খাজা মণ্ডলের কাজ শুরু হয়েছিল সৌদির রিয়াদ শহরে। দত্তফুলিয়ার অফিস-ঘরে এই কার্পেন্টারের ইন্টারভিউতে দালাল কী কী প্রশ্ন করেছিল জানিনা, তবে উঁচু উঁচু বিল্ডিঙের আলো-ঝলমলে রাজধানী শহরে গিয়ে খাজার প্রথম কাজটা ছিল আন্ডার-কন্সট্রাকশন বিল্ডিঙের পিলারে, ছাতে, তক্তায় পেরেক ঠোকা। ঢালাই হবে তারপর। সৌদি আরবের সব থেকে বড় শহরের এদিক-সেদিক গিয়ে গিয়ে চলেছে কাজ। মধ্যভাগের মালভূমির উপর বিশাল বিশাল বিল্ডিং-এর পাশে আরও সব বিশাল বিশাল বিল্ডিং উঠছে। মুসলিম পাড়ার মাটির বাড়ির খাজা মণ্ডলের পায়ের তলায় তখন কেবল বালি। দিনের শেষে সেলাই করা প্যান্টের ভাঁজে ভাঁজে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে, বুক-পকেটে বালি আর বালি। বালি খুঁড়ে মজবুত ভাবে উঠতে লাগল পিলারের উপর পিলার। ওই শীর্ণকায় শর্ট-হাইটের খাজা মণ্ডল বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগল উঁচু উঁচু বিল্ডিঙের বাইরে দিয়ে। কখনও সেফটি-বেল্ট বেঁধে। কখনও সব আয়োজন ছাড়াই নিজের হাত পায়ের ভরসায়। নানা সাইজের পেরেকে হাতুড়ি পেটা করলেও ঘাম বেরোয় না শরীর বেয়ে। ছোটবেলা থেকে মাঠেঘাটে কাজ করে বেড়ালেও – এমন চড়া রোদ, এমন জ্বলুনি ধরানো তাপ গায়ে লাগেনি কখনও। ঝাঁঝালো শুকনো রোদে পুড়তে থাকল খাজা মণ্ডলের চামড়া। মাসের শেষের বেতন মাসের শেষে দেওয়া বন্ধ হ’ল। ছ’মাসের বেতন বাকি রেখে হাতে দিল বাকি কয়েক মাসের বেতন। নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল – কখনওই পুরো বেতন দেবেনা একসঙ্গে। খরচির হিসেব কড়ায় গণ্ডায় রাখল কন্ট্রাক্টর। দু’বছর-আড়াই বছর পর, বাড়ি ফেরার সময় হলে, মালিক কিছু ডিরহাম সেরকমই রেখে, দিত বাকি। কিছু দিত হাতে। কন্ট্রাক্টর বলত, আবার আসবি – তখন পাবি। এভাবে বিদেশের মালিকের কাছে পাওনা বাকি রেখে খাজা মণ্ডল সাত বছরে বাড়ি আসে দু’বার। ... ...
সুতরাং আমরা এই লেখায় অন্তত কয়েকজন এমন ক্রীড়াবিদের নাম লিখে রাখি যাঁদের কথা শোনা যাচ্ছেনা। ধরা যাক দীক্ষা ডগরের কথা। গল্ফে অদিতি অশোকের পাশাপাশি ইনিও ফাইনাল রাউন্ডে খেলছিলেন। গল্ফেই উদয়ন মানে, অনির্বাণ লাহিড়ী পুরুষদের ইভেন্টে ছিলেন। ২০ কিমি রেসওয়াক ইভেন্টে ফাইনাল রাউন্ডে ছিলেন সন্দীপ কুমার, রাহুল রোহিলা, ইরফান থোরি (পুরুষ ), প্রিয়াংকা গোস্বামী এবং ভাবনা জাট (মহিলা )। মহিলাদের ডিসকাস থ্রো তে কমলপ্রীত ক'র । রোইং এ অর্জুন লাল এবং অরভিন্দ সিং। সেইলিং এ পুরুষদের ইভেন্টে বিষ্ঞু সার্ভানন, কে সি গণপতি, বরুণ ঠক্কর, এবং মহিলাদের ইভেন্টে নেত্রা কুমানন। শুটিং এ সৌরভ চৌধুরি। কুস্তির দীপক পুনিয়ার কথা আমরা তাও একটু আধটু শুনতে পেয়েছি, পঞ্চম স্থানে শেষ করায়। হাতে গোনা যে কয়েকজনের নাম এখানে লেখা হলো, এঁরা সবাই স্ব স্ব বিভাগে ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছিলেন। এর বাইরে রয়ে গেলেন বহু ক্রীড়াবিদ, যাঁদের অনেকের নাম আর কোনদিনই প্রচারের আলো পাবেনা। প্রসঙ্গত ভারত এবার মোট ১২০ জনের দল পাঠিয়েছিলো, দেশের ইতিহাসে এর থেকে বেশি খেলোয়াড় আগে কখনো অলিম্পিকে অংশ নেন নি। ... ...
জীবনে কষ্ট তো কম করেনি সম্ভৃতা। সেই অতটুকু বয়েসে যখন সোমেশ্বরের সাথে সংসার শুরু করেছিলো নন্দী স্ট্রীটের এক কামরার ফ্ল্যাটে, কীই বা জানতো সংসারের ! তারপর এ শহর ও শহর ছোটবড়ো নানান রকমের আস্তানা আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা পেরিয়ে, অভিজাত কর্পোরেট আবাসন এয়ারকণ্ডিশন্ড্ গাড়ি আর আনুসঙ্গিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে আসা জীবন ছেড়ে, এক কথায় আবার কলকাতায় ফিরে প্রায় শূন্য থেকে শুরু ! চাকরি করবে না আর সোমেশ্বর ! পলায়নরত মূলধনের ক্ষয়িষ্ণু কলকাতা শহরেই সে পেশার শেষ পনের-ষোল বছর বিপণন পরামর্শদাতার কাজ করলো ! ... ...
ইন্দ্রনীলের স্কুলের বন্ধু গাই বিরনবাউম থাকতো ওয়েস্ট হ্যাম্পষ্টেডে। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের অসম্ভব নৈকট্য গড়ে ওঠে। অনেক সাবাথের সন্ধ্যা কাটিয়েছি তাদের সঙ্গে। বাংলায় আমরা যাকে ভুরি ভোজ বলি সেটা শুক্রবার ইহুদি সাবাথের সান্ধ্য ভোজনের তুলনায় জলখাবার মাত্তর! গাইয়ের মা বিরশেবাকে বলতাম শনিবারের দিনটায় কাজ কর্ম কেন যে মোজেস বারণ করে গেছেন এবারে বুঝলাম। আগের দিনের সেই বৃহৎ ভোজন উৎসবের পরে শনিবার শরীরকে ব্যস্ত না করাই ভালো! ... ...
আমাদের শুরুতেই দেখতে হবে, মেডেলের আশা আমাদের ঠিক কোন কোন খেলাগুলিতে ছিল। আসলে অলিম্পিক স্পোর্টসগুলি সম্পর্কে আমাদের ধারণা এতটাই কম থাকে, যে চার বছর ধরে খবরের কাগজের পাতায় তাদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়, উন্মাদনার কথা ছেড়েই দিলাম। অধিকাংশ ক্রীড়ামোদীই জানেন না – কোন খেলায় কে অলিম্পিকের যোগ্যতা মান পেরোচ্ছেন এবং কারা কারা অংশ নিচ্ছেন। এটা তো আর শুধুমাত্র ক্রিকেটকে আর মিডিয়াকে দোষারোপ করে কাটিয়ে দিলে চলে না। পাবলিক যা খায় মিডিয়া তাই-ই খাওয়ায়। আমরা এই পর্বে দেখে নেব, কারা কারা পদক পাবার সম্ভাবনা নিয়ে টোকিও গিয়েছিলেন। এবং তারপর একে একে ভিন্ন ভিন্ন খেলায় আমাদের পারফরম্যান্সের বিচার করার চেষ্টা করব, প্রস্তুতি সহ। ... ...
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’।এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে উন্যাময়েজি অঞ্চল, যেখানে বর্তমান টাবোরা শহর, তার কাছে রুবুগা নামের জনপদে পৌঁছনর কথা। তরজমা স্বাতী রায় ... ...
ছেলেটা অর্ডার নিতে এলে – পিৎজা এদের স্পেশালিটি কিনা জিজ্ঞেস করলে, হ্যাঁ বলল। আমার কি মনে হল - এও না সেই অন্য রেষ্টুরান্টের মত পিৎজার ইতিহাস ব্যাখ্যা করা শুরু করে! তাই সে-ই কিছু বলার আগেই আমি বললাম – আমি জানি পিৎজা বলে আধুনিক কালে আমরা যে জিনিসটিকে চিনি তার জন্ম হয় ১৮৮৯ সালে ইতালির নেপলস্-এ। একসময়ে নেপলস্-এর বাজারে যা পরিচিত ছিল ‘পিৎজা আলা মোজারেল্লা’ নামে, সেই পিৎজা খেয়েই রাণী মার্গারিটা কুপোকাত – বিশাল ভালোবেসে ফেলে ডিক্লেয়ার করে দিলেন, যে এটাই তাঁর সবথেকে প্রিয় পিৎজা। ব্যাস, সেই থেকে এই পিৎজার নাম হয়ে গেল ‘পিৎজা মার্গারিটা’ সেই ওয়েটার দেখি আমার কান্ড দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে – ... ...
একজন চিত্রপরিচালক হিসেবে, বিগত বহুবছরের পরিশ্রমে, আমি এদেশে ফিল্ম-শিল্পের যে পরিকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম – আশঙ্কা হয়, তা অচিরেই ধ্বংস করে ফেলা হবে। পুরোদস্তুর তালিবান শাসন শুরু হলেই তারা সব ধরনের শিল্প ও চারুকলার চর্চাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। আমি এবং আমার সকল সতীর্থ তাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠব এবং আমাদের সবার নাম তাদের হিট লিস্টে উঠে যাবে। নারীর সকল অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হবে অন্তপুরের অন্ধকারে, তাদের সমস্ত অভিব্যক্তির কণ্ঠরোধ করা হবে। ইতিপূর্বের তালিবান শাসনে একটি মেয়েও স্কুলে ছিল না। গত কুড়ি বছরে ৯০ লক্ষেরও বেশি আফগান মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করেছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, যে ‘হেরাত’ শহরের (যা ইতিমধ্যে তালিবান দখলে চলে গেছে) বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ভর্তির প্রায় ৫০%-ই ছিল মেয়েরা। এমন সব সাফল্যের খবর কিন্তু বাকি দুনিয়ার কাছে পৌঁছয়নি। মাত্র গত কয়েক সপ্তাহে তালিবানরা অসংখ্য স্কুল ধ্বংস করেছে আর তার ফলে প্রায় ২০ লক্ষ মেয়েরা আবার স্কুল-ছাড়া। ... ...
সারা দেশ যখন জনগণমনঅধিনায়ক সুরে মাতোয়ারা, সারে জাঁহা সে আচ্ছা গাইছে দৃপ্ত উচ্চারণে আর তেরঙ্গা ঝান্ডা দুলিয়ে গাল ফুলিয়ে নারা তুলেছে বন্দে-মাতরম, তখন বাংলা অসম আর পাঞ্জাবের বুক চিরে উঠে আসছে অক্ষম ক্রোধের দীর্ঘশ্বাস, বিশ্বাসহীনতার কাছে পরিচয়ের হারানো অপমানিতের চিখ চিৎকার - "আমগো দ্যাশ ভাগ হৈয়া গেল / মোর দেখ ভাগ হৈ গ'ল / সাড্ডা দেস ভডিয়া গৈ" আজ সেই বিশ্বাসঘাতকাতার, সেই পিঠ পিছে ছুরি মারার, সেই চুর চুর হয়ে ভেঙ্গে পড়া স্বপ্নযাপনের পঁচাত্তর বছর। কি বীভৎস মজা ! এমন দিনে চেতনে বার বার আছড়ে পড়ে গান তার সুর আর বাণী নিয়ে, যে শোনায় তার কন্ঠ, যে শোনে তার অন্তর গেয়ে ওঠে – "যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক / আমি তোমায় ছাড়বোনা মা" ... ...
গ্রেপ্তারের সময় ফাদার স্ট্যানের বয়স ছিল ৮৪। তিনি পার্কিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন এবং প্রায় শ্রবণশক্তিহীন ছিলেন। এছাড়াও তাঁর বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা ছিল। তাঁকে যখন তালোজা জেলে নিয়ে আসা হয়, তখন বরেণ্য কবি ভারভারা রাও প্রবল অসুস্থ, যমে মানুষে টানাটানি চলছে। জেল তখন উপচে পড়ছে; ২১২৪ জন কয়েদি যেখানে থাকার কথা – সেখানে বন্দির সংখ্যা ৪০০০ ছাড়িয়ে গেছে। করোনার কারণে জেল খালি করার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, সেখানে তখনও আরও অভিযুক্তদের ঠুসে দেওয়া হচ্ছে। এই ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে ফাদারকে ঠেলে দেওয়া হল.. ... ...
কংগ্রেস নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, ব্যথিত বৃদ্ধ ঠিক করেন নোয়াখালির গ্রামে গ্রামে, বিহার-কলকাতা-দিল্লি-পাঞ্জাবের দাঙ্গা-বিদ্ধস্ত বস্তিতে তিনি শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। তাঁর সারাজীবনের আদর্শ - অহিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করবেন। সঙ্গী তাঁর অক্ষয় সাহস আর হাতে-গোনা কয়েকজন অনুগামী। বিহারে হিন্দুরা তাঁদের আচরণ পরিবর্তন না করলে তিনি আমরণ অনশনের হুমকি দেন '৪৬-এর নভেম্বর মাসে। আর '৪৭ এর জানুয়ারি মাসে তিনি শুরু করেন তাঁর নোয়াখালি ভ্রমণ। দাঙ্গার শিকার নোয়াখালির সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের মনোবল জোগানো আর সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মন পরিবর্তনের জন্য এই তাঁর যাত্রা-সাত সপ্তাহের এই যাত্রায় ১১৬ মাইল তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। জল-কাদার মধ্য দিয়ে, ভাঙা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে, বিরুদ্ধ-ক্রুদ্ধ মানুষের ঘৃণা পেরিয়ে, সংশয়-অবিশ্বাস পেরিয়ে, মৃত্যুভয় পেরিয়ে খালিপায়ে তাঁর এই হাঁটা - এ হাঁটার তুলনীয় নজির পৃথিবীর মানুষ খুব বেশি একটা দেখে নি। তাঁর পথে ক্রুদ্ধ মুসলমানদের ছড়ানো ময়লা তিনি একবার নিজের হাতে পরিষ্কার করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে তাঁর যাত্রা শুরু হত রবীন্দ্রনাথের 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে' গান দিয়ে। সুমিত চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন - 'সেটি হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রিয় স্তোত্র।' শুরুতে কিছু প্রতিরোধ ছিল - সাংবাদিক শৈলেন চ্যাটার্জি লিখেছেন - মুসলমানরা তাঁকে বিশ্বাস করত না; পরে তারা বুঝতে শুরু করল - এই মানুষটি সাধারণ একজন মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু নয়, এ অন্য কিছু। লাইন দিয়ে মানুষ তাঁকে দেখতে আসত, তাঁর চলার পথে ভিড় করে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকত তারা - তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে পীড়িত মানুষজনকে সান্তনা দিতেন, প্রার্থনা করতেন, সম্প্রীতির কথা বলতেন। ... ...
১৯২০তে ভারতবাসী যে স্বরাজের ছবি দেখেছিল, তা ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা এবং তার ফলে গড়ে ওঠা আজকের রাষ্ট্রব্যবস্থার থেকে পৃথক ছিল। রাষ্ট্রের থেকে সমাজের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল স্বরাজের ধারণায়। ... ...
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন চর্চায় আমরা বারবারই এই প্রশ্ন তুলি, যে দেশভাগ কি এড়ানো যেত না ? তা কি অবশ্যম্ভাবী ছিল ? কীভাবে এড়ানো যেতে পারত দেশভাগ তার উত্তর দিতে গিয়ে নানাজনে নানা কথা বলেন। সম্প্রীতি উদ্যোগকে আন্তরিকভাবে দৃঢ় করার চেষ্টা থেকে ফেডারেল কাঠামোর কথা ভাবা – নানা প্রসঙ্গই সেখানে আসে। দেশভাগ যে দাঙ্গা, ভিটে ছেড়ে যন্ত্রণাযাত্রা আর উদ্বাস্তু জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত – তা আমাদের সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সিনেমা সহ নানা সাংস্কৃতিক পরিসরে উঠে এসেছে। আমরা এখন পড়তে চাইছি এরকম কিছু বইয়ের পাঠ, যা দেশভাগকে নানা দিক থেকে দেখেছে। ... ...
বইটি পড়তে পড়তে আচ্ছন্ন লাগে, প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত হই। একেবারে তরতরে সাহিত্যিক বাচনে গল্পচ্ছলে যেন লেখা হয়েছে বিবরণগুলি। ফলত ইতিহাস হয়ে উঠেছে জীবন্ত, সজীব, নড়ে চড়ে বেড়ানো। আমাদের পড়া যাবতীয় পুরনো সাহিত্যকর্ম, নানা গল্প উপন্যাসে যে বিন্দু বিন্দু পার্টিশন-যাপন, তার যাবতীয় ফাঁক-ফোকর পূর্ণ করার দায় নিয়ে এসেছে এই বই। এই বই আসলে চেয়েছে নিজের শর্তে কথা বলতে, নিজের মত করে চলতে চেয়েছে গদ্যের ভেতর দিয়ে। কোন নস্টালজিয়াকে প্রশ্রয় দেয়নি, একপেশে গল্পও বলতে চায়নি - যেখানে কোনও একটি ধর্মের মানুষই উৎপীড়িত...। এখানে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ এই তিন গোষ্ঠীর মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখের গল্প থেকে যায়। এই গল্পগুলো জুড়ে জুড়ে একটা ছিন্নভিন্ন সময় ও ছিন্ন জনজাতির কথা চলে আসে। একরকম শারীরিক বেদনাবোধ জাগে, ভেতরে ভেতরে ক্ষত বিক্ষত লাগে - কেননা আমার পরিবারও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উচ্ছিন্ন পরিবার। ... ...
"আমাদের দেশভাগ এক জটিল, বহুস্তরীয় ইতিহাস। বিভিন্ন ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথায় তার বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে। কোনও একটি লেখা তো তার সব কোণ ধরতে পারে না। তার উপর উদ্বাস্তু শব্দটা তো আর কোন সমসত্ত্ব গোষ্ঠীকে বোঝায় না। বিভিন্ন জাত-ধর্ম-লিঙ্গ-দেশ-কালের স্থিতির ভিত্তিতে একেক জনের দেশভাগের স্মৃতি একেক রকমের। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন লেখা জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় এক রক্তমাখা ইতিহাস। সেখানে হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, সাফল্য আর ব্যর্থতার কাহিনি। যে দেশভাগ মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণ বাঙালি পুরুষের কাছে ধন-মান-প্রাণ নিয়ে পলায়ন, এবং পরবর্তীকালে এক ধরণের স্মৃতিমেদুরতার জন্মদাতা, সেই একই দেশভাগ অন্য অনেক মেয়েদের ব্যক্তিগত যাতনার উৎসমুখ।" জ্যোতির্ময়ী দেবীর "এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা" আর গোপালচন্দ্র মৌলিকের "দেশভাগ ও ননীপিসিমার কথা" - পড়লেন স্বাতী রায়। ... ...
"উদ্বাস্তু কলোনি পত্তন ঘিরে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট, ডান-বাম রাজনৈতিক বিরোধ, দলাদলি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত কোঁদল, নেতাদের দাপট- দুর্নীতি- ধান্দাবাজি ছিল। কিন্তু সেটাই সমাজে নির্ধারক ছিল না। জমিদারের গুন্ডা-পুলিশের সঙ্গে যুঝে রাতপাহারার ফাঁকে জলজংলা, পতিত জমি দখল করে নয়া বসত পত্তন ও ভিটেমাটির বিলি-বন্দোবস্তের কালে নানা মতের পূর্বপুরুষদের যূথবদ্ধ অস্তিত্বের লড়াই এখন পুরাকথার সামিল।" উদ্বাস্তু কলোনির কথা : একটি স্মৃতিকথা সংকলন - বইটি নিয়ে লিখলেন বিশ্বজিৎ রায়। ... ...
"পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক মুসলিম পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে লেখক সুকৌশলে বুনে দিয়েছেন – সাতচল্লিশের আগের অখণ্ড ভারতের উত্থান-পতন, তদানীন্তন রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশগঠন ও সামাজিক অবক্ষয়ের আখ্যান। এ কাহিনীর নায়ক সময়। সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতি মিলেমিশে গেছে এ উপন্যাসে। একটি পরিবারের নানা ওঠাপড়ার ছবি আঁকতে আঁকতে গোটা একটি সমাজের উত্থান-পতনের চিত্র এঁকে দিয়েছেন কাহিনীকার। বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুঠাম গদ্য পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। লেখক আগাগোড়া উপন্যাসটিতে রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন।" হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ নিয়ে লিখলেন রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায়। ... ...
কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর এমনই এক অনুশীলক বলেই তাঁর হাতে জন্ম নেয় “উজানতলির উপকথা”-র মতো আদি-অন্তের সীমানা ছাড়ানো এক আশ্চর্য সৃষ্টি। দুই খণ্ডের এই উপন্যাসের প্রধান বিশেষত্ব হল এর বহুস্তরীয় প্রেক্ষাপট। দেশভাগের পরিণতিতে বাংলার দ্বিখণ্ডীকরণ যেমন এর এক প্রেক্ষাপট, তেমনি আবার অবিভক্ত বাংলায় – এবং ভাঙ্গা বাংলায়ও বটে – বাঙালি জনসম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য এর অন্য এক প্রেক্ষাপট, আবার জাতি ও ধর্মীয় বিভাজনের সঙ্গে আর্থিক শ্রেণিবিভাজনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এ কাহিনির তৃতীয়, এবং জটিলতর পৃষ্ঠভূমি। প্রেক্ষাপটের বিভিন্নতার বিপরীতে আছে সেই বিভিন্নতাগুলো নিয়ে নির্মিত ও এগিয়ে চলা এক বৃহত্তর মানব সংহতির উপাখ্যান। আলোচনা করলেন কুমার রাণা। ... ...
যাত্রা, চলচ্চিত্র সব ধ্বংস করে দিয়ে আমরা পরীমণির কাছে আশা রাখছি সে ছ্যাঁচোরের মতো দু চার পয়সা রোজগার করে কোনরকমে চেয়ে চিন্তে জীবন কাটিয়ে সতীত্বের পরকাষ্ঠা দেখাবে। সব দায় পরীমণির। যখন তার সামান্য চোখের ইশারায় সে বুভুক্ষু পুরুষকে বাগে নিতে পারে ,তুড়ি মেরে আয় করে নিতে পারে অঢেল অর্থ, বিলাসী জীবন। শরীরের বিনিময়ে যে অর্থ বিত্ত সহজলভ্য, তা গ্রহন না করে নিজেকে সতী সাধ্বী রাখার দায় কেবল পরীমণির। এর সব দোষও হয়তো পরীমণির। ... ...
মাইকে ঘোষণা হয়, অবরোধ উঠে গিয়েছে৷ পরবর্তী ডাউন ট্রেন ইছাপুর স্টেশন ছাড়ছে৷ ওই পথটুকু ঘড়ি ধরে আসলে, সোদপুরে সেই ট্রেনের পৌঁছতে আরও মিনিট কুড়ি৷ সময় যত গড়ায়, চোখের সামনে ভাসতে থাকে ট্রেনের চেনা ছবিটা — মালপত্রে উপচে পড়া ট্রাক, লরির মত - ট্রেনের ইঞ্জিন, ড্রাইভার-গার্ডের কামরার বাইরে, দরজার পাদানিতে, ভিড়ের গায়ে ভিড় লেপ্টে৷ মাঝে মধ্যে কানে আসে, সেই ট্রেন থেকেই আগে কোথাও রেলের পোস্টে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছেন কোনও যাত্রী৷ ট্রেনের ছাদও বাদ যায় না। সেখান থেকে মাঝেমধ্যেই ওভারহেড তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে টপাটপ মানুষ মরে। এই আছি, এই নেই - কী বিচিত্র জীবন। ... ...