"ওই দ্যাখ, খাল পরিষ্কার করার একটা লোক পাঁকে পড়ে আর উঠতে পারছে না," কে যেন চিৎকার করে উঠল। সদ্য ঘুম ভাঙা মুখগুলো অমনি একসঙ্গে ঘুরে গেল কাদাজলে ভরা খালটার দিকে। দু'দিন তুমুল বৃষ্টির পর যেটা কানায় কানায় ভরা আর ময়রার দোকানে সদ্য তৈরি গরম রাবড়ির ট্রে-র ওপর থেকে ওঠা অল্প সাদা ধোঁয়ার মতো যার পুরোটা জুড়ে উঠছে তীব্র দুর্গন্ধের ভাপ। এমনিতেই কেষ্টপুর খালের ধারের বস্তিগুলোর ঘুম ভাঙে অনেক সকালে, কল আর পায়খানার দখল নিয়ে মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ঢালু পারে জায়গা প্রচুর, কিন্তু আব্রু নেই। তাই ওখানে কেবল বাচ্চা আর পুরুষ মানুষের ভিড়। ঝগড়াঝাঁটি ক্যালোর ব্যালোর লেগেই আছে। তার ওপর আবার একটা জলজ্যান্ত মানুষ খালে নেমে দ্রুত পাঁকে ডুবে যাচ্ছে, এই নতুন উত্তেজনায় গোটা বস্তি ভেঙে পড়ল খালের ধারে। কারও হাতে নিমডালের আধ খাওয়া দাঁতন, কেউ সেফটিপিন আটকান ব্লাউজের ফাঁকে ঝুলে পড়া মাই চোষা বাচ্চা কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে, সোমত্ত মেয়েরা নজর আটকাবে বলে ব্রা হীন নাইটির বুকের ওপর আলগোছে গামছা ফেলে রেখে ঝুঁকে পড়ে ডুবন্ত লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই আবার ঘরের খেয়ে বনের মোষ-চরানেরা দৌড়ে গেল পুজো প্যান্ডালের পাশে রাস্তা আটকে ফেলে রাখা লম্বা বাঁশ আনতে। ... ...
ইদ মানে উৎসব। ইদ-উৎসবকে ঘিরে আনন্দ স্মৃতি, না বলা কথা, কিম্বা ভীষণ বলতে চাওয়া আখ্যান নিয়ে রইল এবারের ইদের কড়চা। এই কড়চার দুই কিস্তির প্রথমটি বেরোল আজ। ... ...
মকিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মইশা বলে কতো জল। আল্লাহ সাক্ষী রইল গো। দেখি কে কারে তাড়ায়।’ মাথা এত গরম হয়ে গেল সারা রাত্রি ঘুম হল না। তাঁর উপর ছাদ থেকে শুধু প্লাস্টার খসে পড়ছে। মশারির ভেতর দিয়ে সারা বিছানা বালি বালি হয়ে গেছে। মশারির উপরে একটা চাদর পেতে দিলে হয়। কিন্তু তাতে পাখার হাওয়া একটুও ভেতরে ঢুকবে না। কী করি ভাবতে ভাবতে লোডশেডিং হয়ে গেল। দুত্তোর বলে উঠে পড়লাম। ভাবলাম, কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি। সাপের কথা ভেবে আবার মশারির ভেতরে ঢুকলাম। সারা গায়ে প্যাচপ্যাচে ঘাম। তার সাথে বিছানায় বালি ভর্তি। শুয়ে শুয়ে কান্না পাচ্ছিল। কাল আবার ভোর ছ’টা থেকে ডিউটি করতে হবে। ... ...
- কী হয়েছে? তোমরা কোনটা করতে পারনি? - সব পেরেছি মেডাম, কিচ্ছু ছাড়িনি। - তাহলে? ভাইভা কেমন হয়েছে? কে ভাইভা ধরেছেন, কোনো ম্যাডাম নাকি স্যার? - একজন স্যার, একজন মেডাম – দু’জন মিলে ভাগ করে। - যিনি ভাইভা ধরছিলেন, তিনি ঐ কলেজের ইন্টারনাল নাকি এক্সটার্নাল, সেটা জেনেছ? - সেটা জানি না মেডাম, বুঝতে পারিনি। - কী জিজ্ঞেস করেছিলেন? তোমরা কি ভালো করে উত্তর দিতে পারনি? মুখগুলো কেমন ভারভার ঠেকছে। (এবার সমস্বরে) - উত্তর কী দেব মেডাম? দু’জনের কেউ তো ভূগোলের প্রশ্ন তেমন করলেনই না। - সে কী! তাহলে কী ভাইভা হল? ... ...
রমজান এলেই ইদের আমেজ শুরু হয়। শুরু হয় বাস-ট্রেনের টিকিট কাটার তোড়জোড়। মনে জেগে ওঠে বাড়ি ফেরার তাড়া। দিন গোনা শেষে স্বজন-পরিজনের সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করার লক্ষ্যে বাড়ির পথে ছোটা শুরু হয়ে যায়। ... ...
আমি অবাক হয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কুড়ি টাকা! মাত্র কুড়ি টাকা দিয়ে আম্মা কী বলছে এসব! একটা পিস্তলের দাম ৮ টাকা, ১ টাকা করে বারুদ। একটা বাঁশি দুই টাকা, একটা প্লাস্টিকের চশমা ৫ টাকা। তারপর? ট্রলারখান কেনা হবে না! সে ভারি দাম, অতি দরাদরি করলেও ১৮ টাকার নিচে কুলাবে না। কিন্তু বাদবাকি জিনিস কেনার পর আমার হাতে থাকবে সাকুল্যে ৪ টাকা! তাহলে? তাহলে কী, সব বাদ দিয়ে শুধু ট্রলারখান কিনে ফেলব? ... ...
আমিও আমার মায়ের মতো রাত জেগে ইদের আগের দিন রান্না করি। ইদের দিন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন মিলে সারাদিন খাই দাই আর আড্ডা দিই। টেবিলে সব সাজানো থাকে, পটে চা থাকে। বেশির ভাগ ইদে আমার মেনু হয় নানা রকম বেকিং গুডস, দুধ সেমাই, জর্দা সেমাই, কখনো কখনো চালের জর্দা, রসমালাই, সরের মিষ্টি, বা নানা রকম নাড়ু, চটপটি, কাবাব বা আলুর চপ। পোলাও, রোস্ট, বিফ কারি, বেগুনবাহার, মাটন চাপ, ইত্যাদি। আর মায়ের ট্রাডিশন ধরে রাখতে সব রকম ডাল দিয়ে খিচুড়ি। ... ...
রোজার শুরু মানেই স্মৃতির বই মেলে ধরে পড়তে শুরু করা। এ যেন নিজেকে আবিষ্কার করা আর শৈশব আর কৈশরে বিপণি বিতানগুলোতে মায়ের হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো এক কন্যার হাসি কান্না। ... ...
ইসলামে রমজানের উপবাস মানুষের উপর নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শয্যাশায়ী, নিরাময় অযোগ্য রোগী, গর্ভবতী মহিলা, সফরকারী মানুষকে রোজা পালন করা থেকে সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতিকূল অবস্থা দূর হলে তখন তাদের সেই রোজাগুলি করে নিতে হবে। কোন ব্যক্তি উপবাস করে ভুলবসত পেট ভরে খেয়ে নিলেও তার উপবাস ভঙ্গ হয় না। ... ...
ধীরেন্দ্র এস জাফা ভারতীয় বায়ুসেনার ফাইটার পাইলট এবং উইং কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের হাতে যুদ্ধবন্দি হন। পরে মুক্তি পাবার পর তাঁকে বীর চক্র পুরস্কার দেওয়া হয়। বন্দিদশার সেই কাহিনি তিনি লিখছেন তাঁর Death Wasn’t Painful বইটিতে। এই বইটির ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদ টির নাম "আয়েশা"। তাঁর পরিবারের সম্মতি নিয়ে সেই পরিচ্ছেদটির কিছু অংশ অনুবাদ করা হল। ... ...
আমার অনেক ইদ ছিল। কৈশোর থেকে যৌবন। সেই বৃত্তান্ত যদি বলি, বলতে হয় আমার ইদ হারিয়ে যাবার বৃত্তান্তও। দুটোরই বড় অবশ্যম্ভাবী আগমন জীবনে। তারও আগে যে সত্য স্বীকার্য – একটা বয়সে যে উৎসবে নতুন জামা জুতোর রং, নির্ঘুম অপেক্ষা, বালিশের নিচে জুতো নিয়ে ঘুমানো আর রান্নাঘরে মায়েদের রাতভর সেমাই পিঠা – তাই ইদ, তাই উৎসব। এই রাতজাগা আনন্দে যতদিন ঘুম টুটে টুটে যায়, ততদিন উৎসব রঙিন। ... ...
ইদের দিনের সবচেয়ে জরুরি কাজ যেটা, মানে নামাজটা পড়ার পরে যখন ইদের আর কোন আইনকানুন থাকে না তখন যা থেকে যায় তা হচ্ছে খাওয়া দাওয়া! এক মাস রোজা রাখার পরে মুখ খুলে গেল, এবার খাও। এই খাওয়ার নানা তরিকা আছে, নানা রঙের আছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গেলেই চেহারা ভিন্ন হয়ে যায়। ... ...
অনেক সময় দহলিজে খাঁ সাহেবেদের রোজার ব্যবস্থা থাকত অবস্থাপন্নের যৎসামান্য ইফতার দেওয়ার মাধ্যমে। এইভাবেই চলত মাসভর। শেষ রোজায় গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরলে পাড়াতে একসাথে ইফতারের মজলিসে তাদের আনা শহুরে নানা ফলের ডালি খানচায় নিয়ে দোওয়ার মজলিসে সমবেত হত, সব বাড়ির ছোট ছেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মজাই ছিল আলাদা। সেদিনে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করার অলিখিত ছুটি মঞ্জুর হতো দু-তিন দিন। ... ...
শাহ আব্দুল করিমের লেখায় ব্যাপক জায়গা জুড়ে আছে সাম্যবাদ৷ শাহ আব্দুল করিমের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন এবং রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা এর বড় কারণ। গণমানুষের অধিকারের ব্যাপারে তিনি বরাবরই সচেতন ছিলেন। শাহ আব্দুল করিম সম্পর্কে আলোচনার একটা বিশেষ সুবিধা হলো ‘করিমের পদই পদের ব্যাখ্যা’। অর্থাৎ শাহ আব্দুল করিমের পদ মনোযোগ দিয়ে দেখলে বাড়তি কোনো ব্যাখ্যা পড়তে হয় না। অত্যন্ত সরলভাষায় পদ রচনা করতেন তিনি। তাই তাঁর পুঁজিতন্ত্র বিরোধী পদ মানুষকে জাগ্রত করেছে ও উৎসাহিত করেছে লড়াইয়ে। শ্রেণীসংগ্রাম থেকে বিপ্লব কী নেই তাঁর পদে। এত সূক্ষ্মদৃষ্টি হয়তো অনেক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক কিংবা নেতাদেরও ছিল না। ... ...
বাঙালির দ্বিতীয় প্রজন্ম ক্রমশ বাংলাটা ভুলে যাচ্ছে। শুধু বিদেশে বা ভিন রাজ্যেই না, খোদ কলকাতা শহরেও। কিন্তু এসব নিয়ে বলতে গেলে বাঙালি নিজেই হাঁ হাঁ করে উঠবে। তারা সর্বভারতীয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক হচ্ছে। আরও কী-কী হচ্ছে, ঈশ্বরই জানেন। সেখানে এসব ছোটো মনের পরিচয় দেওয়াটা ঠিক না। যদিও, যুক্তি দিয়ে জিনিসটা বোঝা দুষ্কর। বাঙালি যদি দিল্লি কিংবা নিউ-ইয়র্কে গিয়ে হিন্দি কিংবা ইংরিজি ভাষী হয়ে ওঠে, সেটাই যদি দস্তুর হয়, তবে বাংলায় এসে অন্যভাষীদের বঙ্গভাষী হয়ে ওঠারই কথা। আবার অন্যভাষীরা বাংলায় এসে যদি নিজের ভাষা বজায় রাখে, বা রাখতে পারে, অন্যত্র বাঙালিদেরও তেমনই হবার কথা। এর কোনোটাই হয়না। ভারতীয় বাঙালির কাছে এর কোনো ব্যাখ্যাও নেই। সম্ভবত অস্বস্তিকর বলেই। আর সেই জন্য প্রশ্নটা তোলাই ট্যাবু। তুললে কঠিন-কঠিন ইংরিজি গালি বর্ষিত হতে পারে। ... ...
যেহেতু অস্তিত্ব নিছক একক নয়, সামূহিক – ‘কে আমি’ থেকে পৌঁছে যাই ‘কে আমরা’: এই জিজ্ঞাসায়। পারিবারিক পরিচয়েও নিহিত রয়েছে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরম্পরা, রয়েছে বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের আলো-ছায়া, রয়েছে চিৎপ্রকর্ষ অর্জনের দীর্ঘ ইতিহাস। এতে কত অজস্র উচ্চাবচতা, কত নতুন সূচনাবিন্দু। এসব ভাবতে গিয়ে দেখি, জাতিসত্তার বিচিত্র হয়ে ওঠায় ‘আমি’ ও ‘আমরা’-র অভিজ্ঞান অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। ভাষাই জাতির পরিচায়ক, ধর্ম কখনই নয়। ... ...
আজ ষষ্ঠী, রাত ফিকে হলেই সপ্তমী। ভোট, ভাইরাস আর ভিড়ের ভয়েবচ সামলাতে না সামলাতেই এসে পড়েছে আরও একটা উৎসবের উপলক্ষ্য। আর এই বিস্তীর্ণ মানচিত্রের কোথাও কোথাও আলো ক্রমে আসিতেছে, আর তার পাশে মঞ্চের বাইরে মাটিতে, আলোর বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেউ কেউ। নতুন নতুন গল্প শুরু হবে এখন-ই, সুতোর টানে আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠবে এক-এক করে চরিত্র। আসুন তাহলে এই ক'টা দিন, প্যান্ডেলের বাইরে দু'টো চেয়ার টেনে একটু বসা যাক নিরিবিলি আড্ডার মেজাজে, এই তো আমরা-ই ক'জন ... আসুন তার এক ফাঁকে পর্দা তুলে উঁকি মারি মঞ্চের ভেতরে ও বাইরে, ভিড় ছেড়ে চলুন এসে বসি ইন্টারনেটের এই ঠেকে। একটু একটু করে জমে উঠুক কথা ও বার্তা। এবারের শারদ সংখ্যা প্রকাশিত হবে আগামী কিছুদিন ধরে, উৎসবের পুরো মরশুম জুড়েই যতটুকু পুজোর গন্ধ গায়ে মেখে নেওয়া যায়। চোখ রাখুন গুরুর শরৎ ২০২১-এর পাতায়, প্রতিদিন নতুন লেখা জুড়ছে, জুড়বে। পড়তে থাকুন রয়ে সয়ে। ভাল লাগলে ভাগ করে নিন, না লাগলেও। ... ...
দুর্গাপুজোর সময় থেকেই আপনারা নিশ্চই এরকম অনেক ছবি দেখেছেন যেখানে মডেলরা বিভিন্ন দেবীর সাজে ছবি তুলেছেন। সেরকম কিছু ছবি দেখে আপনারা নাক সিঁটকেছেন, কিছু দেখে ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন. কিন্তু আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এই লেখার সঙ্গে যে ছবিগুলি আছে সেরকম আপনারা আগে কোথাও দেখেননি। কেন বলুন তো? এই ছবিগুলোর যিনি মডেল তিনি কোনো মহিলা নন বরং একজন পুরুষ। তাঁর নাম সৌরভ গোস্বামী। কী, একটু চমকে গেলেন তো? চমকানোরই কথা! এই চমক, এই ব্যতিক্রম দিয়েই শেষ হল এবারের উৎসব সংখ্যা। ... ...