প্রেম সরে গেলে, লিখনটি - অলীক দেওয়ালে সুমন মান্না কথা তো কাহিনিময় স্তব্ধতা কবিতার মতো অলক্ষ্যে ছুঁয়ে গেল স্মিতরূপ বেদনার ক্ষত বুক জুড়ে শূন্যতা যেন পরিযায়ী পোষাকের ভাঁজ কাল ফিরে গিয়েছিল ঘুম, জেগে থাকা সারারাত আজ- তোমাকে লুকিয়ে রেখে মৃদু ভয় খোঁজা সাপখোপ আলোর ঘোমটা টানা মুখ ঢাকা গাঢ় ঘেরাটোপ ... ...
বর্তমানে শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরে করোনাতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৭,৫৫১ ও মৃতের সংখ্যা ৩০৪৮। স্কুল, কলেজ মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে মার্চের ১২ তারিখ থেকে। আর সরকারি ভাবে লকডাউন শুরু হয়েছে ২০শে মার্চ থেকে। আসলে এরম পরিস্থিতি হতো না, যদি আর একটু আগে লকডাউনটা শুরু হতো। প্রায় ৫ দিন দেরি করে দিয়েছে নিউ ইয়র্ক সরকার। ১২ই মার্চ ক্যালিফোর্নিয়া ও ওয়াশিংটন স্টেটের তুলনায় নিউ ইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু প্রায় সমান ছিলো, খুব বেশি তফাৎ ছিলো না। আর আজ গোটা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫,১৫৮ ও মৃতের সংখ্যা ৩৫০। ক্যালিফোর্নিয়া সঠিক সময় লকডাউন করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, কিন্তু দেরি করে দেওয়ায় নিউ ইয়র্ক পারেনি। ... ...
সন্ধেবেলা এই তেলেভাজার ভ্যানটা নিয়ে আসে মা-মেয়েতে মিলে। দুটো সাতমহলার মাঝের গলিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। সন্ধেবেলা তুষ্টিকে ফ্ল্যাট থেকে বার করে, বুটিকে নিয়ে আসে আজকাল নীলু। কুসুমের তেলেভাজার ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে উল্টো দিকে। সন্ধের পর মিন্টিকে ছেড়ে আর কোথাও বেরোতে চায় না শ্রেয়সী। মিন্টি অভিমান করে আজকাল। তবু আজ বেরোতেই হত। অনেকদিন বাদে উদয়ন এসেছে কলকাতায়.... ... ...
আমরা বরং, এই দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার শেষে, পপুলিজম কেন বিপজ্জনক সেটা বোঝার চেষ্টা করি। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে পপুলিজম ব্যাপারটা মোটেই খুব একটা খারাপ বলে মনে হয়না। হাজার হোক, গণতন্ত্রের তো উদ্দেশ্যই মানুষের কথা আরো বেশি করে তুলে আনা, তাঁদের অভাব অভিযোগ গুরুত্বসহকারে ভাবা। একরকমভাবে এলিট শাসকদলের এইসব অভাব অভিযোগ সম্পর্কে ঔদাসীন্যই তো পপুলিস্ট বা তোষণের রাজনীতির কারণ। কিন্তু বিভিন্ন দেশে পপুলিস্ট দল বা নেতৃত্বের উত্থান এবং ঘটনাপরম্পরা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় বিপদটা কোথায়। আরো স্পষ্ট হয় ক্যারিশম্যাটিক জনপ্রিয় নেতাদের কার্যকলাপ দেখলে। সেখানে একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন আছে। ... ...
অনন্তর,পরিশেষে বলা জরুরি,ভৌগলিক অবস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দূর্ভাগ্য এই যে,বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহে সাম্প্রদায়িক সংকট যথেষ্ট প্রকট। অন্তত এই বিবেচনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। কিন্তু এর অবনতি ঘটিয়ে যারা ফায়দা হাসিলে সচেষ্ট তারাই যে এই সাম্প্রদায়িক অপরাধটি সংঘটিত করেছে তা বুঝতে বাড়তি কোনো বিদ্যেবুদ্ধি কিংবা তথাকথিত বুদ্ধিজীবি হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। এটা সত্যি যে,রামুতে কতিপয় মুসলিম সন্ত্রাসির নেতৃত্বে যে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও হামলা হয়েছে নোয়াখালির দাঙ্গার পর সন্দেহ নেই এটিই সবচে' বড় কলঙ্কজনক ঘটনা। ধর্মান্ধ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিকে উস্কে দিয়ে সুকৌশলে যারা এই সাম্প্রদায়িক অপরাধ সংঘটনে পরিকল্পনা এবং ষড়যন্ত্র করেছে অবশ্যই তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইতোমধ্যে রামু নিয়েও শুরু হয়েছে পরস্পর দোষারোপের সেই নোংরা রাজনীতি। তবে কি অচিরেই আমরা রামুর এই সহিংস ঘটনাটিকেও বিস্মৃতির অতলেই হারিয়ে যেতে দেখবো? আর সেটি কি আদৌ আমাদের জন্যে মঙ্গলজনক হবে? আর কতকাল সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিশেবে বিবেচিত হবে? সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক রাজনীতিকরা স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধিতে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জংগিবাদের ধুয়ো তুলে খাল কেটে কি কুমিরকেই আমন্ত্রণ জানিয়ে যাবে? এদেশের অসাম্প্রদায়িক প্রকৃত মুসলিমদের কি কিছুই করণীয় নেই? তারা কি শুধুই হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে আর ইসলামের মহত্বই প্রচার করে যাবে? একজন নির্যাতিত বাংলাদেশি বৌদ্ধের তুলনায় একজন নির্যাতিত রোহিঙ্গা কিংবা ফিলিস্তিনি মুসলিমের প্রতি এদেশীয় ধর্মপ্রাণ মানুষের মমতা কি আসলেই বেশি? হ্যাঁ,এইসব,সবকিছুই বিবেচনাপূর্বক রামু ট্র্যাজেডির সুষ্ঠু সমাধানকল্পে একটি স্বচ্ছ বিচারবিভাগীয় তদন্ত এই মুহূর্তে সত্যিই ভীষণ জরুরি। তা না হলে যে সভ্যতার পোড়াঘ্রাণে বারম্বারই অসহ হয়ে উঠবে আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ। তাই নয় কি? ... ...
ভাদুড়ি বাড়ির বৌ নাকি লেবু গাছগুলো নিজে হাতে লাগিয়েছিল। তাই এই বাগানের লেবুগুলো বড়দাদি পাড়ার সবাইকে বিলিয়ে দেন, “খুব রসালো এই লেবু আর ঘ্রাণ, হাতে বারপাঁচেক ধোওয়ার পরেও থেকে যায়। ভাদুদি কত শখ করেই না লাগিয়েছিল। মানুষটা প্রাণভরে গাছের ফলগুলো খেতেও পারল না” বড়দাদির দীর্ঘশ্বাসে কী থাকে তা না বুঝলেও, ভাদুদি যে বড়দাদির খুব আপন কেউ – তা বুঝতে আমার সময় লাগে না মোটেও। না হলে ভাদুড়ি বাড়ির বাগানের সব ফল শুধু পাড়ায় বিলিয়েই ক্ষান্ত হন বড়দাদি, একটা ফলও নিজের বাড়িতে নেন না, “ওসব ফল আমার গলা দিয়ে নামবে না। ভাদুদি কখনও ফিরলে দু’জনে একসাথে খাব।” ... ...
রাজ্যের কিছু হিংসাত্মক ঘটনার পর ফিসফিসিয়ে চলছে প্রচার। 'ওদের' নিয়ে। উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইলে ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার ঘটনার পর থেকে ফিসফিসিয়ে বা সোচ্চারে চলছে সাম্প্রদায়িক প্রচার। 'ওদের আন্দোলন', 'ওরা হিংসা ছড়াচ্ছে'। কিন্তু কী বলছেন স্থানীয় মানুষ? আমাদের হাতে আছে দুই সম্প্রদায়ের কিছু স্থানীয় মানুষের বক্তব্য সম্বলিত একটি ভিডিও। কী বলছেন তাঁরা? কী হয়েছিল? কী নিয়ে আন্দোলন? কারা করছেন? শোনা যাক, বক্তব্য। উলুবেড়িয়া থেকে সরাসরি. প্রকাশ করা হল গুরুচণ্ডালির পক্ষ থেকে। ... ...
পৃথিবীর সব বাঙালির প্রথম রান্না শুনেছি, ডিম আলুর ঝোল। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে পড়ানোর সময় ফেরার কোনও ঠিক ঠিকানা থাকতো। বিশেষ করে পাঁচটায় পরীক্ষা শেষ করে সন্ধ্যা ছটা চোদ্দয় কৃষ্ণনগর লোকাল ধরলে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সেটা। প্রায়ই ট্রেনের গণ্ডগোল। আজ কলা পাতা ফেলেছে, কাল লাইনে গণ্ডগোল। কোনও স্টেশনে নয়, বেশিরভাগ সময় ফাঁকা জায়গায় বীরনগরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো ট্রেন। বসে বসে অন্ধকারে মশা মারো আর গল্প করো। খিদে পেটে খাওয়ার গল্পই বেশি হতো। ... ...
গত কয়েকদিন ধরে আসামের উত্তর অঞ্চলের বাসিন্দারা সাক্ষী হয়ে চলেছেন রাজ্য পুলিশ এবং সিআরপিএফ এর দমননীতির। এই দমননীতি বাঁধ বিরোধী আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য। উক্ত বাঁধটি ২০০০ মেগাওয়াটের লোয়ার সুবনসিরি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট, তৈরি হওয়ার কথা আসাম-অরুণাচল প্রদেশের বর্ডারে। মে ১১ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় এনএইচ ৫২র কাছে ঠেকেরাগুড়ি গ্রামে এনএইচপিসি-র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একটি ১১০০০ লিটার ডিজেল সমৃদ্ধ ট্যাঙ্কারের সামনের অংশে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটা ঘটে সুবনসিরি নদীর ব্রিজ ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে। এই ব্রিজটা পড়ে আসামের লখিমপুর জেলায় আর লাগোয়া ধেমাজি জেলার ২-৩ কিমি আগে। নদী পেরোলে বাম দিকে যে পর্বতশ্রেণী দেখা যায়, সেটা পড়ে অরুণাচল প্রদেশে। ... ...
আমি একটু আহত মুখে আমার পড়ার টেবিল থেকে নীলচে কভারের ‘কালেক্টেড ফিকশনস’ বইটা এনে ওর সামনে ফেলতাম; সেটাই তখন আমার সংগ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন। আমি বোর্হেসের মতো লেখক হব, আমি ঘোষণা করতাম। — বোর্হেস কে? — সে অবাক হয়ে জানতে চাইত। বিশ শতকের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠতম লেখক, আমি কায়দা করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলতাম, প্রথমজন অবশ্যই ফ্রাঞ্জ কাফকা। বোর্হেস সম্পর্কে আমার মুগ্ধতা, বলা বাহুল্য, শুধু সাহিত্যগত কারণে ছিল না। বোর্হেস যে মায়ের পরিবারের রীতি অনুযায়ী সৈনিক হতে না চেয়ে বাবার বিশাল লাইব্রেরির ভেতর আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন, এইটা আমাকে দারুনভাবে টানত। তেহরানের দিনগুলোয় যেসব উদ্ভট নিষেধাজ্ঞা আমাদের সহ্য করতে হতো, ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন বাসিজের খপ্পরে পড়তে পড়তে কয়েকবার আমি ও আমার বন্ধুরা বেঁচে যাই, এসবকিছুর মধ্যে বোর্হেসের আয়না ও গোলকধাঁধার জগতে ঘুরে বেড়ানো ছিল আমার জন্যে সব থেকে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। ... ...
ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, 'যদি রিপোর্ট পজিটিভ আসে তখন কি করব? বাড়ির বাইরে তো বেরোতে পারবো না? না না..... এখন টেস্ট করা যাবে না। এমনিতেই কোথা থেকে টাকা জোগাড় করবো সেই চিন্তায় ঘুম নেই।' ... ...
এই যন্ত্রণা হওয়ার একটা ইতিহাস আছে। খিদে যন্ত্রণা ও অপমানের ইতিহাস। ১৯৮২। মাধ্যমিক দিয়েছি। ম্যালেরিয়া নিয়েই। পরীক্ষা ছিল ২ মার্চ। এক অমানবিক অবৈজ্ঞানিক অমার্কসিয় সিদ্ধান্ত ছিল তখন ২৩ কিলোমিটার দূরে পরীক্ষা দিতে যাওয়া। আমাদের স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি ছয় কিলোমিটার। স্কুল থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র আরো ১৭ কিলোমিটার। বাসে তখন লাগতো ঘন্টাখানেক। এখন বোধহয় চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট। রাস্তা ঝরঝরে। বাস লঝঝরে। প্রায়ই চাকা পাংচার হয়ে যায়। তাতে আরো আধঘন্টা। দিনে দুটো করে পরীক্ষা। ... ...
বিজেপিকে টক্কর দিতে কংগ্রেসের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, প্রায় দুশো আসনে মুখোমুখি লড়াই। বাকি আঞ্চলিক দলদের অনেকটাই কম। কিন্তু বিগত ১৯-এর নির্বাচনে কংগ্রেস বিজেপির কাছে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয় এবং তার ফলেই বিজেপি এতবড় সাফল্য পায়। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, যে, কংগ্রেস ৫০/৫২তেই আটকে থাকবে ও আঞ্চলিক বা অন্যান্য দলেরা এতটাই ভালো ফল করবে, যে, বিজেপি ২০০র নীচেই থেমে যাবে। গণিত কিন্তু তা বলছে না। ... ...
আমার এক স্কুলের বন্ধু, তার স্ত্রী, বাবা ও মা জ্বর নিয়ে দেখাতে এসেছিলেন। তাদের অন্তত একজনকে কোভিড – ১৯ পরীক্ষা করাতে বলেছিলাম। চারজনই করিয়েছে এবং চারজনই পজিটিভ। ওরা স্বামী- স্ত্রী ভালো আছে। কিন্তু বাবা মায়ের জ্বর, কাশি কমেছে না। লোকাল কাউন্সিলরকে জানিয়েছে। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে। ফোনে স্বাস্থ্যদপ্তরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। সবচেয়ে মুশকিলে পড়েছে ওদের চার বছরের মেয়েকে নিয়ে। সে সম্পূর্ণ সুস্থ। ঘরে চারজন করোনা রোগীর সাথে থাকছে। তাকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়ারও উপায় নেই। ... ...
সভ্যতা এভাবেই ভাবে- ক্রিয়া করে, অর্থের শাস্ত্রই ধর্ম তার। বিনিময়ের অতীত যা যা, তাকে অতীত করে দিয়ে নিয়ে আসে শিল্পবিপ্লব, কলোনি-বানানোর লড়াই, ইনকুইজিশনের নেড়াপোড়া। তবু সেই যজ্ঞের কালি আবির হয়ে গুঁড়োগুঁড়ো মিশে যায় সব চেয়েছির রাজত্বে। বেদবিরোধী শূন্য উপাসক বৌদ্ধ নাগার্জুনের মায়ায় ধর্মসংস্থাপক শঙ্কর ধর্মকেই মায়া ভেবে বসেন। স্তূপের আদল রেখে শিবলিঙ্গ পুঁতে যান মানুষের বাড়িতে বাড়িতে, অবধারিত করে যান খাদ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ, ব্রতয় ব্রহ্মচর্য, কর্মে আত্মনির্যাতন । নেড়া বৌদ্ধের মতই শিখা কেটে ফেলেন ব্রাহ্মণ বিশ্বম্ভর মিশ্র। উপবীত ছিঁড়ে ফেলে ভূলুণ্ঠিত হন মোক্ষের উপাস্যে। ভারতের প্রান্তে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে বেদ-বিমুখ জাতবিহীনদের হোলিখেলা। সম্বলে বাঁদরের রঙ, ভাঙের সিদ্ধিদ্রব্য। ক্রমশ: মন্দির বহির্ভূত:, যজ্ঞরহিত উচ্ছ্বাসের সামাজিক সংশ্লেষ তৈরি হতে থাকে আশূদ্র ভারতসমাজে। হোলিকা নিধনের ফাগোৎসবের দিন ইতিহাস মুখ ঘুরিয়ে দেয় লালন সাঁইজির সাধুসঙ্গের উৎসবে, একব্রহ্মের উপাসক রবিঠাকুরের বসন্ত উৎসবে। শূদ্রভারত তো এভাবেই ব্রাহ্মণ্য উৎপাদনতন্ত্রের অত্যাচারের সমস্ত দাগ গায়ে রেখেও, কান্না-অবিচারের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে শেখে আনন্দের উপাসনায়। ... ...
হ্যাঁ গল্পের মধ্যে আবার দুটো আরও ছোট গল্প। সেই যে এসিয়ান গেমসে চূণীদার ক্যাপ্টেন্সিতে সোনা জেতার কথা বললাম, সেই দলে ছিলেন মেওয়ালাল। বিশ্ব ফুটবলের ‘যাদুকর’ বলা হত স্ট্যানলি ম্যাথিউজকে, আর ভারতের যাদুকর মেওয়ালাল। মেওয়ালালের গোলেই সম্ভবতঃ সোনাটা এসেছিল। সেই মেওয়ালাল গুরুতর অসুস্থ। তিনি প্রাক্তন রেলকর্মী হিসেবে রেলের হাসপাতালে ভর্তি হতে গেছেন। ডাক্তার বলল যায়গা নেই। মেওয়াদার ছেলে বলল, একটু দেখুন না, এসিয়াডে সোনাজয়ী খেলোয়াড়ের যদি এই অবস্থা, সাধারণ কর্মীদের কী হবে? ডাক্তার বলল, তাই নাকি? সোনাজয়ী নাকি? কাল মেডেলটা সঙ্গে আনবেনতো, দেখব কি করা যায়। মেওয়াদা মারা গেলেন পরের দিন। ... ...
এর মধ্যেই এক অবাঙালি পরিবার এলেন। এরা মাঝে মাঝেই আসেন। স্বামী গেঞ্জি কারখানায় কাজ করেন। স্ত্রীর গ্রেড থ্রি ম্যালনিউট্রিশানে ভোগা চেহারা। আঠাশ বছর বয়েসে ওজনও আঠাশ কেজি। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভোগায় অমন চেহারা হয়েছে। ... তারপর তিনি তাঁদের দুঃখের সাত কাহন শোনালেন। গেঞ্জি কারখানার মালিক গত মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছেন। তাতে অবশ্য পুরুষটি বিশেষ দোষ দেখেন না। মালিকেরও আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। তার উপর চৈত্র সেলের সময় ব্যবসা ভালো হবে ভেবে ধার দেনা করে অনেক কাঁচামাল তুলেছিলেন। মহিলা ভালো বাংলা জানেন না। তিনি এক জগাখিচুড়ি ভাষায় জানালেন গত দুই সপ্তাহ ইনসুলিন বন্ধ। এখন শরীর অত্যন্ত দুর্বল। হাঁটতে গেলে মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছেন। গ্লুকোমিটারের গোটা দুই স্ট্রিপ অবশিষ্ট ছিল। তাই দিয়ে সুগার মাপলাম। পাঁচশো বত্রিশ। বললাম, 'ইনসুলিন না নিলে তুমি শিওর মারা পড়বে।' ... পুরুষটি বললেন, 'ডাক্তারসাব, পনেরো তারিখে লকডাউন উঠলেই বাড়ি ফিরব। হাতে টাকা পয়সা নেই। খাওয়া জুটছে না। বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দেবে বলেছে। তার আগে যমুনাকে খাড়া করে দিন।' একজন সহৃদয় মানুষের সাহায্যে এক ভায়াল ইনসুলিনের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু মহিলা যে ডোজে ইনসুলিন নেন, তাতে খুব বেশি দিন চলবে না। তাতেই তাঁরা খুব খুশি। বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, যদি আচ্ছে দিন সত্যিই আসে, তাহলে আবার দেখা হবে। তখনও আমরা কেউই জানিনা লকডাউন ৩০ শে এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যেতে যেতে মহিলাটি আবার ফিরে এলেন। আমায় অবাক করে ছেঁড়া চটের ব্যাগ থেকে একটা নতুন হেলথ ড্রিংকস এর কৌটো বার করলেন। যেটার বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয় এটা খেলে বাচ্চার তিনগুণ বেশি বুদ্ধি ও শক্তি হবে। মহিলা তাঁর বিচিত্র ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'যদি এটা রোজ দু-চামচ করে মেয়েকে খাওয়াই, তাহলে মেয়ের এই মহামারীতে কিছু হবে নাতো।' আমি গালাগালি দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। কাকে গালি দেব? সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখতে চাওয়া ওই অশিক্ষিত মা-কে? ... ...