এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • achintyarup | 69.93.246.41 | ২০ জুন ২০১২ ০৪:২৮559221
  • গগন রায়ের আত্মকথা আগেই গুরুচরণে নিবেদন করেছি। সে লেখা বাঙ্গালা ১৩৩১ সনের। যখন লেখকের বয়স ৬৫। ভূমিকা, মূল্যাদি সহ সে লেখা একেবারে প্রেস কাপি। প্রতি পাতার একদিকে লেখা, অন্যদিক সাদা। সে পুস্তকের পরিকল্পনা অনেক দিনের, সে কথা তিনি সেখানেই লিখেছিলেন।

    প্রেস কাপিটি ছাড়াও আমার পরদাদার আরও দুই খানি খাতা পরিবারের সঙ্গে এপারে এসেছিল। তার একখানি কিছুদিন হল আমার অগ্রজ দীপংকর পাঠোদ্ধার করে একটি নূতন খাতায় পরিষ্কার করে লিখেছেন। সেই পাঠোদ্ধৃত লেখা এবং মূল খাতাটি কয়েকদিন হল আমি হস্তগত করেছি। এটিকে গগনবাবুর আত্মকথার খসড়া বলা যেতে পারে। এ খসড়া লেখা হয়েছিল বাঙ্গালা ১৩০৩ সালে। হিসাব মত লেখকের বয়স তখন ৩৫। এখানে যা লেখা হবে তার অনেক কিছুই গুরুবৃন্দ আগেই পড়েছেন। কিন্তু কোথাও কোথাও কিছু বাড়তি ইন্‌ফার্মেশান আছে, আবেগের বাহুল্যও লক্ষ্য করা যায়। কোথাও কোথাও খসড়ায় লেখা ঘটনা প্রেস কাপিতে একটু পরিবর্তিত হয়েছে। এবং এ খাতায় আত্মজীবন ছাড়া পাতঞ্জল দর্শনের কথাও কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হয়েছে।

    তৃতীয় আর একখানি খাতা ছিল, যেটি আমি দেখেছি বলে মনে পড়ছে, কিন্তু ইদানীং তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সে খাতায় কিছু গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ এবং নানা খুচরো বিষয়ে টুকরো লেখা ছিল।
  • achintyarup | 69.93.246.41 | ২০ জুন ২০১২ ০৪:৪৩559232
  • উপক্রমণিকা

    বাঙ্গলা এগার শত শতাব্দির মধ্যভাগে প্রসিদ্ধ ছিয়াত্তরে মন্বন্তরের পূর্ব্বে কোন সময়ে দক্ষিণ রাঢ়্দেশ হইতে ইন্দ্রবংশের আদিপুরুষ পূর্ব্ববঙ্গে আগমন করতঃ ময়মনসিংহ জেলার পূর্ব্বদক্ষীণ সীমান্তে প্রবাহিত প্রসিদ্ধ মেঘনা নদের সমীপবর্ত্তী কোন স্থানে প্রথমতঃ বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া বসতি করিয়াছিলেন। কিছুকাল তথায় বসতি করার পরই জলপ্লাবনের আধিক্য বশতই হউক কি অন্য কোন অসুবিধা বশতঃই হউক বাসস্থান পরিবর্ত্তনের আবশ্যক হইল। তৎপর তাঁহার বঁশধর গন্ধর্ব্বনারায়ণ ইন্দ্র মহাশয় হাজারাদী পরগণার অন্তর্গতঃ আয়জন (বর্ত্তমান নাম আঠারবাড়ীয়া) গ্রামে বাসস্থান মনোনীত করতঃ জঙ্গল আবাদ করিয়া তত্রত্য জমীদার সুবিখ্যাত জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান সাহেব সরকার হইতে তালুকী সনন্দ গ্রহণে তালুক হাসীল করতঃ নিজ এলাকায় আবাসবাটী নির্ম্মাণপূর্ব্বক বসতি করিতে লাগিলেন। এই সময়ে উক্ত গ্রামে মাত্র আঠারোটী ভিটা অর্থাৎ বাড়ী আবাদ হইয়া বিভিন্ন স্থান হইতে আগত ভদ্রলোকের বাসোপযোগী হওয়ায় উক্ত গ্রামের পূর্ব্বকথিত 'আয়জন' নাম পরিবর্ত্তনে ভদ্রোচ্চারিত আঠারবাড়ীয়া নামে অভিনব নামকরণ হইল। আজকালও তাহা দেখা যায়, লোকের শিক্ষা ও সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে২ গ্রামের পূর্ব্বতন অর্থশূণ্য কুৎসিৎ নাম পরিবর্ত্তনে নূতন নামকরণ হইতেছে। যথা কাহেত পাউলী = কাহেস্ত পল্লী, পুড্ডা = পুরুরা, ধাইরণ = ধারীশ্বর, গোতাউরা = গৌতম পাড়া, বাণীয়া গ্রাম বাণী গ্রাম।
  • kiki | 69.93.240.175 | ২২ জুন ২০১২ ২২:৫৪559243
  • চিন্টুবাবু,
    তোর মেক্সিকো লেখা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছিনাতো!

    এইটে বেশ ইন্টারেস্টিং শুরু হয়েছে।
  • kiki | 69.93.202.246 | ২৩ জুন ২০১২ ১৬:৩৮559265
  • থেঙ্কু থেঙ্কু..............
  • achintyarup | 24.96.151.136 | ২৪ জুন ২০১২ ০০:০০559270
  • পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে ইন্দ্রবংশের আদিপুরুষ মেঘনা নদের সমীপবর্ত্তী স্থান বিশেষে প্রথম বাসস্থান নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তাহা কেবল অনুমান নহে। ইন্দ্রবংশের কুলপুরহিত অষ্টগ্রামের কাশ্যপগোত্রীয় প্রসিদ্ধ ভট্টাচার্য বংশ, এখনও তাঁহারা অষ্টগ্রামেই বাস করিতেছেন। গুরু ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত: পত্তন নামক গ্রামের বিখ্যাত গোস্বামী বংশ। তাঁহারা আজও তথায় বাস করিতেছেন।
  • achintyarup | 24.99.23.93 | ২৪ জুন ২০১২ ০০:৫৯559271
  • (আগের বার লিখেছি কিনা মনে নেই, তাই এইখানে একটা কথা বলে দিই। বছর দশেক আগে যে মহিলার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছি, তেনার পদবী ভট্টাচার্য, পিতৃকুলের গোত্র কাশ্যপ এবং তাঁদের পরিবার ময়মনসিংহের অষ্টগ্রাম থেকে এসে এপার বাংলায় থিতু হয়েছেন। হরি হে...)
  • achintyarup | 24.99.23.93 | ২৪ জুন ২০১২ ০১:২৭559272
  • কথিত আছে এই গোস্বামী পুরহিত বংশের আদি পুরুষ দক্ষীণ রাঢ়দেশ হইতে সশিষ্য পূর্ব্ব ময়মনসিংহে আগমন করতঃ মেঘনা তীরবর্ত্তী যে স্থানে প্রথম বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট করেন সেই স্থানের নামকরণ হয় গোসাইপুর আর তাঁহারা যে স্থানে হোম করিতেন সেই স্থানের নাম হয় হোমাইপুর। অদ্যাবধি কাস্তুন ও অষ্টগ্রামের তলবাহি যে মেঘনার শাখানদী প্রবাহিত আছে তত্তীরে গোসাইপুর ও হোমাইপুর গ্রাম বর্ত্তমান আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখন আর ঐ সকল গ্রামে ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক কেহ নাই, কেবল নিম্নশ্রেণীর লোক তাহাতে বাস করিতেছে।

    কালক্রমে জলপ্লাবনের অসহ্যতা নিবন্ধনই হউক অথবা অন্য আগন্তুক উপদ্রব বশতঃই হউক উক্ত গোস্বামী বংশের আদিপুরুষের পরবর্ত্তী বংশধরগণ বাধ্য হইয়া স্থান পরিবর্ত্তন করিতে লাগিলেন এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চস্থান অনুসন্ধান করতঃ কেহ পশ্চীমাভিমূখী কেহবা পূর্ব্বদক্ষিণাভিমূখিন হইলেন। যাঁহারা পশ্চীমদিগে গমন করিলেন তাহাদের কেহ যশোদল কেহ বা চান্দুরাতে বাসথান মনোনীত করিলেন। আর যাঁহারা পূর্ব্বদক্ষীণাভিমুখিন হইলেন তাঁহাদের কেহ২ পত্তন গ্রামে বাসস্থান নির্ম্মাণ করিয়া অদ্যাপিও তথায় বাস করিতেছেন। তাঁহাদের শিষ্যগণও এইরূপ উচ্চভূমি অনুসন্ধান করিয়া নানাদিকে গমন করতঃ যে যে স্থানে সুবিধা পাইল সে সেখানেই বাসস্থান ঠিক করিয়া লইল। এইরূপে রাঢ়দেশ হইতে ১ম মেঘনা নদের তীরবাসী ব্রাহ্মণ কায়স্থগণের বংশধরগণ কালক্রমে ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা জেলায় বিস্তৃত হইয়া পড়িলেন।

    আমাদের ইন্দ্রবংশের আদিপুরুষও ঐ এক সময়ে রাঢ় দক্ষিণবাসী (?) গুরু, পুরহিতসহ আগত হইয়াছিলেন এবং তাহার বংশধরগণ কালক্রমে উল্লিখিত কারণেই স্থান পরিবর্ত্তন করতঃ নূতন স্থান মনোনীত করিলেন, এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নাই। পুরাতন কাগজপত্রেও তাহার প্রমাণ বিদ্যমান আছে। বিশেষ গুরু পুরহিতের যে বিবরণ উপড়ে প্রদান করা গেল তদ্বারা তাহা সুস্পষ্ট উপলব্ধি হইতেছে। গন্ধর্বনারায়ণ ইন্দ্র মহাশয়ের নামে গন্ধর্ব্বসাজনপুর তালুক এখনও আমাদের বর্ত্তমান আছে। তাঁহার পুত্র ফকীরচন্দ্র ইন্দ্র মহাশয়ের ৫ পুত্র। তাঁহারা অতুল ধনসম্পদের অধিকারী হইয়াছিলেন। কথিত আছে তাহারা যখন পৃথগান্ন হন তখন টাকা গণিয়া ভাগ করা শ্রম ও সময়সাপেক্ষ বিধায় ধান্য পরিমাপের কাঠা ধারক মানিয়া ভাগ করা হইয়াছিল। ১১৭৬ সালে জলপ্লাবনে বহু নিরাশ্রয় লোকে আশ্রয় দিয়া সুদিন না হওয়া পর্য্যন্ত প্রতিপালন করিয়াছিলেন। ...... অনেক লোক দাসদাসী ... রহিয়া গেল।
  • achintyarup | 24.96.152.234 | ০৩ জুলাই ২০১২ ০৪:৪০559273
  • আমার কথা

    ১৩ ভাদ্র ১৩০৩।
    ২৮।৮।৯৬ সন।

    ১৭৭৯ শকের (বাংলা ১২৬৪ সাল) চৈত্র মাসের ২৬এ তারিখ মাতুলালয়ে আমার জন্ম হয়। মাতুল ঁদীননাথ কর রায় মহাশয় স্বর্গীয় জগন্নাথ রায় মহাশয়ের একমাত্র পুত্র এবং আমার মাতাঠাকুরাণী একমাত্র কন্যা। আমি মাতাঠাকুরাণীর ১ম গর্ভের সন্তান সুতরাং আমার জন্মেতে মাতুলালয়ের সকলেই অপরিসীম আনন্দিত হইলেন। দৈবজ্ঞ আনাইয়া আমার ঠিকুজি রাখা হইল। এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ও মঙ্গলজনক ক্রিয়া সম্পাদনে ত্রুটী হইল না।

    আমার জন্মের পূর্ব্বেই মাতামহ মহাশয় স্বর্গগত হইয়াছিলেন। মাতামহী মহাশয়া তখনও জীবিতা, এবং তাঁহাদের অন্যান্য পরিবারের মধ্যে মাতুলানী, অতিবৃদ্ধ এক খুল্লমাতামহ, তৎপক্ষের এক বিধবা মাসী, দাসদাসী এবং মাতুল মহাশয়কে আমি দেখিয়াছি।

    তাঁহাদের পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। তালুক জমীর আয়ের দ্বারাই সংসার চলিত। তদতিরিক্ত মাতুল মহাশয় এক ধনাঢ্যর বড়ীতে চাকুরী করিয়াও মাসিক কিছু উপার্জ্জন করিতেন। মাতুল মহাশয়ের সেকালের লেখাপড়ায় বিজ্ঞতা ছিল এবং গ্রামের মধ্যে সম্ভ্রান্ত পরিবার বলিয়া বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল।
  • achintyarup | 24.96.152.234 | ০৩ জুলাই ২০১২ ০৫:০৩559222
  • মাতাঠাকুরাণীর নিকট শুনিয়াছি, আমার ৬ ছয় মাস বয়ক্রম হইলে, আমাকে পিত্রালয়ে লইয়া আইসেন।

    পিত্রালয়ের তখনকার অবস্থা, যদিও পিতামহের আমলের অতুল বিভব সম্পত্তির ধ্বংসাবশেষ, তথাপি গ্রামের মধ্যে উন্নতাবস্থা এবং সুখী পরিবার বলিয়াই খ্যাত ছিল।

    আমার জন্মের সালে বাড়ীর সম্মুখের পুখুর পঙ্কউদ্ধার করিয়া মাছ পরিপূর্ণ করা হইল। বাড়ীর অন্দরখণ্ডের পাশে মুশলমান চাকরদিগের খাওয়ার সুবিধা করার উপলক্ষে এক বৃহৎ অন্দরখণ্ড নির্ম্মিত হইল। অন্দরখণ্ডের পুখুর কাটান হইল। অনেক বিষয়ে পৃথক ও নূতন ব্যবস্থা হইল। ইহার কারণ, আমার মধ্যম জ্যেষ্ঠতাত শ্যামচন্দ্র রায় মহাশয় খুব নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ছিলেন। বাড়ীতে বৃহৎ গৃহস্থীর কারবার, তদোপলক্ষে অধিকাংশ চাকরই মুশলমান রাখা হইত। তাহারা অন্দরখণ্ডের প্রাঙ্গণে বসিয়া খাইত। তাহাদের ভূজনস্থান গোময় দ্বারা পরিস্কার করিয়া রাখা সত্তেও শ্যাম রায় মহাশয় সেই২ স্থানে পদক্ষেপ করিতেন না। সেই সকল স্থানে তাঁহার পাঁড়া (পদক্ষেপ) পড়িবে বলিয়া তিনি সকল সময়েই খুব সতর্ক হইয়া চলিতেন। এই কথা নিয়া পিতা মহাশয় ও তাঁহাদের সর্ব্বাগ্রজ ঁরাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের সহিত শ্যাম রায় মহাশয়ের বাদানুবাদ হয় এবং এই সূত্রে শ্যাম রায় মহাশয় পৃথক হইয়া পড়েন। এই হইতেই ইঁহাদিগের মধ্যে মনান্তর ঘটে এবং সর্ব্ববিষয়ে পৃথকভাবে .... থাকে। পিতা ও রাজচন্দ্র ......... রহিলেন। তাঁহারা পৃথক নূতন অন্দরখণ্ড নির্ম্মাণ করিলেন। সেখানে মুশলমান ভৃত্যের খাওয়ার সুবিধা হইল। সেদিক দিয়া শ্যাম রায় মহাশয় কখন যাইতেন না।
  • kiki | 69.93.193.81 | ০৩ জুলাই ২০১২ ০৭:৪৭559223
  • অ্যায় মেরেছে। অন্দরখন্ড কি? উনুন?

    সতেরোশো! ক্ষী ক্ষান্ড!!
  • kiki | 69.93.193.81 | ০৩ জুলাই ২০১২ ০৭:৪৮559224
  • ঐ খাতাটা ঠিক ঠাক আছে এখন ও? ওটাকে ছুঁলে অদ্ভুত অনুভুতি হয় না তোর?
  • ranjan roy | 24.96.129.202 | ০৩ জুলাই ২০১২ ১৯:৪৩559225
  • খবদ্দার কিকি! নজর দেবে না। সব কিছু হারিয়ে রিফিউজি হয়ে আমাদের শুধু ওই দুটো খাতাই আছে।
  • ranjan roy | 24.96.129.202 | ০৩ জুলাই ২০১২ ১৯:৪৫559226
  • আর অন্দরখন্ড উনুন হবে কেন? অন্দরমহল। তবে যোগরুঢ় অর্থে উনুন বটেক।
  • kiki | 69.93.242.247 | ০৩ জুলাই ২০১২ ২২:৫৮559227
  • ও রঞ্জনদা,
    নজর কেন দোবো? খালি একবার গিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখতে আর গন্ধ শুঁকতে চাই।

    আমার একটু ভৌ টাইপ ব্যাপার আছে। গন্ধের সাথে অনেক কিছু, বিশেষ করে ক্ষন রিলেট করে যায়।ঃ)
  • achintyarup | 125.111.248.134 | ০৩ জুলাই ২০১২ ২৩:৪২559228
  • চলে আয়।

    লেখকের বয়সটা ভুল লিখেছিলাম দেখছি। এই খসড়া লেখার সময় ভদ্রলোকের বয়স ছিল ৩৯, ৩৫ নয়। এবং পরের খাতাটি যখন লেখেন তখন তাঁর বয়স ৬৯।
  • achintyarup | 24.96.33.143 | ০৪ জুলাই ২০১২ ০৪:৫০559229
  • শ্যাম রায় মহাশয় পৃথক হইয়া হিন্দু চাকর রাখিলেন। তাঁহার শুচি ও নিষ্ঠার বিষয়ে অনেক কথা রাষ্ট্র আছে। তিনি মুশলমানের প্রদত্ত টাকা পয়সা না ধুইয়া গৃহে নিতেন না। মুশলমান বাড়ী হইতে রাত্রিতে আসিলেও স্নান না করিয়া ঘরে যাইতেন না। তাঁহার সাক্ষাতে কেহ পুকুরের ঘাতে জলে কুলকুচা কি থুথু ফেলিতে পারিত না। দালানের নিকট কি তন্মধ্যে থুথু ফেলিলে সর্ব্বনাশ ঘটীত। এরূপ অনেক বিষয়েই তিনি শুচি ও নিষ্ঠার চূড়ান্ততা প্রদর্শন করিতেন। সাধারণের সহিত তাঁহার মিল হইত না। ...... তাঁহাকে ভয় করিয়া চলিত।

    এরূপ নিষ্ঠা তাঁহার হওয়ার প্রকৃতিসিদ্ধ কারণ আছে। আদিম কাল হইতে আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ বৈষ্ণবধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া বংশপরম্পরাক্রমে তাহাতে বিশেষ আস্থা ও নিষ্ঠাবান হইয়া উঠেন। সমস্ত সম্পত্তি ধর্মার্থ নিয়োগ করেন। খুল্লপিতামহ ঁজয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের সময়ে ১২০২ সালে ঁশ্রীগোবিন্দজী বিগ্রহের স্থাপন জন্য দৃঢ় নির্ম্মিত বৃহৎ দ্বিতল দালান প্রস্তুত হয় এবং ঁশ্রীবৃন্দাবনধাম হইতে উক্ত বিগ্রহজীকে আনাইয়া মহা মহোৎসবে তাঁহাকে স্থাপন করা হয়। বহু ব্যয়ে ঐ সকল ব্যাপার সম্পন্ন হয়, এবং তৎপরেও অত্যন্ত আড়ম্বরের সহিত ঠাকুর সেবার নিয়ম প্রচলিত করা হয়। কথিত আছে তাঁহার জীবনকাল পর্য্যন্ত প্রত্যহ ।।০ মোন দুগ্ধের মিষ্টান্ন ঠাকুর সেবার জন্য নিয়মিত ছিল। হরি সংকীর্ত্তন নিত্যকার্য্য;-- দোতালার উপরই ঠাকুরের কোঠার সম্মুখে যে ছাদবিহীন খোলা আঙ্গিনার কোঠায় নিত্য হরিসংকীর্ত্তন হইত এবং ঠাকুরের প্রসাদ বিতরণ হইত। রামায়ৎ, সন্যাসী ও সাধুগণ সময় সময় ঠাকুরদালানে বাস করিত। নিয়মিত দোল ঝুলন ইত্যাদি ঠাকুরের বার মাসিক ক্রিয়া রীতিমত সম্পন্ন হইত। ধর্ম্মগ্রন্থাদি পাঠ হইত। কথিত আছে ঁজয়গোবিন্দ রায় মহাশয় যখন নসিরাবাদ মোকামে বাগদ্বন্দ্বের ওকালতী করিতেন, সেই সময়ে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত দ্বারা বহুতর ধর্ম্মগ্রন্থাদির হস্তলিপি বহুব্যয়ে প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। তখন ছাপার বহী পাওয়া যাইত না এবং মুদ্রাযন্ত্রের কার্য্য সুলভ ছিল না। এই কারণে এবং ধর্ম্মগ্রন্থ হস্তলিপিতে প্রস্তুত হইলেই শুদ্ধ ও পূজ্য তদকালের লোকের এইরূপ বিশ্বাস ছিল বলিয়াই বোধহয় তিনি বহুব্যয়েও ভক্তিপ্রবণতাবশতঃ এই সুমহৎ ব্যাপার সম্পন্ন করাইয়াছিলেন। প্রাচীন লোকের নিকট শুনিয়াছি প্রায় শতাধিক বহী প্রস্তুত করাইয়াছিলেন; কিন্তু আমরা এইক্ষণে মাত্র ৪ খানা বহী 'ঁবিশ্বম্ভর' নামে দালানে ঠাকুরের সিংহাসনে পূজিত দেখিতে পাই; আরও ২/১ খানা বহী জীর্ণাবস্থায় স্থিত আছে। কথিত আছে অনেক বহী ঁজয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের পরলোকপ্রাপ্তির পর ময়মনসিংহ হইতেই কে কোথায় লইয়া যায় তাহার ঠিকানা পাওয়া গেল না। ঁবিশ্বম্ভর নামে যে বহীগুলি এখনও আমাদের ন্যায় ভক্তিহীনের অমন্ত্রক পূজায় নিত্য পূজিত হইতেছেন তাহা 'গীতগোবিন্দ' এবং এরূপ অপর ভক্তিপ্রকাশক বৈষ্ণব গ্রন্থ। তুলট কাগজে আলতার কালীর লিখা সংস্কৃত রচনা, আমরা ভক্তিহীন মূর্খ সংস্কৃতানভিজ্ঞ, ভয়েই আমরা তাহা খুলিয়া দেখিনা।
  • achintyarup | 24.96.127.106 | ২৪ জুলাই ২০১৩ ০৫:১৫559230
  • জয়গোবিন্দ রায় মহাশয় পরম ভক্তিমান বৈষ্ণব ছিলেন; কেবল বাহ্যারম্ভরেই তাঁহার প্রীতি ছিল না। কথিত আছে তাঁহার একমাত্র পুত্র ঁকৃষ্ণচন্দ্র রায় যখন ঠাকুর কোঠার সন্মুখে উপর তলায় বসিয়া গীতগোবিন্দাদি গ্রন্থ রাগিণী সংযোগে পাঠ করিতেন তখন নিম্নতলে বসিয়া সেই গান শ্রবণে তিনি বিমুগ্ধ হইতেন এবং ভক্তিগদগদ হৃদয়ে ক্রন্দন করিতেন।

    ফলতঃ তাঁহার কার্য্য দেখিলেই তাঁহার অকৃত্রিম ভক্তির নিদর্শন যথেষ্ট পাওয়া যায়। অপরিমিতরূপে ধনাদি যখন উপার্জ্জিত হইতে লাগিল, তখন সর্ব্বপ্রথমেই ঠাকুরের স্থাপনা উদ্দেশ্যে বৃহৎ দালানের সূচনা করিলেন। নিজের ভোগ বিলাসের দিকে চাহিলেন না। দালান যে স্থানে তৈয়ার হইল তাহাতে কেবল ঠাকুরের কার্য্য পক্ষেই তাহা সম্যক উপযোগী এবং সেরূপ ধরণেই গঠিত হইল। অন্দরখণ্ড এবং ঠাকুর আঙ্গীনার মধ্যবর্ত্তী স্থানে দালান হইলে দুই কার্য্যই হইতে পারিত, নিজের প্রয়োজনীয় কার্য্যও চলিত এবং ঠাকুর সেবার কার্য্যও চলিত; কিন্তু তাহা করিলেন না। অন্দরখণ্ডের পূর্ব্বদিকে ঠাকুর আঙ্গীনা, তাহার পূর্ব্ব প্রান্তে দালান প্রস্তুত করিলেন। উপর তালার মধ্যে বড় কোঠায় ঠাকুর স্থাপিত হইলেন। তদোত্তরের কোঠায় ঠাকুরের শয়ন স্থান, সন্মুখে খোলা ছাদবিশিষ্ট আঙ্গীনা, তাহাতে সংকীর্ত্তনাদি হওয়ার সুবিধা। তদোত্তরের কোঠায় ঝুলনাদি হওয়ার বন্দবস্ত। নীচতালায়ও ঐ সকল প্রত্যেক কোঠার নীচে সমভাবে এক একটী কোঠা, তন্মধ্যে ৪টী কোঠা জিনিসাদি রাখার এবং সর্ব্ব দক্ষিণের কোঠা দুর্গোৎসবাদি পুজার মণ্ডপ। এই কোঠাকে উত্তর ভিটে মণ্ডপ করিয়া তদ্দক্ষিণে বহির্বাটী। এরূপ বন্দবস্তে যে দালান প্রস্তুত হইল তাহাতে কি কেবল ভক্তির পরাকাষ্ঠাই দেখা যায় না? বাস্তবিক তিনি যেরূপ অমিতরূপে ধন উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, তাহা সদর্থে ব্যয় করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। এবং সমস্ত সম্পত্তিই যে ঠাকুরের, তাঁহাদের নিজ ভোগের জন্য নহে এরূপ তিনি মনে করিতেন।

    কথিত আছে তিনি যখন ময়মনসিংহ সদরে উকালতী করেন সেই সময় অনেক লোকই তৎকর্ত্তৃক পরিচালিত মোকদ্দমায় জয়লাভ করিয়া তাঁহাকে পুরস্কার দিতে চাহিত; তিনি বলিতেন আমাকে দিয়া কাজ নাই, আমার ঠাকুরকে কিছু দেও। অনেকেই সন্তুষ্ট হইয়া ভূমি দান করিয়াছে-- তাহা এখনও বিভিন্ন গ্রামের অন্তর্গত দেবোত্তর বলিয়া প্রসিদ্ধ -- কিন্তু এই সমস্ত ভূমিই হাজারাদী পরগণায় চিরস্থায়ী বন্দবস্ত কালে একটী মাত্র তালুকের অন্তর্গতঃ রাখিয়া নিজ নামে চিরস্থ বন্দ করিয়া একটী খারিজা তালুক করিয়া লইয়াছিলেন। তাহা এখনও জয়গোবিন্দ ইন্দ্র নামে কালেকটরীর ২৪১২ ন তৌজীতে দেখা যায়। এই সকল নিদর্শন তাঁহার নিষ্কাম ভক্তিপ্রকাশ করিয়া আমাদের ন্যায় কঠোর পাষাণ হৃদয় ভক্তিহীনকে কি কিছু শিক্ষা দিতেছে না? কিন্তু, আমরা দেখিব কি!! আমরা যে পার্থিব স্বার্থের দাসানুদাস, অহর্নিশি কতই না ভক্তিবিরোধী দুষ্কর্ম সাধন করিতেছি!!

    তাঁহার ভক্তি কেবল একদেশদর্শী সামান্য গোঁড়া বৈষ্ণবগণের ন্যায় ছিল না; তাঁহার ভক্তি সার্ব্বভৌমিক ভক্তি ছিল। তিনি নিজে বাণলিঙ্গ শিবের পূজা করিতেন। রীতিমত দুর্গোৎসবাদি ক্রিয়া বাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সে কালে এরূপ উদার সার্ব্বভৌমিক ভাব লোকে দুষ্প্রাপ্য ছিল। সাধারণতঃ শাক্ত বৈষ্ণবে বিদ্বেষ ভাবই প্রবল ছিল।
  • b | 135.20.82.164 | ২৪ জুলাই ২০১৩ ০৮:১০559231
  • "শ্যাম রায় মহাশয় পৃথক হইয়া হিন্দু চাকর রাখিলেন। তাঁহার শুচি ও নিষ্ঠার বিষয়ে অনেক কথা রাষ্ট্র আছে। তিনি মুশলমানের প্রদত্ত টাকা পয়সা না ধুইয়া গৃহে নিতেন না। মুশলমান বাড়ী হইতে রাত্রিতে আসিলেও স্নান না করিয়া ঘরে যাইতেন না।"

    বাংলা ভাগ কি এমনি এমনি হয়েছে?
  • achintyarup | 69.93.245.58 | ২৫ জুলাই ২০১৩ ০৪:২৬559233
  • এরূপ ভক্তিমানের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া মধ্যম জ্যেষ্ঠতাত শ্যাম রায় মহাশয় যে বিশেষ নিষ্ঠাবান হইবেন তাহা আর আশ্চর্য কি? যদিও শ্যাম রায় মহাশয় তত উর্দ্ধে উঠিতে পারেন নাই, কিন্তু তাঁহার জীবনেও অনেক মহৎ ভাব পরিলক্ষিত হইয়াছে। আমার পিতামহাশয় যখন বাল্যাবস্থা পরিত্যাগ করেন নাই, সে সময়েই শ্যাম রায় মহাশয় লিখাপড়া শিখিয়া সংসারের জ্ঞান লাভে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি সেকালের মত বাঙ্গলা লিখাপড়া ভালরূপ শিক্ষা করিয়াছিলেন এবং তদতিরিক্ত পারস্য ভাষাও কিছু শিখিয়া থাকিবেন। সেকালে পারস্য ভাষা না জানিলে বিজ্ঞতা প্রকাশ পাইত না। তাঁহাকে লোকে বিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলিয়া জানিত। তদাগ্রজ রাজচন্দ্র রায় মহাশয় বয়োজ্যেষ্ঠ হইলেও লিখাপড়ায় অধিক মনোযোগ করেন নাই। সামান্য রকম বাঙ্গলা জানা ভিন্ন তাঁহার বিজ্ঞতা কিছু ছিল না। সুতরাং তাঁহাকে অতিক্রম করিয়া শ্যাম রায় মহাশয় সংসারের কর্ত্তৃত্বভার গ্রহণ করিলেন। তিনি মামলা মোকদ্দমা অধিক ভালবাসিতেন না। পরের বৃত্তি আত্মসাৎ করা এবং মিথ্যা কথার ভয়ে তিনি নিজের ন্যায্য প্রাপ্য অনেক ভূমি সম্পত্তি অপরকে বিনা বিবাদে ছাড়িয়া দিয়াছেন। মোকদ্দমাদি করিয়া রক্ষা করার ক্ষমতা সত্ত্বেও এরূপ উদারতা তখনকার দিনেও বড় দেখা যাইত না।

    প্রজাদিগের নিকট হইতে খাজনা ছাড়া বাজে জমা এক কপর্দ্দকও গ্রহণ করিতেন না; তাহা খুব পাপ কার্য্য মনে করিতেন। প্রজায় প্রজায় বিবাদ বিসম্বাদ হইলে মৌখিক সাশন মাত্র করিতেন, অন্য কোনরূপ কোঠরতা ছিল না।

    কৌলিক ধর্ম্মের আচার ব্যবহারে তাঁহার একান্ত নিষ্ঠা থাকায়, তাঁহার ধর্ম্মকার্য্যের বিঘ্ন আশঙ্কায় তিনি ভ্রাতাদিগের সহিত পৃথক হইয়া পড়িলেন। পৃথক হইয়া খাস মহাল এবং অপরাপর নিকটস্থ ভূম্যাধিকারীগণের মহালের ইজারাদারী করিয়া তিনি অনেক টাকা সঞ্চয় করেন। তাঁহার গোলায় অনেক ধান মজুদ থাকিত। দুর্ভিক্ষ কি দুর্ব্বৎসরের দিনে যখন লোকের ঘরে অন্ন থাকিত না, গরিব দুঃখী লোক টাকা দিয়াও ধান খরিদ করিতে পারিত না, সেই সময় তিনি গোলা ভাঙ্গিয়া ধান করজ দিয়া লোকের প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন। সুদিন হইলে ধান কি তন্মূল্য দিবে, এই নিয়মে সকলই লইয়া গিয়াছে, পশ্চাৎ ২ বৎসর ৪ বৎসর পরে কেহবা দিয়াছে, কেহবা দেয়ও নাই। তাঁহার ধান বিতরণের সুখ্যাতি এখনও প্রাচীন লোকের মুখে শুনা যায়। টাকা লগ্নিও তাঁহার এক কারবার ছিল। গরিব দুঃখী ও মাতৃদায়, কন্যাদায় ও বিবাহ উপলক্ষে যে টাকা চাহিত তাহার সম্পত্তি থাকুক কি না থাকুক সে বিমুখ হইত না। এরূপ অনেক লোককে যে সকল টাকা দিয়াছিলেন তাহার অধিকাংশই উত্তরকালে আর আদায় হইত না।
  • achintyarup | 69.93.245.58 | ২৫ জুলাই ২০১৩ ০৪:৫৮559234
  • গুরুর প্রতি তাঁহার অচলা ভক্তি ছিল। আগরতলা রাজ্যের অন্তর্গতঃ ত্রিপুরা জিলার অধিন পত্তন নামক গ্রামের প্রসিদ্ধ গোস্বামী বংশ আমাদের বংশের গুরু। বৎসরে একবার গুরু মহাশয়গণ আমাদের বাড়ীতে আসিবার নিয়ম। যখন যখন গুরু মহাশয় আসিয়াছেন, শ্যাম রায় মহাশয় সাধ্যানুসারে তাঁহার সেবা পূজায় ত্রুটী করেন নাই এবং নিরতিশয় শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে ............ও করিয়াছেন। অন্যান্য লোকের সাধারণ ভক্তি অপেক্ষা তাঁহার অনেক বিশেষত্ব ......... গিয়াছে। তাঁহার নিষ্ঠা ও ভক্তি সম্বন্ধে এখনও প্রাচীন লোকের মূখে অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়।

    তাঁহার একপুত্র ও চারিকন্যা আমি দেখিয়াছি। সকলই অল্প বয়সেই মৃত্যুমুখে চলিয়া গিয়াছে, কেহই বংশের নিদর্শন (কোন) সুসন্তান রাখিয়া যায় নাই। ইহা দেখিয়া লোকে বলাবলি করে যে, শ্যাম রায় ধার্ম্মিক লোক ছিলেন, ঈশ্বর তাঁহার সদগতির জন্যই কোন সন্ততি রাখেন নাই। কুলাঙ্গার হইলে তাঁহার সদগতির ব্যাঘাত ঘটীত।

    জ্যেষ্ঠতাত রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ও বিশেষ ভক্তি... ছিলেন। তাঁহাকে যে ভাবে প্রত্যহ ত্রিসন্ধ্যা গোবিন্দজীর সিংহাসনের সন্মুখে পড়িয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিতে ও উচ্চস্বরে ভগবান্নামাবলী আবৃত্তি করিয়া প্রার্থনা করিতে দেখিয়াছি তাহা আজও ভূলিতে পারি নাই। অহর্নিশ কঠোর পাকা ভূমিতে পুনঃ পুনঃ কপালাঘাতে কপালের শীর্ষস্থানে উচ্চ কঠোর গুটীকা জন্মিয়াছিল। এই গুটীকা-সংযোগে যখন তিনি দুতালার উপর প্রণিপাত (?) আঘাত করিতে থাকিতেন, তখন নিম্নে থাকিয়া থাকিয়া সেই আঘাতের শব্দ শুনা যাইত এবং (?) আর্ত্তনাদ ধ্বনিতে পাষাণ হৃদয়েরও মন বিগলিত হইত।

    তিনি সকল কার্য্যেই ভগবানের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভর করিতেন। কথায়২ বলিতেন কৃষ্ণ যাহা করেন, তাহাই হইবে। তাঁহার জীবনে অতি সামান্য কার্য্যেও এরূপ নির্ভরশীলতা দেখা গিয়াছে। ঘোর বিপদেও তিনি অচল, অটল ও নির্ভিক চিত্ত থাকিতেন। বাড়ীর প্রায় সমস্ত ছোট বড় ঘর ১২৮২ সনের জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিবস আকস্মিক ঘূর্ণিবায়ুতে ভূপতিত করিল; আহার নিদ্রার স্থানাভাব প্রায়, জিনিশ পত্রের বিশৃঙ্খলা ও ক্ষতি এবং নানা প্রকার অসুবিধা উপস্থিত হইল। এ হেন সময়ে তাঁহার কন্যা নৃত্যময়ীর বিবাহ প্রস্তাব হইল। তিনি কালবিলম্ব না করিয়া তাহাতে স্বীকৃত হইলেন এবং সেই ভাঙ্গা বাড়ীতেই নানা অসুবিধা ও বিশৃঙ্খলার ভিতর বিবাহ দিতে উদ্যত হইলেন। বাড়ী শুদ্ধ সকলেই এই ব্যাপারে অসম্মত; রীতিমত কার্য্য হওয়ার স্থানাভাব বশতঃই বাড়ীর সকলেই কিছুকাল বিলম্ব করিয়া বিবাহের দিন ঠিক করিতে প্রস্তাব করিলেন; লোকে মন্দ বলিতে লাগিল; তিনি কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ করিলেন না। নিশ্চিন্তমনে বলিয়া উঠিলেন, 'কৃষ্ণ যাহা করেন তাহাই হইবে'। লোকের মন্দ শুনিলেন না, বিবাহ সেই অবস্থায়ই দিয়া ফেলিলেন। কোন বিষয়েই তাহাকে ব্যতীব্যস্থ হইতে দেখা গেল না।
  • achintyarup | 69.93.245.58 | ২৫ জুলাই ২০১৩ ০৫:১৩559235
  • জমীতে প্রচুর ফশল হইয়াছে, ফশল কাটাইবার কি উঠাইবার উপযুক্ত প্রায়। হঠাৎ বর্ষা হইয়া কি অন্য দৈব উৎপাতে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা হইয়াছে, সকলেই ব্যতীব্যস্থ হইয়া তাড়াতাড়ি নিজ নিজ ক্ষেত্রস্থ ফশল উঠাইয়া লইতেছে, তাঁহাকেও লোকে তাগাদা করিতেছে। তাঁহার ভ্রুক্ষেপ নাই, তিনি নিশ্চিত মনে বলিতেছেন-- 'কৃষ্ণ যাহা করেন তাহাই হইবে'। ফশল জলে ভাষাইয়া নিল, যেতক হয় লওয়া গেল, হয়ত অধিকাংশই নষ্ট হইয়া গেল, তিনি নিশ্চিন্ত, গুরুতর ক্ষতি হইয়াছে বলিয়া তাহাকে কিছু মাত্র উদ্বিগ্ন হইতে দেখা গেল না। এরূপ ঘটনা অনেকবার দেখা গিয়াছে। ক্ষতো সামান্য ক্ষতি নহে, খুব বড় রকমের গৃহস্তি, বিস্তৃত খামার, সময় সময় ক্ষতির গুরুত্ব খুব বেশী হইত।
  • achintyarup | 69.93.245.58 | ২৫ জুলাই ২০১৩ ০৫:২০559236
  • তিনি দুই বিবাহ করেন; প্রথম বিবাহের স্ত্রী নিঃসন্তান পরলোকগমন করিলে পর আর এক বিবাহ হয়। এই পক্ষে এক পুত্র ও তিন কন্যা সন্তান জন্মে। পুত্র মথুরের বয়ক্রম ৯/১০ বৎসর হইলে, সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ক্রমে তাহার মাতা ও দুই ভগ্নির মৃত্যু হয়। ঁরাজচন্দ্র রায় মহাশয় স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদ্বয়ের শোক এক কালেই প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু এই সময়ে একদিনও তাঁহাকে নিত্য নিয়মিত ঁবিশ্বম্ভরের সেবাপুজায় ত্রুটী করিতে কি শোক ব্যাকুলিত হইয়া কোন আচার নিষ্ঠায় অমনোযোগ করিতে দেখি নাই। অচল, অটলভাবে তাঁহাকে সব সহ্য করিতে দেখিয়াছি। ঈশ্বরের প্রতি একান্ত নির্ভরশিলতা না থাকিলে, হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাস ও ভক্তির প্রবলতা না থাকিলে কয়্‌ জন লোক এরূপ আপদ বিপদে অবিকৃত চিত্ত থাকিতে পারে?
  • achintyarup | 69.93.245.58 | ২৫ জুলাই ২০১৩ ০৫:২২559237
  • মিসটেক মিসটেক... *ক্ষতি সামান্য ক্ষতি নহে
  • achintyarup | 69.93.245.179 | ২৮ জুলাই ২০১৩ ০৩:২৩559238
  • এই টই যাঁরা পড়ছেন, নিচের প্রোজেক্টটি তাঁদের ইন্টারেস্টিং লাগতে পারেঃ

    http://www.indianmemoryproject.com/
  • achintyarup | 69.93.245.179 | ২৮ জুলাই ২০১৩ ০৩:৪৬559239
  • আমার পিতা মহাশয় বর্ত্তমান থাকা পর্য্যন্ত বৈষয়িক সমস্ত কার্য্যের ভার তাঁহার উপরই ছিল। রাজচন্দ্র রায় মহাশয় সাংসারিক ব্যাপারে বড় লিপ্ত হইতেন না, সুতরাং প্রথম হইতে শিক্ষা না করায় মামলা মোকদ্দমাদি জটীল ব্যাপারে তিনি অনভিজ্ঞ ছিলেন। পিতা মহাশয়ের মৃত্যুর পরে যখন সংসারের ভার তাঁহার উপর পড়িল, তখন শত্রু লোকেরা সুযোগ পাইয়া তাঁহাকে কুমন্ত্রণা দিয়া নানা মামলা মোকদ্দমায় জড়িত করিল। (আমি তখন স্কুলে পড়ি।) সরল বিশ্বাসের সহিত দুষ্ট লোকের কুমন্ত্রণায় কাজ করিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হইতে লাগিলেন এবং পরিশেষে ঋণভারে জড়িত হইলেন। বহুতর টাকা তাঁহার নিজ তহবিলের লগ্নি ছিল, সে সকলের অধিকাংশ খাতকই দেউলীয়া প্রকাশ পাইল। তাহা হইবার কথাই; তাঁহার টাকা লগ্নির কথা ভাবিলেও তাঁহার হৃদয়ের কত মহত্ব ছিল তাহা বুঝা যায়। যে ব্যক্তি বিবাহের জন্য, হালের গরু খরিদ করার জন্য কি এইরূপ কোন ঠেকা কার্য্যের জন্য টাকা করজ চাহিয়াছে তাহাকে কখনও বিমুখ করিতেন না। সে গরিব হউক, দুঃখী হউক, তাঁহার টাকা আদায়ের সংস্থা কিছু থাকুক বা নাই থাকুক বিনা জামিনে অনেক সময় বিনা খতে টাকা দিতেন। এইরূপ লগ্নির বহু টাকাই অবশেষে মারা গেল। তাহা আদায়ের জন্য তিনি যে বড় বেশী চেষ্টা করিয়াছেন এরূপ দেখা যায় নাই।

    ঋণভারে যখন জড়িত হইয়া পড়িলেন সে সময়ে আমি স্কুল ছাড়িয়া বাড়ী গেলাম। পড়ার খরচ বন্ধ হইল, আমাকে সংসার দেখিতে বলিলেন।

    এই সময়ে তাঁহার সহিত আমার মতান্তর ঘটীল। সহসা সম্পূর্ণ ভাবে সর্ব্ববিষয়ে তিনি আমার প্রতি ভারার্পণ করিতে চাহিলেন না এবং ঋণ আদায়ে তাঁহাকে শিথিল প্রযত্ন দেখিয়া, আমি ঋণ আদায়ের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলাম। এই সময়ে তিনি পৃথকান্ন হইলেন। ইহা ১২৮৩ সনে ঘটীল, তখন তাঁহার বয়স প্রায় ৮০ বৎসর হইবে। বৃদ্ধ হইলে লোকের মতিভ্রম ঘটীয়া থাকে, বোধহয় এই কারণেই এরূপ করিলেন। নিজে পাক করিয়া খাইতেন, কেহ পাক করিবার ছিল না। কিছু দিন তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুরবাটীর সম্পর্কিত কোন বিধবা আত্মীয়াকে আনিয়া পাকাদির জন্য রাখিয়াছিলেন। পরে শেষ কালে মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্ব্বে আবার আমাদের সহিত একান্ন থাকিয়াই ১২৯৩ সনের পৌষ মাসের শেষভাগে লীলা শেষ করিয়া গিয়াছেন।
  • achintyarup | 69.93.245.179 | ২৮ জুলাই ২০১৩ ০৪:১৩559240
  • এই যে আমাদের সহিত নানা বিষয়েই মতান্তর ঘটীল, তথাপি তিনি আমাদের প্রতি মমতাহীন হন নাই। ২/১ বৎসর গোলমালের পর ১২৮৪ সনের শেষ ভাগে তিনি তাঁহার সম্পত্তির বার আনা অংশ আমাদিগকে কাওলা করিয়া দিলেন এবং সমস্ত ঋণভার হইতে মূক্ত হইলেন। শত্রু লোকের ইচ্ছা ছিল যে তাঁহার নিকট হইতে সম্পত্তির অংশ খরিদ করিয়া আমাদিগের সহিত বিবাদ বাঁধায়, কিন্তু তিনি তাহা করিলেন না। অবশীষ্ট যে চারি আনা অংশ ছিল তাহাও তিনি ১২৯৩ সনের পৌষ মাসে মৃত্যুর কিয়দ্দিবস পূর্ব্বে উইল করিয়া আমাদিগকে দিয়া গিয়াছেন। তাহার বর্ত্তমান কন্যা ও দৌহিত্রের জন্য কিঞ্চিৎ বার্ষিক বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছেন। এ সকল কার্য্যেও তাঁহার যথেষ্ট উদারতা ও মহত্ব প্রকাশ পাইয়াছে। বিষয়ে অনাশক্তি ও ভগবানের প্রতি প্রবল ভক্তি তাঁহার কার্য্যতা দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়।

    তিনি প্রাণিহিংসার খুব বিরুধি ছিলেন, মাছ প্রায় খাইতেন না, গরুকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করিতেন। কুকুর বিড়ালকে যথোচিত স্নেহ প্রকাশ করিতেন। একটী কুকুরকে তিনি আহারান্তে দুই বেলাতেই পাতাবশিষ্ট ভাত হাতে করিয়া নিয়া দিতেন। তাঁহার মৃত্যুর পর দিন দেখা গেল সেই কুকুরটী তাঁহার ঘরের সন্মুখস্থ প্রাঙ্গণে উত্তরশিরা হইয়া পড়িয়াছে। বাটীস্থ সকলেই কৌতুহলী হইয়া দেখিলেন সেই কুকুর মৃত, তাহার সংজ্ঞা নাই। সকলেই বলিতে লাগিল বড় রায় মহাশয় (তাঁহাকে সকলই বড় রায় মহাশয় বলিয়া সম্বোধন করিত) এই কুকুরকে ভাত দিতেন, তাঁহার সঙ্গেই কুকুরও মরিয়া গেল, অর্থাৎ তাঁহার দুঃখেই কুকুর ইচ্ছা করিয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিল। এই ঘটনা সামান্য হইলেও সকলেই খুব আশ্চর্য্যান্নিত ও কুকুরের আকস্মিক মৃত্যুর কারণপ্রকাশে অক্ষম হইল।

    তাহার মৃত্যু পূণ্যবানের মৃত্যুর ন্যায়ই ঘটীল। উত্তরায়ণ, দিবা ভাগে পৌষ সংক্রান্তির পূর্ব্বদিবসে তাহার মৃত্যু হইল। বিশেষ কোন রোগে তাঁহাকে মৃত্যুকালে অধিক অজ্ঞান হইতে দেখা যায় নাই। মৃত্যুর পর গ্রামশুদ্ধ লোকে হরিসংকীর্ত্তন করিতে২ তাঁহার দেহ নদীপারে লইয়া গিয়া সৎকার করিল। কন্যা অগ্রগণ্য শ্রাদ্ধাধিকারিণী-- তিনি গঙ্গাপার কলিকাতায় বাস করিতেছিলেন -- ১ম পিণ্ড তিনি গঙ্গায়ই দিয়াছেন। পরে মাসান্তে আমি যথারীতি শ্রাদ্ধক্রিয়া আমার সাধ্যানুসারে বাড়ীতে সম্পাদন করিয়াছি। এরূপ অবস্থায় তাঁহাকে বিশেষ পূণ্যবান বলিতে আর দ্বিধা কি?
  • achintyarup | 69.93.245.179 | ২৮ জুলাই ২০১৩ ০৪:৩৭559241
  • আমার পূজ্যপাদ পিতাঠাকুর ঁরামকানাই রায় মহাশয়, তাঁহারা তিন ভ্রাতার মধ্যে সর্ব্বকনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি শ্যাম রায় মহাশয়ের পৃথক হওয়ার পর হইতেই বৈষয়িক কার্য্যে প্রবেশ করেন। তাঁহার অতুল সাহস ও শক্তির জন্য তিনি প্রশংসিত ছিলেন। এমনকি নিকটস্থ যে সকল হিন্দু মুশলমান সে সময়ে শারীরিক বলে বলীয়ান ছিল সকলেই তাহাকে সন্মান ও ভয় করিত। কিন্তু তাঁহার যেরূপ অমিত শারীরিক বল ছিল, ততোধিক পরিমাণে তিনি ধৈর্য্যশীল ছিলেন। এই ধৈর্য্যই তাঁহার সন্মানের কারণ। তিনি বহু দুষ্ট প্রকৃতির প্রবল শত্রুর সহিত অনেক বিষয়ে বিপদাপন্ন হইয়াও মোকদ্দমাদি করিয়াও শত্রুদিগের নিকটও পরিশেষে প্রশংসিত হইয়াছেন।

    ঁশ্যাম রায় মহাশয় যে সকল সম্পত্তি ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, সেই সকল সম্পত্তি নিয়া তাঁহার সময়ে তিনি অনেক মোকদ্দমা করিয়াছেন। মোকদ্দমাদি উপলক্ষে, সেই সময়ের দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়া নানা প্রকার কষ্ট সহ্য করিয়া তিনি কলিকাতা বার বার যাতায়াত করিয়াছেন। তাঁহার মত কষ্ট সহিষ্ণুতা কম লোকেরই থাকে। তাঁহার পূর্ব্ববর্ত্তির সময়ে যে সকল সম্পত্তি বিনষ্ট হইয়াছিল, যদিও তিনি তৎসমস্ত উদ্ধার করিতে পারেন নাই, কিন্তু তাহার সময়ে আর কোন সম্পত্তি নষ্ট হইতে পারিল না। তিনি সাংসারিক সমস্ত কার্য্যেই বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এবং তাঁহার সময়ে সংসারের যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। তাঁহার অধ্যবসায় ও যত্নে বিস্তৃত গৃহস্তির কারবার হইতে প্রভূত আয় হইতে লাগিল। নিজ তালুক জমীর ভাল সাশন সমরক্ষণ চলিল। বহুতর মহাল ইজারায় আবদ্ধ করিয়া আয়ের পথ প্রশস্থ করিয়া তুলিলেন। বহুতর লোক তাহার ধৈর্য্য ও সৌজন্যে বশীভূত হইল।
  • achintyarup | 69.93.245.179 | ২৮ জুলাই ২০১৩ ০৪:৪৫559242
  • এই সময়ে অনেক ব্যয় সঙ্কুল বৃহৎ বৃহৎ কার্য্য সকল সম্পন্ন হইতে লাগিল। পুষ্করণী কাটান ও অন্দরখণ্ডের পৃথক ব্যবস্থার কথা পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি। শ্যাম রায় মহাশয়ের বড় ও মধ্যম কন্যার (বড় দিদি ও মধ্যম দিদির) বিবাহ মহা সমারোহে ও বহুব্যয়ে দেওয়া হইল। এই সকল ব্যাপারের পূর্ব্বেই শ্যাম রায় মহাশয়ের মৃত্যু হইয়াছিল। আমার জন্মের প্রায় তিন বৎসর পরেই শ্যাম রায় মহাশয়ের মৃত্যু হয়।

    আমার ৫/৬ বৎসর বয়সের সময় আমি এবং উভয় জ্যেষ্ঠতাত পক্ষের ভ্রাতাদ্বয় ও কয়েকটী ভগ্নির চূরাকর্ম্ম (কর্ণভেদ) ক্রিয়া খুব ধূম ধামের সহিত ব্যয়বাহুল্যে সম্পন্ন হইল।

    ঁরাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের দ্বিতীয়বারের বিবাহও পিতামহাশয়ের কর্তৃত্বেই সম্পন্ন হইয়াছিল। ইহা ঐ সকল ব্যাপারের পূর্ব্বে হইয়াছিল। শ্যাম রায় মহাশয়ের শ্রাদ্ধ ক্রিয়া ইত্যাদি ব্যয়বাহুল্যজনক অনেক কার্য্যই তাহার সময়ে সুসম্পন্ন হইল।
  • achintyarup | 69.93.246.56 | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০৫:২২559244
  • তিনি যে কেবল ঐ সকল বৈষয়িক কার্য্যেই তৎপর ছিলেন, দেব কার্য্যে যে তাহার অনুরাগ ছিল না এমন নহে। তবে তাহার ভক্তি নিষ্ঠা, তাঁহার অগ্রজদ্বয়ের ন্যায় বাহিরে তত প্রকাশ পাইতে দেখা যায় নাই।

    তিনি দস্তুর মত আচার ব্যবহারের অনুষ্ঠান করিয়া কৌলিক রীতি রক্ষা করিতেন। সাধ্যানুসারে যথ সময়ে দেবকার্য্য সকল করিতেঅন। সময়২ বিশেষ বিশেষ ভাবে তাহার ভক্তি প্রকাশ পাইত। বৎসরের মধ্যে নানা ক্রিয়া উপলক্ষে অনেকবারই ব্রাহ্মণভূজন করাইতেন। ইহাতে তাহার বিশেষ শ্রদ্ধা ভক্তি দেখা যাইত। দুষ্প্রাপ্য মনোরম জিনিশাদি সংগ্রহ করিয়া ব্রাহ্মণ ভূজনের ব্যবস্থা করিতেন। ভাল মধু অনেক সময়েই দুষ্প্রাপ্য। তাঁহাকে দেখিয়াছি, উৎকৃষ্ট মধু নিজে মৌচাক্‌ হইতে প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করিয়া, অপরিমিতরূপে প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে ভূজন সময়ে দান করিতেন। ব্রাহ্মণগণ মধুপানাধিক্যে হর্ষলাভ করিয়া তাঁহার ভক্তির প্রশংসা করিতেন। কখন দেখিয়াছি দুষ্প্রাপ্য কালীয়া জিরার চাউল ও 'বাছা' মাছ সংগ্রহ করিয়া সেবার কেবল তাহাই প্রচুর পরিমাণে প্রধান খাদ্যদ্রব্যরূপে দিয়া ব্রাহ্মণগণকে সন্তুষ্ট করিতেন। এরূপ নানা সময়ে নানা মনোমুগ্ধকর দ্রব্য যাহা সাধারণে সংগ্রহ করিতে অপারগ হইত তাহাই দিয়া তিনি ব্রাহ্মণগণকে পরিতুষ্ট করার চেষ্টা করিতেন। হৃদয়ে ভক্তি বিশ্বাস না থাকিলে ব্যয় ও পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কেহ এরূপ করে না। ইহা ছাড়া অন্যান্য দেবকার্য্যেও তাহাকে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা করিতে দেখা গিয়াছে। হরিসংকীর্ত্তনেও তাঁহার খুব অনুরাগ ছিল। তাঁহার মত কেহ করতাল বাদন করিতে পারিত না। হরিসংকীর্ত্তনে এইটা তাঁহার নিত্য কার্য্য ছিল। এখনও লোকে তাহার করতাল ধ্বনির মিষ্টত্ব ও পটুতার বিষয়ে আলোচনা ও সুখ্যাতি করিয়া থাকে।

    ১২৭৩ সনে তিনি তীর্থ ভ্রমণে পশ্চীমাঞ্চলে যান। ঁকাশীধাম পর্য্যন্ত গিয়াছিলেন। তাঁহারা তিন ভ্রাতার মধ্যে তিনিই ঐ কার্য্যে সক্ষম হইয়াছিলেন; অন্য কেহ পারিয়া উঠেন নাই।

    ইহার পর তিনি একবার কলিকাতায় গমন করেন। তালুক শিবরাম পশুরাম (?) সম্বন্ধে নিজ গ্রামের গোপীনাথ চক্রবর্তীদিগের সহিত জেলার সবর্ডিনেট জজ আদালত পর্য্যন্ত মোকদ্দমা হইয়া অবশেষে হাইকোর্টে আপীল হইলে তদ্বিরার্থ তথায় গমন করেন। তথা হইতে আসিয়া ঐ মোকদ্দমার বিষয়ে সর্ব্বদাই চিন্তিত রহিলেন। এই মোকদ্দমাই তাঁহার কাল হইল। হাইকোর্টে মোকদ্দমায় পরাজয়ী হইয়াছেন এই সংবাদ পাওয়ার কিয়দ্দিবস পরেই তিনি জ্বর রোগে অকস্মাৎ কাতর হইলেন। জ্বরজারী অতি সামান্য ব্যারাম বলিয়া তাঁহার ধারণা ছিল; বিশেষ সতর্কতা নিলেন না, রোগ, বিকারে পরিণত হইল। তখন আশ্বীন মাস, স্কুলের বন্ধের সময় ছিল, কাজেই আমিও বাড়ীতে ছিলাম। যখন তিনি শয্যাগত হইয়া পড়িলেন, প্রলাপ বকিতে লাগিলেন তখন আমরা ব্যস্ত হইয়া কবিরাজ ডাকিলাম। নিকটে তখন ডাক্তার কবিরাজ কেহ ছিল না। বাজিতপুর হইতে এক কবিরাজ আনিলাম, ঔষধাদির ব্যবস্থা হইল, কিন্তু কবিরাজ মহাশয়ের ভাব ভঙ্গি দেখিয়া বুঝিলাম, রোগ কঠিন হইয়া দাঁড়াইয়াছে, বাঁচিবার ভরষা অতি কম!! সকলেরই হৃদয় ভাঙ্গিয়া পড়িল!! কয়েকদিন চিকিৎসা চলিল, কিন্তু কিছুতে কিছু হইল না। ১৮ দিনের জ্বর ভোগের পর পরিশেষে লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাত্রিতে তিনি (১২৭৭ সনের আশ্বীন মাসে) আমাদিগকে শোকসাগরে ভাষাইয়া স্বর্গধামে চলিয়া গেলেন। তখন আমার বয়স ১২ বৎসর গত হইয়া ১৩ তেরয় পড়িয়াছে। লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাত্রি বড় আনন্দের রাত্রি, কিন্তু আমাদের অন্তর বাহির নিরানন্দে ভরিয়া গেল। আমার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল! এতকাল যেন আমি এক বৃহৎ বৃক্ষের ছায়ায় অত্যন্ত আরামের সহিত বাস করিতেছিলাম, অকস্মাৎ কোথা হইতে প্রবল ঝড় আসিয়া যেন সে বৃক্ষ উড়াইয়া কোথায় লইয়া গেল। আমি অনাবৃত ময়দানে পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিলাম! আমার সকল আশা ভরষা ফুরাইল!!

    পিতা মহাশয়ের বড় সাধ ছিল যে আমাকে তিনি লিখাপড়ায় বিজ্ঞ করিয়া রাখিয়া যাইবেন। কিন্তু তাহার সে সাধ পূর্ণ হইল না। অতি অকালে ৪৫ বৎসর বয়সের সময় দুরন্ত কাল তাঁহার সাধের ঘর ভাঙ্গিয়া দিল!! সেই সঙ্গে সঙ্গে আমারও অদৃষ্টের বিড়ম্বনার সূত্রপাত হইল।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন