এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • শিবাংশু | 127.197.244.235 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১৮:৫৮577353
  • শান্তিগোপাল আমাদের প্রজন্মের সর্বাধিক কার্যকরী ইতিহাস শিক্ষক ছিলেন। চল্লিশ বছরের বেশি পেরিয়ে এসেও মনে হয় তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি সেই সব প্রকৃত ইতিহাসপুরুষদের থেকেও আমার কাছে এখনও অধিক স্বীকার্য হয়ে আছে। যাত্রা মাধ্যমে 'লোকশিক্ষে'র ঐ মাত্রা আর কারুর কাছে পাইনি।

    তাঁকে নমস্কার।
  • রূপঙ্কর সরকার | 24.96.87.167 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১৯:৫০577364
  • কিছুদিন আগে 'ভূতের ভবিষ্যৎ' নামক 'ছায়াছবি' দেখছিলাম। জর্জ বেকারের কিংস ক্রস প্রদানের কথা শুনে শাশ্বত বলল, 'এটা কেরে শান্তিগোপাল '? চেনা শোনা কিছু অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীদের জিজ্ঞেস করে দেখলাম, কেউ বোঝেনি ব্যাপারটা। অথচ এক সময়ে কোনো মানুষ তার স্বভাবসিদ্ধ আচরণ না করলেই তাকে 'শান্তিগোপাল বলা হত। পেলে কোলকাতায় খেলতে এসে সেই সাম্বা ম্যাজিক দেখাননি, মাঠশুদ্ধু লোক বলল, ওরে, এটা শান্তিগোপাল, পেলে সেজে নেমেছে।

    কি অসাধারণ মেক আপ করতেন। নিজের মেক আপ নিজেই করতেন, মেক-আপ ম্যান কে ধারে কাছে আসতে দিতেন না। লেনিন-এর মেক আপ করতে মাসের পর মাস রাশিয়ায় পড়ে থেকেছেন, বারংবার ডকুমেন্টারি চালিয়ে চালিয়ে লেনিনের প্রতিটা ম্যারিজম, হাত নাড়া, মুখস্থ করেছেন। হিটলার দেখে মানুষ সত্যি ক্ষেপে গিয়ে হামলা করার মত অবস্থা হয়েছে কোথাও কোথাও।

    এখনকার প্রজন্ম সিনেমার উত্তমকুমারের কথা জানে মঞ্চের, শিশির ভাদুড়ির কিংবা গিরিশবাবুর মত বহু প্রাচীন অভিনেতার কাহিনীও মুখস্থ, অথচ এই অসামান্য প্রতিভা স্মৃতির অতলে চলে গেল কোন অভিশাপে কে জানে। বেশ কিছু এযুগের লোক দেখেছি নামই শোনেনি।
  • kumu | 132.160.159.184 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ১৯:৫৯577375
  • যাঁরা দেখেছেন বা জানেন,লিখুন।
  • রূপঙ্কর সরকার | 24.96.87.167 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২০:০৬577386
  • হ্যাঁ, এই অসামান্য প্রতিভার একটু স্মৃতিচারণ হবেনা ? কেউ যদি থাকেন তো লিখুন। আমি তো দেখেছি-ই, খুব কাছ থেকে। ওঁর একটাই প্রোডাকশন পছন্দ হয়নি, সেটি উৎপল দত্ত পরিচালিত মাও সে তুং। বাকি সব কটাই ওঁর নিজের পরিচালনায়। আসলে দুই প্রতিভার ঠোকাঠুকিতে ব্যাপারটা জমেনি। কিন্তু গুরুর সদস্যরা আর কেউ ওঁর অভিনয় দেখেননি ? একি হতে পারে ?
  • | 127.194.87.195 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২১:০৬577390
  • আমি এক সময় যাত্রা দেখতাম । কিন্তু উনার অভিনয় দেখি নি। রুপঙ্কর দা লিখুন না। শিংবাশু তুমি ও লেখো না।
  • janataa | 127.221.50.245 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২১:৩৪577391
  • ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ নাটকে শান্তিগোপালের অভিনয় ছিল অনবদ্য। তাঁকে লক্ষীবাঈয়ের ঘোড়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল।
  • | 24.99.182.226 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২১:৫৩577392
  • দেখেছি।
    স্পার্টাকাস মনে আছে। আরো একটা দুটো
  • | 24.99.182.226 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২১:৫৬577393
  • স্মৃতির ব্যাড সেক্টর থেকে উদ্ধার করতে পারলে একটু লিখব।স্পার্টাকাসই কেবল মনে পড়ছে।
  • aranya | 154.160.226.53 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২৩:২৭577394
  • নেতাজীর চরিত্রে দেখেছি মনে হচ্ছে, নাকি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে .. আর স্পার্টাকাস । দারুণ লেগেছিল, সেই ভাল লাগাটাই মনে আছে, ডিটেলস সব বিস্মৃত :-( ।
    যাদের মনে আছে, জমিয়ে লিখুন। খুবই বড় শিল্পী ছিলেন, imho।
  • ranjan roy | 24.97.59.69 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২৩:৩৯577354
  • মানুষ শান্তিগোপালঃ
    সালটা সম্ভবতঃ ৭৭ কি ৭৮। ভিলাইয়ের একটি ক্লাব আনিয়েছে শান্তিগোপাল পরিচালিত অভিনীত " রক্তাক্ত চিলি" ( নামটা ভুল হতে পারে কিন্তু ঘটনাটা ওই)। ওনার দলটির নাম তরুণ অপেরা। বড় টিম নিজস্ব তিনটে না চারটে বাস ভরে কোলকাতা থেকে এসেছে ওনার কলাকুশলী, যন্ত্রপাতি, প্রপ্স।
    খবর পেয়ে ভিলাইয়ের চারপাশের ছোট শহরতলী গুলো থেকে পঙ্গপালের মত এসেছে বাঙালীর দল। জায়গা পাওয়া মুশকিল।
    বেশ রাতে অভিনয় শেষ হলে জনতার অনুরোধে শান্তিগোপাল ওনার দলের দুটো বাস দিয়ে দূরের দর্শকদের দুটো ট্রিপ করে বিনে পয়সায় পৌঁছে দিয়েছিলে্ন।
    নাটকটায় উনি করছিলেন সি আইয়ের ক্যুদেতায় ক্ষমতাচ্যুত নিহত প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দের রোল। উঁচু স্টেজের ডানদিকের মাত্র একটা জোন উনি ব্যবহার করছিলেন-- প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের একটি গবাক্ষ। অনেক খেটে তৈরি ভূমিকাটি। কোথাও লাউড লাগে নি। আর বলতেই হবে সংগীত পরিচালক প্রশান্ত ভট্টাচার্য্যের কথা। লোক কবি জারার গানের চেয়েও আমার বেশি ভাল লেগেছিল একটি তরুণ শ্রমিক দম্পতির অভিনয়ের সঙ্গে খোলা গলায় গাওয়া গান, ওদের প্রেম ও শহীদ হওয়া।
    " খনিগুলো মণিভরা, আমি তাই তুলে আনি দিনরাতি,
    তবু আমার গোলপাতার ঘরে, জ্বলেনি রোশনাই বাতি।
    কারখানায় কারখানায়---"
    কালো একটু গোলগাল দেখতে মেয়েটির উদাত্ত ভরাট গলা, চোখদুটো জ্বলছিল।
    একটা অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। মোহগ্রস্ত। নিরপে্ক্ষ মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

    আর কয়েকবছর পরে ভোপালে কার্ল মার্ক্স। কৌতূহল ছিল এর নাট্যরূপ নিয়ে।
    কিন্তু উনি যখন লন্ডনে না খেতে পাওয়া অবস্থায় দূধের দাম চাইতে আসা গয়লাকে সারপ্লাস ভ্যালূ বোঝাচ্ছিলেন, বা হাইড পার্কে বাচ্চাদের পিঠে নিয়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছিলেন, অথবা একটি সিকোয়েন্সে পরিবারের সুখে দুঃখে সঙ্গী মহিলার সঙ্গে ওনার প্রেমের মার্মিক ইশারা পাই তখন মার্ক্স আমার কাছের মানুষ হয়ে যান। পার্টির বইপত্তর পড়ে এক অতিমানব প্রায় ঈশ্বরের সমতূল্য মার্ক্সকে জানতাম।
    মার্ক্স নিয়ে চাপ কাটিয়ে উঠলাম, ভালোবাসাটা রয়ে গেল।
    শান্তিগোপাল কে শ্রদ্ধা জানাই, নিজের মত করে ভাল থাকুন।
  • siki | 11.38.14.3 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২৩:৪৪577355
  • আমি অ্যাকচুয়েলি নামটাই প্রথম শুনলাম আজ। এমনকি রেফারেন্স হিসেবে যে সব নাটক / যাত্রা / সিনেমার নাম লেখা হচ্ছে এখানে, সেগুলোর নামও আজই প্রথম শুনছি।
  • শুদ্ধ | 127.194.238.254 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২৩:৪৬577356
  • কি আশ্চর্য্য! রূপঙ্করদার ফেসবুকের পাতায় লিখে দিলাম 'খোঁড়া বাদশা'-র কথা। শান্তিগোপাল নেই শুনে। আমার অশিক্ষা সীমাহীন।

    বাবার মতে আমার বয়স তখন আড়াই যখন আমি 'খোঁড়া বাদশা' দেখি। খড়্গপুরে এক রাত্রের যাত্রার আসরে। শীত আসছে আসছে এমন সময় তখন। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আসছে। কালীপূজো কেটে গেল। মফস্বলের শীতের আগে আমেজ এসে গিয়েছে। বাতাসে হালকা বারুদের গন্ধ লেগে আছে বাজীর। প্রচুর, প্রচুর বাজী পুড়তো। তুবড়ির প্রতিযোগিতা হত। কোনটা কুড়ি ফুট, কোনটা পঁচিশ ফুট এমনকি চল্লিশ-ও, সে তুবড়ির ফুটন্ত আগুণের খই ঝোরতো। যে বাজীকরের বাজী উচ্চতার বদলে ফেটে যেত সে তুবড়ির আসরে সে বাজীকরের জন্য দুয়ো শোনার মতন। সেই সব দুয়োর দাগ-ও লেগে আছে বাতাসে। এমন সময় রেল কলোনীর বিশাল মাঠ ঘিরে ফেলা হল। টিনের দেওয়াল। দেড় মানুষের বেশী উচ্চতা। সেই টিনের দেওয়াল যা ঘিরছে তা কিন্তু সার্কাস না। তা হল যাত্রা।
    ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন একটা মঞ্চ হচ্ছে। সেই মঞ্চের চারদিক খোলা। লম্বা দুটো স্লোপ চলে গ্যাছে সাজঘর থেকে সোজা সে মঞ্চে। মঞ্চের সামনে বসবে কনসার্ট পার্টি। তাদের জন্য একটু নীচু করে জায়গা রাখা। কখনো দু পাশেও বসতে দেখেছি তাঁদের। পিছনে সাজঘরের দিক থেকে টেপ বাজতো। সামনে, পিছনে আলোর স্ট্যান্ড বসে যাবে। আলোক নিয়ন্ত্রকের বসার ব্যবস্থা হবে ওই দুটো স্লোপের মাঝখানের অংশে। শুনেছি এ সব ব্যবস্থা হল যাত্রা সম্রাট স্বপনকুমারের করা। আধুনিক করেছেন তিনি। রবি ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে তাঁর জ্যাঠাইমা। মেজদা, বিজন মুখোপাধ্যায়। শিশির ভাদুড়ির সাক্ষাৎ ছাত্র। তিনি, স্বপনকুমার ছিলেন সনৎ, হলেন স্বপন যাত্রায়। বাবা, দাদার মৃত্যুর পরে, দিদির একমাত্র ছেলে দাঙ্গায় মারা যাবার পরে, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এসেছিলেন যাত্রায়।

    সন্ধ্যা নামবে একদিন মফস্বলে, শীত আসার আগের সন্ধ্যা। দলে দলে লোক যাত্রার সিজন টিকিট কেটেছে। একেক কোম্পানি আসবে, একেক যাত্রা গাইবে। নট্ট থেকে শুরু করে রয়্যাল বীণাপাণি। সে আমলে শান্তিগোপাল অপেরাও। শান্তিগোপালে আসার আগে বলে নিই আমার ভয় পাওয়ার কথা। মঞ্চে দেখলাম তেমন এক সন্ধ্যায় এক খোঁড়া বাদশার জন্য থালায় সাজিয়ে কাটা মুন্ডু নিয়ে আসছে এক পার্ষদ। অবিকল যেমন দেখতে অভিনেতা একটু আগে খুব লড়ছিলেন বাদশার সঙ্গে তাঁর কাটা মুন্ডু। ভয় পাবো না? তখন কি ছাই জানি ও মুন্ডু মাটির? ও মুন্ডু কৃষ্ণনগরের ফুল-ফলের মতন? তবে বাদশাটি শান্তিগোপাল না, তিনি শিবদাস।

    শান্তিগোপাল-ও ভয় দেখালেন। হিটলার-এ। আরেকটু বড় তখন। মেদিনীপুড়, জকপুর, খুড়দা কত কত জায়দায় যাত্রা হয়। বাবার সঙ্গে সঙ্গে, পাড়ার পাতানো সোনা কাকা, দাদাভাই-এর সঙ্গে চলে যাই। রাত জেগে যাত্রা। দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়েছি। আবার আতঙ্কের মধ্যে জেগে থেকেছি সারারাত। স্পার্টাকাসে কালো লোকটা সেই! সেই যে যে স্পার্টাকাসের মতন দাস ছিল, গ্ল্যাডিয়েটর ছিল, যে এরিনায় স্পার্টাকাসকে খুন করতে চেয়েছিল, স্পার্টাকাসের বউ-কে কামনা করেছিল, সেই লোকটা কি কালো, কি ভয় ধরাণো ছিল। সেই হাসিটা? কি ক্রুর, কি ভয়ানক! মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই মনে হত এই শয়তানটা কেন মরে না? কিন্তু যখন স্পার্টাকাস ওকে মারলো না, যখন ও স্পার্টাকাসের বন্ধু হল, যখন ওরা একসঙ্গে বিদ্রোহের কথা বললো, করলো- তখন মন ভরে গেছিলো। মনে হয়েছিল এবারে কেউ স্পার্টাকাসকে হারাতেই পারবে না। আমি ছাই তখন বুঝি শ্রেণী সংগ্রাম কি? সশস্ত্র বিপ্লবের কত কত পথ ও পন্থা? বামের কত মত? যত মত তত পথ না? খুনোখুনি হয়ে যায় বামের বামত্ব মাপতে? কিচ্ছু জানি না এসব। শুধু জানি মালিকেরা বড় ভয়ানক। নিগ্রো মানুষটার চেয়েও। তারা শয়তানের-ও শয়তান। তারা সব লুঠে নেয়। কেমন করে জানলাম? শান্তিগোপাল দেখে। সুকান্ত-র শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার পড়ে।

    সুকান্তর কবিতা, শান্তিগোপালের যাত্রা, সুরেশবাবুর পাপেট থিয়েটার-এর একটি মোরগের কাহিনী সব মিলে মিশে যেত সেই সব শীত সন্ধ্যার অন্তরে অন্তরে। মানুষ গর্জন করতো। মানুষের গর্জন যারা শোনেনি তারা জানে না কেমন ভীষণ সে গর্জন। সমুদ্র-ও শিশু তার কাছে। মহাসমুদ্রের নাদ সে। আমি আমার দুই থেকে বারো অব্দি মজে ছিলাম যাত্রায়। থিয়েটার অল্প স্বল্প এসেছে মফস্বলে। মাচা বেঁধে খুব বেশী দল করতো না ওখানে। ডিহি কলকেতার বাবু মহলের যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকের দলে পড়তাম আমরা। মফস্বলের-গ্রামের মানুষরা। আমরা সেই ফাত্রা লোক, যারা না খাটলে মাঠ থেকে ধান ওঠে না, যারা না খাটলে কল-কারখানা চলে না। বাবুদের ফুটুনি তিন মিনিটে উবে যায়। আমরা যারা অপমানিত হতাম বাবুদের হাতে, যারা বাবুদের ফাত্রা লোক তারা যাত্রাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম।

    শান্তিগোপাল, পোষাকি নাম বীরেন্দ্রনারায়ণ পাল। বাবা প্রেসিডেন্সির ছাত্র, দাদা জজ। ও বাড়ির ছেলে যাত্রা করে না। তিনি করেছিলেন। প্রথমে পাড়ার নাটক, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার উদয়াচল, তারপরে একদিন যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রা। বাগবাজারের মদনমোহনতলায় শুরু হত সিজন। সেখানে অমর ঘোষ পরিচালক হয়েছিলেন। শান্তিরাম, শান্তিরঞ্জন পেরিয়ে অবশেষে তিনি শান্তিগোপাল হয়েছেন। মম্মথ রায় গলার মালা খুলে দিয়েছেন। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে রাতের পর রাত ইতিহাস পড়িয়েছেন শান্তিগোপাল। বাংলার এক অনন্য ইতিহাসের শিক্ষক। লোকে বলতো জ্যোতিবাবুর দালাল। গ্রামের কংগ্রেস গুন্ডা, জোতদার, দালালরা বলতো। লেনিন করে। রাশিয়া যায়। হিটলার করে। আবার আমি সুভাষ-ও করে। মাও সে তুং করে। ব্যাটা নকশাল। কত কি! শুনেছি মারার জন্য মুখিয়ে থাকতো তারা। শুনেছি কৃষকদের দল হাতে কাস্তে নিয়ে যাত্রা দেখতে আসতো। দেখেছি পাড়ার কংগ্রেসের ছোট নেতা তড়পে গেলে পালটা রুখে দাঁড়াতে রেলের কর্মী মজদুরদের। যারা ইউনিয়নের লোক। যারা লাল। বা অতিলাল। শান্তিগোপাল আসবেন-ই। শান্তিগোপাল এসেছিলেন। আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। লোকশিক্ষা দিতেন। এবং একটা অনন্য শিক্ষা দিতেন। আজ ডিহি কলকেতার বাবুপাড়ার থেটারে এসে দেখি 'লোকে কি খাবে' তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলে। এমনকি যা নাকি অতি বুদ্ধিজীবি ব্যাপার সেই নব নাট্যেও। আমরা যারা গ্রামে-মফস্বলে শান্তিগোপালের একনিষ্ঠ দর্শক, বোকা এবং ফাত্রা লোক- তারা জানি কে কি খাবে ভেবে রান্না হবে না। এ থ্যাটার হোটেল না, কি স্বাস্থ্যকর, কি দরকারী, কি তারপরেও সুস্বাদু তাই রান্না করা দরকার। যদি রাঁধিয়ের দম থাকে তাহলে পাত পেড়ে খাবে পাড়া-বেপাড়ার লোক। না থাকলে উঠোন কেন ব্যাঁকা তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হবে, নাচা হবে না। শান্তিগোপাল, আমাদের শিক্ষক হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। চাষাভূষো, মজুর-টজুর বিধিবদ্ধ ফাত্রা লোককে শিক্ষণীয় যাত্রা দেখিয়েছেন হাজারে হাজারে বসিয়ে। হ্যাঁ, তারাও দেখে গিয়েছে। সেলাম করে গিয়েছে, আর গর্জনে উত্তাল হয়েছে। মহাসমুদ্রের মহানাদে। এমন দিন থুড়ি এমন রাত বাংলা কি আবার দেখবে?
  • শুদ্ধ | 127.194.238.254 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২৩:৪৬577357
  • কি আশ্চর্য্য! রূপঙ্করদার ফেসবুকের পাতায় লিখে দিলাম 'খোঁড়া বাদশা'-র কথা। শান্তিগোপাল নেই শুনে। আমার অশিক্ষা সীমাহীন।

    বাবার মতে আমার বয়স তখন আড়াই যখন আমি 'খোঁড়া বাদশা' দেখি। খড়্গপুরে এক রাত্রের যাত্রার আসরে। শীত আসছে আসছে এমন সময় তখন। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আসছে। কালীপূজো কেটে গেল। মফস্বলের শীতের আগে আমেজ এসে গিয়েছে। বাতাসে হালকা বারুদের গন্ধ লেগে আছে বাজীর। প্রচুর, প্রচুর বাজী পুড়তো। তুবড়ির প্রতিযোগিতা হত। কোনটা কুড়ি ফুট, কোনটা পঁচিশ ফুট এমনকি চল্লিশ-ও, সে তুবড়ির ফুটন্ত আগুণের খই ঝোরতো। যে বাজীকরের বাজী উচ্চতার বদলে ফেটে যেত সে তুবড়ির আসরে সে বাজীকরের জন্য দুয়ো শোনার মতন। সেই সব দুয়োর দাগ-ও লেগে আছে বাতাসে। এমন সময় রেল কলোনীর বিশাল মাঠ ঘিরে ফেলা হল। টিনের দেওয়াল। দেড় মানুষের বেশী উচ্চতা। সেই টিনের দেওয়াল যা ঘিরছে তা কিন্তু সার্কাস না। তা হল যাত্রা।
    ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন একটা মঞ্চ হচ্ছে। সেই মঞ্চের চারদিক খোলা। লম্বা দুটো স্লোপ চলে গ্যাছে সাজঘর থেকে সোজা সে মঞ্চে। মঞ্চের সামনে বসবে কনসার্ট পার্টি। তাদের জন্য একটু নীচু করে জায়গা রাখা। কখনো দু পাশেও বসতে দেখেছি তাঁদের। পিছনে সাজঘরের দিক থেকে টেপ বাজতো। সামনে, পিছনে আলোর স্ট্যান্ড বসে যাবে। আলোক নিয়ন্ত্রকের বসার ব্যবস্থা হবে ওই দুটো স্লোপের মাঝখানের অংশে। শুনেছি এ সব ব্যবস্থা হল যাত্রা সম্রাট স্বপনকুমারের করা। আধুনিক করেছেন তিনি। রবি ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে তাঁর জ্যাঠাইমা। মেজদা, বিজন মুখোপাধ্যায়। শিশির ভাদুড়ির সাক্ষাৎ ছাত্র। তিনি, স্বপনকুমার ছিলেন সনৎ, হলেন স্বপন যাত্রায়। বাবা, দাদার মৃত্যুর পরে, দিদির একমাত্র ছেলে দাঙ্গায় মারা যাবার পরে, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এসেছিলেন যাত্রায়।

    সন্ধ্যা নামবে একদিন মফস্বলে, শীত আসার আগের সন্ধ্যা। দলে দলে লোক যাত্রার সিজন টিকিট কেটেছে। একেক কোম্পানি আসবে, একেক যাত্রা গাইবে। নট্ট থেকে শুরু করে রয়্যাল বীণাপাণি। সে আমলে শান্তিগোপাল অপেরাও। শান্তিগোপালে আসার আগে বলে নিই আমার ভয় পাওয়ার কথা। মঞ্চে দেখলাম তেমন এক সন্ধ্যায় এক খোঁড়া বাদশার জন্য থালায় সাজিয়ে কাটা মুন্ডু নিয়ে আসছে এক পার্ষদ। অবিকল যেমন দেখতে অভিনেতা একটু আগে খুব লড়ছিলেন বাদশার সঙ্গে তাঁর কাটা মুন্ডু। ভয় পাবো না? তখন কি ছাই জানি ও মুন্ডু মাটির? ও মুন্ডু কৃষ্ণনগরের ফুল-ফলের মতন? তবে বাদশাটি শান্তিগোপাল না, তিনি শিবদাস।

    শান্তিগোপাল-ও ভয় দেখালেন। হিটলার-এ। আরেকটু বড় তখন। মেদিনীপুড়, জকপুর, খুড়দা কত কত জায়দায় যাত্রা হয়। বাবার সঙ্গে সঙ্গে, পাড়ার পাতানো সোনা কাকা, দাদাভাই-এর সঙ্গে চলে যাই। রাত জেগে যাত্রা। দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়েছি। আবার আতঙ্কের মধ্যে জেগে থেকেছি সারারাত। স্পার্টাকাসে কালো লোকটা সেই! সেই যে যে স্পার্টাকাসের মতন দাস ছিল, গ্ল্যাডিয়েটর ছিল, যে এরিনায় স্পার্টাকাসকে খুন করতে চেয়েছিল, স্পার্টাকাসের বউ-কে কামনা করেছিল, সেই লোকটা কি কালো, কি ভয় ধরাণো ছিল। সেই হাসিটা? কি ক্রুর, কি ভয়ানক! মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই মনে হত এই শয়তানটা কেন মরে না? কিন্তু যখন স্পার্টাকাস ওকে মারলো না, যখন ও স্পার্টাকাসের বন্ধু হল, যখন ওরা একসঙ্গে বিদ্রোহের কথা বললো, করলো- তখন মন ভরে গেছিলো। মনে হয়েছিল এবারে কেউ স্পার্টাকাসকে হারাতেই পারবে না। আমি ছাই তখন বুঝি শ্রেণী সংগ্রাম কি? সশস্ত্র বিপ্লবের কত কত পথ ও পন্থা? বামের কত মত? যত মত তত পথ না? খুনোখুনি হয়ে যায় বামের বামত্ব মাপতে? কিচ্ছু জানি না এসব। শুধু জানি মালিকেরা বড় ভয়ানক। নিগ্রো মানুষটার চেয়েও। তারা শয়তানের-ও শয়তান। তারা সব লুঠে নেয়। কেমন করে জানলাম? শান্তিগোপাল দেখে। সুকান্ত-র শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার পড়ে।

    সুকান্তর কবিতা, শান্তিগোপালের যাত্রা, সুরেশবাবুর পাপেট থিয়েটার-এর একটি মোরগের কাহিনী সব মিলে মিশে যেত সেই সব শীত সন্ধ্যার অন্তরে অন্তরে। মানুষ গর্জন করতো। মানুষের গর্জন যারা শোনেনি তারা জানে না কেমন ভীষণ সে গর্জন। সমুদ্র-ও শিশু তার কাছে। মহাসমুদ্রের নাদ সে। আমি আমার দুই থেকে বারো অব্দি মজে ছিলাম যাত্রায়। থিয়েটার অল্প স্বল্প এসেছে মফস্বলে। মাচা বেঁধে খুব বেশী দল করতো না ওখানে। ডিহি কলকেতার বাবু মহলের যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকের দলে পড়তাম আমরা। মফস্বলের-গ্রামের মানুষরা। আমরা সেই ফাত্রা লোক, যারা না খাটলে মাঠ থেকে ধান ওঠে না, যারা না খাটলে কল-কারখানা চলে না। বাবুদের ফুটুনি তিন মিনিটে উবে যায়। আমরা যারা অপমানিত হতাম বাবুদের হাতে, যারা বাবুদের ফাত্রা লোক তারা যাত্রাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম।

    শান্তিগোপাল, পোষাকি নাম বীরেন্দ্রনারায়ণ পাল। বাবা প্রেসিডেন্সির ছাত্র, দাদা জজ। ও বাড়ির ছেলে যাত্রা করে না। তিনি করেছিলেন। প্রথমে পাড়ার নাটক, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার উদয়াচল, তারপরে একদিন যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রা। বাগবাজারের মদনমোহনতলায় শুরু হত সিজন। সেখানে অমর ঘোষ পরিচালক হয়েছিলেন। শান্তিরাম, শান্তিরঞ্জন পেরিয়ে অবশেষে তিনি শান্তিগোপাল হয়েছেন। মম্মথ রায় গলার মালা খুলে দিয়েছেন। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে রাতের পর রাত ইতিহাস পড়িয়েছেন শান্তিগোপাল। বাংলার এক অনন্য ইতিহাসের শিক্ষক। লোকে বলতো জ্যোতিবাবুর দালাল। গ্রামের কংগ্রেস গুন্ডা, জোতদার, দালালরা বলতো। লেনিন করে। রাশিয়া যায়। হিটলার করে। আবার আমি সুভাষ-ও করে। মাও সে তুং করে। ব্যাটা নকশাল। কত কি! শুনেছি মারার জন্য মুখিয়ে থাকতো তারা। শুনেছি কৃষকদের দল হাতে কাস্তে নিয়ে যাত্রা দেখতে আসতো। দেখেছি পাড়ার কংগ্রেসের ছোট নেতা তড়পে গেলে পালটা রুখে দাঁড়াতে রেলের কর্মী মজদুরদের। যারা ইউনিয়নের লোক। যারা লাল। বা অতিলাল। শান্তিগোপাল আসবেন-ই। শান্তিগোপাল এসেছিলেন। আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। লোকশিক্ষা দিতেন। এবং একটা অনন্য শিক্ষা দিতেন। আজ ডিহি কলকেতার বাবুপাড়ার থেটারে এসে দেখি 'লোকে কি খাবে' তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলে। এমনকি যা নাকি অতি বুদ্ধিজীবি ব্যাপার সেই নব নাট্যেও। আমরা যারা গ্রামে-মফস্বলে শান্তিগোপালের একনিষ্ঠ দর্শক, বোকা এবং ফাত্রা লোক- তারা জানি কে কি খাবে ভেবে রান্না হবে না। এ থ্যাটার হোটেল না, কি স্বাস্থ্যকর, কি দরকারী, কি তারপরেও সুস্বাদু তাই রান্না করা দরকার। যদি রাঁধিয়ের দম থাকে তাহলে পাত পেড়ে খাবে পাড়া-বেপাড়ার লোক। না থাকলে উঠোন কেন ব্যাঁকা তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হবে, নাচা হবে না। শান্তিগোপাল, আমাদের শিক্ষক হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। চাষাভূষো, মজুর-টজুর বিধিবদ্ধ ফাত্রা লোককে শিক্ষণীয় যাত্রা দেখিয়েছেন হাজারে হাজারে বসিয়ে। হ্যাঁ, তারাও দেখে গিয়েছে। সেলাম করে গিয়েছে, আর গর্জনে উত্তাল হয়েছে। মহাসমুদ্রের মহানাদে। এমন দিন থুড়ি এমন রাত বাংলা কি আবার দেখবে?
  • শুদ্ধ | 127.194.238.254 | ০৫ নভেম্বর ২০১২ ২৩:৪৬577358
  • কি আশ্চর্য্য! রূপঙ্করদার ফেসবুকের পাতায় লিখে দিলাম 'খোঁড়া বাদশা'-র কথা। শান্তিগোপাল নেই শুনে। আমার অশিক্ষা সীমাহীন।

    বাবার মতে আমার বয়স তখন আড়াই যখন আমি 'খোঁড়া বাদশা' দেখি। খড়্গপুরে এক রাত্রের যাত্রার আসরে। শীত আসছে আসছে এমন সময় তখন। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আসছে। কালীপূজো কেটে গেল। মফস্বলের শীতের আগে আমেজ এসে গিয়েছে। বাতাসে হালকা বারুদের গন্ধ লেগে আছে বাজীর। প্রচুর, প্রচুর বাজী পুড়তো। তুবড়ির প্রতিযোগিতা হত। কোনটা কুড়ি ফুট, কোনটা পঁচিশ ফুট এমনকি চল্লিশ-ও, সে তুবড়ির ফুটন্ত আগুণের খই ঝোরতো। যে বাজীকরের বাজী উচ্চতার বদলে ফেটে যেত সে তুবড়ির আসরে সে বাজীকরের জন্য দুয়ো শোনার মতন। সেই সব দুয়োর দাগ-ও লেগে আছে বাতাসে। এমন সময় রেল কলোনীর বিশাল মাঠ ঘিরে ফেলা হল। টিনের দেওয়াল। দেড় মানুষের বেশী উচ্চতা। সেই টিনের দেওয়াল যা ঘিরছে তা কিন্তু সার্কাস না। তা হল যাত্রা।
    ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন একটা মঞ্চ হচ্ছে। সেই মঞ্চের চারদিক খোলা। লম্বা দুটো স্লোপ চলে গ্যাছে সাজঘর থেকে সোজা সে মঞ্চে। মঞ্চের সামনে বসবে কনসার্ট পার্টি। তাদের জন্য একটু নীচু করে জায়গা রাখা। কখনো দু পাশেও বসতে দেখেছি তাঁদের। পিছনে সাজঘরের দিক থেকে টেপ বাজতো। সামনে, পিছনে আলোর স্ট্যান্ড বসে যাবে। আলোক নিয়ন্ত্রকের বসার ব্যবস্থা হবে ওই দুটো স্লোপের মাঝখানের অংশে। শুনেছি এ সব ব্যবস্থা হল যাত্রা সম্রাট স্বপনকুমারের করা। আধুনিক করেছেন তিনি। রবি ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে তাঁর জ্যাঠাইমা। মেজদা, বিজন মুখোপাধ্যায়। শিশির ভাদুড়ির সাক্ষাৎ ছাত্র। তিনি, স্বপনকুমার ছিলেন সনৎ, হলেন স্বপন যাত্রায়। বাবা, দাদার মৃত্যুর পরে, দিদির একমাত্র ছেলে দাঙ্গায় মারা যাবার পরে, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এসেছিলেন যাত্রায়।

    সন্ধ্যা নামবে একদিন মফস্বলে, শীত আসার আগের সন্ধ্যা। দলে দলে লোক যাত্রার সিজন টিকিট কেটেছে। একেক কোম্পানি আসবে, একেক যাত্রা গাইবে। নট্ট থেকে শুরু করে রয়্যাল বীণাপাণি। সে আমলে শান্তিগোপাল অপেরাও। শান্তিগোপালে আসার আগে বলে নিই আমার ভয় পাওয়ার কথা। মঞ্চে দেখলাম তেমন এক সন্ধ্যায় এক খোঁড়া বাদশার জন্য থালায় সাজিয়ে কাটা মুন্ডু নিয়ে আসছে এক পার্ষদ। অবিকল যেমন দেখতে অভিনেতা একটু আগে খুব লড়ছিলেন বাদশার সঙ্গে তাঁর কাটা মুন্ডু। ভয় পাবো না? তখন কি ছাই জানি ও মুন্ডু মাটির? ও মুন্ডু কৃষ্ণনগরের ফুল-ফলের মতন? তবে বাদশাটি শান্তিগোপাল না, তিনি শিবদাস।

    শান্তিগোপাল-ও ভয় দেখালেন। হিটলার-এ। আরেকটু বড় তখন। মেদিনীপুড়, জকপুর, খুড়দা কত কত জায়দায় যাত্রা হয়। বাবার সঙ্গে সঙ্গে, পাড়ার পাতানো সোনা কাকা, দাদাভাই-এর সঙ্গে চলে যাই। রাত জেগে যাত্রা। দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়েছি। আবার আতঙ্কের মধ্যে জেগে থেকেছি সারারাত। স্পার্টাকাসে কালো লোকটা সেই! সেই যে যে স্পার্টাকাসের মতন দাস ছিল, গ্ল্যাডিয়েটর ছিল, যে এরিনায় স্পার্টাকাসকে খুন করতে চেয়েছিল, স্পার্টাকাসের বউ-কে কামনা করেছিল, সেই লোকটা কি কালো, কি ভয় ধরাণো ছিল। সেই হাসিটা? কি ক্রুর, কি ভয়ানক! মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই মনে হত এই শয়তানটা কেন মরে না? কিন্তু যখন স্পার্টাকাস ওকে মারলো না, যখন ও স্পার্টাকাসের বন্ধু হল, যখন ওরা একসঙ্গে বিদ্রোহের কথা বললো, করলো- তখন মন ভরে গেছিলো। মনে হয়েছিল এবারে কেউ স্পার্টাকাসকে হারাতেই পারবে না। আমি ছাই তখন বুঝি শ্রেণী সংগ্রাম কি? সশস্ত্র বিপ্লবের কত কত পথ ও পন্থা? বামের কত মত? যত মত তত পথ না? খুনোখুনি হয়ে যায় বামের বামত্ব মাপতে? কিচ্ছু জানি না এসব। শুধু জানি মালিকেরা বড় ভয়ানক। নিগ্রো মানুষটার চেয়েও। তারা শয়তানের-ও শয়তান। তারা সব লুঠে নেয়। কেমন করে জানলাম? শান্তিগোপাল দেখে। সুকান্ত-র শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার পড়ে।

    সুকান্তর কবিতা, শান্তিগোপালের যাত্রা, সুরেশবাবুর পাপেট থিয়েটার-এর একটি মোরগের কাহিনী সব মিলে মিশে যেত সেই সব শীত সন্ধ্যার অন্তরে অন্তরে। মানুষ গর্জন করতো। মানুষের গর্জন যারা শোনেনি তারা জানে না কেমন ভীষণ সে গর্জন। সমুদ্র-ও শিশু তার কাছে। মহাসমুদ্রের নাদ সে। আমি আমার দুই থেকে বারো অব্দি মজে ছিলাম যাত্রায়। থিয়েটার অল্প স্বল্প এসেছে মফস্বলে। মাচা বেঁধে খুব বেশী দল করতো না ওখানে। ডিহি কলকেতার বাবু মহলের যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকের দলে পড়তাম আমরা। মফস্বলের-গ্রামের মানুষরা। আমরা সেই ফাত্রা লোক, যারা না খাটলে মাঠ থেকে ধান ওঠে না, যারা না খাটলে কল-কারখানা চলে না। বাবুদের ফুটুনি তিন মিনিটে উবে যায়। আমরা যারা অপমানিত হতাম বাবুদের হাতে, যারা বাবুদের ফাত্রা লোক তারা যাত্রাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম।

    শান্তিগোপাল, পোষাকি নাম বীরেন্দ্রনারায়ণ পাল। বাবা প্রেসিডেন্সির ছাত্র, দাদা জজ। ও বাড়ির ছেলে যাত্রা করে না। তিনি করেছিলেন। প্রথমে পাড়ার নাটক, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার উদয়াচল, তারপরে একদিন যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রা। বাগবাজারের মদনমোহনতলায় শুরু হত সিজন। সেখানে অমর ঘোষ পরিচালক হয়েছিলেন। শান্তিরাম, শান্তিরঞ্জন পেরিয়ে অবশেষে তিনি শান্তিগোপাল হয়েছেন। মম্মথ রায় গলার মালা খুলে দিয়েছেন। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে রাতের পর রাত ইতিহাস পড়িয়েছেন শান্তিগোপাল। বাংলার এক অনন্য ইতিহাসের শিক্ষক। লোকে বলতো জ্যোতিবাবুর দালাল। গ্রামের কংগ্রেস গুন্ডা, জোতদার, দালালরা বলতো। লেনিন করে। রাশিয়া যায়। হিটলার করে। আবার আমি সুভাষ-ও করে। মাও সে তুং করে। ব্যাটা নকশাল। কত কি! শুনেছি মারার জন্য মুখিয়ে থাকতো তারা। শুনেছি কৃষকদের দল হাতে কাস্তে নিয়ে যাত্রা দেখতে আসতো। দেখেছি পাড়ার কংগ্রেসের ছোট নেতা তড়পে গেলে পালটা রুখে দাঁড়াতে রেলের কর্মী মজদুরদের। যারা ইউনিয়নের লোক। যারা লাল। বা অতিলাল। শান্তিগোপাল আসবেন-ই। শান্তিগোপাল এসেছিলেন। আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। লোকশিক্ষা দিতেন। এবং একটা অনন্য শিক্ষা দিতেন। আজ ডিহি কলকেতার বাবুপাড়ার থেটারে এসে দেখি 'লোকে কি খাবে' তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলে। এমনকি যা নাকি অতি বুদ্ধিজীবি ব্যাপার সেই নব নাট্যেও। আমরা যারা গ্রামে-মফস্বলে শান্তিগোপালের একনিষ্ঠ দর্শক, বোকা এবং ফাত্রা লোক- তারা জানি কে কি খাবে ভেবে রান্না হবে না। এ থ্যাটার হোটেল না, কি স্বাস্থ্যকর, কি দরকারী, কি তারপরেও সুস্বাদু তাই রান্না করা দরকার। যদি রাঁধিয়ের দম থাকে তাহলে পাত পেড়ে খাবে পাড়া-বেপাড়ার লোক। না থাকলে উঠোন কেন ব্যাঁকা তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হবে, নাচা হবে না। শান্তিগোপাল, আমাদের শিক্ষক হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। চাষাভূষো, মজুর-টজুর বিধিবদ্ধ ফাত্রা লোককে শিক্ষণীয় যাত্রা দেখিয়েছেন হাজারে হাজারে বসিয়ে। হ্যাঁ, তারাও দেখে গিয়েছে। সেলাম করে গিয়েছে, আর গর্জনে উত্তাল হয়েছে। মহাসমুদ্রের মহানাদে। এমন দিন থুড়ি এমন রাত বাংলা কি আবার দেখবে?
  • শিবাংশু | 127.197.245.105 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০০:২৫577359
  • একজন নট ও চতুর্থ মাত্রার সিদ্ধি

    তখন আমার সাত-আট বছর বয়স। আমাদের সবুজ কল্যাণ সঙ্ঘে যাত্রা উৎসব। দুদিন সন্ধেবেলা যাত্রা হবে তরুন অপেরার। শান্তিগোপালের 'হিটলার' আর 'রাজা রামমোহন'। বাবা দেখলুম শান্তিগোপালের সম্বর্ধনার জন্য মানপত্রের খসড়া লিখছেন।

    যাত্রা নিয়ে মায়ের বেশ রিজার্ভেশন ছিলো। তিনি বলতেন, 'যাত্রা শোনে ফাতরা লোকে/আর কবি শোনে ভদ্রলোকে'। এটা তাঁর পিতৃদেবের থেকে পাওয়া ধারণা। বাবাও 'যাত্রা' বিষয়ে নিতান্ত অনুৎসাহী ছিলেন। তাঁর কলকাতায় পড়াশোনা করার সময় শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্যের 'ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো' দেখার গরিমা কখনও ভুলতেন না। সাব-অল্টার্ন শব্দটা তখন লোকের জানা ছিলোনা। কিন্তু যাত্রার সঙ্গে সংযুক্ত মানুষজন সম্পর্কে 'ভদ্রলোকে'রা ঐ গোত্রীয় কিছু ভাব পোষণ করতেন। সে হেন বাবাকে একজন যাত্রা অভিনেতার জন্য সম্বর্ধনাপত্রের খসড়া করতে দেখে মা বেশ ক্ষুণ্ণ। কারণ বাবা ইতোপূর্বে এই কাজটা যাঁদের জন্য করেছেন তাঁদের তালিকায় আছেন, শিশির ভাদুড়ি, প্রমথনাথ বিশী, উস্তাদ আলাউদ্দিন, পন্ডিত রবিশংকর, উস্তাদ আলি আকবর, শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়, আচার্য নীহার রঞ্জন রায় প্রমুখ নানা ব্যক্তিত্ব। সেই সারিতে একজন 'যাত্রা অভিনেতা' কীভাবে আসতে পারেন?

    বাবা শান্তিগোপাল সম্বন্ধে কার কাছে কী শুনেছিলেন তা আমরা জানতুম না, কিন্তু তিনি স্পষ্টতঃ এই কাজটি করতে আনন্দ বোধ করছিলেন। তা আমরা সবাই তরুণ অপেরার 'হিটলার', নামভূমিকায় শান্তিগোপাল দেখতে পৌঁছোলুম। এর মধ্যে হলো একটা ঝামেলা। জানা গেলো শান্তিগোপাল মেক আপ নিজে নেন আর অন্তত দুঘন্টা লাগে এই কাজ করতে। তাই যদি তাঁকে সম্বর্ধনা গাওনার আগে দিতে হয় তবে সেটা ছটার মধ্যে করে ফেলতে হবে এবং আসর বসবে রাত আটটার আগে নয়। তাই সই,

    তখনও জামশেদপুরের লোক শান্তিগোপালের কোনও পালা দেখেনি। শুধু শুনেছে 'হিটলার'পালায় তিনি নাকি ফাটিয়ে দিয়েছেন। তার আগে আমাদের শহরের লোক দেখেছিলো স্বপনকুমারের ' মাইকেল মধুসূদন'। সেটাই তখন পর্যন্ত ছিলো উৎকর্ষের শেষ কথা। তো সেই ফাটাফাটি হিরো মঞ্চে এলেন শাদা ধুতি আর শাদা ফতুয়া পরে। সবিনয়ে নত হয়ে মানপত্র ও সম্বর্ধনা গ্রহণ করলেন। এও বললেন, এভাবে কলকাতায় কেউ তাঁকে সম্মান জানায়নি। কিন্তু প্রবাসীদের থেকে এই সম্মান তাঁকে অভিভূত করেছে। তাঁকে তখন দেখতে লাগছিলো একজন পরিশীলিত বৈষ্ণব কীর্তন গায়কের মতো নম্র,সুভদ্র, মৃদুভাষী। এই লোক কীভাবে হিটলারের ভূমিকা করবেন তাই নিয়ে জনতার বিপুল কৌতূহল।

    কর্নেট, বাঁশি, হার্মোনিয়াম, তবলার কেরামতি শেষ হলো। মঞ্চ অন্ধকার, হঠাৎ স্ট্রোভে লাল আলোর ঝলক আর চাবি পটকার দুমদাম। প্রথম দৃশ্য রণাঙ্গনে ট্রেঞ্চে দুজন সৈনিক লড়াইয়ের মাঝে কথা বলছে। একজনের সংলাপে নৈরাশ্য, কারণ এই অন্তহীন লড়াইয়ে সে হতাশ বোধ করছে। কিন্তু অন্যজন তাকে বোঝাচ্ছে ফুয়েরার কখনও ভুল করেন না,যা হচ্ছে ভালোর জন্যই হচ্ছে। তার পরেই আলো জ্বলে উঠলো। সেই ঝলমলে আলোয় হিটলারবেশী শান্তিগোপালের প্রবেশ, টেপে জনতার হর্ষধ্বনি এবং সামনে বাহু প্রসারিত করে হিটলারের বক্তৃতা। পলকের মধ্যে আসরে একেবারে ক্রেসেন্ডো এবং সেই টান ঢিলে হলোনা পরবর্তী আড়াই-তিন ঘন্টা। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দেখা আমার জীবনের প্রথম যাত্রাপালা। নায়িকা ছিলেন তন্বী সুন্দরী বর্ণালী বন্দোপাধ্যায়। তার পর আরো বছর কুড়ি যাত্রা দেখেছি। কিন্তু শুধু শান্তিগোপাল ও তাঁর পালা। একটিমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো লোকনাট্যের 'ঝড়'।

    ২.
    উৎপল দত্তের যাত্রায় আসার সঙ্গে সঙ্গে এই মাধ্যমটি একটা ইন্টেলেক্চুয়াল লেজিটিমেসি অর্জন করে। তার আগে ব্রজেন দে, ক্ষীরোদচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ, মাখনলাল নট্ট থেকে পঞ্চু সেন প্রমুখ এই মাধ্যমে লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু শহুরে 'শিক্ষিত' মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনের ঘরে সিঁধ কাটতে পারেননি। রাইফেল, ফেরারি ফৌজ থেকে ঝড়, উৎপল গ্র্যামারটা নতুনভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কাজটা ছিলো শান্তিগোপালের তুলনায় অনেক সহজ। উৎপল দত্তের ছিলো গ্রুপ পারফর্ম্যান্স এবং প্রয়োগে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। কিন্তু শান্তিগোপালের ছিলো প্রায় একক অভিনয়। যদিও তাঁর দলে শিব ভট্টাচার্যের মতো শক্তিমান সহ অভিনেতা বা বর্ণালীর মতো ক্ষমতাশালিনী অভিনেত্রীও ছিলেন ( পরে তিনি লোকনাট্যে চলে আসেন), কিন্তু শান্তিগোপালই সমস্তকে রাখতেন মস্তকে। যে সব চরিত্র রূপায়ন করতে তিনি প্রয়াস পেয়েছেন, তাদের সবারই জনমনে ও ইতিহাসে নথিবদ্ধ প্রামাণ্যতা ছিলো। তাই নাটকীয়তার প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো তথ্যের কাল্পনিক বিচ্যুতি ঘটানোর কোনও স্বাধীনতা তিনি নিতে পারতেন না। সেই বাল্যকালে শান্তিগোপালের হিটলার দেখে আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হই।হয়তো না দেখলেও হতাম, কিন্তু বাবাকে সমানে খুঁচিয়ে হিটলার ছাড়াও গোয়েরিং, গোয়েবল্স, রোমেল,মার্শাল ঝুকভ ইত্যাদির প্রতি সেই বয়সে যে আকর্ষণ বোধ করি, তার শ্রেয় নিঃসন্দেহে শান্তিগোপালের। হিটলারের পরের দিনই ছিলো 'রাজা রামমোহন' পালা। অপেক্ষাকৃত চেনা চরিত্র। মা প্রথমদিন শান্তিগোপালের অভিনয় দেখে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দ্বিতীয়দিনও 'যাত্রা' দেখতে সাগ্রহে যাত্রা করলেন। এই পালাটি দেখার আগে ব্যক্তিগতভাবে আমি আর দশটা লোকের মতো রামমোহনকে একজন 'মহাপুরুষ' হিসেবে জানতুম।কিন্তু রামমোহনের লড়াইটা যে কী ছিলো এই পালাটি দেখার পর বালক আমির কাছে তার পরিপ্রেক্ষিতটি অনেক স্পষ্ট হয়ে যায়। অনেক পরে রামমোহনের উপর লেখা দিলীপবাবুর সুদীর্ঘ আকরগ্রন্থটি যখন পড়েছি তখনও শান্তিগোপালের রূপায়িত রামমোহন চরিত্রের থেকে কোনও ব্যতিক্রমী লক্ষণ খুঁজে পাইনি।

    ৩.
    সত্তরদশকে শ্যামবাজার-হাতীবাগানের মঞ্চে বিভিন্ন 'মিস'এরা রাজত্ব করতেন তখন ছিলো চিৎপুরের স্বর্ণযুগ। স্বামী,শাঁখা,সিঁদুর, সতীত্ব, লাম্পট্য, অতি সংক্ষিপ্ত শেষ দৃশ্যে দুষ্টের দলন শিষ্টের পালন, এসব নিয়ে অসংখ্য যাত্রাদল রাজত্ব করে গেছেন। কিন্তু শান্তিগোপাল ও তরুণ অপেরা ছিলো ব্যতিক্রম। তেলচুকচুক সেন্টি,মাখোমাখো লাম্পট্য ও টকটকে টিপের সতীনারীদের তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র শুভবুদ্ধি ও অভিনয় ক্ষমতার দৌলতে জনরুচি ও লোকশিক্ষা প্রতিষ্ঠা করার যে উদ্যম শান্তিগোপালের মাধ্যমে আমরা দেখেছি, তা সত্যিই অনন্য। একের পর এক যাত্রা পালা ( প্রতি বছর দুটি) নিয়ে তিনি আসরে আসতেন। হিটলার- রামমোহনের পর লেনিন, স্ট্যালিন, মাও, সুভাষ, আরো মনে পড়ছে না চরিত্র নিয়ে তিনি যখন মঞ্চে প্রবেশ করতেন, জনতা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতো। হ্যাঁ,সব পালা একভাবে উৎরোতো না হয়তো, কিন্তু তিনি নিঃসংশয়ে দর্শকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতেন। রূপংকর যেমন বলেছেন, লেনিন সম্ভবতঃ তাঁর শ্রেষ্ঠ চরিত্রসৃষ্টি,আমিও তাই মনে করি। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে দেখা শান্তিগোপালের লেনিন এবং বদরুদ্দিন উমরের লেখা বিদ্যাসাগরের আলোচনা আমাকে সমাজতন্ত্র নিয়ে সিরিয়াস চিন্তা করতে প্রেরিত করে। শেক্সপিয়র অনুপ্রেরিত বাংলায় আমার দেখা প্রথম নাটক শান্তিগোপালের ওথেলো। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা স্মরণ করতে পারবেন তাঁর অভিনয়। আমার উত্তর কৈশোরে দেখা এই পালাটি, যার পরদিন তিনি মঞ্চস্থ করতেন' আমি সুভাষ' ,তাঁর অভিনয় ক্ষমতার বহুমুখিনতাকে প্রকাশ করে। আমার স্ত্রী নিতান্ত বালিকা বয়সে প্রথম যাত্রা দেখেছিলেন এই দুটি পালার মাধ্যমে,এখনও তিনি শান্তিগোপালের অভিনয় স্মরণ করে রোমাঞ্চিত হন। আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন শান্তিগোপালের এই দুটি পালার উল্লেখ যেন আমি অবশ্য করি। তেমন সফল না হলেও গোগোলের ইনস্পেক্টর জেনারাল অবলম্বনে করেছিলেন 'এবার তদন্তের পালা',সেই সময়ের চিৎপুরী বিশ্বে নেহাৎ ব্যতিক্রমী সন্ধান ছিলো তা।

    ৪.
    বহুকাল কেটে গেছে ইতোমধ্যে। একমাত্র পুত্র নিরুদ্দেশ হবার পর শান্তিগোপাল আর মঞ্চে আসেননি। আমারও যাত্রা দেখার পালা এভাবেই শেষ হয়ে গেলো। এতোদিন পরে যেটা মনে থেকে গেছে যে এই সব ইতিহাস সৃষ্টিকারী গগনচুম্বী ব্যক্তিত্বদের চরিত্র রূপায়ণ শান্তিগোপাল যে পারঙ্গমতায় করে গেছেন, তার তুল্য আমরা বাংলা মঞ্চে আর দেখিনি। অনন্ত জনগণের মনের মধ্যে এই সমস্ত চরিত্রের ইতিহাস অনুসারী ভাবমূর্তির ধারণা স্পষ্ট। সেই পর্বতপ্রমাণ প্রত্যাশার চাপকে অবলীলায় ( হয়তো প্রচুর শ্রমসঞ্জাত) এই ভাবে স্বীকার করে আসরের পর আসরে 'ফাটিয়ে' দিয়ে যাওয়া একজন অনন্য ক্ষমতাধারী নটের পক্ষেই সম্ভব। তখন বুঝতুম না, তিনি কী করে এতো বিশ্বাসযোগ্যভাবে এতো রকমের যুগন্ধর পুরুষকে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করে উঠতে পারেন? এখন হয়তো একটু বুঝতে পারি। তিনি সেই সব ঐতিহাসিক চরিত্রের চতুর্থ মাত্রাটিকে অবিকল অনুভব করতে পারতেন। সেটাই ছিলো তাঁর শিল্পের সাধনা। এই জন্যই শুধু যাত্রামাধ্যমে নয়,শান্তিগোপাল নিজেকে সমগ্র নাট্যজগতের একজন বরেণ্য অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। অল্পবয়সে তাঁর অভিনয় দেখতে পাবার সৌভাগ্য আমার উজ্জ্বল সঞ্চয়।
  • একক | 24.99.244.187 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০০:৩১577360
  • আমার বাবা এই সেদিন শান্তিগোপালের নাম করছিলেন । বাবা গ্রামে ঘুরে ঘুরে যাত্রা দেখেছেন আবার কলকাতার গ্রুপ থিয়েটার ও । আমি কখনো শান্তিগোপালের অভিনয় সামনে থেকে দেখেছি কিনা কিছুতেই মনে পড়ছে না । "টিপু সুলতানের তরবারি" নামে একটি যাত্রা দেখেছিলুম জাত্রাপারায় বাবার সংয়ে গিয়ে । সে অনেক ছোটবেলা । শান্তিগোপাল ছিলেন কি ? মনে নেই :(
  • i | 147.157.8.253 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০২:৫৬577361
  • যাত্রার প্রচুর বিজ্ঞাপন বেরোতো তো কাগজে-নেতাজী, মার্ক্স, লেনিনের সাজে শান্তিগোপাল-বড় বড় ছবি।যাত্রা সমালোচনাও বেরোতো সম্ভবতঃ যুগান্তরে। আমার ভুলও হতে পারে। রূপংকরবাবু যেমন বললেন, শান্তিগোপালকে নিয়ে এরকম গল্প অজস্র ছিল।

    কদিন আগেই যাত্রার কথা ভাবছিলাম -জ্যোৎস্না দত্ত, গুরুদাস ধাড়ার বিবি আনন্দময়ীর একটা গান হঠাৎ মনে পড়ছিল। যাত্রা নিয়ে একটা টই খোলা হোক। অধিকারীজন লিখুন।
  • Rit | 213.110.243.23 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৩:২৪577362
  • বীনা দাশগুপ্তার মীরার বঁধুয়া ক্যাসেটে শুনেছিলাম। অপূর্ব লেগেছিল। গ্রামে ৪-৫ টা যাত্রা দেখেছি। তবে যুগান্তকারী কিছু দেখিনি। সবই সামাজিক পালা।
  • ranjan roy | 24.97.233.17 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৫:১৯577363
  • ছোট আই ঠিকই বলেছেন। তখন যাত্রার বিজ্ঞাপন নিয়মিত বেরোত। পূজোর ক'মাস আগে থেকেই চিৎপুর ব্যস্ত। বুকিং শুরু। কোলকাতার নাম করা দলগুলোর অনুকরণে মেদিনীপুর অবদি দল গড়ে উঠতো।
    যেমন, বীণাপাণি অপেরা, তো নিউ বীণাপাণি অপেরা, আবার দি রয়াল নিউ বীণাপাণি। যাত্রাসম্রাট স্বপনকুমার,নটসম্রাট পঞ্চুসেন, ছোট পঞ্চু, বড় ফণি। দেশ পত্রিকার নিয়মিত সমালোচক প্রবোধবন্ধু অধিকারী ( আমরা বলতাম অবোধবন্ধু) যাত্রার স্পন্সর হলেন।
    যুগান্তর পত্রিকার ঘোষ পরিবার অনেকখানি স্পেস দিতেন।
    আর বড় বড় বিজ্ঞাপন বেরোত ছবি দিয়ে। তরুণ অপেরার ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে পালাগুলো আলাদা মাত্রা পেত।
    শিবাংশু যেমন বলেছেন---- অধিকাংশের সম্বল তেলচুক্চুক সেন্টি, মাখো মাখো লাম্পট্য।
    আমার বিয়ের পর ভিলাইয়ে যাত্রা উৎসব। তিনটে পালার নাম মনে আছে--"সিঁদূর নিও না মুছে"," শাঁখা ভেঙো না", " পতিঘাতিনী সতী"।
    কিন্তু যাত্রা দেখার জন্যে যে উন্মাদনা তা কোলকাতা থেকে আসা মনোজ মিত্রের টিমের অভিনয় দেখতে ছিল না।
    প্রবাসী বাঙালীরাও যাত্রা করতেন, বছরে অন্ততঃ একবার। ব্রজেন দে'র সেই ক্লাসিক সোনাই দীঘি ধরণের। পৌরাণিক পালাগুলোও হারিয়ে গেছে।
    আমি সেই সময়টা প্রবাসে থাকার ফলে এ নিয়ে আলোচনার যোগ্য লোক নই।
    কিন্তু শিবাংশু, রূপংকরদা, শুদ্ধ, কল্লোল হয়ত বিশদে ভাল বলতে পারবে।
    আমার মনে হয় যাত্রার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে বাঙালী নিজেদের হারানো ঐতিহ্য, মিথের সঙ্গে একটি রোমান্টিক সম্পর্ক ধরে রেখেছিল। পৌরাণিক, ভক্তিমূলক, ঐতিহাসিক পালাগুলো -- যেমন কংসবধ, শ্রীরামকৃষ্ণ, কেদার রায়, সিরাজদ্দৌল্লা বা হারিয়ে যাওয়া গ্রাম সমাজের সামাজিক পালাগুলো।
    গণনাট্য এবং নবনাট্য আন্দোলন এর থেকে ভিন্ন রাস্তায় হেঁটে সমসাময়িক সমাজজীবনের বাস্তববাদী রূপায়ণের দিকে জোর দিল। আস্তে আস্তে এই নাটকগুলো একটি শহুরে রুচি তৈরি করল।
    তবু গাঁয়ে গঞ্জে রয়ে গেল যাত্রা। যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে।
    এবার উৎপল দত্ত, শেখর চাটুজ্জে ও নাটকের দলের অনেক নামী লোকেরা নাটকে ভাঁটার টান দেখে যাত্রায় এলেন। তাঁদের আসায় যাত্রা বদলে গেল। খুইয়ে ফেললো তার নিজস্ব বৈভব। রবীন্দ্রনাথের সেই চিত্রপটের দরকার নেই চিত্তপটই যথেষ্ট কনসেপ্ট বৈধতা হারালো। গ্যাজেটে আধুনিক স্টেজ ও প্রপে যাত্রা থিয়েটারের কাছাকাছি এসে গেল। উৎপল দত্তের রাইফেল যাত্রা থিয়েটারের অনেক কাছাকাছি।
    কিন্তু এর পরে টলিউড বানানো শুরু করলো যাত্রাধর্মী চড়া সুরের ছবি। গণনাট্যের জ্ঞানেশ বানালেন জয় বাবা তারকনাথ। ওনাকে যখন বলা হল কেন আর 'হারানের নাতজামাই " করছেন না? উনি বল্লেন-- একটা গৌরীসেনের নাতজামাই এনে দিন, তখন করব।
    তারপর হরনাথ চক্রবর্তীরা এলেন। গ্রামবাংলার দর্শক মজলো পোসেনজিতে আর বাবা কেন চাকর এ। অধিকাংশই গ্রামে আসা শহুরে অফিসার বা শিক্ষক বা পুলিশের গল্প। গ্রামও যে অনেক পাল্টে যাচ্ছে।
    শেষে টেলিভিশন এসে গাঁয়ের লোকের ঘরে পৌঁছে দিল যাত্রাধর্মী সিনেমার ইন্স্ট্যান্ট প্যাকেটগুলো। যাত্রার নাভিশ্বাস উঠলো।

    শিবাংশুর কথায় মনে পড়লো শান্তিগোপালের একমাত্র ছেলে নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর বেশ কিছুদিন কাগজে বেরিয়েছিল। তরুণ অপেরা বন্ধ হয়ে গেল। উনি সেই পরাজিত সম্রাট।
  • 3Q | 161.141.84.239 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৫:৪০577365
  • আরে রেডিওর সেসব কথা কারুর মনে পড়ে না? যাত্রা র অনেক অনেক ছোটো ছোটো প্রচারমূলক অংশ তো রেডিওতেই শুনেছি। শনিরবিবারের বিজ্ঞাপণদাতা দ্বারা প্রচারিত অনুষ্ঠানে, বিবিধভারতী তে। শান্তিগোপালের কথা শুধু শুনতাম বাবামা জ্যেঠাজ্যেঠি এদের মুখে, আমাদের ছোটোবেলা ছিলো যাত্রালক্ষ্মী বীণা দাশগুপ্তা র রমরমা, তার গলা যে কীরকম সে রেডিওতে শুনেই চিনেছিলাম। একবার মনে হয় উনি বিনোদিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, ঐ অংশটা রেডিওতে হতো যেখানে চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় চলাকালীন দিনগুলোতে বিনোদিনী নিয়মিত গঙ্গা স্নানে যাচ্ছেন চত্রিতের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্য।
    আমাদের অজপাড়াগাঁয়ে সেই ছিয়াশি সাতাশি অষ্টাশিসালে যাত্রা খুব রমরমা ছিলো, খোলা বড় বড় মাঠও ছিলো, শীতকালে যাত্রার তাঁবু পড়তো সেখানে। আর তারা আসার একসাম আগে থেকে বিকেল সন্ধ্যে ধরে রিকশা করে মাইকে প্রচার। সে এক উৎসবের সীজন যেন। একবার তিনদিন তিন পালা হলো বড়মাঠে, উঃ সে যেন দুর্গাপূজার মতন ব্যাপার।
    নব্বইয়ের মাঝামাঝি এসে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল, তারপরে আর যাত্রার কথা শুনিনা, আর কি বলবো রেডিও ও তো অজন্প্রিয় হয়ে গেলো। যারা রেডিওকে শেষ অবধি আঁকড়ে ছিলো, তারাও টিভিতে শিফট করে গেলো। দুনিয়া বদলে যেতে লাগলো যেন বিদ্যুৎগতিতে।
    অধিকারীজন লিখুন যাত্রা নিয়ে, আমারো অনুরোধ।
  • 3Q | 161.141.84.239 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৫:৪৩577366
  • কী টাইপো হলো!

    চরিত্রের
    একমাস
    অজনপ্রিয়
  • i | 147.157.8.253 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৬:১১577367
  • হ্যাঁ থ্রিকিউ,
    রেডিওতে বুধবার বুধবার কৃষিকথার আসরের পরে যাত্রা হত। আমার ঠাকুমা পিঁড়িতে বসে জপের মালা হাতে শুনত বসে। আমরাও কোনোকোনোদিন শুনতাম -পড়াশোনা না থাকলে।
    আমাদেরও পাশের মাঠে শীতকালে যাত্রা হ'ত। একটা রাত মনে পড়ে খুব। নটী বিনোদিনী হচ্ছিল। মা জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে-মাইকে গান ভেসে আসছে-হরি মন মজায়ে লুকালি কোথায়-
  • | 127.194.82.106 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৬:৪২577368
  • অ্যাঁ "ঝাল লঙ্কা" বলেন কি!!

    প্রফেসন্যাল যাত্রা দেখার অনেক আগে থেকে আমি আমাদের গ্রামে যাত্রা দেখতাম। অন্নপুর্না,বাসন্তী পুজোর সময় দু দিন ধরে যাত্রা হত সারা রাত ধরে। আমাদের বাড়ি র অনেকে যাত্রা করেছেন।আমার দাদু এবং ঠাকুরদা। তাদের যাত্রা আমি দেখি নি।তবে "হিন্দুমান" ঠাকুর দার অসাধারন অভিনয় অনেকের মুখে শুনেছি।আমাদের আগের প্রজন্মে খুব ভালো অভিনয় করতেন আমার স্বর্গতঃ জেঠু।এ ছাড়া ছোট্কাকা ও বেশ ক টা যাত্রা য় অভিনয় করলেও মূলতঃ নাটক করতো এবং সেই সময় একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় অনেক প্রাইজ পায়। মামার বাড়ি র দিন থেকে অনেকে অভিনয় করতো।বড়মামার করা "ভীমসিংহ"( জয়চাঁদের প্রধান সেনাপতি) "পৃথ্বিরাজ চৌহান " পালায় দেকেছি। মানানসই। তবে ছোটমামা অভিনয় বেশী ভালো লাগতো। আর মায়ের আর দুই পিসতুতো ভাই গুপীমামা র করা "সংগ্রাম সিংহ" ( মহম্মদ ঘোরী র বিরুদ্ধে পৃথ্বিরাজ কে সাপোর্ট করা একমাত্র রাজপুত রাজা বেশ ভালো। তবে দীপু মামা র করা "মেঘা"( নারী চরিত্রে) ( চরিত্রে র কথা মনে পরলে আজ ও গায়ে কাঁটা দেয়।
  • | 127.194.82.106 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৬:৫৯577369
  • আসলে স সময় যাত্রা গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। সেই সময় এত সিনেমা ,ভিডিও পার্লাও র রমরমা ছিল না।আমি দেখেছি কি যত্নে যাত্রা অন্ততঃ ২ মাস আগে থেকে রিহার্সেল হত। সেখানে মহড়া যুদ্ধ করার জন্যে রীতিমতো বাঁখারি র তলোয়ার তৈরী করার হত। এই প্রসঙ্গে মনে পরল। বড় মামা র সাজ হয়ে যাবর পরে আমি মামা র তরোয়াল টা বাগিয়ে কি হনু এমন ভাব করে সবাই কে দেখিয়ে বেরাচ্ছিলাম ঃ))

    গ্রামে আর যাদের কথা মনে আছে ভুতো পাড়ুই , অসাধারন অভিনেতা ।জয়চাঁদ হয়েছিল। তারাপদ কাকার "মহম্মদ ঘোরী"। তবে "পৃথ্বীরাজ" র সময় এক মজার ঘট্না ঘটেছিল। সুশান্ত কাকা। সুপুরুষ খুব ভালো আবৃত্তি করতো। স্বভাবতঃ ই মেন রোলে এ নেওয়া হয়েছিল। যাত্রা র দিন সন্ধে হঠাং বলে আমি যাত্রা করতে পারবো না। জ্বর এসে গেছে। সারা বই জুড়ে ওর পার্ট।তখন গৌর মামা মাত্র তিন ঘন্টা গাঁথিয়ে নামিয়ে দিল।এবং বেশ ভালো। গৌর মামা প্রফেশন্যাল অভিনেতা ছিল। মোহন অপেরায় ছিল। মামা র চেহারা ছিল সাঙ্ঘাতিক। প্রায় ৬ ফুটের কাছাকাছি লম্বা আর পেশী বহুল পেটানো শরীর। তাই ভীম টাইপের চরিত্রে বেশী অভিনয় করতো। মামা র সুবাদে অনেক ফ্রি পাস পেয়ে "মোহন অপেরা" র যাত্রা দেখেচি কলকাতায়। আমাদের পাশের গ্রামে এদের যাত্রা দেখেছি । তখন আমি ৮/৯ বছরের হবো দাদু র সাথে দেখতে গিয়েছিলাম।
  • h | 127.194.230.31 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৭:০২577370
  • আমি শান্তি গোপালের স্তালিন দেখেছি, আর স্পার্টাকাস দেখেছি। ডেভিডের ফাঁসির সময়ে আমার ঠাকুমা হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন। আর ক্র্যাশাস যখন ড্রাবা কে ভয় পাচ্চিল, হঠাৎ ঠাকুমার বন্ধু, বুবুদিদির ঠাকুমা, কি চিৎকার, মার শালাকে মার শালাকে, কুত্তা শালা বলে। তার পরে আমার দিকে তাকিয়ে কি লাজুক হাসি বুড়ির।

    আর তার আগের রাতে ছিল মহিষাসুর মর্দিনী দেখেছিলাম, চ্যাটার্জি অপেরার। সে সব ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। যাত্রার আগে বাই দ্য ওয়ে, আমাকে ক্ল্যারিনেট টি হাতে ধরতে দেওয়া হয়েছিল।

    আর যাত্রা শেষে রাত দুটো নাগাদ, আমি আর বাবু দা, একজন ৭ , একজন ৮, অসংখ্য দিদা, ঠাকুমা কে নিয়ে দু কিলোমিটার হেঁটে ফিরেছিলাম।
  • nina | 79.141.168.137 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৩৭577371
  • শান্তিগোপাল --তরুণ অপেরা---আমার শুধু মনে পরে-- ছোট ছিলাম --পাটনায় যাত্রা হবে --নেতাজী সুভাষ আর হিটলার---অভিনয় ভাল খারাপ বোঝার বয়স হয়নি--কিন্তু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম একজন মানুষ কি করে অবিকল নেতাজির মতন দেখতে আবার পরের দিন অবিকল হিটলার!! তার চেয়েও অবাক হলাম ওনাকে নিজের চেহারায় দেখে---কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই--আমার মনে হয়েছিল--উনি দারুণ ম্যাজিসিয়ান।
    অনেক গুণিজনেরা একে একে চলে যাচ্ছেন----বড় কাছাকাছি একের পর এক---
  • | 127.194.82.106 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৪২577372
  • হ্যাঁ 3Q মনে আছে। আমি রেগুলর শুনতাম। এক একত দলের ১৫-৩০ মিনিটের প্রোগাম থকতো। এখনো ২/৪ মনে আছেঃ

    অপ্সরা অপেরার ঃ

    "ভেতরে কালো বাইরে আলোর রঙ্গীন ফানুশ
    ময়লা মানুষ"

    কিংবা বীনাপানি অপেরার যেখানে বীনা দাসগুপ্তা অভ্নয় করতেন তাদের পাল "দু টুকরো মা" ( ক্ষী চাপ)

    নট্ট অপেরা কিছু কিছু দেখেছি। টু গুড।
  • Lama | 127.194.233.150 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৯:৩৮577373
  • ছোটবেলায় (এই ১৯৭৫-৭৮ হবে) আনন্দবাজারের নীচের ডানদিকের কোণে বড় করে যাত্রার বিজ্ঞাপন থাকত। যাত্রা কখনো নিজের চোখে না দেখে থাকলেও ঐ বিজ্ঞাপন দেখে দেখে কলাকুশলীদের নামগুলো মুখস্ত হয়ে যেত- যেমন শান্তিগোপাল, বা যাত্রালক্ষ্মী বীনা দাশগুপ্তা ইত্যাদি।
  • রূপঙ্কর সরকার | 24.99.20.27 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ০৯:৫৫577374
  • মানুষ শান্তিগোপাল - আসল নামটা ঠিক লিখেছেন, বোধহয় শুদ্ধ, বীরেন্দ্রনারায়ন পাল। বাগবাজারের বিখ্যাত 'পালবাটি'-র ছেলে। কাশী মিত্তির ঘাট থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তাটার গোটাটা জুড়ে সেই বাড়ি, সেই বাড়ির এক দেয়াল থেকে রাস্তাটা শুরু, অন্য দেয়ালে শেষ। যতদূর মনে পড়ে, মনে হয় ৬৫ খানা ঘর ছিল সে বাড়িতে। বাইরের দেয়াল ছিল পঞ্চান্ন ইঞ্চি। বীরেনদার বিয়ের সময় গিয়ে দেখি, যে দেয়ালের কুলুঙ্গিতে লোকে প্রদীপ টদীপ রাখে, সেই কুলুঙ্গির একটাতে সানাইওয়ালা বসে বাজাচ্ছে, অন্যটাতে ডুগিতবলা, কুলুঙ্গি এতই চওড়া। ডাকনাম ছিল শান্তিরাম, সেই থেকে শান্তিগোপাল।

    খুব রক্ষণশীল পরিবার। যাত্রা থ্যাটার করতে গিয়ে স্বভাবতই মূখ্য অভিনেত্রীদের সঙ্গে মূখ্য অভিনেতা বা পরিচালকের নৈকট্য বাড়ে। তুমুল আপত্তি বাড়িতে, হলনা প্রজাপতির বন্ধন। নিজে প্রচূর রোজগার করেন, 'ধুত্তেরি' বলে বেরিয়ে আসতে পারতেন, আসেননি। বহু বছর পর বাড়ির দেখে দেয়া পাত্রীর পাণিগ্রহন।

    সুখী ছিলনা জীবন। ছেলের 'নিরুদ্দেশ' এর ব্যাপারটা আলোচনার বাইরে থাক। যা জানি তা নিয়ে পাঁচকান করলে বিদেহী আত্মা কষ্টই পাবেন। আর ছিল মেয়েটি। কাগজে কোথাও লেখেনি, সে আগাগোড়া স্প্যাস্টিক। বড় কষ্টের জীবন। কত কষ্টের তা ভাবাও স্বাভাবিক লোকের কাছে প্রায় অসম্ভব। তবু শেষ বয়সে নান্দীকারে অভিনয় বছর দুই আগে। প্ল্যান ছিল, আবার নতুন করে অভিনয় শুরু করার, হলনা। বোধহয় ভালই হল।

    নানা অভিনয়ের কথা লিখেছেন যাঁরা সে সব দেখেছেন, লেনিন, স্টালিন, সুভষ, মার্ক্স - যেটার কথা কেউ লেখেননি, বা হয়তো অনেকে দেখেন-ই নি, এমনকি খবরের কাগজও যেটার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব, সেটাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় এবং পরিচালনা - 'মহেঞ্জোদারো'। বাজি রেখে বলতে পারি মহাজাতি সদনের সব দর্শকের গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠত।

    অনেকে বললেন, 'যাত্রা' দেখার কথা। শান্তিগোপাল নিজে বলতেন, 'থিয়েট্রিকাল যাত্রা'। যাত্রার ছাঁদে বাঁধা থাকবে, কিন্তু আদপে হবে নাটকের ঢং-এ। কিংবা উল্টো করে বলা যায় নাটকের অভিনয় হবে খোলা মঞ্চে, যাত্রার মত। সেই শেক্ষপীরের চিরন্তন উক্তি - গোলাপকে যে নামেই ডাক, ইত্যাদি। যাক, শেষ হয়ে গেল একটা পর্ব। বড় ভাল লেগেছিল 'ভূতের ভবিষ্যৎ' ছবিতে শশ্বত-র উক্তি - 'এটা কে রে শান্তিগোপাল?' অনীক বাবুর মত কিছু লোক তবু জানেন এই লিভিং লেজেন্ড-এর কথা, যে লেজেন্ড হারিয়ে গেছে দুই দশকেই।
  • | 127.194.84.243 | ০৬ নভেম্বর ২০১২ ১০:১৫577376
  • তারাশঙ্কর র "মঞ্জরী অপেরা" তে এই যাত্র সমাজের কথা ধরা আছে নিঁখুত ভাবে। বেশ দামড়া টাইপের বই। সিনেমা ও হয়েছিল । মুখ্য চরিত্রে উত্তম কুমার। কিন্তু ওটা দেখা হয় নি।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন