আফগানরা স্বাধীনচেতা জাতি। ব্রিটিশরাও তাঁদের পুরোপুরি পদানত করতে পারেনি। তারা ব্রিটিশদের রক্ষাধীন ছিল, প্রটেক্টোরেট। গত চার দশকে মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই তাঁদের কব্জা করতে পারেনি। দেশটা জ্ঞাতি ও উপজাতি রেষারেষি ও দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। দেশের বিভিন্ন পকেটে, দুর্গম অঞ্চলে যুদ্ধবাজ সামন্তসর্দারদের সার্বিক আধিপত্য, যেখানে ধর্মের চেয়েও নিজের ক্ল্যান বা উপজাতির প্রতি আনুগত্যই ছিল প্রধান। আশির দশক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ানকে আটকানোর জন্য উগ্র ধর্মান্ধ সৌদি জঙ্গিদের মাধ্যমে আমেরিকানরা প্রথম এখানে ধর্মীয় মৌলবাদ রফতানি করে। আজকের তালিবানি উত্থান সেই নীতিরই বিষফল। এটা নিশ্চিত যে তালিবানিরা পালটাবে না। প্রতিদিন মধ্যযুগীয় বর্বরতার নতুন সব নমুনা প্রকাশ্যে আসছে। কিছু অসমসাহসী মহিলা এবং সামান্য কিছু জায়গায় সর্দারদের মিলিশিয়া প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। এটা চলবে, কারণ আফগানিস্তান এমন একটা দেশ যেখানে যুদ্ধ চিরন্তন। একটাই রাস্তা, আফগানদের তাঁদের নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া হোক। হয়তো তাতে আফগানিস্তান আগামী দিনে সৌদি আরবের মতো একটা ‘সভ্য’, ‘আধুনিক’ (যেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি পাওয়ার জন্য কয়েক দশক ধরে অপেক্ষা করতে হয়) মৌলবাদী দেশ হয়ে উঠতে পারবে। ইতিহাস বারবার শিক্ষা দিচ্ছে যে বহিরাগত শক্তি সেখানে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করলে শুধুমাত্র হিতে বিপরীতই হবে। ... ...
রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশন বলপূর্বক উচ্ছেদকে মানবাধিকারের উপর জঘন্যতম আঘাত বলে অভিহিত করেছে। জবরদস্তি উচ্ছেদ শুধু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদকেই লঙ্ঘন করে না, এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র, শিশু অধিকারের নীতি, নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যের অবসানের নীতি, জাতিগত বৈষম্যের অবসানের নীতিসহ একাধিক নীতিকেও লঙ্ঘন করে।.... – এমনই বিপন্ন সময়ে প্রায় অলক্ষ্যে হরিয়ানা সরকার অকথ্য অত্যাচারে উচ্ছেদ করল খোরিগাঁও-এর লক্ষাধিক গরিব মানুষকে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল – দরিদ্র মানুষের প্রতি দেশের শীর্ষ আদালতের চূড়ান্ত হৃদয়হীন এবং বৈষম্যমূলক আচরণ। জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে অল্পই জায়গা পেয়েছে এ হেন ব্যাপক রাষ্ট্রীয় উৎখাত। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক বৃত্তেও তেমন গুরুত্ব পায়নি প্রান্তবাসী বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর উপর ঘটে যাওয়া রাষ্ট্রের এই নৃশংসতা। ... ...
ভারত সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য এদেশের সমস্ত নাগরিককে সন্ত্রাস বিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে সুষ্ঠভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা। সেইসঙ্গে ভারতের সরকার ও বর্তমান শাসক দলের উচিত এই পরিপ্রেক্ষিতে সি এ এ আইনটিকে গভীরভাবে পুনর্বিবেচনা করা। এই আইন যখন মুসলিমদের শরণার্থী হিসেবে নাগরিকত্ব প্রার্থীর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল, তখনই এর প্রতিবাদ হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আফগানিস্তানের মুসলিমদের ভারত সহ বিভিন্ন দেশে তালিবানি সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে আশ্রয় ও পুনর্বাসন কতটা প্রয়োজন। তালিবানকে দেখিয়ে সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে নিশানা করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাও কোনও কোনও শিবির থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে। যদিও বাস্তবে যে বিশ্ব জনমত তালিবানি বর্বরতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, তার মধ্যে মুসলিম সমাজের মানুষজন রয়েছেন বিরাট সংখ্যায়। এই ঘৃণা বিদ্বেষের রাজনীতিকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করা দরকার। তালিবানি শাসনের প্রত্যাবর্তন দেখিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক তৈরির চরম ক্ষতিকর চেহারাটি কেমন হতে পারে। বিশ্বের যেখানেই আধুনিককালে রাষ্ট্র ও ধর্মের নৈকট্য সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে, সেখানেই গণতন্ত্র ও আধুনিকতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ধর্ম ও বিশ্বাসকে ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ রেখে রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনা কতটা দরকারি – বর্তমান আফগানিস্তান তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দিচ্ছে। ... ...
উনিশশ’ পাঁচে বঙ্গ-ভঙ্গ হয়েছিল। মামনুর রশিদের লেখা নাটক ‘ভঙ্গ বঙ্গ’। কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের সময়। বেনাপুল, হরিদাসপুরের কথা। স্মাগলার রাজা আর যৌনকর্মী মালিনীর কাহিনী। দেশভাগের সঙ্গেই এসেছে কাঁটাতার। বর্ডার। স্মাগলিং। মেয়েরা দেহব্যবসাতে নেমেছে। এই কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে, ঘুরে বেড়াতে চায় এক আশ্চর্য মানুষ। যদি নদীকে, বাতাসকে দু’ভাগ করা না যায়, যদি পাখি সব আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে, তবে মানুষ কেন পারে না? কেউ আটকাতে পারে না তাকে। সে চলে যায় সীমানা পার হয়ে। ইমিগ্রেশন আউট অব কন্ট্রোল। এইখানে যুক্ত হয় রক্তকরবীর রাজা, রঞ্জন, নন্দিনী। সেই আশ্চর্য মানুষ, নিয়মভাঙা মানুষ রক্তকরবী খুঁজছে। ... ...
একের বিপরীতে অন্য কাউকে দাঁড় করানো যে আমাদের শেষ পর্যন্ত ঠেলে দেয় ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইয়ের ঢাকা শহরে, ইলিয়াসের মতো সর্বদ্রষ্টা লেখক তা জানতেন। তিনি কেবল করেছেন সেই কাজটিই, যা করতে পারেন সৎ এবং মহৎ সাহিত্যিকেরাঃ ভাষাহীনকে ভাষা দেওয়া। কালাম মাঝি হোক, কি শরাফত মণ্ডল; কম্যুনিস্ট পার্টির ছোকরারা হোক কিংবা মুসলিম লীগের চ্যালারা; ইলিয়াস ব্যাক্তির ওপর কোনো সত্য আরোপ করেননি। তিনি কেবল সমষ্টির মাঝে ব্যক্তির আকাঙ্খার সাথে সমাজের বৈষম্যের পার্থক্যটাই এঁকে গেছেন। লেখার টেবিলকে ইলিয়াস পল্টনের ময়দান করে তোলেননি। ফলে, উদ্দিষ্ট এই উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের এন্টি-থিসিস; এমন কথা যে ইদানিং শুনতে পাই, সাহিত্যের পাঠক হিসেবে তখন আহত না হয়ে আর উপায় থাকে না। ... ...
৭৫ বছরে কিছু পাল্টায়নি, কারণ আমাদের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো অনড় হয়ে আছে ঘৃণার পাহাড়। পাল্টাতে হলে সেটাকে সরাতে হবে। দাঙ্গার আগুন আর রক্ত সত্য, সত্য মানুষের নিষ্ঠুরতা। কিন্তু তাকে পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো 'তবু', যেগুলোর কাছে যাওয়া খুব কঠিন কাজ। কিন্তু এমন মানুষ তো বিরল নন, যারা দাঙ্গায় সর্বস্ব খুইয়েছেন, কিন্তু তবু সাম্প্রদায়িকতাকে মনে স্থান দেননি। এখনই মনে পড়ছে সদ্য প্রয়াতা সীমা দাসের কথা যাঁর আত্মজৈবনিক "দ্যাশ থেকে দেশে" বইটি প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল। মিহির সেনগুপ্তের সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, অমর মিত্রের দেশভাগ-বেদনার উত্তরাধিকার পড়লেই বোঝা যায় উভয় পক্ষেরই দাঙ্গা-উত্তর মানসিকতা কী হওয়া উচিত। এই আগুন ও রক্ত আর ঐ 'তবু'র মধ্যে নিরন্তর দোল খায় যে পেন্ডুলাম তার নাম মানুষের মন। যখন সে থামে, দেখা যায় তা নিশ্চিত হেলে আছে 'তবু'-র দিকেই। ... ...
হায়দারের উপন্যাসের পাঠক-মাত্রেই জানেন, অজস্র চরিত্র ও দ্রুতগামী ঘটনাক্রমের সাথে তাল রাখতে গেলে পাঠককে সদা সতর্ক থাকতে হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, তাদের সামাজিক অবস্থা, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরগুলির মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া – এমন অনায়াস বয়ানে বুনে চলেন, যেন এক মহানদী – যাতে এসে মিশছে শাখানদীরা, বেরিয়ে যাচ্ছে উপনদীরা, আবার ঘুরে এসে হয়ত মিশছে মূল নদীতে। এই বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক স্তরের চরিত্রগুলো এত নিখুঁত বিস্তারিত – তাদের প্রায় রক্ত-মাংসের মানুষের মতই অনুভব করা যায়। এই উপন্যাসে রসবোধ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। এক প্যারাগ্রাফ পড়ে হেসে ফেলতে না ফেলতেই, পরের প্যারাগ্রাফ প্রায় বিধ্বস্ত করে দেয়। অথচ কোথাও একটুও তাল কাটে না, একটুও আরোপিত মনে হয় না। ... ...
সূর্য দীঘল বাড়ি। যে আয়তাকার বাড়ির দুই সমান্তরাল দীর্ঘ বাহু পূব থেকে পশ্চিমে টানা। এই ধরণের বাড়িতে থাকে স্থায়ী অমঙ্গলের ছায়া। এখানে কেউ বেশিদিন টিকতে পারে না, নইলে নির্বংশ হয়। এইখানটায় এসে আমি থমকে যাই। জীবনে একটাই বাড়ি বানিয়েছিলাম – আরে সেটাও তো ছিল এক সূর্য দীঘল বাড়ি! সে বাড়িতে কতদিন ছিলাম? মাত্র দশ বছর। আমার পেছনের আরেক সূর্য দীঘল বাড়িতে দুই ছেলে মারা যাওয়ায় বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। কেনে আমার পরিচিত এক উদীয়মান কবি। একবছরের মধ্যে মারা যায় রক্তবমি হয়ে। তবে কী - ! ... ...
বাষট্টি অধ্যায়-বিশিষ্ট ৩৩৬ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির পট উত্তোলিত হয় বীরাঙ্গনা দাসীর প্রসঙ্গায়নে। বীরাঙ্গনা নামটি আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় মাইকেল সৃষ্ট বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুন্তলা, তারা, রুক্মিণী, কেকয়ী, সূর্পনখা, দ্রৌপদী, ভানুমতি, দুঃশলা, জাহ্নবী, উর্বশী, জনাকে। এই বীরাঙ্গনা ওপার থেকে এপারে এসেছে, পুত্র বা কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল; কিন্তু কলকাতা, বসিরহাট, অনায়াস যাতায়াত করেছে। তার নিরন্তর পথিক বৃত্তি, সবাইকে হাস্যমুখ করানাের চেষ্টা বিস্মিত করে। কিন্তু সাদা থান, সেমিজ, বগলে পুঁটলি নিয়ে প্রৌঢ়া কপােতাক্ষ স্বপ্নে বিভাের, মধুসূদনের রচনা, মধুজীবনী সে লােকজনকে শুনিয়ে বেড়ায়, মধুজীবন ও রচনা পাঠে বালক বৃদ্ধ সকলকে উৎসাহ জোগায়। তার এই নিরন্তর মাইকেলচর্চা নিজের ও অন্যের দুঃখ ভােলায়। ইনি নাকি মাইকেলের দৌহিত্রী, সবার কাছে মাইকেল দিদিমা। আর অসম্পৃক্ত পাঠকের কাছে বীরাঙ্গনা মাইকেল প্রসঙ্গের চারণ কবি, ফরাসী এবাদুরদের মতােই। পুত্র কোর্টের মুহুরি, মেয়ের শ্বশুর বাড়ি দিল্লিতে। পথপরিক্রমা জীবনেরই, বুড়ি বীরাঙ্গনাকে মাইকেল উদ্বুদ্ধ করে, কপােতাক্ষ তাকে দেয় স্নেহ ও বিষাদ। তবে বিরলে ছাড়া এ অনুভব জাগে না। নিরন্তর তার চোখ ছলছল করে - "কেমনে ফিরিব—হায়রে কে কবে মােরে, ফিরিব কেমনে শূন্য লঙ্কাধামে আর।' বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ-দুটোই শূন্য হয়ে গেছে তার মতে। দিদিমা অভিরামের বেলগাছিয়ার বাড়িতে প্রায়ই এসে ওঠে, যেন আপনজন। হাবুলের পাকিস্তান মানি না জেহাদ বুড়ি মানে না। চারপাশের লোককে সময়ে অসময়ে সে মধুজীবন, মধু রচনা শোনায়। ... ...
বিত্তহীন একটি পরিবারের সবচেয়ে বড় বিত্ত হল আবেগ। কাঁধ-উঁচো থালাখান, ছিক্ষেত্তরের বাটিখান, তেঁতুলের আচারের ঠিলেডা বা পুরনো একটু ঘি --সবকিছু বস্তায় ভরে নিয়ে গেলেও, ওদের মন-মগজে স্মৃতি জট পাকিয়ে রয়। কী যেন ফেলে যাচ্ছে! পুরুষ-পুরুষের পায়ের ছাপ পড়ে আছে যে বাড়ির আনাচেকানাচে, তার ধুলোটুকুও যেন আগল হয়ে সামনে দাঁড়ায়।....গল্প এগোয়। এগোয় কুঁড়োরামের পরিবার। ... ...
আমার কাছে আসে তো টাকা বদলে ডলার নিতে। কার কাছে কী টাকা দেখলেই সব বুঝি। কান এঁটো করে একচোট হাসল ডক্টর। রেখেও যায় ওদের টাকা, আমি ওদের হয়ে সুদে খাটাই। এবার লোকটার আসল ব্যবসাটা বোঝা গেল। গোবিন্দর আরো শোনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আক্রাম আলি পেছন থেকে খালি গুঁতাচ্ছিল। অবশ্য কথায় কথায় দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেক। ওরা বেরোচ্ছিল, লোকটা পিছন থেকে ডাকল। শোন, শোন। যে পথে যাচ্ছো সেখানে পাউন্ডে দিলে ঘাঁটা পড়ে যাবে তোমাদের। তার চাইতে আমার এখানে ডলার বানিয়ে নিয়ে যাও। কথাটা সত্যি। লোকটার কাছ থেকে পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে দশ দশ ডলার হাতে নিয়ে বেরোল দুজনে। বোঝা গেল এটা লোকটার সাইড ব্যবসা। কিংবা এটাই আসল, দোকান খুলে রেখেছে শুধু লোক টানার জন্য। ডক্টর লোকটা বেরোবার আগে আর একবার মনে করিয়ে দিল জাহাজ থেকে পালালে তাদের জীবনটা কেমন বেবাক ভাল হয়ে যেতে পারে। আক্রাম দাঁড়িয়ে থেকে দোকানির কথা শুনতে না চাইলেও, রাস্তায় বেরিয়ে সেই কথা তুলল আবার। জুইতোর কথা কইছে গোবিনদা, জায়াজো আর না গেলে কিতা ওয়? কথা কইবার বেলা খুব সওজ রে, অতো সুজা বিষয় নায় মনো রাখিস; যুদি একবার পুলিশোর আ'তো পড়স, তে কিতা অইবো? কেনে, তুমরার ক্লাবার সাব কিতার লাগি? তান আ'তো রেজগি ধরাই দিলেই অইবো। ওয়, তুমরার ওউ ক্লাবার সাব অখনও টিকিয়া আছে নি দেখ, মরিয়া মাটির মিশি গেছে! বাপ নাই তে কিতা অইছে, পুয়া ভাতিজা তো বেটার আছে; তারার চলাফিরাত কুনু উঁচনিচ দেখছো নি কুনু দিন? ... ...
২০১৯ - আমার দেখা প্রথম রমজানে ফুড ডিস্ট্রিবিউশনে বিএমডাব্লিউ, অডি, মার্সেডিজ চড়ে লোক আসছে ডোনেশন নিতে। যেমন পোশাকের জৌলুস, তেমন গয়না। মহিলারা সবাই বোরখা আর হিজাব। শরীরের যতটুকু দেখা যায় দামিদামি মণি-মুক্তো-হিরে। চড়া মেকআপ। আপাদমস্তক ব্র্যান্ডেড। তখনো রোহিঙ্গা ক্লায়েন্ট আমি দেখিনি। আমার জ্ঞানের পরিধি যতটা জানে রিফিউজি শব্দকে - তাকে গরিব হতে হবে। আমার রিফিউজি কলিগ আর এই ডোনেশন নিতে আসা মানুষদের সাথে ঐ সংজ্ঞার কোন মিল নেই। রোহিঙ্গা ক্লায়েন্টরা ওদের ধারেকাছে আসতে পারবে না। আফগানি, ইরানি ক্লায়েন্টের বাড়ি ঢুকলে সুন্দর গন্ধ। দারুন সব চায়ের সেট। অসাধারণ চা, পেস্তা, বাদাম, বিরিয়ানি, ফিরনি। রোহিঙ্গা ক্লায়েন্টের বাড়ি জুতোর জঙ্গলের পাশে রান্না, দুর্গন্ধ ভরা ঘর। দম বন্ধ হয়ে আসে। জুতোর পাশে বসি। পানের পিকের পাশে বসি। নিজেও পান খাই। ... ...
কী খবর, কেমন আছিস, মাসিমার কী খবর, মেসোমশাই ভালো আছেন, ইত্যাদি কথাগুলি সবার কাছেই কেমন বহুকাল না শোনা ঠেকল। অথচ, এই তো সেদিনের কথা, পাড়ায় কারও বিয়ে হলে নতুন বউ কিংবা বরকে দেখতে প্রতিবেশীরা রাস্তায় এসে দাঁড়াতেন। পাড়ার কেউ গত হলেও দেখা যেত একই দৃশ্য। শেষ যাত্রা চাক্ষুষ করতে গোটা পাড়া যে যার বাড়ির গেটে এসে দাঁড়াত। মাঝরাত কিংবা ভোররাতে দেহ শ্মশানের যাবে শুনে অনেকে একে তাঁকে অনুরোধ করতেন, ‘যাওয়ার সময় আমারে একটু ডেকে দিও।’ কেউ কেউ জানালার ধারে বসে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন শেষ যাত্রার সাক্ষী থাকবেন বলে। তার আগে চলত মৃতের স্মৃতিচারণা। সব কিছু যে কবে বদলে গেল তারও কি খবর রেখেছি আমরা? ... ...
খাজা মণ্ডলের কাজ শুরু হয়েছিল সৌদির রিয়াদ শহরে। দত্তফুলিয়ার অফিস-ঘরে এই কার্পেন্টারের ইন্টারভিউতে দালাল কী কী প্রশ্ন করেছিল জানিনা, তবে উঁচু উঁচু বিল্ডিঙের আলো-ঝলমলে রাজধানী শহরে গিয়ে খাজার প্রথম কাজটা ছিল আন্ডার-কন্সট্রাকশন বিল্ডিঙের পিলারে, ছাতে, তক্তায় পেরেক ঠোকা। ঢালাই হবে তারপর। সৌদি আরবের সব থেকে বড় শহরের এদিক-সেদিক গিয়ে গিয়ে চলেছে কাজ। মধ্যভাগের মালভূমির উপর বিশাল বিশাল বিল্ডিং-এর পাশে আরও সব বিশাল বিশাল বিল্ডিং উঠছে। মুসলিম পাড়ার মাটির বাড়ির খাজা মণ্ডলের পায়ের তলায় তখন কেবল বালি। দিনের শেষে সেলাই করা প্যান্টের ভাঁজে ভাঁজে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে, বুক-পকেটে বালি আর বালি। বালি খুঁড়ে মজবুত ভাবে উঠতে লাগল পিলারের উপর পিলার। ওই শীর্ণকায় শর্ট-হাইটের খাজা মণ্ডল বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগল উঁচু উঁচু বিল্ডিঙের বাইরে দিয়ে। কখনও সেফটি-বেল্ট বেঁধে। কখনও সব আয়োজন ছাড়াই নিজের হাত পায়ের ভরসায়। নানা সাইজের পেরেকে হাতুড়ি পেটা করলেও ঘাম বেরোয় না শরীর বেয়ে। ছোটবেলা থেকে মাঠেঘাটে কাজ করে বেড়ালেও – এমন চড়া রোদ, এমন জ্বলুনি ধরানো তাপ গায়ে লাগেনি কখনও। ঝাঁঝালো শুকনো রোদে পুড়তে থাকল খাজা মণ্ডলের চামড়া। মাসের শেষের বেতন মাসের শেষে দেওয়া বন্ধ হ’ল। ছ’মাসের বেতন বাকি রেখে হাতে দিল বাকি কয়েক মাসের বেতন। নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল – কখনওই পুরো বেতন দেবেনা একসঙ্গে। খরচির হিসেব কড়ায় গণ্ডায় রাখল কন্ট্রাক্টর। দু’বছর-আড়াই বছর পর, বাড়ি ফেরার সময় হলে, মালিক কিছু ডিরহাম সেরকমই রেখে, দিত বাকি। কিছু দিত হাতে। কন্ট্রাক্টর বলত, আবার আসবি – তখন পাবি। এভাবে বিদেশের মালিকের কাছে পাওনা বাকি রেখে খাজা মণ্ডল সাত বছরে বাড়ি আসে দু’বার। ... ...
সুতরাং আমরা এই লেখায় অন্তত কয়েকজন এমন ক্রীড়াবিদের নাম লিখে রাখি যাঁদের কথা শোনা যাচ্ছেনা। ধরা যাক দীক্ষা ডগরের কথা। গল্ফে অদিতি অশোকের পাশাপাশি ইনিও ফাইনাল রাউন্ডে খেলছিলেন। গল্ফেই উদয়ন মানে, অনির্বাণ লাহিড়ী পুরুষদের ইভেন্টে ছিলেন। ২০ কিমি রেসওয়াক ইভেন্টে ফাইনাল রাউন্ডে ছিলেন সন্দীপ কুমার, রাহুল রোহিলা, ইরফান থোরি (পুরুষ ), প্রিয়াংকা গোস্বামী এবং ভাবনা জাট (মহিলা )। মহিলাদের ডিসকাস থ্রো তে কমলপ্রীত ক'র । রোইং এ অর্জুন লাল এবং অরভিন্দ সিং। সেইলিং এ পুরুষদের ইভেন্টে বিষ্ঞু সার্ভানন, কে সি গণপতি, বরুণ ঠক্কর, এবং মহিলাদের ইভেন্টে নেত্রা কুমানন। শুটিং এ সৌরভ চৌধুরি। কুস্তির দীপক পুনিয়ার কথা আমরা তাও একটু আধটু শুনতে পেয়েছি, পঞ্চম স্থানে শেষ করায়। হাতে গোনা যে কয়েকজনের নাম এখানে লেখা হলো, এঁরা সবাই স্ব স্ব বিভাগে ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছিলেন। এর বাইরে রয়ে গেলেন বহু ক্রীড়াবিদ, যাঁদের অনেকের নাম আর কোনদিনই প্রচারের আলো পাবেনা। প্রসঙ্গত ভারত এবার মোট ১২০ জনের দল পাঠিয়েছিলো, দেশের ইতিহাসে এর থেকে বেশি খেলোয়াড় আগে কখনো অলিম্পিকে অংশ নেন নি। ... ...
জীবনে কষ্ট তো কম করেনি সম্ভৃতা। সেই অতটুকু বয়েসে যখন সোমেশ্বরের সাথে সংসার শুরু করেছিলো নন্দী স্ট্রীটের এক কামরার ফ্ল্যাটে, কীই বা জানতো সংসারের ! তারপর এ শহর ও শহর ছোটবড়ো নানান রকমের আস্তানা আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা পেরিয়ে, অভিজাত কর্পোরেট আবাসন এয়ারকণ্ডিশন্ড্ গাড়ি আর আনুসঙ্গিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে আসা জীবন ছেড়ে, এক কথায় আবার কলকাতায় ফিরে প্রায় শূন্য থেকে শুরু ! চাকরি করবে না আর সোমেশ্বর ! পলায়নরত মূলধনের ক্ষয়িষ্ণু কলকাতা শহরেই সে পেশার শেষ পনের-ষোল বছর বিপণন পরামর্শদাতার কাজ করলো ! ... ...
ইন্দ্রনীলের স্কুলের বন্ধু গাই বিরনবাউম থাকতো ওয়েস্ট হ্যাম্পষ্টেডে। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের অসম্ভব নৈকট্য গড়ে ওঠে। অনেক সাবাথের সন্ধ্যা কাটিয়েছি তাদের সঙ্গে। বাংলায় আমরা যাকে ভুরি ভোজ বলি সেটা শুক্রবার ইহুদি সাবাথের সান্ধ্য ভোজনের তুলনায় জলখাবার মাত্তর! গাইয়ের মা বিরশেবাকে বলতাম শনিবারের দিনটায় কাজ কর্ম কেন যে মোজেস বারণ করে গেছেন এবারে বুঝলাম। আগের দিনের সেই বৃহৎ ভোজন উৎসবের পরে শনিবার শরীরকে ব্যস্ত না করাই ভালো! ... ...
আমাদের শুরুতেই দেখতে হবে, মেডেলের আশা আমাদের ঠিক কোন কোন খেলাগুলিতে ছিল। আসলে অলিম্পিক স্পোর্টসগুলি সম্পর্কে আমাদের ধারণা এতটাই কম থাকে, যে চার বছর ধরে খবরের কাগজের পাতায় তাদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়, উন্মাদনার কথা ছেড়েই দিলাম। অধিকাংশ ক্রীড়ামোদীই জানেন না – কোন খেলায় কে অলিম্পিকের যোগ্যতা মান পেরোচ্ছেন এবং কারা কারা অংশ নিচ্ছেন। এটা তো আর শুধুমাত্র ক্রিকেটকে আর মিডিয়াকে দোষারোপ করে কাটিয়ে দিলে চলে না। পাবলিক যা খায় মিডিয়া তাই-ই খাওয়ায়। আমরা এই পর্বে দেখে নেব, কারা কারা পদক পাবার সম্ভাবনা নিয়ে টোকিও গিয়েছিলেন। এবং তারপর একে একে ভিন্ন ভিন্ন খেলায় আমাদের পারফরম্যান্সের বিচার করার চেষ্টা করব, প্রস্তুতি সহ। ... ...
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’।এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে উন্যাময়েজি অঞ্চল, যেখানে বর্তমান টাবোরা শহর, তার কাছে রুবুগা নামের জনপদে পৌঁছনর কথা। তরজমা স্বাতী রায় ... ...
ছেলেটা অর্ডার নিতে এলে – পিৎজা এদের স্পেশালিটি কিনা জিজ্ঞেস করলে, হ্যাঁ বলল। আমার কি মনে হল - এও না সেই অন্য রেষ্টুরান্টের মত পিৎজার ইতিহাস ব্যাখ্যা করা শুরু করে! তাই সে-ই কিছু বলার আগেই আমি বললাম – আমি জানি পিৎজা বলে আধুনিক কালে আমরা যে জিনিসটিকে চিনি তার জন্ম হয় ১৮৮৯ সালে ইতালির নেপলস্-এ। একসময়ে নেপলস্-এর বাজারে যা পরিচিত ছিল ‘পিৎজা আলা মোজারেল্লা’ নামে, সেই পিৎজা খেয়েই রাণী মার্গারিটা কুপোকাত – বিশাল ভালোবেসে ফেলে ডিক্লেয়ার করে দিলেন, যে এটাই তাঁর সবথেকে প্রিয় পিৎজা। ব্যাস, সেই থেকে এই পিৎজার নাম হয়ে গেল ‘পিৎজা মার্গারিটা’ সেই ওয়েটার দেখি আমার কান্ড দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে – ... ...