এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৫৯৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Samik | 121.242.177.19 | ২৮ জুন ২০১০ ১৬:৩৭449667
  • করিমে একটা ভরপেট খ্যাঁটন পাওনা রইল। শ্রাবণী, সময় সুযোগ করে জানিয়ে দিও। আমি তৈরি।
  • Lama | 203.99.212.54 | ২৮ জুন ২০১০ ১৭:০১449668
  • কদিন ধরে যদিও আরো লেখার জন্য তাড়া দিচ্ছিলাম, শেষ হয়ে যাবার পর মনে হচ্ছে এত তাড়াতাড়ি শেষ না হলেও হত
  • de | 203.199.33.2 | ২৮ জুন ২০১০ ১৭:৩৫449669
  • ভালো গান শোনার মতো -- সুরের রেশ লেগে রইলো কানে -- আবারো এমন সুন্দর গল্প লিখো শ্রাবণী!
  • Manish | 117.241.229.16 | ২৮ জুন ২০১০ ১৮:০০449670
  • সাধু সাধু।
    আচ্ছা এই গল্পটাকেও চটি করে বের করা যায় না।
  • Nina | 64.56.33.254 | ২৯ জুন ২০১০ ০০:৪২449671
  • শ্রাবণী, বহুদিন আগে মনোজ বসুর ' নিশিকুটুম্ব" পড়ে খুব ভাল লেগেছিল ---তোমার লেখাটা যে কত ভাল লাগল বলে বোঝাবার ভাষাই নেই---অনেক তাড়া দিয়েছি তোমায়, রাগ কোরোনা--কি করব বল , এত ভাল লেখা ----খুউউব ভল থেক আর অ--নে---ক অ--নে--ক লিখ।
    এই গল্প দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকায় বেরোনো উচিত। এখনো লোকে ভাল লেখার খোঁজে হতাশ হয়ে ফেরে।
    আরও কোথাও যদি তোমার লেখা থাকে , আমকে প্লিজ জানিও , আমি প্‌ড়ব।
    অনেক ভালবাসায়---নিনাদি

  • Shuchismita | 71.201.25.54 | ২৯ জুন ২০১০ ০৭:৪১449672
  • অসম্ভব ভালো। এ লেখা বই হয়ে বের হতেই হবে।
  • M | 59.93.244.67 | ২৯ জুন ২০১০ ০৮:৫১449673
  • সত্যি, অসাধারন। এটা চটি হলে ভালো হয়, আর সইয়ের লেখা গুলো ও।সেটাও এখানে বলে ফেললাম। আর সর্ষেবাটা গুলো অজ্জিনাল ফর্মে।
  • shrabani | 124.30.233.102 | ২৯ জুন ২০১০ ১১:৩৭449674
  • ভেবেছিলাম আমার শোনা, দেখা গ্রামের নানা ঘটনা গুলো লিখে রাখব, কারন আমরা ও আমাদের গ্রামের দুনিয়া সবই খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি।
    তখন যখন সেভাবে গ্রামেও ঘরে ঘরে টেলিভিশন আসেনি, ফোন আসেনি তখন এরকম নানা দৈনন্দিন ঘটনাই গ্রাম জীবনে এন্টারটেনমেন্টের উৎস ছিল। ঝগড়া, চুরি, নতুন লোক, মেয়ে দেখা, যাত্রা নাটকে অঘটন, স্কুলে ইন্সপেক্টর আসা এসব নানা ঘটনা ঘিরে সারাদিন এবাড়ী ওবাড়ী নানা মহলের নানা আড্ডায় আলোচনা চলত। একটা কিছু নিয়ে আলোচনা শেষই হতনা যতক্ষন না আবার নতুন কোনো ঘটনা ঘটছে!

    লিখতে শুরু করে ভাবলাম এমনি লেখার চেয়ে গল্পের ছলে লিখলে ভালো হবে, তাই করতে গিয়ে কিভাবে যেন রহস্য চলে এল। এছাড়া চরিত্ররা কেউ কেউ আমার শোনা চেনা, আমার চোখ দিয়ে এদের নিয়ে লিখতে মজাই লাগছিল।

    তবে এও সত্যি নিনা, লামা, হুতোর তাড়া আর বাড়ি জুড়ে বিচ্ছিরি ভাবে মিস্ত্রী লেগে আমাকে এক ঘরে বন্দী না করলে এতটা নামত না!

    কিন্তু লিখতে গিয়ে কখনও ভাবিনি যে শেষে শমীকের করিম অফার ওয়েট করে থাকবে! পরিশ্রম সার্থক!
    শমীক, গরম কমলে মনে করিয়ে দেব।:)
  • Samik | 121.242.177.19 | ২৯ জুন ২০১০ ১৩:৪৬449675
  • শিওর :-)
  • Mridha | 208.85.244.2 | ৩০ জুন ২০১০ ০২:৪৮449677
  • শ্রাবনী, অসাধারণ। গল্পটা পড়ার অনুভুতিটা অনেকটা ছোটোবেলার আনন্দমেলার ধারাবাহিক পড়ার মতো, অনেক দিনের পুরোনো ঐ অনুভুতিটা আবার যেন ফিরে পেলাম।
    আর চরিত্র গুলো যেন আমার কোনো হরিয়ে যাওয়া জীবন থেকে উঠে আসা, অনেক ধন্যবাদ এমন একটা Nastalgic Feeling এর জন্য
  • aishik | 122.166.161.157 | ৩০ জুন ২০১০ ২২:৩৯449678
  • ওফ্‌ফ্‌ফ্‌ফ্‌ফ দম বন্ধ করে পড়্‌লাম। কোনো কথা হবে না।
  • jayanti | 122.163.13.85 | ০৬ জুলাই ২০১০ ১৬:৫৮449679
  • শ্রাবণী,

    দু:খিত, অনেকদিন পড়তে পারিনি।

    শেষ করে অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল।মনে হোলো এক অসাধারণ আনন্দধারার স্পর্শ পেলাম।

    তবে এমন চমৎকার রূপকথাটা শেষ হয়ে গেল-এটাই দু:খ।
    আর একটা রূপকথা লেখো, প্লীজ।
  • শ্রাবণী | 127.239.15.102 | ১৮ জুন ২০১২ ১২:২৩449680
  • আর এক গাঁয়ের কথা
    *****************************
    তখনও ভোরের আলো ঠিকমত ফোটেনি, নগেন পাড়ুই দাঁতন হাতে দক্ষিন মাঠের দিকে চলেছে। শীত গ্রীষ্ম বরাবরই তার রাত থাকতে ওঠা অভ্যেস। বয়স হয়েছে, বাড়ির লোকে বিশেষ করে ছেলেরা বিরক্ত হলেও সে তার স্বভাব পালটায় নি। মাঠের ধারের জঙ্গলে প্রাতঃকৃত্য সেরে বোসেদের ঠাকুরপুকুরে যায় চানে। চান সেরে উঠে রাধামাধবের মন্দিরে প্রণাম প্রদক্ষিণ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বাড়ির মেয়েদের বাসী কাজ সারা, উনুনে আগুন ধরানো এসব নিত্যকর্ম শুরু হয়ে যায়।
    সকালে প্রথম এক কাপ চা গিন্নী তার জন্য নিজে হাতে তৈরী করে দুয়ারে স্টোভ জ্বালিয়ে। সেই চা খেয়ে নগেন বাইরে সদরে গিয়ে দোকান খুলে বসে। লোহা লক্কড়ের জিনিসের দোকান, লাগোয়া দুয়ারে কামারশাল। তারা জাতে কামার নয় তবু ঠাকুদ্দার আমল থেকে এই ব্যবসা, হাপর চালায় দুখে কামার। দুখেরাও বংশ পরম্পরায় এই দোকানে কাজ করে। তবে যেমন নগেনের ছেলেরা আর দোকানে বসতে আগ্রহী নয় তেমনি দুখের ছেলেও ইস্কুলে পড়ে এখন হরিপুরের হেলথ সেন্টারে কাজ করছে!
    কদিন আগে কালীপুজো হয়ে গেছে, ঠাকুরপুকুর থেকে এখনো কাঠামো তোলা হয়নি। এই সকালে মাঠের ধারে বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ, হালকা কুয়াশা পড়েছে, ঘাস পাতা সব শিশিরে ভেজা। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মাঠের আল ধরে খানিকটা হেঁটে গেলে ঠাকুরপুকুরের পাড় আসে, বেশ উঁচু পাড়, মাঠের জমির ওপর দাঁড়ালে এদিক থেকে জল দেখা যায়না। বাঁধানো ঘাটটা ওপারে,বোসপাড়ার ভিতর পড়ে, অনঙ্গ বোসের খিড়কী দুয়ারের সামনে। মাঠ দিয়ে উঠলে, এপারে বাইরের লোকের সরার জন্য কতগুলো ইঁট আর তালগুঁড়ির পৈঠা পেতে ঘাট মত করা আছে। পাড়ে উঠে আবার ঘাটে নামতে হয়, পাড়টা গাছগাছালিতে ভরা। মাটিতে এখানে সেখানে স্তুপাকার ঝরা পাতা,সরু ডাল, শিশিরে ভিজে ভিজে অল্প পিছল হয়ে আছে। নগেন আস্তে আস্তে গাছের ডালে ভর দিয়ে দিয়ে নামতে লাগল। ঠাকুরপুকুর এমনিতে বালিপুকুর, জলে নেমে পড়লে পায়ে কাদা লাগেনা।
    পুকুরের জল কনকনে ঠান্ডা, প্রথমটা নামতে গা শিরশির করলেও আস্তে আস্তে সয়ে যায়। চান করে ধুতি গামছা কেচে ভিজে গামছাটা পরে নিল আর ধুতিটা জল নিঙড়ে হাতে ঝুলিয়ে নিল। আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে, পুব আকাশে লালের ছটা, সুয্যি উঠল বলে। ওঁ গঙ্গা গঙ্গা জপতে জপতে সবে পাড়ে উঠেছে চোখ পড়ল আতা গাছের তলার দিকে। কী যেন চকচক করছে না? কী পড়ে রয়েছে ওখেনে?

    রাতে ফনিভূষণের আজকাল ঠিকমত ঘুম আসেনা। যোগেশ ডাক্তারকে বললে খালি বলে চিন্তাভাবনা গুলো এই বয়সে একটু কম করতে, তাহলেই ঘুম আসবে। ওপাড়ার কেতা অর্থাৎ কাত্তিক পাল তারই বয়সী, সন্ধ্যের আড্ডায় বারোয়ারীতলায় দুজনের দেখা হয় প্রতিদিন, সে নাকি রোজ দুধের সাথে একটু আপিম খায়, ভালো ঘুম হয়। বড় ছেলেকে আপিম আনার কথা বলতে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে দেখবে বলল। তা সে আপিমের আর দেখা নেই, যোগেশ নির্ঘাত বাগড়া দিয়েছে। আসলে বাড়ির সকলে গিন্নীর দলে আর তাঁর বক্তব্য যে ফনিভূষণ নাকি দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়, ঘুম না হওয়া তার বাই, বুড়োবয়সের ভীমরতি। সারারাত তো গিন্নী নিজে নাক ডাকায়, রাধামাধবের কৃপায় ঘুম পেয়েছেন বটে, বিছানায় পড়ল কী নাক ডাকা শুরু। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে ভোরবেলা কত্তা যখন একটু দু চোখের পাতা এক করে, তখন গিন্নীর ওঠার সময়, তাই তিনি দেখেন ফনিভূষণকে ঘুমোতে। এসব কথা কাউকে বলে লাভ নেই, সংসারে গিন্নীর পাল্লা ভারী, দাপটও খুব, ছেলেবউ নাতিনাতনীরা তার কথাতেই সায় দেবে, ফনির কথা শুনবেনা। পাড়াতে সবার বড়, মান্যিগণ্যি কত্তাব্যক্তি হলে কী হবে নিজের বাড়িতে গিন্নীর কাছে জব্দ!
    ভোরের ঘুমের আগে রোজের মত আজও ওপরের ঘরের দেওয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং ঢং করে তিনটে বাজতে শুনেছিল মনে আছে।
    এই নতুন বাড়িটায় ওপর নীচে দুইখান ঘর, ওপরে ছোট ছেলেরা থাকে নীচে তারা কত্তাগিন্নী, বাকী সবাই পুরনো বাড়িতে, রান্নাখাওয়াও সেখানে। এবাড়িখানা মন্দিরের পাশেই, আজকাল আর রোজ সন্ধ্যেয় আরতির সময় গিয়ে বসতে পারেনা, খাটটা জানালার ধারে পাতা, সেখানে বসে বসেই আরতি দেখতে পায়। বিনয় ঠাকুর রাধামাধবকে শীতল দেখিয়ে শয়ন করিয়ে সব শেষে চানজল নিয়ে আসে বড়কত্তাকে খাওয়াতে। তখনই বৈষয়িক কথাবার্তা সারা হয়, পাড়ার মাতব্বরেরাও কেউ কেউ থাকে রোজই, ভালো জমাটি আসর বসে।
    স্নান সেরে পাটের কাপড় পরে মন্দির প্রদক্ষিন করছে ফনিভূষণ প্রতিদিনের মতো, শুধু আজ স্নানটা একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। চাদ্দিকে ভালো করে আলোও ফোটেনি। লোকজন তবু জেগে গেছে মনে হচ্ছে, ঐ তো একটা ছেলে কলকে ফুল পেড়ে রাধামাধবের দোরের সামনে এনে এনে রাখছে। চোখে চশমা নেই, কাদের ছেলে ঠিক ঠাহর করতে পারলনা! হবে কেউ, পাড়ায় কতই তো বাচ্চা এবাড়ি ওবাড়ি, সবকে সে চেনেও না বোধকরি। একটু সামনে আসতে বাচ্চাটা হাসি হাসি আদুরে মুখ করে তার কাছে এল,
    -"ইস, ঠাকুরের গয়নাগুলো কত পুরনো হয়ে গেছে। নতুন গয়না গড়িয়ে দাওনা কেন?"
    ফনিভূষণ অবাক হল, ঠাকুরের গয়না পুরনো হয়ে গেছে? কই বিনয় তো এনিয়ে কিছু বলেনি কখনো। প্রদক্ষিণ না থামিয়েই বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
    -" কই না তো, গয়না পুরনো হবে কেন? এইতো কোন পুজোটায় যেন পালিশ হল, ভালই চমক আছে তো।" ঘুরে আবার এদিকে এসে দেখে ছেলেটা নেই, দুয়ারে ফুলগুলো পড়ে আছে। এতক্ষণ ছেলেটাকে ভালো করে খেয়াল করেনি, এখন হঠাৎ কেমন মনে হল, একটা আকুলতা জাগল মনে। চারিদিকে আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল, গেল কোথায় ছেলেটা, গয়না পুরনো হয়ে গেছে এটা ও কার কাছে শুনেছে জানতে হবে! সারা পাড়ায় কোথাও খুঁজে পাচ্ছেনা ছেলেটাকে, ঘুরতে ঘুরতে ঘেমেনেয়ে ক্লান্ত শরীরটা মন্দিরের দুয়ারে এলে দিয়েছে আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল।
    ওঃ স্বপ্ন, কী কান্ড, এক্কেবারে সত্যি মনে হচ্ছিল যে, ঘেমেও গেছে সত্যি সত্যি! পাশের সিন্দুকের ওপর রাখা জলের গ্লাসটা থেকে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেল, পাশে গিন্নী ঘুমে অচেতন। মন্দিরের ওদিককার খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে, বেশ আরাম লাগল, একটু পরেই আবার ঘুমে ঢলে পড়ল ফনিভূষণ।

    -"জয় গুরু জয় রাধামাধব", এ কী দেখছে সে? নগেন পাড়ুই ঠক ঠক কাঁপতে থাকে। যে যুগলমূর্তি সে রোজ মন্দিরের ভেতর সিংহাসনে বসে থাকতে দেখে,আজ সেই রাধামাধবকে এখানে এরূপে দেখছে কেন, গাছতলায় ধূলায় গড়াগড়ি যাচ্ছেন প্রভু, নিরাভরন?
    চোখদুটো বন্ধ করে নিল ভয়ে, একী ঠাকুরের লীলা! সেকি তবে এখনো ঘুমের ঘোরে, স্বপ্ন দেখছে? প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও নগেন ঝানু দোকানদার লোক, চোখ বন্ধ করেই অবস্থাটা চিন্তা করতে লাগল। নাঃ সে জেগেই আছে, ভিজে কাপড়ে খোলা মাঠের ধারে পুকুরপাড়ে ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি ভালৈ মালুম দিচ্ছে। তবে দেখার ভুল হতে পারে,আস্তে আস্তে চোখদুটো খুললো সাহস করে। না, কোনো ভুল নেই মাটিতে যিনি পড়ে আছেন তিনি বোসেদের মন্দিরের রাধামাধবই।
    চোখ খুলে খুঁটিয়ে দেখল, তারপরে এদিক ওদিকও ভালো করে দেখে নিল, একটু দুরে নাড়ুগোপাল মূর্তি আর শালগ্রাম শিলা কটা দেখা গেল। ঠাকুরদের পরনে কাপড় আছে তবে গয়নাগাঁটি কিছু নেই, বাঁশি ,মুকুট, হার, রাধারাণীর টানা নথ, কিচ্ছু নেই। আজ এতকাল ধরে নগেন রোজ দুবেলা মন্দিরে যায়, এই সকালে চান করে একবার আর সন্ধ্যের আরতির সময়। ঠাকুরের সাজগোজ মুখস্থ প্রায়, এখন ন্যাড়া মূর্তিগুলো দেখে তার বুকের মধ্যেটা কেমন করে উঠল, একী অনাছিষ্টি, এ সর্বনাশ হল কী করে!
    চোখ খুলে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগল করনীয় কী, এ চোরের কাজ সন্দেহ নেই। তবে এতক্ষণ সে চোর কী আর আশপাশে বসে আছে, গয়নাগাঁটি নিয়ে সটকেছে নির্ঘাত।
    আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে, মাঠে লোকের আনাগোণা শুরু হতে দেরী নেই। এই অবস্থায় মূর্তিগুলোকে অরক্ষিত রেখে পাড়ার ভেতরে লোক ডাকতে যেতেও মন সায় দিলে না, আবার মন্দিরের ঠাকুর সে যতই ধূলায় লুটোক না কেন, নিজে অব্রাহ্মন হয়ে তাকে হাতে তুলে নিতেও সাহস হচ্ছেনা। এরকম দোটানায় কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল, একরকম পাহারা দেওয়ার মতই দাঁড়িয়ে রইল নগেন রাধামাধবকে ঘিরে, ভিজে জামাকাপড়ে। অপেক্ষায় যুগপৎ ওপাড়ে বোসেদের পাকা ঘাটের দিকে আর মাঠের দিকের থেকে আসা পুকুরপাড়ের পায়েচলা পথের দিকে চেয়ে থাকে।
  • শ্রাবণী | 127.239.15.102 | ১৮ জুন ২০১২ ১২:২৯449681
  • খাঁদি ঝি ঘুমচোখে গজগজ করতে করতে বাসনের পাঁজা নিয়ে অনঙ্গ বোসের খিড়কী দিয়ে বেরোয়, পেছন পেছন বোসেদের বড়গিন্নী। খাঁদি বেচারা প্রচন্ড ঘুমকাতুরে, তাই তাকে কড়া পাহারা দিতে হয়। নাহলেই সে জলে বাসন ভিজিয়ে অথবা উনুনে আঁচ দিয়ে কিম্বা গুল দিতে দিতে অর্থাৎ যে কোনো কাজের ফাঁকেই একচোট ঘুমিয়ে নেওয়ার তাল করে। গিন্নীর হাতে ঘুঁটের ছাই, দাঁতে ঘসতে ঘসতে ঘাটের ধারিতে এসে বসেছে, পরণে শুধু শাড়ি গায়ে গামছা জড়ানো। দাঁতমাজা হলে, একেবারে ডুব দিয়ে কাপড় কেচে উঠবে। খাঁদি বাসন ভিজিয়ে আবার বাড়ির ভেতরে যায় বাসি রান্নাঘর দুয়ার সব ন্যাতা দিয়ে পরিস্কার করতে, মাজা বাসন তুলে রাখতে হবে।
    সারাদিনের মত সংসারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে বোসগিন্নী ভোরের এই একাকী অবকাশের মুহূর্ত সইতে থাকে অলস চোখে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে। পাড়ুই কর্তার আজ নাইতে দেরী হয়েছে বোধকরি, এখনো ওপাড়ে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে কী দেখছে কে জানে! এসময় তো তার চান হয়ে মন্দিরে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
    হঠাৎ একটা চিৎকার কানে আসতে বোসগিন্নী উঠে দাঁড়াল, শুনে মনে হচ্ছে আওয়াজটা মন্দিরের দিক থেকে আসছে। আর ঠিক সেই সময়ই নগেন পাড়ুইও যেন চিৎকার করে এদিকে তাকিয়ে কী বলতে আরম্ভ করল। কিছু শোনার আগে পাড়ুইকে এদিকে তাকাতে দেখে বোসগিন্নীর নিজের অবস্থার দিকে নজর গেল। চান করতে এসেছে, সেভাবে কাপড়চোপড়ের ঠিক নেই, ব্যাটাছেলেদের সামনে লজ্জা করে না! একগলা ঘোমটা টেনে ঘাটের মাঝখান থেকে ঝোপের দিকে সরে একটু আড়াল হয়ে গেল।

    ওদিকে পাড়ুই তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, "ও বৌমা, ও বৌমা, অনঙ্গ ভুজঙ্গকে ডাকো, ছেলেদের ডাকো, সর্বনাশ হয়ে গেছে"! ঘোমটা ও ঝোপঝাড়ের ধাক্কায় সে আওয়াজ ঠিক করে আসছেইনা গিন্নীর কানে।
    হেনকালে ন্যাতা বালতি হাতে খাঁদির ঘাটে পুনরায় আগমন।
    এমনেতে বোসবাড়ীর সকলে সাক্ষী দেবে খাঁদি কানে আধকালা তবে কেউ কেউ এও সন্দেহ করে যে তার ইচ্ছাশ্রুতি। পাড়ায় কার বাড়ি কী হচ্ছে, কোন বউয়ের সাথে কোন শাশুড়ীর ধুন্ধুমার, কোন কত্তার সিন্দুকে বেহিসেবের কড়ি, এসব খবর যখন এ ওর কানে ফিসফিস করে তখন খাঁদি কিভাবে যেন সব ঠিকঠাক শুনে নিয়ে প্রচারসচিবের দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করে থাকে। শুধু বাড়ীর কাজের মত অদরকারি কথাবার্তা শুনতেই তার অসুবিধে হয়।
    তাই পাড়ুইয়ের কথা বোসগিন্নীর ঘোমটা ভেদ করে ঠিকঠাক না পৌঁছলেও, বাধাহীন সকালের নির্মল বাতাসে ভর দিয়ে খাঁদির একেবারে কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল। আর সেও ভাবনা চিন্তা, সঠিক উপলব্ধিতে একবিন্দু সময়ও না ব্যয় করে সারা পাড়ার কানের পোকা নড়ানো একখান চিৎকার জুড়ল, "ওরে সব্বোনাশ হয়ে গেল রে, সব্বোনাশ হয়ে গেল"।
    যদিও বলাই বাহুল্য সর্বনাশের রকমের কোনো আভাস সে পাড়ুই কত্তার কাছে তখনো পায়নি।

    পাড়ুইয়ে চিৎকারে যা উঠেছিল, এই আওয়াজে বোসগিন্নীর সেই ঘোমটা খসে পড়ল। অনঙ্গ বোসের খিড়কী দিয়ে সারা পরিবারে যে যেমন ছিল, চাদর গায়ে, আধ বস্ত্রে, দাঁতন হাতে,হুঁকো মুখে দৌড়ে ছুটে হেঁটে হামা দিয়ে চটি টেনে "কী হল, কী হল" রবে বেরিয়ে পড়ল।
    বোসগিন্নী ও খাঁদি দুজনেরই দৃষ্টি অনুসরণ করে সকলের চোখ পড়ল দক্ষিণপাড়ে পাড়ুইকত্তার পানে। পাড়ুই এত লোককে দেখে তার এতক্ষণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা সফল হয়েছে ভেবে দ্বিগুণ উৎসাহে হাতপা নাড়িয়ে লম্ফঝম্প করে সবাইকে তার কাছে যাওয়ার জন্যে ডাকতে লাগল।
    এপাড়ে বড়কত্তা অনঙ্গ স্থিতধী ব্যক্তি, কোনো কিছুতে সহজে উতলা হয়না, পাড়ার একজন অন্যতম প্রাচীন ও প্রাচীনপন্থী মাতব্বর। এই সিগারেট বিড়ির যুগেও হুঁকো ছাড়া অন্য কিছুর ধোঁয়া তার সহ্য হয়না। সে যখন দেখলে কেউ মরেনি বা বড়বউ ভির্মি খায়নি ইত্যাদি মানে সেরকম কিছুই হয়নি শুধু নগা পাড়ুই ওপাড়ে লাফাচ্ছে তখন আয়েস করে ঘাটের প্রথম সিঁড়িতে বসে হুঁকোয় টান দিয়ে মেজভাই ভুজঙ্গ আর বড়ছেলেকে বলে,
    "গিয়ে দ্যাক, নগার আবার কী হল, সাপটাপ দেখল নাকি কে জানে!"
    কত্তার আদেশে উৎসাহী তিন চারজন ঘাট থেকে উঠে বাঁদিক দিয়ে পাড় ধরে মাঠে যাবার রাস্তা ধরল দক্ষিণ পাড়ে পাড়ুই মশায়ের কাছে যাবার জন্যে। ততখনে মাঠ থেকে দুচারজন মুনিষের দল বোসপাড়ায় কাজে আসছিল, তারা হাঁকডাক শুনে ওপারে পৌঁছে গেছে।

    বিনয় ঠাকুরের গল্পটা অবশ্য সোজাসাপটা। একমাইল দুরে চাটুজ্জ্যে পাড়ায় তার বাড়ী থেকে চানটান সেরে সে একদম কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটায় রওনা দিয়েছিল রোজের মতই। পাড়ায় ঢোকার মুখে সদরঘাটে হাতপা মুখ ধুয়ে পিতলের চকচকে গাড়ুতে জল ভরে নিয়েছিল মন্দিরে উঠে আর একবার হাত পা ধোবার জন্য। মন্দিরের চৌহদ্দি চারদিক থেকে পাকা পাঁচিলে ঘেরা হলেও কোনো গেটটেটের বালাই নেই। ভেতরে ফুলের গাছ অনেক, কল্কে চাঁপা জবা টগর গন্ধরাজ। ঢুকতে ঢুকতেই ফুলের গাছের দিকে নজর যায় বামুন মশায়ের। কত কষ্ট করে ভয় দেখিয়ে মেরে পাড়ার বদমায়েশ বাচ্চাগুলোর নাগাল থেকে বাঁচিয়ে রাখে ফুলগুলোকে। রোজ সাজি ভরে ফুল তুলে মালা গেঁথে অনেক সময় নিয়ে রাধামাধব ও অন্যান্য দেবতাদের সাজায় বিনয়। কত্তারা তারিফও করে খুব, বড়কত্তা তো রোজ বলে বিনয়ের হাতে পড়ে রাধামাধবের এমন রূপ খুলেছে যে দেখে দুচোখ জুড়িয়ে যায়। এত করেও বদমায়েশগুলো কখনো কখনো রাতে আঁকশি দিয়ে ফুলশুদ্দু ডাল ভেঙে পালায় তাকে জব্দ করার জন্য।
    সকালে এসে তাই তার সর্বাগ্রে ফুলগাছের দিকে চোখ চলে যায়।
    তা ফুলের গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে অন্যমনস্ক ভাবে রোজের মত দুধাপ বেয়ে দালানে উঠে কোমর থেকে চাবির গোছা বার করে তালায় লাগাতে গিয়ে দেখে তালা নেই। ফুলের চিন্তাটা সরিয়ে দরজার দিকে মন দিয়ে দেখে, তালা নেই দরজাটা ভেজানো। দোর ঠেলে ভেতর দালানে ঢুকে দেখে মূল দরজাটা হা হা করে খোলা। বিনয়ের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, চলৎশক্তি রহিত যেন এমনি দাঁড়িয়ে রইল, আধো অন্ধকার অন্দরেও ঠাকুরের শূণ্য সিংহাসন পষ্ট দেখল সে। কিছুক্ষণ এইভাবে থেকে একসময় হাতের গাড়ু পাশে রেখে মাথায় হাত দিয়ে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়ল, অন্য হাতে তার তখনও চাবির গোছা ধরা!
  • kumu | 132.160.159.184 | ১৮ জুন ২০১২ ১৫:৩০449682
  • কী ভাল লাগল পড়ে,পুকুরে চান করার মতই শরীর মন জুড়িয়ে গেল।

    বাঁধানো ঘাটটা ওপারে,বোসপাড়ার ভিতর পড়ে, অনঙ্গ বোসের খিড়কী দুয়ারের সামনে। মাঠ দিয়ে উঠলে, এপারে বাইরের লোকের সরার জন্য কতগুলো ইঁট আর তালগুঁড়ির পৈঠা পেতে ঘাট মত করা আছে। পাড়ে উঠে আবার ঘাটে নামতে হয়, পাড়টা গাছগাছালিতে ভরা। মাটিতে এখানে সেখানে স্তুপাকার ঝরা পাতা,সরু ডাল, শিশিরে ভিজে ভিজে অল্প পিছল হয়ে আছে। -এত ডিটেল শ্রাবণীর মনে থাকে কী করে???
  • aishik | 213.200.33.67 | ১৮ জুন ২০১২ ১৬:৩২449683
  • তারপরে????????
  • Nina | 78.34.167.250 | ১৯ জুন ২০১২ ০৮:৪৭449684
  • আজ সকালে উঠে কার মুখ দেখলুম----শ্রাবণীর লেখা পড়তে পেলুম---কি আনন্দ কি আনন্দ ঃ)
    একেবারে পাটি পেড়ে বসলুম----কি ভাল কি ভাল--তাপ্পর --শ্রাবণী---বল বল
  • শ্রাবণী | 127.239.15.102 | ২২ জুন ২০১২ ১৫:১৯449685
  • বেলা সাতটা বেজেছে কী বাজেনি তখন, পাড়ার একটা মনিষ্যিও ঘরে বসে নেই, সব এসে জুটেছে রাধামাধবের মন্দিরে।
    সাতকুঁড়ের এক কুঁড়ে পল্টন বোস যে দশটার আগে বিছানা ছাড়েনা সেও, তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকা সরী ঠাকুমা যে বাতের ব্যাথায় নড়তে পাড়েনা, সেও। বুড়ো বাচ্চা চুনো পুঁটী এলে বেলে সব এসে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। দালানের ওপরে সব বড় মেজ কত্তারা, কে নেই সেখেনে!

    অনঙ্গ বোসেরা দুই ভাই, অজিত বোস, ধম্মদাস, শম্ভু বোস। বিনয় বামুন একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দুখানি রক্তজবা, কিছু আগেও কান্নাকাটি করেছে। নীচে উঠোনে একধারে ছেলে ছোকরারা গজাল্লি করছে, চোর কিভাবে কখন এসেছে তা নিয়ে নানান মতামত। বাচ্চারা মহানন্দে এগাছ ওগাছ করছে, কল্কের ডাল ধরে দোল খাচ্ছে, একদল ধরাধরি খেলছে, বড়রা দেখেও কিছু বলছেনা বা বকছেনা।
    দালান থেকে নেমেই ভোগ মন্দিরের নীচেটায় ধম্মদাসের মা বুড়ি আরো দুচারজন সঙ্গী নিয়ে বিলাপ জুড়েছে, সব কথা কান্নার ইঁ ইঁ সুরে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা তবে মাঝে মাঝেই "কী সব্বোনাশ হল গো,ওলাউঠা হয়ে মরবে যে" এই জাতীয় কিছু একটু উঁচু স্বরে উঠেই আবার কর্তাদের বিরক্তিসহ ধমকানিতে নীচুগ্রামে চলে যাচ্ছে।
    সরী ঠাকুমা বাতজনিত কারণে নীচে বসতে পারেনা বলে কাছের সম্বলদের বাড়ী থেকে একখান টুল এনে তাকে বসানো হয়েছে। সে নিজে বিলাপ করছেনা তবে দলটাকে মাঝে মাঝে গাইড করছে সর্বনাশের নানা সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে। সবচেয়ে পেছনের সারিতে অর্থাৎ পাঁচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ীর গিন্নী বউ ও মেয়ের দল অর্থাৎ মহিলাকূল। তারা প্রধানত নীরব দর্শক, মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ঘোমটার আড়ালে অল্পস্বল্প ভাব বিনিময় যাও হচ্ছে তাও ফিসফিসিয়ে, বহির্জনতার কানে তা পৌঁছচ্ছেনা।

    আলোচনা প্রচুর হচ্ছে, ঘন ঘন মাথা নাড়ছে সবাই তবে করণীয় কিছু এখনও স্থির হয়নি। সবাই অপেক্ষা করছে সবার বড় ফনিভূষণের জন্য। বড়ছেলে নবীন এসে জানিয়েছে বাবা সেই উঠেছে ঘুম থেকে, প্রাতঃকৃত্য সেরে চা খাচ্ছে। তাকে মন্দির চুরির ব্যাপারে এখনো জানানো হয়নি,বয়স হয়েছে, হঠাৎ শক পাবে। চা খাওয়া হলে গিন্নী ধীরেসুস্থে জানিয়ে মন্দিরে পাঠিয়ে দেবেন ঠিক হয়েছে। এদিকে ঠাকুরের মূর্তি সব সেই পুকুরধারে পড়ে রয়েছে, কয়েকজনকে সেখানে পাহারায় রাখা হয়েছে। এমত অবস্থায় কী করা উচিৎ কারুরই কোনো ধারণা নেই, চুরি এমন্দিরে এই প্রথম। বিনয় বামুন নিত্য সেবার পুরোহিত, গাঁয়েরই লোক, তবে জ্ঞানগম্যি বিশেষ নাই। বড় পুজোতে, পালেপাব্বণে এদের কুলপুরোহিত ভবেন ভটচাজ আসে সেই কুলতলি থেকে। ভটচাজ মশায় সংস্কৃতে পন্ডিত, জ্ঞানীগুণী লোক। তার কাছে লোক পাঠানোর কথাও উঠল।
    আলোচনার নামে গুলতানি আরও কিছুক্ষণ চলার পরে ফনিভূষণ এলে নাতি বাবলুর সঙ্গে। সবাই একযোগে তাকে সমস্ত বিবরণ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মায় ম্রিয়মাণ বামুন পর্যন্ত।
    কত্তামশায় মন্দিরের ভেতর ঢুকলে, এবং ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই এদিক ওদিক পাকা চোখে নজর করে, যা এত্স্ক্ষন কেউ খেয়াল করেনি তা দেখে ফেললে। মাঝে রাধামাধবের সিংহাসন থেকে দুরে এককোণে একটা ছোট চৌকির ওপর রাখা থাকত এক আঙুলের সাইজের একটি খাঁটি সোনার চামুন্ডা মূর্তি। কথিত আছে যে এই চামুন্ডা স্বপ্ন দিয়ে উঠেছিলেন পদ্মপুকুর থেকে। এনার আবির্ভাবের পর থেকেই এই আপাত বৈষ্ণব বাড়িতে দূর্গা পুজার প্রচলন হয়, সে আজ প্রায় নয় নয় করে চারশ বছর আগের কথা হবে।
    ফনিভূষণ চৌকির পেছন দিকে এই মূর্তিটি খুঁজে পেলেন। সারা জমায়েত এ খবরে উল্লাস প্রকাশ করল, যাক। দেখতে গেলে মোদ্দা ব্যাপার যা দাঁড়ালো তা হল মন্দিরের সমস্ত মূর্তি , শালগ্রাম শিলা ইত্যাদি অক্ষত ও বিদ্যমান।
    যা গেছে তা হল কিছু গয়নাগাঁটি, রুপো ও কাঁসার বাসনকোসন ইত্যাদি। কিছু ভালো সোনার গয়না তোলা থাকে অনঙ্গ বোসের পাকাবাড়ির সিন্দুকে, তেমন তেমন উৎসবে বার করে পরানো হয় আবার উৎসব শেষে তুলে রেখে দেওয়া হয়, সেগুলোও বেঁচে গেল।
  • শ্রাবণী | 127.239.15.27 | ২২ জুন ২০১২ ১৫:৩৩449686
  • এদিকে আজ সব বাড়ীতে নিত্য কাজকম্ম সব শিকেয় উঠেছে। এতক্ষণে ঘরে ঘরে আঁচ ধরিয়ে ইস্কুল কলেজ কাছারির ভাত বসে যায়। সারা পাড়ায় ছেলেদের পড়ার চেঁচানি শুরু হয়ে যায় একসুরে। ঘাটে বাসন আর চানের ফাঁকে নানা কারণে ঝি বউদের খিটিমিটির চোটে কাকপক্ষী একটু দুরে দুরে থাকে। আজ সেসব হয় আধা পড়ে আছে নয় শুরুই হয়নি। যাদের আঁচ ধরেছে, তাদের ভাত বসানো হয়নি। ভাত হয়েছে যাদের তাদের বাজার আসছেনা কারণ ব্যাটাছেলেরা বাজার যাচ্ছেনা!
    বেপাড়ার পড়ানোর মাস্টাররা এসে বসে বসে চলে গেছে, পাড়ার মাস্টার কজন জুটেছে মন্দিরে, ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে।
    গিন্নীরা নিজেরা একটু দুরে দাঁড়িয়ে সব নজর রাখছে, বুড়ীরা বিলাপের ফাঁকে গিন্নীদের এহেন অধঃপতনে দাঁত খিঁচিয়ে তাদের বাড়ি গিয়ে ঘরের কাজকম্ম সারতে বলছে। গিন্নীরা চাপা গলায় বউ মেয়েদের ঘাড়ে উক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্‌চিন্ত হচ্ছে, আর আজকালকার মেয়েরা যেমন হয় অবাধ্য, তারা সব শুনেটুনেও নড়ছেনা, বড়জোর একটু সরে গিয়ে পল্টুদের দুয়ারে বা সম্বলদের উঠোনে দাঁড়াচ্ছে।

    সরেজমিনে দেখে শুনে আর সোনার চামুন্ডা আবিস্কার করার পর ফনিভূষণ এসে জমিয়ে মন্দিরের বাইর দালানে রাখা টিনের চেয়ারে বসল, পাশাপাশি অন্যান্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঠাকুরকে চোর তো ছুঁয়েই ফেলেছে অতএব সাধারণ মানুষের ছোঁয়ায় আর বাধা কিসের যতদিন না প্রাচিত্তির হচ্ছে। মোটামুটি অল্প তক্কাতক্কি তাও আবার বয়স্কাদের তরফে ছাড়া এই সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিল।
    তখন বিনয় বামুন সঙ্গে ভাইপো ভুতুকে নিয়ে গেল পুকুরপাড় থেকে রাধামাধব ও অন্যান্যদের উদ্ধার করে আনতে। ফনিভূষণ বা সরীঠাকুমার মত প্রাচীনেরাও কোনোদিন এমন্দিরে চুরি দেখেনি বা চুরির কথা শোনেনি। তাই মন্দিরে চোর ঢুকলে তারপরে কী করা উচিৎ, আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়ে কারোরই ঠিক ধারনা নাই।
    তবে চাটুজ্জ্যেদের গোবিন্দকে একবার কোনো পাগল মন্দির থেকে তুলে নিয়ে মাঠের ধারে আশুত তলায় বসিয়ে ভাত খাওয়াতে গেছিল, ফনিভূষণের যুবাকালে। তখন দেখেছিলে ঠাকুরের প্রাচিত্তির, মন্দির শুদ্ধির যাগযজ্ঞ ইত্যাদি।
    কারুর কাছে অবশ্য সেটা উল্লেখ করলে না, তবে মন্দির পরিস্কার করে শুদ্ধিকরণের আগে ঠাকুরদের আবার আগের মত মন্দিরে রাখা যাবেনা এটা জানিয়ে দিলে। ঠিক হল যদ্দিন না সব হচ্ছে, চামুন্ডা শুদ্ধু ঠাকুরদের রাখা হবে পাকাবাড়ির সদর ঘরে। ভুজঙ্গর ছেলে সতু আর ফনির নাতি ক্যাবলা যাবে কুলতলি, ভটচাজ মশায়ের বিধান নিতে। শুধু বিধান না, এই দুঃসময়ে তিনি যাতে নিজে আসেন এবং সমস্ত বিধি বন্দোবস্ত নিজে করেন এই অনুরোধ জানিয়ে ফনিভুষণের নাম করে চিঠিও লেখা হয়ে গেল।

    একটু মধ্যবয়সীরা পুলিশে খবর দেওয়ার কথা তুলল, সেও লোক পাঠানো হল। বেলাবেলি রাম দারোগা এসে তদন্ত করে যাক, যা সাবুদটাবুদ দরকার মন্দিরের চাদ্দিকে খুঁজুক ভালো করে। এরপরে মন্দিরে ঠাকুর ঢুকে গেলে তো আর পুলিশ ঢুকতে দেওয়া যাবেনা।
    সব বন্দোবস্ত হয়ে গিয়ে যারা যেখানে যাবার রওনা দিয়ে দিলে লোকজন যে যার ঘরের দিকে রওনা দিলে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের আজ আর ইস্কুল কলেজ যাওয়ার বালাই রইলনা, মায়েদের রান্না হয়নি। বড়দেরও কাজে যাওয়া হলনা।
    উত্তেজনা একটু থিতিয়ে গেলে,মেয়েরা বাড়ি গিয়ে রান্না খাওয়ার পাট শুরু করল। কত্তারাও উঠলো সকালের কাজকম্ম সারতে। অবশ্য সব সারা হলে আবার তারা এক এক করে এবার মন্দির ছেড়ে দুগ্গা মন্ডপের সামনের আটচালায় এসে জুটতে লাগল।
    কতগুলি উৎসাহী গোয়েন্দা গল্প পড়া অল্পবয়সী ছেলে পুলিশ আসার আগে নিজেরাই গোয়েন্দা হয়ে পুকুরঘাট দক্ষিণমাঠ মায় পাড়ার সব বাড়ি বাগান তন্ন তন্ন করে ফেলল সূত্র খুঁজে খুঁজে। আর বাড়ির কচিকাঁচারা ঢালাও ছুটির বাজারে মাঠে বৌ বসন্ত প্রতিযোগীতায় মেতে উঠল।

    সকাল গড়িয়ে বেলা হল। কুলতলিতে যারা গেছিল তারা এখনও ফেরেনি, অবশ্য পথও তেমন কম নয়। সাইকেলে করে হরিপুর বাসস্ট্যান্ডে যাবে, সেখান থেকে বাস ধরে গেবড়া। গেবড়া থেকে দুমাইল ভেতরে গেলে ভটচাজ মশায়ের বাড়ি কুলতলি। এত বেলায় পৌঁছলে ঠাকুরমশায় কী আর না খাইয়ে ছাড়বেন নাকি তার বাড়ির লোকেরাই তাঁকে না খাইয়ে আসতে দেবে।
    আজ আর পাড়ায় কারোর ই অন্য কোনো কাজে মন নেই, যে যেখানে যাই করছে তাতেই শুধু এই চুরির আলোচনা। কর্তারা সব আটচালায় আজ পুরো ডেরা পেতেছে, সেখানে মধ্যমণি অবশ্যই ফনিভুষণ। চা খাবার সব এর ওর বাড়ি থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকেই তারা নানা কাজকম্ম তত্বাবধান করছে। কাজও অনেক, কিভাবে খবর পেয়ে রাধামাধবের সেবক জমি চাষ করে এমন সব প্রজা চাষীরা হাজির হয়েছে। তারাই উৎসাহী হয়ে কোদাল শাবল নিয়ে মন্দিরের চারিদিকে আগাছা উপড়ে সাফ করতে শুরু করেছে ঠিক পুজো পাব্বনে যেমনটা হয়!
    গাঁয়ের মাতব্বরেরা এক এক করে এসে দেখেশুনে ও আটচালায় কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে মতামত জানিয়ে যাচ্ছে। চাটুজ্জ্যেদের কত্তা বুড়ো মাধব চাটুজ্জ্যেও এলে, ফনিভুষণ তার কাছে শুদ্ধি, প্রাচিত্তির সম্বন্ধে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তবে দেখা গেল এতকাল আগের ঘটনা মাধবেরও ঠিক স্মরণে নেই সবকথা।
    ইতিমধ্যে ফনিভুষণ সবাইকে জানিয়েছে রাতের স্বপ্নের কথা। তাই নিয়ে বেটাছেলেদের মধ্যে খুব বেশী চর্চা না হলেও মেয়েমহলে রীতিমত সাড়া তুলেছে!
  • শ্রাবণী | 134.124.86.27 | ২২ জুন ২০১২ ১৫:৫৩449688
  • সরী ঠাকুমা একা মানুষ, ঠাকুদ্দা গত হয়েছেন তা বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। একমাত্র মেয়ে বিনিপিসীর সংসার কলকাতায়। বিশাল উঠোনজোড়া বাড়ি ঠাকুমার, ঘর যদিও দুখানি, এছাড়া আছে রান্নাদুয়ার, হামার, কুয়োতলা। উঠোনে সারা দিনই কোনো না কোনো দিক থেকে রোদ আসে আর তাই তো শীত পড়তে না পড়তেই পাড়ার বৌ মেয়েরা রোদ পোয়াতে ঠাকুমার বাড়ি এসে জোটে।
    সরী ঠাকুমা অনঙ্গ বোসেদের অর্থাৎ বড়বাড়ির মেয়ে, বিয়ে হয়েছিল পাড়াতেই, বোসেদের দৌহিত্রী বাড়িতে, আজীবন কাল তার এপাড়াতেই বাস। এমনিতে ঠাকুমা বাতের ব্যাথায় কাহিল থাকে, বিশেষ করে শীতকালে, ঘোরাফেরা খুব একটা করেনা। উঠোনে রোদে একখানা বড় ইজিচেয়ার পাতা আছে,ঠাকুমার বাবার, বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। চেয়ারে বসেই সে সারা পাড়ার বিশেষ করে মহিলাসমাজের গতিবিধি চোখে চোখে রাখে। ঠাকুমাকে দেখাশোনা করার জন্যে জমির রাখাল বিষ্টু তার বৌ ছেলে নিয়ে এবাড়িতেই থাকে, খিড়কীদিকে তাদের জন্য একখানা চালাঘর তোলা আছে।

    মেয়েরা আজ ঘরের কাজকর্ম তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে খাওয়া দাওয়া বেলাবেলি মিটিয়ে দিয়েছে। অবশ্য তা নিয়ে কারোর কোনো অনুযোগ নেই, একমাত্র দোলায় শোয়া বাচ্চা ও শয্যাশায়ী রুগী বা বয়স্ক ছাড়া আজ কেউ ঘরে থাকতে রাজী নয়!
    সংসারের পাট চুকিয়ে গিন্নীরা ও তাদের পিছু পিছু মেয়ে বউয়েরা জড়ো হয়েছে তাদের দ্বিপ্রাহরিক আড্ডার স্থল, সরী ঠাকুমার দুয়ারে। গিন্নীদের হাতে রোজকার মতই বিন্তির তাস, বউদের হাতে নভেল বা পত্রিকা, মেয়েদের এ ওকে ঠেলা মেরে গল্প। এমনিতে ঠাকুমার ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্যে অনেক গিন্নীই আড়ালে তাকে গালমন্দ করে থাকে, কিন্তু সামনাসামনি কেউ সাহস করে না কিছু বলতে।

    আজ আর তাসের আসর বসেনা, সবাই আজ পিসীর চেয়ার ঘিরে বসেছে।
    গিন্নীদের মধ্যে সবথেকে বেশী পড়াশোনা জানা বিজয় বোসের স্ত্রী, কলকাতার মেয়ে। মন্দিরের এধারে, পুরনো বোসপাড়ার ছোটবৌ সে, মানুষটিকে সবাই খুব ভালোবাসে, উপকারী বুদ্ধিমতী। এমনকী সরী ঠাকুমাও কলকাতার বৌকে একটু সমীহ করে চলে।
    ছোটবৌ অনেক ভেবে চিন্তে মত দিলে কিছু একটা অলৌকিক নির্ঘাত হয়েছে। নাহলে চোর চামুন্ডা মাকে নেয়নি কেন বা বাকী ঠাকুরদেরই বা রাস্তায় ফেলে যাবে কেন!
    অষ্টধাতুর মূর্তি, সোনার চামুন্ডা, কর্তাদের কাছে শোনা, এসব মূর্তির দাম কম নয়। তাহলে এত দামী মূর্তি ফেলে চোরেরা শুধু কয়েকটা সোনারুপোর গয়না আর রুপো তামা কাঁসার বাসন নিয়ে চলে গেল!
    -"বড়কর্তার স্বপ্নটার কথাও ভাব ছোটো বৌ। তোরা বৌয়েরা দিনরাত্তির প্যাটান বদলে বদলে গয়না ভেঙে গয়না গড়াচ্ছিস, আর ঠাকুরের বেলায় এসি কোন সাবেক কালের গয়নাই চলছে। আমি তো সেদিনই বিনয় বামুনকে বলছিলুম, রোজকার গয়নাগুলো খুব ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছে, কত্তাদের বলো।"

    যদিও অনেকেরই ঠাকুমার এই বক্তব্য গুল মনে হল তবু কেউ আপত্তি না করে সায়ই দিল বরং। পুকুর পাড়ে ঠাকুর ফেলে যাওয়ার ব্যাপারে ছোটবৌয়ের মত হল যে ঠাকুর কোনো রূপ ধরে ওদের ভয় দেখিয়ে এমন কিছু করেছেন যার জন্যে বাছাধনরা সব ফেলে পালাতে পথ পায়নি। গিন্নীদের সবার খুব পছন্দ হল কথাটা, সবাই দু হাত জড়ো করে মাথায় ছোঁয়ায় নারায়ণকে স্মরণ করে। সরীঠাকুমাও সায় দেয়, এ আর নতুন কথা কী বলল কলকাতার বউ, এতো চিরকালই জানা যে আমাদের ঠাকুর মহা জাগ্রত।

    "সেই যে তখন আমার বাবা বেঁচে, বিনি বছর পাঁচেকের হবে, পালেদের বিধবা মেজ বউয়ের ছেলে বিশু আসত তখন বড়দার কাছে পড়তে। বিধবার ছেলে, বড়দা বিনাপয়সায় একঘন্টা পড়াত বিকেলে ঘুম থেকে উঠে। তা সে ছেলে তো খুব দুরন্ত। আমাদের বাড়ীর ছেলেপিলেরা কোনোদিন মন্দিরের গাছে হাত দেয়না, বিশেষ করে দুকুরবেলায় তো মন্দির চত্বরে যাওয়াই বারণ। একদিন বিশু পড়তে এসেছে তাড়াতাড়ি, বড়দা তখনও ঘুমুচ্ছে , বদমাশ ছেলে কী করেছে ভরদুপুরে মন্দিরের বাগানে ঢুকে ফুলে ভরা চাঁপা গাছে উঠেছে।
    বিশু বিকেলে পড়তে আসেনি দেখে দাদা ভেবেছে তাহলে সেদিন কোনো কারণে আসবেনা পড়তে। তখন বামুন ছিল ভবেন ভটচাজের বাপ, আমাদের বামুনদামশাই। সে বিকেলের পাট করার সময় গাছের ফুল তুলতে গিয়ে দেখে গাছতলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ছেলে ।
    লোকজন ডেকে তুলে নিয়ে এসে জল দেওয়া হয় মুখেচোখে, জুতো শোঁকায়, লঙ্কাপোড়া, কিছুতেই জ্ঞান আর ফেরেনা। ব্রজেন ডাক্তারকে ডাকা হল, কবরেজ মশায় আসে, কেউ কিছু করতে পারেনা।
    বিধবা মায়ের ঐ এক ছেলে, সে মা তো কেঁদে মরে। শেষে সবার পরামশ্যে বিশুর মা আমাদের ঠাকুর দালানে রাধামাধবের কাছে হত্যে দেয়।
    তিনদিনের দিন ঠাকুর বড়দাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলে ও ছেলে গাছের ডাল ভেঙে ফুল ছিঁড়ে নৈরেকার করেছে, ওনার বিশ্রাম ভঙ্গ করেছে, এ তারই শাস্তি। "ওর মাকে বল উঠতে, ছেলে ভালো হয়ে যাবে"।
    পরদিন সকালে ছেলে চোখ চায়। পালবউ ঘটা করে পুজো করায় সিন্নী দেয়। সেই থেকে প্রেত্যেক বছর ওদের বাড়ী থেকে পুজো আসে, সিন্নী পড়ে, সে আজ এতকাল হয়ে গেল। আমাদের ঠাকুর এমনি দয়াময় কিন্তু রাগলে কঠিন শাস্তি দেয়। আমি তো বলি ও পুলিশ টুলিস ডাকার দরকার নেই চোর ধরার জন্য, তেরাত্তির পেরোবে না দেখবে চোরগুলো ওলাউঠা হয়ে ভেদবমি করতে করতে ছুটে আসবে।"

    দুটি কলেজে পাঠরতা আর দুটি কলেজ শেষ করে বিয়ের অপেক্ষায় মেয়ে, তারাও গিন্নীদের এই আসরে বসেছিল, দু তিনটি শিক্ষিতা কমবয়সী বউও ছিল। তারা অবশ্য যুগের হাওয়ায় আর দুপাতা ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে ঠাকুরের কীর্তিকাহিনীতে একেবারে সহমত হতে পারছিলনা। শেষমেশ আর থাকতে না পেরে ঠাকুরের কাছে মনে মনে জিভ কেটে, মুখে জিজ্ঞেস করেই ফেলে " তা ঠাকুর ভয় দেখালই যখন চোরগুলোকে যেতে দিল কেন, তাও আবার গয়না বাসন সব নিয়ে। সেগুলোও রেখে নিতে পারত। সেযদি হয় তো মন্দিরে ঢুকতেই বা দিল কেন, তাদের হাতে উঠে ঠাকুরপুকুরের পাড় অবধি গিয়ে অশুদ্ধিই বা হল কেন।"
    সব অবিশ্বাসীর দল, নিশ্চয়ই কারণ আছে, ভগবানের সব লীলা কী মানুষে বুঝতে পারে?
    এই ফল হয় মেয়েছেলেদের বেশী লেখাপড়া শেখালে, দেবদ্বিজে ভক্তি ঘুচে যায়, এতে ঘরসংসারের যা অকল্যেণ হবে তা কেউ রুখতে পারবে!
    সরী ঠাকুমার এহেন সশব্দ গজগজানি ও অন্যান্য বড়দের চোখ রাঙানি "রাধামাধব রাধামাধব"এর দাপটে ভেসে যায় আলোকপ্রাপ্তাদের টুকরো টাকরা সন্দেহের খড়কুটো!

    দুপুরের রোদ তখনও বেশ চড়া। উঠোনে কাঁঠাল গাছের ছাওয়ায় তখন নানা মতামত, গল্প কাহিনীতে মেয়েদের আসর জমে উঠেছে, এমনসময় একটি কচি ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিয়ে গেল, "ঠাকুমা জেঠিমারা, বুড়ো দাদু চা জলখাবার বানাতে বলল, দারোগা এসেছে, সিপাই এসেছে।"
    "ওরে থাম থাম, কী বৃত্তান্ত ভালো করে বল দেখি", এসবের উত্তর দেবার তার সময় নেই, সে ছুটে চলে যায়, দারোগা সিপাই এসে মন্দিরে তদন্ত করতে ঢুকছে, এখন অন্যখানে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা চলে নাকি!
  • Nina | 22.149.39.84 | ২২ জুন ২০১২ ২০:১৯449689
  • জমে ক্ষীর-----মেয়েটার হাতে জাদু কি ছড়ি হ্যায়!
  • Lama | 127.194.234.204 | ২২ জুন ২০১২ ২০:৩২449690
  • জাদুলেখা- সত্যিই
  • kumu | 132.160.159.184 | ০৬ জুলাই ২০১২ ১৯:৩৪449691
  • তুলে দিলাম,অ শ্রাবণী,লেখো দেখি।আজ না হয় হোম ডেলিভারির খাবার খাও।
  • sch | 132.160.114.140 | ০৬ জুলাই ২০১২ ১৯:৫৭449692
  • শ্রাবণীদি সাগরময় ঘোষ বেঁচে থাকলে আপনাকে চাকরী ছাড়িয়ে আনন্দবাজারে নিয়ে যেতেন - sure. আর পরে গর্ব করে বলতেন এই লেখিকাকে আমি আবিষ্কার করেছি
  • Zzzz | 109.227.143.99 | ০৭ জুলাই ২০১২ ১৭:৫২449693
  • আর কই?
  • শ্রাবণী | 69.94.103.69 | ১৪ জুলাই ২০১২ ১৪:৪২449694
  • রামচরণ দারোগা এককালে এ গাঁয়েরই বাসিন্দা ছিল, তার বাপ শিবচরণ ছিল প্রাইমারী ইস্কুলের অঙ্কের মাস্টার, ভিন গাঁথেকে এখানে চাকরি নিয়ে এসে বাসা বেঁধেছিল। এমনিতে বুদ্ধিমান যাকে বলে তা না হলেও, বাপের কড়া শাসনে ও নজরদারীতে মোটামুটি ভাবে পাসটাস দিয়ে পুলিশের চাকরীতে বেশ সহজেই ঢুকে পড়েছিল। তবে চিরদিনই এ গাঁয়ের লোকেদের ওপর রামচরণের একটা চাপা ক্ষোভ রয়ে গিয়েছে, এরা নাকি কোনকালে তাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। তার মনে হয় এরা আসলে তাদের এগাঁয়ের লোক হিসেবে কোনদিন ধরেইনি, চিরদিন বহিরাগত ভেবেছে। আগে তারা গোরা চাটুজ্যের মাটির বাড়ির দুখানা ঘরে ভাড়া থাকত, এখন চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর শিবচরণ ধর্মতলায় শ্মশানের থেকে একটু এগিয়ে বড় রাস্তার ধারে বোসেদের একটা খামারবাড়ি ছিল,খানিকটা জমি পুকুর ও একটা চালাঘরসহ, সেটা কিনে নিয়ে সেখানে কাঁচাপাকা মিশিয়ে ঘর তুলে গাঁয়ের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে।
    শিবচরণ, বোসকত্তা ফনিভুষণের বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিল অনেককাল, এখনও ওবাড়ির ছেলেরা তার কাছে এসে অঙ্ক করে যায়, বোসবাড়ির সঙ্গে তার খুব দহরম মহরম। রামের আবার অপছন্দের তালিকাতে বোসবাড়ি প্রথম সারিতে, গাঁয়ের মধ্যে এদের মাতব্বরীটাই সবচেয়ে বেশী, শাস্তি বিচার সব কিছুতে বোসকত্তারা আগে আগে, তারা থাকলে অন্য কেউ পাত্তা পায়না গাঁয়ের লোকেদের কাছে।

    পুলিশে চাকরি নিয়ে সে কিছুকাল এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, তারপর দারোগা হওয়ার পরে একরকম আর্জি দিয়েই হরিপুর থানায় এসেছিল যত না বাপমায়ের কাছাকাছি থাকতে,তার চেয়ে বেশী পুরনো জায়গায় পুরনো লোকজনদের কাছে নিজের নবলব্ধ পদের ওজন দেখাতে। কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে তত তার নিজের এই সিদ্ধান্তের জন্যে আফশোসের মতই হচ্ছে। এখানে আসা থেকে চিত্তে সুখ নেই, চেনা লোকেরা চেনা দারোগাকে মান্যি করার প্রয়োজনই বোধ করেনা, এমনকি দারোগাবাবু বলে ডাকে কজন সে হাতে গোণা যায়!
    এখনও সবার কাছে সে "রেমো", বড়জোর "রেমোদা", সেইথেকে চারগাঁয়ের যারা অচেনা তারাও এখন তাকে "রেমোদারোগা" বলে ডাকতে শুরু করেছে। এমনকি একবার জেলাশহর থেকে একজন এসে থানায় সাধু কনস্টেবলকে "রামচরণবাবু আছেন", জিজ্ঞেস করায় সাধু তাকে "এখানে ওনামে কেউ নেই" বলে ভাগিয়ে দিচ্ছিল। শেষে রামচরণ এসে পড়ায় সেমুহূর্তে "আরে কনস্টেবলটার আসলে কাল রাত থেকে পেটের ব্যাথায় এখনতখন অবস্থা,হাত শুকোচ্ছেনা, তাই মাথার ঠিক নেই", এসব দোহাই দিয়ে মান বাঁচে সেযাত্রায়।

    এছাড়া মাঝে মাঝেই গাঁয়ের কর্তা ব্যক্তিরা থানায় ঢুকে তাকে নানাব্যাপারে উপদেশ দিয়ে যায়, তার বাবা শিবচরণও থাকে সেদলে, এদের সকলেরই মত যে রামের বোধবুদ্ধি কম, তাকে সদবুদ্ধি দিয়ে ঠিকপথে চালিত করে চার গাঁয়ের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আসলে তাদেরই ঘাড়ে। রাগে শরীর জ্বললেও সে বড়দের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনা, ছোটোবেলার অভ্যেস, এদের দেখলে এখনো ভয় সমীহ সব জুড়ে আসে, মুখে কথা সরেনা। থানার কর্মচারী থেকে শুরু করে লক আপের ওধারে চোরডাকাতরাও গাঁয়ের এইসব দিকপালদের দেখলে হাত জড়ো করে গদগদ হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে খুব বেশী রাগ হলে, এরকম ঘটনার পরে রাম এক আধটা চোরকে ধরে বেধড়ক দেয়, তবে সবসময় তো আর হাতে চোর থাকেনা, তখন একা বসে বসে এমনিই ফুঁসতে থাকা ছাড়া উপায় থাকেনা!

    আজ অবশ্য সেই বাঘের আড্ডাতেই ঘুঘুর হানা, বোসেদের রাধামাধব আবার এই গাঁয়ের সকল গৃহদেবতাদের মধ্যে কুলীনশ্রেষ্ঠ, তার মন্দিরে সংকল্পর অধিকার শুধু বোসেদের, আর কারুর নেই। তাও গাঁয়ের লোকেরা পালা পাব্বনে যায় সেখানে পুজো দিতে, রামের মাও ওখানেই যায় সব কিছুতে, রামের পরীক্ষাগুলোর আগেও যেত। এনিয়ে রাম অনেক ঝামেলা করেছে এককালে, রামের বিশ্বাস তার নামে সংকল্প হতনা বলেই স্বর্গে ঠাকুরের কাছে তার পরীক্ষা ভালো করার আবেদন ঠিকমত পৌঁছয়নি। ঠিকানা গন্ডগোল হয়ে গেছে, আর তাই সে ঠিকঠাক নম্বর পায়নি কোনোদিন। এর চেয়ে মা যদি ধর্মতলায় পুজো দিত তাতেও বোধহয় আরেকটু ভালো ফল হত, কিন্তু মা বাবা শুনলে তো!
    মন্দির চুরির খবরটা সকালে পেলেও সে ইচ্ছে করেই দুকুর পেরিয়ে, খেয়েদেয়ে ঘুম থেকে উঠে ধীরেসুস্থে দুই কনস্টেবল সাধু আর দুখনকে নিয়ে রওনা দিল। এদিকে এসে মাবাবার কাছে ঘুরে না গেলে কেলেংকারি হবে,তবু আসার পথে বাবা মার কাছে ঢুকলনা, ফিরতি পথে যাবে। তাকে হরিপুরে থানার লাগোয়া কোয়ার্টারে থাকতে হয়, পরিবারও সেখানেই থাকে, বাবা মা একা গাঁয়ের বাড়িতে। এমনিতে অবিশ্যি সর্বক্ষণই যাতায়াত চলে দুই বাড়ির মধ্যে, মাইলখানেকের রাস্তা, বৌ ছেলে প্রায় রোজই আসছে, মা যাচ্ছে তার সংসারের তদারকিতে, বাবা নাতিকে অংক করাতে।

    বোসপাড়ায় দারোগা ঢুকেছে খবর পেয়ে পাড়ার লোক জুটতে থাকল এক এক করে, কিছু রামের বন্ধু, সহপাঠী ছিল এককালে, তারা এগিয়ে এসে ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করল। সে অবিশ্যি কাউকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বেশ দারোগাসূলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে সবার কথা শুনতে শুনতে মন্দিরের দিকে চলল। মন্দিরে তখন কর্তারা কয়েকজন এসেছে,খবর পেয়ে। সব মাতব্বরদের একসাথে দেখে রামের দারোগাগিরি একটু ধাক্কা খেল, ছোটবেলার অভ্যেস অনুযায়ী ঘাবড়ে গিয়ে তড়িঘড়ি করে মন্দিরের দালানে উঠে ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে একটা বাঁজখাই হুঙ্কার,
    "অ্যাই রেমো, হতভাগা। তোর কি কোনোকালে কোনো কান্ডজ্ঞান হবে না? হু, ঁদারোগা হয়েছে, এই যার বিদ্যের বহর, সে আবার দেশের রক্ষাকর্তা!"
    না দেখেও বুঝতে পারে রামচরণ, এ তার বাবা শিবচরণের গলা। ছোটবেলায় অঙ্কে ভুল করলে এমন পিটত যে প্যান্ট ভিজে যেত, আজও ঐ আওয়াজে সেইরকম কেঁপে উঠল বুক। কী হয়েছে বুঝতে না পেরে বাপের দিকে ঘুরে দেখে বাপের আঙুল নির্দেশ করছে তার পায়ের দিকে।
    "রাধামাধবের মন্দিরে জুতো পরে উঠেছিস কী বলে তুই? এই সাধু দুখনও তো দেখছি তোর থেকে বেশী বুদ্ধি ধরে,কেমন নীচে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেপিলের ঘরে, অনাচারে সর্বনাশ হয়ে যাবে যে।"
    রেমো দারোগার গা রি রি করতে থাকল, কনস্টেবলদের সামনে এমন অপমান!
    হুঁ:, সর্বনাশ হয়ে যাবে, এত জাগ্রত ঠাকুর, তাহলে তার ঘরে চুরি হয়ই বা কেন আর দারোগাকে ডাকতেই বা হয় কেন! কিন্তু বাপের জ্বলন্ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এসব বলার সাধ্যি নেই তার। ভীড়ের থেকে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে মন্দির থেকে নেমে এসে মিনমিন করে বলে,
    "এখন তো ঠাকুর নেই মন্দিরে।"
    শিবচরণ কর্তাদের দিকে তাকিয়ে হাহাকার করে,
    "দেখছেন তো কিভাবে কতকষ্টে এই গাধা পিটিয়েছি, তবু শুধু দারোগাই হয়েছে, ঘোড়া বানাতে পারিনি। ওরে, ঠাকুর নেই একথা বলতে আছে, এসব ঠাকুরের লীলা বই তো নয়। মন্দির ঠাকুরের ঘর, তিনি যেখানেই থাকুন সব দেখছেন সেখান থেকে, নিজের ঘরের দিকে তার কড়া নজর রয়েছে না!"
    ভীড়ে উপস্থিত সবার খুব মনোমত হল কথাটা, কর্তারা ঘাড় নেড়ে শিবচরণকে বাহবা দিল। রেমো দারোগার আর কিছু বলার থাকলনা, সাধু ও দুখন একদিকে ইঁটের ওপর বসে বুটজুতো খুলছে দেখে সেও বসে গেল জুতো খুলতে। এমনই লোক এরা দারোগার জন্যে একটা চেয়ারও রাখেনি। দুখানা চেয়ারে দুইবাড়ির দুই কত্তা অনঙ্গ আর ফনিভুষণ গ্যাঁট হয়ে বসে আছে, যেন তারাই দারোগা, রামচরণ কিছু নয়। নাঃ এবার হেড অফিসে গিয়ে বদলির দরখাস্তটা দিয়েই ফেলবে আর দেরী না করে!
  • শ্রাবণী | 69.94.97.135 | ১৪ জুলাই ২০১২ ১৪:৫১449695
  • সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, রোজ বিকেলের পর থেকে সরী ঠাকুমার বাতের ব্যাথাটা জেঁকে ধরে, তখন সে আর নড়াচড়া করতে পারেনা বেশী। রোজ তাই বিনয়বামুন ফণিভুষণকে চানজল খাইয়ে, সেখানে একটু বসে সব খবরাখবর দিয়ে তারপর আসে সরী ঠাকুমাকে চানজল দিতে।
    পাড়ার অন্যান্য বাড়ির কেউ না কেউ গিয়ে আরতির সময় গেলাস পেতে রাখে মন্দিরের দরজার সামনে, বাড়ির সবার জন্যে চানজল নিতে। সরী ঠাকুমার বাড়িতে সেরকম কেউ নেই যাবার,বামুনই ভরসা। ঐসঙ্গে অবশ্য বিনয়বামুনের সন্ধ্যের চামুড়িও জুটে যায় এবাড়ীতে আর ফনিভুষণের আড্ডার আলোচনার বিস্তারিত সংবাদ জানতে পারে ঠাকুমা!

    আজ আর আরতি হয়নি, বোসবাড়ীর ইতিহাসে এই প্রথম বোধহয়। পুলিশ চলে যাওয়ার পর মন্দিরে চাবি পড়ে গেছে। অনঙ্গ বোসের সদরঘরের চৌকিতে ঠাকুর রাখা আছে একটা ভেলভেটের চাদর পেতে তার ওপরে। পুজো করার নিয়ম নেই, তবু মেয়ে বৌদের কেউ গিয়ে একখানা প্রদীপ জ্বালিয়ে ধুপ দিয়ে এসেছে।
    বিনয় ওদিকে আর যায়নি, সারাদিন অনেক ধকল গেছে। বাড়ীতে তার কেউ নেই, স্ত্রী অনেকদিন হল গত হয়েছে, একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সে নিজে থাকে ভাইয়েদের সংসারে। আলসারে ভুগছিল, কলকাতার দোকানে কাজ করত, সেখানের জল সহ্য হচ্ছিল না। শেষে মেয়ের বিয়ের পর কাজ ছেড়ে দিয়ে গাঁয়ে এসে বসল। এজমালী জমি থেকে যা পায় তাতে তার একজনের পেট চলে যেত কিন্তু ঐ পেটের অসুখ আর সারছিল না। অল্প নেশার ঝোঁক ছিল আগে, ডাক্তার বারণ করায় ছাড়তে হল, ও নাকি একেবারে বিষ তার পক্ষে। ভবেন ভটচাজ বোসবাড়ীর প্রধান পুরোহিত, বিনয়দের আত্মীয়। এদের দুর্গা পুজো সেইই করে, সেবারে পুজোয় তন্ত্রধারক শেষমুহূর্তে অসুস্থ হয়ে না আসায় বিনয়কে ডাকল তন্ত্র ধরতে। বোসবাড়িতে বিনয়ের আসাযাওয়া ছিল আগে তবে কলকাতা থেকে ফিরে আর আসা হয়নি।
    এদের অনেক বছরের নিত্য পুজোর বুড়ো বামুন তখন সেই মাসখানেক হল মারা গেছে,এরা নিত্য পুজোর জন্যে একজন কাউকে খুঁজছিল যে শুধু পুজোর কাজ করবে,অন্য কোনো কাজ থাকবে না তার, চাকরি ইত্যাদি।
    ভবেন দেখেশুনে বিনয়কে বলল কাজটা করতে। বিনয়ের বাবা চাষবাসের সাথে সাথে পুরুতগিরিও করত, ওরা ভাইয়েরাও তাই পুজো আচ্চা জানেটানে। কথা হয়ে সব পক্ষ বেশ রাজী হয়ে গেল, ভবেনের কথা বোসকত্তারা খুব মানে। ভবেন ঐ পুজোর পর কদিন নিজে হাতে তাকে রাধামাধবের পাট শেখাল। সেই থেকে বিনয় রাধামাধবের সেবা করছে। সবচেয়ে অবাক কান্ড, পুজোর কাজ ধরার পর থেকে তার পেটের অসুখ বেমালুম উধাও। এ ঠাকুরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কী হবে, রাধামাধব যে জাগ্রত দেবতা সে তো এ অলের সকলেই জানে। শুধু কী অসুখ, কিছুদিন পর জামাইয়ের পাকা চাকরি হয়ে মেয়েটারও অবস্থা ভালো হয়ে গেল। ঠাকুরের কাছে বিনয়ের কৃতজ্ঞতার আর শেষ নেই, ঠাকুরের কাজের সে কোনো ত্রুটি কখনো করেনা, তবু আজ এ কী হয়ে গেল, কার দোষে এমন হল!

    ফণিভুষণের ওখানে আজ ভীড় অনেক, সেখানে উঁকি মেরে সে এসে বসেছে এখন সরী ঠাকুমার দুয়ারে। বিষ্টুর বৌ রোজকার মত লংকা তেল দিয়ে মুড়ি মেখে দিয়েছে এক কাঁসি, সঙ্গে ছোলা সেদ্ধ আর এক গেলাস চা। বড় ভালো করেছে ছোলা সেদ্ধটা আর সরীঠাকুমার হাতের ভাজা টাটকা মুড়ি অমৃতের মত স্বাদ, অন্যদিন হলে বিনয়বামুন তারিয়ে তারিয়ে খেত কিন্তু আজ তার মন ভালো নেই, এত ভালো খাবারও মুখে বিস্বাদ লাগছে। সরী ঠাকুমা দু চারটে কথা বলতে গিয়ে ভাসা ভাসা জবাব পেয়ে ভালো করে লক্ষ্য করে বামুনকে। নাঃ আজ বিনয়ের মনমেজাজ ভালো নেই মনে হচ্ছে, মেয়ে আর নাতিটার কথা জিজ্ঞেস করতেও কোনো উৎসাহ দেখায় না।
    সরী ঠাকুমার স্থান মোটামুটি এপাড়ায় ফণিভুষনের পরেই, অনঙ্গ বোস প্রবীণ হলেও ঠাকুমা তাদের বাড়ির মেয়ে, অনঙ্গ ভুজঙ্গর সম্পর্কে দিদি হয়, তারাও কাজে কম্মে এরই পরামশ্যি নিয়ে থাকে। বিনয়ের উৎসাহ না থাকলেও সরী ঠাকরুন এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্তর নয়। পান মুখে দিয়ে দোক্তার কৌটো খুলে এক চিমটে দোক্তা হাতের চেটোয় ডোলে মুখে পুরতে পুরতে বলে,
    -"তা কত্তারা কী বলে, ও বিনয়? সব কি ঐ রেমো হতভাগাটার ভরসায় বসে থাকবে না কি নিজেরাও কিছু চেষ্টা চরিত্তির করবে চোর ধরতে?"
    বামুনের ইচ্ছে ছিলনা এ প্রসঙ্গ তোলার,সকাল থেকে সবার মুখে ঐ এক কথা, মন্দির চুরি আর মন্দির চুরি, সারাদিন নানা উত্তেজনা, কান্নাকাটি ইত্যাদির পরে তার এখন ঝিমোনো ভাব। নিজের বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিতে পারলে শান্তি। তবু এনাকে এড়ানো কঠিন, তাই একটু গা ছাড়া ভাবেই বলে,
    -"জানিনে দিদি, তবে তেমন বেশী কিছু তো খোয়া যায়নি, তাই চোর ধরাতে বোধহয় কত্তাদের তেমন গা নেই। কুলতলি থেকে লোক ফিরে এসেছে, ভবেনদার সঙ্গে কথা হয়েছে। পরশু দিন স্থির হয়েছে, দাদা নিজে এসে সব করবেন। তাই আমি যতক্ষণ ছিলুম শুধু প্রাচিত্তিরের কথাবার্তাই হচ্ছিল। কেষ্ট স্যাঁকরা এসেছে, রুপোর যত জিনিসপত্র, বাঁশি ছাতা মুকুট, এছাড়া রুপোর হার কুন্ডল সব তাকে করতে বলা হল রাতারাতি, পরশু লাগবে।"
    -"সেসব তো ঠিক আছে, কিন্তু কার এত সাহস হল, বোসপাড়ায় ঢুকে স্বয়ং রাধামাধবকে তুলে নিয়ে যাওয়ার, এটা জানতে হবেনা।"
    বুদ্ধিমতী সরীঠাকুমা মেয়ে মহলে যতই হাঁকডাক করুক অলপ্পেয়ে চোরেদের ঠাকুর শাস্তি দেবে বলে, আসলে নিজে যে শুধু ঠাকুরের শাস্তির ওপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারছেনা তা বোঝা গেল।
    -"কী জানি দিদি, আমার তো কিছুই মাথায় আসছেনা।"
    একটু অন্যমনস্ক ভাবে পায়ের গাঁটে হারিকেনের মাথায় বসানো নুনের পুঁটুলির সেঁক দিতে দিতে ঠাকুমা বলে,
    -"কোনো চেনা লোক তো থাকতেই হবে এর মধ্যে। একেবারে অচেনা চোর এসে এত সাহস দেখাবে, ঠাকুর মন্দিরে চুরি করবে! এছাড়া চাবি তো থাকে একখান তোমার কাছে আর অন্যটা আমার বাপের বাড়ী অর্থাৎ বড়বাড়ির সদরে সরকার মশাইয়ের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো থাকে। তালা ভাঙেনি, খুলেছে অথচ দুই চাবিই যথাস্থানে আছে, কেমনে হয়।"

    বিনয় বামুন আর উদাস থাকতে পারেনা, কিরকম যেন একটা ইঙ্গিত পায় সরীদিদিমনির কথায়। খানিক হতাশায় খানিক ভয় আর অভিমান মেশানো গলায় হাঁউমাউ করে ওঠে,
    -"কী বলেন দিদিমনি, আপনি কি মনে করেন আমি এর মধ্যে আছি? হায় হায়, রাধামাধব জানেন, আমি এমন কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। একী কথা, এ শোনার আগে মাধব আমায় টেনে নিলেন না কেন!"
    সরী ঠাকুমা অবশ্য এসবে অপ্রস্তুত হবার জিনিস নয়, এক দাবড়ানি দেয়,
    -"তুমি থামো তো বিনয়, তোমার ঘটে আমার কথা বোঝার মত বুদ্ধি থাকলে আর পুরুতগিরি করতে না এই বুড়োবয়সে এসে, দোকানের মালিক হতে। মেলা না বকে আমায় ভাবতে দাও, আর একটু মনে করার চেষ্টা কর, এই কদিনে কিছু সন্দেহজনক দেখেছ কিনা, বাইরের কেউ মন্দিরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল কিনা এইসব আর কি!
    ঠাকুমার কথায় বিনয় বামুন চুপ করে গেলেও একটু যেন গোঁসা মতন করেই বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। সরী ঠাকুমা তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকল চুপচাপ, অন্যদিনের মত বামুন যেতেই খেতে দেবার জন্যে বিষ্টুর বৌয়ের প্রতি হাঁকডাক করতে দেখা গেলনা।
  • শ্রাবণী | 69.94.97.135 | ১৪ জুলাই ২০১২ ১৫:০৩449696
  • জগ যখন বারোয়ারীতলায় পৌঁছল কানা পঞ্চু আটচালায় গান শেষ করে হরির দোকান থেকে এক কাপ চা নিয়ে আয়েস করে চুমুক দিচ্ছে বসে বসে। একতারাটা সামনে নামানো, তার মধ্যে ফঙ ফঙ করছে দুচারটে খুচরো পয়সা, পথ চলতি লোকের দান, একপাশে ভিক্ষের ঝোলাটা রাখা।
    জগর নাম আসলে বাপ মা বেশ বাহারী রেখেছিল, প্রকাশ। তার প্রাণের বন্ধু হল বোসেদের বংশীলোচন, ইস্কুলে একদম মানিকজোড় ছিল দুজন। একটু গোলমাল মারপিট বেশীই করত,তাই বাঁটুল স্যর তাকে বাঁশীর বন্ধু জগঝম্প বলে ডাকতে শুরু করে দিল, সেই থেকে মুখে মুখে তার নাম জগ হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে উঠে সে আর ইস্কুল যায়নি, তার ভাল্লাগে না। বংশী অবিশ্যি ইস্কুল পাস দিয়ে কিছুদিন কলেজেও পড়েছিল, এখন পড়া ছেড়ে পীরচকে ওর বাবার লোহার দোকানে বসে।
    বংশী অনঙ্গ বোসের খুড়তুতো ছোটভাই ধুর্জটির ছেলে। ধুর্জটি পীরচকে থাকে পরিবার নিয়ে, সেখানের ব্যবসা দেখে, শুধু বংশী এবাড়িতে থাকে জ্যাঠাদের কাছে। বংশী ছোট থেকে হরিপুরে ইস্কুলে পড়েছে এবাড়িতে থেকে, তার এখানেই ভালো লাগে, বন্ধুরা সব এখানে। অনঙ্গ বোসের পরিবার এগাঁয়ের বড়লোকদের মধ্যে একজন, জমিজমা ব্যবসাপাতি সব মিলিয়ে জমজমাট মালক্ষ্মীর রাজপাট। সরস্বতীর কৃপাও মন্দ নেই বাড়িতে, ছেলেরা অনেকেই ভালো লেখাপড়া করে পাসটাস দিয়ে শহরে দিব্যি চাকরিবাকরি করছে। বংশী বাড়ির ছোট ছেলে,সবার আদরের তবে লেখাপড়াতে সেই সবচেয়ে নীরেস। জগর বাড়ির অবস্থাও খারাপ না, মাইতিপাড়ায় তার বাপের জমিজিরেত আছে মোটামুটি, বাপ ভাইয়েরা চাষ নিয়েই থাকে, সেও বাড়িতে সবার ছোট।
    জগ আজকাল চাষবাসের কাজে লাগে ভাইদের সঙ্গে তবে তার ওসব ঠিক পছন্দের নয়, সে অন্য কিছু করতে চায় কিন্তু সেই অন্য কিছু টা ঠিক কী এখনও হদিশ করে উঠতে পারেনি!

    কানা পঞ্চু চিরকাল নাকি এমনটা ছিলনা। জগর বাবার সমসাময়িক হবে, বাবা বলে এককালে পঞ্চু ভালই ছিল, পীরচকে শেঠেদের কাপড়ের দোকানে কাজ করত। ঠিক কী হয়েছিল কেউ জানেনা তবে একবার বাজারে অনেকগুলো দোকানে পরপর ডাকাতি হয়ে গেল, শেঠেদের দোকানেও। পঞ্চুর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল তা হলফ করে কেউ বলে নি কখনো, পুলিশও নয়। কাকতালীয় হতে পারে তবে এরপর থেকেই পঞ্চু বদ সঙ্গে পড়ে নেশা ভাঙ করে নিজের বারোটা বাজিয়ে দিল, শেষমেশ কাজটাও গেল।
    এখন এই বুড়ো বয়সে একতারা নিয়ে ভিক্ষে করে বেড়ায় আর রাতে বংশীদের খামারের পাশে খোড়ো চালাটায় শুয়ে থাকে। বাড়ি বাড়ি ঘুরলেও ভিক্ষে তেমন জোটেনা, এগাঁয়ে কেউ ওকে পয়সা দেয়না, বলে পয়সা দিলেই তাই দিয়ে নেশা করবে। তবে কেউ না কেউ খেতে দিয়ে দেয়,
    জগদের বাড়ি গেলে ওর মা গাল দেয় খুব, তবে খেতেও দেয়। আসলে যেখানে যা চুরি ডাকাতি হয় এখনো সবাই বলে ঐ পঞ্চুই করিয়েছে। জগর মাও বলে বছর পাঁচেক আগে তাদের হামার থেকে যে দশ বস্তা কবরেজশাল চুরি হয়েছিল সে ঐ কানার কাজ। জগর কেমন এতদিন বিশ্বেস হতনা, চুরিডাকাতিতে থাকলে কানা পঞ্চুর এই হাড়হাভাতে অবস্থা কেন! গাঁয়ের লোকে বলে এ নাকি কানার ভেক, ভিক্ষার নাম করে এবাড়ি সেবাড়ি ঘুরে খবর জোগাড় করে। তবু জগর ঠিক প্রত্যয় হয়নি, তবে আজকের ব্যাপার অন্যরকম।

    পঞ্চুকে হরি ময়রা রোজ সকালে এক কাপ চা আর দুটো বাসী লেড়ো বিস্কুট খেতে দেয়। শীত গ্রীষ্ম কানা এসে রোজ এই রাস্তার ধারে বারোয়ারীতলার আটচালাতে বসে একতারা টঙ টঙ করে "একবার বিদেয় দে মা ঘুরে আসি" ধরবে। একটা লাইন গাইতে দশবার থামে কাশির দমকে, তবু ঘুরেফিরে ঐ লাইনই গেয়ে যায়।
    গায়ের রঙ মিশকালো, পরনের কাপড় চিমটি কাটলে ময়লা উঠে আসবে এমনতরো, গায়ে একখান মিশকালো ভুটকম্বল,মাথায় আবার একটা ধুতির টুকরো পাগড়ি করে বাঁধা। চোখদুটো সবসময় জবাফুলের মতো লাল হয়ে থাকে, নেশার ঘোরে কী কেন কে জানে!
    আশ্চর্যের ব্যাপার, বংশী বলে পঞ্চুজ্যাঠা রাতে কিন্তু একদম কাশে না। বংশী ছাতের ওপরে চিলেকোঠার ঘরে থাকে, সেখান থেকে জানালা দিয়ে কানা পঞ্চুর চালাঘরটা পরিস্কার দেখা যায়।

    দুদিন আগে রোজকার মত বিকেলে দুই বন্ধুতে যখন প্রাইমারী ইস্কুলের সামনের মাঠে দেখা হল তখন জগর বংশীকে একটু যেন চিন্তাক্লিষ্ট মনে হয়েছিল। এমনিতে বংশীর বুদ্ধির ঘরে একটুক খামতি আছে, তবে বড় সাদা সরল সে। সব ব্যাপারে বন্ধুর ওপর তার অগাধ আস্থা, সব কথা তাই তার জগকে বলা চাই। আগের রাতে বংশীর একটু পৈটিক গোলযোগ হয়, বাড়িতে জামাই এসেছে, দুবেলা ভালোমন্দ খ্যাঁটনের জোগাড়। বংশী খেতে খুব ভালোবাসে, খাওয়াটা কদিন একটু বেশীই হচ্ছিল, শেষে সেদিন রাতে পেট জবাব দিল। বারবার উঠে বাইরে যাওয়ার ফাঁকে তার চোখ পড়ে যায় পঞ্চুর চালার দিকে। অত রাতে চালার মধ্যে আলোর আভাস দেখে সে ছাদে বেরিয়ে কোণের দিকে গিয়ে ভালো করে দেখতে যায় ব্যাপার খানা। টেমি জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছে নাকি কানা বুড়ো? চারদিকে ধানের গাদা, অগ্নিকান্ড না হয়!
    একটু পরে আবছা অন্ধকারে ঠাহর করে দেখে বংশীর মনে হয় দুজন কী তিনজন লোক পঞ্চুর চালার ওদিক থেকে বেরিয়ে খামার পেরিয়ে মাঠের দিকে চলে গেল, আলোও নিভে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। অত রাতে বুড়োর কাছে লোকের আনাগোনা, গন্ধটা সন্দেহজনক, তবে কী লোকে যা বলে তা সত্যি!
    জগর পড়ায় মন নেই, অথচ বুদ্ধি যে তার ঘটে বেশ আছে এ ইস্কুলের মাস্টাররা থেকে বাড়ির লোকেরা, মোটামুটি সবাই বলে থাকে। তবে তার বাপ বলে
    "ও বুদ্ধি হল বদ বুদ্ধি, যে বুদ্ধিতে লোকে লেখাপড়ায় মন দিয়ে পাস দেয়না সে বুদ্ধি কোনো কাজের নয়"।
    হাতে তার কাজকম্ম তেমন নেই, বাপ ভাইয়েরা তাকে ফাইফরমাশ খাটায়। কাজের কাজ কেউ দেয়না ঐ বদ বুদ্ধির ভয়ে, কখন কী করে বসে। ছোটখাটো অঘটন সে মাঝে মাঝে ঘটিয়ে থাকে তাতে করে ঘরে বাইরে একটু বদনাম হয়েছে কিন্তু সেসবই আসলে সে কিছু করে দেখাতে চায় বলে। মাঝে মাঝেই সে আর বংশী বসে বসে জল্পনা কল্পনা করে, কী করলে বেশ নামডাকও হবে আবার পয়সাকড়িও আসবে। এখনো অবশ্য সেরকম কিছু একটা রাস্তা পাওয়া যায়নি তবে আলোচনা চলছে নিত্যই!

    কাল বংশীদের রাধামাধবের চুরির খবর সকালে শুনেই সে দৌড়েছিল বোসপাড়ায়। বন্ধুর সঙ্গে মন্দিরেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। দুজনে মিলে অনেক ঘোরাঘুরি করেছে, পুকুরের পাড়, দক্ষিণ মাঠ, মন্দিরের চারপাশ আঁতিপাতি করে খুঁজেছে চোরেরা যদি কিছু সূত্র ফেলে গিয়ে থাকে, কিন্তু কিছুই পায়নি।
    দুপুরে বংশীর বাড়িতে খেয়ে নিয়ে, ওর ঘরে দুই বন্ধুতে শুতে গেছে। এরকম জগ অনেকদিনই করে, বংশী বাড়িতে সবার আদরের বিশেষ করে তার জেঠিমার, এবাড়ির বড় গিন্নীর। বংশীর বন্ধু হিসেবে জগর তাই বোসবাড়িতে অবারিত দ্বার। তা যাই হোক, চিলেকোঠার ঘরে বংশীর খাটে শুয়ে জানালা দিয়ে পঞ্চুর চালাঘরের দিকে নজর গেল জগর। মনে পড়ে গেল দুদিন আগে বংশীর মুখে শোনা সেই রাত্তিরে পুর ঘরে লোক আসার কথা। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে,
    -"পঞ্চু খুড়ো এসময় ঘরে থাকে? "
    -"কে জানে, আমি ওসব জানিনা। আমি তো এসময় দোকানে থাকি। এমনেতে তো সকালে ভিক্ষেয় বেরোয়, কখন ফেরে কে জানে।"
    পঞ্চুর উল্লেখ করা সত্বেও বংশী সেরাতের কথাটা তুললনা। বংশী এরকমই, কোনো জিনিস নিয়ে তলিয়ে ভাবে না, জগকে সব জানিয়ে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জগর মনে খটকা জাগে, কানা পঞ্চুর ঘরে রাতবিরেতে বাইরের লোকের আনাগোনা, আর তারপরেই বোসবাড়িতে চুরি, এতো দুয়ে দুয়ে চার বলেই মনে হচ্ছে।
    তবে প্রমাণ না পেলে শুধু তার আর বংশীর মুখের কথায় কেউ বিশ্বাস করবেনা। কানা বুড়ো আজ কতকাল বোসপাড়ায় ডেরা বেঁধে আছে, এতদিনে ছিঁচকে দু একটা ছাড়া এ পাড়াতে উল্লেখযোগ্য কোনো চুরি কখনো হয়নি। বললেই লোকে কেন মেনে নেবে তার কথা।
    সেই থেকে তার মনে হচ্ছে কানা পঞ্চুর ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। কানা যদি সত্যি চোর ডাকাতের দলের লোক হয় এবং এই ভিক্ষের ব্যাপারটা তার আসলে ভেক হয় তাহলে এটা প্রমান হলে গাঁয়ের লোকের উপকার হবে। আবার যদি কানা নিরপরাধ হয় সেটাও সামনে আসা দরকার, নাহলে সারাজীবন একটা লোক এভাবে অপবাদ ঘাড়ে বয়ে বেড়াবে। নানা চিন্তা করে সে আজ এই সাতসকালে কানা পঞ্চুকে ধরতে বারোয়ারীতলায় এসে হাজির!!
  • ঐশিক | 132.179.86.50 | ১৪ জুলাই ২০১২ ২৩:১৮449697
  • তারপরে?
  • Nina | 78.34.167.250 | ১৫ জুলাই ২০১২ ০৩:১৩449699
  • এটাকে একসঙ্গে PDF এ কেউ করে দেবে প্লিজ??
    শ্রাবণীর গল্পগুচ্ছ র চটি কবে হবে? আমি এক কপি বুক কল্লুম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন