যে সময়কার কথা, তখন না ছিলো মাইন, না ছিলো রাষ্ট্র, না ছিলো এ-কে ৪৭। এইসবের অনেক অনেক আগে, কুয়াশাঢাকা কোন গণোনোত্তর অতীতে, থাকত সাত ভাই। সাত ভাই বড় হতে থাকল সেই গাঁয়ের বনে ঢাকা শান্ত ছায়ায়। বড় ছয় ভাই ছিলো দামাল দুরন্ত অরণ্যসন্তান। ছোটোটি ধির-স্থির, শান্ত-শিষ্ট, জ্ঞানগম্ভীর। তার গভীর কাজলচোখে ছায়া পড়ে অরণ্যের, আকাশের ও মননের আয়নায় ফুটে ওঠে প্রজ্ঞাঋদ্ধ তারারাজি। আর তার রক্তে রক্তে বইতো গানের তরঙ্গলহরী বুঝি। এক সাথে বারো রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারত সে। বনের গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়েরাও বুঝি শান্ত হয়ে শুনতো সেই বাজনা, ভেসে যেতো সুরের প্রবাহে। বাকি ছয়ভাই খেত-খামারের কাজ করতে লাগল দিনভর, বয়ঃক্রমে ঘর বাঁধলো, বিয়ে করল। পড়ে রইলো লিঙ্গো। অথচ তার গান-বাজনায় এতই মুগ্ধ ছিলো তার দাদাবৌদিরা, যে তাকে ঘরের কাজ, বনের ফল-কাঠ-বীজ-শিকার জোগাড়, খেতি-বাড়ির কাজ, এমনকি রান্না-বান্নার কাজ করার জন্য বকুনি দিতে মন সইতো না কারুরই। সে এ’সবের ধার ধারতো না, শুধুই গাইতো আর বাজাতো। ক্রমে ক্রমে তিক্ত হয়ে উঠলো তার ছয় দাদার গৃহী মন। ... ...
যত ঘুরছি, কথা বলছি, জানছি, শিখছি, একটা বিষয় পরিস্কার হচ্ছে। ফৌজি-কৃত ভায়োলেন্স এবং মাইনিং-এর মধ্যে একটা আলবাৎ-কোরিলেশান রয়েছে। যে সব জায়গায় মাইনিং আরম্ভ হয়, সেই সব অঞ্চলে তার আগ-আগ দিয়ে বন-বাদাড় সাফ করে গড়ে ওঠে আধাসামরিক ক্যাম্প। ক্যাম্প বলতে মূলতঃ কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলায় বর্ডার সিক্যুরিটি ফোর্স এবং সশস্ত্র সীমা বল এবং বস্তার, দান্তেওয়াড়া, সুকমা, বীজাপুর জুড়ে সি-আর-পি-এফ, মূলতঃ তাদের ‘এলিট’ শার্প-শ্যুটার কোব্রা ব্যাটেলিয়ন। বস্তার সম্ভাগ দেশের কোনো বর্ডারের ধারেকাছে নয়, তাই বি-এস-এফ বা সশস্ত্র সীমা বল এ’খানে কি করছে তা সভ্রেনেরই মালুম। ... ...
এই সব তথাকথিত টাউনে যারা হোমড়া চোমড়া, তাদের মোটমাট প্রত্যেকেই অনাদিবাসী, গরিষ্ঠাংশের তেল—বনোপজ-লকড়ির ব্যবসা। (নুনটা জঙ্গল থেকে লুঠ করা ব্যবসায়িক-ভাবে অপ্রয়োজনীয়, কারণ আপাতত বিশ্ব-বাজার ছেয়ে আছে সৈন্ধবলবণে, জঙ্গলের বিভিন্ন গ্রামে থাকা আদিবাসীদেরও মুখিয়ে থাকতে হয় সমুদ্র থেকে তোলা নুন কবে বাজারে আসবে, তার উপরে। বস্তারের ধারেকাছে তো সমুদ্র নেই। বস্তারিয়া কৌম-প্রাকৃত ফুড সিস্টেমে ইতিহাসের কতটা স্রোত-ঢেউ-বাতাসিয়া-লুপের ফলে, মলয়াদ্রি বা সহয়াদ্রির উপকুলবর্তী জঙ্গল থেকে আসা মানুষেরা সৈন্ধব লবণ নিয়ে এসেছিলো, অথবা কত শতাব্দী-সহস্রাব্দের সৈন্ধব লবণের খাদ্য-প্রাকৃতিক বা ফুড-কালচারাল হেজিমনির বশবর্তী হয়ে রক-সল্ট ছেড়ে সৈন্ধব লবণ দিতে শুরু করল রান্নায়, আন্দাজ দুষ্কর।) তবে এই সমস্ত হোমড়া চোমড়ারা কেউই বস্তার তো ধূস্তরি মায়া, এক বা ম্যাক্সিমাম দুই জেনারেশন আগে কেউই হালের ‘ছত্তিসগড়’ এলাকাতেও থাকতোও না, থাকত মূলতঃ উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা বা মহারাষ্ট্রতে, অথবা নর্মদা নদীর উত্তর উপকুলের টেবল-টপ-সমতলময় ডেকানিয় উত্তর-মধ্যপ্রদেশে, মানে যেইখানে গোণ্ডওয়ানাল্যাণ্ড মিশে গ্যালো অ্যাংগোরাল্যাণ্ড, সেইখানে। ... ...
সংবিধানে যে সকল এলাকা পঞ্চম তফসিলভুক্ত – মানে যে সমস্ত জায়গার জনসংখ্যার গরিষ্ঠাংশ বাসিন্দা আদিবাসী, সেই সকল এলাকায় পঞ্চায়েতি রাজ জারি করা হয়েছে ১৯৯৬ সালে প্রণীত পঞ্চায়েৎ একস্টেনশান টু শ্যেড্যুল্ড এরিয়াস (পেসা) অ্যাক্ট মাধ্যমে। উক্ত কেন্দ্রীয় আইন, ২০০৬ সালের দ্য শ্যেড্যুল্ড ট্রাইবস অ্যাণ্ড আদার ট্রেডিশিনাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স রেকগনিশান অব ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট (এফ-আর-এ) এবং রাজ্য ছত্তিসগড়ে প্রযোজ্য ছত্তিসগড় পঞ্চায়েতি রাজ অধিনিয়ম ১৯৯৩ অনুসারে কোনো আরণ্যক গ্রামের মানুষের ব্যাবহারযোগ্য ব্যক্তিগত জমি মানে ভিটেমাটি, খেতি-আবাদী এবং গ্রামের নিস্তারী, মানে সেখানকার দেবদেবীদের থান, উৎসবের জায়গা, শ্মশান, গোচারণভূমি – সমস্ত কিছু যদি ‘বিকাশ’-এর ধ্বজিত উদ্দেশে হাপিস করতে হয়, তাহলে প্রভাবিত সমস্ত গ্রামের গ্রাম সভার মাধ্যমে রেসল্যুশান পাস করতে হবে, গ্রামবাসীদের গরিষ্ঠাংশের সম্মতি প্রয়োজন। এছাড়াও, উক্ত এফ-আর-এ আইন অনুসারে আরণ্যক গ্রামের গ্রামবাসীরদের নানাবিধ অধিকার-জ্ঞাপক পাট্টা দেওয়া হয় – যেমন বসবাসের অধিকার, খেতি-আবাদির অধিকার, খাদ্য হিসেবে আহৃত ফল-মূল-ব্যাঙের ছাতা, পানীয় হিসেবে আহৃত মহুয়া, সালফি প্রভৃতি, জীবিকার উদ্দ্যেশ্যে আহৃত তেন্দু পাতা, গালা, ধুপ বানানোর রেসিন-সমূহের অধিকার, পরম্পরা-নির্দিষ্ট স্থানে পুজো, উৎসব অন্ত্যেষ্টাদি সকল রিচুয়াল-উদযাপনের অধিকার, অরণ্য ও জীব-বৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখার অধিকার ইত্যাদি। এই পাট্টার আবেদন-ও করা হয় উক্ত গ্রাম-সভা মারফৎ। ... ...
গোটা বস্তার সম্ভাগের যা আয়তন, তার ৫১% জমি তুলে দেওয়া হয়েছে মাইনিং, পাওয়ার-প্ল্যাণ্ট সহ বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য। এর মধ্যে ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের খাঁই মারাত্মক। ঐখানে কাজ করা এক বন্ধু জানিয়েছিলো যে প্ল্যাণ্টের যন্ত্রপাতির অবস্থা তথৈবচ। অথচ, ভারতের গৌরব এই বি-এস-পি, নবরত্নের এক রত্ন সে, তাকে তো উৎপাদন করে চলতেই হবে। তাই, আউটপুট বাড়াতে, ইনপুট বাড়াতেই হবে। এ’দিকে ছত্তিসগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলাস্থ দল্লী-রাজারার মাইন শেষ হওয়ার মুখে। অতএব, বস্তার সম্ভাগের কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলা জুড়ে রাওঘাটে আকরিক লোহার নতুন মাইন বানাও নতুন, দান্তেওয়াড়া জেলার খ্যাতনামা বৈলাডিলার চলতি মাইনের প্রোডাকশান ক্যাপাসিটি ২৯ মিলিয়ন টন থেকে ২০২০র মধ্যে ১০০ মিলিয়ন টন কর, রাজনন্দগাঁওর মহামায়া অঞ্চলে ও বস্তার-সংলগ্ন বালোদ জেলার দুলকিতে নতুন মাইন বানাও, প্রভৃতি উদ্যোগ। শুধুই কি ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্ট? আয়রণ ওর মাইনের নাম করে নারায়ণপূরের অবুজমাড়ে, কাঁকেরের চারগাঁ নামের দুইটি গ্রামে এসে গিয়েছে নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানী। দান্তেওয়াড়ার বাচেলি ও কিরণ্ডৌলে তৈরী হচ্ছে আয়রণ ওর বেনেফ্যাকশান প্ল্যাণ্ট। ইতিমধ্যে বস্তারেই তৈরী হচ্ছে তিনটি স্টীল প্ল্যাণ্ট – ডিলমিলি, নগরনাড় ও লোহাণ্ডিগরে। প্রথমটি আবার ‘আল্ট্রা মেগা’। কাঁকেরের আমাবেড়া অঞ্চলে তৈরী হচ্ছে বক্সাইট মাইন। ... ...
একই পদ্ধতিতে, নকশাল-দমনের উদ্যেশ্যে সন ২০০৬তে সালওয়া জুডুম কম্যাণ্ডো-বাহিনী গঠিত হয় বস্তার সম্ভাগে।এই বাহিনীর পুরোভাগে ছিলেন ভা-ক-পা বিতাড়িত কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মা। বাহিনীর সদস্য হল ছোটো ছোটো আদিবাসী কিশোরেরা। তাদের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হতে লাগল এবং দুই সপ্তাহের ট্রেণিং দেওয়া হতে লাগল, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হল বস্তারের জংলা গাঁ-গঞ্জে যখন তখন হানা দেওয়ার, যত খুশি লুট, খুন, ধর্ষণ ও গৃহদাহ সংঘটিত করার। গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বলে ছাই হয়ে গেলো। তটস্ত আদিবাসীরা পাহাড়ি জঙ্গল ছেড়ে নেমে এলো পাকা-রাস্তা তথা হাইওয়ের দুইধারে খাঁচার মত করে তৈরী ‘ক্যাম্প’-গুলিতে। পাশাপাশি ‘কোয়া’-উপজাতির আদিবাসী কিশোর যুবকদের দিয়ে তৈরী হল কোয়া-কম্যাণ্ডো। একই ধরণের কার্য্যকলাপের উদ্দ্যেশ্যে। এই সবের জন্য টাকাপয়সা সহ সমস্ত সুবন্দোবস্ত করে দিলো সরকার। এই সব ‘স্থানীয় কম্যাণ্ডো’-বাহিনীর পাশাপাশি জোরকদমে ‘মিলিটারাইসেশান’। স্থানীয় থানাগুলির হাতে চলে এল প্রচুর অর্থ, ক্ষমতা ও ক্ষমতার উৎস তথা ভয়াল অস্ত্রশস্ত্র। বস্তারজুড়ে প্রায় সমস্ত থানা পরিণত হল কাঁটাতার পাঁচিলে ঘেরা ক্যাম্পে। এবং একের পর এক আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হতে থাকল অঞ্চলে, অজস্র গ্রামকে ঘিরে ফেললো সি-আর-পি-এফ, বি-এস-এফ, কোব্রা ব্যাটেলিয়ন নাগা ব্যাটেলিয়নের ক্যাম্প। শক্ত নজরদারীতে ঘেরবন্দী হয়ে গেলো বস্তারের মানুষেরা। তার পাশাপাশি অন্ধ্রের কুখ্যাত নকশাল-দমক গোষ্ঠী ‘গ্রেহাঊণ্ড’ এসে করে যেতে লাগল একের পর এক এনকাউণ্টার। ২০০৮-এ যখন অপারেশান গ্রীণ হাণ্ট আরম্ভ হয় তখন থেকে আজ অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ২০১৬ অবধি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছে বস্তারে। ... ...
অনেক মানুষ মনে করে, এই জঙ্গলের আদিবাসী লোকগুলো কোনওরকম পরিবর্তন চায় না। এটা ভুল ধারণা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানীয় জল – জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এরা আমাদের সাহায্য চায়। সবার আগে, অন্য যে কোনও মানুষের মত এরাও নিজেদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু চায়। ভদ্রবোধসম্পন্ন মানুষের নিজেদের এক্তিয়ারে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার। উচ্ছেদের পরে আমরা এদের নতুন যে জীবনদান করতে চাইছি, কোনওরকম পুঁথিগত শিক্ষা ছাড়াই এই লোকগুলোর বোঝার ক্ষমতা আছে যে সেই জীবনে মর্যাদাবোধ নেই – এমনই বিচক্ষণ এরা। যতদিন না আমরা এদের সেই অধিকারবোধ দিচ্ছি, এরা নিজেদের জীবন এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম জারি রাখবে, সে যত স্বল্প পরিসরেই হোক না কেন। ... ...
অভিযোগ রক্ষার্থে ভরত আর জেলের ডাক্তারকে সামনে নিয়ে আসা হল। কিন্তু সে কি অবাক কান্ড!! কিছুক্ষণ আগে যে ভরতের সাথে দেখা করে এলাম সেই ছেলে আর এই ছেলের মধ্যে কত তফাৎ । সে এক ভীতু বাচ্চা ছেলের মতো যা যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল সবেতেই নিচু স্বরে খালি হ্যাঁ হ্যাঁ করে যাচ্ছিল। তাকে থ্রেট দেওয়া হয়েছিল যাতে আমাদের দিকে সে না তাকায়। সকলের সামনে জেলার তার সাথে খুব ভালভাবেই কথা বলছিল। আমরা জেল থেকে বেড়িয়ে আসার সময় জেলারকে বললাম আসামীদের কোনও অভিযোগ লিখিতভাবে জানানোর জন্য আপনারা নিদেনপক্ষে তাদের সেই সুযোগটুকু করে দিন”। তার পরিপ্রেক্ষিতে জেলার রেগে উত্তর দিল “আপনারা যদি উকিল হতেন তাহলে এই ব্যাপারটা বুঝতেন ভালো করে যে কোনও বন্দীর অভিযোগ জানানোর কোনও অধিকার নেই”। ভরত যখন আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল আমরা গুনগুন করে তাকে আশ্বাস দিলাম “ভয় পেও না”। সে নীরবে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল। ... ...
বাস্তবিকই, নুড়ি পাথরের জন্য কিছুটা হলেও জল পরিশ্রুত। কিন্তু কতটা? বস্তারের বেশীরভাগ গ্রামে লোকে এমনই জল খায়। পাহাড়ি স্রোত ঝোরাগুলোর জল সমতলভূমির জলের চাইতে কম দূষিত হলেও কখনোই পুরোপুরি নিরাপদ নয়। বস্তারের গ্রামে আজও ডায়েরিয়ার মড়ক লাগে। গতবছর ছত্তিসগড়ে প্রায় একশ'র ও বেশী লোক কলেরা হয়ে মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানতে পেরে যাতে মহামারি আখ্যা না দেয়, সেইজন্য কলেরা ছড়ানোর খবর গোপন রাখা হয়েছিল। এমন খবর উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত ছত্তিসগড়ের গর্ব অবশ্যই খর্ব করতে পারতো। ... ...
এই ক্যাম্পের লোকেরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছে। মোটের উপর এটা কোনও গ্রাম নয় যেখানে যুগ যুগ ধরে গ্রামের প্রতিটা পরিবারের একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্যের সম্পর্ক; একটা গ্রাম যেটা জীবন্ত প্রতিজন গ্রামবাসীর নিঃশ্বাসে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দময় চলমান দিনের গতিবিধিময় প্রতিচ্ছবি; এটা একটা ক্যাম্প। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য এই ক্যাম্প, এখানে মানুষ অপেক্ষা করে থাকে পুরাতন জীবনে ফিরে যাওয়ার, অথবা নতুন কোনও জীবন শুরু করার। এই সবের মাঝে দায়গ্রস্ত এরা শিখে নিয়েছে একে অপরের সাথে মিশে থাকার। ... ...
ছত্তিসগড়ে হিংসামূলক কাজকর্মের জন্য উৎখাত হওয়া ১৬,০০০ জনেরও বেশী মানুষ অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মাম অঞ্চলে ২০৩ টে অস্থায়ী উপনিবেশে রয়েছেন। এইসব ক্যাম্পগুলির কিছু কিছু গ্রামের আশেপাশে। কিছুসংখ্যক এই ক্যাম্প মানবাধিকার সংস্থাগুলির দ্বারা নথিভুক্ত। তা সত্ত্বেও রাজ্য এই উপনিবেশগুলির অস্তিত্ব স্বীকার করতে নারাজ। বাস্তবিকই, রাজ্যের গন্ডীর মধ্যে এই ১৬,০০০ মানুষের বাঁচা বা মরা রাজ্যের দায় নয় – এটা বুঝিয়ে দিতে অন্ধ্রপ্রদেশ এই মানুষগুলির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। এ যেন এমন এক অদৃশ্যকরণ জাদুকৌশল যেটা দক্ষতম জাদুকরেরও ক্ষমতার বাইরে। আপনি সরকারি নথিপত্র দেখতে পারেন, কিন্তু কোথাও এই মানুষগুলির উল্লেখ নেই। ... ...
প্রিয়াঙ্কাঃ শেষ প্রশ্ন এবং ব্যক্তিগত – এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের পিছনে কারন নিয়ে আপনারা পুলিশ ক্যাডাররা কি ভাবেন? আলিঃ দেখুন, আমরা সাধারণ পুলিশ। ২০০৭ সালের আসাম পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী আমাদের একমাত্র কাজ হল অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ করা। আইন- শৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে আমরা আগ্রহী নই। ... ...
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে গগৈএর ছেলে রূপঙ্কর আর তার বন্ধু ভরত সাহুকে ধরার পর পুলিশ এদের দুজনকে ১১ তারিখ রাত্রে মারধোর করে ও রাস্তায় টেনে আনে। পুলিশ ছোট ছেলেদের মারতে শুরু করতেই গগৈ ওদের দিকে তেড়ে যায় আর তখনই পুলিশ গগৈ আর তার স্ত্রীকে আক্রমণ করে ও গ্রেপ্তার করে। গগৈএর হাত ভাঙ্গে, ভরত গ্রেপ্তার হয় আর রূপঙ্কর নিজের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়। চুলধোয়া পঞ্চায়েতের (এই পঞ্চায়েতের বিস্তৃতি অনেকটা এলাকা জুড়ে) গ্রামগুলোতে অনেক ঘুরেও কেউ রূপঙ্করের সন্ধান দিতে পারে না। গগৈএর বাবার বাড়ি (রূপঙ্করের দাদু) বাসন্তীপুরে পৌঁছে একটা ঠাণ্ডা ঔদাসিন্য অনুভব করলাম। অনেক জোরজার এবং বোঝানোর পর যে আমরা পুলিশের লোক নই বা আসাম সরকার আমাদের পাঠায়নি, ওনারা রাজি হলেন রূপঙ্করকে ‘খুঁজতে’। কয়েক মিনিট পরে স্থানীয় এক আন্দোলনকারীর সঙ্গে সে এল। সেদিনের ঘটনার পর থেকে কুড়ি বছরের রূপঙ্কর খুবই মানসিক আঘাত ও ভয় পেয়েছে। সঙ্গের ভিডিওতে সে মে ১১ তারিখ রাত্রের সমস্ত ঘটনা ব্যাখ্যা করে। ও বলে কিভাবে পুলিশ এবং সিআরপিএফ ওকে ও ভরত সাহুকে আক্রমণ করে; কিভাবে অস্ত্রধারী কিছু লোক ধাবার আশেপাশে ওরা যে শুয়োরগুলো পুষছিল সেগুলোকে এমনভাবে মারে যে তাদের পিছনের চামড়া উঠিয়ে নেয়। ... ...
শুনেছি এই নির্মম আক্রমণের পিছনেও ছিল জর্জদারই নিজের করা কিছু অসতর্ক মন্তব্য। বিশ্বস্ত সূত্রে শোনা কথা হল সম্পাদকমশায় নাকি প্রায়শই মদ্যপ অবস্থায় গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন। তাঁর এই অভ্যাসের জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে কোন এক অনুষ্ঠানে দেখা হবার পর ভদ্রলোকের স্ত্রী নিজের মর্ম বেদনা জর্জদার কাছে পারিবারিক হিতাকাঙ্খী হিসেবে ব্যক্ত করেন। ঘটনাটি শুনে জর্জদা নাকি ভদ্রমহিলাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই মর্মে যে ঘরে যে বাড়িতে যদি "ঝাড়ু' থাকে তবে তিনি যেন সেটি ব্যবহার করেন নির্দ্বিধায়। ফলও পেয়েছিলেন হাতে নাতে! তবে হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জর্জদা আপোষ করেননি কোনদিন। রেকর্ড করা বন্ধ করেছিলেন কয়েকবছর আগেই, কিন্তু ঘনিষ্ঠজনেদের কাছে প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলতেন এ ভাবে আমার রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করা হয়ত বন্ধ করা যাবে কিন্তু আমর কণ্ঠরোধ করা যাবে না। ... ...
একথা ভাবলে ভুল হবে, স্রেফ আঁতেল সাহিত্য আর গ্রুপ থিয়েটার নিয়েই নিউজ চ্যানেলের সমস্ত মাথাব্যথা। এই জাতীয় এলিটপনাকে কবেই নিউজ চ্যানেল ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। ভোটে যেমন, টিআরপিতেও তেমনই একজন দর্শকের একটিই ভোট। তিনি রোগা না মোটা, লম্বা না কালো, আঁতেল না হাড়হাভাতে, তাতে কিস্যু যায় আসে না। এই ব্যাপারে নিউজ চ্যানেল পরিপূর্ণ উত্তরাধুনিক। শিল্পের কোনো রকম হায়ারার্কিতেই তার বিশ্বাস নেই। তাই শুধু এলিট সাহিত্য বা শিল্প নয়, জনতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারও আজ বাংলা নিউজ চ্যানেলেরই হাতে। নতুন মোড়কে বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিস্মৃতপ্রায় ফর্মকে তারা তুলে এনেছে জনতার দরবারে, যার নাম খেউড়। এবং এর অবিরত পরিবেশনায় বাঙালি দর্শককুলকে করে তুলেছে মুগ্ধ ও মোহিত। ... ...
দোকানগুলো অবধি নেমে এসেছে রাস্তায়। সরু রাস্তা আরও সরু হয়েছে। এবং সেখানে পিলপিল করছে লোক। রোগামোটালম্বাসরু। লাইন দিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে দিয়ে নানা রোমহর্ষক কায়দায় এঁকেবেঁকে অটো চলেছে। আমাদের ছোটো অটো চলে আঁকেবাঁকে। অফিস টাইমে তাতে টার্জান থাকে। বাসরা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। নড়েওনা চড়েওনা। কন্ডাক্টররা চিল্লাচ্ছে, রিক্সারা ভেঁপু বাজাচ্ছে, গাড়িরা তেড়ে হর্ন দিচ্ছে, আর বাকিরা শাপশাপান্ত করছে। রাস্তার হরেকরকম দেশি-বিদেশী গাড়ির ভিড়। সিগনালের বালাই নেই। একেকটা মোড়ে জনা ছয়েক করে পুলিশ আর হোমগার্ড আকাশের দিকে লাঠি উঁচিয়ে আছে। গাড়িরা খানিকটা সার দিয়ে চলেই যেখানে খুশি নাক গুঁজে দিচ্ছে। উল্টো দিকের রাস্তা থেকে তখন আরেকগুচ্ছ গাড়ি এসে হাজির হচ্ছে। সবাই মিলে হর্ন দিচ্ছে, খিস্তি করছে, আর যেখানে সেখানে নাক গুঁজে জটটা আরও খোলতাই করে তুলছে। ... ...
দিল্লিওয়ালা কী করে চিনবেন? একটা প্রচলিত জোক চলে বাজারে, কলকাতার বাঙালির হাতে পয়সা জমলে বাঙালি কী করে? না, এবারে পূজোয় কোথায় বেড়াতে যাবে, তার প্ল্যান করে। বম্বের মারাঠির হাতে পয়সা জমলে সে কী করে? না, কোন শেয়ারে সেই পয়সা লাগালে তার সবচেয়ে বেশি লাভ হবে, তার ছক কষে। আর দিল্লিওয়ালার হাতে পয়সা জমলে দিল্লিওয়ালা কী করে? ... কী আবার, প্রপার্টি কেনে। ... ...
ভোজ কয় যাহারে - আজ বরম্ একটু খাওয়া দাওয়ার গল্প হোক। শুধু শুধু চা আর লেড়ো বিস্কুটের জোরে আর কতদিন গল্প জমে, বলুন? আচ্ছা, বলেন তো, দিল্লি বললেই প্রথম কোন্ খাবারের কথা আপনার মনে আসে? ....... ঐ দ্যাখেন, একসাথে কতগুলো হাত উঠেছে। এদিকে দমোদিদি চোখ পাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে যাচ্ছেন "ঘেভর ঘেভর'; ঐদিকে অজ্জিতকাকু এন্তার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন আর মন্তর পড়ার মত করে বলছেন "করিম্স ..... লস্যি ..... মালাই মার কে'। ... ...
উৎসবের নাম দুর্গাপূজো। মারাঠিদের যেমন গণেশ চতুর্থী, উত্তরভারতীয়দের যেমন দিওয়ালী, বাঙালির তেমনি ট্রেড সিম্বল হল দুর্গাপূজো। এমনিতেই বাঙালি কমিউনিটিপ্রিয় জাতি, বাংলার বাইরে এসে বাঙালির মত কমিউনিটি তৈরি করতে আর কোনও প্রবাসী ভারতীয় জাতি পারে না। তবে প্রবাসে সব ঐক্যের শেষ ঐক্য খাটে এই দুর্গাপূজোর সময়ে। ... ...
আবার অন্যদিক থেকে দেখলে, দিল্লিতে বাঙালি, পুনরায়, দুই প্রকার। এক গ্যাঁড়ার মত লোকজন, যারা প্রায়শই বড়মেজ বিভিন্ন রকমের চাকরি পেয়ে বাংলার মাটি ছেড়ে দুর্জয় ঘাঁটি গেড়ে বসছে দিল্লি এনসিআরের বুকে, এবং এখানেই থেকে করেকম্মে খাচ্ছে, পয়দা করছে সেকেন্ড, থার্ড জেনারেশন প্রবাসী বাঙালি। চাকরি অথবা উচ্চশিক্ষা, সঙ্গে সাইড ডিশ হিসেবে উইকএন্ডে বাংলা কল্চর, এই এদের গল্প তো শুনেছেন আগের বারে। ... ...