ছুটতে ছুটতেই দারিয়ানাসু লুকোনো দরজার দূরত্ব মনে মনে মেপে নেয়, মনে মনেই একবার হাসে। নিশ্চিন্ত হবার হাসি, পেছনে ছোটা ঘোড়সওয়ারদের বোকা বানানোর হাসি। আরও পিছনে হৈ-হৈ করতে থাকা লোকগুলোকে এখন দেখা যাচ্ছে না, টিলার আড়ালে হারিয়ে গেছে। ঘোড়সওয়ারদেরও দারিয়ানাসু আগেই বোকা বানিয়ে দিতে পারত, হরিণের মতো ছুটতে পারে সে, কিন্তু পিঠের দামি বোঝাটা ফেলে দিতে চায়নি। অবশ্য তাতে কিছু ক্ষতি হয় নি তার, আর বিশবার শ্বাস নিতে-না-নিতেই সে পৌঁছে যাবে লুকোনো গোল দরজার পাশে। ব্যাস, তারপর একটা ছোট্ট লাফ, তারপর দু’পলকে দরজার ফাঁকটুকু বুজে যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ, ঘোড়সওয়ারগুলো বুঝতেই পারবে না কোথায় ভ্যানিস হল তাদের শিকার। ছাউনিতে গিয়ে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবে অন্যদের কাছে, বলবে ভুতুড়ে মানুষের কথা, যাদের দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। ... ...
শাসককুল? আচ্ছা, এ নিয়ে তাঁর কেন মাথাব্যথা হবে? তিনি কে? তিনি তো সামান্য রাজভৃত্য মাত্র! মাতা সত্যবতী যখন যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন কি তাঁকে বলেছেন যাওয়া উচিত হবে কিনা? তাঁকে ডেকে শুধু যাবার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে মাত্র। ব্যাস! তাহলে? তিনি এবং প্রাসাদের কঞ্চুকী প্রধানের মধ্যে পার্থক্য কি? ক্লান্ত, শ্রান্ত একজন মানুষ তিনি। লোকে বলে এই প্রাসাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম আনুগত্য। না। এটা লোকের ভুল ধারণা। তাঁর আনুগত্য তাঁর শপথের কাছে। এই বংশকে তিনি অনেককাল আগেই ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁর বোধ তাঁকে বাধা দিয়েছে। একের পর এক বিপর্যয় সঙ্গী হয়েছে কুরুবংশের। কোনো সময়েই শাসনকে স্থায়ী এবং বিপর্যয়মুক্ত দেখেননি তিনি। চলে যেতেই পারতেন! কিন্তু মন বলেছে এভাবে চলে গেলে লোকে বলবে দেবব্রত রাজ্য শাসন করার সুযোগ পায়নি বলে চলে গেল। পিতার জন্য স্বার্থত্যাগ করা থেকে যে ফাঁদ শুরু হয়েছে সেই ফাঁদেই তিনি বন্দী হয়ে পড়েছেন। কোনোদিন ভাবতেই পারেননি কি এই লোকসমাজ? কী ভূমিকা আছে এর? তাঁর জীবন কেমন করে চলবে তা এ নির্ধারণ করার সাহস পায় কোথা থেকে? এসব কিছুই তিনি কখনো ভেবে উঠতেই পারেননি। অথচ তিনি যেমন শান্তনুর সন্তান তেমনই তিনি তো গঙ্গারও সন্তান। তাহলে মায়ের চরিত্রের স্বাধীনতা বোধ কেন তাঁর এল না? এ প্রশ্ন আজ এতবছর পরে এসেছে তাঁর মনে! আবারও যখন ব্যাস তাঁর সাহয্য চাইছেন কুরুবংশকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তখন তিনি ভাবতে বসেছেন। ... ...
মেহমুদের সংসার জীবন অনুল্লেখিত, বোঝা যায় তার সচ্ছলতা আছে কিন্তু চিত্তে শান্তি নেই। রাতের একটি দৃশ্যে দেখানো হয় – ইউসুফ ও মেহমুদ দুজনেই দেখছে রান্নাঘরে ইঁদুর-কলে একটা ইঁদুর আটকে পড়েছে। ব্যাস, আর কিছু বলা হয় না। ঘর গৃহস্থালিতে এ খুবই সাধারণ ঘটনা, ফলে দৃশ্যটিকে মূল গল্পে আরোপিত বলে মনে হয় না। অথচ বহুবিধ অর্থের ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ দৃশ্যটি। এই সৌন্দর্য-ব্যঞ্জনা কিন্তু শুধুমাত্র বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে তৈরি হয়নি, বরং নির্মাণ রীতিই অনেকাংশে একে দিয়েছে মহার্ঘ্যতা। পরিচালকের নাম ‘নুরি বিলজ সেলান’ (Nuri Bilge Ceylan) (১৯৫৯-)। ... ...
আছড়ে পড়ার শব্দে মুখ তুলে তাকায় মনীষা। চিলের ছানা মনে হলো । নাকি পায়রা। রেস্টোরান্টের পুরু কাঁচের ওপাশে উড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে, সড়সড় নেবে গ্যালো। মনীষা কফিতে মন দেয়। কমলেশের দিকে চিনির প্যাকেট এগিয়ে, কফিতে এক চুমুক দিয়ে, শূন্য কাঁচের দিকে তাকায় আরেকবার। কোনো আঁচড়ের দাগ নেই। কফিকাপ নাবিয়ে রেখে স্পষ্ট তাকিয়ে বলে - না , কাকু । এই অনুরোধটা করবেন না । আমি যা সত্যি বলে জানি , তার বাইরে গিয়ে গল্প সাজানো সম্ভব নয় ... ...
রমা তার থেকে দূরে সরে যেতে থাকে এই অনুযোগ করেই, যে অমর ঐ উপন্যাসে তাকে "কাঁচামালের' মত ব্যবহার করেছে। কিন্তু অমরের মতে সমস্যা এটাই - ""যে সম্বন্ধ সে তুলে ধরবার চেষ্টা করছে তা নিয়ে যদি সে নাটক করত তাহলে এ আলোড়ন হত না। সে যদি এমন আষ্টেপৃষ্টে নিজেকে বেঁধে না ফেলত তার বইয়ের সঙ্গে, তাহলে তার মা এমন মর্মান্তিকভাবে অভিভূত হতেন না, আত্মীয়স্বজনেরা এমন ভাবে চাইত না তার দিকে। লোকে জানত অমর আজকাল সাহিত্য করছে। সেখানেই চুকেবুকে যেত ব্যাপারটা, কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামাত না। কিন্তু তার বই পড়ে এ কথা সুস্পষ্ট যে এ বই লেখকেরই এক অবিচ্ছিন্ন ডায়েরী। ডায়েরীর মত নগ্নভাবে প্রায় শিল্পকে বিপন্ন করে নিজেকে মেলে দেওয়ার চেষ্টা অনেকেই নিতে পারেনি।'' অংশটিতে আমার চোখে পড়ে "আষ্টেপৃষ্টে নিজেকে বেঁধে না ফেলত' এবং "অবিচ্ছিন্ন ডায়েরী' শব্দগুলি। এই শব্দ কটি জীবনানন্দ দাসের সমগ্র গদ্যকর্মের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পারি কারণ এ আমরা পড়েছি যে জীবনানন্দ দাস উপন্যাস সম্বন্ধে 'diversified autobiography' - র প্রসঙ্গ এনেছিলেন এবং তাঁর দিনলিপি ও "লিটারারি নোটস'-এর মধ্যে কোন ফারাক থাকে না। বলতে পারি , উপন্যাসের অমর আর জীবনানন্দ দাস দুজনের প্রকল্পই যেন উপন্যাসের মাধ্যমে কীভাবে নিজের জীবনকেই অনুসরণ করা যায়, কীভাবেই বা নিজের জীবনকে আবিষ্কারের বিষয় করে তোলা যায় তারই অনুসন্ধান। অসীম রায়ের অন্বিষ্টও কী এটাই ছিল? ... ...
সাহিত্যে লিখে দেওয়া যত সহজ চলচ্চিত্রে করে ফেলা ততটাই কঠিন। চলচ্চিত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণত ভাঁড়ামোয় পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। এব্যাপারটা আমাদের দেশে সত্যজিৎ রায়ের থেকে ভালো আর কেউ বুঝতেন না। এর কারণ শুধুমাত্র এই নয় যে সিনে-টেকনিক বা সিনে-প্রকরণবিদ্যার উপর তাঁর দখল ছিল ঈর্ষণীয়, এর সঙ্গে এটাও সত্যি যে তাঁর আঠাশটি পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের ছবির মধ্যে কমবেশি বাইশটিই অন্যের লেখা সাহিত্য থেকে করা! ফলত তুলসীর সহজাত অভিনয় ক্ষমতা ও মৌখিক-দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে যতটুকু করা যায় তাই করেছিলেন সত্যজিৎ ... ...
এই যে বিভিন্ন দল এলজিবিটিকিউদের নিয়ে কথা বলে, তারা নিজেরা কতটা আন্তরিক? আপনি বলতেই পারেন, খেতে পেলে শুতে চায়। রাজনৈতিক সমাবেশে খান দুই রামধনু পতাকা ওড়াতে দিয়েছি, একজন বক্তা এলজিবিটিকিউদের জন্য একটা বাক্য বলেছেন, এই না কত। এটুকুই বা কে করে? ... ...
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরো টুকরো হয়েছে। একদা এই পনেরোটি রিপাবলিকের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল রাশিয়ান। কালিনিনগ্রাদে যখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে, পুবে দিওমেদ দ্বীপে তখন পরের দিনের ভোর সাড়ে পাঁচটা – সর্বত্র ভাষা এক। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া থেকে কাজাখ অবদি সবার নিজস্ব ভাষা আছে, ছিল। তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় রাশিয়ান। নইলে রাজ্য শাসন অসম্ভব। যেমন আমাদের শাসকরা চাপিয়েছিলেন ইংরেজি, সেটিকে আমরা আঁকড়ে ধরেছি। বাইরের জগতের পাসপোর্ট এটি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে রবার্ট ক্লাইভকে হারাতে পারলে ফরাসি আমাদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হত! ... ...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুরমানসকের ভূমিকা বিশাল। জার্মানদের রাশিয়া আক্রমণের পর এই বন্দর দিয়েই মিত্র শক্তি সাহায্য পাঠাতে থাকেন। লেনিনগ্রাদ ও স্টালিনগ্রাদের মত মুরমানসক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি হিরো সিটি বা বীর শহর নামে পরিচিত। শহরের প্রায় চুড়োয় একটি বিশাল মূর্তি আছে, তার নাম আলইশা। সেটি সেই সংগ্রামের স্মারক। নিচের কোলা উপসাগরে বরফ ভেঙে সমুদ্রপথ পরিষ্কার করার প্রথম আণবিক শক্তি চালিত জাহাজ “লেনিন” বন্দরে নোঙর করা আছে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে অনেক বরফের দেয়াল খনন করে ১৯৮৯ সালে লেনিন এখানে বিশ্রান্তি গ্রহণ করেছে। এতটা উত্তরে এলে সারা দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন মনে হয়! সেটি হয়তো সঠিক নয়। আলইশা স্ট্যাচুর পদতলে দাঁড়িয়ে কল্পনাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলে মনে মনে হয়তো অনেক দূরে চলে যাওয়া যায় – এই তো সামনে কোলা উপসাগর, সেটি গিয়ে মিশেছে বারেনট সাগরে। সেখান থেকে একটু বাঁয়ে ঘুরলেই কানাডার সমুদ্রপথ। বছরে অন্তত পাঁচ মাস খোলা থাকে। এর নাম সুমেরু সেতু। মালবাহী জাহাজ যেতে পারে চার হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ম্যানিটোবার চার্চিল বন্দরে। আর খাড়া উত্তরে গেলে মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বে উত্তর মেরু। পা আরেকটু বাড়ালেই তো খাঁটি উত্তর বা ট্রু নর্থ! ... ...
পুরকাইতদার স্কুলের দোতালায় আড্ডা জমে উঠলো। দেশ, সমাজ, নোটবাতিল, গোরক্ষার পাশাপাশি ফেসবুকের বিভিন্ন মানুষ আলোচনায় উঠে আসতে লাগলেন। পুরকাইতদা শুধু ভোজনরসিক নন, কিংবা চরম অতিথিবৎসল বললেই তাঁর মূল্যায়ন সম্পূর্ণ হয় না। ক্রমশ ‘সামসুদ্দিন পুরকাইত’ সাহেবের কর্মকান্ডের আঁচ পাওয়া গেলো। বেশ কিছু বছর আগে বাচ্চাদের স্কুল গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন পুরকাইতদা। কিন্তু পর্যাপ্ত পয়সার অভাবে তা বাস্তবায়িত হতে পারছিলো না। এমন সময় দেবী লক্ষ্মীর মতো নিজের বিয়ের গহনা বন্ধক দিয়ে স্বামীর হাতে পয়সা তুলে দিয়েছিলেন পুরকাইতভাবী। সেই সুমহান সিদ্ধান্তের ফসল এই স্কুল। স্কুলঘরের দোতালায় বসে কথাগুলো বলতে বলতে পুরকাইতদার চোখে কিছু করতে পারার পরম তৃপ্তির জলকণা চিকচিক করে উঠছিলো। আচমকা ফ্যাকাসে হাসি সহযোগে বলে উঠলেন - “এই যে স্কুল, আপনাদের ভাবী ছাড়া সম্ভব হতো না। ... ...
কৌশিকঃ আমাদের সবার মধ্যে একটা গান্ডু লুকিয়ে আছে। সুরজিৎঃ তবে কি ওদের ভেতরের গান্ডুকে আমরা চিনতে পারছি না? তাই আমরা ওদের বোঝাতে পারছি না? কৌশিকঃ অথবা ওরা আমাদের ভেতরের গান্ডু কে চিনতে পারছে না, তাই বুঝতে পারছে না। সুরজিৎঃ তাহলে আমাদের আর ওদের গান্ডুর মধ্যে একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেই হয়। কৌশিকঃ তার আগে আমাদের গান্ডুর ব্যাপারটা লিখতে হবে। সুরজিৎঃ বেশ। আমরা যেভাবে গান্ডুকে চিনি, সেটা লিখে ফেলা যাক। কৌশিকঃ গান্ডুর নাম জানি না, ওকে সবাই গান্ডু বলে ডাকে। সুরজিৎঃ ও তো নিজের আসল নাম বলে না, বলে আমি গান্ডু। এই ভাবে শুরু হল গান্ডুর গল্প লেখা। ... ...
শ্রী অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় যে ‘নিবন্ধের’ কথা লিখেছেন, এবং লীলা মজুমদারের ওপর বেরনো যে বইটির কথা এখানে উঠেছে, আমার এই লেখাটি আমি সেই প্রসঙ্গেই লিখছি। ৬ মে সকালে রবিবাসরীয়তে অশোকবাবুর লেখা পড়ার পর দুপুরবেলায় আমি আনন্দবাজারের সম্পাদককেও একটি ইমেল লিখেছিলাম। তিনি তখন তখনই উত্তর দেন, এবং বলেন যে, বিষয়টির কথা তিনি জেনেছেন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমি আমার ইমেল এবং সম্পাদকের বক্তব্য প্রসঙ্গে একটি পোস্ট লিখেছিলাম ফেসবুকে। দু’দিন পর অশোক মুখোপাধ্যায়ের এই ঋণস্বীকার। আমি এই কথাটাই আনন্দবাজারের সম্পাদককে লিখেছিলাম, যে, আপনারা একটা লাইন ছেপে দেবেন দুঃখ প্রকাশ করে। ব্যাস, আপনাদের দিক থেকে আপনারা পরিষ্কার হয়ে যাবেন। ... ...
অবশ্য আরও একটা কারণও থাকতে পারে। এত অস্থির হবার। আসলে সব ছাপিয়ে আরও একটা কথা মনে পড়ছে। মেয়েটা সেই রাতে সিনেমা দেখে ফিরছিল। লাইফ অফ পাই। সে তো আমিও এই সেদিন দেখে এলাম। বৌ-বাচ্চা নিয়ে। পপকর্ন খেলাম। আমার পরিচিত মেয়েটি, মেয়েরা, অনেকেই তো দেখেছে, যারা দেখেনি দেখবে সিনেমাটা। কে জানে কোনদিন তাদের কেউ খবরের কাগজে "ধর্ষিতা" হয়ে যাবে কিনা। নাম অবশ্য জানা যাবেনা এই বাঁচোয়া, কারণ, আব্রু রক্ষার্থে সেসব আমরা চেপে রাখতে জানি। আমরা ভদ্র ও সভ্য হয়েছি। লোকলজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য আমরা ভিক্টিমের নাম মিডিয়ায় উচ্চারণ করিনা। আমাদের ধর্ষিতাদের কোনো নাম হয়না। ... ...
বিয়ের চারদিনের দিন এক ঘটনা ঘটল। এখানে বাসি বিয়ে হয় না। চৌথী হয়। ঐদিন রাতে শাড়ির আঁচলে পাঁচটা ফল বেঁধে ঘুমোতে হয়। ভোরে পুকুরে ডুব দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ভোররাতে বর ঘুম থেকে ডেকে বলে, নিচে কলটানার আওয়াজ। মা উঠে পড়েছে। তুমি উঠে পড়। আমার আর হুঁশ নেই। শেষে দরজায় ঠকঠক। নভেম্বরে বালির ঠান্ডা, হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে খিল খুললাম। দেখি বাইরে মোটা শাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শাশুড়ি মা। পুকুরে নামা অভ্যেস নেই। এই ঠান্ডায় শাল জড়িয়ে... বলির পাঁঠা হয়ে চললাম। পুকুরের সামনে শাশুড়ি বললেন, গাছের আড়ালে জামা বদলে নাও। বলে আমার পরনের শাড়িটা পুকুরে কেচে মেলে দিলেন। আর বললেন, চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। আমার ওপরে যা চলেছে তা বৌয়ের ওপর হতে দেব না। মনে ভাবি, আড়বালিয়ায় যদি এমন হত, জ্যাঠাইমারা বলতেন – একটা দিন মানতে হয়। ওষুধ খেয়ে নেবে। রীতি-রেওয়াজ এক ফুঁয়ে উড়িয়ে আমার প্রাণরক্ষা করলেন ইনি। না হলে হাসপাতালের শয্যা অপেক্ষায় ছিল। ... ...
বিসমার্ক দূরের কথা, এঁরা কেউ সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকু পড়ে আসেননি। আপাত স্বাধীনতার লম্বা দড়ি ছেড়ে দিয়ে টিটো তো ঠিক সেটাই চেয়েছিলেন – রাজনীতি নয়, অর্থনীতি। লগে রহো ক্রোয়াট আউর সার্ব ভাই। চল্লিশ বছর যাবত হয়তো সেই কারণে শান্তি বজায় ছিল। এবারের বিবাদ অর্থনীতির নয়, জাতীয়তাবাদের। স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া না হয় মেনে নিল; কিন্তু আসল সমস্যা সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের পারস্পরিক শোধ তোলার বাসনা। ... ...
আসামের তিনসুকিয়াতে বাঘজান তৈলকূপের কথাই মনে এল সবার আগে। কারণ খবরের কাগজে একেবারে ভেতরের পাতায় এ খবর কতোজনের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে নিশ্চিত নই। অথচ ক্ষতি যা হল তা মারাত্মক। এই তৈলকূপ ঘিরে রয়েছে ডিব্রু-শইখোয়া ন্যাশনাল পার্ক। পার্কের গাছপালা, পশুপাখি ঝলসে গেছে। লাগোয়া বিলে ভেসে উঠছে অসংখ্য জলজ প্রাণীর পচাগলা মৃতদেহ। বিলেই পাওয়া গেছে দুজন দমকল কর্মীর লাশ। আগুন আর গ্যাস তাদের এমনভাবে ঘিরে ফেলেছিল যে পালাবার অবকাশ ছিল না। ডিব্রু নদী বিখ্যাত ছিল নানা বিরল প্রজাতির মাছ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জন্য। লাগোয়া বন বিখ্যাত ছিল বুনো ঘোড়ার জন্য। ৩৬ টি স্তন্যপায়ী প্রজাতি যার মধ্যে বাঘ একটি, এবং ৩৮২টি প্রজাতির পাখি এই ৩৪০ কিলোমিটার ব্যাপ্তির বনে বাস করত। তাদেরই বা কী হল ! শোনা যাচ্ছে ৪ সপ্তাহের আগে এ আগুন নেভানো সম্ভব হবে না। ... ...
গতকাল যখন পার্ক সার্কাসের একটি খাবারের দোকানের সামনে জমায়েত হচ্ছিলেন বেশ কিছু এনআরসি বিরোধী কর্মীরা, তখন পুলিশ এসে বলে ওই স্থানে জমায়েত করা যাবে না। কারণ, ওই জমায়েতের নাকি কোনও অনুমতি নেই। অথচ নির্বাচন কমিশনের থেকে প্রাপ্ত অনুমতিপত্র দেখানো হলেও তাঁরা বলেন, অনুমতিতে বলা নেই যে ঐ স্থানে জমায়েত হয়ে মিছিল শুরু করা যাবে। আর কথা বাড়ালে গ্রেপ্তার করা হবে। কোনও কথা বাড়ানোর সুযোগই দেওয়া হল না, সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হলো প্রসেনজিত বসু, মনজর জমিল, ইমতিয়াজ আলি মোল্লা, অমিতাভ চক্রবর্তী-সহ দশজনকে। ঘটনাচক্রে আমরা কয়েকজন তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে। পুলিশ এসে আমাদের বলল, এইখানে জমায়েত করা যাবে না। আমরা উল্টে বললাম, দু’জন মানুষ কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে কথা বলাও অপরাধ নাকি? এটা কি উত্তরপ্রদেশ? ... ... ...
১৯৭০-এর গোড়া। বাঁকুড়ার ছোট্ট মফস্সল শহর বিষ্ণুপুর থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিন তরুণ। দুনিয়া ঘুরে দেখতে হবে। সাইকেলে। ইন্টারনেট নেই। জিপিএস নেই। গুগ্ল ম্যাপ নেই। অর্থবল নেই। মাতৃভাষা বাংলা বই দুটি ভাষা জানা নেই। সম্বল স্রেফ স্বপ্ন। আর জেদ। হাল ছাড়লেন দুজন। ঘুরতে থাকল তৃতীয়জনের সাইকেলের চাকা। ১৭ বছর। ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। ১৫৪ টি দেশ। আজও এ কীর্তিতে তিনি অদ্বিতীয়। এই প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সে পরমাশ্চর্য সফরের অনুপুঙ্খ কাহিনি শোনাচ্ছেন জয় মণ্ডল। এ পর্বে চম্বলের ডাকাতের খপ্পর ও ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ। আলাপে নীলাঞ্জন হাজরা। ... ...
আরও বেশ কবছর পরের কথা, মন্ডল সাহেবের বাগান বাড়িতে নেমন্তন্ন। অনেকটা পিকনিকের মেজাজ। লোকজন এদিক সেদিক ঘুরছে। সবেদা গাছগুলোর ছায়ার বেতের চেয়ারে কফি নিয়ে আমরা জনা পাঁচেক। আমার ঠিক উল্টোদিকে এক নম্বর। কিছুক্ষণ পর একজনের বাথরুম পেল, দুজন মাছধরা দেখতে গেলেন, রইল বাকি দুই, মুখোমুখি। উসখুস, গলা খাঁকারি,- মানে ইয়ে, আমি মনে হয় আপনার সঙ্গে কোথাও এক সঙ্গে কাজ করেছি। আমি গ্র্যানাইট পাথর, হবে হয়তো। আচ্ছা অমুক ব্র্যাঞ্চে আপনি একাশি বিরাশি সাল নাগাদ ছিলেননা? আমি বললাম, ছিলাম। - ও, হ্যাঁ মনে পড়েছে, ওখানেই তো আপনার সঙ্গে – আমি বললাম, হবে হয়তো, এত লোকের সঙ্গে কাজ করেছি, সবাইকে মনে রাখা সম্ভব? বাথরুম সেরে একজন ফিরলেন, মাছধরা দেখে বাকি দু জন, আলোচনা শেষ। ... ...