এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বিদেশি কবিতার অনুবাদ

    Malay Roychoudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ০৮ জুন ২০১৯ | ১৪০৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Malay Roychoudhury | ০৮ জুন ২০১৯ ১২:৫০383587
  • এমি সিজেয়ার-এর পরাবাস্তব কবিতা ( ১৯১৩ - ২০০৮ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    এমেট টিল
    তোমার চোখ ছিল সামুদ্রিক শাঁখ যার ভেতরে তোমার পনেরো বছরের
    বিপুল সংঘর্ষের রক্ত ঝকমক করছিল ।
    তরুণদেও কোনও বয়স ছিল না,
    কিংবা আকাশচুম্বী বাড়িগুলোর চেয়ে
    পাঁচ শতকের অত্যাচার
    ডাইনিদের আগুন তাদের ওপরে চাপ হয়ে গিয়েছিল,
    পাঁচ শতকের সস্তা জিন বড়ো চুরুটের
    মোটা ভূড়ির টোকো বাইবেলের টুকরোয় ভরা
    পাঁচ শতকের তেতো মুখ সম্ভ্রান্ত বয়স্ক মহিলাপাপ
    তারা ছিল পাঁচ শতক পুরোনো এমেট টিল,
    কেইনের বলিকাঠে পাঁচ শতকের বয়সহীন বয়স ।
    এমেট টিল আমি বলি :
    শূন্য হৃদয়ে,
    রক্তের একটা ফোঁটা নেই,
    আর তোমার কথা বলতে হলে তা আমার সূর্যকে লুকোক, আমার রুটির সঙ্গে মেশাক:
    ---”ওহে শিকাগোর খোকা
    এটা কি এখনও সত্যি যে তোমার দাম
    একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের সমান ?”
    বসন্তকাল, সে তোমাকে বিশ্বাস করতো। এমনকি রাতের কিনারায়,
    মিসিসিপি নদীর কিনারায় গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার বাঁধ,
    তার সমাধির মতন ঝড় উঁচু বাঁধ আর জাতি-ঘৃণার মাঝে ।
    তার ঝর্ণা নিজের ফিসফিসানিকে বয়ে নিয়ে গেছে চোখের বন্দরগর্তে।
    বসন্তকালে শিকারি কুকুরের ডাকে গবাদি পশুর আতঙ্ক রক্তের সাভানায় ।
    বসন্তকালে সুন্দর হাত থেকে খোলা দস্তানায় গোলাবারুদের বিস্ফোরণে আর কপির বীজ,
    আতঙ্কে জমারক্ত, ঘৃণার জমারক্তকে গলিবে ফেলার
    বয়সের সঙ্গে ফুলে ওঠা রক্তস্রোতে যা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
    তাড়া-খাওয়া পশুদের বিপজ্জনক শিরোনাম ।
    কিন্তু ওরা
    ওরা ছিল দুর্ভেদ্ধ, ঢিলেঢালা যেমন ওরা ছিল,
    আর অজানা রামছাগলের ওপরে চেপেছে গায়ের জোরে
    ---”শিকাগোর খোকা”---
    সবকিছু চলে গেছে জাতের বাতাসের ভেড়ারডাকে
    ও শিরায় নীল ঝোপের আওয়াজ শোনে
    রক্তপাখির অবিরাম গানের সঙ্গে,
    ও ঘুমের তীরের ওপরে অনুমান করে নেয়
    সূর্যকে, তোমার অলক্ষিত পদক্ষেপের উথ্থান,
    এক উদ্দীপ্ত মাছ, আশ্চর্য নীল ক্ষেতের ।
    তারপর রাত তার বাহুকে মনে রেখেছে
    এক রক্তচোষার পেটমোটা উড়াল হঠাৎ মাথার ওপরে
    আসর বিগ মিলামের কোল্ট ৪৫
    রাষ্ট্রের দণ্ডাদেশ লিখে দিল জঙধরা অক্ষরে জীবন্ত কালো দেয়ালের ওপরে :
    ২০ বছর দস্তা
    ১৫ বছর তামা
    ১৫ বছর তেল
    আর ১৮০তম বছরে এই রাজ্যগুলো
    কিন্তু হৃদয়ে সময়ের ঘড়ির কোনো বোধ ছাড়াই
    কি, কিচ্ছু নয়, শূন্য
    রক্তের একটা ফোঁটাও নয়
    শাদা হৃদয়ের কঠিন অ্যান্টিসেপ্টিক মাংসে ?

    লাফাসাদিও হার্ন-এর মূর্তি
    নিঃসন্দেহে এটা অসম্ভব মাঝ সমুদ্রে ডাক দেওয়া
    তখনও উল্লম্ব দাঁড়িয়ে বাতাসের আঁচড়ের মধ্যে
    যার হৃদয় প্রতিটি স্পন্দনের সঙ্গে ধাক্কা খায়
    সত্যিকার এক পুষ্পলতার প্রলাপ ।
    সংবেদনময় হৃদয়ের বড়ো দণ্ডাদেশ
    মূর্খদের সম্পর্কে তোতলামি !
    “আর কে, কে চায়,” আমি শুনতে পেলুম
    টিটকিরির খিঁচুনি ছাড়াই এক কন্ঠস্বর, “অংশ নেবার জন্য
    মানুষের আত্মায় ? লড়ে যাবার
    তেজ ? সারসত্তার নৈতিকতায় যার অধঃপতন সে পড়ে যায়
    আবার উঠে দাঁড়াবার ? হৃদয়ের নেতার ? নরকের লাঙল ?”
    তারপর তারপর আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এগিয়ে চলল
    আর চাউনি অবিরাম ডিম পাড়তে লাগল :
    তুমি খেজুরগাছে চড়ে গেলে
    ন্যানি রোসেট পাথরের ওপরে বসে খাচ্ছিলেন
    শয়তান চারিদিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল
    সাপের চর্বি মাখানো দেহে
    বিগত আত্মাদের তেল মেখে
    শহরে একজন দেবতা ষাঁড়ের মাথা পরে নাচছিলেন
    গলা থেকে গলায় বইছিল পিঙ্গল মদ
    কেঠো-বাসায় মৌরির সঙ্গে মেশানো হচ্ছিল কমলালেবুর রস
    তামাকরঙা মানুষদের ভিড়ে
    দাবা খেলায় মত্ত
    আঙুল দিয়ে পাঠিয়ে দিল স্বপ্নদের
    ছায়ায় পকেটের ভেতরে বড়ো মাপের ক্ষুরগুলো ঘুমোচ্ছিল
    গলা থেকে গলায় বইছিল পিঙ্গল মদ
    কিন্তু কেউই নয় কেউই নয় জবরদস্ত সাড়া দিতে উদ্যত
    আর ভিমরুলদের কামড়ে নিজের শ্লেষ্মা উৎসর্গ করল
    হে অদ্ভুত প্রশ্নকারী
    তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি আমার অতিরিক্ত জগ
    কালো স্বরবর্ণকে স্মৃতিতে ধরে রাখার প্রতি
    আমি আমি আমি
    আর তোমার কথা বলতে গেলে তোমার ধৈর্য সৃষ্টি করা হয়েছিল
    অর্কিডে চাটা ঝড়ে বিপর্যস্ত ভাঙা মাস্তুল জলদস্যুর হুকুমে

    ...রাষ্ট্রের অবস্হা সম্পর্কে
    আমি কল্পনা করি রাষ্ট্রের অবস্হা সম্পর্কে এই বার্তা কংগ্রেসকে দেয়া:
    অবস্হা বেগতিক,
    কেবল ৭৫ বছরের লোহা মাটির তলায় টিকে আছে
    ৫০ বছরের কোবাল্ট
    কিন্তু ৫৫ বছরের সমান গন্ধক আর ২০ বক্সাইটের
    হৃদয়ে নাকি ?
    কিচ্ছু নয়, ফাঁকা,
    আমার কোনো আকরিক নেই,
    গিরিখাদে যেখানে কোনো প্রাণীই শিকারের জন্যে ঘুরঘুর করছে না,
    রক্তের একটা ফোঁটাও আর বাঁচেনি ।

    আমার ঘোড়া বিয়োবার আস্তাবল থেকে
    মেঘের দল, মশাল নিয়ে লাইন লাফ দিয়ে পেরোও ! বৃষ্টি হিংস্র তরুণী তোমার আশ্রয় ফাঁস করে দিচ্ছেঁ ! সমুদ্র সাপের হিসহিসানি দিয়ে থেমে যাবে ! সমস্ত গর্ত আর আগ্নেয়গিরি ভাসছে! ভিড়ের হুড়োহুড়ি আর পাগল দেবতারা ! তোমার মগজকে উড়িয়ে দাও ! ক্ষেতগুলোকে ত্রিশুল আর মুক্তো দিয়ে ফালাফালা করো ! জেলেদের ছুঁড়ে আকাশে পাঠাও ! একটা চিন্তা । কী ? আগুন যা আর নষ্ট করা হয় না । যা ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব তার তৃপ্ত বুকে সবকিছুই শ্লথ হয়ে আসছে।
    রাত । কী ? সমস্ত বস্তু যার ওজন হয় আর ফুরিবে যায় তার পরিসরে রূপান্তরিত হয় । পাসওয়র্ড । কী ? জগতকে একটা চালুনির ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া আর প্রতিটি এড়ানোর কৌশলে সঙ্ঘবদ্ধতার অভাব ।
    বিদ্যুতের সময়, বিদ্যুতের সময়, নড়বড়ে জানোয়ার, টালমাটাল জানোয়ার, সন্ধানী জানোয়ার, আর নাকের ফুটোর ডাকে আর ফেনাব তুমি আকাশের আস্তাবল থেকে পালিয়ে যেতে।
    আর সেখানে ছিল চমৎকার বহুরঙা
    দীর্ঘ-ঘাসের মাঠ প্রতিটি টগবগের জন্য এবং প্রতিটি
    গবাক্ষের ছায়া যেগুলো বেড়ে উঠছিল এইসব রাগি জানোয়ারদের আকাঙ্খার জন্য কমবয়সী আর কোকোফল দিয়ে পালিশ-করা
    জলের কোমল ত্বকের তলায় চিরকালের জন্য উজ্বল
  • Malay Roychoudhury | ০৮ জুন ২০১৯ ১২:৫৪383598
  • ফেদেরিকো গারসিয়া লরকা-র পরাবাস্তববাদী কবিতা ( ১৮৯৮ - ১৯৩৬ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    চাঁদ চাঁদের গাথাসঙ্গীত

    কনচিতা গারসিয়া লরকার জন্য
    চাঁদ কামারের কাছে এলো
    সুগন্ধনির্যাসে তৈরি পেটিকোট পরে
    যুবক দ্যাখে আর দেখতেই থাকে
    যুবক চাঁদের দিকে তাকায়
    অশান্ত বাতাসে
    চাঁদ নিজের বাহু তুলে ধরে
    দেখায় - বিশুদ্ধ আর যৌন --
    ওর টিন-পাতের বুক
    দৌড়োও চাঁদ দৌড়োও চাঁদের চাঁদ
    যদি জিপসিরা আসে
    শাদা আঙটি আর শাদা গলার হার
    তারা তোমার হৃদয় থেকে স্পন্দিত হবে
    যুবক তুমি কি আমায় নাচতে দেবে --
    যখন জিপসিরা আসবে
    ওরা তোমায় নেহাইয়ের ওপরে পাবে
    তোমার ছোট্টো চোখ বন্ধ করে
    দৌড়োও চাঁদ দৌড়োও চাঁদের চাঁদ
    আমি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি
    আমাকে রেহাই দাও যুবক । কথা বোলো না
    আমার শাদা মাড়ের গলিতে
    ঘোড়সওয়াররা বাজাতে বাজাতে এলো
    সমতলের ঢোলক
    কামারশালায় যুবক
    নিজের ছোটো চোখ বন্ধ করে নিয়েছে
    অলিভগাছের বন দিয়ে
    কাঁসায় আর স্বপ্নে
    জিপসিরা এসে পড়ল
    ওদের মাথা উঁচু করে
    ওদের চোখ নামিয়ে

    রাতের সারস কেমন গান গায়
    কেমন গাছে বসে গান গায়
    চাঁদ আকাশ পেরিয়ে চলে যায়
    যুবকের হাত ধরে

    কামারশালায় জিপসিরা
    কাঁদে আর তারপর চেঁচায়
    বাতাস লক্ষ রাখে লক্ষ রাখে
    বাতাস চাঁদের দিকে লক্ষ রাখে
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------
    অবিশ্বস্ত গৃহিণী

    মেরি পিসের জন্য
    তারপর আমি ওকে নদীতে নিয়ে গেলুম
    নিশ্চিত যে ও অক্ষতযোনি
    যদিও ওর একজন স্বামী ছিল ।
    জুলাইয়ের চতুর্থ শুক্রবারে,
    কথা দেবার মতন নির্দিষ্ট।
    রাস্তার আলোগুলো উবে যাচ্ছিল
    আর জোনাকিরা জ্বলে উঠছিল ।
    শহরের শেষ বাঁকে
    আমি ওর ঘুমন্ত বুক আদর করলুম।
    তারা হঠাৎ কুসুমিত হয়ে উঠল
    হায়াসিন্থের ডগার মতন
    আর ওর পেটিকোটের মাড়
    আমার কানে রেশমের মতন হইচই তুললো
    ডজনখানেক ব্লেডে চেরা ।
    পাইনগাছগুলো, তাদের জ্যোতি
    রুপোর, বাদ দিয়ে, বিশাল হয়ে উঠলো
    আর কুকুরের দিগন্ত
    নদী থেকে বহুদূর কান্না শোনাতে লাগলো ।

    জামগাছের পাশ দিয়ে,
    নলখাগড়া আর কাঁটাঝোপ,
    যুবতীর এলোচুলের তলায়
    আমি বালিতে ডুব দিলুম ।
    আমি খুলে ফেললুম আমার গলার রুমাল।
    যুবতী ওর পোশাকের বাঁধন খুলে ফেলল।
    আমি আমার পিস্তল আর তার খাপ,
    ও নিজের কাপড়কানির পরত…
    রজনীগন্ধা নয়, খোল নয়,
    মসৃণতার অর্ধেকের মতন ত্বক
    আয়নার কাচের মতনও নয়
    চকমকানির অর্ধেক আছে।
    ওর নিতম্ব আমার জন্যে পাখনা নাড়ালো
    এক জোড়া সচকিত পোনামাছের মতন:
    একটা পুরো আগুনময়
    আরেকটা ঠাণ্ডায় ভরপুর ।

    সেই রাতে আমি হয়তো
    বরং চাপতুম
    পথগুলোর মধ্যে বেছে নিয়ে
    মুক্তো রঙের ঘোটকীর পিঠে
    লাগাম আর রেকাব ছাড়াই।
    যেহেতু আমি একজন ভদ্রলোক,
    আমি সেসব টুকরোকথা বলব না
    যা যুবতী ফিসফিস করে বলেছিল।
    সেখানেই ভোর হয়ে এলো
    আমার ঠোঁটে কামড়ের দাগ নিয়ে।
    চুমু আর কাদায় নোংরা
    আমি ওকে নদী থেকে নিয়ে গেলুম
    আর লিলিফুলের ফলক
    বাতাসের সঙ্গে লড়ছিল ।

    আমি তেমন আচরণই করেছিলুম
    আমার মতন বজ্জাত যেমন করবে।
    আমি ওকে বড়ো খালুই দিতে চাইলুম
    খড়ের রঙের সাটিনের তৈরি ।
    আমার ইচ্ছে ছিল না ওর প্রেমে পড়ার।
    ওর তো একজন স্বামী আছে,
    যদিও ও তখনও অক্ষতযোনি
    যখন ওকে নদীতে নিয়ে গেলুম ।
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------
    সন্ধ্যার দুটি চাঁদ

    আমার বোনের বন্ধু, লরিতার জন্য
    চাঁদ মৃত মৃত
    ---বসন্তকালে তা জীবনে ফিরবে
    যখন দখিনা এক বাতাস
    পপলারের ভ্রুকে এলোমেলো করে দেবে
    যখন আমাদের হৃদয় দীর্ঘশ্বাসের শষ্য ফলায়
    ছাদগুলো যখন ঘাসের টুপি পরে থাকে
    চাঁদ মৃত মৃত
    ---বসন্তকালে তা জীবনে ফিরবে

    আমার বোন, ইসাবেলার জন্য
    সন্ধ্যা ঘুমপাড়ানি গান গায়
    কমলালেবুর জন্য

    আমার ছোট্ট বোন গায়
    “পৃথিবী একটা কমলালেবু”

    চাঁদ ফুঁপিয়ে বলে
    “আমি কমলালেবু হতে চাই”

    হতে পারবে না তুমি -- আমার আদুরি --
    তুমি গোলাপি হয়ে গেলেও
    কিংবা সামান্য পাতিলেবু
    কতো দুঃখের !

    তোমার একটা চুমু পাবার জন্য
    তোমার একটা চুমু পাবার জন্য
    আমি কিই বা দেবো
    একটা চুমু যা তোমার ঠোঁট থেকে বিপথে গিয়েছিল
    ভালোবাসার প্রতি মৃত
    আমার ঠোঁট স্বাদ পায়
    ছায়াদের কাদা
    তোমার কালো চোখের দিকে তাকাবার জন্য
    আমি কিই বা দেবো
    রামধনু তামড়ির ভোর
    ঈশ্বরের সামনে নিজেকে মেলে ধরছে---
    নক্ষত্রগুলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে
    মে মাসের এক সকালে
    আর তোমার পবিত্র উরুতে চুমু খাবার জন্য
    আমি কিই বা দেবো
    আকরিক গোলাপী স্ফটিক
    সূর্যের পলল
    ----------------------------------------------------------------------------------------------------
    ছোটো নগরচত্বরের গাথাসঙ্গীত

    খোকাখুকুর গান
    রাতের নৈঃশব্দে :
    স্রোতোস্বিনীর আলো, আর
    ঝর্ণার শান্তি !
    খোকাখুকুরা তোমাদের হৃদয়ে কিসে পূর্ণ
    দৈব আনন্দে ?
    আমি ঘণ্টাঘরের এক নিনাদ,
    অস্পষ্টতায় হারিয়ে গেছি।
    খোকাখুকুরা গান গেয়ে আমাদের ছেড়ে যাও
    এই ছোটো নগরচত্বরে ।
    স্রতোস্বিনীর আলো, আর
    ঝর্ণার শান্তি !
    কী ধরে আছো তুমি
    তোমার বসন্তকালের হাতে ?
    আমি রক্তের এক গোলাপ, আর
    শাদার লিলিফুল ।
    খোকাখুকুরা জলে ডুব দেয়
    প্রাচীনকালের গানের ।
    স্রোতিস্বিনীর আলো, আর
    ঝর্ণার শান্তি !
    তোমাদের জিভ কি অনুভব করে,
    লাল আর তৃষ্ণার্ত ?
    আমি হাড়ের এক স্বাদ
    আমার চওড়া কপালের ।
    খোকাখুকুরা স্হির জল পান করে
    প্রাচীনকালের গানের ।
    স্রোতোস্বিনীর আলো, আর
    ঝর্ণার শান্তি !
    কেন তোমরা অনেক দূরে চলে যাও
    এই ছোটো নগরচত্বর থেকে ?
    আমি খুঁজতে যাই পূর্বজগদ্বাসী জ্ঞানীদের
    আর রাজকুমারীদের ।
    খোকাখুকুরা যারা তোমাকে সেখানের পথ দেখিয়েছিল,
    তা কবিদের পথ ?
    আমি স্রোতোস্বিনীর উৎস
    প্রাচীনকালের গান ।
    খোকাখুকুরা তোমরা কি অনেক দূরে চলে যাও
    পৃথিবী আর সমুদ্র থেকে ?
    আমি আলোয় পরিপূর্ণ, রয়েছে
    রেশমের তৈরি আমার হৃদয়, আর
    ঘণ্টাগুলো যা হারিয়ে গেছে,
    মৌমাছির সঙ্গে লিলিফুলের সঙ্গে,
    আর আমি বহুদূরে চলে যাবো,
    ওখানে ওই পাহাড়গুলোর পেছনে,
    নক্ষত্রের আলোর কাছে,
    যিশুকে সেখানে প্রশ্ন করার জন্য
    হে নাথ, আমাকে ফিরিয়ে দাও
    আমার শিশুর আত্মা, প্রাচীন,
    কিংবদন্তিতে ভরা,
    পালকের টুপিতে,
    আর কাঠের তরোয়াল নিয়ে ।
    খোকাখুকুরা তোমরা আমাদের গাইতে গাইতে ছেড়ে যাও
    এই ছোটো নগরচত্বরে ।
    স্রোতোস্বিনীর আলো, আর
    ঝর্ণার শান্তি !
    বিশাল চোখের তারা
    রোদে পোড়া খেজুরপাতার
    বাতাসে হাহত, ওরা
    মৃত পাতার জন্য কাঁদে ।

    অশ্বারোহীর গান
    করদোবা।
    বহু দূরে, আর একা ।
    পূর্ণিমা, কালো ঘোড়া,
    আমার জিনের পাশে অলিভ ।
    যদিও আমি সব রাস্তাঘাট চিনি
    আমি কখনও করদোবায় পৌঁছোতে পারব না ।
    মৃদুমন্দ হাওয়ার ভেতর দিয়ে, উপত্যকা বেয়ে,
    লাল চাঁদ, কালো ঘোড়া।
    মৃত্যু আমার দিকে তাকাচ্ছে
    করদোবার মিনারগুলো থেকে ।
    ওহে, কতো দীর্ঘ এই পথ !
    ওহে, আমার সাহসী ঘোড়া !
    ওহে, মৃত্যু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে,
    আমি করদোবা পৌঁছোবার আগেই।
    করদোবা ।
    বহু দূর, আর একা ।
    এটা সত্যি
    ওগো, যে ব্যথা আমি সয়েছি
    তোমাকে ভালোবাসতে যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি।
    তোমাকে ভালোবাসার জন্য, বাতাস, এটা ব্যথা দেয়,
    আর আমার হৃদয়,
    আর আমার টুপি, তারা ব্যথা দেয়।
    কে-ই বা আমার থেকে কিনবে,
    এই রিবন যেটা ধরে আছি,
    আর কাপড়ের দুঃখ,
    শাদা, যা দিয়ে রুমাল তেরি হবে ?
    ওগো, যে ব্যথা আমি সয়েছি
    তোমাকে ভালোবাসার জন্যে যেমন তোমাকে ভালোবাসি !

    নিষ্ফলা কমলালেবু গাছের গান
    কাঠুরিয়া ।
    আমার ছায়াকে কেটে ফ্যালো ।
    এই অত্যাচার থেকে আমাকে মুক্তি দাও
    আমাকে নিষ্ফলা দেখার ।
    আমি কেন আয়নাদের মাঝে জন্মেছিলুম?
    দিনের আলো আমার চারিপাশে ঘোরে ।
    আর রাত নিজেই আমার পুনরাবৃত্তি করে
    তার যাবতীয় নক্ষত্রপূঞ্জে ।
    আমি বেঁচে থাকতে চাই নিজেকে না দেখে।
    আমি খোসা আর কীটদের স্বপ্ন দেখবো
    আমার স্বপ্নে বদলে যাচ্ছে
    আমার পাখিতে আর লতাপাতায়।
    কাঠুরিয়া ।
    আমার ছায়াকে কেটে ফ্যালো ।
    এই অত্যাচার থেকে আমাকে মুক্তি দাও
    নিজেকে নিষ্ফলা দেখার ।
    চাঁদ জেগে থাকে
    চাঁদ যখন পাল তুলে বেরিয়ে যায়
    ঘণ্টাধ্বনি মিইয়ে যায় স্হিরতায়
    আর দেখা দেয় পথরেখা
    যার মধ্যে যাওয়া যায় না ।
    চাঁদ যখন পাল তুলে বেরিয়ে যায়
    পৃথিবীর পৃষ্ঠতলকে লুকিয়ে ফ্যালে জল,
    হৃদয় নিজেকে দ্বীপের মতন অনুভব করে
    শাশ্বত নৈঃশব্দে ।
    কেউই কমলালেবু খায় না
    চাঁদের প্রাচুর্যের তলায় ।
    খাওয়া ঠিক কাজ, তাহলে
    সবুজ আর শীতল ফল ।
    চাঁদ যখন পাল তুলে বেরিয়ে যায়
    একই রকমের একশো-মুখসহ,
    রুপোর তৈরি পয়সাগুলো
    তোমার পকেটে ফোঁপায় ।

    বিদায়
    আমি মরে যাচ্ছি,
    বারান্দাটা খোলা রাখো ।
    বাচ্চাটা কমলালেবু খাচ্ছে ।
    ( বারান্দা থেকে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি ।)
    ফসলকাটিয়ে যবের ফসল তুলছে ।
    ( বারান্দা থেকে, আমি তাকে শুনতে পাচ্ছি ।)
    আমি মরে যাচ্ছি,
    বারান্দাটা খোলা রাখো ।
    স্বপ্নচর রোমান্স
    সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
    সবুজ বাতাস, আর সবুজ গাছের শাখারা ।
    সমুদ্রে অন্ধকার জাহাজ
    আর পাহাড়ে ঘোড়াটা ।
    মেয়েটির সঙ্গে যার কোমর ছায়ায় গড়া
    উঁচু বারান্দায় স্বপ্ন দেখি,
    সবুজ মাংস, আর সবুজ বিনুনি,
    আর জমাট রুপোর চোখ ।
    সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
    জিপসিদের চাঁদের তলায়
    নিঃশব্দ জিনিসেরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে
    জিনিসগুলো যা মেয়েটি দেখতে পায় না ।
    সবুজ, আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
    শাদা তুহিনের বিশাল নক্ষত্রদল
    সকালের পথ খুলে দিচ্ছে ।
    ডুমুরগাছ গা ঘষছে ভোরের বাতাসে
    তার শাখাদের কর্কশ কন্ঠস্বরে,
    আর পাহাড় বিড়ালের মতন চোর
    তার খামখেয়ালি চোরকাঁটায় রাগ দেখাচ্ছে ।
    কে আসছে ? আর কোথা থেকে…?
    মেয়েটি উঁচু বারান্দায় অপেক্ষায়,
    সবুজ মাংস আর সবুজ বিনুনি,
    স্বপ্ন দেখছে তেতো সমুদ্রের ।
    --’বন্ধু, ভাই, আমি অদলবদল করতে চাই
    আমার ঘোড়ার সঙ্গে তোমার বাড়িকে,
    তোমার আয়নার জন্য বিক্রি করব আমার জিন,
    তোমার কম্বলের বদলে আমার ছোরা ।
    প্রিয় ভাই আমার, আমি এসেছি রক্তাক্ত
    কাবরা’র গিরিপথ ধরে ।’
    --’ যদি পারতুম, আমার যুববন্ধু,
    তাহলে দরদস্তুর করতে পারতুম,
    কিন্তু আমি আর আমি নই,
    আর এই বাড়িটা আমার, আমার নয়।’
    --’বন্ধু, ভাই, আমি এখন মরতে চাই,
    আমার বিছানার সাজসজ্জায়,
    লোহার তৈরি, যদি তা পারা যায়,
    মিহিন ক্যামব্রিক কাপড়ের চাদরে ।
    তুমি কি আমার জখম দেখতে পাচ্ছ
    আমার গলা থেকে হৃদয় পর্যন্ত ?’
    --’তিনশো লাল গোলাপ
    তোমার শাদা জামায় এখন ।
    তোমার রক্ত থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে আর চুইছে,
    তোমার রক্তবর্ণ কাটা থেকে ।
    কিন্তু আমি আর আমি নই,
    আর এই বাড়ি আমার, আমার নয় ।’
    --’তাহলে আমাকে, অন্তত, ওখানে চড়তে দাও,
    উঁচু বারান্দার দিকে ।
    আমাকে চড়তে দাও, আমাকে ওখানে চড়তে দাও,
    উঁচু সবুজ বারান্দায় ।
    চাঁদের আলোয় তৈরি উঁচু বারান্দা,
    যেখান থেকে শুনতে পাচ্ছি জলের আওয়াজ ।’
    এবার ওরা আরোহণ করে, দুই সহযোগী,
    ওপরে উঁচু বারান্দায়,
    রক্তের ফোঁটা ঝরাতে ঝরাতে
    চোখের জলের রেখা ফেলতে-ফেলতে ।
    ভোরের ছাসগুলোয়,
    কাঁপে, টিনের ছোতো লন্ঠন ।
    স্ফটিকের হাজার খঞ্জনি
    ভোরের আলোকে জখম করেছে ।
    সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায়।
    সবুজ বাতাস, আর সবুজ গাছের শাখারা ।
    ওরা ওপরে আরোহণ করল, দুই সহযোগী ।
    মুখের ভেতরে, অন্ধকার আওয়া
    এক অদ্ভুত গন্ধ রেখে গেলো,
    হীরাকষ, আর পুদিনা, আর মিষ্টি তুলসীপাতার।
    --’বন্ধু, ভাই ! মেয়েটি কোথায়, আমাকে বলো,
    মেয়েটি কোথায়, তোমার তেতো সুন্দরী ?
    প্রায়ই তো, মেয়েটি তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছে !
    প্রায়ই তো, মেয়েটি অপেক্ষা করতে পারতো,
    শীতল মুখাবয়ব, আর অন্ধকার এলোচুলে,
    এই সবুজ বারান্দায় !’
    জলাধারের ঢাকনার ওপরে
    জিপসি মেয়েটা দোল খাচ্ছিল ।
    সবুজ মাংস, সবুজ এলোচুল
    জমাট রুপোর চোখ ।
    চাঁদের আলোর তৈরি বরফরশ্মি
    ওকে জলের ওপরে তুলে ধরে আছে।
    রাত কতো অন্তরঙ্গ হয়ে এলো,
    এক ছোটো, লুকোনো বাজারের মতন ।
    মাতাল সিভিল গার্ডরা টোকা দিচ্ছে,
    টোকা দিচ্ছে, দরোজা চৌকাঠে টোকা দিচ্ছে ।
    সবুজ, যেমন আমি তোমায় ভালোবাসি, সবুজাভায় ।
    সবুজ বাতাস, আর গাছের সবুজ শাখারা ।
    সমুদ্রে অন্ধকার জাহাজ,
    আর পাহাড়ের ওপরে ঘোড়া ।

    অপ্রত্যাশিত প্রেমের হরিণ
    কেউই বুঝতে পারেনি সুগন্ধ
    তোমার তলপেটের ম্যাগনিলোয়া ছায়াকে ।
    কেউই জানে না তুমি সম্পূর্ণ পিষে দিয়েছ
    তোমার দাঁতের মাঝে প্রেমের টুনটুনি পাখিকে ।
    এক হাজার ছোটো পারস্যের ঘোড়া ঘুমিয়েছিল
    তোমার কপালের চাঁদের আলোর বাজারে,
    যখন কিনা, চার রাত ধরে, আমি জড়িয়ে ধরেছিলুম
    তোমার কোমর, তুষারপাতে সে শত্রু ।
    পলেস্তারা আর জুঁইফুলের মাঝে,
    তোমার দৃষ্টি ছিল ফ্যাকাশে এক শাখা, বীজপ্রসূ ।
    আমি তোমাকে দেবার চেষ্টা করলুম, আমার বুকের হাড়ে,
    হাতির দাঁতের অক্ষরে যা বলছিল ‘চিরকাল’।
    চিরকাল, চিরকাল । আমাকে অত্যাচারের বাগান,
    তোমার দেহ, আমার কাছে থেকে চিরকালের জনভ বিদায় নেয়,
    তোমার শিরার রক্ত এখন আমার মুখে,
    ইতিমধ্যে আমার মৃত্যুতে আলোমুক্ত ।

    গোলাপের গীতিকাব্য
    গোলাপ
    সকালের খোঁজ করছিল না :
    তার শাখায়, প্রায় অবিনশ্বর,
    তা অন্যকিছু চাইছিল ।
    গোলাপ
    জ্ঞানের খোঁজ করছিল না, কিংবা ছায়ার :
    মাংসের কিনার আর স্বপ্ন দেখছিল
    তা অন্যকিছু চাইছিল ।
    গোলাপ
    গোলাপের খোঁজ করছিল না,
    স্বর্গে ছিল অবিচলিত
    তা অন্যকিছু চাইছিল ।

    অন্ধকার পায়রাদের গীতিকাব্য
    জলপাই গাছের শাখার ভেতর দিয়ে
    আমি অন্ধকারে দুটি পায়রা দেখতে পেলুম।
    একটা ছিল সূর্য’ আরেকটা ছিল চাঁদ ।
    আমি বললুম : ‘ছোট্ট প্রতিবেশীরা
    আমার সমাধিফলক কোথায় ?’
    ‘আমার লেজের পালকে,’ বলল সূর্য ।
    ‘আমার গলায়,’ বলল চাঁদ।
    আর আমি যে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল
    আমার শরীরে পৃথিবীকে জড়িয়ে নিয়ে,
    শাদা তুষারে গড়া দুটো ঈগল দেখতে পেলো,
    আর একটি মেয়ে যে ছিল নগ্ন ।
    আর একজন ছিল অন্যজন,
    আর মেয়েটি, সে দুটির কিছুই ছিলনা ।
    আমি বললুম, ‘ছোট্ট ঈগলরা
    আমার সমাধিফলক কোথায় ?’
    ‘আমার লেজের পালকে,’ সূর্য বলল ।
    ‘আমার গলায়,’ চাঁদ বলল ।
    জলপাই গাছের শাখার ভেতর দিয়ে,
    আমি দুটো পায়রাকে দেখতে পেলুম, দুটোই নগ্ন ।
    আর একজন ছিল অন্যজন,
    আর দুজন কিছুই ছিল না ।

    ওহে অন্ধকার প্রেমের গোপন কন্ঠ
    হে লুকোনো ভালোবাসার গোপন কন্ঠস্বর !
    হে পশাম ছাড়াই ভেড়ার ডাক দিচ্ছ ! হে জখম !
    হে শুকনো চিরহরিৎ-গুল্ম, তেতো ছুঁচ !
    হে সমুদ্রহীন স্রোত, দেয়ালহীন শহর !
    হে শাণিত পরিলেখে গড়া বিশাল রাত,
    স্বর্গীয় পর্বতমালা, সরু উপত্যকা !
    হে হৃদয়ের ভেতরের কুকুর, কন্ঠস্বর উবে যাচ্ছে,
    সীমাহীন স্তব্ধতা, পূর্ণবিকশিত রামধনু !
    আমাকে হতে দাও, হিমশৈলের উষ্ণ কন্ঠস্বর,
    আর আমাকে বিলুপ্ত হতে বোলো না
    জংলিঘাসে, যেখানে আকাশ আর মাংস ফলহীন ।
    চিরতরে ছেড়ে চলে যাও আমার হাতির দাঁতের করোটি,
    আমাকে দয়া করো । অত্যাচার বন্ধ করো !
    হে আমিই প্রেম, হে আমিই প্রকৃতি ।

    প্রতিটি গান
    প্রতিটি গান
    অবশিষ্টাংশ
    ভালোবাসার ।
    প্রতিটি আলো
    অবশিষ্টাংশ
    সময়ের ।
    একটা গিঁট
    সময়ের ।
    আর প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস
    অবশিষ্টাংশ
    এক কান্নার ।
  • Malay Roychoudhury | ০৮ জুন ২০১৯ ১২:৫৮383609
  • মাহমুদ দারবিশ-এর কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    কবিতা থেকে ঘোড়াটা পড়ে গেল

    কবিতা থেকে ঘোড়াটা পড়ে গেল
    প্রজাপতি আর শিশিরে
    গ্যালিলিয় নারীরা ভিজে গেলেন,
    ক্রিসানথিমামের ওপরে নাচতে-নাচতে

    যারা দুজন অনুপস্হিত : তুমি আর আমি
    তুমি আর আমি এই দুজন অনুপস্হিত

    একজোড়া শাদা পায়রা
    হোম-ওক গাছের ডালে বসে আলোচনা করছে

    প্রেম নেই, কিন্তু আমি প্রাচীন
    প্রেমের কবিতা ভালোবাসি যা আড়াল করে রাখে
    ধোঁয়া থেকে অসুস্হ চাঁদকে

    আমি আক্রমণ করি আর পিছোই, অন্ত্যমিল বেহালার সুরের মতো
    যখন আমি জায়গাটার বিবরণের কাছে থাকি
    আমার সময় থেকে বহু দূরে চলে যাই…

    যা ভালোবাসি তা উদযাপনের জন্য
    আধুনিক ভাষায় আর প্রান্ত অবশিষ্ট নেই,
    কেননা আমরা যা হবো তা হয়ে গেছে...ছিল

    ঘোড়া পড়ে গেল রক্তাক্ত
    আমার কবিতা নিয়ে
    আর আমি পড়ে গেলুম রক্তাক্ত
    ঘোড়াটার রক্ত নিয়ে…

    পরিত্যক্ত থিয়েটারে আমার একটা আসন আছে
    পরিত্যক্ত থিয়েটারে আমার একটা আসন আছে
    বেইরুটে । আমি ভুলে যেতে পারি, আর আমি মনে করতে পারছি
    আকুল আকাঙ্খা ছাড়াই শেষ অঙ্ক...অন্যকিছুর জন্য নয়
    কেবল এই কারণে যে নাটকটা লেখা হয়নি
    দক্ষতায়…
    বিশৃঙ্খলা
    বিষণ্ণদের মতন যুদ্ধের দিনকালে, আর এক আত্মজীবনী
    দর্শকদের আবেগের । অভেনিতারা তাদের স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে ফেলছিল
    আর আমাদের মাঝে খুঁজছিল নাট্যকারকে, আমরা যারা সাক্ষী
    আমাদের আসনে বসে
    আমার পাশের আসনের শিল্পীকে বলি : আপনার অস্ত্র বের করবেন না,
    আরও অপেক্ষা করুন, যদি না আপনিই নাট্যকার হন !
    ---না
    তারপর উনি আমায় জিগ্যেস করেন : আর আপনিই কি নাট্যকার ?
    ---না
    আমরা তাই ভয়ে বসে থাকি । আমি বলি : হয়ে উঠুন নিরপেক্ষ
    নায়ক যাতে প্রতীয়মান অদৃষ্ট থেকে কেটে পড়া যায়
    উনি বলেন : কোনো নায়কই মহিমায় মারা যায় না দ্বিতীয়
    দৃশ্যে । আমি বাকিটুকুর জন্য অপেক্ষা করব । হয়তো আমি
    কোনো অঙ্কের পুনর্লিখন করে দেবো । আর হয়তো আমি সংশোধন করব
    লোহা যা আমার ভাইদের জীবনে ঘটিয়েছে
    তাই আমি বলি : তাহলে আপনিই ?
    উনি উত্তর দেন : আপনি আর আমি দুজন মুখোশ-পরা নাট্যকার আর দুজন মুখোশ-পরা
    সাক্ষী
    আমি বলে : তা আমার উদ্বেগের বিষয় হবে কেন ? আমি একজন দর্শক
    উনি বলেন : কোনো দর্শকই গহ্বরের দরোজায় দাঁড়িয়ে নেই….আর তাই
    একজন এখানে নিরপেক্ষ । আর আপনি বেছে নিতে বাধ্য
    আপনার অন্তকালীন ভূমিকা
    আমি তাই বলি : আমি আরম্ভটার অভাব বোধ করছি, কী যেন ছিল আরম্ভে?

    আমার আছে একজন দণ্ডিতের জ্ঞান

    আমার আছে মৃত্যুর দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তের জ্ঞান
    আমার অধিকারে কিছুই নেই তাই কিছুই আমাকে অধিকার করতে পারে না
    আর আমার ইচ্ছাপত্র লিখেছি আমার নিজের রক্তে:
    “হে আমার গানের নিবাসীরা : জলকে বিশ্বাস করো”
    আর আমি আমার আগামীকালে বিদ্ধ হয়ে আর মুকুটে অভিষিক্ত হয়ে ঘুমোই…
    আমি স্বপ্ন দেখলুম পৃথিবীর হৃদয়
    তার মানচিত্রের চেয়ে বড়ো,
    আয়নার চেয়ে আর আমার ফাঁসিকাঠের চেয়ে
    বেশি পরিষ্কার ।
    আমি একটা শাদা মেঘে হারিয়ে গিয়েছিলুম যা আমাকে ওপরে তুলে নিয়ে গিয়েচিল
    যেন আমি এক ঝুঁটিওয়ালা পাখি
    আর বাতাস নিজেই আমার ডানা ।
    ভোরবেলা, আমার রাতের পাহারাদারের ডাক
    আমাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুললো, আমার ভাষা থেকে :
    তুমি আরেকটা মৃত্যু বেঁচে থাকবে,
    তাই নিজের ইচ্ছাপত্র পুনর্লিখন করো,
    ফাঁসির সময় আবার মুলতুবি রাখা হয়েছে ।
    আমি জানতে চাই : কবে অব্দি ?
    ও জবাবে বলে : আরও মরে নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো ।
    আমি বলি : আমার অধিকারে কিছুই নেই তাই কিছুই আমাকে অধিকার করতে পারে না
    আর আমার ইচ্ছাপত্র লিখেছি আমার নিজের রক্তে :
    “হে আমার গানের নিবাসীরা : জলকে বিশ্বাস করো।”

    যা করেছ তার জন্য কৈফিয়ত দিও না

    যা করেছ তার জন্য কৈফিয়ত দিও না -- আমি একথা বলছি
    গোপনে । আমি আমার ব্যক্তিগত অপরকে বলি :
    এখানে তোমার যাবতীয় স্মৃতি দৃষ্টিগোচর :
    এক বিড়ালের নিদ্রালুতায় মধ্যদিনের অবসাদ,
    বিদূষক,
    সন্ন্যাসীর গন্ধ,
    মায়ের কফি,
    মাদুরের সঙ্গে বালিশ,
    তোমার ঘরে ঢোকার লোহার দরোজা,
    সক্রেটিসকে ঘিরে মাছির ভনভনানি,
    প্ল্যাটোর ওপরদিকের মেঘ,
    দিওয়ান আল-হামজা
    বাবার ফোটো,
    মুজাম আল-বুলদান,
    শেক্সপিয়ার,
    তোমার তিন ভাই আর তিন বোন
    তোমার বাল্যকালের বন্ধুরা --
    আর অনধিকারচর্চাকারীদের গুলতানি :
    “এই লোকটাই সে ?”
    সাক্ষীরা ভিন্নমত :
    “হতে পারে।”
    “মনে হয় তেমনই ।”
    আমি জানতে চাই :
    “আর ও কে ?”
    কোনো উত্তর পাই না ।
    আমি আমার অপরকে ফিসফিস করে বলি :
    “ও কি সে যা তুমি ছিলে...যা আমি ছিলুম?”
    ও অন্য দিকে তাকায় ।
    সাক্ষীরা আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে সত্যতা জানতে চায়
    ও আসলে আমি আর
    মা গাইবার জন্যে তৈরি হন
    ওনার নিজস্ব গান :
    “আমিই সে যে ওর জন্ম দিয়েছি
    কিন্তু বাতাস ওর লালন-পালন করেছে।”
    আর আমি আমার অপরকে বলি : “তোমার মাকে ছাড়া, আর কাউকে কৈফিয়ত দিও না।”

    এরকম একটা দিনে

    এরকম একটা দিনে, কোনো গোপন কোনায়
    এক গির্জায়, এক সম্পূর্ণ মেয়েলি চমৎকারীত্বে,
    এক অধিবর্ষে, যখন শাশ্বত সবুজ
    নেভি-নীল সকালের সঙ্গে দেখা করে,
    যখন আঙ্গিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে দেখা করে আর ইন্দ্রিয়চেতনার
    দেখা হয় বোধাতীতের সঙ্গে,
    পরিপূর্ণ চক্রনেমির তলায়
    যেখানে এক চড়ুইপাখির ছায়া মুছে ফ্যালে
    মর্মার্থের প্রতিমাকে -- এই আবেগের জায়গায়
    আমি আমার শেষ আর আমার শুরুর মুখোমুখি হবো
    আর বলব : মরগে যাও তোমরা দুজনে। নিজেদের রাস্তা দ্যাখো
    যদি তাইই চাও -- আমাকে নাও আর এগিয়ে চলো,
    হৃদয়ের সত্যকে তরতাজা রেখে যাও
    শৈয়ালের ক্ষুধার্ত মেয়েদের জন্য ।
    আমি বলি : আমি নাগরিক নই
    কিংবা এক উদ্বাস্তু ।
    আর আমি একটা জিনিস চাই : তার বেশি নয়,
    একটা জিনিস : এক সরল, নিরব মৃতভু
    এরকম একটা দিনে, এক গোপন হৃদয়ে
    শ্বেতপদ্মের,
    হতে পারে অনেকটা বা একটু ক্ষতিপূরণের জন্য,
    মুহূর্ত ও প্রস্হানের মাঝে মাপা জীবনের জন্য ।
    আমি এই বাগানে মৃত্যু চাই ।
    বেশি নয়...কম নয় ।
  • Malay Roychoudhury | ০৮ জুন ২০১৯ ১৩:০৩383620
  • Nazik Al-Malaika, Arabic poet from Iraq
    নাজিক আল-মালাইকা-র ( ১৯২৩ - ২০০৭ ) কবিতা । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    'রাতের নৈঃশব্দ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে'

    পায়রাদের ছাড়া তাতে ভাঙন ধরেনি, অনেক দূর থেকে,
    বকবকম করে চলেছে, বিভ্রান্ত, আর কুকুরেরা ডাকছে প্রাচীন নক্ষত্রদের
    যেমন ক্ষুধার্ত ঘড়িগুলো আমাদের অস্তিত্ব গিলে খায় ।
    ওই দিকে, লাইনের ওপর দিয়ে দ্রুত
    একটা রেলগাড়ি
    চলে গেল । আমি অযথা সারাটা রাত অপেক্ষা করলুম
    তার আর দিনের জন্য...রেলগাড়িটা
    তার শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না, দূরে, স্‌ইর,
    আমার হৃদয়ে এক দুর্বল প্রতিধ্বনি
    কেবল টিকে আছে, দূরের পাহাড়ের পেছনে ।
    স্বপ্নালু নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়ে, শুরু করি
    রেলগাড়ির কামরার কল্পনা, কম আলো
    ঘুমহীন যাত্রিদের সারিগুলোর ওপরে,
    রাত্রির ওজনের কল্পনায় মশগুল
    ক্লান্ত চোখের পাতায়, যে চোখের দৃষ্টি আবছা,
    অন্য সবায়ের মুখ দেখে বিষণ্ণ, ফ্যাকাশে আর অনমনীয়,
    অন্ধকারকে পাহারা দিয়ে ক্লান্ত ।
    তিক্ত বিরক্তির ছবি ভেসে ওঠে
    প্রতিটি রেলস্টেশনের সাথে-সাথে যা আত্মায় আরও ঘষে যেতে থাকে
    তাদের মালপত্র অপেক্ষা করছে, যা করা জরুরি,
    মালপত্র, ধুলোর পরতের তলায় অপেক্ষা করছে ।
    ওরা একটু ঘুমিয়ে নেয়, কিন্তু প্রতিটি ঝাঁকুনিতে জেগে ওঠে
    পুরোনো রেলগাড়ির, হাই তোলে, তন্দ্রাচ্চন্ন, ভোরের দিকে তাকায়,
    ওরা আবার অন্য লোকেদের মুখের দিকে তাকায়,
    রেলগাড়ির জড়ো-করা অচেনাদের মুখ ।
    অনেকে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে তখন কানে আসে
    এক তোতলা কর্কশ কন্ঠস্বর, “দ্যাখো,
    হাতঘড়ির এই কাঁটাগুলো, যেন পথ হারিয়েছে ।
    কতক্ষণ পৌঁছোতে লাগবে ? বলতে পারো ?”
    ওর হাতঘড়ি উদাসীনভাবে তিনটে বাজায়
    আর তখনই ট্রেনের সিটি কথায় ব্যাঘাত ঘটায়
    ট্রেনের কন্ডাক্টরের আলো, ঝুলছের
    জানালায় স্টেশনের আলোর সঙ্গে মিশ খায়,
    আর কিছুক্ষণেই ক্লান্ত রেলগাড়ি ধীরগতি হতে থাকে ।
    ...ওখানে আকটা ছেলে, গুঁড়ি মেরে রয়েছে
    ক্লান্ত কিন্তু ঘুমোতে চাইছে না, দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে
    আর নক্ষত্রদের পাআরা দেয় ।
    এক উদ্বিগ্ন নৈঃশব্দ আকার পায়, ওর চোখে,
    শীতল উদাসীনতায়, অসুস্হ স্বপ্ন আলো ফ্যালে
    ওর মুখে, অদ্ভুত, লালচে আলোয় ।
    ওর ঠোঁট দুটো, খোলা, দেখা বোঝা যায়
    স্বপ্ন যা ছড়িয়ে পড়েছে, এই ফাঁকা রাতের তলায়,
    গোপন সঙ্গীত ডানা ঝাপটাচ্ছে,
    ওর চোখ প্রায়-বন্ধ, যেন ভয়ে
    আলোর রশ্মি পালটে দেবে যাকিছু ও দেখছে তাকে,
    কিংবা হয়তো এক্ষুনি কোনো জঘন্য বস্তু আবির্ভূত হবে,
    এই ছেলেটা, এতো বিক্ষুব্ধ আর আন্তরিক,
    অন্যদের মাঝে অকারণে খুঁজে চলেছে
    পুরোনো রহস্যের চেয়ে বেশি কিছু,
    হাজার পর্বে ভাগ করা সেই জীর্ণ কাহিনি ।
    নায়কদের পরবর্তী কাহিনি সম্পর্কে জগতসংসার পরিশ্রান্ত,
    আর আগ্রহহীনভাবে তাকে অনুসরণ করে ।
    এই ছেলেটা…
    টকিট চেকারের পায়ের আওয়াজ পাশ দিয়ে চলে যায়
    তারপর ওর ঘুমহীন মুখ
    কাচের ভেতর দিয়ে তাকায় !
    ওর লন্ঠন জায়গাটাকে আলোকিত করে
    ওদের মুখ দেখতে পায়, ক্লান্ত চোখ-মুখ
    যাত্রীরা যারা সারারাত ঘূমহীন কাটিয়েছে,
    ও দেখতে পায় তন্দ্রালু, অপেক্ষারত প্রাণীদের,
    ভোরের নাম ধরে ডাকছে চোখের পাতা ।
    আর তারপর পায়ের ভারি আওয়াজ মিলিয়ে যায়
    রেলগাড়ির অন্ধকারে ।
    এক পতিতজমির পাশ দিয়ে ট্রেন চলে যায়
    আর আমি একা, কালোয় চোবানো,
    রাতকে অনুরোধ করি আমার কবিকে ফিরিয়ে আনতে ।
    ট্রেনটা ওকে এতোক্ষণ অপেক্ষ করিয়েছে কেন ?
    ও কি পাশ দিয়ে চলে গেছে, অবাক হই,
    পেটমোটা টিকিটচেকারের
    নিজের যাতায়াত বজায় রেখেছে, ওকে দেখতে পায়নি,
    ফিকে আলোয় যাত্রীদের নিরীক্ষণ করার সময়ে ?
    আর এখানে আমি অপেক্ষায়, আর এখানেই আমি থাকব
    রেলগাড়ির আসার অপেক্ষায় ।

    'এক গুরুত্বহীন মহিলার জন্য রচিত এলেজি'

    উনি মারা গেলেন, কিন্তু কোনো ঠোঁট কাঁপেনি, কোনো গাল ফ্যাকাশে হয়নি
    কোনো দরোজা শোনেনি ওনার মৃত্যুর কাইনি
    কোনো জানালার কপাট খুলে ক্ষুদে চোখ চাউনি মেলেনি
    শবশকট এলো আর চলে গেলো দৃষ্টির বাইরে ।
    কেবল পথের একটা ভিখারি, আর্ত
    ক্ষুধায়, ওনার জীবনের প্রতিধ্বনি শুনতে পেলো--
    সমাধিদের নিরাপদ বিস্মৃতি
    চাঁদের সবিষাদ-চিন্তা ।
    রাত নির্দ্বিধায় সকালকে জায়গা ছেড়ে দিলো,
    আর আলো নিজের সঙ্গে নিয়ে এলো আওয়াজ -- বাচ্চারা ঢিল ছুঁড়ছে,
    একটা ক্ষুধার্ত, মিঁউমিঁউ বিড়াল, শুধু চামড়া আর হাড়গিলে,
    আর ফিরিঅলারা লড়ছে, তিক্ত মারামারি,
    কিছু লোক উপোস করে আছে, অন্যেরা আরও বেশি চাইছে,
    কুলকুচি করছে নোংরা জল, আর এক মৃদুমন্দ বাতাস
    খেলছে, একা, দরোজায়
    ওনাকে প্রায় ভুলতে বসেছে ।

    'সূর্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ'

    বিপ্লবীদের জন্য উপহার ।
    মেয়েটি সূর্যের সামনে দাঁড়ালো, চিৎকার করে :
    “সূর্য ! তুমি আমার বিপ্লবী হৃদয়ের মতো
    যার জীবনকে ভাসিয়ে দিয়েছে যৌবন
    আর যার চির-নবীকরণকরা আলো
    নক্ষত্রদের দিয়েছে পান করার জন্য ।
    সাবধান ! তোমাকে প্রবঞ্চনা করতে দিও না
    কোনো বিভ্রান্ত দুঃখ কিংবা আমার চোখের জল ।
    কেননা দুঃখ হল আমার বিপ্লব আর আমার প্রতিরোধের আঙ্গিক
    রাতের তলায় -- আমার সাক্ষ্যের দৈবতা !”

    “সাবধান ! প্রবঞ্চনা করতে দিও না আমার চেহারার দুঃখ,
    আমার ফ্যাকাশে রঙ, কিংবা আমার আবেগর রূপোকে ।
    আমার হতবুদ্ধি আর আমার কবির দুঃখের পংক্তির ধারাপ্রবাহ
    আমার ভ্রূযুগলে কাঁপতে থাকা উচিত,
    কেবল অনুভব আমার আত্মায় যন্ত্রণাকে অনুপ্রাণিত করে
    আর জীবনের ভয়াবহ ক্ষমতায় আনে চোখের জল ।
    কেবল ভবিষ্যবাণী উড়তে পারে না আর তাই তাকে প্রতিরোধ করে
    দুঃখ, বেদনাদায়ক জীবনের মুখোমুখি ।”

    “আমার দুই ঠোঁট--তাদের যন্ত্রণায় চেপে-ধরা
    আমার দুই চোখ, শিশিরে তৃষ্ণার্ত ।
    সন্ধ্যা আমার ভ্রূযুগলে ছায়া ফেলে গেছে,
    আর সকাল আরেকবার রুদ্ধ করেছে আমার আশা ।
    তাই আমি প্রকৃতিকে উজাড় করে দিতে এসেছি আমার বিভ্রান্তি
    সুগন্ধময় গোলাপে, দুপুরের ছায়ায় ।
    কিন্তু তুমি আমার গভীর দুঃখ আর চোখের জল নিয়ে ঠাট্টা করলে
    আর হাসাহাসি করলে আমার তিক্ততা ও যন্ত্রণা নিয়ে ।”

    “এমনকি তুমিও, সূর্য ? কি দৌর্মনস্য !
    তুমি আমার স্বপ্নের অভিপ্রায়ের লক্ষ্য ।
    তুমিই সেইজন যার উদ্দেশে আমার যৌবন গান গেয়েছিল,
    তোমার হাসিমুখ আলোর বন্যায় মন্ত্রোচ্চারণ করেছিল ।
    তুমিই সেইজন যাকে আমি পবিত্র মনে করে পূজা করেছি
    আদর্শ হিসাবে যখন আমি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চেয়েছি ।
    কি মোহমুক্তি ! আর তুমি আমার জন্য নও
    আমার দৌর্মনস্য ও বিষণ্ণতার ছায়ার চেয়ে বেশি কিছু ।”

    “তোমার যে আদর্শ-প্রতিমা আমি গড়েছি তা ভেঙে চুরমার করব
    আমার ভালোবাসা থেকে প্রতিটি বিকীর্ণ আলোর জন্য
    আর তোমার দীপ্তি থেকে আমার চোখ সুরক্ষিত রাখব ।
    তুমি প্রতারণাপূর্ণ উদ্ভাসের প্রেত ছাড়া আর কিছুই নও।
    আমি আমার নিজের হৃদয়ের স্বপ্ন থেকে গড়ে তুলব এক স্বর্গোদ্যান ;
    উদ্ভাসিত দীপ্তি না হলেও আমার জীবন কেটে যাবে ।
    আমাদের, আদর্শবাদীদের, আমাদের তেজোময়তায়
    আছে দৈবতার এবং হারিয়ে-যাওয়া অমরত্বের রহস্য।”

    “আমার ঝোপঝাড়ের ওপরে তোমার আলোকরশ্মি ফেলো না !
    যদি তুমি উদয় হও, তা আমার কবি হৃদয় ছাড়া অন্য কোনও কারণে ।
    তোমার আলো আর আমার আবেগকে প্ররোচিত করে না,
    কারণ আমাদের মতন মানুষদের আছে রাতের নক্ষত্র যা মননকে অনুপ্রাণিত করে ।
    তারা বন্ধু যারা অন্ধকারেও জেগে থাকে ।
    তারা আমার আত্মাকে বোঝে, আমার বিস্ফোরিত আবেগকে,
    আর তারা আমার চোখের পাতার ওপরে দীপ্তিময় রেশ তৈরি করে
    রহস্যময় সন্ধ্যায় রূপালি আলোর ।”

    “জীবনের সঙ্গীত আর কবিতা হল রাত্রী
    যেখানে পায়চারি করেন সৌন্দর্যের প্রেরণাদায়িকা দেবী।
    আত্মা, আর কারারুদ্ধ নয়, তার মাঝে ডানা ঝাপটায়
    আর নক্ষত্রের ওপরে উঠে যায় তেজোময়তা ।
    প্রায়ই আমি তার ছায়ার আর আলোর তলায় হেঁটেছি
    অন্যায্য অস্তিত্বের দুঃখ ভুলে গিয়ে,
    আমার কন্ঠে দৈব অনুনাদের গান
    আমার মুখের ভেতরে নক্ষত্রদের যাত্রীদলের আবৃত্তি।”

    “প্রায়ই আমি দেখতে গেছি সব কয়টি অপসরণরত আলোদের
    আর রাতের অন্ধকারে বেঁধেছি আমার সঙ্গীত,
    কিংবা দেখতে গেছি অন্ধকারকে বিদায় জানাচ্ছে চাঁদ
    আর ঘুরে বেড়িয়েছি আকর্ষক কল্পনার উপত্যকায় ।
    নৈঃশব্দ আমার আত্মাকে শি্রিত করে তোলে
    সন্ধ্যার শান্তি আর অন্ধকারের আড়ালে,
    আর আলো নাচতে থাকে আমার চোখের পাতায়, ডাক পাড়ে
    আসাময় হৃদয়ের স্বপ্নগুলোর গভীরতায় ।”

    “সূর্য ! তোমার কথা বলতে হলে...কি ?
    আমার আবেগ আর আমার মন তোমার মধ্যে কি পেতে পারে ?
    অবাক হয়ো না যদি আমি অন্ধকারের প্রেমে পড়ি,
    দাহের দেবীরা তোমরা গলে যাও আর তরল হয়ে যাও
    প্রতিটি স্বপ্ন দেখা দিলে তাকে ছিঁড়ে ফ্যালো
    স্বপ্নদ্রষ্টাদের জন্য, এবং প্রতিটি মনোরম তেজোময়তার---
    অন্ধকার যা গড়ে তোলে তাকে ধ্বংস করো
    আর কবির হৃদয়ের গভীরে যে নৈঃশব্দ আছে তাকে ।”

    তোমার নৃত্যরত আলোর যোগফল, হে সূর্য,
    আমার প্রতিরোধের আগুনের চেয়ে দুর্বল,
    আর তোমার আগুনের উন্মাদনা আমার সঙ্গীতকে কখনও নষ্ট করতে পারবে না
    যতক্ষণ আমার গানের বাজনা আমার হাতে রয়েছে ।
    যদি তুমি পৃথিবীকে ঢেকে দাও, মনে রেখো
    আমি আমার মন্দির থেকে তোমার রশ্মিদের বিদায় করব
    আর যে অতীতকে মহিমান্বিত করেছ তাকে কবর দেবো
    যাতে সুন্দর রাত আচ্ছাদন গড়ে তোলে
    আমার আগামী দিনের ওপরে ।”

    'শব্দের জন্য প্রেমের গান'

    কেন আমরা শব্দদের ভয় পাই
    যখন তাদের রয়েছে গোলাপি-তালু হাত,
    সুগন্ধিত, আমাদের গালে আলতো হাত বুলোয়,
    আর স্বাদু মদের গেলাসভর্তি
    পান করে, গ্রীষ্মে, তৃষ্ণার্ত ঠোঁট দিয়ে ?

    কেন আমরা শব্দদের ভয় পাই
    যখন তাদের মধ্যে রয়েছে অদেখা কাঁসরঘণ্টা,
    আমাদের বিপর্যস্ত জীবনে যাদের প্রতিধ্বনি ঘোষণা করে
    মনোরম ভোরের কালখণ্ডের আগমনকে,
    ভালোবাসায় আর জীবনে পুরাদস্তুর সিক্ত ?
    অতএব কেন আমরা শব্দদের ভয় পাই ?

    আমরা নৈঃশব্দের মাঝে আনন্দ উপভোগ করি ।
    আমরা স্হানু হয়ে যাই, এই ভয়ে যে গুপ্ততথ্য আমাদের ঠোঁট ছেড়ে চলে যাবে।
    আমরা ভেবেছিলুম শব্দের ভেতরে পাতা আছে অদেখা লাশখোর পিশাচ,
    কুঁজো, সময়ের কান থেকে অক্ষরের দ্বারা লুকোনো ।
    আমরা তৃষ্ণার্ত অক্ষরদের শেকল পরালুম,
    আমরা ওদের নিষেধ করলুম আমাদের খাতিরে রাত্রীকে বিছিয়ে দিতে
    গদির মতন, সঙ্গীত ঝরে পড়ছে, স্বপ্ন,
    আর উষ্ণ পেয়ালা ।

    কেন আমরা শব্দদের ভয় পাই ?
    তাদের মাঝে আছে মসৃণ মিষ্টতার শব্দ
    যার অক্ষরগুলো আমাদের দুই ঠোঁট থেকে আশার উষ্ণতা পেয়েছে,
    এবং আরওকিছু, আনন্দে উৎসবমত্ত
    দুটি মাতাল চোখ নিয়ে সাময়িক আহ্লাদের ভেতর দিয়ে গেছে।
    শব্দেরা, কবিতা, কোমলভাবে
    আমাদের গালে হাত বোলাবার জন্য ফিরে দেখেছে, আওয়াজ
    যা, তাদের প্রতিধ্বনিতে ঘুমিয়ে, গাঢ় রঙে রাঙানো, এক ফুরফুরে,
    এক গোপন আকুলতা, লুকোনো আকাঙ্খা ।

    কেন আমরা শব্দদের ভয় পাই ?
    কখনও যদি তাদের কাঁটা আমাদের আহত করে থাকে,
    তারা তো তাদের বাহু দিয়ে আমাদের গলা জড়িয়ে ধরেছে
    আর আমাদের ইচ্ছায় মাখিয়েছে তাদের মিষ্টি সুগন্ধ ।
    যদি তাদের অক্ষর আমাদের বিদ্ধ করে থাকে
    আর বিতৃষ্ণায় আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে
    তারা তো আমাদের হাতে দিয়ে গেছে ম্যাণ্ডোলিন
    আর আগামীকাল তারা আমাদের ওপর জীবনের বৃষ্টি ঝরাবে ।
    তাই আমাদের গেলাসদুটো শব্দ দিয়ে কানায় কানায় ভরে দাও !

    আগামীকাল আমরা নিজেদের জন্য শব্দের স্বপ্ননীড় তৈরি করব,
    বেশ উঁচুতে, তার অক্ষরদের থেকে ঝুলবে আইভিলতা ।
    আমরা তার কুঁড়িদের কবিতা দিয়ে লালন করব
    আর শব্দ দিয়ে তাদের ফুলে জল দেবো ।
    ভিতু গোলাপফুলের জন্য আমরা বারান্দা গড়ব
    শব্দ দিয়ে গড়া থামের ওপরে,
    আর এক শীতল হলঘর যা হবে গভীর ছায়াময়,
    শব্দদের পাহারায় ।

    আমাদের জীবন আমরা প্রার্থনা হিসাবে নির্ণয় নিয়েছি
    কার কাছে আমরা প্রার্থনা করব...কেন শব্দদের ?
  • Malay Roychoudhury | ০৮ জুন ২০১৯ ১৮:৫০383628
  • প্যারিস স্প্লিন : শার্ল বদল্যার
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    উৎসর্গ
    আরসেন হাউসেকে
    প্রিয় বন্ধু, আমি আপনাকে একটা ছোটো কাজ পাঠাচ্ছি যাকে কেউই বলতে পারবেন না যে এর মুড়ো বা লেজ নেই, কেননা, বরং বিপরীত, এতে যা কিছু আছে তা সবই মুড়ো আর লেজ, পর্যায়ক্রমে এবং ব্যতিহার্যভাবে । দয়া করে ভেবে দেখুন কতো সূক্ষ্ম সুবিধা এই মিশেল আমাদের সবাইকে দেয়, আপনাকে, আমাকে, এবং পাঠককে । আমরা যেখানে ইচ্ছে থামতে পারি --- আমি, আমার ভাবাবেশ, আপনি, পাণ্ডুলিপি, এবং পাঠক, তাঁর পড়া ; কেননা আমি অধৈর্য পাঠককে ফালতু প্লটের সীমাহীন সুতোয় বাঁধতে চাই না । যেকোনো একটা কশেরুকায় টান দিন, এবং এই প্যাঁচালো কল্পনার দুটি অর্ধাংশ ব্যথাহীনভাবে নিজেদের জুড়ে নেবে । অসংখ্য টুকরো করুন, আপনি দেখবেন যে প্রতিটি নিজের জীবন যাপন করতে পারে । এই আশায় যে বৃক্ষমূলের কয়েকটা বেশ জীবন্ত হয়ে আপনাকে আনন্দ দেবে আর আপনার মনোরঞ্জন করবে আমি এই সমগ্র সাপটিকে আপনাকে উৎসর্গ করছি ।
    আপনাকে আমার একটা সংক্ষিপ্ত স্বীকৃতি দেবার আছে । পাতা ওলটাবার সময়ে, অন্তত কুড়িবার, অ্যালোয়সিয়াস বেরত্রাঁর বিখ্যাত ‘গাসপার্ড অব দি নাইট’ ( এই বইটা কি আপনার, আমার, অজানা নয়, এবং আমাদের কয়েকজন বন্ধুর আছে “বিখ্যাত” হবার দাবি করার অধিকার আছে ? ), তেমন কিছু করার প্রয়াসের চিন্তা মাথায় এলো, প্রাচীন জীবনকে তুলে ধরার জন্য যে প্রণালী তিনি প্রয়োগ করেছিলেন, অদ্ভুতরকম ছবি তুলে ধরে, আধুনিক জীবনের, বরং আধুনিক ও বিমূর্ত জীবনযাপনের ।
    আমাদের মধ্যে কে-ই বা স্বপ্ন দেখেনি, তার উচ্চাকাঙ্খী দিনগুলোয়, কাব্যিক গদ্যের অলৌকিকতা সম্পর্কে, ছন্দ ও মিল বাদ দিয়েও যা সঙ্গীতময়, যথেষ্ট নমনীয় এবং যথেষ্ট বেসুরো, যাকে আত্মার গীতিময় প্রসারণে মানিয়ে নেয়া যায়, ভাবাচ্ছন্নতার তরঙ্গের সঙ্গে, চেতনা যে মোচড় ও বাঁকবদল করে তার সঙ্গে ?
    আমার এই ধারণার সূত্রপাত ঘটেছিল মূলত বিশাল শহরগুলোয় যাতায়াতের কারণে, তাদের সংখ্যাহীন যোগাযোগের পারস্পরিক বিভাজন থেকে । আপনি নিজেই, প্রিয় বন্ধু, আপনি কি শার্শি বসানোর ফেরিঅলার কানফাটানো চিৎকারকে গানে অনুবাদ করার জন্য উৎসাহিত হননি, তাদের ওপরদিকের জানালার উদ্দেশ্যে ছোঁড়া দুঃখি চিৎকারকে গীতিময় গদ্যে প্রকাশ করতে চাননি, পথের সবচেয়ে উঁচু কুয়াশা ভেদ করে যা উঠে যায় ?
    কিন্তু, সত্যি কথা বলতে, আমি ভীত যে আমার ঈর্ষা আমাকে সৌভাগ্য দেয়নি । একবার লিখতে আরম্ভ করে, আমি আবিষ্কার করলুম যে আমার রহস্যময় ও মেধাবী কাঠামো থেকে আমি অনেক দূরে অবস্হান করছি, কিন্তু আমি কিছু সৃষ্টি করছিলুম ( যদি একে “কিছু” বলা যায় ) যা একেবারে আলাদা, একটি দুর্ঘটনা যাতে অন্য যে কেউ গর্ববোধ করার কারণ খুঁজে পেতো, কিন্তু যা কেবল গভীর অপমান ঘটাতে পারে এমন একজনের ক্ষেত্রে, যে মনে করে কবির সবচেয়ে বড়ো সন্মান হলো যা করার পরিকল্পনা করেছিল তার সঠিক প্রাপ্তি ।
    সস্নেহে আপনার
    শা.ব.
  • Malay Roychoudhury | ০৮ জুন ২০১৯ ১৮:৫৩383629
  • প্যারিস স্প্লিন : শার্ল বদল্যার
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    এক
    সেই বিদেশি
    “রহস্যময় পুরুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো ? তোমার বাবা,
    তোমার মা, তোমার বোন না তোমার ভাইকে ?”
    “আমার বাবা নেই, মাও নেই, বোন নেই, ভাই নেই।”
    “তোমার বন্ধুবান্ধব ?”
    “এই যে তুমি একটা শব্দ ব্যবহার করলে তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝিনি।”
    “তোমার দেশ?”
    “আমি জানি না কোন দ্রাঘিমায় তা অবস্হিত ।”
    “সৌন্দর্য ?”
    “আমি যেচে তাঁকে ভালোবাসবো, তিনি ঈশ্বরী ও অবিনশ্বর।”
    “সোনা ?”
    আমি তা ঘৃণা করি যেমন ঈশ্বরকে তুমি ঘৃণা করো ।”
    “আচ্ছা, তাহলে কীই বা তুমি ভালোবাসো, বিস্ময়কর আগন্তুক ?
    “আমি ভালোবাসি মেঘ...যে মেঘ ভেসে যাচ্ছে...ওপরে ওইখানে...ওপরে ওইখানে…
    বর্ণনাতীত মেঘমালা !”

    দুই
    বুড়ির বিষাদ
    ছোটোখাটো লোলচামড়া বুড়ি ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে আহ্লাদিত হলেন, যাকে নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত, যাকে সবাই খুশি করতে চাইছিল ; ওনার মতনই পলকা এই সুন্দর প্রাণী, ছোট্ট বুড়ি, আর --- তাঁরই মতন -- দাঁত আর চুলহীন ।
    উনি বাচ্চাটার কাছে গেলেন, তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি আর হাসিখুশি মুখ দেখাতে চাইলেন ।
    কিন্তু বাচ্চাটা জীর্ণ ভালো বুড়ির আদরে ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো, আর সারা বাড়ি নিজের কাঁদুনি দিয়ে ছেয়ে ফেললো ।
    তখন ভালো বুড়িটি ফিরে গেলেন নিজের শাশ্বত একাকিত্বে, এককোনে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন, নিজেকে শুনিয়ে বললেন :
    “আহ, আমাদের মতন অবজ্ঞেয় বুড়িদের জন্য, নিষ্পাপদের আনন্দ দেবার যুগও চলে গেছে ; আর যে শিশুদের আমরা ভালোবাসতে চাই তাদের মনে আতঙ্ক জাগিয়ে তুলি !”

    তিন
    শিল্পীর পাপস্বীকার
    ওহ, হেমন্তের শেষ দিনগুলো কতো কাঁটা ফোঁটায় -- এমন ফোটায় যে ব্যথার সীমায় পৌঁছে যায়!
    কেননা, তৃপ্তিকর সংবেদগুলোর মধ্যে এমন কয়েকটা আছে, যাদের অনির্দিষ্টতা প্রাচুর্যকে বাদ দিতে পারে না ; আর অনন্ত ছাড়া অন্য কোনও ক্ষুরধার বিন্দু নেই ।
    সমুদ্র ও আকাশের বিশালতার দিকে নিজের চাউনিকে সাঁতরাতে দেয়া যে কি আনন্দময় ! নৈঃশব্দ, একাকীত্ব, ওই আশমানি রঙের অতুলনীয় কৌমার্য ! দিগন্তে কাঁপছে এক ছোটো পর্দা, আর, তার ক্ষুদ্রতা ও নিঃসঙ্গতায়, প্রতিবিধানের অসাধ্য আমার অস্তিত্বকে অনুকরণ করে, ঢেউদের একঘেয়ে সঙ্গীত -- এই সবকিছুই আমার মাধ্যমে চিন্তা করে, কিংবা তাদের মাধ্যমে আমি ( কেননা, এই ভাবাবেশের মহনীয়তায়, ওই “আমি” দ্রুত হারিয়ে যায় ) ; ওরা মনে করে, আমি বলতে চাই, কিন্তু তা গানে, ছবি আঁকায়, কোনোরকম তর্ক, ন্যায়সিদ্ধান্ত, ব্যবকলন ছাড়াই ।
    কিন্তু এই চিন্তাগুলো, তা আমার মধ্যে থেকে আসুক বা বিভিন্ন বস্তু থেকে উৎসারিত হোক, দ্রুত ঐকান্তিক হয়ে ওঠে । যখন তেজোময়তা মেশে ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে, তা থেকে জন্মায় এক অসুস্হতা এবং এক উপকারক যন্ত্রণা । আমার অত্যধিক পীড়িত স্নায়ু কেবল কটু আর দুঃখময় কাঁপন জাগিয়ে তোলে । আর এখন আকাশের গভীরতা আমাকে বিক্ষুব্ধ করে, স্হবিরতা আমাকে উত্যক্ত করে । সমুদ্রের উদাসীনতা, দৃশ্যের অপরিবর্তনীয়তা আমাকে বিতৃষ্ণ করে...। ওহ, সারাজীবন কি কাউকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, নাকি সৌন্দর্য থেকে চিরকাল পালিয়ে বেড়াতে হবে ? প্রকৃতি, হে নির্দয় মোহিনী, তুমি সব সময়ে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী, আমাকে একা থাকতে দাও!
    আমার আকাঙ্খা আর আমার গর্ববোধকে জাগিয়ে তুলো না ! সৌন্দর্যের পাঠ হলো এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ, যা শেষ হয় হেরে যাবার আগে শিল্পীর কান্নামাখা ত্রাসে ।

    চার
    একজন ভাঁড়
    তখন ছিল নববর্ষের বিস্ফোরণ ; কাদা আর তুষারের বিশৃঙ্খলা, হাজার ঘোড়ার গাড়ির চাকায় মাড়ানো, খেলার জিনিশ আর মোমবাতিতে ঝিলমিলে, লোভী কামনা আর বিষাদে একাকার, এক মহান শহরের অনুমোদিত বিকার, সবচেয়ে দৃঢ় নিঃসঙ্গের মনকেও বিরক্ত করার জন্যে পরিকল্পিত ।
    এই হইচই আর আওয়াজের মাঝে, চাবুকে হাতে এক গেঁয়ো লোকের ধাতানি খেয়ে, একটা গাধা টগবগিয়ে ভিড়ে ঢুকে গেলো ।
    গাধাটা যখন রাস্তার বাঁক নিতে চলেছে, একজন সাজগোজ করা ভদ্রলোক, হাতে সুন্দর দস্তানা, পালিশ খাওয়া চেহারায় আর চুলে তেল দিয়ে, নিষ্ঠুরভাবে নেকটাই বেঁধে আর নিজের নতুন পোশাকে বন্দী, নম্র প্রাণীটার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণত হলেন আর , নিজের হ্যাট নামিয়ে বললেন, “আমি আপনার সুস্বাস্হ্য এবং আনন্দ কামনা করি !” তারপর, বন্ধুবান্ধব যারা তাঁর পেছনে আসছিল তাদের দিকে বোকার মতন তাকালেন, যেন আত্মতৃপ্তির জন্য তাদের অনুমোদন চাইছেন ।
    গাধাটা এই অসাধারণ ভাঁড়কে দেখতেই পেল না, আর যেদিকে তার কাজ সেই দিকে একান্তভাবে টগবগিয়ে যেতে লাগল ।
    যদি আমার কথা ধরা হয়, আমি আচমকাই এই অসাধারণ মূর্খের প্রতি বাঁধভাঙা ক্রোধে আক্রান্ত হলুম, যাকে দেখে আমার মনে হল সে ফরাসিদেশের আত্মা।

    পাঁচ
    যুগল ঘর
    স্বপ্নের মতন এক ঘর, একটা ঘর যা সত্যই জগৎ-বহির্ভূত, যার স্হির আবহাওয়া ফিকে গোলাপি আর নীল ।
    সেখানে আত্মা স্নান করে আলস্যে, সুগন্ধিত হয়ে আছে অনুশোচনা ও কামনায় । -- ব্যাপারটা সন্ধ্যাকালের, কিছুটা নীলাভ, গোলাপি ; গ্রহণের সময়কার এক ইন্দ্রিয়ময় স্বপ্ন ।
    আসবাবের গড়ন লম্বাটে, শোয়ানো, দুর্বল । মনে হয় আসবাবগুলোও স্বপ্ন দেখছে ; তাদের জীবনে যেন রয়েছে ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলার ক্ষমতা, উদ্ভিদ আর খনিজের মতন । পর্দারা মৌনভাষায় কথা বলছে, ফুলের মতন, আকাশের মতন, সূর্যাস্তের মতন । দেয়ালে কোনো শৈল্পিক জঘন্যতা নেই । বিশুদ্ধ স্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করলে, অবিশ্লেষিত প্রভাবসহ, একটি নির্দিষ্ট এবং ইতিবাচক শিল্প হল ঈশ্বরনিন্দা । এখানে সবকিছুরই রয়েছে যথেষ্ট স্পষ্টতা, আর সেই সঙ্গে ঐকতানের রুচিকর দুর্বোধ্যতা ।
    অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বেছে নেয়া পরিমেয়ভাবে ক্ষুদ্র এক সুগন্ধ, হালকা আর্দ্রতার সঙ্গে মেশানো, এই বাতাবরণের মাঝ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, যেখানে এক উষ্ণীকৃত ঘরের সংবেদনের মাঝে দোল খাচ্ছে ঘুমন্ত আত্মা । বিছানার সামনে আর জানালায় মসলিন পরম প্রাচুর্যে দুলে ওঠে ; নিজেকে ছড়িয়ে দেয় তুষারপ্রপাতের মতন । এই বিছানায় শুয়ে আছেন এক প্রতিমা, স্বপ্নের রানি। কিন্তু কেনই বা তিনি এখানে ? কে তাঁকে এনেছে ? কোন ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা তাঁকে এই ভাবাচ্ছন্ন ও ইন্দ্রিয়সুখী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছে ?
    কীই বা তাতে আসে-যায় : উনি তো রয়েছেন ! আমি ওনাকে চিনতে পারছি ।
    হ্যাঁ, এই চোখদুটি তাদের আগুন দিয়ে সন্ধ্যাকে ছিন্ন করে ; এই তনুকৃত ও ভয়ঙ্কর চোখদুটি, তাদের আতঙ্কজনক অশুভ কামনাকে আমি শনাক্ত করতে পারি । তারা আকর্ষণ করে, তারা বশে আনে, কারোর হঠকারী চাউনি যদি তার প্রতি মনোযোগ দেয় তাহলে তাকে গিলে খেয়ে ফ্যালে । আমি অনেকসময়ে নিরীক্ষণ করেছি, কৌতূহল ও বিস্ময়ের দাবিদার এই দুটি কালো নক্ষত্রকে ।
    কোন সেই দয়ালু দানব যার কাছে এরকম রহস্য, স্তব্ধতা, শান্তি আর সুগন্ধে আচ্ছাদিত থাকার জন্য আমি ঋণী ? হে স্বর্গসুখ ! যাকে আমরা সাধারণত বলি জীবন, এমনকি তার আনন্দময় প্রাচুর্যের সময়ে, আমি এখন যে পরম জীবনের কথা জানি, তার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই, আর আমি তা সেকেণ্ডের পর সেকেণ্ড, মিনিটের পর মিনিট উপলব্ধি করি !
    না ! আর কোনও সেকেণ্ড নেই, কোনও মিনিট নেই ! সময় উধাও হয়ে গেছে ; এখন অনন্তের শাসন, অনন্তকালীন পরমানন্দ !
    কিন্তু এক মৃদু, ত্রাসময় কড়া নাড়ার আওয়াজ দরোজায় শুনলুম এবং, যেমন নারকীয় স্বপ্নে ঘটে থাকে, আমার মনে হল আমার পেটে কুঠারাঘাত করা হয়েছে । তারপর প্রবেশ করল এক অপচ্ছায়া । সে বিচারকের প্রতিনিধি, আইনের নামে আমাকে নির্যাতন করতে এসেছে ; একজন নোংরা উপপত্নী “বিপর্যয়ের” কান্না কাঁদতে এসেছে আর নিজের জীবনের তুচ্ছতার সঙ্গে জুড়তে এসেছে আমার দুঃখ ; কিংবা হয়তো কোনো সংবাদপত্র সম্পাদকের স্যাঙাত পাণ্ডুলিপির বাকি অংশ চাইতে এসেছে।
    স্বর্গীয় ঘরখানা, প্রতিমা, স্বপ্নের রানি, মহান রেনে শাতোব্রিয়োঁ যেমন বলেছেন ‘সিলফাইড’-এর কথা -- যাবতীয় ইন্দ্রজাল মিলিয়ে গেল অপচ্ছায়ার নির্দয় কড়া নাড়ার দরুন ।
    আতঙ্কজনক ! এখন আমার মনে পড়েছে ! মনে পড়েছে ! হ্যাঁ ! এই জঘন্য বাসা, অনন্তকালীন একঘেয়েমির এই বাসা, আসলে আমারই । সেই একই বোকা আসবাবপত্র, ধুলোমাখা, বিধ্বস্ত; তাপ পোয়াবার আগুনহীন, এমনকি স্ফূলিঙ্গও নেই এমন চিমনি, থুতু-গয়েরে নোংরা ; লজ্জাকর জানালা, যার ওপরে ধুলোয় দরানি এঁকেছে বৃষ্টি ; পাণ্ডুলিপি, মুছে-ফেলা বা অসম্পূর্ণ ; ক্যালেণ্ডার, যার ওপরে কাজ নিষ্পন্ন করার ভীতিকর তারিখগুলোতে পেনসিল দাগানো!
    আর সেই ভিনজগতের সুগন্ধ যা আমার অভিজাত সংবেদনকে আচ্ছন্ন করতো, হায়, তার জায়গা নিয়েছে তামাকের সঙ্গে মেশানো, ঈশ্বরই জানেন কোন বমি উদ্রেককারী ছত্রাকের পূতিগন্ধ। এখন, এখানে, তুমি নিঃশ্বাস নেবে কেবল নিঃসঙ্গতার বাসি জীর্ণতা ।
    এই জগতে, এতো ঘিঞ্জি তা সত্বেও বিতৃষ্ণায় ঠাশা, কেবল একটি পরিচিত জিনিশই আমার দিকে তাকিয়ে হাসে : আফিমের শিশি , একজন পুরোনো আর ভয়ঙ্কর বন্ধু ; আর সব বন্ধুই যেমন হয়, হায়, আমাকে আদর করতে আর বিশ্বাসঘাতকতা করতে উদারচিত্ত ।
    ওহ, হ্যাঁ ! সময় ফিরে এসেছে ; সময় এখন রাজার মতন সাম্রাজ্য চালায় ; আর বীভৎস বুড়োটার সঙ্গে আসে স্মৃতি, আফশোষ, আক্ষেপ, ভয়, উদ্বেগ, দুঃস্বপ্ন, ক্রোধ আর স্নায়বিক পীড়ার দানবেরা ।
    আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি যে মিনিটগুলো এখন শক্তিমত্তায়, সমারোহে ঘনঘোর, এবং প্রতিটি, ঘড়ি থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে, বলে : “আমিই জীবন, অসহ্য, অপ্রশম্য জীবন!”
    মানবজীবনে একটিমাত্র মিনিট থাকে যার উদ্দেশ্য হল সুসংবাদ ঘোষণা করা, যে সুসংবাদ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এক অনির্বচনীয় ভয়কে প্ররোচিত করে ।
    হ্যাঁ ! সময় রাজত্ব করে ; সে তার নৃশংস স্বৈরাচারকে দৃঢ়ভাবে জাহির করেছে । আর সে আমাকে ঠেলে নিয়ে যায়, তার দুদিকে ধারালো লাঙল টেনে-টেনে, যেন আমি একটা বলদ : “ চলে এসো, ওহে গাধা ! গায়ের জোর খাটাও, ক্রীতদাস ! বেঁচে থাকো, ঘৃণ্য কোথাকার !”

    ছয়
    যে যার অসার দানবের পাল্লায়
    বিশাল অনুজ্বল আকাশের নীচে, পথহীন ঘাসহীন কাঁটাগাছহীন বিছুটিহীন এক ধূলিধূসরিত বির্স্তীর্ণ সমতলভূমিতে, কয়েকটা লোককে দেখতে পেলুম যারা ঝুঁকে হাঁটছিল।
    তারা প্রত্যেকে নিজের পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বিরাট দানব, এক বস্তা আটা কিংবা কয়লার মতন ভারি, কিংবা প্রাচীন রোমের পদাতিক সৈন্যের পিঠের বোঝার মতন । কিন্তু দানবিক জানোয়ারটা নিষ্ক্রিয় ছিল না ; বরং বিপরীত, সে নিজের পেশির স্হিতিস্হাপকতা আর গায়ের জোরে লোকগুলোকে জড়িয়ে ধরে কষ্ট দিচ্ছিল ; নিজের দুটো বড়ো-বড়ো দাঁড়া দিয়ে বাহকের বুক আঁকড়ে ধরেছিল ; আর তার পৌরাণিক মাথা ছিল বাহকের মাথার ওপরে , সেই আগেকার দিনের ভারি হেলমেটের মতন যা প্রাচীন যোদ্ধারা পরে মনে করত যে সেটা শত্রুদের মনে ভয় জাগিয়ে তুলবে ।
    তাদের মধ্যে থেকে একজন লোককে আমি জিগ্যেস করলুম, এই রকম অবস্হায় তারা কোথায় যাচ্ছে । সে বলল যে সে কিছুই জানে না, সেও জানে না অন্যেরাও জানে না ; কিন্তু তারা কোথাও যাচ্ছে, কেননা তারা হাঁটবার অপ্রতিরোধ্য প্রয়োজন-তাড়িত ।
    চোখে পড়ার মতন কৌতুহলজনক : এই পর্যটকদের কাউকে দেখেই মনে হচ্ছিল না যে এক ভয়ঙ্কর জানোয়ার তার গলা জড়িয়ে রয়েছে আর পিঠের ওপরে ঝুলে আছে বলে তার অসুবিধা হচ্ছে ; যেন প্রত্যেকে মনে করছে সেটা তার দেহের অংশ ।
    এই সমস্ত পরিশ্রান্ত, গম্ভীর মুখগুলো কোনও বিষাদ ব্যক্ত করছে না ; আকাশের বিষণ্ণ গম্বুজের তলায়, আকশের মতোই নিরানন্দ ধূলিধূসর মাটিতে পা পুঁতে, তারা পরাজিত মুখে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে গেল সেই সব লোকের মতন যারা চিরকালীন আশায় দণ্ডপ্রাপ্ত ।
    পুরো দলটা আমার পাশ দিয়ে চলে গেল, তাড়াতাড়ি মিলিয়ে গেল আবছা দিগন্তে, সেই দিকে যেখানে গ্রহের গোলাকার পাটাতন মানুষের কৌতূহলময় দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যায়।
    এবং কয়েক মিনিটের জন্য আমি জেদের সঙ্গে রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করলুম ; কিন্তু তখনই এক অপ্রতিরোধ্য উদাসীনতা আমার ওপর ভেঙে পড়ল, আর ওই লোকগুলো যে অলীক দানবের ভারি ওজনে নুয়ে পড়েছিল তার চেয়েও ভারি বোঝার ভার আমার ওপর চেপে বসল।

    সাত
    মূর্খ এবং প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী
    কি সুন্দর দিনটা ! সূর্যের জ্বলন্ত চোখের তলায় বিশাল বাগানটা বিবর্ণ হয়ে উঠল, যেমনটা যৌবনে ঘটে প্রেমের প্রভূত্ববিস্তারে ।
    বস্তুজগতের সর্বব্যাপী আহ্লাদ কোনও শব্দের দ্বারা অভিব্যক্ত হচ্ছিল না ; মনে হচ্ছিল জলরাশিও নিজেরা ঘুমিয়ে পড়েছে । মানুষের উৎসবাদির থেকে একেবারে আলাদা, এখানে মহোৎসব ছিল নৈঃশব্দের ।
    যেন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া আলো, বস্তুদের আরও বেশি ঝিলমিলে করে তুলছিল ; যেন উত্তেজিত ফুলগুলো, আকাশের নীলাভের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, স্বকীয় রঙের তেজপূঞ্জ দিয়ে নিজের আকাঙ্খায় পুড়ছিল, আর যেন উত্তাপ সুগন্ধকে করে তুলছিল দৃষ্টিগোচর, বাষ্পের মতন নক্ষত্রদের দিকে উড়ে যাবার কারণ হয়ে উঠছিল ।
    যাইহোক, এই সর্বজনীন আমোদপ্রমোদের মাঝে, আমার চোখে পড়ল এক দুর্দশাগ্রস্ত প্রাণী।
    প্রেমের অতিকায় অধিষ্ঠাত্রীদেবীর পায়ের কাছে, রাজাকে আনন্দ দেবার কাজে আত্মনিয়োজিত ভাঁড়েদের মধ্যে সেই সব কৃত্রিম মুর্খদের একজন, যখন কিনা আত্মগ্লানি কিংবা বিষাদ তাদের মুক্ত করতে পারত, রঙচঙে, হাস্যকর পোশাক পরার ফাঁদে পড়ে, মাথায় শিঙ আর ঘণ্টা, বেদিতে হেলান দিয়ে অশ্রুভরা চোখ মেলে ধরল অবিনশ্বর ঈশ্বরীর দিকে।
    আর তার চোখ বলল : “আমি মানবসমাজে ক্ষুদ্রতম এবং অত্যন্ত একা, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব থেকে বঞ্চিত, আর তাই ত্রুটিপূর্ণ পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট। কিন্তু তবু আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আমিও, যাতে অবিনশ্বর সৌন্দর্যকে উপলব্ধি ও অনুভব করতে পারি ! আহ, ঈশ্বরী ! আমার দুঃখ ও উন্মাদনার প্রতি দয়া করো !”
    কিন্তু অপ্রশম্য অধিষ্ঠাত্রীদেবী শ্বেতপাথরের চোখ মেলে কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, আমি জানি না কিসের দিকে, দূরে ।

    আট
    কুকুর আর শিশি
    “আমার চমৎকার কুকুর, আমার ভালো কুকুর, আমার ছোট্ট কুকুর, এখানে এসো আর গন্ধ শোঁকো অত্যুৎকৃষ্ট সৌরভের, শহরের শ্রেষ্ঠ সৌরভ প্রস্তুতকারকের কাছে কেনা।”
    কুকুরটা ল্যাজ নাড়ালো, যে ইঙ্গিত, আমি মনে করি, নগণ্য প্রাণীদের মধ্যে থাকে, যারা জোরে বা মৃদু হাসি পাবার যোগ্য, এগিয়ে এলো, কৌতূহলের সঙ্গে ভিজে নাক খোলা শিশিতে ঠেকালো -- আর তক্ষুনি, ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে, আমাকে উদ্দেশ্য করে ঘেউঘেউ করল, যেন ভর্ৎসনা করছে।
    “আহ, তুই বোকা কুকুর, তোকে যদি আমি এক প্যাকেট গু দিতুম, তুই আনন্দে তার গন্ধ শুঁকতিস আর হয়তো খেয়েও নিতিস । এই প্রসঙ্গে আমি তোকে শ্রদ্ধা করি, আমার যন্ত্রণাময় জীবনের অযোগ্য সহচর, জনসাধারণের মতনই তুই, যাদের চটিয়ে দেবে এমন মিহি সৌরভ কখনও উপহার দেয়া যায় না, তার বদলে তাদের দাও গোবর, ভালোভাবে বাছাই করে।”

    নয়
    জানালায় কাচ বসাবার খারাপ কর্মী
    এমন অনেক বিশেষ চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব আছে, কাজের একেবারে অযোগ্য, যারা তা সত্বেও অনেকসময়ে, কোনো রহস্যময়, অজানা প্রেরণার বশীভূত হয়ে, এমন দ্রুতির সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে যে তারা নিজেরাই বিশ্বাস করবে না অমন ক্ষমতার তারা যোগ্য।
    এই ধরনের লোক যে, দারোয়ান তাকে কোনো হয়রানির খবর দেবে, ভেতরে ঢোকার সাহস যোগাতে না পেরে ঘণ্টাখানেক যাবত নিজের দরোজার বাইরে ভীতুর মতন উঁকিঝুঁকি মারে;
    সেই ধরণের লোক যে একটা চিঠিকে দুই সপ্তাহ যাবত খোলে না, কিংবা কোনো নির্ণয় নিতে ছয় মাস নেয় যখন কিনা কাজটা পুরো করতে এক বছর লাগবে -- তারপর সে নিজেকে আচমকা আবিষ্কার করে যে কোনো বিবেচনাহীন কাজ তড়িঘড়ি করতে চলেছে, ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীরের মতন । নীতিবাদী এবং চিকিৎসক, যাঁরা সবজান্তার ভান করেন, এই আচমকা উন্মাদ কর্মশক্তির উৎসের ব্যাখ্যা দিতে পারেন না, যা জেগে ওঠে অলস, সংবেদনময় চরিত্রে, আর কেমন করে, অত্যন্ত সরল ও জরুরি কাজ করার অযোগ্যতা সত্বেও, তারা কোনও মুহূর্তে অসম্ভব এমনকি বিপজ্জনক কাজ করার ঝুঁকি নিয়ে ফ্যালে ।
    আমার বন্ধুদের একজন, অতিনিরীহ স্বপ্নদ্রষ্টা, একবার জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল যাতে ও দেখতে পায়, ও বলেছিল, যে লোকজন যেমন বলে থাকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সে কথা সত্যি কিনা তা পরখ করতে চায় । পরপর দশবার, তা ঘটেনি ; কিন্তু এগারোবারের সময়ে তা ভালোভাবে ঘটেছিল ।
    আরেকজন বারুদের বাক্সের পাশে বসে সিগার জ্বালাতো, কেবল দেখার জন্য, যাতে ও জানতে পারে, অদৃষ্টকে লোভ দেখাবার জন্য, নিজের কাছে প্রমাণ করার জন্য, যে একজন জুয়াড়ির উদ্দীপনা তো ওর আছে, যা থেকে ও উদ্বেগের আনন্দ নিতে পারে, কিংবা অকারণেই, খেয়ালখুশিতে, অন্য কোনো কাজ হাতে নেই বলে ।
    এই ধরণের কর্মক্ষমতা একঘেয়েমি আর দিবাস্বপ্ন থেকে উৎসারিত হয় ; আর যাদের জীবনে তা অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা দেয় তারা সাধারণত, যেমন আগেই বলেছি, সবচেয়ে শ্রমবিমুখ আর অলীক-কল্পনা করার প্রাণী । আরেকজন, অন্যেরা তার দিকে তাকালে চোখ নামিয়ে নেয় এমন ভীরু, মনের সমস্ত জোর খাটিয়ে কফিহাউসে ঢোকে কিংবা নাট্যমঞ্চকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, যেখানে ওর মনে হয় যে টকিট বিক্রেতারা গ্রিক পুরাণের মিনোস, এজিনার রাজা ইকস, আর মৃতদের বিচারক রাদামানথুসের মতন ডাঁটে বসে থাকে, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে রাস্তায় ওর পাশ দিয়ে যেতে থাকা একজন বৃদ্ধের গলা আঁকড়ে ধরবে, আর অবাক পথচারীদের সামনে অতিউৎসাহে তাকে আলিঙ্গন করবে । কেন ? কারণ...কেননা সেই বিশেষ চেহারা তার কাছে দুর্নিবার আকর্ষক মনে হয়েছিল বলে ? হয়তো ; কিন্তু এ কথা অনুমান করা বেশি ন্যায়সঙ্গত যে সে নিজেই তার কারণ জানত না ।
    আমি এক বারের বেশি এই ধরণের সঙ্কট এবং উত্তেজনার শিকার হয়েছি, যা আমাদের বিশ্বাস করায় যে আমাদের মধ্যে অশুভ দানবেরা চুপিচুপি ঢুকে পড়ে, আমাদের তেমন কাজকর্ম করতে বাধ্য করে, যা আমাদের অজানা, তাদের বিদকুটে ইচ্ছেগুলোকে পুরণ করার জন্য ।
    একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠলুম, খারাপ মেজাজে, হতোদ্যম, আমার আলস্যে বিরক্ত, আর তাড়িত, আমার মনে হল, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু করি, কোনও সুন্দর কাজ ; আর, হায়, জানালা খুললুম !
    ( অনুরোধ করছি, আপনি লক্ষ করুন, লোকজনের সঙ্গে মজা করার উৎসাহ ভাবনাচিন্তার কিংবা সচেতন পরিকল্পনা নয় বরং আকস্মিক প্রেরণা, আর তার সঙ্গে লাগোয়া, উৎসাহবাহিত আকুলতা, যে ঠাট্টা-ইয়ার্কিকে চিকিৎসকরা বলেন বায়ুরোগ আর যাঁরা চিকিৎসকদের তুলনায় আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন তাঁরা বলেন শয়তানি, যা আমাদের অনুপ্রাণিত করে, প্রতিরোধহীন, অসংখ্য জঘন্য কাজ করতে ।) জানলা খুলে রাস্তায় প্রথম যে লোকটাকে দেখলুম সে ছিল একজন কাচের শার্শি বদলকারী, যার বেসুরো চিল চিৎকার প্যারিসের ঘন, দুর্গন্ধিত বাতাস ভেদ করে উঠে এলো আমার কাছে । বলা একেবারে অসম্ভব যে ওই বেচারা লোকটাকে দেখে আমার মন ঘৃণায় ভরে গেল, যা ছিল আকস্মিক আর সেই সঙ্গে হুকুমকারীর মতন । “ওহে ! ওহে !” আমি ওকে ওপরে আসতে বললুম । সেই ফাঁকে ভাবলুম, বেশ মজা করা যাবে, আমার ঘরটা সাত তলায় আর সিঁড়িটা বেশ অপ্রশস্ত হওয়ায়, ওপরে উঠে আসতে লোকটার বেশ খাটুনি হবে, আর ওঠার পথে ওর ঠুনকো জিনিশপত্র নানা জায়গায় ধাক্কা খাবে ।
    শেষ পর্যন্ত লোকটা এলো : আমি খুঁটিয়ে ওর শার্শিগুলো দেখলুম, আর ওকে বললুম, “কী ? তোমার কাছে রঙিন কাচ নেই ? গোলাপি কাচ নেই, লাল নেই, নীল নেই, ঐন্দ্রজালিক শার্শি নেই, স্বর্গের শার্শি নেই ? বেহায়া মূর্খ কোথাকার ! তুমি গরিবদের পাড়ায়-পাড়ায় ফিরি করে বেড়াচ্ছ অথচ জীবনকে সুন্দর করে তোলে এমন শার্শি নেই !” আমি ওকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে দিলুম, যেখানে ও থমকে দাঁড়িয়ে ঘোঁতঘোঁত করল ।
    আমি বারান্দায় ফিরে গিয়ে ফুলের একটা ছোট গামলা তুলে নিলুম, আর লোকটাকে যখন নীচে সিঁড়ির বাইরে বেরোতে দেখলুম, আমি আমার যুদ্ধাস্ত্র সোজা নীচে ফেলে দিলুম ওর পিঠের বস্তার ওপর ; ধাক্কায় ও পেছনে হেলে পড়ে গেল, আর তার ফলে ভেঙে ফেলল, নিজের পিঠের চাপে, ওর সমস্ত মর্মন্তুদ ভ্রাম্যমান ঐশ্বর্য, স্ফটিকের তৈরি প্রাসাদে বিদ্যুৎ পড়ার মতন জাঁকালো আওয়াজ করে ।
    আর নিজের উন্মাদনায় মাতাল, আমি লোকটার উদ্দেশে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠলুম, “জীবনকে সুন্দর করে তোলো ! জীবনকে সুন্দর করে তোলো !”
    এই ধরণের বাজে ঠাট্টা বিপদহীন নয়, আর প্রায়ই তার জন্য বড়ো খেসারত দিতে হয় । কিন্তু যে মানুষ একটা ক্ষণের মধ্যে আনন্দের অনন্তকাল আবিষ্কার করেছে, তার কাছে অভিশপ্ত অবিনশ্বরতা কি কোনো ব্যাপার হতে পারে ?

    দশ
    দুপর একটার সময়ে
    শেষ পর্যন্ত, একা ! যা শোনা যাচ্ছে তা কেবল কয়েকটা পুরোনো, ক্লান্ত ঘোড়ার গাড়ির চাকার আওয়াজ । কয়েক ঘণ্টার জন্য, আমাদের থাকবে, আরাম না হলেও, নিস্তব্ধতা । শেষ পর্যন্ত ! আমাকে এখন ছায়ায় স্নান করার ঢিলেমি দেয়া হয়েছে ! কিন্তু প্রথমে, ঘড়িতে দুই বার চাবি দিতে হবে : আমার মনে হয় এই বাড়তি চাবি ঘোরানো আমার একাকীত্বকে বল দেবে আর জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পাঁচিলকে পোক্ত করবে ।
    ভয়ঙ্কর জীবন ! ভয়ঙ্কর শহর ! সারা দিনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক : কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হল, তাদের একজন আমাকে জিগ্যেস করলে যে স্হলপথে কি রাশিয়ায় যাওয়া যায় ( স্বাভাবিক যে ও রাশিয়াকে একটা দ্বীপ বলে মনে করেছে ) ; এক পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে অনেকক্ষণ তর্ক হল, যিনি প্রতিটি আপত্তির একটাই জবাব দিচ্ছিলেন, “এই যে, আমরা শোভনতার পক্ষে,” যার মানে দাঁড়ায় যে অন্য সব পত্রিকা চালায় বজ্জাতের দল ; প্রায় কুড়িজন লোককে শুভেচ্ছার অভিবাদন করলুম, যাদের পনেরোজনকে আমি একেবারে চিনি না ; ততোজনের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলুম, আর গ্লোভস কেনার পূর্বাহ্ণিক সতর্কতা না নিয়ে ; বৃষ্টির ঝর্ণা বাঁচিয়ে সময় কাটাবার জন্য, একজন ফালতু নর্তকীর কাছে গেলুম, যে আমার কাছে অনুনয় করল যে “ভিস-নিস” অভিনয় করার জন্য তার পোশাকটার নকশা যেন আমি তৈরি করে দিই ; একজন নাটক-পরিচালকের কাছে হাজিরা দিলুম যে বলল, আমাকে বাতিল করে, “তুমি অমুকের সঙ্গে পরিচয় করলে ভালো করবে ; ও সবচেয়ে ভোঁদা, বোকা, আর লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত, ফলে তার কাছে তুমি হয়তো কিঞ্চিদধিক গুরুত্ব পেতে পারো। ওর সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো, আর তারপর দেখা যাবে”; বেশ কয়েকটা নীচ কাজ যা আগে করিনি সে সম্পর্কে গর্ববোধ ( কেন ? ) করলুম, আর ভীতুর মতন আমার অনেক দুষ্কর্মকে অস্বীকার করলুম যেগুলো বেশ আনন্দের সঙ্গেই আমি করেছিলুম -- দম্ভোক্তি করার আহ্লাদ, মানবিক শোভনতার বিরুদ্ধে অপরাধ ; এক বন্ধুকে অনায়াস সাহায্য করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান, আর একজন পাক্কা বোকার সুপারিশ করে লিখলুম চিঠি -- উফ ! ফিরিস্তি শেষ হল ?
    সবকিছু সম্পর্কে অসন্তুষ্ট, নিজের সম্পর্কে অসন্তুষ্ট, আমি সত্যিই প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, রাতের নৈঃশব্দ ও একাকীত্বে এক চিলতে গর্ববোধ । যাদের অন্তরাত্মাকে ভালোবেসেছি, যাদের অন্তরাত্মার গান গেয়েছি, আমাকে শক্তি দেয়, সমর্থন করে, জগতসংসারের মিথ্যা ও ভ্রষ্টাচারের বাষ্প থেকে আমাকে দূরে রাখে, আর তুমি, আমার দেবতাত্মা ঈশ্বর ! কয়েকটা সুন্দর পংক্তি সৃষ্টি করার কৃপা আমাকে দাও যাতে নিজের কাছে প্রমাণ করতে পারি যে মানুষের মাঝে আমি সবচেয়ে হীন নই, আমি যাদের অবজ্ঞা করি তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট নই !

    এগারো
    অসভ্য নারী আর ছোট্টো রক্ষিতা
    সত্যি, হে প্রিয়া, তুমি আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছ ; তোমার অভিযোগগুলো দয়ামায়াহীন, বেখাপ্পা । তোমার দীর্ঘশ্বাস শুনলে, যে কেউ ভাববে ষাট বছরের বুড়ি জঞ্জাল কুড়ানির চেয়ে কিংবা সেই বুড়ি ভিখারিনীরা যারা রেস্তরাঁর দরোজার বাইরে রুটির টুকরো কুড়োয়, তাদের চেয়ে তুমি বেশি দুঃখযন্ত্রণায় ভুগছ ।
    “যদি তোমার দীর্ঘশ্বাস অন্তত অনুশোচনা প্রকাশ করত, তা তোমাকে সন্মান দিত ; কিন্তু তা কেবল ফাঁস করে দেয় যে তুমি ভালোভাবে জীবনযাপনে পরিতৃপ্ত, আর তুমি অতিরিক্ত বিশ্রাম করে হাঁপিয়ে পড়েছ । আর তারপর, তোমার বকবকানির স্রোত থামে না : ‘আমাকে বেশি করে ভালোবাসো ! আমি তা ভীষণভাবে চাই ! আমাকে এইভাবে সান্ত্বনা দাও, সেইভাবে আদর করো।’ দ্যাখো, আমি চেষ্টা করছি তোমার সুস্বাস্হ ফিরে আসুক ; আর হতে পারে যে আমরা তার উপায় বের করে ফেলব, কাছাকাছি কোনো মেলায় গিয়ে দুটাকা খরচ করে।
    “দয়া করে, বিবেচনা করো, যে লোহার শক্তপোক্ত খাঁচার ভেতরে বসে, পতিতের মতন খ্যাঁকখ্যাঁক করে, নির্বাসনে পাগল ওরাঙওটাঙের মতন খাঁচার গরাদ নাড়িয়ে, বাঘের পাক খাওয়ার নিখুঁত অনুকরণ করে, আর এখন শ্বেতভাল্লুকের মতন মূর্খ জবুথবু হাঁটাচলা করে, মনে হয় লোমশ দানবীর চেঁচামেচি আনেকটা তোমারই মতন ।
    “এই দানবী সেইসব জানোয়ারের অন্যতম, যাকে কেউ সাধারণভাবে ‘আমার দেবকন্যা’ বলে ডাকে! -- মানে, একজন নারী । তার সঙ্গে যে আরেকটা দানব, যার হাতে ছড়ি রয়েছে, গলার জোর খাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, একজন স্বামী । নিজের আইনসঙ্গত স্ত্রীকে জানোয়ারের মতন শেকল বেঁধে রেখেছে, আর মেলার দিনগুলোয় শহরতলিতে তাকে প্রদর্শন করে বেড়ায় -- স্বাভাবিকভাবে, অফিসারদের অনুমতি নিয়ে ।
    “সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করো ! দ্যাখো কেমন গোগ্রাসে ( হয়তো লোকদেখানো নয় ! ) রক্ষকের ছুঁড়ে দেয়া জ্যান্ত খরগোশগুলোকে আর গ্যাঁকগ্যাঁকে মুর্গিগুলোকে মেয়েটা ছিঁড়ছে । ‘রোসো’, লোকটা ওকে বলে, ‘তোমাকে সব খাবার এক বারে খেয়ে ফেলতে হবে না,’ আর এই উপদেশ দিয়ে লোকটা সতর্ক হয়ে মেয়েটার কাছ থেকে তার শিকার কেড়ে নেয়, ভয়ঙ্কর জানোয়ারটার দাঁত থেকে কিছু নাড়িভূঁড়ির টুকরো ঝুলতে থাকে -- মানে, আমি ওই নারীর কথা বলছি।
    “দ্যাখো ! মেয়েটাকে শান্ত করার জন্য ছড়ির এক সুন্দর খোঁচা ! --- কেননা মেয়েটা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে, কেড়ে নেয়া খাবারের জন্য, লালসায় ক্ষেপে গিয়ে । হায় ঈশ্বর ! ছড়িটা মঞ্চে মজা দেখাবার জন্যে নয় ; মেয়েটার মাংসে যে সপাং আওয়াজ হল তা শুনলে তো, জটপড়া নকল চুল সত্বেও ? আর মেয়েটার চোখ যেন ওর মুণ্ডু থেকে বেরিয়ে আসছে, ও এবার স্বাভাবিকভাবে চেঁচাচ্ছে । রাগের চোটে, মনে হয় ওর সারা শরীর কাঁপছে, লোহাকে পিটলে যেমন হয় ।
    “অ্যাডাম আর ইভের উত্তরসূরীদের এরকমই দাম্পত্যজীবন, তোমার আয়ত্বে এই সমস্ত কাজ, হায় ভগবান ! এই নারী সত্যিই যৎপরোনাস্তি দুঃখযন্ত্রণায় রয়েছে, যদিও, হয়তো, খ্যাতির সুড়সুড়ির আনন্দ ওর অজানা নয় । এর চেয়েও খারাপ দূরপনেয় যন্ত্রণা আছে, এবং তা ক্ষতিপূরণহীন । কিন্তু যে জগতে ওকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, ওর মনে হয়নি যে একজন নারীর এর চেয়ে আলাদা অদৃষ্ট হতে পারে ।
    “আর এবার, নিজেদের কথায় ফেরা যাক, আমার দামি প্রাণীটির দিকে ! এই জগতের লোকজন যে নরকে থাকে, তোমার বিশেষ সুন্দর নরক সম্পর্কে আমার কাছে কী আশা করো, তুমি, যে কখনও নিজের খসখসে ত্বকের তুলনায় অন্য কোনো জিনিশে হেলান দাওনি, আর যে কেবল অনুগত চাকরের রাঁধা মাংস খাও প্রতিটি গ্রাসে ?
    “আর কেমনভাবেই বা আমি এই ছোট দীর্ঘশ্বাসগুলোকে মেনে নেব যা তোমার সুগন্ধিত স্তনকে ফুলিয়ে তোলে, আমার পোক্ত ছোট্ট ছিনাল ? আর বই পড়ে জড়ো করা এই সমস্ত কৃত্রিম আচরণ, আর এই ক্লান্তিহীন বিষাদ, দর্শকের মনে দয়ার বদলে অন্য একরকমের ভাবপ্রবণতা জাগাবার চেষ্টা ? সত্যিই, আমি অনেকসময়ে ভাবি তোমাকে শিখিয়ে দিই কাকে প্রকৃত দুঃখযন্ত্রণা বলে ।
    “ আমার তুলতুলে সুন্দরী, তোমার পা কাদায় আর তোমার চোখ গাগনিকভাবে আকাশের দিকে, যেন তোমাকে একজন মহারাজা এনে উপহার দেয়া হবে, যে কেউ তোমাকে মনে করবে একটা কচি ব্যাঙ, সেই আশা পূর্ণ করার প্রয়াস করছ । যদি তুমি বর্তমান রাজাকে অবজ্ঞা করো ( যা বর্তমানে আমি, তা তুমি ভালো করেই জানো ), পরের বার যে আসবে তার সম্পর্কে সাবধান হও, সে তোমাকে চিবোবে, গিলে ফেলবে, আর নিজের ইচ্ছেমতো কোতল করবে !
    “হতে পারে আমি একজন কবি, কিন্তু তুমি যেমন ভাবছ আমাকে তেমন ঠকাতে পারবে না, আর যদি তুমি তোমার মূল্যবান কাঁদুনি গেয়ে আমাকে প্রায়ই ক্লান্ত করো, আমি তোমার সঙ্গে অসভ্য মেয়েমানুষের সঙ্গে যেমন করা উচিত তেমন ব্যবহার করব, কিংবা খালি বোতলের মতন জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলে দেবো ।”

    বারো
    ভিড়
    টবে স্নান করার মতন করে জনতার ভেতরে সবাই নিজেকে চোবাতে পারে না ; ভিড়ের মজা নেয়া হলো শিল্প ; আর কেবল সেই লোকগুলো মানবজাতির শৌর্যকে উৎসবে পরিণত করতে পারে যাদের, তাদের শৈশবের দোলনায়, একজন পরী এসে ছদ্মবেশে আর মুখোশ পরে এসে, বাড়ির প্রতি ঘৃণার, আর ভ্রমণের নেশার শ্বাস ফেলেছিল ।
    জনতা, একাকীত্ব : এই অভিধাগুলোর মর্মার্থ সক্রিয় ও বহুপ্রসূ কবির কাছে একই এবং সমভাবে বিনিমেয় । যে লোক জানে না যে তার একাকীত্বকে কেমন করে জনতা দিয়ে ভরে তুলতে হয়, সে জানতে পারবে না ব্যস্ত ভিড়ে কেমন করে একা থাকা যায় । এই অতুলনীয় সুবিধা উপভোগ করেন একজন কবি, তিনি হয়ে উঠতে পারবেন, যেভাবে তিনি চান, হয় নিজে স্বয়ং কিংবা আরেকজন । যে ভবঘুরে আত্মারা দেহের খোঁজে বেরিয়েছে, তাদের মতন, তিনি প্রবেশ করেন, যখনই তিনি চান, সকলের চরিত্রে । শুধুমাত্র তাঁর কাছে, সবকিছুই ফাঁকা, তা এইজন্যে যে তাঁর দৃষ্টিতে সেখানে যাওয়ার পরিশ্রম করার কোনো মানে হয় না যেখানে যাওয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ ।
    একা, চিন্তামগ্ন পথচারী এই সর্বজনীন অংশীদারিত্বে খুঁজে পান একক মাদকতা । যে মানুষ ভিড়কে বিয়ে করেন, তিনি অতিব্যাকুল মহানন্দ উপভোগ করেন, যা থেকে অহংকারীরা বঞ্চিত, যারা সিন্দুকের মতন তালা দেয়া, আর অলসদের ভাগ্যেও তা জোটে না, যারা ঝিনুকের মতন নিজেতেই আবদ্ধ । তিনি তাঁর কাছে ঘটণাচক্রে উপস্হাপিত যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে, সমস্ত রকমের আনন্দ আর সমস্ত দুঃখযন্ত্রণাকে নিজের করে তোলেন ।
    লোকেরা যাকে প্রেম বলে মনে করে তা এতো ক্ষুদ্র, এতো সীমাবদ্ধ, এতো দুর্বল, সেই অনির্বচনীয় মহোল্লাসের তুলনায়, আত্মার পবিত্র বেশ্যাবৃত্তি যা সম্পূর্ণ নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তার যাবতীয় কবিতা ও পরার্থবাদিতা, অভাবনীয়দের কাছে, অচেনাদের কাছে, যেমন যেমন তারা দেখা দেয় তাদের কাছে বিলিয়ে দেয় ।
    যারা এই জগতের সৌভাগ্যবান তাদের শিক্ষিত করে তোলা অনেক সময়ে ভালো, যদি তাতে তাদের মূর্খ গর্বকে ক্ষণিকের জন্য দমিয়ে দেয়া যায়, অর্থাৎ তারা যা জানে তার চেয়ে আরেক উচ্চতর আনন্দ আছে, বিশাল ও অধিকতর সংস্কৃতিসম্পন্ন । বসতের প্রতিষ্ঠাতারা, জনগণের চালকরা, জগতের সীমায় নির্বাসিত মিশনারি যাযকরা, সন্দেহ নেই যে তাঁরা এই রহস্যময় মাদকতা সম্পর্কে যৎসামান্য জানেন ; আর তাঁদের প্রতিভা থেকে তাঁদের হৃদয়ে যে বিশাল পরিবারের জন্ম হয়েছে, তাঁরা অনেক সময়ে সেই লোকগুলোকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন যারা তাদের কষ্টপূর্ণ ভাগ্য আর পবিত্র জীবন নিয়ে হাহুতাশ করে ।

    তেরো
    বিধবারা
    অভিজাত ভভেনার্গুস বলেছেন যে জনগণের বাগানে এমন সমস্ত হাঁটাপথ আছে যার ওপর নিরাশ উচ্চাকাঙ্খী, অভাগা আবিষ্কারক, ব্যর্থ সাফল্যের লোক, ভাঙা হৃদয়, ভুত চরে বেড়ায়, সেই সব বন্ধ আত্মার দল যাদের মধ্যে ঝড়ের শেষ দীর্ঘশ্বাস এখনও গুরুগুরু আওয়াজ তোলে, আর যারা হাসিখুশি ও অলস লোকেদের দুর্বিনীত চাউনি দেখে নিজেদের গুটিয়ে নেয় । এই ধরণের ছায়াময় আশ্রয়গুলো হলো জীবনে মার খাওয়া সেই সমস্ত মানুষের মিলনস্হল। তাছাড়া, কবি ও দার্শনিকরা নিজেদের প্রিয় অনুমানগুলো এই ধরণের জায়গায় যাচাই করতে চান। এখানে আছে এক বিশেষ ধরণের পুষ্টিসাধক খাবার । কেননা, যদি কোনও একটা জায়গা থাকে যেখানে তাঁরা প্রবেশ করতে ঘৃণা বোধ করেন, তা হল এইটি, যার কথা আমি বললুম, জায়গাটা হলো বৈভবের আনন্দ উপভোগ করার । এই ফাঁকা ঘনঘটায় তাঁদের আকর্ষণ করার কিছুই নেই। বরং বিপরীত, তাঁরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্যভাবে আকর্ষিত বোধ করেন তার প্রতি যা দুর্বল, ধ্বংসপ্রাপ্ত, দুর্দশাগ্রস্ত, অনাথ ।
    অভিজ্ঞ চোখ কখনও প্রবঞ্চনা করে না । এই সমস্ত অনমনীয় বা পেটানো বৈশিষ্ট্যে, এই সমস্ত শূন্য, ফ্যালফেলে চোখে, বা ধ্বস্তাধস্তির শেষ আলোয় যা তখনও দীপ্যমান, এই সমস্ত গভীর ও অসংখ্য কুঞ্চনে, এই সমস্ত শ্লথ ও ভাঙাচোরা চলনভঙ্গীতে, ক্ষণিকের মধ্যে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হয় তাদের প্রতারিত প্রেমের, অব্যাখ্যাত আত্মোৎসর্গের, ব্যর্থ প্রয়াসের, ক্ষুধার এবং মুখ বুজে সহ্য করে নেয়া শীতের অসংখ্য কিংবদন্তিগুলোকে ।
    তুমি কি কখনও লক্ষ্য করেছ ফাঁকা বেঞ্চে বসে থাকা গরিব বিধবাদের ? তারা শোকপালন না করলেও, সহজেই চেনা যায় । আর তাছাড়া, গরিবদের শোকপালনে সর্বদা কিছুর অভাব থাকে, সমন্বয়ের অনুপস্হিতি যা তাদের হৃদয়কে আরও ভেঙে ফ্যালে । তারা তাদের মর্মযন্ত্রণায় সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় । ধনীরা নিজেদের মর্মযন্ত্রণাকে সবাইকে দেখিয়ে বয়ে বেড়াতে পারে।
    কে সেই সবচেয়ে দুঃখী ও অত্যন্ত মর্মন্তুদ বিধবা, যে একজন শিশুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে সে নিজের চিন্তাধারা ভাগাভাগি করতে পারে না, নাকি যে একেবারে একা ? আমি জানি না ...। একদিন এমন হয়েছিল যে আমি অনেকক্ষণ ধরে একজন বয়স্ক, ভারাক্রান্ত দেখতে বিধবাকে অনুসরণ করছিলুম ; সে ছিল ঋজু, সোজা পিঠ, পুরোনো ছেঁড়া শালে ঢাকা দেওয়া, তার সমস্ত অস্তিত্ব থেকে নির্বিকার গর্বের ছটা প্রকাশিত হচ্ছিল । দেখে সহজে বোঝা যাচ্ছিল যে বার্ধক্যের কৌমার্যের পরম একাকীত্বের অভ্যাসে সে দণ্ডপ্রাপ্ত, আর পুরুষালী চলনভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছিল কঠোর আত্মসংযমের রহস্যময় কটূতা । আমি বলতে পারব না কোন বাজে রেস্তরাঁয় সে দুপুরের খাবার খেয়েছিল, কিংবা কেমন করে খেয়েছিল । আমি তাকে জনসাধরণের জন্য উন্মুক্ত পাঠাগার পর্যন্ত অনুসরণ করলুম ; আর যখন সে একদা কান্নায় পুড়ে যাওয়া সক্রিয় চোখ দিয়ে সংবাদপত্রে অনুসন্ধান করছিল, ব্যক্তিগত আগ্রহের কোনো জরুরি খবরের, তখন অনেকক্ষণ ধরে তার দিকে নজর রাখলুম।
    শেষ পর্যন্ত, দুপুরবেলা, হেমন্তের মনোরম আকাশের তলায়, সেই ধরণের আকাশ যেখান থেকে ঝরে পড়ে অজস্র পশ্চাত্তাপ আর স্মৃতি, সে পার্কের এক কোনায় বসে, ভিড় থেকে দূরে, শোনার চেষ্টা করছিল, প্যারিসবাসীদের প্রিয় সেনাবাহিনীর কনসার্টের সঙ্গীত ।
    সন্দেহ নেই যে এই নিষ্পাপ বুড়ির সাময়িক আমোদ ( অথবা এই বিশুদ্ধিপ্রাপ্ত বুড়ির ), বন্ধুহীন, কথাবার্তাহীন, সঙ্গীহীন, দুর্বহ দিনগুলোয়, যা ঈশ্বর তাঁর ওপরে হয়তো বহু বছর যাবত চাপিয়ে দিয়েছেন, তা সুঅর্জিত সান্ত্বনা ! বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ।
    আরেকজনের কথা :
    ভিড়ের ফালতু লোকেরা, যারা বেড়া ঠেলে কোনো প্রকাশ্য কনসার্টে ঢুকে পড়তে চায়, তাদের দিকে কৌতূহলভরে না তাকিয়ে আমি থাকতে পারি না, তা সম্পূর্ণ সমবেদী না হলেও । রাতের আনন্দের গানে, আহ্লাদের বিজয়কেতনে, অর্কেস্ট্রা ছড়িয়ে পড়ে । পোশাক পেছনদিকে ঝোলে আর ঝলমল করে, চাউনির অদলবদল হয় ; যারা অলস, কোনো কাজকর্ম না করেও জীর্ণ, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গীত উপভোগ করার শ্রমবিমুখ ভান করে । এখানে ঐশ্বর্য ছাড়া আর কিছু নেই, আনন্দধারা ব্যতীত আর কিছু নেই ; বেঁচে থাকার জন্য যে শ্বাসপ্রশ্বাস বেপরোয়া আনন্দকে উৎসাহিত করে ; কিচ্ছু নয়, ওইখানে ভিড়ের দৃশ্য ছাড়া, যারা বাইরের বেড়ায় হেলান দিয়ে আছে, বিনা পয়সায় সঙ্গীতের সামান্য রেশ শুনতে পাচ্ছে, বাতাসকে ধন্যবাদ, তারা দেখতে পাচ্ছে তাঁবুর ভেতরের ঝকমকানি ।
    গরিবের চোখে ঐশ্বর্যশালীদের আনন্দের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া সব সময়েই বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক । কিন্তু সেই দিন, এই লোকগুলো, যারা তাদের কাজকরার আঙরাখা পরে আছে, আর তাদের সুতির জামা, তাদের ছাপিয়ে আমার চোখে পড়ল এমন একজন অভিজাত মহিলার দিকে যিনি এই ঘিরে-থাকা গেঁয়োগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত । একজন ঢ্যাঙা, মর্যাদাপূর্ণ রমণী, এমন এক মহিমাময়ী চারিত্র্য যে আমি মনে করতে পারলুম না অতীতে অভিজাত সুন্দরীদের জমায়েতে এমন কাউকে দেখেছি । তাঁর উন্নত সততার সুগন্ধ উদ্ভাসিত হচ্ছিল তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব থেকে। তাঁর মুখশ্রী ছিল দুঃখী আর রোগা, শোকের যে আনুষ্ঠানিক পোশাক তিনি পরেছিলেন তার সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ খাচ্ছিল । এবং তিনিও, সাধারণ নাগরিকদের মতন, যাদের মাঝে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন আর যাদের উপস্হিতি তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না, তিনি আলোকময় জগতকে গভীর আগ্রহে অবলোকন করছিলেন, শোনার সময়ে মৃদু মাথা দোলাচ্ছিলেন।
    একটি একক দিব্যদৃশ্য ! “নিঃসন্দেহে”, আমি নিজেকে বললুম, “ওনার দারিদ্র্য, যদি তা দারিদ্র্য হয়, তার জন্য অর্থগৃধ্নুতার মিতব্যয়ীতার প্রয়োজন ছিল না ; ওই মহিমান্বিত মুখশ্রী তার প্রমাণ। কিন্তু কেনই বা উনি জেনেশুনে অমন পরিপার্শ্বের অংশ হতে চাইলেন, যার মাঝে তিনি উজ্বল বিবর্ণতার মতন দাঁড়িয়ে আছেন ?”
    কিন্তু কৌতূহলবশত যখন ওনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলুম, কারণটা আমি আঁচ করতে পারলুম। দীঘাঙ্গী বিধবাটি একটি শিশুর হাত ধরেছিলেন, তাঁর মতনই কালো পোশাকে ; ঢোকার টিকিটের দাম যুক্তিযুক্ত ছিল, সেই টাকাটা হয়তো বাচ্চাটার কোনো প্রয়োজন মেটাতে লাগবে, কিংবা, আরও ভালো হয়তো, বিলাসদ্রব্য বা খেলনা কেনা যাবে।
    আর উনি হেঁটে বাড়ি ফিরবেন, নিজের চিন্তা ও স্বপ্নে মগ্ন, একা, সর্বদা একা ; কেননা বাচ্চারা চেঁচামেচি করে, একলষেঁড়ে হয়, শান্তস্বভাব হয় না, ধৈর্যশীল হয় না ; আর একাকীত্বের দুঃখ লাঘবের জন্য বাচ্চাটা, সত্যিকার জানোয়ারের মতন, কুকুর বা বিড়ালের মতন, তাঁর অন্তরঙ্গ হতে পারে না ।

    চোদ্দ
    বুড়ো সঙ
    ছুটির দিনের ভিড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল সর্বত্র, মৌজমস্তিতে ব্যস্ত । দিনটা সেই ধরণের উৎসবের ছিল যখন রাস্তার মাদারিরা, দড়াবাজিকররা, পশুর খেলা দেখিয়েরা, ভ্রাম্যমান ফেরিঅলারা, সারা বছরের দুরবস্হাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য চিরকাল এই দিনটির ওপর নির্ভর করেছে । এই রকম দিনে আমার মনে হয় লোকেরা সবকিছু ভুলে যায়, ভালো দিনকাল আর ব্যস্ত কাজকর্ম থেকে মুক্ত ; তারা হয়ে যায় বাচ্চাদের মতন । ছোটোদের জন্য এটা একদিনের ছুটি, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য স্কুলের আতঙ্ক থেকে মুক্তি ; বড়োদের জন্য, দিনটা জীবনের অপকারী ক্ষমতার সঙ্গে ঘোষিত বোঝাপড়ার, শেষহীন সংগ্রামের বিবাদ-বিতর্ক থেকে সাময়িক আরামের। এমনকি সমাজকর্মী আর আধ্যাত্মিক শ্রমে নিযুক্ত মানুষের পক্ষেও এই সর্বাত্মক বিজয়ানন্দের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয় । অপেক্ষা না করেই, তাঁরা তাঁদের অংশের বেপরোয়া বাতাবরনে মিশে যান । আমার কথা বলতে গেলে, সত্যিকার একজন প্যারিসবাসীর মতন, আমি এই ধরণের সমারোহপূর্ণ সুযোগে পথের ধারের ঘুপচি-দোকানগুলোকে নিরীক্ষণ করতে ছাড়ি না ।
    আর তারা নিজেদের মধ্যে হইচই করে প্রতিযোগীতা করে : তারা তারস্বরে চিৎকার করে, ষাঁড়ের মতন চেঁচায়, নেকড়ের মতন ডাক পাড়ে । তা ছিল সব রকম ধ্বনির মিশেল, বাসনের ঘ্যাঙঘ্যাঙ আর বাজি ফাটাবার আওয়াজ । লাল পোশাকে সারিবদ্ধ দড়াবাজিকর আর ডিগবাজি-খাওয়া ভাঁড়েরা তাদের রোদে-পোড়া , বাতাসে, বৃষ্টিতে আর সূর্যের তাপে ক্ষয়ে যাওয়া মুখে, ভেংচি কাটছিল । আত্মবিশ্বাসী অভিনেতারা নিজেদের প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত, তারা চালাক-চতুর ঠাট্টার গল্প বলছিল, মলিয়েরের কমেডির মতন যা একঘেয়ে আর আগেই আঁচ করা যায় । পালোয়ানরা, তাদের বড়সড় অঙ্গ সম্পর্কে গর্বিত, ওরাঙওটাঙের মতন কপাল আর করোটি, আঁটোসাঁটো লোকদেখানো পোশাকে ডিগবাজি খেয়ে বেড়াচ্ছিল, আগেভাগে পোশাক কাচিয়ে নিয়েছিল । নর্তকীরা, পরী কিংবা রাজকন্যার মতন সুন্দরী, দুলছিল আর তিড়িংবিড়িং করছিল, লন্ঠনের আলোয় তাদের ঘাগরা ঝকমক করছিল । সবকিছুতেই ছিল দীপ্তি, ধুলো, চেঁচামেচি, আনন্দ, হই্হল্লা ; কিছু লোক টাকাকড়ি খরচ করল, যখন কিনা অন্যদের লাভ হলো, দুই পক্ষই সমানভাবে খুশি । বাচ্চারা মায়ের পোশাকের খুঁট ধরে লজেঞ্চুশ পাবার আশায় হাঁটছিল, কিংবা তাদের বাবার কাঁধে চেপে ম্যাজিকঅলার দেবতাসূলভ চমৎকারিত্ব দেখছিল । আর সর্বত্র, সব রকমের গন্ধ ছাপিয়ে, চর্বি ভাজার সুবাস ঘুরপাক খাচ্ছিল, যেন তা উৎসবের ধুপধুনো ।
    সবার পেছনে, দুই ধারের দোকানসারির একেবারে শেষে, যেন এই সমস্ত ঘনঘটা থেকে নিজেকে লজ্জায় নির্বাসন দিয়েছে, আমি একজন বুড়ো সঙকে দেখতে পেলুম, ঝুঁকে পড়েছে, রুগ্ন, জরাজীর্ণ, একজন মানুষের ধ্বংসাবশেষ, তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দিয়ে আছে ; কোনো বুনো বর্বরের চেয়েও ছেঁড়াখোঁড়া তাঁবু, সেখানে দুটো ফুরিয়ে-আসা মোমবাতি, দপদপ করছিল আর ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁবুর দারিদ্র্য ।
    সর্বত্র, উল্লাস আর মুনাফা আর অসংযম ; সর্বত্র কালকের খাবারের আশ্বাস ; সর্বত্র জীবনীশক্তির ব্যস্ত উচ্চরব । এখানে, চরম দুরবস্হা, পোশাক পরানো দুরবস্হা, যাতে আতঙ্ককে তীব্রতর করা যায়, হাস্যকর কাঁথায়, যে অবস্হায় শিল্পের তুলনায় প্রয়োজন তৈরি করেছে বৈপরীত্য । লোকটা, দীনদরিদ্র, হাসেনি ! লোকটা ফোঁপায়নি, লোকটা নাচেনি, লোকটা অঙ্গভঙ্গী করেনি, লোকটা চেঁচায়নি ; লোকটা কোনো গান গায়নি, তা সে মজার হোক বা দুঃখের ; লোকটা ভিক্ষা চায়নি । লোকটা ছিল চুপচাপ আর স্হির । লোকটা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, লোকটা অধিকার ত্যাগ করে দিয়েছিল । ওর নিয়তি ছিল নিশ্চিত । কিন্তু ভিড় আর আলোর স্পন্দিত জোয়ার ওর বীভৎস দারিদ্র্যের কয়েক পা দূরত্বে এসে থেমেছিল, ওর চাউনি ছিল গভীর জ্ঞানপূর্ণ, ভোলা যায় না এমন ! আমি অনুভব করলুম আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে বায়ুরোগের ভয়ঙ্কর প্রকোপে, আর আমি অনুভব করলুম যে আমার নিজের দৃষ্টি দ্রোহের কান্নায় মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেছে যা থেকে অশ্রু ঝরবে না ।
    তাহলে কীই বা করি ? ছেঁড়া পর্দার পেছনে, অভাগা লোকটাকে যদি জিগ্যেস করি যে এই ছায়ার আড়ালে আমাকে দেখাবার মতন কোন আশ্চর্য , কোন কৌতূহল-জাগানিয়া ব্যাপার আছে, তাতে কী উপকার হবে ? আর সত্যি বলতে, আমার সাহস হলো না ; আর যদিও আমার ভীতির কারণ শুনে তুমি হাসবে, আমি দিব্বি করে বলতে পারি যে আমার ভয় করছিল লোকটাকে অপমান করে ফেলব । শেষ পর্যন্ত, নিজেকে বুঝিয়ে, আমি ঠিক করলুম যে লোকটার পাটাতনের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে কিছু টাকা তার ওপর রেখে দেব, এই আশায় যে সে আমার অভিপ্রায় হৃদয়ঙ্গম করবে, অথচ সেই সময়েই কোনো অজানা উৎসাহের আকস্মিক ঢেউয়ে ভিড়ের ঠেলায় আমি ওর থেকে অনেকটা দূরে চলে এলুম ।
    আর, বাসায় ফেরার পথে, এই দৃশ্যের আচ্ছন্নতায়, আমি আমার আকস্মিক দূঃখকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলুম, আর নিজেকে বললুম : আমি এক্ষুনি একজন বৃদ্ধ সাহিত্যিকের স্পষ্ট ছবি দেখলুম যে সেই প্রজন্মের চেয়ে অধিককাল বেঁচেছে যে প্রজন্মকে সে এক সময় মেধাবী আনন্দ দিয়েছিল ; বন্ধুহীন একজন বুড়ো কবি, পরিবারহীন, সন্তানহীন, দারিদ্র্যের আর জনগণের অকৃতজ্ঞতা দ্বারা বিধ্বস্ত, তাঁবুর আড়ালে যেখানে ভুলো জগৎ আর ঢুকতে চায় না !

    পনেরো
    কেক
    আমি পর্যটনে বেরিয়েছিলুম । যে ভূদৃশ্যে আমি নিজেকে পেলুম তা ছিল চমৎকারিত্ব ও মহনীয়তায় অপ্রতিরোধ্য । এর কিয়দংশ নিঃসন্দেহে আমার অস্তিত্বে প্রবেশ করেছিল ।
    আবহের সমান সহজতায় আমার চিন্তাধারা উড়াল পেলো ; গেঁয়ো আবেগ, যেমন ঘৃণা ও নিষিদ্ধ প্রেম, মনে হতে লাগল আমার পায়ের নীচে বহুদূরের মেঘদলের মতন ভেসে
    গেছে গভীর অতলে ; আমার ওপরে ঘিরে থাকা আকাশের গম্বুজের মতন বিশাল আর বিশুদ্ধ অনুভব করছিল আমার আত্মা ; বহুদূরের, পাহাড়ের ঢালে আরেক পর্বতমালায় অদৃশ্য চারণভূমির গরুদের ঘণ্টাধ্বনির মতন আমার স্মৃতির পার্থিব ব্যাপার হৃদয়ে এসে দুর্বল হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল । স্হির ছোটো জলাশয়ে, তার অতল গভীরতার কারণে কালো, মেঘের ছায়ারা বয়ে যাচ্ছিল, যেন আকাশে ডানাঅলা উড়ন্ত দৈত্যের আলখাল্লার ছায়া । আর আমার মনে পড়ছে সেই সমারোহপূর্ণ, বিরল সংবেদন, ব্যপ্ত নিখুঁত স্তব্ধ সঞ্চরণের দ্বারা উদ্ভূত, আমার অন্তরে সৃষ্টি করেছিল মহোল্লাস ও ভয়ের মিশ্রণ । সংক্ষেপে, আমি অনুভব করছিলুম, আমার চতুর্দিকের উদ্দীপনাময় সৌন্দর্যকে ধন্যবাদ, নিজের ও ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে পরম শান্ত এক সম্পর্ক ; আমি বিশ্বাস করি, আমার পূর্ণ সুখে, আর পৃথিবীর যাবতীয় শয়তানিকে ভুলে যাওয়ায়, আমার এমনকি মনে হতে লাগল সংবাদপত্ররা যে দাবি করে যে মানুষ সৎ হয়ে জন্মায় তা তেমন হাস্যকর নয় । --- কিন্তু যখন জাগতিক প্রয়োজনীয়তা তার চাহিদা মেটাতে চাইলো, আমার মনে হল এতো উঁচুতে চড়ার দরুণ যে ক্লান্তি আর ক্ষুধা দেখা দিয়েছে তা মেটানো দরকার । পকেট থেকে একটা বড়ো রুটির টুকরো, চামড়ার কাপ, আর তখনকার দিনে ডাক্তাররা পর্যটকদের যে ধরণের টনিক দিতেন আর তাতে গলিত তুষার মেশানো যেতো, তার ফ্লাস্ক বের করলুম। রুটিটা চুপচাপ কাটতে লাগলুম, তখনই একটা মৃদু শব্দ আমাকে ওপরে তাকাতে বাধ্য করল । আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক ছোট প্রাণী, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে আর অবিন্যস্ত, যার ফাঁকা চোখের কোটর, আরণ্যক, আর যেন মিনতি করছে, রুটিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। আর আমি তার নিচুস্বর, কর্কশ কন্ঠের দীর্ঘশ্বাস মেশানো, “কেক” উচ্চারণ শুনতে পেলুম ! আমার মামুলি রুটিকে ওই শব্দে সন্মান করার দরুণ না হেসে থাকতে পারলুম না, আর আমি একটা বড়ো টুকরো কেটে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলুম । ও ধীরে এগিয়ে এলো , ঈর্ষার বস্তুটি থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই ; তারপর হঠাৎই, রুটির টুকরোটা হাত দিয়ে কেড়ে নিয়ে, তাড়াতাড়ি পেছিয়ে গেলো, যেন ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে আমার উপহার হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিংবা বলে ফেলে আমি পশ্চাত্তাপ করছি।
    কিন্তু সেই মুহূর্তে আরেকজন বুনো কে জানে কোথা থেকে এসে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর দুজনকে এমন একইরকম দেখতে যে মনে হচ্ছিল ওরা যমজ ভাই । দুজনে ধুলোয় গড়াগড়ি খেলো, দামি শিকারের লোভে, মনে হচ্ছিল দুজনেই নিজের ভাইকে অংশ দিতে চায় না । প্রথম জন, হতাশায়, দ্বিতীয়জনের চুলের মুঠি ধরল । দ্বিতীয়জন প্রথমজনের কান দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল, আর অমার্জিত শব্দে গালাগাল দিয়ে রক্তমাখা থুতু ফেলল । কেকের বৈধ দাবিদার চেষ্টা করল দখলদারের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে ; পরবর্তীজন তার হাত দিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর গলা টিপে ধরতে চাইল, আর অন্য হাত দিয়ে জিতে নেয়া পুরস্কার পকেটে পুরে ফেলতে চাইলো । কিন্তু হতাশায় চাগিয়ে উঠে, পরাজিতজন গায়ের পুরো শক্তি খাটিয়ে বিজয়ীর পেটে মাথার ধাক্কা মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো । কিন্তু একটা নোংরা লড়াই, যা তাদের বালকসূলভ চেহারার তুলনায় বেশিক্ষণ বজায় ছিল, তা বর্ণনা করে কীই বা হবে ? মুহূর্তে-মুহূর্তে কেকটার হাতবদল আর পকেটবদল হতে থাকলো ; কিন্তু, হায়, তার পরিমাণেও পরিবর্তন ঘটতে থাকলো ; আর সব শেষে, ক্লান্ত হয়ে, শ্বাসের জন্যে হাঁপিয়ে, রক্তাক্ত, তারা থামলো, কেননা আর লড়াই করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে, লড়াই করার জন্যে বাঁচেনি কিছুই ; রুটির টুকরোটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল গুঁড়ো হয়ে, বালুকণায় মিশে গিয়ে আর পার্থক্য করা যাচ্ছিল না ।
    ঘটনাটার দরুণ ভূদৃশ্য ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল আমার সামনে, আর এই দুই ক্ষুদে মানুষ আসার আগে আমার আত্মা যে শান্তি উপভোগ করছিল তা সম্পূর্ণ উবে গিয়েছিল; কিছুক্ষণের জন্যে আমার মন বেশ ভারাক্রান্ত ছিল, আমি নিজেকে বলছিলুম : “আচ্ছা, তাহলে, একটা চমৎকার দেশ যেখানে রুটিকে বলা হয় কেক, এক বিরল উপাদেয় যা ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট !”

    ষোলো
    ঘড়ি
    বিড়ালের চোখ দেখে চীনারা সময় বলে দিতে পারে ।
    একদিন একজন যাযক, নানকিঙের শহরতলির পথ দিয়ে যাবার সময়ে, তাঁর মনে পড়ল যে ঘড়ি পরে আসতে ভুলে গেছেন, আর একটি ছোটো ছেলেকে জিগ্যেস করলেন এখন কয়টা বেজেছে।
    চীন সাম্রাজ্যের লোচ্চা ছোঁড়া প্রথমে ইতস্তত করল ; তারপর ভেবে নিয়ে বলল, “আমি গিয়ে তোমার জন্য জেনে আসছি”। কিছুক্ষণ পরে সে ফিরে এলো, একটা মোটা বিড়ালকে সঙ্গে নিয়ে, আর বিড়ালের চোখ দেখে, তার শাদা অংশের দিকে তাকিয়ে, লোকে যেমন বলে থাকে, কোনো দ্বিধা ছাড়াই ঘোষণা করল : “এখনও দুপুর হয়নি।” কথাটা সত্যি ।
    আমার কথা যদি বলি, যখন আমি আমার সুন্দর ফিলিনের দিকে ঝুঁকি, বেশ ভালো নাম, যে তার যৌনতার জন্য সন্মানিত, আমার হৃদয়ের গর্ব, আর আমার আত্মার সুগন্ধ -- তা সে রাত হোক বা দিন, ঝলমলে আলোয় কিংবা আবছা ছায়ায় -- তার আদরযোগ্য চোখের গভীরতায় আমি নিখুঁত সময় দেখতে পাই, সর্বদা একই সময়, বিশাল একটি সময়, সৌন্দর্যমণ্ডিত, এবং শূন্যতার মতন শৌর্যময়, মিনিট ও সেকেণ্ডের বিভাজন ছাড়াই -- স্হির একটা সময় যা ঘড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট নয়, কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের মতন হালকা, চোখের পাতা ফেলার মতন দ্রুত ।
    আর যখন আমি সুন্দর ঘড়িমুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি সেই সময়ে কেউ এসে যদি আমাকে বিরক্ত করে, যদি কোনো অসৎ ও অসহ্য জিনপরী, খারাপ সময়ের কোনো দানব এসে বলে, “এতো মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ ? এই প্রাণীর চোখে তুমি কী খুঁজছ ? তুমি কি সময় দেখছ, ওহে অলস, অপচয়ী নশ্বর ?”-- কোনো দ্বিধা না করেই আমি জবাব দেবো : “হ্যাঁ, আমি সময়কে দেখছি ; তা হলো অনন্তকাল !”

    সতেরো
    মেয়েটির কেশদামের গোলার্ধ
    আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।
    আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে -- যাকিছু আমি অনুভব করি -- তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে ।
    তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।
    তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।
    তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।
    আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।
    আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।

    আঠারো
    সমুদ্রভ্রমণের নিমন্ত্রণ
    এক দারুণ দেশ আছে, কোকেইন নামের দেশ, লোকে বলে, সেখানে আমি আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে যাবার স্বপ্ন দেখি । তুলনাহীন দেশ, উত্তরের কুয়াশায় ডোবা, যাকে বলা যায় পাশ্চাত্যের প্রাচ্য, ইউরোপের চীন, তেমন অবাধ নিয়ন্ত্রণ তপ্ত, খেয়ালি কল্পনার উৎসার ঘটায় না, আর তাই ধৈর্য ধরে ও জেদে তার গূঢ় ও অপলকা বনানীর স্বপ্নবিলাস এঁকে রাখেনি।
    সত্যকার এক কোকেইন দেশ, যেখানে সমস্তকিছু সুন্দর, বৈভবপূর্ণ, শান্তিময়, নিখুঁত ; যেখানে শৃঙ্খলার সঙ্গে বিলাস নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে উদ্বাহু ; যেখানে জীবন শ্বাস নেবার জন্য মোহময় ও মিষ্টি ; সেখান থেকে বিশৃঙ্খলা, উথালপাথাল, এবং যা অচিন্তিতপূর্ব তা নির্বাসিত ; সেখানে নৈঃশব্দের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আনন্দের ; সেখানে রান্না করার ব্যাপার একই সঙ্গে কাব্যিক, মূল্যবান ও উৎসাহবর্ধক ; সেখানে, হে প্রিয় দিব্যতা, সব কিছু তোমার সদৃশ ।
    তুমি তো জানো আমাদের শীতল দুঃখযন্ত্রণার দিনগুলোতে যে জ্বরময় অসুখ ঘিরে ধরে, সেই অজানা দেশের জন্য মনকেমন, কৌতূহলপ্রসূত উদ্বেগ ? একটা দেশ আছে যা তোমার সদৃশ, সুন্দর, বৈভবপূর্ণ, শান্তিময়, এবং নিখুঁত, যেখানে কল্পনা সৃষ্টি করেছে আর সাজিয়েছে এক পাশ্চাত্য চীনদেশ, যেখানে শ্বাস নেবার জন্য জীবন বেশ মিষ্টি, যেখানে আনন্দের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নৈঃশব্দের । সেখানেই আমাদের সকলের যাওয়া উচিত, আমাদের উচিত সেখানে গিয়ে মারা যাওয়া !
    হ্যাঁ, শ্বাস নেবার জন্য, স্বপ্ন দেখার জন্য, এবং সময়কে সংবেদনের অনন্তকালীনতা দেবার জন্য, আমাদের যাওয়া উচিত । একজন সঙ্গীতকার ওয়াল্টজ নৃত্যে নিমন্ত্রণ নামে সুর বেঁধেছিলেন ; কোথায় সেই লোক যিনি সমুদ্রভ্রমণের নিমন্ত্রণ-এর সুর বাঁধবেন, যা প্রিয়তমাকে উপহার দেয়া যায়, নির্বাচিত বোনকে দেয়া যায় ?
    হ্যাঁ, সেই আবহাওয়াতে বেঁচে থাকা হয়ে উঠবে শ্রেয় -- সেই দূরদেশে, যেখানে স্তিমিত সময়ে বহু চিন্তা একত্রিত হয়, যেখানে ঘড়িগুলো গভীর, অর্থময় শান্তিতে আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি করে । জানালার ঝিকমিকে শার্শিতে, কিংবা গিল্টি-করা দামি কালো চামড়ার ওপরে, চুপচাপ বাস করে আশীর্বাদময়, শব্দহীন, গূঢ় পেইনটিঙ, যেন তা সেই চিত্রকরদের আত্মা যাঁরা সেগুলো সৃষ্টি করেছেন । অস্তগামী সূর্য, যা অভ্যর্থনাঘরের খাবার জায়গায় এমন রঙ এনেছে, সুন্দর পর্দার কাপড়ে সাজানো কিংবা দীর্ঘ জানালায় সীসার পাতলা পটি দিয়ে বাঁধানো একাধিক শার্শি ।
    কাঠের আসবাবগুলো বিশাল, কৌতূহলময়, অদ্ভুত, এবং সূক্ষ্ম আত্মার মতন তালা ও গোপনতা দিয়ে বন্ধ । আয়নাগুলো, বাসনকোসন, আচ্ছাদন, সোনার থালা, আর মাটির জিনিসপত্র চাউনির জন্য বাজায় এক মৃদু, রহস্যময় সঙ্গীত ; আর সবকিছু থেকে, কোনাগুলো থেকে, দেরাজের ফাঁকগুলো থেকে, পর্দার ভাঁজ থেকে, এক একক সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, সুমাত্রার এক স্মৃতিচিহ্ণ, গৃহের আত্মার মতন এক সুবাস ।
    সত্যকার এক কোকেইন দেশ, আমি বলি, যেখানে সকলে ধনী, পরিচ্ছন্ন, এবং সুস্হ বিবেকের মতন উজ্বল, রান্নার বাসনকোসনের মতন চমৎকার, যেন পেটা সোনার মতন, বহুরঙা অলঙ্কারের মতন অসাধারণ ! জগতের তাবৎ ঐশ্বর্য সেখানে একত্রিত হয়, যেন কোনো এক শ্রমিকের বাসা যে সারা পৃথিবীর ধন্যবাদ অর্জন করেছে । একটি অনুপম দেশ, সবার চেয়ে উন্নত, যেমন প্রকৃতির তুলনায় শিল্প, যেখানে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকৃতিকে নতুন করে গড়া যায়, যেখানে তা পরিশুদ্ধ, সাজানো, পুনর্নির্মিত । ওদের খুঁজতে দাও, ওরা খুঁজতে থাকুক, নিজেদের আনন্দের সীমাকে ওরা অপরিসীম বাড়িয়ে তুলুক, উদ্যানপালনবিদ্যার সেই রাসায়নিকরা !
    তাদের উচ্চাকাঙ্খী সমস্যার সমাধানের জন্য তারা ষাট কিংবা শতহাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করুক । আমার কথা যদি বলি, আমি আমার কালো টিউলিপ আর নীল ডালিয়া খুঁজে পেয়েছি !
    তুলনাহীন ফুল, পুনরাবিষ্কৃত টিউলিপ, আলঙ্করিক ডালিয়া, সেখানে আছে, নয় কি, সেই সুন্দর দেশে যা শান্তিময় আর স্বপ্নালু, যেখানে আমাদের গিয়ে প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠা উচিত ? তুমি কি তোমার নিজের তৈরি উপমা দিয়ে উদ্ভাসিত হতে চাইবে না, এবং তুমি কি সেখানে প্রতিফলিত হতে চাইবে না -- অতিন্দ্রীয়বাদীরা যেমন বলে থাকেন -- তোমার নিজের প্রতিষঙ্গে ?
    স্বপ্ন, সব সময়ে স্বপ্ন ! আর আত্মা যতো উচ্চাকাঙ্খী আর সূক্ষ্ম, সম্ভাব্য থেকে স্বপ্নেরা ততো দূরে সরে যায়। প্রতিটি মানুষ নিজের অন্তরে প্রাকৃতিক আফিমের খোরাক বয়ে বেড়ায়, অশেষভাবে লুকিয়ে রাখা আর অশেষভাবে নবায়িত, এবং জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে, প্রকৃত আনন্দের কতোটা সময় আমরা গুণতে পারি, সুচিন্তিত ও সফল কর্মকাণ্ডে ? আমরা কি কখনও বেঁচে থাকব, আমরা কি কখনও আত্মার রাঙানো নাট্যদৃশ্যে প্রবেশ করব, সেই নাট্যদৃশ্য যা তোমার সদৃশ?
    এই ঐশ্বর্য, এই আসবাবপত্র, এই বিলাসদ্রব্য, এই শৃঙ্খলা, এই সুগন্ধরাজি, এই অলৌকিক ফল, তারা সকলেই তুমি । আর তারা সকলেই তুমি, এই বিশাল স্রোত আর এই স্বচ্ছ খাল । জলবাহিত এই বিশাল নৌপোতগুলো, সবই ধনরত্নে ভরা, জাহাজের দড়িদড়া থেকে মন্ত্রের মতন জেগে ওঠা গান, তারা আমার চিন্তাধারা যেমন জাগ্রট করে, তারা তোমার বুকে ঘুমোয় আর পরিবাহিত হয় ।
    তুমি ধীরে তাদের সাগরে নিয়ে যাও যা অনন্তকালীন, তখন তুমি তোমার আত্মার সুন্দর স্পষ্টতায় আকাশের গভীরতাকে প্রতিফলিত করো --- আর তখন তারা ঢেউয়ের উথ্থানে ক্লান্ত হয়ে যায়, আর প্রাচ্যের ফলমূলে ভারি হয়ে ওঠে, আর নিজের দেশের বন্দরে ফিরে যায়, তারা তখনও থাকবে আমার চিন্তাধারা হয়ে, ঐশ্বর্যময়, আর তোমার নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে আসবে ।

    উনিশ
    গরিবের খেলনা
    আমি একটা নিরীহ ভিন্নমুখের ইঙ্গিত দিচ্ছি । কিছু বিনোদনে অপরাধবোধ নেই!
    তুমি যখন সকালে বাইরে বেরোও, মনঃস্হির করে নিয়ে যে কেবল রাজপথে ঘুরে বেড়াবে, পকেটে কয়েকটা ছোটো গ্যাজেট পুরে নাও যাদের দাম এক টাকাও নয় -- যেন একটা সুতোয় বাঁধা চ্যাপ্টা নাচ-পুতুল, কামার নেহাইয়ের ওপরে পিটছে, ঘোড়া আর তার সওয়ার, লেজ যেন হুইসিলের কাজ করছে -- আর রেস্তরাঁর সামনে, কিংবা গাছতলায়, যে গরিব বাচ্চাদের সঙ্গে তোমার দেখা হয় তাদের উপহার দিয়ে দাও । প্রথমে তাদের নেবার সাহস হবে না ; তারা তাদের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করবে না । কিন্তু তারপর তাদের ব্যগ্র হাত কেড়ে নেবে উপহার, আর নিয়ে পালাবে, যেমন বিড়ালদের তুমি যখন খাওয়াও তারা সেটা খাবার জন্য বেশ দূরে চলে যায়, মানুষকে অবিশ্বাস করার অভিজ্ঞতার দরুণ ।
    পথে এগিয়ে, বিশাল এক বাগানের গেট অতিক্রম করে, যার পেছনে দেখা যাচ্ছিল সূর্যের আলোয় ঝলকে-ওঠা সুন্দর এক বাগানবাড়ির ঔজ্বল্য, দাঁড়িয়ে ছিল এক সংস্কৃতিমান ও তরতাজা বালক, গ্রামীণ পোশাকে যা বেশ নম্র আর আকর্ষক ।
    বিলাস, দুশ্চিন্তার অনুপস্হিতি, এবং বৈভবের অভ্যাসগত প্রদর্শনী এই বালকদের এমন শোভন করে তোলে যে মনে হবে সাধারণ ও দারিদ্র্যের ছাঁচে গড়া বালকদের চেয়ে এদের গড়ার ছাঁচ আলাদা।
    তার পাশে ঘাসের ওপরে পড়ে আছে এক চমৎকার খেলনা, তার মালিকের মতনই টাটকা, চকচকে আর সোনালী, বেগুনি পোশাক পরানো, ছোটো-ছোটো পালক আর কাচের পুতি দিয়ে সাজানো । কিন্তু ছেলেটি তার প্রিয় খেলনা নিয়ে খেলছিল না ; পরিবর্তে, সে তাকিয়ে ছিল এই দৃশ্যের দিকে :
    গেটের অন্য দিকে, রাস্তার ওপর, শেয়ালকাঁটা আর জংলিঝোপের মাঝে ছিল আরেকজন বালক, অপরিচ্ছন্ন, পুঁচকে, তেলচিটে, সেই ধরণের এক অস্পৃশ্য প্রাণী যার অন্তরে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কেউ দেখলে খুঁজে পাবে, যেমনভাবে একজন বিশেষজ্ঞ আদর্শ পেইনটিঙের ভার্নিশের আবরণের তলায় প্রকৃত শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করেন, তেমন করে দারিদ্র্যের বিকর্ষক চাদর ধুয়ে ফেলে তাকে দেখতে পাবে ।
    এই প্রতীকি পাঁচিল যা দুটি জগতকে আলাদা করে রেখেছে, রাজপথের আর বাগানবাড়ির, গরিব বালকটি ধনী বালকটিকে নিজের খেলনা দেখাচ্ছিল, যে বেশ উৎসাহ নিয়ে সেটা পরখ করছিল যেন তা কোনো বিরল ও অজানা বস্তু । এখন, নোংরা ছেলেটি যে খেলনা দেখিয়ে প্ররোচিত করছিল, খাঁচার ভেতরে ঝাঁকাচ্ছিল আর দোলাচ্ছিল -- তা ছিল এক জ্যান্ত ইঁদুর ! ওর বাবা-মা, নিঃসন্দেহে ব্যয়সঙ্কোচের কারণে, জীবনযাপন থেকেই সরাসরি খেলনা যোগাড় করে ফেলেছিলেন।
    আর বালক দুজন ভাতৃত্ববোধে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছিল, সমান ঔজ্বল্যের সাদা দাঁত মেলে ।

    কুড়ি
    পরীদের উপহার
    সেদিন ছিল পরীদের বিশাল জমায়েত, বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় যারা জন্মেছে তাদের উপহার দেবার ব্যবস্হা করার জন্য ।
    নিয়তির এই সুপ্রাচীন আর খেয়ালি বোনেরা, আনন্দ আর দুঃখের এই অদ্ভুত মায়েরা, একে অপরের থেকে একেবারে আলাদা : কাউকে মনে হচ্ছিল গম্ভীর আর বদমেজাজি ; আবার কেউ চঞ্চল আর দুষ্টু ; কেউ যুবতী, যারা চিরকালের জন্য যুবতী ; অন্যেরা বয়স্কা, যারা চিরকালই বয়স্কা রয়েছে ।
    যে বাবারা পরীর অস্তিত্ব বিশ্বাস করে তারা হাজির হয়েছে, প্রত্যেকের কোলে সদ্যজাত।
    উপহারগুলো, সামর্থ্যগুলো, সৌভাগ্যগুলো, অজেয় পরিস্হিতিগুলো জড়ো করা হয়েছে এক সালিশিসভার পাশে, যেমনভাবে সান্মানিক স্নাতক উৎসবে পুরস্কারগুলো একটা টেবিলের ওপরে রাখা থাকে । পার্থক্য হলো যে উপহারগুলো প্রয়াসের পরিশোধ হিসাবে নয় ; বরং বিপরীত, তারা ছিল এমন মানুষদের মর্যাদা দেবার উপলক্ষ যারা তখনও পর্যন্ত জীবনযাপন করেনি, এমন মর্যাদা যা দুঃখযন্ত্রণা অথবা, তেমনই সহজভাবে, আনন্দের খাতিরে ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে ।
    বেচারা পরীরা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, কেননা দরখাস্তকারিদের সারি ছিল দীর্ঘ, আর মাঝামাঝি জগত, মানবসমাজ ও ভগবানের মাঝে, আমাদের মতনই সময়ের ভয়ঙ্কর আইন আর তার অগুন্তি সন্তানসন্ততি, দিন, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ডকে মানতে তারা মনে হচ্ছিল বাধ্য।
    সত্যি বলতে, তারা সবাই যাযকদের অধিবেশনের দিনের মতন বিক্ষুব্ধ ছিল, কিংবা মঁ-দ্য-পিয়েতের তেজারতি কারবারিদের মতন যখন রাষ্ট্রিয় উৎসবের দিন বিনামূল্যে উত্তরণপ্রাপ্তি ঘোষণা করা হয়, তেমন । আমার সন্দেহ হলো যে সময়ে-সময়ে ওনারা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাচ্ছিলেন ঠিক যেমন মানুষ-বিচারকরা করেন যাঁরা, সকাল থেকে ঠায় চেয়ারে বসে, রাতের ভোজের , পরিবারের কথা, আর তাঁদের প্রিয় চটির ব্যাপারে দিবাস্বপ্ন দেখেন । সেকারণে যদি অতিবাস্তব বিচারের জন্য একটু ব্যস্ততা আর এলোমেলোভাব ঘটে, তাহলে অবাক হওয়া উচিত নয় যে একই ব্যাপার ঘটে থাকে মানুষের বিচারব্যবস্হাতেও । আমরা যদি অবাক হই তাহলে আমরা নিজেরাই অন্যায্য বিচারক হয়ে যাবো ।
    সুতরাং, সেদিন কয়েকটা সাঙ্ঘাতিক ভুল হয়েছিল যা মনে হতে পারে অদ্ভুত, যদি খামখেয়াল নয়, বিচক্ষণতা হয় পরীদের নির্দিষ্ট, শাশ্বত চারিত্র্য ।
    আর তাই চুম্বকের মতন বৈভব আকর্ষণের ক্ষমতা পুরস্কার হিসাবে দেয়া হলো একটি ঐশ্বর্যশালী পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে, যার না ছিল পরার্থবাদীতার বোধ বা না ছিল দেখিয়ে বেড়াবার জিনিসপত্র সম্পর্কে আগ্রহ, যার ফলে কোটি কোটি অর্থের ভারে অস্বাভাবিকভাবে বিব্রত তারা শেষ পর্যন্ত সর্বনাশ ঘটিয়েছিল নিজেদের ।
    আর তাই সৌন্দর্য্য এবং কাব্যিক ক্ষমতার প্রতি প্রেম দেয়া হয়েছিল কৌতূকরসবোধহীন এক বুড়ো ইতর দুর্বৃত্ত, পাথরভাঙা মজুরের ছেলেকে, যে নিজের কারিগরি শেখাতে পারেনি ছেলেকে, বা তার নিন্দনীয় সন্তানের সমস্যা লাঘব করতে পারেনি ।
    বলতে ভুলে গিয়েছিলুম যে এই পবিত্র দিনগুলোয় বিতরণের প্রক্রিয়া পুনর্বিচারযোগ্য নয়, আর কোনও উপহার প্রত্যাখ্যান করা যায় না ।
    পরীরা সকলে উঠে দাঁড়ালো, এই মনে করে যে তাদের উঞ্ছবৃত্তি শেষ হয়েছে ; কেননা কোনো উপহার আর বাঁচেনি, দেবার মতন আর খুদকুঁড়ো ছিল না যা মানুষের ভিড়ে ছুঁড়ে দেয়া যায়, তখন একজন সাহসী লোক -- একজন ছোটোখাটো গরিব ব্যবসাদার, দেখে তাই মনে হলো--- উঠে দাঁড়ালো আর নিজের কাছের পরীর বহুরঙা বাষ্পময় পোশাক আঁকড়ে, চেঁচিয়ে উঠলো:
    “ওহ, ঠাকরুন ! আপনারা আমাদের ভুলে যাচ্ছেন ! আমার ছেলেও রয়েছে ! কিচ্ছু পাবো না বলে আমি এতোদূর আসিনি !”
    পরীটি হয়তো সত্যিই বিব্রত হয়ে থাকবে, কেননা আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু তখনই পরীটির একটা সর্বজনবদিত নিয়মের কথা মনে পড়লো যা সচরাচর প্রয়োগ করা হয়না অতিবাস্তব জগতে বসবাসকারী অননুভবনীয় প্রতিমাদের দ্বারা, মানবসমাজের বন্ধু এবং মানুষের আবেগের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য যাদের অনেক সময়ে বাধ্য করা হয়, যেমন পরীরা, যক্ষ-যক্ষিনী, উভচর প্রাণীরা, তন্বীদেবীরা, কৃশকায়াদেবীরা, জলের ভুতেরা, সন্তানবতী মানবাত্মারা আর বনকুমারীরা -- আমি বলতে চাইছি সেই আইনের কথা যা পরীদের, এইরকম ক্ষেত্রে, এমন ঘটনায়, যখন উপহারসামগ্রী ফুরিয়ে গেছে, দেবার মতো ক্ষমতা আর নেই, সম্পূরক হোক বা ব্যতিক্রম, পরীটির যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ছিল যে তৎক্ষণাত কিছু তৈরি করে ফেলতে পারে ।
    অতএব, ভালো পরীটি বলল, তার পদমর্যাদার আত্মনিয়ন্ত্রণ খেয়াল রেখে : “আমি তোমার ছেলেকে দিচ্ছি...আমি তাকে দিচ্ছি...খুশি করার ক্ষমতা !” কিন্তু ছোটোখাটো দোকানদার, যে সাধারণের মতন চিন্তাকারীদের একজন, নিজের মনকে অসম্ভাব্যতার যুক্তিতে উন্নীত করার প্রতিভা যার নেই, এঁড়ে জেদ করে জানতে চাইলো, “কিন্তু কেমন করে খুশি করবে ? খুশি…? কেনই বা খুশি ?”
    “কেননা ! কেননা !’ বলল ক্রুদ্ধ পরীটি, লোকটির দিকে পেছন ফিরে ; আর নিজের সহকর্মীদের মিছিলে আবার যোগ দিয়ে, পরীটি সঙ্গীদের বলল, “এই আত্মাভিমানী ছোট্ট ফরাসি লোকটার সম্পর্কে কী ভাবো তোমরা, যে সবকিছু বুঝে ফেলতে চায়, আর যে, নিজের ছেলের জন্যে সবচেয়ে ভালো ভাগ্য উপহার পেয়েছে, যা জিগ্যেস করা যায় না তাইই জিগ্যেস করার সাহস দেখাচ্ছে, আর যা নিয়ে তর্ক করা যায় না তাই নিয়ে তর্ক করছে ?”

    একুশ
    প্রলুব্ধিগুলো : অথবা যৌনতা, ঐশ্বর্য, এবং খ্যাতি
    দুজন জাঁকজমকপূর্ণ শয়তান আর প্রেতিনী, কম অসাধারণ নয়, গত রাতে সেই রহস্যময় সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল যে পথে নরক ঘুমন্ত দুর্বল মানুষকে আক্রমণ করে, আর তার সঙ্গে গোপন বার্তালাপ করে । আর তারা আমার সামনে এসে দ্যূতিসহ জাহির দাঁড়ালো, মঞ্চের অভিনেতাদের মতন ঋজু । আর যখন তারা রাতের অস্পষ্ট গভীরতা থেকে নিজেদের আলাদা করে এগিয়ে এলো, এই তিন ব্যক্তিত্ব থেকে গন্ধকের অত্যুজ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছিল । তাদের দেখে এতো গর্বোদ্ধত আর এতো বেশি কর্তৃত্বময় লাগছিল যে প্রথমে আমি ভেবেছিলুম তারা সত্যকার দেবতা।
    প্রথম শয়তানের মুখ ছিল দ্ব্যর্থক, আর তার দেহের কোমল রেখা আর চেহারা মনে হচ্ছিল প্রাচীনকালের গ্রিকদের আসবদেবতার মতন । তার সুন্দর, ধীরুজ চোখ, ছায়াময়, অবর্ণনীয় রঙসহ, যেন ঝড়ের দেয়া অশ্রুফোঁটায় ভেজা ভায়োলেট ফুল, আর তার দু-ফাঁক করা ঠোঁট যেন তপ্ত ধুনুচির মতন, আতর বিক্রির দোকান থেকে সুগন্ধের শ্বাস ফেলছে ; আর যখনই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, তার অগ্নিময় নিঃশ্বাস থেকে যেন কস্তুরী-সুবাসের কীটেরা উদ্ভাসিত হচ্ছে আর স্পন্দিত হচ্ছে ।
    তার বেগুনি রঙের জামায় এক উজ্বল সাপ বেল্টের মতন করে জড়ানো ছিল, আর মাথা তুলে তার দিকে অগ্নিময় অলস চোখে তাকিয়ে ছিল । এই জীবন্ত বেল্ট থেকে ঝুলছিল, ভয়ানক শিশির ফাঁকে ফাঁকে, চকচকে ছুরি আর শল্যচিকিৎসার অস্ত্রপাতি । তার ডানহাতে সে ধরেছিল আরেকটা শিশি যাতে ছিল লাল উজ্বল বস্তু, লেবেলে এই উদ্ভট কথা লেখা : “পান করো, এ হলো আমার রক্ত, উৎকৃষ্ট বলদায়ক” ; বাঁ হাতে ছিল একটা বেহালা যা স্পষ্টত তাকে সাহায্য করছিল নিজের আনন্দের আর নিজের দুঃখের গান গাইতে, আর কর্মবিরতির জন্য শাস্ত্রনির্দিষ্ট রাতে উন্মাদনার ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে দিতে ।
    তার কমনীয় গোড়ালিতে পরা ছিল সোনার ভাঙা শেকল, আর তার দরুণ যে অস্বাচ্ছন্দ্য তাকে বাধ্য করছিল মাটির দিকে চোখ নামাতে, সে আত্মশ্লাঘায় মুগ্ধ হয়ে নিজের বুড়ো আঙুলের নখ দেখছিল , তা ছিল পালিশ করা মণিরত্নের মতন,
    তার সান্ত্বনাতীত বেদনাময় চোখ, প্রতারণাপূর্ণ মাদকতায় চুর, সে মেলে ধরল আমার দিকে, আর সে আমাকে সঙ্গীতময় কন্ঠে বলল, “তুমি যদি চাও, তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে আত্মাদের প্রভূ করে দেবো, আর তুমি জীবন্ত বস্তুর শিক্ষক হয়ে উঠবে, কাদার ভাস্করের চেয়ে বড়ো ; আর তুমি সুখানুভবের সঙ্গে পরিচিত হবে, যা শেষহীণভাবে নবায়িত হবে, তুমি নিজের কাছ থেকে মুক্তি পাবে আর অন্যদের মাঝে নিজেকে ভুলে যাবে, আর অন্যদের তাদের আত্মা থেকে টেনে বের করতে পারবে, এমন এক অবস্হায় থাকবে যেখানে তুমি তাদের থেকে নিজেকে আলাদা মনে করতে পারবে না।”
    আর আমি জবাবে বললুম, “অনেক ধন্যবাদ ! অন্যের জঞ্জাল নিয়ে আমার কিছুই করার নেই, যাদের হয়তো, আমার চেয়ে বেশি মূল্য নেই । আর যখন কিনা আমার রয়েছে বহু লজ্জাজনক স্মৃতি, আমি কিছুই ভুলতে চাই না ; আর আমি যদি আগে থাকতে তোমাকে নাও চিনতুম, পুরোনো দানব কোথাকার, তোমার রহস্যময় ছুরি-চামচ, তোমার সন্দেহজনক শিশিগুলো, যে শেকল তোমার পা বেঁধে রেখেছে সেগুলো সবই এমন প্রতীক যা স্পষ্টভাবে তোমার বন্ধু হওয়ার বিড়ম্বনা ব্যাখ্যা করে । তোমার উপহার তোমার নিজের কাছেই রাখো।”
    দ্বিতীয় শয়তানের তেমন বিয়োগান্তক হাসিমুখের হাবভাব ছিল না, তেমন সূক্ষ্ম, পরোক্ষ ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণও নয়, তেমন মোলায়েম আর সুগন্ধিত সৌন্দর্যও ছিল না । লোকটা ছিল পেল্লাই, চোখহীন মস্তবড়ো মুখ, ফোলা ভুঁড়ি ঝুলে পড়েছে উরু পর্যন্ত, আর তার গায়ের চামড়া ছিল সোনালী ও ছবি আঁকা, যেন উলকি দেগে দেয়া হয়েছে, তাতে প্রতিনিধিত্ব করছিল দুঃখদুর্দশার সর্বাত্মক আঙ্গিকে খুদে-খুদে বিচরণশীল প্রাণী । সেখানে ছিল ছোট্ট রোগা মানুষ যারা স্বেচ্ছায় পেরেক থেকে ঝুলছে ; ছিল ছোট্ট, টিঙটিঙে , বিকলাঙ্গ পাতালপ্রেত যাদের মিনতিভরা চোখ তাদের কাঁপতে-থাকা হাতের তুলনায় সার্থকভাবে ভিক্ষা চাইছিল ; আর তারপর তাতে ছিল বুড়ি মায়ের দল যারা নিজেদের চোপসানো বুকে আঁকড়ে রেখেছিল রুগ্ন শিশুদের । আর ছিল অনেক কিছু।
    মোটা শয়তান নিজের পেল্লাই ভুঁড়িতে ঘুষি ঠুকলো, যার ফলে শোনা গেল দীর্ঘক্ষণ, ঠুঙঠাঙ, ধাতব আওয়াজ, যা শেষ হলো বহু মানুষের কন্ঠে অস্পষ্ট গোঙানিতে । আর ও হেসে উঠলো, অশ্লীল কায়দায় নিজের ভাঙা দাঁত দেখিয়ে, সে এক চওড়া জড়বুদ্ধি হাসি, যেমন বহু দেশে দেখা যায়, বেশি খাবার-দাবার খেয়ে কিছু লোক অমন করে থাকে ।
    আর ও আমাকে বলল, “আমি তোমাকে এমনকিছু দিতে পারি যার দরুণ তুমি সবকিছু পাবে, যা সবকিছুর দাম মেটাবে, যা প্রতিটি জিনিসকে বদলে দিতে পারবে !” আর সে নিজের দানবিক পেটে ঘুষি ঠুকলো, যার নাকিসুর প্রতিধ্বনি তার কর্কশ কথাগুলো সম্পর্কে মন্তব্যের মতন শোনালো ।
    আমি বিরক্তিতে পেছন ফিরলুম, আর জবাবে বললুম : “আমার আনন্দের জন্যে, আমি অন্যের দুঃখদুর্দশা, চাই না ; আর ওয়ালপেপারের মতন তোমার চামড়ায় আঁকা পাপগুলো, নোংরা মাখানো কোনো ঐশ্বর্য, চাই না ।”
    যদি প্রেতিনীর কথা বলি, অস্বীকার করা মিথ্যা হবে, যদি বলি যে তার মধ্যে প্রথমে অদ্ভুত একটা মনোহারিত্ব আমি পাইনি । এই মনোহারিত্বকে যে একটি মাত্র কথায় বলতে পারি তা হলো সেই সব সুন্দরী রমণীরা, যাদের সৌন্দর্য ঝরে গেছে, কিন্তু তবু যারা বুড়ি হয়নি, যাদের সৌন্দর্য ধ্বংসের তীব্র কৌতূহলের ইন্দ্রজাল ধরে রাখে । প্রেতিনী ছিল একই সঙ্গে উদ্ধত এবং জবুথবু, আর তার চোখদুটো, মেলে-মেলে ক্লান্ত, তা সত্তেও মোহিনীশক্তি বজায় রেখেছিল ।
    যা আমার সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় মনে হলো তা হলো প্রেতিনীর কন্ঠস্বরের রহস্য, যাতে আমি পেলুম স্তিমিত সুরের মাধুর্যের প্রতিধ্বনি, সেই সঙ্গে বহুক্ষণ ব্র্যাণ্ডি পান করার ফলে গলায় যে খসখসে ভাব থাকে, তাই ।
    “তুমি তোমার ক্ষমতা জানতে চাও ?” মেকি ঈশ্বরী বলল তার মনোমুগ্ধকর, স্ববিরোধী কন্ঠস্বরে।
    “শোনো ।”
    আর প্রেতিনী তার ঠোঁটে একটা বিরাট আড়বাঁশি ঠেকালো, যা থেকে ঝুলছিল একাধিক ফিতে, খেলনার বাঁশির মতন, যার ওপরে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সংবাদপত্রের নাম লেখা ছিল, আর নিজের আড়বাঁশি বাজিয়ে প্রেতিনী আমার নাম ঘোষণা করল, যা শতহাজার বজ্রধ্বনির ক্ষমতায় ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পরিসরে, আর সবচেয়ে দূর থেকে আসা উপগ্রহের প্রতিধবনির মতন ফিরে এলো আমার কাছে ।
    “প্রেতিনী !” আমি বললুম, অর্ধেক পরাভূত, “জিনিসটা দামি বটে !”
    কিন্তু ফোসলানো বাঁশিটা খুঁটিয়ে লক্ষ করে, আমার একটা অস্পষ্ট অনুভব হলো যে আমি একে চিনি, আমার জানাশোনা কয়েকজন মূর্খের সাথে কোথাও একে মদ খেতে দেখেছি ; আর আমার কানে ওর কাঁসার কর্কশ আওয়াজ আবছাভাবে মনে করিয়ে দিল এক বারবনিতাসূলভ আড়বাঁশির ।
    তাই আমি বললুম, অত্যন্ত তাচ্ছল্যে, “এখান থেকে কেটে পড়ো ! নাম বলতে চাই না এমন লোকেদের রক্ষিতাকে বিয়ে করার জন্যে আমি জন্মাইনি।”
    নিঃসন্দেহে আমার সাহসী প্রত্যাখানের জন্যে আমার গর্ববোধ করার অধিকার ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমি জেগে উঠলুম, আর আমার সমস্ত শক্তি আমায় ছেড়ে চলে গেলো। “সত্যি”, আমি নিজেকে বললুম, “এই ধরণের শুদ্ধ বিবেক প্রদর্শন করার সময়ে আমি নিশ্চয়ই গভীর নিদ্রায় ছিলুম । আহ, যখন জেগে ছিলুম তখন যদি ওরা আসতো, তাহলে আমি অতো ভদ্রতা করতুম না!”
    আর আমি যতো জোরে পারা যায় চিৎকার করে ওদের বললুম, আমাকে ক্ষমা করে দিতে, তাদের অনুগ্রহ পাবার জন্যে আমি আত্মঅপমানিত হতে রাজি হলুম ; কিন্তু আমি তো ওদের বেশ অপমান করেছি, তাই ওরা আর কখনও ফেরেনি ।

    বাইশ
    গোধূলীসন্ধ্যা
    দিন ফুরিয়ে আসে । সারা দিনের খাটুনির দরুণ ক্লান্ত আত্মাগুলোর অন্তরে এক বিশাল শান্তিময়তা সৃষ্টি হয় । আর এই সময়ে তাদের চিন্তায় ফুটে ওঠে গোধুলীর অভিমানী, অনিশ্চিত রঙ।
    কিন্তু পাহাড়ের চূড়া থেকে, এক অত্যুচ্চ আর্তনাদ আমার বারান্দায় পৌঁছোয়, রাতের উঁচু পাতলা মেঘের ভেতর দিয়ে, দূরত্বের সঙ্গে মিশ-খাওয়া বিসদৃশ কান্নায় তালগোল-পাকানো বিষণ্ণ ঐকতান, ঠিক যেমন ফুঁসে-ওঠা জোয়ার কিংবা জেগে-ওঠা ঝড়ে ঘটে ।
    সেই অভাগারা কারা যারা সন্ধ্যার দ্বারা শান্ত হয় না আর যারা, পেঁচার মতন, এসে-পড়া রাতকে মনে করে অপবিত্র ডাইনির শাস্ত্রসন্মত ছুটির সংকেত ? এই অমঙ্গলের লক্ষণপূর্ণ উলুধ্বনি আমাদের কাছে আসছে পাহাড়ের ওপরের কালো আতুরাশ্রম থেকে ; আর সন্ধ্যাবেলা -- নেশা ফোঁকার সময়ে বিশাল নীরব সমতলভূমির কথা গভীরভাবে বিবেচনা করি, যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক বাড়ি যার প্রতিটি জানালায় লেখা, “এখন এখানে শান্তি বিরাজ করছে ; এখানে এখন পারিবারিক আনন্দ !” -- যখন ওখান থেকে বাতাস বয়ে আসে, আমি আমার চমকে-ওঠা চিন্তাগুলো নরকের ঐকতানের ওই অনুকরণের মাঝে খেলাতে পারি । গোধুলী পাগলদের উত্তেজিত করে। -- মনে পড়ছে আমার দুজন বন্ধু ছিল যারা গোধুলীর কারণে অসুস্হ হয়ে পড়েছিল । একজন, সেই সময়ে, প্রথমে যে তার কাছে পৌঁছোত, বন্ধুত্বের আচরণ আর বিনয়কে ভুল বুঝে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করত । আমি ওকে দেখেছিলুম প্রধান সেবকের দিকে ভালোভাবে রাঁধা মুর্গির মাংস ছুঁড়ে দিতে, ও মনে করেছিল তাতে বুঝি কে জানে কোন অপমানজনক সংকেতলিপিতে লেখা বার্তা আছে । সন্ধ্যায়, সবচেয়ে স্বাদু খানাপিনার প্রথম পাত হেয় করার পর, ওর জন্য নষ্ট হয়ে যেত যাবতীয় রসালো খাদ্যবস্তুগুলো ।
    আরেকজন, নিজের উচ্চাকাঙ্খায় আহত, সূর্যাস্ত আরম্ভ হতেই ক্রমশ আরও তিক্ত, আরও বিষণ্ণ, আরও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতো । দিনের বেলায় প্রশ্রয়দানকারী আর বন্ধু, সন্ধ্যায় হয়ে উঠতো নির্দয়, আর তা কেবল অন্যদের ক্ষেত্রেই নয়, গোধূলীর পাগলামি সে নিজের ওপরেও বাঁধনছাড়া ক্রোধে প্রয়োগ করত ।
    প্রথমজন পাগল হয়ে মারা গেল, নিজের স্ত্রী আর বাচ্চাকেও চিনতে পারত না ; দ্বিতীয়জন নিজের অন্তরে অবিরাম অসুস্হতার উদ্বেগ বয়ে বেড়ায়, আর আমি বিশ্বাস করি যে রাষ্ট্র আর রাজপুত্ররা তাকে সন্মান জানিয়ে সন্তুষ্ট করতে চাইলেও, গোধুলী তার ভেতরে তবুও কাল্পনিক স্বাতন্ত্রের লোভের আগুন জ্বালিয়ে দিতো । রাত্রি, যা তাদের আত্মায় অন্ধকার পুঁতে দেয়, আমার ক্ষেত্রে আলো আনে ; আর যদিও একই ব্যাপারের দুটি ভিন্ন পরিণতি বিরল নয়, তবু ব্যাপারটা আমাকে একই সঙ্গে বিহ্বল ও সতর্ক করেছে ।
    হে রাত্রি, হে তরতাজা করে তোলা ছায়াগণ ! আমার জন্যে তুমি অন্তরের পবিত্র দিনের সংকেত, তুমি মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তিদানকারী ! সমতলভূমির একাকীত্বে, গলিঘুঁজির পাথুরে রাজধানী শহরগুলোয়, তুমি, ঝিলমিলে নক্ষত্রের আর রাস্তার লন্ঠনের ঝরে পড়া আলোয়, স্বাধীনতা-দেবীর আতশবাজি !
    গোধূলী, তুমি কতো মিষ্টি আর কোমল ! দিগন্তে এখনও ছড়িয়ে পড়তে থাকা গোলাপি রশ্মি, রাতের বিজয়ী অত্যাচারের চাপে দিনের মৃত্যু-সংঘর্ষের মতন, সূর্যাস্তের শেষ গৌরবের ওপারে ঘন লাল দাগ তৈরি করে দেয় ঝাড়বাতির উজ্বল আলো, পূর্বদিকের নিগূঢ়তা জুড়ে এক অদৃশ্য হাত টাঙিয়ে দেয় ঠাসবুনান কাপড়ের ঝালর --- জীবনের ম্লান সময়ে একজন মানুষের হৃদয়ে যুদ্ধরত এগুলো হলো জটিল অনুভূতির অনুকরণ ।
    কিংবা, পূনর্বার, নর্তকীরা যেমন অদ্ভুত পোশাক পরেন, যার মলিন স্বচ্ছ কাপড়ের তলায় দেখা যায় একদা বিস্ময়কর স্কার্টের ফিকে হয়ে আসা সৌন্দর্য, তেমনভাবেই বর্তমানের কালোকে স্বাদু অতীত ভেদ করে ; আর দোদুল্যমান, ছড়িয়ে-পড়া সোনা-রুপোর নক্ষত্ররা কল্পনার সেই শিখাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যা কেবল রাতের গভীর শোকে সুস্পষ্টভাবে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে ।

    তেইশ
    একাকীত্ব
    এক উদার-হৃদয় সাংবাদিক আমাকে বলল যে মানুষের জন্য একাকীত্ব খুব খারাপ ; আর নিজের গবেষণার সমর্থনে ও উদাহরণ দিল, অবিশ্বাসীরা যেমন সদাসর্বদা দিয়ে থাকে, গির্জার যাযকদের উপদেশগুলোও তাই ।
    আমি জানি শয়তান সব সময় জনবসতিহীন অঞ্চল পছন্দ করে, আর হত্যা করার উৎসা্হ ও লালসা আশ্চর্যভাবে নিঃসঙ্গ স্হানে প্রতিপালিত হয় । কিন্তু হতে পারে যে এই নিঃসঙ্গ জায়গাগুলো কেবল অলস, নিরানন্দ লোকেদের জন্যই বিপজ্জনক, যারা জায়গাটাকে নিজের আবেগ আর ছায়ামূর্তি দিয়ে ভরে রাখে ।
    এটা নিশ্চিত যে একজন বারফট্টাই-হাঁকিয়ে, যার মহানন্দ হলো একটা বেদি বা বেঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে নিজের মতামতকে অভ্রান্ত ঘোষণা করা, তার পাগল হয়ে গিয়ে চীৎকার চেঁচামেচির ভয়ঙ্কর বিপদ রয়েছে যদি সে রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপে থাকে । আমি সাংবাদিককে রবিনসন ক্রুসোর সাহসী সততার কথা জিগ্যেস করিনি, কিন্তু আমি ওকে অনুরোধ করেছিলুম যেন সেইসব লোকেদের বিরুদ্ধে নালিশ না করে যারা একাকীত্ব আর রহস্য ভালোবাসে।
    আমাদের বকবককারী জাতিতে কিছু লোক আছে, যদি তাদের ফাঁসির মঞ্চের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে শব্দবহুল বাগাড়ম্বরের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে তারা ফরাসি বিপ্লবের গিলোটিনের সময়ে বক্তৃতা থামাবার জন্য বাজানো দামামাকে পরোয়া না করেই, মৃত্যুদণ্ডকেও সামান্য অনিচ্ছাভরে মেনে নেবে ।
    তাদের সম্পর্কে আমার নালিশ নেই, কেননা আমি বুঝতে পারি যে অন্যেরা যেমন নিজেদের নৈঃশব্দ আর ধ্যানে আনন্দ পান, তারাও তেমনি তাদের বক্তৃতার নির্গমন থেকে আনন্দ পায় ; কিন্তু আমি তাদের ঘৃণা করি ।
    তাছাড়া, আমি চাইবো যে আমার অভিশপ্ত সাংবাদিক আমাকে আমার মতো করে খেয়ালখুশিতে থাকতে দেবে । “তাহলে, তুমি অনুভব করো না,” ও আমাকে জিগ্যেস করেছিল, যাযকীয় নাকিসুরে, “যে তোমার আনন্দ অন্যের সঙ্গে বাঁটোয়ারা করার প্রয়োজন আছে ?” দ্যাখো এই কৌশলী হিংসুটেকে ! ও জানে যে ওর সুখভোগের ধরণকে আমি অবজ্ঞা করি, তাই ও বিদকুটে রসভঙ্গ করার জন্য আমার মতামত সম্পর্কে ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করছে !
    “একা না থাকতে পারার এই অতিঅমঙ্গল হলো…” লা ব্রুয়েরে কোথাও লিখেছেন, নিজেকে ভুলে থাকার জন্য ভিড়ের মধ্যে ঢুকে লোকগুলোকে অপমান করার জন্য দৌড়ে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করা, এই ভয়ে যে সে একা থাকলে নিজেকে সহ্য করতে পারবে না ।
    “আমাদের প্রায় সমস্ত অমঙ্গলের উৎসসূত্র হল নিজের ঘরে না থাকতে পারা,” বলেছেন আরেকজন জ্ঞানী, পাসকাল, আমার বিশ্বাস, এইভাবে নিজের অন্তরজগতের ধ্যানশীলতার কুঠুরীতে সেই সমস্ত উন্মাদ মানুষদের ডাক দেয়ার চেষ্টা করেন যাঁরা নিজেদের আনন্দ এমন কাজকর্মে আর এমন প্রাণীর বেশ্যাবৃত্তিতে খোঁজেন যাকে আমি বলব ভ্রাতৃবৎ, যদি আমার শতকের সুন্দর ভাষায় তা বলতে হয় ।

    চব্বিশ
    পরিকল্পনা
    ও নিজেকে বলল, একা একটা বাগানে বেড়াবার সময়ে : “রাজ দরবারের জটিল সূক্ষ্ম কারুকাজ করা পোশাকে মেয়েটিকে কতো সুন্দর দেখাবে, সুন্দর সান্ধ্য বাতাসে, রাজবাড়ির শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে, বিশাল বাগান আর ঝিলগুলোর দিকে যদি ও তাকায় ! কেননা ওর তো রাজকন্যা হবার স্বাভাবিক আভিজাত্য রয়েছে।”
    পরে রাস্তায় হাঁটার সময়ে, ও একটা ছাপার দোকানের সামনে দাঁড়ালো, আর একটা দেয়ালে ক্রান্তিবৃত্তের দেশের উপত্যকার ছবি দেখে, নিজেকে বলল : “নাহ ! রাজপ্রাসাদ তেমন জায়গা নয় যেখানে আমি ওর মিষ্টি জীবনকে অধিগ্রহণ করব ! সেখানে আমরা ঘর বাঁধতে পারব না । আর সোনার ছিটে দেয়া দেয়ালগুলোতে ওর ছবি ঝোলাবার মতন জায়গা থাকবে না ; জাঁকালো দরদালানগুলোতে নিরালা অন্তরঙ্গতার নিভৃতি থাকে না । নিঃসন্দেহে, এইটিই সেই জায়গা যেখানে আমার জীবনের স্বপ্নের চর্চা করতে হবে ।”
    আর, ছাপা ছবিটি খুঁটিয়ে বিস্তারিত দেখার সময়ে, ও নিজেকে আবার বলল, “সমুদ্রের ধারে, এক সুন্দর কাঠের ঘরে, অদ্ভুত আলোকময় গাছে ঘেরা, যাদের নাম আমি ভুলে গেছি....হাওয়ায়, সেই মাদক, ব্যাখ্যাহীন সুবাস...ঘরের ভেতরে, এক তীব্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে, কস্তুরীর...আরও দূরে, আমাদের ছোট্ট এলাকার পেছনে, সাগরের ঢেউয়ে দুলতে-থাকা মাস্তুলের শীর্ষ...আমাদের চারিদিকে, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গোলাপি আলোয় আলোকিত আমাদের ঘর ছাড়িয়ে, বোনা শীতল চাটাই আর সংবেদনী ফুলে সাজানো, ঘন কালো বিরল পোর্তুগিজ রোকোকো চেয়ার ( যার ওপরে ও এলিয়ে বসবে, হাওয়ায়, আফিমদেয়া তামাকের ধোঁয়া উড়িয়ে ), আর তার ওইদিকে, বারান্দায়, রাতের আলোয় মাতাল পাখিদের কুজন, আর ছোটোখাটো আফরিকি মেয়েদের গল্পগুজব...আর রাতের বেলায়, আমার স্বপ্নকে সঙ্গদানের জন্য, সঙ্গীতময় গাছেদের সবিলাপ গান, সবিষাদ ক্যাসুরিনা গাছ । হ্যাঁ, সত্যি, এই ধরনের দৃশ্যপটই আমি চেয়েছি । কেনই বা আমি রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে মাথা ঘামাবো ?”
    আর পরে, তরুশ্রেণীর মাঝখানের পথ দিয়ে যখন সে হাঁটছিল, সে একটা ছোটো পরিষ্কার রেস্তরাঁ দেখতে পেলো, সুতির পর্দায় আলোকিত জানালার ভেতরে, দুটি হাসিমুখ দেখতে পেলো। আর সহসা : “আমার মন”, ও নিজেকে বলল, “নিশ্চয়ই একটা সত্যিকার ভবঘুরে যে অনেক দূরে যা খুঁজতে যায় তা এতো কাছে রয়েছে । যে প্রথম রেস্তরাঁ আমার চোখে পড়ল, তাতেই রয়েছে আহ্লাদ আর খুশি, ভাগ্যক্রমের রেস্তরাঁ, উপভোগের জিনিসে ঠাশা । তাপ পোয়াবার আগুন, রঙিন থালা, চালু রাত্রিভোজন, আমুদে মদ, আর বড়ো বিছানা তার সঙ্গে কম্বল যদিও লোমশ কিন্তু পরিচ্ছন্ন : এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ?”
    আর একা বাসায় ফেরার সময়ে, যখন পর্যন্ত বাইরের জীবনের জাঁকজমকে জ্ঞানের বার্তা দূরে মিলিয়ে যায়নি, ও নিজেকে বলল : “আজকে আমি কল্পনায় তিনটে বাড়ি পেয়েছিলুম, যার সবকটাতেই পেয়েছি সমান আনন্দ । কেনই বা আমার শরীরকে জায়গা বদলে বাধ্য করব, যখন আমার আত্মা অমন কর্মতৎপরতায় ভ্রমণে বেরোতে পারে ? আর কেনই বা আমার পরিকল্পনাকে রূপ দেবার জন্য মাথা ঘামাবো, যখন কিনা পরিকল্পনাটা নিজেই যথেষ্ট আনন্দের ?”

    পঁচিশ
    সুন্দরী ডরোথি
    সূর্য তার তপ্ত, উল্লম্ব রোদে শহরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ; বালি ঝকমক করছে আর সমুদ্রের ঢেউ কেঁপে উঠছে । হতচেতন জগত দুর্বল আত্মসমর্পণ করে দুপুরঘুম আরম্ভ করেছে, এক ধরণের প্রিয় মৃত্যুর মতন এমন দুপুরঘুম যে নিদ্রায় ঘুমন্ত মানুষ, অর্ধেক জেগে, নিজের বিলয়নের পরমানন্দ উপভোগ করে ।
    কিন্তু ডরোথি, সূর্যের মতনই তেজি আর গর্বিত, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ছড়িয়ে-পড়া নীলিমার বিস্তারের তলায় এই সময়ে একমাত্র জীবন্ত প্রাণী, রোদের আলোয় কালো ছায়া ফেলে হাঁটছে ।
    মেয়েটা হালকা চালে এগোয়, চওড়া পাছার ওপরে তার একহারা চেহারা দুলতে থাকে । তার ফিকে গোলাপি রেশমের পোশাক তাকে জড়িয়ে ধরে থাকে, তার কালো ত্বকের রূঢ় বৈশাদৃশ্য হিসাবে, তার দীর্ঘ চেহারাকে নিখুঁতভাবে মুড়ে, তার পলকা পিঠ, তার বুক দুটো ছুঁচালো।
    রোদ্দুরকে ছেঁকে নিচ্ছে তার লালরঙের ছোট্ট ছাতা, রক্তবর্ণ রুজের প্রলেপ দিচ্ছে তার কৃষ্ণকায় ত্বকে ।
    তার প্রচুর চুলের ওজন, প্রায় নীল, তার সুন্দর মাথাকে পেছনদিকে হেলিয়ে রেখেছে, যা তাকে দিয়েছে বিজয়িনীর শ্রমবিমুখ ঔদ্ধত্য । তার ভারি কানের দুল চুপিচুপি কানে-কানে প্রশংসা করছে।
    থেকে-থেকে সাগরের বাতাস তার ভাসমান পোশাকের একটা কোন তুলে ধরছে, দেখা যাচ্ছে তার মসৃণ, অসাধারণ পা দুটি ; আর তার পায়ের পাতা, ইউরোপ মর্মপাথরের তৈরি যে ধরণের ঐশী দেবীদের জাদুঘরে বন্ধ করে রাখে, মিহি বালুকণার ওপরে অনুগত ছাপ ফেলছে । কারণ ডরোথি এমনই অস্বাভাবিক ছিনাল যে তার মুগ্ধ-প্রশংসার আনন্দকে অতিক্রম করে চলে যায় মুক্তি পাওবার গর্বের দিকে, আর সে স্বাধীন হলেও, পায়ে জুতো না পরেই হাঁটে ।
    তাই মেয়েটি এগিয়ে যায়, সমন্বয়ে ডগমগ, বেঁচে থাকার আনন্দে, মুখের ঝকঝকে হাসি, যেন সে বহু দূরের কোনো আয়নায় তার চালচলন ও সৌন্দর্য প্রতিফলিত হতে দেখছে ।
    এই সময়ে, যখন কুকুররাও রোদ্দুরের কামড়ের নীচে দুঃখে ঘেউঘেউ করে, কোন সে কর্মদ্যোগী উৎসাহ যা শ্রমবিমুখ ডরোথিকে এইভাবে পরিচালিত করছে, ব্রোঞ্জের মতন সুন্দর ও শীতল তরুণী ?
    মেয়েটি কেন তার ছোট্ট ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, যত্ন করে সাজানো, যেখানে অত্যন্ত কম খরচে গোছাগোছা ফুল আর মাদুর গড়ে দিয়েছে নিখুঁত এক খাসকামরা ; সেখানে চুল আঁচড়ে, সিগার টেনে, পাখার বাতাস খেয়ে কিংবা পালকের পাখা-আয়নায় নিজেকে দেখে সে আনন্দিত হয়, যখন সমুদ্র, একশো পা দূরে তীরভূমিতে আছড়ে পড়ে, মেয়েটির অস্পষ্ট কল্পনার সঙ্গে সশব্দ তাল মিলিয়ে, আর যখন লোহার পাত্র, যাতে মেয়েটি কাঁকড়া, ভাত, আর জাফরান ভাপে সেদ্ধ করেছে, দালানের পেছন থেকে উদ্দীপক সুবাস ভাসিয়ে দেয় ?
    হয়তো মেয়েটি কোনো যুবক অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাতের পরিকল্পনা করেছে, যে, বহু দূরের সমুদ্রতীরে, তার বন্ধুদের থেকে শুনেছে ডরোথির প্রসিদ্ধি । অবশ্যই, মেয়েটি যুবকটিকে মিনতি করবে, বেচারা, অপেরার নাচের বর্ণনা করতে, আর মেয়েটি তাকে জিগ্যেস করবে সেখানে কেউ খালি পায়ে যেতে পারে কিনা, যেমন রবিবারের নাচগুলোয় বুড়ি কাফ্রিরাও মাতাল হয়ে নিজের আনন্দে নাচতে পারে ; আর তারপর, জিগ্যেস করবে প্যারিসের সুন্দরীরা তার চেয়েও সুন্দরী কিনা ।
    ডরোথিকে সকলেই প্রশংসা আর স্নেহ করে, আর সে খুবই আনন্দ পাবে যদি তাকে তার এগারো বছরের বোনকে, যে এখনই গায়েগতরে তৈরি আর সুন্দরী, তাকে ফেরত কিনে নেবার জন্য প্রতিটি পয়সা বাঁচাতে না হয় ! ও নিঃসন্দেহে সফল হবে, সুকন্যা ডরোথি ; বোনের মালিকটা এতো লোভী, এতো বেশি লোভী যে টাকাকড়ি বোঝে কিন্তু সৌন্দর্য বোঝে না !

    ছাব্বিশ
    গরিবের চোখ
    আহ, তুমি জানতে চাও কেন আজ আমি তোমায় অপছন্দ করছি। আমার ব্যাখ্যা করার তুলনায়, নিঃসন্দেহে, তোমার পক্ষে তা বোঝা কঠিন হবে ; পৃথিবীর মাটিতে নারীর অভেদ্যতার সুন্দরতম উদাহরণে আমি বিশ্বাস করি ।
    আমরা দুজনে সারাটা দিন একসঙ্গে কাটিয়েছি, যা আমার বেশ ছোটোই মনে হয়েছে। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে পরস্পরের ভাবনাচিন্তাকে সেদিন বিনিময় করব, আর আমাদের দুটি আত্মা এক হয়ে যাবে -- এমন স্বপ্ন যাতে কোনো মৌলিকতা ছিল না, যাই হোক, কথা হলো যে সবাই এই স্বপ্ন দেখে থাকলেও, কেউই এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত করতে পারেনি ।
    সেই সন্ধ্যায়, যৎসামান্য ক্লান্ত, নতুন তরুবীথির সদ্য প্রতিষ্ঠিত রেস্তরাঁর সামনে তুমি বসতে চেয়েছিলে, তখনও পর্যন্ত ভাঙাচোরা ইঁটপাথরের মাঝে, কিন্তু বেশ জাঁকজমক করে তাদের অসমাপ্ত জিনিসগুলো তারা সাজিয়েছে । রেস্তরাঁটা ছিল আলো ঝলমলে । গ্যাসবাতিটা নিজেই যেন প্রথম দিনের উত্তেজনাকে অনুভব করছিল, আর নিজের সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে দেয়ালগুলোকে চোখধাঁধানো আলোয় শ্বেতশুভ্র করে তুলেছিল, ঝকমকে আয়নার সারি, সোনালি কার্নিস আর সাজানো কারুকৃতি, বকলেস বাঁধা কুকুরেরা টান মারছে গালফোলা ছোকরা-বেয়ারাদের, হাতের ওপরে বাজপাখি রেখে হাসছেন মহিলারা, পরীরা আর দেবীপ্রতিমারা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে ফলের টুকরি, মাংসপোরা রুটি আর খাবার পাখি, গ্রিক চাকরানি হিবসের দল আর চাকর গ্যানিমিডের দল নিজেদের হাতে ধরে আছে ফেনিল মুসেকেক কিংবা বহুরঙা লম্বাটে আইসক্রিম: যাবতীয় ইতিহাস আর যাবতীয় পুরাণকাহিনি নামিয়ে আনা হয়েছে কোটনাগিরি আর খানাপিনার স্তরে।
    আমাদের ঠিক সামনে পথের কিনারায়, যেন সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে, চল্লিশ বছর বয়সী এক সজ্জন দাঁড়িয়েছিলেন, মুখময় ক্লান্তি আর শাদা দাড়ি, এক হাতে একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে আর অন্য হাতে কোলে ধরা আরেকটা বাচ্চা, তখন পর্যন্ত যার হাঁটার বয়স হয়নি । লোকটা আয়ার ভূমিকা পালন করছিল, আর নিজের বাচ্চাদের সান্ধ্যভ্রমণ করাতে নিয়ে বেরিয়েছিল । সকলেই ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে । তিনটে মুখই ছিল অত্যন্ত গম্ভীর, আর ছয়টা চোখ সমানভাবে অবাক হয়ে দেখছিল নতুন রেস্তরাঁর শৌর্য, কিন্তু বয়স অনুযায়ী তারতম্য ছিল । বাবার চোখ দুটো বলছিল, “কতো সুন্দর ! কতো সুন্দর ! ঠিক যেন গরিব পৃথিবীর সমস্ত সোনা জড়ো করে এই দেয়ালগুলো সাজানো হয়েছে।” ছোটো ছেলেটার চোখ দুটো : “কতো সুন্দর ! কতো সুন্দর ! কিন্তু এই জায়গাটা এমন যে আমাদের মতন লোকেদের ঢুকতে দেবে না ।” আর সবচেয়ে ছোটো বাচ্চার চোখ দুটো, তারা জাঁকজমকের জৌলুসে এতোই মুগ্ধ যে নির্বাক এবং গভীর আনন্দ ছাড়া আর কিছু ব্যক্ত করতে পারছিল না ।
    গানলেখকরা বলেন যে আনন্দ আত্মাকে উন্নীত করে আর হৃদয়কে করে নম্র । সেই সন্ধ্যায় গানগুলো সঠিক ছিল, আমার ক্ষেত্রে । আমি যে কেবল এই পরিবারের চোখের দ্বারা বিচলিত হয়েছিলুম তাইই নয়, আমাদের তৃষ্ণার চেয়ে বড়ো গেলাস আর মদ্যপানের পাত্র সম্পর্কে একটু লজ্জা বোধ করেছিলুম । প্রিয়তমা, আমি তোমার চোখে চাউনি মেললুম, যাতে সেখানে আমার চিন্তাভাবনাকে পাঠ করতে পারি : আমি গভীরভাবে নেমে গেলুম তোমার দৃষ্টিতে, কতো সুন্দর আর কতো অদ্ভুতভাবে মোলায়েম, তোমার সবুজ চোখের ভেতরে, ওই চোখে বসবাস করে খামখেয়াল, আর চাঁদের প্রেরণা পেয়ে, তুমি আমাকে বললে, “ওইখানে যে লোকগুলো রয়েছে তাদের সহ্য করা যায় না, ওদের চোখগুলো খোলা সিংদরোজার মতন ! তুমি তো প্রধান বেয়ারাকে বলতে পারো ওদের তাড়িয়ে দিতে ?”
    কতো কঠিন পরস্পরকে বুঝতে পারা, আমার প্রিয় পরীরানি, এমনকি যে দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে, আমাদের চিন্তা একে আরেকজনকে জানানো অসম্ভব !

    সাতাশ
    নায়কোচিত মৃত্যু
    ফাঁসিউলে ছিল একজন প্রশংসনীয় জোকার, বস্তুত রাজপুত্রের বন্ধু । কিন্তু সেই সমস্ত লোকেদের ক্ষেত্রে, যাদের কর্মজীবন হাসিঠাট্টায় বাঁধা, গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় তাদের বিপজ্জনকভাবে আকর্ষণ করে ; আর একজন জোকারের মস্তিষ্কে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা যদি স্বেচ্ছাচারীর মতন দখল করে তাহলে তাকে বিটকেল মনে হতে পারে, আর ফাঁসিউলে একদিন কয়েকজন অসন্তুষ্ট অভিজাতদের ষড়যন্ত্রে শামিল হয়ে গেল । সব জায়গাতেই ভালো মানুষেরা থাকে যারা ক্ষমতাসীন কর্তৃত্বের কাছে দুঃখী ধরনের লোকেদের উৎসর্গ করতে চায় যাতে রাজপুত্রদের বেদখল করে পটের পরিবর্তন করে সমাজে পরিবর্তন আনা যায়, আর তা বিচার-বিবেচনা না করেই। অভিজাতের দল তো গ্রেপ্তার হলোই, সেই সঙ্গে ফাঁসিউলেও, পেল নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড ।
    আমি বিশ্বাস করতে পারি যে তাঁর প্রিয় অভিনেতাকে বিপ্লবীদের সঙ্গে দেখে রাজপুত্র কিছুটা বিপর্যস্ত বোধ করেছিলেন । অন্যদের মতন রাজপুত্র যেমন ভালো ছিলেন না তেমন খারাপও ছিলেন না ; কিন্তু অত্যধিক সংবেদনে চালিত হয়ে, অনেক ক্ষেত্রে, তিনি তাঁর অভিভাবকদের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আর বেশি উৎপীড়ক হয়ে যেতেন । সুকুমার শিল্পের অনুরাগী, এবং বিচক্ষণ বোদ্ধা, উপভোগের ক্ষেত্রে তাঁকে তৃপ্ত করা যেতো না । মানুষ আর নৈতিকিতার ক্ষেত্রে ছিলেন যথেষ্ট উদাসীন, এবং নিজেও একজন প্রকৃত শিল্পী, যে একমাত্র ভয়ঙ্কর শত্রুর কথা তিনি জানতেন তা হলো একঘেয়েমির ক্লান্তি, এবং সেই অবস্হা থেকে মুক্তির ও তাকে দাবিয়ে রাখার জন্য তিনি এমন উদ্ভট কাজকারবার করতেন যে কোনো কঠোর ইতিহাস লেখক তাঁকে “দানব” খেতাব দিতো, যদি তাঁর রাজত্বে অমনকিছু লেখার অনুমতি দেয়া হতো, যা আদপে আনন্দ বা অনুভূতিতে অসহ্য আঘাত দেয় না, আর অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হলো আনন্দের সবচেয়ে সূক্ষ্ম আঙ্গিক । এই রাজপুত্রের দুর্ভাগ্য যে তার প্রতিভার সমকক্ষ কোনো বড়ো নাট্যমঞ্চ ছিল না । পৃথিবীতে যুবক নিরোরা আছে যাদের গণ্ডীবাঁধা অবস্হায় দম বন্ধ হয়ে যায়, আর ভবিষ্যতের শতকগুলোয় তাদের নাম আর সদিচ্ছা অজানা থেকে যায় । অসতর্ক ভাগ্যবিধাতা এই রাজপুত্রকে জমিজমার তুলনায় সামর্থ্য বেশি দিয়েছিলেন । হঠাৎই গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে শাসক ষড়যন্ত্রকারীদের মাফ করে দেবেন ; আর এই গুজবের উৎস ছিল এক বড়োসড় নাট্যাভিনয়ের ঘোষণা, যে নাটকে ফাঁসিউলে ওর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, অতিপরিচিত ভূমিকায় অভিনয় করবে, আর যাতে অভিযুক্ত অভিজাতবৃন্দও অংশ নেবে, লোকে বলে বেড়াচ্ছিল ; যাদের মগজ ফাঁকা, তারা বলে বেড়াতে লাগল যে অপমানিত রাজপুত্রের দয়ালু চরিত্রের এটা সুস্পষ্ট প্রমাণ।
    একজন মানুষের পক্ষে, যে স্বাভাবিকভাবে আর জেনেশুনে খামখেয়ালি, তার পক্ষে সবকিছু করাই সম্ভব, এমনকি সততা, এমনকি ক্ষমাশীলতা, আর বিশেষ করে যদি সে তাতে কোনো অজানা আনন্দ আবিষ্কার করে । কিন্তু সেই সমস্ত মানুষের পক্ষে, যেমন আমার ক্ষেত্রে, যে ওই অদ্ভুত অসুস্হ আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে, এটা আরও বেশি বিশ্বাযোগ্য যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মানুষের নাট্যপ্রতিভা দেখতে রাজপুত্র বেশি কৌতূহলী ছিলেন । উপলক্ষটাকে কেন্দ্র করে উনি মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞার ইতিবাচক প্রকোপ নিয়ে শারীরবৃত্তীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাইছেন, আর অনুসন্ধান করতে চাইছেন একজন শিল্পীর অভ্যাসগত সামর্থ্য অসাধারণ অবস্হায় পড়লে কতোটা পালটে যেতে পারে ; এই তর্ক বাদ দিয়ে ওনার চরিত্রে কি সুনির্দিষ্ট ক্ষমাশীলতা ছিল নাকি ? এই তর্কের নিষ্পত্তি কখনও হয়নি ।
    শেষ পর্যন্ত সেই দিন এলো, আর ছোটো দরবারকে সাজিয়ে তোলা হলো আত্মম্ভরী আড়ম্বরে, আর কল্পনা করা কঠিন, যদি তুমি না দেখে থাকো, কতোটা জাঁকজমক একটা ছোটো রাজ্যের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেনি, সীমাবদ্ধ সঙ্গতি নিয়ে, একটা দুঃখজনক উপলক্ষে তুলে ধরতে পারে। আর এটা তো ছিল দ্বিগুণ দুঃখদায়ক, প্রথমত বিস্ময়কর বিলাসদ্রব্যের প্রদর্শন, আর দ্বিতীয়ত এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নৈতিক ও রহস্যময় আগ্রহ ।
    ফাঁসিউলে তো নির্বাক ভূমিকায় কিংবা যাতে সংলাপ অল্প ছিল, সেই ধরণের ভূমিকা যা ঐন্দ্রজালিক নাটকে প্রতীকিস্তরে জীবনের রহস্যের প্রতিনিধিত্ব করে, তাতে উৎকৃষ্ট অভিনয় করল । ও মঞ্চে প্রবেশ করেছিল হালকা চালে আর নিখুঁত আত্মসংবরণ করে, যা দেখে জনসাধারণের বিশ্বাস হলো যে ক্ষমা আর দয়া পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ওর আছে ।
    যখন কেউ একজন অভিনেতা সম্পর্কে বলে, “এই লোকটা একজন ভালো অভিনেতা”, তখন সে একটা ফরমুলা প্রয়োগ করে, তা হলো এই যে চরিত্রটির মধ্যে অভিনেতাকে পাওয়া যায় -- তার শিল্প, তার প্রয়াস, তার ইচ্ছাশক্তি । এইবার, কোনও অভিনেতাকে যদি হয়ে উঠতে হয়, যে চরিত্র সে উপস্হাপন করতে চলেছে তাই, তাহলে প্রাচীনকালের সুন্দর মূর্তিগুলোর কী ঘটবে যদি তারা অলৌকিকভাবে প্রাণশক্তি পায়, বেঁচে ওঠে, চলাফেরা করে, দ্যাখে, সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষের সাধারণ ও বিভ্রান্ত ধারণা -- তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি একক ও নতুন ব্যাপার । সেই রাতে ফাঁসিউলে ছিল একটি আদর্শের নিখুঁত নিদর্শন, এমনই, যাকে কেউ জীবন্ত নয়, অসম্ভব নয়, বাস্তব নয়, বলতে পারত না । তার মাথা ঘিরে ধ্বংসাতীত জ্যোতি নিয়ে জোকার প্রবেশ করল আর চলে গেল, হাসল আর কাঁদল আর নিজের অঙ্গকে আক্ষিপ্ত করল, সেই জ্যোতি এমনই ছিল যা অন্যেরা দেখতে না পেলেও আমি দেখতে পাচ্ছিলুম, এমনই জ্যোতি যা ছিল শিল্পের রশ্মি আর শহিদের গৌরবের অভাবিত মিশ্রণ । ফাঁসিউলে, কে জানে কোন বিশেষ প্রসংসনীয় গুণে, উপস্হাপন করল, অমিত ভাঁড়ামির মধ্যেও ঐশ্বরিকতা ও অলৌকিকতা । আর ভুলতে পারা অসম্ভব এক সন্ধ্যার বর্ণনা করতে বসে আমার কলম কাঁপছে, আর পোঁছা যায় না এমন অশ্রুর আবেগ জমে ওঠছে আমার চোখে । ফাঁসিউলে আমাকে মানতে বাধ্য করল, অকাট্যভাবে, যে অতলে তলিয়ে যাবার সন্ত্রাসবোধকে ঢেকে ফেলার জন্য শিল্পের মাদকতা অনেক বেশি ক্ষমতাদক্ষ ; কবরের ধারে দাঁড়িয়ে প্রতিভাবানরা পরমানন্দে এমন ঠাট্টাইয়ার্কি করতে পারে যা কবরটাকে আড়াল করে দেয়, এমন এক স্বর্গোদ্যানে হারিয়ে যায় যেখানে তাদের কবরের আর ধ্বংসের কোনো ধারণা নেই ।
    দর্শকদের মধ্যে সকলেই, আমোদ-ক্লান্ত আর ছেবলা, শিল্পীর ক্ষমতাশীল প্রভাবের কাছে দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল । মৃত্যুর কথা কেউই আর ভাবছিল না, কিংবা শোকের, কিংবা চরম শাস্তির । সবাই আহ্লাদের ঘনঘটায় এমনভাবে মজে গিয়েছিল যা কেবল শৈল্পিক শ্রেষ্ঠ অবদানই দিতে পারে । আনন্দ আর সমাদরের বিস্ফোরণে, বজ্রবিদ্যুতের তেজোময়তায়, নাট্যগৃহের খিলানগুলো অনেক বার কেঁপে উঠছিল । রাজপুত্র নিজেই, উদ্বেলিত, দরবারের সকলরব সমর্থনে যোগ দিলেন ।
    তা সত্তেও, তীক্ষ্ণ চোখ তাঁর উদ্বেলতায় অন্য কিছুর মিশেলও দেখতে পাচ্ছিল । উনি কি নিজের স্বৈরাচারী ক্ষমতার কাছে পরাজিত ? জনগণের হৃদয়ে সন্ত্রাসী আঘাত ও শীতল হতবুদ্ধি সৃষ্টি করার উদ্দেশে নিজের শিল্পের দ্বারা অপমানিত ? নিজের অনুমানের দ্বারা হতাশাক্রান্ত এবং নিজের পরিকল্পনার ফলাফলে বোকা বনে গেছেন ? অমন ভাবনাচিন্তা -- যদিও সর্বাংশে ন্যায্য নয়, কিন্তু একেবারে অন্যায্যও নয় -- রাজপুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, তাঁর মুখের পরিচিত বিবর্ণতার ওপর অনবরত নতুন বিবর্ণতার প্রলেপ পড়ছিল, যেমন তুষারের ওপর তুষার জমতে থাকে । উনি বারবার ঠোঁট কামড়াচ্ছিলেন, আর ওনার চোখে জ্বলছিল ঈর্ষা আর তিক্ততার মতন আগুন, যদিও উনি নিজের পুরোনো বন্ধু আর অদ্ভুত জোকারের প্রতিভাকে লোকদেখানো প্রশংসা করছিলেন, যে মৃত্যুতেও ভালোভাবে ইয়ার্কি করতে পেরেছিল । একটুক্ষণ পরে, আমি দেখলুম সিংহাসন অধিকারী তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রাজভৃত্যর দিকে ঝুঁকে কানে-কানে কিছু বললেন । সৌম্যকান্তি ছেলেটির দুষ্টু মুখ হাসিতে আলোকিত হয়ে উঠল ; তারপর সে রাজপুত্রের দরবার ছেড়ে চলে গেল যেন কোনো জরুরি কাজ করতে যাচ্ছে।
    কয়েক মিনিট পরে, এক তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ হিসহিস-ধ্বনি ফাঁসিউলেকে ওর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মুহূর্তে বিঘ্ন ঘটালো, একই সঙ্গে হৃৎপিণ্ড আর কান ভেদ করে । আর যেখান থেকে এই অপ্রত্যাশিত অননুমোদন ঘোষিত হয়েছিল, সেই বেদি থেকে একজন বালক দৌড়ে দরবারে এসে চাপা হাসি হাসতে আরম্ভ করল ।
    ফাঁসিউলে, আঘাতপ্রাপ্ত, স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল, প্রথমে চোখ বন্ধ করল, তারপর অস্বাভাবিক ভাবে বড়োবড়ো করে মেলে ধরল, মুখ খুলল যেন শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে, হেলেদুলে একটু এগিয়ে, কিছুটা পেছিয়ে, তারপর মঞ্চের ওপর মরে পড়ে গেল ।
    সেই হিসহিসধ্বনি, তারোয়ালের আঘাতের মতন দ্রুত, সত্যিই কি ঘাতককে হতাশ করেছিল ? রাজপুত্র কি নিজেই পূর্বাহ্ণে এই ছলনার স্বশ্রেনিঘাতী কার্যকরতা আঁচ করেছিলেন ? এটা সন্দেহ করা অনুমোদিত । উনি কি ওনার প্রিয় এবং শত্রুভাবাপন্ন ফাঁসিউলের অভাব বোধ করেছিলেন? একথা বিশ্বাস করা মধুর ও আইনসঙ্গত । অপরাধী অভিজাতবৃন্দ শেষ বারের মতন মজার প্রদর্শনী দেখেছিলেন । সেই রাতেই জীবন থেকে তাঁদের মুছে ফেলা হয় । সেই সময় থেকে, বহু মূক নাট্যাভিনেতারা, অন্য দেশে সঠিক সমাদৃত হলেও, “অমুকের” দরবারে অভিনয় করতে এলেও, তাদের একজনও ফাঁসিউলের সমকক্ষ প্রতিভার প্রদর্শন কখনও করতে পারেনি, আর তাদের কেউই একই আনুকূল্যের উচ্চতায় উঠতে পারেনি ।

    আঠাশ
    নকল টাকাকড়ি
    তামাকের দোকান থেকে বেরোনোর পর, আমার বন্ধু টাকা-পয়সাগুলো আলাদা করে গুছিয়ে নিলো : তার কোটের বাঁ দিকের পকেটে রাখলো সোনার ছোটো মুদ্রা ; ডান দিকে, চাঁদিরগুলো; প্যাণ্টের বাঁদিকের পকেটে, একমুঠো কাঁসার ; আর সব শেষে, ডান দিকে, রুপোর একটা দুই ফ্রাংক পয়সা যা ও বহুক্ষণ ধরে যাচাই করেছিল ।
    “বেশ সূক্ষ্ম পৃথগীকরণ !” আমি নিজেকে বললুম ।
    আমরা একজন গরিব ভিখিরির সামনে পৌঁছোলুম, সে কাঁপা হাতে টুপি এগিয়ে দিয়েছিল। ওই মিনতিময় দুটো চোখের নিঃশব্দ বাগ্মীতার তুলনায় আর কোনো অপ্রতিভ ব্যাপারের সঙ্গে পরিচিত হইনি, একজন সংবেদী মানুষ জানে কেমন করে তা বুঝতে হয়, যে চোখে একই সঙ্গে রয়েছে অবমাননার গভীর বোধ আর ভর্ৎসনা । তাতে এমন কিছু ছিল যা কুকুরের চোখের জলে দেখা যায় যখন কুকুরটাকে কেউ চাবুক মারে । আমার বন্ধু আমার চেয়ে বেশি পয়সা দিয়েছিল, আর আমি ওকে বলেছিলুম, “তুমি সঠিক কাজই করেছো ; নিজে অবাক হবার আনন্দের চেয়ে আরও বেশি আনন্দ হলো অন্য কাউকে অবাক করে দেয়া।”
    “ওটা নকল পয়সা ছিল”, ও শান্তভাবে বলল, যেন নিজের বৈভবকে যুক্তিপূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে । কিন্তু আমার দুস্হ মস্তিষ্কে, যা সব সময়ে অনভ কিছু দেখতে ব্যস্ত থাকে যা সাদা চোখে দেখা যায় না ( আমার এই ক্লান্তিকর প্রতিভা প্রকৃতি আমাকে দিয়েছে ), একটা ধারণা তৈরি হল যে আমার বন্ধুবরের অমন কাজ তখনই মাফ করা যায় যদি ও ভেবে থাকে বেচারা গরিবটার জীবনে কোনো আকস্মিকতা সৃষ্টি করবে, আর হয়তো দেখতে চাইছিল কতোরকম প্রতিফল, ভয়ঙ্কর অথবা অন্যরকম বিপদ, একটা নকল পয়সা একজন ভিখারির হাতে দিলে ঘটতে পারে । তা কি ভালো পয়সায় বৃদ্ধি ঘটাবে না ? তা কি ওকে কারাগারে পাঠাবে না ? সরাইখানার মালিক কিংবা কসাই, ধরা যাক, নকল পয়সার জন্য ওকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারে । আর নকল পয়সাটা সহজেই হয়ে উঠতে পারে কোনো ছোটোখাটো বেচারা সাট্টাবাজের বহুদিনের রোজগারের উৎস । আর এই ভাবেই আমার চিন্তাধারা নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো, আমার বন্ধু যা ভাবছিল তাতে হয়তো ডানা যোগালো, কতো রকমের সম্ভাবনার কতো রকমের প্রতিফল । কিন্তু ও হঠাৎই আমার ভাবনাস্রোতে বাধা দিয়ে আমারই কথাগুলো পুনর্বার বলল : “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, একজন মানুষকে তার আশার চেয়ে বেশি দিয়ে অবাক করার তুলনায় আর মধুর আনন্দ হয় না ।”
    আমি সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকালুম, আর সেই চোখে প্রশ্নাতীত অকপটতার ঔজ্বল্য দেখে আতঙ্কিত বোধ করলুম । আমি এখন স্পষ্ট দেখলুম যে ও যা করতে চাইছিল তা হলো দানকর্ম, আর সেইসঙ্গে এক ধরণের দরাদরি ; চল্লিশ পয়সা জেতা আর তার সঙ্গে ঈশ্বরের হৃদয়কেও জেতা ; যাতে মিতব্যয়ের মাধ্যমে স্বর্গে যেতে পারে ; আর শেষে, মাঙনায়, দানশীল মানুষের পদমর্যাদা পেতে পারে । আমি ওর অপরাধী আনন্দকে ক্ষমা করে দিতে পারতুম, আমি এখনই অনুমান করতে পারছি যে ওর পক্ষে একাজ করা সম্ভব ; গরিব মানুষকে ঠকিয়ে ও মজা নিচ্ছে, তা হয়তো আমার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করত আর তাকে ভাবতুম বিদকুটে ; কিন্তু ওর অবান্তর হিসেবিপনাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না । বজ্জাত হওয়াটা কখনই মার্জনাযোগ্য নয়, কিন্তু একজন যে অমন তা জানতে পারাটা অর্জন ; আর সবচেয়ে ক্ষমাহীন দোষ হল বোকার শয়তানি ।

    উনত্রিশ
    বদান্য জুয়াড়ি
    কালকে একটা ভিড়েভরা উদ্যানপথে আমি অনুভব করলুম এক রহস্যময় অস্তিত্ব আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেল, যার সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছি, আর যাকে তক্ষুনি চিনতে পারলুম, যদিও তাকে আমি সত্যিই আগে দেখিনি । সেও আমার সম্পর্কে একই রকম অনুভব করল, কেননা পাশ দিয়ে যাবার সময়ে অর্থপূর্ণ চোখ মারলো, যা আমি দ্রুত স্বীকৃতি দিলুম । আমি ওকে অনুসরণ করলুম, আর ওর পেছন-পেছন মাটির তলায় একটা ঘরে নামলুম, ঝকমকে জায়গা, বিলাসিতায় এমনই আলোকিত যা প্যারিসের উঁচু স্তরের বাড়িতেও পাওয়া যাবে না । অদ্ভুত মনে হলো যে এই প্রতিপত্তিপূর্ণ আড্ডাঘরের সামনে দিয়ে কতোবার গেছি অথচ প্রবেশপথ নজরে পড়েনি । এক সজ্জাবিলাসী, এমনকি মত্ততাদায়ক বাতাবরণ সেখানে ছেয়ে ছিল, যা তোমাকে প্রায় তৎক্ষণাৎ জীবনের একঘেয়ে গণ্ডোগোলের কথা ভুলিয়ে দেবে ; সেখানে, তুমি শ্বাস নেবে এক বিষণ্ণ স্বর্গসুখে, যেমন পদ্মফুলখোরদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল, যখন তারা, সূর্যের আলোয় আলোকিত শাশ্বত দুপুরে মায়াবী দ্বীপে নেমেছিল, তারা নিজের অন্তরে অনুভব করেছিল, সঙ্গীতময় ঝর্ণার মোহক শব্দে, যেন বাড়ির দেবীদেবতাদের, স্ত্রীদের, ছেলেমেয়েদের আর না দেখতে হয়, আর সমুদ্রের উঁচু ঢেউয়ে চেপে পাড়ি দিতে না হয় ।
    সেখানে ছিল অদ্ভুত চেহারার পুরুষরা আর নারীরা, মারণ সৌন্দর্যে চিহ্ণিত, যা আমার মনে হলো, এমন সময়ে আর দেশে এর আগে দেখেছি, যা ঠিক এক্ষুনি মনে পড়ছে না, আর যা আমাকে, সচরাচর অচেনা আগুন্তুক দেখে যে অজানা ভীতি হয়, তার বদলে দিলো ভাতৃত্বের সহমর্মিতা। ওদের চাউনির অদ্ভুত অভিব্যক্তিকে যদি বর্ণনা করতে হয়, তাহলে আমি বলব এর আগে আমি কখনও এমন দৃষ্টি দেখিনি যা ক্লান্তির যন্ত্রণায় আর বেঁচে থাকার ইচ্ছেতে প্রবল সক্রিয়তায় পুড়ছে।
    আমার নিমন্ত্রণকর্তা আর আমি যতক্ষণে বসলুম, আমরা ততোক্ষণে আমরা দুজনে পুরোনো, সহযোগী বন্ধু হয়ে গিয়েছিলুম । আমরা খেলুম, আমরা অনেক ধরণের মদ বেপরোয়াভাবে পান করলুম আর, সবচেয়ে মজার, কয়েক ঘণ্টা পরেও আমার মনে হচ্ছিল যে ও যতোটা মাতাল হয়েছে আমি ততোটা হইনি । কিন্তু জুয়া, সেই অতিমানবিক আহ্লাদ, মাঝে মাঝে আমাদের মদ খাওয়ায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল, আর আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমি বাজি ধরলুম, আর যে-জিতবে-সে-সবকিছু নেবে খেলায় আমার আত্মাকে নায়কোচিত উদ্বেগহীনতায় আর হালকাচিত্তে হারালুম । আত্মা এমনই এক স্পর্শাতীত জিনিস, বেশির ভাগ সময়ে অকেজো আর অনেক সময়ে এতো বিরক্তিকর, যে তা হারিয়ে ফেলার দরুন আমার কোনো আবেগ হলো না, অনেকটা বেড়াতে বেরিয়ে ভিজিটিঙ কার্ড হারিয়ে ফেলার মতন ।
    আমরা আয়েস করে চুরুট ফুঁকলুম যার অতুলনীয় সুস্বাদ আর সুগন্ধ আমাদের আত্মায় এনে দিলো অজানা দেশ আর আনন্দের মনকেমন, আর এই মাতোয়ারায় মাতাল, সুপরিচিতির তরঙ্গ ওকে অসন্তুষ্ট করেছে বলে মনে হলো না, আমি সাহস করে চেঁচিয়ে বললুম, কানায় কানায় ভরে গেলাসে চুমুক দিয়ে, “প্রিয় নিক ! তোমার চিরন্তন স্বাস্হ্যের প্রতি ।” আমরা জগতসাংসার সম্পর্কে আলোচনা করলুম, অর্থাৎ প্রগতি আর নিখুঁত হয়ে ওঠার বিষয়ে বিশ্বাস সম্পর্কে, আর সাধারণভাবে মানুষের নানা মোহাচ্ছন্নতা নিয়ে আলোচনা করলুম । এই বিষয়ে মান্যবর চতুর এবং অকাট্য ঠাট্টাইয়ার্কিতে কম যায় না, নিজের মতামত ভদ্র বাক্যবিন্যাসে আর স্বচ্ছ রসিকতায় সাজিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করছিল যা এর আগে মানবসমাজের নামকরা বাগ্মীদের মুখেও শুনিনি । ও আমাকে বিভিন্ন দর্শনের অসম্ভাব্যতা ব্যাখ্যা করে বোঝালো, যে দর্শন এ-পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক দখল করে আছে, এমনকি আমাকে মৌলিক তত্বগুলোর কয়েকটায় শিক্ষিত করে তুলতে চাইলো, যদিও তত্বের জ্ঞান আর লাভ সম্পর্কে আমি যে কোনো কারোর সঙ্গে আলোচনা করি না । দুনিয়া জুড়ে নিজের কুখ্যাতির বদনাম নিয়ে একেবারেই নালিশ করল না, কুসংস্কার দূর করায় ওর সর্বাধিক আগ্রহ নিয়ে বিশ্বাস জাগালো, আর শপথ করে জানালো যে কেবল একবারই ও নিজের ক্ষমতাকে ভয় পেয়েছিল, যেদিন একজন যাযককে বলতে শুনেছিল, সহযাযকদের চেয়ে বার্তাবহ, বেদির ওপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিল, “আমার প্রিয় ভাতৃবৃন্দ, কখনও ভুলবেন না, যখন আপনি আলোকপ্রাপ্তির প্রগতি নিয়ে গর্ব করেন, বলেন যে, শয়তানের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ছলনা হলো আপনাদের প্রত্যয় জন্মানো যে তার কোনো অস্তিত্ব নেই !”
    সেই নামকরা বাগ্মীর স্মৃতি স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আমাদের আলোচনাকে নিয়ে গেলো, আর আমার অদ্ভুত নিমন্ত্রণকারী জোর গলায় বলল যে, লেখার কলমকে, বক্তৃতা দেয়াকে, পাতিপণ্ডিতদের ভাবনাচিন্তাকে উৎসাহিত করা ওর মর্যাদার তুলনায় নিম্নস্তরের, আর ও ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ে বিদ্যায়তনিক সভায় উপস্হিত থেকেছে, যদিও অদৃশ্য হয়ে । এই সব দয়ালু কথাবার্তায় প্ররোচিত হয়ে, আমি ওকে ঈশ্বরের কথা আর সাম্প্রতিক কালে ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা জিগ্যেস করলুম । উদাসীন কন্ঠে ও বলল, তাতে একটু দুঃখ মেশানো, “আমাদের যখনই সাক্ষাৎ হয় আমরা পরস্পরকে হ্যালো সম্ভাষণ করি, কিন্তু তা দুজন বৃদ্ধ ভদ্রসন্তানের দেখাসাক্ষাতের মতন হয়, যারা, তাদের জন্মসূত্রে পাওয়া আভিজাত্য সত্ত্বেও, পুরোনো ঝগড়ার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি ।”
    একজন মামুলি নশ্বরকে মান্যবর এতক্ষণ সময় নিয়ে দর্শন দেননি বলেই মনে হয়, আর বিশ্বাসভঙ্গ যাতে না করে ফেলি সে ভয় আমার ছিল । শেষ পর্যন্ত, জানালায় যখন ভোরের প্রথম আলো দেখা গেল, এই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব, না জেনেই যার গুণগান করেছেন বহু কবি আর যার শৌর্যকে সেবা করেছেন দার্শনিকরা, আমাকে বলল, “আমি চাই আমার সম্পর্কে তোমার স্মৃতি আনন্দময় হোক, আর তা আমি তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব, আমার সম্পর্কে তো কতো খারাপ কথা লোকে বলে বেড়ায়, আমি অনেক সময়ে একজন ‘শুভ শয়তান’ হয়ে যাই , যেমন তোমাদের একটা জনপ্রিয় প্রবাদ আছে । তাই, তোমার আত্মার যে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি তুমি ভোগ করলে, ভাগ্য তোমার সহায় হলে তুমি যে দাঁওগুলো জিততে --অর্থাৎ, তোমার সম্পূর্ণ জীবনে , ক্লান্তির বিটকেল অসুস্হতার সম্ভাবনাকে প্রশমিত ও পরাভূত করার জন্যে, যা তোমার অসুখ আর এগিয়ে যাবার দুঃখময় কারণ, আমি খেসারত দিয়ে তা পুষিয়ে দেবো । এমন কোনো ইচ্ছে তোমার হবে না যা পেতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না ; ফালতু সহযোগীদের ওপর তুমি কর্তৃত্ব করবে ; তুমি পাবে স্তাবকদল এমনকি সমাদর ; চাঁদি, সোনা, হীরে, পরীরা তোমায় খুঁজে বের করে তাদের গ্রহণ করার জন্য অনুনয়-বিনয় করবে, তার জন্য তোমাকে কোনো প্রয়াস করতে হবে না ; তুমি যখনই চাইবে নিজের দেশ আর জাতীয়তা বদলে ফেলতে পারবে ; আহ্লাদে মাতাল হবে, কখনও তাতে ক্লান্তি আসবে না, সেই সব দেশে যা সর্বদা উষ্ণ আর যেখানে নারীদের গায়ে ফুলের মতন সুগন্ধ --- ইত্যাদি, ইত্যাদি….” ও উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকল , বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে বিদায় নিলো ।
    এরকম জনগণের আড্ডায় নিজেকে অবমানিত করার ভয় যদি না থাকতো, আমি স্বেচ্ছায় এই বদান্য জুয়াড়ির পায়ে পড়ে তার অশ্রুতপূর্ব দানশীলতার জন্যে ধন্যবাদ জানাতুম । কিন্তু ও যাবার পরে, একটু-একটু করে, চিকিৎসার অসাধ্য আমার সন্দেহের অভ্যাস বুকের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলো ; অমন বৈভবপূর্ণ আনন্দে বিশ্বাস করার সাহস হলো না, আর যখন বিছানায় গিয়ে শুলুম, নীচ অভ্যাসের দরুণ প্রার্থনা করার সময়ে, আধোঘুমে বললুম : “হায় ভগবান ! ওহ আমার দেবতা, আমার ভগবান ! আমাকে দেয়া কথাগুলো শয়তানটা যাতে রাখে তা দেখো !”

    ত্রিশ
    দড়ি
    এদুয়ার মানে’র জন্য
    “মায়া”, বন্ধু আমাকে বলল, “যতোরকমের মানব সম্পর্ক হতে পারে ততো অসংখ্য, কিংবা যেমন বস্তু আর জনগণের সম্পর্ক, তেমন । আর মায়া যখন বিলুপ্ত হয়, অর্থাৎ, যখন প্রাণীটি অথবা ঘটনাটি আমাদের বাইরে অবস্হিত, আমাদের একটা অদ্ভুত, জটিল অনুভব হয়, উবে যাওয়া মায়াপুরুষের জন্য অর্ধেক মনখারাপ, আর বাকি অর্ধেক এই অনন্যতায় অবাক হওয়া, এই বাস্তব ঘটনার জন্য অবাক হওয়া।
    এখন, কোনও ব্যাপার যদি নিখুঁতভাবে স্বাভাবিক আর সাধারণ মনে হয়, সব সময়ে একই, যা আমাদের কখনও বোকা বানাতে পারে না, তা হলো মায়ের ভালোবাসা । মায়ের মাতৃত্বহীন ভালোবাসা কল্পনা করা যেমন কঠিন, যেমন তাপহীন আলো ; তাই , মায়ের সব কাজ আর কথাবার্তা, নিজের সন্তান সম্পর্কে, মায়ের ভালোবাসার সঠিক বৈধ কারণ নয়কি ? আর তবু, এই গল্পটার কথা শুনুন, যার দরুন আমি পুরোপুরি প্রাকৃতিক মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলুম।
    “চিত্রকর হিসাবে আমার পেশা অন্যের মুখ খুঁটিয়ে দেখতে আমাকে বাধ্য করে, চলার পথে যে চেহারাগুলো আমি প্রত্যক্ষ করি, আর তুমি জানো এই দক্ষতা থেকে আমরা কেমন আনন্দ উপভোগ করি, অন্য লোকেদের দৃষ্টির তুলনায় আমাদের চোখে যা প্রতিভাত হয়, জীবনকে আরও প্রাণবন্ত এবং অর্থবহ করে তোলে । দূরের যে পাড়ায় আমি থাকি, যেখানে বাড়িগুলোকে পরস্পরের থেকে আলাদা করে রেখেছে তৃণভূমি, আমি প্রায়ই একটা বাচ্চাকে দেখতুম যার উষ্ণ, দুষ্টু মুখভাব অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আমাকে তৎক্ষণাৎ আকর্ষণ করতো । আমার জন্যে ও অনেকবার পোজ দিয়েছে, আর আমি কখনও ওকে ছোট্ট জিপসি এঁকেছি, কখনও দেবদূত, কখনওবা পূরাণের কামদেব । আমি ওকে ভবঘুরের বেহালা হাতে এঁকেছি, কাঁটার মুকুট আর খৃস্টের শেষযাত্রার আবেগসহ, আর যৌনতার দেবতার আলোকবর্তিকা হাতে । শেষে, ওর মজা করার ব্যাপারে এমন আনন্দ পেতুম যে একদিন আমি ওর বাবা-মাকে, যারা বেশ গরিব, বললুম যে ছেলেটিকে আমায় দিতে, আমি ভালো পোশাক পরিয়ে রাখবো, যৎসামান্য টাকাকড়ি দেবো, আমার বুরুশ পরিষ্কার আর এদিক-ওদিকের কাজ ছাড়া দায়িত্বপূর্ণ কোনো কাজ দেবো না । বাচ্চাটা, আমি ওকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলার পর, বেশ সুশ্রী হয়ে উঠল, আর আমার সঙ্গে যে ধরণের জীবন কাটাতে লাগলো তা ওর বাবা-মায়ের জঘন্য বাসার তুলনায় মনে হয় স্বর্গ । তবে এখানে আমি একটা কথা বলব যে ছোটো ভদ্রলোকটি অনেক সময়ে তার অসাধারণ, অকালপক্ক মর্মযন্ত্রণার আকস্মিক প্রকোপ প্রদর্শন করে আমায় অবাক করে দিতো, আর দ্রুত ও চিনি এবং লিকোয়ার খানিক বেশি করে স্বাদ করার ঝোঁক দেখালো ; এমনই যে একদিন যখন ধরে ফেললুম যে ও এই রকম চুরি আবার করেছে, আমি ওকে বাবা-মায়ের কাছে ফেরত পাঠাবার ভয় দেখালুম । তারপর কাজে বেরোলুম আর আমার কাজকর্ম আমাকে বাড়ি থেকে কিছু সময়ের জন্যে বাইরে রাখলো ।
    “তুমি চিন্তা করতে পারবে না কীরকম আতঙ্ক আর আকস্মিকতায় বাড়ি ফিরে আক্রান্ত হলুম, যখন সবচেয়ে প্রথমে আমার চোখে পড়ল, ছোটো ভদ্রলোকমশায়, আমার জীবনের দুষ্টু সঙ্গী, কড়িকাঠের হুক থেকে ঝুলছে ! ওর পা প্রায় মাটি ছুঁয়ে রয়েছে ; একটা চেয়ার যা দৃশ্যত লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ; এক কাঁধে ঝুলছে ওর আক্ষিপ্ত মাথা ; মুখ ফুলে উঠেছে আর ওর চোখ, ভয়ার্ত চাউনি মেলে খোলা, প্রথমে দেখে আমার ভ্রম হয়েছিল ও এখনও বেঁচে আছে। তুমি যেমন ভাবছো, ওকে নামানো সহজ কাজ ছিল না । ওর দেহ ইতোমধ্যে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, আর আবর্ণনীয় আতঙ্কে আমার মনে হচ্ছিল ও মেঝেয় পড়ে যেতে পারে । আমি এক হাতে ওকে তুলে ধরলুম আর অন্য হাত দিয়ে দড়িটা কাটলুম । কিন্তু তখনও পর্যন্ত সব পুরো হয়নি ; ছোটো জানোয়ারটা একটা সরু শক্ত দড়ি ব্যবহার করেছিল যা ওর গলার মাংসকে গভীরভাবে কেটে চেপে বসে গিয়েছিল, তখন, একটা ছোটো কাঁচি নিয়ে, ওর ফুলে ওঠা মাংস আর দড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে কেটে ফেলতে হলো, যাতে ওর গলাকে মুক্ত করা যায় ।
    “বলতে ভুলে গেছি যে আমি চেঁচিয়ে সাহায্য চাইছিলুম ; কিন্তু কোনো প্রতিবেশি আমাকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলো না, এই ব্যাপারে সভ্য মানুষেরা পরস্পরের আচরণের কাছে একনিষ্ঠ, যারা কখনও, আমি জানি না কেন, গলায় দড়ি দেয়া মানুষের ব্যাপারে নাক গলাতে চায় না। শেষে ডাক্তার এসে জানালেন যে বাচ্চাটা বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছে । আর তারপর, যখন ওকে গোর দেবার জন্য ওর পোশাক খোলার প্রয়োজন হলো, শবদেহ এতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে আমরা ওর অঙ্গ নাড়াতে পারছিলুম না, আর পোশাক খোলার জন্য তা কেটে-ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল ।
    “পুলিশকর্তা, যার কাছে ঘটনার বয়ান দেবার ছিল, অবশ্যই, চোখের কোন দিয়ে আমাকে দেখে বললেন, ‘এতে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার আছে’ -- বলাবাহুল্য, প্রত্যেকের মনে ভয় জাগাবার ওনার জেদি অভ্যাসবশত, তা সে নিষ্পাপ হোক বা অপরাধী, কথাগুলো বললেন ।
    “একটা বড়ো কাজ রয়ে গেছে”, যা মাথায় আসা মাত্র নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হলুম। আমার কাজ হলো ওর বাবা-মাকে জানানো । সেখানে যেতে আমার পা দুটো রাজি হচ্ছিল না ।
    শেষে সাহস সঞ্চয় করতে পারলুম । কিন্তু, আমাকে অবাক করে দিয়ে, মা ছিলেন অবিচলিত, চোখে জলের একটা ফোঁটাও নেই । এই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার কারণ মনে হল ঘটনার আকস্মিকতায় উনি নির্বাক, আর আমার পুরোনো এক প্রবাদ মনে পড়ল : ‘সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শোক প্রকাশিত হয় মৌনতায়।’ বাবা, নিজেকে স্তোক দিলেন, অর্ধেক বিধ্বস্ত, অর্ধেক বিষণ্ণ : ‘যাই হোক, এটা হয়তো ভালোর জন্যই ঘটেছে ; ও তো কোনো কালেই ভালো ছেলে হয়ে উঠতে পারতো না !’
    ‘ইতোমধ্যে, দেহটা আমার ঘোড়ার গাড়িতে রাখা হয়েছিল আর চাকরের সাহায্য নিয়ে আমি অন্ত্যেষ্টির যোগাড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিলুম, তখন ছেলেটির মা আমার স্টুডিওতে এলেন । উনি বললেন, উনি ওনার ছেলের শব দেখতে চান । আমি ওনার শোক প্রকাশের পরম ও শান্ত সন্তুষ্টির জন্য ওনাকে সত্যই বাধা দিতে পারতুম না । তারপর উনি আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন সেই জায়গাটা দেখাই যেখানে ছেলেটি গলায় দড়ি দিয়েছিল । ‘আহ না, ম্যাডাম’, আমি বললুম, ‘তা আপনার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে !’ কিন্তু অজান্তে আমার দৃষ্টি কড়িকাঠের দিকে গেলো, আর আমি দেখলুম, বিরক্তি আর আতঙ্কের মিশেলে, যে খুঁটিটা তখনও সেখানে ছিল, তা থেকে ঝুলছিল একটা লম্বা দড়ি । আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দুঃখযন্ত্রণার শেষ প্রমাণ ছিঁড়ে সরিয়ে ফেলতে চাইলুম, আর যখন তা জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলতে যাবো, বেচারা মহিলাটি আমার বাহুঁ আঁকড়ে অপ্রতিরোধ্য স্বরে বললেন : ‘ওহ, স্যার ! ওটা আমাকে দিন ! আমি অনুরোধ করছি !’ স্বাভাবিকভাবে, ওনার ব্যথা, আমি ভাবলুম, ওনার মাথা এমন খারাপ করে দিয়েছে যে, যে জিনিসটা ওনার ছেলের মৃত্যুর কারণ, তা প্রত্নবস্তুর মতন যত্নে সামলে রাখতে চাইছেন বলে উনি কোমলতায় নুয়ে পড়েছেন । উনি খুঁটি আর দড়ি কেড়ে নিলেন ।
    “শেষে, শেষে, সবকিছু সমাধা হলো । যা বাকি রইলো তা হলো আমার নিজের কাজে ফেরা, আগের থেকেও বেশি আগ্রহে, আমার মস্তিষ্কের ভাঁজে-ভাঁজে ঘাপটি মেরে থাকা ছোট্ট শবের সন্মোহন থেকে মুক্তির জন্য যা ছিল জরুরি, সেই মায়াবালক যে তার ছবি আর চাউনি দিয়ে আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছিল তাকে আঁকা। কিন্তু পরের দিন আমি এক গোছা চিঠি পেলুম ; কয়েকটা আমার অট্টালিকার নিবাসীদের থেকে, কয়েকটা প্রতিবেশিদের থেকে ; একটা একতলা থেকে, আরেকটা দোতলা, আরেকটা তিনতলা, আর এইরকমই সব ; কয়েকটা ছিল অর্ধেক রসিকতাপূর্ণ, যেন হালকা চালে নিজেদের অনুরোধ লুকোতে চাইছে, কিছু একেবারে নির্লজ্জ আর ভুল বানানে ভরা, কিন্তু সবায়ের উদ্দেশ্য এক, মৃত্যুময় এবং স্বর্গীয় দড়ির একটা টুকরো পাবার প্রয়াস। সাক্ষরকারীদের মধ্যে, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, পুরুষদের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি ছিল, কিন্তু তারা সকলেই, আমি তোমাদের নিশ্চিন্ত করে বলছি, গেঁয়ো নিম্ন শ্রেনির ছিল না । চিঠিগুলো আমি সংগ্রহ করে রেখেছি ।
    “তারপর হঠাৎই, আমি আঁচ করলুম, আর বুঝতে পারলুম ছেলেটির মা কেন দড়িটা কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর নিজের সন্তুষ্টির জন্য কেমনতর বাণিজ্যের পরিকল্পনা করেছিলেন ।
    “‘হায় ভগবান’, আমি আমার বন্ধুকে বললুম : ‘গলায় ফাঁসি দেয়া একজন মানুষের এক মিটার দড়ির দাম একশো ফ্রাঁ প্রতি ডেসিমিটার, যার যেমন ক্ষমতা সে তেমন অর্থ দিয়ে কিনবে, যার যোগফল দাঁড়ায় এক হাজার ফ্রাঁ, বেচারা গরিব মায়ের সত্যিকার সান্ত্বনা !”

    একত্রিশ
    কাজকারবার
    এক সুন্দর বাগানে, যেখানে হেমন্তের রোদ অলস আনন্দে ছড়িয়ে পড়েছিল, ইতোমধ্যে সবুজ আকাশের তলায়, ভেসে যাওয়া মহাদেশগুলোর মতন সোনালি মেঘেরা, চারটে সুন্দর বাচ্চা, চারজনেই ছেলে, খেলে-খেলে ক্লান্ত, নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিল ।
    একজন বলছিল : “কালকে ওরা আমাকে নাট্যগৃহে নিয়ে গিয়েছিল । সেখানের মঞ্চে বিরাট সব দুঃখি-দুঃখি প্রাসাদ ছিল, যার পেছনে সমুদ্র আর আকাশ দেখা যায়, পুরুষ আর মহিলারা, কেউ গম্ভীর কেউ মনখারাপ, কিন্তু চারপাশে যাদের দেখি তাদের চেয়ে সুন্দর আর দামি পোশাকে, আর তারা এমনভাবে কথা বলছিল যেন গান গাইছে । তারা একে অন্যকে ভয় দেখাচ্ছিল, অনুরোধ করছিল, মনখারাপ করছিল, আর কোমরে গোঁজা ছোরায় নিজেদের একটা হাত রেখে কথা বলছিল । ওহ, কী বলব কতো সুন্দর ! আমাদের বাড়িতে যে মহিলারা বেড়াতে আসেন তাঁদের চেয়ে সুন্দরী আর দীর্ঘাঙ্গী ওখানের মহিলারা, আর তাদের বড়ো দীঘল চোখ আর ফোলা গাল মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর, কিন্তু তাদের ভালো না বেসে তোমরা থাকতে পারবে না । কখনও তুমি ভয় পাবে, কখনও তোমার কাঁদতে ইচ্ছে করবে, অথচ তা সত্বেও হাসিখুশি থাকবে । তাছাড়া, আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, তোমারও মনে হবে অমন পোশাক পরি, আর অমন কাজকারবারই করি, আর ওইরকম কন্ঠস্বরে কথা বলি…”
    চারজন ছেলের মধ্যে একজন, যে তার বন্ধুর কথায় এতোক্ষণ কান দেয়নি, অবাক চোখে দূরের আকাশে কিছু দেখছিল, হঠাৎ বলল, “দ্যাখো, ওপরে তাকিয়ে দ্যাখো ! দেখতে পাচ্ছো ওনাকে ? উনি ছোট্ট আলাদা মেঘে বসে রয়েছেন, আগুনরঙা মেঘটা ধীরে ভেসে যাচ্ছে । উনিও, যেন আমাদের ওপর লক্ষ রাখছেন।”
    “কে ? উনি কে ?” অন্যেরা জিগ্যেস করল ।
    “ঈশ্বর!” ছেলেটা নিশ্চিন্ত গলায় বলল । “ওহ ! উনি তো এখনই অনেক দূরে ; কিছুক্ষণে ওনাকে আর দেখতে পাবে না । উনি বোধহয় বেড়াতে বেরিয়েছেন, অন্য দেশগুলোয় যাচ্ছেন । দাঁড়াও,
    দিগন্তের প্রায় কাছাকাছি গাছের সারির ওপারে চলে যাচ্ছেন...আর এবার উনি গির্জার চূড়ার পেছনে ডুবে যাচ্ছেন...আহ, আর তোমরা ওনাকে দেখতে পাবে না !” এবং ছেলেটা অনেকক্ষণ যাবত সেইদিকে তাকিয়ে রইলো, ওর চোখ আকাশ আর পৃথিবীর সংলগ্নরেখার দিকে, ভাবাবেশ ও দুঃখের অনির্বচনীয় দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো ।
    “এ পাগলাটে, এই ব্যাটা, ওর মহান ঈশ্বরকে কেবল ওই দেখতে পাচ্ছে,” তৃতীয়জন বলল, যার সম্পূর্ণ ছোটো দেহ ছিল বিরল জীবনীশক্তি আর উদ্যমের বহিঃপ্রকাশ । “আমি, আমি তোমাদের এমনকিছু বলতে যাচ্ছি যা আমার জীবনে ঘটেছে কিন্তু তোমাদের জীবনে ঘটেনি, আর যা তোমাদের নাটক এবং মেঘের চেয়ে বেশি কৌতূহল-উদ্দীপক ।--- দিনকয়েক আগে, আমার বাবা-মা আমাকে ওনাদের সঙ্গে প্রমোদ-ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা যে হোটেলে ছিলুম তাতে আমাদের সকলের জন্যে বিছানা ছিল না বলে, নির্ণয় নেয়া হলো যে আমি কাজের মেয়ের সঙ্গে একই বিছানায় শোবো ।” ছেলেটি বন্ধুদের আরও কাছে আসতে ইশারা করে নিচু গলায় বলল । “ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল, বিছানায় একা না শুয়ে কাজের মেয়ের সঙ্গে শোয়া, তাও অন্ধকারে । আমার ঘুম আসছিল না, নিজের ভাবনা ভাবছিলুম কিন্তু মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল আর আমার হাত নিয়ে ওর নিজের বাহুতে, গলায়, কাঁধে বোলাতে লাগল । ওর বাহু আর কাঁধ অন্য মেয়েদের চেয়ে মাংসল, ত্বক বেশ নরম, এতো নরম, যেন লেখার কাগজ কিংবা সিল্কের কাগজ । আমার তাতে এতো আহ্লাদ হল যে যদি না ভয় করতো আমি অনেকক্ষণ অমনভাবে চালিয়ে যেতে পারতুম , ওর ঘুম ভাঙিয়ে ফেলার ভয়, আর তাছাড়া জানি না আর কি-কি । তারপর ওর পিঠে ছড়ানো ঘোড়ার লেজের মতন এলোচুলে আমি আমার মুখ গুঁজলুম, আর এতো ভালো গন্ধ পেলুম, তোমরা বিশ্বাস করবে না, এখন বাগানে ফুলগুলোর যেমন গন্ধ বেরোচ্ছে তেমন । যদি সুযোগ পাও তাহলে চেষ্টা করে দেখো, তখন বুঝতে পারবে !”
    এই অস্বাভাবিক উদ্ঘাটন বর্ণনার তরুণ লেখক, নিজের কাহিনি বলার সময়ে, চোখদুটোকে একধরনের হতচেতন চাউনিতে মেলে ধরেছিল যেন ও তখনও স্মৃতিকে অনুভব করছে, আর সূর্যাস্তের আলো ওর লালচে কোঁকড়ানো চুলের ঢেউকে লালসার গন্ধকবর্ণ জ্যোতিতে আলোকিত করে দিয়েছে । বলা সহজ যে কেউই মেঘ থেকে ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্যে জীবন নষ্ট করবে না, আর তা পাবে অন্য কোথাও ।
    শেষে চতুর্থজন বলল : “তোমরা তো জানো যে বাড়িতে আমি তেমন মজা পাই না ; আমাকে নাটক দেখতে নিয়ে যায় না ; আমার গৃহশিক্ষক বড়োই কড়া মেজাজের ; ঈশ্বর আমার আর আমার একঘেয়েমির সময় জুড়ে থাকেন না, আর আমার কোনো সুন্দরী কাজের মেয়ে নেই যে আদর করবে । আমি প্রায়ই ভাবি যে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবো যদি পালিয়ে যেতে পারি, কোথায় যাচ্ছি তা না জেনেই, আর কাউকে উদ্বিগ্ন না করে, আর সব সময় নতুন দেশ দেখে বেড়াবো । আমি যেখানেই থাকি না কেন সুখি থাকি না, আর সবসময় মনে হয় অন্য কোথাও গেলে ভালোভাবে থাকব । তাই ! পাশের গ্রামে গত মেলার সময়ে, আমি তিনজন লোককে দেখলুম যারা অমনভাবে থাকে, যেমনভাবে আমি থাকতে চাই । তোমরা তাদের দেখোনি, তোমরা সবাই । তারা ছিল বিশালদেহ, ময়লা চামড়া, প্রায় কালো, আর যদিও ছেঁড়া পোশাকে তবুও বেশ গর্বিত, মনে হচ্ছিল আর কোনো মানুষের প্রয়োজন ওদের নেই । যখনই বাজনা বাজাতো ওদের বড়ো-বড়ো নম্র চোখ আলোকিত হয়ে উঠতো; এমন চমৎকার সঙ্গীত যে তোমাদের কখনও মনে হবে নাচি, কখনও মনে হবে কাঁদি, কিংবা দুটোই একই-সঙ্গে করি, আর বেশিক্ষণ শুনলে তোমরা যেন পাগল হয়ে যাবে । যে বেহালা বাজাচ্ছিল সে যেন কোনো দুঃখের বর্ণনা করছিল, আরেকজন, নিজের কাঁধে ঝোলানো ছোটো পিয়ানোর চাবিতে ঘা মেরে যেন অন্য লোকটার দুঃখকে ঠাট্টা করছিল, আর তৃতীয়জন মাঝে মাঝে তার খঞ্ঝনি বেশ জোরে বাজাচ্ছিল । তারা নিজেদের নিয়ে এতো হাসিখুশি ছিল যে বুনো সঙ্গীত বাজাতেই থাকলো, এমনকি জনগণ বিদায় নেবার পরেও । শেষে, ওদের দেয়া পয়সাকড়ি কুড়িয়ে, পিঠে নিজেদের বস্তা নিয়ে চলে গেলো । আমি, আমি জানতে চাইছিলুম ওরা কোথায় থাকে, আর জঙ্গলের প্রান্ত পর্যন্ত ওদের অনুসরণ করলুম, সেখানে গিয়ে জানতে পারলুম যে ওরা কোথাও থাকে না ।
    “ওদের একজন বলল : ‘আমরা কি তাঁবুটা খাটাবো ?’
    “‘না, মোটেই নয়,’ আরেকজন বলল, ‘এতো সুন্দর আজকের রাতটা !”
    “তৃতীয়জন, দিনের রোজগার গুণে নিয়ে, বলল, ‘এই লোকগুলো সঙ্গীত বোঝেনা, আর ওদের মহিলারা ভাল্লুকের মতন নাচে । ভাগ্য ভালো যে এক মাসের মধ্যে আমরা অস্ট্রিয়ায় গিয়ে থাকবো, সেখানে পছন্দের লোকজন পাওয়া যাবে ।’
    “আমরা স্পেনে গেলে ভালো হয়, কেননা ঋতু ক্রমশ পালটাচ্ছে ; বৃষ্টিকে এড়াতে হবে, আর এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে গলা ভেজানো যায়’, আরেকজন বলল ।
    “দেখছো তো, আমার সবই মনে আছে । তারপর ওরা এক গ্লাস করে ব্র্যাণ্ডি খেয়ে ঘুমোতে গেল, সেখানে শুয়ে, নক্ষত্রদের দিকে মুখ করে । প্রথমে, আমি ভেবেছিলুম ওদের অনুরোধ করব আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে আর ওদের যন্ত্রসঙ্গীত শেখাতে ; কিন্তু আমার সাহস হলো না, তার কারণ বড়োসড়ো নির্ণয় নেয়া বেশ কঠিন, আর আরও কারণ হলো যে আমার ভয় করতে লাগল ফ্রান্স ছাড়ার আগেই আমি ধরা পড়ে যেতে পারি।”
    বাকি তিন জন বন্ধুর অনাগ্রহ আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করল যে এই ছোটো ছেলেটিকে আগে থেকেই ভুল বোঝা হয় । আমি ওকে খুঁটিয়ে দেখলুম ; ওর চোখেমুখে সেই অননুভবনীয়,
    বালপ্রৌঢ় সর্বনাশের রেশ দেখা যাচ্ছে যা সাধারণত সমবেদনাকে বেমানান করে দেয় কিন্তু যা, আমি ঠিক জানি না কেন, উত্তেজিত বোধ করলুম, সহসা অদ্ভুত ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে, যে, আমার হয়তো এক ভাই ছিল যার কথা কখনও শুনিনি ।
    সূর্য অস্ত গেল । বিষণ্ণ রাত দখল নিলো । ছেলেগুলো যে যার পথে এগোলো, কিন্তু ওরা কেউই জানত না, নিজের-নিজের নিয়তিকে পরিস্হিতি আর ঘটনাক্রম অনুযায়ী কেমন করে হাসিল করতে হয়, বন্ধুকে বদনাম করতে হয়, আর শৌর্যকে ঘিরে পাক খেতে হয় , কিংবা অপমানের পথে যেতে হয়।

    বত্রিশ
    নাচের ফুলছড়ি ( থায়েরসাস )
    ফ্রানৎস লিৎসের জন্য
    নাচের ফুলছড়ি কি জিনিস ? নৈতিক আর কাব্যিক দৃষ্টিতে, তা পুরুষ-পুরোহিত ও নারী-পুরোহিতদের হাতে-ধরা দেবী-দেবতাদের উৎসব পালনের যাজকীয় নিশান, যাঁদের তারা ব্যাখ্যাকারী আর চাকর । কিন্তু বাস্তবে তা একটা ছড়ি, কেবল একটা ছড়ি, যেমন আঙুরলতাকে তোলার জন্য ব্যবহার হয়, শুকনো, অনমনীয়, আর ঋজু । ছড়িতে জড়ানো থাকে ডালপালা আর ফুল যা সাপের খেয়ালি ভঙ্গীতে খেলে, দোল খায়, কয়েকটা আঁকাবাঁকা আর আঁকড়ানো, কয়েকটা ঘণ্টার মতন ঝোলা কিংবা যেন ওলটানো কাপের মতন । এবং এক পরমোৎকৃষ্ট চমৎকারিত্ব গড়ে ওঠে রেখা ও রঙের এই জটিলতা থেকে, কখনও কোমল, কখনও সপ্রতিভ ।
    মনে হয় না কি যে বেঁকা আর জড়ানো রেখা সোজা রেখাটাকে সেলাম করছে, মূক সমাদরে তাকে ঘিরে নাচছে ? মনে হয় না কি এই সমস্ত সূক্ষ্ম পরাগ, এই সমস্ত পাপড়ি, গন্ধে আর রঙে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, পৌরোহিত্যের ছড়িটার চারিধারে স্পেনীয়দের রহস্যময় ফানডানগো নাচছে?
    এবং তবু, কোন সে ধৃষ্ট নশ্বর যে নির্ণয় নেবার সাহস দেখাবে যে ফুলগুলো আর লতাগুলো ছড়িটার জন্যই বানানো, কিংবা ফুলগুলো আর লতাগুলোর সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য ছড়িটা কেবল একটা ছুতো ? থায়েরসাস নামের ফুলছড়ি হলো দ্বৈততার আশ্চর্য প্রতিনিধি, ক্ষমতাবান এবং শ্রদ্ধেয় পরিচালক, রহস্যময় ও আবেগপ্রবণ সৌন্দর্যের প্রিয় মদ্যপ । অদৃশ্য মদ্যদেবতার দ্বারা উত্তেজিত কোনও সমুদ্রপরী নিজের উন্মাদ সঙ্গিনীদের মাথার ওপরে ফুলযষ্টি নাড়ায়নি, তোমার মতন কর্মশক্তি আর কামখেয়াল নিয়ে, যখন তুমি তোমার প্রতিভাকে তোমার ভ্রাতৃবৃন্দের হৃদয়কে প্রভাবিত করার কাজে লাগাও । --- ছড়িটা তোমার ইচ্ছাশক্তি, ঋজু, শক্ত আর অপ্রতিরোধ্য ; ফুলগুলো তোমার ইচ্ছাশক্তিকে ঘিরে ঘুরে বেড়ানো কল্পনা ; তারা পুরুষের চারিধারে এক পায়ে নৃত্যরতা ঝলমলে নারীউপাদান । সোজা রেখা, জালিদার রেখা, অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তি, ইচ্ছাশক্তির ন্যায়পরায়ণতা, শব্দের সর্পিলতা, বিভিন্ন উপায়ে একটি মাত্র লক্ষে পৌঁছানোর প্রয়াস, প্রতিভার সর্বশক্তিময় ও অদৃশ্য মিশ্রণ : কোন সে বিশ্লেষক যার ঘৃণ্য সাহস হবে তোমাকে খণ্ডন ও পৃথক করতে ?
    প্রিয় লিৎস, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে, নদীদের ওই পারে, শহরের ওপরে পিয়ানোগুলো তোমার গৌরবের গান গায়, যেখানে ছাপার প্রেসগুলো তোমার জ্ঞানের অনুবাদ করে, যে দেশেই তুমি থাকো না কেন, অনন্তকালীন শহরের বৈভবে হোক কিংবা স্বপ্নময় দেশের কুয়াশায়, তোমাকে সান্ত্বনা দেবেন বিয়ারের রাজা ক্যামব্রিনাস, তোমার মনোরম কিংবা দুঃখের গানকে নতুন সুরে বাঁধবে, কিংবা কাগজকে গোপনে জানাবে তোমার নিগূঢ় ধ্যানের কথা, শাশ্বত আনন্দ ও ক্ষোভের গায়ক, দার্শনিক, কবি, এবং শিল্পী, তোমার অমরত্বকে আমি সেলাম করি !

    তেত্রিশ
    নিজেকে মাতাল করে তোলো
    তোমার উচিত সদাসর্বদা মাতাল থাকা । এটাই আসল তর্কবিন্দু, একমাত্র প্রশ্ন । সময়ের ভয়ঙ্কর চাপ যাতে তোমার কাঁধ ভেঙে তোমাকে মাটির দিকে নুইয়ে না দেয়, তাই তোমাকে অবিরাম মাতাল থাকতে হবে ।
    কিন্তু কিসে মাতাল ? মদে, কবিতায়, সততায়, যা তোমার পছন্দ । কিন্তু তোমাকে মাতাল থাকতে হবে ।
    আর কখনও কোনো সময়ে, কোনো প্রাসাদের সিঁড়িতে অথবা অবতলের সবুজ ঘাসে কিংবা তোমার ঘরের নিঃসঙ্গতায়, তুমি যদি জেগে উঠে বোঝো যে তোমার মাতলামি কমে এসেছে বা ফুরিয়ে গেছে, তাহলে বাতাসকে, ঢেউদের, নক্ষত্রদের, পাখিদের, ঘড়িকে, যা-কিছু বয়ে চলে যায় তাদের, যা-কিছু গোঙায়, যা-কিছু গড়িয়ে চলে যায়, যা-কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যা-কিছু কথা বলে, তাদের প্রশ্ন কোরো এখন কয়টা বাজে, আর জবাবে বাতাস, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি বলবে : “এটা মাতাল হবার সময় ! তাই যদি তুমি সময়ের একজন কেনা গোলাম শহিদ হতে না চাও, তাহলে নিজেকে মাতাল করে তোলো ; নিজেকে সদাসর্বদা মাতাল করে রেখো ! মদে, কবিতায়, কিংবা সততায়, যা তোমার পছন্দের ।”

    চৌত্রিশ
    ইতোমধ্যে !
    ইতোমধ্যে একশোবার সূর্য লাফিয়ে উঠেছে, প্রখর বা অন্ধকারাচ্ছন্ন, সমুদ্রের বিরাট চৌবাচ্চা থেকে, যার পরিধি দেখা দুষ্কর ; একশোবার ফেরত ডুব মেরেছে, ঝলমলে বা মনমরা, নিজের সান্ধ্য স্নানে । অনেকদিন যাবত আমরা নভোমণ্ডলের অপর পারকে অনুমান করতে পেরেছি এবং উপজাতিদের গাগনিক অক্ষরমালার মর্মার্থ বের করতে পেরেছি । এবং প্রতিটি যাত্রী বিলাপ করেছে আর কাতরেছে । যেন ডাঙার কাছাকাছি পৌঁছোবার কারণে তাদের দুর্দশা বৃদ্ধি পেয়েছে।
    “কখন, কখন,” ওরা জানতে চেয়েছে, আমরা ঢেউদের উথালপাথালে পাওয়া ঘুম আর ঘুমোবো না, বাতাস এমন নাক ডাকছে যা আমাদের নাক ডাকার তুলনায় বেশি আওয়াজ করছে কেন ?
    কখন আমরা মাংস খেতে পাবো যা আমাদের বয়ে নিয়ে যেতে থাকা অভিশপ্ত পঞ্চভূতের দেয়া এতো নোনতা নয় ? কখন আমরা স্হির আরামদায়ক চেয়ারে বসে খাবার হজম করতে পারবো?”
    তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিল যারা নিজের ভিটেমাটির কথা ভাবছিল, যাদের মনকেমন করছিল তাদের বিশ্বাসঘাতক, গোমড়া বউদের আর এঁড়ে বাচ্চাদের জন্যে । আর অনুপস্হিত ডাঙার জন্য এমন পাগল হয়ে উঠেছিল যে, আমার বিশ্বাস, গবাদি পশুদের চেয়ে বেশি উৎসাহে ওরা ঘাস খেয়ে নিতো । শেষে, তীরভূমি দেখতে পাওয়া গেল ; আর আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছোলে, দেখতে পেলুম তা ছিল এক চমৎকার, চোখধাঁধানো দেশ । মনে হলো যেন জীবনের নানা রকম সঙ্গীত এক অস্পষ্ট মর্মরধ্বনিতে সেখানে উৎসারিত হচ্ছে, আর তার তীরভূমি, সব রকমের সবুজে ছত্রালাপ, ফুল এবং ফলের স্বাদু সুবাস চতুর্দিকে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
    হঠাৎই সবাই আনন্দিত হয়ে উঠলো, প্রত্যেকে নিজেকে তার বাজে মনস্হতি থেকে মুক্ত করল । ভুলে গেল ঝগড়াঝাঁটি, মাফ করে দিল পরস্পরের দোষ ; যে দ্বন্দ্বযুদ্ধগুলো হবার ছিল সেগুলো স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হলো, আর ধোঁয়ার মতন উবে গেল গোঁসা ।
    আমি একা ছিলুম মনমরা, ধারণার অতীত মনখারাপ । একজন পুরোহিতের মতন, যার কাছে তার দেবতাকে কেড়ে নেয়া হয়েছে, হৃদয়বিদারক তিক্ততা ছাড়া,আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছিলুম না, সমুদ্রের দানবিক আকর্ষণ থেকে, যে সমুদ্র তার ভয়ানক সারল্যে অসংখ্যপ্রকারে বিভিন্ন, যে সমুদ্রে, মনে হচ্ছিল নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে আর প্রতিনিধিত্ব করছে তার কৌশলের, লোভনীয়তার, ক্ষোভের, হাসির, মেজাজের, যন্ত্রণার এবং যতো রকমের আত্মা এতাবৎ বেঁচেছিল, বেঁচে আছে কিংবা বেঁচে থাকবে তার আহ্লাদময় সমুদ্র !
    সেই তুলনাহীন সৌন্দর্যকে বিদায় জানিয়ে, আমার মনে হলো আমাকে আধমরা করে মেরে ফেলা হয়েছে ; আর সেই জন্যেই, যখন আমার সহযাত্রীদের প্রত্যেকে বলল, “যাক শেষ হলো!” আমি শুধু বলতে পারলুম, “ইতোমধ্যে !”
    আর তবু, এইটেই তো পৃথিবী, ধ্বনিময়, আবেগময়, বস্তুময় এবং উৎসবময় এই পৃথিবী ; এ ছিল ঐশ্বর্যময় এবং চমৎকার পৃথিবী, প্রতিশ্রুতিপূর্ণ, আমদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে গোলাপের, কস্তুরীর এক রহস্যময় সুগন্ধ, তার সঙ্গে প্রণয়লীলার হর্ষধ্বনিতে গুঞ্জরিত জীবনের কতোরকম সঙ্গীত ।

    পঁয়ত্রিশ
    জানালাগুলো
    একজন লোক দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে যতো রকমের ব্যাপার দেখতে পায়, তার চেয়ে বেশি ব্যাপার দেখতে পায় সেই মানুষ যে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে । মোমবাতিতে আলোকিত জানালার মতন আর কোনো বস্তুকে অতো বেশি প্রগাঢ়, অতো বেশি রহস্যময়, অতো বেশি ফলপ্রসূ, অতো বেশি ছায়াময়, অতো বেশি ঝলমলে দেখায় না । যা প্রকাশ্য দিনের আলোয় দেখা যায় তা জানালার পেছনের ঘটনার তুলনায় কম আগ্রহসঞ্চারী । ওই অন্ধকার অথবা আলোকিত গবাক্ষে, জীবন বেঁচে থাকে, জীবন স্বপ্ন দেখে, জীবন যন্ত্রণাভোগ করে।
    ছাদের ঢেউগুলোর ওপর দিয়ে, আমি একজন সম্পূর্ণাঙ্গ নারীকে দেখতে পাই, যে এখনই লোলচর্ম, গরিব, সব সময়ে কিছুর দিকে ঝুঁকে আছে, কখনই বাইরে বেরোয় না -- আর তার মুখাবয়ব লক্ষ্য করে, পোশাকের মাধ্যমে, অঙ্গভঙ্গী দেখে, কোনো জিনিসপত্র ছাড়াই, আমি এই নারীর ইতিহাস নতুন করে গড়ে নিয়েছি, কিংবা তার কিংবদন্তিকে, আর অনেক সময়ে তা নিজেকে শোনাই, চোখে অশ্রুজল নিয়ে । যদি কোনো গরিব পুরুষ হতো তার ইতিহাসও আমি তাড়াতাড়ি গড়ে ফেলতে পারতুম ।
    আমি বিছানায় শুতে যাই, গর্ব বোধ করি যে নিজেকে ছাড়া অন্য লোকেদের জীবনের যন্ত্রণাতে আমি বেঁচে থেকেছি ।
    তুমি হয়তো জানতে চাইবে, “তুমি কি নিশ্চিত যে এই কিংবদন্তি সত্য ?” কিন্তু তাতে কীই বা এসে যায়, আমার বাইরে যে বাস্তবের অবস্হান, তা যদি আমাকে অনুভব করতে সাহায্য করে আর আমি কে তা জানায় ?

    ছত্রিশ
    আঁকার ইচ্ছা
    লোকটা হয়তো মানুষ হিসাবে দুর্দশাগ্রস্ত, কিন্তু সে আকাঙ্খায় বিদীর্ণ একজন সুখী শিল্পী !
    আমি তাকে আঁকতে চাই যে আমাকে অনেক কম দেখা দিয়েছে, যে আমার কাছ থেকে দ্রুত পালিয়েছে, সেইরকম সুন্দর অনুতাপের জিনিসের মতন যা রাতের দ্বারা প্রভাবিত একজন পর্যটক, ফেলে চলে যায় । কতোকাল হলো সে উধাও হয়ে গেছে !
    সে সুন্দরী, সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি সুন্দরী : সে অবাক-করা । অন্ধকার তার মধ্যে উপচে পড়ে: আর যা-কিছুকে সে অনুপ্রাণিত করে তা নিশিময় ও গভীর । তার চোখ দুটি আশ্রয়নিবাস যার মধ্যে রহস্য আবছাভাবে জ্বলজ্বল করে, আর তার চাউনি বিদ্যুতের মতন ঝলকে ওঠে : যেন ছায়াদের বিস্ফোরণ । যদি কেউ আলো-ছড়ানো ও আনন্দময় কালো নক্ষত্রের কল্পনা করতে পারে, আমি তাকে কালো সূর্ষের সঙ্গে তুলনা করতে পারি । কিন্তু ও সাবললীলতায় আমাকে চাঁদের কথা মনে পড়ায়, যা ওর ওপর নিশ্চয়ই প্রচণ্ড প্রভাব রেখে গেছে ; রাখালি কবিতার শ্বেত চাঁদ নয়, শীতল স্ত্রীর মতন নয়, বরং অমঙ্গলময় নেশাধরানো চাঁদ, ঝড়ের রাতের গভীরতায় নিলম্বিত, এমন এক রাত যে দ্রুতগামী মেঘেদের পরস্পরের রেশারেশি চলছে সেখানে ; শান্তিময়, গোপন চাঁদ নয় যে পবিত্র লোকেদের স্বপ্নে দর্শন দেয়, বরং আকাশ থেকে ছিঁড়ে নামানো চাঁদ, পরাভূত ও দ্রোহী, যাকে আতঙ্কিত ঘাসের ওপরে নাচতে বাধ্য করেছিল থেসালিয়ার করালদর্শন ডাইনিরা ! তার সরু ভ্রুর তলায় বাস করে এক একগুঁয়ে ইচ্ছা আর শিকারের প্রতি ভালোবাসা । কিন্তু এই অশান্তিকর মুখাবয়বের তলার দিকে, সর্বদা স্ফূরিত নাসারন্ধ্রের অজানা ও অসম্ভব শ্বাসের কাঁপুনিতে, বিস্তৃত মুখগহ্বরের হাসি অবর্ণনীয় মাধুর্যে ঝলকায় , লাল এবং শ্বেত, এবং স্বাদু, যা দেখে যে কেউই আগ্নেয়গিরির ঢালে ফুটে থাকা অলৌকিক ফুলের স্বপ্ন দেখবে। এমন নারীরা আছেন যাঁরা তাঁদের জয় ও সঙ্গদান করার প্রেরণা যোগান ; কিন্তু এই নারী জাগিয়ে তোলেন মৃত্যুর আকাঙ্খা, ধীরে, তাঁর দৃষ্টির গভীরে ।

    সাঁইত্রিশ
    চাঁদের আনুকূল্য
    তুমি যখন দোলনায় শুয়েছিলে তখন চাঁদ, খামখেয়ালের মূর্ত প্রতিমা, জানালা দিয়ে তোমাকে দেখেছিল, আর বলেছিল : “আমি এই বাচ্চাটাকে পছন্দ করি।”
    এবং ভেড়ার সলোম চামড়ার মতন নরম, মেঘের সিঁড়ি বেয়ে তিনি নেমে এলেন, শব্দ না করে জানালা দিয়ে চলে গেলেন । তারপর মায়ের নমনীয় কোমলতায় তিনি তোমার ওপরে ছড়িয়ে পড়লেন, ওনার রঙগুলো রেখে গেলেন তোমার মুখাবয়বে । এই কারণেই তোমার চোখের তারা সবুজ, আর তোমার গালদুটো অত্যধিক ফ্যাকাশে । আর এই আগন্তুকের কথা মনে করে তোমার চোখদুটো অস্বাভাবিক বড়ো হয়ে উঠলো ; আর এমন কোমলতায় তিনি তোমার গলা জড়িয়ে ধরলেন, যে তবে থেকে তোমার ফোঁপাতে ইচ্ছে করেছে । তবু, তাঁর ছড়িয়ে পড়া আনন্দে, চাঁদ সারা ঘরকে অনুপ্রভার বাতাবরণে ভরে তুললো, আলোকময় বিষের মতন ; আর এই জীবন্ত আলো ভাবলো, আর বললো : “তুমি চিরকাল আমার চুমুর প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। তোমার সৌন্দর্য হবে আমার । যা আমি ভালোবাসি তুমিও তাই ভালোবাসবে, আর যা-কিছু আমাকে ভালোবাসবে : জল, মেঘ, স্তব্ধতা, এবং রাত্রি ; বিশাল সবুজ সমুদ্র ; আঙ্গিকহীন ও বহুআঙ্গিকের জল ; যে জায়গায় তুমি নেই ; যে প্রেমিককে তুমি জানো না ; দানবিক ফুলদল ; বিভ্রম সৃষ্টিকারী সুগন্ধ ; পিয়ানোর ওপর শুয়ে থাকা বিড়ালের নারীসুলভ খসখসে গলায়, মিষ্টি সুরের কাতরানি, সমস্তকিছু !
    “আর আমার প্রেমিকরা তোমাকে ভালোবাসবে, যারা আমার সঙ্গ দেয় তারা তোমায় সঙ্গ দেবে। তুমি হবে সবুজ-চোখ পুরুষদের রানি যাদের কন্ঠকে আমি নিশির আদরে জড়িয়ে ধরেছি ; যারা সমুদ্রকে ভালোবেসেছে, বিশাল, প্রাণবন্ত এবং সবুজ সমুদ্রকে, আঙ্গিকহীন ও বহুআঙ্গিকের জল, যে প্রাসাদ নেই, যে নারীদের তারা চেনে না, অজানা ধর্মের ধুপধুনোর মতন ভয়ানক ফুলদল, যে সুরভি ইচ্ছাশক্তিকে বিরক্ত করে, এবং আরণ্যক, কামনাময় পশুরা যারা উন্মাদনার প্রতিনিধি ।”
    আর সেই কারণেই, অভিশপ্ত, প্রিয়, নষ্ট আমার শিশু, এখন আমি তোমার পায়ের কাছে শুয়ে আছি, তোমার প্রতিটি অঙ্গে ভয়াবহ ঐশ্বরিকতার প্রতিফলন চাইছি, মারাত্মক ধর্মমাতা, সমস্ত উন্মাদদের বিষাক্ত সেবিকা ।

    আটত্রিশ
    কোনটা আসল ?
    আমি একজন বেনেডিক্টাকে জানতুম, যার থেকে আদর্শময়তার ছটা বিস্ফারিত হতো, যার চোখ মহৎ হবার সদিচ্ছার বীজ বপন করতো, সৌন্দর্ষের জন্য, খ্যাতির জন্য, আর সমস্তকিছু যা আমাদের অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস জন্মায় তার জন্য। কিন্তু এই ঐন্দ্রজালিক মেয়েটি বেশিদিন বাঁচার তুলনায় বড়ো বেশি সুন্দরী ছিল ; তার সঙ্গে আমার দেখা হবার কয়েকদিন পরেই সে মারা গেল, আর আমিই তাকে গোর দিয়েছিলুম, তা ছিল বসন্তকাল, গোরস্তানেও তার ধুপধুনো উড়িয়েছিল । আমিই তাকে গোর দিয়েছিলুম, সুগন্ধী ও নিষ্পাপ কাঠের কফিনে বন্ধ করে, ভারত থেকে আসা সিন্দুকের মতন ।
    আর আমার ঐশ্বর্য বিদায় নিয়েছিল, যখন সেদিকে তাকিয়ে ছিলুম, আমি হঠাৎ দেখলুম একজন ছোটোখাটো তরুণী যাকে দেখতে হুবহু মৃতার মতন, আর যে, টাটকা মাটিকে পাগলের মতন অদ্ভুত হিংস্রতায় খুঁড়ছিল, হাসিতে ফেটে পড়ে বলে উঠলো : “আমিই, বাস্তবের বেনেডিক্টা! আমিই, একজন বিখ্যাত বারবণিতা ! আর তোমার পাগলামির আর তোমার অন্ধত্বের শাস্তি হিসাবে আমি যেমন তেমনই তুমি আমাকে ভালোবাসবে !”
    কিন্তু আমি, ভয়ানক রেগে গিয়ে, জবাবে বললুম, “না ! না ! না !” এবং আমার প্রত্যাখ্যানকে গুরুত্ব দেবার জন্য, মাটিতে আমার পা এতো জোরে ঠুকলুম যে নতুন কবরের ভেতরে আমার পা হাঁটু পর্যন্ত সেঁদিয়ে গেল, আর ফাঁদে পড়া নেকড়ের মতন, আমি টিকে আছি, বোধহয় চিরকালের জন্য, পরমাদর্শের কবরে বাঁধা অবস্হায় ।

    উনচল্লিশ
    বিশুদ্ধ বংশজাত
    মেয়েটি নিঃসন্দেহে কুৎসিত । তা সত্বেও সে উপাদেয় !
    সময় ও প্রেম তাদের নখ দিয়ে তার গায়ে আঁচড় দিয়েছে আর তাকে নিষ্ঠুরভাবে শিখিয়েছে যে প্রতিটি মিনিট ও প্রতিটি চুমু তার যৌবন আর তার নতুনত্বকে ফুরিয়ে দিয়েছে ।
    মেয়েটি সত্যিই কুৎসিত ; পিঁপড়ের মতন, মাকড়সার মতন, এমনকি কঙ্কালের মতন, যদি তুমি ওকে চাও ; কিন্তু একই সঙ্গে মেয়েটি একরকম মলম, ইন্দ্রজাল, ডাকিনিবিদ্যা ! সংক্ষেপে, মেয়েটি নিখুঁত চমৎকারীত্বপূর্ণ । সময় ওর চলনভঙ্গীমার ঐকতান ভাঙতে পারেনি বা ওর দেহবল্লরীর অভঙ্গুর সৌষ্ঠব নষ্ট করতে পারেনি । প্রেম ওর শিশুসূলভ শ্বাসের মিষ্টতাকে নষ্ট করতে পারেনি ; এবং ওর কেশরের প্রাচুর্য হ্রাস করতে পারেনি সময়, যা এখনও নিঃশ্বাস ফেলে, কস্তুরি সুগন্ধে, দক্ষিণ ফ্রান্সের আরণ্যক প্রাণবন্ততা : নাইম, একস, আর্লে, অ্যাভিনিও, নাবোন, তুউল, সূর্যের আশীর্বাদপ্রাপ্ত শহর, প্রণয়লীলার ও পুলকের !
    সময় ও প্রেম মেয়েটির অস্তিত্বে তীব্র ক্ষয় ঘটাতে চেয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ; ওর বালকসূলভ বুকের অস্পষ্ট ও শাশ্বত জাদুকে তারা একটুও কমাতে পারেনি ।
    হয়তো জীর্ণতাপ্রাপ্ত কিন্তু অব্যবহার্য হয়নি, আর চিরকালের জন্য বীরাঙ্গনা, মেয়েটি তোমাকে সেইসব অভিজাত-বংশজাতদের কথা মনে পড়ায় যা প্রকৃত রসপণ্ডিতেরা সবসময় চিহ্ণিত করতে পারেন, এমনকি কোনো ভাড়াকরা ঘোড়ার গাড়িতে হোক বা ফালতু ঠেলায় সে বসে থাকুক।
    আর তাছাড়া মেয়েটি বেশ মিষ্ট প্রকৃতির আর কতো ঐকান্তিক ! লোকে যেমন হেমন্তকালকে ভালোবাসে মেয়েটি সেইভাবেই ভালোবাসা জানায় ; যেন আগত শীত তার হৃদয়ে নতুন আগুন জ্বেলেছে, আর তার কোমলতায় যে বশ্যতা তা কখনও ক্লান্তিকর নয় ।

    চল্লিশ
    আয়না
    একজন বীভৎস লোক ভেতরে ঢুকে এসে আয়নায় নিজের দিকে তাকালো ।
    “তুমি কেনই বা নিজেকে আয়নায় দ্যাখো, যখন কিনা তুমি সম্ভবত নিজেকে অপছন্দ করা ছাড়া অন্য কিছু দেখবে না ?’
    বীভৎস লোকটি জবাবে আমাকে বলল : “স্যার, ১৭৮৯ সালের অপরিবর্তনীয় আইন অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের আছে সমান অধিকার ; অতএব, আমারও অধিকার আছে আয়নার দিকে তাকানোর : তা পছন্দের হোক বা অপছন্দের তা অন্য কারোর মাথা ঘামাবার ব্যাপার নয়, কেবল আমার ব্যাপার।”
    শুভবুদ্ধির তর্কে আমি নিশ্চয়ই ঠিক ছিলুম ; কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে, লোকটাও ভুল ছিল না।

    একচল্লিশ
    বন্দর
    জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত আত্মার বিশ্রামের জন্যে একটা বন্দর খুবই ভালো জায়গা। আকাশের বিস্তার, মেঘেদের ভ্রাম্যমান স্হাপত্য, বদলাতে থাকা সমুদ্রের রঙ, লাইটহাউসগুলোর ঝিলমিলে আলো চোখদুটোকে ক্লান্তি না দিয়ে তাদের আনন্দ দেবার চমৎকার ত্রিপার্শ্বকাচ । জাহাজগুলোর এগিয়ে চলা আকার, তাদের জটিল দড়িদড়া-মাস্তুলসহ, যা সমুদ্রের ঐকান্তিক ঢেউগুলোর সন্ধান পায়, আত্মার সৌন্দর্য ও ছন্দের স্বাদ বজায় রাখতে সাহায্য করে । আর তাছাড়া, রয়েছে একধরনের রহস্যময়, অভিজাত আনন্দ, বিশেষ করে সেই লোকগুলোর জন্যে মনঃসংযোগ করার জন্য যাদের কৌতূহল বা উচ্চাকাঙ্খা নেই, আচ্ছাদিত জায়গায় শুয়ে কিংবা জেটির খুঁটিতে হেলান দিয়ে, যারা চলে যাচ্ছে আর যারা ফিরে আসছে তাদের চলাফেরা দেখা, যাদের এখনও যা ইচ্ছে চাইবার কর্মশক্তি বজায় আছে, পর্যটনে বেরোবার বা ধনী হবার আকাঙ্খা রয়েছে।

    বিয়াল্লিশ
    রক্ষিতাদের প্রতিকৃতি
    খাসকামরার পুরুষ রূপান্তরণে -- অর্থাৎ, জমকালো এক জুয়াখানার লাগোয়া তামাক ফোঁকার ঘরে -- চারজন লোক বসে ফুঁকছিল আর কথা বলছিল । তারা ঠিক যুবক নয় আবার বুড়োও নয়, সৌম্যকান্তি নয় কুৎসিতও নয় ; কিন্তু যুবক হোক বা বুড়ো, তাদের চোখেমুখে ছিল মজায় জীবন কাটাবার ঝানুদের নির্ভুল ছাপ, সেই অবর্ণনীয় কিছু-একটা, সেই শীত আর ব্যঙ্গমাখা বিষাদ যা ব্যথায় ঘোষণা করে : “আমরা আশ মিটিয়ে বেঁচে নিয়েছি, আর এখন আমরা খুঁজছি এমনকিছু যা আমরা ভালোবাসতে আর সমাদর করতে পারি ।”
    ওদের একজন আলোচনার বিষয়বস্তু নারীদের দিকে নিয়ে গেল । তাদের সম্পর্কে কথা না বলাই দার্শনিকভাবে ভালো ছিল ; কিন্তু কিছু চালাক মানুষ আছে যারা, যৎসামান্য মদ টানার পর, ফালতু আলোচনাকেও বাতিল করবে না । তেমন অবস্হায়, যে কথা বলছে তার দিকে কান দিতে হয়, যেমনভাবে লোকে নৃত্যসঙ্গীত শোনে ।
    “প্রতিটি মানুষ”, সে বলছিল, “তার দেবদূতের মতন কালখণ্ড কখনও নিশ্চয়ই কাটিয়েছে ; তা হলো সেই সময় যখন, বনপরীর অভাবে, লোকে জেনেশুনে ওকগাছের গুঁড়িকে জড়িয়ে ধরে । এটা হলো প্রেমের প্রথম ধাপ । দ্বিতীয় ধাপে লোকে বাছবিচার করে । ধীর ও সতর্ক হওয়ার স্তরে ইতোমধ্যে সে সৃজনীশক্তিচ্যুত হয়ে গেছে । এইটাই হল সেই সময় যখন একজন মনঃস্হির করে নিয়ে সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে ব্যপৃত হয় । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, বন্ধুগণ, আমি গর্বিত যে শেষ পর্যন্ত যৌবনান্তকালীন পর্বে পৌঁছেচি, তৃতীয় ধাপে, যেখানে সৌন্দর্যই সবকিছু নয় যদি না তা সুগন্ধ, সুশ্রী পোশাক ইত্যাদির দ্বারা পরিপক্ক হয় । এবং আমি স্বীকার করছি যে অনেকসময়ে আমি চেয়েছি, অজানা আশীর্বাদের স্তরে, চতুর্থ ধাপে পৌঁছোতে, যা কিনা পরম শান্তির দ্বারা সংজ্ঞায়িত। কিন্তু আমার সমগ্র জীবনে, বনপরীদের পর্ব ছাড়া, আমি মেয়েদের বিরক্তিকর বোকামি আর অস্বস্তিকর মধ্যমেধা সম্পর্কে অন্য লোকেদের চেয়ে বেশি জানতুম । পশুদের যে ব্যাপারটা আমি বেশি পছন্দ করি তা হলো তাদের সারল্য । তাহলে ভেবে দ্যাখো, আমার শেষ রক্ষিতা আমাকে কতো কষ্ট দিয়েছে । “সে ছিল এক রাজপুত্রের জারজ মেয়ে । সুন্দরী, নিঃসন্দেহে; নয়তো কেনই বা তাকে আমি নিয়ে আসতুম ? কিন্তু মেয়েটা সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে ফেললো এক কুরুচিপূর্ণ এবং বিকৃত উচ্চাকাঙ্খার ফলে । সে ছিল এমন নারী যে সবসময় পুরুষের ভূমিকাটা নিতে চাইতো : ‘তুমি তো পুরুষ নও ! আহ, যদি আমি পুরুষ হতে পারতুম ! আমাদের দুজনের মধ্যে, আমিই পুরুষ!’ অমনধারা অসহ্য কথাবার্তা ওর গলা থেকে বেরোতো যে কন্ঠ থেকে আমি চেয়েছিলুম গানের উড়াল । এবং যদি আমার মুখ ফসকে কোনো বই, কবিতা, কিংবা অপেরার সমাদরের কথা বেরোতো, ও তক্ষুনি বলে উঠতো : তুমি কি সত্যিই মনে করো ওটা ভালো ? অবশ্য, তুমি কীই বা জানো কাকে ভালো বলে ?’ আর তারপর তর্কাতর্কি আরম্ভ করে দিতো ।
    “একদিন, ও রসায়নের বিষয় আলোচনা করতে চাইলো : আর তারপর থেকে, ওর আর আমার ঠোটের মাঝে কাচের মুখোশ গড়ে উঠলো । তার সঙ্গে শালীনতার ভান । যদি আমি যখন তখন ওর প্রতি সামান্য প্রণয় প্রকাশ করার জন্যে এগোতুম, ও ছিঁড়ে নেয়া ফুলের মতন ঝিমিয়ে পড়তো….”
    “ব্যাপারটা কেমন করে শেষ হলো ?” ওদের মধ্যে একজন জানতে চাইলো। “আমি তো তোমার ধৈর্যশীলতা কখনও দেখিনি ।”
    “ঈশ্বর,” ও বলল, “রোগের সঙ্গে উপশমও পাঠান । একদিন আমি আমার মিনার্ভাকে দেখতে পেলুম, নিজের জোরালো আদর্শে বুভুক্ষু, আমার চাকরের সঙ্গে দৈহিকভাবে লিপ্ত, যে দৃশ্য দেখে আমি বাধিত হলুম চুপচাপ সরে যেতে যাতে তারা লজ্জায় না ভোগে । সেই সন্ধ্যায় আমি দুজনকেই বরখাস্ত করলুম, তাদের পাওনা টাকাকড়ি মিটিয়ে দিয়ে ।”
    “যদি আমার কথা বলি,” যে লোকটা মাঝখানে কথা বলেছিল সে বলল, “আমার তো নিজেকে ছাড়া আর কারোর বিরুদ্ধে নালিশ ছিল না । আনন্দ আমার সঙ্গে বসবাস করতে এলো, অথচ আমি তা বুঝতে পারিনি । বেশিদিন আগের কথা নয়, ভাগ্য আমাকে এক নারীসঙ্গের আনন্দ দান করেছিল যে ছিল খুবই মধুর, অত্যন্ত বশ্য, আর একান্ত অনুরক্ত জীব, আর সবসময় তৈরি ! আর কোনো রকম উৎসাহ ছাড়াই! ‘তোমাকে আনন্দ দেয় বলে আমি একাজ করে খুশি ।’ তা ছিল ওর গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া । তুমি ওই দেয়ালে ঠেলে বা এই সোফায় ফেলে ঠুকতে পারো, আর আমার রক্ষিতার ঠোঁট থেকে যে দীর্ঘশ্বাস বেরোতো তার চেয়ে দেয়াল আর সোফা থেকে পাওয়া যেতো একই শ্বাস, এমনকি সঙ্গমের বুনো আস্ফালনের সময়েও । দুজনে এক বছর একসঙ্গে বসবাসের পর, ও স্বীকার করল যে কখনও আনন্দ পায়নি । আমি সেই একতরফা দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে পড়লুম, আর অতুলনীয় মেয়েটি বিয়ে করে ফেললো । পরে, ওকে আবার দেখার রোখ চেপে বসল, আর ও আমাকে ওর ছয়টা সুন্দর বাচ্চা দেখিয়ে বলল, ‘প্রিয় বন্ধু ! স্ত্রী সেরকমই অক্ষতযোনি হয় যেমনটি তোমার রক্ষিতা ছিল।’ ওর কোনো কিছুই বদলায়নি । অনেকসময় আমি আফশোষ করি ; আমার উচিত ছিল মেয়েটিকে বিয়ে করা ।”
    অন্য সকলে হেসে উঠলো, আর তৃতীয়জন তার কথা বলা আরম্ভ করলো :
    “বন্ধুগণ, আমি কিছু আনন্দ পেয়েছি যা তোমরা হয়তো অবহেলা করেছ । আমি প্রণয়লীলায় হাসিঠাট্টার কথা বলতে চাই, এমন হাসিঠাট্টা যা সমাদর করতে উৎসাহ জাগায় । আমি আমার শেষ রক্ষিতাকে সবচেয়ে বেশি সমাদর করতুম, মনে হয়, যতোটা তোমরা নিজেদের রক্ষিতাকে ঘৃণা করতে বা ভালোবাসতে পারতে । যখনই আমরা কোনো রেস্তরাঁয় ঢুকতুম, কিছুক্ষণ পরে সবাই খাওয়া-দাওয়া ভুলে কেবল ওর দিকেই তাকিয়ে থাকতো । এমনকি বেয়ারারা আর কাউন্টারের মহিলারা ওর ছোঁয়াচে আহ্লাদে প্রভাবিত হতো আর নিজেদের কাজ অবহেলা করতো। সংক্ষেপে, কিছুদিনের জন্য আমি প্রকৃতির একজন জীবন্ত উদ্ভট সৃষ্টির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছি । মেয়েটি খেতো, চিবোতো, কামড়াতো, গোগ্রাসে গিলতো, আর হজম করতো, কিন্তু হালকাভাবে, জগতের সবচেয়ে বেপরোয়া চালে । ও আমাকে অনেককাল যাবত ভাবাবেশে উচ্ছ্বসিত রেখেছিল । ও বলত, মধুর, স্বপ্নালু, ইংরেজি, রোমান্টিক কন্ঠস্বরে ‘আমার খিদে পেয়েছে’ । আর পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দাঁত মেলে, কথাটা দিনের আর রাতের বেলা বারবার বলতো-- তোমরা একই সঙ্গে বিচলিত আর আনন্দিত হতে -- আমি ওকে মেলায় নিয়ে গিয়ে সর্বগ্রাসী দানবী হিসাবে প্রদর্শনী করে অনেক রোজগার করতে পারতুম । আমি খাইয়ে-দাইয়ে ভালোই রেখেছিলুম ; তবু ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল….”
    “নির্ঘাৎ কোনো মুদিখানার মালিকের কাছে, নাকি ?”
    “সেইরকমই একজন, সৈন্যবাহিনীর মাল সরবরাহকারী কেরানি, কোনো ঐন্দ্রজালিক ছড়ি প্রয়োগ করে লোকটা, বেচারী মেয়েটাকে কয়েকজন সেনার বরাদ্দ খাবারের ব্যবস্হা করে দিতো। আমার তো তাই মনে হয়।”
    “আমার কথা যদি বলো”, চতুর্থজন বলল, নারীর অহঙ্কার বলতে সচরাচর যা বোঝায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপারের নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হয়েছে আমাকে । আমার মনে হয়, তোমরা বড্ডো ভুল করছ, তোমরা যারা অতিভাগ্যবান নশ্বর মানুষ, তোমাদের রক্ষিতাদের ত্রুটির বয়ান করে-করে !”
    এই কথাগুলো বেশ গম্ভীরভাবে বলেছিল, যে লোকটাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল শান্তস্বভাব এবং আত্মসংবরণশীল, হাবভাব কেরানিদের মতন, ওর মুখাবয়ব ধূসর চোখের পরিষ্কার উজ্বলতায় বলতে চাইছিল : “আমি এটা চাই !” কিংবা, “তোমার ওটা করা উচিত!” কিংবা এমনকি, “আমি কখনও ক্ষমা করি না !”
    “যদি, আমি তোমাকে যতোটা উত্তজক বলে জানি, জি, কিংবা ঢিলেঢালা আর দুর্বল তোমাদের দুজনের মতন, কে আর জে, তোমাদের যদি আমার পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে জুটি বেঁধে দেয়া হতো, হয় তোমরা পালিয়ে যেতে কিংবা মারা পড়তে । আমি, আমি টিকে গেলুম, দেখতেই পাচ্ছ। একজন মহিলার কথা ভেবে দ্যাখো যে অনুভব বা বিচারে ভুল করতে অসমর্ধ ; একজন মহিলা যার চরিত্র ভয়ঙ্কর রকম শান্ত, ঠাট্টাইয়ার্কি বা জাঁকজমক ছাড়াই আত্মসমর্পিত, দুর্বলতা ছাড়াই মধুর, উগ্রতা ছাড়াই তেজোময় । আমার প্রেমের কাহিনি আয়নার মতন পালিশকরা পবিত্র পৃষ্ঠতলের ওপর দিয়ে অন্তহীন যাত্রার মতন, মাথাখারাপ-করা একঘেয়েমির, যে আয়নায় আমার নিজের বিবেকের হাস্যকর স্পষ্টতায় প্রতিফলিত হতো আমার যাবতীয় অনুভব আর অঙ্গভঙ্গী, যাতে না আমি আমার অবিচ্ছেদ্য অপচ্ছায়ার তাৎক্ষণিক ভর্ৎসনার যোগ্য কোনো অযৌক্তিক আবেগ বা কাজে জড়িয়ে পড়ি । প্রেমকে মনে হতো শিক্ষার বৈঠক । কতো যে বোকামির কাজ থেকে ও আমাকে বিরত করেছে, যে কাজ না করার দরুন আফশোষ হয় ! আমি রাজি না হওয়া সত্বেও কতো যে ধারদেনা শোধ করিয়েছে ! আমার ব্যক্তিগত মূর্খতা থেকে যে লাভ আমি পেতুম তা থেকে বঞ্চিত করেছে । ভাঙা চলবে না এমন শীতল নিয়মকানুনে বেঁধে সে আমার সমস্ত খামখেয়াল রুদ্ধ করেছে । আর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো যে ও কখনও চায়নি যে বিপদ কেটে যাবার পর ওকে ধন্যবাদ জানাই! কতোবার যে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছি ওর গলা ধরে চেঁচিয়ে বলি : ‘ওগো দুর্দশাময় নারী, একটু ত্রুটিপূর্ণ হও ! যাতে অসুস্হ আর ক্রুদ্ধ অনুভব না করে তোমাকে ভালোবাসতে পারি !’ অনেক বছর যাবত আমি ওকে সমাদর করেছিলুম, আমার হৃদয়ে ঘৃণা নিয়ে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত, আমি সেই ব্যক্তি নই যে মারা পড়ল !”
    “হায়”, সবাই বলল, “মেয়েটি মারা গেছে ?”
    “হ্যাঁ ! আমি অমনভাবে চালিয়ে যেতে পারছিলুম না । প্রেম আমার কাছে সর্বভূক দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল । বিজয় অথবা মৃত্যু, রাজনীতিকরা যেমন বলে থাকেন, এইটিই ছিল বেছে নেবার পথ যা নিয়তি আমাকে দিয়েছিল । একদিন রাতে, ঝিলের পাশের জঙ্গলে….মনখারাপ করা পায়চারির পর, যে সময়ে ওর দুই চোখে স্বর্গের মাধুর্য প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর আমার স্নায়ু ছিঁড়ে যাবার অবস্হায়…”
    “কী !”
    “ কি বলতে চাইছ !”
    “তোমার বক্তব্য কি ?
    “ব্যাপারটা ছিল অবশ্যম্ভাবী । অমন ত্রুটিহীন সেবিকাকে পেটানো, অপমান করা, কিংবা ছাঁটাই করা আমার বিবেকের উর্ধ্বে ছিল । কিন্তু সেই বোধের সঙ্গে আমাকে ভারসাম্য রাখতে হলো আমার মধ্যে প্রাণীটার দেয়া আতঙ্কের সঙ্গে ; অশ্রদ্ধা না করে প্রাণীটা থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার ছিল। তাছাড়া আমি আর কীই বা করতে পারতুম, যখন কিনা মেয়েটা ছিল নিখুঁত ?”
    অস্পষ্ট হতচেতন চাউনি মেলে ওর তিন বন্ধু ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন না বোঝার ভান করছে এবং যেন অন্তর্নিহিত অর্থোদ্ধার করতে পারছে যে, তাদের কথা যদি বলা হয়, তারা অমন কঠোর কাজ করার যোগ্য নিজেদের মনে করে না, তা যতো বিশ্বাসযোগ্য কথায় ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকুক না কেন ।
    তারপর ওরা আরেক প্রস্হ মদ আনতে বলল, সময় নষ্ট করার জন্য, যা জীবনকে নির্দয়ভাবে আঁকড়ে ধরে, আর একঘেয়েমিকে দ্রুতি দিতে পারে ।

    তেতাল্লিশ
    প্রণায়াভিলাষী লক্ষ্যবেধী
    জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘোড়ার গাড়িটা যাবার সময়ে, ও চালককে বলল গুলি-চালানো অভ্যাস করার মাঠের কাছে থামতে, বলল যে স্রেফ সময় কাটানোর জন্য কয়েক রাউণ্ড গুলি চালাবার সুযোগের আনন্দ নিতে পারবে । আর দানবটাকে মেরে ফেলা -- এটা কি প্রত্যেকের একেবারে মামুলি ও বৈধ পেশা নয় ? --- আর ও নিজের প্রণয়াভিলাষী হাত এগিয়ে দিলো ওর প্রিয়, সমধুর, এবং বিরক্তিকর নারীর দিকে, ওর রহস্যময় স্ত্রী যার প্রতি ওর বহু আনন্দদানের দেনা রয়েছে, বহু দুঃখ, এবং ওর প্রতিভার অনেকাংশ ।
    লক্ষ্যবিন্দু থেকে দূরে-দূরে কয়েকটা গুলি গিয়ে বিঁধলো, একটা গুলি তো গিয়ে ছাদে আটকে গেলো; আর যখন সুন্দরী প্রাণীটি আপ্রাণ হাসতে আরম্ভ করলো, নিজের স্বামীর অক্ষমতাকে ঠাট্টা করে, লোকটা হঠাৎ নারীটির দিকে ফিরে বলল, “ওখানে ডানদিকে ওই পুতুলটাকে দ্যাখো, বাতাসে নাক উঁচু করে উদ্ধত গোমর দেখাচ্ছে । ওগো ! আমার প্রিয় প্রতিমা, আমি কল্পনা করছি যে ওটা তুমি।” লোকটা চোখ বন্ধ করে ট্রিগার টিপলো । পুতুলটার মাথা সুস্পষ্টভাবে ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল । তারপর নিজের প্রিয়, সমধুর, বিরক্তিকর স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে, যে ওর অপরিহার্য এবং নির্দয় অনুপ্রেরণা, হাতে আনত চুমু খেয়ে বলল, “আহ, আমার প্রিয় প্রতিমা, আমার দক্ষতার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই !”

    চুয়াল্লিশ
    সুপ এবং মেঘ
    আমার ছোটোখাটো প্রেয়সী ক্ষেপি আমার জন্যে রাতের খাবার রাঁধছিল, আর খাবার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে আমি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলুম যে বাষ্প থেকে ঈশ্বর কেমন ভাসমান স্হাপত্য গড়ে তোলেন, স্পর্শাতীতের চমৎকার কারুকার্য । আর আমার ভাবনায়, আমি নিজেকে বলছিলুম : “এই সমস্ত মায়ামেঘ ঠিক আমার সুন্দরী প্রেয়সীর সুন্দর চোখের মতন, আমার ক্ষেপির দানবী সবুজ-চোখ যেন ।”
    এবং হঠাৎ আমার পিঠে একটা সজোর ঘুষি অনুভব করলুম, আর শুনতে পেলুম এক খসখসে, চমৎকার কন্ঠস্বর, ব্র্যাণ্ডিটানার দরুন গলাভাঙা পাগলি কন্ঠস্বর, আমার ছোটোখাটো প্রেয়সীর কন্ঠস্বর, যে বলছিল, “তাহলে, তুমি তোমার সুপ খেতে চলেছ, মেঘের কারবারী কুত্তির বাচ্চা কোথাকার ?”

    পঁয়তাল্লিশ
    গুলি চালানো শেখার মাঠ আর গোরস্তান
    “এক অসাধারণ সাইনবোর্ড” -- গোরস্তান দেখার হোটেল, আমাদের ফেরিঅলা নিজের মনে বলল, “কিন্তু যে কাউকে তৃষ্ণার্ত করে তোলার জন্যে ভালোভাবে তৈরি করা ! নিঃসন্দেহে, হোটেল মালিক হোরেস এবং এপিকিউরাসের কবিশিষ্যদের মর্ম উপলব্ধি করেন । হয়তো প্রাচীন মিশরীয়দের নিগূঢ় বিশোধনের সঙ্গে উনি পরিচিত, যাদের কাছে একটা কঙ্কালের উপস্হিতি ছাড়া কোনো ভোজসভা পূর্ণাঙ্গ হতো না, কিংবা জীবনের স্বল্পস্হায়িতার অন্য কোনো চিহ্ণ।”
    আর লোকটা ভেতরে ঢুকে গেল, কবরগুলোর দিকে মুখ করে এক গ্লাস বিয়ার খেলো, এবং ধীরেসুস্হে একটা চুরুট ফুঁকলো । হঠাৎ কোনো খামখেয়ালে আক্রান্ত হয়ে ও গোরস্তানে যাওয়া মনস্হ করল, ঘাসগুলো ছিল উঁচু আর্ আ্‌হ্বায়ক, আর এক ঝকমকে সূর্য সবার ওপর রাজত্ব করছিল ।
    সত্যি বলতে কি, মনে হচ্ছিল তীব্র আলো আর তাপ মাতাল সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়ছে, যা চমৎকার ফুলগুলোর ওপরে, যে ফুলগুলোর স্বাস্হ তলাকার পচনের কারণে বেশ পুরুষ্টু, তাদের ওপরে আগাপাশতলা জাজিম বিছিয়ে দিয়েছে । বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে জীবনের বিস্তৃত মর্মরধ্বনি -- সবচেয়ে ক্ষুদ্রের জীবন --- যা মাঝেমাঝে কাছাকাছি কোনো গুলিচালানো শেখার মাঠ থেকে রাইফেলের আওয়াজে বিঘ্নিত হচ্ছিল, শ্যাম্পেনের ছিপিখোলার মতন মৃদু নিচুস্বর ঐকতানের মাঝে ।
    তারপর, সূর্যের তলায়, যা ওর মস্তিষ্ককে পোড়াচ্ছিল, এবং মৃত্যুর উষ্ণ সুগন্ধের বাতাবরণে, যে গোরের ওপরে ও বসেছিল তা থেকে ফিসফিসে গলার আওয়াজ শুনতে পেলো। আর কন্ঠস্বর বলল, “তোমার লক্ষ্যবস্তু আর গুলিগোলা অভিশপ্ত হোক, তোমরা অস্হির জীবন্ত প্রানী কোথাকার, মৃতের আর তাদের বিশ্রামের পবিত্র জায়গা সম্পর্কে তোমাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই ! অভিশপ্ত হোক তোমাদের উচ্চাকাঙ্খা, তোমাদের পরিকল্পনা অভিশপ্ত হোক, তোমরা ধৈর্যহীন নশ্বর কোথাকার, মৃত্যুর নিভৃত আবাসের কাছে আসো হত্যার শিল্প শেখার জন্য !
    হায়, যদি তোমরা জানতে এই পুরস্কার জয় করা কতো সহজ, এই লক্ষ্যবিন্দুকে ভেদ করা কতো সহজ, আর মৃত্যু ছাড়া সবকিছুই শূন্য, তোমরা নিজেদের ওভাবে ফুরিয়ে ফেলতে না, তোমরা শ্রমশীল জীবন্ত প্রাণী কোথাকার, আর যারা বহুকাল আগে লক্ষ্যভেদ করেছে, যা কিনা এই বিরক্তিকর জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যবস্তু, তাদের ঘুমে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য তোমরা কম উৎপাত করতে !”

    ছেচল্লিশ
    মাথার পেছনের হারানো জ্যোতি
    “কী ? তুমি এখানে, আমার প্রিয় দোস্ত ? তুমি, এই রকম একটা নোংরা জায়গায় ! তুমি, যে সবচেয়ে অপরিহার্য পানীয় পান করো, দেবতাদের খাবার খাও ! সত্যি, এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার ।”
    “বন্ধুবর, তুমি ঘোড়া আর ঘোড়ারগাড়ি সম্পর্কে আমার আতঙ্কের কথা জানো। ঠিক এক্ষুনি, তাড়াতাড়ি বাগানের রাস্তা পার হবার সময়ে, কাদার ওপরে লাফ মেরে ওই ভ্রাম্যমান বিশৃঙ্খলায়, যেখানে মৃত্যু টগবগিয়ে তোমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফ্যালে, আমি আচমকা রূঢ়ভাবে হাঁটছিলুম আর আমার মাথা থেকে জ্যোতিটা খসে গেল, পড়ল গিয়ে রাস্তার কাদায় । ফিরে যাওয়ার ঝঞ্ঝাটের কোনো মানে হয় না । আমার মনে হলো নিজের হাড় ভাঙার চেয়ে নিজের তকমা হারানোটা কম অপ্রীতিকর । আর তারপর মনেমনে বললুম, প্রতিটি খারাপ ব্যাপারের একটা ভালো দিক থাকে । এখন আমি আত্মপরিচয় গোপন করে ঘুরে বেড়াতে পারি, বজ্জাতি করতে পারি, লাম্পট্যে নিজেকে সঁপে দিতে পারি, সাধারণ নশ্বর মানুষদের মতন । আর এখন এই আমি, অবিকল তোমার মতন, দেখতেই পাচ্ছ !”
    “তোমার উচিত জ্যোতিটার জন্যে একটা বিজ্ঞাপন দেয়া, কিংবা পুলিশের সাহায্য নিয়ে ফিরে পাবার চেষ্টা করা ।”
    “হায় ভগবান, না ! আমার এই ভাবেই ভালো লাগছে । কেবল একমাত্র তুমিই আমাকে চিনতে পেরেছ । আর তাছাড়া, মর্যাদা আমাকে বিরক্ত করে । আর আমার ভাবতে ভালো লাগছে যে কোনো মূর্খ কবি ওটা তুলে নিয়ে নির্লজ্জের মতন নিজের মাথায় পরে নেবে । কাউকে খুশি করা --- কতো যে আনন্দের ! আর তার চেয়েও উৎকৃষ্ট, যদি সে এমন কেউ হয় যাকে দেখে তুমি হাসাহাসি করতে পারবে ! ভেবে দ্যাখো, এক্স-এর মাথায়, কিংবা জেড-এর ! ওহ কতো মজার হবে।

    সাতচল্লিশ
    কুমারী বিসতৌরি
    শহরের শেষ প্রান্তে গ্যাসবাতির তলা দিয়ে হাঁটার সময়ে, অনুভব করলুম একটা হাত আস্তে আমার বাহু আঁকড়ে ধরল, আর আমার কানে একটা কন্ঠস্বর বলল, “আপনি একজন ডাক্তার, স্যার ?” আমি চেয়ে দেখলুম ; বেশ দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্হ্যবতী বড়ো-বড়ো চোখের যুবতী, মুখে যৎসামান্য সাজগোজ, শিরাবরণের ফিতের সঙ্গে বাতাসে তার চুল উড়ছে ।
    “না, আমি ডাক্তার নই । হতে চাই ।”
    “হ্যাঁ ! আপনি একজন ডাক্তার । আমি দেখে বলতে পারি । আমার বাসায় আসুন । আমার সঙ্গ আপনার ভালো লাগবে ; আসুন !!”
    “হতে পারে, আমি তোমার বাসায় যাবো, কিন্তু ডাক্তার হবার পরে, ধ্যাৎ !”
    “আহা, আহা”, মেয়েটি বলল, আমার বাহু আঁকড়ে থেকে, আর হাসতে লাগলো, “আপনি একজন মজার ডাক্তার । আপনার মতন কয়েকজনকে আমি জানি ! আসুন দিকিনি ।”
    আমি রহস্য বেশ পছন্দ করি, কারণ আমার সব সময়ে মনে হয় তার সমাধান করতে পারবো । তাই আমি এই নতুন সঙ্গিনীর টানের সঙ্গে চললুম, কিংবা বলা যায়, এই অপ্রত্যাশিত হেঁয়ালির সঙ্গে ।
    আমি ওর বাসার বর্ণনা বাদ দিচ্ছি ; তা বহু নাম-করা পুরোনো কবিদের রচনায় পাওয়া যাবে । যাই হোক, যে বিস্তারিত বর্ণনা অঁরি দ্য রেনিউ দেননি, দেয়ালে দুই বা তিনজন বিখ্যাত ডাক্তারের ছবি ঝুলছিল ।
    কতো যে প্রশ্রয় আমাকে দেয়া হলো ! জ্বলজ্বলে তাপ পোয়াবার আগুন, মশলা মেশানো মদ, চুরুট ; আর আমাকে এই জিনিসগুলো দেবার সময়ে এবং নিজে একটা চুরুট ধরিয়ে, মজার মেয়েটি আমাকে বলল: আরাম করে বসুন, বন্ধুবর, আয়েশ করে বসুন । এটা আপনাকে হাসপাতালের আর যৌবনের ভালো দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেবে -- আরে ! আপনার চুল অমন শাদা হয়ে গেছে কেমন করে ? সেসময়ে তো এরকম ছিল না, সেই কতোকাল আগে, যখন আপনি এল-এর শিক্ষানবীশ ছিলেন । আমার মনে আছে জটিল শল্যচিকিৎসায় আপনিই ওনাকে সাহায্য করতেন । তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি কাটাছেঁড়া করতে, কাঁচি চালাতে আর অংশ বাদ দিতে ভালোবাসতেন !
    আপনি ওনার হাতে সরঞ্জাম তুলে দিতেন, ক্ষতস্হান সেলাইয়ের সুতো আর স্পঞ্জ দিতেন -- আর আমার মনে আছে কেমন করে, যখন শল্যচিকিৎসা শেষ হয়ে যেতো, তিনি নিজের ঘড়ি দেখতেন আর গর্বভরে ঘোষণা করতেন, ‘পাঁচ মিনিট, ভদ্রমহোদয়গণ !’ ---ওহ, আমি, মনে পড়ছে । আমি সেই ভদ্রমহোদয়দের ভালোভাবে চিনি ।”
    কয়েক সেকেণ্ড পরে, এবার ঘরোয়া ঢঙে, মেয়েটি গল্পের সূত্র এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি একজন ডাক্তার, নয়কি, আমার প্রিয় বাঘ ?”
    মেয়েটির এই পাগলামির ধুয়া আমাকে বাধ্য করল চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে ।
    “না !” আমি চেঁচিয়ে বললুম ।
    “তাহলে একজন শল্যচিকিৎসক ?”
    “না, না ! যদি না আমি তোমার মাথা কেটে ফেলার জন্য শল্যচিকিৎসক হই ! পূতচরিত্র ম্যাকেরেল মাছ ঢোকানোর গর্ত কোথাকার !”
    “দাঁড়ান, “ মেয়েটি বলল । “আপনি নিজেই জানতে পারবেন ।”
    আর মেয়েটি আলমারি থেকে একতাড়া কাগজ বের করল, যেগুলো নামকরা ডাক্তারদের ছবির সংগ্রহ, মরাঁর লিথোগ্রাফ করা, যা কয়েক বছর কোয়ায় ভোলতেয়ারে প্রদর্শিত হয়েছিল ।
    “দেখুন ! এনাকে চিনতে পারছেন ?
    “হ্যাঁ ! ইনি এক্স । ছবির তলায় ওনার নাম ছাপা রয়েছে ; কিন্তু আমি ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ।”
    “হ্যাঁ আপনি তো চিনবেনই ! এটা, দেখুন ইনি জেড, যে লোকটি এক বক্তৃতায় এক্স সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এমন দানব যে নিজের আত্মার কালিমা মুখাবয়বে প্রকাশ করে !’ আর তা কেবল এই জন্যে যে বিশেষ এক রোগির ক্ষেত্রে দুজনের মতের মিল হয়নি ! বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই কতো হাসাহাসি করেছিল তখন, আপনার মনে আছে ? -- এবার এই যে, কে-এর দিকে দেখুন, যে খবর দিয়েছিল যে তার হাসাপাতালে বিপ্লবীদের সে চিকিৎসা করছে । তা ছিল দাঙ্গার সময়ে । অমন ভদ্রলোকের কেন অতো কম সাহস ছিল?--- আর এই যে ডাবলিউ, বিখ্যাত ইংরেজ ডাক্তার; উনি যখন প্যারিসে এসেছিলেন তখন ওনাকে পাকড়াও করেছিলুম । ওনাকে অনেকটা মেয়েদের মতন দেখতে, তাই না ?”
    এবং যখন আমি টেবিলের ওপরে রাখা সুতো বাঁধা একটা তাড়ায় হাত দিলুম, মেয়েটি বলল, “একটু দাঁড়ান ; ওগুলো শিক্ষানবীশদের, আর এই তাড়াটা যারা আবাসিক ছিল না তাদের।”
    তারপর মেয়েটি ফোটোগ্রাফের গোছা বের করল, সেগুলোতে মুখগুলো তরুণতরদের।
    “আমাদের যখন আবার দেখা হবে, আপনি আপনার ছবি আমাকে দেবেন, বলুন, দেবেন তো, হে প্রিয় ?”
    “কিন্তু”, আমি মেয়েটিকে বললুম, আমার ব্যক্তিগত আচ্ছন্নতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে অপারগ, “তুমি কেন মনে করো যে আমি একজন ডাক্তার ?”
    “কারণ আপনি কতো ভালো, নারীদের কতো সন্মান জানান !”
    “অদ্ভুত যুক্তি !” মনে মনে বললুম ।
    “ওহ, আমি তেমন ভুল করি না ; আমি ওনাদের অনেককে চিনি । আমি এই ভদ্রলোকদের এতো ভালোবাসি যে অসুস্হ না হলেও, আমি অনেকসময়ে তাঁদের কাছে যাই কেবল তাঁদের দেখবো বলে । ওনাদের কেউ কেউ শীতল কন্ঠে বলেন : ‘তুমি মোটেই অসুস্হ নও !’ কিন্তু কেউ কেউ আমাকে বুঝতে পারেন, যখন ওনারা দেখেন আমি কেমনভাবে তাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসছি ।”
    “আর যখন ওনারা তোমাকে বুঝতে পারেন না ?”
    “হায় ভগবান ! আমি তো তাঁদের কোনোভাবে বিরক্ত করিনি, আমি দশ ফ্রাঁ তাকের ওপরে রেখে দিই ! --- ওনারা এতো ভালো আর এতো ভদ্র, ওই লোকজন ! ---আমি একজন ছোটো শিক্ষানবীশকে পিটি-তে খুঁজে পেয়েছিলুম, দেবদূতের মতন সৌম্যকান্তি আর কতো নম্র ! কতো পরিশ্রম করতো, বেচারা ! ওর বন্ধুরা আমায় বলেছিল ওর অবস্হা ভালো নয়, কারণ ওর বাবা-মা গরিব আর ওকে টাকাকড়ি পাঠাতে পারেন না । শুনে আত্মবিশ্বাস হলো । আমি তো দেখতে যথেষ্ট ভালো, যদিও ততো কম বয়স নয় । আমি ওকে বললুম : ‘এসো, আমার সঙ্গে দেখা করো, আমার সঙ্গে প্রায়ই তুমি দেখা করবে । আর আমাকে নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না : আমার টাকাকড়ি চাই না !” কিন্তু আপনি বুঝবেন যে সেসব কথা আমায় নানা উপায়ে বলতে হয়েছিল ; আমি অমার্জিত ঢঙে বলতে চাইনি । ওকে অপমান করে ফেলার ভয় ছিল আমার, আমার খোকাবাবু !”
    “আচ্ছা ! তুমি কি বিশ্বাস করবে যে আমার এক ধরণের মজার উদ্দীপনা চাগিয়ে উঠেছিল যা ওকে বলার সাহস আমার হয়নি ?--- আমি চেয়েছিলুম ও আমাকে দেখতে আসুক ওর ডাক্তারি ব্যাগ আর শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি নিয়ে, এমনকি তাতে লেগে থাকা রক্তসুদ্দু আসুক !”
    মেয়েটি এই কথাগুলো বেশ অকপটে বলল, যেমনভাবে সংসারি লোক তার অভিনেত্রী প্রেমিকাকে বলবে, “আমি তোমাকে তোমার বিখ্যাত ভূমিকায় পরা পোশাকে দেখতে চাই।”
    আমি জেদাজেদি করে জিগ্যেস করলুম : “তুমি কি আমাকে বলতে পারো কোথায় তোমার এই অদ্ভুত চাহিদার সূত্রপাত ঘটেছিল ?”
    আমার কথা বোঝানো বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সফল হলুম । কিন্তু মেয়েটি বড়ো দুঃখি কন্ঠে জবাব দিল, যতোদূর আমার মনে পড়ে, আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে : “আমি জানি না….আমার মনে নেই ।”
    বিশাল একটা শহরে কতো অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যদি লোকে জানে যে কেমন করে চলাফেরা করতে হয় আর তাদের খুঁজতে হয় ! জীবনে ভেসে বেড়ায় নিষ্পাপ দানবেরা । --- হায় ভগবান, হে ঈশ্বর ! তুমি স্রষ্টা, তুমি মালিক ; তুমি আইন ও মুক্তি দুটিই গড়েছ ; তুমি সর্বভৌম যে অনুমতি দেয়, তুমি বিচারক যে ক্ষমা করে, তুমি উদ্দেশ্য ও কারণে সম্পূর্ণ, আর যে সম্ভবত ভয়ঙ্করের স্বাদ আমার আত্মায় দিয়েছে আমার হৃদয়ে পরিবর্তন ঘটানোর জন্য, ছুরির ডগা থেকে যেমন সুশ্রূষা আসে ; ভগবান, দয়া করো, পাগল ও পাগলিনীদের দয়া করো ! হে সৃষ্টিকর্তা ! তোমার দৃষ্টিতে তাদের কি রাক্ষস বলে মনে হয় কেননা কেবল তুমিই জানো কেন তাদের অস্তিত্ব, কেমন করে তাদের তৈরি করা হয়েছে এবং কেমন করে তাদের অন্যরকম তৈরি করা যেতে পারতো ?

    আটচল্লিশ
    এই জগতের বাইরে যেখানে হোক
    এই জীবন একটা হাসপাতাল যেখানে প্রতিটি রোগী বিছানা বদল করার জন্য হন্যে হয়ে থাকে। এই লোকটা আগুনের দিকে মুখ করে ভুগতে চায়, আর অন্যজন ভাবে জানালার পাশে থাকলে ভালো হয়ে উঠবে । আমার সব সময় মনে হয়েছে আমি যেখানে আছি তার চেয়ে অন্য যে-কোনো জায়গায় ভালো থাকবো, এবং এই অন্যত্র যাওয়ার প্রশ্ন আমি আমার আত্মার সঙ্গে অবিরাম আলোচনা করি ।
    “আমাকে বলো, আমার আত্মা, আমার বেচারা শীতল আত্মা, লিসবনে গিয়ে থাকার বিষয়ে কী ভাবো ? সে-জায়গাটা নিশ্চয়ই উষ্ণ, আর তুমি গিরগিটির মতন উদ্দীপিত হয়ে উঠবে । শহরটা জলের কিনারায় ; লোকে বলে শ্বেতপাথরের তৈরি, আর সেখানকার জনগণের উদ্ভিদ সম্পর্কে এমন ঘৃণা যে সব গাছপালা কেটে ফ্যালে । ন তোমার পছন্দ মতো একটা দেশ : আলো এবং আকরিক পদার্থে গড়া ভূদৃশ্য, আর তাদের প্রতিফলিত করার জন্য তরল !”
    সাড়া দেয় না আমার আত্মা ।
    “যেহেতু তুমি নীরবতা আর বহমানতার প্রদর্শনী ভালোবাসো, তুমি কি হল্যাণ্ডে গিয়ে বসবাস করতে চাইবে, মোহময় দেশে ? হয়তো ওই দেশে তোমার চিত্তবিনোদন করা হবে যার ছবি তুমি প্রায়ই মিউজিয়ামগুলোয় দেখে মুগ্ধ হয়েছ । তুমি রোটারডম সম্পর্কে কী ভাবো, তুমি তো জঙ্গল আর মাস্তুলশ্রেনি ভালোবাসো, আর বাড়ির বাইরে নোঙরবাঁধা নৌকো ?”
    আমার আত্মা বোবা হয়ে থাকে ।
    “ব্লাটভিয়া কি তোমার মুখে বেশি হাসি ফোটাবে ? সেখানে আমরা ক্রান্তিমন্ডলের সৌন্দর্যের সঙ্গে ইউরোপীয় কর্মশক্তির মেলবন্ধন খুঁজে পাবো ।”
    একটি শব্দ নয় -- আমার আত্মা কি মৃত ?
    “তাহলে, তুমি কি এতোই অনড় যে নিজের রোগ থেকেই কেবল আনন্দ পেতে চাও ? যদি তাইই হয়, তাহলে চলো সেইসব দেশে পালাই যারা মৃত্যুর সদৃশ । --- আমি জানি তুমি কী চাও, বেচারা আত্মা ! আমরা তোর্নিও যাবার জন্য বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে নেবো । আমরা আরও দূরে চলে যাবো, বালটিকের একেবারে শেষ পর্যন্ত ; এমনকি জীবন থেকে বহুদূরে, যদি তা সম্ভব হয় ; আমরা মেরুঅঞ্চলে বাসা বাঁধবো । সেখানে সূর্য পৃথিবীর কাছে তীর্যকভাবে আসে, এবং আলো ও রাত্রির ধীর পরিবর্তন বৈভিন্ন্যকে দমন করে একঘেয়েমিকে প্রশ্রয় দেয়, তা আরেক ধরনের শূন্যতা । সেখানে আমরা বহুক্ষণ ছায়ায় স্নান করতে পারবো, কেবল সেই সময়ে, যখন, ক্ষণে-ক্ষণে, উত্তরের আলো তাদের গোলাপি পিচকারি দিয়ে আমাদের চিত্তবিনোদন করবে, তা দেখে নরকের আতশবাজির প্রতিফলন মনে হবে !”
    শেষ পর্যন্ত আমার জ্ঞানী আত্মা কান্নায় ভেঙে পড়ে : “যেখানে হোক ! যেখানে হোক ! এই জগতের বাইরে যেখানে হোক !”

    উনপঞ্চাশ
    চলো গরিবদের ধরে পেটাই !
    সপ্তাহ দুয়েক আমি ঘরবন্দি ছিলুম, আর সেই সময়ের ফ্যাশান অনুযায়ী আমি নিজের চতুর্দিক বই দিয়ে ঘিরে রেখেছিলুম ( ঘটনাটা ষোলো বা সতেরো বছর আগের ); মানে সেই ধরনের বই যা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জনগণকে সুখি, জ্ঞানী আর ধনী করে তোলার শিল্প প্রতিপাদন করে।
    ফলে আমি হজম করলুম -- কিংবা গিললুম, আমি বলতে চাই -- জনগণের আনন্দের সকল ঠিকাদারদের লেখা দীপালোকের গন্ধ-মাখানো যাবতীয় পণ্ডিতি রচনা --- তাঁরা যাঁরা উপদেশ দিলেন যে গরিবদের সবায়ের উচিত কেনা গোলাম হয়ে যাওয়া, আর তাদের যাঁরা বোঝাতে লাগলেন যে তারা আসলে রাজপরিবারের সিংহাসনচ্যুত মানুষ । তাহলে অবাক হবার কথা নয় যে, আমি মূর্খতার কিনার বরাবর মাথা-ঝিমঝিমে অবস্হায় বিরাজ করছিলুম।
    তবু আমার মনে হলো যে আমি টের পাচ্ছি, আমার বোধের গভীরে কোথাও চাপা পড়ে আছে, এমন একটা ধারণার অজ্ঞাত বীজানু, যা বুড়ি বউদের ফরমুলার অভিধানের তুলনায়, যা এক্ষুনি পড়লুম, তার চেয়ে উচ্চতর । কিন্তু তা ছিল ধারণার অন্তর্গত ধারণা, এমনকিছু যা সীমাহীনভাবে অস্পষ্ট । আর আমি অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত অবস্হায় বাইরে বেরিয়ে পড়লুম । কেননা বাজে কিছু পড়ার আবেগান্বিত রুচি সমান্তরালভাবে খোলা হাওয়া আর ঠাণ্ডা পানীয়ের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্রয় দেয় ।
    আমি একটা মদের ঠেকে ঢুকতেই যাচ্ছিলুম, একজন ভিখারি তার টুপিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো, ভুলতে পারা যাবে না এমন এক চাউনি মেলে যা সিংহাসন ওলোটপালোট করে দিতে পারে --- মন যদি বস্তুকে সক্রিয় করে তুলতে পারে, কিংবা সন্মোহনকারীর দৃষ্টি যদি আঙুরফলে পাক ধরাতে পারে তেমন ।
    একই সঙ্গে, আমার কানে একটা গলার আওয়াজের ফিসফিসানি শুনতে পেলুম, একটা কন্ঠস্বর যা আমি তক্ষুনি ভালোভাবে চিনতে পারলুম ; ওটা ছিল ভালো দেবদূতের কন্ঠস্বর, কিংবা ভালো দানবের, যে সদাসর্বদা আমার সঙ্গে থাকে । যেহেতু সক্রেটিসের ছিল ভালো দানব, আমার কেন ভালো দেবদূত থাকবে না, আর কেনই বা আমি, সক্রেটিসের মতন, আমার নিজের পাগলামির প্রমাণপত্র পাবার গৌরবে অভিষিক্ত হবো না, কৌশলী লেলুট এবং বিচক্ষণ বেইলারজারের সই করা ?
    সক্রেটিসের আর আমার রাক্ষসের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে : ওনারটা ওনাকে দেখা দিয়েছিল বারন করার জন্য, হুশিয়ার করার জন্য, প্রতিরোধ করার জন্য, যখন কিনা আমারটা অভীষ্টপূরণের জন্য এসেছিলেন উপদেশ দিতে, স্মরণ করাতে, যুক্তি-পরামর্শ দিতে । বেচারা সক্রেটিসের ছিল এক নেতিবাচক রাক্ষস ; আমার অত্যন্ত ইতিবাচক, কর্মশক্তি প্রয়োগের রাক্ষস, লড়ে যাবার রাক্ষস ।
    এখন, আমার রাক্ষস কানে-কানে বলল : “অন্যের সমান সে-ই একমাত্র মানুষ যে তা প্রমাণ করতে পারে, আর একমাত্র সেই মানুষই মুক্তির হকদার যে জানে তা কেমন করে হাসিল করতে হবে ।”
    তক্ষুনি, আমি ভিখারিটার ওপরে ঝাঁপালুম । একটা ঘুষিতে ওর একটা চোখ কালো করে দিলুম, যা ক্ষণেকেই বলের মতন ফুলে উঠলো । ওর দুটো দাঁত ভাঙতে গিয়ে আমার একটা নখে চোট লাগল, এবং যেহেতু আমার কখনও মনে হয়নি যে গায়ে যথেষ্ট জোর আছে, অত্যন্ত রুগ্ন জন্মের কারণে আর বক্সিঙের বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল না বলে, বুড়ো লোকটাকে তাড়াতাড়ি কাবু করার জন্যে আমি এক হাতে ওর কলার চেপে ধরলুম আর অন্য হাতে ওর গলা টিপে ধরলুম, আর জোরে-জোরে ওর মাথা দেয়ালে ঠুকতে আরম্ভ করলুম । আমি স্বীকার করছি যে এই সব করার আগে আমি চারিপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলুম, আর দেখে নিয়েছিলুম যে ফাঁকা শহরতলিতে যেখানে আমি রয়েছি তা পুলিশের থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিরাপদ জায়গায় ।
    তারপর, ষাট বছরের দুর্বল বুড়োটাকে মাটিতে ফেলে, আমি ওর পেছনে একটা দ্রুত লাথি মারলুম, ওর শিরদাঁড়া ভেঙে দেবার জন্য যথেষ্ট, কাছাকাছি গাছের যে ডাল ঝুলছিল তা হাতে নিয়ে, বিফস্টিক রাঁধুনি একগুঁয়ে মেজাজে যেমন মাংস নরম করে, ওকে তেমন পেটালুম ।
    হঠাৎই --- আরে, অলৌকিক ঘটনা ! আহা , তত্বের গুরুত্ব প্রমাণ করার কি আনন্দ দার্শনিকের !---আমি দেখলুম প্রাচীন লাশ নড়েচড়ে উঠল, আর আমাকে এতো জোরে আক্রমণ করল যে আমি ভাবতেই পারিনি ভেঙে-পড়া যন্ত্রে অমন ক্ষমতা আছে ; আর, ঘৃণার চাউনি মেলে, যা আমার মনে হলো ভবিষ্যৎসূচক লক্ষণ, জরাজীর্ণ বুড়ো বজ্জাতটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার দুটো চোখকেই কালো করে দিলো, ঘুষি মেরে আমার চারটে দাঁত উপড়ে ফেললো, আর সেই একই গাছের ডালটা নিয়ে আমাকে মার দিয়ে প্লাস্টারের চেয়ে চ্যাপ্টা করে দিলো । --- আমার ঝাঁঝালো ওষুধ পেয়ে, আমি ওকে ওর গর্ব আর জীবন ফেরত দিলুম।
    তারপর, নানা ইশারার মাধ্যমে আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমাদের আলোচনা শেষ হয়েছে, আর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পোরটিকোর কুতার্কিকদের পরিতৃপ্তিসহ, আমি ওকে বললুম : “স্যার, আপনি আমার সমকক্ষ ! আমার টাকাকড়ি আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করার সুযোগ দিন ; আর মনে রাখুন, আপনি যদি প্রকৃত লোকহিতৈষী হন, যখনই আপনার কোনো সহযোগী ভিক্ষা চাইবেন, আপনি তাদের ক্ষেত্রে একই তত্ব প্রয়োগ করবেন যা আমি আপনার ক্ষেত্রে পয়োগ করার জন্য এতো কষ্ট করলুম ।”
    ও আমাকে আশ্বস্ত করল যে আমার তত্ব বুঝেছে, আর ও আমার উপদেশ মেনে চলবে ।

    পঞ্চাশ
    ভালো কুকুরেরা
    জোসেফ স্টেভেন্সের জন্য
    বুফোঁ ( যিনি পশুদের জীবন নিয়ে লিখেছেন ) সম্পর্কে আমার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে আমি কখনও কুন্ঠিত হইনি, এমনকি আমার শতকের তরুণ লেখকদের কাছেও ; কিন্তু বর্তমানে, প্রকৃতির তাবৎ সৌন্দর্যকে যে চিত্রকর উপস্হাপন করেন, আমাকে সাহায্য করার জন্য তাঁর আত্মাকে আর জাগিয়ে তুলবো না । উহুঁ।
    আমি বরং যেচে স্টার্নকে ডাক দেবো, আর তাঁকে বলব : “স্বর্গ থেকে নেমে আসুন, কিংবা এলিসিয় মাঠ থেকে আমার দিকে উঠে আসুন যাতে আমি ভালো কুকুরদের, খারাপ কুকুরদের, গুণগান করতে পারি, আপনার উপযোগী গান, হে ভাবপ্রবণ সিক, হে অতুলনীয় সঙ ! যে গাধাটা সব সময় আপনার সঙ্গে থাকে, ভবিষ্যতের স্মৃতির জন্য তার পিঠে চেপে ফিরে আসুন ; এবং সর্বোপরি, গাধাটাকে ভুলতে দেবেন না, তার ঠোঁটের মাঝে পরিচ্ছন্নভাবে ঝুলিয়ে আনতে, বাদামে তৈরি তার অমর বিস্কুট ! বিদ্যায়তনিক সৃষ্টিপ্রতিমার নাগালের বাইরে ! শালীনতার ভানকারী ওই বুড়ির আমার কোনো প্রয়োজন নেই । আমি পরিচিত সৃষ্টিপ্রতিমাকে আহ্বান জানাই, শহরের যুবতী, জীবন্ত, যাতে সে আমায় ভালো কুকুর, খারাপ কুকুর, বাজে গন্ধের কুকুর, গায়ে পোকাধরা ক্ষতিকর কুকুর যেগুলোকে সবাই হ্যাট-হ্যাট করে তাড়ায়, তাদের নিয়ে গান গাইতে সাহায্য করে, তারা গরিবদের সহচর, আর কবিরা তাদের ভাইয়ের দৃষ্টিতে সম্ভ্রম করে ।
    ফুলবাবু কুকুরদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, চারপেয়ে জড়বুদ্ধিগুলো, গ্রেট ডেন, কিঙ চার্লস, খ্যাঁদানাকি, কিংবা স্প্যানিয়েল, নিজেকে এতোই ভালোবাসে যে কেউ বেড়াতে আসলে তার পায়ের মাঝে বা কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন তাকে নিশ্চয়ই আদর করা হবে, বাচ্চার মতন চেঁচামেচি করে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো লোকের মতন বোকা, চাকরের মতন বদমেজাজি আর উদ্ধত ! এবং চার-থাবার সাপগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে, দুলুনিখোর ও অলস, যার নাম গ্রেহাউণ্ড, যার প্রলম্বিত চোয়ালে গন্ধ শোঁকার যৎসামান্যও বোধ নেই যে কোনো বন্ধুর গমনপথ অনুসরণ করবে, যার চ্যাপ্টা মাথায় ডমিনো খেলার মতন বুদ্ধিটুকুও নেই !
    এই সমস্ত ক্লান্তিকর পরগাছা নিয়ে ফেরা যাক কুকুরের কাঠঘরে ! ফেরা যাক তাদের রেশমের গদি-বসানো কুকুরবাসায় !
    আমি নোংরা কুকুরের গান গাই, দরিদ্র কুকুরের, গৃহহীন কুকুরের, অবাঞ্ছিত কুকুরের, ডিগবাজিখোর কুকুরের, যে কুকুরের সহজপ্রবৃত্তি, গরিবের মতন, জিপসির মতন, এবং অভিনেতার মতন, প্রয়োজনের দ্বারা চমৎকারভাবে তীক্ষ্ণ, সেই ভালো মা, বোধবুদ্ধির প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক নারী !
    আমি অভাগা কুকুরদের গান গাই, তারা একা ঘুরে বেড়াক, বিশাল শহরের ঘুরপাক গর্তগুলোয়, কিংবা সেইগুলো যারা তাদের কানা আধ্যাত্মিক চোখে পরিত্যক্ত লোকেদের বলে : “আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো, এবং আমাদের দুজনের দুর্দশা থেকে আমরা একরকম আনন্দ সৃষ্টি করতে পারবো !”
    “কুকুরগুলো কোথায় যায় ?” নেসতর রোকেপ্লাঁ একবার এক চিরস্হায়ী প্রবন্ধ লিখেছিলেন যে লেখাটা তিনি নিজেই হয়তো ভুলে গেছেন, আর যা কেবল আমি, এবং সম্ভবত স্যঁৎ বভ, আজ পর্যন্ত মনে রেখেছি ।
    কুকুরগুলো কোথায় যায়, আপনি জিগ্যেস করুন, হে অনাগ্রহী লোকজন ? তারা নিজের কাজে যায় ।
    কাজের সমাবেশ, প্রণয়লীলার সমাবেশ । কুয়াশার ভেতর দিয়ে, তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে, কাদার ওপর দিয়ে, জ্বলন্ত কুকুরদিবসের রোদে, তুমুল বৃষ্টিতে তারা যায়, তারা আসে, তারা হাঁটে, তারা ঘোড়ারগাড়ির তলা দিয়ে বেরোয়, পোকা কিংবা আবেগে চালিত হয়ে, কর্তব্যকর্মের দিকে যায় । আমাদের মতোই তারা ভোরবেলা ওঠে আর রোজগারের চেষ্টা করে কিংবা নিজেদের আনন্দের পেছনে দৌড়োয় ।
    অনেকে শহরতলির ভাঙাচোরা বাড়ির তলায় শোয় আর প্রতিদিন একই সময়ে র‌য়াল প্যালেসের
    রান্নাঘরের দরোজার সামনে টুকরো-টাকরা ভিক্ষা চায় ; অন্যেরা দলবেঁধে পাঁচ মাইল দৌড়োয় কোনো অবিবাহিতা ষাট বছরের বুড়িদের রাঁধা দাতব্য খাবার ভাগাভাগির জন্য, যে বুড়িরা তাদের দাবিদারহীন হৃদয়কে পশুদের বিলিয়ে দেন কেননা মূর্খ লোকেরা আর তাঁদের চায় না ।
    অন্যেরা, পলাতক কেনা-গোলামের মতন প্রেমে পাগল, নিজের এলাকা ছেড়ে নির্দিষ্ট দিনে শহরে এসে কোনো সুন্দরী কুকুরীর চারিপাশে ঘণ্টাখানেকের জন্য ক্রীড়াচঞ্চল হয়ে ওঠে, যে কুকুরী নিজের চেহারাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, গর্বিত ও কৃতজ্ঞ হয় ।
    এবং তারা সকলেই বেশ আচারনিষ্ঠ ও সময়নিষ্ঠ, কোনোরকম রোজনামচা, খাতা বা পকেটবই ছাড়াই ।
    আপনি কি শ্রমবিমুখ বেলজিয়ামে গেছেন, এবং মুগ্ধ হয়েছেন, আমার মতন, কসাইয়ের গাড়ির পেছনে বাঁধা প্রাণবন্ত কুকুরগুলোকে দেখে, কিংবা গয়লানির গাড়ি, বা পাঁউরুটিঅলার ঠেলার পেছনে বাঁধা, যাদের জয়ধ্বনির ঘেউঘেউ ঘোড়াদের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গর্ববোধ ও আনন্দ অনুভবের প্রমাণ ? যদি ইচ্ছা হয় তাহলে দুটি কুকুরের বিষয়ে ভেবে দেখুন যারা সভ্য সমাজস্তরের সদস্য । অনুমতি দিন আপনাকে একজন রাস্তার ক্রীড়া-প্রদর্শনকারীর ঘরটা দেখাই যে অনুপস্হিত । একটা রঙকরা কাঠের খাট, কোনও পর্দা নেই, ছারপোকাভর্তি কোঁচকানো চাদর, খড়ের গদিতে ঠেসান দেবার দুটো চেয়ার, একটা লোহার উনোন, একটা বা দুটো সঙ্গীতযন্ত্র । হায়, দুঃখি আসবাবপত্র ! কিন্তু চেয়ে দেখুন্, যদি দেখতে চান, ওই দুটি মেধাবী চরিত্র, মামুলি ও বিলাসী, সৈনিক বা প্রেমের গীতিকবিতা রচয়িতার মতন শোভন, উনোন থেকে আসা রহস্যময় পাঁচমিশালি রান্নার দিকে খেয়াল রেখেছে, যা থেকে উঁচু হয়ে বেরিয়ে আছে বড়োসড়ো হাতা, এমনভাবে রাখা যেন কোনো অট্টলিকার ছাদে বাঁশের মতু উঁচু যাতে সংকেত দেয়া যায় যে রাজমিস্ত্রির কাজ এখনও শেষ হয়নি ।
    নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে, নয় কি, যে অমন একান্ত অনুরত অভিনেতারা কাজে বেরোবার আগে পেটভরে কড়া, সারবান সুপ খেয়ে বেরোবেন না ? আর আপনার কি হিংসে হবে যদি এই বেচারা গরিবরা একটু আনন্দ করেন, কেননা তাঁদের তো প্রতিদিন জনগণের উদাসীনতা এবং ম্যানেজারের অসাধুতার মুখোমুখি হতে হয় --- যে লোকটা রোজগারের অধিকাংশ হাতিয়ে নেয়, যে চারজন অভিনেতার খাবার সুপ একাই খেয়ে নেয় ?
    আমি অনেকসময়ে লক্ষ্য করেছি, তাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আর তাদের সমব্যথার অংশীদার হয়ে, ওই চারপেয়ে দার্শনিকরা, ওই অনুগত, বশ্য, আত্মসমর্পণকারী কেনা-গোলামেরা, যাদের প্রজাতান্ত্রিক অভিধান বেসরকারি কেনা-গোলাম বলে সংজ্ঞায়িত করবে, যদি সেই প্রজাতন্ত্র, মানুষের সুখ সম্পর্কে অত্যধিক উদ্বিগ্ন হতো, কুকুরদের প্রাপ্য সন্মান নিয়ে চিন্তা করার সময় থাকতো ।
    এবং আমি অনেকসময়ে চিন্তা করেছি, ( যদিও, কে-ই বা তা জানে ? ) অমন সাহসকে পুরস্কৃত করার জন্য, অমন ধৈর্য ও পরিশ্রম, ভালো কুকুরদের জন্যে, গরিব কুকুরদের জন্যে , দুর্গন্ধিত ও অত্যাচারিত কুকুরদের জন্য একটা বিশেষ স্বর্গোদ্যান কোথাও তো হবে । কেননা সুইডেনবোর্গ তো জোর দিয়ে বলেছেন যে তুর্কিদের জন্য অমন বিশেষ জায়গা আছে, এবং আরেকটা আছে ওলন্দাজদের জন্যে !
    ভার্জিল এবং থিওক্রিটাসের মেষপালকরা, গানের প্রতিযোগীতায়, পুরস্কারের আশা করেছিল, সুস্বাদু পনির, সবচেয়ে ভালো কারিগরের তৈরি একটা বাঁশি, কিংবা থনে দুধভরা একটা ছাগলি । যে কবি বেচারা কুকুরদের গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন তিনি পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন গাঢ় আর ফ্যাকাশে রঙের ফতুয়াকোট, হেমন্তের সূর্যের স্মারকের মতন, স্বাস্হ্যবতী রমণীর সৌন্দর্যের মতন, এবং ভারতীয় গ্রীষ্মের মতন ।
    যারা রু ভিলা হেরমোসা শুঁড়িখানায় উপস্হিত ছিল তারা কখনই ভুলবে না কতো উৎসাহে চিত্রকর তাঁর ফতুয়াকোট খুলে ফেলে কবিকে দিয়েছিলেন, কেননা তিনি ভালোভাবেই জানতেন বেচারা কুকুরদের গান গেয়ে শোনানো কতো ভালো এবং সৎ ।
    তাই তো প্রাচীন কালে একজন চমৎকার ইতালীয় স্বৈরাচারী তাঁর মণিরত্নখচিত দৈব আরেতিনো ছোরা অথবা দরবারি পোশাক একটি অসাধারণ সনেট অথবা কৌতূহলোদ্দীপক বিদ্রূপাত্মক কবিতা রচয়িতার সঙ্গে অদল-বদল করে নিয়েছিলেন ।
    এবং যখনই চিত্রকরের ফতুয়াকোট কবি পরে নেন, তিনি ভালো কুকুর, দার্শনিক কুকুর, ভারতীয় গ্রীষ্মকাল, আর যৌবনশেষের নারীদের সৌন্দর্যের কথা ভুলতে পারেন না ।
    [ রচনাকাল : ১৮৫৫ - ১৮৬৭ ]
    [ প্রকাশকাল : ১৮৬৯ ]
    [ অনুবাদ : ২০১৯ ]
  • রঞ্জন | 232312.180.891223.206 | ১০ জুন ২০১৯ ১৫:২২383630
  • আশি পেরিয়ে মলয়বাবু অসাধারণ সব অনুবাদ করছেন।

    এরমধ্যে লোরকার 'অবিশ্বস্ত গৃহিণী' ষাটের গোড়ায় সুনীল অনুবাদ করেছিলেন ( "অন্যদেশের কবিতা" বইতে আছে ), ভালো লাগে নি ।
    যেমনঃ
    "তখন কেন বলল আমায় কুমারী সে,
    যখন তাকে নিয়ে গেলাম নদীর ধারে"।

    বরং মলয়বাবুর অনুবাদে কবিতাটা প্রাণ পেয়েছে। আশা করছি, গুরু'র কর্তৃপক্ষ এটা বই করবেন।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 012312.60.1234.251 | ১১ জুন ২০১৯ ১৭:১৯383631
  • বিট জেনারেশনের মহিলা কবি এলিজা কাওয়েন-এর কবিতা ( ১৯৩৩ - ১৯৬২ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "আমি শবগুলোর চামড়া ছাড়িয়ে নিলুম"
    আমি শবগুলোর চামড়া ছাড়িয়ে নিলুম
    আর আমার স্বপ্নের জন্য নীল রঙে রাঙিয়ে নিলুম
    ওহ, আমি এই পোশাক সর্বত্র পরে যেতে পাসরি
    বাড়িতে বসে রইলুম জিনস পরে।

    আমি শবগুলোর চুল কেটে দিলুম
    আর নিজের জন্যে বুনলুম পোকার পক্ষাবরণ
    রেশম বা পশমের চেয়ে সূক্ষ্ম আমার মনে হয়
    আর তার ভেতরে কাঁপতে লাগলুম ।

    আমি শবগুলোর কান কেটে ফেললুম
    আমার মাথা ঢাকার টুপির জন্যে
    চোরকাঁটার চেয়ে উষ্ণ
    আমি তার দাম দিলুম রক্ত দিয়ে ।

    আমি শবগুলোর চোখ উপড়ে নিলুম
    যাতে সূর্যের মুখোমুখি হতে পারি
    কিন্তু দিনগুলো ছিল মেঘলা আকাশ
    আর আমি হারিয়ে ফেলেছিলুম নিজের।

    শবেদের যৌনাঙ্গ থেকে
    আমি কর্মীসঙ্ঘের উর্দি বানালুম
    এসথার, সলোমন, ঈশ্বর নিজে
    আমার যোনির চেয়ে উদার ছিলেন ।

    আমি শবগুলোর চিন্তা নিয়ে নিলুম
    প্রতিদিনের প্রয়োজনের খাতিরে
    কিন্তু সব দোকানে সব জিনিসে
    সুন্দর করে লেবেল লাগানো ছিল ‘আমি’।

    আমি শবগুলোর মাথা ধার নিলুম
    পড়ার সুবিধার জন্য
    প্রতিটি পাতায় দেখলুম নিজের নাম
    আর যতো মিথ্যা শব্দ বলেছি সেগুলো।

    শবগুলোর হাড় থেকে গড়া এক যন্ত্র
    আমার মানুষের ভালোবাসার সঙ্গে খেলবে
    কেবল যে শব্দ বেরোবে চাবিগুলো থেকে
    তা পায়রাদের বকবকম ।

    আমি অসংখ্য কবরের ভেতরে খুঁড়লুম
    আমি ভাবলুম আমার সময় বেশ ভালো কাটলো
    আয়নার দিকে যখন তাকাই সে খিলখিল হাসে
    আমার মাথায় টাক আমি অন্ধ আর গায়ে সজারুর কাঁটা ।

    আমি ভাবলুম শবগুলো গুরুত্বপূর্ণ
    যে ঝুঁকি নিয়েছি তা নিশ্চিন্ত করেছে
    যে বস্তুগুলো আমি নিয়েছি
    তা দামি বিশুদ্ধ শ্বেতপাথরের ।

    কিন্তু যখন এক হৃদয়ের আকর্ষণে পড়লুম
    ( ছোটো মণিরত্ন দিয়ে বদলাবার পর )
    দেখলুম তা মনের মতন রক্তে ভরা
    আর আমারটা হয়ে গেল ভুতুড়ে ।

    এখন যখন আত্মাদের সঙ্গে দেখা হয়
    যাদের ফাঁদে আমি কারারুদ্ধ
    তারা আমায় মদ কিনে দেয় বা বই পড়ে শোনায়
    কেউই আমার জামিন দিতে পারে না ।

    আমি যখন আত্মা হয়ে গেলুম
    ( আমাকে জীবনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে )
    আমি আমার মারাত্মক দেহকে বিক্রি করলুম
    ছাত্র-ডাক্তারের ছুরির কাছে ।

    "এমিলি ডিকিনসনকে লেখা কাল্পনিক প্রেমপত্র"
    এমিলি
    গ্রীষ্ম এলে
    তুমি খুলে ফেলবে তোমার
    রত্নময় মৌমাছিগুলো
    যেগুলো আমাকে হুল ফোটায়
    আমি খুলে ফেলবো আমার দুর্গন্ধময়
    জিনস
    হাতে হাত রেখে
    আমরা বাইরে দৌড়োবো
    সরাসরি দেখবো
    সূর্যের দিকে
    দ্বিতীয়বার
    তামাটে ত্বকের হয়ে ওঠার জন্যে

    আমি মনে করতে পারছি না
    প্রশ্নটা -- সমাধান এইভাবে হলো
    বালির দুটো ঢিবি
    মরুভূমিতে বাঁয়ে আর ডাইনে, কিন্তু
    উত্তরটা ছিল না দীর্ঘ থাম
    এক কাপ চা তাদের মাঝে

    মুখের প্রতিটি শব্দ এতো কঠিন
    আর বিদেশযাত্রা প্রয়োজন
    দেয়াল পর্যন্ত আর ফেরত

    ঠিক এক্ষুনি মেয়েটা যে পারে
    কিছুই না করে তাকিয়ে থাকতে--

    যখন ওরা, জনসাধারণ, জগতসংসার
    সামলাবার লোক, চেয়ার আর টেবিল তাতে
    অবস্হান তাদের সবায়ের মাঝে, গুনতে ব্যস্ত
    জিনিসগুলো আমি জানি এখানে আছে
    কল্পনা করতে হবে পরিসর অতিক্রম করে
    আমার চোখের কেবল যদি যতোদূর ছবিগুলো
    কম বাস্তব হয়ে যায় । বিশাল সূর্য
    বন্ধ জানালার ভেতর দিয়ে
    তারপর আমিও
    শেষ পর্যন্ত দুজনেই অদৃশ্য হয়ে যাবো

    "একটা পুরুষ আরশোলা"
    একতা আরশোলা
    ঢুকে এলো
    আমার জুতোর ভেতরে
    সুগন্ধী অন্ধকার ওর ভালো লাগলো

    একটা আরশোলা
    আমার জুতোর ওপরে
    উঠে এলো
    শীত আর আলো এড়াতে

    আমি আমার হাত
    ঢোকালুম
    ওর পেছনে

    আরশোলা
    তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো যা করতে পারি
    তোমাকে তুলনা করতে পারি কাঁসার সঙ্গে
    আর ইহুদিদের

    তুমি মোটেই স্বাগত নও
    আমার জুতো ব্যবহার করার জন্য
    পথের ধারে এক খেপ আরাম পেতে

    আমার হাতের ছায়ায়
    তুমি ফিরে আসতে থাকো
    মেঝের ওপরে
    আরও কিছু ? -- ভার --
    তুমি একটা শুঁড় হারিয়ে ফেলেছো
    আমি তোমার শুশ্রুষা করব

    "শিক্ষক -- তোমার দেহ আমার কাব্বালা…"
    শিক্ষক -- তোমার দেহ আমার কাব্বালা
    রাহামিম --দরদ
    তিফেরেতে -- সৌন্দর্য
    মিস্টার রচেস্টারের চুরুটের সুবাস
    ফুলের মাঝে
    ফেটে বেরোচ্ছে
    আমি তোমার কন্ঠরোধ করতে চাইছি
    সূক্ষ্ম চিন্তা
    প্রস্তাব রাখা হয়েছে
    ফ্র্যাংকেনস্টাইন থেকে মনোরম সৌষ্ঠব
    আমার ভয় থেকে জেগেছে
    আর তুমি
    সুন্দরভাবে
    আমার গলা চেপে ধরো

    দেহ আত্মার সামনে ক্ষুধার্ত
    আর তারপর নিজের স্মৃতির জন্য ধাক্কা দেবার পর

    কেন ভয় নেই উপযুক্তকে আঘাত করার---
    বুদ্ধি ছাড়া আমাকে আঘাত করতে পারে না, মজার
    আমি পারিনি, পারব না শিল্পের ক্ষেত্রে
    কিন্তু গোলাপ বা পচা বাঁধাকপি দিয়ে

    ঠিক--শুধু এসো আমি বাদামি কাগজ ভেঙে বেরোই
    ঘর
    তোমার
    ফ্র্যাংকেনস্টাইন
    জগত কি থেকে দেবেরো বাবিসতে
    দড়ির ওপরে হাঁটে আমি
    দেসনুয়েলু ( সে কে ? ) তোমার কন্ঠরোধ করার জন্য
    দুহামেল আর তুমি
    দে ব্রৌলে সুন্দরভাবে
    দেবেরক্স আমার গলা টিপে ধরো
    দেক্রক্স
    দেবেরক্স
    বারাল্ট
    সূক্ষ্ম
    ফরাসি যুক্তি
    গির্জা সন্ন্যাসিনীদের কালো ফুলের শেকল
    আমরা সবাই খুনি
    কেইথের বুড়ো বাপ ঢেউয়ে লাফিয়ে পড়ল
    মেথাড্রিন
    সকালের সূক্ষ্ম নাচ
    “আমি চাই তুমি আমাকে ডেকে নিয়ে যাও
    যখন আমি পড়ে যাবো”
    আমি যাইনি আর পড়ে গেলুম
    এমনকি মৃত্যুও নয়
    আমি অপেক্ষা করলুম
    ডুবে যাবার
    ঘরের সঙ্গে
    বিড়াল গুয়ের মতন
    আমাকে নিয়ে যাবে

    ডোনাল্ডের প্রথম বিছানা যেখানে এই কল্পনা
    লজ্জা ওকে তোমায় পালটে ফেলছে
    আর তুমি বলছ কুলফুলের গোটানো কাগজ
    আর সবুজ মোটরগাড়ি
    লজ্জা দেহকে চিন্তা যোগাচ্ছে
    আর খেলা
    বিড়ালের দোলনা আর কাল্পনিক
    জ্ঞানের জাফরি আর বাখ
    প্রণালী
    ভয় তৈরি করছে অপরাধবোধ তৈরি করছে লজ্জা
    তৈরি করছে কল্পনা আর যুক্তি আর খেলা আর
    সৌম্য গরিমাকে ঢাকা
    ঘটনার স্মৃতিকে ফাঁকা করে দিচ্ছে
    মামুলি সৌম্য দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে গরিমা
    ঢেকে দিচ্ছে
    দেবদূতদের মাঝে ভেঙচি
    হবে না পারব না
    খুনির ভয়
    ঝোলাভরা কৌশল আর কর্নেলের ছবি নিয়ে বেঁটে লোক
    আমার হত্যা আমার জন্য করে দেবে
    ঈশ্বর লুকোনো
    আর ছবির পোস্টকার্ডের জন্য নয় ।

    "এমিলি"
    আমহার্সটের শাদা ডাইনি এমিলি
    আমহার্সটের ভীরু শাদা ডাইনি
    নিজের শিক্ষদের খুন করল
    তার ভালোবাসা দিয়ে
    আমি বরং নিজেরটা কবর দেবো
    আমার মন
    কিংবা ভালো হবে ই নরম ধূসর পায়রা।
  • Hettie Jones ( Wife of Amiri B | 012312.60.4534.236 | ১৩ জুন ২০১৯ ১০:০৬383632
  • বিট জেনারেশনের মহিলা কবি হেটি জোনস-এর কবিতা ( ১৯৩৪ -
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "আবহাওয়া"
    আমার কবিতার ফোলডার
    লেবেল দেয়া “আবহাওয়া” তাতে
    আবহাওয়া সম্পর্কে কোনো সূত্র নেই
    কিংবা তাতে থাকবেও না

    আবহাওয়া সম্পর্কে বলতে হলে, ধরো,
    কঠিন বৃষ্টি যেমন “ছোটো পেরেক”, কিংবা
    সেই বানভাসি “ঝাঁপদেয়া ঔজ্বল্য”

    এখন যেহেতু আমরা যুদ্ধ করতে ঝাঁপিয়েছি
    আর যুদ্ধ কখনও থামে না বৃষ্টি-ফোঁটার মতন

    সেই আগের বারের ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতন
    পুরোনো টিনের স্নানঘরের ফোকরে

    বেড়ে ওঠার মিষ্টি ইশারা
    নরম ভিজে উত্তরে ভাসমান

    আগুন কিংবা বরফ, আগুন কিংবা বরফ

    তুমি কি শ্বাস নিচ্ছ, তুমি কি যথেষ্ট সৌভাগ্যবান
    যে শ্বাস নিতে পারছ

    "হার্ড ড্রাইভ"
    শনিবার তুলোভরা ভাল্লুকগুলো আবার উঠে পড়েছিল
    মেজর দিগনের ওপরে
    সেতুর রেললাইন ধরে প্লাস্টিক পরে নাচছিল
    অর্ধেক নীল, অর্ধেক কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের তলায়
    আর শাদা মেঘও ছিল
    ভেসে আসছিল পশ্চিম থেকে

    যা যথেষ্ট হতে পারতো
    যারা আনন্দে মাতে তাদের জন্য
    ছোটো ছোটো কিস্তিতে

    কিন্তু পরে, সূর্যাস্তের সময়ে,
    কাঠচেরাই কলের পাশ দিয়ে ভেসে গেল উত্তর দিকে
    ঝোড়ো বাতাসে, বড়ো মেঘের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে
    রাস্তার ওপরে জানোয়ারের মতন
    নিজেদের গোলাপি তলপেট সম্পর্কে বেশ গর্বে
    জোরালো আলোর মুহূর্তে
    আমি দেখতে পেলুম একটা এডওয়ার্ড হপার বাড়ি,
    একই সঙ্গে সুন্দর-হালকা রঙ আর অন্ধকারাচ্ছন্ন
    যে আমি কেঁদে ফেললুম, রুট নম্বর বাইশ ধরে
    সেই অনিয়ন্ত্রিত চোখের জল
    “যেন দেহ নিজেই কাঁদছিল”

    আর তাই তরুণীরা
    এখানেই সমস্যা
    যা নিজেই সমাধান

    আমি সব সময়েই এরকমই থেকেছি
    কেঁদে ফেলার মতন এক নারী
    আর যথেষ্ট পুরুষ
    যে-কোনো দিকে আমার মোটরগাড়ি চালিয়ে নেবার জন্য

    "তুর্কি আত্মহত্যার জন্য বিলাপ, বয়স ২২"
    ও যা চেয়েছিল তা আরও বেশি
    স্কুল কিংবা একটা চাকরি, যেভাবেই হোক
    ও একটা আঁটোসাঁটো স্কার্ট যোগাড় করে ফেলল

    মেয়েটি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়নি

    কিন্তু ওর বাবা স্কার্টটা পুড়িয়ে দিলেন
    আর তিনজন লোক ওকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দিলো

    মেয়েটি সেইটুকু বেঁচে থাকতে চেয়েছিল লেখার জন্য
    যে ও মরে যেতে চায়

    আর তারপর ও কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠল
    আর বাতাসে পা রেখে দিলো
    আর ছেড়ে ফেলল ওর সংক্ষিপ্ত
    জীবনের শিল্পকৌশল

    "প্রশংসা"
    মেরি পনসটের জন্য
    সবাই মাঝ-সপ্তাহের বাজারের প্রশংসা করে,
    ঋতুর প্রথম যৌন শসা
    ভিড়ে ঠাশা তাদের বাক্স থেকে
    তাকিয়ে রয়েছে

    সবাই চেরিগুলোর প্রশংসা করে, তাদের শক্ত
    লাল তলপেট, মিষ্টি, সরু ডাঁটি
    আর গর্ত, আহা গর্ত, সেবা করার জন্য
    মুখের ভেতরে পুরে, ছাড়িয়ে নেবার জন্য ভুলিয়ে
    শেষ মিষ্টি কামড়, প্রশংসা
    করো । সবায়ের প্রশংসা করো । সবাইকে প্রশংসা।

    "সনেট"
    ভালোবাসা কখনও হামার হাত ধরেনি
    গ্রীষ্মকালের সেইসব দম্পতির মতন
    তালুতে তালু, নিখুঁত
    আঙুলে আঙুলে বোনা
    চাপ দেয়া
    ভালোবাসা কখনও ঝাঁপায়নি
    আমার কাঁধের পাশে, কিংবা
    আমার পানোৎসবপ্রিয় কোমর মাপেনি
    যদিও ভালোবাসা ছিল এক ওস্তাদ
    আর ও হাসতো যখন আসতো
    ডাকাত পেটাবার মতন করে যে
    ওকে প্রত্যাখ্যান করতো, আহ ।
    আমি বশ্যতা স্বীকার করলুম, আপশোষ নেই
    কিন্তু আমি সব সময়ে অবাক হয়েছি
  • Denise Levertov | 012312.60.4534.236 | ১৩ জুন ২০১৯ ১০:১০383588
  • বিট জেনারেশনের মহিলা কবি ডেনিসে লেভেরটভ-এর কবিতা ( ১৯২৩ - ১৯৯৭ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
    "ঘোষণা"
    আমরা দৃশ্যটা জানি : ঘর, নানাভাবে সাজানো,
    প্রায় সব সময়েই এক বক্তৃতার টেবিল, একটা বই ; সব সময়
    দীর্ঘ লিলিফুল ।
    বিশাল ডানা মেলে পবিত্র মহিমায় নেমে এলেন,
    দৈবিক দূত, দাঁড়িয়ে বা মাথার ওপরে ঘুরছেন,
    যাকে উনি চেনেন, এক অতিথি ।
    কিন্তু আমাদের বলা হয়েছে ভীরু আনুগত্যের কথা। কেউ বলেনি
    সাহস
    উৎসারিত তেজোময়তা
    তাঁর অনুমতি ছাড়া সামনে যায়নি । ঈশ্বর অপেক্ষা করছিলেন।
    উনি স্বাধীন
    গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে, বাছবার অধিকার
    যা মানবিকতার অঙ্গ ।
    কোনো ঘোষণা কি নেই
    এক বা অন্য ধরণের বেশিরভাগ জীবনের ?
    অনেকে অনিচ্ছায় পরম নিয়তি বেছে নেয়,
    তাদের কার্যকর করে বিরূপ গর্বে,
    বুঝতে না পেরে ।
    বেশিরভাগ সময়ে সেই মুহূর্তগুলো
    যখন আলো আর ঝড়ের পথএকজন পুরুষ বা নারীর অন্ধকার থেকে বেরোয়,
    তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়
    আতঙ্কে, দুর্বলতার ঢেউয়ে, বিষণ্ণতায়
    আর অসুবিধা লাঘবে।
    সাধারণ জীবন চলতে থাকে।
    ঈশ্বর তাদের যন্ত্রণা দেন না ।
    কিন্তু সিংহদুয়ার বন্ধন হয়ে যায়, লোপাট হয় পথ…
    উনি একজন শিশু ছিলেন যিনি খেলা করতেন, খেতেন, বানান
    করতেন অন্য শিশুদের মতন -- কিন্তু অন্যদের মতন,
    দয়া ছাড়া কাঁদতেন না, হাসতেন না
    বিজয়ে নয় আনন্দে ।
    সমবেদনা ও বুদ্ধি
    মেশানো ছিল তাঁর মধ্যে, অবিভাজ্য ।
    আরও যুগান্তকারী নিয়তির জন্য ডাক পড়ল
    অন্যান্যের চেয়ে বিশেষ সময়ে,
    উনি পেছপা হলেন না,
    কেবল জিগ্যেস করলেন
    সহজভাবে, “কেমন করেই বা এটা হতে পারে ?”
    আর গম্ভীরমুখে, সৌজন্যে,
    দেবদূতের উত্তর হৃদয়ে মান্যতা দিলেন,
    তক্ষুনি বুঝতে পারলেন
    তাঁকে যে অদ্ভুত মন্ত্রিত্ব উপহার দেয়া হচ্ছিল :
    তাঁর গর্ভে ধারণ করতে হবে
    অনন্ত ওজন আর ভারহীনতা ; বইতে হবে
    গোপনে, সীমিত অন্তরে,
    নয় মাসের অনন্তকাল ; ভেতরে রাখতে হবে
    কোমল অস্তিত্ব,
    ক্ষমতার যোগফল--
    এক মৃদু মাংসে,
    আলোর যোগফল ।
    তারপর জন্ম দিতে হবে,
    বাতাসে ঠেলে বের করতে হবে, এক মানব-শিশুকে
    অন্য সকলের মতন যার প্রয়োজন
    দুধ আর ভালোবাসা---
    কিন্তু তিনি ছিলেন ঈশ্বর ।

    "উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ায়"
    ক্ষয়রোগে মৃত ইউকালিপটাস গাছগুলোর মাঝে,
    ক্রিসমাসের তুষারে মরচে-পড়া গাছ আর ঝোপের মাঝে
    ক্ষেত আর পাহাড়তলি পাঁচ বছরের খরায় হাঁপিয়ে-ওঠা,
    এক ধরণের বাতাসি শাদা ফুল নিয়মিত ফুটেছে
    পুনরায় ফুটেছে, আর ফিকে গোলাপি, ঘন গোলাপি ঝোপ--
    এক সূক্ষ্ম আতিশয্য । তাদের মনে হল
    অতিথিরা আনন্দে এসে পড়ছেন পরিচিত
    উৎসবের দিনে, বছরের ঘটনাগুলো সম্পর্কে অবিদিত, দেখতে পাননি
    চটের পোশাক অন্যেরা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।

    আমাদের কয়েকজনের, মনপরা উপত্যকা ভালো সঙ্গ দিচ্ছিল
    আমাদের লজ্জা আর তিক্ততার পাশাপাশি । আকাশ চিরকেলে-নীল
    প্রতিদিনের সূর্যোদয়, আমাদের বিরক্ত করছিল হাসাবার বোতামের মতন।
    কিন্তু ফুটেথাকা ফুলগুলো, সরু ডাল আঁকড়ে
    উড়ন্ত পাখিদের চেয়েও বেশি সতর্ক,
    ভেঙেপড়া হৃদয়কে উৎসাহিত করছিল
    এমনকি তার নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ।
    কিন্তু
    আশার প্রতীক হিসাবে নয় : ওরা ছিল ফালতু
    অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ
    --আবার, আবার--- আমাদের নামে ; আর হ্যা, তারা ফিরছিল
    বছরের পর বছর, আর হ্যাঁ, সংক্ষিপ্ত সময়ের নির্মল আনন্দে উজ্বল হয়ে উঠছিল
    অন্ধকার আলোর বিরুদ্ধে
    শয়তানি দিনগুলোর। ওরা আছে, আর ওদের উপস্হিতি
    স্তব্ধতায় অনির্বচণীয় -- আর বোমাবর্ষণ হচ্ছিল, ছিল
    সন্দেহ নেই আরও হবে ; সেই শান্ত, সেই বিশাল শ্রুতিকটূতা
    যুগপৎ । কোনো কথা দেওয়া হবনি, ফুলগুলো
    তো পায়রা নয়, কোথাও রামধনুও ছিল না । আর যখন দাবি করা হল
    যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, তা মোটেই শেষ হয়নি ।

    "প্রেমের কবিতা"
    হতে পারে আমি একটা অসুস্হ অংশ
    একটা অসুস্হ জিনিসের
    হয়তো কোনোকিছু
    আমাকে ধরে ফেলেছে
    নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে
    আমাদের মাঝে
    আমি তো তোমাকে
    দেখতেই পাই না
    কিন্তু তোমার হাত দুটো
    দুটো জানোয়ার যা ঠেলে দেয়
    কুয়াশা একপাশে আর আমাকে ছোঁয় ।

    "বিবাহ সম্পর্কে"
    আমাকে বিয়ের বাঁধনে জেলে পুরো না, আমি চাই
    বিয়ে, একটা
    সাক্ষাৎ প্রতিদ্বন্দ্বীতা--
    আমি তোমাকে বলেছিলুম
    সবুজ আলো
    মে মাসের
    ( নৈশব্দের একটা পরদা ফেলা হয়েছে
    শহরের মাঝখানের বাগানে,
    গত
    শনিবারের পর
    দুপুর, দীর্ঘ
    ছায়া আর শীতল
    বাতাস, সুগন্ধ
    নতুন ঘাসের,
    নতুন পাতার,
    ফুল ফোটার জন্য তৈরি
    প্রচুর---
    আর পাখিগুলোকে সেখানে আমি দেখেছিলুম,
    উড়ন্ত পাখিরা যাত্রাপথে থামছে,
    বিভিন্ন রকমের তিনটি পাখি :
    আজেলা-ফুলের রঙ গোল মাথা, কালচে,
    চিত্রবিচিত্র, ফুরফুরে, ইঁদুরপেছল পাখি,
    আর সবচেয়ে ছোট্ট, সোনালি কাঁটাদার ঝোপের মতন পরে আছে
    কালো ভেনিশিয় মুখোশ
    আর তাদের সঙ্গে তিনটে সম্ভ্রান্ত গৃহিনী পাখি
    কোমল বাদামি জীবন্ত পালকে মোড়া---

    আমি দাঁড়ালুম
    আধঘণ্টার মতো জাদুমগ্নতার তলায়,
    কেউ কাছ দিয়ে যায়নি
    পাখিগুলো আমাকে দেখলো আর
    আমাকে যেতে দিলো
    তাদের কাছে ।)

    এটা
    অপ্রাসঙ্গিক নয় :

    আমার সঙ্গে
    দেখা হবে

    আর তোমার সঙ্গে
    দেখা করব
    তাই,

    একটা সবুজ
    ফাঁকা জায়গায়, কারারুদ্ধ
    থাকতে চাই না ।

    "মনচলার পর"
    একবার আমরা খেটেখুটে
    আমাদের পুরোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর --
    ‘ভৌতিক’, ‘ঘন’, ‘বাস্তব’, ‘বস্তুনিচয়’ -- থেকে মুক্ত হলে
    প্রাচীন পরিমাপ থেকে স্বীকার করতে হয় কি,
    যদিও খোলাচোখে কিন্তু লুণ্ঠিত
    নেত্রগোচর যন্ত্রপাতিতে, দর্শনীয় নয় ( ওহ,
    সংক্ষেপে দেখা যায় না ! ) স্বীকার করতে হয়
    যে ‘বড়ো’ আর ‘ছোটো’ ওদের
    মর্মার্থ নেই, কেননা বস্তু নয় বরং প্রক্রিয়া, কেবল প্রক্রিয়া,
    চেষ্টা করে দেখা দেবার
    জ্ঞানযোগ্য : জগতসংসার, ব্রহ্মাণ্ড---
    তারপর আমরা যা অনুভব করি
    দুর্বল গ্রেপ্তারের মুহূর্তে,
    আতঙ্কের কালো কাপড় পড়ে যাচ্ছে
    আমাদের মুখের ওপরে, আমাদের শ্বাসের ওপরে,
    তা পাসকালের আতঙ্কের নতুন এক মোচড়,
    নিরীক্ষণের এক প্রসারণ,
    এর উদ্দেশ্য এখন
    আমাদের মাংসের ভেতরে, অনন্ত পরিসর আবিষ্কার
    আমাদের নিজের অণুর ভেতরে, নূনতম
    কণা যাকে আমরা অনুমান করেছিলুম
    আমাদের নশ্বর অহং ( আর ভেতরে আর বাইরে,
    তারা ঠিক কি ? ) -- তারা এখন উদ্দেশ্য
    আগে থেকে ফেলে যাওয়া শূন্যতা
    বিলাসের ঘোষণা, পরিমাপের বিরে
    আমাদের অশরীরী, কাল্পনিককে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া,
    ( হ্যাঁ, কিন্তু সংবেদী, ) পদার্থের ধারণা,
    আমাদের ভাষার মতনই ভ্রমাত্মক,
    প্রবহণ যা আত্মা কেবল
    পরিব্যপ্ত, এড়িয়ে যায় কিন্তু নাছোড় ।

    "বিবাহের অবিরাম বেদনা"
    বিবাহের অবিরাম বেদনা:
    উরু আর জিভ, হে প্রিয়,
    এর সঙ্গে বেশ ভারি,
    তা দাঁতে স্পন্দিত হয়

    আমরা আংশিদারীর চেষ্টা করি
    কিন্তু ফিরিয়ে দেয়া হয়, হে প্রিয়,
    প্রত্যেকে আর প্রত্যেকে

    এটা হল প্রকাণ্ড হাঙর আর আমরা
    তার পেটের ভেতরে
    আনন্দ খুঁজি, কোনও আনন্দ
    যা এর বাইরে জানা যাবে না
    দুই বনাম দুই এর সিন্দুকের
    মধ্যে এর অবিরাম বেদনা ।

    "নভেম্বর ১৫, ১৯৬৯ বিচার বিভাগে"
    বাদামি ডিজেল-ধোঁয়া, শাদা
    রাস্তার বাতগুলোর তলায় ।
    তিন দিকে ছাঁটা, সব জায়গা ভরা
    আমাদের দেহ দিয়ে ।
    দেহ যা হুমড়ি খেয়ে পড়ে
    বাদামি বাতাসহীনতায়, শাদা রঙে রাঙানো
    আলোয়, এক ছাতাপড়া বিহ্বল দ্যুতি,
    যা হুমড়ি খেয়ে পড়ে
    হাতে হাত দিয়ে, অন্ধ-করে-দেয়া, মুখবিকৃতি ।
    তাকে চাই, চাইছি
    এখানে উপস্হিত থাকতে, দেহ বিশ্বাস করছে নিজের
    বিবমিষায় মৃত্যু, আমার মাথা
    নিজের বিষণ্ণতায় স্পষ্ট, এক ধরণের আনন্দ,
    জানতে পারা যে এটা মোটেই মৃত্যু নয়,
    মামুলি, এক দুর্ঘটনা, একটা
    ঠুনকো মুহূর্ত। তাকে চাই, চাইছি
    আমার যাবতীয় চাহিদা দিয়ে এই ক্ষোভ,
    দেহের ভেতরে জানতে পারা
    আমরা সকলে কঠোর অস্বাভাবিকতার
    বিরুদ্ধে লড়ছি, চাইছি এর বাস্তব রূপ।
    নদীর তীরে যেখানে ডিজেলের ধোঁয়া
    আইভিলতায় পাক খেলো, পরস্পরকে টেনে নিয়ে
    ওপর দিকে, অচেনা, ভাইয়েরা
    আর বোনেরা । কিছুই
    ঘটবে না কিন্তু
    তিক্ততার স্বাদ নেয়া
    স্বাদ । নেই জীবন
    অন্য, এটা ছাড়া ।
  • dc | 232312.174.565612.209 | ১৩ জুন ২০১৯ ১০:১৩383589
  • জোর বেঁচে গেলাম। টইটার শুরুটা পড়তে গিয়ে একটা দাঁত নড়ে গেল, আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি চোখ বুজে ফেলেছি বাবা।
  • Atoz | 125612.141.5689.8 | ১৩ জুন ২০১৯ ১০:১৮383590
  • সেই ভোগোনদের কথা মনে পড়ে গেল। এক জবরদস্ত সেনাপতিকে একটা থামের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে কবিতা শোনাচ্ছিল। ঃ-)
  • dc | 232312.174.565612.209 | ১৩ জুন ২০১৯ ১০:২১383591
  • প্রসটেটনিক ভোগন জেল্ট্জ। তা এই কবিতাগুলো ভোগনদের কবিতার থেকে কিছু কম না। কিংবা কে জানে, হয়তো এগুলো আসলে ভোগনদেরই কবিতা।
  • Atoz | 125612.141.5689.8 | ১৩ জুন ২০১৯ ১০:৩২383592
  • ভোগোনদেরই। নির্ঘাৎ এসব ভোগোনদেরই। ঃ-)
  • Lenore Kandel | 012312.60.56.222 | ১৫ জুন ২০১৯ ১০:৫০383593
  • বিট জেনারেশনের মহিলা কবি লেনোর কানডেল-এর কবিতা ( ১৯৩২ - ২০০৯ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "ঈশ্বরের/প্রেমের কবিতা"
    ভালোবাসার অন্য কোনো পথ নেই/কিন্তু/সুন্দর/
    আমি তোমার সবকিছু ভালোবাসি
    আমি তোমাকে ভালোবাসি/তোমার শিশ্ন আমার হাতে
    পাখির মতন চঞ্চল হয়ে ওঠে
    আমার আঙুলগুলোয়
    যেমন যেমন তুমি ফুলে বেড়ে ওঠো আর কঠিন হও আমার হাতে
    বাধ্য করো আমার আঙুলগুলোকে খুলতে
    তোমার শক্ত শক্তি
    তুমি সুন্দর/তুমি সুন্দর
    তুমি এক শতবার সুন্দর
    আমি আমার প্রেমের হাত দিয়ে তোমাকে আলোড়িত করি
    গোলাপি-নখ দীর্ঘ আঙুল
    আমি তোমাকে সোহাগ করি
    আমি তোমাকে আদর করি
    আমার আঙুলের ডগা...আমার হাতের তালু…
    তোমার লিঙ্গ উঠে দাঁড়ায় আর আমার হাতে স্পন্দিত হয়
    এক চমকপ্রদ জ্ঞান/যেমন আফ্রোদিতি জানতেন
    একটা সময়ে দরবতারা পবিত্র ছিলেন
    /আমি মনে করতে পারি লতাকুঞ্জের মধ্যে রাতগুলো
    আমাদের রস মধুর চেয়েও মিষ্টি
    /আমরা একইসঙ্গে ছিলুম মন্দির আর দেবতা/
    আমি তোমার সঙ্গে নগ্ন
    আর আমি আমার মুখ তোমাতে দিচ্ছি শ্লথতায়
    আমি অপেক্ষা করছি তোমাকে চুমু খাবার জন্য
    আর আমার জিভ তোমাকে পুজো করছে
    তুমি সুন্দর
    তোমার দেহ আমার কাছে এগিয়ে আসে
    মাংসের সঙ্গে মাংস
    ত্বক পিছলে যায় সোনালি ত্বকে
    যেমন আমার তোমাতে
    আমার মুখ আমার জিভ আমার হাত
    আমার তলপেট আর পাদুটি
    তোমার মুখে তোমার ভালোবাসায়
    অবাধে...অবাধে…
    আমাদের দেহ আলাদা হয় আর জোড়া লাগে
    অসহ্যভাবে
    তোমার মুখাবয়ব আমার ওপরে
    যাবতীয় দেবতাদের মুখাবয়ব
    আর সুন্দর রাক্ষসদের
    তোমার চোখ
    ভালোবাসা ভালোবাসাকে ছোঁয়
    মন্দির আর দেবতা
    এক

    "সন্মতির বয়স"
    দেবদূতদের সঙ্গে কথা না বলে আমি সন্তুষ্ট হই না
    আমি দেবতার চোখ দেখতে চাই
    যাতে ব্রহ্মাণ্ডে অলৌকিকতার টোপ দেবার জন্য নিজেরটা প্রয়োগ করতে পারি
    যাতে শ্বাস ফেলতে পারি আর বিষ ওগরাতে পারি
    যাতে ওই দরোজাটার তালা খুলতে পারি যেটা আগেই খোলা আর ঢুকতে পারি বর্তমানে
    যা আমি কল্পনা করতে পারি না
    আমি তার জবাব চাই যে প্রশ্নগুলো করতে এখনও শিখিনি
    আমি আলোকপ্রাপ্তিতে প্রবেসের দাবি করছি, অলৌকিকতার সংমিশ্রণে
    অসহ্য আলোর উপস্হিতিতে
    হয়তো সেই ভাবেই যেভাবে গুটিপোকারা তাদের উড়ালের ডানা দাবি করে
    কিংবা ব্যাঙাচিরা দাবি করে তাদের ব্যাঙজীবন
    কিংবা মানবসন্তান দাবি করে তার বেরোনো
    উষ্ণ গর্ভের সুরক্ষা থেকে

    "প্রথমে ওরা দেবদূতদের জবাই করলো"
    ১.
    প্রথমে ওরা দেবদূতদের জবাই করলো
    তারের দড়ি দিয়ে তাদের রোগা শাদা পা বেঁধে
    আর
    তাদের রেশমের কন্ঠ শীতল ছুরি দিয়ে চিরে
    মুর্গির বাচ্চার মতন ডানা ঝাপটিয়ে তারা মারা গেল
    আর তাদের অবিনশ্বর রক্ত জ্বলন্ত পৃথিবীকে ভিজিয়ে দিলো
    আমরা মাটির তলা থেকে তা দেখলুম
    সমাধিফলক থেকে, কবরের গুপ্তঘরে
    আমাদের হাড়গিলে আঙুল চিবিয়ে
    আর
    পেচ্ছাপে দাগ-ধরা গোটাবার চাদরে কাঁপতে লাগলো
    বিদায় নিয়েছে উচ্চশ্রেনির দূতেরা আর স্বর্গীয় দূতেরা
    ওরা ওদের খেয়ে ফেলেছে আর মজ্জার লোভে হাড় ফাটিয়েছে
    ওরা নিজেদের পাছা পুঁছেছে দেবদূতদের পালকে
    আর এখন তারা পাথুরে রাস্তায় হাঁটছে
    আগুনের গর্তের মতন চোখ নিয়ে

    ২.
    দেবদূতদের ব্যাপারে কে শাসকদের খবর দিয়েছে ?
    কে যিশুর শেষ-ভোজের পেয়ালা চুরি করেছে আর তা বদলে দিয়েছে একজগ মদ দিয়ে?
    কে গ্যাব্রিয়েলের সোনালি শিঙকে লোপাট করেছে ?
    তা কি কোনো ভেতরের লোক করেছিল ?
    কে দেবতার মেষশাবককে পুড়িয়ে খেয়েছে ?
    কে সন্ত পিটারের চাবিগুলো উত্তর সাগরতীরের
    পায়খানার মধ্যে ফেলেছে ?
    কে সন্ত মেরিকে ঘরসামলাবার ছাপ মেরেছে ?
    তা কি কোনো ভেতরের লোক করেছিল?
    আমাদের অস্ত্রগুলো কোথায় ?
    আমদের গদাগুলো কোথায়, আমাদের আগ্নেয়তীর, আমাদের বিষ-গ্যাস
    আমাদের হাতবোমা ?
    আমরা বন্দুকের জন্যে হাতড়াই আর আমাদের হাঁটুতে গজায় ক্রেডিট কার্ড।
    আমরা বাতিল চেক বমি করি
    দুই পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি চাপের সামনে সাবান-মাখা মুখে ফুঁপিয়ে
    আমাদের রেডিওঅ্যক্টিভ চোখে
    আর চিৎকার করি
    শেষতম রাইফেলের জন্য
    পয়গম্বরি কামান
    ইস্টারের বোমা
    নারীদের গর্ভ চিরে শিশুদের বের করে আনে
    বেয়োনেট দিয়ে
    অন্ধ নার্সদের চোখে রক্ত ছেটাতে থাকে
    তাদেরই তরোয়ালে তাদের কচুকাটা করার আগে
    পুরুষদের লিঙ্গ হয়ে উঠেছে নীল ইস্পাতের মেশিনগান,
    বুলেট বীর্যপাত হয়, মৃত্যুকে ওরা অরগ্যাজমের মতন ছড়িয়ে দ্যায়
    ঝোপের ভেতরে প্রেমিকরা একে আরেকের লিঙ্গ ওপড়াতে থাকে
    লোহার নখ দিয়ে
    টাটকা রক্ত খেতে দেয়া হয় স্বাস্হ্যের জন্য বীজানুহীন
    কাগজের কাপে
    ক্লাবের সিফিলিসে ভোগা মেয়েরা তা এক ঢোঁকে গিলে ফ্যালে
    পেপিয়ার মাশে মুখোশ পরে
    প্রত্যেকে মুখ হাতে রাঙানো হ্যামলেটের মা
    দশ বছর বয়সে
    আমরা মাটির তলা থেকে দেখি
    আমাদের চোখগুলো দূরবীনের মতন
    আমাদের আঙুল ছুঁড়ে দিই কুকুরদের দিকে লজেঞ্চুসের জন্য
    তাদের ডাক থামাবার উদ্দেশে
    শান্তি বজায় রাখার খাতিরে
    বন্ধুত্ব করা আর প্রভাবিত করার জন্য

    ৩.
    বোমা পড়লে আশ্রয় নেবার কোলাপসিবল ঘরগুলো আমরা কোলাপস করে দিয়েছি
    আমরা জীবন বাঁচাবার গোটাবার নৌকোগুলো গুটিয়ে ফেলেছি
    আর বারোটা বাজবার পর
    সেগুলো ভেঙেচুরে ইঁদুরের গুয়ে জমে পাহাড় হয়েছে
    সার হয়েছে বিষাক্ত ফুলের জন্য
    আর ভিনাসকুঁজো গাছের জন্য
    মাটির তলায় আমরা গুঁড়ি মেরে থাকি
    আমাদের ছ্যাঁদাকরা বুক জড়িয়ে ধরি ছাতাপড়া বাহু দিয়ে
    আমাদের ছিন্ন শিরা থেকে টপটপ রক্ত পড়ার আওয়াজ শুনতে থাকি
    আমাদের চেনলাগানো খুলির ব্রহ্মতালু উপড়ে তুলি
    মস্তিষ্কে হাওয়া খেলানোর জন্য
    ওরা আমাদের দেবদূতদের খুন করেছে
    কৌতূহলীদের কাছে আমরা আমাদের দেহ আর সময় বিকিয়ে দিয়েছি
    আমরা আমাদের শৈশব বেচে দিয়েছি ডিশওয়াশার আর মিলশহরের বিনিময়ে
    আর নুন ঘষেছি রক্তাক্ত স্নায়ুতে
    অনুসন্ধানের সময়ে
    আর ওরা দেবতার খোলা মুখে হেগেছে
    ওরা সন্তদের শেকল বেঁধে ঝুলিয়েছে আর ওরা
    পয়গম্বরদের ঘুমের ইনজেকশান দিয়েছে
    ওরা ক্রিস্ট আর শিশ্ন উভয়কেই অস্বীকার করেছে
    আর বুদ্ধকে বলেছে স্কিৎসোফ্রেনিবার রোগী
    ওরা যাযকদের আর পবিত্র পুরুষদের নপুংসক করে দিয়েছে
    এমনকি প্রেমের শব্দগুলোকে সেনসর করেছে
    প্রতিটি মানুষের জন্য মগজের শল্যচিকিৎসা!
    আর তারা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য একজন অবমানবকে বেছেছে
    প্রতিটি গৃহিণীর জন্য মগজের শল্যচিকিৎসা!
    প্রতিটি ব্যবসাদারের জন্য মগজের শল্যচিকিৎসা !
    শিশুদের প্রতিটি স্কুলের জন্য মগজের শল্যচিকিৎসা !
    আর তারা দেবদূতদের খুন করেছে

    ৪.
    এখন গলিগুলোতে উভলিঙ্গীরা জড়ো হয় কুষ্ঠরোগিদের ঘণ্টা বাজিয়ে যেমন করে ধুনুচি জ্বালিয়ে দেবতাদের ধর্ষণ করার উৎসবের তোড়জোড় করে
    যে চর্বি ওদের ঠোঁটে চকচক করে তা দেবদূতদের দেহের
    যে রক্ত তাদের থাবায় জমে থাকে তা দেবদূতদের রক্ত
    ওরা রাস্তায় জড়ো হচ্ছে আর দেবদূতদের চোখ নিয়ে দাবা খেলছে
    ওরা শেষ মানুষদের প্রলয়ের জন্য গড়ে তুলছে

    ৫.
    এখন ভোরবেলার পরে
    আমরা মাটির তলায় পাথর সরাচ্ছি, গুহার ভেতর থেকে
    আমরা ফণিমনসার আঠায় পাওয়া দৃষ্টিপ্রতিভায় চোখ বড়ো করে তুলেছি
    আর দাঁত মেজেছি গত রাতের মদে
    আমাদের বগল ঠুসে বন্ধ করেছি ধুলোয় আর ছুঁড়ে দিয়েছি
    আর তর্পণ করেছি একে আরেকের পায়ে
    আর আমরা রাস্তায় ঢুকবো আর তাদের মধ্যে হাঁটবো আর লড়াই করব
    আমাদের রোগা ফাঁকা হাত তুলে ধরব ওপরে
    আমরা জগতের আগন্তুকদের মাঝে তিক্ত বাতাসের মতন প্রবেশ করব
    আর আমাদের রক্ত গলিয়ে ফেলবে লোহা
    আমাদের শ্বাস গলিয়ে ফেলবে ইস্পাত
    আমরা খোলা চোখে মুখোমুখি দাঁড়াব
    আর আমাদের চোখের জল ঘটাবে ভূকম্পন
    আর আমাদের বিলাপ পাহাযগুলোকে উঁচু করে তুলবে
    সূর্যের পথচলা থামিয়ে দেবে
    ওরা আর কোনো দেবদূতকে খুন করতে পারবে না !

    "সঙ্গমের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি করা"
    সঙ্গমের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি করা
    ভালোবাসার সমস্ত উষ্ণতা আর আরণ্যকতা নিয়ে সঙ্গম করা
    তোমার মুখের জ্বর আমার তাবৎ গোপনীয়তা আর অজুহাত খেয়ে ফেলছে
    আমাকে রেখে যাচ্ছে বিশুদ্ধ জ্বলন্ত নিঃশেষে
    এই মিষ্টতা সহ্য করা কঠিন
    মুখ প্রায় ছুঁচ্ছে না মুখকে

    স্তনবৃন্তের সঙ্গে স্তনবৃন্ত আমরা ছুঁইয়েছি
    আর আমরা হয়ে গেছি সহসা অসাড়
    এক তেজোময়তার স্রোতে
    যা কিছু আমি এতোকাল জেনেছি তার অতিরিক্ত
    আমরা স্পর্শ করলুম

    আর দুই দিন পরে
    আমার হাত জড়িয়ে ধরল তোমার ধাতুরসাসিক্ত শিশ্ন
    আবার !
    তেজোময়তা
    বর্ণনাতীত
    প্রায় অসহনীয়

    প্রপঞ্চগুণহীন বস্তু আর প্রপঞ্চের মাঝের আড়াল
    অতিক্রম করে
    বৃত্ত সাময়িকভাবে পরিপূর্ণ
    ক্রিয়ার ভারসাম্য
    নিখুঁত
    একসঙ্গে পাসাপ[আশি, আমাদের দেহ ভালোবাসায় মজে যাচ্ছে
    যা কখনও মজেনি এর আগে
    আমি তোমার কাঁধে চুমু খাই আর তা থেকে লালসার গন্ধ বেরোয়
    কামদগ্ধ দেবদূতদরা নক্ষত্রদের সঙ্গে সঙ্গম করছে

    আর চিৎকার করে স্বর্গকে জানাচ্ছে তাদের অপ্রশমণীয় আনন্দ
    ধুমকেতুদের লালসা ধাক্কা খাচ্ছে অপার্থিব মৃগিরোগে
    স্ত্রীপুরুষ লক্ষণান্বিত দেবতারা পরস্পরের সঙ্গে
    অচিন্ত্যনীয় কাজ করছে
    চিৎকার করেসমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে আর তা অতিক্রম করে
    ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের আহ্লাদ
    আর আমরা পাসাপাশি, আমাদের দেহ ভিজে আর জ্বলন্ত,
    আর
    আমরা ফোঁপাই আমরা ফোঁপাই আমরা ফোঁপাই অবিশ্বাস্য চোখের জলে
    যা সন্তরা আর পবিত্র মানুষেরা ঝরিয়েছে
    তাদের নিজেদের জ্যোতির্ময় দেবতাদের সামনে

    আমি কানে কানে তোমার প্রতিটি রোমকূপে ভালোবাসা জানিয়েছি
    যেমন তুমি জানিয়েছ
    আমাকে
    আমার সমস্ত দেহ হয়ে উঠেছে যোনিমুখ
    আমার পা আমার হাত আমার তলপেট আমার বুক আমার কাঁধ আমার চোখ
    তুমি তোমার জিভ দিয়ে
    আমাকে অবিরাম সঙ্গম করো তোমার দৃষ্টি দিয়ে
    তোমার কথা দিয়ে তোমার উপস্হিতি দিয়ে
    আমরা অন্য মূর্তিতে বদলে যাচ্ছি
    আমরা কোমল উষ্ণ আর কম্পনরত
    নতুন সোনালি প্রজাপতির মতন

    তেজোময়তা
    বর্ণনাতীত
    প্রায় অসহনীয়
    রাতের বেলায় অনেক সময়ে আমি দেখি তোমার দেহ উদ্ভাসিত

    ভালোবাসার গ্রিক দেবতা/কবিতা
    ভালোবাসার যুবক গ্রিক দেবতাকে প্রণাম যিনি তরুণীদের সঙ্গে সঙ্গম করেন!
    কেবল দেবতারাই অমন ঔদার্য্য পছন্দ করেন
    সবায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন সুষমা
    ভালোবাসার গ্রিক দেবতাকে প্রণাম ! যিনি সৌন্দর্য্যকে ভালোবাসেন
    আর তা সর্বত্র পান
    হে ভালোবাসার গ্রিক দেবতা আমি তোমাকে আর তোমার দেবীদের দেখেছি
    ভালোবাসার কামনার কুয়াশায় মোড়া ফুলের মতন সত্য
    যা নিজের দিনে ফোটে আর বাতাসে হারিয়ে যায়
    আমি তোমার চোখ দেখেছি আহ্লাদে ধিকিধিকি জ্বলছে
    যখন তুমি তোমার সুন্দর জিভ দিয়ে মিষ্টি মননের সৌন্দর্য্যকে ভালোবাসছিলে
    আর তারপর দেখেছি একই আহ্লাদের গভীরতায় ঝিকমিক করছে
    যখন কোমল রমণীরা তোমার বাহুতে শুয়েছিল
    ভালোবাসার গ্রিক দেবতাকে প্রণাম ! যিনি প্রেমকে সঞ্চয় করে রাখেন না
    বরং তা খরচ করে ফ্যালেন সোনালি ছাঁকনিতে জলের মতন
    ভাগাভাগি করে নেন নিজের কোমল খেয়ালি গরিমা
    সকলের সঙ্গে যারা তাঁর উপস্হিতিকে মান্যতা দেয়
    ফুলের মতন অবিশ্বস্ত, বাতাস-তাড়িত প্রজাপতির মতন চপল
    ভালোবাসার গ্রিক দেবতাকে প্রণাম, তিনি দেবতাদের বালক !
    যিনি কেবল সৌন্দর্য্যকে ভালোবাসেন
    আর তা খুঁজে পান সর্বত্র

    "ফিনিক্সের গান"
    তাহলে আমি আর বড়ো হবো না
    যদি শিশু বলতে বোঝায় বিস্ময়ের বোধ
    আমার বৃষ্টিময় বাতাসে আমার মাথায় থাকে বৃষ্টি
    আমি সময়ের আগুনে উধাও হবো না
    বরং নিজেকে ফিনিক্স হিসাবে প্রমাণ করব
    ( নক্ষত্রের গুঁড়োর মতন ছাই )
    আবার জন্ম আর আবার আর আবার

    স্বৈরাচারীদের জন্য কবিতা
    সংবেদনশীল মানুষেরা অসংখ্য--
    আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তাদের আলোকিত করব
    --বুদ্ধধর্মের প্রথম সঙ্কল্প
    মনে হয় তোমাকেও ভালোবাসতে হবে
    সুন্দরদের ভালোবাসা সহজ
    শিশুদের সকালের গরিমা
    সহজ ( যেমন যেমন সমবেদনা বৃদ্ধি পায় )
    অচেনাকে ভালোবাসা

    অনুধাবন করা আরও সহজ ( সমবেদনায় )
    তাতে যে ব্যথা আর সন্ত্রাস লুকিয়ে আছে
    যারা নিজেদের চারিপাশের জগতকে
    হিংস্রতার সঙ্গে পরিচালনা করেন এতো ঘৃণা

    কিন্তু ওহ আমি যিশুখ্রিস্ট নই যে
    আমাকে যারা ফাঁসি দেয় তাদের আশীর্বাদ করবো
    আমি বুদ্ধ নই কোনো সন্ত নই

    আমার সেই জ্যোতির্ময় ক্ষমতাও নেই
    বিশ্বাসে আলোকিত

    তবু তা সত্তেও
    তুমি একজন সংবেদনশীল মানুষ
    এই বাতাসে শ্বাস নিচ্ছ
    এমনকি আমিও একজন সংবেদনশীল মানুষ
    এই বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি
    চাইছি নিজের আলোকপ্রাপ্তি
    তোমার জন্যেও চাইতে হবে

    যদি আমার যথেষ্ট ভালোবাসা থাকে
    যদি আমার যথেষ্ট বিশ্বাস থাকে
    হয়তো আমি তোমার পথকে পার হতে পারবো
    আর তাকে বদলাতেও পারব

    আমাকে ক্ষমা করুন, তাহলে--
    আমি এখনও আপনাকে ভালোবাসতে পারব না
  • Amiri Baraka | 012312.60.78.226 | ১৬ জুন ২০১৯ ১০:২৮383594
  • আফ্রোমার্কিন কবি আমিরি বারাকা-র কবিতা ( ১৯৩৪ - ২০১৪ )
    ধর্মান্তরিত হবার আগের নাম লেরয় জোনস
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "কেউ আমেরিকা কে উড়িয়ে দিয়েছে"
    ওরা বলছে কোনো সন্ত্রাসবাদী
    কোনো বর্বর
    এক রব,
    আফগানিস্তানের
    আমাদের মার্কিন সন্ত্রাসবাদী নয়
    কু ক্লাক্স ক্ল্যান বা ন্যাড়ামাথা ফ্যাসিবাদী নয়
    কিংবা যারা নিগ্রোদের উড়িয়ে দেয়
    গির্জা, কিংবা ফাঁসির মঞ্চে পুনর্জন্ম নেয়
    ট্রেন্ট লট নয়
    কিংবা ডেভিড ডিউক কিংবা গুইলিয়ানি
    কিংবা শাণ্ডলার, হেলমস অবসর নিয়ে
    এটা ওরা নয়
    পোশাকের গনোরিয়া
    শাদা কাপড়ের রোগ
    যা কালো মানুষদের খুন করেছে
    যুক্তি আর সুবুদ্ধিকে ভয় দেখিয়েছে
    বেশিরভাগ মানুষকে, যেমন তাদের ইচ্ছে
    ওরা বলে ( কারা বলে ? )
    বলার কাজ কারা করে
    কাদের টাকাকড়ি দেয়
    কারা মিথ্যা কথা বলে
    কারা ছদ্মবেশে
    কাদের ক্রীতদাস ছিল
    কারা টাকাকড়ি গেঁড়িয়েছে
    কারা মোটা হয়েছে বাগানের চাষে
    কারা রেডইনডিয়ানদের গণহত্যা করেছে
    কারা চেষ্টা করেছে কালো দেশকে নষ্ট করতে
    কারা ওয়াল স্ট্রিটে থাকে
    প্রথম বাগান-চাষ
    কারা তোমার মাথা কেটেছে
    কারা তোমার মাকে ধর্ষণ করেছে
    কারা তোমার বাবাকে পিটিয়ে মেরেছে
    কারা আলকাৎরা পেয়েছে, কারা পালক পেয়েছে
    কাদের দেশলাই ছিল, কারা আগুন ধরিয়েছিল
    কারা খুন করেছে আর ভাড়া করেছে
    কারা বলে তারা ঈশ্বর আর তবু শয়তান হয়
    কারা একমাত্র বড়ো
    কারা একমাত্র ভালো
    কাদের দেখতে যিশুর মতন

    কারা গড়েছে সবকিছু
    কারা সবচেয়ে চতুর
    কারা সবচেয়ে বড়ো
    কারা সবচেয়ে ধনী
    কারা বলে তোমরা কুৎসিত আর তাদের দেখতে সবচেয়ে সুন্দর
    কারা শিল্পের সংজ্ঞা বানায়
    কারা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বানায়
    কারা বোমা তৈরি করেছে
    কারা বন্দুক তৈরি করেছে
    কারা ক্রীতদাস কিনেছে, আর তাদের বেচেছে
    কারা তাদের নাম দিয়েছে
    কে বলেছে ডাহমার পাগল ছিল না

    কারা ? কারা ? কারা ?

    কারা পুয়ের্টো রিকো চুরি করেছে
    কারা রেডইনডিয়ান, ফিলিপিনো, ম্যানহ্যাটন চুরি করেছে
    অস্ট্রেলিয়া আর হেবরাইডদের
    কারা চীনাদের ওপর আফিম চাপিয়েছিল
    কারা অট্টালিকাগুলোর মালিক
    কাদের আছে বৈভব
    কারা তোমাদের মজার মনে করে
    কারা তোমাকে জেলে পুরেছে
    কারা সংবাদপত্রের মালিক
    কারা ছিল ক্রীতদাস জাহাজের মালিক
    কারা সেনাবাহিনী চালায়
    কে নকল রাষ্ট্রপতি
    কে শাসক
    কে ব্যাঙ্কের মালিক

    কে ? কে ? কে ?

    কারা খনির মালিক
    কারা তোমার মগজ বিগড়ে দেয়
    কারা রুটির মালিক
    কারা শান্তি চায়
    কারা যুদ্ধ চায় বলে তুমি মনে করো
    কারা পেট্রলের মালিক
    কারা খাটাখাটি করে না
    কারা জমির মালিক
    কারা নিগ্রো নয়
    কারা এতো বড়ো যে তাদের চেয়ে বড়ো নেই
    কারা শহরের মালিক
    কারা বাতাসের মালিক
    কারা জলের মালিক
    কারা শস্যভাঁড়ারের মালিক
    কারা ডাকাতি আর চুরি আর প্রতারণা আর খুন করে
    আর মিথ্যাকে সত্য করে তোলে
    কারা তোমায় বলে অদ্ভুত
    কারা সবচেয়ে বড়ো বাড়িতে থাকে
    কারা সবচেয়ে বড়ো অপরাধ করে
    কারা যেকোনো সময়ে ছুটিতে যায়
    কারা সবচেয়ে বেশি নিগ্রোদের খুন করেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি ইহুদিকে খুন করেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি ইতালিয়কে খুন করেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি আইরিশদের খুন করেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি আফ্রিকানদের খুন করেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি জাপানিদের খুন করেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি ল্যাটিনোদের খুন করেছে

    কারা ? কারা ? কারা ?

    কারা সমুদ্রের মালিক
    কারা বিমানগুলোর মালিক
    কারা মলগুলোর মালিক
    কারা টেলিভিশনের মালিক
    কারা রেডিওর মালিক
    কারা এমনকিছুর মালিক যার মালিকানা এখনও জানা যায়নি
    কারা মালিকের মালিক যারা প্রকৃত মালিক নয়
    কারা শহরতলির মালিক
    কারা শহরগুলোকে চুষে খায়
    কারা আইন বানায়
    কারা বুশকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছে
    কারা মনে করে কনফিডারেট পতাকা ওড়া উচিত
    কারা গণতন্ত্র আওড়ায় আর মিথ্যা কথা বলে
    কারা দৈববাণীতে বর্ণিত পশু
    কারা ৬৬৬
    কারা সবজান্তা আর কারা নির্ণয় নিয়েছে
    যিশুকে ক্রুশকাঠে বিঁধতে
    বাস্তব জগতে শয়তান কারা
    কারা আরমেনীয় গণহত্যা থেকে ধনী হয়ে গেল
    কারা সবচেয়ে বড়ো সন্ত্রাসবাদী
    কারা বাইবেল বদলেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি মানুষ মেরেছে
    কারা সবচেয়ে বেশি শয়তানি করে
    কারা টিকে থাকার বিষয়ে চিন্তা করে না
    কারা উপনিবেশের মালিক
    কারা সবচেয়ে বেশি জমি চুরি করেচে
    কারা পৃথিবী শাসন করে
    কারো ভালো কথা বলে আর খারাপ কাজ করে
    কারা সবচেয়ে বড়ো জল্লাদ

    কারা ? কারা ? কারা ?

    কারা পেট্রলের মালিক
    কারা আরও পেট্রল চায়
    কারা তোমায় বলেছে যা ভাবছ পরে তা মিথ্যা

    কারা ? কারা? কারা ?

    কারা বিন লাদেনকে খুঁজে পেলো, বোধহয় শয়তান
    কারা সিআইএকে মাইনে দেয়
    কারা জানতো বোমা ফাটতে চলেছে
    কারা জানতো কেন সন্ত্রাসবাদীরা
    ফ্লোরিডা আর স্যান ডিয়েগোতে প্লেন চালাতে শিখলো
    কারা জানে কেন পাঁচজন ইজরায়েলি বিস্ফোরণের ফিল্ম তুলছিল
    আর ইয়ার্কি করছিল
    কাদের চাই জীবাশ্মের তেল যখন সূর্য কোথাও যাচ্ছে না
    কারা ক্রেডিট কার্ড বানায়
    কারা সবচেয়ে বেশি ট্যাক্সের সুবিধা পায়
    কারা রেসিজম-বিরোধী সভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল
    কারা ম্যালকম, কেনেডি আর তার ভাইকে খুন করেছে
    কারা ডক্টর কিংকে খুন করেছে, কারা অমন ব্যাপার চাইবে ?
    তারা কি লিংকন খুনের সঙ্গে জড়িত ?
    কারা গ্রেনাডা আক্রমণ করেচিল
    কারা অ্যাপারথেড থেকে রোজগার করেছিল
    কারা আইরিশদের উপনিবেশ করে রেখেছে
    কারা পরে চিলে আর নিকারাগুয়ার সরকারদের পতন ঘটালো
    কারা খুন করেছে ডেভিড সিবেকো, ক্রিস হানি
    সেই লোকগুলো যারা খুন করেছিল বিকো, কাবরাল,
    নেরুদা, আয়েন্দে, চে গ্বেভারা, সানডিনোকে
    কারা খুন করেছিল কাবিলাকে, যারা মুছে দিতে চেয়েছিল
    লুমুম্বা, মণ্ডলেন, বেটি শাবাজ, ডাই, প্রিন্সেস ডি, রাল্ফ ফেদারস্টোন
    লিটল ববিকে
    কারা জেলে পুরেছিল ম্যাণ্দেলা, ধোরুবা, জেরোনিমো, আসতা,
    মুমিয়া, গারভি, দাশেইল হ্যামেট, আলফেয়াস হাটনকে
    কারা খুন করেছিল হুয়ে নিউটন, ফ্রেড হ্যাম্পপটন, মেজার এভার্স,
    মিকি স্মিথ, ওয়ালটার রডনিকে
    তারাই কি ফিদেলকে বিষে মারতে চেয়েছিল
    কারা ভিবেতনামিদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল
    কারা লেনিনের মাথার জন্য দাম রেখেছিল
    কারা ইহুদিদের উনোনে ঢুকিয়েছিল
    আর তাতে কারা সাআয্য করেছিল
    কারা বলেছিল “সবচেয়ে আগে আমেরিকা”
    আর হলুদ স্টারকে সন্মতি দিয়েছিল
    কারা খুন করেছিল রোজা লুক্সেমবার্গ, লিবনেক্ট
    কারা খুন করেছিল রোজেনবার্গদের
    আর ভালো লোকেদের বরফে চুবিয়েছিল
    অত্যাচার করেছিল, গুমখুন করেছিল, লোপাট করেছিল
    কারা আলজেরিয়া, লিবিয়া, হাইতি, ইরান, ইরাক
    সউদি, কুয়েত, লেবানন, সিরিয়া, মিশর, জর্ডান,
    প্যালেস্টাইন থেকে ধনী হয়েছিল
    কারা কঙ্গোতে মানুষের হাত কেটে দিতো
    কারা এইডস আবিষ্কার করলো
    কারা জীবানুভরা কম্বল রেডইনডিয়ানদের বিলিয়েছিল
    কারা ভেবে বের করেছিল “অশ্রুর গমনপথ”
    কারা মেইনে উড়িয়ে দিলো আর স্পেনের গৃহযুদ্ধ আরম্ভ করল
    কারা শারনকে আবার ক্ষমতায় বসালো
    কারা সমর্থন করলো বাতিস্তা, হিটলার, বিলবো
    চিয়াঙ কাই শেককে
    কারা ইতিবাচক পদক্ষেপকে শেষ করেচিল
    পুনর্নিমাণ, নিউ ডিল, নিউ ফ্রন্টিয়ার, দি গ্রেট সোসায়টি
    টমের পাছা ক্লারেন্স কার হয়ে কাজ করে
    কোলোনের মুখ থেকে কারা বেরিয়ে আসে
    কারা জানে কণ্ডোলিজা কি জিনিস
    কারা কনেলিকে মাইনে দেয় কাঠের নিগ্রো হবার জন্য
    কারা প্রতিভার পুরস্কার দেয় হোমো লোকাস সাবসিডেয়ারকে
    কারা এনক্রুমা, বিশপের গদি উল্টে ছিল
    কারা রবসনকে বিষ দিয়েছিল
    কারা দুব্যকে জেলে পুরতে চেয়েছিল
    কারা র‌্যাপ গাইয়ে জমিল আল আমিনকে ফাঁসাতে চেয়েছিল
    কারা রোজেনবার্গদের, গার্ভিকে, স্কটসবরো বয়েজদের,
    হলিউড টেনদের ফাঁসিয়েছিল
    কার রাইখস্টাগে আগুন ধরিয়েছিল

    কারা জানতো ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টারে বোমা মারা হবে
    কারা টুইন টাওয়ার্সের ৪০০০ ইজরায়েলি কর্মীকে
    বাড়িতে থাকতে বলেছিল
    শারন কেন সেখান থেকে দূরে ছিল ?

    কারা ? কারা ? কারা ?

    পেঁচার বিস্ফোরণ বলেছে সংবাদপত্রগুলো
    শয়তানের মুখ দেখা গেছে
    কারা যুদ্ধ থেকে ধনী হয়
    কারা ভয় আর মিথ্যা থেকে রুজিরুটি কামায়
    কারা চায় পৃথিবীটা যেমন আছে তেমনই থাকুক
    কারা চায় জগতটা সাম্রাজ্যবাদীরা শাসন করুক
    আর জাতীয় শোষণ আর সন্ত্রাস হি২স্রতা, ক্ষুধা আর
    দারিদ্র্য শাসন করুক।
    কারা নরকের শাসক ?
    কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান
    কাকে তুমি জানো যে কখনও
    ঈশ্বরকে দেখেছে ?

    কিন্তু সকলেই দেখেছে
    শয়তানকে

    প্যাঁচার বিস্ফোরণের মতন
    তোমার জীবনে তোমার মগজে তোমার অস্তিত্বে
    প্যাঁচার মতন যে শয়তানকে চেনে
    সারা রাত, সারা দিন যদি তুমি শোনো, প্যাঁচার মতন
    আগুনে ফেটে পড়ছে । আমরা প্রশ্ন উঠতে শুনেছি
    পাগল কুকুরের শিসের মতন ভয়ঙ্কর আগুনে
    নরকের আগুনের অ্যাসিড বমির মতন
    কারা আর কারা আর কারা কারা কারা
    কারাআআআ আর কারাআআআআআআআআআআ !

    "ঘটনা"
    ও ফিরে এলো আর গুলি চালাল । ও ওকে গুলি মারল । ও যখন ফিরে
    এলো, গুলি চালাল, আর ও পড়ে গেল, হুমড়ি খেয়ে, চলে গেল
    ছায়া-জঙ্গল পেরিয়ে, গুলি চালাল, মরছে, মরে গেল, সব শেষ ।

    তলার দিকে, রক্ত বেরোচ্ছে, গুলি খেয়ে মৃত । ও তখন মারা গেল, সেখানে
    পড়ে যাবার পরে, ঘুরন্ত বুলেট, ফর্দাফাঁই করে দিলো ওর মুখ
    আর রক্ত হত্যাকারীর ওপর আর ধূসর আলোয় ঝর্ণার মতন ছিটিয়ে পড়ল।

    মৃত লোকটার ছবি, সব জায়গায় । আর তার আত্মা
    আলোকে শুষে নিচ্ছে । কিন্তু ও মরে গেলো অন্ধকারে ওর আত্মার চেয়েও
    অন্ধকারে আর সবকিছুই অন্ধের মতন হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও যখন মরছে

    নক্ষত্রদের নীচে ।
    আমাদের কিছু বলার নেই
    হত্যাকারী সম্পর্কে, শুধু এই যে ও ফিরে এলো, কোথাও থেকে
    যা করেছে তা করার জন্য । আর কেবল একবার গুলি চালাল ওর শিকারের
    চাউনির দিকে, আর রক্ত বেরোতে আরম্ভ করতেই দ্রুত কেটে পড়ল। আমরা জানি

    হত্যাকারী ছিল বেশ পটু, দ্রুত, আর মৌন, আর ওর বলি-দেয়া লোকটা
    বোধহয় ওকে চিনতো । তাছাড়া, মৃত লোকটার জমাট রক্তের
    অপ্রীতিকর মুখের ভাব, আর ওর হাতের ও আঙুলের শীতল
    হতভম্বভাব ছাড়া, আমরা আর কিছুই জানি না ।

    "কুড়ি খণ্ডে লেখা আত্মহত্যার চিরকুটের ভূমিকা"
    ইদানিং, আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি যেভাবে
    মাটি ফেটে যায় আর আমাকে গিলে ফ্যালে
    যখনই আমি কুকুরটাকে বেড়াতে নিয়ে যাই ।
    কিংবা নাটুকে ব্যাবসার ফালতু সঙ্গীত
    বাতাস তৈরি করে যখনই আমি বাস ধরতে দৌড়োই…
    ব্যাপারটা তেমনই দাঁড়িয়েছে।

    আর এখন, প্রতিরাতে আমি নক্ষত্র গুনি।
    আর প্রতি রাতে আমি একই সংখ্যা পাই।
    আর যখন তারা গোনবার জন্য আসবে না
    আমি তাদের ফেলে যাওয়া গর্তগুলো গুনি ।

    কেউ আর গান গায় না ।

    আর তারপর গতরাতে আমি পা টিপে টিপে
    আমার মেয়ের ঘরের কাছে গিয়ে ওর গলার আওয়াজ পেলুম
    কারোর সঙ্গে কথা বলছে, আর যখন দরোজা খুললুম
    তখন কেউই সেখানে ছিল না….

    কেবল ও হাঁটু গেড়ে, উঁকি মারছে
    নিজের জোড়-করা হাতে

    "রেডিওর স্মৃতি"
    লভামন্ট ক্র্যান্সটনের দৈবতা সম্পর্কে চিন্তা করা কে-ই বা বন্ধ করেছে ?
    ( কেবল জ্যাক কেরুয়াক, যা আমি জানি : আর আমি।
    তোমরা বাদবাকিরা হয়তো টিভিতে বা কেট স্মিথের কাছে শুনেছ,
    কিংবা সেই রকমই কিছু অনাকর্ষক ।)

    আমি কিই বা বলতে পারি ?
    এর চেয়ে বরং প্রেমে পড়ে হারিয়ে ফেলা ভালো
    তোমার বৈঠকখানায় লিনোলিয়াম পাতার তুলনায় ?

    আমি কি কোনো সন্ন্যাসী বা অমনকিছু নাকি ?
    সপ্তাহান্তে ম্যানড্রেকের সন্মোহক ভঙ্গী ?
    ( মনে রেখো, কথা বলিয়ে রবার্টদের সারিয়ে তোলার ক্ষমতা আমার নেই…
    আমি পারি না, এফ জে শীনের মতন, কেমন করে সঞ্চয় ধনী করে তুলবে !
    আমি এমনকি তোমাকে হুকুম করতে পারি না যে হিটলার বা গডি নাইটের মতন
    গ্যাসচেম্বারের আলোকপ্রাপ্তিতে ঢোকো )

    আর ভালোবাসা একটা evil শব্দ ।
    উল্টে দাও/দ্যাখো আমি কি বলতে চাইছি ?
    একটা বাজে শব্দ । আর তাছাড়া
    কে-ই বা এর মানে বোঝে ?
    আমি অমন অঙ্গ নিয়ে নিশ্চয়ই বাইরে বেরোতে চাইব না ।

    শনিবার সকালে আমরা শুনতুম রেড ল্যানটার্ন আর তার সমুদ্রের তলাকার লোকজন।
    এগারোটার সময়ে, লেটস প্রিটেণ্ড
    আর আমরা তা-ই করতুম
    আর আমি, যে একজন কবি, এখনও তাই করি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ !

    আমি কী বলতুম যেন ( বদলে যাবার পরে যখন সে সুরক্ষিত আর অদৃশ্য আর অবিশ্বাসীরা ঢিল ছুঁড়ে মারতে পারত না ?) “হেঃ, হেঃ, হেঃ ।

    কে-ই বা জানে পুরুষের হৃদয়ে evil ওৎ পেতে থাকে ? ছায়ারা জানে ।”
    ওহ, হ্যাঁ ও জানে
    ওহ, হ্যাঁ ও জানে
    শব্দটা evil
    এই ভালোবাসা ।

    "বক্তৃতা দেবার চিরকুট"
    আফ্রিকান ব্লুজ
    আমাকে চেনে না । ওদের পায়ের তাল, বালিতে
    তাদের নিজের
    দেশের । একটা দেশ
    কালো আর শাদায়, সংবাদপত্র
    ফুটপাতে ওড়ানো
    জগতসংসারের । অনুভব
    করে না
    আমি কে ।

    শক্তি

    স্বপ্নে, স্নায়ুর চোরাগোপ্তা
    শাবক, বাতাস
    বালি উড়িয়ে দেয়, চোখগুলো
    কিছুতে বাঁধা পড়েছে
    ঘৃণা, ঘৃণায়, ঘৃণায়, যেতে হবে
    বিদেশে, ওরা চালায়
    মৃত্যুকে আলাদা করে
    আমার নিজের থেকে । ওই
    মাথাগুলো, আমি বলি
    আমার “জনগণ”

    ( আর ওরা কারা । জনগণ । নিজের বলতে
    আমি, কুৎসিত মানুষ, যে
    তুমি, চিন্তা করো
    শাদা চ্যাপ্টা পাকস্হলীর কথা
    চাকরানিদের, বাড়ির ভেতরে
    মরছে, কৃষ্ণাঙ্গ । ছাড়ানো চাঁদ
    আমার আঙুলে আলো
    নড়ে মেয়েটির
    পোশাকের তলায় । যেখানে
    ওর স্বামী রয়েছে । কৃষ্ণাঙ্গ
    কথাগুলো বালি ওড়ায়
    চোখে, আঙুলগুলো
    সৈন্যদের মৃত । যাদের
    আত্মা, চোখ, বালিতে । আমার গায়ের রঙ
    ওদের মতন নয় । ফিকে, শাদা মানুষ
    কথা বলে। কেটে পড়া । আমার নিজের
    মৃত আত্মারা, আমার, তথাকথিত
    জনগণ । আফ্রিকা
    এক বিদেশ । তুমি
    যেকোনো দুঃখি মানুষের মতন এখানে
    আমেরিকার লোক ।
  • Gregory Corso | 012312.60.8923.182 | ১৭ জুন ২০১৯ ১৯:১৬383595
  • বোমা
    ইতিহাসের পলাতক সময়ের নিয়ন্ত্রক তুমি বোমা মারো
    ব্রহ্মাণ্ডের খেলনা সবথেকে দারুন ছিনিয়ে নেয়া আকাশ তোমাকে ঘেন্না করতে পারি না
    আমি কি বজ্জাত বিদ্যুৎ গাধার চোয়ালকে ঘেন্না করতে পারি
    যিশু জন্মের এক কোটি বছর আগের পাথরের চাঁই গদা লাঠি কুঠার
    গুলতি দা ভিঞ্চি রেডইনডিয়ান যুদ্ধকুঠার আপাচে-নেতার মশাল র‌্যাথবোনের ছোরা
    আহ আর দুঃখি বেপরোয়া বন্দুক ভেরলেম পুশকিন ডিলিঞ্জার বোগার্টের
    আহ সন্ত মাইকেলের কি জ্বলন্ত তরোয়াল ছিল না সন্ত জর্জের শূল ডেভিডের গুলতি
    বোমা তুমি ততোই নিষ্ঠুর যেমন তোমাকে মানুষ তৈরি করে তুমি ক্যানসারের চেয়ে নিষ্ঠুর নও
    সব মানুষই তোমাকে ঘেন্না করে তারা বরং গাড়ির ধাক্কায় বাজপড়ায় ডুবে মরতে চাইবে
    ছাদ থেকে পড়ে ইলেকট্রিক-চেয়ারে ঋডরোগে বুড়ো হয়ে হে বোমা
    তারা যেকোনো উপায়ে মরতে চাইবে কিন্তু তুমি মৃত্যুর আঙুল স্বাধীনকর্মী
    তুমি ফাটো বা না ফাটো তা মানুষের ব্যাপার নয় মৃত্যু বহুকাল যাবৎ আমাদের বিপর্যস্ত করেছে
    আমি পর্বে ব্লু গান গাই তোমার জন্য বোমা মৃত্যুর উড়নচণ্ডীপনা মৃত্যুর উৎসব
    মৃত্যুর মণিরত্ন অধিকন্তু নীল উড়োজাহাজ ধ্বংসে মরলে তা আলাদা
    পর্বতারোহী পড়ে গিয়ে কেউটের দংশনে মরবে তা শুয়োরের খারাপ মাংস খেয়ে মরা নয়
    অনেকে জলাভূমিতে মরে অনেকে সমুদ্রে আর কেউ রাতের বেলায় ঝোপচুল মানুষের হাতে
    ওহে ডাইনির হাতে মৃত্যু আছে বরিস কারলফের মতন ভয়ের মৃত্যু
    অনুভূতিহীন মৃত্যু যেমন জন্মেই মৃত্যু দুঃখহীন মৃত্যু বাওয়ারির ব্যথায় মৃত্যু
    পরিত্যক্ত মৃত্যু যেমন মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রের হাতে সেনেটরদের হাতে মৃত্যু
    আর অভাবনীয় মৃত্যু যেমন হারপো মার্কস মেয়েরা ভোগ পত্রিকার প্রচ্ছদে আমার নিজের
    আমি জানি না বোমায় মরা কেমন ভয়ঙ্কর কেবল কল্পনা করতে পারি
    কিন্তু অন্য কোনো মৃত্যু জানি না যা হাস্যকর পটভূমি গড়ে এক শহরে
    নিউইয়র্কে খোলা চোখে সাবওয়েতে আশ্রয়
    হাজার হাজার মানুষের জমঘট জুতোর উঁচু হিল বেখে যায়
    টুপি উড়ে যায় যুবকেরা তাদের চিরুনি ভুলে যায়
    মহিলারা বুঝে উঠতে পারেন না তাঁদের কেনাকাটার ঝোলা নিয়ে কি করবেন
    চিউইঙ্গামের মেশিনগুলো চুপচাপ তবু বিপজ্জনক তৃতীয় রেল লাইন
    ব্রংকসে ধরা পড়ল রিৎজ ভাইরা একটা ট্রেনে
    শেনলির হাসিমুখ পোস্টার সব সময়েই হাসবে
    শয়তানের বাচ্চা মৃত্যু যৌনঅতৃপ্ত বোমা বোমামৃত্যু
    ইসতানবুলের ওপরে ফেটে পড়ছে কচ্ছপরা
    জাগুয়ারের উড়ন্ত থাবা
    তাড়াতাড়ি ডুবিয়ে দেবে উত্তরমেরুর তুষার
    স্ফিংক্সে লাফিয়ে পড়বে পেঙ্গুইনরা
    এমপায়ার স্টেট বাড়ির মাথায়
    সিসিলির ব্রোকোলি ক্ষেতে তীরবিদ্ধ
    ম্যাগনোলিয়া বাগানে ধনুকের মতন ব্যাঁকা আইফেল টাওয়ার
    সন্ত সোফিয়া সুদানে ছাল ছাড়াচ্ছেন
    হে খেলোয়াড় মৃত্যু বোমার খেলোয়াড়
    প্রাচীন দিনকালের মন্দিরগুলো
    তাদের মহিমাময় ধ্বংস বন্ধ হয়ে গেছে
    ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রন
    হার্সপেরিয়দের চুল জড়ো করছে
    আরকেডির তন্দ্রাচ্ছন্ন সাগরতীরে হাঁটছে
    যোগ দিচ্ছে পাথরের গুরুদের সঙ্গে
    ঢুকছে শেষ নাট্যশালায়
    সম্পূর্ণ ট্রয়ের সঙ্গে অনুভবের অর্চনা গাইছে
    জ্বালাচ্ছে সাইপ্রেসের মশাল
    দৌড়োচ্ছে পালকের দল আর পতাকা
    আর তবু জেনে হোমারের এক পা গরিমা
    নিন এসে পড়ল বর্তমানের দল
    অতীতের নিজেদের দল
    বীণা আর নল দুটিকেই জোড়া হয়েছে
    হটডগ সোডা অলিভ আঙুর শোনা যাচ্ছে
    আনন্দোৎসব ছায়াপথ আলখাল্লা পরে সবাই একইরকম
    কমিশার হে আনন্দের স্হিতি
    গাগনিক শেকড় আর হর্ষ আর ভেঙচি
    সর্বকালের কোটি উপস্হিতি
    গ্রিক দেবতা জিউসের হইহল্লা
    ওয়েনদের দৌঢ় করা চ্ছে হারমেস
    বুদ্ধের চেবানো কাগজ
    যিশু বেরিয়ে পড়েছেন
    লুথার তৃতীয় অবস্হানে
    গ্রহবিজ্ঞানে মৃত্যু হোসানাগান বোমা
    হে বসন্তকালের বোমা শেষ গোলাপ ফোটাও
    ডাইনামাইট সবুজ পোশাক পরে এসে
    প্রকৃতির অখণ্ড দৃষ্টি থেকে বজ্জাতি সরাও
    তোমার সামনে সারা শরীর ঢাকা অতীত
    তোমার পেছনে শেয়ালডাকের ভবিষ্যৎ হে বোমা
    ঘোষণার ঘাসে বাঁধা বাতাসে
    ফাঁদে পড়া শেয়ালের মতন
    ওরা ব্রহ্মাণ্ডকে ল হিসাবে নামায়
    লাফাও বোমা বন্ধ বোমা এঁকে বেঁকে নাচো
    তোমার মদের ঝুলিতে নক্ষত্রেরা এক ঝাঁক মৌমাছি
    তোমার উৎসবের পায়ে আটকানো দেবদূতের দল
    তোমার ওপরের বাংকে বৃষ্টিআলোর চাকা
    তোমার আসার সময় হয়েছে শোনো তোমার সময় হয়েছে
    আর স্বর্গেরা তোমার সঙ্গে আছে
    স্তুতিগান দ্যুতিময় মহিমার সম্পর্ক
    বোমা হে ব্যাপক ধ্বংস গির্জার দ্বৈতসঙ্গীত গলালাভার ফাটল বুম
    বোমা শাশ্বতকে হঠাৎ চুল্লি চিহ্ণিত করো
    ছড়িয়ে দাও তোমার অসংখ্য ঘেরাটোপের জাল
    মারাত্মক কার্যপ্রণালী তৈরি করো
    পচা নক্ষত্র কবর গ্রহমণ্ডল শবদেহ উপাদান
    ব্রহ্মাণ্ডকে লাশ করে দাও মুখে আঙুল দিয়ে সিটি বাজাও
    ওর বহুকাল আগে মৃত নতুবায়
    তোমার কোমল জটপড়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত চোখ থেকে
    স্বর্গীয় প্রেতদের ভিড় ওড়াও
    তোমার নামকরা গর্ভ থেকে
    বিশাল পোকাদের জন্মধোঁয়া ওড়াও
    চিরে ফ্যালো তোমার তলপেটের বোমা
    তোমার তলপেট থেকে সেলাম নাও শকুনদের
    তোমার হায়েনা-আঙুলের থাবায় লড়াই করো
    স্বর্গোদ্যানের কিনার বরাবর
    হে বোমা হে শেষ হ্যামেলিনের বাঁশিঅলা
    উভয় সূর্য আর উৎপাত নাচের আগুনের পেছনে
    ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করা হয়েছে নকল নগ্নতায়
    ওনার রোগা নকল পাউডার মাখানো কয়ামতের সময়ে
    উনি শুনতে পান না তোমার বাঁশির
    আনন্দের দিনকালের অপবিত্রতা
    স্তব্ধ করিয়েদের আঁচিল কানে উনি ঢেলে দিয়েছেন বধিরতা
    ওনার রাজত্ব হলো অনন্তকালের ফালতু মোম
    বন্ধ শানাই ওনার জন্য বাজে না
    কারারুদ্ধ দেবদূতরা ওনার গান গাননা
    এক বজ্রবিদ্যুৎহীন ঈশ্বর এক মৃত ঈশ্বর
    হে বোমা ওনার বোমা তাঁর বোমা
    আমি বিজ্ঞানের টেবিলের ওপরে ঝুঁকে থাকি
    একজন জ্যোতিষী ড্র্যাগনের গদ্য নিয়ে চর্চা করছে
    যুদ্ধ সম্পর্কে অর্ধেক বুদ্ধিমান বোমারা বিশেষত বোমারা
    যা ভালোবাসা যায় তাকে আমি ঘেন্না করতে পারি না
    এরকম পৃথিবীতে আমি থাকতে চাই না যা অনুমতি দেয়
    পার্কে এক শিশু একজন মানুষ মরছে ইলেকট্রিক চেয়ারে
    আমি সবকিছু নিয়েই হাসাহাসি করতে পারি
    আমি যাকিছু জানি আর জানি না আমার ব্যথা লুকোনোর জন্য
    আমি বলি যে আমি একজন কবি তাই সব মানুষকে ভালোবাসি
    জানি আমার শব্দগুলো সংগৃহীত ভবিষ্যবাণী সব মানুষের জন্য
    আর আমার না-বলা কথাও সংগৃহীত
    আমি বহুগুণ
    একজন মানুষ যে সোনার তৈরি মিথ্যের পেছনে দৌড়োচ্ছে
    কিংবা একজন কবি ঝকমকে ছাইতে ঘুরে বেড়াচ্ছে
    কিংবা যা আমি নিজের সম্পর্কে ভাবি তা-ই
    এক হাঙরদাঁত ঘুম আর এক মানুষখেকো স্বপ্ন
    তাহলে বোমা নিয়ে আমার অশতো বুদ্ধিমান হবার দরকার নেই
    আনন্দেই তাই ভাবলুম বোমাগুলো যদি গুটিপোকা হতো
    আমি সন্দেহ করতুম না যে তারা প্রজাপতি হয়ে যেতো
    বোমাগুলোর জন্য একটা নরক আছে
    ওগুলো সেখানে আছে আমি তাদের দেখতে পাই
    তারা টুকরো হয়ে বসে থাকে আর গান গায়
    বেশিরভাগ জার্মান গান
    আর দুটো দীর্ঘ মার্কিন গান
    আর ওরা চাও আরো অমন গান হলে ভালো হতো
    বিশেষ করা রুশ আর চীনা গান
    আর আরও বেশি দীর্ঘ মার্কিন গান
    বেচারা বোমা তা কখনও হবে না
    এক এসকিমো গান আমি তোমায় ভালোবাসি
    আমি একতা ললিপপ দিতে চাই
    তোমার মিতব্যয়ী মুখে
    তোমার টেকো মাথায় এক সোনালি পরচুলা
    আর আমার সঙ্গে তুমি হ্যানসেল আর গ্রেটেলের মতন স্কিপিঙ খেলবে
    হলিউডের পর্দায়
    হে বোমা কার ভেতরে সব সুন্দর জিনিস
    নৈতিক আর ভৌতিক উদ্বেগে অংশ নেয়
    হে পরীর মতন উপড়ে তোলা
    বিশাল ব্রহ্মাণ্ডবৃক্ষ
    হে স্বর্গের টুকরো যা সূর্যকে দেয়
    পাহাড় আর পিঁপড়ের ঢিবি দুইই
    আমি তোমার যুঁইসফেদ দারুন দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি
    আমি তোমাকে এনে দিই মিডগার্ডিয় গোলাপো আর আর্কেডিয় মৃগনাভি
    স্বর্গের তরুণীদের কাছ থেকে নামিদামি প্রসাধন
    ভয় পেও না আমাকে স্বাগত জানাও দরোজা খোলো
    তোমার শীতল প্রেতের ধূসর স্মৃতি নয়
    অনির্দিষ্ট আবহাওয়ার ভেড়ুয়ারা নয়
    তাদের নিষ্ঠুর মহাগাগনিক শীতোষ্ণতা
    ওপেনহাইমার বসে আছেন
    আলোর অন্ধকার কোটরে
    মৃত্যুর মোজাম্বিকে শুকনো ফেরমি
    আইনস্টাইন ওনার কিংবদন্তিমুখে
    চাঁদ-স্কুইডের মাথায় এক রাজহংসী ফুলের গোল মালা
    গর্ভবতী ইঁদুরের কোণ থেকে আমাকে বোমার ভেতরে জেগে উঠতে দাও
    ঝাড়ু-তোলা পৃথিবীর দেশগুলোকে ভয় পাই না
    হে বোমা আমি তোমাকে ভালোবাসি
    আমি তোমার ঠুঙঠাঙে চুমু দিতে চাই আর বিস্ফোরণ খেতে চাই
    তুমি চিৎকারের এক ফোড়ার প্রতি অর্চনাস
    শ্রীযুক্ত বজ্রের গীতিকবিতাময় টুপি
    ওহে তোমার বেঁকা হাঁটুতে আওয়াজ তোলো
    বুম বুম বুম বুম বুম
    বুম তোমার আকাশ বুম তোমার সূর্য
    বুম বুম তোমার চাঁদ তোমার তারাদের বুম
    রাত তোমাকে বুম দিন তোমাদের বুম
    বুম বুম বাতাস মেঘ বৃষ্টিযাও গিয়ে হৃদ সমুদ্রে বিস্ফোরিত হও
    বারাকুডা মাছ বুম আর বুড়ির কমবয়সী প্রেমিক বুম
    উবাঙ্গি বুম ওরাঙওটাঙ
    বিঙ ব্যাঙ বঙ বুম বি ভাল্লুক বেবুন
    তুমি ব্যাঙ তুমি বঙ তুমি বিঙ
    ল্যাজ পাখনা ডানা
    হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের মাঝে একটা বোমা পড়বে
    ফুলেরা আনন্দে লাফিয়ে উঠবে তাদের শিকড়ে ধরবে ব্যথা
    ক্ষেতগুলো হাঁটু মুড়ে বাতাসের হ্যালেলুজায় গর্ব করবে
    গোলাপিবোমা কুসুমিত হবে এল্কবোমায় তাদের কানে টান দিয়ে
    আহ বহু বোমা সেদিন পাখিদের অবাক করবে নম্র চাউনি মেলে
    তবু বলা যথেষ্ট নয় যে একটা বোমা পড়বে
    এমনকি স্বর্গীয় আগুনও নিভে যায়
    জেনে যাও যে পৃথিবী যিশুর মায়ের নামে বোমা
    মানুষের হৃদয়ে আরও বোমার জন্ম হবে
    রাজকীয় বোমা বিচারপতির পোশাকে মোড়া সর্বাঙ্গসুন্দর
    আর তারা বসে থাকবে পৃথিবীর গোমড়ামুখো সাম্রাজ্যে
    সোনার গোঁফে ভয়ঙ্কর
  • Peter Orlovsky | 012312.60.8923.182 | ১৭ জুন ২০১৯ ১৯:১৮383596
  • বিট জেনারেশনের কবি পিটার অরলভস্কির কবিতা ( ১৯৩৩ - ২০১০ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    শামুক কবিতা
    আমার কবরকে হৃদয়ের আকারের কোরো যাতে ফুলের মতন স্বাধীন হয়
    আর সুন্দরের অনুভূতি পাওয়া যায়
    কবরের শিকড় বালিশ, কবর থেকে তোলা আর উড়িয়ে দেয়া মেঘের ফাঁকে
    কান বদলে হয়ে যাবে সবুজ শ্যাওলার কাছাকাছি আর বৃষ্টির শব্দ
    ফোঁটা ফোঁটা পড়বে পরতের ভেতর
    শিকড় পর্যন্ত যা আমার কানে সুড়সুড়ি দেবে।
    ওহে কবর, আমার পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলতে হবে তার
    শব্দের বাঁকা রেখায় ঘষে দিও
    জঞ্জাল কবর, আমার মাধার অনেক ওপরে, তাড়াতাড়ি রক্ত গড়িয়ে আসবে
    আমার কানে--
    কোনো বাদবিচার নেই কবর ছাড়া, তাই বিড়াল আর ভেড়া ডেইজি
    ফুলে পালটে গেছে ।
    ট্রেন আমার কবর টেনে নিয়ে যাবে, আমার শ্বাস থেকে মৃদু বাষ্পের গন্ধ
    বেরোবে চাকা আর রেল-লাইনের মাঝে।
    তাই বিড়াল-বাচ্চার দড়ি আর বল, এই ঢিবির ওপর লাফায়
    আলতো আর মিষ্টি
    তাই আমার বুড়ো আঙুল বেঁকে যেতে পারে আর হয়ে যেতে পারে
    একটা শামুক আর কৌতূহলে নিজের পথে যেতে পারে।

    প্রথম কবিতা ( Frist Poem )
    একটা রামধনু আমার জানালায় এসে ঝরতে থাকে, আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হই।
    আমার বুক থেকে গান ফেটে বেরোয়, আমার সব কান্না থেমে যায়,
    বাতাস রহস্যে ভরে যায় ।
    বিছানার তলায় আমার জুতো খুঁজি ।
    একজন কালো মহিলা আমার মা হয়ে যান ।
    আমার এখনও নকল দাঁত নেই । হঠাৎ দশটা বাচ্চা আমার কোলে বসে পড়ে।
    আমি এক দিনে দাড়ি গজিয়ে ফেলি।
    চোখ বন্ধ করে পুরো বোতল মদ খেয়ে নিই।
    আমি কাগজে আঁকি আর অনুভব করি আবার দুজন হয়ে গেছি।
    আমি চাই প্রত্যেকে আমার সঙ্গে কথা বলুক।
    আমি টেবিলের ওপরে জঞ্জাল উপুড় করি।
    আমি হাজার বোতলকে আমার ঘরে নেমন্তন্ন করি,
    আমি ওদের বলি জুন মাসের ছারপোকা।
    আমি টাইপরাইটারকে বালিশের মতন ব্যবহার করি ।
    আমার চোখের সামনে একটা চামচ কাঁটাচামচ হয়ে যায়।
    বন্ধুরা ওদের সব টাকাকড়ি আমায় দিয়ে দেয় ।
    বাকি জীবনের জন্যে আমার একটা আয়না দরকার।
    আমার প্রথম পাঁচ বছর মুর্গির ঝোল খেয়ে ছিলুম যথেষ্ট শুয়োর-মাংস ছাড়াই।
    আমার মা রাতের বেলায় ওনার ডাইনি-মুখ দেখালেন
    আর নীল দাড়ির গল্প বললেন ।
    আমার স্বপ্নগুলো আমাকে বিছানা থেকে সরাসরি তুলে নিলো।
    আমি স্বপ্ন দেখলুম বন্দুকের নলের ভেতরে লাফিয়ে পড়েছি
    বুলেটের সঙ্গে লড়াই করব বলে।
    আমি কাফকার সঙ্গে দেখা করলুম আর উনি আমার কাছ থেকে পালাবার জন্যে
    একটা বাড়ির ওপর দিয়ে ডিঙোলেন ।
    আমার দেহ চিনিতে পালটে গেল, চায়ের ভেতরে পড়ল
    আমি জীবনের মানে খুঁজে পেলুম ।
    যা আমি চেয়েছি তা হল কালি কালো ছেলে হবার জন্য ।
    আমি রাস্তায় ঘুরে বেড়াই চোখের খোঁজে যা আমার মুখকে আদর করবে।
    আমি এলিভেটরদের গান শোনালুম এই বিশ্বাসে যে স্বর্গে যাচ্ছি।
    আমি ৮৬তলা থেকে নামলুম, করিডরে হাঁটলুম তাজা পাছার খোঁজে।
    আমার চিরুনি বিছানায় রুপোর ডলারে পালটে যায়।
    আমি জানালার বাইরে দেখি কাউকে দেখতে পাই না, আমি রাস্তায় বেরোই,
    আমার জানালার দিকে তাকাই আর কাউকে দেখতে পাই না ।
    তাই আমি জলের হাইড্র্যান্টের সঙ্গে কথা বলি, জিগ্যেস করি,
    “তোমার কাছে কি আমার চেয়ে বড়ো অশ্রুফোঁটা আছে ?”
    আশেপাশে কেউ নেই, আমি যেখানে-সেখানে পেচ্ছাপ করি ।
    আমার দেবদূতের শিঙ, আমার দেবদূতের শিঙ : হাসিঠাট্টাকে মেলে ধরো,
    আমার সমকামী হইচই।
    প্যারিস, ২৪ নভেম্বর, ১৯৫৭

    দ্বিতীয় কবিতা
    আবার সকাল, কিছুই করার নেই, হয়তো মাউথঅর্গান কিনবো কিংবা
    আইসক্রিম বানাবো।
    অন্তত ঘর পরিষ্কার করব আর নিশ্চয়ই আমার বাবার মতন আমি ছাই ঝেড়েছি
    আর সিগারেটের টুকরো বিছানার পাশে মেঝেয় ফেলেছি।
    কিন্তু সবচেয়ে প্রথমে গেলাস ধুতে হবে আর
    দুর্গন্ধ মুখ পরিষ্কারের জন্য জল খেতে হবে।
    দরোজায় টোকা পড়ে, একটা বিড়াল ভেতরে ঢোকে,
    তার পেছনে চিড়িয়াখানার বাচ্চা হাতি টাটকা প্যানকেক চায়---
    আমি এই সব বিভ্রম আর সহ্য করতে পারি না ।
    আরেকটা সিগারেটের সময় আর তারপর পর্দাগুলো উঠতে দাও,
    তখন আমিই লক্ষ করি ধুলোর পথ তৈরি হয়েছে জঞ্জালের বিন পর্যন্ত।
    বরফ নেই তাই এক শুকনো কমলালেবু।
    সন্তের মতন কোনো একটা কাজ আছে কি যা আমার ঘরে করতে পারি,
    গোলাপি রঙ করি হয়তো কিংবা বিছানা থেকে মেঝে পর্যন্ত
    একটা এলিভেটর বসাই ?
    বেঁচে থাকার কিই বা মানে যদি না আমি আমার ঘরভূমিকে
    স্বর্গোদ্যান করতে পারি?
    আমার চোখে সময়ের এই ফোঁটার জন্য
    সিগারেটে লাল তারকার সহ্যশক্তির মতন
    মনে হয় জীবন কাঁচির চেয়ে তাড়াতাড়ি আলাদা হয় ।
    আমি জানি আমি নিজেই কামিয়ে ফেলতে পারি
    আমার মুখের চারিপাশের ছারপোকা চিরকালের জন্য চলে যাবে।
    আমার জুতোর ছ্যাঁদাগুলো সাময়িক, আমি তা বুঝি ।
    আমার তোশোক নোংরা কিন্তু কারই বা নয় ?
    জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন সবাই একবার মুখ ধোবার বেসিনে
    পেচ্ছাপ করে --
    এখন এক মিনিটের জন্য আমার জানালাকে কালো রঙ করতে দাও।
    একটা প্লেট ছোঁড়ো আর দুরন্তপনায় ভাঙো --- কিংবা হয়তো কেবল
    অজান্তে দুর্ঘটনায় মেঝেতে ফেলে দাও যখন তুমি টেবিলের
    চারপাশে ঘুরছ।
    আয়নার সামনে আমাকে সাহারা মরুভূমির ভুতের মতন দেখায়,
    কিংবা বিছানার ওপরে আমাকে বাতাসের জন্য কাঁদুনে মমির মতন দেখায়
    কিংবা টেবিলের ওপরে আমি নিজেকে নেপোলিয়ানের মতন মনে করি ।
    কিন্তু এখন দিনের জরুরি কাজ -- জাঙিয়ে ধুতে হবে -- দুই মাস ধোয়া হয়নি--
    পিঁপড়েগুলো এই বিষয়ে কি বলবে ?
    কেমন করেই বা আমার জামাকাপড় ধুতে পারি--
    কেননা আমি, আমি, আমি তা করলে মেয়েমানুষ হয়ে যাবো ।
    না বরং আমি আমার জুতো পালিশ করব আর মেঝের ব্যাপারে
    তা পরিষ্কার করার বদলে রঙ করা বেশি সৃষ্টিশীল।
    আর ডিশগুলোর ব্যাপারে আমি তা করতে পারি কেননা আমি ভাবছি
    আমি একটা রেস্তরাঁয় চাকরি পেতে পারি ।
    আমার জীবন আর আমার ঘর দুটো বিশাল ছারপোকার মতন
    আমাকে সারা বিশ্ব অনুসরণ করে চলেছে।
    ঈশ্বরকে ধন্যবাদ প্রকৃতির জন্য আমার নিষ্পাপ চোখ আছে।
    আমি জন্মেছিলুম ভালোবাসার একটা গান মনে রাখার জন্য--
    এক পাহাড়ের ওপরে এক প্রজাপতি পেয়ালা তৈরি করে
    যা থেকে পান করি, ফুলের সেতুর ওপর দিয়ে যেতে যেতে।
    প্যারিস, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৫৭

    আমার বিছানা হলুদ রঙে ঢাকা
    আমার বিছানা হলুদ রঙে ঢাকা -- হে সূর্য, আমি তোমার ওপরে বসি
    ওহ সোনালি ক্ষেত তোমার ওপরে শুই
    ওহ টাকাকড়ি তোমাব স্বপ্নে দেখি
    আরও, আরও, কেঁদে ওঠে বিছানা -- আমার সঙ্গে বেশি কথা বলো--
    ওহ বিছানা পৃথিবীর ভার নিয়েছে
    তোমার ওপরে রাখা সব হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন
    ওহ বিছানা যার চুল গজায় না, যার সঙ্গে সঙ্গম করা যায় না
    কিংবা যে সঙ্গম করতে পারে না
    ওহ বিছানা সব যুগের খাবারের গুঁড়ো তোমার ওপরে জড়ো করা
    হে হলুদ রঙের বিছানা সূর্যের দিকে কুচকাওয়াজ করে যাও
    যেখানে তোমার যাত্রা ফুরোবে
    ওহ ৫০ পাউণ্ডের বিছানা যে ৪০০ পাউণ্ডের বেশি নিতে পারে
    কতো শক্তিমান তুমি
    হে বিছানা, কেবল মানুষের জন্য আর জান্তুদের জন্য নয়
    হল;উদ বিছানা কবে জন্তুরা সমান অধিকার পাবে ?
    ওহ চারপেয়ে বিছানা মেঝের ওপরে চিরকালের জন্য তৈরি
    ওহে হলুদ বিছানা জগতের সমস্ত খবর
    তোমার ওপরে কখনও না কখনও শোয়
    ১৯৫৭, প্যারিস
  • Ernesto Cardenal | 012312.60.78.81 | ১৮ জুন ২০১৯ ১৭:৩৮383597
  • আরনেস্তো কারদেনাল-এর কবিতা
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    মেরিলিন মনরোর জন্য প্রার্থনা
    প্রভু :
    পৃথিবীতে মারিলিন মনরো নামে পরিচিত এই বালিকাটিকে গ্রহণ করুন
    যদিও তা ওর প্রকৃত নাম নয়
    ( কিন্তু আপনি মেয়েটির প্রকৃত নাম জানেন : অনাথ মেয়ে ৯ বছর বয়সে ধর্ষিত
    দোকানের কর্মচারী মেয়ে যে ১৬ বছর বয়সে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিল )
    যে এখন আপনার সামনে নিজেকে তুলে ধরছে কোনো সাজগোজ না করে
    কোনো কাগজের দালাল সঙ্গে নেই
    কোনো ফোটোগ্রাফার নেই অটোগ্রাফ সইয়ের ব্যাপার নেই,
    নভোচরের মতন একা রাত্রির মুখোমুখি যার নাম মহাকাশ ।
    বালিকা হিসাবে, মেয়েটি গির্জায় নগ্ন থাকার স্বপ্ন দেখেছিল ( টাইম ম্যাগাজিন যেমন বলে )
    সাষ্টাঙ্গ জনগণের সামনে, মেঝেতে মাথা পেতে,
    আর ওকে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল যাতে তাদের মাথায় না পা রাখতে হয়।
    মনোবিদদের চেয়ে ভালো আপনি এই স্বপ্নগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন ।
    গির্জা, বাসা, গুহা হলো মায়ের বুকের মতন সুরক্ষিত
    কিন্তু তার চেয়েও বেশি…
    মাথাগুলো মেয়েটির ভক্ত, তা পরিষ্কার
    ( আলোর এক স্রোতের তলায় অন্ধকারে মাথার জমঘট )।
    কিন্তু মন্দিরটা তো টোয়ান্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স স্টুডিও নয় ।
    মন্দির -- শ্বেতপাথর আর সোনায় -- মেয়েটির দেহের মন্দির
    যেখানে মানবপুত্র, চাবুক হাতে,
    টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স ব্যাবসাদারদের তাড়ায় ।
    যারা আপনার প্রার্থনার বাড়িকে চোরেদের গুহায় বদলে দিয়েছে।

    প্রভু :
    এই জগত কি পাপ আর বিকিরণে দূষিত,
    আপনি দোকানের কর্মচারী মেয়েটিকে কেবল দোষ দিতে পারেন না
    যে, আর সমস্ত দোকানের কর্মচারী মেয়েদের মতন, তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল।
    আর ওর স্বপ্ন ছিল বাস্তব ( কিন্তু যেমন টেকনিকালারও বাস্তব )।
    মেয়েটি কেবল আমাদের দেয়া স্ক্রিপ্ট অভিনয় করেছিল,
    যা আমাদের নিজেদের জীবন, এক অদ্ভুত স্ক্রিপ্ট ।
    মেয়েটিকে ক্ষমা করুন, প্রভু, আর আমাদের ক্ষমা করুন
    আমাদের বিশ শতকের জন্য
    বিশাল অতি-উৎপাদনের জন্য যাতে আমরা সবাই খেটেছি।
    মেয়েটি ভালোবাসা পেতে চেয়েছিল আর আমরা দিয়েছি ঘুমের ওষুধ।
    যে দুঃখের জন্য আমরা কেউই পবিত্র নই
    মেয়েটিকে মনোবিদ দেখাবার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
    মনে করুন প্রভু ক্যামেরা সম্পর্কে মেয়েটির বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আতঙ্ক
    সাজগোজকে ঘৃণা, প্রতিটি দৃশ্যের জন্য তাকে নতুন করে তোলার জন্য দাবি
    আর কেমন করে আতঙ্ক বেড়ে যেতে লাগলো
    আর স্টুডিওতে অনেক দেরিতে পৌঁছোনো ।
    দোকানের কর্মচারী মেয়েদেরর মতন
    মেয়েটি তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল ।
    আর মেয়েতির জীবন ছিল অবাস্তব, স্বপ্ন যা মনোবিদ ব্যাখ্যা করে আর নথি করে রাখে।
    মেয়েটির রোমান্স ছিল দুই চোখ বন্ধ করে চুমু খাওয়া
    কিন্তু তারপর চোখ খুলে যায়
    আর আবিষ্কার করে প্রচুর আলো ওর দিকে মুখ করা
    তারপর আলোগুলো অন্ধকার হয়ে যায় !
    আর লোকেরা ঘরের দুটো দেয়াল ভেঙে ফ্যালে ( তা ছিল ফিল্মের সেট )
    পরিচালক নিজের নোটবই নিয়ে চলে যান
    কেননা দৃশ্যটা তোলা হয়ে গেছে ।
    কিংবা প্রমোদভ্রমণের পোতে, সিঙ্গাপুরে একটা চুমু, রিওতে নাচ
    উইন্ডসর প্রাসাদে ডিউক ও ডাচেসের অভ্যর্থনা
    এক মর্মন্তুদ ফ্ল্যাটের ছোটো বৈঠকখানায় দেখা ।
    শেষ চুমু ছাড়াই ফিল্মটি শেষ হয় ।
    ওরা মেয়েটিকে তার বিচানায় মৃত পেলো, হাতে ফোন ।
    আর গোয়েন্দারা জানতে পারেনি কাকে মেয়েটি ডাকছিল ।
    তা ছিল
    সেইরকম যে বন্ধু কন্ঠস্বরকে চেনে তাকে ফোন করতে চাইছিল
    কেবল রেকর্ড করা কন্ঠস্বর শোনার জন্য যা বলবে : রং নাম্বার
    কিংবা কারোর মতন, যে, ডাকাতদের দ্বারা ঘায়েল
    তার ছেঁড়া ফোনের দিকে হাত বাড়ায় ।
    প্রভু :
    কাকে ডাকার চেষ্টা মেয়েটি করেছিল তাতে কিছুই আসে-যায় না
    কিন্তু পারেনি ( আর হবতো তা কেউ ছিল না
    কিংবা কেউ যার নাম্বার লস অ্যাঞ্জেলেস ফোনের বইতে নেই ।

    আপনিই ফোনের জবাব দিন !
  • Nazim Hikmet | 012312.60.2334.251 | ২০ জুন ২০১৯ ১০:৩০383599
  • নাজিম হিকমত-এর কবিতা ( ১৯০২ - ১৯৬৩ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "বেঁচে থাকা সম্পর্কে"
    বেঁচে থাকো কোনো হাসির ব্যাপার নয় :
    আপনাকে অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে বাঁচতে হবে
    একটা কাঠবিড়ালির মতন, উদাহরণস্বরূপ---
    আমি বলতে চাইছি বেঁচে থাকার বাইরে আর উর্দ্ধে কোনও কিছু না খুঁজে,
    আমি বলতে চাইছি বেঁচে থাকা হওয়া উচিত আপনার পেশা ।
    বেঁচে থাকা কোনো হাসির ব্যাপার নয় :
    আপনাকে তা গাম্ভীর্যের সঙ্গে নিতে হবে,
    এমনভাবে আর এতোটা গুরুত্ব দিয়ে
    যে, উদাহরণস্বরূপ, আপনার হাত আপনার পেছনে বাঁধা,
    আপনার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে,
    কিংবা কোনো রসায়নাগারে
    আপনার শাদা কোট আর সুরক্ষার চশমায়,
    আপনি জনগণের জন্য জীবন দিতে পারেন---
    এমনকি সেই লোকেদের জন্য যাদের আপনি কখনও দেখেননি,
    যদিও আপনি জানেন বেঁচে থাকা
    সবচেয়ে বাস্তব, সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার ।
    আমি বলতে চাইওছি, আপনি বেঁচে থাকাকে এমন গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন
    যে সত্তর বছর বয়সেও, উদাহরণস্বরূপ, আপনি অলিভ গাছ পুঁতবেন---
    আর আপনার সন্তানদের জন্য, দুইই,
    কিন্তু যেহেতু আপনি মৃত্যুকে ভয় পান আপনি তা
    বিশ্বাস করেন না.
    কেননা বেঁচে থাকা, আমি বলতে চাইছি, বয়ে নিয়ে যেতে হয়।


    ধারা যাক আমরা সঙ্কটজনকভাবে অসুস্হ, শল্যচিকিৎসার দরকার--
    যার অর্থ আমরা হয়তো উঠতে পারব না
    শাদা টেবিল থেকে ।
    যদিও এটা অসম্ভব যে দুঃখ বোধ করব না
    এতো তাড়াতাড়ি চলে যেতে,
    আমরা তবুও মজার গল্প শুনে হাসব,
    আমরা জানালার বাইরে দেখব বৃষ্টি পড়ছে কিনা,
    কিংবা তবুও উদ্বেগে অপেক্ষা করব
    সাম্প্রতিক সংবাদের সম্প্রচারের জন্য…
    ধরা যাক আমরা যুদ্ধের প্রথম সারিতে--
    এমনকিছুর জন্য যা নিয়ে যুদ্ধ করা যায়, ধরা যাক ।
    সেখানে, প্রথম আক্রমণে, সেই দিনই,
    আমরা মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে পারি, মৃত ।
    আমরা তা কৌতূহলী ক্রোধ নিয়ে জানবো,
    কিন্তু তবুও উদ্বেগে মারা পড়ব
    যুদ্ধের ফলাফলের ব্যাপারে, যা বহুকাল চলতে পারে।
    ধরা যাক আমরা কারারুদ্ধ
    আর পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি
    আর আমাদের রয়েছে আরও আঠারো বছর, ধরা যাক,
    লোহার দরোজা খোলার আগে ।
    আমরা তবু বহির্জগতে থাকব,
    তার জনগণ আর জীবজন্তুদের নিয়ে, সংঘর্ষ আর বাতাস--
    আমি বলতে চাই দেয়ালের ওদিকে যে বহির্জগত ।
    আমি বলতে চাই, যেভাবে হোক আর যেখানেই আমরা থাকি
    আমরা এমনভাবে বাঁচব যে আমরা কখনও মরব না।


    এই পৃথিবী ক্রমশ শীতল হয়ে যাবে,
    নক্ষত্রদের মধ্যে এক নক্ষত্র
    আর সবচেয়ে ছোটো,
    নীল মখমলে এক সোনালি ধূলিকণা---
    আমি এর কথা বলতে চাইছি, আমাদের মহান পৃথিবী ।
    এই পৃথিবী একদিন শীতল হয়ে যাবে,
    এক খণ্ড বরফের মতন নয়
    কিংবা এমনকি মৃত মেঘ
    কিন্তু ফাঁকা আখরোটের মতন এটা গড়িয়ে চলবে
    ঘন কালো শূন্যতায়…
    আপনার এখনই এর জন্য শোকপালন করা উচিত
    --- এই দুঃখ আপনাকে এখনই পেতে হবে----
    কেননা জগতকে এতোটা ভালোবাসতেই হবে
    যদি আপনি বলতে চান, “আমি বেঁচে ছিলুম”...
  • Miroslav Holub | 236712.158.891212.251 | ২১ জুন ২০১৯ ১৮:৩৬383600
  • মিরোস্লাফ হোলুপ-এর কবিতা ( ১৯২৩ - ১৯৮৮ )
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "প্রেম"
    একশো মাইল
    দেয়াল থেকে দেয়াল ।
    এক অনন্তকাল ও অর্ধেক নিশিপালন
    তুষারের চেয়েও উদাস ।
    অজস্র শব্দ
    পুরোনো পথরেখা
    বালিতে প্ল্যাটিপ্লাসের মতন।
    একশো বই যা আমরা লিখিনি
    একশো পিরামিড যা আমরা গড়িনি।
    ঝেঁটিয়ে একত্র-করা জিনিসপত্র ।
    ধুলো ।
    তিক্ত
    জগতের আরম্ভের মতন ।
    বিশ্বাস করো যখন আমি বলি
    ব্যাপারটা সুন্দর ছিল ।

    "হসটেলের বিলডিঙে"
    মাটির ঢিবির ওপরে,
    ইঁটের সাজানো প্রতিক্রিয়ায়,
    কংক্রিটের ক্ষয়াটে দুধদাঁতের মাঝে
    এখনই জন্মেছে
    এক ধূসর, দুই-থাক
    কফিন ।
    ( পা পুঁছে নিন )

    প্রবেশ
    এক মহিমাময় জাদুঘর
    পিত্ত পাথুরির
    শূন্যতার ।
    ( শান্তি বজায় রাখুন )
    নলের আঙুলগুলো গর্তগুলো অনুসন্ধান করে
    আর সোমবার সকালের চেঁচামেচি
    সব জায়গায়
    ( থুতু ফেলবেন না )
    মালপত্র রাখার জায়গার ওপরে
    একটাই টুনিআলো ক্ষোভ দেখায়
    ঝোলানো
    কংক্রিটের আকাশ থেকে ।
    আর এক পেরেকের ওপরে
    মাংসে ঢোকানো
    জাহাজডুবির মোজা আর বক্ষবন্ধনি
    শুকোয় ।
    ( করিডরে ঘোরাঘুরি করবেন না )
    আমাদের দেখা হল
    মেয়েদের চোখে তাকিয়ে,
    দেয়ালগায়ে ছারপোকার মতন বেড়িয়ে
    আর আমরা জানতে চাইলুম,
    ভালোবাসা কাকা বলে
    আর
    আমরা কি তাড়াতাড়ি কমবয়সী হবো ?

    "শূন্যে লাফিয়ে পড়ার দৈহিক গঠনতন্ত্র"
    ক. লিফ্ট ব্যবহার করুন
    ওপরে যাওয়ার
    অনুমতি আছে, শর্ত হল

    খ. লিফ্ট ব্যবহার করুন
    নিচে যাবার
    অনুমতি নেই, শর্ত হল

    গ. লিফ্টের ব্যবহার
    ওপরে যাওয়ার

    ঘ. লিফ্টের ব্যবহার
    নিচে যাবার জন্য নয়

    ঙ. লিফ্টের ব্যবহার
    ওপরে যাওয়ার

    চ. লিফ্টের ব্যবহার
    যাচ্ছে

    ছ. লিফ্টের ব্যবহার

    জ. হল নয়

    ঝ. ব্যবহার

    ঞ. ব্য

    ত. আমি

    "দরোজা"
    যাও আর দরোজাটা খোলো।
    হয়তো বাইরে রয়েছে
    একটা গাছ, কিংবা একটা বন,
    একটা বাগান,
    কিঢবা এক ইন্দ্রজাল শহর ।
    যাও আর দরোজাটা খোলো ।
    হয়তো একটা কুকুর জঞ্জাল ঘাঁটছে ।
    হয়তো তুমি একটা মুখ দেখতে পাবে,
    কিংবা একটা চোখ,
    কিংবা ছবি
    একটা ছবির।
    যাও আর দরোজাটা খোলো ।
    যদি কুয়াশা থাকে
    তা কেটে যাবে ।
    যাও আর দরোজাটা খোলো ।
    যদি সেখানে কেবল
    অন্ধকার স্পন্দিত হয়
    যদি সেখানে কেবল
    ফাঁকা বাতাস থাকে,
    এমনকি যদি
    কিছুই না
    থাকে সেখানে,
    যাও আর দরোজাটা খোলো ।
    অন্তত
    সেখানে থাকবে
    এক আকর্ষণ ।

    "ডানা"
    আমাদের রয়েছে
    এক আণুবীক্ষনিক দৈহিক গঠনতন্ত্র
    তিমিমাছের
    এটা
    দ্যায়
    মানুষকে
    নিশ্চয়তা
    উইলিয়াম কারলস উইলিয়ামস

    আমাদের রয়েছে
    ব্রহ্মাণ্ডের মানচিত্র
    জীবানুদের জন্য,
    আমাদের রয়েছে
    জীবানুদের মানচিত্র
    ব্রহ্মাণ্ডের জন্য।

    আমাদের রয়েছে
    দাবা খেলার একজন গ্র্যাণ্ডমাস্টার
    ইলেকট্রনিক সারকিটে তৈরি ।

    কিন্তু সবার ওপরে
    আমাদের রয়েছে
    সামর্থ্য
    মটরশুঁটি বাছার,
    হাতে পেয়ালা নিয়ে,
    খোঁজা
    সঠিক স্ক্রুড্রাইভার
    সোফার তলায়
    কয়েক ঘণ্টা যাবত

    তা
    আমাদের দ্যায়
    ডানা

    "মাছি"
    উইলো গাছের গুঁড়িতে বসেছিল মেয়েমাছি
    লক্ষ করছিল
    ক্রেসির যুদ্ধের একাংশ,
    চেঁচামেচি,
    শ্বাস নেবার চেষ্টা
    গোঙানি,
    মাড়ানো আর হুমড়ি খেয়ে পড়া
    চোদ্দতম আক্রমণেরর
    ফরাসি অশ্ববাহিনীর
    মেয়েমাছিটি সঙ্গম করলো
    এক কটাচোখ পুরুষ মাছির সঙ্গে
    সে ভাদিনকোর্টের।
    মেয়েমাছি নিজের দুই পা রগড়ালো
    গিয়ে বসল এক পেটকাটা ঘোড়ার ওপর
    গভীর চিন্তা করল
    মাছিদের অমরত্ব সম্পর্কে ।
    ময়লা ফেলে ডানায় ভর দিলো
    নীল জিভের ওপরে
    ক্লেরভাউয়ের ডিউকের ।
    যখন স্তব্ধতা নেমে এলো
    আর কেবল পচনের ফিসফাস
    দেহগুলোর চারিপাশে আলতো পাক খাচ্ছিল
    আর কেবল
    কয়েকটা হাত আর পা
    গাছের তলায় তখনও নড়ছিল,
    মেয়েমাছি ডিম পাড়া আরম্ভ করল
    একটিমাত্র চোখে
    য়োহান উহরের,
    রাজকীয় অস্ত্রাগারের রক্ষক।
    আর এমনি করেই
    মেয়েমাছিটিকে দ্রুত খেয়ে ফেলল
    পলাতকরা
    এসত্রিজের আগুন থেকে ।

    "নেপোলিয়ান"
    খোকারা, কখন
    নেরপোলিয়ান বোনাপার্ট জন্মেছিলেন,
    জিগ্যেস করেন শিক্ষক ।

    হাজার বছর আগে, ছাত্ররা বলে।
    শত বছর আগে, ছাত্ররা বলে।
    গত বছর, ছাত্ররা বলে ।
    কেউই জানে না ।

    খোকারা, কি করেছিলেন
    নেপোলিয়ান বোনাপার্ট,
    শিক্ষক জিগ্যেস করেন ।

    একটা যুদ্ধ জয় করেছিলেন, ছাত্ররা বলে ।
    একটা যুদ্ধ হেরেছিলেন, ছাত্ররা বলে।
    কেউই জানে না ।

    আমাদের মাংসঅলার একটা কুকুর ছিল
    নেপোলিয়ান নামে,
    বলল ফ্রান্তিসেক।

    মাংসঅলাটা তাকে পেটাতো আর কুকুরটা মারা গেল
    না খেতে পেয়ে
    এক বছর আগে ।

    সব ছাত্ররা এখন দুঃখিত
    নেপোলিয়ানের জন্য ।

    "সতর্কতা"
    একটা গাছ প্রবেশ করে আর ঝুঁকে বলে :
    ‘আমি একটা গাছ।’
    আকাশ থেকে একটা কালো অশ্রুফোঁটা পড়ে আর বলে:
    ‘আমি একটা পাখি।’
    একটা মাকড়সার জালের তলার দিকে
    ভালোবাসার মতন কিছু
    কাছে আসে
    আর বলে :
    ‘আমি স্তব্ধতা।’
    কিন্তু ব্ল্যাকবোর্ডে বিস্তারিত
    রাষ্ট্রিয় গণতন্ত্রের এক
    শায়া-পরা ঘোড়া
    আর বারবার বলে,
    চতুর্দিকে কান নাড়িয়ে
    বারবার বারবার বলে,
    ‘আমি ইতিহাসের ইনজিন
    আর
    আমরা সবাই
    ভালোবাসি
    প্রগতি
    আর
    সাহস
    আর যোদ্ধার রোষ।’
    ক্লাসঘরের দরোজার তলায়
    গযায়
    রক্তের এক সরু ধারা।
    কেননা এখানেই আরম্ভ হয়
    গণহত্যা
    নিষ্পাপদের ।
  • মানিক | 237812.68.233412.82 | ২২ জুন ২০১৯ ১৭:৩৪383601
  • কেউ পারলে নদ্দীউ নতিমের কবিতা দেবেন।
  • Vladimir Mayakovsky | 236712.158.891212.197 | ২৩ জুন ২০১৯ ১০:৩১383602
  • ভ্লাদিমির মায়াকভস্কির কবিতা ( ১৮৯৩ - ১৯৩০ ) ‘মেরুদণ্ড বেণু’
    Backbone Flute কবিতার অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    প্রস্তাবনা
    তোমাদের সকলের জন্যে,
    যারা কখনও আনন্দ দিয়েছিল বা এখনও দিচ্ছে,
    আত্মার সমাধিতে প্রতিমাদের দ্বারা সুরক্ষিত,
    আমি তুলে ধরব, মদের এক পানপাত্রের মতো
    উৎসবের অনুষ্ঠানে, খুলির কানায়-কানায় ভরা কবিতা ।
    .
    আমি প্রায়ই বেশি-বেশি ভাবি :
    আমার জন্যে অনেক ভালো হতে পারতো
    একটা বুলেট দিয়ে আমার সমাপ্তিকে বিদ্ধ করে দেয়া ।
    আজকের দিনেই,
    হয়তো বা,
    আমি আমার অন্তিম প্রদর্শন মঞ্চস্হ করছি।
    .
    স্মৃতি !
    আমার মগজ থেকে সভাঘরে একত্রিত হয়
    আমার প্রেমের অফুরান সংখ্যা
    চোখ থেকে চোখে হাসি ছড়িয়ে দ্যায় ।
    বিগত বিয়ের ফেস্টুনে রাতকে সাজাও।
    দেহ থেকে দেহে ঢেলে দাও আনন্দ ।
    এই রাত যেন কেউ ভুলতে না পারে ।
    এই অনুষ্ঠানে আমি বেণু বাজাব ।
    বাজাবো আমার নিজের মেরুদণ্ডে ।
    .


    বড়োবড়ো পা ফেলে আমি মাড়িয়ে যাচ্ছি দীর্ঘ পথ ।
    কোথায় যাবো আমি, নিজের ভেতরের নরকে লুকোবো ?
    অভিশপ্ত নারী, কোন স্বর্গীয় কার্যাধ্যক্ষ
    তার কল্পনায় তোমাকে গড়েছে ?!
    আনন্দে মাতার জন্য পথগুলো অনেক বেশি সঙ্কীর্ণ ।
    ছুটির দিনের গর্ব আর শোভাযাত্রায় জনগণ বেরিয়ে পড়েছে রবিবারের সাজে।
    আমি ভাবলুম,
    ভাবনাচিন্তা, অসুস্হ আর চাপচাপ
    জমাটবাঁধা রক্ত, আমার খুলি থেকে হামাগুড়ি দিয়েছে ।
    .
    আমি,
    যাকিছু উৎসবময় তার ইন্দ্রজালকর্মী,
    এই উৎসব বাঁটোয়ারা করার কোনো সঙ্গী নেই।
    এবার আমি যাবো আর ঝাঁপাবো,
    নেভস্কির পাথরগুলোতে ঠুকবো আমার মগজ !
    আমি ঈশ্বরনিন্দা করেছি ।
    চিৎকার করে বলেছি ঈশ্বর বলে কিছু নেই,
    কিন্তু নরকের অতল থেকে
    ঈশ্বর এক নারীকে অবচিত করলেন যার সামনে পর্বতমালা
    কাঁপবে আর শিহরিত হবে :
    তিনি তাকে সামনে নিয়ে এলেন আর হুকুম দিলেন :
    একে ভালোবাসো !
    .
    ঈশ্বর পরিতৃপ্ত ।
    আকাশের তলায় এক দুরারোহ পাআড়ে
    এক যন্ত্রণাকাতর মানুষ পশুতে পরিণত হয়ে বিদ্ধস্ত হয়েছে ।
    ঈশ্বর হাত কচলান ।
    ঈশ্বর চিন্তা করেন :
    তুমি অপেক্ষা করো, ভ্লাদিমির !
    যাতে তুমি জানতে না পারো নারীটি কে,
    তিনি ছিলেন, নিঃসন্দেহে তিনি,
    যিনি নারীটিকে একজন বাস্তব স্বামী দেবার কথা ভাবলেন
    আর পিয়ানোর ওপরে মানুষের স্বরলিপি রাখলেন ।
    কেউ যদি হঠাৎ পা-টিপে-টিপে শোবার ঘরের দরোজায় যেতো
    আর তোমার ওপরের ওয়াড়-পরানো লেপকে আশীর্বাদ করতো,
    আমি জানি
    পোড়া পশমের গন্ধ বেরোতো,
    আর শয়তানের মাংস উদ্গীরণ করতো গন্ধকের ধোঁয়া।
    তার বদলে, সকাল হওয়া পর্যন্ত,
    আতঙ্কে যে ভালোবাসবার জন্য তোমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে
    আমি ছোটাছুটি করলুম
    আমার কান্নাকে কবিতার মুখাবয়ব দিলুম,
    উন্মাদনার কিনারায় এক হীরক-কর্তনকারী।
    ওহ, কেবল এক থাক তাসের জন্য !
    ওহ, মদের জন্য
    শ্বাসে বেরোনো হৃদয়কে কুলকুচি করার জন্য ।
    .
    তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই !
    তোমাকে আমি চাই না !
    যাই হোক না কেন,
    আমি জানি
    আমি তাড়াতাড়ি কর্কশ চিৎকারে ভেঙে পড়ব !
    .
    যদি সত্যি হয় যে তোমার অস্তিত্ব আছে,
    ঈশ্বর,
    আমার ঈশ্বর,
    যদি নক্ষত্রদের জাজিম তোমারই বোনা হয়,
    যদি, প্রতিদিনকার এই
    অতিরক্ত যন্ত্রণা,
    তুমি চাপিয়ে দিয়েছ নিগ্রহ, হে প্রভু ;
    তাহলে বিচারকের শেকল পরে নাও ।
    আমার আগমনের জন্য অপেক্ষা করো।
    আমি সময়কে মান্যতা দিই
    এবং এক দিনও দেরি করব না ।
    শোনো,
    সর্বশক্তিমান ধর্মবিচারক !
    আমি মুখে কুলুপ দিয়ে রাখব ।
    কোনো কান্না
    আমার কামড়ে-ধরা ঠোঁট থেকে বেরোবে না।
    ঘোড়ার ল্যাজের মতো ধুমকেতুর সঙ্গে আমাকে বেঁধে রাখো,
    আর ঘষটে নিয়ে চলো আমাকে,
    নক্ষত্রদের গ্রাসে ছিন্ন হয়ে ।
    কিংবা হয়তো এরকম :
    আমার আত্মা যখন দেহের আশ্রয় ছেড়ে
    তোমার বিচারব্যবস্হার সামনে নিজেকে উপস্হিত করবে,
    তখন কটমট ভ্রু কুঁচকে,
    তুমি,
    ছায়াপথের দুই পাশে পা ঝুলিয়ে ছুঁড়ে দিও ফাঁসির দড়ি,
    একজন অপরাধীর মতন আমাকে গ্রেপ্তার করে ঝুলিয়ে দিও ।
    তোমার ইচ্ছানুযায়ী যা হয় কোরো।
    যদি চাও আমাকে কেটে চার টুকরো করো।
    আমি নিজে তোমার হাত ধুয়ে পরিষ্কার করে দেবো ।
    কিন্তু এইটুকু করো--
    তুমি কি শুনতে পাচ্ছো !---
    ওই অভিশপ্ত নারীকে সরিয়ে দাও
    যাকে তুমি আমার প্রিয়তমা করেছো !
    .
    বড়ো বড়ো পা ফেলে আমি মাড়িয়ে যাচ্ছি দীর্ঘ পথ ।
    কোথায় যাবো আমি, নিজের ভেতরের নরকে লুকোবো ?
    অভিশপ্ত নারী, কোন স্বর্গীয় কার্যাধ্যক্ষ
    তার কল্পনায় তোমাকে গড়েছে ?!
    .


    উভয় আলাশকে,
    ধোঁয়ায় ভুলে গিয়েছে তার রঙ ছিল নীল,
    আর মেঘগুলো দেখতে ছেঁড়াখোড়া উদ্বাস্তুদের মতো,
    আমি নিয়ে আসবো আমার শেষতম ভালোবাসার ভোর,
    কোনো ক্ষয়রোগীর রক্তবমির মতন উজ্বল।
    উল্লাসময়তায় আমি ঢেকে ফেলবো গর্জন
    সমাগমকারীদের,
    বাড়ি আর আরাম সম্পর্কে বিস্মৃত।
    পুরুষের দল,
    আমার কথা শোনো !
    পরিখা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোও :
    তোমরা এই যুদ্ধ আরেকদিন লোড়ো।
    .
    এমনকি যদি,
    মদ্যপানের গ্রিক দেবতার মতন রক্তে লুটোপুটি খাও,
    এক মত্ত লড়াই তার শীর্ষে পৌঁছে গেছে--
    তবুও ভালোবাসার শব্দেরা পুরোনো হয় না ।
    প্রিয় জার্মানরা !
    আমি জানি
    গ্যেটের গ্রেশেন নামের নারী
    তোমার ঠোঁটে উৎসারিত হয় ।
    ফরাসিরা
    বেয়োনেটের আঘাতে হাসিমুখে মারা যায় ;
    মৃদু হাসি নিয়ে বিমানচালক ভেঙে পড়ে ;
    যখন তাদের মনে পড়ে
    তোমার চুমুখাওয়া মুখ,
    ত্রাভিয়াতা ।
    .
    কিন্তু গোলাপি হাঁ-মুখের জন্য আমার আগ্রহ নেই
    যা বহু শতক এতাবৎ কামড়েছে ।
    আজকে আমাকে জড়িয়ে ধরতে দাও নতুন পা!
    তুমি আমি গাইবো,
    লালমাথায়
    রুজমাখা ঠোঁটে ।

    হয়তো, এই সময়কে কাটিয়ে উঠে
    যা বেয়োনেটের ইস্পাতের মতন যন্ত্রণাদায়ক,
    পেকে-যাওয়া দাড়িতে বহু শতক
    কেবল আমরাই থাকবো :
    তুমি
    আর আমি,
    শহর থেকে শহরে তোমার পেছন পেছন ।
    সমুদ্রের ওই পারে তোমার বিয়ে হবে,
    আর রাতের আশ্রয়ে প্রতীক্ষা করবে---
    লণ্ডনের কুয়াশায় আমি দেগে দেবো
    তোমায় পথলন্ঠনের তপ্ত ঠোঁট ।
    এক গুমোটভরা মরুভূমিতে, যেখানে সিংহেরা সতর্ক,
    তুমি তোমার কাফেলাদের মেলে ধরবে--
    তোমার ওপরে,
    হাওয়ায় ছেঁড়া বালিয়াড়ির তলায়,
    আমি পেতে দেবে সাহারার মতন আমার জ্বলন্ত গাল।
    .
    তোমার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলিয়ে
    তুমি চাউনি মেলবে
    আর দেখবে এক সৌম্যকান্তি বুলফাইটার !
    আর হঠাৎ আমি,
    এক মরণাপন্ন ষাঁড়ের চোখের জন্য,
    ধনী দর্শকদের দিকে আমার ঈর্ষা ছুঁড়ে দেবো ।
    .
    যদি কোনো সেতু পর্যন্ত তুমি তোমার সংশয়াপন্ন পা নিয়ে যাও,
    এই ভেবে
    নিচে নামা কতো ভালো--
    তাহলে সে আমিই,
    সেতুর তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সিন নদী,
    যে তোমাকে ডাকবে
    আমার ক্ষয়াটে দাঁত দেখিয়ে ।
    .
    যদি তুমি, অন্য পুরুষের সাথে মোটর গাড়িতে দ্রুত চলে যাচ্ছো, পুড়িয়ে দাও
    স্ত্রেলকা-পাড়া বা সোকোলনিকি অঞ্চল--
    তাহলে সে আমিই, উঁচুতে উঠছি,
    চাঁদের মতন প্রত্যাশী আর আবরণমুক্ত,
    যে তোমাকে আকাঙ্খায় আকুল করে তুলবে ।
    .
    তাদের প্রয়োজন হবে
    আমার মতো এক শক্তিমান পুরুষ--
    তারা হুকুম করবে :
    যুদ্ধে গিয়ে মরো !
    শেষ যে শব্দ আমি বলব
    তা তোমার নাম,
    বোমার টুকরোয় জখম আমার রক্তজমাট ঠোঁটে ।
    .
    আমার শেষ কি সিংহাসনে বসে হবে ?
    নাকি সেইন্ট হেলেনা দ্বীপে ?
    জীবনের ঝড়ের দাপটগুলোকে জিন পরিয়ে,
    আমি প্রতিযোগীতায় নেমেছি
    জগতের রাজত্বের জন্য
    আর
    দণ্ডাদেশ-পাওয়া কয়েদির পায়ের বেড়ি ।
    .
    আমি জার হবার জন্য নিয়তি-নির্দিষ্ট--
    আমার মুদ্রার সূর্যালোকপ্রাপ্ত সোনায়
    আমি আমার প্রজাদের হুকুম দেবো
    টাঁকশালে ছাপ দিতে
    তোমার চমৎকার মুখাবয়ব !
    কিন্তু যেখানে
    পৃথিবী হিমপ্রান্তরে বিলীন হয়,
    নদী যেখানে উত্তর-বাতাসের সঙ্গে দরাদরি করে,
    সেখানে আমি পায়ের বেড়িতে লিলির নাম আঁচড়ে লিখে যাবো,
    আর কঠোর দণ্ডাদেশের অন্ধকারে,
    বারবার তাতে চুমু খাবো ।
    .

    তোমরা শোনো, যারা ভুলে গেছ আকাশের রঙ নীল,
    যারা সেই রকম রোমশ হয়েছ
    যেন জানোয়ার ।
    হয়তো এটাই
    জগতের শেষতম ভালোবাসা
    যা ক্ষয়রোগীর রক্তবমির মতন উজ্বল ।
    .


    আমি ভুলে যাব বছর, দিন, তারিখ ।
    কাগজের এক তাড়া দিয়ে নিজেকে তালাবন্ধ করে রাখব।
    আলোকপ্রাপ্ত শব্দাবলীর যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে,
    সৃষ্টি করব তোমায়, হে অমানবিক ইন্দ্রজাল !
    .
    এই দিন, তোমার কাছে গিয়ে,
    আমি অনুভব করেছি
    বাড়িতে কিছু-একটা অঘটন ঘটেছে ।
    তোমার রেশমে কিছু গোপন করেছ,
    আর ধূপের সুগন্ধ ফলাও হয়ে ছড়িয়েছে বাতাসে ।
    আমাকে দেখে আনন্দিত তো ?
    সেই “অনেক”
    ছিল অত্যন্ত শীতল ।
    বিভ্রান্তি ভেঙে ফেলল যুক্তির পাঁচিল ।
    তপ্ত ও জ্বরে আক্রান্ত, আমি হতাশার স্তুপে আশ্রয় নিলুম ।
    .
    শোনো,
    তুমি যা-ই করো না কেন,
    তুমি শবকে লুকোতে পারবে না ।
    সেই ভয়ানক শব্দ মাথার ওপরে লাভা ঢেলে দ্যায় ।
    তুমি যা-ই করো না কেন,
    তোমার প্রতিটি পেশীতন্তু
    শিঙা বাজায়
    যেন লাউডস্পিকার থেকে :
    মেয়েটি মৃতা, মৃতা, মৃতা !
    তা হতে পারে না,
    আমাকে জবাব দাও ।
    মিথ্যা কথা বোলো না !
    ( এখন আমি যাবো কেমন করে ? )
    তোমার মুখাবয়বে তোমার দুই চোখ খুঁড়ে তোলে
    দুটি গভীর কবরের ব্যাদিত অতল ।
    .
    কবরগুলো আরও গভীর হয় ।
    তাদের কোনো তলদেশ নেই ।
    মনে হয়
    দিনগুলোর উঁচু মাচান থেকে আমি প্রথমে মাথা নামিয়ে লাফিয়ে পড়ব।
    অতল গহ্বরের ওপরে আমি আমার আত্মাকে টেনে বাজিকরের দড়ি করে নিয়েছি
    আর, শব্দদের ভোজবাজি দেখিয়ে, তার ওপরে টাল সামলাচ্ছি ।
    .
    আমি জানি
    ভালোবাসা তাকে ইতিমধ্যে পরাস্ত করেছে ।
    আমি অবসাদের বহু চিহ্ণ খুঁজে পাচ্ছি ।
    আমার আত্মায় পাচ্ছি আমাদের যৌবন ।
    হৃদয়কে আহ্বান জানাও দেহের উৎসবে ।
    .
    আমি জানি
    আমাদের প্রত্যেককে এক নারীর জন্য চড়া দাম দিতে হবে ।
    তুমি কি কিছু মনে করবে
    যদি, ইতিমধ্যে,
    তোমাকে তামাক-ধোঁয়ার পোশাকে মুড়ে দিই
    প্যারিসের ফ্যাশনের বদলে ?
    .
    প্রিয়তমাষু,
    প্রাচীনকালে যিশুর বার্তাবাহকদের মতন,
    আমি হাজার হাজার পথ দিয়ে হাঁটবো ।
    অনন্তকাল তোমার জন্য এক মুকুট তৈরি করেছে,
    সেই মুকুটে আমার শব্দাবলী
    শিহরণের রামধনুর জাদু তৈরি করে ।
    .
    হাতির দল যেমন শতমণ ওজনের খেলায়
    পুরুর রাজার বিজয় সম্পূর্ণ করেছিল,
    আমি তোমার মগজে ভরে দিয়েছি প্রতিভার পদধ্বনি ।
    কিন্তু সবই বৃথা ।
    আমি তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে আনতে পারি না ।
    .
    আনন্দ করো !
    আনন্দ করো,
    এখন
    তুমি আমাকে শেষ করে দিয়েছ !
    আমার মানসিক যন্ত্রণা এতোটাই তীক্ষ্ণ,
    আমি ছুটে চলে যাবো খালের দিকে
    আর মাথা চুবিয়ে দেবো তার অপূরণীয় গর্তে ।
    .
    তুমি তোমার ঠোঁট দিয়েছিলে ।
    তুমি ওদের সঙ্গে বেশ রুক্ষ ছিলে ।
    আমি হিম হয়ে গেলুম ছুঁয়ে ।
    অনুতপ্ত ঠোঁটে আমি বরং চুমু খেতে পারতুম
    জমাট পাথর ভেঙে তৈরি সন্ন্যাসিনীদের মঠকে ।
    .
    দরোজায়
    ধাক্কা ।
    পুরুষটি প্রবেশ করলো,
    রাস্তার হইচইয়ে আচ্ছাদিত ।
    আমি
    টুকরো হয়ে গেলুম হাহাকারে ।
    কেঁদে পুরুষটিকে বললুম :
    “ঠিক আছে,
    আমি চলে যাবো,
    ঠিক আছে !
    মেয়েটি তোমার কাছেই থাকবে ।
    মেয়েটিকে সুচারু ছেঁড়া পোশাকে সাজিয়ে তোলো,
    আর লাজুক ডানা দুটো, রেশমে মোড়া, মোটা হয়ে উঠুক।
    নজর রাখো যাতে না মেয়েটি ভেসে চলে যায় ।
    তোমার স্ত্রীর গলা ঘিরে
    পাথরের মতন, ঝুলিয়ে দাও মুক্তোর হার ।”
    .

    ওহ, কেমনতর
    এক রাত !
    আমি নিজেই হতাশার ফাঁস শক্ত করে বেঁধে নিয়েছি ।
    আমার ফোঁপানি আর হাসি
    আতঙ্কে শোচনীয় করে তুলেছে ঘরের মুখ ।
    তোমার দৃষ্টিপ্রতিভার বিধুর মুখাকৃতি জেগে উঠলো ;
    তোমার চোখদুটি জাজিমের ওপরে দীপ্ত
    যেন কোনো নতুন জাদুগর ভেলকি দেখিয়ে উপস্হিত করেছে
    ইহুদি স্বর্গরাজ্যের ঝলমলে রানিকে ।
    .
    নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায়
    মেয়েটির সামনে যাকে আমি সমর্পণ করে দিয়েছি
    আমি হাঁটু গেড়ে বসি ।
    রাজা অ্যালবার্ট
    তাঁর শহরগুলোকে
    সমর্পণের পর
    আমার তুলনায় ছিলেন উপহারে মোড়া জন্মদিনের খোকা ।
    .
    ফুলেরা আর ঘাসভূমি, সূর্যালোকে সোনার হয়ে গেল !
    বাসন্তী হয়ে ওঠো, সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তির জীবন !
    আমি চাই একটিমাত্র বিষ--
    কবিতার একটানা গভীর চুমুক ।
    .

    আমার হৃদয়ের চোর,
    যে তার সমস্তকিছু ছিনতাই করেছে,
    যে আমার আত্মাকে পীড়ন করে চিত্তবিভ্রম ঘটিয়েছে,
    গ্রহণ করো, প্রিয়তমা, এই উপহার--
    আর কখনও, হয়তো, আমি অন্যকিছু সম্পর্কে ভাববো না ।
    .
    এই দিনটিকে উজ্বল ছুটির দিনে রাঙিয়ে দাও ।
    হে ক্রুশবিদ্ধসম ইন্দ্রজাল,
    তোমার সৃষ্টি বজায় রাখো ।
    যেমনটা দেখছো--
    শব্দাবলীর পেরেকগুচ্ছ
    আমাকে কাগজে গিঁথে দাও ।
    .

    ( ইংরেজিতে এই কবিতাটির অনুবাদ অনেকে করেছেন । তাদের মধ্যে প্রচুর তফাত । আমি বেছে নিয়েছি Live Journal-এর ভার্সান )
  • Yevgeny Yevtushenko | 236712.158.891212.39 | ২৪ জুন ২০১৯ ১০:৩২383603
  • ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো-র কবিতা "স্তালিনের উত্তরাধিকারীরা"
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    মার্বেল পাথরের দেয়াল বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে
    বোবার মতো পরিষ্কার জানালার কাচ
    বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে পাহারাদাররা
    ঝোড়ো বাতাসে তাদের মুখ ম্লান
    যখন সমাধির দরোজা খুলে
    পাহারাদাররা তাঁকে বের করে আনলো
    কফিনের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস
    ক্রমশ কফিনখানা ভেসে যাচ্ছে
    স্হির বেয়োনেটগুলোর ডগা ছুঁয়ে
    উনি নিজেও ছিলেন বোবা -- নিঃসন্দেহে বোবা
    কিন্তু চমকদার আর বোবা
    নির্মমভাবে মুঠো বন্ধ করে আছেন
    ওনার মৃত সংরক্ষিত হাতে
    কফিনের ফাঁক গলে উনি তাকান
    শুয়ে আছেন মরে যাবার ভান করে
    প্রত্যেক শববাহকের মুখ
    মনে রেখেছেন উনি
    রিয়াজান আর কুর্সক থেকে আগত তরুণ সেনা
    পরে কোনো সময়ে উনি
    গায়ে জোর পেলেই আক্রমণ করবেন
    উঠে বেরিয়ে আসবেন কবর থেকে
    আর প্রতিশোধ নেবেন
    সব কয়টা অকৃতজ্ঞের ওপর
    যত সব মাথা মোটার দল
    মনে-মনে উনি ষড়যন্ত্র কষছেন
    এখন ক্লান্ত, জিরিয়ে নিচ্ছেন কিছুক্ষণ ।
    সরকারের কাছে আমার
    হাঁটুমুড়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ
    সমাধিতে পাহারাদারের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দিন
    কিংবা তিনগুণ
    যাতে স্তালিন কবর থেকে উঠে আসতে না পারেন
    আর স্তালিনের সঙ্গে -- আমাদের অতীত ।
    আমরা সৎপথে চলি, ক্ষেতে বীজ বুনি
    সৎভাবে কারখানায় লোহা গলাই
    সৎভাবে কুচকাওয়াজ করি
    সেনা আর সেনাধ্যক্ষ -- যে যার মতন করে ।
    কিন্তু নেতা আমাদের ভুলে গিয়েছিলেন
    উপায়গুলোও উপযুক্ত হওয়া দরকার ছিল
    সেই মহান উদ্দেশ্যে পৌঁছোবার জন্য ।
    উনি ছিলেন দূরদর্শী
    যুদ্ধ লড়ার নানা পরিকল্পনায় দক্ষ ।
    এই জগতে উনি ছেড়ে গেছেন
    অজস্র বংশধর ।
    আমার মনে হয়
    ওনার কফিনের ভেতরে টেলিফোনের লাইন বসানো আছে
    স্তালিন সেখান থেকে
    তাঁর চরদের হুকুম করেন
    কফিন থেকে বেরিয়ে
    টেলিফোনের তারগুলো কোনদিকে যায় ?
    না, স্তালিন মারা যাননি
    জেনেশুনে উনি মৃত্যুর ভান করছেন ।
    আমরা তাঁকে সরিয়েছি
    জাঁকালো সমাধিভবন থেকে ।
    কিন্তু কার এমন বুকের পাটা আছে যে
    স্তালিনকে সরাবে
    ওনার বংশধরদের হৃদয় থেকে !
    বংশধরদের কয়েকজন
    ছুটি নিয়ে গোলাপের চাষ করেন
    কিন্তু গোপনে তাঁরা ভাবতে থাকেন
    এই ছুটি মাত্র কিছুদিনের জন্য ।
    অন্যের
    মঞ্চে উঠে জোর গলায় স্তালিনকে গালমন্দ করেন
    কিন্তু
    গভীর রাতে
    তাঁদের পুরোনো দিনকালের জন্য মনকেমন করে ।
    এতে অবাক হবার কিছু নেই
    যে যুক্তিপূর্ণ কারণে
    আমাদের চোখের সামনে
    স্তালিনের কয়েকজন বংশধরের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলো ।
    তার মানে স্তালিনের চরগুলো
    ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছে
    দেখছে সব বন্দি শিবিরগুলো জনশূন্য ।
    অথচ সভাঘরগুলো
    উপচে পড়ছে শ্রোতায়
    মাতৃভূমি আমাকে শান্ত থাকতে বারণ করে ।
    যদিও নেতারা বলে, ‘চিন্তার কিছু নেই’
    আমি নিজেকে শান্ত রাখতে পারি না ।
    স্তালিনের বংশধররা
    যতোদিন পৃথিবীতে বেঁচে আছে
    আমার দৃঢ় বিশ্বাস
    স্তালিন ততোদিন বেঁচে থাকবেন ওনার কবরে ।
  • Yevgeny Yevtushenko | 236712.158.891212.251 | ২৪ জুন ২০১৯ ১০:৩৫383604
  • ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো-র কবিতা "বাবি য়ার"
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    বাবি ইয়ারের ওপরে কোনো স্মৃতিফলক বসানো হয়নি
    গভীরে নেমে গেছে গিরিখাত
    মামুলি মানুষের স্মৃতিচিহ্ণের মতন ।
    আমি ভয়ে আক্রান্ত ।
    আজকে আমার নিজের বয়স
    জগতের সব ইহুদিদের বয়সের যোগফলের সমান ।
    এখন আমার সত্যিই মনে হয়
    যে আমি আদপে একজন ইহুদি
    এখানে আমি প্রাচীন মিশরে ঘুরেফিরে বেড়াই ।
    ক্রুশকাঠে ঝুলে এখানেই হয়েছিল আমার সমাপ্তি
    আর আজও আমার সারা শরীর জুড়ে পেরেকের ঘা ।
    আমি নিজেকে মনে করি সেই দ্রেফিস ।
    যে একাধরে প্যালেস্টাইনের
    গুপ্তচর আর বিচারক ।
    আমি জেলখানায় বন্দি ।
    চারিদিকে বাধার পাঁচিল ।
    ওরা কুকুর লেলিয়ে দ্যায়
    গায়ে থুতু ফ্যালে
    নোংরা গালাগাল দ্যায় ।
    বাচাল আর সুন্দরী ধনী যুবতীরা
    দামি লেসবসানো ফ্রক পরে
    আমার মুখের ওপর রঙিন ছাতা উড়িয়ে চলে যায় ।
    আমি যেন তখন
    বাইলোস্তকের সেই যুবক
    যার রক্ত ঝরে মাটিতে বইতে থাকে ।
    ভাটিখানায় জড়ো-হওয়া নেতাদের গা থেকে
    ভোদকা আর পেঁয়াজের দুর্গন্ধ বেরোয় ।
    আমি অসহায়, মুখবুজে বুটের লাথি খাই ।
    জাতিবিদ্বেষী খুনীরা উত্তেজনায় চেল্লায়
    “ইহুদিদের মারো, রাশিয়াকে বাঁচাও”।
    আমার অনুনয়-বিনয়ে কেউ কান দ্যায় না ।
    চাল-গমের একজন দোকানদার
    আমার মাকে ধরে পেটায়
    হে আমার রুশি ভাইবোনেরা !
    তোমাদের তো
    আমি চিনি
    হাড়ে-হাড়ে তোমরা আন্তর্জাতিক ।
    কিন্তু যাদের হাতে নরকের পাঁক লেগে আছে
    তারা অনেক সময়ে বিশুদ্ধতার গুণগানে মেতে ওঠে ।
    আমি আমার দেশের লোকেদের ধার্মিকতা বুঝি ।
    কী নারকীয় ওই ইহুদিবিদ্বেষীরা
    বিবেকের ছিটেফোঁটা চাপ ছাড়াই
    তারা বুক ফুলিয়ে নিজেদের বলে
    ‘রুশ জনগণের সংঘবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র’।
    আমি হতে চাই
    অ্যানে ফ্র্যাংক
    জীবন্ত, স্বচ্ছন্দ,
    বসন্তঋতুর গাছের ডালের মতন ।
    আমি ভালোবাসতে চাই ।
    তার জন্য গালভরা তোষামোদের দরকার নেই ।
    আমার বড়োই দরকার
    একে অন্যের চোখে চোখ মেলে তাকানোর।
    কতটুকু চোখে দেখার
    বা গন্ধ নেবার ক্ষমতা আমাদের আছে !
    গাছের পাতাগুলো আমাদের নাগালের বাইরে
    আকাশ দেখার অনুমতি আমাদের নেই ।
    তবু আমরা অনেক কাজ করতে পারি ।
    কোমল
    একে আরেকজনকে জড়িয়ে ধরি অন্ধকার ঘরে ।
    কারা আসছে এদিকে ?
    ভয় নেই । দূর থেকে আসা আওয়াজগুলো
    বসন্তঋতুর বজ্রনির্ঘোষ :
    বসন্তঋতু আসছে আমাদের দেশে
    তাহলে তোমরা আমার কাছে এসো
    মেলে ধরো তোমাদের ঠোঁট ।
    ওরা কি দরোজা ভেঙে ফেলছে ?
    না, না, বরফের চাঙড় ভাঙার আওয়াজ….
    বাবি ইয়ারের বুনো ঘাসে উঠেছে বাতাসের ইশারা ।
    গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে বিচারকদের মতন,
    তাদের ডালপালায় রয়েছে খারাপ ইঙ্গিত ।
    চারিদিক থেকে শুনতে পাচ্ছি মুখবোজা চিৎকার,
    আর আমি মাথার টুপি খুলে
    ক্রমশ অনুভব করছি
    মাথার চুলগুলো পেকে যাচ্ছে ।
    এখানে কবরে শোয়া শতসহস্র মানুষের মতন
    এক খাঁ-খাঁ নিঃশব্দ হাহাকার ।
    এখানে রাইফেলের গুলিতে মারা গেছেন
    অজস্র বুড়ো-বুড়ি
    আমিও ।
    এখানে রাইফেলের গুলিতে মারা গেছে
    সব কয়টি খোকা-খুকু
    আমিও ।
    আমার প্রতিটি জীবনকণা
    কোনোদিন ভুলবে না
    ওই ‘ইনটারন্যাশানাল’ গান
    আমরা প্রাণভরে গাইবো
    যখন পৃথিবীর শেষ ইহুদিবিদ্বেষীকে
    চিরকালের জন্য সমাহিত করা হবে ।
    আমার গায়ে কোনো ইহুদির রক্ত লেগে থাকবে না ।
    তাদের যুক্তিহীন ক্রোধে
    প্রত্যেক ইহুদিবিদ্বেষী
    আমি ইহুদি বলে আমায় ঘেন্না করে ।
    তাই মনেপ্রাণে
    আমি একজন খাঁটি রুশ নাগরিক ।
  • Allen Ginsberg | 236712.158.891212.59 | ২৫ জুন ২০১৯ ১০:১৫383605
  • অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর "হাউল"
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    কার্ল সলোমনের জন্য

    আমি দেখেছি আমার প্রজন্মের সর্বোৎকৃষ্ট মানস বিদ্ধস্ত হয়েছে উন্মাদনায়, খিদেতে মৃগি-আক্রান্ত উদোম

    ক্রুদ্ধ বোঝাপড়ার ধান্দায় তারা ভোরবেলার নিগরো রাস্তা দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে নিজেদের,

    রাত্রি-কলকব্জার তারাপ্রজ্বলনযন্ত্রের সঙ্গে প্রাচীন স্বর্গের সম্বন্ধ খুঁজতে জ্বলে উঠেছে দেবদূতমুখো মাস্তানবৃন্দ,

    যারা ছোটোলোকমি আর ন্যাকড়াকানি আর চোখবসা আর অতিপ্রাকৃত অন্ধকারে তুরীয় ধোঁয়া টেনে ভাসমান জলশীত বসতবাড়ি-শহরের উপরিভাগে আফরিদি সঙ্গীতের ধ্যান করেছে,

    যারা স্বর্গের কাছে মেলে ধরেছে তাদের ঘিলুমগজ আর দেখেছে বস্তির চালার ওপর জ্যোতির্ময় ইসলামি দেবদূতদের পায়চারি,

    যারা অ্যারাক্যানসাস-এর সপ্রতিভ শীতল চোখের মায়ায় ছুটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে আর যুদ্ধ-পণ্ডিতদের সভায় উইলিয়াম ব্লেকের বিষাদ-আলোয় দৌড়েছে,

    যারা মাথার খুলির জানালা দিয়ে অশ্লীল গীতিকবিতা প্রকাশ ও খ্যাপামির দরুণ শিক্ষায়তন থেকে বিতাড়িত,

    যারা কয়েকদিনের না-কামানো ঘরের অন্তর্বাসে গুটিসুটি, নোংরা ফেলার গাদায় পুড়িয়েছে টাকা আর শুনেছে দেওয়াল ফুঁড়ে ঠিকরে-আসা সন্ত্রাস,

    যারা মারিহুয়ানার বেল্ট বেঁধে লারেডো থেকে নিউইয়র্ক ফেরার পথে ধরা পড়েছে বয়ঃসন্ধির কেশগুচ্ছে,

    যারা রঙ-সরাইয়ের আগুন চিবিয়েছে কিংবা স্বর্গবীথিকায় চুমুক দিয়েছে রেড়ির তেলে, মৃত্যু, কিংবা নিজের ধড়কে রাতের পর রাত অভিযোগমুক্ত করেছে স্বপ্ন দিয়ে, নেশা দিয়ে, জাগরুক দুঃস্বপ্নে, মদ আর শিশ্ন আর অন্তহীন অন্ডকোষ দিয়ে,

    ক্যানাডা ও প্যাটারসনের খুঁটির দিকে ঝাঁপিয়ে-পড়া মেধায় অতুলনীয় কানাগলির শিহরিত মেঘ ও বজ্রস্হির সময়-পৃথিবীকে তার মাঝে আলোকিত করেছে,

    হলঘরের শূন্যগর্ভ কাঠিন্য, প্রাঙ্গণের গাছসবুজ কবরসকাল ছাদের ওপরে মদখোঁয়ারি, চোখমারা নিয়ন আলোর ট্র্যাফিক জ্যোতিতে দোকানসঙ্ঘের রাস্তায় আনন্দটহল, ব্রুকলিনের গর্জাতে-থাকা শীতকালীন সন্ধ্যায় থিরথিরিয়ে-ওঠা গাছপালা এবং সূর্য এবং চাঁদ, ছাই-ক্যানেসতারার আবৃত্তি আর মেধার দয়ালু আলো-মহারাজ,

    যারা বেনজেড্রিন খেয়ে য়্যাটারি থেকে পবিত্র ব্রংক্স পর্যন্ত অন্তহীন পরিভ্রমণের জন্যে নিজেদের বেঁধে ফেলেছে সুড়ঙ্গপথে যতক্ষণ না চাকা আর শিশুর হুল্লোড়শব্দ তাদের নামিয়ে এনেছে গ্যাঁজলাওঠা থ্যাঁৎলানো বেহুঁশ-মগজ চিড়িয়াখানার বিষণ্ণ দীপ্তি-নেঙড়ানো আলোয়

    যারা ডুবে থেকেছে সারারাত বিকফোর্ডের সাবমেরিন-আলোয় আর ফুগাৎসির নির্জন দোকানে কাটিয়েছে বিস্বাদ বিয়ারের সারাটা দুপুর, হাইড্রোজেন সঙ্গীত-বিস্ফোরণে কান পেতেছে সর্বনাশের চিড়খাওয়া আওয়াজ শোনার জন্য,

    যারা লাগাতার সত্তর ঘন্টা বকবক করেছে বাগান থেকে বিছানা থেকে শুঁড়িবাড়ি থেকে বেলেভিউ থেকে যাদুঘর থেকে ব্রুকলিন-সেতু অব্দি,

    নিষ্কাম আলাপচারীর হারিয়ে-যাওয়া এক সৈন্যদল ঝাঁপিয়ে নেমেছে চাঁদের বাইরে এমপায়ার স্টেট বিলডিঙে জানালায় ঝুঁকে-পড়া অগ্নিতারণ রাস্তায়,

    হুললোড় চ্যাঁচামেচি বমি-করে ফিসফিস ঘটনা আর স্মৃতি আর গালাগল্প আর চোখনাচানো নেশা আর হাসপাতালের শক-চিকিৎসা আর জেল আর যুদ্ধ,

    সাতদিন সারারাত ধরে প্রখরচোখে সমগ্র মেধাশক্তির আমূল উৎপাটন ফুটপাতে ছুঁড়ে দেয়া ইহুদি উপাসনা-মন্দিরের মাংস,

    যারা অতলান্তিক পৌরগৃহের ধোঁয়াটে ছবির পোস্টকার্ডের ভূমিপথ এঁকে অনির্দিষ্ট জেন নিউ জারসিতে নিরুদ্দেশ,

    অন্ধকারে সাজানো নিউআর্কের ঘরের মধ্যে নেশা ভাঙবার পরে বরদাস্ত করেছে পূবদেশের ঘাম আফরিকার হাড়ব্যথা চিনের মস্তিষ্কপ্রদাহ,

    যারা কোথায় যেতে হবে কুলকিনারা না পেয়ে রেল-স্টেশানে ঘুরে বেড়িয়েছে মাঝরাতে, তারপর চলে গিয়েছে, ভাঙা হৃদয় ফেলে যায়নি,

    যারা দাদু-প্রাচীন রাতে জিড়িগাড়ি জুড়িগাড়ি জুড়িগাড়িতে বসে সিগারেট ধরিয়ে তুষারপাত ফুঁড়ে এগিয়েছে নির্জন খামারবাড়ির দিকে,

    যারা পড়েছে প্ল্যাটিনাস পো সেইন্ট জন অব দ্য ক্রস টেলিপ্যাথি এবং ইহুদি গুপ্তমন্ত্র কারণ ক্যানসাস শহরে তাদের পায়ের কাছে সহজাত ধারণায় স্পন্দিত হয়েছে মহাজগত,

    যারা অলৌকিক রেড ইন্ডিয়ান দেবদূতদের খোঁজে একা-একা টহল দিয়েছে ইডাহো শহরের অলিগলি তারা নিজেরা সত্যিই অলৌকিক দেবদূত ছিল,

    যারা নিজেদের মনে করেছে উন্মাদ যখন অতিপ্রাকৃত উচ্ছ্বাসে আভাউজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বাল্টিমোর শহর,

    যারা শীত-মাঝরাত-পথ আলোব ছোটোশহর-বৃষ্টির প্রেরণায় ওকলাহোমা’র চিনামজুরের সঙ্গে আচ্ছাদিত বিলাসগাড়িতে,

    যারা গানবাজনা বা সঙ্গম বা ঝোল-তরকারির ধান্দায় হিউস্টন শ্রে ক্ষুধার্ত ও একা ঘুরে মরেছে, আর আমেরিকা ও অনন্তের বিষয়ে আলোচনার জন্যে পিছু নিয়েছে মেধাবী ইসপাহানিদের, অসাধ্য কাজ, তাই জাহাজে পাড়ি দিয়েছে আফ্রিকায়,

    যারা শিকাগো বৈঠকখানায় তাত পোয়াবার আগুনে কবিতার লাভা ও ছাই ছড়িয়ে মেকসিকোর আগ্নেয়গিরিতে উবে গেছে আর পোশাকের ছায়া ছাড়া তারা কিছুই ফেলে যায়নি,

    যারা তারপর আবার ফিরে এসেছে চামড়ার রঙ ঝলসিয়ে ডাগর শান্তিকামী চোখে দাড়ি আর হাফপ্যান্টে পশ্চিম উপকূলে এফ বি আই তদন্ত করে দুর্বোধ্য ফালিকাগজ বিলোতে বিলোতে,

    যারা পুঁজিবাদের মাদক তামাক-অস্পষ্টতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিজেদের বাহুতে সিগারেট-আগুনের ছ্যাঁদা করেছে,

    যারা জামা-কাপড় ছেড়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে ইউনিয়ান স্কোয়ারে বিলিয়েছে অতিসাম্যবাদী পুস্তিকা যখন লস অ্যালামস সাইরেনের বিলাপ তাদের দমিয়ে দিয়েছে, বিলাপ দমিয়েছে শেবারবাজার, আর স্টেটেন দ্বীপের ফেরিজাহাজও বিলাপ করেছে,

    যারা চুনকাম-জিমনাশিয়ামে অন্যের কংকালযন্ত্রের সামনে উলঙ্গ শিহরণে কাঁদতে-কাঁদতে ভেঙে পড়েছে,

    যারা কামড়ে ধরেছে গোয়েন্দাদের ঘাড় এবং আরণ্যক সমকামের রান্নাবান্না ও নেশাভাঙ ছাড়া অনড় কোনো অপরাধ না করার দরুন পুলিশের গাড়িতে চিৎকার করে উঠেছঢ আনন্দে,

    যারা গলিপথে হাঁটু গেড়ে আর্তনাদ করে উঠেছে আর ছাদের ওপর হিঁচড়ে নিয়ে যাবার সময় লিঙ্গ ও পাণ্ডুলিপির ইশারা উড়িয়েছে,

    যারা মোটরসাইকেলের সন্ত আরোহীদের পায়ুধর্ষণ করতে দিয়ে চিৎকার করেছে উল্লাসে,

    যারা উড়িয়েছে আর যাদের উড়িয়েছে সেই মানব-দেবদূতরা নাবিকরা অতলান্তিক ও ক্যারিবিয়ান ভালোবাসার আদর,

    যারা সকাল-সন্থ্যা অবাধে যাকে-তাকে বীর্য বিলিয়েছে গোলাপবাগানে পার্কের ঘাসের ওপরে আর কবরখানায়,

    যারা খিলখিলিয়ে হাসতে গিয়ে অবিরাম হেঁচকি তুলেছে আর যখন শ্বেতশুভ্র ল্যাংটো দেবদূতরা তলোয়ার বিদ্ধ করেছে তাদের তারা স্নানের ঘরের আবডালে কেঁদে ফেলেছে,

    যারা অদৃষ্টের তিন জ্বালাতনকারিনীর কাছে হারিয়েছে নিজেদের প্রেমবালকদের এক সেই বহুকামী টাকার একচোখো মাগি এক সেই একচোখো মাগি যে গর্ভের ভেতর থেকে চোখ মারে এবং সেই একচোখো মাগি যে নিজের পাছার ওপর বসে কিছুই করে না কেবল কারিগরের তাঁতের মেধাবী সোনালি ধাগা ছেঁড়ে,

    যারা সঙ্গমে ভাবাবিষ্ট ও অতৃপ্ত সঙ্গে এক বোতল বিয়ার এক প্রণয়ী এক প্যাকেট সিগারেট আকটা মোমবাতি সুদ্ধ খাট থেকে মেঝেয় পড়েছে মেঝেতে গড়াতে-গড়াতে হলঘরে দেয়াল পর্যন্ত গিয়ে মূর্চ্ছা গিয়েছে পরম-যোনির কল্পনায় এবং ফিরে এসেছে চেতনার শেষ স্তরে,

    যারা গোধুলির কম্পমান হাজার নারীর চাউনিকে সুধা-মোহিনী করেছে আর ভোরবেলায় লাল চোখ নিয়ে জাগা সত্বেও সূর্যোদয়ের চাউনিকে সুধামোহন করার জন্য তৈরি হয়ে গোলবাড়ির দাওয়ায় দেখিয়েছে পাছার ঝলক আর ঝিলঝিলে উদোম,

    যারা অজস্র চুরি-করা রাতমোটরে কোলোরাডো শহর ছাড়িয়ে বেলেল্লাপনা করতে বেরিয়েছে, এন সি, এই কবিতার গোপন নায়ক, ডেনভার-এর অ্যাডোনিস ও শিশ্নমানব—- খাবার ঘরের ফাঁকা জায়গায় অসংখ্য মেয়ের সঙ্গে সঙ্গমের স্মৃতি-আনন্দ, সিনেমাঘরের পেঁচোয়-পাওয়া সারিতে, পাহাড়চুড়ায় গুহায় কিংবা চেনাজানা রাস্তায় ফাঁকা শায়াগোটানো শিড়িংগে চাকরানির সঙ্গে আর বিশেষ করে আত্নজ্ঞানবাদী পাকা খেলুড়েদের গোপন পেটরল-পাম্প, এমনকি শহরের অলিগলিতে,

    যারা বিশাল নোংরা সিনেমায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে, স্বপ্নের মধ্যে তুলে নিয়ে গিয়েছে তাদের, জেগে উঠেছে আচমকা ম্যানহাটনে, হৃদয়হীন টোকে-র মাটির তলার ঘরে সামলেছে নিজেদের আর থার্ড অ্যাভেনিউ-এর ধাবমান স্বপ্নের আতঙ্ক এবং শেষকালে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে চাকরি-খোঁজার দফতরে,

    যারা সারারাত তুষারমাখা জাহাজঘাটায় রক্তভর্তি জুতো পরে এই আশায় হেঁটেছে যে একদিন আফিম আর তাপবাষ্পে ঠাসা ঘর দরজা খুলে দেখবে একটি নদী,

    যারা চাঁদের যুদ্ধকালীন নীলাভ আলোকবন্যায় হাডসন বাসাবাড়ির কানায় মহান আত্মঘাতী নাটক করেছে আর নশ্বরতায় তাদের পরানো হবে জলপাইপাতার শিরোমুকুট,

    যারা খেয়েছে কল্পনার ভেড়ার মাংস কিংবা বাওয়ারির ঘোলাটে নদীতলের কাঁকড়া হজম করেছে,

    যারা তাদের ঠেলাগাড়ির পেঁয়াজ আর ফালতি সঙ্গীত নিয়ে রাস্তার রোমান্সে কেঁদে ফেলেছে,

    যারা সেতুর তলায় অন্ধকারে তাদের বাক্যের ওপর বসে নিশ্বাস ফেলেছে, আর চিলেকোঠার আস্তানায় জেগে উঠেছে তারের বাদ্যযন্ত্র বেঁধে ফেলতে,

    যারা ব্রহ্মবিদ্যার কমলালেবু-ভরা যক্ষ্মা-আক্রান্ত আকাশের তলায় আগুনের মুকুট পরে হার্লেমপাড়ার ছয় তলায় বসে কেশেছে,

    যারা সারারাত মহিমান্বিত জাদু মন্ত্রোচ্চারণের জন্যে পাশ ফিরে উপুড় হয়ে আঁকিবুকি কেটেছে যা হলুদ ভোরবেলায় হয়ে উঠেছে মানেহীন বুকনির স্তবক,

    যারা বিশুদ্ধ উদ্ভিদ সাম্রাজ্যের স্বপ্নে রান্না করেছে পচা জন্তু-জানোয়ারের ফুসফুস হৃদয় ঠ্যাঙ লেজ অন্ড বৃক্ক,

    যারা মাংস-বোঝাই লরির তলায় ডিম খুঁজতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে,

    যারা সময়ের বাইরে অনন্তকে ভোট দেবার জন্যে ছাদের আলসে থেকে হাতঘড়ি ছুঁড়ে ফেলেছে, তারপর দশ বছর ধরে প্রতিদিন তাদের মাথার ওপর পড়েছে টেবিল-ঘড়ির শব্দ,

    যারা পরপর তিনবার নিজের কব্জি কাটতে অসফল হয়েছে, ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হয়েছে পুরানো মালপত্তরের দোকান খুলতে তারা ভেবেছে তারা বুড়িয়ে যাচ্ছে আর কেঁদেছে,

    যারা তাদের নিরীহ ফ্ল্যানেল-পোশাকে জ্যান্ত পুড়ে মরেছে ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ-এর সিসকনির্মিত পদ্য-বিস্ফোরণের মাঝে এবং ফ্যাশনের লৌহসেনানীর যুদ্ধ-কিড়মিড়ে এবং বিজ্ঞাপনপরিদের হুংকারের নাইট্রোগ্লিসারিনে এবং ক্ষতিকর বুদ্ধিমান সম্পাদকদের বিষবায়ুতে, কিংবা পিষে গেছে চরম সত্যের মাতাল ট্যাকসিগাড়ির তলায়,

    যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্রুকলিন ব্রিজ থেকে এসবই সত্যি আর কোথায় বিস্মৃত হারিয়ে গেছে চিনাপাড়ার অলিগলি আগুনবাড়ির ভুতুড়ে ধোঁয়ায় এমনকি এক গেলাস মাগনা বিয়ারও পায়নি,

    যারা বিষাদের জানালা খুলে গেয়ে উঠেছে, ভূগর্ভ জানালার বাইরে গিয়ে থুবড়ে পড়েছে, লাফিয়েছে নোংরায়, ঝাঁপিয়েছে নিগরোদের ওপর, সারা রাস্তা কেঁদেছে, খালি পায়ে নেচেছে ভাঙা মদের গেলাসের ওপর মনকেমন-করা ইউরোপের ১৯৩০ জার্মান সঙ্গীতের গ্রামোফোন রেকর্ড চুরমার হুইসকি শেষ করে রক্তাক্ত পায়খানায় কাতরেছে, কর্নকুহরে চাপা গোঙানি শুনেছে আর দৈত্যাকার বাষ্পরাশির গর্জন,

    যারা একে অন্যের আঘাতশাস্তি জেলপএকাকীত্বে পিপাবন্দী হয়ে যাত্রা করেছে অতীতের রাজপথে কিংবা বার্মিংহাম বাজনার পুনর্জন্মে,

    যারা অমরত্ব জানবার জন্যে আমার ভাবাবেশ ঘটছে কি না কিংবা তোমার ভাবাবেশ ঘটছে কি না কিংবা কারোর ভাবাবেশ ঘটছে কি না তার খোঁজে বাহাত্তর ঘন্টা মাঠবাদাড় চষে বেড়িয়েছে,

    যারা ডেনভার অব্দি পাড়ি দিয়েছে, মরেছে ডেনভার-এ, ডেনভার-এ ফিরে এসে ব্যর্থ অপেক্ষা করেছে, দেখেছে ডেনভার আর ভেবেছে আর একলা ঘুরে বেড়িয়েছে ডেনভার-এ এবং শেষ পর্যন্ত সময়কে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে আর এখন ডেনভার তার নায়কদের অভাবে ফাঁকা,

    যারা ব্যর্থ গির্জাঘরে হাঁটু পেতে পরস্পরের মুক্তি আর আলো আর হৃদয়ের জন্যে প্রার্থনা করেছে, যতক্ষণ না ক্ষণকালের জন্যেও অন্তত আত্মার চুলের গোছা আলোকিত হয়ে উঠছে,

    যারা সোনালি মাথার অসম্ভব অপরাধীদের জন্যে মগজ চিরে অপেক্ষা করেছে জেলখানায় আর তাদের হৃদয়ে বাস্তবতার সৌন্দর্য আলকাত্রাজ-এর লোকগান শোনায়,

    যারা একটা অভ্যাস গড়ে তুলতে মেক্সিকোয় অবসর নিয়েছে, কিংবা বুদ্ধকে ভক্তি জানাতে রকি মাউন্টেন-এ কিংবা ট্যানজিয়ার্স-এ বালকদের জন্যে কিংবা সাদার্ন প্যাসিফিক-এ কালো রেলগাড়ির জন্যে কিংবা হারভার্ড থেকে নারসিসাস থেকে উডলন থেকে ঘাসফুল-শৃঙ্খলায় কিংবা কবরে,

    যারা বেতারযন্ত্রকে জাদুসন্মোহনে অভিযুক্ত করে প্রকৃতিস্হ বিচারের দাবি জানিয়েছিল তারপর পড়ে রইলো তাদের নিজেদেরই পাগলামি এবং দুই বাহুর ভেতরে একদল অনিশ্চিত জুরি,

    যারা নিউইয়র্ক কলেজে ডাডাইজমের ক্লাসে আলুর স্যালাড ছুঁড়েছে তারপর ন্যাড়ামাথায় আত্ম্ত্যার নাটুকে বক্তৃতা দিয়ে দাঁড়িয়েছে গিয়ে পাগলাগারদের গ্র্যানিট সিঁড়িতে দাবি জানিয়েছে তাৎক্ষণিক লবোটমির,

    আর তার বদলে তারা পেয়েছে ইনসুলিন মেটরাসল ইলেকট্রিসিটি হাইড্রোথেরাপি সাইকোথেরাপি পিংপং স্মৃতিবিলোপের পাষাণ-শুন্যতা,

    যারা কৌতুকহীন প্রতিবাদে একটাই পিংপং প্রতীক টেবিল উল্টে দিয়ে এখন ক্যাটালোনিয়ায় সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম নিচ্ছে,

    কেবল রক্তশিরার পরচুলা ছাড়া সত্যিকারের টেকো হয়ে ফিরেছে বহুবছর পর, আর চোখের জল হাতের আঙুল পুবের উন্মাদ শহরগুলির দৃশ্যমান উন্মত্ত ধ্বংসের কাছে ফিরেছে তারা,

    বিভিন্ন দুরপাল্লার বাসকোম্পানির ভ্রূণঘরে আত্মার প্রতিধ্বনির সঙ্গে খুনসুটি, মাঝরাতের একাকী বসার জায়গায় প্রেমের পাটুরে আসরে দোল-খাওয়া নড়াচড়া, জীবনচিন্তা শুধু দুঃস্বপ্ন, পরিদের পাষাণে পরিবর্তিত যেন চাঁদের সমান ভারি,

    তারপর মায়ের সঙ্গে, বাসাবাড়ির জানালা দিয়ে শেষ খেয়াল-সর্বস্ব বইটা ছুঁড়ে ফেলা, আর সকাল চারটেয় শেষ দরজা বন্ধ আর শেষ টেলিফোন উত্তর দেবার বদলে দেয়ালে ঝোলানো আর শেষ গোছানো ঘর থেকে তাবৎ মানসিক আসবাব সরিয়ে ফেলা, আলমারির তারে ঝুলছে কাগজের মোচড়ানো গোলাপ আর সেই কল্পনাটুকু, একটুকরো আশায় ছোট্ট বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়—-

    হায়, কার্ল, তুমি যদি বিপন্মুক্ত না হও আমিও বিপন্মুক্ত নই, আর এখন তুমি সত্যিই সময়ের সামগ্রিক জান্তব ঝোলঝালে—-

    আর কে তাহলে ঠান্ডা হিম রাস্তার মাঝ-বরাবর দৌড়েছে অপরসায়নের আকস্মিক ঝলকে বৈসাদৃশ্যের ব্যবহারে তালিকায় মাপজিক আর স্পন্দ্যমান রেঁদায় আবিষ্ট হয়ে,

    যারা পরস্পরবিরোধী বাকপ্রতিমার মাধ্যমে সময় কাল ও স্হানের গঠন করেছে ও স্বপ্মে দেখিয়েছে মূর্তিমান হাঁ-মুখ, আর দুই দৃশ্যমান কল্পনার মাঝে আত্মার শ্রেষ্ঠ দেবদূতদের ধরে ফেলেছে আর জুড়েছে নিদানিক ক্রিয়াপদ আর পাতের ওমনিপোটেনাস এটারনা ডিউস-এর চেতনার সঙ্গে লাফাতে থাকা বিশেষ্য ও সমান্তরাল যতিচিহ্ণের সংবেদনকে মিলিয়েছে,

    শব্দবিন্যাসকে পুনর্গঠিত করার জন্যে এবং দরিদ্র মানবিক গদ্যের পরিমাপ তোমার সামনে বাকরুদ্ধ ও বুদ্ধিমান ও লজ্জায় অধোমাথা, উদোম ও অন্তহীন মগজে চিন্তার ছন্দমাত্রার সঙ্গে তাল রাখতে পরিত্যক্ত হবার পরেও আত্মাকে কবুল করেছে,

    সময়ের অমোঘ উন্মাদ পেয়াদা ও দেবদূতের ঝাপট, অজানা, তবু মরে যাবার পর সময়ের কাছে ছেড়ে যাওয়া কথাবার্তা এখন রেখে যেতে হবে,

    আর তারপর নবঅবতার হয়ে এসেছে ঐকতানের স্বর্ণশিঙা ছায়ায় আফরিদি সঙ্গীতের ভুতুড়ে পোশাকে আর এলি এলি লামা লামা সাবাকতানি স্যাকসোফোন-কান্নায় শেঢ় রেডিও অব্দি শহরগুলোকে কাঁপিয়েছে, তাতে প্রেমের জন্যে আমেরিকার উলঙ্গ মানসে দুঃখবিস্ফোরণ ঘটেছে,

    হাজার বছর ধরে খেতে ভালো লাগবে এরকম তাদের শরীর থেকে কেটে বের করে আনা জীবনকবিতার পরম হৃৎপিণ্ড।
  • Vladimir Mayakovsky | 236712.158.9001212.26 | ২৬ জুন ২০১৯ ১০:১১383606
  • ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি-র কবিতা ‘ট্রাউজার-পরা এক মেঘ’ (A Cloud in Trousers)
    অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    প্রস্তাবনা
    তুমি ভাবলে,
    স্যাঁতসেতে এক মগজের কল্পনায়,
    এক তেলচিটে খাটে হাত-পা-ছড়ানো পেট-মোটা চাকরের মতন,--
    আমার হৃদয়ের রক্তাক্ত ছেঁড়া টুকরো নিয়ে, আমি আবার ঠাট্টা করব ।
    যতক্ষণ না আমি উপেক্ষিত নই, আমি হবো নিষ্ঠুর আর পীড়াদায়ক ।
    আমার চিত্তে আর দাদুসুলভ স্নেহশীলতা নেই,
    আমার আত্মায় আর ধূসর চুল নেই !
    আমার কন্ঠস্বর দিয়ে জগতকে ঝাঁকিয়ে আর কাষ্ঠহাসি হেসে,
    আমি তোমাদের পাশ দিয়ে চলে যাই, -- সৌম্যকান্তি,
    বাইশ বছর বয়সী ।
    সুশীল ভদ্রমহোদয়গণ !
    তোমরা বেহালায় তোমাদের ভালোবাসা বাজাও ।
    অমার্জিতরা তা ঢোলোকে তারস্বরে বাজায় ।
    কিন্তু তোমরা কি নিজেদের অন্তরজগতকে বাইরে আনতে পারো, আমার মতন
    আর কেবল দুটো ঠোঁট হয়ে যেতে পারো পুরোপুরি ?
    এসো আর শেখো--
    তোমরা, দেবদূত-বাহিনীর ফুলবাবু আমলার দল !
    মিহি কাপড়ের বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসো
    আর তোমরা, যারা তোমাদের ঠোঁট পেতে দিতে পারো
    সেই রাঁধুনীর মতন যে নিজের রান্নার বইয়ের পাতা ওলটায় ।
    যদি তোমরা চাও--
    আমি কাঁচা মাংসের ওপরে চারুশিল্পের শত্রুর মতন লালসিত হবো
    কিংবা সূর্যোদয় যে উদ্রেক ঘটায় তার রঙে পালটে দেবো,
    যদি তোমরা চাও---
    আমি হতে পারি অনিন্দনীয় সুশীল,
    মানুষ নয় -- কিন্তু ট্রাউজার-পরা এক মেঘ।
    আমি সুন্দর অঙ্কুরোদ্গমে বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করি !
    তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের প্রশংসা করব, ---
    পুরুষের দল, হাসপাতালের বিছানার চাদরের মতন কোঁচকানো,
    আর নারীরা, অতিব্যবহৃত প্রবাদের মতন নির্যাতিত ।

    প্রথম পর্ব
    তোমরা কি ভাবছ আমি ম্যালেরিয়ায় ভুল বকছি ?
    তা ঘটেছিল ।
    ওডেসায়, তা ঘটেছিল ।
    “আমি চারটের সময় আসব,” কথা দিয়েছিল মারিয়া ।
    আটটা…
    নয়টা…
    দশটা…
    তারপর তাড়াতাড়ি,
    সন্ধ্যা,
    বিরাগ দেখানো,
    আর ডিসেম্বরসুলভ,
    জানালাগুলো ছেড়ে
    আর ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
    আমার পেছন থেকে, আমি শুনতে পাই হ্রেষা আর হাসি
    ঝাড়বাতিগুলোর ।
    তোমরা আমায় চিনতে পারতে না যদি আগে থেকে পরিচিত হতে :
    পেশীতন্তুর স্তুপ
    গোঙানি,
    স্নায়বিক অস্হিরতা ।
    এরকম একজন বোকাটে কি চাইতে পারে ?
    কিন্তু একজন বোকাটে অনেক কিছু চায় ।
    কেননা নিজের জন্য তা অর্থহীন
    তা তোমরা তামায় গড়া হও
    কিংবা হৃদয় হোক শীতল ধাতুর ।
    রাতের বেলায়, তোমাদের দাবিকে জড়িয়ে নিতে চাইবে
    মেয়েলি কোনোকিছু দিয়ে,
    কোমল ।
    আর এইভাবে,
    বিশাল,
    আমি কাঠামোর ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হই.
    আর আমার কপাল দিয়ে, গলিয়ে ফেলি জানালার কাচ ।
    এই ভালোবাসা কি অসাধারণ হবে নাকি গতানুগতিক ?
    তা কি বজায় থাকবে নাকি উপেক্ষিত হবে ?
    বিরাট কেউ এরকম দেহে আঁটবে না :
    একটু ভালোবাসা জরুরি, -- একটা শিশু, হয়তো,
    যখন মোটরগাড়ি হর্ন বাজায় আর আওয়াজ করে তখন এ ভয় পায়,
    কিন্তু ঘোড়ায়-টানা ট্র্যামের ঘণ্টি পছন্দ করে ।
    আমি মুখোমুখি হলুম
    তরঙ্গায়িত বৃষ্টির সঙ্গে,
    তবু আরেকবার,
    আচ্ছা অপেক্ষা করো
    শহুরে ফেনার বজ্রপাতের গর্জনে ভিজে গেলুম ।
    ছুরি নিয়ে পাগলের মতন বাইরে বেরিয়ে,
    রাত ওকে ধরে ফেললো
    আর ছুরি মেরে দিলো,
    কেউ দেখেনি ।
    ঠিক মধ্যরাতে
    গিলোটিন থেকে খসা মুণ্ডুর মতন পড়ে গেলো।
    জানালার কাচে রুপোর বৃষ্টিফোঁটা
    জমিয়ে তুলছিল মুখবিকৃতি
    আর চেঁচাচ্ছিল ।
    যেন নত্রে দামের পশুমুখো নর্দমাগুলো
    চেল্লানো আরম্ভ করে দিলো ।
    ধিক্কার তোমাদের !
    যা ঘটেছে তাতে কি তোমরা এখনও সন্তুষ্ট নও ?
    কান্না এবার চারিধার থেকে আমার গলা কাটবে।
    আমি শুনতে পেলুম:
    আস্তে,
    বিছানার বাইরে রোগীর মতন,
    একটা স্নায়ু লাফালো
    নীচে ।
    প্রথমে,
    পুরুষটা সরে যায়নি, প্রায় ।
    তারপর, সন্দিগ্ধ
    আর সুস্পষ্ট,
    ও লাফাতে আরম্ভ করলো।
    আর এখন, ও আর আরও দুই জন,
    এদিক-ওদিক লাফাতে লাগলো, তিড়িঙ নাচ ।
    একতলায়, পলেস্তারা তাড়াতাড়ি খসে পড়ছিল ।
    স্নায়ুরা,
    বড়োগুলো
    ছোটোগুলো,--
    নানান ! --
    পাগলের মতন টগবগাতে আরম্ভ করলো
    যতক্ষণ না, শেষে,
    ওদের পা ওদের টানতে অক্ষম হলো ।
    ঘর থেকে রাত টপটপ করে বেরিয়ে এলো আর ডুবে গেলো।
    চটচটে মাটিতে আটকে গিয়ে, চোখ তা থেকে পিছলে বের করতে পারলো না।
    হঠাৎ দরোজাগুলো দুমদাম করতে লাগলো
    যেন হোটেলের দাঁতগুলো কিড়মিড় করতে শুরু করেছে ।
    তুমি প্রবেশ করলে,
    আচমকা যেন “এই নাও !”
    সোয়েড চামড়ার মোচড়ানো দস্তানা পরে, তুমি অপেক্ষা করলে,
    আর বললে,
    “তুমি জানো,--
    আমার শিগগির বিয়ে হবে।”
    তাহলে যাও বিয়ে করো ।
    ঠিকই আছে,
    আমি সামলে নিতে পারবো ।
    দেখতেই পাচ্ছো -- আমি শান্ত, নিঃসন্দেহে !
    কোনো শবের
    নাড়ির স্পন্দনের মতন ।
    মনে আছে ?
    তুমি বলতে :
    “জ্যাক লণ্ডন,
    টাকাকড়ি,
    ভালোবাসা আর আকুলতা,”--
    আমি কেবল একটা ব্যাপারই দেখেছি :
    তুমি ছিলে মোনালিসা,
    যাকে চুরি করা জরুরি ছিল !
    আর কেউ তোমায় চুরি করে নিলো ।
    ভালোবাসায় আবার, আমি জুয়া খেলা আরম্ভ করব,
    আমার ভ্রুর তোরণ আগুনে উদ্ভাসিত ।
    আর কেনই বা নয় ?
    অনেক সময়ে গৃহহীন ভবঘুরেরা
    পোড়া বাড়িতেও আশ্রয় খোঁজে !
    তুমি আমাকে ঠাট্টা করছো ?
    “উন্মাদনার কেবল গুটিকয় চুনী আছে তোমার
    ভিখারির কয়েক পয়সার তুলনায়, একে ভুল প্রমাণ করা যাবে না !”
    কিন্তু মনে রেখো
    এইভাবেই পম্পেইয়ের শেষ হয়েছিল
    যখন কেউ ভিসুভিয়াসের সঙ্গে ইয়ার্কি করেছিল !
    ওহে !
    ভদ্রমহোদয়গণ !
    তোমরা অশুচি
    নিয়ে চিন্তা করো,
    অপরাধ
    আর যুদ্ধ ।
    কিন্তু তোমরা কি দেখেছো
    ভয়ঙ্কর সন্ত্রস্ত
    আমার মুখ
    যখন
    তা
    নিখুঁত শান্তিময়তায় থাকে ?
    আর আমি অনুভব করি
    “আমি”
    আমাকে ধরে রাখার জন্য খুবই ক্ষুদ্র ।
    আমার অন্তরে কেউ কন্ঠরুদ্ধ হচ্ছে ।
    হ্যালো !
    কে কথা বলছে ?
    মা ?
    মা !
    তোমার ছেলের হয়েছে এক অত্যাশ্চর্য অসুখ !
    মা !
    ওর হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে !
    তার বোন, লিডিয়া আর ওলগাকে বোলো
    যে আর কোথাও কোনো লুকোবার জায়গা নেই ।
    প্রতিটি শব্দ,
    মজার হোক বা অভদ্র,
    যা ও নিজের জ্বলন্ত মুখ থেকে ওগরায়,
    উলঙ্গ বেশ্যার মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে
    জ্বলন্ত বেশ্যালয় থেকে ।
    লোকেরা গন্ধ শোঁকে--
    কোনো কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।
    ওরা দমকলকে ডাকে ।
    ঝলমলে হেলমেট পরে
    তারা অবহেলাভরে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে ।
    ওহে, দমকলের লোকদের বলো :
    বুটজুতো পরে ঢোকার অনুমতি নেই !
    গনগনে হৃদয় নিয়ে একজনকে বিচক্ষণ হতে হবে ।
    আমিই তা করব !
    আমি আমার জলভরা চোখ ঢেলে দেবো চৌবাচ্চায় ।
    আমাকে কেবল আমার পাঁজরকে ঠেলতে দাও আর আমি আরম্ভ করে দেবো।
    আমি লাফিয়ে পড়বো ! তোমরা আমাকে বাধা দিতে পারবে না !
    তারা বিদ্ধস্ত ।
    তোমরা হৃদয় থেকে লাফিয়ে পড়তে পারবে না !
    ঠোঁটের ফাটল থেকে,
    এক অঙ্গার-আস্তৃত চুমু উৎসারিত হয়,
    জ্বলন্ত মুখাবয়ব থেকে পালিয়ে যায় ।
    মা !
    আমি গান গাইতে পারি না ।
    হৃদয়ের প্রার্থনাঘরে, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল গায়কদের গায়ে !
    শব্দাবলী আর সংখ্যাসমূহের প্রতিমাদের
    খুলির ভেতর থেকে,
    জ্বলন্ত বাড়ি থেকে শিশুদের মতন, পালাতে থাকে ।
    এইভাবে ভয়,
    আকাশে পৌঁছে, ডাক দেয়
    আর তুলে ধরে
    লুসিতানিয়ার আগুনে-বাহু আর উদ্বেগ ।
    শত-চোখ আগুন শান্তির দিকে তাকালো
    ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে, যেখানে লোকেরা ঘামছিল ।
    এক শেষতম চিৎকারে,
    তুমি কি গোঙাবে, অন্তত,
    শতাব্দীগুলোকে প্রতিবেদন দেবার জন্য যে আমি অগ্নিদগ্ধ ?

    দ্বিতীয় পর্ব
    আমার মহিমাকীর্তন করো !
    প্রসিদ্ধরা কেউ আমার সমকক্ষ নয় !
    যাকিছু এপর্যন্ত করা হয়েছে তার ওপরে
    আমি ছাপ মেরে দিই “নস্যাৎ।”
    আপাতত, আমার পড়ার ইচ্ছে নেই।
    উপন্যাস ?
    তাতে কি !
    বইপত্র এইভাবে তৈরি হয়,
    আমি ভাবতুম :--
    একজন কবির আগমন হয়,
    আর নিজের ঠোঁট অনায়াসে খোলে।
    অনুপ্রাণিত, মূর্খটা বেমালুম গাইতে আরম্ভ করে--
    ওহ ক্ষান্তি দাও !
    দেখা গেলো :
    উৎসাহে গাইবার আগে,
    নিজেদের কড়া-পড়া পায়ে ওরা কিছুক্ষণ তাল ঠোকে,
    যখন কিনা কল্পনার ঘিলুহীন মাছেরা
    হৃদয়ের পাঁকে কাদা ছেটায় আর মাখামাখি করে ।
    আর যখন, ছন্দে হিসহিসোচ্ছে, ওরা গরম জলে সেদ্ধ করে
    যাবতীয় ভালোবাসা আর পাপিয়া-পাখিদের ক্বাথের মতন ঝোলে,
    জিভহীন পথ কেবল কিলবিল করে আর কুণ্ডলী পাকায়---
    তাতে আর্তনাদ করার বা এমনকি বলার মতো কিছুই থাকে না ।
    আমরা নিজের গর্ববশে, সারাদিন সৎমেজাজে কাজ করি
    আর ব্যাবেলের শহর-মিনারগুলোর আবার পুনরানয়ন হয় ।
    কিন্তু ঈশ্বর
    গুঁড়িয়ে
    এই শহরগুলোকে ফাঁকা মাঠে পালটে ফ্যালেন,
    শব্দকে মন্হন করে ।
    নৈঃশব্দে, রাস্তাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দুর্দশায়।
    গ্রাসনলিকার পথে এক চিৎকার ঋজু দাঁড়িয়ে পড়ে।
    যখন মোটাসোটা ট্যাক্সি আর মোটরগাড়ি অন্তরায়ে স্হির,
    গলার ভেতরে আটকে থাকে ।
    যেন ক্ষয়রোগের কারণে,
    নিষ্পিষ্ট বুক শ্বাস নেবার জন্য খাবি খাচ্ছিল ।
    শহর, বিষাদে আক্রান্ত, তাড়াতাড়ি রাস্তা বন্ধ করে দিলো ।
    আর তখন--
    তা সত্ত্বেও !--
    রাস্তাটা চৌমাথার মোড়ে নিজের ধকল উগরে দিলো কেশে
    আর গলা থেকে বারান্দাকে ঠেলে বের করে দিলো, শেষ পর্যন্ত,
    মনে হলো যেন,
    শ্রেষ্ঠশ্রেনির দেবদূতের গায়কদলের ধুয়ায় যোগ দিয়ে,
    সাম্প্রতিককালে লুন্ঠিত, ঈশ্বর তার তাপ আমাদের দেখাবে !
    কিন্তু রাস্তাটা উবু হয়ে বসে কর্কশকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো :
    “খেতে যেতে দাও !”
    শিল্পপতি ক্রুপ আর তার আণ্ডাবাচ্চারা ঘিরে ধরে
    শহরে চোখরাঙানো ভ্রু আঁকার জন্য,
    যখন কিনা সঙ্কীর্ণ প্রবেশপথে
    শব্দাবলীর লাশ এদিক-ওদিক ছড়ানো পড়ে থাকে,--
    দুটো বেঁচে থাকে আর মাথাচাড়া দ্যায়,--
    “শুয়োর”
    আর অন্যটা,--
    আমার মনে হয় “খাবার সুপ” ।
    আর কবির দল, ফোঁপানি আর নালিশে ভিজে সপসপে,
    রাস্তা থেকে দৌড় লাগায়, বিরক্ত আর খিটখিটে :
    “ওই দুটো শব্দ দিয়ে এখন আর ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়
    এক সুন্দরী রমণী
    কিংবা ভালোবাসা
    কিংবা শিশির-ঢাকা ফুল।”
    আর কবিদের পর,
    অন্যান্য হাজার লোকের হুড়োহুড়ি আরম্ভ হলো :
    ছাত্রছাত্রীর দল,
    বেশ্যার দল,
    বিক্রেতার দল ।
    ভদ্রমহোদয়গণ,
    থামুন !
    আপনারা তো অভাবগ্রস্ত নন ;
    তাহলে ভদ্রমহোদয়গণ কেন আপনারা ওগুলো চাইছেন !
    প্রতিটি পদক্ষেপে দালান অতিক্রম করে,
    আমরা স্বাস্হ্যবান আর অত্যুৎসাহী !
    ওদের কথা শুনবেন না, বরং ওদের পিটুনি দিন !
    ওদের,
    যারা মাঙনার বাড়তি হিসাবে সেঁটে রয়েছে
    প্রতিটি রাজন্য-বিছানায় !
    আমাদের কি নম্রভাবে ওদের জিগ্যেস করতে হবে :
    “সাহায্য করো, দয়া করে !”
    স্তবগানের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে হবে
    আর বাগ্মীতার জন্য ?
    আমরা জ্বলন্ত স্তবগানের সৃষ্টিকারী
    কলমিল আর রসায়ানাগারের গুনগুনানির পাশাপাশি ।
    আমি কেন ফাউস্তের কথা ভাবতে যাবো ?
    আতশবাজির লুন্ঠনে পরীদের প্রদর্শন করে
    ও মেফিসটোফিলিসের সঙ্গে নক্ষত্রপূঞ্জের নকশাকাটা পাটাতনে পিছলে চলেছে !
    আমি জানি --
    আমার বুটজুতোয় একটা পেরেক
    গ্যেটের কল্পনার চেয়ে বেশি ভয়াবহ !
    আমি
    সবচেয়ে সোনালী-হাঁমুখের
    প্রতিটি শব্দের সঙ্গে আমি দিচ্ছি
    দেহের এক নামদিবস,
    আর আত্মাকে এক পূনর্জন্ম,
    আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি :
    জীবজগতের কণাও
    আমি এই পৃথিবীতে যা কিছু করব তার চেয়ে অনেক বেশি !
    শোনো !
    বর্তমান যুগের জরাথুষ্ট্র,
    ঘামে ভিজে,
    তোমাদের চারিপাশে দৌড়োচ্ছে আর এখানে ধর্মপ্রচার করছে ।
    আমরা,
    বিছানার কোঁচকানো চাদরের মতন মুখ নিয়ে,
    ঝাড়লন্ঠনের মতন ঝোলা ঠোঁটে,
    আমরা,
    কুষ্ঠরোগীর জন্য নির্দিষ্ট শহরে বন্দী,
    যেখানে, জঞ্জাল আর সোনা থেকে, কুষ্ঠরোগীদের ঘা দেখা দিয়েছিল,
    আমরা ভেনিসের নীলাভ সমুদ্রের চেয়ে পবিত্র,
    রোদ্দুরের মলম-রশ্মিতে ধোয়া ।
    আমি সেই তথ্যে থুতু ফেলি
    যে হোমার আর ওভিদ সৃষ্টি করেননি
    গুটিবসন্তে ঢাকা ঝুল,
    আমাদের মতন সব মানুষদের,
    কিন্তু সেই সঙ্গে, আমি জানি যে
    সূর্য ফ্যাকাশে হয়ে যাবে
    যদি তা আমাদের আত্মার সোনালি খেতের দিকে তাকায়।
    প্রার্থনার তুলনায় পেশী আমাদের কাছে নির্বিকল্প !
    আমরা আর ভরতুকির জন্য প্রার্থনা করব না !
    আমরা--
    আমরা প্রত্যেকে--
    নিজেদের মুঠোয় ধরে রাখি
    জগতকে চালনা করার লাগাম !
    এ-থেকেই সভাস্হলগুলোয় গোলগোথার সূত্রপাত
    পেট্রোগ্রাড, মসকো, কিয়েভ, ওডেসায়,
    আর তোমাদের একজনও সেখানে ছিলে না যারা
    এইভাবে হাঁক পাড়ছিল না :
    “ওকে ক্রুসবিদ্ধ করো !
    ওকে উচিত শিক্ষা দাও !”
    কিন্তু আমার কাছে,--
    জনগণ,
    এমনকি তোমরা যারা জঘন্য ব্যবহার করেছ,--
    আমার কাছে, তোমরা প্রিয় আর আমি গভীরভাবে তোমাদের কদর করি।
    দেখোনি কি
    যে হাত তাকে পেটাচ্ছে সেই হাতকেই কুকুরটা চাটছে ?
    আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে
    আজকালকার দলবল ।
    তারা তৈরি করেছে
    আমাকে নিয়ে
    একটা নোংরা পরিহাস ।
    কিন্তু আমি সময়ের পাহাড়কে ডিঙিয়ে দেখতে পাই,
    ওনাকে, যাঁকে কেউ দেখতে পায় না ।
    যেখানে মানুষের দৃষ্টিশক্তি পৌঁছোয় না,
    বিপ্লবের কাঁটার মুকুট পরে,
    ক্ষুধার্ত মানুষদের নেতৃত্ব দিয়ে,
    ১৯১৬ সাল ফিরে আসছে ।
    তোমাদের মধ্যে, ওনার অগ্রদূত,
    যেখানেই দুঃখকষ্ট থাকবে, আমি থাকবো কাছাকাছি ।
    আমি সেখানে নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করেছি,
    প্রতিটি অশ্রুফোঁটার ওপরে ।
    ক্ষমা করার মতন এখন আর কিছু নেই !
    যে আত্মারা সমবেদনার অঙ্কুরের জন্ম দেয়, আমি পুড়িয়ে দিয়েছি তার ক্ষেত ।
    তা অনেক কঠিন
    হাজার হাজার ব্যাষ্টিল আক্রমণের তুলনায় ।
    আর যখন
    তাঁর আবির্ভাব ঘোষিত হয়,
    আনন্দে আর গর্বে,
    তোমরা এগিয়ে যাবে উদ্ধারককে অভ্যর্থনা জানাতে--
    আমি টেনে নিয়ে যাবে
    বাইরে আমার আত্মাকে,
    আর পায়ে পিষবো
    যতক্ষণ না তা ছড়িয়ে পড়ছে !
    আর তোমাদের হাতে তুলে দেবো, রক্তে লাল, পতাকা হিসাবে ।

    তৃতীয় পর্ব
    আহ, কেমন করে আর কোথা থেকে
    ব্যাপারটা এই পরিণতিতে পৌঁছেছে যে
    উন্মাদনার নোংরা মুঠোগুলো
    আলোকময় আনন্দের বিরুদ্ধে বাতাসে তুলে ধরা হয়েছিল ?
    মেয়েটি এলো,--
    পাগলাগারদের চিন্তায়
    আর আমার মাথা ঢেকে দিলো বিষণ্ণতায় ।
    আর যেমন ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসের বেলায়
    কন্ঠরুদ্ধ অঙ্গবিক্ষেপে
    সেনারা আধখোলা দরোজার ভেতরে লাফিয়ে পড়েছিল, জাহাজডুবির আগে,
    ভবিষ্যবাদী কবি বারলিয়ুক হামাগুড়ি দিয়ে এগোল, পেরিয়ে গেল
    তাঁর চোখের চিৎকাররত ফাঁক দিয়ে ।
    তাঁর চোখের পাতাকে প্রায় রক্তাক্ত করে,
    উনি দেখা দিলেন হাঁটু গেড়ে,
    উঠে দাঁড়ালেন আর হাঁটতে লাগলেন
    আর উত্তেজিত মেজাজে,
    কোমলভাবে, অমন মোটা একজনের কাছে অপ্রত্যাশিত,
    উনি কেবল বললেন :
    “ভালো !”
    ব্যাপারটা ভালোই যখন পর্যবেক্ষণে এক হলুদ সোয়েটার
    আত্মাকে লুকিয়ে রাখে !
    ব্যাপারটা ভালোই যখন
    ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে, আতঙ্কের মুখোমুখি,
    তুমি চেঁচিয়ে বলো :
    “কোকো খাও -- ভ্যান হুটেন কোম্পানির !”
    এই মুহূর্ত,
    বাংলার আলোর মতন,
    বিস্ফোরণে ঝলসে,
    আমি কিছুর সঙ্গেই অদলবদল করব না,
    কোনো টাকাকড়ির জন্যও নয় ।
    চুরুটের ধোঁয়ায় মেঘাচ্ছন্ন,
    আর মদের গেলাসের মতন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত,
    যে কেউ কবি সেভেরিয়ানিন-এর মতো মাতাল-মুখো হতে পারে ।
    কোন সাহসে তুমি নিজেকে কবি বলো
    আর ধূসর, তিতির-পাখির মতন, নিজের আত্মাকে কিচিরমিচিরে ডুবিয়ে দাও !
    তখন
    পেতলের বাঘনখ দিয়ে
    ঠিক এই মুহূর্তে
    জগতের খুলিকে তোমায় চিরে ফেলতে হবে !
    তুমি,
    মাথায় শুধু একটিমাত্র ভাবনা নিয়ে,
    “আমি কি শৈলী অনুযায়ী নাচছি ?”
    দ্যাখো আমি কতো আনন্দিত
    তার বদলে,
    আমি,--
    সদাসর্বদা একজন ভেড়ুয়া আর জোচ্চোর ।
    তোমাদের সবার কাছ থেকে,
    যারা মামুলি মজার জন্য ভালোবাসায় ভিজেছো,
    যারা ছিটিয়েছো
    শতকগুলোতে অশ্রুজল, যখন তোমরা কাঁদছিলে,
    আমি বেরিয়ে চলে যাবো
    আর সূর্যের একচোখ চশমাকে বসাবো
    আমার বড়ো করে খোলা, একদৃষ্ট চোখে ।
    আমি রঙিন পোশাক পরব, সবচেয়ে অস্বাভাবিক
    আর পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবো
    জনগণকে খুশি দিতে আর তাতিয়ে তুলতে,
    আর আমার সামনে
    এক ধাতব দড়িতে গলাবাঁধা,
    ছোটো কুকুরবাচ্চার মতন দৌড়োবে নেপোলিয়ান ।
    একজন নারীর মতন, শিহরিত, পৃথিবী শুয়ে পড়বে,
    আত্মসমর্পণ করতে চেয়ে, মেয়েটি ধীরে-ধীরে অবনত হবে ।
    জীবন্ত হয়ে উঠবে সবকিছু
    আর চারিদিক থেকে,
    ওদের ঠোঁট তোতলা কথা বলবে :
    “য়াম-য়াম-য়াম-য়াম !”
    হঠাৎ,
    মেঘের দল
    আর বাতাসে অন্যান্য ব্যাপার
    আশ্চর্য কোনো উত্তেজনায় আলোড়িত,
    যেন শাদা-পোশাকে শ্রমিকদল, ওপরে ওইখানে,
    হরতাল ঘোষণা করেছে, সবাই তিক্ত আর আবেগে আক্রান্ত ।
    বর্বর বজ্র মেঘের ফাটল থেকে উঁকি দিলো, ক্রুদ্ধ ।
    নাকের বিশাল ফুটো থেকে ঘোড়ার ডাক দিয়ে, গর্জন করলো
    আর এক মুহূর্তের জন্যে, আকাশের মুখ তেবড়ে বেঁকে গেলো,
    লৌহ বিসমার্কের ভেঙচির মতন ।
    আর কেউ একজন,
    মেঘের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে,
    কফিপানের রেস্তরাঁর দিকে, হাত বাড়িয়ে দিলো এখন :
    দুটিই, কোমলতর,
    আর নারীমুখ নিয়ে
    আর একই সঙ্গে, কামান দাগার মতন ।
    তুমি কি ভাবছো
    ওটা চিলেকোঠার ওপরে সূর্য
    কফিপানের রেস্তরারাঁকে আলতো আদর করতে চাইছে ?
    না, আবার এগিয়ে আসছে সংস্কারকামীদের কচুকাটা করতে
    উনি জেনেরাল গালিফেৎ !
    ভবঘুরের দল, পকেট থেকে হাত বের করে নাও--
    বোমা তুলে নাও, ছুরি কিংবা একটা পাথর
    আর কেউ যদি লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে না পারে
    তাহলে সে চলে আসুক কেবল নিজের কপাল দিয়ে লড়তে !
    এগিয়ে যাও, ক্ষুধার্ত,
    গোলামের দল,
    আর নির্যাতিতরা,
    এই মাছি ভনভনে জঞ্জালে, পোচো না !
    এগিয়ে যাও !
    আমরা সোমবারগুলো আর মঙ্গলবারগুলোকে
    ছুটির দিনে পালটে দেবো, তাদের রাঙিয়ে দেবো রক্তে !
    পৃথিবীকে মনে করিয়া দাও তাকে আমি হীন প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলুম !
    রূঢ় হও !
    পৃথিবী
    রক্ষিতার মুখের মতন ফুলে উঠেছে,
    যাকে রথসচাইল্ড বেশি-বেশি ভালোবেসেছিল !
    গুলির আগুনের বরাবর পতাকাগুলো উড়ুক
    যেমন ওরা ছুটির দিনে করে, জাঁকজমকসহ !
    ওহে, রাস্তার লন্ঠনেরা, পণ্যজীবীদের আরও ওপরে তোলো,
    ওদের মড়াগুলোকে হাওয়ায় ঝুলতে দাও ।
    আমি অভিশাপ দিলুম,
    ছুরি মারলুম
    আর মুখে ঘুষি মারলুম,
    কারোর পেছনে হামাগুড়ি দিলুম,
    তাদের পাঁজর কামড়ে ধরে ।
    আকাশে, লা মারসেইলিজ-এর মতন লাল,
    সূর্যাস্ত তার কম্পিত ঠোঁটে মরণশ্বাস তুলছিল ।
    এটা মানসিক বিকার !
    যুদ্ধ থেকে কোনো কিছুই বাঁচবে না ।
    রাত এসে পড়বে,
    কামড়ে ধরবে তোমাকে
    আর বাসিই গিলে ফেলবে তোমাকে ।
    দ্যাখো--
    আকাশ আরেকবার জুডাস-এর ভূমিকায়,
    একমুঠো নক্ষত্র নিয়ে কাদের বিশ্বাসঘাতকতায় চোবানো হয়েছিল?
    এই রাত
    তাতার যুদ্ধবাজ মামাই-এর মতন, আহ্লাদে পানোৎসব করে,
    উত্তাপে দগ্ধ করে দিলো শহরকে ।
    আমাদের চোখ এই রাতকে ভেদ করতে পারবে না,
    দুই পক্ষের চর আজেফ-এর মতন কালো !
    শুঁড়ির আসরে চুপচাপ এক কোণে হেলান দিয়ে, আমি বসে থাকি,
    আমার আত্মায় আর মেঝেতে মদ চলকে পড়ে,
    আর আমি দেখি :
    কোনের দিকে, গোল চোখের প্রভা
    আর তাদের সঙ্গে, ম্যাডোনা চেবাচ্ছে হৃদয়ের কেন্দ্র ।
    এরকম মাতাল ভিড়ে অমন আনন্দবিচ্ছুরণ প্রদান করা কেন ?
    ওদের কিই বা দেবার আছে ?
    তোমরা দেখতে পাচ্ছ -- আরেকবার,
    ওরা কেন বারাব্বাসকে পছন্দ করে
    গোলগোথার মানুষটির তুলনায় ?
    হয়তো, ভেবেচিন্তে,
    মানবিক ভানে, কেবল একবার নয়
    আমি কি তরতাজা মুখ পরে থাকবো ।
    আমি, হয়তো,
    তোমার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে সৌম্যকান্তি
    সম্পূর্ণ মানবজাতিতে ।
    ওদের দিয়ে দাও,
    যারা আহ্লাদে ডগমগ,
    এক দ্রুত মৃত্যু,
    যাতে ওদের ছেলেপুলেরা ভালোভাবে গড়ে ওঠে ;
    ছেলেরা -- পিতা হিসাবে
    মেয়েরা -- গর্ভবতী নারী হিসাবে ।
    সেই জ্ঞানী মানুষদের মতন, নব্যপ্রসূতদের
    অন্তর্দৃষ্টি আর ভাবনাচিন্তায় ধূসর হয়ে উঠতে দাও
    আর ওরা আসবে
    শিশুদের নামকরণের অনুষ্ঠানে
    যে কবিতাগুলো আমি লিখেছি, তাদের।
    আমি যন্ত্রপাতি আর ব্রিটেনের শিল্পের গুণগান করি ।
    কোনো মামুলি, সার্বজনিক ধর্মোপদেশে,
    হয়তো লেখা হয়ে থাকতে পারে
    যে আমিই ত্রয়োদশতম দূত ।
    আর যখন আমার কন্ঠস্বর তারস্বরে ঘোষণা করবে,
    প্রতি সন্ধ্যায়,
    ঘণ্টার পর ঘণ্টা,
    আমার আহ্বানের অপেক্ষায়
    যিশুখ্রিস্ট, নিজে, হয়তো ঘ্রাণ নেবেন
    আমার আত্মার ফরগেট-মি-নট গুল্মের ।

    চতুর্থ পর্ব
    মারিয়া ! মারিয়া !
    ভেতরে আসতে দাও, মারিয়া !
    আমাকে রাস্তায় ফেলে যেও না !
    তুমি অমন করতে পারো ?
    আমার গাল চুপসে গেছে,
    অথচ তুমি নিষ্ঠুরভাবে অপেক্ষা করাও ।
    তাড়াতাড়ি, সবায়ের দ্বারা পরীক্ষিত,
    বাসি আর বিবর্ণ,
    আমি চলে আসবো
    আর বিনা দাঁতে তোতলাবো
    যে আজকে আমি
    “সাতিশয় অকপট।”
    মারিয়া,
    চেয়ে দ্যাখো--
    আমার কাঁধ দুটো আবার ঝুলে পড়ছে ।
    রাস্তায়, লোকেরা
    তাদের চার-তলা পেটের চর্বিতে আঙুল বোলায়।
    ওরা চোখ দেখায়,
    চল্লিশ বছরের অবসাদে ক্ষয়িত, আর অস্হির---
    ওরা চাপা হাসি হাসে কেননা
    আমার দাঁতে,
    আবারও,
    আমি গত রাতের আদরগুলোর শক্ত-হয়ে-যাওয়া ধৃষ্টতা কামড়ে ধরে রেখেছি ।
    বৃষ্টি ফুটপাথের ওপরে কেঁদে ফেললো,--
    ও তো জমা-জলে কারারুদ্ধ জোচ্চোর ।
    রাস্তার লাশ, পাথরবাঁধানো পাথরের পিটুনি খেয়ে, নিজের কান্নায় ভিজে গেলো।
    কিন্তু ধূসর চোখের পাতাগুলো--
    হ্যাঁ !--
    ঝুলন্ত বরফের চোখের পাতা হয়ে উঠলো জমাট
    তাদের চোখ থেকে ঝরা অশ্রুজলে--
    হ্যাঁ !--
    ড্রেনপাইপগুলোর বিষাদভারাতুর চোখ থেকে ।
    প্রতিটি পথচারীকে চাটছিল বৃষ্টির শুঁড় :
    পথের গাড়িগুলোয় ঝিকমিক করছিল খেলোয়াড়ের দল ।
    ফেটে পড়ছিল জনগণ
    গাদাগাদি ভরা,
    আর তাদের চর্বি উথলে উঠছিল ।
    ঘোলাটে এক নদীর মতন, মাটিতে স্রোত গড়ে উঠেছিল,
    তাতে মিশেছিল
    বাসি মাংসের রস ।
    মারিয়া !
    কেমন করে আমি কোমল শব্দকে স্ফীত কানে আঁটাবো ?
    একটা পাখি
    ভিক্ষার জন্য গান গায়
    ক্ষুধার্ত কন্ঠস্বরে
    বরং ভালো,
    কিন্তু আমি একজন মানুষ,
    মারিয়া,
    আমি তো প্রেসনিয়ার নোংরা তালুতে অসুস্হ রাতের কাশি ।
    মারিয়া, তুমি কি আমাকে চাও ?
    মারিয়া, আমাকে গ্রহণ করো, দয়া করো ।
    কাঁপা আঙুলে আমি গির্জার ঘণ্টার লোহার গলা টিপে ধরবো !
    মারিয়া !
    রাস্তার চারণভূমিগুলো বুনো আর দর্শনীয় হয়ে গেছে !
    ওরা আমার গলা টিপে ধরেছে আর আমি প্রায় অজ্ঞান হতে চলেছি।
    খোলো !
    আমি আহত !
    দ্যাখো -- আমার চোখ খুবলে নেয়া হয়েছে
    মেয়েদের টুপির আলপিন দিয়ে !
    তুমি দরোজা খুলে দিলে ।
    আমার খুকি !
    ওহ, ভয় পেও না !
    এই মহিলাদের দেখছো,
    আমার গলায় পাহাড়ের মতন ঝুলে রয়েছে,--
    জীবনভর, নিজের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাই
    কয়েক কোটি, প্রচুর, বিশাল, বিশুদ্ধ ভালোবাসাদের
    আর কোটি কোটি নোংরা, বিদকুটে ভাড়াপ্রেমিকাদের ।
    ভয় পেও না
    যদি সততার
    প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয়,
    হাজার সুন্দরী মুখ দেখে, আমি নিজেকে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেবো--
    “ওরা, যারা মায়াকভস্কিকে ভালোবাসে !”
    দয়া করে বোঝো যে ওটাও হল
    রানিদের বংশ, যারা একজন উন্মাদ মানুষের হৃদয়ে সওয়ার হয়েছে ।
    মারিয়া, কাছে এসো !
    নগ্ন আর লজ্জাহীন হও,
    কিংবা আতঙ্কে শিহরিত,
    তোমার ঠোঁটের বিস্ময়কে সমর্পণ করো, কতো নরম :
    আমার হৃদয় আর আমি কখনও মে মাসের আগে পর্যন্ত থাকিনি,
    কিন্তু অতীতে,
    শত শত এপ্রিল মাস জড়ো হয়েছে ।
    মারিয়া !
    একজন কবি সারা দিন কল্পিত সুন্দরীর বন্দনায় গান গায়,
    কিন্তু আমি--
    আমি রক্তমাংসে গড়া,
    আমি একজন মানুষ --
    আমি তোমার দেহ চাই,
    খ্রিস্টধর্মীরা যেমন প্রার্থনা করে :
    “এই দিনটা আমাকে দাও
    আমাদের প্রতিদিনের রুটি।”
    মারিয়া, আমাকে দাও !
    মারিয়া !
    আমি ভয় পাই তোমার নাম ভুলে যাবো
    চাপে পড়ে কবি যেমন শব্দ ভুলে যায়
    একটি শব্দ
    সে অস্হির রাতে কল্পনা করেছিল,
    ঈশ্বরের সমান যার প্রভাব ।
    তোমার দেহকে
    আমি ভালোবেসে যাবো আর তত্বাবধান করবো
    যেমন একজন সৈনিক
    যুদ্ধে যার পা কাটা গেছে,
    একা
    আর-কেউ তাকে চায় না,
    অন্য পা-কে সে সস্নেহে যত্ন করে ।
    মারিয়া,--
    তুমি কি আমাকে নেবে না ?
    নেবে না তুমি !
    হাঃ !
    তাহলে অন্ধকারময় আর বেদনাদায়ক,
    আরেকবার,
    আমি বয়ে নিয়ে যাবো
    আমার অশ্রু-কলঙ্কিত হৃদয়
    এগোবো,
    কুকুরের মতন,
    খোঁড়াতে খোঁড়াতে,
    থাবা বইতে থাকে সে
    যার ওপর দিয়ে দ্রুতগতি রেলগাড়ি চলে গেছে।
    হৃদয় থেকে রক্ত ঝরিয়ে আমি যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই তাকে উৎসাহ দেবো,
    আমার জ্যাকেটে ফুলের গুচ্ছ ঝুলে থাকে, ধূসরিত করে,
    সূর্য পৃথিবীর চারিধারে হাজার বার নাচবে,
    স্যালোম-এর মতন
    ব্যাপটিস্টের মুণ্ডু ঘিরে যে নেচে ছিল ।
    আর যখন আমার বছরগুলো, একেবারে শেষে,
    তাদের নাচ শেষ করবে আর বলিরেখা আঁকবে
    কোটি কোটি রক্ত-কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে
    আমার পিতার রাজত্বের পথ
    আমি চড়ে বেরিয়ে আসবো
    নোংরা ( রাতের বেলায় গলিতে ঘুমিয়ে ),
    আর কানেতে ফিসফিস করে বলব
    যখন আমি দাঁড়িয়ে
    ওনার দিকে :
    শ্রীমান ঈশ্বর, শোনো !
    এটা কি ক্লান্তিকর নয়
    তোমার মহানুভব চোখদুটো মেঘেতে ডুবিয়ে দাও
    প্রতিদিন, প্রতি সন্ধ্যায় ?
    তার বদলে, এসো,
    বৃত্তাকারে পাক খাবার উৎসব আরম্ভ করা যাক
    শুভ আর অশুভের জ্ঞানবৃক্ষ ঘিরে !
    সর্বশক্তিমান, তুমি চিরকাল আমাদের পাশে থাকবে !
    মদ থেকে, মজাগুলো আরম্ভ হবে
    আর প্রেরিত দূত পিটার, যিনি সব সময়ে ভ্রুকুটি করেন,
    দ্রুত-লয়ের নাচ নাচবেন--- কি-কা-পু ।
    আমরা সব কয়জন ইভকে ইডেন স্বর্গোদ্যানে ফিরিয়ে আনবো :
    আমাকে আদেশ করো
    আর আমি যাবো --
    বীথিকাগুলো থেকে, প্রয়োজনের সুন্দরী মেয়েদের বেছে নেবো
    আর তাদের তোমার কাছে আনবো !
    আনবো তো আমি ?
    না ?
    তুমি তোমার কোঁকড়াচুল মাথা কেন অভব্যভাবে নাড়াচ্ছো ?
    কেন তুমি তোমার ভ্রুতে গিঁট ফেলছো যেন তুমি রুক্ষ ?
    তুমি কি মনে করো
    যে এই
    যার ডানা আছে, সে কাছেই,
    ভালোবাসার মানে জানে ?
    আমিও একজন দেবদূত ; আগেও ছিলুম--
    শর্করায় তৈরি মেশশাবকের চোখ নিয়ে, আমি তোমার মুখগুলোর দিকে তাকালুম,
    কিন্তু আমি ঘোটকিদের আর উপহার দিতে চাই না, --
    সেভরে-পাড়ার সমস্ত অত্যাচারকে ফুলদানির রূপ দেয়া হয়েছে ।
    সর্বশক্তিমান, তুমি দুটো হাত তৈরি করে দিয়েছো,
    আর তা সযত্নে,
    একটা মাথা গড়ে দিয়েছো, আর তালিকায় অনেককিছু রয়েছে--
    কিন্তু কেন তুমি তা করলে
    কেননা ব্যথা করে
    যখন কেউ চুমু খায়, চুমু, চুমু ?!
    আমি ভেবেছিলুম তুমিই মহান ঈশ্বর, সর্বশক্তিমান
    কিন্তু তুমি একজন ক্ষুদে মূর্তি, -- স্যুট-পরা একজন নির্বোধ,
    ঝুঁকে, আমি ইতিমধ্যে আয়ত্বে পেয়েছি
    সেই ছুরি যা আমি লুকিয়ে রেখেছি
    আমার বুটজুতোর ফাঁকে ।
    তোমরা, ডানাসুদ্ধ জোচ্চোরের দল
    ভয়ে জড়োসড়ো হও !
    নিজেদের কাঁপতে-থাকা পালকগুলো ঝাঁকাও, রাসকেলের দল !
    তুমি, গা থেকে ধুপের গন্ধ বেরোচ্ছে, তোমাকে চিরে ফালাফালা করব,
    এখান থেকে আলাস্কা পর্যন্ত ধাওয়া করে।
    আমাকে যেতে দাও !
    তুমি আমাকে থামাতে পারবে না !
    আমি ঠিক হই বা ভুল
    তাতে কোনো তফাত হয় না,
    আমি শান্ত হবো না ।
    দ্যাখো,--
    সারা রাত নক্ষত্রদের মাথা কাটা হয়েছে
    আর আকাশ আবার কোতলে রক্তবর্ণ ।
    ওহে তুমি,
    স্বর্গ !
    মাথা থেকে টুপি খোলো,
    যখনই আমাকে কাছে দেখতে পাবে !
    স্তব্ধতা ।
    ব্রহ্মাণ্ড ঘুমোচ্ছে ।
    কালো, নক্ষত্রে- কানের তলায়
    থাবা রেখে ।
  • T.S.Eliot | 236712.158.891212.167 | ২৭ জুন ২০১৯ ১০:৩৩383607
  • টি.এস.এলিয়ট-এর কবিতা[ ১৮৮৮ - ১৯৬৫] ‘ফাঁপা মানুষেরা’
    ( The Hollow Men ) অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    মিস্টাহ্ কুট্জ্--সে মরেছে
    বেচারা বুড়োর জন্যে এক পেনি


    আমরা সবাই ফাঁপা মানুষ
    আমরা সবাই ঠুঁশো মানুষ
    একসঙ্গে হেলান দিয়ে
    মস্তকাংশ খড়ে ভরা। হায়রে !
    আমাদের শুকনো স্বর, যখন
    সবাই মিলে ফিসফিসোই
    চুপচাপ আর মানেহীন
    যেন শুকনো ঘাসে বইছে হাওয়া
    বা ভাঙা কাচে ইঁদুরের ঠ্যাঙ
    শুকনো মদের ভাঁড়ারেতে

    আঙ্গিকহীন আদলখানা, ছায়ার মাত্রা রঙহীন,
    তেজ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, অঙ্গবিক্ষেপ চলনহীন;

    যারা সবাই পৌঁছে গেছে
    তাক-করা চাউনি-চোখে, মৃত্যুর আরেক রাজ্যে
    আমাদের মনে রেখো - রাখতে পারলে - হারিয়ে গিয়ে নয়
    উগ্র আত্মার মতো, কিন্তু কেবল
    যেন ফাঁপা মানুষেরা
    ঠুঁশো মানুষেরা

    ২.
    সাহস করি না স্বপ্নেও চোখ মেলাবার
    মৃত্যুর স্বপ্নরাজ্যে
    হয় না এরা আবুর্ভূত :
    সেখানে চোখগুলোসব
    ভাঙা থামে সূর্য-আলো
    সেখানে, একটা গাছ দুলছে
    আর গলার আওয়াজগুলো
    হাওয়ার গানে
    আরও দূরবর্তী আর আরও গুরুগম্ভীর
    একটি বিলীন তারার চেয়ে ।

    দিও না আমায় কাছে যেতে
    মৃত্যুর স্বপ্নরাজ্যে
    নিতে দিও তবু আমায়
    অমন সুচিন্তিত গুপ্তবেশ
    ইঁদুর-জামা, কাকের চামড়া, কাকতাড়ুয়া
    একটা মাঠে
    তেমনি আচরণ করব যেমন করে হাওয়া
    নয় কাছাকাছি--

    সেই শেষ সাক্ষাৎ নয়
    গোধূলীর রাজ্যে

    ৩.
    এটা সেই মরা জমি
    এটা ক্যাকটাস জমি
    এখানে পাথর-প্রতিমাগুলো
    উত্তোলিত হয়, এখানে তারা পায়
    এক মরা মানুষের হাতের মিনতি
    একটি বিলীন তারার ঝিকিমিকির নিচে ।

    এটা এই রকম
    মৃত্যুর আরেক রাজ্যে
    একা জেগে উঠে
    যখন আমরা সে সময়ে
    কাঁপছি কোমলভাবে
    যে-ঠোঁটেরা চুমু খাবে
    ভাঙা পাথরকে প্রার্থনায় ।

    ৪.
    চোখগুলো এখানে নেই
    এখানে কোনো চোখ নেই
    মরতে-থাকা তারাদের এই উপত্যকায়
    এই ফাঁপা উপত্যকায়
    আমাদের হারানো রাজ্যের এই ভাঙা চোয়ালে

    মিলিত হওয়ার এই শেষতম স্হানে
    আমরা একই সঙ্গে হাতড়াই
    আর আলাপ এড়াই
    জড়ো হয়েছি স্ফীত নদীর এই তীরে

    দৃষ্টিহীন, যদি না
    চোখগুলো আবার দেখা দেয়
    যেন সেই অবিরত নক্ষত্র
    বহুস্তর পাপড়ির গোলাপ
    মৃত্যুর গোধূলী রাজ্যের
    একমাত্র আশা
    ফাঁকা মানুষের।

    ৫.
    এখানে আমরা কণ্টকী নাশপাতি ঘিরে পাক খাই
    কণ্টকী নাশপাতি কণ্টকী নাশপাতি
    এখানে আমরা কণ্টকী নাশপাতি ঘিরে পাক খাই
    ভোর পাঁচটায়।

    ভাবকল্প ও
    বাস্তবের মাঝে
    চলন ও
    কাজের মাঝে
    ছায়া নেমে আসে
    কেননা রাজ্য তো আপনরই

    ধারণা ও
    সৃষ্টির মাঝে
    আবেগ ও
    সাড়ার মাঝে
    ছায়া নেমে আসে
    জীবন বড়োই দীর্ঘ

    আকাঙ্খা ও
    অঙ্গবিক্ষেপের মাঝে
    শক্তি ও
    অস্তিত্বের মাঝে
    সত্তা ও
    উৎরাইয়ের মাঝে
    ছায়া নেমে আসে
    কেননা এ রাজ্য তো আপনারই

    কারণ আপনারই
    জীবন হলো
    কারণ আপনারই হলো এই

    এভাবেই বিশ্বের অবসান হয়
    এভাবেই বিশ্বের অবসান হয়
    এভাবেই বিশ্বের অবসান হয়
    নয়কো এক বিস্ফোরণে বরং এক ঘ্যাঙানিতে
  • Atoz | 237812.69.4545.135 | ২৭ জুন ২০১৯ ১০:৩৬383608
  • এগুলো কী?????????
    গুগল ট্রানস্লেটে ফেলেও তো এর চেয়ে ভালো অনুবাদ হয় একটু ঝেড়েবেছে নিলে।
  • Jorges Luis Borges | 236712.158.8989.241 | ২৮ জুন ২০১৯ ১২:৪০383610
  • হোর্হে লুই বোর্হেস-এর কবিতা (১৮৯৯ - ১৯৮৬) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

    "বাইরের প্রাঙ্গণ"
    সন্ধ্যাবেলায়
    ওরা বিষণ্ণ হয়ে যায়, প্রাঙ্গণের দুই বা তিনটি রঙ ।
    আজ রাতে, চাঁদ, উজ্বল বৃত্ত,
    পরিসরের ওপরে খবরদারি করতে পারে না ।
    বাইরের প্রাঙ্গণ, আকাশের খাল ।
    বাইরের প্রাঙ্গণ ঢালু
    হয়ে যায় যেখান দিয়ে আকাশ ঘরে ঢোকে ।
    নির্মল,
    অনন্তকাল নক্ষত্রদের চৌমাথায় অপেক্ষা করে ।
    বন্ধুত্বময় অন্ধকারে থাকতে ভালো লাগে
    প্রবেশপথে, কুঞ্জবন আর জলাধার ।

    "সরলতা"
    খুলে যায়, বাগানে যাবার গেট
    একটা কাগজের পাতার নিরীহতা নিয়ে
    যার সন্নিহিত আনুগত্য প্রশ্ন তোলে
    আর ভেতরে, আমার দৃষ্টির
    কোনো প্রয়োজন নেই বিশেষ বস্তু দেখবার
    যা আগেই আছে, হুবহু, আমার স্মৃতিতে ।
    আমি রীতিগুলো আর আত্মাদের
    আর উপভাষার ইঙ্গিতগুলোকে
    যা মানুষদের প্রতিটি সমাবেশ বুনে চলে ।
    আমার বলবার কোনো দরকার হয় না
    মিথ্যে সুবিধার দাবি পেশ করবারও;
    যারা এখানে আমাকে ঘিরে থাকে তারা আমাকে ভালোভাবে চেনে,
    ভালো করে জানে আমার পরিতাপ আর দুর্বলতার কথা ।
    এটা সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য,
    যা হয়তো স্বর্গ আমাদের দিতে রাজি হবে :
    সমাদর কিংবা বিজয়প্রাপ্তি নয়
    কিন্তু সরলভাবে গ্রহণ করে নে্য়া
    অনস্বীকার্য বাস্তবতার অংশ হিসাবে,
    পাথরদের আর গাছেদের মতো ।

    "সীমানা"
    এই পথগুলো যারা সূর্যাস্তকে গভীর করে তোলে,
    একটা নিশ্চয়ই আছে ( কিন্তু কোনটা ) যাতে আমি হেঁটেছি
    আগেই একবার, উদাসীনভাবে
    আর তা না জেনে, সমর্পণ করেছি
    একজনের কাছে যিনি অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন আইনের সীমা বাঁধেন
    আর এক গোপন আর এক অনমনীয় মাপকাঠি
    ছায়াদের, স্বপ্নের, আর আঙ্গিকের জন্য
    যা এই জীবনের টানা ও পড়েনের কাজগুলো করে।
    যদি সবকিছুরই একটা সীমা আর মূল্য থাকে
    শেষ বারের জন্য এক বিস্মৃতির বেশি কিছু নয়
    কেই বা এই বাড়িতে বলতে পারে কাকে
    অজান্তে, আমরা জানিয়ে দিয়েছি বিদায় ?
    ইতোমধ্যে ধূসর কাচের ভেতর দিয়ে রাত কমে যেতে থাকে
    আর বইয়ের গাদার মধ্যে যা ছুঁড়ে দেয়
    অনালোকিত টেবিলের ওপরে এক ভাঙা ছায়া,
    তার মধ্যে একটা নিশ্চয়ই আছে যা কখনও পড়ব না ।
    দক্ষিণে একটার বেশি ক্ষয়ে যাওয়া গেট আছে
    তার গাঁথুনির কলসি আর কণ্টকী নাশপাতি নিয়ে
    যেখানে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ
    কেননা তা রয়েছে এক লিথোগ্রাফে ।
    এক দরোজা আছে যা তুমি চিরকালের জন্য বন্ধ করেছো,
    আর এক আয়না যা তোমার জন্য বৃথাই অপেক্ষা করে ;
    আড়াআড়ি পথ তোমার মনে হয় তোমার জন্য প্রশস্ত খোলা
    আর সেখানে এক চার-মুখো তোরণ-দেবতা নজর রাখে ।
    তোমার স্মৃতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, এমন এক
    যা এখন অপুরণীয়ভাবে হারিয়ে গেছে ;
    ওই কুয়োর কাছে যেতে তোমাকে দেখা যাবে না
    শাদা সূর্য আর হলুদ চাঁদের নিচে ।
    তোমার কন্ঠস্বর পুনরুদ্ধার করতে পারে না যা সেই ইরানি
    তার পাখি আর গোলাপের জিভ ব্যবহার করে গেয়েছিল,
    যখন সূর্যাস্তে, আলো যেমন যেমন ছড়িয়ে পড়ে,
    তোমার ইচ্ছে করে অবিনাশী বিষয়ের কথা বলো ।
    আর অবিশ্রান্ত রোন নদী আর ঝিল,
    গতকালকের ওপরে আমি আজ ঝুঁকে থাকি ?
    ওরা হারিয়ে যাবে সেই কার্থেজের মতো
    রোমানরা যেমন আগুন ও লবণে মুছেছিল।
    ভোরবেলা মনে হয় শুনতে পাই এক করাল
    কলনাদ বহু মানুষের যা পালিয়ে যায় দূরে ;
    সবাই যারা আমাকে ভালোবেসেছে আর ভুলে গেছে;
    স্হান, কাল আর বোর্হেস এখন আমায় ছেড়ে যাচ্ছে।

    "ব্লেক"
    কোথায় আপনার হাতে গোলাপফুল থাকে
    যা অবাধে অর্পণ করে, অজান্তে, অন্তরঙ্গ উপহার ?
    রঙে নয়, কেননা ফুল তো অন্ধ,
    মিষ্টি অফুরান সুগন্ধেও নয়,
    পাপড়ির ওজনেও নয় । ও-ব্যাপারগুলো
    হলো বিরল ও দূরবর্তী সব প্রতিধ্বনি ।
    প্রকৃত গোলাপ আরও অধরা ।
    হয়তো কোনো স্তম্ভ বা লড়াই
    বা দেবদূতদের গগনপট, কিংবা এক অসীম
    জগত, গোপন ও দরকারি,
    কিংবা এক দেবতার আনন্দ যা আমরা দেখতে পাবো না
    অথবা আরেক আকাশে রুপোর এক গ্রহ
    কিংবা এক ভয়ঙ্কর আদিরূপ
    যার গোলাপের আঙ্গিক নেই।

    "একটি গোলাপ এবং মিলটন"
    গোলাপদের বহু প্রজন্ম থেকে
    কালের অতলে যা হারিয়ে গিয়েছে
    একটিকে আমি বিস্মৃতি থেকে রক্ষা করতে চাই,
    এক নিখুঁত গোলাপ, সবকিছুর মাঝে
    যা কখনো ছিল । ভাগ্য অনুমতি দিয়েছে আমাকে
    একবারের জন্য বেছে নেবার ক্ষমতা
    সেই নিঃশব্দ ফুল, শেষ গোলাপ
    যা মিলটনের নিজের হাতে ছিল ধৃত,
    অদেখা । তা টকটকে লাল, কিংবা হলুদ
    অথবা শাদা গোলাপ কোনো নষ্ট বাগানের,
    তোমার অতীত তবু জাদুবলে রয়ে গেছে
    চিরকালের জন্য উজ্বল এই কবিতায়,
    সোনা, রক্ত, হস্তিদন্ত অথবা ছায়া
    যেন তাঁর হাতে, অদৃশ্য গোলাপ ।

    "পাঠকেরা"
    সেই বীরব্রতী যার ফ্যাকাশে, শুকনো
    আর নায়কোচিত চেহারা, ওরা অনুমাম করে
    যে, এই চললেন বুঝি অ্যাডভেঞ্চারে,
    নিজের গ্রন্থাগারের বাইরে উনি কখনও নৌকো ভাসাননি ।
    ওনার আগ্রহের সংক্ষিপ্ত সালতামামি
    আর তার বিয়োগাত্মক বিপর্যয়গুলো
    স্বপ্নে দেখেছিলেন উনি, সেরভানতেস নয়,
    ব্যাপারটা স্বপ্নের সালতামামির চেয়েও বড়ো ।
    আমার অদৃষ্টও তেমনই । আমি জানি কিছু একটা আছে
    অবিনশ্বর আর জরুরি যা আমি কবর দিয়েছি
    অতীতের কোনো গ্রন্থাগারের কোথাও
    যেখানে আমি বীরব্রতীর ইতিহাস পড়েছিলুম।
    ধীর পাতাগুলো এক শিশুর কথা মনে পড়ায় যে গম্ভীরভাবে
    অস্পষ্ট জিনিসের স্বপ্ন দেখে যা সে বুঝতে পারে না ।

    "ম্যানুয়েল ফ্লোরেসের জন্য এক মিলোঙ্গা নাচ"
    মরতে চলেছে ম্যানুয়েল ফ্লোরেস,
    তা ‘টাকার জন্য’ ;
    মারা যাওয়া একটা অভ্যাস
    তা অনেকেই জানেন ।
    তবুও আমি দুঃখ পাই
    জীবিত কাউকে বিদায় বলতে,
    ব্যাপারটা এতো পরিচিত,
    এতো মিষ্টি আর বজায় থাকে ।
    ভোরবেলা আমি নিজের হাতের দিকে তাকাই,
    আমার হাতে শিরাগুলো রয়েছে ;
    আমি তাকাই কিন্তু বুঝতে পারি না
    যেন ওগুলো সব অপরিচিত ।
    কালকে চারটে বুলেট আসবে,
    জ্ঞানী মানুষ মেরলিন অমনই বলেছিলেন :
    মারা যাওয়া মানে সে জন্মেছিল ।
    রাস্তায় কতো কিছু রয়েছে
    এই দুটো চোখ তা দেখেছে !
    যখন যিশু আমার বিচার করেছেন
    কে জানে ওরা কি দেখতে পাবে ।
    ম্যানুয়েল ফ্লোরেস মরতে চলেছে
    তা ‘টাকার জন্য’;
    মারা যাওয়া একটা অভ্যাস
    তা অনেকেই জানেন ।

    "নিউ ইংল্যাণ্ড ১৯৬৭"
    আমার স্বপ্নে আঙ্গিকগুলো বদলে গিয়েছে ;
    এখন সেখানে পাশাপাশি লাল রঙের বাড়ি
    আর পাতাগুলোর নরম পেতল
    আর শুদ্ধ শীত আর পবিত্র বনানী ।
    যেমন সপ্তম দিনে, জগতসংসার
    ভালো থাকে । সেখানে গোধুলীতে বজায় থাকে
    যার অস্তিত্ব প্রায় নেই, সাহস, দুঃখ,
    বাইবেলের প্রাচীন এক কলনাদ, যুদ্ধ ।
    শিগগিরি ( সবাই বলছে ) প্রথম তুষারপাত হবে
    প্রতিটি রাস্তায় আমেরিকা আমার জন্য অপেক্ষা করে,
    কিন্তু সন্ধ্যার অবসানে আমি অনুভব করি
    আজকের দিনটা বড়ো দীর্ঘ, আর গতকাল ছিল ছোটো ।
    বুয়েনস এয়ারিস, আমি বেড়াতে যাই
    তোমার রাস্তায়, কোনো সময় আর যুক্তি ছাড়াই ।

    "আত্মহত্যা"
    একটা তারাও থাকবে না রাতের বেলায় ।
    রাত নিজেই তো থাকবে না ।
    আমি মারা যাবো আর আমার সঙ্গে
    সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অসহ্য সমষ্টি ।
    আমি পিরামিডগুলো মুছে ফেলবো, পয়সাকড়িও,
    উপমহাদেশগুলো আর সমস্ত মুখ ।
    আমি মুছে ফেলবো একত্রিত অতীত ।
    আমি ইতিহাসকে ধুলোয় পরিণত করব, ধুলোর ধুলো ।
    এখন আমি শেষ সূর্যাস্তের দিকে তাকাই।
    আমি শুনছি শেষ পাখিটাকে ।
    আমি কাউকে শূন্যতা উপহার দিয়ে যাচ্ছি না ।

    "জিনিসপত্র"
    আমার হাঁটবার ছড়ি, পয়সাকড়ি, চাবির গোছা,
    নিরীহ তালা আর বিলম্বিত লেখালিখি
    যে কয়টা দিন বেঁচে আছে তা দেবে না
    পড়ে ওঠার সময়, তাসগুলো, টেবিল.
    একটা বই, তার পাতায়, চেপ্টে-যাওয়া
    বেগুনি ফুল, দুপুরের অবশিষ্টাংশ
    যা নিঃসন্দেহে ভোলবার নয়, ভুলে গেছি,
    রক্তবর্ণ আয়না পশ্চিমের দিকে মুখ করে
    যেখানে ভ্রমাত্মক ভোর জ্বলছে । অনেক জিনিস,
    ফাইল, চৌকাঠ, মানচিত্র, মদের গেলাস, পেরেক,
    যা আমাদের কাজে লাগে, মুখবোজা ক্রীতদাসের মতন,
    কতো অন্ধ আর কতো রহস্যময়ভাবে গোপন !
    আমাদের বিদায় নেবার পরও তারা বহুদিন থাকবে ;
    আর জানবে না যে আমরা চলে গেছি ।

    "পাপিয়া পাখিকে"
    কোন গোপন রাতে ইংল্যাণ্ডে
    কিংবা ধারণাতীত নিয়ত রাইন নদীর তীরে,
    আমার রাতগুলোর সব রাতের মাঝে হারিয়ে যাওয়া,
    আমার অজ্ঞ কানে পৌঁছে দিলো
    তোমার কন্ঠস্বর, কিংবদন্তিতে ভারাক্রান্ত,
    ভারজিলের পাপিয়া, নাকি পারস্যদের ?
    বোধহয় আমি কখনও তোমায় শুনিনি, তবু আমার জীবন
    আমি তোমার জীবনে বেঁধেছি, অঙ্গাঙ্গিভাবে ।
    তোমার প্রতীক এক পর্যটনকারী আত্মা
    হেঁয়ালির এক বইতে । এল মেরিনো
    তোমার নাম দিয়েছিলেন বনানীর কুহকিনী
    আর তুমি জুলিয়েটকে সারা রাত গান শোনাও
    আর জটিল লাতিন পৃষ্ঠাগুলোয়
    আর অপরের সেই পাইন-গাছ থেকে,
    জার্মানি আর জুডিয়ার পাপিয়া পাখি,
    হাইনে, ঠাট্টা করে, জ্বলেপুড়ে, শোকে ।
    কিটস সবায়ের জন্য তোমায় শুনেছিলেন, সব জায়গায় ।
    এমন একটিও উজ্বল নাম নেই যা
    পৃথিবীর লোক তোমাকে দেয়নি
    তাতে তোমার সঙ্গীতের সমকক্ষ হবার আকুলতা নেই,
    ছায়াদের পাপিয়া । মুসলমান লোকটি
    স্বপ্ন দেখেছিল তুমি ভাবাবেশে মাতাল
    তার বুক কাঁটায় এফোঁড়-ওফোঁড়
    গীত গোলাপের যাকে তুমি লাল করে তোলো
    তোমার শেষ রক্ত দিয়ে । এভাবেই
    গোধুলীর শূন্যতায় আমি এই পংক্তিগুলো লিখি,
    সমুদ্রতীর আর সাগরের পাপিয়া পাখি,
    যে উল্লাস, স্মৃতি আর উপকথায়
    ভালোবাসায় পোড়ে আর সঙ্গীতময়তায় মারা যায় ।

    "চাঁদ"
    ওই সোনায় কতো নিঃসঙ্গতা আছে ।
    এই রাতগুলোর চাঁদ সেই চাঁদ নয় যা
    প্রথম আদম দেখেছিল । বহু শতক যাবত
    মানুষের দৃষ্টি মেয়েটিকে ভরে তুলেছে
    পুরোনো এক বিলাপে । দ্যাখো । মেয়েটি তোমার আয়না ।

    "মনস্তাপ"
    আমি সবচেয়ে খারাপ পাপগুলো করেছি
    যা একজন করতে পারে । আমি হতে পারনি
    সুখি । বিস্মৃতির হিমবাহগুলো আমাকে
    নিয়ে নিক আর গিলে ফেলুক, নির্দয়ভাবে ।
    আমার মা-বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন
    জীবনের বিপজ্জনক আর সুন্দর খেলার জন্য,
    পৃথিবী, জল, বাতাস আর আগুনের জন্য ।
    আমি ওনাদের ইচ্ছে পুরো করিনি, আমি সুখি নই ।
    আমার জন্য তাঁদের যৌবনের আশা পুরো হয়নি।
    আমি আমার মনকে শিল্পের সুসামঞ্জস্যের
    তর্কে প্রয়োগ করলুম, তার নগণ্য তন্তুজালে ।
    তাঁরা চেয়েছিলেন আমি সাহসী হই । আমি সাহসী হইনি।
    তা আমাকে কখনও ছেড়ে যায় না । সদাসর্বদা আমার পাশে
    একজন বিষণ্ণ মানুষের ছায়া ।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন