এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • মিশনের ধুপছায়া দিনগুলি

    ranjan roy
    অন্যান্য | ২৪ মে ২০১২ | ৪০৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • ranjan roy | 24.99.158.53 | ২৫ মে ২০১২ ০০:০৪552356
  • ( ভুল বুঝবেন না, এটি মিশনের বা কোন মিশনারি শিক্ষাব্যবস্থার ভ্যালুয়েশন নয়; সে ইচ্ছে বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। পাঁচবছর ধরে কিশোরবয়সে হস্টেলে থাকার টক-ঝাল-মিষ্টি স্মৃতি আমার সম্পদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে ক'টি প্রতিষ্ঠান শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, মিশন তাঁর অন্যতম। এর সাফল্য-সীমাবদ্ধতা-বিফলতা সময় বলবে। পঞ্চাশ বছর পরে আজকের মিশনের হস্টেলের জীবন নিশ্চয়ই সময়ের চাপে অনেক বদলেছে, যেমন বদলেছে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক জীবন। আমার দায় শুধু গভীর ভালবাসায় তেরো-চৌদ্দো বছরের চোখে ধরে রাখা স্মৃতির জলছবি আঁকা। এখানে যে কুশীলবদের কথা বলা হয়েছে তাঁদের অনেকে প্রয়াত, কিন্তু অনেকে আমার মতই বুড়ো, কিন্তু দিব্যি বেঁচে বর্তে আছেন। তাই কিছু নাম বদলে দিয়েছি। নিশানের লেখা দেখে এবং মণীশের বার খেয়ে সাহস করে লিখছি। তবে আমাকে গুরুরা যখনই থামতে বলবেন, থেমে যাব। )
  • ranjan roy | 24.99.158.53 | ২৫ মে ২০১২ ০০:৩৪552367
  • ১)
    ২০১০ এর জানুয়ারি, সরস্বতী পূজোর সেই দিনটি
    --------------------------------------------------
    ওরা পাঁচজন। সওয়ার হয়েছে একটা ভাড়া করা চারচাকায়।
    ওদের ছোটবেলা কেটেছে দক্ষিণ কোলকাতায়। গাড়ি এগিয়ে চলেছে খান্না সিনেমা, টালা পার্ক, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ। গল্পে গল্পে এসে গেল সিঁথির মোড়। গাড়ি এগিয়ে গেল ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের বিদ্যামন্দির। ওরা হৈ-হৈ করে ওঠে। সেবার আমরা এদের ৩-২ গোলে হারিয়েছিলাম না? নন্দন, তুই একটা অসা ব্যাকভলিতে গোল দিয়েছিলি না? চন্দনের মুখে হাজার ওয়াটের আলো। --হ্যাঁরে, তোদের সত্যি মনে আছে? এবার নবজীবন যুবক সংঘের মাঠ। ওরা গম্ভীর হয়ে যায়। হরিদাস পাল বলে- একাত্তরে বরানগর হত্যাকান্ড শুরু হওয়ার জন্যে বকরা করা হয়েছিল এদের মালিক,-কাম -লীডারকে। এই বক্সিং-ব্যায়ামের আখড়া যার ডিক্টেটর ছিলেন ভদ্রলোক , একটু সহজে বার খেতেন আর অহংকারী মাথাগরম টাইপ। জেনে শুনে ওনাকে নকুদের ঘাঁটি রতনবাবু রোড না কাশীমিত্রের ঘাট কোথায় যেন একা পাঠানো হল, উনি গেলেন আর নকুদের হাতে জবাই হলেন। ব্যস্‌, এটাই ছিল সিগন্যাল। শুরু হল কসাইখানার দোকান।
    শুদ্ধ বলে -- উনি কিন্তু আমাদের হস্টেলের গঙ্গারামের জামাইবাবু ছিলেন। ওরা চুপ করে যায়।
    জয়শ্রী সিনেমা হল।
    -- কি রে হরিদাস? তুই সেবার পাঁচিল টপকে জয়শ্রী সিনেমা নাইট শো দেখতে গিয়ে ধরা পড়েছিলি না?
    -- ধরা পড়িনি তো! ওসব মহারাজদের পেঁয়াজি।
    কিন্তু গাড়ি ভেতরে ঢুকে একপাশে দাঁড়ায়। সরস্বতী পূজোর ভীড়। বরানগরের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রসাদ পেতে আর ঠাকুর দেখতে উপচে পড়েছে।
    -- জানিস, সেবার আমি পূজোর সেক্রেটারি হয়ে কুনোরটুলিতে ঠাকুর আনতে গিয়ে--
    --থাম তো! আরে অফিস আর সেক্রেটারি মহারাজের ঘর প্রায় সেই রকমই রয়ে গেছে, সেই পঞ্চাশ বছর আগের মত। কিন্তু অমন চমৎকার খেলার মাঠটার পেছন মেরে দিয়েছে মাইরি! এখানে আবার কার মন্দির তুলে দিয়েছে? ছেলেরা এখন কোথায় ফুটবল খেলে?
    -- দূর শালা! জানিস না নকশাল আন্দোলনের সময় আমাদের সময়ের নন্দবাবু ওয়ার্ডেন ছুরি খেলেন। তখন থেকেই হস্টেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের সেই থাকার ঘর গুলো এখন সেন্ট্রাল মদেল স্কুল।
    নীরবতা। না আসলেই ভাল হত।
    ওরা খবর পাঠায়। সেক্রেটারি মহারাজ কি এখন দেখা করবেন?
    ওদের নিয়ে যাওয়া হয় দোতলায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন অল্পবয়সী ছিপছিপে সন্ন্যাসী, স্মিত চেহারায় বলেন,-- আপনারা?
    নিউইয়র্ক থেকে আসা রবি গলাটা গম্ভীর করে বলে- আমরা১৯৬৭র পাস আউট।
    উনি হেসে বলেন-- সে'বছর আমি জন্মে ছিলাম।
    সবাই হাসে।
  • ranjan roy | 24.99.152.154 | ২৫ মে ২০১২ ১২:৪৬552378
  • -- মহারাজ, আপনার বাংলা শুনে মনে হচ্ছে আপনি অন্য প্রদেশের লোক, ঠিক বলছি?
    -- হ্যাঁ, আমি গুজরাতের, পোরবন্দর শহরের।
    -- মিশনের সাথে যোগাযোগ কি করে হল? মানে আপনি কোলকাতায় এসে পরে দীক্ষিত হয়েছেন, না গুজরাত থেকেই?
    --- ছোটবেলা থেকেই বিবেকানন্দ সাহিত্যের অনুরাগী ছিলাম, ভাল লাগত। গ্র্যাজুয়েট হতে হতে ঠিক করলাম মিশনে যোগ দেব। ওখানেই অনেক দিন কাজ করেছি। তারপর বেলুড়ের নির্দেশে কয়েক বছর হল এখানে বরানগর মিশনের দায়িত্বে এসেছি।
    রঞ্জনের কেমন মনে পড়ে ওর চেনা বহু বাম পার্টির হোলটাইমারের কথা, যাঁরা একটা স্বপ্নকে রূপ দিতে সারাজীবন নিষ্ঠার সংগে সংগঠনের নিয়ম মেনে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে চলেছেন।
    চরৈবেতি! চরৈবেতি! চরৈবেতি!
    -- মহারাজ! আমরা কি একটু ঘুরে ঘুরে দেখতে পারি? অনেক কিছু বদলে গেছে। আবার অনেক কিছু পঞ্চাশ বছরেও বদলায় নি।
    -- নিশ্চয়ই! এই যে ইনি আপনাদের যেখানে বলবেন নিয়ে যাবেন। আপনারা চাইলে প্রেয়ার হলও একটু আগে খুলে দেয়া হবে।
  • অপু | 132.248.183.1 | ২৫ মে ২০১২ ১২:৫১552389
  • প্রথমেই অনুরোধ সত্য গোপন করার দরকার নেই। কিন্তু আপানার দেখা রামকৃষ্ণ মিশন র থেকে এখন বোধহয় অনেক আলাদা।

    আর আপনি আশা করি এমন কিছু লিখবেন না ( যেটা আগে লিখছেন) যাতে আপনার লেখা রামকৃষ্ণ মিশনে পড়া কাউকে আঘাত করে।

    আপনার লেখা সবসময় সুখপাঠ্য। লিখতে থাকুন।
  • r | 213.91.201.54 | ২৫ মে ২০১২ ১২:৫৭552400
  • যা ভালো লাগবে, তাই লিখবেন, কুনো রেস্ট্রটিকশান নাই।
  • ranjan roy | 24.99.152.154 | ২৫ মে ২০১২ ১৩:৩৪552404
  • ওরা সবাই নীচে নামার জন্যে তৈরি হয়। পাঁচজন স্মৃতিবিভোর প্রৌঢ়, সবাই ষাটের ঘরে।

    দোতলার দুটো ঘর ঠিক তেমনি রয়েছে। লাল সিমেন্টের মেজে, সামান্য জোড়াতালির ছাপ,খাটগুলো বদলেছে। পুরনো মডেলের পাখা, গেরুয়া রঙের চাদরে ঢাকা বিছানা। না, মহারাজদের পোষাক সূতির কাপড়ে তৈরি। রঞ্জনের ছিদ্রান্বেষী মন কোথাও টেরিকটের আভাস পেল না।
    এইখানেই আগে ছিলেন ন'দা, পূর্বাশ্রমের নাম নিরঞ্জন সেনগুপ্ত । উনি নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে কোন টেররিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অসুখে ভুগে বড় কষ্ট পেয়ে গেলেন। তারপর স্বামী শান্তিনাথানন্দ, মানে রামকানাইদা। তারপরে নির্জরানন্দ বা মোহিত মহারাজ। আপ্তানন্দ বা অনিলদা ছিলেন অনেক কাছের মানুষ, কিন্তু আগের মহারাজদের পরিশীলনের ছাপ ওনার মধ্যে ছিল না।
    ওরা আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসে। নীচে অফিস ঘর , সামনে একটা জাল লাগানো হয়েছে, কিন্তু কেন?

    বারান্দায় দুটো কাঠের বেঞ্চি পাতা। সেগুলো ভরে যাওয়ায় কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, উৎকন্ঠায় পায়চারি করছে, কখন ডাক পড়বে? আজ ক্লাস ফাইভ থেকে এইট অব্দি ভর্তির জন্যে ইন্টারভিউ চলছে। গার্জেনদের সঙ্গে বাচ্চারা। বেলা প্রায় দশটা, জানুয়ারী মাস।
    অনেকের ভীড়ে দুটো কালোকোলো বাচ্চা ওদের মেজকাকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জন ওর ভাইয়ের দিকে তাকায়, বোকাবোকা হাসে। ভাই বোঝে দাদা খুব নার্ভাস। এর আগে ওরা কাকার সঙ্গে গিয়ে সরিষা মিশনেও রিটন টেস্ট দিয়েছে, পেপারগুলো বরানগরের মতই। ইংরেজি-বাংলা-অংক।
    সরিষা মিশনের ক্লাসরুম, ব্ল্যাকবোর্ডগুলো বেশ বড়সড়, কেমন ভয় ভয় করে। ওরা দু'জায়গা থেকেই কল পেয়েছে। বাড়ির সবার ইচ্ছে সরিষায় দেয়া, ওখানে মেয়েদের স্কুলটিতে ওদের সম্পর্কে পিসি হেডমিস্ট্রেস, উনি নাকি ছোটবেলা থেকেই মিশনে, পড়াশুনো-নাচ-গান সবেতেই প্রশংসা কুড়িয়েছেন
    কিন্তু ওটা বড্ড দূর, বেশ গ্রাম-গ্রাম। ধূলোভরা মাঠ, খেজুর গাছ, গাধা চরছে।
    বরানগর তো কোলকাতার মধ্যে, চারদিকে পাকাবাড়ি, সামনেই জয়শ্রী সিনেমা হল।
    -- এই, তোর নাম ডেকেছে, চল, ভেতরে চল।
    একজন ব্রহ্মচারী কাকাকে আটকালেন।
    ভেতরে বেশ বড় একটি টেবিলের ওপাশে চশমা পড়া টাকমাথা একজন মোটাসোটা মহারাজ বসে। ওনার চোখ দুটো হাসছে। রঞ্জন বুকের মধ্যে কাকিমার শিলনোড়ায় বাটনাবাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
    ( কাকা বলে দিয়েছিলেন-- বসতে না বল্লে বসবি না কিন্তু।
    উনি আর বসতে বলেন নি।)
    -- কি খেলতে ভালবাস?
    -- ক্রিকেট।
    --- ফুটবল না?
    ---- খেলি, খুব ভাল নয়।
    ---- ক্রিকেটে কি কর?
    --- স্লো অফ স্পিন।
    -- আচ্ছা? গ্রিপটা দেখাবে? তোমার ছোট্ট হাতে লাগে না।
    --- লাগে, তবে আমরা পার্কসার্কাসের রাস্তায় ইঁটের উইকেটে রবাবের বলে বা টেনিস বলে খেলি। রবারের বল খুব ঘোরে । আমার বল অফ স্টাম্পের বাইরে পরেও লেগস্টাম্প ছাড়িয়ে যায়।
    -- বেশ, এটা বলতো? অফ স্পিন আর অফ কাটারের মধ্যে তফাৎ কি? পারলে না? আচ্ছা , গুগলি বল জান? তাহলে ওর আবিষ্কর্তা কে আর উনি কোন্দেশের লোক বলতে পারবে?
    -- হ্যাঁ, বোসাঙ্কোয়েট, সাউথ আফ্রিকা।
    দুজনের মধ্যে গল্প জমে ওঠে। রঞ্জন জানিয়ে দেয় যে অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দুটো ইনিংস মিলে শেষ বলে ড্র হয়েছে। ওয়েসলি হলের ঐতিহাসিক রান আউটটাও ও জানে।
    কিন্তু হটাৎ প্রশ্নগুলো ঘুরে গেল। ও আমি ভাত খাইয়াছি এবং আমি ভাত খাইতেছির ইংরেজি বলতে গিয়ে তোতলাতে লাগল। তারপর ও নমস্কার করে বেরিয়ে এসে কাকাকে জানাল-- কয়েকটা বলতে পারিনি।
    সাতদিন পরে চিঠি এল-- টাকাপয়সা এবং
    বিছানাপত্তর-জামাকাপড় নিয়ে
    গার্জেনের সাথে উপস্থিত হতে। আবার সেই অফিস ঘর।
  • নিশান | 82.89.200.226 | ২৫ মে ২০১২ ১৪:০৯552405
  • বরানগর মিশনের পোজিশানটা কিন্তু মারকাটারি, একদম জয়শ্রীর উল্টোদিকে, অবশ্য অন্য দিক দিযে দেখলে জয়শ্রীর পোজিশানটাই মারকাটারি!

    তবে রঞ্জনদার লেখা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, পড়তে চমৎকার সরেস লাগে, আলো অন্ধকারে যাইটা তো গোলা! এটাও তাই দাঁড়াবে আর ১-২ কিস্তিতে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিৎ।
  • aishik | 132.181.132.130 | ২৫ মে ২০১২ ১৫:৪৬552406
  • রঞ্জন দা লিখুন, থামবেন না।
  • Shanku | 127.219.194.21 | ২৫ মে ২০১২ ১৭:৪৯552407
  • রঞ্জন্দা, আমার জন্ম রায়পুরে। আপনি ওখানে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। সেই সুবাদে আপনাকে লেখবার সাহস করছি। [email protected] -এ দু'লাইন আশিব্বাদ পাঠালে ধন্য হব।
    আর আপনার লেখা? আ-হ, আমার সর্বকালের প্রিয় কড়াইয়ের ডাল আর আলু-পোস্তর মত।
    রোজ একবার করে দেখে যাবো।
  • একক | 24.96.157.68 | ২৫ মে ২০১২ ১৯:০৩552357
  • বরানগর মিশন ! বুকমার্ক করি এবার :( আমাদের সময় নন্দ দা , মণি দা , অমলেশ দা প্রাইমারি তে . এস.কে.জি ১ কে মনে হয় চিনবেন রঞ্জন বাবু .
  • ranjan roy | 24.99.210.180 | ২৫ মে ২০১২ ২০:৩৬552358
  • শংকু,
    আমরা সবাই গুরু এবং চন্ডাল। এটাই আমাদের ইউ এস পি। আমরা গম্ভীর দার্শনিক বক্তব্য নিয়ে খিল্লি করি, বা খিল্লির ঢঙে কথা বলি। আর হালকা কথা গম্ভীর চালে বলি।
    তাই আমরা আশীর্বাদ নিই না, দিই না। আমরা দেয়া নেয়া করি বন্ধুত্ব, যা আমার মতে যে কোন সম্পর্কের শাঁস।
    রায়পুরে প্রতিমাসে যাই। দেশবন্ধু বিল্ডিং এ অ্যাডাল্ট এডুকেশনের স্টেট রিসোর্স সেন্টারে কনসাল্টেন্সি করি, আর " আড্ডা'' বলে বাঙালীদের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ভবিষ্যতে আমরা রায়পুরে আমার অফিস বা কফি হাউসে আড্ডা দিতেই পারি।
  • ranjan roy | 24.99.210.180 | ২৫ মে ২০১২ ২০:৪৩552359
  • একক,
    কোন বছরে হায়ার সেকেন্ডারি?
    অমলেশদা বিয়ে করার আগে হস্টেলে সুপার ছিলেন। হ্যান্ডস আম। আমি ওনার প্রিয় ছাত্রদের একজন। নন্দবাবু দুজন। একজন কেমিস্ট্রির হেড, রোজ সন্ধ্যেয় জয়শ্রীর পাশে একটি ইলেক্ট্রিকের দোকানে আড্ডা মারতেন, ভাল ঠ্যাঙাতেন।
    আর একজন প্রাইমারির, দাড়িওলা-- হস্টেলে সুপার। আমাদের সঙ্গে পরে চরম ঝামেলা। ওনার কার্টুন এঁকেছিলাম।
    কানুদার কথা মনে আছে? গালটা একটু পোড়া? প্রাইমারিতে পড়াতেন। হস্টেলের খেলাধুলোর ইনচার্জ?
    আমি ১৯৬১-১৯৬৫ অব্দি ছিলাম।
  • ranjan roy | 24.99.210.180 | ২৫ মে ২০১২ ২০:৪৪552360
  • যা তা! "হ্যান্ডসাম" হবে।
  • একক | 24.99.25.242 | ২৫ মে ২০১২ ২১:০৮552361
  • রঞ্জন বাবু, আমি আপনার চে বয়েসে অনেক ছোট . ৯৫-এ মাধ্যমিক . নন্দ দা এবং অমলেশ দা কে প্রাইমারি তে পেয়েছি. আমরা যখন ৫-এ তখন উনি রিটায়ার করলেন. নন্দদার ছেলে দিব্য-দা আমাদের
    লাইফ-সাইন্স এর টিচার হয়ে এলেন ক্লাস ৮-এ . বাপের মতো মারকুটে নন মোটেই . হেব্বি মাই-ডিয়ার ছিলেন . আপনার ব্যাচ আন্দাজ করে মনে হচ্ছে আপনি সুভাষ-দার (সুভাষ মুখার্জি) আশেপাশে. আমাদের ইংলিশ পড়াতেন, হি ইস নীআরিং ৬৭ নাও .

    লেখা দারুন হচ্ছে , উদগ্রীব হয়ে আছি :)
  • ranjan roy | 24.99.0.170 | ২৫ মে ২০১২ ২৩:২১552362
  • না, না; ঠ্যাঙানোর জন্যে বিখ্যাত নন্দদা ( " ওরে, দিনের বেলায় তারা দেখিয়ে ছাড়বো") কেমিস্ট্রির হেড ছিলেন। প্রাইমারির নন্দদা বেঁটে, রোগা ছিলেন। হার্মোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন। মারতেন না। সম্ভবতঃ নকশাল আমলে ওনার ওপর হামলা হয়েছিল। উনি যখন হোস্টেলের ওয়ার্ডেন ছিলেন তখন আমাদের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। সেটা পরিস্থিতিজন্য, আমাদেরও দোষ ছিল।
  • ranjan roy | 24.99.0.170 | ২৫ মে ২০১২ ২৩:২৫552363
  • একক,
    সুভাষ মুখার্জি আমার একটু সিনিয়র। যদ্দূর মনে পড়ছে উনি হস্টেলের না, ডে-স্কলার ছিলেন। বরানগরের কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। কথাবার্তায় বেশ সফিস্টিকেশন ছিল, সদালাপী। খুব ভাল স্পিনার ছিলেন। আমি ৬২।
  • harmad | 127.194.207.51 | ২৫ মে ২০১২ ২৩:৫৭552364
  • আমি ব্যারাকপুর মিশন এর মাধ্যমিক ২০০১ আর রহড়া মিশন উঃমাঃ ২০০৩। কেউ আছে নাকি এদিকে ?
  • Blank | 69.93.246.68 | ২৬ মে ২০১২ ০০:৪৩552365
  • দারুন হচ্ছে রঞ্জন দা।
  • অপু | 24.96.87.184 | ২৬ মে ২০১২ ০১:১১552366
  • রহড়ার অনেকে আছে।
  • harmad | 127.194.207.51 | ২৬ মে ২০১২ ০১:১৫552368
  • ব্রতীন দা এখনো জেগে ?
  • অপু | 24.96.87.184 | ২৬ মে ২০১২ ০১:২০552369
  • দাবা খেলছি ঃ)
  • bb | 127.213.212.137 | ২৬ মে ২০১২ ১০:৫০552370
  • এই ২০০০ এর পরে পাশ করা বাচ্চাগুলোকে ব্যান করে দেওয়া হোক ১০ বছরেরে জন্য- এগুলো বড়দের মধ্যে কথা কেন যে বলে ঃ)।

    বাপরে এগুলো একদম কুঁচোকাচা সব।
  • harmad | 127.194.207.51 | ২৬ মে ২০১২ ১১:০৪552371
  • বিবি দা কে ঘ
  • ranjan roy | 24.96.143.40 | ২৬ মে ২০১২ ১২:৪৭552372
  • ২)
    সন্ধ্যে নামছে। শীতের সন্ধ্যে। মাত্র বিকেলের খেলাধুলো শেষ হয়েছে। স্কুল ছুটির পরে সামান্য জলখাবার বোঁদে-মুড়ি খেয়ে খেলার মাঠে। পার্কসার্কাসের ফুটপাথে ক্রিকেট খেলা হরিদাস পাল এতদিন জানত যে মাঠে খেলা শুধু বড়দের হক, তাও কোন ক্লাবের মেম্বার হলে। এখানে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেরা মাঠে বড়দের ক্রিকেট ডিউস বলে। কিন্তু ঘেরা মাঠের বাইরে অনেকগুলো চটজলদি তৈরি পিচে টেনিস বলের ক্রিকেট খেলে চলেছে বিভিন্ন বয়সের ছোটরা। কিন্তু টেনিস বলের টার্ন ও বাউন্স রবাবের বলের চেয়ে অনেক কম, অবশ্যি পিচের রাস্তার হার্ড সারফেস আর ধুলোভরা বা ঘাসের সারফেস ও আলাদা স্বভাবের।
    আজকে ওকে কেউ খেলতে নেয় নি। ক্লাস সেভেনের খেলা ও একটু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দেখছিল। একটা বল উড়ে এসে ওদের প্লেয়ারের নাগালের বাইরে পড়ল। হরিদাস বলটা তুলে নিল। ওদের ক্যাপ্টেন হাতের ইশারায় বলটা ফেরত দিতে বলল। ও কিন্তু সোজাসুজি থ্রো না করে বলটা বোলিং অ্যাকশনের সঙ্গে হাত ঘুরিয়ে রিলিজ করলো। বলটা সমীরণের সামনে ড্রপ খেল। তারপর সামান্য টার্ন নিয়ে সমীরণের প্রত্যাশায় বাড়ানো জোড়া হাতের পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল। সবাই হেসে উঠল।
    সমীরণের চোখ-মুখ রাগে গনগন করছে।
    -- এই তুই কে রে? নতুন ছেলে? কোন ক্লাস ? সিক্স? বড়দের সঙ্গে পাকামি ? যা , নিজের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে খেল গে যা!
    ও আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে পড়ে। ঘন্টা বাজে। খেলা শেষ। দলে দলে ছেলের দল গোটা কয়েক কলের সামনে লাইন দিয়ে হাত পায়ের ধুলো কাদা দুচ্ছে। এর পর? একটি ছেলে জানাল প্রেয়ার হলে যেতে হবে।
    ও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ছোট ভাইটা কোথায় গেল। এ পরবাসে ওই তো স্বজন। গেল কোথায়?
    ইতিমধ্যে মাথায় পড়ে একটা চাঁটা। পেছন ফিরে দেখে গোটা কয়েক ছেলে ভাবলেষীন মুখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর ছোখ ঘুরে বেড়ায় সবার মুখে? মারল কে? কেন মারল, উত্তর খোঁজে।
    -- প্যাট প্যাট করে কি দেখছিস রে? জানিস না, সিনিয়রদের দিকে অমনি করে তাকাতে নেই! আর সিনিয়ররা আগে হাত-পা ধোবে, তারপর তুই, সরে দাঁড়া।
    ও সরে দাঁড়ায়।
    গতকাল ঠিক এই সময়েই ওর কাকা এসে ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামিয়ে ওদের দুভাইকে নামিয়ে দিয়েগেছিলেন। অফিস ঘরে রুক্ষ্ম চেহারার অনিলদা বা স্বামী আপ্তানন্দ হাসিমুখে বরাভয় দিয়েছিলেন। -- কিছু ভাববেন না, কদিন মন খারাপ করবে, তারপর এখানে এমন ভাল লাগবে যে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করবে না। অ্যাই কল্যাণ, এদিকে এস।
    একটি বছর চোদ্দোর চুলে সিঙ্গারা করা ছেলে এগিয়ে আসে।
    -- দেখুন, এ ক্লাস নাইনে পড়ে, এখন বন্ধুদের ছেড়ে আশ্রমের পরিবেশ ছেড়ে গরমের ছুটিতেও ঘরে যেতে চায় না। আর হ্যাঁ, এখানে সবাই সমান। ঠাকুর-স্বামীজির আদর্শে আমরা বাচ্চাদের বড় করি, কৃচ্ছসাধনে অভ্যস্ত করাই। সাদাসিদে জামাকাপড় দেবেন। হাতে পয়সা দেবেন না। দরকার হলে এক্স্ট্রা পয়সা অফিসে জমা রাখবেন।
    ট্যাক্সি কাকাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কেউ বলে যে এখন প্রার্থনা হলে যেতে হবে। দুভাই ,যন্ত্রচালিত, অন্ধকার আঙ্গিনা পেরিয়ে বিশাল মোজাইক- পালিশ করা প্রেয়ার হলে ঢুকে সারি সারি বসে থাকা ছেলেদের পেছনে বসে পড়ে।
    আলোঝলমল হল। একটু দুরে ঠাকুর-শ্রীমা- বিবেকানন্দের ফটো। তার সামনে পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে কর্পুরের আরতি করছেন কেউ। সামনে হার্মনিয়াম নিয়ে মূল গায়ক। পাশে একজন খঞ্জনী বাজাচ্ছে। আর একজন অন্ধ বাদকের হাতে পাখোয়াজ কথা বলছে-- ভদতং - ভদতং, ভদ-ভদ-ভদ-ভদ, তং -তং।
    আর হলের শেষ প্রান্তে একজন বাজাচ্ছে ফুট-অর্গ্যান।
    ইমনকল্যানে চৌতালে আরাত্রিক গাওয়া হচ্ছে-"" খন্ডন-ভব-বন্ধন-জগ-বন্দন-বন্দি-তোমায়"।
    এত বিলম্বিতে গান এরা কখনো শোনে নি। তাই শব্দগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়, কানে ঢোকে, কিন্তু চেনা হয়ে ওঠে না।
    গান শেষ হয়, সবাই আভূমি প্রণত হয়, কিন্তু কিছু ছেলে আর ওঠে না।
    দ্বিতীয় গান শুরু হয়, কেউ একজন হর্মনিয়ামের রিড টিপে ফিসফিস করে-- " ওং। ঋং, ঋতং,ত্বমচলো-গুণজিৎ-গুণেড্যং,
    হটাৎ সবাই কোরাসে উঁচু স্কেলে চেঁচিয়ে ওঠে-
    " নক্তংদিবং সকরুণং তব পাদপদ্মম"।
    রঞ্জন অবাক হয়। এটা কেন চেনা চেনা লাগছে? লাগার তো কথা না! কোথায় শুনেছিল?
    মনে পড়েছে, না , কথাগুলো নয়, এই সুর এই গায়নভঙ্গী ও শুনেছি অনেক আগে ,পার্কসার্কাসে ট্রামলাইনের পাশে একটি চার্চের খোলা দরজা দিয়ে হাওয়ায় ভেসে আসছিল।
    এবার টিউটোরিয়াল। ছেলেদের থাকার ঘরেই। নতুন ছেলেরা একজায়গায়। একটি বেঁটে ছোট মত ছেলে এগিয়ে এসে বলে--শোন, ক্লাস সিক্স-বি'র এগুলো হোমটাস্ক। এই খাতাগুলো আর বইগুলো নিয়ে চল, কানুদার কাছে। দেরি হলে মারে, বেত দিয়ে।
    দোতলার হলঘরে সবাই পড়তে বসেছে। একদিকে ক্লাস সিক্স, অন্য দিকে ফাইভ। রঞ্জন দেখতে পায় ছোটভাই রজত দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে।
    কানুদা ঢুকলেন। রোগা একহারা কুচকুচে কালো কানুদার বাঁ দিকের গালটা অনেকখানি ঝলাসানো, হাতে লিকলিকে বেত। এসেই হাসিমুখে উনি গোটা দুই পুরনো ছেলেদের পিঠে শপাং -শপাং করে বসিয়ে দিলেন। ওরা হেসে বিগলিত হয়ে সামান্য উ-আ করল।
    তারপর উনি বল্লেন-- নতুন ছেলেরা শোন। যারা মার সহ্য করতে পারবে না তারা কাল থেকে অমলেশদার কোচিংএ চলে যাবে। বাকি এখানে আমার কাছে পড়বে। একটু পরে উনি টাস্ক দিয়ে কোথাও চলে গেলেন।
    কেউ একজন বলল--- কালকের বাংলা
    কবিতাটা মুখস্থ করা যাক।
    রঞ্জন বই খুলল। কালিদাস রায়ের কবিতা। এক বুড়ির পোষা ছাগলছানাকে কালীমার কাছে বলি দেয়া হয়েছে, সেই নিয়ে বুড়ির অভিশাপ।
  • ranjan roy | 24.96.11.165 | ২৬ মে ২০১২ ১৩:০৮552373
  • শেষ লাইনদুটো সবাই কোরাসে জোরে জোরে পড়তে লাগল আর কিছু ছেলে হেসে উঠল।
    ' মরার বাড়া আর নেই শাপ বল ঠাকুর যাও,
    সকাল সকাল বুড়িটাকেই এবার শ্যামা নাও।'
    হাসছে কেন? পাশের ছেলেটি মুচকি হেসে বলল," জান না? ওরা প্রথম লাইনের দ্বিতীয় শব্দটা চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে পড়ছে, তাইতে সবাই হাসছে।"
    --তাতে কি হল?
    -- আরে ওটা খারাপ কথা।
    কানুদা কখন নিঃশব্দে ঢুকেছেন, প্রায় বেড়ালের মত।
    সমবেত "মরার বাড়া" আর হো-হো হাসি হটৎ বদলে গেল আর্তনাদে। তিনটে ছেলেকে উনি টার্গেট করে ঠ্যাঙাচ্ছেন। বেত চলছে মাথায়, মুখে, পিঠে।
    রঞ্জন ভয়ে শিঁটিয়ে গেছে। উনি চলে গেলে ও সবচেয়ে ছোট কিন্তু সবচেয়ে বেশি মারখাওয়া ছেলেটাকে জিগ্যেস করল--- খুব লেগেছে না?
    ও একগাল হেসে বলল," ধ্যেৎ, ও তো জলভাত।"
    -- তাহলে তুমি যে অত চেঁচাচ্ছিলে?
    -- ও তো অ্যাক্টিং! যদি না কাঁদো, না চেঁচাও তাহলে কানুদার রাগ আরও বেড়ে যাবে, আরও মারবেন।
    -- কি নাম তোমার?
    --প্রহ্লাদ।
    তিনকোণা থেকে তিনটে ছেলে চেঁচিয়ে উঠল-- এঃ প্রহ্লাদ! ও হল পেল্লাদ। আল্লাদী, পেল্লাদী, গুয়ের লাদি।
    কোচিংক্লাসের পর বিবেকানন্দ হলে পিঁড়ি পেতে খাওয়া। তারপর মশারি খাটিয়ে বিছানা করে ঘুম। পরের দিন ভোরে উঠে প্রার্থনা, তারপর পিটি, জলখাবার, পড়া, চান-খাওয়া-স্কুল করে কখন যেন বিকেল হয়ে গেল, আবার খেলার মাঠে। তারপর সন্ধ্যের সময় হাত-পা ধোয়া। এইসময় না কালকে কাকা আমাদের ছেড়ে গেছল। চব্বিশ ঘন্টার একটা চক্র পূর্ণ হল। এমনি ৩৬৫ চক্রে বছর ঘুরবে। আর কত বছর , কত দিন, কত আবর্তন এই পরবাসে থাকতে হবে। কেউ ওর জামা ধরে টানছে। ফিরে দেখে ছোটভাই। কিছু বলার আগে ডুকরে কেঁদে ওঠে রজত,-- দাদারে! কিচ্ছু ভাল লাগে না। চল, বাড়ি ফির‌্যা যাই।
    -- চুপ কর, কান্দে না। সব ঠিক হইয়া যাইবো। আস্তে আস্তে।
    রঞ্জন জানে না, ওর পিতামহ এই আশ্বাসেই ১৯৪৯ এর দাঙ্গার সময় দেশভাগের পর কোলকাতায় এসেছিলেন। আস্তে আস্তে সব ঠিক হইয়া যাইবো।
  • Abhyu | 107.81.99.89 | ২৮ মে ২০১২ ০৭:৩২552374
  • বড়ো ভালো লেখা রঞ্জনদা। লিখে চলুন।
  • ranjan roy | 24.99.222.184 | ২৮ মে ২০১২ ১৬:৫৭552375
  • ২)আয় ঘুম,ঘুম আয়, আয় ঘুম আয় রে !
    --------------------------------------
    প্রেয়ারের পর ওদের রুমের ক্যাপ্টেন দিলীপদা ( ক্লাস সেভেন) বলল," তোমাদের দুইভাইকে রামকানাইদা ডেকে পাঠিয়েছেন। সোজা ওনার অফিস ঘরে যাও, তারপর পড়তে বসবে।"
    দু'ভাই রঞ্জন আর রজত( সিক্স আর ফাইভ) ইতিউতি তাকায়। কেন ডেকেছেন রামকানাইদা? গেলেই বুঝবে। ক্যাপ্টেনের গলার স্বরে একটু মস্করার ছোঁয়া।
    রামকানাইদা? মানে স্বামী শান্তিনাথানন্দ? যিনি প্রেয়ারের জন্যে ভজনগুলোর একটি সংকলন সম্পাদন করেছেন! নীল রঙের বইটি , সুন্দর ভূমিকা প্রায় শ'খানেক গান। প্রত্যেকটি গানের লিরিকের ওপর রাগ ও তাল লেখা আছে। তাতে ঠাকুর, সারদা-মা, বিবেকানন্দ, শিব, কালী, দূর্গা, দু একটা রামপ্রসাদী, মীরার ভজন-- কী নেই?
    আর আছে পরিশিষ্ট, তাতে চৌতাল থেকে শুরু করে ঝাঁপতাল, তেওড়, কাহারবা-দাদরা আদি তালের মূল ঠেকার বোল, সম, তাল, ফাঁক সব চিহ্ণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া। কৌতূহল জাগে, এগুলো শিখতে পারলে কেমন হয়?
    ওনার চে্ম্বারে গিয়ে রঞ্জন দেখে -- আরে, ইনি তো সেই সন্ন্যাসী যিনি ভর্তির আগে ইন্টারভিউয়ের সময় ক্রিকেট আর ইংরেজির টেন্স নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন।
    কিন্তু আজ ওনাকে যেন চেনা যাচ্ছে না। রাগে গনগন করছেন রামকানাই মহারাজ।
    -- ব্যাটারা ভেবেছিস কি! দুটো ভাই সন্ধ্যেয় প্রেয়ারের সময় এত ঘুমোস কি করে ? যারা প্রেয়ারের সময় ঘুমোয় তাদের নাম নোট করা হয়। এই দেখ, মাত্র একমাস হল ভর্তি হয়েছিস , রোজ তোদের নাম উঠ্জেছে ঘুমোনোর খাতায়। আজ প্রেয়ারের সময় নিজে গিয়ে দেখেছি, পাশাপাশি দুই লাইনে দুভাই বসেছে, দুটৈ ঘুমোচ্ছে। আর সেকি ঘুম ? বসা অবস্থায় ঢুলে ঢুলে পড়ছে, একটা ভাই উঠছে তো আর এক ভাই নামছে। যেন ঢেঁকিতে পাড় পড়ছে। ফের যদি দেখি তো সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দেব, মনে থাকে যেন! "

    দুভাই হতভম্ব হয়ে বেরিয়ে আসে। কি করা যায়! এখন উনি যদি বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেন তো বড় সমস্যা হবে। সেশন শুরু হয়ে গেছে, কোনো স্কুল ওদের নেবে না। ভিলাইয়ে চাকরিরত বাবা বিব্রত হবেন। কি করা যায়?
    প্রথম, দু'ভাই কক্ষণো প্রেয়ার হলে দুটো লাইনে সমান্তরাল বসবে না। তাহলে আর ঢেঁকির- পাড়- দেয়া উপমাটা শুনতে হবে না।
    আস্তে আস্তে ওরা জানতে পারলো বিশাল প্রেয়ার হলের বারান্দা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিশ্বস্ত কয়েকজন। তারা ঘুমন্তদের নাম নোট করে। কখনও অনিল মহারাজ ঘুরে বেড়ান। একইভাবে বারান্দার বিশাল জানালাগুলো দিয়ে নজর রাখেন। কখনো ঘুমে ঢুলে পড়া ছেলে গুলোর আশেপাশে বসা কাউকে ইশারা করেন জাগিয়ে দিতে। এটাও দেখল যে কয়েকজন সিনিয়র ছেলে প্রেয়ার হলে বসে ঘুমোনোর খেলায় সিদ্ধিলাভ করেছে। তারা সোজা হয়ে বসে চোখ বুঁজে ঘুমোয়, একটুও নড়েচড়ে না, ঢুলে পড়ে না।তারা গান গায় না। জিগাইলে বলে ধ্যান করছে। এই ভাবেই তারা কাটিয়ে দেয় আরাত্রিক-- বিলম্বিত ও দ্রুত, ওঁ- ঋং-ঋতং, এবং সব শেষে সর্বমঙ্গল্য -মঙ্গল্যে-শিবে-সর্বার্থসাধিকে। আরতি শেষ হলে তারা ওঠে এবং গম্ভীর পদক্ষেপে হল থেকে বেরিয়ে যায়, তাদের নিষ্ঠা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তোলে না,এবং ছোটরা তাদের ধ্যানের পরাকাষ্ঠায় প্রভাবিত হয়ে বিশেষ শ্রদ্ধা করতে থাকে। কিন্তু এদের নকল করতে গিয়ে কিছু ছেলে ধরা পড়ে যায়। কারণ, তারা একবার একটি স্তোত্রের শেষে প্রণাম করার সময় সেই যে শোয় আর ওঠে না। প্রসাদ বিতরণ হয়ে হলের লাইট নেভানোর সময় তাদের ঠেলে তোলা হয় বড় অনুকম্পা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে, যেন রাস্তায় পড়ে থাকা মাতালকে পাহারাওলা ঠেলে তুলছে।
  • ranan roy | 24.99.222.184 | ২৮ মে ২০১২ ১৭:৩১552376
  • আবার ডেকে পাঠিয়েছেন রামকানাইদা। ইতিমধ্যে রঞ্জন পড়ে ফেলেছে গানের বইটির শুরুতে রামকানাইদার লেখা ভূমিকা। উনি শুরু করেছেন " গানাৎ পরতরং নহি" এই সূত্রবাক্য দিয়ে। এর মানে কি রঞ্জন জানেনা। কিন্তু ওর মন ছুঁয়ে যায় ওনার এই বাক্যটি" একটু সুরের ঝিকিমিকি, একটু তালের রংচং, হয়তো মনকে তাৎক্ষণিক ছুঁয়ে যায়, কিন্তু নিয়ে যায় সংগীতের মণিকোঠা থেকে অনেক দূরে।"
    আজ রামকানাইদার ঘরে গিয়ে রঞ্জন প্রথমেই বলে-- আমি আপনার লেখা বইটির ভূমিকা পড়েছি। আমি গান শিখতে চাই।''
    -- "" বেশ, আপাততঃ প্রত্যেক রোববার সকালে ডানকুনি থেকে বীরেশ্বরদা আসবেন তোমাদের গানের ক্লাস নিতে। ওনার কাছে যাও। পরে আমি ডেকে নেব। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে যে তুমি প্রার্থনা হলে ঘুমোবে না। এত ঘুম আসে কেন? এককাজ কর, কাল থেকে তুমি বারান্দায় ঘুরে ঘুরে যারা ঘুমোচ্ছে তাদের নাম লেখার দায়িত্ব নাও। তাহলে আর ঘুমোনোর সুযোগ পাবে না। দেখ, হয়ত তোমার ঘুমের রোগ সেরে যাবে।"
    নিজের রুমমেটদের গিয়ে ও গর্বের সঙ্গে বলে-- জানিস, কাল থেকে আমি--"।
    আশ্চর্য, ওরা বিদ্রুপে মুখ বাঁকায়,---- কিরে শ্লা, তুইও শেষে দালাল হলি?
    দালাল? আমি দালাল? নয়তো কি? কাল থেকে বন্ধুদের নামে চুকলি করবি মহারাজদের কাছে? ছ্যা-ছ্যা!
    পরের দিন ও গিয়ে রামকানাইদাকে বলে-মহারাজ, আমি ঘুমোব না। প্রেয়ারে বসে গান গাইব, খঞ্জনী বাজাবো।
    আস্তে আস্তে ও গিয়ে বসে অন্ধ পাখোয়াজ বাদক নগেশদার পাশটিতে। বাঁয়ার গায়ে আটার গোলা লাগিয়ে ভারি আওয়াজ বের করাটাকে মন দিয়ে দেখে। তারপর প্রেয়ারের শেষে খঞ্জনী দিয়ে ঘষে আটা তোলায় হাত লাগায়। নগেশদাকে হাত ধরে সিঁড়ি থেকে নামিয়ে দেয়।
    কিন্তু মাঝে মাঝে মেতে ওঠে অন্য এক খেলায়। সামনে বা পেছনে বসা ঘুমে ঢুলে পড়া ছেলেটির নাকের সামনে ঘুষি পাকিয়ে অপেক্ষা করে কখন ঢুলতে ঢুলতে ওর নাক এসে পড়বে ওর পাকানো মুঠোর ওপরে। চমকে উঠে লাল চোখ করে তাকানো ছেলেটিকে অনায়াসে বলে-- ঘুমোস্‌ না, অনিল মহারাজ দেখতে পেয়ে তোকে ডেকে দিতে বল্লেন।
  • ranjan roy | 24.99.222.184 | ২৮ মে ২০১২ ১৮:০৩552377
  • সকাল বেলা , বিশেষ করে শীতের সকালে , অনেকেই শাল জড়িয়ে এসে প্রেয়ার হলে বসে। প্রায়ান্ধকার হলে প্রার্থনার সময় অনেকে ঘুমোয়। তারপর সুর্য ওঠে। কিন্তু রোববারে বাঁধা গতের গানের জায়গায় অন্য গান হয়। যেদিন রামকানাইদা এসে বসেন, টেনে নেন, স্কেল-চেঞ্জার বিশেষ হার্মনিয়াম সেদিন চেনাজানা গানগুলো অন্য মাত্রা প্রায়। বীরেশ্বরদা ভৈরবীতে গাইতে থাকেন- "শ্রীদূর্গা নামটি ভুল না; ভুলো না, ভুলো না, ভুউউলো না।''
    সেটাই রামকানাই মহারাজ যখন কানাড়ায় গেয়ে ওঠে্ন , অন্তরায়, " তারায় দিয়ে ভার, সুরথ রাজার, লক্ষ অসিঘাতে প্রাণ গেল না" তখন প্রেয়ার হলের বাতিগুলো উজ্বল হয়ে ওঠে। কেউ ঘুমোয় না।
    একদিন, প্রেয়ার শেষ, জলখাবারের ঘন্টা বেজে গেছে, সবাই চলে গেছ- উনি অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু সেদিন ওনাকে গানে পেয়েছে। একাই খালি হলে আপনমনে গান গেয়ে চলেছেন। একটু দূরে নিজেকে প্রায় গোপন করে রঞ্জন শুনছে।
    নানান গানের পরে উনি ধরলেন অতুলপ্রসাদের " সে ডাকে আমারে, বিনা সে সখারে, রহিতে মন নারে''। তারপর হটাৎ " বরষ বরষ ধরি থাকি চাহিয়া", অন্তরায় " দখিনা সমীরণে-এ-এ-এ, সমীরণ, হা- আ- সমীরণ!"
    রঞ্জন তখন খেয়াল করলো এগুলো তো ঠিক প্রথাসিদ্ধ ভজন নয়! তাহলে ? স্বামী শান্তিনাথানন্দের মনের কি অনেকগুলো কোণ আছে? তার থেকে আলো ঠিকরে পরে? কার প্রতীক্ষায় উনি বরষ-বরষ-ধরি চাহিয়া থাকেন? ঈশ্বর? তাই কি!
    গান শেষ হলে উনি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। বেলা বাড়ছে। রঞ্জন বলে উঠলো-- মহারাজ, আরেকটা গাইবেন?
    উনি চমকে উঠলেন। যেন হলে আর একটি প্রাণীর উপস্থিতি এতক্ষণ খেয়াল করেন নি। তারপর কোন কথা না বলে উঠে চলে গেলেন।
  • maximin | 69.93.211.176 | ২৮ মে ২০১২ ১৮:৫৯552379
  • সঙ্গে রইলাম।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন