এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • শেখ মুজিবের উপর খ্যাপা কেনো চিনাপন্থীরা?

    কুলদা রায়
    অন্যান্য | ২৩ নভেম্বর ২০১২ | ৬৭৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৪:৩৬576935
  • পুনর্বার:

    ["বাকশাল বিষয়ে মুজিবের অবস্থান ছিল পরিষ্কার। তিনি সমাজতন্ত্রী না হয়েও সমগ্র বিশ্ব্যবাপী সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পরিস্থিতিকে স্যালুট করে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, "বাকশাল হচ্ছে শোষিতের গণতন্ত্র।" সুতরাং, মুজিব ট্রু ন্যাশনালিস্ট, খাঁটি জাতীয়তাবাদী! যেমনটা সান-ইয়াৎ সেন; কামাল আতাতুর্ক; গান্ধীজী; নক্রুমা; আলেন্দে; লুমুম্বা।।।। মুজিবের সমালোচনা হতে পারে বিস্তর। কিন্তু তিনি কখনোই একনায়ক ছিলেন না; আপাদমস্তক গণতন্ত্রী; গণমানুষের একান্ত আপনজন।"]-- আবুল খায়ের

    ____________

    ০১. ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ১৯৭১ এর মহান জনযুদ্ধটি মুক্তিযুদ্ধই ছিলো, এটি ছিলো ছাত্র-শিক্ষক-জনতা-সাধারণ মানুষ সকলের মুক্তির সংগ্রাম, মোটেও কেবলমাত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম বা একখণ্ড দেশপ্রাপ্তির লড়াই তো নয়ই [এ কারণেই আদিবাসীরাও বাঙালির পাশাপাশি এতে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেন, স্বাধীন দেশে সব রকমের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন তারাও, যদিও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাদের সে স্বপ্ন নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, 'তোরা সব বাঙালি হইয়া যা' ], শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার মানুষের স্পিরিটটুকু ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়, বাঙালি ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন প্রায় কিংবদন্তীতুল্য নেতা, বঙ্গবন্ধু [এতে নিজস্বপন্থায় বিপ্লবকাঙ্খায় সরাসরি অংশ নিয়ে অবদান রাখে কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন দল ও উপদল, এমকি সিরাজ সিকদার, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাদের সকলকেই মুজিব-জিয়া স্বৈর শাসনে নির্মমভাবে খুন হতে দেখা যায়, উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রপাগান্ডায় তারা থাকেন উপেক্ষিত এবং 'কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?'], সাতের দশকে অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ এক পর্যায়ে সমর্থক হয়ে পড়ে [স্বাধীনতার পর সেই মোহ চূর্ণ হয় অচিরেই, বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত আর বঙ্গের বন্ধু থাকেননি, নায়ক থেকে খলনায়কে তার উত্তোরণ ঘটে দ্রুত, সহযোগি ভক্তকূল তাকে সামনে রেখে সব রকম দেশবিরোধীতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও লুঠপাটে মত্ত হয়], যদিও মুক্তিযুদ্ধের নিয়ামক এই শক্তিটি এর আগে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় জোর ভূমিকা রেখেছে।

    সে সময় একমাত্র বাংলা এবং পাঞ্জাব প্রদেশেই মুসলিম লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জোরেই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের সম্বাবনা ভারতবর্ষের বাদবাকি মুসলমানদের দেখাতে সাহস করে। তখন শেখ মুজিবও সেই আন্দোলনেরই বলিষ্ঠকর্মি ছিলেন [এবং মওলানা ভাষানী]। শেখ মুজিব তখন মুসলিম লীগের রক্ষণশীল সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কর্মি ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীদের বিরুদ্ধে ছিলেন আবুল হাশিমের মতো প্রগতিশীল তরুণ নেতা। বাংলার অখণ্ডতা ঠেকাতে আবুল হাশিম-শরত বোস প্রমুখের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৪৭-এর পর আবুল হাশিম রাজনীতিই ছেড়ে দেন। কিন্তু শেখ মুজিব টিকে থাকেন। হাশিমপন্থীরা গোপনে কমিউনিস্টদের সমর্থন দিতে থাকে আওয়ামী লীগের ভেতর। তার বাইরে স্বতন্ত্র ছাত্র-যুব সংগঠনও করতেন তারা, সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও ছিলোন।

    ০২. পাক উপনিবেশটি ক্রমেই পূর্ব বাংলার হাতে-পায়ে শেকল হয়ে এঁটে বসে। পাকিস্তানে প্রথমত আঘাত হানেন তারাই, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে, এর আগে হাজং বিদ্রোহের সশস্ত্র লড়াইয়ে। ১৯৫২-র পরপরই কমিউনিষ্টরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন পাক শাসনে মুক্তি নেই, নইলে কৃষক-শ্রমিক স্বরাজও সম্ভব নয়, বাংলাকে স্বাধীন না করলে রাষ্ট্র বিপ্লবও সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের অগ্রসর কর্মি — ভাষা মতিন, অলি আহাদদের পরের কার্যক্রম দেখলে সেটা মনে হয়।

    ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন করে বাঙালিদের সব দল এক হয়ে মুসলিম লীগকে শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেশ স্বাধীনের শর্ত তৈরী করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নযাত্রা শুরু এরই আগেই হয়। তখন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দুটি স্পষ্ট ধারা সমান্তরাল চলতে শুরু করে। একদিকে কমিউনিষ্ট প্রভাবিত ছাত্ররা সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাকে স্বাধীন করতে চান, আরেকদিকে জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি আস্থায় সাংবিধানিক পথে পূর্ণ স্বাত্তশাসনের মাধ্যমে অখণ্ড পাকিস্তানের জায়গায় ফেডারেল পাকিস্তানের স্বপ্ন। শেষোক্ত এই ধারাটিই ২১ দফার প্রবক্তা।

    কিন্তু পাক সরকার ২১ দফা মানতে প্রবলভাবে অস্বীকার করে, মাওলানা ভাসানী ১৯৫৬-তে ঘোষণা করেন, এ রকম হলে বাঙালিরা আলাদা রাস্তা ধরবে, এক সঙ্গে থাকবে না। সোহরাওয়ার্দীর প্রধান অনুসারী শেখ মুজিব তার নেতার পথেই থাকেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্র্দী মত দেন, ৯৮ ভাগ স্বাধীনতা তো দেওয়াই হয়েছে।

    ০৩. আইয়ুব শাহী কমিউনিস্ট কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলে তাদের একটি বড় অংশ মওলানা ভাষানীর সমর্থক হয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে থাকেন। কাগমারি সম্মেলনে দলে দলে বিপ্লবী কমিউস্টরা যোগ দেন ['পাকিস্তান, ওয়ালাইকুম আস সালামালাইকুম']। আমেরিকার সঙ্গে সামরিক চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়। মুসলিম কাম মার্কিন কাম পাকিস্তানপন্থীদের নেতা থাকেন সোহরাওয়ার্দী ও মুজিব। ভাষানী ন্যাপ গঠন করে পৃথক হন।

    আওয়ামী লীগের ভেতরের কমিউনিস্টপন্থীরা তখন মস্কো-চীন দুই গ্রুপে ভাগ হয়। তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় এর আগেই কমিউনিস্টদের অপর অংশটি আওয়ামী লীগে ঢুকেছিলো। মস্কোওয়ালারা চলে যায় মুজিবের সঙ্গে আর চীনারা ভাষানীর সঙ্গে।

    ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়াদী গ্রেফতার হলে ৩১ জানুয়ারি ৪ টি ছাত্র সংগঠন মধুর ক্যান্টিনে যৌথভাবে বসে। সভা থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সকল আন্দোলন কর্মসূচিকে সংগঠিতভাবে রূপ দেওয়ার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফোরাম নামে সাধারণ ছাত্রদের একটি মোর্চা গঠন করে। এরই মধ্যে একদল জঙ্গি ছাত্র বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স নামে একটি বাহিনী তৈরি করে। ছাত্ররা তখনই বুঝেছিলো, তাদের লড়তে হবে আইয়ুব শাহীর সেনাদের সঙ্গেই। স্বাধীনতার দুই পথের পার্থক্য তখন আরো স্পষ্ট হয়।

    ০৪. উপমহাদেশ ও বিশ্ব রাজনীতিতে ১৯৬৫-৬৬ সালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একমাত্র বাঙালিরাই বীরের মতো লড়ে পাকিস্তানের সন্মান অক্ষুন্ন রাখে। কিন্তু তারা দেখতে পায়, যুদ্ধে পূর্ব বাংলা অরক্ষিত ছিলো। সেটি বাঙালির বৈষম্যকে প্রকট করে। প্রণীত হয় ছয় দফা। যার প্রণোদনা এসেছিলো বামপন্থি শিক্ষক নাজমুল করিমের বই থেকে।

    লক্ষনীয়, যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সে দ্বিজাতিত্ত্বওয়ালারাই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলো, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণ সমান নয়। এ থেকে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের প্রেরণায় তৈরি করলো বাঙালিদের আরেক দ্বিজাতিত্ত্ব, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এক জাতি নন! সে সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবসহ ৩৪জন সশস্ত্র অভুত্থানের পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেফতার হন, তারা তা অস্বীকার করেন। পূর্ব বাংলা ক্ষুব্ধ থেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল মুজিব জেলে ছিলেন।

    অন্যদিকে, ১৯৬৬ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক বিপ্লববের ঢেউ সারা বিশ্বে আছড়ে পড়ে। গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক মাওসেতুং প্রদর্শিত সশস্ত্র বিপ্লবের ঢেউ আলোড়ণ তোলে ভারত ও পূর্ব বাংলায় [ 'মোর গাঁয়েরও সীমানায়/পাহাড়ের ওপারে/নিথীশ রাত্রির প্রতিধ্বনী শুনি/নতুন দিনের যেনো/পদধ্বনী শুনি', ভূপেন হাজারিকা]। ভিয়েতনাম ও কিউবার সশস্ত্র গেরিলা বিপ্লবী সংগ্রামও কমিউনিস্টদের উজ্জীবীত করে ['তোমার নাম, আমার নাম/ভিয়েতনাম! ভিয়েতনাম!']

    আরো পরে ভারতের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের নেতা চারু মজুদারের ‘শ্রেণী শত্রু খতমের লাইন’ও এপারের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে প্রভাবিত করে ['৭০ দশককে মুক্তির দশকে পরিনত করুন']। এরই পথ ধরে পরে বিপ্লবকাঙ্খি চীনপন্থী কমিউনিস্টরা নিজ নিজ নেতা ও তত্ত্বের সমর্থনে সশস্ত্র হতে শুরু করেন [এবং সিরাজ সিকদার]।

    [দ্রষ্টব্য: সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা http://www.unmochon.net/node/639 ]

    এদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্রের ক্ষোভের পথ ধরে আসে ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থান। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার যুথবদ্ধ যে জঙ্গি আন্দোলন সে সময় হয়, তা-ই রচনা করে ১৯৭১ এর জনযুদ্ধের পটভূমি।

    ০৫. আরো লক্ষ্যনীয়, ১৯৫২ সালের পর তখনও শেখ মুজিব সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিলেন না, প্রধান নেতাও ছিলেন না। ভাষানী, তোয়াহা এবং ছাত্রনেতারাই আন্দোলন চালিয়ে যান। তারা সেনা নিবাস ঘেরাও করে শেখ মুজিবকে মুক্ত করেন। কিন্তু শেখ মুজিব আবারো তার অতি চেনা নির্বাচনের পথেই হাঁটলেন। তখন তার জন্য সেটিই ছিলো স্বাভাবিক ও সহজ। কারণ তিনি বিপ্লবী ছিলেন না, ভাষানী মতের তো নয়ই। ১৯৭০ এর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ন্যাপ-ভাষানী এবং প্রায় সকল কমিউনিস্ট পার্টি বর্জন করে। ভাষানীর শ্লোগান ছিলো: ভোটের আগে ভাতা চাই। কমিউনিস্ট শ্লোগান ছিলো: ভোটের বাক্সে লাথি মারো, সমাজতন্ত্র কায়েম করো। বামপন্থীদের একটা বড় অংশ এবং ছাত্ররা মিলে তখনই স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচি ঘোষণা করে [এবং সিরাজ শিকদার]। তারা বাহিনী গঠনের কাজে মন দেন; মুজিবের প্রস্তুতি ছিলো নির্বাচন কেন্দ্রীক।

    ভাসানী ও চীনাপন্থীরাও নির্বাচন বাদ দিয়ে জনযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের জমিন তৈরিতে ব্যস্ত হন। সে সময়, ভাষানী বা মুজিব, কে কার থেকে বেশী জনপ্রিয় তা বোঝা ছিলো মুশকিল। তবে তখন শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে কমিউনিষ্টদের সাংগঠনিকভিত্তি ছিলো দৃঢ়। কোনো জোর প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ভোটে শেখ মুজিব নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন।

    নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই উপকূলীয় অঞ্চলে বিরাট ঘূর্ণিঝড়ে কয় লাখ মানুষ মারা যায়। ভাসানী সেখানে ত্রাণ দিয়ে এসে পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন, ‘ওরা কেউ আসেনি’ [পাক সরকার]। নির্বাচনোত্তর ক্ষমতা মুজিবের কাছে হস্তান্তর করতে পাক-সরকার কালক্ষেপন করতে থাকে। আসলে তারা সময় নিচ্ছিলো সামরিক প্রস্তুতির। ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ভাষানীর জনসমর্থনও বাড়তে থাকে ['ভোটের বাক্সে লাথি মারো']।

    ০৬. ১৯৭১ এর ৩ জানুয়ারি, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি আবার রমনা রেসকোর্স ময়দানে গণআবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়। এদিন সেখানে আইনসভার সকল পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যদের সভা ডাকেন শেখ মুজিব। তিনি তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান, তারা আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিনামার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন।

    ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি- মার্চের ঘটনাবলি স্বাক্ষ্য দেয়, ফেডারেল পাকিস্তানের সম্ভাবনা বাস্তবে আর সম্ভব নয়। কিন্তু তখনো পাকিস্তানের মধ্যে ছয় দফার বাস্তবায়নের কাঁঠালের আমস্বত্তটি মুজিবের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়নি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাতেই অনঢ় ছিলেন। কারণ কারণ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি ছিলো তার অগাধ আস্থা, নির্বাচনী রায় এবং জনগণের সমর্থনে এরচেয়ে বেশী তার কাছে আশা করাও বাতুলতা [মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন]।

    তবে বাস্তবতার কঠিন জমিনে শিগগিরই তিনি নেমে আসেন। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে ৩ মার্চ, ঢাকায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘোষণা দেন, ছয় দফা জনিত সৃষ্টি জটিলতার অবসান না হলে তার দল জাতীয় পরিষদের সভায় যোগ দেবে না। ২১ ফেব্রুয়ারি মুজিব কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আবারও ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন আদায়ে তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

    এ পর্যায়ে পাক চক্রান্ত আরো প্রকাশ্য হয়। ইয়াহিয়া মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে জেনারেলদের বৈঠক করে নিজস্ব কায়দার সঙ্কট সমাধান করতে উদ্যোগ নেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, অধিকার আদায় ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় পুর্ব পাকিস্তান দরকার হলে লড়াই করবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সকল সদস্যের কাছে ঢাকা অধিবেশনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু পরের দিন ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন।

    এ হেন খবরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলস্থলে জড়ো হন। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে দাবি তোলেন, শেখ মুজিব যেনো এখনই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেন। তারা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বিক্ষোভ করে।

    এদিকে, ছাত্রনেতারা সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। এর নেতা ছিলেন নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব এবং রুহুল কুদ্দুস মাখন [খলিফা চতুষ্টয়]। তারা স্বাধীনতার সংগ্রামে যৌথভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

    ১৯৭১ সালের মার্চে এই প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রস্তুতি প্রধান ধারা হয়ে ওঠে [অবশ্যই মুজিবও তার 'নিয়মতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন' দাবি থেকে ক্রমেই সরে আসেন, তবে এই মোহভঙ্গ হতে একটি গণহত্যার প্রয়োজন পড়ে এবং আত্নসমর্পন]। এই দাবির শক্তি ও জনসমর্থন সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিকপন্থী তো ছিলোই না, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধই ছিলো এর একমাত্র লক্ষ্য। ২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে ছিলো স্বতষ্ফূর্ত হরতাল। ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা থেকে অগনিত মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমবেত হন। সেখানে ছাত্র-জনতা জাতীয় স্বাধীনতার ধ্বনী তোলে এবং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা দৃঢ় সিদ্ধান্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদের ভিপি, ছাত্রলীগ নেতা আসম আব্দুর রব বিপুল করতালি ও গগনবিদারী জয়োধ্বনী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন [পতাকার নকশাবিদ শিবনারায়ন দাস]।

    ০৭. এ ভাবেই জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন ইত্যাদির পরও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ শেষ হয়ে যায়। দেশ এগিয়ে চলে ইতিহাসের নির্ধারিত পথে– রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামে। পরের ঘটনাবলীও তাই অনিবার্যভাবে সেই সংঘাতের দিকেই ধাবিত হয়। শেষে ২৫ মার্চ রাতে জাতি মুখোমুখি হয় সামরিক জান্তার ভয়াল আক্রমনের [ওই সন্ধ্যাতেও মুজিব গোল টেবিল বৈঠক চালিয়ে গেছেন, সমঝোতার পথ]।

    স্পষ্টতই তিনি ভুল পথে হেঁটেছিলেন, ওই সান্ধ্য-বৈঠক সে প্রমানই বহন করেন। মুজিব ব্যাখ্যা মতে, তিনি ভারতের কাছে যেতে চাননি [কিন্তু যেতে কী হয়নি, যেতে কী হতো না?] এবং তিনি লোকক্ষয় এড়াতে বৈঠক অব্যহত রেখেছিলেন [ কিন্তু গণহত্যা কী এড়ানো গেছে? বরং পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে লোকক্ষয় আরো কত হতো, প্রতিরোধ লড়াইটি হতো অনেক জোরদার]।

    ৭ মার্চ মুজিব গণসমূদ্রে উচ্চারণ করেছিলেন সেই অস্মরণীয় কাব্য ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। কিন্তু লক্ষ্যনীয়, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো/ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ো’ ছাড়া যুদ্ধের জন্য মুজিব অনুসারীদের তখনো কোনো প্রস্তুতিই ছিলো না।

    নির্মোহ বিচারে ৭ মার্চের ভাষণের কাব্যময় আবেগকে মুজিব নিজেই ধারণ করেননি [মার্চের আগে তো নয়ই]। ‘যার যা কিছূ আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ হুংকারের পর দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে তিনি জনতার হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়েছেন! স্বাধীনতা সংগ্রামের এমন নেতার এ হেন নজির বিশ্বজোড়া মেলা দায়ই বটে। বিশ্বের আর কোনো নেতা যুদ্ধ ঘোষণা করে আত্মসমর্পণের জন্য ঘরে বসে থেকেছেন? নাকি তখনো তিনি পাক- প্রধামন্ত্রীত্বের খোয়াবে বিভোর ছিলেন? গুঢ় বাস্তবতা এই যে, মুজিব তখনো মার্কিনের বন্ধু ছিলেন, তাদের কাছেই সমাধান চাইছিলেন [দ্র. সম্প্রতি প্রকাশিত সিআইএ-এর নথি]। মুজিব সারা জীবন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, আলোচনা ও নির্বাচন করে এসে জনযুদ্ধের দাবি মেটাতে না পেরে কারাবরণ করেন। তার অনুসারী আওয়ামী নেতারা জাতিকে অরক্ষিত রেখে যে যেভাবে পারেন ভারতে চলে গেলেন।

    মুক্তিকামী জাতি দেশেই থেকে সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সন্তানদের পাঠিয়েছে রণাঙ্গনে। গণহত্যার পর গণহত্যা, ধর্ষনের পর ধর্ষন, জ্বলে-পুড়ে খাঁক হতে হতে পুরো জাতি তার জাতীয় নেতাকে ছাড়াই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে [যদিও লক্ষন রণনীতিতে মুক্তিযুদ্ধটি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামটি হয়েছে শেখ মুজিবের নামেই, এর নেতৃত্বে থাকে আওয়ামীলীগ।]

    [দ্রষ্টব্য: শেখ মুজিব- আহমেদ শরীফের ডায়েরী থেকে- http://www.amarblog.com/raselpervez/posts/76302]

    ০৮, [পুনর্বার, অতএব সংক্ষেপে] আমরা যারা প্রজন্ম ৭১, তারা অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই-পত্র পড়ে, চলচ্চিত্র দেখে, স্বাধীন বাংলা বেতারের গান শুনে, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ, জাহানারা ইমাম, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তো বটেই..[এমন কি ড. আহমদ শরীফ এবং সিরাজ সিকদার]…ইত্যাদিতে মুক্তিযুদ্ধের সব ঘটনা প্রবাহ বুঝতে চেষ্টা করি।

    অনুধাবন করার চেষ্টা করি, বাঙালির গৌরবের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসের ঘটনাটিকে অনুধাবনের জন্য এবং যুদ্ধোত্তোর বাংলাদেশ। …এই পঠন-পাঠনটিও অব্যহত থাকে এবং বিতর্ক তো বটেই।

    তবে ইতিহাসের ঘটনাবলিকে [ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিব তো বটেই] বোধহয় নির্মোহভাবেই দেখা ভালো। এখানে আবেগতাড়িত হয়ে ভাব-বুদ্বুদে মজে গিয়ে দেবোত্ব আরোপ করার যৌক্তিকতা দেখি না। মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত এই পাঠটিকেই বরং বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া কর্তৃব্যজ্ঞান করি; কারণ শেষ পর্যন্ত এটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধই ছিলো, নিছক স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিলো না। এখানেই মুক্তি সংগ্রামের জনযুদ্ধটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে; যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও নানা মাত্রায় [চেতনা ও বিনির্মানে] অব্যহত রাখার দাবি রাখে।

    এর সূচনা সাতের দশকে বাম ভাবাদর্শে সশস্ত্র পন্থায় হয়েছিলো, ১৯৭১ এ স্বাধীনতা একটি চূড়ান্তপর্ব মাত্র, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটি শেষ হয়ে যায়নি, এটি অব্যহতভাবে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম ও চেতনাটিকে অব্যহত রাখা জরুরি; যদিও শেখ মুজিব এবং আওয়ামী অনুসারীরা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এটিকে বরাবরই স্বাধীনতার সংগ্রামেই আটকে রাখতে চেয়েছে, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামটিকে তারা শেষ পর্যন্ত [এবং কি নিষ্ঠুরভাবে পরের সব কয়েকটি অধ্যায়ে] জিইয়ে রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। বাকশালী একনায়কতন্ত্র/ফ্যাসিজমের বিষবৃক্ষ মুজিব দর্শনের ঔরসজাত এই সীমাবদ্ধতারই ফল। অবশ্য আটার কলের কাছে আখের রস চেয়ে লাভ কী?

    দেখতে পাই, মুক্তিযুদ্ধকে নিজস্বপন্থায় সে সময় যেসব কমিউনিস্ট পার্টি এগিয়ে নিতে চেয়েছিল [অধিকাংশই দক্ষিনপন্থা এবং চরমপন্থার ঝোঁকের কারণে শেষ পর্যন্ত হঠকারিতার চোরাবালিতে আটকে যায়, নকশালী কায়দায় আত্নঘাতিতায় নিক্ষিপ্ত হয়], পুরো সাতের দশক ধরে মওলানা ভাসানী তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়/সমর্থন দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনিও তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন, অতি গুঢ় বাস্তবতা অনুভব করেই [আবার পাইপগান/এতো বেশী গরম হয়ে আসে যে/ক্রমশ এর ব্যবহার কমে আসছে]।

    তাই আমাদের দেখার চোখটি যেনো সাদাকালো হয়, পরিশেষে এ আহ্বান জানাই। বিতর্ক চলুক।
  • PT | 213.110.246.230 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৪:৪২576936
  • ঐ জাতীয় "তিন" কেন তিরিশ "বছরের দুঃশাসন" আমেরিকার পেয়ারের লোকজন বিশ্বের অনেক দেশেই চালিয়েছে। তার জন্য তাদের পরিবারকে হত্যা করে মুছে দেওয়া হয়নি। মুজিব আমেরিকাপন্থী হলে তিনিও তিরিশ বছর দিব্য চালাতেন। এইজাতীয় বক্তব্য শুধুমাত্র পরোক্ষে হত্যাকারীর সমর্থনেই কাজ করে।

    মনে রাখা ভাল যে ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালার গণতান্ত্রিক সরকারকে United Fruit Company সিয়ার সাহায্যে উৎখাত করে এক ডিক্টেটরকে ক্ষমতায় বসায়।

    During 1953, as the land expropriations occurred, the United Fruit Company asked the Eisenhower Administration to confront the Árbenz Government, in order to compel the reversion of Decree 900. To involve the politically reticent President Eisenhower, the UFC employed the public relations-and-advertising expert Edward L. Bernays to create, organise, and direct a psychologically inflammatory, anti–Communist disinformation campaign (print and radio, film and television) against the liberal Árbenz Government of Guatemala. The public-opinion pressure generated by the UFC disinformation campaign compelled President Eisenhower to become involved in the private-business vs. national-government quarrel of the United Fruit Company, lest he appear to be “soft on Communism” in Guatemala — a serious personal imputation and great political accusation of which the American public took serious note, especially during the McCarthy Era.

    Hence, the US State Department reduced economic aid to and commercial trade with Guatemala, which harmed the Guatemalan national economy, because 85 per cent of exports were sold to the US, and 85 per cent of imports were bought from the US. Such economic sabotage of Guatemala was secret, because economic warfare violated the Latin American non-intervention agreement to which the United States was a signatory party;.-ইত্যাদি ইত্যাদি।

    কি চমৎকার মিল। দুরাত্মা শক্তিমান হলে একই চাল বার বার কাজে লাগায়। শুধু কাস্ত্রোকে জব্দ করতে পারেনি।
  • lcm | 34.4.162.218 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৫:১২576937
  • বেশ। এবার একটু অন্য তথ্য।
    ... US provides from $16 to $18 million a year in food assistance to address elevated levels of chronic malnutrition in Guatemala—the highest in the hemisphere...
    ...Over the period 2004–2008, total estimated funding for USAID’s program in Guatemala is $192.5 million...
    Currently USAID funding for Guatemala is around $40 million a year....
    ...USAID/Guatemala also manages the Central America Regional Program for HIV/AIDS that supports the President’s Emergency Plan for AIDS Relief. The annual budget for this program is approximately US $6 million...
  • lcm | 34.4.162.218 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৫:১৯576938
  • মুশকিল হল এইটাই। এক্সট্রিম চিন্তাভাবনা বা প্রোপাগন্ডা ২০১২ তে খাওয়ানো মুশকিল।

    ভালো মুজিব, খারাপ মুজিব - দুইই এখন মানুষ জানে।
    সমাজতন্ত্রের ভালো খারাপ - দুইই মানুষ জানে।
    ডেমোক্রেসির গুণ/দোষ, তাও মানুষ জানতে পারছে।
    ভালো আমেরিকা, খারাপ আমেরিকা - দুদিকই মানুষ জানে।

    এখন আর জগৎটাকে এত সহজে সাদা/কালোয় ভাগ করে দেওয়া যায় না।
  • PT | 213.110.246.230 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৬:২৫576939
  • গুয়াতেমালাকে এখন সাহায্য দেয় বলে ১৯৫৩-র কাজটাকে কি ভাল বলতে হবে?
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৭:২১576940
  • ["সিরাজ সিকদারের রাজনীতির সূচনাই হচ্ছে খতমের মাধ্যমে বিপ্লব। ভড়ং করে "শ্রেণী শত্রু খতম"য়ের স্থলে নাম দিয়েছিল "জাতীয় শত্রু খতম।" ফলে খতমের রাজনীতি করতে করতে এসএস-এর পার্টি শুরুতে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ খুন দিয়ে শুরু করলেও পরে তা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের খুন করে সমাজৈ ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়। খতমের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় পার্টির অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব খতম হয়ে আরো পরে তা খোদ কেন্দ্রীয় কমিটিকে খতম করে ১ সদস্য বিশিষ্ট করে ফেলে। এসএস শূলত সিআইএ প্রণীত "রেড ব্যানার ওপোজ রেড ব্যানার" কর্মসূচী বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন। ফলে যে পথে আর আগমন এবং উত্থান সে পথেই তার গমন! খুন, খতম, গলাকাটা ইত্যাকার কুকর্মের মধ্যদিয়েই তার উত্থান। কর্মীদের শ্রেণীচেতনার শাণিত করতে সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্ঠির অভ্যন্তরে চালু করেছিল এই নীতি যে, নবীন কমরেডদের বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহে ছুরি চালিয়ে শ্রেণী চেতনা শাণিত করতে হবে।"] --আবুল খায়ের।

    ["এই চিনাপন্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিল না। এদের নিজেদের চলার মত কোনো অবস্থার কারণে মওলানা ভাসানীর আশ্রয়ে থেকেছে। ফলে মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে মার্কসবাদ-মাওবাদের একটা আজগুবী মিশেল করার করেছে। তবে রাজনৈতিক হাওয়া বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ, মস্কোপন্থীদের পক্ষে থাকায় একাত্তরে এদের একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশ নেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এরা স্বাধীনতার পরে পরিস্থিতি বুঝে আবার পাকিস্তানী রাজাকারদের হয়ে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করতে শুরু করে। মজার কাণ্ড এদের দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই সাম্প্রদায়িক-পাকিস্তানপন্থানপন্থীদের পরিবার থেকে এসেছে। আমার শহরে সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা বিড়ধী লাল মিয়ার ছেলে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির নেতা হয়েছিলেন ৭১ এর পরে। আবার ১৯৭৫ সালের পরে তিনি আবার যথারীতি সরাসরি পাকিস্তানপন্থীদের দলেই ভিড়ে গেছেন। সর্বহারা দলে নেই।"] --কুলদা রায়

    ___________________________________________________

    সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা :: বিপ্লব রহমান • প্রকাশকাল: 3 আগস্ট 2011 - 5:09অপরাহ্ন

    [এসএস'কে নিয়ে এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। বেশীরভাগ লেখাই কোনো দলীয়স্বার্থ পূরণের জন্য। অনেকে ব্যক্তি এসএস'র জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে তার বিপ্লবীত্বকে খাটো করেছেন। কেউ তাকে 'ভুল/বেহাত বিপ্লব'এর দোসর বলেই মূল্যায়নটি শেষ করতে চান। এই সব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বলে লেখার শিরোনামে 'অন্য আলোয় দেখা' কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। এটি মোটেই এসএস'র কর্মকাণ্ডের সামগ্রীক মূল্যায়ন নয়। এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নির্মোহভাবে এই শহীদ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে দেখার একটি ছোট্ট প্রয়াস।]

    আর কয়েকটা শত্রু খতম হলেই তো গ্রামগুলো আমাদের/ জনগণ যেনো জল, গেরিলারা মাছের মতো সাঁতরায়…সিরাজ সিকদার।

    অস্ত্র কোনো নির্ধারক শক্তিনয়, নির্ধারক শক্তি হচ্ছে মানুষ। সংগঠিত জনগণ অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী।…মাওসেতুং।

    ১। সর্বহারা পার্টি গঠন, ১৯৭১
    গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক মাওসেতুং-এর নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব ও চীনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছয়ের দশকের শেষভাগে সারা বিশ্বের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো যুদ্ধোপূর্ব বাংলাদেশেও। পাকিস্তানী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট, অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলাকে বেশ কয়েকটি বামপন্থী গ্রুপ সশস্ত্র পন্থায় মুক্ত করতে চেয়েছিলো।

    এ সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও বিকশিত হতে থাকে জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন। পাকিস্তানপর্বে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় কমিউনিস্ট পার্টি মূলত আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মধ্যে মিশে গিয়ে কাজ করতে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই বাঙালিদের স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকে। এ পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার নানা প্রক্রিয়া হাতে নেয়। এ সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও জমে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর সঙ্গীদের। মামলার শেষ পর্যায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

    অন্যদিকে ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির ফাশিদেওয়া, নকশালবাড়ীতে ঘটে যায় এ সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পথ হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ নেয় চারু মজুমদারের নেতৃত্বে একদল কমিউনিস্ট। পরে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-- সিপিআই (এমএল) নামে পার্টি তৈরি করেছিলেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে নকশাল আন্দোলন নামে পরিচিত হয়েছিল। নকশালবাড়ীর সেই প্রবল জোয়ার পূর্ব পাকিস্তানেও আছড়ে পড়ে।

    পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আগেই রুশ ও চীন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি ধর্মভিত্তিক বৈরী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় কমিউনিস্ট হিসেবে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পথ তখন সহজ ছিল না, খুব কম লোকই সেই পথে এগোতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র সিরাজুল হক সিকদার বা সিরাজ সিকদার। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের ছাত্র বুয়েটের লিয়াকত হল শাখার সভাপতি সিরাজ সিকদার ওই বষয়েই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সদস্যপদ ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) চারু মজুমদারের সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের তত্ত্বকে হঠকারী হিসেবে আখ্যায়িত করল। এর প্রতিক্রিয়ায় পার্টি থেকে বেরিয়ে আসেন সিরাজ সিকদার।

    এই উত্তাল পরিস্থিতিতে তরুন বিপ্লবী সিরাজ সিকদার প্রথমে মাওসেতুং গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে শিক্ষিত ও বিপ্লব আকাঙ্খী যুবকদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি গঠন করেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। প্রতিষ্ঠার পরেই এ গ্রুপটির মূল থিসিস ছিলো: পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের’ মাধ্যমে এ উপনিবেশের অবসান ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়।

    ছয়-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

    অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল ‘দুই শ্রেণী শত্রু’ মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।

    অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল ‘দুই শ্রেণী শত্রু’ মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।

    ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এতে স্পষ্ট লেখা হয়:

    আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাক্ত ইহিতাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে, ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে। আপনাকে ও আপনার পার্টিকে পূর্ব বাংলার সাত কোটি জনসাধারণ ভোট প্রদান করেছে পূর্ব বাংলার উপরস্থ পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান করে স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলা কায়েম করার জন্য। পূর্ব বাংলার জনগণের এ আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন আপনার প্রতি ও আওয়ামী লীগের প্রতি নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলো পেশ করছে :

    " ১. পূর্ব বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এবং সংখ্যাগুরু জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করুন।

    ২. পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি-সংবলিত স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন।

    ৩. পূর্ব বাংলাব্যাপী এ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। এ উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয় শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান জানান।

    ৪. পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিক-কৃষক এবং প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে 'জাতীয় মুক্তি পরিষদ' বা 'জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট' গঠন করুন।

    ৫. প্রকাশ্য ও গোপন, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র, সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী পদ্ধতিতে সংগ্রাম করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।"

    (এরপর ৬ নম্বর পয়েন্টে শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠিতে ১৩টি করণীয় নির্ধারণ করে। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে জমি বণ্টন, শ্রমিকদের শ্রম শোষণ বন্ধ, ভাষাগত, ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম-অধিকার দেওয়ার বিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হাজির করে)।

    কিন্তু আওয়ামী নেতারা সিরাজ সিকদারের এই আহ্বান উপেক্ষা করেন, যা পরে গড়ায় দুই পার্টির এক রক্তাক্ত ইতিহাসে।

    ১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেনী শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়ায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা।

    পাকিস্তানী বাহিনীর আকস্মিক হামলার পর সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল জন্ম নেয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। রণকৌশল নির্ধারণ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিরাজ সিকদারের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা হয় ‘সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনা কমিটি’। ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয়: পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি।

    বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল–বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে।

    সে সময় সর্বহারা পার্টি শত্রুমুক্ত এলাকায় (মুক্তাঞ্চল) বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেশ কিছু পর্ষদ গঠন করে। কিন্তু এই সময় সিরাজ সিকদার ত্রি-মুখী লড়াইয়ের রণ কৌশল ঘোষণা করেন, যাতে সর্বহারা পার্টি ব্যপক লোকবল হারায়। আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে মুজিব বাহিনী ও সর্বহারা পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।

    এমনই পরিস্থিতিতে অক্টোবরে সর্বহারা পার্টি দলের গেরিলাদের নির্দেশ দেয় পাক-বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে। কারণ সিরাজ সিকদার পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী , ভারতকে অধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

    নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হয়েছিলো।

    ২। নকশালী মূল্যায়ন: আই অ্যাম দা পার্টি!
    ১৯৬৬ সালের চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে দুই বাংলায়। ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’ মাওসেতুং এর এই দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ, তথা সশস্ত্র কৃষক বিপ্লবের রনোনীতি গ্রহণ করে যুদ্ধপূর্ব সময়ের বামপন্থী দলগুলোর একাংশ। সাধারণভাবে এসব বামদলগুলো পিকিংপন্থী (পরে নকশাল) হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরই একটি পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টি; এই পার্টির নেতৃত্বে ছিলো আবার দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা ১৯৭১ সালে রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলেন পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। তবে স্পষ্টতই এর বেশীরভাগ প্রতিরোধ যুদ্ধই পরিচালিত হয় মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে।

    এর আগে অগ্নিগর্ভ যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে ১৯৬৯-৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর ন্যাপের নেতৃত্বে লাল টুপির সম্মেলন এবং সন্তোষ কৃষক সম্মেলনেও পিকিংপন্থী নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

    পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (দেবেন সিকদার) কেন্দ্রীয় নেতা আজিজ মেহের ১৯৬৯ সালে সার্বক্ষনিক কর্মী হিসেবে পার্টির ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল আঞ্চল তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে সারাদেশে সামরিক আইন জারী করেছেন।

    প্রকাশ্য রাজনীতি ছেড়ে আত্নগোপনে থেকেই পার্টির নেতারা চেষ্টা করলেন মাওবাদী ছোট ছোট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার। মূল দায়িত্ব দেয়া হলো আজিজ মেহেরকে। বরিশালে একজন অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের সঙ্গে আজিজ মেহেরের প্রথম দফা বৈঠক অসফল হয়। পরে মাওপন্থী ছাত্রদের একটি গ্রুপ তাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্নতা প্রকাশ করে পার্টিতে যোগ দেয়। এর পর ঐক্যের ডাক নিয়ে আজিজ মেহের সাক্ষাৎ করেন সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদারের সঙ্গে।

    বাকী কথা আজিজ মেহেরের ভাষ্যে:

    "…একটি গ্রুপ কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে তখন বিকশিত হচ্ছে ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও তার সম্পর্কে বামপন্থী-বুদ্ধিজীবী মহলে নানা বিভ্রান্তি। কেউ মনে করতেন, এরা অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, সন্ত্রাসবাদী; কেউ মনে করতেন, সিরাজ সিকদার হচ্ছেন সিআইএ’র এজেন্ট। তবে আমাদের পার্টি এ বিষয়টি এমন একপেশে, যান্ত্রিকভাবে দেখতো না। আমি মনে করি, কমরেড সিরাজ সিকদারের একটি বিপ্লবী আকাঙ্খা ছিলো। কথাবার্তা, চলাফেরা– সবকিছুর মধ্যে ছিলো একটা আকর্ষণীয় ব্যপার। তরুণ ছাত্রকর্মী, যারা বিপ্লবের জন্য ছিলো ব্যাকুল, তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়েছিলো। তারা কয়েকটা গেরিলা গ্রুপ করে, কয়েকটি সরকারি অফিসে বোমাবাজী করে, দেয়াল লিখনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। বিশেষ করে সিরাজ সিকদারের থিসিস আকৃষ্ট করেছিলো ছাত্র-তরুণদের।

    কিন্তু আমরা মনে করতাম, এদের কর্মকাণ্ডে যতটা রোমান্টিক বিপ্লবী উপদান আছে, ততটা মার্কসীয় উপাদান নেই।

    তবু অনেক চেস্টার পর ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় কমরেড সিরাজ সিকদারের সঙ্গে আমার দেখা হলো। উনি আমাদের পার্টির দলিলই পড়েননি! তার ব্যাগে দলিল ভড়ে দিলাম। সব শুনে উনি বললেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কোনো ইচ্ছা ‘তার বা তার পার্টির’ নেই। কথা শুনে মনে হলো: উনিই পার্টি!

    কথাবার্তার সময় সিরাজ সিকদার বার বার তার কোটের পকেট থেকে মাওসেতুং এর লাল বই (কোটেশন ফ্রম মাওসেতুং, রেড বুক হিসেবে সারা বিশ্বে বহুল প্রচারিত) বের করে দু-এক পাতা দেখে নিচ্ছিলেন। ওনার শোল্ডার হোল্ডারে একটা রিভলবার দেখতে পেলাম। সব কিছুই যেনো একটা ‘শো’ বলে মনে হচ্ছিলো।

    মনে হলো, উনি একজন উচ্চাকাঙ্খী বামপন্থী নেতা। রোমান্টিক কর্মকাণ্ডের জন্য তার গ্রুপের কিছুটা বিকাশ হয়তো হবে; তার কোনো ভবিষ্যত নেই। আমাদের পার্টির ঐক্য হলো না।…"

    ৩। তোমার নাম, আমার নাম/ ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!
    সাতের দশকের শুরুতে ওপারে ভারতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) বা সিপিআই (এম-এল) জলপাইগুড়ির নকশালবাড়িতে সফলভাবে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একে ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ হিসেবে চিহ্নিত করলে চারু মজুমদার পার্টিতে ঘোষণা করেন:

    নকশালবাড়ির পথ ধরেই ভারতে কৃষক বিপ্লব বিদ্রোহ হবে; মাওসেতুং-এর দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের পথই আমাদের পথ; জনযুদ্ধই মুক্তির সদন…

    কলকাতার দেয়ালে লেখা হয়:

    নকশালবাড়ি লাল সেলাম!

    চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান!

    বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে!

    ৭০এর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন!

    হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী চার মজুমদারের উদাত্ত আহ্বানে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দেয়।

    সে সময় নকশালরা সাইকেলের পাইপ কেটে ছড়ড়ার বুলেট ব্যবহার করে হাতে তৈরি সিঙ্গেল শট বন্দুক ‘পাইপগান’ বানায়। আর পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল ও কুঁদো ছেটে ছোট আকৃতি দিয়ে তৈরি করা হয় সহজে বহনযোগ্য কাটা-রাইফেল। এছাড়া কাঁচের বোতলের ভেতর আলকাতরা ও পেট্রোলের মিশ্রনে তৈরি হয় মলটোভ বোমা। নকশালবাদী আন্দোলনে গ্রাম ও শহরে ‘শ্রেনী শত্রু খতমের লাইনে’ বিপ্লব করতে এই অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে। সঙ্গে রাম দা তো ছিলোই।

    নকশালবাদী আন্দোলনের ঢেউ এপারে মাওপন্থী বাম দলগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি সরাসরি চারু মজুমদারের খতমের লাইন গ্রহণ না করলেও নকশালী কায়দায় জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী লাইন, তথা জোতদার নিধন কর্মসূচি চালায়। এপারেও নকশালাইট ও সর্বহারাদের মধ্যে পাইপ গান ও কাটা রাইফল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

    নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে কবি সুবিমল মিশ্র লিখলেন:

    আবার পাইপ গান এতো বেশী গরম হয়ে আসে যে, ক্রমশ এর ব্যবহার কমে আসছে। …

    অর্থাৎ মাওবাদী গ্রুপগুলো সাতের দশকে ‘শ্রেণী শত্রু খতমের’ নামে যখন পাইপগানের যথেচ্ছ ও ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে, এমন কী তা দলীয় কোন্দল মেটাতেও ব্যবহার হতে থাকে, তখন তারা আদর্শচ্যূত হয়ে পড়ে। জনযুদ্ধের অস্ত্রের বিপ্লবী ব্যবহার না হয়ে, তা ব্যবহত হতে থাকে গোষ্ঠি বিপ্লবের নামে, কখনো ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষাতেও। …

    পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) কেন্দীয় নেতা, নকশালপন্থী আজিজ মেহের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, চারু মজুমদারের মতো এপাড়েও শিক্ষিত তরুণ সমাজ সহজেই সিরাজ সিকদারের বিপ্লবের থিসিসে আকৃষ্ট হয়।

    সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিজ মেহেরকে আটক করে ব্যপক নির্যাতন করে এবং তাকে সশ্রম কারাদন্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। নতুন রাজনৈতিক বন্দী এবং কয়েকজন বাঙালি জেল পুলিশের বরাতে তিনি তখন দেশের সব খবরাখবরই পেতেন। এমন কী পার্টির নেতাদের সঙ্গেও তার গোপন চিঠিপত্রের লেন দেন চলছিলো।

    আজিজ মেহের বলেন,

    " …ওদিকে কিন্তু ভারতে নকশাল দমনের নামে হাজার হাজার তরুনকে হত্যা করা হচ্ছে; গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের বামেরা কখনো ডানে, কখনো বামে হেলছেন। কিন্তু তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, শ্রেণী শত্রু খতম করছেন, কখনো মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। আমরা সব খবরই জেলে বসে বিশেষ চ্যানেলে পেতাম।"

    এই সময় কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো-চে গুয়েভারার বিপ্লবী আন্দোলন এবং ভিয়েতনামে হো চি মিনের কৃষক বিপ্লব ওপার বাংলা-ওপার বাংলায় তরুনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। সারাদেশে শ্লোগান ওঠে:

    তোমার নাম, আমার নাম
    ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!

    এদিকে ১৯৭২-৭৪ মাওবাদী বা পিকিংপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে সশস্ত্রপন্থার রণোনীতি নিয়ে বিভেদ দেখা দেয়। শিগগিরই শুরু হয়ে যায় পরস্পরকে বহিস্কার ও মৃত্যূদণ্ড ঘোষণা। সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্টিকে নিস্কন্টক রাখতে ‘নিপাত চক্র’ নামে পার্টির ভেতরে একটি অনুগত গ্রুপ করেছিলেন। এদের মূল কাজ ছিলো, পার্টির ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীলদের হত্যা করা।

    আজিজ মেহের জেল খানার জীবনের স্মৃতি চারণ করে বলেন,

    " …আমাকে নিউ ২০ সেলে স্থানান্তর করা হলো। পাশের সেলে ছিলো বৃহত্তর বরিশালের কাকচিরা গ্রামের ও বরিশাল কলেজের ছাত্র কমরেড সেলিম শাহনেওয়াজ। সে ছিলো সিরাজ সিকদারের পার্টির সদস্য। ১৯৭১ এর পরে ১৯৭৩ এ পার্টির সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সিরাজ সিকদারের নির্দেশে এই আত্নত্যাগী তরুণকে হত্যা করা হয়। যেমন হত্যা করা হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন কবিরকে।…"

    যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুতে পরিণত হয় মাওপন্থীরা।

    আজিজ মেহের বলছেন,

    "(১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে) আমি দ্রুত পার্টি লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং (আত্ম-গোপনের জন্য) ঢাকায় কয়েকটি শেল্টার ঠিক করে ফেললাম। ১৯৭১ সালে আমাদের পার্টি বিশেষ এক অধিবেশনে চারু মজুমদারের নকশালী লাইন গ্রহণ করে। সে সময় তারা শ্রেণীশত্রু খতমের পাশাপাশি পাক-বাহিনীকেও মোকাবিলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের পার্টি একই রকম কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ও মুজিব বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলো এই সব গ্রুপ। সারাদেশে ‘ধরো আর মারো’ শুরু হয়ে গেলো। শেখ মুজিব এক জনসভায় ঘোষণা করলেন: নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে। মওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিলেন: নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অধিকার সরকারের নেই।…"

    এদিকে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়,

    ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ম সমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে।

    মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থন করেন। হরতাল সফল হয়।…

    ৪। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?
    সাতের দশকের নকশাল নেতা আজিজ মেহের বলছেন:

    " ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্মসমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়।…সশস্ত্র কার্যক্রমের মুখে মুজিব সরকার নকশাল ও সর্বহারা পার্টি নিধনে ব্যপক তৎপর হয়। সর্বহারা নেতা সিরাজ সিকদার পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে ধরা পড়েন। মুজিব সরকার তাকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেন। …এটি ছিলো ১৯৭২-৭৫ এ মাওপন্থী নিধনযজ্ঞের একটি ধারাবাহিকতা মাত্র।"

    ৪ জুন ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন : ১. সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ২. আবদুর রাজ্জাক এমপি, ৩. তোফায়েল আহমেদ এমপি, ৪. সাবেক আইজিপি ই এ চৌধুরী, ৫. সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, ৭. মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

    " আর্জিতে বলা হয়, আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১ নং থেকে ৬ নং আসামি তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উলি্লখিত আসামিরা তাঁদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ই এ চৌধুরীর একজন নিকটাত্মীয়কেও চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে ওই দিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দিদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগস্থ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।

    "২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। আর্জিতে আরো বলা হয়, প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সিরাজ সে অবস্থায়ও শেখ মুজিবের পুত্র কর্তৃক সাধিত ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম, ভারতীয় সেবাদাসত্ব না করার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শেখ মুজিবের কাছে দাবি জানালে শেখ মুজিব আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সে সময় ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন তাঁর রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ওই সময় সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এর পর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং ২ থেকে ৭ নং আসামি সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১ নং আসামিকে নির্দেশ দেন। ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন আহমদ আসামিদের সঙ্গে বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। এর পর তাঁর ওপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১ নং আসামির সঙ্গে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।"

    এদিকে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ নামক প্রামান্য গ্রন্থে তুলে ধরেন সিরাজ সিকদার হত্যার বিস্তারিত দিক। এর আগে মুজিব সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এ সংক্রান্ত কিছু সাক্ষাতকারভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হয়।

    বলা ভালো, মাসকেরেনহাসই প্রথম সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় তখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাক-বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরে ধরেন। তার সেই নিবন্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্যগ্রন্থ ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ’ সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্পূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই সাংবাদিকের ছিলো একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানসহ শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।

    ‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে মাসকেরেনহাস মুজিব হত্যা, তিন জাতীয় নেতা হত্যা, জিয়উর রহমান হত্যাসহ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা নাটকীয় ঘটনা নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে বর্ণনা করেন। এ জন্য তিনি শাতাধিক সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন।

    মাসকেরেনহাস বলছেন:

    "ঘটনাচক্রে মাওপন্থী সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলেন।

    জাকারিয়া চৌধুরির (সিরাজ সিকদারের ছোটবোন, ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, তাকে পাহারা দিয়ে ঢাকায় আনা হলো শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করানো জন্য। শেখ মুজিব তাকে তার আয়ত্বে আনতে চাইলেন। কিন্তু সিকদার কোনো রকম আপোষ রফায় রাজী না হলে মুজিব পুলিশকে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে বলে দিলেন।

    জাকারিয়া বললো, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় রমনা রেস কোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর (২ জানুয়ারি ১৯৭৫) গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই সময় সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় যে, ‘পালানোর চেষ্টাকালে সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

    সিকদারের বোন, জাকারিয়ার স্ত্রী শামীম জানায়, সিরাজের দেহের গুলির চিহ্ন পরিস্কার প্রমাণ করে যে, স্টেনগান দিয়ে তার বুকে ছয়টি গুলি করে তাকে মারা হয়েছিলো।

    সিরাজ সিকদারকে, শেখ মুজিবের নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে বলে সারাদেশে রটে গেলো।

    ১৯ বছরের যুবতী শামীম তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

    সে আমাকে বলেছিলো, আমি সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটা রিভলবার পেয়েছিলাম এবং এই হত্যাকারীকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধান করছিলাম।

    শামীম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন। গত বছরই কেবল সে তার ভাস্কর্যের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করে। তার ধারণা, সে নিশ্চয়ই মুজিবকে গুলি করার দূরত্বে পেয়ে যাবে।

    শামীম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুবার আর্জি পেশ করেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সে। তারপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের কলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানালো। মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলেন।

    সে স্মৃতিচারণ করে বললো, আমি ভায়নক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে (শেখ মুজিব) আমার গুলির আয়ত্বে আনতে পারলাম না।

    ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। শামীম জাকারিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। শেষে তাদের বিয়ে হলে স্বামীর সঙ্গে শামীম বিদেশে চলে যায়।"

    এদিকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করানোর পর তার দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল প্রসঙ্গে শেখ মুজিব অধিবেশনে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর যারা এর বিরোধীতা করেছে, যারা শত্রুর দালালী করেছে, কোনো দেশেই তাদের ক্ষমা করা হয় নাই। কিন্তু আমরা করেছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বলেছি, দেশকে ভালোবাসো। দেশের স্বাধীনতা মেনে নাও। দেশের কাজ করো। কিন্তু তারপরও এদের অনেকে শোধরায়নি। এরা এমনকি বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে বিদেশ থেকে টাকা নিচ্ছে। ওরা ভেবেছে, আমি ওদের কথা জানি না! একজন রাতের আঁধারে মানুষ মেরে যাচ্ছে, আর ভাবছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? তাকে যখন ধরা গেছে, তখন তার সহযোগীরাও ধরা পড়বে।…

    এরপর মুজিব, জিয়া ও এরশাদ সরকারের দমননীতির ভেতর সর্বাহারা পার্টি বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বেশীরভাগ উপদলই আদর্শহীন সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিনত হয় মাত্র– সে ইতিহাস সবার জানা।

    বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফজতে মৃত্যু/বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড/ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার প্রশ্নে সিরাজ সিকদারই প্রথম রাজনৈতিক নেতা কি না, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম এমন রাষ্ট্রীয় খুনের শিকার হলেন–এ বিষয়টিও এসে যায়।

    তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাংদেশের সঠিক ইতিহাস রচনায় শুধু শেখ মুজিব, চার জাতীয় নেতা বা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারই শুধু যথেষ্ট নয়, শহীদ দেশ প্রেমিক বিপ্লবী সিরাজ সিকদার, কর্নেল তাহের, চলেশ রিছিলসহ সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার হওয়া জরুরি।

    অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তার ওই বইটির শেষ বাক্যে যেমন বলেন,

    "দুরভিসন্ধী আর হত্যা, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। এক হত্যা আরেক হত্যাকে তরান্বিত করেছে, দেশকে আবদ্ধ করেছে এক রক্তের ঋণে।…"

    তবে সবার আগে চাই '৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এর আবশ্যিকতা সব প্রশ্নের উর্দ্ধে।।

    http://www.unmochon.net/node/639
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৭:২১576941
  • ["সিরাজ সিকদারের রাজনীতির সূচনাই হচ্ছে খতমের মাধ্যমে বিপ্লব। ভড়ং করে "শ্রেণী শত্রু খতম"য়ের স্থলে নাম দিয়েছিল "জাতীয় শত্রু খতম।" ফলে খতমের রাজনীতি করতে করতে এসএস-এর পার্টি শুরুতে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ খুন দিয়ে শুরু করলেও পরে তা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের খুন করে সমাজৈ ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়। খতমের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় পার্টির অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব খতম হয়ে আরো পরে তা খোদ কেন্দ্রীয় কমিটিকে খতম করে ১ সদস্য বিশিষ্ট করে ফেলে। এসএস শূলত সিআইএ প্রণীত "রেড ব্যানার ওপোজ রেড ব্যানার" কর্মসূচী বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন। ফলে যে পথে আর আগমন এবং উত্থান সে পথেই তার গমন! খুন, খতম, গলাকাটা ইত্যাকার কুকর্মের মধ্যদিয়েই তার উত্থান। কর্মীদের শ্রেণীচেতনার শাণিত করতে সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্ঠির অভ্যন্তরে চালু করেছিল এই নীতি যে, নবীন কমরেডদের বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহে ছুরি চালিয়ে শ্রেণী চেতনা শাণিত করতে হবে।"] --আবুল খায়ের।

    ["এই চিনাপন্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিল না। এদের নিজেদের চলার মত কোনো অবস্থার কারণে মওলানা ভাসানীর আশ্রয়ে থেকেছে। ফলে মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে মার্কসবাদ-মাওবাদের একটা আজগুবী মিশেল করার করেছে। তবে রাজনৈতিক হাওয়া বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ, মস্কোপন্থীদের পক্ষে থাকায় একাত্তরে এদের একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশ নেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এরা স্বাধীনতার পরে পরিস্থিতি বুঝে আবার পাকিস্তানী রাজাকারদের হয়ে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করতে শুরু করে। মজার কাণ্ড এদের দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই সাম্প্রদায়িক-পাকিস্তানপন্থানপন্থীদের পরিবার থেকে এসেছে। আমার শহরে সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা বিড়ধী লাল মিয়ার ছেলে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির নেতা হয়েছিলেন ৭১ এর পরে। আবার ১৯৭৫ সালের পরে তিনি আবার যথারীতি সরাসরি পাকিস্তানপন্থীদের দলেই ভিড়ে গেছেন। সর্বহারা দলে নেই।"] --কুলদা রায়

    ___________________________________________________

    সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা :: বিপ্লব রহমান • প্রকাশকাল: 3 আগস্ট 2011 - 5:09অপরাহ্ন

    [এসএস'কে নিয়ে এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। বেশীরভাগ লেখাই কোনো দলীয়স্বার্থ পূরণের জন্য। অনেকে ব্যক্তি এসএস'র জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে তার বিপ্লবীত্বকে খাটো করেছেন। কেউ তাকে 'ভুল/বেহাত বিপ্লব'এর দোসর বলেই মূল্যায়নটি শেষ করতে চান। এই সব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বলে লেখার শিরোনামে 'অন্য আলোয় দেখা' কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। এটি মোটেই এসএস'র কর্মকাণ্ডের সামগ্রীক মূল্যায়ন নয়। এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নির্মোহভাবে এই শহীদ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে দেখার একটি ছোট্ট প্রয়াস।]

    আর কয়েকটা শত্রু খতম হলেই তো গ্রামগুলো আমাদের/ জনগণ যেনো জল, গেরিলারা মাছের মতো সাঁতরায়…সিরাজ সিকদার।

    অস্ত্র কোনো নির্ধারক শক্তিনয়, নির্ধারক শক্তি হচ্ছে মানুষ। সংগঠিত জনগণ অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী।…মাওসেতুং।

    ১। সর্বহারা পার্টি গঠন, ১৯৭১
    গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক মাওসেতুং-এর নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব ও চীনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছয়ের দশকের শেষভাগে সারা বিশ্বের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো যুদ্ধোপূর্ব বাংলাদেশেও। পাকিস্তানী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট, অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলাকে বেশ কয়েকটি বামপন্থী গ্রুপ সশস্ত্র পন্থায় মুক্ত করতে চেয়েছিলো।

    এ সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও বিকশিত হতে থাকে জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন। পাকিস্তানপর্বে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় কমিউনিস্ট পার্টি মূলত আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মধ্যে মিশে গিয়ে কাজ করতে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই বাঙালিদের স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকে। এ পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার নানা প্রক্রিয়া হাতে নেয়। এ সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও জমে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর সঙ্গীদের। মামলার শেষ পর্যায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

    অন্যদিকে ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির ফাশিদেওয়া, নকশালবাড়ীতে ঘটে যায় এ সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পথ হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ নেয় চারু মজুমদারের নেতৃত্বে একদল কমিউনিস্ট। পরে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-- সিপিআই (এমএল) নামে পার্টি তৈরি করেছিলেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে নকশাল আন্দোলন নামে পরিচিত হয়েছিল। নকশালবাড়ীর সেই প্রবল জোয়ার পূর্ব পাকিস্তানেও আছড়ে পড়ে।

    পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আগেই রুশ ও চীন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি ধর্মভিত্তিক বৈরী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় কমিউনিস্ট হিসেবে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পথ তখন সহজ ছিল না, খুব কম লোকই সেই পথে এগোতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র সিরাজুল হক সিকদার বা সিরাজ সিকদার। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের ছাত্র বুয়েটের লিয়াকত হল শাখার সভাপতি সিরাজ সিকদার ওই বষয়েই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সদস্যপদ ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) চারু মজুমদারের সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের তত্ত্বকে হঠকারী হিসেবে আখ্যায়িত করল। এর প্রতিক্রিয়ায় পার্টি থেকে বেরিয়ে আসেন সিরাজ সিকদার।

    এই উত্তাল পরিস্থিতিতে তরুন বিপ্লবী সিরাজ সিকদার প্রথমে মাওসেতুং গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে শিক্ষিত ও বিপ্লব আকাঙ্খী যুবকদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি গঠন করেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। প্রতিষ্ঠার পরেই এ গ্রুপটির মূল থিসিস ছিলো: পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের’ মাধ্যমে এ উপনিবেশের অবসান ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়।

    ছয়-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

    অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল ‘দুই শ্রেণী শত্রু’ মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।

    অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল ‘দুই শ্রেণী শত্রু’ মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।

    ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এতে স্পষ্ট লেখা হয়:

    আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাক্ত ইহিতাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে, ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে। আপনাকে ও আপনার পার্টিকে পূর্ব বাংলার সাত কোটি জনসাধারণ ভোট প্রদান করেছে পূর্ব বাংলার উপরস্থ পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান করে স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলা কায়েম করার জন্য। পূর্ব বাংলার জনগণের এ আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন আপনার প্রতি ও আওয়ামী লীগের প্রতি নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলো পেশ করছে :

    " ১. পূর্ব বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এবং সংখ্যাগুরু জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করুন।

    ২. পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি-সংবলিত স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন।

    ৩. পূর্ব বাংলাব্যাপী এ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। এ উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয় শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান জানান।

    ৪. পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিক-কৃষক এবং প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে 'জাতীয় মুক্তি পরিষদ' বা 'জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট' গঠন করুন।

    ৫. প্রকাশ্য ও গোপন, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র, সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী পদ্ধতিতে সংগ্রাম করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।"

    (এরপর ৬ নম্বর পয়েন্টে শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠিতে ১৩টি করণীয় নির্ধারণ করে। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে জমি বণ্টন, শ্রমিকদের শ্রম শোষণ বন্ধ, ভাষাগত, ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম-অধিকার দেওয়ার বিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হাজির করে)।

    কিন্তু আওয়ামী নেতারা সিরাজ সিকদারের এই আহ্বান উপেক্ষা করেন, যা পরে গড়ায় দুই পার্টির এক রক্তাক্ত ইতিহাসে।

    ১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেনী শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়ায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা।

    পাকিস্তানী বাহিনীর আকস্মিক হামলার পর সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল জন্ম নেয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। রণকৌশল নির্ধারণ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিরাজ সিকদারের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা হয় ‘সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনা কমিটি’। ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয়: পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি।

    বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল–বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে।

    সে সময় সর্বহারা পার্টি শত্রুমুক্ত এলাকায় (মুক্তাঞ্চল) বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেশ কিছু পর্ষদ গঠন করে। কিন্তু এই সময় সিরাজ সিকদার ত্রি-মুখী লড়াইয়ের রণ কৌশল ঘোষণা করেন, যাতে সর্বহারা পার্টি ব্যপক লোকবল হারায়। আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে মুজিব বাহিনী ও সর্বহারা পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।

    এমনই পরিস্থিতিতে অক্টোবরে সর্বহারা পার্টি দলের গেরিলাদের নির্দেশ দেয় পাক-বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে। কারণ সিরাজ সিকদার পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী , ভারতকে অধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

    নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হয়েছিলো।

    ২। নকশালী মূল্যায়ন: আই অ্যাম দা পার্টি!
    ১৯৬৬ সালের চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে দুই বাংলায়। ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’ মাওসেতুং এর এই দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ, তথা সশস্ত্র কৃষক বিপ্লবের রনোনীতি গ্রহণ করে যুদ্ধপূর্ব সময়ের বামপন্থী দলগুলোর একাংশ। সাধারণভাবে এসব বামদলগুলো পিকিংপন্থী (পরে নকশাল) হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরই একটি পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টি; এই পার্টির নেতৃত্বে ছিলো আবার দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা ১৯৭১ সালে রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলেন পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। তবে স্পষ্টতই এর বেশীরভাগ প্রতিরোধ যুদ্ধই পরিচালিত হয় মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে।

    এর আগে অগ্নিগর্ভ যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে ১৯৬৯-৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর ন্যাপের নেতৃত্বে লাল টুপির সম্মেলন এবং সন্তোষ কৃষক সম্মেলনেও পিকিংপন্থী নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

    পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (দেবেন সিকদার) কেন্দ্রীয় নেতা আজিজ মেহের ১৯৬৯ সালে সার্বক্ষনিক কর্মী হিসেবে পার্টির ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল আঞ্চল তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে সারাদেশে সামরিক আইন জারী করেছেন।

    প্রকাশ্য রাজনীতি ছেড়ে আত্নগোপনে থেকেই পার্টির নেতারা চেষ্টা করলেন মাওবাদী ছোট ছোট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার। মূল দায়িত্ব দেয়া হলো আজিজ মেহেরকে। বরিশালে একজন অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের সঙ্গে আজিজ মেহেরের প্রথম দফা বৈঠক অসফল হয়। পরে মাওপন্থী ছাত্রদের একটি গ্রুপ তাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্নতা প্রকাশ করে পার্টিতে যোগ দেয়। এর পর ঐক্যের ডাক নিয়ে আজিজ মেহের সাক্ষাৎ করেন সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদারের সঙ্গে।

    বাকী কথা আজিজ মেহেরের ভাষ্যে:

    "…একটি গ্রুপ কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে তখন বিকশিত হচ্ছে ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও তার সম্পর্কে বামপন্থী-বুদ্ধিজীবী মহলে নানা বিভ্রান্তি। কেউ মনে করতেন, এরা অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, সন্ত্রাসবাদী; কেউ মনে করতেন, সিরাজ সিকদার হচ্ছেন সিআইএ’র এজেন্ট। তবে আমাদের পার্টি এ বিষয়টি এমন একপেশে, যান্ত্রিকভাবে দেখতো না। আমি মনে করি, কমরেড সিরাজ সিকদারের একটি বিপ্লবী আকাঙ্খা ছিলো। কথাবার্তা, চলাফেরা– সবকিছুর মধ্যে ছিলো একটা আকর্ষণীয় ব্যপার। তরুণ ছাত্রকর্মী, যারা বিপ্লবের জন্য ছিলো ব্যাকুল, তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়েছিলো। তারা কয়েকটা গেরিলা গ্রুপ করে, কয়েকটি সরকারি অফিসে বোমাবাজী করে, দেয়াল লিখনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। বিশেষ করে সিরাজ সিকদারের থিসিস আকৃষ্ট করেছিলো ছাত্র-তরুণদের।

    কিন্তু আমরা মনে করতাম, এদের কর্মকাণ্ডে যতটা রোমান্টিক বিপ্লবী উপদান আছে, ততটা মার্কসীয় উপাদান নেই।

    তবু অনেক চেস্টার পর ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় কমরেড সিরাজ সিকদারের সঙ্গে আমার দেখা হলো। উনি আমাদের পার্টির দলিলই পড়েননি! তার ব্যাগে দলিল ভড়ে দিলাম। সব শুনে উনি বললেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কোনো ইচ্ছা ‘তার বা তার পার্টির’ নেই। কথা শুনে মনে হলো: উনিই পার্টি!

    কথাবার্তার সময় সিরাজ সিকদার বার বার তার কোটের পকেট থেকে মাওসেতুং এর লাল বই (কোটেশন ফ্রম মাওসেতুং, রেড বুক হিসেবে সারা বিশ্বে বহুল প্রচারিত) বের করে দু-এক পাতা দেখে নিচ্ছিলেন। ওনার শোল্ডার হোল্ডারে একটা রিভলবার দেখতে পেলাম। সব কিছুই যেনো একটা ‘শো’ বলে মনে হচ্ছিলো।

    মনে হলো, উনি একজন উচ্চাকাঙ্খী বামপন্থী নেতা। রোমান্টিক কর্মকাণ্ডের জন্য তার গ্রুপের কিছুটা বিকাশ হয়তো হবে; তার কোনো ভবিষ্যত নেই। আমাদের পার্টির ঐক্য হলো না।…"

    ৩। তোমার নাম, আমার নাম/ ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!
    সাতের দশকের শুরুতে ওপারে ভারতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) বা সিপিআই (এম-এল) জলপাইগুড়ির নকশালবাড়িতে সফলভাবে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একে ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ হিসেবে চিহ্নিত করলে চারু মজুমদার পার্টিতে ঘোষণা করেন:

    নকশালবাড়ির পথ ধরেই ভারতে কৃষক বিপ্লব বিদ্রোহ হবে; মাওসেতুং-এর দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের পথই আমাদের পথ; জনযুদ্ধই মুক্তির সদন…

    কলকাতার দেয়ালে লেখা হয়:

    নকশালবাড়ি লাল সেলাম!

    চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান!

    বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে!

    ৭০এর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন!

    হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী চার মজুমদারের উদাত্ত আহ্বানে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দেয়।

    সে সময় নকশালরা সাইকেলের পাইপ কেটে ছড়ড়ার বুলেট ব্যবহার করে হাতে তৈরি সিঙ্গেল শট বন্দুক ‘পাইপগান’ বানায়। আর পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল ও কুঁদো ছেটে ছোট আকৃতি দিয়ে তৈরি করা হয় সহজে বহনযোগ্য কাটা-রাইফেল। এছাড়া কাঁচের বোতলের ভেতর আলকাতরা ও পেট্রোলের মিশ্রনে তৈরি হয় মলটোভ বোমা। নকশালবাদী আন্দোলনে গ্রাম ও শহরে ‘শ্রেনী শত্রু খতমের লাইনে’ বিপ্লব করতে এই অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে। সঙ্গে রাম দা তো ছিলোই।

    নকশালবাদী আন্দোলনের ঢেউ এপারে মাওপন্থী বাম দলগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি সরাসরি চারু মজুমদারের খতমের লাইন গ্রহণ না করলেও নকশালী কায়দায় জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী লাইন, তথা জোতদার নিধন কর্মসূচি চালায়। এপারেও নকশালাইট ও সর্বহারাদের মধ্যে পাইপ গান ও কাটা রাইফল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

    নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে কবি সুবিমল মিশ্র লিখলেন:

    আবার পাইপ গান এতো বেশী গরম হয়ে আসে যে, ক্রমশ এর ব্যবহার কমে আসছে। …

    অর্থাৎ মাওবাদী গ্রুপগুলো সাতের দশকে ‘শ্রেণী শত্রু খতমের’ নামে যখন পাইপগানের যথেচ্ছ ও ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে, এমন কী তা দলীয় কোন্দল মেটাতেও ব্যবহার হতে থাকে, তখন তারা আদর্শচ্যূত হয়ে পড়ে। জনযুদ্ধের অস্ত্রের বিপ্লবী ব্যবহার না হয়ে, তা ব্যবহত হতে থাকে গোষ্ঠি বিপ্লবের নামে, কখনো ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষাতেও। …

    পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) কেন্দীয় নেতা, নকশালপন্থী আজিজ মেহের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, চারু মজুমদারের মতো এপাড়েও শিক্ষিত তরুণ সমাজ সহজেই সিরাজ সিকদারের বিপ্লবের থিসিসে আকৃষ্ট হয়।

    সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিজ মেহেরকে আটক করে ব্যপক নির্যাতন করে এবং তাকে সশ্রম কারাদন্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। নতুন রাজনৈতিক বন্দী এবং কয়েকজন বাঙালি জেল পুলিশের বরাতে তিনি তখন দেশের সব খবরাখবরই পেতেন। এমন কী পার্টির নেতাদের সঙ্গেও তার গোপন চিঠিপত্রের লেন দেন চলছিলো।

    আজিজ মেহের বলেন,

    " …ওদিকে কিন্তু ভারতে নকশাল দমনের নামে হাজার হাজার তরুনকে হত্যা করা হচ্ছে; গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের বামেরা কখনো ডানে, কখনো বামে হেলছেন। কিন্তু তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, শ্রেণী শত্রু খতম করছেন, কখনো মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। আমরা সব খবরই জেলে বসে বিশেষ চ্যানেলে পেতাম।"

    এই সময় কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো-চে গুয়েভারার বিপ্লবী আন্দোলন এবং ভিয়েতনামে হো চি মিনের কৃষক বিপ্লব ওপার বাংলা-ওপার বাংলায় তরুনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। সারাদেশে শ্লোগান ওঠে:

    তোমার নাম, আমার নাম
    ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!

    এদিকে ১৯৭২-৭৪ মাওবাদী বা পিকিংপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে সশস্ত্রপন্থার রণোনীতি নিয়ে বিভেদ দেখা দেয়। শিগগিরই শুরু হয়ে যায় পরস্পরকে বহিস্কার ও মৃত্যূদণ্ড ঘোষণা। সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্টিকে নিস্কন্টক রাখতে ‘নিপাত চক্র’ নামে পার্টির ভেতরে একটি অনুগত গ্রুপ করেছিলেন। এদের মূল কাজ ছিলো, পার্টির ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীলদের হত্যা করা।

    আজিজ মেহের জেল খানার জীবনের স্মৃতি চারণ করে বলেন,

    " …আমাকে নিউ ২০ সেলে স্থানান্তর করা হলো। পাশের সেলে ছিলো বৃহত্তর বরিশালের কাকচিরা গ্রামের ও বরিশাল কলেজের ছাত্র কমরেড সেলিম শাহনেওয়াজ। সে ছিলো সিরাজ সিকদারের পার্টির সদস্য। ১৯৭১ এর পরে ১৯৭৩ এ পার্টির সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সিরাজ সিকদারের নির্দেশে এই আত্নত্যাগী তরুণকে হত্যা করা হয়। যেমন হত্যা করা হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন কবিরকে।…"

    যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুতে পরিণত হয় মাওপন্থীরা।

    আজিজ মেহের বলছেন,

    "(১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে) আমি দ্রুত পার্টি লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং (আত্ম-গোপনের জন্য) ঢাকায় কয়েকটি শেল্টার ঠিক করে ফেললাম। ১৯৭১ সালে আমাদের পার্টি বিশেষ এক অধিবেশনে চারু মজুমদারের নকশালী লাইন গ্রহণ করে। সে সময় তারা শ্রেণীশত্রু খতমের পাশাপাশি পাক-বাহিনীকেও মোকাবিলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের পার্টি একই রকম কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ও মুজিব বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলো এই সব গ্রুপ। সারাদেশে ‘ধরো আর মারো’ শুরু হয়ে গেলো। শেখ মুজিব এক জনসভায় ঘোষণা করলেন: নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে। মওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিলেন: নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অধিকার সরকারের নেই।…"

    এদিকে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়,

    ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ম সমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে।

    মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থন করেন। হরতাল সফল হয়।…

    ৪। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?
    সাতের দশকের নকশাল নেতা আজিজ মেহের বলছেন:

    " ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্মসমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়।…সশস্ত্র কার্যক্রমের মুখে মুজিব সরকার নকশাল ও সর্বহারা পার্টি নিধনে ব্যপক তৎপর হয়। সর্বহারা নেতা সিরাজ সিকদার পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে ধরা পড়েন। মুজিব সরকার তাকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেন। …এটি ছিলো ১৯৭২-৭৫ এ মাওপন্থী নিধনযজ্ঞের একটি ধারাবাহিকতা মাত্র।"

    ৪ জুন ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন : ১. সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ২. আবদুর রাজ্জাক এমপি, ৩. তোফায়েল আহমেদ এমপি, ৪. সাবেক আইজিপি ই এ চৌধুরী, ৫. সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, ৭. মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

    " আর্জিতে বলা হয়, আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১ নং থেকে ৬ নং আসামি তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উলি্লখিত আসামিরা তাঁদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ই এ চৌধুরীর একজন নিকটাত্মীয়কেও চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে ওই দিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দিদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগস্থ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।

    "২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। আর্জিতে আরো বলা হয়, প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সিরাজ সে অবস্থায়ও শেখ মুজিবের পুত্র কর্তৃক সাধিত ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম, ভারতীয় সেবাদাসত্ব না করার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শেখ মুজিবের কাছে দাবি জানালে শেখ মুজিব আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সে সময় ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন তাঁর রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ওই সময় সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এর পর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং ২ থেকে ৭ নং আসামি সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১ নং আসামিকে নির্দেশ দেন। ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন আহমদ আসামিদের সঙ্গে বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। এর পর তাঁর ওপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১ নং আসামির সঙ্গে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।"

    এদিকে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ নামক প্রামান্য গ্রন্থে তুলে ধরেন সিরাজ সিকদার হত্যার বিস্তারিত দিক। এর আগে মুজিব সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এ সংক্রান্ত কিছু সাক্ষাতকারভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হয়।

    বলা ভালো, মাসকেরেনহাসই প্রথম সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় তখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাক-বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরে ধরেন। তার সেই নিবন্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্যগ্রন্থ ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ’ সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্পূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই সাংবাদিকের ছিলো একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানসহ শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।

    ‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে মাসকেরেনহাস মুজিব হত্যা, তিন জাতীয় নেতা হত্যা, জিয়উর রহমান হত্যাসহ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা নাটকীয় ঘটনা নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে বর্ণনা করেন। এ জন্য তিনি শাতাধিক সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন।

    মাসকেরেনহাস বলছেন:

    "ঘটনাচক্রে মাওপন্থী সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলেন।

    জাকারিয়া চৌধুরির (সিরাজ সিকদারের ছোটবোন, ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, তাকে পাহারা দিয়ে ঢাকায় আনা হলো শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করানো জন্য। শেখ মুজিব তাকে তার আয়ত্বে আনতে চাইলেন। কিন্তু সিকদার কোনো রকম আপোষ রফায় রাজী না হলে মুজিব পুলিশকে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে বলে দিলেন।

    জাকারিয়া বললো, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় রমনা রেস কোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর (২ জানুয়ারি ১৯৭৫) গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই সময় সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় যে, ‘পালানোর চেষ্টাকালে সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

    সিকদারের বোন, জাকারিয়ার স্ত্রী শামীম জানায়, সিরাজের দেহের গুলির চিহ্ন পরিস্কার প্রমাণ করে যে, স্টেনগান দিয়ে তার বুকে ছয়টি গুলি করে তাকে মারা হয়েছিলো।

    সিরাজ সিকদারকে, শেখ মুজিবের নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে বলে সারাদেশে রটে গেলো।

    ১৯ বছরের যুবতী শামীম তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

    সে আমাকে বলেছিলো, আমি সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটা রিভলবার পেয়েছিলাম এবং এই হত্যাকারীকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধান করছিলাম।

    শামীম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন। গত বছরই কেবল সে তার ভাস্কর্যের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করে। তার ধারণা, সে নিশ্চয়ই মুজিবকে গুলি করার দূরত্বে পেয়ে যাবে।

    শামীম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুবার আর্জি পেশ করেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সে। তারপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের কলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানালো। মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলেন।

    সে স্মৃতিচারণ করে বললো, আমি ভায়নক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে (শেখ মুজিব) আমার গুলির আয়ত্বে আনতে পারলাম না।

    ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। শামীম জাকারিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। শেষে তাদের বিয়ে হলে স্বামীর সঙ্গে শামীম বিদেশে চলে যায়।"

    এদিকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করানোর পর তার দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল প্রসঙ্গে শেখ মুজিব অধিবেশনে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর যারা এর বিরোধীতা করেছে, যারা শত্রুর দালালী করেছে, কোনো দেশেই তাদের ক্ষমা করা হয় নাই। কিন্তু আমরা করেছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বলেছি, দেশকে ভালোবাসো। দেশের স্বাধীনতা মেনে নাও। দেশের কাজ করো। কিন্তু তারপরও এদের অনেকে শোধরায়নি। এরা এমনকি বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে বিদেশ থেকে টাকা নিচ্ছে। ওরা ভেবেছে, আমি ওদের কথা জানি না! একজন রাতের আঁধারে মানুষ মেরে যাচ্ছে, আর ভাবছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? তাকে যখন ধরা গেছে, তখন তার সহযোগীরাও ধরা পড়বে।…

    এরপর মুজিব, জিয়া ও এরশাদ সরকারের দমননীতির ভেতর সর্বাহারা পার্টি বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বেশীরভাগ উপদলই আদর্শহীন সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিনত হয় মাত্র– সে ইতিহাস সবার জানা।

    বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফজতে মৃত্যু/বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড/ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার প্রশ্নে সিরাজ সিকদারই প্রথম রাজনৈতিক নেতা কি না, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম এমন রাষ্ট্রীয় খুনের শিকার হলেন–এ বিষয়টিও এসে যায়।

    তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাংদেশের সঠিক ইতিহাস রচনায় শুধু শেখ মুজিব, চার জাতীয় নেতা বা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারই শুধু যথেষ্ট নয়, শহীদ দেশ প্রেমিক বিপ্লবী সিরাজ সিকদার, কর্নেল তাহের, চলেশ রিছিলসহ সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার হওয়া জরুরি।

    অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তার ওই বইটির শেষ বাক্যে যেমন বলেন,

    "দুরভিসন্ধী আর হত্যা, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। এক হত্যা আরেক হত্যাকে তরান্বিত করেছে, দেশকে আবদ্ধ করেছে এক রক্তের ঋণে।…"

    তবে সবার আগে চাই '৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এর আবশ্যিকতা সব প্রশ্নের উর্দ্ধে।।

    http://www.unmochon.net/node/639
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৭:২৭576942
  • @ lcm , ঠিক। এক্সট্রিম প্রোপাগান্ডা এখন আর পাবলিকে খায় না। কিন্তু মুজিব+এসএস প্রশ্নে এটি অনেক সু/কুলেখকেরই মগজ কুরে কুরে খাচ্ছে দেখতে পাই। ইতিহাসের লীলা? :D
  • Sibu | 86.79.34.100 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ১৯:৩৬576943
  • গুয়াতেমালাকে খাদ্য সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন - এটি খাদ্য খয়রাতি না খাদ্য ঋণ (পিএল ৪৮০র অধীনে হলে টাইটল ১ না অন্য কোন ধারায়)? খাদ্য ঋণ হলে ব্যাপারটা ঠিক ততটা ফিলানথ্রপিক না।

    আম্রিকা একটি সরল গোলগাল ব্যবসায়ী যার পলিটিক্যাল গোল আছে। তার পলিটিক্যাল গোল বাংলাদেশ বা ভারতের সাধারন লোকের পক্ষে সব্সময় ভাল নাও হতে পারে, সত্যি বলতে কি সেটা তাদের নিজেদের সাধারন লোকের জন্যও সবসময় ভাল নাও হতে পারে। এখন সেটাকে কেউ দুষ্টু/ভাল বললে বলতেই পারে, সেটা কথা না। কথা হল গিভেন দেয়ার লং হিস্টরী অফ পলিটিক্যাল মিসচীফ অ্যান্ড ইন্টারফিয়ারেন্স, আম্রিকান দান-খয়রাতি একটু কেয়ারফুলি স্ক্রুটিনি করে দেখার দরকার আছে। সবটাকেই/খানিকটাকেও ফেসভ্যালুতে ফিলানথ্রপি বলে ধরে নেওয়া অযৌক্তিক।
  • b | 135.20.82.166 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ২১:৩৭576733
  • বিপ্লব বাবুর লেখাটা একটু অগোছালো লাগলো।
  • lcm | 138.48.127.32 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ২৩:০৯576734
  • শিবুদা,
    ঠিক। অনেক এইড-ই পলিটিক্যালি মোটিভেটড, অন্য দেশের রাজনৈতিক আনুগত্য আদায়ের অস্ত্র। গত বিশ বছরে, সোভিয়েতের পতনের পর থেকে, ফরেন এইড-এর রাজনীতির বদল হয়েছে।
    কন্ডিশ্যানাল এইড কিন্তু কোনো দেশ রিফিউজ করতে পারে। যেমন, ইদানীং কালে ইউএস ফরেন এইড যে সব দেশ পায় তাদের মধ্যে দ্বিতীয় ইজিপ্ট (প্রথম ইস্রায়েল)। ইজিপ্ট কিন্তু মাঝে ইউএস-এর কিছু কন্ডিশন্যাল এইড রিফিউজ করেছে। নর্থ কোরিয়া রিফিউজ করেছে - কন্ডিশন ছিল যে নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম বন্ধ রাখতে হবে, এসেট্রা। এইড (রিসার্চ, মেডিক্যাল, ফুড) নিয়ে কিছু দেশের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণের তীব্রতা যতটা কোল্ড ওয়ার পিরিয়ডে ছিল, এখন কমেছে - মিলিটারি এইড বাদে।
    পিএল৪৮০-র আইডিয়া ছিল অতিরিক্ত খাদ্য নষ্ট না করে, অন্য দেশে সরবরাহ করা, তবে বিনিময়ে শান্তি চাই - এই প্রোগ্রামের আর এক নাম দেওয়া হয়েছিল - food for peace - নামটাই হাস্যকর। এই প্রোগ্রাম ডেফিনিটলি পলিটিক্যালি মোটিভেটেড ছিল, ১৯৫০-৮০র সময়ে পিস ব্যাপারটাই ছিল পলিটিক্যাল, এখনও।

    হাইতি-তে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর আমেরিকান এইড নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম (এনওয়াইটি, বা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট কোথাও একটা), তাতে বেশ ডিটেইলস-এ কভার করেছিল - ইউএস ফরেন এইড প্রোগ্রাম, জিও পলিটিক্স... এসেট্রা।
  • Sibu | 139.93.4.17 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ২৩:২০576735
  • শুধু কন্ডিশনাল কেন, আনকন্ডিশনাল এইডও কেউ রিফিউজ করতে পারে, ইন থিওরি। মহাজনের ঋণও তো চাষী না নিতে পারে, ইন থিওরি।

    মহাজনও ফিলানথ্রপি করে না, আম্রিকাও না। এইটুকুই বলার।
  • ranjan roy | 24.96.107.12 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:৩৮576736
  • PT কি বলছেন যে আমেরিকা তার দালালদের হত্যা করে না? কি যে কন কত্তা?
    খালি ষাটের দশকের ভিয়েতনামরে দ্যাখেন। যখন থেকে ফ্রান্সের জায়গায় আমেরিকা ভিয়েতনামে নিয়ন্তা হয়ে সায়গনে পুতুল সরকার চালানো শুরু করেছে, তখন থেকে একের পর এক কাজ ফুরোলেই নিজের চ্যালাদেরও সি আই এর ঘাতকদের দিয়ে নির্মম হত্যা করাতে পিছপা হয় নি। একটি নমুনা দেখুন-- নগো দিন দিয়েম। প্রেসিডেন্ট ধীরে ধীরে ক্ষমতাশালী হলেন মাদাম দিয়েন, যদ্দূর মনে আছে প্রেসিডেন্টের ভাইবৌ। আধো আধো উচ্চারণে বলতেন- পাওয়ার ইজ ওয়ান্দারফুল, তোতাল পাওয়ার ইজ তোতালি ওয়ান্দারফুল। ওনার বিলাসব্যসনের তুলনা শুধু ফিলিপাইনসের মহিলা শাসকটি।
    যখন দিয়েম পরিবার তাদের অত্যাচারেরো বিলাসের জন্যে আমেরিকার বোঝা হয়ে দাঁড়াল তখন তাদের নির্মম হত্যা করিয়ে আরেক পুতুল কম্যান্ডার জেনারেল কাও কি কে প্রেসিডেন্ট করা হল।
    এই ঘটনা থাইল্যান্ডে ও বিভিন্ন ব্যানানা রিপাব্লিকেও রিপিট হয়েছে।
    দিদি ও তো অনুগত কিন্তু জনপ্রিয়্তা হারানো মন্ত্রী বা আইপিএসদের বদলান !
    তবে এর থেকে মুজিব আমেরিকার দালাল ছিলেন এটা একটু সরলীকরণ মনে হয়। কিন্তু ওনাকে সমাজতন্ত্রের পূজারী বলাটাও বিশ্লেষণ নয় পূজা। তাহলে ইন্দিরাও গরীবের বন্ধু ও সমাজতান্ত্রিক!
    আর মুজিবের প্রথম রাজনৈতিক জীবন কেটেছে মুসলীম লিগের নেতা ও সোহরাবর্দীর অনুগামী হয়ে এটাও তো ইতিহাস।
    বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোল্নের ইতিহাস নিয়ে লেখা প্রামাণ্য বইটির বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু ডকুমেন্টেড তথ্যগুলোর সঙ্গে?
  • কুলদা রায় | 34.90.91.2 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ০৪:৪৯576737
  • সিরাজ সিকদারকে নিয়ে আলোচনা দেখে মনে হয় তিনি অনেক বড় নেতা ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বিপ্লব হয়ে যেত। বিপ্লব প্রায় হয়েই গিয়েছিল--কিন্তু সিরাজ সিকদারকে মেরে ফেলার পরে বিপ্লব মুছে গেল। বিপ্লব এসেই সিরাজ সিকদারকে না দেখে চলে গেছে। আর কোনোদিন আসবে না।
    বিষয়টা এ রকম। কিন্তু বাস্তবতা হল সিরাজ সিকদার বাংলাদেশে কোনো কালেই বড় ধরনের নেতা ছিলেন না। তার দল কোনো পর্যায়েই ছিল না। তাকে নিয়ে এতো আলোচনা কেনো? কারা তাকে নিয়ে আলোচনা করে?

    বিপ্লব রহমানই বলেছেন--তার দল দেশের কয়েকটি এলাকায় যুদ্ধ করেছিল। এলাকার নামগুলো দেখেন-- রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গ এবং বরিশালের স্বরুপকাঠি ও ঝালকাঠীর পেয়ারা বাগান। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে কয়েকটি গ্রামে। অথচ বাংলাদেশে ৭০,০০০ গ্রাম আছে। সিরাজ সিকদারের দল এই ৭০,০০০ গ্রামের মধ্যে হয়তো মাত্র ৭০টি গ্রামের ছিল। তাহলে কত শতাংশ ছিল সিরাজ সিকদারের দলের অবস্থা! এবং দলের সাংগঠনিক অবস্থাটা দেখেন--সিরাজ সিরাজ সিকদার মারে গেল। কিন্তু তার পরপরই তার বিপ্লবী পার্টি কোথায় গেলো? তারা কেনো পার্টিটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না? কেনো তারা বিপ্লবের পক্ষে আর কাজ করতে পারল না? তাহলে কি সিরাজ সিকদার একাই তার পার্টি ছিলেন? তিনি একাই পার্টির নেতা কর্মি ছিলেন? যদি দলের মধ্যে এক নেতা এক কর্মি নির্ভর দল হয় তাহলে সে দল কি করে জনগণকে সংগঠিত করার মত বড় কাজটি করবে? এটা কোনো আলাদিনের চেরাগের রাজনীতি?

    সিরাজ সিকদার মারা গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে মেরে ফেলা হল। সিরাজ সিকদারের দলের লোকজনের আর কোনো খবর পাওয়া গেল না। কিছু কিছু লোকজন পরে সেনাতন্ত্র, আমলাতন্ত্র, ধনিকতন্ত্র সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল লুটেরাদের দলে ভিড়ে গেলেন। দেখা গেল--এরা গ্রামে গ্রামে এই অস্ত্রপাতি নিয়ে এই সব দল্গুলোর হয়ে কাজ করছে। তাদের হয়ে প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলছে। তাদের হয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করছে। দিনের বেলা নানা ধরনের ফাটকা ব্যবসা করছে আর রাতের বেলা ডাকাতি করছে। বরিশালের পেয়ারা বাগান এলাকাটি হুন্দু নমশুদ্র অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে গরীভ চাশজীরা পেয়ারা বাগানে করে চলে। পেয়ারা মৌসুমে পেয়ারা বিক্রি করে ঘরে টাকা আনার আগেই এই সর্বহারার নামে লোকজন চান্দা তুলে নিয়েছে। না দিলে তাদের মেরে ফেলেছে। মজার কাণ্ড হল--সিরাজ সিকদারের দলের লোকজন কিন্তু কেউ নিঃশ্ব হয়ে যায় নাই। তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এদের বাড়ি-গাড়ি-ব্যাবসাপাতি আছে। কিভাবে হল?

    সিরাজ সিকদারকে আলোচনা আনা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তী ক্ষুণ্ণ করার জন্য। এটা করে তারাই যারা বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছিল। বঙ্গবন্ধুরে খুনের একটা সাফাই হিসেবে এই সিরাজ সিকদারকে মহান চরিত্র রূপকথার চরিত্র হিসেবে আনা হয়। সিরাজ সিকদার কী মোহাম্মদ তোয়হএর চেয়ে বড় নেতা ছিলেন? কাজী জাফরের বা রাশেদ খান মেনোনের চেয়ে বড় দল করেছিলেন? ইতিহাস কিন্তু তা বলে না।
  • SC | 34.3.20.47 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ০৮:৫৪576738
  • আপনাদের সকলের লেখাই মন দিয়ে পড়ছি। অনেক কিছুই জানতাম না, জানতে পারছি। আমার বিশেষ কিছুই বলার নেই।
    একটা একটু অফ টপিক প্রশ্ন ছিলো। অনেকদিন ধরেই জিজ্ঞাস্য ছিলো, আপনাদের পেয়ে করে ফেলি।
    মুক্তিযুদ্ধে মৃতের সংখ্যাটা কি সত্যিই প্রায় তিরিশ লাখ? মুজিব এরকমই বলেছেন বহু জায়গায়।
    পাকিস্তান স্বভাবতই অনেক কম বলে (তিরিশ হাজার মনে হয়)।
  • | 24.96.116.231 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ০৯:২০576739
  • হ্যাঁ আমি যতটুকু পড়াশোনা করেছি, তাতে তিরিশ লাখের বেশী ছাড়া কম হবে না।

    শুধু পাকিস্তান কেন, কৃষ্ণা বসুর মেয়ে শর্মিলা বসুও এরকম কিছু ভুলভাল লিখেছেন তাঁর বিভিন্ন বইতে। তো, শর্মিলা বসুকে খন্ডন করে ব্লগার শুভাশীষ দাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে। সেগুলো দেখতে পারেন, আইডিয়া পাবেন। এছাড়াও শর্মিলা বসুকে একবার গর্গ চট্টোপাধ্যায় ও কৌস্তুভ অধিকারি একটা সাক্ষাৎকারে এই ভুল তথ্য দেওয়া নিয়ে চেপে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। সেটাও বেশ ইন্টারেস্টিং।
  • lcm | 34.4.162.218 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ০৯:৫৯576740
  • ১৯৭১-এ পশ্চিমী সাংবাদিক রবার্ট পেয়েন-কে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে ইয়াহিয়া খান বলেছিল - "Kill three million of them, and the rest will eat out of our hands" ।
  • | 24.99.157.47 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ১১:২৫576742
  • হুঁ দেখলাম। একটা লেখা মনে হচ্ছে আগেও পড়েছিলাম। কিন্তু ফারুক ওয়াসিফের অ্যাপ্রোচ খুব একটা পছন্দ করলাম না শুভাশীষের অ্যাপ্রোচ আমার অনেক বেটার লেগেছিল, প্রচুর ক্রস রেফারেন্স ছিল। পরে খুঁজে লিঙ্ক দিয়ে দেব।
  • PT | 213.110.246.230 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ১২:৩৬576744
  • RR
    আমেরিকা তার প্রিয় দালালদের সরিয়ে দেয় যখন তাদের প্রয়োজন শেষ হয়। আবার অনেক সময় দেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের দেশেও রেখে দেয়-বোধহয় নরিয়েগাকে রেখেছিল। সেই মন মাতানো উক্তি "He may a son of a bitch, but he is our son of a bitch"
    -ভুলে গেলে চলবে কি করে?

    মুজিব বিশাল সমাজতান্ত্রিক নেতা ছিলেন একথা কোথাও বলিনি-বলেছি যে আমেরিকার প্রিয় দালাল হলে হয়্ত আরও বেশ কিছুদিন রাজত্ব করতে পারতেন। নাহলে কাস্ত্রোর মত কঠিন হতে হত। মুজিবের সামনে খুব বেশে পছন্দ করার মত রাস্তা ছিল না।

    আর মুজিবের প্রথম ভোটে জেতাটা পাকিস্থান (পড়ুনঃ মিলিটারি) মেনে নিলে আদৌ বাংলাদেশের জন্মই হত কিনা কে জানে!! সেকথা আগেও লিখেছি। তবে এ বঙ্গে পুরুতের নাতি কিংবা ধনী পরিবারের ছেলে কমুনিস্ট হতে পারলে, মুসলিম লীগের ছত্রছায়াতে জীবন শুরু করা মুজিবের সমাজতন্ত্রকে আশ্রয় করাকে প্রশ্ন করব কেন?
  • PT | 213.110.246.230 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ১৩:০৪576745
  • *may be
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ১৪:৩৩576746
  • ০১. কুলদা রায়ের টইপত্রের নাম যখন "শেখ মুজিবের উপর খ্যাপা কেনো চিনাপন্থীরা? " তখন সিরাজ সিকদার [এসএস] প্রসঙ্গক্রমেই আসে। এখানে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা বা এসএস খুব বড়মাপের নেতা ছিলেন কি না, সে বিষয় অবান্তর। শেখ মুজিবের সঠিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এসএস'কে উপেক্ষা করার অর্থ হচ্ছে, চোখ বুজে চড়ুই ধরা।

    ০২. বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফজতে মৃত্যু/বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড/ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার প্রশ্নে এসএসই প্রথম রাজনৈতিক নেতা কি না, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম এমন রাষ্ট্রীয় খুনের শিকার হলেন–এ বিষয়টিও এসে যায়।

    ০৩. এসব কারণে মুজিব নামে পাগলপাড়াদের কাছে এসএস যতোই ব্যর্থ বিপ্লবী/সন্ত্রাসী হোন না কেন, তার নামটি খুবই অস্বস্তিকর। প্রসঙ্গত পুনর্বার:

    [ সাবেক নকশাল নেতা "আজিজ মেহের বলছেন,

    "(১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে) আমি দ্রুত পার্টি লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং (আত্ম-গোপনের জন্য) ঢাকায় কয়েকটি শেল্টার ঠিক করে ফেললাম। ১৯৭১ সালে আমাদের পার্টি বিশেষ এক অধিবেশনে চারু মজুমদারের নকশালী লাইন গ্রহণ করে। সে সময় তারা শ্রেণীশত্রু খতমের পাশাপাশি পাক-বাহিনীকেও মোকাবিলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের পার্টি একই রকম কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ও মুজিব বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলো এই সব গ্রুপ। সারাদেশে ‘ধরো আর মারো’ শুরু হয়ে গেলো। শেখ মুজিব এক জনসভায় ঘোষণা করলেন: নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে। মওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিলেন: নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অধিকার সরকারের নেই।…"

    http://www.unmochon.net/node/639

    ০৪. এ পর্যায়ে এসএস অমুকের চেয়েও কি বড় মাপের নেতা/বিপ্লবী, না তমুকের মতো বিশাল মুক্তিযোদ্ধা-- এ হেন প্রশ্ন যতোই বেয়াক্কেলে হোক, একই সঙ্গে বিনোদনমূলকও। :D
  • বিপ্লব রহমান | 212.164.212.14 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ১৪:৪৮576747
  • @ b ,

    হতে পারে। কিন্তু ঠিক কোন নোটটির কথা বলছেন? অধমের প্রায় সব লেখাই তাৎক্ষনিক; অনেক বইপত্র ঘেঁটে তাত্বিক লেখা খুব একটি হয়ে ওঠে না। তাই অনলাইনের প্রায় সব লেখাই "ব্লগাড্ডা/ব্লগর ব্লগর" ট্যাগ করা থাকে।

    তবে এসএস'কে নিয়ে নোটটি বেশখানিকটা তথ্যবহুল করার চেষ্টা আছে। অনুগ্রহ করে নীচের সুতোও গিয়ে মূল লেখাটি পড়লে সেখানে প্রাসঙ্গিক আরো সুতোর সন্ধান মিলবে। জটিলতা এড়াতে নোটটির সুতোগুলো টইয়ে দেওয়া হয়নি।

    আরো জানাই, ওই নোটটি মুক্তমনাসহ একই সঙ্গে একাধিক ব্লগে আছে। অনেকেই তথ্য-বিশ্লেষনটিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে একটি দেশীয় রাজনীতির একটি বিশেষ রাজনীতি হয়তো চট করে অনেকের কাছেই বোধগম্য না-ও হতে পারে।

    http://www.unmochon.net/node/639

    তবু আপনার সমালোচনা মনে থাকবে। বিনীত পাঠ ও প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। :)
  • আবুল খায়ের | 123.11.74.55 | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:২১576749
  • "প্রশ্ন হল - খাঁটি জাতীয়তাবাদ কি সমাজতন্ত্র?"- মোটেই না। "খাঁটি জাতীয়তাবাদের অনিবার্য পরিণতি সমাজতন্ত্র" কথাটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। খাঁটি জাতীয়তাবাদ, জাতীয়- আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে-তাপে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে স্বাধীন বিকাশের পথ হিসেবে সমাজতন্ত্রকেই অবলম্বন করেছে। ২য় মহাযুদ্ধের পর বিংশ শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা ধারণ করে আছে। এর ক্লাসিক উদাহরণ কিউবার বিপ্লব এবং ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ফিদেল প্রথমে ছিলেন খাঁটি জাতীয়তাবাদী, পরে কমিউনিস্ট। চীনে সান-ইয়াৎসেনের নেতৃত্বাধীন পরে মাদাম সান-ইয়াৎসেনের নেতৃত্বাধীন কুওমিনটাং পার্টির বাকী অংশটা গণচীনের জাতীয় সরকারের অংশ। আর আফ্রিকায় নক্রুমা, লুমুম্বা, ক্রিস হানি, মুগাবে, এঁরা সকলেই প্রথমে খাঁটি জাতীয়তাবাদী, সংগ্রামের পরবর্তী স্তরে কমিউনিস্ট; মুজিবও তদ্রুপ।
    "খাঁটি জাতীয়তাবাদ কি সমাজতন্ত্র?" এ প্রশ্নের উত্তরে বলবো, খাঁটি জাতীয়তাবাদ কখনোই সমাজতন্ত্র নয়! তবে খাঁটি জাতীয়তবাদের রয়েছে সর্বশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার অন্তর্গত উদারতা। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চৈতন্যিক প্রতিফলন ঘটে। আর গরিষ্ঠের স্বার্থের পতাকা বহন করতে গিয়ে খাঁটি জাতীয়তাবাদ যতটুকু সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী অবস্থানে থাকে ঠিক ততটুকুই সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠে।
  • আবুল খায়ের | 123.11.74.55 | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:২১576748
  • "প্রশ্ন হল - খাঁটি জাতীয়তাবাদ কি সমাজতন্ত্র?"- মোটেই না। "খাঁটি জাতীয়তাবাদের অনিবার্য পরিণতি সমাজতন্ত্র" কথাটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। খাঁটি জাতীয়তাবাদ, জাতীয়- আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে-তাপে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে স্বাধীন বিকাশের পথ হিসেবে সমাজতন্ত্রকেই অবলম্বন করেছে। ২য় মহাযুদ্ধের পর বিংশ শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা ধারণ করে আছে। এর ক্লাসিক উদাহরণ কিউবার বিপ্লব এবং ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ফিদেল প্রথমে ছিলেন খাঁটি জাতীয়তাবাদী, পরে কমিউনিস্ট। চীনে সান-ইয়াৎসেনের নেতৃত্বাধীন পরে মাদাম সান-ইয়াৎসেনের নেতৃত্বাধীন কুওমিনটাং পার্টির বাকী অংশটা গণচীনের জাতীয় সরকারের অংশ। আর আফ্রিকায় নক্রুমা, লুমুম্বা, ক্রিস হানি, মুগাবে, এঁরা সকলেই প্রথমে খাঁটি জাতীয়তাবাদী, সংগ্রামের পরবর্তী স্তরে কমিউনিস্ট; মুজিবও তদ্রুপ।
    "খাঁটি জাতীয়তাবাদ কি সমাজতন্ত্র?" এ প্রশ্নের উত্তরে বলবো, খাঁটি জাতীয়তাবাদ কখনোই সমাজতন্ত্র নয়! তবে খাঁটি জাতীয়তবাদের রয়েছে সর্বশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার অন্তর্গত উদারতা। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চৈতন্যিক প্রতিফলন ঘটে। আর গরিষ্ঠের স্বার্থের পতাকা বহন করতে গিয়ে খাঁটি জাতীয়তাবাদ যতটুকু সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী অবস্থানে থাকে ঠিক ততটুকুই সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠে।
  • আবুল খায়ের | 123.11.74.55 | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:৩২576750
  • "১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হয়েছিল, এটি ইতিহাসেরই চরম সত্য, কিন্তু একমাত্র সত্য নয়।"
    "ইতিহাসেরই চরম সত্য কিন্তু একমাত্র সত্য নয়।"(?!) এর মানে কী? চরম সত্যটা কি? আবার "চরম সত্য, কিন্তু একমাত্র সত্য নয়" এরই বা মানে কি? সত্য তো আপেক্ষিক! আপেক্ষিকতার মধ্যেই যে 'চরম সত্য' সেটি তো অবশ্যই একমাত্র; তার কোন দুইমাত্র হয় না!!! হয় তখনই যখন ঢালাইতে গণ্ডগোল থাকে।
  • আবুল খায়ের | 123.11.74.55 | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:৪৭576751
  • একটি প্রশ্ন এসেছে, "মুক্তিযুদ্ধে মৃতের সংখ্যাটা কি সত্যিই প্রায় তিরিশ লাখ?" মুক্তিযুদ্ধে অজানা শহীদদের সংখ্যা নিরূপণে মুজিব সরকারের উদ্যোগে সরকারী পত্রিকা দৈনিক বাংলা, বেসরকারী পত্রিক দৈনিক পূর্বদেশ এবং সোভিয়েত পত্রিকা দৈনিক প্রাভদা যৌথভাবে ১৯৭২-এর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর অবধি সারাদেশের গণকবর, বধ্যভূমি, জল্লাদখানার তালিকা তৈরী করে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মৃতের সংখ্যা উল্লেখ করে ত্রিশ লক্ষাধিক। আর অস্ট্রেলিয়ার সার্জন জিওফ্রে হার্ভে (সম্ভবত) ও তাঁর টিম ধর্ষিতা নারীদের সংখ্যা নিরূপণ করেছিল চার লক্ষাধিক।
  • আবুল খায়ের | 123.11.74.55 | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:৫৯576752
  • এখানে জনাব বিপ্লব রহমানের লেখার একটি স্থানে চোখ আটকে গেল, "শামীম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন।" মোটেই না। শামীম সিকদার হচ্ছেন নিকৃষ্ট-অরুচিকর ভাস্করদের একজন; এটিই দেশে প্রতিষ্ঠিত মত।
  • কুলদা রায় | 34.90.91.2 | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ০৩:৫৮576753
  • শামীম সিকদার প্রসঙ্গে একটা তথ্য--
    তিনি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করেছেন। সে সময়ে তার ভাই সিরাজ সিকদারের হত্যাকারীর মূর্তি নির্মাণ কেনো করেছেন--সে বিষয়ে বিপ্লব রহমানের বক্তব্য কি?

    ২. একটা তথ্য বলা দরকার--বিপ্লব রহমান আজিজ মেহেরের উদ্ধৃতি দিলেন, তিনি বিপ্লব রহমানের পিতা।

    ৩. বিপ্লব রহমানের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে--সিরাজ সিকদারকে আটক করার পরে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে কনভিঞ্চ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিরাজ সিকদার তার জীবিতকালে যাদেরকে হত্যা করেছেন--তাদেরকে হত্যার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, তাকে বা তাদেরকে কোনো ধরনের সুযোগ দেননি। তিনি মনে করেছেন তার অমুক সহকর্মী তার কথার বাইরে ভাবছে। সুতরাং তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। সে সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। সিরাজ সিকদার তার নিজের ভগ্নীপতিকে হত্যা করেছেন এই ভাবে। এই যা বিনা বিচারে হত্যা যিনি করছেন--তার এই হত্যা কাণ্ড কি ক্রসফায়ারের তুল্য অমানবিক অপরাধ নয়? কবি হুমায়ুন কবিরের হত্যাকাণ্ডকে কি বলবেন?

    ৪. সাধারণ মানুষের রুটি-রুজীর সমস্যা নিয়ে এই সিরাজ সিকদার বা চীনাপন্থীরা কোনোদিন কি আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন? সাধারণ মানুষের কাছে সিরাজ সিকদারদের ভাবমূর্তীটা কি? কেউ কি তাকে মনে রেখেছে?
  • আবুল খায়ের | 123.11.74.210 | ০২ ডিসেম্বর ২০১২ ১২:১৯576755
  • যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকে "দুই কুকুরের লড়াই" অভিহিত করে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধুয়া তুলে পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে মানবতাবিরোধী নানাবিধ নিকৃষ্ট কুমর্মে রত ছিল তাদেরকেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে বামরাজাকার বলে সম্বোধন করি। এবং এরাই হচ্ছে চীনাপন্থী নকশাল।
    দীর্ঘদিন যাবত বাম রাজাকারেরা বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল নিয়ে মিথ্যা প্রচারণায় লিপ্ত। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাম রাজাকারেরা বঙ্গবন্ধু মুজিবের সরকার উচ্ছেদে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে। এটা অনস্বীকার্য যে, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উচ্ছেদে ১৯৭২ থেকেই বাম রাজাকাররা যে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শুরু করে তাতে তারা দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের বিশেষ করে পাকিস্তানীদের সহায়তায় এ কু-কর্মে সফল হয় এবং ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যা করে। বিশিষ্ট বাম রাজাকার আবদুল হক এ কুকর্মে পৌরহিত্য করেন। তার স্যাঙ্গাৎ হিসেবে এ-কুকর্মে যে দলগুলো মালকোঁচা বেধে নেমেছিল তাদের অন্যতম জাসদ, সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) আর আবদুল হকের পার্টির নাম ছিল "পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)।" স্বাধীন বাংলাদেশ অথচ আবদুল হকের মালিকানায় পার্টির নাম পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) ১৯৭৬ সন পর্যন্ত এনামেই অস্তিত্বশীল। ১৯৭৪-এ স্বাধীন হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ বিষয়ে ভুট্টোকে লেখা এক চিঠিতে আবদুল হক নিজ আক্ষেপ প্রকাশ করে সাধের ফাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য চেয়ে এক দীর্ঘ পত্র লেখেন। তাতে আবদুল হক ভুট্টোর নিকট অস্ত্র ও সৈন্যবল সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং পুনরায় সাধের অখণ্ড ফাকস্তান কায়েম করবার মনোবাঞ্ছা তুলে ধরেন। (সূত্রঃ স্ট্যানলি ওলপার্ট লিখিত গ্রন্থ "জুলফি ভুট্টো্ইন পাকিস্তান।")
    অপরদিকে জাসদ উগ্র ভারত বিরোধীতার নামে ভারত বিদ্বেষী প্রচারণায় এমন মাত্রায় মেতে ওঠে যেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ফাকস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নয়, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আর কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচিত সদস্যদের খুন করে কেন্দ্রীয় কমিটি দখল করে তা ১ সদস্য বিশিষ্ট করে নিজ মালিকানায় নিয়ে নেন সর্বহারা পার্টির একচ্ছত্র অধিপতি, খুনী, সর্বব্যাপী ব্যাভিচারে মত্ত ফ্যাসিস্ট সিরাজ সিকদার। যার দলের কাজ ছিল একটাই- "জয় বাংলা" শ্লোগান দিয়ে কী করে থানা লুট, ফাড়ি লুট, পাটের গুদামে আগুন আর জাতীয় শত্রু খতমের নামে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গুম করা খুন করা ইত্যাদি করে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা যায়। কথিত আছে যখন চট্টগ্রামে মতান্তরে টেকনাফে সিরাজ সিকদার ধরা পড়েছিল তখন তার স্যুটকেস ভর্তি ছিল ডলার। এদের কর্মকাণ্ডে এটা সুস্পষ্ট যে, এই সকল ইতরেরা মার্ক্সবাদ, বিপ্লববাদ, সাম্যবাদ, মাওবাদ ইত্যাকার বাদের নামে সিআইএ'র চালু করা প্রোজেক্ট "লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ঠেকাও" কর্মসূচী প্রতিপালনে সচেষ্ট ছিল।
    ১৯৬৭ সনে মূল ইপিসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্তির পর থেকে নক্সালপন্থীদের একটাই টার্গেট ছিল আর সেটা হচ্ছে "শ্রেণী শত্রু" বা "জাতীয় শত্রু" খতম করার নামে "ট্রু ন্যাশনালিস্ট"দের খতম করা, কতল করা। পরম নিষ্ঠার সাথে লেগে থেকে বিরতীহীনভাবে সারা দেশব্যাপী এরা এ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে গেছে ১৯৭৫ সন পর্যন্ত এবং অদ্যাবধি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে এই সকল দঙ্গল ভাড়াটে খুনী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জেনারেলদ্বয় ক্ষমতায় আসার পরপরই নিজদের কর্মসূচী যেহেতু বাস্তবায়িত হয়ে গেছে; সুতরাং, নেতৃস্থানীয় শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ আর সমর্থবানেরা পার্টি-ফার্টি বিলুপ্ত অথবা খণ্ডীকৃত করে বিশেষ সংস্থার সহায়তায় জাসদ, সর্বহারা আর হুক্কা হুয়ার বিপ্লবীরা ইউরোপ এবং মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছে। অর্থাৎ জাগার মাল জাগায় গিয়ে উঠেছে।
    অপরদিকে এঁটো-কাটার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাদবাকীরা হয় বিএনপি-জামাত অথবা জাতীয় পার্টিতে কেউ কেউ স্বল্প মূল্যে কেউ-বা আবার চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। উপরোল্লিখিত চরম প্রতিক্রিয়াশীল অতিবিপ্লবী পাতিবুর্জোয়া রোমান্টিক এইসব দঙ্গলদের জন্ম থেকে অদ্যাবধি একটাই আরাধ্য কাজ যা তারা পরম নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে, আর তা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু মুজিব ও আওয়ামী লীগের উঠোন চষে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকারের পত্তন বাড়ানো। এই কুকর্মে বাম রাজাকারেরা মতাদর্শিক ক্ষেত্র তৈরী করতে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুজিব সরকার বিরোধী প্রচুর সাহিত্যকর্ম তৈরী করে প্রচার-প্রোপাগান্ডা সংগঠিত করে ভালো সাফল্য পেয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল সম্পর্কে সীমাহীন মিথ্যা প্রচারণা। এই প্রচারণা গোয়েবলসীয় প্রচারণাকেও হার মানিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রচারণার এবংবিধ কুকর্মে যারা পৌরহিত্য করেছেন তাদের অন্যতম আইয়ুব খানের মৌলিক স্পীকার জব্বার খানের কুপুত্র প্রয়াত এনায়েত উল্লাহ খান, সাদেক খান অন্যতম। এছাড়া আরো রয়েছে শাহাদাত চৌধুরী প্রমুখ। এদের মৌল আলোচ্য বিষয়ই ছিল বঙ্গবন্ধুর চারিত্র-বৈশিষ্ট্যকে কলুষিত করণ, সচেতনভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষাড়যন্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ চালানো। এনায়েতউল্লাহ খান, সাদেক খান, শাহাদাত চৌধুরী, আহমেদ হুমায়ুন, আহমেদ ছফা, আহমেদ মুসা সহ তাবৎ আহাম্মক এবং বুরবকের দল হলিডে, বিচিত্রা ইত্যাদি পত্রিকার মাধ্যমে লাগাতার এসব কুকর্মে লিপ্ত ছিল। দেশের স্বল্প শিক্ষিত সহজ মানুষদের বোকা বানানোর মতলবে এসকল দঙ্গল বাকশাল সম্পর্কে একটিই প্রচারণা সর্বব্যাপী করে তুলেছিল আর তা হচ্ছে, "মুজিব, আমরণ প্রেসিডেন্ট থাকার জন্য এই ব্যবস্থা করেছে" আর "মুজিবের মৃত্যুর পর তার ছেলে বা বংশধরদের মনোনীত কেউ না কেউ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবে" ইত্যাদি। এই মিথ্যা প্রচারণাটি অতিবিপ্লবী দঙ্গলদের সকলেই ফেরী করে বেড়িয়েছে। গেরাম দিয়ে শহর ঘেরাও করাবার অভিপ্রায়ে ব্যর্থ দঙ্গলটির মনোভাব ছিল অনেকটা এরকম "অভিলাষী মন চন্দ্র না পাক” ষড়যন্ত্রে “পাক সামান্য ঠাঁই।"
    সশস্ত্র বিপ্লবের চীনেবাদাম ফেরীওয়ালাদের তত্ত্ব থেকে '৭১-এর গেরিলা কায়দার দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত বিপ্লবটি হস্তচ্যুত হয়ে তা মুজিবের হস্তগত হওয়ায় হুক্কা হুয়া ও তদীয় দোসর বদ। উমর মুজিবের উপর যার পর নাই ক্ষিপ্ত ছিলেন। উপরন্তু, বিপ্লব নামক এই মহার্ঘ্য বস্তটি যারা জন্ম থেকেই ইজারা নিয়েছেন সেই সব অতিবিপ্লবীদের হাত থেকে বিপ্লব চলে যাবে ফরিদপুরের জনৈক সেরেস্তাদারের ছেলের হাতে। এ অসহ্য! হুক্কা হুয়া পীর বাড়ীর বনেদী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। আর বদ উমর! ওরে ব্বাপ! সৈয়দ বংশের সন্তান। খোদ কুরাইশ বংশ। উপায় আছে। সুদূর মক্কা থেকে যার পূর্ব পুরুষ উটের দড়ি সম্বল করে এদেশে হিজরত করেছিলেন। তাদের বাদ দিয়ে বিপ্লব চলে যাবে মুজিব-তাজউদ্দীন এদের দখলে। আবার এই কাজে সহায়তা করছে পৌত্তলিক কাফের হিন্দুস্থান। সুতরাং, এবার স্বাধীন বাংলাদেশে যেভাবে যে করেই হোক মুজিবকে উৎখাত করতেই হবে। ব্যাস, নাম ভিন্ন থাকলে কী হবে এই ইস্যুতে এক কাট্টা হয়ে নামতে হবে। নেমেও পড়লো সকলেই এবং কামিয়াব হলো।
    মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আবদুল হুক্কা হুয়া ঢাকায় ক্যান্টনমেন্টে জামাই আদরে থাকতেন। বদ। উমর গ্রাম্য মৌলভীর বেশে ঢাকা শহরেই বহাল তবিয়তে চলাফেরা করতেন এবং পাক বাহিনীর বিশেষ বিশেষ তত্ত্বীয় কুকর্মে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধারা বদ। উমরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল চাঁদনী ঘাট এলাকায় শাস্তি দিতে। পিতা কানা হাশিমের অনুরোধে বঙ্গবন্ধুর কৃপায় সে যাত্রায় বদ। উমরের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। হুক্কা হুয়া, তোয়াহা, আলাউদ্দীন আর ভাষা মতিন এরা সকলেই হয় মুজিব নতুবা তাজউদ্দীনকে ধরে জীবন রক্ষা করেছেন। জীবন থেকে রক্ষা পেয়েই "উপকারীরে বাঘে খায়", "বাঙালী যে পাতে খায় সে পাতে হাগে" এসব প্রবচন প্রমাণে এরা মেতে উঠিছিল মুজিব নিধনে। কামিয়াব হয়েছে বটে! তবে তা সাময়িক। মুজিবকে মেরেছে ঠিকই, কিন্তু মুজিবের দলটিকে মারতে পারেনি। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক শক্তিশালী এটা প্রমাণ করে মুজিবের প্রতিষ্ঠিত দল ঠিকই টিকে আছে; পক্ষান্তরে বাম রাজাকাররা চক্রান্ত করে, ষড়যন্ত্র করে, জেনারেলদের শয্যাসঙ্গী হয়ে, তাদের পদলেহন করে, মলদ্বার ভাড়া দিয়ে পার্টিকে শতধা বিভক্ত করে, পোন্দের চাড়া খাপছাড়া করে ঝুলে আছে উল্টো হয়ে শূন্যে। এখন না আছে পার্টি, না আছে তত্ত্ব! আছে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, খিস্তি-খেউড় আউড়াবার অক্ষম পিঁচুটি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন