প্রায় গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি, এমন সময়ে পেছন থেকে লোকটির গলা কানে আসে। ফিরে দেখি, এদিকেই হেঁটে আসছে। ও ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। ওপর থেকে তার চেহারার প্রকৃত বিশালত্ব আন্দাজ করা যায় না। তাকে ছোটো, এমনকী, যথেষ্ট অসহায় বলে মনে হয়। তার হাঁটার ভঙ্গীতে ক্লান্তির ছাপ ফুটে ওঠে। আমি ঢালু জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকি। “আমাকে দেখলে চিনতে পারবে? পরে?” ফেরার পথে লোকটি জিজ্ঞাসা করে। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ও চুপ করে থাকি। “মনে থাকবে নিশ্চয়ই।” লোকটা মুখ থেকে অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে হাসে। অল্প কাশি হয়। সে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রাখে। ও ধীরে ধীরে সামলে নেয়। একটি কুকুর হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছিল। হর্ণ দিতে ছিটকে সরে যায়। আমি আড়চোখে বাঁ-দিকে তাকাই। দেখি, চোখ বন্ধ। ও ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি লেগে আছে। “ইটস নট ইজি, ইয়াং ম্যান। নট সো ইজি।” ... ...
লাইব্রেরিতে সোভিয়েত দেশ খুব একটা কেউ পড়ত না। বরং ‘কালনাগিনীর প্রতিহিংসা’ কিংবা ‘মরণগুহার ভয়ংকর’ খোঁজ করেও পাওয়া যেত না। আমার কিন্তু সোভিয়েত দেশ ভালো লাগত। কী মসৃণ ঝকঝকে কাগজ, কী সুন্দর রঙিন ছবি। তখন অন্য কোনও পত্রিকায় রঙিন ছবি প্রায় দেখাই যেত না। নতুন পত্রিকা এলেই আমি প্রথমে পৃষ্ঠা খুলে গন্ধ শুঁকতাম। কাগজ থেকে, অক্ষর থেকে রাশিয়ার বাতাস ফুসফুস ভরে টেনে নিতাম। বুকের ভেতরটা বিশ্বাসে ভরে উঠত। মনে হত আমার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে লেনিনগ্রাদ, মস্কো, বাকু, আজারবাইজান, তাসখন্দের বাতাস। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম পৃথিবীর ভেতরে শ্রেষ্ঠ দেশ হচ্ছে ইউ এস এস আর। পত্রিকায় এক একজন লেখকের নাম খুঁজে পাই, লাইব্রেরি থেকে তাদের বই খুঁজে নিয়ে পড়ি। বাংলায় অনুবাদ। তুর্গেনিভ, গোগোল, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি। নিকোলাই অস্ত্রয়েভস্কির ‘ইস্পাত’ পড়ে তো দু’রাত ঘুমই হল না। আমারও ইচ্ছে করত মাতৃভূমি না বলে আমাদের দেশকে পিতৃভূমি বলে ডাকতে। সেই লেনিনগ্রাদ থেকে ভারখায়ানস্ক – পৃথিবীর আদ্ধেকটা জুড়ে তো ওরাই রয়েছে। যুদ্ধ হলে শুধু একটা বোতাম টিপবে, আমেরিকা ফিনিশ। ... ...
প্রথম দেখায় বিন্দুরে বুকিং দিছিল মতি। এমন মাল না চাখলে জিবলা কাইট্টা ফালান্ উচিত। কিন্তু বিন্দু তো আটটা-দশটা বাজারী মাইয়্যার মতো না। হলে সিট পাওয়ার জন্য একটু তদবীরে এসেছিল। পরে অবশ্য কৃতজ্ঞতাবশত দলের বড় মিছিলগুলানে অ্যাটেন্ড করত। সেই থেকে শুরু। যা হোক, মতিন ওরফে কুক্কুরু-মতি সেইদিন সাক্ষাত মোরগা-মতি। দুধচিনি বেশি কিং সাইজ চা খেয়ে কথা উঠছিল, কী করে অপোন্যান্ট গ্রুপকে ক্যাম্পাস ছাড়া করা যায়? তখন গাণ্ডু-হেলালের টেম্পার দেখার মতো। বলে, ‘অত কওনের কাম নাই, ল সেন্ট্রাল মাঠে যাই, কাটারি হান্দায়া দেই। ব্যস ফাইনাল।’ ‘কিন্তু বিন্দু যে আমারে টাসকি দিলো দোস্ত!’ ‘হ, কঠিন মাল একখান।’—এখনও নিজের কথা কানে বাজে কুক্কুরু-মতির। কী করে পারত সে? যার সাথে একটা লটরপটর চলতেছে তারে নিয়া এমন ছালবাকলাহীন কথা! এখন মাথা দপদপ করে। শেষে রাগ বাড়ে নিজের ওপরই। ওর নাম কুক্কুরু-মতিন না হয়ে গাণ্ডু-মতিন হওয়া উচিত ছিল। বুঝতেই পারেনি এই বিন্দুর প্রেমে পড়ে যাবে, আর ওর গলার কাটা হয়ে উঠবে বিলা-মেজবাহর ডাইল উৎসবের রাত। কারণ, শুধু দেখে খান্ত হয়নি, সেদিন রগরগে কিপটা ব্লুটুথ দিয়ে নিজেদের মোবাইলে নিয়ে যে যার মতো ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বিদিক নাচ-গানা করেছিল। সেদিন ঘুরেফিরে একই কথা—মামা কইও না, কইও না, শহীদ হয়া যাই! সেদিন ‘ম্যায় দুধারি তলওয়ার হু’ গান গাইতে গাইতে তারা ভাগ করে নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ দিকের টেন্ডারবাজি—‘বকশিবাজার তোর, গিরিঙ্গি লেন গাণ্ডুর আর গেদু-আলিমের হইল কোর্টচত্বর।’ ... ...
লোকটা অবিনাশকে দেখে হাসল। ভাল আছেন, অবিনাশ? অবিনাশ ভাবল, এই যে ভাল আছি কিনা জিজ্ঞেস করল লোকটা, আসলে কিন্তু এটা কোনও প্রশ্ন নয়। আমি তো কোনওদিনই উত্তর দিই না। তাতে তার খুব একটা কিছু আসে যায় বলে মনে হয়না। তবু লোকটা বলে, ভাল আছেন অবিনাশ? আসলে ও আমায় মনে করিয়ে দেয় যে আমি অবিনাশ। কিন্তু আমি অবিনাশ কেন? আমার বৌ নেই কেন? আমি চাকরি করিনা কেন? আমি বাড়িতে একা থাকি কেন? আমি কি পাগল? ... ...
তারা আসল দরিয়ায় নয় এখন। সোমনাথপুরের বর্ষায় আউশ ধানের ক্ষেত, জলাভূমি, শ্রাবণের পূর্ণিমার জোবায় সাগর থেকে ঠেলে-পুরে দক্ষিণাঞ্চলে যে-জল উঠেছে তা নামার আগেই আবার অমাবস্যার জোবা এসে গেছে। ফলে পুরো দিনের আলো ঝড়ের সন্ধ্যা-আকাশের রূপ ধরেছে। পাগলাটে আকাশে গুড়ো বৃষ্টি উড়ছে বর্ষার নির্মেঘ আকাশে যেমন গুটিপোকার পঙ্গপাল নামে। জোয়ারের জল ক্ষেতের পেট ফাঁপিয়েছে মরা গোরুর মতো। বীজধানের ক্ষেত তো কথাই নেই, ভিটার পাটক্ষেতও ভাসিয়েছে তুফান। বিশাল ক্ষেতের কোথাও আলের উপর বেড়ে-ওঠা নিসঃঙ্গ খেজুর গাছগুলোই দাঁড়িয়ে আছে বাতাসের ঝাপটায় বিধ্বস্ত মাথা নিয়ে। এ-গ্রাম ও-গ্রামের মাঝখানে অবাধ জলরাশিতে ঢেউয়ের হিল্লোলে কলম ফরাজী নাতিদের এটা দরিয়াই ভেবে নিতে বলেছে। ডুবে যাওয়ার আগে বিলের মাঝে যে ছোট খাল ছিল তার শেষমাথার জলায় শাপলা ধরেছে প্রচুর। জল পেয়ে শাপলা আরও দীর্ঘ হয়ে উপরে ভাসিয়েছে মাথা। লম্বা শাপলার ঝাড় তুলে এনে রেঁধে ভাওর দিন চালিয়ে নেবে এমন পরিকল্পনা করে কলম ফরাজী নৌকায় উঠে বসে। আমগাছের শেকড়ের সঙ্গে বাঁধা নৌকার রশির বান খুলে নাতিদের ‘জোংরা’সহ আসতে বলে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির হাত থেকে পিঠ বাঁচানোর জন্য। বড় নাতি হাবেলের পরনের লুঙ্গি খুলে দুভাই লুঙ্গির দুপ্রান্ত বাতাসের উলটোদিকে ধরে নৌকার গলুইর গুড়ায় দাঁড়িয়ে বাদাম-নামক পাল তোলে। নাতিদের বানানো লুঙ্গি-পালে বাতাস লেগে নৌকা জোরে চলা শুরু করার পরই দাদু হাল ধরে শান্ত হয়ে বসে দিগম্বর নাতিদের খোঁচা মেরে কথা বলে--‘মোর হালাগো দেহি লজ্জাশরমের মাতাডা খাওয়া গেচে। দুইডা ছিলা ক্যালা, ল্যাংডা ফহির অইচে।’ এর পরই দাদুর লুঙ্গি বাতাসে উলটে যায় যেমন পুঁটিতে ঠোকর বসাবে বলে অপেক্ষারত স্থির বলাকারা পাখা অনাকাক্সিক্ষত দমকা বাতাসে উলটে গিয়ে ডানার নিচের বিবর্ণ মাংস বেরিয়ে পরে। আর তখনই নাতিরা চেঁচিয়ে ওঠে--দাদুর বেগগুইন জিনিস দেহন যায়। ... ...
সিন নদীর পারে সেবারের জুলাইটা ছিল সত্যিই অন্যরকম। ইউজিন, তোমার কি মনে পড়ে? জুলাই বরাবরই এই ফরাসী দেশে ভিন্ন আভা, ভিন্ন দীপ্তি নিয়ে আসে। প্রায় পৌনে একশ বছর আগের জুলাইয়ের চোদ্দ তারিখের গল্পটা পিতামহ পিতামহীরা শোনায় নি কি? দিকে দিকে খবর রটে গেছিল যে বাস্তিল দুর্গের উপর কামান থেকে গুলি ছোঁড়া হবে সাধারণ, নিরস্ত্র মানুষের উপর। আর সে খবরে এত দিনের ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও বিপন্ন মানুষ যত ভয় পাবার বদলে বরং উল্টো হঠাৎই অতিকায় দৈত্যের মনের জোর নিয়ে ছুটলো সো-জা বাস্তিল দুর্গ বরাবর। ১৪ই জুলাইয়ের দু’দিন আগেই রাজা ভার্সেই থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে জনতার উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। জনতাও এর উত্তরে সাথে সাথেই পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তÍত হয়ে গেছিল। শহরের ঘণ্টা বেজে উঠলো। জনগণের পক্ষ থেকে সতর্ক ঘণ্টা। জনতা দরকারে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রভাণ্ডারও দখল করতে প্রস্তÍত। একটি গার্ড রেজিমেন্ট জনতার পক্ষে অবস্থান নিল। ঠিক তার দু’দিন পরেই অর্থাৎ চোদ্দ তারিখেই যেই না খবর রটলো যে বাস্তিল দুর্গ থেকে মানুষের দিকে গুলি ছোঁড়া হবে, অমনি সব ধেয়ে গেল দুর্গ বরাবর। তারপর বাকিটা ইতিহাস। গিলোটিনে অভিজাতদের মাথা। লিবার্তে-ফ্রাতের্নিতে-ইগালিতে...সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা...মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায়...তথাপি সে সদা শৃঙ্খলিত! তবু, ইউজিন...যেমনটা তোমার পিতামহ বলতেন আর এ-ও জানা কথাই...প্রতিটা বিপ্লবের পরই আসে একটি করে প্রতিবিপ্লব...হাজার অন্যায়ের প্রতিবাদেও কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট করতে পারত না। নারী রয়ে গেল আগের মতই নিরক্ষর, গৃহকর্মের দাসী। তবে বিপ্লবটা কোথায়? তবু ১৭৯২ থেকে ১৮৭০...গুনে গুনে ৭৮টা বছর পরে আবার এই জুলাই...সে যেন একইসাথে রক্তবর্ণ অথচ পিঙ্গলাভ মেঘ, যা যে কোন ঝড়ের আগে দেখা যায়। ... ...
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি দু’টোই খুব বেশি প্রগতিশীল না। বাবার বাড়িই শাহবাগ থেকে কাছে। দ্রুত একটা রিক্সা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করে ফারহানা। আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যায়। কলিং বেল টিপতেই মেজো আপা দরজা খোলে, ‘শাহবাগ থেকে মাত্র ফিরলি? জানিস, ব্লগার থাবা বাবা যে মারা গেছে? টিভিতে বললো!’ ‘হুম- রাজিব হায়দার নামে একজন মারা গেছে জানি...’ ‘সে-ই ত’ থাবা বাবা নামে লিখত। তুই ত’ আর ব্লগ পড়িস না। আমি বাবা লন্ডনে থাকি বলে দেশের সব পেপারের ই-ভার্সন আর ব্লগ পড়তে হয়! ছেলেটা নাস্তিক ছিল। তা’ নাস্তিক হওয়া কি দোষের? তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই? তাই বলে তাকে খুন করতে হবে? কবে আমরা একটু সভ্য হবো?’ ... ...
...তবু বিপ্লবের পিছু পিছু পায়ে পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে আসে যে প্রতিবিপ্লব ক্ষুধার্ত ডাইনির মতো, সে সহসাই পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপ্লবের কাঁধে ছুরি বসায়। বাঘনখে বিদ্ধ করে তার হৃৎপিণ্ড। তাই কি হয় নি? মার্চের ২২ তারিখেই অভিজাতদের কিছু দাঙ্গাবাজ গায়ে পড়ে হামলা করলো কমিউনের লড়াকু শ্রমিকদের সাথে। শ্রমিকরা আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করতেই ওরা ছুরি, পিস্তল, লাঠি রেখে পালালো। কমিউনের সেনাপতি লুলিয়ার লোকটিকে তোমাদের যে ভাল লাগত না, সেটা ত’ ঠিকই ছিল ইউজিন! অভিজাতরা তাড়াতাড়িই যে আবার দখল করে নিল দুর্গ মঁ-ভালেবিঁ। ব্যর্থতার শাস্তিতে বহিষ্কৃত হবার সাথে সাথে কমিউনের পিছু নিল সে। ভার্সেই থেকে আসা অভিজাতদের শেষ বাহিনীর পক্ষে কাজ করলো লুলিয়ার। হায়, শ্রমিক নারীরা পর্যন্ত লড়াইয়ে এগিয়ে এলো। নিজেদের দরিদ্র, নিরন্ন বস্তি রক্ষায় পুরুষের পাশাপাশি তারাও কামান চালালো। গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো রাস্তায়। নিকোলা আর জাঁকের স্ত্রী, প্রেয়সিরা খুন হলো রাস্তায়। মৃত স্বামীর শবদেহের পিছু হাঁটতে হাঁটতে শিশু সন্তানের কাণে শ্রমিক মেয়েরা শ্লোগান দিয়েছে, ‘ভিভা পারি কমিউন!’ তবু ভার্সেইয়ের সেই বিপুল সৈন্যবাহিনীর সাথে শেষরক্ষা হলো কি? শ্রমিক নেতা ফ্লুঁরাসকে পেছন থেকে খুন করলো বুর্জোয়া সেনাপতি দেসার্ত, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের হাত থেকে যার জীবন বাঁচিয়েছিল ফ্লুঁরাসই। ফ্লুঁরাসের মৃতদেহ টুকরো করার দৃশ্য ভার্সেইয়ের গোলাপ বাগানে উপভোগ করলো বুর্জোয়াদের স্ত্রী ও রক্ষিতারা। ৬ই এপ্রিল শহীদ শ্রমিকদের শবযাত্রায় কফিনের পিছু পিছু দুই লাখ শ্রমিকের শবযাত্রার ঢল...শুধু পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না কমিউনের...ভার্সেই সৈন্যরা এপ্রিলের ৭ তারিখ দখল করে নিল নিউলি-তে সিন নদীর ঘাট। মে মাসের শেষ নাগাদ জার্মানরা বন্দী ফরাসী সৈন্যদের ছাড়ার পর বুর্জোয়াদের শক্তি আরো বাড়লো। ফরাসী বুর্জোয়াদের সাথে হাত মেলালো জার্মান বাহিনীও...আটটা দিন...আট/আটটা দিন সে কি খাণ্ডবদাহন! লোশেজের কবরখানা ভরে উঠলো নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধের লাশের স্তুপে। ত্রিশ হাজার মানুষ হত্যার পর শুরু হলো পাইকারি গ্রেপ্তার। লড়াইয়ের শেষ দুই দিনে হেরে যাবে বুঝে শ্রমিকেরা নিজের হাতে নিজের প্যারি প্রিয়তমার দেহে জ্বালালো আগুন। বুর্জোয়া ভার্সেই যেন পায় নিছকই এক অগ্নিদগ্ধ শহর। তিন দিন ধরে দাউ দাউ করে জ্বললো আগুনের লকলক শিখা। ... ...
ঘুমন্ত নগরীতে সবাই ঘুমোচ্ছে। সবাই পাথরের মত ফ্রিজ। রানীর পায়ের কাছে এক মস্ত ফিনিক্স পাখি, সেও ঘুমোচ্ছে। দুইজন মুখোশধারী জ্যান্ত যুবক সব খুঁটে খুঁটে দেখছে। একজন রানীর পাশে রাখা বড় ঘন্টায় আওয়াজ করতেই সবাই জেগে ওঠে। অন্যজন ফিনিক্স জেগে উঠতেই তরবারি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলে। নগরীর সবাই ছটফট করতে করতে ড্রাগনের আকারধারণ করে ও মারা যায়। ভয়েস ওভারে সীমান্তবাবা কী করে অশুভ শক্তি ড্রাগনদের ধ্বংস করতে হবে তার বিবরণ দেন। সারা সমুদ্র লাল রঙ হয়ে যায়। মুখোশ পরিহিত দুই যুবক তার মধ্যে দিয়ে ভেসে ওঠে। সমুদ্রতটে দেখা যায় ড্রাগন দেবাদিদেব ইউনিকর্ণ ছটফট করতে করতে ঢুবে যেতে থাকে চোরাবালিতে। মুখোশ পরা দুই যুবক তাকে ডিঙিয়ে ফ্রেমের দুইপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ড্রাগন দেবাদিদেব ইউনিকর্ণ বাঁচাও বাঁচাও করতে করতে ঢুবে যায় চোরাবালিতে। ... ...
মরুপ্রান্তর। দিন। রক্ষীরা চলেছে উটের পিঠে। তাদের মাথায় ছত্রী ধরে আছে মরু পোষাকে স্থানীয় মানুষ। পেছন পেছন চড়া রোদে সালমা ও রুমকি কোলে সন্তান নিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলেছে দিগন্তের দিকে। আবহে দুইজনের একসঙ্গে থাকার গানটির স্যাড ভার্শন শোনা যায় (হামনিকা শুনে শোলের কথা মনে পড়বে)। কাঁটাতারের বেড়া। রক্ষীরা তাদের বেড়া পার করে ফিরে যায়। ... ...
সেদিন আমাদের সামনে, আমাদের তিন আপা—রিজিয়া, ফরিদা আর আমেনা খবরটি পেয়ে ঠিক উড়ে যাওয়ার মত করে ছুটে গিয়েছিল মডেল স্কুলের পুকুরের দিকে। তখন ভরা বর্ষা। জল থৈ থৈ করছে। আর মাঝখানে পদ্ম ফুটেছে। পদ্মের গায়ে ফড়িং উড়ছে। হাল্কা হাওয়ায় জল নড়ছে। এর মধ্যে কোথাও বাছেদ ভাই নেই। তিন বোনে সেই পুকুর পাড়ে বসে হাহাকার করে বাছেদ ভাইয়ে নাম ধরে ডেকে ডেকে ফিরল। সেই আর্তনাদে জলের মধ্যে একটা আলোড়ণ উঠল। একটি হাওয়াও ছুটে এলো দক্ষিণ থেকে। আর কারা কারা মিছিল নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল—তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। এবং আরো কয়েকটি লোক রাঁতে ইঁদুর ধরতে পারেনি বলে হায় হায় করছিল আর মাঝে কপাল চাপড়াচ্ছিল, এর মধ্যে কে জন বলছিল, আজি রজনীতে দীপালী অপেরায় অভিনীত হইবে একটি পয়সা দাও। মূল ভূমিকায় অভিনয় করিবেন—নট সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস। আর কিছু ডানাকাটা পরী। এই পরী শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে জলের নীচ থেকে বাছেদ ভাই উঠে এলো। একটা বড় সড়ো মাছের মত। মাথাটি উপর দিকে। দুহাত দুদিকে তখনো ছড়ানো। ঠিক এই ভাবেই গাছ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। পড়তে পড়তে বলেছিল—আমি উড়ছি। ... ...
সৌমিত্র, এম ডি-র লোক। এম ডি অফিসে ডিরেক্টরদের লোক আছে এটা পছন্দ করেনা। নিজেও স্বস্তিতে থাকেনা। প্রচুর গরমিল থাকে হিসেবে তাদের। সময় মতো কোনো ডাটা এক্সেল শিট-এ ওঠেনা। ভাউচারে সই হয়ে যায় কিন্তু সেই ভাউচার হারিয়ে যায় আবার। অডিট এসে ধরলে বলে আসলে খুচরো মাছ বিক্রি করে যে টাকা হয় তার বিল আর কে দেবে! অথচ কোটি কোটি টাকা মাছের বিক্রিতে নাকি আসে। এমন সব গল্পের মধ্যে বেশ কিছু টাকা চলে যায় এম ডি-র পকেটে। তার লোকদের খেয়ে-খাইয়েও তার ভালই থাকে। কিছু করার নেই। কোম্পানিটাই জালি। ব্রিটিশ একটা কোম্পানির এক বড় মাথা আছে এই কোম্পানির বোর্ডে। তার মামাশ্বশুর আছেন ব্রিটিশ কোম্পানিটিতে। তারা কেউ কারোর সঙ্গে এমনিতে ব্যবসা করেনা, অথচ দুই কোম্পানির দুই বড় মাথা পরস্পরের কোম্পানির বোর্ডে আছে। কি হয়? দুজনে দুজনের জন্য ঘুরিয়ে টাকা কামায়। এখানকার বাজারে সরকার চাষের জন্য যে মাল কেনে, যেমন বীজ,সার ইত্যাদি, সেই মাল কেনা প্রভাবিত করে মামাশ্বশুর। মন্ত্রী-সান্ত্রী নেতাদের সঙ্গে তার ভালই যোগাযোগ। আবার ওখান থেকে সমাজসেবার জন্য ফান্ড আসে মামাশ্বশুরের এন জি ও-তে। কোটি কোটি টাকা আসে। মাঝে মাঝে পাঁচড়া, তালদি, ধুবুলিয়াতে পোলিও শিবির, এইডস সচেতনতা, হুইলচেয়ার দানের আসর বসে। ব্যাস্! দুপক্ষই আরামে আছে। এম ডি এসব সামলায়। তাই তাকে সরায় না মামাশ্বশুর। ইদানীং হাতের বাইরে যেতে পারে বলে কৌশিককে বসিয়ে রেখে চাপ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া এম ডি-র যে পার্সোনাল সেক্রেটারি, কৌশিকের বৌ বলেছে সেটাও মামাশ্বশুরের ফিট করে দেওয়া। এম ডি তাকে নিয়ে এখানে ওখানে লীলা করে, সে সব রেকর্ড করা থাকে। এম ডি আবার এই বোর্ডের একজন ডিরেক্টরের জামাই এবং বর। মানে তার শ্বশুর এবং বৌ দুজনেই আছে বোর্ডে। লে ক্যাচাল! ... ...
গাঙ্গুলি বাড়ির বৌ হয়ে যেদিন প্রথম এসেছিল সৌদামিনী, শাশুড়িমা থুতনি ধরে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, তোমার নামটা বাছা আমি একটু বদলে দেব। একে অতবড় নাম ধরে ডাকাও যায়না, তাছাড়া আর একটা সমস্যাও আছে। তোমার কোনও ডাক নাম নেই? সৌদামিনী বলল, হ্যাঁ আছে তো, মিনু। উনি বললেন, তাহলে আজ থেকে সবাই মিনু বলেই ডাকবে তোমায়। সবাই আর কে, বাড়িতে তো আর মোটে তিন জন, কত্তা, গিন্নী আর সৌদামিনীর বর মহাদেব। সৌদামিনী তবুও জিজ্ঞেস করল, সমস্যা কী একটা আছে বলছিলেন মা? গাঙ্গুলি গিন্নী বললেন, আসলে আমাদের বাড়িতে যে কাজের মেয়ে, তার নামও সৌদামিনী। অবশ্য তাকে আমরা সদু বলে ডাকি। এ নামটা তো আমার মায়ের আমলের, এই আধুনিক যুগেও এমন নামে দু-দুজন? যাক, সমস্যা আর থাকল না। ... ...
আসলে হাওয়ার রাত ছিল সেদিন। ফুলশয্যার খাটে ঘন নীল মশারি ফুলে ফুলে উঠছিল। তখন নীলকমলকে হাতির গল্পটা বলেছিল স্বপ্না। নীলকমল হাসিমুখ করে শুনছিল তারপর বলেছিল -ধ্যাত, সরু গলিতে হাতি ঢুকবেই না। হাতি বিষয়ে নীলকমল সবই জানে-এরকমই মনে হয়েছিল তার নতুন বৌয়ের। তখন স্বপ্না অন্য গল্প বলবে ভাবছিল- বিরাট উঠোনে জ্যোৎস্নায় লক্ষ্মীপ্যাঁচা নামত, সেই গল্প। নীলকমল ততক্ষণে সুকুমারের গল্প শুরু করেছিল। চাঁদ আর জ্যোৎস্না দিয়েই শুরু করেছিল নীলকমল। বলেছিল সুকুমারের আশ্চর্য বাড়ির কথা। বলেছিল, চাঁদ উঠলে সুকুমারের বাড়ির সামনের রাস্তায় আইসক্রীম ট্রাক আসে। লাল নীল আলো জ্বলে,ঘন্টা বাজায়। নীলকমল বলেছিল সুকুমার আইসক্রীম ভালোবাসে। স্বপ্নারও একটা গল্প ছিল আইসক্রীমের। প্রাচীন এক আইসক্রীমের রেসিপির- যা ও এক মেমসাহেবের থেকে পেয়েছিল কুচবিহারে-ওর বাপের বাড়ির পাড়ায়। জীর্ণ এক বাড়িতে থাকত সেই মেম আর তার অন্ধ কুকুর। স্বপ্না অবশ্য সে গল্প বলে নি তখন। সুকুমারের গল্প শুনেছিল চুপ করে। এক বছর শুনেছিল সুকুমারের গল্প। তারপর বছর ঘুরতেই কুচবিহার গিয়ে রুফাসকে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল বাপের বাড়ির কুকুর। বলেছিল ছোটোবেলায় ও ইংরিজি শিখেছিল এক মেমের কাছে। ইংরিজি শিখত আর রান্না। রুফাস আর রান্নার বই এনেছিল কুচবিহার থেকে। বলেছিল মেম দিয়েছে। নীলকমল রান্নার বই উল্টে দেখেছিল। সমস্ত উপকরণ, মাপামাপির হিসেব অচেনা ঠেকেছিল নীলকমলের। বলেছিল -এসব এদিকের বাজারে পাওয়া যায় না। বলেছিল - সুকুমারকে বলে দেব, দেশে এলে নিয়ে আসবে। স্বপ্না সে বই তুলে রেখেছিল। রুফাস তখন ছোটো। স্বপ্না বলেছিল মেমের অন্ধ কুকুরের নাতি রুফাস। মেমই নাম রেখেছে। পরে একদিন তুমুল ঝড় জলে শিয়ালদায় স্বপ্নার পিসতুতো দাদার সঙ্গে নীলকমলের দেখা হয়েছিল। দার্জিলিং মেল ধরার কথা দুজনেরই। ট্রেন লেট ছিল সেদিন। অনেকক্ষণ গল্প করেছিল ওরা। মেমের কথা কিছু জানে না স্বপ্নার পিসতুতো দাদা, বরং, সেদিন সে রুপুর কথা বলেছিল আচমকা। বলেছিল, রুপু স্বপ্নার প্রেমিক ছিল কুচবিহারে। বাড়ি ফিরে স্বপ্নাকে সে সব কিছু বলে নি নীলকমল। প্রথম ইন্টার্ভিউ দিতে গিয়ে সুকুমারের ট্রেন আটকে পড়েছিল পাটনায়-সে গল্প বলেছিল। ... ...
নাহ্...আর ভাবিবে না দুলালী বেওয়া! আর কিছু মনে করিবে না! টোকানি তখন ছয় বছরের। টোকানির হাত ধরে সে, রঞ্জিতা মুর্মু আর ধিরতুর বউ শান্তি কুমারী বর্মন মিলে ছুটেছিল চোদ্দ মাইল মূল সড়কের সামনে। সেখানে তার বড় বেটি কুড়ানী যে ছিল। ভ্যানগাড়ির উপর হাত-পা মেলে। মুখে রক্ত। টোকানি হাতে তালি দিয়ে বলেছিল, ‘বুবু- বুবু এ্যাংকা ঘুমায় রছে, মাও!’ আর তখন মেয়ের সদ্য ওঠা দুই কিশোরী বুকের মাঝে মুখ গুঁজে সে যেমন চিৎকার করেছিল, তেমন চিৎকারই কি ভেসে আসছে বর্মন পাড়া থেকে? কার্তিকের দুপুরে চিল ছানা হারিয়ে ফেলা সোনালী রঙা মা চিলের আর্তনাদের মত? টোকানি ঘুমে কাদা। মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে মা-মেয়ে এক সাথে ছুটবে নাকি দুলালী একাই যাবে? আল্লা চাহে ত’ টোকানির কোন ক্ষতি হবে না। কোন বাঘডাঁশ এসে তার এই হাঁসের ছানার মত মেয়ের পালকে কামড় দেবে না! আল্লাহ চাহে তো? বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়ে সেই মাঝ রাতে সে ছুটেছিল শান্তি-ধিরতুদের বাড়ি। শান্তি দুলালীর ছোট বেলার সই। মাটির শিব গড়ে ভাল বরের পূজা করতে করতেই ধিরতুকে তার ভাল লেগেছিল। শান্তির বিবাহ ঠিক হয়েছিল অংপুর শহরে ‘নিউ লক্ষ্মী বস্ত্রভান্ডার’-এর আড়তদার লক্ষ্মীনারায়ণ বর্মনের সাথে। কিন্তু অন্ধ হলেও দারুণ ফর্সা ধিরতুর কম্পনহীন সবুজাভ-নীলচে চোখের মণি, একহারা দীর্ঘ গড়ন টেনেছিল শান্তিকে। গায়ে হলুদের সন্ধ্যায় হবু শাশুড়ি সন্ধ্যামালতী মাসীর পায়ে পড়ে সে কেঁদেছিল। পাজি দুলালীরা এ নিয়ে শান্তি কুমারীকেও কম কথা শুনায় নি, ‘তুই এ্যালা গান্ধারির মতো চোখে একখান কাপড় বান্ধিব্যি শান্তি? তোর বরের যে চক্ষু নাই! গান্ধারির মত একশ’ চ্যাংড়ার মা হবি?’ শান্তি কুমারী এ কথার উত্তরে হাত জোড়া করে কপালের কাছে নমস্কার করে বলতো, ‘ওনারা স্বর্গের দেবী।’ ... ...
অতএব ভয়ংকর জরিটরি দেয়া বিকটদর্শন সব লাল বেনারসী ধুপধাপ পড়তে লাগল আর তালপাতার সেপাই সেলসম্যানটি নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে সেগুলো গায়ে ফেলে দেখাতে লাগল।জেঠিমার সবগুলোই পছন্দ, কেবলীর কোনটাই না, বাকীদের মধ্যেও মতের মিল নেই। প্রায় হাতাহাতি হতে যাচ্ছে এমন অবস্থায় বুদ্ধিমতী পটলদি হাল ধরেন - "লাল নয়, কাছাকাছি কিছু দেখান"। তেমন-লাল-নয় অর্থাৎ ম্যাজেন্টা, মেরুন, গাঢ় গোলাপী ইত্যাদি বেনারসীর একটি পাহাড় জমা হল, এবার পটলদি নিজের গায়ে ফেলে ফেলে দেখাতে লাগলেন, সকলেরই মোটামুটি পছন্দ এমন কয়েকটি কেনাও হয়ে গেল, ফাঁকতালে পটলদিরও হয়ে গেল একটা। ... ...
গাজন - সোমনাথ রায় লিটলমেঘ মেলা - শুভ্রনীল সাগর গণেশ পাইনের রানি - শিবাংশু দে না-হওয়া কথারা -সোনালি সেনগুপ্ত দৃষ্টিকোণ - শান্তনু রায় মামুলি কথা -মলয় ভট্টাচার্য মুকুর - শ্ব মর্স কোড - অধীশা সরকার গুহালিপি - চিরন্তন কুণ্ডু মনান্তর - নিশান চ্যাটার্জী স্বগতভাষণ - সুমন মান্না ফেরা - মিঠুন ভৌমিক ... ...
নতুন ছেলেটা খুব বকবক করছে। মেয়েটা খুব হাসছে। প্রথম ছেলেটার মুখে ক্ষুণ্ণ ভাব। হঠাৎ খেয়াল করে টিনের বাক্সটা এখনো তার হাতে। বাক্সটা মেয়েটাকে ফেরত দেয়। মেয়েটা এর হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে অম্লানবদনে অন্য ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিল। তাতে প্রথমজনের মুখের ক্ষুণ্ণ ভাবটা আরো বেড়ে গেল। একটু পরে পথের ধারে একটা খারাপ হয়ে যাওয়া রোড রোলার। প্রথম ছেলেটা হাঁচোড়পাচোড় করে ড্রাইভারের সিটে ওঠার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে সঙ্গীরা অনেকটা এগিয়ে গেছে দেখে হাল ছেড়ে দিয়ে আবার হাঁটা লাগায়। স্কুল মনে হয় আর বেশি দূরে নয়। রাস্তায় এদের মতই রংজ্বলা নীল হাফপ্যান্ট অথবা স্কার্ট পরা কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে এবার। ... ...
বাড়ির পেছন দিকে ছিল একটা এঁদো ডোবা। আর ঘন ঘাস। এই ঘাস শুকিয়ে হয়েছিল আমাদের প্রিয় বিছানা। এই নরম গরম বিছানায় আমরা জড়াজড়ি ঘুমাতাম। আবার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখতাম। সে সময় আমাদের একটি ছোটো বোন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ও স্বপ্ন দেখতে জানত না। ... ...
বাদুরে খেয়ে ফেলা লিচুর খোসার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্ধকারে ফচকাটা ঝলসে ওঠে! রাত্তির সবে গভীর হতে শুরু করেছে। ঘন-দুধের সর হয়ে তখনো তা পুরু হতে পারে নাই! অথচ শলাগুলোর তীক্ষ্ণ আগা আয়শা খাতুনের দিকে তাক করা! খানিক পরই তা ধাই করে বুকে বিঁধে যাবে। একেবারে বাম পার্শ্বে। বাম পাশ, না ডান? ডান পাশ, না বাম? যেনো ভয়ানক তাল-বেতালের ভেতর পড়ে আয়শা খাতুন উদ্দিশ করতে পারে না! কিন্তু সে নিশ্চিত জানে তাক করে থাকা ফচকাটা তাকে বিদ্ধ করবে। করবেই। ফচকার ধারালো শলা বুকের মাংসপেশিতে ঠিক ইঞ্চি তিনেক গেঁথে যাবে। মুহূর্তে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে। আর আয়শা খাতুন তখন আর্তনাদ করে উঠবে। তীব্র-তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। অতঃপর মরিয়া হয়ে সুইচ বোর্ড হাতড়াবে। কাঠের বোর্ডটা হাতে ঠেকলে খুট করে সুইচ জ্বালাবে। এই পর্যন্তই। তারপর সবকিছু শান্ত। স্থির। নিরব। নির্জন। নিথর। একেবারে গোরস্থানের মতো থই থই নির্জনতায় ভরে যাবে ঘরখানা। আয়শা খাতুন ধীরে সুস্থে এই নির্জনতায় পা ডুবাবে। বালিশের কাছে রাখা চশমাটা চোখে পড়বে। চশমা চোখে নিজের বুক-পেট ভালো করে দেখবে। হাতিয়ে হাতিয়ে রক্তচিহ্ন খুঁজবে। অতঃপর ফচকার তীক্ষ্ণধার শলাগুলো খুঁজবে। কিন্তু কোথাও কিনা ওইসবের আলামত নাই! সব যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে! আয়শা খাতুন চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলবে। আঁচলের কোণা দিয়ে ভালো করে মুছে-টুছে ফের পড়বে। এবং পুনরায় দেখার চেষ্টা করবে। কোথায় সেই ক্ষত? কোথায় রক্তের প্রপাত? ঝলসে ওঠা ফচকা? এই সবের চিহ্নও কোথাও নাই! এই রকম অযাচিত বিপদে আয়শা খাতুন কালে-ভদ্রে পড়েছে। অবশ্য এ বিষয়টাও তো নিশ্চিত নয়। জীবন যদি মস্তক হয় তাহলে তার লেজ হলো বিপদ! ফলে যতদিন জীবন ততদিন বিপদ। ধড় থেকে লেজ আলাদা করা যায় না। জীবন আর বিপদ তাই আষ্টে-পৃষ্টে বাধা থাকে! ... ...