‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ ছাপার জন্য আমি ঝাড়গ্রাম কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সেই ঋণ দুবছর কয়েক মাস ধরে সুদসহ শোধ করেছিলাম। তখন মাইনে পেতাম শ’পাঁচেক টাকা। আমি তখন একেবারেই অচেনা এক নবীন লেখক। অমৃত পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেয়েছি সদ্য। গল্প যা বেরিয়েছে, লিটল ম্যাগাজিনে। কবিপত্র, অনুক্ত, পরিচয়, সংক্রান্তি---ইত্যাদি পত্রিকায়। লিখে উপার্জন হয়ই না প্রায়। বই ছিল ৭ ফর্মা মানে ১১২ পাতার। অ্যান্টিক নামের একটি মূল্যবান কাগজে লেটার প্রেসে ছেপে বেরিয়েছিল সেই বই। খুব সম্ভবত সুকিয়া স্ট্রিটের হরিপদ পাত্রের ছাপাখানা সত্যনারায়ন প্রেসে কম্পোজ হয়েছিল। আমি এইসব কথা বলছি এই কারণে যে সেই লেটার প্রেস, অ্যান্টিক কাগজ, সীসের অক্ষর, কাঠের গালি এখন হারিয়ে গেছে। এক একটি খোপে এক এক অক্ষর। ই-কার, আ-কার, উ-কার, এ-কার সব আলাদা আলাদা খোপে। কম্পোজিটরের সব মুখস্ত থাকত। কী দ্রুতই না সিসের অক্ষর সাজিয়ে সাজিয়ে গোটা বই নির্মাণ করে ফেলতেন। হ্যাঁ, সেই লেটার প্রেস, সেই ছাপাখানা উঠে গেছে। ... ...
জে জে স্কুলের পাঠ শেষ হলে আমার বাবা – নিশ্চয়ই বুঝেছো উমেশ আমার বাবার নাম – বোম্বে ম্যুনিসিপাল কর্পোরেশনে চাকরিতে ঢুকে গেলো আর ভূতনাথ চৌধুরি তাঁর মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন য়্যোরোপে। কোন বিশেষ আর্ট স্কুলে নয় কিন্তু, তাঁর অনেক বন্ধু ছিলেন য়্যোরোপে, তাদের তত্ত্বাবধানে পুরো কন্টিনেন্ট ঘুরে গ্রেট মাস্টার্সদের ছবি দেখা আর নানা সেমিনারে যোগ দেওয়া দু বছর ধরে; এটাই কাজ, এটাই হায়ার এডুকেশন। দু বছর পর যখন ফিরলো রুনু পিসি, তার মধ্যে আমাদের বাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী বাবার বিয়ে হয়ে গেছে, আরও বছর খানেক পর জন্মালাম আমি। আমার দখল নিয়ে নিলো রুনু পিসি। ... ...
টাসমানরা দুটো জাহাজ নিয়ে এসেছিলেন, একটার নাম জিহান আর অন্যটার নাম হিমসকার্ক যেখানে টাসমান স্বয়ং ছিলেন। এর মধ্যে জিহান নামে জাহাজটি থেকে একটি ছোট নৌকো ডাচরা সমুদ্রে নামিয়ে হিমসকারক জাহাজে নিয়ে এসেছিল, এবার সেটি জিহানের দিকে ফেরত যাবে, এমন সময় আরো তেরো জন মাওরি সম্বলিত আরেকটি নৌকো করে এগিয়ে এসে সজোরে ডাচ নৌকোটিকে ধাক্কা মারে | এর ফলে তিন-চারজন ডাচ নাবিকের মৃত্যু হয়। ডাচরা অবশ্য তৎক্ষণাৎ গুলি গোলা ছোঁড়ে, তবে তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি। মাওরিরা একটি মৃতদেহ নৌকোয় তুলে ফেরৎ যায়। মাইকেল কিং পেঙ্গুইন হিস্ট্রি অফ নিউজিল্যাণ্ডে লিখেছেন মাওরিরা তাদের মানা অনুযায়ী, যেকালে পরাজিত সৈনিকদের মেরে ফেলে খেয়ে নেওয়াই তাদের রীতি রেওয়াজ, খুব সম্ভবত এই মৃত ডাচটিকে রান্না করে তাই খেয়ে ফেলে থাকবে। ... ...
‘আসল বিষয়টা হল মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল না থাকলে বাস্তবের চেয়ে গল্পের ভুবনের মু্গ্ধতা জীবনপ্রবাহে মিশে যায়৷ যদিও শেষে ফিরে আসে প্রবহমানকালের আবহমান বার্তা, তবু গ্রন্থের সংযোগে বিচ্যুতি ঘটে না৷ পরের গল্প পাঠেই সব দুঃখ দূর হয়ে যায়’- এই অভূতপূর্ব বিজ্ঞাপন দেওয়া চায়ের আকর্ষণ যথার্থই পছন্দ হয়ে গেল তার৷ ... ...
শ্যামলবাবুর সঙ্গে মেশা আমার জীবনের এক মহার্ঘ স্মৃতি। তা ছিল অম্ল এবং মধুরতায় মেশানো। প্রথমে শ্যামলবাবু ধরেই নিয়েছিলেন আমার দ্বারা তেমন লেখা হবে না। বন্ধুরাই বলে। আর শৈবাল বলে। একদিন তো আমাকে বলেই বসলেন, লেখা অভ্যাস করো, প্রতিদিন লেখো, তবে তুমি এদের সঙ্গে মেলামেশার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। ভয় করতাম খুব। একদিন তুষার সমীরের সঙ্গে সন্ধ্যায় গিয়েছি শ্যামলদার বাড়ি। ওরাই টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পান করা হল। শ্যামলদা আমাকে নিয়ে পড়লেন। আমার কাছে কুলটিকরির খবরাখবর নিলেন। হাটের খবর, চালের দর, সবজির দর ইত্যাদি। সুবর্ণরেখা এবং ডুলং নদীর কথা শুনলেন। তিনি বললেন বিদ্যাধরীর মৃত্যুর কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যা দেখেছিলেন। তাঁর রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় ইত্যাদি গল্পে আর কুবেরের বিষয়আশয় উপন্যাসে যা আছে। ... ...
শুধু যে ছবি কেউ কেনেনি তা-ই তো নয় ! এতগুলো খবরের কাগজ আর পত্রিকায় নিজে গিয়ে সম্পাদক আর যাদের যাদের চিনতো, উদ্বোধনের দিনে আসার জন্যে নেমন্তন্ন কোরে এসেছিলো তাদের। কোনও কাগজে, কোনও পত্রিকায়, কেউ একটা মন্তব্যও করলো না ! এ ছাড়াও কলকাতায় ওর চেনা-জানা লোক তো কম নেই। শিল্পসাহিত্য মহলে যারা ঘোরাঘুরি করে, যাদের মধ্যে অনেকেই কিছু-না-কিছু লিখেছে-এঁকেছে শাম্বর জন্যে, তাদেরও তো অনুরোধ করেছিলো আসার জন্যে, কতজনই বা এলো ! এমনকি এসেওছিলো যারা, ওর ছবির বিষয়ে ভালোমন্দ মন্তব্যই বা করলো তাদের মধ্যে কতো জন ! জঙ্গল নিয়ে, জঙ্গলে ওর যাওয়া-থাকা-সময় কাটানো, এ সব নিয়েও উৎসাহ দেখালো অনেকে, কিন্তু ছবির বিষয়ে খুব একটা গুরুত্বই কেউ দিলো বলে মনে হলো না। ... ...
পলিনেশিয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে এখানে আসবার পর মাওরিরা দেখলেন যে এ প্রকৃতপক্ষে এক প্রকাণ্ড দ্বীপভূমি, সরাসরি প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বটে, কিন্তু তটরেখা মিলিয়ে দেখলে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এক দেশ, যার প্রায় সর্বত্র বসতি স্থাপন করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, ভারি বৈচিত্রপূর্ণ ও বর্ণময় এক দেশ - একদিকে যেমন ঘন সমুদ্রতটের জঙ্গল, অন্যদিকে তুষারমণ্ডিত গিরিশ্রেণী। তুষারশুভ্র গিরিশ্রেণী এঁরা এর আগে দেখেন নি, তার নাম দিলেন “হুকা” (বাং: ফেনা) | ... ...
আজ ঠাকুমা চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে দিয়ে জোলাপাড়ায় ঢুকে যায়। জোলাপাড়ার বাড়িগুলোর উঠোনে উঠোনে চরকি। আর সুতো ভরা লাল নীল নলিগুলো বারান্দায় স্তুপ করা। ও ঠাকুমা, আমার পুতুলের জামায় সুতোর ফুল তুলে দেবে বলেছিলে। দেবো দিদি, ঠাকুমা খেজুর চাচার বাড়ি পেরিয়ে যায়। করিম জোলার বাড়ির উঠোনে মুরগীগুলো খোঁপ থেকে বেরিয়ে আসছে। পেছন পেছন ছানাগুলোও। করিম জোলার বাড়ি ছাড়ালেই কলেজের মাঠ। সে মাঠের ওই কোণায় মান্দার গাছ। ... ...
রেস্ট হাউজের বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে দিয়ে চৌকিদার গেলো সাহেবকে খুঁজতে। বিক্রম বললেন, কনের বাড়িতে আপনি থাকতে চাইবেন তা আমি জানি। কিন্তু সত্যি-সত্যিই থাকা যাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। আপনি আমার নামটা যদি খেয়াল করে থাকেন তা হলে বুঝতে পারবেন আমি ঠিক আপনাদের মতো ভদ্দরলোক সমাজের মানুষ নই, আমিও, যাকে আপনারা বলেন ট্রাইবাল, মুণ্ডা। তবে মুণ্ডা আর সাঁওতালরা সংখ্যায় বেশি, অনেক আগেই ক্রিশ্চান মিশনারিদের সংস্পর্শে এসেছে, অনেকেই লেখাপড়া শিখেছে ওদেরই দয়ায় – ইনক্লুডিং মী। কিন্তু খাড়িয়ারা সংখ্যায় অনেক কম। ওদের মধ্যে আবার তিন রকমের ভাগ আছে। যাদের বলে দুধ-খাড়িয়া আর ধেলকি-খাড়িয়া তারা জঙ্গল ছেড়েছে আগেই, এখন চাষবাস করে, সাঁওতাল-মুণ্ডাদের থেকে ওদের চট করে আলাদা করতে পারবেন না। ... ...
জন্মপরিচয়ের উপর এত গুরুত্ব কেন? তার কারণ দারায়ুস সাইরাসের বংশজাত ছিলেন না, আর সাইরাস এবং তিনি একই বংশজাত সেটা প্রমাণ করার দায় তাঁর ছিল। তার জন্য আমাদের দেখতে হবে দারায়ুস কীভাবে সিংহাসনে বসেন। সাইরাসের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেস, আর তার মৃত্যুর পর সাইরাসের অন্য পুত্র বরদিয়া। কিন্তু রাজদরবারের সাতজন সম্ভ্রান্ত মানুষ দাবি তোলেন এই বরদিয়া সত্যিকারের বরদিয়া নয়, সে আসলে একজন ম্যাজাই (জাদুকর), যে ছদ্মবেশ ধরে বরদিয়া সেজে বসে আছে- যার আসল নাম গৌমাত। সাতজন সম্ভ্রান্ত মিলে এই গৌমাতকে হত্যা করে- দারায়ুস তাদেরই একজন। ইতিহাস কোনওদিনই জানতে পারবে না এই গৌমাত আদৌ কোনও ছদ্মবেশী বহুরূপী ছিল, না কি সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরসুরী বরদিয়াই ছিল, যাকে ছলনা করে সরানো হয়। ... ...
তার গ্রাম মৌচুরিয়ার সেই বন্ধুর নাম বুধন টুডু। বুধন নকশাল ছিল। কলকাতার বাবুদের সঙ্গে বেলপাহাড়ির দিকে বিপ্লব করতে গিয়েছিল। বাবুরা কেউ ধরা পড়েছে, কেউ ফিরে গেছে বাড়ি। বুধনকে পুলিস খুঁজছিল অনেকদিন। কিন্তু পাত্তা করতে পারছিল না। সে খুব বুদ্ধিমান। বার বার পুলিশকে ধোঁকা দিয়েছে। ধরতে পারলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। মেরেও ফেলতে পারে। সে কোথায় থাকে, কোথা থেকে গ্রামে ফেরে, তা পুলিশের খোঁচড় বুঝে উঠতেই পারে না। তার দেড় বিঘে জমিন আছে চাষের। সেই জমিই তাকে টেনে এনেছিল গ্রামে। ধান কাটার সময় গত অঘ্রানে এসেছিল। তখন পুলিস টের পায়নি। যখন খবর গিয়েছিল, সে কাজ সেরে পালিয়েছিল। এই বর্ষার দিনে চাষের টানে আবার ফিরে এসেছিল। গ্রামের চাষিবাড়ির ছেলে, প্রায় ভূমিহীন বুধন। জমি পাবে ভাত পাবে, তাই শহরের বাবুবাড়ির ছেলেদের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি ছেড়েছিল। বিপ্লবের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। বাবুবাড়ির ছেলেরা ফিরে গেছে শহরে। ... ...
খুব সামনেই মনিপিসির আই এ পরীক্ষা। কালরাতেও ইংরেজী নিয়ে দাদুর কাছে বকা খেয়েছে। মনিপিসিটা পড়তেই চায় না একদম। সুযোগ পেলেই মা আর কোহিনূর ফুফুর সাথে দিলরুবা হলে ম্যাটিনি শো দেখতে যায়। আর সেদিন তো হল থেকে ফিরেই ববিতার মতো চুল কেটে নিয়েছে কোহিনূর ফুফুর কাছ থেকে। আমাকে বলেছিলো এবার সত্যি সত্যি ববিতাকে দেখাতে আমাকে হলে নিয়ে যাবে। কিন্তু গেলো কই? ... ...
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে সোমেশ্বর। সব হিসেবেরই কী গণ্ডগোল হয়ে গেলো? উনসত্তর সালে চারু মজুমদার নতুন পার্টির নাম ঘোষণা করলেন, সি-পি-আই (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। কিন্তু পার্টি তৈরি হবার আগেই তো পার্টি ভেঙে গেছে ! আগের পাঁচ বছর ধরে ইঁটের ওপর ইঁট গেঁথে গেঁথে যে মন্দির তৈরি করছিলেন চারু মজুমদার, সে মন্দিরে মাথা নীচু করে ঢুকতে চাইলো না যারা, যারা মার্কসবাদকে সর্বশক্তিমান বলে প্রণাম করতে রাজি হলো না, পিকিং রেডিও ঘোষিত রোজনামচার সাথে যারা নিজেদের রোজনামচাকে মেলাতে পারলো না, একেকটি 'খতম' থেকে আশ্চর্য অলৌকিক উপায়ে একেকটি মুক্তাঞ্চল গঠনের ম্যাজিকে যারা বিশ্বাস করতে পারলো না, কমরেড চারু মজুমদারের লাইনই একমাত্র সরলরেখা, এই মন্ত্রকে যাদের মনে হলো আজগুবি, তারা তো আগেই শ্রেণীশত্রু ঘোষিত হয়ে গেছে ! তারপর তো রাস্তাঘাটে-অলিতে গলিতে শুধুই মৃত্যুর মিছিল ! ... ...
কনেপক্ষ এসে পৌঁছোলো যখন, দুপুর তখন গড়িয়ে গেছে। সাত-আট জন লোক। প্রথমে সীরিয়স মীটিং, তারপর খাওয়া-দাওয়া, হাঁড়িয়া পান আকণ্ঠ; অনেক রাত পর্যন্ত সেদিন তিরিশটা বাড়ির ছোট গ্রামটার আবালবৃদ্ধবনিতা জেগে রইলো। পরের দিন সকালে দুটো সাদা মোরগ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সময় কনেপক্ষ জানিয়ে গেলো বিয়ে পাকা, দিনও ঠিক হয়ে গেলো। মাস দুয়েক পরের এক শুভদিন ! ... ...
ও মনিপিসি বাটিতে কী এনেছো? এতক্ষণ কী করছিলে উপরে? মনি, তুই আজও ঘুমালি না? মনিপিসির হাতের বাটিটার প্রতি আমার অদ্ভুত আগ্রহ বেড়েই চলেছে। শিকবিহীন কাঠের বড় জানালার ঠিক নীচে সেই বাটিটা রাখে মনিপিসি। আমি সব ভয় অগ্রাহ্য করে ঘাড় ঊঁচিয়ে বাটির ভেতর কী আছে দেখতে যাই। কিন্তু ঠাকুমা কলাপাতার মাইজ দিয়ে চট করে ঢেকে ফেলে বাটি। মনিপিসি এবার আমাকে প্রায় অগ্রাহ্য করে বাইরবাড়ির দরজা পেরিয়ে গোলেনূর দাদীর উঠোনের দিকে চলে যায়। ... ...
লোকটির প্রশ্নগুলো কিছুই বুঝতে পারছিল না নিমাই। দুর্বোধ্য, অব্যক্ত একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল তার ভেতরে। জেরার পর জেরায় খুবই ক্লান্ত বোধ করছিল। তীক্ষ দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে ছিল সার্টিফিকেটটার দিকে। আর কান পেতে শুনছিল গির্জার ঘণ্টাধ্বনি। এই শব্দটি ওর খুব প্রিয়। গির্জার ফ্রেস্কোগুলোও খুব সুন্দর। কালই একবার গিয়ে দেখতে হবে। শুধু একবার যদি ওই ধুলোয় ধূসর হয়ে যাওয়া কাগজটা ওর হাতে দিত লোকটা। খুব যত্ন করে আগে ধুলোগুলো পরিষ্কার করত সে। তারপর সেটাকে ল্যামিনেশন করে নিজের আলমারির লকারে রেখে দিত। কিন্তু লোকটা এখনও দিচ্ছে না কেন? কেন ওইভাবে ধরে আছে কাগজের টুকরোটা? বিশ্রিভাবে ওর চোখের ওপর নাচাচ্ছে? চোখের ইশারায় ওকে ধুলোমাখা মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসতে আর ক্ষমা চাইতে বলছে? নিমাইয়ের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যায় ... ...
সময় জয়মালিকার কাছে বড় দামি। দু বছর তো এই কলেজেই সময় নষ্ট হয়ে গেলো তার, বিকাশদার কথা শুনে। শুনছে বিকাশদাও নাকি ছেড়ে দেবে, সরকারি কলেজে জয়েন করবে নাকি। কিন্তু জয়মালিকার তো সময় নেই, সে অপেক্ষা করতে চায় না। সে শুধু চায় আরও বেশি বেশি লোক তার ছবি দেখুক। মিসেস পাণ্ডে সেই স্কুলের সময়েই বলেছিলেন সে আঁকে অন্য সবায়ের মতো নয়, ঠিক নিজের মতো কোরে। তার মানে তার নিজের স্টাইল তো তৈরি হয়েই গেছে, তাহলে আর কেন কলেজে যাওয়া ! জয়মালিকা ভেবেছিলো অন্তত একজন তাকে ঠিক ঠিক বুঝবে। তাই শক্তিদার সমর্থন চেয়েছিলো ও। কিন্তু শক্তিদা, শক্তিদার মতো মানুষও, ঐ বিকাশদার মতোই কথা বললো। সব আর্টেই অনুশীলন করতে হয় রে জয়ি, কঠোর অনুশীলন, বলেছিলো শক্তিদা। কিন্তু কেন? কেন সবাইকেই অনুশীলন করতে হবে? ... ...
আমার ক্যাম্প অফিসে। করণ্ডায়। মানুষের মুখের কথা বলি। যে মুখগুলি মনে আছে তার ভিতরে প্রধান মুখটি নিখিল প্রধানের। নিখিলবাবুকে আমি প্রথম যখন দেখি আমি তখন ২৩, তিনি ৫০। তিনি সেটেলমেন্টের ডি-গ্রুপ কর্মচারী। উপরওয়ালা স্যার, বাবুদের কাছে পিয়ন। এখন পিয়ন শব্দটি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছে। কর্মচারীদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ —চার শ্রেণীতে ভাগ করে সেইভাবেই অভিহিত করা হয়। এর অন্যথা হলে প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদ এবং সংগঠিত থেকে তাঁরা কিছুটা সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। তবে এখনো সামান্য হোমগার্ড জেলার এস,পি, র বাড়ির বাজার করেন কি না, জামা কাপড় কাচেন কি না, ফাই ফরমাস খাটেন কি না জানি না। হয়তো বদল হয়েছে, হয়তো বদল হয়নি, এ ঘটনা সামান্য কনস্টবলের মুখে শোনা। ... ...
আমরা এক সচেতন প্রয়াস-এর পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিগত চার বছরে রামনবমী উত্তর পর্বে সাম্প্রদায়িক হিংসার স্বরূপ বুঝতে বিভিন্ন জনপদে তথ্যায়ন করা হচ্ছে। ২০১৮-২০২০ এই তিন বছর আমরা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ভাটপাড়ায় ক্ষেত্র গবেষণা চালিয়েছি, ইতিমধ্যে তার প্রতিবেদন প্রকাশিত। সেই ধারাবাহিকতায় তেলেনিপাড়া হোল দ্বিতীয় প্রতিবেদন। ... ...