আমি অবাক হয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কুড়ি টাকা! মাত্র কুড়ি টাকা দিয়ে আম্মা কী বলছে এসব! একটা পিস্তলের দাম ৮ টাকা, ১ টাকা করে বারুদ। একটা বাঁশি দুই টাকা, একটা প্লাস্টিকের চশমা ৫ টাকা। তারপর? ট্রলারখান কেনা হবে না! সে ভারি দাম, অতি দরাদরি করলেও ১৮ টাকার নিচে কুলাবে না। কিন্তু বাদবাকি জিনিস কেনার পর আমার হাতে থাকবে সাকুল্যে ৪ টাকা! তাহলে? তাহলে কী, সব বাদ দিয়ে শুধু ট্রলারখান কিনে ফেলব? ... ...
বাবা যেদিন ফিরল খবর আনল হিন্দুরাও মুসুলমানেদের পালটা মেরেছে, ওদের মতই পিটিয়ে পুড়িয়ে মেরে দিয়েছে। বলতে বলতে বাবার চোখ জ্বলজ্বল করে মোটা গোঁফ থিরথিরিয়ে নাচে, টুলির মনে হয় তাহলে কি হিন্দুরাও মেয়েদের পেলেই ... আর ভাবতে পারে না, আবার শক্ত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা এসে দুই গালে ঠোনা মেরে বলে ‘এই এক ন্যাকাষষ্ঠী মেয়ে দ্যাখ না দ্যাখ ভিরমি যাচ্ছে।’ দুদিন পরে ওরা বামুনহাটে চলে গেল, নাকি সেখানে মুসুলমানেরা সব প্রজা, কত্তাদাদার জুতোর নীচেই থাকে সব। ওদের রেখে বাবা আর কাকামণি আবার ফিরে এসেছিল, কলকাতায় অনেকদিন পর্যন্ত সমানেই গন্ডগোল চলেছে এদিক সেদিক। ... ...
ইদের দিন সকালে মা গরম পানি করে কাকিমা'র ঘরের ছাদে সাবান শ্যাম্পু মাখিয়ে গা ধোয়াতো, তারপর নতুন জামা পরিয়ে, চুলে ক্লিপ বেড়ি (হেয়ার ব্যান্ড) লাগিয়ে, পন্ডস বডি লোশন গায়ে ও মুখে পন্ডস ক্রিম লাগিয়ে, লিপস্টিক কাজল টিপ দিয়ে সাজিয়ে এমনকি জুতো পরিয়ে দিতো, তারপর দুই ভাইকে পাঞ্জাবি পায়জামা পরিয়ে আব্বার সঙ্গে আমাদের পাঠাতো ইদগাহে। তখনো মেয়েরা তৈরি হইনি, মেয়েদের ইদ গাহে যেতে নেই, মেয়েরা ছেলেরা একসঙ্গে তৈরি হয়ে কী হবে? আগে ছেলেরা স্নান করে তৈরি হয়ে চলে যাক। তারপর ঝট করে স্নান করে রান্না ঘরে রকমারি রান্না করতে বসে পড়ার মত মেয়ে হইনি। ... ...
আমিও আমার মায়ের মতো রাত জেগে ইদের আগের দিন রান্না করি। ইদের দিন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন মিলে সারাদিন খাই দাই আর আড্ডা দিই। টেবিলে সব সাজানো থাকে, পটে চা থাকে। বেশির ভাগ ইদে আমার মেনু হয় নানা রকম বেকিং গুডস, দুধ সেমাই, জর্দা সেমাই, কখনো কখনো চালের জর্দা, রসমালাই, সরের মিষ্টি, বা নানা রকম নাড়ু, চটপটি, কাবাব বা আলুর চপ। পোলাও, রোস্ট, বিফ কারি, বেগুনবাহার, মাটন চাপ, ইত্যাদি। আর মায়ের ট্রাডিশন ধরে রাখতে সব রকম ডাল দিয়ে খিচুড়ি। ... ...
রোজার শুরু মানেই স্মৃতির বই মেলে ধরে পড়তে শুরু করা। এ যেন নিজেকে আবিষ্কার করা আর শৈশব আর কৈশরে বিপণি বিতানগুলোতে মায়ের হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো এক কন্যার হাসি কান্না। ... ...
ইসলামে রমজানের উপবাস মানুষের উপর নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শয্যাশায়ী, নিরাময় অযোগ্য রোগী, গর্ভবতী মহিলা, সফরকারী মানুষকে রোজা পালন করা থেকে সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতিকূল অবস্থা দূর হলে তখন তাদের সেই রোজাগুলি করে নিতে হবে। কোন ব্যক্তি উপবাস করে ভুলবসত পেট ভরে খেয়ে নিলেও তার উপবাস ভঙ্গ হয় না। ... ...
হ্যাঁ স্যার, আসলে ওটা তো হন্টেড হাউজ। আপনি দূর থেকে আর কীভাবে বুঝবেন আমার কী অবস্থা হচ্ছে। একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি স্যার। নাক মুখ থেতো হয়ে গিয়েছে। যাকে বলে ঘাড়ে ধাক্কা। বিশ্বাস না হয় ছবি পাঠাব স্যার? ... ...
রুদ্র জ্যৈষ্ঠ। সকাল নটা-দশটাতেই রোদের যা তাত! গা যেন ঝলসে যায়, সওয়া যায় না। পিরবাবার মাজারের দিক থেকে হাওয়া আসে। হাওয়া তো নয়, আগুনের হলকা। পাক খেতে খেতে ছুটে আসে গ্রামের দিকে। ঝলসিয়ে দেয় চামারদের বিবর্ণ গেরস্থালির আয়োজন। নেহাতই একটেরেতে বাসের ব্যবস্থা, গ্রামের অনেকটা দক্ষিণে। এদের গায়ের হাওয়া যেন আশরাফদের গায়ে না লাগে। হাওয়াকে নিয়মের গণ্ডিতে বাঁধে কার সাধ্যি। তবু চেষ্টার কমতি নেই! ... ...
খুশীর ইদ। সকলের। শুধু তৃতীয় বর্ষের মেয়েটি হারিয়ে গেল। পড়ার জন্য জেলা বদল। প্রতিষ্ঠান বদল। এবার বদলে গেল পৃথিবীর ঠিকানাও। ঘটনা ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। মেয়ের অকালে মৃত্যু। এবং অপঘাতে। ... ...
আজ ঠাকুমার একাদশী। এসব দিন ঠাকুমা আগবেলা নির্জলা থাকে। বারবেলায় সব কাজ সেরে স্নান করে ঠাকুরঘরে গোবিন্দকে সাবুর ফলার সাজিয়ে তারপর নিজে খায়। তবে আজ ঠাকুরঘরে সব নেবার আগে আলাদা পাথর বাটিতে দুধে ভেজানো সাবু, কোরা নারকেল, ক্ষীরের সন্দেশ, একটা বারোমাসি আম আর আমাদের গাছের চন্দন কবরী কলা আলাদা করে সরিয়ে রাখে ঠাকুমা, “কোহিনূরদের বাড়িতে দিয়ে আসিস।” ... ...
সমাজ রাধাকান্ত দেবের সতীদাহের পক্ষে আর বিধবাবিবাহের বিপক্ষে দাঁড়ানোটাই বেশি করে মনে রেখেছে। তাঁর শব্দকল্পদ্রুম, স্কুল-কলেজ স্থাপনগুলি ততটা মনে রাখেনি। একথাও মনে রাখেনি, যে রামমোহনের পরিবারেও সতীদাহ হয়েছে, দেব পরিবারে একটিও হয়নি। অবশ্য এতে সমাজকে দোষ দেওয়া যায় না। রেঁনেশার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাধাকান্ত আজও ভিলেন। তবে একথা আমি মন থেকে মানি – ঐ বাধার পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল বলেই রামমোহনের আর বিদ্যাসাগরের জয় চিরস্থায়ী ... ...
স্পষ্ট সূর্যের আলোয় আবার বেরিয়ে আসার পরে, শিকারের সন্ধানে আরও খানিকটা হাঁটলাম। এই সময়ে দেখলাম, এমটাম্বু উপত্যকার বাঁদিক ঘেঁষা এই জঙ্গলে একটা বিশাল, লালচে রঙের, অতি ভয়ঙ্কর দাঁতওলা বুনো শুয়োর চড়ে বেড়াচ্ছে। কালুলুকে একটি গাছের আড়ালে মাটিতে শুয়ে থাকতে বললাম, আর আমার সোলার হ্যাট-টা কাছের আরেকটা গাছের পিছনে রেখে দিলাম... ... ...
সেই ঘনায়মান আঁধারে এক সময় বালুদা এসে বসে ছিল আমার পাশটিতে। নেশা মেশানো নীচু গলায় বলেছিল: দাদাবাবু, আমার বড় সপপন ছিলো লালন মুর্দাফরাশ হবে না। জিন্দা আদমি তুলবে... ইলাজের জন্য হাসপাতাল আনবে এম্বুলেন্স চাপিয়ে। .... হল না। শালা মর্গে ডিউটি পেল -- অ্যানাটমি ঘরেও নয়। সবাই বলে ওখানে পয়সা আছে। ডেড দের গায়ের আংটি -হার ঘুরিয়ে দিলেই হলো। আমি লেকিন হেরে গেলাম দাদাবাবু। ... ...
ধীরেন্দ্র এস জাফা ভারতীয় বায়ুসেনার ফাইটার পাইলট এবং উইং কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের হাতে যুদ্ধবন্দি হন। পরে মুক্তি পাবার পর তাঁকে বীর চক্র পুরস্কার দেওয়া হয়। বন্দিদশার সেই কাহিনি তিনি লিখছেন তাঁর Death Wasn’t Painful বইটিতে। এই বইটির ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদ টির নাম "আয়েশা"। তাঁর পরিবারের সম্মতি নিয়ে সেই পরিচ্ছেদটির কিছু অংশ অনুবাদ করা হল। ... ...
স্বপ্ন দেখি, একদিন সত্যি ভেঙে যাবে বার্লিন দেওয়ালের মতোই আমাদের পদ্মার বুক ভেদ করে চলে যাওয়া ব্যবধান। দুই বাংলা এক হয়ে যাবে আবার। কোনও উগ্রপন্থার হাত ধরে না। স্বাভাবিক ভাবেই। বরিশালের মাটিতে দাদুর সুরে আমার গলা দিয়ে বেরবে আবার মুকুন্দ দাসের গান..সেদিন...আমার অজানা পূর্বপুরুষের বহু কিছু জানিয়ে দেবে বরিশালের আকাশ-বাতাস আমায়....আমি মানুষ হিসেবে পূর্ণ হয়ে উঠব.. প্রণত হব আরেকবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে.. ... ...
আমার অনেক ইদ ছিল। কৈশোর থেকে যৌবন। সেই বৃত্তান্ত যদি বলি, বলতে হয় আমার ইদ হারিয়ে যাবার বৃত্তান্তও। দুটোরই বড় অবশ্যম্ভাবী আগমন জীবনে। তারও আগে যে সত্য স্বীকার্য – একটা বয়সে যে উৎসবে নতুন জামা জুতোর রং, নির্ঘুম অপেক্ষা, বালিশের নিচে জুতো নিয়ে ঘুমানো আর রান্নাঘরে মায়েদের রাতভর সেমাই পিঠা – তাই ইদ, তাই উৎসব। এই রাতজাগা আনন্দে যতদিন ঘুম টুটে টুটে যায়, ততদিন উৎসব রঙিন। ... ...
ইদের দিনের সবচেয়ে জরুরি কাজ যেটা, মানে নামাজটা পড়ার পরে যখন ইদের আর কোন আইনকানুন থাকে না তখন যা থেকে যায় তা হচ্ছে খাওয়া দাওয়া! এক মাস রোজা রাখার পরে মুখ খুলে গেল, এবার খাও। এই খাওয়ার নানা তরিকা আছে, নানা রঙের আছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গেলেই চেহারা ভিন্ন হয়ে যায়। ... ...
অনেক সময় দহলিজে খাঁ সাহেবেদের রোজার ব্যবস্থা থাকত অবস্থাপন্নের যৎসামান্য ইফতার দেওয়ার মাধ্যমে। এইভাবেই চলত মাসভর। শেষ রোজায় গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরলে পাড়াতে একসাথে ইফতারের মজলিসে তাদের আনা শহুরে নানা ফলের ডালি খানচায় নিয়ে দোওয়ার মজলিসে সমবেত হত, সব বাড়ির ছোট ছেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মজাই ছিল আলাদা। সেদিনে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করার অলিখিত ছুটি মঞ্জুর হতো দু-তিন দিন। ... ...