১৯৯৭/৯৮ সালে ব্যাঙ্ক অফ রাশিয়া (আমাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক) ডলার আর রুবলের বিনিময় মূল্যের একটি মান বেঁধে দিয়েছিল। এক ডলারের দাম ৫ আর ৭ রুবলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে। যদি রুবলের দাম কমে, বাজার থেকে ডলার কিনে ব্যাঙ্ক অফ রাশিয়া রুবলকে চাঙ্গা করবে। আর যদি রুবল শক্তিশালী হয়ে এক ডলারের বদলে ৫ নয়, ৪ রুবলের দিকে চলে যায়, বাজারে ডলার বিক্রি করে ব্যাঙ্ক রুবলের ভাও আবার পাঁচে নিয়ে আসবে। এর কেতাবি নাম ভাসমান গাঁটছড়া (ফ্লোটিং পেগ) বা ম্যানেজড পেগ। এই ভাবে রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রুবলের মূল্যরক্ষার শপথ নিলো। কাগজ-কলমে এই পদ্ধতি আগ মার্কা শুদ্ধ। কিন্তু এটির শক্তি নির্ধারিত হয় যেকোনো দেশের ডলারের ভাঁড়ারে সঞ্চিত ধন (ডলার) এবং দেয় সুদের হার অনুযায়ী। মাত্র ছ’ বছর আগে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড এইরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করে পাউন্ডের দাম ধরে রাখতে সম্যক ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁদের প্রতিরক্ষা প্রয়াস একদিনেই বিধ্বস্ত হয় – কালো বুধবার ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯২। এই জুয়োয় দান দিয়ে জর্জ সোরোস একদিনে এক বিলিয়ন ডলার লাভ করেন। ... ...
একটা জিনিস খুব স্পষ্ট – কলকাতার প্রথম অ্যাকুইফারের উপরে ১০ থেকে ৫০ মিটার পুরু একটি অ্যাকুইটার্ড বা কর্দমের স্তর আছে, যা অপ্রেবেশ্য বা আংশিক প্রবেশ্য। এটি থাকার জন্য এবং কলকাতার অধিকাংশই কংক্রিট বা অ্যাসফল্টে ঢাকা বলে কলকাতার বৃষ্টির জল সরাসরি ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারে না বা পারলেও এত ধীরগতিতে, যে তা হিসাবের মধ্যে আসে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কলকাতায় এত যে বৃষ্টি হচ্ছে – তা কলকাতার কোনো কাজেই আসছে না। প্রায় সবটাই বয়ে চলে যাচ্ছে। উল্টে তা আবার জলমগ্নতার সমস্যা সৃষ্টি করছে। কলকাতায় তো বৃষ্টির জল ভূগর্ভে যেতে পারে না, তবে এই ভূগর্ভের অ্যাকুইফারগুলি পুষ্ট হয় কীভাবে? ... ...
নব্বই সালের পর বিশ্ব রাজনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সে পরিবর্তনের আঘাত এত দ্রুতগতি সম্পন্ন ছিল যে বিশ্বের তাবড় বড় অনেক রাষ্ট্র ঝাপটে পড়েছে। অর্থনীতি মুচড়ে গেছে। রাষ্ট্রের সীমানা আর জনগণের নাগরিকত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশহারা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। পুঁজিবাদ নিপাত যাক বলে লাল ঝাণ্ডার পাণ্ডারা আর ফান্ডা দেখাতে পারছে না। বিপ্লব হিমঘরে। নেতাদের চরিত্র পালটে সম্পূর্ণ বিপরীতে এসে ঠেকেছে। সমাজতন্ত্র ভাগাড়ে আর ধর্মনিরপেক্ষতার মরণ হয়েছে। গণতন্ত্র সেজে উঠেছে ভোগবাদী আভিজাত্যে। এর সঙ্গে ধম্মো ধম্মো বোল উঠেছে আকাশ বাতাস মাটিতে, নদীতে। আজকাল দেখি অনেকেই স্ত্রী সহবাস, স্বামী সহবাসের দোআ মুখস্থ করার পাশাপাশি হাগতে যাওয়ার দোআও মুখস্থ করে ফেলছে। মন্দিরা শঙ্খ বাজিয়ে তিন বেলা সাড়ম্বরে পূজা করছে। পাঁচ বেলা পড়ে নামাজ পড়ে কপাল ঘষে ঈমানী ছাপ বসাচ্ছে। তবে ধর্ম যত জোরে শোরে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, ঘরে ঘরে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দাঁত শূলাচ্ছে তারচে বেশী জোরে নৈতিকতা পালিয়ে গেছে। মানুষ বেশি বেশি মুসলমান হয়েছে। বেশি বেশি হিন্দু হয়ে গেছে। ... ...
– সুমিতাদিদা আর নিনাদিদা এখন কেমন আছেন, মা? – আছেন বলতে জরাগ্রস্ত, নব্বই ছুঁই ছুঁই। আর নিনাদিদা তো মানসিকভাবে সুস্থ নয়, অল্পবয়সে উত্তমকুমারকে বিয়ে করবে বলে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাই বিয়ে-থাও হয়নি। – মানে? উত্তমকুমারকে বিয়ে করতে চাইতো? – হ্যাঁ, হাসছিস? বহুমেয়েই তখন এমন পাগল ছিল। স্টার থিয়েটারে শ্যামলী দেখে নিনাদিদা পাগল হয়ে গেল। রোজ স্টারের দরজায় বসে থাকত। উত্তমকুমার কখন ঢুকবেন, কখন বেরোবেন। তারপর ধীরে ধীরে বিকার গ্রাস করলো। বলতো, উত্তমকুমার ওকে নিয়ে যাবে। মেহগনি কাঠের কারুকাজ করা পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের বিরাট আয়নার সামনে সেজেগুজে বসে থাকতো, উত্তমের সঙ্গে বেরোবে বলে .... ... ...
পুজোর গামছার প্রধান দুই সমস্যা ছিল তাদের দৈর্ঘ্য এবং ঘনত্বের। সবচেয়ে নিকৃষ্টমানের গামছা সাপ্লাই করা হত পুজোর সময় ব্রাহ্মণদের প্রণামীতে। সেই গামছা প্রায় মসলিনকেও হার মানিয়ে দেয়, অনেকে ভয়ে ভাঁজই খুলত না গামছার, এই যদি ফেঁসে যায়! তবে পুজোতে গামছা এক সিম্বলিক জিনিস ছিল প্রায় – ডাঁই করে রাখা গামছার উপরের কয়েকটায় কিছু সিঁদুর এবং ফুল-গঙ্গা জল পড়ত। তাদের তলার গুলো পুজো শেষ হয়ে গেলে ব্রাক্ষণ ঠাকুর নিজে গিয়ে বিক্রী করে দিয়ে আসত আমরা যেই দোকান থেকে কিনেছি। পরের বছর আবার সেই গামছা আমরা কিনতাম। ... ...
সেকালে সপ্তম শ্রেণিতে উঠলেই ছেলেরা ক্লাব বানাতো।এখন কী করে? আর কেউ কেউ কবিতা লিখতো। ১৯৭৮-এ আমি সপ্তম শ্রেণি। আমরা গ্রামের ছেলেরা একটা ছোটোদের ক্লাব করে ফেললাম। নাম অরুণোদয় সংঘ। বাড়ি বাড়ি বই চেয়ে একটা ছোটো লাইব্রেরি গড়া হল। আমাদের বৈঠকখানা ঘরের আলমারি হলো সেই বইঘরের ঠিকানা। ক্লাবের দপ্তর আমাদের বৈঠকখানা। বাবাকে বলতেই রাজি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হৈহৈ করে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হতো। জুনিয়র হাইস্কুলে ছুটিই থাকে। আমরা ১৫ আগস্ট পতাকা তুলে গোটা গ্রাম ঘুরে মাতিয়ে দিলাম। ... ...
আশঙ্কা ও বিষাদের হাত ধরে ১৪ ই অগাস্ট '৪৭ এসেছিল- আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেলাম। তবে স্কুলে বা বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা ওঠে নি। মাঝে, অখণ্ড বাংলা গঠনের কথা নিয়ে শরৎ বসু, কিরণশঙ্কর রায়, সোহরাবর্দি প্রভৃতি নেতারা বহু আলোচনা করলেও, হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সকলেই এ প্রস্তাব অন্তত তৎকালীন পরিবেশে অবাস্তব মনে করলেন। বর্ণহিন্দুরা পাকিস্তানের মুসলমান গরিষ্ঠতার শাসন মেনে নিতে অপ্রস্তুত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য মহাত্মা গান্ধীর আন্তরিক প্রয়াস তাঁদের মনে বিন্দুমাত্র সাহস যোগাতে পারল না। আমাদের বাড়ির আট- নয় গৃহস্থ পরিবারের মধ্যে পড়ে রইলাম আমরা তিন - চার ঘর। মা বাবার ওপর চাপ দিতে লাগলেন কলকাতায় সপরিবার চলে যেতে। বাবা তখনও গররাজি। এভাবে এক বছর কেটে গেল। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে টেনের ক্লাস আরম্ভ হল। ততদিনে স্কুলের মাঠ চোর-কাঁটায় ভরে গেছে, খেলাধুলা হয় না। গ্রামের ক্লাবের অবস্থাও সঙ্গীন। টিমটিমে আলো-ও জ্বলে না সন্ধ্যের পরে। ম্লান সন্ধ্যা। নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব ঘিরে ধরতে লাগল। ঐ বছরই, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দূর্মূল্যতা সম্পর্কে বাবা এক পত্রে লিখছেন , " চালের দাম মণ প্রতি ২১-২২ টাকা; দুধঃ টাকায় তিন - সাড়ে তিন সের; নারকেল ১ জোড়া ৮-১০ আনা। পত্রের তারিখ ২৪শে এপ্রিল, ১৯৪৮। ... ...
লুন্ডা বা লোন্ডা দেশে পা রাখার পরেপরেই, কাজেম্বে শাসিত এলাকায় প্রবেশ করার আগে, লিভিংস্টোন চাম্বেজি নামের একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ নদী পেরিয়েছিলেন। দক্ষিণের সেই ব্যাপ্ত, বিশাল নদী, যে নদীর নামের সঙ্গে লিভিংস্টোনের নাম চিরকাল জড়িয়ে থাকবে, তার সঙ্গে এর খুবই নামের মিল। ব্যাপারটা সেই সময়ে লিভিংস্টোনকে বিভ্রান্ত করেছিল, আর সেই কারণেই , তিনি এই নদীকে তার প্রাপ্য মনোযোগ দেননি, বিশ্বাস করেছিলেন যে চাম্বেজি তাহলে আদতে জাম্বেজিরই উৎস ধারা, আর তাই তিনি মিশরের যে নদীর উৎসের সন্ধান করছেন, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই। পর্তুগিজ তথ্যের সত্যতার উপর গভীর বিশ্বাস রাখাই তার দোষ হয়েছিল। এই ত্রুটি সংশোধনের জন্য তাকে অনেক, অনেক মাসের ক্লান্তিকর পরিশ্রম করতে হয়েছে, অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ... ...
আজ সকালের পাতে ঠাকুমা দিল ভোগের সাবুখিচুড়ি, তার সাথে মনিপিসির হাতে বানানো সাবুর পাঁপড়। পাত উঠে যেতেই মা ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। আমার অবশ্য আজ সেসবে মন নেই। স্কুল না যাবার আনন্দে আমি ঠাকুমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছি। উঠোন জুড়ে ধুয়ে দেওয়া কাপড়ে জাম-জামরুল গাছের পাতা গলে পড়েছে রোদ। সে রোদ তেতে উঠছে একটু একটু করে। ভাদুড়ি বাড়ির বাগানে একটানা ডেকে চলেছে ঘুঘুপাখিটা। আমাদের বাজারের ব্যাগ উঠোনে পড়ল। মুসা’র মা কচুর পাতায় ব্যাগ উপুড় করতেই বেরিয়ে এল বরিশালী চওড়া ইলিশ আর বেলেমাছ। চকচকে বেলে মাছগুলো নদীর মাছ, বড়বাজারে খুব কমই এমন মেলে। ঠাকুমার খুব পছন্দের মাছ এটা। এ ক’দিনে বাবা এই মাছ জোগাড় করে উঠতে পারেনি। ... ...
অষ্টমঙ্গলার ঠিক কুড়ি বছরের মাথায় ক্যান্সার ধরা পড়েছিল লতিকার। বহুদিনই একটা লাম্প পুষেছিল বুকে। যখন বোঝা গেল, অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে রোগ। ডাক্তার খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন লতিকাকে, অশোককে। বলেছিলেন, ভ্গবানকে ডাকুন। মির্যাকল তো হয়ও। বাড়ি ফিরে খিলখিল করে হেসেছিল লতিকা- 'একদম মিলি । পুরো মিলি। জয়া ভাদুড়ির সেই সীনটা মনে আছে?' অশোক পাগল হয়ে গিয়েছিল যেন- লতিকার ওপর রাগ করেছিল, খ্যাপার মত বলেছিল, 'শুধু সিনেমা , না? শুধু সিনেমা? তুমি মিলি হতে চেয়েছিলে , তাই বলো নি। আমি জানি। সিনেমাই সব তোমার। আমি, বাবলু -কেউ না?' লতিকা শান্ত চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল-'কেঁদো না।' ওকে নন্দিনী মালিয়ার মত লাগছিল অশোকের । যেন ওরা দুজনে ভ্রমর আর অমল। যেন ওদের জোর করে কেউ সিনেমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে-অভেদ্য এক পর্দায় আটকে গিয়েছে লতিকা আর ও- দম আটকে যাচ্ছে, কিছুতেই বেরোনো যাচ্ছে না - 'ছুটি'র লাস্ট সীন চলছে। সিনেমার থেকে বেরোতে না পেরে অশোক ভাবল, তবে সিনেমাই দেখা যাক। ... ...
বইটা একটা ভয়াল নকশিকাঁথার মাঠ। ছুঁচের নিপুণ বুনুনিতে গাঁথা হয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট কোলাজ। তাতে নানান চিত্র, নানান শহরের টুকরো ছবি। কোলকাতা থেকে মুম্বাই, পুনে, কেরল এবং পাটনা। সবমিলিয়ে ধীরে ধীরে উপন্যাসটি ৭২ টি পর্বে এবং পঞ্চাশ হাজার শব্দের বয়নে এক মহাকাব্যিক আকার নেয়। আর বইটি নিখাদ উপন্যাস, সমসাময়িক জীবনের জীবন্ত দলিল, কিন্তু কখনই খবরের কাগজের রিপোর্ট নয়। একশ বছর আগের স্প্যানিশ প্লেগে শুধু শহর কোলকাতায় দু’কোটি মানুষের মরে যাওয়ার গল্প আমাদের আজ তেমন বিচলিত করে না। ও তো অনেক আগের কথা, তখন ভারত ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশ। তখন তো টিবি’রও তেমন চিকিৎসা ছিল না। স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কার হয়নি। আজ স্বাধীন ভারতে এমনটি হতে পারে না। তখন এত হাসপাতাল ছিল না। এত প্রাইভেট হাসপাতাল ছিল না। খোলা বাজারে এত ওষুধ পাওয়া যেত না। আমরা নিশ্চিন্ত থাকি। এখন মানুষের গড় আয়ু তখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কোন চিন্তা নেই। ... ...
মানুষের ভয়ের প্রতি এক আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। সেই আকর্ষণ থেকেই শিশুরা ভূত বা জুজুবুড়ির গল্প শুনে ভয় পায় এবং বারবার সেই ভূত ও জুজুবুড়ির গল্প শুনতে চায়। বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশের এক বড় বাধা এই ভূত পেত্নী ও জুজুর গল্প। ... ...
কেমন করে সময় দেখতাম আমরা? সত্তর দশকে? বাড়িতে প্রথমে একটাই ঘড়ি। যে ঘড়ি বাবা ষাট বছরের বেশি সময় পরেছেন। পরে দাদার একটা ঘড়ি হয়। কিন্তু দাদাও তো বাইরে থাকেন। আমরা সময় মেলাতাম নানা পদ্ধতিতে। একটা ছিল পাশের বাড়িতে একটা দেওয়াল ঘড়ি ছিল হরিণের শিংয়ের পাশে। কাঠের পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়ি। সবসময় যেতে ইচ্ছে হতো না। একটা তো মায়ের ওঠা। মা কী করে উঠতেন মা-ই জানেন। এছাড়া ভোর চার ১৫ মিনিটে ফজরের আজান। সবসময় শুনতে পেতাম না। দুই, সকালে গুঁড়ুভাইয়ের হাঁক ডাক করে আসা। ঠিক ছটায়। কই, শাশুড়ি চা কই? তিন, নোটনমণি ফুলের ফোটা। ঠিক নটায়। চার, ঝাঁটার কাঠির ছায়া মেপে। পাঁচ, বালি ঘড়ি করে। ... ...
গোদার বিপ্লব। গোদার নাশকতা। গোদার ধ্বংস, সৃষ্টি, স্পর্ধা সব কিছুই। বিংশ শতাব্দী জ পল সাত্র, বব ডিলান বা বিটলস ছাড়া এরকম সুগভীর চুম্বনের স্বাদ খুব একটা পেয়েছে বলে মনে করা যায় না। তাঁর যাবতীয় রহস্য, দুর্বোধ্যতা, ইমেজ সমস্ত কিছু নিয়ে পাতার পর পাতা লেখাপত্র হয়েছে, তুফান উঠেছে চায়ের কাপে, গবেষণা কাটাছেঁড়া বিতর্ক কিছুই নেই যা এই নামটিকে ঘিরে হয়নি। তিনি সিনেমার শতাব্দী স্পন্দিত নায়ক। তাঁর অরৈখিক সম্পাদনা, কাহিনী বিরোধিতা, জাম্প কাট, প্রতিবিল্পব ও প্রতিসংস্কৃতি প্রায় রূপকথার মতন পঠিত। আজ বিয়োগের মুহূর্তে সেইসব আলোচনা করে আমি এই শূন্য দেবস্থানে বিলাপ করতে চাইনা। কেবল রইল গোদার নামক কোন এক ধ্রুবতারার সাথে একুশ শতকের একটি তাল-ভোলা যুবকের আলাপ আর সম্পর্কের কিছু চিরকুট। ... ...
রাইটার্সের সামান্য কেরাণী প্রমদাকান্ত, বড় দুই মেয়ের বিয়ের ভাবনাতেই কাহিল হয়ে থাকেন, আবার একটা মেয়ে৷ একটাও কি পাশে দাঁড়াবার মত কেউ জন্মাতে নেই! আর এই তো দেশের অবস্থা! যখন তখন স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে! আরে তোরা পারবি ঐ শক্তিশালী ইংরেজদের সাথে? আর সত্যি তো ইংরেজরা না দেখলে এই দেশটার কি হাল ছিল সে তো জানাই আছে৷ এইসব ভাবনার মধ্যে মানদার চাঁছাছোলা গলা ভেসে আসে ‘অ রুনু মায়ের কাছে একটু বোস দিকি, আমি খুকীটারে একটু পোস্কার করে নিই’৷ জলের স্পর্শে নবজাতিকা তীক্ষ্ণকন্ঠে কেঁদে ওঠে আর মানদার গজগজ চলতে থাকে ‘থাক থাক আর কাঁদে না – ঐ তো মেয়ের ঢিপি – তার আবার অত আদিখ্যেতা কিসের’? সাড়ে ছ বছরের রুনু ঠিক বুঝে যায় এই বোনটা একেবারেই অবাঞ্ছিত৷ ৩ বছরের ঝুনু অতশত বোঝে না, বোনকে দেখতে চায়, হাত বাড়াতে যায় – মানদার ঝঙ্কারে ভয় পেয়ে সেও বোধহয় নিজের মত করে বুঝেই যায় যে বোনটা এমনকি তার চেয়েও বেশিঅনাকাঙ্খিত৷ সরলাবালার জ্ঞান আছে কিনা বোঝা যায় না, চুপচাপ পড়ে থাকেন৷শুধু অনিলাবালা বলতে থাকেন ভগবান যা দেন তাই হাত পেতে নিতে হয়৷ অশ্রদ্ধা করতে নেই৷ তবে বাড়িতে জামাই আছে, তাই গলা তেমন চড়ে না৷ ... ...
তিনতলার ঘরে মস্ত বড় পালঙ্কের এক কোনায় বসে যুঁই আপনমনে সরু সরু দুটো কাঁটা আর খুব শক্ত আর সরু একলাছি সুতো দিয়ে নক্সা বুনছিল; একে বলে কুরুশের কাজ, নতুন শিখেছে ও নমিতা, ছোটমাসীমার দেওরের মেয়ের কাছে, বেশ দিব্বি ছোট ছোট কয়েকটা কাপডিশ বসাবার নকশাদার ঢাকনি বানিয়েও ফেলেছে। পুর্ববঙ্গে থাকতে ওরা জানত শুধু উলবোনা, চটের আসন বোনা আর টুকটাক রুমালে সুতো দিয়ে নকশা করা। ছোটমাসীমার নিজের চারটিই ছেলে কিন্তু তাঁর দেওর ভাসুরদের বেশ ক’টি মেয়ে, সকলের সাথেই যুঁইয়ের বেশ ভাব হয়ে গেছে এই কয়দিনে। মাঝে একবার খবর পেয়ে সাঁতরাগাছি থেকে সেজমাসীমা তাঁর বড়ছেলেকে নিয়ে এসে দেখে গেছেন যুঁইকে। কিন্তু তাঁকে কেমন অচেনা লাগে ওর, কিরকম অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন উনি। ছোটমাসীমাদের ভাষাও যুঁইদের থেকে খানিকটা আলাদা, কিন্তু তাও অনেকটাই মিল আছে, কিন্তু সেজমাসীমার ভাষা, উচ্চারণ সব কেমন আলাদা হয়ে গেছে। সেজমাসীমা আসবেন তাই দিদিমণিও এসেছিলেন খড়দা থেকে। দিদিমণি বলেন ‘তুই অ্যাক্করে এদেশী হইয়া গেছস শেফালী, তর কথাবার্তা আর আমরার দ্যাশের নাই’ সেজমাসীমা দিব্বি হেসে কেমন করে বলেন ‘যা বোলোচো মা। অ্যাগদম তোমার জামাইয়ের ভাষায় কতা কইচি।’ ... ...
এইসময় তো বাবার ব্যাঙ্কে অনেক কাজ থাকে, চেয়ার থেকে ওঠার সময়ই থাকে না , এইসময় হঠাৎ বাবা বাড়ী এল কেন --- এইসব ভাবতে ভাবতেই যুঁইয়ের স্নান সারা হয়, গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে ঘুরে অন্দরের ঘরে এসে ঢুকে চুল আঁচড়ায়, কাজল দিয়ে কপালে একটা টিপ পরে ছোট্ট – আধা অন্ধকার ঘরের দেরাজ আয়নায় নিজেকে দেখে একবার এপাশ ফিরে, একবার ওপাশ ফিরে। মা ঘরে ঢোকে বাচ্চুকে কোলে নিয়ে, ওকে দেখেই চাপা গলায় একবার বাইরের বৈঠকখানার ভেতরদিকের দাওয়ায় আসতে বলে। যুঁই ভারী অবাক হয়, বাইরের লোক থাকলে বৈঠকখানার দিকে ওর যাওয়া মানা তো, মা’কে প্রশ্ন করার সাহস ওর নেই, যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মা’র চোখ পড়ে ওর কপালের টিপের দিকে, চাপা গলায় প্রায় ধমকে মা ওকে টিপটা মুছে বাইরে যেতে বলে। যুঁইয়ের চোখে জল আসে – কোথাও তো একটু বাইরে যায় না কতদিন হল, ইস্কুলে যাওয়াও বন্ধ, বাড়ীর মধ্যে একটা ছোট্ট মুসুর দানার মত টিপ – তাও মুছতে হবে! মা ততক্ষণে অধৈর্য্য হয়ে এগিয়ে এসে নিজের আঁচল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে দেয় টিপটা – একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখে নেয় কপালে টিপের কোনও চিহ্ন থেকে গেল কিনা – বাচ্চু হাত বাড়ায় যুঁইয়ের কোলে আসবে – মা হাত টেনে নিয়ে শক্ত করে বাচ্চুকে কোলে চেপে ধরে হাঁটা দেয়। যুঁই কেমন আবছামত বুঝতে পারে কোথাও একটা কিছু গোলমাল হয়েছে, বড় গোলমাল। ... ...
– জেঠিমা, তার মানে পুতুল দিদা যে এমন হৈ চৈ করে, সেটা মনের দুঃখ ঢেকে রাখার জন্য? এসব এত কিছু তো জানতামই না। – মানুষের মনের খবর কেই বা রাখতে পারে বাবু। – জেঠিমা, তুমি মোহনবাগানের গল্প বলতে গিয়ে বলেছিলে, স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন কুমুদিনী। পুতুলদিদাও কি ভেঙে পড়েছে? – এসব কথা তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। বুঝে নিতে হয়। তবে আগের পিসি আর এখনকার পিসির মধ্যে কিছুটা তফাৎ তো আছেই। তোর জেঠুও ঐজন্য সবসময়ে দেখিস না পিসির সঙ্গে টরেটক্কা করে যায়? আগের পিসিকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আর রইল কুমুদিনীর কথা। নিজের কথা তিনি নিজেই বলে গেছেন। ... ...
সাবুধানার দুধে এবার পড়ল ছোট করে কেটে রাখা বড়দাদির গাছের কচি তালশাঁস। আবার অনবরত নাড়া পড়ে দুধ-সাবুতে। তালশাঁসগুলো একটু জল ছেড়ে ছোট হয়ে আসতেই ঠাকুমা কোরানো নারিকেল ছড়িয়ে খাবড়ি নামিয়ে ফেলে। তাঁলশাসের পায়েস পাথরের বাটিতে ঢেলে ঠাকুমা নিবেদন করে দেয়ালে ঝুলানো রাধাকৃষ্ণের ছবির সামনে। কমলা রঙের পদ্মজবা পড়ে সেখানে। ঠাকুমা দু’হাতে তালি দিয়ে গেয়ে ওঠে, “হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে…” ... ...
১৮৬৯ সালের অক্টোবরে আমাকে লিভিংস্টোন আবিষ্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মিঃ বেনেট টাকা নিয়ে বসে ছিলেন আর আমিও যাওয়ার জন্য তৈরি। পাঠক, লক্ষ্য করবেন যে আমি কিন্তু সরাসরি তাঁকে খুঁজতে চলে যাইনি। এই কাজ শুরু করার আগে আমার আরও অনেক কাজ ছিল, অনেক হাজার মাইল পেরোতে হয়েছিল। ধরুন যে, প্যারিস থেকে সোজা জানজিবারে পৌঁছে গেলাম, সাত বা আট মাস পরে, সম্ভবত, উজিজিতে আমাকে পাওয়া যেত তাহলে, কিন্তু লিভিংস্টোনকে তখন সেখানে পাওয়া যেত না; তিনি তখন লুয়ালাবাতে ছিলেন; এবার আমাকে তাহলে মান্যুয়েমার আদিম বনের মধ্য দিয়ে, লুয়ালাবার আঁকাবাঁকা পথ ধরে, তাঁকে ধাওয়া করে কয়েক শত মাইল ঘুরে ঘুরে মরতে হত। ... ...