গতকাল, কাজি বলে, ঘুম আসছিল না কাল রাতে; তারপর হঠাৎ কেমন মনে হল, একটা কবিতা লিখতে হবে। ওদিকে মুজফ্ফর তখন গভীর ঘুমে। আমি উঠে ভয়ে ভয়ে আলোটা জ্বালালুম, পাছে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিই। দেখলুম ও ঘুমিয়েই চলেছে, আলো বুঝতেও পারছে না। তখন লিখতে শুরু করলুম, পেনসিল দিয়ে। কেমন যে একটা তোলপাড় হচ্ছিল মনের মধ্যে বোঝাতে পারব না আপনাকে। মনে হচ্ছিল, দোয়াত-কলম দিয়ে পারব না লিখতে, কালি শুকিয়ে যাওয়া, দোয়াতে আবার কলম ডোবানো, এসব করতে পারব না, করার সময় হবে না। পেনসিল দিয়ে কিন্তু ঝর ঝর করে লেখাটা হয়ে গেল অবিনাশদা। লেখাটা দেখুন, বিশেষ কিছু কাটাকুটি নেই, যেন আমার মাথার মধ্যে ছিলই কবিতাটা। শুরু করতেই নিজেই নিজেকে যেন টেনে নিয়ে গেল। লেখা শেষ হতে, মুজফ্ফরকে ঘুম ভাঙিয়ে টেনে তুললুম। কাউকে একটা শোনাতেই হবে। ... ...
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরো টুকরো হয়েছে। একদা এই পনেরোটি রিপাবলিকের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল রাশিয়ান। কালিনিনগ্রাদে যখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে, পুবে দিওমেদ দ্বীপে তখন পরের দিনের ভোর সাড়ে পাঁচটা – সর্বত্র ভাষা এক। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া থেকে কাজাখ অবদি সবার নিজস্ব ভাষা আছে, ছিল। তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় রাশিয়ান। নইলে রাজ্য শাসন অসম্ভব। যেমন আমাদের শাসকরা চাপিয়েছিলেন ইংরেজি, সেটিকে আমরা আঁকড়ে ধরেছি। বাইরের জগতের পাসপোর্ট এটি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে রবার্ট ক্লাইভকে হারাতে পারলে ফরাসি আমাদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হত! ... ...
দেশত্যাগ বিয়ের কনে বিদায় দেবার মত ব্যাপার নয়। এখানে সবাইকে জানিয়ে যাওয়া যায় না। যথাসম্ভব চুপিচুপি চলে যেতে হয়। বিদায়ের কষ্টের চেয়েও ঢেড় বড় হচ্ছে নিরাপত্তা। ১৩৫৪ সনের পৌষের এক কুয়াশাঢাকা ভোরে খলিল আর জাহেরা পরিবার নিজেদের সামান্য পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে বেলডুবি ছাড়লেন। পেছন ফিরে তাকাতে সারি সারি তাল, নারকেল আর সুপুরি গাছের মাথাগুলো দেখা গেল; তার নিচে বাকি গাছপালা আর গাঁয়ের বাড়িগুলো কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। মনে হচ্ছিল তাঁরা সবাই যেন এক প্রাগৈতিহাসিক গুহার ভেতর থেকে বের হয়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটছেন। ... ...
জোর? জোর করার কথা আসে কোথা থেকে? – বলেন আবুবক্র্, মোগল সম্রাট আকবরের জন্মের কথা জানেন তো? তাঁর জন্মের সময় তাঁর পিতা যুদ্ধপর্যুদস্ত হুমায়ুন কিছু পারিষদ এবং গর্ভবতী যুবতী সম্রাজ্ঞীসহ অমরকোটের রাণার দুর্গে আশ্রিত। সেই অবস্থায় পুত্র জালাল উদ্দিন মহম্মদ আকবরের জন্ম হয়। পারিষদদের কাছে মহার্ঘ কিছু আছে কিনা খোঁজ করতে করতে জৌহর নামক একজন পণ্ডিত আমীরের কাছে দু'শো খোরাসানী স্বর্ণমুদ্রা, একটি রজতনির্মিত রিস্টলেট এবং এবং খানিকটা মৃগনাভি হুমায়ুন পেয়ে গেলেন। স্বর্ণমুদ্রা বা রজতনির্মিত অলঙ্কারটি হুমায়ুন গ্রহণ করলেন না। মৃগনাভিটুকু স্বহস্তে বহু ছোট ছোট টুকরো করে উপস্থিত সকলকে একটি করে টুকরো তিনি উপহার দিলেন। নিজের শরীরজাত যে মৃগনাভির সুগন্ধে মাতোয়ালা মৃগটি নিজেই উন্মাদগ্রস্ত হয়, সেই গন্ধে বহু যোজন আমোদিত হল। মঙ্গলাচরণ করে হুমায়ুন উপস্থিত সকলকে বললেন, আপনারা প্রার্থনা করুন, এই আশ্চর্য সুগন্ধের মতো আমার এই সদ্যোজাত পুত্র আকবারের সুকর্মের ফল এবং যশ যেন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ... ...
সপ্তাহে দুদিন তিনি আসেন। কৃষ্ণের নাম গান করতে করতে গ্রামে সবার বাড়ি ঘুরে তবে তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরবেন। গুনগুন করতে করতে নেমে যাবেন আলপথে। সকালের নরম আলোয় স্নান করে পরম প্রশান্তিতে উন্মুক্ত ওই ঈশ্বরের মাঠ পেরিয়ে চলে যাবেন তিনি। আজ এ গাঁয়ে, কাল আবার অন্য গাঁয়ে নাম গান করতে যেতে হয় তাঁকে। মাস পোহালে ধামা চ্যাঙারি নিয়ে সিধে সংগ্রহ করতে বেরোন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করেন। কেউ তাঁকে নিয়োগ করেনি একাজে। কবে যেন তিনি কোন যুবক বয়সে প্রান্তরের বাধা অতিক্রম করে এসে পৌঁছেছিলেন এ গাঁয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে কৃষ্ণের নাম গাইতে গাইতে। তারপর এত বছর পার করে আমার বালিকাবেলায় তিনি প্রৌঢ়। ... ...
একটা দল খুনোখুনিতে ছিল না, কিছু লুটও করেনি – তাদের লক্ষ্য ছিল ভেতর বাড়ি। প্রতিটি ঘর, রান্না ঘর, বারান্দায় তারা কী যেন খুঁজে শেষে ভাঁড়ার ঘরের ভেতরে জাহেরাদের তিনজনকে আবিষ্কার করে। এইবার এই দলটি ‘নেড়েটার মাগীগুলোকে পেয়ে গেছি রে!’ বলে উল্লাস করে ওঠে। তারা জাহেরাদেরকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরের শোবার ঘরে নিয়ে এসে উপর্যুপরি ধর্ষণ শুরু করে। ধর্ষণ কি জিনিস তা জাহেরা বা ঝিয়ের জানা থাকলেও তেরো বছরের মাহিরার অজ্ঞাত ছিল। তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে চেপে ধরাতে সে চেঁচাচ্ছিল, কিন্তু প্রথমবার তাকে যখন বিদ্ধ করা হল তখন সে এক অপার্থিব জান্তব চিৎকার দিয়ে উঠল। ... ...
কোনো এক সুপ্রভাতে হয়তো মন ভালো ছিল, তাই প্রকৃতি কাজাখকে দিলেন ইউরেনিয়াম, তামা, শিসে, ক্রোমিয়াম, দস্তা, লোহা, হীরে এবং অগাধ খনিজ তেলের ভাঁড়ার। কিন্তু এই আশ্চর্য ধন সম্পদ খুঁজে দেখেননি, তার পরোয়া করেননি যাযাবর জনতা। সে অমৃত পড়ে রইল আসা যাওয়ার পথের ধারে। এ দেশের মানুষ স্থায়ী ভাবে বাস করতেন না কোথাও। মোঙ্গল রক্ত শরীরে আর মন উড়ু উড়ু। যাযাবরের মত আসা যাওয়া—আজ এখানে, কাল ওখানে। দেশটা এত বড়ো, যে, চরৈবেতি বলে চরে খাওয়ার কোনো অসুবিধে ছিল না। দীর্ঘ জনযাত্রায় তাঁদের চোখে পড়েছে দেশের বিস্তৃত প্রান্তরে একটি ক্ষিপ্র গতির প্রাণী এখানে ওখানে দৌড়ে বেড়ায়। হেঁটে ক্লান্ত যাযাবরেরা হঠাৎ কোনো এক সময়ে তার ওপর চড়ে বসলেন। সে প্রাণী খুব একটা প্রতিবাদ হয়তো করেনি, করলেও তার কথা লিখে রাখবার মতন ট্রাভেল রাইটার জোটেনি। ... ...
জাহেরা কসাই বাড়ির মেয়ে। তাঁর হাঁকডাক কম নয়, দরকারে ছুরি-চাপাতিও চালাতে পারেন। চাইলে তিনি প্রবল প্রতিরোধ করতে পারতেন, হৈচৈ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেসবের কিছুই করলেন না। তাঁর সকল প্রতিরোধের শক্তি গত কয়েক মাসে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে গেছে। যেদেশে নারীর পরিধেয় ব্লাউজ, পেটিকোট বা শেমিজ বিহীন শাড়ি আর পুরুষের পরিধেয় ধুতি বা লুঙ্গি—সেদেশে তাদের যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বেশি আয়াসের দরকার হয় না, সম্পূর্ণ বিবস্ত্রও হতে হয় না। নাজির খাঁ’র ভারি দেহের নিচে নিষ্পেষিত হতে হতে জাহেরা ভাবলেন, উদয়াস্ত পরিশ্রম করলে তাঁদের তিন জনের দু’বেলার খাবার হয়তো জোটানো যাবে, কিন্তু সবার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাড়তি কিছু মূল্য দিতে হবে। বাইরের দুনিয়ায় শেয়াল শকুনের খাবার হবার চেয়ে এটা হয়তো মন্দের ভালো হল। ... ...
কাগজখানা হাতে নিয়েই কাজি বলে, এ কী! প্রথমেই তো বানান ভুল। কেন, কোন্ বানানটা? এই যে, কাঠবেড়ালী। ঠিকই তো আছে; ক-য় আ-কারে কা আর ঠ কাঠ, ব-য় এ-কারে বে র-য় আ-কারে রা আর ল-য় দীর্ঘ ঈ, লী। কাঠবেরালী। আরে, এ তো বাঙালদের বানান হল, ভুল। তুমি কি তাহলে ইংরাজি বানান চাও? ইংরাজি নয়, ইংরিজি। কিন্তু সেটাই বা চাইব কেন? বিশুদ্ধ বাংলা বানান, কাঠবেড়ালী। ব-য়ে শূন্য র নয়, ড-য়ে শূন্য ড়-য়ে আ-কার, ড়া। বেড়ালী, কাঠবেড়ালী। ... ...
পিসি কাচের চুড়ি পরতে না পারলেও অঘ্রাণমাসের মেলায় কিনে ফেলল। তবে লুকিয়ে রাখল বেলোয়ারি চুড়ি। সুযোগ মতো পরা, যখন কাকু বাড়ি থাকবে না। সেবার শীত শেষের মুখেই হবে হয়তো, অত মনে নেই, বৃষ্টি হল বেশ। হতে পারে আমার কল্পনা প্রবণ মন ছবি বানাচ্ছে, তাই সেই ছবিতে সুন্দর করে মিলে যাবে যে দৃশ্য মন সেটাই দেখছে। দেখলাম, অকাল বৃষ্টির দিন পশ্চিম দুয়ারি ঘরের ধারিগোড়ায় বসে পিসি চুড়ি ঘুরিয়ে হাতখানা দেখছে। আচমকা কাকু হাজির বাইরে থেকে। এক লাথিতে পিসি ছিটকে পড়ল উঠোনে। বৃষ্টির জলের ভেতর পড়ল আছাড় খেয়ে, হাতের চুড়ি ভেঙে খানখান। যেন অপমানিত, অতৃপ্ত চুড়িগুলি চরম অভিমানে শীতের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চোখ ভরা জল নিয়ে তাকিয়ে আছে চরম বিস্ময়ে। ভাঙা চুড়িগুলি ভিজতে লাগল। ভিজছে পিসি। তার চোখ মুখ থেকে জলের ধারা নামছে। সে ধারা বৃষ্টির, না চোখের তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। বৃষ্টির দিনে ভাঙা রঙিন চুড়ি খেলি কুঁড়িপিসির সঙ্গে, চুড়ির গায়ে কত কত সুখ দুঃখ লেগে থাকে সঙ্গোপনে। ... ...
বাংলা ১৩৪৬ সনে ভারত যখন মহাযুদ্ধে জড়াল, তখন থেকে একটু একটু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আক্রা হতে শুরু করল। ‘জাপানিরা বর্ম্মাতে এসে গেছে, দু’দিন পরে কলকাতায় চলে আসবে’। ‘জাপানি বিমান দুমদাম বোমা ফেলে সব শেষ করে দিচ্ছে’। এমনসব কথা যত বাড়তে থাকল, বাজার থেকে চাল-ডাল ততই উধাও হতে থাকল। বর্ম্মা থেকে আসা গরিবের খাবার ‘পেগু চাল’ একেবারেই মিলল না। মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মত ১৩৪৯ সনের আশ্বিন মাসের ঘূর্ণিঝড়ে বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো তছনছ হয়ে গেল। ঘুর্ণিঝড়ের পরে ধানের রোগবালাই আর পোকার আক্রমণ বেড়ে আমন ধান মার খেয়ে গেল। সে আমলে বোরো নয়, আমনই মূল ফসল ছিল। ফৌজি লোকজন বড় বড় নৌকা পুড়িয়ে দিতে আর গরুর গাড়ি ভেঙে দিতে থাকলে গাঁ থেকে ধানের চালান আর শহরে বা অন্যত্র যেতে পারল না। ১৩৪৮ সনের শীতকালে মোটা চালের দাম ছিল সাড়ে পাঁচ টাকা ছ’টাকা মণ, সেই চালের দাম এক বছরের মাথায় ১৩৪৯ সনের চৈত্র মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ টাকা মণ দরে। ... ...
মস্ত একটা ঠান্ডা সোনার থালার মতো কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। তার আলো এসে পড়ল আমাদের পুব দুয়ারী ঘরের নিকোনো দাওয়ায়। গা শিরশিরে ঠান্ডা ভাব বাতাসে। দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। মা জ্যেঠিমা পুজোর জোগাড় করে বামুন ঠাকুরের অপেক্ষায়। ঢাকি একবার বাজিয়ে দিয়েই চলে যাবে। পুরুত এসে দু-চারটে মন্ত্র বলে একটু ঘণ্টা নেড়েই পুজো শেষ করবেন। আজ বেশি সময় দেবার মতো সময় নেই। সবার বাড়িতেই পুজো। ঠাকুরকে চিঁড়ে নারকেল মন্ডা ইত্যাদি নিবেদন করে গেলেই আমরা প্রসাদ পাব। ... ...
মেয়েদের নাম রাশিয়ান ও তুর্কিক, দুই ধরনের। কিন্তু পদবীটি হবে রাশিয়ান স্টাইলে স্বামী বা পিতার নাম অনুযায়ী ওভা অথবা এভা। যেমন গুলনারার পুরো নাম গুলনারা গালিমোভা। আর এক মন্ত্রী নাতালিয়া করজোভা! প্রায় তিরিশ বছর যিনি রাষ্ট্রপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন তাঁর নাম নুর সুলতান নজরবায়েভ। তাঁর এক মেয়ের নাম দিনারা নুরসুলতানোভনা নজরবায়েভা – তিনি বিলিওনেয়ার। নতুন রাজধানীর নাম নুর সুলতান। যেমনটি সচরাচর হয়ে থাকে! ... ...
পবিত্র বোধ হয় আবার কিছু বলবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সুভাষ নজরুলের দিকে তাকিয়ে বলল, নজরুল সাহেব, আজ সকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে আপনি যখন কনফার্ম করলেন আপনিই নজরুল ইসলাম, আমি তখনই আপনাকে একটা প্রস্তাব দেব ভাবছিলাম। সেই জন্যেই আমি আপনার নবযুগের কথাটা তুলছিলাম। আপনারা তো এতক্ষণে শুনেইছেন, কয়েকমাস আগে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবার বাসনায় আমি চিত্তরঞ্জন দাশ মশায়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি অতি স্নেহে আমাকে তাঁর সঙ্গী করতে রাজি হলেন। আমাকে তিনি প্রথম দিনেই দুটো কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন; এক, গৌড়ীয় বিদ্যায়তনের অধ্যক্ষতা, এবং দুই, বাংলায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রচারের দায়িত্ব। ওই যে স্টেট্স্ম্যানের মন্তব্যের যে-কথা পবিত্রবাবু বলছিলেন সেটা ওই প্রচারেরই একটা অংশবিশেষ। কিন্তু আমার বাসনা আছে, বাংলার কংগ্রেসের পক্ষ থেকে একটা বাংলা দৈনিকপত্র বের করার। আমি ভাবছিলাম, এ ব্যাপারে যদি আপনার সক্রিয় সাহায্য পাওয়া যায়। ... ...
শিবিরা এত গরীব, ওদের কীকরে সংসার চলে সেটা একটা ভাবার বিষয়। কেউ জিগ্যেস করলে শিবি তার কাজের ফিরিস্তি দেয়, “বাড়ির মেয়েদের কাচ থে কিচু না কিচু কাজ জুটেই যায়। কেউ বলে, শিবি চাল পাছড়ে দে – শিবি চাল বেছে দে – শিবি উঠোন ঝাঁট দিয়ে দে – গোয়াল পরিষ্কার করে দে, ধান ভেনে দে, চাল কুটে দে—কত কত ফাই ফরমাশ! মিলনীও কাজ করে সমান তালে। তবে ছেলেদের সমান মজুরি ও পায় নে কুনোদিনই। অবশ্য আমিও পাই না।তবু বোনের থে কিচু বেশি মজুরি পাই মেয়েদের মদ্যি বেশি চৌকোস বলে”। অথচ সে পরিশ্রমে, দক্ষতায় পুরুষদের সঙ্গে সমানে তাল মেলাতে পারে। কিন্তু সেকথা মানছেটা কে? ... ...
বাংলা পড়া শেখার কথা সায়েরা একদিন ভয়ে ভয়ে আলীর দাদীকে বলেও ফেলে। আলীর দাদী কিন্তু মোটেও রাগ করলেন না। উলটো তিনি বললেন, মেয়েদের বাংলা পড়তে ও লিখতে, গোনাগুনতি শিখতে পারা উচিত। তাহলে তারা নামাজ শিক্ষাসহ ইসলামী বইগুলো পড়তে পারবে, নিজের বাচ্চাকাচ্চাকে দ্বীনি এলেম শেখাতে পারবে, খসম দূরে কোথাও কাজে গেলে তাঁকে চিঠি লিখতে পারবে, চিঠি লিখে নিজের বাবা-মায়ের খোঁজও নিতে পারবে। তাছাড়া মেয়েরা যদি গোনাগুনতি না শেখে, পাই পাই হিসেব করতে না পারে তাহলে সংসারের আয়-রোজগার বারো ভূতে লুটে খাবে। সায়েরার ইচ্ছার কথা শুনে আলীর দাদী ঠিক করলেন তিনি মেয়েদেরকে বাংলা আর হিসেবও শেখাবেন। এই কথা জানার পরে মেয়েদের বাবারা তো বটেই আলীর চাচা (কাকা) মান্নাফ, ইয়ার নবী আর হারুনও বেঁকে বসলেন। ... ...
অনেক পুরনো এই মস্কো শহরের পথঘাট সুপ্রশস্ত। লন্ডন-প্যারিস-ভিয়েনা-রোমের মত সেখানে কোনো সরু বা কানা গলি নেই। তার কারণ জানতে বেশিদূর যেতে হয় না। স্তালিন (আক্ষরিক অর্থে স্টিল বা লৌহমানব) যানবাহন ও জনসাধারণের সুবিধার্থে সেই হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের সঙ্গে কোনো আপোষ করতে চাননি। যেখানে বাধা, সেখানেই বুলডোজার চালিয়ে আপন পথ পরিষ্কার করেছেন, আপন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অর্থে দ্বিবিধ। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি রুমানিয়ার চাউসেস্কু সেপথেই চলে বুখারেস্টকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন। নির্মম হাতে প্রাচীন শহরকে নির্মূল করে কংক্রিট নগরী গড়ে তোলার পথে অনেকটাই এগিয়েছিলেন। অকালে তাঁর নিধন না হলে বুখারেস্ট শহরের ইতিহাসকে সমূলে উৎপাটন করে সারিবদ্ধ দশতলা ফ্ল্যাট বাড়ি বানিয়ে দেওয়াটা অসম্ভব হত না। ... ...
ও আমার ন্যাংটো বেলার বন্ধু। এ-রকম কথা বলার মানুষ ক্রমেই কমে আসছে। অথচ আমাদের, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে, সবার, 'ন্যাংটো বেলা' ছিল। শহরে হয়তো আলাদা। শহরে ধনী উচ্চমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত স্বল্পবিত্তদের ক্ষেত্রে আলাদা হতেও পারে, কিন্তু সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনে এখনো গ্রাম বেঁচে আছে। খেলায়, মেলামেশায়-- অভ্যাসে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কাউকে কাউকে ঘুরতে আসতে দেখেছি প্যান্ট না পরেই। পুকুরে স্নান করার সময় ছোটদের পোশাকের কোনো বালাই নাই। বর্ষাকালে যত খুশি কাদা ঘাঁটার জল মাখামাখি করার কাদায় গড়িয়ে ফুটবল খেলার প্রভৃতি আজো জমজমাট। ... ...
পলিটিক্স্ তো এক-একজনের এক-এক রকমের হতে পারে। যেমন ধরুন আপনি নিজেই ন্যাশনাল কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ হয়েছেন। তার মানে তো এই নয় যে, সরকারী স্কুল-কলেজ যারা এখনও ছাড়তে রাজি নয় আপনি তাদের বিরোধী। মূল একটা ঐকমত্য থাকলেই সংবাদপত্রে এক সঙ্গে কাজ করা যায়, বলে মুজফ্ফর, সেখানেই আমাদের প্রগতিশীলতা। নানা মতকে একটা প্ল্যাটফর্মে এনে আলোচনায় কোন আপত্তি নেই আমাদের। নিজেদের একটা মত থাকতেই পারে, কিন্তু বিরুদ্ধ মতকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখিয়ে সেই মত কাগজে ছাপতে কোন আপত্তি হবে না আমাদের। তবে হ্যাঁ, কৃষক শ্রমিক অভুক্ত অর্ধভুক্তদের কথা আমরা লিখব, লিখব পূর্ণ স্বাধীনতার কথা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পাব না। সংবাদপত্র কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের মুখপত্র এ কথা আমরা বিশ্বাস করি না, কিন্তু তাঁবেদারও নয় কারো। ... ...
আমি বনে-বাদাড়ে ফুলফল তুলে বেড়াতাম - কোথায় বেজির গর্ত, কোথায় সাপের খোলস, কোন ঝোপে কোন গাছ, তাদের আলোছায়ার সঙ্গে কেমন অচেনা নতুন দেশে এসে পড়ার বিস্ময়। যা দেখি, সবই অনির্বচনীয়। বেজির গর্ত দেখে মনে হতো পাতালের বামনের দেশ পর্যন্ত চলে গেছে ওই গহীন সুড়ঙ্গ। সেখানে যক্ষের পুরী, নাকি পৃথিবীর অতল তল কে জানে? কিছু প্রশ্নের উত্তর না পাওয়াই ভালো। কল্পনায় অজস্র সম্ভাবনা মনকেও দূরগামী করে। ঝড়ে পড়া জাহাজের মাস্তুলে উড়ে এসে বসা অ্যালবাট্রস, যে এনে দেয় আশার আনন্দ, এনে দেয় গভীর পর্যটনের স্বাদ আর বয়ে আনে সুগভীর বেদনার মতো বহু দূর অভাবনীয় সমুদ্রের পেটের ভেতরের নতুন গন্ধভরা বাতাস, বিপদগ্রস্ত নাবিকের যে পথপ্রদর্শক। সেসবই ভাষার অতীত। আমার ঘোরাঘুরিতে বিরক্ত মা বকাবকি করত। ভয় পেতো কবে অপঘাতে মরেই যাব। ... ...