আমার প্রজন্ম নতুন করে দেশভাগ-মন্বন্তর-মহামারী দেখছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হচ্ছে আবার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ের পর। আমার ঘরে এসে আমাকেই ভাড়াটে বানাতে যায় আগন্তুক! বাংলাদেশের বরিশালের বাসিন্দা ছিলেন আমার দাদামশাই। মুকুন্দ দাসের দলে গান করতেন। ব্রিটিশ বিরোধী গান করে জেলে গেছেন। এপারে এসে দক্ষিণ কলকাতার এই কলোনির বাসিন্দা হন তিনি। এই উদ্বাস্তু কলোনি তখন দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে আমরা দেখেছি আজাদগড় কলোনি। ঋত্বিক ছাড়াও বিজন-দেবব্রত-জ্যোতিরিন্দ্র-সলিলদের কাজে বারবার ধরা দিয়েছে এই যন্ত্রণা। ... ...
আপনি যদি বিশালকায় হোল্ড -অল আর স্যুটকেস নিয়ে নেমেছেন তো লালজামা লালগামছা কুলিদের শরণাপন্ন হতেই হবে। আজকের নীল বা সবুজ জামা কোথায়? হারিয়ে যাবার ভয় নেই , সবার হাতে তাবিজের মত করে বাঁধা পেল্লায় এক একটি পেতলের চাকতি, তাতে নম্বর লেখা। ওটা মনে রাখলেই হবে। ট্যাক্সির প্রি-পেড বুথ বা স্ট্যান্ড কিস্যু নেই। মিটারে যায়, শেয়ারে যায় । কখনও সামান্য দরাদরি। দুই থেকে পাঁচটাকায় হাওড়া থেকে পার্কসার্কাস। ... ...
ধরা যাক, সন্ধের কালবৈশাখীর পর ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও থেমে গিয়েছে। এখন শুধু ক্লান্ত পাতাগুলো থেকে টিপটিপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। বাগান ছন্নছাড়া। ভেঙে পড়া পাখির বাসায় ইঁদুরেরা হামলা চালিয়েছে। আর ঠিক এসবের মধ্যিখানে, একটি মা মরা ছেলে, ঘুম থেকে উঠে দেখছে, তার বাবা ও মা কোনো একটি গাছের মগডালে নবদম্পতির সাজে পা ঝুলিয়ে বসেছে। খুনসুটি করছে। সরষে রঙের আলো এসে পড়েছে তাদের শরীরে। তারা রস ও রতিতে বিভোর। এতই বিভোর যে তাদের ক্রিয়া মসলিনের মতো গাছের ডালপালায় বিঁধে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু সন্তানের দিকে তাদের খেয়াল নেই। ... ...
বাপে আমার মন বুঝত মানুষের। আকবর প্রায়ই বাপের কাছ থেইকা পাখি কিনে। মনে মনে কিনে। বাপে বলে, আকবরের কাছে ম্যালা পাখি হইছে। অর বুকের ভিতর পাখিগুলা ফড়ফড়ায়.. সক্কালবেলা দ্যাশের পাখি জাগার আগে অর বুকের পাখি কিচিরমিচির করে। আমি বাপের কথা ধুন ধইরা শুনি। এমন আশ্চর্য কথা শুধু আমার বাপেই কইতে পারে। পাড়ার খালায় বলে, তোর বাপের মাথায় ছিট আছে। তুইও কি ওই রকম ছিটাহি হইবি? খাওন দাওনের ঠিক নাই। বয়স হইতাছে কত খিয়াল আছে? তর ফ্রকে যে উড়না দেওন লাগে সেই চোখও নাই কি তর বাপের? ... ...
জায়গার নাম চক ইসলামপুর। বহরমপুর থেকে কিলোমিটার পঁচিশেক দূরে শহুরে ভাষায় এক হদ্দ মুদ্দের 'গণ্ডগ্রাম'। সেই গ্রাম, যা নবাব থেকে হালের আমল পর্যন্ত সকলেবরে অক্ষত 'মুর্শিদাবাদ সিল্ক' এর প্ৰথম প্রাণকেন্দ্র; খাদি এবং রেশম যেখানে হাত ধরাধরি করে বাঁচে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যা কিছু রোশনাই, নহবত ছিল, ১৯২৯ এর বিশ্বজুড়ে মন্দার গ্রাসে সেসব ভয়াবহ ধাক্কা খায় । সেসময় গ্রামের ললিতমোহন সাহা, তৎকালীন বোম্বে প্রদেশের অল ইন্ডিয়া স্পিনার্স অ্যাসোশিয়েশন ও খাদি ভান্ডারের প্রতিষ্ঠাতা-কর্তা এবং স্বয়ং গান্ধীর খাদি দ্রব্যাদির বাণিজ্যিকরণের দায়িত্বে থাকা শ্রী জেরাজিনিজির সাথে যোগাযোগ করে রেশমশিল্পকে খাদির সাথে বিবেচনা করবার জন্য বারবার বোঝাতে থাকেন। ভারত জুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের সৌজন্যে গ্রামীণ শিল্পের কদর তখন তুঙ্গে। ললিতমোহন বাবু দূরদর্শী। তিনি আন্দাজ করেন, গ্রামের মানুষের নিজের হাতে তৈরি রেশম শিল্পও যে খাদির সমতুল্য "খাঁটি ভারতীয়"; এটা গান্ধী-জেরানিজিদের একবার বোঝাতে পারলেই মুখ থুবড়ানো সিল্ক-ইন্ডাস্ট্রি শ্মশানের আগেই কল্কে পাবে। ... ...
"দরজার উল্টোপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ওরা ডাকছিল। “দরজা খুলে দে আমাদেরর না হলে ওটা ভেঙে ফেলব আমরা”। সে দরজা খুলেছিল। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অনেক লোকজন ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ওদের মাথা ঢাকা। বাচ্চারা ভয়ে জেগে উঠতেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিল। রোসা বাচ্চাকে এক হাতে নিয়েছিল আর মেয়েটাকে দু পায়ের ফাঁকে। যে লোকটা আলো জ্বালিয়েছিল তার পরনে অন্যদের মতই কালো পোশাক। বুট জুতো পরা। কারো কারো মুখে লাল রঙের রুমাল বাঁধা আর কালো টুপি দিয়ে মুখ ঢাকা। " ... ...
দেড়শো বছরের পুরোনো অশথ তলা এসে গেল। পুরোহিত মশাই-- সইত্য পুরোইত -- এসে গুছিয়ে নিয়েছেন। এবার পূজো শুরু। বেশ ঘটাপটা করে মন্ত্র ফলমূলের নৈবিদ্য দিয়ে সময়সাপেক্ষ পূজো। প্রতিবারই কেউ না কেউ সংক্ষেপ করার আবেদন জানায় এবং " সইত্য ঠাকুর " সেটি মঞ্জুরও করেন। ছেলেদের কপালে হলুদ ছুঁইয়ে, হলুদ রঙের ষাট সুতো তাদের হাতে বেঁধে দেন। মেয়েদের বাঁহাতে তাগা বাঁধা হয়। উলু আর শাঁখ ঘনঘন বেজে ওঠে। এবার শুরু হবে ব্রতকথা। ... ...
খুব বেশিদিন নয়, মাত্র অর্ধশতক আগের কথা এসব। কোন্ বিত্তে এই ফুলের শিশুদের অবস্থান তা বোঝার বয়স তাদের ছিলনা। তাদের পাপড়ি মেলে জীবনের দিকে প্রথমবার চোখ তুলে তাকানোর সেই মধুর কালপর্বে মুখে মুখে ছড়ার অবাধ গতায়াত ছিল। যে বাংলা ছড়ায় তাদের বর্ণপরিচয়ের হাতেখড়ি সেই অ-এ অজগর সত্যিই তেড়ে আসে কিনা বা আ-এ আমটি পেড়ে খাওয়া কতটা সহজলভ্য তা তাদের কল্পনা শক্তিকে উস্কে দিতে যথেষ্ট ছিল। যে কল্পনায় রং তুলির কাজটা অনায়াসে করে দিত তাদের ঠোঁটের ফাঁক আলগা হয়ে বেরোনো মরমী বাংলা ছড়া। বা, বাস্তবের হাটের যে অতুলনীয় রূপকল্প যেমন, উচ্ছে বেগুন পটল মুলো/ বেতের বোনা ধামা কুলো/ সর্ষে ছোলা ময়দা আটা / শীতের রাপার নক্শা কাটা.., তা কি সংসার যাপন সম্পর্কে শিশু হৃদয়ে এক আবিলতা এনে দেয় না ? জীবনের সহজিয়াকে বুঝতে কোমল হৃদয়কে কি ছড়ার এই ছবি যথেষ্ট উৎসাহ দেয় না ? যে ছড়াতে পল্লীবাংলার ঋতুবদলের ছবি শিশুমনকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসে তা তো স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকার কথা। আমরা কি কোনো দিন ভুলে যাবো- আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে..। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ জড়িয়ে আছে যার পরতে পরতে। চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,/ একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। অথবা, আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর/ মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। এ তো গেল রবীন্দ্রনাথ জানার সহজপাঠ। বাংলার শিশু সমাজ যাঁকে এক কথায় হৃদয়ে জায়গা করে দিয়েছিল। কে যেন ততক্ষণে আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে অন্য কাড়ানাকাড়া। রিন্ রিন্ করে বেজে চলেছে সুকুমারের আবোল তাবোল। ... ...
ছড়া মূলত গ্রাম্য সাহিত্য, মানুষ তাদের বাচিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ছন্দোবদ্ধ ভাবে কথা বা মনের ভাব প্রকাশ করে এই ছড়ার মাধ্যমে। আবার এই ছড়াগুলি পরম্পরায় প্রচলিত ও প্রচারিত। আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে এইসব ছড়ার পাঠভেদও দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইসব ছড়া গুলি কে, কবে রচনা করলেন তা কেও জানে না, কিন্তু সমাজে এগুলি চিরকাল ধরে প্রচলিত। ব্যক্তিক সৃষ্টির এরকম সার্বিক স্বীকৃতি খুবই বিরল। এই ছড়ার রূপরেখা দেখলে বোঝা যায় প্রায় সব এলাকাতেই ছড়া মূলত দু’রকম- ছেলে ভুলানো ছড়া ও সর্বজনীন ছড়া। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় ছেলে ভুলানো ছড়া, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় পুরুলিয়াতে প্রচলিত ছেলে ভুলানো ছড়া। ... ...
সে এক ঝলমলে দিন ছিলো গ্রীষ্মকালে। বাকেট্লিস্টের একটা বাক্সে টিকচিহ্ন দেবার জন্য আমি সাঁতার কাটতে গেছিলাম । গ্রেট লেকগুলোর মধ্যে একটায়। মিশিগান। গভীর অন্ধ্কার জল, তার মধ্যে আস্তে আস্তে নিজের বল্গা খুলে দিতে হয়। আমি টের পেয়েছিলাম জল আমার সাথে কথা বলছে। না, ওর কথা 'শোনা' যায়না। তোমায় বুঝতে হবে, সারা শরীর দিয়ে। ও স্রোতের ভাষা বলে। ঢেউ এর ভাষা। অতলের ভাষা। তরলের। আর আরো কতকিছুর, পৃথিবীর শব্দ দিয়ে যার নাম বলা যায়না। বিশাল গভীর মিশিগান, আমার সাথে কথা বলেছিলো। আপনজনের মত। সেই থেকে আমি জলের সঙ্গে কথা বলতে পারি। মিসিসিপি নদী ভয়ানক রেগে থাকে। মানুষরা ওকে এমন বিষিয়ে দিচ্ছে। রাগবে না তো কি করবে? হুরন লেক আবার খুব লক্ষ্মী মতো। মিশুকে, হাসিখুশি। মস্ত লেক সুপিরিয়র কি গম্ভীর! আমার সেই কঠিন নিষ্ঠুর শিকারী কাকুর মত। যিনি এককথায় আমার জন্য নিজের প্রাণটা দিয়ে দিতে পারতেন! ডেড সী ও চুপচাপ খুব। ইন্ট্রোভার্ট। সমাহিত। অথচ ভূমধ্য সাগর? ভূমধ্য সাগর আমাকে বলেছিলো ওকে 'খাতুনা' বলে ডাকতে। এক নম্বরের ফ্লার্ট একটা! না, এসব আমি বলতে যাইনা কারুর কাছে। বলে কী হবে? আমি যে জলের সঙ্গে কথা বলতে পারি কেউ তো আর বিশ্বাস করবে না? ... ...
ফড়িংচাঁদরা যেদেশে থাকতেন, বেস্পতি নামটা সেখানকার । এর সঙ্গে নির্দেশ করা হতো বিভিন্ন যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রচনায় খেলানো পৌরাণিক চরিত্রকে। সে দেশের সনাতন সাহিত্যমতে বেস্পতি তাদের বৈদিক যুগের একজন ঋষি, যিনি দেবতাদের পরামর্শ দিতেন। মধ্যযুগের বইতে এই বেস্পতি গ্রহকেও ইঙ্গিত করত। বৈদিক বইতে উনি হলেন বাগ্মিতার দেবতা, আর কখনও কখনও তাঁকে অগ্নিদেবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতো প্রাণবায়ুরা।ঋগবেদে লিখেছিল, কে যে লিখেছিল কে জানে, পৃথিবীর প্রথম উজ্জ্বল আর পবিত্র মহাআলোক থেকে বেস্পতির জন্ম যিনি সব অন্ধকার দূর করে দ্যান । কোথাও কোথাও তার মূর্তি দেখেছে ফড়িংচাঁদ, হাতে দন্ড ও পদ্ম আর জপমালা, আরেকটা পুরাণে প্রাণবায়ুরা লিখেছিল বেস্পতি তারাকে বিয়ে করেছিলেন আর সেই তারাকে নাকি চাঁদ কিডন্যাপ করে একটা ছেলে পয়দা করে তার নাম বুধ। ব্রহ্মা চাঁদের উপর চাপ দিয়ে তারাকে তাঁর স্বামী বেস্পতির কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেন। ফড়িংচাঁদরা কুলকিনারা পান না যে এতো পাওয়ারফুল হয়েও বেস্পতি কেন বদলা নেয়নি । ... ...
আমার ঠিক সামনে দুটি চোখ। টানা টানা। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মতো। এ কার চোখ? শুনেছি। এই সামনের পোর্টেটটি রাজকুমারী রুক্মিণীদেবীর। যাঁর নামে এই কলেজ। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী ছিলেন। চোখ দুটি জীবন্ত। কখনও এত স্পষ্ট করে দেখিনি। সোজাসাপটা শাড়ি। কাঁধে ব্রোচ। বছর কুড়ি বয়স মনে হয় ছবিতে। চোখ দুটি কী উজ্জ্বল। যেন টানছে। সামনে ওই চোখ। পায়ের নীচে সর্পিল বাঁধন। আমি ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকি। হাহাকারের মতো কুয়াশা যেন ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে কোনো ফাঁক দিয়ে। যত উঠে দাঁড়াতে চাই সর্পিল অদৃশ্য ফাঁস তত আঁটো হয়। রুক্মিণীদেবীর চোখ । কী মায়াময়। যেন চুম্বক। টানছে। আর তাকাতে পারি না। ... ...
মারাঠীতে নাকুশা মানে নাকি অবাঞ্ছিত বা অপয়া, বিনীতা বলেছিল। নাকুশার মা তখন ওদের ঘর ঝাড়ুপোছা আর বাসন সাফ করত। তারপর তো মা’টা মরেই গেল আর নাক্কিকে এলাকার এক কর্পোরেটার লাগিয়ে দিল পাহাড় পাতলা করার কাজে। চুপচাপ গিয়ে রাস্তা থেকে একটু উপরে উঠে মাটি কেটে কেটে জমা করবে আর হপ্তায় একদিন কর্পোরেটারের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে জমা করা মাটি। এমনি করে করে পাহাড়টা যখন রোগা হয়ে যাবে, বেঁটে হয়ে যাবে, পাহাড় বলে আর চেনা যাবে না, তখন কর্পোরেটার এসে সেখানে মস্ত আলিশান সব বাড়ি বানিয়ে ফেলবে। নাক্কিয়া তদ্দিনে বড়সড় হয়ে সেই সব বাড়িতে কামওয়ালি বাঈ হয়ে কাজে লেগে যেতে পারবে, চাই কি বিয়ে শাদিও হয়ে যেতে পারে। ... ...
পাড়ার দাদারা বলে চিনা শালারাই নাকি এ অসুখের ভাইরাস ছেড়েছে। নাক ফেটা হারামজাদা জাত। ভারতমাতার চরম শত্রু। টিভিতে চিনা মানুষদের ছবি দেখেছে হারু। ষ্টীলের থালার মত গোল চকচকে চেহারা। বাচ্চাকাচ্চা বুড়ো একরকমের দেখতে। বনগাঁর আকবর আলিদাদার দোকানে সাজানো থালার মত। কে জানে বাবা, মানুষ মেরে এদের কি সুখ ! আজকাল বাইরে কোথাও যাওয়া হয় না হারুর। গোহালেই থাকে। যত্ন নেয় গরুগুলোর । প্রত্যেক মাসের প্রথম রবিবার তিরিশটা গরু আর ওদের খাবার দিয়ে যায় চন্দনবাবু । তখন গরুগুলোকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করে। গাল দেখে , দাঁত দেখে , পেটে হাত বুলোও, গাভিদের ওলান ধরে পরীক্ষা করে। কোন গরুকে রোগা লাগলে জানতে চায়, কি রে হারু। খাবার দিসনি নাকি ? ... ...
এটাই নাকি চিত্রকর গ্রাম। ভরতপুর। মোটে পনেরো ঘর চিত্রকর। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে গেলাম প্রথম বাড়িতেই। সঙ্গে দেবাশীষ মুখার্জি ভাই--- আগে এসেছে কিনা। বলল--দাঁড়ান ওই খানটায় , অনিলকে ফোন লাগাই। একটা পুরোনো গরীব কুয়ো --ডুমুর অশথ গাছের শেকড় জল ছোঁয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। ঝুঁকে দেখতে দেখতেই ডাক এল। গাঁয়ের একটি সিমেন্ট বাঁধানো দাওয়ায় ওরা ছবি বিছিয়ে দিচ্ছে। এটাই নিয়ম। বাইরের কেউ এলে পনেরো ঘরে কানাকানি করেই খবর পৌঁছে যায়--যার যেটুকু পুঁজি এনে সাজায় সেই দাওয়ায়। ... ...
আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত, উল্লাস উল্লাসের। বড়ভাই কাস্টমসে চাকুরি করেন, দু হাতে আয় তার। তাই ওর ভবিষ্যত নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। মাঝেমধ্যে অবসর পেলে আমি ওর রুমে ঢু মেরে আসি। কখনও কখনও বলে- কাকু আসো, তোমাকে একটা নতুন আবিষ্কারের কথা বলি। বেশিরভাগ সময় বলত, কাকু, এখন বিরক্ত করো না-তো। অন্যসময় এসো। একমাস পর সে বিড়ালটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করল। বেঁচে আছে দেখেই বড় ভাবীর আনন্দ যেন আঁটছে না। কিন্তু এ কেমন বেঁচে থাকা? বিড়ালটির শরীর শুকিয়ে একেবারে কাঠের জো অবস্থা। ... ...
“পরব হল, এই ধর আমোদ, নাচ গান। সোহরাইতে ঠাওর করিসনি, কেমন নাচ করে বিটিছেলারা?” ধাতুরির ফ্যাসা কণ্ঠে চঞ্চল জীবের কামজ্বর চিতাধূমচালিত চৈত্রের বিশুদ্ধ পাতার ন্যায় অন্তর্হিত হইবার পূর্বে যেরূপ অবশেষ রাখিয়া যায়, ধাতুরি সেমতো চক্ষু উন্মীলন করিয়া বুধনিকে অবলোকন করিল, সে দংশনে শীতপত্রের বিশুষ্কতা, ফলত নিষ্ফল—“এই, এই যে সারদাপ্রসাদ আর বুধনি, উয়াদের বাপলা হবেক সব্ব অগ্রে। উয়ারা বর বউ হবেক, গাঁও জুড়ে বসবেক ভোজ, উয়ার অন্তে আসবেক বারুনি পরব। কিত্তে মজা! মজাই মজা!” হাহাকার করিয়া বুড়া বাতাস ধাতুরির জিহ্বা চুম্বন করিল। ... ...