এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৫৭১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Nina | 78.34.167.250 | ১৫ জুলাই ২০১২ ০৩:১৫449700
  • আহা এটা কেউ প্লিজ PDF এ একসঙ্গে করে দেবে?? আর শ্রাবণীর গল্পগুচ্ছর চটি চাই একপাটি--
  • Nina | 78.34.167.250 | ১৫ জুলাই ২০১২ ০৩:১৭449701
  • PDF করে দাও কেউ প্লিজ---চটি চাই শ্রাবণীর গল্পগুচ্ছর----প্লিজ।
  • সিকি | 132.177.2.130 | ১৫ জুলাই ২০১২ ০৭:৫১449702
  • আরে দিচ্ছি, দিচ্ছি। এত তাড়াহুড়ো করলে চলে?
  • a | 132.179.95.35 | ১৫ জুলাই ২০১২ ০৮:৫৫449703
  • শ্রাবনীদি, আস্তে আস্তে পড়ছি। দারুন।
    সত্যি এই একজনের লেখা পড়ার জন্যেই সরাবছর গুরুতে আসা যায়।
  • de | 130.62.163.157 | ১৫ জুলাই ২০১২ ১০:৫৫449704
  • আহা! পুরোটা একসাথে পড়লুম -- শ্রাবণীর লেখার মজাই আলাদা!
  • kabya | 190.151.44.237 | ১৫ জুলাই ২০১২ ১৫:৫৮449705
  • বড় ভালো লেখা। পুরো টা একসাথে পড়লাম। মন ভরে গেলো আর এতো সাবলীল লেখা জে একবার পড়তে শুরু করলে ছাড়া জাচ্ছে না। কাল রাত জেগে পুরোটা পড়তেই হলো।

    ভিষন ভালো।

    পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
  • শ্রাবণী | 69.94.96.63 | ৩১ জুলাই ২০১২ ২২:১৭449706
  • হাজারি বাগ বোসেদের খামারে এসে মাথা থেকে ঘুঁটের বস্তাটা নামিয়ে একটু দম নিল। গিন্নীমা আজ কদিন থেকে ঘুঁটে আনতে বলছে, ঘুঁটে প্রায় বাড়ন্ত। হাজারি এতবছর এবাড়িতে বাঁধা মুনিষের কাজ করছে, সে হল এদের হেড মুনিষ, দায়দায়িত্ব সব তারই। এমনে কর্তা গিন্নীরা সবাই তাকে খুব ভরসা করে তবু ইদানীং বয়স হয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। হাজারি আজকাল খুব ভুলোমনের হয়ে যাচ্ছে।
    এই ঘুঁটের কথাই বড়গিন্নীমা কদিন ধরে বলে যাচ্ছে, হাজারির বউ পাঁচি বস্তায় ভরে গুছিয়ে রেখেছে সেও আজ দিন চারেক হল, তাও হাজারি রোজ আনতে ভুলে যায়। কাল একটু জ্বর মত হয়েছিল বলে কাজে আসেনি, আর কালই এপাড়ায় এত কান্ড হয়ে গেছে।

    ওদের বাগ পাড়ার অনেকেই এসেছিল চুরির কথা শুনে, হাজারিও আসছিল, বউ আসতে দেয়নি। ছেলে ফটিক এসে সব দেখেশুনে গিয়ে খবর দিয়েছিল, গিন্নীমার দু একটা কাজও করে দিয়ে গেছিল সে। পাঁচি আজও কাজে আসতে দিতে চায়নি হাজারিকে, রাতে শোবার সময় বলেছিল, যেতে হবেনা, দুদিন ছুটি কর। কিন্তু সে শোনেনি, জ্বর কিছু নয় ও নতুন ঠান্ডায় একটু গা ম্যাজম্যাজ করেছে, তারজন্যে সব কাজ বন্ধ করে বসে থাকতে হবে! আসলে তার পেট ফুলছিল, এত বড় একখানা চুরি, সে ঘরের লোক, সন্ধ্যেবেলায় পাড়ার বটতলায় তারই সবাইকে সব খবর দেওয়ার কথা, তা না তাকে বোসপাড়ার খবর জানতে হবে অন্য লোকের মুখে! ভোর ভোর উঠে চুপচাপ বউকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল মনিব বাড়ির উদ্দেশ্যে।

    প্রায় অদ্ধেক মাঠ খালি হাতে চলে এসেছিল, ওপার থেকে ফটকের বিকট চিৎকারে শেষে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকিয়ে দেখে ফটকে ঘুঁটের বস্তা মাথায় তাড়াতাড়ি পা চালাতে না পেরে ওরকম চেঁচাচ্ছে বাপকে থামানোর জন্য। ছেলে গজগজ করতে তাকে উলটে দাঁতখিঁচুনি দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেও মনে মনে বউয়ের বিবেচনার তারিফ না করে পারলনা হাজারি। আজও ঘুঁটের কথা ভুলে গেলে গিন্নীমা খুব রেগে যেত, কবে থেকে বলছে। ফটিক বাপের মাথায় বস্তা তুলে দিয়ে বাড়ির দিকে গেল, তার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়েছে মা, মুখ তাই বেজার।

    দখিন মাঠ থেকে উঠে ঠাকুরপুকুরের পাশ দিয়ে খামারে ঢুকল হাজারি। খামার পেরিয়ে বাড়ির সীমানা শুরু। রান্নাদুয়ারের লাগোয়া কয়লাঘরে ঘুঁটের বস্তা রাখতে গিয়ে হাজারির চক্ষু চড়কগাছ, একখানা মুখবন্ধ বস্তা বসানো রয়েছে সেখানে, অবিকল ঘুঁটের বস্তার মতন। তার যদ্দুর মনে পড়ে পরশু বিকেলেও সে এখানে কোনো বস্তা, খোলা বা বন্ধ কিছুই দেখেনি। আর দেখবে কী করে, একখান বস্তা তো সে খালি করে ঘর নিয়ে গেছে, ঝোড়ায় কয়েকখানা শেষ ঘুঁটে রেখে। ঘুঁটের ঝোড়া ছাড়া কয়লাঘরে খালি কয়লার ঢিপি আর কাঠের উনুনের জন্য শুকনো কাঠের বাণ্ডিল রাখা ছিল। তাহলে এই বস্তা এল কোত্থেকে?
    মাথার বস্তা নামিয়ে হাজারি রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়ল, নাঃ সে এতটা ভুলোমন হয়ে গেছে যে ঘুঁটে এনে ভুলে গেছে, নাকি ফটিক কাল রেখে গেছে! তাই বা কী করে হয়? ফটিক যদি কাল ঘুঁটে রেখেই গেসল তাহলে সাত সকালে আবার ঘুঁটের বস্তা নিয়ে বাপের পেছনে দৌড়ল কেন, পাঁচিই বা তাকে পাঠাবে কেন! কী যে সব ভুল হয়ে যাচ্ছে আজকাল! খুলে দেখবে কী আছে?

    কিছু ঠিক করতে না পেরে অন্যমনস্ক ভাবে খিড়কী ঘাটে গেল হাত পা ধুতে। খাঁদি ঝি এক পাঁজা বাসন নিয়ে ঘাটে এসেছে। সেও হাজারির মতই এবাড়ির অনেককালের লোক। হাজারি একটু আস্তে কথা বলে, খাঁদি চেঁচিয়ে কথা বলে, কানে নাকি কম শোনে, তাই। হাজারিকে দেখে খাঁদি বলে,
    -" ঘুঁটে এনেছ? নাহলে যে উনুন ধরবেনি গো।"
    হাজারি সেইরকম বেখেয়ালেই ধীরে জবাব দেয়,
    -"হ্যাঁ গো এনেছি।"
    -"অ্যাঁ, আজও আনোনি? মাগো, কী ভুলো মনের মানুস তুমি! আমি বাপু সকাল সন্ধে ঐ একখান ঘুঁটে আর রাজ্যের পাতাকুটো দিয়ে আঁচ দিতে পারবনি, চোক জ্বলে যায় এক্কেরে, সারাদিন চোক ঘসে মরি।"
    খাঁদি ঝি গজগজ করতে করতে বাসন ভিজিয়ে উঠে গেল।

    তাই তো, হাজারি এতক্ষনে খাঁদির কথা খেয়াল করল। এই তো খাঁদিও বলছে ঘুঁটের কথা, তার মানে অন্য বস্তাটা ঘুঁটের নয়। তানাহলে তার বৌও কি ওভাবে ফটকেটাকে কাকভোরে ঘুমের থে তুলে আদ্ধেক রাস্তা তার পিছনে দৌড় করাতো ঘুঁটে নিয়ে! বাড়ির সবাই তো আর একযোগে ভুলো মনের হয়ে যেতে পারেনা! হাতপা ধুয়ে জল থেকে উঠে কোমরে বাঁধা গামছাটা খুলে মুছতে মুছতে খিড়কী দোর দিয়ে উঠোনে ঢুকল হাজারি।
    খাঁদি রান্নাঘর নিকিয়ে উঠোনে জলছড়া দিচ্ছে, হাজারি গিয়ে উল্টোদিকের দাওয়ায় বসল। বস্তার কথা আর তার মনেই রইল না!
    খাঁদি কাজ করতে করতে কী সব বলে যাচ্ছে, আধকালা হওয়ার এ এক জ্বালা! নিজে আর্ধেক শুনতে পায়না অথচ ওর ধারণা অষ্টপ্রহর সব্বাই ওকে কিছু না কিছু বলছে, তাই ও উত্তরে সর্বদাই বকে যায়। সকলের মত হাজারিও কান করল না। এই ঠান্ডায় একটু চা নাহলে চলছে না। আজ সে শীগগির এসে পড়েছে মনে হয়, বাড়ির কেউ এখনও নীচে নামেনি। ঠান্ডার দিনে গিন্নী ওপরেই চান আর পুজোআচ্চা সেরে দোতলার ঘেরা বারান্দায় স্টোভ জ্বেলে বাড়ির লোকেদের জন্যে সকালের প্রথম চা বসান। নীচে রান্নাঘরে খাঁদি দুটো উনুনে আঁচ দিয়ে দেয় ততখনে। তারপর রান্নার বামুন নেয়ে এলে, আর একপ্রস্থ চা হয়, জলখাবার হয় বাড়ির লোক, কাজের লোক সবার জন্যে। আজও কি তাই করবে নাকি রে, ঠান্ডা তো সেরকম পড়েনি এখনো!
    দোতলা থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা, এদিকে আঁচ পড়ল উনুনে। খাঁদি বাসন ধুতে ও বামুন ঠাকুর চান করতে গেল ঘাটে। ধোঁয়ার মধ্যে বসতে না পেরে হাজারি খামারে গেল, আজ গোয়ালের চালটা নতুন খড়ে ছাইতে হবে, দুজন মজুর আসার কথা, তারা আসলে কাজ শুরু করবে সে। পুবদিকে চালতা গাছের নীচে দাঁড়ালো,ওখেনেই প্রথম রোদ আসবে। একটা কাশির আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দ্যাখে, কানা পঞ্চু আসছে রান্নাদুয়ারের দিক থেকে। হাজারি একটু অবাক হল, পঞ্চুদা এসময় বারোয়ারীতলায় ভিক্ষে করে, আজ সে এখনও যায়নি, তাছাড়া এদের বাড়ির ভেতর পঞ্চু যায়না, কর্তার বারণ আছে।
    হাজারির বাড়িতে একটাই ঘড়ি আছে ছেলেদের ঘরে। তারা কত্তাগিন্নী দিনের রঙ দেখেই সময় বুঝতে পারে, ওসব ঘড়িমরির দরকার হয়না। সে একবার আকাশের দিকে তাকালো, দেখে তো মনে হচ্ছেনি সে খুব একটা তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে আজ। পঞ্চু কাছে আসে, হাতে একতারা,
    -"কিগো পঞ্চুদা, আজ এখনো কালীতলায় যাওনি? ভেতরপানে কোথা গেসলে,সরীলগতিক ভাল তো?"
    পঞ্চু তার সামনে থামেনা, খামার পেরিয়ে মাঠের পথ ধরে, আল ধরে বারোয়ারীতলা যাওয়ার শর্টকাট। যেতে যেতেই বলে,
    -"ঘুম ধরে গেসল, দেরি হই গেল তাই।"
    ধোঁয়া কমে গেছে,কড়ে বামুনের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল রান্নাদুয়ারে। হাজারি আবার গুটিগুটি ভেতর বাড়ির দিকে এগোলো চায়ের আশায়, পঞ্চুর কথাটা আর তার খেয়াল রইল না।
  • শ্রাবণী | 69.94.97.94 | ৩১ জুলাই ২০১২ ২২:৩১449707
  • জগ একটু অপেক্ষা করে কানার চা বিস্কুট শেষ হওয়ার জন্যে। পঞ্চু ভালো চোখটা আদ্ধেক খুলে আড়ে তাকায় চায়ে চুমুক দিতে দিতে, গগন মাইতির দুরন্ত ছোট ছানাটা আজ সক্কাল সক্কাল কী মতলবে তার কাছে কে জানে! গগনা পঞ্চুর ছোটকালের বন্ধু ছিল, এখন অবশ্য সুসম্পর্ক আর নেই। ওর ইস্ত্রী টা খান্ডারনী, পঞ্চুকে দেখলেই দেখমার করে, তার শাশুড়ী অর্থাৎ গগনের মা এখনও বেঁচে, তাই ইচ্ছে থাকলেও একেবারে দুর দুর করতে পারেনা, ভাত দিতেই হয়। এই ছেলেটা আরো ছোটতে বজ্জাত ছিল খুব, ওদের বাড়ি গেলে কতদিন হয় একতারার মধ্যে নয় ঝোলায় ব্যাঙ ছেড়ে দিয়েছে, পাগড়ির মধ্যে ডেঁয়ো পিঁপড়ে। গগনের আরো দুটো ছেলে আছে তারা অমনধারা নয়, শান্তশিষ্ট, এটা যে একদম হাড়জ্বালানে তা গাঁয়ের আর পাঁচজনের মত পঞ্চুরও জানতে বাকী নেই।
    -"ও খুড়ো, হল তোমার চা খাওয়া?" পু আর চায়ের গেলাস মুখ থেকে নামায় না দেখে অধৈর্য্য হয়ে শেষে জগ বলে ওঠে।
    এবার পঞ্চু ভালো চোখটা পুরো খোলে, গেলাসটাও হাতে নেয়। শ্লেষ্মা জড়ানো ফ্যাসফেসে গলায় বলে,
    -"ক্যান রে ছোঁড়া? আমার চা খাওয়ার সনে তোর কী?"
    জগ দেখল পঞ্চুর মেজাজ সুবিধের নয়। তাকে দেখে এগাঁয়ে অনেকেরই মেজাজ খিঁচে যায়,এ নতুন কিছু নয়, জগ ঘাবড়ালো না।
    -"আরে চটছ কেন? আমি তো তোমার সনে এট্টুস পরামশ্যি করতে এলুম।"

    পঞ্চু উঠে পড়ে, টিপকলের দিকে হাঁটা দেয়, গেলাস ধুতে হবে। জগ তাই দেখে তার আগেই কলতলায় পৌঁছে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ায়। পঞ্চু আসতে পাম্প করতে শুরু করে। নাঃ ছোঁড়াটার মতলব বোঝা যাচ্ছেনা, তার সাথে এর কী পরামশ্যি, গাঁয়ে এত লোক থাকতে!
    গেলাস ধুয়ে ঝোলায় পুরে পঞ্চু এবার তেঁতুলতলার দিকে এগোয়, সেখানে অল্প আবছা কুয়াশাঢাকা রোদ এসেছে। রাস্তায় লোকসমাগম হচ্ছে আস্তে আস্তে, হাটের সময়। জগ পেছন ছাড়েনা, কানা বুড়ো দর বাড়াচ্ছে,যেন বড় তালেবর একখানা। এগাঁয়ের লোকে কে আবার কবে সাধ করে পঞ্চুর সঙ্গে গল্প করতে আসে।
    জগ অবশ্য খালি হাতে আসেনি, তবে নিজের টেক্কাটাও এত তাড়াতাড়ি বার করবেনা ঠিক করেছিল। জগর পকেটে বাপের ভাঁড়ার থেকে হাত সাফাই করা সাইকেল মার্কা বিড়ির বাণ্ডিল থেকে কয়েকটা বিড়ি। সাইকেল মার্কা এদিকের সবচেয়ে দামী ছাপ, ধূমপায়ীদের কাছে এ বিড়ির কদর অনেক। বহু পুরনো তেঁতুল গাছ, ডালপালা শিকড় ছড়িয়ে আছে চারধারে, তারই একখানা মোটা শিকড়ের ওপর গিয়ে বসল পঞ্চু একটু রোদের ওমের আশায়, বুড়ো হাড়ে একটা কম্বলে অঘ্রানের শীতও আর বাগ মানেনা।
    -"খুড়ো একটুস বিড়ি খাবে নাকি গো?"
    -"বিড়ি?" পঞ্চু চোখ বুজে তখনও ঠিকমত না ওঠা রোদের তাপ কল্পনা করে সেঁকছিল, ভালো ও কানা দুই চোখই বুজে এসেছিল আমেজে। বিড়ির নাম শুনে এক্কেরে তড়াক করে জেগে উঠল। ভালো চোখটা খুলে জগর মুখের দিকে তাকালো, জগর ডানহাতে একটা সাইকেল মার্কা বিড়ি, বাঁহাত পকেটে পোরা, তাতে অন্য বিড়িগুলো আছে।
    -"তুই আজকাল বিড়ি ফুঁকা শুরু করেছিস, দাঁড়া তোর বাপকে গিয়ে বলছি।"
    পঞ্চু মুখে রাগ দেখালেও তার জিভের নোলায় সমুদ্র, অন্যতম নেশার মাল দরশনে, জগ সেটা দেখেও না দেখার ভান করে বিড়িটাকে হাতে নিয়ে অবহেলায় খেলতে খেলতে বলে,
    -"দুর, আমি ফুঁকব কেন, এতো আমি তোমার জন্যে এনেছি। শীতের দিনে, গরম চায়ের পরে মৌতাত হবে।"
    পঞ্চু আর খেলাটাকে টানল না,
    -"দে তবে, হরির দোকান থে একটু আগুন নিয়ে আয় তো। অনেককাল এই সাইকেল বিড়ি টানা হয়নি, দেখি টেনে। তারপর নাহয় তোর কথা সুনা যাবে।"
    জগও আর দেরি করল না, তাকিয়ে দেখল দুর থেকে বিমলি ক্ষেপী আসছে। তার মানে এবার পঞ্চুর ওঠার সময় হয়ে এল। রোজ বিমলি এসে বারোয়ারী আটচালার দখল নিলেই কানা বুড়ো উঠে গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করতে বেরোয়।
    বিমলি এসে একটু দম নিয়ে গলা তুলে শুরু করে "ছাতা লাঠি বোম ফটাশ" ও "গেল গেল গেল পিথীমিটা রসাতলে গেল"। অনেকক্ষণ এরকম গাঁ জানিয়ে চিৎকারের পর সে দোকানের পেছনে নাপিতবাড়িতে গিয়ে বাসী পান্তা আর মুড়ি মিশিয়ে খায়।

    বিমলি আসছে মানে এক্ষুনি রোদ ফুটল বলে! তাহলেই জনে জনে রোদে এসে গ্যাঞ্জাম করবে এই তেঁতুলতলায়, তখন আর শান্তিতে কথা বলা যাবেনি।
    ময়রা দোকান থেকে আগুন এনে দিতে পঞ্চু বিড়ি ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে আয়েশে বুজে আসা চোখে সামনে উবু হয়ে বসা গগনার বেটার দিকে তাকালো। সে জানে তাকে এই বিড়ির দাম দিতে হবে, তবে দামটা কী হবে, তার মত লোকের কাছে এ ছোঁড়ার কী কাম এনিয়ে ধন্দে আছে সে!
  • শ্রাবণী | 69.94.97.94 | ৩১ জুলাই ২০১২ ২২:৪৪449708
  • ****************************************
    প্রাইমারী ইস্কুল দশটা থেকে শুরু, হেডমাস্টার বটুক বাবু দাঁড়িয়ে আছে অফিসবাড়ির মাটির দাওয়ায়, সাড়ে নটা বেজেছে, চোখ রাস্তার দিকে, দু একটি করে ছেলেমেয়ে আসছে। প্রাইমারী ইস্কুলের চারটে ক্লাসের জন্যে তিনটি মাস্টার। মাটির দোতলা স্কুলবাড়ির নীচে ওপরে একটা করে টানা ঘর, নীচে ক্লাস ওয়ান আর টু বসে, ওপরের ঘরটাকে একটা বাঁশের বাতার পার্টিশন দিয়ে থি আর ফোরের জন্যে দুটো ভাগ করা। স্কুলবাড়ির আড়াআড়ি এল শেপে দুটো ছোট ছোট মাটির ঘর নিয়ে অফিসবাড়ি, একটা ঘরে অফিস ঘর কাম লাইব্রেরী কাম সবকিছু। সেখানে হাবু পিওন বসে, হাবু এ ইস্কুলের ক্লার্ক, পিওন, দফতরী মানে একাধারে সব কিছু। অন্য ঘরটায় মাস্টাররা বসে। আগে ইস্কুলে প্রার্থনা টনা কিছু হতনা, এই দিদিমনি এসে শুরু করেছে।
    বছরদুয়েক হল বিয়ে হয়ে এই গাঁয়ে এসেছে দিদিমনি, আগে বাপের বাড়ির গ্রামের ইস্কুলে পড়াত, চাকরিটা ছাড়েনি, দরখাস্ত দিয়ে তদবির করে বদলি নিয়েছে। এই ইস্কুলের থার্ড মাস্টার বুড়ো সাজেদ আলি তখনই আবার রিটায়ার হয়েছিল, তাই এখানে পদ খালি ছিল। বটুকের খুব একটা ইচ্ছে ছিলনা, গাঁয়ের বৌ ইস্কুলে পড়াক, মেয়েছেলেকে কিছু বলা যাবেনা, বকা যাবেনা।
    একে একে সবাই এসে পড়ছে, সেকেন্ড মাস্টার এসে পড়ল, প্রার্থনার জন্যে ছেলেমেয়েরা লাইন দিয়েছে, দিদিমনিও এসে পড়ল। প্রার্থনা হয়ে সবাই ক্লাসে গিয়ে বারান্দাটা ফাঁকা হয়ে গেল। বটুক নীচেরতলার নীচু ক্লাস সামলায় আর মাঝে একবার গিয়ে ওপরের ক্লাসের বাংলা পড়ায়, তখন নীচে অঙ্ক করায় সেকেন্ড মাস্টার, তপন, বটুকেরই ছাত্র। ছেলেমেয়েদের একক্লাসে কবিতা মুখস্থ আর অন্য ক্লাসকে ট্রান্‌স্‌লেশন দিয়ে এসে বটুক বাইরে বারান্দায় দাঁড়াল, দশটা বেজে গেছে। সে রোজই এসময় এভাবে দাঁড়ায়, সকাল থেকে দম নেবার ফুরসত মেলেনা, এই সময়টাই তার অবসর। যাওয়া আসা পথের লোক বা হাট ফেরতাদের সঙ্গে গল্প গাল হয়, অনেকসময় কিছু কেনাকাটিও হয়ে যায় ব্যাপারীদের ঝরতি পড়তি মালের ঝাঁকা থেকে। আজ দাঁড়িয়ে পরান মন্ডলের কাছ থেকে এক আঁটি লাউশাক আর বেগুন কেনা হল, টিফিনে কোনো ছেলের হাতে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।

    থানার ভাঙাচোরা লজঝর জীপগাড়িটা এল হেঁপোরুগীর মত আওয়াজ করতে করতে মোরামের রাস্তার লাল ধুলো উড়িয়ে। রেমো দারোগা এককালে বটুকের ছাত্র ছিল এই ইস্কুলে, তার বাবা তখন হেডমাস্টার। বটুককে দেখে এমনিতে হয়ত দাঁড়াতনা কিন্তু ইস্কুলের সামনে এসেই গাড়ীটা একটা হেঁচকি তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার ছগনলাল আর সাধু কনস্টেবল মিলে দৌড়াদৌড়ি লাগিয়ে দিল, একজন একটা কেরোসিনের টিন নিয়ে সামনের ডোবা থেকে জল আনতে গেল, অন্যজন বনেট খুলে খুটখাট করতে থাকল। নতুন কিছু নয়, এরকমটা হামেশাই হয়ে থাকে, তাই দারোগা সচরাচর কোথাও গাড়ী নিয়ে বেরোয় না, দ্বিচক্রযানের ওপরই তার বেশী ভরসা। সেটা জানে বলেই বটুক মাস্টার আর তার সঙ্গে দু একজন যারা ছিল অবাক হল, আবার হলও না। কাল অমন একটা চুরি হয়ে গেছে গাঁয়ে, তায় আবার রাধামাধবের মন্দিরে, এসময় রেমো তৎপরতা দেখাবে না তো আর কবে দেখাবে!
    -"রাম যে, কী ব্যাপার, এত সকাল সকাল?"
    রামচরণ বটুককে দুটি চক্ষে দেখতে পারেনা। ছোটোবেলায় সে একটু কুঁড়ে প্রকৃতির ছিল তার ওপর মায়ের একমাত্র সবেধন নীলমণি, মা চান করিয়ে, এটাসেটা রান্না করে খাইয়ে, ইস্কুলে আসতে আসতে দেরী হয়ে যেত। বাবা শিবচরণ আগেই চলে এসে ইস্কুল খুলত, তার কড়াকড়ি আর যাই থাক সময় নিয়ে ছিলনা। তাছাড়া সে তখন ওপর তলায় অঙ্ক করাতে ব্যস্ত থাকত, নীচে এই এখনকার মত তখনও দাঁড়িয়ে থাকত বটুক। বটুক ব্রতচারীর ছাত্র ছিল এককালে, যারা দেরী করে আসত তাদের দেখলেই একপায়ের পাতাটা একটু তুলে নাচের ভঙ্গীতে দুলে দুলে সুর করে বলত
    "হাসতে নাচতে, পাটের দোলায় দুলতে, নির্ধনীকে ধন দিতে, অপুত্রকে পুত্র দিতে, কানার চক্ষু দিতে, খোঁড়ার পা দিতে, তাই মা এত বেলা"!
    অবশ্য শুধু এতেই হতনা, তার ক্লাসের ছাত্র ছাত্রী হলে একটা পিরিয়ড পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখত।

    রামচরণ বেশীরভাগ দিনই বটুকের খপ্পরে পড়ত। ক্লাসের পেছনে দাঁড়ানো ছেড়ে তার ঐ বটুকের নেচে নেচে মঙ্গলচন্ডীর ছড়া বলাটাই দুটি চক্ষের বিষ ছিল। পরে বটুকের নালিশে অতিষ্ঠ হয়ে শিবচরণ রামকে সঙ্গে করে ইস্কুলে নিয়ে আসতে শুরু করল উঁচু ক্লাসে। সকালে খাওয়া জুতের হতনা, তাড়াতাড়ি সেদ্ধভাত খেয়ে আসতে হত, ভোরে উঠতেও হত, এইসব নিয়ে রামের বটুকের ওপর ছাত্রাবস্থায় যে ক্ষোভ ছিল, সেটা এখনও রয়ে গেছে, যদিও এমনি চিন্তা করে দেখলে সে বুঝে পায়না কেন বটুককে তার পছন্দ হয়না!

    তবু গাঁঘরের ব্যাপার, সহবত দেখাতেই হয়, প্রাক্তন মাস্টার বলে কথা নাহলে নিন্দে হয়। এমনিতেই রাম দারোগা নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সদাই তৎপর।
    -"মাস্টারমশায়, ভালো তো? আর বলবেন না, ঐ প্ঞ্চু খুড়োকে তুলে নিয়ে যেতে হবে। থানায় নিয়ে গিয়ে চুরি সম্বন্ধে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করব ভাবছি, যদি কিছু জানা যায়, ঠাকুর বলেছেন, যেখানে দেখিবে ছাই।"
    বটুক এবার অবাক হল, ঠাকুরের কথায় না রামের কথায়। রাম দারোগা যতদিন এসেছে ততদিন সে পঞ্চুকে ঘাঁটায়নি কোনো ব্যাপারে, সেটা এ গাঁয়ের সবাই লক্ষ্য করেছে, এ নিয়ে মাতব্বরেদের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে। আজ হঠাৎ পঞ্চুকে কেন! বিশেষ করে বোসবাড়িতে, যেখানে তার ডেরা, সেখানে সে চুরি করাবে বলে মনে হয় না।
    -"কানা পঞ্চু ? তা হঠাৎ তাকে কেন? এতকাল বোসপাড়ায় আছে, কোনোদিন কিছু হয়নি। সে করানোর হলে তো অনেক আগেই করাতে পারত। রাধামাধবের মন্দিরে চুরি করাবে এমন পাষন্ড কী হবে পঞ্চুদা।"
    রেমো দারোগা তার একদার বিভীষিকা বটুক মাস্টারের দিকে করুণার চক্ষে তাকায়, কত কম জানে এরা। আরো কয়েকজন জুটেছে ইস্কুল দুয়ারের নীচে খুঁটির কাছে, সবার চোখমুখের ধরণ দেখে মনে হয় তারা বটুকের সাথে একমত।
    -"শুধু মন্দিরের চুরি হলে কথা ছিলনা মাস্টারমশায়, হরিপুরে বোসেদের গদির সিন্দুক ফাঁক হয়ে গেছে। সামনের দিকে লোহার ভারী কোলাপসিবল বন্ধ ছিল, পেছনের দিকে পাকা ঘরে সিঁদ কেটে, সিন্দুকের তালা ভেঙে সব নিয়ে গেছে। এমনিতে সিন্দুকে বেশী টাকা থাকেনা, কাল ভুজঙ্গকাকা সকালে উঠে মাল কিনতে সদরে যাবে বলে পরশু বিকেলে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে সিন্দুকে রেখেছিল, এছাড়া কিছু আদায়ী টাকাও ছিল, সব মিলিয়ে অনেক। তা কাল তো দিনেরাতে মন্দির চুরির জন্যে কেউ গদিতে যায়নি, সদরে যাওয়াও হয়নি। আজ সকালে গিয়ে ঘর খুলে দেখে এই কান্ড। "
    সবার চোখেমুখে সন্দেহের ছায়া দেখল যেন মনে হল। হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকে রাম দারোগা আবার বলে,
    -"চুরির ধরন টা দেখে বোসেদের পুরনো লোকেরাই বলছে, সেই অনেক বছর আগের পীরচকের শেঠেদের দোকানের চুরির মত, পাকা দেয়ালে সিঁদ। সেখানেও দোকানে সেদিনই অনেক টাকা এসেছিল, আর শেঠেদের ছেলে সদরে কাজে আটকে গিয়ে কথামত সময়ে টাকাটা দোকান থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি!"

    সবার বিস্ময়সূচক নানা শব্দ আওড়ানোর মাঝে জীপ ঘরঘর করে স্টার্ট নিল, হতবাক বটুক ও তার দলবলকে পিছনে লাল ধুলোর ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলে রেখে দারোগা তার দল ও বল, সাধু আর ছগনকে নিয়ে কালীতলা অভিমুখে রওনা দিল।
  • ঐশিক | 132.179.109.229 | ০১ আগস্ট ২০১২ ০০:১৪449710
  • তারপরে ?
  • Sibu | 84.125.59.177 | ০১ আগস্ট ২০১২ ০০:১৮449711
  • বেশ ভালমানুষ দারোগা কিন্তু (মানে এখন পর্য্যন্ত)।
  • kumu | 132.160.159.184 | ০১ আগস্ট ২০১২ ১১:৩৪449712
  • দারোগা চরিত্রটি অসাধারণ।
    এত চরিত্র শ্রাবণী মনে রাখচো কী করে?এট্টা ফ্যামিলি ট্রি বানিয়ে?
  • de | 213.197.30.4 | ০১ আগস্ট ২০১২ ১১:৪৩449713
  • অপেক্ষায় রইলাম -- খুব ভালো হচ্ছে--
    কি ডিটেলস থাকে শ্রাবণীর গপ্পে !!
  • শ্রাবণী | 127.239.15.102 | ০১ আগস্ট ২০১২ ১২:২০449714
  • কুমুদি, গাঁয়ের বিভিন্ন চরিত্র, বেশী মনে হচ্ছে কিন্তু বাদ দেওয়াও যায়না.....গাঁয়ের কথা লেখার ফাঁকে গল্প লেখা তো, হয়ত বোরিং হয়ে যাচ্ছে।:(
    কিন্তু বিমলি ক্ষেপীর "ছাতা লাঠি" বাদ দিই কেমন করে!
  • kumu | 132.160.159.184 | ০১ আগস্ট ২০১২ ১৭:০১449715
  • বালাই ষাট,বোরিং হবে কেন?খুব উপভোগ করছি,সেশ করে দিও না যেন,অনেক অনেক লম্বা লেখো।
  • শ্রাবণী | 69.94.98.211 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:১৮449716
  • ভোর থেকে বেশ একটা উৎসবের মত ধুম পড়ে গেছে সারা পাড়ায়। পুজো আচ্চার কাজে যেসব মেয়েবৌরা দড়,তারা রাত থাকতে চান করে মন্দিরে ঢুকেছে। সমস্ত করণীয় ঠিক হয়েছে ফণিভুষনের বাড়িতে কাল সন্ধ্যেয়, কুলতলী থেকে ছেলেরা ফেরার পরে। পরের দিন, দিন ঠিক হয়েছে প্রায়শ্চিত্তের। ভবেন ভটচাজ নিজে এসে সব করবে। মন্দিরে ঝাড়ামোছা শুরু হয়, একদল পুকুর থেকে জল নিয়ে এসে মেঝে,দেওয়াল ঘসতে শুরু করে। আর একদল সমস্ত কাপড়চোপড়, প্রদীপ পিলসুজ যা চোরে নেয়নি সেসব ঠাকুরপুকুরের ঘাটে নিয়ে যায় কাচতে, মাজতে। সিংহাসন টা দালানে বার করে নিয়ে এসে পরিস্কার করছে কজনে। অলপ্পেয়ে চোরের দল চামরটাও নিয়ে গেছে, রুপোর বাঁটের জন্যে। সিংহাসনটা বিরাট, তাই নিয়ে যেতে পারেনি, নাহলে সেটাও রুপোর পাত দিয়ে মোড়া।

    কর্তারা আজ সকাল সকাল আটচালায় এসে জুটেছে। তবে এটুকু ছাড়া পাড়ার আবহাওয়া গতকালের থেকে অনেক স্বাভাবিক। লোকে বাজার দোকানে বেরিয়েছে, ঘরে ঘরে আঁচ পড়েছে। অফিস কাছারি, ইস্কুল কলেজ যাবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। শুধু পড়ুয়াদের চিল চিৎকার করে একসুরে পড়ার বা মহিলাদের ঘাটেপথে ঝগড়ার সুর আজ অনেক নীচুগ্রামে। তাই আপাতদৃষ্টিতে পাড়া অনেক শান্ত মনে হয়। কিছু ছোট ছেলেপিলে আর বুড়ো বেকার ছাড়া পুরুষ নেই এখন পাড়ায়। ছোটরা একবার মন্দির আর একবার আটচালা করছে খেলার ফাঁকে ফাঁকে। তাদেরই একজন মেয়েদের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এল। চামর নেই, আরতির চামর লাগবে, কত্তারা যেন খেয়াল করে।
    রাধামাধবের দেবোত্তরের আয় থেকেই তার খরচখরচা চলে কিন্তু এখন এস্টেটে টাকা বেশী নেই। ধান উঠে বিক্রি হলে আবার তহবিল ভরবে ঠাকুরের। তবে তার সেবকরাও তো হেঁজিপেঁজি নয়। তাই খোয়া যাওয়া জিনিসগুলো কে কী দেবে,সেইসবেরই লিস্টি হচ্ছিল, সকাল থেকে।
    অনঙ্গ জানায় চামর সেই দেবে, তার বড় ছেলের নামে। আলোচনা করে অবশ্য দেখা গেল দেবে তো ঠিক কথা কিন্তু এত তাড়াতাড়ি চামর আসে কোত্থেকে? হয় সদরে দোকানে অর্ডার দিতে হবে নয় কলকাতা থেকে আনাতে হবে, দুটোই সময়সাপেক্ষ।
    দূর্গার একটি বড় চামর আছে, তা ব্যবহার করা যাবে কিনা তাই নিয়ে কথাবার্তা হতে লাগল। দেখা গেল মতলবটি সম্পর্কে অনেকের বিশেষ করে প্রাচীনাদের ঘোর আপত্তি। সরী ঠাকুমা তো স্পষ্ট বলে দিল, ওসব কিছুতেই হবেনা। শাক্ত সামগ্গির দিয়ে বৈষ্ণব রাধামাধবের পুজো হবেনা, দুজনেই মাথায় থাকুন কিন্তু তাদের মেলানোর চেষ্টা করলে ঘোর পাপ হবে!
    শেষমেশ পল্টনদের ঘরে একটা নতুন ময়ুরপুচ্ছের পাখা ছিল, কাশী থেকে কেনা। ঠিক হল ওটা দিয়েই চামরের কাজ চালানো হবে আপাতত। চামর দিয়ে আর কী হয়, ঠাকুরকে পাখাই তো করা হয়!

    আটচালার আসরে শুধু যে গুলতানি হচ্ছে তা নয়, কাজ ও হচ্ছে কিছু কিছু। মূলত, ভবেন পুরুতের পাঠানো ফর্দ মিলিয়ে আলাদা আলাদা পুজোর বাজারের ফর্দ তৈরী হচ্ছে। কাঁচা ফল নৈবিদ্যের তরকারী, পান ইত্যাদির বাজার হবে কাল,পুজোর দিন সকালে, হরিপুরের হাট থেকে, তার আলাদা ফর্দ। দশকর্মার বাজার হবে আজ বিকেলে, তার ফর্দও আলাদা। ব্রাহ্মণ ভোজনের সামগ্রী, চাল ডাল তেলও তখন আসবে। পুজোর মিষ্টি মন্ডা বাতাসা এইসব আসবে বারোয়ারীতলায় হরি ময়রার দোকান থেকে। এছাড়াও যা গাঁয়ে বা হরিপুরের দোকানে পাওয়া যাবেনা তার একটা ফর্দ কাল রাতেই করে ভুজঙ্গ বোসকে দেওয়া হয়েছে। আজ সকালে সে আর তাদের সরকারমশাই সদরের দিকে রওনা হয়ে গেছে।

    ওদিকে মেয়েদের আসরও মন্দির চত্বরে দিব্যি সরগরম। অনেকেই মন্দিরের ভেতরের সিঁড়ি ধরে ছাদে উঠে চারদিক দেখে এল। ঠাকুর থাকলে তো ছাদে ওঠার কথা কল্পনাও করা যায়না। ছাদে এখানে ওখানে দেওয়ালের গা ফুঁড়ে অশুত্থ চারা দেখা দিয়েছে। কেউ আসতে পারেনা বলে সেগুলো মারাও হয়না। বাড়িতে হলে তো সঙ্গে সঙ্গে উপড়ে ফেলা হয়, শিকড়ের আগায় অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়। সরীঠাকুমার কানে যেতে আশপাশ পরিস্কার করছিল যারা তাদের একজনকে বড়বাড়ি থেকে অ্যাসিড আনতে পাঠানো হল। মজুররা তো আর মন্দিরে উঠবেনা, শেষে পুরনো বাড়ির ছোটো বৌ নিজে, অ্যাসিডের বোতল, কাঠারি নিয়ে ছাদে উঠল, সঙ্গে দুটি পাড়াজ্বালানে ডানপিটে মেয়ে।
    সরী ঠাকরুন ঘরের ইজি চেয়ারটা মন্দিরের সামনে আনিয়ে নিয়ে, তাতে বসে ভেতরের সব কাজের তদারক করছিল। কর্তারাই তার ওপর একাজের ভার দিয়েছে। কাল রাতে বিনয় বামুন চলে যাবার পর ধম্মদাস আর ভুজঙ্গ নিজে বাড়ি এসে সবার হয়ে অনুরোধ জানিয়ে গেছে। সরীদিদির মত এপাড়ায় আর কে জানে সব কিছু, কারই বা এত জ্ঞান গম্যি আছে সব ব্যাপারে!
    মন্দিরের কাজকম্মের দিকে চোখ রাখতে গিয়ে বার বার নজর চলে যাচ্ছিল আটচালা হয়ে রাস্তার দিকে। এপাড়ায় ঢোকার মুখে রাস্তার ওপরের বাড়িটাই সরীঠাকুমার বাপের বাড়ি অর্থাৎ অনঙ্গ বোসেদের বাড়ি বা বড়বাড়ি।
    তারপরে একদিকে বিরাট খোলা জায়গা জুড়ে দুর্গামন্দির আটচালা ও অজিত বোস, শম্ভু বোসেদের বাড়ি। আটচালার শেষে চারধার খোলা বৈঠকখানা, তার এদিকে রাধামাধবের মূল মন্দির, ভোগমঞ্চ ও ঝুলনমন্দিরসহ। নীচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দির চত্বর, পাঁচিলের এপারে পুরনো পাড়া,ফনিভুষণের বাড়ি ও অন্যান্য আরো বাড়ি। মোটকথা মূলমন্দিরে বসলে খোলা বৈঠকখানা ও আটচালা দিয়ে বাইরের রাস্তা যেখানে পাড়ায় ঢুকেছে সেখান ও অন্যদিকে অনঙ্গ বোসেদের সদর ও ভিতর বাড়ি ঢোকার দরজা দেখা যায়।

    এমনিতে মেয়ে মহলের ও কাজের লোকেদের যাতায়াত সব খিড়কী দিয়ে। তাই সদরের দিকে এই সকালে লোক তেমন চোখে পড়ছেনা। তবু সরী ঠাকুমা বড়বাড়ির সদরের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কারণটা আর কিছু না, সদরঘরের পাশে সরকারমশাইয়ের ছোট কুঠরীটার দরজা হাট করে খোলা। একবার খাঁদিকেও দেখা গেল ন্যাতাবালতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে। তার মানে যে কেউ ঐ ঘরের দেওয়ালের পেরেক থেকে চাবি খুলে নিতে পারে, যখন খুশী। দীনু সরকার অনঙ্গ বা সরী ঠাকরুনের থেকে বয়সে ছোট হলেও, তার বয়স কম নয়। ষাটের ঘরে হবে,চোখে খুব ভালো দেখেনা, তায় দিনমানে সে কাজেকম্মে ঘরে প্রায় থাকেইনা বলা যায়। তবু ঘরে ফিরলে অমন একখানা ভারী চাবির গোছা নেই হয়ে গেলে খেয়াল করবে না!
    রাতে সরকারমশাই দরজা বন্ধ করেই শুয়েছিল, সকালে চুরির খবরের পর চাবি যথাস্থানে দেখা গেছে। তাই ধরে নেওয়া যায়, চাবি কেউ সরায় নি, সুযোগ থাকলেও নয়। কিন্তু দিনেরবেলা যখন ঘর হাটের মত খোলা, দীনুও এদিক ওদিকে থাকে, তখন কিছুক্ষণের জন্যে চাবি গায়েব হলে দীনুর নজরে নাও পড়তে পারে!

    সাবানে চাবির ছাপ নিয়ে গিয়ে নকল চাবি বানানো নাকি আজকাল ছেলেখেলা, গাঁয়ের চোর কড়িরামের কাছে এমনটাই শুনেছে সরী ঠাকুমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা কুচোকে ডাক দেয়,
    -"যা তো, আমার নাম করে পাড়ুইদের দোকান থেকে দুখে কামারকে একটু আসতে বলে আয় তো, তার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। এই এখানে মন্দিরেই আসতে বলবি।"
    দুখে কামারকে ডাকতে লোক পাঠিয়ে মনে খানিক শান্তি হল ঠাকুমার, একটু হলেও কোনোদিকে কিছু করছে সে। ঐ শিবু মাস্টারের বেটা দারোগা ছোঁড়াটার ওপর তার একটুও ভরসা নেই। শিবুটা গোঁয়ার আর ছেলেটা গাড়োল, নেহাত শিবুর বৌটা সতীলক্ষ্মী বলে তার পুণ্যে সংসারটা দাঁড়িয়ে আছে। আর বোসবাড়ির কত্তারাও হয়েছে তেমনি, বেশীকিছু খোয়া যায়নি বলে চুরি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই কারো, প্রাচিত্তির নিয়েই মেতে উঠেছে সব!
  • শ্রাবণী | 69.94.98.211 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:২৬449717
  • কাল থেকে সারা গাঁয়ের লোক এমনকি মেয়ে বৌরাও কোনো না কোন ছুতোয়, সুযোগ পেলেই একবার বোসপাড়া ঘুরে যাচ্ছে। দুখে কামারও ব্যতিক্রম নয়, সেও সকালে দোকানে আসার পথে উঁকি মেরে বোসবাড়ির কত্তাদের আসর, ঘাটেবাটে ব্যস্ততা দেখে গেছে।
    সরীঠাকুমার দূত আসতে এক মুহূর্তও দেরী না করে পাড়ুইমশায়কে জানিয়ে সে ছুটল রাধামাধবের মন্দিরের দিকে। অন্য চুরির খবর নিয়ে যখন ভগ্নদুতরা পাড়ায় ঢুকেছে, সরী ঠাকরুনের নজর যে ঠিক সেই সময়েই বড় বাড়ির সদর থেকে সরে গিয়েছিল তা শুধু ঐ দুখে কামারের জন্যে।

    -"কী র‌্যা দুখে, তোর ছেলেটা তো বেশ রোজগার করছে এখন শুনছি, বে থা দিয়ে দে। বাপ বেঁচে থাকতে নাতবৌয়ের মুখ দেখে যাক।"
    সরীপিসী হঠাৎ এরম একটা দিনে,এমন সময়ে, তার ছেলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছে, শুধু তাই নয় এব্যাপারে কথা বলতে তাকে ডেকে পাঠিয়েছে! দুখে খালি অবাক নয় একটু হতাশও হল। কেন জানি তার মনে হয়েছিল তাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছে ঠাকরুন, হয়ত বা মন্দিরের ব্যাপারে!
    কী বলবে ঠিক ভেবে না পেয়ে সে বলে,
    -"ছেলে মানা করে যে,বলে এখনই কী, কিছুদিন যাক, অবস্থা একটু সামলাক। কেন পিসী, নজরে মেয়ে আছে বুঝি?"
    -"বেশ যাহোক,হাতে মেয়ে না থাকলে বুঝি ন্যায্যি কথা বলতে নেই তোদের। আইবুড়ো মেয়েও যেমন বসিয়ে রাখা উচিৎ নয় তেমনি রোজগেরে সোমত্ত ছেলেও বেশীদিন বে না দিয়ে রাখতে নেই। বদখেয়ালে হয়, বদসঙ্গে পড়ে। আজকাল এসবও কি তোদের ডেকে ডেকে কান কামড়ে বলতে হবে রে। তোর মা এসে দুঃখু করে, তোর আর তোর বৌয়ের নাকি কোনো হুঁশ নেই, তোমরা আধুনিক হইছ। বুড়োবুড়ির বোধায় আর নাতির ঘরের পুতি দেখা হয়না।"
    দুখে অধোবদনে থাকে, এব্যাপারে তার কিছু বলার নেই, আজকালকার রোজগেরে ছেলে, মাবাপের জোর নেই তার ওপর। দুখেকে বেশ করে ধরাশায়ী করে সরী ঠাকুমা মুখে দোক্তা পুরে চু চু করে,
    -"হ্যাঁরে দুখে, তোর আর তোর বাপের মত কামার তো এ অঞ্চলে আর দ্বিতীয় নেই, পাড়ুইদের এত রমরমা,সেতো তোদের জন্যেই। তা তুই বাপু কী সব শুনি, সেই যে সাবানে তোলা ছাপ থেকে চাবি বানাতে পারিস?"
    সরীঠাকুমার মাথা খারাপ হতে পারে তা কোনো অবস্থাতে এ গাঁয়ের কেউ কোনোদিন স্বপ্নেও ভাববেনা। তবে দুখের মনে হল কাছাকাছি কিছু হলেও হয়েছে হয় তো। ভক্ত মানুষ ঠাকরুন, রাধামাধবের মন্দিরে চুরিটা বড্ড প্রানে বেজেছে।
    -"সাবানের ছাপ থেকে চাবি? আমি কখনো বানাই নি পিসী, ওসব শুনি মন্দ লোকে করে। আমাকে চাবি দিলে তাই দেখে চাবি করে দিই, তাও চিনা লোকেদের।"
    -"তা এগাঁয়ের কোন সে লোক অমন মন্দ, তার নাম শুনি একবার, বল, কে এরকম চাবি করে দেয়?"
    -"আজ্ঞে, এগাঁয়ে কেউ নেই। এদিকে শুনেছি সুলতানপুরের কে মজিদ নাকি করে, তবে সেও নাকি সবার জন্যে নয়। তার ওপর পুলিশের নজর আছে, শুধু চিনাজানাদের জন্যে করে। এদিকের কুলীন চোরেরা কেউ ওসব অধম্মের কাজ করেনি পিসী। কড়িদাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন। তারা তাদের যন্তর দিয়ে তালা খুলবে, ফাঁকি দিয়ে চাবি বানাতে যাবেনি।"
    -"তুই থাম দেখি, যত পাগলের কথাবাত্তা। ধম্মের চোর আবার কী? চুরি জিনিসটাই তো অধম্মের। তায় আবার সায় নেব কার, না কড়ি চোরের!"
    দুখেকে ধমকে চুপ করালেও মনে মনে ঠাকরুন কথাটা উড়িয়ে দিতে পারেনা। এ চুরি এদিককার কোনো সাবেক চোরের নয়, চার গাঁয়ের কারুর অত বুকের পাটা নেই, রাধামাধবের গায়ে হাত দিতে সাহস করবে।"
    কথার মাঝেই চট করে ভেবে নিল, সুলতানপুর এখান থেকে দুর আছে বেশ খানিক। বিনয় বামুন কাছেই ঘোরা ফেরা করছিল, এক গোছা চাবি তার কাছে আছে। এমনিতে সদর থেকে নতুন তালা আসছে মন্দিরের জন্যে, ভারী বিলিতী তালা। তা ছাড়া কথা হচ্ছে মন্দিরের দুয়ার একটু ঘিরে সেখানে বিনয়ের রাতে শোয়ার ব্যবস্থা করা হবে অন্তত তদ্দিন যদ্দিন না চোর ধরা পড়ছে।

    তালেগোলে ভুজঙ্গদের আসাটা চোখ এড়িয়ে গেসল ঠাকুমার। চেঁচামেচি হই হট্টগোল যখন আটচালাতে পুরোদমে, তখন খেয়াল হল। খবর আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে পাড়ার সব লোক আবার আগের দিনের মত দলে দলে আটচালায় এসে জুটেছে। সরী ঠাকুমার সব শুনে বুঝে চেয়ার থেকে উঠে, ঠুক ঠুক করে লাঠি ধরে আটচালায় পৌঁছতে পৌঁছতে সবার সব শোনা হয়ে গেছে।
    এর ওর থেকে কিছুটা করে পুরো ব্যাপারটা জানার পর ঠাকুমার মনে হল দোষ এদেরই। কালকে মন্দিরের চুরি চুরি করে সব এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে গদিঘরের সিন্দুকে অত টাকা রয়ে গেছে কারোর খেয়ালই হয়নি। আর চুরি হয়েছে বলে সবাই মিলে সব কাজ বন্ধ করে রাখতে হবে। করেছে টা কী এই ব্যাটাছেলেগুলো কাল সারাদিন? দৌড়ঝাঁপ কিছুই তো করেনি, চোর ধরার চেষ্টাই করেনি সেভাবে। শুধু সারাদিন বসেবসে গজল্লা করেছে আর চা বিড়ি ধ্বংস করেছে!

    কাল রাতে যখন ভুজঙ্গর মনে পড়েছে টাকার কথা, তখন নাকি তার অস্বস্তি হয়েছে। তাই কানাই বাগকে তড়িঘড়ি পাঠিয়েছে রোজকার মত গদিতে পাহারায়। বাগপাড়ার কানাই বাগ আগে মস্ত লাঠিয়াল ছিল, এখন বয়স হয়েছে তবে শরীরে এখনো প্রচুর শক্তি। রোজ সন্ধ্যেয় গদিঘর বন্ধ হবার মুখে সে যায়, জেগে রাতপাহারা দিয়ে আবার সকালে এরা গদি খুলতে গেলে তার ছুটি হয়।
    তাহলে চুরি হল কী করে, কানাই যখন গদিঘরে ছিল? কানাইকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে, তবে তার কাল যেতে একটু রাত হয়েছিল।
    সকাল থেকে গদি খোলেনি, হরিপুরে যে দুখানা দোকান আছে ওদের, সেগুলূ কর্মচারীরা সকালে একবার খুলেই বন্ধ করে চলে গেছে, মালিকরা কেউ যায়নি বলে। কানাই সকালে মন্দির চুরির খবর পাওয়ার পর থেকে অনঙ্গ বোসের বাড়িতেই ছিল, কখন কী দরকার হয় তাই।

    সন্ধ্যে নাগাদ মেজকর্তা অর্থাৎ ভুজঙ্গর খেয়াল হয়েছে গদিতে কারুর যাওয়া দরকার, টাকা রয়েছে অনেকগুলো। কানাইকে বলাতে সে বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে টর্চ লাঠি নিয়ে বেরোতে বেরোতে একটু দেরী হয়ে গেসল। পুলিশ মনে করছে চুরি ঐ সন্ধ্যে নাগাদই হয়েছে। পাকা দেওয়ালের সিঁদ নাকি পাকা হাতে কাটা, এমন ভাবে ইঁট আবার সাজিয়ে রেখেছে, কানাই রাতে দেখেও ধরতেই পারেনি যে সিঁদ কাটা হয়েছে।
    সকালে ভুজঙ্গ আর সরকারমশাই সিন্দুক খুলতে গিয়ে দেখে তালা ভাঙা,ভেতরে কিছু নেই। পুলিশ এসে প্রথমে তো কানাইকেই ধরে মারে। তারপরে এদিক ওদিক ভালো করে দেখে, দোকানের পিছন দিকে গিয়ে বোঝা যায় যে ইঁট আলগা করে বসানো। তবু পুলিশ কানাইকে ধরে রেখেছে এখনো, সেটাও এক সমস্যা। দারোগা ভুজঙ্গের কথা মেনে কানাইকে এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে রাজী নয়। তার নাকি তদন্তের জন্যে কানাইকে দরকার।
    এখন এটা অন্য কথা যে অনেককাল আগে কানাই গাঁয়ে ঢোকার মুখে বোসেদের আমবাগান আছে, সেখানে পাহারা দিত। আর রামচরণ একদুপুরে ইস্কুলের সঙ্গীসাথীদের সাথে সেখানে আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। তখন কানাই বাগের বয়সকাল, গায়ে অসীম জোর। দুটি থাপ্পড়েই সর্ষেফুল দেখেছিল রেমো। বাপের কাছে সেই নিয়ে নালিশ করেও সুবিধে হয়নি। উল্টে ইস্কুলের টাইমে এসব অন্যায় করার জন্যে বকুনি জুটেছিল উপরি। এখন বুড়ো কানাই থানায় হাত জড়ো করে জবুথবু হয়ে বসে ভয়ে কাঁপছে। রাম দারোগার ব্যাপারটা দেখতে বেশ লাগছে। এমনে সে নিজেকে এবং আশেপাশে চেলাদের বোঝাতে কসুর করেনা যে কানাই এখনো থানায় কারণ সে এ কেসে একজন প্রধান সাক্ষী। তবে মন্দিরে বাপের ধমক খাবার পর বদলির দরখাস্ত যেটা লিখে রেখেছিল সেটা আজ বাড়ি গিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে ঠিক করেছে।

    ওদিকে আটচালায় হাহুতাশ, মড়াকান্নার মাঝখানে জল্পনা চলতে থাকে। যে মূল প্রশ্নটা এতগুলো পাকামাথা এক হওয়ায় দেখা দিল তা হল কারা জানত যে গদিতে টাকা রয়েছে। ভুজঙ্গ, অনঙ্গর বেশ ভেঙে পড়া ভাব, তাদের সরাসরি কেউ জিজ্ঞেস করল না। ওদিকে সরকারমশাই ফেরেনি, সে কানাইয়ের সঙ্গে তখনো থানায়। যা বোঝা গেল, বাড়ির কেউই জানত না। ভুজঙ্গ সদরে যাবে জানত কিন্তু তা যে টাকা নিয়ে মাল গস্ত করতে আর পাওনা মেটাতে তা এরা দুভাই ছাড়া আর কেউ জানত না, অবশ্য দীনু সরকারও জানতে পারে।
    সরী ঠাকরুন ভাইয়েদের সান্ত্বনা দেওয়ার ফাঁকে আবার রাস্তার দিকে চায়। সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বাইরের লোক বলতে হয়ত ঐ সরকারই জানত টাকার কথা। তার ঘরের দেওয়াল থেকেই হয়ত মন্দিরের চাবি বা চাবির ছাপ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য মন মানতে চায়না, এতদিনকার লোক দীনু। অনঙ্গ ভুজঙ্গদের বাপের আমলে এসে এ বাড়ীতেই রয়ে গেছে, বাড়ির লোকই প্রায়!

    অনেক ঝড় ঝ্ঞ্জা এসেছে গাঁয়ে, তবু বটতলা, কালীতলা, আটচালা ইত্যাদির আসর তাতে ভেঙেছে এরকমটা হয়নি। আজও আসরে আলোচনা চলতে থাকে। কেউ কিছু বুঝতে পারেনা, তবে একটা ব্যাপারে সবাই একমত, বোসবাড়িতে কিছু একটা শনি বা রাহু দশা এসেছে। ঠাকুরের প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠানে একটা গ্রহ পুজোও ঢুকিয়ে দেওয়া হবে কিনা এ বিষয়ে জোর তর্ক শুরু হয়! অনঙ্গ বোসেরা অবশ্য সে তর্কে থাকেনা, তাদের অনেক কাজ। প্রথমেই কত গেছে তার একটা খতিয়ান করতে হবে। মাল না এলে ব্যবসা বসে যাবে তাই টাকার ব্যবস্থা করে আজ কালের মধ্যে মাল আনাতে হবে। বোসবাড়ির এত লোক থাকতে শনি রাহুর দশা তাদের ঘাড়েই চেপে বসল কেন সে রাধামাধবই জানেন!

    দুপুরে যখন মন্দিরের সব কাজ গুছিয়ে মন্দিরের ভেতর বাইর ঝকঝকে তকতকে করে সবাই চলে গেছে, তখন সরী ঠাকুমাও বাড়ি ফিরে নাওয়া খাওয়া করেছে। দুপুরে আজ কেউ উঠোনে আড্ডা মারতে আসেনি। মেয়েরা সব শ্রান্ত, সকাল থেকে কাজ করে করে। একা একা কাঁঠালতলায় চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রোদছায়ায় আরামে ঝিমুতে ঝিমুতে সরী ঠাকুমা নিজের মনেই বলে ওঠে,
    -" আসল চুরিটা তাহলে কোথায় হল"?
  • 4z | 152.176.84.188 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৩৪449718
  • শ্রাবণীদিইইইই, এতদিন পরে এইটুকু :(
  • শ্রাবণী | 69.94.98.211 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৪৮449719
  • ***************************
    -"খুড়ো, ভাবছি কামকাজ শুরু করব, তোমার সাহায্যি চাই।"
    পঞ্চু বিড়িতে টান দিয়েও ধোঁয়া ছাড়তে ভুলে গিয়ে শেষে কেশেমেশে একাকার কান্ড। জগ তাই দেখে ইষৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেল, তবে সে অল্প সময়ের জন্যে। পরক্ষণেই আর একটু খোলসা করে বলে,
    -"আরে বাবা কাজ মানে সে আলু পটল ধান চালের চাষ নয় বাবাদাদার মত, অন্যধরনের, একেবারে আলাদা কাজ। এমন কাজ যাতে করে আমার পয়সা রোজগারও হয় আবার পাঁচটা লোকের ভালো হয়।"
    পঞ্চু সামলে নিয়েছে একটু, বিড়িও শেষ। একতারাটা হাতে তুলে নিয়ে টংটং করে, লোকজন যাচ্ছে রাস্তায়, ভিক্ষে পেলেও পেতে পারে।
    জগকে নিয়ে আর তার মাথাব্যথা নেই, সে এখন ধরে নিয়েছে ছেলেটার নির্ঘাত মাথার দোষটোশ হয়েছে। হতেই পারে, যা খান্ডারনী মা আর পাষণ্ড বাপ, ওদের অত্যাচারে মাথার দোষ হওয়া বিচিত্র আর কী! কাজের পরামর্শ করতে আর লোক পেল না, এই পঞ্চু কে ধরেছে!
    চুকচুক করে একটু আফশোসের আওয়াজ বার করে ঐ মুখে যতটা সম্ভব নরম হয়ে বলে,
    -"যা বাড়ি যা, এখেনে মেলা গোল করিসনি। আমারে শান্তিতে ভিক্ষে মাগতে দে।"
    বিড়িটা কি তাড়াতাড়ি দিয়ে ফেলল? কানা তো গুরুত্বই দিচ্ছেনা।
    -"খুড়ো, আমি চোরডাকাত ধরার, চোরাই মাল উদ্ধার করার এজেন্সী খুলব ঠিক করেছি। এদিকে থানা পুলিস যা ধুচুনি, রেমোদাকে দেখেছ তো, কোনো কম্মের নয়। বাপকে দেখলে এখনো এমন করে যেন ইস্কুলের ছাত্তর। আজ অবধি কোনো চুরিই ঠিকঠাক ধরতে পারেনি।
    আমি চোরডাকাত ধরে দিয়ে গাঁয়ের লোকের উবগার করব। তার জন্যে আশপাশে যত চোরডাকাত আছে তাদের সম্বন্ধে, চুরির রকমসকম এইসব ভালো করে জানতে চাই তোমার কাছে।"
    পঞ্চুর টংটং থেমে যায়। একতারার ডান্ডাটা তুলে তাড়া করার ভঙ্গীতে জগর দিকে তাক করে চেঁচায়,
    -"মসকরা হচ্ছে আমার সনে, আমি তোর ইয়ার? চোরডাকাত নিয়ে পরামশ্যি করতে এসছিস মোর সাথে? দাঁড়া, আজই তোর বাপকে গিয়ে বলছি।"
    কানাকে ঐরকম মারমুখী দেখে জগ ঘাবড়ে একটু সরে যায়। কানা যদি গগনকে গিয়ে সত্যি সত্যি বলে তাহলে ঝামেলা আছে। সে ভেবেছিল আস্তে আস্তে চোর ডাকাত নিয়ে কথা বলতে বলতে মন্দির চুরি ও সেদিন রাতের লোকগুলোর প্রসঙ্গে আসবে। কিন্তু সব ভেস্তে গেল, বুড়োর যা মেজাজ, এখন আর ভালো কথায় কিছু বলবেনা।
    মরিয়া হয়ে সেও মেজাজ দেখিয়ে বলে,
    -"এই ধরনা, রাধামাধবের মন্দিরে যে চুরি হল, সূত্র ধরে যদি চোর বের কত্তে পারি বামাল সমেত তাহলে গাঁয়ের লোকে ধন্যি ধন্যি করবে, আমাকে। তার সঙ্গে তুমি আমায় ঠিকঠাক পরামশ্যি দেছ বলে তোমাকেও!"
    পঞ্চু কী একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল, ভালো চোখটাকে সরু করে জগর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উঠে পড়ল তেঁতুলতলা থেকে, কাঁধে ঝোলাটা আর ডান হাতে একতারাটা বাগিয়ে। চাটুজ্যে পাড়ার দিকে হাঁটা দেবার উপক্রম করতেই জগ আবার ঘ্যানঘ্যান করে,
    -"কী হল খুড়ো, চললে কোথায়। একটু শোনোনা কথা ভালো করে।
    -"তোকে কে পাঠিয়েছে?'
    -"পাঠিয়েছে? কেউ না তো। আমি তো নিজেই তোমার কাছে এসেছি মানে বাবার কাছে শুনি কিনা, এদিককার চোর ডাকাত তোমাকে খুব ভয় করে, মানে, তাই।" জগ তোষামোদের গলায় বলে।

    তার কথার মাঝেই প্‌ঞ্চু হনহনিয়ে এগিয়ে যায়। জগও কিছু না ভেবেই পিছু নেয়। প্ঞ্চু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ওকে, কিন্তু কিছু বলেনা, সঙ্গে যেতে বারণও করেনা। প্‌ঞ্চু ভিক্ষের জন্যে কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা হেঁটে চাটুজ্যে পাড়ার সীমানায় এসে পুব মাঠের পথ ধরল।
    এত সকালে মাঠে সেরকম কেউ নেই। সোনালী পাকা ধানের গাছ সকালের রোদ আর শিশির মেখে আলসেমিতে শুয়ে আছে মাটিতে। কদিন বাদেই শুরু হয়ে যাবে মাঠে মাঠে ধান কাটার ব্যস্ততা। সরু আলের পথে জগ চাইলেও কানার পাশে পাশে হাঁটতে পারছিলনা, তবে তার মনে কৌতুহল তখন চরমে। সে ঠিক ধরেছে তাহলে, পঞ্চু কিছু জানে, নাহলে এভাবে তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কেন!

    ধানক্ষেতের পরে আলু ক্ষেত পেরিয়ে, প্রায় মাইল খানেক হেঁটে জগকে নিয়ে পঞ্চু মাঠের ধারে হাটগাছির মিশনের সামনে এসে পৌঁছল। ওদিকে তখন বারোয়ারী কালীতলায় রাম দারোগার গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে পঞ্চুর খোঁজে। সেখানে সেসময় বিমলি খেপীর রোজের পালাগান শুরু হয়েছে। দারোগা ওদিকে কান না করে লোককে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
    কিন্ত তারা না দেখলে কী হবে, ভিড় দেখে বিমলি উৎসাহ পেয়ে গলার জোর তিনগুন বাড়ালো।
    সেই চিৎকারের মাঝে রাম যাদের পঞ্চুর কথা জিজ্ঞেস করে তারা কেউই সঠিক উত্তর দেয় না, অর্ধেক কথা শুনে আন্দাজে যা খুশী বলে দেয়।
    কেউ খুড়োকে বুড়ো শুনে নিজের বয়সের ফিরিস্তি দিতে বসে। আবার কেউ কানাকে মানা ভেবে মঙ্গলবারে মানার হাটের কথা কয়।
    এদিকে পান্তার সময় পেরিয়ে গেলেও বিমলি আজ বেপাড়ার অডিয়েন্সের জন্য ওভারটাইম খাটতে থাকে, শোটাইম বাড়িয়ে দিয়ে। সব মিলিয়ে যাকে বলে হাঙ্গামার একশেষ। দুত্তোর বলে রাম গাড়িতে উঠতে যাবে, গাড়ি স্টার্ট নেয়না। তখন আবার কালীতলার লোকেরা সব গিয়ে গাড়িকে ঘিরে ধরে। তারা সাধু আর দুখনকে এত উৎসাহ দিতে আরম্ভ করল যে গাড়ি আর চালু হল না কিছুতেই। বেলা হলে শেষে গাড়ি ওখানেই ছেড়ে দিয়ে তিনজনে হাঁটা দেয় থানার উদ্দেশ্যে।

    মিশনে জগ অনেকবার এসেছে, বংশীর সাথে বা বাবার সাথে। এলাকাটা বড় নয়, মাটির টানা বারান্দা, লাগোয়া পাশাপাশি কিছু ঘর। সামনে বেশ অনেকটা খোলা জায়গা, উঠোনের মত, রাংচিতের বেড়া ঘেরা। বাড়ির পেছনদিকে কিছুটা জমি, সেখানে মিশনের সবজি চাষ হয়। বেড়ার বাইরে সামনের দিকে একটা মাঠ, সেখানে ফুটবল ভলিবল ইত্যাদি খেলা হয়, শরীরচর্চা শেখানো হয়। প্রথমে কিছু অনাথ ছেলেদের জন্য একজন স্বামীজী কোথা থেকে এসে যেন মিশন শুরু করেছিল। হরিপুরের কাঠগোলার মালিক সামন্তদের কোন কত্তার সঙ্গে তাঁর কোথায় আলাপ হয়েছিল। সামন্তরাই এই মিশনের জমিটমি দান করে মিশন বসিয়েছিল।
    সেই স্বামীজী মারা গেছে অনেককাল, এখন তার শিষ্য একজন আছে, বড় মহারাজ, তিনিই কর্ণধার। এমনিতে মিশনের স্বামীজীরা সাধারণ লোকেদের মতই জামাকাপড় পরে, ধুতি চাদর। গেরুয়া টেরুয়া পরেনা,তাই কাউকেই ঠিক গাঁয়ের সাধারণ লোকেদের থেকে আলাদা মনে হয়না। এখন মিশনে গরীব খেটে খাওয়াদের জন্যে সন্ধ্যেবেলায় বয়স্ক শিক্ষার আসর বসে। ছেলেদের খেলাধুলা করানো হয়, সকালে মেয়েদের সেলাই, হাতের কাজও শেখানো হয়। হরিপুর ও আশেপাশের গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে এসে মিশনের নানা কাজ করে দেয়, জগও এসে করেছে।
    সামন্তদের এখন আর আগের অবস্থা নেই, তবু চার গাঁয়ের লোকেরা যে যেমন পারে মিশনে সাহায্য করে । জগর বাবাও প্রতিবছর ধান উঠলে এক বস্তা ধান আর আলু মিশনে দিয়ে যায়। এমনিতে জগ এদের ধর্মকর্মের ব্যাপারে সেরকম কিছু জানেনা। মন্দির নামে একটা ঘর আছে, তাতে ঠাকুর দেবতার মূর্তি নেই, মহারাজের ছবি, তার খড়ম, বইখাতা আছে। সেখানেই এরা সকাল সন্ধ্যে একত্তর হয়ে নাম গান আর কীকীসব করে। মহারাজের জন্মদিনে প্রত্যেক বছর চব্বিশ পহর হয়। তখন আশপাশের চার গাঁয়ের লোকের সাথে এসে জগ বংশীও হরির লুটের সাথে নেচে ও কলাইয়ের ডাল আর বীচেকলার ঘ্যাঁটের ভোগ খেয়ে যায়।

    উঠোনের মাঝখানে একটা বটগাছ, তার গোড়াটা বাঁধানো। এতটা হেঁটে এসে ক্লান্ত পঞ্চু বাঁধানো বেদীর ওপর বসে হ্যা হ্যা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকল।
    জগর অবশ্য ক্লান্তিটান্তি নেই তবে সে কিঞ্চিত ভেবলে আছে। কানা পঞ্চুর সঙ্গে মিশনের সম্পর্কটা সে ঠিক মেলাতে পারছেনা। চারিদিকে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা, ছেলেরা এইসময় ইস্কুলে চলে যায়। মহারাজরা হয় ঘরে নয় হাটে বা জমিতে কাজে ব্যস্ত থাকে।
    জগ কানার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে এমন সময় মন্দিরঘর থেকে বড় মহারাজ বেরিয়ে এল সঙ্গে রবিদা বা রবি মহারাজ। রবিদা বড় মহারাজের কেমন আত্মীয় হয়। তাকে জগদের মত ছেলেরা খুব ভালোবাসে, খেলাধূলায় দারুন, খুব মজার আমুদে মানুষ। আজকে কিন্তু দুজনেরই মুখ গম্ভীর, জগদের দিকে চোখ পড়তে দুজনে উঠোনে নেমে আসে। পঞ্চুর দিকে তাকিয়ে বড় মহারাজ ধমকের সুরে বলে,
    -"কী ব্যাপার, খুড়ো তুমি এখেনে কেন? এত সকালে?"
    জগ দেখে খুড়োর এতক্ষণের হাঁকডাক সব গায়েব, হাহাকারের স্বরে বলে,
    -"আপুনি তো আমারে জানেন, আমি কোনোদিন কিছু করিনি। কিন্তু সবার সন্দেহ আমার ওপরেই।"
    মহারাজ একটু নরম হয়ে বলে,
    -"কী মুশকিল! কিসের সন্দেহ? কী হয়েছে খুলে না বললে বুঝব কেমন করে। যদি কিছু নাই করে থাক তাহলে এত ভয় কিসের?"
    এবার গলা ছেড়ে হাউমাউ করে বলে কানা,
    -"রাধামাধবের চুরি নিয়ে আমাকে সন্দ করছে সবাই। বোসপাড়ার বাস উঠলে আমি যাব কোথা!"
    এবার রবি বলে,
    -"চুরি তো শুধু রাধামাধবের মন্দিরে হয়নি, বড় চুরিটা তো কাল হয়েছে বোসেদের গদিতে। এই তো আমি বাজারে গিয়ে শুনে এলাম। তুমি জাননা?"
    পঞ্চু হাঁ করে থাকে, বুঝতে পারেনা। জগও অবাক, বলে কী রবিদা, আরও একটা চুরি!

    বড় মহারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে জগ, খবরটা সত্যি আর তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল বলেই বোধহয় দুজনে গম্ভীর।
    -"খুড়ো, লোকে বলছে গদির চুরিটা কিন্তু সেই পীরচকের শেঠেদের দোকান চুরির মত। আমি থানা হয়ে এলুম, রাম তোমাকে ধরে আনতে রওনা হয়েছে। এছাড়া আরও চারধারের সঙ্গে তোমার চালাও তল্লাশি করতে লোক পাঠিয়েছে।"
    পঞ্চুর কাশি শুরু হয়ে গেছে, সে মুখ চেপে হাত নেড়ে না না করতে থাকে। জগর রাম দারোগার বুদ্ধির ওপর অবিশ্বাসটা ঈষৎ নাড়া খেল। রেমোদাও তাহলে পুখুড়োকেই সন্দেহ করছে।
    সে আর চুপ থাকতে পারেনা,
    -"হ্যাঁ রবিদা, এই পঞ্চু খুড়োর ঘরে দুদিন আগে গভীর রাতে কে বা কারা এসেছিল, বংশী নিজের চোখে দেখেছে।
    পঞ্চুর কাশি থেমে গেল, দুই মহারাজও এতক্ষণে প্রথম ভালো করে জগকে খেয়াল করল। বড় মহারাজের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে রবি বলে,
    -"জগ, গগন মাইতির ছোট ছেলে। বংশী ওর বন্ধু, অনঙ্গ বোসের ভাইপো।"
    -"হুঁ, এরে তো দেখেছি, চিনি। বংশীকে ঠিক মনে পড়ছেনা, দেখলে পড়বে। তা পঞ্চুদা, এ কী বলে, কারা এসেছিল তোমার ঘরে?"
    পঞ্চু একটু থতমত খেয়ে যায়, জগর দিকে বিষদৃষ্টি হেনে বলে,
    -"মহারাজ, এই ছেলেটা সকাল থেকে আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। কীসব বলছে তার মাথামুন্ডু নেই, মহা শয়তান ছেলে। বাবুর বাড়ির বংশীটাও এর পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাচ্ছে। পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা, যত কুচিন্তা। এদের কথা ধরবেননি, সারা গাঁ জানে এরা কেমন!"
    বড় মহারাজ মুখটাকে কঠিন পাথরের মত করে বলে,
    -"সারা গাঁ তো তোমায় নিয়েও অনেক কথা বলে পঞ্চুদা। রামচরণ এতদিন কোনো ব্যাপারে তোমাকে ধরেনি, আগের দারোগাদের মত। আজ হঠাৎ সে তোমাকে খুঁজছে কেন? তুমি এখান থেকে থানায় যাও, দারোগা কী বলে শোনো। তার সব প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দাও।"

    কানা ইনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করতে থাকে, সে কিছু জানেনা, কিছু করেনি। জগ পঞ্চুর কথা গায়ে মাখেনা, একে কানাবুড়ো তায় হয়ত চোরেদের লোক, ওর কথা কে ধরে!

    -"কিন্তু খুড়ো তোমাকে আমি মন্দির চুরির ব্যাপারে জিগাতে তুমি এই মিশনের দিকে হাঁটা দিলে কেন? তুমি তো তখন জানতে নি রেমোদা তোমারে ধরতে আসছে।" প্রশ্নটা কানাকে উদ্দেশ্য করে করলেও, উত্তরের আশায় সে তাকায় মহারাজদের দিকে। দুজনেই একটু যেন অপ্রস্তুত, জগ ভাবে, কেন? কানা ভিখারীর সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক?
  • শ্রাবণী | 69.94.98.211 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৫৫449721
  • ***********************************************
    বাসরাস্তা থেকে মাঠে নেমে বেশ খানিকটা আলে আলে হাঁটার পর সুলতানপুর দেখা যায়। দুখে পায়ে হেঁটে হরিপুরে এসে ছেলের সাইকেলটা চেয়ে নিয়েছিল। সে ভালো চালাতে জানেনা, তাই এবড়ো খেবড়ো আলপথে সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছিল। এদিকের জমিতে ধান কাটা পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে, মাঠে চারিদিকে লোক, তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল মজিদের বাড়ির হদিশ। সোজা আড়াঅড়ি মাঠ পেরোলেই একটা পুকুর পড়ে, তার বাঁপাড় ধরে কিছুটা গিয়ে, ডানদিকের সরু রাস্তা ধরে হাঁটলে মসজিদ। মসজিদের পিছনে শাপাড়ায় মজিদের বাড়ি।
    দুখে এর আগে কোনোদিন মজিদকে দেখেনি, মজিদ যার কাছে কাজ শিখেছে পীরচকে সেই মধু কামার দুখের বন্ধুলোক। মধুর কাছেই শুনেছে মজিদের কথা, ছেলেটার হাত নাকি খুব ভালো কিন্তু স্বভাব মন্দ। ছোটোবেলা থেকেই হাতটান ছিল, মধুর দোকানে এটা ওটা সরাত। আগে অত গা করেনি কিন্তু একটু বড় হয়ে টাকার বাক্সে হাত দিতে মধু আর তাকে দোকানে রাখেনি। পরে খবর পেয়েছে মজিদের কাজকারবার ভালোই চলছে। সাধারণ কাজকম্মের সাথে সে গোলমেলে লোকেদের সাথে জড়িয়ে পয়সাকড়ি ভালো উপায় করছে।
    অঘ্রানের মিঠে রোদে ঝিরঝিরে হাওয়া গায়ে মেখে মাঠে হাঁটতে বড় ভালো লাগছিল। মাঠ থেকে উঠে পুকুরপাড়ে পা রেখেছে, একটা কালো মত লোক, মাথায় ঝাঁকড়া রুক্ষ চুল,পরনে লুঙ্গি, কোমরে লাল গামছা বাঁধা, হাতে নিমের দাঁতন নিয়ে কোথা থেকে যেন ভোজবাজির মত সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটার বয়স বেশী হবেনা, দুখের ছেলের চেয়ে কবছর বেশী হবে। দুখেকে আপাদমস্তক দেখে, দাঁতন চিবুতে চিবুতে বলে,
    -"কত্তা তো দেখি এ গাঁয়ের লোক নয়, তা মজিদের ঘর যাবে তো, কোত্থিকে আসা হচ্ছে? "
    গাঁয়ে এভাবেই খবর রটে, সন্দেহ নেই সে সুলতানপুরে ঢোকার আগেই তার আসার খবর সবাই জেনে গেছে। দুখে এমনিতে সাদা মনের বোকাসোকা মানুষ। সরীপিসী পইপই করে বলে দিয়েছে চারিদিক দেখেশুনে পথ চলতে আর মজিদের সঙ্গেও রেখেঢেকে কথা বলে আসল কথাটা বার করে নিতে। কোমরের গেঁজেতে তার মন্দিরের চাবি ফুটছে,
    -"আসছি ঐ পূব গাঁ থে। এট্টু দরকার ছিল মজিদের সঙ্গে, একই কাম কিনা আমাদের।"
    -"মজিদ তো আজ পীরচকের হাটে, তারে ঘরকে পাবে নাই।"
    দুখে হতাশ, তবু একেবারে হাল ছাড়েনা। কথা না বাড়িয়ে বাঁ দিকের পাড়ের রাস্তা ধরে,
    -"যাই একটুস তার ঘরে গিয়ে দেখি। বেলা তো হয়ে এল, হয়ত হাট থে ফিরে পড়বে, বসে যাই কিছুক্ষণ।"
    লোকটি খ্যা খ্যা করে থুতু ফেলে বলে,
    -"যাও, তবে পীরচকের হাট রাত অবধি চলে আর মজিদের মা খান্ডারনী।"

    মজিদের মাটির একঢালা ঘর, ঘরের লাগোয়া ডোবার ধারের চালায় কামারশাল। ঘরের সামনের উঠোনে দুটো মুর্গি ঘুরছিল, এছাড়া চারধার নির্জন। দুখে ডাকাডাকি করতে একজন বুড়ো মানুষ বেরিয়ে এল,
    -"কত্তা, মজিদ কই?"
    বুড়োটি কিছু বলার আগেই ওদিকের রান্নাদুয়ারের আড়াল থেকে খ্যারখেরে এক গলার আওয়াজ এল,
    -"মজিদ ঘরকে নেই। ফিরতে রাত হবে।"
    -"না একটু দরকার ছিল, বসে যাই?"
    -"আ মর জ্বালা। বলি কানে কালা নাকি? রাত অবধি ঘরে বসিয়ে রাখব, কোন আমার কুটুম এলে গা! যাও যাও, দেখা হবেনি।"
    দুখে বুঝল এই মজিদের মায়ের গলা। বুড়ো লোকটি বাপ হবে, সে সভয়ে রান্নাদুয়ারের দিকে একবার আর একবার দুখের দিকে তাকাতে তাকাতে কামারশালে গিয়ে বিড়ি ধরিয়ে উল্টোদিকে মুখ করে বসে।

    কথা না বাড়িয়ে দুখে ফেরার পথ ধরে। রাস্তায়, পুকুর পারের সেই লোকটা আর চোখে পড়েনা। কী করবে বুঝতে পারেনা, ঠাকরুন একটা কাজ দিল, সেটাও সে করতে পারল না। শেষমেশ হরিপুরে এসে সাইকেল রেখে বাস ধরে পীরচকের হাটের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
    পীরচক বাসে গেলে বেশী দুর নয়, কয়েকটা মাত্র স্টপেজ। বাসস্ট্যান্ডে নেমে হাটবারের ভিড় কিছু তেমন চোখে পড়েনা। যদিও দুখের তেমন নিয়মিত যাতায়াত নেই এখানে, তবু এটা জানে যে নদীর ধার বলে জেলায় পীরচকের গুরুত্ব অনেক,মালের নৌকা ছাড়ে এখান থেকে।
    হাটের দিনে দুর দুর থেকে ব্যাপারীরা আসে, জমজমাট কান্ড। অবশ্য শোনা কথা, দুখে নিজে কোনোদিন পীরচকের হাটে আসেনি এর আগে।
    আজ সেরকম কিছুই নেই, বেলা বাড়লে হরিপুরের রোজকারের বাজারে চিত্রটা যেমন হয় তেমনিই। দু চার জায়গায় ছাড়া ছাড়া ভাবে ঝাঁকা নিয়ে কেউ কেউ বসে আছে। নদীর পাড়ও ফাঁকা শুনশান, কাঠগোলাগুলোতে ব্যস্ততাও এখন স্তিমিত। বাসস্ট্যান্ডের এদিকে কিছুটা এলাকা জুড়ে অবশ্য দোকানপাট গদি ইত্যাদি মিলে গ্যাঞ্জাম হরিপুরের থেকে বেশী। সে তো সবসময়ই হয়, হাটবার বলে আলাদা কিছু নয়। এত তাড়াতাড়ি হাট ভেঙে গেল, পীরচকের মতো জায়গায়?

    এতটা পথ এসেছে, ঘোরাঘুরিতে ক্লান্তও বটে, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত খুঁজে বেড়িয়েও মজিদ ছেড়ে কোনো কামারেরই দেখা পেলনা। নদীর ধার ধরে কিছুটা গেলে মজিদের গুরু মধু কামারের ডেরা। দুখে সেইদিকেই হাঁটা দিল, সেখানে জল খেয়ে দুদন্ড জিরিয়ে তারপর এসে ফিরতি বাস ধরা যাবে।
    বয়স হয়ে থেকে বাতের অসুখে ভুগে ভুগে মধু আজকাল কাজের দিকে তেমন মন দিতে পারেনা। একটা ছুটকো সহকারী আছে, তাকে নিয়ে ছোটখাটো কাজকম্ম করে কোনোরকমে চলে যায়। দুখেকে দেখে সে খুশী হয়, বন্ধু লোক, অনেকদিন পরে এল।
    -"আজ কেন হাট বার হবে? এখানে হাট বসে তো রোববারে, সবাই জানে। তা হরিপুর ছেড়ে পীরচকের হাটে কেন?"
    দুখে সুলতানপুরের কথাটা বলেনা, একটু লজ্জামত হয়। হরিপুরে বাসে ওঠার আগে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে খোঁজ করলেই জানতে পারত পীরচকের হাটবার। মজিদের প্রসঙ্গ তুলতে মধু বলে,
    -"তাকে এদিকপানে অনেকদিন দেখিনি, লায়েক বাবু সে, তার ঘরেই কত ব্যবসা,হাটে হাটে মাল ফিরি করে বেরাবে কেন!"
    মধুর ছেলেটা জল বাতাসা নিয়ে আসে, খেয়ে ঠান্ডা হয়।
    মধু হাপরে বিড়ি ধরায় নিজের আর দুখেরটাও। সেইদিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কে কী যেন ভাবে দুখে। কী যেন একটা কথা মনে আসতে আসতেও ঠিক এলনা!
  • শ্রাবণী | 69.94.98.211 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২৩:১২449722
  • ***********************************
    কড়িরাম এখন সেই যাকে বলে রিটার করে অবসর জীবন কাটাচ্ছে। ছেলে আর জামাই দুজনকেই সে নিজে হাতে তৈরী করেছে। রাধামাধবের কৃপায় তাদের ভালো নামডাকও হয়েছে চোরমহলে। অনেক ভেবেচিন্তে জামাইকে সে নিজের কাছে রেখেছে আর ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে ছেলের শ্বশুরবাড়ীতে। এটা অবশ্য এ গাঁয়ের লোকে জানেনা।
    এতদিনের অভিজ্ঞতায় কড়িরাম সার বুঝেছে যে নিজের গাঁয়ে চুরি করে উন্নতি করা খুব কঠিন। চেনাজানার মধ্যে চুরি করা যেতনা, কর্তারা একঘরে করার ধমকি দেয়। বন্ধুলোকেরা চুরি অন্যলোকে করলেও তার কাছে এসে পড়ে, জিনিস উদ্ধার করেদেওয়ার জন্যে। একটু বয়স হয়ে গেলে রোজ রোজ দুরে গিয়ে চুরি করাও অসুবিধে। শেষমেশ তার মত বড় চোরকে ছিঁচকে চুরি করে দিন কাটাতে হচ্ছিল, পুকুরের মাছ, খেতের মূলোটা এইসব। তাই সে ছেলের শ্বশুর,বন্ধু নরহরির সঙ্গে পরামর্শ করে এই ব্যবস্থা করেছে। তার জামাইকে এগাঁয়ে কেউ তেমন চেনেনা, সে রাতেই বেরোয়। আর সবাই জানে কড়ির ছেলে বলরাম এ গাঁয়ে থাকেনা।
    আজকাল চুরিটুরি হলে কড়ির বাড়ি আর দৌড়য় না কেউ। বড়জোর তাকে ডেকে পরামশ্যি নেয়, চুরির রকম দেখে কার কাজ ইত্যাদি জানতে চায়। মোটের উপর কড়িরাম এখন মহাশান্তিতে আছে, এদিকে গেরস্থদের পরামশ্যি দিয়েও কলাটা বেগুনটা আয় হল আবার নতুন নতুন চোরেরা এসে তার কাছে শিক্ষা নিয়ে যায় টাকাটা আনাটা দিয়ে।

    সরীঠকরুনের বাড়ির পিছনে ডোবা মত পুকুরটা ছোট হলে কী হবে, মাছ ভালৈ হত। সেই ঠাকুদ্দা যখন বেঁচে ছিল তখন থেকেই, বিষ্টুর বাপ চারা ছাড়ত ফি বছর। পুজোপাব্বনে পুকুরের মাছেই বড় কাজগুলো হয়ে যেত। কড়িরাম যবে থেকে বাইরে বেশী বেরোতে পারেনা তবে থেকে এই পুকুরটার ওপর তার নজর। একানে মাঠের ধারের ঘর, পুকুরপারের ওদিকটা নিরিবিলি। আসতে যেতে ছাঁকনি জাল ফেলেই বড় মাছ ধরে ফেলত।
    রোজ রোজ রাখাল বিষ্টুর নালিশ শুনে বিরক্ত হয়ে শেষে সরীঠাকুমা কড়িরামকে ডেকে তার কাছেই পুকুর জমা দিয়ে দিল। কড়িরাম নেবেনা, ঠাকুমাও ছাড়বেনা, শেষে কড়িকেই হার মানতে হল। সেই থেকে ঐ পুকুর চাষ করে কড়িরাম চোর। নগদ কিছু টাকা সম্বচ্ছরে পায় ঠাকুমা আর মাঝেসাঝে মাছ পায়, মেয়ে এলে অথবা পালেপাব্বনে।
    শরীরগতিক ঠিক থাকলে সন্ধ্যের দিকে এসে পুকুরটাও দেখে যায় আর ঠাকরুনের কাছে বসে একটু সুখদুখের গপ্প করে যায়।
    আজও এসেছে, সরী ঠাকুমা তাকে চাবি নিয়ে খটকার কথাটা বলে। দুখে ফিরে এসেছে, মজিদের দেখা পায়নি। কথার মাঝে হাজারি বাগ এসে পড়ে, সন্ধ্যে হয়ে গেলে সে এই দিক দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরে, মাঠ দিয়ে যায়না। সে ঠাকুমাকে খুব মানে, ঠাকুমাও হাজারিকে খাতির করে,বাপের বাড়ির মুনিষ যতই হোক। তার কাছ থেকে ওবাড়ির খবর পায়।

    -"ওঃ, পাড়ায় কী সব যে কান্ড হচ্ছে দিদি, কিছুটি বুঝতে পারিনি।"
    -"আবার কী হল রে হাজারি?"
    -"এই দেখুন না, সকালে ঘুঁটের বস্তা রাখতে গিয়ে দেখি আর একটা বস্তা আগে থেকে রাখা আছে, কাঠকুটো পাতা ভত্তি। কোথা থেকে এল খাঁদিদিদিও জানেনি। সকাল থেকে গোয়াল ঘর ছাওয়ার কাজে লেগেছিলাম দুজন মজুর নিয়ে, মন্দিরেরও কাজ হচ্ছিল ফাঁকে ফাঁকে। বিকেলেও ছিল বস্তাটা। এখন সন্ধ্যেবেলা ঘাটে হাতপা ধুতে গিয়ে ভাবলুম খালি করে ঘর নিয়ে যাই, আর এক বস্তা ঘুঁটে এনে আগাম রেখে দেব। তা কয়লার ঘরে গিয়ে দেখি সে বস্তা নেই।
    গিন্নীমাকে বলতে বলে, "তোর বড় ভুলো মন হয়েছে হাজারি। কখন কী দেখিস কিছুই মনে থাকেনা"। তা কড়িদা কিছু জান নাকি? তুমি তো আজকাল ছোটখাটো জিনিসই নাও শুনি?"

    কড়ির একটু আঁতে লাগল, সে মাঝেসাঝে অভ্যেস রাখতে খেতটেত থেকে টুকটাক জিনিস সরায় বটে। তাবলে এত খাটনি করে কুটোর বস্তা সরাবে, এত নীচু নজর!
    সরীঠাকুমা দুজনকে থামিয়ে দেয়, বস্তার ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছেনা, তবে বড়বৌ বলে বটে আজকাল হাজারির খুব ভুলো মন হয়েছে।
    -"ও, কড়িঠাকুরপো, দু দুটো চুরি হয়ে গেল, তোমার কাছে কোনো খবর নেই?
    -"খবর সেরম কিছু নেই বৌঠান। পুলিশ প্ঞ্চুদার খোঁজে এসছেল। শেষমেশ পঞ্চুদাকে নিয়ে মিশনের মহারাজরা থানায় গেসল।"
    -"দাঁড়াও, পঞ্চু লোকটা গোলমেলে বটে তবে রাধামাধবের মন্দিরে চুরি করাবে, এত সাহস? কিন্তু সে থানায় গেল কেন?"
    বিষ্টুর বৌ সবাইকে মুড়ি আর চা দিয়ে গেল। এক গাল মুড়ি মুখে ফেলে চায়ে চুমুক দেয় কড়িরাম।
    -"পীরচকের শেঠেদের দোকানেও যে এমনটাই চুরি হয়েছিল সাঁঝের বেলায়। বৌঠানের তো মনে থাকবে, দাদা তো শেঠেদের বন্ধুলোক ছিল। অত টাকা চলে গিয়ে, বুড়ো শেঠের মনোবলই ভেঙে গেল, বিছানায় পড়ল। শেষটায় ছেলেরা ব্যবসা গুটিয়ে কলকেতা চলে গেল।"

    ঠাকরুনের স্মৃতিশক্তি ভালৈ, তার মনে আছে সেই চুরির কথা। শেঠেদের বড় ছেলে সদরে গেসল, দোকানে অনেক টাকা ছিল সেদিন আদায়ী ইত্যাদি,নতুন কাপড়ের গাঁটরিও এসেছিল। সদর থেকে ছেলেটার বিকেলেই ফেরার কথা, বাস অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে সে ফিরতে পারেনি সময়ে। এদিকে বাড়ির অন্য ছেলেরা অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে,দৌড়াদৌড়ি করছে, বাড়িতে কান্না পড়ে গেছে। ঠাকুর্দাও সেসময় সেখানেই ছিল, শেঠেদের বাড়িতে। টাকার কথা ছেলে ছাড়া বুড়ো শেঠ শুধু জানত। তার তখন ছেলের চিন্তায় মন খারাপ, দোকানের টাকার কথা খেয়াল নেই। পঞ্চু সন্ধ্যেয় দোকান বন্ধ করে চলে যায়।
    সকালে বাস চলতে ছেলে ফিরে আসে, সব চিন্তার অবসান হয়ে যখন টাকার কথা খেয়াল হয় তখন দেখা যায় টাকা উধাও। শুধু তাই না মালপত্রও সব গিয়ে দোকান ফাঁকা। পাকা দেওয়ালে ইঁট সরিয়ে সিঁদ কেটে রাতভর মাল সরিয়েছে।
    সেইসময় পীরচকের আরো কয়েকটা দোকানে চুরি হয়েছিল পরপর ওর আগেই, সেসবে সাথে পঞ্চুর সম্পর্কের কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ। তাই পঞ্চু র বিরূদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে শেঠেরা ওকে আর চাকরিতে রাখেনি।

    -"আমার মনে আছে, তোমারও মনে থাকার কথা। কর্তা বলত, পঞ্চু তখনই নেশা ভাঙ করত, ওর বৌ মরার পর থেকে। পুলিশ মনে করেছিল যে নেশার ঝোঁকে কোনো আড্ডায় বসে টাকার কথা বলে দিয়েছিল। চোরেরা সেইমত কাজ করে, সেসময় একটা দল পরপর ওখানে চুরি করছিল, তারা হয়ত আশেপাশে ছিল, সুযোগ নেয়। পঞ্চু সরাসরি দলে ছিল বলে কর্তা মনে করত না। তা তুমি জাননা সেই চোরের দলের খবর, সেইসময় তুমি তো এদিকের চোরেদের পাণ্ডা!"
    -"ও বাইরের লোকের কাজ ছিল, সে তো পুলিশও জানত। আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলুম গাঁয়ের লোক, থানার লোকেদের সাথে, খুঁজে পাইনি। শেঠেদের চুরির পর থেকেই সব ভোজবাজির মত উবে গেসল। তবে দল ছিলনি, আমার তখন মনে হয়েছিল এ এক বা দুই লোকের কান্ড।
    দল থাকলে কোথাও না কোথায় কিছু না কিছু ধরা পড়ত, অন্তত আমাদের চোরেদের কাছে। পঞ্চুদাকে সেসময় তো লোকে অনেক ধরেছিল কিন্তু সে বরাবর বলে গেছে যে সে কাউকে বলেনি টাকার কথা।
    গগন মাইতির ছোট ছানাটা, ঐ জগ, সে ছিল থানায় পঞ্চুদার সঙ্গে। শুনছি বড়বাড়ির বংশী নাকি রাতবিরেতে কিসব দেখেছে, জগ বলেছে। পঞ্চুদা কিছুতেই মানছেনি। কর্তাদের কথায় পঞ্চুদা আর কানাইকে আজ ছেড়ে দিয়েছে দারোগা, তবে নাকি নজর রাখবে বলেছে।"

    হাজারি এতক্ষন চুপ করে চামুড়ি খাচ্ছিল, কড়ির কথায় বলে ওঠে,
    -"টাকাপয়সা চুরি হয় জানি কিন্তু কুটোর বস্তাও। এরপর হয়ত বড়বাড়ির ছেলেপিলেরাও চুরি হয়ে যাবে, ও কড়িদা!"
    -"বালাই ষাট, সন্ধ্যেবেলায় অলুক্ষুনে কথা বলিসনি তো। তুই কী দেখতে কী দেখেছিস কে জানে। হ্যাঁ কড়ি, ঐ জগ টাই সেই গগনের হাড় জ্বালানো ছেলেটা নয়?
    ওর মা সেবারে ঢেঁকিতে পাড় দিতে এসে কত দুঃখ করল। ছোঁড়াটা কোনো কাজ করেনা, শুধু অকাজ করে বেড়ায়। আমাদের বংশীটা আবার তার ভক্ত হনুমান।
    হাজারি, একটু ওবাড়ি গিয়ে বংশীকে ডেকে আন, শুনি সে কী দেখেছে। আর তুমি একটু চোখকান খোলা রাখো, দুটো দিন চেলাদের বল রাতে সজাগ থাকে। আজকাল কী সব চোর হয়েছে গাঁয়ে, কিছু খবর রাখেনা। ছিল সে তোমার বাপ পাঁচকড়ি খুড়ো, বাপ কাকার কাছে বেত্তান্ত শুনেছি, বাইরের চোরের সাহসই ছিলনা এই গাঁয়ে পা দেবার।"

    কড়িরাম এ ভর্ত্সনা শুনে মিন মিন করে বলতে গেল সে এখন রিটার করেছে, প্রাক্তন চোর।
    সরী ঠাকুমা সে শুনে এমন চোখ পাকালো যে এককালের জাঁদরেল চোর কড়িরামও চুপ মেরে যায়।
    হাজারি বংশীকে ডাকতে গিয়ে জগকেও পেয়ে যায়। আজ সন্ধ্যেয় জগ বংশীর ঘরে, বেলায় ঘর ঢুকে বাপের কাছে বেধড়ক খেয়েছে। বড় হবার পর এমন মার সে কোনোদিন খায়নি, অনভ্যাসের দরুন গায়ে বেদনা, মেজাজও খারাপ। বাড়ি ছেড়ে তাই সে বন্ধুর ঘরে এসে বসে আছে। ঠাকুমা ডাকছে শুনে বংশী জোর করে বন্ধুকেও তার সাথে নিয়ে চলে।

    -"এই হনুমান দুটো, কী দেখেছিস রে তোরা পঞ্চুর চালায় রাতের বেলায়? জগ, তুই কী বলেছিস থানায়, রেমো হতভাগার কাছে?"
    বংশী জানে বড় পিসীমাকে তার বাড়ির সকলে ভয় পায়। সেও ছোটবেলা থেকে সরীপিসীকে ভয় পেয়ে এসেছে। তবে পিসী ডেকে বকে যেমন আবার ভালো ভালো খাওয়ায়ও, বিশেষ করে বাড়ির ছেলেদের। জগ জানে গাঁয়ের লোক ঠাকুমাকে খুব সমীহ করে, তার মাবাপ ও পরামর্শের জন্যে এর কাছে আসে। তবু সে কখনো সেভাবে সরী ঠাকুমাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেনি। সে ভয়ও পেলনা, বিশেষ পাত্তাও দিলনা। তবে নিজে চুপ রইল,যা বলার বংশীকেই বলতে দিল, দেখেছে তো বংশীই।
    হাজারি এদের ডেকে দিয়েই চলে গিয়েছিল, কিন্তু কড়িরাম তখনো বসে ছিল। সরী ঠাকুমা অর্ধেকটা শুনেই কড়ির দিকে তাকায়। তারপরে একটু কঠিন স্বরে বলে,
    -"এগাঁয়ের চোরেদের রমরমা আর আগের মত নেই সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তবু আশাকরি তোমরা এতটা অকর্মণ্য হয়ে পড়নি যে দুদিন আগে রাতে এ গাঁয়ে বাইরের লোক ঢুকেছিল সে সম্বন্ধে খবর বার করতে পারবেনি।"
    কড়িরাম শ্লেষ গায়ে মাখেনা, বরং তাকে বেশ চনমনে দেখায়।
    -"না, একাজ হয়ে যাওয়া উচিৎ। ঐসময় তো কৃষ্ণপক্ষ চলছিল, কাজেকর্মে সুবিধের সময়। নির্ঘাত আমাদের লোক বেরিয়েছিল, কেউ কিছু নিশ্চয়ই দেখেছে। এইটা তো আগে জানা ছিলনা, সেইজন্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আজই খোঁজ নিচ্ছি।
    -"হ্যাঁ যাও, খোঁজ নাও। আর তোরাও যা, কিছু দেখলে সেটা নিয়ে ঢোল পিটোতে বেরোস নি। চুপিচুপি বড়দের কাউকে বলবি,এই আমাকেও বলতে পারিস।"
    জগ আর বংশী গজগজ করতে করতে বেরোয়, তারা ঢোল পিটোতে যায়নি। পাকেচক্রে ঢোলে কাঠি পড়ে গেছে। কড়িরামও ওঠে। যেতে যেতে শুধু এটুকুই বলে,
    -"তবে খটকা যা লাগছে তা হল, এই কদিনের মধ্যে বাইরের লোক ঢুকেছে দেখলে কেউ না কেউ বলত। অন্তত পরশু মন্দির চুরির কথা শুনে কারুর না কারুর টনক নড়ত। সেরকমটা হয়নি মানে কি কোনো চেনা লোক এসবে আছে? খুব গোলমাল লাগছে বৌঠান। খুব গোলমাল লাগছে।"
  • de | 213.197.30.4 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১১:৪৫449723
  • বাঃ শ্রাবণী -- সুন্দর হচ্ছে, চলুক, চলুক!
  • ঐশিক | 213.200.33.67 | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১০:৩৩449724
  • ওফফ,
    শ্রাবনীদি ,
    মন কেমন করা আর শীর্ষেন্দুর পূজা বার্ষিকীর গল্প মনে করিয়ে দেওয়া লেখা, ছেলেবেলা ফিরিয়ে দেবার জন্যে ধৈন্যযোগে,
    সোনার কলম আপনের হবেই হবে। জানি ব্যস্ততা আছে তাও অনুরোধ একটু নিয়মিত এই গলপটা এগিয়েনিয়ে গেলে খুউউব ভালো লাগত
  • নেতাই | 131.241.98.225 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৪:১১449725
  • এই টইটা আগে পড়িইনি!!!!!!!!
    শ্রাবণীদির গল্পের ডিটেলগুলো অসাধারন।
    শারদীয়ার এমনি গল্প উপন্যাসের থেকে দিব্যি ভালো।
    জ্জিও।
  • শ্রাবণী | 69.94.96.181 | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২০:৪৫449726
  • এত বড় কথা!
    নিতাইকে ভাবছি পুজোসংখ্যাগুলো গিফট করব!
    ঐশিক, আমি তো শুরু করলে ঠিক শেষ করি, সময় বার করে। তাই না?
  • nina | 78.34.167.250 | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৬:০৪449727
  • শ্রাবণী
    এ তো বড় খাঁটি কথা--বলেছে নেতাই----পূজোসংখ্যার গল্পগুলো সব আজকাল কি বোরিং , কিম্বা কি ম্যাড়ম্যাড়ে-----
    তাচ্চেয়ে এই টই বারবার পড়ার মতন!
  • aranya | 78.38.243.161 | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৮:৪৪449728
  • আগে বলেছি কিনা মনে পড়ছে না, দূর্দান্ত গল্প, এত এত ভাল লেখা, জাস্ট কিছু বলার নেই।

    চটির কনটেন্টের ব্যাপারে গুরু-র পলিসি কি জানি না, তবে শ্রাবণীর কিছু গল্প নিয়ে চটি বেরোলে খুব খুশি হব।
  • শ্রাবণী | 69.94.96.137 | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২০:৩৩449729
  • অন্ধকারে পুকুরপার দিয়ে মোয়ানের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়েছে কড়িরাম, এমন সময় পেছন থেকে ডাক, "কড়িকাকা, ও কড়িকাকা, একটু দাঁড়ে যাও।" কড়ি দাঁড়িয়ে গেল, মনে হচ্ছে বিষ্টুর গলা। আবার কী হল!
    -"কাকা, তোমার এখন বাড়ি ফিরা হবেনি। জেঠিমা কয়ে দিল।"
    -"ক্যান রে, কী হল? বৌঠান ডাকে নাকি?"
    -"না ঘর যেতে হবেনি। আমাদের দুজনকে কুটোর বস্তা খুঁজে বের করতে বলল।"
    কড়ি অন্ধকারে বিষ্টুর মুখ দেখতে পেলনা, কেমন সন্দেহ হল, মশকরা করে নাকি! পরক্ষণেই নিজের মাথা থেকে চিন্তাটা বার করে দিল। বিষ্টু অমন ছেলে নয়, নেহাতই বোকাসোকা ভালোমানুষ, খাটিয়ে ছেলে। কুটোর বস্তা, মানে হাজারি যে বস্তার কথা বলছিল সেটা? তখন তো সরী ঠাকরুন হাজারির কথায় তেমন কান করছিল বলে মনে হচ্ছিল না। হঠাৎ এই ক মিনিটের মধ্যে কুটোর বস্তার খেয়াল চাপল কেন?
    -"ঠান্ডায়,এই রাত্তিরে কুটোর বস্তা খুঁজতে বলল কেন? কাল খুঁজব খন, এখন ঘর যাই, খিদা লাগছে।"
    -"না কাকা, সেইটি হবেনি। জেঠিমা পইপই করে বলে দিয়েছে আজই খুঁজতে।"
    -"এখন কুথায় খুঁজব, কেমন বস্তা তাই তো জানিনি।"
    -"ও হ্যাঁ, বলল এই পাড়াতেই খুঁজতে। এখানকার তল্লাশি তো হয়ে গেছে, তাই বস্তাটা হয়ত এখন এখানেই আছে। যত রাতই হোক সেটা খুঁজে এনে জেঠিমার হামারে ঢুকিয়ে তবে ঘর যেতে বলেছে তোমায়।"
    তল্লাশির সঙ্গে কুটোর বস্তার সম্পর্কটা ঠিক পরিস্কার হলনা কড়ির কাছে। তবু সে বুঝল এত কথা বলেছে যখন তখন সরী ঠাকরুন কিছু একটা ভেবেই বিষ্টুকে পাঠিয়েছে। সে আর কোনো কথা না বলে বিষ্টুকে নিয়ে আবার বোসপাড়ার ভেতরে ঢুকল।

    বিকেলে দুখন আর সাধু হরিপুর বাজারে ঘুরতে গিয়ে একজন পকেটমার ধরল, হাটগাছির সনাতন বাগের শাগরেদ পচা। পচা আসলে সনাতনের ঠিক শাগরেদ নয়, পুষ্যি। অনাথ ছেলে, সনাতনই ওকে মানুষ করেছে। বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন নেই, তাই চুরি পকেটমারিতে দড় নয় খুব একটা। সনাতন ওকে এখনো অ্যাপ্রেন্টিস রেখেছে, পুরোদস্তুর চোরের সার্টিফিকেট দেয়নি। পচার উৎসাহ খুব বেশী, তাই বারণ সত্বেও তাকে রোখা যায়না। এর আগেও দুএকবার এরকম কাঁচা কাজ করেছে সে।
    সাধু আর দুখন বাদুর দোকানের গরম তেলেভাজার জন্যে লাইন দিয়েছিল। এ অলে বাদুর তেলেভাজা অন্যতম বিখ্যাত জিনিস, দুর দুর থেকে লোকে এসে কিনে নিয়ে যায়, গরম ভাজা ঝুড়িতে পড়তে পায়না। তাই বাদুর ঠ্যাকার খুব, জজ ম্যাজিস্ট্রেট এলেও সে সন্ধ্যে সাতটা বাজলেই কড়া নামিয়ে দেয়। বলতে গেলে সময়ের পরে তার দোকানে আর কিছুই থাকেনা, বাইরে নিরাশ ভিড় ছাড়া।
    দারোগা গিন্নীর বাপের বাড়ির কুটুম এসেছে, তারা বাদুর তেলেভাজা খেতে চায় চায়ের সাথে। তাই সাধুরা বেলাবেলি এসে লাইন দিয়েছে বাদুর দোকানে। দুখনের সামনে লখা মাইতি দাঁড়িয়েছিল। পচা ভিড়ের পাশ কাটিয়ে এসে লখার পাঞ্জাবির পকেট থেকে পয়সার গেঁজেটা ঠিকই তুলেছিল, লখা টের পায়নি। দুখন না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়ত সেও টের পেতনা, তবে দেখা গেল দুখনের পুলিশী চোখ কখনো কখনো কাজ করে যায়। গেঁজেটা এক চটকা দেখেই তার হাতটা কেমন অজান্তেই সেদিকে চলে গিয়ে পচার বামালসমেত হাতটা ক্যাঁক করে ধরে ফেলল।
    পচা হাত ছাড়িয়ে ভিড়ে মিশে যাওয়া শিখেছে, তেমন তেমন হাটের ভিড় হলে হয়ত বেরিয়ে যেত। কিন্তু ভিড় এখানে খুবই পাতলা ছিল আর দুখন যখন তার হাত ধরেছে, তখনই ঠিক কে একজন এসে হুড়মুড়িয়ে গায়ে পড়ে ধাক্কা খেল। সব মিলিয়ে সময় মতো পালানো হল না পচার। সনাতন তাকে হাটবার বা ভিড় বাস ছাড়া পকেটমারি করতে বারণ করেছে কিন্তু তবু সে করে ফেলেছে। পুলিশের শাস্তি যা হবে সে হবে, গুরু তাকে ছাড়বে না। হাতের কেরামতিগুলো এখনো সড়গড় হয়নি, এত তাড়াহুড়ো করা সনাতনের এক্কেবারে পছন্দ নয়।

    কনস্টেবলরা চড় চাপড় মারতে মারতে থানায় নিয়ে এল পচাকে। দারোগা তখন সেখানে ছিলনা। লক আপ খালিই ছিল। বেশী মারধোর না করে ওরা তাকে সেখানে পুরে রাখল। থানায় ফাঁকা লক আপ খুব চোখে পড়ে, আনাড়ী পকেটমার হোক আর যাই হোক তবু কিছুক্ষণ কেউ থাকলে বেশ লাগে।
    পচার একটা খুব বড় গুণ আছে যা তার গুরু আর সে নিজে ছাড়া কেউ জানেনা। কোনো প্রকার মারেই তার লাগেনা। চড় মারলে মনে হয় কেউ হাত বুলিয়ে দিল। লাঠি মারলে মনে হয় গা টিপে দিল। এমনকি কান মলে দিলে ওর সুড়সুড়ি লাগে। আগে সে কোনো টুঁ শব্দ করতনা, মেরে মেরে লোকের হাত ব্যথা হয়ে যেত। ইদানীং সনাতন শিখিয়ে দেওয়াতে সে লাগার অভিনয় করে, নাহলে মার পর্ব চলতেই থাকে, মারনেওয়ালার রাগও বেড়ে যায়।

    রামচরণের আজ মন ভালো নেই। কর্তারা মিছিল করে এসে কানাই আর পঞ্চুকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। কারুর বিরূদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই তারকাছে। বোসেদের ছেলেটা দেখেছে পঞ্চুর চালায় রাতে লোক আসতে কিন্তু পঞ্চু বলছে সে কিছু জানেনি। তার ঘরে ঐদিনের আগের দিন তার ভাগ্নে এসেছিল। রাতে সেই হয়ত বাইরে মাঠের দিকে গেছে পেচ্ছাপ করতে।
    কানা পঞ্চুর ভগ্নীপতি এককালে মিশনে কাজ করত। বোন অনেককাল আগে মরে গেছে, এক ভাগ্নে রয়েছে, মদন। সেও ছোটোবেলায় মিশনেই থাকত। এখন বাপছেলেতে নিজেদের গাঁ পাকুড়তলায় থাকে, হাটগাছির পাশে। মদন নাকি মাঝে মাঝে আসে মিশনে আর বোসপাড়ায় মামার কাছে। ঐদিনও এসেছিল, মিশনের মহারাজরা সাক্ষী। এদিকে সারা গাঁ তল্লাশি করেছে সে, কোথাও চোরাই মালের কোনো নামগন্ধ নেই। এমনকি হরিপুরের দোকান, গুদাম ঘর গুলোতে, মিশনেও খুঁজেছে, কিছু পায়নি। সব কিভাবে যেন রাতারাতি পাচার হয়ে গেছে!

    থানায় এসে সে পচাকে দেখেও দেখল না,আজ তার মেজাজ এতই খারাপ যে চোরকে মেরেও মন ভালো করার আশা নেই। এদিকে মন ভালো নেই, ওদিকে বাড়িতে কুটুম এসেছে। মাছ, কাঁকড়া, কত কী রান্না হচ্ছে, সেসব মুখে রুচবে তার আজ? খামকা গাদা গুচ্ছের খরচ, খেয়ে সুখ তো আর পাবে না সে। কেউ কোথাও নেই, সকাল থেকে এত হাঙ্গামার পর থানা আজ শান্ত। কনস্টেবল গুলো বেঞ্চিতে বসে হাই তুলছে আর মশা তাড়াচ্ছে। রেমূ উঠবে উঠবে করছে, এমন সময় গুটি গুটি পায়ে কে একজন ভেতরে এল।
    পচার ধরা পড়ার খবর সনাতন বিকেলবেলায় তার আর এক শাগরেদের কাছে পেয়েছিল। সে বিয়ে থা করেনি, একা মানুষ, সংসার বলতে তার ঐ পচাই সব। তার এক শিষ্য মিত্তিরদের পুকুর থেকে কাল রাতে একগাদা চিংড়ি মাছ তুলে দিয়ে গেছে। সকালে রান্না করে খেয়েছে সে আর পচা, রাতের জন্যে টক পান্তা, লঙ্কাতেল দিয়ে চিংড়ি মাছ চটকানো আর বড়িভাজা দিয়ে আলুসেদ্ধ মেখে সে বসেছিল। মাছ চটকানো দিয়ে পান্তা খেতে পচা খুব ভালোবাসে। এমন সময় থানার খবরটা পেল। খাবার হয়ে গেছে আর ছেলেটা খেতে পাবেনা, নাঃ ,থানাটা একবার ঘুরেই আসতে হচ্ছে। জামাটা গায়ে দিয়ে নন্দর সাইকেলটা নিয়ে হরিপুর এল।
    -"কে সনাতন নাকি? কী ব্যাপার?"
    সবাই জানে সনাতন এখন চুরি করেনা, চোরেদের ট্রেনিং দেয় শুধু, দারোগাও জানে। সনাতন হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে আসে,
    -"ভালো আছেন তো দারোগাবাবু? এই এদিকে এসছিলাম, ভাবলাম এমন একজন লোক দারোগাবাবু,একটু দেখা করে যাই। আপনার তো মুখ দেখলেও আমাদের মত পাপীতাপী উদ্ধার হয়ে যায়।"
    সারাদিনে এতক্ষণে, রামচরণের একটু ভালো লাগে। যাক, এদিকের লোকেরা তাকে মান্যি করতে শুরু করেছে তাহলে। সনাতন এককালে নামী চোর ছিল। সে যখন এমন কথা বলছে, তাহলে এটা দাঁড়াচ্ছে যে চোরেরা রামদারোগাকে সমীহ করে। গাঁয়ের কতগুলো বুড়ো হাবড়া আর তার বাবা যাই বলুক না কেন, তাতে তার কিছু এসে যায়না, চোরেরা ভয় পেলেই হল। সে একটু খুশী হয়ে বলে,
    -"কী যে বল সনাতন? তা কাজকম্ম কেমন চলছে?"
    -"আজ্ঞে কর্তা কাজ আর কোথায়। কেউ আর চুরিবিদ্যে শিখতেই চায়না। বলে রামদারোগা থাকতে ও যত বিদ্যেই শিখি, ঠিক ধরে ফেলবেন। উনি হলেন সাপের রাজা অজগরের ওঝা, কোনো জারিজুরি টিকবেনি উঁয়ার কাছে।"

    সাধু আর দুখন জানে যে পচা সনাতনের লোক, কিন্তু রাম দারোগা জানেনা। দারোগার খারাপ মেজাজ একটু ঠিক হচ্ছে দেখে সাধুরাও আর কিছু বলেনা।
    -"তা, চা খাবে নাকি সনাতন? খাও একটুস, ও দুখন যাতো দুকাপ চা নিয়ে আয় তো। তোদের জন্যেও আনবি নাকি?"
    দুখন চা আনতে গেলে, সনাতন যেন হঠাৎ নজর পড়েছে লক আপের দিকে এমন ভাব করে বলে,
    -"ওকে, ও পচা না? সত্যি, এইজন্যেই আপনার এত নাম দারোগাবাবু। পচার মত চোরকে ধরে হেলায় গারদে পুরে দেছেন আর ভাবখানি যেন কিছুই হয়নি। না বাবু আপনি বড় বিনয়ী।"
    দারোগা বিস্মিত হয়। গরাদের ওদিকে যে একজন ডাকসাইটে চোর তা তার জানা ছিলনা। কী জন্যে ওকে সাধু দুখন ধরেছে তাই ছাই রামের মনে নেই। কী একটা লখা মাইতির পকেট মারছিল না কী বলল, সে কী ভুল শুনেছে তবে।
    -"তুমি ওকে চেন নাকি?"
    বলেই একটু অপ্রস্তুত হল। সনাতন চিনবেনা এরকম চোর এদিকে কেউ আছে নাকি। তাই তো ওর কথা বিশ্বাস না করার কারণ নেই যে চোরেরা আজকাল দারোগাকে মানছে। সনাতন এক হাত জিভ বার করে,
    -"কী যে বলেন স্যর। আপনাদের দয়ায় এ শর্মা চেনেনা এমন চোর ডাকাত আছে নাকি এ তল্লাটে। ও তো আমার কাছেই শিক্ষে নিয়েছে।"
    -"ও তাই নাকি। তবে কী নাকি পকেটমারি করেছিল বাজারে। সাধু, ও সাধু কী করেছিল এ, একে ধরেছিস কেন তোরা?"
    সাধু বলতে যাবে তাকে থামিয়ে দেয় সনাতন।
    -"পকেটমারি? বলেন কী কর্তা? পচা তো সামান্য পকেট মেরে ধরা পড়ার লোক নয়। তায় আবার সাধু দুখনের হাতে। আমি তো মনে করছিলুম আপনার মত বীরের হাতে ধরা পড়েছে পচা, জীবনটাই ধন্য হয়ে গেল ওর।"
    রামচরণের কানে যেন কে মধু ঢেলে দিচ্ছিল, আজ অনেক দিনের বাদে। আনন্দের আতিশয্যে চোখে প্রায় জল চলে এল। সেই বিহ্বল ভাবের দিকে তাকিয়ে সনাতন বলে,
    -"আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে পচা নির্ঘাত ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছে। নাহলে এভাবে এতসহজে ওকে ধরা যায়না।
    এই সেদিন তো সোনাখালি তে হাকিম সাহেবের বাড়িতে সে কী চুরিটাই না করল। দিনের বেলা সবার সুমুখ দিয়ে আলমারি খুলে টাকা গয়না সব নিয়ে এল, কেউ বুঝতেই পারলনি। হীরেন দারোগা তো কোনো কুলকিনারাই করতে পারল না। শেষে হাকিম সাহেব এসে আমাকে ধরল। পচা এত গুণী চোর হলে কী হবে একেবারে নির্লোভ, সৎ। শুধু অল্প টাকা মজুরি রেখে বাকীটা আমার হাত দিয়ে হাকিম সাহেবকে ফেরত দিল।"
    -"বটে, এতো দেখছি খুব পাকা চোর। আমার হাতে কেসটা এলে....."
    -"না বাবু, চোর হতে পারে তবে অবুদ্ধি তো নয়। আপনার এলাকায় এরকম কাজ করে জানমান খোয়াতে যাবে কেন, হীরেন দারোগা আর আপনি কি এক? কিসে আর কিসে ধানে আর তুষে"।
    দুখন চা নিয়ে এল। রামদারোগা তাকেই বলল লক আপের চাবি খুলে পচাকে নিয়ে আসতে।

    -"এত ভালো চোর একটা সামান্য পকেটমারি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল? তাও দুখনের হাতে, যে নাকি চোর নিজে থানায় এসে তার সামনে দাঁড়ালেও ধরতে পারেনা। সনাতন কদিন খুব গন্ডগোল হচ্ছে এদিকে,বুঝলে। রাধামাধবের মন্দির চুরি হল, আবার বোসেদের গদি চুরি। এখনো কেউ ধরা পড়েনি, মালের হদিশও নেই। বোসেরা নামী লোক, সদরে পুলিশের কর্তাদের কাছেও খবর গেছে। তারা চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেসটার নিষ্পত্তি হয়ে চোরাই মাল উদ্ধার হোক। তা এই পচা চোর থানায় স্পাইয়িং করতে আসেনি তো? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে এই কেসগুলোর সঙ্গে ও জড়িত।"
    সনাতন দেখল হিতে বিপরীত হয়ে যায়, এতো আবার উল্টো বুঝলি রাম হচ্ছে। তাড়াতাড়ি বলে,
    -"না স্যর, গদির চুরি যাইহোক রাধামাধবের মন্দিরে চুরি করবেনি পচা। আমার তো মনে হচ্ছে আপনার মতো দারোগার একবার দর্শনের জন্যেই ও এসেছে থানায়।"

    পচা আসতেই সনাতন কিছু বলার আগে রাম বলে,
    -"আমি বেশ বুঝতে পারছি তোর মতো চোর এই সামান্য পকেটমারি করতে গিয়ে কেন ধরা পড়েছিস। সেদিন রাধামাধবের মন্দির চুরির যে ব্যাপারটা তাতে তুই জড়িত, থানায় খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এসেছিস। হুঁ হুঁঠিক ধরেছি কিনা? না সনাতন, আমাকে তো পথে ঘাটেই দেখা যায়। আমি তো আর তোমাদের হীরেন দারোগা নই যে থানায় বসে বসে ঘুমোবো আর ভুঁড়ি বাগাবো। আমি তো চতুর্দিকে টহল দিয়ে বেড়াই, এই দুখন এরা জানে। কী রে?"
    রামের চেলারা সমস্বরে বলে,
    -"হ্যাঁ বাবু, আপনি তো সবসময় ঘুরছেন, আমরাও ঘুরছি।"
    -"তাহলে? ও তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে, এ অন্য মতলবে এসেছে। কীরে পচা, তুই ভালোয় ভালোয় বলবি মন্দিরের চুরির কথাটা না গুঁতো দিতে হবে?
    সনাতন এমন বিপত্তিতে পড়বে ভাবেনি, দারোগার মাথায় এখন শুধু মন্দির চুরি ঘুরছে, সব কিছুতেই সে মন্দির চুরি দেখে। সে পচাকে ইশারা করতে থাকে কিন্তু পচা বুঝতে পারবে এমন ভরসা তার নেই। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে পচা হতভাগাটা দাঁত কেলিয়ে বলে কিনা,
    -"আমি তো বোসপাড়ায় যাইনি সেদিন, আমি তো দক্ষিণমাঠের ওখানে বাগপাড়ার তালগাছটায় উঠে বসেছিলুম। বগাদা গেছিল বোসপাড়ার দিকে দক্ষিণমাঠ দিয়ে, কিন্তু ঢুকবার মুখে কী দেখল কে জানে আর গেলনা। গাছের নীচে এসে আমাকে "পালা" বলে দে দৌড় মাঠের রাস্তা ধরে সোজা হাটগাছি। আমিও তখন তালগাছ থেকে নেমে ঘরকে চলে গেলুম। পরে আর বগাদার সনে দেখা হয়নি।"
    সনাতন সব ভুলে চেঁচিয়ে ওঠে,
    -"হতভাগা, তুই কী বলছিস জানিস? এসব কথা আগে বলিসনি কেন আমাকে? কালও কড়িদা এসে জানতে চাইছিল কেউ কিছু দেখেছে কিনা। আমি জনে জনে জিজ্ঞাসা করছি, সবাই না বলে।"
    পচা গোঁজ হয়ে বলে,
    -"তুমি কারে কী জিজ্ঞাসা করছো আমি কেমন করে জানব? আমারে তো জিগাওনি।"
    সনাতন ভেবলে যায়। সত্যিই সে পচাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। পচাকে সে চুরি করতে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি এখনো। তবে পচা গাছ বাইতে পারে খুব ভালো। তাই কখনো সখনো তার কোনো শিষ্য পচাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। তারা যখন চুরি করে, পচা গাছে উঠে চারদিকে নজর রাখে, তেমন কিছু হলে কুকুরের ডাক বা ফেউয়ের ডাক কিছু একটা ডেকে চোরকে সাবধান করে দেয়। সনাতন বারণ করেনা, এরকম করে বেরোতে বেরোতে যদি কিছু শেখে, যদি বুদ্ধিসুদ্ধি হয়। এরজন্যে পচা সবসময় তাকে বলে বেরোয় না। বগা দোলুই এখন গাঁয়ে নেই, তাই বোধহয় কড়িরাম বা তার কানে একথা আসেনি।
    রাম একটা ইউরেকা ভাব করে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠল,
    -"তুই চুরি দেখেছিস, বোসেদের রাধামাধবের মন্দিরের চোরেরা কে জানিস?"
    সনাতন তাড়াতাড়ি উঠে পচাকে একটু সরিয়ে নেয়,
    -"বাবু, আমার কথাটা শুনুন। এই ছেলেটা একেবারে অবুদ্ধি, কী বলতে কী বলছে। ওর সঙ্গে মন্দির চুরির কোনো সম্পর্ক নেই। ওকে ছেড়ে দিন বাবু, আমার ছেলের মত। কীরে পচা, তুই চোর দেখেছিস? বল বাবুকে তুই কিছু দেখতে পাসনি।"
    -"পাই নি তো। আমি তো তখন জানিই না মন্দিরে চুরি হচ্ছে। "
    রাম দারোগা ওতে ভোলবার নয়,
    -"না, সনাতন একে তো ছাড়া যাবেনা। আমি একে জেরা করব এখন। বগা কে?"
    সাধু বগাকে চেনে, সে বলল
    -"বগা দোলুই, এই সনাতনদার কাছে যাতায়াত আছে তার।"
    সনাতন বলে,
    -"হ্যাঁ আপনি বরং বগাকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন। এ ছেলেমানুষ কী বলতে কী বলছে। বগা তো এখন শ্বশুরবাড়িতে, শালীর বিয়েতে গেছে। সে এলে তখন না হয় আবার আমি পচাকে নিয়ে আসব।"
    দারোগা এ কথায় ভেজে না।
    -" ছেলেমানুষ হলেও পাকা চোর বললে তো তুমি। না,একে গারদে পোর, আমি বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে আসি। সাধু খেয়েদেয়ে একবার বগাদের বাড়িটা ঘুরে আয়। ফিরেছে কিনা দেখে আয় নাহলে কাল সকাল সকাল তাকে আনতে যেতে হবে।"
    সনাতন হতাশ হয়ে বসে পড়ে। তার সব রাগ গিয়ে পড়ে পচার ওপর,
    -"পোড়াকপালে হতচ্ছাড়া কোথাকার। কোথায় কী বলতে হয় তাও শেখেনি, ওঃ। তাহলে আর কী হবে! আমিও ঘর থেকে পান্তা আর মাছ চটকানো নিয়ে আসি, এখানে বসেই খাব।"
    রামের এখন দরিয়া মেজাজ, সে আপত্তি করেনা,
    -"সাধু, তুই আমার সঙ্গে চল, তোকে কাঁকড়ার ঝাল দিয়ে দেব। দুখন তো খাবেনা এসব, তুই খাস, সনাতনদেরো দিস।"

    খেয়েদেয়ে সনাতন চলে গেল। রাম থানায় এসে দেখল সাধু ফিরে এসেছে। বগা শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরেনি এখনো। শ্বশুরবাড়ি পীরচকে নেমে নৌকোয় যেতে হয়, নয়নজোড়। পচার কাছ থেকে আর কিছুই জানা গেলনা, সে কিছু দেখেনি। বগাকে দৌড়তে দেখে গন্ডগোলের আশংকায় সেও গাছ থেকে নেমে ঘরের পানে দৌড়েছে।
  • শ্রাবণী | 69.94.96.137 | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২১:২১449730
  • শিবচরণ রোজ খুব ভোরে উঠে প্রাতঃভ্রমন করতে যায়। অনেকটা হাঁটে, কখনো কখনো হেঁটে হরিপুর অবধি চলে যায়। ছেলেকে নাতিকে ঘুম থেকে তুলে বৌমার হাতের এক কাপ চা খেয়ে বাজার করে ফেরে।
    আজকে সে রাত থাকতেই উঠে পড়েছে। তাড়াতাড়ি সব কাজ সেরে বোসপাড়ায় যেতে হবে, সেখানে রাধারমণের প্রায়শ্চিত্রের অনুষ্ঠানে হাজির হতে হবে। বোসেদের সব কাজেই শিবচরণ কর্তাদের পাশেপাশে থাকে। ফণিভুষণ কাল সন্ধ্যেয় বারবার বলে দিয়েছে সবাইকে নিয়ে যেতে, বিশেষ করে তাকে সকাল থেকেই তদারকীতে থাকতে হবে।
    রাস্তায় তেমন লোক নেই, ভোরের আলো ফুটিফুটি করছে সবে, দুটি একটি করে পাখি ডাকছে। ধর্মরাজের মন্দিরের সামনেটায় পৌঁছেছে, এমন সময় মাটি ফুঁড়ে একটা লোক উদয় হল।
    -"নমস্কার মাস্টারমশাই, হাঁটতে বেরিয়েছেন?"
    শিবচরণ অস্পষ্ট আলোয় ভালো করে বুঝতে পারেনা লোকটাকে, আন্দাজে অল্পবয়সীই মনে হয়। এত সকালে গাঁয়ের লোকই হবে, জমিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে কোথাও কোথাও, হয়ত মাঠে যাচ্ছে। তবু গাঁয়ের হলে তার ছাত্র ছিল নির্ঘাত, নাম শুনলেই বুঝতে পারবে কোন পাড়ার লোক। এই ইস্কুলেই তার সারাজীবন কেটে গেল, বয়স হয়ে একটু আধটু ভুলো মন হয়েছে বটে তবে ছাত্রছাত্রীদের সে মনে রাখে।
    -"কে তুমি? ঠিক ঠাহর হচ্ছেনি, দত্তদের দেবু নাকি?"
    -"না, মাস্টারমশাই আমাকে বোধহয় আপনি চিনবেননি, আমি এগাঁয়ের ছেলে নই, জামাই।"
    -"জামাই? কাদের বাড়ির? এত সকালে কোথায় চললে?"
    এতগুলো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ধর্মতলার বিশাল বটগাছটার বাঁধানো তলাটা দেখিয়ে লোকটা বলল।
    -"এখানে একটু বসুন না, মাস্টারমশাই। আপনারে কতগুলি জরুরী কথা বলতে পাঠিয়েছে আমাকে। একটু যদি শোনেন।"

    গাঁয়ে হেন লোক নেই যে আজ বোসপাড়াতে আসেনি, রাধামাধবের প্রাচিত্তির দেখতে। ভবেন ভটচাজ সকালেই এসে পৌঁছেছে। তার আগে রাত থাকতে উঠে সমস্ত যোগাড়যন্ত্র করেছে বিনয়বামুন, ভাইপো ভুতুকে সঙ্গে নিয়ে। বাড়ির মেয়েরাও ভোরে চান করে মন্দিরে এসে গেছে জোগাড়ে সাহায্য করতে। খোলা ভোগমঞ্চে ত্রিপল ঢেকে মুছে নিকিয়ে ভোগের আয়োজন হচ্ছে। রাধামাধবের লুচি আর পায়েস ভোগ। ব্রাহ্মণভোজনের রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে অনঙ্গ বোসের বাড়িতে। এছাড়া বাকী যারা আসবে, অতিথি অভ্যাগত, পাড়ার লোক ও কাঙালীভোজনের জন্যে হালুইকর দিয়ে খিচুড়ি তরকারী বেগুনি চাটনি ইত্যাদি তৈরী হবে মন্দিরের পেছনের খালি জায়গায়। সেখানে কালই মজুররা বড় বড় দুখানা উনুন খুঁড়ে গেছে।
    মন্দিরের সামনে মাটিতে শতরঞ্চি পাতা হয়েছে, দালানে লোক ধরবেনা,সেখানে কীর্তনের দল এসে বসেছে। নটা না বাজতেই লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। মন্দিরের চার দিকে মহিলাদের ভিড়, এপাড়ার অন্যপাড়ার।
    পাড়ার ও গাঁয়ের মাতব্বরদের আটচালায় ঠাঁই হয়েছে। শুধু প্রবীণদের মধ্যে ফণিভূষণ কে মন্দির দালানে চেয়ার পেতে বসানো হয়েছে। সরীঠাকুমাও তার চেয়ারে বসে আছে তবে দালানে নয়, নীচে একটু দুরে কাঠচাঁপা গাছের তলায়। ঠাকুমাকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, সে আজ ঠিক ফর্মে নেই। হাঁকডাক সেরকম করছেনা, বৌ ঝিদের ধমক গুলোও কেমন যেন জলছড়া দেওয়া মুড়ির মতো মিয়ানো।
    মন্দির শুদ্ধি হয়ে ঠাকুরের স্নান হয়ে গেছে তখন শিবচরণ এল। সে সাধারণত কাজেকম্মে আগে এসে ফণিভুষণের সাথে সাথে থাকে ,কিন্তু আজ এসে কর্তাদের আসরে একবার দেখা দিয়েই চলে গেল কাঠচাঁপা গাছের তলায়, সরী ঠাকরুনের কাছে।

    জগ রাতে বংশীর কাছেই ছিল, সকালে বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি উঠে পড়াতে তাদেরও উঠতে হয়। প্রাচিত্তির শেষে ভবেন ভটচাজ নিজে অনঙ্গ বোসের বাড়িতে মন্ত্র পড়ে গ্রহ শান্তির পুজো করে যাবে, তাই সে বাড়িতে মন্দিরের পুজোর সাথে বাড়ির পুজোর আলাদা তোড়জোড়। জগ আর বংশী মুখটুখ ধুয়ে চা খেয়ে সদরঘাটে গিয়ে বসেছিল। পাড়ার কতগুলো ছেলে এসে ওদের ডাকল, তারা আমপাতা পাড়তে যাচ্ছে, রঙীন কাগজ আর পাতা দিয়ে মন্দিরের বাইরে আটচালা সাজাবে। বংশী গেল তাদের সঙ্গে কিন্তু জগ গেলনা, সে ঠিক করল বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে একবার।
    মাঠের রাস্তা ধরেছে, আগে আগে দেখল পঞ্চু চলেছে। কাল রাতে পঞ্চু তার চালা ঘরেই ছিল, জগ আর বংশী সরী ঠাকুমার বাড়ি থেকে ফিরে দেখতে গিয়েছিল। বংশীদের বাড়ির কড়ে বামুন রাতে রুটি তরকারী দিয়েছিল, পঞ্চু তাই খাচ্ছিল। ওদের দুজনকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কথার উত্তর দেয়না। জগকে তো সকালে রামদারোগা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল, পঞ্চুকে থানায় রেখেছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে।
    আজ বোসবাড়িতে অনুষ্ঠান, খাওয়া তো সেখানেই জুটে যাবে, আজ কেন খুড়ো বেরিয়েছে? জগ পঞ্চুর সামনে গেলনা, একটু দুর থেকে পিছু নিল। রোজের মত কানাবুড়ো গিয়ে বসেছে বারোয়ারীতলায়। হরি ময়রার দোকান সবে খুলেছে, আঁচের ধোঁয়ায় চারিদিক আঁধার। হাল্কা কুয়াশা আছে আজ। রাস্তায় এখনো তেমন লোক চলাচল শুরু হয়নি। রোজের মত ময়রা দোকান থেকে চা নিয়ে এল কানা। চা খেয়ে গেলাস ধুয়ে রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে পড়ল। জগ কালী মন্দিরের আড়াল থেকে দেখে অবাক হল, ভিক্ষে না করে এত সকালে কোথায় যাচ্ছে পঞ্চুখুড়ো?

    -"কত্তার মুখটা যেন কেমন চিনা চিনা লাগছে। কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে। এ গাঁয়ের তো নয়।"
    বেলা পড়ে এসেছে, তবে সন্ধ্যের আঁধার নামতে দেরী আছে। লোকটার পরণে বেশ বাহারী ছিটের শার্ট, ফুলপ্যান্ট। সাইকেলটা নিয়ে হাঁটছিল মাঠের এবড়োখেবড়ো আল দিয়ে। কোথা দিয়ে সামনে এই ছোঁড়াটা কখন উদয় হয়েছে খেয়াল করেনি। প্রশ্ন শুনে রক্তচক্ষুতে তাকালো, ছেলেটার হেলদোল নেই, সে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
    -"কেন, তোর সে খোঁজে কী দরকার?"
    -"বারে, গাঁয়ে নতুন লোক দেখলে খোঁজখবর করতে হয়, এতো সবাই জানে।"
    একটু সহজ হয় লোকটা, ছেলেটা গোবেচারা ধরণের মনে হচ্ছে। কী জবাব দিয়ে একে কাটাবে ভেবে ওঠার আগেই আবার প্রশ্ন আসে,
    -"মিশনে এসছেন বুঝি? তাহলে বোধহয় মিশনেই দেখছি আপনারে।"
    সে এক মুহূর্ত ভেবে নেয়, তারপরে বলে,
    -"মিশন? সে আবার কোথা?"
    -"মিশন চিনেন নি আপনি? এদিককার সবাই চিনে, ঐ তো দেখা যাচ্ছে, ঐটাই মিশনের বাড়ি।"
    -"ওঃ, ওটা আমি ইস্কুল ভেবেছিলাম। আমি তো সোনাখালি থেকে আসছি, সেখানে কুটুমবাড়ি, হরিপুর গিয়ে বাস ধরব। এদেশের লোক নই, তুমি কারো সাথে ভুল করছ।"
    ভুল করা পচার কাছে নতুন কিছু নয়, সে প্রায়ই ভুল করে। মাঠে আলু চুরি করছিল, কোঁচড় ভর্তি আলু। নতুন আলু পোড়া খেতে সে খুব ভালো বাসে। লোকটার শ্যেন নজর,
    -"আলুবাড়ি টা কি তোমাদের নাকি হে, দিব্যি ফলন হয়েছে তো?"
    -"হ্যাঁ, মানে আপনি তাড়াতাড়ি যান, নইলে বাস চলে যাবে। বিকেলের পরে আর বাস পাবেননি।"
    লোকটা কেমন বিচ্ছিরিভাবে হাসতে হাসতে চলে যায়। পচা ঘরের দিকে কিছুটা চলার পর পেছনে তাকিয়ে লোকটাকে আর দেখতে পায় না, হরিপুরের রাস্তাটা দুর অবধি দেখা যাচ্ছে, ফাঁকা!

    কাজকম্ম সব মিটে গিয়ে সন্ধ্যেয় ফনিভুষণ ঘরে আরামচেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে মন্দিরের আরতি শেষ হয়েছে। লোকজন আজ সকাল থেকে ব্যস্ততা কাজকম্ম ইত্যাদির পর যে যার নিজের বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। সান্ধ্যকালীন আড্ডায় আজ আর কেউ আসেনি। নাতি বাবলু এসে ডাকে, "ও দাদু, ঠাকুমা এসেছে, দ্যাখো।"
    চটকা ভেঙে দেখে সরীকে ধরে ধরে চেয়ারে বসাচ্ছে বাবলু। ফনিভুষণ অবাক, সন্ধ্যের পর থেকে তার মত সরীও অচল হয়ে পড়ে, বাতের ব্যথায় নড়াচড়া করতে পারেনা। সে হঠাৎ এত কষ্ট করে লাঠি ধরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার কাছে মানে কিছু গুরুতর ব্যাপার। কী আবার ঘটল?
    শুধু সরী ঠাকুমাই নয়, একটু পরে শিবচরণও এল। এল কড়িরাম, সনাতন আর সবার শেষে অনঙ্গ বোস।
    বাড়ির গ্রহশান্তির পুজোআচ্চা সব মিটতে মিটতে বেলা পড়ে গেসল। অবেলায় খাওয়াদাওয়া করে শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল বলে অনঙ্গ ছাতে উঠে পায়চারি করছিল। বংশী গিয়ে খবর দিল সরীদিদি ডেকেছে, ফনিভুষনের ঘরে, জরুরী দরকার।
    কড়িরাম আর সনাতন কে এ আসরে দেখে প্রথমে একটু অবাক হলেও অনঙ্গ বুদ্ধিমান ব্যক্তি। চৌকিতে বসে বালিশে হেলান দিয়ে বলে,
    -"চোরের হদিশ কিছু পাওয়া গেল বুঝি? শেষে চোরে চোর ধরলে, দারোগায় কিছু করতে পারলনিকো।"
    একথায় কেউ তেমন কান দিলনা। ফনিভুষণ এতক্ষন কিছু বলেনি, পুরো দলটাকে দেখে তার মনে হল ব্যাপারখানা যাই হোক, মূলে সরীঠাকুমা। তাই সে হাসিমুখে সরীঠাকরুনের দিকে তাকিয়ে এবার বলে,
    -"কিরে, কী ব্যাপার? তা যাই হোক তুই এলি কেন এমনি খুঁড়োতে খুঁড়োতে? আমাকে বলতিস, জরুরী কিছু হলে আমিই না হয় যেতুম বাবলুটাকে নিয়ে।"
    সরীঠাকুমা জিভ কাটল,
    -"কী যে বল বড়দা, এখনো মরিনি তো। সারাদিন এত হাঙ্গামার পরে আবার তোমাকে বাইরে বার হতে বলব, তা কেমন করে হয়। ও ঠিক আছে, ব্যথা তো চিরকাল থাকবে আমার কিন্তু তোমাদের সঙ্গে পরামশ্যি না করলে যে আর চলছিল না। তুমি আছ, অনঙ্গ আছে, তোমরা সব শুনে যা করতে বলবে তাই হবে।"

    নয়নজোড়ে বগার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাকে পেলনা পুলিশের লোক। সে সেখানে যায়নি। সন্ধ্যেবেলায় রাম দারোগা বসে আছে থানায়, দুখন একপাশে বেঞ্চিতে বসে হাই তুলছে। সাধু সেই যে বিকেলে বগাকে খুঁজতে তার পিসীর বাড়ি বদ্যিপুরে গেছে, এখনো ফেরেনি। যাতায়াতের পথে একজন দুজন উঁকি মারছে এছাড়া চারপাশ মোটামুটি ফাঁকাই।
    রামচরণ বারবার পথের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু সে যাদের অপেক্ষায় তারা কেউ আসছেনা। অনেকক্ষন বসে বসে ঘুমে চোখ ঢুলে আসতে সে উঠে বাইরে আসে। অন্ধকারে বারান্দায় পায়চারি করছে এমন সময় একটা ছায়ার মত মানুষ চুপিসাড়ে এসে ডাকে, "রেমোদা"।
  • Souvik | 132.175.23.254 | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২৩:৪৬449732
  • মাইরি এই লেখাটা এতো ভালো হচ্ছে না যে কি বলব।freq টা আর একটু তারাতারি হোলে খুব ভালো হোতো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন