সাধারণত রোগ সেরে গেলে কেউ ডাক্তারের কাছে ফেরত আসেন না। যারা আসেন, হয় তাদের জ্বর কমেনি অথবা পেটে ব্যথা আরও বেড়েছে। প্রথম দিকে হতাশ হয়ে পড়তাম। ভাবতাম, কারোরই তো অসুখ কমাতে পারছি না। আস্তে আস্তে বুঝলাম, দশ জনের মধ্যে দু- তিনজন ফেরত আসছেন। বাকিরা সুস্থ আছেন বলেই আসছেন না। দিনকে দিন অভিজ্ঞতা বাড়ছে। এখন আর সহজে আনন্দ, মন খারাপ, হতাশা এইসব হয় না। কতো রকমের মানুষ যে হয়! সাধারণ মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, আমি ঠিক হয়ে যাবো তো?’ ... ...
আমাদের তথ্যানুসন্ধানের কাজ শুরু হয় ২০১৮-র এমন এক সময়, যখন ভাটপাড়ার অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবন আগুন আর ছাইয়ের উপর দাঁড়িয়েছিল। ভাটপাড়া নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির সহায়তায় আমরা বিভিন্ন সময়ে কিছু ফিল্ড সার্ভে-ও করেছিলাম। বছরখানেক পেরিয়ে এসে আমরা যখন পুরোনো বিবৃতিগুলির পর্যালোচনায় বসেছি, ঠিক তখনই কিছু নতুন শব্দকে কেন্দ্র করে নতুন করে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি রূপ নিতে শুরু করেছে—‘নিজামউদ্দিন-মুসলিম-করোনা’। ইতিমধ্যে তেলিনিপাড়াতেও দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, এবং ফলস্বরূপ হুগলি নদীর দু-পারেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ... ...
মাওরীদের হাতে টাসমানের বেশ কয়েকজন সঙ্গী নিহত হন। এই ঘটনার পর টাসমান আর সে দেশে পা রাখেন নি, ফিরে যান। যে দ্বীপটি তিনি আবিষ্কার করেন তার নাম পরে পরিবর্তিত করে রাখা হয় নিউ জিল্যাণ্ড। এর পর একশো বছরের ওপর এই দ্বীপে ইউরোপীয়দের পা পড়েনি। একশো আঠাশ বছর পর ১৭৭০ সালে ইংরেজ নাবিক ক্যাপটেন কুক আসবেন নিউজিল্যাণ্ডে, শুরু হবে সে দেশের এক কলোনিয়াল ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায়। ... ...
গত শতকের ষাটের দশক থেকে আজকের দিন পর্যন্ত, প্রায় ছ'টি দশক ব্যাপ্ত শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস বৃত্তরৈখিক প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে। ... ...
মাল্যবান, জলপাইহাটি, বাসমতীর উপাখ্যান লেখা হয়েছিল পেনসিলে। গোপনে লিখতেন কবি, আর ভাই অশোকানন্দ দাশের বাড়ি গিয়ে ট্রাঙ্কে জমা করে ফিরে আসতেন। ১৭২/৩ রাসবিহারী এভিনিউয়ের সেই বাড়ি অতি সম্প্রতি ভাঙা শুরু হয়েছে। সেখানেই ছিল সন্দেশ পত্রিকার অফিস। বাড়িটি পেনসিলে আঁকা বাড়ির মতো ধূসর হতে হতে মুছে গেল। ট্রাঙ্কগুলি অনেকদিন আগেই জাতীয় গ্রন্থাগারে জমা পড়েছিল। অনুজ প্রতিম লেখক আফসার আমেদ তা কপি করে আনত ন্যাশানাল লাইব্রেরি থেকে। ভাইরাস আক্রান্ত এই অন্তরীন কালে আমি আমার জীবনের কথা বলব ভাবছি। জীবনানন্দ মুছে যাননি, আমার লেখা অস্পষ্ট হতে হতে হারিয়ে যাবে জানি। আমি সামান্য মানুষ, জীবনভর কলমে লিখেছি, তার উপরে জল পড়ে লেখা ধুয়ে গেছে কতবার। আমি আমার কথা পেনসিলে লিখতে শুরু করলাম। ... ...
যৌবন গিয়ে প্রৌঢ়ত্ব ছুঁই ছুঁই, এমন সময় ছোটদাদু চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন। তখন চাকরি চলে যাওয়া তেমন কোন বড়ো ব্যাপার ছিলোনা, লোকের হামেশাই চাকরি যেত। পরিবারও খুবই সচ্ছ্বল ছিলো -- চারটি কন্যাসন্তানের পিতা ছোট্দাদু বাড়ি এসে "কোনো ভদ্রলোকের বাচ্চা চাকরি করেনা" ঘোষণা করে তাস পিটতে বসে গেলেন। যৌথ পরিবারের কর্তা, বড়োদাদু মার্চেন্ট আপিসের বড়োবাবু। তিনি নার্ভাস হয়ে পরের মাসেই একটা পাকা চাকরির বন্দোবস্ত করে বাড়িতে এসে ছোটভাইকে বলার পর ছোটদাদু নাকি অট্টহাস্য করে বলেছিলেন, "তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে বড়দা? সত্তর টাকার মাইনে পেয়ে এসে আমি এখন পঞ্চাশ টাকায় ঢুকবো?"! বলা বাহুল্য ছোটদাদুকে আর কোনদিন উপার্জন করতে দেখা যায়নি, এবং যৌথ পরিবারটি অনতিবিলম্বে স্বখাতসলিলে ধরাশায়ী হয়। তারপরের দুই প্রজন্ম মুখে রক্ত তুলে খেটেও সেই বিলাসিতার ঋণ চোকাতে পারেনি। যে দারিদ্র পাকিয়ে ধোঁয়া টানে কবি, যে দারিদ্রে জলের ছিটে দিয়ে উজ্জ্বল করে তোলে আঁকিয়ে - সেই রাজকীয় শিল্পমন্ডিত দারিদ্র নয়। শস্তা অগৌরবের দারিদ্র। ... ...
আন্তর্জাতিক বিপণন সমীক্ষক গ্র্যান্ডভিউ রিসার্চের সাম্প্রতিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে এই স্যানিটাইজার বিক্রির মোট পরিমাণ ছিল ২৭০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এর বাজার বার্ষিক ২২.৬ শতাংশ হারে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনার প্রকোপে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই গত মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে স্যানিটাইজার বিক্রি হয়েছে ২০ কোটি ডলার মূল্যের। আগের বছরের তুলনায় যার বৃদ্ধি ৪৬৫ শতাংশ। চলতি বছরের নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ভোট কর্মী ও ভোটদাতাদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে মার্কিন কংগ্রেস ইতিমধ্যে ইলেকশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিশনকে ৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে স্যানিটাইজার, মাস্ক ইত্যাদি কেনার জন্যে। আর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা টেকন্যাভিও নজর রেখে চলেছে ভারতের বাজারের দিকে। তাদের সমীক্ষায় স্পষ্টই বলা হচ্ছে, মহামারীর কল্যাণে আগামী চার বছরে অর্থাৎ ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবসা তুঙ্গে উঠবে যার বৃদ্ধির পরিমাণ হবে ৪১ কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। স্বভাবতই ভারতের বাজার ধরার জন্যে পাল্লা দিচ্ছে থ্রি এম, ডাবর, ইমামি, গোদরেজ কনজিউমার প্রোডাকটস, গোজো ইন্ডাস্ট্রিজ ইনকরপোরেটেড, আই টি সি, ম্যারিকো, রেকিট বেনকাইজার, হিমালয়া ড্রাগ ও ইউনিলিভার গ্রূপের মতো একঝাঁক ডাকসাইটে সংস্থা। ... ...
আমাদের তথ্যানুসন্ধানের কাজ শুরু হয় ২০১৮-র এমন এক সময়, যখন ভাটপাড়ার অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবন আগুন আর ছাইয়ের উপর দাঁড়িয়েছিল। ভাটপাড়া নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির সহায়তায় আমরা বিভিন্ন সময়ে কিছু ফিল্ড সার্ভে-ও করেছিলাম। বছরখানেক পেরিয়ে এসে আমরা যখন পুরোনো বিবৃতিগুলির পর্যালোচনায় বসেছি, ঠিক তখনই কিছু নতুন শব্দকে কেন্দ্র করে নতুন করে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি রূপ নিতে শুরু করেছে—‘নিজামউদ্দিন-মুসলিম-করোনা’। ইতিমধ্যে তেলিনিপাড়াতেও দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, এবং ফলস্বরূপ হুগলি নদীর দু-পারেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ... ...
পাইলটের আকাশবাণী হল আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা ক্রাইস্টচার্চের বিমানবন্দরে অবতরণ করব, ঠিক এই সময়ে নজরে এলেন দক্ষিণ আল্পস, পাহাড়চূড়ায় তুষার, যেন সদ্য স্নান করে গায়ে ট্যালকম পাউডার মেখে স্থাণুবৎ গা এলিয়েছেন পশ্চিমতটরেখা বরাবর। তরঙ্গের মতন সাদা বরফের চূড়া, তার অনতিগভীরে কোথাও বা পাহাড়ের কোলে পান্না সবুজ ছোট হ্রদ, তারপরেই ক্যান্টারবেরির প্রশস্ত প্রান্তর জুড়ে এঁকেবেঁকে চলা অজস্র শিরা উপশিরার মতন নদী, দেখতে দেখতে ক্রাইস্টচার্চ ঘিরে আকাশপাখি গোল করে ঘুরতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো প্রশান্ত মহাসাগরের নীল দিগন্তে ম্যাজিক। ... ...
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে যখন আফ্রিকায় ইউরোপিয়ানরা কলোনি গড়ে তুলছে, তখন তাদের মধ্যে সিফিলিস মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। পেনিসিলিন আবিষ্কার হবে আরও দেড়শো বছর পরে। ইউরোপিয়ান সৈনিকরা খেয়াল করেছিল যাদের ম্যালেরিয়া হচ্ছে এবং বরাত জোরে ম্যালেরিয়ার থেকে বেঁচে ফিরছে তাদের সিফিলিস সেরে যাচ্ছে। একাধিক সৈনিকের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর প্রকৃত কারণ বলা মুশকিল। তবে একটা কারণ হতে পারে সিফিলিসের জীবাণু ট্রিপোনেমা প্যালিডাম বেশি উষ্ণতায় বাঁচে না। ম্যালেরিয়া জ্বরের সময় দেহের উষ্ণতা মাঝে মাঝেই ৪০ – ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। সেই যুগে ম্যালেরিয়ারও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা ছিল না। ফলে জ্বর চলতো দীর্ঘদিন ধরে। শরীরের মধ্যে থাকা সিফিলিসের জীবাণু এই উচ্চ তাপমাত্রায় মারা পড়ত। ... ...
এক সুফি পীর বলেছিল ছেলেকে "রাত কি রানি” ফুলের কাছে নিয়ে যেও না যেন। তাহলে তাকে আর বেঁধে রাখতে পারবে না। রাত কি রানি, শিউলি ফুল। নিশিরাত জুড়ে সে কান্নার মত ঝরে পড়ে। অজস্র কান্নার ফোঁটা। সেই উদাসী - গন্ধ ওকে ঘর ছাড়া করবে। সেই থেকে মা, রাত কি রানি ফুল থেকে ছেলেকে দূরে রাখে ! আজমেঢ় শরিফে মাথা কুটে এই ছেলের জন্ম। বাবার অকাল মৃত্যুর পরে চিরাগ এ দিল্লির আঙিনায় খেলে বেড়ানো এক খ্যাপা ছেলেকে দেখে মায়ের চিন্তা হয়। পীর বলে, রাজার দুয়ারে মাথা কুটলে রাজার জন্ম হয়, নিদেন পক্ষে মন্ত্রীর । ফকিরের দরগায় মাথা কুটলে ফকির হবে না তো কি শাহেনশা হবে? ... ...
মহামারীর আবহে মামুলি এক মাস্ককে ঘিরে যে বহুমাত্রিক তাৎপর্য সেটিও আমাদের কাছে ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। শতবর্ষ আগের নিছক গজ আর কাপড়ের মাস্ক আজ বিপণনের অমূল্য সামগ্রী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, তাবড় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া আর সর্বজ্ঞ হিতৈষীদের প্রতিনিয়ত উপদেশ ও পরামর্শের ঠেলায় এবং 'ইনফরমেশন প্যানডেমিকে'র দাপটে সাধারণ মানুষ আজ দৃশ্যতই বিভ্রান্ত। আর মানুষের মনের এই বিভ্রান্তি ও আতঙ্ককে মূলধন করেই দুনিয়া জুড়ে পসরা বসেছে নানা ধরনের মাস্কের। শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষার তাগিদে নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের চাহিদা, প্রয়োজন, মর্যাদা, ও মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে রকমারি মাস্ককে অনবরত বাণিজ্যিক ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে 'কালচারাল' বা 'ফ্যাশন স্টেটমেন্ট' হিসেবেও। ... ...
আমরা বরং, এই দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার শেষে, পপুলিজম কেন বিপজ্জনক সেটা বোঝার চেষ্টা করি। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে পপুলিজম ব্যাপারটা মোটেই খুব একটা খারাপ বলে মনে হয়না। হাজার হোক, গণতন্ত্রের তো উদ্দেশ্যই মানুষের কথা আরো বেশি করে তুলে আনা, তাঁদের অভাব অভিযোগ গুরুত্বসহকারে ভাবা। একরকমভাবে এলিট শাসকদলের এইসব অভাব অভিযোগ সম্পর্কে ঔদাসীন্যই তো পপুলিস্ট বা তোষণের রাজনীতির কারণ। কিন্তু বিভিন্ন দেশে পপুলিস্ট দল বা নেতৃত্বের উত্থান এবং ঘটনাপরম্পরা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় বিপদটা কোথায়। আরো স্পষ্ট হয় ক্যারিশম্যাটিক জনপ্রিয় নেতাদের কার্যকলাপ দেখলে। সেখানে একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন আছে। ... ...
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করাকালীন সেখানকার এক রসায়নের ছাত্রের সাথে আমার প্রায়ই গল্প হতো। ছেলেটি ব্রাজিলের, তখন সে ডক্টরেট করছে। ব্রাজিল বললেই আমার মন চিরকাল উচাটন হয়। রিও বা সাও পাওলোর ছবি, টিভির পর্দায় বা নেটে যেমন দেখেছি, ভেসে ওঠে। সিটি অফ গডের দৃশ্যাবলী, ফুটবল মাঠের ম্যাজিক স্টিলগুলো, অসংখ্য খেলোয়াড়ের নাম, তাদের নিয়ে মাতামাতি, বিশ্বকাপে কলকাতার চালচিত্র ---এইসব অজস্র ছবির কোলাজ। কিন্তু সেই ছেলের কাছে আমি অন্য এক ব্রাজিলের আঁখো দেখি গল্প শুনতাম। ছেলেটির বাবা একজন নামকরা সার্জেন, অগাধ পয়সা। এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ ছাড়া পড়া খুবই খরচসাপেক্ষ। সেই ছেলে খুবই অপরাধবোধ নিয়ে বলেছিলো, তার বাবার কাছে ঐসব খরচ গায়েই লাগেনি। একেবারে হাইস্কুল থেকে ছেলেটি তাই মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা। স্কুল কলেজের পড়াশুনোয় তাকে কোনদিন কোন কাজ করতে হয়নি, অথচ তার বেশিরভাগ বন্ধুরাই নানারকম ছোটখাটো কাজ করতে বাধ্য হয়েছে পড়ার পাশাপাশি। ব্যক্তিগত প্রিভিলেজ, পারিবারিক বৈভব, ব্রাজিলের আর্থিক বৈষম্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (পৃথিবীর অন্যত্রও) ক্রমশ বেড়ে চলা "ট্রাম্পিয়ানা" তাকে বিষন্ন করতো। ... ...
অনেক রোগী খুপরিতে ঢুকে প্রথমেই স্যানিটাইজারের বোতল থেকে দু-চার ফোঁটা তরল বসার চেয়ার, আমার টেবিলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আজ এক ভদ্রমহিলা গঙ্গাজল এর মত আমার গায়ে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার ছিটিয়ে দিলেন। মানে চেয়ার-টেবিলের সাথে তিনি ডাক্তারকেও স্যানিটাইজ করে নিলেন। ওদিকে রোগীর সংখ্যা রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অধিকাংশই জ্বরের রোগী। জ্বর আসলেই এখন অনেকে গন্ধ শুঁকছেন। একজন বললেন, 'ডাক্তারবাবু, খাবার-দাবারের গন্ধ পাচ্ছি না। কিন্তু ডেটলের গন্ধ, ডেনড্রাইটের গন্ধ এগুলো দিব্যি পাচ্ছি।' একজন রোগী দুদিন আগেই দেখিয়ে গেছেন। জ্বর কমছে না। আবার এসেছেন। তার পুরোনো প্রেসক্রিপশন পুরো সাদা। আমি অবাক হয়ে বললাম, 'এ কি? আমি কোন ওষুধপত্র লিখিনি নাকি?' উনি বিব্রত মুখে জানালেন, 'হ্যাঁ লিখেছিলেন। কিন্তু বাড়ি গিয়ে প্রেসক্রিপশন স্যানিটাইজ করতেই সব লেখা উবে গেছে।' ... ...
সেই যে সব প্রাণ একটি একটি করে বেঁচে গেল, তার মধ্যে আমিও বাঁচলাম, বেঁচে রইল আমার হিরামনও। সে এখন বেশ ডাগরডোগর। বাঁকানো লাল ঠোঁট, চকচকে সবুজ পালক। আমার কাঁধে বসে থাকে। এখনও বসে আছে। তাকে কাঁধে নিয়েই আমি চলেছি। মেহরাউলির পথে। শুধু আমি একা নই। গোটা শাহজাহানাবাদ আমার সঙ্গে চলেছে। আমার সঙ্গে চলেছে বললে ভুল বলা হবে। চলেছে সব বাদশার সঙ্গে। বলতে গেলে শাহজাহানাবাদ আজ ফাঁকা। বাদশা সাজগোজ করে চতুর্দোলা সাজিয়ে মেহরাউলির পথে চলেছেন। বাদশা চলেছেন তাঁর প্রিয় উৎসবে। শুধু বাদশার নয়, তামাম শাহজাহানাবাদের বড়ো খুশির তেওহার। ফুলওয়ালো কি সয়ের। সয়ের এ গুলফারোশাঁ। ফুল ব্যবসায়ীদের মোচ্ছব। চারিদিকে শুধু রং আর রং। ... ...
সংক্রামক রোগীকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন রাখার জন্যে চালু হয়েছিল কোয়ারেন্টাইন প্রথা। তার জন্যে রোগীকে রাখা হত লোকালয়ের বাইরে কোন কোয়ারেন্টাইন হাউজে। চিকিৎসা বা শুশ্রূষার পরিবর্তে সেখানে যে কী অমানবিক আচরণ জুটত তার বরাতে তার প্রমাণ মেলে অসমের বরাক উপত্যকায় শিলচরের এক পুরনো বিবরণে। কলেরা রোগীকে কোয়ারেন্টাইন হাউজে নিয়ে আসার সময় ও সুযোগ হত না। কলেরায় আক্রান্ত রোগী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংক্রমণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যেত। কিন্তু গুটিবসন্তের আক্রমণ হলে রোগীকে কয়েকদিন ভুগতে হত। গুটিবসন্তে আক্রান্ত কোন বেওয়ারিশ রোগী পেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ ওই রোগীকে কোয়ারেন্টাইন হাউজে পাঠিয়ে দিতেন। সাধারণত গুটিবসন্তের রোগী রাখা হত বলে ঘরটার নামই হয়ে গেল 'গুটিঘর'। ... ...
শিকড় তো অনেক গহীনে। সেখানে প্রবেশ করবে কী করে রেখা। সে ছিল নিরূপায় নিরালম্ব এক মানবী, খালেকও কি তাই নয়? খালেক--পোকার রক্তে যে শৈশব রয়েছে তাকে সে এড়াতে পারে না। তাকে সে ভোলে নি। টিপু ভাইজান, মনি ভাইজান, ছবিদি, ইস্কুল, পা ভাঙ্গা শালিক...... কী অপূরব এক শৈশব এঁকেছেন মাহমুদুল হক। সেই শৈশবই খেয়েছে তার প্রাণমন। সেই ফেলে আসা গ্রাম, মানুষজন। ১৯৪৭-এর কথা তা। তখন বালকের বয়স আট হবে বড় জোর। ক্লাস টু। তার দাদা টিপু কলেজে ভর্তি হয়েছে। মনি ভাইজান ক্লাস নাইন হবে কি? সেই বালকের অমল শৈশবই এই উপন্যাসের আধার। এই উপন্যাসের প্রাণ। ছোট ছোট এমন অনুষঙ্গে ভরে আছে এই উপন্যাস যে পড়তে পড়তে বুক মুচড়ে যায়। দেখতে পাই আমার জন্মের আগের পৃথিবী। উপন্যাস তো আমাকে জাতিস্মর করে তোলে। দেখতে পাই সেই সময়কে। ... ...
গলা খাঁকড়িয়ে ইবন, মুখে দুটো লবঙ্গ ফেলে বললেন, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম, বুঝলেন! সবে চিন দেশ ছেড়েছি। সমুদ্রের কোন অজানা অঞ্চল দিয়ে চলেছি মাঝিমাল্লার দল বুঝতেই পারছে না। শোঁ শোঁ হাওয়া। আকাশ কালো অন্ধকার। দশ দিন সূর্যের মুখ দেখিনি। বেঁচে থাকবো কি না বুঝতেই পারছি না! জাহাজের সবাই আবার চিন দেশে ফিরে যেতে চাইলো কিন্তু তখন তা আর সম্ভব নয়। বিয়াল্লিশ দিন সমুদ্রে আমাদের এইভাবেই কাটল। অনিশ্চিত। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কী হতে চলেছে। তেতাল্লিশ দিনে দূর থেকে একটা পাহাড় দেখা গেল। পাহাড়! মানে ডাঙা! বাতাসের বেগ আমাদের সেই দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। জলের মধ্যে পাহাড়! অভিজ্ঞ নাবিকের দল বলাবলি করতে লাগলো, এরকম কোনো ধারণাই তাদের নেই। কোথাও মস্ত বড় কিছু ভুল হচ্ছে! ... ...
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাড় পাঁজরা বেড়িয়ে গেছে। কোভিড রোগীদের তো বটেই, অন্যান্য রোগেও চিকিৎসা পেতেও জনসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে।এটা হওয়ারই ছিল। মিডিয়া ও সরকারের পক্ষ থেকে যথারীতি ভঙ্গুর পরিকাঠামোকে চাপা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। মানুষেরা আমাদের গালি দিয়ে মনের ঝাল মেটাচ্ছে। কর্পোরেট হাসপাতালগুলি জনস্বাস্থ্যের এই দুর্যোগের সময়েও ব্যবসায়িক মনোভাব থেকে বেরোতে পারেনি। তারা নানা রকম করোনা প্যাকেজ চালু করেছে। তা সাধারন মানুষ তো বটেই, আমার মতো মধ্যবিত্ত চিকিৎসকেরও সামর্থ্যের বাইরে। সরকার সে সব দেখে শুনেও চুপচাপ। ... ...