শৈশবের ক্ষণস্থায়ী চিত্রণ, দুরন্ত বালকের দৌরাত্ম্য, মা-বাবার স্নেহ, গ্রামের শীতের সকাল, পল-অনুপল কৈশোরের স্মৃতি, প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা, অসংখ্য ভুল সিদ্ধান্তের আবছায়া জাল হাতের মুঠোর আঙুলের ফাঁক দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়। এরপর আসে যুদ্ধের স্মৃতি, অসিতোপলের নির্দেশে সে দিতার কাছ থেকে একটি ঘড়ি নিয়ে এসেছিল, সেই ঘড়িটি চিতাদের বিরুদ্ধে সমতলের মানুষকে জয়ী হতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এর সঙ্গে একটা বেদনাবোধ জড়িয়ে আছে। রাতের ধাবমান ট্রেনের কাচের জানালায় বৃষ্টির জল ঝরে পড়ে। জানালায় মুখ লাগিয়ে পড়তে চায় সে না-থামা স্টেশনের ঝাপসা নামফলক, স্মৃতির স্টেশন থাকে থামতে দেয় না। ট্রেন থামানোর সুযোগ থাকলে সে নেমে সঙ্কেত বদলে দিত, এই লাইনে তার ভ্রমণ করার কথা নয়। এক অসীম ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। ... ...
‘মা দেখো বুকাই আবার বেডকভার চাপা দিয়েছে’ চেঁচিয়ে, ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় না থেকে চাদর কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। পুকাই চিরকালই অস্বস্তিজনকরকম নর্ম্যাল। পরিবেশপরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজপোশাকে বিশ্বাসী। শীতে বেশি, গরমে কম, সমুদ্রস্নানে আরও কম। কালই দেখলাম, কার্লসবাড বিচে সপরিবারে উল্লসিত স্নানের ছবি আপলোড করেছে, বিকিনিপরিহিত। না, ফেসবুকে নিজের নামে নেই আমি। ফেক থেকে দেখেছি। ... ...
জলের ধারে নৌকায় কয়েকবছর ধরে থাকে শ্যামল হালদার।ডাঙায় আসে না।খেয়া তৈরির প্রথম দিন ছটি প্রদীপ জ্বলেছিল ছয় দেবতা ও পীরের নামে।পাঁচটি দীপ নিভে যায় একটি জ্বলে থাকে কালীর নামে।তরীখানা মুণ্ডমালিনীর নামে উৎসর্গীকৃত, তাই মাংসরন্ধন নিষেধ। ... ...
– ব্রাহ্ম বৌরা বুঝি সিঁদুর পরে না জেঠিমা? – সঠিক জানি না, তবে না পরাই উচিত। বইতে পড়েছি, ১৮৫০ নাগাদ যে ব্রাহ্ম বিবাহ আইন হয়, তাতে আন্তর্বর্ণ বিবাহ ও বিধবাবিবাহ সমর্থন, বাল্যবিবাহ রদ, স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক দ্বিতীয় বিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত ছিল। বিবাহের রীতি হিসেবে বলা যায়, সাবালক পাত্র-পাত্রীরা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে উপস্থিত হয়ে স্ব-স্ব ধর্মে বহাল থেকে ব্রাহ্ম রীতিতে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু সাবালক হবার বয়স ধরা হয়েছিল চোদ্দো বছর। ব্রাহ্ম বিয়েতে সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারণ হয়৷ শেষে বর-কনে, অভিভাবক, উপস্থিত অতিথিরা প্রার্থনা সভায় অংশ নেন এবং ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে বর-কনের মঙ্গল কামনা করেন। যৌতুক দেওয়া নেওয়া ও বিরাট লোক খাওয়ানো, বিলাসিতা, আড়ম্বর এসব চলে না। ... ...
শিবিরে পৌঁছানোর সামান্য আগে আমি একটা চিতাবাঘের দিকে গুলি ছুঁড়লাম, কিন্তু মারতে পারলাম না, ব্যাটা ছুটে পালাল। রাতভর এমটাম্বু নদীর কাছে সিংহেরা গর্জন করতে থাকল। ঘন জঙ্গলের গহীন গোধূলিবৎ-ছায়ায় আমরা হাঁটতে থাকলাম।লম্বা পথ হাঁটায় বনের ছায়া আমাদের প্রখর তপনতাপ থেকে রক্ষা করেছিল। পরের দিন আমরা শিবিরে পৌঁছালাম। উজিজি থেকে আগত একদল আরব এই শিবিরটা সদ্যই তৈরি করেছে। তারা এই রাস্তা ধরে উন্যানয়েম্বের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। এতটা আসার পর মিরাম্বো আর আরবদের মধ্যে যুদ্ধের খবরে শঙ্কিত হয়ে তারা ফিরে যায়। আমাদের পথ ছিল রুগুফু নদীর ডানধার ধরে। একটা চওড়া মন্থর জলস্রোত, মাটাটা নলিকা ও প্যাপিরাসের ঝোপে আটকা-পড়া জলধারা । সর্বত্র মোষদের পায়ের ছাপ আর গাদা গাদা নাদা পড়ে আছে। যা সব চিহ্ন তাতে কাছাকাছি যে গন্ডারও রয়েছে তা পরিষ্কার। নদীর কাছেই একটা ঘন গাছের ঝোপড়ার মধ্যে একদল দাড়িওয়ালা, সিংহ সদৃশ বানরের দেখা পেলাম। ... ...
যাঁদের সংবিধান রক্ষা করার দায়িত্ব, তাঁরা যদি তাঁদের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা বলেন মেয়েরা হিজাব পরে আসতে পারবে না, তখন যাঁরা ঘৃণার রাজনীতির ফেরি করে চলেছেন তাঁদের সুবিধাই হয়। কোনও মানুষ কী খাচ্ছেন, বা কী পরছেন, তা দেখার বদলে রাজনৈতিক নেতারা যদি একটু হলেও কত মানুষ খেতে পাচ্ছেন না, বা কত মানুষের পরিধানের জন্য একটির বেশি দুটি জামা নেই, তা নিয়ে চিন্তিত হতেন, তা হলে কি ভালো হতো না? ... ...
প্রতিদিন কোথাও না কোথাও খবর আসছিল প্রতিবাদের। উত্তর-পূর্ব দিল্লীর জাফরাবাদ, চাঁদবাগ, খাজুরি খাস, পুরোনো মুস্তাফাবাদ, সেলামপুর, তুর্কমান গেট, করডমপুরি, সুন্দর নগরী, লালবাগ, উত্তর-পশ্চিম দিল্লীর ইন্দরলোক, দক্ষিণ দিল্লীর নিজামুদ্দিন, হৌজরানী, উত্তর দিল্লীর সদর বাজার। সারা দেশ দেখছিল জামা মসজিদ চত্বর, ইন্ডিয়া গেট- শ্লোগানে, গানে উত্তাল! উত্তাল সারাদেশ! তার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। কলকাতাতেও পার্ক-সার্কাস, রাজাবাজারে আমরা দেখেছি শাহিনবাগের মতোই সংখ্যালঘু নারীসমাজের নেতৃত্বে নানাবিধ প্রতিকূলতাকে জয় করে দীর্ঘমেয়াদি অসামান্য প্রতিবাদী জমায়েত। ... ...
বগটুই গণহত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরে কবি জয় গোস্বামীর লেখা কবিতা নিয়ে ‘দগ্ধ’ নামে একটি পুস্তিকা আমরা প্রকাশ করেছিলাম। বগটুই এবং তার পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি নারীনির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার প্রতিক্রিয়ায় জয় গোস্বামী আরও কিছু কবিতা লিখেছিলেন। সেই সবকটি লেখা নিয়ে আমরা প্রকাশ করতে চলেছি আরেকটি বই – ‘নিজের বিরুদ্ধে’। পার্টি-প্রশাসন-পুলিশের হাতে আক্রান্ত অসহায় নির্যাতিতা এবং তার পরিজনদের দুরবস্থার এক দলিল হয়ে থাকবে এই কবিতাগুলি। এই লেখাগুলির প্রেক্ষিত সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা হলেও, পরিসর আরও ব্যাপ্ত। যে শাসনকাঠামোয় আমরা জীবন কাটাচ্ছি, তার সুযোগ-সুবিধাগুলি নিয়ে দুধেভাতে সংসার প্রতিপালন করছি, সেই কাঠামোর নৃশংসতা নিশ্চিতভাবে আমাদের নিজেদের দিকেও আঙুল তুলে দেয়- এই উপলব্ধির আয়না আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন কবি। ... ...
বুচকুনের নাকে শিকনি দেখলে বৌমনি ভীষণ রেগে যায়।আর মা রেগে যায় মাফিনের কাগজ খেতে দেখলে।কিন্ত একমাত্র বুচকুন জানে ঐ কাগজ খাবার কী সুখ! চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে দেয় কাগজটাকে। তারপর পারলে পাপোষের নিচে ঢুকিয়ে দেয়। কুলসুম দেখতে পেলে পিঠের চামড়া তুলে দেবে। বুচকুন এইবাড়িতেই ভালোমন্দ খাবার পায়। চাউ মিন। চপ। মিষ্টি। পোলাও। কিন্ত এইসব খাবারে কোন কাগজ নেই যে খাবার শেষ হবার পরেও চিবিয়ে সুখ হবে। তাই বুচকুন মাফিনের জন্য হাঁ করে থাকে। এমনকী মা যেদিন তাকে নিয়ে যায় না, সেদিনও। ... ...
আজকের পর্বটা ভালোই জমে উঠেছে। বিজ্ঞাপনসহ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের শো। প্রথম দুই পর্ব এরই মধ্যে শেষ। সুবহান আর লতা পাল্লা দিয়ে হেসেছে। সুবহান এমনিতেই খুব হাসতে পারে। এটা ওদের পারিবারিক রোগ। সুবহানের বাবা মাটিকাটার কাজ করত। অভাব অনটনের মধ্যেও লোকটা এত হাসত যে পাগলের মতো দেখাত। যেদিন ওর মা ইটভাটায় জ্বালানির সঙ্গে জ্বলেপুড়ে কয়লা হলো, সেদিন বিকালেও হেসেছে। তাও খুব সামান্য কারণে, একটা ছাগলের ছা লাফাতে গিয়ে দড়িতে বেঁধে উপুড় হয়ে পড়ে গেছে, তাতেই সে কী হাসি! শেষ পর্যন্ত পাগল বলে সকলে এক প্রকার মেনে নেয়। সুবহানের বাবারও মানতে অসুবিধা হয়নি। আশেপাশে কেউ পাগল বলে ডাকলেই দাঁত কেলিয়ে উত্তর নিত। আর পাগল বলেই কিনা দুজনের কাজ করে অর্ধেক মজুরি পেত। সেই থেকে সুবহানের ধারণা হাসাটা ওদের অসুখ। মেয়েকেও সেই অসুখে পেয়েছে দেখে সুবহানের কষ্ট হয়। ... ...
একটু বেলা পড়ার দিকে পদ্মপাতায় খাবার সময় ও জোরে জোরে নাক টানত, আর বলত, আঃ! কী সুন্দর গন্ধ গো বাবা! যেন ভোজ খাচ্ছি। অথচ গাছ কীই বা রাঁধতো তার পাতায়? আওতার গাছ, যতটুকু রোদ-জল রুক্ষ মাটি থেকে টেনে নিতে পারে, তা বইতো নয়? সেই তো শাক ডাঁটা, বিড়ির ডাল। বড্ড জোর চুনোমাছের চটচটে করে ঝাল। কোথাও জল ছিঁচে, নাহলে জাল টেনে ধরা। বিক্কিরি করার পর বাকিটা রান্না। বড্ড ভালো রান্না করতো। পদ্মপাতায় খেলে মনে হবেই ভোজবাড়িতে খাচ্ছো। ও আঙুল চেটে চেটে খেতো। পাত আঙুলের ডগায় পরিষ্কার হয়ে যেত। ওর খাওয়া দেখে ওরা দুজনে কী খুশিই না হতো! হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকত ওর দিকে। তারপর তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠত। বড় সুন্দর ছিলো সেসব দিন। ... ...
দুটি কবিতা ... ...
মকিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মইশা বলে কতো জল। আল্লাহ সাক্ষী রইল গো। দেখি কে কারে তাড়ায়।’ মাথা এত গরম হয়ে গেল সারা রাত্রি ঘুম হল না। তাঁর উপর ছাদ থেকে শুধু প্লাস্টার খসে পড়ছে। মশারির ভেতর দিয়ে সারা বিছানা বালি বালি হয়ে গেছে। মশারির উপরে একটা চাদর পেতে দিলে হয়। কিন্তু তাতে পাখার হাওয়া একটুও ভেতরে ঢুকবে না। কী করি ভাবতে ভাবতে লোডশেডিং হয়ে গেল। দুত্তোর বলে উঠে পড়লাম। ভাবলাম, কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি। সাপের কথা ভেবে আবার মশারির ভেতরে ঢুকলাম। সারা গায়ে প্যাচপ্যাচে ঘাম। তার সাথে বিছানায় বালি ভর্তি। শুয়ে শুয়ে কান্না পাচ্ছিল। কাল আবার ভোর ছ’টা থেকে ডিউটি করতে হবে। ... ...
কৌশিক বাজারীর দুটি কবিতা। ... ...
চিরশ্রীর তিনটি কবিতা। ... ...