এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুকি | 172.68.167.45 | ২৮ মার্চ ২০২০ ০৯:০০730340
  • কনফ্লিক্ট
    -------------------------

    অক্টোবর-নভেম্বর আর জানুয়ারী-ফ্রেবুয়ারী মাস নাগাদ অফিসে ম্যানেজারদের জন্য স্পেশালি কিছু হাবি-জাবি ট্রেনিং অ্যারেঞ্জ করা হয় এইচ আর দ্বারা। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, বছর শেষে তোমার অধীনে কাজ করা পাবলিকদের পারফরমেন্স রেটিং কি ভাবে করতে হবে, ব্যালেন্সড সিদ্ধান্ত ঠিক কি ভাবে নিতে হবে, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট কিভাবে এড়াতে হবে – এই সব। আবার নতুন বছর শুরু হলে ট্রেনিং দেওয়া হয় এই শেখানোর জন্য যে ঠিক কিভাবে জানাবে পাবলিকদের কি রেটিং তারা পেয়েছে এবং কেন। কাউকে আঘাত দেওয়া যাবে না, মনক্ষুণ্ণ করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

    আমি কি করে এইচ আর-দের বোঝাই যে নিমোর ছেলেদের এই ধরণের ট্রেনিং কদাপি প্রয়োজন নেই। কারণ আমরা এর থেকেও অনেক বড় বড় মরণ বাঁচন সমস্যা এবং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট ট্যাকেল করে করে বড় হয়েছি! আগে যেমন লিখেছিলাম, এমনি এক বিচারের সিদ্ধান্তে প্রীত না হয়ে কার্ত্তিক পাল কলঘরের তরুণের বীচি টিপে ধরেছিল বা বিশ্বেসদের মৌসুমী উচ্চারিত ডিক্সেনারীর বাইরের গালাগাল। অর্থাৎ ভার্বাল থেকে ফিসিক্যাল সব ধরণের প্রতিক্রিয়াতেই অভ্যস্ত আমরা সেই কবে থেকে।

    সেদিন নিমো স্টেশনে নেমে মিলনের কাছে মাশডাঙা-র ডাইনী তাড়ানোর যজ্ঞের ঘটনা শুনে যখন নিমো বারোয়ারী তলায় পৌঁছলাম তখন বেশ জমিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। মানিক-কাকাকে দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছে দূর্গাদালানের সামনে দিয়ে। মানিক-কা সারা জীবনই হন্তদন্ত হয়েই চলাফেরা করে, কিন্তু সেদিন যেন আবার বিশেষ ভাবে হন্তদন্ত দেখালো। আমাকে দেখে দাঁড়ালো একটু, “সুকান কবে এলি রে? এখুনি ঢুকছিস? আচ্ছা – পরে কথা হবে সব তোকে খুলে বলব, এখন একটু তাড়া আছে”।

    বুঝলাম মানিক হালদার এবং সীতা হালদারের ঝগড়ার এখনো পরিসমাপ্তি হয় নি। মানিক এবং সীতা দুই আপন ভাই হলেও নিজেদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ সেই কবেই গুঁড়ো দুধের মত পাউডার হয়ে গেছে। মানিক হালদারের ছেলে নটা এবং সীতার ছেলে মুকুল দুইজনাই আমাদের সোনার বাংলার টিমের মেম্বার। সেবার গুরুতর ঝগড়া শুরু হয় নিমো থেকে কোলেপাড়া যাবার রাস্তার ঠিক পাশের কয়েক কাঠা জমি নিয়ে। এই দুই ভাই যখন অনেক দিন আগে আলাদা হয়ে যায়, তখন সেই জমি ভাগ হয়েছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে দুই জনা নিজের নিজের ভাগের জমিতে চাষ করছিল।

    এর পরের ব্যাপার বুঝতে হালকা জ্যামিতিক জ্ঞানের প্রয়োজন। সেই কয়েক কাটা জমি বহুদিন আগে ভাগ হয় আড়াআড়ি ভাবে। অর্থাৎ, কোলেপাড়া যাবার রাস্তার একদম পাশে জমি পেল মানিককা এবং তার পূর্বদিকে জমি (যে জমির সাথে রাস্তার সরাসরি কনট্যাক্ট নেই) পেল সীতা হালদার। এমন ভাবেই চলছিল – সীতা হালদারের প্রবলেম ছিল না কোন, বরং পূব দিকের জমি পাওয়াতে সেখান থেকে শ্যালো বা ডিপ-টিউবওয়েলটা একটু কাছে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাধ সাধল যুগের সাথে উন্নয়ন। আগে সেই রাস্তায় তেমন কেউ যেত না – আর এখন পীচ রাস্তা হয়ে গিয়ে এলাহী ব্যাপার। রাস্তার ধারে জমি একদম হট কেকের মত বিকোচ্ছে – পাঁচ লাখ প্রতি কাটা। আগে যেখানে পাঁচ লাখ বিঘে প্রতি পাওয়া স্বপ্ন ছিল।

    এর ফলে সীতা হালদার নড়েচড়ে বসেছে। এবার দাবী করছে যে আগের ভাগ-বাটোয়ারা মানি না – পৈত্রিক জমি এবার লম্বা-লম্বি ভাগ করতে হবে। যেন দুই ভাইই রাস্তার ধারের জমি পায়। বলাই বাহুল্য মানিক হালদার এতে রাজী নয়। তুমুল অশান্তি – পঞ্চায়েতে নালিশ ইত্যাদি।

    এবার আমাদের কনফ্লিক্ট-টা দেখুন – আমরা কার দলে হব? মুকুল এবং নটা দুইজনাই আমাদের ক্লাবের সদস্য। নিমোর সোনার বাংলার সক্রিয় প্রচেষ্টায় গ্রাম পঞ্চায়েতে জয়ী হয় নির্দল প্রার্থী এবং পচাদা গ্রাম প্রধান। এ বিচার খুব চাপের হয়ে যাচ্ছে। মুকুল অভিযোগ জানাতে থাকে, “তোরা আমাকে ঠিক ঠাক দেখছিস না”। সেদিন আবার বোম ফাটাল – বলল যে, “তোরা যে নটা-কে সাপোর্ট করছিস, কিন্তু ও তো তোদের নির্দলকে ভোট দেয় নি! ওদের পুরো ফ্যামিলির ভোট গ্যাছে তৃণমূলে!” অভিযোগ সত্য। তাহলে এবার কি করা হবে – যে ভোট দিয়েছে তার পক্ষে রায় দেওয়া হবে নাকি যার দাবী ঠিক তার পক্ষে? এটা মোটামুটি সবাই একমত যে সীতা হালদারের দাবী এই ক্ষেত্রে অন্যায্য।

    পরের দিন সকালে নটা-র সাথে দেখা – হাতে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। বলল, “আর বলো না দাদা – সীতা হালদার আবার কেস করে দিয়েছে”। কিসের কেস আবার জানতে চাইলে যা বোঝা গেল, মানিক কাকা এবার নতুন ঘর করা শুরু করেছে পুরানো বাড়ির কমপাউন্ডেই। কারণ নটা-র বিয়ে দিতে হবে এবার তাই ঘরের দরকার। এবার সেই জায়গা নিয়ে ঝামেলা করে ইনজাংশান জারির ধান্ধায় আছে সীতা কোর্টে কেস করে। তাই নটা ছোটা ছুটি করছে জমির পর্চা ইত্যাদি নিয়ে। ঘর না তৈরী হলে নটার বিয়েও হবে না। বেচারী খুব টেনশানে তাই।

    অর্থাৎ আমাদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে – মানিক হালদারের জমিতে চাষ হবে কিনা, একমাত্র চাষ বাস করেই যার সংসার চলে। আর থেকেও বড় কথা, সঠিক সময়ে নটার বিয়ে হবে কিনা। এক আইবুড়ো ছেলের স্বপ্ন পূরণের অন্তরায় সীতা হালদার এবং আমাদের রায়।

    এবার আপনারই ভাবে দেখুন এই লেভেলের জিনিস ডিল করার পর চাকুরীর রেটিং কেমন ভাবে দিতে হবে সেই নিয়ে ট্রেনিং করা সময় নষ্ট কিনা!
  • সুকি | 172.68.146.247 | ০১ এপ্রিল ২০২০ ২২:৪৭730411
  • বার বার নষ্ট হয়ে যাই
    ----------------------------

    ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই – বার বার নষ্ট হয়ে যাই’ এই লাইনটা এরপর কোনদিন বললে বদলে নিতে হবে। ‘নষ্ট হয়ে যাই’ আর বলতে পারব না এরপর মনে হয়, আর তো স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ‘প্রভু নষ্ট হয়ে গেছি’।

    বারে বারে নষ্ট হচ্ছিলাম – এই আমি এবং আমরা। বুঝতে পেরেছি অনেক সময়, অনেক সময় বুঝতে পেরেও তেমন কিছু করতে পারি নি। আর এখন তো চাইলেও কিছু করতেই পারছি না।

    লকডাউনে আমাকে ঘর থেকে কাজ করতে হয় বাকি আর সবার মতই – খাবারে কোন টান নেই এখনো, কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর সুইজি, জমাটো-র হোম ডেলিভারী আবার চালু হয়ে গেছে। বিগ বাস্কেট বাড়িতে আবার দিয়ে যেতে শুরু করেছে দুধ, মনোহারী জিনিস পত্র। লিসিয়াস আবার দিতে শুরু করেছে ডিম, মাংস। আমাদের গেটেড-কমিউনিটির গ্রুপে আমরা আলোচনা করি কেন কাজের লোক আসবে না! কিভাবে ওরা নিজেরা ঠিক করে নিতে পারে যে কাজ করতে আসবে না? নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনের করিডোর টুকু পরিষ্কার করার জন্য বারে বারে ভলেন্টিয়ার ডাকা হতে থাকে। কেউ কেউ ক্ষোভ উগরে দিই এই জন্য যে আমাদের গেট পর্যন্ত গিয়ে পিৎজা ডেলিভারী নিতে হচ্ছে বলে! পিৎজাবালক দোরগোরায় আসছে না।

    আমি বোর হই – খুব বোর হলে নেটফ্লিক্স, আমাজন, হটস্টার আর যা কিছু আছে মাঝে মাঝে দেখতে থাকি। আমার খাওয়ার সময় এখনো মেনটেন করতে পারছি – সকালে দুধ দিয়ে কফি খাচ্ছি – বাড়ি থেকে কাজ বলে খুব সকালের বাস ধরার তাড়া নেই। নিজের বিছানা ছেড়ে উঠছি একটু দেরী করে – আলস্যে ভরা শরীর নিয়ে।

    আর তারপর? কখনও কখনও বাড়ির লোকের সাথে কথা বলি, কথা হয় নিমোর ভাই বন্ধুদের সাথে। লকডাউনের অন্যদিকের গল্প কেমন গড়াচ্ছে, সেটা জানতে আমাকে ফেসবুক দেখতে হয় না, না শুনে বিচার করতে হয় ওই মিডিয়ার খবর।

    তর্কে যাব না – কিন্তু ফ্যাক্ট এটা যে সরকারের কাছে, বর্তমান প্রশাসনের কাছে ওই তথাকথিত ঘর ছেড়ে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক – দিন মজুর, যাদের গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাইগ্রেটেড লেবার’ – তাদের জীবনের কোন দাম নেই। এবং সেই নিয়ে সরকার মাথা ঘামাতেও রাজী নয় বেশী।

    হাজারে হাজারে লোক যাচ্ছে নিমোর উপর দিয়ে দল বেঁধে হেঁটে – ঘরে ফিরছে চাইছে তারা, জি টি রোড বরাবর, রেললাইন বরাবর হেঁটে যাচ্ছে তারা কলকাতার দিক থেকে ঝাড়খন্ড, বিহারের দিকে। পিঠে, কোলে বাচ্ছা – বড় বড় বাক্স-ব্যাগ নিয়ে ফিরছে। নিমোর রাস্তার ধারে প্রতিদিন প্রায় ১৫০-২০০ জন লোক খাচ্ছে – চাল, আলু ইত্যাদি জোগাড় হয়েছে। কিন্তু শেল্টার? ইচ্ছা করলেই আপনি ২৫-৫০ জনকে নিয়ে ভাবলেন গ্রামের কোথাও রেখে দেবেন, খাওয়াবেন – সেসব অত সোজা নয়। প্রশাসনের অনুমতিই মোষ্ট লাইকলি আপনি পাবেন না। যে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, তাকে যেতে দাও – শ্রমিক-মজুর এদের কষ্ট-মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামাবার মতন সময় নেই বড়কর্তাদের।

    আমাদের নিমো গ্রামের শিল্পপতি রাজুর সাথে অনেক কথা হল আজ। এই নীচের ঘটনাটা রাজুর বলা এবং ছবি গুলোও সে পাঠালো। কাল পড়ন্ত বেলায়, প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে তখন – রাজু গিয়েছিল নিমো স্টেশনের দিকে। স্টেশনে এককোণে সে দেখে এক ফ্যামিলিকে গুটি সুটি মেরে বসে থাকতে – বাবা, মা এবং একটা বছর ছয়েকের মেয়ে। মেয়েটা খুব কাঁদছে। রাজু কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে মেয়েটি সারাদিন কিছু খেতে পায় নি বলে কাঁদছে। ওরা নিমোর কিছু দূরের গ্রামের মাঠ থেকে রওনা দিয়েছে – বাড়ি গিরিডি। হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যাবেলা নিমো স্টেশনে এসেছে – ভাবছে যে একটা ট্রেন পেলে তাতে উঠে বর্ধমান যাবে এবং সেখান থেকে গিরিডি। কিন্তু ট্রেন তো বন্ধ – মাঝে মাঝে চার কামরার ট্রেন চলে, তবে সেটা স্পেশাল, রেলের নিজের লোক এবং পুলিশের জন্য। তাই তাতে উঠতে দেবে না সেটা রাজু ওদের জানালো।

    এই তিনজন এসেছিল আমাদের পাশের গ্রামের দিকে জমিতে আলু কুড়াতে। কয়দিন আগে সব জমিতে আলু তোলা হয়েছে – চাষী আলু তুলে নিলেও কিছু কিছু আলু পড়েই থাকে মাটি চাপা। আর সেই মাটি চাপা আলু তুলে কিছু পয়সা ইনকামের জন্য সেই সুদূর গিরিডি থেকে এরা বাবা-মা-বেটি এসেছে এখানে। চার বস্তা আলু কুড়িয়ে পেয়েছিল – দু বস্তা বিক্রি করে গত সাতদিন চালাচ্ছে কোনমতে তারা। আর মাথায় করে বাকি দু বস্তা নিয়ে ফিরছে গিরিডি – প্রায় ৩০০ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে।

    রাজু ওদের বলে রাতে গ্রামের ভিতর আসতে তার বাড়ি – রাতে থাকবে সেখানে এবং খাবারের ব্যবস্থা করে দেবে সে। কিন্তু এই ফ্যামিলিটা ওর কথা বিশ্বাস করতে চায় না – ভাবে কোথায় কেন নিয়ে যাবে। আসলে এই ফ্যামিলিটা কোন কারণে অন্য দলের সাথে ছিল না। রাজু অনেক বলে টলেও তাদের রাজী করাতে পারে না তার সাথে আসতে। তখন বলে, যদি তোমাদের মত বদলায় তাহলে গ্রামের ভিতরে গিয়ে বলবে রাজুর বাড়ি যাব – কেউ না কেউ দেখিয়ে দেবে।

    বাড়ি এসে চা-টা খায় রাজু, একটু রাত হয়। কি মনে হয় তার যে, লোকটা তার ফ্যামিলি নিয়ে নিশ্চয়ই আসবে খুঁজতে। রাস্তায় বের হয় রাজু – সামনে একজনকে দেখে জিজ্ঞেস করে কেউ তাকে খুঁজছিল কিনা। সে জানায় হ্যাঁ, একটা লোক মাথায় বস্তা ইত্যাদি নিয়ে গ্রামে ঘুরছিল, রাজুর বাড়ি যাবেও বলেছিল – কিন্তু কে যেন তার কথা বিশ্বাস না করে চোর ইত্যাদি হতে পারে বলে তাকে চলে যেতে বলেছে। রাজু তখন হন্ত দন্ত হয়ে খুঁজতে বেরোয় তাকে। নিমো স্টেশনে গিয়ে আবার পায় দেখা – কিন্তু এবার আর সে আসতে চায় না, বলে আমাকে মারবে গেলে! আর তা ছাড়া ওই আলুর বস্তা বয়ে নিয়ে গিয়ে সে খুব ক্লান্ত।

    যাই হোক, অনেক বলে কয়ে রাজু তাদের নিয়ে আসে গ্রামের ভিতরে। নিয়ে গিয়ে তার পুরানো কারখানায় ঘর খুলে দেয় থাকার জন্য – কিন্তু তারা কিছুতেই ঘরে শোবে না – বলে আমরা দরজার সামনেই শোব। আর একটু রাতে রাজু ভাত নিয়ে গিয়ে দেখে তারা সব অঘোরে ঘুমাচ্ছে – সারা দিনের পরিশ্রম। ডেকেডুকে তুলে ভাত খাইয়ে, মশারি ইত্যাদি খাটিয়ে, ফ্যানের ব্যবস্থাও হয়।

    আজ সকালে রাজু চা নিয়ে গিয়ে খাওয়ায় তাদের। তারপর প্রস্তাব দেয় যে – এই তোমার এত ছোট বাচ্ছা নিয়ে গিরিডি এতটা কি করে হেঁটে যাবে? এখানেই থেকে যাও লকডাউন না ওঠা পর্যন্ত। লকডাউন উঠে গেলে বর্ধমান থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি যাবে না হয়। খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে – কিছু সমস্যা নেই।

    লোকটা কাঁদতে শুরু করে – বাড়িতে সে রেখে এসেছে বুড়ি মায়ের কাছে দেড় বছরের ছেলেকে। দিন পাঁচেকের মধ্যেই ফেরার কথা ছিল, সেই মত চাল-ডাল দিয়ে এসেছে বুড়ি মা-কে। তা এখন যদি সে না যায়, তাহলে তার বুড়ি মা কি করবে? না খাতে পেয়ে মা আর তার দেড় বছরের ছেলে দুই জনাই মারা যাবে।

    ওরা আর অপেক্ষা করে না – রাজু বলল, সুকান্তদা চোখে জল চলে এল আমার। বাড়িতে বুড়ি মা আর দেড় বছরের ছেলে এদের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে – কিভাবে আটকাই এদের!

    সাথের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওরা নিমো গ্রাম ছাড়ছে গিরিডির উদ্দেশ্যে।

    প্রার্থনা করুন যেন ওরা ফিরতে পারে জীবিত অবস্থায় – এবং ফিরে জীবিত বুড়ি মা আর দেড় বছরের বাচ্ছাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে আবার।





  • r2h | 162.158.51.147 | ০১ এপ্রিল ২০২০ ২২:৫৬730412
  • :(
  • সুকি | 108.162.215.123 | ০৮ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৫৬730480
  • গোপালদা
    -----------------------

    কংগ্রেস জামানার ব্যাপারস্যাপার স্লেট থেকে মুছে দিলে, যুক্তফ্রন্ট এবং তারপরে সি পি এম আমলে ঘোষ ফ্যামিলিতে আদরে বাঁদর তৈরী হবার প্রথম উদাহরণ স্বরূপ গোপাল-দাকেই খাড়া করা যেতে পারে। সে মনে হয় নিজেও এই উপাধিতে আপত্তি করবে না – গোপালদা আমাদের সেজ জ্যেঠুর ছেলে।

    গোপালদার স্কুল লাইফ বেশ রহস্যাবৃত – কি বের হতে কি বের হবে সেই নিয়ে আমি আর ঘাঁটা ঘাঁটি করি নি দাদার পড়াশুনা নিয়ে। আমরা ঘোষ বাড়ির ছেলেরা সবাই নিমোতে প্রাইমারী ইস্কুল শেষ করে মেমারী বিদ্যাসাগর স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ট্রান্সফার নিলেও গোপালদা কি ভাবে যেন আর এক স্টেশন কলকাতার দিকে এগিয়ে বাগিলা হাইস্কুলে ভর্তি হল। যারা বলার তারা বলল যে মেমারী ইস্কুলে চান্স না পেলেই তবে লোকে বাগিলা যায়! – জাতপাত আর কবে না ছিল গ্রাম্য জীবনে! তবে এই সব ইস্কুল ভিত্তিক ইমাজেনারী র‍্যাঙ্ক নিয়ে গোপালদার কোন মাথা ব্যাথা ছিল না বলাই বাহুল্য।

    আমাদের মা-জ্যাঠিমাদের মতে গোপাল-দাকে বাঁদর বানাবার অতি আদরটি আসত বড়-বড়মার কাছ থেকে। বড় জ্যাঠা অপুত্রক ছিল এবং তাই গোপাল-দার ভাগে স্নেহ একটু বেশী পড়ত বড়মার কাছ থেকে। ইস্কুল লাইফে সেই প্রবল ভালোবাসা বস্তুগত জাগতিক জিনিসে পরিবর্তিত হয়েছিল ‘হাতখরচা’ নামে। গোপাল-দার সেই বাচ্চা বেলা থেকে এই এখনো পর্যন্ত কোন বদ নেশা নেই – মানে বিড়ি, সিগারেট, মদ, গাঁজা, মেয়েছেলে – কিছুই দাদাকে কোনদিন টানে নি। গোপালদার টান ছিল সেই কালে খাওয়া-দাওয়া এবং সিনেমা দেখা। সিনেমা দেখা এখন কমে কমে প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও, খাবার ব্যাপারে দাদা আমাদের একই রকম ইনটেনসিটি বজায় রাখতে পেরেছে। সেই সময়ে বাগিলাতে পয়সা খরচ করার মত কিছু রেষ্টুরান্ট বা আমোদের জিনিস ছিল না – আর এখনো নেই। তাই খাবার ইচ্ছা চরিতার্থ করতে দাদার সাথে জিগরী দোস্তি হয়ে গিয়েছিল ট্রেনের সব হকারদের। নিমো থেকে বাগিলা দুটি স্টেশন – এই দুই স্টেশনের মধ্যে ওঠা যাবতীয় হকারের সাথে গোপাল-দার মাসকাবারী খাতার বন্দোবস্ত ছিল। সে খেজুর থেকে শুরু করে দিলখুশ, ঝালমুড়ি, বারোভাজা, বাদাম, কলা, শসা ইত্যাদি ইত্যাদি। ট্রেনে তখনো গজা বিক্রী শুরু হয় নি – না হলে মিষ্টির প্রতি গোপালদার যা টান ছিল তাতে করে বছর বছর সেরা ক্রেতার সম্মান হকার অ্যাসোশিয়েশন থেকে বাঁধা ছিল।

    পরবর্তীকালে অনেক বছর পরে ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে গোপালদা বর্ধমান যাওয়া শুরু করল – মনে হয় না সেটা পড়াশুনার জন্য, কেউ বলে টেলারিং এর কাজ শিখতে যাচ্ছে, কেউ বলে ঔষূধের দোকানে ট্রেনিং নিতে যায়। কি করে সেই নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও বর্ধমানে নেমে গোপালদা কোথায় গিয়ে পৌঁছাতো সেই নিয়ে কারো মনেই কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না। দাদার মূল গন্তব্য স্থান ছিল নয় অনিতা না হয় নটরাজ সিনেমা হল। এবং সিনেমা দেখার পরিসমাপ্তি হলে রেষ্টুরান্টে ঢুকে খাওয়া। এই ভাবেই গোপালদা যৌবন বেলা কাটিয়ে ফেলল টুক করে।

    এর পরে খানিক ধোঁয়াশা – মেমারী পুরানো রেজিষ্ট্রি অফিসের পাশে দোকান গুলোর দোতলায়, রংবেরং নামক তখনকার বিখ্যাত ফোটো প্রিন্টিং এর দোকানটার পাশে গোপালদা নাকি কি একটা বিজনেস করতে শুরু করল। কিন্তু দোকান খোলা পাওয়াই টাফ ছিল – দাদা নাকি আনন্দম নয়ত জয়ন্তী সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে ব্যস্ত থাকত। আর সেখানে না পাওয়া গেলে নির্ঘাত পাওয়া যেত পাশের কোয়ালিটি রেষ্টুরান্টে – সকালে অকালে খাবার ব্যাপারে গোপালদার কোন বাছ বিছার ছিল না। মাল কিনতে এসে যদি খদ্দেরকে বেশী সময় ব্যয় করতে হয় দোকানের মালিককে খুঁজে বের করতে, তা হলে যা হবার হল – বিজনেস এক সময় উঠে গেল। গোপালদা এখন নিমো স্টেশন মাষ্টারি করে, মানে সেজো জ্যেঠুর টিকিট মাষ্টারের কাজটা প্রক্সি মারে আর কি।

    আর যেটা বলার, সমাজসেবার জন্য বা পরের দরকারে ঝাঁপিয়ে পরে রক্ত দেওয়ার অনেক পাবলিক গ্রামের আশে পাশে থাকলেও টিফিন খাবার লোভে রক্ত দিতে আমি একজনকেই দেখেছি – সেও হল এই গোপালদা। মেমারী ইস্কুলে তখন বছরে কয়েকবার করে লায়ন্স ক্লাবের তরফ থেকে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হত। রক্তদান শেষে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত একটা টিফিনের বাক্স এবং গোটা দুয়েক ফল, মূলত আপেল এবং কলা। তখন নাকি নিয়ম ছিল বছরে দুবারের বেশী রক্তদান করা যাবে না। শিবিরে রক্তদান করে করে গোপালদা-কে আশে পাশের গ্রাম বা মেমারীর ক্লাবের সদস্যরা সবাই চিনে গ্যাছে ততদিনে। বিছানা সাজিয়ে ডাক্তারি মালপত্র নিয়ে সকাল সকাল বসতে না বসতে গোপালদা সাইকেল নিয়ে হাজির হয়ে যেত রক্ত দিতে। সেবারেও গোপালদা গেছে রক্ত দিতে – কিন্তু ক্লাবের তপা-দা বলছে, “এই তো তিন মাস আগেই তুই রক্ত দিয়ে গেলি গোপাল – তোর রক্ত এবারে নেওয়া যাবে না”। কিন্তু কে শোনে কার কথা – রক্ত সে দেবেই। দরাদরি চলতে থাকে, ক্লাব রক্ত নেবে না, আর গোপালদা রক্ত দেবে। আর কিছুই না, কেবলমাত্র টিফিন খাবার লোভে। শেষ পর্যন্ত তপা-দা বলল, “গোপাল তোকে আর রক্ত দিতে হবে না, এই টিফিনের বাক্স নিয়ে তুই এখন বাড়ি যা”। বাক্স পেয়ে গোপাল-দা শান্ত হল, বাসি ছানার গজাটা খেতে খেতে বিদায় নিল।

    খাওয়া ছাড়া গোপাল-দার আর একটা প্রিয় কাজ ছিল সকাল বেলা আনন্দবাজার এবং বর্তমান খবরের কাগজ দুটো প্রায় মুখস্ত করে ফেলা। এবং কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে অদ্ভূত সব তত্ত্ব ছাড়ত গোপালদা। এমনি একদিন সকালে আমাদের বাড়ির দুয়ারে গোপালদা কাগজ পড়ছে, আর বাড়িতে মা-কাকিমা পেঁপে গাছ থেকে গত রাতে প্রায় পেকে যাওয়া বড় পেঁপেটা চুরি যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করছে। গোপাল-দা বলল, কাকিমা বলছি শোন এমন দিন আসছে যে দেখা মাত্র গুলি করতে হবে এই সব কেসে। মা বলল, সে কি রে গোপাল, পেঁপে চোরকে গুলি করে মারবে কে? গোপালদার যুক্তি হল ভারতবর্ষ ক্রমশ উচ্ছন্নে যাচ্ছে – জেলে কয়েদীদের রাখার জায়গা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কনক্লুশন সব নেতা শালা হারামি!

    আমি আর গোপালদা বহু বহু বিয়েবাড়িতে একসাথে খেতে গেছি – আপ রুচি খানা এবং পর রুচি পড়না্‌ নাকি একটা ডায়লগ আছে, সেটার প্রকৃত মর্ম আমি গোপালদার কাছ থেকেই প্রথম শিখি। ফালতু সামাজিক আদান প্রদানে না মেতে, মাথা নীচু করে নিদারুণ সাঁটিয়ে টুক করে বিয়ে বাড়ি থেকে কেটে পড়ার আর্ট গোপাল-দাই হাতে কলমে শেখায়। আর তা ছাড়া দাদার পাশে খেতে বসলে চক্ষু লজ্জার ব্যাপারটাও থাকত না – কারণ ধরুন এমনি পুতুপুতু পাবলিকের পাশে বসে শেষ পাতে গোটা কুড়ি রসগোল্লা খেতে আমার কেমন কেমন লাগত। কিন্তু গোপালদা নিজে খেত খান তিরিশ – তাই তার পাশে আপেক্ষিক ভাবে কুড়িটা রসগোল্লা কমই লাগত। মেন টার্গেট থাকত পোলাও বা ফ্রায়েড রাইস, মাংস এবং মিষ্টি। মাঝের বাকিদের আমরা পাশ দিয়ে দিতাম। পুরানো দিনের অ্যালুমিনিয়ামের পরিবেশনের বালতি গুলোর পৌনে একবালতি হিসেব থাকত গোপালদার পোলাওয়ের। এমনিতেই সবাই জানত, তাই আর বার বার গোপালদাকে চাইতে হত না – কেবল পেট ভরে গেলে হাত তুলে বারণ করা ছাড়া।

    নীচের ছবিটি তেমনি এক বিয়েবাড়ির, তবে এটা ঘোষ বাড়ির ছাদে – নিজেদের পরিবারের কারো বিয়ে। তখন হারু-দা প্যান্ডেল করত শুধু – বাকি সব ঘোষ ফ্যামিলির – রাঁধা, পরিবেশন বাসন পত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বিয়ে বাড়ির পুরো গল্প অন্য কোন সময়।



    এক সময় বিয়ের বয়স চলে এল – মেয়ে দেখা চলছে। শেষে গিয়ে তারকেশ্বর লাইনের দামোদরের পাশের এক গ্রামের বৌদি-কে দেখে গোপাল-দার খুব পছন্দ হয়ে গেল। লোকে বলল, গোপাল ওখানে বিয়ে করিস না – শ্বশুর বাড়ি যাবি কি করে! রাস্তা বলে কিছু নেই, বর্ষাকালে বান হলে সব ভেসে যাবে – আর মনে হয় এঁটেল মাটি! কিন্তু গোপালদা গোঁ ধরে রইল, বিয়ে করতে হলে এই মেয়েকেই করবে বিয়ে। তা বিয়ে হয়েও গেল – বিয়ের দিন কি বৃষ্টি বৃষ্টি – ঘোষ গুষ্টি প্রায় শ’খানেক লোক বিয়ে দিতে রওয়ানা দিল গোপালকে গাল পাড়তে পাড়তে। সবাই বলছে এ কোথায় বিয়ে করল রে গোপাল – বেঁচে ফিরতে পারলে হয়! বলাই বাহুল্য সবাই বেঁচে ফিরেছিলাম – গোপালদাও দুই মেয়ে নিয়ে সুখে সংসার করছে। এখনো নিমো স্টেশনে নামলে পরিবারের লোকেদের মধ্যে গোপালদার সাথেই দেখা হয় প্রথম স্টেশনে - সুকান ভালো আছিস?

    তবে এখন আর গোপালদা টিফিনের লোভে রক্ত দিতে যায় না।
  • সুকি | 172.69.34.67 | ০৮ এপ্রিল ২০২০ ১৯:০৩730481
  • একটা জিনিস আগে খেয়াল করি নি - সেদিন পাই বলার পর খেয়াল করলাম এবং দেখে বেশ মজা লাগল। আজকাল লেখা কতবার পঠিত সেটা পাশে দেখা যায়। তো এটা লক্ষ্য করলাম - বিশাল মাথা খাটিয়ে প্রবন্ধ লিখি তাতে ওতো পাঠক নেই। কিন্তু নিমোর গল্পের পাঠ সংখ্যা বেড়েই যায় রোজ রোজ! পড়ে কে এগুলো রোজ !!! এমন নয় যে নিমোর ছেলেরা ঢুঁ মারে এখানে -

    এটা ভেবে বেশ গর্ব হয় হয় যে নিমো নিয়ে লোকের ইন্টারেষ্ট আছে :)
  • Du | 172.69.68.208 | ০৮ এপ্রিল ২০২০ ২১:২৭730482
  • নিমো গ্রাম আমাদের আত্মার আরাম যাকে বলে।
  • সম্বিৎ | ০৮ এপ্রিল ২০২০ ২৩:৩৫730484
  • নিমো আমাদের সবাইকার নিজের গ্রাম হয়ে গেছে। কাজেই নিমোর লোকেরাই আসে পড়তে।
  • ar | 173.245.52.68 | ০৯ এপ্রিল ২০২০ ০০:৪১730495
  • @সুকি

    আরে ভাই, আপনার নিমো গ্রামের গল্প হল আমাদের সমস্ত বিষাদের দাওয়াই, প্রাক-করোনা, করোনাকাল এবং করোনাত্তোর কালের।

    কলম চলিয়ে যান, একদম থামাবেন না!!
  • একলহমা | ০৯ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৩১730497
  • নিমো গ্রাম কি আর শুধু তোমার আর তোমাদের গ্রাম? আমার আর আমাদের গ্রাম নয়? কেউ লিখবে আর কেউ পড়বে! অতএব
    :D
  • সুকি | 172.69.34.105 | ০৯ এপ্রিল ২০২০ ১৭:৫৬730507
  • করোনা ইত্যাদি সব ঠিক ঠাক মিটলে তাহলে সবার একবার নিমো আসার আমন্ত্রণ রইল
  • সুকি | 172.69.34.105 | ০৯ এপ্রিল ২০২০ ১৮:২৪730508
  • হাবা
    -----------------------

    বাঙালির ক্রমাগত অবক্ষয়ের পিছনে যে সাম্রাজ্যবাদী কোন চক্রান্ত, নেতাজীর মরে যাওয়া, বড় বাজারের মারোয়ারী বা জ্যোতি বসু নেই তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট করে তুলল আমাদের বাল্য বন্ধু হাবা। এই হাবাই আমাদের সামনে হাতে কলমে প্রমাণ করে ছাড়ল যা কিছু অবক্ষয় বাঙালির তার মূল কারণ হল অম্বলের জ্বালা এবং চোঁয়া ঢেঁকুর। হাবা – সেই হাবা, যে ছিল আমাদের কাছে সেক্সের সিম্বল, ব্রুটাল অনেষ্টির মাপকাঠি, অকুতভয়, ক্রীড়াপটু এবং আরো অনেক কিছু।

    তার অবস্থা দেখে গেল বার বাড়ি গিয়ে আমি নিজেই কাবু হয়ে গেলাম। নিমো স্টেশনের আপ প্লাটফর্মের ঠিক পিছনের দিকে টিকিট কাউন্টারের কাছাকাছি আজকাল হল গিয়ে হাবার পান-বিড়ির দোকান। সুকান কবে এলি ইত্যাদি কুশল বাক্য বিনিময়ের পর আমি জানতে চাইলাম হাবা তোর শরীর কি হয়েছে রে? আমাকে হাবা জানাল, আর বলিস না, খালি পেটে চুল্লু খেয়ে খেয়ে পেটের প্রবলেম – অম্বল আর অম্বল, দিলীপ ডাক্তারের কাছে গেলাম, বলল বাঁচতে চাস তো আর চুল্লু খাস না। চুল্লু বেশী না খেতে পারার দুঃখে হাবাকে কাতর দেখালো। হাবা যখন কথা বলবে তখন তার মাঝে আবার খদ্দেরের কথা বলার হুকুম নেই। কিছু কিনতে চাইলে নিজে সামনে সাজানো হরেক টিনের জার থেকে নিয়ে নিতে হবে আর পয়সা চটের বস্তার উপর ছুঁড়ে দিলেই হবে। আমাদের কথা বলার মাঝে হঠ করে বেশী স্মার্ট এক বাঙাল হকার পান চেয়ে বসে হাবার কাছে। হাবা তাকে ফায়ার করে দিল, “বাঁড়া তোর পান আগে হল নাকি এতদিন পরে বন্ধুটা এল তার সাথে দুটো কথা বলব সেটা?” হকার ভাই সৌজন্য কি জিনিস শেখার অ্যাডভাইস পেয়ে কাঁচুমাচু মুখে বিদায় নিল।

    বলে রাখা ভালো যে, আমাদের বন্ধু ব্যাচে হাবাই সর্বপ্রথম অবৈধ সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়েছিল ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়। ক্ষ্যাপা মাষ্টারের কাছে প্রাইভেট টিউশনি শেষ করা এবং ইস্কুলের গণ্ডী পেরোবার সীমারেখা থেকেই হাবার কাছে তার নিজের ‘রঞ্জিত’ নামটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল। ক্ষ্যাপা মাষ্টার আজ আর নেই – আমাদের গ্রাম থেকেই টিউশনি পড়িয়ে ফেরবার পথে জি টি রোডে লরির ধাক্কায় প্রাণ হারাণ। এই ঘটনা আমাদের বিষাদগ্রস্ত করেছিল কিছুদিন কারণ খ্যাপা মাষ্টার আমাদের নিমো গ্রামের অনেক ছেলেরই কৈশোরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আমরা তাই ক্ষ্যাপা মাষ্টারের স্মৃতি চারণার আয়োজন করেছিলাম ইনফরম্যাল - কেবল আমাদের এই ছেলে ছোকরাদের মধ্যে। কেউ বলল মাষ্টারের কাছে পড়ে কিভাবে সে দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় মাধ্যমিকে ইংরাজীতে পাস দিয়েছিল – কেউ বলল ক্ষ্যাপা মাষ্টারের কাছে পড়েও সে উচ্চমাধ্যমিকে ইংরাজী ডিঙোতে পারে নি, তবে তাতে মাষ্টারের কোন দোষ ছিল না, নিজের বংশের দোষেই সে পাস দিতে পারে নি। হাবার টার্ণ এলে সে বর্ণনা করল কিভাবে ক্ষ্যাপা মাষ্টারের প্রবল কোপে পড়েছিল বীচি টিপে দিয়ে। ক্ষ্যাপা মাষ্টার পাজামা পড়ে পড়াতে বসত। এবং মাঝে মাঝে পাশে বসা হাবাকে রিকোয়েষ্ট করত পা দুটো একটু টিপে দিতে। বারবার রিকোয়েষ্টে তিতি বিরক্ত হয়ে সেই বার হাবা পা টিপতে টিপতে আর একটু উপরের দিকে উঠে মাষ্টারের বীচি দুটি খুব জোরে টিপে দেয়। হাউ মাউ চিৎকারে খ্যাপা মাষ্টার হাবাকে তাড়া এবং আর কোন দিন পড়াবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। পরে অবশ্য মাষ্টারের বউ অর্থাৎ তুফানের মায়ের হস্তক্ষেপে হাবা আবার টিউশনিতে ফিরে আসে। হাবার বলা শেষ হলে আমরা ক্ষ্যাপা মাষ্টারের আত্মার এবং ততসহ তার বীচির শান্তি কামনা করলাম।

    ধোনি র ‘হেলিকপ্টার’ শটের বহু আগে থেকেই আমাদের দিকে হাবা ক্রিকেট মাঠে ওই শটটি দিত – যদিও আমাদের কাছে তা ছিল ‘পাম্প’ (উচ্চারণ যদিও হত ‘পাম্‌’ বলে) দেওয়া মার। ক্রীজে স্টান্স নেবার পর, হাবা তার হাঁটু দুটি অদ্ভুত ভাবে ভাঁজ করত ও আবার সোজা হত। তা অনেকটা দেখতে হত সেই সাইকেলের চাকায় সিরিঞ্জ দিয়ে পাম্প দেবার মত। সেই থেকেই ‘পাম্প’ দেওয়া মারের উৎপত্তি। গায়ের জোরে হাবা ছিল ধোনির বাপ – ফলতঃ বেশীর ভাগ সময়েই সেই খান্না টেনিস বল রশিদের খামারে বা সামনের বাঁশ বাগানে অদৃশ্য হত। এই এখনো, সক্রিয় ক্রিকেট থেকে অবসর নেবার পরও মাঠে গেলে আজকালকার ছেলেরা হাবাকে ‘পাম্প’ দেওয়া মার দেখানোর অনুরোধ করে। এদের অনেকেই হাবাকে কোনদিন খেলতে দেখে নি – কিন্তু হাবা সম্পর্কে উপকথা শুনে এসেছে অফুরন্ত। কিন্তু আমাদের কাছে হাবার ইমপর্টেন্স ওর ক্রিকেটিয় দক্ষতার জন্য ছিল না, ওর থেকে অনেক বেশী ভালো ক্রিকেটার আমাদের গ্রামে ছিল – কিন্তু আমরা কেউই হাবার ব্রুটাল অনেষ্টির ধারে কাছে পৌঁছতে পারি নি কোনদিন। আমাদের ফুটবল শেষে বিকেলের গল্প ছিল বেশীর ভাগ সময়েই হাবিজাবি – সেই চিরাচরিত গল্প শেষ করে মসজিদের আজানের শব্দ কানে এলে, শাঁখের শব্দ শুনতে শুনতে অভস্ত্য আমরা নিজেদের পাড়ায় ফিরে যেতাম। তেমনি এক বিকেলে, ফুটবল খেলা শেষ করা ঘামে ভেজা চৈত্রদিবসেই আমরা প্রথম হাবার পিতৃত্বের খবর পাই।

    হাবাদের আদি বাড়ি ছিল বিহারে। কিন্তু ওর বাবা রেলের চাকুরী করতে এসে আমাদের নিমো গ্রামে রেল কোয়ার্টারে থাকতে শুরু করে। হাবার জন্মও নিমো গ্রামে – আমার থেকেও খারাপ হিন্দী বলে। মোট কথা আমাদের কাছে এবং নিজের কাছেও হাবা ছিল বাঙালী। কিন্তু ওই রেল কোয়ার্টারে বেশীর ভাগ পাবলিকই ছিল বিহারী এবং তারা ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেবার সময় বিহার থেকেই সমন্ধ করে আনত। এই ভাবেই হাবার প্রতিবেশী রামাশীষের বিয়ে হয়ে গেল বিহারের কোন এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক ডাগর মেয়ের সাথে। রামাশীষের কেপেবেলিটি নিয়ে আমাদের মধ্যে চিরকালীন এক সন্দেহ ছিল – ওর আচার আচরণ ইত্যাদি খুব একটা স্বাভাবিক ঠেকত না আমাদের কাছে। এর বহুকাল পরে আমরা সেই আচরণের প্রতিশব্দ খুঁজে পাই – ঋতুপর্ণীয়। বলাই বাহুল্য রামাশীষ ঋতুপর্ণকে চিনত না।

    যাই হোক রামাশীষের সেই ডাগর বউ দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। আমাদের মধ্যে এই বিষয়ে তখনও পর্যন্ত জ্ঞানী দিবাকরের ভাষায় রামাশীষের পক্ষে ওই ইঞ্জিন ঠেলা অসম্ভব। উজ্জ্বল কালো রঙের এক নধর, ডাগর মেয়ে – কেউ খবর দিল যে কাছ থেকে দেখলে নাকি চোখে মুখে খাই খাই ভাবেরও ছাপ দেখা গেছে! তো যাই হোক কি হতে কি হইয়া গেল – এক বছরের মধ্যে রামাশীষের বউয়ের সাথে হাবা জড়িয়ে গেল অঙ্গাঙ্গী। রামাশীষের বউয়ের নাম রাখা হল ‘লাল পরী’ – লাল রঙের শাড়ী পড়েই ঘুরত বলে মনে হয়। এক সময় আমরা জানতে পারলাম লাল পরী সন্তান সম্ভবা – হাবা এক পড়ন্ত বিকেলে ফুটবল খেলার পর বিষ্ফোরন ঘটালো এই বলে যে লাল পরী নাকি কনফার্ম করেছে বাচ্চাটা হাবার। আমাদের তখন ক্লাস টুয়েলভ। আমরা অনেকেই হাবাকে বিশ্বাস করি নি!

    হাবা আমাদের পরিপূর্ণ গল্প বলত – কিভাবে, কোথায় যৌন মিলনে লিপ্ত হত এবং দিবাকর চাপাচাপি করলে যৌনাঙ্গের বিবরণ শুদ্ধু। আমরা বুঝেছিলাম কি ভাবে নির্জন রাস্তা – কেবিনের পিছনের দিকে কৃষ্ণচূড়া, সজনে গাছ, ঝোপঝাড় হাবাকে এগিয়ে দিয়েছিল লাল পরীর দিকে। ঘুম ভেঙে যেত নিয়ম মাফিক – রাত দু-তিনটের সময় স্টেশনের সবুজ বা লাল সিগন্যাল পেরিয়ে, ঘরে ঘুমন্ত রামাশীষকে ডিঙিয়ে লাল পরী মিলিত হত হাবার সাথে। ভাবার দরকার হত না, জানালায় তখন তাকালেই লাল পরী দেখতে পেত হাবার মুখ – হাবা মোড়ে দাঁড়ায়, লাল পরী এগিয়ে আসে – দুজনে হাঁটা পথে ঢুকে যায় ঝোপে ঝাড়ে বা রাধা চূড়া গাছটার তলায়। হাবার নিজের কথায় নির্জনতা কোন চ্যালেঞ্জ ছিল না – কেবল শীৎকারের সময়টুকু ছাড়া – কেবল তখনই লালপরী ফিসফাস ভালোবাসত না।

    আমরা জানতাম হাবা মিথ্যে কথা বলে না, কিন্তু তবুও অনেকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি নি যে লাল পরীর ছেলে আসলেই হাবার! তবে কিছু বছর পর আর অবিশ্বাসের উপায় রইল না – কারণ লাল পরীর ছেলের মুখে ক্রমশঃ হাবার মুখের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল। আমাদের গ্রামে এই তৃতীয় কেস ঘটল একের ছেলে অপরের মত দেখতে হবার। কোন কোন বিকেলে হাবাকে বেশী এফর্ট দিতে দেখা যেত না ফুটবলে। আমাদের সে অম্লানে বলত, আজকে আর শরীর দিচ্ছে না রে, এই একটু আগে ‘মেরে’ এলাম। তবে হাবার চরিত্র নিয়ে আমাদের কোনই সন্দেহ ছিল না – কারণ লাল পরী ছাড়া হাবা আর কাউকে কোন দিন ‘মারে’ নি।

    হাবা এই ভাবেই তার সমস্ত গল্প আমাদের বলত। লাল পরীকে ‘লাগাবার’ আগে সে কিভাবে তার পিস্তলে মেমারী গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে ফ্রীতে পাওয়া ক্যাপ পড়াতো সেই গল্প। ক্যাপের মোটাত্বের সাথে সুখের কি সম্পর্ক তা আমরা প্রথমে হাবার কাছেই জানতে পারি। অবশ্য পিস্তলে ক্যাপ পড়ানো খুব বেশী দিন স্থায়ী হয় নি – আরো সুখের সন্ধানে লাল পরীর পরামর্শে ক্যাপ হয়েছিল বর্জিত এবং ফলতঃ হাবার পিতৃত্ব। লাল পরীর পাখির মত বুক থেকে – ঝোপ ঝাড়, গাছের তলা, বিছানায় তাদের যৌথ আসনের কার্যকলাপ হাবা আমাদের বিস্তারিত ভাবেই বলত – এবং প্রকাশ্যেই।

    হাবার গল্প অনেক, সব কিছু লেখা যাবে না অল্প পরিসরে। তবে হাবার সাহসের গল্পটা শেয়ার করেই শেষ করব। সেই বার রেল লাইন বদলানো হচ্ছে হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে। সব পুরানো শাল কাঠের স্লীপার তুলে কংক্রিট স্লিপার বসানো হবে। রেল লাইন কাটা হচ্ছে আর তুলে পাশের জমিতে ডাঁই করে রাখা। স্বাভাবিক ভাবেই একদিন চোর এল চুরি করতে সেই দামী রেল লাইন। নিমো স্টেশনের পাশে রেল কোয়ার্টার আর আমাদের গ্রামের মাঝে বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা। তাই সেই চোরেরা এল লরি নিয়ে। হাবার ভাষায় এসেই তারা রেল কোয়ার্টার এর দরজায় দরজায় শিকল তুলে দিল এবং সামনে দিয়ে তলোয়ার নিয়ে হাঁটাহাঁটি। অকুতভয় হাবা ওরই মাঝে জানালার ফাঁক দিয়ে নিমো গ্রামে এসে লোক ডাকতে এল।

    গ্রামে বন্দুক বলতে শৈলেন মোড়লের এক দোনলা বন্দুক – সেই কাকাকে উঠিয়ে বন্দুক নিয়ে গ্রামের প্রান্তে নিমো ভারত সেবক সামজের ছাদে ওঠা হল যেখান থেকে গুলি ছোঁড়া হবে লরিতে লোড করতে থাকা চোরেদের দিকে। শৈলেন কাকা গুলি বন্দুকে লোড করে প্রথম ফায়ার, সেই গুলি মিয়ানো বারুদের মত ফুস করে নাকি কিছু দূর গিয়ে লুটিয়ে পড়ল। যাই গুলি করা হয়, কোনটাই আর এগোয় না। কাকা সাফাই দিচ্ছে, আসলে অনেক দিন গুলি রোদে দেওয়া হয় নি তো! আর আমার কানে ভাসছে হাবার গলা, “দূর বাঁড়া কাকা, কেন যে গুলি রোদে দাও না”। কাকা তর্ক করছে, গুলি রোদে দিয়ে কি হবে, গত বার তো ছিঁচকে চোরকে গুলি করতে বললি যে নাকি একটা সন্তোষ রেডিও চুরী করে পালাচ্ছিল। জানিস কি তুই যে একটা গুলির দাম সন্তোষ রেডিওর থেকে বেশী? আমাকে দেখতে হবে তো যে কি রেঞ্জের চুরী হচ্ছে।

    বলাই বাহুল্য তর্ক করেই ক্লাবের ছাদে আমাদের সময় গেল – চোর নিজেদের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে লরি লোড করে রেল লাইন নিয়ে বিদায় নিল।
  • একলহমা | ১০ এপ্রিল ২০২০ ১০:৫৯730520
  • লেখায় ব্রুটাল অনেষ্টির মাপকাঠি কি সেইটা আমার জানা নেই, তবে সেইটা যা-ই হোক না কেন এই লেখা সেই মাপকাঠিতে বাঁ স্টার নিয়ে পাশ করে যাবে! :D
  • সে | 162.158.150.45 | ১০ এপ্রিল ২০২০ ২৩:১৮730543
  • চরম। এই ছেলেটা বহুত বড় লেখক হবে।
  • b | 108.162.215.37 | ১১ এপ্রিল ২০২০ ১২:০৪730546
  • চলুক
  • সুকি | 172.69.34.181 | ১২ এপ্রিল ২০২০ ১১:০৩730559
  • আশ-পাশ
    -----------------------

    বছর ছয়েক আগের কথা – দুর্গাপুজোর সময় নিমো গেছি। পুজো মিটে গেছে, দশমী আর লক্ষ্মী পুজোর মাঝের সময়ের কথা। মনোরম আবহাওয়া, রোদের তেজ একদম কমে এসেছে – একটু বেলা বেড়ে গেলেও আলতো রোদে হাঁটা বেশ সহনীয় হয়ে গেছে ততদিনে।

    তো সেদিন পিন্টু বলল তোর ভালো ক্যামেরা দিয়ে আমার কিছু ছবি তুলে দে ফেসবুকে দেব। আমরা দুজনে স্টেশন ছাড়িয়ে লাইন দিয়ে হাঁটা দিলাম – ভালো ছবির খোঁজে। তখনো নিমো স্টেশনের পাশ দিতে থার্ড রেল ট্রাকের কাজও শুরু হয় নি আর ফলতঃ আমাদের স্টেশনের প্লাটফর্ম দুটো থেকে তিনটেও হয় নি। এই নতুন রেল ট্রাক যেটাকে এখন থার্ড লাইন বলা হয় সেটা আসার আগে লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটার এক পথ ছিল। সেই পথ দিয়েই পাশের গ্রামের লোক যেত আর নিমোর লোকেরা মাঠঘাট চাষ-বাস দেখতে যেত। লাইনের গা বরাবর আগের পায়ে চলার পথটা ততদিনে মুছে যেতে শুরু করেছে আমাদের বা আমাদের মত আরো অনেকের অবর্তমানে। তাই পথ চলা এখন লাইনের স্লিপার দিয়েই, একদম প্রায় সরলরেখা বরাবর।







    বহুদূর দেখা যায় কিন্তু দেখার মত কিছু ভাবা যায় না – কিন্তু লাইনের গায়ের কিছু কিছু গাছ তখনো ছিল, যেমন বড় সেই বেল গাছটা। আমাদের ছোটবেলার বেল গাছ পেরিয়ে যাই – যে বেলগাছ নিমোগ্রামের আত্মহত্যার এক হট স্পট ছিল। কারণ ঠিক বলতে পারব না – বেল পাতা, শিব ঠাকুর - আত্মহত্যা করলে স্বর্গে যাওয়া যায় না এমন ধারণা থেকে বেরোনোর জন্য জীবিত থাকা কালেই কিছু কানেকশন তৈরীর জন্যই হোক – বা সেকালে ট্রেন হামেশা লেট করত। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রোদে পোড়ার তো কোন মানে হয় না – তাই সেই বেল গাছের ছায়ার পোটেনশিয়াল সুইসাইডার অপেক্ষা করত। বড়দের চুলি তো সেই মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি থেকে অভিমানে রাত নটার সময় গিয়ে রেলে মাথা দিয়ে দিল – কুমারদের খ্যাঁদা কি এক অজ্ঞাত কারণে বুড়ো বয়েসে রেলে মাথা দেবার জন্য সেই বেলতলাকেই প্রেফারেন্স দিল। ঘোষ পাড়ার বরুণ কোন এক রহস্যময় কারণে কম বয়েসে রেলে কাটা পড়লে তার বডি ট্রেনের সামনের লোহার গার্ডে ঘষটে গিয়ে তো সেই বেলতলাতেই পোঁছালো।





    সেই নিমো বেলতলার নাম শুধু আশে পাশের গাঁয়ে ছড়িয়ে ছিল এমন নয়, এর নাম কলকাতার দিক পানেও এগিয়ে গিয়েছিল তা আমরা জানতে পারলাম যেখন সেই চন্দননগরের ছেলে আর মেয়েটি আত্মহত্যা করল একসাথে। বেল গাছের সামনের পোষ্টেই চক দিয়ে নাম লিখেছিল চন্দননগরের ছেলেটি, কিংবা কে জানে হাতের লেখাটি ছিল হয়ত ছিল মেয়েটিরই। ঠিকানা দ্রুত খবর দিতে সাহায্য করেছিল। সেই পোষ্টের দিকে ফিরে তাকিয়ে আমার মনে হল, তখন মোবাইল থাকলে হয়ত তাদের বাড়িতে বাইরের লোককে খবর দিতে হত না। গাছের ছবি না তুলে এগিয়ে যাই – কিছু স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা না হয় চলতেই থাকুক।

    নিমো আর রসুলপুর স্টেশনের মাঝে আছে সেই ডিভিসি ক্যানেল – কেজা গ্রামের পাশ দিয়ে ছিনুইয়ের মাঝে দিয়ে নিমো আর মহেশডাঙা (মাশডাঙা) বর্ডার দিয়ে চলে গেছে সেই ক্যানেল। আমাদের চাষ বাসের জল সরাবরাহ করার এক প্রধান উৎস। ক্যানেলের সিঁড়িতে পিন্টুর ছবি তুললাম – এই ক্যানালকে ঠিক আমরা নদী ডাকতাম না, কিন্তু তার পারের জমি আমাদের কাছে ছিল নদীর ধারের জমি। নদীর ধারে, জমির পাড়ে বড় আমগাছ গুলি কেটে দেওয়া হয়েছে। ওই গাছের আঁধারের সুযোগ নাকি নিয়েছে অসামাজিক কেউ – জানা নেই কার সম্মতি আর কারই বা অসম্মতিতে। সেই নারকেল গাছ গুলি রয়ে গেছে – আর তাদের ছায়া অনেক দূরে – পিন্টু নারকেল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, সূর্যের মুখোমুখি – তার ছায়া তখন বেশ কিছুটা দূরে। সবুজ ধানের মাঝেও ছবি পেলাম, উঠে এল সবুজ ধানও। আলপথ বড় অমসৃণ – কেউ কেউ ঘুমিয়ে থাকে সেই পথে বড় অবহেলে।



    ঠিক এই জায়গা থেকে ক্যানালের ধার বরাবর একটু উত্তরে এগিয়ে ছিনুই শীতলা মন্দির। এই তো কদিন আগেই শীতলা পুজো হল, আমরা ছোটবেলায় বলতাম এবং এখনো পুজো উপলক্ষ্যে বাড়ির মা-কাকিমারা সেই শীতলা মন্দিরে গেলে বলা হয় ‘ছিনুই বাড়ি’ যাওয়া। এই ক্যানালই নাকি আগে বেহুলা নদী ছিল এবং সেই নদী দিয়ে বড় বড় ইতিহাসের কেত মারা লোকেরা গেছে এককালে এমন গল্পও শুনতে পাওয়া যায় কান পাতলে। তো এই বারের ছিনুই বাড়ি লকডাউনের কড়াকড়ি ঠিক জমে ওঠার আগেই নাক বরাবর মিটে গিয়েছিল। মা এই বারে পুজো দিতে যায় নি – আমাদের বাড়ি থেকে কাকিমা গিয়েছিল সব পুজো নিয়ে বাবু-র বউয়ের সাথে সনৎ-দার টোটো করে। ছিনুই বাড়ি পুজো দিতে গিয়ে সেই মন্দিরের চাতালে পুজোর অপেক্ষা করতে করতে চপ-মুড়ি খাওয়া এক ট্র্যাডিশন।

    আমার কাকিমার ভক্তির টান যত না ছিল তার থেকেও বেশী ছিল ছিনুই বাড়ির চপ খাবার লোভ। মায়ের সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল, জিজ্ঞেস করলাম ছিনুই বাড়ি কেমন হয়েছে এবার। মা জানালো, এবার করোনা ভাইরাসের জন্য কোন চপের দোকান বসে নি মন্দির চত্ত্বরে – শুধু পুজো দিয়ে চলে আসতে হবে। সেই দেখে তোর কাকিমার মাথা গরম গিয়েছিল, রাগের মাথায় পুজো দেবার সময় গোত্র ভুল বলে দিয়েছে বামুনকে – ফিরে আসার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মঞ্জু, শাণ্ডিল্য গোত্র ঠিক ঠাক বলেছো তো, আর মেহুলের নামে পুজো দিয়েছে তো ঠিকঠাক?” আমাকে বলে, এই রে দিদি, আমি তো ভুল করে কাশপ্য গোত্র বলে দিয়েছি! আমার মা এখন টেনশনে আছে ভুল গোত্রে পুজো দিলে কি হয় সেই দেখার জন্য।

    তবে মা কিন্তু কাকিমাকে ডিফেন্ড করার হালকা চেষ্টা করল – আহা মানুষটা রাগবে না, খেতেই না হয় একটু ভালোবাসে। এদিকে চপ পায় নি ছিনুই মন্দির তলায়, টোটোয় করে ফেরার সময় দেখে নিমো বটতলায় কোচো-র দোকানে লাইন লেগে গ্যাছে চপ কেনার জন্য বেলা এগারোটায়। এমনিতে কোচো চপ করে না, তবে সেই দিন স্পেশাল করেছিল। তোর কাকিমা দিয়েছে লাইন – অনেকক্ষণ লাইন দিয়ে তিনজনের মধ্যে চপের ঝুড়ির কাছে পোঁছে গেছে। ব্যাস – চপ শেষ! তা এতে রাগবে না মানুষ! আর কোচো-কেও বলিহারি, এত বয়স হল বুদ্ধি হল না – জানিস লোক আসবে, তবু বেশী মাল করা নেই!

    আমি আর কি বলি – কাকিমার খাবার লোভ সুবিদিত আমাদের ঘোষ বাড়িতে। কি একটা নিয়ম আছে যে বিয়ে করতে মেয়ের বাড়ি বেরোবার আগে সন্ধ্যে বেলায় ছেলের মা-কে কি একটা রিচ্যুয়াল করতে হয় এবং তার জন্য উপোস করতে হয়। কিন্তু বাবু-র বিয়ের সময় কাকিমা বলল, “দিদি, আপনি গুরুঠাকুরকে বল একটা বিদেন বের করুন – সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত আমি উপোস করতে পারব না। তা থেকে বরং বাবু গিয়ে দিনের বেলায় রেজিষ্ট্রি বিয়ে করে আনুক”। শেষ পর্যন্ত বামুন-কে ‘মূল্য’ ধরে দিয়ে দুপুরের মধ্যেই রিচ্যুয়াল সমাপ্ত হয়। আজকাল বয়স হচ্ছে, কিন্তু খাওয়ায় কম্প্রোমাইজ নেই – প্রায়ই উল্টো-পাল্টা খেয়ে গ্যাসের ব্যাথায় ছটফট করবে – তারপর বাবু-কে মা করবে ফোন, “তাড়াতাড়ি আয়, তোর মা মনে হচ্ছে মারা যাবে”, বাবু তখন তাস খেলা ছেড়ে পচা-দা এবং গ্যাসের ইনজেকশন নিয়ে বাড়ি ফিরবে। পচাদা আমাদের নিমোর এখনকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান এবং অনেকদিনের বিখ্যাত হাতুড়ে ডাক্তার। এখনো কাকিমার গ্যাসের ব্যাথা উঠলে পঞ্চায়েত মিটিং স্থগিত থাকে কিচ্ছুক্ষণ – যতক্ষণ পচাদা ইঞ্জেকশন দিয়ে আবার ব্যাক না করে!

    তো যাই হোক, ডাইগ্রেস করে যাচ্ছি। ফিরে আসি সেই ক্যানেলের ধারে পিন্টুর ছবি তোলার ব্যাপারে। ছবি তোলা শেষ হলে আমরা সার-ভোমলার আমবাগানের মধ্যে দিয়ে ঠাকুরপুকুর – পুকুরের পাড়ে আসি। কত গুলো বৌদি গুগলি তুলছিল তখন, অনেক দিন পর তাদের সাথে দেখা হয়।



    আমরা সাবধানে পা ফেলি – দূর থেকে রেল দেখি, ময়ূরাক্ষী যাচ্ছে নিয়মিত সময়েই। আমরা কাশ ফুল খুঁজি না কারণ তাদের বেঁচে থাকা অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। কাশ ফুলের ছবি হল না – কাশ ফুলের সাথেও ছবি হল না। ন্যাড়া পুকুর পাড়ে কুঁড়েতে বসি – খড়ের চাল ঠাণ্ডা। মাছেদের বেড়ে ওঠার সুবিধা করতে গাছেরা সরে গেছে, তাই নেই তাদের ছায়াও। আমরা বাঁশের মাচায় বসি – পুকুরের জল এখনো স্বচ্ছ, আয় তোর পুকুর পাড়ে একটা ছবি তুলি। ছবিতে সবুজ রঙ বেশী এসে গেছে – গায়ে এলে থাকা ধানেরা কোন কার্পণ্য করে নি অনেক দিন পরেও!







    এই ঠাকুর পুকুর এবং তার খানিকটা দূরে বনধারা পুকুরে সাথে অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই গল্প অন্য কোন সময়।
  • সে | 162.158.150.127 | ১২ এপ্রিল ২০২০ ১৩:৪৫730560
  • বাহ
  • aranya | 162.158.62.48 | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ০৭:০২730580
  • লেখা তো খুবই ভাল, প্রত্যাশিতই, ছবিগুলো ও চোখ জুড়নো। এত সবুজ
  • একলহমা | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ১০:৫০730581
  • অরণ‍্য‍র সাথে সহমত।

  • একক | 162.158.158.202 | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ১২:৪৪730585
  • বাহ কত্ত সবুজ ☺

  • সুকি | 172.69.34.181 | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ২৩:১৪730592
  • সকলকে ধন্যবাদ।  নিমোতে সবুজের ছড়াছড়ি, এটা সত্য, অন্তত এখনও পর্যন্ত

  • শিবাংশু | ১৪ এপ্রিল ২০২০ ০০:০৬730593
  • শেষ দুটি কিস্তি পড়া হয়নি আগে। পড়া হলো ...
  • সুকি | 108.162.215.223 | ১৪ এপ্রিল ২০২০ ১২:১৪730597
  • শিবাংশুদা -  ধন্যবাদ।  অনেক দিন আপনার লেখা দেখি না  - একটা জম্পেশ লেখা জমা দিন এই নতুন বছরে! 

  • সুকি | 108.162.215.21 | ১৬ এপ্রিল ২০২০ ১৬:৫৯730639
  • এই লেখাটা গুরুতে আমার ব্লগেই আছে স্বতন্ত্র ভাবে, কিন্তু নিমোর গল্প বলে এই থ্রেডে জুড়ে দিলাম।

    -----------------------------------

    কাঠমিস্ত্রীর বাবা ও কাঠমিস্ত্রী

    ----------------------------------

    আমাদের পুরানো বাড়িতে কাঠের কাজ করেছিল রাজারাম, তা সে প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল। ঘোষ পাড়ার যৌথ বাড়ি থেকে আমরা স্থানান্তরিত হলাম পাল পাড়ায়, পুকুরের এপাড় আর ওপাড়। আমাদেরই বাগান বাড়িতে গড়ে উঠল আমাদের নতুন বাড়ি। গ্রামে আমাদের তখন কাঠের মিস্ত্রী বলতে ওই রাজারাম ও তার ভাই জয়রাম। আদপে হিন্দুস্থানী হলেও রাজারাম ও তার ভাইকে আমরা কোনদিন হিন্দী বলতে দেখি নি আমাদের সামনে। তবে ওদের দুজনের বউ কিন্তু খাঁটি বিহার থেকে আমদানী কৃত হবার জন্য ভালো বাংলা বলতে পারত না। ফলতঃ বাড়িতে ভালোই শান্তি বজায় ছিল – দুই ভাই মদ খেয়ে কাঁচা বাঙলায় বাওয়ালি করত বউদের উপরে, যারা সেই বাংলার মর্মোদ্ধার আজ বিবাহের চল্লিশ বছর পরেও করে ওঠার মত শিখে উঠতে পারে নি। এবং ভাইস ভার্সা – বউরা হিন্দী ভাষায় যে বাক্যবাণ থ্রো করত তা রাজা বা জয় কোন রামই কোনদিন উদ্ধার করে উঠতে পারে নি। বাড়িতে ইক্যুইলিব্রাম বজায় ছিল, অন্তত আমাদের বাড়িতে কাজ করতে করতে রাজারাম সেটাই দাবি করত।  

    নতুন বাড়িতে জানালা দরজা বানাবার জন্য আমাদের কাঠ কিনতে হয় নি। যে বাগান কেটে বাড়ি তৈরী হয়, সেই বাগানেরই নিম কাঠ দিয়ে হয়েছিল ফ্রেম, আর সোনাঝুরি দিয়ে হয়েছিল জানালা দরজার পাল্লা। কাঠ চেরাই হয়েছিল অন্য এক বিহারীর কাঠ কলে যে আবার আমার বাবার ছাত্র ছিল – ফলতঃ আমাদের বাড়ির সাথে বিহারীদের সমন্ধ বেশ অঙ্গাঙ্গী বললে অত্যুক্তি হয় না। রাজারামের ফুল ফর্মে কাঠের কাজ করা আমার আজ সব মনে পরে না – তবে মনে পড়ে বাবার সাথে রাজারামের রোজকার আলোচনা, স্ক্রু (রাজারাম যাকে ইস্ক্রুপ বলত) কেমন ভাবে কাঠের কাজে ব্যবহার হওয়া উচিত এই নিয়ে। স্ক্রু –কে প্যাঁচ দিয়ে টাইট করা রাজারামের স্বভাবে ছিল না, দুম-দুম করে দিল হাতুরী দিয়ে দুই ঠোক্কর, স্ক্রু কাঠের মধ্যে সমাহিত। বাবা রাজারামকে বোঝানোর চেষ্টা করত যে পেরেকের মত ঠুকে কাজ সারা উচিত নয় স্ক্রু-র ক্ষেত্রে, কারণ তাহলে স্ক্রু উদ্ভাবনের দরকার হত না। কিন্তু কে শোনে কার কথা – বাবা যতক্ষণ আছে রাজারাম ততক্ষণ স্ক্রু টাইট দিচ্ছে, চোখের আড়াল হলেই দুম-দাম। আমার প্রথম গুপ্তচর বৃত্তিরও হাতেখড়ি তখনই – বাবা আমাকে রাজারামের ঠোকার উপর নজর রাখতে বলেছিল। গুপ্তচররা সাধারণত গুপ্ত থাকে, কিন্তু আমার কাজ ছিল রাজারামের আশেপাশে যতক্ষণ ঘুরঘুর করা যায়। আমার কাজ রাজারামের ভাষায় গুপ্তচর এবং আমাদের দিক থেকে নজরদারি – এই দুইয়ের মাঝে ঝুলে ছিল সেই সময়। 

    সময় এগিয়ে গেছে – আমাদের নতুন বাড়ির মধ্যে আবার একটা বাড়ি হল উঠোনের অপর দিকে। ‘নতুন’ বাড়ি হয়ে গেল পুরানো। এখনকার নতুন বাড়ি গড়ে উঠল আমাদের এখনকার বাগানের কিছু গাছ সরিয়ে। দুটো আম গাছ কাটা গেল – মুড়ি ভাজার চালা উঠে গেল, ভাঁড়ার ঘর সরে গিয়ে ঠাঁই নিল এক কোণের দিকে। ঠাকুমার বয়স হয়ে যাবার পর আর অবশ্য আমাদের চালায় মুড়ি ভাজা হত না, মুড়ি ভাজা নামটাই থেকে গিয়েছিল। ভাঁড়ার ঘর তবে পুরোপুরি ব্যবহার হত চাষের সামগ্রী, সার, কাস্তে-কোদাল, বস্তা এবং আরো অসংখ্য জিনিসে। সবচেয়ে বেশী পরিবর্তন এসেছিল গরু নিয়ে – অনেক চোখে জল ফেলে প্রথমে চাষের হেলে-গরু দুটোকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। কারণ ছিল মূলত আর কেউ লাঙল ধরতে চাইত না – ততদিনে মাঠে ট্রাক্টর এবং হ্যান্ড ট্রাকটরে ভরে গেছে। নাগাড়ে কিষেণের অভাব আমাদের নতুন বাড়ির জায়গাকে এমনি অপ্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তারপর ক্রমে গেল গাই গরু গুলি – বাড়িতে রাখাল রাখার আর ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না – ঠাকুমার বয়স হয়ে গিয়ে মারা গেল – বাবা একা আর চারিদিক সামলাতে পারছিল না। নতুন বাড়িতে আমার এখনকার বেডরুমের ঠিক নীচেই ছিল এককালে আমাদের গোয়ালঘর। তবে বাড়ি হবার পরেও থেকে গিয়েছিল কিছু সুপারী গাছ, একটু লীচু, নারকেল এবং একটি আমগাছ।

    আমার নতুন বাড়ির দরজার ফ্রেম আর নিম গাছ দিয়ে হল না – হল সেগুন গাছ দিয়ে। বেলেডাঙা পড়ায় আমাদের পুকুর পাড়ে যে বড় সেগুন গাছ দুটি ছিল, সেই দুটি চেরাই করেই নতুন বাড়ির কাঠের সমস্যা মিটে গেল। তবে রাজারাম এখন আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে যায় না – তার ছেলে রবি এখন আমাদের গ্রামের একমাত্র কাঠমিস্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। রবি আমার ভাইয়ের বয়সী – এবং নিমো গ্রামের ট্র্যাডিশন মেনে, অনেক দিন হল সে আমার বন্ধু স্থানীয় হয়ে গেছে। যতবার বাড়ি যেতাম রবির কাছে তার বাবা রাজারামের খোঁজ নিতাম। রবি বলত, ‘বুঝলে দাদা একেবারে জ্বালিয়ে মারছে। সন্ধ্যা হলেই মদ নিয়ে বসবে, আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার ধমকি দেবে। এদিকে নিজে সারাদিন কাজ কিছু করবে না, সংসার চলছে আমার জন্য’। রবি মুখে বাবাকে গাল দিলেও মনে মনে দারুন ভয় খেত – যার কারণ আমার জানা ছিল না। রাজারামের মদ খাওয়া আরো অনেকের মত আমাদের গাঁয়ে সুবিদিত। আরো একটা কারণে রাজারামের নাম ছিল, সেটা ছিল তার দিল দরিয়া মেজাজ। নিজে খাও এবং পরকেও খাওয়াও, এই নীতি নিয়ে রাজারাম চলত। 

    এবার বাড়ি গিয়ে রবির সাথে কথা বলতে বলতে ওর বাড়ির কাছাকাছি চলে গেছি – দেখি রাজারাম রেজাক মাষ্টারের সাথে কথা বলছে। রেজাক কাকা আমার বাবার বন্ধু এবং খুবই শান্ত লোক। রাজারাম বলছে,

    - বুঝলে রেজাকদা, এই যে মদ খাওয়া খারাপ লোকে বলে, সেই নিয়ে হইচই করে – এগুলো সব ফালতু কথা
    - কেন রে? – রেজাক কা জিজ্ঞেস করল
    - কেন মানে? এই যে আমি তিরিশ বছর ধরে মদ খাচ্ছি, কিছু হয়েছে আমার? যত সব আল-বাল কথা, মদ খেলে নাকি শরীর খারাপ হবে!

    নির্বিবাদ রেজাককা খানিক ক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে কোনক্রমে বিদায় নিল। এই করতে করতে রশিদ চাচার ছেলে গোলাপ এল ওর ওর্ডার দেওয়া তক্তার খোঁজ করতে।

    - কাকা, তক্তাটা ভালো করে বানিও কিন্তু
    - হ্যাঁরে বাঁড়া দেব, তবে মুরগী না খাওয়ালে, কাঠের প্যানা আর মারব না, শুধু গজাল দিয়েই সারব।
    - তোমার শুধু মুরগী খাব খাব
    - আগের বার তো খুব টুপী পরিয়ে তক্তায় প্যানা মারিয়ে নিয়ে গেলি মুরগী খাওয়াব বলে, কিন্তু এখনো তো মুরগী এল না
    - আসলে কি জানো তো কাকা, বউ মুরগী গুলো খুব ভালোবাসে – আগের বার তোমার জন্য ধরতে গেলাম, কিন্তু বউ কান্নাকাটি শুরু করে দিল
    - ঠিক আছে, মুরগী খাওয়াতে হয় না – তোর তক্তাও তেমন হবে
    - রাগ করো কেন কাকা – আচ্ছা, এবার আমি তোমাকে খাওয়াবোই মুরগী। একটার পা একটু খোঁড়া আছে, সেটাই না হয় তোমাকে দেব।

    আমি এই পর্যন্ত দেখে চলে এসেছিলাম। কিন্তুদিন পরে আমি রবিকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে মুরগী কেমন খেলি। রবি বলল

    - আর বলো না, গোলাপের মুরগীর জন্য আমার যা লস হলো
    - কেন রে, মুরগী তো পেলি ফ্রীতে, লসটা আবার কিসের?
    - তুমি তো সেদিন দেখে এলে খোঁড়া মুরগীটা গোলাপ বাপকে দেবে বলে এল। এখন হয়েছে কি, খোঁড়া মুরগীটা বেশ অনেকটাই বড়। গোলাপের বউ দিতে রাজী ন্য় – শেষে অনেক বলে কয়ে গোলাপ একটা ছোট মুরগী নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে হাজির।
    - তোর বাপ কি বলল?
    - বাপ তো মুরগীর সাইজ দেখে রেগে ফায়ার – বলল, সব কাঠের প্যানা টেনে খুলে দেব বোকাচোদা, আমাকে আবার মুরগী বানানো হচ্ছে! অনেক কষ্টে বাপকে শান্ত করলাম, গোলাপ মুরগী দিয়ে বিদায় নিল। বাপ সেই মুরগী একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখল পরের দিন মালের চাট করবে বলে।
    - তা এতে তোর লস কোথায়?
    - আরে শোনই না – পরের দিন সকালে বাপ ঝুড়ি তুলে গেছে মুরগী ধরতে। সেই শালা মুরগী হচ্ছে দেশী, ধরা দেবে কেন? গেছে পালিয়ে – আমার দুজন মিস্ত্রী এসেছিল কাজে, তাদের বলছে তোরা মুরগী ধর এবার।
    - মানে?
    - মানে আবার কি, ২০০ টাকা করে মজুরী দিই মিস্ত্রী গুলোকে আমার কারখানায় কাজ করার জন্য, তাদের দুজন নিয়ে বাপ বেলা দুটোর সময়েও মূর্গী ধরে বেড়াচ্ছে! বাচ্ছা একটা মুরগীর জন্য আমার দুটো মিস্ত্রীর মজুরী জলে গেল।
    - তুই কিছু বললি না?
    - বলতে গেলাম বলে আমার বউয়ের সামনেই আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করল, তুমি তো জানোই।

    তা জানি – আরো জানি যে রবি গালাগাল পারে না খুব একটা, তদোপরি বাপকে নিদারুন ভয় খায় বিয়ের পরেও। তবে রবি ভালো ছেলে, আমাদের গ্রামের অনেকেই বলে। সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত কাজ করে রবি – তারপর রেষ্ট, এবং আমাদের সাথে বিকেলে নিমো স্টেশনে আড্ডা। রাত আটটার মধ্যে আবার রবি ঘরে ঢুকে পরে, বিয়ের আগে থেকেই। বিয়ের পরে তাই আমরা ওকে নিয়ে আর আগে ঘরে ঢোকার টান নিয়ে রসিকতাটা করতে পারি নি। ১২টা পর্যন্ত কাজের মধ্যে আবার গ্রামের কাউকে ব্যাঙ্কে নিয়ে যাওয়া, কাউকে বাইকে করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া, হাসপাতালে কাউকে খাবার পৌঁছে দেওয়া, মিউনিসিপ্যালিটির কাজ – এ সবই করত।

    কিছু বছর আগে থেকে রবির মনে রাজনীতির ঝোঁক লাগে। কেন লাগে বলতে পারব না – কারন ও নিজে ছিল ‘ওয়ার্কার’ শ্রেণির মেধা যুক্ত। জটিল বুদ্ধির কোন রূপ চিহ্ন ওর আপাত সরল মস্তিষ্কে ছিল না। তবে কিনা ওর অনেক বন্ধু ছিল খুব রাজনীতি সচেতনে – তাদের চাপে পরেই মনে হয় ও গা ভাসাল রাজনীতিতে। গ্রাম পঞ্চায়েত ভোটে ওরা এক নির্দল মহিলা প্রার্থী খাড়া করে সামনে শিখন্ডী স্বরূপ – নেপ্তথ্যে থাকে ওরা। তা গ্রামের লোক বেইমান নয় – রবি এবং ওর বন্ধুদের গ্রামের সেবার কথা মনে করে সবাই ওদের ভোট দেয় – সি পি এম এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়ে ওদের প্রার্থী বিপুল ভোটে জেতে।

    নিমো গ্রামে এই ভাবে এক কমপ্লেক্স পরিস্থিতির সৃষ্টী হয় – কিছু আসনে সি পি এম, কিছুতে তৃণমূল এবং একটায় রবিদের দল জয়লাভ করে। তৃণমূল তবু ঠিক আছে, কিন্তু নির্দল থেকে জেতায় রবিদের উপর চাপ বাড়ে। সন্ধ্যাবেলা রবি আর আমাদের সাথে আড্ডা মারতে আসে না – বরং যায় পার্টির অফিসে। গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী, যে পাড়া থেকে রবিরা জয়লাভ করেছে, সেই পাড়ার সকল ঝামেলার ফার্ষ্ট পয়েন্ট অব কন-ট্যাক্ট হচ্ছে ওদের দল। ফলে রোজ সন্ধ্যেতেই প্রায় বিচার সভা বসে। বিচার সঞ্চালনে রবিদের পার্টির ব্যাকবোন হচ্ছে নিতাই, পচা ও মজনু। আমি বহু দিন গ্রাম ছাড়া বলে এবং আমার সাথে সবার সম্পর্ক ভালো থাকার জন্য, এদের বিচার সভার অ্যাক্সেস ছিল আমার কাছে। কোন সন্ধ্যেবেলা সময় না কাটলে আমি রবির সাথে বিচার দেখতে যেতাম।

    তেমনি একদিন সন্ধ্যাবেলা বিচার সভা বসেছে ডাইনী অববাদ দিয়ে – বাউরি পাড়ার নীরজের বউ নাকি ডাইনী এবং সেই অপবাদ দিয়ে ওকে পাড়া থেকে একঘরে করে দেবার বন্দোব্যস্ত হয়েছে। নীরজের বউ বিচার চায়। সব কিছু শোনার পর পচা বলল –

    - তোমরা তো খুব এক জটিল সমস্যা এনেছো গো
    - এ পচা, এই মাগী ডাইনী আছে, ইতে আবার জটিল কি হলো?
    - না, মানে তোমরা ডাইনী বললেই তো আর ডাইনী হবে না – প্রমাণ করতে হবে।
    - কি প্রামন লিবি? উ যেদিন বাপের বাড়ি থেকে আসে, সি দিন আমার ষাঁড়া মোরগটা গাড়ির তলায় চাপা পড়ে!
    - আরে ধুর, এটা কোন প্রমাণ হল – একে বলে কো-ইনসিডেন্ট!
    - হ্যাঁ, আমার মনটাও ‘কু’ গাইছিল বটেক, তবে?
    - আরে ‘কু’ নয়, ‘কো’ – যাগগে ছাড়ান দাও। আর কি প্রমাণ আছে?
    - এ বছর জমিতে আলু পাতার আগে ওর বিয়ে হলোক, আর দ্যাখো, এবার আলুর দাম! চাষের দাম উঠে নাই –
    - ঠিক আছে মানছি, এবারে আলুর দাম নেই – কিন্তু তার জন্য তো ও দায়ী নয়!
    - তবে কে দায়ী বটে?
    - ওসব তোমরা বুঝবে না। বরং বলো, কি করলে তোমরা জানবে যে ও ডাইনী নয়?


    পচার এই প্রশ্ন খুব গুঞ্জন তুলল বিচার সভাতে – বাউরি পাড়ার লোকেরা নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনাতে ডুবে গেল। অনেক আলোচনার পরে


    - উ যদি শিমলাগড়ের কালী বাড়িতে গিয়ে ঠাকুরের থানে হাত দিয়ে বলে যে উ ডাইনী নয়, তাহলে আমরা মেনে নেব
    - এটা ভালো প্রস্তাব [নীরজের বউয়ের দিকে ফিরে] – কি গো তুমি রাজী তো বলতে?
    - [নীরজের বউ] আমি রাজী আছি, কিন্তু তুমাদের একজনকে যেতে হবে সাথে, সাক্ষী থাকতে


    পচা পরল সম্যাসায়, কাকে পাঠানো যায় দিনের বেলা ওদের সাথে! সবার কাজ থাকে। অনেক ভেবে –


    - তাহলে মজনু, তুমি কি করছ কাল সকালে?
    - না এই মানে একটু ভাবছি, হয়ত –
    - বুঝেছি তোমার কাজ নেই কাল, তাহলে তুমি কাল সকালে যাবে নীরজের বউয়ের সাথে।


    মজনু দেখল সে ফেঁসে গেছে, তা একটা ফাঁসে কেন, তাই বলল


    - তা, ষষ্টেরও তো কাজ নেই কাল সকালে, ও তো কালকেই মাছ নিয়ে এল ডায়মন্ডহারবার থেকে


    ষষ্টে কিছু বলার আগেই, পচা বলে উঠল


    - তাহলে ষষ্টে, তুমিও কাল মজনুর সাথে যাবে

    বিচার ফাইন্যাল হয়ে গেল প্রায়, ঠিক হল কাল সকালে ৮.৪৫ এর ট্রেনে দুই পক্ষ শিমলাগড় যাবে, আর সাক্ষী হিসাবে যাবে মজনু ও ষষ্টে। আমরা উঠতে যাচ্ছি পার্টি অফিস থেকে এমন সময় দেখলাম আমাদের গ্রামের গ্যাঁড়া সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হট্‌ করে দেখি নিতাই ডেকে উঠল, এই গ্যাঁড়া শোন এখানে। গ্যাঁড়া পার্টি অফিসে ঢুকল। নিতাই বলল –

    - গ্যাঁড়া, তুই কিন্তু কি করছিস, কোথায় যাচ্ছিস – সাব আমার রেডারে ধরা পড়ছে!

    গ্যাঁড়া গেল ঘাবড়ে – আমিও কিছু বুঝতে পারলাম না। গ্যাঁড়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে রেডার কি জিনিস ভাবতে ভাবতে চলে গেল। আবার হতভম্ভ ভাব দেখে নিতাই আমাকে বলল –

    - বুঝলি না, গ্রামের ছোকরাদের এইভাবে আন্ডার কন্ট্রোল রাখতে হয়, থ্রেট দিয়ে।

    আমি বুঝলাম – সেই দিনের বিচারের এফিসিয়েন্সী দেখে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। যাই হোক, পরের দিন বিকেলে নীরজের বউয়ের সাথে দেখা, জানতে চাইলাম সব মিটমাট হয়েছে কিনা। নীরজের বউ বলল –

    - সকালে স্টিশনে গিয়েছিলুম, কিন্তু তুমাদের পচা যাদের আস্তে বলে ছিল, তারা কেউ তো এলো নাই!


    আমি সেই দিন সন্ধ্যাবেলা ব্যাপারটা পার্টি অফিসে জানার জন্য ঢুঁ মারতে বাঁশতলার কাছে বাঁকটা নিয়েছি, দেখি পার্টি অফিস থেকে আরেক সদস্য দিবাকর হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে এসে কানের গোড়ায় ফিসফাস করে জিজ্ঞেস করল –

    - কাউকে দেখলি তুই?
    - কাকে দেখব? আর এই অন্ধকার শুনশান রাস্তায় এতো কানের গোড়ায় এসে ফিসফাস করে বলারি বা কি আছে?
    - তুই বুঝছিস না – সব স্পাই এ ছেয়ে গেছে, চারিদিকে শুঁকে বেড়াচ্ছে –


    আমি দিবাকরের কোড ওয়ার্ড কিছুই বুঝতে না পেরে ওর সাথে পার্টি অফিসের দিকে এগুলাম। কাছে গিয়ে শুনলাম, নিতাই হুঙ্কার দিচ্ছে –


    - সব শালার ভিতরে ঢুকিয়ে দেব, চারিদিকে আমার নজর – কোথায় যাবি?


    আমার জিজ্ঞাস্যু ভাব দেখে, চোখ টিপে নিতাই বলল,


    - কন্ট্রোলে রাখতে হয় বুঝলি? চাপে রাখতে হয়।


    আমি ঘাড় নাড়লাম, যদিও বুঝতে পারলাম না নিতাই কাকে কিভাবে চাপে রাখতে চাইছে। পচাকে আমি নীরজের বউয়ের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করলাম, কেন কেউ যায়নি – পচা বলল

    - আরে ছাড় তো, কত যাবি? বিচার করে দিলাম, এটাই অনেক।

    খানিক গল্প হল সেদিন। আমাকে বলল, তোকে কালকে লাগতে পারে – মল্লিক পাড়া বনাম হাজরাদের একটা কেস আছে। দুই দলই দাবী করছে জমি তাদের। একটা পুরানো কোর্টের রায় আছে ইংরাজীতে, তুই একটু পড়ে দিবি, তার পর আমরা বিচার করব। আমি বললাম আমি পড়লে হবে কিনা। বলল, তুই তো নিরপেক্ষ, সবাই তো চেনে, প্রবলেম নেই। দরকার হলে ডেকো বলে চলে এলাম।

    রবিকে জিজ্ঞেস করলাম পরের দিন, আচ্ছা তোদের দল কি পয়সা মাড়ছে? আমি জানি রবি সৎ ছেলে, অন্তত এখনো। রবি জানালো যে, ইন্দিরা যোজনায় ঘর করতে গরীবদের টাকা দেওয়া হচ্ছে পঞ্চায়েত থেকে। আর সেই টাকা পাইয়ে দিতে ওদের দলের কে নাকি ৩০ হাজার করে দাবি করছিল। তাকে গুচ্ছ ক্যালানি দেওয়া হয়েছে এবং দল থেকে বিতারিত। ওরা সৎ ভাবেই কাজ করার চেষ্টা করছে। আমাকে জানালো যে ওদের অনেক ভালো পরিকল্পনা আছে – কিছু দিন পরে গরীবদের কম্বল বিতরণ করবএ, চাঁদা দিতে হবে। আমি দিলাম, মনে করিয়ে দিলাম যে মরে দিস না যেন টাকাটা। ক্ষমতায় আসার পর থেকে রবিদের দল কি কি ইন্টারেষ্টিং কাজ করেছে জানতে চাইলাম – নিম্নলিখিত টপিক গুলি উদ্ধৃত হলঃ

    - কাশী এবং কাশীর তৃতীয় পক্ষের বউয়ের মধ্যে চলা দীর্ঘমেয়াদী কলহের পরিসমাপ্তি। তৃতীয় পক্ষের বউয়ের গর্ভে জন্মানো মেয়েটি যে কাশীর নিজেরই ঔরসজাত, সেটা কাশির স্বীকার করে নেওয়া।

    - নিমোর রাস্তা চওড়া করতে গ্রাম্য অভিযান। সে সমস্ত লোকেরা রাস্তার জায়গায় বসার চেয়ার বা সদর দরজা বসিয়েছিল সেই সব ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া। [কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে, এর প্রধান কালপ্রিট হবে নিতাই নিজে, আমি সেটা পয়েন্ট আউট করলে, নিঃস্তব্ধতা নেমে এল]।

    - গ্রামের রাস্তা মোরাম থেকে পীচ এ উত্তীর্ণ হবার জন্য টাকা স্যাঙসন এবং অনেকটা অলরেডি হয়ে যাওয়া।

    - কিছুদিন আগে নিদারুণ বৃষ্টি জনিত বন্যার সৃষ্টি হলে কবলিত এলাকায় চিঁড়েমুড়ি ও ত্রিপল বিতরণ।

    আমি ব্যর্থতার কথা কথা জিজ্ঞেস করলাম – আমাকে বলা হল, “জানোই তো”। বুঝলাম অনেক! রবিকে মনে করিয়ে দিলাম যে পার্টি করতে গিয়ে আমার জানালা-দরজা পালিশ করে দেবার যে কথা ছিল সেটা যেন না ভোলে। বলল – কাল থেকেই পাঠাচ্ছি!

  • সে | 162.158.150.87 | ১৬ এপ্রিল ২০২০ ২০:৫২730643
  • ভালো হয়েছে।

  • সুকি | 162.158.166.18 | ০২ মে ২০২০ ১৮:১৫731015
  • এটাও কিঞ্চিত লিখেছিলাম আগে - তবে নিমোর গল্প বলে এখানেও তোলা থাক।

    আমাদের ভ্রাতৃস্থানীয় ব্যাচে এখন নিমোতে দুজন পুলিশে চাকুরী করে - তপন আর বামুনদের পল্টু।

    তপন আমার এবং আমাদের এক নির্ভর যোগ্য খুঁটি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাবে পিকনিক হবে – আমি শুধু ইচ্ছে প্রকাশ করে আর টাকা দিয়েই খালাস – তপন ছোটাছুটি করে চল্লিশ জন ছেলেকে খবর দেওয়া, বাজার করা থেকে শুরু করে বাকি সব কিছুই করত – যার মধ্যে বাজার করা, মদের অ্যারেঞ্জমেন্ট, আর রাঁধতে আসতে না চাওয়া বুধো কলুকে পুনরায় পিকনিকে রান্নায় রাজী করানো, লাইটের ব্যবস্থা, রান্নার সরঞ্জাম জোগাড় – এই সব নানা বিধ কাজ জুড়ে ছিল। পড়াশুনার লিমিটেশনের দরুণ এবং বাপ পুলিশ হবার জন্য তপনের ভবিতব্য যেন পুলিশ হবার জন্যই ঠিক হয়ে ছিল। আমরা এক সময় মাঠে ভোর বেলা ছোটা প্র্যাক্টিস করতে গেছি – আমি ফিট থাকার জন্য আর তপন কনস্টেবলের দৌড় আর লঙ-জাম্প পরীক্ষায় পাশ করার জন্য। যথাসময়ে তপন চাকুরী পেয়ে ব্যারাকপুরে চাকুরী করতে গেল – এটা আগের বছরের ঘটনা। ব্যারাকপুরে ট্রেনিং পিরিওডের গল্প আমাকে তপন শুনিয়েছে। প্রায় চারশো ছেলের জন্য মাত্র একটা পায়খানা, তপন সেখানে রাতে ভয়ে ঘুমাতো না ভোর বেলা পায়খানার লাইনে চান্স পাবে না বলে। ভোর চারটের সময় সে পায়খানা সারত – জলের কৌটা যার নিজের নিজের। আমি আর লজ্জা বশতঃ প্যানে জল কে ঢালত – সেই প্রশ্নটা আর করি নি। ট্রেনিং পিরিওডের শেষে তপনের পোষ্টিং হল শিলিগুড়িতে –  সে  বারে পুজোয় গিয়ে দেখা তপনের সাথে একদিন সকালে নিমো ভারত সেবক সমাজ ক্লাব চত্ত্বরে।

    ততদিনে তপনের বিয়ে হয়ে গেছে, শুনেছিলাম যে বিয়ের পর তপন বউকে নিয়ে দীঘা গ্যাছে নাকি হানিমুনে। জিজ্ঞেস করলাম কেমন বেড়ালি -

    - আর বলো না, হাওড়া থেকে গেছি তো দুরন্ত-তে। বউ বলল এসি-তে যাবে। আমি বউকে বললাম, দ্যাখো আমি ট্রেনে উঠে কাগজ পেতে পেচ্ছাপ খানার পাশে চুপ করে সেঁটিয়ে যাওয়া পাবলিক – এসি-ফেসি তে যেতে গিয়ে কি কেলো হবে আমি জানি না। বউ নাছোর – হাওড়া তে গিয়ে কম্পর্টমেন্টে সিট খুঁজে বসলাম। বাঁড়া, কি ঠান্ডা করছিল দাদা তোমায় বোঝাতে পারব না। বসে আছি তো বসেই আছি – বাল, কেউ আর ওঠে না। বউ খোঁছাচ্ছে, কিগো ঠিক চাপলাম তো। আমি তো দিলাম ঝেড়ে, বলেছিলাম আমি এই সব বুঝি না – কোনদিন এসি মারিয়েছি যে জানব? ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলে একটা খাবার নিয়ে যাওয়া ভেন্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা এখানে এতো ঠান্ডা করছে কেন? সুইচ-টুইচ কোথাও আছে নাকি? আর বাকি পাবলিকই বা গেল কোথায়? মালটা আমাকে বলল যে, আজকে ট্রেন ফাঁকা আছে – অন্য কামরায় গিয়ে বসতে। সেই শুনে আবার পিছনের দিকে লোকজন থাকা কামরায় গিয়ে বসলাম।

    এরপর জিজ্ঞেস করলাম চাকুরী কেমন চলছে বা চাপ আছে কিনা -

    - আর বলো না দাদা – এই তো পুজোর সময় ‘ডান্সিং কার’ নিয়ে খুব বিজি ছিলাম।

    আমি এক ‘ডান্সিং কার’ বুঝি – কিন্তু সেই জিনিস তপন কি করে জানবে ভেবে কনফিউজড হয়ে গেলাম। তাই ক্লারিফিকেশনের জন্য

    - ‘ডান্সিং কার’ কি রে?

    - পুজোর সময় রাতে টহল দিয়ে বেরিয়ে মাঝে মাঝে দেখি রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর গাড়ি নড়ছে, মানে দাদা ভিতরে কাজ চলছে আর কি!

    তপনের ‘ড্যান্সিং কার’ আর আমার জানা ‘ড্যান্সিং কার’ একই বোঝা গেল – আরো ক্লীয়ার হল যে পুলিশে আজকাল সত্যি করেই পড়াশুনা জানা ছেলেরা জয়েন করছে।!

    - তোরা কি পয়সা নিয়ে ছেড়ে দিস?

    - তাই করি বেশীর ভাগ সময়। তবে এই পুজোর সময় পুলিশ ড্রাইভার সব ব্যস্ত থাকায় সিভিল ড্রাইভার ভাড়া করতে হয়েছিল। সে খানকীর ছেলে কিসুই জানে না – আরে বাঁড়া, গাড়ি তো সামনে নিয়ে গিয়ে আড়াআড়ি দাঁড় করাবি! তা না, দিল শালা পিছনে গিয়ে দাঁড় করিয়ে – তা সেই টাটা সুমো থেকে বেরিয়ে আর কি মাল ধরা যায়? মনে হয়ে ওই মালেরা অ্যাক্সিলেটারে পা দিয়েই কাজ করছিল- যেভাবে হুস করে বেরিয়ে গেল!

    - যাঃ, তাহলে কিছু কামাই হাতছাড়া হল। আর কিছু ইন্টারেষ্টিং করেছিস কি এর মধ্যে?

    - এক দিন হায়না মারতে গিয়েছিলাম বুঝলে দাদা। সে তো বনবিভাগের লোক এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া ঘুম পাড়ানি গুলি নিয়ে গ্যাছে কি করে জানব? আমাদের আই সি-র পিছু পিছু আমরা যাচ্ছি। দু এক খান গুলি চলল, কারো গায়ে লাগলো না। অনেক তাড়া করার পর একটা গিয়ে লেগেছে হায়নার গায়ে, মাল নাতিয়ে পড়ে গ্যাছে। স্যার এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা বলছি স্যার যাবেন না। কে শওনে কার কথা – কাছে গিয়ে দ্যাখে হায়না ঘুমায় নি – দিয়েছে তাড়া। আই সি ছুটছে, বন বিভাগ ছুটছে, আমরা ছুটছি – তখনি জানতে পারলাম ওই সব ঘুম পাড়ানি গুলি অনেক দিনের পুরানো। আমরা তো ছুটে গিয়ে পুলিশ ভ্যানে ঢুকে ভিতর থেকে দিয়েছি লক করে। অনেক পরে আই সি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে, “আমাকে তোরা ফেলে চলে এলি? আর এখানে এসে গাড়ি লক করে বসে আছিস?”

    - তোদের আই সি কি জাঁদরেল?

    - জাঁদরেল না বাল! একবার শালা থানায় আটক করা গাড়ির নতুন টায়ার বেচে দিয়েছিল আর একটু হলে!

    - বলিস কি রে! তা নিজে নিজে খুলল কি করে?

    - আরে সেই বার একটা অ্যাক্সিডেন্টের গাড়ি থানায় আনা হয়েছে – গাড়ির ছটা টায়ারই নতুন। প্রায় ৩০-৪০ হাজার করে এক একটা টায়ার। বুজতেই পারছো দু-আড়াই লাখের ব্যাপার। তা আই সি করেছে কি, লক আপে থাকা দুটো চোরকে ফিট করেছে। তাদের বলেছে যে, আমি তোদের রাতের বেলা ছেড়ে দেব, তোরা টায়ার গুলো খুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রী করে দিবি – আবার এসে ঢুকে পড়বি লক আপে। যা হবে ভাগ করে নেব। তা রাতের বেলায় হয়েছে কি মাল তো দিয়েছে ছেড়ে চোর গুলোকে। এবার যে রাতে ডিউটি থাকে, সে দেখতে পেয়ে গেছে চোর পালাচ্ছে, দিয়েছে সাইরেন বাজিয়ে। ধর – ধর – চোর ধরা পড়ে এই মার সেই মার। চোর চিৎকার করে আর বলে, মেরো না গো, তোমাদের স্যারই আমাদের চুরি করতে বলেছে! তখন ব্যাপার বোঝা যায় – বাকি সবাই স্যারকে বলে, আরে আগে জানাবেন তো যে আপনি ছেড়েছেন! তা তো জানাবেন না – কারণ পুরোটাই নিজে খাবার ধান্ধায় ছিলেন।! স্যার তখন আবার ছেড়ে দাও – ছেড়ে দাও বলে ব্যাপার সামলায়!

    গল্প করতে করতে এবার পল্টু এসে ঢুকলো –  ও পেয়েছে ওর বাবার চাকরীটা। অনেক দিন আগে, পল্টু যখন বাচ্ছা তখন ওর বাবা অন ডিউটি মারা যায়। তা সেই চাকুরী এখন করছে পল্টু। তবে পল্টুর লাইফ ইজি – চুঁচড়োর পুলিশ লাইনে থাকে আর একটা ব্যাঙ্কে গার্ডের ডিউটি দেয় (এই মুহুর্তে চুঁচড়ো কোর্টের জাজের বডিগার্ড)। আমি পল্টুর কাছ থেকে এককথা সে কথার পর ওদের উপরি ইনকামের চান্স আছে কিনা জানতে চাইলাম। পল্টু বলল 

    - আমাদের দিকে দাদা উপরি হয় অ্যাক্সিডেন্ট হলে!

    - তার মানে?

    - ওই সেটেল করা পয়সা আর কি মালিক কি আর কোর্টে যেতে চায়! একদিন বিকেলে মুড়ি খাচ্ছি পুলিশ ফাড়িঁতে, হঠাৎ করে খবর এলো বালি ব্রীজে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সব দূর দার করে রেডি হতে লাগল। কেউ তো গেঞ্জী পরেই ছুটলো। আমাকে বলল, “মুখার্জী – তাড়াতাড়ি গেঞ্জীটা গলিয়ে নাও – পরে জীপে জায়গা পাবে না”। তা দেখলাম ঠিকই – গিয়ে দেখি দুটো জীপ চলে গ্যাছে, আমরা ৩ নম্বর জীপটায় কোন ক্রমে ঝুলতে ঝুলতে চললাম।

    - এতে তোদের ইনকাম টা কোথায়?

    - শোনো না – লরী তো থানায় নিয়ে চলে এলাম। লরী মালিক চলে এলো স্যারের সাথে সেটেল করতে। আমরা বাইরে কান পেতে বসে আছি। স্যার বলছে – “এক লাখের কমে কি করে সেটেল করব বলুন তো? কত গুলো আমার ছেলে গিয়েছিল দেখেছেন তো? তাদের দিতে হবে, আবার আমাকে উপরে কিছু পাঠাতে হবে। এর কমে সেটেল করলে আমি কি করে জবাব দেব?” গাড়ির মালিক অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে ৭৫ হাজারে উঠল। এবার স্যার বলছে – “ঠিক আছে, আপনি ওটা ৮০ করে দিন, রাউন্ড ফিগার। এর কমে হয় না – আপনি বলেই ব্যালেন্স করে নিচ্ছি”। মালিক চলে গেল টাকা দিয়ে – আমাদের পাঁচশো করে দিয়ে বোকাচোদা বাকিটা নিজের পকেটে পুরলো!

    গল্প করতে করতে দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেল প্রায় – নিমো ভারত সেবক সমাজ সকাল বেলার মত ক্লোজ হবার সময় হয়ে এল। আবার খুলবে সন্ধ্যেবেলা – বাকি গল্প তখন হবে বলে আমরা উঠে পড়লাম।

  • Дж | ০২ মে ২০২০ ২৩:৩৪731033
  • আগেও পড়েছি। আবারও পড়লাম।

    চিরনতুন।

  • সুকি | 162.158.165.25 | ০৮ মে ২০২০ ১৯:৩৫731292
  • ধাতু-বিদ্যা

    ------------------

    তখন আমি ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করি। সেবার ছুটিতে নিমো এসেছি, একদিন পাকড়াও হয়ে গেলাম বারোয়ারী তলায়। সেই বারোয়ারী তলায় নিমোর রাজ্যের জ্যাঠা সকল গুলতানি করত। আমাকে এক জ্যাঠা জিজ্ঞেস করলঃ

    - সুকান, তোর বাপ বলল যে তুই নাকি বিলেত গেছিস পড়াশুনা করতে। তা আমাদের মত করে একটু বুঝিয়ে বলত, তুই ওখানে ঠিক করছিস টা কি?

    আমি ফাঁপরে পরে গেলাম, মেটালার্জি – করোশন এই সব কি ভাবে সহজ করে বোঝাবো! একটু ভেবে বললাম,

    - জ্যাঠা, ওই ধাতু নিয়ে নাড়াচাড়া করি আর কি

    জ্যাঠা নড়েচড়ে উঠল,

    - বলিস কি রে সুকান, ও দেশেও ধাতু নিয়ে মাতামাতি আছে!

    দিয়ে পাশের শিবে জ্যাঠার দিকে ঘুরে বলল, “শিবে, তালেপরে এ সমস্যা শুধু আমাদের নয় – সাহেবদেরও টনক নড়েছে”। এবার আমার দিকে ফিরে

    - তা ধাতুর কোন ব্যাপারটা নিয়ে তুই নাড়ানাড়ি করিস? 

    আমি তখনো কেস বুঝতে পারি নি কোন দিকে গড়াচ্ছে। বেশ সরল মনে বললাম,

    - জ্যাঠা, আমি ওই ধাতু-ক্ষয় নিয়ে পড়াশুনা করছি

    জ্যাঠা আরো বেশী উত্তেজিত

    - শিবে, কি বললাম। আমরা শালা না জেনেই শুধু শুধু নিজেদের দোষারোপ করি। সাহেবরাও তো মানুষ নাকি – মনুষ্য অঙ্গের সমস্যা কাউকে কি আর ছাড়বে!

    এর পর আমার উপর ফরমান এল

    - তা ভালো জিনিস নিয়ে পড়াশুনা করছিস সুকান। বলি কি, তাড়াতাড়ি শেষ করে দেশে ফিরে আয়। আমাদের না হয় বয়স হয়ে গ্যাছে। কিন্তু তুই ফিরে এলে আর গ্রামের ছোকরা গুলোকে ডাঃ কাশেম কাছে ছুটতে হবে না বারে বারে!

    পাশ থেকে কে বলে উঠল – “জ্যাঠা, ডাঃ কাশেম শুধু কেন? কেজা গ্রামের মানু ডাক্তারও তো রয়েছে”

    জ্যাঠা উত্তর শুনতে শুনতে আমি বাড়ির দিকে এগুলাম,

    “তুই আর আমাকে ঠাকুর তলায় বসে মুখ খারাপ করাস নি। মানু করবে ধাতুর চিকিৎসা? ওর নিজেরটা …

    বাকিটা আর কানে এল না আমার -

  • Дж | ০৮ মে ২০২০ ২০:০১731294
  • যাচ্ছেতাই :-)

  • সুকি | 49.207.203.64 | ১১ জুলাই ২০২০ ০৮:৪৯732366
  • বাঁকুর বউ আমাদের বাড়ি কুমড়ো কিনতে আসত একসময়। পাইকারী নয়, ঢাউস কুমড়ো হলে একটা, আর একটু ছোট হলে দুটো কিনে নিয়ে গিয়ে বর্ধমানে তেঁতুলতলা বাজারে বসে কেটে বিক্রী করত।

    সকাল সাতটার আগেই বাঁকুর বউ কুমড়ো কিনতে হাজির। কুমড়োর গাদা থেকে টুক-টাক ঠোকা মেরে কুমড়ো পছন্দ হল, একটু ফালি কেটে দেখা হল ভিতর লাল কিনা - কারণ রঙ না হলে কুমড়োর দাম নেই।

    এর পর শুরু হত আসল গল্প। বাবা বলল,

    - কি বউ, কি দাম দেবে?
    - দাদা, আপনি বলেন

    বাঁকুর বউ জুত করে উঠোনে বসে ঠাকুমার সাথে গল্প করতে করতে পান সাজতে শুরু করল। বাবা মাঠ দেখতে গিয়ে, একেবারে নারাণের দোকানে চা খেয়ে ঘন্টা খানেক পরে ফিরে

    - কি, বউ - কি ঠিক করলে?
    - দাদা, আপনি বলেন যা বলার

    আবার গল্পে নিমজ্জিত হয়ে গেল ঠাকুমার সাথে - বাবাও আবার খামাড়ে ধান ঝাড়া দেখতে গেল

    এই করে করে বেলা দশটা হয়ে গেল, এবার বাবা স্কুল যাবে। ফাইনাল জিজ্ঞাসা

    - বউ, এবার বল কি দাম দিচ্ছ
    - দাদা, কি আর বলি, আগের দিনের দামটাই নেবেন
    - ঠিক আছে, তাই দিও

    সাড়ে দশটায় বাঁকুর বউ মুড়ি খেয়ে ঝাঁকা নিয়ে বিদায় নিল।

    আজকাল ওয়ার্কিং-ফ্রম-হোম আর অনলাইন ক্লাসের ব্যাপার স্যাপার দেখে আমার বাঁকুর বউয়ের কথা খুব মনে হয়।

  • সুকি | 49.207.203.64 | ১১ জুলাই ২০২০ ০৮:৫০732367
  • আজকে আমাকে স্মৃতিতে পেয়েছে - তাই বলেই রাখি। একজনের কাজকর্ম দেখে আজকাল আমার গঙ্গা পাঁজার কথা খুব করে মনে আসছে।

    গঙ্গা পাঁজা আমার মামার বাড়ির দেশের লোক - যাত্রা করে বিশাল নাম করেছিল। এমনিতে ছাগল চড়িয়ে খেত, কিন্তু যাত্রা - যাত্রা করে গায়ে রঙ চঙে পোষাক চাপিয়ে এক বিশাল ইমেজ গড়ে তুলেছিল রাজা রাজা ভাব একটা।

    তো সেবার যাত্রা হচ্ছে - গঙ্গা পাঁজা গ্রীন রুম থেকে খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে আসছে স্টেজে। পাবলিক সব থরোথরো টেনশনে, কি হয় কি হয় ভাব।

    স্টেজে ঢোকার জাষ্ট একটু আগে একটা গরু বাঁধার গোঁজ ছিল - আলো আঁধারে ঠিক দেখতে না পেয়ে গঙ্গা পাঁজা বিশাল হোঁচট খেয়ে ছিটকে ঢুকলো স্টেজে। তলোয়ার হাত থেকে ছিটকে সেই ওদিকে, জামা কাপড়ে ধূলো লেগে একশা। কিন্তু গঙ্গা পাঁজা অনেক দিনের খেলোয়াড় - ওতেও টলল না। ধীরে ধীরে উঠে তলোয়ারটা নিল হাতে, দিয়ে গোঁজের দিকে তাকিয়ে, বিশাল উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

    "কেবা হেথা গাড়িয়াছে গোঁজ, তারে আমি দিব শাস্তি সমুচিত"।

    পাবলিক ঠিক বুঝতে পারলো না কি হচ্ছে - তারা গঙ্গা পাঁজাকে নয়নের মণি করে রেখেছে। তারা ভালোবাসে হায়, হায় করে উঠলো - গুরু কি দিলে! হাততালিতে ভরে গেল যাত্রা প্রাঙ্গণ।

    দু একজন সন্দেহ প্রকাশ করল যে গঙ্গা ছড়ানোর পরে মেকাপ দিচ্ছে - কিন্তু তাদের কন্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল বাকি গঙ্গা পাঁজার ফ্যানদের গলার জোরে।

    আমার খুব গঙ্গা পাঁজার কথা মনে হচ্ছে একজনার কাজ কর্ম দেখে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন