বাবার গাল শক্ত হলেই আমি সাধারণত দৌড় দিতাম। আজ অসতর্ক। পেয়েছে। কিন্তু চড় খেয়েই সজাগ হয়ে, দে দৌড় দে দৌড়। ৫০০ মিটার দৌড়ে এসে ধরেছে। ধরেই গলায় পা, তোকে আজ মেরেই ফেলবো। আমি কাঁদছিও না, ছাড়তেও বলছি না। চুপ করে শুয়ে আছি। এদিকে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কোনোদিন স্কুল কামাই করি না। পরীক্ষা দিচ্ছি না। মোবাইল না থাকলেও সেযুগেও খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়াত। খবর পেয়ে হেডমাস্টার মশাই এসে গেলেন। বাবা ছাড়বেন না, ওর খুব অহঙ্কার। আমি চাই ফেল করুক। আমি ওর মধ্যেই বলছি, ইতিহাসে আমি কোনোদিন ফেল করবো না। বাবা বললেন, তোকে যেতেই দেবো না। এদিকে অন্য শিক্ষকরাও হাজির। আধঘন্টা পর হলে গেলাম পরীক্ষা দিতে। ধুলোটুলো ঝেড়ে। স্যাররাই কেউ কলম এনে দিলেন। এই বাবার মতো অসাধারণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ... ...
যতদূর শুনেছি গলা (গোলাস) খোলার অধিকার বা বাক স্বাধীনতার নাম গ্লাসনস্ত এবং পুনর্গঠন বা পুনর্নির্মাণের নাম পেরিসত্রইকা। অভিপ্রায় নিঃসন্দেহে ছিল সাধু – কেন্দ্রীয় নির্দেশ দ্বারা ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে সমষ্টির শুভ সাধনা করার যে আপাত প্রয়াস চলে এসেছিল স্তালিনের সময় থেকে, সেটির ব্যর্থতা স্বীকার করলেন গরবাচভ। লক্ষ্য – এক স্বচ্ছ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে দেশের নবনির্মাণ ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়া। এবার ব্যক্তি তার মত প্রকাশের অধিকার পেল। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, মতান্তরে কেজিবি নিরুদ্দেশ। অন্ধের নগরী, চৌপট রাজা। বাজার থেকে অদৃশ্য হল খাবার। ১৯৯০-এর আগে লাইন দিলে কিছু জুটত। যদিও মস্কোর বাজারে একটা রসিকতা চালু ছিল – কোথাও লাইন দেখলেই মানুষ দাঁড়িয়ে পড়তেন, পরে জানতে চাইতেন এটা কিসের লাইন। জনজীবন বিপর্যস্ত, তার কিছুটা আগেই দেখেছি সেন্ট পিটার্সবুর্গে। ... ...
আমার ভাবনা ছোটো চাষীদের নিয়ে। একদিক থেকে দেখলে তাদের এখনো কিছু স্বাধীনতা আছে জানো। তারা চাষবাস এখনো অনেকটা বৈচিত্র্যময়। ফসলচক্র মেনে চলে মোটামুটি। সার বিষের ব্যবহার খুব কম করে। এরকম চাষীর সংখ্যা অবশ্য কম। অনেকেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে কৃষি পাঠশালায় ডেকে এনে সকলে মিলে বুঝতে চাইছি যে সার বিষ ছাড়া চাষ সম্ভব। তাতে খাবার খরচ, স্বাস্থ্য খাতে খরচ অনেক কমে যাবে। চাষীরা অনেকটাই বোঝেন। সমস্যা তাদের অন্য জায়গায়। তাদের একটু আর্থিক সুরক্ষা প্রয়োজন কারণ মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হলে ঠিক হতে সময় লাগে। সেসময় ফলনে সমস্যা হতে পারে। রোজগার কমে যাবে। সেই সময়টুকু তাদেরকে কে সাহায্য করবে? পুরো বাজারটাই তো উৎপাদক বিরোধী। ... ...
অনেক দিন পর কবিতা বেরোল হাত থেকে। বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ে কাজি নিজে। বেশ হয়েছে, ভালই হয়েছে!– নিজের মনেই বলে কাজি, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা লুঙ্গি। মাথা দিয়ে গলিয়ে দেয় লুঙ্গিটা, এবার জামাকাপড় বদলিয়ে পুকুরে নামবে সে। এমন সময় দ্রুতপদে দেখা যায় দুলিকে, সে আসছে পুকুরের দিকেই, নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে আসছে। একটু অপেক্ষা করে কাজি, দুলি এসে পৌঁছোয়, তাড়াতাড়ি আসায় একটু জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। কাজি বলে, আমি একটা ডুব দিয়ে আসি, তু্মি ততক্ষণ পড় এই কবিতাটা, খাতাটা দেয় দুলির হাতে। ... ...
দু’দিকে দুটো লোক – সামনে আর পিছনে দুটো হ্যাজাক ধরে আছে। মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি বা গামছা, প্রায় আধ-ন্যাংটা কালোকোলো সন্ন্যাসীরা পরস্পরের এক হাত আর তাদের হাতের দণ্ড ধরে অর্ধ গোলাকৃতি একটা বেড় তৈরি করেছে। নাচছে ভূতের মত। মাঝে মাঝে – বল গঙ্গাধরের চরণের সেবা লাগি, বল তারকনাথের চরণের সেবা লাগি মহাদেব – ইত্যাদি শিবের নানান নাম করে টেনে টেনে বলে চলেছে। যেটা সবচে’ আশ্চর্য লাগে, তা সন্ন্যাসীদের অমন গলা ছেড়ে মহাদেব – ডাকও নয়, ছায়া-ছায়া ভূতুড়ে নাচও নয়। আশ্চর্য হল – সেই বেড়ের মাঝখানে আমাদের ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাই যে! এবং তিনি নাচছেন! এগিয়ে – পিছিয়ে। তিনি তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে পথ শেষ করতে চাইছেন, কিন্তু সেই উপবাসী, আধন্যাংটা সন্ন্যাসীরা – কোথা থেকে এত জোস পেল কে জানে, তারা কিছুতেই এগোতে দিতে চায় না। সামান্য পথ আসতেও তাই দীর্ঘ সময় লাগে। রাগী, ছাত্র-পেটানো অথচ ছাত্র-দরদী, স্নেহ বৎসল মাস্টারমশাই-এর সব গাম্ভীর্য ওই গাজনের সন্ন্যাসীরা ঘুচিয়ে দিয়েছে। ধুলো হয়ে উড়ছে হ্যাজাকের আলোয় – তাঁরই অটল গম্ভীর মুখোশখানা। ... ...
সৌম্য বলল, “ওয়েট ওয়েট। একটু ধৈর্য ধরুন। বলছি। তবে তার আগে বলি, আমন মানে হল শান্তি। তুহিন ওর ধাঁধায় আমাদের বলেছে যে যদি কখনো তদন্তের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমরা যেন আমনকে খুঁজি। খুঁজব কোথায়? সেটারও ক্লু ও দিয়ে রেখেছিল। বলেছিল জীবনে শান্তি খুঁজতে। আনন্দ শর্মা ওরফে আমন উঠেছিল জীবন লজেই। তুহিনের কোনও কারণে মনে হয়েছিল যে আমাদের হয়তো যখন তদন্তের প্রয়োজন হবে তখন আমাদের ক্লু দিতে ও আর এই পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু ও সেই ব্যাপারে সিওর ছিল না। তাই পৃথাকে সব কিছু খুলে বলে নি ওকে মিছিমিছি চিন্তায় ফেলবে না বলে। কিন্তু ও যদি নিজের বিপদ বুঝেই ছিল তাহলে জীবন লজে গেল কেন?” ... ...
পড়া হতো। তার চেয়েও গল্প হতো বেশি। এই গল্পই একবার আমার প্রাণ বাঁচায়। পূজার ছুটি। কলেজ হোস্টেলে আমি একা। জ্বর চলছিল। বিকেলের দিকে মনে হল জ্বর ছেড়েছে। গায়ে হাত দিয়ে কোনো উষ্ণতা টের পাচ্ছি না। বিকেলে হোস্টেলে ফিস্ট। কৌশিক লাহিড়ী কৌস্তভ সায়ন ওদের আসার কথা। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। কৌশিক এলো সবার আগে। এসে দেখে বলল, বাবুর্চি সাহেব, শুয়ে কেন? বললাম, জ্বর এসেছিল। এখন নেই। কৌশিক তখন ডাক্তারি পড়ছে। গায়ে হাত দিয়ে বলল, গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ছোটাছুটি। ... ...
রজত যখন তুহিনদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। তুহিনদের বাড়িতে এখনো একটা চাপা শোকের ছায়া। রজত চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। ঘরটা প্রথম দিনের মতই আছে। শুধু দেওয়ালে ঝুলছে তুহিনের একটা হাসিমুখের বড় ছবি। গলায় রজনীগন্ধার মালা। রজত বসার খানিক পরে ঘরে ঢুকল পৃথা। আজকে পরনে একটা হাল্কা সবুজ রঙের চুড়িদার, সাদা ওড়না। চেহারায় শোকের ছায়া অনেকটা কম। সম্ভবত খানিক আগেই স্নান করে বেরিয়েছে। রজত লক্ষ্য করে দেখল, চুল থেকে এখনও অল্প অল্প জল ঝরছে। ... ...
যে পানীয় প্রস্তুত করার গৌরবে এ দেশ অমরত্বের দাবি রাখে, অকস্মাৎ ছোট ছোট গ্লাসে রাশিয়ার সেই শ্রেষ্ঠ পানীয় আমার সামনে উপনীত হল। গ্লাসের আকৃতি দেখে ভাবলাম, ভদকা তুমি এত ছোট কেনে? সকলেই সেটি দ্রুত পান করলেন। গ্লাসগুলি টেবিল থেকে অদৃশ্য হল মুহূর্তের মধ্যে। গরুর ঘাস থেকে মানুষের স্টেজে উঠলাম। এবার আগমন আলুসেদ্ধ গোছের কিছু, তার সঙ্গে বাঁধাকপি। সেগুলো টেবিলে রাখা হয়েছে কি হয়নি, কে বা কারা আবার আমার সামনে হাজির করলেন ভদকার ছোট গ্লাস। মানে কী? এঁরা কি এইভাবে কিস্তিতে কিস্তিতে ভদকা পান করেন? প্রশ্নটা ডাক্তার সাহেবের জন্যে জমিয়ে রাখলাম। ... ...
একদিন ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর পাঠশালায় পড়তে গেলাম। তিনি গাঁয়ের ভেতর শিব মন্দিরের গায়ে একটা চাতালে পড়ান। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সেটা। তার আগে হাতেখড়ি হল ক্ষুদুবাবুর কাছে। পিসি আর কাকু আমায় নিয়ে গিয়েছিল ওঁর বাড়ি। নিশ্চয়ই সেটা সরস্বতী পুজোর দিন। আমার ঠিক মনে নেই। ঠাকুমা পিসির হাতে সিধে পাঠাল। একটা পাথরের থালায় আতপ চাল, আনাজ আর ষোলো আনা পয়সা। কাকুর হাত ধরে গেছি। আমার বগলে শ্লেট, হাতে পেনসিল। এরপর ওঁর কাছে একদিন আসন বগলে পড়তে গেলাম গ্রামের ভেতরের শিবতলায়। মাস্টারমশাই যেন স্বয়ং যমদূত! সেই যমদূত যদি ভিক্টিমের জাগ্রত অবস্থায় হাতে ডাঙশের বদলে মার্বেল গুলি আর মণ্ডা-মিঠাই নিয়ে যমপুরীতে নিয়ে যাবার জন্য আসে, তাহলেও ছেলের দল নির্ঘাৎ মাটিতে পায়ের আঙুল পুঁতে দিয়ে শরীরটা শক্ত করে পিছন দিকে ঠেলুনি দিয়ে পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়ত “আমি যাব না গো–ওওওও” বলে! ছেলেদের গাধা থেকে ঘোড়া বানাবার জন্য আর শাসনে রাখার জন্য অভিভাবকেরা সেই যমদূতসম “মাস্টামশায়”-এর কাছেই পাঠাতেন। ... ...
আমাদের গ্রামে ডাকাতি কম হয়েছে। আমার মামাদের বাড়িতে একবার হয়। কংগ্রেসের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের ফসল। বড় মামাকে ডাকাতির নামে মেরে ফেলাই ছিল লক্ষ্য। সবাই জানত, কারা ডাকাতি করিয়েছে, কাদের দিয়ে, কিন্তু কিছু প্রতিকার হয়নি। বড়মামা সেদিন 'নীলরক্ত' যাত্রা শুনতে তিন কিলোমিটার দূরের বুড়ুল গ্রামে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর মামার বাড়িতে দু নলা বন্দুক এল। কোনা বলে গ্রামের কংগ্রেসের এক বড় নেতা ডাকাতদের আসল সর্দার। আমাদের গ্রামের কয়েকজন ছিল আলাদা ডাকাত দলে। যে বন্দুক দিত, ডাকাতির ৫০% টাকা তার। পরে ডাকাতি আমাদের এলাকায় উঠে যায়। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পরে। তার আগে ডাকাতির খুব ভয় ছিল। ডাকাতি ছেড়ে দেওয়া একজন মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম। অনেক ডাকাতির গল্প শুনেছি। কিন্তু সব লিখতে পারব না। ডাকাতের দলে থাকা লোকদের ছেলেমেয়েরা কষ্ট পাবে। ... ...
জীবন লজের বাইরে দাঁড়িয়ে, দিব্যেন্দুকাকুর সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে, সিগারেট ধরিয়েছিল সৌম্য। ফাঁকা রাস্তা দেখে এক হাতে রজতের ঘাড়ে আঁকিবুঁকি কাটছিল। হঠাৎ একটা গাড়ি প্রচণ্ড জোরে কোথা থেকে এসে হুশ করে বেরিয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে রজত সৌম্যকে ধরে এক ঝটকায় সরে না গেলে একটা বড়সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত। রজতের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গিয়েছিল। একটু সামলে নিয়ে বলল, “আমাদের কেউ খুনের চেষ্টা করছে।” সৌম্য মৃদু হেসে বলল, “এগুলো রাতের শহরে বড়লোকের বখাটে ছোঁড়াদের কাজ। রাত বাড়লে সবাই সলমন খান হয়ে যায়।” রজতকে এই বলে প্রবোধ দিলেও সাদা ইনোভার পাশের আঁচড়ের দাগটা সৌম্যর চোখ এড়ায়নি। অর্থাৎ কেউ এখন আর শুধু ওদের ওপর নজর রেখে ক্ষান্ত দিচ্ছে না, সরাসরি খুন বা আহত করার চেষ্টা করছে। ... ...
আমার দেখা প্রথম টিভি, টেপ রেকর্ডার, এইচ এম ভি ফিয়েস্তার কলের গান, মোটর সাইকেল--সব কালামদের বাড়িতে প্রথম। টিভি আর ভিডিও দেখতে ওদের খামার লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো ১৯৮২ তে। ১৯৭৮/৭৯ ঠিক মনে পড়ছে না, টেপ এলো। শোলের গব্বর সিংয়ের সংলাপ শোনা যাচ্ছে। বিরাট ব্যাপার। আমাদের নিজেদের গলাও শোনা যাবে! লাইন পড়ে গেল। আমিও পচাশ পচাশ মাইল সে, আমজাদ খানের সংলাপ বলে নিজের গলা শুনে চমকিত। ... ...
নিজের প্লেট থেকে চামচে করে চাউমিন তুলে সৌম্যর প্লেটে দিল রজত। খাবারের প্রথম গ্রাসটা একে অন্যকে বেড়ে দেয় ওরা। বহুদিনের অভ্যেস। আগে বেশ একটা প্রেম-প্রেম ব্যাপার ছিল। এখন সেটা এতটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, যে খাওয়ার শুরুতে এই কাজটা আপনাআপনিই হয়ে যায়। রজত চাওমিন মুখে পুরে বলল, “তোর অনুমানটাই ঠিক। তুহিন সেদিন পুরো সন্ধ্যেটা ঋকের বাড়িতে ছিল না। অন্তত একবার তো বেরিয়েইছিল। ওর কল লিস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, যে সন্ধ্যে পাঁচটা পঞ্চান্নয় ওর ফোনে একটা কল আসে। দিল্লির নাম্বার। সাম আনন্দ মিশ্র। মিনিট পাঁচেক কথা হয়। তারপর তুহিনের ফোন থেকে ওই নাম্বারে আবার একটা ফোন যায়। সেটা সাতটা পনেরোয়। সেই ফোনটা যখন করা হয়, তখন তুহিনের টাওয়ার লোকেশন হাওড়া স্টেশনের কাছাকাছি। এইবার কল ডিউরেশন দু’মিনিটেরও কম। এর ঠিক পরেই ও পৃথাকে মেসেজ করে। এরপর অনেকক্ষণ কোনো কল রেকর্ড নেই। তারপর আবার তুহিনের ফোনে কল ঢোকে রাত দশটায়। লোকেশন ঋকের বাড়ি। ফোন এসেছিল ফুড ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে।” ... ...
আম গাছটা খুঁজে পেতে যে অনেকটা সময় গেল এমন নয়। নজরুল অবাক হয়ে দেখে, এই যে ছ-সাত বছর বাদে সে ফিরে এসেছে দরিরামপুরে, কিছুই যেন বদলায়নি। এই আমগাছটা, এর সামনের পুকুরটাও তো ঠিক আগের মতোই আছে। এখানে বসে বসেই দূরে বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িটা দেখা যায়, বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছটা একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোথায় গেল মাঝখানের এতগুলো বছর! নজরুলের মনে হয়, সে যেন স্কুলের পর ওই বাড়িটাতেই কোনরকমে বইখাতাগুলো রেখে দৌড়ে এখানে এসে বসলো এইমাত্র। সূর্য অস্ত যাবার আর বেশি দেরি নেই, লালচে আকাশের রং পুকুরের জলে পড়ে নিস্তরঙ্গ জলটারও রংও বদলিয়ে দিল। এরই মাঝে এক দঙ্গল কিশোরীর কলধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে পুকুর-পার। ওরই মধ্যে শ্যামলা একটি মেয়ে, বন্ধুদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বোধ হয় নজরুলের দিকে তাকিয়ে নিল একটা মুহূর্তের জন্যে। তার শিথিল বেণী থেকে কি খসে পড়ল একটা ছোট্ট মাথার কাঁটা? কবে যেন সেই ছোট্ট কাঁটাটাকে বুক-পকেটে ভরে নিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল নজরুল তার ছোট টিনের বাক্সটায়। তারপর চুরুলিয়া-আসানসোল-শিয়ারশোল-কলকাতা-নৌশহরা-করাচি হয়ে আবার কলকাতায় যখন ফেরে নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানায়, তখন ওর জিনিসপত্রের মধ্যে মুজফ্ফর আহ্মদের চোখে পড়ে যায় এতদিন-ধরে-যত্ন-করে-রেখে-দেওয়া ওই মাথার কাঁটা! ... ...
এই তো একবছর হয়নি, আমার অজাতশত্রু বোন, আমার অজাতশত্রু ভাই পূর্ণ মেজাজে ডালপালা মেলে ধরেছে। তাদের পাতা ঝরে পড়ছে। পাতাগুলো ঝাঁটিয়ে রাখা হচ্ছে তাদেরই ছায়ার নীচে মাটিতে। এছাড়া মাটিকে আচ্ছাদিত করে আছে কিছু প্যারা ঘাস, লজ্জাবতী, দুর্ব্বো। ভাইয়ের গায়ে লতিয়ে উঠছে অপরাজিতা। ঝরাপাতা বাদামী থেকে কালো হয়ে উঠেছে। ঘাস-পাতা-গুল্ম আচ্ছাদিত মাটি রসে টইটম্বুর। সেখানে প্রতিনিয়ত মাননীয় মিলিপেড, সেন্টিপেড, কেঁচো, শামুক, পিঁপড়ে ও অন্যান্য (আমার নাম না জানা) পোকাদের চলাফেরা। তারাই তো মাটির স্বাস্থ্য, মসৃণতা এইসব বজায় রাখবেন – যাতে মাটি গ্যালন গ্যালন জল ধরে রাখতে পারে তার পেটের ভেতরে। আর ফুল-পাতা-ঘাস যা ঝরে পড়বে সবাইকে জারিয়ে করে দেবে মাটির খাবার। মাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। ... ...
গায়ত্রী দীপালি এখন পশ্চিম বাংলার কোথাও আছে। ওর দু’ভাই ওকালতি আর পলিটিক্স নিয়ে বাংলাদেশেই থাকে। বুলু, টুলু, অঞ্জলিরাও নব্বই সালের দিকে চলে গেছে। খুব কম বেড়াতে আসে। বাংলাদেশে এ এক পরিচিত দৃশ্য। সবাই জানে, প্রতিটি হিন্দু পরিবারেরই একটি খুঁটি আছে ভারতে। রাতে গল্প করছে, চা খাচ্ছে যে বন্ধুদের সঙ্গে, তারা সকালে জানতে পারে বন্ধুটি পরিবারসহ চলে গেছে ইন্ডিয়া। ওদের বাড়িটি গোপনে বিক্রি করে গেছে কোনো মুসলমান পরিবারের কাছে। কিন্তু কবে থেকে এ দৃশ্যের আরম্ভায়ন? ... ...
মস্কোর বয়েস ন’শ’ বছর। মাত্তর ১৮ শতকে জার পিটার দি গ্রেট এই ভুঁইফোড় শহরটির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম নাম সাঙট-পিটার-বুর্খ (ডাচ)। জার্মান প্রভাবে সেটি হয়ে দাঁড়ায় সাঙট পেটার্সবুর্গ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান শব্দ ব্যবহার জনবিরোধী বিবেচিত হল। নাম বদলে পেত্রগ্রাদ – পিটারের গড়! এই সময় ব্রিটেনেও দু’টি নামের পরিবর্তন হয় একই কারণে। লর্ড বাটেনবের্গ (ফ্রাঙ্কফুর্টের অনতিদূরের গ্রাম) হলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন (বের্গ = পাহাড় = মাউন্ট: বাটেন হল ব্যাটেন)। ব্রিটিশ রাজপরিবারের পরিচয় হাউস অফ হানোভার (জার্মান শহর, যেখান থেকে রাজা জর্জকে খুঁজে এনে সিংহাসনে বসানো হয় ১৮ শতাব্দীতে – পরবর্তী ছয় রাজার ধমনিতে ছিল জার্মান রাজরক্ত, প্রত্যেকে জার্মান বলেছেন) বদলে হাউস অফ উইনডসর। সহজ ব্যবস্থা। জার্মানির সঙ্গে যখন লড়াই চলছে, পিতৃপুরুষের নাম বদলে ইংরেজ সাজাটাই তো বাঞ্ছনীয়। ... ...
শান্তার কবিতার বই বেরোল দু’বছর পর। তখন কবিতা আর সায়নে যাপন যুগপৎ চলছে। বেদনা ও আকুতি প্রতিদিন চোখ ধুয়ে দিয়েছে তার। যাকে দেখতে চায় আর খোলা আকাশের নীচে গায়ে গা লাগিয়ে সময় কাবার করে দিতে চায় অজস্র কথায় – তাকে দেখা হয় না। শূন্যে মিলিয়ে গেছে যেন! নীরব ছটফটানিতে সে চুরমার হয়। সান্ত্বনা বলতে পত্র-পত্রিকায় পেয়ে যাওয়া সায়নদীপের লেখাগুলো। একদিকে একটা সর্বগ্রাসী প্রেম সে অন্তরে লালন করেছে। অন্যদিকে প্রতিটি সামাজিক, দেশজ, বৈদেশিক আর প্রাকৃতিক ঘটনার অভিঘাতে ছটফট করেছে একা। ... ...