মন্দিরে মসজিদে না থাকুন, ঈশ্বর আছেন আমাদের মননে, চিন্তায়, দৃষ্টিতে, অনুভবে। সে উপলব্ধি আমাদের অন্তরে আসে অহরহ। তিনি আছেন, শরতের নির্মল আকাশ ও সোনালী রোদ্দুরে। তীব্র গ্রীষ্মের পর ঘন বর্ষার প্রভাতে। শীতের শুকনো-ঝরাপাতা বওয়া হিমেল হাওয়ায়। বসন্তের পলাশ-রাঙা অরণ্যের অভিলাষে। সমুদ্রের ব্যাপ্তিতে, পর্বতের মহিমায়। প্রতিটি শিশুর দৃষ্টি ও হাসিতে। নিরন্ন মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে। মায়ের মমতায়, পিতার হাত ধরে উৎসবের মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানোয়। ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ায় কপালে দিদি বা বোনের অনামিকার স্পর্শে, প্রিয়ার মুখ চুম্বনে। ... ...
কী করব বলুন, আদতে বীরভূম জেলার লোক তো, ঢেঁকিতে চড়ে সেখানকার আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ে নারদ মুনির কী অবস্থা হয়েছিল জানেনই তো। অ, জানেন না, তাইলে শুনুন। বেলা তখন দশটা হবে। প্রভু নারায়নের নাম জপতে জপতে বীরভূমের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন নারদ। হঠাৎ সোঁ সোঁ করে একটা অদ্ভুত শব্দ। কী ব্যাপার? মেঘ করল নাকি? ঝড় এল? না তো, আকাশ দিব্যি পরিস্কার। ওদিকে সোঁ সোঁ আওয়াজটা হয়েই চলেছে। ভয় পেয়ে স্পিড বাড়িয়ে দ্রুত চলে গেলেন নারদ। নারায়নের কাছে গিয়ে সব খুলে বলে জিজ্ঞেস করলেন, “ওটা কিসের শব্দ ছিল?” ... ...
(আমার এ রচনা বিভিন্ন সিঁড়ি নিয়েই। হঠাৎ করেই একদিন অন্যমনায় ছিলাম। সে সময়ে মাথার মধ্যে ছোটবেলার আমাদের বাড়ির এক প্রাচীন আমলের সিঁড়ির নানান ঘটনা ভেসে উঠল অতর্কিতেই।) ... ...
প্রায় সকল অনার্য দেবতারাই এখন হিন্দু দেবতা। কিন্তু তাও দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক, দেবতাদের থেকে এখন সাধারণ মানুষের দূরত্ব বেড়ে উঠেছে বহুগুণ। আগে অনার্য মানুষরা দেবতাদের কাছে সরাসরি প্রার্থনা করতে পারতেন। কিন্তু এখন সে প্রার্থনার অনেক রীতি, অনেক পদ্ধতি, অনেক মন্ত্র, সে মন্ত্র আবার কোন আঞ্চলিক ভাষায় নয় – সে ভাষা দেবভাষা সংস্কৃত। আর এই সকল পূজার বিচিত্র বিধি-বিধান, বিভিন্ন দেব-দেবীর বিবিধ মন্ত্র যিনি জানেন, তিনিই পুরোহিত এবং তিনি অবশ্যই ব্রাহ্মণ। ... ...
ধরুন আপনি আঁকতে শিখছেন। আবার ধরুন আপনি বেড়েপাকা। তাই ধরে ধরে আইডিয়াল ঘোড়া না এঁকে একেবারে চক্ষু মুদে আঁকতে গিয়ে খচ্চর এঁকে বসেছেন। আবার ধরুন আপনি গান গাইতে চান। কিন্তু সারেগামা না সেধে একেবারে খাম্বাজ রাগিণী ধরতে গিয়ে এবারে স্টেজের উপর টম্যাটোর দোকান বসিয়ে দিলেন। কিংবা ভাবুন আপনি কর্পোরেট থ্রিলার লিখতে চান। অনেক আগে জয়েস পরেছিলেন। ইদানিং ম্যান্টল। তারপরেই কেমন গা ঘুলিয়ে উঠে ভক করে নামিয়ে ফেললেন সাহিত্যিক উদবমন। একবারে নয়। কিস্তিতে কিস্তিতে। ... ...
হাঁদাভোঁদা আর নন্টেফন্টে-কেল্টুদার কীর্তিকাহিনীতে যে সব অতুলনীয় ধ্বন্যাত্মক শব্দ পাওয়া যেত তার মধ্যে ছিল ‘উলস চাকুস চুকুস’, জিভে জল আনা খাবার চেটেপুটে খাওয়ার শব্দ। অর্থাৎ রাজধানীর স্ট্রিট ফুড। দিল্লিতে থেকে সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার না করে কোন মূর্খ ? আলকাতরা মার্কা ছোলার তরকারি যারা রাঁধে তারা চুলও বাঁধে, মানে জিভে জল আনা চাটও বানায় স্যার। ... ...
সেকাল থেকে আজ পর্যন্ত, তীর্থে-তীর্থে এবং কলকাতা বা যে কোন বড়ো শহরের রত্নব্যবসায়ীদের চেম্বারে প্রায়ই স্বঘোষিত সিদ্ধ সাধকদের দেখা যায়। তাঁদের অনেকে আবার স্বর্ণপদক প্রাপ্ত – এই পদক কোন প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে জানা যায়না। তবে এঁরা বশীকরণ করতে পারেন, আপনাকে যে কোন কাজে সার্থক করে তুলতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল বৈদেশিক আক্রমণের সময় এঁদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যোদ্ধাদেরই সীমান্তে লড়তে হয়ে। তাঁরা বশিত্ব দিয়ে বিপক্ষ সৈন্য বা সেনাপতিদের বশ করে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারতেন, কিন্তু কোনদিন করেননি। অথবা সাধারণ আকৃতির সাধক মহিমা সিদ্ধি দিয়ে হঠাৎ বিশাল শরীর বানিয়ে, গরিমা সিদ্ধিতে তাঁদের পায়ের তলায় পিষে একজন শত্রুকেও বিনাশ করতে পেরেছেন - এমন শোনা যায় না। ... ...
নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে হুজুগ করে এসব না খাওয়াই ভালো, জীবনে কখন কী যে হয় কে বলতে পারে? ... ...
এই ডবল ডোজের গোবর খেয়ে মহাভারতের শুদ্ধতা না হয় ফিরিয়ে আনা গেল, কিন্তু বাংলার পোড়া পেটের শুদ্ধতা বাঁচে কি করে? অফিসের ক্যান্টিনের খাবার টিফিন হিসেবে চলতে পারে, কিন্তু কালা ছোলে (আলকাতরার মধ্যে চাট্টি সেদ্ধ ছোলা ফেলে দিলে যেমন দেখায়) দিয়ে লাঞ্চ? অনেকে যেমন খায়, তেমনি পেপসি বা কোকাকোলা সহযোগে? নাঃ, অমন সাঙ্ঘাতিক ফিউশন আমার চলবে না। অতএব তিন কোর্সের লাঞ্চ চালু করলাম – ভাত, ডাল আর অমলেট। আমার আর তথাগতর সঙ্গেই এই অফিসে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার এক বাঙালি – দাশগুপ্ত। কালা ছোলে দিয়ে লাঞ্চ করতে বিরক্তি প্রকাশ করায় তাঁকে আমার মেনু সাজেস্ট করেছিলাম। তিনি নাক সিঁটকে বললেন, “অমলেট! সেটা তো লোকে ব্রেকফাস্টে খায়”। ... ...
এটা ছোটদের গল্প নয়। এটা একজন ছোট্ট মানুষের গল্প। নাম তার সাবু। সাবুকে আমরা এই ৫ পর্বের খুদে গল্পে খুঁজে পাই বয়ঃসন্ধির গোড়ায়। তার পৃথিবী বদলে যেতে দেখি আকস্মিক পরিবর্তনের ঝড়ে। তার কিশোর হৃদয়ে জাগতে দেখি নতুন অনুভুতি - হারানোর নীরব বেদনা, হেরে যাওয়ার ভয়, ক্ষোভ, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। কিন্তু সব ছাড়িয়ে দেখিয়ে সাবুর কোমল মনে জীবনের প্রতি ভালবাসা। ... ...
দেবরাজ ইন্দ্র অসুর ও দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রায়শঃ পরাজিত ও স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে পরিত্রাণের জন্য ত্রিদেবের শরণ নিয়ে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে দেবী পার্বতীর কোলে থাকা একটি শিশুকে বধ করার জন্য তাঁকে প্রথমেই হাতে বজ্র তুলে নিতে হল! আবার শিশুরূপী দেবাদিদেবের হাতের ইশারায় তিনি একেবারে জড়বৎ পুতুল হয়ে গেলেন! দেখা যাচ্ছে ভাগবত এবং শৈব - উভয় পুরাণকারই সুযোগ পেলে বৈদিক দেবরাজ ইন্দ্রকে অপদস্থ করতে দ্বিধা করেননি। ... ...
তাঁরা দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ। চা খেতে খেতে তাদেরই এক জন বললেন, "ইহার পূর্বে কি কোনও কেলেংকারি ঘটে নাই এই দেশে ? রাজনীতিকরা কি অভিযুক্ত হন নাই পূর্বে ? সে সকল লইয়া প্রবল তদন্ত হইয়াছে এবং তাহা যে অতি বৃহৎ গ্রিন ব্যানানা ব্যতীত অন্য কিছু প্রসব করে নাই, তাহা বুঝিতে চিন্তন বৈঠক নিষ্প্রয়োজন। অতয়েব, হে অর্বাচীন, তুমি নিশ্চিন্তে পানভোজনে নিরত থাক এবং বাহুমূলকে বাদ্যযন্ত্র রূপে ব্যবহার কর।’’ ... ...
ব্রজরাজ নন্দ, তাঁর দুই রাণি – রোহিণী ও যশোদা, বলরাম (যিনি বিষ্ণুর অংশ-অবতার) এবং ব্রজের সকল গোপ ও গোপীগণ স্বর্গ থেকে আবির্ভূত, তাঁরা কৃষ্ণের আগে জন্ম নিয়েছিলেন, শিশু ও বালক কৃষ্ণকে লালন-পালনের জন্য। রাজা কংসের চোখে ধুলো দিতে, কৃষ্ণের সঙ্গে একই সময়ে আবির্ভূতা হয়েছিলেন, দেবী যোগমায়া। দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের এই সব সংবাদ কিছুই জানতেন না? কেমন দেবরাজ তিনি? নাকি পুরাণকারেরা কাহিনী কল্পনার সময়, এই দিকটি খেয়াল রাখেননি? নাকি অনার্য বা হিন্দু দেবতার কাছে বৈদিক দেবরাজের লাঞ্ছনার ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত ভাবেই উপস্থাপিত করেছেন? ... ...
একই টেকনিক যে সব জায়গায় কাজ করে না সেটা বোঝানোর জন্য সেদিন বাড়ি ফিরে ভজহরি বাবুর বাজার করার গল্প বলেছিলাম তথাগতকে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-এর গল্প ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’-তে ‘বাজাড়ু’ ভজবাবুর দাম কমানোর কায়দা ছিল এক এক দোকানে এক এক রকম। কোথাও চড়া মেজাজ দেখিয়ে, কোথাও আবার হাপুস নয়নে কেঁদে। আমার রুম-মেটটি গল্প শুনে খুশী হল না, তার প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন লেগে গেছে, মুখে স্কচ ব্রাইট ঘসে দিয়েছে বাসের লোকটা। অমন চমৎকার মুক্তো ভুল জায়গায় ছড়িয়ে বসলাম। ... ...
"মহর্ষি বেদব্যাস আরও বিষণ্ণ হলেন। তিনি চার বেদের সংকলন করেছেন, অজস্র শিষ্যকে বেদের পাঠ দিয়েছেন। শূদ্র এবং নারীদের বেদপাঠ নিষিদ্ধ বলে, তিনি পঞ্চম বেদস্বরূপ মহাভারত রচনা করে, সকলের কাছে বেদের জ্ঞান প্রকাশ করেছেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা সত্ত্বেও, তিনি পূর্ণ ব্রহ্মলাভ করতে পারেননি। সামান্য অপ্সরাগণও তাঁর মতো জ্ঞানবৃদ্ধের দৃষ্টিতে সমদর্শন দেখতে না পেয়ে, লজ্জিতা হয়, তাঁকে সাধারণ মানুষ বলেই মনে করে! সেদিন সরস্বতী নদীর তীরে বসে, নির্জন গোধূলিতে তিনি চিন্তা করতে বসলেন, তবে কী আমার জ্ঞান অসম্পূর্ণ এবং অপরিণত?" ... ...
(আমার এ রচনা বিভিন্ন সিঁড়ি নিয়েই। হঠাৎ করেই একদিন অন্যমনায় ছিলাম। সে সময়ে মাথার মধ্যে ছোটবেলার আমাদের বাড়ির এক প্রাচীন আমলের সিঁড়ির নানান ঘটনা ভেসে উঠল অতর্কিতেই। ভাবলাম লিখেই ফেলি। এই নিয়ে গুগুল মামার শরণাপন্ন হতেই দেখলাম - ওরে বাবা, এই সিঁড়ি নিয়েই হয়তো একটা বিরাট রচনা নামিয়ে ফেলা যায়। সারা বিশ্বের নানান সিঁড়ি, সেগুলোর ইতিহাস, সবচেয়ে বড় কথা সেই আদিম যুগ থেকে কতই না পরিবর্তন হয়ে আজকের গতিমান লিফট থেকে এস্ক্যালেটর। আমারই চোখে দেখা কত কিছুই। স্মৃতির মননে ছোট বেলা থেকে কলেজ জীবন পেরিয়ে চাকরি জীবন। সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে আছে এই সিঁড়ি। জানিনা আপনাদের ভাল লাগবে কিনা...ভাল লাগলে যদি জানান তাহলে আরো একটু বিস্তৃত ভাবে রচনাটি শেষ করবো। আমি এ রচনাটিকে "ধারাবাহিক" বিভাগ আর "ইতিহাস" উপবিভাগেই রাখছি।) ... ...
তিনি হাতে ডু-অ্যাণ্ড-ডোন্ট লিস্ট ধরিয়ে দিলেন। তাকিয়ে দেখলাম ‘ডু’ তাতে বিশেষ কিছু নেই, কেবল ‘ডোন্ট’ আর ‘ডোন্ট’। ১) কম করে ছ-মাসের আগে ঘর ছাড়া চলবে না, ২) ঘরে বান্ধবী টান্ধবী আসা চলবে না, ৩) ভোজন চলতে পারে, তবে পান চলবে না, ৪) বেশি রাত অবধি আলো জ্বালিয়ে রাখা চলবে না, ৫) ভাড়া তিন তারিখের বেশি বাকি রাখা চলবে না, ৬) ১১-টার বেশি রাত করে ঘরে ফেরা চলবে না, ৭) ঘরের দেওয়ালে পেরেক টেরেক পোঁতা চলবে না, ৮) ইত্যাদি আরও অনেক কিছু চলবে না... ... ...
একদা এই নগরে বয়স্কদের ছোটোরা বাসে ট্রামে ট্রেনে জায়গা ছেড়ে দিত। এই ৩০ বছর আগেও। এখন বাসে দুটি আসন বয়স্কদের জন্য এবং একটি প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত। ... ...
স্বয়ং ধর্ম এবং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের আলোচনায় ধর্ম বলতে প্রচুর ঘৃতাহুতি ও বেদোচ্চারণ করে বিশাল যজ্ঞের অনুষ্ঠান এবং তারপর বিপুল দান-টান করে স্বর্গবাস সুনিশ্চিত করার প্রকরণ বলে মনে হল না। যজ্ঞ-টজ্ঞ নিয়ে দু চার কথা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা গৌণ, মুখ্যতঃ ধর্ম বলতে যা বুঝলাম, সংসার, সমাজ, প্রতিবেশী, গুরুজন, স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সকলের সঙ্গে সদাচরণ, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সদ্ভাব বজায় রেখে চলা। একথা ভগবান বুদ্ধ, সম্রাট অশোকও বলেছিলেন, তাঁদের আমরা “বুদ্ধু” বলেছি, বলেছি “নির্বোধ”। কারণ এই ধর্ম আচরণে সমাজের পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ শ্রেণীর স্বার্থ সিদ্ধি হয় না। তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির প্ররোচনায়, আমরাই “বুদ্ধু” এবং “নির্বোধ”-এর মত, ধর্ম নিয়ে প্রতিবেশী, সমাজ, বন্ধুজনের প্রতি আনৃশংস্যতার পরিবর্তে নৃশংস হয়ে উঠেছি বহুকাল। ধর্মের নামে আমরা কবেই খুইয়ে বসেছি আমাদের মানবধর্ম। ... ...