জয়দেব মাঝি আমাকে কোলে নিয়ে নৌকায় বসিয়ে দেয়। দাদু পাশে বসতেই আমি ফিসফিস করে বলি, আমি সবসময় তোমার হাত ধরে থাকবো মাদলা গ্রামে গিয়েও, দেখো তুমি। পৌষের মরা করতোয়া তখন ঢেউ হারিয়ে নিশ্চুপ। নির্বিকার সে নদীর বুকে বৈঠা আছড়ে পড়লে যেটুকু আলোড়ন উঠছে, তা নিমেষেই কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে। ওপার এখন খুব কাছে চলে এসেছে। অল্পসময় পড়েই ঘাটে লাগে নৌকা। আমি পাড়ে আইনুল চাচা কে দেখে চেঁচিয়ে উঠি, আইনুল চাচা। ঘাটের পাড় ঘেঁষা জমিতে এখন সবুজ সর্ষে গাছ। গায়ে গা লাগানো গাছগুলো সবুজ চাদরের মতো পড়ে রয়েছে জমির বুকে। ও দাদু, এটা আমাদের জমি? এটা কাদের জমি? কীভাবে বুঝতে পারছো এটা আমাদের জমি না? আমাদের জমি চিনতে পারবে তো? ... ...
এই আমলক, কলস, উল্টোনো পদ্মফুল- হিন্দু শিল্পরীতির প্রভাবগুলো কিন্তু মুঘল আমলের অনেক আগে থেকেই ভারতীয় মুসলিম শিল্পে দেখা যায়। সৈয়দ ও লোদী বংশের সমাধিসৌধগুলোতে এদের দেখা পাওয়া যায়। বরং সেইযুগের কিছু হিন্দু প্রভাব, যেমন মকরতোরণ তাজমহলে নেই। মকরতোরণ হল দরজার উপরে দুদিকে মকরের মত দেখতে ভাস্কর্য যা হিন্দু মন্দিরে বহুপ্রচলিত। ভারতীয় গম্বুজের সূচনা ত্রয়োদশ শতকে বলবনের সমাধির মাধ্যমে। প্রথমে অর্ধগোলক আকৃতি থেকে শুরু করে, ইউরোপীয় গম্বুজগুলি একটু সঙ্কুচিত হয়ে মোচার আকৃতি নেয়, কিন্তু ভারতীয় এবং রাশিয়ান গম্বুজগুলি তাদের মধ্যদেশকে কিছুটা স্ফীত করে পেঁয়াজের আকার ধারণ করে । হয়তো এই পেঁয়াজের আকারটা আসলে পদ্মের আকৃতি। মন্দিরের ছাদ থেকে ঝুলানো পাথরের বা পোড়ামাটির তৈরি উল্টানো পদ্ম এর অনুপ্রেরণা হতে পারে। তাজমহলকে শুধু শাহজাহানের সৃষ্টি বললে এর সঙ্গে যুক্ত ডিজাইনার, আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়ারদের অবজ্ঞা করা হবে। তাঁদের ব্যাপারেও জানা যাক। সব মিলিয়ে ৩৭ জন ডিজাইনার এবং আর্কিটেক্টের নাম মুঘল সরকারি নথি থেকে পাওয়া যায় যাঁরা তাজমহলের প্রধান স্থপতিদের মধ্যে ছিলেন। ... ...
এর ঠিক দুদিন পরেই এসে পড়ল সেই অভিশপ্ত দিন, ৬ই ডিসেম্বর। তারপর সারা ভারত জুড়ে তাণ্ডব – এমন কি এই কলকাতা শহরেও আমার জীবনের সেই প্রথম কার্ফিউ দেখা। সুমনের বসে আঁকো তখনও বেরোয়নি – মগজে কারফিউ শব্দবন্ধ তখনো অচেনা, শহরে কারফিউ চিনে ফেললাম। কিন্তু দাঙ্গা হল না পশ্চিমবঙ্গে। রাজাবাজার, খিদিরপুর, পার্ক সার্কাস, কোথাও না। আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল শহর – কিন্তু মনের কালো ছায়াটা সরছিল না কিছুতেই। উত্তর ভারত জুড়ে চলমান অশান্তি – আদবানীর গ্রেপ্তারী, খবর আসছিল সবই, যদিও খবরের কাগজই ছিল আমাদের প্রধান ভরসা – আর ডিডি ওয়ান এর সংবাদ। আর এসবের মধ্যেই ১৯ তারীখে এসে পড়ল বাবা, মা, বোন – কুচবিহার থেকে। তিনদিন গজল্লা পাড়ার পরে ২১শে সন্ধেবেলা ট্যাক্সি ধরে সোজা হাওড়া - রাতে ম্যাড্রাস মেল সাড়ে দশটায়। স্লিপার থ্রি-টায়ার। থ্রি-এসি তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে, এসি কামরা বিরাট বড়লোকেদের ব্যাপার। ... ...
সে গাছগুলো কিন্তু ভগবান যে কদিন জল দিলেন, সে কদিন বাঁচল। মানে, বড়জোর মাস দুই। আবার পরের বছর সিক্সথ জুন। ইতোমধ্যে দুজন ফোটোগ্রাফার টস্কে গেছেন। নতুন যাঁরা এলেন, তাঁদের একজন একটু ছটফটে। খুব মৃদুস্বরে তাঁর কানের গোড়ায় কেউ বলল, ভাই, কনুই মারবেন না, বুঝতে পারছি সার্কিটে নতুন। আমি অল্পেশ গোস্বামী, নামটা বোধহয় জানা আছে। সারা জীবনের মত পুটকি জ্যাম করে দেব। ফ্ল্যাশ, ক্লিক্, ঝাঁঝরি কাড়া, পাঞ্জাবী ভেজা, সাপলুডো, ইত্যাদি। রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিপ্লে।মায়া কেটে গেল এক নিমেষে। মায়া নাকি কাটে না? অরুণবাবু সামান্য মাইনের চাকরি করেন ইস্কুলে। একটা খুব দামি কলম নিয়ে এসেছেন। বকলাম, এটা কী করলেন, এত দামি – উনি বললেন, চুপ স্যার, একদম চুপ। এক ভদ্রলোক একটা বিশাল বড় বাতাবি লেবু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে কোনও দিন দেখেছি বলেই মনে পড়ছে না, কোনও উপকার করা তো দূরে থাক। বললেন, আমার বাগানের স্যার। আরও অনেকে ঘুরছেন খবরের কাগজে কিছু জড়িয়ে। আমার ব্যাগে একটা বিশাল সন্দেশের বাক্স কে যে ঢুকিয়ে দিল পেছন থেকে, বুঝতেই পারলামনা। বিমলি কাছে আসছেনা, দূরে গাছের আড়াল থেকে দেখছে। সুকুমার চোখ মুছল কবার। এ মায়া প্রপঞ্চময়। চলো মন নিজ নিকেতনে। ... ...
পায়ে পায়ে মিছিল এগিয়ে চলেছে, কলকাতার রাস্তা দিয়ে। হাজরার মোড় থেকে কালীঘাট হয়ে দেশপ্রিয় পার্ক। প্রায় তিনশো জন নারী, হাতে মোমবাতি, মুখে স্লোগান - ""৮ই মার্চ দিচ্ছে ডাক পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক''। এই বছর, ২০১০ সালে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একশো বছর পূর্ণ হল। ঐ মিছিলের শেষের দিকে কিছু অল্পসংখ্যক মেয়ে, তারা বয়ে নিয়ে চলেছে রামধনু পতাকা। গলা মেলাচ্ছে মিছিলের বাকি মেয়েদের সঙ্গে। কিন্তু মাঝে মাঝে ওরা আরো বলে উঠছে - ""তোমার আমার অংশীদারী, সমকামী তবুও নারী''। সেই সুরে সুর মেলায় মিছিলের শেষের দিকের সকল নারী। রাস্তার দু'ধারের মানুষেরা অবাক চোখে দেখতে থাকে সবাক সমকামী নারীদের। মিডিয়ার ক্যামেরার বিশেষ নজর কাড়ে ওরা। ... ...
শুভ যোগ বলুন আর ত্রহ্যস্পর্শ মাইনাস ওয়ান, এমন কেলোর কীর্তি এর আগে হয়েছে কি? নারীদিবস আর দোল এবার পিঠোপিঠি। ওদিকে গালে রঙ কত জমেছে কে জানে, আমাদের লেখা জমে গেছে বিস্তর। টেকনিকাল টিমের হুড়কোয় এতদিন চুপচাপ থাকলেও এই মওকা আর ছাড়া গেলনা। জমে যাওয়া জিনিসপত্তর থেকে তুলে নিয়ে কিছু ছড়ানো-ছেটানো লেখা তোড়ায় বেঁধে হাজির করা হল এবারের স্পেশাল বুলবুলভাজায়। নতুন ভার্সানে নতুন গুরু এলে নতুন বুলবুলভাজা আবার বেরোবে। কিন্তু তার আগেই, এই সুযোগ, আর ছাড়াছাড়ি নেই। কত বাড়ি দেখা হল। এখনও তো বেশি বড় হইনি। যখন মায়ের মতন হব তখন আরো কত বাড়ি দেখব। কত ভাল কত খারাপ। মায়ের মতন বড় হওয় অব্দি কি বাড়িতে বাড়িতে কাজ করতেই থাকব? না আমি ভাবি যে বাবাকে বলব আমকে বিয়ে দিও না, আমাকে তোমার পার্টিতে নিয়ে নাও। দাদা আছে, আমিও থাকব। আমাকে ঐ চক্চকে সানাইএর মত বাঁশিগুলো বাজাতে দেবে। আমি তো বাজাতে পারি। যখন বাবা থাকে না, আমি একএকদিন বাজাই। জামাইদাদাও এগুলোই বাজায়। ওরা যা বাজাতে বলে সব বাজাতে পারি। আমি তো আর দাদার মতন নেশা খাব না, দুটো পয়সা পেলে ঘরেই আনব। বলব বাবাকে। ... ...
প্রথমদিন হাঁড়ি দুটো কথকের বাড়ির পাশে রক্তকরবী গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হল। তাদের খাবার দেওয়া হল দু-ঘটি জল আর দুমুঠো মাটি। টিভিতে শুনে তারা হিন্দি গান পটাপট গলায় তুলে ফেলল। কয়েকদিন পর তাদের স্থান হল মাটির হাঁড়ি থেকে অ্যালুমিনিয়ামের ডেচকিতে। সুষম খাদ্য তালিকা অনুযায়ী তাদের খাবার দেওয়া হতে থাকল। ভুজু ডিবরা গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময় কথককে অনুরোধ করে গেল ‘গাঁইয়া ভূত’ বলে তাদের যেন অনাদর না করেন, সর্বদা যেন সন্তান স্নেহে ‘মানুষ’ করেন। সত্যিকারের কোনো দোষ করলে আচ্ছা করে কানমলা দিয়ে শাস্তি দিতেও যেন না ভুলে যান। ... ...
টাকার চিন্তায় যখন পাগল পাগল লাগে, তখন মনে হয়, আমি বোধ হয় কাকীদিদা হয়ে যাচ্ছি। কাকীদিদা আমার মায়ের কাকীমা - প্রথমদিকে সত্যি টাকার দরকার ছিল, পরের দিকে ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত, মা কে তারা দিব্যি যত্নেই রেখেছে - তখনও দুপুরবেলায় বেরিয়ে পড়ত কাকীদিদা - বাসে চেপে, রিক্সায় এর বাড়ি তার বাড়ি- 'দিবি রে পঞ্চাশটা টাকা? খুব দরকার। সামনের মাসেই দিয়ে দেব'। অদ্ভূতভাবে মারা গিয়েছিল। কাকীদিদার ছোটো বাড়ি - একতলাই ছিল, বহুবছর পরে ছাদে একখানা ঘর তুলেছিল। বড়মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল সেই ছাদে ; কে যেন বলেছিল, মেয়ের বিয়ে দেখতে নেই না কি -কাকীদিদা তাই ছাদের লাগোয়া ঘরেই বসে ছিল , ছাদের দিকে দুটো জানলায় পর্দা টানা। ওদিকে বিয়ের আসরে মালাবদল, শুভদৃষ্টির সময় ছবি তুলছে সবাই; হঠাৎই কাকীদিদার এক বোনপো 'একি একি মেজমাসি জানলায় উঠে কী করছ' বলে চেঁচিয়ে উঠতে কাকীদিদা জানলার রড ছেড়ে ঘরের মেঝেয় ধড়াম করে পড়ল। ... ...
পয়লা একলা - ঐ একই হলো, এমনিতেও পয়লা হলে সচরাচর একলা হয়। সে যাই হোক, সংক্রান্তি পেরিয়ে গেল, আজ কবিতার শুভ হালখাতা মহরৎ। কবিতার ভৌগোলিক গন্ডী হয়না, কিন্তু সাহিত্যের ভূগোল কিছু থাকে তো। ক'দিন আগেই আলোচনা হচ্ছিল বাংলা সাহিত্যের কলকাতা-কেন্দ্রিকতা নিয়ে। সেই ভূগোলের সীমানা ভাঙার চেষ্টা করছি, আপাতত তার সামান্য ছোঁয়া এখানেও থাকবে। হুগলী কপোতাক্ষ আড়িয়াল খাঁ বুঢ়া লুঈ ছুঁয়ে সুদিন আসুক, নতুন বছরের কবিতা পড়ি আমরা। এই পর্বে লিখছেন যশোধরা রায়চৌধুরী, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, মিঠুন ভৌমিক, সোমনাথ রায়, জারিফা জাহান, সায়ন কর ভৌমিক, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সুমন মান্না। প্রকাশিত হল নববর্ষ ১৪২৫ সংখ্যার প্রথম পর্বের কবিতাগুলি। খুব শিগ্গিরই বেরুবে আরো কবিতা, এই সংখ্যার পরের পর্বে। ... ...
গাঁওবুড়ো এক যাত্রাপথের গল্প। বলে যেতে পারে হাঁটার গল্প। হাঁটতে হাঁটতে সুখ অনুসন্ধানের গল্প। সুখ এখানে বিভ্রম। কিন্তু সন্ধানটা জরুরি। যে সন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সুখের স্বপ্ন দেখায়। মানুষ তো সুখের সন্ধানে বাঁচে। সমস্ত প্রাপ্তির মধ্যেও আরেকটু সুখ বা সমস্ত অপ্রাপ্তির মধ্যেও সামান্য সুখের সন্ধান করে। ‘গাঁওবুড়ো’ তেমনই এক গল্প যেখানে বিভ্রমকে সামনে রেখে বিভ্রমের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করে জনপদ জীবনের চরম অর্থনৈতিক অস্বচ্ছন্দতার নিত্য নৈমিত্তিক দিনলিপি। রাঙা পথের জীর্ণ চিত্রে জার্নির ক্লান্তিতে মেঠো সুরে ব্যক্তি ও সমষ্টির ব্যথিত কোলাহল সহ রূপহীন-রংহীন মানুষের সমস্ত না পাওয়া ও পথের দিকে চেয়ে থাকার উদাসীন সোপান। যে ভূগোলে কিছুই নেই, যেখানে বাঁচার তীব্র আকুতি নিয়ে মানুষ বাঁচে-স্বপ্ন দেখে, সেখানে কেউ কেউ অলীক জাল রচনা করে আরও দুই মুহূর্তের স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে যায়, ‘গাঁওবুড়ো’ সেই স্বপ্ন হাতছানির গল্প। ... ...
গরম একটা স্ট্যাটাস দিয়েই চায়ের দোকানে বসে নারী দেশ চালাচ্ছে বলেই গোল্লায় যাচ্ছে দেশ, দেশের নারী কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়ে, সামনে দিয়ে কোন নারী গেলে তাকে এক্সরে করে আগাপাসতলা দেখে নিয়ে তারপরে যেতে দিয়ে দেশ ও সমাজের প্রভূত উন্নতি সাধিত করে আমাদের দিন যায়। আমাদের মাথায়ই ধরে না সেনাবাহিনীর মত জায়গায় নারী কী করে সুযোগ পায়? কিছু জিনিস তো পুরুষের হাতে থাকা উচিত, তাই না? সব কাজ কী সবাইকে দিয়ে হয় নাকি? যে রাস্তায় জ্যাম দেখবেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন সামনে নিশ্চিত কোন নারী সার্জেন্ট বসে আছে, আরে দেখতে হবে না, এইটা আমরা জানি! নারী চাকরি করবে না এমন না, অতটা খারাপ মানসিকতার মানুষ আমি না। নারী চাকরি করবে স্কুলে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা পদটা তো তৈরিই হইছে নারীদের জন্য। এরপর আছে ব্যাংকের চাকরি। কি দারুণ সুযোগ নারীদের জন্য। বেশি জটিল কাজ দেওয়ার দরকার নাই, প্যাচগুজ লাগিয়ে ফেলতে পারে। এই ধরেন রিসেপশনিস্ট হিসেবে নারীর বিকল্প আজও আবিষ্কার হয়নি। সাজুগুজু করে বসে থাক, কেউ আসলে মিষ্টি করে হাসি দাও, স্যার একটু ব্যস্ত আছে বলে বসায় রাখ! সোজা কাজ, কোন ঝামেলা নাই। ... ...
ক্রিকেটের মতোই মেয়েদের হকি ভারতে দুয়োরানীর মর্যাদা পেয়ে এসেছে তাদের পুরুষ দলের তুলনায়। এক্সপোজার কম, টুর্নামেন্ট কম, শারীরিক সক্ষমতা কম সর্বোপরি মানসিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া। কিন্তু ওই যে ওপরে বললাম, যাদের প্রতিনিয়ত সমাজের সঙ্গে মেয়ে হিসেবে, খেলোয়াড় হিসাবে এবং সমাজ ব্যবস্থার শিকার হিসাবে লড়তে হয় তারা বোধহয় এতো সহজে হার মানে না। ... ...
কেইএম হাসপাতালের প্রাক্তন মেট্রন দুর্গা মেহেতা-কে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রশ্ন করা হল, কেন তিনি ও তাঁর অন্যান্য নার্সরা চাননি অরুণাকে নিষ্কৃতিমৃত্যু দেওয়া হোক l উত্তরে তিনি টিভির পর্দায় জানালেন- আমাদের অধিকার মানুষকে বাঁচানোর, হত্যা করার নয় l অরুণা আমাদেরই একজন ছিল l তুমি নিশ্চয় চাইবে না তোমার কোনো প্রিয়জনকে এভাবে হত্যা করা হোক l (We have right to give life to anybody, not the right to kill anybody. She was one of us. You don’t want your family member to be killed.) এ আবেগসর্বস্ব বক্তব্যের সাথে একমত হওয়া কোনো যুক্তিনির্ভর মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয় l তবে, অরুণার শায়িত শরীরের সাথে আবেগ ব্যতিরেকে আরও টুকরো টুকরো কিছু বাস্তবতা জড়িয়ে ছিল l নার্সরা জানান- অনেক বছর আগে জন্মদিনে একবার অরুণাকে মাছের টুকরো ভেঙে খাওয়ানো হয়েছিল l অরুণা নাকি সেদিন খুশি হয়েছিল খুব l তার ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠেছিল l বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল আপাত-ভাষাহীন চোখ l মনে পড়ে যাচ্ছে ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ ছবির আনন্দভাই-এর কথা, যে একমাত্র মুন্নার প্রশ্নের উত্তরেই ‘পলক ঝপককে’ জবাব দিত, আর বাকিদের কাছে সে ছিল স্রেফ একটা ‘কেস’ l ... ...
পঁচাত্তরে চাকরী পেলাম আমি। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে শেষে। উনআশি তে বিয়ে করলাম শম্পাকে। আশীর মাঝামাঝি মনে হয়। তখন আমাদের ফ্লাটেই আড্ডা মারতাম সবাই। এক রবিবার সকালে হঠাৎ ঘনঘন "পেটো"র শব্দ। একেবারে আমাদের ফ্লাটের সামনে। রাস্তার ধারের ঘরে বাবা থাকতেন। স্পিন্টার ঢুকে এল ঘরে। বাইরে থেকে চিৎকার করে কে বললো - জানলা বন্ধ করে দিন। আমাদের ফ্লাটে তখন বন্ধুরা সবাই। বেশ কিছুক্ষন পর অবস্থা শান্ত হলে বেরিয়ে শোনা গেল মিল্কডেয়ারীর ভাঙা বোতল আর স্ক্রাপ কে পাবে তাই নিয়ে দু দল কংগ্রেসী দের মধ্যে ঝামেলা। তখন বোতলে দুধ দেওয়া হত। বড় বড় দুধের গাড়ি বেরতো ভোরের আলো ফোটার আগেই। ... ...
জামু ছেলেটা খায় খুব তৃপ্তি করে, যাই দেন সব চেটেপুটে খেয়ে নেয় শুধু মাছটা ছাড়া। মাছ দিলে কেমন যেন খিমচে খিমচে মাছ ছাড়ায় কাঁটা থেকে, খেয়াল করে দেখলে ওর অস্বাচ্ছন্দ্য নজরে পড়ে বৈকী। তা হিন্দী কথা যারা বলে, তারা অনেকেই মাছটাছ মোটে খায় না জানেন সরলা। কিন্তু এ ছেলে ঠিক নিরামিষাশি তো নয়। একদিন মাংস হয়েছিল, ইতস্তত করে জিগ্যেস করেছিলেন মাংস খাবে কিনা? শুনে মুখটা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল, খেয়েওছিল ভারী তৃপ্তি করে। মাংস খায় যখন নিশ্চিন্তেই মাছ দিয়েছিলেন সরলা। হয়ত ওদের কানপুরে মাছ পাওয়া যেত না, তাই খেতে শেখে নি ভাবেন আর চেষ্টা করেন ডাল তরকারি বেশি করে দিতে। মাছটা নাহয় আর দেবেন না ওকে, ভাবতে নিজের কাছেই মাথা হেঁট হয়ে যায় তবু না ভেবে পারেন না – ছেলেটা মাছ না খেলেও একটু সাশ্রয় হয় বৈকি। বাড়ির কথা কিছুই বলতে চায় না ছেলে, জিগ্যেস করলেই ওর চোখ মুখ কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় আর খুব অস্থির হয়ে ওঠে, একদিন না খেয়েই দৌড়ে চলে গেছিল, তারপর থেকে খুব সাবধানে ওর সাথে গল্প করেন। ঝুনু টুনুকেও বলে দিয়েছেন বাড়ির কথা জিগ্যেস না করতে। তা বাদে কতশত গল্পও যে জানে ছেলে! দিল্লীতে থাকার সময় রোজ নাকি সকালে উঠে স্টেশানে চলে যেত, সেখানে গিয়ে ট্রেনে উঠে জায়গা রাখত। পাকিস্তান থেকে আসা ট্রেন ফিরতি যাবার জন্য ছাড়ত অনেক পরে – ততক্ষণ জামুরা দলবেঁধে উঠে জায়গা দখল করে বসে থাকত। পরে পাকিস্তানযাত্রী সব ‘রহিস আদমী’রা এলে তাদের কাছে পাঁচ টাকা করে নিয়ে সিট বিক্রি করে দিত। ... ...
সাধারণভাবে কোনও বই পড়া শুরু করার আগে আলাদা করে কোনও মানসিক প্রস্তুতি নেবার দরকার হয় না – কিন্তু এই বইটা পড়ার আগে আমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হয়েছিল। বইটা পড়ার জন্য হয় তো আগে থেকে ঘটনাটার কিছু না জানলেই ভালো হত, একটা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বইটা পড়ে একটা মতামতে পৌঁছনো যেত। কিন্তু এটা কোনও কাল্পনিক গল্পের বই নয়, কঠিন বাস্তবের ন্যারেশন। এই ন্যারেশনের একটা অংশ আমি জানি, জানতাম, ঘটনার শুরু থেকেই আমি নজরে রেখেছিলাম, নিজের মত করে খবর জোগাড় করতাম, পড়তাম, ফলে নিজের অজান্তেই একটা মত – সহজ ইংরেজিতে যাকে বলে ওপিনিয়ন, আমার তৈরি হয়ে ছিল। ফলে পুরোপুরি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই বই পড়া আমার পক্ষে আর কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। আমি জানতাম, বইটা পড়ে ফেলার পরে আমি ঠিক আগের মত স্বাভাবিক থাকতে পারব না, বইটা আমাকে ধাক্কা মারবে জোরে, আর হন্ট করে চলবে অনেকদিন ধরে। পড়বার পরে বুঝেছিলাম, আমার এই ধারণা অমূলক ছিল না। ... ...
ওর আঙুলগুলোর দিকে তাকাই। লম্বা,সরু,ফিকে প্রবাল রঙের। ওই আঙুল আমার হাতের মুঠোর মধ্যে গুঁজে দিচ্ছে… কোথাও একটা প্রজাপতি আস্তে আস্তে ডানা ঝাপ্টাতে থাকে। কিম্বা দুটো? পাঁচটা? ফিরতে অনেক রাত হয়েছিলো। ভয়েডকে দেখতে পাইনা এসে। আজকাল মাঝেমাঝেই পাইনা। কোথায় যায় কে জানে?কখোনো জিজ্ঞেস করিনি। কোনো কোনোদিন অনেক রাত্রে আধোঘুমের মধ্যে গালের ওপর ওর নিঃশ্বাস টের পাই। ফিসফিস করে বলে “আই নো, ইউ হ্যাভ সামওয়ান এলস অন ইওর মাইন্ড”। আমি ওর কথার খেই ধরতে চাই – “আই নো…”, বাক্য শেষ হবার আগেই আধোচেতনা আমার জিভকে আচ্ছন্ন করে। আবল্লী আমাকে আস্তে আস্তে টেনে নিতে থাকে। যেন কেউ খুব নরম একটা কম্বল দিয়ে আমায় মুড়ে দিচ্ছে। বহুদিন হারিয়ে থাকা একটা কম্বল। আমি আবল্লীর মধ্যে তলিয়ে যাই। তলিয়ে যাওয়া বেশ ভালোই জিনিস। গভীরে। ... ...
নটেন হাঁ করে বড়ো ছেলেকে দেখতে থাকে, দেখতে থাকে নির্নিমেষ। সে একবার ভাবল বাকি ভাত ক'টি কি সত্যেনকে খাইবে দেবে? ফের ভাবে থাক, ভাতটা ঢাকা দিয়ে এখন ছেলেকে খাটে শুইয়ে দেবে? সত্যেন কি অসুস্থ? নাকি ক্ষুধায় মুমূর্ষুপ্রায়? সত্যেনের ওয়াক ওয়াক স্তিমিত হয়েছে। সাপের নিশ্বাসের মতো ফ্যাঁসফেসে শব্দ বেরোচ্ছে এখন মুখ দিয়ে। নটেন কুপি তুলে ধরে সত্যেনের মুখের কাছে ধরতে গেলে তেল ফুরিয়ে যাওয়া কুপির শিখার টুপ করে নিভে-যাওয়া নিপূণ অন্ধকার। ঘরের ভেতরের কুপিটির আলোয় মাটির দেয়ালে আবছা দেখা যাচ্ছে সত্যেনের মা আরতি মরার পর কাগজের ওপর নটেনের নেওয়া পদতলের আলতার জোড়াছাপের ফটো। আধো আলোয় অন্ধকারে দূর থেকে প্রাচীন মথের মতো দেওয়ালে সে পদচিহ্ন। ... ...