‘মা দেখো বুকাই আবার বেডকভার চাপা দিয়েছে’ চেঁচিয়ে, ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় না থেকে চাদর কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। পুকাই চিরকালই অস্বস্তিজনকরকম নর্ম্যাল। পরিবেশপরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজপোশাকে বিশ্বাসী। শীতে বেশি, গরমে কম, সমুদ্রস্নানে আরও কম। কালই দেখলাম, কার্লসবাড বিচে সপরিবারে উল্লসিত স্নানের ছবি আপলোড করেছে, বিকিনিপরিহিত। না, ফেসবুকে নিজের নামে নেই আমি। ফেক থেকে দেখেছি। ... ...
মেয়েমদ্দ বাচ্চারা পালাতে চাইছিল। ওরা মেয়েদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, বাচ্চাদের আগুনে ছুঁড়ে দিচ্ছিল আর মরদদের মাথায় বাড়ি। বলতে বলতে সুরজ কাঁপছিল, গোঙাচ্ছিল। ইসমাইল ওকে জল খাওয়ায়, জিগ্যেস করে লুটেরারা কোন ধ্বনি দেয় নি? সুরজ কেমন চুপ হয়ে যায়, খুব আস্তে বলে ‘আল্লা হু আকবর’ তারপর বাতাসের স্বরে ফিসফিস করে বলে ‘আমি দেখেছি ওদের অনেকের কপালে কমলা টিকা ছিল, লিডারের হাতে প্রধান নৌকরজির ফোটু ছিল’। ইসমাইল ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে বসে সুরজের মুখ চেপে ধরে ‘চুপ চুপ। খবরদার এইসব এখানে আর কাউকে বলবি না, আমার জানও চলে যাবে। ... ...
"কিছু মনে কোরোনা, তুমি বাঙালী বলেই বলছি। এসব জায়গা কোনো ভদ্র মেয়েদের কাজের উপযুক্ত নয়। মেয়েদের পক্ষে ঐ ইস্কুল বা কলেজে কাজ করাই ঠিক আছে। তোমার বাড়ির লোকই বা কী ধরণের, মেয়েকে এরকম একটা চাকরি করতে পাঠিয়েছে। তা আজকাল কম্পিউটার টম্পিউটার কম্পানি খুলছে তো কলকাতা দিল্লী বম্বেতে শুনি। তুমি তো সেসব জায়গায় চাকরি খুঁজলেও পারতে।" স্থান : পশ্চিমবঙ্গে স্থিত একটি সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। কাল: উপরোক্ত ঘটনার একবছর পর। পাত্র: ট্রেনিং শেষে জয়েন করতে আসা উল্লিখিত দুটি মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারের একটি। যে লোকটি এরকম সুমধুর সম্ভাষণে প্রথম দিন মেয়েটিকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন তিনি ঐ প্রজেক্টের মেন্টেনান্স বিভাগের প্রধান। মেয়েটি এরকম অভ্যর্থনায় নির্বাক, প্রথম কাজ শুরু করার আগে বিভাগীয় প্রধানের এধরণের উৎসাহ প্রদানের বহরে মনে একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব। তবু মরিয়া হয়ে জানায় যে তার ইচ্ছা এরকম জায়গায় কাজ করা, পড়াতে তার ভালো লাগেনা। প্রচুর বিরক্তিতে ভদ্রলোক খুঁজে পেতে একটি অদরকারী বিভাগে মেয়েটিকে পাঠালেন মুখ দিয়ে অনর্গল বিরক্তিসূচক নানা শব্দ বার করতে করতে। তারপরের কাহিনী, দীর্ঘ লড়াইয়ের, বারে বারে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা। জরুরী কাজের পারমিট হাতে নিয়ে টেকনিশিয়ান ও মজদুরকে ডাকতে গেছে ফিল্ডে যাবার জন্য, সেখানে তাদের বক্তব্য, "আপনার লিখিত অর্ডার টা দেখি এই গ্রুপে পোস্টিংয়ের, নাহলে আপনার সাথে কাজ করতে যাব না। কিছু গণ্ডগোল হলে তো মেয়েছেলেকে কেউ কিছু বলবেনা, আমাদেরই ধরবে।" ... ...
তাহলে কি আমি অপেক্ষা করে থাকব কবে সেনাবাহিনির জওয়ান আমার মেয়েকেই টেনে নিয়ে যাবে, কবে আমারই ছেলেকে পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে (পড়ুন বিনাবিচারে) নাশকতার অভিযোগে খুন হয়ে যেতে হবে, আমারই টাকা লোপাট হয়ে যাবে, আমারই ভাইয়ের আঁকা ছবি কেউ কিছু না বুঝেই সাম্প্রদায়িক লেবেল সেঁটে দেবে বা আমার বোনের লেখাকে ‘উস্কানিমূলক’ বলে প্রচার করে তাকে দেশছাড়া করবে, আমার ভাষাকে, সাহিত্যকে, শিল্পকে প্রান্তিক বলে ঠেলে দেবে......। নাকি যে কোন বিষয় সামনে এলে মতামত দেওয়া এমন কি না দেওয়ার আগেও (মতামত না দেওয়াও একটা মতামত) একটু ভাববো কেন এমন হল! ওদের কথাও একটু মন দিয়ে শুনবো আর নিজেকে ওই ‘ওদের’ জায়গাটায় বসিয়ে দেখব এই ঘটনা আমার সঙ্গে হলে, আমার বাবা-মা-ভাই-বোন-ছেলে-মেয়ে-র সঙ্গে হলে কী করতাম, কী ভাবতাম! এই স্টেপটা সবচেয়ে কঠিন, কেবলই মনে হবে আমার সঙ্গে কক্ষনো এমন হত না, আমার এতসব ভাবার কী দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু এই স্টেপটা ‘জাম্প’ করে যাওয়া যাবে না। ... ...
একদিন গোলু জানালা দিয়ে দেখলো কালো মেঘে পুরো আকাশ ভর্তি হয় গেছে।মন খারাপ হল।কোনও আলো নেই।গোলু তখন দেখল যে বৃষ্টি কমেছে।কিন্তু একটাই সাদা মেঘ।হঠাৎ গোলু দেখল ওই সাদা মেঘটা নেমে আসছে।হঠাৎ সত্যি মেঘটা জানালার কাছে এসে বলল,"কি গোলু?কেমন আছো?" গোলু বলল "হ্যাঁ!একি! মেঘ আবার কোথাও বলে!" মেঘ বলল,"হ্যাঁ গো,আমি বুন্টি মেঘ।আমার নাম বুন্টি।তুমি আমাকে মেঘ দিদি বোলো।" ... ...
সঙ্ঘের চেয়ে সত্য বড়। আর সেই সত্যের খাতিরে রেয়াত করা চলে না কারোকেই। দ্বিতীয় তথ্যটিও এই সত্যভাবনা সম্পর্কিত। একেবারে শুরু থেকেই সে নিষ্ঠা প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়েছে। শান্তিনিকেতনের সাহিত্যমেলায় উচ্ছ্বসিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়ে ফেললেন তরুণ শঙ্খের একটি কবিতা। কবি তখন পদ্মাপারের শৈশব স্মৃতি ও ছন্নছাড়া বড় হয়ে ওঠা পেরিয়ে প্রেসিডেন্সির ছাত্র। বুদ্ধদেব বসু উপস্থিত ছিলেন সে সভায়। মুখচোরা লাজুক শঙখ যাবেন না ভেবেও কী করতে যেন সেখানে উপস্থিত। সুভাষের বক্তব্যের পর বুদ্ধদেব মহা উত্তেজিত হয়ে অনাহুত ভাবেই মাইক তুলে নিলেন৷ কবিতা লেখা এতো সোজা নয়। স্লোগান বা প্রচার তার উপজীব্য হতে পারে না কখনো। কবিতা এক গাঢ়তর বোধের জগত,ভাত ভাত বলে সরল চিৎকার করলেই সেটা কবিতা হয় না। এইরকমই কিছু নাকি সেদিন বলেছিলেন তিনি। ... ...
জয়ন্তী অধিকারী, তথা কুমুদি গুরুচণ্ডালির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন ওতঃপ্রোতভাবে। তিনি এখন স্মৃতি। তবু স্মৃতিস্তম্ভের স্থবিরতাকে ভালবাসিনি আমরা। চাইছি স্মৃতির চলমানতা। আমরা চাইছি, বাংলা অক্ষর বেয়ে বেয়ে পরের প্রজন্মেও পৌঁছে যান কুমুদি। তারা আমাদের কুমুদিকে চিনুক, ভালবাসুক, লেখা পড়ুক, পড়াক বন্ধুদের। কুমুদিও তাদের চিনতে চাইবেন -- বলাই বাহুল্য। এইসব অলীক চেনাজানাকে বাস্তব করতে গুরুচণ্ডা৯ শুরু করেছে বার্ষিক 'কুমুদি পুরস্কার' -- কিশোর কিশোরীদের বাংলা গল্প লেখার প্রতিযোগিতায়। ... ...
বিধ্বস্ত ইউরোপ ছেড়ে বাইবেল হাতে ডাচ একদিন বাসস্থান খুঁজেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, বন্দুকের ডগায় উচ্ছেদ করেছিলেন আদি বাসিন্দাদের। এমনটা আমরা দেখেছি আমেরিকায় অস্ট্রেলিয়ায় কানাডায় সেখানকার আদি বাসিন্দাদের মেরে ইউরোপীয়রা বানালেন আপন রাষ্ট্র। ১৯৭৮ সাল অবধি আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের কোন রিচুয়াল পালন বেআইনি ছিল; অস্ট্রেলিয়া তাদের রেখেছিল র্যাবিট হ্যাচে। আলোকিত সভ্য সমাজের বিবেক বিচলিত হয় নি। ... ...
এই যে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ নামক জুজুটি দেখিয়ে গোটা বাঙালি জাতিকেই অভাবনীয় এক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, সেই জুজুটি কতটা ঠিক? হিটলারের জার্মানির সঙ্গে এখানেও মোদীর ভারতের অদ্ভুত মিল। পুরো জুজুটাই তৈরি করা হয়েছে গুলগল্পের ভিত্তিতে। ২০১১ সালের জনগণনার বহুপ্রতীক্ষিত অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য অনেক টালবাহানার পর সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষ মোটেই বাংলাদেশ থেকে আগত বে-আইনী অনুপ্রবেশকারীতে ছেয়ে যাচ্ছেনা। আইনী-বেআইনী মিলিয়ে ২০১১ সালে ভারতবর্ষে বাংলাদেশ থেকে আগত মানুষের সংখ্যা ছিল ২৩ লক্ষ। মনে রাখতে হবে, এটা শুধু 'বে-আইনী' অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা নয়। বহুসংখ্যক মানুষ আইনী পদ্ধতিতেই ভারতবর্ষে বসবাস করছেন, যাঁদের একটা বড় অংশ আইনসঙ্গত উদ্বাস্তু (সেই সংখ্যাটা বিরাট, যদিও স্বাভাবিক মৃত্যুর কারণেই সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে)। তার মধ্যে একটা বড় অংশেরই বাস পশ্চিমবঙ্গে। ফলে আসামেই ১৯ লক্ষ বে-আইনী বাংলাদেশী অভিবাসী এসে বসে আছেন, এ একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ... ...
ফ্ল্যাটবাড়ির নাম শশীবাবুর সংসার। তার ডাইনে বাঁয়ে একতলা দোতলা পুরোনো বাড়ি, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল। তিন নম্বর বাড়ি মিঠুদের। ও বাথরুমে যাচ্ছিল- আজকাল রাত শেষ না হতেই পেট কামড়ায়, সম্ভবত রাতের খাবার হজম হয় না- ভোরের আগে বমি বমি লাগে; বিছানা ছেড়ে বাথরুমের আলো জ্বালাচ্ছে মিঠু, পাতলা সুজনির তলায় গুলগুলে আর কুন্তী ছিল এতক্ষণ- চাদর সরে যেতেই আড়মোড়া ভাঙছে, এমন সময় গুমগুম আওয়াজ যেন গলির মুখ থেকে এসে ওদের বাড়িতে ধাক্কা খেলো- জলের ফিল্টারের তলার তিন পা টেবিল অনেকদিন নড়বড়ে; ঝাঁকুনিতে ফিলটারের ওপরে উপুড় করে রাখা কাচের গেলাস খানখান হতেই মিঠু চেঁচালো - "মা, ভূমিকম্প"; এমন জোরে চিৎকার করল যে বুকে ধরে রাখা বাতাসটুকু যেন খরচ হয়ে গেল তার। আবার শ্বাস নিল সে, তারপর একদমে- "কতদিন বলেছি এই ভাবে গ্লাস রাখবে না"- বলে, পেট চেপে বাথরুমে ঢোকার আগে চোখের কোণ দিয়ে ডাইনের ঘর থেকে ছন্দাকে আলুথালু হয়ে বেরোতে দেখল। ছিটকিনি দিতে দিতে এক মুহূর্তের কৌতূহল হয়েছিল , বিপ্লবও একই ঘর থেকে বেরোলো কী না জানতে। ... ...
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম ধবধবে সাদা পোশাক ও টুপি পরা অল্পবয়সী এক ছেলে। বাক্স ধরতে এসেছে। আমি আর কথা বললাম না। এই ডিস্ট্রিবিউশন আমার জন্য, আমার গাড়ির জন্য খুব পরিশ্রমের। কয়েকটা স্টক পয়েন্ট ঠিক করা হয়। এরপর ক্লায়েন্টদের ঐ ঠিকানা শেয়ার করা হয় যাতে নিজেরা তুলে নেয়। আমার বাকি সহকর্মীদের ক্লায়েন্টরা অডি, বিএমডাব্লু, মার্সেডিজ চড়ে যায় ডোনেশন নিতে (ঐ আরেক মজার গল্প, পরে বলব)। আর আমার সদ্য এদেশে আসা অভাগা ক্লায়েন্টদের প্রায় কারো গাড়ি নেই। যাদের আছে, খুব মেজাজও আছে সঙ্গে। যাদের গাড়ি নেই, তাদের অনেক অনুনয় বিনয় করতে হয় গাড়ির সার্ভিস পেতে হলে। ... ...
মালদায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়িতে বড় হলেও নিজের রোখে কলেজের পড়া শেষ করেছিল সে। সহপাঠি এবং অন্যান্যদের ঠাট্টাবিদ্রুপের শিকার হয়েও। কিন্তু চাকরির কোনো ব্যবস্থা তো সমাজ এবং রাষ্ট্র করে রাখেনি, রাখেও না। বাধ্য হয়ে দুটো অপশন থাকে সামনে - হয় হাতে তালি দিয়ে রাস্তায় নামা অথবা আদিম পেশার হাতছানি। কোনটাই করবে না জেদি হিয়া, তাই সে একদিন ট্রেনে চাপলো বিহারে যাবে বলে। ... ...
খিল্লি। প্রচণ্ড খিল্লি। উতপটাং, চিতপটাং, মিশনারি-কুত্তাপটাং-সিক্সটিনাইন-আইন-বেয়া-ডোপ বেআইন বিল্লির ল্যাজে দিনরাত দাঁত-অঙ্গ খিঁচিয়ে-খেঁচিয়ে ইয়ে উত্তোলনে স্বাধীনতা-ভ্যালেন্টাইন-বসন্ত-বাতাসে হতাশ দশায় জীবন উদযাপনে গুপ্তধনে দোল দিয়ে যায় যাবার বেলায় আত্মনির্ভর করে তোলে নালে-ঝোলে রাম-হরিবলের মায়া জাদুবলে এই খিল্লি। ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে শুনি অতল খিল্লির উদগ্র আহবান। ... ...
শ্যাম লালের একটি নিকনেম চালু ছিল গাজিয়াবাদের আদালতে। সাজা লাল। দীর্ঘ বিচারকজীবনে, কখনও কোনও অভিযুক্তই নাকি তাঁর বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি পায় নি। প্রত্যেকেই শাস্তি পেয়েছে তাঁর জাজমেন্টে। শ্যাম লাল নিজে যদিও দাবি করেন অনেকেই তাঁর রায়ে মুক্তি পেয়েছেন বা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, কিন্তু এ রকম একটা কেসের রেফারেন্সও তিনি দিতে পারেন নি। আরুষি হত্যাকাণ্ডের কেস তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল সম্ভবত এই কারণে, ন্যায় প্রদানের থেকেও এই কেসে তাঁর কাছে জরুরি ছিল এই কেসের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত পালন করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম তোলার। “শেষ পর্যন্ত” কথাটি অবশ্যই ব্যঞ্জনামূলক, কারণ, শেষ করার জন্য কোনও চাপ তাঁর ওপর ছিল না, চাপটা ছিল তাঁর নিজের কাছেই। আরুষি হত্যার রায় প্রকাশের ছদিন পরেই শ্যাম লাল অবসর নেন। দেশের সমস্ত মিডিয়া যখন গভীর আগ্রহের সঙ্গে এই কেসটা ফলো করছিল, একটা সঠিক বিচার হওয়া খুব দরকার ছিল, কিন্তু শ্যাম লালের হাতে বেশি সময় ছিল না। অবসর নেবার আগেই তাঁকে মামলার শুনানি শেষ করে জাজমেন্ট শুনিয়ে যেতে হত। শ্যাম লাল চাইলেই কেসটি আরও শুনানির জন্য পরবর্তী বিচারকের হাতে ছেড়ে যেতে পারতেন, শেষ করার জন্য কোনও চাপ ছিল না, কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেন নি। ... ...
যেদিন খদ্দের থাকে না, আমরা অনেক অনেক গল্প করি। বরাবর এমনটাই হয়ে আসছে। আমাদের দেওয়ালে চারজনের ছবি লাগানো আছে। আমি চারজনকেই চিনি। একটা আদ্যা মা, একটা নেতাজি, একটা মাধুরী দীক্ষিত, আরেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দীপালির ট্রাঙ্কে আরও একটা ছোট্ট মতো ছবি আছে। আমি জানি ওটা কার। পলাশের। আমাকে কেউ বলেনি। কিন্তু জানি। একদিন দুপুরবেলা খাটের ওপর ছবিটা পড়েছিল, আর আমি রাগ করে একটু চিবিয়ে ফেলেছিলাম। দীপালি কী মারই মেরেছিল। ওই একদিনই। আর কখখনও না। তারপর নিজেই একঘন্টা কাঁদলো। দীপালি ওর মা বাবার কথা একেবারে বলে না। গোমতীর কারো কথাই বলে না প্রায়। কেবল একজন দিদিমণির কথা বলে – তার নাম মায়া। উনি দীপালিকে খুব ভালোবাসতেন। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন, ঘি ভাত রান্না করে খাওয়াতেন। সেইসব গান দীপালি গায়। মাঝে মাঝে। বিশেষ করে ওই শুভাশিস এলে। শুভাশিসকে একটানা দু’বছর হলো দেখছি, মাসে সাধারণত একবার আসে। শুরুর দিকে, মাইনে পেয়ে। আমার জন্য ক্রিমবিস্কুট আনে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। আর টাকা দেওয়ার পর আমাদের একটা-দুটো করে কবিতা শুনিয়ে চলে যায়। আমি আর দীপালি তখন খুব হাসি। ... ...
ঐ মহামিছিলকে চিরস্মরণীয় রাখা বাংলার দায়। কেননা, ঐ মিছিলই প্রমাণ করেছিল বাংলার মানুষ একই মানবিকতার সূত্রে গাঁথা। আজও অন্যান্য রাজ্যে- মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, হরিয়ানায় বলপূর্বক জমিদখল চলছে, হত্যা-গুলি-ধর্ষণ–কিছুই বাদ যাচ্ছে না, কিন্তু কোনও রাজ্যের রাজধানীতেই তথাকথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদেরকে ধরে নেওয়া হয় উদারবাদী বাজার-অর্থব্যবস্থা, শিল্পায়ন-উন্নয়নের সমর্থক, কেননা উন্নয়নের ক্ষীর-ননী তো এই শ্রেণিই পায়, রাস্তায় নামছে না। কলিঙ্গনগর বা পস্কো নিয়ে কটক-ভুবনেশ্বরে দলহীন মিছিল, ভাট্টা-পারসোল নিয়ে লক্ষ্ণৌ বা দিল্লিতে ঝাণ্ডাহীন মিছিল, জইতাপুর নিয়ে মুম্বাইতে স্লোগানহীন বিশাল জনসমুদ্র – দেখা তো যাচ্ছেই না, এমনকি স্বপ্নও দেখছেনা কেউ। ... ...
মায়ের চিন্তার কি আর শেষ আছে? সংসারের হাজারো খুঁটিনাটি কাজ সামলে একটু সময়ের জন্যও নিজের কথা ভাববার জো নেই মেনকার। সারাক্ষণ নানান চিন্তা মাথাতে জাঁতার মতো বনবন করে ঘুরে চলেছে। এদিকে আকাশপটের রঙ বদলানো মানেই হলো মেয়ের বাপের বাড়ি আসার দিন ঘনিয়ে আসা। উঠোনের বাইরে রাখা বড়ো পাথুরে চাট্টানের ওপর খড়ি দিয়ে আঁক কেটে কেটে শুভ সময়ের হিসেব রাখার পর্ব ... ...
'বেজাতে' বিয়ে বলে নিজ মহল্লায় দামামা বেজেছিল। পাত্র ডাক্তার এই কথাটা কর্পূর হয়ে 'হিন্দু ছেলে' এটাই প্রচার হয়েছিল। তো, এই কালী পুজো নিয়ে আমার এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কালীমা আমার প্রতিদিনের। ছাত্রজীবন থেকে কলেজ টানা সময় জুড়ে আমায় 'মা কালী' বলে পথে ঘাটে ডেকে দিত কেউ। অবশ্যই পুরুষকণ্ঠ। কখনো পেছন ফিরে দেখিনি। দেখতে নেই এটাই ছিল পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। তখন অবশ্য আমি খুব ভয় পেতাম এই ডাকে। লজ্জা হত খুব। কী এমন আছে এই চেহারায়? নিজের মাও মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতেন, আমার পেটের মেয়ে এমন কালো কীকরে?বুঝতাম না এই সমাজে মেয়েদের কেন কালোরঙ হওয়া বারণ ? কেন এত নেগেটিভ? তারপর মাথায় সিঁদুর চড়ানোর পর আমায় কেউ কোনদিন 'মা কালী' বলে ডাকেনি। সিঁদুর ছাড়ার পরও। জানিনা, বিবাহিত মেয়েদের বুঝি সব মাফ। ধীরে ধীরে নিজের গায়ের রং ও চেহারার সঙ্গে কম্ফর্টেবল হয়ে গেলাম। নিজেকেই ভালবেসে ফেললাম। বিয়ের আগেই জানতাম আমার স্বামী কালীভক্ত। বিয়ে রেজেষ্ট্রির আগের দিনই সে নিয়ে যায় আমায় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি পুজো দিতে। সেখানেই লাইনে দাঁড়িয়ে সে জানায় আমার কাছে তার একটিই দাবি। মন্দিরে তার পাশে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে হবে ও প্রসাদ খেতে হবে। তার এই ভক্তি একইভাবে সন্তানের মধ্যে জন্ম নিল । প্রতিদিনই ড্রাইভার অভিযোগ করত মেয়ে স্কুলের পথে যেখানেই মন্দির দেখছে গাড়ীর কাচ নামাতে বলছে। নেমে পড়ে প্রণাম করছে। এরপর আমার নিজের বাড়িতে মেয়ের পছন্দের কালী মায়ের ওয়াল হ্যাঙ্গিং লাগানো হল। তার নিজের পূজা করার জায়গা ক'রে দেওয়া হল। আনা হল লাল কাপড়,ঘণ্টা,কর্পূর, সিদুর,গঙ্গাজল,ধূপকাঠি। কাছের মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গিয়ে লিখে আনা হল মন্ত্র। আমার মা এখানেই কখনো কখনো কোরান পাঠ করতেন, নামাজ পড়তেন। আমার বাবা কালীপুজোর জন্য চারটে করে জবাফুল এনে দিতেন বাজার থেকে প্রতিদিন। ... ...
এই মদ্যপান নিয়ে বাঙালির নৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস বড় পুরাতন। মূলধারার সাথে অস্ফুট লোকাচারের পার্থক্য তো ছিলই; কিন্তু মূল সুর ছিল সহাবস্থানের। কথিত আছে, একবার শাক্ত সাধক কমলাকান্তকে মদ্যপান করতে দেখলে, বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র তিরস্কার করেন। প্রত্যুত্তরে মাতৃভক্ত কমলাকান্ত মদ্যকে দুগ্ধে পরিণত করে সেই দুধে দেবীপ্রতিমার পূজা করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতিভূ তেজচন্দ্রের কাছে যা অনৈতিক, সাধক কমলাকান্তের কাছে তা নয়। ভারতীয় লোকাচারের ঊর্ধ্বে থাকা সাধক সামাজিক নিয়মনীতির অধীন নন। কমলাকান্তের মতই, সাধক রামপ্রসাদও মদ্যপান করতেন। পণ্ডিতসমাজের প্রধান কুমারহট্ট এ নিয়ে তাঁকে তিরস্কার করলে, রামপ্রসাদ বলতেন, “সুরাপান করিনা আমি / সুধা খাই জয় কালী বলে”। কিন্তু সব প্রেমিক যেমন দেবদাস নয়, সকল মদ্যপই রামপ্রসাদ নয়। শাক্তমতে গুহ্যসাধন-ক্রিয়ায় মদ্যপানের যে রীতি, তা প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ না হওয়াটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘প্রাত্যহিক জীবন’ তো কোন সমসত্ত্ব ধারণা নয়, বরং তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন। একদিকে প্রাক-ঔপনিবেশিক বঙ্গীয় উচ্চবর্গ যেমন পারতপক্ষে মদ্যপান এড়িয়ে চলেছে, মঙ্গলকাব্যের অন্ত্যজ শ্রেণি অবশ্য শুঁড়িখানায় ক্রমাগত ভিড় জমিয়ে গেছে। তাই মদের বিচারেই বাঙালি অনেক আগেই ‘আমরা-ওরা’-র ব্যবধান তৈরি করে ফেলেছে। ... ...
পহেলা বৈশাখ এলেই আজকাল একজনের কথা আমার মনে পড়ে। ভদ্রলোক আর আমি পাশাপাশি ডেস্কে বসে কাজ করতাম এক সময়। চাকরি ছেড়ে দেবার পরও তার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতো। এখনো হয় কালেভদ্রে। আমাদের কলিগ সবিমল বসু ধর্ম নিয়ে প্যাঁচপ্যাচি ধরনের মানুষ। অফিস ছুটির পর দেখতাম কলা গাছের বাকল নিয়ে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বলত বাড়িতে কি নাকি পুজা আছে। সকালবেলা কখনো হাঁটতে বের হলেও দেখতাম ফুল কিনছেন। বাড়িতে নিজেই পুজা দেন। ঠাকুর দেবতায় খুব ভক্তি। আমাদের জীবন থেকে বাংলা কেলেন্ডার উঠে গেলেও সুবিমলকে দেখতাম বাংলা মাসের তারিখ পর্যন্ত মনে রাখছেন। উনার সঙ্গে কথা বলে মজা পেতাম কারণ উনি উনার জীবনে এখনো ইংরেজি তারিখের সঙ্গে বাংলা তারিখটি সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন বৃষ্টি কম হচ্ছে, এ বছর বৃষ্টির দেখা নেই… সুবিমলদা বলে উঠতেন আষাড়ের আজকে ২ তারিখ ১৪ তারিখে রথযাত্রা। এর আগে বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না…। কিংবা পৌষ ২২ চলছে কিন্তু শীতের দেখা নেই ইত্যাদি…। ... ...