এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • পুরোনো কলকাতার নেশাভাঙ

    Achintyarup Ray
    অন্যান্য | ০১ জানুয়ারি ২০১২ | ৬২৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • achintyarup | 59.93.218.88 | ০১ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:০৭527739
  • দারুণ ছিল এই সুতোটা। আগে দেখেছি, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে সিকিকে ধন্যবাদ। হুতুমকে অনুরোধ, নেশাভাঙ বিষয়ে আর একটু বিশদে লিখুন না এই টইয়ে।
  • achintyarup | 59.93.218.88 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ০০:৫২527750
  • কালীশঙ্কর ঘোষের বাটির কালীপূজা অতি ভয়ানক ব্যাপার ছিল। ... ইঁহারা চোপার ঘোষ, ভীষণ তান্ত্রিক, এখনও সুরাপান ভিন্ন আহ্নিক সম্পন্ন হয় না। কালীশঙ্কর ঘোষের বাটীর গুরু পুরোহিত কর্ত্তা প্রভৃতি পুরুষ, অন্দরে গৃহিণী এবং সমস্ত পুরনারী মায় দাস দাসীকে পর্যন্ত সুরাপান করিতে হইত। শ্যামাপূজার রাত্রে এই সুরাপান অব্যাহত ভাবে চলিত। সুরাপানে উন্মত্ততা সম্বন্ধে কতকগুলি গল্প প্রচলিত আছে, একবার ঢুলিরা পূজার দিন মধ্যাহ্নকালে অন্ত:পুরে গৃহিণীর নিকট গিয়া তৈল ও জলপান প্রার্থনা করায় পানোন্মত্তা গৃহিণী বলিলেন, ""কি তোরা আমার বাড়ীতে তেল জলপান চাহিতেছিস, মিঠাই খা, মোমবাতি মাখ।'' একদিন সন্ধ্যাহ্নিক অন্তে কালীশঙ্কর একটী পা মুড়িয়া একটী পা বাড়াইয়া মালাজপ করিতেছেন, মাতাল ভৃত্য সেই পাখানি টিপিতে টিপিতে কাঁদিতেছে। বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, তুই কাঁদিতেছিস কেন রে? উত্তর হইল, কর্ত্তা এত দিন চাকুরী করিতেছি, কখনও কোন অপরাধ করি নাই, আজ আপনার একখানা পা হারাইয়া ফেলিয়াছি, খুঁজিয়া পাইতেছি না। কর্ত্তা হাসিয়া বলিলেন, তার জন্য চিন্তা কি, বোধ হয় জল খাবার জায়গায় ফেলিয়া আসিয়াছি, যা বাটীর ভিতর হইতে লইয়া আয়। ভৃত্য অন্দরে গিয়া অনেক অনুসন্ধান করিল, শেষে গৃহিণীকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, একবার আহ্নিকের জায়গায় দেখিয়া আয়, তাহাও হইল, কিন্তু পা পাওয়া গেল না। কাঁদিতে কাঁদিতে ভৃত্য আবার কর্ত্তাকে সমস্ত অনুসন্ধানের কথা জানাইল, তিনি বলিলেন, তবে বুঝি আহ্নিকের নৈবেদ্য সহিত ঠাকুর মহাশয়ের বাটীতে গিয়াছে, যা সেখানে জিজ্ঞাসা করিয়া আয়। ভৃত্য গুরুর গৃহে গিয়া জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, ওরে কালীশঙ্করের পা যদি আমার বাটীতে আসিয়া থাকে; তাহা হইলে আমি কাল সকালে মাথায় করিয়া পঁহুছিয়া দিয়া আসিব, তুই এখন যা। ভৃত্য আশ্বস্ত হইয়া গৃহে ফিরিয়া আসিল।

    একবার কালীপুজার রাত্রে কর্ত্তার খেয়াল হইল যে, আমি এতগুলা পশুকে বলিদান দিয়া স্বর্গে পাঠাইতেছি, আমার কত পুণ্য হইতেছে, যদি গুরুদেবকে বলিদান করিয়া স্বর্গে পাঠাই, তাহা হইলে তো আরও পুণ্য হইবে। গুরুকেও এই কথা জিজ্ঞাসা করা মাত্র তিনি তথাস্তু বলিয়া নাচিয়া উঠিলেন। তাঁহাকে হাড়িকাঠের নিকট উপস্থিত করা হইল। যে কামারেরা বলিদান করিতেছিল, তাহাদিগকেও মদ খাইতে হইয়াছে। কিন্তু যখন এত বলিদান করিতে হইবে, তখন মাতাল হইলে বিপদের সম্ভাবনা জানিয়া তাহারা সামান্য পান করিয়া কর্ত্তাদিগের নিকট অধিক পানের ভান করিতেছিল। কামার বলিল, কর্তা মহাশয় এ সব খাঁড়াগুলাতে চিরকাল পশু বলি দিয়া আসিতেছি, ইহাতে কি গুরুদেবকে বলি দিতে আছে? আমার গৃহে গুরু বলির জন্য নূতন খাঁড়া প্রস্তুত আছে, একটু অপেক্ষা করুন, আমি শীঘ্র লইয়া আসিতেছি। এই বলিয়া আপনার সহকারীদিগকে সাবধান করিয়া দিয়া বাহিরে গিয়া থানাদারকে ডাকিয়া আনিয়া গুরুকে রক্ষা করিল।
  • aka | 75.76.118.96 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ০১:১০527761
  • অচিন্টি একঘর হইছে। একটু চালু ভাষায় লিখলে আমার পড়তে ভালো লাগে। :)
  • Sibu | 108.23.41.126 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ০১:৪৮527769
  • আরো সব গপ্পো ছেল তো। সিংহীবাবুর সিংহ ভেঙে নিজে সিংহ হয়ে দূর্গা মূর্তির পায়ের কাছে বসে যাওয়া। তাপ্পরে রূপচাঁদ আর নিতাই পক্ষীর গপ্পো। সে সবও হোক।
  • achintyarup | 59.93.218.88 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ০৩:২৫527770
  • @ আকা: আরে সব্বোনাশ, উপরের লেখা আমার নয়। (এক্ষুণি মেধাস্বঙ্কÄ¡পহরণের দায়ে পড়েছিলুম আর কি।) ওইটি নববিধান ব্রাহ্মমণ্ডলীর প্রচারক ভাই প্রাণকৃষ্ণ দত্তর লেখা কলিকাতার ইতিবৃত্ত নামক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। প্রাণকৃষ্ণের এই লেখা অনিয়মিত দশটি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল নব্যভারত পত্রিকায়, খুব সম্ভবত বিশ শতকের প্রথম দশকে। প্রাণকৃষ্ণই প্রথম বাংলাভাষায় কলকাতা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন এবং তাতে দিশি কলকাতাবাসীদের কথা লেখেন।

    @ শিবুদা: সবই লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু এ বিষয়ে অলরেডি দারুণ প্রবন্ধ লিখে রেখেছেন ঐতিহাসিক অরুণ নাগ। এখানে লেখার জন্য সেটির ওপর অনেকটাই নির্ভর করতে হবে (অর্থাৎ অনেকটাই সেখেন থেকে টুকতে হবে।) বুড়োদের কতা টইতে যে চন্ডু ইত্যাদি প্রস্তুতের বিবরণ আছে, অরুণবাবুর প্রবন্ধেই সেটি আগে পড়েছি। তাছাড়া এদিকে ওদিকে পুরোনো বইপত্রে আর যা চোখে পড়েছে সে সবও লিখব। (হুতোম তো অবশ্যই থাকবেন। ওই দুগ্গার সিঙ্গির গল্পের সিঙ্গি যদ্দুর মনে পড়চে কালীসিঙ্গি নিজেই। অবশ্য ভুলও মনে পড়তে পারে, ভুল হলে বই দেখে পরে লিখে দেব।)

    দিশি কলকেতার নেশা আর সায়েবি ক্যালকাটার নেশা দুই নিয়েই বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু টুকে দেওয়ার ইচ্ছে রাখি।
  • siki | 123.242.248.130 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ০৮:৫৭527771
  • হুতোমকে এখানে নিয়ে আসার দায়িত্ব অচিন্ত্যকে দেওয়া হইল।
  • kc | 194.126.37.78 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১০:২৬527772
  • হুতোম আর বদ্যিবুড়ি দুজনকেই নিয়ে আসার দায়িত্ব আমি নিতে চাই।
  • siki | 123.242.248.130 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১১:০৪527773
  • দেওয়া হল।
  • ad | 223.223.129.158 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১২:৫৬527729
  • কালী প্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা । পর্ব ১

    ‘‘কহই টুনোয়া-
    শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালী’’- টুনোয়ার টপ্পা।

    কলিকাতা শহরের চারদিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্চে, চড়কীর পিঠ সড় সড় কচ্চে; সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নুপুর, মাতায় জরির টুপি, কোমরে চন্দ্রহার, সিপাইপেড়ে ঢাকাই শাড়ি মালকোচা করে পরা, তারকেশ্বরে ছোবান গামছা হাতে, বিল্বপত্র বাঁধাসূতা গলায় যত ছুতোর, গয়লা, গন্ধবেনে ও কাঁসারীর আনন্দের সীমা নাই-‘আমাদের বাবুদের বাড়ি গাজোন।’

    কোম্পানির বাংলা দখলের কিছু পরে, নন্দকুমারের ফাঁসি হবার কিছু পূর্বে আমাদের বাবুর প্রপিতামহ নিমকের দাওয়ান ছিলেন, সেকালে নিমকীর দাওয়ানিতে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় ছিল; সুতরাং বাবুর প্রপিতামহ পাঁচ ব্‌ৎসর কর্ম করে মৃত্যু কালে প্রায় বিশ লক্ষ টাকা রেখে যান-সেই অবধি বাবুরা বনেদী বড় মানুষ হয়ে পড়েন। বনেদী বড় মানুষ কবলাতে গেলে বাঙালী সমাজে যে সরঞ্জামগুলি আবশ্যক, আমাদের বাবুদের তা সমস্তই সংগ্রহ করা হয়েচে-বাবুদের নিজের একটা দল আছে, কতগুলি ব্রাহ্মণপন্ডিত, কুলিনের ছেলে, বংশজ, শ্রোত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য, তেলী, গন্ধবেনে আর কাঁসারী ও ঢাকাই কামার নিতান্ত অনুগত- বাড়িতে ক্রিয়েকর্ম ফাঁক যায় না, বাৎসরিক কর্মেও দলস্থ ব্রাহ্মণদের বিলক্ষণ প্রাপ্তি আছে; আর ভদ্রাসনে এক বিগ্রহ, শালগ্রামশীলে ও আকবরী মোহর পোরা লক্ষ্মীর খুঁচির নিত্যসেবা হয়ে থাকে।

    এদিকে দুলে বেয়ারা, হাড়ি ও কাওরারা নূপুর পায়ে উত্তরি সূতা গলায় দিয়ে নিজ নিজ বীরব্রতের ও মহত্বের স্তম্ভস্বরূপ বাণ ও দশলকি হাতে করে প্রত্যেক মদের দোকানে বেশ্যালয়ে ও লোকের উঠানে ঢাকের সঙ্গতে নেচে ব্যাড়াচ্চে। ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখির পালক, ঘন্টা ও ঘুঙুর বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরু মহাশয়ের পাঠশালা বন্দ হয়ে গিয়েচে- ছেলেরা গাজনতলায় বাড়ি করে তুলেচে; আহার নাই; নিদ্রা নাই ঢাকের পেচোনে রপ্টে রপ্টে ব্যাড়াচ্চে, কখনো ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চিৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্চে, কখনো ঢাকের চামর ছিঁড়ছে, কখন ঢাকের পেছনটা দুম দুম করে বাজাচ্চে – বাপ মা শশব্যস্ত, একটা না ব্যয়রাম কল্লে হয়।

    ক্রমে দিন ঘুনিয়ে এল, আজ বৈকালে কাঁটাঝাঁপ! আমাদের বাবুর চার পুরুষের বুড়ো মূল সন্ন্যাসী কানে বিল্বপত্র গুঁজে, হাতে এক মুটো বিল্বপত্র নিয়ে, ধুঁক্তে ধুঁক্তে বৈঠকখানায় উপস্থিত হল; সে নিজে কাওরা হলেও আজ শিবত্ব পেয়েচে, সুতরাং বাবু তারে নমস্কার কল্লেন; মূল সন্ন্যাসী এক পা কাদা সুদ্ধ ধোব ফরাশের উপর দিয়ে বাবুর মাথায় আশীর্বাদী ফুল ছোঁয়ালেন, – বাবু তটস্থ !

    বৈঠকখানার মেকাবি ক্লাকে টাং টাং করে পাঁচটা বাজলো, সূর্যের উত্তাপের হ্রাস হয়ে আসতে লাগলো। শহরের বাবুরা ফেটিং, সেলফড্রাইভিং বগি ও ব্রাউহ্যামে করে অবস্থানমত ফ্রেন্ড, ভদ্রলোক, বা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরুলেন, কেউ বাগানে চল্লেন – দুই-চারজন সহৃদয় ছাড়া অনেকেরই পেছনে মালভরা মোদাগাড়ি চললো, পাছে লোকে জানতে পারে এই ভয়ে কেউ সে গাড়ির সইস কোচম্যানকে তকমা নিতে বারণ করে দেচেন – কেউ লোকাপবাদ তৃণজ্ঞান, বেশ্যাবাজী বাহাদুরির কাজ মনে করেন; বিবিজানের সঙ্গে একত্রে বসেই চলেছেন, খাতির নদারাৎ ! -কুঠিওয়ালারা গহনার ছক্কড়ের ভিতর থেকে উঁকি মেরে দেখে চক্ষু সার্থক কচ্চেন।

    এদিকে আমাদের বাবুদের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, ঢাক বাজতে লাগলো, শিবের কাছে মাথা চালা আরম্ভ হল, সন্ন্যাসীরা উবু হয়ে বসে মাথা ঘোরাচ্চে, কেহ ভক্তিযোগে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে পড়চে – শিবের বামুন কেবল গঙ্গাজল ছিটুচ্চে, আধ ঘন্টা মাথা চালা হল, তবু ফুল আর পড়ে না; কি হবে ! বাড়ির ভিতরে খবর গেল; গিন্নীরা পরস্পর বিষণ্ন বদনে ‘কোন অপরাধ হয়ে থাকবে’ বলে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন উপস্থিত দর্শকেরা ‘বোধ হয়, মূল সন্ন্যাসী কিছু খেয়ে থাকবে, সন্ন্যাসীর দোষেই এই সব হয়’ এই বলে নানাবিধ তর্ক বিতর্ক আরম্ভ কল্লে; অবশেষে গুরু পুরুত, ও গিন্নীর ঐক্য মতে বাড়ির কর্তাবাবুকে বাঁধাই স্থির হল। একজন আমুদে ব্রাহ্মণ ও চার-পাঁচজন সন্ন্যাসী দৌড়ে গিয়ে বাবুর কাছে উপস্থিত হয়ে বললে- ‘মোশায়কে একবার গা তুলে শিবতলায় যেতে হবে, ফুল তো পড়ে না !’ সন্ধ্যা হয় – বাবুর ফিটন প্রস্‌ত্‌তত, পোশাক পরা, রুমালে বোকা মেখে বেরুচ্ছিলেন – শুনেই অজ্ঞান ! কিন্তু কি করেন, সাত পুরুষের ক্রিয়েকান্ড বন্দ করা হয় না, অগ্যতা পায়নাপেলের চাপকান পরে, সাজগোজ সমেতই গাজনতলায় চললেন – বাবুকে আসতে দেখে দেউড়ির দরওয়ানেরা আগে আগে সার গেঁতে চললো; মোসাহেবেরা বাবুর সমূহ বিপদ মনে করে বিষণ্ন বদনে বাবুর পেচোনে পেচোনে যেতে লাগলো।

    গাজনতলায় সজোরে ঢাক ঢোল বেজে উঠলো, সকলে উচ্চস্বরে ‘ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ বলে চিৎকার করতে লাগলো; বাবু শিবের সম্মুখে ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। বড় বড় হাত পাখা দুপাশে চলতে লাগলো, বিশেষ কারণ না জানলে অনেকে বোধ কত্তে পারতো যে, আজবুঝি নরবলি হবেন। । অবশেষে বাবুর দু-হাত একত্র করে ফুলের মালা জড়িয়ে দেওয়া হল, বাবু কাঁদ কাঁদ মুখ করে রেশমি রুমাল গলায় দিয়ে এক ধারে দাঁড়িয়ে রইলেন, পুরোহিত শিবের কাছে ‘বাবা ফুল দাও, ফুল দাও,’ বারংবার বলতে লাগলো, বাবুর কল্যাণে এক ঘটি গঙ্গাজল পুনরায় শিবের মতায় ঢালা হল সন্ন্যাসীরা সজোরে মাতা ঘুরুতে লাগলো, আধ ঘন্টা এই রূপ কষ্টের পর শিবের মাতা থেকে এক বোঝা বিল্বপত্র সরে পড়লো ! সকলের আনন্দের সীমা নাই, ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো’ বলে চিৎকার হতে লাগলো, সকলেই বলে উঠলো, না হবে কেন- কেমন বংশ !

    ঢাকের তাল ফিরে গেল। সন্ন্যাসীরা নাচতে নাচতে কাছের পুকুর থেকে পরশু দিনের ফ্যালা কতকগুলি বঁইচি ডাল তুলে আনলে। গাজনতলায় বিশ আঁটি বিচালি বিছানো ছিল, কাঁটার ডালগুলো তার উপর রেখে বেতের বাড়ি ঠ্যাঙান হল, ক্রমে সব কাঁটাগুলি মুখে মুখে বসে গেলে পর পুরুত তার উপর গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিলেন, দুজন সন্ন্যাসী ডবল গামছা বেঁদে তার দু-দিকে টানা ধল্লে,- সন্ন্যাসীরা ক্রমান্বয়ে তার উপর ঝাঁপ খেতে পড়তে লাগলো। উ: ! ‘শিবের কি মাহাত্ম্য !’ কাঁটা ফুটলে বলবার যো নাই। এদিকে বাজে দর্শকের মধ্যে দু-একজন কুটেল চোরা গোপ্তা মাচ্চেন। অনেকে দেবতাদের মত অন্তরীক্ষে রয়েচেন, মনে কচ্চেন বাজে আদায়ে দেখে নিলুম, কেউ জানতে পাল্লে না। ক্রমে সকলের ঝাঁপ খাওয়া ফুরুলো; একজন আপনার বিক্রম জানাবার জন্য চিত হয়ে উলটো ঝাঁপ খেলে; সজোরে ঢাক বেজে উঠলো। দর্শকেরা কাঁটা নিয়ে টানাটানি কত্তে লাগলেন –‘গিন্নীরা বলে দিয়েচেন, ঝাঁপের কাঁটার এমনি গুণ যে, ঘরে রাখলে এজন্মে বিছানায় ছারপোকা হবে না !’

    এদিকে শহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁসোর ঘন্টার শব্দ থামলো। সকল পথের সমুদায় আলো জ্বালা হয়েছে। ‘বেলফুল !’‘বরফ !’ মালাই !’ চিৎকার শুনা যাচ্চে। আবগারী আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েচে অথচ খদ্দের ফিচ্চে না – ক্রমে অন্ধকার গাঢাকা হয়ে এল; এ সময় ইংরাজি জুতো, শান্তিপুরে ডুরে উড়নি আর সিমলের ধুতির কল্যাণে রাস্তায় ছোট লোক ভদ্দর লোক আর চেনবার যো নাই। তুখোড় ইয়ারের দল হাসির গররা ও ইংরাজি কথার ফররার সঙ্গে খাতায় খাতায় এর দরজায় তার দরজায় ঢুঁ মেরে বেড়াচ্চেন – এঁরা সন্ধ্যা জ্বালা দেখে বেরুলেন আবার ময়দা পেষা দেখে বাড়ি ফিরবেন। মেছোবাজারের হাঁড়িহাটা-চোরবাগানের মোড়, জোড়াসাঁকোর পোদ্দারের দোকান, নতুন বাজার, বটতলা, সোনাগাজীর গলি ও অহরিটোলার চৌমাথা লোকারণ্য – কেউ মুখে মাথায় চাদর জড়িয়ে মনে কচ্চেন কেউ তাঁরে চিনতে পারবে না; আবার অনেকে চেঁচিয়ে কথা কয়ে, কেশে, হেঁচে, লোককে জানান দিচ্চেন যে,‘তিনি সন্ধ্যার পর দু-দন্ড আয়েস করে থাকেন !’

    শৌখীন কুঠিওয়ালা মুখে হাতে জল দিয়ে জলযোগ করে সেতারটি নিয়ে বসেছেন। পাশের ঘরে ছোট ছোট ছেলেরা চিৎকার করে বিদ্দেসাগরের বর্ণপরিচয় পড়চে। পীল ইয়ার ছোকরারা উড়তে শিখচে। স্যাকরারা দুর্গাপ্রদীপ সামনে নিয়ে রাংঝাল দিবার উপক্রম করেচে। রাস্তার ধারের দুই একখানা কাপড়, কাঠ কাটরা ও বাসনের দোকান বন্ধ হয়েচে, রোকোড়ের দোকানদার, পোদ্দার ও সোনার বেনেরা তহবিল মিলিয়ে কৈফিয়্‌ৎ কাটচে। শোভা-বাজারে রাজাদের ভাঙা বাজারে মেচুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা ও লোনা ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের –‘ও গামচাকাঁদে, ভালো মাচ নিবি ?’‘ও খেংরাগুঁপো মিনসে, চার আনা দিবি’ বলে আদর কচ্চে – মধ্যে মধ্যে দুই একজন রসিকতা জানাবার জন্য মেচুনী ঘেঁটিয়ে বাপান্ত খাচ্চেন। রেস্তহীন গুলিখোর, গেঁজেল ও মাতালরা লাটি হাতে করে কানা সেজে ‘অন্ধ ব্রাহ্মণকে কিছু দান করো দাতাগণ’ বলে ভিক্ষা করে মৌতাতের সম্বল কচ্চে; এমন সময় বাবুদের গাজনতলায় সজোরে ঢাক বেজে উঠলো, ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো’ চিৎকার হতে লাগলো; গোল উঠলো এবারে ঝুল সন্ন্যাস। বাড়ির সামনের মাঠে ভারা টারা বাঁধা শেষ হয়েচে; বাড়ির ক্ষুদে ক্ষুদে হবু হুজুরেরা দরওয়ান, চাকর ও চাকরানীর হাত ধরে গাজনতলায় ঘুর ঘুর কচ্চেন। ক্রমে সন্ন্যাসীরা খড়ে আগুন জ্বেলে ভারার নীচে ধল্লে -একজনকে তার উপরপানে পা করে ঝুলিয়ে দিয়ে তার মুখের কাছে আগুনের উপর গুড়ো ধুনো ফেলতে লাগলো, ক্রমে একে একে ঐ রকম করে দুল্লে, ঝুল সন্ন্যাস সমাপন হল; আধ ঘন্টার মধ্যে আবার শহর জুড়ুলো, পুর্বের মত সেতার বাজতে লাগলো, ‘বেলফুল’‘বরফ’‘মালাই’ ও যতামত বিক্রি করবার অবসর পেলে, শুক্রবারের রাত্তির এই রকমে কেটে গেল।

    আজ নীলের রাত্তির ! তাতে আবার শনিবার; শনিবারের রাত্তিরে শহর বড় গুলজার থাকে – পানের খিলির দোকানে বেল-লন্ঠন আর দেওয়ালগিরি জ্বলচে। ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে বেলফুলের গন্ধ ভুর ভুর করে বেরিয়ে যেন শহর নাচিয়ে তুলচে। রাস্তার ধারের দুই একটা বাড়িতে খ্যামটা নাচের তালিম হচ্চে, অনেকে রাস্তায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে ঘুমুর ও মন্দিরার রুনু রুনু শব্দ শুনে স্বর্গসুখ উপভোগ কচ্চেন। কোথাও একটা দাঙ্গা হচ্চে। কোথাও পাহারাওয়ালা একজন চোর ধরে বেঁদে নে যাচ্চেন- তার চারদিকে চার-পাঁচজন চোর হাসচে আর মজা দেকচে এবং আপনাদের সাবধানতার প্রশংসা কচ্চে; তারা যে একদিন ঐ রকম দশায় পড়বে তার ভ্রুক্ষেপ নাই। আজ অমুকের গাজনতলায় চিৎপুরের হর। ওদের মাটে সিঙ্গির বাগানের প্যালা। ওদের পাড়ায় মেয়ে পাঁচালি। আজ শহরে গাজনতলায় ভারি ধুম, -চৌমাথার চৌকিদারের পোয়াবারো। মদের দোকান খোলা না থাকলেও সমস্ত রাত্তির মদ বিক্রি হবে, গাঁজা অনবরত উড়বে, কেবল কাল সকালে সুনবেন যে- ‘ঘোষেরা পাতকোতলার বড় পেতলের ঘটিটি পাচ্চে না’। পালেদের একধামা পেতলের বাসন গ্যাচে ও গন্ধবেনেদের সর্বনাশ হয়েচে’। আজ কার সাধ্য নিদ্রা যায়- থেকে থেকে কেবল ঢাকের বাদ্যি, সন্ন্যাসীর হোররা ও ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহোদেব’ চিৎকার।

    এদিকে গির্জার ঘড়িতে টুং টাং ঢং, টুং টাং ঢং করে রাত চারটে বেজে গেল – বারফট্‌কা বাবুরা ঘর মুখো হয়েচে। উড়ে বামুনরা ময়দার দোকানে ময়দা পিষতে আরম্ভ করেচে। রাস্তার আলোর আর তত তেজ নাই। ফুরফুরে হাওয়া উটেচে। বেশ্যালয়ের বারান্দার কোকিলেরা ডাকতে আরম্ভ করেচে; দু-একবার কাকেরডাক, কোকিলের আওয়াজ ও রাস্তার বেকার কুকুরগুলোর খেউ খেউ রব ভিন্ন এখনও এই মহানগর যেন লোকশুন্য। ক্রমে দেখুন-‘রামের মা চলতে পারে না’ ওদের ন-বৌটা কী বজ্জাত মা,’‘মাগী যে জক্কী’ প্রভৃতি নানা কথার আন্দোলনে দুই এক দল মেয়ে মানুষ গঙ্গাস্নান করতে বেরিয়েচেন। চিৎপুরের কসাইরা মটন চাপের ভার নিয়ে চলেচে। পুলিসের সার্জন, দারোগা, জমাদার, প্রভৃতি গরীবের যমেরা রোঁদ, সেরে মস মস করে থানায় ফিরে যাচ্চেন, সকলেরই সিকি, আধুলি, পয়সা ও টাকায় ট্যাক ও পকেট পরিপূর্ণ – হুজুরদের কাছে চ্যালা কাঠখানা, তামাক ছিলিমটে ও পানের খিলিটে ফেরে না, অনেকের মনের মত হয় নাই বলে শহরের উপর চটেছেন, রাগে গা ঘস ঘস কচ্চে, মনে মনে নতুন ফিকির আঁটতে আঁটতে চলেছেন, কাল সকালেই একজন নিরীহ ভদ্র সন্তানের প্রতি কার্দনি ও ক্যারামত জাহির করবেন – সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেব সাদা লোক, কোরকাপ বোঝেন না, চার-পাঁচজন ফ্রেন্ড নিয়তই কাচে থাকে, ‘হারমোনিয়ম’ বাজিয়ে ও কুকুর নিয়ে খেলা করেই কাল কাটান – সুতরাং ইনস্পেক্টর মহলে একাদশ বৃহস্পতি!!!

    গুপুস করে তোপ পরে গেল ! কাকগুলো ‘কা কা’ করে বাসা ছেড়ে উড়বার উজ্জুগ কল্লে। দোকানীরা দোকানের ঝাঁপতাড়া খুলে গন্ধেশ্বরীকে প্রণাম করে দোকানে গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে হুঁকোর জল ফিরিয়ে তামাক খাবার উজ্জুগ কচ্চে। ক্রমে ফর্সা হয়ে এল মাচের ভারিরা দৌড়ে আসতে লেগেচে – মেচুনীরা ঝকড়া কত্তে কত্তে তার পেচু পেচু দৌড়েচে। বদ্দি বাটির আলু, হাসনানের বেগুন, বাজরা বাজরা আসচে। দিশি বিলিতি যমেরা অবস্থা ও রেস্তমত গাড়ি পালকি চড়ে ভিজিটে বেরিয়েচেন – জ্বর বিকার ওলাউঠোর প্রাদুর্ভাব না পড়লে এঁদের মুখে হাসি দেখা যায় না – উলো অঞ্চলে মড়ক হওয়াতে অনেক গো-দাগাও বিলক্ষণ সঙ্গতি করে নেচেন; কলিকাতা শহরেও দু-চার গো-দাগাকে প্রাকটিস কত্তে দেখা যায়, এদের ওষুধ চম্‌ৎকার, কেউ বলদের মতন রোগীর নাক ফুঁড়ে আরাম করেন; কেউ সুদ্ধ জল খাইয়ে সারেন। শহুরে কবিরাজরা আবার এঁদের হতে এক কাটি সরেশ, সকল রকম রোগেই ‘সদ্য মৃত্যুশ্বর’ ব্যবস্থা করে থাকেন – অনেকে চাণক্য শ্লোক ও দাতাকর্ণের পুঁথি পড়েই চিকিৎসা আরম্ভ করেচেন।

    টুলো পুজুরি ভট্‌চাজ্জিরা কাপড় বগলে করে স্নান কত্তে চলেচে, আজ তাদে বড় ত্বরা, যজমানের বাড়ি সকাল সকাল যেতে হবে। আদবুড়ো বেতোরা মর্নিং ওয়াকে বেরুচ্চেন। উড়ে বেহারারা দাঁতন হাতে করে স্নান কত্তে দৌড়েছে। ইংলিশম্যান, হরকরা, ফিনিক্স, এক্সচেঞ্জ গেজেট, গ্রাহকদের দরজায় উপস্থিত হয়েচে। হরিণমাংসের মত কোন কোন বাঙ্গালা খবরের কাগজ বাসী না হলে গ্রাহকরা পান না – ইংরাজি কাগজের সে রকম নয়, গরম গরম ব্রেকফাস্টের সময় গরম গরম কাগজ পড়াই আবশ্যক। ক্রমে সূর্য উদয় হলেন।

    সেকসন-লেখা কেরানীর মত কলুর ঘানির বলদ বদলি হলে -পাগড়িবাঁধা দলের প্রথম নস্টলমেন্টে -সিপসরকার ও বুকিংক্লার্ক দেখা দিলেন। কিছু পরেই পরামানিক ও রিপুকর্ম বেরুলেন। আজ গবর্নমেন্টের আপিস বন্দ, সুতরাং আমরা ক্লার্ক, কেরানী, বুককিপার ও হেড রাইটর দিগকে দেখতে পেলাম না। আজকাল ইংরাজি লেখাপড়ার আধিক্যে অনেকে নানা রকম বেশ ধরে আপিসে যান – পাগড়ি প্রায় উঠে গেল – দুই একজন সেকেলে কেরানীরাই চিরপরিচিত পাগড়ির মান রেখেছেন, তাঁরা পেনসন নিলেই আমরা আর কুঠিওয়ালা বাবুদের মাথায় পাগড়ি দেখতে পাবো না; পাগড়ি মাথায় দিলে আলবার্ডফেশানের বাঁকা সিতেটি ঢাকা পড়ে এই এক প্রধান দোষ। রিপুকর্ম ও পরামানিকদের পাগড়ি থাকে না থাকে হয়েচে।
    দালালের কখনই অব্যাহতি নাই। দালাল সকালে না খেয়েই বেরিয়েচে, হাতে কাজ কিছুই নাই, অথচ যে রকমে হোক না চোটাখোর বেনের ঘরে ও টাকাওয়ালা বাবুদের বাড়িতে এক বার যেতেই হবে –‘কার বাড়ি বিক্রি হবে,’‘কার বাগানের দরকার,’‘কে টাকা ধার করবে,’ তাহারই খবর রাখা দালালের প্রধান কাজ, অনেক চোটাখোর বেনে ও ব্যাভার বেনে শহুরে বাবুরা দালাল চাকর রেখে থাকেন, দালালেরা শিকার ধরে আনে – বাবু আড়ে গেলেন !

    দালালি কাজটা ভালো,‘নেপো মারে দইয়ের মতন’ এতে বিলক্ষণ গুড় আছে। অনেক ভদ্রলোকের ছেলেকে গাড়িঘোড়ায় চড়ে দালালি কত্তে দেখা যায়, অনেক ‘রেস্তহীন মুচ্ছদী’‘চার বার ইন্সলভেন্ট’ হয়ে এখন দালালি ধরেছেন। অনেক পদ্মলোচন দালালির দৌলতে কলাগেছে থাম’ ফেঁদে ফেল্লেন -এঁরা বর্ণচোরা আঁব, এঁদের চেনা ভার, না পারেন হেন কর্ম নাই। পেশাদার চোটাখোর বেনে ও ব্যাভার বেনে বড় মানুষের ছলনারূপ নদীতে বেঁউতি জাল পাতা থাকে, দালাল বিশ্বাসের কলসী ধরে গা ভাসান দে জল তাড়া দেন, সুতরাং মনের মতন কোটাল হলে চুনোপুঁটিও এড়ায় না।

    ক্রমে গির্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গেল। শহরে কান পাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারিদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধোঁ, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্নাসীরা বাণ, দশলকি, সুতোশোন, সাপ, ছিপ ও বাঁশ ফুঁড়ে একে বারে মরিয়া হয়ে নাচতে কালীঘাট থেকে আসচে। বেশ্যালয়ের বারান্দা ইয়ারগোচের ভদ্রলোকে পরিপূর্ণ, সকের দলের পাঁচালি ও হাপ আখড়ায়ের দোয়ার, গুলগার্ডেনের মেম্বরই অধিক, – এঁরা গাজন দ্যাখবার জন্য ভোরের ব্যালা এসে জমেছেন।

    এদিকে রকমারি বাবু বুঝে বড় মানুষদের বৈঠকখানা সরগম হচ্চে। কেউ সিভিলিজেশনের অনুরোধে চড়ক হেঁট করেন। কেউ কেউ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও –‘সাত পুরুষের ক্রিয়াকান্ড’ বলেই চড়কে আমোদ করেন। বাস্তবিক তিনি এতে বড় চটা, কি করেন, বড় দাদা, সেজো, পিসে বর্তমান – আবার ঠাকুরমার এখনো কাশীপ্রাপ্তি হয় নাই।

    অনেকে চড়ক, বানফোঁড়া, তরোয়ালফোঁড়া দেখতে ভালোবাসেন; প্রতিমা বিসর্জনের দিন পৌত্তুর, ছোট ছেলে ও কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে ভাষান দেখতে বেরোন। অনেকে বুড়ো মিনসে হয়েও হীরে বসানো টুপি, বুকে জরির কারচোপের কর্ম করা কাবা ও গলায় মুক্তোর মালা, হীরের কন্ঠি, দু-হাতে দশটি আংটি পরে ‘খোকা’ সেজে বেরুতে লজ্জিত হন না; হয়তো তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলের বয়স ষাট ব্‌ৎসর – ভাগনের চুল পেকে গ্যাছে।

    অনেক পাড়াগেঁয়ে জমিদার ও রাজারা মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় পদার্পণ করে থাকেন। নেজামত আদালতে নম্বরওয়ারী ও মোৎফরেক্কার তদ্বির কত্তে হলে ভবানীপুরেই বাসার ঠিকানা হয়। কলিকাতার হাওয়া পাড়াগাঁয়ের পক্ষে বড় গরম। পূর্বে পাড়াগেঁয়ে কলিকাতায় এলে লোনা লাগত, এখন লোনা লাগার বদলে আর একটি বড় জিনিস লেগে থাকে – অনেকে তার দরুন একেবারে আঁতকে পড়েন – ঘাগিগোচের পাল্লায় পড়ে শেষ সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি যেতে হয়। পাড়াগেঁয়ে দুই একজন জমিদার প্রায় বারো মাস এখানেই কাটান। দুপুরব্যালা ফেটিং গাড়ি চড়া পাঁচালি বা চন্ডীর গানের ছেলেদের মতন চেহারা, মাথায় ক্রেপের চাদর জড়ানো, জন দশ-বারো মোসাহেব সঙ্গে, বা জানের ভেড়ুয়ার মত পোশাক, গলায় মুক্তার মালা – দেখলেই চেনা যায় যে, ইনি একজন বনগাঁর শিয়াল রাজা বুদ্ধিতে কাশ্মীরী গাধার বেহদ্দ – বিদ্যায় মূর্তিমান মা ! বিসর্জন, বারৈয়ারি খ্যামটা নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত – মধ্যে মধ্যে খুনী মামলার গ্রেপ্তারী ও মহাজনের ডিক্রীর দরুন গা ঢাকা দেন। রবিবার, পালাপার্বণ, বিসর্জন আর স্নানযাত্রায় সেজে গুঁজে গাড়ি চড়ে বেরোন।

    পাড়াগেঁয়ে হলেই যে এই রকম উনপাঁজুরে হবে, এমন কোন কথা নাই। কারণ, দুই একজন জমিদার মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় এসে বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠা ও প্রশংসা নিয়ে যান। তাঁরা সোনাগাজীতে বাসা করেও সে রঙ্গে বিব্রত হন না; বরং তঁদের চালচুলো দেখে অনেক শহুরে তাক হয়ে থাকেন। আবার কেউ কাশীপুর বোড়স্যা, ভবানীপুর ও কালীঘাটে বাসা করে, চবিবশ ঘন্টা সোনাগাজীতেই কাটান, লোকের বাড়ি চড়োয়া হয়ে দাঙ্গা করেন; তার পরদিন প্রিয়তমার হাত ধরে যুগলবেশে জ্যাঠা খুড়া বাবার সঙ্গে পুলিসে হাজির হন, ধারে হাতী কেনেন। পেমেন্টের সময় ঠ্যাঙ্গা-ঠেঙ্গি উপস্থিত হয় – পেড়াপেড়ি হলে দেশে সরে পড়েন, – সেথায় রামরাজ্য।

    জাহাজ থেকে নতুন সেলার নামলেই যেমন পাইকেরে ছেঁকে ধরে সেই রকম পাড়াগেঁয়ে বড় মানুষ শহরে এলেই প্রথমে দালাল পেশ হন। দালাল, বাবুর সদর মোক্তারের অনুগ্রহে বাড়ি ভাড়া করা, গাড়ি যোগাড় করা, খ্যামটা নাচের বায়না করা প্রভৃতি রকমওয়ারি কাজের ভার পান ও পলিটিকেল এজেন্টের কাজ করেন। সাতপুকুরের বাগান, এসিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়ম – বালির ব্রিজ, বাগবাজারের খালের কলের দরজা – রকমওয়ারি বাবুর সাজানো বৈঠকখানা,- ও দুই এক নামজাদা বেশ্যার বাড়ি নিয়ে বেড়ান। ঝোপ বুঝে কোপ ফেলতে পারলে দালালের বাবুর কাছে বিলক্ষণ প্রতিপত্তি হয়ে পড়ে। কিছুকাল বড় আমোদে যায়, শেষে বাবু টাকার টানাটানিতে বা কর্মান্তরে দেশে গেলে দালাল এজেন্টি কর্মে মকরর হন।

    আজকাল শহরে ইংরাজি কেতার বাবুরা দু’টি দল হয়েচেন, প্রথম দল ‘উঁচুকেতা সাহেবের গোবরের বস্ট’। দ্বিতীয় ‘ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ’। প্রথম দলের সকলে ইংরাজি কেতা, টেবিল চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরট, জগে করা জল, ডিকান্টরে ব্রান্ডী ও কাচের গ্লাসে সোলার ঢাকনি, সালু মোড়া – হরকরা, ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও বেস্ট নিউজ অব দি ডে নিয়েই সর্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমোডে হাগেন, এবং কাগজে পোঁদ পোঁচেন। এঁরা সহৃদয়তা, দ, পরোপকার, নম্রতা প্রভৃতি বিবিধ সদ্‌গুনে ভূষিত, কেবল সর্বদাই রোগ, মদখেয়ে খেয়ে জুজু, স্ত্রীর দাস, – উৎসাহ, একতা, উন্নতীচ্ছা একেবারে হৃদয় হতে নির্বাসিত হয়েছে; এঁরাই ওল্ড ক্লাস।

    দ্বিতীয়ের মধ্যে – বাগাম্বর মিত্র প্রভৃতি, সাপ হতেও ভনক, বাঘের চেয়ে হিংস্র; বলতে গেলে এঁরা এক রকম ভনক জানোয়ার। চোরেরা যেমন চুরি কত্তে গেলে মদ ঠোঁটে দিয়ে গন্ধ করে মাতাল সেজে যায়, এঁরা সেই রূপ কেবল স্বার্থ সাধনার্থ স্বদেশের ভালো চেষ্টা করেন। ‘ক্যামন করে আপনি বড়লোক হব’, ‘ক্যামন করে সকলে পায়ের নীচে থাকবে’, এই এঁদের নিয়ত চেষ্টা – পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে আপনার গোঁপে তেল দেওয়াই এঁদের পলিসী, এঁদের কাছে দাতব্য দূরপরিহার – চার আনার বেশি দান নাই !

    সকাল বেলা শহরের বড় মানুষদের বৈঠকখানা বড় সরগরম থাকে। কোথাও উকিলের বাড়ির হেড কেরানী তীর্থের কাকের মত বসে আচেন। তিন চারটি ‘ইকুটি’, দু-টি ‘কমন লা’ আদালতে ঝুলচে। কোথাও পাওনাদার, বিলসরকার, উটনূয়ালা মহাজন খাতা, বিল ও হাতচিঠে নিয়ে তিন মাস হাঁটচে, দেওয়ানজী কেবল আজ না কাল কচ্চেন। ‘শমন’, ‘ওয়ারিন’, ‘উকিলের চিঠি’‘সফিনে’ বাবুর অলংকার হয়েচে। নিন্দা, অপমান তৃণজ্ঞান। প্রত্যেক লোকের চাতুরী , ছলনা মনে করে অন্তর্দাহ কচ্চে ‘অয়সা** দিন নেহি রহেগা’, অঙ্কিত আংটি আঙ্গুলে পরেচেন; কিন্তু কিছুতেই শান্তি লাভ কত্তে পাচ্চেন না।

    কোথাও একজন বড় মানুষের ছেলে অল্প বয়সে বিষয় পেয়ে কান্নেখেকো ঘুঁড়ির মত ঘুচ্চেন। পরশু দিন ‘বউ বউ’‘লুকোচুরি’‘ঘোড়া ঘোড়া’ খেলেচেন, আজ তাঁকে দাওয়ানজীর কুটচালে খতেনের গোঁজা মিলন ধত্তে হবে, উকিলের বাড়ির বাবুর পাকা চালে নজর রেখে সরে বসতে হবে, নইলে ওঠ্‌সার কিস্তিতেই মাত ! ছেলের হাতে ফল দেখলে কাকেরাও ছোঁ মারে, মানুষতো কোন ছার – কেউ ‘স্বগীয় কর্তার পরম বন্ধু’, কেউ স্বর্গীয় কর্তার ‘মেজো পিসের মামার খুড়োর পিসতুতো ভেয়ের মামাতো ভাই’ পরিচয় দিয়ে পেশ হচ্চেন, ‘উমেদার’‘কন্যাদায়’ ( হয়তো ‘কন্যা’-দায়ের বিবাহ হয় নাই ) নানা রকম লোক এসে জুটচেন; আসল মতলব দ্বৈপায়ন হ্রদে ডোবান রয়েচে – সময়ে আমলে আসবে।

    ক্রমে রাস্তায় লোকারণ্য হয়েচে। চৌমাথার বেনের দোকান লোকে পুরে গ্যাছে। নানা রকম রকম বেশ – কারুর কফ ও কলারওয়ালা কামিজ, রুপোর বগলস আঁটা শাইনিং লেদর, কারো ইন্ডিয়া রবার চায়না কোট, হাতে ইস্টিক, ক্রেপের চাদর, চুলের গার্ড চেন গলায়, আলবার্ট ফ্যাশানে চুল ফেরানো। কলিকাতা শহর রত্নাকরবিশেষ, না মেলে এমন জানোয়ার নাই; রাস্তার দু-পাশে অনেক আমোদ গেঁড়ে মহাশয়েরা দাঁড়িয়েচেন; ছোট আদালতের উকিল, সেকসন রাইটার, টাকাওয়ালা গন্ধবেনে, তেলী, ঢাকাই কামার আর ফলারে যজমেনে বামুনই অধিক – কারুকোলে দু-টি মেয়ে, কারু তিনটে ছেলে।
    কোথাও পাদরি সাহেব ঝুরি ঝুরি বাইবেল বিলুচ্চেন – কাচে ক্যাটিকৃষ্ট ভায় – সুবর্ধন চৌকিদারের মত পোশাক – পেনটুলন ট্যাংট্যাঙে চাপকান, মাথায় কালো রঙের চোঙাকাটা টুপি। আদালতী সুরে হাত-মুখ নেড়ে খ্রীষ্টধর্মের মাহাত্ম্য ব্যক্ত কচ্চেন – হঠাৎ দেখলে বোধ হয় যেন পুতুলনাচের নকীব। কতকগুলো ঝাঁকাওয়ালা মুটে, পাঠশালের ছেলে ও ফ্রিওয়ালা একমনে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্যাটিকৃষ্ট কি বলচেন কিছুই বুঝতে পাচ্চে না ! পূর্বে বওয়াটে ছেলেরা বাপ-মার সঙ্গে ঝকড়া করে পশ্চিমে পালিয়ে যেতো, না হয় খ্রীষ্টান হত, কিন্তু রেলওয়ে হওয়াতে পশ্চিমে পালাবার বড় ব্যাঘাত হয়েছে – আর দিশি খ্রীষ্টানদের দুর্দশা দেখে খ্রীষ্টান হতেও ভয় হয় !

    চিৎপুরের বড় রাস্তা মেঘ কল্লে কাদা হয় – ধুলোয় ধুলো, তার মধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েচে। প্রথমে দু’টো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশে বেঁধে কাঁধে করেচে – কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ি বাজাতে বাজাতে চলেচে – তার পেচোনে এলোমেলো নিশেনের শ্রেণী। মধ্যে হাড়িরা দল বেঁধে ঢোলের সঙ্গতে ‘ভোলা বোম ভোলা রঙ্গিলা, লেংটা ত্রিপুরারি শিরে জটাধারী ভোলার গলে দোলে হাড়ের মালা’, ভজন গইতে গাইতে চলেচে। তার পেচোনে বাবুর অবস্থামত তকমাওয়ালা দরওয়ান, হরকরা, সেপাই। মধ্যে সর্বাঙ্গে ছাই ও খড়ি মাখা, টিনের সাপের ফণার টুপি মাথায় শিব ও পার্বতী সাজা সং। তার পেচোনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকি ফুঁড়ে ধুনো পোড়াতে পোড়াতে নাচতে নাচতে চলেচে, পাশে বেনোরা জিবে হাতে বাণ ফুঁড়ে চলেচে। লম্বা লম্বা ছিপ, উপরে শোলার চিংড়িমাছ বাঁধা। সেটকে সেট ঢাকে ড্যানাক ড্যানাক করে রং বাজাচ্চে। পেচোনে বাবুর ভাগ্নে, ছোট ভাই বা পিসতুতো ভেয়েরা গাড়ি চড়ে চলেচেন -তাঁরা রাত্রি তিনটের সময় উঠেচেন, চোক লাল টক টক কচ্চে, মাথা ভবানীপুরে ও কালীঘেটে ধুলোয় ভরে গিয়েছে। দর্শকেরা হাঁ করে গাজন দেখচেন, মধ্যে বাজনার শব্দে ঘোড়া ক্ষেপেচে – হুড় মুড় করে কেউ দোকানে কেউ খানার উপর পড়চেন, রৌদ্রে মাথা ফেটে যাচ্চে – তথাপি নড়চেন না।

    ক্রমে পুলিসের হুকুম মত সব গাজন ফিরে গেল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট রাস্তায় ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছিলেন, পকেটঘড়ি খুলে দেখলেন, সময় উতরে গ্যাচে; অমনি মার্শল ল জারি হল, ঢাক বাজালে থানায় ধরে নিয়ে যাবে। ক্রমে দুই একটা ঢাকে জমাদারের হেতে কোঁতকা পড়বা মাত্রই শহর নিস্তব্ধ হল। অনেকে ঢাক ঘাড়ে করে চুপে চুপে বাড়ি এলেন – দর্শকেরা কুইনের রাজ্যে অভিসম্পাত কত্তে কত্তে বাড়ি ফিরে গেলেন।

    শহরটা কিছুকালের মত জুড়ুলো। বেনোরা বাণ খুলে মদের দোকানে ঢুকলো। সন্ন্যাসীরা ক্লান্ত হয়ে ঘরে গিয়ে হাতপাখায় বাতাস ও হাঁড়ি হাঁড়ি আমানি খেয়ে ফেল্লে। গাজনতলায় শিবের ঘর বন্ধ হল – এ বছরের মত বাণ-ফোঁড়ার আমোদও ফুরুলো। এই রকমে রবিবারটা দেখতে দেখতে গেল।

    আজ ব্‌ৎসরের শেষ দিন। যুবত্ব কালের এক ব্‌ৎসর গেল দেখে যুবক যুবতীরা বিষণ্ন হলেন। হতভাগ্য কয়েদীর নির্দিষ্টকালের এক ব্‌ৎসর কেটে গেল দেখে আহ্লাদের পরিসীমা রইল না। আজ বুড়োটি বিদেয় নিলেন, কাল যুবটি আমাদের উপর প্রভাত হবেন। বুড়ো ব্‌ৎসরের অধীনে আমরা যে সব কষ্ট ভোগ করেচি, যে সব ক্ষতি স্বীকার করেচি – আগামীর মুখ চেয়ে আশার মন্ত্রণায় আমরা সে সব মন থেকে তাঁরই সঙ্গে বিসর্জন দিলেম। ভূত কাল যেন আমাদের ভ্যাংচাতে চলে গেলেন – বর্তমান ব্‌ৎসর স্কুল মাস্টারের মত গম্ভীর ভাবে এসে পড়লেন – আমরা ভয়ে হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত ! জেলার পুরানো হাকিম বদলী হলে নীল প্রজাদের মন যেমন ধুক পটুক করে, স্কুলে নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন মাস্টারের মুখ দেখে ছেলেদের বুক যেমন গুর গুর করে – মড়ুঞ্চে পোয়াতীর বুড়ো বয়েসে ছেলে হলে মনে যেমন মহান সংশয় – উপস্থিত হয়, পুরানোর যাওয়াতে নতুনের আসাতে আজ সংসার তেমনি অবস্থায় পড়লেন।

    ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আদর করেন। আগামীকে দাঁড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান – নেশার খোয়ারির সঙ্গে পুরানোকে বিদায় দেন। বাঙালীরা বছরটি ভালো রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ হোক, সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরানোকে বিদায় দেন। কেবল কলসী উচ্ছুগগু কর্তারা আর খাতাওয়ালারাই নতুন ব্‌ৎসরের মান রাখেন।

    আজ চড়ক। সকালে ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মরা একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিধিপূর্বক উপাসনা করেচেন -আবার অনেক ব্রাহ্ম কলসী উচ্ছুগগু করবেন। এবারে উক্ত সমাজের কোন উপাচার্য বড় ধুম করে কালীপূজো করেছিলেন ও বিধবা বিবাহে যাবার প্রায়শ্চিত্ত উপলক্ষে জমিদারের বাড়ি শ্রীবিষ্ণু স্মরণ করে গোবর খেতেও ত্রুটি করেননি। আজকাল ব্রাহ্মধর্মের মর্ম বোঝা ভার, বাড়িতে দুর্গোৎসবও হবে আবার ফি বুধবারে সমাজে গিয়ে চক্ষু মুদিত করে মড়াকান্না কাঁদতেও হবে। পরমেশ্বর কি খোট্টা না মহারাষ্ট্র ব্রাহ্মণ ? যে বেদভাঙা সংস্কৃত পদ ভিন্ন অন্য ভাষায় তাঁরে ডাকলে তিনি বুজতে পারবেন না -আড্ডা থেকে না ডাকলে শুনতে পারবেন না; ক্রমে ক্রিশ্চানী ও ব্রাহ্মধর্মের আড়ম্বর এক হবে, তারি যোগাড় হচ্চে।

    চড়কগাছ পুকুর থেকে তুলে মোচ বেন্দে মাথায় ঘি-কলা দিয়ে খাড়া করা হয়েচে। ক্রমে রোদ্দুরের তেজ পড়ে এলে চড়কতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো। শহরের বাবুরা বড় বড় জুড়ি, ফেটিং ও স্টেট ক্যারেজে নানা রকম পোশাক পরে চড়ক দেখতে বেরিয়েচেন, কেউ কাঁসারীদের সংয়ের মত পালকি গাড়ির ছাতের উপর বসে চলেচেন – ছোট লোক, বড় মানুষ ও হঠাৎ বাবুই অধিক। য়্যাং যায় , ব্যাং যায়, খলসে বলে আমিও যাই – বামুন কায়েতরা ক্রমে সভ্য হয়ে উঠলো দেখে শহরের নবশাক, হাড়িশাক মুচিশাক মহাশয়রাও হামা দিতে আরম্ভ কল্লেন, ক্রমে ছোট জেতের মধ্যেও দ্বিতীয় রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্দেসাগর ও কেশব সেন জন্মাতে লাগলো – সন্ধ্যার পর দু-গাছি আটা ও একটু ন্যাবড়ানোর বদলে – ফাউলকরি রোল রুটি ই¾ট্রডিউস হল। শ্বশুরবাড়ি আহার করা, মেয়েদের বাঁ নাক বেঁধান চলিত হল দেখে বোতলের দোকান, কড়িগণা, মাকু ঠেলা ও ভালুকের লোম ব্যাচা কলকেতায় থাকতে লজ্জিত হতে লাগলো। থরকামান চৈতনফক্কার জায়গায় আলবার্ট ফ্যাশান ভর্তি হলেন। চাবির থলো কাঁদে করে টেনা ধুতি পরে দোকানে যাওয়া আর ভালো দেখায় না, সুতরাং অবস্থামত জুড়ি, বগি ও ব্রাউহাম বরাদ্দ হল। এই সঙ্গে সঙ্গে বেকার ও উমেদারী হালোতের দু-একজন ভদ্রলোক মোসাহেব, তকমা আরদালী ও হরকরা দেখে যেতে লাগলো। ক্রমে কলে, কৌশলে, বেনেতি বেসাতে টাকা খাটিয়ে অতি অল্পদিন মধ্যে কলিকাতা শহরে কতকগুলি ছোটলোক বড় মানুষ হন। রামলীলে, স্নানযাত্রা, চড়ক, বেলুন ওড়া, বাজি ও ঘোড়ার নাচ এঁরাই রেখেচেন-প্রায় অনেকেরই এক একটি পোষা পাশ বালিশ আছে –‘‘যে আজ্ঞে’‘হুজুর আপনি যা বলচেন, তাই ঠিক’ বলবার জন্যে দুই এক গন্ডমূর্খ বরাখুরে ভদ্রসন্তান মাইনে-করা নিযুক্ত রয়েছে। শুভকর্মে দানের দফায় নবডঙ্কা। কিন্তু প্রতি ব্‌ৎসরের গার্ডেন ফিসটের খরচে চার-পাঁচটা ইউনিভারসিটি ফাউন্ড হয়।

    কলকেতা শহরের আমোদ শিগগির ফুরায় না, বারৈয়ারি পূজোর প্রতিমা পূজো শেষ হলেও বারো দিন ফ্যালা হয়না। চড়কের বাসী, পচা, গলা ও ধসা হয়ে থাকে – সে সব বলতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায় ও ক্রমে তেতো হয়ে পড়ে, সুতরাং টাটকা চড়ক টাটকাই শেষ করা গেল।

    এদিকে চড়কতলায় টিনের ঘুরগুরি, টিনের মুহুরি দেওয়া তলতা বাঁশেরা বাঁশী, হলদে রং করা বাঁখারির চড়কগাছ, ছেঁড়া ন্যাকড়ার তৈরি গুরিয় পতুল, শোলার নানা প্রকার খেলনা, পেল্লাদে পুতুল, চিত্তির করা হাঁড়ি বিক্রি কত্তে বসেচে, ‘ড্যানাক ড্যানাক ড্যাডাং ড্যাং চিংড়ি মাছের দু-টো ঠ্যাং’ ঢাকের বোল বাজ্জে, গোলাপী খিলির দোনা বিক্রি হচ্চে। একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুঁড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়কগাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লে -মইয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া হতে লাগলো। সকলেই আকাশ পানে চড়কীর পিঠের দিকে চেয়ে রইলেন। চড়কী প্রাণপণে দড়ি ধরে কখনো ছেড়ে, পা নেড়ে ঘুত্তে লাগলে। কেবল ‘দে পাক দে পাক’ শব্দ। কারু সর্বনাশ, কারু পৌষ মাস ! একজনের পিঠ ফুঁড়ে ঘোরানো হচ্চে; হাজার লোকে মজা দেকচেন !

    পাঠক ! চড়কের যথাকথঞ্চিৎ নকুশার সঙ্গে কলিকাতার বর্তমান সমাজের ইনসাইট জানলে, ক্রমে আমাদের সঙ্গে যত পরিচিত হবে, ততই তোমার বহুজ্ঞতার বৃদ্ধি হবে, তাতেই প্রথমে কোট করা হয়েছে, ‘শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালী।
  • ad | 223.223.129.158 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১৩:০২527730
  • হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা । পর্ব ২

    ‘‘Andthesewhatnameortitlee’ertheybear ,
    Ispeakofall”
    Beggarsbush.

    শৌখীন চড়কপার্বণ শেষ হল বলেই যেন দু:খে সজনে খাড়া ফেটে গেলেন। রাস্তার ধুলো ও কাঁকরেরা অস্থির হয়ে বেড়াতে লাগলো। ঢাকীরা ঢাক ফেলে জুতো গড়তে আরম্ভ কল্লে। বাজারে দুধ সস্তা হল ( এত দিন গয়লাদের জল মেশাবার অবকাশ ছিল না ) , গন্ধবেনে ভালুকের রোঁ বেচতে বসে গেলেন। ছুতরেরা গুলদার ঢাকাই উড়ুনিতে কাঠের কুচো বাঁদতে আরম্ভ কল্লে। জন্মফলারে যজমেনে বামুনেরা আদ্যশ্রাদ্ধ , বাৎসরিক সপিন্ডীকরণ টাক্তে লাগলেন- তাই দেখে গরমি আর থাক্তে পাল্লে না , ‘ ঘরে আগুন ’ , ‘ জলে ডোবা ’‘ ওলাউঠা ’ প্রভৃতি নানা রকম বেশ ধরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন।

    রাস্তার ধারের ফলের দোকান , পচা লিচু ও আঁবে ভরে গেল। কোথাও একটা কাঁঠালের ভুত্রির উপর মাচি ভ্যান ভ্যান কচ্চে , কোথাও কতকগুলো আঁবের আঁটি ছড়ানো রয়েছে , ছেলেরা আঁটি ঘষে ভেঁপু করে বাজাচ্ছে। মধ্যে এক পশলা বিষ্টি হয়ে যাওয়ায় চিৎপুরের বড় রাস্তা ফলারের পাতের মত দেখাচ্চে , -কুঠিওয়ালারা জুতো হাতে করে বেশ্যালয়ের বারান্দার নীচে আর রাস্তার ধারের বেনের দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন – আজ ছক্কড় মহলে পোহাবারো!
    কলকেতার কেরাঞ্চি গাড়ি বতো রোগীর পক্ষে বড় উপকারক , গ্যালবানিক শকের কাজ করে। সেকেলে আসমানি দোলদার ছক্কড় যেন হিন্দুধর্মের সঙ্গে সঙ্গেই কল্কেতা থেকে গাঢাকা হয়েছে – কেবল দুই-একখানা আজও খিদিরপুর , ভবানীপুর , কালীঘাট আর বারাসাতের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি বলেই আমরা কখনো কখনো দেখতে পাই। ‘ চার আনা ! ’‘ চার আনা ! ’‘ লালদিকি ! ’‘ তেরজুরী ! ’‘ এসো গো বাবু ছোট আদালত ! ’ বলে গাড়োয়ানরা শৌখীন সুরে চিৎকার কচ্চে – নবদ্ধাগমনের বউয়ের মত দুই এক কুঠিওয়ালা গাড়ির ভিতর বসে আচেন – সঙ্গী জুটচে না। দুই একজন গবর্নমেন্ট আপিসের কেরানী গাড়োয়ানদের সঙ্গে দরের কষাকষি কচ্চেন। অনেকে চটে হেঁটেই চলেচেন
    গাড়োয়ানরা হাসি টিটকিরির সঙ্গে ‘ তবে ঝাঁকা মুটেয় যাও , তোমাদের গাড়ি চড়া কর্ম নয় ’ কমপ্লিমেন্ট দিচ্চে !

    দশটা বেজে গ্যাচে। ছেলেরা বই হাতে করে রাস্তায় হো হো কত্তে কত্তে স্কুলে চলেছে। মৌতাতী বুড়োরা তেল মেখে গামছা কাঁদে করে আফিমের দোকান ও গুলির আড্ডায় জমে্‌চন। হেটো ব্যাপারীরে বাজারের ব্যাচা কেনা শেষ করে খালি বাজরা নিয়ে ফিরে যাচ্চে। কল্কেতা শহর বড়ই গুলজার – গাড়ির হররা , সহিসের পয়িস পয়িস শব্দ , কেঁদো কেঁদো ওয়েলার ও নরম্যান্ডির টাপেতে রাস্তা কেঁপে উঠে্‌চ – বিনা ব্যাঘাতে রাস্তায় চলা বড় সোজা কথা নয়।

    বীরকৃষ্ণ দাঁর ম্যানেজার কানাইধন দত্ত এক নিমখাসা রকমের ছক্কড় ভাড়া করে বারৈয়ারি পূজার বার্ষিক সাধে্‌ত বেরিয়েচেন।
    বীরকৃষ্ণ দাঁ কেবলচাঁদ দাঁর পুষ্যিপুত্তুর , হাটখোলায় গদি ; দশ-বারোটা খন্দ মালের আড়্‌ৎ , বেলেঘাটায় কাটের ও চুনের পাঁচখান গোলা , নগদ দশ-বারো লাক টাকা দাদন ও চোটায় খাটে। কোম্পানির কাগজেরও মধ্যে মধ্যে লেন দেন হয়ে থাকে , বারো মাস প্রায় শহরেই বাস , কেবল পূজোর সময় দশ-বারো দিনের জন্যে বাড়ি যেতে হয় ; একখানি বগি , একটি লাল ওয়েলার , একটি রাঁড় , দু’টি তেলি মোসাহেব , গড়পারে বাগান ও ছ-দেঁড়ে এক এক ভাউলে ব্যাভ্যার , আয়েস ও উপাসনার জন্যে নিয়ত হাজির !
    বীরকৃষ্ণ দাঁ শ্যামবর্ণ , বেঁটেখেঁটে রকমের মানুষ , নেয়াপাতি রকমের ভুঁড়ি , হাতে সোনার তাগা , কোমরে মোটা সোনার গোট , গলায় এক ছড়া সোনার দু-নর হার , আ‎‎‎হ্নিকের সময় খেলবার তাসের মত চ্যাটালো সোনার ইষ্টিকবচ পরে থাকেন , গঙ্গাস্নানটি প্রত্যহ হযে থাকে , কপালে কণ্ঠায় ও কানে ফোঁটাও ফাঁক যায় না। দাঁ মহাশয বাংলা ও ইংরাজি নাম সই কত্তে পারেন ও ইংরেজ খদ্দেরের আসা যাওয়ায় দু-চার ইংরাজি কোম্পানির কন্‌ট্‌র্‌যাক্টে ‘ কম ’ আইস , ‘ গো ’ যাও প্রভৃতি দুই এক ইংরাজি কথাও আসে , হিন্তু দাঁ মহাশয়কে বড় কাজকর্ম দেখতে হত না , কানাইধন দত্তই তাঁর সব কাজকর্ম দেখতেন , দাঁ মহাশয় টানা পাখায় বাতাস খেয়ে , বগি চড়ে , আর এসরাজ বাজিয়েই কাল কাটান।

    বারোজনে একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজা করার প্রথা মড়ক হতেই সৃষ্টি হয় – ক্রমে সেই অবধি ‘ মা ’ ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ারদলে গিয়ে পড়েন। মহাজন , গোলদার , দোকানদার ও হেটোরাই বারৈয়ারি পূজার প্রধান উদ্যোগী। সম্‌ব্‌ৎসর যার যত মাল বিক্রি ও চালান হয় , মণ পিছু এক কড়া , দু-কড়া ও পাঁচ কড়ার হিসাবে , বারৈয়ারি খাতে জমা হয়ে থাকে , ক্রমে দুই এক ব্‌ৎসরের দস্‌ত্‌তরি বারৈয়ারি খাতে জমলে মহাজনদের মধ্যে বর্ধিষ্ণু ও ইয়ারগোচের শৌখিন লোকের কাছেই ঐ টাকা জমা হয় , তিনি বারৈয়ারি পূজোর অধ্যক্ষ হন – অন্য চাঁদা আদায় করা , চাঁদার জন্য ঘোরা ও বারৈয়ারি সং ও রং-তামাসার বন্দোবস্ত করাই তাঁর ভার হয়।
    এবার ঢাকার বীরকৃষ্ণ দাঁ-ই বারৈয়ারির অধ্যক্ষ হয়েছিলেন , সুতরাং দাঁ মহাশয়ের আমমোক্তার কানাইধন দত্তই বারৈয়ারির বার্ষিক চাঁদা ও আর আর কাজের ভার পেয়েছিলেন।
    দত্ত বাবুর গাড়ি রুনু ঝুনু ছুনু ছুনু করে নুড়িঘাটা লেনের এক কায়স্থ বড় মানুষের বাড়ির দরজায় লাগলো। দত্ত বাবু তড়াক করে গাড়ি থেকে লাপিয়ে পড়ে দরওয়ানের কাছে উপস্থিত হলেন। শহরের বড় মানুষের বাড়ির দরওয়ানরা খোদ হুজুর ভিন্ন নদের রাজা এলেও খবর নদার্ৎ! ‘ হোরির বক্সিস ’‘ দুর্গোৎসবের পার্বণী ’‘ রাখী পূর্ণিমার প্রণামী ’ দিয়েও মন পাওয়া ভার! দত্ত বাবু অনেক ক্লেশের পর চার আনা কবলে একজন দরওয়ানকে বাবুকে এৎলা দিতে সম্মত কল্লেন। শহরের অনেক বড় মানুষের কাছে কর্জ দেওয়া টাকার সুদ বা তাঁর পৈতৃক জমিদারী কিনতে গেলেও বাবুর কাছে এৎলা হলে , হুজুরের হুকুম হলে লোক যেতে পায় ; কেবল দুই এক জায়গায় অবারিত দ্বার! এতে বড় মানুষদেরও বড় দোষ নাই , ব্রাহ্মণ পন্ডিত উমেদার কন্যাদায় আইবুড়ো ও বিদেশী ব্রা‏‏হ্মণ ভিক্ষুকদের জ্বালায় শহরে বড় মানুষদের স্থির হওয়া ভার। এঁদের মধ্যে কে মৌতাতের টানাটানির জ্বালায় বিব্রত , কে যথার্থ দায়গ্রস্ত , এপিডেপিট কল্লেও বিশ্বাস হয় না! দত্ত বাবু আধ ঘন্টা দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন এর মধ্যে দশ বারো জনকে পরিচয় দিতে হল তিনি কিসের জন্যে হুজুরে এসেচেন – ও দুই-একটা বেয়াড়া রকমের দরওয়ানি ঠাট্টা খেয়ে গরম হচ্ছিলেন , এমন সময় তাঁর চার আনা দাদুনে দরওয়ান ঢিকুতে ঢিকুতে এসে তাঁরে সঙ্গে করে নিয়ে হুজুরে পেশ কল্লে।
    পাঠক! বড় মানে্‌ষর বাড়ির দরওয়ানের কথায় এইখানে আমাদের একটি গল্প মনে পড়ে গেল , সেটি না বলেও থাকা যায় না।
    বছর দশ-বারো হল , এই শহরের বাগবাজার অঞ্চলের একজন ভদ্রলোক তাঁর জন্মতিথি উপলক্ষে গুটিকতক ফ্রেন্ডকে মধ্যাহ্ন ভোজনের নেমন্তন্ন করেন। জন্মতিথিতে আমোদ করা হিন্দুদের ইংরেজদের কাপি করা প্রথা নয় , আমরা পুরুষপরম্পরা জন্মতিথিতে গুড় দুধ খেয়ে , তিল বুনে , মাছ ছেড়ে , ( যার যেমন প্রথা ) নতুন কাপড় পরে , প্রদীপ জ্বেলে , শাঁখ বাজিয়ে , আইবুড়ো ভাত খাওয়ার মত – কুটুম্ব বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে ভোজন করে থাকি। তবে আজকাল শহরের কেউ কেউ জন্মতিথিতে বেতরগোছের আমোদ করে থাকেন। কেউ ষেটের কোলে ষাট ব্‌ৎসরে পদার্পণ করে আপনার জন্মতিথির দিন গ্যাসের আলোর গেট , নাচ ও ইংরেজদের খানা দিয়ে চোহেলের একশেষ করেন ; অভিপ্রায় আপনারা আশীর্বাদ করুন , তিনি আর ষাট বছর এমনি আমোদ কত্তে থাকুন , চুলে ও গোঁপে কলপ দিয়ে জরির জামা ও হীরের কন্ঠি পরে নাচ দেখতে বসুন , – প্রতিমে বিসজ্জন – স্নানযাত্রা ও রথে বাহার দিন। অনেকের জন্মতিথিতে বাগান টের পান যে , আজ বাবুর জন্মতিথি , নেমন্তন্নেদের গা সার্তে আপিসে এক হপ্তা ছুটি নিতে হয়। আমাদের বাগবাজারের বাবু সে রকমের কোন দিকেই যাননি , কেবল গুটিকতক ফ্রেন্ডকে ভালো করে খাওয়াবেন , এই তাঁর মতলব ছিল। এদিকে ভোজের দিন নেমন্তন্নেরা এসে একে একে জুটলেন , খাবার দাবার সকলই প্রস্‌ত্‌তত হয়েছিল , কিন্তু সে দিন সকালে বাদলা হওয়ায় মাছ পাওয়া যায়নি। বাঙালিদের মাছটা প্রধান খাদ্য , সুতরাং কর্মকর্তা মাছের জন্যে বড়ই উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন। নানা স্থানে মাছের সন্ধানে লোক পাঠিয়ে দিলেন – কিন্তু কোন রকমেই মাছ পাওয়া গেল না – শেষে একজন জেলে একটা সের দশ-বারো ওজনের রুইমাছ নিয়ে উপস্থিত হল । মাছ দেখে কর্মকর্তার খুশির আর সীমা রইলো না। জেলে যে দাম বলবে , তাই দিয়ে মাছটি নেওয়া যাবে মনে করে জেলেকে জিজ্ঞাসা করল্লেন , ‘ বাপু , এটির দাম কি নেবে ? ঠিক বল , তাই দেওয়া যাবে।’ জেলে বললে , ‘ মশাই ! এর দাম বিশ ঘা জুতো !’ কর্মকর্তা ‘ বিশ ঘা জুতো !’ শুনে অবাক হয়ে রইলেন , মনে কল্লেন , জেলে বাদলা পেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে , না হয়তো পাগল , কিন্তু জেলে কোন ক্রমেই বিশ ঘা জুতো ভিন্ন মাছটি দেবে না , এই তার পণ হল। নেমন্তন্নে বাড়ির কর্তা ও চাকরবাকরেরা জেলের এ আশ্চর্য দাম শুনে তারে কেউ পাগল কেউ মাতাল বলে ঠাট্টা মস্করা কত্তে লাগলো , কিন্তু কোন রকমেই জেলের গোঁ ঘুচে্‌লা না। শেষে কর্মকর্তা কি করেন , মাছটি নিতেই হবে , আস্তে আস্তে জেলেকে বিশ ঘা জুতো মাত্তে রাজী হলেন , জেলেও অম্লান বদনে পিঠ পেতে দিলে। দশ ঘা জুতো জেলের পিঠে পড়বামাত্র , জেলে ‘ মশাই! একটু থামুন , আমার একজন অংশীদার আছে , বাকি দশ ঘা সেই খাবে , সে আপনার দরওয়ান , দরজায় বসে আছে , তারে ডেকে পাঠান , আমি যখন বাড়ির ভিতর মাচ নিয়ে আসছিলাম , তখন মাছের আদ্দেক দাম না দিলে আমারে ঢুকতে দেবে না বলেছেল , সুতরাং আমিও আদ্দেক বক্রা দিতে রাজী হয়েছিলাম।’ কর্মকর্তা তখন বুঝতে পাল্লেন , জেলে কি জন্যে মাছের দাম বিশ ঘা জুতো চেয়েছিল। দরওয়ানজীকে দরজায় বসে আর অধিক্ষণ জেলের দামের বক্রার জন্যে প্রতিক্ষে করে থাকতে হল না ; কর্মকর্তা তখনি দরওয়ানজীকে জেলের বিশ ঘার অংশ দিলেন। পাঠক বড় মানুষেরা ! এই উপন্যাসটি মনে রাখবেন।

    হুজুর দেড় হাত উঁচু গদির উপরে তাকিয়ে ঠেস দিয়ে বসে আছেন , গা আদুড় ! সামনে মুন্‌শী মশায় চশমা চোকে দিয়ে পেস্কারের সঙ্গে পরামর্শ কচ্ছেন – সামনে কতকগুলো খোলা খাতা ও একঝুড়ি চোতা কাগজ , আর এক দিকে চার-পাঁচজন ব্রাহ্মণ পন্ডিত বাবুকে ‘ ক্ষণজন্মা ’‘ যোগভ্রষ্ট ’ বলে তুষ্ট করবার অবসর খুঁজছেন। গদির বিশ হাত অন্তরে দু-জন বেকার ‘ উমেদার ’ ও একজন বৃদ্ধ ‘ কন্যাদায় ’ কাঁদ কাঁদ মুখ করে ঠিক ‘ বেকার ’‘ কন্যাদায় ’ হালতের পরিচয় দিচ্চেন। মোসাহেবরা খালি গায়ে ঘুরঘুর কচ্চেন , কেউ , হুজুরের কানে কানে দু-চার কথা কচ্চেন – হুজুর ময়ূরহীন কার্তিকের মত আঢ়ষ্ট হয়ে বসে রয়েছেন। দত্ত বাবু গিযে নমস্কার কল্লেন।

    হুজুর বারৈয়ারি পূজোর বড় ভক্ত , পূজোর ক-দিন দিবারাত্রি বারৈয়ারিতলাতেই কাটান , ভাগ্নে , মোসাহেব , জামাই ও ভগিনীপতিরা বারৈয়ারির জন্যে দিবারাত শশব্যস্ত থাকেন।

    দত্ত বাবু বারৈয়ারি বিষয়ক নানা কথা কয়ে হুজুরি সবিস্ক্রিপশন হাজার টাকা নিয়ে বিদেয় নিলেন , পেমেন্টের সময় দাওয়নজী শতকরা দু-টাকার হিসাবে দস্তরি কেটে ন্যান , দত্তজা ঘরপোড়া কাটের হিসাবেও দাওয়ানজীকে খুশি রাখবার জন্যে তাতে আর কথা কইলেন না। এদিকে বাবু বরৈয়ারি পূজোর ক-রাত্তির কোন কোন রকম পোশাক পরবেন , তারই বিবেচনায় বিব্রত হলেন
    কানাইবাবু বারৈয়ারি বই নিয়ে না খেয়ে বেলা দু-টো অবধি নানা স্থানে ঘুরলেন , কোথাও কিছু পেলেন , কোথাও মস্ত টাকা সই মাত্র হল। ( আদায় হবে না , তার ভয় নাই ) , কোথাও গলা ধাক্কা , তামাসা ও ঠোনাটা ঠানাটাও সইতে হল।

    বিশ বচ্ছর পূর্বে কলকেতায় বারৈয়ারি চাঁদা-সাধারা প্রায় দ্বিতীয় অষ্টমের পেয়াদা ছিলেন – ব্রহ্মোত্তর জমির খাজনা সাধার মত লোকের উনোনে পা দিয়ে টাকা আদায় কত্তেন – অনেকে চোটের কথা কয়ে বড় মানে্‌ষদের তুষ্ট করে টাকা আদায় কত্তেন।

    একবার এক দল বারৈয়ারি একচক্ষু কানা এক সোনারবেনের কাছে চাঁদা আদায় কত্তে যান। বেনেবাবু বড়ই কৃপণ ছিলেন , বাবার ‘ পরিবারকে ’ ( অর্থাৎ মাকে ) ভাত দিতেও কষ্ট বোধ কত্তেন , তামাক খাবার পাতের শুকনো নলগুলি জমিয়ে রাখতেন , এক ব্‌ৎসরের হলে ধোবাকে বিক্রি কত্তেন , তাতেই পরিবারের কাপড় কাচার দাম উসুল হত। বারৈয়ারির অধ্যক্ষেরা বেনেবাবুর কাছে চাঁদার বই ধল্লে তিনি বড়ই রেগে উঠলেন ও কোন মতে এক পয়সাও বারৈয়ারিতে বেজায় খরচ কত্তে রাজী হলেন না , বারৈয়ারি অধ্যক্ষেরা অনেকক্ষণ ঠাউরে ঠাউরে দেখে্‌লন , কিন্তু বাবুর বেজায় খরচের কিছুই নিদর্শন পেলেন না – তামাক গুলি পাকিয়ে কোম্পানির কাগজের সঙ্গে বাক্স মধ্যে রাখা হয় – বালিশের ওয়াড় , ছেলেদের পোশাক , বেনেবাবু অবকাশমত স্বহস্তেই সেলাই করেন – চাকরদের কাছে ( একজন বুড়ো উড়ে মাত্র ) তামাকের গুল , মুড়ো খেংরার দিনে দু-বার নিকেশ নেওয়া হয় – ধুতি পুরনো হলে বদল দিয়ে বাসন কিনে থাকেন – বেনেবাবুর ত্রিশ লক্ষ টাকার কোম্পানির কাগজ ছিলো , এ সওয়ায় তার সুদ ও চোটায় বিলক্ষণ দশ টাকা আসতো , কিন্তু তার এক পয়সা খরচ কত্তেন না। ( পৈত্রিক পেশা ) খাঁটি টাকায় মাকু চালিয়ে যা রোজগার কত্তেন , তাতেই সংসার নির্বাহ হত ; কেবল বাজে খরচের মধ্যে একটা চক্ষু , কিন্তু চশমায় দু-খানি পরকোলা বসানো ; তাই দেখে বারৈয়ারি অধ্যক্ষেরা ধরে বসলেন , ‘ মশাই ! আপনার বাজে খরচ ধরা পড়েছে , হয় চশমাখানির একখানি পরকোলা খুলে ফেলুন , নয় আমাদের কিছু দিন।’ বেনেবাবু এ কথায় খুশি হলেন , শেষে অনেক কষ্টে দু-টি সিকি পর্যন্ত দিতে সম্মত হয়েছিলেন।
    আর একবার একদল বারৈয়ারি পূজোর অধ্যক্ষ শহরের সিঙ্গি বাবুদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত , সিঙ্গিবাবু সে সময় আপিসে বেরুচ্ছিলেন , অধ্যক্ষরা চার-পাঁচজনে তাকে ঘিরে ধরে ‘ ধরেছি ’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তায় লোক জমে গেল। সিঙ্গিবাবু অবাক – ব্যাপারখানা কি ? তখন একজন অধ্যক্ষ বললেন , ‘ মহাশয় ! আমাদের অমুক জায়গার বারৈয়ারি পূজোয় মা ভগবতী সিঙ্গির উপর চড়ে কৈলাশ থেকে আসি্‌ছলেন পথে সিঙ্গির পা ভেঙে গ্যাছে ; সুতরাং তিনি আর আসতে পাচ্চেন না , সেইখানেই রয়েচেন ; আমাদের স্বপ্ন দিয়েচেন যে , যদি আর কোন সিঙ্গির যোগাড় কত্তে পার , তা হলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয় ! আমরা আজ এক মাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্চি , কোথাও আর সিঙ্গির দেখা পেলাম না ; আজ ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেয়েচি , কোন মতে ছেড়ে দেবো না – চলুন ! যাতে মার আসা হয় , তারই তদ্বির করবেন।’ সিঙ্গিবাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বারৈয়ারি চাঁদায় বিরক্ষণ দশ টাকা সাহায্য কল্লেন।
    এ ভিন্ন বারৈয়ারি চাঁদা সাধার বিষয়ে নানা উদ্বট কথা আচে , কিন্তু এখানে সে সকল উত্থাপন নিÖপ্রয়োজন। পূর্বে চুঁচড়োরমত বারৈয়ারি পুজো আর কোথাও হত না , ‘ আচাভো ’‘ বোম্বাচাক ’ প্রভৃতি সং প্রস্‌ত্‌তত হত ; শহরের ও নানা স্থানের বাবুরা বোট , বজরা , পিনেস ও ভাউলে ভাড়া করে সং দেখতে যেতেন ; লোকের এত জনতা হত যে , কলাপাত এক টাকায় একখানি বিক্রি হয়েছিল , চোরেরা আন্ডিল হয়ে গিয়েছিল , কিন্তু গরীব দু:খী গেরস্তোর হাঁড়ি চড়েনি। গুপ্তিপাড়া , কাঁচড়াপাড়া , শান্তিপুর , উলো প্রভৃতি কলকেতার নিকটবর্তী পল্লীগ্রামে ক-বার বড় ধুম করে বারৈয়ারি পূজো হয়েছিল । এতে টক্করাটক্করিও বিলক্ষণ চলেছিল। একবার শান্তিপুরওয়ালারা পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে এক বারৈয়ারি পূজো করেন ; সাত ব্‌ৎসর ধরে তার উজ্জুগ হয় , প্রতিমেখানি ষাট হাত উঁচু হয়েছিল , শেষে বিসর্জনের দিনে প্রত্যেক পুতুল কেটে কেটে সির্জন কত্তে হয়। তাতেই গুপ্তিপাড়াওয়ালারা ‘ মার ’ অপঘাত মৃত্যু উপলক্ষে গনেশের গলায় কাচা বেঁদে এক বারৈয়ারি পূজো করেন , তাতেও বিস্তর টাকা ব্যয় হয়।

    এখন আর সে কাল নাই ; বাঙালী বড় মানুষদের মধ্যে অনেকে সভ্য হয়েছেন। গোলাপজল দিয়ে জলশৌচ , ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিড়ে পরা , মুক্তাভস্মের চুন দিয়ে পান খাওয়া আর শোনা যায় না। কুকুরের বিয়েয় লাখ টাকা খরচ , যাত্রায় নোট প্যালা , তেল মেখে চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান কত্তে যাওয়া শহরে অতি কম হয়ে পড়েচে। আজ্ঞা হুজুর , উঁচুগতি কার্তিকের মত বাউরি চুল , এক পাল বরাখুরে মোসাহেব , রক্ষিত বেশ্যা আর পাকানো কাছা – জলস্তম্ভ আর ভূমিকম্পোর মত ‘ কখনোর ’ পাল্লায় পড়েছে।

    কায়স্থ ব্রা‏‏হ্মণ বড় মানুষ ( পাড়াগেঁয়ে ভূতেরা ছাড়া ) প্রায় মাইনে করা মোসাহেব রাখেন না ; কেবল শহরে দু-চার বড় মানুষই মোসাহেবদের ভাগ্যে সুপ্রসন্ন। বুক ফোলানো , বাঁকা সিঁতি , পইতের গোচ্ছা গলায় , কুঁচের মত চক্ষু লাল , কানে তুলোয় করা আতর ( লেখা পড়া সকল রকমই জানেন , কেবল বিস্মৃতিক্রমে বর্ণ পরিচয়টি হয়নাই ) আমরা খালি সোনারবেনে বড় মানুষ বাবুদের মজলিসে দেখে্‌ত পাই।
    মোসাহেবী পেশা উঠে গেলেই , ‘ বারৈয়ারি ’‘ খ্যামটা ’‘ চোহেল ’‘ ফর্‌রার ’ লাঘব হবে সন্দেহ নাই!

    সন্ধ্যা হয় হয় হয়েচে – গয়লারা দুধের হাঁড়া কাঁদে করে দোকানে যাচ্চে। মেচুনীরে আপনাদের পাটা , বঁটি ও চুবড়ি ধুয়ে প্রদীপ সাজাচ্চে। গ্যাসের আলো জ্বালা মুটেরা মই কাঁদে করে দৌড়চ্চে – থানার সামনে পাহারাওয়ালাদের প্যারেড ( এঁরা লড়াই করেন কিন্তু মাতাল দেখে ভয় পান ) হয়ে গিয়েচে। ব্যাঙ্কের ভেতো কেরানীরে ছুটি পেয়েচেন। আজ এ সময় বীরকৃষ্ণ দাঁর গদিতে বড় ধুম – অধ্যক্ষেরা একত্র হয়ে কোন কোন রকম সং হবে , কুমোরকে তারই নমুনো দেখাবেন ; কুমোর নমুনো মত সং তৈরি করবে ; দাঁ মহাশয় ও ম্যানেজার কানাইধন দত্তজা নমুনোর মুখপাত!

    ফৌজদুরী বালাখানা থেকে ভাড়া করে এনে কুড়িটি বেল লালঠন ( রং বেরং – সাদা , গ্রীন , লাল ) টাঙানো হয়েচে। উঠোনে প্রথমে খড় তার উপর দরমা , তার উপর মাদ্রাজী খেরোর জাজিম হাসে্‌চ। দাঁড়িপাল্লা , চ্যাটা , কুলো ও চালুনীরে , গনি ব্যাগ ও ছেঁড়া চটের আশপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মাচ্চে – আজ তারা ঘরজামাই ও অন্নদাস ভাগ্নেদের দলে গণ্য!

    বীরকৃষ্ণবাবু ধূপছায়া চেলীর জোড় ও কলার কপ ও প্লেটওয়ালা ( ঝাড়ের গোলাপের মত ) কামিজ ও ঢাকাই ট্যারচা কাজের চাদরে শোভা পাচ্চেন , রুমালটি কোমরে বাঁদা আছে – সোনার চাবির শিকলী কোঁচা কামিজের উপর ঘড়ির চেনের অফিশিয়েটিং হয়েচে।

    পাঠক ! নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মত অস্ত গেল। মেঘান্তের রৌদ্রের মত ইংরাজদের প্রতাপ বেড়ে উঠে্‌লা। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হল। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। নবো মুন্সি , ছিরে বেনে , ও পুঁটে তেলি রাজা হলো। সেপাই পাহারা , আসা সোঁটা ও রাজা খেতাব , ইন্ডিয়া রাবারের জুতো ও শান্তিপুরে ডুরে উড়ুনির মত , রাস্তায় পাঁদাড়ে ও ভাগাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগলো। কৃষ্ণচন্দ্র , রাজবল্লভ , মানসিংহ , নন্দকুমার , জগ্‌ৎশেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্নে যেতে লাগ্লো , তাই দেখে হিন্দুধর্ম , কবির মান , বিদ্যার উৎসাহ , পরোপকার ও নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালালো। হাফ আখড়াই , ফুল আখড়াই , পাঁচালী ও যাত্রার দলেরা জন্ম গ্রহন কল্লে। শহরের যুবকদল গোখুরী , ঝকমারী ও পক্ষীর দলে বিভক্ত হলেন। টাকা বংশগৌরব ছাপিয়ে উঠে্‌লন। রামা মুদ্দফরাস , কেষ্টা বাগ্‌দী , পেঁচো মল্লিক ও ছুঁচো শীল কল্কেতার কায়েত বামুনের মুরুববী ও শহরের প্রধান হয়ে উঠলো। এই সময়ে হাফ আখ্‌ড়াই ও ফুল আখ্‌ড়াই সৃষ্টি হয় ও সেই অবধি শহরের বড় মানুষরা হাফ আখ্‌ড়াইয়ে আমোদ কত্তে লাগলেন। শ্যামবাজার , রামবাজার , চক ও সাঁকোর বড় বড় নিষ্কর্মা বাবুরা এক এক হাফ আখ্‌ড়াই দলের মুরুববী হলেন। মোসাহেব , উমেদার , পাড়া ও দলস্থ গেরস্তগোছ হাড়হাবাতেরা শৌখীন দোহারের দলে মিশলেন। অনেকের হাফ আখ্‌ড়াইয়ের পুণ্যে চারটি জুটে গেল। অনেকে পুজুরী দাদাঠাকুরের অবস্থা হতে একেবারে আমীর হয়ে পড়লেন – কিছু দিনের মধ্যে তক্মা , বাগান , জুড়ি ও বালাখানা বনে গেল।

    আমরা পূর্বে পাঠকদের যে বারৈয়ারি পূজোর কথা বলে এসেচি , বীরকৃষ্ণ দাঁর উজ্জুগে প্রথম রাত্তির বারৈয়ারিতলায় হাফ আখ্‌ড়াই হবে , তার উজ্জুগ হচ্চে।

    ধোপাপুকুর লেনের দুইয়ের নম্বর বাড়িটিতে হাফ আখ্‌ড়াইয়ের দল বসেচে – বীরকৃষ্ণবাবু বগি চড়ে প্রত্যহ আড্ডায় এসে থাকেন – দোয়াররা কুঠি থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে জলযোগ করে রাত্তির দশটার পর একত্রে জমায়েত হন – ঢাকাই কামার , চাষা ধোপা , পুটে তেলি ও ফলারে বামুনই অধিক। মুখুয্যেদের ছোট বাবু অধ্যক্ষ। ছোট বাবু ইয়ারের টেক্কা , বেশ্যার কাছে চিড়িয়ার গোলাম ও নেশায় শিবের বাবা ! শরীর ডিগডিগে ; পইতে গোচ্ছা করে গলায় , দাঁতে মিশি , প্রায় আধ হাত চেটালো কালো ও লালপেড়ে চক্রবেড়ের ধুতি পরে থাকেন। দেড় ভরি আফিম , দেড়’শ ছিলিম গাঁজা ও এক জালা তাড়ি রোজকী মৌতাতের উটনো বন্দোবস্ত। পালপার্বণে ও শনিবারে বেশী মাত্রায় চড়ান!
  • ad | 223.223.129.158 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১৩:০৭527731
  • আমি এই গুলো খুলনা জার্নালে পেয়েচি! তাই ওখান থেকে কপু, পেস্টা করচি! পড়তে সুবিদে হবে!
  • siki | 123.242.248.130 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১৪:৩৪527732
  • এডি, ধরে নিচ্ছেন কেন এখানে হুতোম প্যাঁচার নকশা কারুর পড়া নেই? বেকার খাটনি খাটছেন।
  • kallol | 119.226.79.139 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১৬:১৮527733
  • পুরোনো মানে কত পুরোনো। কালী সিংগীর আমল হয় তো কালী সিংগী আছেন আর আছেন অরুণ নাগ। কালী সিংগীবাবু তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অরুণবাবুর কলম অক্ষয় হোক।
    মহাভারতের টইতে অরুণবাবুর পুরাতঙ্কÄ নিয়ে একটা লেখা তোলার ইচ্ছে আছে।
    গত শতাব্দীর ৭০ দশকের কলকাতা কি পুরোনো বলে গণ্য হবে? তখনকার ফ্যাৎরা ফচকেদের নেশা ভাং চলবে কি?
  • EL d | 220.227.106.153 | ০২ জানুয়ারি ২০১২ ১৬:২১527734
  • ad হুতুম থেকে আরো আরো কপি পেষ্ট করুন

    আমি ইন্টেলেকচুয়ালি চ্যালেঞ্জড আমার পড়া নেই ,এখানে পড়তে হেব্বি লাগছে প্লিজ থামবেন না
  • achintyarup | 59.93.254.228 | ০৩ জানুয়ারি ২০১২ ০৪:৪২527735
  • হুতোমের নক্সা বাজারে আসে ১৮৬২ সালে। তার সাত বছর পর বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে ছাপা হয়ে বেরোয়

    কলিকাতার নুকোচুরি।
    The
    Mysteries Of Society In
    Calcutta.

    Vol. 1.

    By

    Tek Chand Thakoor, Junior


    নামপত্রে শেক্সপীয়র কোট করা:
    Hear me a little;
    For I have only been silent so long.


    কি উদ্দেশ্যে এ কেতাব লেখা হয়েছিল তা ভূমিকাতেই মোটামুটি পরিষ্কার:

    এমত সময়ে সল্টওয়াটারের নবাব পোর্ট কেনিং সহরে একটি চিড়িয়াখানা করিলেন। দেশ বিদেশ হইতে নানা প্রকার পশুপক্ষি ও অন্যান্য দ্বিপদ চতুষ্পদ জানোয়ারের আমদানি হইতে লাগিল, অধিক কি বলিব যাহা ন্যাচুরেল হিস্ট্রিতে নাই, তাহাও আমদানি হলো! যদি পাঠক মহাশয়রা জিজ্ঞাসা করেন সেটা কি? উত্তর -- ""হুতুম প্যাঁচা''। সকলেই জানেন, যে কেবল কালপ্যাঁচা আর লক্ষ্মীপ্যাঁচা আছে; কিন্তু এ নবাব হুতুম প্যাঁচা কোথা হইতে আমদানি করিয়াছেন, এই দেখতে লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল। চিরস্থায়ী কিছুই নয়! ক্রমে পোর্ট কেনিং হ্রাস হইতে লাগিল, ঘরাহ বিচ্ছেদ হইয়া, সুইনোর রামরাজত্ব হইল, সেয়ারের দর দিন দিন কমতে লাগিল, মোকদ্দমা সুরু হল, ডিবেঞ্চর ডিউ হল, এবং নবাবও চিড়িয়াখানার দরজা খুলিয়া দিলেন। হুতুম প্যাঁচা গোটা কতক দাঁড়কাকের সঙ্গে ক্যাঁ, ক্যাঁ, করতে করতে কলিকাতায় আসিয়া কাশীমিত্রের ঘাটে বাসা করিল। দিন কতক নতুন ২ সকলেই দেখিতে গেল, অবশেষে ধরা পড়ে আর উড়তে পারলে না। ঈশ্বরদত্ত ডানা না হলে তো আর ওড়া যায় না; ধার করে তো পুচ্ছ নিয়ে ময়ূর হওয়া যায় না? আর যদি হয়, তো সে কদিনের জন্য?
  • achintyarup | 59.93.254.228 | ০৩ জানুয়ারি ২০১২ ০৫:৩৭527736
  • তো, এই টেকচাঁদ ঠাকুর জুনিয়র (চুনীলাল মিত্র) মশাইয়ের বইয়ে প্যাঁচা যে ঘুরে ফিরে বারবার আসবে সে কথা আর বলে দিতে হবে না।
    যেমন ধরুন,

    কলিকাতায় মদ খান না এমত অতি অল্প লোক আছে, বাকির মধ্যে শালগ্রাম ঠাকুর, প্যাঁচার বুড়ো ঠান্‌দিদি ও টেকচাঁদ ঠাকুরের টেপি পিসি, আর জনকতক মাত্র।

    তারপরে ধরুন, এক আবদারে বাবুর কথা বলা হয়েছে, যিনি নাবালক, পিতৃহীন, হাতে বিষয় পড়েনি, মরণ বাঁচন এক্‌জিকিউটারের হাতে, টাকার জন্যে মায়ের উপর ভারি তম্বি করেন।

    সেই সময়ে আবার অভিনয়ের আমোদ বেড়ে উট্‌লো, কতকগুলো বায়ুত্তরে গোচ ছেলে এসে জুটলো, নাটক না হতে হতেই সূত্রমুখে চরস সূত্রধর হয়ে দেখা দিলেন, দুদিন চাদ্দিন পরে তাহা ভাল বিবেচনা না হতে, গাঁজাকে তৎপদে নিয়োগ কোল্লেন। ফলে চরসকেও চটালেন না। দুইই চোলতে লাগলো। আবদারে বাবু চরসের নাম রাবণ আর গাঁজার নাম রাম রাখলেন। যখন যে বিষয়ের ইচ্ছে হোতো, রামকে কি রাবণকে ডাক বোল্লে অমনি এডিক্যাম্প বাবুরা চরস কি গাঁজা সেজে তয়েরি কোত্তো। শেষে রঙ্গ ভূমিতে সুরা রূপা নটী দেখা দিলেন, তাঁর ভাব ভঙ্গিতে আবদারে বাবু মোহিত হয়ে গেলেন।

    অনেক কথা লেখা আছে নুকোচুরি বইতে, এই আবদারে বাবুকে নিয়ে:

    কিছুদিন পরেই বয়েস প্রাপ্ত হোলো। বাপের বিষয় পেতে আর ধুমধামের পরিসীমা ছিল না। যখন যা মনে আসে তাই করেন। কখন হোটেলের খানা আনিয়ে আমোদ আহ্লাদ কচ্চেন, কখন তেলেভাজা ফুলরি বেগ্‌নির সহ রকমারি নিয়ে ইয়ারকি দিচ্চেন। আজ স্যাম্‌পেন ঢালোয়া -- কাল ব্রাণ্ডির মোচ্ছব -- পরশু পাঁচ রকম মদ দিয়ে পঞ্চ্‌ কচ্চেন। বাঁদি নেসা না হলে কখন বা মদের সঙ্গে, লডেনম্‌, ও মরফিয়া মিশাচ্চেন। পাঁচ ইয়ারির দল হলেই পাঁচ রকম লোক এসে যোটে। কোথাও ভটচাজ্জির টিকি কেটে সন্দেশের সঙ্গে ফ্যান্সি বিষকুট দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কাহাকে ডাবের জলে এমিটিক দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কেহ নেশায় অচেতন হয়ে পোড়ে আছে। কোথায় কেহ হাত পা আছড়াচ্চে, কোথাও কেহ গড়াগড়ি দিচ্চে, কোথাও কেহ বমি কোচ্চে, কোথাও কেহ দুটো হাত তুলে ইংরাজী লেকচার দিচ্চে, কোথাও কেহ বাঙ্গালায় বক্তৃতা কোচ্চে।

    এইখানে ১৮৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সোমপ্রকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত এক টুকরো খবর টুকে দিই:

    বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহের চীৎপুরের বাগানে এক ব্যক্তি মদ্যে নেশা হয় না বলিয়া তাহাতে মরফিয়া (অহিফেনসার) মিশ্রিত করিয়া খাইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে। এতৎ সংক্রান্ত এইরূপ একটি ভয়ঙ্কর জনরবও উঠিয়াছিল যে কালীপ্রসন্ন বাবু রঙ্গ দেখিবার নিমিত্ত মদে মরফিয়া মিশাইয়া দিয়াছিলেন।...পরিতাপের কারণ এই, কালীপ্রসন্ন বাবু হইতে বঙ্গদেশের অনেকবিধ উপকার লাভ হইতেছে, তাঁহার আলয়ে এরূপ একটী অনর্থকর কুৎসিত ঘটনা হইল! শান্তি রক্ষকেরা তাঁহার প্রতি সন্দেহ করাতে তাঁহার বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনাও হইয়াছিল। আহ্লাদের বিষয় এই যে তিনি নির্দ্দোষী হইয়াছেন।
  • ranjan roy | 14.97.190.94 | ০৩ জানুয়ারি ২০১২ ১৭:০২527737
  • কেসি,
    আমার দুই ফেবারিট হুতোম ও বদ্যিবুড়িকে এখানে আনতে পারলে আমার তরফে পার্টি :)))))।
  • achintyarup | 115.111.248.6 | ০৩ জানুয়ারি ২০১২ ১৮:০৯527738
  • হুতোম কোথায়? তেনার নাম তো আবার হুতুম
  • ranjan roy | 14.97.62.152 | ০৩ জানুয়ারি ২০১২ ১৯:২৯527740
  • হক কথা। আসলে ওনারা হলেন প্রো বৈ চ আর দময়ন্তী। বহুদিন এপাড়ায় আসেন না, তবু আশায় আছি। আশায় বাঁচে চাষা।
  • siki | 123.242.248.130 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ১০:৩৩527741
  • এটা আর এগলো না কেন?
  • kallol | 119.226.79.139 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ১৩:১০527742
  • এগুচ্ছেই না যখন, তখন ততো পুরোনো নয় কলকাতার নেশা ভাঙ্গ চলুক।
    আমাদের তখন কলেজ বেলা। সেটা ১৯৭৩।
    বাড়ি থেকে হেঁটেই সুইস পার্কের মধ্যে দিয়ে মুটেপাড়ার মোড়ে এসে দাদুর দোকান থেকে ভুর্‌রা কিনতুম। ভুর্‌রা হলো কমদামী দেশী গাঁজা। যাতে চিরল চিরল পাত ছাড়াও ডাঁটি ও বীজ থাকতো। ভালো গাঁজা কেনার মুরোদ আমাদের পকেটের ছিলো না। কচিৎ কেউ নিয়ে আসতো সদর স্ট্রিটে ববের ঠেক থেকে, আফগানী বা নেপালী মাল।
    সে যাগ্গে। আমরা পুরিয়া হিসাবে কিনতাম। পুরিয়া ২৫ পয়সা। তারপর ঢাকুরিয়া লেকের ব্রিজের বাঁদিকে কেয়া ঝোপের পাশের বেঞ্চে বসে গাঁজা দুরস্ত করা হতো। প্রথমে পুরিয়া খুলে বাঁ হাতের তেলোয় নিয়ে খৈনীর মতো ডলতে ডলতে বীজ ও ডাঁটি ফেলে দেওয়া হতো। বীজ ফেলাটা সোজা। ডাঁটি ফেলার সময় নজর রাখতে হতো ডাঁটির সাথে যেন এক কুচি পাতাও না চলে যায়। ডলতে ডলতে যখন গাঁজা প্রায় পাউডার হয়ে আসতো, তখন সিগারেট নিয়ে পড়া হতো।
    আমরা গাঁজার জন্য ফিল্টার সিগারেট পছন্দ করতাম। তাতে পেছন দিক দিয়ে গাঁজা পড়ে না যায়, আর গাঁজার শেষ কুচিটুকুও যেন নষ্ট না হয়। তবে ফিল্টার সিগারেটের বড্ডো দাম, তাই যত সম্ভব কমদামী ফিল্টার সিগারেট কেনা হতো। গাঁজার দেবতা আমাদের কষ্ট বুঝলেন ও বাজারে বাংলাদেশী ফিল্টার সিগারেট ছড়লেন। নাম মুক্তি, দাম এক প্যাকেট (১০টা) ৩০ পয়সা। তো, মুক্তি কিনে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী এই দুই আঙ্গুলে ফিল্টারের দিক থেকে ধরে ধীরে ধীরে ঘোরাতে ঘোরাতে তামাক ফেলে দেওয়া হতো। শুধু ফিল্টারের গায়ে লাগা সামান্য একটু তামাক রেখে দেওয়া হতো। খুব সাবধানে এটা করতে হতো, যাতে সিগারেটের পাতলা কাগজ না ছিঁড়ে যায়। তামাক ফেলা হয়ে গেলে বাঁ হাতের তেলোয় রাখা পাউডার হয়ে যাওয়া গাঁজার ওপর খালি সিগারেটের মুখ রেখে ফিল্টারের দিক ঠোঁটে চেপে দম টেনে সে গাঁজা ভিতরে ঢোকানো হতো। মাঝে মাঝে আবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী দুই আঙ্গুল দিয়ে সিগারেটের পেটের কাছে (যতটা গাঁজা ভরা আছে, তার ঠিক উপরথেকে) ঘোরাতে ঘোরাতে টাইট করে নেওয়া হতো, যাতে টানার সময় ঝুর ঝুরে হয়ে পড়ে না যায়।
    এই ভাবে পুরো পুরিয়া একটা সিগারেটে চলে আসতো। এরপর সিগারেটের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হতো।
    তারপর টানা শুরু। কেউ কলকের মতো মুদ্রায়, কেউ পুরোনো আমলের কাপ্তানদের মতো মুঠো করে, কেউ চলতি সাধারণ সিগারেট খাওয়ার কায়দায় টানতো। স্টাইল আপনা আপনা। ধোঁয়া অনেকক্ষণ ধরে রাখা হতো, তারপর আস্তে আস্তে ছাড়া হতো।
    মোটামুটি পাঁচ ছয় টানে নেশা শুরু হতো। এক পুরিয়ায় ঘন্টা দুয়েকের মতো ধুমকী হতো। ধুমকীর মাত্রা বাড়াতে মিষ্টি খাওয়া হতো। মিষ্টি মানে, এক পয়সার গোল গোল লজেন্স।

  • aka | 75.76.118.96 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ১৭:৩৭527743
  • শুনেছি একটু জিভের ডগায় সিগ্রেটটা বুলিয়ে নিলে নাকি বেশিক্ষণ জ্বলত? সত্যি কল্লোলদা?
  • maximin | 59.93.246.171 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ১৮:৫৪527744
  • এই পুরিয়া এখনও আছে। একই পদ্ধতিতে বানানো হয়।
  • kallol | 115.184.9.50 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ২১:০৯527745
  • আমি কখনো চেষ্টা করিনি। তবে অনেকে বলতো। আমি করিনি কারন বেশীক্ষণ বা কমক্ষণ, তাতে কিই বা আসে যায়। এক পুরিয়া ধোঁয়া হবে, কতক্ষণে তাতে আমার কি?
  • siki | 122.177.189.106 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ২১:৪৬527746
  • এ তো ন্যাচারাল ব্যাপার। জলে ভিজিয়ে নিলে ধুপ একটু বেশিক্ষণ জ্বলে।
  • r2h | 198.175.62.19 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ২২:১২527747
  • আমাদের সময় ছিল পুরিয়া সাতটাকা, আনোয়ারশা মোড় থেকে টালিগঞ্জ ফাঁড়ি যেতে মসজিদের উল্টোদিকের ফুটপাথ। আর আমি কিনা ছবি ছাবা আঁকতাম, তাই বন্ধুবর্গের বিশ্বাস ছিল আমি বানালে জিনিসটা খুব সূক্ষ্ম ও শিল্পসম্মত হবে।
  • sda | 117.194.203.140 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:১৭527748
  • টেকনোপলিসের কাছে জনৈক মাসির চায়ের দোকানে পাওয়া যেত (এখনো নিশ্চয়ই যায়, বেশিদিন আগের কথা নয়)। বিড়ির প্যাকেটের সাইজের প্লাস্টিকের পাউচ ভর্তি, দাম তিরিশ মুদ্রা। আমরা খেতুম ক্যাপস্টানের সিগারেট পেপারে মুড়িয়ে, সঙ্গে একটু তামাক মিশিয়ে। নেশা চড়ানোর জন্য এক্লেয়ার্স চকোলেট। কলেজের ছাতে আসর বসতো , সিকিউরিটির লোকজন বাওয়াল দিতো, তাও মাঝেসাঝে বিড়ি-সিগারেট খাইয়ে সে সব ম্যানেজ হত। তবে সে গাঁজা রসিকজনের পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়, কল্লোলদা যেমন বললেন , বীজ ইত্যাদিতে ভর্তি।
    সত্যিকারের ভালো গাঁজা খেয়েছিলুম বোলপুর বেড়াতে গিয়ে। এক সাধুবাবাকে অনেক সাধাসাধি করে যোগাড় হয়েছিল প্রায় ডবল দাম দিয়ে। সে বস্তু কলকেতে ভরে টেনে (তৎসহ এক এক নিপ ওল্ড মংক) তিন বন্ধু প্রায় ৭-৮ ঘন্টা উল্টে পড়েছিলাম। কি ভাগ্যিস মাথার উপর একটা ছাদ এর বন্দোবস্তো ছিল।
    সেই দিনগুলোকে বড্ড মিস করি। এখন শুক্রবার অফিস ফেরত এক ক্যান বিয়ার (যা কিনা জলের সমান মনে করতাম এক সময়) খেয়ে কোনক্রমে পিত্তিরক্ষে। পালে-পার্বণে অলিপাব গোছের "পলিটিক্যালি কারেক্ট" যায়গায় অশ্লীলরকম চড়া দাম দিয়ে দুয়েক পেগ ভদকা। ভাল্লাগে না।
  • aka | 168.26.215.13 | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ২৩:৪৫527749
  • আমাদের সময় কলেজ স্ট্রীটে বাছা বাছা চায়ের দোকানে ৫ টাকা পুরিয়া/বস্তা পাওয়া যেত। আর প্রমোদের ক্যান্টিনের ভেতরের ঘর তো ছিলই। চোখ দেখে বোঝা যেত কার তখন ধুমকি চলছে।
  • Update | 168.26.215.13 | ০৬ জানুয়ারি ২০১২ ০০:০৫527751
  • Name:takaaiMail:Country:

    IPAddress:139.124.3.100Date:05Jan2012 -- 11:45PM

    দুর কি সব হিজিবিজি নেশা, নেশা হল রাবড়ির। খালি একটাই অসুবিধে বেশি খেলে পৈটিক সমস্যা হয়।

    --------------------------------------------------------------------------------

    Name:maximinMail:Country:

    IPAddress:59.93.246.171Date:05Jan2012 -- 11:57PM

    কালীপ্রসন্ন সিংহ পোস্ট করার জন্যে এডিকে ধন্যবাদ জানাই।

  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন