স্বপন সিগারেট ফেলে দেয়। ও তারপর রনকে চুপুচুপি বলে, "তোকে বলা হয় নি আসলে। আমার সেইসব বইগুলো, উদয়নের 'আমি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে', কিংবা তুষারের 'শেষ নৌকা', সেগুলোও খুঁজে পাচ্ছে না কয়েকদিন হল। আর, আর আমাদের পত্রিকার পরের সংখ্যার প্রুফ, সেটাও . . .' দূরে গাড়ির আসা-যাওয়ার শব্দ এইখানে বেশ পরিষ্কার শোনা যায়। বৃষ্টি ধরে এসেছিল। আলো যৎসামান্য, ও হলুদ। এখন স্বপন উঠে দাঁড়ায়। দুহাতে কোটটা ফাঁক করে ধরে। বলে, "আমি কিন্তু ছাড়ব না, রন। আই উইল ডেফিনিটলি প্রোটেস্ট। প্রোটেস্ট রন, প্রোটেস্ট। ইয়েস ইয়েস, প্রোটেস্ট। আমি, আমি এ নিয়ে আন্দোলন করব। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখব। সংসদে বিল আনব।" ... ...
এই অসুখের পোশাকি নাম মানডে ব্লুজ। কাজে যাবার অনীহা। বিশেষ করে রবিবার সন্ধ্যায় এই মহামারীর প্রকোপ বাড়ে। আর লোকে ভিড় জমায় এই ক্যাফেতে। বিয়ার আর বাংলা খেয়ে নিজেদের চাঙ্গা করার জন্য। টেবিলে-টেবিলে ধোঁয়া ওঠে। গজল্লায় গমগম করে চারদিক। ফুর্তির ফোয়ারা ছোটে। মেয়েরা প্রেমিকের কোলে উঠে বসে। ছেলেরা হেঁড়ে গলায় গান গায়। ... ...
না যান, না যান, না যান মাহুত রে, / মাহুত বাড়িতে বহেন রে হাল। / ভালে না হয় হাতীর চাকিরি, সাথে সাথে কাল।। ... ...
মরা সাহেবের টেবিল দিয়েই সেদিন শুরু হয়েছিলো - আসলে কি, অফিসে পরপর দুজন বড়সাহেব একই ঘরে মরে যাওয়ার পর প্রাণে ধরে এমনিতেই ওখানে আর কেউ ঢুকতে চাইছিলো না। প্রথম জন টিকলো একটি গোটা মাস, মরলো শনিবার, অফিস ছুটি হলো মঙ্গলবার। দ্বিতীয়জন বড়দিনের ঠিক আগে জিমখানায় দৌড়তে গিয়ে হাঁসফাঁস করে মাটিতে ঘামতে ঘামতে মরে গেলো, সে ছিলো হপ্তাখানেক। দুর্ঘটনার এখানেই শেষ নয়, এক ভরদুপুরে উড়ো খবর এলো যে ওপরের তলায় ডানদিকের ঘরের সাহেব নাকি ছুটিতে ছিলো,বউবাচ্চা সমেত গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে সেও নাকি মারা গেছে। খবরটা সত্যি। ... ...
আব্বার সাথে রাশেদের আজ আশ্চর্য শত্রুতা। আজ সারাদিন, দিনমান। ছোট্ট চায়ের টেবলের দু'পাশে ওরা দু'জন ঠিক দুই যুযুধানের মতন দাবার গুটি নিয়ে বসে আছে সকাল থেকে। কখনও গালে হাত, কখনও বাঁকানো ভ্রূ, কখনও চুপচাপ। আব্বার অফিস ছুটি আজ, রাশেদের ইশকুলও তাই। ওদের সারা ঘরে ছুটির আমেজ এলিয়ে আছে, বসার ঘর থেকে রান্নাঘর, সেখান থেকে বারান্দায়, সবখানে। আপাতত শুধু ছুটি নেই দুজনের মাথার ভেতর, তুমুল তান্ডব তাতে, যুদ্ধ পরিকল্পনায় ব্যস্ত, আর বাইরে তবু বেশ নিরাবেগ, অথবা ভঙ্গিটা সেরকমই, খাঁজ কাটা সুন্দর কাঠের সাদা কালো সৈন্যদের ওরা লেলিয়ে দেয় একে অপরের দিকে। ... ...
অতসী দাঁড়িয়ে আছে এক্সাইড হাউসের মোড়ে। যেখানে হলদিরামের দোকান, তার সামনে। নীলরঙা শিফন শাড়ীতে। অফিস কেটেছে অতসী। অতসী দেখতে মোটামুটি। শ্যামলা, সামান্য স্থূলকায়া। এখন সকাল এগারোটা। বাসে অফিসযাত্রীর ভীড় এখনো পুরো মাত্রায়। সরকারী চাকুরেদের বাজার,ছেলে-মেয়েদের স্কুল, পাড়ার গলির মুখে প্রাত:কালীন গুলতানি, রুটি-ভাত-চচ্চড়ির আহার সেরে এটাই অফিস যাওয়ার আসল সময়। ... ...
আজ অনেকদিন পরে এমনটা হল। এই মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া। অন্ধকারে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। ঘুমের আমেজ যেন চোখের পাতা ছেড়ে পালিয়ে না যেতে পারে! চোখ খোলা যাবেনা কোনোমতেই, তাহলেই ঘুমের দফারফা। রাত এখন কটা কে জানে? ইস, কমপক্ষে ছ ঘন্টা না ঘুমোলে কাল সারাদিন টানতে পারা যাবে না। অফিসে সীটে বসলেই ঘন ঘন হাই উঠবে, কাজে বিরক্তি আসবে। ... ...
তিনমাস জাহাঁ আরা'র সাথে কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এল আব্দুল সাত্তার ঠাকুর। জাহাঁ আরার আকুল কান্না তার কানে যেন সর্বক্ষণ বাজে। কোন কাজে মন বসে না সাত্তারের। চোখের সামনে নানা আকারে ঘুরে বেড়ায় জাহাঁ আরা। কখনো সে এইটুকুনি ছোট্ট এক মেয়ে হয়ে যায়, যে কিছুতেই নতুন শাড়িটিকে সামলাতে পারে না। এদিক গোঁজে তো ওদিক খুলে যায়, আঁচল সামলায় তো পিঠ বেরিয়ে যায়। ... ...
ডাইনিং টেবিলে একটা মাছি লেপ্টে আছে। আধঘন্টা আগে ওখানে আমার চায়ের কাপটা ছিলো। মাছিটাও ছিলো বোধহয় একই জায়গায়। এখন কাপ নেই, মাছির মৃতদেহ পড়ে আছে। আমি তখনও এই চেয়ারটাতেই ছিলাম, এখনও আছি। সেই থেকে ঠায় তাকিয়ে আছি মরা মাছিটার দিকে। কাজ না থাকলে যা হয় আর কি! হাতে সত্যিকারের কাজ না থাকলে একসঙ্গে অনেক কিছু করা যায়। ... ...
এই খেলাটা একা খেলতে হয়। একা একা। নিজে নিজে। শুধুই নিজের সঙ্গে।খুব কিছু লম্বা নয় খেলার সময়টুকু। আধঘন্টামত।কিছু কমই হয়তো। খেলাটা একদিন নিজেই শুরু করেছিল ও। নিয়মকানুন ঠিক করেছিল। কিম্বা হয়তো খেলতে খেলতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। শুধু এখনও জানে না খেলা আরম্ভের সময়টা। ঠিক কখন্ শুরু হয়। একটা হুইশলের আওয়াজ হয় কোথাও। কোথাও একটা। আর ও খেলতে শুরু করে দেয়। ... ...
এদেশে আসার পর চার্চের ভেতরে ঢোকা আমার এই দ্বিতীয়বার। প্রথমবার এসেছিলাম গ্র্যাডস্কুলের বন্ধু ডায়ানার বিয়ের অনুষ্ঠানে। এই শহরের একটি ক্যাথলিক চার্চের শান্ত ও সাদার সমারোহে বিয়ে হয়েছিল ওর। কনের সাদা ওয়েডিং ড্রেস, মাথায় সাদা ফুল, টেবিলে টেবিলে সাদা ফুলের বোকে, ব্রাইডমেডের মাথায় সাদা টিয়ারা - সাদার ঔজ্জ্বল্যে কেমন চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল সেদিন। ... ...
ইয়োর অনার, আমি সত্যি কথাই বলব। আমি তো আর কম দেখলাম না, স্যার, জগতটা যদি ঠিকঠাক দেখেন আপনার ঘেন্না করবে স্যার! এভাবে বেঁচে থাকাও অন্যায়। বাপ ফাপ জানি না কিন্তু যা কিছু করছি তাতে তো কিছু সুবিধার বুঝছি না। আজ আমাদের মানুষ মরছে কাল ওদের। আচ্ছা স্যার আমাদের তোমাদের কী? মানুষের ভাগ বাটোয়ারা সেসব তো হত স্যার মিশরে, হলিউডের ফিল্মে। লোহার শিকলের ঝনঝন শব্দ, মানুষ মরুভূমির বুকে পাথর টেনে আনছে, পিরামিড তৈরি হচ্ছে। ... ...
প্রণম্য পাঠক, এই মুহূর্তে আপনি বাহিরে আসিলেন, মোবাইল বোতামে মৃদু চাপ দিলেন, ভূগর্ভ হইতে কামোদ্দীপক আশ্চর্য স্লিক শকট অনুগত ভৃত্যের মত আপনার সম্মুখে গরুড়সদৃশ করজোড় ভঙ্গিতে একরূপ উদয় হইল বলিয়া-- এই সমস্তই আমি জ্ঞাত আছি। আপনার জিহ্বা নাচিতেছে প্রশ্ন করিবার নিমিত্ত, অজস্র প্রশ্নে সজ্জিত আপনার যোদ্ধ্বৃবেশ-- ইহাও আমি বিলক্ষণ অবগত। তবে, এখনকারটি হইল, "কে বে তুই?' অর্থাৎ, আমি কে? বলিবার কথা, এই প্রশ্নটি এক অনন্তকে টানিয়া আনে এবং মনুষ্য প্রজাতিকে নানাভাবে বিড়ম্বিত করে। ... ...
গ্রামের নাম ছোট দেওয়ান পাড়া বললে কেউ চিনবে না, "ঠাউর বাড়িত যামু' বললে সাত মাইল দূরের ঐ মহকুমা শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে কেউ তোমাকে নরাইল থানার ছোট দেওয়ান পাড়া গ্রামের ঐ ঠাকুর বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা বাৎলে দেবে, হাতে সময় থাকলে পৌঁছেও দেবে। এমনই তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি। সেই গ্রামের নাম ছোট দেওয়ান পাড়া আর সেই ঠাকুর বাড়ির ঠাকুর আব্দুল গাফ্ফারের কথা বলতে গেলে অনেক কথাই চলে আসে সে সব কিস্সা কিন্তু গল্পকথা নয়। ... ...
আমার দাঁতে অনেকটা জীবন জড়িয়ে গেছে। জার্মান শেফার্ড জিভ ইচ্ছে মত ক্লান্ত হয়। ঐ সব ফাঁকফোকর ঘুরে 'তাড়ানো তাড়ানো' পরিচ্ছেদ গুলোতে চরম ক্লান্তি ওর। অন্য সময়ে ওকে ভার্মিয়ের বলে ডাকতেও ইচ্ছে করে কোনো কোনো দিন। ভালোই। গুঁড়ো গুঁড়ো না তাড়ানো জীবন অনেক ক্ষণ ধরে জিভের আঁচে দমপুখ্ত,'চাওয়াদের' ঝিকমিকে সব চে ভালো বাসাটা থেকে আখরোট-বাসরে সেঁধিয়ে যায়। রোজ রোজ। অহনের সব বেলাগুলো, বার্ষিকগতির রাস্তায় পড়ে পাওয়া ঋতুরা,আমার শৈশব,কৈশোর,আমার প্রৌঢ়ত্ব,ইন্তেকাল,একমাত্র ওই টের পায়। জিভটা। আমার ভার্মিয়ের। ... ...
রাতের চন্দ্রাহত জানালায় একফালি নরম কলজে রেখে এসেছি। জানালা বন্ধ করেছি ঠিকঠাক। এখন ভোরের অপেক্ষায় অ্যাশট্রে জ্বলছে নিভছে। জানলায় রেখে আসা কলজের টুকরোটায় আমার ইতিহাস কতখানি মিশে আছে, আর কতখানি তাতে এ শহরের স্বাদ- গন্ধ- রং, তা জানি না। শুধু মনে পড়ে জেসিকা আমাকে বলেছিল- সাধারণ মেয়েরা ভাল থাকে, খারাপ থাকে। ডাইনিরা শুধু জেগে থাকে। চিরকাল। অনন্তকাল। ... ...
নিরালম্বের বাবা বৃকোদর ইংরেজ জমানার ফাঁসু¤ড়ে। সন্ধ্যেবেলা একশো ওয়াট বালেÄর নীচে ম হ'য়ে বসে থাকেন। চা-মু¢ড় খান। আর মাঝে মাঝে "হুম' শব্দে আওয়াজ ছাড়েন। হয়তো এই ¢ন¢খল সংসারকে বু¢ঝয়ে দেন -- "আ¢ম আ¢ছ'। আছেন তো বটেই। বদহজম, বদরাগ আর বদন¢সব -- এই ¢তন ¢নয়ে ¢ত¢ন রী¢তমত আছেন। বদহজমের জন্যে পাড়ার হো¢মওপাথের স® প্রায়ই আলোচনা হয়। "এখনকার স¢ব্জ পর্যন্ত... বুঝলে ডাক্তার। এখনকার স¢ব্জ পর্যন্ত যেন কেমন ¢বষাক্ত হ'য়ে গেছে। তখন ক¥মড়ো খেলে... বুঝলে ডাক্তার ("বুঝলে ডাক্তার'টা তাঁর কথার মাত্রা)।' ... ...
জলপাত্রটি কানায় কানায় ভরা।তলায় নীল নুড়ি।লালচে বেগুণী পাখনায় জল কাটে, ঘাই দেয়। নুড়ি ছুঁয়ে উঠে আসে। জলপাত্রের কাঁচদেওয়ালে বিম্বিত হয় সে। সিয়ামিজ ফাইটার। লড়ে যায় নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে। এক দানা, দু'দানা, তিনদানা খাবার-দিনে তিনবার। জল পাল্টানো সপ্তাহে একদিন। পুরোনো টেবিল। দাগধরা।টেবিল ঘিরে চেয়ার।চার, পাঁচ,ছয়। কিম্বা তার বেশি। মর্নিং টী, লাঞ্চ, আফটারনুন টী। ওরা চা খায়।কফি। সূপ, কাপ নুডলস,স্যান্ডউইচ। টেবিল ঘিরে ওরা ক'জন। প্রতিদিন। ... ...
শ্রীমতীদের শোবার ঘরের জানলার গ্রিলের জাল দিয়ে এক ফালি আকাশ ধরা যায় রোজ। আজ ধরা পড়েছে দুটো কালো পাখি। কাক না চিল কে জানে। পাখিদুটো আকাশে কাটাকুটি খেলে পাখা মেলে। দুরে দুরে বিন্দু হয়ে আবার ফিরে আসে। যায় আর আসে।তারপর হারিয়ে যায় কখন যেন, থেকে যায় শুধু শ্রীমতীর মনের পাতায় অন্যমনস্ক আঁকিবুকি। সুখের, দু:খের, ভালোবাসার, ঘেন্নার। প্রথমের, শেষের। ... ...
গুরু কয়েছেন স্যাভেজের মধ্যে যেমন সেজ, ঠিক তেমনি জানার মধ্যে জান লুকিয়ে আছে। এই যে গুরুর কাছে সমাদ্দারস্যার আসেন, ওনার কাছ থেকেই না জানলাম কিভাবে তিরুপতির থেকে কাটাচুল এনে উনি "বালকুন্তল" ব্র্যান্ড উইগ বানিয়ে বাজারে ছাড়েন। স্পেশাল মাল ওনলি ফর টেকো বাচ্চাস। এই সমাদ্দার স্যারের থেকে কম জেনেছি! মধ্যমগ্রামে ফ্ল্যাটের পার স্কোয়ার ফিট হাজার হয়ে গেছে, অশোকনগর হরিদাস নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের হেডমাস্টারের গরুভাড়া দেওয়ার সাইড বিজনেস আছে, চাম্পাহাটি স্টেশনের এক মাসির কাছে বেস্ট সবরিকলা পাওয়া যায়, মায় "যাহাদের লিঙ্গে তিল থাকে তাহাদের কামভাব প্রবল হয়" এত অব্দি। ... ...