এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  বিবিধ

  • চিনের সাথে ক্যাঁচাল

    দেব
    আলোচনা | বিবিধ | ২০ জুলাই ২০১৭ | ১৫৩৬৭ বার পঠিত
  • ১৯৬২র পর ১৯৮৬-৮৭, তারপর এই ২০১৭ এ এসে আবার চিনের সাথে ভাল রকম ঝামেলা শুরু হয়েছে। সেই একই গপ্পো - জমি কার?

    ঘটনার স্থল সিকিম-তিব্বত-ভুটান এই তিনটি রাজ্য ও দেশ যেখানে এসে মিলেছে সেই বিন্দু এবং তার পূর্বদিকের কয়েক বর্গকিমি ক্ষেত্র নিয়ে। সিকিম এবং তিব্বতের সীমানা ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ ভারত ও চিনের রাজার মাঝে হওয়া চুক্তিতে স্থির হয়েছিল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 24.139.196.6 | ২৩ আগস্ট ২০১৭ ২০:৫৭366984
  • সরাইঘাটের যুদ্ধ আকবর নয়, আওরঙ্গজেবের সময়ে। স্বয়ং রামসিংহ (জয়সিংহের ছেলে) মুঘল সেনাপতি হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু গৌহাটির কাছে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র পেরোতে গিয়ে মুঘল সৈন্যদল প্রায় কচুকাটা হয়ে যায়। তবে পশ্চিম আসাম, মানে ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড় এগুলো মুঘলদের আন্ডারে ছিলো। গুয়াহাটি অঞ্চল মোটামুটি সীমানা, বহুবার হাতবদল হয়েছে । এর পূর্বে আহোম রাজাদের রাজত্ব।
  • S | 57.15.15.108 | ২৪ আগস্ট ২০১৭ ০০:২৮366985
  • @দেব,
    "সারা পৃথিবীতে ২০০ মতন সার্বভৌম দেশ আছে। এর মধ্যে বোধহয় ১৫০ টার সাথে প্রথম পাঁচটা ট্রেড পার্টনারের মধ্যে চিন থাকে। চিনের সাথে 'সকলের' এতো সংঘাত লাগলে এখানে চিন আজকে পৌঁছত?"

    একই লজিকে চীনের সবথেকে বড় ৫টি ট্রেড পার্টনারের নাম বলুন আর তাদের সঙ্গে চীনের সম্পক বলুন।
  • দেব | 127.197.240.223 | ২৪ আগস্ট ২০১৭ ০০:৫৫366986
  • চিনের সবথেকে বড় ট্রেড পার্টনারের কথা বলিনি। অন্য দেশগুলোর দিক থেকে সবথেকে বড় ট্রেড পার্টনারের কথা বলছিলাম। চিন তাতে প্রথম ৫এর মধ্যে থাকে। ঘুরিয়ে বললে চিনের সাথে সবথেকে বড় ৫টি ট্রেড পার্টনার যে ৫টি দেশ তাদের দিক থেকেও এক বা দুই নম্বর ট্রেড পার্টনার চিনই। চিনকে লোহা বেচে খাব আবার গালাগালও দেবো (অস্ট্রেলিয়া) অমন করলে তারে কয় হিপোক্রিসি।

    আর শুধু সবথেকে বড় ৫ টা নিতে যাব কেন? তার পরের ৫ টা কি দোষ করল? বা শেষ ৫ টা?
  • S | 57.15.15.108 | ২৪ আগস্ট ২০১৭ ০১:৪২366987
  • বাহ। এটা ভালো যুক্তি তো। যেহেতু চীন অনেক দেশের বড় ট্রেড পার্টনার, অতেব চীনের সাথে তাদের সমস্যা থাকার কথা নয়। এইটা আপনার যুক্তি। আমি চীনের ক্ষেত্রেই যখন দেখিয়ে দিলাম যে বড় ট্রেড পার্টনারদের সঙ্গেই বোধয় চীনের সবথেকে বেশি কনফ্লিক্ট, তখন আপনার আপত্তি।

    "চিনকে লোহা বেচে খাব আবার গালাগালও দেবো (অস্ট্রেলিয়া) অমন করলে তারে কয় হিপোক্রিসি।"

    প্রথমতঃ সেই হিসাবে চীনের তো উচিত আম্রিগার ধামাধরা হয়ে থাকা। চীন-আম্রিগার ট্রেড ৬০০ বিলিয়ন ডলার - চীনের জিডিপির ৫% এর একটু বেশি। আর চীনের ট্রেড সারপ্লাস আম্রিগার সাথে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার।

    সেকেন্ড, অস্ট্রেলিয়া এমনি এমনি তো খায় না। নিজের দেশের কয়লা, লোহা বেচে খায়। আর চীনও দয়া করে কেনে না, দরকার বলেই কেনে। না কিনলেই তো পারে। চীন লোহা কেনার আগেও অস্ট্রেলিয়া ছিলো (বহাল তবিয়তেই), পরেও থাকবে। অতেব অস্ট্রেলিয়া কি করে খায় সেকথা না ভাবলেও চলবে।

    ফাইনালি, আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি হয়ে কি করে এমন একটা কথা বললেন সেইটাই ভাবার। এতো সেই আমার পয়সায় খাস অতেব আমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবিনা টাইপের কথা। এইধরনের কথা আম্রিগাতে চুরান্ত দক্ষিনপন্থীদের বলতে শুনেছি।
  • amit | 149.218.44.202 | ২৪ আগস্ট ২০১৭ ০৬:১৫366988
  • উহু, এই মুহূর্তে চীনের অস্ট্রেলিয়া কে যতটা দরকার, অস্ট্রেলিয়ার চীনকে দরকার তার থেকে অনেক বেশি। ২০০৯-১০ এর পরে লোহার ডিমান্ড কমে আসতে অস্ট্রেলিয়ার ইকোনোমিতে তার ভালো মতো ইমপ্যাক্ট পড়েছে। আর অস্ট্রিয়ান কয়লার ডিমান্ড আগে বেশি ছিল, কারণ ছাই একদম কম (ভারতের কয়লাতে ওটা মেজর মাইনাস পয়েন্ট), এখন ইন্দোনেশিয়া থেকে চীন কয়লা নেওয়াতে সেটাতেও প্রভাব পড়েছে। তাই অস্ট্রেলিয়া ভারতের মার্কেট ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে, আদানি গ্রুপ এখানে একটা বড়ো প্রজেক্ট করার চেষ্টা করছে।

    মিডিয়াতে যতই হাইপে করা হোক, অস্ট্রেলিয়া আর চীন, দুটো দেশের মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো আর কিছু মাস আগেই এখানে pm গিয়ে চীনের সাথে ট্রেড এগ্রিমেন্ট সেরে এসেছে। মোদী আসার পরে ভারতের সাথে সম্পর্ক অনেক ভালো হয়েছে, কিন্তু এখন ভারত চীনের ঝগড়া লাগলে এই সব দেশ ভারতের পাশে দাঁড়াবে, সেই স্টেজ এ আদৌ নয় এখনো।

    দেব এর লেখা একেবারে নিরপেক্ষ, সেটা বলছি না, কিন্তু উনি একটা অ্যাঙ্গেল থেকে একটা বড়ো সময়ের ইতিহাস কে দেখছেন, অন্য কেও অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতেই পারেন। তারা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখুন না। খোঁচা মারার দরকার কি ? লেখাটা চলুক। আলোচনাও।

    দেব, আকসায় চীন নিয়ে লেখাটা এখনো বাকি আছে। আরো কিছু থাকলে লিখে ফেলুন।
  • a | 59.199.5.182 | ২৪ আগস্ট ২০১৭ ০৬:৩০366989
  • অমিত বাবু কি অস্ট্রেলিয়ায়? কোন দিকে?
  • amit | 149.218.44.202 | ২৪ আগস্ট ২০১৭ ১০:০২366990
  • a-, আমরা ব্রিসবেন এ আছি। আপনি কোন দিকে ?
  • a | 59.184.165.238 | ২৫ আগস্ট ২০১৭ ০৪:১৯366992
  • আমি মেলবোর্ন। আঅগামি জানুয়ারিতে ব্রিসবেন যাবার সম্ভাবনা।
  • amit | 213.0.3.2 | ২৯ আগস্ট ২০১৭ ০৭:২১366994
  • দেব, লেখাটা কি শেষ হয়ে গেলো ? আকসায় চীন এর কি হলো ?

    এখনো অবধি মোদী সরকার মোটামুটি ঠিক ঠাক গেম খেলেছে মনে হচ্ছে চীনের সাথে, তবে আরো কিছুদিন গেলে বোঝা যাবে। টু আর্লি টু কমেন্ট।
  • দেব | 57.11.229.158 | ২৯ আগস্ট ২০১৭ ০৮:১৫366995
  • কালকের খবর অনুযায়ী ডোকলাম ষ্ট্যান্ডঅফ উঠে গেলো। কিন্তু দুপক্ষের বক্তব্যে মিল নেই। ডিল্প্লোম্যাটিক সাইফারস্পিক ঘেঁটে যেটুকু বুঝলাম সেটা হচ্ছে এই -

    ১। ভারত সেনা সরিয়ে নেবে।
    ২। চিন রাস্তা বানাবে না। মানে রাস্তাটা ওখানে আগে থেকেই আছে কিন্তু সেটার মেরামতি বা এক্সটেনশন কিছু হবে না।
    ৩। চিন ও ভুটান দুই দেশের সেনাই ঐ এলাকায় টহল দেবে। কিন্তু সেটাই স্ট্যাটাস কুয়ো ছিল। সুতরাং ভারতের এতে আপত্তি নেই। আসল হচ্ছে ঐ রাস্তাটা।

    এইটা মোটের ওপর ভারতের পন্ডিতরা বলছেন। যদি এটাই হয় তাহলে ভারতকে মোদি এই রাউন্ডে জেতালেন। চিনের দিক থেকে অবশ্য একটা শব্দ ব্যবহার হয়েছে - সার্বভৌমত্ব। চিন জানিয়েছে ভারত সেনা সরিয়ে নিয়েছে কিন্তু চিন ওখানে টহল দেবে। ঐ এলাকা চিনের। সুতরাং চিন ঐ এলাকায় নিজের 'সার্বভৌমত্ব' প্রয়োগ করবে। 'সার্বভৌমত্বের' মধ্যে সবকিছুই পড়ে। সুতরাং রাস্তা বানানোটাও কি পড়বে? চিন রাস্তাটা নিয়ে কিছু বলেনি এখনো পর্যন্ত।

    তো আমি এটাকে ভারতের জিত হিসেবেই ধরছি। ব্যাপারটা গুরুত্বে সামান্য হলেও জিত। তবে এইটুকু প্রশ্ন খোলা রয়ে গেল যে চিন রাস্তাটা বানাবে কি না। যদি সেটা হয় তাহলে ভারতের হার।

    @amit - কাজের থেকে ফাঁক পাচ্ছি না। খসড়াটা হয়ে গেছে। দু'তিন দিনের মধ্যে দিয়ে দেব।
  • দ্রি | 103.115.95.216 | ২৯ আগস্ট ২০১৭ ১১:০৫366996
  • স্পুৎনিকে একটা অর্টিক্‌ল একটা সম্ভাবনার কথা আলোচনা করেছে। বলেছে ডোকলাম একটা চাইনীজ গ্যাম্বিট হতে পারে। এই স্ট্যান্ড-অফে ভারত কিছুটা হলেও রং-ফুটে ছিল। ভারতের মিলিটারী ছিল ভুটানের মাটিতে, হোয়্যার‌্যাজ চীন ছিল চীনের মাটিতে। আর্টিক্‌লটা বলছে ভারতের এই মুভ ভুটান কিভাবে নেবে সেটা ওয়াচ করার ব্যাপার আছে। ভুটানে দুটো ফ্যাকশান আছে - প্রো-ভারত আর প্রো-চীন। ইলেকশান আসছে। চীনের এই মুভে ভারতের ইনকার্শান ভুটানী ইলেক্টোরেটের মনে কেমন প্রভাব ফেলে সেটা দেখার। আপাতত প্রো-ভারত ফ্যাকশান পাওয়ারে। ইলেকশানের পর সেটা থাকবে তো?

    নেপাল, ভুটান এইসব জায়গায় ভারতের সাথে চীনের একটা কম্পিটিশান আছে কাদের সরকার পাওয়ারে আসবে সেই নিয়ে।
  • sm | 52.110.176.87 | ২৯ আগস্ট ২০১৭ ১১:২০366997
  • নেপাল তো চীনের দিকে হেলে। আই মিন ভারত থেকে একটু হলেও দূরে সরে গেছে। চীন প্রচুর টাকা ছড়াচ্ছে।
    আর ভুটানে রাজাই বোধ হয় বিরাট নির্ণয়কের ভূমিকা নেয়। তো চীন রাজার কোম্পানি তে বেশি ইনভেস্ট করলে বেশি ফুটেজ পাবে। এই আর কি!
  • PM | 127.194.2.145 | ২৯ আগস্ট ২০১৭ ১৬:৪১366998
  • ভারত ভুটান কে ভালো পরিমান এড দেয়-

    It steadily rose over the years to reach US$985 million (INR 61.60 billion) in 2015–16 making Bhutan the largest beneficiary of India's foreign aid. Bhutan’s Prime minister, Tshering Tobgay, secured an additional aid package from India worth INR 54 billion (US$819 million, as per the exchange rates at the time of signing the deal) for his nation during his visit to New Delhi in August 2013

    On August 8, 1949 Bhutan and India signed the Treaty of Friendship, calling for peace between the two nations and non-interference in each other's internal affairs. However, Bhutan agreed to let India "guide" its foreign policy and both nations would consult each other closely on foreign and defence affairs. The treaty also established free trade and extradition protocols.Scholars regard the effect of the treaty is to make Bhutan into a protected state, but not a protectorate, because Bhutan continues to have the power to conduct its own foreign policy.

    কিন্তু সেই চুক্তি এখন নেই-

    India re-negotiated the 1949 treaty with Bhutan and signed a new treaty of friendship in 2007. The new treaty replaced the provision requiring Bhutan to take India's guidance on foreign policy with broader sovereignty and not require Bhutan to obtain India's permission over arms imports

    ওদিকে নেহেরু ১৯৫৯ সালে পার্লামেন্টে নেহেরু বলেছিলেন ভুটানের সুরক্ষার দায়িত্ব ভারতের। কিন্তু ভুটানের রাজা সাথে সাথে এর বিরোধীতা Kঅরেন, বলেন Bhutan is not a protectorate of India nor did the treaty involve national defence of any sort।

    কঠিন পুরোনোচুক্তিতেই ভুটান ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ (সুরক্ষায় হলেও) সমর্থন করে নি-- এখন অনেক ডাইলিউটেড চুক্তির ভিত্তিতে ভারত কিভাবে ভুটানের সুরক্ষার জন্য সেনা পাঠায় করে তা ঠিক পরিস্কার নয় !!
  • PM | 127.194.2.145 | ২৯ আগস্ট ২০১৭ ১৭:৫০367000
  • Foreign ministry spokeswoman Hua Chunying refused to disclose future plans for the road project that had triggered the confrontation on the remote Doklam plateau.

    When asked whether China would halt road-building, Hua told reporters: "We'll take into consideration all relevant factors, including weather, to make any infrastructure plans -- including road-building."

    http://m.france24.com/en/20170829-chinese-troops-patrol-border-area-after-india-stand-off

    মানে আপাতত রাস্তা বানানো বন্ধ
  • Du | 182.58.67.203 | ৩০ আগস্ট ২০১৭ ০০:০৬367001
  • মহান ভক্তরা ও তাদের সরকার চার বছর ধরে নেপালকে বিরূপ করার কাজটা ভালৈ করেছে।
  • দেব | 57.11.239.182 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৯:৪১367002
  • কাজে ফেঁসে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো। যাই হোক আগে বাড়ি।

    @S - যুক্তিটায় ভুল কি হল? আপনি বললেন চিনের সাথে 'সকলের' এত সংঘাত লাগে কেন? আমি বললাম চিনের সাথে 'সকলের' সংঘাত লাগে ওটা আমেরিকান প্রোপাগ্যান্ডা। কারণ তাহলে চিন এত দেশকে বেচে করে খেতে পারত না। দি অ্যাসাম্পসন বিইং দুটো দেশের মধ্যে বিবাদ থাকলে ট্রেড খুব একটা মসৃণ ভাবে চলে না। ভারত-পাকিস্তান যেমন। তার মানে এই নয় যে চিনের সাথে 'কোন' দেশেরই বিবাদ নেই। কিন্তু সেরকম বিবাদ সারা পৃথিবী জুড়েই নিকট প্রতিবেশীদের মধ্যে থাকে। চিন ব্যতিক্রম নয়। এবং অন্য সবার দাবী ঠিক শুধু চিন একা ভুল এরকমও নয়। ঐ বিবাদগুলো নিয়েও আসছে। বাট ইফ ইউ আর কম্পেয়ারিং লাইক উইথ লাইক, চিনের থেকে অনেক অনেক বেশী দেশের সাথে আমেরিকার বিবাদ আছে। এবং সেই বিবাদগুলোর টেম্পারেচারও অনেক বেশী। চালুনি-ছুঁচ।

    চিন ব্যতিক্রম নয় বললাম ঠিকই কিন্তু এটাও ঠিক যে সব দেশ সমান হয় না। ছোট দুর্বল দেশের জন্য এক নিয়ম আর খুব শক্তিশালী দেশের জন্য আলাদা নিয়ম। আমেরিকা আলাদা স্তরে। অন্য সব দেশের জন্য নিয়ম আমেরিকার ওপরে খাটে না। সব দেশের সমান সন্মান ও অধিকার একথা শুনলে আমেরিকানরা হাসবে। চিনও সে স্তরে ঢুকতে চলেছে এক দু'দশকের মধ্যে। খেলা তো সবে শুরু।
  • দেব | 57.11.239.182 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ২০:০৮367003
  • ১৮৩৪ সাল। উত্তর পশ্চিম ভারতে তখন রণজিৎ সিংএর শিখ সাম্রাজ্যের শাসন চলছে। জম্মু ও কাশ্মীর সমেত। গুলাব সিং, এক ডোগরা রাজপুত, তখন জম্মুর গভর্নর। গুলাব সিং এর এক সেনাপতি, জোরওয়ার সিং পার্শ্ববর্তী লাদাখে সে বছর হানা দিলেন। লাদাখ তখন স্বাধীন রাজ্য। তবে তিব্বতের ট্রিবিউটারী। সিকিমের মতন। সাংস্কৃতিক ভাবে লাদাখ বরাবরই তিব্বতের প্রভাববলয়ের অংশ ছিল। জোরওয়ার সিং অনায়াসে লেহ দখল করলেন। তারপর কয়েকবছর বাদে হানা দিলেন খোদ তিব্বতের ওপরে। ১৮৪১ সালে। একই সময়ে তখন প্রথম চিন-ব্রিটেন যুদ্ধ চলছে আফিম নিয়ে। জোরওয়ার সিং মানস সরোবর অবধি দখলে আনলেন। এরপরেই একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন। তিব্বতে শীতকালটা কাটানোর। শীতে তিব্বতের বরফসমুদ্রের মধ্যে জোরওয়ার সিং পুরো বাহিনী সমেত প্রাণ হারালেন। এবার তিব্বতি সেনারা পাল্টা আক্রমণ করল লাদাখকে আবার ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু লেহর কাছে গুলাব সিংএর সেনাদের কাছে উড়ে গেল তিব্বতি সেনাদল। শেষে ১৮৪২ এর অক্টোবরে দু'পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হল। তিব্বত মেনে নিল লাদাখ এখন থেকে শিখ সাম্রাজ্যের অংশ । বিনিময়ে গুলাব সিং কথা দিলেন তারা আর কখনো তিব্বতকে আক্রমণ করবেন না। সেই সাথে - "দু'পক্ষই একে অপরের সীমানা লঙ্ঘন করবে না" - ঘোষণা হল। কিন্তু সীমানাটা ঠিক কোথায় সে বিষয়ে পত্রটি নিরব। শুধু লেখা রইল - 'প্রচলিত' সীমানা মেনে চলা হবে। 'প্রচলিত' শব্দটির ব্যবহারের কারণ হচ্ছে এর আগে ১৬৮৪ সালে তিব্বত, লাদাখ ও মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে এক প্রস্থ মারপিটের পর একটা চুক্তি হয়েছিল। তাতে লাদাখের দিকে শেষ গ্রামগুলি কোথায় সেইটুকু লেখা ছিল। সেই চুক্তিটিকে দু'পক্ষ বহাল রাখল। একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন এটা সেই বিচ্ছিন্নতা দিয়ে সীমানা। ডোগরা ও তিব্বতির দু'পক্ষই জানত যে তারা প্রতিবেশী হলেও তাদের রাজ্যদুটো ঠিক গায়ে গায়ে ঠেকে নেই। মাঝখানে একটা ফাঁক রয়েছে। সুতরাং তাদের নিজেদের 'প্রচলিত' সীমানা কোথায় সেটা অন্যপক্ষ জানলে ও মেনে চললেই হল। নিঁখুত লাইন টানার প্রয়োজন নেই কারণ লাদাখ ও তিব্বতের মাঝের ঐ ফাঁকা অংশটা কেউই দখল করার মতলবে ছিল না। এই ফাঁকটাই হচ্ছে আকসাই চিন ও তার দক্ষিণের কিছু এলাকা। এলাকাটি এককথায় দুর্ভেদ্য। ভারতের দিক থেকে এগোলে প্রথমে আপনাকে কাশ্মীরের হিমালয় পেরোতে হবে। তারপর কারাকোরাম পর্বতমালা পেরোতে হবে। তবে আপনি পৌঁছবেন। আকসাই চিনের দক্ষিণ সীমা কারাকোরাম দিয়ে বদ্ধ। আর উত্তর দিকে রয়েছে কুয়েন লুন পর্বতমালা। সব ৭০০০ মিটার+। একমাত্র পূর্বদিকটা কিছুটা খোলা, তিব্বতের দিকে। প্রায় ৩০০০০ বর্গকিমি এলাকা। এককুচো ঘাসও গজায় না। জনবসতি শূন্য। তবে প্রাচীনকাল থেকে একটা পায়ে চলা রাস্তা এর ভেতর দিয়ে ছিল। অল্প যে কমাস গ্রীষ্মকাল তখন তিব্বতিরা চমরী গাইএর পিঠে মালের বোঝা চাপিয়ে বেচাকেনায় যাওয়া আসা করত প্রতিবেশী রাজ্য শিংকিয়াংএর সাথে। একটা বাণিজ্যপথ।

    চার বছর পর ১৮৪৬ সালে ব্রিটেনের হাতে শিখ সাম্রাজ্যের পতন ঘটল। গোটা ভারতের ম্যাপ ছুপল লালে। গুলাব সিং দল পাল্টিয়ে ব্রিটেনকে সাহায্য করেছিলেন। বিনিময়ে ব্রিটেন তাকে জন্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের (ততদিনে লাদাখ সমেত) মহারাজার পোষ্টটা উপহার দিল। লাদাখের ভারতভুক্তির প্রেক্ষাপট এই। তবে গুলাব সিংএর রকম সকম দেখে ব্রিটেনের সন্দেহ ছিল। সদ্য তখন প্রথম চিন-ব্রিট্নে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। গুলাব সিং যদি আবার তিব্বতের দিকে হাত বাড়ান তাহলে তিব্বতের হয়ে চিনের সাথেও ব্রিটেনের লাগতে বাধ্য। অমৃতসর চুক্তিতে ব্রিটেন গুলাব সিংকে ফর্ম্যালি মানা করে দিল কলকাতাকে না জানিয়ে যেন এদিক ওদিক হাত না বাড়ান। সেই সাথে চুক্তিতে প্রস্তাব রইল তিব্বত ও লাদাখের মধ্যে পাকা সীমারেখা টানার। এর প্রায় সত্তর বছর পর সিমলায় ১৯১৩ সালে হেনরী ম্যাকমোহন একই প্রস্তাব দেবেন আসাম-তিব্বত সীমারেখা নিয়ে। আমরা দেখব দুটো প্রচেষ্টাই ব্যার্থ হবে। এবং বাঁশটা নামবে স্বাধীন ভারত, বার্মা, পাকিস্তান ও চিনের ঘাড়ে।

    ১৮৪৬ এ ব্রিটেন চিঠি দিল লাসা ও দক্ষিণ চিনের ক্যান্টনে ব্রিটিশ ট্রেড মিশনে নিযুক্ত চিনের রাজপ্রতিনিধিকে। অনুরোধ - কথাবার্তা বলে ও মাপজোক করে সীমারেখাটা পাকা করা হোক। ক্যান্টনে চিনের রাজপ্রতিনিধি উত্তর দিলেন লাদাখ ও তিব্বতের 'প্রচলিত' সীমানা বহুকাল ধরেই সুনির্ধারিত হয়ে আছে। ওটাকে আর ঘাঁটানোর প্রয়োজন নেই। বহুকাল বলতে চিনের প্রতিনিধি এখানে সেই ১৬৮৪ সালের চুক্তির কথা বলছিলেন। চিনও সেযুগে বিচ্ছিন্নতা দিয়েই সীমানা বুঝত। ব্রিটেন আর কোন উত্তর পেল না চিনের দিক থেকে। তিব্বতের থেকে তো নয়ই।

    চিনের থেকে সাড়া না পেয়ে ব্রিটেন তখন ঠিক করল চিন যদি উত্তর না দেয় তাহলে ব্রিটেনের নিজের দিক থেকেই আন্দাজ মতন ম্যাপে একটা লাইন টেনে রাখা উচিত। তাতে অন্তত গুলাব সিং যেন টের পান যে ব্রিটেনের চোখে কাশ্মীরের সীমানা কোনখানে। সেক্ষেত্রে তিনি উল্টোপাল্টা কিছু কাজ করে পরে আর কোন অজুহাত দিতে পারবেন না। বাউন্ডারী কমিশন বসল। বড়কর্তাদের নির্দেশ ছিল আখাম্বার মতন যেকোন এলাকাকে ম্যাপে নিজেদের দিকে ঢুকিও না। ঐ দূর্গম এলাকার দু'মাইল জমি নিয়ে আমাদের কোন চাপ নেই। জায়গাটা দূর্গম না হলেও না। যেটা আমরা চাই সেটা হচ্ছে পরিস্কার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য (নদী বা পর্বতশৃঙ্খল) অনুসারী সীমারেখা। সেইমতন ১৮৪৬-৪৭ সালে জরীপ করে অফিসারেরা একটা সীমারেখা টানলেন। বর্তমানের হিমাচল প্রদেশের স্পিতি নদীর কিনারা থেকে (নিচের ম্যাপে ৩২, ৭৮.৫) লাদাখের প্যাংগং হ্রদের একটু উত্তর অবধি (৩৪, ৭৮.৫)। কিন্তু এইখানে গিয়ে আটকে গেলেন ব্রিটিশরা। এর উত্তর দিকটা এতই দুর্গম ছিল যে আর দাঁত ফোটানো গেল না। তখনকার মতন ঐ রইল। ব্রিটেন ধরে নিল যে আকসাই চিন নো ম্যানস ল্যান্ড।



    এর পর ১৮৬৫ সালে সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার আরেক অফিসার, ডব্লিউ এইচ জনসন বাকি অংশটুকুতে একটা সীমারেখা টানলেন। উনি সেবছর শিংকিয়াংএর হোতান শহরে (ম্যাপে নেই, আরো উত্তরে) ট্রেকিং করে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে আকসাই চিনের ভেতরের সেই প্রাচীন বাণিজ্যপথটি দিয়ে ফেরেন। উনি আরো অনেকটা উত্তরে কুয়েন লুন পর্বতমালার চূড়ো দিয়ে লাইনটা টানলেন। ফলে আকসাই চিনকে লাদাখের দিকে ঢুকিয়ে নিলেন, সেই সাথে আকসাই চিনেরও উত্তরে আরো প্রায় ২০০০০ বর্গকিমি কাশ্মীরের ভেতরে দেখালেন। তবে এ সবই নেহাতই কাগজে কলমে। ম্যাপের একদম ওপরের দিকে গোলাপী লাইনটা দেখুন। ঐটা হচ্ছে জনসন লাইন। অর্থাৎ উপরওয়ালাদের যে বারণ ছিল - 'আখাম্বার মতন যেকোন এলাকাকে নিজেদের দিকে ঢুকিও না' - জনসন সেটা অগ্রাহ্য করেছিলেন। এই হচ্ছে আকসাই চিনকে নিয়ে ক্যাঁচালের সূত্রপাত। প্রসঙ্গত ৫০এর দশকে ভারত কাশ্মীরের ম্যাপ প্রকাশ করলে তাতে উত্তরের এই অতিরিক্ত অংশটুকু বাদ দেয়। তবে সবটুকু নয়। তবে আকসাই চিনকে ভারত 'অবিচ্ছেদ্য' অংশ বলে ঘোষণা করে।

    ১৮৬৮ থেকে জনসনের লাইনটা ম্যাপে ছাপা হতে শুরু হল ঠিকই কিন্তু ব্রিটেন কোন চেষ্টা করেনি আকসাই চিনের ওপরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জারি করার। ওটা ধরে নেওয়াই ছিল শুধু কাজ চালানোর জন্য। কিন্তু এই সময়ে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকটাতে এসে নতুন একটা ভয় চাগিয়ে উঠল। সেই রাশিয়ার ভয়। ব্রিটেন সে যুগে রাশিয়ার থেকে বেশী শক্তিশালী ঠিকই কিন্তু ব্রিটেনে শক্তি জলে। কিন্তু রাশিয়া ভারতের স্থলসীমার কাছে। চিনের শিংকিয়াং রাজ্যটি তখন কাশ্মীর ও রাশিয়ার মাঝে বাফার। কিন্তু চিন তখন অত্যন্ত দূর্বল। ১৮৯০ সালে এক ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ড, যার সাথে আমাদের আগের খন্ডে মোলাকাত হয়েছে, শিংকিয়াং গেলেন চিনের সাথে সীমানা নিয়ে আলোচনা করতে। চিনারা তখন তাকে জানাল চিনের সীমানা কারাকোরাম পর্বতমালা বরাবর। অর্থাৎ আকসাই চিন শিংকিয়াংএর অংশ। এইখানে প্রথম ব্রিটেন একটা পরিস্কার ধারণা পেল যে চিনের চোখে তার সীমানা কোনখানে। ১৮৯২ সালে চিনারা কারাকোরাম গিরিপথের কাছে একটা সীমানার নিশানদিহি খাম্বা বসাল (৩৫.৫, ৭৮)। ব্রিটেন খুশি হল। চিন যদি ঐ এলাকাকে নিজের বলে দেখায় তাহলে রাশিয়া আর সহজে এগিয়ে আসতে পারবে না। ঐ বিন্দুর পশ্চিম দিকটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই কারণ ওটা পাকিস্তানের ভাগে। পূর্বদিকটা লাদাখের গায়ে। কারাকোরাম গিরিপথ থেকে শুরু করে প্যাংগং হ্রদ পর্যন্ত অংশটাতে সীমানার অবস্থানটা দেখিয়ে চিন একটা ম্যাপ ছাপল। এটা হচ্ছে সেই অংশটা যেটা ১৮৪৬ সালে ব্রিটেন করে উঠতে পারেনি। লাইনটা মোটামুটি ঐ কারাকোরাম পর্বতমালা বরাবর। আকসাই চিন ভূখন্ডটি চিন নিজের বলে ঘোষণা করল। এই ম্যাপটা ব্রিটেন হাতে পেল ১৮৯৬ সালে। ততদিনে শিংকিয়াংএর কাশগড় শহরে ব্রিটেন আরেকটা কনস্যুলেট খুলেছে। কনস্যুলেটের এক অফিসার, জর্জ ম্যাকার্টনি (হ্যাঁ যে ডিপ্লোম্যাট একশো বছর আগে চিনে গেছিলেন এনারও একই নাম) চিনের প্রতিনিধিদের জনসনের আঁকা ম্যাপটা দেখান। জনসন লাইনটা অনেক উত্তর দিয়ে গেছিল। সেই কুয়েন লুন পর্বতমালা বরাবর। তাতে আকসাই চিন ভারতের দিকে দেখানো ছিল। চিনারা তাতে আপত্তি জানিয়ে তখন ম্যাকার্টনিকে তাদের ঐ ম্যাপটা দেয়। ম্যাকার্টনি সেই ম্যাপ ফরোয়ার্ড করে দিলেন কলকাতায়। সাথে বললেন চিন যখন দাবী করছে আকসাই চিনকে ভাগাভাগি করে নিলে ভাল হয়।

    উল্টোদিকে প্রায় একই সময়ে লন্ডনের এক দুঁদে মেজর জেনারেল জন আরদাঘ পরামর্শ দিলেন যে রাশিয়াকে ভরসা করা ঝুঁকি হয়ে যাবে। চিনের পক্ষে রাশিয়াকে সূদুর শিংকিয়াং এ আটকানো অসম্ভব। আজ না হয় কাল রাশিয়া শিংকিয়াং খাবেই। ব্রিটেন যদি কারাকোরাম পর্বতমালাকে কার্যকরী সীমানা ভেবে বসে থাকে (চিনও তাই) তাহলে বিপদ আছে। যদিও ম্যাপে ব্রিটেন আরো উত্তরে কুয়েন লুন পর্বতমালা বরাবর জনসন লাইনটাই দেখাচ্ছিল, কর্তাব্যাক্তিরা সেসময় ওটাকে শুধু 'একটা দেখাতে হয় তাই' সীমানা হিসেবেই ধরতেন। আরদাঘ বললেন না ওখানে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করা হোক। আকসাই চিনে তো বটেই। কারাকোরাম গিরিপথের উত্তর দিকে অংশটাতেও। একদম পাকাপোক্ত ভারত সাম্রাজ্যের অংশ যাতে রাশিয়া কিছু গড়বড় না করতে পারে। রাশিয়াকে নিয়ে আরদাঘ ও অন্যান্য ব্রিটিশ কর্তাব্যাক্তিদের ভয়টা একেবারে অমূলক ছিল না। সেই সময়ে রাশিয়া ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অজুহাতে শিংকিয়াংএর টুকরো টাকরা খেতে আরম্ভ করেছিল। ১৮৯৭ সালে আরদাঘ রিপোর্ট জমা দিলেন। কিন্তু কলকাতা আরদাঘের প্রস্তাব উড়িয়ে দিল। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড এলগিন উত্তর দিলেন ব্যাটাকে লন্ডনে বসে ল্যাজ নাড়াতে বারণ কর। কোন ধারণা আছে এলাকাটা কি রকম দূর্গম? কারাকোরাম পেরোনই অসম্ভব। বাবু আমার কুয়েন লুন যাত্রার প্ল্যান করেছেন। ঐ জায়গায় সেনা পাঠানো যাবে না। আর এমনিতেই চিন আকসাই চিন এলাকাটা নিজের বলে দাবী করে।

    এই জায়গাটাতে একটা জিনিস লক্ষণীয়। সেযুগে ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে ভারতে উত্তর-পশ্চিম সীমানা নিয়ে দু'রকম মত ছিল। একদল বলতেন যতটা দূর পারা যায় সমতল থেকে ততদূরে সীমানাটা থাকুক। যাতে রাশিয়াকে দূরে রাখা যায়। দ্বিতীয় পক্ষ বলতেন যে অতদূরে সীমানা থাকলে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। উল্টে বিপদ হবে। একটু পেছনে থাকলেই ভাল। এই দু'রকম মত। আরদাঘ ও জনসন প্রথম দলে। লর্ড এলগিন দ্বিতীয় দলে। এই পুরো সময়টা জুড়ে ব্রিটিশ কর্তাব্যাক্তিদের মধ্যে সীমানা নিয়ে এই টানাপোড়েনটা ছিল। আফগানিস্তানের সাথে ডুরান্ড লাইনটাও এই টানাপোড়েনের ফসল। লাদাখেও একই জিনিস চলছিল। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৮ সালে দু'দলের মধ্যে একটা সমঝোতা হল। লর্ড এলগিনের তত্ত্বাবধানে ব্রিটিশ অফিসারের একটা নতুন সীমারেখা আঁকলেন। জনসনের লাইনটার থেকে অনেকটা পিছিয়ে এসে কিন্তু কারাকোরামের উত্তরে। কারাকোরাম গিরিপথ থেকে শুরু করে প্যাংগং হ্রদ পর্যন্ত বিস্তৃত কারাকোরাম পর্বতমালার (যেটাকে চিন নিজের সীমা ধরত) সমান্তরালে একটু উত্তরে লাকসাং বলে একটা শাখা পর্বতশ্রেণী ছিল। জর্জ ম্যাকার্টনির পরামর্শ মতন লাইনটা মোটামুটি এই শাখাটা বরাবর গেল, আকসাই চিনকে দু'ভাগ করে। উত্তর দিকটা, সেই প্রাচীন বাণিজ্যপথটি সমেত চিনের দিকে রইল। দক্ষিণটা ভারতে। ১৮৯৯ সালের মার্চ মাসে বেজিংএ ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার ক্লড ম্যাকডোনাল্ড মাঞ্চু সরকারকে ম্যাপটা পেশ করে ঐ সীমারেখাটা গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। খেয়াল করুন সেযুগে চিনের সাথে ব্রিটেন যতই অন্য উৎপাত করে থাকুক না কেন, সাধারণত ন্যূনতম কূটনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করত। একতরফা যে সীমানা টানা যায় না সাহেবদের সে হুঁশ ছিল। ব্রিটেন চিনকে ১৮৪৬ সালেও ফর্ম্যালি ডেকেছিল। ১৮৯৯ সালেও আবার ডাকল। কিন্তু ১৮৪৬ এর মতন এবারেও চিন কোন উত্তর দিল না। ততদিনে চিন পরিস্কার বুঝে গেছে যে দূর্বল অবস্থায় সীমাচুক্তি করা মানেই গচ্চা যাওয়া। এড়িয়ে গেল প্রস্তাবটা। আমাদের দূর্ভাগ্য, চিন এই প্রস্তাবটা মেনে নিলে ১৯৬২ সালের যুদ্ধটা হয়তো হত না। সীমারেখাটা পাকা হয়ে যেত।

    ১৮৯৯ সালের এই ম্যাকার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইনটাই ব্রিটেনের তরফ থেকে শেষ অ্যাটেম্পট, চিনের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে লাদাখের সীমানা নির্ধারণের। চিনের থেকে উত্তর না পাওয়ায় ব্রিটেন পরবর্তী কয়েক বছর এই লাইনটাই লাদাখের সীমানা হিসেবে মেনে চলল। কিন্তু ১৯১১ সালে চিনের কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র ভেঙ্গে পড়লে আবার ব্রিটেন ঘাবড়ে গেল। ব্রিটেন ধরেই নিল যে মঙ্গোলিয়ার মতন শিংকিয়াং ও রাশিয়ার পেটে ঢুকতে চলেছে। আবার ম্যাপে সেই জনসন লাইনটাই ফেরত এল। তবে সাহেবরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অ আ ক খ বুঝতেন। তাই খেয়াল রেখেছিলেন লাইনটির পাশে ম্যাপে "সীমা অনির্ধারিত" এই কথাটি যেন লেখা থাকে। ১৯২৭ সালে দিল্লী আরেকবার খাতাপত্র খুলে বসল। সিদ্ধান্ত হল জনসন লাইনটা অনেক উত্তরে। একটু নিচে দিয়ে সীমাটা থাকুক। ১৮৯২ সালে চিনারা যে খাম্বাটা বসিয়েছিল সেইটা হয়ে লাইনটা গেল। কিন্তু সরকারী ম্যাপে এই লাইনটা ছাপা হয় নি। জনসন লাইনটাই রয়ে গেল ১৯৪৭ অবধি। তবে এই দীর্ঘ সময়কালে দু'একজন সার্ভেয়ার আর ভূপর্যটক ছাড়া কেউই আকসাই চিন এলাকায় ব্রিটিশ আমলে পা রাখেন নি। ব্রিটেন ঐ এলাকাটা ম্যাপে ঢুকিয়েছিল নেহাতই রাশিয়াকে দূরে রাখবে ভেবে। মানে যতটা দূরে রাখা যায় তত ভাল। কিন্তু ঐ অঞ্চলে কোনদিনও ব্রিটেন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের কথা চিন্তা করেনি। সেই কীর্তি করবেন নেহেরু।

    এবার নিচে সামারীটা দেখে নিন। সবুজটা ম্যাকার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইন।



    --------------------------------------------------------------

    রাষ্ট্র কারে কয়? ম্যাক্স ওয়েবার বলে এক জার্মান পন্ডিত খুব খাসা একখানা সংজ্ঞা দিয়েছেন। কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডে যে সত্ত্বার একলার ক্ষমতা আছে প্রয়োজনমত গায়ের জোর ফলানোর সেই রাষ্ট্র। এত ভাল সংজ্ঞা খুব কম হয়। ছোট্ট করে নির্বিকার রক্ত ঠান্ডা করে দেওয়া সংজ্ঞা। তা সেই সত্ত্বা যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ ভূখন্ডে অন্য যে কাউকে 'প্রয়োজনমত' ঠেঙাতে পারবে ততক্ষণ তাকেই ঐ ভূখন্ডে রাষ্ট্র বা সরকার বলে ধরা হবে। যদি ঠেঙাতে না পারে, যদি কোন কম্পিটিটর চলে আসে অমনি সেই ভূখন্ডে সে আর সরকার রইল না। ঠেঙানিটাই মূল। পরবর্তীকালে মাও সে দং এটার একটা কোরোলারী দেবেন - বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। এটা আরো ছোট এবং আরো খুনে। মানে ঠেঙাতে পারার ক্ষমতা দিয়েই যদি 'রাষ্ট্র' চিহ্নিত হয় তাহলে উল্টোটাও সত্যি। ঠেঙাতে পারে কে? যার কাছে বন্দুক আছে সে। অতএব সে ই রাষ্ট্র। তা প্রশ্ন হচ্ছে ভারত গণরাজ্য নামক দেশটির ভূখন্ডে রাষ্ট্রের সংখ্যা কটা? আমি এখনো অবধি গুণেছি সাড়ে তিনখানা। আর যদি ঠেঙানির শর্তটা বাদ দিই তালে সাড়ে পাঁচখানা। প্রথম এবং প্রধান হচ্ছেন মহামান্য ভারত সরকার। দিল্লীতে গদি। শীর্ষপদে বর্তমানে রয়েছেন চেয়ারম্যান মোদি। কিন্তু ভারত ভূখন্ডের সর্বত্র এই রাষ্ট্রের ঠেঙানোর ক্ষমতা নেই। মানচিত্রে দেখেছেন নিশ্চয়ই কাশ্মীরের চেহারাটা। পুরো রাজ্যটাই আমাদের 'ইন্টিগ্রাল' পার্ট। কিন্তু ওটার একটা টুকরোয় শুধু পাকিস্তান আর একটা টুকরোয় শুধু চিনের হাতে ঠেঙানোর ক্ষমতা রয়েছে। তাহলে হল তিন। এর পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রকম কম্পিটিটর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বীরাপ্পন, মাওবাদী, কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, গোবলয়ের গন্ডগ্রাম, জেএনইউ এর ক্যাম্পাস ইত্যাদি। এগুলোতেও দিল্লীর হাত গিয়ে পৌঁছয় না। তা এগুলো সব মিলিয়ে আমি অর্ধেক ধরছি। সেনা প্রধান বিপিন রাওয়াতও আমার সাথে একমত। টু অ্যান্ড এ হাফ অয়্যার শুনেছেন তো। তাহলে হল গিয়ে সাড়ে তিন।

    যদি ঠেঙানির শর্তটা বাদ দিই তাহলে আরো দু'খানা আছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে একটা পুঁচকে দ্বীপ আছে - সেন্টিনেল। ৬০ বর্গকিমি মতন (কলকাতার তিন ভাগের এক ভাগ)। আগাগোড়া ঘন বনে ঢাকা। সেই দ্বীপে এক আদিম উপজাতি বাস করে। জনসংখ্যা ঠিক জানা নেই, ৫০-১০০ হবে। তারা বাইরের কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার কয়েকবার চেষ্টা করেছিল বন্ধুত্ব করার। ফল হয় নি। নব্বইএর দশকে এসে হাল ছেড়ে দেয়। বর্তমানে দ্বীপটিতে উপজাতিটির নিজেদের জগৎ। পৃথিবীতে হাতে গোণা এমন কয়েকটি আদিম উপজাতি আছে যারা এখনো বাইরের কারোর সাথে মিশতে চায় না। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গলে আছে বেশ কয়েকটি। আর পাপুয়া নিউগিনিতে কিছু। আন্দামান ও নিকোবরের বড় দ্বীপগুলিতে এরকম আরো কয়েকটি আদিম উপজাতি আছে। এরা আজকাল মূল ভূখন্ডের লোকেদের সাথে অল্পবিস্তর মিশলেও কিছু উপজাতি এখনো আলাদাই থাকে। তবে সেন্টিনেলিরা সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্র।(১) এগুলো সব মিলিয়ে একটা ধরছি। তাহলে হল সাড়ে চার।

    শেষেরটা একটু অন্য রকম। এই 'রাষ্ট্রটি' ভারত ভূখন্ডের কোন অংশের ওপর অধিকার দাবী করে না। এদের দাবী অন্য একটি ভূখন্ডের ওপর, তিব্বত। সেইসাথে ভারতে বসবাসকারী প্রায় ১০০,০০০+ তিব্বতি উদ্বাস্তুদের ওপর এদের প্রতীকি শাসন চলে। দিল্লীর সরকার এদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছেন। নাম - সেন্ট্রাল টিবেটান অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন। ( http://tibet.net/ ) রাষ্ট্রের যা যা উপকরন লাগে তার কিছু কিছু আছে এদের। ক্যাবিনেট আছে, মন্ত্রীমন্ডল আছে, প্রেসিডেন্ট আছেন। স্টেট উইদিন এ স্টেট। এই হল সাড়ে পাঁচ। এনারা কিন্তু গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বলতে অজ্ঞান। মানে বর্তমান চিনের ঠিক উলটো আর কি। কোদ্দিয়ে স্থাপিত হল এই সরকার?

    ১৯৩৬ সাল। লুংশার নামে তিব্বতের এক উচ্চশিক্ষিত আমলা প্রস্তাব দিলেন তিব্বতের শাসনতন্ত্রকে একটু পরিস্কার করা যাক। ভদ্রলোক ইংল্যান্ডে ঘুরে এসেছিলেন। তো বিলেতের রকমসকম দেখে ওনার মনে ধরে তিব্বতেও ঐরকম সাংবিধানিক শাসন প্রচলন করলে কেমন হয়। সেই সাথে হালকা করে দু'একটা জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। তিব্বত তখন এক তেঁতুলে গোঁড়া থিওক্রেসি। আজকের সৌদি আরব কোথায় লাগে। সৌদিতে রাজা আর মক্কা মসজিদের ইমাম দুই আলাদা লোক। সব ক্ষমতা রাজপরিবারের কিন্তু পুরুতের রোলটা অন্তত রাজা ছেড়ে দিয়েছেন। লাসায় রাজা ও পোপ মিলে একজনই - দলাই লামা। শব্দটির অর্থ 'ধর্মসাগর'। পদটি বংশানুক্রমিক ছিল না। সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে হাত বদল হত। ১৯৩৬ সালে ত্রয়োদশতম ধর্মসাগরের শাসন চলছে। ক্রিষ্টাল পিউর সামন্ততন্ত্র। সব চাষের জমি কিছু অল্প বড় জমিদারের হাতে। প্রজাদের একটা বড় অংশ ক্রীতদাস। বড় বড় মঠগুলোতে হাজারে হাজারে ক্রীতদাস নিযুক্ত। চুরির শাস্তি হস্তচ্ছেদ। এই পরিবেশে লুংশারের প্রস্তাবের যা ফল হতে পারত তাই হল। শুনে মন্ত্রী আমলারা হুকুম দিলেন ব্যাটার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। কি রকম শাস্তি? চমরী গাইএর হাঁটুর হাড়। মাথাটা পালিশ করে মসৃণ করা। চামড়ার বেল্ট দিয়ে বেঁধে ঐরকম দু'খন্ড হাড় কপালের ওপর বসানো হবে। তারপর একটা কাঠের টুকরো বেল্টটার ভেতরে ঢুকিয়ে স্ক্রূএর মতন প্যাঁচ দেওয়া হবে যাতে হাড়জোড়াটা কপালের ওপরে চেপে বসতে শুরু করে। প্যাঁচ দেওয়া চলতে থাকবে যতক্ষণ না দুই চোখের মণিগুলো চাপে ঠিকরে বেড়িয়ে এসে মাটিতে টপাক করে পড়ে! সেই শাস্তি দেওয়া হল লুংশারকে। কিন্তু প্রসেসটা ঠিক করে সম্পন্ন হল না। শুধু একটা চোখের মণি বেড়িয়ে এল। তখন অন্যটাকে ছুরি দিয়ে উপড়ে আনল ঘাতকরা। তারপর দুই চোখের কোটরে গরম তেল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়।(২)

    এই ছিল ডি ফ্যাক্টো স্বাধীন তিব্বত। ১৯৫০ সালে চিন আবার তিব্বতে ফিরে এল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিব্বতের শাসনব্যবস্থায় চিন হাত লাগায়নি। পরের বছর বেজিং লাসার সাথে একটা চুক্তি করল। ১৭ দফার সেই চুক্তিতে তিব্বতের সাথে চিনের সম্পর্ক কি হবে, তিব্বতের অভ্যন্তরীণ শাসনপ্রণালী, বৌদ্ধমঠ ও ধর্মীয় শাসনরীতি এই সমস্তর একটা ফ্রেমওয়ার্ক খাড়া করল চিন।(৩) চিন তিব্বতকে অভ্যন্তরীণ স্বশাসন দিল। দলাই লামা (ততদিনে চতুর্দশতম বা বর্তমান যিনি) ও তার অনুসারীরাই ক্ষমতায় রইলেন। চিন আরো ঘোষণা করল তিব্বতের প্রচলিত ধর্মীয় রীতিগুলিকে মেনে চলা হবে। কিন্তু একটা জায়গাতে পার্টি ছাড়ল না। চিন ক্রীতদাসপ্রথা বন্ধ করল। সেইসাথে ভূমিসংস্কার শুরু হল। তবে চিনের অন্যান্য এলাকায় যেরকম এক ধাক্কায় হয়েছিল সেরকম নয়, ধাপে ধাপে। বলাই বাহুল্য তিব্বতের অভিজাতশ্রেণী এতে আদৌ খুশি হয় নি। ঝামেলা বাড়তে বাড়তে ১৯৫৯ সালে এরা বিদ্রোহ করলেন। চিন গ্লাভস খুলল। বিদ্রোহ দমন করার পর তিব্বতের স্বশাসন কেড়ে নিল বেজিং। দলাই লামা সমেত তিব্বতের অভিজাত শ্রেণীদের একটা বড় অংশ পালিয়ে এলেন ভারতে। এদেরকে নিয়েই পরবর্তীকালে ভারত "সেন্ট্রাল টিবেটান অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন" বানায়। সেই যে সাঁকো নড়েছিল আজও নড়েই চলেছে।

    অন্যদিকে ১৯৫০ সালে ভারত একটু হাঁফ ছেড়ে উঠতে পেরেছে। পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুস্রোত থিতিয়ে এসেছে। কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ ভারতের হাতে। এইবার নেহেরু নজর দিলেন উত্তরের সীমারেখার দিকে। ১৯৫০ সালের নভেম্বরে নেহেরু পার্লামেন্টে জানালেন আসাম-তিব্বতের মাঝের সীমারেখা ১৯১৪ সালের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ঠিক হয়ে গেছে - ম্যাকমোহন লাইন বরাবর। এমপিরা প্রশ্ন করলেন তিব্বত কি ঐ লাইনটা স্বীকার করে? আর চিনের ম্যাপে তো ঐ এলাকাটা চিনের বলে দেখাচ্ছে। নেহেরু ধমক দিলেন দেখাচ্ছে তো কি হয়েছে! আমরা যখন বলছি তখন ওটাই আমাদের সীমারেখা! এইখানে প্রথম ব্রিটিশ অ্যাপ্রোচের থেকে চ্যূতি ঘটল। একতরফা সীমারেখা ঘোষণা করা। ১৯৫১ সালে তাওয়াং দখল করে ম্যাকমোহন লাইনকে ম্যাপ থেকে মাটিতে সম্পন্ন করল ভারত। চিন কোন উচ্চবাচ্য করল না। আগে যে কথা লিখেছি। চিন শুধু প্রস্তাব দিল, ১৯৫২য়, ব্রিটিশ আমল থেকে তিব্বতের ওপর ভারতের যে যে 'অধিকার' আছে সেগুলো স্ট্রীমলাইন করা হোক। কিন্তু সীমারেখা নিয়ে চিন কিস্যু বলে নি। নেহেরু ধরে নিলেন এর অর্থ চিন ম্যাকমোহন লাইনকে ডি জ্যুর মেনে নিচ্ছে। খুব ভুল করলেন। ঐ বছর এক দূরদর্শী ভারতীয় কূটনীতিক, জি এস বাজপাই নেহেরুকে পরামর্শ দিলেন একতরফা সীমানা ঘোষণা না করে চিনকে অন্তত ফর্ম্যালি জানানো হোক। "ম্যাকমোহন লাইনটা" - বাজপাই চিঠিতে লিখলেন - "ঔপনিবেশিক আমলে চিনের ওপর ব্রিটেন চাপিয়ে দিয়েছিল। চিনের কাছে ওটা একটা ক্ষতের মতন হতে পারে। চিনের সাথে কথা বলুন। চিন একাধিক বার এর আগে জানিয়েছে যে তারা ম্যাকমোহন লাইন ও সিমলা চুক্তি স্বীকার করে না। সুতরাং নিজের থেকে কিছু ধরে নেবেন না"। খুব প্রেসিয়েন্ট কথাটা লিখেছিলেন ভদ্রলোক। নেহেরু চিনে ভারতের রাষ্ট্রদূত কে এম পানিক্করের সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিনকে আগবাড়িয়ে কিছু না বলাই ঠিক হল। দ্বিতীয় ভুল।

    যাই হোক চিনের প্রস্তাব মতন ১৯৫৪ সালে চিন-ভারত বৈঠক বসল তিব্বতের ওপর ভারতের 'অধিকার' নিয়ে। শুল্ক, বাণিজ্য, তীর্থযাত্রা, লাসার কনস্যুলেট এইসব পলিসিগুলো স্ট্রীমলাইন হল। দু'পক্ষই জানত যে এক অপরের ম্যাপে পার্থক্য আছে। অরুণাচল ও আকসাই চিন দুইদিক থেকেই দাবী করে। কিন্তু কোন পক্ষই সীমারেখা নিয়ে মুখ খুলল না। সাথে সাথে এই বৈঠকেই সেই বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) 'পঞ্চশীল' ঘোষণা হল। ভারত-চিনের সম্পর্কে এই বছরটা হাই পয়েন্ট। কিন্তু বিপদ গোকূলে বাড়ছিল। বৈঠকে শেষের ঠিক তিন মাসের মাথায় নেহেরু ও তার অধঃস্তনরা এক অবিশ্বাস্য কাজ করলেন। যতই ঘোটালা থাকুক সিমলা চুক্তিতে অন্তত তিব্বতি প্রতিনিধিদের সইটুকু ছিল। আকসাই চিনে কিছুই কোন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই। এলাকাটি সম্পূর্ণ জনবিরল। আকসাই চিনের দক্ষিণে দেমচক এলাকায় একটা দু'টো তিব্বতি গ্রাম ছিল শুধু। কাশ্মীরে এতদিন ধরে সেই জনসন লাইনটাই ভারত ম্যাপে দেখিয়ে আসছিল। ১৯২৭ সালে ব্রিটেন শেষ যে লাইনটা টেনেছিল (অপ্রকাশিত), জনসন লাইনকে উত্তরের দিকে একটু কমিয়ে, সেইটাকে নেহেরু একতরফা লাদাখের 'সুনির্ধারিত ও পাকা' সীমা বলে ঘোষণা করে দিলেন ১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে! ম্যাপে আকসাই চিন দেখানো হল ভারতের দিকে। এবং ব্রিটিশ আমলে যে 'সীমানা অনির্ধারিত' লেখা থাকত সেটা উঠে গেল। নেহেরু চিনের সাথে কথা বলাও প্রয়োজন বোধ করলেন না। বা বলা ভাল জেনে বুঝেই কথা বললেন না। ভারত জানত সিমলা চুক্তিতে ঘোটালা আছে। চিন মানে না। অতএব আকসাই চিন নিয়ে কথা বলতে গেলে উল্টোদিকে চিন অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। অন্যদিকে চিন ম্যাকমোহন লাইনটাকে মোটের ওপরে মেনে নিয়েছে। আকসাই চিন যদি ভারত নিজের ম্যাপে দেখাতে শুরু করে তাহলে বোধহয় ওটাও মেনে নেবে। অনৈতিক,অদূরদর্শী এবং ভুল সিদ্ধান্ত।

    বাস্তবে অবশ্য আকসাই চিনে ভারতের কোন উপস্থিতি ছিল না। ১৯৫৪ সালে যখন নেহেরু ঐ ঘোষণা করলেন তখন সবথেকে অগ্রবর্তী সেনাঘাঁটি ছিল চুসুলে (৩৩.৩, ৭৮.৩), প্যাংগং হ্রদের ধারে। আকসাই চিনের অনেক দক্ষিণে। এর তিন বছর বাদে ১৮৫৭য় ভারত খবর পেল আকসাই চিন এলাকার মধ্যে দিয়ে চিন একটি রাস্তা বানিয়েছে। তখনও আকসাই চিনে গিয়ে পৌঁছয় নি ভারত। চিনেরই একটি খবরের কাগজে রাস্তাটির নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হওয়া নিয়ে একটা রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। সেইটা বেজিংএ নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের চোখে পড়ে। তিনি দিল্লীতে তড়িঘড়ি খবর পাঠালেন। ব্যাস। তুলকালাম পড়ে গেল। বিপক্ষদলের রাজনীতিকরা তখন প্রত্যহ নেহেরুর মুন্ডপাত করতে শুরু করলেন। কংগ্রেসের ভেতরেও ক্ষোভ বাড়তে শুরু করল। আমাদের মাটি দখল করেছে চিন! বিমানবাহিনী পাঠিয়ে ঐ রাস্তা ধ্বংস করছে না কেন ভারত?! নেহেরু ফাঁদে পড়লেন। অথচ কেউই একবার ভাবল না বাপু হে ওটা যদি ভারতের 'ঐতিহাসিক পাকা' সীমাই হয়, 'অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ' বলে ভারত দাবী করে,তাহলে চিন ভারতের চোখ লুকিয়ে রাস্তাটা বানালো কি করে? একটা গোটা রাস্তা। পুঁচকে ওয়াচ টাওয়ার বা বাঙ্কার নয়। উত্তর - অঞ্চলটিতে কোন কালেই ভারতের কোন উপস্থিতি ছিল না। চিনের ছিল। কিন্তু সেসব কথা ভাবার সময় তখন কোথায়।

    চিন ততদিনে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। চিন ভাবল ঐ দূর্গম পাহাড়ের এলাকা নিয়ে ভারত এত উত্তেজিত কেন? ওখানে তো সত্যিই বাপের জন্মে কোনকালে কোন সীমাচুক্তি হয় নি। ভারত বোধহয় ভুল বুঝছে। তাছাড়া চিন ম্যাকমোহন লাইন বেআইনি হলেও মেনে নিয়েছে। ভারতকে বোঝালে বোধহয় ভারত চিনের সাথে কথা বলে মিটিয়ে নেবে। নেহেরুর সাথে তখন চিনের সম্পর্ক এমনিতে খুবই ভাল। সীমান্তে ভুল করলেও চিনের প্রতি নেহেরুর প্রকৃত সহৃদয়তা ছিল। কিন্তু নেহেরু ও ভারত উল্টোদিকে ভাবল ভারত চিনকে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে সম্পূর্ণ সাহায্য করছে। আমেরিকার বিরুদ্ধে গিয়ে। চিন কেন ভারতের দিকটা দেখবে না? চিন কি তবে মুখে এক আর কাজে আর এক? নেহেরু স্রেফ বুঝে উঠতে পারলেন না যে একতরফা কারোর এলাকা দখল করে নিলে অন্য দিকে তাকে যতই দাও সে শুনবে না। বিশেষত ভারত যখন ইতিমধ্যেই ৬৮০০০ বর্গকিমি অরুণাচল প্রদেশে খেয়ে বসে আছে। শিঙে শিঙ আটকে গেল দুই দেশের। অথচ আগামী খন্ডে চিনের সাথে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলির সীমান্ত চুক্তিগুলি দেখলে বুঝতে পারবেন একটু ঠান্ডা মাথায় ভারত ব্যাপারটা ভেবে দেখলে অনায়াসে দু'পক্ষকেই খুশি করার মতন একটা ডিল হয়ে যেতে পারত।

    এরপর কি হল সেই কাহিনী আপনাদের জানা। চিৎকার চেঁচামেচি, সেনাদের মধ্যে অল্প মারপিট, বেশী মারপিট, রক্তপাত, প্রবল রক্তপাত, 'হিন্দি-চিনি ভাই ভাই' দি এন্ড, চিন আমাদের 'ঠকিয়েছে' -- ভারত ভেবেছিল 'ব্রিটিশ অফ এশিয়া' হবে। ইল্লি আর কি -- চিন আমাদের পিঠে ছুরি না মারলে ভারত যুদ্ধে কক্ষণো হারত না -- ভারত 'সেকেন্ড হ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম' করতে চেষ্টা করেছে চিনের ওপর, আমাদের জমি দখল করতে চেষ্টা করেছে, বেশ করেছি পেঁদিয়েছি, আবার প্যাঁদাবো -- কি বললি?! জানিস রামায়ণে আকসাই চিনের উল্লেখ আছে -- এই চুপ করতো, যা ছেঁড়গে যা -- বদলা আমরা নেবো মনে রাখিস -- যা করবি করে নে।

    চলবে।

    --------------------------------------------------------------

    মূল তথ্যসূত্র - India's China war - নেভিল ম্যাক্সওয়েল।

    ১.


    ২. A History of Modern Tibet, 1913-1951: The Demise of the Lamaist State, p. 208. http://bit.ly/2j34zfX

    ৩. https://en.wikipedia.org/wiki/Seventeen_Point_Agreement_for_the_Peaceful_Liberation_of_Tibet
  • b | 24.139.196.6 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ২১:৫২367005
  • লুংশারের কেসটা ইন্টারেস্টিং। উইকি করে দেখলাম যে উনি ত্রয়োদশ দলাই লামার প্রোটেজে ছিলেন। ত্রয়োদশ দলাই লামা মারা যাবার পরে আভ্যন্তরীন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হেরে যান।

    **
    তবে জমে ক্ষীর। এই ফাঁকে একটু সাইনো সোভিয়েট হবে নাকি?

    *****
    অনেকগুলো লুজ এন্ড আছে। এগুলোকে জোড়া দিয়ে একটা চটি হবে নাকি?
  • দেব | 135.22.193.149 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১০:৫৩367006
  • @b - হ্যাঁ ঐ স্প্লিটটা হয়ে গুটিয়ে আনব।
  • amit | 213.0.3.2 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৯:০৪367007
  • যাক, খুঁজে পেয়েছি। গত কদিন ধরে কি সব ভাটের কীর্তন চলছে, এক গুচ্ছ ঢপের বাঁচা বাড়া মার্কা টুই এর মধ্যে ইটা হারিয়ে ফেলছিলুম। তুলে দিলাম।

    ১৯৬২ এর পরে অরুণাচল এর সীমা এখন ঠিক কোথায় ? সেটা কি ম্যাকমোহন লাইনের আশে পাশে ? এই দলাই লামার খেলা টাও ঠিক বুঝতে পারিনা। ভদ্রলোক আন্তর্জাতিক পলিটিক্স এ বেশ ভালো ল্যাজে খেলেন, নোবেল তা বাগিয়ে নিয়েছেন ঠিক। ধর্মশালায় Tibet এর যে এক্সিল গভর্নমেন্ট, ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ কি সেটাকে স্বীকার করে ?
  • দেব | 135.22.193.149 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১২:২৬367008
  • ১৯৬২র যুদ্ধে চিন পুরো অরুণাচল দখল করেছিল। যুদ্ধ শেষ হলে মাস দুয়েক পরে আবার ছেড়ে চলে যায়। ভারত আবার গুটিগুটি ম্যাকমোহন লাইন অবধি ফিরে আসে। আজও ঐটাই কাজচালানো বর্ডার। চিনের আশা ছিল ভারতকে একটা ঝটকা দিলে ভারত হয়তো আকসাই চিন নিয়ে জিদ ছেড়ে দেবে। একটা দ্বিপাক্ষিক সীমাচুক্তি করে লাইনটা ফাইনাল হয়ে যাবে। চিন আংশিকভাবে সফল হয়। ঐ লজ্জাজনক হারের পর নেহেরু আকসাই চিনে সেনা পাঠানো বন্ধ করেন। আকসাই চিনে আজও ভারত চিনের ক্লেম লাইন মেনে চলে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সীমাচুক্তি পায় নি চিন। ভারত সেই থেকে আজ অবধি আকসাই চিনের দাবী ছাড়েনি।

    তবে ব্যাপারটা এখন এমন হয়ে আছে যে সীমাচুক্তি না হলেও কিছু যায় আসে না। পূর্ব সীমান্তে চিন ম্যাকমোহন লাইন মেনে নিয়েছে। পশ্চিম সীমান্তে ভারত চিনের ক্লেম লাইন মেনে নিয়েছে। বর্ডার এখন ঠান্ডা। এফেক্টিভলি ঝৌ এইটাই অফার করেছিলেন নেহেরুকে। সেইটাই হল। তবে ভারতের মিডিয়া মাঝে মধ্যেই না বুঝে চেঁচায়।

    দলাই লামাকে নিয়ে পলিটিক্সটা শুরু করেছিল আমেরিকা। ৫০এর দশকে চিনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক তলানীতে ঠেকলে তখন আমেরিকা তিব্বতিদের কাল্টিভেট করা শুরু করে। ১৯৫৯এর পর ভারতে যে সব তিব্বতিরা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে একটা জঙ্গি সংগঠন বানায় সিআইএ। নাম - চুশি গাংদ্রুক। নেহেরুর দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়াটা ছিল ৬২র যুদ্ধের অন্যতম কারণ। যুদ্ধের পর ভারত থেকে তিব্বতে জঙ্গি পাঠানো শুরু করেন নেহেরু, সিআইএর মদতে। অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন বিজু পটনায়েক, ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নবীন পটনায়েকের বাবা। অর্থাৎ এ সেই চিরাচরিত ফর্মুলা। কোন দেশের মধ্যে কোন একটা মাইনরিটিকে নিয়ে ঝামেলা থাকলে তাদেরকে উসকাও। ৬২র পরে ভারত ও আমেরিকার ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা এক জায়গায় মিলে গিয়েছিল - চিনকে ঠেঙাও যেভাবে পারো। আমেরিকা থেকে হুলিয়ে অস্ত্রশস্ত্র আমদানী শুরু করে ভারত। নন-অ্যালাইনমেন্ট পলিসি ততদিনে শেষ। আরেকটু হলেই ভারত 'ফ্রি ওয়ার্ল্ড' ক্যাম্পে ঢুকেই যাচ্ছিল কিন্তু ১৯৬৫তে পাকিস্তানের সাথে ক্যাঁচালটা বেধে গিয়ে ঝুলে গেল। পাকিস্তানও তখন আমেরিকার ক্যাম্পে। ভারতের থেকে বেশী মাত্রায়। দুই ক্লায়েন্টের মধ্যে ঝামেলা লাগায় আমেরিকার শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশা। আমেরিকা কাউকেই কিছু সাহায্য দিল না ৬৫র যুদ্ধে। তবে রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে একটা সন্ধিপ্রস্তাব ব্রোকার করেছিল, তাসখন্দে।

    http://www.hindustantimes.com/india/the-curious-case-of-establishment-22/story-eiDenZvNioffJFupLzNGOI.html

    কয়েক বছর আগে ম্যাপে দেখেছিলাম কটকের কাছে একটা ছোট বিমানবন্দর আছে। কৌতুহলী হয়ে খুঁজে দেখি ওটা সিভিলিয়ানদের জন্য নয়। বায়ুসেনার ঘাঁটি। সম্প্রতি জানলাম বায়ুসেনাও নয়। ওটা RAWএর ঘাঁটি। চারবাতিয়া বেস। এইখানেই ট্রেনিং দেওয়া হত তিব্বতিদের। ৬২র পরে (বা হয়তো আগেও) সিআইএ এখানে একটা এরিয়াল অবসার্ভেশন পোষ্ট বানায়। এই ঘাঁটি থেকে পেটে ক্যামেরা লাগানো গুপ্তচর প্লেন রওনা দিত চিনের ওপরে নজরদারী করতে। পাকিস্তানের পেশোয়ার বেস থেকে যেমন ছিল রাশিয়ার জন্য। ভারত থেকে তেমনি চিন।

    http://magazines.odisha.gov.in/Orissareview/2016/August/engpdf/42-45.pdf

    দলাই লামা এই পুরো ব্যাপারটাতেই যুক্ত ছিলেন। ওনাকে ১৯৫৯ থেকে মাসে মাসে একটা ভাতা দিতে শুরু করে আমেরিকা। ১৫০০০ ডলার করে। আজকের দিনে মাসে ১৫০০০ ডলার মানে আমেরিকায় আপনি বড় ডাক্তার বা উকিল। সেই আমলে ১৫০০০ ডলার! ১৯৭১ এ নিক্সন চিনের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ভূরাজনীতি। তখন অবশেষে সিআইএ ক্ষ্যামা দেয়। ভাতাটা ১৯৭৪ সালে বন্ধ করে দেয় সিআইএ।

    http://www.nybooks.com/daily/2013/04/09/cias-cancelled-war-tibet/

    তবে ধর্মসাগরকে এইভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াটা ইউএস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশনের খারাপ লাগছিল। তাই অহিংসার দূতটিকে ১৯৮৯ সালে নোবেলটা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। চিন এমনি এমনি নোবেল 'শান্তি' পুরস্কার নিয়ে খিল্লি করে না।

    ধর্মশালার ঐ এক্সাইল তিব্বতি সরকারকে কেউই স্বীকার করে না এখন। ভারতও নয়। এককালে 'ফ্রি ওয়ার্ল্ডের' সদস্যরা করত অবশ্য। সেই ৬০, ৭০এর দশকে। আজকের দিনে ভারত ও আমেরিকা দুই পক্ষই তিব্বতিদের কাটিয়ে দিয়েছে। ওনাদের তো আর তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে আবার ঝামেলা বাধলে হয়তো আবার পকেট থেকে বের হবে।
  • অ্যান্ডালগ্যালর্নিস | 131.241.218.132 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৩:০২367009
  • লেখাটা ভালো লাগছে। ম্যাক্সওয়েলের বইটা পড়েছি। এক কালে ৬২এর যুদ্ধ নিয়ে বাংলা ফোরামগুলোতে রেগুলার খিটিমিটি লাগতো - কমিদের দেশদ্রোহীতা ইত্যাদি :-p

    তিব্বতের বইখানা নামাতে দিলুম। অনেক আগে একটা লেখা পড়েছিলুম - মাইকেল পেরেন্টি-র - ফ্রেন্ডলি ফিউডালিজম বলে। সেটা এখানেও দিয়ে দিই -

    http://www.michaelparenti.org/Tibet.html
  • সিকি | 158.168.40.123 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৩:০৮367010
  • উফফ, জাস্ট অসম্ভব অবিশ্বাস্য। এ জিনিস প্রথমে ভেবেছিলাম ব্লগে রাখব। কিন্তু এ বই হয়ে বেরোনর যোগ্য। অতুলনীয় লেখা। অতুলনীয়। পুরো বাঘের মত টই হচ্ছে একটা।
  • অ্যান্ডালগ্যালর্নিস | 131.241.218.132 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৩:২৬367011
  • Scribd-কে পেইড সার্ভিস করে দিয়ে মেরে দিয়েছে। ম্যাক্সওয়েলের বইটা কখনো নামিয়েছিলুম, এখন আর খুঁজে পাই না (মানে কম্পুতে)। এদিকে স্ক্রিবডি থেকে নামাতে গেলে বলে এক মাসের ফ্রী অ্যাকাউন্ট খোলো - ক্রেডিট কার্ড ডিটেলস দাও...
  • PP | 159.142.103.12 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:১৩367012
  • ব্লগে নয় সিকি দা এটা বই চাইই চাই। আমি আগাম বুক করে গেলুম।
  • শঙ্খ | 113.242.197.187 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ২২:১০367013
  • এই খানে একটা কপি আছে, চলেবল টাইপ http://philoshistorydepartment.weebly.com/uploads/1/2/8/7/12870319/indias_china_war_neville_maxwell_natraj_publishers_1997.pdf

    আর লেখা নিয়ে বলার কিছু নেই। একটাই অনুরোধ, আরো চলুক, দুম করে যেন বন্ধ না হয়ে যায়, দরকার হলে আরেকটু বিশদে, খেলিয়ে খেলিয়ে, মানে, বুঝতেই পারছেন ঃ) দা শো মাস্ট গো অন
  • দেব | 113.72.58.226 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৭:৪০367014
  • @অ্যান্ডালগ্যালর্নিস

    নেভিল ম্যাক্সওয়েলের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। উনি এবং হাতে গোণা কয়েকজন গবেষক, বিশেষ করে অ্যালিস্টার ল্যাম, না থাকলে আসল ইতিহাসটা হয়তো ঠিক করে সামনে আসত না।
  • দেব | 113.72.58.226 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৭:৫৪367016
  • ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ শেষ হলে চিন একটু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পেল। ঘর ঠান্ডা হলে বিদেশনীতিতে প্রথম কাজ প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সীমানা নির্ধারণ। চিনের সীমারেখা বিশাল। ১৯৫০এর দশকে রাশিয়া ও চিন এই দুই দেশের স্থলপ্রতিবেশী দেশের সংখ্যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ -১২। ভারত ৭ (গোয়া পুনরুদ্ধারের পরে ৬, বাংলাদেশের জন্মের পরে ৭, সিকিমের ভুক্তিকরণের পরে আবার ৬)। বিগত এক শতাব্দীর খাপচা খাপচিতে প্রায় প্রতিটির সাথেই চিনের গ্যাঁড়াকল লেগে আছে। প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিবেশী দেশই চিনের হয় এক'দুটুকরো খেয়ে বসে আছে নয়তো দাবী করছে। এরা ঠিক নিজেরা করেনি অবশ্য। ইউরোপীয় শক্তিগুলি চিনের প্রতিবেশী দেশগুলিকে দখল করার পর চিনের গায়েও খাপচা মারে। ভারত ও বার্মায় ম্যাকমোহন লাইন জারী করার চেষ্টা করেছিল ব্রিটেন। ভিয়েতনাম ও লাওসে একইরকম জিনিস করেছে ফ্রান্স। এই দেশগুলি স্বাধীন হবার পর সেই বিবাদগুলো উত্তরাধীকার সূত্রে পেল। রাশিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ায় কাজাকস্থান, তাজিকিস্তান এই দেশগুলির সাথেও ৯০এর দশকে এসে মিটমাট করতে হয়েছিল।

    চিন বুঝলো কেলো করেছে। এতগুলো প্রতিবেশীর সাথে বিবাদ মারাত্মক ব্যাপার। জমি, যত সামান্যই হোক জাতীয় ইজ্জতের সাথে জড়িত। চিনের কাছেও যেমন প্রতিবেশী দেশগুলির সাথেও তেমন। চিন এইখানে একটা অত্যন্ত দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিল। চিন ঠিক করল জমির থেকে প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সুসম্পর্ক বেশী দামী। জমি হয়তো চিন মেরে কেড়ে নিতে পারবে। কিন্তু তাহলে বরাবরের মতন প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক বিষিয়ে যাবে। খুব বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। ১৯৫৫ সালে বান্দুং সন্মেলনে ঝৌ এন লাই চিনের সীমানা নীতি ব্যাখ্যা করলেন - "চিনের ১২টি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অধিকাংশের সাথেই চিনের সুনির্ধারিত পাকা সীমারেখা নেই। আমরা এই দেশগুলির সাথে কথা বলে যৌথ ঐক্যমতের ভিত্তিতে সীমারেখা পাকা করতে চাই। যতদিন সেটা না হচ্ছে আমরা সীমানায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখব।"

    সেই মত চিন কথা বলতে বেরোল। সবার প্রথমে বার্মা। উত্তরের কাচিন রাজ্যের প্রায় ৫০০০ বর্গকিমি এলাকা নিয়ে দ্বন্দ। সেই ম্যাকমোহনের কীর্তি। এর বাইরেও কয়েকখন্ড জমি বার্মার পূর্বের শান রাজ্যে; সেগুলো নিয়েও ঝামেলা ছিল। তার উপরে কুয়োমিং তাং এর অবশিষ্ট কিছু সেনা, আমেরিকার অস্ত্রে সজ্জিত, বার্মা থেকে হানা দিচ্ছিল চিনের ভেতরে। ব্যাপারটা যত দ্রুত সম্ভব মেটানো দরকার হয়ে পড়ল। ১৯৫৮ সালে আলোচনা শুরু হল। চিন বিনা বাক্যব্যয়ে ম্যাকমোহন লাইনের বার্মার অংশটা মেনে নিল। এর বাইরে অন্যান্য যা কিছু জমিখন্ড ছিল সেগুলোতেও মাঞ্চু আমলের অধিকাংশ দাবী ছেড়ে দিল চিন। ফর ইটস পার্ট বার্মাও চিনের দিকটা দেখল। ভারতের মতন একেবারে গেঁড়ে বসে না থেকে সামান্য কিছুটা জমি চিনকে ফেরত দিল বার্মা। যতটুকু জমি নিয়ে বিবাদ ছিল তার ১০% গেল চিনের ভাগে। ৯০% বার্মায়। ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে সীমাচুক্তিতে মোহর পড়ল। এরপর নেপাল। সেখানেই একই চিত্র। যৌথ আলোচনায় কোন এলাকায় কার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আছে তার ভিত্তিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত। এভারেষ্ট পর্বতটা অবশ্য দুজনেই চায়। বাউন্ডারী কমিশন বলল ঠিক আছে ওটাকে দু'ভাগ করে নাও। সীমারেখাটা ঠিক এভারেষ্টের চূড়ো দিয়ে যাবে। ডিল - বার্মার সাথে চুক্তির ঠিক একবছর পর, ভারতের সাথে যুদ্ধের ঠিক একবছর আগে - ১৯৬১র অক্টোবর। এরপর পাকিস্তান। পাকিস্তান প্রথমে চিনকে ঠিক বিশ্বাস করেনি। তখন পাকিস্তান 'ফ্রি ওয়ার্ল্ডের' অংশ, মনে করুন। কিন্তু এক আন্তর্জাতিক সন্মেলনে বার্মার প্রতিনিধিরা পাকিস্তানীদের সঙ্গে দেখা হলে তারা পাকিস্তানীদের আপ্লুত হয়ে জানালেন চিন খুব ভাল মশাই। আমাদের সাথে কোন জোর করেনি। আপানারা টক করে সীমাচুক্তিটা সেরে নিন। আয়ুব শুনে বললেন তাই নাকি। দ্রুত আলোচনা শুরু হল। যেটুকু অংশ নিয়ে দ্বিমত ছিল প্রায় আধা আধি ভাগ চিন পাকিস্তানকে দিয়ে দিল। ১৯৬৩র মার্চে ডিল। ঐ বছরই নভেম্বরে আফগানিস্তানের সাথেও রাশিয়া ও ব্রিটেনের টানা সীমানাটুকুতে (১৮৯৫ সালের) সই করে দিল চিন।

    বার্মা, পাকিস্তান ও নেপাল, এই তিনটি উদাহরণ থেকে চিনের সীমানা নির্ধারণ প্রণালীটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন। মারপিট নয়। চিৎকার নয়। গালাগাল নয়। ছোট প্রতিবেশীকে জোড় করা বা ভয় দেখানো নয়। ঠান্ডা মাথায় কথা বলে সমস্যা মেটাও। কিছু ছাড়ো। বদলে কিছু চাও। চিনের সাইকোলজিটা ছিল এই রকম -

    ১. যেখানে আগে থেকেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে সেখানে চিন সেই চুক্তি মেনে চলবে। তা সে চুক্তি উনবিংশ শতাব্দীতে চিনের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়ে থাকলেও। মাঞ্চু আমলে এরকম অনেকগুলি চুক্তি ইউরোপীয় শক্তিগুলি চিনের ঘাড়ে চাপিয়েছিল। সেই প্রথম চিন-ব্রিটেন যুদ্ধ দিয়ে শুরু। ঐ যুদ্ধের পর নানকিং এর চুক্তিতে (আগে খন্ডে দেখুন) ১৮৪২এ হংকং কেড়ে নেয় ব্রিটেন। চিনের ইতিহাসে এগুলি 'অনৈতিক' চুক্তি বলে পরিচিত। কিন্তু নৈতিক হোক বা অনৈতিক, চুক্তি চুক্তিই। চিন সেগুলি মেনে চলল। হংকং (বা ম্যাকাও) চিন চাইলেই কেড়ে নিতে পারত। ভারত যেমন গোয়াকে নিয়েছিল। কিন্তু চিন হাত গুটিয়ে রাখল।

    ২. যেখানে কোন চুক্তি নেই সেখানে কোন এলাকায় কার 'প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ' আছে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ নেই কিন্তু আবাং কথাবার্তা বললে চিন শুনবে না। ভারত সেই কীর্তি করল আকসাই চিনে।

    ৩. যেখানে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে কিন্তু অন্যপক্ষ চুক্তির বয়ান লঙ্ঘন করছে সেখানে চিন শুনবে না। এই কীর্তি করল রাশিয়া, উত্তর পূর্ব চিনের মাঞ্চুরিয়ায়।

    ৪. যেখান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই কিন্তু চুক্তির ভান রয়েছে সেখানে চিন শুনবে না। ভারত এই কীর্তি করল অরুণাচলে, সিমলা 'চুক্তির' দোহাই দিয়ে। বার্মার সাথে চিন চুক্তিতে রাজি হয়েছিল কারণ বার্মা সিমলা চুক্তির দোহাই দেয় নি। অথচ চিন কিন্তু ম্যাকমোহন লাইনের বার্মার অংশটুকু মেনেই নিল। অর্থাৎ চিন ডিল করবে 'সমান' অংশীদার হিসেবে। ঔপনিবেশিক কালের পেঁয়াজি মেরে জোর করলে চিন শুনবে না। চিনের দিকটা দেখতে হবে, সামান্য হলেও। বার্মা সহ এই তিনটি প্রতিবেশী দেশ সুস্থবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সেটা দেখল। কিন্তু ভারত এবং রাশিয়া ছড়িয়ে লাট করল।

    ভারতের সাথে ঝগড়াটার সম্বন্ধে লিখেছি। এবার রাশিয়ার সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডটা দিই। ক্যাঁচালের সূত্রপাত ১৮৫৮ সালে, দ্বিতীয় চিন-ব্রিটেন যুদ্ধের সময় থেকে। ঐ বছর আইগুন চুক্তি ও দু'বছর পরে ১৮৬০এ পিকিং চুক্তিতে রাশিয়া একটা বিশাল খাবলা মারল উত্তর-পূর্ব চিনে। মাঞ্চুরিয়া সংলগ্ন উত্তর পূর্ব চিনের এক বিশাল এলাকা, ৬ লক্ষ বর্গকিমির বেশী, রাশিয়াকে দিতে বাধ্য হল চিন। উত্তর-পূর্ব চিন প্রশান্ত মহাসাগরের থেকে উপকূল হারিয়ে স্থলবদ্ধ হয়ে গেল। উপকূল বরাবর প্রায় ২০০ কিমি চওড়া একফালি জমি নিল রাশিয়া। নিচের ম্যাপে দেখুন। হলুদ অংশটা ১৮৫৮য় নেওয়া। গোলাপীটা ১৮৬০এ। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম চিনের শিংকিয়াংএর দিকেও বিশাল একখন্ড এলাকা রাশিয়া নিজের পেটে ঢোকালো।



    পিকিংএ যে কাগজটায় দস্তখত হল তাতে উত্তর-পূর্ব এলাকায় চিন ও রাশিয়ার সীমারেখাটা টানা হল দুটো নদী বরাবর - আমুর ও তার উপনদী উসুরি। প্রশ্ন হচ্ছে একটা চওড়া নদী যদি আন্তর্জাতিক সীমানা হয় তাহলে সীমারেখাটা ঠিক কোন বরাবর যাবে? চিনের দিকের তীর বরাবর? না রাশিয়ার দিকে? নদীটির মাঝে চড়া পড়ে কোন দ্বীপ জন্মালে সেটা কার ভাগে পড়বে? পিকিং চুক্তিতে সেইটা আলাদা করে লেখা হয় নি। আলাদা করে লেখা না হলে সেক্ষেত্রে সাধারণত আন্তর্জাতিক পদ্ধতি হচ্ছে নদীর খাতের সবথেকে গভীর অংশ বরাবর সীমারেখাটা টানা হয়। মানে নদীটা দু'ভাগে ভাগ হবে। নদীর খাত বরাবর সবচেয়ে গভীর বিন্দুগুলিকে যোগ করে একটা কাল্পনিক রেখা টানলে যেটা হয় ভূগোলের ভাষায় সেই রেখাটিকে বলে থলওয়েগ। সেইটা হবে সীমারেখা। নদীর মাঝের কোন দ্বীপ থাকলে সেটি ঐ থলওয়েগের যে দিকে আছে সেই দিকের দেশের অংশ হবে। দুই দেশেরই অধিকার থাকবে নদীটিতে নৌপরিবহনের। পরিচ্ছন্ন ফর্মুলা।

    পিকিং চুক্তির ঠিক এক বছর পরে ১৮৬১ সালে পিটার কাজাকেভিচ নামে এক রাশ্যান অফিসার - উনি রাশিয়ার তরফে আইগুন ও পিকিং চুক্তির বাউন্ডারী কমিশনের প্রধান ছিলেন - চিনা প্রতিনিধিদের একটা ম্যাপ দিলেন। বললেন এই ম্যাপে দেখুন সুন্দর করে চুক্তিমাফিক উত্তর পূর্ব চিন ও রাশিয়ার সীমারেখাটা দেখানো রয়েছে। আসলে ওলাফ ক্যারোর মতন তিনিও ম্যাপে গুপি মেরেছিলেন। ম্যাপটা অত্যন্ত ছোট স্কেলে আঁকা হয়েছিল। তাতে উনি সীমারেখাটা আমুর-উসুরির থলওয়েগ বরাবর না দেখিয়ে দেখালেন চিনের দিক বরাবর। অর্থাৎ নদীদুটির মাঝের সবকটি দ্বীপ রাশিয়ার দিকে পড়ে গেল। সেই সঙ্গে আরেকটা স্পেশাল গুপি - আমুর ও উসুরি নদীদুটি যেখানে এসে মিলেছে সেই বিন্দু থেকে প্রায় ৩৫ কিমি আগে আরেকটা সরু নালা নদী দুটিকে জুড়েছে। নালাটির নাম ফুইউয়ান। ফলে এই তিনটি জলধারার মাঝে - আমুর, উসুরি ও ফুইউয়ান - একটা দ্বীপ রয়েছে। চিনাদের কাছে দ্বীপটির নাম 'ভালুক' দ্বীপ। রাশ্যানরা বলে বড় উসুরি দ্বীপ। এটা কিন্তু নদীখাতের দ্বীপ নয়। পিকিং চুক্তির বয়ানে পরিস্কার লেখা ছিল সীমারেখাটা যাবে আমুর ও উসুরি নদী বরাবর, নদীদুটির মিলনস্থল হয়ে। সুতরাং সীমারেখাটি চিনের দিকের তীর বরাবরও যদি ধরা হয় তাহলেও ভালুক দ্বীপ চিনের দিকেই পড়ে। কিন্তু কাজাকেভিচের ম্যাপে এই অংশে সীমারেখাটা দেখানো হল ফুইউয়ান নালাটি বরাবর। ফলে ম্যাপে গোটা ভালুক দ্বীপ চলে গেল রাশিয়ার দিকে। ভয় দেখিয়ে হোক বা ঠকিয়ে কাজাকেভিচ ঐ ম্যাপে চিনা প্রতিনিধিদের সই হাসিল করলেন। উপরের ম্যাপের ডানদিকের উপরের কোণের ইনসেট দেখুন। নীচের আরো পরিস্কার একটা ম্যাপ দিলাম। ভালুক দ্বীপটা লাল রঙে। উত্তরে আমুর। দক্ষিণ-পূর্বে উসুরি। দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে দেখুন যে সরু নালাটি দুটি নদীকে জুড়েছে ঐটা হচ্ছে ফুইউয়ান নালা।



    কাজাকেভিচের কীর্তি দেখে খুশি হয়ে রাশিয়ার সরকার ফুইউয়ান নালাটিকে তার নামে নামাঙ্কিত করল - 'কাজাকেভিচ প্রণালী'। আমুর ও উসুরি নদীর মিলনস্থলে রাশিয়া খাবারোভস্ক শহরের পত্তন করল। ভালুক দ্বীপের উল্টো তীরে। ১৯২০র দশক থেকে ভালুক দ্বীপেও রাশ্যানরা লোকবসতি স্থাপন শুরু করল। এই সময়কালটাতে চিনের আরো একটি বিশাল এলাকার উপরে রাশিয়া 'অধিকার' জমায় - মঙ্গোলিয়া। এর আগে লিখেছিলাম মঙ্গোলিয়ার কথা। আর আগে যাওয়ার আগে সেইটা শেষ করি।

    মঙ্গোলিয়া ও তিব্বত এক অপরের প্রায় মিরর ইমেজ। সে যুগে দুটি দেশই মাঞ্চু সাম্রাজ্যের অধীনস্থ স্বশাসিত রাজ্য। দুটিই স্বাধীন হতে চায়। দুটিই বৌদ্ধ থিওক্রেসি। তিব্বতের যেমন দলাই লামা আছেন মঙ্গোলিয়ারও তেমনি এক 'দলাই লামা' আছেন। উপাধী - জেসুন দাম্পা হু থুগ থু (হ্যাঁ এটাই)। ১৯১১-১২ সালে শিংহাই বিপ্লবে চিনের কেন্দ্রীয় শাসনব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়লে তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ব্রিটেন তিব্বতকে চিন থেকে বার করতে পারে নি। রাশিয়া কিন্তু মঙ্গোলিয়াকে পেরেছিল। রাশিয়া মঙ্গোলিয়াকে কাল্টিভেট করা শুরু করেছিল আরো কয়েক বছর আগেই। ১৯০৭ সালে চিনকে চাপ দিয়ে রাশিয়া মঙ্গোলিয়াকে দু'ভাগে ভাগ করায়। ইনার মঙ্গোলিয়া ও আউটার মঙ্গোলিয়া। আউটার মঙ্গোলিয়ার উপরে রাশিয়া কিছু 'অধিকার' জমায় কিন্তু আউটার মঙ্গোলিয়াকে চিনের 'সুজেরানিটিতে' রেখে। অর্থাৎ ঠিক যে প্রস্তাব কয়েক বছর পর সিমলায় হেনরী ম্যাকমোহন দিয়েছিলেন ১৯১৩ সালে, তিব্বতের সাপেক্ষে। 'ইনার', 'আউটারের' ফান্ডাটা ম্যাকমোহন কোথা থেকে পেয়েছিলেন আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চয়ই। যাই হোক ১৯১২ সালে জেসুন দাম্পা হু থুগ থু বোগদ খানের নেতৃত্বে এই 'আউটার' মঙ্গোলিয়া অঞ্চলটি স্বাধীনতা ঘোষণা করল। চিন কিছু করতে পারল না। ১৯১৯ সালে উত্তর চিনের এক মনসবদার শু সুঝেং আবার মঙ্গোলিয়াকে অল্প কিছুদিনের জন্য দখলে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু রাশিয়া ১৯২১ সালে (ততদিনে লেনিন ক্ষমতায়) চিনের সেনাদের তাড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন মঙ্গোলিয়াকে স্বীকৃতি দিল। ১৯৪৯ সালে যখন পার্টি ক্ষমতায় এল ততদিনে মঙ্গোলিয়া ডি ফ্যাক্টো রাশিয়ার রাজ্য। নামেই স্বাধীন। রাশিয়াকে হঠিয়ে মঙ্গোলিয়াকে ফেরত নেবার প্রশ্নই ছিল না। আর পার্টি চিনে ক্ষমতাতেই এসেছে রাশিয়া সাহায্য পেয়ে। এবং ষ্ট্যালিনের রাশিয়া সেই মুহূর্তে চিনের একমাত্র বন্ধু। আমেরিকা রোজ খিস্তি দিচ্ছে।(১) চিন মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতা মেনে নিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করল। মঙ্গোলিয়া রাশিয়ার তাঁবে থাকবে ১৯৯১এ রাশিয়ার পতন অবধি।

    বর্তমানকালে মঙ্গোলিয়া আবার চিনের অরবিটে ফিরে এসেছে। দেশটির আয়ের মূল উৎস চিনকে বিভিন্ন খনিজ আকর রপ্তানী করা। সাধারণ মঙ্গোলিয়রা এতে আদৌ খুশি নন। পুরোনো রাগ সহজে যায় না। মঙ্গোলিয়া মাঝে মধ্যেই একটু মাথা তোলবার চেষ্টা করে আর চিনের কাছে থাবড়ানী খায়। এই হয়তো চতুর্দশ দলাই লামাকে নেমন্তন্ন করে বসল। উদ্দেশ্য চিনকে খোঁচানো। চিন পালটা দু'পার্সেন্ট ট্রানসিট ট্যারিফ বাড়িয়ে দিল। তখন মঙ্গোলিয়া ভাবছে কি করা যায়। রাশিয়া এককালে চিনের বিরুদ্ধে ব্যাকিং দিয়েছিল। এখন আরেকবার জিগেশ করলে হয় না। পুতিন ভাগিয়ে দিলেন। বললেন চিনকে খোঁচানো বন্ধ করে দেশের ভেতরে মন দাও। তখন মঙ্গোলিয়া কার কাছে হাত পাতল জানেন? আরে আমাদের নরেনদা। কিছুদিন আগে মোদি মঙ্গোলিয়ায় গিয়ে কলাটা মুলোটা দিয়ে এসেছিলেন। দিল্লী উলানবাতোরকে ১ বিলিয়ন ডলার লোন দেবে বলে কথা শোনা গেছিল। সন্দেহ করা যেতে পারে যে দিল্লীর থেকে সাহায্যের ভরসা পেয়েই মঙ্গোলিয়া দলাই লামার স্টান্টটা করেছিল। তো সেই আশায় আশায় মঙ্গোলিয়া এসে হাজির। কত আশাই করে লোকে। দিল্লী একটু আমতা আমতা করে বলল টাকা? হ্যাঁ মানে ঐ কি জানেন আমাদের রাজনীতিকেরা ওরকম ভোটের আগে অনেক কথাই বলে থাকেন। তো মোদী বিদেশে গিয়েও অভ্যেসবশত বলে ফেলেছেন। টাকা তো আমাদের কিছু নেই। দুঃখিত আপনাদের সময় নষ্ট করার জন্য।

    বেচারা মঙ্গোলিয়া। মুখ নিচু করে ফেরত গেল চিনের কাছে। চিন মঙ্গোলিয়াকে কান ধরে ওঠবোস করালো। মঙ্গোলিয়াকে প্রতিজ্ঞা করতে হল আর কোনদিনও দলাই লামাকে দেশে ঢুকতে দেবে না। চিন বলল মনে থাকে যেন। আর হ্যাঁ বাজেটে কত ঘাটতি চলছে তোমাদের এখন? অনেক? আচ্ছা আপাতত ৪ বিলিয়ন ডলার আমরা দিচ্ছি। খাজাঞ্চিখানা ঐ দিকে। যাও গিয়ে কথাবার্তা বল।

    মঙ্গোলিয়া সাষ্টাঙ্গপ্রণাম ঠুকে বিদেয় নিল।(২)

    --------------------------------------------------------------

    ১৯৫০এর দশকে এসে পার্টি প্রথম একটা পরিস্কার ধারণা পেল কাজাকেভিচের গুপিটার সম্বন্ধে। রাশিয়ার ম্যাপে সীমারেখাটা তখন আমুর-উসুরির চিনের দিকের তীর বরাবর দেখাচ্ছে । সেইসঙ্গে খাবারোভস্ক শহরের কাছে ভালুক দ্বীপের কাছে সীমারেখাটা রাশিয়া দেখাচ্ছিল ফুইউয়ান প্রণালী বরাবর। তখনও রাশিয়ার সাথে চিনের অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক। চিন রাশিয়ার উপর প্রযুক্তিগত সাহায্যের জন্য নির্ভরশীল। সাথে কোরিয়ার ঐ যুদ্ধ। চিন সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। কিন্তু চিন পাল্টা ম্যাপ প্রকাশ করল থলওয়েগ বরাবর সীমারেখা দেখিয়ে ইনক্লুডিং ভালুক দ্বীপ। তবে পুরো সীমানাটা আমুর-উসুরি নদী বরাবর হলেও একস্থলে আমুরের উত্তর তীরে রাশিয়ার দিকের একটুকরো জমি পিকিং চুক্তি অনুযায়ী চিনের অধিকারে ছিল। '৬৪টি গ্রাম' বলে পরিচিত এই এলাকাটিতে মাঞ্চু জনগোষ্ঠীর লোকে বাস করত। ১৮৯৯এর বক্সার বিদ্রোহের পর রাশিয়া গণহত্যা করে এই গ্রামগুলিকে খালি করে দিয়ে দখল করে নেয়। ম্যাপে এইটা চিন ছেড়ে দিল। কিন্তু ভালুক দ্বীপ চিন দেখালো নিজের দিকে। এবং ঐ দ্বীপের কাছে সীমারেখাটা চিন দেখালো আমুর-উসুরির মিলনস্থল হয়ে, ফুইউয়ান প্রণালী বরাবর নয়। কিন্তু উত্তরে রাশিয়াও কিছু প্রতিক্রিয়া দিল না। ডিসপিউটটা দু'পক্ষই বুঝেও না বোঝার ভান করল। প্রসঙ্গত এই সময়কালটাতে ম্যাপে নদীগুলিকে পুরোপুরি রাশিয়ার অংশ হিসেবে দেখালেও চিনকে আমুর ও উসুরি বরাবর নৌপরিবহনে কোন বাধা দেন নি ষ্ট্যালিন।

    ১৯৫৩ সালে ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় আসার পর কয়েক বছর ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ১৯৫৬য় ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনকে মরণোত্তর খিস্তিখাস্তা শুরু করলে স্টেবিলিটির ডায়নামিকটা পটাং ভেঙ্গে গেল। স্ট্যালিনের অন্য কুকীর্তি যতই থাকুক না কেন তার ওপর পার্টি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ছিল। স্ট্যালিনকে ক্রুশ্চেভ গাদায় ছুঁড়ে ফেললেন। মাও চমকালেন। চিন তখনও রাশিয়ার (বিশেষ করে স্ট্যালিনের) ল্যাজ ধরে চলত। ক্রুশ্চেভের স্টিয়ারিং ঘোরানো দেখে মাওএর অস্বস্তি বাড়তে শুরু করল। চিনে তখন আইডিওলজির প্রভাব বিশাল। আজকের দিনে চিন রিয়েলপলিটিক মেনে চলে। তখন সেরকম ছিল না। রাশিয়াকে দোষ দেওয়া যায় না। সে নিজের দিকটা দেখবে। কিন্তু চিন রাশিয়ার দিকে চেয়ে বসে ছিল। ১৯৫৮য় চিন একটা চেষ্টা করল তাইওয়ান ফেরত নেবার। রাশিয়া সঙ্গ দিল না। ঐ বছরই রাশিয়া প্রস্তাব দিল চিনে একটা ডুবোজাহাজের ঘাঁটি বানানোর। চিন রাজি হল না। ইগোর ব্যাপারও ছিল। মাও এবং ক্রুশ্চেভের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলল।

    কিন্তু বিশেষ করে যে ব্যাপারটা নিয়ে চিন-রাশিয়ার সম্পর্ক সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গেল সেটা আর অন্য কিছু নয় - ভারত। রাশিয়া ও আমেরিকা দু'পক্ষই তখন নেহেরুকে দলে টানতে ব্যাস্ত। ১৯৫৯ সালের অগস্টে অরুণাচলের লংজু ও অক্টোবরে আকসাই চিনের কংকা গিরিখাতের কাছে ভারত ও চিনের সেনাদের মধ্যে গুলি চালাচালিতে প্রাণহানি ঘটে যাওয়ার পর মস্কো বুঝল ব্যাপার গুরুতর। ভারতকে তখন রাশিয়া ও আমেরিকা দু'পক্ষই দলে টানতে ব্যস্ত। চিন রাখি না ভারত রাখি ঠিক করতে গিয়ে ক্রুশ্চেভ চিনকেই ঝাড়লেন। বেশ প্যাট্রোনাইজিং ভাবে। কিন্তু লংজুতে ভারতের সেনাই ম্যাকমোহন লাইনের উত্তরে চলে গিয়েছিল।(৩) ক্রুশ্চেভ সেসব কিছু শুনলেন না। এর পরের বছর ১৯৬০এর জুন মাসে রোমানিয়ায় পার্টি কংগ্রেসে রাশিয়া-চিনের ক্যাঁচালটা খোলাখুলি সামনে চলে এল। ক্রুশ্চেভ ভারতের সাথে ঝামেলার জন্য সম্পূর্ণভাবে চিনকে দায়ী করলেন। চিনে রেগে টং হল। চিনের রাগের কারণটা শুধুমাত্র মস্কো দিল্লীকে কূটনৈতিক ভাবে আড়াল করছিল বলেই ছিল না। রাশিয়া তখন ভারতকে হুলিয়ে সমরাস্ত্র বিক্রী করছিল, গাম্বাট কিছু হেলিকপ্টার সমেত। সেও আবার ভর্তুকি দিয়ে সস্তায় (উদ্দেশ্য ভারতকে নিজের দলে টানা)! এই শক্তিশালী হেলিকপ্টারগুলো দিয়েই লাদাখের ঐ সুউচ্চ দুর্গম এলাকায় ভারত তখন ঘাঁটি বানাচ্ছিল। বিবাদটা মৌখিক তর্ক থেকে বাস্তবের মাটিতে নেমে এল। তার উপরে ঐ বছরেই ক্রুশ্চেভ চিনকে সবরকম সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। আচমকা। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দুইই। সম্পর্কটা পুরোপুরি তেতো হয়ে গেল। এবং সীমানা নিয়ে রাশিয়া যে গুপি মারছিল সেটাকে সহ্য করারও আর কোন কারণ রইল না চিনের কাছে।

    এরই মধ্যে কিউবা নিয়ে আমেরিকা-রাশিয়ার মধ্যে রীতিমতন একপ্রস্থ হয়ে গেল। মাও ক্রুশ্চেভকে এই সুযোগে একহাত নিলেন। বললেন ক্রুশ্চেভের প্রথম ভুল - আমেরিকাকে অতটা উসকানো ঠিক হয় নি। দ্বিতীয় ভুল - উসকালিই যদি তাহলে কেনেডির ধমকি শোনামাত্র ল্যাজ গুটিয়ে চলে এলি কেন? ক্রুশ্চেভ বললেন আরে ভাগ তো শালা। আমাদের দয়ায় ক্ষমতায় এসেছিস আবার বড়বড় লপচপানি! কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ক্রুশ্চেভ যে ছড়িয়েছেন সে ব্যাপারে রাশ্যান পলিটব্যুরোও মাওএর সাথে একমত। দু'বছরের মধ্যে ক্রুশ্চেভ গদি হারালেন। অবশ্য তাতে মাওএর সডেনফ্রয়েডের কোন সম্ভাবনা ছিল না। সিসিপির ভেতরে মাওএর নিজের দশাও তখন ক্রুশ্চেভেরই মতন। ততদিনে গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড ফেল করার পর চিনে সবাই বুঝে গেছে মাও ও ছড়িয়েছেন। দেশে প্রবল খাদ্যাভাব চলছে। মাও নামেই চেয়ারম্যান। সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই সময়টাতে পার্টির অন্যান্য নেতারা প্রথমবারের জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা ভাবতে শুরু করেন। তখন মাও আঁতকে উঠলেন। শালারা আবার সেই পুঁজিবাদ ফিরিয়ে আনতে চায়! সব ক্যাপিটালিষ্ট রোডার! ১৯৬৬ সালে মাও চেঁচালেন - 'সদর দপ্তরে কামান হানো' - লক্ষ্য উদারপন্থী সদস্যরা, বিশেষ করে লিউ শাউকি ও দেং জিয়াও পিং। এদের সবার মাথা মুড়িয়ে রাস্তায় ঘোরানো শুরু হল। তাদের মধ্যে কোরিয়া যুদ্ধের হিরো, পেং দে হুয়াইও সেই দাওয়াই পেলেন। ভদ্রলোক কতটা মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন বুঝতে অসুবিধা হয় না। উৎপাত থামার পর দেং ক্ষমতায় এলে প্রথম কাজ করেন পেংএর স্মৃতিকে পুনর্সন্মানে বহাল করা। দুর্ভাগ্য ততদিনে দেরী হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালেই পেং মারা যান। তবে পরবর্তীকালে দেং এর নেতৃত্বে ১৯৭৯ থেকে চিন যে রাস্তায় হাঁটল সেটা দেখলে মাওএর অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনাকে সমর্থন না করলেও এখানে একটা কথা স্বীকার করতে হবে, যে দলের ভেতরে 'ক্যাপিটালিষ্ট' চিনতে মাও ভুল করেন নি।

    যাই হোক ক্রুশ্চেভ মাওকে আরও আওয়াজ দিলেন - "কিউবা নিয়ে আমাদের কথা না শুনিয়ে যদি ক্ষমতা থাকে তো হংকং ফেরত নে ব্রিটেনের থেকে"। চিন পাল্টা দিল - "ব্রিটেনের সাথে আমাদের একটা চুক্তি হয়েছিল বলেই (নানকিং ১৮৪২) আমরা হংকং ছেড়ে দিয়েছি। যদি সেই চুক্তি ভেঙ্গে আমাদের হংকং ফেরত নিতে বল তাহলে ১৮৬০ সালের পিকিং চুক্তিটাকেও ভেঙ্গে দিই কি বল? জারের আমলে অনৈতিক চুক্তিগুলোতে রাশিয়া আমাদের থেকে যেসব জমি কেড়ে নিয়েছে সেগুলোও তাহলে একইভাবে আমাদের ফেরত নেওয়া উচিত না কি?" এইবার রাশিয়া চমকাল। খেয়েচে চিন কি ঐ সব এলাকাগুলো ফেরত চায় না কি?! ৬০এর দশক জুড়ে আমুর ও উসুরি নদীদুটি বরাবর রাশিয়ার সেনা ও চিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চোরপুলিশ খেলা বাড়তে শুরু করল। নদীদুটির তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের বেজিং অনুমতি দিল - নদীর অর্ধেকটা আমাদের। তোমরা নিশ্চিন্তে নদীর জল ব্যবহার কর, মাছ ধর, মধ্যবর্তী দ্বীপগুলির যেগুলি আমাদের দিকে সেগুলিতে চাষ আবাদ কর, নৌপরিবহন চালাও কোন অসুবিধা নেই। উল্টোদিকে মস্কো নিজের বর্ডার গার্ডদের নির্দেশ দিল কোন চিনা যেন নদীগুলি ব্যবহার না করে। দেখতে পেলে আটকাবে। কিন্তু গুলি না চালিয়ে। সেই মতন একদিকে নিরস্ত্র সাধারণ চিনা নাগরিক ও অন্যদিকে রাশ্যান সেনার মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হল। ডিসপিউটটা খোলাখুলি সামনে চলে এল।

    রাশিয়ার দিক থেকে দেখলে বোঝা যায় যে ওনাদের চিন্তাভাবনা এখানে ঠিক ভারতের মতন ছিল। ভারত ভাবছিল আমরা চিনকে জেনুইন ডিপ্লোম্যাটিক সাপোর্ট দিচ্ছি। কিন্তু চিন সেটার খাতির না করে ঐটুকু জমি ছাড়তে রাজি নয়। রাশিয়াও তাই। ভাবছে আমরা চিনকে এত সাহায্য করেছি। অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত সাহায্য ঢেলে দিয়েছি। অন্য সব দেশগুলো চিনের শুধু ক্ষতি করে গেছে। জারের আমলের রাশিয়াও। কিন্তু আমরা সেরকম করিনি। জাপানের থেকে মাঞ্চুরিয়া উদ্ধার করার পর সেটা সঙ্গে সঙ্গে চিনকে ফেরত দিয়েছি। চিন এগুলো স্বীকারও করে। অথচ চিন ঐ সামান্য কয়েকটা দ্বীপ ছাড়তে রাজী নয়! রাশিয়া বা ভারত কেউই বুঝতে পারল না যে চিনের লক্ষ্য শুধু জমি নয়। চিন সন্মান চায়। চিনে পার্টির সন্মান বিগত একশ বছরের গ্লানী হটিয়ে চিনকে আবার মাথা তুলে দাঁড় করানোর জন্য। জমি নিয়ে বিবাদ থাকলে চিন জমি কিছুটা ছেড়ে দিতে রাজী। কিন্তু শুধু একতরফা চিনের ওপরে দাবী চাপিয়ে দিলে চিন মানবে না। কারণ তাতে আবার সেই বিগত শতাব্দীর অনৈতিক চুক্তিগুলোর স্মৃতি ফিরে আসছে। চিন আলোচনা করবে। তাতে চিনকে সমান সন্মান দিতে হবে। এবং সীমাচুক্তিবিহীন কোন এলাকা নিয়ে বিবাদ থাকলে সেখানে চিনকে কিছুটা জমি, সামান্য হলেও অন্তত টোকেন হিসেবে ফেরত দিতে হবে। এই প্যাটার্নটা উপরোল্লিখিত উদাহরণগুলোর থেকেই স্পষ্ট। ভারত সেটা ধরতে পারল না। রাশিয়াও নয়। অরুণাচলে ৬৮০০০ বর্গকিমি ছেড়ে দিয়েছিল চিন। কারণ সেখানে ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল। এর ফলে তিব্বতিরা বেজিংকে প্যাঁক দিয়েছিলেন - "কি রে খুব তো আমাদের দখলে আনলি। অথচ ভারতের হাত থেকে তো তাওয়াং ফিরিয়ে আনতে পারলি না।" কিন্তু চিন ঝামেলা না বাড়িয়ে চুপ রইল। ঝৌ শুধু বললেন যে সিমলা চুক্তি ও ম্যাকমোহন লাইন বেআইনী। সুতরাং ভারত যদি গেঁড়ে বসে থাকে যে সিমলা চুক্তিতের আসাম-তিব্বত সীমারেখা 'সুনির্ধারিত' হয়ে গেছে তাহলে চলবে না। নতুন করে আলোচনায় বসুন (যেমন বার্মা বসেছিল আলোচনায়)। যেহেতু ওখানে ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আছে তাই আমরা ওটা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু আলোচনায় বসুন। নেহেরু চিনকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না। উলটোদিকে আকসাই চিনে ভারতের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। চিনের দাবী ও নিয়ন্ত্রণ দুইই ছিল। অতএব চিন আকসাই চিন ছাড়ল না।

    ১৯৬৪ সালে দু'পক্ষ একটা চেষ্টা করল আলোচনা করে ব্যাপারটা মেটানোর। বৈঠক বসল। বৈঠকে রাশ্যানরা গেঁড়ে বসে রইলেন। রাশ্যানদের বক্তব্য কাজাকেভিচের ম্যাপ অনুযায়ী পুরো নদীটা আমাদের। এবং সঙ্গে ভালুক দ্বীপ। চিন ও রাশিয়ার সীমানা 'সুনির্ধারিত' হয়ে গেছে। চিন চুপচাপ সেটা মেনে না নিলে ফল ভুগতে হবে। অর্থাৎ যে পজিশন নেহেরু নিয়েছিলেন - "সিমলা চুক্তি অনুযায়ী আসাম-তিব্বতের সীমারেখা 'সুনির্ধারিত' হয়ে গেছে। আর কোন কথা বলার দরকার নেই" - হুবহু সেই পজিশন। বৈঠকটা সম্পূর্ণ ব্যার্থ হল। ১৯৬৭ সালে রাশিয়া সুর চড়াল আরো একধাপ। এতদিন অবধি আমুর-উসুরির নদীদুটির মিলনস্থল হয়ে (অর্থাৎ খাবারোভস্ক শহরের গা ঘেঁষে) চিনা জাহাজ চলাচল করলে রাশিয়া বাধা দিত না। এই বছর থেকে রাশিয়া ঐ রাস্তাটা আটকে দিয়ে চিনকে বলল সীমানা ফুইউয়ান প্রণালী দিয়ে গেছে। সুতরাং ঐটা ব্যাবহার কর গিয়ে। এরপর ধাক্কা লাগা ছিল সময়ের অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত সেই ক্ল্যাশ হল ১৯৬৯ সালে। ততদিনে রাশ্যান বর্ডার গার্ডরা মোটের উপর চিনা নাগরিকদের নদীদুটিতে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে চিনও পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলেছে। ফিসন (১৯৬৪) ও ফিউসন (১৯৬৭) দু'রকমই। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে। মস্কো ভাবছে থলওয়েগ সীমার দাবীটা আসলে অজুহাত। চিন আসলে মাঞ্চুরিয়ার উত্তরের যে এলাকাগুলো এক শতাব্দী আগে হারিয়েছিল সেগুলো ফেরত চায়। উত্তেজনা এমন স্তরে যে চিনের নেতৃত্বকে পরমাণু বোমা মেরে পুরো ওড়ানো উচিত হবে কি না সেই নিয়ে মস্কো ভাবতে শুরু করল। কারণ বোমা বানাতে পারলেও চিন তখনও অবধি নির্ভরযোগ্য মিসাইল বানিয়ে উঠতে পারেনি যাতে করে বোমাগুলো রাশিয়ার শহরগুলোর ওপরে ফেলা যেতে পারে। সুতরাং এই শেষ সুযোগ। কিন্তু মাও হুমকি দিয়ে রেখেছেন রাশিয়া পরমাণু বোমা ব্যবহার করলে চিন 'শেষ' দেখে ছাড়বে। শেষ পর্যন্ত ব্রেজনেভ ঝুঁকি নিলেন না। চিনা নাগরিকদের হঠিয়ে দেওয়ার পর ততদিনে চিনের সেনারা নদীদুটিতে টহল দেওয়া শুরু করেছে। রাশ্যানরা তাদের আটকাচ্ছে। প্রথম প্রাণহানি ঘটল ১৯৬৯ সালের ২রা মার্চ। স্থান - ভালুক দ্বীপ থেকে সোজাসুজি উসুরি নদী বরাবর ৪০০ কিমি দক্ষিণে একটি ছোট্ট নদীখাতের দ্বীপ। নাম চিনাদের কাছে ঝেন বাও। রাশ্যানরা বলেন দামানস্কি। দ্বীপটি থলওয়েগের চিনের দিকে ছিল। এখানেও রাশিয়ার একই পজিশন - সীমানা যাচ্ছে চিনের দিকে উসুরির তীর বরাবর। সুতরাং নদীর মাঝখানের ঝেন বাও/দামানস্কি দ্বীপটি রাশিয়ার। দ্বীপটি নিয়ে চিন ও রাশিয়ার সেনাদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি চলছিল। এতদিন পর্যন্ত গুলি চলেনি। এইবার চলল। প্রথম দফার মারপিট শেষে দ্বীপটি চিনের দখলে রয়ে গেল। মস্কো রাগে আগুন হয়ে নির্দেশ দিল দ্বীপটা থেকে চিনের সেনাদের হটাতে। দ্বীপটির থেকে চিনের সেনাদের বার করার জন্য রেড আর্মীর এক ডিভিসন এসে হাজির। কিন্তু দেড়দিন ধরে প্রবল যুদ্ধের পরেও চিনকে হটানো গেল না।

    প্রবল ঝটকা খেল মস্কো। যেটা এর আগে আমেরিকা খেয়েছিল কোরিয়ায়। রাগের মাথায় পশ্চিমে শিংকিয়াং সীমান্তে চিনের ছোট ছোট কয়েকটি সেনাদল ও চৌকিকে রাশিয়া ওড়ালো। ট্যাক্টিক্যালি অর্থহীন। অন্যদিকে বেজিং বুঝে গেছিল রাশিয়াকে 'শিক্ষা' দেওয়া হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়া দিল না। একমাসের মধ্যে সীমানা ঠান্ডা হয়ে গেল। রাশিয়াও বুঝতে পারল উনবিংশ শতকে চিনকে যেমন অনায়াসে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া যেত সে দিন চিরকালের মতন বিদেয় নিয়েছে। কোরিয়ায় যদি চিন আত্মসন্মান পুনরুদ্ধার করে থাকে, ঝেন বাওতে সেটা সম্পূর্ণ পাকাপোক্ত হল। ১৯৭৬ সালে রাশিয়া ভালুক দ্বীপের উত্তর দিকে আমুর-উসুরির মিলনস্থল বরাবর নদীখাতটা খুলে দিল। ৮০র দশকে এসে অবশেষে গোর্বাচেভ সিদ্ধান্ত নিলেন ঝামেলা মেটানোর। রাশিয়া মেনে নিল যে চিনের অবস্থানই সঠিক। সীমানাটা থলওয়েগ বরাবরই যাবে। চিনের দিকের তীর বরাবর নয়। ১৯৯১ সালে আলোচনা শুরু হল। ভালুক দ্বীপটা অবশ্য রাশিয়া ছাড়তে চাইছিল না। কারণ খাবারোভস্ক শহরের একদম গায়ে তাহলে উঠে আসবে সীমানাটা। চিন বুঝল রাশিয়ার দিকটা ঐটুকু দেখতে হবে। দ্বীপটা দুই দেশ ভাগাভাগি করে নিল। উপরের দ্বিতীয় ম্যাপটাতে দেখুন লাল রঙের ভালুক দ্বীপের ঠিক মাঝ বরাবর বর্তমান সীমারেখাটা টানা রয়েছে। কাজাকেভিচ বা ফুইউয়ান প্রণালী চিনের দিকে। অর্থাৎ কাজাকেভিচের গুপিটাকে চিন-রাশিয়া পিছনে ফেলে এল। আমুর-উসুরির নদীদুটির মিলনস্থল হয়ে চিনা জাহাজ চলাচলের অধিকার স্বীকৃত রইল চুক্তিতে। ২০০৫ সালে ভ্লাদিভস্তক শহরে সীমাচুক্তি সম্পন্ন হল দু'দেশের মাঝে। কি কি হাতবদল হল তার বিস্তারিত বিবরণ উইকিতে ভাল পাবেন - https://en.wikipedia.org/wiki/1991_Sino-Soviet_Border_Agreement

    উত্তর-পশ্চিম চিনের শিংকিয়াংএর দিকে যে এলাকাগুলো রাশিয়া নিয়েছিল সেগুলো ১৯৯১ রাশিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়া তিনটি 'স্তান দেশের ভাগে পড়ে - কাজাকস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান। চিন এদের সাথেও সীমাচুক্তি সেরে নিয়েছে যথাক্রমে ১৯৯৪, ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিন বিরাট বিরাট এলাকা ছেড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তাজিকিস্তানের ডিলটাতে ৯৫% এলাকা তাজিকিস্তান পেয়েছে।

    এবার নিচের ম্যাপে দেখে নিন চিনের কোন কোন টুকরো নিয়ে বিবাদ ছিল এবং সেগুলো কোন কোন দেশের কাছে গেছে। এই ম্যাপটা তাইওয়ান থেকে প্রকাশিত চিনের ম্যাপের ভিত্তিতে বানানো। তাইওয়ানের কুয়োমিং তাং সরকার এই ম্যাপের এলাকাগুলো নিজের বলে দাবী করে। যেহেতু তাইওয়ান চিনকে স্বীকার করে না তাই চিনের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলির যে সীমাচুক্তিগুলির কথা উপরে লিখলাম সেগুলোও কোনটাই তাইওয়ান স্বীকার করে না। ফলে আজও তাইওয়ান ঐ পুরোনো ম্যাপই দেখায়। আমাদের এতে সুবিধা। প্রতিবেশী দেশগুলিকে চিন কি কি ছাড় দিয়েছে এটাতে দেখতে পাবেন। যেমন ডানদিকের উপরের কোণের হলুদ প্যাচটা দেখুন। ঐটা হচ্ছে সেই আমুরের উত্তর তীরের ৬৪ গ্রামের এলাকা। এটা চিন ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু তাইওয়ান দাবী করে। অন্যান্য অংশগুলোও তাই। মোদ্দা কথা চিন গায়ের জোরে জমি দখল করতে চায় এটা স্রেফ কংগ্রেসের গুল। গত ৭০ বছর ধরে প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে চিনের সেন্সিবল কনডাক্টে শুধু একটি ব্যাতিক্রম - ভিয়েতনাম। কিন্তু সেখানে ঝগড়ার অন্য কারণ ছিল। শুধু জমি নয়।



    --------------------------------------------------------------

    ১৯৮১ সাল। চিন সে বছর ১০০০০ কিমি পাল্লার একটি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা করল। দেংকে জানানো হলে তিনি বললেন বাঃ খুব ভাল। মস্কো সমেত পুরো রাশিয়াই আমাদের নাগালে তো? তখনও চিনের বড় শত্রু রাশিয়া। আমেরিকা নয়। সারা চিন-রাশিয়া বর্ডার জুড়ে সর্বদা সেনা মোতায়েন হয়ে আছে রেডি হয়ে বসে। দুপক্ষেই। কোষাগারের টাকা জলের মতন নষ্ট হচ্ছে। সেই দিন আর আজকের দিন। আজকের চিন-রাশিয়া সম্পর্ক দেখে আন্দাজ করাও মুশকিল কি ক্যাঁচাল ছিল এককালে। যাই হোক দেংএর প্রশ্নে বৈজ্ঞানিকরা জানালেন -

    "হ্যাঁ স্যার। পুরো রাশিয়াই নাগালে। সাখালিন দ্বীপ থেকে কালিনিনপুর অবধি। আর ক্ষেপণাস্ত্রটি একসাথে দশটি বোমা বহন করতে পারে। প্রত্যেকটি বোমার ল্যাজে একটি করে ছোট রকেট লাগানো। পুরো ঝাঁকটাকে বড় রকেটটা রাশিয়ার আকাশে উপগ্রহের কাছাকাছি উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তারপর বোমাগুলি আলাদা হয়ে গিয়ে যে যার নিজের গন্তব্যের দিকে হানা দেবে। রাশিয়ার দশটি আলাদা আলাদা শহরকে একসাথে ওড়াতে একটা ক্ষেপণাস্ত্রই যথেষ্ট।"

    "অসাধারণ। তা এটার কি নাম দেওয়া যায় বলতো হে?"

    "স্যার 'পুবের হাওয়া' নাম দিলে কেমন হয়।" (৪)

    আইব্বাস! দারুণ বলেছ তো হে। পুবের হাওয়া...বেশ একটা গা জুড়োন আমেজ। ব্রেজনেভের মাথাটাও ঠান্ডা রাখবে। তা নামটা কার মাথায় এল? তোমার?"

    "আমাদের গণেশ স্যার। ছেলেটার বেশ লেখালেখির ঝোঁক আছে। গেল বার তো ডিপার্টমেন্টের একটা কবিতা প্রতিযোগিতাতে পুরস্কারও জিতেছিল।"

    "ভাল ভাল। তা এখন মস্কো ও ওয়াশিংটন দুই ই যখন আমাদের নাগালে, এবার তাহলে বাজার খোলা যাক।"

    --------------------------------------------------------------

    মূল তথ্যসূত্র - নেভিল ম্যাক্সওয়েল -
    How the Sino-Russian Boundary Conflict Was Finally Settled: From Nerchinsk 1689 to Vladivostok 2005 via Zhenbao Island 1969
    Settlements and Disputes - China's Approach to Territorial Issues
    India's China war

    ১. ১৯৪৯এ পার্টি ক্ষমতায় আসার পর আজকে উত্তর কোরিয়ার যে পরিস্থিতি, সেই সময় আমেরিকা চিনের ওপরে সেইরকম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল। ৭১এ নিক্সনের চিনযাত্রার পর ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে।

    ২. http://www.thecitizen.in/index.php/NewsDetail/index/1/9527/China-Beats-Mongolia-into-Submission-Friend-India-Watches

    ৩. এইটা একটা চমৎকার ব্যাপার। এর আগে লিখেছি ব্রিটেন উপমহাদেশে রাজত্বকালে যে কটা সীমারেখা এঁকেছিল তাতে পার্বত্য এলাকায় জলবিভাজিকা অনুসরণ করত। নিকটতম সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্খলের ডগা দিয়ে সীমারেখা। অরুণাচলের ম্যাকমোহন লাইনটাও তাই। কিন্তু সে আমলে ঐ দুর্গম পার্বত্য এলাকায় সবসময় নিঁখুত জরীপ করা হয়ে উঠত না। ৫০এর দশকে সমগ্র অরুণাচলে নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের সময় ভারত আবিস্কার করে যে জায়গায় জায়গায় ম্যাকমোহন লাইনটা ম্যাপে যে বরাবর দেখানো রয়েছে, বাস্তবে নিকটতম সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্খলটা ঠিক সেইখানে নেই। একটু উত্তর দিয়ে গেছে। অতএব নেহেরু ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ঠিক করেন ম্যাপে দেখানো লাইনের অবস্থানটা অগ্রাহ্য করে আরেকটু উত্তরে চলে যাওয়ার! যাতে করে সীমানাটা ঠিক বাস্তবের জলবিভাজিকা পর্বতশৃঙ্খল বরাবর বসে। জ্যামিতিপ্রিয় লোকজনের কাছে খুব ভাল লাগবে কিন্তু ভাবুন -

    ৩.১ - সীমারেখা এক দুই কিমি আগুপিছু করাটা এমন কিছুই ব্যাপার নয়। ১৯১৩য় আঁকা ম্যাকমোহন লাইনটা যদি আপনি 'প্রাথমিক খসড়া' ধরেন তাহলে পরে সীমাচুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাকালে ঐটুকু ঠিক করে নেওয়াই যায়। ভৌগোলিক বিচারে জলবিভাজিকা খুব খাসা সীমারেখার কাজ করে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব যখন আপনি চিনের সাথে আলোচনা করে সহমত অর্জন করে করছেন। ভারত ম্যাকমোহন লাইন নিয়ে আলোচনার কথা চিন্তাও করেনি।

    ৩.২ - আলোচনা যখন হচ্ছে না অতএব দু'পক্ষের মধ্যে একমাত্র বোঝাবুঝির উপায় ঐ দু'খন্ড ম্যাপই। সেক্ষেত্রে ম্যাপে যেখানে দেখানো আছে মাটিতে সেইটাকে মেনে চলা ছাড়া উপায় নেই। ম্যাপের 'স্পিরিট' জলবিভাজিকাকে অনুসরণ করে অতএব আমরা একতরফা লাইনটা আগুপিছু করব (আসলে শুধুই আগু, পিছু কখনই করেনি ভারত) এরকম বললে সেটা যাবতীয় আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক সীমানা 'একতরফা' পাল্টানো - জাস্ট যায় না।

    ৩.৩ - চিন ও তিব্বত দুইই ততদিনে জানিয়ে দিয়েছে তারা সিমলা চুক্তি ও ম্যাকমোহন লাইন স্বীকার করে না। অর্থাৎ ভারত শুধু একতরফা সীমারেখা পাল্টাচ্ছিল তাই নয়, জ্ঞানত চিনের অমত সত্ত্বেও!

    নেহেরুর আরো অনেক উদ্ভট সিদ্ধান্তের মতন এইটারও কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু চিন যখন ক্রুশ্চেভকে এই ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করল তিনি শুনলেন না। অন্যদিকে নেহেরু তখন চেঁচাচ্ছেন - "চিন অরুণাচলে 'আগ্রাসন' চালিয়েছে।" ফাইন প্রিন্ট - চিন ম্যাপে বর্ণিত ম্যাকমোহন লাইন মেনে চলেছে অর্থাৎ ভারতকে ম্যাকমোহন লাইনেরও উত্তরে ঢুকতে দেয় নি। ভারতখোকা নিজের খুশিমত ধরে নিয়েছে লাইনটাকে একটু এগিয়ে (কয়েক কিমি) নিলে চিন কিছু বলবে না। এই হচ্ছে চিনের 'আগ্রাসন'।

    প্রসঙ্গত ১৯৬২র যুদ্ধের সরাসরি কারণ ভারতের এই ম্যাকমোহন লাইনের উত্তরে চলে যাওয়াটা নিয়েই। ক্যাঁচালটা যতদিন আকসাই চিনে চলছিল চিন প্রতিবাদ করলেও হাত ওঠায়নি। কিন্তু লংজুর ঘটনাটা থেকেও নেহেরুর শিক্ষা হয় নি। ১৯৬১ সালে তাওয়াংএর একটু উত্তরে ভারত আরেকখানা খুদে সেনাঘাঁটি বানায়। নাম - ধো লা। এইখানেও একই ব্যাপার। ম্যাপে বর্ণিত ম্যাকমোহন লাইনটা নিকটতম পর্বতশৃঙ্গের বদলে পার্শ্ববর্তী উপত্যকা দিয়ে টানা ছিল। নিকটতম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্খল একটু উত্তরে। নাম - থাগ লা। ধো লা ঘাঁটিটা ভারত বানালো এই থাগ লা শৃঙ্খলের সামনে, নামকা চু নামে একটা ছোট পাহাড়ী নদীর পাশে, ম্যাকমোহন লাইনের ৪-৫ কিমি উত্তরে। চিন আর থাকতে না পেরে অবশেষে গ্লাভস খোলে।

    http://ajaishukla.blogspot.in/2014/03/henderson-brooks-report-part-iv-dhola.html

    ৪. দং ফেং - পুবের হাওয়া।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন