এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বুদ্ধকথা

    শিবাংশু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৪ মে ২০১৫ | ১৯১১ বার পঠিত
  • অশান্তি তাঁকে ক্রমাগত আঘাত করে যায়। সবাই শান্তিতে, স্বস্তিতে দিনযাপন করে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি তার স্বাদ পাচ্ছেন না। তাঁর জাগতিক কোনও কিছুর অভাব তো ছিলোনা। ঊনত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। একজন যাবতীয় ক্ষাত্রবিদ্যায় নিপুণ নৃপতিপুত্র। বধূ শুয়ে ছিলো ঘরে, শিশুটিও ছিলো। তবু অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, কোন বিপন্নতা তাঁকে ঘরছাড়া করেছে, তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেন না। জরা, ব্যধি, মৃত্যু'হীন এক মানবসমাজ তো নিতান্ত অসম্ভব সন্ধান। যদি রক্তমাংসের মানুষ এই প্রাকৃত পরিণতি'কে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, তবে তার জন্য দুঃখবোধ কেন? দুঃখের কারণ কী? দেশত্যাগী হয়ে যখন মগধের পথে অগ্রসর হলেন, তখন বিশ্বাস ছিলো গঙ্গার দক্ষিণ প্রান্তে মগধের রাজধানী রাজগৃহ সারা গাঙ্গেয় উপত্যকার সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু। জ্ঞানী, সাধক, বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা সেখানে বসবাস করেন। কেউ তো তাঁর বিপন্নতাটি বুঝতে পারবেন। কিন্তু তিনি নানা সাধুসঙ্গ করে অনুভব করলেন মানুষের অধ্যাত্মসাধনার লক্ষ্য অনন্ত স্বর্গলাভ করা। যে স্বর্গে অগণিত রিপুতাড়িত দেবতা, অপ্সরা, প্রমোদমত্ত অস্তিত্ত্বের ভিড়। এতো কামনার পরাকাষ্ঠা। কামনা কি মানুষকে কখনও মোহমুক্ত করতে পারে? 'স্বর্গ' মানে বিবশ মানুষের বাস্তব থেকে পলাতক হয়ে কামনার অগ্নিকে আহুতি প্রদানের এক কল্পিত ভূগোল। তিনি রাজগৃহের কাছে গৃধকূট পর্বতে একটি একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। মাধুকরী করতে আসা এই তরুণ সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বের খবর লোকমুখে শুনে স্বয়ং রাজা বিম্বিসার তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁর বংশপরিচয় বিশদ শুনে তাঁকে রাজ হস্তীবাহিনীর সেনানায়কের পদ দিতে চাইলেন। সেকালে অনন্য সম্মান। কিন্তু সিদ্ধার্থ স্থির করে নিয়েছিলেন সংসারধর্ম তাঁর জন্য নয়।
    -------------------------------------

    বারাণসি গমিষ্যামি গত্বা বৈ কাশিকা পুরীম।
    ধর্মচক্রং প্রবর্তিষ্যে লোকে স্বপ্রতিবর্তিতম ।।
    কাশীপুরী গমন করে বারাণসিতে লোকের মুক্তির জন্য ধর্মচক্র প্রবর্তন করলাম ( আজীবকের প্রতি শাক্যমুনি বুদ্ধ)

    মহাভিনিষ্ক্রমণের পর সিদ্ধার্থ প্রথমে গিয়েছিলেন কোসল রাজ্যে আলার কালামের কাছে। অরিয়পরিয়সেন সূত্তে বুদ্ধের জবানিতে লেখা হয়েছে, ' মঙ্গলকর পথ ও শ্রেষ্ঠ, লোকোত্তর, শান্তিময় তত্ত্বের সন্ধানে আমি আলার কালামের কাছে গেলাম। নিদানকথা, বুদ্ধচরিত ও ললিতবিস্তরে এ বিষয়ে নানা বিপরীত কথা বলা হয়েছে। প্রথম দুটি গ্রন্থে বলা হয়েছে সিদ্ধার্থ প্রথমে রাজগৃহে রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও তার পর মগধে আলার কালামের কাছে দর্শনশিক্ষা করতে যান। তৃতীয় গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে তিনি প্রথমে বৈশালী গিয়ে আলার কালামের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। পরে রাজগৃহে এসে রাজা বিম্বিসারের নির্দেশে উদ্দক রামপুত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে এই তিনটি গ্রন্থই বুদ্ধের দেহাবসানের অনেক পরে, পঞ্চম শতকে, সংকলিত হয়েছিলো। তাই স্বয়ং বুদ্ধের উক্তিটিকেই প্রামাণ্য ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু আলার কালাম বা উদ্দক রামপুত্তের কাছে সিদ্ধার্থকে দেবার মতো কিছুই ছিলোনা। তাঁরা ছিলেন সংসারত্যাগী উপাসক, নিজস্ব ধরনে সাধনা করতেন। তাঁদের থেকে সিদ্ধার্থের প্রাপ্তি বলতে চারটি ধ্যান ও চারটি স্তব। তাতে তাঁর আর কী হবে? কোসল ত্যাগ করে এলেন রাজগৃহের নানা প্রসিদ্ধ শ্রমণদের থেকে দর্শনতত্ত্ব শিখতে। এই শ্রমণরা নানারকম তপস্যা করতেন। তাই দেখে সিদ্ধার্থ তপস্যা করতে শুরু করলেন। প্রথমে হটযোগ, তার পর কৃচ্ছ্বসাধন, উপবাস, খাদ্যগ্রহণ করে আবার উপবাস, এরকম চললো ছ'বছর। কিন্তু ধ্যানমার্গ, তার স্তরভেদ, কঠোর কৃচ্ছসাধন ও তপস্যা , অর্থাৎ সেসময় যা যা কিছু প্রচলিত সাধনবিধি ছিলো সব কিছু নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন। এটা প্রমাণ করে তিনি আদ্যন্ত একজন মানুষ ছিলেন, কোনও স্বর্গচ্যুত দেবতা নয়। পরবর্তীকালে তাঁকে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে নানা প্রচেষ্টা হয়েছে।
    সেই সময় বৈদিক ধর্মের অন্যমেরুতে একটি সামাজিক মন্থন চলছিলো। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতির অত্যাচারে সংখ্যাগুরু মানুষ কোনও নতুন 'ধর্মীয়' উত্থানের অপেক্ষায় মুহ্যমান। এ বিষয়ে চর্চা আরণ্যক ও উপনিষদেও আছে। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ব্যতিরেকে যেসব মুনিঋষি তখন সমাজে ছিলেন তাঁরা ব্যক্তিগত দর্শনের গন্ডিতে আবদ্ধ, নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা তাঁদের ছিলোনা। এঁদের মধ্যে ছিলেন, অজিত কেশকম্বলি, পুরাণ কাশ্যপ, পাখুদা কাত্যায়ন, সঞ্জয় বেলটঠিপুত্ত, মোক্ষলি গোপাল, চার্বাক প্রমুখ। তাঁরা হয়তো প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি বীতরাগ ছিলেন, কিন্তু নিপীড়িত মানুষকে শূশ্রূষা দেওয়া ছিলো সাধ্যের অতীত। তাঁদের পঞ্চভূতবাদ, বিক্ষেপবাদ, অক্রিয়বাদ, নিয়তিবাদ ইত্যাদি ছিলো মস্তিষ্কের ব্যায়াম, প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিতান্ত তাত্ত্বিক। এই সব জড়নীতির প্রেক্ষাপটে তীর্থংকর মহাবীর প্রচার করছেন পঞ্চমহাব্রত ও ব্রহ্মচর্য। জাগতিক প্রয়োজনকে অস্বীকার করে কঠোর উপবাস ও নিবেদিত সন্ন্যাস জীবনের ব্রত।
    সিদ্ধার্থকে এসব কিছুই প্রভাবিত করতে পারলো না। কঠোর, কঠোরতর তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের পীড়ন প্রত্যাখ্যান করে তিনি অবলম্বন করলেন 'মধ্যপথ'। প্রচার করলেন সংক্ষিপ্ত স্মৃতিনির্দেশ, পঞ্চশীল। তাঁর তপস্যাপর্বের পাঁচ সঙ্গী, কোন্ডিণ্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম ও অস্মজি মনে করলেন বুদ্ধ কঠোর তপস্যার চাপ নিতে অক্ষম এবং 'মধ্যপন্থা' আসলে আরামের কাছে আত্মসমর্পণ। তাঁরা ত্যাগ করলেন বুদ্ধকে। মগধ ছেড়ে তাঁরা যাত্রা করলেন বারাণসির দিকে।
    -----------------------------------------
    ২.
    'অনেক জাতি সংসারং সন্ধাবিস্সং অনিব্বিসং
    গৃহকারকং গবেসন্তো দুঃখ জাতি পুনপ্পুনং ।
    গহকারক ! দিটঠোহসি, পুন গেহং ন কাহসি
    সব্বা তে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসংখিতং।
    বিসঙ্খারগতং চিত্তং তণ হানং খয়মজঝগা ।
    (ধম্মপদ)
    'জন্ম জন্মান্তর পথে পথে ফিরেছি কিন্তু সন্ধান পাইনি। এ গৃহ যে নির্মাণ করেছে কোথায় সে গোপনচারী। বার বার দুঃখ পেয়ে এবার তোমার দেখা পেলাম, হে গৃহকারক! আর তুমি এ গৃহ রচনা করতে পারবে না। তোমার স্তম্ভ, গৃহভিত্তি সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার চিত্ত আজ সংস্কারবিগত, তৃষ্ণার থেকে মুক্ত আমি আজ।'
    নৈরঞ্জনা নদীর ধারে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে প্রথম প্রহরে তাঁর মনে পড়লো পূর্বজীবনের কথা। দ্বিতীয় প্রহরে লাভ করলেন দিব্যচক্ষু, তৃতীয় যামে দর্শন করলেন ভবচক্র ( প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ) এবং চতুর্থ প্রহরে সর্বজ্ঞান অধিগত করে অর্হত্ত্ব প্রাপ্ত হলেন সিদ্ধার্থ। উল্লিখিত উপলব্ধি উচ্চারণ করার পর শাক্যমুনি পরমকারুণিক গৌতম বুদ্ধের জন্ম হলো।
    বুদ্ধত্ব লাভের পর আট-দশ দিন গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষের চারদিকে তপস্যাযাপন করলেন। মহাবগ্গ অনুযায়ী এই সময়ই প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু সংযুক্তনিকায় বলে এই উপলব্ধি বুদ্ধের অনেক আগেই হয়েছিলো। এই তত্ত্ব জটিল। তবে মূল কথা হলো তৃষ্ণা ও তার ফলরূপ দুঃখের আকর মানুষের অবিদ্যা। কীভাবে অবিদ্যাকে বিনাশ করে স্তরে স্তরে তৃষ্ণা ও দুঃখ জয়ের শেষে মোক্ষলাভ হয় তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা আছে এই তত্ত্বে। কিন্তু কার কাছে প্রচার করবেন তাঁর অর্জিত দর্শন? প্রথমে প্রয়াস করলেন তাঁর প্রথম 'গুরু' উদ্দক রামপুত্তের সঙ্গে এই তত্ত্ব নিয়ে বিনিময় করেন। কিন্তু সংবাদ পেলেন উদ্দক প্রয়াত হয়েছেন। তার পর খোঁজ নিলেন আলার কালামের কুশল। দুর্ভাগ্য আলারও তখন আর ধরাধামে নেই। এই নবদর্শনকে সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে এমন কাউকে আর মগধে পেলেন না। বুদ্ধ কাশীর পথে অগ্রসর হলেন।
    ---------------------------------------
    ৩.
    দীর্ঘ, দুর্গম বনপথ অতিক্রম করে তিনি পৌঁছোলেন বারাণসির উপান্তে ঋষিপত্তনে ( ইসসিপত্তন)। পথে গঙ্গানদী পেরোলেন সাঁতার দিয়ে। তাঁর কাছে নৌকোযাত্রার পাথেয় ছিলোনা। তাঁর পঞ্চশিষ্য শুনলেন বুদ্ধ এসেছেন, কিন্তু কৌন্ডিণ্য ব্যতিরেকে বাকিরা স্থির করলেন কঠিন তপোশ্চর্যা যে মানুষের কাছে ত্যজ্য, তিনি গুরু হতে পারেন না। কিন্তু যেহেতু তিনি রাজসন্তান তাই ন্যূনতম সম্মান তাঁর প্রাপ্য। তাই পাঁচ জনেই অপরাণ্হে এলেন ঋষিপত্তনের দক্ষিণে সেই প্রান্তরে যেখানে বুদ্ধ ধ্যানমগ্ন ছিলেন। বুদ্ধকে দর্শনমাত্র তাঁরা বুঝতে পারলেন যে এই বুদ্ধ একজন অন্য ব্যক্তিত্ব। ধর্মদর্শন আলোচনা করতে করতে তাঁরা আরো উত্তরের দিকে মৃগদাবের পথে যাত্রা করলেন। রাত্রির প্রথম যামে বুদ্ধ উপবেশন করলেন একস্থানে,
    । তার পর মৌনতা অবলম্বন করে ধ্যানমগ্ন হলেন। দ্বিতীয় প্রহরে তিনি ধ্যান সম্বরন করে পঞ্চশিষ্যের কাছে আত্মউন্মোচন করলেন। সেই নিশীথ আকাশের নীচে সুপ্ত চরাচরে তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর উপলব্ধির মূলতত্ত্ব।
    " হে ভিক্ষুগণ, একদিকে সংসারী মানুষের উপভোগ্য ইন্দ্রিয়সুখ, অপরদিকে ফলহীন দুঃখকর ব্রহ্মচর্য্য, এই উভয়ই ধর্মার্থীগণ পরিত্যাগ করিবে। আমি এক মধ্যপথ আবিষ্কার করিয়াছি, যে পথ অবলম্বন করিলে চক্ষু উন্মীলিত হয়, দিব্যজ্ঞান জন্মে, শান্তিলাভ হয়, মানব নির্বানপ্রাপ্ত হয়। সৎদৃষ্টি, সদবাক্য, সৎসঙ্কল্প, সদ্ব্যবহার, সদুপায়ে জীবিকা আহরণ, সৎচেষ্টা, সৎস্মৃতি, সম্যক সমাধি, আমার আবিষ্কৃত এই অষ্ট পথ। দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখনিরোধ, দুঃখনিরোধের পথ, আমার প্রচারিত এই চারিটি মহাসত্য। " তার পর সারা রাত্রি ধরে তিনি আলোচনা, ব্যাখ্যা, বিনিময় করলেন তাঁর হৃদয়ের উপলব্ধি। এই পঞ্চশিষ্য তাঁকে রাজগৃহ-উরুবেলায় ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন। বিশদ আত্মমন্থন করে তাঁরা অনুভব করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ বিনা তাঁদের গতি নেই। তাঁরা তো গুরুর অপেক্ষাতেই দিনযাপন করছিলেন বারাণসিতে।
    পরদিন ব্রাহ্মমূহুর্তে কৌন্ডিণ্য বুদ্ধের প্রথম শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। তার পর একে একে বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অস্মজি বুদ্ধের শরণ নিলেন।
    -----------------------------------------
    ৪.
    'নত্থি রাগসম অগ্গি, নত্থি দসসমো কলি,
    নত্থি খন্দাদিসা দুক্খা, নত্থি সন্তিপরং সুখং।
    জিঘচ্ছা পরমা রোগা, সঙ্খারা পরমা দুখা,
    এতং ঞত্বা যথাভূতং নিব্বানং পরমং সুখম ।।'
    চৌখন্ডিস্তূপ থেকে দু-আড়াই কিমি উত্তরে এগিয়ে গেলে সারনাথের মূল পুরাতত্ত্ব অবশেষের অবস্থান। বুদ্ধ পদার্পণ করার সময় এখানে ছিলো বিস্তীর্ণ বনভূমি । স্থানটি হরিণ অধ্যুষিত হবার জন্য সেটি মৃগদাব নামেও কথিত হতো। এই মৃগদাবের সন্দর্ভ ধরেই পরবর্তীকালে জাতককথার সূত্রপাত হয়। আসলে সারনাথ নামটিই এসেছে মৃগরাজ সারঙ্গনাথের নাম থেকে। এখনও সেখানে একটি সরকার স্থাপিত হরিণ অভয়ারণ্য রয়েছে। সেখানে মূলতঃ বিদেশী বুদ্ধভক্তদের ভিড় দেখতে পেলুম। মূল চত্বরটির প্রবেশপথের পাশ থেকে শুরু হয়ে যায় বৌদ্ধ মঠের ভগ্নাবশেষ। চক্রপথের ডানপাশে শ্রমণ ও ভিক্ষুদের সারবাঁধা বাসস্থানের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। সেগুলি পেরিয়ে গেলেই ধর্মরাজিকাস্তূপ। এই স্তূপটির মাহাত্ম্য বিষয়ে পরে আলোচনা করছি। ধর্মরাজিকা স্তূপ থেকে ঈষৎ উত্তরমুখী হলেই প্রাচীন মূলগন্ধকুটিবিহার মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ।
    -----------------------------------
    ৫.
    ' বারাণসির উত্তর-পূর্বদিকে বরণা ( বরুণা) নদী পেরিয়ে ১০ লি মতো গেলে 'লু ঈ' বা মৃগদাব সঙ্ঘারামের দেখা পাওয়া যায়। এর সীমানা আট ভাগে বিভক্ত, একটি ঘেরা দেওয়াল দিয়ে সব গুলি সংযুক্ত রয়েছে। কয়েকতল উঁচু বুরুজগুলি সংলগ্ন ঝুলবারান্দা ও সেগুলির কারুকাজ খুব নিপুণ হাতের কাজ। এই সঙ্ঘারামটিতে ১৫০০ মতো ভিক্ষু রয়েছেন। তাঁরা হীনযান মতের সম্মতীয় শাখার উপাসক। বিরাট সীমানার মধ্যে প্রায় দুশো ফুট উঁচু একটি বিহার দেখলাম। তার শীর্ষদেশে একটি সোনায় মোড়া আমের প্রতিকৃতি রয়েছে। দালানগুলির ভিত্তি পাথরের। সিঁড়িও পাথরের, কিন্তু বুরুজ ও কুলুঙ্গিগুলো ইঁটের তৈরি। কুলুঙ্গিগুলো চারদিকে একশোটি সারিতে সাজানো ও তার প্রত্যেকটিতে একটি করে সোনার বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। বিহারের মধ্যে দেশি তামা দিয়ে তৈরি একটি বুদ্ধমূর্তি। ধর্মব্যাখ্যানের রত এই মূর্তিটির আকার স্বাভাবিক মানুষের সমান।'
    মূলগন্ধকুটিবিহারের এই বর্ণনা করেছিলেন হিউ এন সাং আনুমানিক ৬৪০ সালে। তাঁর বিবরন পড়ে মনে হয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে নির্মিত এই বিহারটি সেই সময় পূর্ণ গৌরবে বিরাজ করতো। বুদ্ধ নিজে তাঁর অনুগামীদের যে চারটি স্থানকে 'অভিজাহিতাত্থানানি' অর্থাৎ অপরিবর্তনীয় তীর্থভূমি বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঋষিপত্তনের মৃগদাব, যেখানে মূলগন্ধকুটিবিহার নির্মিত হয়েছিলো, তার অন্যতম। বাকি তিনটি উরুবেলা (বোধগয়া), সংকস্সা ও শ্রাবস্তীর জেতবন। বৌদ্ধদর্শনের পবিত্রতম কেন্দ্র হিসেবে ঋষিপত্তনের বিহারটি সমগ্রবিশ্বে স্বীকৃত ছিলো। একটি রটনা আছে যে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক নাকি ঋষিপত্তনের বিহারটি বিধ্বস্ত করেছিলেন। এই রটনাটির সূত্র কিন্তু আবার এই হিউ এন সাং। তিনি ৬৪৪ সালে ভারত ত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর ঋষিপত্তন আগমন তার দুচার বছর আগেই। তাই তাঁর পূর্বোক্ত বিবরনের সঙ্গে এই স্থানে শশাঙ্কের ধ্বংসলীলার আখ্যান ঠিক মেলেনা। একথা ঠিক অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধদেশে শশাঙ্ক 'বেদবিরোধী' শ্রমণদের বহু প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট করেছিলেন এবং সেইকালে তীব্র বৌদ্ধবিরোধিতার কারণে বেশ বিখ্যাত বা কুখ্যাতও ছিলেন। শ্রীহর্ষের সঙ্গে তাঁর বহুবিদিত শত্রুতা এবং সেই কারণে শ্রীহর্ষানুগত হিউ এন সাঙের রচিত ইতিহাসে তাঁর সম্বন্ধে সমদর্শী বিশ্লেষণ থাকার সম্ভাবনা নিতান্ত কম মনে হয়।
    হিউ এন সাং 'ধর্ম-ব্যাখ্যানে রত' যে বুদ্ধমূর্তিটির কথা উল্লেখ করেছেন সেটি বুদ্ধের উপবিষ্ট 'ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রা'র প্রতিচ্ছবি। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী সেটি ধাতুনির্মিত ছিলো। কিন্তু ঊনবিংশ শতকে মূলবিহারের খননসূত্রে লব্ধ এই মুদ্রায় বুদ্ধের প্রস্তরমূর্তিটির ( যেটি এই সময় সারনাথ জাদুঘরে রয়েছে) মতো উচ্চকোটির ভাস্কর্য আমি দেশে আর একটিই দেখেছি। সেটি পাটনা জাদুঘরে আরো চারশো বছর আগে মৌর্যযুগের শেষ পর্যায়ে নির্মিত বিখ্যাত দিদারগঞ্জের যক্ষী মূর্তি।
    -----------------------------------
    ৬.
    এই বিহারটির বাইরে হিউ এন সাং দশটি স্তূপ, তিনটি সরোবর ও 'হেঁটে যাবার ভঙ্গিমায়' তথাগতের একটি 'মহান করুণা ও ভাবব্যঞ্জক' মূর্তি দেখেছিলেন। এছাড়া তিনি একটি প্রায় তিনশো ফুট স্তূপ দেখেছিলেন এখানে। ' এই স্তূপটির নীচের ভিত্তি বেশ চওড়া ও নির্মানটি অনেকটা উঁচু। এটি বিভিন্ন ধারার কারু ও শিল্পকাজ শোভিত এবং মহার্ঘ বস্তু দিয়ে সুন্দর করে সাজানো'। এই স্তূপটিই আদিরূপে সম্রাট অশোক নির্মিত 'ধর্মচক্র স্তূপ' ছিলো, পরবর্তীকালে পালিভাষায় ধম্মখ বা বর্তমানকালে ধামেখ স্তূপ নামে পরিচিত। এটিকে পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে বিশাল আকার দেওয়া হয়। এর নীচের অংশে আটদিকে আটটি কুলুঙ্গি করা আছে এবং পাথরে উৎকীর্ণ নানা জ্যামিতিক বিন্যাস , স্বস্তিক, পুষ্প-পত্র, পক্ষী ও মানুষিক নক্শা দেখতে পাওয়া যায়। কারুকৃতি হিসেবে এর তুলনা সাঁচীর স্তূপের সঙ্গে করা যেতে পারে। এর দক্ষিনে রয়েছে ধর্মরাজিকা স্তূপ। এখন শুধু এর চক্রাকার ভিত্তিভূমিটিই অবশিষ্ট রয়েছে। সারনাথের উপর বারাণসির অন্যান্য মন্দিরের মতো বারম্বার তুর্কি ও অন্যান্য বিধর্মী আক্রমণ হয়েছে। ফলতঃ এর গরিমাময় প্রাচীন স্থাপত্যের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই শুধু ধামেখ স্তূপটি ছাড়া। কিন্তু ধর্মরাজিকা স্তূপটির যতোটা অবশেষ বাকি ছিলো, অষ্টাদশ শতকে কাশীনরেশ চেত সিংএর দিওয়ান জগত সিং একটি বাজারের দোকানপাট নির্মাণের জন্য তার ইঁটগুলি ভেঙে নিয়ে যায়। এই স্তূপে একটি সবুজ পাথরের আধারের মধ্যে বুদ্ধের দেহাবশেষ ছিলো। এই লোকটি বুদ্ধের আত্মার শান্তি কামনায় তা গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। শূন্য আধারটি এই মূহুর্তে ভারতীয় জাদুঘর, কলকাতায় রক্ষিত আছে। এই নিদর্শনটি ব্যতিরেকে এই স্তূপটির অভ্যন্তরে বেশ কিছু অমূল্য পুরা সামগ্রী পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু তার কোনও হদিশ এখন আর পাওয়া যায়না। ধর্মরাজিকা স্তূপটি প্রাক অশোকপর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কারণ প্রাপ্ত লোককথা বা ইতিহাস অনুযায়ী এই বিশেষ স্থানটিতেই বুদ্ধ তাঁর প্রথম পাঁচ শিষ্যকে ধর্মচক্রপ্রবর্তন বিষয়ক উপদেশ দিয়েছিলেন। অশোক পিয়দসসি ইতোপূর্বে স্থাপিত স্তূপটিকে বিবর্ধিত করেছিলেন। তার পর গুপ্তযুগে দুবার এবং পরবর্তীকালে আরো দুবার এই স্তূপটির আকার বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। কিন্তু জগত সিংয়ের কল্যাণহস্তের আশীর্বাদে এখন শুধু এর ভিত্তিভূমিটিই অবশিষ্ট আছে।
    সিংহলে প্রাপ্ত মহাবংশে বলা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে যখন অনুরাধাপুরায় মহাস্তূপের উদ্বোধন হয়েছিলো তখন ঋষিপত্তন থেকে প্রায় দ্বাদশ সহস্র ভিক্ষু ও শ্রমণ সেখানে সমাগত হয়েছিলেন। পঞ্চশিষ্যকে দীক্ষা দেওয়ার পর যশ নামে কাশীর এক প্রতিপত্তিশালী ব্রাহ্মণ বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তিনি সপরিবারে ঋষিপত্তনে এসে তাঁর শরণ গ্রহণ করেন। এই ঘটনার পর বারাণসিতে বুদ্ধের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এক বছরের মধ্যে ষাট জন অনুগামী তাঁর ধর্মে দীক্ষা নেন। এই সব শিষ্যকে বুদ্ধ নবধর্ম প্রচার করতে বিভিন্নদিকে প্রেরণ করেন ও নিজে ফিরে যান উরুবেলায়।
    ------------------------------------
    ৭.
    এই পরিসরে এখনও বেশ কিছু স্তূপ ও চৈত্যের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। দেখা যায় অশোক পিয়দসসির স্থাপিত ধর্মচক্র সিংহস্তম্ভের ভগ্ন মূল ভিত্তিটি। এই স্তম্ভটি তুর্কি আক্রমণে ভূলুন্ঠিত হয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ এই স্তম্ভের শীর্ষদেশে স্থাপিত চতুর্দিকে সিংহচিণ্হিত মূর্তিটি ভূলুণ্ঠিত হলেও তার ক্ষতি সামান্যই হয়েছিলো। এই সিংহমূর্তিটিই স্বাধীন ভারতের সরকারি প্রতীক। সিংহমূর্তিগুলির নীচে চারটি পশুমূর্তি, হস্তী, বৃষ, অশ্ব ও সিংহ এবং চব্বিশ শলাকার চক্র উৎকীর্ণ রয়েছে। এই চক্রটি ভারতীয় জাতীয় পতাকার মধ্যমণি। এই চতুর্সিংহ ও অন্য চারটি পশু ভারতবর্ষের চতুর্দিকে সার্বভৌম সম্রাট অশোকের অধিকার প্রচার করছে। একদিকে প্রায় ভূমিগত অবস্থায় রয়েছে এককালের জমকালো পঞ্চায়তন মন্দির।
    সারনাথ শুধু বৌদ্ধধর্মের শ্রেষ্ঠ তীর্থ নয়। সার্বভৌম ভারতধর্মের যে সংহত রূপ বারাণসি নামক ধারণার মধ্যে দেখি, সারনাথ তার সার সংক্ষেপ বলা যায়। যখন ঐ অঙ্গনপরিসরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম তখন এই ভাবনাটিই মনের ভিতর ক্রমশঃ অনুরণিত হয়ে যাচ্ছিলো। ইতিহাসের নানাপর্যায়ে বিভিন্ন চিন্তানায়কের থেকে ভারতদর্শন বা ভারতধর্ম বিষয়ে যেসব বোধের মণিমুক্তো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে, ঋষিপত্তন বা সারনাথের ঐ নাতিবিশাল ভূখন্ডটি তার মূর্ত নিদর্শন।
    ----------------------------------
    ৮.
    যেসব উৎসাহী মানুষ সারনাথ দর্শনে আগ্রহী, তাঁদের অবশ্যকর্তব্য এর সন্নিহিত জাদুঘরটি মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করা। স্থানিক জাদুঘর সারাদেশে অসংখ্য দেখেছি, কিন্তু এই ছোট্টো সংগ্রহশালাটি এককথায় অনুপম এবং শিহরণ জাগায়। মৌর্য, কুষাণ, গুপ্ত ও পালযুগের বিভিন্ন পুরানিদর্শন ও ভাস্কর্যের যে নমুনা এখানে আমি দেখেছি তার সত্যিই কোনও তুলনা নেই। পূর্বোক্ত ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রায় বুদ্ধের মূর্তিটি ও অশোকের সিংহস্তম্ভ ছাড়াও বহু বোধিসত্ত্ব ও সনাতনধর্মের দেবদেবীর ঈর্ষণীয় সংগ্রহ এই জাদুঘরটিতে দেখা যায়।
    ঋষিপত্তনের বৌদ্ধ এলাকার সঙ্গে লাগোয়া রয়েছে জৈন তীর্থংকর শ্রেয়সনাথের মন্দির। একটি মহাবৃক্ষকে কেন্দ্রে রেখে এই মন্দিরের সন্নিহিত উদ্যানটি মনে হয় শান্তিকল্যাণ। বারাণসি শ্রেয়সনাথের জন্মস্থান। এই মন্দিরটির বিপরীতদিকে রয়েছে বিখ্যাত বৌদ্ধ সাধক, পন্ডিত ও চিন্তানায়ক সিংহলের অনাগারিক ধর্মপাল কর্তৃক ১৯৩১ সালে স্থাপিত মূলগন্ধকুটিবিহারের নবমন্দিরটি। মনে করা হয় ঋষিপত্তনে গৌতমবুদ্ধ এই মন্দিরটির ভূমিতে অবস্থিত একটি মঠে বসবাস করতেন। এই মন্দিরটিতে তক্ষশিলা থেকে সংগৃহীত কিছু বৌদ্ধ পুরানিদর্শন রয়েছে। অনাগারিক ধর্মপাল ছিলেন আধুনিককালে ভারতভূমির বৌদ্ধ নবমূল্যায়ণের পথিকৃৎ । ১৮৯১ সালের বুদ্ধপূর্ণিমায় তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহাবোধি সমাজ। আজকের সারনাথের সংস্কার ও বিকাশের ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন মূল প্রেরণা। তাঁর সমাধিমন্দিরও রয়েছে এই পরিসরেই।
    -------------------------------------
    ৯.
    সূর্যাস্তের সময় এগিয়ে এলো। ফিরে যাচ্ছিলুম আবার বারাণসির মূল শহরের আস্তানার দিকে। 'বেদবিরোধী' বুদ্ধকে একসময় ব্রাহ্মণ্য শক্তিকেন্দ্র চরম আক্রমণ চালিয়েছিলো বিধর্মী অভিযোগে। আদি শংকরের পূর্বসূরি কুমারিলভট্টের নেতৃত্বে যে সংখ্যায় বুদ্ধভক্তদের হত্যা করা হয়েছিলো, চারশো বছর তুর্কি অত্যাচারেও ততো বৌদ্ধনিধন হয়নি। ব্যক্তিক নীতিবোধ যখন গোষ্ঠীগত 'ধর্ম'বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়, মানবিকচর্যা ও মূল্যবোধের তুমুল বিপর্যয় তখনই সম্ভবামি এবং যুগে যুগে তার অন্ধ অনুকরন ইতিহাসকে কলংকিত করে রাখে। কিন্তু এই ঋষিপত্তনে শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ তাঁর এক প্রিয়তম শিষ্য সারিপুত্তকে যা বলেছিলেন, তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কালের উপনিষদেরও মর্মবাণীর মধ্যে সেই একই আকূল পথনির্দেশ পাওয়া যায়।
    ' অপারূতা তেসং অমতস্স দ্বারা
    যে সোতবন্তো পমুঞ্চন্তু সদ্ধং,
    বিহিংস সঞঞী পগুণং ন ভাসিং,
    ধম্মং পণীতং মনুজেসু ব্রহ্মে ।' ( মহাবগ্গ)
    অমৃতের দুয়ার আজ উন্মুক্ত। যাহারা শ্রবণে সক্ষম, তাহারা শোন। শ্রদ্ধাদ্বারাই এই অমৃতের সাক্ষাৎকার লাভ হইবে। হিংসা অপগুণ হইতে মুক্ত হও। ধর্ম এইরূপে মানুষের সার্থকতা প্রণয়ন করে।
    ..................................................
    আজ বৈশাখী পূর্ণিমা...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৪ মে ২০১৫ | ১৯১১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • শিবাংশু | 127.248.140.241 (*) | ০৪ মে ২০১৫ ০৮:৫৫66259
  • জ্ঞান হবার আগে থেকে শুনে যাচ্ছি এই গান অভ্যাসবশে। স্বীকার করি, অতিপরিচিত হয়ে যাবার সুবাদে এই সব শব্দমালা আমাদের মনে কোন পৃথক অনুরণন আনেনা। বড়ো বেশি পুনরাবৃত্ত, ফরমায়েসি আর দর্শনদুষ্ট। নিত্যদিনের জীবনে যেন এর আর কোনও জায়গা নেই। তবু আজ যখন এসব গান নতুন করে শুনতে শিখছি, বিস্মিত হচ্ছি। আমাদের বিস্ময়হীন, মুগ্ধতাহীন রোদপোড়া দৈনন্দিন বেঁচে থাকায় কোথাও একটা আশাবোধের মেঘলা ছায়া খুঁজে পাই যেন। এখানেও থাক,

  • sosen | 24.139.199.11 (*) | ০৪ মে ২০১৫ ০৯:৩১66260
  • মন দিয়ে পড়ার জন্য তুলে রেখে দিলাম।
  • d | 24.97.182.148 (*) | ০৪ মে ২০১৫ ০৯:৩৮66261
  • হুঁ আমিও তাই। পড়ে পড়ব মন দিয়ে সময় নিয়ে।
  • d | 24.97.182.148 (*) | ০৪ মে ২০১৫ ০৯:৩৮66262
  • *পরে পড়ব
  • pi | 116.196.141.147 (*) | ০৪ মে ২০১৫ ১২:৫৩66263
  • ' হিংসা অপগুণ হইতে মুক্ত হও। ধর্ম এইরূপে মানুষের সার্থকতা প্রণয়ন করে।'

    সব ধর্মপালনকারীরা যদি এটা ..
  • phaltu | 118.171.130.168 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০১:৫৯66264
  • স্বল্পবুদ্ধিতে যা বুঝেছি, বুদ্ধ একটা systemetic পদ্ধতিতে মনকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন। মনকে একটা entity ধরে নিয়ে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার property দেখছিলেন। আর এই মনের property কেই উনি ধম্ম বলছেন - আমরা আজ ধর্ম বলতে যা বুঝি, সে সব তিনি করেন নি বা করতে চান নি।
  • Atoz | 161.141.84.175 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০২:৩২66265
  • বুদ্ধের এই অনুসন্ধানকে ব্যক্তিগতভাবে আমারো সাইকো থেরাপির মতন কিছু মনে হয়। এরকম নিঁখুত কতগুলো সূত্রাকারে কিছু কার্যকারণ সম্পর্ক দেখানো, মনের বিষয়ে ও জীবনের বিষয়ে, একদম যুক্তিনির্ভর গাণিতিক অ্যাপ্রোচের মতন লাগে। ধর্ম বলতে যা প্রচলিত তার কোনোটার সঙ্গেই মিল নেই। বরং দর্শন বলা যায় খানিকটা।
  • সন্দীপন মিশ্র | 178.235.195.156 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০২:৩৬66266
  • ভালই লাগল পড়ে । অন্ততঃ শুরুটা বেশ,গল্পের ছোঁয়া । নিজের ছোটবেলায় অর্জিত জ্ঞান এর সাথে মিলিয়ে দেখছিলাম । শেষের দিকটা ইতিহাস ঘেঁষা ভ্রমণবৃত্তান্ত। সুখপাঠ্য।

    ব্যক্তিগত ভাবে বুদ্ধদেব কে আমার একজন দার্শনিক, চিন্তাবিদ মনে হয় । এমন মানুষ যেন দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ (রাজাদের সাধারণভাবে মনুষ্যগোত্রীয় মনে হয় না) ; যিনি জনমদুখী, শিকার বিরোধী, মানুষের দুখে সহমর্মী - প্রচণ্ড ভাবে আধুনিক ও মননশীল এই আচরণ আমরা পাচ্ছি এমন একজন এর কাছ থেকে যিনি জন্ম হয়ছেন প্রবল বৈভবে । এই বৈপরীত্য,অস্বীকার করার উপায় নেই আমায় টানে, টানত বলা ভাল।

    আর বাকিটা 'কোথা থেকে কী হইয়া গেল ' এর ধরণে আমরা এক পিস ধর্ম পেয়ে গেলাম সে আলোচনা উঝ্য থাকুক
  • Atoz | 161.141.84.175 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০২:৩৯66267
  • "এমন সময় কোথা হইতে কী হইয়া গেল, দৈত্যের পিস্তল প্রহ্লাদের হাতে"
    ঃ-)
  • pintu | 181.25.193.77 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০৩:৩৪66268
  • বুদ্ধের সম্পর্কে আমার আকর্ষণ ওনার মধ্যপন্থার জন্য। অহিংসার যে ক্রীডের জন্য বুদ্ধ পৃথিবীর কাছে পরিচিত, সেখানেও বুদ্ধ মধ্যপন্থী। বুদ্ধের জীবিত অবস্থাতেই সংঘে মাংস খাওয়া নিয়ে একটি বিদ্রোহ হয়। বুদ্ধ বনাম বুদ্ধের খুড়তুতো ভাই দেবদত্ত। সেই যে উড়ন্ত হাঁসকে তীর মারা নিয়ে জাতকের গল্প, তার খলনায়ক। সংঘে দেবদত্ত চরমপন্থী, মাংস কোন অবস্থাতেই খাওয়া যাবে না এই তার বিশ্বাস। বুদ্ধের কথা, শ্রমণ ভিক্ষাজীবি। উপাসক যা ভিক্ষা দেবে, তাতেই তার জীবনধারণ। এছাড়া শ্রমণ বিভিন্ন দেশে যাবেন ধর্মপ্রচারে। নিরামিষ আহার সর্বত্র সুলভ নাও হতে পারে। তবে শ্রমণের জন্য বিশেষ করে পশুবধ হয়েছে জানলে সেই মাংস নিষিদ্ধ, এবং ভবিষ্যতে তেমন ঘটনা নিষেধ করা শ্রমণের কর্তব্য।

    এই নিয়ে সংঘ ভেঙে যায়। দেবদত্ত তার অনুসারীদের নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সংঘ স্থাপন করে। অজাতশত্রু দেবদত্তের পৃষ্ঠপোষক হন। দুই সংঘের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে দীর্ঘদিন। একবার তো বুদ্ধকে খুন করার জন্য দেবদত্ত অজাতশত্রু মগধের রাজপথে ভিক্ষারত বুদ্ধের উপর নীলগিরি বলে একটি হাতি লেলিয়ে দেয়।

    মাংসাহার নিয়ে বুদ্ধের মধ্যপন্থা শুধু তাত্ত্বিক নয়। উনি নিজেও ভিক্ষালব্ধ মাংসাহার করতেন। বুদ্ধচরিতে আছে এক শিষ্যের দেওয়া শূকর-মার্দব (সাকলিং পিগ?) খেয়ে ওনার পেটের অসুখ করে ও তাতেই উনি মহাপ্রয়ান করেন।
  • Atoz | 161.141.84.175 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০৫:৩৪66272
  • সুকরমদ্দব বলে যে খাবারটা , ওটা একরকম মাশরুম ছিল।
  • Su | 181.33.192.182 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০৭:৪০66269
  • মহাযান ও হীনযান নিয়ে কিছু লেখা হোক
  • শিবাংশু | 127.197.247.241 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ০৭:৪৯66273
  • প্রাসঙ্গিক আলোচনায় যোগ দেবার জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। এই লেখাটি ঠিক অ্যাকাডেমিক লেখা নয়। ইতিহাসের কিছু বিন্দু ছুঁয়ে, রবীন্দ্রনাথের কথায় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়, সেই অনন্য পুরুষটির জন্মদিনে একটি স্মরণ যাপন মাত্র। বিষয়টি শুধু যে বিপুল তাই নয়, অতি জটিল। অতি অতি সংক্ষিপ্ত হলেও বড়ো পরিসর লাগবে। একটু প্রয়াস পাচ্ছি অসম্পূর্ণ আলাপের,
    ১. 'ধর্ম' বলতে যে প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীবদ্ধ লোকাচার ও দৈব নিবেদিত অভ্যাসগুলি'কে আমরা চিনি, শাক্যমুনির সময় সে রকম কোনও কিছুর অস্তিত্ত্বও ছিলোনা। প্রাক ও প্রাথমিক বৈদিক জনগোষ্ঠীর একমাত্র 'ধর্মীয়' আচার ছিলো যজ্ঞ অনুষ্ঠান। যেখানে অসংখ্য ও বহুরকম পশুবলি হতো বলে বুদ্ধ তার বিরোধিতা করতেন। তিনি যজ্ঞের উপাসনাকেন্দ্রিক আচারগুলির বিরোধিতা করেননি। কিন্তু 'বেদবিরোধী' তকমাটি তাঁর গায়ে স্থায়ীভাবে লেগে গিয়েছিলো। তাই তিনি যখন 'ধর্ম' শব্দের উল্লেখ করেন তখন সেখানে য়ুরোপীয় Faith নামক সংকীর্ণ ধারণাটির স্থান নেই। যে ধারণা পরবশ হয়ে গ্যালিলিপর্বতের শিখর থেকে নেমে আসা সেমিটিক ধর্মগুলির, অর্থাৎ ইহুদি, খ্রিস্টিয় ও ইসলামিক, অনুসারিরা সঙ্ঘবদ্ধ হতেন, আমাদের বিশ্বাস ও তার অনুপালন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চালিত হতো। যতোদিন না ভিক্ষুসঙ্ঘ বড়ো আকারে সংগঠিত হয়েছিলো, ততোদিন তিনি নিজে ও তাঁর অনুসারীরা 'সদ্ধর্ম' নামক কিছু আচরনীয় নৈতিক উপলব্ধি নিয়ে প্রচার চালিয়ে যেতেন। সেখানে কোনও লোকাচারকেন্দ্রিক রিচ্যুয়ালিস্টিক 'ধর্মীয়' প্রক্রিয়ার স্থান ছিলোনা। মোটামুটিভাবে বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া সারিপুত্তের প্রতি উপদেশে তাঁর 'ধর্ম' শব্দের ব্যবহারকে 'এক পিস ধর্ম' নামক কটাক্ষটি মনে হয় অপ্রয়োজনীয়।
    -------------------------------------------
    ২. শাক্যমুনি নিজে কুলীন আর্য ক্ষত্রিয়সমাজের সামন্তপরিবার থেকে এলেও অত্যন্ত প্রবলভাবে আর্য বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথাকে অস্বীকার করেছিলেন। বর্ণাশ্রম প্রথা শুধু তৎকালেই নয়, পরবর্তী আড়াই হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষীয় অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বুদ্ধের প্রতি ঘৃণা, অসূয়া ও অরুচির কারণটি 'ধর্মীয়' নয়, অর্থনৈতিক। কারণ বর্ণাশ্রম ও তদ্জনিত বিকশিত দাসপ্রথাই ছিলো ভারতীয় আর্থিক ব্যবস্থার মেরুদন্ড। বুদ্ধ সর্বপ্রথম বলেছিলেন এই বিভাজনটি অলীক, মিথ্যা ও বলপ্রযুক্ত। প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব দুঃখজয়ের সাধনা করার অধিকার আছে। সেখানে রাজা বা পুরোহিতের কোনও ভূমিকা নেই। এই জাতীয় মুক্তচিন্তা সেকালে, সেই পরিবেশে, ঐতিহাসিক পটভূমির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ কিছু, কী করে তাঁর উপলব্ধির ফসল হতে পেরেছিলো, এটা ভাবলে এখনও স্তম্ভিত হতে হয়। তাঁর উপদেশ ( আমি দর্শন শব্দটি এড়িয়ে যাচ্ছি, কারণ তিনি নিজে কোনও দর্শন রচনা করেননি। তাঁর উপদেশের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে যে মনন মন্থন হয়েছে সেখানে বহু দার্শনিক সূত্রের অবকাশ পাওয়া গেছে) সম্পূর্ণভাবে নৈতিকতার যুক্তি আধারিত। তৎকালীন আর্যসমাজের প্রাকৃত দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা যজ্ঞানুষ্ঠানকে তার সামনে ছেলেখেলা বলে বোধ হয়। আধুনিককালের সনাতনধর্মীয় ব্যাখ্যা, যা মূলতঃ স্বামীজী কথিত, " বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বিদ্রোহী সন্তান" ধাঁচটিই অনুসরণ করে। যার যৌক্তিকতা স্বীকার্য নয় নানা কারণেই।
    -------------------------------------------------
    ৩. মহাযান ও হীনযান, যার আসল নাম মহাসাংঘিক ও থেরবাদ, তাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ অতি জটিল এক প্রক্রিয়া। গৌতমবুদ্ধ নিজের জীবৎকালে ভিক্ষুসঙ্ঘকে যথাসম্ভব পরিশীলিত ও অনুশাসিত একটি সামাজিক চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আমরা জানি, তাঁর প্রচারিত সদ্ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শ্রেষ্ঠী ও বৈশ্যসমাজ। তাঁর সমসাময়িক আজীবক বা জৈনমতের অনুসারীরাও ছিলেন মূলত বণিকসমাজের মানুষ। এর একটি অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। সমাজের এই বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষদের নিজস্ব জীবিকাকে বিকশিত করার জন্য সামাজিক শান্তির প্রয়োজন। বুদ্ধ বা মহাবীর, চিরকাল এই সামাজিক শান্তির পক্ষেই ওকালতি করে গেছেন। তাই এই দুই মতানুসারী গোষ্ঠী চিরকাল বণিকসমাজের থেকে সর্বৈব সহায়তা পেয়ে এসেছে। কিন্তু ভারতীয় ও অনুশাসন, এই দুই ধারণা কখনও একযোগে থাকতে পারেনা। বুদ্ধ অনুভব করছিলেন সঙ্ঘে অনুশাসন ও নিবেদিত প্রত্যয়ের অভাব দেখা দিচ্ছে। সচেতনভাবেই তিনি কুশীনগরের দিকে তাঁর শেষ যাত্রার আয়োজন করেছিলেন।৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রায় আশি বছরের রোগজীর্ণ শরীর ও ক্লান্তি তাঁর সঙ্গী হয়েছিলো। তাঁর পরিনির্বাণের খবর পেয়ে সুভদ্দ নামে এক ভিক্ষু বলে ওঠেন, " আঃ, বাঁচিলাম। কঠোর শাসন হইতে আমাদের উদ্ধার হইলো। এখন আমরা যা খুশি করিতে পারিব।" এই সময় সঙ্ঘে রীতিমতো স্বৈরাচার মাথা তুলতে থাকে। প্রবীণ স্থবিররা একজোট হয়ে রাজগৃহে সপ্তপর্ণী গুহার সামনে বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য মহাকাশ্যপ'কে সঙ্ঘথের নির্বাচিত করেন ও প্রথম সংগীতি'র আয়োজন করে অবস্থা সামাল দেন। এর একশো বছর পর ৩৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সঙ্ঘথের ছিলেন সর্বকামী। সেই সময় 'দশবস্তু' নিয়ে বৈশালীর বজ্জিপুত্তদের সঙ্গে অন্য থেরবাদীদের প্রবল মতান্তর দেখা দেয়। তক্ষশীলা থেকে স্থবির রেবত এসে উব্বাহিকা করে অবস্থা সামলাতে চাইলেন। কিন্তু বজ্জিপুত্তরা বিদ্রোহ করে পৃথক দল তৈরি করলো, 'মহাসাংঘিক' নাম নিয়ে। যদিও বিদ্যা-বুদ্ধি-অর্থ-প্রতিপত্তিতে থেরবাদীরা অনেক এগিয়ে ছিলো, কিন্তু এই বিভাজনটি আটকানো গেলোনা। থেরবাদী ও মহাসাংঘিক দুটি পৃথক নিকায় হয়ে গেলো। এর পর ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের আয়োজিত মহাসংগীতির সময় মহাসাংঘিকদের মধ্যে ছয়টি পৃথক নিকায় ও থেরবাদীদের মধ্যে বারোটি ভিন্ন নিকায়ের সৃষ্টি হয়ে গেছে। পিয়দস্সি অশোক নিজে থেরবাদী মতে আস্থা রাখতেন বলে সে সময় সমগ্র দেশে থেরবাদীরা প্রাধান্য পেয়েছিলো। কিন্তু পুষ্যমিত্র সুঙ্গের হাতে মৌর্যশাসনের অবসান হয়ে যেতে সদ্ধর্মের কেন্দ্র ক্রমশঃ পূর্ব ভারত ছেড়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে স্থানান্তরিত হয়ে যেতে থাকে। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে অন্ধ্রসাম্রাজ্যে মহাসাংঘিক নিকায়ের অন্তর্গত একটি নিকায় 'চৈত্যবাদ' এবং বর্তমান মহারাষ্ট্রে তৎকালে শক্তিশালী 'সস্মিতীয়' নিকায় এই দুই মত মিলে মহাযানপন্থী সাধনা বিকশিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি আরো স্থিতি পায় যখন বাহ্লীকদেশের রাজা কণিষ্ক সদ্ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন । গান্ধারের পাঠানজাতির দুই ভাই অসঙ্গ ও বসুবন্ধু'র 'হেতুবাদ' ও তার প্রায় দুশো বছর আগে অন্ধ্রের নাগার্জুনের মাধ্যমিক বা 'শূন্যবাদে'র চর্চা শুরু হয়। এগুলি মহাযানপন্থী ধারা। খ্রিস্টিয় প্রথম শতক থেকে থেরবাদ বা হীনযানী সাধনা বিকশিত হয় মূলত সিংহল দ্বীপে।
    ----------------------------------
    ৪. গুপ্তযুগের সময় থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত মহাযানী সাধনায় অসংখ্য শাখাপ্রশাখা দেখা দিতে থাকে। বজ্রযান ও সহজযান নামে বৌদ্ধতন্ত্রের বিশাল চর্চা শুরু হয়ে যায়। এর কিছু আলোচনা আমার তন্ত্রবিষয়ক যে আলোচনা গুরু'তে রয়েছে সেখানে পাওয়া যেতে পারে। এবার থামি। এ এক অনন্ত বিষয়, থই পাওয়া ভার।
  • সুকি | 129.160.188.96 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ১১:০২66270
  • শিবাংশুদার লেখা আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে - এটাও তার ব্যতিক্রম নয়।
  • ref.link | 132.163.82.64 (*) | ০৫ মে ২০১৫ ১১:৩৪66271
  • বৌদ্ধধর্ম নিয়ে আরো একটা টই আছে। http://tinyurl.com/guruchandali-buddhism ওখানে মহাযান, হীনযান নিয়ে লেখা আছে।
  • ranjan roy | 229.64.68.110 (*) | ০৬ মে ২০১৫ ০১:১৮66274
  • শিবাংশু,
    অবশেষে। আপনার সঙ্গে আগে দুয়েকবার কথা হয়েছে--বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন নিয়ে আপনি এখানে লিখবেন।
    কাজেই এত তাড়াতাড়ি থামলে ধম্মে সইবে না।ঃ)))
    আপনাকে অনুরোধ নীচের বিন্দুগুলো নিয়ে কিছু বলুনঃ
    ১) "নির্বাণ" বলতে বুদ্ধ কী বলতে চেয়েছেন?
    অনেক আগে আচার্য শেরবাটস্কির "Concept of Budhdhist Nirvana" বইটি হাতে এসেছিল। বুঝতে পারি নি। আজকে পেলে পড়ব।
    ২) রাহুল সাংকৃত্যায়ন বৌদ্ধধর্মকে "অনাত্মবাদিন" অর্থাৎ দেহবিহীন আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী বলছেন। ধর্মকীর্তির শ্লোকটিও সেই পথানুসারী। কিন্তু কিছু বিপরীত এভিডেন্সও আছে। আপনার কী মনে হয়?
    ৩) পতিচ্চসমুৎপাদ নামক ল অফ কজালিটি নিয়ে আরও একটু?
    ৪) সেই সমাজে বণিক, রাজন, শূদ্র ও দাস নিয়ে বৌদ্ধমত?

    একটু বেশি আবদার করে ফেললাম কি?
  • b | 135.20.82.164 (*) | ০৬ মে ২০১৫ ০২:৪৭66275
  • বৌদ্ধ দর্শনের টই তুলে দিলাম (ওপরের লিংক)। শিবাংশু এখানে মানুষ বুদ্ধ নিয়ে বলতে চাইছেন আশা করি।
  • ranjan roy | 24.96.74.143 (*) | ০৬ মে ২০১৫ ০৪:৫৪66276
  • ধন্যবাদ বি।
  • শিবাংশু | 127.201.149.16 (*) | ০৬ মে ২০১৫ ০৫:৪৫66277
  • রঞ্জন,

    'নির্বাণ' শব্দের আভিধানিক অর্থ নিভে যাওয়া। মাটির প্রদীপ বা জীবনপ্রদীপ, উভয়ের জন্যই এই পদটি প্রযোজ্য। এককথায় জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাওয়া। এ হলো শব্দগত অর্থ। কিন্তু শাক্যমুনির নিজের ও তাঁর অনুগামীদের অনুসৃত অসংখ্য নিকায় অনুযায়ী তার অর্থের এতো রকম ব্যাখ্যা হয়েছে যে এক কথায় কোনও পরিভাষা দেওয়া যায় না।
    ----------------------------------------
    বেশ কিছু মানুষের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বুদ্ধ স্বয়ং আত্মার বিনাশকেই নির্বাণ মনে করতেন। এই পরিভাষাটি কেন্দ্র করে আদি শঙ্করাচার্য থেকে খ্রিস্টিয় মিশনারিরা তাঁকে 'বিনাশবাদী' বা নিহিলিস্ট দর্শনের প্রবক্তা বলে কটাক্ষও করেছেন। তিনি নিজে 'নির্বাণে'র কোনও পরিভাষা নথিবদ্ধ করেছিলেন কি না, তার কোনও সাক্ষাৎ প্রমাণ নেই। তাঁর দেহাবসানের প্রায় পাঁচশো বছর পরে একটি পালি প্রতিবেদনে পাওয়া যায় তিনি নাকি নির্বাণ'কে প্রদীপ নিভে যাবার সঙ্গেই তুলনা করেছিলেন। কিন্তু শ্রোতারা যখন তাঁকে প্রশ্ন করে নির্বাণের পর কী থাকবে, তিনি বলেন কিছু থাকবে না। আবার প্রশ্ন করা হলো, থাকা-না-থাকার মাঝে কোনও অবস্থান থাকবে কি? তিনি বললেন , না। পুনর্বার প্রশ্ন এলো, থাকা-না-থাকার ঊর্ধে কোনও অবস্থা থাকবে কি? তিনি আবার বললেন, না। তার অর্থ নির্বাণ মানে অস্তি, নাস্তি বা তার ব্যতিরেকে কোনও তৃতীয় অবস্থাও নয়। সে এক অনির্বচনীয়, অর্থাৎ বচনের অতীত উপলব্ধি। এই অবস্থাটিকে মহাযানে পরবর্তীকালে 'শূন্য' অবস্থা বলা হয়েছে।
    -----------------------------------------
    আমি আগে উল্লেখ করেছি পিয়দস্সি অশোক থেরবাদে অনুগত ছিলেন বলে তাঁর সময়ে মহাসাংঘিক বা মহাযানীরা বিশেষ প্রশ্রয় পায়নি। সুঙ্গশাসন আসার পর তিনশো বছর ধরে মহাযানপন্থার অক্ষপথটি দেশের উত্তর-পশ্চিমে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। বাহ্লীকের রাজা কণিষ্কের পোষকতায় বৌদ্ধমতের এই শাখাটি বিকশিত হয়ে ওঠে। কণিষ্কের গুরু ছিলেন অশ্বঘোষ। রাজা তথা শিষ্যের অনুরোধে তিনি জনসাধারণের বোধগম্য করে শাক্যমুনির জীবনী ও ভাবধারা'কে লিপিবদ্ধ করতে উদ্যমী হ'ন। শাক্যমুনির মহানির্বাণের পাঁচশো বছর পরে সেকালের সব চেয়ে প্রামাণ্য বুদ্ধজীবনী 'বুদ্ধচরিত' তাঁর কলমে রচিত হয়। তাঁর নিজের ভাষায় বৈদ্যরা যেমন তিক্ত ঔষধের সঙ্গে মধু মিশ্রিত করে রোগীকে সেবনের জন্য পরিবেশনা করেন , তেমনই তিনি বৌদ্ধমতের দুরূহ ও জটিল সন্দর্ভগুলি কাব্যাকারে লিখে মানুষের মধ্যে প্রচার করছেন। তিনি'ও নির্বাণ বিষয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। একথা জানিত যে শাক্যমুনির সঙ্গে তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। উপরন্তু মাঝখানে পাঁচশো বছর কেটে গেছে। কিন্তু সেকালে অশ্বঘোষ ছিলেন রাজগুরু এবং সর্বজনমান্য বৌদ্ধমতের প্রধান প্রচারক ও গুরু। তাই তাঁর ব্যাখ্যা'কে অস্বীকার করা যায়না।
    " দীপো যথা নিবৃর্তিমভ্যুপেতো
    নৈবাবনিং গচ্ছতি নান্তরিক্ষম
    দিশং ন কাঞ্চি`য় বিদিশং ন কাঞ্চিৎ
    স্নেহক্ষায়াৎ কেবলমেতি শান্তিম ।।
    এবং কৃতী নিবৃর্তিমভ্যুপেতো
    নৈবাবনিং গচ্ছতি নান্তরিক্ষম
    দিশং ন কাঞ্চিদ্বিদিশং ন কাঞ্চিৎ
    ক্লেশক্ষয়াৎ কেবলমেতি শান্তিম ।।

    অস্যার্থ,
    প্রদীপ যেমন নিভে যাবার পর পৃথিবীতে যায়না, আকাশে যায়না, দিকদিগন্তরেও যায়না; তেল শেষ হলেই প্রদীপেরও শেষ; সাধকও তেমনি ভাবে পৃথিবী, আকাশ, দিকদিগন্তর কোথাও যান'না। তাঁর ক্লেশের অন্ত হয়। তাঁর সব কিছু শেষ হয়ে শান্ত হয়ে যায়।

    এখানে অশ্বঘোষ কিন্তু সমগ্র অস্তিত্বলোপের কোনও ইশারা করেননি। বরং এর পরেই তিনি বলছেন তৃষ্ণাই যেহেতু সব জন্মের হেতু তাই তৃষ্ণাচ্ছেদন করলেই মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যায়। এখানে তিনি 'ধর্মে'র একটি নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তা একটি উপলব্ধিমাত্র। তিনি বলছেন, তুমি যদি এই 'ধর্ম'কে প্রত্যক্ষ করো তবে তোমার তৃষ্ণা তথা দুঃখের ক্ষয় হবে। কারণ এ 'ধর্ম' শান্তিময়, মঙ্গলময়, তৃষ্ণাবিরোধী, পরিত্রাণকারী। এ এক চরম ও অচ্যুত পদ। এখানে জন্ম নেই, জরা, মৃত্যু, ব্যাধি নেই, শত্রুসমাগম, নৈরাশ্য, প্রিয়বিরহ কোনও কিছু নেই। এই 'ধর্ম' ,অর্জন করার উপযুক্ত ও শ্রেষ্ঠ বোধ। অতএব তিনি এখানে অস্তিত্বের পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, লোপের নয়। সেক্ষেত্রে 'নির্বাণ'কে বিনাশকারী অবস্থা মনে করাটা ঠিক স্বীকার্য নয়।
    -----------------------------------------
    মহাযানী শূন্যবাদে 'শূন্য' মানে ভ্যাকুয়াম নয়। " অস্তিনাস্তিতৎ উভয়নুভয় চতুষ্কোটি বিনির্মুক্তং শূন্যম।" অর্থ, শূন্য মানে একটি অবস্থা, যা অস্তিনাস্তি প্রভৃতি চারটি অবস্থার অতীত। অতএব উক্ত পালি প্রতিবেদন ও অশ্বঘোষের ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'নির্বাণ' ভাষা, বাক্য, ধারণার অতীত এক অনির্বচনীয় অবস্থা। য়ুরোপীয় দার্শনিকেরা বহুকাল পরে এই অবস্থাটিকে ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল অর্থাৎ অতীন্দ্রিয়বোধের কাছাকাছি কোনও অবস্থান বলে মনে করতেন। অশ্বঘোষ উক্ত 'অচ্যুতপদ' কিন্তু 'অস্তি' নয়। কারণ আত্মা থাকলেই অহং থাকবে, জ্ঞান থাকবে, একত্ব সংখ্যা থাকবে। জ্ঞান থাকলেই দুঃখ থাকবে। অতএব অশ্বঘোষের ব্যাখ্যায় বুদ্ধ বলছেন, আত্মার অস্তিত্ত্ব যতোক্ষণ স্বীকার করা হবে, ততোক্ষণতার মুক্তি হবেনা। তাই আত্মার অস্তিত্ব নষ্ট করে তাকে চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত না করা পর্যন্ত নির্বাণ আসবে না।
    ----------------------------------
    আজ এতোটাই থাক....
  • ranjan roy | 24.99.81.204 (*) | ০৬ মে ২০১৫ ০৬:১৫66278
  • অনেক ধন্যবাদ, শিবাংশু।
  • phaltu | 118.171.130.168 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৩:০১66280
  • পড়াশুনা কম, তাই প্রশ্নটা করতে হচ্ছে, হয়্ত এটা আসলে স্বগতোক্তি।
    নির্বাণের পর কিছু থাকবে না - এইটে কি কিছুতেই কেউ খেতে পারছিলেন না? তার মানে তাঁরা এটাও খেতে পারতেন না যে জন্মের আগেও কিছু ছিল না!
  • phaaltu | 118.171.130.168 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৩:১৭66281
  • আচ্ছা, এটা বোধহয় জীবন আর জড় এর দ্বান্ধিক সমস্যা।
    তার মানে কি তখনকার কালে বুদ্ধ একমাত্র যিনি ভেবেছিলেন জড় থেকে জীবন হয়?
  • Atoz | 161.141.84.175 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৩:৫৪66282
  • তাহলে ঐ জাতক সিরিজ? নানা জন্মে জন্মে নানারূপে---
    জন্মের আগেও কিছু নেই, মৃত্যুর পরেও কিছু নেই--এদিকে ঐ জাতক কাহিনিমালা যা কিনা জাতিস্মর হয়ে বলে বলে গেছেন, এই দুটো বিপরীত ব্যাপার কেমন করে একইসঙ্গে চল্লো?
  • phaaltu | 81.162.234.248 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৪:৩৪66283
  • তাও বটে।
    আচ্ছা, সে সব কি বুদ্ধ বলেছেন, না পরে জুড়েছে?
  • Atoz | 161.141.84.175 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৪:৪৭66284
  • কিছুকিঞ্চিৎ বুদ্ধ নিজেই বলেছিলেন মনে হয়(হয়তো তাঁর বলার নেপথ্যের ভাবনাটা বা ব্যাখ্যাটা বলেন নি ), পরে বিশাল লতাপাতা নকশা জুড়ে ইয়া ইয়া কাহিনি হয়েছে, লোকজনে বানিয়ে নিয়েছে। ছবিটবিও তো এঁকেছে পরে অজন্তা ইলোরা ইত্যাদিতে।
  • Atoz | 161.141.84.175 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৪:৫২66285
  • কয়েকটা সূত্র সত্য ইত্যাদি দিয়ে তৈরী একটা মতবাদের মধ্যে যখন পরবর্তীকালে ব্রহ্মার চোখ, তুষিত স্বর্গ, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতারা উড়ে আসছেন বুদ্ধের উপদেশ শোনার জন্য, অসিতদেবলও আসছেন, মায়াদেবীও আসছেন, অন্যদিকে তারা, নীল সরস্বতী, তন্ত্রের নানা ব্যাপার ঢুকে একেবারে ইয়া ব্বড় ব্যাপার হয়ে গিয়েছে, তখন লোকজনের কাহিনি বানানোর ও অন্যদিক থেকে এনে জুড়ে দেবার ক্ষমতাকে একেবারেই হাল্কা করে দেখা উচিত নয়।
  • শিবাংশু | 127.201.161.230 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৭:৩৯66286
  • শাক্যমুনির সমসময়ে, অর্থাৎ আদি ও মধ্য বৈদিক যুগে যেসব ঐশী অস্তিত্ত্বের উপাসনা করা হতো তাঁরা সব বিভিন্ন প্রাকৃত শক্তি; অগ্নি, বরুণ, মরুৎ, পর্জন্য, অর্যমা ইত্যাদি। এই উপাসনার উদ্দেশ্যই ছিলো এই সব শক্তিকে ভজনা করে ঐহিক লাভ সন্ধান করা। বস্তুত বিভিন্ন বেদের যাবতীয় ব্রাহ্মণে শুধু দেহি দেহি রব। গুপ্তযুগের পরবর্তীকালে সব পুরাণেও এই দৈব ভিক্ষাবৃত্তির বিরাম নেই। বরং তা আরো প্রকট হয়েছে। এমত স্পিরিচুয়াল বাতাবরণে গরিষ্ঠের কাছে শাক্যমুনির উপদেশ পৌঁছে দেবার সর্বাধিক সমস্যা ছিলো সেখানে কোনও নগদ'বিদায়ের প্রত্যাশা ছিলোনা। ব্রাহ্মণরা খুব জোরের সঙ্গে দাবি করতো যজ্ঞ ইত্যাদি করলে হাতে হাতে গোধন, ভূধন, স্ত্রীধন, কাঞ্চন সব লাভ হবে। উপরন্তু বোনাস হিসেবে অনন্ত স্বর্গবাসের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। সেখানে শাক্যমুনি স্বর্গের অস্তিত্ত্বেই বিশ্বাস করেন না। উপরন্তু পাবার মধ্যে রয়েছে শুধু নির্বাণের হাতছানি। আর নির্বাণ মানে শুধু নেতি নেতি। সব কিছু বিনাশপ্রাপ্ত হবার নিশ্চিত আহ্বান। 'নির্বাণ' মানে এক অনির্বচনীয় অবস্থা। যাকে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না, বোঝা যায়না। শাক্যমুনি বলেন দুঃখ দূর করো, দুঃখের কারণ দূর করো, তৃষ্ণা দূর করো, কামনা দূর করো, তবেই মোক্ষ, তবেই নির্বাণ। এদিকে ব্রাহ্মণরা বলে যাচ্ছেন যজ্ঞবলে যে সম্পদলাভ হবে তা দিয়ে তুমি সব ঐহিক দুঃখের সমাধান করে দিতে পারবে। এখানে একটা 'কিন্তু' আছে। এই লাভ কিন্তু সবার জন্য নয়। তা শুধু উচ্চবর্ণের মৌরসিপট্টা। তবে সংখ্যাগুরু অন্ত্যজদের জন্য কী উপায় নির্দিষ্ট হবে? এই অনিশ্চিত অধ্যাত্ম স্পেসটিকে বুদ্ধের আশ্বাস দখল করে নিলো। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে।
    ----------------------------------------
    প্রথমযুগের বৌদ্ধরা নির্বাণের এই 'চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত' আত্মার বিনাশকে স্বীকার করে নিয়েছিলো। কিন্তু কালক্রমে এতোটা বিমূর্ত কোন ধারণার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। শূন্যরূপ আত্মার ধারণাকে পরিবর্তিত করে তারা বললো জীবন হলো 'ভাব'পদার্থ আর নির্বাণ হলো 'অভাব'। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে এটাও স্পষ্ট হলো যে সংসারও বস্তুত নেতিপদার্থ, অর্থাৎ তাকেও 'অভাব' বলা যায়' । এই যুক্তিতে ভব ও নির্বাণ দুইই শূন্য। বৌদ্ধ ধর্মের এই পর্যায়টা আসতে প্রায় এক হাজার বছর লেগে গিয়েছিলো। আমাদের ইতিহাসে সেটা চর্যাপদের যুগ। লামা সরহপাদের দোহা'তে আছে,
    " অপণে রচি রচি ভব নির্বাণা।
    মিছেঁ লোঅ বন্ধাবএ অপনা।।
    অর্থ, ভব শূন্যরূপ, নির্বাণও শূন্যরূপ। ভব ও নির্বাণে কোনও ভেদ নেই। মানুষ আপন মনে ভব রচনা করে, নির্বাণও রচনা করে। এইভাবে তারা নিজেদের ক্রমশঃ বদ্ধ করে ফেলে। পরমার্থ সন্ধান করতে গেলে কিছুই পাওয়া যাবেনা। সবই শূন্যময়। তাঁদের স্লোগান হলো ' শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত স্বরূপ"। পরম যোগীও মুক্ত, চরম পাপিষ্ঠও মুক্ত। এই পথেই সহজিয়া বৌদ্ধমতের যাত্রা শুরু হলো। তবে আগেই বলেছি, তা পরবর্তীকালের ক্রমবিকাশ।
    -----------------------------------
    মহাযানীরা, কেবল শূন্যতায় পর্যবসিত হওয়াই জীবনের চরম উদ্দেশ্য, এই ম্যাক্সিমটি মেনে নিতে পারলেন না। তাঁরা এর সঙ্গে 'করুণা' নাম দিয়ে একটি ধারণার সূচনা করলেন। এটি ব্যক্তিগত সাধারণ করুণাভাব নয়। সর্বজীবে, সর্বভূতে করুণা। ইতোপূর্বে নির্বাণের সূত্রে তাঁরা রূপধাতুকে অরূপধাতুতে পরিবর্তিত করেছিলেন। সে কারণে সমস্ত পদার্থকেই আকাশের মতো অনন্ত অনুভব করতেন। এই নবসংযোজিত করুণাভাবকেও তাঁরা আকাশের মতো অনন্ত ঘোষণা করলেন। যে নির্বাণ এতোদিন শুধু শূন্য ছিলো, নিশ্চল, নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দ, করুণাভাব তাতে প্রাণসঞ্চার করলো। অরহৎ হয়ে যাঁরা মুক্তির সাধনা করার সংকল্প করেছিলেন তাঁরা পার্থিব জগতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত থাকলেও তার প্রতি পূর্ণ উদাসিন ছিলেন। নির্বাণের সঙ্গে করুণার সংযোজনে তাঁরা শুধু আত্ম উদ্ধারের জন্যই ব্যাকুল থাকাটা সমীচীন মনে করলেন না। জগৎ উদ্ধারের তাঁরা আকুলতা বোধ করলেন। ব্যক্তিগতভাবে নির্বাণ লাভ করে লক্ষ্যপূর্তির স্বার্থসন্ধ উপায়কে তাঁরা ত্যাগ করলেন। আমি মুক্ত হবো আর কোটি কোটি জীব সংসারের মায়ায় বদ্ধ থাকবে, এই আত্মপরতাকে তাঁরা বিসর্জন দিলেন। মহাযানী বৌদ্ধ দর্শন, বাকি সব কীর্তিকে যদি অস্বীকারও করি, শুধু এই উপলব্ধিটির জন্য বৃহত্তর মানবজাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকলো। শাক্যমুনির পরম করুণাময় প্রতিচ্ছবিটি এভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠে আগামী পৃথিবীর কাছে। এই পর্যায়ের নিরীক্ষার মাধ্যমে আরেকটি নতুন ধারণার সৃষ্টি হলো। এক নিবেদিত দৈবী কল্যাণকারক অস্তিত্ব, বোধিসত্ব। যিনি বোধির পথে অগ্রসর, কিন্তু বুদ্ধত্ব লাভ করেননি। আপামর মানুষের কল্যাণহেতু যাঁর পথচলা।
    ----------------------------------------
  • শিবাংশু | 127.201.161.230 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৭:৪১66287
  • phaltu ও Atoz,

    আপনারা যেসব প্রশ্ন ও প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন তা হয়তো আমার লেখায় আসবে কোন সময়। তখন আরো বিশদে আলোচনা হতে পারে।
  • একক | 24.96.176.33 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৯:২১66288
  • এতো ভাস্ট সাবজেক্ট এত স্বল্প পরিসরে.......দারুন এগোচ্ছে !
  • rupak bandyopadhyay | 127.221.161.60 (*) | ০৭ মে ২০১৫ ০৯:৪০66279
  • read the article ...I will read it again ..I will reread.. and repeat..I am trying to understand...but I must say , you are multifaceted!
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন