এইটুকু দেখে যদি বইটি বন্ধ করে তাকে তুলে রাখেন তো মস্ত ভুল করবেন। এটি একেবারেই নানা প্রাক্তন বিপ্লবীর দাম্ভিক আত্মগর্বী ফাঁপানো ফোলানো কাহিনী নয়, যেখানে তিনি কোন ভুল করেন নি। শুধু জনগণ তাঁকে বুঝতে ভুল করে ছেড়ে গেছে। বরং এটি এক বিনম্র নারীর অন্তরঙ্গ আলাপন, যিনি হাতড়ে হাতড়ে পথ খুঁজে নেন। যাঁর কাহিনীতে সাফল্যের চেয়ে বিফলতার খতিয়ান বেশি। যিনি অকপটে নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং জীবনের একটি বাঁকে এসে মনে করেন এবার ঘরে ফেরার সময়। ... ...
এই রোবটের জন্য যে কত অসুবিধায় পড়তে হয়েছে! যেমন এখানে আসার পর কিছুদিন হোটেলে ছিলাম। হোটেলে স্নান করার জন্য সাবান ছিল না রুমে – সাবান চাইতে গেছি, তখন ম্যানেজার জিজ্ঞেস করল, কে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে আপনাকে? আমি অবাক হয়ে বললাম – সাবান আবার কে মাখিয়ে দেবে? নিজেই মাখবো! ম্যানেজার অমনি হাঁ হাঁ করে বলল, – “আরে দাদা, বলেন কী? এসব দামী সাবান, আপনি নিজে মাখবেন না – রোবট মাখিয়ে দেবে আপনাকে। নইলে আপনি অনেকটা ক্ষইয়ে ফেলবেন”। আমি কত করে বললাম বেশী খোয়াবো না – কিন্তু ম্যানেজার কিছুতেই শুনবে না! অতএব রোবটেই চান করালো! ... ...
এই তো একবছর হয়নি, আমার অজাতশত্রু বোন, আমার অজাতশত্রু ভাই পূর্ণ মেজাজে ডালপালা মেলে ধরেছে। তাদের পাতা ঝরে পড়ছে। পাতাগুলো ঝাঁটিয়ে রাখা হচ্ছে তাদেরই ছায়ার নীচে মাটিতে। এছাড়া মাটিকে আচ্ছাদিত করে আছে কিছু প্যারা ঘাস, লজ্জাবতী, দুর্ব্বো। ভাইয়ের গায়ে লতিয়ে উঠছে অপরাজিতা। ঝরাপাতা বাদামী থেকে কালো হয়ে উঠেছে। ঘাস-পাতা-গুল্ম আচ্ছাদিত মাটি রসে টইটম্বুর। সেখানে প্রতিনিয়ত মাননীয় মিলিপেড, সেন্টিপেড, কেঁচো, শামুক, পিঁপড়ে ও অন্যান্য (আমার নাম না জানা) পোকাদের চলাফেরা। তারাই তো মাটির স্বাস্থ্য, মসৃণতা এইসব বজায় রাখবেন – যাতে মাটি গ্যালন গ্যালন জল ধরে রাখতে পারে তার পেটের ভেতরে। আর ফুল-পাতা-ঘাস যা ঝরে পড়বে সবাইকে জারিয়ে করে দেবে মাটির খাবার। মাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। ... ...
নিজের প্লেট থেকে চামচে করে চাউমিন তুলে সৌম্যর প্লেটে দিল রজত। খাবারের প্রথম গ্রাসটা একে অন্যকে বেড়ে দেয় ওরা। বহুদিনের অভ্যেস। আগে বেশ একটা প্রেম-প্রেম ব্যাপার ছিল। এখন সেটা এতটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, যে খাওয়ার শুরুতে এই কাজটা আপনাআপনিই হয়ে যায়। রজত চাওমিন মুখে পুরে বলল, “তোর অনুমানটাই ঠিক। তুহিন সেদিন পুরো সন্ধ্যেটা ঋকের বাড়িতে ছিল না। অন্তত একবার তো বেরিয়েইছিল। ওর কল লিস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, যে সন্ধ্যে পাঁচটা পঞ্চান্নয় ওর ফোনে একটা কল আসে। দিল্লির নাম্বার। সাম আনন্দ মিশ্র। মিনিট পাঁচেক কথা হয়। তারপর তুহিনের ফোন থেকে ওই নাম্বারে আবার একটা ফোন যায়। সেটা সাতটা পনেরোয়। সেই ফোনটা যখন করা হয়, তখন তুহিনের টাওয়ার লোকেশন হাওড়া স্টেশনের কাছাকাছি। এইবার কল ডিউরেশন দু’মিনিটেরও কম। এর ঠিক পরেই ও পৃথাকে মেসেজ করে। এরপর অনেকক্ষণ কোনো কল রেকর্ড নেই। তারপর আবার তুহিনের ফোনে কল ঢোকে রাত দশটায়। লোকেশন ঋকের বাড়ি। ফোন এসেছিল ফুড ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে।” ... ...
কুসুমপুরের ঝোপঝাড় জলশূন্য ডোবা, পুকুর পেরিয়ে দমকা একটা মাঠের মধ্যে এসে পড়ে। এই মাঠ, কুসুমপুরের বিশাল ডাহি, সামান্য চড়াই উৎরাই, পাথুরে গেরুয়া ভূমি, মাথার উপর বিস্তীর্ণ আকাশ, দিগন্তে বিলীন এই বিশাল পৃথিবীতে আলো গাঢ় হয়ে আসছে। গাঢ় আলোর ভিতর কৃষ্ণবর্ণের মানুষ একা হাঁটছে; এখন এই রকম দৃশ্য। যেতে হবে বহুদূর। মাঠ পার হয়ে গাঁ পেরিয়ে জঙ্গল, সেই জঙ্গল পেরিয়ে আবার মাঠ জঙ্গল গ্রাম ডাহি এই রকমই তো পথ। কত বছর আগে এই গাঁয়ে এসেছিল বুড়ো তা আর স্মরণে থাকে না। সেই যে বার যুদ্ধের উড়োকল ভেঙে পড়েছিল নিশ্চিন্তার ওপারে তারও অনেক আগে। যুদ্ধের উড়াকল। হ্যাঁ। ঘড়ঘড় শব্দে সে আকাশে চোখ মেলে। মাথায় পাখা ঘুরিয়ে হেলিকপ্টার যাচ্ছে কলাইকুন্ডার দিকে। ... ...
সকালবেলা। জোরে জোরে দরজায় বেল বাজছে। আপনি দরজা খুললেন। খুলেই কিছু অফিসারদের দেখতে পেলেন: "আমরা ইডি। আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদের সাথে যেতে হবে। এক্ষুণি।" আপনি তাদের সাথে তাদের অফিসে পৌঁছালেন। আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়: "আপনি কি গত বছর আপনার একটা প্লট গুপ্তজিকে বিক্রি করেছিলেন?" আপনি বললেন: "হ্যাঁ, আমার নিজস্ব প্লট ছিল, কোনো বিতর্কিত সম্পত্তি ছিল না। দু নম্বরি করে বিক্রি করিনি, কোনো কালো মামলাও নেই। সঠিক পন্থায় নথিভুক্ত, সাক্ষী, সমস্ত প্রমাণও আছে আমার কছে।" তারা আপনার প্রমাণের প্রতি একটুও আগ্রহী নয়: "আপনি কি জানেন যে গুপ্তা, যার কাছে আপনি প্লট বিক্রি করেছেন, ব্যবসায় কারচুপি করার জন্য তার বিরুদ্ধে ৪২০ র মামলা আছে?" আপনি মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন: "দেখো ভাই, আমি তার কাছে প্লট বিক্রি করেছি, কন্যাদান করিনি। সম্পত্তির এজেন্ট চুক্তিটা করেছে। পেমেন্ট চেকের মাধ্যমে এসেছে। তার সাথে, তার পরিবার বা ব্যবসার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। মাস কয়েক আগে আমি খবরের কাগজে পড়লাম যে তার বিরুদ্ধে কিছু ফর্ম রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। কিন্তু সেসব তো আমাদের চুক্তির পরে ঘটেছে।" আপনি মনে করলেন,যে ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়েছে। বিষয়টা মিটে গেছে। কিন্তু তখনই আপনার মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়বে: "মনে হচ্ছে আপনি PMLA (প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট) আইনটার ব্যাপারে কিছু জানেন না। আপনি এই আইনের অধীনে একজন অপরাধী। কারণ অপরাধের আয় আপনার পকেটে পৌঁছেছে। কাজেই আপনিও একজন অপরাধী। এই অপরাধের দরুন আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করছি!" ... ...
নাট্যকারের প্রাণের সঙ্গে তাঁর নাটকও বেঁচে যায়। ঢাকায় বাংলা মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫৯ সালে। সেখান থেকেই পরের বছর যুগান্তকারী নাটকটি প্রকাশিত হয়। দীনবন্ধু সরকারি চাকরিতে ছিলেন বলে প্রথমে তা প্রকাশিত হয়েছিল 'নীলকর-বিষধর-দংশন-কাতর-প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ-কেনচিৎ-পথিকেনভিপ্ৰাণীতং' ছদ্মনামে। বহুদিন পর্যন্ত তিনি নিজের আসল নাম প্রকাশ করতে পারেন নি। ঢাকার বাড়িতে বসে সরকারি চিকিৎসক ও দীনবন্ধুর প্রিয় বন্ধু ডাঃ দুর্গাদাস কর রাত জেগে নাটকের প্রুফ সংশোধন করেছিলেন। বাংলার আধুনিক নাট্যধারার পথিকৃৎ মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র অবশ্য মাইকেল প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। এই ধারায় তিনিই হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালের নাট্যকারদের আদর্শ স্থানীয়। ... ...
এই হলেন দেবনুরা মহাদেব। এক আইকনিক কন্নড় সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব, জনসাধারণের বুদ্ধিজীবী এবং কর্ণাটকের এক শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক কর্মী। এতই মুখচোরা এবং আত্মপ্রচার বিমুখ, যে মাঝে মাছে সন্দেহ হতে শুরু করে, যে এই লোকটি জনজীবনে করছে টা কী। জনতার মনোযোগ থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার বিশেষ প্রতিভা রয়েছে তাঁর। মঞ্চে তাঁকে হঠাৎই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা— কেউ হয়তো দয়াপরবশ হয়ে বলল: উনি ধূমপান করতে গেছেন। মহাদেব সর্বদা এবং বিরক্তিকরভাবে দেরিতে চলেন, এমনকি আমার তুলনায়ও, সবসময় একটু অপ্রীতিকর, হয়তো কিছুটা বিকৃতও। সেটা কিন্তু বোহেমিয়ান কবির যত্ন সহকারে পরিকল্পিত অসাবধানতা নয়, তাঁর জীবনের এক আলাদা ছন্দ আছে, আছে নিজস্ব পূর্বাপরবোধ, যা চিরাচরিত কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তির ক্ষেত্রে কল্পনাই করা যায়না। ... ...
এই মিছিলের নাম, ‘India March for Science’। কেন এই মিছিল? এ বছর নতুন নয়। ২০১৭ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানসমাজ তাঁদের দেশের সরকারকে বারংবার অনুরোধ করছিল, যেন অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, কুসংস্কার, ইত্যাদির, সরকারি খরচে প্রসার রদ করা হয় এবং বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা করা হয়। সরকারি নীতি – তা সে পরিবেশ বিষয়কই হোক, বা স্বাস্থ্যসম্পর্কিত, যেন বিজ্ঞান-অনুসারী ও কল্যাণকামী হয়। ভারতের বিজ্ঞানকুলও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এঁদের দাবি ছিল, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ও প্রচার, সংবিধানের 51(A) ধারা অনুযায়ীই, আমাদের কর্তব্য। এই সব দাবি নিয়ে এবং বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান-আন্দোলনের সমর্থনে ভারতও হাঁটতে থাকে প্রতি বছর, ২০১৭ থেকে ২০১৯। ... ...
- উড়িষ্যার ভিতরকণিকায় অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড থেকে হাজার হাজার অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপ আসে ডিম পাড়তে – সেটা জানিস তো? - হ্যাঁ। - কিছু কচ্ছপ জেলেদের জালে ধরা পড়ে যায়। আর চোরাশিকারিরা তো আছেই। তারা ঐ কচ্ছপ ধরে। এই এলাকার লোক কচ্ছপ খায়, মানে এমনি তো পায় না। কচ্ছপ ধরা, বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু পেলে ছাড়ে না। আর বড় অলিভ রিডলেকে বলে বালিগড়। একটা বালিগড় চোরাগোপ্তা পেয়ে গেলে এদিকের মানুষের ঘরে উৎসব লেগে যায়। গতকাল আমাদের যে দুর্গাবৌদি রান্না করে, সে খুব হেসে হেসে নাতিকে কোলে নিয়ে বলছিল, “তুমি কী খেয়েছ?” বাচ্ছাটা আধো আধো করে বলছে – বালিগল। ... ...
গায়ত্রী দীপালি এখন পশ্চিম বাংলার কোথাও আছে। ওর দু’ভাই ওকালতি আর পলিটিক্স নিয়ে বাংলাদেশেই থাকে। বুলু, টুলু, অঞ্জলিরাও নব্বই সালের দিকে চলে গেছে। খুব কম বেড়াতে আসে। বাংলাদেশে এ এক পরিচিত দৃশ্য। সবাই জানে, প্রতিটি হিন্দু পরিবারেরই একটি খুঁটি আছে ভারতে। রাতে গল্প করছে, চা খাচ্ছে যে বন্ধুদের সঙ্গে, তারা সকালে জানতে পারে বন্ধুটি পরিবারসহ চলে গেছে ইন্ডিয়া। ওদের বাড়িটি গোপনে বিক্রি করে গেছে কোনো মুসলমান পরিবারের কাছে। কিন্তু কবে থেকে এ দৃশ্যের আরম্ভায়ন? ... ...
তিস্তা লিখছেন তিনি গুজরাটি হওয়ায় গর্বিত। এক সময় ঐ রাজ্য তাঁর ছোটবেলার সুখস্মৃতির অঙ্গ ছিল। রাতের ট্রেনে বোম্বে থেকে আহমেদাবাদ যাওয়া, মা বোনের সাথে পুরানো শহরের জামাকাপড়ের বাজারে চক্কর মারা, তাঁকে এখনো শিহরিত করে। ‘ফেমাস’ নামক রেস্টুরেন্ট থেকে কুচো লঙ্কা, পেঁয়াজ ও পুদিনা পাতা দেওয়া মাংসের সামোসার কথা মনে হলে এখনো তাঁর জিভে জল আসে। ১৯৯১ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রের হয়ে ঐ রাজ্যে গিয়ে তাঁর সেই সযত্নে লালিত স্মৃতিমেদুরতা ধাক্কা খেল। তখন লাল কৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা চলছে, গুজরাটে সেটার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তিস্তা বিভিন্ন শহর পরিক্রমা করাকালীন কিছু ঘটনার সাক্ষী হন যা তাঁকে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এবং মুসলিমদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত করে তোলে। ট্রেনে এক হিন্দু ব্যবসায়ীকে উল্লসিত হয়ে বলতে শোনেন হিন্দুত্ব ও হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা এখন খুব জনপ্রিয়! হিংসাত্মক কার্যকলাপ করা, খুন করায় গুজরাটিদের যে ভয় ছিল সেটা এঁরা খতম করে দিয়েছে। এটা দারুণ! একবার শহরের গণ্যমান্য মানুষ রউফ ওয়ালিউল্লার সাথে দীর্ঘ কথোপকথনে মুসলিমদের সমস্যা সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে, সেই বিখ্যাত সামোসা কিনে, ফ্লাইট ধরে বোম্বে বাড়ি ফিরে এসেছেন। সাক্ষাৎকার থেকে বাড়ি, এতে মাত্র এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট সময় অতিবাহিত হয়েছে। বাড়ি ফেরা মাত্র ফোনঃ রউফসাব খুন হয়ে গেছেন! ... ...
প্রবুদ্ধসুন্দর কর। বাংলা কবিতার ক্ষণজন্মা এই কবিতাপুরুষকে নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি লিখতে হবে, ভাবনায় আসেনি। অথচ এই কাজটাই করতে হচ্ছে কঠিন সত্যকে মেনে নিয়ে। প্রবুদ্ধসুন্দর ও তাঁর কবিতা নিয়ে চর্চার অবকাশটুকু প্রবুদ্ধসুন্দর নিজেই কিছুটা সহজ সমীকরণে নির্ণয় করে গেছেন। উপরে উদ্ধৃত ‘বায়ডাটা’ শিরোনামে কবিতা থেকে তাঁকে চিহ্নিত করতে পারবেন একজন কবিতা পাঠক। ‘সংকর’ জাত প্রবুদ্ধসুন্দর তাই অবলীলায় লিখতে পারে, ‘বাবা বেগবান অশ্ব/ মা, উদ্ভট সংসারের ভারবাহী গাধা/ আমি খচ্চর, বাংলা কবিতা লিখি।’ ... ...
কবিতার সঙ্গে আপোষহীন এই মানুষটিকে তাই পড়তেই হবে বর্তমান এবং উত্তর প্রজন্মকে। নিন্দিত এবং নন্দিত হওয়া যেকোনো সৃজনশীল মানুষের যাত্রাপথের পাথেয়, কেউ হয়তো ইচ্ছে করেও অধিক আলোচিত হওয়ার জন্য নিজেকে নিন্দিত এবং সমালোচিত হতে দেন, এসময়টা তখনই আসে যখন সৃজনশীলতার গতিপথে সামান্য ছায়া ঘনিয়ে ওঠে, একজন কবির কাছে এই সময়টা হলো সবচেয়ে কঠিন এবং অন্ধকারতম সময়। কোনো কোনো কবি তখন স্তব্ধ থাকেন, সরিয়ে রাখেন নিজেকে, কেউ বা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন, সমস্ত বিষয়েই আক্রমনাত্মক বিচ্ছুরণ, কবিতা তখন শ্লেষ, বিদ্রুপ এবং কবির স্বভাবগত তীক্ষ্ণ মেধা ও শব্দের ওপর আসুরিক ও ঐশ্বরিক দখলে এক একটি যন্ত্রণাদায়ক উল্কির মতো বিঁধতে থাকে পাঠককে, এই চলমান সময়ে কবি প্রবুদ্ধসুন্দরের লেখাকে আমার তাই মনে হয়েছে। ... ...
সাহিত্য নয়, কথকতা। পড়তে পড়তে মনে হয়, কথকতাও নয়, চিত্রনাট্য। সাবলীল গদ্যের টানে টেনে নিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রই যেন। প্রতিটি ছোট ছোট অভিজ্ঞতা আর তার আগে-পরে বহু ফ্ল্যাশব্যাক মুহূর্তকে লেখক ধরেন কখনও ক্লোজ শট, কখনও মিড শট, কখনও লং শটে। তাঁর ক্যামেরার চোখে কখনও ভি শান্তারাম, কখনও বিমল রায়, কখনও গুলজার। ছোটখাটো চেহারার ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত আদ্যন্ত বাঙালি যে মানুষটি বাংলা সাহিত্যের পুনর্নির্মাণ করেছেন সেলুলয়েডে, তাঁর নির্ভার স্মৃতিচারণে কী অবলীলায় ধরা পড়েছে ষাট-সত্তর দশকের বোম্বে থেকে কলকাতা। শচীনকর্তার বাড়ি থেকে হেমন্ত কুমারের সঙ্গে আড্ডা, বিমল রায় থেকে সত্যজিৎ রায়ের সাহচর্য, ম্যাডাম কাননবালা থেকে মিসেস সেনের কাছের মানুষ, মহানায়ক উত্তম থেকে ম্যাটিনি আইডল রাজ কাপুরের সখ্যতা... বর্ণময় জীবন কি একেই বলে? ... ...
এই বইটাতে সুদীপ্ত দু’টি দুরূহ কাজ সম্পন্ন করেছে। প্রথমত সহজে বিজ্ঞান বলা, আর দ্বিতীয়ত বাংলায় বিজ্ঞান বলা। এই দু’টিই যে কতটা কঠিন কাজ – সেটা যারা কখনো চেষ্টা করেছেন, তাঁরাই জানেন। সেই কাজটা আরো কঠিন হয়ে যায়, যখন আপনি এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে বসেন, যার অনেকটাই এখনো কুয়াশায় ঢাকা। সমকামিতার কারণ এখনো তর্কাতীতভাবে জানা যায়নি। এর পেছনের একটা কারণ বিষয়টির জটিলতা, অপর কারণটি রাজনৈতিক। সমকামিতা জেনেটিক না এপিজেনেটিক না হরমোনাল না সামাজিক এই নিয়ে বহু পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। এই জট পাকানো বিষয়টিকে বইটিতে সুন্দরভাবে গুছিয়ে ধাপে ধাপে পরিবেশন করা হয়েছে, যাতে সহজে গ্রহণ করা যায়, কোথাও ধাক্কা খেতে না হয়। যেখানে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সুদীপ্ত খুব সুন্দরভাবে একদম গোড়ার কথাগুলোও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। ... ...
বিলিতি সংস্কৃতির প্রভাবে বদলে যেতে থাকা বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের খাদ্য-রুচির দারুণ বিবরণ দিয়েছিলেন পরশুরাম তাঁর ছোটগল্প 'রাতারাতি'তে। সেখানে দেখি, হারিয়ে যাওয়া পুত্র বাঁটুলের খোঁজে কলকাতার আংলো-মোগলাই কাফেতে হাজির হন চরণ ঘোষ যেখানে বাঁটুলের সমবয়সী তরুণ-তরুণীদের তারিয়ে তারিয়ে মুরগির ফ্রেঞ্চ মালপোয়া খেতে দেখা যায়। আবার বাঁকুড়া ও বর্ধমানের মানুষের কলাইয়ের ডাল-প্রীতির সুখ্যাতি করে প্যারীমোহনের আর একটি গানে বলা হয়েছে, ওই ডালের বড়া খাওয়ার জন্যে বৈকুণ্ঠ থেকে নেমে এসে থালা হাতে ভগবানও লাইন দেবেন। ... ...
লেখাটির মাঝে কিছু সত্য আছে। আবার সত্যকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে লেখকের নিজের মর্জিমাফিক বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে অনেক কিছুই বলা হয়নি, দুয়েকটি বিষয় এবং প্রধানত ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের অ্যাসোসিয়েট এডিটর (“বরিষ্ঠ সম্পাদক” নন, সত্যের খাতিরে বললে) পিটার দোশীর একটি বা দুটি প্রবন্ধকে হাতিয়ার করা হয়েছে। এর বাইরে অসংখ্য গবেষণাপত্র আছে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল, ল্যান্সেট, নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এর মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মান্য জার্নালগুলোতে। এবং এ জার্নালগুলো কর্পোরেটদের টাকায় নিয়ন্ত্রিত হয়না। এসব জার্নালে স্বাধীন গবেষণাপত্র ছাপা কর্পোরেট ফান্ডিংয়ের বদান্যতা ছাড়া। যদি বিজ্ঞানের এই স্বাধীন পরিসর না থাকে তাহলে বলা ভালো – প্রপঞ্চময় এ কর্পোরেট বিশ্বে কেউ স্বাধীন নয়। স্বাধীন হওয়া সম্ভবও নয়, “জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া” ফুটিয়ে না দিলে। এখানে একবার স্মরণ করে নেওয়া ভালো – যখন বিভিন্ন রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ, উপাত্ত বা সম্ভাবনা থেকে শুধুমাত্র নিজের অনুকূলে বা পক্ষে যায় এরকম উপাত্ত, প্রমাণ বা সম্ভাবনাকেই বাছাই বা নির্বাচন করা হয় তখন যে হেত্বাভাস বা অনুপপত্তি (অর্থাৎ ভ্রান্ত যুক্তি) সংঘটিত হয়, তাকে যুক্তিবিদ্যায় পক্ষপাতদুষ্ট বাছাই বা ইংরেজি ভাষায় চেরি পিকিং (Cherry picking) বলা হয়। পক্ষপাতদুষ্ট বাছাই ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজান্তেই হতে পারে। তবে জনবিতর্কে এই ভ্রান্তি একটি বড় সমস্যা। ... ...