কোথাও গেলে, ফিরে এসে সেটা নিয়ে লিখতে হয়। এটাই নিয়ম। তার ওপর, সেই জায়গাটা যদি হয় "আয়লা'-য় ভেসে যাওয়া সুন্দরবন, তবে তো লেখাটা একটা মাস্ট ডু লিস্টের মধ্যে পড়ে যায়। তাই লিখছি। তথ্য খুব কমই জানি, তাই মূলত: যা দেখেছি সেটাই লিখবো। কোনো থিয়োরী থাকবে না। নিছকই একটা "আয়লা ট্যুর' ভাবতে পারেন। "ট্যুর'-টা শুনতে বা বলতে খুব খারাপ লাগলো, আমাদের সাধ্যমত "ত্রাণ' দিতেই গিয়েছিলাম তো, কিন্তু বিশ্বাস করুন, শেষপর্যন্ত যা দেখলাম, তাতে ঐ "ত্রাণ' নিয়ে যাওয়াটা নিজের কাছে দেওয়ার জন্য একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। ... ...
১৮৭৪ সালে বাংলার থেকে শ্রীহট্টকে এবং গোয়ালপাড়া জেলাকে উত্তরবঙ্গ থেকে কেটে আসামের সঙ্গে যে জুড়ে দেওয়া হয়, এই কাটা জোড়ায় জেলাদুটির বাসীন্দাদের মতামতের কোন মূল্যই দেওয়া হয় নি। কেননা রেভিনিউ স্টেট হিসেবে আসাম স্বনির্ভরতা পাবে। অর্থাৎ কাল পর্যন্ত যারা বাংলার অধিবাসী ছিল নেহাৎ-ই প্রশাসনিক কারণে তারা হয়ে গেল আসামের বাসিন্দা। গোয়ালপাড়া ও শ্রীহট্ট জেলার অধিবাসী বলতে প্রায় সবাই তখন বাংলা ভাষাভাষী। সামাজিক বিরোধের বীজ উপ্ত হল এখানেই। বাঙালিরা কোনদিন অসমীয়া ভাষাকে নিজের ভাষা হিসাবে মেনে নিতে পারে নি, আর অসমীয়াভাষীরাও কোনদিন বাঙালীকে ভ্রাতৃপ্রতিম বলে মন থেকে স্বীকার করতে পারেনি। ... ...
শেষটায় খকখক কাশত। দুদিন গায়ে জ্বর ছিল। কোত্থেকে একটা ছেঁড়া কানি খুঁজে মুখে বেঁধে রাখত। ঝুপড়ির বাসিন্দারা সব জেনে গিয়েছে গত তিন হপ্তাভর ঢিভি দেখে দেখে। কেউ কাজে যায় না। সরকার নাকি কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজে বেরোলে মরণ। ঘরে সেই মরণ ঢুকে পড়বে চুপিসাড়ে। সবকে থেকে থেকে কামড়াবে। বুঢ্ঢা সারাদিন সারারাত নর্দমার ওপরে বসে থাকত। গত পরশু ভোরে উল্টে পড়ে শুয়ে ছিল ওখানেই। খাবার নাই। আধপেটা খেতে পেলে ভাগ্যি। এক বাটি খেচড়ি। ব্যস। শরীরে সাড় ছিল না। হাসপাতাল থেকে কিম্ভূত জামা পরা লোকজন এসে তুলে নিয়ে গেছে গাড়িতে। সে গাড়ি দেখবার মতো। চকচকে। কাচ ঢাকা। উঁই উঁই সাইরেন। আহা বুঢ্ঢার গতি হল বটে। ঝুপড়ির অধিবাসীগণ কপালে জোড়াহাত ঠেকিয়ে রাম রাম হরি হরি স্মরণ করেছিল। ... ...
বিরান ঘাটে সেই সময় নজর পড়লো ত্রপার ওপর। বুকের কাছে কয়েকটা বই, একটা লম্বা খাতা জড়ো করে দাড়িয়ে আছে। স্কুল ড্রেস পরণে ছিলো না। তাই অনুমান করা গেলো যে, কলেজ ছাত্রী। একবার ভেবেছিলাম, কথা শুরু করা যাক। কিন্তু সেটা বড্ড বেশী সিনেমাটিক হয়ে যেতো। তাই চুপ করে রইলাম। কথাটা শুরু হলো দূর্ঘটনাচক্রে। দূর্ঘটনা আমিই ঘটলাম। ... ...
শিলচরে বড় হবার সুবাদে ছেলেবেলা থেকে দেখতাম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর দিন কতক পরেই পাড়ায় পাড়ায় আরেকটি দিন উদযাপনের ধুম পড়ে যেত, সেটি ১৯শে মে। ১১ শহীদের ছবি একটা চেয়ার বা অস্থায়ীভাবে তৈরি বেদীর উপর রেখে ফুলে ধূপে সাজিয়ে রাখা হতো, কেউ কেউ পাশে বাংলা দেশাত্মবোধক গান মাইকে বাজিয়ে দিত, কেউ নয়। এই রীতিতে দিবস উদযাপনের রীতিটি বোধ করি শিলচরীয়, বা কাছাড়ি ব্যাপার। কেননা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে ওমন দেখা যায় না। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে বা নেতাজী জয়ন্তীতে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রভাত ফেরি হতো, স্কুল থেকেই যোগ দিতে বলা হতো। কিন্তু ১৯শের কোনো পথ চলাতে গেছি বলে মনে পড়ে না। কলেজে গিয়ে জেনেছি যে ১৯শের দিনে খুব সকালে শিলচর শ্মশানে জড়ো হওয়া আর বিকেলে গান্ধিবাগ শহীদ বেদীতে –একটি নিয়মিত প্রথা। ... ...
দ্বিমেরু বিশ্বে যে ধারণা জনমানসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলো একটা সময়ে তা হল আমেরিকা-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-জাপান এতদিন ধরে (প্রায় ২০০ বছর) সার্বজনীন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জনস্বাস্থ্য-কাজের অধিকার-খাদ্যের অধিকার-বাসস্থানের অধিকার নিয়ে যে পথে চলে এসেছে তার বিকল্প আরেকটা রাস্তা আছে। এ রাস্তায় কার্টেলের (কর্পোরেটদের পিতৃপুরুষ) বদলে সমবায়ের ভাবনা আছে। এ রাস্তায় ব্যক্তির লাভালাভ একমাত্র বিষয় না হয়ে সমাজ ও সমষ্টির প্রাধান্য আছে। রবীন্দ্রনাথের বলা (যদিও একুশ শতকের পৃথিবীতে তার কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক এবং মতদ্বৈধ প্রত্যাশিত) গ্রামসভার কথা, গ্রামের সমূহকে ব্যবহার করে গ্রামে পুকুর খোঁড়া, গ্রামকে পরিচ্ছন্ন রাখা, গ্রামের সিদ্ধান্ত প্রাথমিকভাবে গ্রামে নেওয়া (প্রসঙ্গত সমধর্মী ধারণা গান্ধীজিরও ছিলো) এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মানুষের বোধে জারিত হতে শুরু করেছিলো। ... ...
এই আপতকালীন সময়ে মানুষের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকে এক কবিতা ঘুরছে, কখনো সেই কবিতার নাম শঙ্খচিল, কখনো তার নাম ‘মহামারী’। কখনো তা জীবনানন্দের কবিতা, কখনো তা শঙ্খ ঘোষের, কোভিড-১৯ এর মতো সে মিউটেট করেই যাচ্ছে। প্রতিপাদ্য হলো ‘ আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে...আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে...আমাদের দেখা হোক বীজানু ঘুমালে---ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর কন্যা শ্রাবন্তী ভৌমিক জানালেন, এই কবিতা তাঁর বাবার নয়। বাবার নামে যা ঘুরছে তা কে লিখেছে কেউ জানে না। ঘরে বসে যে যা পারছে করছে। এত ভিডিও, এত কার্টুন, এত সব ভুয়ো সংবাদ আসার বিরাম নেই। সংবাদ ভুয়ো হয় জানি। গুজব রটিয়ে এক এক গোষ্ঠী এক একরকম স্বার্থ সাধন করে। কিন্তু কবিতার গুজব এই জাতিই পারে। ... ...
ইরফানের মৃত্যুর পরে বিভিন্ন ভারতীয় পত্র পত্রিকায় তো বটেই, আন্তর্জাতিক খ্যাতির কারনে বিদেশী পত্রিকাতেও তাঁকে নিয়ে লেখাপত্র হয়েছে। সেখানে ইরফান সম্পর্কে এই বিষয়টিতে খুবই বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে যে, তিনি এমন একজন অভিনেতা যাঁর অভিনেতা হওয়ার কথা নয়। এবং তারপরেও তিনি শুধু যে একরকম নতুন স্টারডমের সংস্কৃতিই তৈরী করলেন তাই না, এমন বেশ কিছু ছবিতে খুবই সাবলীলভাবে কাজ করলেন যেখানে তাঁকে কেউ কেউ বিবেচনাই করতে চাইবেন না। এই কথায় সত্যতা আছে। এই কয়েক বছর আগের সাক্ষাৎকারেও ইরফান বলেছেন অভিনয় করতে চাওয়া তাঁর "ইনার কলিং" না, বরং "কাল্টিভেটেড ডিজায়ার"। ... ...
সেনাপতি লকডাউনে কী করছে? জানতে চাইলে বলে, “বনধের সময় বসে আছি। আমার এমনিতে কোথাও যাওয়া হয়না এখন সকলেই যেতে পারছে না। আমার কষ্টটা ভালো করে সবাই বুঝছে।” সিনাপতির মা আঁচলে চোখ মুছে বলে, “গরিব মানুষ আমরা। গেল মাসে চাষের মাঠে একবার কাজ পেয়েছিলাম। এখন তো কাজের কোনও আশা নেই। মেয়েটার লেখা-পড়া হয়নি। আবার বিয়েও হবে না। পেটে না খেলে তো লোক জানতে পারে না! বিয়ে দিতে না পারলে তো বিপদে পড়ে যাব।” চাল বা আলু কি পেয়েছেন? জিজ্ঞাসা করতেই সিনাপতির মা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, “কত লোক এল। লিস্ট করে নিয়ে গেল। বলল চাল-ডাল দেবে। কেউ আসেনি। কেউ কিছু দিল না। ... ...
রবীন্দ্রসঙ্গীত অপ্রগলভ মানুষের শিল্প। গত দু'দশক ধরে আমাদের দেশে জীবনযাপনের চালিকাশক্তি হলো বাজার অর্থনীতি। প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি জীবনের মূল্য ধরা হয় বাজারে তাদের চাহিদা কতোটা রয়েছে, সেই মাপে। ইংরিজিতে একটা শব্দ রয়েছে ' স্ট্রিট স্মার্ট' । বাংলায় বলা হয় ' চালাকচম্বা '। বিশেষণটির মধ্যে হয়তো কিঞ্চিৎ কৌণিক ব্যঙ্গ থাকে। কিন্তু আমরা লক্ষণটিকে এ যুগের জাগতিক সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করি। আমাদের সন্তানদের উদ্বুদ্ধ করি এই 'গুণ'টি আয়ত্ব করতে। তারাও সেভাবে বেড়ে ওঠে। জাগতিক সাফল্য কতোটা আসে তার বিচার সব সময় করে ওঠা যায়না। কিন্তু তাদের উদ্বৃত্ত সময়ে গভীরতর চিন্তার পরিসরটি কমে যায়। উদাহরণ হিসেবে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' নামক চিন্তার অঙ্গনটির কথা ভাবা যেতে পারে। এই শিল্পটি যতোটা 'সরল' বোধ হয়, সেটা বোধ হয় ততোটাই কঠিন। 'কঠিন' বলতে বোঝাচ্ছি ফাঁকি দিয়ে এর তল পাওয়া যায়না। এই ধারাটি গাইতে যাওয়ার আগে তাকে পড়তে হয়। সযত্নে, সাবধানে, ভালোবেসে। প্রতিটি শব্দ থেকে, নির্মাণ থেকে উঠে আসে নতুনতর অর্থ, ব্যঞ্জনা, তাৎপর্য। বিশ বছর বয়সে যে গানটি যেভাবে পড়েছিলুম, ষাট পেরিয়ে তার অর্থ বা ব্যঞ্জনা আমার কাছে আলাদা হয়ে গেছে। ... ...
ব্যাঙ্কসি কে, বা তাঁকে কেমন দেখতে, তিনি শ্বেতাঙ্গ নাকি তাঁর গাত্রবর্ণ গাঢ় - সেকথা কেউ জানেন না। অথচ, তিনি ভুবনবিখ্যাত। ক্যামেরার সামনে নিজের মুখটিকে অষ্টপ্রহর ভাসিয়ে রাখার এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার যুগে, তিনি নিজেকে আড়ালে রাখেন - এবং, অনেকে বলেন, এই আড়ালে রাখার সচেতন প্রয়াসই, সম্ভবত, তাঁর বিপণন-কৌশল - আর, সেটাকে যদি কৌশল বলে মেনেই নেন, মেনে নিতেই হয়, সে কৌশল অসম্ভব কার্যকরীও বটে। তিনি পথশিল্পী - রাস্তার ধারের দেওয়ালে তিনি ফুটিয়ে তোলেন নিজের শিল্প - তিনি গ্রাফিত্তি-শিল্পী - এক নিজস্ব ধাঁচের স্টেনসিলে দেওয়ালে আঁকেন সময়ের ধারাভাষ্য। গ্যালারিতে নিয়মিত শো না করেও তিনি বিশ্ববিখ্যাত। ... ...
ভারত সরকারের কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই লড়াই শুধু ভাইরাসকে পরাজিত করা নয়, একই সাথে চিরদিনের মত ভারতের মুসলমান সমাজকেও আবদ্ধ করা। ব্রাহ্মণ্যবাদের পবিত্র সংক্রমণ এর মুক্ত প্রসারের জন্য এই দুই শয়তানকেই চিরতরে বন্দী করা হিন্দু রাষ্ট্রের চোখে একই রকম প্রয়োজনীয়। সুতরাং অতিমারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালীনই একই সাথে মুসলিম অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে তাদের গ্রেপ্তার করা মোটেই অবাক করার মতো কোন বিষয় নয়। এবং কোভিড-১৯ কে সীমিত রাখার প্রয়াস যত ব্যর্থ হয়েছে, সেই ব্যর্থতার হতাশা ক্রমশই বাড়িয়ে তুলেছে মুসলিম সমাজের প্রতি ঘৃণা এবং দ্বেষ। ভক্তেরা দেখতে চায় রাষ্ট্র তাদের জন্য কতটা ভাবিত - তাদের তা দেখানো রাষ্ট্রের প্রয়োজন। ফর্মুলা খুব সহজ এবং পরিষ্কার - কোভিড-১ যদি না প্রতিহত করতে পারো, মুসলিমদের করো। সে যুদ্ধ করোনা যুদ্ধের চেয়ে সর্ব অর্থেই বেশী লাভজনক। ... ...
ঋণ অনাদায়ী হয়, যখন ঋণীরা ঋণ থেকে পাওয়া পুঁজিটি নিয়ে ফাটকা খেলেন বা তা অন্য ব্যবসায়ে লাগিয়ে দেন। আমাদের দেশের পশ্চিম প্রান্তে একটি রাজ্য রয়েছে। যেখান থেকে আসা বণিকরা সরকার নির্বিশেষে এদেশের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। অতীতে সব বৃহৎ অর্থনৈতিক কেলেংকারিই তাঁদের মগজের জোরে হয়েছিলো। এই তালিকাতেও তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফাটকাবাজি তাঁদের রক্তে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলিকে তাঁরা এককথায় কিনে রাখেন। প্রতি নির্বাচনের সময় যেসব লক্ষকোটি টাকা বেআইনি হাতবদল হয়, তার রাশটি তাঁদের হাতেই থাকে। যে দলই সরকারে আসুন না কেন, এই সব বণিক তাঁদের থেকে শাইলকের ভাগের মাংস উঁচু সুদসহ উসুল করে নেন। ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণও সেই ভাগের মাংস। ... ...
এই লকডাউন ভারতবর্ষ তথা সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে কি সাংঘাতিকভাবে আহত করেছে এবং করে চলেছে, সে সম্পর্কে খবর প্রায়ই পাচ্ছি। কিন্তু যে দেশে প্রতিবন্ধকতা দারিদ্র্যের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে, যে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের একটা বড় অংশ অ-সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, সে দেশের আর্থিক বিপর্যয়ের বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা সেভাবে উঠে আসছে কই? ভাতা ও রেশনের চালের কিছু ব্যবস্থা করা হলেও ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রে জানতে পারছি যে আমাদের চারপাশের বহু প্রতিবন্ধী মানুষই হয় তার আওতায় পড়েন না, অথবা সেসব ন্যায্য পাওনা এখনও তাঁদের হাত অব্দি এসে পৌঁছয় নি। তবে এইসব বড় কথা থাক। আমার মত সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কথা বলা বা ভারতবর্ষের প্রতিবন্ধী মানুষদের গোটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা চূড়ান্ত ধৃষ্টতা বই কি! ... ...
আমরা আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাস, ইউরোপের কলোনি ও যুদ্ধ-বাণিজ্য বিস্তারের ইতিহাস, সমস্ত কিছুতেই এই রাষ্ট্রধারণার প্রাবল্য দেখি। এমন কী ধর্মকেও রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হয়। কিন্তু, ভারতীয় দেশগুলিতে যেহেতু এই রাষ্ট্রচেতনা গণমানসে খুবই ক্ষীণ, তাই রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিসমূহ নিয়ে আলোচনা-আন্দোলনে জনতার উৎসাহও কম। সম্ভবতঃ, আজকের ভারতেও আমরা দেখতে পাই, এই চেহারাটা। রাজনৈতিক দলগুলির ভাগাভাগি, একই এজেন্ডা নিয়ে একাধিক নামে দল তৈরি হওয়া, ব্যক্তিগত প্রভাবের প্রাচুর্য সবই পলিটিকালাইজেশোনের অভাবকে একভাবে সূচিত করে। এমন কী, রাজনৈতিক দলগুলিও সেখানেই সফল যেখানে তারা রাষ্ট্রনীতির পরিসর, পার্লামেন্টারি ডিবেটের বাইরে সামাজিক সংযোগ করেছে। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ এইদেশে পলিটিক্স-এর অচলতার কারণ বুঝেছিলেন, এই প্রবন্ধগুলিতে বেশ বিশদে তা আলোচনা করেছে। ... ...
গ্রামের যে রাস্তাটা উড়িষ্যার দিকে চলে গেছে সেই পথ দিয়ে ওরা হাঁটছিল।আমরা ওদের থামালাম।জিজ্ঞেস করলাম,কোথা থেকে এসেছে আর কোথায়ই বা যাবে! লোকগুলো কথা বলতে ভয় পাচ্ছিল।একটু থেমে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারিদিক দেখতে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে ফের চলতে লাগল কোনো জবাব না দিয়ে।আমরা আবার আটকালাম।জানতে চাইলাম একই কথা।কোথা থেকে আসছে ওরা?ওদের মধ্যে একজন বলল,মূর্শিদাবাদে বাড়ি।ওরা হেঁটে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে।ভিন কোনো রাজ্যে কাজে গেছিল! এমন সময় দেখলাম পেছনে লোকাল পুলিশের গাড়ি।ওরা কোনোরকমে বলল পুলিশ ওদের বর্ডার পার করে দিতে চাইছে।কিন্তু ওরা তো বাংলার মানুষ!! ... ...
ইতিহাস বলে, সংকট মানুষকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, সমাধানের পথ বাৎলে দেয়। করোনাভাইরাস থমকে দিয়েছে উন্মত্ত পৃথিবীর অর্থহীন দৌড়, হয়ত সাময়িকভাবেই। অভূতপূর্ব এই বিশ্বজোড়া মানুষের এতটা দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা, নিজের ঘরের চৌহদ্দিতে। এই পড়ে-পাওয়া সময় হয়ত প্রকৃতির দান, কিম্বা প্রকৃতির পাঠানো কোনো সংকেত -- অন্তর্দর্শনের ডাক। আরও অনেক বড় বড় সঙ্কটের সূচনায় করোনা হয়ত এক ছোট্ট যতিচিহ্নের মতো। ... ...
ফেরো, আমার দেশ, ঘরে ফেরো। আর যেওনা রাক্ষসের নরভুক পুরীর উন্নয়ন-পুজোয় বলি হতে। নিজের ঘরে থাকো। নিজের জোরে থাকো। ও মা আমার, তোমার লক্ষ মুখ যখন কাতরাচ্ছিল, যখন মায়ের কোলেও ঘুমোচ্ছিল না খিদেয় কাঁদা শিশুরা, যখন সতেরো দিনের বাচ্চা কোলে বাড়ি যাবে বলে হাঁটছিলে তুমি, তখনও তোমার মাথার ওপর জেগে ছিল নীল আকাশ। মেঘ। গাছপালারা তাকিয়েছিল দূর থেকে। পাশের সরু ঘোলাটে জলধারাটি যে তোমার ফেটে যাওয়া বুকে ওই কাদাজলের অঞ্জলি জোগাচ্ছিল- এরা সবাই তাকিয়েছিল তোমার দিকে। তোমার অপেক্ষায়। ওরাও আশ্রয়হারা। তুমি ওদেরও বাঁচাও। আমাদের বাঁচাও, শিক্ষিত করো আমাদের। তুমি নিজের ঘরে থাকো। ... ...
এই মধ্যমগ্রামও যেন আগের শহর নয়। আজ বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা পুরো শুনশান। চৌমাথা থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে একটাও গাড়ি চোখে পড়ল না। ওভারব্রিজের মাঝামাঝি প্রতিদিনই দাঁড়াই। প্লাটফর্মের প্রত্যেকটা সিগন্যাল লাল হয়ে আছে। এই সময় যে হাজার হাজার লোক স্টেশনে ভিড় করে থাকত, আপ ট্রেন একগাদা ক্লান্ত লোককে কলকাতা থেকে বয়ে এনে প্লাটফর্মে উগড়ে দিত, তারা কোথায় গেল? তারা আর আদৌ কোনও দিন প্লাটফর্মে ভিড় করবে তো?সবকিছু বদলে গেছে, ভেবেছিলাম হাসপাতালও বদলে গেছে। অনেকদিন হাসপাতাল ভাঙচুরের খবর নেই, ডাক্তারের মাথা ফাটছে না। বিষ্ঠা মাখতে হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কর্মীদের কয়েক জায়গায় পাড়া ছাড়া করা হয়েছে, মাঝ রাতে সিস্টারকে ভাড়া বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অসংখ্য মানুষ সেই সব ঘটনার সমালোচনা করে স্বাস্থ্য কর্মীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ... ...
সোশাল ডিসটেনসিং-এর প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং তার গূঢ় অর্থ সরলীকরণ না করে নির্বিচারে এই শব্দ-বন্ধ ব্যবহার করলে অচিরেই করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক সামাজিক দূরত্ব তৈরি হবে। খেয়াল করুন মধ্যপ্রদেশে করোনা মোকাবিলায় কমিউনিটি ভিজিটে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের শারীরিক নিগ্রহের শিকার হওয়া, বিভিন্ন রাজ্যে করোনা সন্দেহে আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণ, করোনা সন্দেহদের কোয়ারান্টাইন ভেঙে আইন হাতে নেওয়া এইসব ঘটনা পরোক্ষ ভাবে সামাজিক দূরত্বের বার্তা বহন করে না কি? উত্তর দিচ্ছে সম্প্রতি এই রাজ্যের ঝাড়্গ্রাম জেলার সাকরাইল অঞ্চলের এক ঘটনা। ... ...