পাখিদের তো আর শেখানো যায় না যে তোরা হাওড়া ব্রিজে আর মল ত্যাগ করিস না বাপু! এত তো জায়গা রয়েছে! কিন্তু দেখা গেল শুধু পাখি নয়, মানুষদের শেখানোও খুব চাপ – এত পোস্টার, অনেক সচেতনতা ক্যাম্পেনের পরেও পাবলিক পানের আর গুটকার পিক হাওড়া ব্রিজের পিলার গোড়ায় ফেলা বন্ধ করল না। পিলারের গোড়ার ঠাকুর দেবতার ছবি আটকেও তেমন সাফল্য এল না। আগে যেমন লিখেছি, পানের/গুটখার থুতু বেশ বেশ অম্ল এবং তাই লোহার জন্য ক্ষতিকারক। প্রথমে পিলারের গোড়া গুলি বার বার রঙ করা হচ্ছিল এবং পরিষ্কার করা হচ্ছিল – কিন্তুতেই কিছু হল না। বরং দেখা গেল মাত্র চার বছরে, ২০০৭ থেকে ২০১১ এর মধ্যে পান/গুটখার পিক পিলার ক্ষইয়ে দিয়েছে ৩ মিলিমিটার! দৈনিক হাওড়া ব্রিজের ফুটপাথ ব্যবহার করেন প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ (১-৫ লক্ষের মধ্যে)। এর মধ্যে শতকরা এক ভাগও যদি থুতু ফেলেন, তাহলে দৈনিক পিলারে থুতু ফেলছেন কয়েক হাজারের মত লোক! সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়! ... ...
মাদের দেশে ‘দর্শন’ বলে আলাদা কোনো বিষয় কখনও ছিল কি? বেদে, উপনিষদে যা আছে বা মহর্ষি কপিল, কণাদ, জৈমিনি, ব্যাস, মধ্বাচার্য, রামানুজম, শঙ্করাচার্য ইত্যাদিরা যা বলে বা লিখে গিয়েছিলেন তৎকালে তা ‘দর্শন’ নামে বিবেচিত হতো কি? সম্ভবত না। প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ ও অপার বৈচিত্র্যময় এই জগতের দিকে তাকিয়ে যুগপৎ বিস্মিত ও কৌতূহলী হয়েছিলেন অগাধসলিলা সরস্বতী নদীর তীরের আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষেরা। তারই ফল স্বরূপ যেগুলি বিবেচিত হয়েছে সাংখ্য, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা, উত্তরমীমাংসা, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ইত্যাদি হিসেবে, এগুলির ভিতর দিয়ে তাঁরা যা বলতে চেয়েছিলেন নিজেদের জীবন-চর্যায় তাই তাঁরা প্রতিভাত করে গিয়েছিলেন, যার অন্ত বোধিতে বা মুক্তিতে। এমনকি বস্তুবাদী চার্বাকেরাও চর্যায় ছিলেন বস্তুবাদী দর্শনানুগ। অর্থাৎ, আদিতে দর্শন আসলে জীবন-চর্যার নামান্তর ছিল ও পরিশেষে জীবনের অন্তিম লক্ষের সন্ধানী। এসব দূর অতীত বা সুপ্রাচীন কালের কথা। স্বতন্ত্র একটি বিষয় হিসেবে ‘দর্শন’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বহু পরে মূলত পাশ্চাত্যের হাত ধরে। আমাদের নিকটবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীর দর্শন বলে যা পরিচিত বলা বাহুল্য তা জোরালো ভাবে পাশ্চাত্যেরই অবদান। এর সূত্রপাত মোটামুটি ভাবে George Edward Moore-র আধুনিক বাস্তববাদের হাত ধরে, প্রসারিত হাল আমলের Slavoj Zizek পর্যন্ত। ... ...
শিক্ষকতার চাকরি করি, সেই অবস্থান থেকে লজ্জিতবোধ করলেও, স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে, বিশেষত কেন্দ্রীয় সংস্থা ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পাঠক্রমকে এত অপ্রাসঙ্গিক ও হাস্যকর আগে মনে হয়নি। চারিদিক যখন বালির প্রাসাদের মতো ভেঙে পড়ছে, তখন দেশের শহরকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষা এমনই আচরণ তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পাঠক্রমের সঙ্গে তিলমাত্র আপসে না গিয়ে, যেন অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার অসহয়তাটুকুকে বাদ দিলে বাদবাকি সব একদম স্বাভাবিক আছে; এমনকি উন্নতিও করছে। ... ...
ভারতবাসীর মনে হিমালয় পর্বতমালা এক রোমান্টিক ধারণায় অবস্থিত। আমরা ছোটবেলা থেকেই উত্তরে গিরিরাজ হিমালয় এবং তার ভাবগম্ভীর একটি মূর্তিকে কল্পনা করি ধর্মীয় অনুষঙ্গে। সেখানে দেবতাদের বাস, হিন্দু দর্শনের বহু তীর্থ এই হিমালয়ে অবস্থিত। হিমালয়- যা দুর্গম, যা উচ্চ, যা ভয়ংকর সুন্দর। কিন্তু কয়েক দশক ধরে যেভাবে উন্নয়নের নামে এখানে গাছ কাটা হয়েছে এবং ভয়ঙ্কর সব বাঁধ তৈরি করা হয়েছে তা নিয়ে সমতলের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। সময়ের সাথে সাথে স্থানীয়দেরও অনেকেই উন্নয়ন মানে চাকরি এই আপ্তবাক্য মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সুন্দরলাল বহুগুণার মত মানুষ বরাবর আন্দোলন করেছেন। সুন্দরলাল গোটা বিশ্বের কাছে চিপকো আন্দোলনের মাধ্যমে হিমালয়ের ভয়াবহ পরিবেশ ধ্বংসকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে অরণ্য ধ্বংসের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ায় কাজের সন্ধানে পুরুষদের দূরদূরান্তে যেতে হয়। থেকে যান মেয়েরা, যাদের উপর থাকে সমস্ত দায়িত্ব। ... ...
পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে বাংলাদেশ যেমন তিস্তার জল পাওয়ার দাবী তুলেছে, তেমনি আমাদেরও একটি উল্টো দাবী জানানোর জায়গা রয়েছে বাংলাদেশের কাছে। সেটাও নদীর জল নিয়েই। যে সমস্ত নদী বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢোকে, তার মধ্যে যেমন দক্ষিণ দিনাজপুরের আত্রেয়ী, যমুনা আর উত্তর দিনাজপুরের কুলিক রয়েছে। এই নদীগুলোর ওপর ‘রাবার ড্যাম’ দিয়ে জল আটকে রেখেছে বাংলাদেশ। এটি হল জাপানি টেকনোলজি। দেখতে অনেকটা লম্বা টিউবের মত। যেখানে বাতাস ভরে ড্যামের আকৃতি তৈরি করে নদীর জলের প্রবাহ রোধ করা হয়। আর তার ফলে ভারতের দিকের নদী পাড়ের স্থানীয় এলাকার মানুষেরা জল সংকটে ভুগছে। চাষের ক্ষতি হচ্ছে। ... ...
৬ই জুলাই রাতে শুতে যাবার আগেও মার্ক জানত না যে সেদিন পার্কে ঘুরতে যাওয়া বাচ্চাদের মধ্যে তার বাবাকে আবার জীবিত দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য তারই হবে! সেই রাতেই মৃত্যুর দিক থেকে দেখতে গেলে অফশোর তেলের রিগ-এ ঘটে যাওয়া এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনায় ১৬৭ জন প্রাণ হারান – মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে। ছয় তারিখে অফশোর অ্যাকোমডেশনে রাতে ছিলেন মোট ২২৮ জন, এর মধ্যে বেঁচে গিয়েছিলেন মাত্র ৬১ জন – মার্কের বাবা তাঁদের মধ্যে একজন। ... ...
"আমরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। তাই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। তার জন্য সরকারকে দায়ী করা মোটেই উচিত নয়!” – ভক্তদের এই প্রচার নিশ্চয়ই আপনার মোবাইলস্ক্রিনে ভেসে উঠেছে বেশ কিছু বার। ভক্তদের চরিত্রই হল অর্ধসত্যর উপর নিজেদের নির্মাণকে খাড়া করা। ওপরের তথ্যটাই যদি আপনি দেশের জনসংখ্যার নিরিখে দেখেন, তাহলে, একদম শুরু, মানে ২০২০-র প্রথম থেকে ৬ মে ২০২১ পর্যন্ত ভারতে ১০ লাখ মানুষ প্রতি (per million) সর্বমোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা *১৫,৪২৯ / ১৬৮*। বিশ্বে আমাদের স্থান *১১৩ / ১১০* নম্বরে। এই পরিসংখ্যান অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার কতজন সংক্রমিত / মৃত - অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে একবার দেখে নেওয়া যাক। ... ...
সর্বোপরি, আবার একবার বলি- স্টেরয়েড নিয়ে অযথা ভয় পাবেন না কিন্তু সতর্ক থাকুন। স্টেরয়েড একটি আশীর্বাদ। স্টেরয়েড আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার অন্যতম স্তম্ভ। স্টেরয়েডের যুক্তিযুক্ত ব্যবহার অসংখ্য মানুষকে রোগমুক্তি দিয়েছে। ভবিষ্যতেও দেবে। এবং, এটা ভাবুন- যখন লাভক্ষতির হিসেব করবেন তখন যদি লাভের ঘরে অনেক বেশি জমে তাহলে সামান্য সাইড-এফেক্টের দুশ্চিন্তা ভুলে থাকাই শ্রেয়। দুর্ঘটনা এড়ানোর ভয়ে কে কবে রাস্তায় নামা বন্ধ করেছে? ... ...
শুরুটাও বেশিদিন আগে নয়। প্রথম স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় ১৯৩০ সাল নাগাদ। তখনও তার নাম স্টেরয়েড হয়নি। প্রথমদিকে মূলত টেস্টোস্টেরন জাতীয় যৌগ ব্যবহার হ'ত। প্রথমে মুখে খাওয়া হ'ত। পরে জানা যায়, মুখে খেলে অধিকাংশটাই লিভারে ধ্বংস হয়ে যায়। তখন পেশীতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেওয়া আরম্ভ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের মধ্যে শক্তিবর্ধক হিসেবে স্টেরয়েড নেওয়ার চল শুরু হয়। নাৎসী ক্যাম্পগুলোতে যুদ্ধবন্দীদের ওপর স্টেরয়েড প্রয়োগ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। শোনা যায়, হিটলার নিজেই নাকি স্টেরয়েড নিতেন এবং তার ফলে তাঁর মধ্যে স্টেরয়েড সাইকোসিসের লক্ষণ দেখা যায়। ১৯৫৬ সালের ওলিম্পিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাথলেটরা নিজেদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে শারীরিক সক্ষমতা বর্ধক ওষুধ প্রয়োগ করেন এবং খেলায় চোখ টাটিয়ে দেওয়ার মত সাফল্য পান। ১৯৫০ সালে প্রেডনিসোন আবিষ্কার এবং তার বানিজ্যিক উৎপাদন ৫ বছর বাদে। তারপর পরবর্তী ছয় দশকে স্টেরয়েড মডার্ন মেডিসিনের রাজপথ-অলি-গলি চষে বেড়িয়েছে। বর্তমানে মডার্ন মেডিসিনের প্রতিটি সাব-স্পেশালিটির সাথে স্টেরয়েডের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ... ...
মিউকর সংক্রমণ চিরকালই ডায়াবেটিস কিংবা রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যাদের কম তাদের মধ্যেই দেখা যেত। এই বছরও যেসব কোভিড রোগীদের ডায়াবেটিস আছে অথবা অন্যান্য ইমিউনোকম্প্রোমাইজড রোগ আছে অথবা মাত্রাতিরিক্ত স্টেরয়েড দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যেই এই রোগটির সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে শুধু এটা বললেই চলবে না, তার কারণ কিছু কোভিড রোগী যাদের বয়স কম, যাদের ডায়াবেটিস কিংবা অন্যান্য রোগ নেই, যারা স্টেরয়েড পাননি তাদের মধ্যেও কিন্তু দেখা যাচ্ছে , যা খুবই বিরল। এ থেকে আমরা এই ধারণা করতে পারি যে, করোনা রোগটি মানুষের শরীরে নিশ্চয়ই এমন বিশেষ কিছু করছে যাতে এই ছত্রাক সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই প্রসঙ্গে এটাও বলে দেওয়া ভাল যে, সাধারণ মানুষের নাকে এমনিতেই যে মিউকর থাকে তা কিন্তু কোনো ক্ষতি করে না, কারণ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো আছে তাদের এর থেকে কোনো ক্ষতিই হয় না। শুধু তাদেরই হয় যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে সেটা কোভিড হোক বা ডায়াবেটিস হোক বা অন্যান্য ইমিউনোকম্প্রোমাইজ রোগ হোক বা তাদের এমন ওষুধ দেওয়া হয়েছে যথা স্টেরয়েড বা অন্যান্য ওষুধ যেগুলো কিনা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় আর তাদের মধ্যেই এই ধরনের ছত্রাক সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। ... ...
এ তো গেল সামাজিক আচার-বিচার সংক্রান্ত চাপ, যা রবীন্দ্রনাথকে সামলাতে হয়েছিল। কিন্তু এর পাশাপাশি শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থাটাকেই ভিতর থেকে বদলে দেবার জন্য রীতিমত অন্তর্ঘাত চলতে থাকে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার পর থেকেই শান্তিনিকেতনে এই মারণ-জীবাণু প্রবেশ করে। নোবেল-প্রাপকের বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়িয়ে আত্মপ্রসাদ ও সামাজিক গরিমাবৃদ্ধির তাড়নায় সেখানে সামাজিকভাবে উচ্চ আর ধনী অভিজাত শ্রেণীর ভিড় বাড়তে থাকে। এই শ্রেণীটির অর্থ এবং তজ্জনিত ক্ষমতার জোর ছিল প্রবল। মূলত তাঁদের চাপেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক অবাঞ্ছিত পরিবর্তনেও সায় দিতে বাধ্য হন। আগে এখানে মণ্ডলীপ্রথায় শিক্ষা হত, অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক একই সঙ্গে মাটিতে বসে পড়াশুনা হত। তিরিশের দশকেই তার পরিবর্তে শিক্ষকদের জন্য উঁচু মাটির বেদী তৈরি হয়। খাওয়াদাওয়ার পর ছাত্রদের নিজেদের বাসন মেজে নেবার রীতিও উঠে যায়। ছবি আঁকা, গান, হাতের কাজ, গ্রামসেবা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে মূল পাঠক্রম থেকে সরিয়ে ‘আনুষাঙ্গিক পাঠক্রমে’ পরিণত করা হয়। ১৯৩১ সালে বিশ্বভারতীর তরফে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাতে শান্তিনিকেতন ওই সময় কী কী বিষয়ে পঠন পাঠন হয় এবং কী কী পরীক্ষা বা ডিগ্রি দেওয়া হয়, তার উল্লেখ ছিল। তাতে এও জানানো হয়েছিল যে, বিশ্বভারতীর ছাত্রদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আই.এ এবং বি.এ পরীক্ষা দেবারও ব্যবস্থা আছে। মহান রাবীন্দ্রিক শিক্ষাদর্শ থেকে মুখ ঘুরিয়ে এই যে বিশ্বভারতীর কেরানী-গড়ার প্রথাগত শিক্ষার দিকে চলন, তা-ই রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করে তুলেছিল। ১৯২৫ সালে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন, “একদিন এই কলেজের বিরুদ্ধে মাথা তুলেই একলা আমার তরী ভাসিয়েছিলুম --- কিন্তু তরী ঘুরেফিরে এলো সেই কলেজের ঘাটেই। বসে বসে দেখছি … শান্তিনিকেতন আপন আইডিয়ালের গর্ব ভাসিয়ে দিয়ে ছেলে পাশ করাচ্ছে। … ভাগ্যে ছিল আমার কলাভবন এবং শ্রীনিকেতন। আমার শেষ বয়সের সমস্ত চেষ্টা যদি ঐ কলাভবন সংগীত ভবনের জন্য দিতে পারতুম … মনে করতুম জীবন সার্থক হয়েছে।“ ... ...
ব্রজ রায়দের লড়াই থামে না। একের পর এক বাধা পেরোতে হয়। ব্রজ রায় মনে করতেন, আদর্শ কমিউনিস্ট হতে গেলে একজন ব্যক্তিকে নিজের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়। জীবনচর্যায় নিরন্তন চাই সেই বোধের অনুশীলন। অনাড়ম্বর জীবন যাপনই কেবল নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি ছিলেন সেই আদর্শের সৈনিক। আন্দোলন যাতে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার কাজ থেকে সরে না আসে, সরকারি বা বিদেশি অনুদান নির্ভর সংগঠনে পরিণত না হয় সে বিষয়েও শেষদিন পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। কারণ এন জি ও’র নামে অরাজনীতির রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করতেন। অভ্যাসবশত আমরা অনেকেই এমন শব্দ ব্যবহার করি, ভাববাদী ধারণা থেকেই যেগুলির জন্ম। কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে প্রয়াত শব্দটি আমরা প্রায়শই ব্যবহার করি। কিন্তু তাঁর এই শব্দে আপত্তি ছিল। শব্দটির সঙ্গে চলে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। যাওয়া মানেই তো গন্তব্যস্থল রয়েছে। তাঁর মতে মৃত্যুর পর ইহলোক থেকে পরলোকে যাওয়ার ধারণা থেকেই মৃত ও প্রয়াত কে সমার্থক করা হয়েছে। তাই এই শব্দের ব্যবহার মানে, পরলোকের ধারণাকে মেনে নেওয়া। আমরা অনেকেই ভাগ্যবাদী না হয়েও সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য এসব কথা ব্যবহার করি। তাঁর সামনে কেউ এসব শব্দ ব্যবহার করলেই তিনি আপত্তি করতেন। অভ্যাস ভাঙ্গাই তো এগিয়ে চলার শর্ত। সারা জীবন তিনি পথ খুঁজে এগিয়ে গেছেন, অনতিক্রম্যকে অতিক্রম করে। মৃত্যুর পরে তাঁর উত্তরসূরীরা সেই কাজই করলেন। করোনায় মৃত্যুর পর তাঁর দেহ রোগ নির্ণায়ক ময়নাতদন্তের কাজে লাগলো। গণদর্পণের কমরেডদের প্রচেষ্টা ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সদিচ্ছা ছাড়া একাজ হত না। প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সির জন্য তাঁর লড়াই কয়েক কদম এগিয়ে গেলো। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজেই রাজ্যের প্রথম মরণোত্তর দেহদান হয়েছিল আর সেখানেই হল প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সি। দুটি ঘটনার সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন ব্রজ রায়। এভাবেই এগিয়ে চলে ইতিহাস। ... ...
৭ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ হর্ষ বর্ধন ঘোষণা করছেন যে আমরা অতিমারির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি; ৩০ মার্চ বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে; ২৭ এপ্রিল বলছেন সরকার মারির মোকাবিলায় শারীরিক ও মানসিক ভাবে অনেক বেশি প্রস্তুত, সারা দেশে যখন খোলা আকাশের নীচে লাইন দিয়ে চুল্লি জ্বলছে তখন নির্লজ্জ ভাবে মিথ্যা বলছেন যে বেড, অক্সিজেন, ওষুধের কোনও অভাব নেই; ২৯ এপ্রিল গর্ব করছেন মৃত্যুহার সারা বিশ্বে ভারতেই সবচেয়ে কম (১.১১%); পরের দিন আবার গর্ব করছেন যে ২.৬৯ লক্ষ মানুষ আরোগ্য লাভ করেছে, ২.২৮ কোটি মানুষ টীকাকরণের জন্য নাম লিখিয়েছে এবং আবারও নির্লজ্জ ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে কোনও রাজ্য সরকারের কাছে টীকা মজুত নেই। এর সাথে আছে হিমালয়সম দম্ভ, স্বেচ্ছাচারিতা এবং হিরো সাজবার উদগ্র বাসনা। ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের কাছে ত্রাতা সাজলেন। নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন যে, ভারত বহু দেশকে টীকা সরবরাহ করে পৃথিবীকে সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করেছে। তিন মাসের মধ্যে দেখা গেলো টীকার অভাব এতোই প্রকট যে নিজের দেশের বরিষ্ঠ নাগরিকদেরই দু ডোজ দিতে পারা যাচ্ছে না। তিনি এতোই বেপরোয়া, বাংলার মসনদ দখলে এতোই মত্ত যে ১৭ এপ্রিল যখন কোভিড ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তখনো নির্বাচনী সভায় সদম্ভে দাবি করলেন যে এতো মানুষ এর আগে কোনও সভায় তিনি দেখেননি। ... ...
বীরচন্দ্রের মৃত্যুর পরে ১৮৯৬ সালের শেষে মহারাজা রাধাকিশোর সিংহাসনে বসেন চল্লিশ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথেরই সমবয়সী। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। রাধাকিশোরের রাজত্বের ছমাস কাটতে না কাটতেই ১৮৯৭ সালের প্রবল ভূমিকম্পে ত্রিপুরা সহ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে করুণ আর্থিক অবস্থার মুখোমুখি হয় রাজ্য এবং তার মধ্যেই রাজপারিষদদের স্বার্থপর আচরণে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। রাধাকিশোরের একান্ত অনুরোধে তাঁকে সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভেবে অবাক হতে হয়, সাহিত্যের নান্দনিক বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এসে বিরাট ধৈর্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বন্ধুকে রাষ্ট্রশাসনের কূটিল বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, নিজে ত্রিপুরায় হাজির হয়ে শাসন ব্যবস্থার নানা ত্রুটি বিচ্যুতি লক্ষ্য করে উপযুক্ত বিশ্লেষণ সহ একটি গোপন নোট পাঠান রাজার কাছে। তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কবির বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে... ... ...
করোনা প্রতিরোধের নাম করে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলকে এড়িয়ে খোলা হয়েছিল " PM Care Fund"- যার পরিচালক মন্ডলী শাসকদলের কার্যকর্তায় ভর্তি। উঠেছে ৩৫ হাজার টাকা। ব্যবসায়ীরা কর ছাড়ের জন্য ঐ তহবিলে ঢেলে অনুদান দিয়েছেন। সে টাকা কোথায় গেল? ভারতের ১৩৮ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৪০% এর বয়স ১৮- এর নীচে। বাকি রইলো ৮৪ কোটি নাগরিক। ১৫০টাকা (বর্তমান বিক্রয়মূল্য?) করে ডোজ দিতে খরচ হয় ২৫,২০০ কোটি টাকা। এই টাকা কি ভারত সরকারের নেই! ২০২১ শে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বাজেটে মোট বরাদ্দ প্রায় ২.২০ লক্ষ কোটি টাকা। তার মধ্যে ৩৪ হাজার কোটি কোভিড টীকার জন্য। P. M. Care এ আরো ৩৫ হাজার কোটি। এই সত্তর হাজার কোটি টাকা থেকে ২৫ হাজার কোটি বার করা কি অসম্ভব? আরও আশ্চর্যের বিষয় নিধিরাম সর্দার রাজ্যগুলির দিকে দায়িত্ব পুরো ঠেলে দেওয়া হল, তাদের সরাসরি একটা বেসরকারি সংস্থার থেকে টীকা কিনে নিতে বলা হলো অগ্রিম অর্থ দিয়ে। অথচ টীকার সামগ্রিক উত্পাদন ও বন্টনে রাজ্যের কোনো হাত নেই। বর্তমানে যে হারে দুটি ভ্যাক্সিন উত্পাদন হচ্ছে, তাতে সবাইকে টীকা দিতে গেলে দেড় বছর সময় লেগে যাবে। তার মধ্যে তৃতীয়( বুস্টার) ডোজের দরকার হবে কিনা কে জানে ! প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকার ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন যা নাগরিকদের করের টাকা। যুক্তি ছিল জনস্বার্থ। এখন পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য আদার পুনাওয়ালা আবার সাহায্য চাইছেন। অথচ মানুষ টীকা কিনবে সাত থেকে দশগুণ দামে (যদি ক্ষমতায় কুলোয়)। এরা কি সাধারণ ভারতবাসীকে দিয়ে লাশবিপণি খুলে বসেছেন? ... ...
ও-জে-সিম্পসন নিজের স্ত্রীকে খুন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন, বহুদিন ধরে বহুল-চর্চিত ট্রায়াল হয় তার, সে ট্রায়ালের সম্প্রচার হয় সারা আমেরিকা জুড়ে টেলিভিশনে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, প্রথমবার ট্রায়ালে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ছাড় পেয়ে যান ওজে। প্রসিকিউশন প্রমাণ এনে দেন ওজে নিজের স্ত্রীকে মারধোর করতেন, কিন্তু ডিফেন্স অ্যাটর্নি অ্যালান ডেরশোউইজ সওয়ালে বলেছিলেন, তাতে কী? প্রতি ২৫০০-এ নির্যাতনকারীর ১ জন খুন করেন শেষমেশ। জুরির লোকেরা একটু বেইজ থিয়োরেম জানলেই দেখতে পেতেন এই তথ্য বরং প্রমাণ করে যে ওজে সিম্পসনের দোষী হওয়ার সম্ভাবনা ৯০% এর উপরে! ... ...
কবিতাপ্রয়াসী হিসেবেই শুধু নই, একজন পাঠক হিসেবে মনে হয়, কবিতা ও কবিতা সংক্রান্ত ভাবনাবিশ্বের যে যুগলবন্দি তিনি তৈরি করেছিলেন ধারাবাহিক ভাবেই, তা আমাদের খোলা হাওয়ার বাঁচতে শেখায়। কারণ একপ্রকার ভাবনাগত দৈন্যের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। এ সময় শঙ্খ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মতো কবিদ্বয় আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, তাই আমাদের আগামীদিনের সহায় হয়ে উঠতে পারে। দুজনকেই আমরা হারিয়েছি খুব অল্প ব্যবধানে। অথচ দুজনেই তাঁদের চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগে পর্যন্ত তাঁদের সৃষ্টি ও ভাবনায় আমাদের সমৃদ্ধ করে গেছেন। ... ...
প্রকৃতপ্রস্তাবে বর্তমানের বিজেপি হল ভারতীয় জনমনের প্রকৃত প্রতিফলন। এই সরকার দেশের উদার-গণতন্ত্রের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে জনগণকে একেবারে তার উলঙ্গ প্রতিলিপির সামনে সটান দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিজেপি দেশকে একটি বাইনারির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ... ...
সঙ্ঘের চেয়ে সত্য বড়। আর সেই সত্যের খাতিরে রেয়াত করা চলে না কারোকেই। দ্বিতীয় তথ্যটিও এই সত্যভাবনা সম্পর্কিত। একেবারে শুরু থেকেই সে নিষ্ঠা প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়েছে। শান্তিনিকেতনের সাহিত্যমেলায় উচ্ছ্বসিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়ে ফেললেন তরুণ শঙ্খের একটি কবিতা। কবি তখন পদ্মাপারের শৈশব স্মৃতি ও ছন্নছাড়া বড় হয়ে ওঠা পেরিয়ে প্রেসিডেন্সির ছাত্র। বুদ্ধদেব বসু উপস্থিত ছিলেন সে সভায়। মুখচোরা লাজুক শঙখ যাবেন না ভেবেও কী করতে যেন সেখানে উপস্থিত। সুভাষের বক্তব্যের পর বুদ্ধদেব মহা উত্তেজিত হয়ে অনাহুত ভাবেই মাইক তুলে নিলেন৷ কবিতা লেখা এতো সোজা নয়। স্লোগান বা প্রচার তার উপজীব্য হতে পারে না কখনো। কবিতা এক গাঢ়তর বোধের জগত,ভাত ভাত বলে সরল চিৎকার করলেই সেটা কবিতা হয় না। এইরকমই কিছু নাকি সেদিন বলেছিলেন তিনি। ... ...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে মার্কিন সাংবাদিক মিল্টন মায়ার গিয়েছিলেন জার্মান মহানগর ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে একটা গ্রামে। উদ্দেশ্য: গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলে বোঝা যে, নাজ়ি পার্টির শাসনে থাকাটা সাধারণ গ্রাম্য জার্মান নাগরিকের চোখে কেমন ছিল। মায়ার সেখানে দশ জন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন, এবং তাঁদের সাথে কথা বলে তাঁদের চিন্তাভাবনা বুঝে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। মায়ার আবিষ্কার করেন যে, সেই দশজনের মধ্যে কেবলমাত্র একজন (হ্যাঁ, ঠিক-ই ভাবছেন, মানে মাত্র ১০ শতাংশ) মনে করতেন যে, হিটলারের নাজ়ি পার্টির শাসন ছিল স্বৈরাচারী শাসন। ... ...