প্লেন একটু একটু করে রাতের আকাশে উঠল। আজ পূর্ণিমা। রাত্রি আটটার ধূসর কমলা রঙের একথালা চাঁদ আকাশে! তলায় দেখতে পেল, সমুদ্রের পাড় দেখা যাচ্ছে, আর আলো-অন্ধকারের বিন্যাসটা দেখে ব্যাকওয়াটারের অস্তিত্বটাও বোঝা যাচ্ছে। সমুদ্র আর ব্যাকওয়াটারের মাঝে কত কত গ্রাম। কোনও একটা গ্রাম হয়তো কুজিপল্লি। তলার কোনও একটা বিচে শুয়ে আছে সে আর সারথি! বালির মধ্যে থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে কুড়িয়ে সে মালা গাঁথছে একের পর এক, আর পড়িয়ে দিচ্ছে সারথির বুকের উপর। পূর্ণিমার চাঁদে জল চকচক করছে, সেই জলে ওরা ভেসে বেড়াচ্ছে – না, শান্ত তুঙ্গভদ্রা নদীর কোরাকল ভেলা নয়, দোল খাওয়া সমুদ্রের মাঝে মেছো নৌকায়। প্রতিবারই সারথি তার হাতে একটা জিনিস তুলে দেয়, কল্পনার রসদ, নতুন নতুন কল্পনার রসদ। কল্পনা কল্পনাই, কল্পনা সারথির মতনই মিথ্যা বলে, কল্পনা সারথির মতনই মন ভোলানো গল্প বলে, কল্পনাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে! ... ...
আমার পাশে যে বসে ছিল তাকে বললাম, “এ তো গামা গাছের ডগাগুলো কেটে দিয়ে গেছে মনে হচ্ছে! সাদা প্লেটে চিজ ছড়িয়ে দিলেই কি গরুর খাবার মানুষের হয়ে যায় নাকি!” পাশের জন বলল “হোয়াট ইজ গামা?” তাকে অনেক কষ্টে আমার বিখ্যাত ইংরাজিতে বোঝালাম, যে এর সাথে ভাস্কো-দা-গামা-র কোন সম্পর্ক নেই। বাড়ির গরুতে খাওয়ার জন্য আমরা জমিতে গামা (বাংলায় অনেক জায়গায় একে গমা বা গ্যামা বলা হয়) চাষ করতাম। এমনি সবুজ লকলকে ডাঁটির মত গাছ জমি থেকে কেটে এনে বাড়িতে খড় কাটার বঁটিতে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কুচাও। আমাকে বলা হল এগুলোকে নাকি ‘অ্যাসপারাগস’ বলে! গামা গাছের ডাঁটির বিজ্ঞান সম্মত নাম যে অ্যাসপারাগস, সেটা কে আর জানত! ... ...
কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি যে সাদা মানুষেরা এখানকার লোকদের 'মুলুঙ্গু' বা আকাশের দেবতার ভাষা শেখাচ্ছে, তাদের কিভাবে ফসল বপন করতে হয় বা ফসল কাটতে হয় বা বাড়ি বানাতে হয় তা শেখাচ্ছে , শেখাচ্ছে কিভাবে আরও স্বচ্ছন্দে থাকা যায়— মোদ্দা কথা, তাদের সভ্য করে তুলছে। আর পুরোন কাদেতমারের লোকরা সেই দেখে খুশিতে হাত ঘষছে। তবে কিনা সফল হতে গেলে, একজন নাবিককে যেমন দড়িদড়া সামলানো, পাল গোটানো থেকে হাল ধরা অবধি নৌকা চালানোর সব গুণই রপ্ত করতে হয়, মিশনারিকেও তেমন নিজের সব কাজেই পটু হবে। নরম-সরম মেয়েলি মানুষ হলে চলবে না, জার্নাল-লিখিয়ে বা ঝগড়ুটে তার্কিকও চলবে না, রেশমী-পোশাক-প্রিয় পাদ্রী হলেও হবে না— প্রভুর বাগানের একজন উদ্যমী পুরোদস্তুর শ্রমিক হতে হবে তাঁকে – যেন ডেভিড লিভিংস্টোন বা রবার্ট মোফ্যাটের ছাঁচে গড়া। ... ...
ঠাকুমা আর মানিক কাকুর কথার মাঝেই আমি দেবদারু বাগানের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। হাতে গামছায় বাঁধা খাবার আর গায়ে চাদর জড়িয়ে সাদা কুয়াশার ভেতর ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে তাঁতিরা। সেই ছায়া থেকে আমি খুঁজে খুঁজে বের করি কলিম তাঁতি, মকবুল তাঁতি, পরেশ তাঁতি, নিবারণ তাঁতি, মান্নান ড্রাম মাস্টার সবাইকে। আজ অন্যদিনের মতো এগিয়ে গিয়ে আমি ওদের সাথে গল্প জুড়ি না। আমি পা বাড়াই গোলেনূর দাদির বাড়ির দিকে। সে বাড়ির উঠোনে এখনো নিঃস্তব্ধতা। শুধু গোলেনূর দাদির বড়ঘরের টিনের বেড়ায় ঝুলানো কবুতরের খোপ থেকে ভেসে আসছে ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ... ...
পরমাণু বিদ্যুৎশিল্পের এখন হতচকিত অবস্থা। চিন, ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশে যে পরমাণু বিদ্যুতের প্রসার নিয়ে কথা হয় তার আসল কারণ এইসব দেশ হয় পরমাণু অস্ত্রধারী, অথবা তা হতে চায় .... তেজস্ক্রিয় বিকিরণের বিপদ, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা, তেজস্ক্রিয় বর্জ্যপদার্থের সমস্যা, চুল্লির ডিকমিশনিং নিয়ে রাষ্ট্রের দুশ্চিন্তা তেমন নেই। এসব দুশ্চিন্তা প্রতিবাদীদের এবং তার জন্য পরমাণু রাষ্ট্রের মত বদল হয় না। খরচ বেশি, প্রযুক্তিগত প্রতিকূলতা বেশি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি সস্তা – এই তিন কারণেই পরমাণু বিদ্যুতের প্রসার বন্ধ হয়ে গেছে .... বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার প্রায় কিছুই কমেনি .... অন্য বছরের মত এ বছরও বিশ্বে ঘন ঘন তাপপ্রবাহ,ঝড়, বন্যা, দাবানল ও অন্য্যান্য বিপর্যয় ঘটেই চলেছে। এ বছর জার্মানি ও বেলজিয়ামের বন্যায় দুশ’র বেশি মানুষ মারা গেছে – যা কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না। ... ...
এই মদ্যপান নিয়ে বাঙালির নৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস বড় পুরাতন। মূলধারার সাথে অস্ফুট লোকাচারের পার্থক্য তো ছিলই; কিন্তু মূল সুর ছিল সহাবস্থানের। কথিত আছে, একবার শাক্ত সাধক কমলাকান্তকে মদ্যপান করতে দেখলে, বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র তিরস্কার করেন। প্রত্যুত্তরে মাতৃভক্ত কমলাকান্ত মদ্যকে দুগ্ধে পরিণত করে সেই দুধে দেবীপ্রতিমার পূজা করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতিভূ তেজচন্দ্রের কাছে যা অনৈতিক, সাধক কমলাকান্তের কাছে তা নয়। ভারতীয় লোকাচারের ঊর্ধ্বে থাকা সাধক সামাজিক নিয়মনীতির অধীন নন। কমলাকান্তের মতই, সাধক রামপ্রসাদও মদ্যপান করতেন। পণ্ডিতসমাজের প্রধান কুমারহট্ট এ নিয়ে তাঁকে তিরস্কার করলে, রামপ্রসাদ বলতেন, “সুরাপান করিনা আমি / সুধা খাই জয় কালী বলে”। কিন্তু সব প্রেমিক যেমন দেবদাস নয়, সকল মদ্যপই রামপ্রসাদ নয়। শাক্তমতে গুহ্যসাধন-ক্রিয়ায় মদ্যপানের যে রীতি, তা প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ না হওয়াটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘প্রাত্যহিক জীবন’ তো কোন সমসত্ত্ব ধারণা নয়, বরং তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন। একদিকে প্রাক-ঔপনিবেশিক বঙ্গীয় উচ্চবর্গ যেমন পারতপক্ষে মদ্যপান এড়িয়ে চলেছে, মঙ্গলকাব্যের অন্ত্যজ শ্রেণি অবশ্য শুঁড়িখানায় ক্রমাগত ভিড় জমিয়ে গেছে। তাই মদের বিচারেই বাঙালি অনেক আগেই ‘আমরা-ওরা’-র ব্যবধান তৈরি করে ফেলেছে। ... ...
একটি ক্লাস সেরে টিচার্স রুমে ঢুকে দেখি টেবিলের ওপর বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন। জানা গেল ছাত্রছাত্রীদের থেকে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। একজন দিদিমনি সেই মোবাইলগুলি ঘাঁটছেন আর প্রবল আক্রোশে গজগজ করছেন। দিদিমনি যারপরনাই সুন্দরী, রূপসজ্জা-পটিয়সী, নানা আছিলায় সেলফি তোলা আর ফেসবুকে পোস্ট করা তার সর্বক্ষণের বিলাসিতা। ছেলেরা ফেসবুক থেকে তার প্রোফাইল থাকা ছবিগুলো ডাউনলোড করেছে দেদার। জানতে চাইলাম, মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে – ভাল কথা, তাই বলে তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ঘাঁটা হবে কেন? দিদিমনি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘ওরা ফেসবুক থেকে আমার প্রোফাইল পিকচার নামিয়েছে’। ... ...
অন্য সবাই বসার ঘরে গল্পে ব্যস্ত, তিনি এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে খিড়কির দরজার দিকে গিয়ে দেখেন বেশ কজন অঙ্গনওয়াড়ি মহিলাকর্মী বসে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। জানা গেল দুইমাস ভাতা পান নি, উপরন্তু আজকের খাওয়া দাওয়া হয়েছে তাঁদেরই থেকে সংগ্রহ করা চাঁদার টাকায়। লজ্জায় দুঃখে কোনমতে নিজের ব্যাগে যেটুকু যা টাকা ছিল বের করে ভাগ করে দেন ওঁদের মধ্যে। পরবর্তীতে অবসর নেওয়া পর্যন্ত আতিথেয়তার ভার নিজেই বহন করেছেন, আর কখনো চাঁদা সংগ্রহ করতে দেন নি মিটিঙের নামে। সেই আই এ এস অফিসার, প্রখ্যাত লেখক ও দক্ষ প্রশাসক অনিতা অগ্নিহোত্রী, পড়ছিলাম তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিকথা ‘রোদ বাতাসের পথ’। ... ...
বিদ্যাসাগর ও রামমোহনকে কোম্পানি তথা বৃটিশের ঘৃণ্য দালাল হিসেবে থিসিস দাঁড় করাতে গিয়ে গোটা বইটিতে বারবার ধ্রুবপদের মত উঠে এসেছে একটি কথাঃ হিন্দু সমাজে সম্পত্তির অধিকার/ভাগ / বাঁটোয়ারার ব্যাপারে বাংলায় প্রচলিত ছিল পন্ডিত জীমুতবাহনের ‘দায়ভাগ’ পদ্ধতি আর বাকি ভারতে ছিল পরাশর সংহিতার উপর বিহারের বিজ্ঞানেশ্বর প্রণীত টীকা ‘মিতাক্ষরা’। মিতাক্ষরায় বিধবাদের সম্পত্তির অধিকার ছিল না। ‘দায়ভাগে’ ছিল। (?) অর্থাৎ বঙ্গদেশে বিধবারা মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। হ্যালহেডের জেন্টু ল’ এবং পরবর্তী হিন্দু ল’ মুড়িমিছরির এক দর করে বঙ্গের বিধবাদের স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করল। বিধবাবিবাহ আইনে বিদ্যাসাগর সেই ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে এই ব্যাপারটায় মোহর লাগিয়ে দিলেন। তাই বিধবাবিবাহ ইত্যাদি নিয়ে বিদ্যাসাগরের নারীদরদী ভূমিকা নিয়ে যাও বলা হয় সব দুষ্প্রচার। আসলে উনি নারীহিতৈষী নন, ঔপনিবেশিক এজেন্ডার দাস মাত্র। ... ...
বাস্তবিক, কুড়ি বছর আগে, ২০০১ সালে আমেরিকা ও যৌথবাহিনী যখন তালিবান ও আল-কায়দাকে ধ্বংস করতে আফগানিস্তান অভিযান চালিয়েছিল, তারা এমন একটি ভাব করেছিল যেন শুধুমাত্র তালিবানদের উৎখাত করাই নয়, ‘রক্ষণশীল’ আফগান সমাজের আধুনিকীকরণ এবং সেখানকার নারীদের রাতারাতি পশ্চিমী নারীতে পরিণত করাই তাদের অগ্রাধিকার। সেই সঙ্গে একটি মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি পশ্চিমী ধাঁচের উদার গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে শান্তি ও প্রগতির পতাকা তুলে ধরাও ছিল তাদের প্রতিশ্রুতির তালিকায়। কিন্তু গত দুই দশকে যে-সব ছবি উঠে এসেছে, তাতে এ-কথা আজ স্পষ্ট যে, শান্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা উন্নয়ন কোনটাই তাদের লক্ষ্য ছিল না। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরে পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে, রাশিয়া, চীন ও ইরান— মার্কিন সাম্রাজ্যের প্রতিস্পর্ধী এই দেশগুলির চারপাশে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি তৈরি করাই ছিল আফগানিস্তান দখলের প্রধান উদ্দেশ্য। ... ...
রোগ থেকে আরোগ্যের এমন বৈজ্ঞানিক প্রমাণের পরাকাষ্ঠা শুনে ডাক্তার হ্যারিস মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘আপনাদের মতো গ্রীষ্ম প্রধান দেশে শুধু নয়, স্নান সবার পক্ষেই একটি আবশ্যিক প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান। তবে ইহুদিদের কাছে নয়! তাদের একটা ঐতিহাসিক জলাতঙ্ক আছে! আমি যদি রুগীকে স্নান করতে বলি, সে খুব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করবে, স্নান করতে হবে কেন? আমার অসুখটা কি এতোই কঠিন?’ এ নিয়ে গল্পের শেষ নেই । কারলসবাদ (কারলোভি ভারি, আজকের চেক) সেখানে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে খনিজ জল। জলের দ্বারা স্বাস্থ্য – সানুস পের আকুয়াম । এস পি এ - স্পা ! ইলান গেছে জল চিকিৎসার টিকিট কাটতে । কাউন্টারের মহিলা : একটা কেন, একসঙ্গে যদি বারোটা টিকিট কাটেন, সস্তা হবে। এগারোটার দামে বারোটা পাবেন । ইলান (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ) :আমি কি আর বারো বছর বাঁচবো ? ... ...
ফ্ল্যাটবাড়ির নাম শশীবাবুর সংসার। তার ডাইনে বাঁয়ে একতলা দোতলা পুরোনো বাড়ি, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল। তিন নম্বর বাড়ি মিঠুদের। ও বাথরুমে যাচ্ছিল- আজকাল রাত শেষ না হতেই পেট কামড়ায়, সম্ভবত রাতের খাবার হজম হয় না- ভোরের আগে বমি বমি লাগে; বিছানা ছেড়ে বাথরুমের আলো জ্বালাচ্ছে মিঠু, পাতলা সুজনির তলায় গুলগুলে আর কুন্তী ছিল এতক্ষণ- চাদর সরে যেতেই আড়মোড়া ভাঙছে, এমন সময় গুমগুম আওয়াজ যেন গলির মুখ থেকে এসে ওদের বাড়িতে ধাক্কা খেলো- জলের ফিল্টারের তলার তিন পা টেবিল অনেকদিন নড়বড়ে; ঝাঁকুনিতে ফিলটারের ওপরে উপুড় করে রাখা কাচের গেলাস খানখান হতেই মিঠু চেঁচালো - "মা, ভূমিকম্প"; এমন জোরে চিৎকার করল যে বুকে ধরে রাখা বাতাসটুকু যেন খরচ হয়ে গেল তার। আবার শ্বাস নিল সে, তারপর একদমে- "কতদিন বলেছি এই ভাবে গ্লাস রাখবে না"- বলে, পেট চেপে বাথরুমে ঢোকার আগে চোখের কোণ দিয়ে ডাইনের ঘর থেকে ছন্দাকে আলুথালু হয়ে বেরোতে দেখল। ছিটকিনি দিতে দিতে এক মুহূর্তের কৌতূহল হয়েছিল , বিপ্লবও একই ঘর থেকে বেরোলো কী না জানতে। ... ...
ক্রিকেটের মতোই মেয়েদের হকি ভারতে দুয়োরানীর মর্যাদা পেয়ে এসেছে তাদের পুরুষ দলের তুলনায়। এক্সপোজার কম, টুর্নামেন্ট কম, শারীরিক সক্ষমতা কম সর্বোপরি মানসিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া। কিন্তু ওই যে ওপরে বললাম, যাদের প্রতিনিয়ত সমাজের সঙ্গে মেয়ে হিসেবে, খেলোয়াড় হিসাবে এবং সমাজ ব্যবস্থার শিকার হিসাবে লড়তে হয় তারা বোধহয় এতো সহজে হার মানে না। ... ...
চাঁদ আর খরগোশের সম্পর্ক কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছেনা! পশ্চিম গোলার্ধেও গল্প নেই ভেবেছো? অবশ্যই আছে। মেক্সিকোতে আছে। অ্যাজটেকদের গল্প। উত্তর অ্যামেরিকা আর ক্যানাডার উপজাতিদের মধ্যেও আছে। অ্যাজটেকদের গল্পটা এই এশিয়ার গল্পেরই রকমফের অবশ্য। ওখানে 'কোয়েতজালকোটল' বলে একজন দেবতা অমনি মানুষ সেজে পৃথিবী দেখতে বেরিয়েছিলেন। খিদেয় ক্লান্তিতে যখন আর পা চলেনা তখন ঐ বুনো খরগোশ এসে নিজের মাংস দিয়ে ওঁর পেট ভরানোর প্রস্তাব দিয়েছিলো। শেয়াল টেয়াল অবশ্য ছিলোনা। এদিকে 'ক্রী' উপজাতির লোকেরা একটা অন্য গল্প বলে। তাতে খরগোশ অনেক জাদু জানতো। তার এদিকে চাঁদের ভেতরটা দেখার ভারী শখ। কিন্তু তেমন কোনো জাদু ওর জানা নেই যা দিয়ে আকাশে ওঠা যায়। খরগোশ গিয়ে পড়লো সারস পাখির কাছে। 'স্যান্ডহিল ক্রেন' বলে যেগুলোকে ইংরেজিতে। সারস পাখিদের কিন্তু তখন অমনি লম্বা পা ছিলোনা। অন্য পাখিদের মতই ছোটছোট ঠ্যাং। তা, সারসের মনে দয়া হলো। খরগোশকে বললো -- "আমার পা ধরে ঝুলে পড়ো। উড়ে উড়ে তোমাকে চাঁদে নিয়ে যাবো।" তাই হলো শেষ অবধি। খরগোশ তো সারসের পা ধরে লটকে আছে। এদিকে চাঁদ তো আর কাছে নয়! উড়তে উড়তে ওর টানের চোটে পা গুলো একটু একটু করে লম্বা হতে হতে ঐ আজকের সারসের মত হয়ে দাঁড়ালো। তবে গিয়ে তারা চাঁদে পৌঁছেছে। অতক্ষণ ধরে ঝুলে থেকে থেকে খরগোশের হাতও কেটেকুটে এক শা। সেই রক্তমাখা হাত সারসের মাথায় রেখে সে আশীর্বাদ করলো। সেই থেকে স্যন্ডহিল ক্রেনের মাথায় অমনি সুন্দর লাল ছাপ। ... ...
প্রতুল বাবু বলেন, ঠিক রুটিন কিছু নেই সোমদা, আপনি আর সোমদি যে যে ক্লাসে পড়াতে চান, চলে যান। তারপর আমি আর মুজফ্ফর যাবো। ইংরিজি প্রায় পড়ানোই হয়নি কখনো, যে দুয়েকজন একটু-আধটুও জানে তাদের মুজফ্ফর আর আমি আলাদা করে ক্লাসের বাইরে গাইড করার চেষ্টা করেছি। বাকিরা কিছুই জানে না প্রায়। বাংলার অবস্থাও খুবই খারাপ, তবে বোধ হয় ইংরিজির মতো অতটা নয়। ক্লাস ওয়ানে রাজীবই যাক, ওটা ও-ই ম্যানেজ করতে পারে ভালো। ... ...
বিনোদ স্যার ঋষভকে বললেন, ফোর্ট কোচিতে প্যালেস আর পর্তুগিজ যুগের বাড়িঘর দেখে আসতে। সুন্দর সুন্দর বিখ্যাত কেরালা মুরাল পেন্টিং আছে প্যালেসে। ঋষভ একাই বেরিয়ে পড়ল। প্যালেসের দেয়ালে রামায়ণ পেইন্ট করা – রঙ ফিকে হয়ে গেছে – তবে অদ্ভুত সুন্দর। ভেবে অবাক হল – বাড়ির দেয়ালে রামায়ণ নিয়ে কিছু মানুষ বাস করত। ফোর্ট কোচির সমুদ্রপাড়ে চাইনিজ ফিশিং নেট দেখতে দেখতে সে ভাবছিল, বছর দুয়েক আগে হয়তো মঞ্জুনাথের বিয়ে হয়ে যায়, সারথি কেরালা চলে আসে। তারপর মঞ্জুনাথের ছেলে হয়, সেই জন্য হয়তো সারথি ওর সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। কপাল ফাটে। আবার পুরনো এবং পছন্দের ক্লায়েন্ট ডঃ শ্রীধরের সাথে হয়তো ও সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় নূতন লোক অর্থাৎ বিনোদ স্যারকে পাবার পর। আর বুড়োর পয়সার তো কোনো অভাব নেই। তবে এগুলো সবই ‘হয়তো’। সব জুড়ে জুড়ে গল্প সে নিজেই বানাচ্ছে, তাও সেই লোকটাকে নিয়ে যার সত্যি মিথ্যার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ... ...
ক্যাটোরবাসী বিছানায় একটা হাল্কা সুবাস ছিল। কোন মন কাড়া আতরের গন্ধ, নারী শরীরের সুগন্ধি আবেশ। গোবিনের মনে পড়ছিল দামুর মায়ের কথা, রমনাবি। গত বিশ বছরে বিবির সঙ্গে মোলাকাত হয় দুই বছরে একবার। গোবিন বাড়ি ফিরলে তার তাম্বুল খাওয়া ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়ে, পায়ে আলতার পোঁচ পড়ে, হাটে চুপড়ি ভরা নোলা আর খলিসা মাছ বেচে জালালের বিলে ধুন্দুলের খোসা দিয়ে ঘসে ঘসে সিনান করে চালা ঘরের বিছানায় গোবিনের কাছে ঘন হয়ে আসত। রমনাবির পাক দেওয়া পাটালি গুড়ের মত চামড়ায় নাক ডুবিয়ে আঁশটে গন্ধে সিনা জুড়াত গোবিনের। মৎস্যগন্ধা নারী তার লেজের ঝপটায় ভাতারকে পাকে পাকে জড়িয়ে নিত একদম। স্বপ্নে দামুর মায়ের জন্য ছটফট করে উঠল দশ ঘাটের পানি-ছ্যাঁচা, ব্রিটিশ জাহাজের পোড় খাওয়া লস্কর গোবিন্দ সারেং। দামুর মা, জীর্ণ বেড়ায় ঘেরা তার একচালা ঘর, ভিটের এক ছটাক জমিতে মাথা দোলানো নিমের শীতল বাতাস, স্বপ্নে তাকে ঘিরে ধরেছিল। ক্যাটোর বিছানায় যখন ঘুম ভাঙল গোবিন্দের, তখনও মনে জেগে রইল পায়ের তলায় শক্ত জমির কথা, পায়ের পাতায় ধুলা মাখার সুখানুভূতি। গোবিন্দ সাব্যস্ত করল যা হয়েছে সে বাচ্চা পীরের দোয়া। এই যে আক্রাম হঠাৎ করে চোখের সামনে কোন ভোজবাজিতে হাফিস হয়ে গেল সেটা আখেরে ভালই হল। তাকে জাহাজে ফিরতে দিল না। যে ইঞ্জিন রুমের জন্য বছরের পর বছর বাঙ্কার থেকে চাঁই চাঁই কয়লা বয়ে নিয়ে এসেছে, হাতুড়ি মেরে মেরে সেই কয়লা ভেঙেছে, কিংবা ফার্নেসের হ্যাচ খুলে আগুনে কয়লা ঠেলেছে, সে জাহাজি জীবন আর তাকে টানছিল না। সেই কোন জোয়ান বয়সে মাছ ধরার জাল গুটিয়ে রেখে জাহাজের খোলে প্রবেশ করেছিল গোবিন্দ। তার দেশ বিদেশ দেখার হাউশ মিটেছে। অনেক দেশের লোক দেখেছে সে-ও সত্যি, কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেছে তিরিশ-হাত পানির নিচে, সে যেন এক অন্য পৃথিবী। যেখানে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া জড়ো হয় হাতের ফুলে ওঠা পেশিতে। ... ...
বিদ্যা ভারতী নিজেদের “বিশ্বের সর্ব বৃহৎ শিক্ষা সংগঠন” হিসাবে দাবী করে থাকে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে “একটা জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি নির্মাণ করা যেটা নারী পুরুষের একটা তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলবে যারা হিন্দুত্বর প্রতি দায়বদ্ধ, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং যারা প্রাণবন্ত ও শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক ভাবে পরিপূর্ণ উন্নত………” ... ...
আমাদের বাঙলার রাজা লক্ষণ সেনের (শুনেছি বখতিয়ার খিলজি যখন বাঙলা আক্রমণ করেন, তখন লক্ষণ সেন নাকি বসে ভাত খাচ্ছিলেন – আক্রমণের খবর শুনে হাত না আঁচিয়েই ঘোড়ায় চড়ে পিছনের দরজা দিয়ে হাওয়া!) মত এই খেমাই রাজাদেরও প্রধান এবং প্রিয় খাদ্য ছিল ভাত – সাথে মেকং এবং টোনলে-স্যাপ নদীর মাছ, গেঁড়ি-গুগলি-শামুক-ঝিনুক, একদম টাটকা ধরা। ট্রাডিশ্যানাল খেমাই ক্যুজিনের প্রধান ডিশগুলি ছিল – স্যুপ, স্যালাড, একটা মাছের কোর্স, একটা মাংসের ডিশ, শাকসবজি এবং ভাত। মুখে জল আনা নানা রকমের সস বানাতে ছিল এরা প্রসিদ্ধ – আর খাবারে নানাবিধ মশলা এবং সুগন্ধি ইনফিউজ করার চেষ্টা করত। আর একটা কথা, কাম্বোডিয়ার রান্না বান্নায় রসুন কিন্তু বেশ দিল খুলে ব্যবহার করা হয়। শেষ পাতের মিষ্টি বলতে তা ছিল ফলমূল এবং নারকেল থেকে বানানো। সব মিলিয়ে বেশ জমকালো ব্যাপার। ... ...