আমার একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। যার বেশীরভাগ প্রবন্ধই এই ব্লগে প্রকাশিত। সেই বই বিষয়ে দু'চার কথা ভাগ করে নিলাম আমার পাঠকদের সাথে। নিজের বই নিয়ে ফেসবুক জাতীয় সমাজমাধ্যমে আলোচনা করাটাই রীতি। কিন্তু আমি ফেসবুক বা অন্য প্রচলিত সমাজমাধ্যম থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি। গুরুচন্ডালিই আমার একমাত্র মাধ্যম নিজের কথা বলার জন্য। আশা করি নিজের ব্লগে, নিজের বই নিয়ে লেখা একটু রীতি বহির্ভুত হলেও নীতি বহির্ভুত বলে বিবেচিত হবে না। ... ...
তিনি ছিলেন আমার রাঙামা। আসলে রাঙা ঠাকুমা। বাবার মেজ কাকিমা। কিন্তু সকলের কাছেই তিনি একডাকে পরিচিত ছিলেন এই রাঙামা নামেই। একেবারে টুকটুকে গায়ের রঙের সঙ্গে আদরের ডাকের কী মিল! মাথায় কালো চুলের বড়ি খোঁপা। ছোটখাটো চেহারা। সংসারের হাজারো কাজ সামলে ওই বয়সেও মসৃন ত্বক। আদতে দ্বারভাঙার কন্যা। কবি যদিও বলেছেন, "যব-ছাতু খেয়ে বাঁচে পশ্চিমের দীনে," পশ্চিমে কিন্তু লোকপ্রিয় ছোলার ছাতু। উত্তরবঙ্গে বলতে শুনেছি, বুটের ছাতু। তা রাঙামা ছিলেন এই ছোলার ছাতু মাখার স্পেশালিস্ট। তাঁর হাতের তারে সেই ছাতু মাখা গোল বলের মতো দলার যে কী সুস্বাদ ছিল তা এখনও ভুলতে পারি না। আজকের আধুনিক প্রজন্ম এমন সব আটপৌরে জলখাবারের মর্মই হয়ত বোঝে না। তবে আজও এই সব সাধারণ ঘরোয়া খাবার নিয়ে বসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবী থেকে একে একে চলে যাওয়া প্রিয় মুখগুলি যাঁদের স্নেহ, আর ভালোবাসা আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে এমন উজ্জ্বল করে রেখেছে। ... ...
আচ্ছা, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এই যে আমাদের এত কান্নাকাটি, এইটা আদৌ করছি কেন আমরা? শুধুই ওটা আমাদের সংবিধানে সসম্মানে উল্লিখিত আছে বলে? শুধুই কি এই কারণে যে, পশ্চিম একে এক অবশ্য-পালনীয় আদর্শ বলে মনে করে, এবং আমরা পশ্চিমকে অনুকরণ করতে ভালবাসি? শুধুই কি এই কারণে যে, ওর মধ্যে ‘নিরপেক্ষতা’ কথাটা আছে এবং সেটা শুনতে বেশ চমৎকার লাগে? ... ...
কাবলিওয়ালার ঝোলা যেমন হিং-সুর্মার গন্ধে আমোদিত হতো, এই সব ডাক্তার জ্যেঠুদের গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ --- না, ব্রিফ কেস নয় -- কালো বা বাদামি চামড়ার হাতে ঝোলানো গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ খুললেই ছড়িয়ে পড়ত স্পিরিট -- টিংচার আয়োডিন আর ইউকিলিপ্টাস অয়েলের মিশে যাওয়া একটি ঘ্রাণ। আর তখনই মনে হত -- এই তো আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি। মা আজ বিকেলেই খেলতে যেতে দেবেন। ... ...
আমাদের দেশে এখনকার ভোগবাদ-তাড়িত মূল্যবোধহীন সমাজের সঙ্গে তখনকার ইউরোপীয় সমাজের বেজায় মিল। আজ এই করোনা অতিমারীর সময় জাল কোভিড ভ্যাকসিন, জাল স্যানিটাইজার, ইমিউনিটি বাড়ানোর বুজরুকি -- এসব যত দেখছি তত মনে পড়ে যাচ্ছে বেন জনসনের কথা। ১৬১০ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হওয়া যাঁর 'দ্য অ্যালকেমিস্ট' নাটকটির প্রাসঙ্গিকতা আজ চারশ বছর পরেও বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় কলকাতার রঙ্গমঞ্চে সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিচ্যুতিকে কষাঘাত করে মঞ্চস্থ হয়েছে কত বলিষ্ঠ নাটক। সামাজিক ও রাজনৈতিক ভণ্ডামি, ধর্মীয় প্রহসন, মানুষের লোভ, লালসা, দুর্নীতি, প্রতারণা, সমাজের অসঙ্গতিগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার জন্যে আমাদের এই বঙ্গেও তো ছিলেন হুতোম, টেকচাঁদ ঠাকুর, রূপচাঁদপক্ষী, পরে সজনীকান্ত দাস, 'অচলপত্রে'র দীপ্তেন সান্যাল, রূপদর্শী/গৌড়ানন্দ কবি। আর এই করোনার আবহে চিকিৎসা, অক্সিজেন সঙ্কট, জীবনদায়ী ওষুধ নিয়ে কালোবাজারি, কোটরগত মানুষের অসামাজিকতা, অসহায়তা আর টিকা নিয়ে ঠগবাজি, জীবিকা-খোয়ানোর মতো বিষয়গুলি নিয়ে কালজয়ী সাহিত্য বা চলচ্চিত্র কি সৃষ্টি হবে না? ... ...
সিনে নস্টাল ... ...
ফাদার্স ডে ইস্পেশাল ... ...
ভোজনরসিক বাঙালি ... ...
মানুষের চোখ যে এত সুন্দর তা এই অতিমারী না হলে হয়তো জানতেই পারতাম না। মহিলা, পুরুষ, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ - সবার চোখ দৃশ্যমান। নাকের নিচ থেকে ঢাকা মুখোশে, মাথা আর কপালও অনেকেরই টুপির নিচে চলে গেছে। বাজারে ঢোকার মুখের রাস্তায় পাঁচটা মিনিট দাঁড়িয়ে যান, দেখুন আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের চোখ। কারও চোখ যামিনী রায়ের ক্যানভাসের মত, কারোর আবার রবি ঠাকুরের কালোহরিণ। কারও চোখে সরু কাজলের টান, কারোর চোখের উজ্জ্বলতা আবার চশমার ভিতর দিয়েও স্পষ্ট। কারও চোখ আবার অন্য গল্পও বলে। ... ...
আব্বাকে নিয়ে একলা থাকার সময়টা আব্বা অসুস্থ হয়ে থাকার পুরো তিন বছর দশ মাস সময়ের মধ্যে অন্যতম সেরা সময় ছিল আমার। বারান্দায় বসায় দিতাম। উনি নানান দিক নির্দেশনা দিতেন আমাকে, ওই গাছের গোরায় একটু পানি দেও, এইখানে একটু পানি দেও, পাখিরা খাবে, গোসল করবে! আমি বলতাম, আল্লার দুনিয়ায় পাখির গোসলের জায়গার অভাব? আমি এইখানে পানি না দিলে গোসল হব না পাখির? উনি বলতেন হব, তবে তাতে তোমার কোন অবদান থাকব না, এই যা! আমি পানি দিতাম। আরেকদিন মাটির নিচে কি জানি একটা মাথা উঁচু করে রয়েছে, ওইটা উনার চোখে পড়ছে। ওইটা কী? আমি কী জানি ওইটা কী? বললাম আমি। কিন্তু কাজ হল না, ওইটা তুলে আনো! হুকুম হয়ে গেছে, তুলে না এনে গতি নাই। তুলে আনলাম, কী জানি একটা আবর্জনা জাতীয় কিছু ছিল। উনি হতাশ হয়ে বললেন, ধুর! আমি ভাবছি অন্য কিছু! লেবু গাছটা মরে গেল কেন এই চিন্তা সম্ভবত মারা যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত করে গেছেন। কেউ না বলে চুরি করে লেবু নিছে বুঝছ? এই জন্য লেবু ধরা বন্ধ হয়ে গেছে! আমি এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিলাম। চুরি করলে লেবু গাছ মাইন্ড করে নাকি? উনি হা হা করে হাসি দিয়ে বললেন, তুমি বুঝবা এগুলা, দেও, পিঠটা একটু চুলকায় দেও! ... ...
জনা পনেরো ডাক্তার-নার্স-আয়া-ওয়ার্ডবয়ের 'টিপিন' মাখতেন হাসিমুখে। একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি বাড়ি থেকে নিয়ে আসা 'কিছুমিছু' আচারের তেল আর পেটমোটা লংকার অন্তর্বাসী মশলা (উনি হেসে বলতেন "মশল্লা") মেশাতেন - অতো জোড়া উৎসুক, খিদে খিদে দৃষ্টির সামনে। তারপর... যাহ্ , লঙ্কা আনা হয়নি ! ... ...
আজ সন্ধ্যার ঝোঁকে মেঘ করে এসেছিল। চৈতালী মেঘ। সঙ্গে এক পশলা ভিজে বাতাস। গ্রীন-ভার্জের আধা শুকনো নারকেল গাছের টঙে বাসা বেঁধেছিল এক গর্ভিণী চিল। ডিম ফুটে কয়েকটা বাচ্চা বেরিয়েছে কিছুদিন হলো । সন্ধ্যেবেলা মা ফিরে না আসা অবধি উদগ্রীব হয়ে থাকে তারা। জীবনের প্রথম ঝোড়ো বাতাসের ছোঁয়া আজ লেগেছিল তাদের ছোট্ট পাঁজরাগুলিতে। ভয়ে জড়সড় হয়ে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছিল সোনালী কিংবা কালো কিংবা বাদামী ডানার মা- চিলটিকে। কেন জানি রহস্য-রোমাঞ্চর কথা মনে পড়ল আজ। ... ...
কমল অর্চনার চুলের মুঠি ধরে তাঁকে চেয়ার থেকে টেনে তোলে এবং তাঁর মাথা দেওয়ালের দিকে ছুড়ে দেয়। দেওয়ালে মাথা ধাক্কা লাগার ঠিক আগে চুল ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজের দিকে নিয়ে আসে। এই পদ্ধতিতে অত্যাচার চলে ১৫-২০ মিনিট ধরে। অর্চনা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। তাঁর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল। সারা শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছিল তখন অর্চনার। তাঁকে চেয়ারে বসতে বলা হল। কিছুক্ষণ পর আদিত্যকে রুণু নির্দেশ দিল অর্চনার চুল ধরে ঝুলিয়ে রাখতে। আদিত্য ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্চনার চুল এত জোরে টানে যে তাঁর মাথার কিছু চুল ছিঁড়ে যায়। ... ...
আমি ভয় করবনা ভয় করব না/দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরবনা..." আশা করছি ভালভাবেই এই কোভিডযাপনের নিভৃতবাসের বাকী কটা দিন কাটিয়ে উঠব। উঠবই... ... ...
বাবার কথা মনে পড়লেই একটা গন্ধ নাকে আসে অবিকল ... সদ্য জ্বালানো উইলস ফ্লেকের গন্ধ, আমি চিনি ... আবছা একটা ছবি ভেসে ওঠে - বাইরের পেশেন্ট দেখার ঘরের কাঠের চেয়ার, জানলার ঠিক ধারেই, বাবা মুখের সামনে লাইব্রেরী থেকে আনা একটা বই ধরে আছেন ... মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু রেক্সিনের বাঁধাইয়ের আড়াল থেকে এক-একটা রিং উড়ে উড়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে মেঘ হয়ে যাচ্ছে ... ... ...
সুচিত্রা সেনকে নিয়ে আমারো বেশ আগ্রহ আছে। তাঁর সিনেমা আমার ঠাকুরদা শেষবেলায় দেখেছেন। বলেছিলেন, বাহ, এই মাইয়াডা দেখি অভিনয় জানে! তাঁকে বাবাও পছন্দ করতেন। আমার ভাতিজা ভাগ্নেভাগ্নিনীরাও করে। সমগ্র বাঙালিরই প্রিয় প্রিয় নায়িকা সুচিত্রা সেন। আমি এই সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটি গল্প লিখেছি। যা হয় আরকি। আমি যেহেতু কোনো পত্র পত্রিকায়, বলা যায়, লিখি না। এক বৈঠকে লিখি না। ইচ্ছে হলে লিখি। ইচ্ছে হলে লিখি না। একটু একটু করে লিখি। শব্দ সংখ্যার ধারধারিনা। তাই গল্প বড়ো হয়ে যায়। গোপনে বলি আপনাকে, আমার ঠাকুরদা সুচিত্রা সেনকে কিডন্যাপ করেছিলেন। এটা সত্যি মনে করে মজা পাই। আরেকটা কথা। আমার গল্পের অনেক চরিত্র বাস্তব। আবার আমার পরিচিতিদের নামধামও অবলীলায় বসিয়ে দেই গল্পে। অনেকে এজন্য গোস্যা করেন। অনেকে খুশি হন। সে যাই হোক না কেনো যারা পড়বেন এটাকে গল্প হিসেবেই পড়বেন। এই গল্পের রবি ঠাকুরও একবার চরিত্র হয়ে এসেছেন। সুচিত্রার জন্য না এসে পারেননি। সুচিত্রা সেন বলে কথা। ... ...
কমল নিজের ডান হাত দিয়ে লতিকা গুহর বাঁ গালে ভয়ংকর জোরে চড় মারতে শুরু করে। এতটাই নির্মমভাবে কমল চড় মারছিল যে অর্চনার মনে হয়েছিল লতিকার চোখ কোটর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসবে। বেশ কিছুক্ষণ চড় মারার পর লতিকাকে চেয়ারে বসানো হয়। অর্চনা দেখেন, লতিকার গাল ভয়াবহ রকম ফুলে গিয়েছে এবং তাতে স্পষ্ট আঙুলের দাগ। ... ...
পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যের মসনদ ধর্মান্ধ হিংস্র মৌলবাদী শক্তির হাতে চলে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনায় আতঙ্কিত ছিলেন এ রাজ্যের গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষ। ফলপ্রকাশের পর যখন দেখা গেল যে তা ঘটেনি, তখন তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, উঠে এসেছে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন। এ রাজ্যের পূর্বতন ক্ষমতাসীন বাম শক্তি, বিশেষত তার বড় শরিক সিপিএম, কি মৌলবাদী শক্তিকে গোপনে সাহায্য করেছে? অর্থাৎ, তাদেরকে ক্ষমতা থেকে যারা হঠিয়েছে, সেই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি ক্রোধ ও প্রতিহিংসা বশত তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা কি বিজেপি-কে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে চেষ্টা করেছিলেন? নির্বাচনের আগে থেকেই এ হেন সম্ভাবনার কথা হাওয়ায় ভাসছিল কোনও কোনও মহলে, এবং নির্বাচনের পর তার ‘প্রমাণ’ মিলেছে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনী ফলাফল থেকে সত্যিই এমন ইঙ্গিত মেলে কি? সেটাই আজ আমরা এখানে পর্যালোচনা করে দেখব। ... ...
তথাকথিত ক্যুইয়ার কমিউনিটিতে বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে আমার আছে। অদ্ভুত একটা মাতৃত্বের অনুভুতিতে সত্যিই তাদের জন্য অপত্যস্নেহের এতটুকু ঘাটতি নেই। Happy Mother's Day ... ...
নিচের স্টুডিওতে ঢুকে কবিগুরুর মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন বৃদ্ধ। ভাস্কর্যের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে যেন অনেক দূর থেকে বললেন, "সুধীর কিন্তু কাজটা খুব ভালো করেছিল, বল। আমার যেখানে যত মূর্তি দেখেছি -- ," তারপর মজদুরমন্ডলীর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কৌতুকের গলায় বললেন, "এটা কিন্তু তুমি বল নি -- কত লোক যে আমার ছবি এঁকে আর মূর্তি বানিয়ে সংসার করছে এত বছর!" এই প্রথম শব্দ করে হাসতে শোনা গেল বুড়ো মানুষটিকে। সবাই তখন বাইরে জনতা সামলাতে ব্যস্ত। ... ...