এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • অচলায়তনের দেয়ালের ফোকর ও ভালবাসা

    ranjan roy
    অন্যান্য | ১৩ জুন ২০১৬ | ১২৩৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 132.162.161.160 | ১৩ জুন ২০১৬ ০৩:৫১708215
  • [ কোন প্রতিষ্ঠানবিশেষ বা ব্যক্তিবিশেষকে আঘাত দেওয়া এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। এটি নেহাৎ কিছু ব্যতিক্রমী ভালোবাসার গল্প। তবু কারও মনে আঘাত লাগলে আগাম মাফ চেয়ে রাখছি।
    যদিও ধারা ৩৭৭ এর কাঠামো ধরে ঝাঁকানো হচ্ছে, আরও কিছু অচলায়তনের জানলা খুলে ত্রিজটা দেবীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা চলছে , তবু জনমানসে পঞ্চকদের প্রতি বিরক্তি ও মহাপঞ্চকদের প্রতি আস্থা আজও অটুট। তাই গাল খাওয়ার ভয় রয়েই গেল।
    আসল ভয় নিজের ভেতরে;-- পাছে লেখনীর অক্ষমতায় এই ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে লেখা গল্প ভালবাসার অন্তর্লীন বিষাদকে ধরতে না পারে? যদি সব ছাপিয়ে যৌনতার গন্ধ প্রবল হয়ে উঠে এটাকে ফুটপাথে বিছিয়ে রাখা লেখক/প্রকাশকের নাম গোত্রহীন সাহিত্যের ক্লাবের সদস্য করে দেয়?]
  • ranjan roy | 132.162.161.160 | ১৩ জুন ২০১৬ ০৫:০৩708326
  • ১)
    'সে কোন বনের হরিণ এল আমার মনে?'
    ---------------------------------------------
    যোগানন্দধামে সন্ধ্যে বেলা আমাদের টিউটোরিয়াল। আমরা মানে ক্লাস এইটের আবাসিকের দল। দুটো সেকশন মিলে জনাপনেরো হবে।
    যোগানন্দধাম আসলে একটি লম্বাটে দোতলা হল ঘর। পুকুরপাড়ে। এই ঘরে আমরা থাকি। মাটিতে সতরঞ্চির উপরে তোষক পেতে বিছানা। আমরা বলি-বেডিং। দিনের বেলায় এই বেডিং গুটিয়ে দেয়াল ঘেঁষে রেখে দিতে হয়। টিউটোরিয়ালের সময় শুধু সতরঞ্চি পেতে বসে পড়াশুনো। আমাদের টিচার অনিমেষদা হোস্টেলেই থাকেন। উইক এন্ডে বাড়ি যান।
    হলে পাখা নেই। তাই জানলা কখনই বন্ধ করা হয় না।এই জানুয়ারী মাসের শীতেও না। তবে বর্ষার দিনের কথা আলাদা। নইলে বিছানা ভিজে যাবার ভয়। সামনের পানাপুকুর থেকে একটা আঁশটে গন্ধ ভেসে আসছে, আর নীচের তলা থেকে সোঁদা গন্ধ।
    আসলে মার্কিন সংস্থা CARE এর থেকে পাঠানো গুঁড়ো দুধে বড় গামলায় জলে মিশিয়ে সপ্তাহে তিন দিন উদ্বাস্তু কলোনির বাচাকাচ্চাদের মধ্যে বিলি করা হয়। নীচের তলায় তার গুদাম ঘর। গন্ধ আসছে সেখান থেকে। আমরা এতে অভ্যস্ত। নাকে সয়ে গেছে। সয়ে গেছে জানলা দিয়ে ক্রমাগত ধেয়ে আসা মশার ঝাঁক। পানাপুকুরটায় ওর চাষ হয় নির্ঘাৎ। আমি ভূগোল বই খুলে '' আফ্রিকাকে কেন অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়' মুখস্থ করার ফাঁকে ফাঁকে চটপট হাত চালিয়ে মশা মারতে থাকি। কোন কোন মশা মারলে ওর পেট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়ে , তখন বড় আনন্দ হয়। শুকনো মরুটে মশা মেরে মজা পাইনে। তবু মশাদের শবদেহ গুনতি করে একটা টেক্কামার্কা দেশলাই বাক্সে পুরে ফেলি। বন্ধুরা আমাকে শতমশকমারীবীর টাইটেল দিয়েছে যে!
    গৌতম ও সহদেবের অংকের খাতা দেখে বকুনি দেওয়ার ফাঁকে অনিমেষদার চোখ ফিরেছে আমার দিকে।
    --- অ্যাই প্রদ্যুম্ন, তোর হল? নাকি স্ট্যানলি লিভিংস্টোনের মত জঙ্গলে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিস? এদিকে উঠে আয়!
    পাশে একটা বেত সবসময় রাখা থাকলেও উনি সেটার ব্যবহার কদাচিৎ করেন। দরকার পড়লে ওনার হাতই যথেষ্ট। ফোরহ্যান্ড ব্যাকহ্যান্ড ঝড়ের মত চলে। তবে মেজাজ বিগড়োলে।
    আমি বই হাতে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াই। গুটি গুটি পায়ে ওঁর দিকে এগিয়ে যাই , আর বোঝার চেষ্টা করি যে ওঁর মুড এখন কী-- ইম্পারেটিভ না সাবজাংকটিভ?
    পোড়োদের গলার স্বর আচমকা থেমে গেছে। কোন ঘটনা ঘটবে। আমার কিন্তু 'কানের কাছে নানান সুরে, নামতা শোনায় একশ' উড়ে' কেস।
    হলের অন্য প্রান্তে দরজায় শব্দ। সবার চোখ সেদিকে ঘুরল। হস্টেলের কাজের ছোকরা পঞ্চা ঢুকেছে, ওর সঙ্গে একটি ছেলে। শ্যামলা লম্বাটে গড়ন, মুখে একটু অপ্রস্তুত লজ্জা লজ্জা হাসি। ওর চোখ গিয়ে থেমেছে স্যারের পাশে রাখা বেতগাছার দিকে,আর চেহারায় খেলছে একটু ভয়ের ছায়া। কিন্তু এইটের ছেলে ফুলপ্যান্ট পড়েছে? আর গায়ে ওটা কি? এই রকম সোয়েটার তো শুনেছি 'বিশ সাল বাদ' সিনেমার নায়ক বিশ্বজিৎ পরে। এ নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে সিগ্রেট খায়।
    ঠিক আছে; এ কে সময়মত ঠিক সাইজ করে নেওয়া যাবে। কোন সেকশনে ভর্তি হয়েছে? আর ওর বেডিং স্যুটকেস থালা বাটি? কোন হলে?
    কৌতুহল খানিকটা মিটল। পঞ্চা স্যারকে জানিয়ে দিল যে নতুন ছেলে বিপ্লব আজই ভর্তি হয়েছে, সেকশন এ। সীট পেয়েছে বিবেকানদ হলে। মহারাজ ওকে অনিমেষদার টিউটোরিয়ালে বসতে বলেছেন। অনিমেষদার প্রশ্নে ছেলেটি নিজেই জানাল যে ও হেয়ার স্কুল থেকে এসেছে। ওর বাবা দূর্গাপুরে বদলি হয়ে গেছেন, তাই হস্টেলে।
    আমাকে মশা কামড়ায়; টের পাই না। হাফপ্যান্টের ফাঁকে কোথায় চুলকোতে চুলকোতে ফুলে ওঠে। ও নিয়ে ভাবি না। স্যার ওঠার আগে কালকের জন্যে টাস্ক নোট করিয়ে দিলেন, লেখা হল না।
    শেষ হতেই সবাই হুড়োহুড়ি করে নীচে নামতে থাকে। নতুন ছেলেটা একটু হকবকিয়ে গেছে। আমি পা চালিয়ে ওর পাশে দাঁড়াই। বলি-- এখনই খাওয়ার ঘন্টা পড়বে। আমার সঙ্গে চল। কলতলাটা পেছল। আমি দেখিয়ে দেব। হাত মুখ ধুয়ে নাও।
    পাশ থেকে কেউ ফুট কাটল-- ওর সঙ্গে যেও না খোকাবাবু। ও মহা ল্যাবা, অংক পারে না। নিজেই পা পিছলে পড়ে যায়!
    -- ছাড় না! কেন ওর পেছনে লেগেছিস?
    -- দ্যাখ না শালা! প্রথম দিন থেকেই নতুন ছেলেটাকে লাইন মারছে।
    সমবেত হো হো হাসি! নতুন ছেলেটা অপ্রস্তুত। আমি ওর হাত ধরে ফেলি। নীচু গলায় বলিঃ
    --- ফালতু কথায় কান দিও না। নিজেরা তো গত বছর গাব্বু মেরেছে!
  • ranjan roy | 132.162.161.160 | ১৪ জুন ২০১৬ ০৬:৪৯708360
  • পরের দিন রোববার।
    আজকে হোস্টেলের টপ দুটো দলে ক্রিকেট ম্যাচ। বেশির ভাগ নাইন আর টেনের ছেলে, জনা দুই এগারো ক্লাস ( ওদের এবার বোর্ড আছে না!)। কিন্তু দুতিনটে ক্লাস এইটের ছেলেও আছে--রিজার্ভ বেঞ্চে, আমি তাদের একজন। অফব্রেক মন্দ করি না, কিন্তু ফিল্ডিং ভালো নয়, তাই রিজার্ভের দলে।
    ক্লাস টেন এর বিকাশদা বাড়ি গেছে, একটা বোলার কম পড়েছে, মনে মনে ঠাকুর ঠাকুর করছি--আজ বোধহয় ম্যাচে একটা চান্স পাবো। সাদা হাফ প্যান্ট, জামা ও সাদা রং করা কেড্স্‌ পরে লাইনের বাইরে বসে আছি।
    কিন্তু এটা কী হল?
    ক্যাপ্টেন অমিতদা হটাৎ নতুন ছেলেটাকে ডাকলেন।
    --- ক্রিকেট খেল? আগের স্কুলে খেলতে?
    --হ্যাঁ, স্কুল টিমের হয়ে খেলেছি।

    মিথ্যে কথা! এই মুখচোরা লালটুমত ছেলেটা কিছুতেই হেয়ার স্কুলের মত অভিজাত স্কুলের টিমে রেগুলার হতে পারে না। নিঘঘাৎ ইম্প্রেস করার জন্যে ঢপ দিচ্ছে।
    -- একবার ট্রায়াল ম্যাচে খেলালে হয় না? ওরা ডিউস বলে খেলে। আমদের তো টেনিস বল।
    --অ্যাই! তোকে কে জিজ্ঞেস করছে? নিজের চরকায় তেল দে।
    যাঃ, ক্যাপ্টেনকে রাগিয়ে দিয়েছি। আমার চান্স গেল। এই ছেলেকেই না আমি কাল হাত ধরে ডাইনিং হলে নিয়ে গেছলাম? এছাড়া কলঘর, মশারি টাঙানোর কায়দা, কিছু কিছু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ!
    ক্যাপ্টেন ভুল করেনি।
    ছেলেটা ওপেনিং নেমে বেশ ব্যাট করল। দু'হাত আগে পড়ে লাফিয়ে ওঠা বলগুলোকে ব্যাকফুটে টো এর ওপর ভর দিয়ে আস্তে করে নামিয়ে দিচ্ছিল। ফরওয়ার্ড শর্ট লেগ ও গালির ছেলেগুলো ক্যাচ নেওয়ার চেষ্টা করে মাটিতে গড়াল।
    প্রথম দিনেই গোটা হোস্টেল ওর দিকে আলাদা ভাবে তাকাতে শুরু করল।
  • Manish | 127.200.85.108 | ১৪ জুন ২০১৬ ১৩:০৬708371
  • পড়ছি।
  • de | 69.185.236.52 | ১৪ জুন ২০১৬ ১৫:৪০708382
  • আম্মো -
  • d | 144.159.168.72 | ১৪ জুন ২০১৬ ১৬:০৩708393
  • আমিও
  • ranjan roy | 132.162.161.160 | ১৫ জুন ২০১৬ ১০:১৩708404
  • আরে! তিনদিন পরেই বেলুড়ে স্বামী বিবেকানন্দ জন্মোৎসবে ছাত্রদের দিন! বেলুড় কলেজের সঙ্গে অন্য স্কুল থেকেও কিছু কিছু চান্স দেওয়া হবে।
    আমাদের ভাগ্যে জুটেছে স্বামীজির লেখা কবিতার আবৃত্তি।
    বাংলা আবৃত্তিতে অবশ্যই আমি, প্রদুম্ন। প্রতিবার হোস্টেলে এবং স্কুলে সমস্ত ব্যাচ মিলিয়ে আবৃত্তি চ্যাম্পিয়ন। হুঁ হুঁ বাবা! বরানগরের কুঠিঘাট রোডের ভব রায় আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। উনি ইউনিভার্সিটির দিনে কয়েকবার "সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা"র চ্যাম্পিয়ন।
    ঠিক হল, বরানগর ইউনিটকে কে রিপ্রেজেন্ট করব আমি। সেই "সখার প্রতি", সেই 'বহুরূপে সম্মুখে তোমার';। লম্বা কবিতা, প্রায় চার পাতা। কিন্তু এতবার করেছি যে মুখস্থ হয়ে গেছে।
    আচ্ছা, ইংরেজিটা কেউ ট্রাই করবে? The Cup? কেউ এগোয় না।
    -- প্রদ্যুম্ন?
    এই সুযোগ, ইংরেজি বাংলা দুটোই আমি? এ যে শালা জ্যাকপট!
    কিন্তু আমি দুলাইন বই দেখে বলতেই স্যার হাত তুললেন।
    --শোনো, তুমি কবিতাটা বুঝতে পারোনি। এই কাপ চায়ের কাপ নয়। এ বয়সে বোঝা সম্ভবও নয়। কিন্তু এই ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে বেলুড়ের স্টেজে---! নাঃ, শুধু বাংলাটাই কর।
    --- আমি ট্র্রাই করব?
    সেই নতুন ছেলেটা! মহা পাকা তো!
    -- This is your cup.
    The cup assigned to you from the begining.
    Nay my child
    স্যার হাত তুললেনঃ তুমি ও কে! ছোট কবিতা, আজকে মুখস্থ করে ফেলবে। এই প্রথম বরানগর বাংলার সঙ্গে ইংরেজি রিসাইটেশনেও পার্টিসিপেট করবে।
    সবাই লাজুক হেসে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া ছেলেটার দিকে প্রশংসার চোখে তাকিয়ে। আমি স্যারের মাথার পেছনে সাদা দেওয়ালে একট টিকটিকি কেমন পোকা ধরছে সেটা মন দিয়ে দেখতে লাগলাম।
    এই বিপ্লব ছেলেটাকে আর পাত্তা দেব না। ও কোনদিন আমার বন্ধু হবে না।

    তিনদিন পরের সকাল। আমরা কজন অনিলদা , মানে আমাদের ছোট মহারাজ, ও একজন ওয়ার্ডেনের সঙ্গে বরানগর কুঠিঘাট থেকে নৌকোয় উঠেছি। গঙ্গার বুকে একটু কুয়াশা কুয়াশা ভাব। আমি মাঝখানে একধারে বসেছি। দেখছি যে দাঁড়ের আঘাতে জলের বুকে কেমন ছোট ছোট ঘুর্ণি তৈরি হচ্ছে। কোথাও এক আধটা নিঃসঙ্গ কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে।
    কোত্থেকে একটা বেয়াড়া লাইন মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছেঃ
    ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর।
    দিবাকর? সূর্য? এখনও ভাল করে ওঠেনি। কেমন ফ্যাকাশে ম্যাদামারা রোদ্দূর। একটা হাফ সোয়েটার পরে আছি, শীত শীত করছে।
    বিপ্লব হাসছে, আমাকে হাত নেড়ে কাছে আসতে বলছে। আমি এখানেই বেশ আছি।
    নৌকো পাড়ে ভিড়ল। ভাটার সময় । ঘাটের কাছে থকত্থকে কাদা। একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে নৌকো থেকে যাত্রীদের কাদা এড়িয়ে শুকনো ডাঙায় পা রাখার ব্যব্স্থা করা হয়েছে।
    বিপ্লব কাঠের পাটায় পা রাখতে ইতঃস্তত করছিল। এঃ, ভয় পেয়েছে খোকাবাবু! এবার হেয়ার স্কুলের ফাট বেরিয়ে যাবে।
    আমি ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ও করুণ চোখে আমাকে দেখল।
    পা রাখল, পাটাতন দুলছে। অনিল মহারাজ বললেন-- কী হল? তাড়াতাড়ি কর।
    ও আদ্দেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছে। এই বার আর দুটো স্টেপ। কিন্তু পাটাতন বড্ড দুলছে যে! সবাই মন দিয়ে দেখছে।
    আমি নিজের অজান্তেই কখন পাটাতনের কাছে পৌঁছে গেছি। শেষ পা রাখতেই পাটাতন বিচ্ছিরি ভাবে নড়ে সরে গেল আর বিপ্লব ব্যালান্স হারিয়ে হুড়মুড়িয়ে এক পা শুকনো মাটিতে আর এক পা কাদায় পড়ে গেল।
    না, ঠিক পড়ে যায় নি। কেউ কিছু বোঝার আগেই আমি ওর এক হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছি, ও এসে হুড়মুড়িয়ে আমার গায়ে এসে পড়ল। আমিও হয়ত পড়ে যেতাম। কিন্তু তার আগেই অনিমেষদা আমাকে ধরে সামলে দিলেন।সবাই হেসে উঠল। ওর মুখটা লাল। কিন্তু আমাকে বলল-- থ্যাংকস্‌!
    আমি বাংলায় বললাম-- ঠিক আছে।
    ও কি কোন বিশেষ সেন্ট মাখে। নইলে কেমন একটা অন্যরকম গন্ধ কেন ওর গায়ে? অচেনা গন্ধটা ভালো লাগছে।
    এটা কি ইংলিশ মিডিয়াম ছেলেদের গায়ের গন্ধ? নাকি শুধু হেয়ার স্কুল হিন্দু স্কুল ছেলেদের?
  • ranjan roy | 132.162.161.160 | ১৫ জুন ২০১৬ ১২:১৪708415
  • আমরা এগিয়ে যাচ্ছি স্টেজের কাছে। এখনও বেশি ভীড় হয় নি। আস্তে আস্তে লোক আসছে। শীতের সকাল। গান হচ্ছে--ক্ষাত্রবীর্য ব্রহ্মতেজ মূর্তি ধরিয়া এল এবার!
    অনিমেষদার পেছন পেছন আমি আর বিপ্লব স্টেজের কাছে দাঁড়াই। উনি বল্লেন-- তোমরা এখানেই অপেক্ষা কর। আমি ভেতরে গিয়ে জেনে নিচ্ছি আমাদের কখন চান্স দেবে।
    বিপ্লব বলল-- গানের সুরটা বেশ ভাল লাগছে।
    আমি গম্ভীর মুখে বলি-- রাগ মালকোষ, তাল তেওড়া।
    ওর চোখ বড়বড়।--তুমি এসব জান? গান শিখছ?
    -- এখানে সবাইকে শিখতে হয়। তোমার ইচ্ছে থাকলে তুমিও শিখে যাবে। সবে তো এসেছ।
    ওর চোখে বেশ সম্ভ্রম। আমার হাত ধরে। বলে আমি নাকি কাদায় পড়ার হাত থেকে ওকে বাঁচিয়েছি। জামাকাপড়ে একরাশ কাদা নিয়ে ও কী করে স্টেজে উঠত!
    যাকগে, অনিমেষদা আসলেই আমরা ব্যাকস্টেজে বড় ঘরটায় এন্ট্রি পাব। তখন নিশ্চয়ই স্পেশাল জলখাবার দেবে। সাতসক্কালে বেরিয়েছি। খিদে পেয়েছে চড়চড় করে।
    হটাৎ কানখাড়া হয়। কখন গান শেষ হয়ে কবিতা আবৃত্তি শুরু হয়েছে, বাংলায়।
    "--- দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার,
    পিতাপুত্রে নাহি দেয় স্থান।
    স্বার্থ স্বার্থ সদা এই রব,
    কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?"
    আরে! এটাই তো আমার করার কথা, স্বামী বিবেকানন্দের "সখার প্রতি"! একটি কলেজের ছেলে করছে, ভারী গলা। মন্দ নয়। কিন্তু আমি এর চেয়ে ভাল করি। তাহলে?
    অনিমেষদা ফিরে এলেন। কেমন শুকনো মুখ।
    -- বাংলা কবিতাটা ওরাই করে দিল; দেখলে তো? ইংরেজিটার জন্যে বিপ্লবকে ভেতরে ডাকছে। তুমি বরং রাজা মহারাজের মন্দিরের কাছে চলে যাও। ওখানে ভলান্টিয়ারদের জলখাবার দিচ্ছে। ওখানেই ডিউটি কর। সেকেন্ড হাফে সম্ভবতঃ তোমাকে একটা চান্স দেবে। আমি তখন তোমাকে ওখান থেকে ডেকে আনব।
    অনিমেষদা বিপ্লবকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ও একবার আমার দিকে দেখল। আমি রাজ মহারাজের মন্দিরের দিকে হাঁটছি। বড্ড খিদে পেয়েছে যে! সামনে অন্য একটা মন্দির। সেখানেই দেখি ভলান্টিয়ারদের জন্যে লুচি আর আলুর ঘ্যাঁটমত দিচ্ছে। ওখানে আমাদের হোস্টেলের ক'জনকেও দেখতে পাচ্ছি। মহাউৎসাহে ওরা আমাকে জলখাবারের লাইনে ঢুকিয়ে নিল। খাবার পর জ্যোতিষ বলল- তুই এখানে আমাদের সঙ্গেই থাক। সহজ কাজ।
    কাজটা হল পাবলিকের জুতো রাখা। একদিকে সারি সারি জুতো অর চটি। অন্যদিকে বড় বড় করে নম্বর লেখা একগাদা কাগজের স্লিপ আর একটা বালতিতে জ্বাল দেওয়া ময়দার লেই।
    আমি মন দিয়ে লোকের কাছ থেকে জুতো নিই। ওদের একটা নম্বরের কাগজ ধরিয়ে দিই। বলি- সামলে রাখবেন, নইলে--!
    তারপর যমজ স্লিপটির নীচে বেশ করে আঠা লাগিয়ে জুতোর তলায় হাত লাগিয়ে সেঁটে দিই। এভাবে খানিকক্ষণ পরে জুতোর তলার ধূলো ও আঠা মিলেমিশে আমার হাতের চেটোয় এক বিচিত্র নকশা তৈরি করে। বন্ধুরা বলে-- যা, দুটো বিল্ডিং এর পরে একটা কল আছে। সেখান থেকে হাত ধুয়ে একটু ঘুরেটুরে আয়।
    -- মানে?
    -- আরে যত কাজ তার থেকে ভলান্টিয়র বেশি। তাই আমরা মাঝে মাঝে ডিউটি বদল করব। আমরা আগে ঘুরে এসেছি। এবার তুই যা। খালি ভলান্টিয়র ব্যাজটা খুলে পকেটে ঢোকা, কোন গেরুয়া যদি দেখে ফেলে তো চিত্তির!

    আমি হাত ধুতে থাকি। ধুয়ে মুছে তারপর ব্যাজ পকেটে পুরবো। এমন সময় কাছে একটি বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা অ্যাম্প্লিফায়ার গর্জন করে ওঠে-- This is your cup. The cup assigned to you from the begining. বিপ্লবের গলা।
    আমি আর ভলান্টিয়র ক্যাম্পে ফিরে যাই না। ঘুরে বেড়াই।মন্দির এরিয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে। বিশাল গঙ্গার পাড়। সবুজ ঘাস। কিছু কিছু জোড়া ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে। তাদের অলস কৌতূহলে দেখি। এগিয়ে চলি।
    নানান দোকানপাট, কেনা কাটা। যেন হাট বসেছে। একজায়গায় পূপস বলে একটা কোম্পানি লাল সরবত বিক্রি করছে। না পয়সা নিচ্ছে না। অর্থাৎ বিলোচ্ছে। কাঁচের গেলাসে লাল শরবত। লোকের কাড়াকাড়ি। আমি ভীড়ের মধ্যে মাথা গলাই। লোকেদের কনুইগুলো একধাক্কায় সরিয়ে দিই। কেউ কড়া চোখে তাকালে আমার পকেটে পিন দিয়ে সাঁটা ব্যাজ দেখাই। জায়গা ছেড়ে দেয়। এভাবে দুগ্লাস মিঠে শরবত খেয়ে শরীর জুড়োয়। কিন্তু বরফে গলা খুসখুস করে।
    এরপরে আর একটি ছোটখাট ভীড়ের দিকে গিয়ে দেখি লেক্স সিগ্রেট বিলোনো হচ্ছে। বিজ্ঞাপন। সেখানেও দুটো বাগাই--একই কায়দায়। পাটের দড়ি থেকে একটা ধরিয়ে দুটো টান মেরে কাশতে শুরু করেছি কি পেছন থেকে আওয়াজ-- এ কী প্রদ্যুম্ন ! তুমি সিগ্রেট খাও?
    বিপ্লব হাঁফাচ্ছে।
    -- কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। শোন, অনিমেষদা তোমাকে খুঁজছেন। এই নাও খাওয়ার টিকেট। এটা নিয়ে দুপুরের প্রসাদ খেতে পারবে। কিন্তু এটা?
    আমি কথা না বাড়িয়ে অন্য সিগ্রেটটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিই। খাবে?
    ও চমকে যায়। তারপর হেসে ফেলে।
    -- ঠিক আছে। কিন্তু তার আগে পকেট থেকে ব্যাজটা খুলে ফেল, আমিও খুলছি।
    সন্ধ্যের দিকে ফেরার পালা। নৌকোগুলোয় অসম্ভব ভীড়। স্বামীজি কিছু ছেলে কে নিয়ে আগেই দক্ষিণেশ্বর চলে গেছেন। সেখানে দর্শন করে ৩২ বা ৩৪ নম্বর বাসে ফিরবেন। আমরা ক'জন নৌকোর যাত্রী।
    অন্ধকারে টেমির আলোয় অনিমেষদা টিকেট কিনলেন। অন্ধকারে টাহর হয় না। একজন অচেনা লোক হাত ধরে আমাকে নৌকোয় তোলে । অনিমেষদা আর বিপ্লব যে কোন দিকে বসেছে টের পাইনে।
    কালো আকাশ। কালো জল। শুধু দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ। বড্ড শীত করছে।
  • ranjan roy | 229.64.186.127 | ১৬ জুন ২০১৬ ০০:২৪708426
  • ২)
    একটা গোটা বছর। কখন যে কীভাবে চলে গেল!
    আমার ও বিপ্লবের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব এখন হোস্টেলের গসিপ কলামে স্বীকৃত তথ্য। সিনিয়র দাদারা যারা হেয়ার স্কুল থেকে আসা ভাল ইংরেজি বলতে পারা ও কঠিন অংক কষতে পারদর্শী কোঁকড়াচুলের ছিপছিপে ছেলেটির সঙ্গে দোস্তি করতে আগ্রহী ছিল তারা ফুটে গেছে। আমি বেশ গর্বিত। বিপ্লব আমাকেই তার আসল বন্ধু ভাবে। কেন? তা জানি না।
    আমরা পড়াশুনো গান নাটক গল্পের বই পড়া এবং আড্ডা মারায় ব্যস্ত থাকি। ফুটবল খেলি না, কিন্তু ক্রিকেট ও ভলিবল খেলি। হোস্টেলে দুজন ছেলের একসঙ্গে ওঠাবসা চোখে পড়লেই সবার মুখে একটা অশ্লীল হাসি ফুটে ওঠে। তারপর কিছু তির্য্যক মন্তব্য।
    -- কী রে! তোদের কেমন চলছে আজকাল?
    -- মানে?
    -- মানে তোদের সংসার ধর্ম? কে কর্তা আর কে গিন্নি? এখনও পাকাপাকি ঠিক করিস নি? হেল্প চাই?
    -- ফালতু কথা বলবেন না। আমরা এসব পছন্দ করি না।
    -- আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। ভাল হলেই ভাল। আমাদের কী?
    কখনও কোন সিনিয়র এসে আমার পিঠ চাপড়ে দেয়। বিপ্লবের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে প্রোপোজ করেছিলাম। ও বলল যে ওর একটাই বন্ধু--প্রদ্যুম্ন; আর সংখ্যা বাড়াতে পারবে না। আমি বললাম তো ঠিকই আছে। প্রদ্যুম্ন বেশ ভালো ছেলে। তোদের মত উদাহরণ এখানে খুব কম। আশা করি তোদেরটা টিকে থাকবে।

    বিপ্লব নাক কোঁচকায়। এরা এভাবে কথা বলে কেন? দুজনের বন্ধুত্বের কি একটাই মানে? সেই অনিবার্য আঁশটে ব্যাখ্যা?
    কী করা যাবে! কবে থেকে শুরু জানি না। এ চলে আসছে। কিন্তু আমরা এসবের বাইরে থাকব। বুঝলি? সে আর বলতে।

    এখন ক্লাস নাইন। ও সায়েন্স নিয়েছে, ম্যাথস্‌। ওর বাবা ইঞ্জিনিয়র, ছেলেও তাই হবে। আমি আর্টস্‌ নিয়েছি। আমি কবি হতে চাই।
    আমরা স্কুলের সময়টা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতে চাই। প্রেয়ার হলে ডাইনিং হলে পাশাপাশি বসি। কিন্তু আলাদা রুম। দুটো আলাদা উইং।
    এবারে গরমের ছুটির পর আমাকে ৫ নম্বর ঘর অ্যালট করা হয়েছে।প্রত্যেক রুমে চারটে জানালা, পাঁচটা করে খাট , থুড়ি চৌকি। প্রত্যেক রুমে সিনিয়র ছেলেটি ক্যাপটেন। আমাদের রুমে তিনজন ক্লাস নাইনের, এক্জন টেন ও একজন ইলেভেন। রাজকুমারদা ইলেভেন, অতএব ক্যাপ্টেন। আমরা পালা করে ঘর ঝাঁট দিই, ঘর মুছি। সপ্তাহে একদিন প্রেয়ার হলে দল বেঁধে সাফ করতে যাই।রাজকুমারদা ওসব কিচ্ছু করে না। ওর পালিটাও আমরাই পালা করে মেরে দিই। তবে নির্ঝঞ্জাট লোক। নিজের মনে থাকে। জুনিয়রদের সঙ্গে বেশি কথা বলে না , পড়াশুনো নিয়ে জ্ঞান দেয় না। খালি বলে--ঘরের মধ্যে কেউ সিগারেট খাবে না।আমি কোন ফালতু ক্যাচাল কম্প্লেন পছন্দ করি না। আর রাত দশটার মধ্যে সব ঘরে ঢুকবে। আমি সাড়ে দশটায় লাইট অফ করব। পড়াশুনো করতে বা গল্পের বই পড়তে হলে ভোরে উঠে লাইট জ্বালাবে। নইলে বারান্দায় চেয়ার টেনে নিয়ে যাবে।
    বই পড়া নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। ওদের চালের হোলসেল বিজনেস। টেনে টুনে পাশ করে যায়। সারাবছর স্বামীজিরা ওর মত ছেলেদের খুব খেয়াল করে দেখেন না। কিন্তু বছরে একবার কালীপূজো বা সাধূসেবার সময় ওদের দারুণ কদর। আশ্রমের গাড়ি করে ওদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে রসীদ বই নিয়ে আশ্রমের কেউ হোমরাচোমরা। উদ্দেশ্য মহৎ। ওদের বাবা-কাকাদের থেকে প্রতিমার দাম বা সাধুসেবার চালের যোগান নেওয়া।
    উত্তম কাট চুল আর মিডিয়াম পেস বোলিং-- রাজকুমারদার অনেক ফ্যান। ও কিন্তু নিজের ব্যাচ ছাড়া কারও সঙ্গে বেশি মেশে না।

    ব্যতিক্রম একজন। ক্লাস টেনের বিমানদা। বিমানদাদের বাঁকুড়া জেলায় কোথায় একটা সিনেমা হল আছে। ওই প্রথম হোস্টেলে টি-শার্ট নিয়ে আসে। ওটাকে প্রথম প্রথম বম্বে শার্টও বলা হত। বিমানদা রোজ স্নানের পর পাউডার মাখে। গলা ও ঘাড়ে দাগ দেখা যায়। বিমানদা কখনও আমাদের চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলে না। বড্ড ঘ্যাম। তাতে আমার কী!
    আমার যে কী তা আগে যদি জানতাম!
    কী করে জানব? আগে তো কখনও রাজকুমারদার সঙ্গে একরুমে জুনিয়র হয়ে থাকি নি। এখন ভাবি -- কী করে রুম বদলানো যায়। বন্ধুরা বলল-- এভাবে বদলানো যায় না। বড়দের সম্বন্ধে নালিশ করবি? তারচেয়ে মুখ বুজে চারটে মাস কাটিয়ে দে। তারপরই পূজোর ছুটি। তখন তো রুম ফের বদলে যাবে।
    বেশ, তাই সই। চারমাস? মুখ বুজে কাটাবো ? কী করে?
    রোজ ভোরে উঠতে হয়। তাই সারাদিনের পর আলো নিভিয়ে বিছানায় মশারি গুঁজে গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা বুজে যায়।
    কিন্তু খানিকক্ষণ পরে, বোধহয় একঘন্টা হবে, জানলায় খুট খুট শব্দ। না, আমার জানলায় নয়, ক্যাপ্টেনের জানলায়, সে ও গাঢ় ঘুমে। খুট খুট এবার খট খট হয়। কেউ চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে ডাকছে-- রাজু! এই রাজু!
    একটু ভয় পাই। কে? কে ওখানে?
    পাশের বিছানা থেকে মানস ফিসফিসিয়ে বলে-- চুপ কর। কথা বলিস না।
    তারপর ও উঠে আস্তে করে দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের মশারিতে সেঁদিয়ে যায়।
    একটা ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ; তারপর রাজু, থুড়ি রাজকুমারদার মশারি তুলে ঢুকে পড়ে। ভয়ে ও অবাক বিস্ময়ে আমার ঘুম উপে গেছে।
    মশারির মধ্যে ঘুমজড়ানো গলায় রাজকুমারদা কিছু বলে। পাশ ফিরে শোয়। আগন্তুক নাছোড়বান্দা। সে ক্রমাগত রাজু, ওঠ, আমি এসেছি বলে চলে।
    একটু পরে দুজনের চাপাগলায় গল্প শুরু হয়। একটা চড়ের মত আওয়াজ হল কি? না, ওরা তো হাসছে। হ্যাঁ, দুজনেই। তারপর এটা কী? কেমন যেন বেড়াল চুরি করে দুধ খাচ্ছে! কিন্তু এখানে বেড়াল কেন আসবে?
    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।
  • ranjan roy | 132.180.220.170 | ২২ জুন ২০১৬ ১২:২৮708216
  • পরের দিন সকালে স্নানে যাওয়ার আগে মানসকে চেপে ধরি।
    কী ব্যাপার বল তো? কাল রাত্তিরে যা ভয় পেয়েছিলাম না? কে এসেছিল রে?
    -- শোন, ভয় পাওয়া ভাল। তাহলে মুখ বন্ধ থাকবে।
    --- ভাগ শালা! ন্যাকামি না করে ঝেড়ে কাশ দিকি! কে এসেছিল?
    -- বিমানদা, ক্লাস টেন।
    -- রাজকুমারদার মশারিতে কেন ঢুকেছিল?
    --- কেন আবার? বিমানদা রাজকুমারদার সঙ্গে প্রেম করছে তাই!
    --- সেকি! কবে থেকে এসব হচ্ছে?
    -- দু'বছর ধরে। সবাই জানে শুধু তোর মতন আতাক্যালানে ছাড়া।
    --- তা মশারির ভেতরে ঢুকেছিল কেন?
    --- দূর গাধা! ভালবাসে বলে।
    -- তা বলে এই গরমে এক মশারিতে?
    -- তুই কি রে! ওরা স্বামী-স্ত্রী তাই।
    -- কী বললি? কে কার স্বামী?
    --ঠিকই শুনেছিস। রাজকুমারদা স্বামী আর বিমানদা--। তাই রোজ রাতে সবাই শুলে স্ত্রীরা হেঁসেল গুছিয়ে লাইট নিভিয়ে স্বামীর বিছানায় যায় না? তেমনি।
    --- বিমানদা ক্যাপ্টেনকে রাজু বলে ডাকছিল কেন?
    --- ধেত্তেরি! তোর বগলে কাঁইবিচি। বল্লাম তো ভালবাসে বলে। বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখ, তোর বাবা তোর মাকে একটা অন্য নামে ডাকেন নিঘ্ঘাৎ।
    চন্ডাল রাগে ওর কলার ধরে ঝাঁকাতে থাকি। কী বললি! জিভ ছিঁড়ে নেব। দুজনে জড়াজড়ি করে বারান্দায় গড়াতে থাকি। অন্যদের চোখে পড়ে ; ওরা দৌড়ে এসে ছাড়াতে যায়। আমাদের টেনে তোলে।
    --কী হয়েছে? দুটো দামড়া তায় রুমমেট, মারপিট কেন?
    --দেখ না; এই শুয়োরের বাচ্চা মানস আমার বাপ-মা তুলেছে।
    --কী রে মানস?
    -- বাজে কথা। আমি খালি বলেছি ভালবাসলে একজন আর একজনকে আরেকটা আলাদা নিজস্ব নাম দেয়। যেমন আমার বাবা প্রাণেশ আর মা স্বর্ণলতা। তো বাবা মাকে সোনিয়া বলে ডাকে, আমাদের সামনেই। মা বাবাকে বলে রাজা, কিন্তু আমাদের আড়ালে। ওর বাবা-মা হয়ত নিজেদের তেমন ভালবাসেন না, তাই কোন স্পেশাল নাম নেই।
    আমি আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম কিন্তু তিনজোড়া হাত আমাকে আটকায়।
    সিনিয়র একজন জিজ্ঞেস করে-- সামনে হাফ ইয়ারলি, তোদের পড়াশুনো ছেড়ে হটাৎ প্রেম-ভালবাসা নিয়ে ঝগড়া হল কেন?
    আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মানস চোখের ইশারায় চুপ করতে বলে। নিজেই এগিয়ে এসে বলে আসলে জয়শ্রী সিনেমার পাশের দোকান থেকে রোজ লাউডস্পীকারে পান্নালালের ওই গানটা শোনা যাচ্ছে তো!
    সবাই ভেবলে যায়।
    --কোন গানটা?
    -- সেই যে 'আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরি, সকলি ফুরায়ে জায় মা'।
    --ওঃ, ওটা? ট্রেনের ভিকিরির দল গায়।তার থেকে প্রেম-ভালবাসা? ফান্ডা ক্লিয়ার হল না।
    অনিরুদ্ধ অধৈর্য হয়ে যায়।
    -- আরে? ওই লাইনটা দেখুন--যেথা আছে শুধু ভালবাসাবাসি সেথা যেতে প্রাণ চায় মা!
    সবাই হেসে ওঠে। প্রশান্ত ট্রেনের গায়কদের নকল করে বিকৃত সুরে দু'কলি গেয়ে দেয়।
    ঢং ঢং ঢং ঢং!
    স্নানের ঘন্টা বেজে ওঠে।
    আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার ঘরের দিকে ছুটি। গামছা নিয়ে এসে কলতলায় লাইন ধরতে হবে। আধঘন্টার মধ্যে। তারপর নাকে মুখে দুটো গুঁজে স্কুল।
  • d | 144.159.168.72 | ২২ জুন ২০১৬ ১৩:২৮708227
  • পড়ছি
  • Ranjan Roy | ২৩ জুন ২০১৬ ১৩:০১708238
  • ৩)
    " কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইল রে!"

    সেদিন বিকেলে আর খেলতে যাওয়া হয় নি। মানস বলেছে প্রেয়ার হলের পেছনের বারান্দায় বিকেল পাঁচটায় দেখা করতে।
    সাদা ধবধবে শ্বেতপাথরের মেজে। তিনদিকেই ঢালা বারান্দা। বাঁদিকের আর সামনের বারান্দায় লোকজনের আনাগোনা। পেছনের বারান্দায় একটু অন্ধকার মত। কিছু জবা ও অন্য ফুলের আর বেলফলের গাছ। তারপরে মানুষপ্রমাণ এক ইঁটের পাঁচিল। তার ওপাশে দু'তিনটে বাড়ি। আমাদের ওদিকে তাকানো বারণ। কখনও ওদের জানলায় দাঁড়ানো কোন বউ বা মেয়ের দিকে অসভ্য ইঙ্গিত করার কমপ্লেন এসেছিল। অপরাধীকে পত্রপাঠ টিসি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
    আর আশ্রমের ঘেরাটোপের বাইরে যে নানান প্রলোভন। আমরা জানি যে স্বয়ং বুদ্ধদেব আর একটু হলেই মারের আক্রমণে কাবু হয়ে যাচ্ছিলেন। শিবের তপস্যা কি এমনি এমনি ভঙ্গ হছিল? মদনভস্মের গল্প আমাদের রোববারের সকালের ধর্মক্লাসে পড়ানো হয়ে গেছে। ব্রহ্মচর্য্য যে কতভাবে নষ্ট হয়! বাইরের দুনিয়া সারাক্ষণ চক্রান্ত করছে আমাদের ব্রহ্মচর্য্য নষ্ট করার জন্যে।
    একজন বলেছিল যে রবিঠাকুর একটা গান লিখেছেন-- প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!"
    তো অনিলদা, মানে অনিল মহারাজ বললেন-- রবিঠাকুর সরস্বতীর বরপুত্র। উনি ঠাকুর। উনি এ সব ছ্যাবলা গান লিখতে পারেন না।
    আমরা কয়েকজন জোর দিয়ে বললাম যে সত্যি উনি লিখেছেন। লাইব্রেরি থেকে রচনাবলী এনে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। অনিলদা এত সহজে হার মানবেন কেন? উনিও সমান জোর দিয়ে বললেন যে আমরা ক্লাস নাইনেই বখে যাচ্ছি। গানের বিকৃত অর্থ করছি। রবি ঠাকুরের গানে পূজা ও প্রেম মিলেমিশে যায়। এ ফাঁদ, ঈশ্বরের ভক্তের জন্যে পাতা ফাঁদ। ওই গানটা খেয়াল কর-- বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ কেমনে দিই ফাঁকি!
    দুঃসাহসী নিখিলেশ বিবেকানন্দের জন্যে কেউ ফাঁদ পেতে ছিল কি না জিজ্ঞেস করে বেত খেল, তবে সেদিনের মত ধর্মক্লাসের হাত থেকে ছুটি পেয়েছিলাম।
    সে যাকগে, মানস কেন ডাকল সেটা নিয়ে একটু ভয় ছিলই। সকালের মারপিটের দ্বিতীয় ইনিংস নয় তো? তাই আমিও একা যাই নি। বিপ্লব সঙ্গে এল।
    বিশাল বারান্দা, খালি। কেউ নেই।
    -- কী রে! ফালতু বিকেলটা নষ্ট হবে নাকি!
    ----শুয়োরের বাচ্চা আচ্ছা বোকা বানাল ! ঝাড় খেয়ে এখন শোধ তুলছে!
    --আর একটু দেখি।
    -- দ্যাখ, আমি কিন্তু খেলা শেষের লম্বা ঘন্টা পড়লেই কাটব। হাত-পা ধুয়ে 'খন্ডন ভব-বন্ধন" করতে আসতে হবে না? ফালতু লেট এর খাতায় নাম তুলতে দেব না।

    কিন্তু ঘন্টা বাজার অনেক আগেই মানস এসে গেল। কিন্তু ও একা নয়। সঙ্গে মিথিলেশদা। আমাদের হস্টেলের টিমের গোলকীপার। পড়ে ক্লাস ইলেভেনে।
  • Ranjan Roy | ২৩ জুন ২০১৬ ১৩:৩০708249
  • কিন্তু মিথিলেশদা কেন? মারবে? মানস মিথ্যে কথা বলে খেপিয়ে আনে নি তো?
    আমাদের আশ্রমে বড়রা ছোটদের মারতে, থুড়ি শাসন করতে পারে। কোন আপিল চলে না। তবে বেয়াদপি বা বড়দের অসম্মান করা --এই জাতীয় ভ্যালিড কারণ থাকতে হবে। সাক্ষী থাকলে আরও ভাল।
    আর যারা মহারাজের বা ম্যানেজমেন্টের খোচরের কাজ করবে তাদের বলা হবে দালাল। তার থেকে দালু বা পচা আলু। পরে বুঝেছিলাম যে বড়দের একচেটিয়া ঠ্যাঙানোর অধিকারের বিরুদ্ধে ছোটদের একটা সেফগার্ড হল দালালদের ভয় পাইয়ে দেওয়া বা একঘরে করা।
    এই মানস ব্যাটাও ক্লাস সিক্স-সেভেনে দালাল উপাধি পেয়েছিল। শীতকালে ওর লেপে জল ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সবাই আশ্রমের নিয়ম মেনে কলাই করা থালা-মগ ব্যবহার করি। ও বাড়ি থেকে কাঁসার থালা নিয়ে এসে্ছিল। সেই থালার সদগতি হল আশ্রমের পচাপানার পুকুরে।
    আমরা ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালাম। বসতে বলল মিথিলেশদা, একটু হাসল। এটা কি বলির আগে কাঁঠালপাতা খাওয়ানো?
    --- মানস বল; কী হয়েছে?
    মানস কাল রাত্তিরের ঘটনা সংক্ষেপে বলল। তারপর বলল--প্রদ্যুম্ন মেনে নিতে পারছে না। ভাবছে মহারাজের কাছে যাবে।
    মিথিলেশদা গম্ভীর হল।
    তারপর বলল-- আর কে কে জানে? প্রদ্যুম্ন, আর কাকে বলেছিস?
    -- কাউকে না। আমি আর মানস।
    -- শোন, বড়দের ব্যাপার ওদেরই বুঝে নিতে দে, নাক গলাস না। তোর প্রবলেমটা কী?
    -- না মানে মানস বলছিল--!
    --- কী বলছিল?'
    --- বলছিল যে বিমানদা নাকি আমাদের ক্যাপ্টেন রাজকুমারদাকে ভালবাসে? তাই ওকে রাজু বলে ডাকে। ওরা নাকি স্বামী-স্ত্রী?
    -- ঠিকই তো বলেছে; তাতে তোর কোথায় চুলকোচ্ছে?
    --- না, মানে ছেলেতে ছেলেতে ভালবাসা? এরকম তো আগে কখনও শুনি নি। তাই।
    --- এই আশ্রমে আসার আগে অনেক কিছুই শুনিস নি। তো? কীভাবে সবার বাচ্চা হয় জানিস? বায়োলজি নিয়েছিস?
    --না, ও তো আর্ট্স্‌ নিয়েছে, কবি হবে।
    -- আমার ইয়ে হবে। স্কুলের ম্যাগাজিনে চাল এর সঙ্গ ডালের মিল দিয়ে পদ্য লিখে নিজেকে রবিঠাকুর ভাবতে লেগেছে?
    ঢং ঢং করে খেলা শেষের টানা ঘন্টা বেজে উঠল। আধঘন্টা বাদে প্রেয়ারের ঘন্টা বেজে উঠবে, শুধু একবার --ঢং!
    আমরা উঠলাম।সবাই ।
    মিথিলেশদা বলল--দাঁড়া। কথাটা মন দিয়ে শোন। ফালতু দালালি মেরে নালিশ করতে যাস না। কোন লাভ হবে না।ওরা দুজন ডিনাই করবে, এরকম কিছু হয় নি। মানস বলবে-- তুই আসলে কাল খারাপ স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলি। তারপর আমরা কয়েকজন সিনিয়র মিলে তোকে ভাল করে ক্যালাবো, বড়দের নামে মিথ্যে মিথ্যে চুকলি করার জন্যে। আর তুই হবি তোদের ব্যাচের নতুন দালাল। এবার যা!
  • Ranjan Roy | ২৩ জুন ২০১৬ ১৯:০২708260
  • ঘরে এসে আমি আর বিপ্লব নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা বলি। ছেলেতে ছেলেতে ভালবাসা। এ কী করে সম্ভব। যোগ দেয় নিখিলেশ আর প্রশান্ত।
    --কেন হয় না? আমরা কি একে অন্যকে ভালোবাসি না?
    --হ্যাঁ হ্যাঁ; তুই কি তোর বাবা- মাকে ভালবাসিস না? ভালবাসা কি জেন্ডার- স্পেসিফিক হতেই হবে?
    -- কী বললি কথাটা? নতুন কোন ঢপ?
    -- আরে না। আমার দাদা শিবপুর বি ই তে পড়ে। ওর কাছে শুনেছি।
    -- এ শালার জুটেছে এক দাদা। ওর থেকে নতুন নতুন শব্দ শিখে আমাদের কাছে ঘ্যাম নেয়।
    -- বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ, চল ডিকশনারি দেখি। বাজি?
    --- আমি জুয়াড়ি না। শালা বাজি ধরতে হয় তো শনিবার শনিবার ঘোড়ার পোঁদে ধর। সে ব্যাপারে দম নেই।
    --- ছাড় তো! ক্লাস নাইনে পড়ে রেস খেলবে! পোঁদে নেই ইন্দি, ভজ রে গোবিন্দি! ফুটবল ম্যাচ দেখার পয়সা নেই আর উনি--!
    ---আমাদের পাড়ার নবীনকাকু খেলে। রোববার দিন ওদের বাড়িতে খুব চেঁচামেচি হয়।
    --কেন? আরে বেশিরভাগ দিন পকেট খালি। কাকিমা বাসন আছড়ে ফেলেন।
    --সেকি রে! একবারও জেতে না?
    --দেখি নি তো! জিগ্যেস করলে বলে --বুঝলি প্রশান্ত, এবার যে ঘোড়াটাকে ধরেছিলুম না, একেবারে বাঘের বাচ্চা! দেখি সবকটা ঘোড়াকে তাড়া করে আসছে! বলে হ্যা হ্যা করে হেসে গেলাসে চুমুক! এই হল তোর রেসের কিস্‌সা।
    -- কী রে নিখিলেশ! রেস খেলার রেস্ত না হোক নতুন কিছু শব্দ তো মুখস্থ করে হোস্টেলে ফান্ডা ঝাড়তে পারিস।
    নিখিলেশ রাগতে গিয়ে হেসে ফেলে।
    --- সে কি তোর থেকে জ্ঞান নেবার জন্যে বসে থাকবো? ওসব আগেই ক্যাচ করে নিয়েছি।
    -- শোনা না দু-একটা?
    -- টোটে এত, উইনে এত, হ্যান্ডিকাপে বা জ্যাকপটে।
    -- এ শালা কিস্যু জানে না। আনন্দবাজারের খেলার পাতা থেকে মুখস্থ করেছে।
    চারজনের হো-হো-হি-হি শেষ হওয়ার আগে বিশু এসে পড়ে---আরেক ফান্ডাবাজ। ওর গলায় কন্ঠিমালা। ওদের বসিরহাটে পারিবারিক কীর্তনের দল আছে। আমাদের আশ্রমে একবার ওদের পার্টি এসে ফাটাফাটি পালা গেয়েছিল। সখীসম্বাদ আর মাথুর। ওর বাবা মূল গায়েন। হেবি হেবি আখর দিয়েছিলেন। আর বিশু করতাল হাতে জুড়ি ধরেছিল।
    আমরা নতুন করে তর্কে মেতে উঠি। ছেলেয় ছেলেয় ভালবাসা কী করে সম্ভব?
    বিশু বলে-- তোদের উদাহরণগুলো বড় ছড়ানো। বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্কের রস হল বাৎসল্য, বন্ধুদের সঙ্গে সখ্য, মানে ফ্রেন্ডশিপ। ভালবাসার অনেক রকমফের , অনেক নাম।
    প্রশান্ত বলে-- গোঁসাইঠাকুর, সে তো বুঝলাম। কথা হচ্ছে ছেলেতে ছেলেতে স্বামী-স্ত্রীর মত ভালবাসা হয় কী করে?
    নিখিলেশ--এটা বোধহয় একরকম ইয়ার্কি! বা বিকৃত কাম।
    বিশু--দ্যাখ, নারীপুরুষের ভালবাসাকে বলে মধুর রস বা শৃংগার। এতে প্রেম ও কাম মিলেমিশে থাকে। কোথাও কাম বেশি, কোথাও প্রেম।
    --যত্ত ভুলভাল ফান্ডা! কথা গুলিয়ে দেওয়া। প্রেম ও কামের তফাৎ কী করে বুঝবো?
    --- এত অধৈর্য হোস কেন? গোস্বামী কবিরাজ সেটাও স্পষ্ট করে বলে গেছেন।
    "আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম,
    কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম"।
    --- রাখ তোর কবিরাজের মকরধ্বজ বটিকা। আরও গুলিয়ে গেল। দুটো ছেলেমেয়ে বা ছেলে ছেলের মধ্যে কৃষ্ণ কোত্থেকে এল?
    বিশু মাথা চুলকোয়।
    --আমিও ভাল বুঝি নি। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, এর মানে সত্যিকারের ভালবাসার কষ্টিপাথর হল ত্যাগ করা। যাকে ভালবাসি তার জন্যে।
    -- কী যে বলিস? আমি যাকে ভালবাসি তাকে তো পেতে চাইব, ধরে রাখতে জান লড়িয়ে দেব। ওকে ত্যাগ করব কেন?

    খাওয়ার ঘন্টা বেজে ওঠে। মাত্র দুটো স্ট্রোক।
  • Ranjan Roy | ২৪ জুন ২০১৬ ১৩:১৭708271
  • ৪)
    এবার দূর্গাপূজোর সময় আমাদের আশ্রমের 'এস্কার্সন' হবে দার্জিলিংয়ে। আচ্ছা, এস্কার্সন মানে কী? অমন খটোমটো কোন শব্দ তো ক্লাস নাইন অব্দি কোন বইয়ে পাইনি! কিন্তু বিপ্লব তো হেয়ার স্কুলের। ও আমাকে মানে বলে দিল। আমি গর্বিত। আমাদের ব্যাচে শুধু আমিই ওই কঠিন শব্দের মানে জানি।
    থাকা হবে স্নোভিউ হোটেলে; স্বামীজি, মানে রামকানাইদা অর্থাৎ শান্তিনাথানন্দ চিঠি লিখেছেন। যারা যারা যেতে চায় তাদের সবাইকে গার্জেনের চিঠি শুদ্ধু একটি নির্দিষ্ট টাকা ১৫ দিনের মধ্যে আশ্রমের অফিসে জমা দিতে হবে।
    আমি ও বিপ্লব নানা রকম প্ল্যান করি, স্বপ্ন দেখি। দার্জিলিং!! হিমালয়! বরফ! শুধু ছবিতে দেখেছি। স্কুলের পাঠ্যবই 'কিশলয়' এ জলধর সেনের বর্ণনা পড়েছি; টয় ট্রেন! ওখানে তো শুধু বড়লোকেরা যায়। যেমন আমাদের ভাড়াবাড়ির উল্টো দিকে বিশাল দোতলা বাড়ির দত্তদের ছেলেমেয়েরা। তবু আশ্রমের সুবাদে আমরাও যেতে পারব। স্টুডেন্ট কনসেশন, আরও কী কী সব। হটাৎ বুকের মধ্যে আশ্রমের জন্যে একটা ভালবাসার জোয়ার টের পাই। রামকানাইদার জন্যেও।
    এখানের চারদেওয়ালের মধ্যে হাঁফিয়ে উঠি, খোলা আকাশের নীচে কী আনন্দ!
    বাবার চিঠি এল। গত দু'বছর পরপর আমাদের দুভাইকে বাবা এস্কার্শনে পাঠাতে কোন আপত্তি করেন নি। রাজগীর-বোধগয়া বা ম্যাসানজোড়। এবার সম্ভব হবে না। আর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন আরও দু'লাইন। এখন ক্লাস নাইনে আমার পড়াশুনো নিয়ে আরও সিরিয়াস হওয়া উচিত , নইলে পরে পস্তাতে হবে। হায়ার সেকেন্ডারিতে সম্স্ত প্রশ্নপত্রে সেক্শন এ বা ৫০% প্রশ্ন তো নাইন-টেন থেকেই আসবে। আমি সিরিয়স না হলে পরের দু'ভাইয়ের কী হবে? ওরা বিপথগামী হবে।

    রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যায়।
    আমি তাহলে মেড়ার পালের সর্দার মেড়া। আমি যে দিকে যাব,ছোট দুভাইও সেদিকে? দুস্‌ শালা!
    দুদিন পরে বিকেলে আমি ও বিপ্লব নতুন স্কুল বাড়ির আদ্ধেক তৈরি অংশটায় মিট করি। ও বলে--শোন, একটা রাস্তা আছে। আমি বাবাকে বলে তোর পয়সাটা জমা করিয়ে দেব। তুই বাড়িতে বলবি--তোকে কনসেশন দিয়েছে।
    \ আমি মাথা নাড়ি। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার চোখে জল।
    বলে-- আমিও যাব না। তোকে বাদ দিয়ে অন্য ফালতুগুলোর সঙ্গে !! সেবার রাজগীর আর বোধগয়া এস্কার্শনের সময় কত আনন্দ হয়েছিল ভাব তো!
    সপ্তপর্ণী পাহাড়, বিপুলগিরি বা প্যাগোডায় আমরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। রোজ রাত্তিরে ক্যাম্প ফায়ারে দুজনে মিলে কোন স্কিট বানিয়ে অ্যাক্টিং করেছি। ও খুব ভাল মাউথ অর্গান বাজায়। বাজিয়েছিল-- এ অপনা দিল তো আওয়ারা, আর নতুন হিট ইংরেজি সিনেমা কাম সেপ্টেম্বরের থিম মিউজিক,
    রামকানাইদা সংগীত নাটক বোঝেন, পছন্দ করেন। আপত্তি করেন নি।
    তবে ফেরার পথে রাত্তিরে ট্রেনে আর একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা মনে পড়তেই দুজনে হেসে উঠলাম।
    ওইপ্যাসেঞ্জার ট্রেনে একটা গোটা কামরা আমাদের জন্যে রিজার্ভ ছিল; থার্ড ক্লাস। সন্ধ্যের পরেই ট্রেনের আলো নিভু নিভু হতে হতে একেবারে চলে গেল। রান্না তৈরি ছিল। সমবেত টর্চের আলোয় আমরা লুচি, আলুর শুকনো তরকারি ও তিনটুকরো মাংস দিয়ে খাওয়া সেরে নিলাম।
    সবাই শুয়ে পড়েছে।
    কিন্তু কোথা থেকে একটা গানের আওয়াজ আসছে না? আন্দাজে ভর করে এগিয়ে দেখি রামকানাইদা হারমোনিয়ামে বসেছেন। উল্টোদিকে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছেন রঘুনাথ গোস্বামী ও তাঁর সঙ্গিনী মহিলা। উনি তখন অ্যাডভান্সড্‌ পাপেট শো করিয়ে কোলকাতায় বেশ নাম করেছেন। আমরাও দেখেছি।
    একটা গান শেষ হল। রঘুনাথ দূর্গা রাগের ফরমাশ করলেন। রামকানাইদা একটা সরগম বাজিয়ে আরোহ, অবরোহ, পকড় দেখিয়ে দিয়ে গান ধরলেন, অন্তরায় ছিল--"রামকৃষ্ণ বলে আপনার মনে , কালীনাম বিনা কর্ণে নাহি শুনে"।
    এরপর টর্চের ব্যাটারি নিভে যাওয়ায় ওঁরা উঠলেন। রামকানাইদা আমাকে দেখে বললেন--- কী রে ব্যাটা! ভালো লেগেছে? আশ্রমে ফিরে চল, কথা হবে। এখন শুতে যা!
    আমি ফিরে এসে দেখি আমার আর বিপ্লবের বিছানা মুখোমুখি দুটো বাংকে। নীচের বেঞ্চের একটায় কেউ ঘুমোচ্ছে আর অন্যটায় ক্লাস টেনের অসীমদা জানলার কাছে বসে টর্চ জ্বালিয়ে বাইরে ছুটে চলা ঘন জঙ্গল দেখছে। বললাম-- সেল ফুরিয়ে যাবে যে! ঘুমোবে না?
    -- আর এক জোড়া এক্স্ট্রা আছে। ঘুম পাচ্ছে না। তুই শুয়ে পড়।
    আমি ওপরে উঠে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবতে থাকি, ভেড়া গুণি, ঘুম আসে না।
    একটা চাপা হাসির শব্দ; কী রে ? খুব গান শুনছিলি?
    আরে? বিপ্লব ঘুমোয় নি!
    তোর সঙ্গে কথা না বলে ঘুমোতে পারি?

    মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। আমরা ফিসফিস করে গল্প শুরু করি। মনে হয় ট্রেনের গতি আর 'তুমি থাকো, আমি যাই" ছন্দের দোলায় কারও ঘুম ভাঙবে না,
    কিন্তু একটু পরে অসীমদা চাপা গলায় ধমকায়-- আবে! তোদের ন্যাকড়াবাজি শেষ হয় না, অ্যাঁ? ঘুমো।

    খানিকক্ষণ সব শান্ত। ফের শুরু হয় ফিসফিসানি।
    অসীমদা তেতো গলায় বলে--বাঞ্চৎ গুলোর মাঝরাত্তিরে রস উথলে উঠেছে!

    আমি বলি--আমরা কি লাকি রে! গোটা ট্রেন ঘুমোচ্ছে। শুধু আমরা দুজন জেগে আছি।
    -- তাহলে তোর নাম হল লাকি।
    -- মানে?
    -- আরে কোলকাতা পুলিশের কুকুরের নামকরা একটা জোড়া আছে না? আজকাল কাগজে ওদের কথা খুব বেরোচ্ছে।--লাকি আর মিতা।
    --- তুই তাহলে মিতা?
    --হ্যাঁ; শোন, এটা আমাদের কোড নাম। এই নামে আমরা নিজেদের মধ্যে চিঠি লিখব। নিজেদের ডাকব। কেউ টের পাবে না। কী মজা!
    ও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমিও বাড়িয়ে দিই। কিন্তু কেউ কাউকে ছুঁতে পারি না। ও বাংকের থেকে একটু কিনারার দিকে গড়িয়ে আসে। এবার ছোঁয়া যাচ্ছে।
    আমার কী যে মনে হল-- আমি হাত বাড়িয়ে ওর কনুইয়ের ভাঁজে একটা চপ মারলাম। ও টাল সামলাতে না পেরে মাথা নীচের দিকে করে পড়ে গেল। কিন্তু ওর মাথা মাটি ছোঁয়ার আগে আমার দু'পা কাঁচির মত ভাঁজ হয়ে ধরে ফেলেছে ওর গোড়ালি। ও ঝুলছে বিপজ্জনক ভাবে, মুখে চাপা আর্ত চিৎকার!
    নীচের থেকে অসীমদা লাফিয়ে এসে ধরে ফেলেছে ওর মাথা। ওদিকের বেঞ্চ থেকে ঘুমন্ত ছেলেটি অসীমদার ডাকে উঠে এসে ধরে ফেলেছে বিপ্লবকে। ওরা দুজনে আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয়।
    আমি নীচে নেমে আসি। বিপ্লব স্বাভাবিক হতে একটু সময় নিল।
    -- কী করে পড়ে গেলি বলত? আর একটু হলেই বিচ্ছিরি চোট লাগত। কেউ ধাক্কা দিয়েছিল?
    আমি জনলা দিয়ে বাইরে তাকাই।
    বিপ্লব কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-- ঝিমুনি এসেছিল, বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম। গড়িয়ে পড়েছি।
    -- যত্ত সব ঢ্যামনামি! এসব হল নতুন বাল গজানোর চুলকুনি।
    পরের দিন বিকেলের মধ্যে আশ্রমের সবাই জেনে যায় অসীমদার উপস্থিত বুদ্ধি ক্যাচ ধরার টেকনিক আর আমাদের দুজনের ঢ্যামনামির গল্প।
    আমাদের নিজস্ব রইল শুধু দুটো শব্দ-- লাকি আর মিতা।
  • Manish | 127.200.85.151 | ২৫ জুন ২০১৬ ১৩:২২708282
  • পড়ছি।
  • Ranjan Roy | ২৭ জুন ২০১৬ ০০:৫৩708293
  • ৫)
    কালকে দার্জিলিং যাওয়ার গ্রুপটা রওনা হয়ে যাবে। প্রায় ৪৫ জন। বাকি দেড়শ জন পূজোর ছুটিতে বাড়ি যাব সাতদিন পরে।
    অর্থাৎ এই সাতদিন লাকি একলা হয়ে যাবে, মিতা তো দার্জিলিং গিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে মশগুল হবে।
    আমরা যথারীতি প্রেয়ার হলের পেছনের বারান্দায় হাতধরাধরি করে দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছি।
    পূজোর পনের দিন ছুটি। লক্ষ্মীপূজোর পর হোস্টেলে ফিরতে হবে। বিসর্জনের পর বাড়িতে কেমন একঘেয়ে লাগবে। বাড়ির রান্না, পূজোর নতুন জামাকাপড়, পার্কসার্কাস পাড়ায় দূর্গোপূজো বা অষ্টমী-নবমীতে সকালের অঞ্জলি ও সন্ধ্যেয় ঘুরে ঘুরে বালিগঞ্জ ভবানীপুরের ঠাকুর দেখা-- তার রোমাঞ্চ আর আগের মত নেই।
    মিতা বলে-- একদিন আমার বাড়িতে আয় না? দুজনে খেয়েদেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে --।
    --- কোথায়?
    -- আমহার্স্ট স্ট্রীট পাড়ায়।
    --বেশি চিনি না। শ্যালদা চিনি, আর কলেজ স্ট্রিটে গোপাল পাঁঠার দোকান চিনি। কয়েকবার কাকার সঙ্গে মাংস কিনতে গেছি।
    --ব্যস্‌, ব্যস্‌! ওতেই হবে। তুই পার্কাসার্কাস ডিপো থেকে শ্যালদার ট্রাম ধরে আয়। তারপর হ্যারিসন রোড ধরে কলেজ স্ট্রীটের দিকে দুটো স্টপ এগিয়ে যা। ছবিঘর সিনেমার সামনে দাঁড়াবি। আমি এসে তোকে নিয়ে যাব। দুপুর একটা নাগাদ আয়।
    -- মাকে বলতে হবে। ট্রামের ভাড়া চেয়ে নিতে হবে না?
    -- হ্যাঁ, বলেই আসবি। তাইতো একটা নাগাদ আসতে বললাম। নইলে মাসিমা ভাববেন ম্যাটিনি শো'তে সিনেমা দেখার ধান্দা করেছিস।

    আমরা বেশ উদ্দীপ্ত হই। এটা দারুণ হবে।
    এমন সময় খেলার মাঠের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকারে চমকে উঠি। নাঃ, বেশ কয়েকজনের উত্তেজিত কথাবার্তা আর চিৎকার।
    আমরা উঠে পড়ি, দ্রুত পা চালাই হট্টগোলের উৎস সন্ধানে।
    ফুটবল মাঠের কাছে বিশাল ভীড়। এর ওর কাঁধের ফোকর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি--- আমাদের রুম ক্যাপ্টেন রাজকুমারদাকে দোতলার ওয়ার্ডেন সন্তোষদা বেধড়ক পেটাচ্ছেন। কিন্তু তালঢ্যাঙা আর পেস বোলার রাজুদাকে পেটানো সহজ নয়। ও প্রাণপণে মারগুলো ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সন্তোষদা হাঁফিয়ে উঠেছেন। এবার বেত ফেলে দিয়ে ওর কায়দা করে সিঙাড়া করা চুলের মুঠি ধরে ঘাড়ে রদ্দা।
    আর তক্ষুণি একটা তীক্ষ্ণ খ্যানখেনে গলাঃ অ্যাই ছেড়ে দিন, ওকে ছেড়ে দিন বলছি! ও কিচ্ছু করে নি। মারতে হয় আমাকে মারুন!
    বিমানদা!
    রাজুদার ভালবাসার পার্টনার!
    বিমানদা অনুরোধ করছে না, সন্তোষস্যারের কাছে ভিক্ষে চাইছে না, বরং ওর রাগে গলা কাঁপছে, ও কাঁদছে!
    সন্তোষদা হতভম্ব। ভিড়ের মধ্যে নানান আওয়াজ, অধিকাংশই সন্তোষস্যারের বেত চালানোর বিরুদ্ধে।
    উনি ছেড়ে দিয়ে বললেন-- যা! ফের কখনো--!
    বিমানদা, ক্লাস টেনের বিমানদা, কাঁদতে কাঁদতে সবার সামনে রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে আমাদের রুমের দিকে নিয়ে যায় আর রাজুদা শরীরের সমস্ত ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে কেমন ঘসটে ঘসটে চলে যায়।
    ভিড় পাতলা হয়। অনেকের সঙ্গে আমরাও কলতলার দিকে এগিয়ে যাই। একটু পরেই প্রেয়ারের ঘন্টা বাজবে।

    প্রশান্ত আমাকে বলে--দেখলি! এই হল সত্যিকারের ভালবাসা।
    -- আচ্ছা, বিমানদা ওরকমভাবে সবার সামনে রাজুদার জন্যে স্ট্যান্ড নিল, কাঁদল; তারপর মার খাওয়া রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল।
    -- গেল তো! তাতে কী হয়েছে?
    -- লজ্জা করল না?
    -- কেন করবে? ঠাকুর বলেছেন না?--লজ্জা-মান-ভয়, তিন থাকতে নয়!
    --- ভাগ শালা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা?
    --- হ্যাঁ হ্যা`; কোথায় নেতাজি আর কোথায় পেঁয়াজি!
    বিশু ফান্ডা দেয়-- ভুল কী বলেছে! ঠাকুর যে তিনটে আকর্ষণ বা টান এক হলে ঈশ্বর থাকতে না পেরে ভক্তকে দেখা দেন বলেছেন তার মধ্যে একটা হল --নষ্ট মেয়ের উপপতির জন্যে টান।
    --ঠাকুর এরম উদাহরণ দিতেই পারেন না।
    -- পড়িস নি তো! না পড়ে তক্কো করছিস। পড়লে জানবি ঠাকুরের উদাহরণগুলো সব গ্রামের জীবনের থেকে নেওয়া।

    প্রেয়ার হলে ঢোকার মুখে বিপ্লব থুড়ি মিতা আমার হাত ধরে টানে।
    -- লাকি, আজ বিমানদাকে দেখে কেমন সেদিনের বিশুর বলা কথাটা একটু যেন বুঝতে পারলাম।
    -- কোন কথাটা?
    -- ওই যে-- "আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম,
    কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম"।

    এরপর রাত্তিরে দরজায় ঠক্ঠক বা চাপা গলায় রাজু-রাজু ডাক শুনলে আর বিচলিত হই না। সবার আগে গিয়ে চুপচাপ দরজা খুলে দিই। তারপর বিমানদা ক্যাপ্টেনের মশারিতে ঢুকে গেলে আমিও নিজের মশারিতে সেঁদিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ওদের মশারি থেকে কথাবার্তা বা বেড়ালের দুধে চুমুক দেওয়ার আওয়াজ কিছুই আর আমার কানে ঢোকে না; আমি অঘোরে ঘুমোতে থাকি।
  • Ranjan Roy | ২৯ জুন ২০১৬ ২৩:২৭708304
  • ৬)

    পূজোর ছুটির পরে হোস্টেল ফিরতে দেরি হল। ঠান্ডা লেগে বুকে সর্দি বসে ঘুসঘুসে জ্বর হয়ে সে এক কেলো!
    সপ্তমীর দিন ঠিক সকালে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে পার্কসার্কাস থেকে যোধপুর পার্ক , আনোয়ার শা রোড পোদ্দার নগর ঘুরে বিকেলের দিকে সন্ধ্যে হয় হয়, তখন বাড়ি ফিরলাম। দুপুরে খাবার বলতে খালি বাদামভাজা, ঝালমুড়ি আর বুড়ির চুল।
    অনভ্যাসে এতটা একদিনে পায়ে হেঁটে যা ব্যথা, তারপরেই জ্বর। কিন্তু আনন্দে ছিলাম। পোদ্দারনগর কলোনীর ভেতরে রাস্তায় টিউকল থেকে জল ভরছিলেন জনাকয় মহিলা। পাশেই পূজোর প্যান্ডেল থেকে তারস্বরে বাজছে নতুন হিন্দি সিনেমার গান---" বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নহীঁ? "
    ত্যক্ত বিরক্ত নায়িকা হার মেনে বলে ওঠে--হোগা, হোগা হোগা!
    জল ভরতে ব্যস্ত একজন মহিলা সঙ্গিনীদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বাঙাল উচ্চারণে বলে ওঠেন-- হগা, হগা, হগা!
    সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে।
    যোধপুর পার্কের পূজো প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাজছে-- " ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান?"
    আশ্রমে রামকানাই মহারাজ একবার বলেছিলেন-- ওই গানটা পটদীপ রাগিণীতে।

    কিন্তু ছবিঘর সিনেমার সামনে মিতার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হল না। সিনেমার সামনে বন্ধু অপেক্ষা করছে শুনেই মায়ের চেহারা কেমন কঠিন কঠিন হয়ে গেছেল আর মাত্র জ্বরে ভূগে উঠেছি-- এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে মা আমার বেরনোর প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন।
    কিন্তু বিপ্লব মানে মিতা নাকি দুঘন্টা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল লাকি আসবে এই ভরসায়। তবে লাকির বদলে দেখা হয়ে গেল টিউটোরিয়ালের রথীন স্যার ও ক্লাস টেনের অসিতদার সঙ্গে। জেরায় জেরায় ও কবুল করল যে প্রদ্যুম্নের জন্যে দাঁড়িয়েছিল।
    ও সময়মত হোস্টেলে ফিরল। আমি সেদিন অ্যাপো ফেইল করা ও হওস্টেলে ফিরে যেতে দেরির কথা লিখে একটা পোস্টকার্ড ছাড়লাম। সেটা ওর মা হোস্টেলের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন।
    চিঠিটা ওর হাতে সোজাসুজি যায় নি, গেল সেই অসীমদার মাধ্যমে। অসীমদা মহা ছোটলোক-- চিঠিটা পড়ে তবে ওকে দিল। খোলা পো্টকার্ড বলেই কি অন্যের চিঠি পড়া যায়?
    ব্যস-, অসীমদা হোস্টেলে পুরো গল্পটা আদা নুন মাখিয়ে ছাড়ল।
    দশদিন পরে হোস্টেলে ফিরে দেখলাম আমরা দু'জন বিরাট খোরাক হয়ে গেছি। আর তদ্দিন গোটা তামাশা শুধু বিপ্লবকে নিয়েই হয়ে্ছে।
    রাত্তিরে ও আমাকে চেপে ধরল, বলল-- কে তোকে বলেছিল পোস্টকার্ডে লাকি-মিতা লিখতে?
    এবার ছুটির পর আবার রুম অ্যালটমেন্ট পাল্টেছে। একই ঘরে আমরা চারজন ক্লাস নাইন, শুধু একজন ক্লাস সেভেন, এবছর নতুন ভর্তি হয়েছে। হোস্টেল খুলেও স্কুল খোলেনি, খুলবে সোজা ভাইফোঁটার পর।
    অমাদের রুমের ক্যাপ্টেন বিপ্লব। সকালবেলা প্রেয়ার ও ড্রিলের পর জলখাবার, দুঘন্টা পড়া, একঘন্টা ক্রিকেট। তারপর স্নান করে সাঁটিয়ে খেয়ে কষে ঘুম। বিকেল চারটেয় উঠে জলখাবার খেয়ে খেলার মাঠ, তারপরে প্রেয়ার, টিউটোরিয়ল, খাওয়া-- শেষে সাড়ে দশটায় লাইট অফ।
    কিন্তু প্রথম দিন দুপুরে খালি চোখ লেগেছে এমন সময় দরজায় খটখট। অতিকষ্টে চোখ খুলে দেখি কেউ ডাকছে-- বিপ্লবদা, অ বিপ্লবদা! দরজা খোলো।
    বিপ্লব উঠল, কাঁচাঘুমে লাল চোখ।
    দরজা খুলতেই সেই নতুন ছেলেটা হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। বিপ্লব কোন কথা না বলে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় মারল। তারপর আবার নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ক্লাস সেভেনের ছেলেটা গালে হাত বুলোতে বুলোতে শুতে গেল।
    বিকেলে ওকে বললাম--অমন করে মারলি কেন?
    -- দু'দিন দেখ! বুঝে যাবি।
    পরের দিন দুপুরে আমরা সবাই গাঢ় ঘুমে কাদা-- অনেক দূর থেকে কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে-- প্রদ্যুম্নদা, ও প্রদুম্নদা!
    আমার খাটের কাছেই দরজা। উঠে খুলে দিতেই সেই ছেলেটা !একইরকম ভাবে হুড়্মুড়িয়ে ঢুকল। আমিও সোজা দুটো চড় কষিয়ে নিজের বিছানায় ফিরে গেলাম।
    বিপ্লব উঠে লাল চোখ দিয়ে দুজনকে দেখে ফিক করে হাসল, তারপর শুয়ে পড়ল।
  • Ranjan Roy | ০৩ জুলাই ২০১৬ ২০:২১708315
  • কিন্তু স্কুল খোলার আগে নতুন বাওয়াল যার মাথামুন্ডু বোঝা কঠিন।
    ক্লাস সিক্সের নবারুণ বলে একটা বাচ্ছা ছেলে পাগল হয়ে গেছে!
    ফুটফুটে ছেলেটা, এবছরই নতুন এসেছে। ১৫ই অগাস্টের ক্যাম্পফায়ারে একটা মজার কবিতা বলেছিল, সঙ্গে সুন্দর অ্যাক্টিং।
    " ওই রাবণ আসিল যুদ্ধে পড়ি বুটজুতা,
    হনুমান মারে তারে লাথি-চড়-গুঁতা।
    লাথি খেয়ে রাবণরাজা যান গড়াগড়ি,
    হনুমান করে তারে দন্ত কিড়িমিড়ি।"
    জুরিদের সর্বসম্মতিতে ওকে একটা প্রাইজ দেওয়া হল। ও একটা আধুনিক গানও গেয়েছিল--"সূর্যমুখী সূর্যে খোঁজে সূর্য খোঁজে বিনা,
    বল তো গো-- আমি তোমার মনের মত কি না?"

    ভালই গেয়েছিল, কিন্তু অনিল মহারাজ নাক কোঁচকালেন। ফলে কোন প্রাইজ দেওয়া গেল না।
    সেই সবার প্রিয় ছটফটে হাসিমুখ ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে?
    হুড়মুড়িয়ে ছুটলাম অফিসের দিকে।
    লম্বা বারান্দায় একটা থামের সামনে ছোট কাঠের টুল, তাতে বসে ছোট্ট নবারুণ, কোমরের হাতদুটো পিছমোড়া করে থামের সঙ্গে গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। ঘোলাটে চোখে ও সবাইকে দেখছে অথবা কাউকে দেখছে না।
    কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠছে-- পোকা! পোকা!
    তারপর নিঃস্তেজ হয়ে পড়ছে। একটু পরে আবার শুরু হল সেই পোকা পোকা চিৎকার। দেখতে দেখতে ভীড় জমে গেছে। কারো কারো চোখ গোল্লা হয়ে গেছে আর ছোট বাচ্চারা মজা পেয়ে হেসে উঠছে।
    এবার নবারুণও হাসতে শুরু করল।
    --- পোকা! পোকা! চারদিকে পোকা। পোকার বাড়ি। ছোট পোকা দুধ খাবে, বড় পোকা বাজারে যাবে।মা্ছ কিনে আনবে।

    আমার দমবন্ধ লাগছে। দেখলাম বড় মহারাজ অনিল মহারাজকে ডেকে কিছু বললেন, উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
    আমার কানের কাছে ক্লাস টেনের অমিয়দা ফিসফিস করল-- ওর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে লোক আসছে, ওকে নিয়ে যাবে।
    কিন্তু এই তামাশা বেশিক্ষণ চলল না। আমাদের আশ্রমের এল এম এফ ডাক্তারবাবু ওঁর কালো ব্যাগ নিয়ে রিকশা থেকে নামলেন। নবারুণকে মন দিয়ে দেখে অনিল মহারাজকে ওইরকম ফিসফিসিয়ে কিছু বললেন, মহারাজও আগের মত মাথা নাড়লেন।
    তারপর উনি একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ বের করে কাউকে ইশারা করলেন। বাচ্চাটার বাঁধন খুলে দিয়ে দুজন চৌকিদার শক্ত করে ওর দুটো হাত চেপে ধরল। উনি স্পিরিট লাগানো তুলো দিয়ে বাচ্চাটার হাতে একটু ঘষে সুঁচটা পট করে বিঁধিয়ে দিলেন। একটা ওষুধ আস্তে আস্তে ঢুকছে।
    সুঁচ দেখেই নবারুণ পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছিল। এবার আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ল। তারপর ওর মাথাটা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়ল। সিক রুমের বড়দা এসে এবার ওকে কোলে করে সিক বেডে নিয়ে গেলেন।
  • ranjan roy | 192.68.31.37 | ০৭ জুলাই ২০১৬ ১৫:১৭708327
  • নবারুণ চলে গেছে। ওর বাবা-কাকা এসে ওকে নিয়ে গেছেন। মহারাজ টিসি দিয়ে দিয়েছেন।
    কিন্তু প্রশ্নগুলো রয়ে গেল।
    কেন? কী হয়েছিল?
    কোন উত্তর নেই। একমাস হয়ে গেল।
    মন মানে না; জানতে হবে। গুরুর কাছে হত্যে দিতে হবে।
    ইদানীং আমাদের এক গুরু হয়েছে-- ক্লাস টেনের অমিয়দা। কোলকাতার উপকন্ঠে কোন পুরনো জনপদের বাসিন্দে। খেলাধূলো আর ফচকেমি--দুটোতেই চৌকস, শুধু পড়াশুনোটা মোটামুটি। তবে বুককীপিং এ ভাল নম্বর পায়। আমি হলাম ওঁর বাঁহাত, ডান হাত প্রশান্ত।
    অমিয়দা খবর আনল--শোন, নবারুণ রোজ সকালে বা সন্ধ্যেয় ফাঁক পেলে বলাইদার কাছে যেত। বলাইদার থাই ম্যাসেজ জানিস তো? উনি ছোট ছোট বাচ্চাদের ওনার কোয়ার্টারের বারান্দায় ব্যায়াম করাতেন; তারপর কুল ডাউন করাতে করাতে ওদের থাই ম্যাসাজ করতেন।
    অমিয়দা অর্থপূর্ণ ভাবে চোখ টিপল।
    --- ধেত্তেরি! ওসব আমাদের জানা আছে। কবে ঠোঙা হয়ে যাওয়া গল্পগুলো ছাড়ছ। নবারুণের ব্যাপারটা যদি জান তো বল। নইলে?
    -- নইলে কী রে শ্লা? ঘোড়ায় জিন চড়িয়ে এসেছিস? আগে শোন তো!
    --- আরে, নবারুণ গিয়েছিল সেক্রেটারি মহারাজের কাছে কমপ্লেন করতে।
    --কী কম্প্লেন?
    --বাচ্চাছেলে; বলল --আমাকে হুল ফুটিয়ে দিয়েছে!
    --- কী ? সেটা কী কেস?
    --বল্লাম তো, বাচ্চারা ওইভাবেই বলে অনেকসময়। বুঝলি না?
    --হ্যাঁ, হ্যাঁ; কিন্তু কে?
    --- কে আবার আমাদের বলাইদা! ব্রহ্মচারী বলাই!
    --- কী ফালতু বকছ? বলাইদা!
    -- এ শর্মা ফালতু বকে না; খামোকা কারো কুচ্ছো করে বেড়ায় না।
    -- তারপর?
    --তারপর তো পুরো কেলো! বলাইদা হলেন আমাদের ফেবারিট মেজো মহারাজ রামকানাইদার ছোট ভাই। এখনো গেরুয়া পান নি, সাদা পরে ব্রহ্মচারী মানে সন্ন্যাসী হওয়ার অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে আছেন।
    তো সেক্রেটারি মহারাজ-- আমাদের ন'দা--- রামকানাইদা মানে স্বামী শান্তিনাথানন্দ ও ব্রহ্মচারী বলাইদা , দুজনকেই ডেকে পাঠালেন। বলাইদা পুরো ব্যাপরাটা অস্বীকার করে বললেন বাচ্চাটা ওনার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সময় কিছু ঘটেছে। উনি ঘরে ছিলেন না। হয়ত ক্লাস এইটের বিভাস কিছু করে থাকতে পারে। ও সেই সময় ঘরে ছিল।
    --- কী ডেঞ্জারাস !
    --আরে শোন না! ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয় নি। নবারুণদের পরিবারের কেউ লালবাজারে অফিসার। ওঁর বাবা-কাকারা স্বামীজিকে বলে গিয়েছিলেন যে ওঁরা ছেড়ে দেবেন না।
    -- কী করলেন?
    -- সে জানি না। তবে এই একমাসের মধ্যে কোথাও কেউ কলকাঠি নেড়েছে। গতকাল বলাইদাকে আমাদের আশ্রম থেকে সন্ধ্যেবেলা বিদেয় করে দেওয়া হয়েছে। ওঁর আর এ জীবনে বেলুড়ে গিয়ে গেরুয়া ল্যাঙোট পাওয়া হবে না।
  • d | 144.159.168.72 | ০৭ জুলাই ২০১৬ ১৭:৪৬708338
  • তারপর
  • ranjan roy | 192.68.31.37 | ০৭ জুলাই ২০১৬ ২০:২৬708349
  • ৭)
    আস্তে আস্তে ব্যাপারটা থিতিয়ে যায়। শুধু রাত্তিরের আডডায় বলাইদার থাই ম্যাসাজ একটা ছ্যাবলা জোক হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
    কিন্তু অমিয়দাকে ঘটনাটা বোধহয় আমাদের থেকে বেশি নাড়া দিয়েছিল।
    ও একদিন ওর ঘরে আমাদের পাঁচজনের মিটিং ডাকে। সবার আগে হাজির হই আমরা তিনজন। ডানহাত প্রশান্ত, বাঁ-হাত আমি ও আমার মিতা মানে বিপ্লব। বাকি দুজন --নিখিলেশ ও বিশু-এল একটু দেরি করে। ওদের অনিলদা, স্বামী আপ্তানন্দ প্রেয়ারে যারা ঘুমোয় তাদের নাম লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ওদের খাতা খালি ছিল, তাই একরাউন্ড বকুনি।
    অমিয়দা বুড়োদের মত গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করতেই আমরা হেসে ফেললাম। ও এত মজার এ হাসি পেয়েই যায়। শেষে মাথা চুলকোতে লাগল।
    --- কী ? কী জন্যে ডেকেছ নিজেই ভুলে গেছ? এই তোমার জরুরি মিটিং?
    --- বালের মিটিং!
    -- দাঁড়া, দাঁড়া; এক্ষুণি মুখ খারাপ করিস না। আসলে কোত্থেকে যে শুরু করি?
    -- ল্যাজা মুড়ো যেখান থেকে ইচ্ছে! শুরু তো কর, গুরু!
    --- শোন, নবারুণের কেসটা তো দেখলি! এটাই প্রথম না, শেষও না। এখানে বহুদিন ধরে কচি কচি ছেলেদের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করে এইসব করা চলছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
    --- কী করবে? কেউ যদি কম্প্লেন না করে তো ? তোমার এই ফোঁপরদালালি স্বভাব নিয়ে না? আমি এসব ফালতু ঝামেলায় নেই বাবা!
    -- বিশু, তুই কী বলিস?
    -- একই কথা; নিজ নিজ পশ্চাদদেশ নিজ দায়িত্বে রক্ষা করিবেন। ইহার দায়িত্ব লইতে আশ্রম অপারগ।
    --- আশ্রমের কথা আসছে কী করে? আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে স্টেপ নেওয়ার কথা বলছি।
    --- আর কম্প্লেন হলে আশ্রম স্টেপ নেয় না এমন তো নয়! বলাইদাকে , মানে ব্রহ্মচারী বালচৈতন্যকে বের করে দিল তো।
    -- দূর বাল! কতগুলো ঘটনা ঘটে চলেছে আর তুই একটা স্টেপ নেওয়ার কথা বলছিস। আজকাল স্বামীজিদের দালালি করছিস নাকি?
    ---তোকে কালীকীর্তনের দলে রামকানাই মহারাজ নিয়ে নিয়েছেন তাই?
    হাতাহাতি হতে যাচ্ছিল, অমিয়দার কড়া ধমকে সব থেমে গেল।
    ওর ইশারায় প্রশান্ত বলতে শুরু করলঃ
    দেখ, সব হোস্টেলেই এক অবস্থা। কোন উৎসবে বা ফুটবলের ময়দানে বহড়া , বীরেন্দ্রপুর বা কাঠালিয়া আশ্রমের ছেলেদের সঙ্গে দেখা হলেই একবার শুরু হয়-- কী দাদা? আপনাদের ওখানে চলে? আমাদের ওখানে তো চলছে।
    আমি আর থাকতে পারি না। সোৎসাহে দোহার দিইঃ
    হ্যাঁ, দাদা। গত সপ্তাহে একটা দারুণ বই পড়েছি, 'ফর হুম দি বেল টোলস্‌', অশোক গুহের বাংলা অনুবাদে। তাতে লেখক হেমিংওয়ে বলছেন--স্প্যানিশ ভাষায় নাকি গালাগালি সাংকেতিকতার চরমে পৌঁছেচে। সেখানে অশ্লীল ক্রিয়ার নামটি না বলে শুধু 'করেছে' এমন বলা হয়।
    --- ধ্যেৎ, এই প্রদ্যুম্নটা মহা ক্যালানে। কোথায় আমাদের মিশন আর কোথায় হেমিংওয়ে?
    -- আরে সম্বন্ধ আছে; বলছি যে হেমিংওয়ে আমাদের আশ্রমে আসেন নি। তাহলে দেখতেন আমরাও অমনি করি। খালি 'করেছে'র জায়গায় বলি 'দিয়েছে'। যেমন অমুক্দা তমুক ছেলেটাঅকে না 'দিয়েছে'।
    এবার অমিয়দা নিজে হাসতে হাসতে বিছানা থেকে গড়িয়ে যায়।
    তারপর জল খেয়ে বলে--আমার কথাটা শোন। আমি একটা সল্যুশন ভেবেছি। আমরা এই পাঁচজন কাজটা শুরু করব। কান খোলা রাখলেই টের পাওয়া যাবে কোন কোন বাচ্চা কার শিকার হতে চলেছে।
    আমরাই সিনিয়র। ইলেভেনের মাত্র সাতজন, আর তারা বোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষার চিন্তায় হিমসিম খাচ্ছে। আমি টেন, তোরা নাইন। আমরা রাত্তিরে তক্কে তক্কে থাকব। শিকারী ও শিকারদের হাতে নাতে ধরতে হবে।
    -- কিন্তু যদি ওরা বলে যে আমরা যাই করি তোদের বাপের কি? তখন?
    --- হাতেব নাতে ধরলে ফিফটি-ফিফটি ধোলাই খাবে। আশ্রমে এসব নোংরামি চলবে না। আর যেগুলো ছোট বাচ্চাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করে তাদের মহারাজদের কাছে নিয়ে যাব।
    --- বেশ, আমি তোমার সঙ্গে আছি। কিন্তু তোমার ক্লাসের বন্ধুরা? বা যারা বিমানদা-- রাজকুমারদার মত জোড়া বেঁধেছে? ভালবাসাবাসি না কী যেন?
    আমাদের গুরুর কপালে ঘাম জমল।
  • d | 144.159.168.72 | ০৮ জুলাই ২০১৬ ১২:২৪708353
  • পড়ছি ...
    তারপর?
  • ranjan roy | 192.68.31.37 | ০৮ জুলাই ২০১৬ ১৩:৪২708354
  • নাঃ, গুরুর সল্যুশন নেহাৎ রাবার সল্যুশন , তাও হট নয়, কোল্ড। বিশেষ কাজে এল না।
    ওভাবে পুলিশগিরি হয় না। আর রাত্তির জেগে দুটো ফ্লোরের বারান্দায় ঘুরে বেড়ানো? জানলার কাছে আড়ি পাতা? কদিন সম্ভব? উল্টে একদিন মহারাজের কাছে ডাক পড়ল।
    ইতিমধ্যে ন'দা মানে সর্বজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ মহারাজ স্বামী নিরঞ্জনানন্দ অনেক দিন ধরে অসুখে ভুগে গত হয়েছেন।
    এখন রামকানাইদা মানে আমাদের ফেবারিট রাজসিক রুচির স্বামী শান্তিনাথানন্দ সেক্রেটারি মহারাজ ।

    ন'দার চলে যাওয়াটা অদ্ভূত। দুপুর থেকেই শুনছি ডাক্তারবাবুরা জবাব দিয়েছেন, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই সময় এল রাত সাড়ে আটটায়। হটাৎ হাঁউমাঁউ কান্না ও চিৎকারে আমরা ছেলের দল দৌড়ে গেলাম।
    খাটের উপর শুয়ে ন'দা; চোখ তুলসীপাতা দিয়ে বোজানো। খাটের চারদিকে ভীড় করে অনেক লোকজন, সবাই কাঁদছে।
    একজন সাদাচুলের মহিলা ঢুকলেন। বেশ এলিট চেহারা। উনি শায়িত দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।
    -- আমি কতদূর থেকে তোমাকে দেখব বলে এসেছি, সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, কিন্তু ঠাকুর আমার ইচ্ছে পূরণ করলেন না!
    কান্নার রোল বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে বিবাদী সুর বেজে উঠল। আশ্রমের কার্পেন্টারি বিভাগের মানিক মিস্ত্রী ভেতরে ঢুকে সরু মোটা নানান স্বরে সমবেত কান্না শুনে হটাৎ হোঃ-হোঃ করে হেসে উঠল।
    কান্না থেমে গেল। সবার লাল চোখ ওর দিকে ফিরেছে। ও লজ্জা পেয়ে হুড়মুড়িয়ে পালিয়ে গেল।
    আমরা জানতে পারলাম যে শোকাকুল মহিলাটি ন'দার পূর্বাশ্রমের আপন বৌদি।

    উনি নাকি একসময় নেতাজির সহকর্মী ছিলেন। এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। আমাদের ওয়ার্ডেন নন্দদা ও আরো দু'একজন আশ্রমকর্মী বলতেন-- শৌলমারীর সাধুটি আসলে নেতাজী!
    সে যাকগে, শোনা গেল যে ক্লাস সেভেনের রুদ্রাংশু ও প্রতুল নাকি ন'দার প্রয়াণ নিয়ে প্যারডি গান বেঁধেছে, শাম্মী কাপুরের চায়না টাউনের 'হিট সং "বার বার দেখো, হাজার বার দেখো"র 'সুরে।
    গুরু অমিয়দা বলল-ওই বাঁদর দুটোকে রোববার আমাদের ঘরে নিয়ে আয় তো! কী কী সব গান বেঁধেছে শুনব।
    --- শুনে? বাঁদরামির জন্যে ক্যালাবে?
    --- আমি এর মধ্যে নেই, ওরা নেহাৎ বাচ্চা ছেলে। যাদের ক্যালানো উচিৎ তাদের এক আঁটি কলমীশাকও ছিঁড়তে পারলে না ? এবার বাচ্চাদের ওপর হাতের সুখ করবে?
    --- এই প্রদ্যুম্নটা কে নিয়ে আর পারি না। ওরা বাচ্চা, আর তোরা বুড়োর বাপ? আরে ডেকে আন, মারব কেন? যদি গান ভাল হয় তো দুপুর বেলা দু'পিস মাছ বেশি দেব।

    ওরা কাঁদো কাঁদো মুখে এল। কিছুতেই গাইবে না। অনেক করে সাধ্যসাধনা এবং ভয় দেখানোর পর ডুয়েট শুরু হলঃ
    " বল হরি বল,
    এ ন'দা মারা গেল,
    নদাকে ধরে নিয়ে টানাটানি কর ন'দা গো-ও-ও!
    ও নদা, তোমাকে ছাড়া আর চলছে না,
    মাঠে মাঠে দিনগুলো কাটছে না।
    --"।
    এমন সময় দরজায় কড়া নড়ে উঠল। আমরা হাসতে হাসতে উঠে দরজাখুলে ফ্রিজ! চৌকাঠে দাঁড়িয়ে স্বামী আপ্তানন্দ, মানে অনিলদা।
  • ranjan roy | 132.162.189.73 | ০৯ জুলাই ২০১৬ ০০:৪২708355
  • অনিলদা বিদ্যেসাগরী চটি পরে দ্রুতপায়ে বারান্দার একমুড়ো থেকে অন্য মুড়োয় পৌঁছে যেতেন, প্রায় নিঃশব্দে। এই বিরল দক্ষতার গুণে ছেলেরা ওঁর নামকরণ করেছিল--প্রাইভেট বাস।

    ওনার অনেক দায়িত্ব, কারণ উনি জুনিয়র স্বামীজি। সকালে কেউ প্রেয়ারে না গিয়ে ঘরেই ঘুমুচ্ছে কি না, বা প্রেয়ার হলে প্রার্থনার সময় চোখ বুঁজে ঢুলছে কি না--সব উনি সুপারভাইজ করতেন। সন্ধ্যের টিউটোরিয়লে কোন রুমে পড়াশুনো হচ্ছে আর কোন রুমে স্থানীয় মাস্টারমশাই নাক দিয়ে গিটারে সন্ধ্যা মুখার্জির লেটেস্ট গান শোনাচ্ছেন এসব দিকে ওঁর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। আর রোববার বিকেলের দিকে ঘরে ঘরে ঢুকে ইন্স্পেকশন, অর্থাৎ ঘর পরিষ্কার করা, বিছানার চাদর ধোয়া, হাত ও পায়ের নখ কাটা এগুলো দেখাও ওঁর ডিউটির মধ্যে।

    -- কী হচ্ছে এখানে?
    আমরা চুপ, কথা জোগাচ্ছে না।
    -- জুনিয়র ছেলে দুটো এখানে কী করছে,? বড়দের ঘরে? বল।
    ওরা চুপ, ভয়ে কাঁপছে। করুণ মুখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা কি ওদের ফাঁসিয়ে দেব? চোখে নিঃশব্দ বিনতি--- প্রভূ মোরে, অবগুণ চিত ন ধরো!
    -- কী হল? প্রদ্যুম্ন? বিপ্লব? গলায় কিছু আটকেছে কি? দরজা বন্ধ ছিল কেন? সিগ্রেট খাচ্ছিলে?
    উঃ! অনিলদাকে নিয়ে পারা গেল না। বাচ্চাদের সঙ্গে সিগ্রেট খাব?
    --অমিয়? তুমি হলে সিনিয়র। তুমিই বল। দরজা বন্ধ করে এখানে কী হছিল? কোন মহৎ কর্ম?
    অমিয়দা থতমত খেয়ে বলে-- রিহার্সাল।
    অনিলদার ভুরু কুঁচকে যায়।
    --কিসের রিহার্সাল?
    -- গানের।
    --মানে?
    এবার আমাদের সম্মিলিত টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।
    --হ্যাঁ মহারাজ গানের,-- গানের রিহার্সাল!
    --আসলে প্রেয়ারে একটা ছোট গানের দল সামনে বসবে, সুর ধরবে।
    মানে, ইদানীং প্রেয়ার বড্ড বেসুরো হচ্ছিল।
    -- কে বলেছে বেসুরো?
    --রামকানাইদা মানে বড় মহারাজ। উনিই তো বললেন কিছু গাইতে পারে ছেলে জোগাড় করে ওদের রিহার্সাল দিয়ে তৈরি করতে। উনি পরীক্ষা নেবেন। তারপর ওরা নিয়মিত সামনের সারিতে বসে গাইবে।

    গুরু এটা তুরুপের তাস খেলল। সবাই জানে অনিল মহারাজ বেসুরো, তাই ধ্রুপদ রাগপ্রধান পারঙ্গম বড় মহারাজ রামকানাইদা ওনাকে বেশ কৃপার চোখে দেখেন। আর অমিয়দা মহারাজের গানের দলের-- বিশেষ করে কালীকীর্তনের-- স্থায়ী সদস্য। অনিলদার সাহস নেই গান নিয়ে রামকনাইদার সামনে গিয়ে কিছু বলার।
    কিন্তু উনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
    --বেশ, কী রিহার্সাল হচ্ছিল শুনি।
    অমিয়দার ইশারায় আমি গম্ভীর হয়ে ঘোষণা করিঃ
    রাগ--মালকোষ, তাল--তেওড়া।
    তারপর সবাই মিলে উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠিঃ
    ' ক্ষাত্রবীর্য ব্রহ্মতেজ মূর্তি ধরিয়া এল এবার,
    গগনে পবনে উঠিল রে ঐ মাভৈঃ মাভৈঃ হুহুংকার"।
    অনিলদা কনফিউজড! সবাইকে একবার দেখে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন-- চালিয়ে যাও। কিন্তু ডাইনিং হলে আসতে দেরি কর না। এক্ষুণি বেল পড়বে।
    ও হ্যাঁ, অমিয়! তোমাদের তিনজনকে রামকানাইদা খাওয়ার পরে দেখা করতে বলেছেন। তোমরা কিসব রাতপাহারা শুরু করেছ করছ নাকি ?
  • ranjan roy | 132.180.212.202 | ১০ জুলাই ২০১৬ ০১:১৮708356
  • ৮)

    রামকানাইদা ডেকেছেন!
    রামকানাইদা, মানে যিনি এখন বড় মহারাজ হয়েছেন। মোটাসোটা মাঝবয়েসী চশমা চোখে, একটু টাকমাথা, গেরুয়া পাঞ্জাবীর নীচে একটা মোটা বেল্ট দিয়ে ভুঁড়িটাকে একটু তুলে বেঁধে রাখেন। ওঁর পোশাকী নাম স্বামী শান্তিনাথানন্দ।
    তবে আমাদের সবাইকে উনি চুম্বকের মত টানেন। আমরা সবাই ওঁর ভক্ত, ওঁর ফ্যান।
    উনি সাত্ত্বিক কম, রাজসিক বেশি। ওঁর ঘরের খাটে ফিনফিনে মশারিটি বেশ দামী; সিলিং ফ্যান ছাড়াও পাশের টুলে রয়েছে সিনি টেবিল ফ্যান, একটি ট্রানজিস্টর রেডিও; আর ছোট আলমারিতে বাংলা সাহিত্যের ভাল ভাল বই।
    ওনার বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃতে সমান দখল। রোজ রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পরে কিছু ছেলে যায় ওঁর ঘরে। তাদের উনি অনেক গল্প শোনান। ঘরে সব আলো নিভে গিয়ে নীল আলো জ্বলে।
    আস্তে আস্তে ওনার চোখে ঘুম নেমে আসে। কিছু বাচ্চাও হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকিরা সবাইকে তুলে ঘরে ফিরিয়ে আনে।
    উনি আমাদের আশ্রমের ব্যান্ড পার্টি গড়ে দিয়েছেন। অনেকটা ইন্ডিয়ান নেভির মত ইউনিফর্ম স্কার্ফ ও টুপি পড়ে আমরা ড্রাম, কেটল ও বিউগল বাজাই। আমিও শিখেছি কেটল ড্রাম বাজাতে। ১লা বৈশাখে, ১৫ অগাস্টে, ২৬ জানুয়ারিতে আমাদের ব্যান্ড পার্টি বরানগর মিউনিসিপ্যালিটির মাঠে পুলিশ ব্যান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিত।
    উনি ক্রিকেট ম্যাচে কখনও সখনও আম্পায়ারিং করতেন। এল বি ডব্লিউয়ের নতুন নিয়ম উনি জানেন। প্রত্যেক বার আমাদের নাটকে উনি মিউজিক দিতেন। তার কিছু গান হিট হত; পরের দুয়েক বছরও সবাই সেগুলো গুনগুন করত। যেমন কুশধ্বজ নাটকে বলি চড়বার আগে মেমারির ফুটফুটে ছেলেটি গাইল-- "পায়ের ধূলো, দাও গো দাদা! সময় যে আর নাই-ই-ই; এবার আ-আমি যাই।" গান এমন হিট হল যে ছেলেটির আসল নাম হারিয়ে গিয়ে নতুন নাম হল --কুশে!

    ভর্তির সময়ই আমাদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি নীল রঙের পাতলা বই--সংগীত সংকলন, সম্পাদনা--স্বামী শান্তিনাথানন্দ।
    তাতে রামকৃষ্ণ আরাত্রিক থেকে শুরু করে প্রচুর গান-- সব গুলোর ওপরে রাগ ও তাল লিখে দেওয়া; পরিশিষ্টে মূল কয়েকটি তালের ঠেকার বোল ও মাত্রা এবং প্রধান রাগগুলোর ঠাট , জাতি, আরোহ, অবরোহ ও পকড় লিখে দেওয়া।
    সপ্তাহে কয়েকদিন সন্ধ্যেয় ওঁর ঘরে তানপুরা নিয়ে আসর বসত। আসতেন বরানগরের স্থানীয় মার্গসংগীতের গায়কেরা। আমি টিউটোরিয়াল থেকে পালিয়ে সেখানে চুপচাপ বসে থেকে শুনতাম , কখনও কেউ ধমক দেয় নি।
    সেবার টাকি মিশনের প্রোগ্রামে ওঁর সঙ্গে গেছি, স্টেজে জনৈক গায়ক গাইছেন অতি পরিচিত শ্যামাসংগীত--" গয়া -গঙ্গা -প্রভাসাদি, কাশী- কাঞ্চী কে বা চায়; কালী কালী কালী বলে অজপা যদি না ফুরায়"।
    রামকানাইদার চোখ বড় বড়। গায়ক গান শেষ করে স্টেজ থেকে নামলে উনি তাঁকে কাছে ডেকে হাতে তাল দিয়ে দিয়ে দেখালেন যে গানটি ঝাঁপতালে, মানে ৫x ২ মাত্রায়, গায়কের দম ছাড়ার ভুলে সেটা হয়ে যাচ্ছে তেওড়া , মানে ৭x২ মাত্রা।
    রামকানাইদার ঘরে আসেন আধুনিক পাপেট শো খ্যাত রঘুনাথ গোস্বামী । আর আসেন চশমা চোখে একজন মহিলা বেশ পরিশীলিত চেহারা, সবাই বলে লিন্টুদি। ওঁকে নিয়ে কিছু হাসাহাসি কিছু রসালো মন্তব্য কানে আসে। কিন্তু আমি জানি ওসব বেয়াড়া সিনিয়র ছেলেদের বিকৃত রুচির ফল। সবকিছুতেই দাল মে কুছ কালা দেখার অভ্যেস। লিন্টুদি আমাদের একজন প্রাক্তন সিনিয়র শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের মেয়ে। ওঁর ভাই রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারেন, শেখানও। বাজে কথা বল্লে হবে।।
    আমরা তিনজন বিকেলে রামকানাইদার অফিসে গেলাম। টাইপিস্ট মানিদা বসে বসে একটা চিঠি টাইপ করছিলেন। বল্লেন--তোরা একটু অপেক্ষা কর। মহারাজ একটা জরুরী ফোনে আছেন, বেলুড়ের সঙ্গে। তারপরেই আসছেন।
    অমিয়দা চুপচাপ থাকতে পারে না। বলে ওঠে -- মানিদার গাঁট্টা, পয়সায় আটটা!
    মানিদা হেসে ফেলেন।
    -- তোর কিসস্যু হবে না। সিনিয়র হয়েছিস, সেই চ্যাংড়া কে চ্যাংড়াই রয়ে গেলি! আর গাঁট্টা মারা কবেই ছেড়ে দিয়েছি, দীক্ষা নিয়েছি যে!
  • | ১০ জুলাই ২০১৬ ১০:৫২708357
  • তারপর?
  • ranjan roy | 192.69.60.201 | ১০ জুলাই ২০১৬ ১৭:১৮708358
  • অমিয়দা বলতে যাচ্ছিল যে গাঁট্টার সাপ্লাই কমে দাম বেড়ে গেছে। এখন পয়্সায় একটার বেশি হবে না, তক্ষুণি রামকানাই মহারাজ ঢুকলেন।
    কোন কারণে বেশ রেগে আছেন।
    -- তোরা এসব কী শুরু করেছিস? হয়েছেটা কী?
    আমরা চুপ। আমি টেবিল টপের সবুজ ভেলভেটের নকশা খুব মন দিয়ে দেখছি।
    -- কী রে প্রদ্যুম্ন? তোর কি মাথাটাথা একেবারেই গেছে? আর অমিয়, তুই বোধহয় পালের গোদা? রাত জেগে পাহারা দেওয়া? তাহলে পড়াশুনো কখন হবে? বাবা-মা কি এইজন্যে এখানে পাঠিয়েছে?
    কোন উত্তর নেই। শুধু মানিদার আঙুল টাইপরাইটারে দ্রুত চলছে।
    এবার ওনার সুর একটু নরম হল।
    --দেখ, একটা মাত্র ঘটনা ঘটেছে যেটা না ঘটলেই ভালো হত। আমার কাছে কমপ্লেন আসতেই কড়া স্টেপ নিয়েছি; ভবিষ্যতেও নেব--সে যেই হোক। তো? তোদের প্রবলেমটা কী?খামোখা স্টর্ম ইন এ টি-পট! এতে আশ্রমের বদনাম হবে না? তোরা সিনিয়র। তোদের থেকে আরও দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার আশা করেছিলাম। এবার যা! কোন কিছু ঘটলে সোজা আমার কাছে আসবি।

    আমরা পেছন ফিরতেই উনি আবার ডাকলেন।
    -- প্রদ্যুম্ন, শোন। আগামী মাসেই উৎসব ও সাধুসেবা। প্রথম দিন পথের পাঁচালী সিনেমা দেখানো হবে, তারপরে পাপেট শো। পরের দিন ভক্তিগীতি-- রামকুমার চট্টোপধ্যায় বলে ভদ্রলোক আর পূর্ণদাস বাউল; তার পরে যাত্রাপালা কংসবধ।
    শেষদিন তোদের-- ছাত্রদের। এবার কী নাটক করছিস? কর্ণার্জুন?
    -- না রামকানাইদা। ওটা গত বছর হয়ে গেছে। এবার আলেকজান্ডার-পুরু নিয়ে, নামটা মনে নেই। রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে।
    -- গানগুলো?
    আমি হেসে ফেলি।
    --দেখুন না; রিহার্সাল রোজ রাতে অনিলদা দেখছেন। কিন্তু একটা যুদ্ধবিজয়ের পর রাত্তিরে গ্রীকসৈন্যরা উৎসবে মেতেছে, গান গাইছে। কিন্তু অনিলদা বলছেন গানটা হবে "জয় রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ বলরে আমার মন"!
    উনি হেসে ফেলেন। না;, অনিলকে নিয়ে আর পারা গেল না। পুরু-আলেকজান্ডার তো বিসি জমানায়; তখন রামকৃষ্ণ? আর গ্রীকসৈন্যরা হল যবন। ওরা এসব গাইবে? ঠিক আছে, বইয়ে কোন গান আছে?
    -- হ্যাঁ, মহারাজ। "কাতারে কাতারে মোরা চলি সেনানী"।
    -- ঠিক আছে, বইটার একটা বাড়তি কপি সন্ধ্যেবেলা প্রেয়ারের পরে আমার কাছে দিয়ে যা। তিনদিনে সুর করে দেব।
    আর অমিয়, তুমি সবার সঙ্গে কথা বলে আমাকে উৎসবের জন্যে ষোলজন ভলান্টিয়রের নাম ঠিক করে কালকে লিস্টি দিয়ে যাবে। তুমিই কম্যান্ডার, বুঝলে!
  • ranjan roy | 132.176.10.197 | ২১ জুলাই ২০১৬ ০০:১০708359
  • ৯)
    হ্যাঁ, বার্ষিক উৎসব ও সাধূসেবা।
    প্রতিবছরই হয়; এবার যেন একটু অন্যরকম। আমরা ভলান্টিয়ার যে! ভলান্টিয়র মানে অন্যদের ওপর মাতব্বরি করার সুযোগ। খেলার মাঠ জুড়ে প্যান্ডাল বাঁধা হচ্ছে; কিছু কিছু ঘুগনি-চপ-ফুলুরির দোকান বসে গেছে। চারদিকে বেশ একটা ছুটি ছুটি ভাব; দিনের বেলায় ক্লাসে না গেলেও চলে, সন্ধ্যের থেকে উৎসব!
    হেড মাস্টার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার যাই বলুন-- আমাদের ব্যাজ আছে। ডে-স্কলার ছেলেগুলো হিংসেয় জ্বলে মরে। বেশ কিছু বরানগরের স্থানীয় বন্ধুরা একদিনে অপরিচিত হয়ে যায়।

    সাধুসেবার দিন নানান প্রান্ত থেকে মিশনের সাধুরা আসছেন, কেউ কেউ হিন্দিটানে বাংলা বলেন। বেশির ভাগই আমাদের পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও গানগল্পে মেতে থাকেন। আমরা নানারকম ফাই ফরমাস খাটি।
    ব্যতিক্রমী একজন -দেওঘরের মহারাজ-- আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। তোদের হইল কী রে! ই'রকম নিমপাতা মুখ কেন? শোন শোন, একটা ছেইলে নিমপাতা হাতে নিয়ে আসিতেছিল তো ওর নাম হইল নিমাই! যদি জামপাতা নিয়ে আসে তো কী নাম হইবে?
    আমরা ইচ্ছে করে প্রত্যাশিত উত্তরটি না দিয়ে ভ্যাবাচাকা মুখ করি।
    -- পারলি না তো?- জামাই--হা-হা-হা-হা!
    আমরাও হেসে উঠি।
    তারপর ওঁদের পাত পেড়ে খাওয়াতে লেগে যাই। কোমরে প্যান্টের ওপর সেই বাঁদিপোতার গামছা বেঁধে বালতি, পেতলের গামলা ও হাতা।
    সে কী খাওয়া! বড় বড় মাছভাজা, ডিম সেদ্ধ, মাংসের ঝোল, চাটনি, ছানার পায়েস ও সন্দেশ; আর বেশ বড় বড় ফজলি আম।
    কিন্তু কী আশ্চর্য! এসব সাধূদের জন্যে; আমাদের বাচ্চা ধাড়ি কারও জন্যে নয়। মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে।
    যে একান্নবর্তী পরিবার থেকে এসেছি সেখানে খাওয়াদাওয়ায় বাচ্চাদের অগ্রাধিকার। আর কাজের লোক ? ওরাও একই খাবার পাবে; হয়ত মাছের পিস শুধু একটা, তবুও পাবে তো! এখানে দেখছি আমরা যা পরিবেশন করছি তা পাব না! আমাদের কপালে সেই কারি পাউডার দিয়ে রাঁধা আধসেদ্ধ ঝোল। দুস্‌ শালা; আমাদের নজর লেগে ঠিক মহারাজদের পেট খারাপ হবে।
    বিপ্লবকে বলি--একচোখোমিটা দেখলি?
    ও হাসে। আরে, ওঁরা সন্ন্যাসী, সংসার ছেড়ে এসেছেন। ত্যাগ করেছেন। একদিন একটু ভাল- মন্দ খাবেন, তাতেও তোর ইল্লি!
    --- হুঁঃ, অমন খাওয়া দাওয়া পেলে আমিও সন্ন্যাসী হব। সে ওরা খান, তাতে কিছু না। কিন্তু আমরা কেন পাব না? আমরা তো ফ্রি তে থাকছি না। আমাদের বাবা কাকারা রীতিমত হোস্টেলের চার্জ পে করছেন।
    বিকেল তিনটে।
    ডাইনিং হল খালি। শুধু আমরা যারা পরিবেশন করেছিলাম সেই চোদ্দজনের খেতে বসা বাকি। আমার কিছু ভাল লাগছে না। বলি--খেতে ইচ্ছে করছে না। রুমে যাচ্ছি।
    বিপ্লব বলে-- ঠিক আছে, তোর খাবার আমি ঢাকা দিয়ে রুমে রেখে নেব। যখন খিদে পাবে খেয়ে নিবি।
    দোতলায় উঠে নিজের রুমে শুতে যাব , কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বিরক্ত হয়ে খটখট করি, কোন সাড়া নেই। এবার দরজায় তিন লাথি! খোল শালা!
    -- কে?
    আরে ! এ যে আমার গুরু অমিয়দার গলা। খোল গুরু! কী ইয়ার্কি হচ্ছে?
    -- তুই একা?
    -- না, বরযাত্রী নিয়ে এসেছি। খোল বলছি।
    দরজা খুলে যায় আর আমি ঢোকা মাত্র বন্ধ হয়।
    আমার চোখ ছানাবড়া! ঘরের মধ্যে অন্ততঃ দশজন। তিনটে বালতি ভর্তি ফিশ ফ্রাই, ফজলি আম আর সন্দেশ! সবার মুখ ভর্তি। প্রাণপণে সাঁটাচ্ছে!
    গুরুর মুখে লজ্জা লজ্জা হাসি।
    -- এটা কী হল গুরু? এতবড় অপারেশন! তোমার ডানহাতও আছে, অন্য ছেলেরাও আছে। শুধু বাঁহাত আমিই বাদ? আমাকে বিশ্বাস কর না?
    ডানহাত প্রশান্ত ফুট কাটে-- খাওয়াটা তো ডানহাতেরই ব্যাপার, বাঁ-হাত তো শুধু পোঁদ ধুতে কাজে লাগে। তখন তোকে খবর করা হবে।
    বড় কিছু হবার আগেই গুরু মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।
    --ব্যস্‌ ব্যস্‌। খেতে শুরু কর। তুই রাগ করে খাস নি, খবর পেয়েছি। সবাই মিলে হাত চালা। কিছু বাঁচানো যাবে না। তারপরে খালি বালতিগুলো কায়দা করে ফেরত দিয়ে আসতে হবে।
    খেয়ে দেয়ে জমপেশ ঘুম।
    সন্ধ্যেয় স্নানটান সেজেগুজে প্যান্ডেলে। মেয়েদের লাইনে ভলান্টিইয়রি করা নিয়ে কম্পিটিশন আছে যে! আজ পথের পাঁচালি দেখানো হবে। বইটা পড়েছি। সিনেমাটার এত নাম! দেখতেই হবে।
    কিন্তু তখন মুখের স্বাদ তেতো হয়ে গেল ।
  • ranjan roy | 192.68.28.156 | ২২ জুলাই ২০১৬ ১৬:৪৯708361
  • সন্ধ্যের আলো-ঝলমল মঞ্চ এখন অন্ধকার।অতিথি শিল্পীরা তাঁদের কাজ করে ভূরিভোজ খেয়ে বিদায় নিয়েছেন। এখন সিনেমা দেখানো হবে। তাই অধিকাংশ আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে।
    আমরা ভলান্টিয়াররা ফুরসত পেয়েছি; ঢের হল। আমাদের খাওয়া জুটবে সিনেমা শেষ হলে। অস্থায়ী মঞ্চের পাশে স্কুল বিল্ডিংয়ের লাগোয়া চারটে থাম দিয়ে তৈরি স্থায়ী সিমেন্টের স্টেজ। এখানেই যাত্রা হয়, নাটক হয়, বিশ্বশ্রী মনতোষ রায় বা বরানগরের ডাবের দোকানের মালিক ভারতশ্রী বিশ্বনাথ দত্তের দেহশ্রী শো' হয়।
    সেখানেই টাঙানো হয়েছে একটি সাদা পর্দা। ওদিকে আশ্রমের কর্মী গৌরদা ১৬ মিলিমিটারের প্রোজেক্টর নিয়ে পজিশন নিয়েছেন; স্পুল লাগানো হয়ে গেছে। ওঁর একটিই হাত, আরেকটি কব্জি থেকে নেই। কুলোকে বলে বোমা বাঁধতে গিয়ে এই হাল। তা উনি এক হাতেই ভলিবল ম্যাচে নেটের সামনে লাফিয়ে উঠে স্ম্যাশ করেন। সেই হাতেই সিনেমার প্রোজেক্টর অপারেট করেন। পান ভরা গালে স্মিত চেহারায় এমন একটা ভাব যেন দুনিয়ার কাছে ওঁর কিছু চাইবার নেই।
    সিনেমা শুরু হল। সাদা কালো।
    কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই খেই হারিয়ে ফেললাম। ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু। জোর করে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে একবার ইন্দির ঠাকরুণের গাছের তলায় শুয়ে পড়া আর ঘটি গড়িয়ে যাওয়া চোখে পড়ল।
    পাশের থেকে বিপ্লব গুঁতো মারল।
    --কী হচ্ছে কী?
    -- লাকি, সিনেমা দেখবি না গেঁয়ো ভূতের মত ঢুলে পড়বি?
    -- ঘুম পাচ্ছে রে! ঘরের চাবিটা দে তো, আমি যাচ্ছি। খাবার ঘন্টা পড়লে ডেকে দিস।
    উঠে রওনা দিলাম। কিন্তু ঘর যে অনেক দূর! আর ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই নিস্তরঙ্গ জনসমুদ্রের মধ্যে থেকে ঘুম চোখে সাঁতরে বেরোনো?
    বুদ্ধি খেলল।উল্টো দিকে হাঁটি। পর্দাটার কাছে। ওখানে অন্ধকারে থামে হেলান দিয়ে চমৎকার ঘুম দেব। কেউ দেখতে পারবে না, টেরও পাবে না। কাউকে ডিস্টার্ব না করে ভদ্রলোকের মত , জম্পেশ হবে।
    যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বাঁদিকের থামটায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমার ডান দিকে হাত পাঁচ দূরে লোহার চাকাওয়ালা ফ্রেমে সাদা পর্দায় অপূ দূর্গা হরিহর কি সব বলাবলি করছে। ওদের চেহারা দেখতে পারছি না; কথা কানে আসতে আসতে অস্পষ্ট হয়ে ভ্রমরগুঞ্জন।
    আঃ, কোথায় শোনা একটা হিন্দিগানের কলি মাথার ভেতরে গুনগুন করছে-- আরাম বড়ী চিজ হ্যায় মুহ্‌ ঢাককে শৌইয়ে!
    কিন্তু মিনিট বিশেক পরে ঘুম ভেঙে গেল। একটা রীল শেষ হয়েছে। হাত কুড়ি দূরে একটা লাইট জ্বালিয়ে গৌরদা পরের রীলটা স্পুলে লাগাচ্ছেন। লোকজন কথাবার্তা শুরু করেছে। আর তক্ষুণি টের পেলাম পর্দার কাছে আমি একা নই।
    ডানদিকের থামের গায়ে সিঁটিয়ে বসে আছে দুটো ছায়ামূর্তি, কিন্তু ঠিক বসে নেই। একজন আর একজনের কোলে।
    দূর থেকে এসে পড়া হালকা আলোয় ওদের চিনতে পারছি। বড় ছেলেটা ইলেভেনের বিমলদা , বেলগাছিয়ার কোন ক্লাবের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। দু'বার ফেল মেরে এই থার্ড অ্যাটেম্প্ট। বয়সে বেশ বড়। কিন্তু আমরা সবাই ভয় পাই। ও নাকি রামকানাইদার স্পাই। ও আমাদের ঠ্যাঙালে নালিশ করা যায় না। সবাই জানে।
    কিন্তু ওর কোলে ঢলে পড়ছে যে ছেলেটা ? ও তো টেন কমার্সের ফার্স্ট বয়! বুক কীপিংয়ে ওর একটা নম্বরও কাটা যায় না। হাফ ইয়ার্লিতে একশ তে আটানব্বই দেওয়ায় স্যারের সঙ্গে ঝগড়া করতে গেছল। সন্দীপদার বাবার গড়িয়াহাটে রেডিমেড জামাকাপড়ের বড় দোকান। মাসে একবার সপরিবারে গাড়ি ্ড়ে আসেন ছেলেকে দেখে যেতে। তেল চুকচুকে কালো সন্দীপদার কোঁকড়ানো চুল, দুবেলা রেক্সোনা সাবান মেখে চান করে। স্টেনলেস স্টিলের থালাবাটিতে খায়। প্রেয়ার হলে পেছনের দিকে বসে অর্গান বাজায়। ওটা আশ্রমে আর কেউ পারে না। ওকে স্বামীজিরাও খুব পছন্দ করেন।
    ওরাও যেন এখনই আমাকে খেয়াল করল, কিন্তু না দেখার ভান করে রইল। আমি অন্যদিকে তাকাচ্ছি, ঘুম মাথায় উঠেছে।বিমলদা উঠে কোথায় যেন গেল। সন্দীপদা অন্য সময় আমাকে পাত্তা দেয় না। এখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

    বিমলদা ফিরে এসেছে , সঙ্গে কাগজের ঠোঙায় কয়েকটা সিঙারা। আমাকে একটা দিতে গেল, আমি না করলাম।
    সিনেমা আবার শুরু হয়েছে।
    এবার ওরা আর আমার পরোয়া করছে না। বিমলদা প্রাণপণে চটকাচ্ছে সন্দীপদাকে, চুমো খাচ্ছে। বিমলদাটা ওরকমই , কেমন গুন্ডামত। কিন্তু সন্দীপদা? আশ্রমে প্রেয়ার হলে অর্গান বাজানো বিরল প্রতিভা ? ও কেন অমন করছে? ও যে কী আনন্দ পাচ্ছে কে জানে! দেখে মনে পড়ছে শস্তা নভেলের সেই বস্তাপচা লাইন-- চরম সুখে ঢলিয়া পড়িল!
    আমি যেন চুইংগাম দিয়ে সেঁটে গেছি। অন্ধকারে একাগ্র চোখে দুই ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি।
    কতক্ষণ? মিনিট পনের। হটাৎ দেখি দুজন নয়, ওরা এখন তিনজন, আরও কেউ এসে জুটেছে। ওরা ফিসফিস করছে। প্রোজেক্টর এর ঘরঘরানিতে কিছু শোনা যাচ্ছে না।
    কিন্তু এ কী?
    তিননম্বর যে নীচু হয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পর্দার পেছন দিয়ে আমার দিকেই আসছে। মারবে নাকি? বিমলদা আমাকে পেটাতে চাইছে? আমি তো কিছু করি নি! বাগড়া দিই নি। আমাকে কি চলে যেতে বলবে? ভাগ শালা! কেন যাব? আমি কি বিমলের বাবার চাকর? একবার গায়ে হাত তুলে দেখুক তো? এমন হল্লা মচাব! আমাদের পুরো ক্লাসে খুব ইউনিটি, কেউ সহজএ ঘাঁটায় না। কিন্তু ছেলেটা কে?
    তিন নম্বর এসে আমার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বলে- প্রদ্যুম্নদা, আমি তোমার কাছে একটু বসব।
    আমি কিছু বলতে পারি না। এ যে ক্লাস সেভেনের অনিকেত। দু'বছর আগে আশ্রমে এসেছিল। এর মধ্যেই পেকে ঝানু হয়ে গেছে। ও নাকি বড়দের গোপন রেজিস্টারে হস্টেলের নগরবধূ! ওর জন্যে দু-তিনজন সিনিয়রদের মধ্যে মারপিট হয়ে গেছে।
    আমাদের গ্রুপটা এদের এড়িয়ে চলে, বাইরে থেকে দেখলে এই ছটফটে বাচ্চাটাকে ভালই লাগে। ওর সম্বন্ধে চালু গল্পগুলোর একটাও বিশ্বাস করি না।
    আমি মন দিয়ে সিনেমার ডায়লগ শোনার ভান করি। ও আমার হাতে হাত জড়িয়ে রাখে।
    আমি কান পেতে শুনি-- অপু! দূর্গা! এরা সব গেল কোথায়?
    আচমকা সব কথাবার্তা বন্ধ। কঁকিয়ে উঠেছে সেতার ও তারসানাই।
    অনিকেত কখন সহজ সরল ভাবে আমার কোলেউঠে বসেছে। আমার ওকে এক্ষুণি নামিয়ে দেওয়া উচিত। জোর করে? হ্যাঁ, জোর করে।
    কিন্তু আমার সব জোর কোথায় গেল! ও আমার গালে গাল ঘষছে। আমি কাঠ হয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি। এবার কী হবে? কিছু একটা হতে চলেছে। না; কিছু হবে টবে না। একটা ছোট বাচ্চা কোলে এসে বসেছে তা নিয়ে এত কথা কিসের অ্যাঁ?
    ও আস্তে আস্তে গালে গাল ঘষছে। আমি অসাড়; নাকে আসছে একটা গন্ধ, তেলের ও অন্যরকম।
    লাইট জ্বলে উঠল, সিনেমা শেষ। আমরা দুই জোড়া একে অন্যকে দেখি।
    বিমলদা ও সন্দীপদা আমার দিকে তাকিয়ে বুঝদারের মত হাসে। আমি তাকাতে পারি না।

    ভীড় এবার যে যার ঘরমুখো হবে। আমার পকেটেই রুমের চাবি। পা চালাই। কিন্তু এই ঘটনাটা কাকে বলব? মিতাকে বলা কি ঠিক হবে?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন