ওয়াশিংটনে পৌঁছলাম সন্ধেবেলায়। ক্যাব ড্রাইভার বলল যে আটলান্টায় নতুন করে ঝামেলা তৈরি হয়েছে। পুলিশের গুলিতে একজন ব্ল্যাক মারা গেছে।সেই নিয়ে ওখানে বিরাট গন্ডগোল হচ্ছে
২৫শে মে-র আগের মিনিয়াপোলিস আর ২৫শে মে-র পরের মিনিয়াপোলিসে অনেক ফারাক। পিটারের পরিবার আগে মিনিয়াপোলিসে থাকত। চুপচাপ সাতে পাঁচে না থাকা একটা জায়গা। এখন সেখান থেকে প্রতিবাদের গর্জন উঠে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা আমেরিকায়।
নিউ ইয়র্ক সিটি।আমি অনাবিল চ্যাটার্জি । এদেশে এসেছি বছর তিনেক হল । খুব জমকালো রাস্তাঘাট ।ঝলমলে দোকানপাট। রাত নামলে আলোয় ঝলমল করতে থাকে গোটা শহর। অজস্র শপিংমলের ঔজ্জ্বল্যে ভেসে যায় চারপাশ। বসন্ত যেন দিনরাত আকাশে বাতাসে হেসে খেলে নেচে নেচে বেড়ায় ।
তেমন গরম পড়েনি এখনও। সন্ধের ঝটকা হাওয়ায় ধুলো উড়ছে এলোমেলো। পার্বতী মেঠো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে সনিষ্ঠ যত্নে।বসে থাকলে চলে না। সে বসে গেলে পরিবারও বসে যাবে।আরো তিনটে ছেলেমেয়ে আছে। কাঁচা বয়েস, কাঁচা মন। তবে পেকে যাচ্ছে অকালের বাতাসে।
সাগরের খাড়ির ধারে ও-ই মস্ত উঁচু টাওয়ারে পতাকাটা শনশনিয়ে পাক খাচ্ছে কদিন ধরে। ঘোলাটে আকাশ । বাতাসে ভিজে ঢেউ। জব্বর একটা ঝড় আসছে নাকি। ম্যানগ্রোভের সংসারে যেন কিসের শংকা। কড়াক লড়াইয়ের প্রস্তুতি। ঝরঝর ঝরঝর করে বেপরোয়া ডাকাবুকো হাওয়া জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে যুদ্ধবাজের মতো।
কপাল...কপাল ! যাক বাবা ইলেকট্রিক গ্রিডগুলো বসে যায়নি। সে কি আর এমনি এমনি। দিনভর রাতভর কি হয়রাণি কি হয়রাণি ।ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারদের নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড় । তবে যাই বলুন, কেমন মজা হল বলুন তো।
প্রভাবশালীদের চেনে না। বড্ড বেয়াড়া চিজ , টাকার গরমে পোড়ে না। নীচের মানুষ মরবে গাদায় গাদায় , মিনারে চড়ে দূরবীন চোখে গুনব শুধু লাশ, দেয় না, এমনি করতে মোটেই দেয় না।
আজ বিশ্ব নারী দিবস। শশাঙ্ক বিরক্ত হয়ে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ আ :, এত নড় কেন তুমি ? একটু চুপচাপ শুতে পার না। যখনই একটু ধমকি আসছে ওলোট পালোট খাচ্ছ। এতো মহা ক্যাঁচাল হল .... ‘ মাধু গুটিসুটি মেরে জড়সড় হয়ে শোয়। কি করবে ? সারারাত ঘুম নেই। শুধু উসখুস করে। গরমে হাঁসফাঁস। ঘুপচি গরম পড়েছে। মাঝে মাঝে একঝলক হাওয়া বইছে। তাতে জানলার কোল ঘেঁসে খোলা গাটারের দুর্গন্ধ খোঁচা খেয়ে হাওয়ায় ভেসে ঘরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হল। বিবাহিত জীবনের রসকস কিছু টের পায়নি এই দুবছরে। শশাঙ্কর মতো রগচটা লোক সে বাপের জন্মে দেখেনি। অবশ্য মাধু কতটুকু আর দেখেছে এই ছোট্ট জীবনে। ... ...
মাঝনদীর ভরাট জলে দুলছে নৌকো। মেয়ে পুরুষ কাচ্চা বাচ্চায় ঠাসাঠাসি নৌকো।চৈত্রের দুপুর। উবু হয়ে বসে আছে সব। শুধু দুধের শিশুরা মায়ের কোলে। কোনটা আঁচলের তলায় হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। কোন কোন ক্ষুদে মায়ের কোলে সেঁটে থেকে কুততুত করে তাকিয়ে দেখছে প্রবল জলরাশির অনর্গল বয়ে চলা। ওকূল থেকে তাড়া খেয়ে কোনরকমে মাঝরাতে ডিঙি বোঝাই করে ভেসে পড়েছে দল বেঁধে আর এক কূলে গিয়ে ভেড়ার আশায়। আপন প্রাণ বড় প্রিয় জিনিস। কজনা খুবলে খাওয়া শরীর নিয়ে পড়ে রইল ওপারে, কয়জনা বা বেপাত্তা, বেমালুম গায়েব, হিসেব রাখার ফুরসৎ নেই। ... ...
রূপকথা পুনের সেমিনার শেষ করে কলকাতায় ফিরেছে পরশুদিন। চাইল্ড অটিজম-এর দুদিনে মোট ছটা সেশান হয়েছে ওখানে। এসে চয়নকে ফোন করেছিল তিনবার।তিনবারই মোবাইল বেজে গেছে । কেউ ধরেনি। চয়নের বাবা চল্লিশ লাখ টাকা কোর্স ফি-তে বোস্টনের একটা ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেছে তাকে। বোধহয় সেখানে চলে গেছে সিয়াটেল থেকে। কিন্তু ফোন রিসিভ না করার কারণ কি ? রূপকথা বেশ অবাক হয়। ... ...
শ্যামলীদের নিয়ে হিমাংশু শোভাবাজারে পৌঁছল রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। বাতাস থেকে শীতের হিম পড়ছে। ট্রামলাইন ধরে একটু হাঁটার পর ডানদিকের গলিতে ঢুকবে। গলির মুখে পৌঁছয়নি এখনও। একটা সোনালী রঙা কুকুর একলা বসে আছে। বসে থাকার ভঙ্গী ঠি ক রাস্তার আর পাঁচটা কুকুরের মতো নয়। কেমন যেন অসহায়, উদ্বিগ্ন, বিভ্রান্ত , ব্যথিত দৃষ্টি। মোলায়েম সোনালী পশমি লোমে ঢাকা শরীর। কান দুটো একটু ঝোলা। কৌতূহলবশত হিমাংশু ওর একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পেডিগ্রি কুকুর। হিমাংশু কুকুর চেনে। ... ...
গোপাল সাঁতরা চামড়ার থলেতে করে হরেক যন্ত্রপাতি নিয়ে সাতসকালে বেরোয়। তার দু:খু অনেক। কিন্তু শোনবার লোক নেই। সে কাজে যাবার পথে সকালবেলায় একবার করে মহাদেববাবুর উঠোনে ঢুঁ মারে। সেখানে তখন ত্রিকালসহ মহাদেব এবং দীনবন্ধু বাবু চা পানে ব্যস্ত।সে এসে সেখানে থলে নামিয়ে রেখে উবু হয়ে বসে।তার দু:খু অনেক। তিন তিনটে সোমত্ত ছেলে। সবাই বেকার। কেউ এক পয়সা কামায় না। দুটো বারো তেরো বছরের মেয়ে।বেওয়ারিশ যত্র তত্র চরে বেড়াচ্ছে। এত বড় সংসারের ভার তার একার ঘাড়ে। এই বুড়ো বয়সে সে আর খেটে খেটে পারে না। ছোটখাট কলকব্জা যন্ত্রপাতি সারিয়ে বেড়ায় সে। একরকম ফ্রি-ল্যান্সার মিস্ত্রি বলা যায়। বড় হাঁফ ধরে আজকাল। ... ...
এদিকে এক পাহাড় । ওদিকে এক পাহাড় । মাঝখানে নদী। সেই নদীতে বাঁধ দিয়ে তৈরী হয়েছে সরন্তি ড্যাম। শাল, পলাশ, শিশু, সেগুনের জঙ্গলে ঘেরা এই আদিবাসী গ্রাম। ফাগুন চোত মাসে রুখা সরন্তি সেজে ওঠে পলাশের সাজে। লাল মাটির পাশে সবুজ ধানক্ষেত।ওই ধানক্ষেতের ওপারে চার্চের জমি। সেন্ট অ্যাগনেস চার্চ। বেশ বড়সড় ইমারত। জমির চারপাশে দেড় মানুষ সমান লোহার রেলিং। গেট খুলে ভেতরে গেলে বেশ শান্তির পরশ লাগে যেন। পুব দিকে শাল সেগুনের বনের মাথা টপকে সূয্যির আলো পড়ে সকালবেলায়, চার্চের দুধসাদা দেয়ালের গায়ে। ওখানে মূল দরজার ওপরে প্রভু যীশুর শ্বেত পাথরের পূর্ণ মূর্ত্তি । মূর্ত্তির নীচে লেখা, “ হে ভারাক্রান্ত ও পরিশ্রাম্ত পথিকেরা আমার নিকট আইস আমি তোমাদিগকে বিশ্রাম দিব “ ... ...