এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মণ

    ন্যাড়া লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ জানুয়ারি ২০১৪ | ২৪১৭ বার পঠিত
  • [ লেখাটা অন্যত্র শুরু করেছিলাম ]

    সলিল চৌধুরী আর রাহুল দেব বর্মন - মেলোডির দুই রাজা । দুজনেই কমার্শিয়াল গানের জগতে নিজেদের পেশাদার জীবন গড়ে তুলেছিলেন । অথচ সঙ্গীতের অপ্রোচে দুজনে দু পথের পথিক । সলিল চৌধুরীর আকর্ষণ জটিল সঙ্গীতিক নির্মাণে, অন্যদিকে রাহুল দেব বর্মন সুরের সহজ চলনে বিশ্বাসী । অ্যারেঞ্জমেন্টে সলিল প্রথম জীবনে ধ্রুপদী - বিশেষতঃ পশ্চিমী আঙ্গিকে, শেষের জীবনে তৎকলীন পশ্চিমী রক-পপ ঘরানার অনুসারী । রাহুল প্রথম থেকেই নিজের মতন পাঁচমিশেলি আঙ্গিক তৈরি করে নিয়েছেন । সলিল চৌধুরী যেখানে ঘন স্ট্রিংস আর বাঁশির বুনিয়াদে সঙ্গীতের প্রাসাদ গড়ছেন, রাহুল দেব বর্মনের সাঙ্গীতিক ইমারত সেখানে পার্কাশান আর গিটার ভিত্তিক ।

    কিন্তু সলিল ও রাহুল দুজনেরই কিন্তু সাঙ্গীতিক রসদের ভাঁড়ার লোকসঙ্গীত । দুজনের সঙ্গীতের মূল কিন্তু সেখানেই । তার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই মিশেছে পশ্চিমি সঙ্গীতের শ্রবণাভ্যাস । সলিলের ক্ষেত্রে পশ্চিমি ধ্রূপদী সঙ্গীত, রাহুলের ক্ষেত্রে জ্যাজ, পপ ও পরে রক । তার মানে এ অবশ্যই নয় যে দুজনেই সব ধরণের গানে অসামান্য জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলেন নি । সুমন চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় জানতে পারি নিউ ইয়র্কের কোন এক জ্যাজ ক্লাবে এক জ্যাজ সঙ্গীতকারকে সলিল জ্যাজের কর্ড প্রোগ্রেশন নিয়ে এমন ফান্ডা দিয়েছিলেন যে সেই সঙ্গীতকার স্বীকার করেন এমন ফান্ডাবাজ সঙ্গীতজ্ঞ তিনি আর দেখেননি ।

    যদি ধরে নিই যে সঙ্গীতনির্মাণ কোন গভীর মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যেখানে চেতনের থেকে অবচেতনের প্রভাব বেশি - তাহলে অবশ্যই সঙ্গীতের বাইরে আর কী কী এলিমেন্ট এই দুই ধুরন্ধর সঙ্গীত ব্যক্তিত্বর বেড়ে-ওঠা-সময়ে জীবনে প্রভাব ফেলেছিল সেটা জানা এনাদের সঙ্গীত বিশ্লেষনে প্রয়োজন হবে। অথচ এই দিকে গালগল্প যত চলে, ঠিকঠাক তথ্যের চালান তত নেই । সলিল চৌধুরীর তাও অর্ধসমাপ্ত একটি আত্মজীবনী আছে, রাহুলের তো তাও নেই ।

    এনাদের গানের একটা তুলনামূলক আলোচনা শুরু করার একটা ভাল জায়গা হল এনাদের এমন কোন গান বেছে নেওয়া যেখানে কোথাও একটা সাধারণ সূত্র আছে । সেরকম একটা গান হল সলিলের "পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী" আর রাহুলের "তুম মেরি জিন্দগীমে কুছ এইসি তরাহ সে আয়ে"। দুটি সুরই একই সুর থেকে অনুপ্রাণিত ।

    প্রথমে শুনুন সলিলের "পল্লবিনী" । গানের প্রিলিউড থেকেই অ্যাকোর্ডিয়ান আর বঙ্গোর সঙ্গত গানের উচ্ছল মেজাজ তৈরি করে দেয় ।

    http://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=HQaitde3dyY

    রাহুল তাঁর গানটি ব্যবহার করলেন "বম্বে টু গোয়া" ছবির জন্যে । গানের শুরু হচ্ছে লতার হাল্কা হামিং দিয়ে । তৈরি করছে - যাকে বলে - "সফট রোমান্টিক" মেজাজ । (যে রেকর্ডিং শুনছেন, তার প্রথম গিটার লীড পরে যোগ করা ।)

    http://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=s3gGoYM5b2A

    প্রথম থেকেই গান দুটির মেজাজের তফাত স্পষ্ট । খুব তৈরি কান ছাড়া মিল খুঁজে পাওয়া দুরূহ । কিন্তু মূল সুর শুনলে মিল পরিষ্কার হয়ে যাবে । (একবার মূল সুরের সঙ্গে 'পল্লবিনী' গুনগুন করুন, দ্বিতীয়বার 'তুম মেরে' গুনগুন করুন । দুবারই খাপে খাপ মিলে যাবে ।) মূল সুরটি চার্লি চ্যাপলিনের লাইমলাইট ছবিতে ব্যবহার করা হয়, সম্ভবতঃ চ্যাপলিনের নিজের কম্পোজিশন । এবার শুনুন মূল সুরটি -

    http://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=3S_9wiT67gs

    মুক্তছন্দের মূল সুরকে সলিল ফেললেন ৪/৪ ছন্দে, ষোলমাত্রায় । রাহুল ফেললেন ৩/৪ ছন্দে পশ্চিমি ওয়াল্টজের চলন - যা গানটির সফট রোমান্টিক মেজাজ আনতে সাহায্য করছে । সুরকারদের এটা একটা প্রচলিত কায়দা - মূলের সুর মোটামুটি এক রেখে তাল-লয় বদলে গানের অবয়ব বদলে দেওয়া। আপাতভাবে সলিল সুরের বেশি কাছাকাছি মনে হবে। যদিও হয়তো তা নয়। সলিল বিদেশী পিসের প্রথম অংশকেই নিজের গানের প্রথম লাইনে ব্যবহার করেছেন। রাহুল ডালপালা ছেঁটে সেই সুরই ব্যবহার করলেন। এটও লক্ষ্যণীয় যে, সুরের চলনে যেটুকু বিদেশী গন্ধ আছে, যেমন কিছু অ্যাক্সিডেন্টাল নোটসের ব্যবহার, সেগুলো সলিল-রাহুল দুজনেই পরিহার করলেন।

    আসলে এই দুই সুরকারই যখনই যেখানে নেবার মতন কোন মিউজিকাল এলিমেন্ট পেয়েছেন, তা সচ্ছন্দে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু নির্বিচারে নয়। নিজেদের মতন গড়ে-পিঠে নিয়ে ব্যবহার করেছেন। রাহুলের ক্ষেত্রে অভিযোগ যে বহু বিদেশি সুর তিনি "চুরি" করেছেন। এ অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই রাহুল প্রথম কয়েকটি বারের বেশি নেননি। এবং যে অংশ নিয়েছেন তাকেও নিজের মতন বদলে নিয়েছেন। সলিলও যখন মোৎজার্টের সিম্ফনির সুর ব্যবহার করছেন, তখনও কিন্ত ২/৪ কে পাঁচমাত্রা ফেলে এবং লয়ের পরিবর্তন করে অন্য রূপ দেবার চেষ্টা করছেন।

    +++++++++++++++++++++++++++++++++

    সলিল বা রাহুল কেউই খুব কড়া রাগভিত্তিক গান বানাতে পছন্দ করতেন বলে মনে হয়না । তবে যেহেতু দুজনেই মূলতঃ ছবির জন্যে গান বানাতেন, বিভিন্ন সিচুয়েশনে রাগনির্ভর গান বানাতে হয়েছে । এর বাইরে বেসিক গানে দুজনেই রাগ ব্যবহার করেছেন খুবই নিয়ন্ত্রিতভাবে, এবং প্রায় সব সময়েই রাগরূপকে প্রকট না করে ।

    রাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সলিল কিন্তু রাগের চলন বা পকড় প্রতিষ্ঠা করে দিতেন প্রথমেই। রাহুল আনতেন এক দু লাইন পরে। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। এমনকি এমনও বলতে পারি যে ব্যতিক্রমের সংখ্যা এত বেশি যে আগের মন্তব্য হয়ত করা ঠিকই নয়। তবু সেই মন্তব্যের স্বপক্ষে কয়েকটা উদাহরণ দিই।

    কলাবতী রাগকে ভিত্তি করে সলিল চৌধুরীর বেশ গুটিকয়েক গান আছে । এর মধ্যে ধরা যাক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলায় "ঝনন ঝনন বাজে" গানটি । পঞ্চাশের দ্শকে তৈরি গান। প্রথম লাইনেই কলাবতী পরিষ্কার। অন্তরাতে গিয়ে গানের চলন বদলে যাচ্ছে।

    ঝনন ঝনন -


    আরেকটা কলাবতীভিত্তিক গান, "লাল পাথর" ছবিতে সবিতা চৌধুরী আর শ্যামল মিত্রর যৌথ - "ডেকোনা মোরে ডেকোনা গো আর"। এখানেও প্রথম লাইন থেকেই রাগ চিনতে অসুবিধে হয়না।

    ডেকোনা মোরে -


    অথচ এই কলাবতী (বা মিশ্র কলাবতী) রাগে রাহুলের গান - "বল কী আছে গো" নিজের গলায়, যার হিন্দি গেয়েছিলেন মান্না দে ও লতা মঙ্গেসকর জুরমানা ছবিতে, "এ সখী, রাখিকে"। কলাবতীর চলন প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু, গানের আভোগে নয়, অন্তরায় গিয়ে - "চকিত চাহনী যেন দেখেও না দেখা"। আভোগ বা মুখড়ার দু-লাইনে রাহুল রাগকে আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখেন।

    বল কী আছে গো -


    এ সখী -


    এরকম আরেকটা উদাহরণ শিবরঞ্জনী রাগে। সলিল করলেন "ধরণীর পথে পথে আমিও পৌঁছে যাব"। গাইলেন একবার সুবীর সেন, একবার লতা মঙ্গেশকর। প্রথম থেকে শিবরঞ্জনী প্রতিষ্ঠিত। এবং সলিলের যা রীতি, অন্তরাতে গিয়ে রাগ গৌণ, সলিলের সুর মুখ্য হয়ে পড়ল।

    ধরণীর পথে পথে - সুবীর সেন


    রাহুল মিশ্র শিবরঞ্জনীতে করলেন "মেরে নয়না সাওন ভাদো" - মেহেবুবা ছবির জন্যে কিশোরকুমার আর লতা মঙ্গেশকর আলাদা দুটি গান গাইলেন। এখানে পকড়ের ছবি পাওয়া যাচ্ছে, পাশ্চাত্য রক-পপে যাকে গানের হুক বলে সেই অংশে, দ্বিতীয় "ফির ভি মেরা মন পেয়াসা" উচ্চারণে। গানের প্রথমেই নয়।

    মেরে নয়না - কিশোরকুমার


    এবার উল্টোদিকে - শেষ জীবনে (১৯৯০ সালে) করা গান, নন্দ বা আনন্দী কল্যাণ রাগে হৈমন্তী শুক্লা গাইলেন, "মন বন পাখী চন্দনা"। প্রথম লাইনের নন্দবাবুকে চিনে নেওয়া গেল।



    রাহুল মিশ্র নন্দ রাগে করলেন "যেতে দাও আমায় ডেকোনা"। এখানে বরং প্রথম লাইনে নন্দবাবুকে ধরা যায় কিছুটা।

    যেতে দাও আমায় -


    সলিল চৌধুরী করলেন অন্তরা চৌধুরীর জন্যে বেহাগ-আশ্রিত "না দির দির দা, তুম না তুম, নাচ তো দেখি আমার পুতুলসোনা", প্রথম লাইন থেকে বেহাগ খুলে পড়া যায়।

    না দির দির দা -


    যেমন যায় প্রায় একই সময়ে করা - সত্তরের দশকের প্রথম দিকে - "আপ কি কসম" ছবির জন্যে রাহুলের সুরে কিশোরকুমারের "জিন্দেগীকে সফর মেঁ গুজর যাতে হ্যায়" গানে।

    জিন্দগীকে সফর মেঁ -


    আগেই যে বললাম, খুব কড়া রাগভিত্তিক গান তৈরি করতে কি সলিল, কি রাহুল, কেউই পছন্দ করতেন না। কিন্তু ছবির সিচুয়েশন অনেক সময়ই রাগভিত্তিক গানে চেয়েছে। সেরকম ক্ষেত্রে এনারা রাগের পরিসীমার মধ্যে থেকেই যতটা সম্ভব নিজেদের সাঙ্গীতিক উদ্ভাবনী দেখিয়েছেন। এমনই একটি গান - সলিলের বিখ্যাত হংসধ্বনী, "যা তোসে নহি বলুঁ কানহাইয়া"। একদম রাগদারী গান, প্রথম লাইন থেকেই।



    এ গানেরই বাংলা করলেন শেষ জীবনে, গাওয়ালেন হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে -



    রাহুল এমতাবস্থায় বহুবার বাবার খজানায় হাত বাড়িয়েছেন - যেমন কিনারা ছবিতে "মিঠে বোলে বোলে" শচীনের বিখ্যাত বাংলা ভৈরবী "মধুবৃন্দাবনে দোলে রাধা"-কে ফিরিয়ে আনে।

    মিঠে বোলে বোলে -


    মধুবৃন্দাবনে -


    অথবা ইজাজত ছবির "খালি হাত শাম আয়ি হ্যায়" গানে ফিরিয়ে আনলেন কর্তার "মালাখানি ছিল হাতে" গানের বন্দিশ।

    খালি হাত -


    মালাখানি -


    অথচ এমনটা নয় যে বাবার খজানা ছাড়া এই ধরণের সিচুয়েশনে রাহুলের কোনরকম অসুবিধে হত। অমর প্রেম ছবিতে "রহনা বীত যায়" কি "কুছ তো লোগ কহেঙ্গে" অথবা "বড়া নটখট হ্যায় ইয়ে" গানেই তার প্রমাণ। অথবা পরিচয় ছবির "বিতি না বিতায়ি রহনা"।

    বিতি না বিতায়ি -


    "বড়া নটখট" সম্বন্ধে গল্প চলে যে সাধাসিধেভাবে রাগের চালু বন্দিশে ফেলে কাজ সারতে চেয়েছিলেন রাহুল। বাবা বর্মন নাকি ছেলে বর্মনকে কড়কানি দেন এই বলে যে, এই গানে তুমি কী যোগ করলে? যে কোন সঙ্গীত পরিচালকই তো রাগে ফেলে এই গান বানাতে পারে। এই ধাঁতানির পরে শোনা যায় রাহুল গানটিকে খাম্বাজে রেখে নতুন করে সাজান। শেষ পর্যন্ত যে গানটি দাঁড়ায় সেটি এই -

    বড়া নটখট -


    +++++++++++++++++++++++

    আগেই বলেছি সলিলের আকর্ষণ সুরের জটিল বিন্যাসে। রাহুল সে তুলনায় অনেক সহজপন্থী। "ফুলে গন্ধ নেই" কিংবা "পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়" (বাংলা - গুণ গুণ গুণ কুঞ্জে
    আমার) সহজ মেজর কর্ডের নোট প্যাটার্ন দিয়ে শুরু হয়। বলছি না যে রাহুলের সব, এমনকি বহু সুরই, এমন সরল। কিন্তু সহজ গাণিতিক সুর করতে রাহুল পেছপা হতেন না। সলিলও অনেক ক্ষেত্রে গাণিতিক - কিন্তু সে হায়ার ম্যাথেমেটিক্স। গাণিতিক সুর বলতে কী বলতে চাইছি সেটা পরিস্কার করে দিই। যদি সুরের ফ্রেজগুলো মূলতঃ চালু কর্ডের (মেজর, মাইনর ইত্যাদি) নোট ফলো করে, ফ্রেজগুলো যদি চালু কর্ড প্রগ্রেশন মেনে ট্রানসপোজড হয়ে (এক, চার, পাঁচ - যেমন সি মেজর, এফ মেজর, জি মেজর ইত্যাদি), তাহলে তাকে গাণিতিক সুর বলছি। সহজ গাণিতিক সুরের চালু উদাহরণ - "ইন্দি-বিন্দি-সিন্দি"। সুরের এই চলন, বোঝাই যায়, খুবই পশ্চিমি।

    সলিলের সুরের আরেক বৈশিষ্ট্য নোটেদের লাফালাফি। এই রয়েছে তার সপ্তকের সা-তে, এই লাফ দিয়ে নেবে এল মধ্য সপ্তকের রে-তে। নীচু থেকে উঁচু নোটে লাফ দিয়ে যাবার উদাহরণ তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য। উল্টোদিকের উদাহরণ, উঁচু থেকে নীচে লাফ দিয়ে নাবা - সে বরং অনেক কম। রবীন্দ্রনাথে পাই, "যেতে যেতে একলা পথে" গানে "ঝড়কে পেলেম সাথী" লাইনে সা-থী শব্দের সুরে। একেই চার-পাঁচ দিয়ে গুণ করলে পাবেন সলিলের "ও ঝর ঝর ঝরণা, ও রূপালী
    বর্ণা" বা "ও বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়" ধরণের গান। লাফ দিয়ে চলা সুর খুব পশ্চিমি ব্যাপার। অনেকদিন আগে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে দার্ঢ্য আনতে শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন সুরের এই উল্লম্ফনকে।

    সলিল-রাহুল এই দুজনের সুরেই তাই পশ্চিমি ছায়া স্পষ্ট। দীর্ঘদিন আগে, গণনাট্য সঙ্ঘ যুগে, ঠিক এই নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে সলিল চৌধুরীর এক বিখ্যাত তর্ক হয়েছিল।
    হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্তালিনের বক্তব্য "নতিওনল ইন ফোর্ম, সোিঅলিস্ত ইন োন্তেন্ত" হতে হবে। এই গান যারা শুনবে, শুনে উদ্বুদ্ধ হবে তারা
    মাটির কাছের মানুষ। তাদের কাছে দেশজ সুরের মাধ্যমে মেসেজ পৌঁছবে তাড়াতাড়ি। গানের সুরের এই পশ্চিমি চলন তাঁর একেবারেই না-পসন্দ ছিল। সলিল চৌধুরীর বক্তব্য ছিল যে তাঁরা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তারা ফর্মের দিক থেকে অন্ত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়েছেন। যেমন আধুনিক কামান-বন্দুকের মতন যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে টাঙি-বল্লমের মতন দেশজ
    অস্ত্র দিয়ে লড়াই চালান যায় না, তেমনি গানের লড়াইও করতে হবে যেখানে যেরকম আধুনিক উপায় আছে - সে সব ব্যবহার করে। পশ্চিমি চলনে বাঁধা গান সুন্দরবনের প্রত্যন্তে
    মানুষ শুনছেন, উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

    এই তর্কের মধ্যে রাজনীতির অংশ ছেড়ে দিলেও দেখব যে এই পশ্চিমি অনুপ্রেরণা, পশ্চিমি চলন, পশ্চিমি নকলনবিশির ভূত তাড়া করে বেরিয়েছে সলিল-রাহুল - দুজনকেই। অবস্থা এমনই হয়েছিল যে "সুরসিঙার" নামে একটি বিখ্যাত সংস্থার অতি নামী পুরস্কার যখন রাহুল দেব বর্মন তাঁর "ও গঙ্গা মাইয়া" গানের জন্যে প্রায় পেয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সংস্থার কর্ণধারদের মাথায় হাত পড়ে যায়। কেননা, ঐ সংস্থা ও পুরস্কার ভারতীয় বনেদী সঙ্গীতের জন্যে উৎসর্গীত। রাহুল দেবের মতন একজন পশ্চিমি লারেলাপ্পাপন্থী কী করে সেই পুরস্কার পেতে পারেন, সে তাঁর একটি গান যতই ভাল হোক না কেন। এ তো গরহিত অপরাধ। সে যাত্রায় অব্শ্য ভারতীয় সংস্কৃতির অতলস্পর্শী পতন শেষ মুহুর্ত্যে রক্ষা করা গিয়েছিল রাহুলের বদলে অন্য এক সঙ্গীত পরিচালককে পুরস্কার দিয়ে।

    তো যা বলছিলাম - যেহেতু সলিলের সুরে জটিলতা, সলিলের প্রয়োজন ছিল অনুশীলিত গলার।বম্বে যাবার পরে, এবং লতা মঙ্গেশকর নামের গান্ধর্বীর সঙ্গে কাজ শুরু করার পরে সলিল
    হাত খুলে সুর করতে পারলেন। যদিও সলিল বহু আনট্রেন্ড গলার সঙ্গে কাজ করেছেন। সলিল-হেমন্ত জুটি তো কিংবদন্তী। অবশ্য সলিল জনান্তিকে মন্তব্য করেছেন হেমন্তর জন্যে নিজের বহু সুরকে সরল করতে হয়েছিল। এ বক্তব্যে হালকা আক্ষেপ থাকলেও মনে রাখতে হবে হেমন্তর কন্ঠমাধুর্যের - গলার টিম্বারের - খুব ভক্ত ছিলেন সলিল। বলেছিলেন ঈশ্বরের
    গান গাইতে ইচ্ছে হলে তিনি হেমন্তর গলায় গান করেন। এছাড়াও সময়ে সময়ে চিত্রতারকা বিশ্বজিৎ থেকে তৎকালীন মাচার উঠতি জুটি কার্তিককুমার-বসন্তকুমারকে দিয়ে গান করিয়েছেন সলিল। তা সত্বেও দেখছি জীবনের প্রথম দিকে সলিলের গান গাইছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, উৎপলা সেনরা। মৃণাল চক্রবর্তীর লেখায় আক্ষেপ দেখি পয়সার জন্যে "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" মৃণাল না পেয়ে পেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ কথা যদি সত্যিও হয় (মিথ্যে ভাবার কোন কারণ নেই), তাহলেও বলতে হয় সন্ধ্যার ট্রেনড ভয়েস গানটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে যায়, মৃণালের গলায় গানটা সে উচ্চতায় উঠত কিনা জানা নেই। যদিও মৃণালেরও যথেষ্ট ট্রেন্ড গলা, কিন্তু সন্ধ্যার অনুশীলন সেখানে নেই।

    রাহুলের প্রয়োজন ছিল ভোকাল ক্যালিস্থেনিকসের। যা তিনি পেয়ে গেছিলেন কিশোরকুমার আর আশা ভোঁশলের গলায়। এবং ষাটের দশকের মান্না দে-তে। এমনকি এও শোনা যায় রাহুলের যুগান্তকারী "মেহবুবা মেহবুবা" গানটি আদতে মান্নাবাবুর গাইবার কথা ছিল। মান্না দে-র বম্বেতে নাম ও পসার রাগগন্ধী ভারী গান গেয়ে। রাহুল মান্নাকে দিয়ে যেমন "বুডঢা মিল গয়া" ছবিতে খাম্বাজে "আয়ো কহাঁসে ঘনশ্যাম" গাইয়েছেন, তেমনি - বরং তার অনেক আগে মেহমুদের "ভূত-বাংলা"-র জন্যে গাইয়েছেন "আও টুইস্ট করে" - যাতে
    মান্না দেখিয়েছিলেন ভোকাল ক্যালিস্থেনিক্সে তিনিও কম যান না। বোধহয় এই ভোকাল ক্যালেস্থেনিক্সের কারসাজি না দেখাতে পারার কারণে রফি সাহেব রাহুলের গানে বঞ্চিত
    হন জীবনের শেষের বছর দশেক। রাহুলের দলে যিনি গিটার বাজাতেন, ভূপিন্দর সিং গাইয়ে হিসেবে শুধু আবির্ভূতই হন না, "বিতি না বিতায়ি"-র মতন গানে লতাবাঈয়ের সঙ্গে প্রায় রফি-সম টক্কর দিয়ে যান। এর বাইরে রাহুলের সব রকম
    পুরুষকন্ঠের প্রয়োজনে কিশোরকুমার প্রায় ওয়াইল্ড কার্ডের - বা মাস্টারকার্ডের - মতন ব্যবহৃত হন। ফর এভরিথিং এলস দেয়ার ইজ কিশোরকুমার।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ জানুয়ারি ২০১৪ | ২৪১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • anandaB | 154.160.130.16 (*) | ২০ জানুয়ারি ২০১৪ ০৮:৫৬74121
  • আগের পোস্ট তা উড়ে গেল, ফলে আর একবার চেষ্টা করি :(

    "বল কি আছে গো" কোথায় একটা পরেছিলাম "মধ কল্যাণ" রাগাশ্রয়ী, পরে রাগ শুনে ধারণা কিছুটা পাকাপোক্ত-ও হয়

    কিন্তু ন্যাড়া বাবুর কথাও উড়িয়ে দিতে সাহস হয় না, ওদিকে মিশ্র কলাবতী-ও ঠিকঠাক কোনদিন সুনি নি, সব মিলিয়ে টোটাল confused

    তবে শেষ বিচারে কি-ই বা আসে যায়, ভালো লাগাটাই তো আসল, অন্তত প্রাথমিক শর্ত তো বটেই (অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত মতামত )
  • lcm | 118.91.116.131 (*) | ২০ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:৩৮74122
  • কাঁপাকাঁপি, ন্যাড়া ফুল ফর্মে। আরো চাই।
    প্রথম উদাহারণ-টা অসাধারণ।
  • PM | 181.6.226.206 (*) | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ০২:০৪74127
  • দারুন লেখা। খুব ভালো লাগলো।

    SD র ব্যবহৃত বহু ব্যাক্গ্রাউন্ড মিউসিক এর পিস এর ওপোর বেস করে RD র গানের মুখরা হতে শুনেছি। এক্খুনি মনে করতে পারছি ন যদিও।

    অবশ্য জানি না ঐ ব্যাক্গ্রাউন্ড মিউসিক গুলো RD র ই করা কিনা। কারন ঐ সময় উনি SD কে অ্যাসিস্ট করতেন।
  • b | 135.20.82.164 (*) | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ০৩:২১74123
  • ন্যাড়াসার অনেকদিন পরে। আরো চাই।
  • কল্লোল | 111.63.204.0 (*) | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ০৩:৪৮74124
  • বড় অল্প হইল।
    এটার দ্বিতীয় কিস্তি চাই। এবারে এঁদের প্রিল্যুড-ইন্টারল্যুড নিয়ে। এঁদের কেউ কি কোডা লাগিয়েছেন? আমার মনে পড়ছে না।
    ন্যাড়া জ্জিও।
  • anandaB | 154.160.130.16 (*) | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ০৫:১৯74128
  • ঠিক ঠিক, মধ কল্যাণ আর কলাবতী-র চলনে প্রচুর মিল, ইন ফ্যাক্ট উস্তাদ সালামত আলীর শেষ বয়েসের গাওয়া কিছু বন্দিশ শুনলে ফারাক ধরতে খুব কষ্ট হয়

    ভেবে দেখলাম ঠিক রাগাশ্রয়ী বলাটাও বোধহয় যুক্তিযুক্ত নয়, রাগের ছোঁয়া আছে বলাটাই নিরাপদ :)

    এরকম-ই আর একটা উদাহরণ "ঘুংরু কি তারা বাজতা হি রাহা হু"


    বোধহয় বছর তিরিশেক আগে (মিড-৮০'স) কলকাতা দূরদর্শনে একটা গানের অনুষ্ঠান হত, অন্য সব কিছু ভুলে গেছি শুধু মনে আছে সেটার-ই কোনো একটা এপিসোড-এর শেষে এই গান টা কোন রাগ-এর ওপর এরকম একটা প্রশ্ন ছিল, দাদা instantly বলল কলাবতী, আর আমি বেঁড়ে সদ্য সদ্য "গুলো মে রংগ ভরে" শুনেছি, ফলে না ভেবেই বলে দিলাম jinjhoti (রাগ-এর নাম টা বাংলায় লিখতে পারলাম না ঠিকমত), উত্তাল বাওয়াল হল আমাদের মধ্যে। পরে যখন সঞ্চালক এসে সত্যি সত্যি jinjhoti বললেন দাদা হেভি খচে গেল আমার ওপর :)
  • ন্যাড়া | 172.233.205.42 (*) | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ০৭:০৫74125
  • কেলো করেছে। আমার রাগ-টাগ সম্বন্ধে ফান্ডা প্যাটার্ন ম্যাচিং দিয়ে। সেই দিক দিয়ে 'বল কী আছে গো"-কে কলাবতীতে ফেলেছি। আগে "মধ কল্যাণ" শুনিনি। এখন শুনলাম। শুনে অবশ্যই মিল পাচ্ছি "বল কী"-র সঙ্গে। তবে কলাবতীকেও ছাড়তে পারছি না।

    অন্য গুণীরা কী বলেন?
  • সুকান্ত ঘোষ | 212.160.18.32 (*) | ২১ জানুয়ারি ২০১৪ ১১:০০74126
  • ন্যাড়াদার লেখা খুবই ভালো লাগে - অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায়। গুণী ব্যক্তি
  • | 127.194.83.93 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ০২:৩৪74134
  • ন্যাড়া দা খুব ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম। থ্যাঙ্কু। ঃ))
  • jhumjhumi | 127.194.232.141 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ০৩:০৫74135
  • মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর "না যেয়ো না মধুযামিনী" গানটিও হংসধ্বনি রাগের উপর । 'যা তোসে না বোলুঁ' এর সাথে ভীষণ মিল।

    খুব ভালো লাগছে, অনেক কিছু জানতে পারছি।
  • PM | 181.6.226.206 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ০৪:১৮74136
  • "ভোকাল ক্যালিস্থেনিকস" ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেবেন ন্যাড়াদা?
  • ন্যাড়া | 172.233.205.42 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ০৬:৫৪74129
  • নতুন পোস্টে লাইন-টাইনগুলো ঘেঁটে গেল। যাকগে!
  • kc | 204.126.37.78 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ০৭:১৬74130
  • লেখাটা ভাল হচ্ছে। কিন্তু এধরণের জিনিস, লেখা পড়ে মজা আসেনা। পড়তে পড়তে গানগুলো শুনতে গেলেই গানে ঢুকে পড়ছি সেখান থেকে অন্য গানে ক্লিক করছি। কিছু পরে খেয়াল হচ্ছে আরে আমি তো একটা লেখা পড়ছিলাম। এই করে কন্টিনিউয়িটি থাকছেনা আমার কাছে, না লেখার না গানের। আসলে সাবজেক্টটাই এরকম, আড্ডার সাবজেক্ট, গল্প করার সাবজেক্ট। একমুখি লেখা সেই মজাটা আনছেনা। তার জন্য লেখক কোনওভাবেই দায়ি নন। সাবজেক্টটাই এরকম। শুধু পড়ে গেলে মনে হচ্ছে লেখক কত জানেন, যদিও লেখক আদৌ সেটা জানাতে চাইছেন না।

    আটভাট টাইপ করে গেলাম। আর টাইপই যখন করলাম সাব্মিটও করে দিই।
  • ন্যাড়া | 172.233.205.42 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ০৭:২২74131
  • গুড পয়েন্ট। আমি দেখতে চাইছিলাম সঙ্গে গানগুলো দিলে ডিসট্র্যাক্শন হয় না ভ্যালু অ্যাডিশন হয়। তুই বলছিস ডিসট্র্যাকশন হয়। পরে গান কাটিয়ে দিলাম স্রেফ এই কারণে যে ইউটিউব লিংক থাকলে পেজ লোড হতে অসীম সময় লাগে। তবে লিখতে লিখতে এও বুঝছি সুরের আলোচনা লিখে করা কী অসম্ভব।
  • একক | 24.99.122.205 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:৫৪74132
  • হুহু পড়ে যাচ্ছি । আরও চাই ।
    গান না দিলে তো রেফারেন্স পাওয়া যাবেনা :( রেফারেন্স এ ঢুকে পাঁচটা জিনিস দেখে ফিরে আসা আমাদের সবারই কম বেশি অভ্যেস । লেখার টানেই ফিরে আসবো আবার ।
  • khilli | 131.241.218.132 (*) | ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ১১:২৭74133
  • http://www.thehindu.com/features/metroplus/article2771739.ece
    S.D. Burman and Salil Chowdhury apparently used to enjoy it whenever R.D. Burman declared Salil Chowdhury his musical guru, and not his father. Salil Chowdhury used to rebuke his student, and an apologetic R.D. Burman would look to his father for rescue, who would promptly bless his son and son's ‘guru'.

    অসাম শালা হচ্ছে
  • | 127.194.87.26 (*) | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ০২:৪৩74142
  • জ্জিও শিংবাংশু দা মার্কেটে এসে গেছে। সত্যি গুরু তে এসে এগুলো ই প্রাপ্তি। ঃ))
  • কল্লোল | 125.242.252.162 (*) | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ০৫:৩৪74137
  • এরকম একটা পেলাম।
    একধরনের কন্ঠস্বরের ব্যয়াম। তবে বিশদ করতে পারে ন্যাড়াই। আমার এ বিষয়ে কোন ফান্ডা নাই।
  • ন্যাড়া | 172.233.205.42 (*) | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ০৬:২৬74138
  • ভোকাল ক্যালিস্থেনিক্স বলে সত্যি কিছু আছে জানতাম না। আমি বোধহয় কোথাও টার্মটা পড়ে নিজের মতন মানে করে নিয়েছি। বলতে চেয়েছি গলাকে নিয়ে যা খুশি করা - অ্যাক্রোব্যাটরা যেরকম নিজেদের শরীর দুমড়ে-মুচড়ে যা খুশি প্রায় করতে পারেন। যেমন উদাহরণ হিসেবে ধরুন এই ক্লিপটায় ৪৫ সেকেন্ড থেকে ৬০ সেকেন্ড মার্কারে মান্নাবাবু গলার যে কারসাজি করছেন -

  • শিবাংশু | 127.201.149.32 (*) | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ০৭:৪৭74139
  • লেখাটি পড়ছি ।

    আমাদের গানে 'ভোক্যাল ক্যালিস্থেনিক্স' দুভাবে আসে । এক দেশি ঢং, অপরটি বিদেশি ঢং । দেশি ঢংটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রশিক্ষণের অঙ্গ , বাংলায় যাকে ভয়েস ট্রেনিং বলা হয় । বিভিন্ন ঘরানায় এর গুরুত্ব কমবেশি হয় । যেমন পটিয়ালা ঘরে এর গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু কিরানায় ততোটা নয় ।

    আবার বিদেশি ঢঙে হার্মনি-সিম্ফনি, কর্ড বদল-তার ওঠানামা ইত্যাদিকে গায়ক কতোটা নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারছেন তাঁর উপর সাফল্য নির্ভর করে । প্রথম ঢংটিতে মান্না বা রফিসাহেব সিদ্ধ । তাঁদের সেই তৈয়ারি দিয়ে তাঁরা অন্য ঢঙের ভূতবাংলা বা জংলিও সামলে নেন। সেটা আশাও করেছেন । একটা সাক্ষাৎকারে তিনি ছোটোকত্তার বেটনে ক্যারাভানের গান রেকর্ড করতে গিয়ে যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন তার কথা উল্লেখ করেছিলেন। যদিও ওম্কারপ্রসাদ নইয়ার আর রামচন্দ্র চিতলকরের ট্রেনিঙের সুবাদে তিনি দ্বিতীয় ঢংটিতে মোটামুটি স্বচ্ছন্দ ছিলেন । অন্যদিকে অন্নদাতার গান রেকর্ড করতে গিয়ে কিশোরের সলিলের পায়ের কাছে বসে মহলা দেওয়ার গপ্পো-ও তো সবাই জানেন । এর মূল রহস্যটি হলো মেলোডির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা । সলিল বা ছোটোকত্তা সুরজগতের আকাশ-পাতাল তোলপাড় করেও শেষ পর্যন্ত দিনশেষে মেলোডির গৃহকোণেই প্রদীপটি জ্বেলে দেন । আসলে প্লেব্যাক গানের গোটা শাস্ত্রটাই একেবারে আলাদা । 'ভালো' সুরকার বা গায়ক হলেই সফল প্লেব্যাক শিল্পী হওয়া যায়না। অজয়বাবু বা রাশিদ যখন নেপথ্যে মাঝে মাঝে সলিল বা ছোটোকত্তার কম্পোজিশন গেয়ে থাকেন, তখন এই সত্যটি টের পাওয়া যায়।

    প্লেব্যাক গানের সুরকে কোনও বিশেষ শাস্ত্রীয় রাগের খাঁচায় ধরে চিণ্হিত করা কিঞ্চিৎ বিড়ম্বনাকর । তবে এটা একটা বেশ লোকপ্রিয় ব্যসন । আমিও করে থাকি । হয়তো এর পিছনে বিভিন্ন হিন্দুস্তানি রাগ ও তার সুরের সঙ্গে জড়িত নানা প্রেজুডিস, যা আমাদের শ্রবণ অভ্যেসের সঙ্গে ওতোপ্রোত, একটি কারণ হতে পারে । রাগাবলীর টাইম স্কেল, মেজাজ, ঋতুনির্ভরতা ইত্যাদি পরিচিত পূর্বাগ্রহ কাজ করে এই জাতীয় নির্বাচনে ।

    গানবিশেষের উল্লেখ করে তার লিংটি যদি সংযোজিত করা হয় তবে বহু শ্রোতার জন্য তা বেশ উপাদেয় বোধ হবে । কারণ হাতে গরম 'মিলিয়ে নেওয়ার' একটা সুযোগ পাওয়া যায় । প্রয়াসটি স্বাগতযোগ্য । কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আরো কিছু শ্রোতার মতো আমার কাছে এই সব মণিমুক্তো সহস্রবার শুনে ফেলার ফলে এখন পারসেপশন স্তরে পৌঁছে গেছে, তাই হয়তো আরেকবার কানে শোনার প্রয়োজন বোধ করিনা। :-)

    গান বিষয়ে ন্যাড়ার ভাবনাচিন্তার সঙ্গে কখনও অন্যমত হইনি, তাই তাঁর লেখা নীরবে পড়তেই উপভোগ করি। উপরের প্রলাপটিকে মূল লেখাটির সংযোজন হিসেবেই দেখা ভালো ।
  • কল্লোল | 125.244.239.22 (*) | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:২৭74140
  • আহাহা। এই হলো গুরুচন্ড৯। এ যেন আলি আকবরের বোলবাটের মধ্যে বিলায়েৎএর তানকারী।
    ন্যাড়া-শিবাংশু যুগলবন্দী জিন্দাবাদ।
    ইচ্ছে ছিলো, খুব ইচ্ছে ছিলো, হয় ন্যাড়ারে হায়দ্রাবাদে নয় শিবাংশুরে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে এসে একটা ঘরে প্রচুর সিডি দিয়ে তালা বন্ধ করে আমি টিকিটিকি হয়ে সেই ঘরের দেওয়ালে লেপ্টে থাকি। তা আমার কি আর সেই ভাগ্য রে ভাই। একটা গেলো ভুবনেশ্বর, তাও আশা ছিলো, অন্যটা গেলো আম্রিগা। ভালোবাসাআআ গেলো।
  • শিবাংশু। | 127.201.149.32 (*) | ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:৩৩74141
  • আমার বহুদিন আগের একটা লেখা যেটা প্রথমে ওপাড়ায় লিখেছিলুম, পরে এপাড়ায় অন্য একটা টইতেও পত্রস্থ হয়েছিলো । ন্যাড়ার অনুমতি সাপেক্ষে আরেকবার কল্লোলদার সংযোজনসহ এখানে ফেলছি। ছোটোকত্তাকে কখনও দেখিনি, কিন্তু তাঁকে একজন আত্মীয়ের মতো মনে হয় । তাই প্রিয়জন প্রসঙ্গ মনে করে আরেকবার তাঁকে নিয়ে আমার এই অকিঞ্চিৎকর লেখাটি ( অনেক চন্ডালের পড়া, কিন্তু মনে হয় এখনও খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক নয় ) এখানে রইলো । সহৃদয় বন্ধুরা প্রগলভতার ত্রুটি মার্জনা করবেন ।
    ---------------------------------------------------

    প্রিন্স ও প্রতিবিম্বের পিঞ্জর ...
    -----------------------------

    'মেরা কুছ সামান, তুম্‌হারে পাস পড়া হ্যাঁয়'

    ১৯৭০ সালে 'সরগমের নিখাদ' রচনার সময় শচীন কত্তা অনুলেখক সলিল ঘোষকে বলেছিলেন বলেছিলেন " আমাদের একমাত্র সন্তান শ্রীমান রাহুলের জন্ম হয় ১৯৩৯ সালের ২৭শে জুন। শিশুকাল থেকেই গানবাজনার উপর রাহুলের অসাধারণ ঝোঁক দেখে ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের কাছেই ওর সরোদ শেখার ব্যবস্থা করে দিলাম, কলকাতাতে। পরে যখন চলচ্চিত্রের সুরসংযোজনায় ওর ইচ্ছা লক্ষ্য করলাম, তখন ওকে নিয়ে এলাম বম্বেতে ১৯৫৯ সালে। আমার সহকারীরূপে হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত রচনায় ওকে তৈরি করতে লাগলাম। এখন রাহুল বম্বেতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সুনামও অর্জন করেছে। তরুণদের কাছে তার সঙ্গীত রচনা খুবই জনপ্রিয়। এখন সে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেই নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করছে।'

    মনে রাখতে হবে ততোদিনে পঞ্চম ( অশোককুমারের দেওয়া নাম) সতেরোটি ছবিতে সুর দিয়ে ফেলেছেন। যার মধ্যে আছে, ছোটে নওয়াব, তিসরি মঞ্জিল, ভূত বাংলা, বহারোঁ কে সপনে, অভিলাষা, পড়োশন, প্যার কা মৌসম, ওয়ারিশ, এহসান, কটি পতঙ্গ, ট্রেন। হিন্দি চিত্রগীতির যাবতীয় ধ্যানধারণাকে স্থায়ীভাবে পাল্টে দেওয়া সব কম্পোজিশন। আর বাংলা 'আধুনিক' গানের জগতকে বদলে দেওয়া রচনা, যা শুরু হয়েছিলো ১৯৬৬ সালে পুজোর গান থেকে। কিশোর কুমার গেয়েছিলেন, 'একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে' আর ' আকাশ কেন ডাকে' তাও ছিলো । যদিও তিনি দীর্ঘদিন ধরেই, প্রায় প্রথম কৈশোর থেকে, পিতৃদেবের সঙ্গীত পরিচালিত ছবিতে সক্রিয়ভাবে নির্মাণ করে যাচ্ছিলেন অনবদ্য সব সুর আর আবহসঙ্গীত। মূলত দেব আনন্দের ছবিগুলি, যেমন গাইড, জুয়েল থিফ বা শক্তি সামন্তের আরাধনা ইত্যাদি। ছ'সাত বছর বয়েস থেকে আমাদের সুরের কান তৈরি হচ্ছিলো এইসব জাদুমন্ত্রের মতো গান শুনতে শুনতে। সেই বাবাকে লুকিয়ে শোনা বিনাকা গীতমালা, শর্ট ওয়েভে ভেসে যায়, হারিয়ে যায়, ভাসিয়ে দেওয়া সুরের বিলোল ধারার সুবর্ণরেখা।
    ******************************
    মজরুহ সুলতানপুরিকে তিনি বলেছিলেন, ' বাবা বিরাট বড়ো সুরকার, কিন্তু আমার পথ আলাদা।' শচীনকত্তা চিন্তায় ছিলেন পঞ্চম বড্ডো বেশি পশ্চিমি ঢংয়ে সুর করছে, বড্ডো বেশি আলাদা। মান্না দেকে বলতেন, তুই তো পঞ্চমের অন্ধ ভক্ত। ওকে বোঝা। মান্না কী বোঝাবেন তাঁকে, যার কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন, একদিকে 'আও টুইস্ট করেঁ' আবার অন্যদিকে 'আয়ো কহাঁ সে ঘনশ্যাম'। নৌশাদ 'ভূতবাংলা', 'ছোটে নওয়াব' শুনে বলেন, 'বড়ে মিয়াঁ তো বড়ে মিয়াঁ, ছোটে মিয়াঁ শুভানাল্লা'। পারফেকশনিস্ট সলিল চৌধুরি বলেন, হিন্দি ছবিতে গত কুড়ি বছরের মধ্যে পঞ্চমই একমাত্র ফেনোমেনন। কতো লোকেই তো কতো অপার গুণগান করেছে তাঁর। কিন্তু সবাই, আপনি আমি সবাই, তাঁকে বন্দি করতে চেয়েছি একটা প্রতিবিম্বের খাঁচায়। পঞ্চম তো আসলে পশ্চিমি সুর, তাল, ছাঁদ, পরিবেশনের ওস্তাদ। বাকি যা কিছু তা শুধু কথার কথা।
    *********************************

    এনিয়ে তো বিশদ গবেষণাপত্র লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এখানে তা আঁটবে না। তবু বলি, তাঁর প্রথম ছবি 'ছোটে নওয়াব'য়ে কেউ কি ভুলতে পারবে মালগুঞ্জি রাগে লতার কণ্ঠে'ঘর আজা ,ঘির আই', তাঁর উনিশ কুড়ি বছরের রচনা। বা জোগিয়া রাগে সেই লতার কণ্ঠে 'চন্দন কা পলনা' তে 'ও গঙ্গা মাইয়া'? এই গানটি সুর শিঙ্গার সংসদের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় মনোনয়ন পেয়েছিলো। 'বহারোঁ কে সপনে' ছবিতে নন্দ রাগে ' ও মোরে সাজনা ও মোরে বালমা' মনে পড়ে। আবার 'পড়োশনে' 'এক চতুর নার'য়ের সমকক্ষ রচনা হিন্দি ছবিতে আমরা কটা পেয়েছি? এই ছবিতেই খমাজ রাগে ' শর্ম আতি হ্যাঁয় মগর আজ য়হি কহনা হোগা' ,.... ক্যা নজাকত থি উসমে, হায়, হায় !!( বাংলায় ঠিক এলোনা, মাফ করবেন)। শচীন কত্তার ব্যাটা, আলি আকবরের চ্যালা শুধু 'তরুণ'দের জন্য 'সস্তা' পপ গানেই ফুরিয়ে যাবে? এতো অবিচার ধরণী সইবে কী করে?
    **********************************

    'অমর প্রেম' বা 'কটি পতঙ্গ' তো বলছিই না। রাগ তোড়ি আর খমাজ মেলানো 'রয়না বীতি যায়' বা উস্তাদ আমজাদ আলি খাঁয়ের মতে সর্বকালের একটা শ্রেষ্ঠ ভৈরবি রচনা ' চিঙ্গারি কো ই ভড়কে', তার সঙ্গে খমাজে ' কুছ তো লোগ কহেঙ্গে' বা মিশ্র কলাবতীতে ' ইয়েহ ক্যা হুয়া'। একটা প্রায় ঘরোয়া বৈঠকে পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীকে বিভোর হয়ে এই রচনাগুলি গাইতে শুনেছি। তা নিশ্চয় কিশোর কুমারের থেকে একেবারেই আলাদা, কিন্তু সুরকার পঞ্চমকে নতুন করে চেনায়। কে ভুলবে মিশ্র সোহিনিতে ' ন কো ই উমঙ্গ হ্যাঁয়'। শিবরঞ্জনীতে, 'মেরে নয়না শাওন ভাদো' বা খমাজে 'আয়ো কহাঁ সে ঘনশ্যাম'। আরও কতো, অসংখ্য, অগনিত, এ ধরনের রাগভিত্তিক রচনা, রাত ফুরিয়ে যাবে, ' জিয়া ন লাগে মোরা', 'পিয়া বাওরি', বীতি ন বিতাই রয়না' .... !!!
    **************************************
    আবার একেবারে ষাট দশকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলিকে প্রায় ম্লান করে দিয়ে অগণন সজল মেলোডির নির্মান করে গেছেন ক্লান্তিহীন ভাবে। 'পড়োশন'এর 'কহনা হ্যাঁয়, কহনা হ্যাঁয়' থেকে শুরু করে 'কটি পতঙ্গ'এর ' য়েহ জো মুহব্বত', প্যার দিওয়ানা', ' শাম মস্তানি', 'বুড্ঢা মিল গয়া'র ' রাতকলি', 'রামপুর কা লক্ষণ'য়ে ' গুম হো কিসি কে প্যার মেঁ' 'আঁধি'তে 'তুম আ গয়ে হো', 'তেরে বিনা', 'ইস মোড় সে জাতে হ্যাঁয়', 'ঘর'এর 'আজকল পাওঁ জমি পর' বা 'তেরে বিনা জিয়া জায়েনা'। ' 'রিমঝিম গিরে শাওন' বা 'ওয়াদিয়া মেরে দামন', আর কে ফিরিয়ে দিতে পারে? এখনও যাকে ভালোবাসি তাকে চোখ বুজে শোনাবো ' এক অজনবি হসিনা সে, য়ুঁ মুলাকাত হো গয়া', 'বহুত দূর মুঝে চলা জানা হ্যাঁয়' বা ' এক পহেলি হ্যাঁয় তু', 'ওয়াদা করো নহি ছোড়োগে তুম মেরা সাথ'।
    ************************************

    আমরা গান শুনতে শিখেছি, গান বুঝতে শিখেছি, প্রেম করতে শিখেছি, প্রেম শোনাতে শিখেছি, বৃষ্টি ভিজতে শিখেছি, রোদে পুড়তে চেয়েছি এই সব সৃষ্টিকে দিয়ে। গহন রাতের স্বপ্নে যখন পঞ্চম যখন এসে বলবেন, ' মেরা কুছ সামান, তুম্‌হারে পাস পড়া হ্যাঁয়, আমরা অনেক বেশি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলবো, 'হো সকতা, পর মেরা বহুত সামান, আমাদের কৈশোর, আমাদের যৌবন, আমাদের পেরিয়ে এসেও পিছু টানে ফিরিয়ে আনা জীবনের অনেক কিছু, তুম্‌হারে পাস পড়া হ্যাঁয়। আখির তুমহে লৌটানা নহি হ্যাঁয়, সির্ফ সাথ রহনা, ইতনা মহেরবানি হি সহি।
    **********************************

    এর মানে তাতো নয়, 'চুনরি সম্‌হাল গোরি', দম মারো দম', পিয়া তু অব তো আজা', 'দুনিয়া মে লোগোঁ কো', 'চুরা লিয়া হ্যাঁয়', ' ও মারিয়া'র পঞ্চমকে আমরা ভুলে যাবো। এ সব গান তো প্রায় 'জাতীয় সম্পদ'। কিন্তু যদি আমাদের মনগড়া প্রতিবিম্বের এই পিঞ্জরেই পঞ্চমকে আমরা আজও ধরে রাখতে চাই তবে তার থেকে বড়ো অবিচার আর হবেনা। আমাদের পূর্বসূরিরা হয়তো এমন একটা ভুল ধারণার বশে ছিলেন, কিন্তু তাকে পেরিয়ে এসে নতুন করে তাঁর মূল্যায়ণ আজ আমাদের দায়িত্ব । সব নমস্য সুরকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি, সৃজনশিল্পের বহুমুখিনতার বিশালত্বে পঞ্চম নিজেই নিজের তুলনা।
    *************************************

    ক্ল্যাসিকাল ওয়ালজে দুই নর্তকনর্তকীর যে কোনও ভঙ্গিমাতেই হাত ছাড়ার অনুমতি নেই,মার্কিন ওয়ালজে সেটা আছে। পঞ্চম ক্ল্যাসিক প্রিন্স, কখনও আমাদের হাত ছাড়েননি ব্যথায়, বেদনায় বা মৃত্যুতে । স্বভাবসিদ্ধ আনন্দময় মানুষটি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দুহাত ধরে যেন ওয়ালজে বাঁধা এই গানটি গাইতে গাইতে মঞ্চের নেপথ্যে চলে গেলেন, আমিও তাঁর এই সৃষ্টিটি স্মরণ করে আজকের প্রলাপ শেষ করি।

    ' জীবন কে দিন ছোটে সহি, হম ভি বড়ে দিলওয়ালে
    কল কি হমে ফুরসত কঁহা, হোতে তো হম মতওয়ালে।'

    -----------------------------------------------

    কল্লোলদার সংযোজন....
    ------------------------------------------
    শিবাংশু। আয় বাবা বুকে আয়। উফ, কেন যে অতদূর গেলি। তোকে এবার ব্যাঙ্গালোরেই আনতে হবে। ন্যাড়াভাই, কুছ আপ ভি ফরমাইয়ে।
    একটা শুধু বলার আছে। মেরে নয়না শাওন ভাদোঁ। আমার ভালো লাগে না। মজা নেই গানটায়। বড় বেশী শিবরঞ্জনী ধরে বসানো। শিবরঞ্জনী হো তো - শংকর-জয়কিষন। জানে কাঁহা গয়ে য়ো দিন, যেকোন সময়ে সাওন-ভাদোঁকে ছাড়িয়ে যায়। এমনকি দিল কি ঝরোখোঁ মে তুঝকো বিঠাকর - শিবরঞ্জনীর খুব বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার।
    তা বলে শংকর-জয়কিষন কোথাও কোন ভাবে রাহুলের এক অলোকবর্ষের কাছাকাছিও আসেন না (কেই বা আসে)।
    আমি শুধু শিবরঞ্জনী নিয়ে বললাম।

    কিশোরের মত ন্যাচরাল ভয়েস নিয়ে এক হেমন্ত ছাড়া কেউ আসে নি। মান্না-রফি খেটে তৈরী করা গলা - লা জবাব। কিন্তু হেমন্ত আর কিশোর তাদের গানে কোথাও এইসব উৎকর্ষ-টর্ষ ভাসিয়ে নিয়ে যান। তবে সব রকম গান সবার আসে না। গজলধর্মী গানে চাচা জিন্দাবাদ। কথা হবে না। রোমান্টিক মেলডিতে দুজনে দুরকম। আ চলকে তুঝে, দিল আজ শায়র হ্যায়, রাতকলি, য়ে জীবন হ্যায়, রূপ তেরা মস্তানা যেমন রফির দ্বারা হবে না, তেমনি দিওয়ানা হুয়া বাদল, রাত কে হমসফর, তেরী আখোঁ সে সিবা ইস দুনিয়া মে রাখ্‌খা কেয়া হ্যায়, আজারে আ জরা, তুমনে মুঝে দেখা, এহেসান তেরা হোগা মুঝপর - এসব কিশোরের আসবে না। মান্নার এরকম একটাই মনে পড়ছে - হাসনে কি চাহ মে কিতনা মুঝে রুলায়া হ্যায় - অসাধারণ।
    কিশোরের একটা বড়ো অ্যাডভান্টেজ ইয়ুডলিং। মান্নার আসতো (চুণরী সাম্ভাল গোরী)। পরে আর কেউ মান্নাকে দিয়ে তেমন করে গাওয়ালো না। আবার ছোট দানাওয়ালা রাগপ্রধানে মান্না, রফি, য়েসুদাস তুল্যমূল্য। ওখানে কিশোর নেই, একদম নেই।
    কিছু গানে মহেন্দ্র কাপুর খুব ভালো - নীলে গগণকে তলে, আজাও আ ভি জাও (এটা রাজেশ-মুমতাজের সিনেমা রবির সুর - নাম মনে পড়ছে না)। কিন্তু মনে হয় রফি আরও ভালো গাইতে পারতেন এই গানগুলো।
    মুকেশ একদম আলাদা। ওঁর ন্যাজাল গলা একটা আলাদা আবহ তৈরী করতো। তবে এও মনে হয় ওঁর গানগুলো মান্না আর কিশোর আরও ভালো গাইতে পারতেন।
    এক হেমন্তর গান হেমন্তরই। ঐ গলার মায়াবী আবেশ এটা কারুর ছিলো না। কাছাকাছি আসতো রফি।
  • ন্যাড়া | 172.233.205.42 (*) | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ০৭:১৯74143
  • শিবাংশুবাবু ঠিক ধরেছেন। আমাদের বেড়ে ওঠা পঞ্চম আর কিশোরকে জড়িয়ে। আমাদের বয়ঃসন্ধির সঙ্গে এনারা জড়িয়ে গেছেন, এ মরজীবনে সে হাত ছাড়ান যাবে বলে মনে হয় না। এখন গানের সঙ্গে গানের যে অ্যাসোসিয়েশন সেটাও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। এবং আশ্চর্য, যে গানগুলো উল্লেখ করলেন তার ৯০%-এর সঙ্গে কোন না কোন ঘটনার অ্যাসোসিয়েশন মনে পড়ে যায়।

    স্মৃতি এক আজব চিড়িয়া।
  • কল্লোল | 125.241.1.163 (*) | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:৫০74144
  • ছোটে মিয়াঁ বড়ে মিয়াঁ বা সলিল তো আছেনই। আর একজনের কথা বড় শুনতে ইচ্ছে করে শিবাংশু আর ন্যাড়ার থেকে - মদনমোহন। শুনেছি ওনার অ্যারেঞ্জমেন্ট নাকি সলিলও ফলো করতেন। আমার প্রিয় সুরকারদের একজন।
  • PM | 120.168.216.42 (*) | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১১:২৯74145
  • যদিও এই টইটা ঠিক যায়গা নয় তবু প্রশ্নটা এখানেই করি।

    ওপি নায়ারের কম্পোজিসন এতো ইউনিক কেনো মনে হয়? ওনার সুর এমনকি ইন্স্ট্রুমেন্ট অ্যারেন্জমেন্ট শুনলেও চোখ বুজে বলা যায় এটা ওপির সৃষ্টি। এর সাংগীতিক কারন কি?

    সাংগীতিক বিশ্লেষন কি ওপি কে গ্রেট দের মধ্যে বসাবে? নাকি উনি একটাই নির্দিষ্ট ফর্ম নিয়ে ভাঙাচোরা করে গেছেন?
  • কল্লোল | 111.63.209.144 (*) | ২৬ জানুয়ারি ২০১৪ ০৬:২৬74146
  • ও পি নায়ার বেশ কিছু ভালো সুর করেছেন। তা সে রকম ধরলে, রোশন, খৈয়াম, জয়দেব, রবীন্দ্র জৈন অনেকেই আছেন। ও পির অ্যারেঞ্জমেন্ট বললেই নারকেলের মালা বাজিয়ে ঘোড়ার ট্রটিং মনে পড়ে যায়।
  • শিবাংশু | 127.197.250.98 (*) | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:১১74147
  • PM, কল্লোলদা,

    আজ ও পি নইয়ারের মৃত্যুদিন । তিনি ট্রট বিটের বাইরেও অনেক বড়ো মাপের স্রষ্টা । কখনও সময় পেলে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে আছে ; তবে নিশ্চয় এখানে নয় । ছোটোকত্তাকে নিয়ে বড়ো লেখা মাথায় ঘুরছে বহুদিন । বসার সময় নেই :-(
  • nina | 78.37.233.36 (*) | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ১১:৫২74148
  • এত সুরেলা টই --আহা!
    শিবাজি প্লিজ ও পি নাইয়ার কে নিয়ে লেখ---সলিল চৌধুরী আর ডি কে নিয়ে পড়তে চাইলে অনেক কিছু খুঁজে পাই---কিন্তু ও পি কে জানতে চাইলে বিশেষ কিছু পাইনা---ও পি নাইয়ার আশা ভোঁসলে ---এই কম্বি মন মাতানো----তখনকার সময় লতা কে বাদ দিয়ে এই সুরপাগোল মানুষ আশাকে নিয়ে যা আমাদের দিয়ে গেছেন--উফ! আমি ভিষণ ও পি ভক্ত--প্লিজ শিবাজি অনুরোধ করে রাখলাম--ও পি নাইয়ার ও তার সুরের কথা লিখ।
  • sahana | 90.3.254.53 (*) | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ০১:১৮74149
  • এতদিন পর গুরুচন্ডালির পাতা খুলে, টইপত্তর এ এসে আমার প্রিয়তম দুজন সুরকার এর এমন অনবদ্য অন্বয় , আমার বিজন দিন আনন্দে ভরে গেল। ধন্যবাদ। আরো আলোচনা আরো গান এর আশায় রইলাম।
  • sahana | 90.3.254.53 (*) | ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ০১:২৬74150
  • ঘর আজা ঘির আয়ে বদরা কতদিন পর শুনলাম। আবার। মা কে মাঝে মাঝেই বলতাম এমন একটা গান শোনাও না যে গান বহুদিন শুনিনি। মা এই গান টা অনেক দিন আগে একবারি শুনিয়ে্ছিল। সেই প্রথম বারের পর আজ মনে হয় ২০ বছর বাদে এই গান টা আবার শুনলাম। কথা মনে ছিল না, সুর শুনে চিনতে পারলাম। আরো কত কি মনে পড়ে যাচ্ছে , কত সুর আর কত গান।আবার ও ন্যাড়া দা কে ধন্যবাদ।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন