এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৫৯৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Manish | 117.241.228.251 | ১২ মে ২০১০ ১৮:০৭449827
  • তারপর???????????????????????????????????????????????????????????
  • rabaahuta | 203.99.212.53 | ১৩ মে ২০১০ ১৮:৩৩449828
  • :-|
  • a | 122.167.240.47 | ১৬ মে ২০১০ ০১:২৯449829
  • তাড়া দে গেলুম
  • shrabani | 124.30.233.102 | ১৭ মে ২০১০ ১২:০১449830
  • সকাল সকালই সাইকেল নিয়ে তদন্তে বেরিয়ে পড়ল ঘন্টা দারোগা, সঙ্গে আর একটা সাইকেলে মাণিকজোড় রাম আর মানিক। উৎসাহে কারোর কোনো খামতি নেই। গাঁয়ের পথে প্রথম কানাই জেলের সাথে দেখা। দারোগা তাকে দেখেই সাইকেল থামিয়ে বলল,
    -"হ্যাঁরে, চোরটার কি দাড়ি গোঁফ ছিল? পোশাক কিরম পরেছিল বল তো মনে করে, ধুতি না লুঙ্গি?"
    কানাই আগের রাতে তাড়িটা একটু বেশীই টেনেছিল, খোঁয়ার তখনও কাটেনি, দুচোখ জবাফুলের মত লাল। একটু তেড়িয়া হয়ে দারোগার দিকে এগিয়ে গেল,
    -"কি বললেন, আমি চোর? আমি রাসু জেলের ছেলে কানাই, আমি করব পরের দব্ব চুরি! এরম অনেয্য কথা কইলে দারোগা বলে মান দেখাতে পারবুনি বলে দিচ্ছি।"
    কানাইয়ের ঐ মারমুখী ভঙ্গী দেখে ঘন্টা ও তার সাগরেদরা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। সবাই মিলে এরপর খুব বাবা বাছা করে কানাইকে শান্ত করতে লাগল।
    সে তবু চটেই রইল, জাল তুলে গজগজ করতে করতে নিজের পথে চলল, "ওরম ঢের ঢের দারোগা দেখা আছে।"
    দারোগা এঘটনায় একটু দমে গেলেও উৎসাহ হারায়না। পথে আরো দু একজনকে ধরে চুরি সম্বন্ধীয় নানা সাধারণ প্রশ্ন করে ফেলল।
    "ছিঁচকে চোর আর পাকা চোরে তফাত কি? ডাকাত কে ডাকাত বলা হয় কেন, বড় চোর বলে না কেন?" ইত্যাদি।

    এরকম করতে করতে বেশ একটু সময় লেগে গেল শেষমেশ হারানের দোকানে পৌঁছতে। পৌঁছনো মাত্র বিশে চা এনে হাজির করতে বেশ খুশীই হল তিনজনে। চা খেয়ে টেয়ে দোকানের চারধার ঘুরে ঘুরে ভালো করে দেখল। সারা মাঠে চক্কর লাগালো, স্কুলঘরের আশপাশ অবধি উঁকিঝুঁকি মেরে এল। তারপরে শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। ততক্ষনে পুলিশ আসার খবর পেয়ে বেশ দু চারজন মজা দেখতে জড়ো হয়েছে। ঘন্টা জমিয়ে বসে হারানকে ডেকে বলল,
    -"তা হারান, লোকটা যখন তোকে মারল তখন তাকে দেখেছিলি, কেমন দেখতে?"
    -"আজ্ঞে, অন্ধকার ছিল, তাছাড়া মারল তো আমার পিছন থিকে, আমি দেখব কেমন করে?"
    ঘন্টা একথায় ছ্যা ছ্যা ছো ছো জাতীয় নানাবিধ আওয়াজ মুখ দিয়ে বার করে বলল,
    -"কথায় বলে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, তোর তো দেখছি বুদ্ধি কমেছে র‌্যা। পিছন থেকে মারল যখন তখন ঘুরে দাঁড়াবি তো, তাহলেই দেখতে পেতিস। ছি: ছি:। এবার যদি আমি তোকে চোরকে সাহায্য করার অপরাধে গ্রেফতার করি তখন? পারি তো নাকি?"
    বলে একটা বেশ আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে আশেপাশে তাকালো।
    হারান ও অন্যরা প্রায় অভিভূত হয়ে গেল এধরণের উচ্চকোটির ফন্দি শুনে। দু চারজন বিচক্ষণ যারা ছিল গলা নাক প্রভৃতি ঝেড়ে এক পা দু পা করে মানে মানে কেটে পড়ল। তাদের পিছু পিছু অন্যরাও।
    খগেন মন্ডলও ছিল সেখানে। সেও অন্যদের পথ ধরতে গিয়েও কি ভেবে একটু দাঁড়িয়ে দারোগাকে বলল,
    -"আপনি দারোগাবাবু এখানে বেশী সময় নষ্ট না করে শিবুদের বাড়ী যান, মাইতিপাড়ায়। রামী খুড়ি কে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করুন। চোর এসে তার বালিশের তলা থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে সাফ করল আর সে টেরটি পেলনি, এ আবার কি অনাছিষ্টি! এছাড়া সিন্দুকে ছিলই বা কি। " কথাটা বলেই সে টুক করে রাস্তায় নেমে গেল।

    দারোগা একটু গম্ভীর হয়ে এদিক ওদিক তাকালো। দোকানে এখন হারান, আশু চাটুজ্জ্যে আর বিশে ছাড়া আর কেউই নেই। তাও বিশে দাওয়া থেকে নেমে দুরে একধারে বাঁশের খুঁটিটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে তৈরী হয়ে, দারোগা ডাকলেই চোঁ চা দৌড় দেবে। দারোগাও বোধহয় খগেনের কথামত শিবুর বাড়ি যাওয়াই ঠিক করল তবে একেবারে সঙ্গে সঙ্গে না গিয়ে চাটুজ্জ্যে বুড়োর দিকে গেল।
    -" তা দাদু, আপনি তো রোজ দিন রাত এসে এই দোকানের দাওয়ায় বসে থাকেন, দোকানের চোরটাকে কোনোদিন দ্যাখেন নি? একটু মনে করে বলুন দেখি?"
    হারান একটু কৌতূহলী হয়ে কান খাড়া করে রইল। যদি দারোগাকে দেখে বুড়ো আবার কিছু বলে। কিন্তু না, আশু বাবু আর মুখ খুললেনা। দারোগা একটু জেদ ধরে তাকে নানা প্রশ্ন করে গেল,
    "সেদিন রাতে হারানকে যখন মারল, আপনি কোথায় ছিলেন? হারান কে যেভাবে মেরেছে তাতে চোরের বয়স কিরকম হবে বলে মনে হয়? আপনার বয়স এই মাঘে কত হোলো? চা দিয়ে সেদিন আপনি কি বিস্কুট খেয়েছিলেন?" ইত্যাদি।
    বুড়ো কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
    দারোগা ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে শেষে হারানকে ধমকাল,
    -"আমাকে না জিজ্ঞেস করে গাঁ ছেড়ে কোথাও যাবিনা"
    এই বলে সদলবলে মাইতিপাড়ার দিকে রওনা হল।

  • shrabani | 124.30.233.102 | ১৭ মে ২০১০ ১২:২১449831
  • প্রাইমারী ইস্কুলে আজ ইন্সপেক্টরের আসার কথা। হেডমাস্টার গাঁটু দত্ত আজ সকাল থেকে তাই খুব ব্যস্ত। মুশকিল হল কিছুদিন আগে শীতের শুরুতে ঝড়বৃষ্টি হয়ে দুটো ঘরের মাথার চাল একেবারে গেছে। গেল বর্ষায় সারানো হয়নি, ইস্কুল বোর্ডের টাকা পেয়েছিল কিন্তু নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি, টাকা খরচ হয়ে গেছে। সেসব হিসেব দিতে হবে এখন। থ্রি আর ফোরের ক্লাস তাই দুয়ারে বা কখনো মাঠে রোদে হচ্ছে। আজ দুয়ারে বেঞ্চি পাতা হয়েছে।
    এদিকে তাকে নিয়ে তিনজন মাস্টার। তারমধ্যে আবার একজন ছুটি নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। ইন্সপেক্টরের সারপ্রাইজ ভিজিট, পর্শুই জানা গেছে। গতকাল সব ছাত্রছাত্রীদের পইপই করে পাখিপড়া করিয়েছে নানা প্রশ্নোত্তর, সবাইকে ভালো জামাকাপড় পরে আসতে বলেছে। নিজে সাতসকালে ফর্সা ধুতি পাঞ্জাবী পরে এসেছে। পিওন কাম দারোয়ান কাম সবকিছু হারু কে দিয়ে অফিসঘর বার বার মোছাচ্ছে। হারু বেশ বিরক্ত, এত খাটুনিতে অভ্যস্ত নয় সে, গজগজ করছে সমানে। নতুন সিগারেটের প্যাকেট আনা হয়েছে, বাড়ি থেকে শরবৎ এসেছে জগ ভরে, পান সাজা হয়ে আছে। হারানের দোকানে বলা আছে হারু গিয়ে বললেই ভাল কাপ প্লেটে চা আর দামী বিস্কুট পাঠাবে।

    সব নিজে দেখেশুনে তদারকি করেও বুকের ধুকপুকানি কমছে না গাঁটুর। এক এক করে ছাত্রছাত্রীরা আসছে। সেকেন্ড মাস্টার সব ক্লাসে ঘুরে ঘুরে ছেলেমেয়েদের চুপ করাচ্ছে। সব মিলিয়ে উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গে!
    বেলা বারোটা নাগাদ একটা জিপে করে মোরামের লাল ধূলো উড়িয়ে গোলগাল ফর্সা ইন্সপেক্টর এল, পরণে খাকি প্যান্ট আর সাদা জামা। তার সঙ্গী একজন বেঁটে রোগা বয়স্ক ধুতি পাঞ্জাবী পরে, গম্ভীর আমাশারোগীর মত মুখ। হাতে তার অনেক খাতা পত্র। আরো স্কুল ঘুরে ঘুরে আসছে ওরা। শরবৎ চা পান সব দিয়ে আপ্যায়ন করার পর ইন্সপেক্টর ক্লাস দেখতে চাইলে। তার সঙ্গী বসলে স্কুলের খাতাপত্র নিয়ে।
    গাঁটু প্রথমেই নিয়ে গেল ক্লাস ফোরে, একটু বড় বাচ্চা সব, ভয়টয় পাবেনা। পালেদের বিলে ক্লাসের ফার্স্ট বয়, চালাকচতুর। গাঁটু ইশারা করল, আগে থেকেই শেখানো ছিল, কিছু জিজ্ঞেস করলে বিলেই উঠে দাঁড়াবে। দু একটা মুখে মুখে অঙ্ক ঠিক বলে দিল। আরো দু একজন দু তিনটে টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। গাঁটুর মুখটা প্রায় হাসি হাসি হয়ে গেসল। কিন্তু ট্রানস্লেশনে এসেই গন্ডগোল হয়ে গেল। সঠিক উত্তর পেয়ে পেয়ে ইন্সপেক্টরের মুখ থমথম করছিল, খুব ভেবে চিন্তে ইংরেজী করতে দিল, "আমাদের গ্রামের প্রবেশপথে যে বটগাছটি আছে তাতে অনেক পাখি এসে বাসা বেঁধেছে"। বিলে ঠেকে ঠেকে দু চারটে শব্দ "ভিলেজ", "বার্ড" আউড়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়েও শেষ রক্ষা হলনা।

    পরিদর্শক মহা খুশী, ক্লাসের মনোবল ভেঙে দিতে এটুকুরই দরকার ছিল। এরপরে জৈন ধর্মের প্রবর্তক জিজ্ঞেস করাতে "মহাবীর" বলে জিভ কেটে ফেলতে তিনি ক্ষান্ত দিয়ে হাসতে হাসতে অফিসঘরের দিকে চললেন, পেছন পেছন গাঁটু ছেলেদের দিকে একবার বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।ইন্সপেক্টর এতই তৃপ্ত নিজের বুদ্ধিমত্তায় যে খাতাপত্র দেখায় আর তার উৎসাহই রইলনা। এর ফলে চাল ছাওয়ানোর কারচুপিটা ধরা পড়ার আগেই সব গুটিয়ে পরের স্কুলের দিকে রওনা হলেন।

    গাঁটু প্রথমেই সেকেন্ড মাস্টারকে ডেকে প্রচুর বকাবকি করল ঠিক করে পড়ায় না বলে। সে দু একবার বলার চেষ্টা করল যে সে তো অঙ্ক করায়, ইংরেজী গাঁটু নিজেই শেখায় কিন্তু বকুনির তোড়ে তার আওয়াজ শোনা গেলনা। ক্লাস ফোরে গিয়েও একটু ঝাল ঝাড়ল এত সামান্য ট্রানস্লেশন না করতে পারার জন্য। ছাত্রছাত্রীরা মুখ নীচু করে বকুনি খেল, শুধু শেষে বিলে জিজ্ঞেস করল "স্যর, বটগাছের ইংরেজীটা কী হবে?" এতে গাঁটু আরো রেগে গিয়ে বিলের কান ধরে টেনে দিয়ে স্কুলই ছেড়ে বেরিয়ে গেল। হারুও ঢনঢন করে ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দিল।

    হাঁটতে হাঁটতে কখন গাঁয়ের শেষে বা ঢোকার মুখে এসে গেছে খেয়াল করেনি। শ্মশানের ধারে ধর্মতলার বটগাছটা দেখে মনে পড়ল সে বাড়ি যেতে গিয়ে ভুল করে এখানে এসে গেছে। গাছটার তলাটা বাঁধানো, চারিদিকে মাটির ঘোড়া আস্ত ভাঙা ছড়ানো। ধর্ম ঠাকুরের পুজোর দিনে এখেনে খুব ভীড় হয় বৌ মেয়েদের। গাঁটু এতটা পথ চলে একটু হাঁপিয়ে উঠেছিল, তাই একদিকে ছায়ায় বসল। যদিও বটগাছ ছায়াটায়া ভালই দেয়, পাখিরা বাসাও বাঁধতে পারে তবু আজ এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল এখানে বটগাছ না হয়ে একটা আমগাছ থাকলেই ভাল হত। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোরেই বলে ফেলল,
    -"এখানে এই বটগাছটা না থেকে যদি একখান আমগাছও থাকত।"
    -"সেটা কিরকম হত কর্তা, ধম্ম ঠাকুরের থানে বটগাছের জায়গায় আমগাছ?"

    গাঁটু চমকে উঠল। কখন যে একটা লোক এসে পাশে বসেছে টেরও পায়নি সে। লোকটাকে সে আগে দেখেছে বলে মনে হয়না। যাইহোক তার মনের অবস্থা বেশ সুবিধের নয়, ইস্কুলটা টিকলে হয়। লোকটা গলায় দরদ ঢেলে বলে,
    -"তা ইনিসপেকশন বোধহয় সুবিধের হলনি, না মাস্টারবাবু?"
    গাঁটু আর সামলাতে পারলনা।
    -"আচ্ছা, এই গাঁয়ে ঢোকার পথে বটগাছ হওয়ার দরকার কি ছিল বল তো? আর যদি তাই থেকেই থাকে, ঠাকুরের ব্যাপার একটা, ওনাদের এদিক দিয়েই বা প্রবেশ করতে হবে কেন? ওরা উল্টোদিক দিয়েও তো গাঁয়ে ঢুকতে পারত।"
    লোকটা খুব বিচক্ষণের মতো ঘাড় নাড়াতে থাকল।
    -"কিন্তু শহর থেকে আসতে গেলে তো এদিক দিয়েই আসতে হবে। নাহলে ওদের এখান দিয়ে ঢুকে গাঁ পেরিয়ে ঐদিকের ইস্কুল গুলো সব সেরে নিয়ে ফিরতি পথে আপনের ইস্কুলে ঢুকতে হত। সে হলে তখন উল্টোদিকই সোজাদিক হত।"
    গাঁটুর খুব মনে ধরল কথাটা।
    -"তবে? তুমিই বলো, এরকমটাও তো হতে পারত। সব আসলে অন্য ইস্কুলগুলোর ষড়যন্ত্র।" লোকটা একটু ভেবে বলল,
    -"ওদিকে আবার তো গাবগাছ। তা মাস্টারবাবু, গাবগাছের ইংরিজীটা জানা আছে তো?"
    গাঁটু একটা বিষদৃষ্টি হেনে এই প্রথম বোধহয় লোকটাকে ভালো করে খেয়াল করল। কালো, রোগা, বদমাইশের মতো চোখ!
    -"তুমি কে হে? আগে তো কখনো দেখিনি এ গাঁয়ে?"
    লোকটা দেখল গাঁটু খেপেছে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলল,
    -"আমি এ গাঁয়ের লোক নই তো দেখবেন কেমনে? পথে যেতে যেতে একটু জিরুতে বসেছিলুম। যাই দেরী হয়ে যাচ্ছে।"
    গাঁটু তাকিয়ে রইল লোকটার যাবার পথে। ঠান্ডার দিন,রোদে কষ্ট নেই তেমন। বটের ছায়ায় জিরুতে বসবে কেন লোকে, হারানের দোকান ছেড়ে! আর ইন্সপেকশনের কথা এত জানলই বা কেমন করে? গাঁটুও উঠে পড়ল, এবার আর বাড়ির রাস্তা ভুল করল না, তবে এখন মাথায় ইস্কুলের চিন্তা ছেড়ে ধর্মতলায় দেখা লোকটার কথাই মনে হতে থাকল।
  • r.h | 203.99.212.54 | ২৪ মে ২০১০ ১১:৪৯449832
  • :-|
  • Nina | 64.56.33.254 | ২৬ মে ২০১০ ০০:২১449833
  • কত দেরী আর কত দেরী বল মা-----
  • jayanti | 59.178.35.201 | ২৬ মে ২০১০ ১৭:০০449834
  • শ্রবণী, অন্য কাজ বাদ দিয়ে শুধু লিখে জাও,প্লীজ।
  • jayanti | 59.178.129.223 | ২৬ মে ২০১০ ১৭:০৩449835
  • শ্রাবণী,যাও।
  • JAYANTI | 122.163.208.60 | ২৭ মে ২০১০ ২২:৫৬449837
  • ও শ্রাবণী, কি হোলো? একটু সময় কোরে লেখো না গো ও ও ও!
  • Nina | 64.56.33.254 | ০৩ জুন ২০১০ ০২:২২449838
  • গল্পটারও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যাথা হয়ে গেল যে ----ও শ্রাবণী, কোথায় গেলে?

  • shrabani | 124.124.244.109 | ০৩ জুন ২০১০ ০৯:৩২449839
  • নীনা,
    আমি একটু বেকায়দায়, শরীরগতিক ঠিক ছিল না। মাথার মধ্যে গজগজ করলেও লিখে উঠতে পারছিনা। দু তিনদিনের মধ্যেই আবার শুরু করব।
  • shrabani | 124.124.86.102 | ০৭ জুন ২০১০ ১২:৩১449840
  • ঘন্টা দারোগা সারাদিন ধরে ঘুরে ঘুরে অনেক তদন্ত করল। লোকজনকে ধরে ধরে নানা প্রশ্ন করল, ঝোপঝাড় বনবাদাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে সূত্র খুঁজল কিন্তু চোরের বা চুরির হদিশ করতে পারলনা। মাইতিপাড়ায় শিবুদের বাড়ীও গেল। শিবু গরম গরম খাঁটি দুধ দিয়ে খাতির যত্নও মন্দ করলনা কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলনা।
    রামীবুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যেতেই সে এমন হাহাকার আর কান্না জুড়ে দিলে যে দারোগা তাকে বেশী ঘাঁটানো সমীচিন মনে করলো না। সব মিলিয়ে আজ দারোগা আসায় গাঁয়ে হুলস্থূল কান্ড!
    কিছু লোক মজা পেল আবার কেউ কেউ বিরক্তও হল।
    মহেন পালকে যখন বিভিন্ন লোকে দারোগার কীর্তিকলাপের কথা বলল, সে শুধু গম্ভীর হয়ে ঘাড় নাড়তে থাকল, কিছু মন্তব্য করলনা।

    বেলা হয়ে আসছিল, দুই কনস্টেবল উসখুস করছিল। এত ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত তারা, খিদেও পেয়েছে জবর। ঢের হয়েছে তদন্ত, এবার ফিরলেই হয়। সাহস করে শেষমেশ বলেই ফেলে রাম,
    -"বাবু, ওনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আবার গিয়ে খানা পাকাতে হোবে। এবার ফিরা যাক।"
    মাণিক তার সঙ্গে জুড়ে দেয়,
    -"বাবু পিসীমা রাগ করবেন রাঁধা খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে। আজকে আবার বোধহয় কাঁকড়া আর পাকা রুই রেঁধেছেন, সকালে সেইরকমই ব্যবস্থা হচ্ছিল দেখলাম।"
    এই একটি কথায় ঘন্টা একেবারে বাস্তবে ফিরে এল। সে নিজে একটু খাদ্যরসিক বলে তার জন্য পিসী রোজ দুবেলা হরেক রকম পদ রেঁধে থাকে । আর সময়মত বাড়ী গিয়ে সেসব না খেলে কুরুক্ষেত্র বাঁধায়। আজ সকাল থেকে তদন্তে ব্যস্ত থাকায় সে নাওয়াখাওয়ার কথা ভুলেই মেরে দিয়েছিল।এখন মনে পড়তেই খিদেয় পেট চোঁ চা করতে লাগল।

    এতক্ষন সাইকেল ঠেলে ঠেলে ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে ঘুরছিল তারা। এবার সে তড়িঘড়ি সাইকেলে চড়ে বসল। বেশ স্পীডে বাড়ির দিকে গাড়ী ছোটাল। দেখাদেখি রাম আর মাণিকও সাইকেলে উঠল।
    তাড়াহুড়ো টা কিঞ্চিৎ বেশীই হয়ে গেসল। কিছুটা গিয়ে যেখানে গাঁয়ের সীমানা শেষ হয়েছে, একটা পাথরে ঠোকর খেয়ে ছিটকে দারোগা চিৎপাত হল রাস্তার ধারের জলাজমিতে। এই ভরদুপুরে রাস্তায় লোকজন ছিলনা। চেহারাটা তার একটু ভারী মতন, তারপরে পড়েছে একদম বেকায়দায়। এদিকে দুই চেলা একটা সাইকেলে, তাই তারা একটু পিছনে রয়ে গেছিল।
    দু একবার নিজে নিজে ওঠার চেষ্টা করে ঘন্টা প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছে যখন ঠিক তখনই মাঠের দিক থেকে একটা লোক যেন জমি ফুঁড়ে উঠে এসে দারোগার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। জলকাদায় মাখামাখি হয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে লোকটার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল।

    রাম আর মাণিকও এসে পড়েছে ততক্ষনে। তারা সাইকেলটাকে তুলেছে, সেটা সামান্য বেঁকেচুরে গেছে। ওরা দুজনে মিলে ঠুকঠাক করে সাইকেলটাকে ঠিক করতে থাকল। ঘন্টা একটু সরে এসে রোদ পড়েছে এমন যায়গা দেখে একটা তেঁতুলগাছের গুঁড়ির ওপর বসল। সেই লোকটা তখনও আছে পাশে দাঁড়িয়ে। রোদে আর শুকনো হাওয়ায় জামাকাপড় শুকিয়ে আসছে, অতটা ঠান্ডা আর লাগছেনা।

    ঘন্টা লোকটার দিকে ভাল করে তাকালো, কালোপানা চাষাভূষোর মতো দেখতে, এ গাঁয়েরই লোক হবে। যাবার আগে একে দুচারটে কথা জিজ্ঞেস করাই যায়। কখন কোথা থেকে কি অজানা তথ্য বেরিয়ে আসে, বলা তো যায়না!
    গলাটা একটু সাফ করে নিয়ে বলল,
    -"তুমি কি এই গাঁয়েরই? কোন পাড়ায় থাকো?"
    লোকটা এমন ভাবে ঘাড় নাড়ল তাতে হ্যাঁ না যা খুশী হতে পারে। দারোগা উত্তরের অপেক্ষা না করেই পরের প্রশ্নে চলে গেল।
    -"তা সেদিন শিবুর আর হারানের দোকানের চুরির ব্যাপারে কিছু জানা আছে?"
    এবার লোকটা প্রায় হাতজোড় করে গড় হয়ে পড়ল ঘন্টার সামনে,
    -"আজ্ঞে, দারোগাবাবু আমি ছাপোষা মনিষ্যি। সারাদিন খেটেখুটে রেতে মোষের মত ঘুমাই। এসব রেতের কারবারীদের ব্যাপার আমি কুত্থেকে জানব বাবু?"
    একে সকাল থেকে অনেক ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত। তার ওপরে জলে ভিজে দারোগা বেশ মিইয়ে পড়েছে। গলায় আর সকালের জোর নেই, একটু মিনমিন করেই বলল,
    -"না মানে তোমরা কাজেকম্মে বেরোও তো। এই ধর রাস্তাঘাটে সেরকম কিছু বা কেউ চোখে পড়েছে কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছিলুম আর কি!"
    লোকটি খুব বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বলল,
    -"সে তো বটেই বাবু। আপনের কাজই তো জিজ্ঞাসাবাদ করা। সরকার বাহাদুর তাজ্জন্যেই আপনেরে মাইনা দ্যান। তবে সেরম কিছু চোখে পড়েনি বাবু, পড়লে আপনেরে নিচ্চয়ই বলতুম।"
    ঘন্টা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
    -"তোমার আর দোষ কি? এই যে আমি একটা এতকালের দারোগা, সকাল থেকে সারা গাঁ চরকি মেরে বেড়ালুম, আমার চোখেই সেরম কিছু পড়লনা। আমাদের পুলিশের চোখকে যে চোর ফাঁকি দিতে পারে সে তোমার মতো লোককে কি দেখা দেবে!"
    -"তবে বাবু একটা কথা মনে হইছিল, যদি কিছু মনে না করেন তো বলি।"
    ঘন্টা একটু উৎসাহ দেখিয়েই বলে,
    -"আরে বলো না, মনে করার কি আছে।তদন্তে বেরিয়ে আমাদের মানে পুলিশকে সবার কথাই ভালো করে বুঝেশুনে দেখতে হয়।বলো কি বলবে।"
    -"আজ্ঞে,কথায় বলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। তালে এর মানে হল কি সব চোরেরই মাসতুতো ভাই থাকে। চোরকে যখন পাওয়া যাচ্ছেনি তখন তার মাসতুতো ভাইকে খুঁজে দেখলে হতনি। আমার বোধ হচ্ছে ভাইকে পেলেই চোরকেও পাওয়া যাবে।"

    ঘন্টা একদম মুগ্‌ধ হয়ে গেল লোকটির কথা শুনে। চাষাভূষো হলেও এক্কেরে পুলিশের মত বুদ্ধি। ইস, সারা বেলা ঘুরে বেড়াল শুধু চোরের সন্ধানে। সাথে সাথে যদি গাঁয়ে যত মাসতুতো ভাই আছে তাদের খোঁজটাও করত, চোরধরা এক্কেরে জলের মত সোজা হয়ে যেত!
    আফশোষ সূচক নানা শব্দ তার মুখ থেকে বেরোতে থাকল আর সেই ফাঁকে লোকটা মাঠে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরে রামেরা সাইকেল ঠিক করে আনলে আবার চলতে গিয়ে দারোগার খেয়াল হল, এমন একটা জ্ঞানীগুণী লোকের নামটা জেনে নেওয়া হয়নি!
  • shrabani | 124.124.86.102 | ০৭ জুন ২০১০ ১২:৫০449841
  • গোবিন্দ শাগরেদ বটুককে নিয়ে দু রাত্তির এমনিই গাঁয়ের আশেপাশে ঘুরছিল। হারানের দোকানের চুরির পর থেকে রাতপাহারা বসানো হয়েছে। মাতব্বরেরা তিনপহরের পালা ভাগ করে দিয়েছে। অবশ্য এসব ছেলেছোকরাদের রাতপাহারায় গোবিন্দর মত পাকা চোরের কিছু এসে যায়না। পাহারা বলতে তো একবার একটু টহল মেরে এসেই তাস নিয়ে বসে যায়। মাঝে মাঝে আবার পালা করে ঘুমিয়েও নেয়। বটুক নতুন ছোকরা, তাই কাজেকম্মে উৎসাহটা একটু বেশীই। ওস্তাদ কেন শুধু শুধু সারা গাঁ চক্কর মারছে তার মাথায় ঢুকছেনা। তার হাত নিশপিশ করছে নতুন শেখা বিদ্যে ঝালাতে কিন্তু গোবিন্দর বারণ আছে। সে একটু মনমরা হয়েই গোবিন্দর সাথে ঘোরে। চুরি করবেনা এদিকে বলছে,
    "চোখ কান খোলা রাখিস বটুক, কিছু অন্যরকম সকম দেখলেই বলিস।"
    বটুক বুঝে পায়না চুরি যখন করবেই না তখন চোখকান খোলা রাখার কি দরকার আছে!

    দুজনে বারোয়ারীতলার দিকটা ঘুরে এসে হারানের দোকানের পেছন দিকে এল। দাওয়ায় তখন পাহারাদারদের তাসের আড্ডা চলছে। দান দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চোর নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। দুদিন ধরে পাহারা চলছে কোনো অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি কারোরই। কোনো অঘটনও ঘটেনি। মনে হয় বাইরে থেকে ছিটকে এসে পড়েছিল কোনো চোর এখন আবার স্বস্থানে ফিরে গেছে।
    ওখান থেকে গোবিন্দরা মাইতিপাড়ার দিকে গেল। বাড়িসুদ্ধু সবাই ঘুমে অচেতন। সদরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ঘুরে ওরা বাড়ির পিছনদিকে রামীবুড়ির জানালার কাছে গেল। গোবিন্দ কি ভেবে পা টিপে টিপে গিয়ে বন্ধ জানালায় হালকা একটা টোকা মারল। বটুকের চোরের কান বলে দুরে দাঁড়িয়েও শুনতে পেল নাহলে এ টোকা প্রায় শোনাই যায়না।
    -"কেরে, কেরে ওখানে কেরে, ও শিবু? " বুড়ি উঠে পড়েছে। চুরির পর থেকে শিবুর ছেলেটা বুড়ির কাছে শোয়। সে জেগে উঠে কান্না শুরু করল। শিবুর ঘরে লন্ঠনের শীষ উঠল। বুড়ি রোজের মতই সজাগ, এদিক নিয়ে চিন্তা নেই। গোবিন্দ ওখান থেকে আস্তে আস্তে সরে এসে চাটুজ্জ্যেদের বাড়ির দিকে যায়।

    আকাশ পরিস্কার তারায় ভরা। একফালি চাঁদের চাপা আলোয় চারিদিক আবছা আলোকিত। দুজনে আপাদমস্তক চাদরে জড়িয়ে চাটুজ্জ্যেদের খিড়কীর দিকে পৌঁছল। এদিকওদিক দেখে টেখে ঘুরতে ঘুরতে রান্নাদুয়ারের পাঁচিলের দিকে চোখ পড়তে দুজনেরই পা যেন মাটিতে আটকে গেল, মুখের বাক্যি গেল হরে।
    একটা মূর্তি আগাগোড়া সাদা কাপড়ে ঢাকা, মাথায় একহাত ঘোমটা, উবু হয়ে পাঁচিলের ওপর বসে আছে। গোবিন্দ অত্যন্ত সাহসী তবু এই দৃশ্য দেখে একটু ঘাবড়াল। পাশে ধুপ করে একটা আওয়াজ হতে তাকিয়ে দেখে বটুক মাটিতে পড়ে গোঁ গোঁ করছে, চোখদুটো উল্টিয়ে। কি বিপত্তি, এদের নিয়ে বেরোনই ঝকমারি!
    গোবিন্দ বেজার হয়ে পুকুরঘাট থেকে জলহাত করে এসে ওর মুখে চোখে দিল। উঠে বসে "ভু ভু উউউউ ত " বলে চেঁচিয়ে উঠতে গোবিন্দ তাড়াতাড়ি ওর মুখে হাত চাপা দিল। বটুককে দেখতে গিয়ে পাঁচিলের দিক থেকে চোখ সরে গেছিল, এখন তাকিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই।

    চাটুজ্জ্যে গিন্নী মরার পরে গাঁয়ে কানাঘুষো একটা শোনা যেত যে তাকে ঘরের আশেপাশে নানা জায়গায় দেখা যায়। ছাদ, বেলগাছ, পাঁচিল ইত্যাদি নানাজায়গায় তাকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখে বাড়ির সদু ঝি, বামুন মা নতুন বৌ এরা সব। বিশেষ করে একাদশীর দিন নাকি হেঁসেল থেকে কাঁচা বা রান্না মাছ অদৃশ্য হবেই। গাঁয়ের মেয়েদের নানা আড্ডার আসরে সবাই চোখ গোল গোল করে এসব আলোচনা করত। কত বড় সতীলক্ষী ছিলেন গিন্নী, এক তো পাকাচুলে সিঁদুর নিয়ে সগ্গে গেছেন, আবার সেখান থেকেও সোয়ামীর কল্যাণে একাদশীতে মাছ খেতে ভোলে না ইত্যাদি। তবে বেটাছেলেরা এসব কথায় খুব একটা কান দিতনা। আজ অনেক বছর হয়ে গেছে, এসব কাহিনীও আর খুব একটা শোনা যায়না।গোবিন্দ রাতবিরেতে এত ঘুরে বেড়ায়, এরকমটা আগে চোখে পড়েনি। গিন্নী কি প্রায়ই এরকম পাঁচিলে বসে থাকে, কে জানে!

    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।গোবিন্দর বাড়ি চাটুজ্জ্যে পাড়া থেকে বেশী দুরে নয়, গোঁসাইপুকুরের পাড় দিয়ে শর্টকাটে যাওয়া যায়। বটুকের বাড়ি উল্টোদিকে। গোবিন্দ বটুককে বাড়ি যেতে বলল, তার আজ রাতে আর ঘুরে কাজ নেই। কিন্তু বটুক ভয়েই সারা, একা বাড়ি যাবেনা। কি করে! ওকে সঙ্গে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে হল।

    গোবিন্দ নিজের কাজে খুবই পাকা কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি বেশী নেই। বটুককে ছেড়ে এসে ঘুরপথে চাটুজ্জ্যেদের বাড়ির দিকে না গিয়ে শেতলামন্দিরের পাশ দিয়ে গোঁসাইপুকুর পাড়ে এল। পুকুরপাড় জুড়ে বড় বড় গাছগাছালি কেমন রহস্যময় করে তুলেছে চারধার। আর পাঁচটা দিন গোবিন্দ এমনিই পার হয়ে যায় এই রাস্তা। আজ অবস্থা অন্য, অন্ধকার যেন আরও জড়িয়ে ধরেছে,বেশ গা ছমছম করছে। বাড়ির কাছে প্রায় পৌঁছে গিয়ে হাঁফ ছাড়ল। সামনে একটা ছোট বাগান মত, দুটো বড় বড় আমগাছ আর কিছু এমনি গাছগাছালি । আমের গাছ দুটো গোবিন্দর মা লাগিয়েছিল, নিজে ফল খাবার আগেই মরে গেল তবে ছেলে আর নাতিরা খাচ্ছে। বাগানটা সবে পেরিয়েছে, পেছন থেকে কে ফিসফিসিয়ে উঠল,
    -"গোবিন্দভায়া, একটু দাঁড়িয়ে যাও। দুটো কথা আছে।"
    গোবিন্দ পিছন ফিরতে যাবে কে যেন সাঁড়াশির মতো দুটো হাত দিয়ে ওর ঘাড়টাকে ধরে রইল পিছন থেকে।
    -"উঁহু উঁহু, ভুলেও ঐ কাজটি কোরোনি। এদিকপানে একেবারে তাকাওনি। দেখলেই চোখ চলে যাবে যে, গুরুর আশীব্বাদ।"
    গোবিন্দও কলাকৌশল কিছু কম শেখেনি তার গুরু নিধিরামের কাছ থেকে। মার ধরপাকড়ের হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার অনেক কৌশল জানা আছে। তবু এই বজ্রটিপুনির থেকে নিজের ঘাড়কে আলগা করতে পারলনা। ঘাড়কে ধরে আছে কিন্তু গলায় চাপ নেই কথা বলতে গিয়ে দেখল গোবিন্দ।
    -"বড্ড জবর ধরেছ কত্তা। এ তো চেনা হাত নয়, এদিকে নতুন নাকি?"
    -"আরে ছি ছি, আমারে কি তুমি চোর ডাকাত পেয়েছ নাকি? কটি কাজের কথা আছে, গোপনীয়। তাই এই অসময়ে ব্যস্ত করা।"
    বলেই সুট করে ওকে ছেড়ে লোকটা আমগাছের আড়ালে চলে গেল। একে আঁধার রাত তায় গাছের ঘন ডালপালা ছড়িয়ে জায়গাটায় কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। খুব ভাল করে চোখ চিরে তাকালে একটা আবছা মানুষের রেখা বোঝা যায়। বুক কেঁপে উঠল, মানুষ হলে কিছু নয় সে বুঝে নেবে, কিন্তু যদি মানুষ না হয়! লোকটা সেইরকমই ফিসফিসিয়ে বলল,
    -" কিছুক্ষণ থেকেই তোমারে লক্ষ্য করছিলুম ভায়া। চাটুজ্জ্যে বাড়ির ভিতরে না ঢুকে বাইরে থেকেই চলে এলে। বলি ব্যাপারখানা কি হে?"
    গোবিন্দ দেখল ভুত হোক আর যাই হোক তার নিস্তার নেই। জয় বাবা পঞ্চানন্দ বলে সে কথাবার্তা চালিয়ে যাবে ঠিক করে। গোবিন্দ চোর যে আজ চুরি না করে চোর ধরতে বেরিয়েছে সে ব্যাপারে সে কাউকে কিছু বলবেনাই ঠিক করেছে, নিধিরামের বারন তাই বটুককেও বলেনি। এখনও তার উচ্চবাচ্য করলনা। লোকটা বা ভুতটা ভেবেছে সে চাটুজ্জ্যেদের ওখানে চুরি করতে গেসল, তো তাই সই।
    -"আজ্ঞে, কি করে ঢুকব। ঢোকার আগেই যা দেখলুম, আমার সঙ্গী বটুক ছোঁড়াটা তো ভির্মি খেয়ে গেল। তাকে ধরে ধরে বাড়ি পৌঁছুতে হল। এরম অবস্থায় আর কাজ হয়!"
    লোকটার মুখ বোঝা যাচ্ছেনা।
    -"আহা, তবে তো তুমিও দেখেছ। আমি তো ভাবলুম খালি আমিই দেখলুম।"
    গোবিন্দ একটু কৌতূহলেই বলে,
    -"কি দেখার কথা বলছেন বলুন দিকি?"
    লোকটা (লোকই হবে, ভুত হলে এত কথা কয়ে সময় নষ্ট করবে নাকি, হাতে সময় নেই বিশেষ, শেষ রাত!) ধড়িবাজ আছে,
    -"উঁহু আগে তুমি বলো তোমরা কি দেখলে।"
    গোবিন্দ পাঁচিলে কি বা কাকে দেখেছিল তা নিয়েও খুব একটা নিশ্চিত ছিলনা, তবু বলল,
    -"সে কি কান্ড দাদা, দেখি চাটুজ্জ্যেদের মরা গিন্নীমা রান্নাঘরের পাঁচিলে। সেই দিশ্যি দেখে আর সাহস হলনা ভিতরে যেতে, যদি ঘাড় মটকায়।"
    লোকটা চু চু চাক করে একটা মুখ দিয়ে আওয়াজ বার করল।
    -"সেই তো ভায়া আমারও ঐ দিশ্য দেখেই ভিতরে ঢোকা হলনি কো।"
    গোবিন্দর ভয়টা কেটে গিয়েছে অনেকটাই।
    -"তা দাদা আপনের কি দরকার ছিল ওবাড়ীতে এই রেতের বেলায়? আপনি তো আর চোর ডাকাত নন।"
    লোকটা একটু খ্যাঁক খ্যাঁক করে শেয়ালের মতো হেসে উঠল।
    -"ধরেছ ঠিকই ভায়া। না, চোর হলে তো তুমি জানতে আমাকে, তাই না? আসলে আমি একটা জিনিস খুঁজছি সেটা সম্ভবত চাটুজ্জ্যে বুড়োর ঘরের সিন্দুকে আছে।"
    গোবিন্দ বলে,
    -"তা চোর যখন নন তখন বুড়োর কাছে গিয়ে দর দিয়ে জিনিসটা কিনে নিলেই হয়।"
    -"সে হয়, তবে বুড়ো জিনিসটা বেচবেনা।"
    গোবিন্দ অবিশ্বাসের কন্ঠে বলে,
    -"ঠিক দাম দিলে বেচবেনা তা হয় নাকি? আপনি বলে দেখেছেন?"
    লোকটা একটু চুপ করে থেকে এবার গোবিন্দর হাতটা চেপে ধরল বেশ জোরে। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল,
    -"না বেচবেনা কারন ওটা তার নিজের জিনিস নয়। সে অনেক কথা, বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। পরে পশ্চাতে বলবখন তোমায়।শুধু জেনে রাখো জিনিসটা ন্যায়ত আমার। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা এখন একটু কঠিন। তাই ওসব কচাকচির মধ্যে না গিয়ে আমি জিনিসটা না বলেই নিতে চাই।
    আমি অনেক খোঁজ নিয়ে দেখলুম তুমিই এখন এ গাঁয়ের সবচেয়ে বড় চোর। তোমার মতো হাতের কাজ আর কারুর নয়।তুমি আমাকে সাহায্য করবে ঐ জিনিসটি বুড়োর ঘর থেকে আনতে। ভেবোনি, তোমারও লাভ থাকবে।"
    গোবিন্দর একটু কৌতূহল হল,
    -"জিনিসটা কি?"
    -"সে ঠিক সময়ে জানতে পারবে।"
    -"আপনার নামটা?"
    লোকটা একটু চাপা স্বরে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল।
    -"সে তোমার সুবিধেমত একটা দিয়ে দিও। আমার সব নামেই সায় আছে।"
    গোবিন্দ বুঝতে পারছিল লোকটা রোগাপাতলা হলেও গায়ে অসীম জোর। হলধর নামটা মুখে এনেও চেপে গেল। একে সহজে কাটানো যাবেনা। সে আমতা আমতা করে বলল,
    -"চাটুজ্জ্যেদের বাড়ি অনেক লোক। বুড়োর ঘরে নাতি শংকুও শোয়, সে আবার কিসব মারপ্যাঁচ শেখে, দারুন লেঙ্গি মারে। কাজটা সহজ হবেনি। তবু আপনি যখন বলছেন আমি যাব। কবে যেতে হবে?"
    লোকটা গোবিন্দর হাত ছেড়ে দিল। গোবিন্দ উ: করে উঠল। গলায় একেবারে মাখন মিছরি মিশিয়ে বলল,
    -"এই দ্যাখো, তোমার হাতটা খুব জোরে ধরেছি নাকি? এ হে বেশী লাগেনি তো? এই আমার দোষ, যাকে ভাল লাগে তাকে একটু জোরেই ধরি।
    তা হলে ঐ কথাই রইল। আজ রাতে এই বারোটা নাগাদ চাটুজ্জ্যেদের খিড়কীদিকে ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে থেকো। আমি তোমাকে ডেকে নেব। তবে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলাই ভালো, বুঝলে কিনা। তাহলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়, আমার হাতটাত আবার একটু বেয়াড়া আছে, কিভাবে চলে এদিক ওদিক আমি নিজেই অনেকসময় টের পাইনা। তোমার অনিষ্টি কিছু হলে আবার আমার খুব খারাপ লাগবে। বুঝলে তো ভাই, তোমাকে আমার দিব্যি লেগেছে। "
    এই বলে লোকটা কোথায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

    গোবিন্দের মাথা ঘুরছিল, সে চুপচাপ ঘরে ঢুকে খিল দিল। তার ঘরের দরজা রাতে খোলাই থাকে। শুতে গিয়েও কি ভেবে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে খিড়কী দিক দিয়ে বাইরে বেরোল। সামনে খোলা মাঠ, আবছা আলো ফুটছে, কোথাও কেউ নেই। ভালো করে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বাঁ দিকের আলপথ ধরল।
  • Nina | 64.56.33.254 | ০৭ জুন ২০১০ ২১:২৩449842
  • শ্রাবণী , উফ! হাত চালাও ভাই হাত চালাও! এত ভাল লিখছ আর এত খারাপ থামছ --না না, শরীরের যত্ন নিও--কিন্তু প্লিজ --রইলুম বসে হাঁ করে--তাপ্পর কি হল গো------
  • Nina | 64.56.33.254 | ১২ জুন ২০১০ ০১:০৮449843
  • Weekend এ লিখবে তো শ্রাবণী ? প্লিজ !
  • Samik | 122.162.75.63 | ১২ জুন ২০১০ ১০:১৫449844
  • শ্রাবণী, এখানেই লিখলাম, তোমার ফোন্নং আর মেলাইডি দুটোই হারিয়ে ফেলেছি, পারলে আমাকে একবার মেল বা ফোন করতে পারবে?
  • shrabani | 124.124.244.109 | ১৫ জুন ২০১০ ১১:১৪449845
  • পরেশ চাটুজ্জ্যে ভোরবেলা উঠে মন্দিরের সামনের খালিজায়গাটায় দাঁতন হাতে একটু পায়চারি করে খালি পায়ে। দাঁত মাজা সেরে আজ সামনের ঘাটে মুখ ধুয়ে উঠতে যাবে সিঁড়িতে বড় বউয়ের সঙ্গে দেখা। পুজোর বাসন নিয়ে ঘাটে নামছে। মনে পড়ে গেল আজ বারের পুজো, কাজ বেশী, তাই বড় বউকেও লাগতে হয় মন্দিরে। তবে ঠাকুরের কাজ করতে যাচ্ছে কিন্তু মুখ প্রসন্ন নয়।
    শাশুড়ী মরা থেকে বড় বউই এতবড় সংসারের গিন্নী, মেলা দিকে দেখতে হয় মেজাজ এমনিতেই একটু টঙে থাকে সব্বদা।
    পরেশ সকালের চাটা বারবাড়িতে মন্দিরের সামনের দিকে বৈঠকখানায় বসেই খায়। আজ গিয়ে বৈঠকখানায় কাঠের বেঞ্চিতে বসল, চা আসেনি এখনো। বড় বৌ ঘাট থেকে উঠে মন্দিরের দিকে যেতে যেতে বলল,
    -"আজ চা পেতে দেরী হবে। উনুন ধরেনি এখনও। আমার উঠতে দেরী হয়েছে, সোজা এদিকে চলে এসেছি। ছোট বৌকে ডেকে দিয়ে এসেছি, সে নেয়ে আসবে তবে উনুনে আঁচ দেবে। উনুন ধরলে তখন চা বসবে।"
    পরেশ বুঝল বড় বৌয়ের মেজাজ সুবিধের নয়। সে পা পা করে মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
    -"তা বামুনঠাকুরও কি ঘুমোচ্ছে নাকি এখনো? সে উনুন ধরায়নি কেন?"
    একথায় বড় বৌ আরো তেলেবেগুনে জ্বলে গেল।
    -"আ মরণ! ঘরে থাকো না বনে? আজ চারদিন হল মানুষটা ধুমজ্বরে পড়ে আছে। বড় খোকা নীলু ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে দিয়েছিল। কিন্তু আমি তো সারার লক্ষণ দেখছিনা।"
    পরেশ বউকে ভয় করে। একটু ব্যস্ততা দেখাল।
    -"আরে রে, তাহলে তো তোমাদের খুব খাটনি পড়েছে। আমি তো জানতেই পারিনি।"
    গিন্নী মুখ বেঁকিয়ে হাতের কাজ করতে করতে বলল,
    -"ঢঙের কথা শোনো। তোমাকে জানতে হবে কেন,বাড়িতে লোক নেই! মেলা বকিওনি দিকি, নিজের জায়গায় গিয়ে বোসো। এখনি পুরুত ঠাকুর এসে যাবে, কাজ সারতে দাও।"

    পরেশ আর কথা না বাড়িয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। ঝি মন্দিরের সামনে গোবরজল ছড়া দিয়ে নারকেল ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে, একটু পরে মন্দিরে পুরুত এল। ছোটোবৌমা নিজে এল চায়ের কাপ নিয়ে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ পরেশের মনে পড়ল কালকের সন্ধ্যের কথা। কি যেন বলেছিল পালখুড়ো?
    মন্দিরের পিছনে চাঁপাগাছ তলায় বিরিঞ্চির সঙ্গে দেখা হয়েছে। পরেশ একটু রেগে গেল। উড়ে বামুনটা নির্ঘাত বেশী জ্বরের ভান করে বাড়ির মেয়েদের ঠকাচ্ছে। জ্বরে উঠে কাজ করতে পারছেনা অথচ খিড়কী দিকে বিড়ি ফুঁকতে যেতে পারছে। বাড়ির ছেলেগুলোই বা কি? নীলুর কাছ থেকে ওষুধ আনিয়েই খালাস। নীলুকে একবার ডেকে দেখালেই তো বাছাধনের মটকা মেরে পড়ে থাকা বেরিয়ে যেত। আর সত্যিই যদি রাঁধুনী বামুন জ্বরে শয্যাশায়ী তো কাল সন্ধ্যেয় পালকত্তা কাকে দেখল! না: ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে হবে।

    চাটা খেয়ে পরেশ বাড়ির ভেতরে গেল। পাকা দোতলা বাড়ির আর মাটির বাড়ির মাঝখানে একটা দরজা, সেটা এখন খোলা, রাতের বেলা বন্ধ থাকে। মাটির বাড়ি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, বড় উঠোন একপাশে একচালা রান্না ভাঁড়ার ঘর। তারি পাশে একফালি ঘেরা জায়গায় চালা তুলে তক্তপোশ পেতে বামুনঠাকুরের থাকার ব্যবস্থা। মাটির বাড়ির খিড়কী দিকে পুকুর আর বাগান, মন্দিরের পিছনে পড়ে। সারাদিন দরজাটা খোলাই থাকে, কাজের লোকেরা বাড়ির মেয়েরা অনবরত যাতায়াত করে এখান দিয়ে।
    পরেশ মাঝের দরজাটা দিয়ে উঁকি মারল। রান্নাদুয়ারে ব্যস্ততা, মেয়েরা কাজে। এখন ওদিকে তার যাওয়া একেবারেই ঠিক হবেনা।
    ঘেঁটু তাদের ঝিয়ের ছেলে, সারাদিন মায়ের সঙ্গে থেকে বাড়ীর লোকের ফাইফরমাস খাটে। খালি চায়ের কাপ নিয়ে দোতলা থেকে নেমে এল। পরেশ ওকে ধরল।
    -"বামুন ঠাকুর কে একবার ডাক তো রে, কি হয়েছে শুনি। এদ্দিন ধরে জ্বর, এতো ভালো কথা নয়।নীলুকে খবর পাঠাতে হবে।"
    ঘেঁটু একটু অবাক হল,
    -"বামুন ঠাকুর তো উঠতে পাচ্ছেনি বিছনা থেকে, হেঁটে এইখেনে আসবে ক্যামনে?"
    পরেশ বিরক্ত হল, -"তুই গিয়ে বল গা যা আমি ডাকছি।"
    ঘেঁটু বামুনের চালার দিকে গিয়ে আবার তক্ষুনি ফিরে এল,
    -"বড়বাবু, বামুন ঠাকুর বোধায় বাইরে গেছে গো, নিজের চালায় নেই।"

    রান্নাদুয়ারে মেয়েরা কাজ থামিয়ে এইদিকেই চেয়ে আছে। পরেশ আর দাঁড়ালো না। ঘেঁটুকে বলল বিরিঞ্চি ফিরে এলে তাকে খবর দিতে।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ১৫ জুন ২০১০ ১১:২৩449846
  • ভোর ভোর উঠে থেকেই মহেন পালের বড় অস্থির লাগছে। মুখহাত ধুয়ে দুধমুড়ি খেয়ে খামারে গেল। ধান ঝাড়াই শুরু হয়েছে, দেখার লোক পাল বাড়িতে কম নেই তবু ফিবচ্ছর নিজে বসে হিসেব না দেখলে তার হয়না। আজ কিন্তু তার ধানের দিকে মন নেই তেমন। কাল রাতে ঘুমও হয়েছে ছেঁড়া ছেঁড়া। যেন কিছু একটা খুব দরকারী কথা মনে পড়া উচিৎ কিন্তু পড়ছেনা। একটু পরে সে উঠে পড়ল খামার থেকে। লাঠিটা হাতে নিয়ে ঠুক ঠুক করে হেঁটে বারোয়ারীতলার দিকে গেল। লোকজনের সাথে দেখা হলে দুটো কথা কইলে একটু সুস্থির লাগবে। কিন্তু সেখানে আজ কেউ নেই, শুধু কতগুনো ছেলে ইস্কুল ছুটি বলে ক্যারমের আসর পেতেছে। আরো একটু কচিকাঁচার দল ডাঙ্গুলি খেলছে রাস্তার ওপর। এসময় সকলেরই ধান ঝাড়া চলছে, তাই দিনের বেলা সবাই ব্যস্ত।

    এদিক ওদিক দেখে ফিরে যাবার উপক্রম করছে এমন সময় দেখে হনহন করে খগেন মন্ডল আসছে এই দিকেই। পাল কত্তাকে দেখে খগেন বলল,
    -"এই যে খুড়ো, তোমার বাড়ির দিকেই গেসলাম, সেখানে বলল তুমি এইদিকে এসছ।"
    -"কেন, সাতসকালে আমার কাছে কেন রে? কিছু হয়েছে নাকি?"
    খগেন একটু মাথা চুলকালো। আটচালার দল, নিমাইয়ের দোকানের খদ্দের সব তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দেখে খগেন মহেন পালকে টেনে নিয়ে চলে,
    -"চলো খুড়ো, হারানের দোকানে যাই। চা খেতে খেতে তোমাকে সব বেত্তান্ত বলা যাবে।"
    মহেন পাল আপত্তি করেনা। দুজনে মিলে চলে হারানের দোকানের দিকে।

    হারান আজ একটু মনমরা, চুরির কোনো সুরাহা হবে বলে মনে হয়না। অনেকগুলো টাকা লোকসান হয়ে গেল। বিশু চা দিয়ে গেছে, তাই খাচ্ছে। আড়চোখে একবার আশু চাটুজ্জ্যের দিকে তাকালো। বুড়ো সেদিনের পর থেকে আবার সেই মৌনী নিয়েছে। হারান আজকাল যখন আশেপাশে কেউ থাকেনা তখন বুড়োর কাছে গিয়ে "হলধর হলধর" জপে, যদি বুড়োর মুখ খোলে। কিন্তু কিছুই হয়না, বুড়ো ভাবলেশহীন। একদিন বুড়োর পেয়ারের ছোটনাতি শংকুকে জিজ্ঞেস করেছিল কথায় কথায়, ওদের কেউ কুটুম টুটুম আছে নাকি হলধর নামের। তা সে ছোঁড়া কিছু জানেটানেনা, বেশী বলাও যায়না পালঠাকুদ্দার বারণ আছে।

    এখন পালকত্তা আর খগেনকে একসাথে আসতে দেখে হারান একটু অবাক হল। বিশেকে চা দিতে বলে খগেন দাওয়ার একদিকে বসল, হারানের কেনাবেচার জায়গা থেকে একটু দুরে। হারানের ইশারায় বিশে মহেনকে আস্ত মোড়াটা এগিয়ে দিয়ে এসে চায়ের জোগাড়ে লাগল।
    মহেন পাল আশু চাটুজ্জ্যের দিকে তাকালো একবার তারপরে খগেনকে বলল,
    -"বল এবারে তোর বেত্তান্ত শুনি।"

    বিশে চা নিয়ে এসেছে। হারানও আর কৌতূহল সামলাতে না পেরে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছে। মহেন পাল একবার চারধার দেখে নিয়ে জুত করে চায়ের কাপে চুমুক দিল। যদিও সে চা খুব একটা খায়না তবু ঠান্ডায় এই গরম জিভ পোড়ানো স্বাদ ভালৈ লাগল।
    খগেন এবার তার মায়ের কাছে শোনা গুরুদেবের ডিবের কথা বলল।
    -"আগে বলিনি খুড়ো, ভেবেছিলুম মা বুড়িমানুষ কি বলতে কি বলেছে। এদিকে কাল সদরে গিয়ে নয়নপুরের বীরেন নস্করের সনে দেখা। গল্পে গল্পে গাঁয়ের চুরির কথা উঠল। নস্করদের মহাজনী কারবার, বীরেন আমার ছোটোবেলার ইস্কুলের বন্ধু। ওর বাপ ছিল রামীখুড়ির সম্পর্কে জেঠা, নয়নপুরে খুড়ির বাপেরবাড়ি। তোমার খেয়াল আছে নিশ্চয়ই দু বছর আগে খুড়ি রায়েদের কাছ থেকে ঝিলের পুকুর আর তার পারের কিছু জমি কিনে নেয়। এখন সেখানে বুড়ির আলুর চাষ হয়। রায়েরা ভালো দর হেঁকেছিল, বুড়ির কাছে অত টাকা ছিলনি। তখন বুড়ি বীরেনদের কাছে টাকা নেয় তার সমস্ত গয়না বন্ধক রেখে।"

    মহেন সব শুনে বলল,
    -"তারমানে বুড়ির গয়নাগাঁটি সব বাঁধা পড়ে আছে। সিন্দুকে নেই। শিবু জানে?"
    -"না খুড়ো। এসব কেউই জানেনা। বুড়ি টাকাপয়সা সম্পত্তির ব্যাপারের চিরকাল নিজের বাপেরবাড়ির লোকেদের পরামশ্যি নেয়।"
    হারান চুপ করে শুনছিল, এবার বলে উঠল,
    -"তাইলে বুড়ির সিন্দুকে ছিলটা কি যা চুরি হয়েছে? বুড়ি সবাইকে মিথ্যে কথা বলছে?"
    মহেন পাল ঘাড় নাড়ল।
    -"না,এতবড় মিথ্যে বলবে মনে হয়না। আমার আজকাল কেমন মনে হচ্ছিল রামী বৌ একটু ভুলোমন হয়ে যাচ্ছে। হয়ত গয়না রেখে টাকা নিয়েছে সেটা ভুলে গেছে।
    আমার এখন মনে পড়েছে। খগেনের মা কিছুটা ঠিক বলেছে পুরোটা নয়। শিবুর দাদু বনমালীদাদা আর বৌঠান তিত্থি করতে গিয়ে এক সাধুর সঙ্গে দেখা হয়। যদ্দুর মনে পড়ে ইনি ঠিক সন্ন্যাসী ছিলেননা তবে সেরকমই জীবনযাপন করতেন। কোথাকার এক রাজবাড়ি না জমিদারবাড়ির কুলপুরোহিত ছিলেন, তিত্থি করতে এসছিলেন। আবছা মনে পড়ছে পরে সেখানে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছিল, সেসময় তিনি এখানে আসেন। কিছুদিন থেকে জায়গাটা ওনার ভালো লেগে যায়,
    পঞ্চানন্দের থান। খুব জ্ঞান ছিল,পাঠটাঠ করতেন, ওষুধবিষুদ ও দিতেন। বেশ কিছু ভক্ত জুটে গেসল তার। এই আশুদাদাও তার মধ্যে একজন।
    এরাই উদ্যোগ নিয়ে গোঁসাইপুকুরের ধারে তাকে চালা বেঁধে দেয়। বছরখানেক মত তিনি সেখানে থাকেন, তারপরে হিমালয় যাচ্ছে বলে চলে যায়। তবে উনি মন্তরটন্তর দিতেন বা এদের গুরু ছিলেন কিনা তা ঠিক মনে নেই। গুরুদেবের ডিবে মানে কি তোর মা ঐ গুরুদেবের কথাই বলেছে?"

    খগেন মন্ডল এবার বলে,
    -"ঠিক খুড়ো, এবার মনে পড়েছে, সে অনেকদিনের কথা। এত বিত্তান্ত না জানলেও এখন মনে পড়েছে আমাকেও মা এক আধবার ঐ সাধুবাবার কাছে নিয়ে গেসল হাত দেখাবার জন্য। আসলে বেশীদিন ছিলনা তাই বোধহয় কারুর মনে নেই।
    -"চল খগেন একবার শিবুদের ওখানে যাই, তোয় আমায় নিরিবিলিতে ধরলে বুড়ির যদি কিছু মনে পড়ে। "
    হারানেরও ইচ্ছে ছিল ওদের সঙ্গে যাওয়ার, কিন্তু মহেন বারণ করল। সে বরং দোকানেই থাক, সবাই মিলে গেলে বুড়ি মুখ নাও খুলতে পারে।

  • shrabani | 124.124.244.109 | ১৫ জুন ২০১০ ১১:৩০449848
  • বিরিঞ্চিকে না পেয়ে পরেশ চাটুজ্জ্যে দোতলায় চলে এল। চারিদিকে এখন কেউ নেই, সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। তারা দুই ভাই। ছোট সদরের দোকান ব্যবসা দেখে, তাকে সাহায্য করে পরেশের মেজ ছেলে। পরেশ একটু অলস প্রকৃতির মানুষ, আগে তবু জমিজমা দেখত টেখত। ইদানীং সব ছেলেরা ভাইপোরা লায়েক হওয়া থেকে সে ঘরেই থাকে, বাগান মন্দির এসব নিয়ে। বিরিঞ্চি বামুনের ব্যাপারটা নিয়ে সে এখন একটু চিন্তায়। বিরিঞ্চি যদি আজ চারদিন জ্বরে শয্যাশায়ী তো কাল সন্ধ্যেয় মহেন পাল কার সঙ্গে কথা বলল? সে ঠিক করল বিরিঞ্চির সঙ্গে কথা বলে একটু পরে বেরোবে, দরকার হলে নীলুকেও একবার কল দিয়ে আসবে আর মহেন পালের সঙ্গে দেখা করে আসবে।
    টানা বারান্দায় সারি সারি ঘর, একেবারে কোণের ঘরটা তার বাবার। বাবার সঙ্গে ভাইয়ের ছোট ছেলে শংকু থাকে। সে এখন তাদের ঘরের সামনে ডাম্বেল না কিসব দিয়ে নানারকম স্বাস্থ্যচর্চা করছে। জ্যাঠাকে দেখে একটু থামল, পরেশ কথার কথায় জিজ্ঞেস করল,
    -"কিরে, দাদু দোকানে চলে গেছে?"
    -"হ্যাঁ সে তো প্রায় ঘন্টাখানেক হবে।"
    পরেশ বাবার ঘরে ঢুকল, ঘরটা বেশ বড় দখিন খোলা। এখন জানালা দিয়ে কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে রোদ এসে পড়েছে লাল তকতকে নিকোনো মেঝেতে। আশু চাটুজ্জ্যে বাইরে কথা না কইলে কি হবে ঘরে দৈনন্দিন কথাবার্তা বলে তবে সেসব বউমেয়েদের সাথে বা ঐ শংকুর সাথে। কাজকারবারের কোনো কথা শোনেনা বা বলেনা।
    পরেশ একটু বিছানায় গড়ালো, পাশের টেবিলে রাখা শংকুর বইপত্র ঘাঁটল। কিছুক্ষণ পরে উঠতে যাবে হঠাৎ চোখ চলে গেল দরজার পাশে দেওয়ালের সিন্দুকে। সিন্দুকের গায়ে চাবি ঝুলছে। সে অলস হলেও সাবধানী, বিশেষ করে টাকাপয়সার ব্যাপারে। বাবার সিন্দুকে গয়নাপত্র টাকাপয়সা বেশী কিছুই থাকেনা, সব তাদের ভাইয়েদের কাছে। দু চারটে এদিক সেদিকের জিনিস, পুরনো অদরকারী দস্তাবেজ চিঠি পত্র, কুচোকাচা সোনার আংটি বোতাম। অল্প কিছু টাকাপয়সা বাবার খরচের জন্য। তবু এভাবে সিন্দুকের গায়ে চাবি দেখে পরেশ একটু রাগত স্বরেই শংকুকে হাঁক দিল। শংকু আসতে সে চাবিটা দেখাল,
    -" এভাবে চাবি রাখা আছে বাইরে? দিনের বেলা চারদিক খোলা, কে কখন উঠে এসে যেটুকু আছে নিয়ে চলে যাবে। তুই দাদুর কাছে থাকিস, খেয়াল রাখিস না?"
    শংকুকে বেশ লজ্জিত মনে হল। মাথা নীচু করে বলল,
    -"বেরোবার আগে দাদু আমাদের ফিস্টির চাঁদা দিতে সিন্দুক খুলেছিল। আমি সেই থেকে ঘরে ঢুকিনি, বারান্দায়ই ছিলুম।"
    পরেশ বেশি বকাবকি করল না, ছেলেটা বাড়ির ছোট বড় আদরের বিশেষ করে জেঠীর।

    চাবি দেওয়ার আগে একবার সিন্দুক খুলে দেখল, নানা হাবিজাবি জিনিসে ভরতি। একদম ভেতরের দিকে একটা ভেলভেটের লাল কাপড়ের বটুয়া। আগে দেখেছে বলে মনে পড়ল না। কি মনে করে পরেশ বটুয়াটা টেনে নিল।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ১৫ জুন ২০১০ ১১:৫৪449849
  • গোবিন্দ বউয়ের চিলচিৎকারে ধড়পড় করে উঠে দেখল বেশ খানিকটা বেলা হয়ে গেছে। এমনেতে সে রাতে কাজ করে বলে দিনে ঘুমোয়। তবে তার আগে সকালে উঠে কাজকম্ম সেরে খেয়েদেয়ে বেলায় আবার শুতে যায়। তারপরে সন্ধ্যেরাত্তিরে ওঠে।
    আজ হাটবার, এছাড়া তার গাছের নারকেল পাড়ার কথা ছিল, ছেলেরা পিঠে খেতে চেয়েছে। তাই বৌ চেঁচাচ্ছে। উঠে মুখেচোখে জল দিয়ে উঠোনে এসে বসল। বউ এক গ্লাস চা আর দুটো রুটি ভেলিগুড় দিয়ে সামনে রেখে গেল। গরম ধোঁয়া ওঠা চা পেটে যেতেই মাথাটা সাফ হয়ে গিয়ে কাল রাত্তিরের কথা মনে পড়ে গেল। দু একবার নিজেকে চিমটি কাটল, দ্বিতীয়টা বেশ জোরে। স্বপ্ন দেখেনি তো কাল?

    বৌ কাঠারিটা সামনে এনে রাখল, "খেয়ে চারটে নারকোল পেড়ে দিও।"
    নারকেল টারকেল পেড়ে আরো কাজ কম্ম কিছু সেরে নেয়ে এল। হাটে যাওয়ার ছিল কিন্তু আজ আর দিনমানে কোথাও বেরোবেনা, একেবারে রাতে বেরোবে। কিছুক্ষণ পরে বটুক এল। দুজনে মিলে বাগানে রোদে এসে বসল। বটুক কালকে রাতের কথা তুলল।
    -"তুই কাউকে বলিস নি তো কাল কি হয়েছিল?"
    বটুক একটু আমতা আমতা করতে লাগল,
    -"না মানে বাড়িতে বলেছি, মা খুব ধরেছেল তাই।"
    -"মাকে বারন করেছিস কাউরে বলতে। জানাজানি হয়ে যাবে আমরা চাটুজ্জ্যে বাড়ির দিকে নজর রেখেচি।"
    বটুক একটু উৎসাহিত হয়ে উঠল।
    -"ওস্তাদ তার মানে তুমি এমনি এমনি ঘুরছিলে নি, চাটুজ্জ্যে বাড়িতে ঢুকবার মতলব করেছিলে? তা আজ আবার যাবে নাকি? আমি দিব্যি করছি কিছু দেখলেও ঘাবড়াবনি,আগে থেকেই চোখ বুজে রামনাম করব।"
    গোবিন্দ আজ রাতে যাবে তো বটে কিন্তু বটুককে সঙ্গে নেওয়া যাবেনা। সে সেকথা বলল না,
    -"দুর, সরীল টায় তেমন জুত পাচ্ছিনি, ঠান্ডা লেগে গেছে মনে হয়। আজ আর কোথাও বেরুবনি।"
    -"হাটেও যাবেনি?"
    বটুককে একটু হতাশ দেখাল। বড় আশা করে সে গোবিন্দর শাগরেদি করছিল, কিন্তু গোবিন্দর কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। নাহলে মাসে একদিন বড় হাট, এমন সুযোগ কি রোজ রোজ হয়!
    একথা ওকথার পর সে উঠে পড়ল। যেতে যেতে ভাবল আর কিছুদিন দেখে পুবগাঁয়ের তারাপদর কাছে নাড়া বাঁধবে। সে গোবিন্দর মত বড় চোর না হলেও বেশ নাম করেছে,হাল ফ্যাশনের চোর, ছুরি টুরিও চালায়।

  • aishik | 122.166.22.103 | ১৫ জুন ২০১০ ১৯:২০449850
  • এর পর ??????????
  • Nina | 64.56.33.254 | ১৫ জুন ২০১০ ২০:১৪449851
  • শ্রাবণী, এত ভাল লেখ--সব কাজ ফেলে পড়ে ফেলি আর তারপর " এবার কি হবে , এবার কি হবে " করে কোনও কাজে মন দিয়ে পারিনা :-((-----তাড়াতাড়ি এস কিন্তু, পরেরটা নিয়ে।
  • shrabani | 124.124.86.102 | ১৭ জুন ২০১০ ১১:৪৩449852
  • মহেন পাল যখন খগেন মন্ডলকে নিয়ে মাইতিপাড়ায় শিবুদের বাড়ী এল, শিবু বাড়ী নেই হাটে গেছে। রামী বুড়ি সেই নেয়ে এসে উঠোনে রোদে বসে শশা মুড়ি খাচ্ছে, জল ঝাপটা মেরে। মহেন পালকে ঢুকতে দেখে বুড়ি শাড়ীর পুঁটুলি টেনে মাথায় দিল, দ্যাওর বলে কথা। খগেনের এ বাড়ীতে ভালই যাতায়াত আছে, পালকত্তাও গ্রামের সব বাড়ীতেই ঘুরে তঙ্কÄতল্লাশ নেয়, তাই তাদের আসায় কেউ অবাক হলনা। শিবুর বউ ঘরের ভেতর থেকে মোড়া এনে বসতে দিল ওদের।

    মহেন বুড়ির কাছে সোজাসুজি গয়নার কথাটা পাড়ে। বুড়ি কিছুক্ষন সময় নিল বুঝতে, তারপরে হাঁউমাউ করে যা বলল তাতে দেখা গেল খগেনের কথাই ঠিক। বুড়ির গয়না তেমন কিছু ছিলনা, সিন্দুক থেকে একটা রুপোর ডিবে চুরি হয়েছে। বুড়িকে ঐ ডিবে তার গুরুদেব তীত্থে যাবার আগে দিয়ে গেছিল। ঐ ডিবের পয়েই বুড়ির অবস্থা ফিরেছে তাই ঐ ডিবেই তার সব্বস্ব।

    অনেক জিজ্ঞেস করেও ডিবেতে কি ছিল বুড়ি বলল না। গুরুর বারণ ছিল তাই সে নাকি খুলে কোনোদিন দেখেনি। মহেন পাল স্থিতধী মানুষ, ওসব ডিবের গুণে ঠিক ভরসা পেলনা তবু বুঝল এর পিছনে গুঢ় কিছু ব্যাপার আছে যা হয়ত রামী বুড়িও জানেনা। ওঠার আগে সে কি মনে হতে জিজ্ঞেস করল বুড়িকে,
    -"তা বৌঠান, তোমার গুরু এখনও আছেন? তার কোনো খবর জানো?"
    এর জবাবে বুড়ি ঘাড় নাড়ল, সে জানেনা। তবে গুরুদেব হিমালয়ে গেছিল আর ডিবেটা আসলে সে বুড়ির কাছে গচ্ছিত রেখে গেছিল। কথা ছিল ফিরে এসে সে তার ডিবে নিতে আসবে।
    ওরা বেরিয়ে এল বুড়ির বাড়ী থেকে।

    গোঁসাইপুকুরের কাছে এসে দেখা হল পরেশ চাটুজ্জ্যের সঙ্গে। সে তখন মহেনের কাছেই যাচ্ছিল। সাধারণত পরেশ খুব ধীরে সুস্থে কাজকম্ম করে। কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করেনা, দিনেকালে সেও বাপ আশু চাটুজ্জ্যের মতই হবে একথা গাঁয়ের সবাই বলে থাকে। কিন্তু আজ তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মহেন তা দেখে একটু অবাক হল,
    -"কি ব্যাপার পরেশ, তোরে যেন একটু কেমন দেখাচ্ছে? কি হয়েছে?"
    -"খুড়ো, আমাদের রাঁধুনী বামুন কে পাওয়া যাচ্ছেনা।"
    মহেন একটু সময় নিল বুঝতে পরেশ কার কথা বলছে। মনে পড়তে বলে উঠল,
    -"সেই কাল যাকে দেখলুম? তা গেছে হয়ত কোথাও, খুঁজে দেখেছ আশপাশ।"
    পরেশ এবার গলা নামিয়ে বলল,
    -"কোথাও নেই, তার জিনিসপত্রও নেই। একটু রহস্য আছে ব্যাপারটায় তাই তোমার কাছে যাচ্ছিলুম।"
    সে খুলে সব কথা বলল ওদের। বিরিঞ্চির জ্বরের কথা, কদিন ধরে যে বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না সে আজ পাততাড়ি গুটিয়ে হাওয়া। সব শুনে মহেন পাল একটু চিন্তায় পড়ল। কাল সন্ধ্যেয় যাকে সে দেখেছে আঁধার হলেও তাকে কোনোমতেই অসুস্থ মনে হয়নি। এমন হতে পারে যে তার সেই রহস্যময় চোরের সঙ্গেই দেখা হয়ে ছিল কাল এবং সে মিথ্যে করে চাটুজ্জ্যেদের রাঁধুনীর পরিচয় দেয়। তাহলে সত্যিকারের রাঁধুনী কেন গায়েব হল? আবার এমনও হতে পারে রাঁধুনীই চোর!
  • shrabani | 124.124.86.102 | ১৭ জুন ২০১০ ১১:৫০449853
  • মহেনরা পরেশকে নিয়ে ফিরে আবার হারানের দোকানে এল। ছেলেকে দেখেও আশু চাটুজ্জ্যের কোনো বিকার নেই, সে যেমন বসে থাকে তেমনিই রইল। সেই দিকে তাকিয়ে মহেন পাল পরেশকে জিজ্ঞেস করল,
    -"তা তোমাদের এই রাঁধুনী কদিন হল এয়েছে বললে?"
    -"মাস কয়েক হবে। আগের বামুনটা পুজোর ঠিক মুখে কাজ ছেড়ে পালাল। এখানে খুব অসুবিধে হচ্ছিল, পুজোয় এত লোকজন। সেইসময় কোথা থেকে খবর পেয়ে এ এসছিল কাজের জন্য।"
    -"আর তোমাদের নিশ্চয়ই খোঁজখবর করার কথা মনে হয় নি? সেসময় কাজের বাড়ী, লোক পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছ মনে করেচো।"

    পরেশ গুরুজনের সঙ্গে তর্কে গেলনা নাহলে বলতে পারত খোঁজখবর নিয়ে আবার কাজের লোক কবে রাখা হয় এসব দিকে! মহেন পালও সেটা জানে।
    সে একটু ভাবনায় পড়ে। গাঁয়ে হঠাৎ অনেক নতুন লোক দেখা যাচ্ছে। সবার বর্ণনা আলাদা আলাদা তবু মহেনের মন বলছে এ লোক এক হলেও হতে পারে।

    হারানের দোকানে নানা খদ্দের আসছে, কেউ দোকান করতে কেউ বা সকালের চা খেতে। একদিকে জোর আলোচনা চলছে ছেলেছোকরাদের মধ্যে ভুত আছে কি নেই।
    মহেন পাল পরেশ চাটুজ্জ্যে এসব বড়রা নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, কান করেনি। খগেন মন্ডলের আবার কোথাও কোনো তক্ক শুনলেই কান খাড়া হয়ে যায়। সে দোকানে এসেই "কি হয়েছে কি ব্যাপার" করে আড্ডাটার দিকে গেল। আসলে বটুকের মার কল্যাণে সারা গাঁ জেনে গেছে কাল রাতে চাটুজ্জ্যে গিন্নী দেখা দিয়েছে।
    ছেলেরা খগেনকে পেয়ে মহা উৎসাহী, সে যে দিকেই বলুক পক্ষে বা বিপক্ষে আসর হই হই করে জমে যাবে। খগেন দেখল পক্ষেই বেশী, নানা গল্প বেরিয়ে আসছে নানান লোকের সচক্ষে ভুত দেখার, আসর প্রায় ভুত আছে এমন একটা রায় দিয়েই দিয়েছে। সে খুব চেঁচাতে লাগল ভুত টুত সব চোখের ভুল, মনের ভয়ই ভুতের আকারে দেখা দেয়, ভ্রম বিকার ইত্যাদি।

    খগেনের গলা চড়তে মহেন পালের খেয়াল হল এরা চাটুজ্জ্যে বাড়ি নিয়ে কিছু বলছে। খগেনকে ডাকল সে। সব শুনে পরেশ অবাক হল। তার মাকে কাল রাতে দেখা গেছে কিন্তু বাড়ির কেউ তাকে কিছু বলেনি এতক্ষণ। সে একবার বাপের দিকে তাকালো, কানে কথা যাচ্ছে কিনা কে জানে, এমনিতে দেখলে মনে হয় নির্বিকার। খগেন একটু উত্তেজিত হয়ে বলল,
    -"গোবিন্দর শাগরেদ দেখেছে মানে গোবিন্দও ছিল সেখানে। পরেশদা, তুমি তো জোর বেঁচে গেছ, রাতদুপুরে তোমাদের খিড়কী দোরে এরা তো আর হরি কেত্তন করতে যায়নি। না: নিধে খুড়োর সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে, গাঁয়ে এমনেই গন্ডগোল চলছে, এসময় এরা এদের চুরি ধান্দা গুলো গাঁয়ের বাইরে গিয়ে করলে পারে না?"
    মহেন পাল কথাটা কানে নিল বলে মনে হলনা, তাকে চিন্তিত দেখাল। সাদা শাড়ী জড়ানো চাটুজ্জ্যে গিন্নীর ভুত? সে কিছু না বলে উঠে পড়ল। পালকত্তাকে উঠতে দেখে খগেনও হাটের পথ ধরল, পরেশ গেল বাড়ির দিকে।
    মহেন পাল কিছুটা গিয়ে আনমনেই যেন পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরল নিধিরামের পাড়ার দিকে।
  • shrabani | 124.124.86.102 | ১৭ জুন ২০১০ ১৬:৩৯449854
  • দলে দলে লোক আজ গাবপুরের হাটে যাচ্ছে, হারানের দোকান প্রায় ফাঁকা হয়ে এল। বিশেকে দোকানে বসিয়ে সে নিজেও হাটের দিকে রওনা দিল সাইকেল নিয়ে, কিছু মাল গস্ত করার আছে।

    বটতলায় রোজের হাট বসে। আজ বড় হাট উপচে এসে পড়েছে বাসরাস্তার দুধারে প্রায় রাজনগরের রাস্তা অবধি।
    বিশাল হাট,বড় পাইকারী বাজার, পাওয়া যায়না এমন জিনিস বোধহয় নেই। ঘুরে ঘুরে নানা মুদীখানার জিনিস কিনতে কিনতে অনেকটা সময় গেল হারানের ।
    সাজেদের মাংসের দোকানের সামনে বেশ বড় লাইন, কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। সেদিকে তাকিয়ে ঠিক করল মাছই নেবে আজ। হাটে নতুন আলু আর কলাই উঠেছে, সস্তায় তাই নিল এক এক বস্তা। ভার বইতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। হাটে ঢোকার মুখে রায়েদের গরুর গাড়ী দাঁড়িয়েছিল, হাটে মাল নিয়ে এসেছে। গাড়োয়ান কাশীর কাছে মালপত্র গচ্ছিত করে গাড়ীতে তুলে দিল। কাশী ফেরার পথে দোকানে বিশের কাছে পৌঁছে দেবে।

    হাত খালি হতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে সোজা নিতাই ময়রার দোকানের দিকে চলল সে। নিতাইয়ের জিলিপী আর সিঙারা না খেয়ে এ হাট থেকে কেউ ফিরে যায় না। ইয়াব্বড় বড় সিঙারা, কি তার সোয়াদ, মুখে দিলে মিলিয়ে যায় আর তেমনি রসে টোবো টোবো মুচমুচে করে ভাজা জিলিপী!
    বেশী দেরী করলে আবার শেষ হয়ে যেতে পারে। দোকানে সবসময়ই ভীড় থাকে। নিতাইকে একপোয়া জিলিপী আর ছটা সিঙারা দিতে বলে অপেক্ষা করতে থাকে বেঞ্চি খালি হওয়ার। দাঁড়িয়ে হাটের নানা দৃশ্য দেখছে, হঠাৎ পিছন থেকে পিঠে এক জোর থাবা। তাকিয়ে দেখে অমিয়।
    অমিয়কে দেখে হারান খুশী হয়, একা একা ঘোরার থেকে একটা সঙ্গী হলে হাটে বেশী মজা হয়। দুজনে জিলিপী সিঙারার ঠোঙা নিয়ে বসেছে, এমন সময় হাই ইস্কুলের ভূগোলের মাস্টার গোলোকবাবু এলেন। গোলোকবাবুর কাছে হারানরা পড়েছে, এককালে খুব কড়া মাস্টার ছিলেন। বছর চারেক আগে ওর একমাত্র ছেলে ক্লাস নাইনে ফেল করে বাপের ভয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তারপর থেকেই উনি একটু কেমন যেন হয়ে যান।

    তীব্র দৃষ্টিতে হারানদের দিকে তাকিয়ে বলেন,
    -"খাচ্ছিস তো এই বিষগুলো কিনে কিনে? জানিস, ঐ জিলিপী তে যে রঙ আছে তাতে সেঁকো বিষ থাকে। সিঙারার ময়দাতে ভেজাল, আলুগুলো নিতাই হাট শেষের পচা আলু কেনে। আর যে তেলে ভাজছে ও তো আমি গন্ধ শুঁকেই বুঝতে পারছি, ডিজেল মেশানো। এ খাওয়া মানে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোনো। এই বেলা সাবধান হও সবাই, বলে দিলুম পরে কিন্তু ভুগলে আমাকে দুষোনা কেউ।"
    দোকানে অনেক খদ্দের, কেউ কানই করলনা, কেউ কেউ শুনে একটু হাসল। ভাজা হয়ে ঝোড়ায় পড়া মাত্র উড়ে যাচ্ছে নিতাইয়ের সিঙারা জিলিপী। হারান হাতের ঠোঙা নিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিলনা। অমিয় জিলিপীতে একটা মোক্ষম কামড় দিয়ে গোলোকবাবুর উদ্দেশ্যে বলে,
    -"আজ্ঞে সে তো আপনি ঠিকই বলেছেন স্যর, কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা শুনলে তো! বুদ্ধিসুদ্ধি কম সব গেঁয়ো মুখ্যু। এই আজই শেষ, নিতাইয়ের দোকানে এই আজকের পরে আর খাবনি। আপনিও তাই করুন।"
    গোলোকবাবু খুশী হলেন, একটা বেঞ্চি খালি হয়েছে, তাতে তিনজনে গিয়ে বসল। নিতাইকে ইশারা করতে সে একঠোঙা জিলিপী সিঙারা এনে মাস্টারকে দেয়। তিনজনে খেতে খেতে হাটের দিকে দেখে, বেলা বাড়তে ভীড় যেন মেলার মতন।
    একথা ওকথায় হারান কি মনে হতে গোলোকবাবুকে জিজ্ঞেস করে,
    -"স্যর, সিধুর কোনো খবর পেলেন?" সিধু মাস্টারমশায়ের ছেলে। গোলোকবাবু গরম সিঙারার আলু মুখে উহু উহু করতে করতে বলে,
    -"হ্যাঁ, সে তো এখন হনলুলু তে আছে।" হারান আর অমিয়র চক্ষু চড়কগাছ। তারা আমতা আমতা করে গোলোকবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে,
    -"স্যর, হনলুলু?"
    -"হ্যাঁ, সেখানের ইস্কুলে পড়ছে। সেসব খাঁটি ইস্কুল, এখানকার ইস্কুলগুলোর মত বদমাশ নয়, পাস ফেল নেই দিব্যি আছে।" মাস্টার এবার আরাম করে একটা আস্ত জিলিপী মুখে পোরে।
    এরা আর বেশী কথা না বলে খাওয়া শেষ করে ওখান থেকে সরে এল।
    মাস্টার ততখনে হনলুলুর উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা আর এখানকার শিক্ষার অবনতি নিয়ে জোর ভাষণ দিতে শুরু করেছে আশেপাশের লোকেদের কাছে, আরো জিলিপী ও সিঙারা সহযোগে!
  • shrabani | 124.124.86.102 | ১৭ জুন ২০১০ ১৭:৪৯449855
  • এদিকে মাছের বাজারের মুখটায় উকিলদের নগা, ফেলু মাইতি আর কানাই জেলের মধ্যে ঘোর বচসা লেগে গেছে । ফেলু একটু বোকাসোকা ধরণের সে সবাই জানে। আলু নিয়ে হাটে এসেছিল। সব পাইকারে নিয়ে গেছে ভালো দামে। খুশী হয়ে তাই কানাই জেলের কাছে মাছ কিনতে গেসল।
    কানাই আজ অন্যান্য মাছের সাথে বড় বড় কইমাছ নিয়ে বসেছিল। ফেলু দশটা বড় কই গামছায় বেঁধে দাম দিয়ে সবে উঠতে যাবে সেইসময় নগা হাজির। তার বাড়িতে আজ বোনকে দেখতে আসবে, তেলকই রান্না হবে বলে ঠিক হয়েছে। কানাইকে সে মাছ রাখতে বলে হাটে ঘুরতে গেছিল, কানাই সব মাছ বেচে দিয়েছে, আর দুটো মাত্র কই পড়ে আছে।
    নগা একটু তেড়েল গাজোয়ারী ধরণের, তার মতে ফেলুর মাছ ন্যায়ত তার। সে ফেলুকে মাছ নিয়ে উঠতে দেবেনা। এদিকে ফেলু খেতে খুব ভালোবাসে, যদিও এমনে সে নগাকে ভয় পায়, তবু সাধের কই মাছের জন্য আজ সে মরীয়া। কানাই এসবের মধ্যে নেই,সে ঘোরে আছে যেমন সবসময় থাকে, লাল লাল চোখ সামনে মাছ কাটার ধারালো বঁটি। কানাইয়ের কাছে সুবিধে করতে না পেরে নগা ফেলু বেচারার ওপর চোটপাট করতে থাকে। ঝগড়া কথা কাটাকাটির মাঝে গামছার বাঁধন আলগা হয়ে কইমাছ বেরিয়ে পড়েছে। খেয়াল হয়েছে যখন তখন মাছেরা সারা হাট ঘুরছে। এবার দুজনেই সব ভুলে হাটের মাঝে কইমাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দু চারটে মাছ কানাইয়ের দিকে যেতে সে চুপচাপ ঝুড়ি চাপা দিয়ে দিল। সব মিলিয়ে মাছের বাজারে একটা হইহই শুরু হয়ে গেল।

    বাজারের মধ্যেই থানা। থানার পাশের মাঠে মেলা ভীড়। চাঁদোয়ার নীচে একটা লোক সাইকেলে ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচদিন হয়ে গেছে সে ক্রমাগতই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, এরকম সে একমাস ধরে করবে। খায়দায় সাইকেলে বসে, রাতে ঘুমনোর নামে ঝিমিয়ে নেওয়া, সেও ঐ সাইকেলেই। "আমরা তরুন" ক্লাবের ছেলেরা সব ব্যবস্থা করেছে। ক্লাবের সেক্রেটারী ভুবন হারানদেরই বয়সী হবে, একটা চোঙা নিয়ে খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকছে। এমনিতে রোজই দুর দুর থেকে লোক আসছে দেখতে, আজ হাটবার বলে ভীড় বেশী। অনেকেই দুদন্ড দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, কিছু পয়সাও রোজগার হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই হাটের ব্যবসাদার দের পক্ষ থেকে একটা টাকার মালা দিয়ে অভিনন্দন জানানো হল। লোকটা সাইকেলে বসেই মালা পরল।

    হারান আর অমিয়ও গিয়ে মজা দেখতে দাঁড়াল ভীড়ের মাঝে। কিছুক্ষণ খেলা দেখে একঘেয়ে লাগলে হারান ভীড়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। অমিয় তখনও সাইকেল ধারীর কীর্তি দেখছে মুগ্‌ধ হয়ে। হারানের হঠাৎ মনে হল একটা লোক যেন তার সঙ্গে চোখাচোখি হতে একটু আড়ালে সরে গেল। ভীড়ে থানার কনস্টেবল রাম আর মাণিকও আছে। হারান আস্তে আস্তে যেন কিছুই দেখেনি এমন ভাব করে অমিয়কে কিছু না বলে সেইদিকে গেল। লোকটা তখন ভীড় ছেড়ে পালাবার উপক্রম করছে। হারান পা টিপে টিপে তার পিছনে গিয়ে অতর্কিতে বলে ওঠে,
    -"কি দাদা, এদিকে কোথায়? নাকি এদিককার কাজ এখনও শেষ হয় নি?"

    গোকুল গুঁই বা হলধর যেই হোক না কেন বেকায়দায় পড়লেও সামলে নিয়ে বাইরে একগাল হাসি হাসে।
    -"আরে কি বলে কি যেন নামটা, ভায়া যে। সব খবর ভালো তো, হাটে আসা হয়েছে বুঝি?"
    -"আমার তো ভালোই, আপনার সেই কি যেন কাজ, কাঠের খোঁজ করা, তা এখনও চলছে?"
    দুজনেই থানার মাঠের এককোণে যেদিকটায় ভীড় নেই সেদিকে সরে এল। গোকুল গুঁইয়ের হাতে একটা কাপড়ের থলে, তার মধ্যে একটা গামছা, দুটো নারকেল এইসব উঁকি মারছে। একটা গাছের কাটা গুঁড়ি পড়েছিল। মাঠে খেলা টেলা দেখতে এসে লোকে তার ওপর বসে বসে ওপর ভাগ টা মসৃণ হয়ে গেছে। গুঁই তারই ওপর বসল আরাম করে। হারান তখনও দাঁড়িয়ে শক্ত মুখে। এই লোকটার সঠিক পরিচয় টা তাকে বার করতেই হবে। তেমন হলে সামনে থানা, পুলিশের লোকেরা কাছেই আছে, চেপে ধরে চিৎকার জুড়বে।
    হারানের দিকে তাকিয়ে গোকুল একটু হাসতে চেষ্টা করে কিন্তু হারানের গম্ভীর মুখ দেখে কেমন দমে যায়।
    -"তা ভায়ার কি আজ শরীর টরীর যুত নেই, কেমন যেমন একটু দেখাচ্ছে? দাঁড়িয়ে কেন, বস না।"
    হারান বসেনা।
    -"বসার দরকার হবেনি। আপনি মানে মানে সত্যি কথাটি বলেন তো দেখি,আপনার আসল নামটা কি, হলধর না গোকুল? দোকানে চুরিটা কি আপনি একাই করেছিলেন না কোনো স্যাঙাৎ ছিল সঙ্গে? সব খুলে না বললে থানা কাছেই আমি এবার পুলিশ ডাকব। ঘন্টা দারোগা হন্যে হয়ে চোর খুঁজে বেড়াচ্ছে, একটা চোর পেলে আনন্দে নাচবে।"
    গোকুল এবার একটু ঘাবড়েছে মনে হল। সে শিউরে ওঠার মতো ভাব করে বলে,
    -"আরে কি কান্ড ভায়া! তুমি শেষে আমাকে চোর ঠাওরালে? না: তোমাকে সব কথা খুলে না বললে আর চলছেনি। মাথা ঠান্ডা করে একটু বস, আমি সবকথা বলব।"
    হারান গন্ডগোল ঝুটঝামেলা খুব বেশী পছন্দ করেনা। নিজের অতগুলো টাকা চুরি হয়েছে তাই, নাহলে অন্যের হলে সে চোরকে দেখেও পাশ কাটিয়ে যাবে এমনি স্বভাব তার। মুখে দেখালেও ভেতরে ভেতরে গোকুলকে ওভাবে বলতে গিয়ে সে মনে মনে যথেষ্ট ঘাবড়ে ছিল। তাই আর দ্বিরুক্তি না করে বসে পড়ল। সাইকেল খেলার ভীড়ের দিকে আড়চোখে নজর করে দেখল অমিয়কে দেখা যাচ্ছেনা। তাকে না পেয়ে হয়ত এদিক সেদিকে চলে গেছে।

    গোকুল এবার গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে,
    -"কাউকে বোলোনা ভায়া, ভয়ানক বিপদ হতে পারে। আমি আসলে গোয়েন্দা।" হারানের চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি দেখে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
    -"বিশ্বেস হলনি তো? এইজন্যে সত্যিকথা বলতে নেই। তোমাকে যখন আমি মিথ্যে মিথ্যে কাঠগোলার ম্যানেজার বলেছিলুম তখন তো দিব্যি মেনে নিয়েছিলে। এখন সত্যিটা বললুম তো মানতে পারছনি।"
    হারানের তবু বিশ্বাস হয়না। গোয়েন্দা জিনিসটা কি তাই সে ঠিকমত জানেনা। ভাসা ভাসা শুনেছে পুলিশের গোয়েন্দা থাকে, পুলিশকে গোপন খবরটবর এনে দেয়।
    -"গোয়েন্দা মানে আপনি পুলিশের লোক, গোপন খবরটবর দেন? ঘন্টা দারোগা তাহলে আপনাকে জানে বলছেন?"

    গোকুল হাতের পান মুখে পুরে বাবু হয়ে জমিয়ে বসল,
    -"একেবারে খুব ভুল বলনি তুমি ভায়া। তবে আমি পুলিশের লোক নই। গোয়েন্দা পুলিশের হতে পারে আবার এমনিও হতে পারে। আমি সেরকম গোয়েন্দা, লোকে সমস্যায় পড়লে খোঁজখবর করে তত্বতল্লাশ করে তাদের সমস্যার সমাধান করে দিই তবে পয়সার বিনিময়ে। এই ধর তোমার দোকানের চুরি হয়েছে, পুলিশ কিছু করতে পারছেনা। তাদের আরো পাঁচটা কাজ রয়েছে, এক তোমার চুরি নিয়ে বসে থাকলে চলেনা। তুমি তখন আমাকে গোয়েন্দা লাগালে চোর ধরতে। আমি খোঁজখবর করে, সমস্ত দেখে শুনে প্রমাণ সহ চুরিটা কে করেছে খুঁজে বার করলুম। এবার পুলিশকে সব জানালুম, তারা চোর ধরল বামাল উদ্ধার করল। তুমি আমাকে আমার পাওনা দিলে।"
    হারান বুঝেও তখনও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলনা। গোয়েন্দা, তাদের গাঁয়ে কেন? লোকটার গল্প বলার ক্ষমতা অসাধারণ, আগের দিনই দেখেছে। এসব বানিয়ে বলছেনা তো!
  • Nina | 64.56.33.254 | ২৩ জুন ২০১০ ০১:১৫449856
  • তুলে দিয়ে গেলুম!
  • Samik | 122.162.75.126 | ২৩ জুন ২০১০ ০৮:৫৭449857
  • শ্রাবণীকে আমি চাক্ষুস না-দেখলে নির্ঘাৎ ভাবতাম, শীর্ষেন্দু এসে ছদ্মনামে লিখছেন।
  • de | 59.163.30.3 | ২৩ জুন ২০১০ ১১:০৫449859
  • শ্রাবণী, পুরো ছবির মতো হচ্ছে! আট্টু হাত চালিয়ে লেখো ভাই!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন