এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৫৭০০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 124.124.86.102 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১১:৩৯449642
  • *****************************************
    পা চালিয়ে চলে হারান, প্রায় ছুটেই পার হয় মনসাতলা। আজ তার দেরী হয়ে গেছে। সুয্যি ছোটপুকুরের পুবপাড়ের বাঁশঝাড়ের আধাআধি আর সে এখনও দোকান খোলেনি। প্রাইমারী ইস্কুলের মাঠ পেরিয়ে দোকানঘরের দাওয়ায় উঠতে উঠতে দেখল রোজকার মত চাটুজ্যেদের বুড়ো আশু চাটুজ্যে আসন পেতে উবু হয়ে রোদে বসে, রাস্তার দিকে চোখ রেখে। দোকানের ঝাঁপ খুলতে খুলতে সে বুড়োকে বলে,
    -"ও দাদু, আপনার সময়ের নড়চড়টি হওয়ার জো নেই শীত গ্রীষ্ম কিছুতেই। আমারই আজ সকালে উঠতে কেমন দেরী হয়ে গেল। ঠান্ডাটা জবর পড়েছে এবারে কি বলেন?"
    চাটুজ্যে বুড়ো রোজের মতই উত্তর করেনা, সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

    গাঁয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে বড় রাস্তার ধারে এই চালাঘরটা অনেকদিন খালিই পড়েছিল।রাস্তার ওধারে, পঞ্চানন্দের ভাঙা পোড়ো মন্দির। অনেককাল আগে হারানদের ছোটোবেলায় ভুতোপাগলা বলে বোসপাড়ায় এক পাগল থাকত। বোসেদেরই কাদের দৌহিত্তির। তার তিনকূলে কেউ ছিলনা, এর ওর বাড়ীতে খেত আর রাতে কাত্তিক বোসেদের সদর দাওয়ায় শুয়ে থাকত। সেসময় বাবা পঞ্চানন্দের রমরমা বাজার। দুর দুর থেকে বারের পুজোর দিন লোক আসে বাবার মাথায় জল ঢালতে, শিবরাত্তিরে মেলা বসে মাঠে।

    একদিন ভুতো পাগলার কি মনে হল, সকালে পুজো করে পুরুতঠাকুর কোথায় একটু গেছে আশেপাশে দোর খুলে রেখে,ভুতো সেই ফাঁকে মন্দিরের ভেতর থেকে বাবাকে তুলে নিয়ে দে দৌড়। গ্যাঁড়া পুরুত মোটাসোটা মানুষ ছিল, হঠাৎ আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখে ঐ কান্ড। সে পিছন পিছন দৌড়তে যায় পারেনা, হাঁসফাঁস করে। তার হাঁকডাক শুনে এদিক ওদিক থেকে আরো লোক জড়ো হয়ে যায়। কিন্তু কোথায় ভুতো? সে তখন সোজা গিয়ে বোসপুকুরের পারের বটগাছের তলায় ঠাকুর নামিয়ে বসে ফিচফিচ করে হেসে যাচ্ছে।

    চারদিকে লোকে হাহা করতে লাগল, ঠাকুর অশুদ্ধ হয়েছেন, গাঁ না জ্বলে যায় বাবার রোষে। পাঁচজন এল, বাঁকিপুরের আশ্রম থেকে বড় পন্ডিত আনা হল বিধান নিতে। ততদিনে মেয়েরা ঐ বটতলাতেই ঠাকুরের ওপর দুধ ডাবের জল ঢালতে থাকল প্রাণপনে বাবার রোষ কমাতে। শেষমেশ বিধান হল এ বাবারই ইচ্ছে, বোসেদের বটতলায় বাস করা। ভুতো পাগলার হাত দিয়ে তিনিই ইচ্ছেপূরণ করেছেন। রাতারাতি সেখানে মন্দির তুলে ঠাকুরের প্রাচিত্তির করে প্রতিষ্ঠা হল। সেই থেকে গাঁয়ের শিব মন্দির বোসপাড়ায় আর পুরনো পঞ্চানন্দের মন্দির ভেঙে পড়েছে, বাদুড় আর চামচিকের আস্তানা। শুধু পঞ্চানন্দতলা নামটা এখনো রয়ে গেছে। ভুতো পাগলা যতদিন বেঁচে ছিল মন্দিরেই থাকত। বোসেদের জমিতে মন্দির, বোসেরাই হর্তাকর্তা। মেলাটেলা এখন আর সেরকম হয়না যদিও তবু লোকের বিশ্বাস এখনও অটুট, পুজো ভালৈ পড়ে। মন্দ লোকে বলে বোসেদের কত্তা কাত্তিক, ভীম বোস এরাই ভুতোকে উস্কেছিল ঠাকুর নিয়ে পালাতে। মন্দিরে ভালই আয় হয়, সেসব এখন বোসেদের ঘরে ওঠে।
  • shrabani | 124.124.86.102 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১১:৪৩449753
  • পোড়ো মন্দিরের লাগোয়া একটা ছোটো ডোবা মতন পুকুর। এধারে চালাটার পাশে ইস্কুলের খেলার মাঠ আর মাটির দোতলা ইস্কুল ঘর। আশেপাশে বসতি বলতে কিছু নেই, এক দুরে ধোপাদের বাড়ি আর উকিলদের বাড়ী ছাড়া। এদিক সেদিক রাস্তা বেরিয়েছে বিভিন্ন পাড়ার দিকে। তবে বড় রাস্তা থেকে যে কোনো পাড়ার মধ্যে ঢুকতে গেলেই পুকুর মাঠ বনের পরদা পেরিয়ে যেতে হবে। পাড়ার আব্রু রক্ষার্থেই এইরকম ব্যবস্থা। আশেপাশে চাষের জমি, আগে এই চালাটা রাত পাহারার জন্য ব্যবহার করত রায়েরা। ইদানীং তাদের জমি অনেক কমে গেছে, বিক্রিবাটা হয়ে গেছে। এছাড়া এই রাস্তায় দিনে তিনবার বাস চলছে, লোকের আনাগোণাও বেড়েছে।

    ঘরটা খালি পড়েছিল অনেককাল। দাওয়াটায় অবশ্য সকাল বিকেল নানা বয়সীদের আড্ডা বসে, মাঠে ফুটবল ভলিবল ম্যাচ হলে লোকে ভীড় করে, একটু রাত করে তাসের আড্ডা বসে। শহরের দোকানে পুরনো চাকরিটা চলে যাওয়ার পর ঘরে এসে বসেছিল হারান। এই বয়সে নতুন চাকরি জোটানো অসম্ভবই বলতে গেলে। বলে আশেপাশে কত ছেলেছোকরা বেকার হাপিত্যেশ করে বসে আছে! ঘরে মা,বউ, দুটো ছেলে আর সবার ওপরে বড় বোন বসে। অবশ্য বড় বোন ঠিক বসে নেই, বলতে গেলে সেই সংসারের কœÑ£। নানা কাজ করে সংসার চালায় সে, নাহলে হারানের ঐ দোকানের আয়ে এতগুলো মুখের চলত নাকি! নিজে বিয়ে থা করেনি, চার চারটে বোনের বিয়ে দিয়েছে, ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছে। সংসারের সব কিছু তার কথাতেই চলে, সবাই তাকেই মানে, হারান নিজেও। কিছুদিন বসে থাকার পরে বোন তার মূর্তি ধরল। কিছু করতে হবে, কিছু কর। তার সাথে গলা মেলাল বউ মা এরাও।

    হারানের নিজের অবিশ্যি খুব একটা তাড়া ছিলনা কিছু করার। বেশ কাটছিল দিন গুলো। সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে, একথালা পান্তা সাঁটিয়ে পা পা এসে এই পঞ্চানন্দতলার চালাঘরের দাওয়ার আড্ডায় এসে বসা। সকালে মূলত বুড়োদের আড্ডা বসলেও কিছু বেকার ছেলে জুটে যায় রোজই। সকালটা ভালই কাটে। এই রাস্তার ওপর দিয়েই সারা গাঁয়ের লোকের যাওয়া আসা। কে কোথায় যাচ্ছে, কার বাড়িতে কে আসছে সব জানা যায়। এছাড়া যেতে আসতে লোকের মুখে সব বেত্তান্ত জানা যায়। বেলা পড়লে আড্ডা ধারীরা সবাই যে যার বাড়ি যায়, হারানও যেত। চান করে খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে আবার আড্ডায়, তখন সেখানে হারানের বয়সী চাকুরীজীবিরা আর খেলার মাঠের ছেলেছোকরারা। অবশ্য কিছু লোক থাকে যারা সব আড্ডাতেই থাকে বয়স যাই হোক না কেন!
    বাইরের কাজকম্ম দোকান বাজার সব বোনই করে, তাই সেদিকেও হারানকে কিছু করতে হত না। মাঝেসাঝে একটু ঘরের মেরামতি বা একটু কাঠ চেরা, ঘাট বাঁধানো এসব করেই হয়ে যেত।

    বছরখানেক এভাবে চলার পর প্রথমে বাড়ির মেয়েদের গলা চড়ল পরে পাড়ার পাঁচজনেও তাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করল। সবার তাড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে কিছুকাল এটা সেটা করল। সেভাবে কোনো কিছুতেই ঠিক জমাতে পারলনা। সে বরাবরই উদ্যমী নয় একটু সুখী ধরণের। ঐ দোকানের চাকরিটা কোনোভাবে করত, মালিকটি বড়ই ভালমানুষ ছিল, তাই বোধহয় তার ব্যবসা ফেল মারল।
    শেষমেশ ঘরের অশান্তি যখন খুব বেড়ে গেল তখন একদিন রায়েদের বড়কত্তা তাকে ডেকে এই চালাটায় একটা দোকান করার পরামর্শ দিল। এতবড় গাঁয়ে একটাই মুদির দোকান, নিমাই সাঁতের। সেও সেই বারোয়ারীতলায়। রায়কত্তা মুদির সাথে সাথে চায়ের ব্যবস্থাও রাখতে বলল, বড় রাস্তার ধারে রমরম করে চলবে।
    হারানেরও খুব মনে ধরল। কতকাল সে দোকানে কাজ করেছে, এ কাজ ভালই করতে পারবে। রায়কত্তা বোনকে বোঝাতে সেই ঘোরাঘুরি করে এদিক ওদিকে ধারধোর করে কিছু মূলধনের জোগাড় করে দিলে। ভালই চলছে দোকান সেই ইস্তক। তার একজন বাচ্চা সহকারীও আছে, বিশে। বছর দশেকের হলে কি হবে খুব চটপটে। ওর মা রায়েদের বাড়ী কাজ করে, সেখানেই ফাইফরমাস খাটত। এখন হারানের দোকানে কাজ করছে। চায়ের দিকটা বিশেই দেখে। দাওয়ার একদিকে উনুন আর একটা মিটসেফে চায়ের সরঞ্জাম রাখা আছে। রাত্রে মিটসেফটা দুজনে মিলে ঘরের ভেতরে তুলে দেয়।
  • shrabani | 124.124.86.102 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১১:৪৪449792
  • *কœÑ£
  • Manish | 117.241.229.57 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১২:০৯449803
  • খুব সুন্দর এগোচ্ছে। পড়তে ভালো লাগছে।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১২:১৫449814
  • আজ বিশেটাও এখনো আসেনি। উনুনে আগুন পড়লনি। শীতের সকাল, লোকে চা চা করে এল বলে। গজগজ করতে করতে এক কোণে রাখা টিনের বালতি নিয়ে জল তুলতে গেল রাস্তা পেরিয়ে মন্দিরের পাশের ডোবায়। দোকানের ভেতরে দাওয়ায় চারদিকে জলছড়া দিয়ে একটা মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে খরখর করে ঝাঁট দেবার নামে বেশ কিছুটা ধুলো ওড়াল। কুলুঙ্গিতে রাখা মা কালীর ফটোর সামনে ধুপ জ্বালিয়ে জল বাতাসা দিয়ে এসে ধপ করে তক্তপোষে মাদুরের ওপর নিজের জায়গায় বসে পড়ল। দোকানের মধ্যে জিনিস খুব বেশী নেই, দু তিনটে বেঞ্চির ওপর সার সার বস্তা আর টিনে মুদিখানা রাখা। তক্তপোষে তার বসার জায়গা আর ক্যাশবাক্সোটা বাদ দিলে সব কৌটোয় আর বয়ামে ভরা।

    নীলু ডাক্তার সাইকেলে এসে নামল দোকানের সামনে।
    -"কিরে হারান, চায়ের জল চড়েনি এখনো? শীতে জমে গেলুম যে।"
    হারান তাড়াতাড়ি উঠে আসে, ভেতর থেকে দুটো চাটাই নিয়ে এসে যেদিকটা রোদ পড়েছে সেদিকে পাততে পাততে বলে,
    -"আসুন খুড়ো বসুন। এই আজ একটু লেট হয়ে গেল। কাঠের উনুন, এক্ষুনি ধরিয়ে ফেলব। আজ শালা বিশেটাও এখুনো এল নি। আপনি বসুন।"
    ডাক্তার হাতে হাত ঘসতে ঘসতে রোদে গিয়ে বসল,
    -"নে তাড়াতাড়ি কর, কলে যেতে হবে রাধাকেষ্টপুর। কি আশুখুড়ো, শরীর কেমন? ঠান্ডাটা ভালই পড়েছে কি বল?"
    আশু চাটুজ্যে যথারীতি একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, উত্তর করেনা। তার থেকে কেউ উত্তর আশাও করেনা। বুড়োর সঠিক বয়স কেউই জানেনা। লোকে একশ থেকে একশ পঞআশ যার যেমন ইচ্ছে বলে। সে দশ ভাইবোনের সবার বড়, এক ছোট বোন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। গিন্নীও গত হয়েছে তা প্রায় অনেক কাল হল। বুড়োর দুই ছেলে দুই মেয়ে নাতিপুতি এছাড়া ভাইয়েদের সংসার মিলে চাটুজ্যে বাড়ি জমজমাট। বাড়িতে যত্ন আত্তিও করে ঘরভর্তি নাতবৌ বৌমারা। খাওয়াদাওয়া সবই ঠিক আছে, শরীরগতিক ও চট করে খারাপ হয়না। শুধু এই এক ব্যামো, বুড়ো কথা প্রায় বলেই না। ঘরে দু একটা দরকারী শব্দ উচ্চারণ করলেও গল্প গালের কথা একেবারেই নয়,বাইরে তো নয়ই। আর রোদ ঝড় জল যাই হোক দুবেলা এসে এই দাওয়াতে বসবেই। চোখে তবে খুব ভাল দেখেনা, একটু সন্ধ্যে হলে বাড়ি থেকে কেউ এসে হাত ধরে নিয়ে যায়।

    নীলু ডাক্তার আসলে ডাক্তার কিনা এই নিয়ে গাঁয়ের লোকের মতভেদ আছে। আজকালকার লেখাপড়া জানা শহরের হাওয়া গায়ে লাগানো নবীনেরা তাকে ডাক্তার মানেনা, বলে ও হাতুড়ে কম্পাউন্ডার। নীলুর সমবয়সী প্রবীণেরা কেউ কেউও একই মত পোষন করে। কিন্তু বৃদ্ধরা একবাক্যে নীলুকে তাদের একমাত্র রক্ষক মানে। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল তারা ছোট থেকে নীলুর বাবার হাতের মিক্সচার খেয়েছে শিশিতে কাগজের দাগ দেওয়া, যেরকম এখনো নীলুই দেয় যে কোন রোগেই। বেশী বাড়াবাড়ি হলে দু চারটে সাদা বড়ি তার সাথে। আর এখনকার নব্য কলকাতা থেকে পাশ করা ডাক্তার মিত্তিরদের ছোটছেলে রোগী দেখে খসখস কাগজ লেখে। রক্ত পরীক্ষা, পেচ্ছাপ পরীক্ষা করায়। রাংতায় মোড়া কত আকারের বড়ি, আলাদা আলাদা শিশির ওষুধ। রোগ সারতে সেই একই সময়। গাঁয়ে পশার না জমায় অরুন মিত্তির এখন গাবপুরের হাটে চেম্বার খুলে বসেছে। গাবপুর মহকুমা শহর, বাইরের লোক বেশী। ভালই চলছে তার ব্যবসা। তবে শোনা যায় মিত্তির কত্তা নিজেও এখনো নীলুকেই ডাকে।
  • Samik | 219.64.11.35 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১৩:২০449825
  • বেলকাম ব্যাক, বেলকাম ব্যাক!
  • de | 203.197.30.2 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১৪:১৮449836
  • খুব ভালো লাগছে শ্রাবণী!
  • Lama | 203.99.212.54 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১৪:৫৫449847
  • খুব সুন্দর
  • byaang | 122.172.56.89 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১৫:২৮449858
  • বা:। খুব ভালো হচ্ছে শ্রাবণী।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১৬:০৬449643
  • উনুন সবে ধরেছে, ছুটতে ছুটতে বিশে এসে হাজির, হাতে দুধের ক্যান। হারান একবার রক্তচক্ষুতে তাকাল তার দিকে। বিশে অবশ্য হারানকে খুব একটা ভয়টয় করেনা, পাত্তাও দেয়না বিশেষ। মাঝেসাঝে আবার তারই ওপর সদ্দারী করে, ধারেটারে জিনিস দিলে বকেও দেয়। ভয় করে বিশে আর সবারই মত হারানের বোন দুগ্গাকে।দুগ্গা দোকানে পা দিলে বিশের স্পীড দশগুণ বেড়ে যায়। তবে দুগ্গা আবার একটু ওকে আশকারাও দেয়। দোকানে কি হয় না হয় সেসব খবরাখবর সে বিশের থেকেই পায়। এখনও বিশে তার দিকে না দেখে দুধের ডেকচি উনুনে বসিয়ে বড় কেটলীটা নিয়ে ইস্কুলের কল থেকে জল ভরতে দৌড়ল।
    জ্বলন্ত উনুনে কেটলীর জল ফুটতে আর কতক্ষন! বিশে চায়ের গেলাস বার করে গুছিয়ে ফেলল। চায়ের রঙে খয়েরী হয়ে যাওয়া ডাঁটি ভাঙা ছাঁকনি পেড়ে ফেলল অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে। দোকানে এক দুই করে খদ্দের আসছে, হারান আড়চোখে বিশের কাজের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ভেতরে তক্তপোষে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে খদ্দের সামলাতে।

    সাধারণত বিশের সবসময় মুখ চলে, কিন্তু আজ সে চুপচাপ। নীলু ডাক্তারের সাথে সাথে আরও দু চারজন আড্ডা আর চায়ের খদ্দের এসে বসেছে রোদে। সবাইকে চা দিয়ে এল বিশে, চাটুজ্যে বুড়োকেও। বুড়ো দুবেলা দু কাপ চা খায় এখেনে, মাস শেষে ছেলে এসে হিসেব মিটিয়ে যায়। মুদির দোকানের মত চায়ের জন্যেও মাসকাবারী খাতা খুলে রেখেছে হারান। শুধু দুরের পথচলতি লোকজনের সাথে নগদের কারবার।
    বিশে প্রথম চটকা চায়ের পাট মিটিয়ে একটু হায় করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে।হারানকে দিয়ে নিজেও নেয় এক কাপ চা। সঙ্গে একটা বাসী লেড়ো বিস্কুট। আড্ডায় আজ লোক কম। ডাক্তার বেরিয়ে গেল, তার সাথে সাথে অন্যান্যরা। হারান আড়চোখে সেই দিকে তাকিয়ে বিশেকে বলে,
    -"কিরে আজ কি সবারই উঠতে দেরী? কেমন খালি খালি।"
    -"এইখেনে আসবে কোত্থেকে, সব তো গে জড়ো হয়েছে মাইতিপাড়াতে।"
    হারান একটু অবাক হল। মাইতিদের কার বাড়ীতে কি আছে আজ, সে তো কিছু জানেনা। কাল রাত অবধি তো মাইতিদের সদা আর গৌর এখেনে বসে তাস পিটছিল। বিশেটাও জরুরী কথা একদমে বলবেনি, হেঁয়ালি করবে। সে ধমকে ওঠে,
    -"অ্যাই,সোজাসুজি কথা কইতে পারিসনি, দেব এক? কি হয়েছে মাইতিপাড়ায়?"
    বিশে একটু গোঁ হয়ে বলে,
    -"বলতেই তো যাচ্ছিলুম, সকাল থেকে এসে তো নি:শ্বেস নেওয়ার ফুরসত পাইনি। মাইতিপাড়ায় রামী বুড়ির ঘরে কাল চোর এয়েছিল। দুধ আনতে গিয়ে সুনলুম। বুড়ির সিন্দুকের তালা ভেঙে সব্বস্ব নে গেছে। সিন্দুক ফাঁকা। যাওয়ার সময় বুড়ির নাতির ছাইকেলটাও নেছে। বুড়ি বুক চাপড়ে চাপড়ে কানছে গো, গাঁয়ের সব মাতবরেরা এসে সান্তনা দেছে। "
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ১৬:২৩449654
  • হারান রামী বুড়িকে ছোট থেকে অমনি বুড়িই দেখছে। বুড়ির দুধ ছানার ব্যবসা। ওর বড় নাতি হারানের সঙ্গে এই প্রাইমারী ইস্কুলে পড়ত। ছেলে নেই মেয়ের ঘরের নাতি। মেয়ে মরে গেছে অনেককাল, ছোট নাতি শিবু তার পরিবার নিয়ে এখন এখানে বুড়ির কাছে থাকে। বুড়ি এখন আর এদিক ওদিক দুধ দিতে যেতে পারেনা শিবুই যায়। তবে বুড়ির জ্ঞান এখনও টনটনে, ব্যবসার হিসেব সব নিজে বুঝে নেয়। জমিজমা বাগান গাছগাছালিও নিজে ভাঙা কোমরে নুয়ে নুয়ে ঘুরে তদারক করে। সকলে বলে দুধে জল ঢেলে ঢেলে প্রচুর পয়সা করেছে কিপটে বুড়ি। একবার রায় গিন্নী রামী বুড়িকে বলেছিল,
    -"বড়ই খারাপ দুধ হচ্ছে দিদি, জ্বাল দিয়ে কিছুই থাকেনা।"
    রায়গিন্নী বড় মানুষের ঝি, বড় ঘরের বউ, কথাবাত্তাই আলাদা। মন্দ কথাও এমন ভাবে বলে শুনতে অন্যরকম লাগে। বুড়ি খরখর করে জবাব দিয়েছিল,
    -"খারাপ কি করে বল মা, পচা পখুরের জল তো আর দিই না, চাটুজ্যেদের টিপকলের জল দি।"

    তবে পয়সা থাকলেও নিজেরা থাকে খুবই সাধারণ ভাবে, শিবুটাও ভাল মানুষ, বুড়ির যত্ন আত্তি করে। কিন্তু কথা হচ্ছে বুড়ি রাতে প্রায় ঘুমোয়ই না বলতে গেলে, ওদিকে দিনে রাতে যেই যাক বাড়ির পাশ দিয়ে, বুড়ি হাঁক দেবে। বাগানে একটা কাক বসলেও বুড়ি ঠিক কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়। শিবুও বলে বুড়ি দুপুরে আর রাতে জেগে থাকে, ঘুমোয় দিনের বেলা তাও তন্দ্রামত। এমনিতে সব সময়ই সজাগ। চোর এসে তালা ভাঙল, সিন্দুক খুলল বুড়ি টের পেলনা?
    হারান কথাবার্তার ফাঁকে একবার চাটুজ্যে বুড়োকে দেখে নিল। রামী বুড়ির বাড়ি মাইতি পাড়ার শেষে,চাটুজ্যে পাড়ার শুরুতে, এই বুড়োর বাড়ীর পাশেই। এই আশু চাটুজ্যের বাড়ীর মন্দিরেই একবার চোর এসে রামী বুড়ির চেঁচানির চোটে তালা আধভাঙা ফেলে শুধু গাছের দুটো কাঁঠাল নিয়ে পালিয়ে গেসল। বুড়ো তো বোধহয় রামী বুড়ির চেয়েও বড়, এত বয়সে ঠিকঠাক ঘুম হয়?

    খগেন মন্ডল ঢুকল দোকানে,
    -"হারান, আধকিলো ময়দা আর এক পো ডালডা দিস তো। আজ গিন্নীর কি সব উপোস আছে। বিশে, তোর রাবণের চিতে তো জ্বলছে দেখছি, দে দেখি এককাপ ঐ চিরতার জল।"
    খগেন মন্ডল একটু মুখ খোলা ধরণের, কথাবার্তায় খুব একটা রেয়াত করেনা কাউকে। কারুর সাথে মতে না মিললে চেঁচামেচি তক্ক জুড়ে দেয়। এ গাঁয়ে সেই একমাত্র লোক যে আশু চাটুজ্যের বয়স একশ পেরিয়েছে মানেনা। বলে মেরেকেটে নব্বুই হতে পারে। অবিশ্যি অন্যরা তার কথা যে সবসময় মেনে নেয় তা নয়, তবে তক্ক থামাতে চুপ করে যায়। যেমন এই চাটুজ্যের বুড়োর বয়সের ব্যাপারটাই অন্য কেউ মন্ডলের কথা মানেনা।

    -"খগেন দা রামী ঠাকমার ঘরের চুরির কথা শুনেছ? যাওনি ওদিকপানে?" বিশের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে জুত করে হারানের সামনে ভাঙা মোড়াটায় বসে খগেন। দাওয়ায় এখন চাদ্দিক থেকে রোদ, কড়ামিঠে।
    -"আরে সে তো সক্কালেই শুনতে পেলুম। শিবু দুধ নিয়ে আসেনি, চা হচ্ছিলনি বলে গিন্নী দেখতে পাঠাল মাইতিপাড়ায়। গিয়ে দেখি এই কান্ড।"
    হারান উত্তেজনায় নিজের জায়গা থেকে একটু ঝুঁকে পড়ল খগেনের দিকে।
    -"তালে তো দাদা তুমি সচক্ষে সব দেখে এসছ। কি মনে হয়, কার কাজ?"
    খগেন ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে সুরুৎ করে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
    -"বলা অত সোজা নয় হে। বুড়ির ঘরের সিন্দুকের তালা খোলা বটে, কিন্তু ঘরে সিঁদ কাটাও নেই খিল ভাঙাও নয়। চোর ঢুকল কোদ্দিয়ে?"
    হারান একটু মাথা চুলকাল। বিশে হাতের কাজ থামিয়ে হাঁ করে ওদের কথা শুনছিল। খগেনের কথায় বলল,
    -"হা, বুড়ি রাতে অনেকবার বাইরে যায়, সেই ফাঁকে ঢুকে পড়েছে হবে।"
    খগেন একটু দমে গেল মনে হয়। তবু হাল না ছেড়ে বলে,
    -"চুপ কর ছোঁড়া, তুই সব জানিস। আমি মাইতিপাড়া থেকে নিধের বাড়ি গেসলুম। সে তো বাতের ব্যাথায় কাহিল। একে এই হাড় কাঁপানো শীত তায় কাল অমাবস্যা। দেখি দুয়ারে রোদে বসে হ্যারিকেনের মাথায় নুন পুঁটলি রেখে সেঁক নিচ্ছে। এ তল্লাটে আশেপাশের চোরেদের গতিবিধি নিধের নখদর্পণে। সব চুরির খবর তার কাছে থাকে। সে তো কিছুই বলতে পারলনা।"

    খগেনের কথায় এদিক ওদিকে আরো দুচারজন খদ্দের ও পথচলতি দাঁড়িয়ে পড়েছে। মধু বাগ বলে,
    -"কিন্তু কত্তা কাল রেতে চুরি হল, আজ সকালে নিধেখুড়ো কি করে জানবে। হতে পারে তার কাছে খবর পরে পশ্চাতে আসবে। আর জানলেই কি সে তুমারে বলবে গো?"
    খগেন মন্ডল গেল ক্ষেপে। উঠে পড়ে যেতে যেতে বললে,
    -"নিধে আজকের লোক নয়, সে যা বলে খাঁটি বলে। আমার সঙ্গে তার যা সম্পক্ক সে তোমরা বুঝবেনা। এলাকার চোরেদের কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে নিধেকে না জানিয়ে চুরি করতে যাবে? যাও যাও, তোমরা আজকাল বড় অবিশ্বাসী হয়ে গেছ, তাই গাঁয়ে এসব অনাচার।"

    নিধে বা নিধিরামের বয়স তা প্রায় আশির ঘরে হবে। এককালে খুব বড় চোর ছিল, এখনো আশেপাশের চোরেরা তাকে মানেগণে। লোকে বলে নিধে এমন করে চুরি করত যে চোর ছেড়ে চুরিও সহজে ধরা পড়ত না। এখন সে অবসর নিয়ে জমিজমা করে গেরস্তর মতই বাস করে। তার ছেলে এ বিদ্যা রপ্ত করতে পারে নি, গাবপুরে দোকান দিয়েছে। এই নিয়ে নিধের খুব দু:খু আছে তবে তার অনেক সাগরেদ আছে যাদের সে হাতে ধরে চুরি শিখিয়েছে। এখনো নতুন চোরেরা এসে নিধের পায়ের তলায় বসে শিক্ষে নেয়, তার আশীব্বাদ নিয়ে তবে কাজ শুরু করে।

  • Nina | 66.240.33.48 | ২২ এপ্রিল ২০১০ ২৩:৪৬449665
  • বাহ! দারুণ। খুব ভাল লাগছে পড়তে।
  • a | 208.240.243.170 | ২৩ এপ্রিল ২০১০ ১০:২৫449676
  • as usual, অনবদ্য হচ্ছে। হাত চালিয়ে শ্রাবণী দি :)
  • rabaahuta | 203.99.212.53 | ২৩ এপ্রিল ২০১০ ১৮:৪১449687
  • (উসখুস)
  • Lama | 203.99.212.53 | ২৩ এপ্রিল ২০১০ ২১:৩৯449698
  • আরো উসখুস
  • Du | 65.124.26.7 | ২৩ এপ্রিল ২০১০ ২২:৪০449709
  • তারপর?
  • rabaahuta | 203.99.212.53 | ২৬ এপ্রিল ২০১০ ১২:০৫449720
  • :-|
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৬ এপ্রিল ২০১০ ১৪:২৭449731
  • বেলা হয়ে এসেছিল। আশু চাটুজ্যে উঠে পড়ল। বিশে তাই দেখে বলল,
    -"কাকা, চল খাওয়ার সময় হই গেছে। আমায় এট্টু তেল দাও দিকিন, নাইতে যাব।"
    -"বেশীক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমাস নি যেন। বেলা থাকতে চায়ের জল চড়াস। সকাল সন্ধ্যে এইরকম দেরী করলে খদ্দের ভেগে যাবে।"

    হারান সরষের তেলের ছোট শিশিটা দাওয়ায় বের করে দিয়ে ঝাঁপ ফেলল। বিশু এক খাবলা তেল তুলে নিয়ে গায়ে মাথায় ঘষতে ঘষতে পাড়ার দিকে গেল। এ বেলা ও হারানদের বাড়িতেই খায়। খেয়ে এসে এই দাওয়াতে মাদুরের ওপর রোদে শুয়ে থাকে। হারানও দড়িতে ঝোলানো গামছাটা কোমরে বেঁধে হাতে পায়ে ভালো করে তেল মাখল। বাড়ির পথেই সদরঘাট, সেখান থেকে চানটা সেরে যাবে। ঘাটের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে হতে আলুক্ষেতের পাশের আল দিয়ে মাইতিপাড়ার দিকে পা বাড়াল।

    রামী ঠাকুমার বাড়িতে ভীড় নেই এখন আর। বুড়ি উঠোনের মাঝখানে কাপড়ের আঁচলটাকে পাকিয়ে পুঁটলি করে কোলে নিয়ে বসে আছে আর থেকে থেকেই হাঁক পাড়ছে। "ওগো কে আমার এ সব্বনাশ কোল্ল গো"। তারসঙ্গে সেই অদৃশ্য রাতের অতিথির উদ্দেশ্যে বাছা বাছা শাপশাপান্তর।
    শিবু চানটান সেরে এসে একটু উদাস হয়ে বসে আছে গোয়ালের ধারে রোদে। আজ সকালে গরু দোয়ানো হয়নি ঠিক করে, একটা গরুর দুধ বাছুরে খেয়ে গেছে। বাকিগুলো বউ যা পেরেছে দুইয়েছে। বাড়ি বাড়ি দুধ দিতেও যায়নি, সাইকেলটা নিয়ে গেছে চোর ব্যাটা। কিছু লোক বাড়ীতে এসে দুধ নিয়ে গেছে। বাঁচা দুধ দিয়ে বউ পায়েস বসিয়েছে, নতুন গুড়ের। গন্ধে বাড়ী ম ম করছে। সব দিক থেকেই নোকসান আজ!
    যা মনে হচ্ছে বুড়ির সব্বস্ব গেছে! কি যে ছিল সিন্দুকে তাও সে ঠিক মতো জানেনা। দুধ ছানা বেচে যা টাকা হয় তার থেকে ঘর খরচা তাকে দিয়ে বাকিটা বুড়ির নামে পোস্টাপিসে জমা হয়। শিবু নিজে জমা করে আসে প্রতি মাসে। বুড়ি হিসেবের ব্যাপারে খুব পাকা, শিবু হিসেব দিলেও আবার চাটুজ্যে বাড়ি গিয়ে কাউকে না কাউকে দেখিয়ে নেয়। জমিজমা বাগানের আয় বেশী নয়, সেটা অবিশ্যি বুড়ির নিজের হাতে। শিবুর আশা ছিল বুড়ির কাছে টাকাকড়ি বাগিয়ে একটা দোকান দেবে গাবপুরে, জায়গাও দেখে রেখেছিল বড় রাস্তার ধারে। মান্না দের ছোট তরফের জায়গা। শ্রীহরি মান্না দোকানঘর তুলে ভাড়া দেবে, শিবুকে বলেছিল।

    দিদিমার কাছে কথাটা তুলেছেও এক আধবার, বুড়ি রা কাটেনি। বউকে একটু দেখে রাখতে বলেছিল বুড়ির কি আছে না আছে। সেই মেয়েমানুষটাও তেমনি। কোনো যদি বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে! রোজ রাতে পায়ে তেল দেয় বুড়ির ঘরে ঢুকে তবু আজ পজ্জন্ত সিন্দুকের ভেতর কি আছে হদিশ করতে পারল না।
    নিজের বাড়ীতে বেকার বসেছিল অনেককাল, বাপের গাল খেয়ে। বউয়ের তাগাদাতেই দিদিমার বাড়ি এসে আস্তানা গেড়েছিল। সবই ভালো, শুধু বুড়ি বড়ই কিপটে, বিশেষ করে নগদ পয়সা তার হাত দিয়ে গলেনা।

    শিবু এই বেলা বড় দার্শনিক হয়ে পড়ছিল টাকার শোকে, সেই গেল যা ছিল। সময় থাকতে বুড়ি যদি সব তার হাতে তুলে দিত, আজ তার দোকান রমরম করে চলত। আর এখানে থেকে কি হবে! অবশ্য এখান থেকে গিয়ে কোথায় যাবে সেটা ভেবে পেলনা। বউকে বলতে গিয়ে মুখ ঝামটা খেল। বসে আছে কত না বাপ ভাইয়েরা বরণের থালা নিয়ে মাগনা খাওয়াবে বলে!

  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৬ এপ্রিল ২০১০ ১৪:৩৭449742
  • সকাল থেকে একের পর এক লোক আসছে, গাঁয়ের সব দিকপালরাও পদধূলি দিয়েছেন। সবারই জানার উৎসাহ কি ছিল বুড়ির সিন্দুকে! দু একজন কথাটা তুলতে গেলেই রামীবুড়ি এমন কান্না জুড়ে দিলে যে কেউ কিছুই সেভাবে বুঝলনা। শুধু এটুকু বোঝা গেল ভালোই গেছে। এখন শুধু আশেপাশের দু চারজন মেয়েছেলেরা বসে আছে বুড়িকে ঘিরে। দুটো বাচ্চা খেলছে উঠোনে শিবুর ছেলের সাথে। বউ রান্নার চালা থেকে খুন্তি হাতে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
    -"ব্যস, অম্বলটা নামলেই খেতে দিচ্ছি। এখন বেরিয়োনি যেন।"
    শিবুর বয়ে গেছে এই ভরদুপুরে বেরোতে। মাথাটা এমনিতেই ভোম্বোল হয়ে আছে। খেয়েদেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমুবে ঠিক করেছে। বিকেলে বারোয়ারীতলায় গিয়ে একবার মাতব্বরদের সঙ্গে কথা কইবে। পাঁচজনের পরামশ্যি হলে ছেলেছোকরারা যেমন বলছে কাল নাহয় থানায় গিয়ে দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করবে।

    হারান যখন রামীবুড়ির বাড়ি ঢুকল তখন বাইরের কেউই আর নেই। বুড়ি একদিকে খেতে বসেছে, পাশে শিবুর ছেলে দুধভাতের বাটি নিয়ে। শিবুর বউ দাঁড়িয়েছিল সামনে, হারানকে দেখে একগলা ঘোমটা টেনে দিল। গাঁ সুবাদে হারান তার ভাসুর হবে। শিবু তাকে দেখে একটু ম্লান হাসি হাসল।
    -"দোকান বন্ধ করে এলে বুঝি? শুনেছো তো সব?" হারানকে দেখে রামী ঠাকুমা কি বলতে যাচ্ছিল, বউ ঘোমটার মধ্যে থেকে প্রচন্ড ইশারা করতে চুপ করে গেল। ভাতের পাতে কথা বলে ফেললে খাওয়া নষ্ট।
    হারান গিয়ে শিবুর পাশটিতে বসল।
    -"কি করে হল বলত? তোরা কেউ টের টিও পেলিনি? হ্যাঁরে ঠাকমার তো সেরম ঘুমটুম নাই চোখে বলে শুনিচি, সেকি তবে গুল নাকি!"
    -"কে জানে দাদা! আমি সারাদিন এদিক ওদিক ধান্দায় ঘুরি, রেতে মড়ার মত ঘুমাই। বউ দিদমার পায়ে তেল দিয়ে, তার খই দুধের বাটি রেখে দোর ভেজিয়ে চলে এসেছিল। শীতের রাত, দরজা জানালা সব বন্ধ, আমার ঘরটাও একটেরে। সকালে বউই আগে উঠে ছড়াটড়া দিচ্ছিল। বুড়ির ঘরের দরজা খোলা ছিল, ভেবেছে বুড়ি বোধায় বাইরে গেছে। হঠাৎ শোনে বুড়ির চিৎকার, সিন্দুকের তালা খোলা, তার মধ্যে নাকি কিছু নেই।"
    -"কিছুই ছিলনা, তুই দেখলি? তালা ভাঙা ছিল না খোলা?"
    -"না:, মাল সেরম কিছু নেই, কতগুলো কাঁথাকানি, বাক্স বয়াম। তালা খোলা ছিল। চাবি বুড়ির বিছানার নীচে থাকত। তালার গায়ে চাবি লাগানো ছিল।"
    হারান খুব একটা চট বুদ্ধির লোক নয়, তবে দোকানে কাজ করেছে। খুব ধীরে হলেও পরিস্কার ভাবতে পারে। চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলে,
    -"বিছানার নীচে থেকে চাবি নিয়ে তালা খুলেছে,অথচ বুড়ির ঘুম ভাঙেনি। বুড়ি মানুষ, আপিম টাপিম খায়না, ঘুম সজাগ হওয়ারই কথা। এতো সোজা চোর নয়। তা সিন্দুকে ছিল কি কি?"
    -"সেইটি দাদা কেউ জানেনা। বুড়ি যক্ষির ধনের মতন আগলাত। ওর ঘরে আমরা বেশী ঢুকতুমনি, সিন্দুকের ধারেকাছে কেউ গেলে রেগে যেত।"
    -"গয়নাগাঁটি ছিল নাকি? তা গয়নার কথা তো বুড়ো কানা স্যাঁকরা জানবে। এ গাঁয়ে সবার গয়নাগাটি তো তারাই বাপ ব্যাটায় বানায়। তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখলে হয় নি?"
    শিবু আবার দার্শনিক হয়ে গেল।
    -"যাই থাক বাবু আমার কি কাজ। যার জিনিস সে যখন বলছেনি। সাঁঝবেলায় বারোয়ারী তলায় গিয়ে পাঁচজনের পরামশ্যি নেব, সবাই বললে থানায় গিয়ে নালিশ লিখিয়ে আসব, না বললে আমার কি?"
    -"তবু জিনিসগুলোর একটু হদিশ তো নিতে হয়, বেশী দেরী হয়ে গেলে তো সোনাদানা গালিয়ে ফেলবে। নিধেখুড়োর কাছে একবার গেলিনি কেন?"
    শিবু কপালে হাত ঠেকায়,
    -"বাপ রে, নিধেখুড়ো পাত্তা দিবে আমাদের মতো লোকেদের, গাঁয়ের মুরুব্বীরাই ওর সাথে সমঝে কথা কয়। ও যা হয় পাঁচজন পাকামাথারাই করবে। যেদ্দাও, যা হবার হবে। আমি যাই খেতে বসি বেলা হয়েছে, তোমারওতো নাওয়া হয়নি এখনো।"

    হারান চেয়ে দেখল বুড়ির খাওয়া শেষ হয়েছে, উঠোনে আঁচাচ্ছে। শিবুর বউ রান্নাদুয়ারে শিবুর খাওয়ার জায়গা করেছে। শিবু খেতে গেল। পেয়ারাতলাটায় রোদ এসেছে, বুড়ি সেখানে চাটাই টা টেনে নিয়ে গিয়ে বসেছে, বউ পান আর হামানদিস্তে সামনে ধরিয়ে দিল। হারানের দেরী হয়ে যাচ্ছিল, বাড়িতে মেয়েরা বসে থাকবে হাঁড়ি নিয়ে। তবু গুটি গুটি পায়ে দাঁড়াল গিয়ে বুড়ির সামনে। বুড়ি একমনে পান ছেঁচে যাচ্ছে। ওর ছায়া পড়তে মুখ তুলে তাকালো। ব্যস, শুরু হয়ে গেল আবার,
    -"ওরে হারান রে, আমার যে সব্বোনাশ হয়ে গেল রে, সব্বস্ব নিল রে অলপ্পেয়ে ড্যাকরা।"
    হারান কোনোরকমে চুপ করিয়ে বলে,
    -"তা ঠাকমা তুমি কিছুই জানতে পারনি, কখন চাবি নিয়েছে, সিন্দুক খুলেছে?"
    -"না রে ভাই, কি যে মরণের ঘুম ধরেছিল কাল। এমনেতে সারারাত গড়াগড়ি খাই, দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। কাল যে কি হল?"
    বুড়ি ছেঁচা পান মুখের একদিকে ঠুসে ইঁ ইঁ করে বিলাপ করতে থাকল। হারান এদিক ওদিক দেখে নেয়, কেউ এদিকে কান করছেনা, শিবু খাওয়ায় ব্যস্ত। গলা নামিয়ে বুড়ির খুব সামনে গিয়ে বলে,
    -"কি কি ছিল ঠাকমা সিন্দুকে? সোনাদানা, টাকাকড়ি কত ছিল?"
    বুড়ি একটা চোখ বন্ধ করে গলা তোলে,
    -"কি বললি দাদা, কিছুই যে ঠিকমত সুনতে পাইনি আজকাল। বুড়োমানসের পিঁপড়ের ধন সেও নিয়ে গেল মরণদশারা, নরকেও যে ঠাঁই হবেনি ওদের।"
    আবার গুনগুনিয়ে শাপশাপান্ত শুরু। হারান বুঝল ধড়িবাজ বুড়ি শুনতে পেলেও বলতে চাইছেনা যে কারনেই হোক। সেও আর বাক্যব্যয় না করে বাড়ির দিকে রওনা দিল, শুধু খটকা কিছু রয়েই গেল। বুড়ির কাল রেতে অমন ঘুম ধরল কেন আর এমন কিই বা ধনসম্পদ ছিল বুড়ির? বিশাল কিছু জমিজমা বা টাকাকড়ি আছে বলে এদের এমনটা তো শোনেনি কখনো!
  • Nina | 64.56.33.254 | ২৭ এপ্রিল ২০১০ ০০:২৬449754
  • দারুণ ! আবার কি এক week অপেক্ষা করতে হবে পরেরটার জন্য?
  • de | 59.163.30.4 | ২৭ এপ্রিল ২০১০ ১৬:৩৩449765
  • খুব সুন্দর, শ্রাবণী! একটু হাত চালিয়ে হোক!
  • M | 222.254.179.174 | ২৭ এপ্রিল ২০১০ ২১:৫৩449776
  • তারপর?
  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৯ এপ্রিল ২০১০ ০৯:৫১449785
  • খগেন মন্ডল খেয়েদেয়ে খামারে গিয়ে রোদে চাটাই পেতে শুয়েছিল। ঘর থেকে কড়া ঘিয়ের গন্ধ বেরোচ্ছে, মেয়েদের উপোসের লুচি ভাজা হচ্ছে। খগেনের ডালডায় অম্বল করে, গন্ধেই গা কেমন করে, তাই সে খামারে এসে শুয়েছে। শুয়ে শুয়ে রামী খুড়ির বাড়ির চুরির কথাই ভাবে। খুড়ির সঙ্গে ওর মায়ের সই পাতানো। তাই অনেক ছোটোবেলা থেকেই ওর মাইতিবাড়ীতে যাতায়াত। ওদের অবস্থা খুবই সাধারণ ছিল। খুড়ো একেবারেই গোছানো ছিলনা। খুড়িই বাগানটাগান করে দুধ বেচে একটু একটু করে টাকাপয়সা জমাত। মেয়ের বিয়ে দিতেও বেশ কিছু খরচ হয়েছিল। খুড়ো মরার পর খুড়ি তেড়েফুঁড়ে ব্যবসায় লাগে। দুধের সাথে সাথে দই ছানা, বাগানের ফলমূল, নানারকম চাষ, আলু কলাই এসব করে করে দুপয়সা করে। এমনিতে কিপটেও খুব, হাত দিয়ে এক পয়সা গলেনা। কোনোদিন কিছুতে চাঁদা দেয়না। বারোয়ারী কালী পুজোতে খগেন গেলবারে সেক্রেটারী ছিল। একমাস ধরে চটি ঘসে ঘসে বুড়ি শেষে একটা টাকা চাঁদা দিলে!

    তবে এসব করে বুড়ি কত পয়সাই বা করেছিল! এই গাঁয়ে অনেক বড়লোক আছে, রায়বাড়ী বোসবাড়ীতে, চাটুজ্যেরা। সবাইকে ছেড়ে চোর রামীখুড়ির বাড়ী ঢুকল, এটা খগেনের ঠিক মন:পুত হচ্ছিলনা।
    না: ঘুমটা আজকে বরবাদ মনে হচ্ছে, একে এই ডালডার গন্ধ তার উপরে গাঁয়ে চুরি। কিছুক্ষণ উশখুস করে খগেন উঠে বসল। হাঁক দিয়ে মেয়েকে জল দিয়ে যেতে বলল। জল খেয়ে ভিতর বাড়ীতে গিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকল। মায়ের আবার শীত খুব বেশী, কুঁকড়ে মুকড়ে তিনখানা কাঁথার তলায় ঢুকে বসে আছে এই দুপুরেই। সকালের দিকে নাতির হাত ধরে একটু ঘরের বাইরে যায়। চান খাওয়া সব ধরে করাতে হয়। খাওয়া হলেই আর বসেনা, ঘরে ঢুকে পড়ে। বয়স রামী বুড়ির মতই হবে, কিন্তু রামীবুড়ি এখনো অনেক ডাঁটো আছে।

    মা শুয়েছিল, খগেনকে দেখে উঠে বসল তক্তপোশের উপর। খগেন দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বুড়ি কানে ভালো শোনেনা, চেঁচিয়ে কথা বলতে হয়, খোলা দরজা দিয়ে কে শুনতে পাবে!
    মা একটু ফোকলা দাঁতে হাসল,
    -"কি রে তুই আজ ঘুমুস নি? আড্ডায় না গিয়ে মায়ের কাছে যে বড়?"
    খগেন একটু গম্ভীর হয়ে মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল,
    -"মা,সইমার বাড়ি যে চুরি হয়ে গেছে গো।"
    -"অ্যাঁ, কি বললি? কি হয়েছে?"
    -"চুরি গো চুরি। রামী খুড়ি মানে তোমার সই মাইতিপাড়ায়, তার ঘরে।"
    -" মাইতিদের রামী? মানে সই। তার কি হোল, মোল নাকি? আহারে, এত তাড়াতাড়ি মরে গেল আর আমি এই পোড়া শরীরে এখনো বেঁচে আছি। হে ভগবান।"
    বিলাপ শুরু হয়ে গেল। খগেন মহা বিরক্ত হয়ে আরও গলা তুলল,
    -"মরবে কেন, দুর। তার বাড়ি চুরি হয়ে গেল, চোর রাতে এসে সিন্দুক খুলে সব নিয়ে চলে গেছে।"
    এতক্ষণে মা বুঝতে পারল। প্রথম চটকায় একটু চুপ করে ঝিমুতে থাকল। তারপরে হঠাৎ জেগে উঠে বলল,
    -"সিন্দুক খুলে সব নিয়ে গেছে বললি? সব গেছে, কিছুই নেই?"
    এবার খগেন সজাগ,
    -"মা, সইমার সিন্দুকে অনেক গয়নাগাঁটি ছিল না?"
    মা একটু যেন অন্যমনস্ক, ভাবনায় ডুবে গেছে। প্রশ্নটা আবার করতে একটু চিন্তা করে বলল,
    -"গয়নাগাঁটি আবার কোথায়? ঐ তো হারছড়াটা আর বালা দুটো। এছাড়া দু চারটে কানপাশা, একটা দুটো আংটি, সোনার চিরুনী। বাকি সব তো মেয়ের বিয়েতে গেছে। নতুন গড়ানো বলতে ঐ কানেরটানের দু চারটে। তা ডিবেটাও নিয়ে গেছে?"
    -"ডিবে, কিসের ডিবে?"
    -"গুরুদেবের দেওয়া ডিবে?"
    খগেন অবাক হল। এরকম কোনো ডিবের খবর তো কিছু জানেনা, শোনেওনি কোনোদিন।
    -"কি ছিল মা সে ডিবেতে?"
    মা ঠোঁট উল্টোলো,
    -"কে জানে বাবু, সে কি আমিও জানি। একবার মেয়ের বিয়ের পরে সই আর ওর বর কুথায় যেন তিত্থি করতে গেসল, পচ্চিমের দিকে। সেইখেনে এক সাধুর সঙ্গে ওদের দেখা হয়। তার কাছে ওরা মন্তর নেয়। সেই গুরুদেব ওদের একটা মন্তর পড়া ডিবে দিয়েছিল সইকে। গোল রুপোর ডিবে, রঙীন পাথর বসানো। ভিতরে কি ছিল খুলে দেখায়নি সই, বারণ ছিল। দত্যি দানোটানো হবে,বলেছিল গুরুদেব সামলে রাখতে বলেছে, এ হারিয়ে গেলে নাকি অমঙ্গল হবে।"

    একে নিজের মা তায় কানে শোনেনা বুড়ো মানুষ, খগেন তক্ক করতে গিয়ে সামলে নিল। দত্যি দানো সাধুর ডিবে, যত্তসব! একি যাত্রা কাহিনী নাকি, কি শুনতে কি শুনেছে মা কে জানে!
    শাশুড়ীর চা নিয়ে বউ ঢুকল ঘরে, খগেন আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে গিয়ে চা খেল, তারপরে গরম চাদরটা গায়ে মাথায় জড়িয়ে বারোয়ারী তলার দিকে হাঁটা দিল।

  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৯ এপ্রিল ২০১০ ১০:০৭449786
  • শীতের বাজারে বিকেলের দিকে চায়ের দোকানে ভীড় হয় বেশ। হারানও মুদিখানা ছেড়ে বিশের সঙ্গে হাত লাগায়। আজ হারানের একটু হাতের কাজ মিটিয়ে বিশের হাতে দোকান ছেড়ে বারোয়ারীতলার দিকে যাবার ইচ্ছে ছিল। রোজ সেখেনে কর্তারা বসে, নানা গুরুগম্ভীর আলোচনা চলে। তবে ছেলেছোকরারা খুব একটা সেই আলোচনায় থাকেনা, পাকামাথাদের ভীড়ে। হারানের বয়সীরাও কোনো বিশেষ কিছু না থাকলে ওদিকে পা দেয়না।
    কিন্তু আজ ব্যাপার অন্য। আজ রামী ঠাকুমার চুরি নিয়ে আলোচনা হবে তাই হারান থাকতে চায়। সে বিশেকে তাড়া মারে। অনেক খদ্দের আসছে, গাঁয়ের কেউ কেউ, ভিনগাঁয়ের পথিক। চা ছাঁকতে ছাঁকতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল চাটুজ্যে বুড়ো রোজকার মতই বসে চা খাচ্ছে বিস্কুট দিয়ে, তার পাশে একটা কালো মতন পাকানো চেহারার খেঁকুড়ে মার্কা লোক বসে আছে চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে। লোকটাকে আগে কোনোদিন দেখেছে বলে মনে হলনা হারানের। লোকটার আপাদমস্তক একটা ছাই রঙের আলোয়ানে মোড়া, মুখটা শুধু বেরিয়ে আছে ,চোখগুলো ছোট কুতকুতে। এরকম দেখতে লোক হারানের কেন জানিনা খুব গোলমেলে লাগে। লোকটা আশু চাটুজ্যেকে কি যেন বলছে, তবে বুড়ো রোজকার মত একইভাবে বসে চা খেয়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে, কান করছে বলে মনে হয়না।

    হাত খালি হতে হারান মুদিখানায় বসতে গেল। সন্ধ্যে হয় হয়,এমনিতে এ সময় ঐদিকে ভীড় তেমন হয়না কারণ সন্ধ্যেবেলায় ধারের কারবার চলেনা। তবু আজ বেশ ভীড়। আস্তে আস্তে চায়ের দোকানের ভীড় হাল্কা হচ্ছে, শুধু সদারা একদিকে তাস পেতেছে। পালেদের অমিয় হারানের বন্ধুলোক, এতক্ষন চা খাচ্ছিল। শেষ করে চারিদিকে একবার দেখে নিয়ে হারানের কাছে এল। খদ্দের চলে যেতে, গলা একটু নামিয়ে বললে,

    -"চাটুজ্জ্যে দাদুর সঙ্গে ঐ লোকটা কে রে? চিনিস, কুটুম নাকি ওদের?"
    হারান আর একবার লোকটাকে দেখে নিয়ে ঘাড় নাড়ে,
    -"না:। দেখে তো চাটুজ্যে বাড়ির কুটুম বলে মনে হয়নি। জামাকাপড় দেখেছিস, এরকম ময়লা চাদরজামা কেউ কুটুমবাড়ীতে পরে? তাছাড়া বুড়ো তো একা যেমন আসে রোজ বিকেলে তেমনই এসেছিল। সঙ্গে তখন কেউ থাকলে নজরে পড়ত।"
    অমিয় মুখ দিয়ে একটা শিষের মতো আওয়াজ বার করে,
    -"উহুঁ, দিনকাল ভালো নয়, নতুন লোকজন চোখে পড়লে একটু সাবধান হওয়া ভালো। কাল যা কান্ড টা হল গাঁয়ে। লোকটা যদি পথচলতি হয়ে থাকে তো চা খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাবে, এর যেন মনে হয় ওঠবার গরজই নেই। আর ঐ মৌনীবাবার সাথে একতরফা গুনগুনিয়ে কি কথা বলে যাচ্ছে তখন থেকে!
    যাক, আমি বারোয়ারীতলায় যাচ্ছি, তুই ও চলনা। ওখেনে সবাই থাকবে, এই লোকটার খোঁজখবর করা যাবে। "
    হারান বিশুকে হাঁক দিয়ে অমিয়কে বলল,
    -"দাঁড়া, আমিও যাব। বিশু চায়ের পাট তুলে দিক, দোকানে ওকে বসিয়ে যাব, এখনি হয়ে যাবে।"

    দুজনে গল্প করতে থাকল, কিছুক্ষণ পরে বিশু হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল। হারান তক্তপোষ থেকে নেমে এল, বিশু উঠে বসল। বিশেকে বলল রাত হলে সে যেন দোকান বন্ধ করে ঘরে চলে যায়, শীতের রাত। বারোয়ারীতলায় আজ দেরী হতে পারে। ভালো করে চাদর জড়িয়ে দুই বন্ধু দাওয়া থেকে রাস্তায় নামতে গিয়ে দেখল আশু চাটুজ্যের ছোটনাতি শংকু আসছে দাদুকে নিয়ে যেতে। ওরা অবাক হয়ে আরও দেখল যে সেই লোকটা নেই কোথাও, বুড়ো একা বসে। ওরা গল্পে মত্ত ছিল, খেয়ালই করেনি লোকটা কখন চলে গেছে।
  • de | 59.163.30.3 | ২৯ এপ্রিল ২০১০ ১৩:৫৫449787
  • গল্পটার ডিটেলগুলো অপূর্ব!
  • Du | 65.124.26.7 | ২৯ এপ্রিল ২০১০ ২৩:০৬449788
  • সেটাই তো, এমন লেখা , মনে হয় যেন ঘটতে দেখছি
  • Nina | 76.124.208.64 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ০৫:৩২449789
  • একেবরে নিঁখুত লেখা ---সবকিছু যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি-----অপেক্ষাটা বেশ কষ্টকর :-((
  • Tim | 71.62.121.158 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ০৭:৩৫449790
  • দারুণ। একসাথে পুরোটা পড়লাম।
  • Samik | 122.162.75.44 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ০৯:০০449791
  • দেকেচো? আমাদের নয়ডাতে কী সব জিনিস থাকে? রত্ন, রত্ন।
  • de | 59.163.30.3 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ১২:১০449793
  • জিনিস বল্লো!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন