এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৫৯৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৩ জুন ২০১০ ১১:৩৯449860
  • মহেন পাল এসে নিধিরামকে বাড়িতে পেলনা, সে বেরিয়েছে। কোথায় গেছে বাড়ির লোকে বলতে পারলনা। তারাও একটু চিন্তায় আছে, সাধারণত নিধিরাম আজকাল একা একা বেশী দুর যায়না। মহেন আর অপেক্ষা করলনা, সেও অনেকক্ষণ বেরিয়েছে, বাড়িতে গিন্নী ছেলেরা ভাববে। আস্তে আস্তে পথ চলে, চারদিক ফাঁকা। শীতের বেলা তারওপরে আজ আবার হাটবার, বাইরে লোকজন তেমন দেখা গেল না।

    চলতে চলতে কখন এসে পড়েছে গোঁসাইপুকুরের ধারে। পুকুরটা চাটুজ্জ্যেদের, তবে খুব বেশী ব্যবহার হয়না, নিয়ম করে মাছ ছাড়া হয় অবশ্য। চারদিকের পাড় ঘিরে ঘন গাছপালার ভীড়। কি মনে হতে এদিক ওদিক ঘুরে মহেন আন্দাজ করে করে সেই জায়গাটায় এল যেখানে গুরুদেবের চালাটা ছিল। সে আজ কতবছরের কথা,বছর কুড়ি তো হবেই। মাটির চালাবাড়ি, মাটিতে মিশে গেছে কোনো চিহ্ন না রেখে। একধারে একটা তুলসীমঞ্চ,এখানে ওখানে কয়েকটা কালো হয়ে যাওয়া মাটির প্রদীপ পড়ে আছে।
    তাই দেখে মহেন বুঝল এটাই সেই গুরুদেবের ভিটে, নাহলে পুকুরপারে বনের মাঝে কেউ কেন এরকম তুলসীর থান বানাতে যাবে। নারায়ণের ঠাঁই বলেই বোধহয় কখনো সখনো বৌ ঝিরা গোবরমাটিটাটি লেপে জল টল দেয় অথবা প্রদীপ জ্বেলে থাকে, তাই মঞ্চটা টিকে গেছে এখনও। ঐখান থেকে একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা গিয়ে মিশেছে পশ্চিম ঘাটে মাইতিপাড়ার দিকে। ঘাট আর গোঁসাইপুকুর সরে মাইতিপাড়ার দু এক ঘরের বউয়েরা যারা একটু নিরিবিলি পছন্দ করে। চাটুজ্জ্যেদের ঘাট দক্ষিন দিকে, সে ঘাট খুব একটা চালু নয়, মাঝেসাঝে জেলেটেলে নামে।

    এখানটা বোধহয় উঠোন ছিল, একটু নজর করে দেখলে বোঝা যায় একধার দিয়ে ভাঙাচোরা ইঁটের একটা পথ নেমে গেছে পুকুরের দিকে, ঘাট সরার জন্য,অবশ্য এখন তা ঘন ঝোপঝাড়ে ঢাকা। একটা বড় জামগাছ আর অশত্থ গাছ ডালপালা মেলে জায়গাটাকে ঘিরে রয়েছে। ভালো করে চারিদিক ঘুরে দেখতে গিয়ে বার বার কেমন যেন মনে হচ্ছিল ঠিক এই জায়গাটায় সদ্য কেউ বা কারা এসে ঘুরে গেছে। যাতায়াতের রাস্তায় পুকুরের এই পাড় পড়েনা। পায়ে চলা রাস্তাটা ছাড়াও এদিক ওদিকে ঘাসে পাতায় পা মাড়ানোর দাগ। সাধারণ চোখে পড়বেনা, কিন্তু মহেন পালের শ্যেন চক্ষু, খুব গভীর নয়, জায়গায় জায়গায় মাটিতে শাবল মারার চিহ্ন। শুধু গুরুদেবের ডিবেই নয়, গুরুদেবের ভিটে নিয়েও কিছু রহস্য আছে তাহলে!

    বাড়ি ঢোকার মুখে দেখে নিধিরাম বেরোচ্ছে, সঙ্গে মহেনের বড় নাতি ধীরু। ওকে দেখে ধীরু বলে উঠল,
    -"কোতায় ছিলে তুমি এতখন? নিধেদাদু কখন থেকে এসে বসে আছে। এতক্ষণ দেখে দেখে এই উঠল, ঠাকমা বলল তাই দাদুকে ঘরে ছেড়ে আসতে যাচ্ছি।"
    মহেন নাতির কথার উত্তর না দিয়ে নিধিরামের দিকে তাকিয়ে বলল,
    -"এই দ্যাখ, আমি যে তোর ওখান থেকেই আসছি। ঘরে চল, আর একটু বসে যাবি, কথা আছে, ধীরু ছেড়ে দিয়ে আসবে।"
    নিধিরাম আপত্তি না করে মহেনের সঙ্গে ভেতর বাড়িতে ঢোকে। মহেনের গিন্নী ওদের দিকে আসতে মহেন জিজ্ঞেস করে,
    -"কিছু খেতেটেতে দিয়েছে এরা নিধেকে? এতটা বেলা হয়ে গেল। নাহলে এখানেই নেয়ে খেয়ে নে।" নিধে রাজী হলনা, তার বাড়ীতে সবাই বসে থাকবে। এরা ছাড়েনি জলখাবার খাইয়েছে, এক্ষুনি তার খাবার তাড়া নেই। মহেনগিন্নীকে সে বলে,
    -"বৌঠান বরং আর এক কাপ ভালো করে চা করে পাঠিয়ে দাও।"

  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৩ জুন ২০১০ ১১:৪২449861
  • নিধিরামকে নিয়ে মহেন নিজের ঘরে ঢুকল। বাড়ির পিছন দিকে একটেরে একটা বড় খোলামেলা ঘরে তারা থাকে। শীতে রোদ আসে সারাবেলা, গ্রীষ্মে ছায়া আর ফুরফুরে হাওয়া দেয়। লাঠি চাদর রেখে আরাম করে আরামচেয়ারে বসল, পাশে একটা গদিআঁটা হাতল দেওয়া কাঠের চেয়ারে বসল নিধিরাম।

    নিধেকে চুপ দেখে মহেন পালই প্রথম শুরু করল। সকাল থেকে যা যা হয়েছে সেসব জানিয়ে শেষে গোবিন্দর কথাটা পাড়ল। সে বুঝতেই পেরেছিল যে নিধের কথাতেই গোবিন্দ গাঁয়ের চারিদিকে নজর করতে আর চোরের হদিশ করতে বেরোচ্ছে রাতে, নিজে চুরি করতে নয়। তবু হারানের দোকানে এ নিয়ে কথা উঠতে সে কোনো মন্তব্য করেনি, সে চায়না এটা লোক জানাজানি হয়ে চোর সতর্ক হয়ে যাক।
    নিধিরাম একটু হেসে বলল,
    -"দাদা তুমি ঠিক কি শুনেছ বল দেকি, কাল রাতের ব্যাপারে?"
    মহেন নিধিরামের কাছে তার সেই ভাবনা প্রকাশ করে যা সে এতক্ষণ কারো কাছে বলেনি।
    -"দ্যাখ নিধে, গোবিন্দরা চাটুজ্জ্যে গিন্নীর ভূত দেকেচে এ আমি বিশ্বেস করিনি। যদি সত্যিই ও গিন্নীর ভূত হত কস্মিন কালেও সধবা ভুত সাদা থান কাপড় জড়িয়ে আসবেনি। আমার মনে ধরে ও চোর ব্যাটাই হবে, চাটুজ্জ্যে বাড়ি ঢুকতে যাচ্ছিল। ওদের আঁচ করে পরনের ধুতি ঘোমটা করে জড়িয়েছে ভয় দেখাতে।"

    নিধে জানে মহেন পালের বুদ্ধির কথা, সে মহেনকে গোবিন্দর কাছে শোনা রাতের সমস্ত বৃত্তান্ত বলল। গোবিন্দ রাতেই গিয়ে তাকে জাগিয়ে সব কথা বলে এসেছে কারন পরে হয়ত সেই লোক গোবিন্দর ওপর নজর রাখবে, আর সুযোগ হবেনা।
    সব শুনে মহেন পাল উত্তেজিত, তাহলে তো আজ রাতেই লোকটাকে ধরা যায়। দরজা ভেজিয়ে দুই বুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পরামর্শ করতে, সব কথাই চাপা গলায় হচ্ছে। বেশী লোক জানাজানি করতে চায়না তারা। গিন্নীর পাঠানো চা পড়ে পড়ে ঠান্ডা হয়ে যায়। ভেজানো দরজা দেখে কিছু বুঝতে না পেরে পালগিন্নী ও তার দু চারজন শাগরেদ কাজের ফাঁকে মুখ ব্যাঁকায়। বুড়ো বয়সের ভীমরতি, ছেলেখেলা হচ্ছে সব নাওয়া খাওয়া ভুলে!

    প্রায় ঘন্টাখানেক পরে নিধিরাম বাড়ির দিকে যায় ধীরুর সঙ্গে। মহেন পাল চান খাওয়া করে সবই একটু অন্যমনস্ক ভাবে। রোগী না হয় ধরা গেল কিন্তু রোগটা পরিস্কার হচ্ছে না। ডিবের রহস্য কি, তার সাথে চাটুজ্জ্যেদের কি সম্পর্ক, রামীবুড়ির গুরুদেবই বা এতকাল বাদে এ কাহিনীতে কিভাবে আসছে কিছুই পরিস্কার নয়!
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৩ জুন ২০১০ ১২:০২449862
  • উকিলদের বাড়ীতে আজ সাজ সাজ রব। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে আসছে। গাঁয়ে কোনো বাড়িতে মেয়ে দেখতে এলে সারা গাঁয়েই একটা হইচই পড়ে যায়। আশেপাশের বাড়ির মেয়েরা সব সকাল সকাল নিজেদের বাড়ির কাজকম্ম সেরে মেয়ের বাড়ীতে জড়ো হয়, হাতে হাতে ঘরের কাজকম্ম করে। গিন্নীরা রান্নার দিক সামলায়, অল্পবয়সী মেয়ে বউরা ঘর গোছানো মেয়ে সাজানো এসবে হাত লাগায়। গয়নাগাঁটি শাড়ী ফুলদানি বেডকভার সব সেরাটা নিয়ে আসা হয় পাড়ার এর ওর বাড়ী থেকে। মেয়ে তো শুধু বাড়ির নয় সারা পাড়ার, সারা গাঁয়ের সম্মানের ব্যাপার। গাঁয়ের গণ্যমান্যরা আসে সব তদারকি করতে।

    ছেলেপক্ষ আসবে দুপুরে, খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম টিশ্রাম নিয়ে গোধূলিতে মেয়ে দেখে ফিরবে।
    নগা শেষমেশ কইমাছ না পেলেও রুই চিংড়ী এসব নিয়ে এসেছে, এছাড়া সাজেদের দোকান থেকে আগে থেকে বলে ভালো খাসির মাংস আনা হয়েছে, নিতাইয়ের দোকানের রাবড়ি, এলাহী ব্যাপার।
    বরপক্ষ এসে পৌঁছেছে বেলা একটার পর, প্রায় জনা দশেক লোক। রান্না খাওয়া সারতে সারতে তিনটে বেজে গেছে। এরকমই হবে সবাই তা জানে। তাই গাঁয়ের লোক যখন দিবানিদ্রা সেরে উকিল বাড়ীতে পৌঁছতে আরম্ভ করল তখন পাত্রপক্ষ এট্টু গড়িয়ে উঠে চা নিয়ে বসেছে। মেলা লোক,সদর দুয়ারে বড় বড় চাটাই পেতে বসার ব্যবস্থা হয়েছে, সেখানে মাথারা বসেছে। অন্য সবাই এদিক ওদিকে দাঁড়িয়ে দেখছে, ভেতরের উঠোনে মেয়েরা ভীড় করেছে।

    মেয়ে দেখা টেখা নির্বিঘ্নেই চুকে গেল। এত হট্টগোলে পাত্রপক্ষ মেয়েকে কত ভালো করে দেখল সে নিয়ে সন্দেহ আছে। অবশ্য তাদের কাছেও এর পরবর্তী অর্থাৎ দেনাপাওনার কথাবার্তাই মুখ্য ব্যাপার। মেয়েকে দেখা তো একটা নিয়মরক্ষা, কানা খোঁড়া নয় ওটুকু হলেই হল।
    হারানও একফাঁকে এসে বসেছিল একধারে। এসব ব্যাপারে একবার এসে মুখ না দেখিয়ে গেলে গাঁয়ে নিন্দে হবে। তার বোন দুগ্গাও আছে ভেতরে, দুগ্গাকে এসব কাজে সবাই ডেকে নিয়ে আসে, তার ঘর সাজানোর হাত খুব ভালো। অন্যদিন হলে হারান গাঁয়ের রোজের একঘেয়েমীর থেকে একটু অন্যরকম কিছু হচ্ছে বলে উৎসাহ নিয়েই আসত, কিন্তু আজ তার এসবে মন নেই। হাট থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে গেছিল। নাইতে খেতেই বেলা হয়ে গেছিল। আজ তার দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রাও হয়নি, দোকান খুলে বিশেকে বসিয়ে বেরিয়েছে। যত শীগগির সম্ভব মহেন দাদুর সঙ্গে দেখা করে সব কথা না বলতে পারলে তার শান্তি হচ্ছেনা। ভেবেছিল এখানেই দেখা হয়ে যাবে কিন্তু এখন দেখছে পালকত্তা আসেনি, তার বড় ছেলে এসেছে। তারমানে পালদাদু আসবেনা।

    মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেছে, হারান এবার পালাবে বলে দাওয়া থেকে নেমে দাঁড়ালো রাস্তার ওপর। নগার দাদা বগা দেখতে পেয়েছে তাকে। কাছে এসে বলল,
    -"দেখছিস কিরকম সোন্দর দেখতে ছেলেটাকে? আবার সরকারী চাকরি করে, বুনির কপাল ভালো বলতে হবে।"

    হারান একবার দলটার দিকে তাকিয়ে দেখল, দু তিনটি কম বয়সী, বাকি সবাই বুড়োর দল। খুব সুন্দর কোনো ছেলে চোখে পড়ল না, কোনটা পাত্র বোঝা যাচ্ছেনা। বয়স্কদের মধ্যে নানারকম গম্ভীর আলোচনা চলছে, ছেলেছোকরারা বরপক্ষর সাথে হালকা হাসিঠাট্টা করছে। গাঁয়েঘরে এরকমই হয়, মেয়ে বা ছেলে দেখতে এলেই সবাই এমন ভাব করে যেন বিয়ে পাকাই হয়ে গেছে। এখানেও তাই হচ্ছে, নগা বগার কাকা ভজহরি একটু অতি বোকাচালাক ধরণের। গাঁয়ে তাকে নিয়ে খুব খোরাক করা হয়। আজ তাকে সামলানো গেলনা, তার নিজের বাড়ীর কাজ!
    কেউ কিছু বোঝার আগেই সে পাত্রপক্ষ যেখানে বসেছিল সেখানে এসে খুব কায়দা করে পাত্রকে বলল,
    -"তা বাবাজী তুমি তো অনেক লেখাপড়া করে পাশ দিয়েছ, চাকরিও করছ, বুদ্ধি অনেক। আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও তো দেকি। প্রশ্ন মানে একটা সহজ ধাঁধা আর কি।"
    সবাই প্রমাদ গুণল, ভজহরির ধাঁধার কোনো মাথামুন্ডু থাকেনা, বরপক্ষ ক্ষেপে না ওঠে। আবার মেয়ের কাকা বলে কথা, বাইরের লোকের সামনে তাকে কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

    একটি ছেলে হাসি হাসি মুখ করে ভজহরির দিকে তাকালো, তাতেই হারান বুঝল ওটিই পাত্র। সবাই উদগ্রীব হয়ে বা উদ্বেগ নিয়ে ভজহরি আর পাত্রর কথা শুনছে। ভজহরি পুরো আসরের ওপর চোখ বুলিয়ে একটু জ্যাঠা হাসি হেসে শুরু করে,
    -"তা বাবাজী, এই ধরো তুমি সকালে উঠেছ, তারপরে জলটল খেয়ে দু মাইল রাস্তা এসে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেছো। তারপরে বাসে উঠে এক ঘন্টায় গাবপুরে নেমেছ। গাবপুর থেকে দু মাইল রাস্তা হেঁটে এসেছ আমাদের বাড়ী। তারপরে জলমিষ্টি খেয়েছ একটার সময়, ভাত খেয়েছ তিনটের সময়, চা খেয়েছ চারটেয়। এখন পাঁচটা বাজে। এই সব তথ্য দিয়ে তোমাকে হিসেব করে বলতে হবে আমার বয়সটি কত।"

    আসর প্রায় হতবাক, এ কিরকম ধাঁধা! একটু ছোট ছেলেরা অনেকে দু মাইল ঘন্টা এসব আঙুলে কড়া গুনতে শুরু করে। বড়রা একটু চুপ থেকে তারপর পাছে বরপক্ষ অপ্রসন্ন হয় তাই নানা কথা বলে প্রসঙ্গ ঘোরাতে শুরু করে। পাত্র ছেলেটি প্রথমে একটু থতমত খেয়ে যায়, কিন্তু পরক্ষনেই সামলে নিয়ে মিটিমিটি হেসে ভজহরির দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
    -"আজ্ঞে, আপনার বয়স হবে পঞ্চাশ বছর।"
    এবার ভজহরির পালা হতভম্ব হবার, এক্কেরে ঠিক বলেছে যে! সে একটু আমতা আমতা করতে থাকে "এ: আন্দাজে বলেছ বাবাজী। তুমি কি করে জানলে আমার বয়স" ইত্যাদি। পাত্রীর বাবা ভজহরির দাদা আর রায়কত্তা এক ধমক দেয় ভজহরিকে,
    -"উত্তর যখন সঠিক হয়েছে তখন কি করে দিয়েছে তা নিয়ে তুই বলার কে। জামাই বুদ্ধিমান এতো প্রমাণ হয়ে গেল নাকি?"
    সবার মুখে হাসি, শুধু ভজহরির মুখ কালো। তাই দেখে ছেলেটি একটু হেসে বলল,
    -"কিভাবে বললাম তা জানতে চান কাকাবাবু? তাহলে শুনুন, আমার এক মামাতো ভাই আছে আধা পাগল, তার বয়স পঁচিশ। আপনার ধাঁধা শুনে মনে হচ্ছে আপনি পুরো পাগল, তাই পঞ্চাশ, এতো খুব সোজা হিসেব।"
    পাত্রপক্ষের সবাই একটু গম্ভীর হয়ে গেছিল, এবার তারা প্রাণ খুলে হেসে উঠল, সাথে এপক্ষের অনেকেও।
    -"কেমন রসিক ছেলে দেখেচ!"
    কারুর কারুর বলার ধরণ একটু খারাপ লাগলেও বড়রা একথা ওকথা বলে আবহাওয়া হালকা করে দিল। বেলা হয়ে এসেছিল, পাত্রপক্ষকে বাস ধরতে হবে। এরপর আর তারা বেশীক্ষণ বসলনা, রওনা হয়ে গেল। উকিলদের বাড়ির আসরও আর জমলনা, দু একজন করে উঠতে শুরু করে দিল।

  • Nina | 64.56.33.254 | ২৩ জুন ২০১০ ২০:২৫449863
  • সত্যি, শ্রাবণী, কি অপূর্ব্ব যে লিখছ কি বলি। এমন লেখা বেশ নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়তে হয়---পরের কিস্তির জন্য নি:শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হয়---তোমার হাতটি সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতন :-))

  • Nina | 64.56.33.254 | ২৫ জুন ২০১০ ০০:৩১449864
  • weekend এ লিখবে তো শ্রাবণী? প্লিজ।
  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:২৩449865
  • হারান উকিলদের ওখান থেকে আগেই বেরিয়ে এসেছিল, পথে তার দোকান পড়ল। আজ সবাই উকিলদের বাড়ী গেছে বলে তার দোকান বা বারোয়ারীতলার আসর প্রায় ফাঁকা। দোকানে শুধু আশু চাটুজ্জ্যে বসে আছে, বিশে তার সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছে একতরফা। বিশেকে দোকান সামলাতে বলে সে চলল পালেদের বাড়ীর দিকে।
    পা চালিয়ে চলল, অন্ধকার প্রায় হয় হয়। যখন পাল বাড়িতে পৌঁছল,পাল কত্তা নিজের ঘরের ভেতরে ছিল, দরজা ভেজানো। আজ বৈকালিক ভ্রমনে বেরোয়নি বলে গিন্নী গজগজ করছে ছেলে বৌদের কাছে। সেই দুপুর থেকে নাকি চুপচাপ, শরীর খারাপ কিনা তাও বলছেনা। কত্তা আরামকেদারায় চোখ বুজে শুয়েছিল, হারানের পায়ের আওয়াজে চোখ খুলল। এসময় ওকে দেখে একটু অবাকই হল মনে হয়।
    -"কি রে তুই, কি ব্যাপার?"
    হারান সামনের মোড়াতে বসে বলল,
    -"দাদু সরীরটরীর খারাপ নাকি, ঠাকমা বলছিল আজ বেড়াতে যাননি।"
    মহেন টেবিলে রাখা জলের গেলাস থেকে জল খেয়ে মুখ মুছে বলল,
    -"না:, ওসব কিছু না। সকালে অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে, অবেলায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। তাই আর বেরুইনি এবেলা। তা তুই কি মনে করে?"
    -"দাদু হাটে গিয়ে আজ গোকূল গুঁইয়ের সাথে দেখা হল।"
    -"কার সাথে?"
    -"গোকূল গুঁই গো। সেই যাকে দেখে আশু দাদু "হলধর হলধর" করেছিল।
    এতক্ষন মহেন পাল শোয়া মত হয়ে কথা কইছিল, এবারে একবারে ধরপড় করে উঠে বসল। হারান গোকূলের কাছ থেকে শোনা পুরো কাহিনী মহেন কে শোনাল এবার।

    *************************
    মনোহর ভটচাজের বাপ ছিল কৈজুড়ির জমিদারবাড়ীর কুলপুরোহিত। সংসারে এক বাপ ছাড়া আর কেউ ছিলনা তার। মনোহর বাপ ঠাকুদ্দার মতো পুরুতগিরি কে পেশা করবে ভাবেনি। সে পড়াশোনায় খুব উৎসাহী ছিল,তাই তার বাপ তাকে কাশীর এক আশ্রমে পাঠায় সংস্কৃত পড়তে। পড়াশোনা শেষ করে ফেরে যখন তখন বাপের মৃত্যু হয়েছে। জমিদার মনোহরের ছেলেবেলার বন্ধু,তার অনুরোধে শেষমেশ মনোহর কৈজুড়িতেই রয়ে যায়,মন্দিরের পুজোর ভারও নেয়। বাকীসময় পড়াশোনা করত আর নিজের বাড়ীতে পাঠশালা খুলে গুটিকয়েক ছাত্র পড়াত। বিয়ে থা করেনি,পড়াশোনা নিয়েই থাকত, মাঝেসাঝে তীর্থ এদিক সেদিক ঘুরতে বেরিয়ে যেত। তবে বেশীরভাগ কাশীতেই যেত, তার পুরনো আশ্রমে। এরকমই এক ভ্রমনের সময় তার দেখা হয়ে থাকবে রামী দের সঙ্গে।

    জমিদারের মৃত্যুর পরে তার ছেলে রাধানাথ জমিদারীর ভার নেয়। সে লোক ভাল কিন্তু অলস প্রকৃতির ছিল। সম্পত্তি কিছু কম ছিলনা, দেখভাল সব কর্মচারীরাই করত। আয়পত্র কমে আসছিল, এদিকে খরচের কমতি নেই। জমিদার নজর না দেওয়ায় মামলা মকদ্দমাতেও হার হচ্ছিল।
    জমিদার অলস বলে কর্মচারীরা ষড় করে ভেতরে ভেতরে লুটেপুটে খাচ্ছিল। এইসবের মূলে ছিল রাধানাথের মার দূর সম্পর্কের এক ভাইপো, সুরেন। গরীব কিন্তু লেখাপড়া জানা ছেলে, তাকে রাধানাথের মা নিয়ে আসেন রাধানাথকে সাহায্য করতে। তিনি বুদ্ধিমতী হলেও এই এক হিসেবে ভুল হয়েছিল। এমনিতে নিজে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে ধম্মকম্ম নিয়েই থাকতেন, সংসারে মাথা ঘামাতেন না। এই সুযোগে সুরেন জাঁকিয়ে বসে জমিদারবাড়ীতে ও আস্তে আস্তে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে, আর রাধানাথ তার হাতের পুতুল।

    জমিদার গৃহিনী আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়ত চেষ্টা করে জমিদারী ও ছেলেকে সুরেনের কবল থেকে ছাড়াতে পারতেন, কিন্তু তিনি বেশীদিন বাঁচেননি।তবে যাবার আগে কি ভেবে তিনি একটা কাজ করেন। এদের বাড়ীতেও অন্যান্য জমিদারদের মত কয়েকপুরুষের জমানো সোনাদানা হীরে জহরত এসব এক করে রাখা ছিল দু:সময়ের জন্য। এছাড়া রাধানাথের মায়ের বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া সোনাদানার পরিমাণ ও কম ছিলনা। কি মনে করে সবকিছু তিনি একদিন গোপনে গচ্ছিত করেন মনোহরের কাছে, ছেলেবৌকেও কিছু জানান না। তার সঙ্গে নির্দেশ দেন যেন এদের দু:সময়ে একেবারে শেষ উপায় হিসেবে এসব ব্যবহার করা হয়। এটাই নিয়ম এবাড়ীর। এছাড়া মূল্যবান কিছু দলিল দস্তাবেজও তিনি মনোহরের হাতে তুলে দেন কাউকে না জানিয়ে।
  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:২৬449866
  • রাধানাথের মার মৃত্যুর পর চোখের পরদার আর বালাই রইলনা। রাধানাথ কে পুতুল বানিয়ে সুরেনই একরকম কর্তা হয়ে উঠল, তার কথাতেই জমিদারী চলত। অবশ্য ওপরে ওপরে সব কিছুতে তখনও রাধানাথকেই সে সামনে রাখত জমিদার হিসেব। রাধানাথের নিজের এ ব্যাপারে কোনো নালিশ ছিলনা, সব ঝামেলা সুরেন দাদা সামলায় বলে সে একরকম খুশীই ছিল। রাধানাথের ছেলের যখন বছর খানেক বয়স হবে তখন একদিন রাধানাথ অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অসাবধানে পড়ে মাথায় চোট পায়।
    হয়ত ভালো করে ডাক্তার দেখালে, শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করলে ভালো হয়ে যেত। কিন্তু সেসব কিছুই হয়না, গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তার আর কবরেজ চিকিৎসা করল। টাকাপয়সা সব সুরেনেরই হাতে, সে যা ঠিক করে তাই হয়। কেউ কিছু ভালো করে বুঝে উঠতে পারার আগেই রাধানাথ মারা যায়।

    সুরেন এবার পুরনো লোকেদের একে একে বিদেয় করতে শুরু করে। মনোহর ততদিনে নিজেই জমিদারবাড়ীর পুরুতগিরি ছেড়ে দিয়েছে, সুরেনের দুর্ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে। তবে তাঁর কাছে গচ্ছিত সম্পদের কথা কেউ জানতনা, এ নিয়ে কোনো কথাও বের হয়নি, তিনিও চুপ ছিলেন। তিনি গ্রাম ছেড়েই চলে যেতেন শুধু তার ওপর যে গুরুদায়িত্ব আছে তার কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
    এমনি অবস্থায় একদিন রাধানাথের স্ত্রী তার কাছে আসে ছেলেকে নিয়ে। জমিদারগিন্নী হয়েও তার খুবই দুরবস্থা, এককোণে পড়ে আছে কোনোরকমে। নিজের সম্বল বলতে কিছুই নেই,সুরেনই এখন জমিদার হয়ে বসেছে, তার পরিবারের লোকেরাই জমিদারবাড়ী চালায়। কিছু প্রজাকে হাত করে এরা দিব্যি রাজত্ব করছে কৈজুড়িতে।

    মনোহর ভেবে দেখে যে এখন মামলা মকদ্দমা করে পুলিশ দিয়ে এদের তাড়াতে হয়। মামলা করলেই তার তদ্বির তদারক আছে, সেসব করা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়, সে পুজারী বামুন বিষয় ব্যাপার কিছু জানেনা । কৈজুড়ির বেশীরভাগ লোকই এখন সুরেনের দলে গিয়ে ভিড়েছে, প্রজাদের কাছ থেকে কতটা সাহায্য পাওয়া যাবে বলা মুশকিল। তারপরে মামলা কবছর চলবে তারও ঠিক নেই, তখন এরা যাবে কোথায়! রাধানাথের দোষেই আজ তার পরিবারের এ অবস্থা। এছাড়া মামলাটামলা এখন করলে, দুর্জনে অনেক কিছুই করতে পারে, রাধানাথের স্ত্রীপুত্রের জীবন সংশয়ও হতে পারে।

    জীবন বলে একজন প্রজা জমিদারবাড়ীতে নানা ছোটখাটো কাজকম্ম করে দিত, রাধানাথের মায়ের খুব প্রিয় ছিল। এমনিতে তার জমি জায়গা ছিল, সে জমিদারদের ঠিক চাকর ছিলনা। মনোহরের সঙ্গে জীবনের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, মনোহরকে ভালোবেসে সে তারও কাজকম্ম করে দিত, দেখাশোনা করত। মনোহরও জীবনকে খুব পছন্দ করত। এই রকম একটা সময়ে সে একমাত্র জীবনকেই বিশ্বাস করতে পেরেছিল। দুজনে অনেক পরামর্শ করে ঠিক করে আপাতত রাধানাথের স্ত্রী আর ছেলেকে কৈজুড়ি থেকে সরিয়ে দিতে হবে, তাদের সুরক্ষার জন্য। সেইমত জীবন গিয়ে দুই গাঁ দুরে ওদেরকে বৌয়ের বাপেরবাড়ীতে রেখে এল কাউকে কিছু না বলে।
    বৌ জমিদারের মেয়ে ছিলনা, তাদের সাধারণ গৃহস্থ বাড়ী। বাপ মরে গিয়ে ভাইয়েদের সংসার, তারা নি:সম্বল দেখে বোনকে নিয়ে খুব উচ্ছসিত হলনা। বরং আপত্তিই জানাল বোন তার ন্যায্য পাওনাগন্ডা ছেড়ে চলে আসায়। কিন্তু তাকে দিয়ে মামলা করানো ইত্যাদি ঝুটঝামেলায় যেতেও তারা সাহস করলনা।

  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:২৯449867
  • মনোহরের কাছে যা গয়নাগাঁটি ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র গচ্ছিত ছিল তার দাম অনেক হয় কিন্তু সেসব তখন প্রকাশ পেলে এদের বিপদ হতে পারে, আত্মীয়রাই লুটেপুটে নেবে। তাই মনোহর জীবনের সাহায্যে এমন ব্যবস্থা করল যাতে রাধানাথের স্ত্রী স্বাধীন অথচ সাধারণ ভাবে থেকে ছেলেকে বড় করতে পারে। কিছু জমিজায়গা আর একটা ছোট বাড়ির ব্যবস্থা করা হল মূলধনের কিছু ভেঙে, তার ভাইদের বাড়ির কাছে। কথা ছিল বাকী যা আছে সেসব আপাতত মনোহরের কাছেই থাকবে,রাধানাথের ছেলে বড় হলে তিনি তার হাতে তুলে দেবেন বা তুলে দেবার ব্যবস্থা করবেন। তখন ঐ ছেলেই তার জমিদারী উদ্ধার করতে পারলে করবে!

    সব ব্যবস্থা হয়ে যাবার পরে মনোহর কৈজুড়ি ছেড়ে চলে এলেন এই গাঁয়ে। এখানে শিবুর দাদু দিদিমা তার সাক্ষাত শিষ্য না হলেও এদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল, খুব মান্যি করত এরা তাঁকে। এখানে আসার পর আরো কিছু ভক্ত জুটে গেল, জায়গাটাও তার ভালো লেগে গেল। জীবন তার সঙ্গে এখানে দেখা করে গেছে বারকয়েক।
    বছরখানেক পরে মনোহর খবর পান ওনার কাশীর গুরু হরিদ্বারে আশ্রম করেছেন। তখন উনি ঠিক করেন উনি বাকী জীবনটা কাশী আর হরিদ্বার করেই কাটিয়ে দেবেন। যাবার আগে মনোহর জীবনকে বেশ কিছু টাকাপয়সা দিয়ে যান এদের দেখভালের জন্য, আর বলে যান যে রাধানাথের ছেলে বড় হলে কি করতে হবে তার নির্দেশ উনি যথাসময়ে পাঠাবেন, এ নিয়ে যেন সে না ভাবে। মনোহর বছরে দু একটা চিঠি লিখতেন খোঁজখবর নিতে, তিনি সাধুপুরুষ ছিলেন, তাকে নিয়ে জীবনের মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি।

    ধীরে ধীরে কৈজুড়ির জমিদারবাড়ীতে গন্ডগোল বাধে। সরকার জমিদারী নিয়ে নেবে এই ভয়ে জমি জায়গা বেচে ব্যবসা করতে গিয়ে বিস্তর লোকসান করে সুরেন। গাঁয়ে যারা ওকে এককালে মদত দিয়েছে তারাও সুযোগ বুঝে বেইমানী করতে লাগল। শেষকালে বছরদুয়েক আগে প্রায় সর্বস্ব খুইয়ে সে মরে যায়। বিষয় আশয় যা অল্পবিস্তর বেঁচে ছিল তা বেচেবুচে তার ছেলেপিলেরা অন্যত্র চলে যায়, বাড়ী খালি করে।

    এইসময় রাধানাথের স্ত্রী কৈজুড়ি ফিরে যেতে পারত কিন্তু জমিদারীর কিছুই ছিলনা, সেখানে চলবে কি করে! জীবন জানত যে মনোহরের কাছে যা সম্পদ আছে তা দিয়ে কৈজুড়ির বাড়ীর হাল ফেরানো যায়। জমিজমা যা বেচা হয়েছে তা বৈনী, দলিলপত্র দিয়ে প্রমাণ করে উদ্ধার করা যায়। সে মনোহরকে কাশীর ঠিকানায় চিঠিও লেখে এ বিষয়ে, কিন্তু কোনো উত্তর পায়না বলে ধরে নেয় মনোহরের এতে সায় নেই। এরপর থেকেই মনোহরের চিঠি আসা বন্ধ হয়।
    এদিকে রাধানাথের ছেলে রতন কুড়িতে পড়ল, তখনও মনোহরের কোনো খবর নেই। রতনকে পড়াশোনা করতে শহরের কলেজে পাঠানো দরকার। যা টাকা আছে তাতে শহরে থাকা পড়ার খরচ জীবন টানতে পারবেনা। এখনই মনোহরের সাহায্যের প্রয়োজন, অথচ তার কোনো খবর নেই। জীবন বেশ চিন্তায় পড়ে, সে গ্রামের লোক, কাছাকাছি ছাড়া গ্রামের বাইরে কোনোদিন যায়নি, এছাড়া তারও বয়স হয়েছে। কি করবে স্থির করতে পারেনা!
  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:৩৮449868
  • হলধর জীবনের দুরসম্পর্কের ভায়রা হয়। এসময় একদিন জীবনের শ্বশুরবাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে তার হলধরের সঙ্গে দেখা হয়। কথায় কথায় সে জানতে পারে হলধরের পেশার কথা। গাঁয়ে নানা বিষয়ে যেমন মামলা মকদ্দমা ইত্যাদিতে লোকের অনেক খবর তথ্য সূত্র এসবের দরকার হয়, শত্রুপক্ষের মামলা সংক্রান্ত গোপন খবর এসব বার করার জন্য লোকে ভালো টাকা খরচ করে। হলধরের ব্যবসা হল পয়সা নিয়ে নানা খবর সংগ্রহ করে চালাচালি করা। একাজে তাকে অনেকসময়ই ঘুরে ঘুরে রীতিমত গোয়েন্দাদের মত অনুসন্ধান করতে হয়। অনেক জায়গা ঘুরে তার অভিজ্ঞতাও অনেক। এমনিতে এসব কাজ করতে গিয়ে হলধরকে অনেকসময় বেআইনী কাজকম্মও করতে হয়েছে, ছিঁচকে চুরি বাটপাড়ি, তবে কারো ক্ষতি সে করেনি। জীবনের সব দেখেশুনে মনে হয় হলধরই পারে তার সমস্যা মেটাতে। সে হলধরকে সব কথা বলে। হলধর যদি কিছু করে মনোহরকে খুঁজে বার করে। রতনের প্রাপ্য সম্পদ উদ্ধার করতে পারলে ভালো পারিশ্রমিক পাইয়ে দেবে এও কথা দেয়। এখনকার খরচপাতির জন্য কিছু টাকাপয়সাও খরচ করতে রাজী হয়, মনোহরের দেওয়া টাকা তার কাছে কিছু ছিল তখনও।

    হলধর ভেবে দেখে মনোহরের যদি কিছু হয় তাহলেও তিনি কোনোভাবে খবরটা জীবনের কাছে পৌঁছবার ব্যবস্থা করবেন। তাই মনে হয় মনোহর এখনও বেঁচে আছেন। বেঁচে থেকে চিঠি পত্র না লেখার কারণ হতে পারে আসলে তিনি অসুস্থ। সে খুঁজে খুঁজে কাশীর আশ্রমে যায়। সেখানে তারা জানায় মাসকয়েক আগে হরিদ্বারে মনোহরের মৃত্যু হয়েছে। শেষ দু বছর তিনি হরিদ্বার আশ্রমেই ছিলেন,তার জিনিসপত্রের খোঁজ সেখানেই পাওয়া যাবে। হরিদ্বারে গিয়ে আশ্রমের সাধুদের সঙ্গে কথা বলে সে অবাক হয়। জীবনের জন্যে বা রাধানাথের স্ত্রী ছেলে কারো জন্যই কোনো নির্দেশ নেই। জিনিসপত্র বলতে নাকি মনোহরের ছিল একটা ছোট টিনের তোরঙ্গ তাতে অল্প জামাকাপড় আর কিছু বইপত্র। তাহলে মনোহর তার কাছে রাখা গচ্ছিত সম্পদ কোথায় রাখল!

    জিনিসপত্র দেখতে চাইতে ওরা বলল দুবছর আগে কাশী থেকে মনোহরের সঙ্গে একজন শিষ্য আসে, সে নাকি মনোহরের চেনা, গাঁয়ের লোক। এই শিষ্যটিই অসুস্থ মনোহরের দেখাশোনা করত। এও জানল যে বাতের অসুখে আঙুল প্রায় পঙ্গু হয়ে যায় বলে মনোহর শেষ কয়েক বছর লেখালেখি করতে পারত না। শেষ দিকে চিঠিপত্র সব সেই শিষ্যই লিখে দিত। সেইই গুরুর মৃত্যুর পর তার সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে, শুধু বইপত্র আশ্রমে দিয়ে গেছে। জীবনের খবর বা ঠিকানা আশ্রমের প্রধানের জানা ছিল, তিনি তাকে খবরটা দিতেও চেয়েছিলেন, কিন্তু মনোহরের শিষ্য বারন করে। সে গাঁয়েই ফিরে যাবে আর সেখানে গিয়ে জীবনের সঙ্গে দেখা করে খবর দেবে।

    হলধর ফিরে গিয়ে সবকথা জীবনকে জানাল। মনোহরের শিষ্য গাঁয়ের কে হতে পারে জীবন কিছু বলতে পারলনা। হলধরের মতে মনোহর সাধু মানুষ, কাশী হরিদ্বারে জীবন কাটাবেন বলে পথে বেরিয়েছিলেন। তিনি সঙ্গে এত ধনসম্পদ নিয়ে মোটেই যাননি। সম্ভবত বেরোবার আগেই তিনি সবকিছুর ব্যবস্থা করে গেছেন। তীর্থে ধর্মকর্ম না করে যখের ধন পাহারা দেবেন, তা হয় নাকি!
    অতএব যে গ্রাম থেকে উনি যাত্রা করেছেন, সব সেখানেই কোথাও আছে। সন্ধান করতে হলে এই গাঁয়েই করতে হবে আগে। হয়ত মনোহরের শিষ্য শেষবেলায় মনোহরের কাছে সব জেনেছে, তাকে বলেছেন জীবনকে জানাবার কথা, কিন্তু সে লোভে পড়ে সব চেপে গেছে। এরকম হলে ওদের তাড়াতাড়ি এই গাঁয়ে গিয়ে খোঁজখবর করতে হবে, শিষ্য এসে সব নিয়ে পালাবার আগেই।

    হলধর স্থির করে সে আগে এ গাঁয়ে এসে খোঁজখবর করবে তারপর দরকার পড়লে জীবনকে খবর দেবে, জীবন যাবে। হলধরের নিজের কাজের জন্য অনেক জায়গায় যাতায়াত আছে, গাবপুরে তার চেনা লোক আছে, অসুবিধে হবেনা। যেটা সে জীবনকে বলেনা তা হল তার বাবা সদরে আশু চাটুজ্জ্যের দোকানে কাজ করত। মাঝে মাঝে বাবা তাকে দোকানে কাজ করতে পাঠাত। কম বয়সের অপক্ক বুদ্ধিতে এক সুযোগে দোকান থেকে গরমিল করে টাকা মারতে গিয়ে আশুবাবুর কাছে ধরা পড়ে এবং পাঁচশ বার কানধরে উঠবোস করিয়ে আশুবাবু তার বাবার হাতে তুলে দেয়। এরপর বাবা এমন খড়মপেটা করে যে সে আর কোনোদিন এধরণের কাজ করতে সাহস পায় নি। জীবন যখন তাকে জানায় মনোহরের সবচেয়ে কাছের লোক ছিল আশু চাটুজ্জ্যে ও রামীবুড়িরা, সে একটু ধন্দে পড়ে। তবে এখন চাটুজ্জ্যে মশায়ের নিশ্চয়ই অনেক বয়স হয়েছে। সে নিজেও মধ্যবয়সী,তাকে এখন আর চিনতে পারবে বলে মনে হয় না। এইসব সাতপাঁচ ভেবে হলধর এ গাঁয়ের দিকে রওনা দেয়।

    যেদিন সে এখানে পৌঁছল তার আগের দিনই রামীবুড়ির বাড়ি চুরি হয়ে গেছে। সারাদিন সেখানে ভীড় হট্টগোল, হলধর তাই আর সেদিকে গেলনা। চাটুজ্জ্যে বাড়িতে গিয়ে বাইরে মুনিষদের জিজ্ঞেস করে জানল, আশুবাবু কারুর সাথে কথা তেমন বলেনা, বাইরের লোকের সাথে তো একেবারে নয়। সারা গাঁয়ে চুরি নিয়ে হইহই চলছিল বলে নিজের পরিচয়ও দেয়নি কারু কাছে। সে বাইরের লোক,কোথা থেকে কি হয়ে গাঁয়ের লোকে যদি শেষে তাকে সন্দেহ করে! সন্ধ্যে অবধি অপেক্ষা করে করে হারানের দোকানে আসে। সেখানে সে আশু বাবুর কাছে মনোহরের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু চাটুজ্জ্যে বুড়ো কোনো কথাই কয়না তার সাথে, তাকে চিনতেও পারেনা।

    রাতটা গাবপুরের কাছেই তার এক চেনা লোকের বাড়িতে থেকে পরদিন ফিরে এসে শোনে হারানের দোকানের চুরির খবর। এদিক সেদিক কথা শুনে বুঝতে পারে আগের দিন তাকে কেউ কেউ দেখেছে এবং সন্দেহ করছে। তখন সে ভয় পেয়ে নিজের আসল নাম বলেনা হারানকে। সব দেখেশুনে তার ধারণা হয় এখানে কিছু একটা গন্ডগোল হতে যাচ্ছে। তাই সে ঠিক করে খোঁজখবর করে যতদিন না ধনসম্পদের একটা হদিশ করতে পারছে ততদিন সে এদিকেই রয়ে যাবে।
    এইসময় হঠাৎ দোকানে আশু চাটুজ্জ্যে তার নাম নেওয়ায় সে আরো ঘাবড়ে যায়, যদি কোনোরকমে প্রকাশ হয় যে সে নাম ভাঁড়িয়েছে তাহলে তার ওপর সন্দেহ জোরালো হবে আর আসল চোর তার আড়ালে নিজেকে বাঁচিয়ে কাজ উদ্ধার করে নেবে। এরপর সে নানারূপে গাঁয়ে ঘুরে বেড়ায় আর তল্লাশ করতে থাকে। যা দেখে তাতে মনে হয় মনোহরের সম্পদ এখনও সেই চোর শিষ্যের হাতে পড়েনি। হয়ত মনোহর খোলাখুলি কিছু না বলে সাটে বলে গেছে এবং সে তার মানে ধরতে পারছেনা বা ভুল ধরেছে।
    এছাড়া হলধরের এও সন্দেহ যে রামীবুড়ির আর আশু চাটুজ্জ্যের বাড়ির সঙ্গে সে যা খুঁজছে তার একটা সম্পর্ক আছে।

    ****************
  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:৩৯449644
  • সব কথা বলে হারান দেখে মহেন একটু চিন্তিত মুখে ঘাড় নাড়তে থাকে।
    -"এতো একেবারে নাটক নবেলের মতো গপ্প রে! তা এই হলধর যে সব সত্যি বলছে তার কিছু প্রমাণ পেয়েছিস?"
    এবার হারান মাথা চুলকায়,
    -"না মানে, সত্যি বলেই তো মনে হচ্ছে দাদু। আপনি একটু কথা কয়ে দেখুন না ওর সাথে।"
    মহেন এবার একটু সহজ হল,
    -"হ্যাঁ সেটা করা যায়, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়। তা এই গোকূল বা হলধরকে পাবি কোথায়? আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবি এখনই?
    হারান সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত,
    -"দাদু সে বোধহয় এখন আমার দোকানে এসে বসে আছে, আমি তাকে সন্ধ্যে হলে আসতে বলেছি। এখনি গিয়ে নিয়ে আসছি।"
    মহেন খুশী হল। হলধরকে চোখে চোখে রাখতে হবে আজ রাতটা তাহলে প্রমাণ হয়ে যাবে গোবিন্দর লোকটা হলধর নিজে না অন্য কেউ! তার গল্পটাও ঝালানো হয়ে আজ রাতেই হয়ত একটা ফয়সালা করা যাবে।
    হারান বেরিয়ে যেতেই মহেন বাইরে গিয়ে নাতি ধীরুকে খগেন মন্ডলকে ডেকে আনতে পাঠালো। খগেন একটু তক্কবাগীশ হলেও বুদ্ধিসুদ্ধি ভাল আছে। বাকি সব ব্যবস্থা নিধিরাম দেখবে। বেশী লোককে না ডেকে এরকম কাজের লোক দুচারজন থাকলেই কাজ হবে। গিন্নীকে বলল আজ তাকে সকাল সকাল খাবার দিতে,রাতে সে রায়বাড়িতে পাঠ শুনতে যাবে। কত্তার হঠাৎ ধম্মেকম্মে এমন মতি কেন হল বুঝতে না পারলেও পাঠের কথা শুনে গিন্নী আর কিছু জিজ্ঞেস করলনা।

    হলধরকে নিয়ে হারান যখন এল পালবাড়ীতে তখন খগেন মন্ডল বেরোচ্ছে তাড়াহুড়ো করে। হারানকে দেখে "পরে কথা হবে" গোছের কিছু একটা বলে চলে গেল। পালকত্তার খাওয়া হয়ে গেসল। সে এদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। হ্যারিকেনের আলোয় ভালো করে দেখল হলধরকে। এখন সব জেনে আর ততটা ধুর্ত লাগছেনা। হারানের সঙ্গে তো তার দিব্যি ভাব হয়ে গেছে, হারানের বাড়িতেই আজ তার খাওয়ার কথা। লাঠি আর টর্চ নিয়ে আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে জড়িয়ে মহেন ওদের সঙ্গে বেরোলো, বাড়িতে বলল রায়েদের বাড়ি পাঠ শুনতে যাচ্ছে। গিন্নী ধীরুকে সঙ্গে নেওয়ার কথা বলতে হারান তাড়াতাড়ি বলল,
    -"ঠাকমা, আমি নিজে দাদুকে ছেড়ে যাব হয়ে গেলে। ধীরু কচি ছেলে, ওসব ধম্মপাঠে গিয়ে ওর ভাল লাগবেনি।" যুক্তির কথা, কেউ আর আপত্তি করল না। মহেনকে তার কথামত আশু চাটুজ্জ্যের বাড়ির রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে হারানরা খেতে গেল। মহেন হারানকে বলে দিয়েছিল সে যেন হলধরকে চোখের আড়াল না করে।

  • de | 59.163.30.4 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:৪৮449645
  • উফ! দম্বন্ধ করে পড়ে ফেল্লাম! তাড়াতাড়ি আরো হোক শ্রাবণী!
  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:৫০449646
  • শীতের রাতে বারোটা মানে অনেকখানি। চাটুজ্জ্যেদের খিড়কী ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে গোবিন্দ। জলের ধার বলে ঠান্ডাটা যেন ছুরির মত বিঁধছে গায়ে, মোটা চাদর মাফলারেও বাধছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল, পাশে ঝোপঝাড়, ছাইগাদা, সেখান থেকে এই বড় বড় মশা পনপন করে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে তাকে ঘিরে ধরছে। মশা থেকে বাঁচতে মুখ অবধি ঢেকে ফেলল চাদর দিয়ে শুধু চোখদুটো বেরিয়ে আছে।

    মশা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে কখন অন্ধকারে একজন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে প্রথমটায় টেরও পায়নি। টের পেয়ে যখন মুখ ঘোরাল, অন্ধকারে ঠিকমত দেখা গেলনা। লোকটা একটু চাপা হাসির মত আওয়াজ করে ফিসফিসিয়ে বলল,
    -"ভায়া যে একদম ঠিক সময়ে এসে হাজির হয়েচ দেখছি। তা ভালো, আর কেউ সঙ্গে নেই তো?"
    গোবিন্দর এমনিই ঠান্ডায় গলা ধরে ছিল তাই গলা চাপতে কষ্ট হলনা।
    -"না: আপনি বলে দিয়েছিলেন একা আসতে।"
    -"বা: বেশ। তাহলে চলো, দেরী না করে কাজ শুরু করে দিই। তুমি এস আমার সঙ্গে।"
    লোকটি চাটুজ্জ্যেদের মাটির বাড়ির পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গেল। দেখে দেখে সেই কোণে এল যেখানে একটা ছোট আমগাছ আছে। গাছটা সরু হলেও তার একটা ডাল পাঁচিলের একদম গা ঘেঁসে আছে, সেটা ধরে পাঁচিলে ওঠা যায়। গোবিন্দ দেখল এইখানটাতেই কাল তারা সেই সাদা শাড়ী জড়ানো হয়ত হতে পারে অশরীরীকে দেখেছিল। পাঁচিলটা খুব উঁচু না হলেও খুব ছোটও নয়। লাফ দিয়ে পড়লে পা না ভাঙলেও চোট লাগার সম্ভাবনা থাকবে।

    লোকটা গাছে উঠে ডালটা ধরে টুপ করে পাঁচিলের মাথায় লাফিয়ে পড়ল। তারপরে গোবিন্দের দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকেও অনুরূপ করতে বলল। গোবিন্দ সেইমত উঠল, তার কাছে এ জলভাত। এখন অন্ধকারটা একটু চোখ সয়া হয়ে গেছে, আকাশের আলোয় আশপাশ আগের থেকে পরিস্কার দেখাচ্ছে। তাকিয়ে দেখল যেখানে তারা উঠেছে ঠিক সেখানটাতেই চাটুজ্জ্যেদের রান্নাবাড়ীর পিছনের উঠোন। পাঁচিলের নীচেই ছাই ইঁট খোয়া ও নানারকম পাতার জঞ্জাল ফেলে একটা স্তুপ করা আছে। তাতে পা দিয়ে এরা সহজেই উঠোনে নেমে গেল। এরপরে পা টিপে টিপে এল দুই বাড়ির মাঝের দরজার সামনে। লোকটা এবার গোবিন্দকে এগিয়ে দিল,
    -"এইবার তোমার হাতের খেল দেখাও দেকি, দরজায় খিল আর কড়ায় তালা আছে ও দিক থেকে। অবশ্য তোমার হাতে এ খিল তালা নস্যি জানি। লেগে যাও কাজে।"
    গোবিন্দ কাপড়ের কোঁচড় থেকে কি একটা যন্তর বার করল। বেশীক্ষণ লাগল না, একটু খুটখাট করে সাবধানে দরজায় ঠ্যালা দিল, খিল আর তালা দুইই হাতে।
    লোকটা মুগ্‌ধ স্বরে বলল,
    -"ধন্য তুমি, আমি ঠিক লোককেই সঙ্গে এনেছি। এই বিলিতী তালা আর লোহার মত খিল এত সহজে খুলে ফেললে, আর আমি কদ্দিন চেষ্টা কচ্ছি। সত্যি এমনি এমনি তোমাকে সেরা চোর বলেনা।"

    গোবিন্দ কিছু বলল না, দালানে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে ভাঙা তালা আর কাটা খিল একপাশে রেখে দিল। লোকটা গোবিন্দকে নিয়ে দোতলায় আশু চাটুজ্জ্যের ঘরের দিকে গেল। চাদ্দিক নিঝুম, কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। শীতের রাতে গৃহস্থ শান্তিতে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘরের দরজা খোলাই ছিল, তাই দেখে লোকটা বেবাক খুশী।
    -"আরে তোমার পয় আছে বলতে হবে। দরজাও খোলা পেয়ে গেলাম।"
    ঘরের এক কোণে একটা লন্ঠন একেবারে টিমটিম করে জ্বলছিল। লোকটা একলাফে গিয়ে সেটা নেভালো। ঐ একটু সময়েই খাটের দিকে তাকিয়ে গোবিন্দ দেখল লেপমুড়ি দিয়ে বুড়ো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে বাঁদুরে টুপি মাথায় দিয়ে। লোকটাও দেখেছিল, একটু চিন্তায় পড়ে গিয়ে বলল,
    -"বুড়োর নাতিটা খাটে নেই, বাইরে টাইরে যায়নি তো! তালে আবার এখুনি এসে আমাদের কাজ পন্ড করে দেবে।"
    গোবিন্দ একটু বিরক্তি দেখিয়ে বলল,
    -"কাজ কি তাইতো বুঝছি না। যাই করুন তাড়াতাড়ি করুন, সারা রাত লাগালে নাতি কেন সারা বাড়ি জেগে উঠে এই ঘরে এসে যাবে।"
    ভাল দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিল লোকটা বিছানার তোষক জায়গায় জায়গায় তুলে আঁতিপাতি করে কি খুঁজছিল। মাঝে একবার বুড়োর মাথাটাও তুলে দেখল। গোবিন্দ আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল
    -"কি খুঁজছেন বলেন তো?"
    -"সিন্দুকের চাবি।"
    গোবিন্দ একটু মুখ বেঁকায়,
    -"দুর, এই জন্যে এত? ও সিন্দুকে কিছুই নেই। সব মালকড়ি বুড়োর ছেলেদের কাছে।"
    লোকটা কান করল না, এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে শংকুর পড়ার টেবিলের দেরাজ টানল। সামনেই একটা চাবির গোছা। তুলে নিয়ে দেওয়ালের সিন্দুকের কাছে গেল, পেছন পেছন গোবিন্দ। একটার পর একটা চাবি লাগিয়ে চেষ্টা করতে থাকল, খান আষ্টেক লাগানোর পর একটা চাবিতে খুলে গেল সিন্দুকটা। লোকটা হাত ঢুকিয়ে কি খুঁজতে লাগল, শেষমেশ কি একটা বের করে আনল।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৫ জুন ২০১০ ১৭:৫৫449647
  • কপি পেস্ট করতে গিয়ে গড়বড় হচ্ছে বোধায়।
    *বৈনী=বেআইনী
  • shrabani | 59.161.98.29 | ২৫ জুন ২০১০ ২২:১৭449648
  • চাদরের ভেতর থেকে একটা সরু টর্চ বার করে জ্বালল। সেই আলোয় গোবিন্দ দেখল একটা বটুয়া, বটুয়া খুলে একটা ডিবে বেরোলো। সিন্দুকে বন্ধ করে চাবি আবার দেরাজে যথাস্থানে রেখে দুজনে বেরিয়ে এল। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সেই দিক দিয়েই পাঁচিল ডিঙিয়ে এল খিড়কী ঘাটে। গোবিন্দ দেখল ঘাটে আর একজন বসে আছে। সে ওদের আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় গোবিন্দর সঙ্গের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল,
    -"কি দাদাবাবু, পেলে?" লোকটা একটা হুঁ আওয়াজ করে এবার গোবিন্দর দিকে তাকালো।
    -"আমি যা খুঁজতেছিলাম তা পেয়েছি অবশেষে, সবই এই গোবিন্দভায়ার জন্য।তুমি ভাই অনেক কল্লে, এবার ঘর যাও, বিশ্রাম নাও। আমার আর একটু কাজ বাকী, সেটা শেষ করে আমি তোমার সাথে দেখা করে তোমার পাওনা বুঝিয়ে দেব।"
    গোবিন্দ এবার রেগে যায়,
    -"বা: কাজ হয়ে যেতেই চলে যাও। ওসব পরে টরে নয় আমার পাওনা আমার এখনই চাই। দেখাও কি আছে ঐ ডিবেতে?"

    গোবিন্দ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা একদম চুপিসাড়ে কাছে এসে এক অদ্ভুত কায়দায় ওর গলাটা ধরে মাটি থেকে তুলে ফেলল। দম বন্ধ হয়ে হাঁসফাস করতে থাকল গাঁয়ের সেরা চোর গোবিন্দ। দু তিনবার চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারলনা। শেষে যখন মনে হচ্ছে আর পারবেনা, অজ্ঞান হয়ে যাবে তখন লোকটা ওকে ছেড়ে দিল এমনভাবে যে সে উল্টে পড়ল মাটিতে।
    লোকটা হিসহিসিয়ে বলল,
    -"এসব তোমাদের গাঁ ঘরের প্যাঁচ নয়, পশ্চিমে শেখা বিদ্যে। এক হাতে শেষ করে দিতে পারি তোমার মত ছুঁচোকে। চুপচাপ কাটো এখন, বলেছি যখন তখন তোমার পাওনা পেয়ে যাবে সময়মত।"
    গোবিন্দ আর কিছু না বলে ওখান থেকে দৌড় লাগালো।

    লোকদুটো একটু দুরে গিয়ে ঝোপের আড়ালে টর্চ জ্বেলে শুকনো ডাল পাতা এক করল, বেশী না অল্প। দ্বিতীয় লোকটা দেশলাই বার করে আগুন দিল, একটা হেরিকেন জ্বলার মত আলো হল। সেই আলোয় প্রথম লোকটা দুটো ডিবে বার করল। একটা খোলা, তারমধ্যে থেকে একটা চাবি বেরোলো। দ্বিতীয়টার ঢাকনার চারদিকে গালা দিয়ে বন্ধ করা। আগুনের আঁচে গালাকে গলিয়ে জোরে মোচড় দিতে ঢাকনা খুলে গেল। এই ডিবের মধ্যে থেকে বেরোলো একটা হলদে মত কাগজ। আলোর কাছে ধরতে দেখা গেল একটা ম্যাপের মত আঁকা,সঙ্গে কিছু লেখাও আছে। লোকটা খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল। অন্য লোকটা একটু অধৈর্য্য হয়ে উসখুস করছিল, কিন্তু প্রথম লোকটা চুপচাপ কি হিসেব করে যাচ্ছিল।
    অনেকক্ষণ পরে যখন আগুন প্রায় নিভে এসেছে, মাথা তুলে বলল,
    -"যা ভেবেছি তাই, ঐ ভিটেতেই আছে সব। এর আর অন্য কোনো মানে হয় নি। চল ঐখেনেই গিয়ে দেখি।" সে উঠে দাঁড়ায়।
    অন্য লোকটা একটু ইতস্তত করে বলে,
    -"এই রাতে ঐ বনে যাবে, সাপখোপ থাকলে?"
    লোকটা চলতে চলতে বলে,
    -"নে চ, ঢঙ করিসনি। রাতে যাব না তো কি দিনে গাঁয়ের সব্বাইকে সাথে নে যাব? শীতে সাপ বেরোয় নি।"

    দুজনে চাটুজ্জ্যে বাড়ির সামনের দিকে এসে বাঁদিকে খামারে ঢুকল। চারদিকে ধানের আর খড়ের গাদা, একদিকে ধানঝাড়াইয়ের পাটা শোয়ানো আছে। একটা গাদার নীচে থেকে দ্বিতীয়জন একটা কোদাল আর শাবল বের করে আনল। দুজনে এক একটা হাতে নিয়ে চলল গোঁসাইপুকুরের পূবপাড়ের দিকে।
    গুরুদেবের ভিটের তুলসীম্‌ঞ্‌চর কাছে এসে টর্চ জ্বালল প্রথমজন।
    -"এর নীচেই আছে বুঝলি।"
    -"কি করে বুঝলে, লেখা আছে?"
    -"আরে না, বুড়ো অত সহজ করে সব লিখে গেলে তো এতদিনে মাল নিয়ে কতদুরে চলে যেতুম। এত ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হতনি। "নারায়ণের শরণে "- এখানে নারায়নের মানে তুলসী গাছ না হয়ে যায়না। নে, চালা শাবল, মঞ্চটা ভেঙে ফেল।"

    দুজনে তুলসী মঞ্চ ভেঙে ফেলল, কিছু বেরোলো না। পাগলের মত জায়গাটা খুঁড়ে খুঁড়ে গত্ত করে ফেলল। এই বাঘা শীতেও দুজনে ঘেমে নেয়ে একসা। শেষমেশ খোঁড়া বন্ধ করে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকল। একটু দম নিয়ে দ্বিতীয় লোকটা তীব্র স্বরে বলে উঠল,
    -"তোমার শুধু গায়ের জোরই আছে, বুদ্ধি নাইকো। কোথায় ভালো করে দিনেরবেলা ধীরে সুস্থে কাগজটা পড়ে বুঝে তবে কাজ করবে তা না। ও তুমি ভুল মানে করেছো।"
    অন্য লোকটা রেগে গেল, একটু গলা তুলে বলল,
    -"হ্যাঁ আমার বুদ্ধি নাই আর তুই দিগগজ! পেটে বোম মারলেও ক বেরোবেনি, সে আবার কথা কয়। চুপ করে থাক, আমার বুঝতে ভুল হয়নি। কাগজে এই ভিটেরই পথ আঁকা আছে। দিনেরবেলা ধীরেসুস্থে করবে, হুঁ:! অত সময় আছে? চাটুজ্জ্যেদের চুরি ধরা পড়লে এখানে টিকা যাবে? কাল থেকে জোর পাহারা বসে গেলে? যা করার আজই করতে হবে।"
    তারপরে নিজের মনে যেন নিজেকেই বলে,
    -"এত বছর হয়ে গেছে, এটাই যে আদত মন্ডপ তা কে জানে। হতে পারে মাটির তুলসীমন্ডপ, ভেঙে গেলে আশে পাশে গড়ে দিয়েছে কেউ।"
    তার সাগরেদ বলে,
    -"তাহলে কি চাদ্দিকে খুঁড়তে বসবে নাকি এখন? এত করতে গেলে ভোর হয়ে যাবে, কেউ পুকুরে এসে যদি এদিকে খেয়াল করে তালে এরম খোঁড়া দেখে হইচই জুড়ে দিতে পারে।"

    দুজনে একটু ডানদিকে সরে আবার শাবল তুলেছে এমন সময় কয়েকটা জোরালো টর্চের আলো ঐ জায়গাটায় পড়ে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। কোনো কিছু বোঝার আগেই গোবিন্দ আর বটুক এসে ওদের শাবল আর কোদাল কেড়ে নিয়ে দুজনকে জমিয়ে গোটাকয়েক থাবড়া মারল। এরা এতই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যে কিছুই করতে পারলনা, দাঁড়িয়ে মার খেল। ততক্ষনে হারান আর কে একটা এগিয়ে এসে ভালো করে দুজনের হাত দুটো বেঁধে ফেলেছে। খগেন মন্ডলের গলা শোনা গেল,
    -"নে নিয়ে চল দুটোকে পরেশদের বৈঠকখানায়।" প্রথম লোকটা কিছু বলবে বলে মুখ খুলেও বন্ধ করে নিল। গোবিন্দ লোকটাকে জোরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে থাকল,
    -"কি বাছাধন, খুব যে পশ্চিমের প্যাঁচ দেখালে তখন। এবার দেখবে মোদের বাংলাদেশের মার, তাহলেই তোমার মারপ্যাঁচ শিক্ষে পুরো হয়ে যাবে।"
  • Nina | 68.45.144.238 | ২৬ জুন ২০১০ ০৯:১৯449649
  • এই রে আবার থেমে গেলে :-(((( শনি-রবিবার অ--নে--ক--টা লিখবে তো? প্লিজ্‌জ্‌জ্‌জ
  • jayanti | 122.177.94.119 | ২৬ জুন ২০১০ ১৭:১৩449650
  • শ্রাবণী,অ-সা-ধা-র-ণ!!!!এতো আনন্দ বহুকাল পাই নি।

    শরীরের যত্ন নিও।
  • Nina | 68.45.144.238 | ২৭ জুন ২০১০ ১১:২৮449651
  • শ্রাবণী, দেখতে এলুম এগোলো কিনা---ভাল থেক। অনেক লিখ।
  • Lama | 203.99.212.53 | ২৮ জুন ২০১০ ১১:২৭449652
  • উসখুস
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১২:৩৭449653
  • দলটা যখন চাটুজ্জ্যেদের বাড়ি এল তখন সে বাড়ি আর একটু আগের ঘুমন্ত পুরী নেই। সামনের দালানে বড় বড় আলো জ্বলছে। বৈঠকখানা খোলা, সেখানে পরেশ চাটুজ্জ্যে, মহেন পাল, নিধিরাম এরা বসে আছে। বাড়ীর পুরুষ সদস্যরা সবাই হাজির। ভেতরবাড়িও হট্টগোলে জেগে গিয়েছে, চায়ের জল ফুটছে, স্পিরিট স্টোভের গন্ধ।
    লোক দুটোকে এনে দাঁড় করানো হল কত্তাদের সামনে। পরেশ প্রথম জনকে দেখে হাঁ মতন হয়ে গেল। সেটা লক্ষ্য করে মহেন বলে,
    -"কি পরেশ চেনা চেনা লাগছে নাকি?"
    পরেশ এদিক ওদিক দেখে ছেলেকে ডাকে,
    -"বড়খোকা দেখ তো, এই লোকটায় যেন আমাদের বিরিঞ্চি বামুনের আদল আছে।" বলে অপ্রস্তুত হয়ে মহেনের দিকে তাকিয়ে যোগ করল,
    -"মানে, আমি তো সেই প্রথমেই একদিন দেখেছি, রান্নাবাড়ীর ওদিকে তো ঠিক যাতায়াত নেই,মেয়েদের এলাকা ।"
    মহেন এবার বলে,
    -"ও আর দেখতে হবেনা। এই মুখই আমি সেদিন তোমাদের এখানে দেখেছি। তাহলে এই হল বিরিঞ্চি ঠাকুর। তা ঠাকুর তুমি পালিয়েছিলেই বা কোথায় আর রাতবিরেতে গেরস্তের বাড়ী হানাই বা দাও কেন? সঙ্গের উটি কে?"
    বিরিঞ্চি বা যেই হোক সে রা কাটেনা, তার সঙ্গীও চুপ। দুজনেই মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। উপস্থিত সবাই হুড়োহুড়ি করে লোকদুটোকে দেখতে আসে। মহেনের কথায় গোবিন্দ লোকটার কাছ থেকে ডিবেদুটো কেড়ে নিয়ে আসে। ডিবে দুটো খুলে দেখে মহেন হলধরকে ডাকে,
    -"কি মনে হচ্ছে হলধর?"
    -"আজ্ঞে, এই দুটো ডিবেই মনে হয় মনোহর ঠাকুরের গোপন নির্দেশ। একটা রামীবুড়ির সিন্দুকে ছিল আর একটা চাটুজ্জ্যে কত্তার কাছে।"
    খগেন এরমধ্যে বলে ওঠে,
    -"এই দুই নচ্ছার তো গুরুদেবের ভিটে খুঁড়ে মুড়ে এক করেছে। তুলসী মঞ্চ ভেঙে ফেলেছে নরাধমের দল। কিন্তু কিছুই তো পায়নি।"
    মহেন ভালো করে কাগজ টা গোল টেবিলের ওপর রাখা আলোয় পেতে ধরল। পরেশ, নিধিরামও উঁকি দিল। একটা সোজা সাপটা আনাড়ী হাতে ম্যাপের মত আঁকা। মনোহর আন্দাজ করেছিলেন তিনি চলে যাবার পর তার ভিটে আর নাও থাকতে পারে। তাই গোঁসাইপুকুরকে ধরে তার পূবপাড়ের একটা জায়গা দেখানো হয়েছে মোটামুটি হিসেবে মাপজোক করে। আর শেষে লেখা

    "কৈজুড়ির জমিদারদের যে সম্পদ আমার নিকট গচ্ছিত রাখা আছে তা আমি এইস্থানে নারায়ণের শরণে রাখিয়া গেলাম । ইহা সমস্তই কৈজুড়ির জমিদার স্বর্গত রাধানাথের পুত্র শ্রীমান রতনের প্রাপ্য।"

    মহেন নিধিরামের দিকে তাকিয়ে বলল,
    -"সকাল হলে মেপেজুপে ঠিক জায়গাটা বের করতে হবে। সবাই গিয়ে শুয়ে পড়। এই চোর দুটোকে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখ,বটুক আর গোবিন্দ পাহারা দিক। কাল ঘন্টা দারোগাকে খবর দিলে এসে নিয়ে যাবে। আমরা কিছু করে কাজ নেই। পুলিশে দু ঘা দিক টিক, মুখ খুললে সব শোনা যাবে।"
    নিধিরাম বটুক আর গোবিন্দকে সেইমত নির্দেশ দেয়। হলধর আর দেরী করেনা, মহেনকে বলে বেরিয়ে পড়ে চাটুজ্জ্যেদের একটা সাইকেল নিয়ে। ভোরের প্রথম বাস ধরেই জীবনের বাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে আসবে।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১২:৪১449655
  • রাত্রে কারুরই তেমন ঘুম হয়নি। সকাল হতে না হতেই আবার সবাই জুটেছে চাটুজ্জ্যে বাড়িতে। শুধু বটুক আর গোবিন্দ এখানেই ছিল রাতভোর। মহেন পাল আর নিধিরাম এল একটু দেরী করে। পরেশ চায়ের ব্যবস্থা করেছে, সবাই চা খাচ্ছে। বেশী লোক জানাজানি করবে না তাই খগেন হারান শিবু এরা নিজেরাই শাবল কোদাল নিয়ে চলল গোঁসাই পুকুরের পাড়ে, মহেনরা তাদের সাথে সাথে। দিনের আলোয় দেখা গেল তুলসীমঞ্চ একদম ভেঙে তার নীচে অনেকটা গভীর অবধি খুঁড়েছে।

    মহেন তাই দেখে বলল,
    -"নারায়ণের শরণে বললে তুলসীমঞ্চই মনে হয়। সেদিক দিয়ে বিরিঞ্চি ভেবেচিন্তেই কাজ করেছে। যে কেউ এটাই ভাববে। পরেশ, এই তুলসীমঞ্চ শুরু থেকেই এখানে আছে কিনা বলতে পারিস?"
    পরেশ যথারীতি কিছুই জানেনা। সে বাড়ি গিয়ে বউকে জিজ্ঞেস করে জেনে এল,মঞ্চ নড়চড় হয়নি। চারিদিক ভালো করে খুঁজে পেতে দেখা হল, মঞ্চের আশপাশটা খুঁড়ল এরা, কিছু পাওয়া গেলনা। একটু বেলা হলে জলখাবার খেতে আবার সবাই চাটুজ্জ্যে বাড়িতে এল। একজন থানায় গেছিল, এসে খবর দিল যে দারোগা জলটল খেয়ে তারপর রওনা দেবে। রাতের লোক দুটোকে নিয়ে এসে মন্দিরের থামের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার আগে অবশ্য তাদের চাটা খাইয়েছে এরা। গোবিন্দ দেখে অবাক হচ্ছিল অমন ওস্তাদ লোক ধরা পড়ে কেমন চুপসে গেছে, যা বলা হচ্ছে তাই করছে!

    এইসবের মধ্যে হলধর এসে হাজির হতে একটা শোরগোল পড়ে গেল। হলধরের সাথে শুধু জীবনই আসেনি, রতনও এসেছে। রতনকে দেখে সবাই খুব খুশী, জমিদারের ছেলের মতই ফর্সা সুন্দর চেহারা। একটু লাজুক লাজুক, সে কিছুই বুঝতে পারছেনা, জীবন তাকে এরকম তড়িঘড়ি করে এই গ্রামে কেন নিয়ে এল। জীবন এসে মহেনদের কাছে হলধর যা বলেছিল সেই কাহিনীই আবার শোনাল। রতন এই প্রথম এসব শুনে খুব অবাক হল। সে জমিদারের ছেলে তা জানত তবে এতসব কিছু জানতনা।
    এরমধ্যে দারোগাও এসে পড়ল দলবল নিয়ে চোর নিয়ে যেতে। এতক্ষণ চোর দুটো আড়ালে ছিল, জীবন তাদের দেখেনি। এবারে তাদের থাম থেকে খুলে রাম আর মাণিক সদরের দিকে নিয়ে আসতে জীবনের চোখ পড়ল এদের দিকে। সে ভালো করে দেখে বিরিঞ্চির কাছে গিয়ে,
    -"আরে, তুই বংশী নয়, বুদি ঝিয়ের ছেলে? চেহারাটা যেন তার মতোই মনে হচ্ছে। সেবছর তো এসছিলি কৈজুড়িতে, তখন দেখলাম।"
    চোরটা হাউহাউ করে উঠল,
    -"হ্যাঁগো জীবন দাদা, তোমার পায়ে পড়ি আমারে মাফ করে দিতে বলো এদের। লোভে পড়ে একটু অন্যায় করে ফেলিচি। কিন্তু বামুন দা মশায়ের শেষকালে আমি অনেক সেবা করেছি দাদা। সে ভেবে আমাকে এবারকার মত ছেড়ে দাও"।
    সবাই একটু অবাক হয়ে এই পালা দেখে। জীবনের অনুরোধে বিরিঞ্চি অথবা বংশীর কাহিনী তার মুখে শোনে সবাই। যা জীবন জানেনা তা বংশী বলে।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১২:৪৪449656
  • ***********************************
    বংশী রাধানাথের মায়ের খাস ঝিয়ের ছেলে। এরা ভেবেছিল সম্পদের কথাটা রাধানাথের মা আর মনোহর এবং পরে জীবন ছাড়া কেউ জানতনা। এটা সত্যি নয়, বুদি ঝিও জানত। মনিবানীর খাস ঝি, হেন কথা ছিলনা গিন্নীমার যা সে জানতনা। তবে বুদি ঝি এতটাই বিশ্বস্ত ছিল যে তার থেকে এ খবর বেরোনোর কোনো সম্ভাবনাই ছিলনা। বংশীও ছোট থেকে মায়ের সাথে ওবাড়ীতেই থেকে মানুষ হয়েছে। তাকে গিন্নীমা মনোহরের পাঠশালাতে পড়তে পাঠাতো। তবে তার পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না। একটু বড় হবার পরে গ্রামে বদ ছেলেদের সাথে মিশে নানারকম বজ্জাতি করে বেড়াত। জমিদার গিন্নীর খাস ঝি বলে বুদি ঝি কে সবাই সমঝে চলত, বংশীর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস করত না।

    রাধানাথের মৃত্যুর পরে পুরনো সব লোকেদের সঙ্গে সুরেন বুদিকেও তাড়িয়ে দেয়, তার সাথে বংশীকে। বংশীর তখন বছর পনের বয়েস হবে। তারা নিজেদের গ্রামে ফিরে গিয়ে কোনোরকমে দিন কাটাতে থাকে। বংশী ততদিনে জমিদারবাড়ীর রহনসহন খাওয়াদাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তার ওভাবে থাকতে খারাপ লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই, তার মায়ের সম্বল সামান্যই। তারও কাজকম্ম করার অভ্যেস বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। কিছুদিন এভাবে চলার পর শেষে একদিন মায়ের অল্প গয়নাগাঁটি যা ছিল সব নিয়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় ভাগ্য সন্ধানে। নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে কোনোভাবে পশ্চিমে পৌঁছয়। সেখানে নানা লোকের সঙ্গে মিশে ছোটখাটো চুরি রাহাজানি এসবে হাত পাকায়। এইসময়ই একদিন সে কাশীর আশ্রমে মনোহরকে দেখে।

    কিছুদিন ওদিকেই থেকে দলে পড়ে চুরি চামারি এসব করে নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে। শ্রীঘর বাসও করে, তবে বেশীদিন নয়। কয়েক বছর এভাবে কাটবার পর তার বাড়ির কথা মনে হতে, দেশে ফিরে আসে। এসে দেখে মায়ের শরীর বেশ খারাপ। বয়স হয়েছে, সারাজীবন জমিদারের দুধ ঘিয়ে থেকে এখন দু:খেকষ্টে শরীর ভেঙে পড়েছে, মাথারও ঠিক নেই, আনমনে খালি পুরনো সব কথা বলে অসংলগ্নভাবে। এই অবস্থায় বুদি একদিন তাকে বলে মনোহরের কাছে রাখা সম্পদের কথা। প্রথমে বংশী বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তার মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ার পরে শুধু ঐ কথাই বলতে থাকে। মনোহর আবার সব ঠিক করে দেবে তাদের কৈজুড়িতে নিয়ে যাবে ইত্যাদি। তবে বংশীর বিশ্বাস হয়না, কারণ সে মনোহরকে কাশীতে দেখেছে, আশ্রমে সাধুর জীবন যাপন করতে। অত ধন সম্পদ নিয়ে যদি সে পালাত, ঐ আশ্রমে থাকবে কেন সে!

    এরপর বুদি মরে যায়। বংশী কিছুদিন বাড়িতে থাকে, বিয়ে থা করে সংসার করে। তার শ্বশুর ও দিককার মোটামুটি নামকরা চোর ছিল। শালারাও এই ধান্দাতেই আছে। সঙ্গের লোকটি তার মেজশালা গজু, সেও চুরিতে বেরোয় কিন্তু বাপ ভাইয়েদের তুলনায় বুদ্ধিতে একটু নিকম বলে তেমন পাকা চোর নয়। এভাবে থাকতে থাকতে বংশী দেখে যে এই গাঁ ঘরে চুরিচামারিতে শুধু কোনোরকমে সংসার চলে, বড় দাঁও মারার সুযোগই নেই। যা আছে তাতেও প্রতিযোগীতা অনেক বেশী।

    বছর দুয়েক আগে সে কোনো কাজে কৈজুড়িতে যায়। জমিদারবাড়ীতে গিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই, ভুতের বাড়ী। খোঁজ নিয়ে সব জানতে পারে। জীবনের সঙ্গেও দেখা হয়। রাধানাথের স্ত্রী ছেলে কোথায় আছে কিভাবে আছে জানতে পারে। যদিও জীবন তাকে কিছু বলেনা, সে কথায় কথায় বোঝে জীবনের সঙ্গে মনোহরের কিছু একটা ব্যাপার আছে। তলিয়ে দেখতে গিয়ে তার মায়ের কথা মনে হয়। সে স্থির করে মনোহরের খোঁজ খবর নিয়ে একবার মায়ের কথাটা যাচাই করে নেবে।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১২:৪৮449657
  • এমনিতেও অনেকদিন গাঁয়ে একঘেয়ে বসে থেকে থেকে সে উবে গেছে, তাই ছেলেবউকে শ্বশুরবাড়ীতে রেখে কাশী যায়। পুরনো লোকজনদের খোঁজ করতে গিয়ে দেখে তারা সব নানাদিকে চলে গেছে। কোথায় যাবে ভেবে ভেবে সে মনোহরের আশ্রমে যায়। মনোহর তখন অসুস্থ, আঙুলে বাত হয়ে লেখালেখি করতে পারেননা। বংশী গিয়ে মনোহরকে নিজের পরিচয় দেয়, বুদি ঝিয়ের ছেলে, তার ছাত্র ছিল। মনোহর তাকে দেখে খুশী হন। কিছুদিন ওখানে থেকে সে মনোহরের সেবা করে, আশ্রমে সবাই জানে সে মনোহরের শিষ্য।

    মনোহরও তাকে বিশ্বাস করে তার ওপর ভরসা করতে আরম্ভ করেন। তবে তখনও জমিদারদের ধনসম্পদ নিয়ে কোনো উল্লেখ কোনোদিন করেন না তার কাছে। কিছুদিন থাকার পরে সে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাবে ভাবছে, তখনই মনোহর একটু বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এইসময় তিনি বংশীকে বলেন জীবনকে চিঠি লিখে কাশী আসতে বলার জন্য। সে সেইমত চিঠি লিখে মনোহরকে দেখায় কিন্তু ডাকে দেয়না।
    জীবন একবার এসে গেলে বংশী আর মনোহরের সঙ্গে থাকতে পারবেনা, সত্যি কথাটা জানতেও পারবেনা। ধনসম্পদ যদি থাকেও তার মার কথা মত তাহলে মনোহর জীবনের হাতেই সব দিয়ে দেবে এইবেলা।

    এদিকে মনোহরের শরীরের অবস্থা দেখে তার আশ্রমের ভাইয়েরা তাকে হরিদ্বার নিয়ে যায়, সেখানে জলহাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা বেশী ভালো। বংশী ও অনেক অনুরোধ টনুরোধ করে তাদের সঙ্গী হয়। একটু সুস্থ হলে মনোহর আবার জীবনকে খবর দেবার কথা বলে কিন্তু বংশী প্রতিবারেই চিঠি লিখে ডাকে দেয়না। জীবন আসছেনা বা কোনো খবর দিচ্ছেনা দেখে মনোহর খুবই চিন্তায় পড়েন। এদিকে তার শরীর আরো খারাব হয়। বংশী তার সেবা করে যায় আর তক্কে তক্কে থাকে জীবনকে না পেয়ে সব কথা তিনি বংশীকেই বলে যাবেন, সম্পদের সন্ধান দিয়ে যাবেন।

    অবশেষে মারা যাবার কয়েক দিন আগে বংশীর ইচ্ছা পূরণ হয়। মনোহর তাকে এক চিঠি লিখতে বলেন জীবনের উদ্দেশ্যে। এও বলেন যে চিঠি ডাকে না দিয়ে বংশী যেন নিজেই নিয়ে যায় জীবনের কাছে। যদি কোনো কারণে জীবনকে না পায় তাহলে রতন আর তার মাকে এ চিঠি দেয়। চিঠিতে তিনি জীবনকে লেখেন সে যেন রতনকে নিয়ে আশু চাটুজ্জ্যের কাছে যায়। ওরা গেলে উনি ওদেরকে দুটো ডিবে দেবেন, সেই ডিবে দুটোতে গচ্ছিত ধনসম্পদের সন্ধান থাকবে। এও বলেন কোনো কারণে যদি আশুকে না পায় তাহলে বনমালীর বউ রামীকে যেন নিজেদের পরিচয় দেয়। একটা ডিবে আশু চাটুজ্জ্যের কাছে আছে, অন্যটা এদের কাছে। তিনি কিছুকাল আগে অবধি খোঁজ নিয়েছেন, এরা বেঁচে আছে।

  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১২:৫১449658
  • বংশী সব জেনে তখনই চলে আসতে পারত, কিন্তু মনোহরের অবস্থা বেশ খারাপ হয়, শেষবেলায় তাকে একা ছেড়ে আসতে ওর একটু বাধে। তিনি মারা যাবার পরের দিনই ও রওনা দেয়।
    এখানে এসে সরাসরি আশু চাটুজ্জ্যের কাছে গিয়ে লাভ হবেনা ও জানত। এরা জীবন আর রতন ছাড়া অন্যের হাতে কিছু দেবেনা। দুই বাড়ি থেকে ডিবেদুটো চুরি করতে হবে, সঙ্গে একটা স্যাঙাত থাকলে সুবিধে হবে মনে করে ও শ্বশুরবাড়ী যায়। সেখানে বউ ছেলে সবার সঙ্গে দেখা করে গজুকে নিয়ে এদিকে আসে। নিজে বিরিঞই সেজে চাটুজ্জ্যে বাড়ী কাজ নেয়। ডিহিকেষ্টপুরে গজুর এক বুড়ি পিসীর বাড়ী। সেখানে পিসী ছাড়া আর কেউ নেই। গজু মাঝে মাঝে সেখানে এসে সেখান থেকে বংশীর সঙ্গে যোগাযোগ করে।

    এতকিছুর পরে কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে চাটুজ্জ্যেদের ভিতরবাড়ীতে ঢুকতে পারেনা। চাদ্দিকে সবসময় মেলা লোক এ বাড়ীতে, রাত্রে দরজায় বিলিতী তালা। এছাড়া সকাল সন্ধ্যে নিজের রান্নার কাজে সে নি:শ্বাস ফেলার ফুরসত পায় না। এ বাড়ীতে কাজ করে রামী বুড়ির ওখানে নজর রাখারও অসুবিধে। তাইজন্যে তার একটু সময় লাগে, আসল চুরিটা করতে। তল্লাশ করেটরে যখন বুঝতে পারে ডিবে কোথায় আছে তখন গজুকে খবর দেয়। বুড়ির ঘরের দরজা খোলাই থাকত, সেদিন সন্ধ্যেয় একফাঁকে গিয়ে বুড়ির খইদইয়ে আপিম মিশিয়ে আসে। তারপরের কাজ সোজা ছিল। রাত্রি হতে গাছ বেয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে বুড়ির ঘরের সিন্দুক খুলে ডিবে নিতে অসুবিধে হয়না। গজু শিবুর সাইকেলটাও নিয়ে নেয়, ডিহিকেষ্টপুর যাতায়াত করতে সুবিধে হবে। হারানের দোকানের চুরিটাও গজুর কাজ। আগের দিন চুরি করেছে তবে তেমন রোজগার হয়নি, তাই তার মেজাজ খারাপ ছিল। সে একটু মাথামোটা, চাটুজ্জ্যে বাড়ী থেকে ফেরার পথে দেখে হারান দোকানে ঢুকতে যাচ্ছে। শীতের রাতে চারদিকে কেউ নেই, মেরেছে হারানের মাথায় ডান্ডা!

    এপর্যন্ত কাজ সোজা ছিল কিন্তু আশুবাবুর ঘর থেকে অন্য ডিবেটা নেওয়া মুশকিল হল। গাঁয়ে পুলিশ এলে, বংশী নতুন, বাইরের থেকে এসেছে,তাকে দেখে সন্দেহ করতে পারে। সেরকমটা হলে উটকো ঝামেলা হবে, কাজ করা যাবেনা। তাই সে জ্বরের ভান করে পড়ে রইল কিছুদিন। গজু রোজ রাতে একবার দেখা করে যেত, বলা তো যায়না কখন সুযোগ হয়! রোজই রাতে তারা একবার মাঝের দরজা খোলার চেষ্টা করত, কিন্তু পারতনা। মহেন পালের সঙ্গে সেদিন দেখা হতে সে কেমন বিপদের গন্ধ পায়। মহেন তার খোঁজখবর নেবে এটা বুঝে নিয়ে, ও পরদিন সকালে চাটুজ্জ্যে বাড়ী ছেড়ে যায়। সকালে পিসীর বাড়ি থাকত আর রাতে এখানে আসত। এতদিনে চাটুজ্জ্যে বাড়ির ঘাঁতঘোঁত অনেকটাই আয়ত্ত করে নিয়েছে। সেইদিন গোবিন্দ আর বটুককে দেখে তার মাথায় বুদ্ধি জাগে। গোবিন্দ নামকরা চোর এদিকের, কিন্তু এমনিতে সাদাসিধে। সে ঠিক করে গোবিন্দকে দিয়ে আশু বাবুর ডিবেটা চুরি করাবে।
    ****************************************
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১৪:৩৮449659
  • বংশীর সব কথা শুনে মহেন আর নিধিরাম ঘাড় নাড়ে। বংশীর বুদ্ধি আছে কিন্তু তা পাকেনি এখনো। যে তালা আর খিল সে আর গজু এতদিন চেষ্টা করেও খুলতে পারেনি গোবিন্দ তা দু মিনিটেই খুলে ফেলল, তা দেখেই তার সন্দেহ হওয়া উচিৎ ছিল যে এটা ফাঁদ। গোবিন্দ নিধিরামকে সব বলে দিতে তারা এই ফাঁদ পাতে। খিল আগেই অদ্ধেক কাটা ছিল আর শংকু ওদিকে চাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, গোবিন্দ যন্তর ঠেকাতেই তালা খুলে দিয়েছে। বটুক লুকিয়ে একফাঁকে গিয়ে গোবিন্দকে বলে আসে তাকে কি করতে হবে।

    ঘন্টাদারোগা আর তার পুলিশেরা চোরেদের নিয়ে চলে যাবার পর আবার এরা আলোচনায় বসল। ভালো করে মনোহরের লেখা আর আঁকা দেখল সক্কলে। খগেন আমিনের ফিতে চেয়ে নিয়ে এসে মাপজোক করল। কিন্তু কিছুই বোঝা গেলনা। মহেন শিবুদের বাড়ীও ঘুরে এল যদি রামী বুড়ি কিছু বলতে পারে। বুড়ি স্বীকার করল যে গুরুদেব বলে গেছিল ডিবে হয় গুরুদেব নিজে এসে নাহলে কৈজুড়ির জীবন বা রতন এসে একদিন নিয়ে যাবে। আর কাউকে যেন ডিবে না দেয় বা ডিবে খোলারও চেষ্টা না করে। এর বেশী তার আর কিছুই জানা নেই। আশু চাটুজ্জ্যেকে কিছু জিজ্ঞেস করাই বৃথা।
    তার বাড়ীতে এত ঘটনা ঘটছে অথচ সে আজও সকালে কোনো দিকে না তাকিয়েই চা জল খেয়ে হারানের দোকানে তার জায়গায় গিয়ে বসে আছে। বিশে দোকান খুলেছে, বুড়োকে চা দিয়েছে।

    বেলা পড়ে আসছে, কাল রাত থেকে সবাই প্রায় জাগা, বাড়ি গিয়ে নাওয়াখাওয়া করার দরকার আছে, একটু বিশ্রাম নিতে হবে। মহেন নিধিরাম পরেশ আর জীবনের সাথে পরামর্শ করতে বসল। জীবন আর রতনের থাকার ব্যবস্থা চাটুজ্জ্যেবাড়ীতেই হয়েছে। শংকুর সাথে রতনের ভারি ভাব হয়েছে, দুজনে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে গল্প করছে।
    ঠিক হল যে সবাই বাড়ী ঘুরে আসুক। তারপরে গোঁসাইপুকুরের ও পাড়ের পুরো এলাকাটাই খুঁজে এবং খুঁড়ে দেখা হবে ধীরে ধীরে। দরকার পড়লে দিনকয়েক লাগলে লাগুক। বেশী লোকের থাকার দরকার নেই, দায়িত্বে থাকবে খগেন আর হলধর। গোবিন্দ জনা পাঁচেক মজুর নিয়ে কাজ করাবে, তবে তারা কি খুঁজছে মজুরদের তা বলার দরকার নেই।

    সেইমত সবাই উঠতে যাচ্ছে এমন সময় আশুবাবু হারানের দোকান থেকে এল। তাকে দেখে মহেন নিধিরাম একটু দাঁড়িয়ে গেল,
    -"দাদা, হয়ে গেল বেড়ানো?" মহেন একটু হেসে এমনিই বলল।
    আশু চাটুজ্জ্যে উত্তর না করে সদরে উঠে অন্দরে যাওয়ার দরজার দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে সবাই যেদিকে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে গেল। সেখানে গিয়ে জীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। জীবনের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, সে আগে যখন এসেছে মনোহরের কাছে আশুবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে, তাকে স্বাভাবিক দেখেছে। যদিও সে অনেকদিন আগের কথা, আশুবাবুর বাড়িতে যত্ন আত্তিও পেয়েছে। এবারে এসেই সেজন্য সে চাটুজ্জ্যে কত্তার খোঁজ করেছে। কত্তা এরকম হয়ে গেছে শুনে তার খারাপই লেগেছে।
    -" জীবন না? তুমি গুরুদেবের কাছ থেকে আসছ তো?" একটু জড়ানো হলেও একদম পরিস্কার কথা।

    সবাই অবাক, মুখে মাছিগেলা হাঁ প্রত্যেকেরই এমন কি আশুবাবু যার সঙ্গে কথা বলে সেই শংকুরও। এত পরিস্কার দুটো বাক্য একসাথে সেও দাদুর মুখে শোনেনি অনেককাল। জীবন প্রায় অভিভূত হয়ে,
    -"হ্যাঁ চাটুজ্জ্যেমশায় আমি জীবন। গুরুদেব আর নেই, আমি এসেছি রতনকে নিয়ে। এই দেখুন এ হল রতন।"
    আশুবাবু রতনকে দেখলে, কি ভাবলে,তারপরে পাশে দাঁড়ানো শংকুকে বললে,
    -"যা সিন্দুক থেকে বটুয়াটা নিয়ে আয়, ওর মধ্যে ডিবে আছে জীবনকে দে।"

    সবাই কেমন একটা ভুত দেখার ঘোরে, তারই মধ্যে মহেন পাল সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে আশু বাবুর কাছে গিয়ে কাগজটা নিয়ে দেখায়।
    -"দাদা ডিবে তো দেওয়া হয়েছে জীবনকে, এই কাগজটা ছিল ওর মধ্যে। কাগজটা দেখে কিছুই বুঝতে পারা যাচ্চেনা, একটু দ্যাখেন তো।"

    মহেন পালের কথায় আশুবাবু প্রথমে কেমন একটু বেভুলের মতো তাকিয়ে থাকে। তারপরে আবার আগের মত হয়ে গিয়ে সেই নির্বিকার ভাব করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে চলে যায়, আর কারো দিকে তাকায় না। সবাই হায় হায় করে ওঠে, জীবন মহেনের দিকে একবার দেখে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে আশুবাবুর সামনে দাঁড়ায়,
    -"কত্তা, আর কিছু বলবেন না আমারে?"
    আশুবাবু একথায় একটু দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে তাকিয়ে বলে,
    -"গাছের গোড়ার চারদিক সাবধানে, শিকড় না কেটে যায়।"
    এই বলে সোজা অন্দরে ঢুকে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। শংকু আর পরেশ পিছন পিছন যায়। কিছুক্ষন পরে পরেশ চাটুজ্জ্যে এসে জানায় যে বাবা আগের মতই আবার কোনো উত্তর করছেনা। চান করে এসে চুপচাপ খেতে বসেছে। এতটা সময়ে শুধু একবার "নুন" বলে নুন চেয়েছে
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১৪:৪৭449660
  • এ কান্ডের পর সবাই ঘরের দিকে না গিয়ে আবার বসে পড়েছিল, অপেক্ষায় ছিল আশুবাবু যদি আরো কিছু বলে শেষপর্যন্ত। পরেশের কথায় সবাই হতাশ হল। মহেন ভ্রু দুটো কুঁচকে অনেকক্ষণ থেকে কি চিন্তা করছিল।
    -"খগেন, মনোহর ভটচাজের ভিটেকে ঘিরে দুটো বড় বড় গাছ আছে না?"
    খগেন খুবই রেগে ছিল, ঘুম হয়নি ঠিকমত, খিদে পেয়েছে। আশুবাবুর এটা বদমায়েশী ছাড়া কিছু নয়, এমন আবার হয় নাকি। বোবা নয় কালা নয় অথচ কথা বলেনা শোনেনা। এইসব নানা তক্ক সে নিজেই নিজের সঙ্গে মনে মনে করছিল। মহেনের কথা শুনে প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেল, চট করে মনে পড়ল না। হারান বলে উঠল,
    -"হ্যাঁ দাদু, একটা জাম গাছ আর একটা অশুত্থ গাছ।"
    মহেন একবার উপস্থিত সবার দিকে তাকালো,
    -"খাওয়া থাক, একদিন না হয় একটু দেরী করে খেলাম। খগেন হারান শিবু, লোকজন নিয়ে অশুত্থ গাছের চারদিকে খোঁড়া। সাবধানে গাছের গোড়া বাঁচিয়ে, শিকড়ে যেন ঘা না পড়ে।"

    সবাই ঠিক বুঝলনা তবু গেল, মহেন পাল বলছে যখন। জীবন রতন হলধর এরাও গেল সঙ্গে। বুড়োরা বসে রইল চাটুজ্জ্যেদের সদরে। সবাই গেলে নিধিরাম জিজ্ঞেস করল,
    -"কি হল দাদা, হঠাৎ গাছের তলা খুঁড়তে বললে কেন। তা আবার এক্ষুনি?"
    মহেন একটু হেসে বলল,
    -"আগে দেখি আমি যা ভেবেছি তা ঠিক কিনা, তারপর বলব।"
    প্রায় একঘন্টা পরে প্রথমে শংকু তার পিছন পিছন হারান শিবু সদা এরা সব দৌড়ে এল।
    -"দাদু, পালদাদু, পাওয়া গেছে। অশুত্থ গাছের গোড়া থেকেই বেরিয়েছে, একটা বড় বাক্স, তালা দেওয়া।"
    সবাই উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু পরেই দেখা গেল গোঁসাইপুকুরের পাড় দিয়ে খগেন বাকি দলটাকে লীড করে নিয়ে আসছে,দুটো লোক একটা ধুলোমাটিতে ভর্তি বড় বাক্স দুদিক দিয়ে ধরে আছে। বাক্সটাকে তাড়াতাড়ি চাটুজ্জ্যেদের ওপরে তুলে দিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে দেওয়া হল। মহেন নিধিরামের দিকে তাকিয়ে বলল,
    -"শাস্ত্রমাস্ত্র তো পড়িনি, অত জানিনি। তবে আশুদাদার কথা শুনে আমাদের কালের পঞ্চানন্দতলার বুড়ো বামুন গোপালদাদামশায়ের কথা মনে পড়ে গেল। দাদামশায় মন্দিরের পাশের অশুত্থ গাছটাকে দেখিয়ে বলতেন শিবের দ্বারপাল নারায়ণ। তাই মনে হল নারায়ণ বলতে তুলসীমঞ্চ না হয়ে যদি অশুত্থ গাছ হয়!"

    পরেশ চাটুজ্জ্যের বাক্সটাকে দেখে কেমন চেনা চেনা মনে হল, তার বাবার দোকানে এরকম বাক্স দেখেছে অনেককাল আগে! বাবাই হয়ত বাক্সটা গুরুদেবকে দিয়েছে, এত বড় বাক্স মনোহর একা একা পুঁতেছে তা হয়না। তার মনে হল আশুবাবুর আগাগোড়াই জানা ছিল বাক্স কোথায় আছে বা তাতে কি আছে! তবে বাপকে নিয়ে সন্দেহের কথাটা সে চেপে গেল,কারো কাছে প্রকাশ করলনা।
  • de | 203.199.33.2 | ২৮ জুন ২০১০ ১৪:৫৪449662
  • দারুণ হচ্ছে!
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১৪:৫৪449661
  • থানায় আজ প্রায় উৎসবের মেজাজ। ঘন্টার পিসী আর বৌ বিশালাক্ষী তলায় পুজো দিয়ে এসেছে, সকলে সেই পুজোর প্রসাদ রসগোল্লা খাচ্ছে এখন। মানিক বিলি করতে করতে গরাদের পেছনে বংশী আর গজুকেও দিয়ে এল। ঘন্টা উত্তেজনায় টেবিলের ওপর চড়ে বসেছে। দু একজন যারা কাজে ঢুকছে তাদের কাহিনী শোনানো হচ্ছে কিভাবে তার পরামর্শেই গাঁয়ের লোকে চোরদুটোকে ফাঁদে ফেলতে পেরেছে। শেষকালে সে রাম ও মানিক কিভাবে সাহস দেখিয়ে এই ভয়ংকর চোরদুটোকে বন্দী করে এনে গারদে পুরেছে। লোকে রসগোল্লা খেতে খেতে শুনছে, মিষ্টি শেষ হলেই অবশ্য আর বসছেনা।

    এদিকে "আমরা তরুন" ক্লাবের ভুবন বাঙালদের সিধু কমল এদের নিয়ে এসেছে রিপোর্ট করতে, কিন্তু কেউ তাদের পাত্তা দিচ্ছেনা। সেই একমাস ধরে চব্বিশঘন্টা লাগাতার সাইকেল চালানোর কথা যে লোকটার সে আটদিনেই ক্লাবের সমস্ত টাকা পয়সা আর বাঙালদের ছোট মেয়ে গুলিকে নিয়ে বেপাত্তা হয়েছে। ঘন্টা দারোগাকে বলতে গেলেই বলছে, এখন তার সময় নেই আর কেস হাতে নেবার, এই একটা এত বড় কেস করে উঠল। তাছাড়া গারদও খালি নেই,লোকটাকে ধরলে রাখবে কোথায়! আগে এই চোরগুলোকে চালান করুক তারপর নতুন কেস নেবে! সেরকম মনে হলে ভুবনরাই খুঁজে টুজে চোরটাকে ধরে আনতে পারে, ততদিনে গারদ খালি হয়ে যাবে!

  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১৫:১৩449663
  • বিকেলবেলা বারোয়ারীতলায় গাঁয়ের সব মাথা আবার জড়ো হল। গাঁয়ের ছেলেছোকরাও আছে, হারান অমিয়র বয়সীরাও। ঠিক সেই রামীবুড়ির ওখানে চুরির পরের দিন যেমন সবাই জড়ো হয়েছি তেমনটাই। ঠান্ডাটা শুধু সেদিনের চেয়ে একটু কম। দুদিন পরে সরস্বতী পূজা। ইস্কুলের মাঠে ছেলের দল প্যান্ডেলের বাঁশ ফেলেছে এর ওর ঝাড় থেকে কেটে।

    গাঁয়ের লোকেরা ছাড়া আজকের জমায়েতে বাইরের লোক আছে তিনজন, জীবন রতন আর হলধর। মহেন পাল একটু দেরী করে এল, সে আসতেই আসরের মাঝখানে চেয়ার পেতে তাকে বসানো হল। আজ আর নিধিরাম ঘরে বসে নেই, সেও এসে মহেনের পাশে বসল। দুজনের এতদিনকার ঠান্ডা দ্বন্দ আজ এতকাল পরে সত্যি সত্যি মিটে গেছে বোধ হচ্ছে। মহেন পালের অনুমতি নিয়ে খগেন মোটামুটি কি হয়েছে, কিবৃত্তান্ত সংক্ষেপে জানাল সবাইকে। সবাই একবাক্যে সায় দিল, মহেন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা একটা কাজের মত কাজ করেছে। মনোহর এ গাঁয়ের ওপর ভরসা করে একটা দায়িত্ব দিয়ে গেসলেন। সেটা যদি ঠিকমত পালন না হত যে কোনো কারণেই, তা গাঁয়ের লজ্জা। রামীবুড়ি আর আশু চাটুজ্জ্যে যেভাবে নিজেদের কথা রেখে এসেছে এতকাল ধরে তারও সব্বাই খুব সুখ্যাত করল।

    সবার কথা শেষ হলে শিবু অনুরোধ করল তার সাইকেলটা অন্তত যদি উদ্ধার করে দেয় দারোগা। হারানের টাকা হয়ত আর পাওয়া যাবেনা। মহেন মেজরায় আর কাত্তিক বোসকে গিয়ে ঘন্টা দারোগার সাথে কথা বলতে বলল। সবশেষে হলধর উঠে দাঁড়াল। সে বলিয়ে কইয়ে লোক, লম্বা বক্তিমে দিল। প্রথমদিকে সবই অকাজের কথা, এ গাঁয়ের সবাই কত ভালো, কত বুদ্ধিমান, সৎ, পরোপকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন সবার প্রায় হাই উঠছে তখন সে বলল, যা ধনসম্পদ পাওয়া গেছে তা অনেক। এছাড়া দলিল দস্তাবেজ থেকে বোঝা যাচ্ছে রতন অনেক জমিজমাও পাবে নানা জায়গায়। হলধর কালই সদরে গিয়ে উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ করে এব্যাপারে কাজ শুরু করে দেবে।
    এ গাঁয়ের লোক যা করেছে তার জন্য তা ভোলার নয়, তাই রতনও গাঁয়ের জন্য কিছু করতে চায়।
    সবাই খুব খুশী হল। কি করলে ভালো হবে সে নিয়ে অনেক আলোচনা হল। ছেলেরা বলল ক্লাব,পাকা রাস্তা। বুড়োরা বলল পুকুর, মন্দির। অমূল্য দত্ত বলল একটা থিয়েটার হল।

    গাঁটু দত্ত সব জেনেও হলধরের ওপর বেশ রাগ রাগ করেই তাকাচ্ছিল। সেই গাবগাছ আমগাছ নিয়ে ইয়ার্কিটা ভুলতে পারছেনা। তার ওপর শোনা যাচ্ছে, তার ইস্কুলটা বন্ধ করে দেবার সুপারিশ করবে ইন্সপেক্টর। ইস্কুল বাড়ির মাটি খসে পড়েছে, চাল নেই, পড়াশোনা হয়না ঠিকমত, টাকা নিয়ে নয়ছয় হয় এইসব নালিশ করেছে। মনটা একদম ভালো নেই গাঁটুর। আর একবার যদি সুযোগ পায় সে দেখিয়ে দেবে কত ভালো করে ইস্কুল চালাতে পারে সে, আর কোনো গন্ডগোল করবেনা। আবার এই বয়সে কোথায় চাকরি খুঁজতে যাবে? এ গাঁয়ের কচি কচি ছেলেগুলোকে সেই কতদূরে হেঁটে হেঁটে পাকুড়দায় যেতে হবে পড়তে!

    সবার সব কথা শুনে হলধর খুব বিনীত ভাবে বলে,
    -"যদি কিছু মনে না করেন, রতন গাঁয়ের ঐ প্রাইমারী ইস্কুলের জায়গায় একটা হাইস্কুল করে দিতে চায় মনোহরের নামে। তাহলে গাঁয়ের কচি ছেলেদের আর উঁচু ক্লাসে পড়তে দুরে যেতে হয়না। বাড়ি তৈরী আর অন্যান্য খরচা সব সে দেবে, গাঁয়ের মাথারা যদি শুধু সরকারী ব্যাপারগুলো একটু দেখে।"
    সুন্দর প্রস্তাব, সবাই খুশী। মহেন পাল তো উঠে রতনকে জড়িয়ে ধরল। রতন আরো লজ্জা পেয়ে ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল। হলধর গাঁটুর কাছে গিয়ে বলল,
    -"আমি কিন্তু সবাইকে বলব, হাইস্কুলেও আপনারেই মাস্টার রাখতে।'
    গাঁটু খুব খুশী, হাইস্কুল হবে যখন তার প্রাইমারী ইস্কুল টা কি আর থাকবেনা! হলধর লোক মন্দ নয়, একটু দুর্মুখ এই আর কি!
    হলধরের দিকে একটা স্নেহের দৃষ্টি দিয়ে সে উঠে দঁড়িয়ে ঘোষণা করার মত করে বলল যে ইস্কুলের আগামী বার্ষিক উৎসবে এবারে প্রধান অতিথি হবে রতন আর সভাপতি মহেন পাল। এছাড়া ইস্কুলের তরফ থেকে সবাইকে যারা যারা রতনের ধনসম্পদ উদ্ধার করেছে, আশুবাবু, রামীঠাকুমা প্রত্যেককে মানপত্র দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হবে। সবাই খুব হাততালি দিল এ ঘোষণায়।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ২৮ জুন ২০১০ ১৫:৩৮449664
  • সকালে হালকা হালকা রোদ উঠেছে, হাওয়াটা আজ সেরকম হাড়কাঁপানো নয়। একটু মিঠে মিঠে যাকে কবিরা বলে মলয় বাতাস!
    আজ হারান দোকানে একটু তাড়াতাড়াই এসেছে, কদিন দোকানে ঠিকমত বসাই হচ্ছিলনা। বিশে যখন দুধ নিয়ে এসে পৌঁছল তখন হারান শুধু যে দোকান খুলে নিজের জায়গায় বসে পড়েছে তাই নয়, উনুনও ধরিয়ে দিয়েছে। বিশে চা করতে করতে আশু চাটুজ্জ্যে এসে তার জায়গায় বসেছে। একটু পরেই লোকজনে চারদিক ভরে গেল। ইস্কুলের মাঠে ছেলেরা বাঁশ দড়ি নিয়ে প্যান্ডেল একতলা না দোতলা হবে তাই নিয়ে ঝগড়া করছে। ছোট ছেলেরা ফাঁকে ফাঁকে এসে হারানকে ধরছে চোরের গল্প বলার জন্য।

    অনেকদিন বাদে হারানের মেজাজ আজ খুব ভালো। কদিন যে কি সব হল একটা ঝড়ের মত, এখন আবার সবকিছু ঠিকঠাক, শান্ত চারধার। সে মাঝেমাঝে গিয়ে মাঠে প্যান্ডেল বাঁধার ওখানে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের নানা পরামর্শ দিতে লাগল। তারাও ছোটবেলায় এই সরস্বতী পূজো করেছে, এই "নেতাজী বালক সংঘ" ক্লাবের সদস্য হিসেবে, সে, অমিয়, বগা। তারা বড় হলে তাদের পরের ব্যাচ নিয়েছে দায়িত্ব তারপরে আরও পরের ব্যাচ। আর দু এক বছর পরে তার ছেলে করবে এই পূজো। এভাবেই গাঁয়ের নানা ঐতিহ্য রয়ে যায়, বয়ে যায়।
    আজ এদের দেখে হারানের নিজেদের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
    -"রায়েদের বাড়ি থেকে কতগুলো ফুলের টব চেয়ে নিয়ে এসে সামনেটায় দিয়ে দে। দেখতে ভাল্লাগবে।"
    তার কথায় দু চার জন কচিকাঁচা হইহই করে ছুটল ফুলের টব নিয়ে আসতে।

    বিশেকে বলে রাখল আজ সে বেলাবেলি বাড়ি যাবে, খেয়েদেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেবে। বিশে পরে দোকান বন্ধ করে যাবে। অমিয় এল, সে আজ কাজে বেরোয়নি। হারান তাকে সবকথা বলে সঙ্গে নেয়নি, পাল দাদুর সঙ্গে তাকে ছাড়াই গোপনে কাজ করেছে। এসব নিয়ে তার অভিমান হওয়ায় সে কাল বারোয়ারীতলায় ইচ্ছে করে একটু দূরে দূরে ছিল। চব্বিশ ঘন্টায় দেখা যাচ্ছে রাগের কাছে কৌতূহলেরই জয় হয়েছে।
    কৌতূহল চাপতে না পেরে আজ সাত্‌সকালে দোকানে হাজির হয়েছে। হারান কাজের ফাঁকে ফাঁকে অমিয়কে হলধরের কাহিনী শোনাল।

    খগেন এল একটু পরে, এই সব ঝামেলাতে খাওয়া ঘুমের অনিয়ম, তারপরে কোদাল শাবল নিয়ে মেহনত, সে ক্ষেপে আছে। দেখা গেল তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছে আশু চাটুজ্জ্যের ওপর। এসেই সে বুড়োর কাছে গিয়ে বলল,
    -"খুড়ো আমি জানি তুমি সব শোনো, সব বুঝতে পারো। তবু ইচ্ছে করেই কোনো কথা কও না। এটা কিন্তু ঠিক করোনা তুমি, আমি রসিক মন্ডলের ছেলে নেয্য কথা বলতে ভয় পাই নি। শুধু শুধু তুমি আমাদের এতটা ঘোরালে সত্যি কথাটা জেনেও না বলে। শুরুতেই যদি বলে দিতে বাক্সটা কুথায় আছে এতগুলো লোককে এত হয়রান হতে হতনি।"
    অমিয়রা খগেন কে ধরে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে চা খাইয়ে ঠান্ডা করল। আশুবাবু খগেনের কথায় কান করেছে বলে মনে হলনা, সে সেই একইভাবে রাস্তার দিকে চোখ রেখে বসে।

    বেলা হতে এরা যখন উঠতে যাবে দেখল শংকু আসছে দাদুকে নিতে। হাতে একটা কাঠের খিল। অমিয় জিজ্ঞেস করতে বলল,
    -"খিল বানিয়ে দিয়েছে ছিদাম দা, নিয়ে যাচ্ছি। জেঠা আজই লাগাতে বলেছে। কাল শহরে গিয়ে আরো একটা অন্যরকম শক্তপোক্ত বিলিতী তালা নিয়ে এসে তালাও পাল্টাবে। গোবিন্দদারা সব ঘাঁতঘোঁত দেখে নিয়েছে যে। সাবধান হতে হবেনা!"
    যারা ছিল ওখানে সবাই হেসে উঠল। সত্যিই তো, কাল থেকে এ গাঁয়ে আবার সব যে যার নিজের কাজে ফিরে যাবে। চোর চুরি করবে, গেরস্ত সামলাবে।
    বিশেকে ঠিক করে দোকান বন্ধ করতে বলে হারান বাড়ির দিকে চলল।
    (শেষ)

     গাঁয়ের কথাটি ফুরোল
     নটে গাছটি ……….

  • Shn | 123.201.130.118 | ২৮ জুন ২০১০ ১৬:১০449666
  • আহা বেশ বেশ বেশ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন