আর আমি?– প্রশ্ন করে কাজি। তুমি? তুমিই খানিকটা আমার প্রেরণা বলতে পার। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে যখন তুমি প্রথম কবিতা পাঠালে করাচি থেকে, আমি তখন সমিতির সহকারী সম্পাদক। তার আগে দুয়েকখানা চিঠিও তুমি লিখেছিলে। কিন্তু ক্ষমা নামে একটা কবিতা যখন পাঠালে, তা ছাপা হল। তোমার প্রথম ছাপা কবিতা। ছাপাবার সময় শুধু কবিতাটার নাম আমি বদলিয়ে দিয়েছিলাম, ক্ষমার বদলে মুক্তি। তুমি রাগ তো করলেই না, চিঠি লিখে ধন্যবাদ দিলে। ... ...
ইন্ডিয়া নামক পর্দার আড়ালে যে একেবারে হদ্দ গরীব ভারতটা লুকিয়ে রয়েছে, তার অধিকাংশ সন্ধ্যেবেলা এমনভাবেই কাটে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বছর ঘোরে। দোকানের বাঁধা খরিদ্দারের তালিকা দীর্ঘায়িত হয়। আবগারি দফতরের আদায় করা রাজস্বের খতিয়ান তার আগের বছরের হিসাবকে দশ গোল দেয়। দেশি মদ তৈরি করে যে সংস্থাগুলো, তারা গলদঘর্ম হয়ে গিয়ে প্রায় হাত জোড় করে বলে, ‘আর পারছি না।’ ট্যাঙ্কের পর ট্যাঙ্ক খালি হয়ে যায় নিমেষে। ... ...
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে সিম্বামওয়েন্নি থেকে উগোগো অঞ্চলের চুন্যো জনপদের উদ্দেশে বেরিয়ে ভয়ংকর মাকাটা জলা-অঞ্চল পার হয়ে এবারে এক বিপুল জনহীন প্রান্তর পার করার কথা। তরজমায় স্বাতী রায় ... ...
প্রায় এক হাজার বছর আগের বাংলা। ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ, পাল রাজবংশের অন্ধকার যুগ চলছে। সিংহাসন নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। সাম্রাজ্যের পরিধি ক্রমশই ক্ষুদ্র হচ্ছে। বাঙালীর গর্ব অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমশিলা মহাবিহার ছেড়ে তিব্বতে চলে গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। চারদিকে শুধুই অন্ধকার। তার মধ্যে একটি প্রদীপের দীপ্ত শিখার মতো জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন চিকিৎসক চক্রপাণি দত্ত। প্রথম বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক, যার রচিত পুস্তক এক হাজার বছর পরেও আজও সমস্ত ভারতবর্ষের আয়ূর্বেদিক কলেজগুলিতে পড়ানো হয়। সে দীপ শিখাও কি নিভে যাবে? ... ...
“ও মনি, শহরে কিরাম করে থাকিস তুই? ঠাকুমা ছাড়া দিন কাটাতি কষ্ট হয় নারে?”, কড়াইয়ের ফুটন্ত জলে কুমড়ো শাক ছেড়ে দিতে দিতে বলল গোলেনূর দাদি। গরম জলে শাক পড়তেই সবুজ রঙ আরও গাঢ় হয়। শাকের সেই রঙের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলি, “দিন তো কাটে গোলেনূর দাদি, কিন্তু রাতে ঠাকুমার কোল ঘেঁষে ঘুমাতে পারি না বলে ঘুমের ভেতর স্বপ্নে বারবার কেঁদে উঠি।” তবে সেসব কথা লুকিয়ে আমি একমনে গোলেনূর দাদির উনুনে ভাপানো গাঢ় সবুজ শাকের দিকে তাকিয়ে থাকি। ... ...
অথচ, চিনিনা তাকে হাতের আড়াল হলে নিভৃতচারিনী স্নেহ ছলে, আলো ছলে বারবার দেখি... বিষণ্ণ আদল মেয়ে স্তন পেতে বলি ' ক্ষুধা নিবি...' ... ...
‘আজাদি ঝুটা’ ছিল কিনা জানিনা, তবে তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে ১৯৫০-র দশকের পটভূমিতে বাংলায় কলেরার বিবরণে, আর শরৎচন্দ্রের ব্রিটিশ আমলের বাংলায় কলেরার বিবরণের মধ্যে মূলগত কিছু ফারাক দেখা যায়। ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ কলেরা আটকাতে ‘শিক্ষিত ছেলেরা’ ‘কোদালি ব্রিগেড’ নামে পরিশ্রুত জলের জন্য কুয়ো খুঁড়ছে। সরকারি ‘স্যানিটারি ইনস্পেক্টরেরা পুকুরে ব্লিচিং পাউডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন’ করছে, ‘অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন ইনজেকশন’ বা ‘কলেরার টিকে’ দিচ্ছে।৩ এই ধরণের জনস্বাস্থ্যের কিছু তৎপরতা ও জনসচেতনতা কিন্তু বাংলায় কলেরা মোকাবিলায় দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি ককের ভিভরিও কলেরির বিষের ধারণার সাত দশক পরে স্বাধীন ভারতে ১৯৫১ সালে তা নিয়ে গবেষণায় এগিয়ে এলেন এক বাঙালিই। কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক, অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে। শম্ভুনাথ খরগোশে পরীক্ষা করে দেখলেন, কলেরার আক্রমণ স্থল অন্ত্র। ভিভরিও কলেরি থেকে তিনি কলেরার বিষ আলাদা করে খরগোশে প্রয়োগ করে ডায়রিয়া ঘটাতে সক্ষম হলেন। এটা কলেরা গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন এক দিশা দিল। এর আগে ধারণা ছিল, কলেরা টক্সিন আসলে ব্যাকটিরিয়ার কোষ প্রাচীরে থাকা এন্ডোটক্সিন থেকে হয়। শম্ভুনাথ প্রমাণ করলেন, কলেরা টক্সিন ব্যাকটিরিয়ার কোষ থেকে নিঃসৃত হয় (এক্সোটক্সিন)। তাই ব্যাকটিরিয়া ছাড়াও খালি এই বিষই ডায়রিয়া ঘটাতে সক্ষম। শম্ভুনাথ দের এই আবিষ্কারের পর দু দশকের মধ্যেই কলেরা টক্সিনের গঠন, প্রকৃতি সবই জেনে ফেলা সম্ভব হয়। কোলকাতায় নিজের গবেষণাগারে যৎসামান্য যন্ত্রপাতির ওপর ভর করে ‘ভারতীয় কলেরা’র গবেষণায় বাঙালির এই অবদান স্বীকৃতি পায় বিশ্বে। ১৯৫৯ সালে বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর এই কাজ। তাঁর কাজ এতটাই আলোড়ন ফেলে যে নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী জসুয়া লিডারবার্গ শম্ভুনাথকে নোবেল পুরস্কারের জন্যেও মনোনীত করেন। শম্ভুনাথের দেখান পথে হেঁটে পরবর্তী কালে কলেরা গবেষণার দৃষ্টিকোণ পালটে যায়। এবং পরের ষাট বছরে সারা পৃথিবীতে কলেরা টক্সিনের ওপর হাজার হাজার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। অবশ্য বাঙালি স্বাভাবিক ভাবেই শম্ভুনাথের কথা বিশেষ জানেও না, আর জানলেও মনেও রাখেনি। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। ... ...
প্রতিটি দিনই তো দেবীপক্ষ ভাবতে ভালো লাগে – কেবল সেই ভোরে ওঠা নিয়ে সূর্যের সাথে রাগারাগি না হয় মাথার কাছে বাজুক চেনা সুর আধোঘুমে গুন গুন নিবিড় হয়ে এসে বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষা ... ...
ঘর বানানো বিষয়ক প্রস্তাবনা ঘর বানানোর জন্য প্রথমেই লাগবে একটুকরো জমি। আপনাকে দেখে নিতে হবে যে জমিটা যেন বৃষ্টিতে ভেসে না যায় এবং ডুবে না যায় বন্যায়। ফলে জমি বিষয়ক সাধারণ জ্ঞানের সাথে আপনার লাগবে প্রাকৃতিক কিছু প্রবৃত্তি। জমিটি নির্বাচিত হলেই আপনি তখন চারটি দেয়ালের কথা ভাববেন; এবং অতি অবশ্যই চার দেয়াল আপনি জমিনের ওপর স্থাপন করবেন না। ঝড়ো বাতাস আর প্রকৃতির বিভিন্ন গজব থেকে রক্ষার স্বার্থেই আপনি চারটি দেয়ালকে আসলে প্রোথিত করবেন মাটির ভেতরে। ঠিক গাছ যেভাবে নিজেকে রাখে। তবে আপনি কোনো শেকড়, কখনোই, স্থাপন করতে পারবেন না। ... ...
মেগামার্টের চত্বরে বাইকটা পার্ক করতে করতেই বৃষ্টি এসে গেল। এখানে বৃষ্টি, হয় আকাশ থেকে বালতি উপুড় করে জল ঢালে নয়ত জলের গুঁড়ো স্প্রে করে। দুটোর কোনওটাতেই ছাতা কোনও কাজে লাগে না।আজকে অবশ্য বৃষ্টি মাঝারি গতিতে একদম সোজা নেমে আসতে লাগল, ছাতা থাকলে কাজেই লাগত। জিতু অল্প দৌড়ে মিঠাসের ভেল কাউন্টারের শেডের নীচে উঠে দাঁড়াল। হেলমেট খুলে মাথায় পেঁচানো বড় কাপড়টা খুলে হাত ঘাড় মুছে পিঠের ব্যাগটায় হাত দিয়েই চমকে ওঠে। হাতে চ্যাটচ্যাটে মত কি যেন লেগে যাচ্ছে। কাপড়ে ঘষে মুছে তাকিয়ে দেখে টমেটো কেচাপের মত রঙ আর গন্ধটা … গা গুলিয়ে ওঠা। ... ...
উমমম, দারুণ জিনিস এনেছে আজ, মাঝারি সাইজের একেবারে টাটকা জীয়ন্ত চিংড়ি মাছ। পুরোনো স্মৃতি মনে আসে। ওয়েটল্যান্ডে যখন দু’জনে চাকরি করতাম, কর্তা একবার পুকুরের গলদা চিংড়ি রান্না করে অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। চিংড়িগুলো এতটাই তাগড়া ছিল, যে দুটো চিংড়ি ছ’ টুকরো করে আমরা ল্যাবের ছ’জন প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্ট টিফিনে হাপুস হুপুস করে খেয়েছিলাম। সে গলদার দাঁড়াগুলো একেবারে নেভি ব্লু আর মোটা মোটা। কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দাঁতে চেপে ভেঙে খেতে হয়েছিল। কিন্তু এগুলো গলদা নয়, চাপড়া চিংড়ি। রান্নার বৌদের হাতে ছাড়লে ওরা সেই একটাই জানে – সেটাই করবে। ডুমো ডুমো আলু, নারকেল বাটা, আর সেই কাঁচা কাঁচা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ঝোল। ওরা যা পারে করুক। আমি একটু চিংড়ি আলাদা করে চিংড়ি থেঁতো বানাব। ... ...
– রাঁচীর দেহাতি চিকেন রান্নাটা কি ফণীজেঠুর আনা চিকেন দিয়ে করা সম্ভব? যদি হ্যাঁ হয় তা'লে কোন কথা নেই। যদি না হয়, তবে কেন সম্ভব নয়? দিশি চিকেন আর দেহাতি চিকেনের তফাৎ কী? – দিশি চিকেন আর দেহাতি চিকেন – ব্যাপারটা একই। ওটা ভাষার তফাৎ। পোল্ট্রির বাইরে যেসব মুরগি বাড়িতে পোষা হয়, স্বাভাবিক খাদ্য খেয়ে বাঁচে, ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে মাংস বাড়ানো হয়না, তেমন চিকেন। তবে হ্যাঁ, বাংলায় যে জাতের মুরগি পোষা হয়, আর ঝাড়খন্ডী আদিবাসীরা যেমন পোষে, তাদের মধ্যে কিছু আলাদা থাকতে পারে। দিশি মোরগের জাতিভেদ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। ... ...
সমাজ রাধাকান্ত দেবের সতীদাহের পক্ষে আর বিধবাবিবাহের বিপক্ষে দাঁড়ানোটাই বেশি করে মনে রেখেছে। তাঁর শব্দকল্পদ্রুম, স্কুল-কলেজ স্থাপনগুলি ততটা মনে রাখেনি। একথাও মনে রাখেনি, যে রামমোহনের পরিবারেও সতীদাহ হয়েছে, দেব পরিবারে একটিও হয়নি। অবশ্য এতে সমাজকে দোষ দেওয়া যায় না। রেঁনেশার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাধাকান্ত আজও ভিলেন। তবে একথা আমি মন থেকে মানি – ঐ বাধার পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল বলেই রামমোহনের আর বিদ্যাসাগরের জয় চিরস্থায়ী ... ...