexander Jorgensen
    Alexander Jorgensen is a globetrotter poet and artist. He has visited all the continents. He met Bengali writers and poets during his visit to India .
    October 24, 2012 – 2:13 pm Categories: Hungryalist Movement, Indian Literature | Post a comment Tagged Allen Ginsberg, Bengali Poetry, Poetry, Tagore |
  • Tanumoy Goswami | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:০৫541342
  • Malay Roychoudhury’s novella ‘Arup Tomar Entokanta’ : The relational orientation between body and mind

    Every writer has a unique way of the looking at the world, and this is the civilization’s centre of gravity, is a cluster of ideas which define the goal of human existence, the ways to reach this goal, the errors to be avoided and the obstacles to be expected on the way. This view interprets central human experiences and answers perennial questions on what is good and what is wrong/ evil, what is real and what is unreal, what is the essential nature of men and women and the world they live in. It is now generally assumed that people are basically selfish, and that fellow feeling is either a weakness or a luxury, or merely a more sophisticated form of selfishness. In this picture kindness becomes something we are nostalgic about, a longing for something that we fear may not really exist.

    Aesthetically, Psychoanalysis is an account of how and why modern people are so frightened of each other. What Freud called defences are the ways we protect ourselves from our desires, which are also our relations with others. Indeed the history of Psychoanalysis after Freud reflects many of the dilemmas we have about kindness (it would be an interesting exercise to read ‘sexuality’ as Freud’s word for ‘fellow feeling’). Are we, Freud’s followers wondered, committed to our desires and then gratification, or to other peoples ? And what, if anything, could such a distinction mean ? Do we crave (sensuous) satisfaction as so-called drive theorists say, or do we crave intimacy and relationships ? Do we want good company or good sex, if we have to choose ? If kindness, in its anti-sentimental sense, is at the heart of human desiring, then these become merely false choices, the wrong way of talking about what goes on between people. Sex becomes one of the more obscure, least articulated forms. It is kind not to overprotect other people from oneself, especially from one’s sexuality.

    Our psyches and the social world are inestricably linked. Whether we consider the social world is composed of dyadic relationslips, or the nuclear or extended family, or the larger community, we know that the psyche is formed by internalization of the external world, while the external world is always perceived through the lens of the internal world, the psyche. As a dyadic practice, psychoanalysis naturally focuses on the vicissitudes of dyadic relationships both in the external world and as represented internally.

    An enigma, hackneyed, an author par excellence, cliché, one who speaks the last word on sexuality, an empty boast. He is the ultimate, the pioneer of a genre, hitherto not fathomed by any Bengali litterateur, what with his slang, his colloquial dialects, his candid confessions of his eccentricities and HIS never say die attitude on the face of odds, which would have dictated anyone to hang up his boots. He is essentially a diaspora and he loves it that way. He has qualms on joining in the milieu of the so called mainstream sheep following the financially rewarding balderdash of literature.

    In this novella, author trying to emphasis on the eroticization of kindness in the psychoanalytic account. Rousseau, as we have seen located the psychological birth of kindness in the outset of puberty. It is sexual maturation that opens the fictional Emile to the feeling and sufferings of others, ‘bring[ing] to his heart the first compassion it has ever experienced.’ Rousseau intimated, and Freud showed so clearly, ambivalence is key to human sexuality, and if there is one thing that exposes this ambivalence, tests human kindness, it is the experience of human jealousy. The ambivalence exposed so vividly by sexual jealousy- that where we love we always hate,- has something important to tell us about the complexity of our emotional lives. We are always tempted to simplify our emotional lives in order to diminish the constant conflict we are in, in sexual jealousy we can no longer keep our conflicts hidden. We hate intensely where we once loved, our dependence on the person we need. Sexual jealousy- the ambivalence that explodes out of it, invites us to ask our questions the other way round. Why are we ever unkind ? And one answer would be to secure, in so far as it is possible, our emotional (psychic) survival. In a lecture on sexual jealousy delivered in Paris in 1929, Ernest Jones argued that what we call love is very often simply the way we manage stronger than love was old hat, atleast in psychoanalytic circles.

    In this story, we observes relational orientation is also congruent between body and mind. In the Indian view, there is no essential difference between body and mind. The body is merely the gross form of matter, just as the mind is a more subtle form of the same matter. Both are different forms of the same body- mind matter- sharira. The emotions that have come to be differently viewed because of the Indian emphasis on connection. As cultural psychologists have pointed out, such emotions as sympathy and feelings of interpersonal communion. Eros not in its narrowing meaning of sex but in its wider connotation of a loving ‘connectedness’ (where the sexual embrace is only the most intimate of all connections), then the relational cast to the Indian mind makes Indians more ‘erotic’ than many other peoples of the world. The relational orientation, however, also easily slips into conformity and conventional behaviour, making many Indians psychologically old even when young. In a post modern accentuation of ‘fluid identities’ and a transitional attitude toward relationships, of ‘moving on’, contemporary westernman (and the modern upper class Indian) may well embody what the Jungians call puer aeternus- the eternal youth, ever in pursuit of his dreams, full of vitality, but nourishing only to himself while those around him.

    Let us again emphasize that the relational orientation, the context sensitivity and the lesser sexual differentiation that go into the formation of the Indian mind. They are continents of an Indian’s psyche. Our sexual desire is far more selective than our kindness- our preconditions for excitement are much narrower than our preconditions for sympathy. The mental representation of our cultural heritage, it remains in constant conversation with the universal and individual aspects of our mind throughout life.
    ...............................................
    Tanumay Goswami
  • Malay | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:০৮541343
  • " শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা রচনার প্রথম শর্ত "
    মলয় রায়চৌধুরী
    এক
    ১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম । একটা হল ইতিহাসের দর্শন যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার যা পরে গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে। হাংরি আন্দোলনের হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম ইংরেজ কবিজিওফ্রে চসার-এর ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে। ওই সময়ে, ১৯৬১ সালে, আমার মনে হয়েছিল যে স্বদেশী আন্দোলোনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে ।

    উপরোক্ত রচনা দুটির খসড়া লেখার সময়ে আমার নজরে পড়েছিল অসওয়াল্ড স্পেংলার-এর লেখা দি ডিক্লাইন অব দিওয়েস্ট বইটি, যার মূল বক্তব্য থেকে আমি গড়ে তুলেছিলুম আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত। ১৯৬০ সালে আমি একুশ বছরের ছিলুম। স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈব প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে । কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন । আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে ও প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । এখানে বলা ভালো যে আমি কলকাতার আদিনিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশজ, এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে সেভাবে খোলসা হয় যা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয় ।

    ওই চিন্তা-ভাবনার দরুণ আমার মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েরও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন । আমি আমার বন্ধু দেবী রায়কে, দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, আমার আইডিয়া ব্যাখ্যা করি, এবং প্রস্তাব দিই যে আমরা হাংরি নামের একটা আন্দোলন আরম্ভ করব । ১৯৫৯ থেকে টানা দুবছরের বেশি সে-সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাড়িতে থাকতেন । দাদার শ্যালিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়েরপ্রেমিক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্হ হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য-এর প্রেমের কবিতাগুলো শীলার প্রেমে লিখিত । সে যাই হোক, ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয় , এবং ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত, আমারা ওই চার জনই ছিলুম আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।
    ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদেরব ওপর, অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম স্পেসিফিক বা সময়-কেন্দ্রিক । কল্লোল গোষ্ঠিএবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনোয়াল ইসথেটিক রিয়ালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত । সময়ানুক্রমী ভাবকল্পের গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে , এবং স্হানিকতা ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে।

    ১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র থেকে পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে । সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে এক মননসন্ত্রাস তৈরি করে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই জন্যই, ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে, ব্যক্তি-প্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো।কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজি-বলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাসত্বাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতত্বের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্যনামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব বা শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক ম্যাক্রো-পরিসরে পাবো মনসা বা চণ্ডী বা শিব বা কালিকা বা শিতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ , তার রচয়িতারা নন । তার কারণ সৃজনশিলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে।
    লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্হায়ি বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোর্সটি উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় , যার ফলে নিম্নবর্গের যে প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বাঙালির সংস্কৃতিতে ছেয়ে ছিল, তা ঔপনিবেশিক আমলে লোপাট হয়ে যায় । আমার মনে হয়েছিল যে ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ের অধিকাংশ কবিলেখক মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়-রেখাটিতে । একারণেই, তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই, এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে, যা আমি বহু পরে জানতে পারি , কাউনসিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব এ বি শাহ , পি ই এন ইনডিয়া-র অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল,এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকার-এর কাছ থেকে।
    অমনধারা সংঘাত বঙ্গজীবনে ইতোপূর্বে ঘটেছিল । ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্হানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি , রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের ক্ষেত্রে ( হেনরি লুইভিভিয়ান ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়প্রমুখ ) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে । একইভাবে, হাংরি আন্দোলন যখন সময়কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়, উত্তরঔপনিবেশিক আমলে আবার স্হানিকতার চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দনকাঠামো থেকে নিষ্কৃতির প্রয়াস দেখা গিয়েছিল । তা না হলে আর হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবিআঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করবেন কেন ?
    দুই
    হাংরি আন্দোলনের সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত , ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত । ১৯৬৫কে কেন আন্দোলনের সমাপ্তি চিহ্ণিত করা হয় সে-করণে পরে আসছি। এই সংক্ষিপ্ত সময়কালে শতাধিক ছাপানো ও সাইক্লোস্টাইল-করা বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, অধিকাংশ হ্যন্ডবিলের মতন ফালিকাগজে , কয়েকটা দেয়াল-পোস্টারে, তিনটি এক ফর্মার মাপে, এবং একটি ( যাতেউৎপলকুমার বসু-র পোপের সমাধি কবিতাটি ছিল ) প্রকাশ করা হয়েছিল কুষ্ঠি-ঠিকুজির মতন দীর্ঘ কাগজে । এই যে হ্যান্ডবিলের আকারে সাহিত্যকৃতি প্রকাশ , এরও পেছনে ছিল সময়কেন্দ্রিক ভাবধারাকে চ্যালেঞ্জের প্রকল্প । ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের পাঠবস্তুতে তো বটেই , মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র প্রজন্ম থেকে বাংলা সন্দর্ভে প্রবেশ করেছিল শিল্প-সাহিত্যের নশ্বরতা নিয়ে হাহাকার । পরে, কবিতা পত্রিকা সমগ্র, কৃত্তিবাস পত্রিকা সমগ্র, শতভিষা পত্রিকা সমগ্র , ইত্যাদি দুই শক্ত মলাটে প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের এই নন্দনতাত্বিক হাহাকারটিকে । পক্ষান্তরে, ফালিকাগজে প্রকাশিত রচনাগুলো দিলদরাজ বিলি করে দেয়া হতো , যে-প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাকঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতাবোধের গর্ব।
    আন্দোলনকে রূপ দেবার জন্যে আমরা পরিকল্পনা করেছিলুম যে সম্পাদনা ও বিতরণের কাজ দেবী রায় করবেন , নেতৃত্ব দেবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গঠিত করার কাজটি দেখবেন দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আর ছাপা আর ছাপানোর ভার আমি নেব । প্রথম ইশতাহারটিতে আগের প্রজন্মের চারজন কবির নাম থাকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ক্ষুন্ন হয়েছিলেন বলে ডিসেম্বরে শেষ প্যারা পরিবর্তন করে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল । ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে, সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে, অংশগ্রহণকারীদের নামসহ এই ইশতাহারটি আরেকবার বেরোয় । ১৯৬২ সালের শেষাশেষি ও ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে । দাদার বন্ধু উৎপলকুমার বসু , বিনয় মজুমদার ওসন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যোগ দেন । আমার বন্ধু সুবিমল বসাক , অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়যোগ দেন । সুবিমল বসাকের বন্ধু ফালগুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র ও আলো মিত্র যোগ দেন । আলো ছিলেন হাংরি আন্দোলনে একমাত্র মহিলা সদস্য। দেবী রায়ের বন্ধু প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সতীন্দ্র ভৌমিক, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, শৈলেশ্বর ঘোষ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ যোগ দেন । তখনকার দিনে বামপন্থী ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের ওপর পুলিশ নজর রাখত । দেবী রায় লক্ষ করেননি যে পুলিশের দুজন ইনফর্মার -- পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু -- হাংরি আন্দোলনকারীদের যাবতীয় বইপত্র, পত্রিকা, বুলেটিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে লালবাজার পুলিশের প্রেস সেকশানে জমা দিচ্ছে এবং সেখানে ঢাউস সব ফাইল খুলে ফেলা হয়েছে ।
    এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রতিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈশাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালা বদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কথন-ভাঁড়ারের, পার্ধক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের , তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের । তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে । হাংরি আন্দোলনকারীঔরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধঃস্তরীয় বাক-বৈশিষ্টের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহিনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটক্রিয়ার তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খণ্ডবাক্যের তহবিল, তড়িত ব্যঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্য-নোঙরের তহবিল, শীৎকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিচ্ছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যবদলের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।
    ইতোপূর্বে ইয়ংবেঙ্গলের সাংস্কৃতিক উথাল-পাথাল ঘটে থাকলেও, বাংলা শিল্প-সাহিত্যে আগাম ঘোষণা করে, ইশতাহার প্রকাশ করে, কোনো আন্দোলন হয়নি। সাহিত্য এবং ছবি আঁকাকে একই ভাবনা-ফ্রেমে আনার প্রয়াস, পারিবারিক স্তরে হয়ে থাকলেও, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে হয়নি । ফলত দর্পণ, জনতা, জলসা ইত্যাদি পত্রিকায় আমাদের সম্পর্কে বানানো খবর পরিবেশিত হওয়া আরম্ভ হয়েছিল । হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতাহার নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয় বেরোলোযুগান্তর দৈনিকে । আমার আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হল দি স্টেটসম্যান, জলসা ও আনন্দবাজার পত্রিকায় । হেডলাইন হল ব্লিৎস পত্রিকায় । সুবিমল বসাকের প্রভাবে হিন্দি ভাষায় রাজকমল চৌধুরী ও নেপালি ভাষায় পারিজাতহাংরি আন্দোলনের প্রসার ঘটালেন। আসামে ছড়িয়ে পড়লপাঁক ঘেঁটে পাতালে পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে । ছড়িয়ে পড়ল বগুড়ার বিপ্রতীক এবং ঢাকার স্বাক্ষর ও কন্ঠস্বর পত্রিকাগুলির সদস্যদের মাঝে, এবং মহারাষ্ট্রের অসো পত্রিকার সদস্যদের ভেতর । ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীরা, যাঁরা নিজেদের নাম দিয়েছিলেন স্যাড জেনারেশান, (বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার প্রমুখ ) জানতেন না যে আমি কেন প্রথম দিকের বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলুম। ফলে তাঁরাও আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন ইংরেজিতে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে।
    অনুশাসন-মুক্তির ফলে, লিটল ম্যাগাজিনের নামকরণের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল হাংরি আন্দোলন, যে. তারপর থেকে পত্রিকার নাম রাখার ঐতিহ্য একেবারে বদলে গেল। কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস, শতভিষা, উত্তরসূরী, অগ্রণী ইত্যাদি থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের পত্রিকার নাম রাখলেন জেব্রা, ফুঃ, উন্মার্গ, ওয়েস্টপেপার, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ইত্যাদি।বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশকেও সমীর রায়চৌধুরী তাঁর পত্রিকার নাম রাখলেন হাওয়া৪৯ । অবশ্য সাহিত্য-শিল্পকে উন্মার্গ আখ্যাটি জীবনানন্দ দাশ বহু পূর্বে দিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও হাংরি আন্দোলনের সময় পর্যন্ত তিনি তেমন প্রতিষ্ঠা পাননি। জেব্রা নামকরণটি ছিল পাঠকের জন্যে নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হয়ে হাংরি পাঠবস্তুর দিকে এগিয়ে আসার আহ্বান । হাংরি আন্দোলন সংঘটিত হবার আগে পূর্ব-প্রজন্মের ওই পত্রিকাগুলোর নামকরণেই যে কেবল এলিটিজম ছিল তা নয়, সে-সব পত্রিকাগুলোর একটি সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল । বনেদিয়ানার মূল্যবোধ প্রয়োগ করে একে-তাকে বাদ দেয়া বা ছাঁটাই করা, যে-কারণে নিম্নবর্ণের লেখকের পাঠবস্তু সেগুলোয় অনুপস্হিত, বিশেষ করে কবিতা । আসলে কোন-কোন রচনাকে টাইমলেস বলা হবে সে জ্ঞানটুকু ওই মূল্যবোধের ধারক-বাহকরা মনে করতেন তাঁদের কুক্ষিগত, কেননা সময় তো তাঁদের চোখে একরৈখিক, যার একেবারে আগায় আছেন কেবল তাঁরা নিজে। এখানে উল্লেখ্য, হাংরি আন্দোলনের আগে পর্যন্ত কাজি নজরুল ইসলাম ও জসীমুদ্দিনকেও 'অপর' করে রাখা হয়েছিল।

    'টাইমলেস' কাজের উদ্বেগ থেকে পয়দা হয়ছিল 'আর্ট ফর আর্ট সেক' ভাবকল্পটি, যা উপনিবেশগুলোয় চারিয়ে দিয়ে মোক্ষম চাল দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ। এই ভাবক্লপটির দ্বারা কালো, বাদামি, হলদে চামড়ার মানুষদের বহুকাল পর্যন্ত এমন সন্মোহিত করে রেখেছিল সাম্রাজ্যবাদী নন্দনভাবনা যাতে সাহিত্য-শিল্প হয়ে যায় উদ্দেশ্যহীন ও সমাজমুক্ত, যাতে পাঠবস্তু হয়ে যায় বার্তাবর্জিত, যাতে সন্দর্ভের শাষক-বিরোধী অন্তর্ঘাতী ক্ষমতা লুপ্ত হয়, এবং তা হয়ে যায় জনসংযোগহীন । হাংরি বুলেটিন যেহেতু প্রকাশিত হতো হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, তা পরের দিনই সমাজ থেকে হারিয়ে যেত । নব্বইটির বেশি বুলেটিন চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে । লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির পক্ষেও কয়েকটির বেশি বুলেটিন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।
    তিন
    যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে । তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা । হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার । বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে ( অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও ) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩-র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত । ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম , কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না । এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক । সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পারসোনাল পজেশান ছিল, কিন্তুপ্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না । ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে।

    হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, গভর্নিং কাউন্সিল বা সম্পাদকের দপতর ধরণের ক্ষঞতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকার ক্ষমতাকেন্দ্র সেই বাড়িতে চলে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায় , যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপালি, অসমীয়া মরাঙী ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল । এখনও মাঝে-মথভে কিশোর-তরুণরা এখাক-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন, যখন কিনা আন্দোলনটি কয়েক দশক আগে, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত-অর্থে ফুরিয়ে গেছে । ১৯৬৫ সালের মে মাসে ব্যাংকশাল কোর্টে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন অংশগ্রহনকারী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা সই করে সম্বন্ধ ত্যাগ করেন এবং হাংরি আন্দোলন মকদ্দমায় রাজসাক্ষীরূপে কাঠগড়ায় অবতীর্ণ হন ।
    ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সুবিমল বসাকের আঁকা বেশ কিছু লাইন ড্রইং, যেগুলো ঘন-ঘন হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হচ্ছিল, তার দরুণ তাঁকে পরপর দুবার কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের সামনে ঘিরে ধরেছিলেন অগ্রজ বিদ্বজ্জন এবং প্রহারে উদ্যত হলেন, এই অজুহাতে যে ওগুলো অশ্লীল । একই অজুহাতে কফিহাউসের দেয়ালে সাঁটা অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা পোস্টার আমরা যতবার লাগালুম ততবার ছিঁড়ে ফেলে দিলেন সাহিত্যিক-পুলিসগণ । বোঝা যাচ্ছিল যে কলোনিয়াল ইসথেটিক রেঝিমেরচাপ তখনও অপ্রতিরোধ্য । হাংরি আন্দোলনের ১৫ নং বুলেটিন এবং ৬৫ নং বুলেটিন, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহারের, যাকে বলা যায় স্নো বোলিং এফেক্ট, আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, এবং আমাদের অজ্ঞাতসারে ক্রুদ্ধ করে তুলছিল তদানীন্তন প্রশাসনের সংরক্ষণশীল কর্তাবাবাদের । আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে ইশতাহার দুটিকে অলমোস্ট প্রফেটিক বলা যায় ।

    ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে হাংরি আন্দোলনকারীরা আরেকটি কাজ করলেন , যাকে এখন রাজনৈতিক সক্রিয়তা নামে চিহ্ণিত করলেও, সে-সময়ের সাহিত্যিকরা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে সমাজের নোংরামি ঘাঁটা সাহিত্যিকদের কাজ নয় । যখন রাক্ষস জোকার মিকিমাউস দানভ দেবী-দেবতা জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদির কাগুজে মুখোশে দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন বার্তাটি ছাপিয়ে হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রীদের, মুখ্য ও অন্যান্য সচিবদের, জেলা শাসকদের, সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের , বাণিজ্যিক লেখকদের পাঠানো হল, তখন সমাজের এলিট অধিপতিরা আসরে নামলেন । এ-ব্যাপারে কলকাঠি নাড়লেন একটি পত্রিকাগোষ্ঠীর মালিক ও তাঁর বশংবদরা, তাঁর বাংলা দৈনিকের বার্তা সম্পাদক , এবং সে-সময়ে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের খোরপোষে প্রতিপালিত একটি ইংরেজি ত্রৈমাসিকের কর্তারা ( মার্কিন অর্থসাহায্য পায় জানাজানি হবার পর পত্রিকাটা বন্ধ হয়ে যায় ) ।
    চার
    ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলুম আমি, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং দাদা সমীর রায়চৌধুরী । এই অভিযোগে উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইশ্যু হয়ে থাকলেও, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এই জন্যে চাপানো হয়েছিল যাতে বাড়ি থেকে থানায় এবং থানা থেকে আদালতে হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতদের সঙ্গে সবায়ের সামনে দিয়ে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি । অন্তর্ঘাতের অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সালের মে মাস পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্ণিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিল, এবং তাদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল তৈরি করে ফেলেছিল, যেগুলো লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স রুমের টেবিলে দেখেছিলুম, যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দপতর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্হ আধিকারিক এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারালকে নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে কয়েক ঘন্টা জেরা করেছিল। কেবল আমাদের দুজনকেই এই বোর্ডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিল, কেননা শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু তাঁদের জেরায় জানিয়েছিলেন যে আমরা দুজনেই হাংরি আন্দোলনের দায়িত্বে আছি এবং তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।

    অভিযোগটি কোন সাংস্কৃতিক অধিপতির মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল জানি না । তবে অ্যাডভোকেট জেনারাল মতামত দিলেন যে এরকম আজেবাজে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভোযোগ দেখলে আদালত চটে যাবে । তখনকার দিনে টাডা-পোটা ধরণের আইন ছিল না; নকশাল আন্দোলনও ঘটেনি। ফলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, এই অভিযোগে যে সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত আমার প্রচণ্ড বৈদ্যূতিক ছুতার কবিতাটি অশ্লীল । আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা সম্ভব হল শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন বলে । অর্থাৎ হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গেল। ওনারা দুজনে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিয়েছিলেন।
    হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গিয়েছে সেই ষাটের দশকে । এখন শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে ব্যবসা । সমীর চৌধুরী নামে আনন্দবাজার পত্রিকার এক কর্মী ( আমার দাদার নামের সঙ্গে মিলটা কাজে লাগিয়ে । 'হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন' নামে একটা বই বের করেছেন। তাতা অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ লেখককে আমি চিনি না ।এই সংকলনে আমার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের রচনা নেই! সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাথ্যায়-এর আঁকা ড্রইং নেই । একটাও ম্যানিফেস্টো নেই । বাজার নামক ব্যাপারটি একটি ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ ।
    পাঁচ
    সম্প্রতি তরুণ কবিদের একটি দল নিজেদের নিও হাংরি নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আওয়াজ তুলেছে, তাদের কয়েকজনের কমিউনিটি পেজ আছে ফেসবুকে । কিন্তু প্রশ্ন হল, বর্তমান সময়ে প্রতিষ্ঠান যখন বেপরোয়া ও সন্ত্রাসকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন তারা সত্যিই সফল হবে কি ? ফরাসি বিপ্লবের পর লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্র্যাটারনিটি কেবল আওয়াজ হয়ে টিকে আছে । সোভিয়েত বিপ্লবের পর কমরেডরা যেভাবে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে লাগলেন তা ভাঙা সোভিয়েতের দিকে তাকালে টের পাওয়া যায় । পশ্চিমবাংলায় আমরা বামপন্হীদের এনেছিলুম অনেক আশা করে, কিন্তু তারাও অধঃপতনের গহ্বরে তলিয়ে গেল । তাদের বদলে যাদের আমরা সিংহাসনে বসালুম, তারাও সেই একই গহ্বরে নেমে চলেছে । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কেবল লেখালিখিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে । তার ওপর গেরুয়া মতামত জোর করে চাপাবার খেলা আরম্ভ হয়েছে। কবি-লেখকরা দলবাজি, পুরস্কার পাবার লোভে তেল মারা, প্রতিবাদের নামে সরকারি মঞ্চে প্রদীপ জ্বালানো ইত্যাদিতে ব্যস্ত ।
    সত্যি বলতে কি হাংরি আন্দোলনের মতো আর কোনো আন্দোলন সম্ভব নয় । তার কারণ সততার অভাব ।
  • Ankan Kazi | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:১০541344
  • অঙ্কন কাজী
    রক্তাক্ত জখম : হাংরি আন্দোলনের বিতর্কিত উত্তরাধিকার

    এই বছর ( ২০১৮ ) কলকাতার এক্সপেরিমেন্টার গ্যালারিতেশিল্পী সঞ্চয়ন ঘোষ ‘শ্রমের আপোষ’ নামে কার্মিক শ্রমের বিভিন্ন উপাদানকে একটি বৌদ্ধিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উপস্‌আপন করে সম্ভাব্য ইউটোপিয়ার দৃষ্টিকল্পনা করেছিলেন ।
    প্রদর্শনীর কেন্দ্রস্হলে ছিল চুন-বালি-জল দিয়ে গড়া একটি বিশাল চাতাল, ঠিক যেমন বীরভূমের ছাদ পেটাইকারীরা তৈরি করেন । তার চারিপাশে ছিল ছাদ পিটিয়েদের ছবি, একটি বাংলা সাহিত্য পত্রিকার প্রথম সংখ্যা এবং শ্রম আইন জার্নালের দুটি সংস্করণ । দেয়াল থেকে যে হেডফোনগুলো ঝুলে ছিল, সেগুলো কানে লাগিয়ে সেই দলিত রমণীদের গান শোনার ব্যবস্হা করা হয়েছিল । যাঁরা এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের শ্রম -- যা মোটামুটি আশির দশকে শেষ হয়ে গেছে -- সেই গানগুলো পুরুষ কবিদের কবিতার ঐতিহ্যে প্রবেশ করেছে । চুন-বালির চাতালের ওপরে রাখা ছিল একটি ঝলমলে বোর্ড, যেন ‘২০০১: একটি মহাশূন্যের যাত্রা’, যার ওপর আলো দিয়ে লেখা ছিল মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার এই লাইনগুলো :
    চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে
    তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন
    দুঃখ কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে
    আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি
    এই নগ্ন দৃষ্টিকল্পনা, এমনই এক সম্ভাব্য ভবিষ্যতের, যা অবিরাম পিছু হটে চলেছে, এবং একটি অবরোধী আধুনিক বিষয়বস্তুর সৃষ্টিশীল বিনির্মাণের ওপর নির্ভর করে আছে, যা হাংরি আন্দোলনের ক্রুদ্ধ আকাঙ্খাপূর্তিকে বুঝতে পারার জন্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জরুরি । হাংরি আন্দোলন ছিল সাহিত্যের আন্দোলন, যা ষাটের দশকের পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক কল্পনায় ছেয়ে গিয়েছিল ।
    সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী ছিলেন “হাংরি আন্দোলনের” প্রতিষ্ঠাতা, যাঁরা হামেশাই পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক এবং আইনি প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্হানকে স্পষ্ট করে তুলেছিল, এবং সেই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শেষাবধি জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং অভিযুক্ত করেছে, ফলে শেষ পর্যন্ত দলটিকে ভেঙে ফেলতে সফল হয়েছে । তা সত্বেও এদের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে, এমনকি হিন্দি সাহিত্যেও ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল । হাংরি সাহিত্য আন্দোলনকে প্রায়ই আণ্ডারগ্রাউণ্ড সাহিত্যিক সংস্কৃতির উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয় -- মূলত ‘লিটল ম্যাগাজিনের’ সমর্পিত বিকল্প পাঠকদের কাছে -- দেশজ ভাষায় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সাহিত্য-ভাণ্ডাররূপে ।
    হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের রচনাবলীকে একাধিক ইশতাহার ও সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছে দিতেন । আত্মসন্দেহ এবং আশা একযোগে উপস্হিত আছে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনায়, যখন কিনা তাঁরা কোনোরকম সমঝোতা সহ্য করতেন না । আধুনিকতাবাদী জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর সাফাইকরা প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার পরিবর্তে, তাঁরা এনেছিলেন সমাজের সীমালঙ্ঘন -- অস্বাভাবিক যৌনতাচর্চা, অতিরিক্ত মদ্যপান, এবং মাদকসেবন, মেলাবার প্রয়াস করেছিলেন হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণের সঙ্গে যৌনতার নিষিদ্ধতাকে --- যা প্রায়শই সাহিত্যিক অভিব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরতেন তাঁরা। ক্রোধের যাথার্থকে বাগ্মীতার মাধ্যমে প্রকাশ করে তাঁরা বিশ্বাসযোগ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ।
    , ‘কবিতা হল মানুষের নার্সিসিস্টিক চালিকাশক্তির কর্মক্রিয়া’, নভেম্বর ১৯৬১ সালে প্রকাশিত প্রথম ইশতাহারে বলেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা । ‘স্বাভাবিকভাবে, আমরা আধুনিকতার ফাঁকাফোকর হিসাবে কবিতাকে, যা কিনা কমার্শিয়াল পত্রিকার ডারলিঙ, যেখানে কবিতা অরগ্যাজমের স্বতঃস্ফূর্তিতে পুনর্জাগরিত হয় না, এবং প্রকৃতপক্ষে যা হয় তা হল নকল কাদাঘুর্ণিতে পাক-খাওয়া, অর্ধশিক্ষিত বুড়ো-খোকাদের ছন্দের গদ্য, তাতে কেউই সেই আর্তচিৎকার খুঁজে পাবে না, যেমনভাবে একটি অপ্রাণ থেকে প্রাণের সৃষ্টি হয়, মানুষ প্রয়াস করে কর্মতেজ হয়ে ওঠার।’
    যে পাঁচ বছর হাংরিদের সাহিত্য আন্দোলন সক্রিয় ছিল, তাঁরা শতাধিক বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। চল্লিশজনের বেশি কবি-লেখক ও শিল্পীদের সদস্য হিসাবে পেয়েছিল হাংরি আন্দোলন, যাঁরা নতুন নতুন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতেন । কিন্তু ১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এগারোজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রুজু করে । বহু পুরোনো সদস্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ, হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধতা করার জন্য এগিয়ে যান, এবং মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার মামলায় সাক্ষ্য দিলেন । ফলে আন্দোলন ক্রমশ প্রাণশক্তি হারিয়ে ফ্যালে ।
    পরবর্তীকালে হাংরি আন্দোলনকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার বহু প্রয়াস করা হয়েছে । সেই সমস্ত আয়োজন মূলত মলয় রায়চৌধুরী এবং শিল্পী অনিল করঞ্জাই-এর অবদানকে ঘিরে বিভিন্ন সভাসমিতিতে এবং বিদ্যায়তনিক চর্চায় সীমাবদ্ধ থেকেছে । অনিল করঞ্জাইয়ের স্বপ্নের মতন যৌনতার ল্যাণ্ডস্কেপ ছিল হাংরি আন্দোলনের ঐতিহ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ।
    বাংলা পপুলার সংস্কৃতিতে, হাংরি-চরিত্র হিসাবে সৃজিৎ মুখার্জির ২০১১ সালের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ফিল্মে সিনেমার আর্টহাউস পরিচালক গৌতম ঘোষকে অভিনয় করতে দেখা গেছে, কলকাতার প্রান্তবাসী একজন অসন্তুষ্ট, সীমালঙ্ঘনকারী হাংরি কবি হিসাবে । ২০১৫ সালে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হাংরি সাহিত্য আন্দোলন : তত্ব, তথ্য, ইতিহাস’ -- আন্দোলনকারী ও তাঁদের সমালোচকদের বক্তব্য একত্রিত করে -- গ্রন্হটির দ্বারা হাংরি আন্দোলনকে বিদ্যায়তনিক স্তরে প্রাণশক্তি দেবার প্রয়াস করা হয়েছে । বইটি হাংরি সাহিত্যের মূল্যবোধের মানদণ্ড ও ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আন্দোলনের অবস্হান নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে ।
    সঞ্চয়ন ঘোষের শিল্পকর্মের মতনই, উপরোক্ত দুটি কর্ম-পরিকল্পনাই হাংরি আন্দোলনের প্রতি সহৃদয়, কিন্তু তাঁদের পুনরায় জাগিয়ে তোলার কর্ম-পরিকল্পনায় হাংরি আন্দোলনের অন্তর্গত বহুবিধ টেনশনের সহজ-সমাধা হয়নি। এই কর্ম-পরিকল্পনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা আন্দোলনটিকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশে তাঁদের রাজনীতিকে বুঝতে পারব ।
    বীরভূমের দলিত নারীদের সঙ্গীতকে সঞ্চয়ন ঘোষ যেভাবে প্রয়োগ করেছেন, তা তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে সমস্যা ও সমাধান দুইই তুলে ধরেছে : টেক্সট ও আইডিয়ার গভীর লিঙ্গবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, যা হাংরি আন্দোলনের মুক্তিপ্রসঙ্গের কেন্দ্রবিন্দু ছিল অথচ যা প্রায়ই বাধাবন্ধনহীন নারীদ্বেষেকে প্রকট করে তুলতো । হাংরি আন্দোলনকারীদের দৃষ্টিতে পৌরুষ ছিল যেন একটি বিপন্ন বৌদ্ধিক ও বস্তুগত আহরণসূত্র । ‘বাইশে শ্রাবণ’ ফিল্মে খলনায়কের পৌরুষ দ্বিধা-খণ্ডিত -- সে একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি --- এবং নিবারণ নামে উচ্চাকাঙ্খী হাংরি আন্দোলনকারী কবির ভূমিকায় পুলিশ-অফিসারটির গড়ে তোলা ছায়ামানুষ হিসাবে গৌতম ঘোষ, যে কিনা সিরিয়াল কিলারও হতে পারে । এই দুই চরিত্রের মাঝে ফেঁসে গেছে একজন যুবক, যাকে সমীহ করা যায়, পরমব্রত চ্যাটার্জি, পাকড়াশী নামে একজন পুলিশ অফিসারের ভূমিকায়, যে নৃশংস খুনগুলোর সমাধান করতে অসফল, সেই সব খুনের শিকার হল ভিখারি আর যৌনকর্মীদের মতন সমাজের প্রান্তবাসীরা ।
    পাকড়াশীকে একদল পুলিশ অফিসারের হুমকির সামনে পড়তে হয়, যারা বিশ্বাস করতে পারেনি যে তার মতন সাদাসিধা একজন যুবক পুলিশ অফিসারের কাজ করতে পারবে । সে ক্রুদ্ধ হয়ে অ্যাকশান-হিরো ধাঁচের পুলিশ অফিসারের ধরাবাঁধা চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করে, আর মনে মনে ভাবে যে তাহলে কি মাংসের দোকানের কসাইয়ের মতন হলে লোকে তাকে সিরিয়াসলি নিতো ! পাকড়াশীর মতন এক সুবোধ ভদ্রলোকের বিপরীতে পুলিশ বিভাগে প্রবীরের উপস্হিতি অনেকটা ভতুড়ে । থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করার আধিক্যের কারণে প্রবীরকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছিল, পরে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় যাতে পাকড়াশীর বইপড়া বিদ্যার সহায়ক হবার জন্য সে তার নিয়মনীতি বর্জিত, অনেক সময়ে বেআইনি, ট্যাকটিকস প্রয়োগ করতে পারে ।
    একজন বয়স্ক এবং আরেকজন উদীয়মান যুবকের দুরকম আঙ্গিকের অস্বচ্ছন্দ পৌরুষের যৌথতার বিরুদ্ধে নিবারণ নামের কবিকে উপস্হাপন করা হয়েছে, যাঁর রচনা প্রকাশিত হয়নি, যিনি বিকৃতকাম চিত্রকল্পে মেতে ওঠেন এবং প্রায়ই হাংরি আন্দোনকারীদের মামলার উল্লেখ করেন । প্রবীর থাকে একটি পুরোনো ভাঙাচোরা প্রাসাদে, যখন কিনা নিবারণ অত্যন্ত গরিব এবং অর্ধোন্মাদ, কেননা তাকে রবীন্দ্রনাথ নামের একজন ছায়াবৎ লোক কবি হিসাবে স্বীকৃতি ও খ্যাতির নিষ্ঠুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । রহস্যকাহিনি যেমন যেমন তার বিষণ্ণ বাঁকবদল দিয়ে এগোয়, পৌরুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব অধিকতর গুরুত্ব পেতে থাকে । প্রবীরের যুক্তিহীন সহিংস পৌরুষকে উপস্হাপন করা হয়েছে বাঙালি পুরুষমানুষের উথাল-পাথাল মনঃস্হিতিকে বোঝার জন্য । প্রথম বাঁকবদলে দেখানো হয় প্রবীরের ক্ষমতার দেখনদারি । সমাজের শরীরে সীমাভঙ্গকারী কবিতার বিপদ সম্পর্কিত বাঁধাধরা ধারণাকে সে স্রেফ নিজের কাজে ব্যবহার করে । ফিল্মের শেষ দিকে তার মৃত্যুকে ট্র্যাজিক ঘটনা হিসাবে দেখানো হয়েছে -- যা পলিটিকালি ইনকারেক্ট, বলতে চেয়েছে ফিল্মটি, সে বেঁচে থাকুক আর নিজেকে বিজয়ী মনে করুক, কেননা বেঁচে থাকলে মনে হতো যে সে জিতে গেছে, কিন্তু তার সন্দেহজনক আত্মবলিদান আসলে স্ট্যাটাস কুয়োকে জিইয়ে রাখার জন্য শোক করার ব্যাপার নয় ।
    ইত্যবসরে হাংরি আন্দোলনকে নিজের ব্যবস্হা নিজে করে নিতে বলা হয়েছে, তার উত্তরাধিকারকে এমনই এক ইনোসেন্ট প্রজন্মের ভুল ব্যাখ্যার জন্য মাঝপথে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যারা তাদের সামাজিক সীমালঙ্ঘনের রাজনৈতিক দৃষ্টিপ্রতিভা দ্বারা বদল আনতে অপারগ, অথবা দায় নেবার দায় তাদের নেই।
    সৃজিৎ মুখার্জির ফিল্মের তুলনায় প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংকলনগ্রন্হটি হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসকে আরও জটিল করে তোলে । হাংরি আন্দোলনকারীদের স্বয়ম্ভু বিপ্লবী হিসাবে তুলে ধরার পরিবর্তে, বইটির ঐতিহাসিক প্রবন্ধগুলো হাংরিদের অবস্হানকে তুলনা করতে চেয়েছে পুরোনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে । সমীর রায়চৌধুরী -- মলয়ের দাদা-- তাঁর প্রবন্ধ আরম্ভ করেছেন জওহরলাল নেহেরুর দুই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মাধ্যমে । দ্বিতীয় পরিকল্পনা, যেটি শিল্পোদ্যোগকে গুরুত্ব দিয়েছিল, তার ফলে মফসসলের আঞ্চলিক প্রান্তে গড়ে উঠেছিল ইস্পাতের কারখানাগুলো । তা ছিল সংস্কৃতি ও সামাজিক দিক থেকে জনগণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শ্রমিকরা বেশ বড়ো আকারে স্হানান্তরিত হয়েছিল ।
    পাটনা, যে শহরে রায়চৌধুরী ভাইরা বড়ো হয়েছিলেন এবং হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন সেই ধরনের জায়গাগুলোর প্রধান গুরুত্ব --- মুঙ্গের, ডালটনগঞ্জ, ধানবাদ, পুর্নিয়া, চাইবাসা, এমনকি বহু দূরের বেনারস ও ত্রিপুরাকে আলোয় আনা হয়েছে । হাংরি আন্দোলনকারীরা অনায়াসে স্হানীয় বুলি, সাহিত্যিক প্রতিনিধিত্ব, স্হানীয় কৌম এবং সেই পরিসরগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাসকে এনেছেন তাঁদের টেক্সটে, আর পাশাপাশি এই ঘিঞ্জি অঞ্চলগুলোর কাঙালি বাঙালি জীবনের একক অভিজ্ঞতাকে লেখায় নিয়ে আসার প্রয়াস করেছেন । সমীর বলেছেন শ্রমিকশ্রেণির পাড়ায় শৈশবের কথা, শ্রেণিভেদের শিকার হবার কথা, প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের দ্বারা এবং বিদ্যায়তনিক সংস্হাগুলোর দ্বারা পরিত্যক্ত হবার কথা ।
    ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক, যে, তিনি ওই অবদমনকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজন অনুভব করছেন এবং দাবি করছেন যে ওই নাকউঁচু বর্গের চেয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও রামচরিতমানস সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখেন । তাঁর দাবিটা মনে হবে হাস্যকর যদি সতীনাথ ভাদুড়ীর বিখ্যাত উপন্যাস ঢোঁড়াই চরিত মানস-এর সঙ্গে তুলনা করে হয়, যে উপন্যাসটি তুলসীদাসের মহাকাব্যটির অন্তর্ঘাতী পুনর্লিখন, যার পৃষ্ঠভূমি ছিল বিহারের অবদমিত তাঁতি জাতের মানুষেরা । একই ধরণের স্হানিক প্রভাব পাওয়া যাবে হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণু এবং রামধারী সিহ দিনকর-এ । হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে, যাঁরা প্রায় সকলেই এসেছিলেন প্রভাবশালী বর্ণ থেকে, নিম্নবর্গকে নিয়ে নিরীক্ষা অথবা পুনর্গঠন গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সমাধানহীন রয়ে গেছে ।
    সমীর যখন বিদ্যায়তনিক স্তরে স্বীকৃতির কথা বলেন, তখন একটি নামই উল্লেখ করতে পারেন, এবং তা হল দীপ্তি ত্রিপাঠীর, যিনি হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখায় যুক্তিকাঠামোর অভাব এবং শব্দবাহুল্যের প্রতি ঝোঁকের কথা বলেছিলেন । সমীর এই সমালোচনাকে, যদিও বেশ আশ্চর্যের, তাঁর লেখায় যৌনতার প্রতি ঔচিত্যবাদী প্রতিক্রিয়া হিসাবে মনে করেছিলেন । সমীর আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন যে ন্যারেটিভের একরৈখিকতাকে পরোয়া করেন না এবং প্লটের মারপ্যাঁচকে মনে করেন কৃত্রিম ।
    হাংরি আন্দোলনের আদর্শগত উদ্দেশ্যের সংক্ষিপ্ত সজ্ঞা নিরুপণে সমীর রায়চৌধুরী এবং প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় উভয়েই তাঁদের বক্তব্যে অস্পষ্ট রয়ে গেছেন । তার মানে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনাবলীকে তাঁদের আধুনিকতাবাদী আচরণ থেকে পৃথক করতে তাঁরা অসমর্থ, যেমন জুতোর বাক্স রিভিউ করার জন্য পাঠানো, কাগজের মুখোশ পাঠিয়ে মুখোশ খুলে ফেলতে বলা ইত্যাদি । তাঁরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রবাহকেও গুরুত্ব দিয়েছেন । কৃত্তিবাস ছিল মহানগরীয় এবং আধুনিকতাবাদী নান্দনিকতার সাহিত্য পত্রিকা । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকাটি ষাটের দশকে নড়বড়ে হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে তা হয়ে ওঠে সমীহ করার মতো একটি সাংস্কৃতিক বস্তু ।
    র‌্যাডিকাল আধুনিকতার হস্তক্ষেপের বিপ্রতীপে সাহিত্যিক অবস্হানের বিপদহীন আশ্রয়ে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংকলন আলো ফেলেছে প্রান্তিক এলাকার গুরুত্বে, যা আমরা দেখতে পাই স্হানিক ক্ষমতা সংঘর্ষের দ্বারা সজ্ঞায়িত একরূপতার দাবিতে --- বাঙালিদের জন্য পশ্চিমবাংলা, ওড়িয়াদের জন্য ওড়িষা, বিহারিদের জন্য হিন্দি বা মৈথিলি --- যখন কিনা বিশাল একটা শ্রমিক জনসমূদায়কে উপেক্ষা করা হয়েছে যারা রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে জীবনযাপনের জন্য অন্যত্র চলে গেছে । হাংরি আন্দোলনকারীরা পাঠকদের পাঠাভ্যাস পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ জানালেন তাঁদের নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে ।
    ব্যাপারটা সঞ্চয়ন ঘোষের ইনস্টলেশনে স্বরলিপির মিশ্রণ ঘটিয়ে যে গান শোনানো হচ্ছে তার ক্ষেত্রেও সত্য । বাউড়ি গায়িকারা যে বুলিতে গান গাইতেন তা শুদ্ধ সাহিত্যিক বাংলা ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল । এমন এক ঐতিহ্য যেখানে প্রভাবশালী জাতের পুরুষদের রুচি প্রতিষ্ঠিত ভাষা এবং গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী ডিসকোর্স নির্ণয় করে, তাতে যদি না খাপ খায় তাহলে আচরণ-অভ্যাসগুলো লোপাট হয়ে যায় । সঞ্চয়ন ঘোষের ইন্সটলেশান লিঙ্গবাদী রাজনীতির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চেয়েছে, বুঝতে চেষ্টা করেছে যে বাঙালির সংস্কৃতিতে শ্রমসাহিত্য গভীরভাবে কেন লিঙ্গবাদী ।
    এই ধরনের মিশ্রণ, সাহিত্যিক সংঘর্ষ থেকে অশুদ্ধতা গড়ে তোলা, মলয় রায়চৌধুরীর বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর তুচ্ছ যৌনচিত্রময় লাইনগুলোর চেয়ে বেশি সামাজিক ও সাহিত্যিক আঘাত করতে পারে :
    তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
    আমাকে তোমাত গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
    আমার বাবা-মা অন্য হলেই কি আমি এরকম হতুম ?

    ঋণস্বীকার : দি ক্যারাভান পত্রিকা, ১ অক্টোবর, ২০১৮
  • Abul Qaiyum | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:১৩541345
  • মলয় রায়চৌধুরীর ”স্বনির্বাচিত” : হাংরিয়ালিস্ট তথা অধুনান্তিক বাঙলা-সাহিত‌্যের বাইবেল
    আবুল কাইয়ুম

    অধুনান্তিক সাহিত‌্যের প্রকাশক ভিন্নচোখ প্রকাশনী ২০১৮ সালে বের করেছে পশ্চিম বাংলার হাংরি আন্দোলনের পুরোধা ও কিংবদন্তীসম আভাঁ-গার্দ লেখক মলয় রায়চৌধুরীর গ্রন্থ “স্বনির্বাচিত”। বাংলাদেশে এই প্রথম একক গ্রন্থাকারে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, কাব‌্যনাটক, অনুবাদ, প্রবন্ধ, গল্প, উপন‌্যাস ও আত্মজীবনী সংকলিত হলো। উল্লেখ‌্য, গত শতকের ষাটের দশকের প্রথমার্ধে তাঁর হাংরি আন্দোলন ভারতে ও পাশ্চাত‌্যে ব‌্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, সে সম্পর্কে সমর্থক-অসমর্থক অতি অল্পসংখ‌্যক লেখকের বাইরে এ-দেশের ( বর্তমান বাংলাদেশ ) সাধারণ পাঠক পরিচিত ছিল না। এর আদি কারণ, ভারতের পাটনা ও কোলকাতার সাহিত‌্য-ভুবন যখন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাংরি আন্দোলনে জবথবু, তখন এই বাংলার ওপর একদিকে চলছিল দ্বিজাতি-তত্ত্বের খোলসে পাকিস্তানি সংরক্ষণবাদী দুঃশাসন এবং অন‌্যদিকে, এখানকার সাহিত‌্যবলয়ে প্রথা-প্রতিষ্ঠানের দাপট। স্বভাবতই, ভারত-বিদ্বেষী এই আয়রন কার্টেনের ভেতরে হাংরির মতো বৈপ্লবিক সাহিত‌্য-চেতনার প্রভাব পড়েনি বা পড়তে দেওয়া হয়নি। ফলত, এটা অবাক করার মতো কিছু ছিল না, যখন সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় রফিক হায়দার নামে একজন বাংলাদেশি কবি মলয় রায়চৌধুরীকে জানালেন যে, তিনি কখনও হাংরি আন্দোলনের কথাই শোনেননি। এ প্রসঙ্গে মলয়বাবু তাঁর গ্রন্থটির “আত্ম-জীবনী” অংশে রসিকতা করে লিখেছেন, “ সম্ভবত তখন কলকাতা থেকে আন্দেোলন চলে গেছে উত্তরবঙ্গে আর ত্রিপুরায়”।

    স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগের পথ খুলে গেলে এবং এ-দেশে পশ্চিম বাংলার সমকালীন সাহিত্য প্রবেশাধিকার পেলে মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর হাংরি সম্পর্কে অবশ‌্য আরো কিছুসংখ‌্যক লেখক-পাঠকের জানা-বোঝার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসুদের তৃষ্ণা নিবৃত করেছিল “মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা”— আশির দশকের মধ‌্য ভাগে, মলয়রায়চৌধুরীর “হাংরি কিংবদন্তী” ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের মাধ‌্যমে। মলয়বাবুর আত্ম-জীবনী থেকে জানা যায়, মীজান সাহেব সেই লেখাগুলো এ-বাংলায় গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ‌্যোগ নিলে তা বন্ধ করার জন‌্য কলকাত্তাই এস্টাবলিসমেন্ট-এর চাঁই সুনীল গং তাঁদের এ-দেশীয় সুহৃদ কবি শামসুর রাহমানকে ব‌্যবহার করেন। এই পরিস্থিতিতে মীজান সাহেব তাঁর ইচ্ছের কবর দিয়ে ঢাকা থেকে প্রকাশ করলেন মলয়বাবুর উপন‌্যাস “নামগন্ধ”। তাই মলয়বাবু লিখেছেন, “ আমাকে নিয়ে সাংস্কৃতিক রাজনীতি কেবল পশ্চিম বাংলাতেই নয়, তা বাংলাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে”।

    এ-দেশে হাংরি আন্দোলনের ভাবাদর্শসমৃদ্ধ লেখাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি সম্পাদক মীজানুর রহমান। তিনি আজ প্রয়াত। তিনি যা পারেননি, সেটাই প্রায় তিন দশক পর আজ এ-দেশের পাঠকের কাছে উপহার দিলেন একালের এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী লেখক-প্রকাশক ও ভিন্নচোখের স্বত্বাধিকারী আলী আফজাল খান। বিভিন্ন সময়ে লেখা এ-সব রচনা মলয়বাবুর হাংরিয়ালিস্ট, জাদুবাস্তব তথা অধুনান্তিক চিন্তা-চেতনার ফসল। গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতা, কাব‌্যনাটক, গল্প ও উপন‌্যাস বিষয়ের অভিনবত্ব ও ভাষার ব‌্যতিক্রমিতা নিয়ে অনবদ‌্য সৃষ্টি। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ রচনা ”আত্মজীবনী” থেকেই এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী লেখকের বেড়ে-ওঠা, হাংরি আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার, এর প্রভাব, বিশ্বখ‌্যাতি এবং প্রতিষ্ঠানপন্থী লেখকদের বিরুদ্ধ-ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা যাবে।

    বাঙলা সাহিত‌্যের ইতিহাসে হাংরি-ই একমাত্র আন্দোলন, যা প্রথা, প্রচলিত ধ‌্যান-ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের আবর্তে ঘুরপাক-খাওয়া সাহিত‌্য ও সনাতন অনুশাসনের মর্মমূলে আঘাত হেনে সাহিত‌্যের এক নতুন ধারা প্রবর্তনে সমর্থ হয়েছিল। মলয় রায়চৌধুরী তাঁর বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ‌্যায়, দেবী রায় প্রমুখকে নিয়ে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন প্রকাশের মাধ‌্যমে ১৯৬১ সালে এই আন্দোলন সূচনা করেন, যা অচিরেই কোলকাতা সহ সমগ্র পশ্চিমবাংলায় বিস্ত‍ৃত হয়। সন্দীপন চট্টোপাধ‌্যায়, বিনয় মজুমদার, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, ত্রিদিব মিত্র, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, রবীন্দ্র গুহ ও অনিল করঞ্জাই সহ প্রায় অর্ধশত তরুণ কবি, সাহিত‌্যিক ও শিল্পী-ও হাংরি আন্দোলনে অংশ নেন। ১০৮টি বুলেটিন প্রকাশ করে তাঁরা একদিকে যেমন উত্তরঔপনিবেশিক সাহিত‌্যরীতির কট্টর সমালোচনায় তার মুখোস উন্মোচন করেন, অন‌্যদিকে ভাষিক ও বৈষয়িক—এ উভয় ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে তাঁদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত‌্য তুলে ধরেন। বুলেটিনের বাইরেও তাঁরা এই বৈপ্লবিক চেতনার আশ্রয়ে লেখা প্রকাশ করেন এবং পশ্চিম বাংলার ব‌্যাপক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৬৪ সালে বুলেটিনে প্রকাশিত ”প্রচণ্ড বৈদ‌্যুতিক ছুতার” শীর্ষক কবিতাটির জন‌্য মলয় রায়চৌধুরীকে অশ্লীলতার দায়ে গ্রেফতার করা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ‌্যজনক হলেও সত‌্য, হাংরি আন্দোলনের সাথিদের মধ‌্যে শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী এবং শক্তি চট্টোপাধ‌্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ‌্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ সরকার-পক্ষের সাক্ষী হয়ে যান। অবশ‌্য সুনীল গঙ্গোপাধ‌্যায়, তরুণ সান্যাল ও জ্যোতির্ময় দত্ত সহ কয়েকজন আসামি-পক্ষে সাক্ষ‌্য দান করেন। একটি কবিতা লেখার জন‌্য এমন মামলা ভূ-ভারতে আর কখনও হয়েছে বলে জানা নেই। পশ্চিম বাংলা ও ভারতের পত্র-পত্রিকায় ঘটনাটি ব‌্যাপক প্রচার পায়। সে-সাথে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকা মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ব‌্যাপক কভারেজ দেয়। আমেরিকার ‘টাইম’ ম‌্যাগাজিন বিষয়টি নিয়ে মুখ‌্য প্রতিবেদন ও প্রচ্ছদ প্রকাশ করে। আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে মলয়বাবু ও তাঁর অনুসারীদের কবিতার অনুবাদ প্রকাশ পায়। আমেরিকার বীট কবি অ‌্যালেন গিন্সবার্গ, মেক্সিকোর কবি ওক্তাভিও পাজ সহ অনেকে এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে ভারতে আসেন। বলতে গেলে, পশ্চিম বাংলা ও পাশ্চাত‌্যের সাহিত‌্যাঙ্গনে একটা তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাঙলা শিল্প-সাহিত‌্যের ইতিহাসে এ এক অভাবিতপূর্ব ঘটনা। মামলার রায়ে মলয়বাবুকে ২০০ টাকা জরিমানা ( সর্বোচ্চ ), অনাদায়ে এক মাসের কারাবাস— এই দণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু হাইকেোর্টে আপীল করা হলে প্রায় তিন বছর পর তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। তারও আগে ১৯৬৫ সালে হাংরি আন্দেোলনের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। এ হলো হাংরি আন্দেোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। কিন্তু এ-সব নিয়েই মলয়বাবুর স্মৃতিতর্পন শেষ নয়। সাহিত‌্যজগতের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কীভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন ও হাংরি সাহিত‌্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ‌্য ও গোপন চক্রান্তে সামিল হয়েছিলেন এবং তাঁদের ছত্রছায়ায় হাংরির একদল কর্মী মুচলেকা দিয়ে খালাস পেয়ে মলয়বাবুর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ‌্য দিয়েছিলেন তারও বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে গ্রন্থটিতে। গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে আন্দোলন চলাকালে অ‌্যালেন গিন্সবার্গ ও বীট জেনারেশনের আরেক দিকপাল লরেন্স ফার্লিংঘেট্টি এবং মলয়বাবুর মাঝে আদান-প্রদানকৃত চিঠিগুলো এবং তৎকালীন প্রতিষ্ঠানপন্থী সাহিত‌্যের গুরু আবু সয়ীদ আইয়ুব কর্তৃক মলয়বাবু ও হাংরির বিরুদ্ধে গিন্সবার্গকে লেখা চিঠি এবং গিন্সবার্গ কর্তৃক প্রদত্ত এর দাঁতভাঙা জবাব সংবলিত চিঠিটাও । তাছাড়া পাটনার বস্তি এলাকায় কৈশোর ও যৌবনে মলয়বাবু যে উদ্দাম, কামনামদির ও সংস্কারমুক্ত জীবন কাটিয়েছেন তারও অকপট ও সরস বর্ণনা রয়েছে আত্ম-জীবনী অংশে। মলয়বাবু ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে বাংলাদেশের পাঠকদের জানা ও বোঝার জন‌্য এই লেখাটি যথেষ্ট সহায়ক হবে।

    আত্ম-জীবনী ছাড়াও গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কাব‌্য-নাটক “যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের” , “প্রচণ্ড বৈদ‌্যুতিক ছুতার “ সহ ২৩টি কবিতা, ”নাম নেই” নামে একটি প্লটমুক্ত উপন‌্যাস, জাদুবাস্তবতা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ, গিন্সবার্গের প্রখ‌্যাত কবিতা “হাউল’-এর অনুবাদ, প্রবন্ধ “হাংরি আন্দোলন ও শক্তি চট্টোপাধ‌্যায়” এবং “মিহিকার জন্মদিন “ শীর্ষক একটি ছোটগল্প। ”স্বরচিত” গ্রন্থের কবিতা ও গল্প-উপন‌্যাস পাঠে সহজেই মলয়বাবুর রচনাশৈলীর অভিনবত্ব ও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চেতনার প্রকৃতি বোঝা যাবে। তিনি তাঁর মতো করেই লিখেছেন, এমনকি সমকালীন হাংরিয়ালিস্ট বা পশ্চিমা প্রভাবের অধুনান্তিক লেখকদের চেয়ে একেবারে আলাদাভাবে সৃজনকর্মে ব‌্যাপৃত থেকেছেন। আশির দশকের পর থেকে তিনি অধুনান্তিক ও জাদুবাস্তব ধারায় লেখা শুরু করলেও, তাঁর বিশেষ উদ্ভাবনী ক্ষমতায় প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বকীয়তারই দীপ্তি ছড়িয়েছেন। আবার, গদ্য-রচনা হোক বা কবিতা, তাঁর একটি রচনার ভাষাবন্ধও অন‌্যটি থেকে একেবারেই পৃথক এবং প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ উপস্থাপনের বেলায় সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রায় সমৃদ্ধ থেকেছে। নির্দিষ্ট আঙ্গিকরীতি, যুক্তি বা নিয়ম-পদ্ধতি থেকে মুক্ত নতুন ধারার বাচনিক নির্মাণ তাঁর সাহিত‌্য। কী কবিতায় কী গদ‌্যে, বিচিত্র যৌন-অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি মোক্ষম শিল্পী। নিষিদ্ধকে তিনি খোলামেলা ভাষায় তুলে ধরেছেন। একদিকে জৈবিকতা এবং অন‌্যদিকে প্রথাগত সমাজের নানা কুশ্রিতা ও অন‌্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে সরস সমালোচনা তাঁর সাহিত‌্যের উপজীব‌্য। সেখানে রয়েছে এমন সব উপাত্ত যে-গুলো নির্মম সত‌্যেরই প্রকাশ ঘটায়, মুখোস খুলে দেয় প্রচলিত সভ‌্যতার, উলঙ্গ করে ছাড়ে এতৎকালের সাহিত‌্য-শিল্পের অনুশাসনকে।

    প্রায় চারশত পৃষ্ঠার এই ”স্বনির্বাচিত” গ্রন্হ, বাঙলা সাহিত‌্যের কিংবদন্তীসম লেখক মলয়বাবু ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে জানা-বোঝার এক মোক্ষম দলিল। আরো ওজস্বিতা নিয়ে একভাবে বলা যায়, এ যেন হাংরিয়ালিস্ট তথা অধুনান্তিক বাঙলা সাহিত‌্যের বাইবেল। বাংলাদেশে অধুনান্তিক সাহিত‌্যের চর্চায় যাঁরা আগ্রহী, এই গ্রন্থটি তাঁদের মনন ও চিন্তা-চেতনা গঠনে নির্দেশক হতে পারে বলে আমি মনে করি।

    (গ্রন্থ : স্বনির্বাচিত। লেখক : মলয় রায়চৌধুরী। প্রকাশক : আলী আফজাল খান, ভিন্নচোখ প্রকাশনী, ঢাকা। প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ। মূল‌্য : ৬৬০ টাকা।)
  • Supriti Burman | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:১৫541346
  • আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরীর পজিটিভ ইরটিসিজম
    সুপ্রীতি বর্মন
    বুদ্ধদেব বসু ইরটিক উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘রাতভর বৃষ্টি’, কিন্তু তিনি ইরটিক প্রেমের কবিতা লেখেননি। মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পর্বের কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ইরটিক প্রেমের কবিতা, মলয় রায়চৌধুরী ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’। মলয় রায়চৌধুরী দ্বিতীয় পর্বেও বহু ইরটিক কবিতা লিখেছেন, একজন বাউলের প্রেমের পজিটিভ ইরটিসিজমের কবিতা । কোটিজন্মের যায় পিপাসা বিন্দুমাত্র জলপানে ।

    মলয় রায়চৌধুরী এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, একজন বাউল । শব্দ, চিত্রকল্প, বাকবন্ধ তাঁর একতারা, গুবা, সারিন্দা, ডুবকি, নুপর, খমক । সকল পথ হারিয়ে ফেলা তরুণী-প্রেমিকার গূঢ় তলাতল খুঁজে তুলে এনেছেন রত্নধন, চাঁদের উদয় দেখিয়েছেন অমাবস্যায় । অভেদের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি নবদ্বার-পিয়াসী এক জাজ্বল্যমান প্রতিমূর্তি, যাঁর হৃদয়ের কোলাজে স্বর্ণালী কলমের ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে স্থলপদ্মে ভাসমান ‘ন্যাংটো তন্বী, । আড়ালের দরমা ছুঁড়ে ফেলে অকপট সহবাস, নগ্নমূর্তির দাম্পত্য কিংবা প্রেমিকের সত্তায়, কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা । ধূসর চিত্রকল্পের পরোয়া না করে, পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচারীতায় না ভুগে, নারীজন্মে পুরুষত্বের অসীম সোহাগশশী কলঙ্কিত না করে, প্রেমের পবিত্র অর্ঘ্যে অর্চনায় হাংরি আন্দোলনের পথিকৃৎ, যে অর্চনার মায়াবী বর্ণনা আছে তাঁর ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে, খুশি মণ্ডলের উদ্দেশ্যে যিশু বিশ্বাসের প্রেমপূজা । আদালতে জেল-জরিমানার ভ্রূকুটি, বন্ধুদের রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়া, তবুও কবির বাউলসত্তাকে কে কবে চোখ রাঙিয়ে অবরুদ্ধ করতে পেরেছে ? মলয় রায়চৌধুরীর মতো অতো দম কারোর নেই ; এ এক সাহসী স্পর্ধা অতল-নিতল-তলাতল সন্ধানের । তাই আমিও কোনও রোক-টোখ ছাড়া স্বাধীনচেতা মননে তাঁর প্রেমের কবিতাগুচ্ছের কয়েকটির বিশ্লেষণ করছি । । বিশ্লেষণের গভীরতার মাপনযোগ্যে যতটা ইহ-দেহবাদের যে আনন্দ তুলে ধরেছি তা শুধু নিঃস্বার্থ ঐশ্বর্গিক প্রেমের অঞ্জলি, আমার স্বামী-সোহাগের অভিজ্ঞতা থেকে।

    "ঘাস" কবিতাটিতে হৃদয়গ্রাহী প্রেম নিবেদনের পংক্তি কথকথা : “আমি জন্মাবো কুমারী উরুদ্বয়ের মাঝে কোঁকড়া কৃষ্ণ ঘাস হয়ে তাতে লুকানো গন্ধমাদনের ঝর্না। মহীরুহ নই তাই জিরোই মনে হয় শুকিয়ে গেছি।” ঢেউ তুলি তোমার ঘর্মাক্ত শরীরে বাড়তি বীজ ফেলবো রাতে। তখন মনে হয় গোল্ডফ্লেকের ধোঁয়ায় নিকোটিনের আসক্তি ওষ্ঠদ্বয়ের হিমাঙ্কে দূর্বল দূর্বাঘাসে আখচার মৌসুমীর অকাল বর্ষণ হবে। সর্বভুক শিখায় উজ্জ্বলা পোড়ামাটি বীর্য উত্থিত হয় পুরুষালি ঘাসে আর প্রেমিকার দেহে উদ্ভাসিত অপরিমেয় গভীরতায় সংক্ষিপ্ত চিল্কা হ্রদ। অবুঝ কিশোরী খামচে ধরে তক্ষক জিভের টপাটপ গ্রাসে অধিগ্রহন ফেনায়িত ঢেউ। অধিগ্রাসে পুরুষালী ঘাস সমর্পিত পাষান ঈশ্বরী বেদী তোমাকে। মৃন্ময়ীর চুলচেরা বিশ্লেষণ আজ ক্ষুরের ডগায় নাছোড় প্রেমিকের মাথাচাড়া। বিছানায় এলানো মৃত্তিকার নগ্নকায়ার সাথে ভূরাজত্বে তৃষ্ণার্ত সঙ্গীর নাগপাশে মুঠোয় অধঃক্ষেপ মৈথুন। মলয় রায়চৌধুরীর ইরটিক কবিতাগুলো বাউলের দেহতত্বের ভূবনমঞ্চ ।

    "ন্যাংটো তন্বীর জন্য প্রেমের কবিতায়" কুচকুচে চকচকে পুংঘোড়ায় বসে আছেন ন্যাংটো তন্বী।
    যৌননৌকায় টালমাটাল পুংঅশ্বের রোমের কেশর ঝাঁকানো ভরাডুবি পিচ্ছিল স্রোতের উষ্ণ প্রসবন।
    অশ্বারোহীর রক্ষাকবচ কনডোম,,, ফানেলে জ্বলন্ত ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের উৎসেচক কেরোসিনে চোবানো আর বর্হিগত অপসারনে ডেসিমেলে কম্পমান স্যাঁতসেতে ধরিত্রী। চুষিকাঠির ইচ্ছেমতন রস নিংড়ানো সরস জিহ্বায় উৎকোচ গাঁটের পর গাঁট খেজুর গাছ। গৃহস্থের পরিপাটি তোশক বিছানা আজ হুলুস্থুলুস দুন্ধুভির গর্জনে কুমারী মেঘে জমাট জলঙ্গি কামনার রসমজ্জায়। লাজুক ঘোমটায় তরুণাস্থির চলন রুফটপের সানসাইনে মালসায় জমেছে গতরাতের ঋতুস্রাব। পুংঘোড়ার ঈষৎ কম্পিত লাফে অচিন পাখির সন্ধান।

    "বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতায় কাম রজঃগুণে প্রেমিক জেদি মন সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবে। সে দেউলিয়া থাকতে চায়, নিঃস্ব, কারণ প্রেম হল তার একমাত্র পাথেয় । সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার প্রিয়তমার বিরহের উদ্বিগ্নতা । দুর্নিবার যন্ত্রনায় ছিন্ন প্রেমিক-স্বত্তার উৎকন্ঠিত হৃদয় প্রেমিকাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিতে চায় আপন ক্ষুধায়। লকলকে জিহ্বায় শ্যাওলা জমেছে নিরাসক্তির ঘোমটার উদাসীনতায় । কবি যেন গা ঠেশে, ছাড়ো ছাড়ো, একরাশ আকাঙ্খায় অশ্রাব্য ঘুমের স্নিগ্ধতার দূরত্ব গড়ে ফেলেছেন ।তাই বোধহয় চোখের পালকি থেকে বিদায় নিয়েছে দৈহিক স্পর্শের টান--- কন্যা এখন যুবতী।
    প্রতিবেশী নাভিগহ্বরে শুয়ে আছে সোঁদা গন্ধের বিনুনি, কবি-প্রেমিকের বীর্যের আঠালো স্রোতে নিংড়ে পেতে চাইছে আজ জরায়ুর গন্ধ, সে প্রেমিকা, সে শুভা, সে বাউলের সঙ্গিনী। মলয়-বাউলের কাছে স্বর্গ-নরক, জন্মান্তর, মূর্তি, মন্দির, শাস্ত্রগ্রন্হ স্বীকৃত ছিল না ; ধর্মের হাংরি ম্যানিফেস্টোয় তিনি লিখেছিলেন সেসব কথা ।

    মশারীর রৌদ্রদগ্ধ আঁতুড়ঘরে হাপরের দীর্ঘশ্বাসে রাত্রিযাপনের কোলাজে নিতম্বের দূর্দন্ডপ্রতাপে শ্রীমতি সোহাগটুকু নিংড়ে রক্তিম টিপে করেছে বন্দী। আঠালো স্রাবে বৈদ্যুতিক ঝাপটা কবি আজ হয়েছেন ছুতোর; কবি বলেছেন যিশুখ্রিস্ট ছুতোর ছিলেন, শুভা তাঁর মেরি ম্যাগডালেন। প্রেমিকের অপটু ধস্তাধস্তি কুঠারে প্রেমিকার নাভিতে উছলিয়ে বৈতরিনী জাহ্নবীর ছলাকলায় গূঢ় অভ্যন্তর সরস মরণ-পতন। উড়ুক্কু কলা ঊরুদ্বয়ে আগোল প্রেমিকার যৌবনতটে কবির আঁশ কামড়ে যোনির সুস্থতা নাড়ি ছেঁড়া রোমান্টিসিজম শুভার প্রতি কাঙাল হৃদয় প্রেমিক মলয়ের। তিনি চিৎকার করে বলছেন, শুভার স্তনের বিছানায় আমাকে শুতে দাও, শেষবার ঘুমোতে দাও, মর্মান্তিক আকুতি এক ব্যথিতচিত্তের । ভরাট স্তনের শিমূলে মাথা গোঁজার ঠাঁই। উদ্দাম ন্যাংটো তন্বীর আঁচড়ে কোঁকড়ানো চুলে মেঘের কার্নিশ আকন্ঠ ভরে যাচ্ছে আজ ধাতুর স্রোতে।

    রূপশালী নাভিমাসে বীর্যস্নেহে স্নিগ্ধ গথিক ভাস্কর্য আঁকশি রূপে নেতিয়ে থাকা দূর্বল শরীরী বাকলের হেতাল বনে আনতে চায় মরা কোটালের বান। পরিপক্ক সোহাগের ডোরে যন্ত্রণা মন্থনে উদ্যত উদ্ধত জেদী আদি যৌনতা ঢোঁড়া সাপ স্ফীতগতরে ঊরুজাত রোঁয়াওঠা শিহরনের কম্বলে দগ্ধভূমি পুরুষত্বের ঔরসে নিষিক্ত জরায়ু আজ তার একচ্ছত্র অধিকার। তাই আজ সব প্রয়োজন শূন্য প্রেমিকার গর্ভে ঔরসজাত সন্তান রূপে শুক্র থেকে প্রেমিকের জন্ম হোক এ যেন এক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেমিকের দৃঢ় অঙ্গীকার, কালজয়ী উৎসর্গীকরণ, বাউলের দেহতত্ত্বের সঙ্গমে। পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি নামছে স্তনে আর তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরের সমগ্র অসহায়তা। যোনি মেলে ধরো, বাউল-প্রেমিকের আকুতির টান পাঁজরাবদ্ধ উৎসবে । কুমারী অমাবস্যায় পদ্মবোঁটার উন্মোচন অন্তর্বাস ছিঁড়ে বেআব্রু শুভার রজঃস্বলায় প্রেমিক শ্লেষা হয়ে মিশে যেতে চায়।মায়ের যোনিবর্ত্মে অাত্মগোপন বা ধিক্কার স্বীয় অধিকারে তাই অথৈ বানে পিতার আত্মমৈথুনের পেচ্ছাপে তার বয়ে যাওয়া কেবল এক নিষ্পাপ প্রেমিকের স্বীকারোক্তি শুভার প্রতি তার শেষ প্রয়োজন।তাই ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে চায় এক প্রেমিকের পাপতাড়িত কঙ্কাল। এক অসাধারণ সান্ধ্যভাষায় রাঙানো চিত্র প্রেমিক সোহাগ স্বপ্ন গর্ভবতী শ্রীময়ী শুভার আসন্ন প্রস্ফুটিত কুসুম। শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলে ৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমন্ডলীর দিকে।রূপায়নে যেন কোন অন্তরীক্ষের দেবশিশু উন্মোচনে আজ বেজে ওঠে বাউলের দেহযন্ত্র । অন্তিমে বিপর্যয়ে আলোড়িত-হৃদয় এক নিষ্পাপ প্রেমীর । গরীবের দেওয়াল জুড়ে দেখবে কেমনে তোমার প্রতুষ্যের বাসি ওষ্ঠমধুর সঞ্চয় যামিনীর কোলাহল। তাই আরশি থাকার পরেও স্বয়ংদর্শন ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে শুধু প্রেমিকের আত্মসমীক্ষণ--- অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি অনন্তকালের জন্য।

    "মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো"---, এই কবিতায় এক আশ্চর্য উপস্হাপন প্রেমিকসত্তা মলয়ের যা হৃদয়গ্রাহী সংলাপের চৌম্বকীয় আকর্ষণে গ্রথিত করবে মস্তিষ্ক-- এক উচাটন-উন্মাদ শোকে পাঠক তাতে সহজেই যোগসূত্র খুঁজে পাবেন, যদি তাঁর আত্মত্যাগ নিঃস্বার্থ প্রেমের নিমিত্ত হয়। সংসারীর অতৃপ্ত ন্যাকা দেহভাষা নয়। বাউলের দেহবন্দনা । আজ তবে প্রেমালাপে সঙ্গীতময় হোক নগ্ন শরীরে। পুরুষ ঠোঁটে আর নগ্ন দৃষ্টির উন্মাদ প্রেমে কামার্ত শৃঙ্গারে নারী তুমি আভূষিত হও। আর নেশারু হোক অতৃপ্ত প্রেমের আগুন প্রেমিকার দেহরহস্যের জতুগৃহে। কারণ আজ অতিরিক্ত বাচনিক ক্রিয়াজাত অগ্নির উপশম হোক তোমার মাই চটকানো দুগ্ধ পানে ছটফটানি/ অস্থিরতা জাগ্রত হোক নবকল্লোলে প্রেমিকার মুখশ্রীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তোমার ন্যাংটো তন্বী আজ হোক আমার উন্মুক্ত আরশি, স্বর্গসুখ পাই স্বীয় মুখদর্শনে আর এটাই আমার ভ্যালেনটাইন দিনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। ষোলোকলায় উন্মুক্ত বিভঙ্গে আলতা চরণে রমণী তুমি তাই নিঃস্ব আজ আমি ঘুমহীন নৈঃশব্দে যন্ত্রনায় আবদ্ধ এক পাগল প্রেমী যার আজ আত্মধ্বংসের ভ্যালেনটাইন কার্ড বা গিফ্টপ্যাক কাটা মাথার রক্তক্ষরণ। আজ তবে তার উচ্ছন্নে, প্রেমে, শরীর সার্বভৌম নয়, তাই আমি মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো। জঙ্ঘাহীন তাই অনাবৃষ্টির শোক, তবুও তোমার যৌনগন্ধী বেড়ায় আবদ্ধ যোনির হাসিমারা অভয়ারণ্যে আশ্রয় নিক নিষ্পাপ স্কন্ধহীন দামাল পুরুষ প্রেমিক লক্ষ্মীতত্ত্ব জাগাক সে রাতপেঁচার শীৎকারে তুমিও আঙুলে জড়িয়ে তাকে, ঝড় তোলো, বিদ্যুত খেলাও।

    মলয়ের কাটা মাথা তোমার কোলে রেখো, তোমাদের কোলে রেখো--- কিন্তু মৈথুনানন্দে চিত্তপ্রাণ জাগে কপালে।কঙ্কালসার হিম ন্যাংটো শরীর তোমার বিবর্জিত রোমন্থন শীৎকার কি করে আজ সম্ভব তোমার সাথে সঙ্গম, কেবল মাথার সাথে । আমিও নির্বাক সাতপাঁচ ভেবে কাপুরুষ ভীত শামুকের ন্যায় মাথা মাংসল যোনিকেশরে ঢুকে আত্মগোপন করি চন্দ্রাহত ওষ্ঠে। মনে আছে একদিন শতরূপা গৌরচন্দ্রিকায় আমার মুখশ্রীর লাবণ্যে হতদগ্ধ হয়েছিলে তুমি কিশোরী, বলেছিলে চলো পালাই, একসাথে তবেই অমাবস্যার চাঁদে আমাদের প্রেমের মোক্ষ প্রাপ্তি কিন্তু আমি কাপুরুষ ভীতু প্রেমিক কাঙাল তোমার প্রেমে। মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ বইয়ের প্রথম প্যারা আরম্ভ হয়েছে এক যুবতী এক পুরুষের হাত ধরে যখন বলেছিল, ‘চলুন পালাই’। সাহসিকতার মাস্তুলে জমেছে আজ অস্তরাগের বিষাদনৌকা, কেন ভাসাতে পারিনি সেদিন।
    তুমিও শিহরিত, কুন্ডলী পাকিয়ে দাঁতের কর্ষণে চুঁইয়ে পড়তে থাকে উঁচিয়ে থাকা অমৃতদুগ্ধ বোঁটার উষ্ণপ্রসবন সিঙ্গেল মল্ট হাঁ করা মুখে ঢালতে লেগেছো অনর্গল আর ঘামে দরদর করে ভিজে আমিও প্রাচীন পুরুষাঙ্গ বর্জিত ঠোঁটে ডুব দিই অতলান্ত অলকানন্দায়। তাঁর আনন্দ, নৃত্য, গীতিময়তা যেন র‌্যাবেলেস্ক ।

    আমরা জানি মলয় রায়চৌধুরীর প্রিয় পানীয় হল সিঙ্গল মল্ট ও আবসাঁথ । বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, ভেরলেনেরও প্রিয় ছিল আবসাঁথ । স্লিভলেস ব্লাউজ তোমার ভিজে সপসপ অন্তর্বাস আর আমার বাউলসুলভ একা মাথার জরায়ুমুখে গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গের কোন স্কোপ নেই আর। শুধু মস্তকের ঔদ্ধত্ব্যে আজ হতে খুব ইচ্ছা করে জ্যান্ত লকলকে জিব্রাগ্রীবা। উঁকি দিয়ে চতুরঙ্গ কৌশলে কোন লাউডগা উদোম করুক তোমায় আমার জিহ্বায় লুকানো তীক্ষ্ণ করাত। হস্তকরপদ্মহীন তাই রুদালির শোক আলিঙ্গনে লুপ্ত তোমার কষিয়ে বুকে জাপটে ধরার বাহুডোর। আজ তাই হতে চাই নিঃষ্পাপ সন্তান অঙ্গ বিবর্জিত তোমার কৃষ্ণগহ্বরের প্রসবে। আজ না হয় সম্ভ্রান্ত লাবণ্যরসে মাধুর্য আনুক রমণীয় লাস্যে তোমার উন্মোচিত জ্যোৎস্নাময় যোনির গোলাপপাপড়ি তাতেই শুষ্ক ফাঁটা ঠোঁট দিয়ে একটু আদর ঘষি আর তাতেই উদ্গীরন হোক মায়াবী মাদকের সিঙ্গল মল্ট। লিঙ্গকলা উচ্ছেদ তাই আমাকে আর উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না। আজ শুধু সম্রাট- মস্তকে হয়েছি জেহাদি। চোখ মুদে তবুও তোমার কস্তুরী ঘ্রাণের নাভিতে দিতে চাই আহুতি আমার চারুকলার কেশগুচ্ছের ঝিম ধরা মাতলামো। মার্জিত করো আজ আমায় কারণ আজ আমি এমন এক ব্যাধ যান্ত্রিক নখ ও দাঁতের শান দেওয়া অস্ত্রছাড়া তাই অসহায় হয়েছে তোমার হুক।

    "বুড়ি" কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরীর এক আশ্চর্য সৃষ্টি যেখানে বাউলের অন্তিম চরণে মোচড়ানো প্রেমিক হৃদয়ে নিঃস্ব রিক্ততার শূন্যতার যন্ত্রণার সাথে মিলেমিশে একাকার তার বুড়ি স্ত্রীর প্রতি যে নাকি তার দিদিমার বয়সী:-

    এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী
    চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত
    নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে--
    কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি
    ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি
    দিদিমার মতো এরও প্রতিরাতে
    ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে
    কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে
    চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা
    বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়
    দিদিমার মতো, বলেছে মরবে
    যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে
    পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি
    চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না
    পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি
    দামি-দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে
    দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়
    দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ
    এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
    আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
    খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
    বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
    কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়--
    এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
    কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।

    "স্বচ্ছ দেওয়াল” কবিতায়----- একটি লজ্জার দেওয়াল প্রতি কুমারীর অলক্ষ্যে যুগে যুগে অনুরাগের আকাঙ্খায় জেগে থাকে আর তার অধিবাস উন্মুক্ত হয় কোন যৌবনের বান ডাকে। ছিঁড়ে যায় সেই স্বচ্ছ দেওয়াল যার ভাঙা ও ভাঙতে দুটোতেই অনাবিল আনন্দ জেগে ওঠে।কোন আড়াল আর অবশিষ্ট থাকে না দুজনের মাঝে শুধুই এক আসন্ন-আনন্দের নবাঙ্কুরের জন্ম:-

    "দেওয়ালখানা
    বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে
    সেই যুবকের জন্য
    যাকে সে ভাঙতে দেবে
    যুবকেরা তবু গলদঘর্ম হয়

    যে ভাঙছে তারও
    অহমিকা নাচে ঘামে
    রসের নাগর খেতাব মিলেছে
    প্রেমিকের।
    দেওয়ালখানা প্রেমের ঘামেতে ভিজিয়ে ফেলা দরকার।"

    "অবন্তিকার শতনাম" কবিতায় ফিরে এসেছেন আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরী ; দ্রাক্ষাস্তনে একাগ্রচিত্তে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর জপমালা শীর্ণ কায়ার শ্বাসরুদ্ধ নাছোড়বান্দা আলিঙ্গনে শঙ্খিনী আড়মোড়া ভাঙে ভাঁজে ভাঁজে জেগে ওঠে পুরুষোত্তম ব্যাকুল উগ্র নিঃশ্বাসের উৎকোচে চাঁই বাঁধে শঙ্কা কাছ ছাড়া ফুটন্ত দুধে। অবন্তিকাকে একশো নামের ব্যঞ্জনায় জপে জাগ্রত হয় প্রেমিকের সদাজাগ্রত কুন্ডলীচক্র দৈহিক নবরসের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোড়নে শতনামে অবন্তিকা তোমায় খোঁজে। আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া, বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী...বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে,প্যান্টির নাম পিকাসো যোনি তার কোন আদল আদরা নেই।ভগ্নাংঙ্কুরের নাম কোন মিষ্টান্ন দ্রব্য বিশেষ জিহ্বার লালার উৎসেচক।ওষ্ঠের নাম আফ্রিকান সাফারি আর পাছা দুটির নাম গোলাপসুন্দরী। উরুর নাম ককেশিয়া আরো কতক নামের শিরোপার ব্যাঞ্জনায় অবন্তিকার শতনাম মুক্তকন্ঠে জপ করছে কোন প্রেমের তপস্যায় লীন পাগল প্রেমিক।"---এরকম কবিতা কেবল মলয় রায়চৌধুরীই লিখতে পারেন, যা আনন্দের, উদ্দীপনার, প্রেমের, রসমগ্নতার, সহজিয়া, দেহসাধনার গান, মধুস্রাবী, তন্ময়তায় নিবিষ্ট । মধ্যবিত্ত কবিচেতনার বাইরে ।

    "পপির ফুল” কবিতাটিও রহস্যময়---- এই কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী পোস্তগাছের ফুল ও ফল নিয়ে লিখেছেন অথচ তা সান্ধ্যভাষায় । পোস্তফুলের রঙ গোলাপি, ফল সবুজ, আঁচড় দিলে আফিম তৈরি হয়, পেকে গেলে ফেটে পোস্তর বীজ পাই । কিন্তু এই নিষিক্ত প্রেমে অধ্যুষিত পঙক্তিগুলো ছেঁকে তোলে রোমকূপে জেগে ওঠা ফুলেল শয্যার কমফর্ট জোন। নরম অঙ্গুলির পেন্সিলস্কেচে হালকা ছোঁয়ায় আঁচড়ে তন্বী-সঙ্গিনী কবোষ্ণ কব্জি জেঁকে বসে ঘনত্বে চারকোল শেডে রোমকূপে আসক্তি ক্যানভাসে। রামকিঙ্করের স্থাপত্যে সটান এলানো বিবস্ত্র কালীমূর্তি পদমূলে বিছানো তোরঙ্গ বলশালী সুউচ্চ গতর পুরুষালি সিংহনাদে ইজেলে টানা রঙের তৈলচিত্রে মধুদ্রবনে মহাপরিনির্বান। সাতলহরীর ছন্দপতনের ঝংকারে ভার্জিন কলসের জল মুখ ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করে যাও যত চেটে খাও তত নেশায় আদম হয়ে ওঠো। রাতের পোশাকের খোলসের তলায় স্তন দৃঢ়মুষ্ঠিতে পিচ্ছিল দলিত স্তনের গোলাপী রঙে আবিষ্ট বোঁটায় অসমাপ্ত চুম্বন আঁকড়ে ধরে শেষটুকু আবরন চাদরে অবন্তিকা তুই ইরটিক প্রেমের আগার :-
    "বোঁটায় তোর গোলাপ রঙ অবন্তিকা
    শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা
    আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা
    চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা
    টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা"

    "নেভো মোম নেভো” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন লেডি ম্যাকবেথকে নিয়ে ; লেডি ম্যাকবেথ মোমবাতি নিয়ে পাগলের মতো ছুটছেন :-

    "পাছার দু-ঠোঁটে, আহা কি মসৃণ হতো রাজরানি হওয়া, যেন ইস্কাপন
    নষ্ট করে নেচে উঠছে বিদ্যুতের খ্যাতি, যার অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না
    আগুন নগ্নিকা, বুক দুটো অতো ছোটো কেন
    লেডি ম্যাকবেথের লোভ সিংহাসনে রাজমহিষীর মতো উঁচু বুকে
    বসে আছো, স্কুল-ফেরত সম্পূর্ণ উলঙ্গ তুমি হাঁটছো পাশাপাশি
    তেমন নারীও, আত্মজীবনীতে লিখবেন কিন্তু প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাহা
    ক্লিটোরিসে অঙ্গুলিবাজনার মৃদু উগরে-তোলা ঝর্ণাঝংকার।"

    "রাবণের চোখ” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন কুলসুম আপাকে নিয়ে । তাঁর আত্মজীবনীতে আমরা জেনেছি কৈশোরে মলয় রায়চৌধুরী তাঁদের বাড়িতে হাসের ডিম কিনতে যেতেন । কুলসুম আপা তাঁকে মাংস খাইয়ে বশ করে একদিন রেপ করেছিলেন, কবিতাটির পৃষ্ঠভূমি পাঠক যদি জানতে না পারেন তাহলে এই কবিতার ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন না :-
    শৈশবের কথা । সদ্যপ্রসূত কালো ছাগলির গা থেকে
    রক্ত-ক্বাথ পুঁছে দিতে-দিতে বলেছিল কুলসুম আপা
    ‘এভাবেই প্রাণ আসে পৃথিবীতে ; আমরাও এসেছি
    একইভাবে’ । হাঁস-মুরগির ঘরে নিয়ে গিয়ে আপা
    আমার বাঁ-হাতখানা নিজের তপ্ত তুরুপে চেপে
    বলেছিল, ‘মানুষ জন্মায় এই সিন্দুকের ডালা খুলে’ ।
    রাবণের দশজোড়া চোখে আমি ও-সিন্দুক
    আতঙ্কিত রুদ্ধশ্বাসে দ্রুত খুলে বন্ধ করে দিই ।

    "জ্যামিতির উৎস” কবিতায় মহালয়ায় বীরেন ভদ্রর চণ্ডীপাঠকে দূর্গার পরিবর্তে দেবী অবন্তিকার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী । সৃষ্টির রহস্যের উন্মোচনে বাউল-প্রেমিকের সংলাপে। সিকোয়েন্স এ সৃষ্টিকর্তাদের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে অনুভবকে আঙ্গিক দিয়েছে প্রেমিকার শরীরের প্রতি আঁকে বাঁকে অপরূপা তিলোত্তমার সৃষ্টি। অবন্তিকাই কবিতা, তাঁর নিজের কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন মলয় এই কবিতায়:-

    অবন্তিকা বললি তুই :
    নৌকো মাতাল হতে যাবে কেন ? এ-যুগে সমুদ্রটা নিজেই মাতাল !
    আমি বললুম :
    যত জ্যামিতি কি শুধু তোরই দখলে ? কার কাছ থেকে পেলি ?
    অবন্তিকা বললি তুই:
    আর্কিমিডিস দিলেন দেহের ঘনত্ব !
    রেনে দেকার্তে দিলেন শরীরের বাঁকগুলো !
    ইউক্লিড দিলেন গোপন ত্রিভূজ !
    লোবাচোভস্কি দিলেন সমন্বিত আদল !
    ব্রহ্মগুপ্ত দিলেন মাংসময় বুকের নিখুঁত বর্তুলতা!
    শ্রীধর দিলেন আয়তন !
    নারায়ণ পণ্ডিত দিলেন দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা !
    আর তুই কী দিলি ? অক্ষরে সাজানো যত ফাঁকা মন্তর ?
    আমি বললুম :
    আমি দিয়েছি প্রেম !
    অবন্তিকা তুই বললি :
    প্রেম তো আলো হয়ে বেগে আসে আর তত বেগে চলে যায় !

    সাম্প্রতিক কালে মলয় রায়চৌধুরী নিজের কবিতাকে বলেছেন ডোমনি ; বাউল মলয়ের কাছে কবিতাই তাঁর দয়াল, মলয় স্বয়ং একজন সাঁই । এই কবিতার নাম ‘মলয় সাঁইয়ের গান’:-

    ডোমনি, তুইই দয়াল, কালো জাগুয়ার চামড়ায় মোড়া দেহ তোর
    দু'জনে ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে যা শিখেছি তা পশুসঙ্গের মহাবোধ
    ডোমনি, তুইই দয়াল, ঘামের ত্বকে মোড়া বিকেলের পাঁকবিলাসিনী
    পুলিশের গুলি খেয়ে কিশোরী বয়সে তুই খোঁড়া হয়ে গেলি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, মেছুনির হাজা-হাত, কাগজকুড়ানিয়াফাটল-গোড়ালি
    কী করে মগজে নিয়ে যাবো সুষুম্নার মুখে ইড়ার রাস্তায় জড়ো করা বীজ
    ডোমনি, তুইই দয়াল, বন্দু ধারণের যোগ্য করে তুলবি কবে
    দম নেবো আর ছাড়ব না দঞ যাতে কুম্ভকে থাকি বহুক্ষণ
    ডোমনি, তুইই দয়াল, পচা মাংসের গন্ধ তোর মুখে, ঠোঁটেতে কাকের রক্ত
    তোর লবণামৃতে সকাল-সন্ধে চান করিয়ে পাপিষ্ঠ করে তুলবি আমাকে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, শ্রেনিহীন করে দিস, আমিশাষী রসে
    নাভিচক্রে কাতুকুতু থিতু করে আসক্তির স্বর্ণলতা দিয়ে মুড়ে দিস
    ডোমনি, তুইই দয়াল, বলে দে কেমন করে কুণ্ডলনী চক্র জেগে যাবে
    তর্জনীতে অষ্টগুণ ধরে রাখবার ক্রিয়া তোয়াক্কাবিহীন করে দিবি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, আমাকে যথেচ্ছাচারী মূর্খ করে তোল
    নিরক্ষর হয়ে যেতে চাই, অশুদ্ধচিত্ত, নির্বোধ, কমলকুলিশ
    ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত ধরাধরি করে ডুব দিই বিষ্ঠার পাঁকে

    “মলয়দাস বাউলের দেহতত্ব” কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী আধুনিক জীবনের কর্মব্যস্ত নারীদের বাউল-সঙ্গিনীর আসনে বসিয়েছেন, কবিতা হয়ে উঠেছে অধুনান্তিক, উত্তরাধুনিক, প্রেমিকার প্রয়োজনও উত্তরাধুনিক দেহবন্দনার গুপিযন্ত্র :-
    ডোমনি, তুইই দয়াল, যখন বিদেশে যাস কেন রে আনিস কিনে সেক্সটয় ?
    ভাইব্রেটর, ডিলডো, বেন-ওয়া-বল, গুহ্যের মুক্তমালা ?
    ডোমনি, তুইই দয়াল,জানি কেন বিডিএসএম কবিতার বই এনেছিস,
    জি-বিন্দু হিটাচির ম্যাজিকের ছড়ি ? নিপল টিপে কাঁপাবার ক্লিপ ?
    ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত-পায়ে দড়ি চোখে ঠুলি আমাকে চেয়ারে
    উলঙ্গ বেঁধে রেখে দিয়েছিস, নিজের ফাঁস খুলে তলাতল রক্তের স্বাদটুকু দিলি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, শুদ্ধ প্রেমে মজল যারা কাম-রতিকে রাখলে কোথায়
    চাবুক মারিস তুই, চুলের মুঠি ধরে ক্ষিরোদধারাকে চুষে বের করে নিস
    ডোমনি, তুইই দয়াল, চাতক স্বভাব নাহলে অমৃতের দুধ তুই দিবিনাকো
    আমার খিদে নেই, মুখের ভেতরে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ খেয়ে মজে গেছি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, যতো ইচ্ছে আনন্দ কর, দেহ নিয়ে খেল
    আমি একটুও নড়ব না, আহ উহ করব না, যতো চাই ধাতুবীজ নিস

    পরিশেষে বলি, মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতার পর্যালোচনার বিশ্লেষণে এইকথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে প্রত্যেকটি সৃষ্টিতে চাক্ষুষমান এক পজিটিভ ইরটিসিজম, এক বেপরোয়া উন্মাদ প্রেমের রসানুভূতি, যাতে তাঁর প্রেয়সীর আঙ্গিক মাধুর্যে চিত্রিত হয়, মধুবনীপটের সান্ধ্যভাষায় রঙীন লৈখিক-চিত্রে বর্ণিল হয়ে ওঠে পাঠক-পাঠিকার মনের ও দেহের জগত ।
  • uttaran dasgupta | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:১৮541347
  • উত্তরণ দাশগুপ্ত : পাটনায় মলয়, সমীর এবং গিন্সবার্গ
    ‘কিল ইয়োর ডারলিংস’ ফিল্মে হ্যারি পটার খ্যাত ড্যান র‌্যাডক্লিফ অ্যালেন গিন্সবার্গের অভিনয় করেছিলেন এবং ‘অন দি রোড’ ফিল্মে স্যাল প্যারাডাইস অভিনয় করেছিলেন জ্যাক কেরুয়াকের ভূমিকায়-- যার দরুন বিট আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে সাম্প্রতিককালে --- নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যিকবৃন্দ । কিন্তু দুটি ফিল্মই তাঁদের ভারতে বসবাসের অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান করেনি ।
    গ্যারি স্নাইডার এবং তাঁর স্ত্রী জোয়ানে কাইজারের দেখাদেখি, মার্কিন বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর প্রেমিক পিটার অরলভস্কির সঙ্গে মুম্বাইতে এসে পৌঁছোন ১৯৬২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি । উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াবার সময়ে তাঁরা কিছুকাল পাটনাতেও ছিলেন, দুই কবির বাড়িতে -- তাঁরা হলেন মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরী ।
    মলয়, বর্তমান সময়ের একজন আইকনিক কবি, ২০০৩ সালে তাঁকে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে পাটনা থেকে তিনি সমীর এবং আরও দুজন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়কে নিয়ে হাংরি জেনারেশন সাহিত্য ও শিল্পের আন্দোলন আরম্ভ করেন । আন্দোলনটি ক্রমে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের আরও শিল্পী, লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের দলে টেনে নিয়েছিল ।
    মলয় এখন মুম্বাইতে থাকেন এবং সমীর কলকাতায় গিয়ে ‘হাওয়া৪৯’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন ।
    পাটনার স্মৃতিচারণ করার সময়ে সমীর ( ৭৯ ) বলেছিলেন যে, “আমার একজন বন্ধু ছিল ঘোড়ার গাড়ির চালক । তার সঙ্গে বসে ঠররা ( বাংলা চোলাই ) খেতুম । একবার ঠররা খাবার আড্ডায় ও আমাকে বলেছিল ওর বড়োলোক হওয়ার গল্প ।”
    দ্বারভাঙ্গার মাহারাজার প্রাসাদের আসবাব নিলাম হচ্ছিল । আমার বন্ধু সেই নিলাম থেকে সস্তায় একটা ঘোড়ার গাড়ি কিনেছিল । গাড়িটা মেরামত করার সময়ে ও দেখল যে বসবার কুশনের ভেতরে দামি-দামি জহরত লুকোনো রয়েছে । ও জহরতগুলো বিক্রি করে রটিয়ে দিয়েছিল যে লটারি জিতেছে, আর তাইতে অনেক টাকা পেয়েছে ।
    সমীরের সঙ্গে গিন্সবার্গের প্রথম দেখা হয় ঝাড়খণ্ডের চাইবাসায়, তখন সেটা ছোট্টো গ্রাম ছিল । “আমার ঘরে অসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা ‘দি ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট’ বইটা দেখে ও জানতে চাইলো, সমীর, তুমি এই বইটা পড়েছ ? হামি উত্তরে বললুম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই । বইটার মার্জিনে দ্যাখো । আমার আর মলয়ের নোটস দেখতে পাবে।”
    স্পেংলারের দর্শনে প্রেরণা পেয়ে মলয় তাঁর আন্দোলনের পরিকল্পনাভূমি তৈরি করেছিলেন । ‘হাংরি’ শব্দ পেয়েছিলেন জিওফ্রে চসারের In the sowre hungry tyme পঙক্তি থেকে ।
    বিহারের বিভিন্ন বৌদ্ধধর্মের তীর্থস্হানগুলো ঘোরার সময়ে এপ্রিল ১৯৬৩ সালে গিন্সবার্গ পাটনায় রায়চৌধুরীদের দরিয়াপুরের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন ।
    সমীর বললেন, “একদিন আমার মে দেখলেন উঠোনে স্নানের জায়গায় উলঙ্গ হয়ে স্নান করছেন গিন্সবার্গ ।”
    “মা আমাব জিগ্যেস করলেন, ‘ও অমন করে চান করছে কেন ?’ আমি বললুম ওইভাবেই ওরা নিজেদের দেশে চান করে । মায়ের ভালো লাগেনি শুনে । উনি ওপর থেকে দুটো তোয়ালে ফেলে দিলেন গিন্সবার্গের ওপর, আর বাংলায় বললেন, ‘খোকা, নিজেকে ঢেকে নাও আর এই তোয়ালে দিয়ে গা পোঁছো।’”
    হাংরি আন্দোলনের কবি এবং লেখকরা দেখছিলেন প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির সীমানাগুলোকে লঙ্ঘন করার তাঁদের যে প্রয়াস তা সমসাময়িক সমাজ কতটা সহ্য করতে পারে ।
    ১৯৬৩ সালে আন্দোন যখন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেচে সেসময়ে তাঁরা জীবজন্তু, দানব, জোকার আর কার্টুন চরিত্রের মুখোশ পাঠিয়েছিলেন খ্যাতনামা ও প্রভাবশালী লোকেদের । মুখোশের ওপরে ছাপানো বার্তা ছিল, ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন” -- হাংরি জেনারেশনের পক্ষ থেকে ।”
    ১৯৬৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর যেন নরক গুলজার হলো ! মলয়, সমীর, দেবী রায় এবং তাঁদের দুই সহযোগী সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষকে সাহিত্যে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল । মলয়ের ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির জন্য নিম্ন আদালতে সাজা হয়েছিল । পরে ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট তাঁর সাজা নাকচ করেন ।
    মলয় কিন্তু এখনও প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেন । তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে যে, কেন তিনি সাহিত্য অকাদেমি অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাখ্যান করলেন, উত্তরে মলয় বলেছিলেন, “আমি কোনো সাহিত্য পুরস্কার নিই না, কেননা যে সংস্হা পুরস্কার দেয় সে তার মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয় পুরস্কারের সঙ্গে।”
    হাংরি আন্দোলনের ওপর গিন্সবার্গের প্রভাব এবং গিন্সবার্গের ওপর হাংরি আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে । মলয় এবং সমীর দাবি করেছেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরাই গিন্সবার্গকে তিনটি মাছের একটি মাথার প্রতীকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে গিন্সবার্গের ব্যক্তিগত মোটিফ হিসাবে এবং ‘ইনডিয়ান জার্নালসসহ ( ১৯৭০ ) তাঁর অন্যান্য বইতে ব্যবহৃত হয়েছে । মলয় বলেছিলেন যে গিন্সবার্গ ওই প্রতীক পেয়েছিলেন আকবরের সিকান্দ্রার সমাধি থেকে এবং পাটনার খুদাবক্স ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ফারসি বই ‘দীন-ই-ইলাহি’র চামড়ায় বাঁধানো প্রচ্ছদ থেকে ।
    নিজের ‘ইনডিয়ান জার্নালস’ বইতে গিন্সবার্গ এই বিষয়ে উল্লেখ করেননি । কিন্তু ভারতে তাঁর আগমন বহু ইউরোপীয় ও আমেরিকানের মনে আগ্রহের সঞ্চার করেছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বিটলস গায়কদের দল ।
    .
  • nayanima basu | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:২০541348
  • নয়নিমা বসু
    হাংরি আন্দোলন ও পচনরত কালখণ্ড
    পশ্চিমবাংলার দেশভাগোত্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন কালখণ্ড এক নতুন প্রতিবাদী সাহিত্যের জন্ম দিয়েছিল । মলয় রায়চৌধুরী যিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টাদের অন্যতম তিনি পঞ্চাশ বছর পর আমার সঙ্গে এই আন্দোলনের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করলেন ।
    “একটি সংস্কৃতির অবসানের সময়ে সেই সমাজের মানুষ যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে”, মুম্বাইয়ের কাণ্ডিভালির একঘরের ফ্ল্যাটে বসে চিন্তারত মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “আজকে যখন পশ্চিমবাংলার দিকে পেছন ফিরে তাকাই তখন হাংরি আন্দোলনের পূর্বাশঙ্কাকে ভবিষ্যবাণীর মতন মনে হয়।”
    মলয় রায়চৌধুরী, এখন ৭২ বছর বয়স, যিনি প্রথম থেকেই ছিলেন প্রতিবাদী সাহিত্যিক, নভেম্বর ১৯৬১ সালে আভাঁগার্দ সাহিত্য আন্দোলন হাংরি জেনারেশন আরম্ভ করেছিলেন । সেই আন্দোলন সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং ভদ্রলোক বঙ্গ সমাজের কটু সমালোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল । হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের প্রথাবাহিত মৌল তর্কবিন্দুগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল ।
    সেই সময়ে কলকাতা, যাকে তখন বলা হতো ক্যালকাটা, অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। দেশভাগের সর্বনাশা কারণে উৎখাত মানুষদের ভয়াবহ স্রোত বদলে দিচ্ছিল কলকাতা শহর ও তার আশেপাশের শহরতলি অঞ্চলকে । দেশভাগের আগে থেকেই আতঙ্কিত মানুষেরা পশ্চিমবাংলায় আসা আরম্ভ করেছিল এবং তা ষাটের দশকে এবং তার পরেও বহুকাল বজায় ছিল । ১৯৫৯ পর্যন্ত বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে গিয়েছিল, এমনকি ভিটে ছাড়ার সময়ে খুন হয়েছিল । যুবসমাজের একটা অংশ এই সর্বনাশকে সহ্য করতে অপারগ ছিল । তাদের মনে হয়েছিল যে ভারতের কংগ্রেস পার্টির নেতারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা পরিণত হয়েছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে । নিজেদের ক্রোধকে প্রকাশ করার জন্য কয়েকজন তরুণ আরম্ভ করলেন হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলন, যা হাংরি জেনারেশন নামে খ্যাত ।
    সাক্ষাৎকারে মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “১৯৫৯-৬০ সালের পশ্চিমবঙ্গ পৌঁছে গিয়েছিল পচনের টকে যাওয়া কালখণ্ডে ; আমার বয়সী যুবকেরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এই সময়ে সমাজের প্রভাবশালী ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছিল বুদ্ধিজীবীদের, যে ক্ষমতাবিন্যাস ততদিনে দখল করে নিয়েছিল রাজনীতিকদের দল, যারা বেশির ভাগই ছিল কানা গলির ব্যক্তিএকক । পশ্চিমবাংলাকে ছেয়ে ফেলেছিল পার্টিশানের ঝোড়ো তরঙ্গ । আমার মানসিক অবস্হা কবিতা লেখার পরিবর্তে এই পচনের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল । ফলে আমরা পরামর্শ করে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করতে বাধ্য হলুম ।”
    মলয় রায়চৌধুরী এই আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী এবং আরও দু’জন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়ের সঙ্গে । তিনি ‘হাংরি’ ধারনা পেয়েছিলেন মধ্যযুগের ইংরাজ কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ পঙক্তি থেকে । এই চারজন বাঙালি কবি মিলে হাংরি বুলেটিন ও ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করতে লাগলেন আর তা বিলি করা আরম্ভ করলেন কলকাতার বিখ্যাত কফিহাউসে, সরকারি অফিসে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদপত্র দপতরে ।
    রায়চৌধুরী ভাতৃদ্বয় দ্বারা আরম্ভ-করা এই আন্দোলনের কোনো দপতর, হাইকমাণ্ড বা পলিটব্যুরো ধরণের কেন্দ্র ছিল না এবং এর সদস্যরা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে কোনো রচনা লিখে নিজেরা প্রকাশ করতে পারতেন । মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “হাংরি আন্দোলনের আগে আর কোনো এরকম সামাজিক-রাজনৈতিক সাহিত্য আন্দোলন হয়নি। তাছাড়া আমরা আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলুম। বহু যুবক লেখক ও চিত্রশিল্পী আন্দোলনে যোগ দেয়া আরম্ভ করলেন । সরকার যখন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ আরম্ভ করল, ততদিনে তিরিশ জনের বেশি সদস্য হয়ে গিয়েছিল।”
    মলয় রায়চৌধুরী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছিলেন । বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীর কারণে, যিনি কলেজে পড়ার জন্য পাটনা থেকে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন এবং আদি নিবাস উত্তরপাড়ায় সেসময়ে থাকতেন ।
    প্রশাসনের দৃষ্টি হাংরি আন্দোলনকারীরা সেই সময়ে আকর্ষণ করলেন যখন তাঁরা ক্ষমতাধিকারীদের, বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের, আমলাদের এবং সংবাদপত্রের মালিকদের জোকার, দানব, দেবী-দেবতা, রাক্ষস, কার্টুন ইত্যাদির কাগজের মুখোশ পাঠিয়ে জানালেন “দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন।”
    ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ এগারোজন হাংরি কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো । তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সাহিত্যে অশ্লীলতা । মূল অভিযোগ ছিল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় অশ্লীলতার জন্য, ইংরেজিতে ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ নামে অনুদিত ।
    আদালতে মামলা বেশ কয়েক বছর যাবত চলল । তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার সংবাদ ৪ নভেম্বর ১৯৬৪ টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল এবং তার ফলে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল । ওক্তাভিও পাজ, আর্নেস্টো কার্ডেনাল প্রমুখের মতন কবি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করলেন । বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গও মলয় রায়চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছিলেন । এর ফলে ভুল ধারনা প্রচারিত হয়েছিল যে হাংরি আন্দোলনকারীরা বিট আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ।
    মলয় রায়চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারে জানালেন, “প্রচারের দরুন আমার কবিতা ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে সেখানকার লিটল ম্যাগাজিনগুলোয় প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হলো । নিউ ইয়র্কের সেইন্ট মার্কস চার্চে আমার কবিতার পাঠ-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হয়েছিল মামলার খরচ তোলার জন্য । এই সাহায্যগুলো ছাড়া হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা লড়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না । আমার আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না । বেশিরভাগ হাংরি বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন । আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হলুম, আমার জেলহাজতের সংবাদে আমার ঠাকুমা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন । আমি সাময়িকভাবে লেখালিখি ছেড়ে দিলুম।”
    মলয় রায়চৌধুরী আরও বললেন যে, পরবর্তী নকশাল আন্দোলনের কারণে হাংরি আন্দোলন এক প্রকার আড়ালে চলে গিয়েছিল, যদিও নকশালরা সেরকমভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখালিখি করেননি ।
    শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিকদের সহযোগীতায় এবং পরিবারের সমর্থনে মলয় রায়চৌধুরী মামলায় জিতে যান। কিন্তু ততদিনে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল । বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হিন্দি ভাষায় ( ভুখি পীঢ়ী এবং হাংরি জেনারেশন হিসাবে খ্যাত ) এই আন্দোলন সম্পর্কে বৃহত্তর জনগণ বিশেষ জানেন না এবং বিষয়টি বুঝতে পারেন না ।
    মলয় রায়চৌধুরী বললেন যে, “আমি মনে করিনা হাংরি আন্দোলন বিফল হয়েছিল ; সরকার এই আন্দোলনকে দাবিয়ে দিয়েছিল । এই আন্দোলন আরও বহু ভারতীয় ভাষায় ছড়িয়ে পড়ছিল এবং সেই সময়ে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে বাধার সৃষ্টি করেছিল । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে নেতার পদ দেয়া হয়েছিল, তিনি ১৯৬৩ সালে আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন আর আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন । কয়েকজন, যাঁরা উদবাস্তু পরিবার থেকে এসেছিলেন, ভয়ে আন্দোলন ছেড়ে চলে গেলেন, কেনা তাঁরা জানতে পেরে গিয়েছিলেন যে সরকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে চলেছে । কয়েকজনকে সিপিএম এবং অন্যান্য বামপন্হী দল লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল ( যেমন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ প্রমুখ )।”
    ১৯৬৮ সালে মলয় রায়চৌধুরী সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন, যিনি রাজ্য স্তরের ফিল্ড হকি খেলোয়াড় ছিলেন । আদালতে মামলা জিতে যাবার পর মলয় লখনউতে এআরডিসিতে যোগ দেন । মলয় এ-পর্যন্ত সত্তরটির বেশি বই লিখেছেন, সবই ছোটো প্রকাশকদের দ্বারা প্রকাশিত - প্রচুর পাঠক থাকা সত্ত্বেও বড়ো প্রকাশকরা আগ্রহ দেখান না । দুই বার হার্ট অ্যাটাকের পর এবং অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি ও আরথ্রাইটিসের কারণে মলয় কলম ধরে লিখতে পারেন না, কমপিউটারে টাইপ করে লেখেন ।
    মলয় রায়চৌধুরী বললেন, “তরুণরা প্রায়ই আমাকে অনুরোধ করেন আবার হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করার জন্য । আমি তাঁদের বলি নিজেদের সময় ও পরিসরকে নিজেরা বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে এবং নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম গড়ে নিতে ।”
    ঋণস্বীকার : বিজনেস স্ট্যাণ্ডার্ড
    ২১ জানুয়ারি, ২০১৩
  • pritha | 012312.60.90012.13 | ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৯:২২541350
  • পৃথা রায় চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা
    বিতর্ককে নস্যাৎ করে কজন হয়ে উঠেছেন নিজস্ব ঘরানার ব্র্যান্ড নেম? বিতর্ককে কবচকুন্ডল করেই আজও তিনি সোজা কথায় বলেন,
    “একাই লড়েছিলুম।
    কেউ বলেনি ‘হোক কলরব’।
    একাই নেমেছিলুম ব্যাংকশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে।
    সেদিন একাই ঘুরেছিলুম কলকাতার পথে সকাল পর্যন্ত।”
    তাই তো তিনি হাজার কোটি মেকিদের থেকে এতটা ওপরে। একাই লড়েছেন আর জিতে গেছেন, আমাদের অনেকেরই ক্ষমতা নেই এভাবে রুখে দাঁড়াবার। নিজের প্রতি, নিজের কবিতার প্রতি সৎ থাকতে তিনিই পেরেছিলেন, পেরেছিলেন নির্দ্বিধায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি সহ বহু পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে।
    “আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য, সাবর্ণ গোত্রের যোদ্ধা
    আজ পর্যন্ত কেউ তরোয়াল চালানোয় আমাকে হারাতে পারেনি
    কতো মুণ্ড এক কোপে ধরাশায়ী করেছি তার গোনাগুন্তি নেই
    আমার বংশধরেরা তাই করবে একদিন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে--
    ঘোড়ার পিঠে বসে চালাবে তরোবারি, যারাই সামনে আসবে মূর্খ মুণ্ড
    গলা থেকে কেটে ফেলবে ধুলায়, সেসব মুণ্ড বেঁচে থাকবে, কথা বলবে
    দরবারে গিয়ে যে-যার লেজটি নাড়িয়ে রাজা বা রানির সেবাদাস হয়ে
    সারটা জীবনভর ঘেউ-ঘেউ করে ক্রমে-ক্রমে জীবাশ্মের রূপ নেবে”
    লাইন কটা তুলে নিয়েছি ‘আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য’ কবিতা থেকে, শিহরিত হয়েছি বারবার এই কবিতা পড়ে, মনে-মনে বলেছি, “যথার্থ ! যথার্থ বলেছো মলয় রায়চৌধুরী, নিজের বংশগৌরবে গৌরবান্বিত তুমি। সেই আপোষহীন উচ্চশির লক্ষ্মীকান্তের বংশধর তুমি… সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের ৩৪তম উত্তরপুরুষ, প্রতি পদে রয়েছো আপোষহীন, নির্ভীক।” ১৬ই জুলাই, ২০১৭ এই কবিতা আমি পড়ি ফেসবুকেই ওঁর পোস্টে। কবিতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতি শব্দে, ছত্রে আর আমাকে বলেছে, "চিনে নে!" এই কবিতায় কিন্তু আমরা কবির ভেতর দিয়েই মানুষটাকেও দেখতে পাচ্ছি, চিরকালের প্রাতিষ্ঠানিকতায় মাখানো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠা, একা লড়াকু মানুষটা, যার হাতের কলম বরাবর তরোয়ালের মতোই ঝলসে উঠেছে, ফালাফালা করে দিয়েছে যা কিছু বস্তাপচা।
    না, এখানে মানুষ মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে মোটেই আলোচনা করতে বসিনি, সেই স্পর্ধা আমার নেই, মনে-মনে কেবল এই ভেবে গর্বিত হই, এই মহান কবি, সম্পর্কে আমার জ্যাঠাশ্বশুর হন, আর এঁর লেখা পড়ে পড়ে শিউরে উঠি কেবল। নিজে যেহেতু কবিতা লিখি, তাই বিশেষ করে পড়ে ফেলি ওঁর কবিতা, বুঝি, কতটা আপাতসরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে উনি নিংড়ে বার করে আনেন মানুষের ভেতরের সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, জটিল ভাবনা বা চলতে থাকা নানান সংঘাত। বসেছি ওনার কবিতা সম্পর্কে সামান্য দুকলম লিখতে, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে যেন মনে হচ্ছে কবি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার সামনে আমরা সকলে এতোটাই হীন, যে তাঁর সব কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা তো করতে পারি, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়ায় সুউচ্চ পর্বতের নীচে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে পর্বতশৃঙ্গের ভয়াল সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করার সমতুল্য।
    কবি তাঁর বহু বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ অশ্লীলতার দায়ে কারাবাস করেন, এ কথা সাহিত্য জগতের প্রতিটি মানুষ জানেন, এই কবিতা নিয়ে আজও প্রতিনিয়ত সাহিত্য সংক্রান্ত গবেষণা করা হয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও। যা এককালে কবিকে অপমানজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছিল, তা এখন একপ্রকার কিংবদন্তী। বড়ো বেশি শরীরধর্মী, যৌনতার আঁশটে ভাষায় লেখা এই কবিতা পড়ে আপাতভাবে শ্লীল সমাজ চোখে-মনে কাপড় বেঁধে গান্ধারী হয়ে যান আজও, অথচ কবিতাটির ভেতর যে চরম যন্ত্রণার প্রকাশ, তা বুঝে নিতে পারলে, এই কবিতা হয়ে ওঠে অমৃত, আপাত অশ্লীল ভাষ্যের গরল মন্থন করে পাঠক পেয়ে যান অমৃত। যন্ত্রণা অপরিসীম, কবিতাটির নিচের কটি লাইনে…
    “প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
    শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
    মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
    তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
    কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না”
    আবার কতটা তীব্র ব্যথা অনুভব হলে কবি এমন অস্থির ভাবে লিখতে পারেন,
    “আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
    মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
    তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
    শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”…
    পাঠক ঢুকে যান কবিতার ছত্রে ছত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কি মারাত্মক আঘাত করেছেন কবি প্রতিষ্ঠানকে, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন চাঁদ-তারা-নদী-তুমি আমি-ফল্গুধারা কাব্যভাষাকে। আর এই প্রচণ্ড বেগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসা কর্কশ সপাট কবিতাকে হজম করে নিতে তখনও বহু মানুষ পারেননি, আজও পারেননা, বলাই বাহুল্য।
    ঝলসে দেওয়া কবিতার কণ্ঠ তাঁর হয়তো ছোটবেলার অস্বাচ্ছন্দের জন্য বেড়ে ওঠা ক্ষোভ বিদ্রোহ ভরা বুকের একেবারে ভেতরের অনুভূতির জন্য। আবার এই কবিই ‘আমার জন্মদিন নেই’ কবিতায় লিখে ফেলেন,
    “ঠাকুমা কবে জেঠা আর বাবাকে প্রসব করেছিলেন
    তার তিথি ঠাকুমা জানেন
    প্রসবদিন পালনের তো কোনো রেওয়াজ নেই
    তাই মা আমাকে কোন তিথিতে প্রসব করেছিলেন জানি
    মায়ের কষ্টের গল্প জানি
    হাসপাতালে ভর্তির গল্প জানি
    কিন্তু আমার জন্মদিন জানি না”...
    সাধারণ পাঠক আমি, কবির অন্তরাত্মা ছুঁয়ে বলি, এতটাও নরম ভাব এই রুক্ষ জমিতে থাকে ! কেবল বারুদ আর লাভা নিয়ে যে কবির বিচরণ, তার ভেতরের প্রকৃত মানুষ হৃদয় কেই বা সহজে বুঝেছে!
    পাঠক যেন ক্রমাগত তড়িদাহত হতে থাকেন তাঁর বিজলীসম কবিতায়। কবির তাৎক্ষনিক মনের ভাব, চঞ্চলতা তিনি প্রকাশ করেন ভিন্ন ভিন্ন থিমের কবিতায়। আবার এই তিনিই ‘নখ কাটা ও প্রেম’ কবিতায় হঠাৎ লিখে ফেলেন, বলা ভালো প্রশ্ন করে বসেন,
    “রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :
    কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন--
    সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?”
    ভাবা যায়? নেকুপুষু প্রেমের কবিতা লিখে তুলতুলে ভাব ভাগ্যিস তিনি তাঁর কবিতায় আনেননি। বরাবর প্রথাভাঙ্গার নিদর্শন হয়েছে তাঁর প্রায় প্রতিটা কবিতা। কি অসামান্য প্রেম দেখিয়েছেন তিনি তাঁর ‘বুড়ি’ কবিতায়। গভীর প্রেম এই কবিতায়।
    “এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
    আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
    খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
    বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
    কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়--
    এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
    কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।“
    মন খারাপ করে, গলায় ব্যথা ব্যথা কষ্ট হয়, অথচ কি চরম প্রেম ! গভীর অনুভূতি, পরম ভরসা ফুটে ওঠে, প্রতি ছত্রে। বিষাদেরও যে এমন মিঠে সোয়াদ, তা বোধহয় এই কবিতা পড়লে তবেই বোঝা যায়। এ যেমন একাধারে প্রেমের কবিতা, তারই সাথে এ চিরশাশ্বত মৃত্যুচেতনার কবিতা। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, এই এত আঁকড়ে থাকা, এত ভালোবাসা, এত জীবন-প্রাচুর্যের মাঝেও মৃত্যুচেতনা কতটা ঘিরে রাখে আমাদের অবচেতন।
    মলয় রায়চৌধুরীর দাদা অর্থাৎ স্বর্গত সমীর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পরের দিন লেখা কবির যে কবিতা, ‘সেন্স অফ লস' এর স্তবগান, তা যেন পাঠককে কবির জায়গায় বসিয়ে দেয়,
    “কাল বাইশে জুন, ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন
    দাদা সমীর রায়চৌধুরী”…………
    “কাল, বাইশে জুন ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন
    দাদা মানে মিনু”
    কবিতার প্রথম লাইন কবিতার মাঝামাঝি আবার ফিরে এসেছে। প্রথম লাইনের পরে এসেছে প্রয়াত দাদার পোশাকি নাম, আর মাঝখানে এসেছে দাদার ডাকনাম। এইভাবে একই লাইনের ব্যবহারে, অথচ দুবার দুরকম নামের ব্যবহারে আমরা আসল ,সেন্স অফ লস, বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কতটা জড়িয়ে রাখেন কবি তাঁর সদ্যপ্রয়াত দাদার স্মৃতি, কতটা হারাবার বোধ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে কবির কাছে।
    “চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন
    দুঃখ-কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি
    হাতের রেখার ওপর দিয়ে গ্রামোফোনের পিন চালিয়ে জেনে নিচ্ছি আমার ভবিষ্যত”
    হাংরি জেনারেশানের পুরোধা কবির নিজের বিশেষ প্রিয় কবিতা ‘জখম’ ( ১৯৬৫ ) থেকে নেওয়া এই কটা লাইনে দ্রিম দ্রিম করে শুরুয়াতি সুর শোনা যায় এক অনন্ত ক্ষুব্ধ আহত অস্থির কণ্ঠের কবিতার। জখম ভর্তি কবি হৃদয় থেকেই কাব্যধারায় বেরিয়ে আসে এই অনন্ত শোণিতাভ দীর্ঘ কবিতা, কবিতায় বারবার প্রয়োগ হয়েছে তাঁর নিরীক্ষার বিশেষ বানানরীতি...
    “বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
    এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে মলয়ে কঙ্কাল জ্বালানো ধোঁয়ায়
    আশপাশ দিয়ে ঘণ্টায় ৯৯ কিলোমিটার দরে উড়ে যাচ্ছে বদমতলব ঝড়
    কব্জিতে ঘড়ির কাঁটা রেখে চলে যাচ্ছে সারসার সমদ্বিঠ্যাঙ মানুষের লাভলোক্সানময় দল”
    আবার কি অনায়াস উচ্চারণে কবি তাঁর লেখা অবিস্মরণীয় ছত্রগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সময়ে সময়ে...
    “armature on the left turned slag long ago
    now eyeflesh twitching in the smoke of malay's burning
    skeleton
    dismantled tempests sweep by at 99mph
    uniform queues of wristwatched zombies tattle”
    রাজনৈতিক বা তৎকালীন সাম্প্রদায়িক যতো অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা যেন ফুটে ওঠে এই জখম ভর্তি কবিতায়। যা তখন সত্যি ছিল, তা আজও চরম প্রাসঙ্গিক। তাই এটুকু বলাই যায়, কবি মলয় রায়চৌধুরী সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়ে নিজের অন্তঃস্থল খুঁড়ে, সচেতনভাবে মানুষের কথা বলে যান তাঁর কবিতায়। তিনি কাব্যকথায় মানুষের অবচেতনের সমস্ত কথা এবং সচেতন যাপনের সার কথা সমস্তই বলে যান অকপট ভাবে।

    এই কবি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তাঁর “কবিতা পায়”; ঠিক মানুষের বাকি সব পাওয়ার মতোই কবিতাও পায়। কবিতার সাথে কতটা ওতপ্রোত ভাবে সম্পৃক্ত হলে, একাত্মতা থাকলে এবং কবিতার প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে, কেউ এই কথা বলতে পারেন, তা সাধারণের পক্ষে বোঝা হয়তো দুষ্কর। গতানুগতিকতার মন্থর চালে চলে আসতে থাকা বাংলা কবিতার রক্ষণশীল বেড়াকে তিনি তাঁর কথ্যভাষার বম্বশেলে গুঁড়িয়ে দিতেই “গেল গেল” রব যেমন উঠেছিলো, সেই রবের কারণগুলোকে কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও পড়ে ফেলত গোঁড়া বাঙালি। ভাষা সাহিত্যের তথাকথিত এলিট ক্লাস সেসব না পড়ে ফেললে, নিজেদের টলোমলো আসন সামলে রাখার জিগিরে কীভাবে গেল গেল রবের হিড়িক তুলতেন?
    ভয় পেয়েছিলেন কি এই আগুন কলমকে তাঁরা?
    সম্প্রতি পড়লাম তাঁর কবিতা ‘রাষ্ট্রের বহি-খাতা’; পড়েই নিজেকে এবং অসংখ্য মানুষের অত্যন্ত সমস্যাসংকুল জীবনের এক মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড়াতে হল, আমরা কি হরেদরে সকলেই এই সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চাকার চোখে নিজের দেশে অভিবাসী মাত্র? আমাদের নাগরিকত্ব, আমাদের স্বদেশের শেকড় কি কেবল সরকারের ঠাপ্পা মারা, সরকারী শিলমোহর আঁকা কয়েক টুকরো কাগজের মুখাপেক্ষি?
    “ দলিল থাকলেও ফেলে দিতুম, তবে দলিলের জেরক্স
    দেখেছিলুম, ষোড়শ শতকের কারোর ফার্সিতে লেখা নাম
    এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে ষোড়শ শতকের
    সেই পূর্বপুরুষে ওর রক্তের শেকড় রয়েছে?
    বাড়ির ট্যাক্স বাবা দিতেন, তার আগে দাদু
    দাদুর বাবা, তার আগে নবাবের খাজনা--
    বিলডার ঘুষের ঠেলা মেরে মালিকানার
    সমস্যা সমাধান করে ফেলেছিল
    এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে
    ও ভারতের সত্যিকারের নাগরিক?”
    রাখি কবির বোন। বোনের ন্যায্য চিন্তার মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি প্রতিফলিত করেছেন এই দেশের নাগরিকদের চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা।
    কবি শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে লিখে ফেলেছেন ‘রাস্তার কবিতা’। তার ছত্রে ছত্রে লেখা আছে, বলা ভালো বয়ান করা আছে আমাদের তুচ্ছতা। আপাতদৃষ্টিতে এখানে যা শুধু কবির দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির লঘু বর্ণনা, তা আসলে গভীরে ঢুকে নাড়া দেয় আমাদের, বুঝিয়ে দেয়, এইটুকুই আমাদের মূল্য। চোখ বাঁধা অন্ধ আমাদের ঝাঁকুনি দেয় তাঁর সোজা সরল কথ্য ভাষায় লেখা গভীর অর্থবহ সমস্ত কবিতা।
    “কাগজ কুড়োনোর কাজ আরম্ভ করে প্রথম ছেঁড়া নোংরা কাগজের টুকরো
    তুলেই কাজটা ছেড়ে দিতে হলো
    কাগজটা দিয়ে দিলুম কুড়ানিকে
    যে আঁস্তাকুড় থেকে কাগজ বাছাই করছিল
    আসলে যে কাগজটা তুলেছিলুম সেটায় দেখলুম
    আমারই একটা কবিতা, ‘কালিমাটি’ পত্রিকায় বহুদিন আগে
    প্রকাশিত হয়েছিল”
    মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে লিখতে বসলে সামান্য কটা পাতায় তা সীমিত রাখা বড়ই কষ্টকর, অথচ সুবিশাল কিছু লেখা এখানে সম্ভব নয়, কারণ তা যে দুতিন পাতার ভেতর লিখতে হবে, তা কবি আগেই বলেছেন । তবুও সামান্য হয়তো বড়ো হয়ে গেল লেখাটা। তাঁর কবিতার কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আসবে ‘অবন্তিকা’র কথা। এক অনবদ্য প্রেমের কবিতা, ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’।
    “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
    মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, "চলুন পালাই"
    ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই
    নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
    ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ
    সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট”…
    হেন প্রেমিক বা প্রেমিকা নেই, যার অন্তঃস্থল পর্যন্ত শিরশির করে উঠবে না এই কবিতা পাঠ করে।
    “কি-বোর্ডে পাকাচুল পড়ে, তুলো দিয়ে সরিয়ে দিই ; চশমার লেন্সে পাকাচুল পড়ে, মুছে সরিয়ে দিই। তবু লেখালিখি ছাড়তে ইচ্ছে করে না”... সম্প্রতি কবি এমনটাই বলেছেন। এক সাধারণ গুণমুগ্ধ পাঠিকার আসন থেকে চীৎকার করেছি, আরও, আরও লিখুন কবি, এত লিখুন যে আমাদের মগজের রক্তক্ষরণ যেন বন্ধ না হয়। রক্তের সরোবর বানান আমাদেরই হৃদয়ের ক্ষরণে, সেই সরোবরকে আয়না করে আমরা সকলে উঠে দাঁড়াই ঋজু ও দৃপ্ত কবিতার কাঁধে ভর করে। তাঁর নিজের ভাষায়, “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয়; উন্মাদের মতো চীৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্টযন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না।” শিখি তাঁর প্রতিটি উক্তি থেকেও। কবি মলয় রায়চৌধুরীর কাছে “কবিতার কোনও সংজ্ঞা নেই, নির্দেশিকা হয় না তাই যা ইচ্ছা, যেমন ভাবে ইচ্ছা লিখুন”... এই মানুষের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা কি সহজ কথা? যিনি কবিতাকেই প্রেমিকা করে নিতে পারেন, তাঁর কবিতার কাছাকাছি গিয়ে তাকে স্পর্শ করাই নিজের মধ্যে এক সুবিশাল অর্জন।
    “আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
    পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁতসেঁতে ধুলোপড়া মেঝে
    আচমকা কড়া আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
    তক্ষুণি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দু-তিনবার”
    তাঁর ‘আলো’ নামক কবিতার প্রথম চার লাইন উদ্ধৃত করে এই লেখা শেষ করছি। এই কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি পেরেছিলেন সামগ্রিকরূপে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ফুটিয়ে তুলতে। রাষ্ট্রের শাসনের নামে যে সন্ত্রাস, যার চাবুকের নীচে আলোহীন বাঁচতে থাকা বোবা মানুষেরা প্রতিবাদী হলেই, তারা প্রথা ভাঙতে চেষ্টা করলেই কি কি ঘটে যায়, তা ধরে রেখেছে এই কবিতার প্রতিটি শব্দ। অথচ লড়াকু প্রতিবাদী কবি কণ্ঠ লিখে ফেলে এই কবিতার শেষ লাইন দুটি মূল উপাদান হিসেবে...
    “একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
    পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিই।"
    কলকাতার সাহিত্যজগত থেকে দূরে বসবাস করে কবি ভারতীয় সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে সচেতনভাবে সৃষ্টিতে মেতে লিখে চলেছেন ষাটের দশক থেকে জ্যা মুক্ত তীরের মতো ক্ষিপ্র ধারালো কবিতা। তাঁর লেখা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র।
    সত্যিই তিনি অসীম শক্তিশালী, আমার কাছে কবিতার ঈশ্বরসম বলেই, তাঁর কবিতার কাছে সহজ মনে না পৌঁছতে পারলে আজও শ্লীল অশ্লীল, অথবা নানান দোহাই পাড়ে যারা, তাদের উদ্দেশ্যে কবির ভাষায় বলি,”আমাকে ধিক্কার দেয়া যায় আমাকে উপেক্ষা করা যায় না।” কারুর আনুকূল্য অথবা হাততালি, পুরস্কার ইত্যাদির পরোয়া না করে তিনি লিখে চলেছেন আজও তাঁর বাঁধনছাড়া বেপরোয়া নিজস্ব শৈলীতে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন