এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • শান্তিনিকেতন যাবার গপ্প

    শঙ্খ
    অন্যান্য | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ | ১৬৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩১572869
  • পুজোবার্ষিকী পড়ে আশাহত?
    প্রিয় লেখকদের অধঃপতন দেখে মর্মাহত?
    মনের মধ্যে অনাভিধানিক খিস্তির ফল্গুধারা অব্যাহত?

    পড়ে ফেলুন এই ব্লগঃ শান্তিনিকেতন যাবার গপ্প। একদম ফ্রী। ফ্রেশ। এই সাড়ে সাতশোর গ্যাসের বাজারেও। ভাবা যায়?

    শান্তিনিকেতন শুনেই 'দাদুফোবিয়াতে' আঁতকে উঠবেন না। মোটেই প্রতি প্যারার বাম্পার টু বাম্পার সিগনালে গীতবিতানের টুকলি নেই, এমনকি ধনধান্যে পুষ্পধারাও নেইকো। আদতেই কি আছে, পড়ার পর 'ঢুঁড়তে রহে যাওগে'।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩২572880
  • তখন থার্ড ইয়ার। অটোমাটা আর অপারেটিং সিস্টেম পড়ে পড়ে গৃহত্যাগী হতে আর বেশি বাকি নেই। এদিকে ক্যাম্পাসিং ও স্টার্ট হয়নি। ক্যাম্পাসিং এর আগের বন্ধুত্ব একরকম হয়, পরের বন্ধুত্ব আরেকরকম। তো আমরা কয়েকজন বন্ধু ঠিক করলাম, এই আগের বন্ধুত্ব বরকরার থাকতে থাকতেই কাছেপিঠে কোথাও একটু ঘুরে এলে হয়।

    দীঘাঃ দূর দূর, লোকে মামাবাড়ির থেকে বেশি দীঘা ঘুরে এসেছে। ও প্ল্যান বাতিল। বকখালি? ন্যাহ। ব্যাটার নামে 'খালি', কাজেও খালি। নর্থে যাওয়া যাবে না, বর্ষাকাল। গরমে যেমন কেউ রাঢ় বঙ্গে ঘুরতে যায়না (নেহাত সেলসের চাকরি না হলে), তেমনি বর্ষাকালে নর্থ বিপজ্জনক। পেপারে রোমাঞ্চকর সব কাহিনী লেখে। কারগিল যুদ্ধের আগে আমার কেমন একটা ধারণা ছিলো, সেনাবাহিনী শুধু ধস নামার পরে রাস্তা সারায় আর সীমান্তের গ্রামে গ্রামে ইন্টু পিন্টু করে। মাইরি বলছি, এই ভাবমূর্তি তৈরি করেছে খবরের কাগজগুলো।

    ঘুরে ফিরে পড়ে থাকলো সেই শান্তিনিকেতন।

    ------------------------------

    সেই আমলে শান্তিনিকেতন বলতেই 'অ্যাই গরু সর' মনে পড়তো না। ওটা খুব সম্ভবতঃ মীর আর ঋতুপর্ণর মিলিত শ্রমের ফসল। (নো রিডিং বিটুইন লাইন, ইউ 'ইয়ে' মাইন্ডস)।

    শান্তিনিকেতন বলতে তখন মনে আসত প্রচুর সবুজে মোড়া একটা আধা গ্রাম আধা শহর এলাকা, যার সিক্সটি পার্সেন্ট কলকাতার লোকে কিনে ফেলেছে, আর স্টেশনে আচার বিক্রি করা দু একজন বাদে প্রায় সবাই রেগুলার কলকাতা বা বিদেশে ঘোরাঘুরি করে। বাউল মানেই পকেটে ডলার আর আসলি গাঁজা। কোথায় লাগে ডেভিড গিলমোর আর তার শাইন অন ইউ ক্রেজি ডায়মন্ড, তেনারা গিটারের মত একতারা আর একতারার মত গিটার বাজাতে সিদ্ধহস্ত। হোটেল বা লজ নিয়ে চাপ নেই, ওখানে গিয়ে আরবিট ঢিল ছুঁড়লে হয় হস্তশিল্পের দোকানে লাগবে, নইলে লজের সাইনবোর্ডে গিয়ে লাগবে।

    তার ওপরে আরো একটা ইনসেন্টিভ পাওয়া গেছে। একবন্ধুর জন্মদিন গেছলো কিছুদিন আগে। তাকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি আদায় করা গেছলো, এখন বলছে, কলকাতায় খাওয়ালে বেদুইনের রোল খাওয়াবে। তারচেয়ে আমরা যদি এই ট্রিপে যাবার পথে বর্ধমানে তার বাড়ি হয়ে ঘুরে যায়, তাহলে উৎকৃষ্ট খাসির মাংস খাওয়াবে। সীতাভোগ, মিহিদানা তো থাকবেই।

    হায় সত্য যুগ, তোমার আমলে এই সব প্রলোভন থাকলে লোকে ইন্দ্রত্ব প্রাপ্তির ধ্যান ছেড়ে দৌড় লাগাতো, আমরা নেহাতই সরলমতি থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা অনুচিত বলে শাস্ত্রে লিখেছে, কাজেই একটু আপত্তি করার ভান দেখিয়ে (যতটা করলে লোকে একেবারে হাঘরে ভাববে না, আবার 'থাক তাহলে' বলে কাটিয়েও দেবে না) তড়িঘড়ি দিনক্ষণ পাকা করে নিলুম।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৩572891
  • কোন একটা সপ্তাহের শুক্রবারে কি একটা ঘোড়ার ডিমের ছুটি ছিল। স্কুল কলেজে এই সব লে লে বাবু ছ আনা ছুটি গুলো খুব পেতাম (স্কুল কলেজের টিচারদের এইখানটায় ওনিডা টিভির ঈর্ষা দিয়ে গেলুম। রানারা আপনাদের ছুটির দিনে বাথরুম ক্লিনিং করার শাপ দিবেন)। স্কুলে পড়ার সময় ক্লাস এইটের পর আর ছুটির কারণও জানতে চাইতুম না। সে যাকগে, তো শুক্রবার ছুটি, বৃহস্পতিবারে প্রক্সি মারার সুবন্দোবস্ত করে ঠিক হল সকাল সকাল বর্ধমানের ট্রেন ধরা হবে।

    আচ্ছা, দিন ক্ষণ বার এত অ্যাকুরেট বলছি কি করে কারুর সন্দেহ হচ্ছে না? ডিটেল বানিয়ে দিতেই পারি, কিন্তু, মাকালী বলছি এই লেখাতে সেটা করিনি। একেবারে ডিটো মনে আছে, তার যথেষ্ট কারণ আছে। ক্রমশঃ প্রকাশ্য।

    বুধবারের রাতে শুতে যাবার জানালার বাইরে তাকিয়ে মনে হল বৃষ্টিটা প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই পড়ে চলেছে।

    আমাদের প্ল্যান এইরকম ছিলোঃ যে বন্ধুর বাড়ি, সে দু একদিন আগেই চলে গেছে। আমরা চারজন কো-অর্ডিনেট করে কলকাতা থেকে যাবো। হাওড়া স্টেশনে মীট হবে সক্কাল সক্কাল। দুপুরে বার্ডোয়ান। দুপুরটা ডাইনিং রুমে কাটিয়ে বিকেলের ট্রেন ধরে চলে যাব শান্তিনিকেতন।

    চলে যাব - তবু আজ দেহে যতক্ষণ আছে প্রাণ
    প্রাণপণে মাটন কারির সাঁটাবো মাংস আর আলু

    কোন নবজাতক শুনলে আঁতকে আবার মায়ের পেটে ঢুকে যাবে, তাই নিজেরা নিজেদের কাছেই দৃঢ় অঙ্গীকার করে রেখেছি। তবে খেয়াল রাখতে হবে মিহিদানা আর সীতাভোগের জন্যেও যেন ইঞ্চিখানেক জায়গা থাকে। কোন সুখাদ্যের প্রতি অবিচার করাটা ন্যায়সঙ্গত না।

    পেট শান্ত হলে মনে কবিত্ব আসে, সেটা জানার জন্যে সুকান্তের কবিতা পড়ার দরকার নেই। সব ঠিকঠাক চললে রাত্রে কবিগুরুর আলোচনায় ভুবন না হোক, ভুবনডাঙ্গার মোড় ভরিয়ে দেবো এমনটাই সাব্যস্ত হল।

    কলেজে, রাখতে হয় বলে রাখা, আরো অনেক মনীষীদের ছবির মাঝে স্যারের ছবিতে বিদ্রুপের হাসি দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে যে ঢাকা পড়ে গেছিলো, সেটা তখন বুঝতেই পারিনি।

    বুধবার রাতের বৃষ্টির পর থেকেই সন্দেহটা দানা বাঁধতে শুরু করলো।

    -------------------------------------

    সেই ঢাকার কুট্টির গল্প বেরিয়েছিলো আনন্দমেলায়। কুট্টি প্রতিদিন দেরি করে কাজে আসে বলে মালিক একদিন কড়কে দেবার মনোবাসনা নিয়ে কুট্টিকে তলব করলেন, কি হে মিঁয়া, ডেলি ডেলি দেরিতে আসছো যে বড়? কুট্টি কান এঁটো করা হাসি দিয়ে বলে, কত্তা ধইরেসেন ঠিকোই। আসি দেরি কইর‌্যা। কিন্তু তাড়াতাড়ি যে সইল্যা যাই, হেইডা কত্তা দ্যাহেন নাই?

    ভোর ভোর উঠতে হলে সেই রাতে কেন জানি ঘুম আসতে বেজায় দেরি হয়। একেবারে ঢাকাইয়া কুট্টি কেস।

    আরো অনেক কিছুর মত ঘুমের ওপরেও কন্ট্রোল নেই, এপাশ ওপাশ করতে হয়, স্নায়ু উত্তেজিত থাকে, তেষ্টা পায়, জল খেতে হয়, বেশি জল খেয়ে ফেললে টয়লেটে ছুটতে হয়, তখন ঘুম আরো চটকে যায়; পুউরো আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের মতন ভিশিয়াস সার্কেল। আর ঠিক যেই মুহূর্তে মনে হয় ঘুমটা টুলটুল রাঙা পায়েতে আসি, আসবো করছে, একান্ত মুহূর্তে ছাতের ঘরে প্রেমিকার বাবার আগমনের মত অ্যালার্মের অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স আর্তনাদ।

    সেই বুধবার রাতেও এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় হলো না। কিন্তু অ্যালার্মকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে উঠে মনে হল যাঃ শাল্লা ইয়ে কাঁহা আ গয়ে হাম? শোবার আগে ভুলভাল টাইম সেট করিনি তো?

    বাইরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, যাকে হেমেন রায়ের ভাষায় বলে 'ঘোর তমিস্রাচ্ছন্ন', এদিকে দেওয়াল ঘড়িতেও বলছে কাক ডাকা ভোর হয়ে গেছে, ধড়মড়িয়ে উঠে জানালা খুলে মনে হল চেরাপুঞ্জি মৌসিনরামে চলে এসেছি, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ে চলেছে, ঘন্টাখানেক তো অনেক পরের কথা, মাসখানেকের আগে এই বৃষ্টি থামবে বলে মনে হচ্ছে না। হু হা এলোমেলো বাতাস লাটপাট খাচ্ছে। জানালার বাইরে যতদূর চোখ গেল রাস্তায় জনপ্রাণী দেখলুম না, ইনফ্যাক্ট রাস্তাটাই দেখলুম না। কুলকুল করে একটা খাল যেন বয়ে চলেছে। ঠিক যেন আমার দেশের বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে যাওয়া 'কুলিধারের খাল'।

    লোকজন আজকাল কলকাতাকে লন্ডন বানাবার জন্যে লাফায়, কিন্তু কলকাতার মধ্যে ইন বিল্ট একটা ভেনিস হবার সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল, সেটা কারুর নজরে এলো না। বর্ষাকালে, এমনকি পাঁচটা ব্যাঙের সম্মিলিত হিসিতেও অবধারিত ভাবে উত্তর কলকাতা, ঠনঠনে, সিমলেপাড়ায় রাস্তাঘাট জলের নিচে চলে যায়, পেপারে ছবি দেখে সেই ট্রামে কাটা পড়া ভদ্রলোক কেন 'কল্লোলিনী' লিখে গেছলেন পরিস্কার বোঝা যায়, আফসোস, কয়েকটা গন্ডোলা নামিয়ে আমোরে মিও গাইলে বাকিটুকু মানে 'তিলোত্তমা' সম্পূর্ণ হত, সেরেফ ঐটুকুর জন্যে উত্তর কলকাতা আর ভেনিস হয়ে উঠতে পারলো না। সিএমসি (এখন কেএমসি)-দেরকে কে বোঝাবে, জল স্রেফ জমালেই হয়না, নৌকা টৌকারও ব্যবস্থা রাখতে হয়। এরাও তাই সেই 'চোরপোরেশান' হয়েই থাকলো।

    সাউথে অবিশ্যি বেশির ভাগ জনগণ পদ্মা মেঘনার দ্যাশের লোক বলে নাকি কে জানে, তেমন একটা জল জমে না, প্রকৃতিও জানে খাল-নদী এইসব দেখিয়ে খাপ খোলা যাবে না। আমাদের মেন রাস্তাতে তো বটেই, গলিতেও কোনদিন জল জমতে দেখিনি। সেখানে যদি রাতারাতি আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে দেখা যায়, তার মানে উত্তরে হয়তো হেলিকপ্টার থেকে ধাঁই ধুপাধুপ কম্বল আর চিঁড়ে বিলি হচ্ছে।

    টেলি-কন শুরু হয়ে গেল একটু ক্ষণের মধ্যেই। একজন কেষ্টপুরে থাকে, সে সোজাসুজি বললো, প্ল্যান ক্যানসেল। তার বাড়ি থেকে বাস রাস্তাটুকু যেতে গেলেও সেই নন্দ ঘোষের কৃষ্ণকে নিয়ে ফেরার সময় যেমন বাসুকি নাগ মাথার ওপরে ফণার ছাতা ধরেছিলো, সেই রকম আল্টিমেট প্যাকেজ ডিল দরকার। এ জিনিস কে সি পাল উইথ ঝাঁকামুটের কম্ম না।

    অন্য দুজন বন্ধু জানালো তাদের অবস্থা ততটা খারাপ না, জল জমেছে, জল বাড়ছে, কিন্তু বারমুডা মোটামুটি ভদ্র উচ্চতাতে তুলে পেরোনো গেলেও যেতে পারে। মেইন রাস্তা দিয়ে নাকি আর্তনাদ করতে করতে দু একটা বাস যাচ্ছে। আজকের দিনেও যখন বেরোতে হয়েছে, 'সুক সপনে, সান্তি সশানে' কথাটা যে বাসগুলোর পেছনে লেখা থাকে, বানানভুল হলেও নেহাত মিথ্যে লেখেনা তাহলে লোকগুলো!!

    বর্ধমানের বন্ধু বেশ আরাম করেই ঘুমোচ্ছিলো, তাকে জাগিয়ে যখন বলা হল, যাত্রা বাতিল, কেউ আসছিনা, শুনে একেবারে আঁতকে উঠলো। সে লাস্ট ঐরকম চমকেছিলো সেকেন্ড ইয়ার ফার্স্ট সেমে, যেদিন ইলেকট্রনিক্স পরীক্ষার দিনে সিগন্যাল প্রসেসিং পড়ে চলে এসেছিলো। সব আয়োজন হয়ে গেছে আমরা না এলে সব মাটিং চকার। কাঙ্গালী ভোজন করিয়ে দে, বলার সাহস হল না, হয়ত বলে বসবে, সেটার জন্যই আমাদের আসাটা দরকার।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৪572902
  • 'বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না', এই কথাটা নিছকই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আট নাম্বারের 'কবি কি বলতে চেয়েছেন ব্যাখ্যা কর' টাইপ কোশ্চেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কথাটার মধ্যে অনেকখানি সত্যি লুকিয়ে আছে। পর্ষদেরই টেস্ট পেপারের সাজেশান পড়ে যাওয়া ছেলেপুলে তো বটেই, ইনফ্যাক্ট আরো কত কোটি লোক যে বেঁচে আছে কেবলমাত্র একটুখানিক আশা বুকে নিয়ে, সেটা ভাবলেও ভাগ্যবান লাগে।

    এই যেমন সেই দুর্যোগের দিনে আমরাও মরে যাওয়া আশার মুখে চোখে জল থাবড়ে বার বার বাঁচিয়ে তুলছিলাম। তা নইলে বাইরে হুড়ুম-দুড়ুম বৃষ্টি, এ-ওকে-তাকে ফোন করে, 'কিরে কি অবস্থা' জানতে জানতে অজান্তেই কেন 'শিট-শেভ-শাওয়ার' সেরে তৈরি হবার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তার কোন ব্যাখ্যা নেই। শেষ মেষ অবস্থাটা এরকম দাঁড়ালো, আমরা তিনজনে রেডি, যে ট্রেনে আমাদের যাবার কথা সেটা আর প্রায় একঘন্টা পরে হাওড়া থেকে বেরিয়ে যাবে, প্রোভাইডেড হাওড়া থেকে ট্রেন চলার মত অবস্থা আছে। বৃথা আশা ছাড়া একে আর কি-ই বা বলা যায়? বছর খানে আগে পুজোর সময় ঐ হাওড়া থেকে ট্রেন ধরতে গিয়ে বড়বাজারের জ্যামে চল্লিশ মিনিট বাসে কাটিয়েছি। শেষ-মেষ ব্রীজের কাছে এসে আর পোষায় নি, দুটো ইয়া গোব্দা ভারি ব্যাগ হাতে নিয়ে ব্রীজের ওপর দিয়ে ছুটেছি। অসহ্য রাগে, আটকে থাকার যন্ত্রণায়, বাড়ি ফেরার তাড়ায় আর বেঢপ ব্যাগ নিয়ে ব্রীজের ওপরে ওঠার কষ্টে এক অবর্ণণীয় শূন্যতা তৈরি হয়েছিল ভেতরে।

    সেখানে একঘন্টায় দক্ষিণ কলকাতা থেকে হাওড়া চলে যাবো, এরম আব্দার মামাবাড়িতে করলেও গাঁট্টা খাওয়া উচিত।

    তবুও, আশায় বাঁচে চাষা।

    কেউ একজন এদিক সেদিকে ফোনে করে 'ভেতরের খবর' জানালো, হাওড়া থেকে কিছু কিছু ট্রেন চলছে। বিশেষ করে বর্ধমান লাইনে সেরকম খুব একটা ট্রেন নাকি বাতিল হয়নি। খোদাই মালুম, এই সব কোথা থেকে জানা যায়, তবে আমরা মরিয়া হয়ে ঠিক করলুম, ট্রাই করেই দেখা যাক একবার। বেশিকে বেশি কি হবে, পরের ট্রেনে অনেক দেরি করে বর্ধমানে পৌঁছাবো।

    জুতো ব্যাগে নিয়ে, চপ্পল পায়ে বারমুডা আর টিশার্ট পরে হাঁটু সমান জল পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি ত্রিসীমানায় জনপ্রাণী নেই। গলিগুলোতে বেশ জল জমেছে, মেন রাস্তায় যেখানে গচ্চা অর্থাৎ গর্ত আছে, সেগুলো প্রায় ডোবা। একটাও দোকান পাট খোলে নি।

    বাবা আমাকে তুলে দিতে এসেছিলো, বলল, কিরে যাবি? ভেবে দ্যাখ আরেকবার।

    বাবা কক্ষনো কোন কাজে বাধা দেয়নি। মনোমত হলে উৎসাহ দিয়েছে, খারাপ লাগলে ঘুরিয়ে বলেছে, সতর্ক করেছে, অন্য দু একটা অ্যাঙ্গেল তুলে এনে যুক্তি দেখিয়েছে। তাই যখন আরেকবার ভাবতে বলল, বুঝলাম না গেলেই মানসিক শান্তি পাবে।

    কিন্তু বাকিদের কথা দেওয়া হয়ে গেছে। তারাও বেরিয়ে পড়েছে। নো টার্নিং ব্যাক। বাবাকে সে কথা বুঝিয়ে এও বললাম, সেরকম খারাপ অবস্থা দেখলে ফিরে আসবো।

    এইসবের মধ্যেই একটা হাওড়া গামী মিনিবাস এসে যেতে উঠে পড়লাম। বাসের চাকা, পাদানিতে থই থই করছে জল, ভেতরটাও জল সপসপে। মেরেকেটে জনা সাতেক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে বাসটাতে, এরা বোধহয় সেই টার্মিনাসে উঠেছিলো। আমাকে উঠতে দেখে মনে হল ভূত না হলেও মঙ্গলগ্রহের প্রাণী দেখেছে। এমনকি বাসের ভেতরে মালিকের বা মালিকের বাবার একটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি ছিল, সেটাও মনে হল আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

    বাস খুব আস্তে আস্তে চলছে জল কেটে কেটে, কিন্তু থামাথামির সিন নেই, লোকজনও নেই, সিগন্যালের ও বালাই নেই। আমি একেবারে সামনে চলে গেলাম। কলকাতার এই রূপ আমি দেখিনি। দেখাটা জরুরি।

    সেই প্রথম দেখা, ঢাকুরিয়া ব্রীজের তলায় ট্যাক্সির আধাআধি জলে ভাসছে, ড্রাইভার জল কেটে এগোতে পারছে না, ভয়ের চোখে জানালার বাইরে জলের লেভেল খেয়াল করছে, হয়তো তার গাড়ির মধ্যেও জল ঢুকে গেছে, তবু সে দরজা খুলতে পারছে না, তাহলে আরো জল একনিমিষে ভেতর ভাসিয়ে দেবে।

    সেই প্রথম দেখা গোলপার্কের ঐ ঘোরানো চত্বরটাতে ফুটপাথে থাকে যারা, জমা জল তাদের সর্বস্ব ধুইয়ে নিয়ে গেছে, কাঠকুটো, জামাকাপড় ভাসছে, শুধুমাত্র একটা তোবড়ানো ঝুলকালো ছোট হাঁড়ি পরম মমতায় বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে আছে এইটুকু একটা মেয়ে, তার মা তাকে নিয়ে পার্কের রেলিং এর ওপরে কতগুলো ইঁট সাজিয়ে উঁচু বেদী মত বানিয়ে উঠে বসে আছে।

    সেই প্রথম দেখা রাস্তার ধারে একটা পাবলিক টয়লেটের মধ্যে জল ঢুকে একূল ওকূল ভাসিয়ে দিয়েছে, আর তার দেওয়ালে একপাটি চপ্পল ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে। গা গুলিয়ে উঠেছিল।

    সেই প্রথম দেখা প্রায় খালি বাস সাউথ থেকে মিনিট চল্লিশের মধ্যে বড়বাজারে ঢুকে গেছে।

    হাতে আর মোটে মিনিট দশেক আছে। এর মধ্যে বাসটাকে ব্রীজ পেরোতে হবে, ওদিকে নেমে আমাকে এই ব্যাগ নিয়ে দৌড় মারতে হবে বৃষ্টির মধ্যেই, টিকিট কাটতে হবে, বাকি দুজন যদি পৌঁছে গিয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে মীট করতে হবে বড় ঘড়ির তলায়, ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্মে দিয়েছে সেটা জানতে হবে, এবং এত সব করেও যদি ট্রেন আদৌ টাইমে থাকে, ট্রেনে উঠতে হবে। এর মধ্যে বেশির ভাগটাই আমার কন্ট্রোলের বাইরে।

    আজকে আমি ব্যাগ হাতে দৌড়াচ্ছি না, আমার কোন ঘরে ফেরার তাড়া নেই;
    জলে মোড়া এক অলীক শহরে, একচিলতে টিনের একটা বাসে চেপে পাড়ি দিতে চাইছি কাল্পনিক এক দূরত্ব, অস্থির আর অনির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে;
    যার সাফল্য-অসাফল্যে কারোর কিছু এসে যাবে না, এমনকি পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে, আমারও না;
    তবুও, মুহূর্তের এই সব ছোট ছোট প্রত্যাশা আর বেহিসেবি গুরুত্ব নিয়েই আমাদের ছোটখাটো জীবনে ছোটখাটো হয়ে বেঁচে থাকা। ওইটুকুনি নিয়েই আমাদের দুঃখসুখের বীজবপন, আর দিন ফুরিয়ে এলে ফসল কেটে পুরোনো দিনের চাঁদের আলোয় পূবের দিকে ফিরে চাওয়া।

    খেয়াল করলুম, সেই শূন্যতাটা আবার যেন ফিরে আসছে।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৫572917
  • "উফ্ফ দাদা বড্ড লেগেছে"...

    আরে বাপরে, কি জোরে ঠোক্কর খেলুম। জীনসের প্যান্ট তখন জাতীয় পোষাক, ঐ পরেই কলেজ, ঐ পরেই অলিপাব, ঐ পরেই গলি ক্রিকেট। সেই লিভ-ইন জীনসের অ্যাডে যেমন দেখাতো, ছেলেটা জীনস কাচতে হবে বলে পরেই ওয়াশিং মেশিনে ঢুকে গেছে, প্রায় সেই রকম অবস্থা। সেটা হলে হাঁটুটা একটু প্রোটেকশান পেতো হয়ত। বারমুডা পরা বলে অনাবৃত হাঁটুতে মনে হল কাঠঠোকরা ঠুকরে দিয়েছে। ব্যাগ ফেলে হাঁটু চেপে বসে পড়লুম। টুপটাপ বৃষ্টি মনের সুখে আমাকে ভেজাতে লাগল।

    পেছন থেকে দু একজন 'গেল গেল' করে উঠেছিল, ভাবলুম কেউ হেল্প করবে, তা না ঐ মুখেই মারিতং কলকাতা, দেখি লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে দেখতে হ্যান ত্যান কতকি সমালোচনা করতে শুরু করে দিয়েছে। একজন তো মেকানিক্সের প্রথম চ্যাপটারটাই পড়িয়ে ফেললো গতি ও সরণের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে। সত্যি লোকজন কত জানে!

    ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারার গোঁসাই, এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে অগত্যা নিজেই নিজেকে টেনে তুললুম। অতিকষ্টে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শীর্ষেন্দু যেমন লেখে, হুবহু সেই রকম ফীল করতে লাগলুমঃ হাঁটু কনকন, মাজা ঝনঝন, মাথা বনবন। হাঁটুর কাছটায় ছড়ে ফুলে গিয়েছে, ভেতরে এখনো হাড়ে হাড়ে প্লেট-টেকটনিক কম্পন জারী আছে।

    একবার ভাবলুম 'ধুত্তোর শালা নিকুচি করেছে শান্তিনিকেতনের' বলে ফিরতি বাস ধরি। কিন্তু প্রায় সামনেই স্টেশানের গুহার মত খোলা মুখ দেখে নিজেকে সামলালাম। সব রকম পরিস্থিতির জন্যই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছি, তাড়াহুড়ো করাটা আমারই ভুল হয়েছে। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে স্টেশানের দিকেই চললুম। তীরে এসে তরী ডোবানোর কোনও মানে হয়না। যদিও সে তরী এখনো আছে না ফুরুৎ ভগবান জানে।

    ওমা, টিকিট কাউন্টারটার কাছে এসে দেখি এক বন্ধু ঠিক সামনেটায় আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখে তার মুখে একেবারে ইদের চাঁদ ঝলমলিয়ে উঠল। টিকিট নাকি কাটা হয়ে গেছে, এবারে ধাঁই কিড়িকিড়ি ট্রেনের দিকে মার দৌড়। এই না হলে দোস্ত! বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও...

    পায়ের খবর শোনানোর বা সহানুভূতি আদায় করার জন্য গোটা রাস্তা পড়ে আছে, এই সময়ে ফুল্লরার বারমাস্যা শুরু করলে অনার্য খিস্তি খেতে হতে পারে, ওর জায়গায় থাকলে আমিও তাই করতুম। প্লাস ট্রেন পেলেও পেতে পারি, এই আশায় মন তখন উথলানো দুধের মত ফেনিয়ে উঠেছে।

    সে দিনটা ফ্রেন্ডশিপ ডে ছিল কিনা জানিনা, দেখি আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের ঠিক সামনেটাতেই। অবিশ্বাস্য কো-অর্ডিনেশান। কো-ইন্সসিডেন্স বলবো না, প্রযোজনই সেদিন আমাদের এই ভাবে কাজ করিয়ে নিয়েছিল হয়ত। বন্ধুদের সঙ্গে বহুবার অনেক ট্রিপে গেছি। এই লেভেলের ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ আর দেখিনি।

    দূর থেকে আমাদের আসতে দেখে দেখি সেই বন্ধু হাত নাড়তে নাড়তে বেজায় জোরে চেল্লাতে শুরু করল, এই দিকে, ওরে এই দিকে আয়। এই দিকে ট্রেন। এই দিকে, এই দিকে, এই দিকে। সে কি পিলে চমকানো হাঁক, একঘেয়ে অ্যানাউন্সমেন্ট ছাপিয়ে আমরা শুনতে পেলুম।
    ইতস্ততঃ অপেক্ষমান কাছে-দূরের যাত্রী, ঠেলাগাড়িতে টং টং করে শব্দ করতে করতে ভারি ভারি মাল নিয়ে যাওয়া কুলি, হুইলারের স্টলের দোকানি, পাকা কলার গন্ধমাখা ফলওয়ালা, খোঁড়া ভিকিরি (যে কিনা রামরাজাতলায় দোতলা হাঁকিয়ে ফেলেছে বলে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের বিশ্বাস), লাগেজে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকা ঝিমন্ত রাতজাগা বৃদ্ধ, চায়ের কেটলি আর মাটির ভাঁড়ের বালতি নিয়ে দৌড়ে যাওয়া বাচ্চা, পেপারওলার মাটিতে বিছানো ঢালাও কাগুজে সংসার থেকে মনোহর কাহানিঁয়া তুলে পড়তে থাকা বিহারি ছোকরা, অলস-উদাস বিরক্ত মুখে ঘুরে বেড়ানো রেলওয়ে পুলিস সব্বাই বোধহয় একবার তাকে আর আমাদের জরিপ করে নিলো, এখনকার জমানা হলে তক্ষুণিই হয়তো মাওবাদী ডিক্লেয়ার করে দিত।

    অনেকটা রিলে রেসের মত সেই বন্ধু আমাদের আগে আস্তে আস্তে দৌড়াচ্ছে, আর পেছনে আমরা দুজনে। ট্রেন ছাড়ার টাইম হয়েও দু মিনিট হয়ে গেছে, বেঁচে থাক বাবা আমাদের 'টার্ডি' রেলের টাইম।

    কিন্তু সামনের দিকের কামরা গুলোতে, সেই বনফুল যেমন লিখেছিলেন, তিলধারণের ঠাঁই হয়তো আছে, মনুষ্যধারণের সত্যই অভাব। এই রকম দুর্যোগের দিনেও হাওড়াতে ব্যাপারটা মোর অর লেস একই আছে। আমরা পাগলের মত একটার পর একটা বগি পেরিয়ে পেরিয়ে দৌড়ে চলেছি সিট পাবার আশায়। প্ল্যাটফর্মে ইতি উতি ছড়িয়ে রাখা আছে লোকজনের মালপত্র, বিশাল বিশাল চটের ব্যাগ, কুলির সঙ্গে দরাদরি করা বিক্ষিপ্ত মানুষ, আমাদের সঙ্গে দৌড়ে চলা আরো কিছু লোকজন। সেই সব টপকে, এঁকে বেঁকে আমরা ছুটছি, দাঁড়িয়ে যেতে হলে হালত খারাপ হয়ে যাবে। পা আর শরীর কোনটাই আর টানছে না। ছুটছি স্রেফ মনের জোরে। হাঁটুতে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, আর নিচের দিকে পা কেমন যেন থ্যাস থ্যাস করছে বালির বস্তার মত, প্রতিটি স্টেপে লাখ লাখ পিন ফোটানোর মত অনুভূতি হচ্ছে পায়ের তলায়। হাতের ব্যাগটা প্রতি ঝাঁকুনিতে যেন কেটে কেটে বসছে। গা মাথা আধভেজা, কিছুটা বৃষ্টিতে, কিছুটা ঘামে।

    কখন জানি ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছলো, ট্রেন গাঝাড়া দিয়ে উঠলো, আর উপায়ান্তর না দেখে আমরাও টপ করে পরের কামরাটাতেই চেপে পড়লুম।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৫572913
  • আমার এক বন্ধু আছে জানেন, সেই ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু। তার মতো উৎকেন্দ্রিক ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। পড়াশোনাতে ভাল, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে অন্য অনেক কিছুতে। চটজলদি স্কেচ করতে খুব ভালো পারে, ইনফ্যাক্ট আমার সঙ্গে তার আলাপও ঐ করেই। একদিন কোথা থেকে দুম করে নিয়ে এলো নারায়ণ স্যান্যালের 'না মানুষী বিশ্বকোষ', তারপর সারাদিন ধরে দুজনে একাইনোডার্মাটা, আনাথা, জীবন্ত জীবাশ্ম সিলাকান্থ মাছ এই সব নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠলাম। তার ঠাকুর্দার অবস্থা খুব ভালো ছিলো, সেমি জমিদার বলা চলে, বর্গা প্রথার আগে ঐদিকের প্রচুর জমি ওদের ছিল, সেগুলো আর নেই, ভারতে চারদিকে চারটে ট্রাক যায়, সেইখান থেকে একটা থোক টাকা পেলেও অবস্থা পড়তির দিকে। তবুও পুরনো আমলের শখের নিদর্শন তার সারা বাড়ি জুড়ে, গ্রামোফোন রেকর্ডস, ইয়া গাব্দা রেডিও, ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার... সেই সময় খুব কম বাড়িতে সেই সব ছিল। এমনকি তার বাড়িতে গুচ্ছের পুরনো রিডার্স ডাইজেস্ট পড়ে আছে, মাঝে মধ্যে ক্লাসে আনে আর আমরা লোভীর মত নজর দিই। জুনিয়ার সায়েন্স রিফ্রেসার আর দেব সাহিত্য কুটিরের 'বুক অব নলেজ' দিয়ে কি আর রিডার্স ডাইজেস্টের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়?

    ক্লাস সিক্সের পরে আমার স্কুল এবং লোকালয় বদল হবার জন্যে তার সঙ্গে যোগাযোগ অনেক কমে গেছলো। তবুও তার অনেক উদ্ভট আইডিয়ার খবরাখবর পেতাম নিয়মিত। এই সময় আমরা দুজনে একসঙ্গে একটা কমিকস বের করার প্ল্যানও করেছিলাম, কিন্তু এই অনিয়মিত যোগাযোগের জন্য সেটা মায়া হয়ে যায়।

    স্কুল লেভেলের মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে যখন যে যার নিজের কক্ষপথে ছুটে চলেছি নতুন গ্যালাক্সি খুঁজে পাবো বলে, মাঝে মধ্যেই দু একটা অ্যাস্টেরয়েডের টোকার মত টুকরো-টাকরা এর ওর খবর পেতাম। একদিন অন্য আরেকজনের কাছে শুনলাম সেই বন্ধু বাড়িতে বসে আছে। এমন কোন একটা জেনেরাল সাবজেক্ট নিয়ে পাশ করেছে যেটা দিয়ে এই হাঙ্গরের মত হিংস্র চাকরির বাজারে পা ফেলা খুব মুশকিল। ওদের অবস্থা নাকি আরো পড়ে গেছে, ট্রাকের বিজনেস লসে রান করছে। ওর গ্রাফিক্সের ওপরে ভালো ফান্ডা ছিলো, কিন্তু চর্চা করার জন্যে রেগুলার সাইবার ক্যাফের ফি মেটানো এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    এই বন্ধুটির ওপরে আমার সবদিনই বড় আস্থা ছিল। তার এই খবরে প্রচন্ড খারাপ লেগেছিল। তার পরেই আমি বাইরে চলে আসি। এসেই অকুল পাথারে পড়ে গেলাম। সে গল্প অন্য কোনদিন।

    আবার বহুদিন বাদে আরেক বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করতে করতে শুনলুম তার বাকি গল্পটুকু।

    যখন তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আর হারানোর কিছু নেই, যাহোক করে কয়েকশো টাকা নিয়ে সে চলে যায় ব্যাঙ্গালোরে, আমাদের আরেক কমন বন্ধুর কাছে, যে ব্যাঙ্গালোরে একটা ভালো ফার্মা কোম্পানিতে সেলসের কাজ করে। অর্থাৎ মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ।

    ঐ বন্ধুর উৎসাহে আর চেষ্টায় কয়েকটা কোম্পানির ইন্টারভিউতে বসে সে। নিজের বাইক নেই, অথচ এম আর হতে গেলে বাইক নইলে চলবে না, সেই কমন বন্ধুর বাইক দেখিয়ে, অনেক খেটে খুটে, পড়াশোনা করে (কেননা তার সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো না বলে শুনেছিলাম) সে একটা কোম্পানিতে কাজ যোগাড় করে। ধার করে দু দিনের মধ্যে বাইক কিনে চালানো শিখে সে কাজ শুরু করে। তার পরে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

    * * * * * * *

    হচ্ছিলো শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাবার গল্প, সেখানে একে বৃষ্টি আর ওয়াটার লগ অনেকখানি অনিশ্চিত করে দিয়েছে পুরো প্ল্যানটা, হাওড়া ব্রীজ পেরিয়ে ট্রেন ধরতে আর দশমিনিট বাকি,

    এই রকম সময়ে বন্ধুর স্ট্রাগলের গল্প????

    এডিটিং এর টেবিলে এটা বাদ দেবার জন্য ভেতরটা অনেক আঁকু পাঁকু করেছিল, কিন্তু শেষ অবধি এটা রাখলাম। একটাই কারণে। ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিতের পথে আমরা অনেক সময়েই পা বাড়াতে পারি না। আমার ঐ বন্ধু পা বাড়িয়েছিল। অনেকে হয়তো ভাববেন ক্যালকুলেটেড রিস্ক, কিন্তু পরে আমি ওর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ঐ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা ওর জীবনের সবথেকে বড় ঝুঁকি ছিল। একজন স্কুলের বন্ধুর শুধু মুখের কথায় ভরসা করে, মাত্র কয়েকশো (এমনকি হাজারও না) টাকা নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যাবার ঝুঁকি, এবং টেম্পোরারি চাকরিতে ঢুকে ধারে কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকার বাইক কিনে ফেলা, এবং এই পুরোটাই বাড়ির অমতে, আপত্তিতে, কি বলব, আমার নিজের কাছেই একটা লেসন।

    কোন তুলনাই হয়না, তবুও সেই দুর্যোগের দিনে সকালে যে ঝুঁকিটা আমরা নিয়েছিলাম, সেটা এর সঙ্গে কোথাও যেন আইডেন্টিফাই করতে পারি। বাড়ির মধ্যে বসে না থেকে আমরা একটা চান্স নিয়েছিলাম, দুর্যোগ বেড়ে গেলে সারাদিন হয়তো হাওড়াতেই আটকে থাকতে হত। অথবা রাস্তাতেও কোথাও আটকে যেতে পারতাম। ঘটতে পারত অনেক কিছুই, কিন্তু ঘটল অন্য রকম। মূল গল্পে ফিরে আসি।

    * * * * * * *

    ব্রীজ পেরিয়ে বাস যখন স্টেশনের কোন একটা এন্ট্রান্সের দিকে এগোচ্ছে, তখন মাত্র কয়েকমিনিট বাকি আছে। আশা আর উদ্বেগে তখন বুকের মধ্যে নেহাই পেটানো চলেছে। বাইরে মোটামুটি বৃষ্টি পড়েই চলেছে, কিন্তু হাওড়া স্টেশনে ছাতা খুলে দৌড়ালে মুহূর্তের মধ্যে জনা দশেক লোক শিকের খোঁচায় কানা অথবা ঘায়েল হয়ে যাবে। গনপিটুনি এবং তারপরেও বেঁচে থাকলে জেল সুনিশ্চিত। এদিকে ব্রীজের ওপরে বলেই হয়তো জল জমেনি, এবং একটু কম, প্রায় রেগুলার ভিড়ই আছে।

    অগত্যা বাসের পাদানিতে চলে এসে রুমাল বের করে মাথা ঢেকে নিলুম। বাসটা হয়তো থামত, কিন্তু পুরো না থেমে হালকা একটা ব্রেক মারতেই আমি লাফিয়ে নেমে দৌড়াবার তাল করেছিলুম, কিন্তু বাসটা একটু বেঁকে আবার এগোতে শুরু করতেই হিসেবটা পুরো গুলিয়ে গেল আর ভারসাম্য হারিয়ে আমি হাঁটু মুড়ে, সজোরে, সেই খোয়া ওঠা, ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় পড়ে গেলাম।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৬572918
  • মাসতুতো ভাই ডাক্তার, চোরে চোরে না, আসলেই নিজের, সে একটা তাদের লাইনে চালু ডাক্তার জোক বলেছিলঃ রোগী গেছে ডাক্তারের কাছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে।
    রোগীকে ভয় না পাইয়ে দেবার জন্য একটু রইয়ে সইয়ে রোগের কথা বলতে হয়। এই ডাক্তারবাবুটি একটু রহস্য করে বললেন, আপনার তো হৃদয়ঘটিত সমস্যা মশাই। রোগী শুনে হাঁ, বলে আপনি তো সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি ডাক্তারবাবু। কিকরে বুঝলেন? ডাক্তারবাবু একটু হেসে বললেন, নামটাও বলে দিচ্ছিঃ অ্যাঞ্জাইনা পেকটোরিস।

    এবারে রোগী লজা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, আজ্ঞে, প্রায় কাছাকাছি গেছেন, ওর নামটা হল অঞ্জনা পত্রনবীশ।

    সেই ট্রামে কাটা পড়া ভদ্রলোকও তেমনি কল্লোলিনী অবধি ধন্বন্তরি ছিলেন। আরেকটা কবিতা লিখে গেছলেন, যেটা সকাল থেকে আমাকে যেসব ফেস করতে হয়েছে, সেইসবের অনেক কাছাকাছি গেছে, সঠিক ভাবে কবিতাটা পড়লে এই রকম দাঁড়াবেঃ

    হাজার বছর ধরে আমি দৌড় মারিতেছি হাওড়া ইস্টিশানে, (মনোযোগী পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, বাস থেকে নেমে ইস্তক আমি দৌড়ে চলেছি)
    ঢাকুরিয়া সমুদ্র থেকে চল্লিশ মিনিটে বড়বাজারে
    বেজায় লেগেছে আমার; ব্রীজের খোয়াওঠা ধূসর রাস্তায়,
    পড়ে গেছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে দক্ষিণ নগরে;
    আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, কলকাতায় জমা জলের সমুদ্র সফেন,
    আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছে, বর্ধমানগামী এই ট্রেন।

    বাববাঃ!!
    কামরাটাতে উঠে আগে তিনজনে একে অন্যকে জাপটে ধরে প্রায় নেচেই নিলুম। ইয়েস, উই মেড ইট। ভেজা স্যাঁতানো শীতল পোষাক ছাপিয়ে উঠে এল পারস্পরিক নির্ভরতা আর আত্মসমর্পণের এক টাটকা ওম, যার পোষাকি নামটা আমরা বেশি ব্যবহার করিঃ বন্ধুত্ব। একসঙ্গে লড়ে জেতার আনন্দ যে কি, ফুটবলের মাঠের বাইরে এই আরেকবার টের পেলুম।

    পা আর কোমর আর সঙ্গ দিচ্ছে না বলে একটা ফাঁকা সিটে ধপাস করে বসে পড়লুম। এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, ট্রেনে উঠে পড়ছি। সকাল থেকে, না না, কাল রাত থেকে যে রেটে কাহানি মে ট্যুইস্ট চলছে।

    ঠিক এই রকম মোক্ষম মুহূর্তে বন্ধু 'নার্ড' পাশে একজনকে জিগগেস করল, দাদা ট্রেনটা কি বর্ধমান যাচ্ছে?

    হ্যাঁ, এইবারে সময় হয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করানোর, তা নইলে গল্পের বাকিটুকুতে রেফারেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এরর দেবে।

    এই যে প্রথম জনকে দেখছেন, মাঝখানে সিঁথি, গোলগাল তেল চুকচুকে মুখ, একটু ময়লাটে রঙ বলে ডার্ক জামাকাপড় বেশি পরে,এর নাম হল 'লাইন' (লাইনের ছেলে)। লাইন আমার জন্য টিকিট কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।

    আর ঐ যে গুঁফো, চারচোখো, টুকটুকে ফর্সা, বেশ একটা থার্টি টু অল আউট লাজুক হাসি দিচ্ছে, ওর নাম হল 'নার্ড'। নার্ড একটু না, অনেকটাই রিজার্ভ, আসলেই নার্ড। নার্ড ছিল প্ল্যাটফর্মের ওপরে, ঐ চিল্লিয়ে আমাদের ডেকে ট্রেনে তুলেছে।

    আর বর্ধমানে যাকে মীট করব, সে হল 'হোস্ট'। সে সিড়িঙ্গে লম্বা, ক্লীন শেভড, চারচোখো। সেও লাইনের ছেলে।

    কি বলব, ওর ঐ প্রশ্নটা শুনেই আমার যেন গা হাত-পা এলিয়ে গেল। বলে কি? ওই দেখেশুনে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল, ডেকেছে আমাদের, আর আমরাও চোখকান বুজে দৌড় মেরেছি, এখন কিনা জানতে চায় ট্রেন বর্ধমান যাবে?

    যাকে জিগগেস করা, সে ওপরে নিচে মাথা নাড়ল, আর আমার যেই ফীলিংটা হল, সেটা বোধকরি শিবঠাকুরও উপলব্ধি করেন, কালীপুজোর ভাসানের পরে যখন মাকালী ওঁর বুক থেকে নেমে দাঁড়ান।

    প্রথমে ভেবেছিলুম ভেন্ডারে চেপে পড়েছি। গুচ্ছ বেতের না বাঁশের ঝুড়ি ডাঁই করে রাখা আছে। গোটা কামরা জুড়ে ছাগলের নাদির ভ্যাপসা গন্ধ। কোত্থেকে এল কে জানে? তারই মধ্যে অসময়ের ছোট কমলালেবু, ঝালমুড়ি এই সব দেদার বিকোচ্ছে। লোকজনও নির্বিকার ভাবে খাচ্ছে, চেবাচ্ছে। কামরাটাতে খুব বেশি ভিড় নেই, শুধু দেদার ঝুড়ির জন্য খুব ক্রাউডেড দেখাচ্ছে, শ্যামের বাঁশি না বাজলে, বাইরে থেকে দেখে আমরাও হয়ত এটাতে উঠতাম না। উঠে লাভই হল। কিছু জায়গা আছে। লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। দুতিনজন চোয়াড়ে যুবক উল্টোদিকের দরজার কাছে বাতাস খেতে খেতে যাচ্ছে, হয় এরা পকেটমার, নইলে কাছে পিঠে কোন স্টপেজে নেমে যাবে।

    মালপত্র ওপরে তুলে, একে ওকে বলে কয়ে একটু অ্যাডজাস্ট করে ওরাও গেঁজে গুঁজে মুখোমুখি বসে পড়লো।

    হাঁটুটা দেখালাম। ফুলে গেছে মনে হল। নার্ড একটা ভেজা ছাতা নামিয়ে এনে দিল, ওটাকেই পায়ে চেপে বসে থাকলুম। আপাতত আর কিছু করার নেই। নিজেদের বাড়ি থেকে স্টেশানে আসার রোমহর্ষক বিবরণ একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করলুম। এই সব গেঁজিয়ে খানিকক্ষণ চলল। বার বার মনে হচ্ছিলো একটা তাস থাকলে ভালো হত। বর্ধমান লাইনের ডিপি (ওরা নিজেদের বলে ডেলি প্যাসেঞ্জার, আম জনগণ বলে ডেলি পাষণ্ড) -এর মত খেলতে খেলতে যেতুম।

    কিছু করার না থাকলে খিদে খিদে পায়। নার্ডকে আমরা দুজনে আবদার করলুম, ঝালমুড়ি খাওয়া। ততক্ষনে গন্ধ সয়ে গেছে। নার্ড রাজি, তবে তাকে পরের স্টেশানে লেবু চা খাওয়াতে হবে। এই সব জাংক ফুড ব্যাপার-স্যাপারে সে বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস ফীল করছে। আমরা জানি এই নিয়ে হাতে গোনা বার সে এই রকম ট্রেনের ক্লাসলেস ক্লাসে উঠেছে। তার বাবা ক্যালকাটা না কোন একটা নামী ক্লাবের মেম্বার।

    কামরাতেই একজন ঝালমুড়িওয়ালা ছিল, তাকে ডেকে 'তিনটে বড় ঝালমুড়ি, একটায় ঝাল দেবেন না' বলে দেখি পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করছে।

    আরে খেলে যা! পাছে ঝালমুড়িওয়ালা গ্রুপে থাকার জন্যে আমাদেরকেও খিস্তি মারে, সেই ভয়ে আমরা খুব উদাস মুখে বাইরে তাকিয়ে সবুজে মোড়া হুগলী দেখতে থাকলুম। এটা বোধহয় 'গ্যালপিং', সব স্টেশানে থামছে না।

    তো এই ভাবে ঝালমুড়ি, তারপরে লেবু-চা, পোষালো না বলে পাতি দুধের চা, সেটা একেবারে পায়েস করে ফেলেছিল বলে আরোই পোষালো না তাই ফটাশ জল এইসব খেতে খেতে আশে পাশের লোকজনের সঙ্গে মোটামুটি আলাপ জমিয়ে ফেললুম। ফটাশ জলটা অবিশ্যি আমি একটু খেয়ে বাকিটা হাঁটুতে ঢাললাম। ঠান্ডা জল লেগে বেশ আরাম হল।

    সবার মুখেই এক কথা। এ কি দেখলুম রে ভাই কলকাতায়! এই লেভেলের জলমগ্ন কলকাতা ধারণারও বাইরে। বিশেষ করে যারা মোটামুটি সাউথ থেকে এসেছে। তবে হুগলীতে বেজায় বৃষ্টি হলেও জল তেমন জমেনি শুনলাম। সেটা পাশে গঙ্গা আছে বলেও হতে পারে।

    আলোচনা ঝিমিয়ে আসছিল, এমন সময়ে আমাদের সেই ট্রিপের পরবর্তী ইন্টারেস্টিং ঘটনাটা ঘটল....
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৭572920
  • খান্ডবদাহন গল্পে পড়েছি। বি আর চোপড়ার মহাভারতের বাইরে চোখের সামনে দেখবো কোনদিন ভাবিনি।

    তা এই এক অদ্ভুত দিনে বোধহয় সবই সম্ভব হবার যোগ এসেছে। হচ্ছে না, হবে না করেও জলমগ্ন কলকাতার রাস্তাঘাট পেরিয়ে এসেছি, ভগ্নঊরু দুরিয়োধনের মত লেংচিয়ে দৌড়ে ট্রেন ধরতে পেরেছি, জানার কথা নয়, তবুও ফাঁকতালে 'বেলমুড়ি' আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, আর বোধহয় ভুটান বাম্পার লটারিটা কাটাই বাকি আছে। ট্রেনে আমি এমনকি জামাকাপড়ও বিক্রি হতে দেখেছি, বিলিভ ইট অর নট, কিন্তু লটারি বিক্রি হতে কোনদিন দেখিনি। তাই এত কাছে এসেও সেই সুযোগ হাতছাড়া হবার দুঃখ পুষিয়ে নিলুম খান্ডবদাহন দেখে, বস্তুতঃ নিজেরাই সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে।

    আর কিছুই না, বর্ধমান অবধি বাকি পথটুকু আমাদের কেটে গেল মুড়ি আর বেলের অনেক রকম রেসিপির পারমুটেশন-কম্বিনেশন করতে করতে, আর কামরাসুদ্ধু লোক, যারা বেলমুড়ি বলতে বা শুনতে একেবারেই অনিচ্ছুক আর অধুনা সেই দলে নাম লেখানো আমাদের নার্ড বন্ধুর ঝাঁ--, সরি, 'ইউ-নো-হোয়্যার'-এ আমরি কান্ডের প্রিক্যুয়েল একেবারে ফ্রন্ট রো ব্যালকনি সিটে বসে দেখতে দেখতে।

    বর্ধমানে যখন ট্রেন থেকে নামলুম, নার্ড আমাদের দুজনের ওপরে খচে বোম। আমাদেরও একটু বাড়াবাড়ি লাগছিল শেষদিকে, কিন্তু দানব একবার জেগে গেলে তাকে ঘুম পাড়ানো, ক্যান্ডি খাওয়া বাচ্চার মতই, বেজায় কঠিন।

    বেশ বেলা হয়ে গেছে, কিন্তু মেঘলা দিনে চট করে সময়ের মাপ বোঝা যায়না। ঘোলাটে দিনের জন্যই হয়তো বর্ধমান স্টেশনটা বড় কাঁচুমাঁচু ভাবে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। খুব একটা ভিড় নেই, ট্রেন থেকেও বিশেষ লোক নামল না। একটা আস্ত বড় স্টেশন দুঃখিনী অহল্যার মত 'স্টোনড' হয়ে ঝিমিয়েই রইল।

    কথা ছিল 'হোস্ট' আমাদের জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করবে। প্রায় খালি প্ল্যাটফর্মে তাই মোলাকাত হতে বেশি দেরি হল না।

    হোস্ট অভ্যেসমতন একটু হম্বিতম্বি করলো, বললো নাকি মিনিট দশেক ধরে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে এই প্রথমবার কথা দিয়ে ঠিক সময়ের আগে এসেছে বলে কনগ্রাটস করতে যাচ্ছিলুম, সেই সময় পাশ দিয়ে কুলিটাইপ দুজন বলাবলি করতে করতে পেরিয়ে গেল, যে, ট্রেন নাকি বেজায় লেট ছিল আজ। হোস্টের দিকে তাকাতে চেশায়ার ক্যাটের মতন একটা হাসি দিয়ে চোখ পিটপিট করলো।

    * * * * * * * *

    চারমূর্তি না কোন একটা যেন টেনিদার গল্পে ডানহাতের কাজ সারার পরে ক্রেন দিয়ে টেনে তোলার কনসেপ্টটা জেনেছিলুম। আমরাও কিছু কম খেল দেখালুম না।

    উঠতি বয়েসে কোলেস্টরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, ওমেগা থ্রি, ক্যালোরি, হার্বার্ট, স্পেন্সার, হাঁচি টিকটিকি কোনকিছুই পাত্তা পায়না, আর সেইদিনে সকাল থেকে হয়ে চলা হয়রানি, ট্রেন লেট, স্টেশন থেকে বেরিয়ে ভাড়া নিয়ে রিকশাওলাদের সঙ্গে খটাখটির পর, হোস্টের বাড়ি পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা তখন তখন লালগোলা প্যাসেঞ্জারের মতন কাকে খাই কাকে খাব করছি। হোস্ট একটু চা-টা খাওয়ানোর জন্য গাঁইগুঁই করছিল, কিন্তু এ কোথায় খাপ খুলেছো মামা, ঐ সব অ্যান্টি-অ্যাপেটাইজার ট্রিকের চালাকি ন চলিষ্যতি। আজকে আর ফোর প্লে করার সময় নেই; হোস্ট নিজেও লাইনের ছেলে, ইঙ্গিতে পন্ডিতে বোঝে ইত্যাদি। আমরা সরাসরি মূলপর্বের খেলাতে ঢুকে পড়লুম।

    সে যে কি ইলাহী বন্দোবস্ত করা ছিল আমাদের জন্য, কি বলবো। শুধু এইটুকু বলে রাখা যাক, খেয়ে দেয়ে আমাদের একটু কাছে পিঠে ঘুরতে যাবার প্ল্যান ছিল, সে সব কাটিয়ে দিয়ে অতিকষ্টে ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে হোস্টের বিছানায় ধড়াম করে পপাত চ, মমার চ হলুম। এমনকি নার্ডের মুখে আবার 32 অল আউট হাসি ফিরে এসেছে। পেটের চাপ সামলে হাঁসফাঁস করছে আর হাসছে। এই রকম সীনের বিবরণ লিখতে গেলে পাতি বাংলায় হবে না, কমলকুমার মজুমদার ধার করে বলতে হবে 'এই মাকৌবার চাপ আমাদিগকে আতান্তরে ফেলিল, আরিঃবাস!'

    ও হ্যাঁ, আমার পায়ের ব্যথাও কোথায় মিলিয়ে গেছে। তার কথা ভুলেই গেছি। আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর। এই সিচুয়েশনের গানও লিখে গেছো, দাদু হে, তুমিই সত্য।

    চোখটা কখন লেগে গেছলো টেরও পাইনি। অনেক দূরে কোথাও আকুল হয়ে একটা ঘুঘু না কি যেন পাখি ডেকে যাচ্ছিলো, সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে ঘসটানো ঘুরে চলার শব্দ ছাপিয়ে, আর ততই বেশি করে একটা আরামের জালের মধ্যে মজে যাচ্ছিলুম। আধো ঘুম, আধো জাগরণ, এই একটা সময়ের কোন তুলনা হয়না, শেষ-মেষ একচিলতে আলো জানালার রেলিং পেরিয়ে চোখে এসে লাগাতে আস্তে আস্তে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে চাইতে ইচ্ছে হয়না, রাজ্যের আলস্য ভিড় করে আছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, মনে মাথায়, তবুও বড় কষ্ট করে তাকিয়ে দেখলুম বাইরের আকাশে লালচে আভা লেগেছে, কেমন একটা নরম শীতের আমেজ ছড়িয়ে যাচ্ছে চরাচরে, জানালার পাশে নারকেল গাছের পাতায় অল্প রোদের ঝালর দুলছে। মনখারাপ করে দেওয়া এক বিকেল নেমে আসছে বর্ধমানে।

    বন্ধুরা সব্বাই গুটিসুটি মেরে ঘুমুচ্ছে ঐটুকু বিছানায়। আমি ওদের দিকে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, সমস্ত আরোপিত খোলস আর মুখোস খসে পড়ে ঘুমের ভিতর, ঘুমন্ত মানুষ বড্ড ভালনারেবল।

    একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর আসতে চায় না, আবার পাশে কাউকে ঘুমোতে দেখলে নিজেকে কেমন নিঃসঙ্গ লাগে, ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে না করলেও বেশ বুঝতে পারছি এবারে জোর করে উঠে পড়তেই হবে। সন্ধ্যেবেলাতে আমাদের ট্রেন, সেই ট্রেনে করে অনেক রাতে আমরা শান্তিনিকেতন পৌঁছাব।

    কিন্তু এতকিছুর আগে বর্ধমানে আমাদের একটা 'বিশেষ কাজ' আগে সেরে ফেলতে হবে। সেটা শান্তিনিকেতনের ভরসায় ফেলে রাখা যাবে না।

    * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

    সৌন্দর্যের একটা বড় ইনগ্রেডিয়েন্ট হল তার রহস্যময়তা, তার আনপ্রেডিক্টেবিলিটি। একবার চেনা হয়ে গেলে, পাওয়া হয়ে গেলে, তা সে যেকোন জিনিসই হোক না কেন, তার সৌন্দর্য একঝটকায় অনেকখানি কমে আসে।

    জীবন ঐ একটা কারণেই বড্ড সুন্দর, সে বাঁকে বাঁকে পাল্টে যায়। এত আনপ্রেডিক্টেবল বলেই বাঁচার আনন্দ এত বেশি। কেউ যদি অ্যাকুরেটলি বলে দিতো, আপনার জীবনে এই দিনে এই ঘটবে, সেই গড়াপেটা জীবন যে কি ভয়ংকর, ভাবতেও একধরণের শূন্যতা গ্রাস করে। আপনি তার পরের কোন সকালে আর কোন রকম স্বপ্ন বা আশা নিয়ে ঘুম থেকে উঠবেন না, কেননা আপনি জেনে গেছেন এই দিন আপনার জন্যে আজ কি সাজিয়ে রেখেছে, সত্যি বলতে কি একজন এক্সটেন্ডেড মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর আর আপনার মধ্যে আর কোন ফারাক নেই, আপনি এখন শুধু একটাই কাজ করেন, দিন গোনেন।

    এখন লিখতে গিয়ে সেটা অনুভব করছি, এই ট্রিপও যে আমাদের জন্য কত কিছু সাজিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছে, সেটা ভাগ্যিস তখন জানতুম না, নইলে কি আর 'বলহরি, বেলমুড়ি' বলে পেল্লায় একটা হাঁক দিয়ে বাকিদের চমকে চুয়াল্লিশ করে জাগিয়ে তুলতুম? বিশেষ করে নার্ড যেখানে শাসিয়েই রেখেছিল, তোরা এতো ঐ অপয়া নামটা নিচ্ছিস তো। দেখিস কি হয়।

    আরো মিনিট কুড়ি বাদে, রোদের আঁচ মরে গিয়ে আকাশে উনুনের ঝুলকালি লেগে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, সন্ধ্যের ট্রেনের সময় হয়ে আসছে, রাস্তার ওপরে উদভ্রান্ত দুজন ছেলে তাদের বন্ধু হোস্টকে উত্তর হয়না জেনেও সেই তামাদি হয়ে যাওয়া প্রশ্নটাই আবার বন্ধক রাখলোঃ

    কি হবে তাহলে?
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৭572919
  • আমার প্রচন্ড মাকড়শা ভীতি আছে।

    নিরীহ এই প্রাণীটি সেরেফ নিজের উপস্থিতি দিয়েই, হোক না কেন কয়েকহাত দূরেই, আমার ব্লাডপ্রেশার কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এটা একধরণের ফোবিয়া, পোষাকি নাম 'অ্যারাক্‌নোফোবিয়া'। হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর ভাই বোনেরও নাকি এই একই ফোবিয়া ছিল/আছে।

    ফোবিয়ার কোন রকম ব্যাখ্যা নেই, না জেনেরিক, না কালচারাল। আমার বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ যেমন মাকড়শাকে ভয় পায় না, আমি চেল্লালেই এসে ফুলঝাড়ু বা এটা সেটা দিয়ে মেরে বা ভাগিয়ে দিতে পারে।

    কতরকমের আপাত তুচ্ছ জিনিসের ওপরে মানুষের ফোবিয়া হতে পারে, না জানলে কল্পনা করা অসম্ভব। স্বয়ং নেপোলিয়ানের বেড়াল ভীতি ছিল। আইলুরোফোবিয়া। ভাবা যায়?

    আর একটি নাম আউড়ে প্রসঙ্গান্তরে যাবো, ফ্রিগাট্রাইস্কাইডেকাফোবিয়া। ফ্রাইডে দা থার্টিন্থ এর ফোবিয়া। ইউ এসে আসার আগে যেমন 'হালাল' মীট শপ দেখিনি, তেমনি এই ফোবিয়ার কথাও শুনিনি, জানতাম না।

    যাবৎ বাঁচি, তাবৎ শিখি। ব্যাপারটা প্রথম খেয়াল করি ২০০৯ এ। কোন একটা শুক্রবারে তেরো তারিখ পড়ে গেছলো, আমাদের বিজনেস টিম ভর্তি আম্রু, লক্ষ্যণীয়ভাবে প্রচুর লোক ঐদিন ছুটি নেয়, অনেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে কাটিয়ে দেয়। পরে সামহাউ ক্যাজুয়ালি কথা প্রসঙ্গে ব্যাপারটা জানতে পারে রীতিমত বিস্মিত হই।

    তার পর সচেতন ভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম এখানে এমনকি স্কাই স্ক্র্যাপারে 13th ফ্লোরটাও থাকেনা। বিল্ডিং বানানোর সময় নাকি একটা এইটুকুনি ফ্লোর বানিয়ে ছেড়ে দেয়, যা ব্যবহারের অযোগ্য, এবং এলিভেটরে (এখানে লিফ্ট বললে হাঁ করে মুখের দিকে চাইবে) তেরো নম্বর বাটন নেই।

    অপয়া তেরোর ব্যাপারটা অবিশ্যি ছোটবেলা থেকে জানতুম। খুব সম্ভব সেই লাস্ট সাপারে তেরো জন ছিল, ঐ রকম কিছু একটা থেকে এই তেরোর গেরো ছড়িয়ে পড়ে। আর এইগুলোর ওপরে ছোটবেলা থেকেই আমার একটা পটশট নেবার প্রবণতা।

    একা আমি বলে না, যা কিছু নিষিদ্ধ, বারণ, সে সবের প্রতি তীব্র আগ্রহ, বাবা আদমের গন্ধম ফল খাবার লিগ্যাসি বহন করে 'হিউম্যান নেচারে' চারিয়ে গেছে। বেশি আর কম। ছোটবেলায় এই ব্যাপারটা বেশি থাকে, কেননা তখন 'কনসিকোয়েন্স' নিয়ে মাথাব্যথা কম থাকে, সেটা এক্সপেরিমেন্ট টাইম। এইজন্যে যখন কেউ, 'দু শালিখ দেখলে ভালো', 'এক চোখ দেখাতে নেই', 'তেরো সংখ্যা অশুভ' এই সব বলে কনভিন্স করতে চাইতো, তখনই যেন আরো বেশি রোখ চেপে যেত, সেটাকে কাউন্টার করার। একটু লায়েক হতে দেখলাম, আমি একা নই, চারপাশে ভর্তি কমরেড।

    গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াইটা ততক্ষণই ভালো যতক্ষণ না সেটা নিজেই আরো বড় গোঁড়া এক দানবে পরিণত হচ্ছে। এইসব ভাবনা এখন ভাবি, কিন্তু ভাংচুরের বয়েসে অ্যাতো হিসেব নিকেশ করে কেই আর কবে এগিয়েছে? হাতের কাছেই একটা উদাহরণ আছে।

    স্কুলে ক্যুইজ কম্পিটিশান হত, সেখানে ফার্স্ট রাউন্ডে বোর্ডে এক থেকে একশো নাম্বার লেখা থাকতো, আর প্রতি নাম্বারের কোশ্চেন লেখা থাকতো কাগজে। র‌্যান্ডম অর্ডারে। দশটা টীম, নিজের প্রশ্ন নিজে বেছে নেবে।

    আমরা পর পর দু বছর পার্টিসিপেট করেছিলাম, শুরু করেছিলাম ১৩ নং প্রশ্ন দিয়ে। এবং পরের প্রশ্নটা ৩১। দুবারই আমরা জিতেছি। কাকতালীয় ভাবে কিনা জানি না। কিন্তু এই সব ঘটতে দেখলে ঐ বিরুদ্ধ গোঁড়ামিটা বেড়ে যেতে থাকে। ঠিক যেমন শালিখের ব্যাপারেও তাই দেখেছি, পরে পরে এক শালিখ না দেখলে কেমন অস্বস্তি হত, দু শালিখ দেখলে বুঝে যেতাম খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে।

    * * * * * * * * * * * * *

    আমাদের মুলতুবি রাখা গল্পটা আবার ফিরে আসছে ঠিক এই কনটেকস্টেই।

    বেশ কিছুটা পথ চলে এসেছি আমরা। সকালের জমিয়ে রাখা কান্না উগরে দিয়ে আবহাওয়া এখন ফোঁপানির মত অবরে সবরে ভেজাচ্ছে, কখনো টিপটিপে বৃষ্টি, কখনো শুধুই দমকা হাওয়া। আকাশের মুখ গোমড়া হয়ে আছে। কামরায় ভিড় বেড়েছে, আমরা একেবারে জানালার ধারে বসতে পেয়েছি। বাইরে থেকে নোংরা জলের ছিটে মুখে চোখে এসে লাগলে বিরক্তি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সতেজ বাতাসের ঝাপটায় প্রাণটা যেন জুড়িয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছে। বাইরে বিরক্তিহীন একইরকমের সবুজ মাঠঘাট, থেকে থেকে ছোট বড় গ্রাম বা জনবসতি আসছে, কখনো বাচ্চা ছেলের দল হাত নাড়ছে ট্রেনের দিকে, ডোবার ধারে প্রাতঃকৃত্য করতে বসা মাঝবয়েসী লোক নির্বিকার চোখে ট্রেন যাওয়া দেখছে, একটা ছটফটে বাছুর কি মনে করে ট্রেনের পাশে পাল্লা দিয়ে তিড়িং বিড়িং ছুটল খানিকক্ষণ, তারপর স্বাভাবিক ভাবেই পিছিয়ে পড়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, মাঠের মধ্যিখান দিয়ে হাইটেনশান তারের লাইন চলে গেছে A শেপের বিশাল বিশাল স্ট্রাকচারের ওপরে ওপরে, দিগন্তরেখার দিকে।

    ট্রেনে যেতে যেতে স্টেশনের নাম পড়তে খুব মজা লাগে। এ একটা মজার খেলা, ওই ধর ধর একটা স্টেশন দুম করে পেরিয়ে গেল, নামটা জানা হল না, কেমন একটা কিছু হারিয়ে যাবার অনুভূতি হয়, আবার নামটা পড়তে পেরে গেলে মনটা খুশি খুশি লাগে। ভাঁড়ারে জমা হল খুদকুঁড়ো।

    সেই খেলাটাই খেলছিলাম, ট্রেনটা এসে দাঁড়াল একেবারেই মধ্যবিত্ত একটা স্টেশনে, এমন কিছু বৈশিষ্ট্য নেই যার জন্য তাকে আলাদা করে ঠাহর করতে হবে, সবে মাত্র স্টেশনের নামটা পড়েছি, এমনসময়ে হঠাৎ করে দুমাদ্দুম 'চক্ষুকর্ণের বিবাদ' শুরু হয়ে গেছে টের পেলুম।

    আমার উল্টোদিকে ওরা দুজন বসে আছে, আর পাশের লোকটি, সে এই লাইনে নিয়মিত যাতায়াত করে বলে জেনেছি তার সঙ্গে আলাপের সময়, এ সেই হাওড়া থেকেই আসছে, কাউকে একটা ডিরেকশান দিচ্ছে, এইটা মাঝেরগ্রাম, এর পরে অমুক, তার পরে তসুক, সেটা পেরোলে ঢ্যাঁক।

    লোকটি বেশ মিশুকে, আলাপ জমে গেছলো, সেই সুবাদে ভাবলুম ভুলটা ধরিয়ে দি। চোখের সামনে হলুদে কালোয় বড় বড় করে লেখা আছে স্টেশনের নামটা।

    - ও দাদা, মাঝেরগ্রাম না, এটা তো 'বেলমুড়ি'। বলে বেশ হাসি মুখে বাইরে দেখালুম। লেখাটা ড্যাবড্যাব করে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।

    লোকটা দেখল, কেমন একটু থতমত খেয়ে এক মিনিট চুপ কি যেন বলবে কি বলবে না ইতস্ততঃ করল, তার ঠোঁটের পর্দা দু একবার কাঁপল, বিস্ফারিত হল, তারপর মনস্থির করে বলল, আমরা এটাকেই মাঝেরগ্রাম বলি।

    আমি সামনে লাইন আর নার্ডের দিকে তাকালুম। ওদের মনেও একই প্রশ্ন, লাইন সোজাসুজিই জানতে চাইল, কি ব্যাপার বলুন তো? এরকম নাম কেন? ঠিক বুঝলাম না।

    লোকটা আবার একটু দ্বিধা করছিল, কিন্তু তার পাশের লোকটা ভান্ডা ফোড় করে দিলো। এই 'বেলমুড়ি' নামটা নাকি অপয়া, তাই এই লাইনে যারা জানে, তারা এটাকে মাঝেরগ্রাম বলে ডাকে। লক্ষ্য করলাম, লোকটা একবারও 'বেলমুড়ি' শব্দটা সরাসরি উল্লেখ করলো না।

    ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেতে পারত, আমরা 'ও তাই নাকি? আচ্ছা?' এই সব বলে হয়ত অন্য প্রসঙ্গে স্যুইচ করেই যাচ্ছিলাম, লাইন এমনি খিল্লি করার জন্য আমাকে এক চোখ মটকে বললো, ইসস, আমরা সকালে ঝালমুড়ি খেলাম, এরম জানলে এখানে 'বেলমুড়ি' খেতাম। আমিও নার্ডের হাঁটু চাপড়ে বলে বসলুম, হয়ে যাক তাহলে এক ঠোঙ্গা নার্ড স্পনসরড 'বেলমুড়ি'।

    নার্ডকে যে খুব ভেবেচিন্তে ব্যাপারটাতে ইনভলভ করার ইচ্ছে ছিল তা না, কিন্তু যেহেতু সকালে ওকেই আবদার করে ঝালমুড়ি খেয়েছি, আর লাইন সেই রেফারেন্সটাই দিলো, কোনভাবে নার্ড প্রসঙ্গে চলে এলো। আবার পরে ভেবে দেখেছি, আমরা তিনজন একসঙ্গে আছি, এক মানসিকতার এই রকম কিছু একটা ঐ লোকগুলোর সামনে প্রমাণ করার একটা তাগিদ হয়ত আমাদের মধ্যে কাজ করছিল। সকালের পারফেক্ট কো-অর্ডিনেশনের পরে একটা বেসিক সমঝোতার স্তর পেরিয়ে এসেছি, এরকমটাই হয়ত ভেবেছিলুম। ফলে, নার্ড যখন বেশ ঝেঁজে আমাদের ঐ 'অপয়া' নামটা উচ্চারণ করতে মানা করল, নিজেদের অস্বস্তি ঢাকার জন্যই শুধু না, হোঁচট খাওয়া বিশ্বাসের বদলা নেবার জন্যে আমাদের ভেতরের ডরম্যান্ট অ্যান্টি-গোঁড়ামি দানব আমরা জাগিয়ে তুলতে শুরু করে দিলাম, যার জেরে পুরো জার্নিটাতে এই 'বেলমুড়ি' একটা সিগনিফিক্যান্ট ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে চলেছে আমাদের সজ্ঞানে-অজ্ঞানে।

    পরের পরের অথবা তারও পরের কোন পর্বেঃ মেক্সিকান অভিশাপ অথবা হিন্দি সিনেমার গপ্প।
    সাউন্ডস গুড? ঃ-))

    জাগতে রহো....
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৮572871
  • "ট্রেনটা আমরা পেয়ে গেছি বেলা শুনছো? এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না।"

    আমাদের দৌড়াতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আলটিমেটলি ট্রেন মিল গয়া। আবারও।

    এমনকি উঠে বসার জায়গা পেতেও অসুবিধে হয়নি। এমনিতে নাকি এই ট্রেনটায় ভিড় থাকে, কিন্তু ডানপিটেরা আজকের ওয়েদারে বেরোতে হয়ত খুব একটা এনথু পায়নি, ফলে আমাদের সুবিধেই হল।

    রাতের ট্রেনের জার্নি আমার সবসময় ভালো লাগে।

    দিনের বেলা কামরায় বড্ড ক্যালর-ম্যালর লেগে থাকে; ট্রেন নিজেই যেন একটা আলাদা দেশ, চলমান ভূখন্ড, তার মধ্যে নানা রকমের মানুষ বসতি করে, পণ্যের বিকিকিনি চলে, এই কিছু ইমিগ্র্যান্ট চলে এল, ঐ কিছু দেশত্যাগী নেমে চলে গেল। কতরকমের জিনিস ওঠে, টাইগার মলম থেকে জিকের বই, লালশালু মোড়া ভেজিটেবল চপ থেকে সবেদার ঝাঁকা। নিত্যযাত্রীদের 'ও বোসদা, ও মুখুজ্যেদা', 'চ্যায়ে গ্রম' এই সব তো রেগুলার আবহসঙ্গীত।

    কিন্তু একটু রাত হলে ট্রেনে সময় ঝিমিয়ে আসে, সমস্ত দিনের পরে অর্থহীন রাজনৈতিক আলোচনা, হকারদের বেচার মরিয়া প্রচেষ্টা, তিনজনের সিটে চতুর্থজনের ইঞ্চিতিনেক পাছা ঠেকিয়ে বসা নিয়ে গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মানসিকতা, সব কিছুতেই একটা ভাঁটার টান আসে। বেশির ভাগ স্টেশনেই লোক নামে যত না, ওঠে তার চেয়ে কম। খালি হয়ে আসা কামরায় দীর্ঘদিনের জমা ধুলো আর মরচে, জানালার পাশে পানগুটখার পিকের দাগ, চুরি যাওয়া বাল্ব, খারাপ হয়ে পড়ে থাকা ফ্যান, ডি কে লোধ টাইপ গুপ্ত রোগের সমাধান অথবা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ভক্তগণ দ্বারা প্রচারিত দুই কালো বেড়ালওয়ালা পীরবাবার মারণ উচাটন বাতলানো অ্যাড, আমাদের সব তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতাকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মধ্যে দিয়ে সামনে নিয়ে আসে। বেশিক্ষণ সেই সবের দিকে তাকিয়ে থাকলে অক্ষমতার হতাশায় বাইরে দিকে আপনিই চোখ চলে যায়।

    বাইরে তাকালে সম্পূর্ণ এক আলাদা জগৎ চোখে আসে, ধূ ধূ অন্ধকারের দেওয়াল কেমন একধরণের বিভ্রম তৈরি করে। চোখ সইয়ে গেলে সেই অন্ধকারের মধ্যে ফুটে ওঠে গাঢ় ফিকে গ্রেডিয়েন্ট, অনেক দূর দূরান্তে হয়ত এক দুটো আলোর ফুটকি, আর বড় জনপদ হলে সেই দিকের উদ্ভাসিত আকাশ। এরই মধ্যে লাইনের পাশে ট্রেন থেকে আসা আলোয় তৈরি হওয়া নানরকমের ছায়া নেচে নেচে ট্রেনের সঙ্গে যায়। সেই সঙ্গে টাটকা তাজা বাতাস চোখমুখ জুড়িয়ে দেয় একেবারে।

    লাইন আর হোস্ট এর মধ্যেই উঠে গিয়ে বার দুয়েক সিগারেট টেনে এসেছে দরজার ধারে। চলন্ত ট্রেনে সিগারেট ধরানো আর টানা চাপের, কিন্তু নাকি হেব্বি মজা হয়। সকালে লাইন একা পড়ে গেছলো, এখন হোস্টকে পেতে সুদে আসলে পুষিয়ে নিচ্ছে। ফুরিয়ে গেলে বুলেট বিড়ি রেডি আছে। এরা ভালোরকমের রসদ বোঝাই করে এনেছে।

    ওদেরকে ফার্স্ট ইয়ারের একটা গল্প বললাম (ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট ইয়ার সাধারণত সব রকম স্ট্রীম মেলানো মেশানো থাকে, অ্যালফাবেটিকালি সেকশন ভাগ হয়। এদের তিনজনের নামই A দিয়ে শুরু বলে এদের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছে সেকেন্ড ইয়ার থেকে)।

    শীতকালে মফস্বলে বন্ধুদের কলেজে গেছলুম। বিকেলে দেখি চার না পাঁচ বান্ডিল বিড়ি আর দুতিন প্যাকেট সিগারেট কিনলো। ঐ মেসে ওরা পাঁচ জন থাকতো, আর আমি এই সব শুকনো জিনিসে কোনদিন নেই। তাহলে অ্যাতো মাল কজনের ভোগে লাগবে? সাতপাঁচ না ভেবে যে কিনলো তাকে বললুম, কিরে, সারা মাসে রসদ কিনছিস?
    শুনে কেমন বিচ্ছিরি খ্যা খ্যা করে হেসে উঠলো সকলে।

    ও বাবা, সন্ধ্যে গড়িয়ে বেশিক্ষণ গেলো না, হাসির অন্তর্নিহিত অর্থ হৃদয়ঙ্গম হল।

    মোচ্ছব শুরু হল সিগারেট দিয়ে। তার পরে পাইকারি হারে বিড়ি। বেগতিক দেখে আমি একটা জানালা খুলে প্রায় গ্রিলের ধারে সিঁটিয়ে গেলুম। প্যাসিভ স্মোকিং-টোকিং বলেও এদের কানে কিস্যু ঢোকানো যাবে না। বাইরে থেকে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে, আর ঘরের ভেতরে বাতাস ভারি হয়ে আছে তামাকের কটু গন্ধে। যাই কোনদিকে? বিটুইন সিলা অ্যান্ড ক্যারিবডিস সিচুয়েশন।

    রাতের দিকে মাথা ধরে একাকার, তখন সবাই মিলে বেরোনো হল। একটু ঘুরেও আসা যাবে আর বাইরে একটা টিউবওয়েল আছে, খাবার জল ভরে আনতে হবে রাতের জন্য।

    বাইরে বেরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি শুধু আমি যেই দিকের জানালা খুলে রেখেছি, সেই দিক থেকে আলো ঠিকরে আসছে, আর শীতের রাত্রে জানালা দিয়ে বেরোনো ধোঁয়া স্পষ্ট অবয়ব নিয়ে ভেসে বেরোচ্ছে। কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে।

    সেটা বাকিদের দেখাতে কি আনন্দ সবার। ওগুলো নাকি ওদের চিতার ধোঁয়া, সিগারেটে ক্যান্সার, ক্যান্সারে মৃত্যু। সিগারেট বা বিড়ি টানাটার নাম দিয়েছে 'মুখাগ্নি'। তারপরে কারুর উর্বর মস্তিষ্কে খেয়াল চাপলো যে আমি যেহেতু 'চিতার আগুনে আমরা কজন' ক্লাবে নেই, তাহলে দল বেঁধে পিটিয়ে মেরে আমাকে কবর দেওয়া হোক, এক যাত্রায় পৃথক ফল নাকি শাস্ত্রে মানা। সেই নিয়ে খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে রাতভর বাওয়ালি। সে ছিল এক দিন আমাদের...

    কমবয়েসে মৃত্যু নিয়ে রসিকতা খুব সহজেই জিভের ডগায় আসতে পারে। আজকে ওদের কজন সিগারেট খায় কে জানে।

    সেই গল্পটাই বলছিলাম সেদিনের ঐ তিনজন বন্ধুকে। আড্ডাটা বঢ়িয়া জমে গেছলো, কিন্তু ভিলেন না হলে কি গপ্প জমে? অতয়েব অতঃপর ভিলেনের আগমন।

    কামরাতে একজন টিটি উঠলেন আর আমরাও আমসির মত শুকিয়ে গেলুম। কি হবে এবার? আমাদের তো লোকালের টিকিট। নার্ড বলেছিল বটে কিন্তু টিকিট পাল্টাতে গেলে এই ট্রেন মায়া হতে যেত। গুজগুজ ফুসফুস করে যে একটু রিহার্সাল দিয়ে নেবো, তার জো নেই, ভদ্রলোক এই দিকেই সোজা আসছেন।

    টিকিটগুলো হোস্টের কাছে ছিল, টিটি এসে টিকিট চাইতে সে একটু গাঁইগুঁই করে বের করতে লাগল অর সেই অবসরে লাইন 'স্যার একটা কথা ছিল' বলে ধরতাই শুরু করল।

    ভদ্রলোক ঘুঘু চরিয়ে খাওয়া মাল। 'না না, আমি কোন কথাই শুনবো না, আগে টিকিট দেখি' বলে মাথাটাথা নাড়িয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আমরা ভাবলুম মুন্ডু খুলে পড়ে না যায়। উনি ভালো মতোই বুঝে গেছেন, ডালমে জরুর কুছ কালা হ্যায়।

    তো সেই কালা ডাল বেরুতে ভদ্রলোক একেবারে সিরিয়াস টু দি পাওয়ার এন হয়ে 'না এই টিকিট চলবে না, ফাইন দিতে হবে, অনাদায়ে জেল' এই সব হুমকি টুমকি দিতে শুরু করলেন।

    বেশ বুঝতে পারছি আমরা সবাই কমবেশি ঘাবড়ে গেছি, তবু হাল ছাড়লে কি চলে? সবাই মিলে বোঝাতে লাগলুম আমরা কলেজ স্টুডেন্ট, শান্তিনিকেতনে এজুকেশনাল (এই খানে prop কে বলে খুক খুক কাশি লাগাতে হবে ব্যাকগ্রাউন্ডে) ট্রিপে যাচ্ছি। আজকের লোক্যাল ট্রেন নেই বলে বাধ্য হয়ে এই ট্রেনে উঠেছি। স্টেশনে টিকিট পাল্টাতে গেছলাম, ওখানে বলেছে, ট্রেনে টিটিকে বললে পাল্টে দেবে। এই সব হ্যানা-ত্যানা গল্প দিয়ে সবশেষে চারদিক থেকে লাইন 'স্যার', হোস্ট 'দাদা', নার্ড 'কাকু' আর আমি মনে মনে 'শালা', মুখে কোয়ালার মত হাসি দিয়ে ভদ্রলোককে একেবারে অভিমন্যুর মত ঘিরে ধলাম।

    মিঃ ঘুঘু খুব একটা গললেন না, ট্রেনের বাকি লোকগুলো হাঁ করে মুফতে এই নাটক দেখছিল, তাদের টিকিট চেক করে উল্টোদিকে চলে গেলেন। যাবার আগে আবারও ফাইন দেবার হুমকি দিয়ে গেলেন।

    ভদ্রলোক চলে যেতে আমরা নিজেদের মধ্যে একটু প্ল্যানিং করে নিলুম। ঠিক হল, এ যদি বেশি ঝামেলা করে তাহলে বলব শান্তিনিকেতনে আমদের নিতে লোক আসবে, তাদের থেকে টাকা নিয়ে ফাইন দেবো। আর দু একটা স্টেশন আগে নেমে পড়লেই হবে। নইলে শান্তিনিকেতনে নেমে লাইন ধরে কেটে পড়লেই হবে। মোটমাট ফাইনের গল্পে কেউ নেই।

    ঐ সব প্ল্যান ট্যান করে বেশ ঘ্যামসে বসে রইলুম।

    ভদ্রলোক অবিশ্যি ফিরে এলেন খানিকক্ষণের মধ্যেই। সুর বেশ নরম হয়েছে। আমাদের আইডি কার্ড গুলো দেখতে চাইলেন, ভাগ্যিস সেগুলো সঙ্গে ছিলো। দেখে টেখে, আর কোনদিন এরকম না করার উপদেশ দিয়ে, ভাড়ার ডিফারেন্সের টাকা গুনে নিয়ে টিকিট পাল্টে দিয়ে চলে গেলেন। আমাদেরও ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। আনন্দের চোটে বেশ কয়েকবার 'জয় বাবা বেলমুড়ি' আউড়ে নিলুম। নার্ড আবার গম্ভীর হয়ে গেল।

    বেশ রাত হয়ে এসেছে। এই হার্ডলটা পেরিয়ে যেতেই খেয়াল হল জম্পেশ খিদে লেগেছে। সুতরাং আমাদের কোণাটাতে উটকো মত একটা লোক বসেছিলো, তাকে গরুতাড়া করে ভাগিয়ে আমরা হোস্টের মায়ের দেওয়া খাবারগুলোর সদ্ব্যবহার করে ফেললুম। খাবার খুব বেশি ছিল না, খিদের মুখে সেসব আগুনে ধুনাচুরের মতই উবে গেল, পরে হয়ত কিছু কিনে খেতে হতে পারে, তবু আপাততঃ পেটের জ্বলুনি একটু কমল।

    * * * * * * * *

    ট্রেন গন্তব্যে অনেক রাত করেই পৌঁছল। লোক্যালে এলে যে কি হাল হত, তাই ভাবলুম।

    এবারে আমাদের দ্বিতীয় স্ট্রাটেজি কাজে লাগানো হল। স্টেশনে নামতেই গুচ্ছের রিকশাওয়ালা ঘিরে ধরলো যথারীতি। আমরাও 'আমাদের ঠিক করা লোক আছে' বলে সেই ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে গেলুম। জেনারেলি, স্টেশন থেকে একটু দূরে গিয়ে রিকশাওলা ধরলে বার্গেন করতে সুবিধে হয়, রেট অনেক কম পড়ে।

    অনেকটা যাবার পরেও যখন দুজন রিকশাওয়ালা আমাদের পিছু ছাড়ল না, বুঝলুম, এরাই আমাদের অদৃষ্টে আছে আজ। তারাও বেশ অনেক করে বলল, সকাল থেকে নাকি বউনি হয়নি, প্রচুর ট্রেন লেট আর যেগুলো এসেছে, তাতে খুব কম লোকই আজকে শান্তিনিকেতনে এসেছে। আমরা না গেলে আজকের দিনটা নাকি তাদের এমনিই যাবে।

    কথাগুলো আমাদেরও খুবই সত্যি মনে হল। সুতরাং আমরা একটা ছোট চুক্তি সেরে রিকশায় চেপে বসলুম। চুক্তিটা হল যে আমাদের ভালো লজে নিয়ে যেতে হবে, তবে ওরা নিয়ে গেলেই সেই লজে আমরা উঠবো তা না (সবজায়গাতেই কমিশনের ব্যাপার থাকে) যদি পছন্দ হয়, তবেই সেই লজে উঠবো, ততক্ষণ অবধি আমাদের ঘোরাতে হবে। আর মোস্ট ইম্পরট্যান্ট সবার আগে 'টান্টু'-র দোকানে নিয়ে যেতে হবে। রাজি? চালাও রিকশা ভুবনডাঙ্গা।

    রিকশায় চেপে হঠাৎ করেই যেন খেয়াল হল, আরে আমরা তাহলে সত্যি শান্তিনিকেতনে এসে গেলাম? সকাল থেকে এত রকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হতে কেমন একটা ইমিউন হয়ে গেছলুম, ভালো মন্দ কিছুই যেন মনে লাগছিল না, আশা-নিরাশার দোলাচলে ভুগছিলুম, এখন কথাটা খেয়াল হতেই গাটা কেমন শিউরে উঠল আনন্দে।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৮572870
  • জানি আমাদের দেশে হিপোক্রেসির অন্ত নেই, তাই বলে এই ভাবে লেঙ্গি মারবি বাপ? এইরকম অস্থানে? সেই যে অ্যাডাল্ট জোক আছে না, ক্রেতা এসে দোকানদারকে জিগগেস করছে, জাঙ্গিয়ার দাম কত? দোকানি বলে আশি টাকা। ক্রেতা চোখ গোলগোল করে খানিক্ক্ষণ কি ভাবল, তারপর পাশে একটা নকলি নাইকির টুপি দেখিয়ে বলল, আর এর দাম? - কুড়ি টাকা। - এটাই দাও ভাই। যার জন্য জাঙ্গিয়া কিনবো, জাঙ্গিয়ার দাম শুনে সে টাকে উঠে গেছে। আমাদেরও বিলকুল সেই অবস্থা।

    আর কিছুই না, আজকের দিনটা খেয়াল আছে? জানি কারুর খেয়াল নেই। আমাদেরও ছিল না। অবেলায় রাক্ষস ভোজনের পরে পেটে গদ আর আইঢাই গা নিয়ে যাহোক করে চা-বিস্কুট মেরে বেশ জলদিই বেরিয়ে পড়েছিলাম হোস্টের বাড়ি থেকে, লাইন তার বাকপ্যাকটা নিয়ে নিয়েছিল, 'বিশেষ কাজ' সারার জন্য যা অত্যন্ত জরুরি। হোস্টকে পই পই করে বলা আছে, সেও আশ্বাস দিয়েছে, সব ব্যবস্থা পাকা। বর্ধমান সে নাকি হাতের তালুর মত চেনে। কোন অসুবিধে হবে না।

    প্রথম পুণ্যস্থানে গিয়ে দেখা গেল তালা ঝুলছে। তখনো সন্দেহ হয়নি, হোস্ট বলল, কুছ পরোয়া নেই। আরেকটা জায়গাও জানি। তবে সেটা একটু দূরে, রাস্তার ধারে।

    বেশ অনেকটা হাঁটার পরে দ্বিতীয় দোকানটাও বন্ধ দেখে বেকুবের মত আমরা সামনে দাঁড়িয়েছিলুম, লাইন পাশের গুমটি দোকানে জানতে চাইল, কি ব্যাপার, এই দোকান বন্ধ কেন?

    দোকানদার একটু হেসে যখন পালটা আজকে বার কি আমরা জানি কিনা জানতে চাইল, তখন আমাদের দিমাগের বাত্তি হঠাৎ রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের মত জ্বলে উঠলো।

    ও হরি!! তাইতো! আজ বেস্পতিবার। ড্রাই ডে!!! কলকাতায় ড্রাই ডে তে বড় বারে ড্রিংকস সার্ভ করে না শুনেছি, সপ্তাহের মাঝে কেই আর কবে বোতল কিনতে গেছে, ফলে দোকান খোলা থাকে কিনা কোনদিন ভেরিফাই করিনি। আজকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে।

    সেই যে গোড়ার দিকে বলেছিলুম না, অ্যাকুরেটলি ট্রিপের দিন/বার বলে দিচ্ছি কি করে, এই বেস্পতিবারের ড্রাই ডের ট্রমা আজো পরিষ্কার মনে আছে। উদভ্রান্তের মত সন্ধ্যে নেমে আসা হতাশায় 'কি হবে তাহলে?' এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে আরো দু একটা জায়গায় ঘুরেছিলাম আমরা।

    খুঁজি খুঁজি নারি। হাঁটুর ব্যথা ক্রমশঃ টনটনে হয়ে থামিয়ে দেবার আগে অবধি একটা লেজিটিমেট জায়গা খুঁজতে আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। দু একজন বেআইনি কান্ট্রি লিকারের পাউচ যোগাড় করে দেবে বলেছিল, কিন্তু হোস্ট এর আগে নাকি একবার কান্ট্রি খেয়ে বমি করে ভাসিয়েছিল, তার তুমুল আপত্তিতে আমাদেরও আর ভরসা হল না।

    এই সবকিছুর মধ্যে সবথেকে ডিস্টার্বিং হচ্ছে, নার্ডের মুখে অরুন গোভিলের মত একটা 'পতিতপাবন' হাসি দেখা দিয়েছে যেটা আমাদের ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দিচ্ছে 'কিরে, বলেছিলাম কিনা? আর বলবি বেলমুড়ি?'

    নার্ডের কেসটা খুব অদ্ভুত। নার্ড ওর বাবার সঙ্গে ক্লাবে গেছে। সেখানে গেলে ওর বাবা নাকি প্রিমিয়াম হুইস্কি খান। নার্ড খায় ফ্রেশ লাইম সোডা। এক দুবার হুইস্কি চেখে দেখেছে, তাতে নাকি ওর পরের দিন টিপটিপে মাথা ব্যথা হয়। আমাদের আগে যখন প্ল্যান হচ্ছিলো, তখন থেকেই শুনিয়ে রেখেছে, আমরা যা নেবার নিই, ওর জন্যে ফ্রেশ লাইম সোডা যোগাড় করে দিতে হবে। সেটা কোথায় পাওয়া যাবে আমাদের কারুরই আইডিয়া নেই, তবুও নার্ডের মন রাখতে আমরা খুঁজবো বলেছি। এখন আর নার্ডের ফ্রেশ লাইম সোডা না পেলেও আফসোস নেই, আমাদের আছোলা বাঁশ যাচ্ছে, এটা দেখার আনন্দের কাছে আর সব কিছুই তুশ্চু।

    হোস্টের এক বন্ধুর সঙ্গে আচমকাই রাস্তায় দেখা হয়ে গেল আর সলিউশনটা আমরা তার কাছ থেকেই পেয়ে গেলুম। সে কুলকাল জানালো, শান্তিনিকেতনে কয়েক মাস আগেই গেছলো অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। ওখানে রাত্তিরে গীতাঞ্জলি হয়তো পাওয়া নাও যেতে পারে কিন্তু কমপক্ষে দুটি 'ম'-এর কোন রকম ঘাটতি অসম্ভব, সে ড্রাই ডেই হোক আর কার্ফুই জারি থাক।

    সেই কথাই সই। আমার হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে, এবারে আমাদের হোস্টের বাড়ি ফিরে জলদি তৈরি হয়ে আবার স্টেশনে পৌঁছে যেতে হবে। নিজের ক্রুশ টানতে টানতে এগোতে লাগলুম....

    বেরোনোর সময় আরেক চমক। পৌঁছতে কত রাত হবে তার ঠিক নেই, অত রাতে কি খাবো তার সমস্যা হতে পারে এই সব সাত পাঁচ ভেবে আমাদের জন্যে হোস্টের মা ইয়াব্বড় এক টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি লুচি আলুরদম মিহিদানা সীতাভোগ সাজিয়ে দিয়েছেন।

    সকালে প্রথমবার দেখার পরে হোস্টের মা বাবাকে যে প্রণামটা করেছিলাম আমরা, তাতে হয়তো প্রথাগত নিয়মরক্ষার তাগিদটাই সিংহভাগ ছিল, কিন্তু বেরোনোর আগে এই প্রণাম একেবারে অন্তর থেকে এলো, কোন রকম খাদ ছিলো না তাতে।

    * * * * * * * * *

    স্টেশনে এসে চল্লিশ মিনিট পরেও যখন নির্ধারিত ট্রেন এলো না, হোস্ট আর লাইন গেলো খোঁজ খবর নিতে। ফিরে এসে জানালো হাওড়াতে বেলার দিকে অনেক ট্রেন বাতিল হয়েছে অথবা অনেক পরে চলছে। ট্রেনের টাইমের কোন বাপ মা আগেই ছিলো না, আজকে পুরো গোত্রই বিনষ্ট হয়ে গেছে।

    যে ট্রেনের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, তর কোন হদিশ কেউ দিতে পারেনি। অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতে বলেছে, ট্রেন এলে তখনই জানা যাবে, তার আগে না।

    ওফ্ফ! সমস্যা দেখছি মোটে আমাদের পেছন ছাড়ছে না। এই ট্রেন পেলেও অনেক রাতে পৌঁছাতাম, এটা লোকাল ট্রেন, কিন্তু এখন আদপেই যে কি হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। যদি আরো রাতে আদৌ ট্রেন দেয় আমাদের শান্তিনিকেতন পৌঁছাতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে।

    কিছুই আর মাথায় আসছে না। কিছু ভাবতেও ভালো লাগছে না। নার্ড আবার সেই বেলমুড়ি প্রসঙ্গ তুলে লেকচার মারতে গেছলো, আমাদের তিনজনের থেকে সাইমালটেনিয়াসলি খিস্তি খেয়ে তার ফেসকাটিং এখন অরুন গোভিল থেকে পাল্টে পুনীত ইশারের মত হয়ে গেছে।

    কি একটা অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছিলো, খুব একটা মনোযোগ দিয়ে শুনিনি, হঠাৎ দেখি হোস্ট ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত সিধে হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা অবাক হয়ে তাকাতেই সে খুব উত্তেজিত হয়ে বললো, শুনলি, রামপুরহাট এক্সপ্রেস আসছে পাশের প্ল্যাটফর্মে।

    আসছে তো আসছে। তাতে তোরই কি, আমাদেরই বা কি? ইফ বেল ইজ পাকিং, দি বায়স গেইনস নাথিং।

    আরে ধুত, ওটা শান্তিনিকেতন হয়েই যাবে।

    তাতেই বা কি, আমাদের তো লোকালের টিকিট। আমাদের এক্সপ্রেসে উঠতে দেবে কেন? তোর মামার ট্রেন?

    যদি আমরা টিকিট পাল্টে নিই? নার্ড সাজেস্ট করল।

    এখন আমাদের টিকিট পাল্টাতে গেলে এই প্ল্যাটফর্মের একেবারে শুরুতে গিয়ে স্টেশন মাস্টার বা ঐ রকম কাউকে ধরতে হবে। সে ঝটপট যদি করেও দেয়, আবার এতটা পথ উজিয়ে এসে পাশের প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে এই ট্রেন ধরতে। ট্রেন এখানে কতক্ষণ দাঁড়াবে কেউ জানি না, এই ট্রেনই এখন আমাদের সবেধন নীলমণি, এর মধ্যে ট্রেন বেরিয়ে গেলে পুরো হাতে হারিকেন, মাঝখান থেকে ফালতু এক্সপ্রেসের ভাড়াটা গচ্চা যাবে।

    আরেকটা বড় ফ্যাক্টর হল আমার এই খোঁড়া পা নিয়ে এই ছোটাছুটি করা সম্ভব নয়, দুপুরে যে রেস্টটা পেয়েছিলাম, বিকেলের উদভ্রান্ত ঘোরাঘুরি আমার পায়ের সক্ষমতার কোটা ফুলফিল করে দিয়েছে। এখন আমি যা হোক করে পা টেনেটেনেই চলছি।

    সকালের উদ্বেগের পুরনো ঢেউটা আবার ফিরে আসতে শুরু করে দিয়েছে, সময় আর নদীর স্রোতের কুলু কুলু ধ্বনিতে না, একেবারে মাইথন ড্যামের খোলা স্লুইশ গেট দিয়ে হু-হা বেরিয়ে যাচ্ছে, একটা জোরালো আলো দূর থেকে তীব্রগতিতে ধেয়ে আসছিল, সেটা এখন এত কাছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। কে বলেছে ট্রেনের শব্দ কুঝিকঝিক? আমাদের সিস্টোল ডায়াস্টোলের প্রতিধ্বনিই যেন ভেসে আসছে এই লৌহদানবের আগমনী গানে। সে আসছে, এসে পড়েছে, ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে...

    অ্যানাউন্সমেন্ট কনফার্ম করলো রামপুরহাট এক্সপ্রেস পাশের প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে শুরু করে দিয়েছে।
  • শঙ্খ | 118.35.9.186 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:৩৯572872
  • রিকশাওলারা কথামতো একটা ঠিকঠাক সাইনবোর্ড লাগানো টান্টুর দোকানেই নিয়ে গেল। দোকান অফিসিয়ালি বন্ধ হয়ে গেছিল, হবেই তো, ভালোই রাত হয়ে গেছে, কিন্তু ঐ রিকশাওলারা বোধহয় আলিবাবার বংশধর; 'চিচিং ফাঁক' বলতেই সিড়িঙ্গে পানা দুটো লোক কোথা থেকে চলে এল। সস্তার কি একটা হুইস্কি নিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই, তবে নার্ড ফ্রেশ লাইম সোডা আছে কিনা জিগগেস করতে লোকগুলো 'বিলিতি রাখিনা স্যার' বলে কান এঁটো করা হাসি দিলো আর আমরাও খিল্লি করার একটা অজুহাত পেয়ে বেজায় খুশি হলুম। বেলমুড়ি নিয়ে আর কচলাতে নিজেদেরই বিরক্তি লাগছিলো।

    খবরের কাগজে মোড়া বোতল হাতে আসতে মনে হল কেউ গ্র্যান্ড স্ল্যামের কাপ হাতে তুলে দিচ্ছে। লাইন ওটা নিজের কাছে রাখল, আমরাও এগ্রি করলাম, এই রকম প্রেমভরা চোখে ও ফুলশয্যার রাতে নিজের বৌয়ের দিকেও তাকাতে পারবে না, আর ফুলশয্যার কথায় খেয়াল এলো, ফুল অউর কাঁটে, যেমনই হোক, একটা করে শয্যার ব্যবস্থা আমাদেরও করে ফেলতে হবে। কাছেপিঠেই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, দু একপশলা ঠান্ডা বাতাস মাঝে মধ্যে বয়ে যাচ্ছে, রাতে আবার ঢালবে মনে হয়।

    রিকশাওলারা আমাদের দুটো লজ দেখালো, প্রায় গায়ে গায়েই। দুটোই এক সে বড়কর এক খাজায়েস্ট লজ। কিন্তু সস্তা। প্রথমটাতে টয়লেটে মনে হলনা জিন্দেগিতে কেউ ফ্লাস করেছে, ঘুপচি ঘরখানা আমোদিত হয়ে আছে। পরেরটাতে রুম বড়, কিন্তু খাটগুলো দেখে মনে হল কেউ মারা গেলে ওগুলো ভাড়া দেওয়া হয়। তাও তিনটে খাট থুড়ি খাটিয়া, জুড়ে দিয়ে কোনমতে চারজনে শোয়া যাবে। বিছানা প্রায় নিরাভরণ, শুধু কুটকুটে কম্বলের ওপরে পরিষ্কার বেডকভার আর ওয়াড় পরানো বালিস। সন্দিগ্ধ পাপী মন, পরে ওয়াড় একটু ফাঁক করে দেখেছিলুম সে এক বিপর্যয় অবস্থা হয়ে আছে ভেতরে। অনেকটা পুরীর ভোগের মত, 'রান্নাঘরে উঁকি দিলে আর খাওয়া যাবে না' টাইপ।

    তবে আসল চমকটা হল, টয়লেটে একটা গাম্বাট বাথটাব বসানো আছে। হোস্টের দেখেই পছন্দ। আমরা একটু গাঁইগুঁই করছিলাম, কিন্তু লজের মালিক দরকষাকষিতে বেশ কিছুটা নেমে এলো। আমাদেরও মনে হল এর চেয়ে কমে শোবার জায়গা খুঁজলে স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম ছাড়া আর যুৎসই কিছু নাও মিলতে পারে। সুতরাং ঐ রুমটাই ফাইনালাইজ করে ফেললুম।

    রুমে ব্যাগগুলো রেখে আরেকবারের মত বেরোতে হল, আমাদের জন্য পেপসি আর নার্ডের জন্য লিমকা কিনতে। হোস্টের আবার একটু চোখের খিদে মত আছে, রাস্তার ধারে একটা হাতরুটির দোকান দেখে খাইখাই করছিল বলে বেশ কিছু রুটি আর আন্ডা-তড়কা কিনলাম আমরা। সত্যযুগে ভাজা কিছু ঠান্ডা পেঁয়াজিও নেওয়া হল, যেগুলো চাটের পারপাস সার্ভ করবে। দোকানির কাছে কাচের বোয়ামে 'শিউড়ির আচার' রাখা ছিলো। শিউড়ির আচারের নামডাক শুনেছি, তাও অল্প করে নেওয়া হল। যদ্দুর মনে পড়ে সরষে-টরষে দিয়ে বেশ থেঁতো করা ঝাল-টক আমের আচার টাইপ কিছু ছিল।

    এই সব করতে করতেই আমরা জায়গাটা একটু ঘুরে নিচ্ছিলাম। রাস্তাঘাটে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, ছোটখাট দুএকটা দোকান খোলা আছে, বর্ধমানের মতই আধা শহুরে-আধা মফস্বল লাগলো জায়গাটাকে। বেশ বোঝা যাচ্ছিলো দিনের বেলা এই সব রাস্তাঘাট গমগম করে। এখন যেন রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে কেউ শুনশান করে দিয়েছে। দু একটা রাতজাগা পাখির ডাক ছাড়া চারিদিক নিশুতি। আমাদের কলকাতার হট্টগোলে অভ্যস্ত কানে কেমন তালা লেগে যাচ্ছিলো বারবার।

    ঘোরা সেরেসুরে ফিরে এসে রাত একটার চৌকাঠ পের করে যখন সস্তার হুইস্কির প্রথম ঝাঁঝালো ঢোঁক আমাদের গলা বেয়ে নামছিল, শান্তিনিকেতনের অদ্ভুত একটা নেশা তার আগেই আমাদের অনেকখানি মাতাল করে দিয়েছে। যেকথাটা আগেও বলেছি, আবার রিপিট করছি, সারাদিনের বিপুল এবং বিচ্ছিন্ন (ডাইভার্স) সব অভিজ্ঞতার পর আমাদের এত নিশ্চিন্ত, এত পূর্ণ লাগছিল, সেটা অনুভব করা যায় হয়তো, বোঝানো দুষ্কর।

    রিকশায় আসতে আসতে আমাদের মনে হয়েছিল, পিঠের তলায় একটা বিছানা পেলেই আমরা একেবারে এসকেপ ভেলোসিটি নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাবো, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সবারই চোখ দাঁড়িয়ে গেছে। সেটা কতটা গলাবুক জ্বালিয়ে দেওয়া হুইস্কি (নার্ডের ক্ষেত্রে লিমকা), কতটা ঐ সব অম্বুলে খাবার, কতটা আমাদের অসাংবিধানিক আলোচনা আর কতটা লোকাল কেবল চ্যানেলে গভীর রাতে প্রচারিত 'রেশমা কি জওয়ানি' টাইপ কেলেকুলো মুষকো অবয়বে ভর্তি মাল্লু সিনেমা যাতে খালি শব্দকল্পদ্রুমই সার, তা বলতে পারবো না।

    চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে থেকেও রাত সাড়ে তিনটে-চারটের সময় যখন শুনতে পেলুম, সাধের ঘুম 'রঞ্জনা, আমি আর আসবো না' গাইছে, তখন সবাই মানে মানে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে বারান্দাতে দাঁড়ালুম।

    আমাদের ঘরের বাইরে সরু প্যাসেজ অন্ধকার, পাশের ঘরগুলোতেও কেউ নেই, কেমন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একা লাগছে। আমাদের রুমখানা তিনতলাতে। নিচেই রাস্তা আর রাস্তার ওদিকে একটা ঝাঁকড়া গাছ আর ল্যাম্পপোস্ট। সেই অল্প আলোতে রাতের গম্ভীর অন্ধকার যেন আরো বেশি করে মালুম হচ্ছে। আকাশে একটাও তারা নেই অর্থাৎ ভালোই মেঘ ঘনিয়েছে।

    বেশি অপেক্ষা করতে হল না। খানিকক্ষণ গুলতানি করতে করতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল।

    সে এক অলীক রাত। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে একলা ভিজছে শুধু রাস্তার ওপারে ঝাঁকড়া সেই গাছ। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সব কেমন হলদেটে ঝাপসা লাগে। বিন্দু বিন্দু জলকণা রেলিং পেরিয়ে আমাদের নেশাশ্রান্ত মুখে-ঠোঁটে-গালে চুমু খেয়ে আসছে-যাচ্ছে, চোখ বুজে সেই আমেজ মাখিয়ে নিচ্ছি সমগ্র চেতনায়, নেশা যেন রক্তের মধ্যে ঘন হয়ে আসে। মাথা এমন এলোমেলো লাগে, মনে হয় হেলিকপ্টারে চড়েছি; সারা গায়ে যেন সুখে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মাথায় গেঁথে থাকা কোন পুরোনো সুর একই লুপে ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে...

    আহ্‌ ! সে এক অপার্থিব রাত। দূরদূরান্তে কেউ নেই, কোন সাড়াশব্দ নেই, শুধু একটানা ঝিরঝিরে শব্দে বৃষ্টি আর সোঁদা মাটির গন্ধ। থেকে থেকে শব্দহীন নীল আলোর রেখা আকাশ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। এই চরাচরহীন জলমগ্ন ভূখন্ডে আমরা চারজন যেন প্যাপিলনের মত একা, রিক্ত, পরিত্যক্ত আর সবকিছু ধুয়েমুছে গেছে বহুদিন। দমকে দমকে বৃষ্টির ধারা রেলিং টপকে বারান্দায় চলে আসে, আমাদের স্নাত করে, মাঝরাত্তিরের আর্দ্র হিমেল বাতাসে কাঁপুনি লাগে কলিজায়।

    ঘরে ঢুকে হুইস্কি যা এক দু ফোঁটা পড়ে ছিল, ভাগাভাগি করে সরাসরি বোতল থেকে গলায় ঢেলে নিই আমরা, ভেতর জ্বালিয়ে যেন ক্যাকটাসের ঝাড় নামতে থাকে, নাকে চোখে জল এসে যায় ঝাঁজের চোটে, তবু ওম পাইনা। আবার বারান্দা যেন নিশির ডাকের মত আমাদের টানতে থাকে। সঙ্গে গরম জামাকাপড় কিছু নেই, আর চেতনাও আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বেড কভারকেই গায়ে জড়িয়ে গুটিসুটি ঘন হয়ে আসি আমরা চারজনে।

    কার মাথায় এসেছিলো মনে নেই, আমরা ট্রুথ অর ডেয়ার টাইপের একটা খেলা খেলতে শুরু করে দিলাম। কড়ার হল এই কথাগুলো শুধু আজ রাতের জন্য, এরপরে কোন দিন কোনভাবেই এই তথ্য তুলে আমরা রেফার করবো না।

    মনের মানুষের খোঁজ বড় জটিল বাবুমশাই। আমাদের প্রত্যেকের মনের মানুষ যে আরশিনগরে লুকিয়ে থাকে, তাকে টেনে বের করে আনা খুব সহজ কাজ না, আমরা তাকে নিয়তই আরো গহীনে ঠেলে দিতে চাই। তবু সেই তার হয়ত গরাদ ভাঙ্গার রাত ছিল, অল্প কিছু সময়ের জন্যে হলেও।

    প্রায় প্রতিটা প্রশ্নোত্তর মনে আছে, সেই রাতে যে কথাগুলো অমোঘ মনে হয়েছিল, আমাদের বিস্মিত করেছিল, যে যার মনের নিভৃততম কথাটি, সম্পর্কের কথা, চাহিদা-বাসনার খবর উজাড় করে দিয়েছিল, এবং আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সেই সময়ের মাপকঠিতে দাঁড়িয়ে সে সবই সত্যি, অনেক ধাঁধার টুকরো জোড়া লেগে গেছল, চেনা মানুষ কি কখনো সম্পূর্ণ চেনা হয়----

    আজকে এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে যখন ভেবে দেখছি, হিসেবের কড়ি বাঘে খেয়ে গেছে। প্রায় সব সমীকরণ উল্টেপাল্টে গেছে, কেউ কথা রাখেনি, অচেনা থেকে আরো সুদূর বৃত্তে সরে সরে গেছি আমরা...

    জীবনের সাজেশান পেপার খুব কমই মেলে।

    সে এক অবিশ্বাস্য রাত, তবু, সে রাত আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাসের রাত।

    * * * * * * * * * * *

    উপসংহার
    -------------

    পনেরশ শতকের দিকে স্প্যানিয়ার্ডরা যখন মেক্সিকো দখল করার জন্য হানা দেয়, তখন আজটেকদের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় মন্টেজুমা। খাল কেটে কুমির আনার মত করে হার্মান কোর্টেজকে নিজের প্রাসাদে নেমন্তন্ন করে বেচারা রাজা ফেঁসে যান। কোর্টেজ মন্টেজুমাকে প্রথমে নিজগৃহে বন্দী ও পরে নিজ দেয়ালে ছবি করে দেন।

    বলা হয় সেই রাগেই নাকি মন্টেজুমা অভিশাপ দেন, এর পর থেকে নতুন দেশে কেউ গেলে নো মামাবাড়ির আদর, উল্টে অভিবাসীর শরীর খারাপ হবে। সেই থেকে একটা পপুলার ফ্রেজ চালু হয়ে যায়ঃ নতুন দেশে বা জায়গায় গিয়ে শরীর খারাপ হলে সেটাকেই বলে 'মন্টেজুমা'স রিভেঞ্জ'।

    বিশেষ করে কলোনিতে পরিণত হওয়া দেশগুলোতে এই ফ্রেজটা খুব চালু। ভারতে এই টার্মটা হল, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন 'ডেলি বেলি'।

    ভোররাতে কখন টলতে টলতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম, তার হুঁশ নেই। ঘুম ভাঙ্গলো সকালে প্রচন্ড মাথা ব্যথা আর গা গুলোনো নিয়ে। প্রায় সবারই অবস্থা হালুয়া টাইট কিন্তু ইস্ক্রুপ টাইট হয়ে গেছে নার্ড, তার পেট হাল ছেড়ে দিয়েছে, হাত শুকোতে পাচ্ছে না। গতরাত্রের খাবার বা অন্য কোন ভাবে ডেলি বেলি অথবা মেক্সিকান অভিশাপ তার পেটে বসতি করেছে।

    হ্যাঁ, আমরা মেন মেন জায়গাগুলো, যেমন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, উপাসনা গৃহ, কালো বাড়ি, দেহলি, উত্তরায়ন এই সব কয়েকটা জায়গা খুব ওপর ওপর চোখ বুলিয়ে দেখার মত করে ঘুরেছিলাম বটে, কিন্তু আশেপাশে আর যেসব জায়গাগুলো দেখব বলে প্ল্যান করেছিলাম যেমন খোয়াই/ডিয়ার পার্ক, কোপাই নদী, কংকালীতলা, সেসব কিছুই দেখা হয়না। পায়ে হেঁটেও জায়গাটা খুব একটা ঘুরতে পারিনি। বাকি রয়ে গেছে কলা ভবন, চীনা ভবন, সঙ্গীত ভবন, আরো কি কি জানিও না হয়তো।

    শান্তিনিকেতন অধরা মাধুরী হয়েই থেকে গেছে মনে মনে।

    * * * * * * * * * * *

    পুনশ্চ
    ----------

    এতদিন বাদে এই লেখাটা লিখতে বসে খুব ভাবলুম, অনেক ভাবলুম। ভ্রমণ কাহিনীতে মেন যেটা ঘোরার জায়গা, সকলে সেটার বিস্তারিত বিবরণই লেখে। আমার সেই পাতাগুলো সাদা পড়ে আছে। শান্তিনিকেতন গেছলুম, দেখেছি ঐ পর্যন্তই হয়ে রয়ে গেছে, বরং মনের মধ্যে অনেক বেশি জমি নিয়ে ঠাঁই গেঁড়ে আছে যাবার দিন ও রাতের ঘটনাপরম্পরা। আর বাঙ্গালীকে পুরী, দীঘা, শান্তিনিকেতন কিংবা দার্জিলিং নিয়ে যাই বলা হোক, তেলা মাথায় তেল দেবার মত লাগবে। বা মায়ের কাছে মাসির গল্প।

    জ্যাকি চানের প্রত্যেকটা সিনেমার শেষে blooper বা goofs থাকে, অর্থাৎ সিনেমা শুটের সময় Unintended indiscretions before microphone and camera। গল্প/সিনেমা তৈরি হবার নেপথ্য ভাষণ। আমি মাঝে মধ্যেই ভাবি শুধু ব্লুপার দিয়েই বানানো একটা গল্প বা সিনেমা থাকলে কেমন হত? আছে হয়ত, আমার পড়ে/দেখে ওঠা হয়নি।

    সেদিক থেকে ভাবলে এই গল্পটাও তো ব্লুপারে ছয়লাপ হয়ে আছে। তাই সই। থাকুক না আমার এই গল্পটা শুধু 'শান্তিনিকেতন যাবার গল্প' হয়েই। এক হয়ে ওঠা জার্নির গল্প।
  • siki | 96.96.160.7 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১০:২৬572873
  • গুরু কী লিখেচো, পুরো একঘর দক্ষিণখোলা উইথ অ্যাটাচড বাথ! সক্কাল সক্কাল উঠে পড়ে ফেলে মনটা তর্‌র হয়ে গেল একেবারে। সেই বেলমুড়ি, মাঝের পাড়া ছাড়াও সংস্কৃতিবান লোকজন যার উল্লেখ আজও করেন শ্রীফল-চালভাজা বলে, তার ওপর, লাইম সোডার বিশেষণে "বিলিতি রাখিনা স্যার" ... একেবারে হ্যাহ্যা করে হেসে যাচ্ছি, বিশ্বাস করুন, এখনো দাঁতও মাজি নি। :)

    অপূর্ব ন্যারেশন। অপূর্ব লেখা।
  • b | 135.20.82.164 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৩:০০572874
  • বেশ।
  • kumu | 132.160.159.184 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৩:২৫572875
  • একটু পড়ে প্রিন্টাউট নিলাম,বাড়ী গিয়ে পড়ব।
  • ঐশিক | 213.200.33.67 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৩:৫৬572876
  • খুব ভালো লাগলো, আরো লিখুন
  • শ্রী সদা | 69.97.137.91 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৫:৩৪572877
  • যাতা তো! এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেল্লাম !
  • j | 230.227.106.153 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৫:৩৫572878
  • অসা এবং খাসা
  • গান্ধী | 213.110.243.21 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৬:৩৬572879
  • দারুণ
  • Rit | 213.110.243.21 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৭:৪৬572881
  • আমি তো আগেই পড়েছি।ঃ) এডিট করোনি নিশ্চয়ই।
  • Debashis | 47.106.25.253 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৭:৫২572882
  • একসঙ্গে পুরোটা পড়ার মজাই আলাদা। একটু সংশোধনী, ও তেমন কিছু না, এ পাড়ায় ব্লগ নাই। টই ঃ)। সে যাহাই হউক, যার নাম চালভাজা, তারই নাম মুড়ি। জয় বাবা বেলমুড়ি ঃ))।
  • Mon | 121.93.171.229 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৭:৫৮572883
  • সবচাইতে ভাল লেগেছে শুরুটা ---- পূজাবার্ষিকির এই অধঃপতনের যুগে আর এই সাড়ে সাতশর গ্যাসের যুগে এমন একটি ফ্রী আর ফ্রেশ লেখা সত্যিই বিরাট পাওনা।
  • bhabuk | 208.80.144.187 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২০:২২572884
  • সাধু সাধু ।
  • | 24.99.6.85 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:২৬572885
  • ক্ষ ভাল। ক্ষুব ভাল্লাগলো।:-)
  • | 24.99.6.85 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:২৭572886
  • *ক্ষি ভাল।
  • | 24.99.6.85 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:২৭572887
  • *ক্ষি ভাল।
  • | 60.82.180.165 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:২৮572888
  • বাঃ,এক টুকরো নষ্ট -লজিঃ)
  • 4z | 152.176.84.188 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৩০572889
  • দারুণ দারুণ!!
  • kk | 117.3.243.18 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৩২572890
  • শংখর লেখার স্টাইল আমার বরাবরই খুব ভালোলাগে। এই লেখাটাও অতি চমৎকার লাগলো।
  • SS | 141.193.196.214 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৩৫572892
  • হুঁ, খুব সুন্দর লেখার স্টাইল।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন